Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • English Books
      • Jules Verne
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    জেরুসালেম : ওয়ান সিটি থ্রি ফেইস – ক্যারেন আর্মস্ট্রং

    মোহাম্মদ হাসান শরীফ এক পাতা গল্প727 Mins Read0
    ⤶ ⤷

    ৫. নির্বাসন ও প্রত্যাবর্তন

    ৫. নির্বাসন ও প্রত্যাবর্তন

    জেরুসালেম ও এর টেম্পল ধ্বংস ছিল কোনো কোনো দুৰ্জ্জেয় ধারণায় দুনিয়ার সমাপ্তি। যিহোবা তার নগরী ছেড়ে চলে গেছেন, জেরুসালেম পরিণত হয়েছে এমন বিরাণ পরিত্যক্ত এলাকায়, সৃষ্টির আগে অবয়বহীন যে বিশৃঙ্খলার মধ্যে এটি যেমন ছিল। নূহের আমলে পুরো দুনিয়াকে ভাসিয়ে দেওয়া বন্যার মতো এই ধ্বংস ছিল একটি সৃষ্টি বিনাশের কাজ। জেরেমিয়া যেভাবে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন, সেভাবেই জনমানবহীন এলাকায় এমনকি পাখি পর্যন্ত উড়ত না, মনে হতো অভিশাপে মহাবিশ্বের সব ব্যবস্থাই উল্টে গেছে : সূর্য ও চাঁদ আলো দেওয়া বন্ধ করে দিয়েছে, পর্বতগুলো কাঁপছে, দুনিয়ার বুকে একটি লোকও দেখা যাচ্ছে না। কবিরা টেম্পলের আঙিনা দিয়ে ছুটে চলা বেবিলনের সৈন্যদের স্মৃতি এবং সিডার প্যানেলগুলো কুঠার দিয়ে কাটার ভয়াবহ বর্ণনা স্মরণ করেছেন। তারা প্রতিহিংসার জন্য লালায়িত ছিল, স্বপ্ন দেখত পাথরে আঘাত লেগে বেবিলিয়ন শিশুদের মাথা গুঁড়িয়ে দিতে। জুদার লোকজন হাস্যম্পদে পরিণত হয় : অইহুদি জাতিগুলো উপহাস করা অবাক করা কোনো বিষয় ছিল না। তারা বিদ্রূপ করে তাদের কাছে জানতে চাইত, তোমাদের ঈশ্বর কোথায়?’ টেম্পল না থাকা মানে প্রাচীন বিশ্বে ঐশী সত্তার সাথে যোগাযোগ করার আর কোনো সম্ভাবনা রইল না। যিহোবা অদৃশ্য হয়ে গেছেন, জেরুসালেম পরিণত হয়েছে জঞ্জালে, ঈশ্বরের লোকজন বিদেশ ভূমিতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়েছে।

    নিকট প্রাচ্যে কোনো নগরী যখন ধ্বংস করা হয়, তখন জীবিতদের জন্য প্রথা ছিল ধ্বংসস্তূপে বসে মৃতদের জন্য শোকগাঁথা গাওয়া। এটি ছিল অনেকটা প্রিয় স্বজনদের অন্তেস্ট্রিক্রিয়ায় সুর করে কাঁদার মতো। জুদা ও ইসরাইলের যেসব অধিবাসী পেছনে রয়ে গিয়েছিল, তারা সম্ভবত বছরে দুবার তাদের নগরীর জন্য শোক প্রকাশ করত : একটি ভিল অ্যাভ মাসের নবম দিনে, এটি হতো ধ্বংসের বার্ষিকী উপলক্ষে। অপরটি হতো সুক্কথে, টেম্পলকে উৎসর্গ করে। একটি ঘটনায় আমরা জানি যে উত্তরাঞ্চলীয় শেচেম, শিলোহ ও সামারিয়া থেকে ৮০ ব্যক্তি মাথা কামিয়ে, জীর্ণ পোশাক পরে ধ্বংসপ্রাপ্ত নগরীতে এসেছিল। দি বুক অব লেমেন্টেশন্সে সম্ভবত এসব শোকগাঁথাই সংরক্ষণ করেছে। শোকগাঁথা গাইত প্রবীণেরা, মাটিতে শোকপ্রকাশ করার ভঙ্গিতে বসে। এসব সময় তারা চটের বস্তা গায়ে দিত, কপালে ছাই মাখত। কবিতাগুলো আমাদেরকে ওই স্থানটির জনমানব শূন্যতার একটি বিষাদময় চিত্র দেয় : যে জনবহুল নগরীর রাস্তাগুলোতে ছিল উপাসকদের ভিড়, এখন সেগুলো কেবলই ফাঁকা চত্বরে পরিণত হয়েছে, প্রাচীরগুলো ভেঙ্গে পড়েছে, বিধ্বস্ত দ্বারগুলোতে শেয়ালের বিচরণ। তবে বিলাপ ছিল বিপর্যয়ের মনোস্তাত্ত্বিক প্রভাব উস্কে দেওয়াও। এর মাধ্যমে বেঁচে থাকা লোকজন নিজেদের ধিক্কার দিত। যারা ৫৮৬ সালে মারা গিয়েছিল, তারা ছিল সৌভাগ্যবান : এখন লোকজন খাবারের খোঁজে আবর্জনায় তাদের নোখ দিয়ে আঁচড় কাটে, কোমল-হৃদয়ের নারীরা তাদের নিজেদের সন্তানদের হত্যা পানিতে ফোটায়, সুদর্শন তরুণেরা অন্ধকার মুখে, কঙ্কলসার দেহে বিধ্বস্ত রাস্তাগুলোতে হাঁটে। সর্বোপরি লজ্জার ভয়াবহ অনুভূতি বিরাজ করছিল। পবিত্র নগরী জেরুসালেম পরিণত হয়েছে অপবিত্রে। যারা এই নগরীর প্রশংসায় উচ্ছ্বসিত ছিল, তারা এখন নিন্দায় ব্যস্ত : ‘যখন সে গোংগাতে গোংগাতে নিজের মুখ সরিয়ে নিলো তার পোশাক ছিল রজঃস্রাবের রক্তে রঞ্জিত। হতাশার কথা বলার সময়ও তাদের বিলাপ বেবিলনিয়ানদের দায়ী করার মধ্যেই সীমিত থাকেনি। লেখকেরা জানতেন, ইসরাইলের লোকজনের পাপের কারণে যিহোবা এই নগরী ধ্বংস করেছেন।

    জেরুসালেম আর বাসযোগ্য ছিল না। নগরীর দক্ষিণ অংশ এতই ধসে পড়েছিল যে সেখানে থাকার মতো অবস্থা ছিল না। সাবেক জুদা রাজ্যের চরম দক্ষিণের ভূমিটি বিধ্বস্ত করেছিল ইদোমিরা। তারাই পরবর্তীকালে ইদুমিয়া রাজ্যের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছিল। ৫৮৬ সালে পেছনে রয়ে যাওয়া জুদাবাসীর বেশির ভাগই বসবাসের জন্য সামেরিনায় পাড়ি জমায় কিংবা জেরুসালেমের উত্তরে মিজপাহ, গিবেয়ন বা বেথেলে চলে যায়। বেবিলনিয়ানরা রাজা যসিয়ার সচিব গেদালিয়াহকে ওই অঞ্চলের গভর্নর হিসেবে বসায়। মিজপাহে অবস্থিত তার বাসভবন থেকে তিনি কিছুটা স্বাভাবিক অবস্থা প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেছিলেন। যেসব বহিষ্কৃত রয়ে গিয়েছিল, তাদেরকে বেবিলনিয়ানরা ভূমি দান করে দেশটি গড়ার চেষ্টা করেছিল। এসব লোক ছিল জুদার সবচেয়ে গরিব ও সবচেয়ে শোষিত অংশ। কিন্তু জুদার সাবেক রাজ্যের প্রতি আনুগত্যের এই চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছিল। ৫৮২ সালে পুরনো জেরুসালেমের যেসব অফিসার ট্রান্সর্দানিয়ায় পালিয়ে গিয়েছিলেন তারা ফিরে এসে দাউদ পরিবারের সদস্য ইসমাইয়ের নেতৃত্বে দেদালিয়া ও তার কয়েকজন সহকর্মীকে হত্যা করে। এই অভ্যুত্থান ব্যর্থ হয়। কারণ ইসমাইল নিজে তৃণমূলের লোকজনের কাছ থেকে সমর্থন লাভ করেননি। তিনি আম্মনে পালিয়ে যান। বেবিলনের ক্রোধ থেকে রক্ষা পেতে আরো কিছু রাজনৈতিকভাবে সক্রিয় লোক মিসরে পালিয়ে যায়। আমরা পরবর্তী ৫০ বছর পর্যন্ত জেরুসালেম ও জুদার ভাগ্য সম্পর্কে কিছুই জানতে পারি না।

    উচ্ছেদের যন্ত্রণা সত্ত্বেও নির্বাসিতদের জন্য অপেক্ষাকৃত সহজ সময় ছিল। বেবিলনে তারা নির্যাতিত হতো না, রাজা জেহোইচিন দরবারে থাকতেন, তিনি তার রাজকীয় পদবি বহাল রেখেছিলেন।’ নির্বাসিতরা বেবিলনের ‘মহা খাল’ চেবারের কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও আকর্ষণীয় কিছু জায়গা বসতি স্থাপন করে। এই খাল দিয়েই ফোরাত থেকে নগরীতে পানি নিয়ে আসা হতো। তারা সম্ভবত বেবিলনের স্থানগুলোর নাম হিব্রুতে অনুবাদ করেছিল। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, তেল আবিব নামে পরিচিত এলাকায় বসবাসকারী লোকজন এর নাম দেয় স্প্রিংটাইম হিল। প্রবাসীরা জেরেমিয়ার উপদেশ অনুসরণ করে বেবিলন সমাজের সাথে ভালোভাবে মিশে যায়। তাদেরকে অবাধে মেলামেশা করা, ভূমি কেনা, ব্যবসা করার অধিকার দেওয়া হয়। অনেকে দ্রুত সমৃদ্ধ ও শ্রদ্ধাভাজন বণিকে পরিণত হয়। কেউ কেউ রাজদরবারে দায়িত্ব লাভ করে। ৭২২ সালে বেবিলনে নির্বাসিতদের বংশধরদের কারো কারো সাথেও সম্ভবত তারা যোগ দিয়েছিল। কারণ বহিষ্কৃতদের একজন বাইবেলে ১০টি উত্তরাঞ্চলীয় গোত্রের সদস্যদের কথা বলেছেন।

    বেবিলন ছিল প্রচণ্ড আঘাত ও চ্যালেঞ্জ উভয়টিই। তারা যেসব নগরী থেকে এসেছিল, সেগুলোর তুলনায় বেবিলন ছিল অনেক বেশি জমকালো ও আধুনিক কসমোপলিটান। ৫৫টি মন্দির-সংবলিত বেবিলন ছিল কেনানের প্রাচীন পৌত্তলিক ধর্মের চেয়ে অনেক বেশি জটিল ধর্মীয় জগত। অবশ্য এর কিছু মিথ বিস্ময়করভাবে একই রকম ছিল। মারদুকের হাতে পরাজিত হয়েছিল যিহোবা। এখন তারা বাস করছে তার ভূখণ্ডে, এতে মনে হয়, নির্বাসিতদের অনেকের স্থানীয় বিশ্বাস গ্রহণ করাটা ছিল সহজাত বিষয়। অন্যরা সম্ভবত বেবিলনের দেব-দেবতাদের উপাসনার পাশাপাশি যিহোবার উপাসনাও করত, তাদের সন্তানদের শামেশলেদিন (ঈশ্বর) শামেশ বিচার করুন!’) বা বেলিয়াদাস (‘বেল রক্ষা করুন!’) নাম রাখত।

    ডিউটারোনোমিস্টরা ইসরাইলিদের প্রতি অনুরোধ করত তাদের সন্তানদের ঐশী নির্দেশনা শিক্ষা দিতে (ডিউটারোনোমি ৬:৭)। টেম্পলটি ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছিল, কিন্তু বেবিলনের নির্বাসনে তারা মুসার বিধানে ঈশ্বরকে খুঁজতে শিখে পবিত্র গ্রন্থকে নতুন দেবালয়ে পরিণত করেছিল।

    তবে অন্যরা তাদের প্রাচীন ঐতিহ্য আঁকড়ে থাকল।

    ডিউটারোনোমিস্টরা ৫৮৬ সালের ট্রাজেডির যৌক্তিকতা অবশ্যই উপলব্ধি করে থাকবে : পুরো সময় তারা সঠিক ছিল। জায়ন অপ্রতিরোধ্য বলে বিশ্বাস করতে জুদাবাসীদের উৎসাহ সৃষ্টিকারী পুরনো কেনানি পুরানতত্ত্ব বাস্তবে ছিল মরীচিকা। এর বদলে তারা মুসার বিধানের প্রতি মনোযোগী হতে ও জেরুসালেমের নাম শোনার আগেই ইসরাইলি জনগণের সাথে যিহোবা যে চুক্তি করেছিলেন, তা অনুসরণ করার জন্য দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানাচ্ছিল তারা। ওই বিধান বেবিলনের একীভূত হয়ে নির্বাসিতদের পরিচিতি হারানো রোধ করত। এই সময়কালে নির্বাসিতরা বিধিবিধান সঙ্কলিত ও চর্চা করে, আর সেটিই তাদের পৌত্তলিক প্রতিবেশীদের থেকে তাদের আলাদা করে রাখে। তারা তাদের ছেলে সন্তানদের খতনা করায়, সাবাতের দিন কাজ থেকে বিরত থাকে, বিশেষ খাদ্য নিয়ম গ্রহণ করে যা তাদেরকে চুক্তিবদ্ধ জাতি হিসেবে আলাদা করে। তাদের ঈশ্বরের পার্থক্য ও বিভাজনের আলোকে তারা হবে ‘পবিত্র জাতি।

    অন্যরা পুরনো পুরানতত্ত্বে স্বস্তি অনুভব করে, মনে করতে থাকে যে জায়নের প্রাচীন প্রতীক ও কাহিনীগুলো আরো ভালোভাবে তাদের পরিবেশের কথা বলে। ধর্মের ইতিহাসে দেখা যায়, সঙ্কট ও বড় ধরনের পরিবর্তনের সময় লোকজন বিশ্বাসের অনেক বেশি যৌক্তিক আকারের চেয়ে পুরানের অনুরক্ত হতেই অনেক বেশি প্রস্তুত থাকে। মনোস্তাত্ত্বিক আকারে পুরানতত্ত্ব যৌক্তিক ধারার অনেক বেশি গভীরে প্রবেশ করতে পারে, আমাদের সত্তার দূরতম প্রান্ত পর্যন্ত বিষাদের অস্পষ্ট কারণকে স্পর্শ করতে পারে। আমাদের যুগে আমরা দেখেছি, নির্বাসন কেবল ঠিকানা পরিবর্তন নয়, বরং তাতে আরো বড় কিছু সম্পৃক্ত থাকে। এটি আধ্যাত্মিক স্থানান্তরও বটে। বিশ্বে তাদের অনন্য স্থানটি হারিয়ে প্রবাসীরা শূন্যে নিক্ষিপ্ত হয়, হঠাৎ করে অচেনা বিশ্বে হারিয়ে গেছে- এমনটা অনুভব করে। একবার যখন ‘বাড়ি’র নির্ধারিত অবস্থানটি চলে যায়, তবে নিজস্বতার মৌলিক অভাবে সবসিছুই তুলনামূলক ও লক্ষ্যহীন মনে হতে থাকে। নিজেদের সংস্কৃতি ও পরিচিতির শিকড় থেকে বিচ্ছিন্ন হলে লোকজনের মনে হয়, তাদের প্রাণরস শুকিয়ে গেছে, তারা গৌণ হয়ে পড়েছে। এ কারণে ফরাসি নৃবিজ্ঞানী আর পি ট্রিফলস উল্লেখ করেছেন, গ্যাবন পিগমিরা তাদের পৈত্রিক ভূমি ত্যাগ করার পর তাদের মনে হয়েছিল, পুরো মহাবিশ্ব ঝামেলায় পড়ে গেছে। তাদের স্রষ্টা তাদের প্রতি ক্রুদ্ধ হয়েছেন, বিশ্ব পরিণত হয়েছে অন্ধকার স্থানে – রাত ও আবার রাত- এবং তাদের নির্বাসন তাদের পূর্বপুরুষদের আত্মারও উচ্ছেদ ঘটিয়েছে। তারা এখন দূরে অপ্রবেশ্য স্থানে হারিয়ে গিয়ে স্থায়ীভাবে বিচ্যুত হয়ে গেছে।

    তারা কি নিচে, আত্মারা, তারা কি সেখানে আছে?
    তারা কি উৎসর্গ দেখতে পান?
    আগামীকাল নগ্ন ও শূন্য।
    স্রষ্টার আর আমাদের সাথে নেই
    তিনি আর আগুনে আমাদের সাথে বসবেন না।’

    আবাসভূমি হারানো মানে জীবনকে একমাত্র সমর্থন জোগানো শক্তি স্বর্গের সাথে সংযোগ হারিয়ে ফেলা। ষষ্ট শতকে জুদার নির্বাসিতরা এটিই প্রকাশ করেছে এই বলে যে তাদের বিশ্বের সমাপ্তি ঘটেছে।

    যারা যিহোবাবাদের প্রতি অনুগত থেকে গিয়ে তাদের পূর্বপুরুষদের ঐতিহ্য বহাল রাখার ইচ্ছা প্রকাশ করেছিল, তারা মারাত্মক সমস্যায় পড়েছিল। নির্বাসিতদের যখন জিজ্ঞাসা করল, ‘অচেনা ভূমিতে আমরা কিভাবে যিহোবার ভজন গাইব?১২ তারা তখন কেবল তাদের গৃহকাতরতাই প্রকাশ করছিল না, বরং সেইসাথে তাদের ধর্মতাত্ত্বিক দোটানাজনিত সমস্যার কথাও উল্লেখ করেছিল। এখনকার ধর্মীয় লোকজন বিশ্বাস করে, দুনিয়ার যেকোনো জায়গায় তথা মাঠ, সুপারমার্কেট, কিংবা চার্চে- সব স্থানেই তারা তাদের ঈশ্বরের সাথে সংযোগ স্থাপন করতে পারে। কিন্তু প্রাচীন বিশ্বে আমাদের ধরনের প্রার্থনা মোটেই অভিন্ন ছিল না। নির্বাসনে জুদার লোকজন তাদের হাত উঠিয়ে জেরুসালেমের দিকে মুখ ঘুরিয়ে কোরবানির (তখন দেবতার কাছে যাওয়ার এটিই ছিল স্বাভাবিক পথ) বদলে নিয়মনিষ্ঠভাবে যিহোবার প্রশংসা বা তার প্রতি সনির্বন্ধ আকুতি জানাত। ১৩ এই ধরনের প্রার্থনা ছিল মহৎ ধারণা। তবে তা প্রথম বহিষ্কৃতদের মধ্যে অবধারিতভাবে প্রচলিত হয়নি। নির্বাসিতরা এক্সিয়াল যুগের আরো গভীর আধ্যাত্মিকতা শিখিয়েছিল জুদাবাসীদের। ৫৯৭ সালে নির্বাসিতরা যখন প্রথম বেবিলনিয়ায় পৌছাল, তখন তারা সম্ভবত মনে করেছিল, তাদেরকে যিহোবার উপস্থিতি থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। তার আবাস ছিল জায়নে, তারা তার জন্য বেবিলনে কোনো মন্দির নির্মাণ করতে পারছিল না, যেভাবে আমরা চার্চ, সিনাগগ বা মসজিদ নির্মাণ করি। কারণ ডিউটারোনোমিস্ট আদর্শ অনুযায়ী ইসরাইলের জন্য একটিমাত্র বৈধ উপাসনালয় ছিল, আর তা হলো জেরুসালেম। গ্যাবন পিগমিদের মতো এই নির্বাসিতরাও এই অদ্ভূত নগরীতে তাদের স্রষ্টা তাদের সাথে আছেন কিনা তা ভাবত। এ যাবত কাল পর্যন্ত যিহোবার প্রকাশের সাথে সম্পৃক্ত এই স্থান বা এ ধরনের অন্য কোনো স্থানেই তারা সম্প্রদায়গত প্রার্থনার করত। কিন্তু বেবিলনিয়ার যিহোবাবাদী দর্শন স্থান হিসেবে পরিচিত কোনো জায়গা ছিল না।

    তারপর অপ্রত্যাশিতভাবে যিহোবা তেল আবিবে আবির্ভূত হয়েছিলেন। ৫৯৭ সালে বেবিলনে আগত প্রথম ব্যাচের নির্বাসিতদের মধ্যে ছিলেন পুরোহিত এজেকেল। প্রথম পাঁচ বছর তিনি তার বাড়িতে একাকী অবস্থান করেন, আত্মার সাথে কোনো কথা বলেননি। পরে আক্ষরিকভাবেই যিহোবার অবাক করা স্বপ্ন দেখেন। এটি তাকে পুরো সপ্তাহ বিহ্ববল করে রাখে। উত্তর থেকে একটি আলোর মেঘ আসতে দেখেছিলেন তিনি। এর মধ্যেই তিনি চারটি দৈব প্রাণীকে একটি বিশাল চ্যারিয়ট নামাতে দেখেন। এসব প্রাণি বেবিলনের প্রাসাদফটকে মুদ্রিত স্বাগত চিহ্নের মতোই ছিল। এজেকেল এই আবির্ভাব বর্ণনা করার সময় স্বাভাবিক শব্দ ও ধারণা বাইরে বের হওয়ার যন্ত্রণা অনুভব করেছিলেন। তিনি যা দেখেছিলেন তা ছিল ‘সেই পাত্রের ওপরে সিংহাসনের মতো একটা কিছু একটা… সেই সিংহাসনে মানুষের মতো একজনকে বসে থাকতে দেখেছেন।’ প্রবল ঝড়, আগুন আর প্রচণ্ড শব্দের মধ্যে এজেকেল জানতেন যে তিনি চোখের পলকে যা দেখেছেন তা ছিল ‘যিহোবার গৌরবের মতো দেখতে কোনো কিছু।’ ১৪ ইসাইয়ার মতো এজেকেলও অস্বাভাবিক বাস্তবতার জ্যোতির্বলয় দেখেছিলেন, যা ছিল টেম্পলের প্রতীকের পেছনে। যিহোবার নশ্বর সিংহাসন আর্ক অব কভেন্যান্ট তখনো জেরুসালেমের টেম্পলে ছিল, তবে তার ‘গৌরব’ বেবিলনে এসে পৌঁছেছে। এটি ছিল সত্যিই ‘প্রকাশ’, একটি উন্মোচনকারী। সোলায়মানের টেম্পলে দেভির থেকে হেখালকে আলাদাকারী মহা পর্দা মানব ধারণার দূরতম সীমার প্রতিনিধিত্ব করত। এখন ওই পর্দা একদিকে টেনে আনা হয়েছে। এজেকেল যদিও যিহোবা ও তার গৌরবের মধ্যে পার্থক্য করেছেন, কিন্তু তার উপস্থিতির প্রকাশকে মানুষের কাছে বোধ্য পবিত্রতার অনির্বাচনীয় বাস্তবতায় পরিণত করেছিল। এই স্বপ্ন প্রাচীনতর ধর্মতত্ত্বকে নতুন করে গড়ে দিয়েছিল। একেবারে প্রাচীন সময়ে ইসরাইল ঈশ্বরকে চলমান হিসেবে দেখেছিল। তিনি দৈবপ্রাণিদের পাখায় ভর করে সিনাই থেকে কেনানে তার লোকজনের কাছে এসেছিলেন। এখন দৈবপ্রাণি তাকে নির্বাসিত লোকজনের কাছে নিয়ে এসেছে। তিনি টেম্পল বা প্রতিশ্রুত ভূমিতে আবদ্ধ নন, যেমন অনেক পৌত্তলিক ঈশ্বর বিশেষ ভূখণ্ডের সাথেই জড়িত থাকেন।

    অধিকন্তু যিহোবা এখনো জেরুসালেমে বসবাসকারী জুদাবাসীদের সাথে না থেকে নির্বাসিতদের সাথে থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এজেকেল ৫৯২ সালের দিকে এই স্বপ্নাবিভাব দেখেছিলেন। এর ছয় বছর আগে নেবুচাদনেজার নগরীটি ধ্বংস করেছিলেন। তবে পরে এক স্বপ্নাবিভাবে তিনি উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন যে জেরুসালেম ধ্বংস হওয়ার কারণ হলো, বিপর্যয়ের প্রান্তে থেকেও জুদাবাসীরা তাদের বাড়ি ফিরে তখনো অন্যান্য দেবতার উপাসনা করছিল এবং যিহোবার সাথে করা তাদের চুক্তির কথা ভুলে গিয়েছিল। একদিন তেল আবিবে নিজের বাড়িতে এজেকেল জুদার নির্বাসিত প্রবীণদের সাথে বসা অবস্থায় ‘প্রভু যিহোবার হাত তার ওপর নেমে এসে তাকে আধ্যাত্মিকভাবে জেরুসালেমে নিয়ে গেল। তাকে টেম্পলে নিয়ে যাওয়া হলো, তিনি সেখানে আতঙ্কিতভাবে দেখলেন, লোকজন ঐশী স্থানগুলোতে বিদেশি ঈশ্বরদের সামনে নত হয়ে আছে। তিনি বলেন, এসব ‘নোংরা প্রথা’ যিহোবাকে তার আবাস থেকে সরে আসতে বাধ্য করেছে। ইজেকেল দেখতে পান যে ঐশী প্রাণিটি তার পাখা বিস্তার করে বিশাল চ্যারিয়ট-সিংহাসনকে চালাতে শুরু করে, ‘যিহোবার গৌরবকে’ জেরুসালেম নগরীর বাইরে নিয়ে গিয়ে মাউন্ট অব অলিভেসের ওপর দিয়ে নগরীর পূর্ব দিকে অদৃশ্য হয়ে যান যিহোবা। তিনি এর বদলে নির্বাসিত সম্প্রদায়ের সামনে আসার সিদ্ধান্ত নেন। এখন যিহোবা আর জায়নে বাস করছেন না, জেরুসালেমের ধ্বংস এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র।*

    তবে নবীকে যিহোবা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, একদিন তিনি তার নগরীতে ফিরে যাবেন, মাউন্ট অব অলিভেসের একই পথ ধরে চলবেন, মাউন্ট জায়নে আবার তার আবাস প্রতিষ্ঠা করবেন। তখন নতুন এক্সোডাস হবে, ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা নির্বাসিতদের বাড়িতে ফিরিয়ে আনা হবে, নতুন এক সৃষ্টির কারণে বিচ্ছিন্ন পতিত ভূমি ‘ইডেনের উদ্যানের মতো’ স্থানে পরিণত হবে। তখন হবে নিরাময় ও একীভূত হওয়ার সময় : জুদা ও ইসরাইল এক দাউদীয় রাজার অধীনে আবার ঐক্যবদ্ধ হবে, যিহোবা তার লোকজনের মধ্যে বাস করবেন।১৬ এটা হবে বিচ্ছিন্নতা, একাকিত্ব ও অনাচারের অবসান এবং লোকজন যে মূল সামগ্রিকতার আকাঙ্ক্ষা করে তাতে প্রত্যাবর্তন। এই স্বপ্নাবিভাবের কেন্দ্রে ছিল জেরুসালেম। নেবুচাদনেজারের নগরীটি ধ্বংস করার প্রায় ১৪ বছর পর এজকেল বা তার অন্য কোনো শিষ্য যিহোবা শ্যাম নামের ‘খুবই উঁচু পর্বতের উপর’ একটি নগরীর স্বপ্নাবিভাব স্বপ্নদর্শন করেন : ‘যিহোবা আছেন সেখানে।’ নগরীটি ছিল নশ্বর স্বর্গ। এই স্থানটি পুরনো ধারণায় শান্তি ও উর্বরতাসম্পন্ন। পানির ধারা যেভাবে ইডেন উদ্যানের মধ্য দিয়ে বয়ে চলে এবং নিচের দিকে প্রবাহিত হয়ে বাকি দুনিয়াকে বলবতী করে তোলে, ইজেকেলও নগরীর টেম্পলের নিচ থেকে একটি নদী বের হয়ে পবিত্র স্থান ও আশপাশে জীবন প্রবাহিত হতে দেখেন। এই নদীর তীরজুড়ে এমন সব গাছ জন্মায় যেগুলোর ‘পাতা কখনো শুকায় না, ফল কখনো ঝরে পড়ে না, এসব ফল খেতে ভালো, পাতার রয়েছে ঔষুধি গুণ। নির্বাসিতরা বিচ্ছিন্নতা ও স্থানচ্যুতির বেদনা বরণ করায় তারা যেখানে ছিল বলে কল্পনা করত, সেখানে ফিরে যাওয়ার প্রাচীন পুরানতত্ত্বের আশ্রয় গ্রহণ করেছিল।

    ইজেকেল কেবল অতীতকেই আঁকড়ে ছিলেন না, তিনি ভবিষ্যতের জন্য নতুন স্বপ্নাবিভাবের অবয়বও গড়ে দেন। তিনি যিহোবা শ্যাম নগরীর কথা ভাবার সময় নতুন একটি ঐশী ভূগোল সৃষ্টি করেছিলেন। নগরীর মাঝখানে থাকা টেম্পলটি ছিল বর্তমানে ধ্বংসপ্রাপ্ত সোলায়মানের টেম্পলের প্রতিকৃতি। এর হলরুম (উলাম), কাল্ট হল (হেখাল) ও অভ্যন্তরীণ পবিত্র স্থান (ডেভির) ঐশী সত্তার বিভিন্ন পর্যায়ের বিভাজনের প্রতিনিধিত্ব করত : প্রতিটি জোন ছিল শেষেরটি থেকে বেশি পবিত্র।১৯ প্রাচীন কালের ধারণা অনুযায়ী ঐশী সত্তা কেবল পর্যায়ক্রমে সামনে আসতে পারে, আর সবাইকে ঐশী সত্তার অভ্যন্তরীণ স্তরে যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হতো না। এই ধারণাটি এজেকেলের স্বপ্নাবিভাবের প্রধান বিষয়ে পরিণত হয়েছিল এবং আদর্শ বিশ্ব নিয়ে তার নতুন মানচিত্রের ভিত্তি হয়েছিল। অবশ্য দুটি গুরুত্বপূর্ণ দিক দিয়ে টেম্পলটি সোলায়মানেরটির চেয়ে ভিন্ন ছিল। রাজার প্রাসাদটি এখন আর টেম্পলের লাগোয়া ছিল না, টেম্পল ভবনরাজি এখন দুটি প্রাচীরঘেরা অংশে বিভক্ত। ২০ যিহোবার ঐশী সত্তা হয়ে পড়ে না-পাক দুনিয়া থেকে আগের চেয়ে অনেক বেশি সতর্কভাবে বিভক্ত। ঈশ্বর পরিণত হন আরো বেশি পরাবাস্তব বাস্তবতা, দুনিয়াবি অস্তিত্বের বাকি অংশ থেকে চরমভাবে আলাদা (কাদশ)। প্রথম বাইবেল লেখক জে কল্পনা করেছেন যিহোবা বন্ধু হিসেবে ইব্রাহিমের পাশে বসে তার সাথে কথা বলেছেন। কিন্তু এক্সিয়াল যুগের মানুষ ইজেকেলের কাছে ঐশী সত্তা ছিলেন মানুষকে ছাপিয়ে যাওয়া বিপুল রহস্য। ঐশী বাস্তবতার অপরিহার্য ‘অন্যত্রতা’ হলেও এটি ছিল নারী-পুরুষের বিশ্বের কেন্দ্রবিন্দু এবং তাদের জীবন ও শক্তির উৎস- এমন এক বাস্তবতা যা স্বর্গীয় নদীর মাধ্যমে এজেকেলের দর্শনকে প্রতীকীভাবে ফুটিয়ে তুলেছে। ইজেকেল এখন প্রতিশ্রুত ভূমিকে এমনভাবে বর্ণনা করেন যা তার আঞ্চলিক ভূগোলের সাথে সম্পর্কহীন। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, জেরুসালেম নগরীর বিপরীতে যিহোবা শ্যাম ছিল ভূমিটির একেবারে কেন্দ্রে। এটি ছিল ইসরাইল ও জুদার যৌথ রাজ্যের এ যাবতকালের চেয়ে অনেক বড়, উত্তরে পালমিয়ার ও পশ্চিমে মিসরের ব্রুক পর্যন্ত বিস্তৃত।২১ ইজেকেল তার আবাসভূমিকে আক্ষরিকভাবে বর্ণনা করার চেষ্টা করেননি, বরং তিনি আধ্যাত্মিক বাস্তবতার একটি চিত্র সৃষ্টি করছিলেন। ঐশী শক্তি যিহোবা শ্যাম থেকে বিচ্ছুরিত হয়ে কয়েকটি ঘনীভূত বৃত্তে (প্রতিটিই তার উৎস থেকে দূরে যাওয়ার সময় হালকা হচ্ছিল) ইসরাইলের ভূমি ও জনগণের দিকে ছড়িয়ে পড়েছিল। টেম্পলটি ছিল বিশ্বের বাস্তবতার কেন্দ্র, পরের জোনটি ছিল একে ঘিরে রাখা নগরীটি। নগরী ও টেম্পলের চারপাশে ছিল বিশেষ ক্ষেত্র, যেখানে ছিলেন পবিত্র ব্যক্তিরা তথা রাজা, পুরোহিত ও লেভি গোত্রের লোকজন। এই এলাকটি ছিল ইসরাইলের ১২টি গোত্রের বাকিদের অধিকারে থাকা অবশিষ্ট স্থানের চেয়েও পবিত্র। এই পবিত্র স্থানের বাইরে ছিল বাকি বিশ্ব, তা দখলে ছিল বাকি জাতিগুলোর (গোয়িম)।২২ ঈশ্বর যেমন অন্য সব সত্তা থেকে চরমভাবে আলাদা, ইসরাইল ঠিক তেমনই। ঈশ্বরকে ঘিরে থাকা পবিত্র জাতি অবশ্যই তার পবিত্র বিচ্ছিন্নতার অংশ, পৌত্তলিক দুনিয়া থেকে আলাদা বাস করেন। এই ধরনের জীবনের একটি ছবিই নির্বাসনে থাকা অনেকে বেবিলনে নিজেদের মধ্যে প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিল।

    নশ্বর জেরুসালেমের নক্সা হিসেবে ইজেকেল এই স্বপ্নবিভাবের কথা চিন্তা করেছিলেন কিনা তা আমরা জানি না। এটি ছিল স্পষ্টভাবেই স্বর্গরাজ্য : এই পর্যায়ে নগরী, টেম্পল ও বেশির ভাগ এলাকা ছিল বিধ্বস্ত, আবার এসব নির্মিত হওয়ার কোনো আশা ছিল না। ইজিকেলের মডেলটি ধ্যান করার স্থান হিসেবে নক্সা করা হয়ে থাকতে পারে। তার রহস্যজনক স্বাপ্নিক গাইড যখন তাকে এই নতুন মন্দিরটি প্রদর্শন করেনছিলেন, তিনি তাকে জানাননি কিভাবে পরবর্তী টেম্পলটি নির্মাণ করতে হবে। স্বপ্নাবিভাবটি ছিল আরেকটি বিষয় :

    হে মানবসন্তান, ইসরাইল পরিবারকে ওই মন্দির সম্পর্কে বলো। তাহলে যখন তারা ওই মন্দিরের পরিকল্পনা সম্পর্কে জানবে তখন তারা তাদের পাপ সম্পর্কে লজ্জিত হবে। তারা ওই মন্দিরের নক্সা সম্পর্কে জানুক। জানুক কিভাবে তা গড়া যাবে, প্রবেশদ্বার ও প্রস্থানদ্বার কোথায় সে সব এবং মন্দিরের সব নক্সাই জানিয় দাও। ২৩

    তারা নির্বাসনে জেরুসালেমের মতো করে নিজেদের মধ্যে যিহোবাকে নিয়ে বাস করতে চাইলে বলা যায়, জুদাবাসী নির্বাসনকে ঐশী জোনে পরিণত করে নিতে হতো। গোয়িমের সাথে কোনো বিপজ্জনক ভ্রাতৃত্বপূর্ণ সম্পর্ক থাকতে পারবে না, মারদুক ও অন্যান্য ভ্রান্ত ঈশ্বরের সাথে দহরম-মহরম চলবে না। ইসরাইল পরিবারকে অবশ্যই নিজেকে ঈশ্বরের, যিনি তাদের মধ্যে বসবাসের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, পরিবার হিসেবে তৈরি করে নিতে হবে। এই আদর্শগত মতালম্বী মানচিত্র নিয়ে গভীর ভাবনার মাধ্যমে ইসরাইলিরা প্রকৃতি ও পবিত্রতার অর্থ জেনেছিল, যেখানে প্রতিটি ব্যক্তি ও বস্তুর তার স্থান রয়েছে। তাদেরকে অবশ্যই তাদের জীবন ও নতুন চিন্তাধারার একটি কেন্দ্র খুঁজে নিতে হবে। এটি বেবিলনে প্রান্তিক হয়ে পড়া নির্বাসিতদের জন্য সান্ত্বনার কারণ হবে, যাতে তারা বুঝতে পারে যে তারা তাদের পৌত্তলিক প্রতিবেশীদের চেয়ে, এমনকি মানচিত্রে না-থাকাদের চেয়ে, অনেক বেশি বাস্তবতার কাছাকাছি আছে। উচ্ছেদ হওয়া লোকজনকে এই নতুন ভাষ্য খুঁজে নিতে হয়েছিল, যেখানে তারা সত্যিই গভীরভাবে অস্বস্তি কাটাতে পারে।

    আমরা নির্বাসনের শুরুতে ‘প্রিস্টলি রাইটিংস’ (‘পি’) পরীক্ষা করার সময় এই পবিত্র জীবনযাত্রা সম্পর্কে কিছুটা পরিষ্কার ধারণা পাব। পি’র পেন্টাটিউক (বাইবেলের প্রথম পাঁচটি গ্রন্থ) জুড়ে পি’র বক্তব্য দেখা গেলেও বিশেষভাবে দৃশ্যমান হয় লেভিটিকাস ও নাম্বার্সে। পি পুরোহিতোচিত দৃষ্টিকোণ থেকে ইসরাইলের ইতিহাস নতুন করে লিখেছিলেন। ইজেকেলের সাথে তার অনেক মিল ছিল। মনে রাখতে হবে, ইজেকেলও ছিলেন পুরোহিত। পি যখন মরুভূমিতে ইসরাইলিদের ঘুরে বেড়ানো ও তাদেরকে মাউন্ট সিনাইয়ে ঈশ্বরের দেওয়া বিধান সঙ্কলিত করার কথা বর্ণনা করেন, তখন তিনি পবিত্রতার ক্রমবিভক্ত জোনের একই ধরনের ধারা কল্পনা করেছিলেন। তাবেরন্যাকলের বুনো এলাকায় ইসরাইলি শিবিরের কেন্দ্রে ছিল আর্ক অব কভেন্যান্ট ও যিহোবার ‘গৌরব’ ধারণ করা তাঁবু মন্দির। এটি ছিল পবিত্রতম এলাকা এবং সর্বোচ্চ পুরোহিত হারুনেরই কেবল ‘হলি অব হলিসে’ প্রবেশ করার অনুমতি ছিল। শিবিরটিও ছিল পবিত্র। এর মধ্যে ঐশী ‘উপস্থিতি’ থাকায় একে সব ধরনের দূষণ থেকেও শুদ্ধ রাখতে হতো। শিবিরের বাইরে ছিল মরুভূমির ঈশ্বরহীন এলাকা। পিও যিহোবাকে চলমান ঈশ্বর হিসেবে দেখেছিলেন। বহনযোগ্য মন্দিরে তিনি অব্যাহতভাবে তার লোকজনের সাথে চলতেন। জেরুসালেমের কথা একবারও উল্লেখ করেননি পি। এর আংশিক কারণ ইসরাইলিরা প্রতিশ্রুতি ভূমিতে প্রবেশের কিছুটা আগে এবং রাজা দাউদের নগরীটি দখলের অনেক আগে তার লেখা শেষ হয়েছে। তবে ডিউটারোনোমিস্টদের বিপরীতে পি সম্ভবত যিহোবা তার নাম জুড়ে দেবেন, এমন বিশেষ ‘স্থান’ কল্পনায় দেখতে পাননি। পি’র স্বপ্নাবিভাবে যিহোবার কোনো নির্দিষ্ট আবাস ছিল না : ‘তার ‘গৌরব’ যাওয়া আসা করে, আর তার ‘স্থান’ হয় সম্প্রদায়ের মধ্যে। পির মতে, যিহোবা যখন ইসরাইলে বাস করতে আসেন, তখনই তারা একটি জাতিতে পরিণত হয়েছিল। তিনি বিশ্বাস করতেন, সঙ্গে থাকা এই ‘উপস্থিতি’ বিধানের মতোই গুরুত্বপূর্ণ : তিনি তাওরাত নাজিল করার সময়েই যিহোবাকে তার বহনযোগ্য ট্যাবারন্যাকলকে মাউন্ট সিনাইয়ে মুসার কাছে প্রকাশ করার পরিকল্পনা করেছিলেন। এখানেও ছিল পি’র দুর্ভোগের মধ্যেও স্বস্তিদায়ক স্বপ্নাবিভাস : এটি নির্বাসিতদের এই আশ্বাস দেয় যে তারা যেখানেই যাক না কেন, এমনকি নির্বাসনে গেলেও, যিহোবা তাদের মধ্যেই আছেন। তিনি কি ইতোমধ্যেই সিনাইয়ের নিস্ফলা নির্জন এলাকায় তাদের সাথে চলে আসেননি?

    জেরুসালেমের পুরোহিতদের সম্ভবত সবসময়ই তাদের নিজস্ব গুপ্ত বিধান ছিল : পির ইতিহাস বর্ণনা ছিল এটি জনপ্রিয় করার ও সাধারণ মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়ার প্রয়াস। কারণ তাদের পুরনো বিশ্ব নেবুচাদনেজারের হাতে ধ্বংস হয়ে যাওয়ায় নির্বাসিতদেরকে নতুন আরেকটি দুনিয়া নির্মাণ করতে হচ্ছিল। পির স্বপ্নাবিভাবের কেন্দ্রে ছিল সৃষ্টি, তবে তিনি পুরনো যুদ্ধ মিথ আবার সামনে নিয়ে আসেন। এটি মন্দিরগুলোর সাথে প্রবলভাবে সম্পৃক্ত ও ঐশী সত্তার স্থানগুলোর সাথে যুক্ত ছিল। এসব কাহিনীর নির্যাসের দিকে মনোনিবেশন করার বদলে তিনি মহাবিশ্ব সৃষ্টির জন্য বিশৃঙ্খলাকে নির্দেশ দিচ্ছিলেন। জেনেসিসের প্রথম অধ্যায়ে পির সৃষ্টি ভাষ্যে যিহোবা সমুদ্র দানব লেভিয়াথানের সাথে প্রাণঘাতী যুদ্ধ ছাড়াই বিশ্বকে নিয়ে এসেছিলেন। এর বদলে তিনি সৃষ্টির আদি অবস্থায় অনেক থেকে একটি উপাদানকে শান্তিপূর্ণভাবে আলাদা করেছিলেন। এর মাধ্যমে তিনি দিন থেকে রাতকে, অন্ধকার থেকে আলোকে, শুষ্ক ভূমি থেকে সাগরকে আলাদা করেছিলেন। সীমারেখা টেনে মহাবিশ্বের প্রতিটি উপাদানকে তার নির্দিষ্ট স্থান প্ৰদান করা হয়। একই ধরনের বিভাজন ও সৃষ্টিব্যবস্থা পি’র বর্ণনায় তাওরাতে পাওয়া যায়। গোশত থেকে দুধকে কিংবা সপ্তাহের বাকি দিনগুলো থেকে সাবাথকে আলাদা করার জন্য ইসরাইলিদের যখন নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল, তখন তারা সময়ের শুরুতে যিহোবার সৃষ্টিশীল পদক্ষেপের অনুকরণ করছিল। এটি ছিল নতুন ধরনের শাস্ত্রাচার ও ঈশ্বর সম্পর্কে মানুষের উপলব্ধি। এই ধারণায় টেম্পল বা দীর্ঘ ভজনের দরকার হয় না। বরং নারী ও পুরুষ তাদের দৈনন্দিন জীবনে অকাল্পনিক ব্যবস্থার মাধ্যমেই তা করতে পারে। ঐশী সৃষ্টিশীলতার শাস্ত্রীয় পুনরাবৃত্তির মাধ্যমে তারা নতুন একটি দুনিয়া নির্মাণ করছিল, নির্বাসিত জীবনে তাদের বিচ্ছিন্নতা ও আলাদা হয়ে যাওয়ার বিষয়টিকে শৃঙ্খলায় আনতে চেয়েছিল।

    অনেক কম্যান্ডমেন্ট (মিতজভোথ) তাদের সঠিক পথে রাখার সাথে সম্পর্কিত। নৃতত্ত্ববিদ মেরি ডগলাস দেখিয়েছেন, পুরোহিতদের কোডে ‘অচ্ছুত’ তকমা লাগানো সত্তা ও বস্তুগুলো তাদের যথাযথ শ্রেণি থেকে বের হয়ে এসেছে, তাদের নিজস্ব নয়, এমন এলাকাকে আক্রান্ত করেছে। ‘নোংরা’ হলো ভুল স্থানে রাখা কিছু জিনিস। এগুলো যিহোবার মন্দিরের কোনো অচেনা ঈশ্বর হতে পারে বা পোশাকে ছত্রাক হতে পারে, এমন কিছুও হতে পারে যা প্রকৃতির দুনিয়ায় ফেলে রাখা হয়েছে এবং মানুষের রাজ্যে অনুপ্রবেশ ঘটিয়েছে। সবকিছুর মধ্যে মৃত্যু হলো সবচেয়ে বড় অশুদ্ধতা। কারণ এটি সংস্কৃতি ও বিশ্বকে নিয়ন্ত্রিত ও ব্যবস্থাপনা করতে আমাদের অক্ষমতার কথাই সবচেয়ে নাটকীয়ভাবে মনে করিয়ে দেয়। ২৪ সুবিন্যস্ত মহাবিশ্বে বসবাস করার মাধ্যমে ইসরাইলিরা ইজেকেলের কল্পনায় থাকা এক দুনিয়া নির্মাণ করেছিল। এই দুনিয়ায় তাদের কেন্দ্রে অবস্থান করেন ঈশ্বর। টেম্পল জেরুসালেমে দাঁড়িয়ে থাকলেও এটি তাদেরকে পবিত্রতায় প্রবেশের সুযোগ দেয়। যিহোবার স্বর্গীয় উদ্যানের মধ্য দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় তার সাথে আদম ও হাওয়া যেমন ঘনিষ্ঠতা উপভোগ করতেন, এখন মিতজভোকও তা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হলো। মিতজভোথের মাধ্যমে নির্বাসিত জুদাবাসীরা নতুন একটি পবিত্র স্থান সৃষ্টি করতে পেরেছিল, যা বিভ্রান্তি ও বিশৃঙ্খলার ব্যতিক্রমকে দূরে রাখে। তবে পি স্রেফ শাস্ত্রীয় বিশুদ্ধতা নিয়ে সংশ্লিষ্ট ছিলেন না। তার হলিনেস কোড ছিল অন্যান্য মানুষের প্রতি আচরণের সাথে সম্পর্কিত মিতজভোথের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। প্রার্থনার বিধান ও পবিত্র ভূমিতে কৃষির পাশাপাশি নিম্নোক্ত ধরনের কঠোর নির্দেশও ছিল :

    তোমরা অবশ্যই চুরি করবে না। তোমরা অবশ্যই লোকদের ঠকাবে না…

    বিচারের ব্যাপারে তোমরা অবশ্যই পক্ষপাতহীন হবে। তোমরা অবশ্যই গরিব মানুষের প্রতি বিশেষ পক্ষপাতিত্ব দেখাবে না। এবং তোমরা অবশ্যই অতি গুরুত্বপূর্ণ লোকদেরও বিশেষ সম্মান দেখাবে না…

    তোমরা তোমাদের ভাইকে অবশ্যই মনে মনে ঘৃণা করবে না। যদি তোমাদের প্রতিবেশী ভুল করে, তাহলে তার সাথে সে বিষয়ে কথা করো, কিন্তু তাকে ক্ষমা করো; তাহলে তুমি তার দোষের ভাগীদার হবে না। তোমার প্রতি লোকেরা খারাপ ইসরাইলে কিছু করেছে, তা ভুলে যেও; প্রতিশোধ নেওয়ার চেষ্টা করো না। তোমাদের প্রতিবেশীকে নিজেদের মতো করে ভালোবাসো। ২৫

    তোমাদের দেশে বাস করা বিদেশীদের প্রতি খারাপ ব্যবহার করবে না। তোমাদের নিজেদের নাগরিকদের মতোই বিদেশীদের প্রতি সমান ব্যবহার করবে। তোমাদের নিজেদের যেমন ভালোবাসো, বিদেশীদের তেমনি ভালোবাসবে। কারণ, একসময় তোমরা মিসরে বিদেশী ছিলেন। ২৬

    সামাজিক ন্যায়বিচার সবসময়ই পবিত্র স্থানের প্রতি নিবেদন ও মন্দির শাস্ত্রাচারের সহগামী। শাস্ত্রাচারের মধ্যে ছিল কেনানি মিথ, জায়ন মতবাদ ও নবীদের দৈববাণী। পি আরো বলেন : কেবল ন্যায়বিচার নয়, ভালোবাসাও থাকতে হবে এবং এই সমবেদনা অবশ্যই ইসরাইল পরিবারের অন্তর্ভুক্ত নয় এমন লোকদের পর্যায় পর্যন্ত সম্প্রসারিত হতে হবে। গোয়িম হয়তো পবিত্রতার ইজেকেলের মানচিত্রে ছিল না, কিন্তু তারা অবশ্যই ইসরাইলের ভালোবাসা ও সামাজিক বিষয়াদির চৌহদ্দির মধ্যেই ছিল।

    নির্বাসনে টেম্পলের স্মৃতি আদর্শে পরিণত হয়ে হওয়ায় পুরোহিতেরা নতুন মর্যাদা লাভ করেন। পি ও ইজেকিল উভয়ে সমাজে পুরোহিতদের ভূমিকার ওপর জোর দিয়েছেন। শুরুতে ইসরাইলে পুরোহিত শ্রেণির কোনো অস্তিত্ব ছিল না। দাউদ ও সোলায়মান উভয়েই পুরোহিতের দায়িত্ব পালন করতেন। তবে ধীরে ধীরে টেম্পলের আচার-অনুষ্ঠান ও বিধানের ব্যাখ্যার দায়িত্ব লেভি গোত্রের ওপর বর্তেছিল। তারা যাযাবর জীবনে আর্ককে বহন করত বলে ধারণা করা হয়। ইজেকিল এ ব্যাপারে সুস্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা করেন। লেভিরা টেম্পলে মূর্তি পূজার বিষয়টি পরোক্ষভাবে অনুমোদন করেছিল বলে তাদের সহায়তাকারী ভূমিকায় নামিয়ে দেওয়া হয়েছিল। এরপর থেকে তারা নতুন টেম্পলে কেবল নীচ কায়িক শ্রমের দায়িত্ব পালন করবে। যেমন উৎসর্গের জন্য পশু প্রস্তুত করা, ভজনদলের সদস্যদের সঙ্গ দেওয়া, টেম্পল ফটকে নজরদারি করা। কেবল যেসব পুরোহিত সরাসরি জাদকের বংশধর, তাদেরকেই টেম্পল ভবনে প্রবেশ করে প্রার্থনাবিধি অনুসরণ করার অনুমতি দেওয়া হয়।২৭ এই বিধিনিষেধ জেরুসালেমে ভবিষ্যতের অনেক বিরোধের কারণ হয়েছিল। আর কঠোর বাস্তবতা হলো, ইসরাইলের বস্তুনিষ্ঠ ঐতিহ্য অনুসরণ করা হচ্ছিল জাদকের পরিবার জেবুসিতদের মাধ্যমে। পুরোহিত্বের আরো বর্জনশীল প্রকৃতিতে ঈশ্বরের অধিকতর সীমা ছাড়ানো অবস্থানকে প্রতিফলিত করছিল। এতে ঈশ্বরের ঐশী সত্তা ছিল অনভিজ্ঞ ও অবচেতনদের জন্য আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি বিপজ্জনক। পি ও ইজেকিল উভয়েই যিহোবার আশ্রমে পুরোহিতদের আচরণ-সংক্রান্ত খুঁটিনাটি নির্দেশনা দিয়েছেন। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, হেখালে প্রবেশ করার সময় অবশ্যই তাদের পোশাক বদল করতে হতো। কারণ তারা এমন এক পবিত্র এলাকায় যাচ্ছে, যেখানে সর্বোচ্চ মাত্রার শুদ্ধতার প্রয়োজন। দেভিরে কেবল উচ্চ পুরোহিতের প্রবেশাধিকার ছিল, তা হতো বছরে মাত্র একবার। ২৮ নতুন বিধিবিধান ইসরাইলিদের যিহোবার ঐশী সত্তার অনুভূতি বাড়িয়ে দিয়েছিল। এখন তিনি অন্য সব সত্তার থেকে আলাদা, সেইসাথে তার সামনে যাওয়া সম্ভব নয়।

    অবাক করা বিষয় হলো, পবিত্রতার এসব বিস্তারিত বর্ণনা, এর স্তোতবাক্য ও পুরোহিত্ব এমন এক সময় বিবর্তিত হচ্ছিল, যখন সেগুলো বাস্তবায়নের কোনো আশাই ছিল না। টেম্পলটি বিধ্বস্ত থাকলেও সবচেয়ে সৃষ্টিশীল নির্বাসিতরা একে পুরোপুরি কার্যকর প্রতিষ্ঠান হিসেবে কল্পনা করেছিল, একে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য একটি জটিল সংস্থার পরিকল্পনা করেছিল। ৮ম অধ্যায়ে আমরা দেখতে পাবো, রাব্বিরা ঠিক একই কাজ করেছেন। ফলে জেরুসালেমের ঐশী স্থান ও পবিত্রতা নিয়ে লেখা সবচেয়ে বিস্তারিত ইহুদি গ্রন্থগুলো এমন পরিস্থিতির বর্ণনা দিয়েছে, যার লেখার সময় কোনো অস্তিত্ব ছিল না। নির্বাসিত জুদাবাসীদের জন্য ‘জেরুসালেম’ অন্তরে থাকা মূল্যবোধে পরিণত হয়েছিল। এটি হয়েছিল মুক্তির ছবি যা জুদার বিচ্ছিন্ন ভূখণ্ডের ভৌত নগরী থেকে অনেক দূরেও অর্জন করা সম্ভব ছিল। প্রায় একইসময় ভারতবর্ষে সিদ্ধার্থ গৌতম, বুদ্ধ নামে পরিচিত, আবিষ্কার করেন যে ধ্যান ও সমবেদনা অনুশীলনের মাধ্যমে চূড়ান্ত বাস্তবতায় প্রবেশ করা সম্ভব : এই আধ্যাত্মিক মাত্রা অর্জনের জন্য মন্দির বা অন্য কোনো ঐশী স্থানে যাওয়ার দরকার নেই। এক্সিয়াল যুগের আধ্যাত্মিকতায় অনেক সময় ঐশী সত্তাকে তার নিজের গভীরে রেখে প্রতীকী ও অভিজ্ঞতা এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব ছিল। ইজেকিল ও পির লেখালেখি নিয়ে তাদের সমসাময়িকদের ধারণা কী ছিল, সে সম্পর্কে আমাদের কোনো ধারণা নেই। সন্দেহাতীতভাবে বলা যায়, তারা আশা করেছিলেন, একদিন টেম্পলটি আবার নির্মাণ করা হবে, তাদের সামনে জেরুসালেম আবার পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হবে। তবে যা সত্য রয়ে গেছে তা হলো, সবশেষে নির্বাসিতদেরকে যখন জেরুসালেমে ফেরার সুযোগ দেওয়া হয়েছিল, তখন তাদের বেশির ভাগই বেবিলনে থেকে গিয়েছিল। তারা মনে করেনি যে জেরুসালেমে তাদের শারীরিক উপস্থিতি প্রয়োজনীয়, কারণ তারা জায়নের মূল্যবোধ উপলব্ধি করতে শিখেছিল। জুদাজম বা ইহুদি ধর্ম হিসেবে আমরা যে বিশ্বাসটিকে জানি সেটি জুদাতে নয়, বরং প্রবাসে সৃষ্টি হয়েছিল এবং তা নেহেমিয়া, ইজরা ও হিলেলের মতো দূতের মাধ্যমে প্রচারিত হয়েছিল।

    ইজেকিল ও পি তাদের ধর্মের নশ্বর প্রতীকগুলোর ঊর্ধ্বে ওঠে তাদের দেখানো শ্বাশত বাস্তবতার দিকে তাকাতে পেরেছিলেন। তাদের কেউ তাদের ভবিষ্যতের স্বপ্নাবিভাবে সরাসরি জেরুসালেমের কথা উল্লেখ করেননি। আর পি তার বর্ণনার শেষ করেছেন প্রতিশ্রুতি ভূমির দ্বারপ্রান্তে গিয়ে। তাদের স্বপ্নাবিভাব ছিল অনিবার্যভাবে কল্পরাজ্যের এবং তারা আশা করেননি যে তা তাদের জীবদ্দশায় পূরণ করা হবে। জেরুসালেমের প্রতি তাদের মনোভাব সম্ভবত ছিল আজকের পাসওভার ভোজে আগামী বছর জেরুসালেমে!’ শব্দগুলো ব্যবহারের মতোই, তারা সবসময় ভবিষ্যতের মেসিয়ানিক যুগের কথা বলত, তবে তা দিয়ে নশ্বর নগরী বোঝাত না। ইজেকিল জায়নে প্রত্যাবর্তনের কল্পনা করার সময় আধ্যাত্মিক রূপান্তরের দিকে তাকিয়েছেন : যিহোবা তার জাতিকে ‘একটি নতুন হৃদয়’ ও ‘একটি নতুন আত্মা’ দেবেন। এ দিকে থেকে জেরেমিয়া ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন যে একসময় বিধান আর পাথরের টেবলেটে মুদ্রিত থাকবে না, বরং মানুষের হৃদয়ে গ্রন্থিত থাকবে।২৯ পরিত্রাণের অপেক্ষায় নতুন ইহুদি ধর্মের স্থপতিরা বিশ্বাস করতেন না যে একদিন কেবল রাজনৈতিক কর্মসূচির মাধ্যমেই তা অর্জিত হতে পারে। তারা বুঝেছিলেন, পরিত্রাণ মানে একটি নতুন টেম্পল ও একটি নতুন নগরীর চেয়ে বেশি : এসব হতে পারে আরো অনেক গভীর স্বাধীনতার প্রতীক।

    অবশ্য হঠাৎ মনে হয়েছিল যে রাজনৈতিক মুক্তি ছিল হাতের নাগালে। সত্যিই ধারণা সৃষ্টি হচ্ছিল, জুদাবাসীদের পক্ষে তাদের পিতৃপুরুষদের ভূমিতে ফিরে গিয়ে জেরুসালেম আবার নির্মাণ করা সম্ভব। বেবিলনের লোকজন ক্রমবর্ধমান হারে নেবুচাদনেজারের উত্তরসূরি রাজা ন্যাবোনিদাসের শাসনের প্রতি মোহমুক্তি ঘটেছিল। তারা গভীর আগ্রহ নিয়ে পারস্যের তরুণ রাজা দ্বিতীয় সাইরাসের ক্যারিয়ার প্রত্যক্ষ করছিল। ৫৫০ সালে মিডিয়া রাজ্য জয় করার পর থেকে তিনি নিজের জন্য বিশাল সাম্রাজ্য গড়ছিলেন। ৫৪১ সাল নাগাদ বেবিলন পুরোপুরি সাইরাসের ভূখণ্ডে ঘেরাও হয়ে পড়েছিল। মারদুকের পুরোহিতেরা বিশেষভাবে সাইরাসের প্রপাগান্ডায় মোহিত হয়ে পড়েছিল। কারণ তাদের মনে হচ্ছিল, ন্যাবোনিদাস তাদের ধর্মমতকে অবহেলা করেছিলেন। অন্যদিকে সাইরাস প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, তিনি সাম্রাজ্যের মন্দিরগুলো পুনঃপ্রতিষ্ঠা করবেন, দেবতাদের সম্মান করবেন। তিনি বিধ্বস্ত নগরীগুলো পুনঃনির্মাণ করবেন, তার সাম্রাজ্যে সার্বজনীন শান্তি পুনঃপ্রতিষ্ঠা করবেন। এই বার্তা নামহীন জুদাবাসী নবীরও আকৃষ্ট হয়েছিলেন। তিনি সাধারণভাবে দ্বিতীয় ইসাইয়া নামে পরিচিত ছিলেন। তিনি সাইরাসকে মেসাইয়া হিসেবে অভিহিত করেছিলেন : জেরুসালেম ও এর টেম্পল পুনঃনির্মাণের বিশেষ দায়িত্বের জন্য তিনি যিহোবাকে তেলসিক্ত করেছিলেন। দ্বিতীয় ইসাইয়া সহজাতভাবে পুরনো মিথ ও জায়নের প্রার্থনাবিধির আশ্রয় নেন। সাইরাসকে তার হাতিয়ার করে যিহোবা নুতন সৃষ্টি ও নতুন গমনের সূচনা করবেন। তিনি যেভাবে একবার লেভিথান ও রাহাবের বিরুদ্ধে জয়ী হয়েছিলেন, এবার তিনি ইসরাইলের বর্তমান শত্রুদের বিরুদ্ধে জয়ী হবেন। আর জুদার নির্বাসিতরা মরুভূমি (এটি তার দানবীয় শক্তি হারিয়ে ফেলেছে) দিয়ে জায়নে ফিরবে। ৩০

    এই প্রত্যাবর্তন পুরো মানবজাতির সাথে সংশ্লিষ্ট ছিল : নির্বাসিতদের ফেরা হবে নতুন বিশ্বব্যবস্থার জন্য পথিকৃত। জেরুসালেমে ফিরেই তারা টেম্পল পুনঃনির্মাণ করবে, যিহোবার ‘গৌরব’ এর পবিত্র পর্বতে ফিরে আসবে। আবারো বলা যায়, যিহোবা ‘সব জাতির দৃষ্টির সামনে’ তার নিজের নগরীতে আসন গ্রহণ করবেন।৩১ জেরুসালেম প্রার্থনাবিধি দীর্ঘ দিন আগেই ঘোষণা করা হয়েছে, যিহোবা কেবল ইসরাইলের রাজা নন, বরং তিনি পুরো বিশ্বের সম্রাট। এখন সাইরাসের বদৌলতে এটি প্রদর্শনযোগ্য বাস্তবতায় পরিণত হতে যাচ্ছে। অন্যান্য দেবতা আতঙ্কে কাঁপতে লাগল : বেবিলনের গুরুত্বপূর্ণ দুই দেবতা বেল ও নেবো ভীত-সন্ত্রস্ত্র হয়ে পড়ল, তাদের মূর্তিগুলো বোঝা বহনকারী সাধারণ পশুর পিঠে করে অপমানজনকভাবে সরিয়ে ফেলা হলো। ৩২ যেসব বিদেশী ঈশ্বর যিহোবার ওপর প্রভুত্ব করেছে বলে মনে হয়েছে, তাদের অপ্রয়োজনীয় বিবেচনা করা হলো। এর পর থেকে বিশ্বের সকল জাতির তথা মিসর, কুশ, শেবাকে ইসরাইলের কাছে নতি স্বীকার করতে বাধ্য করা হবে, তাদের শৃঙ্খলিত করে জেরুসালেমে এনে বলতে বাধ্য করা হবে যে :

    একমাত্র তুমিই ঈশ্বর, তোমার আর কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী নেই : আর কোনো ঈশ্বর নেই। ৩৩

    জায়ন প্রার্থনাবিধি সবসময়ই জোর দিয়ে বলে যে যিহোবাই গণ্য হওয়ার মতো একমাত্র ঈশ্বর; দ্বিতীয় যিহোবার অন্তঃদৃষ্টি সন্দেহাতীত একেশ্বরবাদের বিকাশ ঘটিয়েছিলেন। এই বিশ্বজয়ের অবস্থা সৃষ্টির জন্য জেরুসালেম আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে অনেক বেশি গৌরবময় হবে। এটি মূল্যবান পাথরে সাজবে : প্রাচীরে পদ্মরাগমণি, দরজায় ক্রিস্টাল থাকবে, নগর-প্রাচীরগুলোতে লাগানো হবে রত্নপাথর- নগরীর মধ্যে অখণ্ডতা ও পবিত্রতা প্রদর্শন করবে এগুলো। ৩৪

    এসব স্বপ্ন বাস্তবায়নের এক ধাপ সামনে অগ্রসর হওয়ার ঘটনা ঘটে ৫৩৯ সালের শরতে। ওই সময় ফোরত নদীর অপিসে বেবিলন বাহিনীকে পরাজিত কর সাইরাসের সেনাবাহিনী। এক মাস পর বেবিলনে প্রবেশ করেন সাইরাস। মারদুকের প্রতিনিধি হিসেবে ইসাগিল টেম্পলে বরণ করে নেওয়া হয় তাকে। সাথে সাথেই তিনি তার ঘোষিত প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন করেন। ৫৩৮ সালের সেপ্টেম্বর থেকে আগস্টের মধ্যে বেবিলনদের হাতে আটক সব আসারিয়ান ঈশ্বরকে তাদের আদি নগরীতে ফেরত পাঠানো হয়, মন্দিরগুলো নতুন করে নির্মিত হয়। একইসময় সাইরাস এক ডিক্রি জারি করে বললেন যে জেরুসালেমের টেম্পল আবার নির্মিত হবে, নৌকা ও ধর্মীয় আসবাবপত্রগুলো পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা হবে। সাইরাসের পারস্য সাম্রাজ্য আসারিয়া ও বেবিলনের চেয়ে সম্পূর্ণ ভিন্ন পন্থায় পরিচালিত হয়েছিল। অনেক কম ব্যয়ে ও অনেক বেশি কার্যকর হওয়ায় তিনি তার প্রজাদের কিছু স্বায়াত্তশাসন দিয়েছিলেন : এর ফলে কম ক্ষোভ ও বিদ্রোহের সৃষ্টি হয়েছিল। যেকোনো রাজার জন্যই ঈশ্বরদের জন্য মন্দির পুনঃনির্মাণ একটি প্রধান কর্তব্য। সাইরাস সম্ভবত বিশ্বাস করতেন যে তাকে কেবল তার প্রজাদের কৃতজ্ঞতা অর্জন করবেন না, সেইসাথে ঐশী আনুকূল্যও পাবেন।

    তিনি ওই বিশ্বাস অনুযায়ী বেবিলনে অভিষেকের কয়েক মাস পর জেরুসালেম থেকে নেবুচাদনেজারের জব্দ করা স্বর্ণ ও রৌপ্যের নৌকাগুলো জুদার জনৈক ‘প্রিন্স’ (নাসি) শেশবাজারের কাছে হস্তান্তর করেন। তিনি ৪২,৩৬০ জন জুদাবাসী ও তাদের চাকব-বাকর, দুই শত গায়ক নিয়ে জেরুসালেমের উদ্দেশে রওনা হন। ৩৫ প্রত্যাবর্তনকারী নির্বাসিতরা যদি দ্বিতীয় ইসাইয়া তাদের কানে যেসব ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন সেগুলো নিয়ে বেবিলন ত্যাগ করে থাকেন, তবে তারা জুদায় আগনের অল্প সময়ের মধ্যেই কঠোর বাস্তবতায় ফিরে এসেছিলেন। তাদের বেশির ভাগই প্রবাসে জন্মগ্রহণ করেছিল এবং বেড়ে ওঠেছিল বেবিলনের জাঁকজমক আধুনিকতার মধ্যে। জুদা তাদের কাছে অবশ্যই নিরানন্দ, অপরিচিত স্থান মনে হয়েছিল। সাথে সাথে নতুন টেম্পল নির্মাণ করার প্রশ্নই ছিল না। বিধ্বস্ত স্থানে একটি বিশ্বাসযোগ্য সম্প্রদায় প্রতিষ্ঠা ছিল প্রত্যাবর্তনকারীদের প্রথম কাজ। তাদের খুব কমই জেরুসালেমে অবস্থান করেছিলেন। স্থানটি তখনো ছিল বিধ্বস্ত। ফলে তাদের বেশির ভাগই জুদা ও সামেরিনার মতো অপেক্ষাকৃত স্বস্তিদায়ক স্থানে বসতি স্থাপন করেছিল। যারা থেকে গিয়েছিল, তারা সম্ভবত পুরনো নগরীতে বসতি স্থাপন করেছিল, অন্যরা জেরুসালেমের দক্ষিণের গ্রামীণ এলাকায় বাস করতে থাকে। এ স্থানটি ৫৮৬ সাল থেকে বসতিহীন ছিল।

    আমরা নির্বাসিত সম্প্রদায় ‘গোলা সম্পর্কে পারস্যের রাজা দারিয়াসের রাজত্বের দ্বিতীয় বছর ৫২০ সালের আগে পর্যন্ত কিছুই শুনতে পাই না। এই সময় নাগাদ শেশবাজার আর জুদার গোলার দায়িত্বে ছিলেন না। তার কী হয়েছিল, সে সম্পর্কে আমাদের কোনো ধারণা নেই। ভবন নির্মাণের কাজে স্থবিরতা সৃষ্টি হয়েছিল। তবে দারিয়াসের অভিষেক অল্প পর রাজা হেহোয়াচিনের নাতি জেরুবাবেল পুরনো টেম্পলের শেষ প্রধান পুরোহিতের নাতি যশুয়াকে নিয়ে বেবিলনে ফিরে এলে টেম্পল নির্মাণের ব্যাপারে উৎসাহের সৃষ্টি হয়। জেরুবাবেল জুদা প্রদেশের হাই কমিশনার (পেহা) নিযুক্ত হন। তিনি ছিলেন পারস্য সরকারের প্রতিনিধি, তবে সেইসাথে দাউদ পরিবারের বংশধর। এটি গোলায় নতুন হৃদয় দান করে। পুরনোটির স্থানে নতুন একটি বেদী নির্মাণের জন্য সব অভিবাসী জেরুসালেমে সমবেত হয়। কাজ শেষ হলে তারা বলি দিতে শুরু করে, সেখানে ঐতিহ্যবাহী উৎসবও পালন করতে থাকে। কিন্তু তারপর আবার নির্মাণকাজে স্থবিরতা নেমে আসে। জেরুসালেমে জীবন তখনো ছিল সংগ্রামমুখর : ফসল উৎপাদন পর্যাপ্ত হয়নি, অর্থনীতির অবস্থা ছিল শোচনীয়। ফলে যখন পর্যাপ্ত খাবারও থাকে না, তখন টেম্পল সম্পর্কে উৎসাহিত হওয়া কঠিন। তবে ৫২০ সালের আগস্টে নবী হ্যাগাই অভিবাসীদের বলেন, তাদের অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত সবকিছুই ছিল ভুল। টেম্পল নির্মাণ করার কাজ শেষ না হরে ফসল তো ভালো হবে না : যিহোবার আবাস সবসময়ই প্রতিশ্রুত ভূমির উর্বরতার উৎস। নিজেদের জন্য বাড়িঘর নির্মাণ করে যিহোবার আবাসকে বিধ্বস্ত অবস্থায় রেখে তারা কী বোঝাতে চাইছে?৩৬ এতে গতির সঞ্চার হলো, গোলা কাজে ফিরে গেল।

    দ্বিতীয় টেম্পলের ভিত্তি অবশেষে স্থাপন করা হলো ৫২০ সালের শরতে। সুকুতের উৎসবে তারা আবার বিশেষ অনুষ্ঠানের আয়োজন করল। পুরোহিতেরা ঐশী এলাকায় গেলেন, তাদের অনুসরণ করল লেভিরা, তারা সাম পাঠ করছিল, করতাল বাজাচ্ছিল। তবে কিছু লোকের মনে সোলায়মানের জাঁকজমকপূর্ণ টেম্পলের স্মৃতি জাগুগুক ছিল। ফলে সেটির বদলে বর্তমানটির সাদামাটা অবয়ব দেখে তারা কান্নায় ভেঙে পড়ল।৩৭ একেবারে শুরুতে দ্বিতীয় টেম্পল ছিল একটি হতাশা, অনেকের কাছে অ্যান্টিক্লাইমেক্স। মনোবল চাঙ্গা করার চেষ্টা করেছিলেন হ্যাগাই : তিনি তাদের আশ্বাস দেন যে দ্বিতীয় টেম্পলটি পুরনোটির চেয়েও বড় হবে। দ্বিতীয় ইসাইয়ার ভবিষ্যদ্বাণী অনুযায়ী, শিগগিরই যিহোবা দুনিয়া শাসন করবেন। জেরুবাবেল হবেন মেসাইয়া, যিহোবার পক্ষ থেকে পুরো গোয়িম শাসন করবেন।৩৮ হ্যাগাইয়ের সহকর্মী জেচরিয়া এর সাথে একমত হন। তিনি সেই দিনের প্রতীক্ষায় রইলেন যখন জায়নে বাস করার জন্য যিহোবা ফিরে আসবেন, দুই মেসাইয়ার- রাজা জেরুবাবেল ও পুরোহিত যশুয়ার মাধ্যমে তার শাসন প্রতিষ্ঠা করবেন। জেরুসালেমের প্রাচীরগুলো পুনঃনির্মাণ না করাটা ছিল গুরুত্বপূর্ণ। এর ফলে অল্প সময়ের মধ্যে যে বিপুলসংখ্যক লোক সেখানে বাস করতে এসেছিল, তাদের জন্য জায়গার ব্যবস্থা করা সম্ভব হয়। ৩৯

    তবে সবাই একটি উন্মুক্ত নগরীর এই স্বপ্নাবিভাবের সাথে একমত হয়নি। অল্প সময়ের মধ্যেই পুরনো ইসরাইলের উত্তরাঞ্চীয় রাজ্য সামেরিনার লোকজন দেখতে পায়, যিহোবার নতুন টেম্পল নির্মাণকাজ প্রবলভাবে হচ্ছে। তারা জেরুবাবেলের কাছে গিয়ে তাদেরকে কাজ করার সুযোগ দিতে বলে। ইতিহাসলেখক আমাদের বলছেন যে তারা ছিল বিদেশীদের বংশধর। এসব লোক ৭২২ সালে আসারীয়দের মাধ্যমে সেখানে বসতি স্থাপন করেছিল। তাদের অনেকে ইসরাইলিও ছিল, ১০ উত্তরাঞ্চলীয় গোত্রের সদস্য, অন্যরা ছিল জুদাবাসী। ৫৮৬ সালে পেছনে রয়ে যাওয়া লোকদের সন্তান ছিল তারা। সহজাত কারণেই যিহোবাবাদীরা জায়ন পুনর্গঠনে সহযোগিতা করার ইচ্ছা প্রকাশ করেছিল। জেরুবাবেল অবশ্য মুখের ওপর না করে দিয়েছিলেন। কেবল গোলাই ‘আসল’ ইসরাইল। সাইরাস কেবল তাদেরকেই টেম্পল পুনঃনির্মাণের দায়িত্ব দিয়েছেন। ফলে এই অন্য যিহোবাবাদীরা ভাই নয়, বরং শত্রু হিসেবে বিবেচিত। সম্মিলিতভাবে তারা আম হা-আরেতজ বা ‘ভূমিপুত্র’ হিসেবে পরিচিত ছিল। বেবিলনে ইজেকিল ও পি ১২টি গোত্রের সবাইকেই ইসরাইলের সদস্য বিবেচনা করে পবিত্রতার অধিকারী মনে করেছেন। কেবল পৌত্তলিক জাতি গোয়িমকে ঐশী এলাকা থেকে বাদ দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু প্রত্যাবর্তনকারী নির্বাসিতদের মধ্যে আরো সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি বিরাজ করছিল। আম হা-আরেজরা ‘আগন্তুক’ বিবেচিত হলো। নির্বাসিতরা তাদেরকে হলিনেস কোডে থাকা ব্যবস্থার মতো করে তাদের নগরীতে তাদেরকে স্বাগত জানাল না। পরিণতিতে দেশে শান্তি আসার বদলে নতুন জেরুসালেম পবিত্র ভূমির দাবি নিয়ে নতুন মাত্রার বিরোধের সৃষ্টি হলো। বাইবেল লেখকেরা আমাদের বলছেন, এরপর থেকে আম হা-আরেতজরা ‘নির্মাণকাজে আর অগ্রসর না হতে জুদাবাসীদের নিরুৎসাহিত ও ভয় দেখাতে লাগল। ৪১ তারা পারস্য কর্মকর্তাদের সমর্থন লাভের চেষ্টা করেছিল। ৪৮৬ সালের দিকে একবার সামেরিনার গভর্নর রাজা জেরজেক্সকে হুঁশিয়ার করে দিয়ে বলেছিলেন যে জুদাবাসীরা অনুমতি ছাড়াই জেরুসালেমের প্রাচীর নির্মাণ করছে। প্রাচীন দুনিয়ায় এটি সাধারণত রাজশক্তির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ বিবেচিত হতো। ইকবাতানায় রাজকীয় আর্কাইভে সাইরাসের মূল ডিক্রি আবিষ্কার না হওয়া পর্যন্ত কাজ বলপূর্বক বন্ধ করে দেওয়া হলো।

    এদিকে দ্বিতীয় টেম্পলের নির্মাণকাজ ধীরে ধীরে চলতে থাকল। আম হা- আরেতজের প্রত্যাখ্যানের পর জেরুবাবেলের কথা আমরা আর শুনতে পাই না। সম্ভবত হ্যাগাই ও জেচারিয়ার মেসাইনিক আশাবাদ পারস্য সরকারকে বিপদসঙ্কেত দিয়েছিল। ৫১৯ সালে রাজা দারিয়াস দেশটি অতিক্রমের সময় তাকে হয়তো অপসারণ করা হয়েছিল। আর কখনো দাউদ পরিবারের কোনো সদস্যকে জুদা প্রদেশের পেহা নিযুক্ত করা হয়নি। এই মেসাইনিক স্বপ্ন সত্ত্বেও অভিবাসীরা ৫১৫ সালের ২৩ আদরে (মার্চে) তাদের টেম্পলটি নির্মাণকাজ সম্পন্ন করতে সফল হয়েছিল। এটি সোলায়মানের টেম্পলের স্থানে নির্মাণ করা হয়েছিল এর ঐশী ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতা রক্ষা করার জন্যই। এটি উলাম, হেখাল ও দেভিরের ত্রিপক্ষীয় পরিকল্পনাই আবার সামনে নিয়ে আসে। একটি পাথরের প্রাচীর দিয়ে এটি নগরী থেকে আলাদা করা হয়েছিল। ওই প্রাচীরটি ছিল দ্বিমুখী দরজা। এটি বিভিন্ন অফিস, গুদামঘর ও পুরোহিতদের অ্যাপার্টমেন্টে ঘেরা একটি বাইরের প্রাঙ্গনে নিয়ে যেত। এসব কাঠামো নির্মাণ করা করা হয়েছিল প্রাচীর ঘিরে। আরেকটি প্রাচীর অভ্যন্তরীণ প্রকোষ্ঠকে আঙিনা থেকে আলাদা করেছিল। অভ্যন্তরীণ প্রকোষ্ঠেই ছিল বলি দেওয়ার বেদী। সেটি ছিল সাদা, অমসৃণ পাথরের। অবশ্য এবার জায়ন নগরীতে কোনো রাজপ্রাসাদ ছিল না। কারণ জুদায় এখন কোনো রাজাই নেই। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্য হলো, দেভির এখন শূন্য। কোনো আলামত ছাড়াই আর্ক অব কোভেন্যান্ট অদৃশ্য হয়ে গেছে। এই শূন্যতা যিহোবার ঐশিত্বকে প্রতীকী করেছিল, যাকে কোনো ধরনের মানবীয় চিত্রেই ধারণা করা যেত না। তবে অন্যরা হয়তো অনুভব করত যে এটি এই নতুন টেম্পল থেকে তার দৃশ্যত অনুপস্থিতিই প্রতিফলিত করছে। দ্বিতীয় ইসাইয়ার উচ্ছ্বসিত আশা পূরণ হয়নি। যিহোবার ‘গৌরব’ নেমে এসে দেভিরে বসবাস করতে থাকছেন কিনা, কেউ তা জানত না। গোয়িমে কোনো নাটকীয় ঐশী বার্তা নাজিল হয়নি, অইহুদি জাতিগুলোকে শৃঙ্খলিত করে জেরুসালেমে নিয়ে আসা হয়নি। পৃথিবী থেকে ঈশ্বরের বিপুল দূরত্বের নতুন একটি অনুভূতি ছিল, দ্বিতীয় টেম্পলের এই প্রথম বছরগুলোতে ঐশী দেবতার এই ভবনে থাকার মূল ধারণাটি ক্রমবর্ধমান হারে অদ্ভূত মনে হতে লাগল :

    এ কারণে যিহোবা বলেন :
    আকাশ আমার সিংহাসন
    আর পৃথিবী হলো আমার পাদানি
    তাই তোমরা কি মনে করো আমার জন্য একটা বাড়ি বানাতে পারবে?
    না, পারবে না।
    তোমরা কি আমার জন্য একটি বিশ্রামস্থল বানাতে পারবে? ৪২

    সব লোক খড়কুটো আঁকড়ে ধরার মতো করে আশাবাদী থাকত যে যিহোবা তাদের সাথে সাক্ষাত করার জন্য নেমে আসবেন।

    অতীতের মতো জাঁকালো মন্দিরগুলোমে নেমে আসার বদলে যিহোবা এই দিনগুলোতে ‘বিনীত ও অনুতপ্ত আত্মায়’ মাধ্যমে অনেক বেশি আকৃষ্ট হতেন। প্রথম টেম্পলের মতবাদ ছিল বিশৃঙ্খল, উল্লাসপূর্ণ ও আবেগময়ী। দ্বিতীয় টেম্পলে উপাসনা করার ধারাটি ছিল শান্ত ও সৌম্য। নির্বাসনে থাকার সময় গোলা বুঝতে পেরেছিল যে তাদের নিজেদের পাপই ছিল জেরুসালেম ধ্বংসের কারণ। ফলে গোলার ‘ভগ্ন ও বিধ্বস্ত হৃদয়কে’ প্রতিফলিত করেছিল মতবাদটি। এটি বিশেষভাবে দৃষ্টিগোচর হয়েছিল যম কিপুরের উৎসব তথা অ্যাটোনমেন্ট দিবসে। এ সময় প্রধান পুরোহিত প্রতীকীভাবে একটি ছাগলের ওপর জাতির সব পাপ চাপিয়ে দিয়ে সেটিকে মরুভূমিতে তাড়িয়ে দিতেন। তবে এটি ইসরাইলকে আবারো ঐশী সত্তার দিকে ধাবিত করে। যম কিপুর ছিল বছরে এক দিন। এ সময় প্রধান পুরোহিত জনগণের প্রতিনিধি হিসেবে দেভিরে প্রবেশ করতেন। প্রায়শ্চিত্তের উপাদানটি টেম্পল আঙিনায় প্রতিদিনকার দেওয়া বলিতেও দেখা যায়। লোকজন তাদের তাদের ‘অপরাধ’ বা পাপ মোচনের জন্য সাধ্য অনুযায়ী ষাঁড়, ভেড়া, ছাগল বা কবুতর বলি দিতে নিয়ে আসত। তারা তাদের হাত পশুর মাথায় রাখত যিহোবার প্রতি এর আত্মসমর্পণের প্রতীক প্রকাশ করতে। পশুটিকে হত্যার পর এর একটি অংশ যে ব্যক্তি এটি এনেছে, তাকে দেওয়া হতো। সে তা তার পরিবার ও বন্ধুদের মধ্যে ভাগ করে দিত। ভূমির ওপর পাপ স্বীকারের ভোজটি ঐশী সত্তার সাথে সম্প্রীতির বিষয়টি পুনঃপ্রতিষ্ঠা করত।

    দ্বিতীয় ইসাইয়া যেভাবে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন, সেভাবে যিহোবা জায়নে ফিরে না এলেও লোকজন স্বপ্ন দেখতে থাকে যে একদিন তিনি জেরুসালেমে ‘একটি নতুন স্বর্গ ও একটি নতুন দুনিয়া সৃষ্টি করবেন। পুরনো আশা মরে যায়নি এবং জেরুসালেম ওই চূড়ান্ত পরিত্রাণের এমন এক প্রতীকে পরিণত হয় যেখানে ঈশ্বরের সাথে একীভূত, সমন্বিত ও ঘনিষ্ঠতার সৃষ্টি হবে, স্বর্গে প্রত্যাবর্তন ঘটবে। অন্য কোনো নগরীর মতো হবে না নতুন জেরুসালেম : প্রত্যেকে সেখানে দীর্ঘ ও সুখী জীবন যাপন করবে, প্রত্যেকে তার নিজ স্থানে বাস করতে পারবে। নগরীতে কোনো কান্না থাকবে না, অতীতের বেদনা বিস্তৃত হয়ে যাবে। অ-ইহুদিরা নগরীর শান্তি দেখে অবাক হয়ে যাবে। জীবন যেমন হওয়া উচিত, তেমনভাবেই প্রতিষ্ঠিত হবে। তবে অন্যদের অনেক বেশি মোহভঙ্গ ঘটেছিল। নগরীতে সামাজিক সমস্যা ছিল। অনেক নবী তা প্রকাশ করছিলেন, অধিবাসীরা তখনো পুরনো পৌত্তলিকতার নিমজ্জিত ছিল। গোলার প্রতি নতুন বর্জনকর মনোভাব নিয়ে উদ্বেগ ছিল ঈশ্বরের নগরী কি সবার জন্য উন্মুক্ত হওয়া উচিত নয়, যেভাবে জেচারিয়া বলেছিলেন? সম্ভবত জেরুসালেমের দরজা বিদেশী, পুরোহিতদের ‘অপবিত্র’ বিবেচিত অচ্ছ্যুৎ ও খোজাদের জন্যও খুলে দেওয়া উচিত। যিহোবা ঘোষণা করেছেন, ‘আমার আবাস সব জাতির জন্য উপাসনার স্থান’ : একদিন তিনি এসব বহিরাগতকে নগরীতে নিয়ে এসে তাদেরকে মাউন্ট জায়নে বলি দেওয়ার সুযোগ দেবেন। ৪৬

    কিন্তু তারপরও পঞ্চম শতকে জেরুসালেমের জুদাই বা অ-ইহুদিদের ধর্মমতের কেন্দ্রে পরিণত হওয়ার সম্ভাবনা ছিল কম। নগরীটি তখনো মোটামুটিভাবে বিধ্বস্ত অবস্থায়, জনহীন ছিল। তাছাড়া ৪৫৮ সালে রাজা জেরজেস সিংহাসনে আহরণের সময় পুরো পারস্য সাম্রাজ্যে ছড়িয়ে পড়া গোলযোগে জেরুসালেম আরেক দফা ক্ষতির মুখে পড়ে। ৪৪৫ সালে নগরীর দুর্দশার খবর পারস্যের রাজধানী সুসায় পৌঁছে। এতে সেখানে বসবাসরত জুদা সম্প্রদায়ের মধ্যে কষ্টের সঞ্চার ঘটে। এই সম্প্রদায়ের অন্যতম নেতা ছিলেন নেহেমিয়া। তিনি ছিলেন রাজা প্রথম আরটেক্সাররেক্সের মদ্য-পরিবেশক। জেরুসালেমের গোলার বিপর্যস্তকর অবস্থার (এর প্রাচীরগুলো তখনো বিধ্বস্ত ছিল) খবর শুনে তিনি এতই মর্মাহত হয়েছিলেন যে তিনি তার জাতি ও পরিবারের পাপের জন্য অনুতপ্ত হয়ে কয়েক দিন কেঁদেছিলেন। তার মনে হয়েছিল, এই পাপের কারণেই এ ধরনের বিপজ্জনক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। তখন তিনি জুদা ফিরে গিয়ে তার পূর্বপুরুষদের নগরী পুনর্গঠনের জন্য রাজার কাছে অনুমতি ভিক্ষা করেন। রাজা তাকে অনুমতি দেন। তিনি নেহেমেয়িাকে জুদার পেহা নিযুক্ত করে ওই অঞ্চলের অন্যান্য গভর্নরের জন্য সুপারিশপত্র দেন, যাতে তিনি রাজকীয় উদ্যান থেকে কাঠ ও অন্যান্য নির্মাণসামগ্রী সংগ্রহ করতে পারেন। ৪৭ আরটেক্সাররেক্স সম্ভবত আশা করেছিলেন, নেহেমিয়া জুদার স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠা করতে পারবেন। তার মনে হয়েছিল, মিসরের খুব কাছে অবস্থিত জুদা যদি বিশ্বস্ত পারস্য দুর্গ হয়, তবে তা তার সাম্রাজ্যের নিরাপত্তা বাড়াবে।

    ইজরার গ্রন্থ ও নেহেমেয়ায় বেশ কিছু অসম্পর্কিত নথি রয়েছে। এক সম্পাদক এ দুটিকে একসাথে সঙ্কলিত করার চেষ্টা করেছেন। তিনি ভেবেছিলেন, ইজরা ও নেহেমিয়া ছিলেন সমসাময়িক এবং নেহেমিয়ার আগে জেরুসালেমে পৌঁছেছিলেন ইজরা। কিন্তু সুস্পষ্ট প্রমাণে দেখা যায়, ইজরার মিশন ছিল অনেক পারের, সালে রাজা দ্বিতীয় আরটেক্সাররেক্সের আমলে।৪৮ ফলে নেহেমিয়া হয়তো ৪৪৫ সালে সুসা থেকে যাত্রা করেছিলেন। তিনি সম্ভবত তার পদকে ধর্মীয় চ্যালেঞ্জ হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। কারণ নিকট প্রাচ্যে দুর্গ সুরক্ষিত করার কাজটি পবিত্র কর্তব্য বিবেচিত হতো। জেরুসালেমে পৌঁছে তিনি তিন দিন ছদ্মবেশে নগরীতে অবস্থান করেন। তারপর একদিন রাতে গোপনে নগরপ্রাচীরগুলো পরিদর্শন করেন ঘোড়ায় চড়ে। তিনি দুর্গপ্রাচীরের ব্যবধান ও পুড়ে যাওয়া দরজাগুলোর ভয়ঙ্কর চিত্র আঁকেন। একপর্যায়ে তিনি তার ঘোড়ার চলার মতো পথও পাননি। ৪৯ পর দিন তিনি প্রবীণদের কাছে নিজেকে প্রকাশ করেন, এই লজ্জা ও অমর্যাদার অবসানের জন্য তাদেরকে তাগিদ দেন। পুরো নগরী বিপুলভাবে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয়। পুরোহিত ও সাধারণ মানুষ পাশাপাশি কাজে নেমে পড়ে, রেকর্ড ৫২ দিনে নগরীর নতুন প্রাচীরগুলোর কাজ শেষ হয়ে যায়। এটি ছিল বিপজ্জনক কাজ। এই সময় নাগাদ আম হা-আরেতজের সাথে সম্পর্কের মারাত্মক অবনতি ঘটেছে, নেহেমিয়াকে সবসময় স্থানীয় কয়েকজন নৃপতি যেমন সামেরিনার গভর্নর সানবালত, তার অন্যতম কর্মকর্তা তোবিয়া, ইদোমের গর্ভনর গারশেনের সাথে বিবাদ করতে হয়েছে। পরিস্থিতি এতই উত্তপ্ত ছিল যে নির্মাতারা সবসময় আক্রান্ত হওয়ার ভয়ে থাকত : ‘প্রত্যেকে এক হাতে কাজ করার সময় অন্য হাতে অস্ত্র ধরে থাকত।’ আর প্রতিটি নির্মাণকর্মী কাজ করার সময় তার পাশে তরবারি বহন করত। ওয়েস্টার্ন হিলের উপর অবস্থিত মিসনেহ উপশহরটি সুরক্ষিত করার কোনো চেষ্টা চালানো হয়নি। নেহেমিয়ার নগরী ছিল স্রেফ ওফেলের ওপর পুরনো ইর দাউদ নিয়ে। বাইবেলের পাঠ থেকে আমরা কিভাবে এটি সংগঠিত হয়েছিল তা জানতে পারি। বাজারগুলো নগরীর পশ্চিম দিকের প্রাচীরজুড়ে বিস্তৃত ছিল, পুরোহিতেরা ও মন্দিরের সেবকরা বাস করত পুরনো ওফেল দুর্গের পাশে অবস্থিত টেম্পলের কাছে। শিল্পী ও কারিগরেরা দক্ষিণ-পূর্ব দিকের কোয়ার্টারে বাস করত। সামরিক বাহিনীর অবস্থান ছিল উত্তর অংশে। এখানেই নগরী ছিল সবচেয়ে অরক্ষিত। নেহেমিয়া একটি দুর্গও নির্মাণ করেছিলেন। সম্ভবত টেম্পলের উত্তর-পূর্ব দিকে, তা হাসমোনিয়ান ও হেরডিয়ান দুর্গে সেটি চাপা পড়েছিল। ৪৪৫ সালের ২৫ ইঁদুলে (সেপ্টেম্বরের শুরুতে) নতুন প্রাচীরগুলো উৎসর্গ করা হয় : লেভি ও আশপাশের গ্রামের অধিবাসীরা দুটি বিশাল গায়কদলে বিভক্ত হয়ে বিপরীত দিক থেকে নতুন প্রাচীরগুলো দিয়ে শোভাযাত্রা বের করে, সাম গায়। এভাবে তারা টেম্পলের আঙিনায় প্রবেশ করে। কয়েক মাইল দূর থেকেও সঙ্গীত ও আনন্দ- চিৎকার শোনা গিয়েছিল।

    জেরুসালেমে নতুন আশা নিয়ে এসেছিলেন নেহেমিয়া। তবে তখনো নগরী হিসেবে এটি পূর্ণতা পায়নি। সেখানে নতুন কোনো পরিবার গড়ে ওঠেনি, লোকজন সেখানে সরে আসতে অনীহ ছিল। আম হা-আরেতজ থেকে আক্রমণের আশঙ্কা ছিল সবসময়, নগরীদের নতুন ফটকগুলো পাহারার ব্যবস্থা করতে হতো। নেহেমিয়া লটারির মাধ্যমে প্রতি ১০ জনে একজন করে লোককে নগরীতে সরিয়ে আনার ব্যবস্থা করেছিলেন।৫১ এ ক্ষেত্রে যেসব বসতি স্থাপনকারী ‘স্বেচ্ছাসেবক’ ছিল, তারা ধর্মীয় কাজ করেছিল বলে বিবেচিত হয়। জেরুসালেমে নেহেমিয়ার ১২ বছরের আমলে নগরীটি ধীরে ধীরে প্রাদেশিক রাজধানী হিসেবে মিজপাহকে ছাড়িয়ে গিয়েছিল। তিনি জেরুসালেমের পেহার জন্য একটি আবাসিক ভবনও নির্মাণ করেছিলেন। ধীরে ধীরে নগরীটি গোলার জীবনের কেন্দ্রে পরিণত হয়েছিল। তবে জেরুসালেমেই ক্ষমতার দ্বন্দ্ব চলছিল। কয়েকজন পুরোহিত সানবালাতসহ আম হা-আরেতজের সাথে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রক্ষা করে চলেছিলেন। এ লোকটি ছিলেন নেহেমিয়ার সবচেয়ে বিপজ্জনক বিরোধী। তাকে কয়েকজন অপেক্ষাকৃত সম্পদশালীর লোভও দমন করতে হয়েছিল। এসব লোক ঋণের সুদ দিতে ব্যর্থ গরিবদের ছেলে-মেয়ে ও আঙুর বাগান দখল করে নিয়েছিলেন। ব্যাপক গণ-সমর্থন নিয়ে নেহেমিয়া সুদ গ্রহণ বন্ধ করতে অভিজাত ও কর্মকর্তাদেরকে ঈশ্বরের নামে শপথ গ্রহণ করতে বাধ্য করেছিলেন। ৫২ এটি ছিল জেরুসালেমকে আবার গরিব মানুষের আশ্রয় কেন্দ্রে পরিণত করার উদ্যোগ। তবে তাতে সহজাতভাবেই উচ্চ শ্রেণি বিরোধিতা করেছিল। তারা ক্রমবর্ধমান হারে প্রতিবেশী এলাকায় তাদের মিত্রতা স্থাপন করতে থাকে। এতে দেশে বেশ বড় ধরনের উত্তেজনা দেখা দেয়। সানবালাত, তোবিয়া ও গারশেন বেশ ভালোভাবেই বুঝতে পেরেছিলেন, নগরী সুরক্ষিত করার কাজটি হচ্ছে রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ লাভের উদ্দেশ্য সিদ্ধিমূলক ও প্রধান কাজ।

    দ্বিতীয় মেয়াদে দায়িত্ব পালনের সময়, এটি শুরু হয়েছিল ৪৩২ সালে, নেহেমিয়া স্থানীয় লোকদের বিয়ে করা থেকে গোলার সদস্যদের বিরত রাখার জন্য নতুন আইন প্রণয়ন করেন। সানবালাতের মেয়েকে বিয়ে করা প্রধান পুরোহিত ইলিয়াশিবকে তিনি বহিষ্কার করেন। ইলিয়াশিব সামারিয়ায় গিয়ে বাস করতে থাকেন। সেখানে তিনি সম্ভবত পুরোহিত শ্রেণির অন্য অসন্তুষ্টদের সাথে যোগ দিয়েছিলেন। জেরুসালেমে মিশ্র বিয়ের বিষয়টি ক্রমবর্ধমান হারে বিরোধপূর্ণ ইস্যুতে পরিণত হয়েছিল। নেহেমিয়ার বিধানের উদ্দেশ্য বিশ শতকের বর্ণবাদী বিশুদ্ধতা নিশ্চিত করার জন্য নয় বরং তা ছিল ইজেকিলের মতো নবীদের নির্বাসনকালে যে নতুন ঐশী ভূগোল তৈরি করেছিলেন, সেটি সামাজিক পরিভাষায় প্রকাশ করার প্রয়াস। অর্থাৎ ঈশ্বরের পবিত্র জাতির সাথে মানানসইভাবে গোলাকে অবশ্যই গোয়িম থেকে আলাদাভাবে বাস করতে হবে। বেবিলনে নির্বাসিতরা ইসরাইলে যিহোবার উপস্থিতিকেন্দ্রিক স্বতন্ত্রমণ্ডিত জুদা পরিচিতি সুরক্ষিত রাখার ব্যাপারে সচেতন ছিল। একই কেন্দ্রভিমুখ টানও সামাজিক জীবনে দেখা গেছে। তাওরাত অনুযায়ী ইসরাইলের লোকজন মূল পারিবারিক ইউনিটের বাইরে বিয়ে করতে বাধ্য থাকলেও যতটুকু সম্ভবত ঘনিষ্ঠ স্বজনদের মধ্যে বিয়ে করাটাই অপেক্ষাকৃত ভালো বিবেচিত হতো। পরিবারের ভেতরে লোকজন গ্রহণযোগ্য বৈবাহিক অংশীদার হিসেবে গ্রহণযোগ্য ছিল, বাইরের লোকজন অনাকাঙ্ক্ষিত ছিল। এসব এককেন্দ্রিক বৃত্তগুলো ইসরাইল সীমান্তে থেমে গিয়েছিল। পবিত্রতার মানচিত্রে অনুপস্থিত থাকা গোয়িম আক্ষরিকভাবে ছিল এলাকার বাইরে। ‘বাইরে’ বিয়ে করা মানে ঐশী এলাকার বাইরে চলে যাওয়া এবং ঈশ্বরহীন প্রত্যন্ত এলাকায় গমন করা, যেখানে যম কিপুরে বলির পাঁঠাকে ছেড়ে দেওয়া হয়। এটি ছিল ইসরাইলকে ‘পবিত্র’ ও আলাদা জাতি ও জুদা পরিচিতিসম্পন্ন হিসেবে গঠন করার চেষ্টা। ‘বহিরাগত’ ও ‘আমাদের মতো নয়- এমন লোকদের থেকে পৃথক করার উদ্দেশ্য ছিল এটি। তবে জুদার ওই গোলায় ওইসব লোককে প্রত্যাখ্যান করতে বলা হয় যারা একসময় ইসরাইলি পরিবারের সদস্য হলেও এখন তাদের ভূমিকা আগন্তুক ও শত্রু।

    পঞ্চম শতকে বেবিলনের নির্বাসিতরা একটি উল্লেখযোগ্য ধর্মীয় সংস্কারে নিয়োজিত হয়েছিল। এটি ইহুদি ধর্মে প্রভাব ফেলে। পরিচিতির প্রশ্নটি তখনো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল : নির্বাসিতা তাদের সন্তানদের বেবিলনিয়ান নাম রাখা বন্ধ করে দিয়ে শাবেতাইয়ের মতো নামগুলোকে অগ্রাধিকার দিতে থাকে। এতে তাদের নতুন ধর্মীয় প্রতীকগুলো প্রতিফলিত হতে থাকে। তাদের ধর্মীয় জীবনে কেন্দ্ৰীয় ভূমিকা পালন করতে থাকে তাওরাত, এটি টেম্পলের স্থান অধিকার করে। মিতজভোথ পালন করার মাধ্যমে বেবিলনের জুদাবাসীরা নিজেদেরকে স্বর্গীয় উপস্থিতির ধারক ও পৃথিবীতে ঈশ্বরের নির্দেশ প্রতিষ্ঠাকারী একটি পবিত্র সম্প্রদায় হিসেবে গঠন করতে পারত। তবে এর মানে হলো, সাধারণ ইহুদিদেরকে বিশেষজ্ঞদের মাধ্যমে তাওরাতের জটিল বিষয়গুলোর ব্যাখ্যা গ্রহণ করার নির্দেশনা প্রদান করা হয়। এসব বিশেষজ্ঞদের একজন ছিলেন ইজরা। তিনি নিজেকে যিহোবার বিধান নিয়ে গবেষণা, তা অনুশীলন ও ইসরাইলকে তা শেখানো ও প্রথা অবহিত করার কাজে নিবেদিতপ্রাণ ছিলেন। তিনি সম্ভবত পারস্য রাজদরবারে ইহুদিবিষয়ক মন্ত্রী ছিলেন। ৩৯৮ সালে দ্বিতীয় আরটেক্সেরক্সেস চারটি দায়িত্ব দিয়ে জুদায় পাঠান। মাতৃভূমিতে ফিরতে আগ্রহী একদল ইহুদিও তার সঙ্গী হন। তিনি টেম্পলের জন্য বেবিলনের ইহুদি সম্প্রদায়ের কাছ থেকে উপহার সাথে নিয়েছিলেন। জুদায় পৌঁছেই তিনি ‘ [তাদের] ঈশ্বরের বিধানের ভিত্তি সম্পর্কে জুদা ও জেরুসালেমের অবস্থা সম্পর্কে খোঁজখবর নেন।’ অবশেষে তিনি এই বিধান সম্পর্কে লেভ্যান্টের ইহুদিদের নির্দেশনা দেন। অন্য প্রজা জনসাধারণের বিধান এই সময় পর্যালোচনাধীন থাকে। আরটাক্সোক্সেস ইহুদি টেম্পলের মতবাদ সমর্থন করছিলেন। এটিই ছিল জুদা প্রদেশের জীবনযাপনের মূলকেন্দ্র। তাকে নিশ্চিত হতে হয়েছিল যে এটি সাম্রাজ্যের স্বার্থ ও নিরাপত্তার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। বেবিলনের আইন বিশেষজ্ঞ হিসেবে ইজরা সম্ভবত তাওরাত ও পারস্য আইনিব্যবস্থার মধ্যে সমন্বয় সাধন করতে হয়েছিল। আরটেক্সেরক্সেকে নিশ্চিত হওয়া দরকার ছিল যে এই বিধান জুদায় কাজ করবে। ইজরা জেরুসালেমে তাওরাত জারি করবেনও একে ওই এলাকার সরকারি বিধানে পরিণত করবেন।৫৬

    বাইবেলের লেখক ইজরার মিশনকে তার জাতির ইতিহাসের মোড় পরিবর্তনকারী অবস্থা হিসেবে দেখেছেন। ইজরার জুদায় সফরকে নতুন বহিঃগমন ঢল হিসেবে বর্ণনা করা হয়, ইজরা নিজে দণ্ডদাতা হিসেবে নতুন মুসা হিসেবে অভিহিত হন। তিনি বিপুল সমারোহে জেরুসালেমে পৌঁছে ছিলেন, তবে সেখানকার অবস্থা দেখে আঁতকে ওঠেন : পুরোহিত ও লেভিতরা তখনো আম হা- আরেজতের সাথে গোপনে আঁতাত করে আছে, তখনো বিদেশী স্ত্রী গ্রহণ করছে। জেরুসালেমের লোকজন লজ্জা পেয়েছিল যে রাজার প্রতিনিধি তার চুল ছিঁড়ছেন আর সারা দিনের শোক প্রকাশ করতে রাস্তায় বসে আছেন। তারপর তিনি জেরুসালেমে এক সভায় গোলার সব সদস্যকে তলব করেন : কোনো সদস্য যদি হাজির না হয়, তবে তাকে সমাজচ্যুত করা হবে, তার সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হবে। নববর্ষের দিনে (সেপ্টেম্বর/অক্টোবর) ওয়াটার গেটের সামনের চত্বরে তাওরাত নিয়ে এসে একটি কাঠের মঞ্চে দাঁড়ান। এ সময় শীর্ষস্থানীয় নাগরিকেরা তার চারপাশে ছিলেন। তিনি সমবেত জনতার উদ্দেশে বিধান পাঠ করেন, সেইসাথে এসবের ব্যাখ্যাও শোনান। তিনি তাদের সামনে ঠিক কী পাঠ করেছিলেন, সে সম্পর্কে আমাদের কাছে কোনো ধারণা নেই : তিনি কি পুরো পেন্টাটেক, ডিউটারোনোমি গ্রন্থ নাকি হলিনেস কোড পাঠ করেছিলেন? বিষয়বস্তু যা-ই হোক না কেন, ইজরার বিধান স্পষ্টভাবেই জনগণকে নাড়া দিয়েছিল। তারা এসব কথা আগে কখনো শোনেনি। তারা এমনভাবে কান্নায় ভেঙে পড়েছিল যে ইজরাকে স্মরণ করিয়ে দিতে হয়েছিল যে এটি উৎসবের দিন। তিনি তাওরাত থেকে একটি অংশ উচ্চস্বরে পাঠ করেন। তাদের পূর্বপুরুষদের ৪০ বছরের ঊষর প্রান্তরে থাকার স্মৃতিতে এতে সুকোথ মাসে বিশেষ প্রকোষ্ঠে বাস করার জন্য ইসরাইলিদের বলা হয়েছিল। তিনি লোকজনকে পাহাড় থেকে মেদি, জলপাই, পাইন ও খেজুর গাছের ডালা আনতে পাঠান। ফলে অল্প সময়ের মধ্যেই জেরুসালেম সবুজ আশ্রয়ে পরিণত হয়, পুরো নগরীতে তা দেখা যেতে থাকে। নতুন উৎসবটি সুকোথের পুরনো জেবুসাইত শাস্ত্রাচারের স্থলাভিষিক্ত হয়। এখন নতুন ব্যাখ্যা এক্সোডাস ঐতিহ্যের সাথে দৃঢ়ভাবে সম্পর্কযুক্ত হলো। পরের সাত দিন নগরীতে উৎসবমুখর পরিবেশের সৃষ্টি হলো। প্রতিটি সন্ধ্যায় লোকজন ইজরার বিধানের ব্যাখ্যা শোনার জন্য সমবেত হতো।

    পরের সভাটি ছিল আরো সৌম্যভাবে। ৫৮ এটি টেম্পলের সামনের চত্বরে হয়েছিল। লোকজন নগরীতে শীতে প্রবল বর্ষণে ফলে ঠাণ্ডার যে অনুভূতি পায়, তেমনভাবেই কাঁপছিল। ইজরা তাদেরকে তাদের বিদেশী স্ত্রী তাড়িয়ে দিতে বলেন, একেবারে প্রতিটি ঘটনা খতিয়ে দেখতে বিশেষ কমিটি গঠন করা হয়। আম হা- আরেতজে যোগদান করার জন্য গোলা থেকে নারী ও শিশুদের সরিয়ে রাখা হয়। ইসরাইলের সদস্যপদ এখন বেবিলনে নির্বাসিত ও তাওরাতের কাছে সমর্পণ করতে প্রস্তুত লোকজনের মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে। এখন জেরুসালেমের সরকারি বিধান হলো তাওরাত। অচ্ছ্যুতে পরিণত হওয়া লোকজনের বিলাপ সম্ভবত ইসাইয়া গ্রন্থে আমাদের জন্য সংরক্ষিত রয়েছে :

    ‘ইসরাইল আমাদের স্বীকার করল না, জেরুসালেম থেকে বের করে দিলো। আম হা-আরেতজ সামেরিনার মাউন্ট গেরিজিমে নিজেদের আলাদা মন্দির তৈরি করল। আজকে সামারিতানরা, তাদের বংশধরেরা এখনো তাদের নিজস্ব ধরনের ইহুদি ধর্ম পালন করে।

    ইব্রাহিম আমাদের জানে না।
    ইসরাইল আমাদের স্বীকার করে না।
    প্রভু, আপনি আমাদের পিতা….
    বহু কাল ধরে আমরা সেই লোক ছিলাম যারা আপনার দ্বারা শাসিত ছিলাম না।
    যাদের আপনার নামে ডাকা হয়নি।৫৯ এরপর থেকে অন্য লোকজনকে নির্মমভাবে তাড়িয়ে দেওয়াটা জেরুসালেম ইতিহাসের বৈশিষ্ট্যে পরিণত হয়, এমনকি যদিও তা ইসরাইলের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহ্যগুলোর প্রবল পরিপন্থী ছিল। কেউ কেউ হয়তো ধারণা করতে পারে, অনেক লোক এই নতুন প্রবণতার বিরোধিতা করেছিল। তারা সামেরিনার লোকজনের সাথে সব সম্পর্কের অবসান ঘটাতে চায়নি। তারা আশঙ্কা করেছিল, জেরুসালেম পরিণত হবে সংকীর্ণ ও অন্তর্মুখী এবং নগরীটি অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। কিন্তু অন্যরা নতুন বিধান প্রবল উৎসাহভরে গ্রহণ করে নেয়। ইজরার পরবর্তী কালের প্রজন্মগুলোর আমলে জেরুসালেমের অবস্থা সম্পর্কে আমরা সামান্যই জানতে পারি। তবে পরবর্তী আট প্রজন্মের মধ্যে বিধানটি জুদার লোকজনের আধ্যাত্মিকতায় টেম্পলের মতোই কেন্দ্রীয় বিষয়ে পরিণত হয়েছিল। এই দুই পবিত্র মূল্যবোধ বিপদগ্রস্ত হলে জেরুসালেমের জন্য সৃষ্টি করে সঙ্কট। আর তা নগরীর নতুন ইহুদি পরিচিতি প্রায় হারানোর পর্যায়ে নিয়ে যায়।

    ⤶ ⤷
    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleছোটগল্প – মুহম্মদ জাফর ইকবাল
    Next Article বাইবেল কোরআন ও বিজ্ঞান – মরিস বুকাইলি
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Generic selectors
    Exact matches only
    Search in title
    Search in content
    Post Type Selectors
    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Our Picks

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }