Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • English Books
      • Jules Verne
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    জেরুসালেম : ওয়ান সিটি থ্রি ফেইস – ক্যারেন আর্মস্ট্রং

    মোহাম্মদ হাসান শরীফ এক পাতা গল্প727 Mins Read0
    ⤶ ⤷

    ৩. দাউদের নগরী

    জেবুসিতেরা বিশ্বাস করত, দাউদ কখনো তাদের নগরী জয় করতে পারবেন না। কেনানি নগর-রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে জেরুসালেম সবচেয়ে মর্যাদাবান কিংবা শক্তিশালী না হলেও দাউদের দ্রুত ভুঁইফোড় রাজ্যের তুলনায় ওই নগরী বিবেচিত হতো অনেক প্রাচীন, অত্যন্ত সুরক্ষিত, এবং অনেক বছর ধরেই নগরীটি দুর্ভেদ্য হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেছিল। দাউদের সৈন্যরা ওফেলের পাদদেশে পৌঁছার পর জেবুসিভরা তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে বলতে লাগল : ‘তোমরা এখানে ঢুকতে পারবে না। নগরীর অন্ধ ~ পঙ্গুরা তাদের আটকে দেবে।’ সুরক্ষিত দুর্গে হামলা চালালে কী পরিণাম হতে পারে সে সম্পর্কে হুঁশিয়ারি দিতে সম্ভবত তারা হিত্তিতি সেনাবাহিনীর প্রথা অনুসরণ করে প্রাচীরগুলোর ওপর দিয়ে অন্ধ ও পঙ্গুকে দিয়ে প্যারেড পর্যন্ত করেছিল। কিন্তু দাউদ ভয় পেতে অস্বীকৃতি জানান। তিনি সংকল্প করেন, যে ব্যক্তি প্রথমে কোনো জেবুসিতকে হত্যা করতে পারবে, সে হবে তার সেনাবাহিনীর কমান্ডার। তার প্রবীণ সহকর্মী জেরুয়ার ছেলে জোয়াব চ্যালেঞ্জটি গ্রহণ করে ‘ওয়ারেন্স শ্যাফটে চড়েন। গিহোন স্প্রিং থেকে পানি এখান দিয়েই নগরীতে যেত। আমরা জানি না, দাউদ কিভাবে জেরুসালেম দখল করেছিলেন। বাইবেলের সূত্র একইসাথে অপূর্ণাঙ্গ ও অস্পষ্ট। তবে তার এই জয় ছিল একটি বড় ধরনের মাইলফলক। এর প্রভাব এখনো প্রতিধ্বনিত হয়! যে নগরী তখন পর্যন্ত কেনানের কেবল দ্বিতীয় স্তরের গুরুত্বপূর্ণ নগরী ছিল, সেটি এই জয়ের মধ্য দিয়ে এমন এক ঐতিহ্যের বলয়ে প্রবেশ করেছিল যা শেষ পর্যন্ত ঐতিহাসিক একেশ্বরবাদে পরিণত হয়েছিল। এই জয় তাকে অন্যতম পবিত্র নগরীতে পরিণত করেছিল, সেই সূত্রে পরিণত হয় বিশ্বের সবচেয়ে বিরোধপূর্ণ স্থানে।

    দাউদ সম্ভবত এমন ভবিষ্যত দেখতে পাননি। তিনি যখন খ্রিস্টপূর্ব ১০০০ সালের দিকে নগরীটি জয় করলেন, তখন তিনি তার ঐক্যবদ্ধ রাজ্যের কেন্দ্রে থাকা একটি অসামঞ্জস্যপূর্ণ বিদেশি জেবুসিত ছিটমহল থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার স্বস্তি অনুভব করেছিলেন। তাছাড়া এর মাধ্যমে তিনি নিজের জন্য আরো মানানসই রাজধানী পেয়েছিলেন। ইসরাইল ও জুদার মিলন ছিল ক্ষণস্থায়ী। উত্তরাঞ্চলীয় রাজ্যটি তখনো মর্যাদাসম্পন্ন সত্তা বিবেচিত হচ্ছিল, লোকজনের জন্য অতি সাম্প্রতিক সময়কালেও বিশ্বাসঘাতক বিবেচিত দাউদের কাছে আত্মসমর্পণ নিয়ে মিশ্র অনুভূতিতে ছিল। হেবরন থেকে শাসনকাজ চালানো অব্যাহত রাখা অবিজ্ঞজনোচিত মনে হয়েছে। কারণ এটি দাউদকে তার নিজের দক্ষিণাঞ্চলীয় জুদা রাজ্যের সাথে ঘনিষ্ঠতা সৃষ্টি করত। পুরনো জেরুসালেম নগর-রাষ্ট্র জেরুসালেম অবশ্য ছিল নিরপেক্ষ ভূখণ্ড। কারণ এটি ইসরাইল বা জুদা- কোনোটিরই অন্তর্ভুক্ত ছিল না, তাছাড়া পুরনো গোত্রীয় ঐতিহ্যের সাথেও এর কোনো সম্পর্ক ছিল না। দাউদ তার নিজের সৈন্যদের নিয়ে নগরীটি জয় করায় ওই এলাকার প্রথা হিসেবে এটি তার ব্যক্তিগত সম্পত্তিতে পরিণত হয়ে গিয়েছিল এবং তিনি এর নিজের নামে এর নতুন নাম দেন ‘ইর ডেভিড’ বা দাউদের নগরী। ফলে এটি জুদা বা ইসরাইল থেকে নিরপেক্ষ ও সংযুক্তহীন থাকে, দাউদ তার নিজস্ব রাজকীয় এলাকা হিসেবে নগরীটি ও এর আশপাশের এলাকাকে বিবেচনা করতে পারতেন। এতে কৌশলগত সুবিধাও ছিল। জেরুসালেম ছিল খুবই সুরক্ষিত, হেবরনের চেয়ে অনেক বেশি কেন্দ্রবিন্দুতে। পাহাড়ি দেশে উচ্চ ভূমিতে অবস্থিত জেরুসালেম ফিলিস্তিনদের, সিনাই ও নেগেভের গোত্রগুলোর কিংবা নতুন আম্মন রাজ্যের বা জর্দান নদীর পূর্ব তীরের মোয়াবদের আকস্মিক আক্রমণ থেকে নিরাপদ ছিল। নতুন রাজধানীতে দাউদ এখন পাহাড়ি দেশের অবিচ্ছিন্নভাবে বিস্তৃত এলাকার অবিসংবাদিত রাজা। এটি ছিল কেনানের এ যাবৎকালের বৃহত্তম ঐক্যবদ্ধ রাজ্য।

    দাউদের রাজধানী দেখতে কেমন ছিল? বর্তমানের মানদণ্ডের আলোকে নগরীটি ছিল অতি ক্ষুদ্র। এর আয়তন ছিল প্রায় ১৫ একর এবং ওই এলাকার অন্যান্য শহরের মতো এটিও ছিল একটি দুর্গের চেয়ে একটু বড়। এতে একটি প্রাসাদ, সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তাদের কিছু বাড়ি ছিল। এখানে দুই হাজারের বেশি লোকের ঠাঁই হতো না। অবশ্য দাউদ যে নগরীটি জয় করেছিলেন, তা কিন্তু বাইবেল আমাদের বলে না; আমাদের লেখকেরা জোর দিয়ে বলেন যে তিনি ‘জায়নের দুর্গটি’ জয় করেছিলেন এবং তিনি ‘দুর্গে বসবাস করেছিলেন। যশুয়া গ্রন্থে একটি অধ্যায়ে জেরুসালেমকে ‘জেবুসিতদের পার্শ্বদেশ’ বলা হয়েছে। এ থেকে মনে হতে পারে জেরুসালেমকে ‘জায়ন দুর্গ’ থেকে আলাদা হিসেবে দেখা হতো। দাউদ হয়তো স্রেফ জেবুসিতদের দুর্গটি দখল করেছিলেন। আর এ কাজটি হয়তো একটি সামরিক অভ্যুত্থানের সমপর্যায়ের বিবেচিত হতো। যশুয়া গ্রন্থের মতো করে জেরুসালেমের লোকজনের ওপর গণহত্যা চালানোর কোনো উল্লেখ নেই। এমনকি জেরুসালেমের জেবুসিত অধিবাসীদের নগরী থেকে তাড়িয়ে তাদের স্থানে যিহোবাবাদীদের স্থলাভিষিক্ত করারও কোনো উল্লেখ নেই। ফলে অসম্ভব নয় যে দাউদের বিজয়টি ছিল স্রেফ একটি ‘প্রাসাদ অভ্যুত্থান।’ এতে করে বোঝা যাচ্ছে, দাউদ ও তার কয়েকজন ঘনিষ্ঠ সহযোগী মিলে জেবুসিত রাজা ও তার অতি কাছের সহকর্মীদের উৎখাত করে জেবুসিত নগরী ও এর জনগণকে আগের মতোই রেখে দিয়েছিলেন। আমরা এই নিয়ে কেবল কল্পনাই করতে পারি। কারণ বাইবেলে জেরুসালেমের প্রথম উল্লেখে লেখক আমাদের বলছেন যে জেবুসিত ও জুদাবাসী তখনো নগরীতে পাশাপাশি বসবাস করছিল।

    ফলে ফিলিস্তিনি ও ইদোমিতিসদের পাইকারি গণহত্যার জন্য বিখ্যাত হওয়া দাউদ সম্ভবত ছিলেন জেরুসালেমের ন্যায়পরায়ণ ও দয়ালু বিজয়ী। তিনি নগরীর বিদ্যমান নাগরিকদের প্রতি কেবল মর্যাদাপূর্ণ আচরণই করেননি, সেইসাথে তাদের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করেছেন, তার নিজ প্রশাসনে তাদেরকে অন্তর্ভুক্ত করে নিয়েছিলেন। যওয়া সম্ভবত জেবুসিতদের বেদীগুলো গুঁড়িয়ে দিয়েছিলেন, তাদের ঐশী প্রতীকগুলোর প্রতি কঠোর আচরণ করেছিলেন। তবে দাউদ স্থানীয় ধর্মমতের

    ওপর কোনো ধরনের হস্তক্ষেপ করেছেন বলে কোনো তথ্য পাওয়া যায় না। বস্তুত আমরা দেখব, জেবুসিত ধর্মীয় আদর্শ ও উদ্দীপনা সত্যি সত্যিই জেরুসালেমের যিহোবার প্রার্থনাতেও অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল। জে আরেক ইব্রাহিম হিসেবে দেখেছিলেন দাউদকে। তিনি বিশ্বাস করতেন, দাউদের রাজ্য প্রাচীন প্রতিশ্রুতিগুলো বাস্তবায়ন করেছিল। কারণ ইব্রাহিমের বংশধরেরা একটি শক্তিশালী জাতিতে পরিণত হয়েছিল, তারা কেনান ভূমির উত্তরসূরি হয়েছিল। তবে ইব্রাহিমের মতো দাউদও দেশের জনগণের বিশ্বাসের প্রতি এঁদ্ধাশীল ছিলেন।

    ইর ডেভিডে আসলে জেবুসিত ও ইসরাইলি ঐতিহ্যের মধ্যে একটি সৃষ্টিশীল মিথস্ক্রিয়া ঘটিছিল। শেষ জেবুসিত রাজা (সম্ভবত) অরুনাহকে নগরীর বাইরে মাউন্ট জায়নের উপকণ্ঠে তার এস্টেট বহাল রাখার অনুমতি দেওয়া হয়েছিল। দাউদ পুরনো জেবুসিত প্রশাসনের দায়িত্বও গ্রহণ করেছিলেন। কেনানি নগর-রাষ্ট্রগুলো কয়েক শতকের পরিক্রমায় একটি রাজনৈতিক ও আর্থিক আমলাতন্ত্ৰ বিকাশ করেছিল। অন্য দিকে ইসরাইলি বা পাহাড়ি দেশের জুদাবাসীর নগর-রাষ্ট্র পরিচালনার কোনো অভিজ্ঞতা বা বিশেষজ্ঞ জ্ঞান ছিল না। তাদের বেশির ভাগই ছিল সম্ভবত নিরক্ষর। ফলে পুরনো প্রশাসনকে কেন বহাল রাখা হয়েছিল, জেবুসিত কর্মকর্তাদের কেন কাজে লাগানো হয়েছিল, তা বোঝা যায়। এই কর্মকর্তারাই নগরীর সাবলীল পরিচালনা বহাল রাখতে সহায়তা করেছিল, এবং নতুন জেবুসিত প্রজাদের সাথে সুসম্পর্ক রক্ষা করতে দাউদকে উদ্বুদ্ধু করেছিল। জেরুসালেমে দাউদের আচরণ ইঙ্গিত দেয়, ইসরাইলিরা দেশের জনগণের কাছ থেকে দূরে থাকাটা তখনো পবিত্র দায়িত্ব মনে করত না। বেবিলনে নির্বাসিত জীবন পর পর্যন্ত ইসরাইলে তা রীতি ছিল না। মিসরীয়রা যখন কেনান নিয়ন্ত্রণ করে, তারা সম্ভবত লোকজনকে তাদের প্রশাসনিক পদ্ধতি সম্পর্কে শিক্ষা দিয়েছিল। বাইবেলে আমরা দেখি, দাউদীয় ও সোলায়মানীয় রাজদরবার মিসরীয়দের আদলে গড়া। এর একজন প্রধান উজিড় রয়েছেন, একজন পররাষ্ট্রমন্ত্রী আছেন, অভ্যন্তরীণ বিষয়াদি দেখার জন্য অন্য একজন আছেন; আর আছেন একজন ‘রাজার বন্ধু।’ ফলে আমারনা আমলে যে পদ্ধতিটি সক্রিয় ছিল তা দাউদের ছেলে সোলায়মানের আমলেও কার্যকর ছিল। সোলায়মানের কয়েকজন কর্মকর্তার অ-সেমিটিক নাম ছিল। আর দাউদ প্রায় নিশ্চিতভাবেই জেবুসিতদের স্থায়ী সেনাবাহিনীর দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন। বাইবেলে কেরেতি ও পেলেতি (‘ক্রেতান’ ও ‘ফিলিস্তিন’) নামের দুটি পরিভাষা রয়েছে। তারা সম্ভবত ভাড়াটে সৈনিক হিসেবে দাউদের ব্যক্তিগত দেহরক্ষী হিসেবে কাজ করত। ফলে নগরীতে দাউদের বিজয়ের ফলে বলতে গেলে নগরীর স্বাভাবিক কার্যক্রমে কোনোই ব্যাঘাত সৃষ্টি হয়নি, আগের জেবুসিত বৈশিষ্ট্যই অক্ষুণ্ণ রেখেছিল। ‘ইর ডেভিড’ হিসেবে যে নতুন নাম দেওয়া হয়েছিল, তা কখনো জনপ্রিয় হয়নি। বেশির ভাগ লোক দাউদ-পূর্ব নাম জেরুসালেম ও জায়নই বলা অব্যাহত রাখে।

    বস্তুত, রাজকীয় পরিবারের জেবুসিত রক্তও মিশতে পারে। কারণ দাউদ সত্যিই কোনো জেবুসিত রমনীকে বিয়ে করে থাকতে পারেন। পরবর্তীকালে ইসরাইলিদের জন্য বিদেশীদের বিয়ে করা নিষিদ্ধ করার কঠোর আইন করা হয়। তবে দাউদ বা সোলায়মানের এ নিয়ে কোনো সঙ্কোচ ছিল না। দাউদ তার সেনাবাহিনীর জেবুসিত অফিসারদের একজন ‘উরিয়াহ দি হিত্তিত -এর স্ত্রী বাথশেবাকে প্রলুব্ধ করেছিলেন। (হিত্তিতের সাথে জেবুসিতরা সম্পর্কযুক্ত ছিল বলে বলা হয়ে থাকে।) দাউদ যাতে বাথশেবাকে বিয়ে করতে পারেন, সেজন্য তিনি আম্মোনিতদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে উরিয়াহকে বিশেষভাবে বিপজ্জনক স্থানে মোতায়েন করেন। বাথশেবার নামটি এসে থাকতে পারে ‘সাত ঈশ্বরের মেয়ে’ (কনিফর্ম লিপিতে তা সিব্বিতি লেখা হলেও হিব্রুতে তা হয়ে যায় শেভা বা ‘সাত’।)’ ফলে দাউদ ও বাথশেবার যে ছেলের জন্ম হয় তিনি ছিলেন অর্ধেক জেবুসিত। তাকে ভালো ইসরাইলি নাম জেদিদা (‘যিহোবার প্রিয়) দেওয়া হয়। তাকে যে দাউদের উত্তরসূরি মনোনীতি করা হয়েছে, তারই চিহ্ন ছিল এটি। তবে তার মা-বাবা তাকে যে নামটি দিয়েছিলেন তা হলো সোলায়মান। এ নামটি জেরুসালেমের প্রাচীন দেবতা সালেমের সাথেও সম্পর্কযুক্ত হতে পারে। ইতিহাসলেখকেরা অবশ্য একে হিব্রু সালোমের সাথে সম্পর্কযুক্ত করেন। পিতার বিপরীতে সোলায়মান হয়েছিলেন ‘শান্তির মানব।’

    ইহুদি ঐতিহ্যে খুবই গুরুত্বপূর্ণ হওয়া অন্যান্য জেরুসালেমবাসীর মধ্যেও জেবুসিত থেকে থাকতে পারেন। এদের একজন হলেন নবী নাথান।’ বাইবেলে অন্য প্রায় সব নবীর পারিবারিক পরিচিতি দেওয়া হলেও নাথানের বেলায় ব্যতিক্রম দেখা যায়। তিনি সম্ভবত ছিলেন জেবুসিত রাজার উপদেষ্টা। তা হয়ে থাকলে দাউদ ও তার নতুন জেবুসিত প্রজাদের মধ্যে খুবই সম্ভাবনাময় মধ্যস্ততাকারী ছিলেন তিনি। এ কারণেই উরিয়াহর মৃত্যুর পর দাউদকে তীব্র ভাষায় সমালোচনা করেছিলেন নাথান। মুসায়ী নৈতিকতায় উদ্দীপ্ত হয়ে তিনি এমনটি করেছিলেন তা নয়, বরং রাজ্যে ন্যায়বিচার রক্ষার সংকল্প ব্যক্ত করা নিকট প্রাচ্যের রাজতন্ত্রের দায়দায়িত্বের সুস্পষ্ট বরখেলাপ ছিল ওই ঘটনা। উরিয়াহর হত্যাকাণ্ডটি জেবুসিত জনসাধারণের সাথে দাউদের সম্পর্কও মারাত্মকভাবে ক্ষুণ্ণ করেছিল। জেরুসালেমের প্রধান পুরোহিত জাদোকও সম্ভবত জেবুসিত ছিলেন। অবশ্য এ নিয়ে অতীতে উত্তপ্ত বিতর্ক হয়েছে।১২ পরে আমরা দেখতে পাবো, ইসরাইলের সব পুরোহিতকে প্রমাণ করতে হয়েছিল, তারা ছিলেন জাদোকের বংশধর। কারণ ওই সময় জাদোক পরিণত হয়েছিলেন ইহুদি বিশুদ্ধতার প্রতীক। তবে জাদোক আসলে জেবুসিত নাম। পরে ইতিহাসলেখকেরা একটি অনবদ্য বংশলতিকা উপস্থাপন করেছিলেন। এতে তাকে হারুনের বংশধর হিসেবে অভিহিত করা হয়। কিন্তু দাউদ ও হারুনের মধ্যে আরো বেশি প্রজন্মের অস্তিত্ব ছিল বলে ধারণা করা হয়ে থাকে।১৩ সম্ভবত ইতিহাসলেখকেরা জাদোকের নিজস্ব জেবুসিত বংশই অন্তর্ভুক্ত করে নিয়েছিলেন। আল ইলিয়নের প্রধান পুরোহিতকে বরখাস্ত করাটা সম্ভবত স্থানীয় লোকজনের ভালো লাগেনি। ইসরাইলিদের সন্তুষ্ট করার জন্য জাদোকের পাশাপাশি দায়িত্ব পালনের জন্য শিলোহের পুরোহিতদের বংশধর আবিয়াথারকে নিয়োগ করেছিলেন দাউদ। তবে আবিথার সম্ভবত দাউদের মৃত্যুর গর বেশি দিন বাঁচেননি। জাদোকই জেরুসালেমের প্রধান পুরোহিত হয়েছিলেন। তা সত্ত্বেও একজন ইসরাইলি ও একজন জেবুতিকে পাশাপাশি দায়িত্ব পালন করতে দেখাটি জেরুসালেমে দাউদ যে সহাবস্থান প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন, সেটিই প্রতীকীভাবে ফুটে ওঠেছে। তার ক্রমবর্ধমান হারে বৈচিত্র্যপূর্ণ রাজ্যে ঐক্য ও বিভিন্ন উপাদানকে একত্রিত করার জন্য সংহতি প্রদর্শনকারী প্রতীকের প্রয়োজন ছিল। দাউদ তার এক ছেলেকে বলতেন বালিদা। এতে বোঝা যাচ্ছে, তিনি স্থানীয় জায়ন ঐতিহ্যের কাছে উন্মুক্ত ছিলেন, মাউন্ট জায়নবিষয়ক জেবুসিতদের অনেক পুরনো কান্টিক রীতিনীতি জেরুসালেমের যিহোবার ইসরাইলি ঐতিহ্যের সাথে সফলভাবে মিশ্রিত হয়েছিল।

    দাউদের অন্যতম প্রথম কাজ ছিল আর্ক অব দি কোভেন্যান্টকে জেরুসালেমে সরিয়ে নেওয়া। তখনো সেটি তার রাজ্যের পশ্চিম সীমান্তের কিরেথ জেরিমে ছিল। এটি বিপজ্জনক হলেও উদ্দীপ্ত সিদ্ধান্ত ছিল। দাউদের প্রতি তখনো অস্বস্তিতে থাকা রাজ্যের উত্তরাঞ্চলের লোকজন তার নগরীতে আর্কের (এটি ছিল তাদের সবচেয়ে পবিত্র ঐতিহ্যের অন্তর্ভুক্ত) উপস্থিতিতে অভিভূত হয়ে যেতে পারে মনে করা হয়েছিল। এটি তার শাসনের বৈধতা দিয়েছিল, নগরীকে পবিত্র করেছিল। কারণ, তখন পর্যন্ত জেরুসালেমে যিহোবাবাদীদের জন্য পবিত্র স্থান হিসেবে কোনো ধর্মীয় তাৎপর্য ছিল না। অবশ্য, আর্ক স্থানান্তরে দাউদের প্রথম প্রয়াস মর্মান্তিকভাবে ভণ্ডুল হয়ে গিয়েছিল। কোনো পবিত্র স্থানকে নিজেদের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠা করা কোনো মানবীয় দায়িত্ব ছিল না। পবিত্র স্থানটিকে নিজে থেকে আবির্ভূত হতে হয়। যিহোবাকে অতীতে চলমান দেবতা হিসেবে দেখা হতো, তবে তিনি চলতে পারতেন কেবল রাজার ইচ্ছানুযায়ী। যেকোনো পবিত্র বস্তু বিপজ্জনক হওয়ার আশঙ্কাযুক্ত থাকে, তা কেবল যাদের কাছে যথাযথ প্রতিষেধক আছে, তারাই নাড়াচাড়া করতে পারে। বিষয়টি ভয়াবহভাবে দেখা গিয়েছিল আর্কের প্রথম সফরকালে। ওই সময় উজ্জাহ নামের এক সাহায্যকর্মী এটিকে ধরার জন্য হাত বাড়ালে এটি গাড়ি থেকে পড়ে যাওয়ার আশঙ্কা সৃষ্টি হয়, সে সাথে সাথে মারা যায়। যিহোবার উপস্থিতির প্রতীকে পরিণত হয় আর্ক। ফলে ঘটনাটি প্রমাণ করে, দাউদ নগরীতে ধার্মিক স্মারক হিসেবে নয়, বরং শক্তিশালী ও নজিরবিহীন শক্তিকে নিয়ে আসার চেষ্টা করেছেন। যদি যিহোবাকে জায়নে আসতে হয়, তবে তা হবে তিনি – কেবল একমাত্র তিনিই – তা করতে চেয়েছেন বলেই।

    তিন মাস পর দাউদ আবার চেষ্টা করলেন। এবার যিহোবা কোনো দুর্ঘটনা ছাড়াই জেরুসালেমের ভূখণ্ডে আর্কের প্রবেশ অনুমোদন করলেন। আর্কের সামনে দাউদ নৃত্য করলেন, চক্কর খেলেন। এ সময় তিনি পুরোহিতের মতো লিনেনের সংক্ষিপ্ত পোশাক পরেছিলেন। মাঝে মাঝেই তিনি শোভাযাত্রাটি থামিয়ে ভেড়া বা ছাগল কোরবানি দিচ্ছিলেন। সবশেষে আর্কটিকে বিপুল জাঁকজমক ও উল্লাসের মধ্য দিয়ে গিহোন স্প্রিংয়ের পাশে এ উদ্দেশ্যে নির্মিত তাঁবু-মন্দিরে নিয়ে আসা হলো।১৪ দাউদের নগরীতে বসবাস করার পরিকল্পনা করার মাধ্যমে যিহোবা দ্ব্যর্থহীনভাবে ইঙ্গিত দিলেন যে তিনি দাউদকে ইসরাইলের রাজা করার জন্য মনোনীত করেছেন। স্থায়ী আবাস হিসেবে যিহোবার জায়নকে গ্রহণ করার বিষয়টি দাউদের পরিবারকে নির্বাচন করার সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিল। দাউদ জেরুসালেমে যিহোবার জন্য একটি মন্দির নির্মাণ করার সিদ্ধান্ত নিলেন, তাতেই বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে যায়। নাথানের কাছে আইডিয়াটি উপস্থাপনের সময় নবী ছিলেন খুবই উদ্দীপ্ত। নিকট প্রাচ্যের রাজাদের কর্তব্য হলো যে ঈশ্বরের ওপর তার শাসন নির্ভরশীল, তার জন্য একটি গৃহ নির্মাণ করা। কিন্তু যিহোবার ছিল অন্য পরিকল্পনা : তিনি নাথানকে বললেন, তিনি সবসময় কোনো তাঁবুতে ভ্রাম্যমাণ জীবন কাটাতে চান। তিনি নিজের জন্য কোনো গৃহ চান না, এর বদলে তিনি চান গৃহটি দাউদের জন্য নির্মাণ করা হোক তথা এ রাজবংশটি চিরদিন টিকে থাকুক।১৫

    সম্ভবত নাথানের মনে শঙ্কা সৃষ্টি হয়েছিল যে জেবুসিত জেরুসালেমের মধ্যে কোনো বিদেশী ঈশ্বরের জন্য মন্দির নির্মাণের মাধ্যমে আল ইলিয়নকে সরিয়ে দেওয়ার কাজ দাউদের জন্য খুব বেশি তাড়াহুড়া হয়ে যাবে। দাউদ সম্ভবত গিহন স্প্রিংকে স্থান নির্বাচন করেছিলেন। এটি ছিল প্রাচীরগুলোর বাইরে, জেবুসিত স্পর্শকাতরতা-বহির্ভূত। কিংবা সম্ভবত ইসরাইল ও জুদার গোত্রগুলোর মধ্যে এ নিয়ে পরস্পরবিরোধী ধারণা ছিল। তারা সম্ভবত যিহোবার যাযাবর ভাবমূর্তিতে অভ্যস্ত হয়ে পড়ায় কোনো পবিত্র স্থানে আবদ্ধ থাকার কেনানি অন্যান্য ঈশ্বরের মতো তাকে দেখতে চাচ্ছিল না। সম্ভবত লোকজন এই মন্দির দাউদকে যে ক্ষমতা দেবে, তার ব্যাপারে ভীত হয়ে পড়েছিল। বাইবেললেখকরা মন্দির প্রত্যাখ্যান করার যিহোবার কাহিনীটি অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন এ জন্য যে তাদের আদর্শ রাজা দাউদ তার ঈশ্বরের জন্য কোনো মন্দির নির্মাণ করতে ব্যর্থ হওয়াটা তাদের জন্য ছিল বেশ বিব্রতকর অবস্থা। লেখকেরা মনে করেছেন, দাউদ খুব বেশি রক্তপাত করায় ওই উচ্চ সম্মান দেওয়া হয়নি তকে, এবং সোলায়মান শান্তিবাদী হওয়ায় তিনিই পেয়েছেন তা।১৬ আমরা দেখেছি, প্রাচীন দুনিয়ার নগরীগুলোতে ভবনের ধর্মীয় তাৎপর্য থাকে। দাউদ জেরুসালেমে একজন রাজার জন্য মানানসই অনেক ভবন নির্মাণ করেছিলেন। তিনি লেবানন থেকে সিডর কাঠ এনে নিজের জন্য একটি প্রাসাদ নির্মাণ করেছিলেন; তিনি ‘মিলো’ মেরামত করেছিলেন। বাইবেল লেখকেরা এই ‘মিলো’ শব্দটি নিয়ে ধাঁধায় পড়েছিলেন। তারা শেষ পর্যন্ত একে ওফেলের উপরে প্রাচীন কোনো বারান্দা বুঝেছিলেন। দাউদ নতুন দুর্গ হিসেবে ‘টাওয়ার অব দাউদ’ নির্মাণ করেছিলেন। সাম্রাজ্যের প্রয়োজন মেটানোর জন্য অব্যাহতভাবে বাড়তে থাকা সরকারি কর্মকর্তা, শিল্পী ও সৈন্যদের আবাসনের ব্যবস্থা করার জন্য তিনি নগরীটি সম্প্রসারণ করেন। কাজটি করার জন্য একপর্যায়ে তিনি প্রাচীরগুলোও ভেঙ্গে ফেলেন। কিন্তু মুসা যেমন তার লোকজনকে মিসর থেকে বের করে প্রতিশ্রুত ভূমির দ্বারপ্রান্তে নিয়ে গিয়ে মৃত্যুবরণ করেছিলেন, একইভাবে দাউদও যিহোবার লোকজনকে জেরুসালেমে নিয়ে গেলেও মন্দির নির্মাণ করার সুযোগটি পাননি, যা একদিন এই জেবুসিত নগরীটি ইহুদি বিশ্বের সবচেয়ে পবিত্র স্থানে পরিণত হবে।

    নিকট প্রাচ্যে ধর্ম এখনো নিজের প্রয়োজনে ভূমি ব্যবহারের জন্য ব্যবহৃত হয়। পাসওভারের উৎসবে ইসরাইল-অধিকৃত পশ্চিম তীরে ইহুদি বসতি স্থাপনকারীরা আরব এলাকা দিয়ে শোভাযাত্রা বের করে। এটি এমন এক ‘তীর্থযাত্রা’ যা তাদের বিশ্বাস করা পবিত্র ভূমিতে আগ্রাসী ইহুদি উপস্থিতি প্রতিষ্ঠা করে।

    ভবিষ্যতে সোলায়মানের মন্দিরের স্থানের জন্য তিনি আরাউনার (তিনি সম্ভবত ছিলেন শেষ জেবুসিত রাজা) কাছ থেকে জমি কিনে আয়োজন সম্পন্ন করতে সক্ষম হয়েছিলেন। আমাদের লেখকেরা বলছেন, আদমশুমারির নির্দেশ দিয়ে দাউদ সম্ভবত পাপ করেছিলেন। এটি সবসময় অজনপ্রিয় পদক্ষেপ বিবেচিত হতো। কারণ, এর ফলে সাধারণত কর ও বাধ্যতামূলক শ্রমের ব্যবস্থা করত। ফলে ঈশ্বর রাজ্যে প্লেগ পাঠালেন। ওই রোগে তিন দিনে ৭০ হাজার লোক মারা গেল। শেষ পর্যন্ত দাউদ দেখলেন, মাউন্ট জায়নের উপরে অরুনাহর বিশাল গোলাকার চত্বরে যিহোবার ‘ফেরেশতা’ নিচের নগরীর দিকে হাত বিস্তৃত করে দাঁড়িয়ে আছেন। রাজদরবারের এক নবী দাউদকে অবগত করেন যে এই ঐশী স্থানে যিহোবার জন্য একটি বেদী নির্মাণ করার মাধ্যমেই তিনি কেবল প্লেগ দমন করতে পারেন। বাইবেল লেখকেরা দেখলেন, দাউদ ও অরুনাহ এই সঙ্কটকালে সম্প্রীতিপূর্ণভাবে একসাথে কাজ করছেন। ঘটনাটি ইব্রাহিমের ইফরোন দি হিত্তিত থেকে ম্যাচফেলাই গুহা ক্রয় করার ঘটনাটি মনে করিয়ে দেয়। ইফরোনের মতো অরুনাহও বিনা মূল্যেই জমিটি দাউদকে দিয়ে দিতে চেয়েছিলেন। দাউদ স্থানটি স্রেফ দখল করেও নিতে পারতেন। কিন্তু তিনি তার পূর্বসূরীর প্রতি প্রশংসনীয় সৌজন্যতা ও শ্রদ্ধা প্রদর্শন করে তাকে পূর্ণ মূল্য পরিশোধ করতে অটল থাকেন।১৭ বর্তমানে অনেকে মনে করেন, জেবুসিত জেরুসালেমের অন্যতম পবিত্র স্থান ছিল এলাকাটি। কেনানে উন্মুক্ত চত্বর প্রায়ই জনসমাবেশ বা ভবিষ্যদ্বাণী শোনার জন্য কিংবা বালের উর্বরা মতবাদের জন্য ব্যবহৃত হতো এবং নগরীর প্রবেশপথে প্রকাশ্য স্থানে এ ধরনের একটি স্থানের মালিক অরুনাহর হওয়াটা প্রমাণ করে, এটি ওই মতাদর্শের জন্য ব্যবহৃত হতো।* বাইবেল লেখকেরা এটি উল্লেখ করেননি। কারণ এতে বোঝা যেত, পৌত্তলিক বামাহ (কাল্ট স্থান)-এর জায়গাটি তাদের মন্দির প্রতিষ্ঠার সম্ভাবনার কথা প্রকাশ পাওয়াটা তাদের জন্য ছিল বিব্রতকর। কিন্তু এ ধরনের ধারাবাহিকতা প্রাচীন কালে সাধারণ বিষয় ছিল। অরুনাহ কোনো ধরনের ক্রোধ…. প্রকাশ করেননি, তবে সম্ভবত দাউদের সাথে এ পবিত্র স্থানটি ভাগাভাগি করতে চেয়েছিলেন। তিনি এমনকি নতুন বেদীতে প্রথম কোরবানির জন্য মূল্যও দিতে চেয়েছিলেন। ঐশী সত্তা এমন এক জিনিস যার মালিকানা মানুষের পক্ষে অর্জন করা বা সামগ্রিকভাবে অনুভব করা সম্ভব নয়। ঐশী-প্রকাশটি দেখিয়েছে যে স্থানটি ঈশ্বরদের মালিকানাধীন, পরের প্রজন্মে দাউদ ও অরুনাহর সন্তানেরা একসাথে মাউন্ট জায়নে প্রার্থনা করেছিল।

    দাউদও নতুন মন্দিরের জন্য সামগ্রীও সংগ্রহ করেছিলেন বলে বলা হয়ে থাকে। তিনি সিডার কাঠ ও জুনিপার বৃক্ষ পাঠানোর জন্য তার মিত্র টায়ারের রাজা হিরামকে অনুরোধ করেছিলেন। মন্দির নির্মাণে দাউদ কোনো ধরনের অংশগ্রহণ করেননি, এমনটা ইতিহাসলেখক বিশেষভাবে মেনে নিতে পারছিলেন না। তিনি আমাদের জানাচ্ছেন, যিহোবা ভবিষ্যতের পবিত্র স্থানটি সম্পর্কে পূর্ণাঙ্গ রূপরেখা দাউদকে জানিয়েছিলেন, এবং তিনি এইসব ঐশী নির্দেশনা তার ছেলে সোলায়মানকে অবগত করেছিলেন।১৯ ফলে মন্দিরটি নির্মিত হয়েছিল ‘যিহোবা যেভাবে পরিকল্পনা করেছিলেন, ঠিক সেভাবেই। কোনো রাজা মন্দিরের জন্য স্থান নির্বাচন করতে পারেন না : সেই স্থানেই মন্দির নির্মিত হতে পারে সেখানে বিশ্বের ‘কেন্দ্রগুলোর’ একটি প্রকাশিত হয়। ফলে রাজারা প্রায়ই সাবেক মন্দিরের স্থানই বেছে নিতেন। কারণ এসব স্থানের সাথে ঐশীর সম্পৃক্ততা রয়েছে বলে জানা থাকত। একইভাবে কোনো স্থাপত্যবিদ নতুন কোনো মন্দির নির্মাণ করার সময় মৌলিক হিসেবে তার নক্সা প্রণয়ন করেছেন বলে প্রত্যাশিত ছিল না। এটি হতে হতো প্রতীক। যে গ্রিক শব্দটি থেকে এটির উদ্ভব ঘটেছে তাতে দুটি বিষয় একসাথে প্রকাশ করে। প্রাক-আধুনিক বিশ্বে এই আইডিয়া খুবই গুরুত্বসহকারে গ্রহণ করা হতো। এটি ছিল প্রাচীন ধর্মের ভিত্তি। মন্দিরকে হতে হতো ঈশ্বরের স্বর্গীয় আবাসের অনুকরণ। আর এই পছন্দই স্বর্গীয় আদিরূপের সাথে নিচে দুনিয়ায় অনুকরণটিকে সম্পর্কযুক্ত করে দুটিকে একই অনুভূতিতে প্রকাশ করত। একই ঘনিষ্ঠ মিলের কারণেই দেবতাকে তার দুনিয়াবি তীর্থক্ষেত্রে বাস করা সম্ভব করে তুলত। তিনি দুনিয়াতে স্বর্গীয় স্থানের মতো করেই বাস করতেন। একইসাথে কোনো মন্দিরের পরিকল্পনা প্রকাশ করতে হতো। দাউদও তেমনটি করেছিলেন, যাতে দুনিয়ার উপরে ঈশ্বরের গৃহটির মাত্রা ও গৃহসজ্জাগুলো নিখুঁতভাবে দুনিয়াতেও তৈরি করা সম্ভব হয়।

    কিন্তু তারপরও এসবের মধ্যে প্রবল রাজনৈতিক উপাদান ছিল। আর্ককে জেরুসালেমে নিয়ে আসার মাধ্যমে দাউদ ধীরে ধীরে নগরীকে নিজের করে নিচ্ছিলেন। প্রথমে তিনি ওফেলের পাদদেশে তার জনগণের সবচেয়ে ঐশী বস্তুটিকে নিয়ে এলেন, তারপর অরুনাহর গোল চত্বর ক্রয় করার মাধ্যমে মাউন্ট জায়নের ওপরে তার নিজস্ব মন্দিরে যিহোবার স্থায়ী অভিষেকের ব্যবস্থা করলেন। সোলায়মানের আমলে যিহোবা জেরুসালেমের আল ইলিয়নে তথা এর সর্বশক্তিমান ঈশ্বরে পরিণত হয়েছিলেন। একইভাবে দাউদ তার ছোট সাম্রাজ্য গড়েছিলেন ধাপে ধাপে। প্রথমে তিনি ফিলিস্তিনিদের বশ করেন। বস্তুত, তিনি নগরীটি জয়ের আগে জেরুসালেমের দক্ষিণে রেফাইম উপত্যকায় তাদেরকে পরাজিত করেছিলেন। পর্যায়ক্রমে তিনি অবশ্যই কেনানের অন্যান্য নগর-রাষ্ট্রকেও তার সাম্রাজ্যে অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন। তবে বাইবেল এর উল্লেখ করেনি। তারা সম্ভবত সামন্ত মর্যাদা গ্রহণ করেছিল। সবশেষে তিনি মোয়াব ও ইদোমের প্রতিবেশী রাজ্য দুটিকে বশ মানান। সিরিয়ার বিশাল এলাকাজুড়ে ছিল এই দুই রাজ্যের অবস্থান। (মানচিত্র দেখুন।) ইসরাইলিরা দাউদের রাজ্যের কথা ভোলেনি : তারা আর কখনো রাজনৈতিকভাবে এত শক্তিশালী হয়নি। অবশ্য নিকট প্রাচ্যের ওই সময়ের অন্য কোনো গ্রন্থেই রাজ্যটির কথা উল্লেখ নেই। এ কারণে অনেকে মনে করে, এটি একটি কল্পকথা,

    এগুলো গোষ্ঠপতিদের কাহিনীর মতো, এর কোনো ঐতিহাসিক ভিত্তি নেই। তবে বিশেষজ্ঞদের মধ্যে সাধারণ ঐকমত্য রয়েছে, ইসরাইল ও জুদার ঐক্যবদ্ধ রাজ্যটি বাস্তবেই অস্তিত্বশীল ছিল। বাইবেলে এই সময়ে আমাদের পরিচিত নিকট প্রাচ্যের সামজের সাথে দাউদের সাম্রাজ্যের প্রচুর রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক বর্ণনা থাকায় পুরোটাই বানোয়াট দাবি করা কঠিন। তখন মেসোপোটেমিয়া ও মিসর উভয়টিই নিজেদের অন্তঃদ্বন্দ্বে পতনমুখী হতে থাকায় দাউদের রাজ্যের সাথে তাদের সম্ভবত কোনো যোগাযোগ ছিল না। অধিকন্তু, বাইবেল রাজ্যটিকে আদর্শ হিসেবে উপস্থাপন করেনি। বিপুল প্রশংসাপূর্ণ ভাষ্যের পাশাপাশি আমরা সম্পদ ছাপিয়ে রাজ্যটিকে ভেতর থেকেই তিক্তভাবে বিভক্ত হওয়ার কথাও পাঠ করি। স্পষ্টভাবেই বোঝা যাচ্ছে, রাজ্যটি সঙ্কটের দিকে এগিয়ে চলেছিল।

    দাউদ মরনোত্তর বীর হিসেবে স্বীকৃতি পেয়ে থাকলেও জীবদ্দশায় তিনি সার্বজনীনভাবে ভালোবাসা পাননি। তার ছেলে আবসালোম তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহে নেতৃত্ব দিয়েছিল, জেবুসিত রাজ্যের সাথে সম্পৃক্ত কান্ট-প্রাসাদ এন রোগেলের ঝরনায় নিজের জন্য একটি স্মৃতিসৌধ স্থাপন করেছিল, হেবরনে নিজেকে ইসরাইল ও জুদার রাজা হিসেবে ঘোষণা করেছিলেন। পরিস্থিতি এত মারাত্মক হয়ে পড়েছিল যে দাউদকে জেরুসালেমে পালিয়ে যেতে হয়েছিল। তবে তিনি বিদ্রোহ দমন করতে পেরেছিলেন। বিদ্রোহীদের প্রতি জনসমর্থন থাকায় কেবল শ্রেয়তর সামরিক সামর্থ্যের কারণেই দাউদ তাতে সাফল্য পেয়েছিলেন। ইসরাইল ও জুদার মিলন ও ছিল ভঙ্গুর। কারণ দাউদকে সম্ভবত তার নিজ রাজ্য জুদাতে বেশি পছন্দ করা হতো। আবসালোমের বিদ্রোহের পর পুরো ইসরাইল তার ঐক্যবদ্ধ রাজ্য থেকে সরে যায়। দাউদ আবারো তার শক্তি প্রয়োগ করেই ক্ষমতা ফের জাহির করতে পেরেছিলেন। জীবনের একেবারে শেষ প্রান্তে জেরুসালেমে জেবুসিত ও ইসরাইলিদের মধ্যে বিভক্তি দেখা দেয়। দাউদ মৃত্যুশয্যায় থাকার সময় তার বেঁচে থাকা বড় ছেলে আদোনিজাহ কমান্ডার জোয়াব ও পুরোহিত অ্যাবিথারসহ হেবরনের অভিজাতদের সমর্থনপুষ্ট হয়ে এন রোগেলে নিজেকে রাজা হিসেবে ঘোষণা করেন। পাল্টা ব্যবস্থার জন্য জেবুসিত গ্রুপটি দাউদের সমর্থনে এগিয়ে আসে। কেরেতি ও পেলেতির পুরনো জেবুসিত সেনাবাহিনীকে নিয়ে নাথান, জাদোক ও বাথশেবা এবার সোলায়মানকে গিহোন স্প্রিংয়ের পাশে অবস্থিত ইয়ায়ের মন্দিরে নিয়ে গিয়ে সেখানে বিপুল তুর্যনিনাদে তাকে মুকুট পরান। আদোনিজাহ সাথে সাথে আত্মসমর্পণ করেন। জোয়াবের সাথে তাকেও শেষ পর্যন্ত হত্যা করা হয়, অ্যাবিথারকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়। দাউদ যখন মারা যান, তখন জেবুসিত গ্রুপটি জেরুসালেমে নবাগতদের বিরুদ্ধে বিপুলভাবে বিজয়ী হয়েছিল বলে বলা যায়।

    দাউদের অধীনে জেরুসালেম ছোট একটি কেনানি নগর-রাষ্ট্র থেকে সাম্রাজ্যের রাজধানীতে পরিণত হয়েছিল। আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ৯৭০ সাল থেকে শুরু হওয়া সোলায়মানের আমলে জেরুসালেম লাভ করে আঞ্চলিক মর্যাদা, এর আকার হয় দ্বিগুণ। অনুগত বা মিত্র রাজাদের মেয়েদের নিয়ে রাজকন্যা/রানিদের বিশাল হেরেম ছিল সোলায়মানের। তিনি ফারাওদের এক মেয়েকে বিয়ে করার বিরল সম্মানও অর্জন করেন। রাজ্যের এখন ওই সময়ের সর্বাধুনিক সামরিক প্রযুক্তি শক্তিশালী রথ বাহিনী ছিল, আকাবা উপসাগরে ইজিয়ন গেবারে একটি নৌবহরও ছিল। সোলায়মান হন মিসর ও সিলিসিয়ায় অস্ত্র ব্যবসায়ী, রথ ও ঘোড়া বিক্রিকারী। বাইবেল আমাদের জানাচ্ছে, সোলায়মানের জ্ঞানের খ্যাতি শুনে শেবার (আধুনিক ইয়েমেন) রানি তার সাথে সাক্ষাত করতে গিয়েছিলেন। কাহিনীটি সম্ভবত সোলায়মানের রাজ্যের ক্রমবর্ধমান গুরুত্বের কথা প্রতিফলিত করছে। কারণ তিনি লোহিত সাগরে বাণিজ্য শুরু করে দিলে শেবার অর্থনীতিতে বিপর্যয় সৃষ্টি হতে পারত। সোলায়মান কিংবদন্তির মর্যাদা লাভ করেন। তার সম্পদ ও বিচক্ষণতা বিস্ময়কর পর্যায়ে ছিল বলে ধারণা করা হয়। সফল রাজার মর্যাদার সাথে সঙ্গতি রেখে তিনি বিশাল নির্মাণ প্রকল্প গ্রহণ করেন। হাজর, মেগিডো ও আরাদের নগর দুর্গগুলো পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেন।

    জেরুসালেম পরিণত হয় কসমোপলিটান নগরী। এটিই সোলায়মানের সবচেয়ে উচ্চাভিলাষী নির্মাণ কর্মসূচিতে পরিণত হয়েছিল। নগরীকে উত্তর দিকে সম্প্রসারিত করে সোলায়মান মাউন্ট জায়নের ঢালে অরুনাহর পুরনো এস্টেট এলাকায় একটি রাজকীয় নগর-দুর্গ নির্মাণ করেন। বাইবেলের সূত্রগুলো আমাদের বলছে, এটি সিরিয়া ও উত্তর-পশ্চিম মেসোপোটেমিয়ার বিভিন্ন স্থানে উদ্ঘাটিত ১০ শতকের অন্যান্য নগর-দুর্গের মতো ছিল। এতে যিহোবার একটি বিশাল টেম্পল ছিল, রাজার জন্য ছিল একটি প্রাসাদ। প্রাসাদটি আয়তনে টেম্পলের প্রায় দ্বিগুণ ছিল। ২১ আরো কিছু ভবনও ছিল তাতে। এগুলোর একটি ছিল সিডর-স্তম্ভের ‘হাউস অব ফরেস্ট অব লেবানন’। এটির কার্যক্রম এখনো আমাদের কাছে পরিষ্কার নয়। এছাড়া ছিল ছিল খাজাঞ্চি খানা, বিচার দরবার। এখানেই সোলায়মানের চমকপ্রদ হাতির দাঁতের সিংহাসনটি ছিল। আর ছিল ফারাওয়ের মেয়ের জন্য বিশেষ একটি প্রাসাদ। এই মেয়ে ছিলেন সোলায়মানের সবচেয়ে খ্যাতিমান স্ত্রী।

    এর কিছুই টিকে থাকেনি। এসব ভবনের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল টেম্পল। আর এ সম্পর্কে আমাদের জ্ঞান পুরোপুরি বাইবেললেখকদের ওপর নির্ভরশীল। তারা শ্রুতিনির্ভর প্রচলিত ভাষ্যের (এগুলোর কোনো কোনোটি প্রচরিত হয়েছিল টেম্পলটি ধ্বংস হওয়ার অনেক দিন পর) বিস্তারিত বিবরণ অনুরাগসিক্ত হয়ে তুলে ধরেছেন। যিহোবার উদ্দেশে নিবেদিত টেম্পলেই আর্ক অব কোভেন্যান্ট রাখা হয়েছিল। নিকট প্রাচ্যের মন্দিরগুলোর সাথে এর সবচেয়ে অমিল ছিল এই যে এখানে প্রধান দেবতার উপস্থিতি প্রতীকীভাবে ফুটিয়ে তুলতে তার কোনো মূর্তি ছিল না। জ্বলন্ত ঝোপে মুসার কাছে আত্মপ্রকাশের সময় থেকে যিহোবার মানবীয় মূর্তিতে নিজেকে সংজ্ঞায়িত করতে কিংবা প্রতিনিধিত্বশীল হতে অস্বীকার করে আসছেন। তবে অন্য সব দিক থেকেই টেম্পলটি স্বাভাবিক কেনানি ও সিরিয়ান মডেলের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ ছিল। সম্ভবত টায়ারের শিল্পীদের নক্সায় তারাই এটি নির্মাণ করেছিল। এটি সম্ভবত ছিল সিরিয়ার রাজকীয় স্থাপত্যের বিশেষ উদাহরণ। ২২ সাধারণ পূজারীরা মন্দির ভবনটিতে প্রবেশ করত না, বাইরের আঙিনায় বলি দেওয়া হতো। পবিত্র স্থানটি ছিল বেশ ছোট ও তিন ধাপবিশিষ্ট। পূর্ব প্রান্তে ছিল বেস্টিবুল (চাঁদনি, উলুম), কাল্ট হল (হেখাল) ও ছোট কয়েকটি ধাপের ওপরে ছিল হলি অব হলিস (দেভির)। এতে আর্কটি রাখা ছিল। এটি নীল, আরক্ত ও রক্তবর্ণের লিনেনে মোড়া ছিল। ২৩ (দেখুন ডায়াগ্রাম।) আসবাবপত্রে নিকট প্রাচ্যের আধ্যাত্মিক দৃশ্যপটে যিহোবার মতবাদ নিজেকে খাপ খাইয়ে নেওয়া বিষয়টি দেখা যায়। আর্ক ছাড়া এক্সোডাসের আর কোনো নিশ্চিত প্রতীক ছিল না। বরং বাইবেল আমাদের বলে, হেখালে দুটি বড় আকারের সোনার মোমদানি ছিল। এগুলোর সাথে ছিল পবিত্রতার জন্য সোনার টেবিল, সোনার আবরণ দেওয়া সিডর কাঠের ধূপদানি। এছাড়া ছিল ব্রোঞ্জের সাপ। পরবর্তীকালে বলা হতো, প্লেগ থেকে জনসাধারণকে রক্ষা করার জন্য এটি মুসা ব্যবহার করেছিলেন। তবে সম্ভবত এটি পুরনো জেবুসিত মতবাদের সাথে সম্পর্কযুক্ত ছিল।২৪ উলামের প্রবেশপথে মুক্তভাবে দাঁড়ানো স্তম্ভ ছিল। এ দুটি রহস্যময় কারণে ‘ইয়াখিন’ ও ‘বোয়াজ’ নামে পরিচিত ছিল। বাইরে ছিল খোলা আঙিনা।২৫ সেখানে ছিল বিশাল এক কোরবানির বেদী ও আদি সাগর যমের প্রতিনিধিত্বকারী ১২টি ষাঁড়ে চাপানো একটি বিশাল ব্রোঞ্জের বেসিন। টেম্পলের দেয়ালগুলোর বাইরের দিকে স্বর্গীয় দূত, খেজুর গাছ, ফুটন্ত ফুলের চিত্র খোদাই করা ছিল। ২৬ সিরীয় প্রভাব ছিল সুস্পষ্ট। ব্রোঞ্জের সাগর বালের যম-নাহারের সাথে যুদ্ধের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়, ষাঁড় ছিল ঐশীত্ব ও উর্বরতার অভিন্ন প্রতীক। আর ইয়াখিন ও বোয়াজের স্তম্ভগুলো সম্ভবত কেনানি স্থায়ী পাথর (ম্যাটজাভোত) বোঝাত। টেম্পল নির্মাণ নিয়ে বাইবেলের লেখকেরা হিব্রু পঞ্জিকার বদলে কেনানি দিনপুঞ্জির উল্লেখ করেছেন। এটি উৎসর্গ করা হয়েছিল ইথানিম’ (সেপ্টেম্বর/অক্টোবর) মাসে। এটি বালের শরৎকালীন উৎসবের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হতে পারে। এটি মোতের জয় ও মাউন্ট জাফোনে তার সিংহাসনে আরোহণের উৎসব হিসেবে পালিত হতো। ইসরাইলি ঐতিহ্যে এই উৎসবের নাম ছিল সুখোথ (ত্যাবেরনাকে) এবং পরিশেষে আমরা দেখতে পাবো, এই কৃষি উৎসব নতুনভাবে ব্যাখ্যা করে এক্সোডসের সাথে সম্পর্কিত হবে।

    সোলায়মানের টেম্পলের অনুমিত পরিকল্পনা

    ১. দেভির

    ২. হেখাল

    ৩. উলুম (বস্টিবুল)

    ৪. চেম্বার্স

    ৫. ইয়াখিনও বোয়াজ স্তম্ভ

    ৬. ঘোরানো সিঁড়ি

    ৭. দি আর্ক

    ৮. দি চেরুবিম

    ৯. মোমদানির টেবিল

    ১০. ধুপের বেদী

    ১১. সাবাত দিবসের রুটি

    দৃশ্যত ‘পৌত্তলিক কল্পনায় সাজানো হলেও টেম্পলটি ইসরাইলের সবচেয়ে প্রিয় প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়। অনেক নবী ও সংস্কারক এতে অসন্তুষ্ট হয়ে এক্সোডস সময়কার অপেক্ষাকৃত বিশুদ্ধ ধর্মে ফিরে যেতে জনসাধারণের প্রতি আহ্বান জানিয়েছিলেন। তবে নেবুচাদনেজার যখন সোলায়মানের মন্দিরটি ধ্বংস করেছিলেন, তখন বেশির ভাগ ইসরাইলি মনে করেছিল, তাদের দুনিয়া শেষ হয়ে গেছে। আমাদের বিস্মিত হওয়া উচিত হবে না এ কথা জেনে যে বেশির ভাগ মানুষই কেনানি ও সিরিয়ার পৌরাণিক কাহিনীকে আর্ক ও নির্বাসনের ধর্মের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ বিবেচনা করত। আমরা এক্সোডস কিংবদন্তি অবস্থার প্রেক্ষাপটে বাল ও নারদোকের পুরনো মিথে বদলে যেতে দেখেছি। আমরা যদি এক্সোডসের গল্পকে স্রেফ ঐতিহাসিক ঘটনা হিসেবে ‘সত্য’ বলে ধরে নেই, তবে যমের সাথে বালের যুদ্ধ স্রেফ কল্পকথা অর্থাৎ ‘মিথ্যা’ হয়ে যায়। কিন্তু যদি আমরা এক্সোডসের অন্তর্নিহিত অর্থের দিকে তাকাই এবং এর সময়কে ছাড়িয়ে যাওয়া সত্য হিসেবে এর শক্তিকে উপলব্ধি করি, তবে আমরা দেখতে পাবো যে সোলায়মানের মন্দিরে আঙিনায় থাকা ব্রোঞ্জের সাগরটি একেবারে বেখাপ্পা কিছু নয়। উভয়টিই অন্ধকারের শক্তি ও পথচলার শাস্ত্রাচারের সীমাহীন যুদ্ধের কথা বলে। ইহুদিরা যেমন তাদের প্রতিটি প্রজন্মকে স্মরণ করিয়ে দেয় যে মিসরে ক্রীতদাসের জীবন থেকে তাদের পালাতে হবে, একইভাবে যমের উপস্থিতিও মনে করিয়ে দেয়, বিশৃঙ্খলার শক্তিকে কখনো পুরোপুরি উরানো যাবে না। ঐশী উপস্থিতির আবাস টেম্পলের দরজায় স্থাপন করায় এটি চ্যালেঞ্জ ও প্রয়াসের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়, যা উদ্দীপনা ও প্রয়োজনের আলোকে ঐশী সত্তার সৃষ্টিশীলতাকে উদ্দীপ্ত করে।

    বর্তমানে জেরুসালেমে টেম্পল মাউন্টের স্থানের কাছে একজন রাব্বি প্রার্থনা করছেন। সোলায়মানের টেম্পলের মহান পবিত্রতা ধারণ করে তিনি এর ভিত্তির যতটুকু সম্ভব কাছাকাছি যেতে চান। বর্তমানে এটি মুসলিম হারাম আল-শরিফের নিচে অবস্থিত।

    আমরা জেরুসালেমের যিহোবা মতবাদের সাথে সম্পর্কযুক্ত সম থেকে জানতে পারি, টেম্পলটি কাল্পনিকভাবে মাউন্ট জায়নের সাথে সম্পর্কযুক্ত ছিল। সেখান আর্ককে স্থাপন করা মাত্র স্থানটি ইসরাইলের এমন এক ‘কেন্দ্রে’ পরিণত হয় যা স্বৰ্গ ও পৃথিবীর মধ্যে সম্পর্ক স্থাপন করে, এর শেকড় নিচের পৃথিবীতে থাকায় এটি আদি সাগরের প্রতিনিধিত্বও করত। ঐশী পর্বতের মতো মহাবিশ্বের জীবনকে টিকিয়ে রাখার বাস্তব প্রতীক ছিল টেম্পল। ইয়াকুবের মইয়ের মতো এটি সত্তার উৎসের সাথে সেতুবন্ধের প্রতিনিধিত্ব করেছিল। এই সত্তার সাথে সংযোগ ছাড়া ভঙ্গুর দুনিয়াবি জগত টিকে থাকতে পারে না। অতীতে ঐশী সত্তা নিজেকে প্রকাশ করেছিল, এমন একটি স্থানে এটি নির্মিত হওয়ায় পূজারীরা ঐশী শক্তির সাথে সংযোগ স্থাপন করার আশা করতে পারত। তারা যখন টেম্পল এলাকায় প্রবেশ করত, তখন তারা আরেক মাত্রায় ঢুকে পড়ত। তারা বিশ্বাস করত, এই মাত্রাটি দুনিয়াবি জগতে ঠিক ওই সময়ে অস্তিত্বশীল এবং এখানে তা ধারণ করা হয়। মাউন্ট জায়ন আশপাশের এলাকা থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন হয়ে পড়ে। হিব্রু শব্দ ‘পবিত্র’ (হলি : কাদোশ) অর্থ হলো ‘অন্য’ ‘স্বাতন্ত্র্যমণ্ডিত। তিন স্তরের পবিত্রতার সর্বোচ্চ মাত্রা ফুটে ওঠত দেভিরে (দি হোলি অব হোলিসে)। এতে ঐশী সত্তার সর্বোচ্চ মাত্রায় প্রতীকীভাবে একাশ পেত। পুরোহিত ছাড়া অন্য সবার জন্য দেভিরে প্রবেশ নিষিদ্ধ ছিল। এটি নীরব, ফাঁকা ও অপ্রবেশযোগ্য হয়ে বিরাজ করতে থাকে। তবে আর্ককে সুরক্ষিত রাখায় ঐশী উপস্থিতি প্রদর্শন করার কৌশলটি প্রমাণ করত যে ঐশী সত্তা নারী ও পুরুষের দুনিয়ায় প্রবেশ করতে পারে : তাৎক্ষণিকভাবে আসন্ন ও সর্বোচ্চ অবস্থায় প্রস্তুত।

    পবিত্র জায়ন পর্বতের শীর্ষে নির্মিত টেম্পলটি যিহোবার উদ্যানেরও প্রতিনিধিত্ব করত। জেনেসিসের দ্বিতীয় ও তৃতীয় অধ্যায়ে জে এমনই বর্ণনা দিয়েছেন। ২৭ বিশাল বিশাল মোমদানি শাখাসমৃদ্ধ বৃক্ষের পরিবেশ সৃষ্টি করত। এটি ঢাকা থাকত বাদাম ও ফুলে, দরজাগুলোতে থাকত খেজুর গাছ ও ফুল, হেখালের দেয়ালও সেই উদ্যানের কথা স্মরণ করিয়ে দিত, যেখানে সময়ের শুরুতে পাখাযুক্ত ফেরেশতা হেঁটে বেড়াত, এমনকি সেখানে সাপও ছিল। জে সম্ভবত রাজা সোলায়মানের সময়কালে লিখেছিলেন। তবে তিনি যদি পরবর্তীকালের লোকও হতেন, তবুও নিশ্চিতভাবে বলা যায়, তিনি সুস্পষ্টভাবে টেম্পলের আধ্যাত্মিকতায় প্রভাবিত হয়েছিলেন। মারদোক যখন দুনিয়া সৃষ্টি করেছিলেন, তিনি তখন একটি মন্দির নির্মাণ করেছিলেন। তবে জে আমাদের জানাচ্ছেন, সৃষ্টি সম্পূর্ণ করার পর তিনি একটি উদ্যানের পরিকল্পনা করেছিলেন। তিনি সেখানে সন্ধ্যার স্নিগ্ধ পরশ পেতে হাঁটতেন। এটি ইতিহাসের সূচনায় প্রথম মানুষের সাথে পরিচিত কাহিনীর বিপরীত।

    ইডেনে কাহিনীতে আমরা সোলায়মানের মন্দিরে উপাসকেরা ঐশী সত্তা বলতে কী বুঝত, তা উপলব্ধি করতে পারি। হারানো স্বর্গবিষয়ক সব মিথের মধ্যেই ইডেনকে এমন এক স্থান হিসেবে দেখা যায় যেখান থেকে সহজেই স্বৰ্গীয় দুনিয়ায় প্রবেশ করা সম্ভব। বস্তুত, ইডেন নিজেই ঐশী সত্তার অভিজ্ঞতা অর্জন করেছিল। জে বলছেন, এটি ছিল বিশ্বের উর্বরতার উৎস। এর মধ্যে থাকা একটি নদী চারটি ধারায় বিভক্তি হয়ে উদ্যান ত্যাগ করা মাত্র এটি বাকি দুনিয়াকে উর্বর করেছিল। এসব ধারার একটিকে বলা হতো গিহন। টেম্পলে দুটি বিশাল মোমদানি ছিল। আর ইডেনে ছিল দুটি বৃক্ষ। এ দুটি প্রতি বছর নিজেদের শক্তি সঞ্চয় করত, এগুলো ছিল ঐশী সত্তার অভিন্ন প্রতীক। ইডেন ছিল আদি সামগ্রিকতার সংস্পর্শ লাভ করার প্রতীক। এই সামগ্রিকতাই দুনিয়ার মানুষ তাদের পবিত্র স্থানগুলোর মধ্যে কামনা করত। ঈশ্বর ও মানুষ বিভক্ত ছিল না, তারা বরং একই স্থানে বসবাস করতে পারত। নারী ও পুরুষ জানত না যে তারা একে অন্যের চেয়ে ভিন্ন, ভালো ও মন্দের মধ্যে কোনো পার্থক্য ছিল না। ফলে আদম ও হাওয়া এমন এক স্থানে থাকতেন, যা সব বিপরীত ও সর্ব বিভক্তিকে ছাড়িয়ে গিয়েছিল। এটি ছিল আমাদের অভিজ্ঞতার বাইরে থাকা একটি ঐক্য, পরমানন্দ বা অন্তর্দৃষ্টির বিরল মুহূর্তগুলো ছাড়া আমরা একে উপলব্ধি করা আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়। এটি ছিল এমন এক সম্প্রীতির মরমি ভাষ্য যা সব সংস্কৃতিতে মানবতার বিষয়টি বোঝে। ‘পতন’ ঘটলে আদম ও হাওয়া এটি হারিয়ে ফেললে ও ঐশী উপস্থিতি থেকে প্রত্যাখ্যাত হলে ইডেন থেকে বহিষ্কৃত হন। কিন্তু তারপরও উপাসনাকারীরা যখন সোলায়মানের টেম্পলে প্রবেশ করেন, তখন এর কল্পনাপ্রবণতা ও আসবাবপত্রগুলো তাদেরকে যিহোবার উদ্যানে ফিরে যাওয়া অনুভব করে, ক্ষণিকের জন্য হলেও হারিয়ে যাওয়া স্বর্গের ওই সময়ে ফিরে যায়। এটি তাদেরকে বিচ্ছেদের অনুভূতিতে প্রলেপ দেয়। ধর্মীয় অনুসন্ধানের শিকড় এখানেই নিহিত রয়েছে। প্রার্থনাবিধি ও স্থাপত্য সবই ওই ঐক্যের আধ্যাত্মিক সফরে সহায়তা করে। আমাদের কথিত ‘ঈশ্বর’ বা ‘ঐশী সত্তা’র বাস্তবতা সাথে ওই ঐক্য অবিভাজ্য।

    এসব ধারণা জে’র টাওয়ার অব বাইবেলের কাহিনীতেও পরোক্ষভাবে থাকতে দেখা যায়। এই কাহিনীতে বিকৃতভাবে পবিত্র স্থান সৃষ্টির বর্ণনা রয়েছে। ঐশী স্থানটি তাদের কাছে আত্মপ্রকাশের জন্য অপেক্ষা করার বদলে মানুষ নিজেরাই উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। ‘এসো… আমরা নিজেরাই স্বর্গে পৌঁছার একটি শহর ও টাওয়ার বানিয়ে ফেলি।’ স্বর্গকে পরিমাপ করার এই চেষ্টা গর্ব ও আত্ম-গরিমামূলক কাজ : মানুষ উৎসাহভরে নিজেই সুনাম অর্জন করতে চায়। এর ফলে যা হয়েছে তা ঐক্যে নয়, বরং অনৈক্য, বিভক্তি। এসব লোককে তাদের অনুমানের জন্য শাস্তি দিতে ঈশ্বর ‘তাদেরকে পুরো দুনিয়ায় ছড়িয়ে দিলেন’ এবং তাদের ভাষাকে এত এলোমেলো করে দিলেন যে তারা আর একে অন্যকে চিনতে পারল না। এরপর থেকে স্থানটিকে বাবেল বলার কারণ হলো, ‘ঈশ্বর (সব) ভাষাকে সেখানে তালগোল পাকিয়ে দিয়েছেন।২৮ জে’র কাহিনী বেবিলন ও সেখানকার বিস্ময়কর উপাসনালয় সম্পর্কে প্রবল বৈরিতা প্রকাশ করে। এটি ‘ঈশ্বরদের প্রবেশদ্বার (বাব- ইলামি) হওয়ার বদলে বিচ্ছিন্নতার, অনৈক্যের ও বিভেদের উৎসে পরিণত হয়েছিল, যা সবচেয়ে জঘন্যভাবে নশ্বর অস্তিত্বকে বৈশিষ্ট্যপূর্ণ করে তুলেছিল। শান্তি (সালম) ও পুনঃএকত্রীকরণের নগরী জায়নের উপাসনাকারীদের অভিজ্ঞতা ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। সেখানে ঈশ্বর তার উত্তরাধিকার হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেছেন এমন এক পবিত্র পর্বতে ইসরাইল জাতি সমবেত হতে পারত। এটি মানবীয় উচ্চাভিলাষ ও ক্ষমতার লোলুপতার শিকড় গেঁড়ে থাকা কৃত্রিমভাবে তৈরি পবিত্র কোনা স্থান ছিল না।

    মাউন্ট জায়নের উপর সোলায়মানের নির্মিত টেম্পলটি তীর্থযাত্রী ও উপাসনাকারীদেরকে ঈশ্বরের অস্তিত্ব অনুভব করার সুযোগ দিত। পরের অধ্যায়ে আমরা দেখতে পাবো, অনেকেই সেখানে যিহোবার প্রত্যাদেশ লাভ করার আশা করত। বাবেলের নির্মাতাদের মতো দুনিয়ার বুকে ছড়িয়ে পড়ার বদলে তাদের অনেকে যিহোবার টেম্পলে প্রবেশের সময় বাড়িতে ফিরে এসেছে বলে অনুভব করত। ঐশী প্রতীক হিসেবে টেম্পলটি ছিল বিশ্বের উর্বরতা ও শৃঙ্খলার প্রতীকও।২৯ তবে, নিকট প্রাচ্যের অন্যান্য দেশের মতো, এর মহাপবিত্রতা বর্তমানে আমরা যাকে ‘সামাজিক ন্যায়বিচার’ বলি, তার সাথে অবিচ্ছেদ্য ছিল। এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এখন নিজেদের রাজ্য থাকায় ইসরাইল ও জুদার লোকজন স্বাভাবিকভাবেই ঐশী রাজ্যের স্থানীয় আদর্শ গ্রহণ করেছিল। রাজা ছিলেন যিহোবার ম্যাসিয়াক তথা তার ‘তৈল সিক্ত ব্যক্তি।’ ঈশ্বরের ‘পবিত্র পর্বত, জায়নে নিজের অভিষেকের দিনে ঈশ্বর তাকে তার নিজের ছেলে হিসেবে গ্রহণ করতেন। তার স্থান ছিল টেম্পলের কাছেই এবং তার বিচার করার সিংহাসনটি ছিল দেভিরে যিহোবার সিংহাসনের পাশে। তার দায়িত্ব ছিল ঈশ্বরের শাসন জারি করা, এই ভূমিতে ঈশ্বরের নিজের ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা। সালম আমাদেরকে বলে, রাজাকে ‘গরিবদের রক্ষা করতে হবে, অভাবগ্রস্ত শিশুদের সহায়তা করতে হবে, এবং তাদের ওপর নির্যাতনকারীদের ধ্বংস’ করতে হবে।১ এই ন্যায়বিচার বিরাজ করলে রাজ্যে শান্তি, সম্প্রীতি ও উর্বরতা থাকবে। ২ প্রাচীন দুনিয়ায় আকূল ও অব্যাহতভাবে যে বস্তুটি কামনা করা হতো যিহোবা তা নিশ্চয়তাসহকারে প্রদান করবেন। কারণ জায়ন এখন যিহোবাই উত্তরাধিকার। ফলে এটি ‘সবসময়ের জন্য ঈশ্বরের সংরক্ষিত। ৩৩ কিন্তু জায়নে যদি ন্যায়বিচার না থাকে তবে নিরাপত্তা ও শান্তি বিরাজ করার কোনো নিশ্চয়তা নেই।

    আদর্শটি তিনটি শব্দে প্রকাশ করা যায়। এই শব্দগুলো জেরুসালেম সামে বারবার দেখা যায় : মিসপাত (ন্যায়বিচার), জেদেক (সত্যনিষ্ঠতা) ও শ্যালম (শান্তি)। ৩৪ মিসপাত শব্দটির আসলে আইনগত পরিভাষা। এর অর্থ ‘বিচার’ বা ‘রায়’। তবে এ দিয়ে মাউন্ট জায়নের ওপর যিহোবার সম্প্রীতিপূর্ণ শাসনও প্রকাশ করে। আর্ক অব দি কভেন্যান্টটি দেভিরে নিয়ে আসার সময় যিহোবা তার পবিত্র পর্বতের উপর সিংহাসনে আরোহণ করেন এবং এর মাধ্যমে তিনি জেরুসালেমের সত্যিকারের রাজায় পরিণত হন। আর নশ্বর রাজা ছিলেন স্রেফ তার মানবীয় প্রতিনিধি। মানব রাজার দায়িত্ব হলো জেদেক প্রতিষ্ঠা করা। কেনানে জেদেক (ন্যায়বিচার ও সত্যনিষ্ঠতা) ছিল সূর্য ঈশ্বরের গুণ। তিনি গোপন অপরাধগুলো সামনে নিয়ে আসতেন, নির্দোষ লোকদের ওপর করা অন্যায় শুধরে দিতেন, বিচারক হিসেবে পুরো দুনিয়ার ওপর নজর রাখতেন। জায়নে যিহোবার প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সাথে সাথে জাদেক তারও গুণে পরিণত হলো। তার রাজ্যে ন্যায়বিচার বিরাজ করছে কিনা, অরক্ষিতরা সুরক্ষা পাচ্ছে কিনা, দুর্বলদের শক্তিশালীরা নির্যাতন করছে কিনা তা নজর রাখতেন। কেবলমাত্র তখনই জায়ন পরিণত হতো শান্তির নগরীতে। সালম শব্দটি ‘শান্তি’ হিসেবে অনূদিত হলেও এটির মূল অর্থ ছিল ‘পূর্ণাঙ্গতা,’ ‘সামগ্রিকতা’ অর্থাৎ লোকজন তাদের ঐশী স্থানগুলোতে সামগ্রিকতা ও পূর্ণাঙ্গতার অনুভূতি কামনা করত। অর্থাৎ, সালমের মধ্যে কল্যাণের সামগ্রিক ধারণা তথা উর্বরতা, সম্প্রীতি, যুদ্ধে সফলতা অন্তর্ভুক্ত ছিল। সালমের অভিজ্ঞতা দুনিয়ার বুকে মানুষের মধ্যে বিদ্বেষ সৃষ্টিকারী অনৈতিকতা ও বিচ্ছিন্নতাবোধ বাতিল করে দেয়। আমরা দেখেছি, এটি ঈশ্বরের সাথে সম্পৃক্ত শান্তির অনুভূতিও। তবে জাদেক বা ‘সত্যনিষ্ঠতা’ যদি না থাকে তবে পবিত্র নগরীটি শান্তির হতে পারে না। ইসরাইলের লোকজন বারবার এটি ভুলে গিয়েছিল। তারা পরে জেরুসালেমের পবিত্রতা ও অখণ্ডতার ওপর মনোনিবেশন করেছিল, এর বিশুদ্ধতা রক্ষার জন্য লড়াই করেছিল। তবে নবীরা তাদেরকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন, তারা যদি ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার প্রয়াস না চালায়, তবে তারা অনিবার্যভাবেই সালম হারানো তাদের ললাট-লিখন হবে।

    জায়নের ওপর যিহোবার টেম্পল নির্মাণ করে তাকে সেখানে প্রতিষ্ঠিত করার মাধ্যমে সোলায়মান কেনানিদের ধারা অনুযায়ী দাউদীয় রাজবংশের নামে আনুষ্ঠানিকভাবে ভূমিটির গ্রহণ করলেন। যিহোবা এখন জেরুসালেমের শাসক। আর ইসরাইল তার লোকজন হওয়ায় ভূমিটি তাদের হয়ে গেল। মাউন্ট জাফোনে বালের প্রাসাদটি আশপাশের এলাকাটিকে তার হস্তান্তর অযোগ্য উত্তরাধিকারে পরিণত হয়েছিল। এখন শ্বাশত উত্তরাধিকার হিসেবে জায়ন হলো যিহোবার। টেম্পল ও যিহোবার সিংহাসন ছিল দাউদ পরিবারের শ্বাশত উত্তরসূরি হিসেবে জেরুসালেমে সোলায়মানের দাবির ভিত্তি। টেম্পল নির্মাণ ছিল বিজয়মূলক কাজ। এর অর্থ হলো ঐশী সহায়তায় প্রতিশ্রুত ভূমিটি দখল করা। অট্টালিকাটি ঘোষণা করছিল, ইসরাইলের যাযাবর দিনের অবসান ঘটছে, ঐক্যবদ্ধ রাজ্যের জনগণ অবশেষে বাড়ি ফিরেছে, নিজেদেরকে এমন এক স্থানে প্রতিষ্ঠিত করেছে যেখানে তারা ঐশীর ঘনিষ্ঠতায় বসবাস করতে পারবে।

    অবশ্য চূড়ান্তভাবে সোলায়মান ছিলেন একটি হতাশা। খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ট শতকে ডিউটারোনোমিস্ট ইতিহাসবিদ তাকে মূর্তিপূজক বিবেচনা করেছেন। সোলায়মান তার বিদেশী সব স্ত্রীর জন্য জেরুসালেমে আলাদা আলাদা মন্দির নির্মাণ করেছিলেন। তিনি আশপাশের সব দেবতা- সিডনের দেবী আস্তারতে, আম্মনের দেবতা মিলকম, মোয়াবের দেবতা চেমোশের পূজাও করতেন। জেরুসালেমের পূর্ব দিকের পাহাড়গুলোতে মিলকম ও চেমোশের বেদীও ছিল।৩৫ ডি বিশ্বাস করতেন যে এই অবিশ্বস্ততার কারণেই সোলায়মানের মৃত্যুর পর তার ইসরাইল ও জুদার ঐক্যবদ্ধ রাজ্যটি ভেঙে গিয়েছিল। তবে ডি সম্পূর্ণ ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গিতে লিখেছেন। ষষ্ট শতক নাগাদ ইসরাইলিরা পুরোপুরি একেশ্বরবাদী হয়ে পড়েছিল। তারা তখন বিশ্বাস করতে শুরু করেছিল, যিহোবাই একমাত্র ঈশ্বর, অন্য সব দেবতা মিথ্যা। তবে সোলায়মান ও তার প্রজারা তখনো ওই বিশ্বাসের সাথে একমতে ছিলেন না। সোলায়মানের নির্মিত টেম্পলটিতে পৌত্তলিক মূর্তি যেমন কারো কাছেই অদ্ভূত ঠেকেনি, একইভাবে জেরুসালেমে সোলায়মানের নির্মিত অন্যান্য মন্দিরও সম্ভবত তার স্ত্রীদের প্রতি সৌজন্যতা প্রদর্শনমূলক কাজ হিসেবে বিবেচিত হয়েছিল। এগুলোতে যিহোবার মর্যাদা প্রভাবিত হয়নি। তিনি তখনো ছিলেন জায়নের রাজা, ছোট ছোট এস্টাবলিশমেন্টে অপেক্ষাকৃত ক্ষুদ্র ঈশ্বরদের ওপর প্রভূত্ব করতেন। অবশ্য সামবাদীদের চিত্রে ঐশী সভায় অন্যান্য ঈশ্বরের ওপর তাকে প্রভুত্ব করতে দেখা যায়।

    তবে সোলায়মান যদি ব্যর্থ হয়ে থাকেন, তবে তার কারণ তিনি জাদেক অনুসরণ করেননি। তার রাজ্যের রাজনৈতিক অর্থনীতি ছিল দুর্বল। সম্পদ ফুরিয়ে যাওয়ায় সাম্রাজ্যের পতন ঘটে। আর সোলায়মানের কথিত বিপুল সম্পদ সত্ত্বেও জাতিটি তার সীমার বাইরে সম্প্রসারিত হয়েছিল। সোলায়মান টায়ারের রাজা হিরামের কাছ থেকে মূল্যবান সামগ্রী কিনেছিলেন, কিন্তু ঋণ শোধ করতে পারেননি। এ কারণে তিনি টায়ারকে সম্ভবত পশ্চিম গ্যালিলিতে ২০টি শহর ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছিলেন। তার শক্তিশালী সেনাবাহিনী সত্ত্বেও সোলায়মান কিন্তু দাউদের কাছ থেকে উত্তরসূরি হিসেবে পাওয়া ভূখণ্ড ধরে রাখতে পারেননি। প্রথমে ইদোম ও পরে দামাস্কাসের পতন ঘটে, তারা স্বাধীনতা লাভ করে। তবে আরো মারাত্মক ব্যাপার ছিল তার নিজের রাজ্যেই অসন্তুষ্টি ও অস্থিরতা। দাউদ তার নিজ রাজ্য জুদাকে আনুকূল্য প্রদান করায় তিনি এর পরিণামে ইসরাইল রাজ্যের আনুগত্য প্রায় হারিয়ে ফেলেছিলেন। সোলায়মান এ থেকে শিক্ষা গ্রহণ করেননি। মনে হচ্ছে, তিনি ইসরাইলকে শোষণ করতেন, একে সমান অংশীদার বিবেচনা না করে একে বিজিত ভূখণ্ডের মতো দেখতেন। তিনি তার দেশের উত্তর অংশকে ১২টি প্রশাসনিক ইউনিটে ভাগ করেছিলেন। প্রতিটির এক মাস করে রাজদরবারের সবকিছু যোগান দিতে এবং বেগার খাটতে বাধ্য করতেন। দক্ষিণের জুদা রাজ্যের জন্য এ ধরনের কোনো ব্যবস্থা ছিল না।৩৬ অধিকন্তু, লোকজন বেগার শ্রমের বিরুদ্ধে তিক্তভাবে ক্ষুব্ধ ছিল। প্রাচীন দুনিয়ায় বাধ্যতামূলক শ্রম স্বাভাবিক বিষয় ছিল। দাউদও বাধ্যতামূলকভাবে সৈন্যদলে যোগদানের নীতি চালু করেছিলেন। এতে কেউ আপত্তি করেনি। অবশ্য বিশাল নির্মাণ কর্মসূচির জন্য সোলায়মানের বিপুল শ্রমশক্তির প্রয়োজন ছিল। এতে অর্থনীতির ক্ষতি হয়েছিল। কারণ ভবন নির্মাণকাজ উৎপাদনশীল নয়, আবার বেগার শ্রমের ফলে পুরুষদেরকে সম্পদ উৎপাদনের উৎস ভূমি ও নগরী থেকে সরিয়ে নেয়। আরো খারাপ বিষয় হলো, বাধ্যতামূলক শ্রম ছিল সুস্পষ্ট অবিচার। আমাদেরকে বলা হয়েছে, ইসরাইলের ৩০ হাজার লোককে বাধ্যতামূলক শ্রমিক হিসেবে ভর্তি করা হয়েছিল। কিন্তু জুদা থেকে এ ধরনের ভর্তি করার কোনো তথ্য পাওয়া যায় না।৩৭ ইসরাইলের লোকজন ক্রুদ্ধ হয়ে জেরুসালেম থেকে বের হয়ে যাওয়ার স্বপ্ন দেখেছিল। আমরা দেখেছি, প্রাচীন দুনিয়ায় ন্যায়বিচারের মতবাদ কোনো ধার্মিক স্বপ্ন নয়, বরং সুষ্ঠু রাজনৈতিক ধারণার মধ্যেই তা নিহিত ছিল। সামাজিক অস্থিরতার কারণে রাজ্যের পতন ঘটত। প্রজাদের ওপর বিপুল বোঝা চাপিয়ে দেওয়া ব্যবস্থার করণেই ত্রয়োদশ শতকে উগারিতের পতন ঘটেছিল। সোলায়মান তার প্রজাদের প্রতি ন্যায়বিচার না করার কারণেই তার রাজ্য ভেঙে গিয়েছিল। এটি ছিল তার উত্তরসূরিদের জন্য শিক্ষণীয় বিষয়। নিজের রাজ্য যে বিপদে রয়েছে, তা সোলায়মান টের পেয়েছিলেন। আমরা দেখতে পাই, জীবনের শেষ বছরগুলোতে তার দাস শ্রমিকদের ইসরাইল কর্মকর্তা জেরোবোয়াম রাজার সাথে সঙ্ঘাতে জড়িয়ে পড়েছেন। আমাদেরকে বলা হচ্ছে, উত্তরাঞ্চলীয় নবীদের একজন ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন, সোলায়মানের রাজ্য দুই টুকরা হয়ে যাবে, জেরোবোয়াম ইসরাইলের উত্তরাঞ্চলের ১০টি গোত্রকে শাসন করবেন। ৩৮ এতে মনে হচ্ছে, জেরোবোয়াম বিদ্রোহের পরিকল্পনা করেছিলেন। সোলায়মান তাকে গুপ্তভাবে হত্যার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু জেরোবোয়াম মিসরে পালিয়ে গিয়ে ফারাও শিশাকের রাজদরবারে আশ্রয় গ্রহণ করেন। তাকে দীর্ঘ দিন নির্বাসনে থাকতে হয়নি। কিছু দিনের মধ্যেই প্রায় ৪০ বছর শাসনকাজ পরিচালনা করে খ্রিস্টপূর্ব ৯৩০ সালের দিকে সোলায়মান পরলোকগমন করেন। তাকে ইর ডেভিডে তার পিতার পাশে সমাহিত করা হয়। তার উত্তরসূরি হন তার ছেলে রেহোবোয়াম। সোলায়মান যে বিপর্যয়ের আশঙ্কা করেছিলেন, তা খুবই দ্রুততার সাথে ইসরাইল ও জুদা রাজ্যের ওপর আঘাত হানে।

    ⤶ ⤷
    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleছোটগল্প – মুহম্মদ জাফর ইকবাল
    Next Article বাইবেল কোরআন ও বিজ্ঞান – মরিস বুকাইলি
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Generic selectors
    Exact matches only
    Search in title
    Search in content
    Post Type Selectors
    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Our Picks

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }