Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    রবিনসন ক্রুসো – ড্যানিয়েল ডিফো

    August 19, 2025

    দ্য দা ভিঞ্চি কোড – ড্যান ব্রাউন

    August 19, 2025

    এঞ্জেলস এন্ড ডেমনস – ড্যান ব্রাউন

    August 19, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • 🔖
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    Subscribe
    সাইন ইন
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    টাইম মেশিন – এইচ জি ওয়েলস

    এইচ জি ওয়েলস এক পাতা গল্প97 Mins Read0

    ০৮. ব্যাখ্যা

    ৮। ব্যাখ্যা

    যতদূর চোখ যায়, দেখি টেম্স উপত্যকার মতোই অকৃপণ প্রাচুর্যে ভরে উঠেছে ধরিত্রীর বুক। প্রতিটি পাহাড়ের ওপর থেকে দেখলাম সেই একই দৃশ্য–প্রাসাদের পর প্রাসাদ, বিচিত্র তাদের গঠন কৌশল, জমকালো তাদের আকার। এক একটা বাড়ি এক এক রকম সৌন্দর্যে ঝলমল করছে। চারিদিক সবুজে সবুজ, এসেছে চিরবসন্ত, এনেছে শধ কড়ি, ফল আর ফল। এখানে সেখানে রুপোর মতো করুক করছে জলের রেখা। আর দূরে একটু একটু করে উঁচু হয়ে গিয়ে নীল পাহাড়ের তরঙ্গে মিশেছে সবুজ জমি, তারপর মিলিয়ে গেছে নিমল নীলাকাশের বুকে। কতকগুলো অদ্ভুত জিনিস কিন্তু চোখে পড়ার মতো। গোলাকার কূয়োর মতো কতকগুলো গভীর গর্ত–বিস্তর ছড়িয়ে আছে এদিকে সেদিকে। পাহাড়ে ওঠার সময়ে একটা দেখেছিলাম পথের ধারে। সবগুলোই ব্রোঞ্জে বাঁধানো, বিচিত্র কারুকাজ করা। বৃষ্টির জলরোধের জন্যে, ওপরে গুমটির মতো গোলগম্বুজ। এই সব কুয়োয় পাশে বসে নীচের কুচকুচ্ অন্ধকারের মধ্যে তাকালে জলের রেখা মোটেই দেখা যায় না, দেশলাইয়ের আলোর প্রতিফলন ফিরে আসে না ওপরে। প্রত্যেকটির মধ্যে শুনেছি বিশেষ একটি শব্দ ধুম্ ধুম ধুম্। বিরাট ইঞ্জিন অবিরাম ঘরে চললে এ জাতীয় শব্দ শোনা যায়। দেশলাইয়ের শিখার কাঁপন থেকে যা আবিষ্কার করলাম, তা আরও আশ্চর্য। দেখলাম, বাতাসের স্রোত বিরামবিহীনভাবে নেমে যাচ্ছে কুয়োগুলির মধ্যে। কাগজের ছোট্ট একটা কুচি ছেড়ে দিলাম কুয়োর মুখে। ধীরে ধীরে ভাসতে ভাসতে নিচের দিকে না নেমে বাতাসের টানে সাঁৎ করে দৃষ্টির আড়ালে নেমে গেল কুচিটা।

    এরপর ঢালু জমির এখানে-সেখানে দাঁড়ানো ছুঁচোলো থামগুলোর সঙ্গে কুয়োগুলোর একটা সম্পর্ক বার করে ফেললাম। দারুণ গরমের দিনে রোদে জ্বলা বালুকা বেলার ওপর যেমন বাতাসের অস্থির কাঁপন দেখা যায়, ঠিক তেমনি থিরথিরে কাঁপন দেখেছিলাম প্রতিটি থামের শীর্ষবিন্দুতে। এ সব থেকেই মাটির তলায় বাতাস চলাচলের একটা বিরাট পরিকল্পনা আঁচ করেছিলাম। কিন্তু আমার ধারণা যে কিছুটা ভুল, তা বুঝলাম পরে।

    স্বীকার করতে লজ্জা নেই যে, ভবিষ্যতে যে লোকালয়ে আমি পৌঁছেছিলাম সেখানকার যানবাহনদি বা পয়ঃপ্রণালী ইত্যাদি সম্বন্ধে খুব বেশি আমি জানতে পারিনি। জানাও সম্ভব নয়। আগামী কাল আর ইউটোপিয়া সম্বন্ধে অনেক বর্ণনা আপনারা পড়েছেন। লক্ষ লক্ষ বছরের ব্যবধান এক লাফে টপকে এমন এক সোনার যুগে গিয়ে পড়লাম, যেখানকার অভিনবত্ব আমাকে হকচকিয়ে তুলল। কাজেই স্বয়ংচালিত ব্যবস্থার একটা অস্পষ্ট ধারণা ছাড়া সে যুগ সম্বন্ধে আর কিছু আপনাদের শোনাতে পারব বলে মনে হয় না আমার।

    যেমন ধরুন, অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া সম্বন্ধে কিছুই জানতে পারিনি আমি। শ্মশান বা সমাধিস্তম্ভ জাতীয় কিছু চোখে পড়েনি। ভেবেছিলাম, দূরে কোথাও শ্মশান বা গোরস্থান নিশ্চয় আছে। কিন্তু সে ভাবনা ভাবতে গিয়ে আর একটা আশ্চর্য জিনিষ লক্ষ্য করে স্তম্ভিত হয়ে গেলাম। খুদে মানুষদের মধ্যে বয়স্ক বা অক্ষম একজনও ছিল না। সব মানুষের বয়সই প্রায় সমান, সমান তাদের স্বাস্থ্য আর সৌন্দর্য।

    স্বয়ংচালিত সভ্যতা আর ক্ষয়িষ্ণু মানবজাতি সম্বন্ধে আমার থিয়োরী যে বেশিদিন তেঁকেনি, তা আমি স্বীকার করছি। কিন্তু এ ছাড়া কী আর ভাবা যায় বলুন? যতগুলো বিরাট প্রাসাদে আমি গেছি, সবগুলোতেই শুধু খাবার আর শোবার জায়গা ছাড়া আর কিছু দেখিনি৷ কোনওরকম যন্ত্রপাতির চিহ্নও চোখে পড়েনি। কিন্তু খুদে মানুষদের ঝলমলে পোশাকগুলোও তো মাঝে মাঝে পালটানো দরকার। ওদের অদ্ভুত ডিজাইনের স্যাণ্ডেলগুলো এক রকম ধাতুর তৈরি, সেগুলোই বা আসে কোত্থেকে? অথচ সৃষ্টির স্পৃহা যে ওদের মধ্যে নেই, তা মুখ-চোখ দেখলেই বোঝা যায়। দোকান নেই, আমদানীরও চিহ্ন নেই। সারাদিন শুধু মহাখুশীতে খেলাধুলো করে, নদীতে স্নান করে, ফল খেয়ে, ফুল ছুঁড়ে, রাত্রে দল বেঁধে ঘুমোনোই তাদের কাজ। কিন্তু কীভাবে যে সব চলছে, তা বুঝিনি।

    আট লক্ষ দুহাজার সাতশো এক সালের জগতে পৌঁছানোর পর তৃতীয় দিন কিন্তু আমি একজন সাথী পেলাম। অল্প জলে কয়েকজন খুদে মানুষ স্নান করছিল। বসে বসে দেখছিলাম আমি। হঠাৎ ওদের একজন স্রোতের টানে ভেসে গেল একটু দূরে। টান অবশ্য বেশি ছিল না, কিন্তু তবুও কেউ সাহস করলে না বেচারাকে বাঁচাবার। এ থেকেই বুঝে নিন কি রকম দুর্বল তারা। চোখের সামনে চীৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে একজন ডুবে যাচ্ছে দেখে আমি ঝাঁপিয়ে পড়লাম জলে। অল্প চেষ্টাতেই তাকে তুলে আনলাম তীরে। ফুটফুটে ছোট্ট একটি মেয়ে। হাত-পা একটু ঘষতেই চাঙা হয়ে উঠল সে৷ এর পর থেকেই কিন্তু আমার সঙ্গিনী হয়ে উঠল মেয়েটি। সব সময়ে ছায়ার মতো লেগে থাকত আমার পাছু পাছু। আমিও একজন সাথী পেয়ে খুশী হলাম। একটু চেষ্টা করে নামটাও শুনলাম– উইনা। আমার এই ছোট্ট সাথীটির সঙ্গ কিন্তু দিন সাতেকের বেশি পাইনি–সেকথা পরে বলছি!

    উইনার কাছ থেকেই আমি প্রথম জানলাম যে, ভয় এখনও এ জগৎ ছেড়ে যায়নি। দিনের আলোয় দিব্বি হেসে-খেলে বেড়াত সে, কিন্তু আলো ফুরোনোর সঙ্গে সঙ্গে উইনার সাহস-ও ফুরোত। দেখেছি অন্ধকারকে, ছায়াকে আর যত কিছু কালো বস্তুকে ভয় করত সে। শুধু সে-ই নয়। রাত হলেই খুদে মানুষরা বড় বাড়ির মধ্যে ঢুকে পড়ে দল বেঁধে ঘুমোতে৷ আলো না নিয়ে তখন তাদের মাঝে যাওয়া মানে নিদারুণ ভয় পাইয়ে দেওয়া। আমি তো অন্ধকার হয়ে যাওয়ার পর কাউকেই ঘরের বাইরে একলা ঘুরতে বা ঘরের ভেতরে একলা ঘুমোতে দেখিনি।

    সেদিন ভোরের দিকে হঠাৎ আমার ঘুম ভেঙে গেল। দুঃস্বপ্ন দেখছিলাম। মনে হচ্ছিল যেন ডুবে যাচ্ছি আমি আর সমুদ্রের কুৎসিত প্রাণীগুলো তাদের থলথলে ভিজে শুঁড় বোলাচ্ছে আমার মুখে। ধড়মড়িয়ে উঠে বসলাম, আর কেন জানি মনে হল ধূসর রঙের কোনও জানোয়ার এইমাত্র ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল বাইরে। অদ্ভুত শিরশিরে সে অনুভূতি, বোঝানো যায় না কিছুতেই। আবার ঘুমোবার চেষ্টা করলাম, কিন্তু এত অস্বস্তি বোধ করতে লাগলাম যে, ঘুমোনো আর সম্ভব হল না। আলোছায়ার মায়াময় পরিবেশে রহস্যময় হয়ে উঠেছিল চারিদিক অন্ধকারের বুক চিরে আলোর নিশানা দেখা দিলেও তখনও সবকিছু যেন বর্ণহীন অপ্রাকৃত কুহেলী-ভরা। উঠে পড়লাম। বিরাট হলটা পেরিয়ে প্রাসাদের বাইরের উঠোনে দাঁড়ালাম। ইচ্ছে হল ব্রাহ্মমুহূর্তে দাঁড়িয়ে ভবিষ্যতের সূর্যোদয় দেখব।

    চাঁদ তখন অস্তের পথে। চাঁদের মরা আলো আর ভোরের স্বচ্ছ কিরণ মিশে গিয়ে ফ্যাকাশে আধো আলোর সৃষ্টি হয়েছিল। ঝোঁপঝাড়গুলো তখন কালির মতো কালো, জমি ধোঁয়াটে কুয়াশায় ঢাকা, আকাশ বিরং, বিষণ্ণ। ঠিক এমনি মুহূর্তে মনে হল যেন দূরে পাহাড়ের ওপর ভৌতিক মূর্তি দেখতে পেলাম আমি। ঢালু জমির ওপর চোখ বুলোতে গিয়ে বেশ কয়েকবার চোখে পড়ল অস্পষ্ট কতকগুলো চেহারা। বার দুয়েক মনে হল বাঁদরের মতো একটা সাদা জন্তু পাহাড়ের ওপর বেগে দৌড়ে গেল। আর একবার মনে হল তাদেরই কয়েকজন কালো মতো একটা দেহ বয়ে নিয়ে যাচ্ছে ধ্বংসস্তূপের দিকে। খুব দ্রুত নড়াচড়া করছিল ওরা। কিন্তু শেষ পর্যন্ত যে কোথায় গেল, তা আর দেখতে পেলাম না–যেন ঝোপঝাড়ের সঙ্গে মিলিয়ে গেল সবাই। তখনও চারিদিক অস্পষ্ট। ঠান্ডায় হোক বা যে কারণেই হোক, গা-টা বেশ শিরশির করে উঠল। দুই চোখ মুছে ভালো করে তাকালাম আমি।

    পূর্বদিক ফরশা হয়ে উঠল আস্তে আস্তে। চারিদিক বেশ পরিষ্কার হয়ে উঠতে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি মেলে তাকালাম পাহাড়ের দিকে। সাদা মূর্তির কোনও চিহ্নই দেখলাম না। অন্ধকারের প্রাণী ওরা, তাই যেন আধধা আলোর মধ্যে মিলিয়ে গেল অপছায়ার মতো। আমার কিন্তু মনে হল টাইম-মেশিন খুঁজতে গিয়ে যে সাদা রঙের জানোয়ারটাকে আমি চমকে দিয়েছিলাম, তার সঙ্গে এদের নিশ্চয় কোনও সম্পর্ক আছে।

    স্বর্ণযুগের আবহাওয়া যে এ যুগের চাইতে কত বেশি গরম তা আমি আগেই বলেছি। এর কারণ ঠিক করে বলা কঠিন। সুর্য আরও বেশি গরম হওয়ার জন্যেও হতে পারে। অথবা সূর্যের আরও কাছে পৃথিবীর সরে যাওয়ার ফলেও হতে পারে। কিন্তু কনিষ্ঠ ডারউইনের ভবিষ্যদ্বাণী সম্বন্ধে যারা ওয়াকিবহাল নয়, তারা ভুলে যায় যে সূর্য থেকে যেসব গ্রহের জন্ম, তাদের প্রত্যেকেই একে একে আবার ফিরে যাবে সূর্যে। আর যতবার ঘটবে এ ঘটনা, ততবারই নতুন তেজে দপ করে জ্বলে উঠবে সূর্য। হয়তো কাছাকাছি থাকা কোনও গ্রহ এই ভাবেই আশ্রয় নিয়েছে সূর্যের আগুন-জঠরে। কারণ যাই হোক না কেন, সূর্যের কিরণ যে এখনকার চাইতে অনেক বেশি জ্বালা ধরানো, সে বিষয়ে আর কোনও সন্দেহ নেই।

    সেদিন বোধহয় চতুর্থ দিন। সকালবেলা চারদিক বেশ গরম হয়ে উঠেছে। বড় বাড়িটির কাছে বিশাল ভগ্নস্তূপটার আনাচে-কানাচে গরম আর রোদ্দুরের হাত থেকে রেহাই পাওয়ার জন্যে একটা আশ্রয় খুঁজছিলাম। এই পটাতেই তখন আমি খাওয়া-দাওয়া সেরে ঘুমোতাম। এমন সময়ে অদ্ভুত একটা ব্যাপার ঘটল। ভাঙা চোরা ইমারতের একটা স্কুপে ওঠার পর সঙ্কীর্ণ একটা গ্যালারি দেখতে পেলাম, পাশের জানলাগুলো ধ্বসে পড়া পাথরের চাঁইয়ে বন্ধ হয়ে গেছে। বাইয়ের চোখ ধাঁধানো আলো থেকে হঠাৎ ভেতরে তাকিয়ে নিকষ অন্ধকার ছাড়া আর কিছুই দেখতে পেলাম না। হাতড়াতে হাতড়াতে ঢুকলাম ভেতরে, চোখের সামনে তখনও লাল আঁকাবাঁকা রেখা ছাড়া আর কিছু দেখছি না। আচম্বিতে মন্ত্রমুগ্ধের মতো থমকে দাঁড়িয়ে গেলাম আমি। অন্ধকারের ভেতরে থেকে এক জোড়া চোখ তাকিয়ে আছে আমার দিকে–বাইরের দিনের আলোর প্রতিফলনে জ্বলজ্বল করছে সে চোখ।

    আমি বর্তমান যুগের মানুষ, তাই প্রথমেই বুনো জানোয়ারের সম্ভাবনা মনে এল। শক্ত করে মুঠি পাকিয়ে একদৃষ্টে তাকিয়ে রইলাম সামনের জ্বলন্ত গোলাকার চোখ দুটোর দিকে। পিছু ফেরার মতো সাহসও ছিল না আমার। কিন্তু তারপরেই ভাবলাম, এখানকার মানুষ তো বেশ নিশ্চিন্ত নিরাপত্তা মধ্যে বাস করে–তবে…! হঠাৎ মনে পড়ল অন্ধকারকে কী রকম যমের মতো ভয় করে এরা। সাহস একটু ফিরে এসেছিল, তাই সামনের দিকে। এক পা এগিয়ে কথা বললাম আমি। ভয়ের চোটে গলার স্বর অবশ্য রীতিমতো কর্কশ আর বেসুরো শোনাল। সামনে হাত বাড়াতে একটা নরম জিনিসের ছোঁয়া পেলাম। তৎক্ষণাৎ চোখ দুটো সরে গেল পাশের দিকে, আর সাঁৎ করে সাদা মতো একটা কিছু পাশ দিয়ে ছুটে বেরিয়ে গেল পেছন দিকে! বলতে লজ্জা নেই, সঙ্গে সঙ্গে হৃৎত্যন্ত্রটা ধড়াস করে একটা ডিগবাজী খেয়ে এসে ঠেকল গলার কাছে–চট করে পেছন ফিরে দেখলাম আমার পেছনে রোদ-ঝলমলে পথের ওপর দিয়ে মাথা নিচু করে অদ্ভুত ভঙ্গিতে ছুটে যাচ্ছে কিম্ভুতকিমাকার মর্কটের মতো একটা জানোয়ার। গ্রানাইটের একটা চাঁইতে ধাক্কা খেয়ে একদিকে ছিটকে পড়ল জানোয়ারটা, পরমুহূর্তেই উঠে পড়ে মিলিয়ে গেল পাশের ভাঙা পাথরের স্তূপের অন্ধকারে।

    জানোয়ারটাকে অবশ্য খুব খুঁটিয়ে দেখার সময় পাইনি, কিন্তু যতদূর দেখেছি গায়ের রং তার ম্যাড়মেড়ে সাদা, ধূসর-লালাভ বড় বড় অদ্ভুত আকারের দুটো চোখ, আর মাথায় পিঠে শণের মতো চুলের রাশি। এত দ্রুতবেগে অন্ধকারের মাঝে সে সেঁধিয়ে গেল যে এর বেশি কিছু দেখার সুযোগ পেলাম না। আদতে সে চার হাত-পায়ে ভর দিয়ে দৌড়োচ্ছিল, কি সামনে দুহাতে ভর দিয়ে নিচু হয়েছিল, তা-ও দেখিনি। মুহূর্তের জন্য স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে থেকে ভাঙা স্যুপটার মধ্যে ঢুকে পড়লাম আমি। প্রথমে কিছুই দেখলাম না। বেশ কিছুক্ষণ হাতড়াবার পর দেখি হুবহু সেই রকম কুয়োর মতো একটা গর্ত, আড়াআড়িভাবে ওপরটা ঢেকে রেখেছে একটা ভাঙা থাম। চকিতে ভাবলাম বিদঘুটে জানোয়ারটা কি তাহলে এর মধ্যেই লুকিয়েছে? ফস করে জ্বালোম একটা কাঠি–নিচের দিকে তাকিয়ে দেখি আমার ওপর বড় বড় জ্বলন্ত চোখের অপলক দৃষ্টি রেখে দ্রুতবেগে নিচের দিকে নেমে যাচ্ছে ছোটখাট সাদা একটা প্রাণী। ঠিক যেন একটা মানুষ মাকড়শা! কি বেয়ে জন্তুটা অত তাড়াতাড়ি নামছে দেখতে গিয়ে সেই প্রথম দেখলাম ধাতুর তৈরি হাত-পা রাখার একসারি খোঁটা মইয়ের মতো সিধে নেমে গেছে নিচে। তারপরেই কাঠিটা আঙুল পর্যন্ত পুড়ে নিবে গেল, তাড়াতাড়ি জ্বালালাম আর একটি কাঠি। কিন্তু খুদে দানোটা ততক্ষণে অদৃশ্য হয়ে গেছে নিচের অন্ধকারে।

    কুয়োর অন্ধকারে তাকিয়ে কতক্ষণ যে সেখানে বসেছিলাম জানি না; যাকে এইমাত্র দেখলাম, সে যে একজাতীয় মানুষ, এ ধারণায় কিছুতেই আমার মন সায় দিতে চাইল না। কিন্তু বেশ কিছুক্ষণ ভাবার পর সত্যের মুখ দেখলাম। বুঝলাম, মানুষ আর একটিমাত্র প্রজাতি (species) নয়–দু শ্রেণীর প্রাণীতে ভাগ হয়ে গেছে তারা। ঊর্ধ্ব জগতের ফুটফুটে মানুষরাই আমাদের একমাত্র বংশধর নয়; চোখের সামনে দিয়ে বিদ্যুতের মতো এই যে ম্যাটমেটে সাদা কুৎসিত নিশাচর জানোয়ারটা পালিয়ে গেল এরাও আমাদের রক্ত বহন করছে তাদের শিরায়।

    গোলগম্বুজের গায়ে চারকোণা থামের ওপর বাতাসের থির থির কাঁপন, কুয়ো আর সুষ্ঠু বাতাস চলাচলের পদ্ধতির চিন্তা মনে এল আমার। এই বিরাট আয়োজনের উদ্ভব কোথায়, তা যেন একটু একটু করে দানা বেঁধে উঠতে লাগল আমার মনে। সামঞ্জস্যময়। এই অপূর্ব শৃঙ্খলার সঙ্গে লিমারগুলোর কী সম্পর্ক তারও কিছুটা আঁচ পেলাম, কিন্তু বুঝলাম না, কুয়োর নিচে কী লুকানো আছে। বুঝলাম না, কেন অহরহ যন্ত্রপাতি চলার শব্দ ভেসে আসে ওপরে। ভাবছি একবার নিচে নেমে নিজের চোখে দেখে আসতে হবে সেখানকার রহস্য, এমন সময়ে দুজন খুদে মানুষকে দেখলাম বাইরের আলোয়। ওরা কিন্তু কুয়োর পাড়ে ওই ভাবে আমাকে বসে থাকতে দেখে বেশ ঘাবড়ে গেল। ওদের ডেকে এনে কুয়োর নিচে আঙুল দেখিয়ে ইঙ্গিতে প্রশ্ন করলাম। কিন্তু উত্তর দেওয়া দূরে থাক, কী রকম ভয় ভয় চোখে আমার দিকে তাকিয়ে দুজনেই ছুট লাগালে অন্য দিকে। বাধ্য হয়ে উঠতে হল আমাকে। ঠিক করলাম উইনাকে জিজ্ঞেস করতে হবে কুয়োর রহস্য।

    হাঁটতে হাঁটতে এই সব কথাই ভাবছিলাম। এদের অর্থনৈতিক সমস্যার যে প্রশ্নটি আমাকে রীতিমতো ভাবিয়ে তুলেছিল, তার সমাধানও পেলাম তখন।

    মানুষের এই প্রজাতি যে পাতালবাসী সে বিষয়ে আর দ্বিমত নেই। তিনটি বিশেষ অবস্থা দেখে বুঝলাম কদাচিৎ জমির ওপর আসার কারণ ওদের বহুকাল ধরে মাটির নিচে বসবাসের অভ্যাস। প্রথমেই দেখুন না কেন, যে সব জন্তু বেশিরভাগ সময় অন্ধকারে থাকে, তাদের গায়ের রং ফ্যাকাশে সাদা। কেনটাকি গুহার সাদা মাছের কথা তো জানেনই। তারপর ওদের বড় বড় চোখে আলোর প্রতিফলন যা শুধু নিশাচর প্রাণীদের চোখেই দেখা যায়। উদাহরণ–পেঁচা আর বেড়াল। সব শেষে দেখুন, সূর্যের আলোয় ওর চোখ ধাঁধিয়ে যাওয়া অবস্থাটা। আলো থাকা সত্ত্বেও মাথা নিচু করে ছুটে গিয়ে পাথরে ধাক্কা লাগা আর তার পরেই অন্ধকারের মাঝে আশ্রয় নেওয়ার প্রচেষ্টা–এ সব দেখলে শুধু একটি সিদ্ধান্তেই আসা যায়, তা হল ওদের রেটিনা অর্থাৎ চোখের পর্দা যেমন পাতলা, তেমনি দারুণ অনুভূতিশীল।

    আমার পায়ের নিচে পৃথিবীর বুক অসংখ্য সুড়ঙ্গে ঝাঁঝরা হয়ে রয়েছে। নতুন জাতির নিবাস এই সুড়ঙ্গেই। বাতাস চলাচলের জন্য কুয়ো আর থামের আধিক্য থেকেই অনুমান করা যায় কী সুদূরব্যাপী তাদের বসতি। আর তাই যদি হয়, তাহলে দিনের আলোয় মাটির ওপর যে জাতি বাস করছে, সুখ-সুবিধা চাহিদার জন্যে নিচের জগতের বাসিন্দারা যে তৎপর নয় তাই বা কে নিশ্চয় করে বলতে পারে? এই যুক্তিসঙ্গত চিন্তাধারা থেকে মানব জাতির দুভাগ হয়ে যাওয়া সম্বন্ধে যে থিয়োরী খাড়া ধরলাম, তা শুনুন।

    আমাদের বর্তমান যুগের সমস্যা থেকেই এগনো যাক। মালিক এবং শ্রমিক গোষ্ঠীর মধ্যে ক্রমশ বেড়ে যাওয়া সামাজিক ব্যবধানই রয়েছে সবকিছুর মূলে। ভাবছেন বুঝি আমার মাথা খারাপ হয়েছে। কিন্তু আজকের যুগেই কি সে যুগের পদধ্বনি শুনতে পাচ্ছেন না? লন্ডনে মাটির তলায় মেট্রোপলিটন রেলওয়ে, ইলেকট্রিক রেলওয়ে, সাবওয়ে, মাটির তলায় কারখানা, রেস্তোঁরা দিন দিন বেড়েই চলেছে। বাড়তে বাড়তে এমন অবস্থায় একদিন পৌঁচেছে, যেদিন মাটির ওপর সব অধিকার হারিয়ে মাটির নিচে আশ্রয় নিয়েছে। সমস্ত শিল্প। বছরের পর বছর ফ্যাক্টরীর সংখ্যা বেড়ে গেছে মাটির নিচে, শ্রমিকরা দিনরাতের বেশিরভাগ সময় কাটাতে বাধ্য হয়েছে পাতালের অন্ধকারে। শেষে একদিন…! এমন কি আজও ইস্ট এণ্ডের শ্রমিকরা ইচ্ছেমতো পৃথিবীর ওপর আসার সুযোগ পায় কি?

