Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • English Books
      • Jules Verne
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    জেরুসালেম : ওয়ান সিটি থ্রি ফেইস – ক্যারেন আর্মস্ট্রং

    মোহাম্মদ হাসান শরীফ এক পাতা গল্প727 Mins Read0
    ⤶ ⤷

    ৬. জুদার অ্যান্টিয়ক

    মেসিডোনের আলেক্সান্ডার খ্রিস্টপূর্ব ৩৩৩ সালের অক্টোবরে ইসাস নদীর তীরে পারস্যের রাজা তৃতীয় দারিয়াসকে পরাজিত করলে জেরুসালেমের ইহুদিরা কষ্ট পেয়েছিল। কারণ তারা দুই শ’ বছর ধরে পারস্যের অনুগত সামন্ত ছিল। প্রথম শতকের ইহুদি ইতিহাসবিদ জোসেফাস ফ্ল্যাভিয়াস আমাদের বলছেন, প্রধান পুরোহিত প্রথমে আলেক্সান্ডারের কাছে নতি স্বীকার করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন এ কারণে যে তিনি শেষ পারস্য রাজার অনুগত থাকতে সংকল্প ব্যক্ত করেছিলেন। কিন্তু একটি স্বপ্নের কারণে তিনি ওই অবস্থান থেকে সরে আসেন। তা হলো আলেক্সান্ডার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, তার সাম্রাজ্যজুড়ে ইহুদিরা তাদের নিজেদের বিধান অনুসরণ করতে পারবে।’ বস্তুত, আলেক্সান্ডার কখনো জেরুসালেম সফর করেছিলেন, এমন সম্ভাবনা খুবই কম। মেসেডোনিয়ার এ বিজয় জুদার জনজীবনে সত্যিকার অর্থে খুবই সামান্য পরিবর্তন এনেছিল। প্রদেশটির সরকারি বিধান হিসেবে তাওরাত বহাল থাকে, যে পারস্য আইন ছিল, তাই বিরাজ করতে থাকে, পারস্য আমলের প্রশাসনও বহাল ছিল। কিন্তু তারপরও সর্বোচ্চ পুরোহিতের সাথে আলেক্সান্ডারের আচরণ-সম্পর্কিত কিংবদন্তিটি তাৎপর্যপূর্ণ। কারণ এটি হেলেনবাদের প্রতি ইহুদি প্রতিক্রিয়ার জটিলতা ফুটিয়ে তুলেছে। কিছু ইহুদি সহজাতভাবেই গ্রিক সংস্কৃতির প্রতি সঙ্কুচিত থেকে পুরনো বিধানে আঁকঢ়ে থাকে, অন্যরা হেলেনবাদকে সামঞ্জস্যপূর্ণ বিবেচনা করে তাদের নিজস্ব ঐতিহ্যের প্রতি বিপুলভাবে সহানুভুতিসম্পন্ন মনে করে। এই পরস্পরবিরোধী গ্রুপগুলোর মধ্যকার সংগ্রাম প্রায় তিন শ’ বছর ধরে জেরুসালেমের ইতিহাসকে আলোড়িত করেছিল।

    আলেক্সান্ডারের বিপুল বিজয়ের কয়েক দশক আগেই হেলেনবাদ ধীরে ধীরে নিকট প্রাচ্যে অনুপ্রবেশ করছিল। ধর্মের পুরনো সংস্কৃতি কুঁকড়ে যাচ্ছিল, গ্রিস চেতনায় অনিবার্যভাবে প্রভাব বিস্তার করছিল। কিন্তু জেরুসালেমের ইহুদিদের সাথে গ্রিকদের সরাসরি যোগাযোগ হয়েছিল সম্ভবত খুবই কম। সাধারণত ফোনিশিয়ার উপকূলীয় নগরীগুলোর মাধ্যমে তারা ওই সংস্কৃতির সংস্পর্শে এসেছিল। এই মধ্যস্ততার মাধ্যমেই আরো পরিচিত পরিভাষায় এই সাংস্কৃতিক উপাদানগুলো রূপান্তরিত করতে পারত। জেরুসালেম আবারো বিচ্ছিন্ন এলাকায় অনেক বেশি পশ্চাৎপদ অংশে পরিণত হয়েছিল। এটি কোনো প্রধান বাণিজ্যিক রুটের মধ্যে ছিল না। পেত্রা ও গাজার মতো কাছাকাছি নগরীতে যাত্রাবিরতি করা কাফেলাগুলোর জেরুসালেমে যাওয়ার কোনো কারণ ছিল না। এটি ছিল গরিব নগরী, শিল্প বিকাশের মতো কোনো খনিজসম্পদ ছিল না। অন্তর্মুখীভাবে এই নগরী মন্দিরটি ও অনুমিত প্রাচীন তাওরাতকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হতো। আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে জেরুসালেমের ভূমিকা ছিল নগন্য, পাশ্চাত্য থেকে ওই অঞ্চলে অনুপ্রবেশ করা আধুনিকতার চেয়ে সে অতীতের দিকেই বেশি মনোযোগী ছিল।

    তবে ৩২৩ সালের ১৩ জুন বেবিলনে আলেক্সান্ডার দি গ্রেটের মৃত্যুর পর বিরাট পরিবর্তন ঘটে। একমাত্র সম্ভাব্য উত্তরসূরি ছিল এক ছোট ছেলে। সাম্রাজ্য দখলের জন্য প্রায় সাথে সাথে শীর্ষস্থানীয় জেনারেলদের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। পরের দুই দশকের জন্য আলেক্সান্ডারের জয় করা এলাকাগুলো ছয় উত্তরসূরির যুদ্ধে প্রকম্পিত হয়। গুরুত্বপূর্ণ ট্রানজিট অঞ্চল হিসেবে জুদা এশিয়া মাইনর বা সিরিয়া থেকে মিসরগামী সৈন্যবাহিনীর মালামাল, সরঞ্জাম, পরিবার ও ক্রীতদাসদের নিয়ে অব্যাহত এগিয়ে যাওয়ার সময় আক্রান্ত হতো। জেরুসালেম এসব বছরে অন্তত ছয়বার বিজিত হয়, এর অধিবাসীরা বেদনাদায়কভাবে বুঝতে পারে, শান্তিপূর্ণ বিচ্ছিন্ন থাকার দীর্ঘ সময়টি শেষ হয়ে গেছে। জেরুসালেমের ইহুদিরা হেলেনবাদকে ধ্বংস সৃষ্টিকারী, সহিংস ও সামরিকতন্ত্র হিসেবে মনে করতে থাকে। মেসেডোনিয়ার উত্তরসূরিরা ঔদ্ধত্য বিজয়ী হিসেবে নগরীতে প্রবলভাবে প্রবেশ করেছিল। তারা তাদের স্বার্থের সাথে সংশ্লিষ্ট কোনো বিষয় ছাড়া অন্য কোনো ব্যাপারে স্থানীয় জনসাধারণের দিকে নজর দেয়নি। এই ভয়ঙ্কর বছরগুলোতে পাশ্চাত্য সংস্কৃতি বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনকারী গ্রিক শিল্পকলা, দর্শন, গণতন্ত্র ও সাহিত্য জেরুসালেমের অধিবাসীদের মনে কোনো দাগ কাটতে পারেনি। তারা সম্ভবত গ্রিকদের ‘শক্তিশালী ও খারাপ’ হিসেবে অভিহিতকারী জনৈক সংস্কৃত লেখকের সাথে একমত ছিল।

    জুদা, সামেরিনা, ফোনিসিয়া ও সমগ্র উপকূলীয় এলাকা ৩০১ সালে টলেমি প্রথম সটারের বাহিনীর দখলে চলে যায়। এই ‘উত্তরসূরি’ সম্প্রতি মিসরে নিজের শক্তিশালী ঘাঁটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। পরের এক শ’ বছরে জেরুসালেম টলেমিদের নিয়ন্ত্রণে থাকে। উত্তরের আক্রমণ থেকে রক্ষা পেতে সামরিক নিরপেক্ষ এলাকা হিসেবে সিরিয়া প্রদেশ তাদের দরকার ছিল।

    বেশির ভাগ প্রাচীন কালের শাসকের মতো টলেমিরাও স্থানীয় বিষয়াদিতে অতিরিক্ত কোনো হস্তক্ষেপ করত না। অবশ্য অনেক মূলধারার ও কার্যকর ধরনের প্রশাসন প্রতিষ্ঠা করতে আগ্রহী ছিল তারা। তারা তাদের রাজ্যের বিভিন্ন অংশে যথেষ্ট নমনীয়তার সাথে প্রাসঙ্গিক বিধান প্রয়োগ করত। প্রদেশটির কিছু অংশ ছিল রাজকীয় ভূমি। এগুলো ছিল রাজকীয় কর্মকর্তাদের প্রত্যক্ষ শাসনে। তাছাড়া জোপ্পা ও স্ট্র্যাটোর টাওয়ারে নতুন বন্দর প্রতিষ্ঠা করা হয়, বেথ শান, ফিটোরেরা ও পেলায় নতুন নতুন সামরিক উপনিবেশ গড়ে তোলা হয়। দেশটির বাকি অংশ তার নিজস্ব ব্যাপারগুলো ব্যবস্থাপনা করতে অনেক বেশি স্বাধীন ছিল। ফোনিশিয়ানদের টায়ার, সিডন, ত্রিপলি ও বেবলোকে অনেক স্বাধীনতা ও সুবিধা দেওয়া হয়েছিল। গ্রিক উপনিবেশিকরা সিরিয়া গিয়ে নিজেদের মতো গণতান্ত্রিক গ্রিক প্রজাতন্ত্রের মতো নগর-রাষ্ট্র গড়ে তোলে। এসব নগরীর মধ্যে ছিল গাজা, শেচেম, ম্যারিসা ও আম্মান। এগুলো কার্যত ছিল স্বায়াত্তশাসিত। গ্রিক সৈন্য, বণিক, উদ্যোক্তারা প্রাচ্যের নতুন নতুন সুযোগ গ্রহণ করতে এসব বসতিতে জড়ো হতে থাকে। স্থানীয় লোকজন গ্রিক ভাষায় লিখতে ও পড়তে পেরে ‘হেলেনিস’ হয়ে গিয়েছিল। তাদেরকে সেনাবাহিনী ও প্রশাসনের নিম্ন সারিতে প্রবেশ করার সুযোগ দেওয়া হতো।

    পোলিস ছিল ওই অঞ্চলের বেশির ভাগ লোকের পরিচিত ঐতিহ্যের কাছে অপরিচিত বিষয়। হেলেনবাদী সংস্কৃতি ছিল সেক্যুলার। এটি এমন এক বুদ্ধিবৃত্তিক অবস্থার ওপর নির্ভরশীল ছিল যা প্রাসাদ ও মন্দির উভয়টি থেকে নিরপেক্ষ। ঐশীভাবে নিযুক্ত শাসক বা কোনো পুরোহিত এলিটের মাধ্যমে শাসিত না হয়ে পোলিসে সরকার ছিল ধর্ম থেকে আলাদা। জিমনেসিয়াও এসব নতুন গ্রিক নগরীতে আবির্ভূত হয়েছিল। এখানে তরুণদেরকে হেলেনবাদী আদর্শে প্রশিক্ষিত করা হতো। তারা গ্রিক সাহিত্য অধ্যায়ন করত, কঠোর দৈহিক ও সামরিক প্রশিক্ষণ নিত, একইসাথে দেহ ও মন গঠন করত। জিমনেসন ছিল এমন প্রতিষ্ঠান যা তাদের বিপুল বিস্তৃত সাম্রাজ্যকে একত্রিত রাখার ব্যবস্থা করত। এর নিজস্ব ধর্মীয় মূল্যবোধ ছিল। অলিম্পিক গেমসের (এতে হারমেস ও হেরাক্লেয়াসের সম্মানে ধর্মীয় উদযাপনের জন্য তরুণরা ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় অংশ নিত) মতো জিমনেসিয়ারও পৃষ্ঠপোষক ছিল। সাধারণত স্থানীয় লোকজনদেরকে জিমনেসনে প্রবেশ করতে দেওয়া হতো না। এটি গ্রিকদের জন্য বিশেষভাবে সংরক্ষিত ছিল। তবে টলেমিরা বিদেশীদের প্রবেশে সুযোগ দিত। এর ফলেই আলেক্সান্দ্রিয়ার ইহুদিরা জিমনেসনে প্রশিক্ষণের সুযোগ পেয়ে গ্রিক ও ইহুদি সংস্কৃতির অনন্য মিথষ্ক্রিয়া অর্জন করতে সক্ষম হয়েছিল। গ্রিকরা ছিল বস্তুবাদী ও অনেক সময় জঘন্য খারাপ। তবে স্থানীয়দের অনেকে এই নতুন সংস্কৃতিকে প্রলুব্ধকারী হিসেবে দেখতে পেয়েছিল। অনেকের কাছে এটি ছিল অপ্রতিরোধ্য, ঠিক যেমন বর্তমানে উন্নয়নশীল বিশ্বের অনেকের কাছে পাশ্চাত্য সংস্কৃতি অপ্রতিরোধ্য। এটি ছিল আকর্ষণ সৃষ্টিকারী ও প্রতিরোধকারী, এটি টাবু গুঁড়িয়ে দিয়েছিল। তবে ঠিক এই কারণেই অনেকে এটিকে ব্যাপকভাবে মুক্তি সৃষ্টিকারী মনে হয়েছিল।

