Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • English Books
      • Jules Verne
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    জেরুসালেম : ওয়ান সিটি থ্রি ফেইস – ক্যারেন আর্মস্ট্রং

    মোহাম্মদ হাসান শরীফ এক পাতা গল্প727 Mins Read0
    ⤶ ⤷

    ৭. ধ্বংস

    পম্পেই তার জয়ের পর পরাজিত হাসমোনিয়ান রাজ্যের ওপর কঠোর শর্তাবলী আরোপ করেন। ইহুদিদেরকে জুদা, ইদুমিয়া, পারেইয়া ও গ্যালিলি শাসন করার সুযোগ দেওয়া হলেও ভবিষ্যতে সামারিয়ার ইহুদিবাদীরা, উপকূলীয় সমভূমি, গ্রিক নগরী, ফনেসিয়ান উপকূল, ডেক্যাপলিসের অ-ইহুদিরা তাদের নিজস্ব বিষয়াদি পরিচালনা করার সুযোগ পায়। যেসব লোক ইহুদি ধর্মে দীক্ষিত হতে অস্বীকৃতি করে, দেশ থেকে বহিষ্কৃত হয়েছিল, তাদেরকে ফেরার অনুমতি দেওয়া হয়। দ্বিতীয় অ্যারিটোবুলাসকে শৃঙ্খলিত করে রোমে নিয়ে যাওয়া হয়। তবে পম্পেই তার মিত্রদের পুরস্কৃত করেন। অ্যান্টিপ্যাটার সেনাবাহিনী নিয়ন্ত্রণ করতেন, তিনি ছিলেন জুদার দায়িত্বে। অবশ্য তাকে দামাস্কাসের রোমান দূতের কাছে রিপোর্ট করতে হতো। দ্বিতীয় হারকানাসকে উচ্চ পুরোহিত করা হয়। এটি হাসমোনিসের প্রতি তখনো সহানুভূতি অনুভব করা লোকজনকে খুশি করে। তবে জেরুসালেম তার রাজনৈতিক মর্যাদার অনেকটাই হারিয়ে ফেলে : পম্পেই এর প্রাচীরগুলোকে মাটিয়ে মিশিয়ে দেন, এটি এখন স্রেফ ভূবেষ্টিত উপ-প্রদেশের রাজধানী হিসেবে টিকে রইল। একে সামারিতানদের নিয়ন্ত্রিত ভূখণ্ডের মাধ্যমে গ্যালিলি থেকে আলাদা করা হয়। আর ইহুদি প্রতিবেশীদের প্রতি বন্ধুত্বপূর্ণ হওয়ার কোনো কারণ ছিল না অ- ইহুদিদের।

    হ্যাসমোনিনরা তাদের ক্ষমতা আবার জাহির করার প্রয়াস চালায়। একপর্যায়ে অ্যারিস্টোবুলাস সত্যিই তাকে বন্দিকারীদের কাছ থেকে পালিয়ে নিজেকে জেরুসালেমে আবার প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হন। তিনি সেখানে আবার প্রাচীরগুলো নির্মাণকাজ শুরু করেন। খ্রিস্টপূর্ব ৫৭ সালে সিরীয় দূত গ্যাবিনাস এই বিদ্রোহ দমন করে অ্যারিস্টোবুলাস ও তার ছেলে আলেক্সান্ডারকে রোমে ফেরত পাঠান। তবে রোমানদের কাছে ফিলিস্তিনের কৌশলগত গুরুত্ব ছিল। তাছাড়া তারা তাদের ইহুদি প্রজাদের অনর্থক ক্ষুব্ধ করতে চাইছিল না। অ্যারিস্টোবুলাসের অন্য সন্তানদের ফিলিস্তিনে থাকার অনুমোদন দেওয়া হয়, হারক্যানাস উচ্চ পুরোহিত পদে বহাল থাকেন, হ্যাসমোনিনরা দেশে প্রবল উপস্থিতি বজায় রাখে। আর অ্যান্টিপ্যাটার তখনো অন্য যে কারো চেয়ে বেশি ক্ষমতাধর ছিলেন। তিনি ছিলেন বিচক্ষণ শাসক। তাকে ইহুদিরা শ্রদ্ধা করত। যদিও তার পরিবার মাত্র সাম্প্রতিক সময়ে ইহুদি ধর্ম গ্রহণ করেছিল এবং ইদুমিনদের মতো জাতিগতভাবে ভিন্ন বিবেচিত হতো। অবশ্য, অ্যান্টিপ্যাটার ও তার ছেলেরা কখনো ভুলে যাননি যে তারা তাদের অবস্থানের জন্য রোমের কাছে ঋণী। তারা সাম্রাজ্যের গোলযোগপূর্ণ রাজনীতির প্রতি সতর্ক দৃষ্টি রেখেছিল, পৃষ্ঠপোষকের ক্ষমতা থেকে পতন ঘটলে তারা নিপুণভাবে পক্ষ ত্যাগ করত। ফলে খ্রিস্টপূর্ব ৪৯ সালে জুলিয়াস সিজার যখন পম্পেইকে পরাজিত করেন, তখন অ্যান্টিপ্যাটার দূরদর্শিতার পরিচয় দিয়ে আবারো বিজয়ী পক্ষের সাথে থাকেন। সিজার তাকে সমর্থনের পুরস্কার হিসেবে পুরো জুদার পূর্ণ কর্তৃত্ব প্রদান করেন, তাকে জেরুসালেমের প্রাচীরগুলো আবার নির্মাণ করার অনুমতি দেন। জোপ্পা বন্দর ও জেরিল উপত্যকা ইহুদিদের কাছে ফেরত দেওয়া হয়, অ্যান্টিপ্যাটারের দুই ছেলেকে তার অধীনে টেট্রার্চ (জেলা কমিশনার) করা হয় : হেরড হন গ্যালিলি ও ফাসায়েল হয়েছিলেন জুদার কমিশনার। তারা তাদের বাবার রাজনৈতিক বিচক্ষণতার উত্তরসূরি হয়েছিলেন। এই গোলযোগপূর্ণ বছরগুলোতে তাদের এটি প্রবলভাবে প্রয়োজন ছিল। খ্রিস্টপূর্ব ৪৪ সালের ১৫ মার্চ রোমে মারকাস ব্রুটাস ও গ্যাইয়াস সিজারের নেতৃত্বে সিনেটারদের এক ষড়যন্ত্রে জুলিয়াস সিজার নিহত হন। একই বছর অ্যান্টিপ্যাটর খুন হন তার এক পুরনো শত্রুর হাতে। হেরড ও ফাসায়েল হন সিজারের অনুগত। তবে তারা অত্যন্ত সতর্কতার সাথে রোমের ঘটনাবলীর দিকে নজর রাখছিলেন। জুলিয়াস সিজারের নাতির ছেলে ও দত্তক পুত্র অক্টোভিয়ান ও মার্ক অ্যান্টোনিও যখন ব্রুটাস ও সিজারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন, তখন হেরড ও ফাসায়েল প্রয়োজনবোধে আবার পক্ষ বদল করতে প্রস্তুত ছিলেন। খ্রিস্টপূর্ব ৪২ সালে ফিলিপ্পি যুদ্ধের পর ব্রুটাস ও সিজার পরাজিত হলে ফাসায়েল ও হেরড হয়ে যান মার্ক অ্যান্টোনিওর বন্ধুভাবাপন্ন। মার্ক অ্যান্টোনিও এখন রোমান সাম্রাজ্যের পূর্বাঞ্চলীয় প্রদেশের নিয়ন্ত্রণকর্তা। রোম তখন শান্তি ও সমৃদ্ধির নতুন যুগের দ্বারপ্রান্তে, হেরড ও ফাসায়েল এই পৃষ্ঠপোষতা উপভোগ করেন।

    অবশ্য তা সত্ত্বেও খ্রিস্টপূর্ব ৪০ সালে রোমানরা সাময়িকভাবে ফিলিস্তিনির নিয়ন্ত্রণ হারায়। এসময় মেসোপটেমিয়ার পার্থিয়ানরা প্রতিরক্ষা লাইন ভেদ করে দেশটি আক্রমণ করে, তাদের প্রতিনিধি হিসেবে জেরুসালেমে হ্যাসমোনিয়ান প্রিন্স অ্যান্টিগোনাসকে স্থলাভিষিক্ত করে। ফাসায়েলকে কারাগারে নেওয়া হয়, তাকে বন্দি অবস্থায় বিষ পানে আত্মহত্যা করতে বাধ্য করা হয়। তবে হেরড পালিয়ে রোমে যেতে সক্ষম হয়েছিলেন। সেখানে তিনি ইহুদি হিসেবে সিনেটকে অভিভূত করতে সক্ষম হয়েছিলেন। তিনি প্রমাণ করেন, তিনি রোমের পক্ষ থেকে দেশটিকে রক্ষা করতে সক্ষম। সিনেটররা ইহুদিদের হেরড রাজা হিসেবে নামকরণ করে। খ্রিস্টপূর্ব ৩৯ সালে তিনি ফিলিস্তিনে ফিরে যান। তিনি মার্ক অ্যান্টোনিওর সাহায্যে গ্যালিলি দখল করেন, ৩৭ সালে জেরুসালেম অবরোধ করেন। চার মাস পর নৃশংস হত্যাযজ্ঞের পর নগরীটি দখল করতে সক্ষম হন। হাজার হাজার ইহুদিকে সংকীর্ণ রাস্তাগুলোতে হত্যা করা হয়, টেম্পল আঙিনাকে তারা পবিত্র স্থান বিবেচনা করত। হেরডের অনুরোধে অ্যান্টিগোনাস দি হ্যাসমোনিনকে হত্যা করেন মার্ক অ্যান্টোনিও। অবশ্যই এই প্রথমবারের মতো রোমানরা কোনো অনুগত রাজাকে মৃত্যুদণ্ড দিলো।

    ফিলিস্তিনে ইহুদিদের রাজা হিসেবে স্থলাভিষিক্ত হওয়া মাত্র হেরডের হাতে পুরো নিয়ন্ত্রণ চলে আসে। রোমানরা যথাযথভাবেই বুঝতে পেরেছিল যে তার নেতৃত্বে প্রদেশটি নিরাপদ থাকবে। ফলে তারা নিজেদের প্রত্যাহার করে নেয়। হেরড নৃশংসভাবে জেরুসালেম দখল করা সত্ত্বেও ইহুদিদের মধ্যে তার সমর্থক ছিল। ফারিসিরাও হ্যাসমোনিনদের বিরোধিতা করে আসছিল, তারাও তার দাবিকে সমর্থন করে। হ্যাসমোনিয়ান প্রিন্সেস মরিয়ামকে বিয়ে করার ব্যাপারেও পূর্বসতর্কতা অবলম্বন করেছিলেন হেরা। এর ফলে হ্যাসমোনিয়ান সমর্থকদের চোখেও তাকে এক ধরনের বৈধতা দিয়েছিল। খ্রিস্টপূর্ব ৩৬ সালে তিনি মরিয়মের ছোট ভাই জোনাথনকে উচ্চ পুরোহিত পদে নিযুক্ত করেন। তবে এই সিদ্ধান্ত ভুল বলে প্রমাণিত হয়। তরুণ হ্যাসমোনিয়ান সুকোথে পবিত্র পোশাক পরলে আবেগে লোকজন কান্নায় ভেঙে পড়ে, তারা রাস্তায় রাস্তায় তার নামে উল্লাস ধ্বনি দেয়। হেরড সাথে সাথে জোনাথনকে খুন করে তার স্থলাভিষিক্ত করেন তার নিজের নিরাপদ প্রার্থীকে। সারা জীবন হেরড তার শাসনের প্রতি যেকোনো ধরনের চ্যালেঞ্জ নির্মূল করতে নির্মম ছিলেন। তা সত্ত্বেও তিনি ছিলেন প্রতিভাধর রাজা, তার সম্ভাব্য অস্থিতিশীল রাজ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছিলেন। তার রাজত্বের একেবারে শেষভাগের আগে জুদায় কোনো ধরনের আন্দোলন হয়নি।

    তার ক্ষমতার একটি বিশেষ বৈশিষ্ট ছিল এই যে হেরড কোনো ধরনের বিপ্লবে উদ্দীপ্ত করা ছাড়াই নিজের ইচ্ছামতো উচ্চ পুরোহিতদের নিয়োগ ও বরখাস্ত করতে সক্ষম ছিলেন। আমরা দেখেছি যে দায়িত্ব প্রবল আবেগের জন্ম দেয়, এর ফলে উচ্চ পুরোহিতেরা সারা জীবনের জন্য পদটি আঁকড়ে ধরে থাকেন। হেরডের অধীনে উচ্চ পুরোহিত রাজনৈতিকভাবে নিযুক্ত হতেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও পুরোহিতের পদটি তার ঔজ্জ্বল্য হারায়নি। উচ্চ পুরোহিতেরা কখনো স্রেফ রাজনৈতিক খুঁটি হতেন না। হেরড দেখলেন, উচ্চ পুরোহিতের আনুষ্ঠানিক পোশাক দুর্গে তালাবদ্ধ করে রাখাই দরকার, কেবল বড় বড় উৎসবের সময় তা বের করা হতো। এসব পবিত্র পোশাক পরামাত্র পুরোহিত স্বর্গীয় জ্যোতিৰ্চ্ছটা লাভ করতেন, জনগণের পক্ষ থেকে ওয়াইএইচডব্লিউএইচের কাছে যাওয়ার ক্ষমতাপ্রাপ্ত হতেন। এসব পোশাকের নিয়ন্ত্রণ জেরুসালেমে অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত বিষয় হিসেবে অব্যাহত থাকে, কেবল সম্রাটই পুরোহিত শ্রেণির কাছে তাদের স্থায়ী অবমুক্ত ঘটাতেন। যে ব্যক্তি এই পোশাক পরত, তিনি ঐশী শক্তির অধিকারী বলে অনুমিত হতেন, সিংহাসনের প্রতি হুমকি হতে পারতেন।

    হেরড নিজে খুবই নিবেদিতপ্রাণ ইহুদি হলেও তা ছিল তার নিজস্ব পন্থায়। তিনি ফিলিস্তিন ও আশপাশের এলাকায় অন্যান্য ধর্মের সমন্বয় সাধন করেও খুশি হতেন। হ্যাসমোনিয়ানদের বিপরীতে তিনি কখনো তার প্রজাদের ধর্মীয় জীবনে কোনো ধরনের হস্তক্ষেপ করতেন না। তিনি হ্যাসমোনিয়ানদের লোকজনকে ইহুদি ধর্মে দীক্ষিত করতে বাধ্য করার নীতিকে রাজনৈতিকভাবে দেউলিয়াপনা মনে করতেন। হেরড তার নিজের রাজ্যের ভেতর ও বাইরে অ-ইহুদি নগরীগুলোতে গ্রিক ও রোমান ঈশ্বরদের মন্দির নির্মাণ করেছিলেন। অক্টোভিয়ান নিজেকে স্বৰ্গীয় সত্তা হিসেবে ঘোষণা করলে হেরড সামারিয়ায় প্রথম ব্যক্তি হিসেবে তার সম্মানে একটি মন্দির নির্মাণ করেছিলেন। তিনি এর নতুন নাম দেন সেবাস্টি। এটি ছিল সম্রাটের নতুন পদবি আগাস্টাসের গ্রিক পরিভাষা। এই সময় নাগাদ হেরড আবারো তার আনুগত্য পরিবর্তন করেন, তার পৃষ্ঠপোষক মার্ক অ্যান্টোনিও অ্যাক্টিয়ামের যুদ্ধে অক্টোভিয়ানের কাছে পরাজিত হলে। খ্রিস্টপূর্ব ২২ সালে স্ট্রাটোস টাওয়ারের পুরনো বন্দরের স্থানে আগাস্টাসের সম্মানে সিজারিয়া নগরী নির্মাণ শুরু করেন। নগরীটিতে রোমান দেবদেবীদের সম্মানে অনেক মন্দির, একটি অ্যাম্ফিথিয়েটার, পিরায়াসের প্রতিদ্বন্দ্বী একটি পোতাশ্রয় ছিল। এটি ছিল তার পৌত্তলিক প্রজাদের প্রতি একটি উপহার। ফলে ইহুদি রাজা হেরড পৌত্তলিক বিশ্বেও শ্রদ্ধাভাজন ছিলেন। তাকে প্রদান করা শেষ গ্রেকো-রোমান সম্মানগুলোর অন্যতম ছিল তাকে অলিম্পিক গেমসের সভাপতিত্ব করতে দেওয়া।

    অবশ্য ইহুদিরা যাতে ক্ষুব্ধ না হয়, সে ব্যাপারেও সমান সতর্ক ছিলেন হেরড, জেরুসালেমে পৌত্তলিক মন্দির নির্মাণের স্বপ্ন দেখতেন না। তার উচ্চাভিলাষী নির্মাণ কর্মসূচির অংশ হিসেবে- কোনো ছোট রাজার এ যাবতকালের শ্রেষ্ঠ কৃতিত্ব- তিনি পবিত্র নগরীকে পরিবর্তন করে প্রাচ্যের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ মেট্রোপলিশে পরিণত করেন। নিরাপত্তার প্রতি সদা সতর্ক হেরডের প্রথম কাজ ছিল একটি বিশাল দুর্গ নির্মাণ। টেম্পল মাউন্টের উত্তরে নগরীর সবচেয়ে নাজুক স্থান তথা নেহেমিয়া দুর্গটির জায়গায় খ্রিস্টপূর্ব ৩৫ সালে নির্মাণযজ্ঞ শুরু করেছিলেন। তখনো মার্ক অ্যান্টোনিওর বন্ধু থাকায় তিনি নতুন দুর্গটির নাম তার পৃষ্ঠপোষকতার আলোকে করেন অ্যান্টোনিয়া। তিনি এটি নির্মাণ করেন ৭৫ ফুট উঁচু বিপজ্জনক ঢালু পাথুরে পাহাড়ের উপর। এর ঢালু পথটি মসৃণ পাথরের স্ল্যাবের হওয়ায় এতে আরোহণ করা প্রায় অসম্ভব ছিল। আয়তক্ষেত্রকার দুর্গটি এর উপর ৬০ ফুট উঠে গিয়েছিল। চার কোণায় ছিল চারটি টাওয়ার। এখানে বিশাল একটি গ্যারিসনের আবাসনের ব্যবস্থা করা যেত। এই দুর্ভেদ্য সামরিক বৈশিষ্ট্যের মধ্যেই অ্যান্টোনিয়ায় ছিল প্রাসাদের মতোই বিলাসবহুল সুযোগ-সুবিধা। এর চারপাশে স্ট্রথিন নামে পরিচিত গভীর খাল ছিল। এই খালই দুর্গটিকে উত্তরে নির্মিয়মান নতুন উপকণ্ঠ বেজেথা থেকে আলাদা করে রেখেছিল। এখানে তিনি সম্ভবত জোড়া জলাধার নির্মাণ করেছিলেন। এটি ন্যায়পরায়ণ সাইমনের খনন করা বেথ-হেসদা সরোবরের কাছে এখনো দেখা যায়।

    হেরড খ্রিস্টপূর্ব ২৩ সালের আগে জেরুসালেমের প্রকৃত পরিবর্তন শুরু করেননি। তিনি ২৫-২৫ সালের দুর্ভিক্ষের সময় লোকজনকে খাবার ও শস্য সহায়তা প্রদানে তার দক্ষতা প্রমাণের মাধ্যমে ফিলিস্তিনে শ্রদ্ধা অর্জন করে নিয়েছিলেন। অনেক জেরুসালেমবাসী ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। তবে নগরীটির নির্মাণকাজ শুরু হলে অনেকে নির্মাতা হিসেবে কাজ পেয়েছিল। হেরড ওয়েস্টার্ন হিলের ওপর আপার সিটিতে নিজের জন্য একটি প্রাসাদ নির্মাণ শুরু করেন। এটি তিনটি টাওয়ারে সুরক্ষিত ছিল। তিনটি টাওয়ারের নামকরণ করা হয় তার ভাই ফাসায়েল, তার প্রিয়তমা স্ত্রী মারিয়াম দি হ্যাসমোনিয়ান ও তার বন্ধু হিপ্পিকাসের নামে। এগুলোর ছিল দৃঢ় ভিত্তি, প্রায় ১৫ মিটার করে উঁচু। সম্ভবত হিপ্লিকাসের ভিত্তি এখনো জেরুসালেম দুর্গ থেকে দেখা যায়। এটি ডেভিড (দাউদ) টাওয়ার নামে পরিচিত। প্রাসাদটিতে দুটি বিশাল ভবন ছিল। একটিকে অক্টোভিয়ানের সম্মানে বলা হতো ক্যাসারিয়াম। এতে পানি উদ্যান ছিল। এখানে গভীর খাল ও জলাধার ছিল। এগুলো ব্রোঞ্জের মূর্তি ও ঝরনায় শোভিত ছিল। হেরড সম্ভবত আপার সিটিকে রাস্তার নেটওয়ার্কে নতুন করে সাজিয়েছিলেন। এতে চলাচল ও নগর পরিকল্পনা সহজতর হয়। এছাড়া আপার সিটিতে একটি থিয়েটার, একটি হিপ্পোড্রোম ছিল। তবে আমরা এসব স্থাপনার সঠিক স্থানটি জানি না। প্রতি পাঁচ বছর পরপর আগাস্টাসের সম্মানে খেলাধুলার আয়োজন করা হতো। এতে কৃতি ক্রীড়াবিদদের সমাগম হতো জেরুসালেমে।

    হেরডের আমলে জেরুসালেম পরিণত হয় একটি চমকপ্রদ ও অনন্য বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন নগরীতে। নগরীটি হয় এক লাখ ২০ হাজার স্থায়ী অধিবাসীর আবাসভূমি। তিনি নগর-প্রাচীরগুলো নতুন করে নির্মাণ করেন। তবে সেগুলোর সঠিক স্থান নিয়ে পণ্ডিতদের মধ্যে মতানৈক্য রয়েছে। জোসেফাস আমাদের বলছেন, ফার্স্ট ওয়াল ছিল আপার সিটিকে ঘিরে, লোয়ার সিটি ছিল প্রাচীন ইর ডেভিডের স্থানে। সেকেন্ড ওয়াল অতিরিক্ত প্রতিরক্ষার ব্যবস্থা করার পাশাপাশি অ্যান্টোনিয়া থেকে হ্যাসমোনিয়ানদের বানানো উত্তরের পুরনো প্রাচীর পর্যন্ত বিস্তৃত নতুন বাণিজ্যিক এলাকা ঘিরে রেখেছিল।’ লোয়ার সিটিতে ছিল অন্যান্য সাধারণ প্রাসাদ। এখানেই ছিল মেসোপোটেমিয়ার আদিয়াবেন রাজপরিবারের অভিজাত সদস্যদের বাসভবন। তারা ইহুদি ধর্মে দীক্ষিত হয়েছিলেন। তারা নগর -প্রাচীরের বাইরে বিশাল একটি সমাধিসৌধ নির্মাণ করেছিলেন। এটি এখন ‘টম্ব অব দি কিংস’ নামে পরিচিত। প্রাচীরগুলো চারপাশের পাহাড় আর উপত্যকাগুলোতে সাজানো পাথুরে কবর আত্মপ্রকাশ করতে থাকে। ফলে হলি সিটিতে লাশ সমাহিত করার প্রয়োজন পড়ত না। পাথরের গায়ে গুহার মতো সমাধি নির্মাণ করা হতো। আর তা সুরক্ষিত করা হতো একটি পাথর দিয়ে। এ পাথরটি দিয়েই সমাধিতে প্রবেশের পথটি বন্ধ করা হতো। হেরড আমলের এসব সমাধির মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত কবরগুলো দেখতে পাওয়া যায় কিদরন উপত্যকায় বেনে হেজর পরিবারের সমাধিক্ষেত্রের কাছে। এতে ছিল একটি স্মারক স্তম্ভ ও এর কাছে পাথুরে কবর। এ দুটিকে পরবর্তীকালে তীর্থযাত্রীরা বলত যথাক্রমে ‘পিলার অব অ্যাবসালম’ ও ‘টম্ব অব যেহোশাফাত।

    হেরড খ্রিস্টপূর্ব ১৯ সালের দিকে টেম্পলটি পুনর্নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেন। লোকজন স্বাভাবিকভাবেই উদ্বিগ্ন হলো : রাজা কি বর্তমান ভবনরাজি গুঁড়িয়ে ফেলবেন এবং তারপর দেখতে পাবেন যে কাজ চালাবার মতো তহবিলের অভাবে পড়েছেন: তিনি কি তাওরাতের বিধিনিষেধের প্রতি বিশ্বস্ত থাকবেন? হেরডের ভবনরাজি প্রায়ই চমকপ্রদ উদ্ভাবন হিসেবে দেখা যায়। তবে টেম্পলের পরিকল্পনা মুসা ও দাউদের কাছে প্রকাশ করেছিলেন ঈশ্বর। এখানে মৌলিকত্বের কোনো অবকাশ ছিল না। হেরড সতর্কভাবে লোকজনের ভীতি প্রশমিত করেন। সব সামগ্রী জোগাড় না করে এবং পুরনো ভবনরাজির পুনর্নির্মাণের সতর্ক পরিকল্পনা প্রণয়ন ও মাত্রা নির্ধারণ করার আগে কাজই শুরু করেননি তিনি। সাধারণ মানুষের নিষিদ্ধ এলাকা লঙ্ঘন করতে না পারাটি নিশ্চিত করার জন্য হেরড হাজার হাজার পুরোহিতকে রাজমিস্ত্রি ও কাঠমিস্ত্রি হিসেবে প্রশিক্ষণ দেন। কেবল তারাই হেখাল ও দেভিরের কাজ করার দায়িত্বপ্রাপ্ত ছিল। হেরড তার সবচেয়ে সেরা যে নির্মাণকাজটির জন্য স্মরণীয় হয়ে আছেন তাতে নিজে কখনো তাতে প্রবেশ করেননি। নির্মাণ পরিকল্পনা এমনভাবে করা হয় যে বলির জন্যও একটি দিনও ব্যঘাত ঘটেনি। টেম্পলের নির্মাণকাজ ১৮ মাসের মধ্যে সম্পন্ন হয়। সম্ভবত হেরডের ভবনগুলোতে উপাসনা নিরবচ্ছিন্ন ছিল বলেই এর পরিচিতি হয় সেকেন্ড (দ্বিতীয়) টেম্পল (আসলে তা ছিল থার্ড টেম্পল)।

    সেকেন্ড টেম্পল নামে পরিচিত হেরড ধর্মস্থানটির আকার বা আয়তন বদলাতে পারতেন না। তবে ভবনগুলো আরো সুন্দর করতে পারতেন। প্রাচীরগুলো শ্বেত মার্বেলে ঢাকা ছিল। মার্বেলগুলো ‘সাগরের ঢেউয়ের মতো’ লালভ ও নীলাভ শিরায় গাঁথা ছিল। হেখালের দরজাগুলো সোনায় মোড়া ছিল। এসবের উপরে সোনার আঙুরলতা ছড়ানো ছিল। এগুলো থেকে মানুষের সমান লম্বা আঙুরের গুচ্ছ আঁকা ছিল। দরজাগুলো ঢাকা ছিল অমূল্য টকটকে লাল, নীল পর্দা; সূতায় সূর্য, চাঁদ ও গ্রহ-নক্ষত্রের ছবি ছিল।

    ওয়েস্টার্ন ওয়াল- টেম্পল প্লাটফর্মের পশ্চিম দিকের সহায়ক প্রাচীরটি নির্মাণ করেছিলেন রাজা হেরড। অষ্টম শতকে মুসলিমরা যখন প্রাচীরটি পুনঃনির্মাণ করেছিল, তখন তাদের অপেক্ষাকৃত ছোট পাথরগুলো নিচে থাকা হেরডের ব্যবহার করা বিশাল বিশাল স্ল্যাবের সাথে তুলনীয় ছিল না।

    টেম্পল ভবনরাজি বেশ ছোট হলেও হেরড টেম্পল প্লাটফর্মটি সম্প্রসারণ করে বিশালত্বের প্রতি তার প্রবল ভালোবাসাকে তৃপ্ত করতে পেরেছিলেন। এটি ছিল বিশাল একটি প্রকল্প, সময় লেগেছিল ৮০ বছর। ফলে এর কাজ শেষ হওয়া দেখে যেতে পারেননি তিনি। তবে কাজ সম্পন্ন করার জন্য তিনি ৮০ হাজার কারিগর নিযুক্ত করেছিলেন। কাজ শেষ হলে দেখা যায়, প্লাটফর্মটি প্রায় ৩৫ একর জায়গাজুড়ে অবস্থিত। এটি ছিল মূল আকারের কয়েক গুণ বড়। প্লাজাটি এখন মাউন্ট জায়নের পর্বত চূড়া থেকে অনেক দূর পর্যন্ত বিস্তৃত থাকায় একে টিকিয়ে রাখতে বিশাল ভল্ট আর স্তম্ভ দিতে হয়েছিল। নতুন সহায়ক প্রাচীরগুলো সম্পর্কে জোসেফাস লিখেছেন, এগুলো ছিল ‘অশ্রুতপূর্ব ধরনের বিশালতম। কোনো কোনো পাথরের ওজন ছিল দুই থেকে পাঁচ টন পর্যন্ত। হেরড তার টেম্পল প্লাটফর্মটি পূর্ব দিকে সম্প্রসারিত করতে চাননি। ফলে পুরনো পূর্ব দিকের প্রাচীরটি, যা একইসাথে ছিল নগর-প্রাচীরও, বহাল থেকে যায়। এরপর থেকে টেম্পল মাউন্টের ওই এলাকাটি জায়নের উপর প্রথম নির্মাতা সোলায়মানের নির্মাণস্থলের সাথে সম্পৃক্ত হয়ে যায়। নতুন নির্মাণের মধ্যে পশ্চিম দিকের সহায়ক প্রাচীর ছিল সবচেয়ে দীর্ঘ। এটির আয়তন ছিল অ্যান্টোনিয়া থেকে দক্ষিণে পশ্চিম দিকের প্রাচীরের ভূমিতে অবস্থতি লোয়ার মার্কেট পর্যন্ত প্রায় ৫৩০ গজ। এই মার্কেট ছিল পুরোহিতদের নিয়ন্ত্রণে থাকা এলাকা, পর্যটক ও তীর্থযাত্রীদের কাছে তা ছিল খুবই জনপ্রিয়। প্রাচীরের গায়ে তিন ধারার পাথর দিয়ে এগুলো নির্মাণ করা হয়েছিল। নগর পরিষদ ভবনগুলো ও জাতীয় আর্কাইভ ছিল পশ্চিম প্রাচীরের পাদদেশে। টেম্পল প্লাটফর্মের উপরে বর্তমান হারাম আল-শরিফের পোর্টিকোর মতো করে নির্মাণের বদরে গ্রিক ফ্যাশনের কলামযুক্ত পোর্চে তিন দিক দিয়ে ঘেরা ছিল। প্লাটফর্মটির পুরো দক্ষিণ দিকটি ছিল স্তম্ভ ঘেরা বিশাল এলাকা, অনেকটা রোমান ফোরামের মতো। এটি গ্রীষ্মকালে বৃষ্টি থেকে আশ্রয় ও ছায়া দিত। রয়্যাল পোর্টিকো ছিল স্যালসবারি ক্যাথেড্রালের সমান, ছয় শ’ ফুট লম্বা ও সর্বোচ্চ বিন্দুতে এক শ’ ফুট উঁচু। দক্ষিণ দিকের সহায়ক প্রাচীরের উপরে চকমকে শ্বেত মার্বেলে ঢাকা ছিল। এটি ছিল সমীহ জাগানিয়া দৃশ্য। দূর থেকে টেম্পল মাউন্ট ছিল দর্শনীয় বস্তু। জোসেফাস লিখেছেন, পবিত্র স্থানটির দিকে কেউ তাকাতে চেষ্টা করলে সোনায় প্রতিফলিত সূর্যের আলোকে চোখে আগুনের গোলা হানা দিত, তাকে মুখ সরিয়ে নিতেই হতো।’ তিনি আরো লিখেছেন, দূর থেকে যে অংশটি সোনায় মোড়া ছিল না সেই অংশকে মনে হতো সাদা বরফে ঢাকা পর্বত। ফলে এটি ধ্বংস হওয়ার অনেক পরেও রাব্বিরা যখন এই দাবি করতেন, তা বিস্ময়কর ছিল না : ‘হেরডের টেম্পল যে দেখেনি, সে তার জীবনে সুন্দর কিছু দেখেনি।

    তীর্থযাত্রীরা দুটি দিক দিয়ে টেম্পল আঙিনায় প্রবেশ করতে পারত। তারা হয় রয়্যাল পোর্টিকোতে উঠে যাওয়া বিশাল সিঁড়ি বেয়ে সেখানে যেত কিংবা পশ্চিম দিকের সহায়ক প্রাচীরের পাদদেশে থাকা সড়ক পর্যন্ত বিস্তৃত দুটি সেতু পাড়ি দিয়ে যেত। প্লাটফর্মে গেলেই দর্শকেরা আঙিনার জটিল ব্যবস্থা দেখতে পেত। প্রতিটিই ছিল শেষেরটির চেয়ে পবিত্র। এভাবে পথ চলে দেভিরের চূড়ান্ত পবিত্র স্থানে যাওয়া যেতে। (দেখুন ডায়াগ্রাম)। তীর্থযাত্রীরা প্রথমে ‘কোর্ট অব জেনটিলস’-এ প্রবেশ করত। এটি সবার জন্য উন্মুক্ত ছিল। এটি একটি রাজসিক স্তম্ভশ্রেণি দিয়ে ‘কোর্ট অব ইসরাইলি’ (শাস্ত্রীয়ভাবে বিশুদ্ধ পুরুষ ইহুদিদের জন্য) আলাদা ছিল। বিদেশীদের আর আগে না বাড়ার হুঁশিয়ারি সঙ্কেত দেওয়া ছিল। এই হুঁশিয়ারি অমান্যের শাস্তি ছিল মৃত্যুর যন্ত্রণা। প্রতিবন্ধকতার পর ছিল ‘কোর্ট অব ওম্যান’। উঁচু গ্যালারিতে জালি দিয়ে ঘেরা এই স্থান থেকে নারীরা বেদির আঙিনায় পশু বলি প্রত্যক্ষ করতে পারত। এর পর আসত ‘কোর্ট অব লেভিটেস’। সব শেষে ‘কোর্ট অব প্রিস্টস’, এতে বলির সবচেয়ে বড় বেদী ছিল।

    ভেতরের প্রকোষ্ঠের দিকে এই পর্যায়ক্রমিক যাত্রা তীর্থযাত্রী ও উপাসনাকারীদেরকে স্মরণ করিয়ে দিত যে তারা সম্পূর্ণ ভিন্ন সত্তার পথে আলিয়া (ঊর্ধ্বগমন) করছে। তারা পাক-পবিত্র হতে নানা ধরনের শাস্ত্রাচার পালন করত। এটি তাদের মধ্যে স্বাভাবিক জীবন থেকে কিছুটা আলাদা হওয়ার অনুভূতি সৃষ্টি করত। কারণ, তাদের পবিত্র ঈশ্বরের আলাদা জগতে প্রবেশ করতে যাচ্ছে। এই সফরের সময় তাদেরকে পুরোহিতদের মতো একই ধরনের শাস্ত্রীয় শুদ্ধাচার অনুসরণ করতে হতো। বিশেষ করে তাদেরকে মৃত্যুর (এটিই ছিল সবচেয়ে বড় অসূচিতা) যেকোনো ধরনের সংস্পর্শ থেকে পবিত্র হতে হতো। দৈনন্দিন জীবনে এটি এড়ানো অসম্ভব : যে কেউ অসাবধানতাবশত কিছু বোঝার আগেই প্রাচীন কোনো কবরের স্থানে পা ফেলে থাকতে পারে। তবে জীবনের বড় যেকোনো পরিবর্তন, যেমন শিশুর জন্ম ইত্যাদিও অসূচি বিবেচিত হতো। এটিকে নোংরা বা পাপ কাজ বিবেচনা করা হতো, এমন কারণে নয়, বরং এ কারণে যে এ ধরনের পরিবর্তনের আগেই তারা ঈশ্বরের কাছাকাছি যাওয়ার অবস্থায় পৌঁছেছিল এবং তীর্থযাত্রীর যেখানে যাওয়ার কথা ছিল সেখান গেলে প্রতীকীভাবে এই অপরিবর্তনীয়তার অংশীদার হতো। তীর্থযাত্রীদেরকে বাড়ি ত্যাগের আগে স্থানীয় পুরোহিত যদি বিশুদ্ধ করে না দিতেন, তবে তাদেরকে টেম্পল মাউন্টে যাওয়ার আগে জেরুসালেমে সাত দিন অপেক্ষা করতে হতো। এই সময়ে তাদেরকে যৌনকাজ থেকে বিরত থাকতে হতো, তৃতীয় ও সপ্তম দিবসে তারা শাস্ত্রীয়ভাবে পরিশুদ্ধ হতে পানি ও ছাইয়ের ছিটা দিত, শাস্ত্রীয়ভাবে গোসল করত। এই বাধ্যতামূলক অপেক্ষা ছিল আধ্যাত্মিক প্রস্তুতি ও আত্ম-পরিশুদ্ধ হওয়ার সময়। এটি অভ্যন্তরীণ সফরে তীর্থযাত্রীদের স্মরণ করিয়ে দিত যে তারা অবশ্যই চূড়ান্ত বাস্তবতায় ‘উঠছে’ এবং সম্পূর্ণ ভিন্ন মাত্রায় প্রবেশ করছে।

    তারা যখন সবশেষে বেদী আঙিনায় যে পশুটিকে বলি দিতে চায়, সেটিকে নিয়ে টেম্পল প্লাটফর্মে উঠত, তখন তীর্থযাত্রীরা মনে করত, তারা অস্তিত্বের আরো তীব্র এলাকায় প্রবেশ করেছে। কোনো না কোনোভাবে এই নিঃসঙ্গ এলাকায় পৌছাতে পারলে বাস্তবতার সামগ্রিকতা অনুভব করা সম্ভব হতো। এই সময়ের মধ্যে টেম্পলের প্রতীকীবাদ মনে হয় বদলে গিয়েছিল : এটি এখন সমগ্র মহাজগতের ক্ষুদ্র প্রতীকিতে পরিণত হয়েছিল। একবার পুরোহিত হিসেবে টেম্পলে দায়িত্ব পালনকারী জোসেফাস এর মহাজাগতিক কল্পনাকে ব্যাখ্যা করেছেন। ‘কোর্ট অব দি জেন্টিসল’ এখনো আদি সাগর যমের সাথে সম্পৃক্ত ছিল। তা ছিল পবিত্রতার শৃঙ্খলাপূর্ণ বিশ্বের বিপরীতে দণ্ডায়মান। এটি মনের ওপর স্থায়ী চ্যালেঞ্জ ছিল, তা অতিক্রম করতে হতো। অন্য দিকে হেখাল প্রতিনিধিত্ব করত পুরো সৃষ্ট বিশ্বের। এটি প্রতীকীভাবে চারটি উপাদান থাকত। এগুলো হলো ‘স্বর্গের পুরো উদ্যান’, সাত পৃথিবীর জন্য দণ্ডায়মান মহা বাতিদানের ওপর থাকা বাতি, জুদিয়াকের চিহ্ন স্মরণ করিয়ে দেওয়া পবিত্র ১২টি রুটি ও বছরের ১২ মাস। ধূপদানির বেদীতে থাকত ‘সাগর ও ভূমির (জনবসতিপূর্ণ ও নির্জন এলাকার) ১৩ মসলা। এটি ঈশ্বরের কাছ থেকে আসত এবং ঈশ্বরের প্রতিনিধিত্ব করত। আলেক্সান্দ্রিয়ার ফিলো (আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ৩০ থেকে খ্রিস্টপূর্ব ৪১ পর্যন্ত), তিনি তীর্থযাত্রী হিসেবে একবার জেরুসালেম এসেছিলেন, এই প্রতীকীবাদের সাথে পরিচিত ছিলেন। প্ল্যাটোবাদী এ লোকটিও উল্লেখ করেছেন, হেখালের আসবাবপত্রে স্বার্গীয় ধারণার প্রতিনিধিত্ব করত, ওই আদর্শে তৈরি হতো। ওই আদর্শ ছিল আমাদের অভিজ্ঞতা, বুদ্ধি ও দেখার ক্ষমতার বাইরে!’ অর্থাৎ টেম্পল মাউন্টের পরিকল্পনা ও নক্সা ছিল ঈশ্বরের পথে চলার পরিক্রমা। আপনি সাধারণ নশ্বর দুনিয়া থেকে বিশৃঙ্খলার প্রান্তিক এলাকা, আদি সাগর, গোয়িম অতিক্রম করে ঈশ্বরের সৃষ্ট সুশৃঙ্খল বিশ্বে প্রবেশ করবেন, তবে আপনি এটি দেখবেন ভিন্নভাবে। দুনিয়াটি এখন ঈশ্বরের পথে অপ্রতিরোধ্য হিসেবে প্রকাশিত হচ্ছে। একবার দুনিয়াতে স্বর্গীয় পথে সফর করতে পারলে, উচ্চ পুরোহিত যেভাবে চূড়ান্ত বাস্তবতায় যান হেখাল দিয়ে, পুরো বিশ্বের ভিন্ন অর্থ হয়ে দেখা দেবে। এটি অবশ্যই দেভিরে প্রতীকীভাবে হবে, হেখাল থেকে আরেকটি পর্দা দিয়ে আলাদা থাকবে। দেভির ছিল ফাঁকা, কারণ এটি আমাদের অনুভূতি ও ধারণার ঊর্ধ্বে থাকা কোনো কিছুর প্রতিনিধিত্ব করে : জোসেফাস আমাদের বলেছেন, ‘এখানে একেবারেই কিছু রাখা হতো না। এটি ছিল সবকিছুর ধরা ছোঁয়ার বাইরে, অলঙ্ঘনীয় ও অদৃশ্যমান।

    পবিত্র ঈশ্বরের চরম বিচ্ছিন্নতা এই তথ্যকে গুরুত্ব দিয়ে ফুটিয়ে তুলেছিল যে কেবল পুরোহিতেরাই টেম্পলে পবিত্রতার কেন্দ্রবিন্দুর কাছাকাছি হতে পারে। জোসেফাস ব্যাখ্যা করেছেন যে উচ্চ পুরোহিতের পোশাকও ছিল মহাজাগতিক দিক থেকে তাৎপর্যপূর্ণ : তার জোব্বা স্বর্গ ও পৃথিবীকে প্রতীকীভাবে ফুটিয়ে তোলে, গায়ের উপরের অংশের জামায় থাকে চারটি উপাদান। এটি ছিল যথাযথ। কারণ উচ্চ পুরোহিত কেবল ‘পুরো মানবজাতি নয়, বরং প্রকৃতি, পৃথিবী, পানি, বাতাস ও আগুনের’ প্রতিনিধি হিসেবে হেখালে পৌরহিত্য করতেন।’ তবে যম কিপ্পুরের ওপর দেভিরে প্রবেশ করার সময় উচ্চ পুরোহিত পোশাক বদলিয়ে দেবশিশুদের পোশাক সাদা লিনেনের কাপড় পরে নিতেন। এই পোশাক স্বর্গ ও দুনিয়ার মধ্যে মধ্যস্ততা করত। ঐশী স্থানটি এমন এক অস্তিত্বের শক্তিশালী উপস্থিতি সৃষ্টি করত যা মানবীয় অভিব্যক্তিতে প্রকাশ করা সম্ভব নয়। প্রস্তুতির শাস্ত্রাচার, মাউন্টে আরোহণ, টেম্পল ভবনরাজির আঙিনার স্তরে স্তরে থাকা পবিত্রতার সবই উপাসনাকারীদের মধ্যে এই অনুভূতি সৃষ্টি করত যে তারা স্বাভাবিক জীবনে হলেও তা থেকে সম্পূর্ণ ভিন্নভাবে অস্তিত্বশীল আরেকটি মাত্রায় মোড়া একটি স্থানে প্রবেশ করেছে। মেসোপোটেমিয়ান জিগারাতের উপর থাকা প্লাটফর্মের মতোই ছিল এর পবিত্রতার মাত্রা। তারা টেম্পল মাউন্টের মাত্রাটিকে দেভিরের ‘শীর্ষে’ থাকা ঐশী এলাকাগামী একটি প্রতীকী ঐশী পর্বতে নিয়ে যেত। টেম্পলের কল্পনা উপাসনাকারীদের এমন এক দৃশ্যপটে নিয়ে যেত যেখানে তারা অস্তিত্বের কেন্দ্রে থাকা নশ্বর দুনিয়ার প্রকৃত অর্থ উপলব্ধি করতে পারত। যমের ধ্বংসকরী শক্তিসহ জীবনের সামগ্রিকতা দেভিরের গোপন পবিত্রতায় প্রবেশের সুযোগ সৃষ্টি করত।

    হেরডের আমলে আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে অবশিষ্ট ফিলিস্তিন ও বিভিন্ন স্থান থেকে বেশি তীর্থযাত্রী আকৃষ্ট করত জেরুসালেম। পাসওভারের মহা উৎসব, উইকস পেন্টেকস্টের ফসল তোলার উৎসব ও সুকোথে জেরুসালেমে তিন লাখ থেকে পাঁচ লাখ লোকের সমাবেশ ঘটত।১২ শুদ্ধতার ওপর জোর দেওয়া সত্ত্বেও এসব উৎসব বিষণ্ণতা বা সংযমের কোনো বিষয় ছিল না। তীর্থযাত্রীরা পরিবারগুলোকে একসাথে অবকাশ কাটানোর সুযোগ করে দিত। জেরুসালেমে যাওয়ার দীর্ঘ সফরে তীর্থযাত্রীরা রাতে একসাথে মদ্যপান করতে পারত, কৌতুক বলতে পারত, হাসতে পারত, জনপ্রিয় গান গাইতে পারত। জেরুসালেমে পৌঁছে তারা সত্যিকারের উৎসব মেজাজের সাথে পরিচিত হতো। তীর্থযাত্রীরা নগরীর সিনাগগগুলোতে কিংবা ব্যক্তিগত বাড়িঘরে অবস্থান করতে পারত। অনেকে নগরীর বাইরে পাহাড় ও উপত্যকায় শিবির স্থাপনকে অগ্রাধিকার দিত। তারা জেরুসালেমে ব্যয় করার জন্য বিশেষ তীর্থ কর নিয়ে আসত। এই অর্থ ধার্মিক কাজে ব্যবহার হতো না। তারা তাদের সাথে থাকা অর্থ লাল গোশত, মদ বা অন্য আরো অনেক ভোগে ব্যবহার করতে পারত। এই শিথিল পরিবেশে নতুন বন্ধু জুটত, তীর্থযাত্রীদের মধ্যে ইহুদি সংহতি জোরদার হতো। দানের বন্ধন ঈশ্বরের বন্ধনের পাশাপাশি শক্তিশালী হতো।’