    গরীবদের কাছ থেকে দূরে সরে যাওয়ার প্রচেষ্টা সবযুগের ধনীদের মধ্যেই আছে। অর্থ, শিক্ষা, সামাজিক প্রতিষ্ঠা–এই সবকিছুই ধনীদের ঠেলে দিয়েছে পৃথিবীর সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য আলো-হাওয়ার মধ্যে। আর তারাই গরীবদের বাধ্য করেছে মাটির নিচে থেকে কলকজা চালাতে। হাজার হাজার বছর ওই অবস্থায় থাকতে থাকতে অন্ধকারেই অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে। তারা। যেমন অভ্যস্ত হয়েছে ঊধ্বজগতের মালিকরা আলো-হাওয়ার মধ্যে।

    প্রতিভার চরম শিখরে উঠে আদর্শ সমাজ ব্যবস্থার প্রচলন করতে পেরেছিল মানবজাতি। শিক্ষা, সভ্যতা, জ্ঞান, প্রতিভার সে সোনার যুগ কিন্তু একদিন ফুরলো। অত্যন্ত সুষ্ঠু নিরাপত্তার মধ্যে দীর্ঘকাল নিশ্চিন্ত অলস জীবনযাপন করার ফলে উধ্বজগতের বাসিন্দাদের ধীশক্তি, দৈহিক শক্তির সঙ্গে দেহের আকারও কমে আসতে লাগল আস্তে আস্তে। কিন্তু মর্লকরা (পাতালবাসীদের ওই নামেই ডাকত সবাই) মানুষদের বৈশিষ্ট্য কিছু কিছু তখনও বজায় রেখে দিলে নিজেদের মধ্যে। কিন্তু একটা প্রশ্নের সদুত্তর পেলাম না কিছুতেই। টাইম মেশিন কি মর্লকরা নিয়েছে? তাই যদি নেয়, আর ইলয়রা (ফুটফুটে মানুষদের নাম যে ইলয়, তা উইনার কাছে জেনেছিলাম পরে) যদি ওদের প্রভু হয়, তবে মেশিনটা কেন ওরা ফিরিয়ে আনছে না মর্শকদের কাছ থেকে? অন্ধকারকেই বা এত ভয় করে কেন ওরা? এ প্রশ্নের উত্তর তখন না পেলেও পরে পেয়েছিলাম।

    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleকল্পগল্প সমগ্র – এইচ জি ওয়েলস
    Next Article ইবনে বতুতার সফরনামা – এইচ. এ. আর. গিব

    Related Articles

    এইচ জি ওয়েলস

    কল্পগল্প সমগ্র – এইচ জি ওয়েলস

    July 15, 2025
    এইচ জি ওয়েলস

    দ্য ওয়ার অব দ্য ওয়ার্ল্ডস – এইচ জি ওয়েলস

    July 15, 2025
    এইচ জি ওয়েলস

    ভাবীকালের একটি গল্প – এইচ জি ওয়েলস

    July 15, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo
    Most Popular

    রবিনসন ক্রুসো – ড্যানিয়েল ডিফো

    August 19, 2025

    অনুরাধা

    January 4, 2025

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    রবিনসন ক্রুসো – ড্যানিয়েল ডিফো

    August 19, 2025

    অনুরাধা

    January 4, 2025

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025
    Our Picks

    রবিনসন ক্রুসো – ড্যানিয়েল ডিফো

    August 19, 2025

    দ্য দা ভিঞ্চি কোড – ড্যান ব্রাউন

    August 19, 2025

    এঞ্জেলস এন্ড ডেমনস – ড্যান ব্রাউন

    August 19, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    Sign In or Register

    Welcome Back!

    Login below or Register Now.

    Lost password?

    Register Now!

    Already registered? Login.

    A password will be e-mailed to you.