    প্রথমে এসব নতুন আইডিয়ায় জেরুসালেম প্রভাবিত হয়নি। এটি পোলিস ছিল না, এ কারণে এখানে কোনো জিমনেসিনও ছিল না। অধিবাসীদের বেশির ভাগই যিহোবার নগরীতে হারমেসকে সম্মান জানানোর ধারণায় আতঙ্কিত হয়ে পড়েছিল, তরুণরা নগ্ন হয়ে ব্যায়াম করছে, এমনটা দেখে ভীত হয়ে পড়েছিল। টলেমিদের ব্যাপারে জুদার বড় ধরনের কোনো আগ্রহ ছিল না। ইহুদিরা স্বতন্ত্র ধরনের ‘জাতি’ (ইথনো) গঠন করেছিল। তারা জেরুসালেমভিত্তিক প্রবীণদের পরিষদ জারুসিয়ার মাধ্যমে শাসিত হতো। ‘জাতির’ আনুষ্ঠানিক বিধান ছিল তাওরাত। এটি পারস্যদের অধীনে যেমন ছিল, তেমনই থেকে যায়, অর্থাৎ মন্দির রাষ্ট্রটি এর পুরোহিতদের মাধ্যমে শাসিত হতো। টলেমিরা জুদার বিষায়াদি ওপর নজর রাখার জন্য স্থানীয় এজেন্ট (ওকোনোমোস) নিয়োগ করত, অন্তত যুদ্ধের সময় হলেও তারা নগরীতে একটি গ্যারিসন মোতায়েন করত। তবে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে, ইহুদিদের নিজেদের মতো করেই চলার সুযোগ দেওয়া হয়। মিসরীয় সরকারের সাথে তাদের সম্পর্কের সংযোগসূত্র ছিল ২০ ট্যালেন্ট করে কর। এটি প্রতিবছরই পরিশোধ করতে হতো।

    তবে জেরুসালেমকে যে গ্রিক বিশ্বে টেনে নিয়ে যাওয়া হবে, তা অবধারিতই ছিল। বাকি দেশকেও বদলে দিয়েছিল এটি। দ্বিতীয় টলেমির রাজত্বকালে (২৮২- ৪৬) যোশেফ নামের এক জেরুসালেমবাসী পুরো সিরিয়া প্রদেশের কর সংগ্রহ করার চাকরি জুটিয়ে নিতে সক্ষম হয়েছিলেন। ২০ বছর ধরে তিনি ছিলেন দেশের অন্যতম ক্ষমতাধর ব্যক্তি। যোশেফ ছিলেন তোবিয়াদ গোত্রের লোক, এবং সম্ভবত তোবিয়ার বংশধর, যিনি নেহেমিয়াকে বেশ ঝামেলায় ফেলেছিলেন। যদি তা-ই হয়ে থাকে, তবে তোবিয়াদরা তাদের জীবন তাওরাতের মাধ্যমে পুরোপুরি নিয়ন্ত্রিত হোক তা চাইছিল না। তারা তখনো বিদেশীদের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করতে চাইত, জেরুসালেম এস্টাবলিশমেন্টের বর্জনশীল মূল্যবোধের মধ্যে দাখিল হতে চাইত না। ট্রান্স জর্দানে আম্মানতিসের তোবাইদ এস্টেটটি টলেমিদের অন্যতম সামরিক উপনিবেশে পরিণত হয়। যোশেফ নিশ্চিতভাবেই গ্রিক বিশ্বে স্বস্তিতে ছিলেন। তিনি জেরুসালেমে হেলেনিদের বিপুল পরিমাণ আর্থিক লেনদেন করতে সক্ষম হয়ে প্রথম ইহুদি ব্যাংকারে পরিণত হয়েছিলেন। তার সহকর্মী অনেক ইহুদি যোশেফের সাফল্যে গর্বিত ছিল। যোশেফাসের উদ্ধৃতিতে স্থান পাওয়া একটি ছোট কাহিনীতে তার জীবন-কথা বলা হয়েছে। এতে তার চতুরতা, প্রতারণা ও উদ্যোক্তা হিসেবে তার দক্ষতার উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করা হয়েছিল। নিজ জাতির লোকজনকে দারিদ্র থেকে উদ্ধার ও টলেমিদের ওই অঞ্চলে নিজে আসা অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিতে তাদের সংশ্লিষ্ট করিয়ে দিতে পারার জন্য লেখক যোশেফের প্রশংসা করেছিলেন।

    তোবাইদরা জেরুসালেমে হেলেনবাদের পথিকৃতে পরিণত হয়। তারা তাদের নগরী থেকে পুরনো ঐতিহ্য বিদায় করতে চেয়েছিল। তাদের কাছে এসব ধ্যান- ধারণা অনুপযোগী ও সংকীর্ণ বিবেচিত হয়েছিল। তারা একাই এ কাজ করেনি। গ্রিক সাম্রাজ্যের অনেক লোকই তাদের পূর্বপুরুষদের ধ্যান-ধারণা হঠাৎ করে নির্যাতনমূলক বিবেচনা করে সেগুলো সরিয়ে ফেলতে চেয়েছিল। তাদের বিশ্বকে বিচ্ছিন্ন – যেখানে ওই সীমা, সীমান্তরেখা ও সীমান্ত সুস্পষ্টভাবে অঙ্কিত ও সুনির্দিষ্ট করা ছিল অনিবার্য – হিসেবে দেখার বদলে অনেকেই আরো বড় দিগন্তের দিকে তাকিয়ে ছিল। পোলিস ছিল রুদ্ধ দুনিয়া, কিন্তু অনেক গ্রিক এখন নিজেদের কসমোপলিটান হিসেবে বিবেচনা করতে থাকল, তারা নিজেদের মনে করত পুরো মহাবিশ্বের নাগরিক। তাদের দেশকে সবচেয়ে ঐশী মূল্যবোধ, কারণ এটি তাদেরকে বিশ্বে অনন্য স্থান দিয়েছিল, হিসেবে বিবেচনা না করে গ্রিকরা উপনিবেশিক ও বিশ্ব পর্যটকে পরিণত হয়। আলেক্সান্ডারের বিজয় বিশ্বকে খুলে দিয়েছিল, পোলিসকে ক্ষুদ্র ও অপর্যাপ্ত স্থানে পরিণত করেছিল। যে অসীমতা তাদের পূর্বপুরুষদের কাছে বিশৃঙ্খল ও হুমকিপূর্ণ মনে হয়েছিল, এখন সেটিই উদ্দীপ্ত ও মুক্তি দানকারী মনে হতে লাগল। গ্রিক বিশ্বের ইহুদিরাও এই শিকড়হীনতায় অংশ নিলো, পছন্দনীয় লোকদের সদস্য, সীমাবদ্ধতায় আইনে বাধাগ্রস্ত হওয়ার বদলে মানবতার নাগরিকে পরিণত হতে চাইল। তৃতীয় শতকের শেষ নাগাদ কিছু ইহুদি গ্রিক শিক্ষার মূল বিষয়টি অর্জন করতে শুরু করে, তাদের শিশুদের গ্রিক নাম রাখতে থাকে।

    অন্যরা এসব কিছুকে চরম হুমকিপূর্ণ মনে করতে থাকে। তারা টেম্পলকেন্দ্ৰিক ঐতিহ্য আঁকড়ে ধরে থাকে। বিশেষ করে নিম্নতর শ্রেণিতে, যারা নতুন সমৃদ্ধিতে অংশ নিতে পারছিল না, আগের চেয়েও ঐশী বিধানের প্রতি আগ্রহী হয়ে ওঠে। এতে নিশ্চিত করা হয় যে প্রতিটি জিনিসের নিজস্ব স্থান আছে, সমাজে শৃঙ্খলা তখনই প্রতিষ্ঠিত হতে পারে, লোকজন ও উদ্দেশ্য যখন সংশ্লিষ্ট স্থানে আবদ্ধ থাকে। রক্ষণশীল ইহুদিরা স্বাভাবিকভাবেই পুরোহিত, তাওরাত ও টেম্পলের অভিভাবকদের প্রতি আকৃষ্ট হয়। তাদের নেতা ছিলেন জোদোকবাদী বংশধর পরিবারের পুরোহিতরা। এসব পরিবারের সদস্যরা কিছু সময়ের জন্য জেরুসালেমের প্রধান পুরোহিত হয়েছিল। ওনিয়াদরা নিজেদেরকে গ্রিক আদর্শে আকৃষ্ট করেছিল। তাদের কারো কারো গ্রিক নামও ছিল। তবে তারা পুরনো বিধান ও ঐতিহ্য মেনে চলতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিল। এসবের ওপরই তাদের ক্ষমতা ও সুযোগ- সুবিধা নির্ভরশীল ছিল।

    ওই শতকের শেষ দিকে পরিষ্কার হয়ে যায় যে মেসোপোটেমিয়ার গ্রিক রাজ্য শাসনকারী সেলুসিড রাজবংশের কাছে জেরুসালেম খোয়াতে পারে টলেমিরা। ২১৯ সালে তরুণ, উচ্চাভিলাষী সেলুসিক রাজা তৃতীয় অ্যান্টিয়ওকাস সামারিয়া ও ফোনিশিয়ান উপকূলীয় এলাকা আক্রমণ করেন। তিনি চার বছর এসব এলাকায় নিজের নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছিলেন। এমনকি টলেমি চতুর্থ ফিলোপাটার তাকে শেষ পর্যন্ত তাড়িয়ে দিতে পারলেও মনে হচ্ছে, তিনি ফিরে এসেছিলেন। কারণ, যোশেফ তাদের প্রধান কর সংগ্রহকারী হওয়ার পর থেকে টলেমিদের খুবই ঘনিষ্ঠ হয়েছিল তোবিয়াদরা। অন্য দিকে, জেরুসালেমের অধিকতর রক্ষণশীল ইহুদিরা সেলুসিডদের সমর্থন করত, আশা করত যে তারাই দেশটিতে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে পারবে। তোবিয়াদরা অভ্যন্তরীণ পারিবারিক বিরোধে জড়িয়ে পড়েছিল। তেজোদীপ্ত উচ্চ পুরোহিত ওনিয়াদ পরিবারের দ্বিতীয় সিমন নগরীতে বেশ প্রভাব অর্জন করেছিলেন, সেলুসিডদের স্বার্থ সমর্থন করতেন। ২০৩ সালে অ্যাটিয়াস আবার দেশটি আক্রমণ করলে ২০১ সালে তার ইহুদি সমর্থকেরা তাকে জেরুসালেমের দুর্গ দখল করতে সাহয়তা করে। অবশ্য টলেমিরা পরের বছর তাদেরকে নগরী থেকে বের করে দেয়। ২০০ সালে জেরুসালেম দীর্ঘ অবরোধের মুখে পড়ে, অ্যান্টিয়স আবারো নগরীটি দখল করার আগে মারাত্মক ক্ষতির মুখে পড়ে।

    এবার সেলুসিডরা পুরো দেশটি জয় করে। তারা একে কোয়েলে-সিরিয়া ও ফোনিসিয়া প্রদেশ নামে ডাকতে থাকে। বিভিন্ন রাজনৈতিক ইউনিটের জন্য আবারো ভিন্ন ভিন্ন প্রশাসনিক ইউনিটব্যবস্থা চালু করা হয়। এসব ইউনিটের মধ্যে ছিল গ্রিক ও ফোনিশিয়া নগরী, সামরিক উপনিবেশ, ও রাজকীয় ভূখণ্ড। ইহুদি লেকদের সহায়তায় অ্যান্টিয়াস জুদার মূল্যবোধবিষয়ক বিশেষ সনদ রচনা করেন, জেরুসালেমে তার সমর্থকদের পুরস্কৃত করেন। দ্বিতীয় সিমনকে মূল্যবোধবিষয়ক অংশের প্রধান করা হয়। এর মানে হলো, হেলেনবাদী তোবিয়াদদের বিপরীতে পুরোহিততান্ত্রিক রক্ষণশীল পক্ষ উন্নতি লাভ করে। তাওরাত দেশের আইন হিসেবে বহাল থাকে, ইহুদি সিনেট পরিচালনা সংস্থা হিসেবে বিরাজ করতে থাকে। সনদে টেম্পলের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা করা হয়, এতে ইহুদিদের ঐশী ভূগোল প্ৰতিফলন ঘটালেও নেহেমিয়া ও ইজরার চেয়ে বেশি বর্জনমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়। উপাসনালয়ের বিশুদ্ধতা সংরক্ষণ করার জন্য জেরুসালেম নগরীকে সব অশুদ্ধতা থেকে মুক্ত করা হয়। নগরীর ফটকগুলোতে জেরুসালেমে ‘অশুদ্ধ’ প্রাণীর প্রজনন বা জবাই এখন নিষিদ্ধ হয়ে যায়। পুরোহিতদের মতো করে গোসল না করলে পুরুষ ইহুদিদের টেম্পলের ভেতরের প্রকোষ্ঠে প্রবেশ করার সুযোগ দেওয়া হতো না, এখানেই বলি দেওয়া হতো। পৌত্তলিকদেরও ভেতরের প্রকোষ্ঠে যেতে দেওয়া হতো না। এটি ছিল এমন এক উদ্ভাবন যার কোনো ভিত্তি তাওরাতে ছিল না। তবে এর মাধ্যমে পৌত্তলিক বিশ্বের প্রতি জেরুসালেমের অধিকতর রক্ষণশীল ইহুদিদের বৈরিতার বিষয়টি প্রতিফলিত হয়। এটি নগরীতে গ্রিক পর্যটকদেরও প্রবলভাবে অভিভূত করে। টেম্পল ভবনগুলো থেকে সাধারণ লোকদের দূরে রাখাকে সহজাত বিষয় হিসেবেই দেখা হয়েছিল। কারণ, অনাদিকাল থেকে থেকেই প্রায় সব টেম্পলেই পুরোহিতদেরই কেবল অভ্যন্তরীণ প্রকোষ্ঠে প্রবেশ করার সুযোগ দেওয়া হতো। তবে গ্রিসে পরিশুদ্ধির স্বাভাবিক কৃত্যাচার পালনের পর যে কেউ টেম্পল আঙিনায় প্রবেশ করতে পারত। এখন জেরুসালেমে যাওয়া গ্রিক পরিদর্শকেরা দেখতে পেল, নারী ও শাস্ত্রীয়ভাবে অশুদ্ধ বিবেচিত ইহুদিদের সাথে তাদেরকেও বাইরের আঙিনায় সীমিত রাখা হচ্ছে। তাওরাত অনুসরণ না করায় বিদেশীদের ‘অশূচি’ ঘোষণা করা হয়েছিল। তাদেরকে পবিত্রতার গণ্ডির বাইরে তাদের জন্য নির্ধারিত স্থানেই থাকতে হতো।

    তবে ঐশী চৌহদ্দির মধ্যে থাকা ইহুদিদের জন্য টেম্পল মতবাদ এমন এক স্বর্গীয় অভিজ্ঞতা সৃষ্টি করত যা জীবন সমৃদ্ধ করার নতুন নির্মলতা ও অনুভূতি এনে দিত। সেলুসিড আমলের প্রথম দিকে জেরুসালেমে লেখালেখিতে নিয়োজিত বেন সিরাহ সিমনের যম কিপ্পুরের অনুষ্ঠান পালনের বর্ণনা দিতে গিয়ে বিশ্বাসীদের ওপর টেম্পল প্রার্থনাবিধির প্রভাব সম্পর্কে কিছু ধারণা দিয়েছেন। বছরে একটি দিন ছিল, যখন পদস্থ পুরোহিতকে বিশ্বাসীদের পক্ষ থেকে দেভিরে প্রবেশের অনুমতি দেওয়া হতো। তিনি বের হওয়ার সময় লোকজনের জন্য বিপুল পবিত্রতা বয়ে আনতেন। সিমনের চারপাশে যে ঐশী জ্যোতি ছিল, তা টেম্পলের ছাদে সূর্যের রশ্মি, দৃষ্টিনন্দন রঙধনু, ফলভারে নত জলপাই গাছ ও স্বর্গের দিকে উঠতে থাকা সাইপ্রেসের সাথে তুলনীয়। বাস্তবতা উচ্চকিত হতো, অভিজ্ঞতা ছিল আরো তীব্র ঐশী সত্তা পূর্ণ সম্ভাবনা নিয়ে প্রকাশিত হতো। সিমনের সময় পদস্থ পুরোহিতের অফিসটি সম্পূর্ণ নতুন মর্যাদা পেয়েছিল। এটি জুদা মতবাদের অখণ্ডতার প্রতীকে পরিণত হয়, জেরুসালেমের রাজনীতিতে ক্রমবর্ধমান হারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে থাকে। বেন সিরাহ বিশ্বাস করতেন, পদস্থ পুরোহিত একাই তাওরাতের সুনির্দিষ্ট ব্যাখ্যা করার কর্তৃত্ব রাখেন। তিনি ছিলেন ধারাবাহিকতার প্রতীক : দাউদ পরিবারের রাজত্ব মাত্র কয়েক প্রজন্ম স্থায়ী হলেও হারুনের পুরোহিত্ব টিকেছিল চির দিন। বর্তমান সময় যিহোবা তার জাতির মন-মগজে এতই সমুচ্চ ও তুরীয় ছিল যে তার নাম পর্যন্ত উচ্চারণ করা বিপজ্জনক হয়ে পড়েছিল। তাওরাত পড়ার সময় হিব্রু ব্যাঞ্জনবর্ণ ওয়াইএইচডব্লিউএইচ শব্দগুচ্ছ পাওয়া গেলে ইহুদিরা এখন এর বদলে প্রতিশব্দ ‘আদোনাই’ (প্রভু) বা ‘আল ইলিয়ন’ (সর্বোচ্চ) উচ্চারণ করত। একমাত্র উচ্চ পুরোহিতই ঐশী নামটি উচ্চারণ করতে পারতেন, আর তাও বছরে একবার যম কিপ্পুরে। জেরুসালেমে নির্মাণকাজের জন্য সিমনের প্রশংসাও করেছেন বেন সিরাহ। তিনি নগরপ্রাচীর ও প্রবেশদ্বার মেরামত করেন। ২০০ সালের অবরোধে এগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। তিনি টেম্পল মাউন্টের উত্তরে একটি বিশাল জলাধার (সাগরের মতো বিশাল) খনন করেন। এটি বেথ-হেসদা পুল (আরমাইকে ‘হাউস অব মারসি’) নামে পরিচিত হয়। ঐতিহ্যগতভাবে রাজার দায়িত্ব হিসেবে বিবেচিত হয় নির্মাণকাজ। কিন্তু অ্যান্টিওচুক এসব মেরামতের জন্য পাওনা পরিশোধ করতে রাজি হননি। তিনি স্রেফ নগরীর কর থেকে ভবন নির্মাণের ব্যয় বাদ দেন। ফলে সাইমন এই লঙ্ঘনে হস্তক্ষেপ করেন। তিনি বলেন, এটি জেরুসালেমের রাজা ও পুরোহিতের কাজ।

    বেন সিরাহ ছিলেন রক্ষণশীল। তিনি এখন নগরীতে নীরবে প্রবেশ করা বস্তুবাদের জন্য বিলাপ করছিলেন। তিনি দেখতে পাচ্ছিলেন, গ্রিকদের মতো করে অনেকেই বণিকতান্ত্রিক ব্যবস্থায় আক্রান্ত হয়েছে। গ্রিকরা তাদের ঘুসের জন্য লেভ্যাটাইনদের দায়ী করলেও বাস্তবে তারা এ বদভ্যাসটি পাশ্চাত্য থেকে নিয়ে এসেছিল। প্রাচীনকালে জায়ন মতবাদে জোর দিয়ে বলা হয়েছিল, জেরুসালেম হলো গরিবদের আশ্রয়কেন্দ্র। কিন্তু বেন সিরাহ অভিযোগ করলেন, এখন জেরুসালেমবাসী দারিদ্র্যতাকে অবমাননাকর মনে করে, সম্পদের জন্য গরিবদেরকে একবারে ফেলে পদদলিত করা হয়। আর যদিও বেন সিরাহর গ্রিকদের তোষামতকারী ইহুদিদের প্রতি বিতৃষ্ণ ছিলেন, কিন্তু তিনি নিজেও হেলেনবাদের প্রলোভন থেকে মুক্ত ছিলেন না। তরুণ গ্রিকরা জিমনেসিয়ায় যেভাবে হোমারের রচনাবলী পাঠ করে, জেরুসালেমের তরুণরা কেন সেভাবে মুসার লেখা পড়বে না? এটি ছিল একটি বিপ্লবী পরামর্শ। এরপর থেকে পড়াশোনা না-জানা লোকজন তাওরাতের উদ্ধৃতি মুখস্ত করতে থাকবে, তবে তারা এগুলো পড়তে পারবে, তা প্রত্যাশা করা হয়নি : পুরোহিতেরা তাদের কাছে বিধিবিধান ব্যাখ্যা করবে। কিন্তু বেন সিরাহ নিজে পুরোহিত ছিলেন না। তিনি ছিলেন ইহুদি বুদ্ধিজীবী, তিনি বিশ্বাস করতেন, তাওরাত হওয়া উচিত সব পুরুষ ইহুদির উদার শিক্ষার ভিত্তি। ৫০ বছর পর বেন সিরাহর নাতি, তিনি তার গ্রন্থটি গ্রিকে অনুবাদ করেছিলেন, এ ধরনের শিক্ষা অপরিহার্য বিবেচনা করেছিলেন।’ নিকটপ্রাচ্য জুড়ে হেলেনবাদী চ্যালেঞ্জের বিরোধিতাকারী পুরনো ধর্মগুলো গ্রিক বিশ্বের সংস্পর্শে এসে সূক্ষ্মভাবে বদলাতে থাকে। ইহুদি ধর্মও ভিন্ন কিছু ছিল না। বেন সিরাহর মতো ইহুদিরা ইতোমধ্যেই তাদের ঐতিহ্যের আদর্শ হিসেবে গ্রিক শিক্ষাকে গ্রহণ করেছিলেন। এর ফলে রাব্বানিক ইহুদি ধর্মের ভিত্তি প্রতিষ্ঠিত হয়। এমনকি রাব্বিদের বিকশিত প্রশ্ন ও জবাবের ব্যবস্থাটি সক্রেটিসের শিক্ষা-পদ্ধতির প্রভাব প্রদর্শন করতে থাকে।

    তবে অন্য ইহুদিরা আরো অগ্রসর হয় : তারা পুরোপুরি গ্রিক শিক্ষা গ্রহণ করার আশা করতে থাকে। তারা বিশ্বাস করতে পারছিল না যে এটি ইহুদি ধর্মের সাথে অসামঞ্জস্যপূর্ণ হবে। অল্প সময়ের মধ্যেই তারা জেরুসালেমের রক্ষণশীলদের সাথে সঙ্ঘাতে মেতে ওঠেছিল। বিভক্তির প্রথম লক্ষণটি ফুটে ওঠে ১৮০ সালের দিকে। ওই সময় উচ্চ পুরোহিত দ্বিতীয় ওনিয়াস, দ্বিতীয় সাইমনের ছেলে, অভিযুক্ত হন টেম্পল কোষাগার থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার জন্য। রাজা চতুর্থ সেলুকাস সাথে সাথে তার উজিড় হেলিওডোরাসকে অ্যান্টিয়ক থেকে জেরুসালেমে পাঠান অর্থ উদ্ধারের জন্য। তিনি বিশ্বাস করতেন, এই অর্থ সেলুসিড রাষ্ট্রের। এই পর্যায়ে এই নগরীতে সেলুসিডদের উদ্দীপনা কমে গিয়েছিল। ১৯২ সালে তৃতীয় অ্যান্টিয়ক অগ্রসয়মান রোমান সেনাবাহিনীর হাতে শোচনীয় পরাজয় বরণ করেন। রোমান সেনাবাহিনী গ্রিস ও আনাতোলিয়ার বেশির ভাগ দখল করে নেয়। তাকে সিংহাসনে বসার অনুমতি দেওয়া হয় এই শর্তে যে তিনি বিপুল ক্ষতিপূরণ ও বার্ষিক কর দেবেন। তার উত্তরসূরিরা এর ফলে সবসময় অর্থের তীব্র সঙ্কটে ভুগতেন। চতুর্থ সেলুসিড সম্ভবত এই ধারণা পোষণ করতেন যে সনদের ফলে তাকে জেরুসালেম মতবাদের সব ব্যয়ভার বহন করতে বাধ্য হওয়ায় টেম্পলের কোষাগার নিয়ন্ত্রণ করার অধিকারও আছে তার। তবে তিনি টেম্পলের ব্যাপারে ইহুদি স্পর্শকাতরতার বিষয়টি উপলব্ধি করতে পারেননি। এখন এই বিষয়টি প্রথমবারের মতো সামনে এলো। হেলিওডোরাস যখন জেরুসালেমে পৌছে টেম্পলের কোষাগারের অর্থ বাজেয়াপ্ত করতে চাইলেন, তখন লোকজন আতঙ্কিত হয়ে পড়ল। অনিয়াস মৃতের মতো ফ্যাকাশে হয়ে পড়লেন, মুর্ছা যাওয়ার মতো কাঁপতে লাগলেন, নারীরা চট পরে রাস্তায় রাস্তায় দৌড়াতে লাগলেন, ছোট মেয়েরা তাদের জানালার সামনে গিয়ে ঐশী সহায়তা কামনা করতে লাগল। টেম্পলের বিশুদ্ধতা অলৌকিকভাবে রক্ষা পেয়েছিল। কোষাগারের দিকে যাওয়ার সময় হেলিওডোরাস বাতব্যধিগ্রস্তে মুর্ছা যান। এরপর তিনি সাক্ষী দেন যে তিনি তার নিজের চোখে ইহুদি ঈশ্বরকে দেখেছেন।

    এই ঘটনা ছিল একটি মাইলফলক : এর পর থেকে টেম্পলের ওপর যেকোনো ধরনের হামলা জেরুসালেমে দাঙ্গার উস্কানি দেওয়ার আশঙ্কা সৃষ্টি করে। বছরের পর বছর টেম্পল ইহুদি ধর্মের নির্যাস প্রকাশ করে আসছিল। এটি ছিল ইহুদিদের আবেগময় মানচিত্রের কেন্দ্র, তাদের অবরুদ্ধ পরিচিতির কেন্দ্রবিন্দু। এটি জাতির মূল, এর জীবনের উৎস, সৃষ্টিশীলতা ও বেঁচে থাকার উৎস বিবেচিত হচ্ছিল। তাওরাতের নির্দেশনা মেনে চলা ইহুদিদের হৃদয়-মনে টেম্পলটি তখনো কেন্দ্রীমুখী টান দিয়ে যাচ্ছিল। এমনকি বিদেশে থাকা ইহুদিরাও এখন প্রার্থনার সময় জেরুসালেমমুখী হতো। তারা টেম্পলের মহা উৎসবগুলো উদযাপনের জন্য পবিত্র নগরীতে দীর্ঘ তীর্থযাত্রা করতে শুরু করেছিল। সাম, প্রার্থনা ও পবিত্র লেখালেখি ইত্যাদি সবকিছুই তাদেরকে টেম্পলকে দুনিয়াতে স্বর্গ হিসেবে দেখতে উৎসাহিত করেছিল। এটি নিজে ঈশ্বরের সাথে সংশ্লিষ্ট হয়ে পড়েছিল। একীভূত হওয়ার তাগিদ থাকা বিশ্বে ইহুদিরা স্বতন্ত্র পরিচিতি রক্ষা করেছিল। ফলে টেম্পল ও এর নগরীটি যুদ্ধবিধ্বস্ত বিচ্ছিন্ন একটি এলাকায় পরিণত হয়েছিল। টেম্পল ভবনরাজির কাছাকাছি যেতে দেওয়া হতো না অ-ইহুদিদের, পবিত্রতার যেকোনো ধরনের লঙ্ঘনের চেষ্টা জনগণ ধর্ষণ হিসেবে চিহ্নিত করত। এটি কোনো যৌক্তিক অবস্থান ছিল না, এটি ছিল সহজাত ও তাৎক্ষণিক দৃঢ়সংকল্পবদ্ধ প্রতিক্রিয়া।

    তবে ১৮০ সালের সঙ্কটটি হেলিওডোরাসের স্ট্রোকের মাধ্যমে অবসান ঘটেনি। পরোক্ষ ইঙ্গিত রয়েছে যে ওনিয়াস কোনো না কোনোভাবে তার অসুস্থতার জন্য দায়ী ছিলেন, অপবাদ থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য তাকে সেলুসিডের দরবারে তার যাওয়া দরকার হয়ে পড়ল। তবে তার শত্রুরা যেভাবে চেয়েছিল, তিনি বোকার মতো ঠিক তা-ই করে বসলেন। অ্যান্টিয়কে অবস্থান করার সময় তার উচ্চাকাঙ্ক্ষী ভাই যশুয়া বা জ্যাসন, তিনি তাকে এই নামেই ডাকতে পছন্দ করতেন, রাজা সেলুকাসের কাছ থেকে আনুকূল্য লাভ করে উচ্চ পুরোহিত্ব পাওয়ার বিনিময়ে বিপুল পরিমাণে ঘুষ প্রদান করেন। সেলুকাস এতে খুশিমনে রাজি হওয়ামাত্র ওনিয়াস দরবার থেকে পালিয়ে যেতে বাধ্য হন। পরে তিনি খুন হন। তবে উচ্চ পুরোহিত জ্যাসন তার ভাইয়ের মতো রক্ষণশীল ছিলেন না। তার কাছে তাওরাত ছিল অর্থহীন। তিনি চাইতেন তার লোকজন গ্রিক জীবনযাত্রা গ্রহণের মাধ্যমে বৃহত্তর দুনিয়ার স্বাধীনতা উপভোগ করুক। দায়িত্ব গ্রহণ করার অল্প সময় পর রাজা সেলুকাসও নিহত হন। তাকে হত্যা করেছিলেন তার ভাই অ্যান্টিকাস ইপিফানেস। জ্যাসন নতুন রাজাকেও আরো অর্থ ঘুস দিয়ে এর বিনিময়ে ২০০ সালের পুরনো সনদ বাতিল করার আহ্বান জানান। তিনি চাইতেন না জুদা আর তাওরাতভিত্তিক পুরনো আমলের টেম্পল রাজ্য হিসেবে বহাল থাকুক। এর বদলে তিনি আশা করেছিলেন, জেরুসালেম পরিচিত হবে এর রাজকীয় পৃষ্ঠপোষক অ্যান্টিয়কের মতো পোলিস হিসেবে। সবসময় নগদ অর্থের অভাবে ভুগতে থাকা অ্যান্টিয়াস অর্থ গ্রহণ করে জ্যাসনের কর্মসূচিতে রাজি হন। তিনি আশা করেছিলেন, এতে জুদায় তার কর্তৃত্ব সুসংহত হবে।

    কিন্তু জেরুসালেম তো রাতারাতি কোনো পোলিসে পরিণত হতে পারে না। নগরীতে গণতান্ত্রিক আদর্শ আরোপ করার আগে বিপুলসংখ্যক নাগরিককে হেলেনবাদী হতে হবে। আর তা করার আগে প্রয়োজন তাদেরকে গ্রিক সংস্কৃতিতে অভ্যস্ত করা। অন্তর্বর্তী পদক্ষেপ হিসেবে জ্যাসন সম্ভবত হেলেনকরণ প্রকল্পে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ‘অ্যান্টিয়চেনেস’-এর সমাজ প্রতিষ্ঠার ব্যাখ্যা করেছিলেন। জেরুসালেমে একটি জিমনেশিয়াম প্রতিষ্ঠা করা হয়, উস্কানিমূলকভাবে সেটি টেম্পলের খুব কাছাকাছিই স্থাপন করা হয়। এই জিমনেশিয়ামে তরুণ ইহুদিদের হোমার অধ্যায়ন, গ্রিক দর্শন ও সঙ্গীত শেখার সুযোগ ছিল। তারা নগ্ন হয়ে ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় অংশ নিত। তবে জেরুসালেম পূর্ণাঙ্গ পোলিসে পরিণত হওয়ার আগে তাওরাত ছিল স্থানীয় বিধান। ফলে জেরুসালেমের জিমনেশিয়ামে হারমেস ও হেরাকলদের সম্মান জানানোর সম্ভাবনা ছিল না। প্রথম ধাপে জ্যাসনের পরিকল্পনাটি ব্যাপক সমর্থন পেয়েছিল। বাইবেলীয় সূত্রগুলোতে আমরা জিমনেশিয়ামের কোনো বিরোধিতা দেখি না। অ্যাথলেটিক অনুশীলন সুষ্ঠুভাবে চলার সময়ই পুরোহিতরা তাতে অংশ নিতে দ্রুত টেম্পল থেকে নেমে আসতেন। পুরোহিত, ভূস্বামী, বণিক, শিল্পী- সবাই হেলেনবাদের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় আকৃষ্ট হয়েছিল। তারা সম্ভবত আশা করেছিলেন, আরো উন্মুক্ত সমাজ জেরুসালেমের অর্থনীতিকে চাঙ্গা করবে। নেহেমিয়া ও ইজরার বিচ্ছিন্নতাবাদী নীতির প্রতি সবসময়ই বিরোধিতা ছিল, জেরুসালেমের অনেক ইহুদি বিশ্ব নাগরিকত্বের গ্রিক আদর্শে আকৃষ্ট হয়েছিল। ইহুদি ধর্ম কোনোভাবেই হেলেনিক বিশ্বের সাথে খাপ খাওয়াতে পারবে না- এমনটি তারা মনে করেনি। বিধানদাতা হিসেবে মুসাকে কি তুলনা করা যায় না লিসারগাসের মতো কারো সাথে? তাওরাত কোনোভাবেই সক্রেটিসের মূল্যবোধের মতো ছিল না : উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ইব্রাহিম কখনো মতিজভোথকে মান্য করেননি। মামরেতে যিহোবাকে আপ্যায়ন করার সময় তিনি কি একসাথে দুধ আর গোশত খাননি? ইহুদিদের কোনো প্রয়োজন ছিল না উন্মাদের মতো নিজেদের গোয়িমদের থেকে আলাদা করার। প্রতিবেশীদের সাথে বন্ধুত্ব করে, তাদের সাথে সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক বিনিময় উপভোগ করার মাধ্যমে ইহুদিরা আদি ঐক্যে ফিরে যেতে পারত, যা বাবেল টাওয়ারের ভবনের পর বিভিন্ন গোত্র ও ধর্মের মধ্যে বিভক্তি এনে মানবজাতিকে বিচ্ছিন্ন করার আগের অবস্থা সৃষ্টি করত। রাজা অ্যান্টিয়কাস ইপিফানেস ১৭৩ সালে জেরুসালেম সফর করেন। তাকে উষ্ণভাবে স্বাগত জানানো হয়। জ্যাসন তাদের নতুন পৃষ্ঠপোষকের সম্মানে রাস্তায় রাস্তায় মশাল শোভাযাত্রায় লোকজনের নেতৃত্ব দেন। সম্ভবত এ ঘটনাতেই জেরুসালেম আনুষ্ঠানিকভাবে পোলিসে পরিণত হয়েছিল। আর এতে বেশির ভাগ লোক খুশি হয়েছিল।

    কিন্তু তারপর হেলেনবাদীরা আরো অনেক দূর অগ্রসর হয়। ১৭২ সালে জ্যাসন মেলেনাস নামের এক পুরোহিতকে অ্যান্টিচাসকে দেওয়া প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী টাকাসহ অ্যান্টিয়ক পাঠান। মেলেনাস বিশ্বাসঘাতকতা করে এ আস্থার সুযোগটি কাজে লাগিয়ে নিজেকে উচ্চ পুরোহিত মর্যাদা নিশ্চিত করার জন্য আরেক দফা ঘুষ প্রদান করেন। আর অ্যান্টিওচাসের দরকার ছিল অর্থের। ফলে মেনেলাস উচ্চ পুরোহিত হিসেবে জেরুসালেমে ফিরে আসেন। জ্যাসন বরখাস্ত হন, তিনি জীবন নিয়ে পালিয়ে যান। তিনি জর্ডানের অপর তীরে আম্মানের কাছে তোবিয়াদ এস্টেটে আশ্রয় লাভ করেন। তবে জনগণ মেনেনাসকে উচ্চ পুরোহিত হিসেবে গ্রহণ করেনি। তিনি পুরোহিত পরিবারের সদস্য হলেও তিনি জাদোক বংশের সদস্য ছিলেন না। ফলে ওই পদের জন্য যোগ্য বিবেচিত হননি। মেনেলাস তার ভুল সংশোধন করার চেষ্টায় অ্যান্টিচাসকে দিতে যে অর্থ দিয়েছিলেন সেটি উসুল করতে টেম্পল কোষাগার লুণ্ঠন করেন। মোহভঙ্গের কারণে জেরুসালেমের অনেক লোক ‘অ্যান্টিওচেন’-এর সমাজ ত্যাগ করে। অ্যান্টিওচেন এখন ছোট সংখ্যালঘু গ্রুপে পরিণত হয়ে পুরোপুরি সেলেসিড রাজার ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ল।

    জেরুসালেমের ওয়েস্টার্ন ওয়ালে ইহুদিরা তাদের সিনাগগের জন্য নতুন একটি তাওরাত স্ক্রল নিবেদন করে রেখেছিল। অ্যান্টিচাক ইপিফানেসের নির্যাতনের পর জুদায় বিধানের জন্য নতুন আবেগের সৃষ্টি হয়েছিল।

    হেলেনবাদীরা কিছু খুবই সন্দেহজনক কৌশল গ্রহণ করেছিল। তবে তাদেরকে গ্রিসের সুন্দর জীবন ও বিলাসবহুল জীবনযাপন করতে আকাঙ্ক্ষী স্বার্থবাদী লোক হিসেবে বিবেচনা করা ভুল হবে। তাদের বেশির ভাগই সম্ভবত অপেক্ষাকৃত বর্জনমুখী ইহুদি ধর্মের আকাঙ্ক্ষার প্রতি বেশ আন্তরিক ছিল। আমাদের আজকের দিনে ইহুদিরা তাদের ঐতিহ্যগুলো সংস্কার করতে চাইছে আধুনিকতাকে গ্রহণ করতে ও বিপুলসংখ্যক অনুসারী আকৃষ্ট করতে। এই হেলেনবাদী সংস্কারকদের প্রধান ব্যর্থতা ছিল এই যে তারা জেরুসালেমের হৃদয় পরিবর্তন সম্পর্কে অ্যান্টিচাসকে পুরোপুরি অবগত রাখেনি। এর ফলে তিনি হয়তো বুঝতে পারেননি, তাদের প্রকল্পটি কতটা অজনপ্রিয় হয়েছে। মেনেলাস গ্রিক নগরীতে জেরুসালেমকে রূপান্তরিত করার চেষ্টা করে গেছেন। তিনি জেরুসালেমের নতুন নাম দিয়েছিলেন ‘জুদার অ্যান্টিয়ক’। তিনি জিমনেশন, ইফেবেট (এ সংস্থাটি তরুণদের সামরিক, অ্যাথলেট ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে অংশ নিতে আগ্রহী করে তুলত) ও হেলেনবাদী খেলা উৎসাহিত করতেন। তবে সংস্কার ১৭০ সালে বড় ধরনের বিপর্যয়ের মুখে পড়ে। মিসরে রোমানদের মোকাবিলা করতে গিয়ে অ্যান্টিচাস নিহত হয়েছেন মর্মে একটি খবর প্রকাশিত হওয়ার পর জ্যাসন অভ্যুত্থান ঘটানোর চেষ্টা করেন। তিনি নগরীতে ঢুকে মেনেলাস ও অ্যান্টিচেনেসকবাদী অন্যদের দুর্গে প্রবেশ করতে বাধ্য করেন। অবশ্য অ্যান্টিয়াস তখনো ভালোমতোই জীবিত ছিলেন। তিনি ক্রোধ নিয়ে নগরীতে প্রবেশ করেন। এতে জ্যাসন আবার পালাতে বাধ্য হন। অভ্যুত্থানকে তিনি তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ বিবেচনা করে তিনি টেম্পল কোষাগার লুণ্ঠন করেন, টেম্পল ভবনগুলোতে বলপূর্বক প্রবেশ করে সোনার বাতিদান, ঝাড়বাতি, পর্দা ও দেভির অপসারণ করেন, সব নৌকা ও যতটা সম্ভব ধুনুচি কেড়ে নেন। সবচেয়ে ঐশী এলাকার মধ্যে তার এসব লঙ্ঘনের ঘটনা ইহুদিরা কখনো বিস্মৃত হয়নি, ভবিষ্যতে অ্যান্টিচাস ইহুদি জনগণের আদি শত্রু হিসেবে দেখা হয়। জেরুসালেমে এখন পোলিস থেকে ছোট হয়ে স্রেফ একটি সামরিক উপনিবেশে পরিণত হয়েছে। সিরীয় গ্যারিসনের সমর্থন নিয়ে এর শাসনকাজে নিয়োজিত ছিলেন মেনেলাস। তবে তা নগরীর আইন-শৃঙ্খলা নিশ্চিত করার জন্য পর্যাপ্ত ছিল না। পরের বছর অ্যানিটচাসকে আরেকটি বাহিনী পাঠতে হয়েছিল। এই বাহিনী সাবাথের দিনে জেরুসালেমে আক্রমণ চালিয়ে নগর-প্রাচীরের অংশবিশেষ ভেঙ্গে ফেলে। সিরীয়রা এরপর নতুন একটি দুর্গ নির্মাণ করে যেখান থেকে টেম্পল এলাকা দেখা যায়। একে বলা হয় অ্যাকরা। এটি জেরুসালেমে সেলুসিড সদরদফতরে পরিণত হয়। কার্যত অ্যাকরা পরিণত হয় আলাদা জেলায়। এখানে বাস করত পৌত্তলিক সৈন্য ও হেলেনবাদী ইহুদিরা। এখানে গ্রিক ঈশ্বরদের উপাসনা করা হতো।

    তবে এটিই সবকিছু নয়। সম্ভবত মেনেলাস ও তার অ্যান্টিওচেনেসের আদেশে অ্যান্টিচুস একটি ডিক্রি জারি করেন। এটি ইহুদি উদ্দীপনার ওপর অনিস্বীকার্য প্রভাব ফেলে, অনেক ইহুদির পক্ষে অ-ইহুদি বিশ্বের সাথে খাপ খাওয়ানো আবেগগতভাবে অসম্ভব হয়ে পড়ে। এ ডিক্রিটি ২০০ সালের সনদ বাতিল করে দেয়, জুদায় ইহুদি বিশ্বাসের অনুশীলনকে বেআইনি ঘোষণা করা হয়। এটি ছিল ইতিহাসের প্রথম ধর্মীয় নির্যাতন। এতে সাবাথ বিশ্রাম, খতনা ও বিশুদ্ধতার বিধান পালনের মতো টেম্পলের প্রার্থনাবিধি নিষিদ্ধ করা হয়। ডিক্রি অমান্যকারীকে মৃত্যুদণ্ডের ডিক্রি জারি করা হয। যেসব নারী তাদের ছেলেদের খতনা করাত, তাদেরকে নগরীর চারপাশে ঘোরানো হতো, শিশুদেরকে প্রাচীর দিয়ে উপত্যকার নিচে ছুঁড়ে ফেলা হতো। এক মা তার সাত ছেলের সবার মৃত্যু প্রত্যক্ষ করেন। বিধানের প্রতি তার এমন নিষ্ঠা ছিল যে তিনি তার প্রতিটি সন্তানের মৃত্যুতে উল্লাস প্রকাশ করেন। পরে তিনি নিজেকে মৃত্যুর মুখে সঁপে দেন। ইলিয়েজার নামের ৯০ বছর বয়স্ক এক লোক শূকরের মাংস খাওয়ার বদলে মৃত্যুকেই বেছে নিয়েছিলেন। তাওরাতের জন্য লোকজন একবার মরতে শুরু করলে তা পুরোপুরি নতুন ইহুদি পন্থায় ঐশী বিষয় বলে গণ্য হয়ে যায়।

    এই ডিক্রির ফলে টেম্পল মাউন্ট বদলে যায়। অ্যান্টিচুস নগরী ও বাকি অংশের মধ্যে থাকা পবিত্র স্থানের মধ্যকার প্রাচীরগুলো গুঁড়িয়ে দেন। তিনি পরিকল্পিতভাবে তাওরাতে থাকা নিষেধাজ্ঞা অমান্য করেন, সেখানে গাছপালা লাগিয়ে গ্রিক-স্টাইলের ঐশী উদ্যানে পরিণত করেন। দুই বছর আগে অ্যান্টিয়চুসের লুণ্ঠন করা টেম্পল ভবনরাজি ফাঁকা ও বিচ্ছিন্ন থাকে। ১৬৭ সালের ২৫ কিসলেভে (ডিসেম্বর) রক্ষণশীল ইহুদিরা শুনে আতঙ্কিত হয়ে পড়ল যে বলি দেওয়ার স্থানের পাশে ‘ঘৃণা স্তম্ভ’ (সম্ভবত মাতজেভাহ, একটি দণ্ডায়মান পাথর) স্থাপন করা হবে। এর গাছপালা ও উন্মুক্ত বেদীতে পবিত্র স্থানটি এখন পুরনো ব্যামোহর মতো মনে হতে লাগল। বস্তুত ম্যামরে ও মাউন্ট কারমেলে তখনো এ ধরনের উপাসনালয় বিরাজ করছিল। টেম্পল এখন জিউস অলিম্পিয়সের প্রতি নিবেদন করা হলো। তবে এর মানে অনিবার্যভাবে এ কথা বোঝায় না যে ইহুদিদেরকে এখন গ্রিক দেবতাকে উপাসনা করতে বাধ্য করা হচ্ছিল। এই সময়কালে অলিম্পিয়স ছিলেন স্রেফ ‘স্বর্গের প্রতিশব্দ। এ এলাকাটি তাই স্বর্গের দেবতার উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করা হলো। যিহোবার প্রতি প্রযোজ্য পদবি অন্য যেকোনো সর্বোচ্চ ঈশ্বরের প্রতিই প্রয়োগ করা যেতে পারে।৯

    হেলেনবাদিরা সম্ভবত বিশ্বাস করত যে তারা ইব্রাহিমের অপেক্ষাকৃত সহজ ধর্মে ফিরে যাচ্ছে। তারা মনে করত, মুসার তাওরাতের জটিলতা প্রবর্তনের আগে ইব্রাহিম একই ধরনের ধর্মমন্দিরে উপাসনা করতেন। ১০ আমরা পরের অধ্যায়গুলোতে দেখব, অন্যান্য একেশ্বরবাদীদেরও জেরুসালেমে এই আদি ধর্ম পুনঃপ্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা ছিল। স্বর্গের ঈশ্বরের প্রার্থনার মাধ্যমে তারা সম্ভবত একটি যৌক্তিক মতবাদ সৃষ্টির চেষ্টা চালাচ্ছিল, যা সব মানুষের কাছে তথা অ্যাকরার গ্রিকদের পাশাপাশি অ্যান্টোচেনের ইহুদের কাছে আকষর্ণীয় হবে। তাদের কর্মসূচি অষ্টাদশ শতকের ইউরোপিয়ান আলোকসম্পাত যুগের ফরাসি দার্শনিকদের সর্বোচ্চ ঈশ্বর মতবাদ থেকে ভিন্ন ছিল না। কিন্তু এসব ধারণা বেশির ভাগ ইহুদির কাছে ছিল চরম জঘন্য। প্রথমবারের মতো মহাপ্রলয়বাদী একটি ধর্মানুরাগ ইহুদি ধর্মে প্রবেশ করে, এতে ইতিহাসের সমাপ্তিতে সত্যনিষ্ঠতার চূড়ান্ত বিজয়ের জন্য অপেক্ষা করার কথা বলা হয়। পরবর্তীকালে এ ধরনের বিশ্বাস একেশ্বরবাদী তিন ধর্মের (অ্যান্টিওচুস ইপিফ্যানেসের অধীনে জেরুসালেম যেভাবে আক্রান্ত হয়েছিল সেভাবে সমৃদ্ধিশীল জীবনযাত্রা আক্রমণের শিকার হওয়ার পর) প্রতিটিতেই দৃশ্যমান হয়। গ্রিকদের যৌক্তিক পন্থা ও সেক্যুলার মূল্যবোধ গ্রহণ করার বদলে রহস্যাদঘটনবাদী লেখকেরা দৃঢ়ভাবে পুরনো একেশ্বরবাদী মূল্যবোধের কথা ঘোষণা করেছিলেন। যখন বর্তমান মনে হয় আশাহীন, তখন অনেক ইহুদি মহাবিজয়ের ভবিষ্যতের সংস্করণেই বেশি স্বস্তি অনুভব করে। এসব ‘ঐশী’ কর্তৃত্ব দিতে তারা প্রায়ই নবী দানিয়েল বা ইউনুসের মতো অতীতের সম্মানিত নবীদের প্রতি আরোপ করত। তারা বলত, এ গোষ্ঠীপতিকে জীবনের শেষে স্বর্গে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল।

    শেষ দিনের দৃশ্যপটের যে কল্পনা এসব ভবিষ্যদ্বক্তা করতেন, সেটিই পরবর্তীকালে অনুসৃত হয়েছে। নানা দিকে ছড়িয়ে পড়া ইসরইলের ১২টি গোত্রকে একত্রিত করে তাদের সবাইকে জেরুসালেমে নিয়ে আসা হবে। তারপর তিনি তাদেরকে নেতৃত্ব দিয়ে ভয়ঙ্কর সব যুদ্ধে নিয়ে যাবেন, যা সময়ের শুরুতে হওয়া ঐশী সংগ্রামের স্মৃতিকথা : এবার ইসরাইলের লোকজন বিশৃঙ্খলা ও ধ্বংসের প্রতিমূর্তি হিসেবে থাকা তাদের সব শত্রুকে নিশ্চিহ্ন করবে, অপেক্ষাকৃত ভালো দুনিয়া নির্মাণ করবে। অবশ্য অনেকে যিহোবার ধর্মে গোয়িমদের ধর্মান্তরের প্রতীক্ষায় থাকে। শেষ প্রায়শ্চিত্তের এ ধারণাটি জেরুসালেমে সবসময়ই ছিল। এখন পৌত্তলিক ও ইহুদি দলত্যাগীরা মাউন্ট জায়নকে অপবিত্র করায় দানিয়াল, জুবিলি ও ইউনুস গ্রন্থের মহাপ্রলয়বাদীরা ভবিষ্যতের এমন এক যুগের দিকে তাকিয়ে রইলেন, যখন নগরীটি পরিশুদ্ধ হবে, ঈশ্বর নতুন একটি টেম্পল নির্মাণ করবেন। গ্রিস সাম্রাজ্যে যখন কোনো স্থানীয় রাজা ছিলেন না, ওই সময় লোকজন এক ইহুদি মেসাইয়ার কল্পনা করত, যে তাদের চূড়ান্ত বিজয়ে নেতৃত্ব দেবেন। এসব স্বপ্নাবিভাব ছিল এমন এক সময়ে ইহুদি পরিচিতির দৃঢ় ঘোষণা যখন তা বিশেষভাবে বিপর্যয়কর বলে মনে হতো। এটি ছিল আশাহীন পরিস্থিতিতে বিশ্বাস বজায় রাখার বিষয়, এবং একটি ছোট সংখ্যালঘুর মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা নয়। মহাপ্রলয়বাদী ধর্মানুরাগ দ্বিতীয় ও প্রথম শতকের বেশির ভাগ ধর্মীয় আন্দোলনকে পরিব্যপ্ত করেছিল, বেন সিরার মতো সংযত বুদ্ধিজীবী ও সেইসাথে বিপ্লবীদের উদ্দীপ্ত করেছিল। কেবল ইহুদিরাই এই স্বপ্নাবিভাবের জ্বরে আক্রান্ত হয়নি। মিসরের পুরোত্তি, পারস্যের ম্যাজাই ও ভারতের ব্রাহ্মণদের আধ্যাত্মিক কৃতিত্বে বেশ অভিভূত ছিল গ্রিকরা। এরা তাদের নিজস্ব সাধু পুরুষদের চেয়ে বেশি আধ্যাত্মিক শক্তিসম্পন্ন বলে তারা মনে করত। এটি প্রাচ্যের প্রজা জনসাধারণকে আত্ম-মর্যাদার অতি-প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাটি করে দেয়। গ্রিকরা সম্ভবত খুবই চতুর ছিল, তবে তাদের বিস্তারিত কর্মপন্থা ছিল স্রেফ ‘ঔদ্ধত্যমূলক’ ও ‘বীর্যহীন।’ তারা ফাঁকা ধারণার’ পরিকল্পনা করতে পারত, কার্যকর যুক্তি-তর্ক দিয়ে সেটিকে শানিত করতে পারত, ওই সময়ের সন্ন্যাস পুস্তক তাদের থাকার দাবি করত। তবে ‘বাস্তবে গ্রিকদের দর্শন ছিল স্রেফ কথার অর্থহীন আওয়াজ।’ নিজেদের ঐতিহ্য সম্পর্কে এই বক্তব্য ছিল মার্জিত বিজয়ীদের তাদের জন্য নির্ধারিত স্থানে রাখার প্রয়াস।১১

    এসব স্বপ্নাবিভাবীদের অনেকে নিজেদেরকে সর্বোচ্চ স্বর্গে উড়ার কথা কল্পনা করত। ঈশ্বরের মন্দিরে বসবাস করার ধারণাটি নিকট প্রাচ্যের অনেক অংশে তার প্রবল ক্ষমতা হারাতে থাকে। দ্বিতীয় ও প্রথম শতকের মিসর ও পারস্যের স্বপ্নবিভাবীরা দুনিয়াবি প্রতীক এড়িয়ে যেতে শুরু করে, সরাসরি ঈশ্বরদের পরাবাস্তব জগতে সফর করতে থাকে। এসব মরমি যাত্রা সময়ের নতুন শিকড়বিহীনতাকেই প্রতিফলিত করছিল। অর্থাৎ আধ্যাত্মিকতা আর নির্দিষ্ট কোনো স্থানে প্রোথিত ছিল না। সবাই না হলেও অনেক লোক এ জগতের নয়, বরং ভিন্ন ধরনের আধ্যাত্মিক মতপ্রকাশ করে- এমন স্বাধীনতা কামনা করছিল। ইহুদি মরমিবাদীরাও এসব কল্পপ্রবণ উড্ডয়নের কথা ভাবতে শুরু করে। ‘অ্যাপোক্যালিপস’ শব্দের অর্থ ‘পর্দার উন্মোচন।’ নবীদের মতো এসব স্বপ্নাবিভাবকারীও দেভিরের পর্দার পেছনের জিনিস দেখার দাবি করত। অর্থাৎ অ্যামোস, ইসাইয়া ও ইজেকিলের মতো তাদের ঈশ্বর দর্শনও ছিল জেরুসালেম ধর্মমতের সাথে গভীরভাবে সম্পৃক্ত। দেভির আবারো আর্ক, পৃথিবীর ঈশ্বরের সিংহাসনে সাথে সম্পৃক্ত হলো। এখন দ্বিতীয় শতকে স্বপ্নাবিভাবকারীরা ঈশ্বরের স্বর্গীয় প্রাসাদে সরাসরি আহরণ ও স্বর্গীয় সিংহাসনের কাছাকাছি যাওয়ার কল্পনা করতে লাগলেন। এসব প্রাথমিক স্বপ্নাবিভাবের একটি বর্ণনা রয়েছে ‘ফার্স্ট বুক অব ইউনুসে’ (আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ১৫০)। জেরুসালেমে যাওয়ার বদলে তার দর্শনে তিনি নিজেকে শূন্যে উড়ার মাধ্যমে বাতাসে ভেসে স্বর্গে ‘আগুনের মুখ’ ও ‘সুদর্শন দেবশিশুদের ঘিরে থাকা ঈশ্বরের বিশাল মার্বেল প্রাসাদে যান। এসব কল্পনার অদ্ভূত উড্ডয়ন ছিল না। পরে আমরা পাঠ করব যে ইহুদি মরমিবাদীরা নিজেদেরকে বিশেষ বিদ্যার মাধ্যমে এই অপার্থিব ঊর্ধ্বারোহণের জন্য প্রস্তুত করছেন। এটি বিশ্বজুড়ে যোগী ও সন্ন্যাসব্রতের মতো ছিল। এই ইহুদি স্বপ্নাবিভাবী উপবাস পালন করতেন, মাথাকে হাঁটু দুটির মাঝে স্থাপন করতেন, মন্ত্র হিসেবে ঈশ্বরের প্রশংসা করে কিছু মৃদু ধ্বনি উচ্চারণ করতেন। এর ফলে এসব আধ্যাত্মিক সাধকেরা, এই মরমিবাদী তার নিজের চোখে সাত পাহাড় [ঐশী স্থান], পাহাড় থেকে পাহাড়ে বিচরণ করতে দেখতেন। অন্য সব সত্যিকারের ধ্যানের মতো এটিই ছিল ‘অন্তর্মুখী ঊর্ধ্বাহরণ।’

    যদিও এ স্বপ্নবিভাবী অনুভব করতেন যে তিনি ঈশ্বরের প্রাসাদের জাগতিক প্রতিকৃতি এড়িয়ে যেতে পারেন, কিন্তু তবুও টেম্পল মাউন্ট তখনো ছিল তার ঈশ্বরের কাছে যাওয়ার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পথ। এটি প্রমাণ করে, এর স্থপতিরা জাতির মাধ্যমে আধ্যাত্মিক বাস্তবতার অভিজ্ঞতা অনুভব করেছিল। এটি তাদের অন্তর জগতকে প্রকাশ করত, জেরুসালেম টেম্পলের অস্তিত্ব শেষ হয়ে যাওয়ার পরও তা অব্যাহত ছিল। উপাসনাকারীরা যেমন জেরুসালেমের পবিত্র এলাকা দিয়ে হাঁটার মাধ্যমেই ঈশ্বরের কাছাকাছি হতে পারত, সেভাবেই ইউনুসও স্বর্গীয় দুনিয়ায় সতর্কভাবে ধাপ করা পর্বগুলোর মাধ্যমে ঈশ্বরের কাছে গিয়েছিলেন। প্রথমে তাকে অপবিত্র দুনিয়া ত্যাগ করে ঐশী এলাকায় প্রবেশ করতে হয়েছিল, ঠিক যেমন করে তীর্থযাত্রীরা জেরুসালেমে প্রবেশ করে টেম্পল আঙিনায় যেত। বেশির ভাগকে সেখানেই থামতে হলেও ইউনুসও নিজেকে আধ্যাত্মিক উচ্চ পুরোহিত হিসেবে কল্পনা করেছিলেন। প্রথমে তাকে দেবশিশুতে পরিপূর্ণ হেখালের মতো একটি বাড়িতে নেওয়া হতো। সবশেষে তাকে আরো বড় প্রাসাদ দ্বিতীয় ধাপে নেওয়া হয়। সেটি ছিল স্বর্গের সমতুল্য দেভির। এখানে তিনি জীবন্ত আগুনের স্রোতে সিংহাসনে ‘মহান গৌরবকে তাতে বসে থাকতে দেখেন।’ এখানে ইউনুসকে তার জাতির জন্য একটি বার্তা পেতেন! এবং যম কিপুরের উচ্চ পুরোহিতের মতো তিনি ‘থর্ন রুম’ ত্যাগ করে তার ধর্মাবলম্বী ইহুদিদের জন্য পবিত্রতা বয়ে এনেছিলেন। মধ্যযুগে কাব্বালি মতাদর্শে বিলীন হওয়ার আগে পর্যন্ত এই ধরনের আধ্যাত্মিকতা অব্যাহতভাবে ইহুদিদের চিন্তা করতে উদ্বুদ্ধ করত।

    অনেক ইহুদি স্বপ্নবিভাব নিয়ে গ্রিকদের বিরোধিতা করেছিল, অন্যরা অস্ত্রের আশ্রয় নিয়েছিল। সেলুসিডের সৈন্যরা অ্যাকরায় শিবির স্থাপন ও টেম্পল মাউন্ট অপবিত্র করার পর অধিকতর নিবেদিতপ্রাণ ইহুদিদের অনেকে মনে করতে থাকল যে তারা আর জেরুসালেমে বাস করতে পারবে না। এসব অভিবাসীর মধ্যে ছিল হ্যাসমোনিয়ান পরিবার, বয়োবৃদ্ধ পুরোহিত ম্যাত্তাথিয়াস ও তার পাঁচ ছেলে। তারা মোদিয়েনের গ্রামে আশ্রয় নিলো। তবে রাজকীয় কর্মকর্তারা যখন স্বর্গের ঈশ্বরের নতুন যৌক্তিক মতবাদ প্রতিষ্ঠা করতে এলেন, তখন ম্যাত্তাথিয়াস ও তার ছেলেরা পাহাড়ে পালিয়ে গেল। তাদের অনুসরণ করেছিল অন্যান্য ধার্মিক ইহুদি। তারা তাদের সব মালামাল পেছনে ফেলে গিয়েছিলেন। তারা ‘পাহাড়ে পাহাড়ে বুনো জানোয়ারে মতো বাস করত, অপবিত্রতার স্পর্শ এড়াতে বনের লতাপাতা খেত। ১৪ তারা অ্যান্টিওচুজের ফরমানের কাছে নতি স্বীকারকারী ইহুদিদের বিরুদ্ধে প্ররোচণা চালত, নতুন গ্রিক বেদীগুলো উল্টে দিত, ছেলে শিশুদের খতনা বাধ্যতামূলক করার জন্য উদ্বুদ্ধু করত। ১৬৬ কসালে ম্যাত্তিথিয়াস মারা গেলে তার ছেলে জুদাস, ডাক নাম ন্যাকাবিয়াস (‘হাতুরি-মাথাওয়ালা’), আন্দোলনটির নেতৃত্ব গ্রহণ করে গ্রিক ও সিরিয়ান সৈন্যদের বিরুদ্ধে আক্রমণ শুরু করেন। সেলুসিডরা মেসোপটেমিয়া দখলে ব্যস্ত থাকায়, সেখানে পার্থিয়ানরা তাদেরকে তাদের অবস্থান থেকে তাড়িয়ে দিতে চেষ্টা করেছিল, জুদাসের প্রচারণায় অপ্রত্যাশিত সাফল্য লাভ করে।১৫ ১৬৪ সাল নাগাদ অ্যান্টিয়চুস তার কুখ্যাত ফরমান প্রত্যাহার করে নিতে বাধ্য হন, জুদাস জেরুসালেমের ওপর নিয়ন্ত্রণ লাভে সক্ষম হন। অবশ্য তিনি অ্যাকরা থেকে গ্রিক ও অ্যাটিওচেনদের সরিয়ে দিতে পারেননি।

    জুদাস ও তার সহকর্মীরা টেম্পলের ভস্মীভূত ফটকগুলো ও মাউন্ট জায়নের ঐশী উপবন দেখে তাদের পোশাক ছিঁড়ে ফেলে তাদের কষ্ট প্রকাশ করার জন্য সেগুলো প্রদর্শন করেন। তারপর তারা স্থানটি পরিশুদ্ধ করে, টেম্পল ভবনরাজি নতুন করে সাজিয়ে তোলেন, সবশেষে হেখালে সাত শাখাযুক্ত মোমদানির বাতিগুলো প্রজ্জ্বলিত করেন। ২৫ কিসলেভে, তিন বছর আগে এই দিনে সেলুসিডরা পবিত্র স্থানটিকে অপবিত্র করেছিল, টেম্পলটি আবার উৎসর্গ করা হয়।১৬ অনুগতরা টেম্পলের আঙিনা দিয়ে শোভাযাত্রা বের করে। এ সময় তারা সুকোথের মতো খেজুর ও পাতাযুক্ত শাখা বহন করে। সবশেষে তারা ঘোষণা করে যে এই চানুকা উৎসবটি (‘উৎসর্গ’) পুরো ইহুদি জাতি প্রতি বছর উদযাপন করবে।

    ম্যাকাবিদের বিদ্রোহটি সফল হতে পারার কারণ ছিল সেলুসিড শিবিরে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব। সিংহাসনের দাবিদার একজনের বিরুদ্ধে আরেকজনকে স্থাপনার করার মাধ্যমে জুদাস ও তার উত্তরসূরিরা তাদের অবস্থান সুসংহত করকে সক্ষম হয়। ১৬১ সালে রোমের সাথে মিত্রতা স্থাপন করেন জুদাস। এটি নিঃসন্দেহে তার হাতকে শক্তিশালী করে। ১৭ সবশেষে খ্রিস্টপূর্ব ১৫২ সালের দিকে হ্যাসমোনিয়ান আন্দোলন সরকারি স্বীকৃতি পায়। এ সময় সেলুসিডদের এক প্রার্থী জুদাসের ভাই ও উত্তরসূরি জোনাথনকে ইথনোসের গভর্নর করেন। আরো ভালো কিছু করার প্রত্যাশায় জোনাথনকে তার প্রতিদ্বন্দ্বী উচ্চ পুরোহিত নিযুক্ত করেন। ১৫২ সালের সুকোথ উৎসবে জোনাথনকে প্রথমবারের মতো পবিত্র পোশাক পরানো হয়, লোকজন এই ঘটনায় সম্ভ্রমে নতজানু হয়। ১৮ ১৪৩ সাল পর্যন্ত জোনাথন ওই পদে ছিলেন। তারপর সেলুসিড সিংহাসনের আরেক প্রার্থী তাকে অপহরণ করে হত্যা করে। তার ভাই সাইমন হ্যাসমোনিয়ান কর্তৃত্ব ঘোষণা আবারো করতে সক্ষম হন। তিনি নিজেকে ইথনোসের শাসক হিসেবে নিজেকে ঘোষণা করেন, নতুন সেলুসিড রাজা দ্বিতীয় দেমেত্রিয়াস তাকে উচ্চ পুরোহিত করেন। গ্রিস সাম্রাজ্য থেকে স্বাধীন হয়ে যায় জুদা। কয়েক শ’ বছরের মধ্যে জুদাবাসী পৌত্তলিক নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্ত হয়। পরের বছর গ্রিক ও অ্যান্টিয়চেন ইহুদিরা, অ্যাকরা দখলে রাখা গ্রিক ও অ্যান্টিয়চেন ইহুদিরা, সাইমনের কাছে আত্মসমর্পণ করে। দুর্গটি মাটিতে মিশিয়ে দেওয়া হয়। যোশেফাসের মতে, এ কাজটি ছিল খুবই কঠিন। এতে লাগে তিন বছর। এই বিজয় জাতীয় উৎসব হিসেবে উদযাপিত হয়। ১৯

    হ্যাসমোনিয়ান বিপ্লব শুরু হয়েছিল জনপ্রিয় বিদ্রোহ হিসেবে। তারা আবেগপূর্ণভাবে সাম্রাজ্যের শক্তি গ্রিক সংস্কৃতির বিরোধিতা করেছিল। তবে সাইমন ও তার উত্তরসূরীদের অধীনে যে রাষ্ট্রটি এসেছিল, তাতে এমন কিছু বৈশিষ্ট্য ছিল যা শুরুতেই বিদ্রোহীদের অসন্তুষ্ট করেছিল। মেনেলাস উচ্চ পুরোহিত্ব নিশ্চিত করলে ইহুদিরা মর্মাহত হয়। কারণ তিনি জাদোক বংশের ছিলেন না। এখন হ্যাসমোনিয়ান শাসকেরা উচ্চ পুরোহিত হলেন। তবে তারা পুরোহিত পরিবারের হলেও কোনোভাবেই জাদোক ছিলেন না। সম্ভবত ইহুদি শাসন ও পৌত্তলিক রাজবংশের কোনো একটিকে বেছে নেওয়ার ক্ষেত্রে বিকল্প ছিল সামান্যই। হ্যাসমোনিয়ানরা সৈনিক হিসেবে ভালো ছিল, তাদের কূটনৈতিক দক্ষতাও ছিল, কিন্তু পরমোৎকর্ষের কোনো আদর্শ ছিল না তাদের। সাইমনকে আসলে তার নিজের ছেলেরাই হত্যা করেছিল। যদিও কয়েক শ’ বছরের অন্ধকারময়তা ও বিপর্যয়ের পর বেশির ভাগ জুদাবাসী হ্যাসমোনিয়ানদের অর্জনে চরমভাবে গর্বিত ছিল। সাইমনের ছেলে জন হাইক্যানাস (১৩৪-১০৪) যখন আশপাশের কিছু এলাকা জয় করেন, তখন অবশ্যই তাদের মনে হয়েছিল যে রাজা দাউদের গৌরবময় দিন বুঝি ফিরে এসেছে। ১২৫ সালের দিকে সেলুসিডরা তাদের অভ্যন্তরীণ ক্ষমতার দ্বন্দ্বে ও পার্থিয়ানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে এতই দুর্বল হয়ে পড়েছিল যে হাইক্যানাসের জন্য সামারিয়ার নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করা কঠিন কিছু ছিল না। তার প্রথম কাজ ছিল শেচেমের কাছে মাউন্ট জেরিজিমে ওয়াইএইচডব্লিউএইচের নামে সামারিতানরা যে মন্দিরটি নির্মাণ করেছিল, সেটি ভাঙ্গা। দক্ষিণে উদমিয়া পর্যন্ত সীমানা সম্প্রসারণ করেছিলেন জন। তিনি এখানকার বাসিন্দাদের ইহুদি ধর্মে দীক্ষা গ্রহণ ও খতনা গ্রহণ করতে বাধ্য করেছিলেন। অনেক বিপ্লবের মতো বিদ্রোহী জান্তাও যাদের ক্ষমতাচ্যুত করা হয়েছিল, তাদের মতোই হয়ে যায়। সেলুসিডদের মতো হ্যাসমোনিয়ানরাও সাম্রাজ্যবাদীতে পরিণত হয়। তারা তাদের প্রজাদের ধর্মীয় ঐতিহ্যের প্রতি স্পর্শকাতরতাহীনই ছিল।

    অধিকন্তু, নিমর্ম হলেও সত্য যে ইথনোরা পুরোপুরি হেলেনকৃত অবস্থায় পৌঁছে গিয়েছিল। জন হারক্যানাসের অধীনে জেরুসালেম আবারো টেম্পল মাউন্ট দেখা যায়, এমন দুরত্ব পর্যন্ত জেরুসালেম সম্প্রসারিত হয়েছিল। এটি অধিকতর সম্পদশালী ও অভিজাত ও পুরোহিত পরিবারগুলোর বসবাসের স্থানে পরিণত হয়। তারা নিচে ওল্ড ইর ডেভিডে বসবাসকারী অপেক্ষাকৃত গরিব লোকদের চেয়ে অনেক বেশি ঠাণ্ডা বাতাস ও স্বাস্থ্যকর অবস্থা উপভোগ করত। এই পশ্চিম দিকের জেলাটি অনেক বেশি গ্রিক নগরীতে পরিণত হয়েছিল। হ্যাসমোনিয়ান আমলের খুব সামান্য অবশিষ্ট পাওয়া গেছে। তবে প্রায় নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, ওয়েস্টার্ন হিলের সর্বোচ্চ পয়েন্টে স্তম্ভ ঘেরা একটি বাজার (অ্যাগোরা) ছিল। হ্যাসমোনিয়ানরা জ্যাসনস জিমনেশিয়াম বন্ধ করে দিয়েছিল। তবে নগরীর পশ্চিম অংশে ছিল একটি উদ্যান ঘেরা স্থাপনা। এ ধরনের স্থানে সাধারণত ক্রীড়া প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়। তবে জেরুসালেমে সম্ভবত জনসভার স্থান হিসেবে জায়গাটি ব্যবহৃত হতো। হ্যাসমোনিয়ান স্থাপনাগুলোর মধ্যে বেশ ভালোভাবে টিকে থাকা একটি সৌধ হচ্ছে কিদরন ভ্যালির বেনে হেজির পরিবারের পুরোহিতের কবর। এটিতে গ্রিক ও প্রাচ্য স্টাইলের চমকপ্রদ সমন্বয় দেখা যায়। সবশেষে আসে ওয়েস্টার্ন হিলের পূর্ব দিকের ঢালের কথা। টেম্পলকে দেখা যায়, এমনভাবে তারা নিজেদের জন্য একটি জাঁকজমকপূর্ণ প্রাসাদ নির্মাণ করেছিল। এটি পুরনো নগরীর সাথে সংযোগকারী টাইরোনোয়ন ভ্যালি পর্যন্ত বিস্তৃত একটি সেতু দিয়ে টেম্পল মাউন্টের সাথে সংযুক্ত ছিল।

    এই হেলেনবাদী বৈশিষ্ট্য সত্ত্বেও তখনো অবয়বগত, রাজনৈতিক ও আধ্যাতিকভাবে নগরীতে প্রাধান্য বিস্তার করেছিল টেম্পল। টেম্পলটি বিশেষভাবে অভিভূত করেছিল রাজা দ্বিতীয় টলেমির সময়ের এক লেখককে। তিনি একটি রোমান্সের পটভূমি হিসেবে টেম্পলকে দেখেছিলেন। নিজেকে তিনি বলতেন অ্যাসিটিয়াস। তিনি মাউন্ট জায়নের ঢালে থাকা ধর্মস্থানটি সম্পর্কে লিখেন যে অ্যাম্পিথিয়েটারের আসনের মতো বাসাবাড়ি ও রাস্তাঘাট ছিল। তিনি হেখালের প্রবেশপথে বিশাল পর্দা দেখে অভিভূত হয়েছিলেন যেটি যেকোনো দিক থেকেই দরজার মতো দেখতে ছিল। তবে ব্যতিক্রম ছিল কেবল এই যে এটি উপর থেকে নিচ পর্যন্ত ঘোরে, পথ দিয়ে বায়ু চলাচল করে। ২১ তিনি টেম্পলের আশপাশের পথের নিচে থাকা জলাধারের ব্যাপক ব্যবস্থার প্রশংসাও করেন। এটি বলি দেওয়া পশুর রক্ত ধুয়ে দিত। তিনি ভূমিতে কান পেতে দাবি করেন যে তিনি নিচে পানির কল কল শব্দ শুনতে পেয়েছেন। সর্বোপরি অ্যারিটিস পুরোহিতদের হাবভাব ও দক্ষতায় অভিভূত হন। তার বর্ণনায় দেখা যায়, তারা বিরামহীনভাবে কাজ করে, পূর্ণ মনোযোগের সাথে একটির পর একটি পশু বলি দিতে থাকেন। পশুগুলোকে এক হাতে তুলে উঁচু করে সেগুলোকে দূরে ফেলতে তাদের প্রয়োজন হয় তাদের ‘শারীরিক শক্তিকে ছাপিয়ে যাওয়ার। ২২ তবে তাদের বেশির ভাগ কাজই খুবই অরুচিকর। অবশ্য কাউকে নির্ধারিত বিরতির পর কাজে ফিরতে বলত না। পুরো কাজ সম্পন্ন হয় একটি শব্দ উচ্চারণ ছাড়াই। টেম্পল আঙিনার নিশ্চলতা অতিপ্রাকৃত। অ্যারিস্টেজ লক্ষ করেছেন, সব স্থানে নীরবতা এত ভয়াবহ যে মনে হতে পারে দুনিয়ায় কেউ নেই। তিনি বলেন, পুরোহিতদের সংখ্যা সাত শ’ হলেও এবং তারা টেম্পলে অনেক পশু সাথে করে নিয়ে এলেও সবকিছুই সম্ভ্রমে ও শ্রদ্ধার সাথে সম্পন্ন করা হয়। ২৩

    তবে জুদার সব ইহুদি এই প্রশংসার সাথে একমত ছিল না। তারা সবাই আবেগপূর্ণভাবে টেম্পলের সাথে সম্পৃক্ত ছিল। তবে বেশ বড় সংখ্যক লোক মনে করত যে হ্যাসমোনিয়ানরা তাদের শুদ্ধতা ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। এই কঠিন বছরগুলোতে জুদাতে তিনটি উপদলের আত্মপ্রকাশ ঘটে। তারা মোট জনসংখ্যার দিক থেকে সামান্য হলেও প্রবল প্রভাবশালী ছিল। তাদের ব্যাপকভাবে ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গির অর্থ ছিল ভবিষ্যতে বহিঃশত্রুর বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ অবস্থান গ্রহণ করতে জুদার ইহুদিদের জন্য প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়া। অবশ্য আমরা পরের অধ্যায়ে দেখতে পাব, মাত্র একটি ইস্যুতে তারা তাৎক্ষণিকভাবে একতাবদ্ধ হয়ে পড়ত। তা হলো টেম্পলের পবিত্রতার ওপর কোনো ধরনের হুমকি সৃষ্টি। স্যাদুসিরা ছিল হ্যাসমোনিয়ানদের প্রধান সমর্থক। এই উপদলের সদস্যরা ছিল পুরোহিত ও সম্পদশালী শ্রেণিভুক্ত। তারা ওয়েস্টার্ন হিলের আপার সিটিতে বাস করত। তারা হেলেনবাদীতে পরিণত হয়েছিল, চাইত তাদের পৌত্তলিকদের প্রতিবেশীদের সাথে সুসম্পর্ক রক্ষা করতে। তবে তারা রাজা, টেম্পল ও এর উপাসনা পদ্ধতি হিসেবে তাদের জাতির এ ধরনের প্রাচীন প্রতীকগুলোর প্রতিও প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ছিল। এই সময়ে নিকট প্রাচ্যের অন্যান্য জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের মতো তাদের ইহুদি ধর্মও সেকেলে বলে মনে হচ্ছিল : আদর্শীকৃত অতীতের প্রতি বিশ্বস্ত থাকা ছিল তাদের নিজস্ব ঐতিহ্যের সাথে নতুন গ্রিক উদ্দীপনায় তাদের শিকড়কে সম্পর্কিত রাখার পথ। স্যাদুসিরা লিখিত তাওরাতে কোনো ধরনের সংযোজন গ্রহণ করতে রাজি ছিল না। তারা বিশ্বাস করত যে রাজা দাউদের মতো হ্যাসমোনিয়ানরাও পুরোহিত্বকে রাজতন্ত্রের সাথে মিলিয়ে ফেলেছে। তবে হ্যাসমোনিয়ানদের কারণে অন্য ইহুদিরা সন্ত্রস্ত্র হয়ে পড়েছিল। বুনো প্রান্তরে নতুন নির্বাসনের জন্য তারা ইহুদি সমাজ থেকে নিজেদের পুরোপুরি সরিয়ে নিয়েছিল। টিচার অব রাইটেনাস নামে পরিচিত তাদের নেতা ছিলেন সম্ভবত উচ্চ পুরোহিত। জোনাথনকে ওই পদে নিযুক্ত দেওয়ার সময় তাকে বলপূর্বক অবসর দেওয়া হয়েছিল। তাদের বিশ্বাস ছিল যে কেবল কোনো জাদোকবাদীই এই উচ্চ পদে অধিষ্ঠিত হতে পারেন, তাই জোনাথন টেম্পলের পবিত্রতা নষ্ট করেছিলেন। তার কয়েকজন অনুসারী, এসেনেস নামে পরিচিত, মৃত সাগরের তীরে কামরানে আশ্রম ধরনের সম্প্রদায়ে বাস করত। অন্যরা ছিল অপেক্ষাকৃত কম চরমপন্থী। তারা জুদার শহর ও নগরীগুলোতে বাস করত, টেম্পলে উপাসনা অব্যাহত রাখে। অবশ্য তাদের এই বিশ্বাস ছিল যে এটি নৈরাশ্যকরভাবে দূষিত হয়ে পড়েছে। ইসেনেসরা প্রবলভাবে মহাপ্রলয়ে বিশ্বাস করত। তাদের মতে ওই সময় ঈশ্বর পবিত্র নগরী ও তাদের টেম্পল আবার নির্মাণ করবেন। জন হারক্যানাসের শাসনকালে তাদের সদস্য সংখ্যা বেড়ে প্রায় চার হাজার হয়, এসেনে সম্প্রদায় জেরুসালেমে প্রতিষ্ঠিত হয়।

    এই তিন দলের মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় ও প্রভাবশালী ছিল ফারিসিরা। তারা তাওরাতের সঠিক ও পুঙ্খানুপুঙ্খ অনুসরণ করত। তারাও বিশ্বাস করত যে হ্যাসমোনিয়ন শাসকদের উচিত নয় উচ্চ পুরোহিত্ব গ্রহণ করা। তারা এই বিশ্বাসেও পৌঁছেছিল যে লোকজন এসব খারাপ ইহুদির অধীনের চেয়ে বিদেশী শাসনেই ভালো থাকে। জন হারক্যানাস আমলের শুরুতে জেরুসালেমে ছড়িয়ে পড়া বিদ্রোহের পেছনে ফারিসিরাও থাকতে পারে। এই বিদ্রোহে রাজাকে নির্মমভাবে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়।২৪ তারা তার ছেলে আলেক্সান্ডার জ্যানেয়াসের (১০৫-৭৬) শাসনেরও বিরোধিতা করেছিল। তিনি সুকোথের অনুষ্ঠানে পৌরহিত্য করার সময় টেম্পলে রাজার ওপর আক্রমণকারী বিদ্রোহীদের মধ্যেও তারা থাকতে পারে। তারা শোভাযাত্রার সময় সাথে করে আনা লেবুও তার দিকে ছুঁড়ে মারে। এর পরপরই আলেকজান্ডার ছয় হাজার লোককে হত্যা করেন। ২৫ অপর ঘটনায়, আরেক বিদ্রোহে আলেক্সান্ডার আট শ’ বিদ্রোহীকে জেরুসালেমে ক্রুশবিদ্ধ করেন, তাদের চোখের সামনে স্ত্রী ও সন্তানদের নির্মমভাবে গলা কেটে লাশগুলো ঝুলিয়ে রাখেন। তিনি তার উপপত্নীদের সাথে ভোজ ও পান উৎসব করার ফাঁকে ফাঁকে নৃশংসতার দিকেও চোখ রাখছিলেন।২৬ এই নৃশংস ঘটনায় সম্ভবত অনেকের কাছে প্রমাণ করে যে বিপুল আশা সৃষ্টিকারী এই রাজারা ছিলেন আসলে আরেকটি হেলেনবাদী স্বৈরতন্ত্রের চেয়েও খারাপ।

    আলেকজান্ডার অব্যাহতভাবে নতুন এলাকা জয় করতে থাকেন, জর্ডানের উভয় তীরে সম্প্রসারিত রাজ্য শাসন করতেন তিনি। তিনি নতুন ভূখণ্ড জয় করার সময় অ-ইহুদি অধিবাসীদের ইহুদি ধর্মে ধর্মান্তরকরণের সুযোগ দিতেন। যারা এই প্রস্তাব গ্রহণ করত না, তাদের দেশ থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হতো। তিনি জানতেন যে তার শাসন সার্বজনীনভাবে জনপ্রিয় নয়। তিনি তার মৃত্যুশয্যায় তার স্ত্রী সালোমকে, তিনি তাকে প্রলুব্ধ করেছিলেন, পরামর্শ দিয়ে যান ফারিসিদের ক্ষমতা দিতে। তিনি তাদের প্রভাবের ব্যপ্তি জানতেন, আশা করেছিলেন যে ‘তারা জাতিকে বলপূর্বক তার [স্ত্রীর] অনুকূলে নিয়ে আসতে পারবে।’ তার স্ত্রী তা করেছিলেন, কিন্তু তা রাজবংশটিকে রক্ষা করতে পারেনি। খ্রিস্টপূর্ব ৬৭ সালে তার মৃত্যুর পর তার দুই ছেলে দ্বিতীয় হারক্যানাস ও দ্বিতীয় অ্যাস্টিবোবুলাস বিভিন্ন বহিরাগত শক্তির সহায়তায় রাজত্ব ও পুরোহিত্বের জন্য রক্তাক্ত সংগ্রামে জড়িয়ে পড়েন। এসব মিত্রের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিলেন অ্যান্টিপ্যাটার। ইদুমিন এ লোকটি আলেক্সান্ডারের অধীনে আঞ্চলিক গভর্নরের দায়িত্ব পালন করতেন। তিনি এখন হারকানাসের সমর্থক হলেন। হারকানাস ও অ্যাসিটোবুলাস রোমান জেনারেল পম্পেইয়ের কাছে আবেদন জানান। তিনি খ্রিস্টপূর্ব ৬৪ সালে অ্যান্টিয়কে এসেছিলেন। তিনি শেষ সেলুসিড রাজাকে ক্ষমতাচ্যুত করেন। ফারিসিরা ও পম্পেইয়ের কাছে একটি প্রতিনিধিদল পাঠিয়ে তাকে তাদের দেশের রাজতন্ত্রও উচ্ছেদের জন্য অনুরোধ করেন। কারণ হিসেবে তারা বলে যে তাদের ধর্মে এ ধরনের ঐতিহ্য নেই।

    ভেড়ার শিঙের বাঁশি (শোফার) বাজানোর, ইহুদি নতুন বছরের সূচনায় ওয়েস্টার্ন ওয়ালে রাব্বিরা তা করতেন, উদ্দেশ্য ছিল সম্ভ্রম সৃষ্টি। অনুতাপ ও শেষ দিবসের স্মরণে এ প্রাচীন প্রথাটি সেকেন্ড টেম্পলের সৌম্যতা ও শ্রদ্ধা প্রকাশ করত।

    জেরুসালেম পরিণত হয় এসব যুধ্যমান উপদলের যুদ্ধক্ষেত্র। দ্বিতীয় অ্যারিস্টোবুলাস ও তার সমর্থকেরা টেম্পলে তাদের প্রতিবন্ধকতা স্থাপন করে, টাইরোপোয়ান ভেলির উপর থাকা সেতু আগুনে জ্বালিয়ে দেয়। দ্বিতীয় হারকানাস ও অ্যান্টিপ্যাটারের দখলে ছিল আপার সিটি। তারা তাদের মিত্র হিসেবে রোমান সেনাবাহিনীকে আমন্ত্রণ জানায়। হ্যাসমোনিয়ান প্রাসাদে একটি রোমান সেনাছাউনি স্থাপন করা হয়। পম্পেই নগরীর সবচেয়ে অরক্ষিত স্থানে তথা টেম্পলের উত্তরে তার শিবির সরিয়ে নেন। অ্যারিস্টোবুলাস তিন মাস আত্মরক্ষা করতে সক্ষম হন। যোসেফাস আমাদের বলছেন যে রোমান জেনারেল টেম্পল পুরোহিতদের নিবেদিতপ্রাণ অবস্থা দেখে আশ্চর্য হয়ে গিয়েছিলেন। টেম্পল আঙিনায় ক্ষেপণাস্ত্র বৃষ্টির প্রতি ভ্রূক্ষেপ না করেই পুরোহিতেরা তাদের বলির পশু নিয়ে আসছিলেন। খ্রিস্টপূর্ব ৬৩ সালের সেপ্টেম্বরে হারক্যানাসের সৈন্যদের পর রোমান সৈন্যরা প্রতিরক্ষা গুঁড়িয়ে দিয়ে বিপুল সংখ্যায় টেম্পল আঙিনায় প্রবেশ করে। কিন্তু তা সত্ত্বেও পুরোহিতেরা তাদের কাজ বন্ধ করেননি।২৮ ভয়াবহ তাণ্ডবে ১২ হাজার ইহুদিকে হত্যা করা হয়, পুরো ইহুদি জাতিকে ভয় দেখানোর জন্য পম্পেই টেম্পল ভবনে প্রবেশ করে হেখাল পর্যন্ত হেঁটে যান, ডেভিরের অন্ধকার পবিত্রতার দিকে তাকান। জনসাধারণের উদ্বেগ প্রশমিত করার জন্য তিনি সাথে সাথে সরে আসেন, স্থানটি বিশুদ্ধ করার জন্য নির্দেশ দেন। তবে দেশে, তারা একে বলত প্যালেস্টিনা,২৯ রোমান দখলদারিত্ব টেম্পলের পবিত্রতা লঙ্ঘনের সাথে শুরু হয়। ইহুদিরা লক্ষ্য করল, নতুন প্রভুরা পবিত্র জিনিসকে অপবিত্র করাকে তারা পরোয়া করে না।

    ⤶ ⤷
    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleছোটগল্প – মুহম্মদ জাফর ইকবাল
    Next Article বাইবেল কোরআন ও বিজ্ঞান – মরিস বুকাইলি
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Generic selectors
    Exact matches only
    Search in title
    Search in content
    Post Type Selectors
    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Our Picks

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }