Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    রবিনসন ক্রুসো – ড্যানিয়েল ডিফো

    August 19, 2025

    দ্য দা ভিঞ্চি কোড – ড্যান ব্রাউন

    August 19, 2025

    এঞ্জেলস এন্ড ডেমনস – ড্যান ব্রাউন

    August 19, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • 🔖
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    Subscribe
    সাইন ইন
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    টারজান রচনা সমগ্র – এডগার রাইস বারুজ

    এডগার রাইস বারুজ এক পাতা গল্প1300 Mins Read0

    টারজান ও বিদেশী দূত (টারজন এ্যাণ্ড দি ফরেন লিজিয়ন)

    টারজান ও বিদেশী দূত (টারজন এ্যাণ্ড দি ফরেন লিজিয়ন)

    হয়তো হল্যান্ডের সব মানুষই জেদী নয়, যদিও অন্য অনেক গুণের সঙ্গে জেদী মানসিকতাকেও তাদের অন্যতম জাতীয় বৈশিষ্ট্য বলে গণ্য করা হয়ে থাকে। হেড্রিক ভ্যান ডের মিয়ার-এর চরিত্রে এই জেদটা পুরোপুরিই আছে। কর্মসূত্রে সে সুমাত্রার একজন রবার ব্যবসায়ী। আর ব্যবসাতে সফলও বটে।

    ফিলিফিন আক্রান্ত হল। হংকং সিঙ্গাপুরের পতন ঘটল। সে কিন্তু তখনও স্বীকার করল না যে জাপানীরা নেদারল্যান্ড পূর্ব ভারতকে দখল করতে পারবে। ফলে, স্ত্রী ও কন্যাকে সে অন্যত্র সরিয়ে দিল না।

    তাছাড়া হেড্রিক ভ্যান ডের মিয়ার জাপানীদের ঘৃণা করত। সে বলল, আরে দেখই না দু’দিন পরে আমরাই ওদের ঠেঙিয়ে গাছে চড়িয়ে দেব। ইতিহাস কিন্তু প্রমাণ করে দিল যে তার এই ভবিষ্যদ্বাণী একেবারেই ভুল।

    জাপানীরা এসে হাজির হল। হেড্রিক ভ্যান ডের মিয়ার পাহাড়ে আশ্রয় নিল। সঙ্গে তার স্ত্রী এজে ভাঙ্কুর; আঠারো বছর আগে তাকে সে হল্যান্ড থেকে সঙ্গে করে এনেছিল; আর ছিল তার মেয়ে কোরি। দুটি চীনা চারক লুম কাম এবং সিংতাইও ওদের সঙ্গ নিল। সঙ্গ নিল দুটি কারণে-প্রথমটা জাপানী-ভীতি; তাদের হাতে যে কী হাল হবে সেটা তারা ভালই জানে; আর দ্বিতীয় কারণ, ভ্যান ডের মিয়ার পরিবারের প্রতি তাদের সত্যিকারের ভালবাসা। জাপানী রবার-শ্রমিকরা থেকেই গেল। তারা জানত, আক্রমণকারীরা রবারের ব্যবসা চালাবে, আর তাদেরও কাজ জুটবে।

    যাই হোক, জাপানীরা এল, আর হেড্রিক ভ্যান ডের মিয়াররাও পাহাড়ে আশ্রয় নিল। কিন্তু কিছুটা দেরী করে ফেলল। জাপানীরা তাদের তাড়া করে ফিরতে লাগল। সব নেদারল্যান্ডবাসীদেরই তাড়া করতে লাগল।

    পাহাড়ের আরও উপরে উঠতে গিয়ে ক্রমেই কষ্ট বাড়তে লাগল। রোজ বৃষ্টি হচ্ছে। পথঘাট কর্দমাক্ত। ভ্যান ডের মিয়ারের যৌবন পার হয়েছে; তবু এখনও সে কর্মক্ষম আছে। কোরির বয়স ষোল। স্বাস্থ্য, শক্তি ও পরিশ্রমের অভ্যাস তার আছে। সে দলের অন্য সকলের সঙ্গে সমান তালেই চলেছে। কিন্তু এলজে ভ্যান ডের মিয়ার কথা আলাদা। মনের বল থাকলেও দেহের বল নেই। তার উপর বিশ্রামের অভাব। একটা গ্রামে পৌঁছে কুঁড়ে ঘরের সঁাতসেঁতে মেঝেতে বসে ক্লান্ত দেহটা এলিয়ে দিয়েছে, এমন সময় আদিবাসীরা এসে খবর দিল, এই মুহূর্তে পালাতে হবে।

    তিন সপ্তাহ ধরে চলল একটানা হাঁটা একটা নির্ভরযোগ্য গ্রামের সন্ধানে। এলজে ভ্যান ডের মিয়ার আর চলতে পারছে না। দুদিন কোন গ্রামের দেখা মেলেনি। বন-জঙ্গলে যা জোটে তাই একমাত্র খাদ্য। জামা-কাপড় সব সময়ই বৃষ্টিতে ভেজা।

    মাঝে মাঝেই পাহাড়ি নদী। কখনও হেঁটে পার হল, কখনও বা ভঙ্গুর দড়ির ঝুলন্ত সেতু বেয়ে।

    এলজে ভ্যান ডের মিয়ার আর হাঁটতে পারল না। লুম্ কাম্‌ তাকে পিঠে তুলে নিল। গাইডরা বার বার তাড়া দিচ্ছে তাড়াতাড়ি পথ চলতে, কারণ ইতোমধ্যেই দু’দুবার তারা বাঘের ডাক শুনেছে।

    বার বার থেমে হাঁপাতে হাঁপাতে পাহাড়ের মাথায় উঠে কুকুরের ডাক শুনেই বুঝতে পারল তারা একটা গ্রামের কাছাকাছি পৌঁছে গেছে। গাইডদের মুখে সব কথা শুনে গ্রামের সর্দার তাকুমুদা তাদের সাদর অভ্যর্থনা জানাল।

    তারা তাদর খাবার দিল; ঘুমবার জন্য শুকনো ঘর দিল। কিন্তু এজে ভ্যান ডের মিয়ার কিছুই খেতে পারল না। জ্বরে তার গা পুড়ে যাচ্ছে। হেনড্রিক ভ্যান ডের মিয়ার ও কোরি সারা রাত তার পাশে জেগে কাটাল। দুপুরের আগেই এজে ভ্যান ডের মিয়ার মারা গেল।

    বাপ-মেয়েতে শুকনো চোখে পাথরের মত মৃতার পাশেই বসে রইল। এমন সময় বাইরে একটা হৈ চৈ শোনা গেল। ছুটে ঘরে ঢুকল সিংতাই।

    বলল, শিগগিরী কর। জাপানীরা এসে পড়েছে।

    ভ্যান ডের মিয়ার উঠে দাঁড়াল। বলল, আমি যাচ্ছি ওদের সঙ্গে কথা বলতে। আমরা তো ওদের কোন ক্ষতি করি নি। হয়তো ওরা আমাদের কোন ক্ষতি করবে না।

    সিংতাই বলল, ওই বাঁদর-মুখোদের তুমি চেন না।

    কিন্তু আমার তো আর কিছুই করার নেই। দেখ সিংতাই, আমি যদি বিফল হই, তাহলে মিসিকে নিয়ে তুমি পালিয়ে যেয়ো। সে যেন জাপানীদের হাতে না পড়ে।

    সে মই বেয়ে নেমে গেল। লুম কাম্ গেল তার সঙ্গে; দু’জনই নিরস্ত্র। কোরি ও সিংতাই ঘরের ভিতর থেকেই তাদের উপর নজর রাখল।

    কানে এল সাদা মানুষটির কণ্ঠস্বর আর জাপানীদের বকবকানি। তার কিছুই তারা বুঝতে পারল না। হঠাৎ দেখতে পেল, একটা রাইফেলের কুঁদো লোক দুটির মাথার উপরে উঠল আবার হঠাৎ নেমে এল। তারা জানে, রাইফেলের মাথায় আছে বেয়নেট। কানে এল একটা আর্তনাদ। আরও রাইফেলের কুঁদো উঠল ও নামল। আর্তনাদ থেমে গেল। কানে এল শুধু অমানুষদের উচ্চ হাসি।

    সিংতাই মেয়েটির হাত ধরে চলে এস’ বলে টানতে টানতে তাকে ঘরের পিছন দিক নিয়ে গেল। সেখানে একট দরজা আছে, নিচে আছে শক্ত মাটি।

    সিংতাই তাকে ধরে নামাল। তারপর তাকে নিয়ে চলল গ্রামের বাইরের জঙ্গলের দিকে।

    অন্ধকার নেমে আসার আগেই একটা গুহা খুঁজে পেয়ে দু’দিন সেখানেই লুকিয়ে রইল। তারপর ব্যাপারটা জানতে সিংতাই গ্রামে ফিরে গেল।

    দুটি বছর কেটে গেছে। কোরি ও সিংতাই আশ্রয় পেয়েছে অনেক দূরের একটা পাহাড়ি গ্রামে। সেখানকার সর্দার তিয়েং উমর।

    একদিন অন্য গ্রামের একটি লোক সেখানে এল। কোরি ও সিংতাইকে অনেক্ষণ ধরে দেখল, কিন্তু কিছু না বলেই চলে গেল। সিংতাই বলল, অবস্থা খুব খারাপ। ও গিয়ে আমাদের কথা বলে দেবে আর বাঁদর-মুখোরা চলে আসবে। তুমি বরং ছেলে সাজ, তারপর আমরা অন্য কোথাও গিয়ে লুকিয়ে পড়ি।

    সিংতাই কোরির সোনালী চুলকে মাপ মত করে কেটে দিল; কলপ লাগিয়ে কালো করে দিল। ভুরুও রং করে দিল। নীল ট্রাউজার ও ঢিলে ব্লাউজে তাকে একটি আদিবাসী ছেলের মতই দেখতে লাগল। তারপর দু’জন নামল এক সীমাহীন যাত্রাপথে। নতুন আশ্রয় খুঁজে দেবার জন্য তিয়াং উমর তাদের সঙ্গে কয়েকজন গাইড দিয়ে দিল। গ্রামের অনতিদূরে একটা ছোট পাহাড়ি ঝর্ণার ধারে একটা গুহায় তারা আশ্রয় পেল। সুমাত্রার জঙ্গলে নানারকম ফল-মূল পাওয়া যায়। ঝর্ণায় মাছ পাওয়া যায়। তাছাড়া তিয়া; উমর মাঝে মাঝে তাদের জন্য মুরগি ও ডিম পাঠায়। আলাম নামে একটি যুবক সে সব নিয়ে আসে। অচিরেই তিনজন ঘনিষ্ঠ বন্ধু হয়ে উঠল।

    উপকূলরক্ষী ভারী কামান বসাবার উপযুক্ত জায়গার খোঁজে এবং সেখানে যাতায়াতের পথের জরিপ করতে ক্যাপ্টেন তোকুজো মাসুয়ো এবং লেফটেন্যান্ট হাইদিয়ো সোকাবে একদল সৈন্য নিয়ে হুসিনের গ্রামে এসে হাজির হল। এই হুসিনই ভ্যান ডের মিয়ার পরিবারকে ধরিয়ে দিয়েছিল। তারা সর্দার হুসিনকে জানিয়ে দিল, আপাতত এই গ্রামেই তারা ছাউনি ফেলবে। হুসিন যেন তাদের খাবার-দাবারের ব্যবস্থা করে।

    কোরি ও সিংতাই গুহার মুখে বসে আছে। এক সপ্তাহ আগে আলাম তাদের জন্য খাবার নিয়ে এসেছিল। তারপর আর আসেনি। তাই খাবারের অপেক্ষাতেই দু’জন বসে আছে।

    কান পেতে সিংতাই বলল, কারা যেন আসছে। অনেক লোক। ভিতরে চল।

    হাইদিয়ো সোকাবে সসৈন্যে গুহায় ঢুকলো। তার হাতে উদ্যত তরবারি আর সৈন্যদের হাতে বেয়নেট। অস্পষ্ট আলোয় সোকাবে দেখতে পেল একটা চীনা ও একটা স্থানীয় ছেলেকে। সোকাবে চেঁচিয়ে বলল, মেয়েটা কোথায়? এর জন্য তোমরা সব্বাই মরবে। এটাকে শেষ করে দাও।

    কে যেন বলে উঠল, এটাই মেয়ে। ছেলের পোশাক পরে আছে।

    সোকাবে কোরির ব্লাউজটা টেনে ছিঁড়ে ফেলল। মুখে ফুটে উঠল কুটিল হাসি। একটি সৈনিকের বেয়নেট বিল সিংতাই-এর বুকে। সৈন্যদল ফিরে চলল বন্দিনীকে নিয়ে।

    গোলন্দাজ বাহিনীর সহকারী ইঞ্জিনীয়ার ব্রুকলিনের এসি সার্জেন্ট জো ‘ডাবুম বুবোনোভিচ অন্যান্য সহকর্মীদের সঙ্গে ‘লাভলি লেডি’র ডানার ছায়ায় দাঁড়িয়েছিল।

    একটা জিপ এসে দাঁড়াল বি-২৪-এর ডানার নিচে। তার ভিতর থেকে বেরিয়ে এল তিন অফিসার–আর- এ-এফ কর্নেল, এ-এ-এফ কর্নেল, ও এ-এ-এফ মেজর। লাভলি লেডি’-র পাইলট ও হোমা সিটির ক্যাপ্টেন জেরি লুকাস এগিয়ে গেল; এ-এ-এফ কর্নেল তাকে পরিচয় করিয়ে দিল কর্নেল ক্লেটনের সঙ্গে।

    মার্কিন কর্নেল শুধাল, সব ঠিক আছে জেরি?

    সব ঠিক স্যার।

    বিদ্যুৎ ও মেরামত কর্মীরা তাদের গ্যাজেট ও কামানকে শেষবারের মত পরীক্ষা করে পিছনের জা দিয়ে উঠে পড়ল, সঙ্গে সঙ্গে যুদ্ধযাত্রীরাও বিমানে চড়ে বসল।

    আগাম পর্যবেক্ষণ ও ফটো তোলার উদ্দেশ্যে কর্নেল জন ক্লেটন একটি বিমানঘাঁটি (সেন্সর’বিমান ঘাঁটির নামটা কেটে দিয়েছে) থেকে উড়ে চলেছে নেদারল্যান্ড পূর্ব ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জের জাপ-অধিকৃত সুমাত্রার আকাশপথে। বিমানে উঠে প্রথমে সে দাঁড়াল পাইলটের পিছনে। তারপর দীর্ঘ যাত্রা পথে কখনও বসল সহ-পাইলটের আসনে, কখনও বা পাইলটের আসনে। কথা বলল চালক ও রেডিও ইঞ্জিনীয়ারের সঙ্গে বিমানে কোথাও কোন বোমা নেই।

    ফটোগ্রাফার জনৈক এস সি সার্জেন্ট হাতের ক্যামেরাটা ঠিকঠাক করছিল। সে মুখ তুলে হাসলে ক্লেটনও হাসতে হাসতে গিয়ে তার পাশে বসে পড়ল।

    প্রচণ্ড বেগে বাতাস বইছে। মটরের শব্দে কানে তালা লাগছে। ফটোগ্রাফারের কানের কাছে মুখ নিয়ে ক্লেটন চীৎকার করে ক্যামেরা-সংক্রান্ত কয়েকটা প্রশ্ন করল। ফটোগ্রাফারও চীৎকার করে জবাব দিল। বি-২৪ যখন আকাশে ওড়ে তখন কথাবার্তা বলাই দায়। তবু ক্লেটন তার দরকারী তথ্যগুলো জেনে নিল।

    ভোরের দিকে সুমাত্রার উত্তর-পশ্চিম ভূ-খণ্ড তাদের চোখে পড়ল। দিনটিও ফটো তোলার পক্ষে চমৎকার। মালয় উপদ্বীপের দক্ষিণ থেকে পশ্চিমে বিস্তৃত এগারো শ’ মাইল দীর্ঘ এই ভূ-খণ্ডটির মেরুদণ্ড স্বরূপ পর্বত শ্রেণীর মাথার উপর মেঘ জমেছে; কিন্তু যতদূর দৃষ্টি যায় উপকূলরেখা সম্পূর্ণ নির্মেঘ। আর তাদের কাজ তো উপকূলকে নিয়েই।

    জাপানীরা নিশ্চয় তাদের আগমনের খবর রাখে না। তাই প্রায় আধ ঘন্ট ধরে তারা নির্বিঘ্নে ফটো তুলল। তার পরই বাধা এল। সে বাধা কাটিয়ে আরও নিচে নামতেই শত্রুর আক্রমণ তীব্রতর হল। কয়েকটি গোলা অল্পের জন্য লক্ষ্যভ্রষ্ট হওয়ায় বিমানটা আরও বেশ কিছুক্ষণ নির্বিঘ্নে উড়ে চলল।

    পাডাং-এর কাছে তিনটি জিরো বিমান যেন সূর্যের বুক থেকে গর্জে উঠে নেমে এল তাদের উপর। বুবোনোভিচের পাল্টা আক্রমণে একটা বিমান আগুন লেগে মুখ থুবড়ে পড়ে গেল। অপর দুটি বিমান সরে গিয়ে বেশ কিছুটা দূর থেকে উড়তে লাগল। তার পরই আবার নেমে এসে অ্যাক-অ্যাক শব্দে গোলা ছুঁড়তে লাগল। ইঞ্জিনের মাথায় পড়ে বোমাটা ছিটকে এসে পড়ল ককপিটে। লুকাস রক্ষা পেল, কিন্তু তার সহ-পাইলটের আঘাত লাগল মুখে। পাশে বসা পর্যবেক্ষকটি তার সেটি-বেল্টটা খুলে দিয়ে টানতে টানতে তাকে ককপিটের বাইরে নিয়ে গেল প্রাথমিক সাহায্যের জন্য। কিন্তু ততক্ষণে তার মৃত্যু ঘটেছে।

    ক্রমেই আক্রমণ এত তীব্র হয়ে উঠল যে, মস্ত বড় বিমানটা গোঁ-গোঁ শব্দ করতে লাগল। অগত্যা আক্রমণের হাত এড়াতে লুকাস সেটাকে চালিয়ে দিল বীরভূমির ভিতর দিকে, কারণ সে জানে যে বিমানধ্বংসী কামানগুলো বসানো আছে তটরেখা বরাবর। তাছাড়া পাহাড়ের মাথার উপরকার মেঘের আড়ালে লুকিয়ে তারা সেখান থেকে দেশের দিকে পাড়ি দিতে পারবে।

    দেশ! মুক্তিযোদ্ধারা অতীতেও অনেক লম্বা পথ পাড়ি দিয়েছে। তেইশ বছর বয়সের ক্যাপ্টেন একটি দ্রুত সিদ্ধান্ত নিল। দ্রুত হলেও সঠিক সিদ্ধান্ত। হুকুম দিল, একমাত্র প্যারাসুট ছাড়া বিমানে আর যা কিছু আছে। কামান, গোলা, লাইফ বেল্ট-সব ফেলে দেয়া হোক। ঘাঁটিতে ফিরে যাবার সেটাই একমাত্র পথ।

    যেই তারা মেঘে ঢাকা পাহাড়ের দিকে মুখ ফেরাল অমনি আক্রমণকারীরাও সেই দিকেই এগিয়ে এল। লুকাসের মতলবটা জাপানীরা নিশ্চয় বুঝতে পেরেছে। লুকাস জানে এখানকার পাহাড়ের অনেক চূড়াই বারো হাজার ফুট পর্যন্ত উঁচু। তাই সে উড়তে লাগল বিশ হাজার ফুট উঁচু দিয়ে। ধীরে ধীরে সে উচ্চতা কমাতে লাগল।

    একটা পাহাড়ের ঠিক উপরে পৌঁছতেই চূড়ার উপর থেকে গর্জে উঠল কামান। লুকাসের কানে এল। একটা প্রচণ্ড শব্দ। একটা আহত জন্তুর মত বিমানটা কাত হয়ে পড়ল। লুকাস সাধ্যমত চেষ্টা করতে লাগল বিমানটাকে চালিয়ে নিতে। সংযোগ-রক্ষাকারীর সঙ্গে কথা বলতে চেষ্টা করল। কোন জবাব এল না। লোকটি মারা গেছে। সহ-পাইলটের সামনে বসে ক্লেটনও সাধ্যমত চেষ্টা করতে লাগল। পর্যবেক্ষককে ডেকে বলল, সব কিছু দেখে নাও। সকলেই যাতে লাফিয়ে পড়ে সেদিকে নজর রেখো। তারপর তুমি লাফ দিও।

    পর্যবেক্ষক মুখ বাড়িয়ে দেখল, সামনের গোলন্দাজটিও মারা গেছে। বেতারে লোকটি ডেকে ফিরে গিয়ে বলল, পিছন দিকটাও উড়ে গেছে। সেই সঙ্গে বুচ ফটোগ্রাফারও হাওয়া।

    লুকাস বলল, ও কে। তুমি লাফ দাও। ক্লেটনের দিকে ফিরে বলল, এবার আপনার পালা স্যার।

    ক্লেটন বলল, তোমার আপত্তি না থাকলে আমি তোমার জন্য অপেক্ষা করব ক্যাপ্টেন।

    লুকাস সঙ্গে সঙ্গে বলল, লাফ দিন।

    ক্লেটন হেসে বলল, রাইট-ও!

    লুকাস বলল, বোমা ছুঁড়বার জানালাটা খুলে দিয়েছি; সেদিক দিয়েই সহজ হবে। তাড়াতাড়ি করুন।

    ক্লেটন জানালায় গিয়ে দাঁড়াল। বিমানটি কাত হয়ে নিচে পড়ছে। তার ইচ্ছা, শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত লুকাস লাফ দেয়ার আগে পর্যন্ত অপেক্ষা করবে। শেষ মুহূর্ত সমাগত। বিমানটি উল্টে গেল। ক্লেটন ছিটকে পড়ে বাতাসে মিলিয়ে গেল।

    অজ্ঞান অবস্থায় সে ছুটে চলল মৃত্যুর দিকে। ভারী মেঘের ভিতর দিয়ে সে চলেছে। তিনটে গর্জনমুখর ইঞ্জিন নিয়ে লাভলি লেডি’ গর্জন করতে করতে তার পাশ কাটিয়ে ছুটে গেল। মাটিতে ভেঙ্গে পড়ার আগেই সেটা জ্বলে-পুড়ে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। শত্রুরা কিছুই জানতে পারবে না, কিছুই উদ্ধার করতে পারবে না।

    কিছুক্ষণ পরেই ক্লেটনের জ্ঞান ফিরে এল। মেঘের স্তর পার হয়ে এখন সে পড়েছে মুষলধারা বর্ষণের মধ্যে। হয়ত সেই ঠাণ্ডা বৃষ্টির জন্যই সে বেঁচে গেল। জ্ঞান হতেই সে প্যারাসুটের দড়িটা ধরে টান দিল।

    প্যারাসুটটা ফুলে উঠল। অদ্ভুতভাবে ঝুলতে লাগল তার শরীরটা। নিচে বৃষ্টিভেজা সবুজের সমুদ্র। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই তার শরীরটা নিচে ডালপালা ও লতার মধ্যে ছিটকে পড়ল। প্যারাসুটটা আটকে গেল। সে নিজে ঝুলতে লাগল মাটি থেকে শ’ দুই ফুট উপরে। মৃত্যু আর দূরে নয়।

    একই সঙ্গে কয়েকশ গজ দূরে একটা প্রচণ্ড শব্দ হল-একটা বিস্ফোরণে আগুন জ্বলে উঠল দাউ দাউ করে। লাভলি লেডি’-র অন্তিম চিতার আগুনে জলে-ভেজা অরণ্য ঝিলমিল করতে লাগল।

    একটা ছোট ডাল ধরে ক্লেটন একটা বড় ডালে উঠে সেখানে আশ্রয় নিল। প্যারাসুটের বাঁধন খুলে ফেলল। ইউনিফর্ম ও তলবাস ভিজে জপজপ করছে। টুপিটা আগেই কোথায় পড়ে গেছে। এবার জুতো জোড়াও খুলে ছুঁড়ে দিল। তারপর ফেলে দিল পিস্তল ও গুলি। তারপর মোজা, ট্রাউজার ও তলবাস। রইল শুধু বেল্ট ও খাপবদ্ধ ছুরিটা।

    তারপর আরও উপরে উঠে সবগুলো দড়ি কেটে দিয়ে প্যারাসুটটা খুলে নিল। ভাঁজ করে বেঁধে সেটাকে কাঁধে ফেলল। ডাল থেকে ডালে ঝুলতে ঝুলতে নিচে নেমে গেল।

    বিমান-দুর্ঘটনার ফলে কে যে কোথায় ছিটকে পড়ল, কে বেঁচে রইল আর কে মারা গেল, কে তার হিসাব রাখে।

    বন্দী অবস্থায় লোকগুলোর সঙ্গে চলতে চলতে কোরি ভ্যান ডের মিয়ার দুটি সমস্যার কথাই ভাবতে লাগল? কেমন করে পালাবে, আর পালাতে না পারলে কেমন করে মরবে।

    সকাল গড়িয়ে গেল। আকাশে ঘন মেঘ। প্রচণ্ড বৃষ্টির মধ্যে তারা পথ চলতে লাগল। পচা ঘাস পাতার গন্ধে বাতাস ভারী হয়ে উঠেছে। মাটি থেকে উঠে আসছে ভ্যাপসা মৃত্যু-বাষ্প! মেয়েটি জানে। প্রতিটি পদক্ষেপ তাকে এগিয়ে দিচ্ছে মৃত্যুর মুখে; যদি না

    মাথার উপরে মোটুরের গর্জন শোনা গেল। এ রকম শব্দ তো হামেশাই শোনা যায়। জাপানীরা তো সর্বদাই উড়ে বেড়াচ্ছে। পরক্ষণেই কানে এল বিস্ফোরণের একটা কান-ফাটা শব্দ। হয়তো শত্রুপক্ষের কোন বিমানই ভেঙে পড়েছে-এ কথা ভেবে কোরি মনে মনে খুশিই হল।

    ক্যাপ্টেন তোকুজো মাসুয়ো যে গ্রামে বাসা নিয়েছে সেখানে পৌঁছতে তাদের রাত হয়ে গেল। তাদের দেখেই ক্যাপ্টেন বলল, বন্দীরা কোথায়?

    কোরির হাত ধরে ক্যাপ্টেনের দিকে এগিয়ে গিয়ে সোকাবে বলল, এই নিন।

    আমি তোমাকে পাঠালাম একটা চীনা ও একটা সোনালী চুল ওলন্দাজ মেয়েকে আনতে আর তুমি এনে হাজির করলে একটা কালো চুল ছোকরাকে। ব্যাপারটা কি?

    সোকাবে বলল, চীনাটাকে আমরা মেরে ফেলেছি। আর এটিই সেই ওলন্দাজ মেয়ে।

    সোকাবে সব কথা খুলে বলল। মেয়েটির মাথার চুল তুলে নিচেকার সোনালী চুল বের করে বলল, দেখুন।

    মেয়েটিকে ভাল করে দেখে মাথা নেড়ে মাৎসুয়ো বলল, ওকে আমি রেখে দিলাম।

    গাছের ডালটা প্রবলভাবে নড়ে উঠতেই জেরি লুকাসের ঘুম ভেঙে গেল। বুববানোভিচ ও রসেটিরও ঘুম ভাঙল। রসেটি বলল, কথা বলো না।

    চারদিকে তাকিয়ে বুবোনোভিচ বলল, তো দেখতে পাচ্ছি না।

    জেরি মাথাটা বের করে উপরে তাকাল। মস্ত বড় একটা কালো জন্তু কয়েক ফুট উপরে বসে গাছটাকে দোলাচ্ছে। জেরি বলল, এবার দেখতে পাচ্ছ?

    রসেটি বলল, গীজ! বাঁদর কখনও এত বড় হয় তা তো জানতাম না।

    বুবোনোভিচ বলল, ওটা বাদর নয়। ওকে বলে বেঁটে পঙ্গো। কেন যে বেঁটে বলে তা তো বুঝি না। বলাতো উচিত পঙ্গো দানব।

    শ্রীম্প বলে উঠল, মার্কিনী ভাষায় কথা বল।

    লুকার্স, বলল, তাহলে বলি, ওটা ওরাংউটান।

    মালয় ভাষায় উরাংউটান মানে বনমানুষ; কথাটা তার থেকেই এসেছে, বুবোনোভিচ যোগ করল।

    শ্রীম্প শুধাল, ওটা কি মানুষ খায় অধ্যাপক বুবোনোভিচ?

    না; ওরা প্রধানত শাকপাতা খায়।

    ওরাংউটানটা ধীরে ধীরে সেখান থেকে প্রস্থান করল। এদিক-ওদিক তাকিয়ে শ্রীম্প বলল, আরে, আমাদের ডিউক কোথায় গেল?

    লুকাস বলল, তাই তো। কখন গেল খেয়াল করিনি তো।

    শ্রীম্প বলল, কাল রাতে নির্ঘাত বাঘের পেটে গেছে।

    বুবোনোভিচ আঙুল বাড়িয়ে বলল, ওটা তাহলে তার ভূত আসছে।

    সকলেই তাকাল। রসেটি বলল, হায় পিটার! কি মানুষ রে বাবা!

    গাছের ডালে ডালে ঝুলতে ঝুলতে কাঁধে একটা মরা হরিণ নিয়ে ক্লেটন এসে নামল গাছের ডালে। বলল, এই নাও প্রাতঃরাশ। লেগে যাও।

    হরিণটাকে নামিয়ে ছুরি বের করে একটা বড় টুকরো সে কেটে নিল নিজের জন্য। তারপর একটু সরে গিয়ে তাতে দাঁত বসিয়ে দিল।

    সিংতাই মরে নি। জাপানী বেয়নেট তার বুকে বিঁধেছিল কিন্তু কোন গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গকে বিদীর্ণ করে নি। দু’দিন সিংতাই সেই রক্তাপুত গুহার মধ্যেই পড়ে ছিল। তারপর হামাগুড়ি দিয়ে সেখান থেকে বেরিয়ে এল। প্রচুর রক্তপাত এবং খাদ্য-পানীয়ের অভাবে দুর্বল দেহে কোন রকমে টলতে টলতে এগিয়ে চলল তিয়াং উমরের গ্রামের দিকে।

    ভাবতে ভাবতে পথ চলছে, এমন সময় প্রায় উলফঙ্গ একটি দৈত্য তার পথের সামনে এসে হাজির হল। দৈত্যটার দেহ ব্রোঞ্জ-কঠিন, কালো চুল, ধূসর চোখ। সিংতাই ভাবল, এখানেই তার জীবনের অবসান হবে।

    গাছ থেকে লাফিয়ে নেমেই ক্লেটন ইংরেজিতে সিংতাই-এর সঙ্গে কথা বলল। সিংতাইও ভাঙা ভাঙা ইংরেজিতে জবাব দিল। হংকং-এ থাকতে অনেক বছর সে একটি ইংরেজ পরিবারে বাস করেছিল।

    ক্লেটন জিজ্ঞাসা করল, তোমার এ অবস্থা কি করে হল?

    জাপানী বাঁদরগুলো একটা বেয়নেট বসিয়ে দিয়েছিল-ঠিক এইখানে।

    কেন?

    সিংতাই সব ঘটনা খুলে বলল।

    জাপানীরা কি কাছাকাছি আছে?

    মনে তো হয় না।

    তুমি যে গ্রামের দিকে চলেছ সেটা কতদূর?

    আর বেশি দূর নয়-এক কিলোমিটারের মত হতে পারে।

    সে গ্রামের লোকেরা কি জাপানীদের বন্ধু?

    না। জাপানীদের তারা ঘৃণা করে।

    ক্লেটনের সঙ্গীরা এতক্ষণে রাস্তার মোড় ঘুরে তাদের দেখতে পেল।

    লুকাস বলল, দেখছ, এবারও সে ভুল করেননি।

    সকলে এগিয়ে আসতেই সিংতাই সভয়ে তাদের দিকে তাকাল।

    ক্লেটন বলল, ভয় নেই। এরা আমার বন্ধু-মার্কিন বৈমানিক।

    মার্কিন! সিংতাই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। এতক্ষণে মনে হচ্ছে মিসিকে বাঁচাতে পারব।

    এবার ক্লেটনই সব কথা সকলকে শুনিয়ে দিল। সকলেই একমত হয়ে তিয়াং উমরের গ্রামের দিকে এগিয়ে চলল।

    সিংতাই-এর মুখে সব কথা শুনে তিয়াং উমর সকলকে সাদর অভ্যর্থনা জানাল। সিংতাইকে দোভাষী করে বলল, আগের দিন সকালেই ওলন্দাজ মেয়েটি ও তাদের গায়ের একটি যুবককে নিয়ে জাপানীরা গ্রাম ছেড়ে চলে গেছে। কোথায় গেছে তা সে জানে না।

    সিংতাই অশ্রুসিক্ত চোখে ক্লেটনকে মিনতি জানাল, কোরিকে তারা জাপানীদের হাত থেকে উদ্ধার করে দিক। আলোচনার পরে সকলেই তাতে সম্মত হল।

    তারা চলেছে ধীরে ধীরে, খুব সতর্ক হয়ে। সকলের আগে ক্লেটন।

    গ্রামে পৌঁছতে অন্ধকার হয়ে গেল। সকলকে অপেক্ষা করতে বলে ক্লেটন এগিয়ে গেল। গ্রামের মুখে কোন রক্ষীই নেই। সহজেই ভিতরে ঢুকে গেল। আকাশে চাঁদ নেই। তারাগুলো মেঘে ঢাকা পড়েছে। কয়েকটি ঘরে আবছা আলো জ্বলছে।

    ক্লেটনের তীক্ষ্ণ নাকে যে গন্ধ এল তাতেই সে সাদা মেয়েটির অবস্থান বুঝতে পারল। দুটি জাপানীর ক্রুদ্ধ তর্জন-গর্জনও কানে এল। নিশ্চয় সেই দুই অফিসার এখনও ঝগড়া করছে।

    ক্লেটন সঙ্গীদের কাছে ফিরে গেল। ফিসফিস্ করে কিছু নির্দেশ দিয়ে তাদের নিয়ে গ্রামের পিছন দিকটায় ফিরে গেল। বলল, তোমাদের ৪৫ গুলোতে যে কার্তুজ ভরা সেগুলো নিশ্চয়ই ছোঁড়া যাবে। যতক্ষণ পারবে গুলি ছুঁড়বে। আটকে গেলে সমানে পাথর ছুঁড়তে থাকবে। আর সারাক্ষণ নারকীয় চীৎকার করতে থাকবে। মোটকথা এই দিকেই সকলের মনোযোগ টেনে রাখবে। তিন মিনিটের মধ্যে কাজ শুরু করবে, আর চতুর্থ মিনিটেই এখান থেকে সরে পড়বে। বলেই সে চলে গেল।

    গ্রামের উঁচু দিকটায় পৌঁছে সে অফিসারদের বাড়িটার পিছনে লুকিয়ে পড়ল। এক মিনিট পরেই অপর প্রান্তে গুলি ছোঁড়া শুরু হয়ে গেল। হৈ-চৈ চীৎকারে রাতের স্তব্ধতা ভেঙ্গে খান্‌খা হয়ে গেল। ক্লেটনের মুখে হাসি দেখা দিল।

    এক সেকেন্ড পরেই অফিসার দু’জন হাঁক-ডাক করতে করতে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। সব বাড়ি থেকে সৈনিকরা ছুটল শব্দ লক্ষ্য করে। ক্লেটন ছুটে গিয়ে মই বেয়ে উপরে উঠে গেল। হাত-পা বাঁধা অবস্থায় মেয়েটি মাদুরে শুয়ে আছে। নিচু হয়ে তাকে কোলে তুলে নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এসে ক্লেটন ছুটল জঙ্গলের দিকে। মেয়েটি ভয়ে সারা। এ আবার কি নতুন বিপদ!

    জঙ্গলের পথে কিছুদূর চলেই ক্লেটন মেয়েটিকে নামিয়ে দিল। তার হাতে-পায়ের বাঁধন কেটে ফেলল।

    ওলন্দাজ ভাষায় মেয়েটি বলল, কে তুমি?

    চুপ! ক্লেটন ধমক দিল।

    আরও চারজন এসে তাদের সঙ্গে যোগ দিল। অন্ধকার পথ বেয়ে তারা নিঃশব্দে এগিয়ে চলল। ইংরেজি ভাষায় চুপ’ কথাটা মেয়েটিকে কিছুটা আস্বস্ত করেছে। আর যাই হোক, এরা জাপানী নয়।

    একটি ঘণ্টা তারা নীরবে পথ চলল, এবার কোরি ইংরেজিতে শুধাল, তোমরা কারা?

    ক্লেটন বলল, বন্ধু। সিংতাই তোমার কথা আমাদের জানিয়েছে। তাই আমরা এসেছি।

    তাহলে সিংতাই মারা যায় নি?

    না; তবে মারাত্মক রকম জখম হয়েছে।

    তিয়াং উমরের গ্রামে পৌঁছতে ভোর হয়ে গেল। সেখানে কিছু সময় অপেক্ষা করে খাওয়া-দাওয়া সেরে তারা আবার যাত্রা করল।

    দীর্ঘ পথ হাঁটার মত অবস্থা সিংতাই-এর ছিল না; তাই তাকেও তিয়াং উমরের গ্রামে রেখে যেতে তারা বাধ্য হল।

    একদিন সকালে দলের পুরুষরা সকলেই শিকারে বেরিয়ে গেল। কোরি একা বসে হরিণের চামড়া দিয়ে একটা চটি বানাতে বসল। সেই সুযোগে জনদশেক সুমাত্রাবাসী এসে কোরিকে তুলে নিয়ে গেল। তাদের কথাবার্তা থেকেই কোরি জানতে পারল, তাকে ও সিংতাইকে ধরে দেবার জন্য জাপানীরা পুরস্কার ঘোষণা করেছে।

    সূর্যাস্তের পরেই শিকারীরা গুহায় ফিরল। ঘরে ঢুকতেই বুঝতে পারল, মেয়েটি নেই। কোথায় গেল?

    নানা জনে নানা কথা বলতে লাগল। তাদের থামিয়ে দিয়ে ক্লেটন বলল, না, সে শিকারেও যায় নি, পালিয়েও যায় নি। একদল আদিবাসী তাকে জোর করে ধরে নিয়ে গেছে। পায়ের দাগ দেখিয়ে বলল, তারা ঐদিকে গেছে। যেমন করে হোক, মেয়েটিকে আমরা উদ্ধার করবই। রাতটা কাটিয়ে ভোরেই আমরা যাত্রা করব।

    আলো ফুটে উঠতেই কোরির অপহরণকারীদের পথ ধরে তারা যাত্রা করল। আমেরিকানদের চোখে কোন পায়ের দাগ দেখা না দিলেও ইংরেজিটির অভ্যস্ত চোখে তা স্পষ্ট হয়েই ধরা দিল।

    রাতের অন্ধকার নেমে আসতেই কোরির অপহরণকারীরা একটা পাহাড়ি উপত্যকার এক প্রান্তে ছাউনি ফেলল। বড় বিড়ালকে দূরে রাখতে একটা ধুনি জ্বালিয়ে সকলে সেটাকে ঘিরে বসল; শুধু একটি লোক পাহারায় রইল।

    ক্লান্ত মেয়েটি বেশ কয়েক ঘণ্টা ঘুমল। যখন ঘুম ভাঙল তখন ধুনি নিভে গেছে, পাহারাদারটিও ঘুমিয়ে পড়েছে। এই সুযোগে পালাতে হবে। বাইরে তাকাল-বিপদসংকুল ঘন অন্ধকার, অন্ধকারের একটা নিরেট প্রাচীর যেন। তার মধ্যে লুকিয়ে আছে সম্ভাবিত মৃত্যু। কোরি সিদ্ধান্ত নিতে দেরী করল না।

    নিঃশব্দে উঠে দাঁড়াল। রক্ষীটি শুয়ে আছে নেভা আগুনের ছাইয়ের পাশের সকলকে পাশ কাটিয়ে কোরি জঙ্গলে প্রবেশ করল। হোঁচট খেতে খেতে অন্ধকারে এগিয়ে চলল।

    পথের উপরকার গাছের ডালে বসে লাভলি লেডি’র জীবিত যাত্রীরা বাঘের জন্য অপেক্ষা করে আছে। কতক্ষণে সে এসে চলে যাবে, তবে তারা গাছ থেকে নামতে পারবে।

    গাছের উপর থেকে নিচে পথের দু’দিকের দুটো মোড় পর্যন্ত শ’খানেক ফুট পরিষ্কার দেখা যায়-যে কোন দিকেই প্রায় পঞ্চাশ ফুট করে। হঠাৎ নিঃশব্দ পায়ে দেখা দিল সেই বাঘ। আর সঙ্গে সঙ্গে উল্টোদিকে মোড়ে দেখা দিল কোরির চিকন দেহ। বাঘ ও মেয়েটি যুগপৎ দাঁড়িয়ে পড়ল-দু’জনের মধ্যে ব্যবধান একশ’ ফুটেরও কম। চাপা গর্জন করে বাঘটা সামনে পা বাড়াল। কোরি বুঝি বা ভয়ে জমে গেল। স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। আর ঠিক সেই মুহূর্তে দেখল, একটি প্রায় উলফঙ্গ মানুষ গাছ থেকে লাফিয়ে পড়ল বাঘটার পিঠে। সঙ্গে সঙ্গে আরও তিনটি লোক খাপ-খোলা ছুরি হাতে ছুটে এল বড় বিড়ালের সঙ্গে যুদ্ধরত মানুষটির দিকে। তাদেরই একজন এস সার্জেন্ট রসেটি।

    দেখতে দেখতে বাঘটা নিস্তেজ হয়ে মাটিতে মুখ থুবড়ে পড়ে গেল। লোকটি তার উপর একটা পা রেখে দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে মুখ তুলে একটা বীভৎস হুংকার ছাড়ল- গোরিলার বিজয় হুংকার।

    সভ্য ও সংস্কৃতিবান এই মানুষটিকে দেখে কোরি হঠাৎ ভীষণ ভয় পেল। অন্য তিনজনের অবস্থাও তথৈবচ।

    হঠাৎ জেরি লুকাস তাকে চিনতে পারল। বলে উঠল, জন ক্লেটন, লর্ড গ্রেস্টোক-গোরিলাদের টারজান।

    শ্রীম্পের চোয়াল ঝুলে পড়ল। সে জানতে চাইল, এই কি সেই জনি উইসমুলার?

    বুঝিবা পরিস্থিতিটাকে ঠিকমত বুঝবার জন্যই টারজান মাথাটাকে বার কয়েক ঝাঁকি দিল।

    সহাস্যে কোরিকে অভ্যর্থনা জানিয়ে বলল, তাহলে শেষ পর্যন্ত ওদের হাত থেকে ছাড়া পেলে?

    কোরি মাথা নাড়ল; তখনও সে ভয়ে কাঁপছে। বলল, হ্যাঁ, কাল রাতেই পালিয়েছি।

    পরদিন দিনের আলো ফুটতেই পাহাড়ের উত্রাই ধরে সকলে হাঁটতে লাগল। এক জায়গায় পথটা দু’ভাগ হয়ে গেছে। টারজান সেখানে থেকে হঠাৎ একটা গাছের ডাল ধরে ঝুলে পড়ল। পরমুহূর্তেই সে উধাও। অবাক হয়ে বাকি সকলে আবার হাঁটতে শুরু করল। আগে বুবোনোভিচ, তার পিছনে রসেটি। জেরি ও কোরি চলেছে কয়েক গজ পিছনে। মোকাসিনের ফিতেটা বাঁধতে কোরি একটু থামল; জেরিও তার জন্য অপেক্ষা করতে লাগল। আঁকাবাঁকা পথের মোড়ে বাকি দু’জন অদৃশ্য হয়ে গেল।

    উঠে দাঁড়িয়ে কোরি বলল, টারজান না থাকলে কেমন যেন অসহায় লাগে। তোমার লাগে না?….., না, তোমার, বুবোনোভিচ বা রসেটির উপরও আমার পুরো ভরসা আছে, তবু

    জেরি হেসে বলল, এতো কিন্তু কিন্তু, করার কিছু নেই। আমারও তাই মনে হয়। কি জান, এখানে আমাদের সকলের অবস্থাই ডাঙ্গায় মাছের মত। কিন্তু টারজনের বেলায় তা নয়। এখানেই তাকে ভাল মানায়। সে না থাকলে আমাদের কি হত।

    এই জঙ্গলে আমাদের অবস্থা হত মায়ের কোল ছাড়া ছোট শিশুর মত

    হঠাৎ কান খাড়া করে জেরি বলে উঠল, শুনতে পাচ্ছ! বিচিত্র ভাষায় কর্কশ চেঁচামেচি। জাপানী! সে চেঁচিয়ে বলল। সেই দিকে ছুটে যাবার উদ্যোগ করেও সে থেমে গেল। কোনদিক সে রক্ষা করবে? দুই সহকর্মীকে, না এই মেয়েটিকে? দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে সে সিদ্ধহস্ত। কোরির হাতটা চেপে ধরে তাকে টানতে টানতে পথের পাশের ঝোপঝাড়ের ভিতর দিয়ে জঙ্গলের দিকে ছুটতে লাগল। খানিকটা গিয়ে একটা ঝোপের নিচে এমনভাবে শুয়ে পড়ল যে তাদের খোঁজে কেউ এক ফুট দূর দিয়ে চলে গেলেও তাদের দু’জনকে দেখতে পাবে না।

    এক ডজন সৈনিক বুবোনোভিচ ও রসেটিকে আচমকা আক্রমণ করে বেঁধে ফেলল। আত্মরক্ষার কোন সুযোগই তারা পেল না। জাপানীরা তাদের চড়-চাপড় মারল, বেয়নেট দিয়ে খোঁচা দিল। এমন সময় লেঃ তাদা তাদের কাছে ডাকল। তাদা ইংরেজি ভাষা বলতে পারে। ও কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় ইউজেন-এর একটা হোটেলে কাপ-সিড ধোয়ার কাজ করত। দেখামাত্রই সে তাদের আমেরিকান। বলে চিনতে পারল। তার প্রশ্নের জবাবে প্রত্যেকেই নিজ নিজ নাম, পদবি ও ক্রমিক সংখ্যা জানিয়ে দিল।

    যে বিমানটিকে আমরা গুলি করে নামিয়েছি তোমরা সেটাতেই ছিলে? তাদা প্রশ্ন করল।

    যা কিছু বলা সম্ভব সবই বলেছি।

    জাপানী ভাষায় তাদা একটি সৈনিককে কি যেন বলল। লোকটি এগিয়ে গিয়ে বুবোনোভিচের পেটে বেয়নেটটা ঠেকাল। তাদা বলল, এবার আমার প্রশ্নের জবাব দেবে তো?

    রসেটি জবাব দিল, বলার তো কিছু নেই।

    তোমাদের দলে পাঁচজন ছিল-চারটি পুরুষ ও একটি মেয়ে। বাকি তিনজন কোথায়? মেয়েটিই বা কোথায়?

    আমাদের দলে ক’জন ছিল তা তো দেখতেই পাচ্ছ। আমাদের কি পাঁচজন বলে মনে হয়? না কি তুমি গুণতেই জান না? আমাদের দু’জনকে দেখে কি সুন্দরী বলে মনে হয়? না, দেখছি তোমার মাথাটি কেউ খেয়েছে তোজো।

    তাদা বলল, ও, কে। কাল সকাল পর্যন্ত ভাববার সময় দিলাম। কাল সকালে হয় আমার প্রশ্নের জবাব দেবে। আর না হয় তোমাদের দুজনেরই মাথা কাটা যাবে। তাদা কোমরে ঝোলানো অফিসারদের লম্বা তলোয়ারে হাত রাখল।

    দু’জনকে দলের অন্য লোকদের খোঁজে পাঠিয়ে বাকি সৈন্যদের নিয়ে তাদা বন্দীদ্বয়সহ আমাতের গ্রামের দিকে যাত্রা করল।

    জেরি ও কোরি ঝোপের নিচে শুয়ে সব কথাই শুনল। দলটা যেদিক থেকে এসেছিল সেই দিকেই তাদের চলে যাবার শব্দ তারা শুনতে পেল, কিন্তু দু’জনকে যে তাদের খোঁজেই পাঠানো হয়েছে সেটা জানতে পারল না। আর ধরা পড়ার ভয় নেই ভেবে ঝোপের নিচে থেকে বেরিয়ে এসে তারা আবার পথে। পা বাড়াল।

    চলতে চলতে এক সময় হঠাৎ কে যেন আসছে, বলে মেয়েটিকে টেনে নিয়ে জেরি আবার ঝোপের মধ্যে লুকিয়ে পড়ল।

    একটু পরেই দুটি জাপানী সৈন্য আলস্যভরে হাঁটতে হাঁটতে এগিয়ে এল। রাইফেল দুটো ঝুলছে। তাদের পিঠের উপর।

    জেরির আরও কাছে মাথাটা নিয়ে কোরি চুপি চুপি বলল, আমি বাঁদিককার লোকটিকে তাক করছি, তুমি অন্যটিকে নাও। জেরি মাথা নেড়ে ধনুক তুলল। বলল, ওদের বিশ ফুটের মধ্যে আসতে দাও। তারপর আমি এবার’ বলতেই দু’জন এক সঙ্গে তীর ছুঁড়ব।

    তারা অপেক্ষা করতে লাগল। আপন মনে বক্ করতে করতে জাপানীরা এগিয়ে এল।

    জাপানীরা মৃত্যু নিশানার মধ্যে এসে গেল। জেরি বলল, ‘এবার? শা করে দুটো তীর ছুটে গেল। লক্ষ্য ভেদ হল। কোরির তীরটা বিধল বুকে। জেরির তীরটা বিধল গলায়।

    জেরি এক লাফে পথে নামল। খোলা ছুরিটা দু দু’বার বসিয়ে দিল তার বুকে। লোকটা বার দুই হেঁচকি তুলেই নিথর হয়ে গেল।

    অপর জাপানীর দেহ থেকে কোরি তার রাইফেলটা খুলে নিল। পর পর তিনবার বেয়নেটটাকে ঢুকিয়ে দিল মৃতদেহের বুকে। জেরির দিকে তাকিয়ে বলল, আমি নিজের চোখে দেখেছি এইভাবে আমার বাবাকে ওরা খুন করেছিল। আজ আমি তৃপ্ত। আহা, আজ যদি বাবা বেঁচে থাকত!

    পথের উপরকার গাছ থেকে ঝুলতে ঝুলতে টারজান হঠাৎ থেমে গেল; জমাট বরফের মত নিশ্চল হয়ে গেল। তার ঠিক আগেই গাছের ডালের উপর লতাপাতা বিছানো মঞ্চের উপর বসে আছে একটি লোক। তার মুখময় ঘন দাড়ি-গোঁফ, সঙ্গে বিস্তর অস্ত্রশস্ত্র। লোকটি শ্বেতকায়। নিশ্চয়ই সে কোন শত্রুর গমনাগমনের উপর লক্ষ্য রেখেছে।

    পথ থেকে সরে গিয়ে টারজান একটা ঘুরপথে শাস্ত্রীটিকে এড়িয়ে পিছনের দিকে চলে গেল। সেখানে একটা ছোট পাহাড়ি উপত্যকার এক প্রান্তে দেখতে পেল একটা নোংরা, পুরোনো ছাউনি। জনা বিশেক লোক গাছের ছায়ায় শুয়ে আছে। একটা বোতল তাদের হাত থেকে হাতে, মুখে থেকে মুখে ঘুরছে। পুরুষদের সকলের সঙ্গেই আছে পিস্তল ও ছুরি; হাতের কাছেই একটা করে রাইফেল। দলটা সুবিধার নয়।

    টারজান স্থির করল, এদের সঙ্গ যত এড়ানো যায় ততই মঙ্গল। হঠাৎ যে ডালে সে বসেছিল সেটা ভেঙে পড়ল। টারজান শ’খানেক ফুট নিচে মাটিতে পড়ে গেল। মাথায় চোট লেগে সে জ্ঞান হারাল।

    জ্ঞান ফিরে এলে দেখল সে একটা গাছের নিচে শুয়ে আছে। হাত-পা বাঁধা। তাকে ঘিরে অনেক পুরুষ ও নারী বসে আছে, নয়তো দাঁড়িয়ে আছে। জ্ঞান ফিরে এসেছে বুঝতে পেরে তাদের একজন ওলন্দাজ ভাষায় কি যেন বলল। টারজান তার কথা বুঝল, কিন্তু না বোঝার ভান করে মাথা নাড়ল।

    আর একজন ফরাসী ভাষায় কথা বলল। টারজান এবারও মাথা নাড়ল। যুবকটি ইংরেজিতে কিছু বলল। টারজান এবারও না বোঝার ভান করল।

    তাকে নিয়ে আর বেশিক্ষণ মাথা না ঘামিয়ে লোকগুলো গাছতলার দিকে চলে গেল নতুন করে গলা ভেজাতে। রয়ে গেল শুধু একটি যুবক। সকলে বেশ কিছুটা দূরে চলে গেলে যুবকটি নিচু গলায় ইংরেজিতে বলল, তুমি আমাকে বিশ্বাস করতে পার। আমি নিজেও ওদের হাতে একজন বন্দী। একদল নরঘাতক ডাকাতের হাতে তুমি পড়েছ। দু’একজন ছাড়া তারা সকলেই জেল-ফেরৎ আসামী; জাপানীরা এ দ্বীপ আক্রমণ করার পরেই তাদের হাতে অস্ত্র তুলে দেয়া হয়েছে। দলের অধিকাংশ নারীও জেল-ফেরৎ আসামী। আর কিছু এসেছে সমাজে একেবারে নিচুতলা থেকে।

    কি জান, এই পাহাড়ে অনেক দেশভক্ত গোরিলাও আত্মগোপন করে আছে। তারা জাপানীদের মত এই দেশদ্রোহীদের পেলেও খুন করে ফেলবে। তাদের ভয়, আমি হয়তো গোরিলাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে তাদের ধরিয়ে দেব। আসল কথা হল, তারা আমাকেও জাপানীদের হাতে তুলে দেবে। তুমি যখন অজ্ঞান হয়ে ছিল তখনই অরা এটা স্থির করেছে। তোমাকে হাতে পেলে জাপানীরা ভাল দামই দেবে।

    টারজান ভাবল, তার ভাগ্য যখন স্থির হয়েই গেছে তখন আর এই যুবকটিকে মিথ্যে পরিচয় দিয়ে কি হবে।

    বলল, আমি একজন ইংরেজ।

    যুবকটি মুচকি হাসল। আমাকে বিশ্বাস করার জন্য ধন্যবাদ। আমার নাম টাক ভ্যান ড়ের বস। আমি একজন রিজার্ভ অফিসার।

    আমার নাম ক্লেটন। তুমি এই লোকগুলোর হাত থেকে পালাতে চাও?

    চাই। কিন্তু কোথায় যাব? সেই তো জাপানীদের হাতেই গিয়ে পড়ব, নয় তো বাঘের পেটে। আমাদের গোরিলাদের কোন খোঁজ যদি জানতাম তাহলে নিশ্চয় পালাবার ঝুঁকি নিতাম। কিন্তু আমি যে কিছুই জানি না।

    টারজান বলল, আমার দলে আছে পাঁচজন। আমরা চেষ্টা করছি এই দ্বীপের দক্ষিণ প্রান্তে পৌঁছতে। ভাগ্য প্রসন্ন হলে একটা জাহাজ ভাড়া করে একদিন অন্দ্রেলিয়ায় পৌঁছতে পারব।

    ভ্যান ডের বস কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থেকে মাথা তুলে বলল, আমিও আছি তোমাদের সঙ্গে। সাধ্যে যতটা কুলোয় তা আমি করব।

    যত্র-তত্র চড়-থাপ্পড়, পাছায় বেয়নেটের খোঁচা, গায়ে থুথু-সব কিছু সয়ে রাগে ফুলতে ফুলতে বসেটি ও বুবোনোভিচ এক সময় একটা আদিবাসী গ্রামে পৌঁছে গেল। সেখানে জনৈক আদিবাসীর বাড়িতে নিয়ে গিয়ে হাত-পা বেঁধে ঘরের কোণে দু’জনকে ঠেলে দিল।

    সারা রাত ঘুম হল না। হাত-পায়ের বাঁধন শরীরে কেটে বসে গেছে। গলা শুকিয়ে কাঠ। না খাদ্য, না পানীয়। রাতটা যেন অন্তহীন। তবু এক সময় রাত শেষ হল।

    ঘরে ঢুকল দুটি সৈনিক। হাত-পায়ের বাঁধন কেটে দু’জনকে টেনে তুলল। দুজনই টলতে টলতে মাটিতে পড়ে গেল। হো-হো করে হাসতে হাসতে সৈনিকরা তাদের টানতে টানতে মইয়ের মাথায় নিয়ে ছেড়ে দিল। গড়াতে গড়াতে দু’জন মাটিত পড়ে গেল।

    তাদা এসে তাদের পরীক্ষা করে শুধাল, আমার প্রশ্নের জবাব দিতে তোমরা রাজী?

    না, বুবোনোভিচ জবাব দিল।

    তাদের নিয়ে যাওয়া হল গ্রামের মাঝখানে। সৈনিক ও আদিবাসীরা তাদের ঘিরে দাঁড়াল। খোলা তলোয়ার হাতে তাদা এসে দাঁড়াল তাদের পাশে। তার হুকুমে দু’জনকে নতজানু করানো হল। তাদের মাথা দুটি এগিয়ে দেয়া হল। তাদার হাতের তলোয়ার ঝলসে উঠল।

    জেরি ও কোরি সঙ্গীদের জন্য অপেক্ষা করে করে শেষ পর্যন্ত তাদের খোঁজে পথে নামল।

    দু’জন পাশাপাশি হাঁটতে লাগল। মাঝে মাঝেই তাদের হাতে হাত ছুঁয়ে গেল। একবার কোরি কাদার মধ্যে পড়ে যাচ্ছিল, জেরি তাড়াতাড়ি তাকে জড়িয়ে ধরে ফেলল। তারপর ঘন অন্ধকারে দু’জন অনেক। কষ্টে এগোতে লাগল।

    সাবধানে এগিয়ে একটা ছোট উপত্যকার মুখে এসে তারা দাঁড়িয়ে পড়ল। শ’খানেক গজ দূরেই একটা ছোট গ্রাম। সেখানে আদিবাসী ও জাপানী সৈনিকদের দেখা যাচ্ছে।

    আমাদের ছেলে দুটো নিশ্চয় ওখানেই আছে, জেরি বলল।

    কোরি ফিস্ ফিস্ করে বলল, ওই তো তারা। হায় ঈশ্বর! লোকটা যে ওদের খুন করবে!

    তাদার হাতের তলোয়ার উদ্যত হতেই জেরির রাইফেল থেকে আগুন ছুটল; লেঃ কুমাজিরো তাদা ছিটকে পড়ল তাদেরই পায়ের কাছে এই মাত্রা যাদের মারতে সে তলোয়ার তুলেছিল। একটা জাপানী সৈনিক বন্দীদের দিকে ছুটে যেতেই কোরির গুলিতে তারও ভবলীলা সাঙ্গ হল। দু’জনের অবিরাম গুলিবর্ষণে একের পর এক সৈনিকরা ধরাশায়ী হল; গোটা গ্রাম আতংকে অভিভূত হয়ে পড়ল।

    প্রথম গুলির শব্দেই টারজান ছুটে এসে তাদের পাশে দাঁড়াল। এক মুহূর্ত পরে এসে যোগ দিল ভ্যান ডের বস। যোগ হল আর একটা রাইফেল ও পিস্তল। পিস্তলটা টারজনের হাতে। সকলেই দে ছুট।

    দু’জন বনের প্রান্তে ছোট দলটার কাছে যখন, পৌঁছে গেল ততক্ষণে গোলা-গুলি বন্ধ হয়ে গেছে। জাপানীরা হয় রণে ভঙ্গ দিয়েছে, নয়তো মরেছে। সাময়িকভাবে হলেও এখানকার দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের। অবসান ঘটেছে।

    খণ্ডযুদ্ধ নিয়ে এতক্ষণ সকলেই এত ব্যতিব্যস্ত ছিল যে কেউ কারও দিকে তাকাবার সময়ও পায়নি। এবার সকলেই পরস্পরকে দেখতে লাগল। কোরি ও টাক ভ্যান ডের বস পরস্পরের দিকে হা করে তাকিয়ে রইল। তারপরেই দুজন একসঙ্গে চেঁচিয়ে উঠল ও কোরি! টাক!

    ওলন্দাজ যুবকটিকে জড়িয়ে ধরে কোরি বলে উঠল, প্রিয়তম!

    আদিবাসীদের কাছ থেকে টারজান গোরিলাদের সম্পর্কে বেশি কিছু জানতে পারেনি। তারা কেবল বলেছে, দক্ষিণ-পূর্ব দিকে প্রায় পঁয়ষট্টি কিলোমিটার দূরে একটা আগ্নেয়গিরির পাশে তাদের একটা দল আছে। মাত্র সেইটুকু তথ্য সম্বল করেই টারজান গোরিলাদের খোঁজে বেরিয়েছে।

    হাঁটতে হাঁটতে এক সময় একটা ছোট খাদের মধ্যে তাঁবু দেখতে পেল। একটি শাস্ত্রী খাদের ঠিক মুখেই দাঁড়িয়ে আছে। একজন দাড়িওয়ালা ওলন্দাজ। টারজান পঁচিশ-ত্রিশ গজের মধ্যে পৌঁছলে তাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, তুমি কে? এখানে কেন এসেছ?

    আমি একজন ইংরেজ। তোমাদের সর্দারের সঙ্গে কথা বলতে চাই।

    টারজানকে ভাল করে দেখে নিয়ে লোকটির নিচের দিকে তাকিয়ে হাঁক দিল, ডি লেটেনহোভ! একটি বুনো মানুষ তাৈমার সঙ্গে কথা বলতে চায়।

    ইতোমধ্যে তিনটি লোক উপরে উঠে এল। সকলেই সশস্ত্র। মুখময় দাড়ি; দেখতে শক্ত-সমর্থ। জোড়াতালি মারা শতচ্ছিন্ন পোশাক; কিছুটা বেসামরিক, কিছুটা সামরিক, আবার কিছুটা পশুর চামড়া দিয়ে তেরি। একজনের জামার কাঁধের উপর ফার্স্ট লেফটেন্যান্টের প্রতীক দুটো তারা বসানো। সেই ডি লেটেনহোভ।

    টারজনের দিকে ফিরে ডি লেটেনহোভ ইংরেজিতে শুধাল, তুমি কে? এখানে কি করছ?

    আমার নাম ক্লেটন। আর-এ-এফ-এর একজন কর্নেল। আমি জানতে পেরেছি, একদল ওলন্দাজ গোরিলা এখানে আস্তানা গেড়েছে। তাদের সি,ও-র সঙ্গে কথা বলতেই আমি এখানে এসেছি।

    ক্যাপ্টেন ভ্যান প্রিন্স আমাদের দলপতি। আজ সে এখানে নেই। আশা করছি কালই এসে পড়বে। তাকে তোমার কি দরকার?

    এমন কিছু লোকের সঙ্গে আমি যোগাযোগ করতে চাই যারা আমাকে জাপানী ঘাঁটির অবস্থান এবং বন্ধু স্থানীয় আদিবাসীদের খবর দিতে পারবে। আমি চেষ্টা করছি, কোন রকমে উপকূলে পৌঁছে একটা জাহাজ যোগাড় করে এ দ্বীপ থেকে পালাব।

    ডি লেটেনহোভ। টারজানকে নিয়ে নিচের তাঁবুতে গেল। শিবিরটা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ও সুরক্ষিত। সামরিক কায়দায় নির্মিত একসারি খড়ড়া ঘর। একটা ঘরের সামনে উড়ছে নেদারল্যান্ডের লাল-সাদা-নীল পতাকা। বিশ-ত্রিশটি লোক নানা কাজে ব্যস্ত; অধিকাংশই রাইফেল ও পিস্তল পরিষ্কার করছে। তাদের পরনে শতচ্ছিন্ন নোংরা পোশাক, কিন্তু অস্ত্রশস্ত্রগুলো ঝকঝক করছে। টারজান বুঝল, এটা একটা সুপরিচালিত সামরিক শিবির। এদের বিশ্বাস করা চলে।

    টারজান ঢুকতে সকলেই কাজ থামিয়ে তাকে দেখতে লাগল। কেউ কেউ তার সঙ্গের লোকদের নানা রকম প্রশ্ন করতে লাগল।

    টারজান লেটেনহেভের দিকে ফিরে বলল, নিজেকে সনাক্ত করার মত কোন প্রমাণ আমার সঙ্গে নেই; কিন্তু আমার এমন সব বন্ধু আছে যারা আমাকে সনাক্ত করতে পারবে-তিনজন আমেরিকান ও দু’জন ওলন্দাজ বন্ধু। শেষের দু’জনকে তুমি হয়তো চেন।

    কোরি ভ্যান ডের মিয়ার এবং টাক ভ্যান ডের বস। তাদের তুমি চেন?

    খুব ভাল চিনি; কিন্তু তারা তো মারা গেছে।

    গতকাল পর্যন্তও তারা মরে নি, টারজান বলল।

    ডি লেটেনহোভ বলল, তার আগে বল তুমি সুমাত্রায় এলে কেমন করে? আর আমেরিকানরাই বা এখানে কি করছে? আমাদের এই ডেরার খবরই বা তুমি জানলে কেমন করে?

    টারজান বলল, যে বোমারু বিমানটাকে গুলি করে নামানো হয়েছে আমিও সেটাতে ছিলাম। যে তিনজন জীবিত আমেরিকানের কথা বলেছি তারাও সেই বিমানে ছিল। গতকাল একটা গ্রামে গিয়ে তোমাদের এই শিবিরের একটা মোটামুটি ধারণা আমি পাই।

    ডি লেটেনহোভ হাতটা বাড়িয়ে দিয়ে বলল, এবার তোমাকে বিশ্বাস করলাম। কিন্তু একটা কথা জানতে বড়ই ইচ্ছা করছে; সত্যিকারের টারজনের মতই তুমি এরকম প্রায় নগ্নদেহে থাক কেন?

    কারণ আমি সত্যি টারজান। তোমরা কেউ কেউ হয় তো জান যে টারজান একজন ইংরেজ, আর তার নাম ক্লেটন। আমি তো সেই নামটাই তোমাদের বলেছি।

    একজন চেঁচিয়ে বলল, ঠিক কথা। জন ক্লেটন, লর্ড গ্রেস্টোক।

    আর একজন বলে উঠল, ওর কপালে ওই তো সেই কাটা দাগ; ছোটবেলায় এক গোরিলার সঙ্গে যুদ্ধে ওখানটা কেটে গিয়েছিল।

    সকলে টারজানকে ঘিরে ধরল। প্রশ্নের পর প্রশ্ন করতে লাগল।

    পরদিন সকালে প্রাতরাশের সময় ভ্যান প্রিন্স বলল, কিছু আগাম খবর পাবার ব্যবস্থা করতে হবে, অন্যথায় হয়তো আমরাই অতর্কিত আক্রমণের শিকার হয়ে পড়ব।

    টারজান বলল, আমি তোমাকে আগাম সংবাদ এনে দেব। চার-পাঁচ মাইল এগিয়ে গিয়ে আমি লুকিয়ে থাকব। জাপানীদের দেখতে পেলেই তারা এখানে আসার অনেক আগে তোমাকে সে খবর পৌঁছে দেব।

    কিন্তু তারা যদি তোমাকে দেখতে পায়?

    দেখতে পাবে না।

    টারজান এক লাফে গাছে উঠে অদৃশ্য হয়ে গেল।

    ওলন্দাজটি মাথা নেড়ে বলল, ওর মত একদল সৈন্য হাতে পেলে জাপানীদের আমি এ দ্বীপ থেকেই তাড়িয়ে দিতে পারতাম।

    জেরি, বুবোনোভিচ ও রসেটি গোরিলাদের আগেই অস্ত্রশস্ত্র ও হাত-বোমা নিয়ে নতুন পথে আত্মগোপন করল। ডালপালা ও দ্রাক্ষালতা দিয়ে ঘাড় ও মাথা ঢেকে তারা যেন জঙ্গলেরই একটা অংশ হয়ে গেল। মূল পথ ও তাদের মধ্যে যদি কয়েক ফুট ঝোপঝাড়ের ব্যবধান না থাকত তাহলে জাপানীরা

    এগিয়ে আসতে আসতে তাদের একেবারে ঘাড়ের উপর পা দেবার আগে কিছুই বুঝতে পারত না।

    অচিরেই গোরিলারাও পৌঁছে গেল এবং আত্মগোপনের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ল।

    এই সময় টারজান ফিরে এসে ভ্যান প্রিন্সকে বলল, তোমার বেঁটে বাদামী ভাইরা আসছে। এখন তারা মাইল দুয়েক দূরে, দেখে মনে হল দুটো বড় কোম্পানি। সঙ্গে হাল্কা মেশিন-গান ও ছোট কামান আছে। সেনাপতি একজন কর্নেল।

    ভ্যান প্রিন্স বলল, তোমাকে ধন্যবাদ জানাবার ভাষা নেই। সঙ্গীদের দিকে ফিরে বলল, আর কোন কথা নয়। পঁয়ত্রিশ-চল্লিশ মিনিটের মধ্যেই শত্রুরা এসে পড়বে। পরে টারজনের দিকে ফিরে বলল, একটা কথা স্যার; ওরা আসলে বাদামী নয়। ও শালারা হলদে পাখি।

    গ্রামে যে সব গোরিলাদের রেখে যাওয়া হয়েছে তাদের দলপতি গ্রোয়েন ডি লেটেনহোভ। সে কোরিকে কোন নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যেতে বলল। কিন্তু কোরি বাধা দিয়ে বলল, প্রতিটি রাইফেলই তোমার দরকার সেনাপতি। তাছাড়া, জাপানীদের সঙ্গে আমার বোঝাপড়াটা এখনও বাকি আছে।

    কিন্তু কোরি, তোমার আঘাত লাগতে পারে, মৃত্যুও ঘটতে পারে।

    সে তো তোমার বা তোমার সৈন্যদের বেলায়ও ঘটতে পারে। তাহলে তো আমাদের সকলেরই লুকিয়ে পড়া উচিত।

    তোমাকে নিয়ে পারা যায় না! আমারই ভুল হয়েছে। মেয়ে মানুষের সঙ্গে তর্ক করাই বৃথা।

    আমাকে মেয়ে মানুষ ভেবো না। আমি একটি জীবন্ত রাইফেল। আর আমার নিশানাও অব্যর্থ।

    বনের দিক থেকে একটা রাইফেলের শব্দ আসায় তাদের কথায় বাধা পড়ল।

    জেরি দেখল, মূল সেনাদল এগিয়ে আসছে। সকলের সামনে উদ্যত সামুরাই তরবারি হাতে কর্নেল স্বয়ং। বাকি পথটা প্রথম কোম্পানির সৈন্যে আগাগোড়া ঠাসা। তখনই গর্জে উঠল ভ্যান প্রিন্স-এর রাইফেল। সঙ্গে সঙ্গে ঝাঁকে ঝাঁকে গুলি এসে পড়তে লাগল বিস্মিত সৈন্যদের উপর। জেরি পর পর তিনটে হাত-বোমা ছুঁড়ল দ্বিতীয় কোম্পানিকে লক্ষ্য করে।

    জাপানীরা এলোপাতাড়ি গুলি চালাতে লাগল জঙ্গলের দিকে। যারা গুলি খেল তারা সারি ভেঙে পালাতে লাগল।

    যারা পাগলের মত দিগ্বিদিক জ্ঞান হারিয়ে ছুটে পালাল তাদের মধ্যে ছিল কর্নেল। তাকে পালাতে দেখে। রসেটি চেঁচিয়ে বলল, এবার আর পার পাবি না হলদে ভূড়ি। তার পিস্তলের গুলি কর্নেলকে বিদ্ধ করল।

    সম্পূর্ণ বিশৃঙ্খল অবস্থায় বাকি জাপানীরা জঙ্গলের মধ্যে পালিয়ে গেল। মৃত ও আহতরা সেখানেই পড়ে রইল। ভ্যান প্রিন্স কয়েকজন গোরিলাকে পশ্চাৎ-রক্ষী হিসেবে মোতায়েন করল, কয়েকজনকে লাগাল শত্রুপক্ষের অস্ত্র ও গুলি-গোলা হাতাবার কাজে, আর বাকিদের লাগালে উভয় পক্ষের আহতদের গ্রামে নিয়ে যাবার কাজে।

    জাপানীদের অস্ত্রশস্ত্রগুলো সংগ্রহ করতে করতেই রসেটি ও বুবোনোভিচ হঠাৎ খেয়াল হল, জেরি কোথাও নেই। ছুটে ঝোপের ভিতরে গিয়ে দেখল, রক্তাপুত দেহে জেরি চিৎ হয়ে পড়ে আছে। দু’জনই তার পাশে নতজানু হয়ে বসল।

    রসেটি বলল, মরে নি; এখনও নিঃশ্বাস পড়ছে।

    বুবোনোভিচ বলল, ওকে মরতে দেয়া হবে না।

    সযত্নে তাকে তুলে নিয়ে দু’জন গ্রামের দিকে চলল। ওলন্দাজরা তাদের তিনজন মৃত ও পাঁচজন আহতকে বয়ে নিয়ে চলল।

    নিহত ও আহতদের নিয়ে তারা গ্রামে ঢুকল। সেখানকার গোরিলারা তাদের ঘিরে দাঁড়াল। নিহতদের দেহ ঢেকে দেয়া হল, আর আহতদের শুইয়ে দেয়া হল গাছের ছায়ায়। গোরিলাদের মধ্যে একজন ছিল ডাক্তার। কিন্তু তার কাছে না আছে ওধুষ, না আছে অ্যানেস্থেটিক। তবু সে যথাসাধ্য চেষ্টা করতে লাগল। কোরি তাকে সাহায্য করল।

    বুবোনোভিচ ও রসেটি জেরির পাশেই বসে ছিল। কোরিকে নিয়ে ডাক্তার সেখানে এল।

    ডাক্তার পরীক্ষা করতে বসল।

    কোরি শুধাল, অবস্থা কি খুবই খারাপ?

    সে রকম মনে হচ্ছে না। গুলি হৃৎপিণ্ডে লাগেনি। ফুসফুসটাও বেঁচে গেছে। শিগগিরই ভাল হয়ে উঠবে। এস তো, ওকে একটু উপুড় করে শুইয়ে দি।

    গরম জল দিয়ে ঘাটা ধুইয়ে দিয়ে হাল্কা করে ব্যান্ডেজ বেঁধে দিয়ে ডাক্তার বলল, একজন ওর কাছে থাক। জ্ঞান ফিরলে চুপচাপ থাকতে বলল।

    কোরি বলল, আমি আছি।

    ইতোমধ্যে দীর্ঘশ্বাস ফেলে জেরি চোখ মেলল। বারকয়েক চোখ পিটপিট করল; যেন কিছুই বিশ্বাস করতে পারছে না। জেরির মুখে হাসি ফুটল; হাত বাড়িয়ে সে কোরির হাতটা চেপে ধরল।

    কোরি বলল, এবার তুমি ভাল হয়ে যাবে জেরি।

    জেরি বলল, আমি তো ভাল হয়েই গেছি।

    দু’জন দু’জনের দিকে তাকাল। পৃথিবীটা কী সুন্দর!

    ক্যাপ্টেন ভ্যান প্রিন্স আহতদের জন্য ডুলি বানাবার কাজে ব্যস্ত ছিল। সে এসে জেরিকে শুধাল, কেমন আছ?

    খুব ভাল।

    যাত্রার সময় হল। জেরি কিছুতেই ডুলিতে উঠবে না; সে হেঁটেই যেতে পারবে। শেষে ডাক্তারের ধমক খেয়ে ভুলিতে চাপল।

    চারদিকে চোখ বুলিয়ে ভ্যান প্রিন্স বলল, টারজান কোথায়?

    বুবোনোভিচ বলল, ঠিকই তো। কোথায় সে?

    রসেটি বলল, গীজ, লড়াইয়ের পরে সে তো গ্রামেই ফেরেনি। কিন্তু সে তো আহতও হয়নি।

    বুবোনোভিচ বলল, তার জন্য মাথা ঘামাতে হবে না। নিজের ও অন্য সকলের জন্য ঘামাবার মত মাথা তার আছে।

    ভ্যান প্রিন্স বলল, ঠিক আছে আমাদের যাত্রা শুরু হোক।

    উপত্যকার একেবারে মাথায় একটা চুনা পাথরের পাহাড়ের নিচে অবিরাম উৎসারিত হচ্ছে একটা ঝর্ণার জলধারা। সেখানেই অনেকগুলো গুহাও আছে। ভ্যান প্রিন্স স্থির করেছে সেখানেই একটা মোটামুটি স্থায়ী ঘাঁটি তৈরি করে ম্যাক আর্থারের অধীনে মিত্রশক্তির আগমনের প্রতীক্ষায় থাকবে; আমেরিকানদের কাছেই সে সর্বপ্রথম জেনেছে ম্যাক আর্থার ক্রমশই এগিয়ে আসছে।

    যে ছোট দলটা অস্ট্রেলিয়া পৌঁছতে ইচ্ছুক তাদের মধ্যে আমেরিকান, ওলন্দাজ, ইংরেজ ও ইউরেশিয়ান থাকায় গোরিলারা তাদের নাম দিয়েছে বিদেশী সেনাদল। নামটাকে আরও সার্থক করে তুলতে জেরি আরও জানিয়েছে যে বুবোনোভিচ একজন রুশ, রসেটি ইতালীয়। আর সে নিজে আধা ভারতীয়।

    কোরি বলল, বেচারি বুড়ো সিং যদি আমাদের সঙ্গে থাকত তাহলে মিত্রশক্তির চার প্রধান দেশের প্রতিনিধিই সেনাদলে থাকত।

    শিবিরের ঠিক মাথার উপরে একটা পাহাড়ের চূড়ায় একটি শান্ত্রীকে মোতায়েন রাখা হয়েছে। সেখান থেকে উপত্যকার বহুদূর পর্যন্ত নজর রাখা যায়। ফলে দূর থেকে কাউকে আসতে দেখে সংকেত করা। মাত্রই সকলে গুহা থেকে বেরিয়ে এসে তাকে তাড়া করতে পারে।

    এই শিবিরে এসে বিদেশী সেনাদলটি বেশ নিরাপদ বোধ করছে। বেশ আরামের সঙ্গে তারা দিন কাটাতে লাগল।

    টারজান প্রায়ই সুলুক-সন্ধান জানতে বেরিয়ে পড়ে। কখনও বা শিকারে যায়। তার কৃপাতেই শিবিরের লোকদের মুখে তাজা মাংস জুটছে।

    তিয়াং উমরের গ্রামে সিং তাইকে লুকিয়ে রেখে আসার পর থেকেই কোরি তাকে নিয়ে অনেক ভাবে; তার কি হয়েছে জানতে চায়। তাই টারজান স্থির করল, গোরিলাদের শিবিরে ফিরে যাবার আগে একবার গ্রামটাকে দেখে যাবে। ফলে তাকে অনেকটা পথ ঘুরে যেতে হবে; কিন্তু সময় বা দূরত্ব টারজনের কাছে কোন ব্যাপারই নয়; যখন যে কাজ সে করতে চায়, সময় অথবা দূরত্বের হিসেব না করতেই তা করে।

    ধীরে ধীরে হাঁটতে লাগল। পথে একটা হরিণ মেরে খেয়ে রাতটা ঘুমিয়ে কাটাল। তিয়াং উমরের গ্রামের কাছে যখন পৌঁছল তখন অনেকটা বেলা হয়েছে। বন্য প্রাণীর স্বাভাবিক সতর্কতা ও সন্দেহের বশে টারজান গাছে চড়ে নিঃশব্দে এগোতে লাগল। আদিবাসীরা দৈনন্দিন কাজকর্মে ব্যস্ত।

    তাকে চিনতে পেরে গ্রামবাসীরা সাদর অভ্যর্থনা জানিয়ে নানারকম প্রশ্ন করতে লাগল। কিন্তু টারজান তাদের কথা বুঝতে না পেরে সিংতাইয়ের খবর জানতে চাইল।

    তাকে বলা হল, সে এখনও গ্রামেই আছে, তবে দিনের বেলা বাইরে আসতে সাহস পায় না। কারণ জাপানী স্কাউটরা অতর্কিতে গ্রামে ঢুকে পড়ে।

    টারজানকে সিংতাই এর কাছে নিয়ে যাওয়া হল। তার আঘাত সম্পূর্ণ সেরে গেছে; বেশ সুস্থ হয়ে উঠেছে। কোরি ভাল আছে জেনে খুশিতে তার মুখটা ঝলমলিয়ে উঠল।

    টারজান বলল, সিংতাই তুমি কি এখানে থাকতে চাও, না আমাদের সঙ্গে যেতে চাও? আমরা এই দ্বীপ থেকে পালাবার চেষ্টা করছি।

    আমিও তোমাদের সঙ্গে যাব, সিংতাই জবাব দিল।

    বেশ ভাল কথা, টারজান বলল। আমরা এখনই রওনা হব।

    বিদেশী সেনাদল ক্রমেই অস্থির হয়ে উঠেছে। জেরি সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে উঠেছে, গায়ে জোর পাচ্ছে, সেও এখান থেকে চলে যেতে চাইছে। এখন অপেক্ষা কেবল টারজনের।

    পাহাড়ের চূড়া থেকে শান্ত্রী হাঁক দিল, দুটি লোক আসছে। এখনও ঠিক চিনতে পারছে না। কেমন যেন অদ্ভুত মনে হচ্ছে।

    কয়েক মিনিট পরে আবার হাঁক দিলঃ প্রত্যেকের কাঁধে একটা করে বোঝা। একজন উলফঙ্গ।

    নির্ঘাৎ টারজান, জেরি বলল।

    সত্যি টারজান। সঙ্গে সিংতাই। শিবিরে পৌঁছে দু’জনইে কাঁধ থেকে একটা করে হরিণ মাটিতে রাখল। সুস্থদেহে সিংতাইকে দেখে কোরির সুখের সীমা নেই। আর টারজানকে পেয়ে জেরি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। বলল, তুমি এসে পড়েছ, ভালই হয়েছে। আমরা যাবার জন্য প্রস্তুত, কেবল তোমার জন্যই অপেক্ষা করে আছি।

    টারজান বলল, যাবার আগে আর একটা কাজ করার আছে। উপত্যকার ভঁটিতে হুটের দলের আস্তানা দেখে এসেছি। জাপানীরা এখনও সেখানে আছে। সেখানে কাঁটাতারের বেড়ার মধ্যে দুটি বন্দীকে দেখে এসেছি। তাদের আমি চিনতে পারিনি, কিন্তু এখানে আসতে আসতে সিংতাই বলেছে, কয়েকদিন আগে দুটি আমেরিকান বন্দীকে সঙ্গে নিয়ে জাপানীরা গ্রামে এসেছিল। তারা নাকি গ্রামবাসীদের বলেছেন, কিছুদিন আগে যে বিমানটিকে তারা গুলি করে নামিয়েছিল ওরা সেই বিমানের যাত্রী।

    ডগলাস আর ডেভিস। বুবোনোভিচ চেঁচিয়ে বলল।

    ঠিক। জেরি মাথা নাড়ল। একমাত্র ঐ দু’জনেরই খোঁজ পাওয়া যায়নি।

    বুলেটের বেল্টটা বেঁধে রাইফেলটা হাতে নিয়ে বুবোনোভিচ বলল, চল ক্যাপ্টেন।

    সূর্যের দিকে তাকিযে টারজান বলল, দ্রুত ছুটতে পারলে অন্ধকার হবার আগেই কাজ ফতে করা যাবে। কিন্তু একমাত্র তাদেরই সঙ্গে নিতে হবে যারা দ্রুত হাঁটতে পারে।

    কতজন চাই? ভ্যান প্রিন্স প্রশ্ন করল।

    বিশজনই যথেষ্ট। সব কিছু ঠিকমত চললে এ কাজ আমি একাই করতে পারি।

    ভ্যান প্রিন্স বলল, যথেষ্ট লোকজন নিয়ে আমি নিজেই যাব তোমার সঙ্গে।

    বিদেশী সেনাদলের সকলেই যাবার জন্য প্রস্তুত। কিন্তু টারজান কোরি ও সারিনাকে নিষেধ করল। তারা তর্ক করল, কিন্তু টারজান কোন কথা শুনল না।

    ডাক্তার রেড বলল, আরও একজনের যাওয়া উচিৎ হবে না। ক্যাপ্টেন লুকাস অসুস্থ মানুষ। এত দীর্ঘ পথ ছুটাছুটি করলে আসন্ন দক্ষিণ অভিযানে যোগ দেবার মত শরীরের অবস্থা তার থাকবে না।

    জেরি সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে টারজনের দিকে তাকাল। টারজান বলল, আমারও ইচ্ছা এ নিয়ে তুমি পীড়া পীড়ি করেনা জেরি।

    দশ মিনিট পরে বিশজনের দলটি দ্রুত পায়ে উপত্যকার পথে হাঁটতে শুর করল। সকলের আগে টারজান ও ভ্যান প্রিন্স।

    ক্যাপ্টেন তোকুজো মাৎসুয়ো লেফটেন্যান্ট হাইদিও সোকাবে সারা রাত মদ গিলেছে-মদ গিলেছে আর ঝগড়া করেছে। সৈনিকরাও কম যায়নি। মাতাল সৈনিকদের পাশবিক অত্যাচারের হাত থেকে বাঁচাতে গ্রামের লোকেরা মেয়েছেলেদের নিয়ে জঙ্গলে পালিয়েছে। সুতরাং জনশূন্য গ্রামে মাতাল জাপানীদের পরাস্ত করে দুই বন্দী মার্কিন ডগলাস ও ডেভিসকে উদ্ধার করতে টারজান ও ভ্যান প্রিন্সের বিশেষ কোন অসুবিধা হল না।

    দু’দিন পরে।

    এখন দশজনে গড়া বিদেশী বাহিনী গোরিলাদের বিদায়-সম্ভাষণ জানিয়ে এক অজানা গন্তব্যের পথে পা বাড়াল। ডগলাস ও ডেভিস সকলেই ছোট দলটার সঙ্গে মানিয়ে নিল। ডগলাস এটার নাম দিল। ‘জাতিসংঘ।

    যাত্রাপথ নির্মম, নিষ্ঠুর। হাতের ছুরি দিয়ে ভয়ংকর গভীর জঙ্গলকে কেটে কেটে পথ করে অগ্রসর হতে হচ্ছে। গভীর খাদ আর পাহাড়ি ঝর্ণা বার বার বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। অনেক সময় পাহাড়ের দেওয়াল শত শত মাইল খাড়া; না আছে ধরার কিছু, না আছে পা রাখার জায়গা; অগত্যা অনেক পথ ঘুরে যেতে হচ্ছে। বৃষ্টি তো লেগেই আছে- একেবারে ধারাসারে প্রচণ্ড বর্ষণ। কি পথচলা কি ঘুম, দুই কাজই করতে হচ্ছে ভিজে জামা-কাপড়ে। পায়ের জুতো ও স্যান্ডেল ছিঁড়ে আসছে।

    ভ্যান প্রিন্স যে মানচিত্রটা এঁকে দিয়েছিল, জেরি, বুবোনোভিচ, রসেটি সেটাই মনোযোগ দিয়ে দেখছে।

    জেরি বলল, এখানে আমরা পাহাড়টা পার হয়ে পূর্ব দিকে এসে পড়েছি- আলাহান্ পান্তজাং এর ঠিক নিচে।

    রসেটি বলল, এদিকে দেখ; এই যেখানে আবার আমরা পাহাড়টা পার হব সেটা নাকি ১৭০ কিলো মিটার। যুক্তরাষ্ট্রের হিসেবে কত হয়?

    তা-একশ’ পাঁচ-ছয় মাইল। ওটা বিমান পথের একটা ঘাঁটি।

    আমরা গড়ে দৈনিক কতটা চলেছি? বুবোননাভিচ শুধাল।

    পাঁচ মাইলও হয় কি না সন্দেহ।

    রসেটি বলে উঠল, গীজ! ‘লাভলি লেডি’ হলে কুড়ি-পঁচিশ মিনিটেই আমাদের ওখানে পৌঁছে দিত। আর যেভাবে আমরা চলেছি তাতে তো এক মাস লেগে যাবে। ৬৮৫

    বেশিও হতে পারে, জেরি যোগ করল।

    বুবোনোভিচ বলল, যাই বল দৃশ্যটা কিন্তু চমৎকার। সুপ খেতে খেতে নিচে তাকালে কী সুন্দর যে দেখাচ্ছে।

    রসেটি সায় দিয়ে বলল, তা ঠিক। দেখে তো মনেই হয় না যে এমন সুন্দর একটা দেশে যুদ্ধবিগ্রহ থাকতে পারে।

    টাক ভ্যান ডে বস বলল, অথচ গত একশ’ বছরের আগে এ দেশে কেবল যুদ্ধ-বিগ্রহই চলত। ইতিহাসের আদি থেকে, হয় তো বা প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকেই গোটা পূর্ব ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জকে চষে বেড়িয়েছে একের পর এক যত যুদ্ধবাজের দল-উপস্থিত-প্রধানরা, ছোট প্রিন্সরা, ছোট রাজারা, আর সুলতানরা। ভারতবর্ষ থেকে এসেছে হিন্দুরা, এসেছে চীনারা, পর্তুগিজরা আর স্পেনিয়ার্ডরা, এসেছে। ইংরেজ ও ওলন্দাজরা, আর এখন এসেছে জাপানীরা। তারা নিয়ে এসেছে নৌবহর, সেনাদল, আর যুদ্ধ। ত্রয়োদশ শতাব্দীতে কুবল খানের রাজদূতকে গ্রেফতার ও মুখমণ্ডল বিকৃত করে চীনে ফেরৎ পাঠানোর অপরাধে জাভর রাজাকে শাস্তি দিতে মহান খান সাহেব এ দেশে পাঠিয়েছিল ২০০০০০ সৈন্যসহ এক হাজার জাহাজের এক নৌবহর।

    ওলন্দাজদের বিরুদ্ধে প্রায়ই অভিযোগ শোনা যায় যে, আমরা নাকি ইন্দোনেশীয়দের উপর নিষ্ঠুর অত্যাচার করি। কিন্তু তাদের নিজের দেশের সুলতানরা যে রকম চরম নিষ্ঠুরতার সঙ্গে দেশটাকে ধ্বংস করেছে, দেশের লোকজনদের ক্রীতদাস করে রেখেছে, হত্যা করেছে, সে রকমটা আমরা তো করিই নি, আমাদের আগে যারা এ দেশে এসেছে তারাও করেনি। এই সব পানাসক্ত, ইন্দ্রিয়সর্বস্ব জীবগুলো শুধুমাত্র নিজেদের খেয়াল মেটাতে নিজের প্রজাদেরই খুন করেছে। সুন্দরী নারী ও কুমারীদের নিয়ে গেছে। তাদের একজনের হারেমে নাকি ছিল চৌদ্দ হাজার মেয়ে।

    গীজ! রসেটি সবিস্ময়ে শব্দটা উচ্চারণ করল।

    টাক মুচকি হেসে আবার বলতে শুরু করল। ক্ষমতায় থাকলে আজও তারা তাই করত। আমাদের হাতে আসার পরেই ইন্দোনেশীয়রা পেয়েছে ক্রীতদাসত্বের কবল থেকে মুক্তির স্বাদ পেয়েছে প্রথম শান্তি, প্রথম সমৃদ্ধি। জাপানীদের এ দেশ থেকে তাড়াবার পরে তাদের স্বাধীনতা দিয়ে দেখো, এক প্রজন্মের মধ্যেই তারা যেখানে ছিল আবার সেখানেই ফিরে যাবে।

    কিন্তু সব মানুষেরই কি স্বাধীনতার অধিকার নেই? বুবোনোভিচ প্রশ্ন করল।

    স্বাধীনতার অধিকার যারা অর্জন করে ওটা তাদের প্রাপ্য। খিস্টপূর্ব ২৩ শতাব্দীতে হান বংশের চীনা সম্রাট ওয়াং মাং-এর রাজত্বকালেই আমরা সুমাত্রার কথা প্রথম জানতে পারি। ইন্দোনেশীয় সভ্যতা তখন বেশ প্রাচীন। সেই প্রাচীন সভ্যতা এবং ওলন্দাজ শক্তি কর্তৃক এই দ্বীপটি পুরোপুরি দখলের আপেকার প্রায় দু’হাজার বছরের পরিপ্রেক্ষিতেও যদি দেখা যায় যে এ দেশের মানুষ তখনও অত্যাচারী শাসকদের হাতে ক্রীতদাস হয়েই আছে, তাহলে বলতেই হবে যে স্বাধীনতা লাভের উপযুক্ত তারা তো সর্ব রকমে স্বাধীন। আর কি তারা চায়?

    বুবোনোভিচ মুচকি হেসে বলল, সহজ কথায় বলে রাখি, আমি কিন্তু কম্যুনিস্ট নই। আমার কথা হলঃ যে লক্ষ্য সম্মুখে রেখে আমরা এই যুদ্ধ করছি, মানুষের মুক্তি তার অন্যতম।

    জেরি বলল, বাজে কথা। আমরা কেউ জানি না কেন আমরা যুদ্ধ করছি। শুধু জানি, জাপানীদের মারতে হবে, যুদ্ধটা শেষ করতে হবে, এবং তারপর বাড়ি ফিরতে হবে। তারপর? তারপর হয় তো, ধুরন্ধর রাজনীতিকরা আবার একটা তালগোল পাকিয়ে বসবে।

    আর অসিধারীরা তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের পায়তাড়া কসতে থাকবে, ভ্যান ডের বস বলল।

    তারপর সব চুপচাপ। কারও মুখে কথা নেই।

    গোরিলাদের শিবির ছেড়ে আসার পরে এক মাস কেটে গেছে। অনেক দুঃখ-কষ্ট সইলেও বিদেশী বাহিনী কোন বড় রকমের বিপদে পড়ে নি; নিজেদের মুখ ছাড়া অন্য কোন মানুষের মুখও দেখে নি। তারপরেই নীল আকাশ থেকে বজ্র নেমে এল। টারজান জাপানীদের হাতে বন্দী হল।

    আগাগোড়াই টারজান গাছের উপর দিয়ে সকলের আগে আগেই চলেছে। হঠাৎ একটা জাপানী সেনাদলকে দেখতে পেল। পথের উপর বসে তারা বিশ্রাম করছে। দলে কতজন আছে জানবার জন্য টারজান আরও নিচে নেমে এল।

    টারজনের সব মনোযোগ জাপানীদের উপর নিবদ্ধ। মাথার ঠিক উপরে যে সমূহ বিপদ ঝুলছে সেদিকে তার খেয়ালই নেই। একটা প্রকাণ্ড ময়াল সাপ পাকে পাকে তার শরীরটাকে জড়িয়ে ধরল। সঙ্গে সঙ্গে তার হাতের ছুরি ঝলসে উঠল। আহত সাপটা বেদনায় ও ক্রোধে ছটফট করতে লাগল। যে ডাল ধরে সাপটা ঝুলছিল সেটাকে ছেড়ে দিল। দু’জনেই হুড়মুড় করে এসে পড়ল পথের উপরে জাপানীদের পায়ের কাছে।

    জাপানীদের বেয়নেট ও তরবারির আঘাতে সাপটা পঞ্চত্ব প্রাপ্ত হল। তখন টারজান তাদের হাতের মুঠোয়। সংখ্যায় তারা অনেক। এক ডজন বেয়নেট তার দিকে উদ্যত। অসহায়ভাবে সে মাটিতে উপুড় হয়ে পড়ে রইল। তার তীর, ধনুক ও ছুরি কেড়ে নেয়া হল।

    একটি অফিসার এগিয়ে এসে পেটে লাথি মেরে বলল, কে তুমি?

    কর্নেল জন ক্লেটন। রাজকীয় বিমান বাহিনী।

    তুমি তো আমেরিকান; এখানে কি করছ?

    টারজান জবাব দিল না।

    দেখাচ্ছি মজা, বলে অফিসার জাপানী ভাষায় কি যেন নির্দেশ দিল। আর্জেন্টটি বন্দীর সামনে অর্ধেক ও পিছনে অর্ধেক সৈন্য সাজিয়ে যাত্রা করল। টারজান বুঝল, বিদেশী বাহিনী যে পথ ধরে এসেছিল তারা এখন সেই পথেই ফিরে চলেছে।

    ওদিকে অনেকক্ষণ টারজানকে ফিরতে না দেখে জেরি বলল, টারজনের কোন বিপদ ঘটেছে।

    রসেটি বলল, আমি কি এগিয়ে দেখব ব্যাপারটা কি? আমি তোমাদের সকলের চাইতে জোরে ছুটতে পারি।

    বেশ, এগিয়ে যাও; আমরা পিছনে আসছি।

    কিছুদূর এগিয়েই রসেটি অনেক মানুষের গলা শুনতে পেল। বিপদের কোন আশংকা থাকায় জাপানীরা, হেলাফেলাভাবেই এগোচ্ছে। আরও কিছুটা এগিয়ে সে বেঁটে মানুষগুলোর মাঝখানে টারজনের উন্নত দেহটা দেখতে পেল। টারজান জাপানীদের হাতে বন্দী! এযে অবিশ্বাস্য।

    রসেটির মুখে সব কথা শুনে সকলেই হতাশায় ভেঙে পড়ল। অরণ্য-রাজকে হারানো যে ঘোট দলটার পক্ষে কত বড় ক্ষতি তা তারা বোঝে।

    দলে কতজন জাপানী আছে রসেটি? জেরি শুধাল।

    প্রায় বিশজন। আর আমরা আছি ন’জন। সেটাই যথেষ্ট ক্যাপ্টেন।

    বুবোনোভিচ বলল, তাহলে এগিয়ে চল।

    সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট কেজো কানেকোর নির্দেশে একজন সার্জেন্ট বন্দীর হাত পা এত বেশি মোটা দড়ি দিয়ে এমন শক্ত করে বাঁধল যে অরণ্য-রাজের বলিষ্ঠ মাংসপেশীও তাকে ছিঁড়তে অক্ষম। বাঁধাছাদা শেষ করে সে এক ধাক্কায় টারজানকে মাটিতে ফেলে দিল। একটা ঘোড়া এনে জিন পরানো হল। নিজের সঙ্গে একটা দড়ি বেঁধে তার একটা দিক বেঁধে দেয়া হল টারজনের পায়ের সঙ্গে।

    কানেকো বলল, তুমি যদি আমার প্রশ্নের জবাব দাও তাহলে দড়িটা খুলে দেয়া হবে, আর ঘোড়াটাকেও চাবুক মারা হবে না। তোমরা দলে কতজন আছ, আর তারা কোথায়?

    টারজান নীরব। কানেকোর মুখ রাগে লাল হয়ে উঠল। এগিয়ে গিয়ে সে টারজনের পেটে একটা লাথি কসাল।

    জবাব দেবে না?

    টারজান নিঃশব্দে চোখ তুলে তাকাল। দারুণ রেখে কানেকো অশ্বারোহীকে হুকুম দিল। সঙ্গে সঙ্গে তার হাতের চাবুক উদ্যত হল। একটা রাইফেলের গর্জন শোনা গেল। ঘোড়াটা পাক খেয়ে উল্টে পেড় গলে। আর একটা গুলি। সেকেন্ড লেফঃ কেজো কানেকো আর্তনাদ করে মুখ থুবড়ে পড়ে গেল। তারপর গুলির পর গুলি। একের পর এক জাপানী সৈন্যরা ধরাশায়ী হতে লাগল। যারা পারল উপত্যকার দিকে পালিয়ে গেল। ন’জন রাইফেলধারী উঁচু রাস্তা থেকে লাফিয়ে নেমে শিবিরে ঢুকল।

    একজন আহত জাপানী তাদের লক্ষ্য করে গুলি ছুঁড়তেই কোরি এক গুলিতে তাকে খতম করে দিল। বেয়নেট ও ছুরি হাতে ঢুকল রসেটি ও সারিনা। একটি আহত জাপানীও অবশিষ্ট রইল না।

    জেরি টারজনের বাঁধন কেটে দিল। টারজান বলল, তুমি ঠিক সময় মতই এসে পড়েছিলে।

    ঠিক সার্কাসের ঘোড়ার মত, বুবোনোভিচ বলল।

    জেরি শুধাল, এখন আমাদের কি কর্তব্য?

    টারজান বলল, বাকিদেরও খতম করতে হবে। এদের কোন একজনও যদি মূল ঘাঁটিতে ফিরে গিয়ে খবর দেয় তো তারাই আমাদের তাড়া করবে।

    ওরা সংখ্যায় কতজন ছিল বলতে পার?

    প্রায় পঁচিশ-ছাব্বিশজন। কতজনকে আমরা মেরেছি?

    রসেটি জবাব দিল, যোজন; আমি শুনেছি।

    মৃত জাপানীর রাইফেল ও বুলেটের বেল্টটা হাতে নিয়ে টারজান বলল, আমি গাছের উপর দিয়ে এগিয়ে সুমুখ থেকে তাদের মহড়া নেব, আর তোমরা পিছন দিক থেকে এসে গুলি করবে।

    তাই হল। দু’মুখো আক্রমণের চাপে পড়ে দিশেহারা জাপানীরা কতক গুলিতে মরল, আর বাকিরা নিজেদের হাত-বোমার সাহায্যে হারাকিরি করল।

    আরও ছ’সপ্তাহ পরে বিদেশী বাহিনী মেয়েকে-মোয়েকের ভাটিতে সমুদ্রের তীরে পৌঁছে গেল। অনেক ঝড়-ঝাঁপটা পেরিয়ে অবশেষে বাঞ্ছিত উপকূল। যেখানে তারা আত্মগোপন করল সেখান থেকে প্রায় এক কিলোমিটার দূরে আছে জাপানীদের একটা বিমান-বিধ্বংসী কামানের ঘাটি। কাছেই আছে। একটা আদিবাসী গ্রাম। সেই গ্রামের বুড়ো সর্দার জাপানীদের খুব ঘৃণা করে। জাপানীরা তাকে অনেক লাথি-চড় মেরেছে, সকলের সামনে তাকে মাথা নোয়াতে বাধ্য করেছে।

    বুড়ো বলল, সে যাত্রা পথ বড়ই বিপদ-সংকুল। এখানকার সমুদ্রে অনেক শত্রু-জাহাজ চলাচল। করে। অস্ট্রেলিয়াও তো অনেক দূরের পথ। তবে তুমি ও তোমার বন্ধুরা যদি এই ঝুঁকি নিতে চাও, তাহলে আমি তোমাদের সাহায্য করব। এই গ্রাম থেকে কয়েক মাইল ভাঁটিতে একটা বড় পোয়া (দুদিকে ছুঁচলো মুখ দ্রুতগামী বড় জাহাজ) নদীতে লুকানো আছে। আমরাই তাতে খাবার-দাবার তুলে দেব। তবে সময় লাগবে। জাপানীরা আমাদের উপর কড়া নজর রেখেছে। মাঝে মাঝেই এ গ্রামে আসে।

    একটি মাস কেটে গেল। এই এক মাসে অনেকবার তারা ধরা পড়তে পড়তে বেঁচে গেছে; স্নায়ুর অনেক চাপ সহ্য করেছে। শেষ পর্যন্ত জাহাজ বোঝাইয়ের কাজ সারা হল। এবার এক অন্ধকার অমাবস্যার রাত ও অনুকূল বাতাসের অপেক্ষা।

    অবশেষে এল সেই শুভরাত্রি। জোয়ার এল। আকাশে চাঁদ নেই। তীরভূমি থেকে জোর হাওয়া বইছে। ধীরে ধীরে লগি দিয়ে ঠেলতে ঠেলতে তারা জাহাজটাকে সাগরে নিয়ে গেল। বড় ত্রিকোণ পালটা তুলে দেয়া হল। প্রথমে তাতে অল্প হাওয়া লাগল, কিন্তু বার-দরিয়ার পড়তেই জোরালো হাওয়ায় পাল ফুলে-ফেঁপে উঠল। প্রোয়া তরতর করে ছুটল।

    সকাল হতেই তারা একটা ফাঁকা সমুদ্রে এসে পড়েছে-চারদিকে শুধু দূর-বিস্তার ফেনিল জলরাশি। খোলা হাওয়া বইছে; সমুদ্রও যেন ছুটে চলেছে। তারা কিলিং দ্বীপ পেরিয়ে এসেছে। একটাও শত্রু জাহাজ চোখে পড়েনি।

    এবারে পড়ল। ডগলাস পাহারায় ছিল। সে এসে বলল, জল ছাড়াও একটা কিছু যেন দেখা যাচ্ছে।

    সে আঙুল বারিয়ে দেখাল। সকলের দৃষ্টিই সেই দিকে ঝুঁকল। দিকচক্ররেখার ঠিক উপরে একটা কালো দাগ।

    সকলেরই ভীতু দৃষ্টি সেই কালো দাগটার উপর নিবদ্ধ। অনেকক্ষণ পর্যন্ত সেটার কোন পরিবর্তন ঘটল না। টারজনের তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতেই প্রথম ধরা পড়ল দিকচক্ররেখার উপরে উঠে আসা একটা জাহাজের ছবি।

    কিছুক্ষণ একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে টারজান বলল, জাহাজটা গতি বদলেছে। আমাদের দিকেই এগিয়ে আসছে। এবার তার পতাকাও দেখতে পাচ্ছি। নির্ঘাৎ জাপানী জাহাজ।

    জেরি বলল, আমাদের সকলেরই হাতের টিপ ভাল। কিন্তু আমাদের হাতে যা অস্ত্র আছে তা দিয়ে তো একটা জাহাজকে ডুবিয়ে দেয়া যাবে না।

    টারজান বলল, ওটা একটা সশস্ত্র ছোট বাণিজ্য জাহাজ। সম্ভবত ওতে আছে ২০ মি.মি. বিমান বিধ্বংসী কামান আর ৩০ ক্যালিবারের মেশিনগান।

    জেরি বলল, ২০ মি.মি. কামানের রেঞ্জ মাত্র ১২০০ গজের মত। আমাদের এই সব বন্দুকের রেঞ্জ তার চাইতে বেশি। কাজেই ওরা আমাদের শেষ করবার আগে বেশ কিছু নিপকে আমরা খতম করতে পারব- অবশ্য তোমরা যদি যুদ্ধ করতে রাজী হও।

    সকলেই একবাক্যে যুদ্ধে সম্মতি জানাল। সকলেরই মত, আত্মসমর্পণ করার চাইতে যুদ্ধে মৃত্যুই শ্রেয়।

    বাণিজ্য-জাহাজটি দ্রুত এগিয়ে আসছে। হঠাৎ বাতাসও পড়ে গেল। প্রোয়ার ত্রি-কোণ পালটাও সে হাওয়ায় ফুলে উঠল না।

    জাপানী জাহাজের একটা লাল আলোর ঝলকানি দেখা গেল। তারপরেই একটা ধোঁয়ার কুন্ডলি। মুহূর্তকাল পরে একটা গোলা এসে ফাটল তাদের বেশ কিছুটা দূরে।

    রসেটি বলে উঠল, ভাগ্যঠাকুরাণি অনুকূল হাওয়া নিয়ে প্রস্তুত হয়েছে।

    শেষ পর্যন্ত যা ঘটার তাই ঘটল-একটা গোলা সোজা এসে প্রোয়ার উপর ফাটল। জেরি দেখল, সিংতাই-এর দেহের অর্ধেকটা পঞ্চাশ ফুট উপরে উড়ে গেল। টাক ভ্যান ডের বসের ডান পাটা ছিঁড়ে বেরিয়ে গেল। গোটা দল সাগরের জলে ছিটকে পড়ল। আর জাপানীরা আরও কাছে এসে তাদের লক্ষ্য করে মেশিনগান চালাতে লাগল। তারা তখন কেউ সাঁতরাচ্ছে, কেউ বা ভাঙা কাঠের টুকরো আঁকড়ে ধরে ভাসছে। সকলেই বুঝতে পারছে-’বিদেশী বাহিনী এখানেই ইতি।

    বুবোনোভিচ ও ডগলাস ভ্যান ডের বসের অচেতন দেহটা ধরে ভাসিয়ে রেখেছে। জেরি চেষ্টা করছে মেশিনগান ও কোরির মাঝখানে থাকতে। হঠাৎ কে যেন ভ্যান ডের বসের দেহটাকে নিচের দিকে টানতে লাগল। জলের নিচে একটা শক্ত দেহ বুবোনোভিচের পায়ে লাগল। সে চেঁচিয়ে বলে উঠল, মাই গড! একটা হাঙর টাককে ধরেছে।

    গোলার ধাক্কায় টারজান বেশ কিছুটা দূরে ছিটকে পড়েছিল। সাঁতার কেটে বুবোনোভিচ ও ডগলাসের দিকে এগোতেই তারা তাকে সাবধান করে দিল। তাড়াতাড়ি ডুব দিয়ে সে ছুরিটা বের করল। দ্রুত হাত পা ছুঁড়ে সে হাঙরটার কাছে পৌঁছেই ছুরির এক কোপে হাঙরের পেটটা দুফালা করে ফেলল। ফলে সেটা ভ্যান ডের বসকে ছেড়ে টারজানকে আক্রমণ করল। টারজান তার বিরাট হাটাকে এড়িয়ে বারবার ছুরি চালাতে লাগল।

    এমন সময় আর একটা হাঙর এসে আগেরটাকে আক্রমণ করল। সমুদ্রের জল রক্তে লাল হয়ে গেল। মুহূর্তের জন্য আক্রান্ত লোকগুলো সাময়িক স্বস্তি পেলেও গুলি-গোলা সমানেই চলতে লাগল।

    টারজনের সাহায্যে বুবোনোভিচ ও ডগলাস টাকের দেহটাকে ভাঙা জাহাজের একটা বড় তক্তার উপর তুলে নিল। তার ট্রাউজারের খানিকটা ছিঁড়ে নিয়ে তাই দিয়ে টারজান ক্ষতস্থানটা বেঁধে দিল। তখনও টাকের নিঃশ্বাস পড়ছে। তবে সে সম্পূর্ণ অচেতন।

    হঠাৎ একটা ভয়ঙ্কর শব্দ শোনা গেল। সকলে জাপানী জাহাজটার দিকে তাকাল। একটা বড় মাপের আগুনের শিখা বাণিজ্য-জাহাজটার মাঝখান থেকে কয়েক শ’ ফুট উপরে আকাশের দিকে উঠে গেছে। একটা ধোয়ার স্তম্ভ উঠে গেছে আরও কয়েক শ’ ফুট উপরে। পরক্ষণেই আর একটা বিস্ফোরণ ঘটল। জাহাজটা দুই ভাগে ফাঁক হয়ে সঙ্গে সঙ্গে ডুবে গেল। জ্বলন্ত তেলের মধ্যে কতকগুলো অর্ধদগ্ধ মানুষ আর্তনাদ করতে লাগল।

    কয়েক মুহূর্ত প্রোয়ার জীবিত যাত্রীরা বিস্ময়বিমূঢ় হতবাক হয়ে নিঃশব্দে সে দৃশ্য দেখল। প্রথম কথা বলল রসেটি, ভাগ্যঠাকুরাণি আমার কথা শুনেছে।

    জেরি বলল, আমরা ডুবে যাবার বা হাঙরের পেটে যাবার আগে ভারত মহাসাগরের মাঝখান থেকে আমাদের উদ্ধার করতে হলে তোমার ভাগ্যঠাকুরাণিকে আরও কিছু খেল দেখাতে হবে শ্রীম্প।

    সঙ্গে সঙ্গে রসেটি চেঁচিয়ে বলল, ঐ দেখ ক্যাপ, তার আর এক করুণার খেলা!

    কোরিও আঙুল বাড়িয়ে বলে উঠল, দেখ দেখ।

    জ্বলন্ত আগুন থেকে প্রায় তিনশ’ গুজ দূরে একটা সাবমেরিন ভেসে উঠেছে! তার মাথায় ইউনিয়ন জ্যাক আঁকা।

    টারজান হেসে বলল, ব্রিটিশদের এখন কেমন লাগছে সার্জেন্ট?

    আমি তাদের ভালবাসি।

    সাবমেরিনটা ঘুরে এসে পোয়র সব যাত্রীদেরই তুলে নিল। টারজান ও বুবোনোভিচ ভ্যান ডের বসকেই প্রথম তুলে দিল। ডেকের উপর শুইয়ে দিতেই সে মারা গেল। কোরি তার পাশে নতজানু হয়ে বসল। চোখের জল বাধা মানল না। জেরিও বসল তার পাশে।

    কোরি বলল, হতভাগ্য টাক।

    সাবমেরিনের দলপতি লেফ কম্যান্ডার বোল্টন প্রশ্নের পর প্রশ্ন করে সব জেনে নিল। টাকের দেহটাকে নিচে না নিয়ে সমুদ্রেই তাকে সমাধি দেয়া হল। বোল্টনই অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া পরিচালনা করল।

    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleলাল মৃত্যুর মুখোশ – এডগার অ্যালান পো – (অনুবাদক : চিত্তরঞ্জন মাইতি)
    Next Article The Gringos – Edith Nesbit
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo
    Most Popular

    রবিনসন ক্রুসো – ড্যানিয়েল ডিফো

    August 19, 2025

    অনুরাধা

    January 4, 2025

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    রবিনসন ক্রুসো – ড্যানিয়েল ডিফো

    August 19, 2025

    অনুরাধা

    January 4, 2025

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025
    Our Picks

    রবিনসন ক্রুসো – ড্যানিয়েল ডিফো

    August 19, 2025

    দ্য দা ভিঞ্চি কোড – ড্যান ব্রাউন

    August 19, 2025

    এঞ্জেলস এন্ড ডেমনস – ড্যান ব্রাউন

    August 19, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    Sign In or Register

    Welcome Back!

    Login below or Register Now.

    Lost password?

    Register Now!

    Already registered? Login.

    A password will be e-mailed to you.