    উৎসবগুলো সহজাতভাবেই ছিল আনন্দ করারও সময়। সুকোতের অষ্টম দিবসের পরিবেশ তখনো ছিল ছুটির আমেজপূর্ণ। লোকজন নগরজুরে গাছপালা ঘেরা স্থানগুলোকে ক্যাম্প খাটাত। পাসওভার ছিল বিশেষভাবে জনপ্রিয় উৎসব। প্রতিটি পরিবার পাসওয়ারের জন্য তৈরি একটি বলির ভেড়া টেম্পলে নিয়ে যেত। ওই দিন রাতে সবাই মিলে এটি দিয়ে উৎসব ভোজ সারত। এটি হতো মিসর থেকে তাদের লোকজনের মুক্তির স্মরণে। বিশেষভাবে প্রাণবন্ত উৎসব ছিল ওয়াটার ড্রয়িংয়ের উৎসব। এটি প্রতীকীভাবে উত্তর ও দক্ষিণ দুনিয়ার লোকজনকে ঐক্যবদ্ধ করত। ইসরাইলি সৃষ্টিতত্ত্ব এখন পৃথিবীকে পানিতে ঘেরা একটি ক্যাপস্যুল হিসেবে কল্পনা করত। এর উপরের পানিতে ছিল পুরুষ, আর বিপজ্জনক, স্রোতের নিচে থাকা পানিকে কল্পনা করা হতো তিয়ামাতের মতো নারী হিসেবে : তারা ঐক্যবদ্ধ হওয়ার জন্য চিৎকার করত। জেরুসালেম পৃথিবীর ‘কেন্দ্র’ হওয়ায় এই স্থানে অস্তিত্বের সব পর্যায় মিলিত হতে পারত। বছরে একবার নিচের দুনিয়ার ‘থমকে দেওয়া সত্তা’ প্রতীকীভাবে উন্মুক্ত হতো, উপরের ও নিচের পানিরাশি মিশে যেত, আর লোকজন উল্লাসে ফেটে পড়ত। পরবর্তীকালে রাব্বিরা বলছেন যে এই উৎসবের অভিজ্ঞতা যারা নেই সে কখনো তার জীবনে আনন্দ বলে কিছু জানবে না।’ এটি আদি বিশৃঙ্খলার শক্তিকে স্বীকৃতি দিয়েছিল, যা আগামী বছরের তেজদীপ্ততা, সৃষ্টিশীলতা ও ফলপ্রসূতা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে পৃথিবীতে প্রবেশ করার জন্য দরকার ছিল।

    হেরডের আমলে ইহুদি আধ্যাত্মিকতার কেন্দ্র হিসেবে বহাল থাকে টেম্পল। তবে কোনো কোনো ইহুদি ঈশ্বরের অনুসন্ধানে অন্যান্য পথও খুঁজকে শুরু করেছিল। আমরা দেখেছি, অনেকে বিশেষ করে বিদেশে থাকারা টেম্পল প্রতীকীর দিকে আধ্যাত্মিক যাত্রা করত টেম্পলকে এড়িয়েই। ইহুদিরা সিনাগগ ও সম্মেলন স্থলগুলোতেও জমায়েত হতো। এসব স্থানে তারা তাওরাত পাঠ করে জেরুসালেম সফর না করেই আধ্যাত্মিক জগতে প্রবেশ করতে পারত।১৫ এমনকি ফিলিস্তিনেও অনেক ইহুদি বিশ্বাসী সম্প্রদায় ঈশ্বরের অভিজ্ঞতা অর্জন করতে থাকে। তবে ফারিসিরা তখনো টেম্পলের প্রতি নিবেদিত ছিল। হেরডের আমলে শাম্মাই মতবাদ পৌত্তলিক মতবাদ থেকে অনেক বেশি কঠোরভাবে নিজেদেরকে আলাদা করেছিল। তারা অ-ইহুদিদের সাথে খেত না, গ্রিক ভাষায় কথা বলত না কিংবা পৌত্তলিকদের উপহারও গ্রহণ করত না। টেম্পলের বিশুদ্ধতা রক্ষার জন্যই এমন রূপরেখা প্রণয়ন করা হয়েছিল। এটি পৌত্তলিক শাসকদের সমর্থন পর্যন্ত দীর্ঘায়িত ছিল। তবে শাম্মাইয়ের দেখানো আলাদা সম্প্রদায় প্রাচীন ঐশী ভূগোলও প্রতিফলিত করত। এটি পৌত্তলিকদের পবিত্রতার ঊর্ধ্বে স্থান দিত।

    শাম্মাইয়ের প্রতিদ্বন্দ্বী হিল্লেলও বিশুদ্ধতা ও বিচ্ছিন্নতার ব্যাপারে চিন্তিত ছিলেন। তবে তিনিও বদান্যতার গুরুত্বের ওপর জোর দিতেন। হ্যাসমোনিয়ান আমলে সমানুভূতির আদর্শ সম্ভবত হারিয়ে গিয়েছিল। অ্যান্টিচুস ইপিফানেসের দুর্যোগের পর জেরুসালেমের বিশুদ্ধতার ওপর জোর দেওয়া হতে থাকে। জায়ন মতবাদের অনিবার্য সহগামী বিবেচিত সামাজিক উদ্বেগ তেমন গুরুত্ব পাচ্ছিল না। এখন হিল্লেলের ফারিসিরা তাওরাতের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মিতজভোত হিসেবে দান ও ভালোবাসা-দয়ার্তকে গ্রহণ করতে লাগল। এগুলো টেম্পলে বলি দেওয়ার সমপর্যায়ের প্রায়শ্চিত্ত বিবেচিত হতে লাগল।১৬ কোনো কোনো ফারিসি বিশেষ ভ্রাতৃ সমিতি গঠন করত। এর মাধ্যমে তারা টেম্পল উপাসনার জন্য প্রয়োজনীয় বিবেচিত শাস্ত্রীয় শুদ্ধতায় স্থায়ীভাবে বাস করার জন্য প্রতিশ্রুতিতে আবদ্ধ ছিল। এটি ছিল তাদের নিজেদের বাসায় ঈশ্বরের উপস্থিতিতে অব্যাহতভাবে বসবাস করার প্রতীকী পন্থা। তারা তাদের টেবিলগুলোকে পুরোহিতদের আঙিনার মহা বেদী হিসেবে পবিত্র বিবেচনা করত। তারা যখন ওই টেবিলে একসাথে খাবার গ্রহণ করত, তাদের একসাথে খাবার গ্রহণ পবিত্র ঘটনা বিবেচিত হতো, মনে করত, যেভাবে বলির পশু দিয়ে খাবার গ্রহণ করত পুরোহিতেরা।১৭ এই ধরনের ধর্মনুরাগ প্রতিটি বাড়িকে মন্দিরে পরিণত করত, সাধারণ বাড়িতেও জেরুসালেমের পবিত্র বাস্তবতা নিয়ে আসত।

    একইভাবে হেরড যুগের শেষ দিকে কামরান উপদলও নিজেদের একটি নতুন আধ্যাত্মিক মন্দির হিসেবে সত্যিকারের ইসরাইলি সম্প্রদায় বিবেচনা করত। জেরুসালেমের দূষিত টেম্পলের সাথে তাদের কোনো সম্পর্ক না থাকলেও তাদের স্ব-আরোপিত নির্বাসনে তারা সম্প্রদায়গতভাবে পবিত্র মন্দির হিসেবে খাবার ঘরে যেত। তারা টেম্পলের স্থায়ী অধিবাসী পুরোহিতদের মতোই জীবনযাপন করত। খাবার গ্রহণের আগে তারা ঠাণ্ডা পানি দিয়ে গোসল করত, পুরোহিতরা যেভাবে বলি দেওয়া পশুর গোশত আহার করার সময় লিনেনের সাদা কাপড় পরত, তারাও তেমনটি করত। দলবদ্ধ হয়ে প্রার্থনা করাটি বিবেচিত হতো বলির বিকল্প। তবে এটি কেবল সাময়িক ব্যবস্থা ছিল। এই সম্প্রদায়ের সদস্যরা এমন একদিনের অপেক্ষায় ছিল যেদিন দুই মেসাইয়ার নেতৃত্বে- একজন পুরোহিত ও অন্যজন সাধারণ লোক- তারা জেরুসালেম মুক্ত করার চূড়ান্ত যুদ্ধে অন্ধকার শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করবে। তখন পবিত্র নগরী পুনরুদ্ধার হবে, ঈশ্বর আবার টেম্পল নির্মাণ করবেন। কামরান সম্প্রদায় নিজেদের ইভিওনিম বা গরিব মানুষ হিসেবে অভিহিত করত, তাদের মতে কেবল তারাই ছিল জায়নের সত্যিকারের অধিবাসী। এ স্থানটি সবসময়ই গরিব আর বিনীত লোকদের জন্য স্বর্গ বিবেচিত। তারা এই নতুন জেরুসালেমের অপেক্ষায় থাকার সময় প্রথাগতভাবে ঈশ্বরের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য এসব শরিভাষা ও বাগধারা ব্যবহার করত :

    আমি তোমাকে স্মরণ করছি যে জায়ন, আশীর্বাদের জন্য;
    আমার সব শক্তি দিয়ে, আমি তোমাকে ভালোবাসি;
    তোমার স্মৃতি চিরকালের জন্য আশীর্বাদ।১৮

    তাওরাতে ইহুদিদের প্রশংসা করা হয়েছিল তাদের সব শক্তি দিয়ে কেবল ওয়াইএইচডব্লিউএইচের প্রতি ভালোবাসার জন্য। তিনিই ছিলেন একমাত্র আশীর্বাদের উৎস, কেবল তার স্মৃতিই ছিল চিরকালের আশীর্বাদ। কামরানের প্রার্থনা-গীতে এসব শব্দগুচ্ছের ব্যবহার ঘটনাক্রমে স্থান পেয়েছে- এমন নয় : এই সম্প্রদায়ের সদস্যরা ছিল নিখুঁত ও ঈর্ষান্বিত হওয়ার মতো একেশ্বরবাদী। তবে ঐশী সত্তা কখনো নিজেকে সরাসরি মানুষ হিসেবে প্রকাশ করেননি এবং শত শত বছর ধরে জেরুসালেম ছিল এমন এক মূল প্রতীক যা ইহুদিদের অপ্রবেশযোগ্য ঈশ্বরের অভিজ্ঞতা দিয়েছে। কামরান সম্প্রদায়ের জন্য জায়ন ছিল শান্তি, আশীর্বাদ ও মুক্তি থেকে অবিভাজ্য। এগুলো ছিল ঈশ্বরের অভিজ্ঞতার অখণ্ড অংশ এবং হেরডের অধীনে নশ্বর নগরীর দুঃখজনক অবস্থা সত্ত্বেও এটি তখনো ছিল সবচেয়ে ঐশী ও ধর্মীয় মূল্যবোধের।

    তবে কামরান ছিল ইহুদি ধর্মের অনেক বেশি জঙ্গি রূপ, যা ফিলিস্তিনের নাটিতে আত্মপ্রকাশ করতে শুরু করেছিল। গ্রেকো-রোমান বিশ্বজুড়ে লোকজন জাতীয়তাবাদী নস্টালজিয়ার সহজাত স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছিল। টেম্পলগুলো পূনঃপ্রতিষ্ঠিত হতে থাকে, পুরনো মিথগুলো আবার জীবিত হতে থাকে, বিশেষ করে ‘প্রতিরোধ’ মটিফগুলো। এতে করে কামরানের মহাপ্রলয়বাদী দর্শনটি যুদ্ধের প্রাচীন কল্পকাহিনী আবার চাঙ্গা করে, যা টেম্পল তথা একটি নগরী ও সঠিক ব্যবস্থা গড়ার ভিত্তি গড়ে দেয়। একইভাবে সাধারণ ইহুদি উপাসনাকারীরা মহা উৎসবগুলোকে জাতি ও আবাসভূমির পবিত্রতা উদযাপনের বিষয় হিসেবে দেখেছে। পাসওভার ছিল জাতীয় মুক্তির উৎসব; ফসল উৎসব উইকস (শাভুথ) ইহুদিদের স্মরণ করিয়ে দিত যে স্থানটি কেবল ওয়াইএইচডব্লিউএচের, রোমের নয়। মরুভূমিতে জাতিটির সময় কাটানোর কথা স্মরণ করিয়ে দিত সুকোথ। এটি টেম্পল উৎসর্গের বার্ষিকী ছিল। এ ধরনের বিপুল সংখ্যায় জাতীয় ধর্মস্থানে তাদের ঈশ্বরের সামনে সমবেত হওয়ার সময় তাদের অনুভূতি ছিল তীব্র, কিন্তু তবুও হের অত্যন্ত শক্তিশালী শাসক হওয়ায় যে তারা তাদের কথা খ্রিস্টপূর্ব ৪ শতকে তিনি মৃত্যুশয্যায় আছেন- তা শোনার আগে পর্যন্ত প্রকাশ করার সাহস করেনি।

    ঘটনাটি ছিল তাৎপর্যপূর্ণ। হেরড সম্প্রতি টেম্পল গেটে জুপিটার ও রাজকীয় রোমের প্রতীক একটি স্বর্ণ ঈগল নির্মাণ করেছিলেন। তিনি সীমা লঙ্ঘন করে অনেক বেশি দূর পর্যন্ত চলে গিয়েছিলেন। যখন খবর এলো যে হেরড সত্যিই মারা যাচ্ছেন, তখন দুই শ্রদ্ধাভাজন শিক্ষক জুডাস ও ম্যাথিয়াস তাদের ছাত্রদের ইঙ্গিত দেন যে ঈগলকে নামিয়ে আনার এটিই সুবর্ণ সুযোগ। এ ধরনের পদক্ষেপ ছিল খুবই বিপজ্জনক। তবে এটি হলো তাদের পিতৃপুরুষদের তাওরাতের জন্য মৃত্যুবরণ করার মতো গৌরবজনক কাজ! সে অনুযায়ী, তরুণরা রয়্যাল পোর্টিকোর ছাদে উঠে মোটা রশির সাহায্যে তাদের নিচে নামিয়ে আনে। তারপর কুঠার দিয়ে ঈগলটিকে ভূপাতিত করে। তবে কাজটি সময়োচিত হয়নি। মৃত্যুকে উড়িয়ে দিয়ে প্রচণ্ড ক্রোধে বিছানা থেকে উঠে হেরড ওই তরুণ ও তাদের শিক্ষককে মৃত্যুদণ্ড দেন। কয়েক দিন পর তিনি যখন মারা গেলেন, তখন বলা হয়েছিল যে তার মৃত্যু- যন্ত্রণা ছিল এসব পবিত্র ‘শহিদের’ অভিশাপের শান্তি। এখানে উল্লেখ করা উচিত যে এটি ছিল একটি সীমিত প্রতিবাদ। হেরডকে হত্যা করা কিংবা রোমান আধিপত্য অবসানের বিন্দুমাত্র কোনো চেষ্টা ছিল না এতে। একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল টেম্পলকে কলুষিত করার প্রতিবাদ করা। বিষয়টি এখানেই সীমাবদ্ধ রাখা হতো। কোনো শাসক যতক্ষণ পর্যন্ত টেম্পলকে আলাদা করে রাখবেন, ততক্ষণ পর্যন্ত ইহুদিরা তাকে বরদাস্ত করতে প্রস্তুত ছিল। কিন্তু টেম্পলের প্রতি যেকোনো মহল থেকে কোনো ধরনের হুমকিই সহিংসতা, রক্তপাত ও ভীতিকর প্রত্যাঘাত সৃষ্টি করত।

    হেরড খ্রিস্টপূর্ব ২৯ সালে তার প্রিয়তম স্ত্রী মারিয়ামনকে হত্যা করেছিলেন। মৃত্যুর আগে তিনি তার তিন সন্তানকেও হত্যা করেছিলেন। সব ক্ষেত্রেই কারণ ছিল একটিই : তার সন্দেহ হয়েছিল যে তারা তাকে হত্যার ষড়যন্ত্র করছে। হেরড তার বেঁচে থাকা তিন সন্তান- আচেলাস, ফিলিপ ও অ্যান্টিপাসকে কঠোর নিয়ন্ত্রণে রেখেছিলেন। তাদেরকে তিনি বিন্দুমাত্র ক্ষমতা দেননি। তাদের মধ্যে কে তার স্থান গ্রহণ করতে পারেন, সে সম্পর্কেও তার কোনো ধারণা ছিল না। মৃত্যুকালে তিনি দুটি উইল রেখে গিয়েছিলেন। ফলে তার রাজ্যের ভাগ্য বর্তায় আগাস্টাসের হাতে। তিনি তিন ছেলেকেই রোমে তলব করেন। তবে তাদের যাত্রার প্রাক্কালে তীর্থযাত্রীরা পাসওভার উদযাপনের জন্য বিপুল সংখ্যায় জেরুসালেমে প্রবেশ করছিল। পবিত্র শহিদদের সাম্প্রতিক মৃত্যু নিয়ে আবেগ ছিল প্রবল। স্থানীয় ইহুদিদের কান্না আর বিলাপে ভরে ওঠেছিল জেরুসালেম। তীর্থযাত্রীরা অল্প সময়ের মধ্যেই ক্রোধ, ভয় আর শোকগ্রস্ত হয়ে পড়লেন। সবশেষে জনতাকে নিয়ন্ত্রণের আর কোনো পথ থাকল না। প্রথম দফার পশু বলির পর্ব শেষ হওয়া মাত্র আচেলাস টেম্পল আঙিনায় তার সৈন্যবাহিনী পাঠান। সেখানে থাকা তিন হাজার লোককে হত্যা করা হয়। আবারো মন্দিরকে অপবিত্র করা হলো। তবে এবার কোনো পৌত্তলিক প্রতীকের মাধ্যমে নয়, বরং ইহুদি সৈন্যরা ইহুদি রক্তপাত ঘটাল। পাঁচ সপ্তাহ পরে আর্চেলাস যখন রোমে ছিলেন, তখন পেন্টেকস্ট ও সাবিনাসেনর তীর্থ উৎসবের সময় জেরুসালেমে আরেকটি দাঙ্গা বাঁধে। এবার সিরিয়া এলাকা থেকে জুদায় একটি বাহিনী পাঠানো হয়। এই বাহিনী জেরুসালেমে অবতরণ করলে স্থানীয় ও তীর্থযাত্রী মিলে হাজার হাজার লোক রাস্তায় রাস্তায় ব্যারিকেড দিয়ে রোমান সৈন্যদের ওপর হামলা করে। সাবিনাস টেম্পল মাউন্টের পোর্টিকোগুলোতে আগুন ধরিয়েই এই সহিংসতা দমন করতে পেরেছিলেন। এরপর রোমানরা নগরীর প্রাচীরগুলোতে দুই হাজার বিদ্রোহীকে ক্রুশবিদ্ধ করে। ২০

    ফিলিস্তিনের অন্যান্য অংশেও গোলযোগ ছিল। এর ফলে সিনেট নিশ্চিতভাবেইই বুঝতে পেরেছিল যে ইহুদিদের রাজা হিসেবে হেরডের স্থলাভিষিক্ত হওয়ার মতো আর কেউই নেই। আচেলাস জুদায় ফিরে গেলেন কেবল জুদার ইথনার্চ (শাসক) হয়ে; অ্যান্টিপাস ও ফিলিপকে গ্যালিলি, পারায়া ও উত্তরাঞ্চলের অন্যান্য এলাকার টেট্রারচ (গভর্নর) হিসেবে। তারা ছিলেন সফল জেলা কমিশনার, অনেক বছর তাদের অবস্থান ধরে রাখতে পেরেছিলেন। কিন্তু আৰ্চেলাস ইহুদি ও সামারিতান- উভয়ের প্রতি এত নির্মম নীতি অনুসরণ করতে লাগলেন যে খ্রিস্টপূর্ব ৬ সালে তাকে বরখাস্ত করে এলাকা থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়। এরপর থেকে জুদা রোমান পারফেক্টদের (আঞ্চলিক গভর্নর) মাধ্যমে শাসিত হতে থাকে। তারা নতুন নগরী সিসারিয়াকে তাদের রাজধানী হিসেবে নির্মাণ করেন। এটি ছিল গোলযোগপূর্ণ জেরুসালেম থেকে নিরাপদ ও বেশ ভালো দূরত্বে। এই রোমান দখলদারিত্বের প্রথম দিনগুলোতে গ্যালিলিতে উত্তেজনা ছিল। তবে এটি কল্পনা করা ভুল হবে যে পুরো ইহুদি ফিলিস্তিন আবেগপূর্ণভাবে রোমের বিরোধিতা করেছিল। এমনটি কখনোই ঘটেনি। হেরডের মৃত্যুর পর কয়েকজন ইহুদি আগাস্টাসের কাছে একটি প্রতিনিধিদল পাঠিয়েছিল ফিলিস্তিনে একজন রোমান গভর্নর পাঠাতে বিশেষভাবে অনুরোধ করতে। বিশেষভাবে ফারিসিরা তখনো যেকোনো ধরনের ইহুদি রাজতন্ত্রের বিরোধিতা করে যাচ্ছিল। ফিলিস্তিনে রোমান দখলদারিত্ব আদর্শ ছিল না, তবে রোম অপেক্ষাকৃত খারাপও ছিল না। বরং অতীতে ইহুদিদের শাসনকারী অন্য অনেক সাম্রাজ্যের চেয়ে বেশ ভালো ছিল। কিছু বাজে ব্যতিক্রম বাদ দিলে বেশির ভাগ রোমান কর্মকর্তা ইহুদিদের ধর্মীয় স্পর্শকাতরতাকে আঘাত করা থেকে বিরত থাকার সর্বাত্মক চেষ্টা করতেন। তারা উচ্চ পুরোহিতের সাথে সহযোগিতা করার চেষ্টা করতেন। উচ্চ পুরোহিতেরা তাদের পক্ষ থেকেও শান্তি বজায় রাখার ব্যাপারে সচেতন ছিলেন। তারা ঝামেলা সৃষ্টিকারীদের প্রতি সতর্ক নজর রাখতেন। তবে তারা যাতে দেশদ্রোহিতামূলক কোনো কাজে না জড়ায় সেজন্য নয়, বরং তারা চাচ্ছিলেন না ইহুদিরা অযথা মারা পড়ুক, যেভাবে হেরডের মৃত্যুর পর দাঙ্গায় হয়েছিল। এখন উচ্চ পুরোহিতদের নিয়োগ পুরোপুরি মেধার ভিত্তিতে হতো। ১৮ সালে ক্যাইফাস দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তিনি রোমান আমালে সবচেয়ে সক্ষম উচ্চ পুরোহিত হয়েছিলেন।

    তবে এমনকি ক্যাইফাসও ক্রুদ্ধ জনতাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেননি, যখন ২৬ সালে নতুন প্রিফেক্ট পন্টিয়াস পিলেট আবারো টেম্পলের পবিত্রতা লঙ্ঘন করেন। তিনি অন্ধকারের আড়ালে সিজারের চিত্রশোভিত পতাকা হাতে উস্কানিমূলকভাবে জেরুসালেমে তার সৈন্য পাঠিয়েছিলেন। এসব দেভির থেকে অল্প দূরে শূন্যে অ্যান্টোনিয়ায় তোলা হয়। ইহুদিরা পরের দিন জেগে এই কদর্যতা দেখে তাদের মনে অ্যান্টিচুস ইপিফেনেসের ভীতি জাগে। উত্তেজিত লোকদের একটি দল মিছিল করে ক্যাসেররিয়ায় গিয়ে পিলেতের বাসভবনের সামনে তাঁবু গাড়ে। সাধারণত জুদার ইহুদিরা ভয়াবহ রকমের বিভক্ত ছিল। তাদের পক্ষে একক ফ্রন্ট গড়া কোনোভাবেই সম্ভব ছিল না। কিন্তু টেম্পলের প্রতি হুমকি তাদের সাথে সাথে ঐক্যবদ্ধ করে ফেলে। অবশ্য এবারের ঘটনায় সহিংসতা সৃষ্টি করেনি। সম্ভবত ইহুদিরা খ্রিস্টপূর্ব ৪ সালের ঘটনা থেকে শিক্ষা গ্রহণ করেছিল। এবার তারা অপ্রতিরোধী প্রতিরোধের আশ্রয় গ্রহণ করে। পিলেত তাদের তলব করার আগে পর্যন্ত তারা তার বাড়ির সামনে পাঁচ দিন ধরে অবস্থান করতে থাকে। তারপর তিনি তাদেরকে ক্যাসেরিয়ার অ্যাম্পিথিয়েটারে ডেকে নিয়ে বলেন যে এখন তিনি তাদেরকে একটি জবাব দিতে প্রস্তুত। জনতা সমবেত হওয়ামাত্র পিলেত তার সৈন্যদের সঙ্কেত দেন। তারা সব দিক থেকে তরবারি মেলে ধরে। পিলেত যদি তাদের চুপ করাতে ভয় দেখানোর কথা ভেবে থাকেন, তবে তিনি বড় ধরনের ভুল করেছিলেন। ইহুদিরা সাথে সাথে মাটিতে পড়ে গিয়ে তাদের গলা থেকে কাপড় সরিয়ে কাঁদতে থাকে যে তাদের আইন লঙ্ঘন করার চেয়ে তাদের মরে যাওয়াই ভালো। পিলেত অবাক হয়ে গেলেন। তিনি বুঝতে পারলেন যে হার মেনে নিতে হবে। অবমাননাকর পতাকাগুলো অ্যান্টোনিয়া থেকে অপসারণ করা হলো, আবার শান্তি প্রতিষ্ঠিত হলো। অবশ্য এই ঘটনা জুদার ইহুদিদের মনে টেম্পলের নিরাপত্তার ব্যাপারে আগের চেয়েও সন্ত্রস্ত্র করে তুলেছিল।

    চার বছর পর আবার টেম্পল হুমকির মুখে পড়ল। গাধার পিঠে সওয়ার একটি লোকের নেতৃত্বে একটি ছোট শোভাযাত্রা কিদরন উপত্যকা থেকে নেমে মাউন্ট অব অলিভস হয়ে জেরুসালেমে এসেছিল। তখন ‘হোশানাহ!’ ও ‘আমাদের রক্ষা করো দাউদের পুত্র!’ কান্না শোনা যাচ্ছিল। কয়েকজন লোক ডাল কেটে হাত দিয়ে ঘোরায়। খবর রটে যে তরুণ লোকটি গ্যালিলির নাজারেথ থেকে আসা যিশু। তিনি যখন নগরীর কাছে এসেছিলেন, বলা হয়ে থাকে যিশু কেঁদেছিলেন : জেরুসালেম তাকে গ্রহণ করেনি, অল্প সময়ের মধ্যেই এটি ভীতিপূর্ণ শাস্তির ঘটনায় পরিণত হবে। পবিত্র নাগরীকে তার শত্রুরা ঘিরে ফেলবে, মাটিতে মিশিয়ে দেবে, অধিবাসীদের গলা কাটা হবে। একটি পাথরও দাঁড়িয়ে থাকবে না। তারপর নিজের কথার সত্যতা প্রমাণ করার মতো করেই যিশু নগরীতে প্রবেশ করে সোজা টেম্পলে প্রবেশ করেন। তিনি ছোট দড়ি দিয়ে একটি চাবুক তৈরি করে মুদ্রা বিনিময়কারীদের তাড়িয়ে দেন, কোর্ট অব দি জেনটিলস থেকে বলি দেওয়ার জন্য আনা কবুতর তাড়িয়ে দেন। কিতাবে কি লেখা নেই : আমার গৃহকে বলা হবে ইবাদতখানা?’ তিনি দাবি করেন। ‘তোমরা একে ডাকাতদের আশ্রয়ে পরিণত করেছ। ২২ এটি ছিল পাসওভারের আগের সপ্তাহ। যিশু টেম্পল আঙিনাগুলোতে অনেকটা সময় প্রচারকাজ করেন। তিনি ভবিষ্যদ্বাণী করেন যে হেরডের বিশাল টেম্পলটি অল্প সময়ের মধ্যেই গুঁড়িয়ে দেওয়া হবে। ‘তোমরা এই বিশাল ভবনরাজি দেখছ?’ তিনি তার অনুসারীদের জিজ্ঞাসা করবেন। ‘একটি পাথরও অন্যটির পাশে থাকবে না : সবকিছু ধ্বংস করা হবে। ২৩ চার গসপেলের প্রাচীনতমটির গ্রন্থকার মার্ক আমাদের বলছেন যে প্রধান পুরোহিতেরা কোর্ট অব জেনটিলসে যিশুর এসব কর্মকাণ্ডের খবর পাওয়া মাত্র তারা তার হাত থেকে পরিত্রাণ পেতে চেয়েছিলেন। টেম্পলের প্রতি যেকোনো ধরনের হুমকি, বিশেষ করে জনাকীর্ণ ও আবেগপূর্ণ উৎসব পাসওভারে, সহিংসতার সৃষ্টি করতে পারে। আর এর জের ধরে ভয়ঙ্কর প্রত্যাঘাত ঘটাতে পারে। যিশু ছিলেন এমন এক হুমকি যা ইহুদি জনসাধারণ বরদাস্ত করতে পারত না।

    টেম্পলে উস্কানিমূলক বিস্ফোরণ ঘটিয়ে কী করতে চেয়েছিলেন যিশু? আমরা কেবল অনুমানই করতে পারি। কারণ গসপেলগুলো তেমন তথ্য দিচ্ছে না। যিশু ইতোমধ্যেই গ্যালিলির ছোট ছোট শহর ও পল্লীতে অনুসারী পেয়েছিলেন। তিনি সেখানে আরোগ্যকারী ও ওঝা হিসেবে কাজ করছিলেন। লোকজন তাকে নবী বলত। তবে যিশু নিজেকে মেসাইয়া দাবি করতেন কিনা তা আমরা জানি না। আমাদের উৎসগুলো দ্ব্যর্থবোধক। নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, ফিলিস্তিন থেকে রোমানদের তাড়িয়ে দিতে তিনি কোনো সেনাবাহিনী গঠন করার চেষ্টা করেননি। কিংবা হেরডের মৃত্যুর পর হবু নেসাইয়া আর যেসব কাজ করতে পারেন বলে মনে হচ্ছিল, সেসবেরও কিছু করেননি। জেচারিয়া ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন যে মেসাইয়া হবেন বিনীত শাসক, তাদের কাছে গাধায় চড়ে হাজির হবেন। নগরীতে যিশুর শোভাযাত্রা ছিল সম্ভবত একটি প্রদর্শনী। তিনি লোকজনকে জানাতে চাইছিলেন, ঈশ্বরের রাজ্য জেরুসালেম শাসন করবে গরিবরা, হেরডের মতো সামরিকবাদী রাজা নয়। যিশু স্পষ্টভাবেই বিশ্বাস করতেন যে ওয়াইএইচডব্লিউএইচের দিবসটি আসন্ন। অন্যান্য মহাপ্রলয়বাদী ভবিষ্যদ্রষ্টার মতো তিনিও ইসরাইলে ১২ গোত্রের প্রত্যাবর্তনের সম্ভাবনা দেখেছিলেন। তিনি দাবি করেছিলেন, তারা তার ১২ জন শিষ্যের মাধ্যমে শাসিত হবে।২৪ সাধারণভাবে এটিও মনে করা হয়ে থাকে যে ওয়াইএইচডব্লিউএইচের শেষ বিজয়ের পর তিনি জেরুসালেমে নতুন একটি টেম্পল নির্মাণ করবেন, যেখানে সব জাতি উপাসনা করবে। মুদ্রা বিনিময়কারী ও কবুতর- বিক্রেতাদের তাড়িয়ে দেওয়ার সময় যিশু কিন্তু পবিত্র স্থানের বাণিজ্যিক অপব্যবহারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করছিলেন না। এ ধরনের বেচাবিক্রি অনাদিকাল থেকে যেকোনো মন্দির পরিচালনার জন্য অপরিহার্য ছিল। ফলে এ নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করার কারণ ছিল না। বরং যিশু সম্ভবত আরেকটি নবুয়তি ইঙ্গিত প্রদর্শন করতে চাইছিলেন। তা হলো এই যে হেরডের সুন্দর টেম্পলটির স্থানে মানুষের হাতে নির্মিত নয় এমন একটি তীর্থ স্থান এর স্থলাভিষিক্ত হওয়ার সময়টি আসন্ন। যিশুর এই ঘোষণার মধ্যে মৌলিকত্ব বলে কিছু ছিল না। বরং জাতীয় মুক্তির উৎসবের সময় কর্তৃপক্ষ সম্ভবত ভীত হয়ে ছিল যে তারা রোমের বিরুদ্ধে একটি বিক্ষোভের উস্কানি দেবেন।

    জুদার অন্য যে কারো মতোই যিশুর প্রলয়-সংশ্লিষ্টতা ইঙ্গিতের সাথে পরিচিত ছিলেন ক্যাইফাস। তবে টেম্পল নিয়ে উষ্কানিমূলক কথাবার্তা বলতে দিতে রাজি ছিলেন না। কারণ মাত্র অল্প সময় আগে পিলেতের পরিকল্পিত অবমাননাচেষ্টার ফলে জাতি বিপর্যয়ের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গিয়েছিল। উৎসবের প্রথম দিনে তিনি যিশুকে গ্রেফতার করেন, তবে তার শিষ্যদের চলে যাওয়ার সুযোগ দেন। এতে ইঙ্গিত পাওয়া যায়, তিনি তাকে প্রধান কোনো রাজনৈতিক হুমকি বিবেচনা করতেন না। বিচারের সময় যিশু টেম্পল ধ্বংস করার সংকল্প ব্যক্ত করেছিলেন বলে অভিযোগ পাওয়া যায়। কিন্তু প্রত্যক্ষদর্শীরা তাতে একমত না হওয়ায় অভিযোগটি প্রত্যাহার করা হয়। অবশ্য ঈশ্বর অবমাননার অভিযোগে অভিযুক্ত করতে সক্ষম হয়েছিলেন ক্যাইফাস। কিন্তু ইহুদি বিধান মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার কর্তৃত্ব না থাকায় শাস্তির জন্য পিলেতের কাছে পাঠানো হয় যিশুকে। যিশুকে চাবকান পিলেত। তারপর ক্রুশে বিদ্ধ করে মৃত্যুর শাস্তি দেন। তিনি প্রায়েটোরিয়াম থেকে জেরুসালেমের রাস্তাগুলো দিয়ে গলগোথা (খুলির প্রাসাদ, ল্যাতিনে ক্যালভারিয়াস) নামে অভিহিত নগরীর বাইরের একটি পাহাড় পর্যন্ত ক্রুশটি বয়ে নিতেও তাকে বাধ্য করেন। সেখানে দুই ডাকাতের সাথে যিশুকে ক্রুশবিদ্ধ করা হয়। ক্রুশবিদ্ধ লোকের মৃত্যু ঘটতে কয়েক ঘণ্টা পর্যন্ত লাগত। তবে যিশু বেশ দ্রুত মারা যান। সাবাত আসন্ন থাকায় তার বন্ধুরা তাকে সূর্যাস্তের আগেই কবর দিতে উদ্বিগ্ন ছিল। এ কারণে স্যানেদ্রিনের (ইহুদি পরিচালনা সংস্থা) সদস্য আরিমাথিয়ার যোশেফ তাকে নিজের কবরের ভেতরে লাশটি সমাহিত করতে পিলেতের কাছ থেকে অনুমতি লাভ করেন। এটি ছিল নতুন গুহা-সদৃশ্য সমাধি। গোলগোথার কাছে পাহড়ের ঢালে এগুলো সহজেই খোঁড়া যেত। যিশুকে দ্রুত সমাহিত করা হয়। একটি পাথর সেখানেই রাখা হয়। তার বন্ধুরা সাবাতের পর ফিরে এসে দেহটিকে যথাযথভাবে তৈল সিক্ত করেন।

    বিষয়টি এখানেই শেষ হয়ে যেতে পারত। কিন্তু শিগগিরই গুজব রটে যে যিশু মৃত থেকে জীবিত হয়েছেন। বলা হয়ে থাকে, নারীরা রোববার সকালে সেখানে গিয়ে কবরটিকে ফাঁকা দেখেছেন। তার কয়েকজন শিষ্য ও স্বজনের যিশুকে নিয়ে স্বপ্নাবিভাব ছিল। তারা বলেন, যিশু জীবিত থাকার সময়ের মতো হেঁটেছেন, কথা বলেছেন, খেয়েছেন বলে তারা দেখেছেন। অনেকেই বিশ্বাস করত যে সত্যনিষ্ঠ লোক ‘ডে অব দি লর্ড’-এ মৃত থেকে জীবিত হবেন। যিশু কি এই আসন্ন ঘটনার আগেই জীবিত হয়েছিলেন? সম্ভবত তিনি মেসাইয়া, আসন্ন পরিত্রাণের অগ্রদূত? সবশেষে উইকস উৎসবকালে জেরুসালেমের একটি কক্ষে শিষ্যরা একত্রে প্রার্থনা করার সময় তাদের মনে হলো, তাদের ওপর ওয়াইএইচডব্লিউএইচ ভর করেছেন। তাদের বিশ্বাস জন্মাল যে নবীরা যে নতুন যুগের ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন, অর্থাৎ আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে ঈশ্বরের উপস্থিতি আরো স্পষ্টভাবে বোঝা যাবে, সেটিরই শুরু হয়েছে। যিশুর উপদলের সদস্যরা এই উপস্থিতি প্রদর্শন করতে চেয়েছিলেন বলে মনে হচ্ছে : তারা আরোগ্য লাভের অলৌকিক ঘটনা প্রদর্শন করতেন, অদ্ভূত ভাষায় কথা বলতেন, ভব্যিদ্বাণী করতেন, স্বপ্নাবিভাব লাভ করতেন। যে ব্যক্তি ক্রুশবিদ্ধ হয়ে লজ্জাজনকভাবে মৃত্যুবরণ করেছেন তার মেসাইয়া হওয়ার আইডিয়াটি ছিল অবাক করা ব্যাপার। কিন্তু গ্রুপটি দ্রুত নতুন নতুন ধর্মান্তরিতকে আকৃষ্ট করে, বিশিষ্ট ফারিসি গামালিয়েলের আদেশে স্যানহেদ্রিন বিশুদ্ধ ইহুদি আন্দোলন হিসেবে শেষ পর্যন্ত একে গ্রহণ করে নেয়।২৫ নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, যিশুর শিষ্যরা চিন্তাও করেননি যে তারা নতুন একটি ধর্ম প্রতিষ্ঠা করছেন। তারা অব্যাহতভাবে নিবেদিতপ্রাণ ইহুদি হিসেবে জীবনযাপন করে যান, প্রতিদিন দলবেঁধে টেম্পলে উপাসনা করে গেছেন। কামরানের সাম্প্রদায়িকদের অনুকরণে তারা নিজেদের বলতেন ইভিওনিম তথা গরিব। তারা তাদের মালামাল দান করে দিয়ে সম্প্রদায়বদ্ধ জীবনযাপন করতেন, আকাশের পাখিদের, মাঠের লিলি ফুলগুলোকে যেভাবে ঈশ্বর খাওয়ার ব্যবস্থা করেন, তাদেরও তেমন ব্যবস্থা হবে বলে তারা বিশ্বাস করতেন। ২৬ এটি ছিল আকর্ষণীয় ধর্মানুরাগ, এর প্রশংসা করত অন্য অনেক ইহুদি। অল্প সময়ের মধ্যেই তারা বিশ্বাস করল যে যিশু গৌরবোজ্জ্বলভাবে ফিরে আসবেন, সবার কাছে পরিষ্কার হয়ে যাবে যে অবশেষে ঈশ্বরের রাজ্য এসে গেছে।

    মাউন্ট অব অলিভসের নিচু ঢালুতে অবস্থিত গার্ডেন অব গেথসেমেন, গ্রেফতার হওয়ার আগে কষ্টে এখানে প্রার্থনা করেছিলেন যিশু, ছিল জেরুসালেমের খ্রিস্টানদের প্রথম দিককার অন্যতম পূণ্য স্থান। প্রথম দিকের বেশির ভাগ খ্রিস্টানের কাছে পূণ্য স্থানগুলো ছিল নগর-প্রাচীরের বাইরে।

    আন্দোলনটি আশপাশের নগরী ও শহরগুলোতে ছড়িয়ে পড়ে। জেরুসালেম ও লিড্ডা, জোপ্পা, সিসেরিয়া, গ্যালিলি ও দামাস্কাসে বিশাল জামায়াত বা চার্চ ছিল। এই প্রাথমিক সময়ে জেরুসালেম চার্চের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন যিশুর তিন শীর্ষস্থানীয় শিষ্য – পিটার, জেমস ও জন। তারা ‘পিলার্স’ (স্তম্ভরাজি) নামে পরিচিত ছিলেন। ২৭ বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব ছিলেন যিশুর ভাই জেমস। তিনি জাদিক বা সত্যনিষ্ঠ মানুষ হিসেবে পরিচিত ছিলেন। তিনি যিশুর জীবদ্দশায় তার অনুসারী ছিলেন না। তবে ক্রুশবিদ্ধ হওয়ার পর স্বপ্নাবিভাবে যিশুর আবার জীবিত হওয়ার বিষয়টি যারা বলেছিলেন, তাদের অন্যতম ছিলেন জেমস। তিনি ছিলেন চার্চটির অন্যতম নেতা। ৫০ সাল নাগাদ তিনি হন এর নেতা। জেরুসালেমে জেমস শ্রদ্ধাভাজন ছিলেন। তিনি আশ্চর্য রকমের কৃচ্ছ্রসাধনা করতেন, শাস্ত্রীয় শুদ্ধাচারের প্রতি এতই খুঁতখুঁতে ছিলেন যে বলা হয়ে থাকে, তাকে পুরোহিতদের জোব্বা পরতে, পুরোহিতদের আঙিনায় তাকে প্রার্থনা করতে দেওয়া হয়েছিল। ফারিসিদের সাথেও তার সুসম্পর্ক ছিল, কামরান সম্প্রদায়ও তাকে শ্রদ্ধা করত। জেমস দি জাদিক দেখিয়েছেন, জেরুসালেমে ইহুদি ধর্মীয় জীবনের সাথে যিশুর উপদলটি কত ব্যাপকভাবে একীভূত ছিল। তাওরাত ত্যাগ তো দূরের কথা, জেমস ও জেরুসালেম চার্চ প্রতিটি একক মিতজভাহ পালন করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলেন। বিধানের একটি অংশও বর্জন করা হতো না। যিশুর অনুসারীরা কেবল তাওরাতের বিধিনিষেধে আবদ্ধ থাকবে না, বরং বিশুদ্ধ ইহুদিতে পরিণত হওয়ার প্রত্যাশা করত। তাওরাত যদি বলত, ‘তোমার হত্যা করা উচিত নয়,’ তবে তারা এমনকি রাগান্বিতও হতো না। তাওরাতে যদি বলা হয়ে থাকে, তোমরা ব্যাভিচার করো না, তবে তারা কোনোভাবেই লোলুপ দৃষ্টিতে কোনো নারীর দিকেও তাকাত না।২৮ তাদের কর্তৃব্য ছিল যিশুর ফিরে না আসা পর্যন্ত দৃষ্টান্তমূলক জীবনযাপন করা, টেম্পলে প্রতিদিন প্রার্থনা করা।

    তবে ৩৬ সালের দিকে সম্ভত টেম্পল নিয়ে মূলধারার ইহুদিদের সাথে যিশু আন্দোলনের কয়েকজন সদস্যের সঙ্ঘাত হয়। জেরুসালেম সম্প্রদায় বিদেশের কয়েকজন গ্রিক-ভাষী ইহুদিকে অন্তর্ভুক্ত করেছিল। এসব লোক জুদাবাসীর মধ্যে কিছু অস্বস্তি সৃষ্টি করে। তাদের নেতা ছিলেন স্টিফেন। এই ক্যারিশমেটিক বক্তার দাওয়াতি কার্যক্রম নগরীতে মহা অপরাধ বিবেচিত হচ্ছিল। যিশুর মতো তাকেও টেনে হিঁচড়ে স্যানহেদ্রিনে নেওয়া হয়, তাওরাত ও টেম্পল পরিপন্থী বক্তব্য রাখার অভিযোগ আনা হয় তার বিরুদ্ধে। লুক, তিনিই অ্যাক্টস অব দি অ্যাপসলস-এর গ্রন্থকার বলে ঐতিহ্যগতভাবে বলা হয়ে থাকে, যে বক্তৃতা স্টিফেনের ঠোঁটে তুলে দিয়েছিলেন, সেসবের প্রায় নিশ্চিতভাবেই ঐতিহাসিক ভিত্তি ছিল না। তবে এতে এমন প্রবণতা প্রতিফলিত হয় যা পরে বিচ্ছিন্ন খ্রিস্টান এলাকাগুলোর সাধারণ বিষয়ে পরিণত হয়। এর শিকড় এই প্রাথমিক সঙ্ঘাতের মধ্যেই নিহিত ছিল। স্টিফেনের মধ্যে লুক এই বিশ্বাস ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন যে ঈশ্বর অনেকবারই জেরুসালেমের বাইরে মেসোপোটেমিয়া, হারান, মিসর, মিদিয়ান ও সিনাইয়ে তার জাতির কাছে নিজেকে প্রকাশ করেছিলেন। এমনকি সোলায়মান পর্যন্ত বুঝতে পেরেছিলেন যে ঈশ্বর মনুষ্য-নির্মিত ভবনে বাস করতে পারেন না। স্যানহেদ্রিনকে স্টিফেন এতই ক্ষিপ্ত করেছিলেন যে তারা নগরীর বাইরে নিয়ে গিয়ে তাকে পাথর ছুঁড়ে হত্যা করে। তারপর লুক বলেন, তারা বাকি চার্চের ওপর তাদের ক্রোধ ঝাড়েন। তবে দৃশ্যত তা ‘পিলার্স’ ও যিশুর মূল ফিলিস্তিনি অনুসারীদের প্রতি নয়। সম্ভবত কেবল হেলেনবাদী, গ্রিক-ভাষী ইহুদিদেরকেই নগরী থেকে পালাতে হয়েছিল। তারা প্রথমে গ্রামে এবং তারপর ফনিসিয়া, সাইপ্রাস ও অ্যান্টিয়কে চার্চে আশ্রয় নেয়।

    এই অ্যান্টিয়কেই যিশুর অনুসারীদেরকে প্রথমে খ্রিস্টান’ হিসেবে অভিহিত করা হয়। কারণ তাদের দৃঢ় ঘোষণা ছিল যিশু ছিলেন খ্রিস্টো, তেলসিক্ত ব্যক্তি, মেসাইয়া।৩২ অ্যান্টোকান খ্রিস্টানদের সাথে বিভিন্ন স্থান থেকে আসা আরো ৪০ জন ইহুদি যোগ দিয়েছিলেন। তারা শুরুতে প্রবলভাবে খ্রিস্টান আন্দোলনের বিরোধিতা করেছিলেন। কিন্তু দামাস্কাসের চার্চে নির্যাতন চালানোর জন্য ওই স্থান সফর করার সময় সেখানে যিশুর প্রবল শক্তিধর ভাষ্যের কাছে ধর্মান্তরিত হন। তারসাসের পল হন অ্যান্টিয়কের অন্যতম খ্রিস্টান নেতা। জেরুসালেমের পিলার্সের থেকে খ্রিস্টান ধর্ম সম্পর্কে তার সম্পূর্ণ ভিন্ন ধারণা ছিল। গত অধ্যায়ে আমরা দেখেছিলাম, এই সময়ে গ্রিক বিশ্বের অনেক লোক তাদের পূর্বপুরুষের ঐতিহ্যে সাংঘর্ষিক বিষয় খুঁজে পাচ্ছিল। আমরা পলের প্রাথমিক জীবন সম্পর্কে খুবই সামান্য জানি। তবে মনে হয়, তিনি এমন এক লোক ছিলেন, যিনি নতুন কিছুর অনুসন্ধান করছিলেন। তিনি গ্যাম্যালিয়েলের অধীনে তাওরাত অধ্যয়ন করেছিলেন, ফারিসি উপসম্প্রদায়ে যোগ দিয়েছিলেন। তবে তাওরাতকে তার কাছে তার ব্যক্তিগত মুক্তির জন্য ধ্বংসকরী বোঝা মনে হয়েছিল। এটি তাকে মুক্তি, শান্তি ও ঈশ্বরের সাথে মিলন এনে দিতে পারছিল না।৩৩ দামাস্কাসের পথে নিজের স্বপ্নাবিভাবে পলের মধ্যে এই বিশ্বাস সৃষ্টি হয়েছিল যে পৃথিবীর কাছে ঈশ্বরের মূল ঐশী বাণী হিসেবে তাওরাতের স্থলাভিষিক্ত করা হয়েছে যিশুকে। যিশুর মৃত্যু ও পুনর্জন্ম পরিত্রাণের ইতিহাসে নতুন এক অধ্যায়ের সূচনা করেছে। ইহুদি ও পৌত্তলিক- উভয়েই এখন ব্যপ্তিজমের (যা পরাবাস্তবভাবে তাদেরকে খ্রিস্টের সাথে একীভূত করে নিত) দলভুক্তমূলক শাস্ত্রাচারের মাধ্যম হিসেবে নতুন ইসরাইলে প্রবেশ করতে পারত। ফলে খ্রিস্টানদেরকে খাদ্য-সম্পর্কিত বিধান পালন করা, নিজেদেরকে গোয়িম থেকে আলাদা করার, খতনার প্রয়োজন নেই। কারণ এগুলা ছিল পুরনো চুক্তির চিহ্ন। এগুলো এখন পেছনে পড়ে গেছে। যারাই এখন ‘খ্রিস্টে’ বসবাস করত, তাদের জাতিগত উৎস যাই হোক না কেন, তারা সবাই এখন ঈশ্বরের সন্তান ও ইব্রাহিমের শিশু বলে পরিগণিত হলো।

    পলের গসপেলের আবেগময় সংশোধনবাদী ব্যাখ্যা বিচ্ছিন্ন থাকা ইহুদি বসতিগুলোতে ব্যাপক সাড়া ফেলে। তবে তা যৌক্তিক প্রমাণিত হয়েছিল কিংবা যিশুর জীবন ও মৃত্যুর ঐতিহাসিক তথ্যের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ ছিল বলে নয়। যিশু সম্পর্কে দৃষ্টিভঙ্গি আবেদনময়ী হওয়ার কারণ ছিল এই যে এটি ওই সময়ের অন্যান্য গ্রিকো-রোমান বিশ্বের ধর্মীয় ঘটনাবলীর সাথে ব্যাপকভাবে সামঞ্জস্যপূর্ণ ছিল। আমেরিকান স্কলার জোনাথন জেড স্মিথ ব্যাখ্যা করে বলেছেন, প্রাচীনকালের শেষ দিকে আধ্যাত্মিক জগতে পরিবর্তন ঘটিয়ে পুরনো টেম্পল মতবাদকে পরিবর্তন করে মহাবিশ্বকে একটি মানবীয় রূপ দিচ্ছিল :

    বহিরাগত, বৈরী শক্তিগুলো থেকে মানুষকে রক্ষাকারী নতুন অবরুদ্ধ এলাকা নগর-প্রাচীর না হয়ে হবে একটি মানব গ্রুপ, একটি ধর্মীয় সংস্থা বা একটি গুপ্ত সংগঠন। বিশৃঙ্খলার প্রত্যাবর্তন কিংবা অপবিত্রকণের হুমকির বদলে শত্রুকে বর্ণনা করা হবে অন্য মানব গোষ্ঠী বা দানব হিসেবে, শয়তান বা মৃত্যুর হুমকি হিসেবে। একটি ঐশী স্থানের বদলে প্রধান কেন্দ্র ও ঐশী সত্তার কাছে প্রবেশের প্রধান অবলম্বন হবে ঐশী মানব।… ৩৪

    থেস্যালোস দি ম্যাজিশিয়ানের কাহিনীর মধ্যে মিসরে এই পরিবর্তনের চিহ্ন খুঁজে পেয়েছেন স্মিথ। তিনি চতুর্থ ও পঞ্চম শতকে সিরিয়ার পবিত্র মানুষের মতবাদের দিকে আলোকপাত করেছেন। তবে আমরা ফিলিস্তিনি ইহুদি ধর্মের মধ্যেও ইতোমধ্যে এই প্রবণতা দেখতে পেয়েছি। ফারিসি ও কামরান উপদল তাদের ধর্মীয় সংস্থাকে নতুন মন্দির হিসেবে বিবেচনা করেছেন। এখন খ্রিস্টানরা টেম্পল থেকে সরে গিয়ে ঐশী মানবের দিকে যাত্রা শুরু করল। তীর্থযাত্রা ও বিশুদ্ধকরণের পুরনো শাস্ত্রাচারের বদলে নতুন খ্রিস্টান শাস্ত্রাচার হয় ধর্মান্তর, দলভুক্তকরণ ও মানুষ যিশুর সাথে শনাক্তকরণ। তাদের মতে যিশুকে যখন ঈশ্বর মৃত থেকে আবার জীবিত করেছিলেন, তখনই তিনি ঐশী মর্যাদা লাভ করেছিলেন।৩৫ খ্রিস্টানদের পল শিখিয়েছিলেন যে যিশু হলেন পরিত্রাণের কেন্দ্রবিন্দু। তিনি কেবল আদি বিশৃঙ্খলা থেকেই তাদেরকে উদ্ধার করেননি, বরং সেইসাথে পাপ ও মৃত্যুর দানবীয় শক্তি থেকেও মুক্ত করেছেন।

    এই দৃঢ় ঘোষণা অনেক ইহুদি এবং সেইসাথে ‘পিলার্স’ (বা স্তম্ভ) ও জেরুসালেমে তাদের অনুসারীদের কাছে ঈশ্বর অবমাননা মনে হয়েছিল। কোনো সাধারণ মানুষ ঐশী সংস্পর্শ লাভ করতে পারেন, এমন ধারণা তাদের কাছে কষ্টকর মনে হতে পারে। তবে আমরা দেখেছি, ঐশী সত্তার সবসময়ই নিজেকে নিজের বদলে অন্য কারো মাধ্যমে প্রকাশ করে থাকেন। খোলা মনে বিবেচনা করলে দেখা যাবে নগরী বা মন্দির মানব স্বর্গীয় সত্তার বাহন হিসেবে একেবারেই বেমানান ছিল। ঐশী সত্তার যেকোনো প্রতীক- তা ভবন, নগরী, সাহিত্য পুস্তক, আইনি বিধান বা মানুষ – যাই হোক না কেন, তা অপর্যাপ্ত হতে বাধ্য। ধর্মীয় অনুসন্ধানের কেন্দ্রে অনিবার্য যে পরস্পরবিরোধী বিষয় ছিল তা হলো পবিত্রতার নিজের ঐশী সত্তার মধ্যে, বাস্তবতার নিরঙ্কুশতার মধ্যে, সাময়িকতার শ্বাশতের মধ্যে উপস্থাপন করা। বস্তুত, ভারতীয় মরমিবাদের অবয়বে খ্রিস্টধর্ম এই পরস্পরবিরোধী পরিত্রাণের অভিঘাত লাভ করেছিল : ঐশী সত্তা তার ভালোবাসা প্রদর্শন করেছিল এবং এর সার্বভৌম স্বাধীনতা অপেক্ষাকৃত হীন অবয়ব গ্রহণ করেছিল।৩৬ প্রকৃত রহস্যময়তা হলো এই যে ঐশী সত্তা সবভাবেই প্রকাশ ঘটাতে পারে। প্রথম দিকের অনেক খ্রিস্টানের কাছে ধর্মান্তর বলতে কী বোঝাত তা দামাস্কাসের রাস্তায় পলের নাটকীয় ধর্মান্তর ঘটনার মাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। এটি একটি বিপরীতমুখী পরিবর্তন, তাদের মাথার ওপর পুরনো ঐশী সত্তার পরিবর্তনকে প্রতিফলিত করেছে, যা অনেকে মুক্তির জন্য খুঁজছিল।

    এরপর থেকে খ্রিস্টান ধর্ম কোনো নির্দিষ্ট স্থানে শিকড় গেড়ে থাকবে না। নতুন খ্রিস্টান নায়ক জেরুসালেম টেম্পলের জেমস দি জাদিক নন, তিনি হলেন মুসাফির পল। এই লোক এই দুনিয়ার কোনো নগরীতে আবদ্ধ নন, তিনি স্থায়ীভাবে চলছেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও জেরুসালেমের সাথে বিচ্ছেদ ছিল বেদনাময়। জেমস যখন দেখতে পেলেন যে অ্যান্টিয়কের খ্রিস্টানেরা কোশার মাংস খাচ্ছে না এবং গোয়িমের সাথে অবাধে বিয়ে-শাদি করছে, তখন পল ও মাতৃ চার্চের মধ্যে তিক্ত সঙ্ঘাত ঘটে। একটি সমঝোতা হয়। এর ফলে পলকে পৌত্তলিকদের ধর্মান্তকরণ মিশনের দায়িত্ব দেওয়া হয়। নবীরা সবসময়ই বলতেন যে মেসিয়ানিক যুগে পৌত্তলিক জাতিগুলো ওয়াইএইচডব্লিউএইচের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করতে জেরুসালেমে আসবে। পল এখন পিলার্সকে দেখাতে সক্ষম হলেন যে গোয়িম সত্যি সত্যিই তার চার্চগুলোর কাছে আসতে শুরু করে দিয়েছে। তারা ইহুদি খ্রিস্টানদের মতো পূর্ণ উদ্দীপনা ধারণ করার বিষয়টি প্রকাশ করতেন। ফলে জেমসের জন্য কি যথাযথ হতো তাদেরকে খতনা ও তাওরাত পুরোপুরি অনুসরণ করা নিয়ে অবাস্তব দাবি করে তাদেরকে সরিয়ে দেওয়া? পৌত্তলিক মিশনের স্বায়াত্তশাসনের বিনিময়ে পল প্রতিশ্রুতি দিলেন যে তার ধর্মান্তরিতরা জেরুসালেমের গরিব তথা ইভিওনিমকে সহায়তা করবে। পল তার মিশনজুড়ে এই সংগ্রহকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকারে জেরুসালেম চার্চকে দিতেন। এটি ছিল ধারাবাহিকতার একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতীক। এই পন্থায় তার ধর্মান্তরিতরা ইহুদি ধর্মের প্রতি তাদের আধ্যাত্মিক ঋণের বিষয়টি প্রকাশ করত, প্রাচীন ভবিষ্যদ্বাণী পূরণ করত।৩৭ পৌত্তলিকেরা সত্যিই জেরুসালেমে উপহার নিয়ে আসত। ফলে চূড়ান্ত পরিত্রাণ নিশ্চিতভাবেই ছিল হাতের মুঠোয়।

    কিন্তু পল যখন সত্যিই ৫৮ সালে উইকস উৎসবে জেরুসালেমে এলেন অর্থ নিয়ে, তখন টেম্পলে তার উপস্থিতি দাঙ্গার সৃষ্টি হয়েছিল। গোলযোগ সৃষ্টির অভিযোগে রোমানরা তাকে গ্রেফতার করে। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়, তিনি তার এক অইহুদি ধর্মান্তরিতকে স্তম্ভশ্রেণি ও কোর্টস অব দি ইসরাইলিতে নিয়ে গেছেন।৩৮ খুব সম্ভবত এর মাধ্যমে পল আইন লঙ্ঘন করেননি। কারণ তার অন্যতম পরিচালনা নীতিমালা ছিল ‘সবকিছু সবার জন্য’ এবং লোকজনের ধর্মীয় স্পর্শকাতরতার প্রতি সংবেদনশীলতা প্রদর্শন। যদিও তিনি বিশ্বাস করতেন যে পুরনো প্রতিবন্ধকতাগুলোর অবসান হওয়া উচিত, যাতে পৌত্তলিকেরাও আর ঈশ্বরের রাজ্যে আগন্তুক না থাকে। খ্রিস্টের পুনরুত্থান কেবল তাওরাতই বাতিল করে দেয়নি, গোয়িমকে পবিত্রতার প্রান্তিকে ঠেলে দেওয়ার পুরনো ঐশী ভূগোলের অবসানও ঘটিয়েছিল। পল তার ইফেসিয়ান ধর্মান্তরিতদের বলেছিলেন, ‘যিশু ওই প্রতিবন্ধকতা ভেঙে দিয়েছিন যা [ইহুদি ও পৌত্তলিকদের] আলাদা রাখতে ব্যবহৃত হতো’ এবং এর ফলে ‘তোমরা আর অপরিচিত বা বিদেশী মুসাফির নও; তোরা সব সন্ন্যাসীর মতোই নাগরিক, ঈশ্বরের বাড়ির অংশ।’ বস্তুত, খ্রিস্টানেরা এখন একটি আধ্যাত্মিক মন্দির সৃষ্টি করল এবং ঈশ্বর বাস করেন এমন একটি বাড়ি নির্মাণ করল। একইভাবে কামরান সম্প্রদায়ের লোকজনের প্রতি পলের বিশ্বাস ছিল এই যে ঈশ্বর এখন বিশ্বাসী সম্প্রদায়ের মধ্যে দুনিয়াতে বাস করেন। প্রাচীন কালের শেষ দিকের অন্যান্য লোকের মতো খ্রিস্টানরাও নশ্বর টেম্পল এড়িয়ে যেতে শুরু করেছিল। তারা অনুভব করছিল যে তারা ইতোমধ্যেই টেম্পলে প্রতীকভাবে ফুটিয়ে তোলা আধ্যাত্মিক বাস্তবতায়- ‘স্বর্গীয় জেরুসালেম- প্রবেশ করছে। তবে যেসব ইহুদি তখনো বিশ্বাস করত যে মাউন্ট জায়নের ওপর থাকা টেম্পলটি ঈশ্বরের কাছে যাওয়ার সবচেয়ে নিশ্চিত উপায়, তাদের কাছে এই ধারণা ছিল ঈশ্বর অবমাননা। ফলে ৫৮ সালে টেম্পলে পলের উপস্থিতি হুমকি বিবেচিত হলো, তার আগে যিশু ও স্টিফেনের মতো পলও তার স্বাধীনতা এবং সবশেষে তার জীবনও হারালেন। কারণ তিনি জায়নের পবিত্রতা বিপন্ন করেছেন। পরিণামে অ্যাক্টস অব দি অ্যাপসলসে লুক আমাদের বলেন যে পলকে বন্দি হিসেবে রোমে পাঠানো হয়েছিল। কারণ তিনি দাবি করেছিলেন যে রোমান নাগরিক হিসেবে খোদ সিজারের মাধ্যমে তার বিচার পাওয়ার অধিকার রয়েছে। অ্যান্টিয়চুস ইপিফেনেসের আমলের ইহুদি সংস্কারকদের মতো প্রাচীন কালের শেষ দিকের শিকড়হীন মানুষের মতো পলও জেরুসালেমের পুত্র না হয়ে বিশ্বের নাগরিক হতে চাইতেন। শেষ পর্যন্ত পলের কী হয়েছিল, তা আমরা জানি না। কিংবদন্তি রয়েছে যে ৬৪ সালে সম্রাট নিরোর নির্যাতনের সময় তিনি মারা গিয়েছিলেন। অবশ্য তার মৃত্যুর অনেক পরে বিচ্ছিন্ন বসতিগুলোতে তার প্রতিষ্ঠিত চার্চগুলো তার খ্রিস্টান দর্শনের প্রতি অটল থাকে। এবং ভাগ্যের নির্মম পরিহাসের ব্যাপার হলো, একদিন এই পৌত্তলিক খ্রিস্টানেরা জেরুসালেমকে তাদের নিজস্ব বলে দাবি করেছিল।

    পিলেতের সময় থেকে ইহুদিরা তাদের টেম্পলের ব্যাপারে আরো বেশি রক্ষণাত্মক হয়ে পড়েছিল। কারণ এর ঐশী সত্তা আবারো বিপন্ন হয়ে পড়েছিল। ৪১ সালে সম্রাট গ্যাইয়াস ক্যালিগুলা নির্দেশ দেন যে তার মূর্তি জেরুসালেমের পবিত্র স্থানটিতে স্থাপন করতে হবে। সিরিয়ায় পোপের দূত পেট্রোনিয়াস এই কঠিন কাজের দায়িত্ব নিয়ে টলেমাইস বন্দরে অবতরণ করলেন। তিনি নগরীর সামনের সমভূমিতে স্ত্রী-সন্তানসহ ‘লাখ লাখ ইহুদির’ মুখোমুখি হলেন। তারা কঠিন আলোচনায় এক ইঞ্চি ছাড় দিতেও চাইল না। এমনকি ক্যালিগুলা এমন হুমকিও দিয়েছিলেন যে তারা প্রতিরোধ অব্যাহত রাখলে তাদের সব লোককে বন্দি করে নিয়ে যাওয়া হবে। আবারো ইহুদিরা অহিংস পন্থার আশ্রয় গ্রহণ কর। তারা তাদের শস্য তুলতে অস্বীকার করল। এর অর্থ হলো, বার্ষিক খাজনা তোলা রোমানদের পক্ষে অসম্ভব হয়ে পড়ল। অনেকে বিশ্বাস করত যে তাদেরকে রক্ষার জন্য ঈশ্বর এগিয়ে আসবেন। বস্তুত তিনি তা করেছিলেনও। সম্রাট তার নির্দেশ বাস্তবায়ন করার আগেই তিনি গুপ্তহত্যার শিকার হন। ৪১

    ইহুদিদের সন্তুষ্ট করতে ক্যালিগুলার উত্তরসূরি ক্লাউডিয়াস হেরডের নাতি অ্যাগ্রিপাকে ইহুদি ফিলিস্তিনের রাজা নিযুক্ত করেন। তার সংক্ষিপ্ত শাসনকালে জেরুসালেম সমৃদ্ধ হয়। অ্যাগ্রিপা তাইরোপোয়নের আপার ও লোয়ার মার্কেটগুলোর সম্প্রসারণ করেন। তিনি উত্তরাঞ্চলীয় জেলা বেজেথায় তৃতীয় নগর-প্রাচীর নির্মাণের পরিকল্পনা করেছিলেন। ৪৪ সালে তার মৃত্যু ছিল একটি মারাত্মক আঘাত। তার ছেলে দ্বিতীয় অ্যাগ্রিপা শাসনকাজ চালানোর মতো বয়স্ক ছিলেন না। ফলে ক্লাউডিয়া, জুলায় নতুন রোমান গভর্নর পাঠান। তবে এবার তার মর্যাদা অনেক কমিয়ে প্রসিকিউটার (ব্যবস্থাপক) করা হয়। তরুণ রাজা দ্বিতীয় অ্যাগ্রিপা সরকারের উচ্চ মর্যাদা ফিরে পান। ফিলিস্তিনে অস্থিরতার আভাস ছিল। থিওদাস নামে অভিহিত এক নবী মরুভূমিতে তাকে অনুসরণ করতে চার শ লোককে রাজি করান। তিনি তাদের বোঝান যে ঈশ্বর রোমের শাসন থেকে ইহুদিদেরকে উদ্ধার ও মুক্তি দেবেন। প্রসিকিউটর ফেলিস্কের (৫২-৫৯) আমলে আরেক নবীর আগমন ঘটে। তিনি প্রতিশ্রুতি দেন যে জেরুসালেম থেকে রোমানদের তাড়িয়ে দেবেন। কোনো নবীই তেমন অনুসারী সংগ্রহ করতে পারেননি। তেমন কোনো কষ্ট ছাড়াই রোমানরা তাদের গুঁড়িয়ে দিতে সক্ষম হয়েছিল। জাতীয় উৎসবগুলোতে আবেগ তখনো টগবগ করত। কুমানাসের (৪৮-৫২) প্রসিকিউটরশিপের আমলে পাসওভারের সময়ে পোর্টিকোর ছাদে পাহারায় থাকা এক সৈন্য নিচে তীর্থযাত্রীদের উদ্দেশে কুরুচিপূর্ণ ইঙ্গিত করলে হাজার হাজার ইহুদিকে টেম্পল আঙিনাগুলোতে পিষে মারা হয়। এসব গোলযোগ সত্ত্বেও জেরুসালেম বিকশিত হতে থাকে। চরমপন্থীরাও ছিল। রোমান প্রাধান্য অবসানের বেপরোয়া চেষ্টায় তারা পবিত্র নগরীতে সন্ত্রাসের আশ্রয় নিত। তবে এই সময়কালে রোমের সাথে সমঝোতা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। ৫৯ সালে রাজা দ্বিতীয় অ্যাগ্রিপাকে হ্যাসমোনিয়ান প্রাসাদে বসবাসের অনুমতি দেওয়া হয়। হেরডের প্রাসাদটি জেরুসালেম সফরের সময় প্রসিকিরেটরের বাসভবন হিসেবে ব্যবহৃত হতো। টেম্পলটির নির্মাণকাজ অবশেষে সমাপ্ত হয়। নগরীর রাজপথগুলো পাকা করতে ১৮ হাজার শ্রমিক নিয়োগ করা হয়। জেরুসালেমকে নির্দিষ্ট স্বায়াত্তশাসন দেওয়া হয় : অ্যাগ্রিপা ও উচ্চ পুরোহিত যৌথভাবে নগরী চালাতেন। তারা ক্যাসারিয়ার প্রসিকিউটরের সাথে সৌহার্দ্যপূর্ণভাবে সহযোগিতা করতেন।

    তবে ৬০ সালে রোম জুদার গভর্নর হিসেবে আরো কম প্রতিভার গভর্নর নিযুক্ত করতে থাকে। বলা হয়ে থাকে রোমের সাথে সহযোগিতায় নিয়োজিত সবার মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টিকারী ইহুদি ডাকাতদের কাছ থেকে ঘুষ গ্রহণ করতেন অ্যালিবিনাস (৬০-৬২)। আর গেসিয়াস ফ্লোরাস (৬৪-৬৬) এটি অব্যাহত রাখেন। ক্যাসারিয়ায় ইহুদি ও সিরিয়ান অধিবাসীদের মধ্যে দাঙ্গা বেঁধে গেলে ফ্লোরাস দেখতে পেলেন, তার আরো নগদ অর্থের প্রয়োজন। তিনি টেম্পল কোষাগার থেকে অর্থ গ্রহণ করার বিপর্যয়কর পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। নগরী সাথে সাথে বিস্ফোরিত হয়। রাস্তায় রাস্তায় রোমান গ্রুপগুলোর সাথে লড়াই করতে থাকে। ফ্লোরাস আইন- শৃঙ্খলা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে ব্যর্থ হওয়ার পর নিজেকে প্রত্যাহার করে সিরিয়ার গভর্নর গ্যালিয়াসের কাছ থেকে সহায়তা কামনা করেন। গ্যালিয়াস যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে নভেম্বরের মাঝামাঝি সময় ফিলিস্তিনে এসে পৌঁছেন। তিনি মাউন্ট স্করপাসে তাঁবু গাড়েন, বেজেথা উপকণ্ঠের দিকে অগ্রসর হন। তবে অজ্ঞাত কোনো কারে তিনি ইমায়সে সরে আসেন। ইহুদিরা তাকে প্রবলভাবে ধাওয়া করে। সেখানে তার বাহিনী পরাজিত হয়, ইহুদিরা পাঁচ হাজারের বেশি রোমান সৈন্যকে হত্যা করে।

    এই সঙ্কটের সময় ইহুদিরা তাদের নিজস্ব দ্বন্দ্বে নিয়োজিত ছিল। বিদ্রোহীরা সার্বজনীন সমর্থন পায়নি। পল্লী এলাকার অনেক অভিজাত ব্যক্তি এবং সেইসাথে সেফোরিস ও তাইবেরিয়াসের মতো শহরের অনেক ইহুদিও রোমের বিরুদ্ধে যুদ্ধের বিরোধিতা করেছে। রোমের শক্তিকে ইহুদিরা হারাতে পারে- এমনটি কল্পনাও করতে পারেনি স্যাডিসিরা। তারা ইহুদি স্বাধীনতার ব্যাপারে তাদের স্বপ্ন পরিত্যাগ করেছিল। রাজনীতির চেয়ে ধর্ম নিয়ে বেশি উদ্বিগ্ন অনেক ফারিসি বুঝতে পারল যে ডায়াপারার ইহুদিরা রোমের বিরুদ্ধে ইহুদি বিদ্রোহের মাধ্যমে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। রাজা অ্যাগ্রিপা শান্তির ব্যাপারে রাজি হতে বিদ্রোহীদের বোঝাতে চেষ্টা করেন : তারা কি কল্পনা করছে যে তারা গাউল, জার্মান বা গ্রিকদের চেয়ে শক্তিশালী? এসব জাতিও রোমান সাম্রাজ্যের শক্তির কাছে বশ মানতে বাধ্য হয়েছে। জোসেফাস নিজে পক্ষ ত্যাগ করে রোমান দলে যোগ দেন। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে বিদ্রোহীরা আত্মহত্যার পথে নেমেছে। কিন্তু একটি নতুন, চরমপন্থী জিলট (ধর্মান্ধদের) দলের উত্থান ঘটে উদারপন্থীদের বিপরীতে। তারা বিশ্বাস করত যে রোম ক্ষয়িষ্ণু, ফলে ইহুদিদের জয়ের ভালো সম্ভাবনা রয়েছে। ম্যাকাবিরা কি বিদেশী নিয়ন্ত্রণ ঝেড়ে ফেলে স্বাধীন ইহুদি রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেনি? যারা শান্তি প্রতিষ্ঠার পক্ষে ছিল, তাদেরকে জায়নের প্রতি বিশ্বাসঘাতক বিবেচনা করত তারা। তারা তাদেরকে টেম্পল অনুষ্ঠানের অংশ নিতে দিত না। ফিলিস্তিনের ইহুদি জনসাধারণের অতি সামান্য অংশ জিলটদের সমর্থন করেছিল। এমনকি বিদ্রোহীদের নিজেদের মধ্যেও বিভক্তি ছিল। তাদের অনেক চরমপন্থী মৃত সাগর পথে মাসাদার দুর্গে চলে গিয়েছিল। তারা নগরীর যুদ্ধে আর অংশগ্রহণ করেনি। সেসটিয়াস গ্যালাসের পরাজয়ের পর জিলটরা তখনো জেরুসালেমে একে অপরের বিরুদ্ধে লড়াই করছিল। এই পর্যায়ে তাদের কাছে স্পষ্ট হয়ে যায় যে রোমের সাথে যুদ্ধ অনিবার্য।

    সম্ভবত এই পর্যায়ে ইহুদি খ্রিস্টানেরা জেরুসালেম ত্যাগ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। তাদের চার্চ ও ইহুদি এস্টাবলিশমেন্টের মধ্যে মাঝে মাঝেই টানাপোড়েন দেখা যেত। জেমস দি পিলারের ফাঁসি হয়েছিল, ৬২ সালে জেমস জাদিককে ‘আইন ভঙের দায়ে উচ্চ পুরোহিত মৃত্যুদণ্ড দেন। এমনকি ৮০ জন ফারিসি জেমসের পক্ষ থেকে রোমে প্রতিবাদ জানিয়েছিল, তার সাথে মৃত্যু বরণ করা সত্ত্বেও তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছিল। জেরুসালেম চার্চের নেতৃত্ব এখন যিশুর কাজিন সামিয়নের হাতে বর্তেছে। তিনি নেতৃত্ব দিয়ে তার সম্প্রদায়কে ট্রান্সজর্ডানের পেলায় নিয়ে যান : যিশু জেরুসালেম ধ্বংসের ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন। আর খ্রিস্টানেরা জানত যে নগরীর ধ্বংস আসন্ন। অন্যান্য ইহুদি জয়ের জন্য যুদ্ধ করতে দৃঢ়সংকল্পবদ্ধ ছিল। পরাজয়ের প্রতিশোধ নিতে রোমের এগিয়ে আসার জন্য অপেক্ষা করার সময় তারা গ্যালাসে হানা দেয়। জেরুসালেমে ইহুদি অধিবাসীরা দ্রুত থার্ড ওয়াল নির্মাণ করে। বেজেথায় এটি নির্মাণের পরিকল্পনা করেছিলেন প্রথম এগ্রিপা।

    ইহুদিদের দুর্ভাগ্য হলো, রোম এই ইহুদি বিদ্রোহ দমন করতে তার সবচেয়ে সক্ষম জেনারেলকে পাঠিয়েছিল। ৬৭ সালে ভেসপ্যাসিয়ান ফিলিস্তিনে পৌঁছেন। তিনি গ্যালিলির প্রতিরোধ পকেটগুলো পরিকল্পিতভাবে পরাজিত করতে থাকেন। ৭০ সালে অবশ্য ভেসপ্যাসিয়ান সম্রাট হয়ে রোমে ফিরে যান। তিনি তার ছেলে টাইটাসকে ইহুদি যুদ্ধের দায়িত্ব দিয়ে যান। টাইটাস দ্রুততার সাথে ওই বছরের ফেব্রুয়ারিতে জেরুসালেম অবরোধ করেন। মে মাস নাগাদ উত্তরের প্রাচীর ভেঙে নগরীতে ঢুকে পড়েন। এক সপ্তাহ পরে বাজারের কাছে সেকেন্ড ওয়াল গুঁড়িয়ে দেন। এখন লড়াই চলতে থাকল খোদ টেম্পলের চারপাশে। জুলাই মাসের শেষ দিকে রোমানরা অ্যান্টোনিয়া দখল করে, টেম্পল আঙিনায় গোলা ফেলতে শুরু করে। শেষ পশু বলি দেওয়া হয় ৬ আগস্ট। কিন্তু ইহুদিরা তখনো পরাজয় স্বীকার করেনি। জিলটদের অনেকে তখনো বিশ্বাস করে যাচ্ছিল, ঈশ্বর যেহেতু নগরীতে বাস করেন, এর পতন ঘটবে না। এক নবী জোর দিয়ে বলছিলেন, একেবারে অন্তিম মুহূর্তে তিনি অলৌকিকভাবে হস্তক্ষেপ করে তার লোকজন ও তার টেম্পলকে রক্ষা করবেন। ৪২ আর তাই রোমান সৈন্যরা যখন শেষ পর্যন্ত ২৮ আগস্ট টেম্পলের ভেতরের আঙিনায় প্রবেশ করে, তারা সেখানে মৃত্যু পর্যন্ত যুদ্ধ করতে প্রস্তুত ছয় হাজার ইহুদি জিলটকে দেখতে পায়। গ্রিক ইতিহাসবিদ দিও ক্যাসিয়াস (মৃত্যু ২৩০) বলেন, অবিশ্বাস্য সাহসিকতার সাথে ইহুদিরা আত্মরক্ষা করতে থাকে, মনে হচ্ছিল, তাদের টেম্পল রক্ষার জন্য মৃত্যু বরণ করা অনেক সম্মানের বিষয়। একেবারে শেষ পর্যায়েও তারা বিশুদ্ধতার বিধান পালন করছিল, প্রত্যেকে তার যথাযথ স্থানে লড়াই করছিল এবং বিপদ সত্ত্বেও নিষিদ্ধ এলাকাগুলোতে প্রবেশ করতে অস্বীকার করছিল : ‘সাধারণ মানুষ সামনের আঙিনায় লড়াই করছিল, অভিজাতেরা ভেতরের আঙিনায় এবং পুরোহিতেরা টেম্পল ভবন রক্ষায় নিয়োজিত ছিল। ৪৩ সবশেষে তারা দেখতে পেল, টেম্পলে আগুন ধরে গেছে, আতঙ্কে ভয়ানক শোরগোল শোনা গেল। কেউ কেউ রোমানদের তরবারির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। কেউ কেউ আগুনে ঝাপ দিলো। তবে টেম্পল হাতছাড়া হয়ে গেলে ইহুদিরা লড়াই ছেড়ে দিলো। তারা আপার সিটি রক্ষা করতে কিংবা কাছের অন্যান্য দুর্গ রক্ষার জন্য চেষ্টাই করল না। কেউ কেউ মরুভূমিতে চলে যেতে অনুরোধ করল এই ক্ষীণ আশায় যে এর ফলে নতুন এক্সোডাস ঘটবে এবং নতুন জাতীয় মুক্তির দেখা দেবে। বাকিরা অসহায়ভাবে দেখল যে টাইটাসের অফিসারেরা টেম্পল ভবনের বাকি অংশগুলো বেশ দক্ষতার সাথে গুঁড়িয়ে দিচ্ছে, যদিও বলা হয়ে থাকে, দেভিরের পশ্চিম দিকের প্রাচীরকে রেহাই দেওয়া হয়েছিল। যেহেতু এখানেই ঐশী উপস্থিতি থাকে বলে মনে করা হয়ে থাকে, ইহুদিরা এ থেকে কিছুটা সান্ত্বনা পেয়েছিল। তবে তা ছিল অপ্রতুল স্বস্তি। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে টেম্পল দাঁড়িয়ে ছিল ইহুদি বিশ্বের হৃদয়ে এবং এটি ছিল ইহুদি ধর্মের কেন্দ্রবিন্দুতে। আবারো এটি বিধ্বস্ত হলো। তবে এরপর আর কখনো নির্মিত হবে না।

    ⤶ ⤷
    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleছোটগল্প – মুহম্মদ জাফর ইকবাল
    Next Article বাইবেল কোরআন ও বিজ্ঞান – মরিস বুকাইলি
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Generic selectors
    Exact matches only
    Search in title
    Search in content
    Post Type Selectors
    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Our Picks

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }