Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • English Books
      • Jules Verne
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    জেরুসালেম : ওয়ান সিটি থ্রি ফেইস – ক্যারেন আর্মস্ট্রং

    মোহাম্মদ হাসান শরীফ এক পাতা গল্প727 Mins Read0
    ⤶ ⤷

    ৪. জুদা নগরী

    রেহোবোয়াম একটি দরিদ্র ও খাপছাড়া রাজ্যের উত্তরাধিকারী হয়েছিলেন। সোলায়ামানের শাসন জুদায় স্বাগত জানানো হলেও উত্তরাঞ্চলীয় ইসরাইলে গ্রহণযোগ্য হয়নি। কারণ তার উচ্চাভিলাষী নির্মাণ কর্মসূচির কারণে এখান থেকে সম্পদ নিংড়ে নিয়েছিল, অথচ এসব থেকে আয় হতো কিঞ্চিত, আবার বাধ্যতামূলকভাবে সেনাবাহিনীতে যোগদানের ফলে উৎপাদনশীল শ্রম থেকে বিশাল এলাকাকে বঞ্চিত হতে হতো। রেহোবোয়াম শেচেমে গিয়ে সেখানে তার শাসনের বৈধতার জন্য ইসরাইলের প্রবীণদের সাথে সাক্ষাত করলে তারা বলেন, তিনি যদি তাদের কর ও বাধ্যতামূলকভাবে সেনাবাহিনীতে ভর্তির বিষয়টি শিখিল করেন, তবেই কেবল তারা তাকে রাজা হিসেবে গ্রহণ করে নেবেন। এটি ছিল কঠিন সিদ্ধান্ত : কারণ রেহোবোয়াম যদি এই অনুরোধ মঞ্জুর করেন, তবে তাকে তার দাদার রাজকীয় স্বপ্ন পরিত্যাগ করতে হবে, তার রাজসভায় নিম্নতর মর্যাদা গ্রহণ করে নিতে হবে। খুব কম শাসকই এমনটা মেনে নিতে পারেন। ফলে প্রবীণ ও অপেক্ষাকৃত অভিজ্ঞ সভাসদদের উপদেশ প্রত্যাখ্যান করে রেহোবোয়াম তার কম অভিজ্ঞ সহকর্মীদের পরামর্শ গ্রহণ করেন। এসব লোকের মনে হয়েছিল, ইসরাইল থেকে কম কর পাওয়া মানে তাদের জীবনযাত্রায় ব্যাপক পতন ঘটা। রেহোবোয়াম ইসরাইলের প্রবীণদের তাচ্ছিল্যকরভাবে জবাব দেন : ‘আমার বাবা তোমাদের শুধু চাবকাতেন,; আমি ধারাল লোহা বসানো চাবুক দিয়ে চাবকাব।’ সাথে সাথে প্রবীণেরা অখণ্ড রাজ্য থেকে আলাদা হয়ে যায়, বেগার খাটা শ্রমিকদের সর্দারকে পাথর ছুঁড়ে হত্যা করা হয়। রেহোবোয়াম দ্রুত জেরুসালেমে পালিয়ে যেতে বাধ্য হন।

    এর পর থেকে ইসরাইল ও জুদা তাদের আলাদা পথে চলতে থাকে। জেরোবোয়াম হন ইসরাইলের রাজা, রাজধানী হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেন তিরজাকে, রাজকীয় মন্দিরে পরিণত করেন বেথেল ও ড্যানে রাজকীয় উপাসনালয়গুলোকে। ইসরাইলের পরবর্তী রাজা ওমরি (৮৮৫-৭৪) সামারিয়ায় নতুন রাজধানী প্রতিষ্ঠা করেন। এটি হয় এই অঞ্চলের সবচেয়ে আভিজাত্যপূর্ণ ও বিলাসবহুল নগরী। জুদার চেয়ে অনেক বড় ও সম্পদশালী হয় ইসরাইল। এটি ছিল প্রধান প্রধান রাস্তার কাছে, এতে পুরনো নগর-রাষ্ট্রগুলোর বেশির ভাগ এলাকা সামিল ছিল। বিপরীতে, জুদা রাজ্য ছিল বিচ্ছিন্ন, এখানে সম্পদও ছিল না। এখানে থাকা তৃণভূমি ও পার্বত্য এলাকায় চাষাবাদ করা ছিল কঠিন। স্বাভাবিকভাবেই জুদার রাজা ইসরাইল হারানোর জন্য দুঃখিত ছিলেন, তিনি উত্তরাঞ্চলীয় রাজ্যকে ধর্মদ্রোহী হিসেবে অভিযুক্ত করেন। যদিও বাস্তবে দাউদের অধীনে একীভূত হওয়ার আগের অবস্থায় ফিরে গিয়েছিল দেশটি। অখণ্ড রাজ্য ভেঙে পড়ার প্রায় ৫০ বছর ধরে ইসরাইল ও জুদা যুদ্ধে নিয়োজিত ছিল। অপেক্ষাকৃত দুর্বল ও বিশেষভাবে অরক্ষিত হয়ে পড়েছিল জুদা। কেনানে উপস্থিত নিশ্চিত করার জন্য ফারাও শিশাকের আক্রমণ থেকে রেহোবোয়াম জেরুসালেম রক্ষা করেছিলেন টেম্পলের সম্পদ থেকে বিরাট অংশ দিয়ে। জুদার রাজা আসার (৯১১-৮৭০) সময় ইসরাইলি সেনাবাহিনী জেরুসালেমের পাঁচ মাইল দূরের রামাহয় পৌঁছে গিয়েছিল। এবার রাজা নগরী রক্ষা করেছিলেন দামাস্কাসের আরামাইন রাজ্যের কাছে আবেদন জানিয়ে। আরামাইন রাজ্য তখন পেছনের দিক থেকে ইসরাইল আক্রমণ করেন। এরপর থেকে ইসরাইল দামাস্কাসের সাথে কয়েক দফার রক্তাক্ত ভূখণ্ডগত আক্রমণের মুখে পড়ে, জুদা একাকী পড়ে থাকে।

    জুদার লোকজন তখন চার দিক থেকে অবরুদ্ধ হয়ে পড়েছিল। সবাই এ রাজ্যটি উৎখাত করতে সচেষ্ট ছিল। এমন অবস্থায় জুদার লোকজন জায়নের যিহোবার দিকে আরো বেশি করে মুখ ফেরায়। আমরা জানি যে প্রাচীন নিকট প্রাচ্যের অন্যান্য লোকজনের মতো তারাও তাদের ইসরাইল, মিসর বা পরে দামাস্কাসের শত্রুদের আদি বিশৃঙ্খল শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করেছিল। সাগর বা মরুভূমির মতো এসব দুনিয়াবি শত্রুও খুব সহজে তাদের রাষ্ট্রের ভঙ্গুর নিরাপত্তা ধ্বংস করে জুদা নামে সৃষ্ট রাষ্ট্রটিকে এমন এক ছোট্ট দুনিয়ায় পরিণত করতে পারত যা ঈশ্বরদের বাসযোগ্য বিশ্ব সৃষ্টির আগে নিষ্ফলা ছিল বলে ধারণা করা হয়ে থাকে। এটি অলীক কল্পনা বলে মনে হতে পারে, কিন্তু আমরা এখনো ওই একই পরিভাষায় কথা বলে থাকি যখন আমরা ‘আমাদের দুনিয়াকে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারী শত্রু দখলদারদের ‘দুর্বৃত্ত সাম্রাজ্য’ হিসেবে অভিহিত করি। আমরা এখনো জীবনকে আলো ও অন্ধকারের শক্তির মধ্যকার সংগ্রাম হিসেবে বিবেচনা করি, ‘আমাদের সৃষ্ট সবকিছু শেষ করতে ‘বর্বরতা’ ফিরে আসতে পারে বলে শঙ্কিত হই। আমাদের নিজস্ব শাস্ত্রাচার রয়েছে- স্মারক অনুষ্ঠান, অর্ঘ নিবেদন, মিছিল-সমাবেশ ইত্যাদি। এগুলো আবেগময় প্রতিক্রিয়া উস্কে দিতে প্রণীত, অতীতের যুদ্ধকে বর্তমানে এনে দেয়। আমরা প্রাণবন্তভাবে ওই সময়ের স্মরণ করি, যখন ‘আমরা’ দৃশত বৈরী বিশ্বের বিরুদ্ধে একাকী দাঁড়িয়েছিলাম। আমরা সংগ্রাম অব্যাহত রাখার আশা, গর্ব, ও নতুন করে প্রত্যয়ে সংকল্পবদ্ধ হই। প্রাচীন জেরুসালেমের লোকজনও একই ধরনের কৌশল গ্রহণ করেছিল। তারা করেছিল কেনানি পৌরাণিক কাহিনীকে নিজেদের করে নিয়ে। তাদের নিজেদের যুদ্ধের দিকে ফিরে না তাকিয়ে সময়ের সূচনায় বিশৃঙ্খলার শক্তির বিরুদ্ধে যিহোবার সংগ্রামকে স্মরণ করতে থাকে তারা। নিকট প্রাচ্যজুড়ে তাদের মন্দিরগুলোতে মারদোক ও বালের মতো যুদ্ধগুলো প্রতি বছর বিপুল অনুষ্ঠানিকতায় উদযাপিত হতো। এগুলো ঐক্য ও অনেক সময় ঐশী জয়ের চমকপ্রদ উল্লাস এবং এই শক্তিকে বর্তমানে সহজলভ্য করার প্রয়াস ছিল এতে। কারণ, ধারণা করা হতো যে কেবল কোনো ঐশী যোদ্ধাই তাদের ওপর নির্ভরশীল নগরীর শান্তি ও নিরাপত্তা বিধান করতে পারেন। প্রাচীন বিশ্বের শাস্ত্রাচারগুলো কেবল স্মরণ অনুষ্ঠানই ছিল না : তারা পৌরাণিক কাহিনীগুলো এমনভাবে তুলে ধরত যে মনে হতো, এগুলো বারবার ঘটতে পারে। এতে করে লোকজন অস্তিত্বের মর্মমূলে শ্বাশত, অদেখা সংগ্রামের অভিজ্ঞতা পেত, বিশৃঙ্খলার দানবগুলোর বিরুদ্ধে তারা আদি ঐশী বিজয়ে অংশগ্রহণ করত। অন্যভাবে বলা যায়, মন্দির নির্মাণের সময় পছন্দ করার বিষয়টি পরিচিতি হিসেবে বিবেচিত হতো। প্রতীকী নাটকের মাধ্যমে এসব ঐশী যুদ্ধ অনুকরণ করে এই কাজকে বর্তমানে কিংবা আরো যথাযথভাবে বলা যায়, উপাসনাকারীদেরকে মিথের সময়োত্তীর্ণ বিশ্বে নিয়ে আসা হতো। শাস্ত্রাচারগুলো অস্তিত্বের কঠোর বাস্তবতা প্রকাশ করত। এই অস্তিত্ব দৃশ্যত সবসময়ই যন্ত্রণা ও মৃত্যুর ওপর নির্ভর করত, তবে তা এটিও পরিষ্কার করত যে এই সংগ্রাম সবসময়ই সৃষ্টিশীল ফলাফল তৈরি করে। যম ও মোতের সাথে তার নৈতিক যুদ্ধে জয়ী হিসেবে আত্মপ্রকাশের পর মাউন্ট জফোনে সিংহাসনে বসেছিলেন বাল। ফলে মাউন্ট জফোন চিরদিনের জন্য তার আবাসে পরিণত হয়েছিল। জাফোন থেকে বাল শান্তি, উর্বরতা ও শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করেন। তার শত্রুরা এগুলো ধ্বংস করতে চেয়েছিল। এই জয় যখন উগারিতে উদযাপিত হতো, রাজা তখন বালের স্থান গ্রহণ করে তার এলাকায় শান্তি, ফলপ্রসূতা ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার দায়িত্ব পালনের জন্য ঐশী প্রতিচ্ছবির মতো অভিষেক গ্রহণ করতেন। প্রতিটি শরতে বালের সিংহাসনে আরোহণ ছিল ইথানিনম মাসের উৎসব। এই উৎসব ঐশী শক্তি সৃষ্টি করত, যা আরেক বছরের জন্য উগারিতে সময়ের শুরুর ওই আদি সংগ্রামের সূচনা করত।

    আমরা যতটুকু জানি, জেরুসালেমে মন্দির নির্মাণের আগে সৃষ্টা-ঈশ্বর হিসেবে যিহোবাকে গ্রহণ করার ব্যাপারে সোলায়মানের বলতে গেলে কোনোই আগ্রহই ছিল না। এক্সোডাসের পৌরাণিক কাহিনীতে যিহোবাকে মহাবিশ্ব নয়, জাতি সৃষ্টি করতে দেখানো হয়েছে। কিন্তু মাউন্ট জায়নের ওপর দেবিরে আনুষ্ঠানিকভাবে তিনি সিংহাসনে বসার পর তার মতবাদ তার আগে বাল আল ইলিয়নের উপাসনের অনেক বিষয় গ্রহণ করা হয়। সম্ভবত জাদোকের প্রভাবে জেবুসিত ধারণাগুলো প্রাচীন ইসরাইলি পুরাণে মিশে গিয়েছিল। বালের মতো এখন বলা হতে লাগল, যিহোবাও সমুদ্র দানব লোতানের (তিনি হিব্রুতে হয়ে গিয়েছিলেন ‘লেভিয়াথান’) বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিলেন। তিনি বিশৃঙ্খলার আদি পানিকে বশ মানিয়েছিলেন। এ কাজটি না করা হলে পুরো পৃথিবী ভেসে যেত এবং তিনি ‘সমুদ্রের সীমা নির্ধারণ করে দিয়েছিলেন, বাঁধের অন্য দিকে রেখেছিলেন।’ মারদোকের মতো তিনিও আরেকটি সাগর দানবকে (নাম ছিল র‍্যাহাব) টুকরা করেন। তিনি এটিকে দুই টুকরা করেছিলেন দুনিয়ার ভিত্তি সৃষ্টির সময়। পরে সহিংস সৃষ্টির এসব পুরাণকাহিনীর স্থলাভিষিক্ত হয় পি’র জেনেসিসের প্রথম অধ্যায়ে আদিব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার শান্ত ও শান্তিপূর্ণ বর্ণনায়। তবে বাইবেল দেখাচ্ছে, জুদার লোকজনের কাছে এমন কাহিনী যা ছিল তাদের প্রতিবেশীদের আধ্যাত্মিকতার সাথে অনেক সামঞ্জস্যপূর্ণ ছিল এবং সঙ্কটের সময় তারা সাথে সাথে ‘পৌত্তলিক’ পুরাণতত্ত্বে ফিরে যেতে পারত। যুদ্ধ মিথ ছিল ওই পরিস্থিতিতে স্বস্তিদায়ক। কারণ, এতে বলা হচ্ছিল, ধ্বংসের শক্তি প্রবল হলেও শেষ পর্যন্ত শৃঙ্খলাই জয়লাভ করে। তবে তা সবসময় এমন স্বয়ংক্রিয়ভাবে হয় না। ঐশী শক্তিকে যুদ্ধবিক্ষত নগরী জেরুসালেমে আনতে হলে পুরোহিত ও রাজাদের তাদের টেম্পলে বার্ষিক আদি বিজয়কে নিয়ে আসার দায়িত্ব পালন করতে হতো। তাদের দায়িত্ব হলো বিশ্বকে লালনকারী মহা রহস্যের স্পর্শে জনগণকে রাখা, অস্তিত্বের এড়ানো অযোগ্য সন্ত্রাসকে মোকাবিলা করা এবং ভীতি ও ভয়াবহ মনে হওয়া বিষয়ে যে ইতিবাচক ব্যাপার আছে তা শেখানো। সহিংসতা ও মৃত্যুর ওপর জীবন ও শৃঙ্খলা বিজয় লাভ করবে, খরা আর নিস্ফলতার পর আসবে উর্বরতা, নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়ার হুমকি ভণ্ডুল হয়ে যাবে, কারণ তাদের মধ্যে আছে ঐশী শক্তি।

    জুহার লোকজন কিভাবে পুরোপুরি এই আধ্যাত্মিকতা গ্রহণ করে নিয়েছিল তা দেখা যায় প্রথম দিকের সামে। অনেক সময় তারা উগারিতের পুরনো মিথগুলো বারবার বলত :

    যিহোবা মহান, সর্বোচ্চভাবে তার প্রশংসা করা প্রয়োজন :
    প্রভু মহান! আমাদের ঈশ্বরের শহরে, তার পবিত্র পর্বতে
    লোকেরা নিষ্ঠার সঙ্গে তার প্রশংসা করে।
    ঈশ্বরের পবিত্র শহর একটি মনোরম উচ্চতায় অবস্থিত,
    তা সারা পৃথিবীর লোকদের সুখী করে। জায়ন পর্বতই
    ঈশ্বরের প্রকৃত পর্বত। এটিই মহান রাজার নগরী।
    শহরের রাজপ্রাসাদগুলোর মধ্যে
    ঈশ্বর নগরী দুর্গ হিসেবে খ্যাত।

    যিহোবা জেরুসালেমের জন্য যুদ্ধ করো, ঠিক যেভাবে বাল উগারিতে তার ঐহিত্যের জন্য লড়াই করেছিলেন। তার উপস্থিতি নগরীকে শত্রুদের বিরুদ্ধে অলঙ্ঘনীয় নিরাপত্তা-সংবলিত এলাকায় পরিণত করেছিল। জেরুসালেমবাসীকে জায়নের প্রতিরক্ষাব্যবস্থার প্রশংসা করতে বলা হয়েছিল (তার মিনারগুলো গণনা, প্রাচীরগুলোর প্রশংসা করো, প্রাসাদগুলো দেখো।’), ঠিক যেমন উরুকের লোকজনকে গিলগামেশের দুর্গগুলোর প্রশংসা করতে বলা হয়েছিল। পরিদর্শন সফরের পর তারা এই বলে শেষ করত, ‘ঈশ্বর এখানে আছেন! সময়ের সূচনায় যিহোবা সবকিছু যথাযথ রাখার জন্য সীমারেখা টেনে দিয়েছিলেন। বিলুপ্তি ও বিশৃঙ্খলার হুমকিকে দূরে রাখার জন্য প্রাচীর আর নিরাপত্তাব্যবস্থারও একই ধরনের ধর্মীয় মূল্য ছিল। নগরীর পতন কখনোই হবে না : যিহোবা হলেন তার জনগণের দুর্গ, তাদের শত্রুদের বিরুদ্ধে ধনুক হাতে নেবেন, বর্শা নিক্ষেপ করবেন। তাদের আশপাশে যদি পুরো মহাবিশ্ব ভেঙ্গে পড়ে, তবুও তাদের ভয় পাওয়া ঠিক হবে না। কারণ, ঈশ্বরই তাদের আশ্রয়, তাদের শক্তি। যদি সাগরে পর্বতগুলো প্রকম্পিত হয়, পানি যদি ফুঁসে ওঠে, তবুও জুদার লোকজনের উদ্বিগ্ন হওয়া উচিত নয়। প্রাচীরের মধ্যে যিহোবা শান্তির তথা সামগ্রিকতা, সম্প্রীতি ও নিরাপত্তার স্বর্গ প্রতিষ্ঠা করেছেন। জেরুসালেমের প্রার্থনাবিধি লোকজন যিহোবার দুনিয়া সৃষ্টির প্রেক্ষাপটে প্রাচীন এক্সোডাসের পুরাণকাহিনী দেখতে পেত। তিনি যখন লেভিয়াথান ও রাহাবকে পরাজিত করেন, তখনই পুরো দুনিয়ার রাজা হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন এবং সত্তায় টিকে ছিলেন। মিসর থেকে লোকজনকে মুক্ত করে সমগ্র মানবজাতির জন্য তিনি তার পরিকল্পনা প্রকাশ করেছিলেন।

    সমালোচকেরা সাম থেকে প্রার্থনাবিধি পুনঃগঠনের প্রচেষ্টা চালিয়েছেন, তবে তাদের আরো বিস্তারিত দাবি সম্ভবত অতিরঞ্জিত। আমরা এই প্রাথমিক সময়ে জেরুসালেম মতাদর্শ সম্পর্কে খুবই সামান্য জানি। কিন্তু তাতেও মনে হচ্ছে, তখন মাউন্ট জায়নে যিহোবার রাজত্বের ওপরই জোর দেওয়া হতো। সম্ভবত সুকোাথ ভোজ ছিল রাজা সোলায়মানের টেম্পল উৎসর্গ করার সময় পবিত্র পর্বতে তার সিংহাসন আরোহণ উদযাপন। মোতকে হারানোর পর মাউন্ট জাফোনের ওপর অবস্থিত নিজের প্রাসাদে বালের প্রত্যাবর্তন যেমন ভূমির উর্বরতা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেছিল, জায়নে যিহোবাও আশপাশের এলাকার উর্বরতা নিশ্চিত করেছিলেন। আর এটিও এই প্রাচীন কৃষি উৎসবে উদযাপিত হতো। সঙ্গীত, প্রশংসা ও জয়ধ্বনি ও জয়ডঙ্কার মধ্যে অনুভব করা হতো যে যিহোবা দেভিরে তার সিংহাসনে ওঠেছেন।১০ সম্ভবত প্রচণ্ড শব্দের মধ্যে যিহোবা যখন তার জনগণের মধ্যে আবির্ভূত হতেন, তখন টেম্পলকে পরিপূর্ণ করে থাকা উচ্চশব্দের সরঞ্জাম, কান্টিক চিৎকার ও ধূপের ধোঁয়া মাউন্ট সিনাইয়ের উপরের মানবীয় রূপে আবির্ভাব ঘটনার পুনরাবৃত্তি করত। সম্ভবত গিহন থেকে টেম্পল পর্যন্ত একটি শোভাযাত্রা হতো। এটি মাউন্ট জায়নে যিহোবার প্রথম সফরের স্মৃতি জাগিয়ে তুলত। এই প্রার্থনাবিধি তার পরিচয় পাওয়া যায়। এতে বলা হয়ে থাকে, তার এত বিপুল শক্তি ছিলেন যে তিনি কেবল জায়নের রাজাই ছিলেন না, বরং ‘পুরো বিশ্বের রাজাধিরাজ ছিলেন। ১২ অন্যান্য দেব-দেবীর ওপর তিনি প্রাধান্য অর্জন করেছিলেন :

    হে পরপর প্রভু, সত্যিই আপনি
    পৃথিবীর শাসনকর্তা। দেবতাদের
    চেয়ে আপনি অনেক মহৎ।

    ইহুদিরা বর্তমান জেরুসালেমে সুকোথ অনুষ্ঠানের জন্য খেজুর শাখা নির্বাচন করে। এটি যদিও এখন মরুভূমিতে ইসরাইলিদের ৪০ বছর নির্বাসিত জীবনযাপন স্মরণে পালিত হলেও অনুষ্ঠানটি এখনো মূল ফসল তোলার উৎসবের সাথে সম্পর্কিত।

    ইসরাইলিরা একেশ্বরবাদী ধর্মমত আনুষ্ঠানিকভাবে বিকাশ করার অনেক আগে মাউন্ট জায়নের শাস্ত্রাচার ও আনুষ্ঠানিকতা জুদার লোকজনকে ধারণাগত পর্যায়ে না হলেও আবেগময়ভাবে শেখানো হয়েছিল যে উপাসনা করার জন্য একমাত্র ঈশ্বর হচ্ছেন যিহোবা।

    তবে জায়ন মতবাদ কেবল চিৎকার চেঁচামেমিময় উদযাপনই ছিল না। প্ৰথম দিককার তীর্থযাত্রার সামগুলোতে দেখা যায়, এটি তীব্রভাবে ব্যক্তিগত আধ্যাত্মিকতা সৃষ্টি করতে সক্ষম ছিল। টেম্পল পরিদর্শন ছিল ঊর্ধ্বে (আলিয়া) গমনের অভিজ্ঞা। তারা যখন হিন্মম উপত্যকায় উঠে সেখান থেকে জেরুসালেমের ঢালু পাহাড়গুলো দিয়ে জায়নের চূড়ার দিকে যেতে থাকত, তখন তারা যিহোবার দর্শন লাভের জন্য নিজেদের প্রস্তুত করে নিত। ১৪ এটি স্রেফ কোনো দৈহিক ঊর্ধ্বে আরোহণ ছিল না, বরং এমন এক স্থানের দিকে ‘অন্তর্মুখী গমন’ ছিল, যা ভেতরের দুনিয়া মিশে যেত বাইরের দুনিয়ার সাথে। এটি বাড়ি ফেরার অনুভূতি সৃষ্টি করত :

    পাখিরা পর্যন্ত আপনার মন্দিরে তাদের
    আশ্রয় খুঁজে পেয়েছে। আপনার বেদীর
    কাছেই ওরা বাসা বেঁধেছে এবং
    ওদের শাবকও আছে।

    দাউদের জেরুসালেমে যিহোবার জন্য বাড়ি তৈরির ধারণা প্রথম প্রকাশ করার পর থেকেই টেম্পল-সম্পর্কিত ধারণাটি বিশ্রাম ও স্থায়ী আবাস প্রতিষ্ঠার কল্পনায় উপস্থিত ছিল।১৬ টেম্পল মতাদর্শটি জুদার লোকজনকে বিশ্বের সাথে তাদেরকে সম্পৃক্ত করতে সহায়তা করেছিল। সৃষ্টি পুরাণতত্ত্বে জোর দিয়ে বলা হচ্ছিল, প্রতিটি জিনিসেরই মহাবিশ্বে তার নির্ধারিত স্থান আছে। সাগরকে শুষ্ক ভূমিকে প্লাবিত করা ঠেকাতে যিহোবা তাকে বেঁধে দিয়েছেন। এখন জায়নে যিহোবার বিশেষ স্থান রয়েছে। তিনি জুদাবাসীদের আবাস নিশ্চিত করার জন্য এটি নির্মাণ করেছেন। পবিত্র জাতি হিসেবে তাদেরও বিশেষভাবে নির্ধারিত স্থান রয়েছে। নগর-প্রাচীরের বাইরে বিনাশক শত্রুরা রয়েছে, তারা অবয়বহীন বিশৃঙ্খলায় তাদের বিশ্বকে হ্রাস করে দিতে পারে। তবে এই সুরক্ষিত স্থানের মধ্যে লোকজন তাদের নিজস্ব দুনিয়া সৃষ্টি করতে পারে। জায়ন টেম্পল যে আনন্দ ও অধিকারের অনুভূতি জাগিয়ে তুলত, তা তাদের আবেগগত ও দৈহিকভাবে বেঁচে থাকাকে যথাযথভাবে তৃপ্ত করে তুলত। টেম্পলের উপস্থিতি কোনো বিষণ্ণ কর্তৃব্য ছিল না। সামবাদী যিহোবার দরবারের জন্য ‘আকাঙ্ক্ষা ও আকুতি’ করেছেন, তার পুরো গানই ছিল আনন্দের। ১৭ তীর্থযাত্রীরা পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতে দেখে নিজেদের মধ্যে শক্তি লাভ করত : তারা তুলনামূলকতা ও অর্থহীনতার সীমাহীন প্রবাহ থেকে মুক্তি অনুভব করতেন। তাদের পুরাণতত্ত্ব যে প্রান্তরে জীবনের কোনো আশা মানুষ করতে পারত না, সেখানে অনেক বছর পরিভ্রমণের কথা বলত। সবকিছুর কেন্দ্রে পরিণত হওয়া টেম্পলে তীর্থযাত্রীরা সর্বোচ্চ মাত্রায় তার অস্তিত্বশীল অভিজ্ঞতা উপলব্ধি করত। টেম্পলের আঙিনায় একটি দিবস, অন্যত্র হাজার দিনের চেয়ে মূল্যবান মনে হতো।১৮

    এসব সত্ত্বেও এর মানে এই নয় যে জেরুসালেমে কেবল একমাত্র ঈশ্বর হিসেবে যিহোবাই উপাসনা লাভ করতেন। ডিউটারোনোমিস্ট ইতিহাসবিদ একটি একক বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতে ইসরাইল ও জুদার রাজাদের বিচার করেছেন। তা হলো ভালো রাজা তারাই যারা কেবল যিহোবার উপাসনা প্রচার করেন, প্রতিদ্বন্দ্বী দেবতাদের মন্দির, উপাসনা স্থান (ব্যামথ) ও দণ্ডায়মান পাথর (ম্যাতজেভত) গুঁড়িয়ে দেন। আর খারাপ রাজা হলেন তারা যারা ওইসব বিদেশী মতাদর্শকে উৎসাহিত করেন। এর ফলে ডি’র দীর্ঘ ভাষ্য সত্ত্বেও আমরা এই সময়কার জেরুসালেমের ঘটনাপ্রবাহ সম্পর্কে খুব কমই জানতে পারি। কারণ আমরা রাজার অন্যান্য কার্যক্রম সম্পর্কে বলতে গেলে কিছুই জানতে পারি না। আর কেবল যিহোবার প্রতি নিষ্ঠাবান রাজাদের কথা বলার সময়ও ডি এই সত্য গোপন করতে পারেননি যে এসব শাসকের অধীনে অন্যান্য মতাদর্শ নগরীতে বিকশিত হওয়া অব্যাহত ছিল। ফলে রাজা যেহোশাফতের (৮৭০-৮৪৮) প্রশংসা করা হয় এই জন্য যে তিনি একমাত্র যিহোবার প্রতিই বিশ্বস্ত ছিলেন। তবে ডি স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছেন, অন্যান্য ঈশ্বরের ব্যামথ তখনো সক্রিয় ছিল। অধিকন্তু, জেহোশাফতকে তার ছেলে জেহোরামের সাথে বালের নিবেদিতপ্রাণ উপাসক ইসরাইলের রাজা আহব ও রানি জেজেবেলের মেয়ে প্রিন্সেস আথাইলাহর বিয়ে নিয়ে কোনো সমস্যাতেই পড়েননি। প্রিন্সেস আথাইলাহ তার ফনেশিয়া মতাদর্শ জেরুসালেমে নিয়ে এসেছিলেন। তিনি নগরীতে তার জন্য একটি মন্দিরও নির্মাণ করেছিলেন। এটিতে দায়িত্ব পালন করতেন সিডোনের পুরোহিত মাত্তান।

    জেহোরাম ও আথালিয়াহর বিয়ের ফলে সম্ভবত একটি চুক্তি হয়েছিল। এর ফলে জুদা রাজ্যটি ইসরাইলের সামন্তে পরিণত হয়েছিল। এর পর থেকে জেহোশাফাত ও জেহোরাম উভয়ে দামাস্কাসের বিরুদ্ধে অভিযানে ইসরাইলের পক্ষে থাকতেন। নবম ও অষ্টম শতকে নিকট প্রাচ্যে নতুন সমৃদ্ধি দেখা দেয়। এমনকি জুদার ভাগ্যও উন্নত হয়। কারণ জেহোশাফাত দারুণ জয় পান মোয়াব, আম্মন ও সিয়েরের বিরুদ্ধে। তবে নতুন একটি বিপদের আবির্ভাব ঘটেছিল। আসিরিয়ার (বর্তমান ইরাক) রাজারা তাদের রাজধানী নিনেভেহ থেকে নজিরবিহীন ক্ষমতা ও শক্তিসম্পন্ন একটি সাম্রাজ্য নির্মাণ শুরু করেছিলেন। তাদের প্রধান উচ্চাভিলাষ ছিল ভূমধ্য সাগরীয় উপকূলের দিকে পশ্চিম দিকে তাদের সাম্রাজ্য সম্রাজ্য করা। আসিরিয়ানদের অগ্রযাত্রা প্রতিহত করার চেষ্টায় ইসরাইল ও দামাস্কাস একে অপরের বিরুদ্ধে লড়াই বন্ধ করে দিয়ে এবং আনাতোলিয়া ও স্তেপ এলাকার অন্যান্য ছোট রাজ্যকে সাথে নিয়ে জোট গঠন করে। কিন্তু এই জোট ৮৬৩ সালে রিভার ওরোনটেসের কারকার যুদ্ধে পরাজিত হয়। দামাস্কাস ও ইসরাইল উভয়ই আসারিয়ার সামন্ত হতে বাধ্য হয়। জুদা রাজ্যটি খুব ছোট হওয়ায় এর প্রতি আসিরিয়ানদের নজর পড়েনি। ফলে এটি স্বাধীনই থেকে যায়।

    কিন্তু তবুও ওই বছরগুলো জেরুসালেমের জন্য শান্তিপূর্ণ সময় হয়নি। রানি আথালিয়া ৮৪১ সালে তার ছেলের মৃত্যুর পর রাজপ্রতিভূ হওয়ার পর তিনি তার ধারণায় সিংহাসনের আইনসম্মত সব উত্তরাধিকারীকে হত্যার মাধ্যমে দাউদিয় রাজবংশকে মুছে ফেলার চেষ্টা করেছিলেন। প্রায় ছয় বছর পর টেম্পলের পুরোহিত ও গ্রামীণ অভিজাতেরা সঙ্ঘবদ্ধ হয়ে একটি অভ্যুত্থানের ব্যবস্থা করে। তারা আথালিয়ার সদ্যজাত নাতি জেহোয়াশকে রাজা হিসেবে ঘোষণা করে। এ ছেলেটি হত্যাযজ্ঞ থেকে রক্ষা পেয়ে টেম্পলের মধ্যে অবস্থান করছিল। তারপর তারা আথালিয়াহকে হত্যা করে তার বালের মন্দিরটি ধ্বংস করে দেয়। নগরীটি বহিরাগত শত্রুদের হুমকির মধ্যেও পড়েছিল। দামাস্কাসের রাজা যাতে জেরুসালেম আক্রমণ না করেন, সেজন্য জেহোয়াশ টেম্পলের বিপুল পরিমাণ অর্থ তাকে দিয়েছিলেন। জুদার পরবর্তী রাজা আমাজিয়ার (৭৯৬-৮১) আমলে ইসরাইলি সেনাবাহিনী জেরুসালেমের রাজপ্রাসাদ ও টেম্পল লুণ্ঠন করে, তারা নগর প্রাচীরের কিছু অংশও গুঁড়িয়ে দিয়ে সামারিয়ায় ফিরে যায়। কিন্তু এতেও জায়নের দুর্ভেদ্যতা নিয়ে লোকজনের বিশ্বাসে চিড় ধরেনি। বস্তুত রাজা উজ্জাইহর (৭৮১-৪০) ১৯ আমলে নগরীটির শক্তি ক্রমাগত বাড়তে থাকে। তিনি কুষ্ঠুরোগে আক্রান্ত হওয়া সত্ত্বেও এই সাফল্য লাভ করেন। ইসরাইলি আক্রমণে ক্ষতিগ্রস্ত প্রাচীরগুলো মেরামত করা হয়, মিলোর পুরনো দুর্গটির বদলে নগরী ও টেম্পলের মাঝামাঝি স্থানে ওফেল নামে একটি নতুন দুর্গ নির্মাণ করা হয়। জেরুসালেম পরিণত হয় শিল্পকেন্দ্রে, এর জনসংখ্যা বাড়ে। মনে করা হয়ে থাকে, নগরীটি সম্প্রসারিত হয়ে প্রাচীরের বাইরে টারোপোয়েন উপত্যকায় নেমে পড়ে, মাউন্ট জায়নের বিপরীতে ওয়েস্টার্ন হিলেও ওঠে যায়। এই পর্যায়ে আসিরিয়া সাময়িকভাবে দুর্বল হয়ে পড়েছিল, তারা ওই অঞ্চল থেকে সরে যেতে বাধ্য হয়েছিল। ফলে ইসরাইল রাজ্যটিও সমৃদ্ধির যুগে প্রবেশ করে, কার্যত স্বাধীনতা লাভ করে।

    তবে এই প্রবৃদ্ধিই সামাজিক বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি করে। অধিকতর স্পর্শকাতর লোকজন ধনী ও গরিবদের মধ্যকার অগ্রহণযোগ্য বিপুল ব্যবধান সম্পর্কে তীব্রভাবে সচেতন ছিলেন। আর অবিচার ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে বিস্ফোরিত হতে উত্তর ও দক্ষিণের উভয় রাজ্যেই নবীদের উত্থান ঘটে। নিকট প্রাচ্যের রাজারা তাদের অভিষেক অনুষ্ঠানে গরিব ও অরক্ষিতদের রক্ষা করার শপথ গ্রহণ করতেন। কিন্তু লোকজন সম্ভবত এই আদর্শ দেখতে পাচ্ছিল না। ইব্রাহিমের মামরেতে তার ঈশ্বরকে আপ্যায়ন করার পর থেকে যিহোবাবাদ ইঙ্গিত দিচ্ছিল যে পবিত্র সত্তা মানুষের অবয়বে যেমন আত্মপ্রকাশ করতে পারেন, আবার মন্দির ও পবিত্র স্থানগুলোতেও দেখা দিতে পারেন। এখন এই সময়ে (ইতিহাসবিদেরা যেটাকে এক্সিয়াল যুগ বলে থাকেন) সভ্য বিশ্বজুড়ে যেসব নতুন ধর্ম আত্মপ্রকাশ করতে থাকে, সবই জোর দিয়ে বলতে থাকে, সত্যিকারের বিশ্বাস বাস্তব সমবেদনায় প্রতিফলিত হতে হবে। যিহোবার ধর্মও লোকজনের নতুন প্রয়োজন মেটানোর জন্য বদলে যেতে থাকে। হিব্রু নবীরা সামাজিক ন্যায়বিচারের ওপর জোর দেওয়া শুরু করে দেন। টেম্পলের জাদুকরি শক্তি অর্জনের মতো ধর্মীয় প্রতীক সহজেই এ কাজে ব্যবহৃত হতে পারত, ভ্রান্ত নিরাপত্তা ও স্বস্তির অবসান ঘটাত।

    এক্সিয়াল যুগের কোনো নবীই ইসাইয়ার চেয়ে জেরুসালেম টেম্পলের প্রতি বেশি নিবেদিতপ্রাণ ছিলেন না। রাজা উজ্জাইয়ার মৃত্যুর বছরে তথা ৭৪০ সালে ওই ঐশী স্থানটিতে তিনি নবুয়তি ডাক পান। ইসাইয়া ছিলেন রাজপরিবারের অন্যতম সদস্য, তিনি নিশ্চিতভাবেই পুরোহিতের দায়িত্বও পালন করেছিলেন। কারণ তিনি হেখালে দাঁড়িয়েছিলেন, হলরুমকে ভরে দেওয়া ধূপের ধোঁয়া দেখছিলেন, বিপুল কলেরবে থাকা কাল্টিক চিৎকার-চেঁচামেচি শুনছিলেন। ঠিক ওই সময়েই তিনি হঠাৎ করে টেম্পলের কল্পচিত্রগুলোর মধ্য দিয়ে এর পেছনে থাকা ভীতিপ্রদ বাস্তবতার মুখে পড়েন। তিনি উপলব্ধি করেন, যিহোবা আর্কের মাধ্যমে প্রতীকী করা তার স্বর্গীয় সিংহাসনে বসে আছেন, তাকে ঘিরে আছে উচ্চমর্যাদার দেবদূতেরা। টেম্পলটি ছিল স্বপ্নাবিভাবের স্থান। এখন ইসাইয়া যে জ্ঞান লাভ করলেন তা অবশিষ্ট দুনিয়ার প্রতি দেভির থেকে বিচ্ছুরিত ঐশী সত্তা আগে কখনো দেখেননি। দেবদূত চিৎকার করে বললেন : ‘পবিত্র, পবিত্র, পবিত্র হলো যিহোবার সাবাথ, তার গৌরব পুরো দুনিয়ায় পরিপূর্ণ।’২০

    অর্থাৎ ইসাইয়ার স্বপ্নাবিভাবের জন্য টেম্পলটি ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। জায়নের পবিত্র পর্বতটি ছিল পৃথিবীর কেন্দ্র। কারণ এটি এমন স্থান যেখানে নারী-পুরুষকে মুক্তি দিতে নশ্বর দুনিয়ায় ঐশী বাস্তবতার আকস্মিক আবির্ভাব ঘটেছিল। জায়ন মতবাদ যিহোবার সার্বজনীন রাজ্যের জয়গান গাইত। এখন ইসাইয়া এমন দিনের অপেক্ষায় রইলেন যখন ‘সব জাতি’ ‘যিহোবার টেম্পল-পর্বতের দিকে ছুটে চলবে, একে অপরকে জেরুসালেমে আশ্রয় নিতে তাগিদ দিয়ে বলবে : ‘এসো, এসো আমরা ইয়াকুবের ঈশ্বরের টেম্পলে যাই। এটি হবে ইডেন উদ্যোনে সার্বজনীন প্রত্যাবর্তন, যেখানে সব সৃষ্টি সম্প্রীতিতে থাকবে মেষ বাস করবে নেকড়ের সাথে, শিশুদের সাথে থাকবে প্যান্থার, বাছুর খেলবে সিংহশাবকের সাথে। ২২ জেরুসালেমের পবিত্র পর্বত নতুন বিশ্বব্যবস্থা দেখবে, মানবতার আকুলভাবে কাম্য সামগ্রিকতার পুনরুদ্ধার ঘটবে। নতুন জেরুসালেম প্রশ্নে ইসাইয়ার প্রত্যাদেশ কখনো বিস্মৃত হয়নি। ঈশ্বরের আশীর্বাদপুষ্ট একজন রাজার তথা মেসাইয়ার জন্য তার আশাবাদ, এই শান্তির যুগের সূচনা হবে মেসাইনিক এই আশায় যে এটি ইব্রাহিমের তিন ধর্মের সবার মধ্যেই একেশ্বরবাদের আকাঙ্ক্ষার সৃষ্টি করেছে। ইহুদি, খ্রিস্টান ও মুসলিমরা সবাই জেরুসালেমকে মানব ইতিহাসে চূড়ান্ত হস্তক্ষেপের স্থান হিসেবে দেখে। এখানেই হবে চূড়ান্ত ফয়সালা, সময়ের সমাপ্তিতে হবে চূড়ান্ত যুদ্ধ এবং অনুতপ্ত অবিশ্বাসীরা দলে দলে জেরুসালেমে গিয়ে ঈশ্বরের ইচ্ছার কাছে দাখিল হবে। এসব দর্শন বর্তমান সময়েও জেরুসালেমের রাজনীতিতে প্রভাব বিস্তার করে রেখেছে।

    ইসাইয়ার মন্দিরকেন্দ্রিক ভবিষ্যদ্বাণী পুরো জায়ন মতবাদকে পরীক্ষার মুখে ফেলে দিয়েছিল বলে মনে হয়।

    তোমরা কে আমার উদ্দেশে এত বলিদান
    করে চলেছ? তোমাদের পাঁঠার বলিতে ও
    ষাঁড়, মেঘ ও ছাগলের মেদে আমার অরুচি
    ধরে গেছে। আমি সন্তুষ্ট নই। লোকেরা
    তোমরা যখন আমার কাছে প্রার্থনা
    করতে আসো, তখন তোমরা আমার
    উপাসনালয় প্রাঙ্গনের সবকিছু
    পদদলিত করো। তোমাদের
    এসব করতে কে বলল?

    বিশদভাবে থাকা প্রার্থনাবিধি অপ্রয়োজনীয় বিষয়ে পরিণত হতে পারে যদি না এর সাথে এমন কোনো সহানুভূতি না থাকে যা সর্বোপরি ন্যায়বিচার কামনা করা, · নির্যাতিত, এতিম ও বিধবাদের সহায়তা না করা হয়।২৪ বিশেষজ্ঞরা বিশ্বাস করেন, এই ভবিষ্যদ্বাণী হয়তো ইসাইয়ার রচনা না হলেও সম্পাদকদের মাধ্যমে তার ঐশীবাণীতে অন্তর্ভুক্ত ছিল। অবশ্য এই ধারণা অন্যান্য নবীর মধ্যেও ছিল। উতরের রাজ্যে নবী অ্যামোসও যুক্তি দিতেন যে টেম্পলের শাস্ত্রাচার এক্সোডাসের মূল ধর্মের কোনো অংশ ছিল না। ইসাইয়ার মতো অ্যামোসেরও বেথালের টেম্পলে যিহোবাকে নিয়ে স্বপ্নাবিভাব ছিল। তবে কোনো মতবাদ সৃষ্টির মতো সময় তার ছিল না। তিনি ঈশ্বরের প্রতিনিধিত্ব করতেন। তিনি এভাবে জানতে চাইতেন : ‘ঈশ্বর কি তোমাকে আমার কোরবানি এনে দিয়েছেন কিংবা ৪০ বছরের ঘোরার সময় নৈবেদ্য দিয়েছেন।’ যিহোবা আর জয়ধ্বনি বা বাঁশির সুর শুনতে চাচ্ছিলেন না, তিনি অবারিত স্রোতধারার মতো ন্যায়বিচারের প্রতিষ্ঠা দেখতে চেয়েছিলেন। ২৫ অ্যামোস জেরুসালেমে তার পবিত্র স্থান থেকে ঈশ্বর গর্জন করছেন বলে কল্পনা করেছিলেন। কারণ আশপাশের দেশগুলোতে অবিচার দেখে তার কাছে মতবাদটি বিদ্রূপে পরিণত হয়ে গিয়েছিল। এক্সিয়াল যুগে যিহোবার ধর্ম বদলে যাওয়ায় ন্যায়বিচার ও সহানুভূতি অপরিহার্য গুণে পরিণত হয়েছিল। বলা হয়েছে, এগুলো ছাড়া পবিত্র স্থানে কোরবানির কোনোই মূল্য নেই। জেরুসালেম মতবাদ এই মূল্যবোধও উচ্চকিত করেছে এই ঘোষণা দিয়ে যে যিহোবা সবচেয়ে বেশি চিন্তিত গরিব ও অরক্ষিতদের নিয়ে। জায়ন হওয়া উচিত গরিবদের আশ্রয়কেন্দ্র। আমরা দেখেছি, জেরুসালেমের সত্যিকারের সন্তান বিবেচনাকারী ইহুদিরা নিজেদের বলত ইভিওনিম তথা গরিব মানুষ। অবশ্য জেরুসালেমে ‘দারিদ্র’ বলতে কেবল বস্তুগত সম্পদ থেকে বঞ্চিত থাকাই বোঝাত না। ‘গরিব’-এর বিপরীত শব্দ ‘ধনী’ ছিল না, তা ছিল ‘গর্বিত।’ জেরুসালেমে লোকজন মানবীয় শক্তি, বিদেশী আনুগত্য বা সামরিক শ্রেষ্ঠত্বের ওপর নির্ভর করত না, বরং কেবল যিহোবার ওপর ভরসা করত। একমাত্র তিনিই জায়নের দুর্গ রক্ষা করতে পারেন। মানব সেনাবাহিনী ও সুরক্ষিত দুর্গের ওপর নির্ভরশীল থাকাকে ঔদ্ধত্য বোঝাত। ২৭

    এখনকার মতো তখনো লোকজন সহানুভূতি প্রকাশের অপেক্ষাকৃত কঠিন কর্তৃব্য পালনের চেয়ে ঐশী স্থানে ধর্মীয় শক্তি ব্যয় করার বিকল্পকেই অগ্রাধিকার দিত। ইসাইয়ার দীর্ঘ নবুয়তি জীবনে এমন অনেক বিপদ দেখা যায় যার উদ্ভব ঘটেছে জেরুসালেম মতাদর্শ থেকে। জুদার রাজা আহজের শাসনকালে (৭৩৬- ১৬) আসিরিয়ানরা আবার নিকট প্রাচ্যে আবির্ভূত হয়। দামাস্কাস ও ইসরাইলের রাজারা আসিরিয়ানদের প্রতিরোধের জন্য রাজা তৃতীয় তিগলাথপিলাসারের নেতৃত্বে নতুন জোট গঠন করেন। রাজা আহাজ এই জোটে যোগ দিতে অস্বীকার করলে ইসরাইল ও দামাস্কাস জেরুসালেম দখল করার জন্য দক্ষিণ দিয়ে এগিয়ে যায়। দৃঢ়ভাবে দাঁড়ানোর জন্য আহাজকে বোঝানোর চেষ্টা করেছিলেন ইসাইয়া। তিনি বলেছিলেন : তার রানি যে সন্তান গর্ভে ধরেছেন, তিনিই দাউদের রাজ্য পুনঃপ্রতিষ্ঠা করবেন; তার নাম হবে ইমানু-আল (‘আমাদের সাথে আছেন ঈশ্বর’), কারণ তিনি শান্তির যুগের সূচনা করবেন। এ সময় নারী ও পুরুষেরা আবারা ঐশী ছায়ায় শান্তিতে থাকবে। এই ছেলে বুঝদার বয়সে পৌছার আগে পর্যন্ত দামাস্কাস ও ইসরাইল রাজ্য ধ্বংস হবে; অন্যান্য রাজপুরুষের বিদেশী জোট নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই।২৮ আহাজের উচিত কেবল যিহোবার ওপর নির্ভর করে থাকা।

    ইসাইয়া ক্ষুব্ধ হলেও তার পরামর্শ অনুসরণ করার ঝুঁকি নিয়ে আগ্রহী ছিলেন না আহাজ। রাজা এর বদলে তিগলাথপিলেসারের কাছে বশ্যতা স্বীকার করে আসিরিয়ার সামন্তে পরিণত হন। এর পরপরই দামাস্কাস ও ইসরাইল আক্রমণ করে আসারিয়া। সেখান থেকে বিপুলসংখ্যক অধিবাসীকে বহিষ্কার করা হয়। ৭৩৩ সাল নাগাদ সামারিয়াভিত্তিক ছোট নগর-রাষ্ট্রে পরিণত হয় ইসরাইল, একজন পুতুল রাজাকে বসানো হয় সিংহাসনে। সামন্তদের ওপর নিজের ধর্ম চাপিয়ে দেওয়ার কোনো নীতি ছিল না আসারিয়ার। তবে আহাজ তার নতুন প্রভুর প্রতি মতাদর্শগত আনুগত্য প্রদর্শন করার জন্য নিজেই তেমন কিছু করতে চাইছিলেন। টেম্পলের আঙিনায় বলি দেওয়ার পুরনো বেদির স্থানে আসিরিয়া-ধরনের বেদি বসানো হয়। এরপর থেকে সূর্য, চন্দ্র, নক্ষত্র-সম্পৃক্ত মতবাদের জন্য জুদাতে নতুন উদ্দীপনার সৃষ্টি হয়। নিকট প্রাচ্যের অন্যান্য অংশেও এই সময় এসব পূজা শুরু হয়।

    আসিরিয়ার সামরিক শক্তি : এই কেন্দ্রস্তম্ভে (আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ৭৪৫) সৈন্যরা বর্শা নিক্ষেপের যন্ত্র দিয়ে একটি নগরী অবরোধ করে আছে। তারা তাদের বন্দিদের প্রতি খুবই নির্মম ছিল।

    আহাজের জন্য ইসাইয়ার সময় ছিল সামান্যই। তবে রাজা অন্তত তার দেশকে রক্ষা করতে পেরেছিলেন। তবে ইসাইয়া যাকে আমানু-আল হিসেবে প্রশংসা করেছিলেন, ওই শিশু সম্পর্কে একই কথা প্রযোজ্য নয়। হেজেকিয়া ৭১৬ সালের দিকে তার বাবার স্থলাভিষিক্ত হন। ডি আমাদেরকে অনুমোদনসূচকভাবে বলেন তিনি কেবল যিহোবার প্রতি নিবেদিতপ্রাণ ছিলেন। তিনি অন্যান্য ঈশ্বরের প্রতি নিবেদিত সব ব্যামথ (উপাসনালয়) বন্ধ করে দেন, ম্যাতজেভট (পাথরের স্তম্ভ) ভেঙ্গে ফেলেন, জেরুসালেম টেম্পলের হেখালে থাকা ব্রোঞ্জের সাপ গুঁড়িয়ে দেন। ইতিহাসলেখকেরা আমাদের জানাচ্ছেন, এই সংস্কার আন্দোলনে পুরোহিতেরা নেতৃত্বের ভূমিকা পালন করেছিলেন, টেম্পলের মধ্যে স্থান নেওয়া বিদেশী ধর্মমতের সবকিছু ছুঁড়ে ফেলে দেন। তিনি আরো বলেন, হেজেখিয়া পাসওভার উদযাপনের জন্য সোলায়মানের টেম্পলে সমবেত হওয়ার জন্য ইসরাইল ও জুদার সব লোককে নির্দেশ দিয়েছিলেন। উল্লেখ্য, ওই উৎসবটি এত দিন বাড়িতেই উদযাপিত হতো। ২৯ অবশ্য বাস্তবে এই ভাষ্য সত্য হওয়ার সম্ভাবনা কম। কারণ ষষ্ট শতকের শেষ দিকের আগে টেম্পলে পাসওভার উদযাপিত হতো না। খুব সম্ভবত ইতিহাসলেখক তার নিজেদের সময়কে হেজেকিয়ার মধ্যে নিয়ে গেছেন। এর কারণ হতে পারে, তিনি তার ব্যাপারে সবচেয়ে উৎসাহিত ছিলেন। বস্তুত, আমরা জানি না, এই সংস্কারের ঠিক কী উদ্দেশ্য ছিল হেজেকিয়ার। মনে হচ্ছে, এর কোনো স্থায়ী প্রভাব ছিল না। তিনি সম্ভবত তার বাবার সমন্বয়ধর্মী নীতি থেকে নিজেকে সরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। এর প্রথম ধাপ ছিল আসিরিয়ান প্রাধান্য ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া। ইসরাইলের লোকজনকে জেরুসালেমে তলব করার কাহিনী ইঙ্গিত দিচ্ছে, ইসরাইয়ার ভবিষ্যদ্বাণী অনুযায়ী তিনি অখণ্ড রাজত্ব পুনর্জীবনের স্বপ্ন দেখেছিলেন। ইসরাইল তখন আর হুমকি ছিল না। সাবেক শত্রুদের দুর্দশায় জুদায় নিশ্চিতভাবেই আনন্দ বয়ে গিয়েছিল। বিভক্তির পর প্রথমবারের মতো জুদা অপেক্ষাকৃত শক্তিশালী অবস্থানে চলে এসেছিল। দাউদের নগরীতে অবশিষ্ট ইসরাইলিদের তলব করার মাধ্যমে হেজেকিয়া সম্ভবত ইসাইয়ার মেসাইনিক দর্শন লালন করছিলেন।

    এ ধরনের কোনো আশা যদি থেকেও থাকে, তবে তা ৭২২ সালে পুরোপুরি গুঁড়িয়ে গিয়েছিল আসারিয়ার বিরুদ্ধে ব্যর্থ বিদ্রোহ করার ফলে। পঞ্চম শালমানেসের সামারিয়াকে পরাজিত ও বিধ্বস্ত করেন। ইসরাইল রাজ্যকে আসারিয়ার একটি প্রদেশে পরিণত করা হয়, এর নাম রাখা হয় সামেরিনা। ২৭ হাজারের বেশি ইসরাইলিকে আসারিয়ায় বহিষ্কার করা হয়, তাদের কথা আর কখনো শোনা যায়নি। তাদের স্থলাভিষিক্ত করা হয় বেবিলন, কুচনাহ, আরাদ, হামাহ ও সেফোরিয়াম থেকে লোক এনে। এসব লোক তাদের নিজস্ব দেব-দেবীদের ছাড়াও তাদের নতুন দেশের ঈশ্বর যিহোবার উপাসনাও করত। এরপর থেকে কোনো ভৌগোলিক এলাকার নাম বোঝাতে ‘ইসরাইল’ পরিভাষাটি ব্যবহৃত হতো না। এটি জুদায় পুরোপুরি কান্টিক পরিভাষা হিসেবে টিকে থাকে। তবে সব ইসরাইলিকে বহিষ্কার করা হয়নি। তারা তাদের পুরনো শহর ও গ্রামগুলোতে থেকে যায় এবং নতুন উপনিবেশকারীদের সহায়তায় তাদের বিধ্বস্ত দেশটি পুনঃগঠন করার চেষ্টা করেছিল। অন্যরা সম্ভবত উদ্বাস্তু হিসেবে জুদা এসে জেরুসালেমের আশপাশে বসবাস করতে থাকে। তারা যেসব ধ্যান-ধারণা সাথে করে নিয়ে এসেছিল, সেগুলো হয়তো কিছু সময় উত্তরে প্রচলিত ছিল ও জেরুসালেমের মতাদর্শে তাৎপর্যপূর্ণ প্রভাব ফেলেছিল।

    হয়তো সাবেক ইসরাইল থেকে এ ধরনের বিপুলসংখ্যক লোক আসার কারণেই অষ্টম শতকের শেষ দিকে জেরুসালেম সাবেক আকারের তিন থেকে চার গুণ বৃদ্ধি পায়। দুটি নতুন উপকণ্ঠ নির্মিত হয় : একটি টেম্পলের বিপরীতে ওয়েস্টার্ন হিলের ওপর, যা পরিচিত হয় মিশনেহ বা সেকেন্ড সিটি নামে। অপরটি নির্মিত হয় টাইরোপোয়ন ভ্যালিতে, নাম হয় ম্যাখতেশ বা দি হ্যালো। নতুন আসারিয়ান রাজা দ্বিতীয় সারগন তার সামন্তদের প্রতি আরো উদার নীতি গ্রহণ করেন। এর ফলে জেরুসালেম বিশেষ সুযোগ ও অর্থনৈতিক সুবিধা পায়। কিন্তু উত্তরাঞ্চলীয় রাজ্যের ভাগ্য থেকে শেখার বদলে হেজেকিয়া মনে হয় তার সমৃদ্ধিকে তার মাথার ওপর দিয়ে চলে যেতে দেন। সারগন ৭০৫ সালে মারা যাওয়ার পর জেরুসালেম অসন্তুষ্ট সামন্তদের নতুন জোটের কেন্দ্রে পরিণত হয। তারা আসারিয়ান শাসন ছুঁড়ে ফেলার আশা করেছিলেন। তার সাথে যোগ দেন টায়ার ও অ্যাশকেলনের রাজারা, মিসরের ফারাও সহায়তার প্রতিশ্রুতি দেন। মেসোপটেমিয়ায় আরেকটি জোট দানা বেঁধে ওঠে। এর নেতৃত্ব দেন বেবিলনের রাজা মেরোডাচ-ব্যালাদান। তিনি গুদামঘর ও দুর্গগুলো পরিদর্শনের জন্য জেরুসালেমে দূত পাঠান। হেজেকিয়া যুদ্ধের জন্য ব্যাপক প্রস্তুতি গ্রহণ করেন। একটি নতুন খাল খনন করে তিনি পানি সরবরাহব্যবস্থা উন্নতি করেন। এটি ছিল ১৭ শ’ ফুট লম্বা। এটি গিহন থেকে সিলোয়াম পুল পর্যন্ত পাথুরে এলাকার ওপর দিয়ে বয়ে গিয়েছিল। এই সরোবর ও সেইসাথে সম্ভবত মিশনেহকে রক্ষার জন্য একটি নতুন নগরপ্রাচীর নির্মাণ করা হয়। তিনি তার সামরিক সামর্থ্যের ব্যাপারে সুস্পষ্টভাবে এমন গর্বিত ছিলেন যে তা জেরুসালেমের ‘গরিব’ চেতনা অনেক দূরে সরিয়ে দিয়েছিল।

    তিনি অল্প সময়ের মধ্যেই তার ঔদ্ধত্যের বোকামি বুঝতে পারলেন : আসারিয়ার শক্তিকে প্রতিরোধ করা জেরুসালেমের জন্য ছিল অসম্ভব। বেবিলন ও মেসেপটেমিয়ার অন্যান্য অংশের বিদ্রোহ দমন করা মাত্র নতুন রাজা সেনাচেরিব জেরুসালেমের পথে পশ্চিম দিকে যাত্রা শুরু করেন। মিসর কোনো সৈন্য পাঠায়নি, ট্রান্সজর্ডান ও ফনেশিয়া আসারিয়া সেনাবাহিনীর সামনে তাসের ঘরের মতো গুঁড়িয়ে যায়। সবশেষে সেন্নাচেরিবের সৈন্যরা নগরীর বাইরে পৌঁছয়। বিপর্যয় রোখার চেষ্টায় হেজেকিয়া উপহার ও খাজনা পাঠান। কিন্তু তাতে কাজ হয়নি। ইসাইয়ার ছাত্র নবী মিকাহ ভবিষদ্বাণী করেছিলেন, শিগগিরই জেরুসালেম আবর্জনার জঞ্জালে পরিণত হবে, জায়ন হবে চাষা ক্ষেত। কিন্তু ইসাইয়া তখনো জোর দিয়ে বলছিলেন, সবকিছু শেষ হয়ে যায়নি : জায়নের দুর্গ যিহোবা নগরীকে রক্ষা করবেন। কূটনীতির ওপর ভরসা ও সামরিক প্রস্তুতি ব্যর্থ প্রমাণিত হয়। তবে যিহোবার উপস্থিতিই শত্রুকে তাড়িয়ে দিতে পারে। ৩১ আবারো সব সম্ভাবনার বিপরীতে ইসাইয়ার ভবিষ্যদ্বাণী নাটকীয়ভাবে সত্য প্রমাণিত হয়। আমরা জানি না, কী ঘটেছিল। ইতিহাসলেখকেরা কেবল এটুকু লিখেছেন, আসারিয়ান সেনাবাহিনীকে ধ্বংস করতে যিহোবা তার ‘দেবদূত’ পাঠিয়েছিলেন, সেনাচেরিব তার দেশে ফিরতে বাধ্য হয়েছিলেন। ৩২ সবচেয়ে যৌক্তিক ব্যাখ্যা হলো, আসারিয়ানরা প্লেগে বিধ্বস্ত হয়েছিল। অবশ্য জেরুসালেমের কেউ এ ধরনের নীরস তথ্য শুনতে রাজি ছিল না। তারা অলৌকিক ঘটনার মতো করেই এই উদ্ধার কার্যক্রম প্রত্যক্ষ করে। সত্যিই প্রমাণিত হলো, যিহোবা একজন শক্তিশালী যোদ্ধা, তার ধর্মীয় মতবাদের ঘোষণা অনুযায়ীই তিনি তার জনগণকে উদ্ধার করেছেন।

    এ অনন্য ঘটনাটি জেরুসালেমের রাজনীতিতে ভয়াবহ প্রভাব ফেলে। আগের বছরগুলোতে রেহোবোয়া ও আশার মতো রাজারা স্বাভাবিক কূটনীতির মাধ্যমে তাদের নগরীকে রক্ষা করেছিলেন। তারা ভিত্তিহীনভাবে জায়নে যিহোবা কাল্ট বিশ্বাস করেননি। বরং তারা শত্রুর বিরুদ্ধে তাদের ভাণ্ডারে থাকা প্রতিটি অস্ত্র দিয়ে তারা যথাযথভাবে লড়াই করাকে কর্তব্য মনে করেছিলেন। তারা তাদের বিপুল সংগ্রামে যিহোবাকে যুক্ত করেছিলেন। তবে পরের প্রজন্মের জেরুসালেমবাসীরা তাদের নগরীর দুর্ভেদ্যতার বিষয়টি এত গভীরভাবে অনুভব করে যে অলৌকিক হস্তক্ষেপে তারা রক্ষা পাবে বলে বিশ্বাস করতে থাকে। সেনাচেরিব সরে যাওয়ার পর হেজেকাইয়াহ বীর হিসেবে সম্মান লাভ করেন। তবে তার বেপরোয়া নীতি তার দেশকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যায়। আসারিয়ার বর্ষবিবরণীতে দেখা যায়, সেনাচেরিব দাবি করেছেন যে তিনি হেজেকিয়ার সুরক্ষিত ৪৬টি নগরী ও অসংখ্য গ্রাম লুণ্ঠন করেছেন, জনসংখ্যার একটি বড় অংশকে বহিষ্কার করেছেন, হেজেকিয়া তার প্রায় পুরো এলাকা হারিয়ে ফেলেছেন। জেরুসালেম আবারো ছোট্ট একটি নগর-রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে। তার ছোট ছেলে মানাসের কাছে এটি ছিল কঠিন উত্তরাধিকার। তিনি ৬৯৮ সালে সিংহাসনে আহরণ করেন, ৫৫ বছর জেরুসালেম শাসন করেন। বাইবেল লেখকদের মতে, জেরুসালেমে তিনিই সবচেয়ে খারাপ রাজা। হেজেকিয়া থেকে নিজেকে দূরে রাখার জন্য তিনি তার বাবার ধর্মীয় নীতি পুরোপুরি বদলে ফেলেন, ওই অঞ্চলের সাথে জুদার বৃহত্তর একীভূতকরণের কাজটি করেন, বিশেষ করে বিপজ্জনক পন্থাটি বর্জন করেন। মানব বলির প্রথা হিন্নম উপত্যকায় চালু ছিল। এটি নৃশংসতার একটি আভা ছড়িয়ে দিয়েছিল। আশেরাহর একটি প্রতিকৃতি টেম্পলে স্থাপন করা হয়, সম্ভবত দেভিরেও বসানো ছিল। আঙিনায় ঐশী পতিতাদের জন্য বাড়িও নির্মাণ করেন মানেসে। জায়ন এখন আশেরাহর উর্বরতা কান্টের প্রতি নিবেদিত। অন্যান্য নাক্ষত্রিক দেব-দেবতার বেদিও সেখানে ছিল। ৩৩ এসব পদক্ষেপে সবচেয়ে উদ্দীপ্ত যিহোবাবাদীরা স্বাভাবিকভাবেই আতঙ্কিত হয়েছিল। তবে কিছু লোক এগুলো গ্রহণ করেছিল। আমরা নবী হোসির ভাষ্য থেকে জানি যে বালের উর্বরতা মতবাদ ৭২২ সালের আগে উত্তরের রাজ্যে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছিল। তবে ২৭০ সালের দিকে যিহোবা ছিলেন জেরুসালেমের ইলিয়ন। আর যেসব নবী এই সিংহাসনচ্যুতির জন্য মারাত্মক শাস্তির ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন, তারা ধর্মদ্রোহী আখ্যা পায়, ৭০১ সালে গড়পড়তায় অকৃতজ্ঞ হিসেবে অভিহিত হন। মানেসে সম্ভবত বিশ্বাস করতেন যে আসারিয়ার প্রশংসা করা দরকার এবং তার বাবার যিহোবাবাদী নিষ্ঠায় কঠোর হওয়া উচিত নয়। তার দীর্ঘ শাসন ছিল জুদার পুনরুদ্ধারের সময়। হেরেকিয়ার হারানো ভূখণ্ডের কিছু অংশ মানেশেহ পুনরুদ্ধার করতে সক্ষম হয়েছিলেন।

    মানেশেহর সবচেয়ে তীব্র সমালোচকেরা ছিলেন ডিউটারোনোমিস্ট সংস্কারকেরা। তারা তার আমলে যিহোবাবাদের নতুন সংস্কারণ আবিষ্কার করেছিল, জায়ন মতবাদের দিকে বিরূপতা প্রকাশ করত। তারা সম্ভবত ৭২২ সালের বিপর্যয়ের পর উত্তরাঞ্চলীয় রাজ্য থেকে জেরুসালেমে এসেছিল। তারা হয়তো আসারিয়ানদের ইসরাইলি পুরনো মন্দিরগুলোর প্রতি বিরূপ ভাব সম্পর্কে অবগত ছিল। হয়তো তারা মনে করত, মানব-সৃষ্ট কোনো উপাসনালয়ে স্বর্গ আর দুনিয়ার মধ্যে সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করতে পারে না এবং শত্রুদের থেকে লোকজনকে রক্ষা করতে পারে না। এক্সিয়াল যুগে অনেকের কাছে ঐশী সত্তা ছিল ক্রমবর্ধমান হারে দূরের বাস্তবতা। তাদের কাছে স্বর্গ আর দুনিয়ার মধ্যে নতুন একটি দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছিল। ডিউটারোনোমিস্টরা মানুষের তৈরি কোনো ভবনে ঈশ্বর বাস করতে পারে বলে মনে করত না। ডি যখন বাদশাহ সোলায়মানের জেরুসালেম মন্দির উৎসর্গের কথা বর্ণনা করেন, তখন তিনি তা বাদশাহর মুখে শব্দ যোগ করেন, জায়ন মতবাদের ভিত্তিতে লেগে থাকে। সোলায়মান অবিশ্বাস্যভাবে বলেন, ঈশ্বর কি সত্যিই মানুসের সাথে বাস করেন? তোমাকে কেন আসমান আর তাদের নিজস্ব স্বর্গগুলো ধরে রাখতে পারে না? আমার বানানো এই বাড়িটি কত দুর্বল!৩৪ ঈশ্বর বাস করেন স্বর্গে, কেবল তার ‘নাম’- নিজের ছায়া- আমাদের দুনিয়ায় উপস্থাপিত হয়। ডিউটারোনোমিস্টদের কাছে মনে হয়েছিল জায়ন মতবাদটি খুব বেশিভাবে পুরনো কেনানি পুরানতত্ত্বের ওপর নির্ভরশীল। তারা এমন এক ধর্ম চেয়েছিল যা হবে ইতিহাসভিত্তিক। সেটি প্রতীকী গল্পের ওপর নির্ভরশীল না হয়ে বাস্তবতার ভিত্তিতে হবে। অনেক দিক থেকেই তারা আজকের আধুনিক পাশ্চাত্যের অনেক কাছাকাছি ছিল। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, মাউন্ট জায়নের ওপর যিহোবার সিংহাসনে কেনান ভূখণ্ড অবস্থান করার ইসরাইলি দাবি তারা বিশ্বাস করত না। এর বদলে তারা ঈশ্বরের সহায়তায় অস্ত্রের শক্তিতে ইসরাইল ভূমিটি জয় করেছে- এমনটা প্রমাণ করতে জওয়ার ঐশী উদ্দীপ্ত কেনান জয়ের গল্প তৈরি করেছিল। তারা জোর দিয়ে বলত, সুক্কুথ উৎসবটি ছিল স্রেফ ফসল তোলার উৎসব; এটি মাউন্ট জায়নে যিহোবার সিংহাসনে আরোহণ উদযাপনের জন্য ছিল না। ৩৫

    সর্বোপরি ডিউটারোনোমিস্টরা চেয়েছিল, কেবল ইসরাইলিরাই যেন যিহোবার উপাসনা করে এবং এর বিনিময়ে তারা যেন তাদের অন্য সব ঈশ্বরের প্রতি সমর্থন দেয়। এলিজা ও হোসিয়ার মতো উত্তরের নবীরা দীর্ঘ দিন এই বার্তা প্রচার করেছেন। কিন্তু বাদশাহ সোলায়মানের আমলের পর থেকে জেরুসালেমে সমন্বয়ের ঐতিহ্য প্রচলিত হয়ে আসছিল। ডিউটারোনোমিস্টদের সাথে সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে বলা যায়, মানাসে ছিলেন শেষ অবলম্বন। তারা বিশ্বাস করত, এক্সোডাসের আমল থেকে ইসরাইলিরা কেবল যিহোবার উপাসনা করেছে, যওয়া গ্রন্থের ২৪তম অধ্যায়ে তারা প্রমাণ করেছে, ইসরাইলিরা আনুষ্ঠানিকভাবে চুক্তি সংশোধন করে নিয়েছিল। যশুয়ার অভিভাবকত্বে তারা সব বিদেশী ঈশ্বরকে প্রত্যাখ্যান করে এর বদলে যিহোবাকেই তাদের হৃদয়মন দিয়েছে। তবে ডিউটারোনোমিস্টরা একেশ্বরবাদী ছিল না। তারা অন্যান্য ঈশ্বরের অস্তিত্বে বিশ্বাস করত, তবে মনে করত ইসরাইলিদের কেবল যিহোবার উপাসনা করতে বলা হয়েছে। ৩৬

    জেরুসালেম টেম্পলের প্রার্থনাবিধির অভিজ্ঞতা থেকে আমরা দেখেছি, ইতোমধ্যেই বেশ কিছু লোক এই পর্যায়ে জুদায় চলে এসেছে। জায়ন শাস্ত্রাচার ঘোষণা করছে যে যিহোবা একই ছিলেন রাজা ও অন্য ঈশ্বরদের চেয়ে শ্রেয়তর। তবে ডিউটারোনোমিস্টদের চোখে জায়ন মতবাদ ছিল ত্রুটিপূর্ণ ও ভ্রান্তিপূর্ণ। তারা মন্দিরগুলো পুরোপুরি বিলুপ্ত করতে চাইছিল না : এগুলো ছিল প্রাচীন বিশ্বের ধর্মগুলোর কেন্দ্রীয় বিষয়। আর এখনকার দুনিয়ায় এগুলো ছাড়া জীবন সম্ভবত কল্পনাই করা যায় না। কিন্তু এর বদলে তারা প্রস্তাব করে যে ইসরাইলের কেবল একটি পবিত্র স্থান থাকা উচিত। এটি হতে পারে বিদেশী ধ্যান-ধারণা চুপিসারে মতবাদে অনুপ্রবেশ ঠেকানোর কাজে তদারকির জন্য। শুরুতে তাদের মনে হয়তো শেচেম বা বেথেলের কথা ছিল। কিন্তু ৭২২ সালের পর প্রধান পবিত্র স্থানের মর্যাদা পেতে পারে এমন পীঠ হিসেবে জেরুসালেম টেম্পলই একমাত্র প্রধান যিহোবাবাদী উপাসনালয় হিসেবে টিকে ছিল। ফলে সংস্কারকররা অনিচ্ছা সত্ত্বেও একে মেনে নিয়েছিল। তা সত্ত্বেও পবিত্র ভূমিতে এই প্রধান উপাসনালয়ের প্রতি মুসার নজরদারির কথা বর্ণনা করার সময় তারা সতর্কভাবে ‘জায়ন’ বা ‘জেরুসালেম’-এর উল্লেখ এড়িয়ে গেছেন। এর বদলে তারা মুসাকে দিয়ে অস্পষ্টভাবে বলিয়েছেন, ‘যে স্থানটিকে তোমার ঈশ্বর যিহোবা তার নামের জন্য বাছাই করেছেন। ৩৭

    ডিউটারোনোমিস্টদের আদর্শ মানেশাহের আমলে কার্যকর হওয়ার কোনো সম্ভাবনা ছিল না। তবে তার নাতি যসিয়াহর ( ৬৪০-৬০৯) আমলে অপ্রত্যাশিতভাবে তাদের ওই সুযোগ হাতে আসে। সময়টি ছিল সঠিক। নিকট প্রাচ্যজুড়ে লোকজন অস্পষ্টভাবে সচেতন ছিল যে পুরনো ব্যবস্থা বিদায় নিচ্ছে। নতুন বিশাল সাম্রাজ্য আসিয়ার অধীনে বসবাসের অভিজ্ঞতা ও এর উদীয়মান প্রতিদ্বন্দ্বী বেবিলন লোকজনকে আগের যেকোনা সময়ের চেয়ে অনেক বড় বৈশ্বিক দৃষ্টিভঙ্গি দেয়। প্রযুক্তিগত অগ্রগতিও তাদের পরিবেশের ওপর তাদের আগের চেয়ে বেশি নিয়ন্ত্রণ দেয়। লোকজন আর তাদের পূর্বপুরুষদের মতো বিশ্বকে দেখতে পারছিল না। ফলে তাদের ধর্মীয় আদর্শও বদলে যাচ্ছিল। পৃথিবীর অন্যান্য অংশেও পুরনো পৌত্তলিকতার সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হচ্ছিল। অক্সিয়াল যুগে পুরনো বিশ্বাসের স্থানে তাওবাদ, কনফুসিয়ানবাদ, হিন্দুবাদ, বৌদ্ধবাদ ও সবশেষে গ্রিক যুক্তিবাদ জায়গা করে নিয়েছিল। জুদাতেও একই ধরনের পরিবর্তন সংগঠিত হচ্ছিল। তবে আবহমান কাল বিদায় নেওয়ায় মিসর থেকে মেসোপটেমিয়া পর্যন্ত লোকজন আদর্শ অতীত নিয়ে স্মৃতিকাতরতায় ভুগত। এটি ছিল এক্সোডাস ও বিচারকদের সময়কালের ইসরাইলের স্বর্ণযুগের ডিউটারোনোমিস্টদের সংস্করণ। এটি কল্পিত অতীত হলেও বর্তমানের বিভ্রান্তিকর বর্তমানের চেয়ে অনেক বেশি আকর্ষণীয় ছিল।

    এই নস্টালজিয়া অতীতের অংশ হওয়ায় যসিয়াহ সোলায়মানের টেম্পল পুনঃপ্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। তিন শ’ বছর গত হওয়ায় মন্দিরটির সংস্কার ব্যাপকভাবে প্রয়োজনীয় হয়ে পড়েছিল। সংস্কারকাজ চলার সময় প্রধান পুরোহিত হিলকিয়া একটি স্ক্রল আবিষ্কার করেন। এটি সম্ভবত ছিল বুক অব ডিউটারোনোমিস্ট হিসেবে আমরা যে গ্রন্থটি জানি, তার অংশবিশেষ। স্কুলটি যসিয়ার সামনে পাঠ করার সময় তরুণ রাজা একথা ভেবে কষ্ট পেলেন যে ঈশ্বরের দাউদ গৃহ নির্বাচনের ফলে ইসরাইলের ওপর ঈশ্বরের আনুকূল্য নিঃশর্ত নয়। বরং আনুকূল্য নির্ভর করছে মুসার বিধান পালনের ওপর।৩৮ মাউন্ট জায়নে যিহোবার তার টেম্পলে উপস্থিত থাকাটাই আর পর্যাপ্ত বিবেচিত হলো না। যসিয়ার এই নতুন ধর্মতত্ত্বের ওপর চরম প্রতিক্রিয়া প্রমাণ করল যে বিধানটি জুদার ধর্মীয় জীবনে প্রধান বিষয় ছিল না। মতবাদটি ও রাজার শাসন, যিহোবার মেসাইয়া, ছিল জুদার রাজনীতির ভিত্তি। এখন তাওরাত, মুসার বিধান হওয়া উচিত দেশের আইন।

    যসিয়া নতুন বিশ্বাস অনুযায়ী সংস্কারকাজ শুরু করলেন। আর এ ধরনের অন্য সব সংস্কারের মতো এখানেও অতীততে নতুন করে সৃষ্টির উদ্যোগ গ্রহণ করা হলো। প্রথমে জুদার সব প্রবীণকে তলব করা হলো টেম্পলের প্রতি প্রাচীন চুক্তি নবায়নের জন্য। লোকজন অন্যসব বিদেশী ঈশ্বর থেকে সরে গিয়ে কেবল যিহোবার প্রতি নিজেদের প্রতিশ্রুত থাকার সংকল্প ব্যক্ত করল। পরের পদক্ষেপ হলো মতবাদগুলোকে পরিশোধিত করা, ডি’র ভাষ্যে জেরুসালেমে এসব পৌত্তলিক’ ধর্মমতের প্লাবন ছিল বলে দেখা যায়। বাল, অ্যারেরাহ ও অন্যান্য নাক্ষত্রিক দেব- দেবীর প্রার্থনার সাথে জড়িত ধর্মীয় বস্তু নগরী থেকে বের করে কিদরন উপত্যকায় পুড়িয়ে ফেলা হয়। টেম্পল থেকেও দেব-স্তম্ভ ও আঙিনায় থাকা অ্যারেরাহর প্রতি নিবেদন করা পবিত্র পতিতাদের বাড়িগুলো উচ্ছেদ করা হয় :

    তিনি হিন্নম উপত্যকার অগ্নিকুণ্ড অপবিত্র করেছিলেন যাতে কেউ মোলোচের সম্মানে তার ছেলে বা মেয়েকে আগুনে শোধন করতে না পারে। জুদার রাজারা যিহোবার টেম্পলের প্রবেশপথে সূর্যের প্রতি নিবেদন করে যে বাড়িগুলো নির্মাণ করেছিলেন সেগুলো তিনি গুঁড়িয়ে দিয়েছিলেন… জুদার রাজারা ছাদের ওপর যেসব বেদী নির্মাণ করেছিলেন, যিহোবার টেম্পলের দুই আঙিনায় মানাসেহ যেগুলো নির্মাণ করেছিলেন, সবই রাজা টেনে নামিয়ে সেখানেই টুকরা টুকরা করে ফেলেন… ইসরাইলের রাজা সোলায়মান মাউন্ট অলিভেসের দক্ষিণে জেরুসালেমের দিকে মুখ করে নির্মাণ করা ব্যামথ, আস্তারতের জন্য সিডোনিয়ান ঘৃণ্য বস্তু, চেমোশের জন্য মোয়াবাইতদের জন্য ঘৃণ্য বস্তু, মিলকমের জন্য নির্মিত আমোনাইত ঘৃণ্য বস্তু অপবিত্র করে করে দেন রাজা। তিনি সব ঐশী স্তম্ভ গুঁড়িয়ে দেন, ঐশী দণ্ডগুলো কেটে ফেলেন, ওইসব স্থান মানুষের হাড় দিয়ে ঢেকে দেন। ৩৯

    ধ্বংসের এই তালিকায় উদ্বেগ সৃষ্টিকারী সহিংসতা ছিল। এতে ‘পৌত্তলিকার প্রতি ইসরাইলিদের প্রবল ঘৃণার উপাদান ছিল। এগুলো মনে হয় নবী, সাধু পুরুষ ও সামবাদীদের ক্রুদ্ধ ও সহিংস বিতৃষ্ণার মধ্য দিয়ে পূরণ করা হয়েছিল। এর কারণ সম্ভবত এই যে ইসরাইলিরা এসব পুরনো ধর্মীয় প্রতীকের প্রতি এতটাই আকর্ষণ বোধ করত যে তারা শান্তিপূর্ণভাবে এগুলো একদিকে সরিয়ে রাখতে পারছিল না। বুদ্ধ যেভাবে ভারতবর্ষের পুরনো পৌত্তলিকবাদ সংস্কার করতে সক্ষম হয়েছিলেন, তারা সেখানে হয়নি। ‘পৌত্তলিকতা’ ধর্মীয় অনুসন্ধানের অংশ ছিল। কারণ ঐশী সত্তা সরাসরি নিজেকে মানবীয় রূপে প্রকাশ করত না। বরং মিথ, বস্তু, ভবন, লোকজন বা মানবীয় আইডিয়া বা মতবাদের মতো নানা কিছুর মাধ্যমে নিজেকে প্রকাশ করত। ঐশী সত্তার এসব প্রতীক অপর্যাপ্ত হতে বাধ্য। কারণ এগুলো এমন এক বাস্তবতা নির্দেশ করত যা অনির্বচনীয় ও মানুষের ধারণার চেয়েও বড়। তবে ধর্মের ইতিহাস দেখাচ্ছে, লোকজনের পরিবেশ বদলে গেলে পুরনো পবিত্রতাও তাদের হয়ে কাজ করা বন্ধ করে দেয়। ওগুলো আর ঐশী সত্তা প্রকাশ করত না। বস্তুত ওগুলো তখন ধর্মীয় অভিজ্ঞতার বাধায় পরিণত হয়েছিল। এটিও সম্ভব যে লোকজন পাথর, বৃক্ষ বা মতবাদের মতো প্রতীককেই ঐশী সত্তা হিসেবে ভুল করতে পারে।

    স্পষ্টভাবেই মনে হচ্ছে, যসিয়ার সময় জুদায় এ ধরনের ধর্মীয় পরিবর্তনই হয়েছিল। তিন শ’ বছর ধরে জেরুসালেমের লোকজন কেনানের অন্যান্য ধর্মীয় প্রতীক থেকে আধ্যাত্মিক রসদ পেয়েছে। কিন্তু এখন সেগুলো ত্রুটিপূর্ণ মনে হওয়ায় অপঃশক্তি বিবেচিত হলো। পাথর-স্তম্ভের মাধ্যমে আধ্যাত্মিক বাস্তবতাকে অবলোকন করার বদলে যসিয়াহ ও হিলকিয়াহ তাতে কেবল অশ্লীলতাই দেখতে পেলেন। এতে টানাপোড়েন ছিল, পরবর্তীকালের একেশ্বরবাদী ঐতিহ্যগুলোতেও তা দৃশ্যমান হয়েছে। এই প্রত্যাখ্যান একসময় ইসরাইল রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত থাকা উত্তরাঞ্চলীয় এলাকাগুলোতে বিশেষ তীব্রতায় প্রকাশ পেয়েছিল। আসিরিয়ার এখন পতন ঘটেছে, সামেরিনা প্রদেশে তার নিয়ন্ত্রণ আর বহাল নেই। যসিয়ার অভিযান ছিল পুনর্জয়ের অংশবিশেষ। তা সম্ভবত ছিল ঐক্যবদ্ধ দাউদ রাজ্য পুনঃপ্রতিষ্ঠার প্রয়াস। কিন্তু তার সংস্কার ছিল নির্মম ও নৃশংস। যসিয়া বেথেলের প্রাচীন বেদী ধ্বংস করেন। ‘ধর্মত্যাগী’ জেরোবোয়াম এখানেই ইসরাইলের রাজকীয় মন্দিরটি স্থাপন করেছিলেন। প্রতিহিংসায় যসিয়াহ এর পাথরগুলো খুলে সেগুলো গুঁড়িয়ে দেন। তারপর বেদীটি অপবিত্র করেন কাছের কবরস্থান খুঁড়ে লাশগুলো বের করে সেখানে পুড়িয়ে দিয়ে। তিনি ইসরাইলের অন্যান্য ধর্মীয় স্থানেও একই কাজের পুনরাবৃত্তি করেন : তাদের পুরোহিতদের খুন করেন, তাদের নিজেদের বেদীতেই তাদের হাড়গুলো জ্বালিয়ে দেন। এই নির্দয়তা ও উগ্র অসহিষ্ণুতা অন্যান্য ধর্মীয় ঐতিহ্যের প্রতি ইব্রাহিমের দেখানো সৌজন্যতার সম্পূর্ণ পরিপন্থী ছিল। অন্যদের পবিত্র অধিকারের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শনের কোনো ইঙ্গিত ছিল না। নবীদের জোর দিয়ে শ্রদ্ধা প্রদর্শন ছিল সত্যিকারের ধার্মিকতার লিটমাস টেস্ট। এই চেতনার আলোকেই ডিউটারোনোমিস্ট ইতিহাসবিদেরা যওয়ার প্রশংসায় করেছিলেন। তিনি, তাদের দাবি অনুযায়ী, কেনানে তার ঈশ্বরের নামে ইসরাইলি পূর্বপুরুষদের নির্দয়ভাবে গণহত্যা চালিয়েছিলেন। দুঃখজনকভাবে এই চেতনা এরপর থেকে জেরুসালেমের আধ্যাত্মিক পরিবেশের অংশে পরিণত হয়েছিল।

    যসিয়ার সংস্কার জায়নের জন্য প্রচারণাও ছিল। তিনি পুরো ইসরাইল ও জুদার জন্য জেরুসালেমে যিহোবার একমাত্র মন্দির নির্মাণ করার করার মাধ্যমে ডিউটারোনোমিস্ট আদর্শ বাস্তবায়নের চেষ্টা চালিয়েছিলেন। এ প্রধান পবিত্র স্থানটি সুরক্ষিত করার জন্য অন্য সব পবিত্র স্থান ধ্বংস ও অপবিত্র করা হয়। যসিয়ার বেথেলের প্রতি বিশেষভাবে কঠোর হওয়ার নেপথ্যে ছিল এই কারণ যে এই রাজকীয় মন্দিরটি জেরুসালেমকে চ্যালেঞ্জ করতে সাহসী হয়েছিল। উত্তরের পুরোহিতদের হত্যা করা হলেও জুদার পল্লী এলাকার মন্দিরগুলোর পুরোহিতদের তাদের বিধ্বস্ত মন্দির থেকে সরিয়ে জেরুসালেমে নেওয়া হয়। সেখানে তারা জায়ন পুরোহিতদের নিচের সারিতে অবস্থান পান। জেরুসালেমের মহিমা অনুপ্রাণিত করছিল ধ্বংস, মৃত্যু, অবমাননা ও বাজেয়াপ্তকরণকে। ধর্মমতের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে নবীরা করুণা ও সহানুভূতির কথা প্রচার করলেও যসিয়ার সংস্কার পবিত্র নগরীর সম্মান ও অখণ্ডতাকেই সর্বোচ্চ রাখার চেষ্টা দেখা গেল।

    সংস্কার স্থায়ী হয়নি, যদিও যে চেতনার মাধ্যমে তা করা হয়েছিল তা অটুট থেকে গেলেও। ৬০৯ সালে যসিয়া পূর্ণ রাজনৈতিক স্বাধীনতা লাভের প্রয়াস চালান। এ সময় তার দেশে মিসরীয় উপস্থিতি প্রতিষ্ঠার চেষ্টাকারী ফারাও দ্বিতীয় নেচোকে আক্রমণ করেন। জুদার ও মিসরীয় সেনাবাহিনী মেগিডোতে মুখোমুখি হয়। যসিয়াহ প্রথম মোকাবিলাতেই নিহত হন। নেচো সাথে সাথেই যসিয়ারহ ছেলে (জুদার অভিজাতদের পছন্দ ছিলেন তিনি) যেহোয়াহাজকে ক্ষমতাচ্যুত করে জুদার নিয়ন্ত্রণ কঠোর করেন তার ভাই জেহোয়াকিমকে ক্ষমতায় বসিয়ে। তবে মিসরীয়রা জেরুসালেমের নিয়ন্ত্রণ বহাল রাখতে পারেনি। ৬০৫ সালে বেবিলনের রাজা নেবুচাদনেজার আসিরিয়া ও মিসরকে পরাজিত করে নিকট প্রাচ্যের সবচেয়ে পরাক্রান্ত শক্তিতে পরিণত হন। ওই এলাকার অন্যান্য রাষ্ট্রের মতো জুদাও বেবিলনের সামন্তে পরিণত হয়। প্রথমে মনে হয়েছিল, নতুন সাম্রাজ্যের অধীনে এটি সমৃদ্ধ হবে। জেহোয়াকিম যথেষ্ট আত্মবিশ্বাসী হয়ে মিসনেহ উপকণ্ঠে নিজের জন্য একটি জাঁকাল প্রাসাদ নির্মাণ করেন। কিন্তু অল্প সময়ের মধ্যেই জেরুসালেমে প্রাণঘাতী উগ্র দেশপ্রেম উপস্থিত হয়। রাজা বেবিলন থেকে বের হয়ে মিসরের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করেন। ওই সময় মিসর সেখানে ফিরে আসার চেষ্টা করেছিল। নবীরা পুরনো পন্থায় লোকজনকে আশ্বস্ত করার চেষ্টা করছিল যে জায়নে যিহোবার উপস্থিতির ফলে নেবুচাদনেজারের হাত থেকে জেরুসালেম রক্ষা পাবে, ঠিক যেমন সেন্নাচেরিবের বিরুদ্ধে হয়েছিল। এই আত্মঘাতী প্রবণতার বিরুদ্ধে থাকাদের নেতৃত্বে ছিলেন জেরেমিয়া। তিনি ছিলেন যসিয়ার সহকর্মী হিলকিয়ার ছেলে। তিনি লোকজনকে হুঁশিয়ার করে দিয়ে বলেছেন, যিহোবা যেভাবে শিলোহ ধ্বংস করেছিলেন, তিনি সেভাবে জেরুসালেমও ধ্বংস করে দেবেন। এই ব্লাসফেমির জন্য তিনি মৃত্যুদণ্ডের মুখোমুখি হন। জেরেমিয়া খালাস পেলেও আসন্ন বিপর্যয় সম্পর্কে জেরুসালেমের রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে লোকজনকে হুঁশিয়ার করে দিতে থাকেন। তারা জায়নকে পূজনীয় বস্তু হিসেবে চিহ্নিত করেছিল। তারা এটি যিহোবার মন্দির বলে যখন শ্লোগান দিচ্ছিল, তিনি তাদেরকে বারবার স্মরণ করিয়ে দেন, যিহোবা তাদেরকে রক্ষায় কেবল তখনই আসবেন যখন তারা ভিন দেশী ঈশ্বর থেকে মুখ ফেরাবে, সহানুভূতির বিধান পালন করবে, একে অন্যের সাথে নিরপেক্ষভাবে আচরণ করবে; আগন্তুক, বিধবা ও এতিমদের শোষণ করা বন্ধ করবে।

    নেবুচাদনেজা তার বিদ্রোহী সামন্তকে শাস্তি দিতে উপস্থিত হওয়ার আগেই জেহোইকিম মারা যান। তার স্থলাভিষিক্ত হন তার ছেলে জেহোয়াচিন। প্রায় সাথে সাথেই জেরুসালেমকে অবরুদ্ধ করে ফেলে বেবেলনিয়ার সেনাবাহিনী। তিন মাস পর খ্রিস্টপূর্ব ৫৯৭ সালে আত্মসমর্পণ করে জেরুসালেম। আত্মসমর্পণ করায় কোনো গণহত্যা বা নগরীকে ধ্বংস করা হয়নি। নেবুচাদনেজার নিজে টেম্পল লুণ্ঠন করেই শান্ত থাকেন, তিনি জুদার নেতৃত্বকে বেবিলনে নির্বাসিত করেন। ডিউটারোনোমিস্ট আমাদের বলছেন যে কেবল সবচেয়ে গরিবদেরই পেছনে ফেলে যাওয়া হয়েছিল। রাজা ও তার আমলাদের সাথে ১০ হাজার অভিজাত ব্যক্তি, সামরিক বাহিনী, সব কামার ও ধাতুর কারিগরকে সাথে নেওয়া হয়। নতুন কোনো বিদ্রোহ যাতে মাথাচাড়া না দেয় এবং অস্ত্র তৈরি যাতে সম্ভব না হয়, তা নিশ্চিত করতে এটি ছিল প্রাচীন সাম্রাজ্যগুলোর আদর্শ প্রক্রিয়া। কিন্তু অবিশ্বাস্যভাবে লোকজন তখনো তাদের শিক্ষা থেকে কিছুই শেখেনি। নেবুচাদনেজার সিংহাসনে জেহোইচিনের চাচা ও যসিয়ার আরেক ছেলে জেদেকিয়াকে বসান। তিনি তার শাসনের প্রায় আট বছরের সময় আবারো বেবিলনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেন। এবার কোনো করুণা করা হয়নি। জেরুসালেম অবরোধ করে বেবিলনের সেনাবাহিনী। আট মাস ধরে চলে অবরোধ। তারপর খ্রিস্টপূর্ব ৫৮৬ সালে পতন ঘটে। রাজা ও তার সেনাবাহিনী পালনোর চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু জেরিকোর কাছে ধরা পড়েন। জেদেকিয়াকে অন্ধ করে দেওয়ার আগে তার সামনে তার ছেলেদের হত্যা করা হয়। তারপর তাকে শৃঙ্খলিত করে বেবিলনে নিয়ে যাওয়া হয়। পরে বেবিলনের কমান্ডার পরিকল্পিতভাবে নগরী ধ্বংসে নিয়োজিত হন। তিনি সোলায়মানের টেম্পল, রাজপ্রাসাদ, জেরুসালেমের বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেন। টেম্পলের সব মূল্যবান আসবাবপত্র বেবিলনে নিয়ে যাওয়া হয়। আশ্চর্য বিষয়, এসবের মধ্যে আর্ক অব কোভেন্যান্টের কোনো উল্লেখ ছিল না। সেটি চির দিনের জন্য হারিয়ে গিয়েছিল। এরপর থেকেই এর ভাগ্য সম্পর্কে নানা গুঞ্জন রটে। ৪২ প্রাচীন দুনিয়ায় রাজকীয় মন্দির ধ্বংস ছিল রাষ্ট্র ধ্বংসের সমপরিমাণ ঘটনা। ওই সময়ে ধারণা করা হতো, স্বর্গের সাথে কোনো ‘কেন্দ্রের যোগাযোগ না থাকলে কোনো রাষ্ট্র টিকে থাকতে পারে না। যিহোবা বেবিলনের ঈশ্বর মারদকের হাতে পরাজিত হলেন, জুদা রাষ্ট্র আর থাকল না। ৮২৩ সালে আরো তিনটি পর্যায়ে নির্বাসন ঘটে, এতে কেবল দিনমজুর, গ্রামবাসী ও চাষীরাই নগরীতে থেকে যেতে পেরেছিল।

    নির্বাসিতদের মধ্যে জেরেমিয়া ছিলেন না। সম্ভবত তার বেবিলনিয়ান অবস্থানের কারণে তা হয়নি। একবার বিপর্যয় আঘাত হানার পর মহাপ্রলয়বাদী নবী জেরেমিয়া হন তার জনগণের স্বস্তিদাতা। অচেনা ভূমিতে যিহোবার সেবা করা নিখুঁতভাবে সম্ভব। তিনি প্রবাসে লিখেছিলেন : তাদের উচিত বসতি স্থাপন করা, উদ্যান রচনা করা, বাড়ি নির্মাণ করা, নতুন দেশে জীবন শুরু করা। কেউ আর আর্ক মিস করবে না : এর দিন শেষ হয়ে গিয়েছিল। কেউ এ নিয়ে চিন্তা করবে না, কেউ অনুশোচনা করবে না, আরেকটি তৈরি করবে না। একদিন প্রবাসীরা জেরুসালেম, জুদার শহরগুলো, উচ্চভূমি, নিম্নভূমি ও নেগেভের আশপাশের জেলায় জমি কিনতে ফিরে আসবে।৪৫ টেম্পলের ধ্বংস যিহোবার শেষ বোঝানো হতে পারত। তিনি নগরীকে রক্ষা করতে ব্যর্থ হয়েছেন। তিনি দেখিয়েছেন, তিনি জায়ন দুর্গ নিরাপদ রাখতে পারেন না। জেরুসালেম সত্যিই একটি জনহীন প্রত্যন্ত ভূমিতে পরিণত হলো। বিশৃঙ্খলার শক্তি বিজয়ী হলো, জায়ন ধর্মমতের প্রতিশ্রুতি মোহতে পরিণত হলো। কিন্তু ধ্বংস সত্ত্বেও জেরুসালেম নগরী ধর্মীয় প্রতীকে পরিণত হয়, ভবিষ্যতের জন্য আশাবাদের সঞ্চার করে।

    ⤶ ⤷
    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleছোটগল্প – মুহম্মদ জাফর ইকবাল
    Next Article বাইবেল কোরআন ও বিজ্ঞান – মরিস বুকাইলি
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Generic selectors
    Exact matches only
    Search in title
    Search in content
    Post Type Selectors
    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Our Picks

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }