Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    রবিনসন ক্রুসো – ড্যানিয়েল ডিফো

    August 19, 2025

    দ্য দা ভিঞ্চি কোড – ড্যান ব্রাউন

    August 19, 2025

    এঞ্জেলস এন্ড ডেমনস – ড্যান ব্রাউন

    August 19, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • 🔖
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    Subscribe
    সাইন ইন
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    টারজান রচনা সমগ্র – এডগার রাইস বারুজ

    এডগার রাইস বারুজ এক পাতা গল্প1300 Mins Read0

    দুর্দমনীয় টারজান (টারজান দি আনটে্মড)

    দুর্দমনীয় টারজান (টারজান দি আনটে্মড)

    হাউটম্যান ফ্রিজ স্নাইডার ক্লান্ত পায়ে হেঁটে চলেছে অন্ধকার অরণ্যের গা ঘেঁষে। লেফটেন্যান্ট হাঁটছে তার পাশাপাশি, আর আন্ডার লেফটেন্যান্ট ভন গস জনাকয়েক মাত্র আস্কারিকে সঙ্গে নিয়ে ক্লান্ত তল্পিবাহকদের পিছন পিছন হাঁটছে।

    হাউটম্যানের সামনে দলের অর্ধেক লোক, আর বাকি অর্ধেক তার পিছনে-এইভাবেই অসভ্য মানুষদের বাসভূমি এই জঙ্গলে জার্মান ক্যাপ্টেনটি তার বিপদকে যথাসম্ভব কমিয়ে নিয়েছে।

    কিন্তু গাইড দু’জন পুরো দলটাকে ভুল পথে নিয়ে চলেছে। আফ্রিকার অধিকাংশ গাইডরা তাই করে থাকে।

    হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎই অপ্রত্যাশিতভাবে একটি দৃশ্য তাদের চোখের সামনে ফুটে উঠল। খুশির হাসি হেসে ফিল্ড-গ্লাসটা চোখে লাগিয়ে সে দূরে তাকাল। বলল, আমাদের কপাল ভাল। দেখতে পাচ্ছ?

    লেফটেন্যান্ট ও তার গ্লাস চোকে লাগিয়ে বলল, হ্যাঁ, একটা ইংরেজ গোলাবাড়ি। ওরা নিশ্চয় গ্রেস্টোকের গোলাবাড়ি, কারণ ব্রিটিশ পূর্ব আফ্রিকার এই অঞ্চলে আর কোন গোলাবাড়ি নেই।

    খুশি মনেই সকলে এগিয়ে চলল লর্ড গ্রেস্টোক জন ক্লেটনের ছিমছাম গোলাবাড়িটা লক্ষ্য করে। কিন্তু হায় কপাল! টারজান বা তার ছেলে কেউ বাড়িতে নেই।

    ব্রিটেন ও জার্মানির যুদ্ধের কোন খবরই লেডী জেন রাখে না। কাজেই সে অফিসারদের সাদরে গ্রহণ করল।

    সুদূর পূর্বাঞ্চলে অরণ্যরাজ টারজনের দ্রুতপায়ে নাইরোবি থেকে ফিরছে তার গোলাবাড়ির দিকে। নাইরোবিতেই সে বিশ্বযুদ্ধ শুরু হবার খবর পেয়েছে। জার্মানরা যে কোন সময় ব্রিটিশ পূর্ব আফ্রিকা আক্রমণ করতে পারে এই আশংকা করে স্ত্রীকে কোন নিরাপদ অঞ্চলে সরিয়ে নিতেই সে বাড়ির দিকে ছুটে চলেছে। সঙ্গে জনাবিশেক কালো যোদ্ধা।

    দূর থেকে গোলাবাড়ির উপর নজর পড়তেই টারজনের চোখ দুটি কুঁচকে গেল। গোলাটার চিহ্ন মাত্র নেই; সেখান থেকে ধোঁয়ার কুণ্ডলি পাকিয়ে পাকিয়ে উঠছে।

    বাড়িতে ঢুকেই টারজান আতংকে শিউরে উঠল। শোবার ঘরের দেওয়ালে ক্রুশবিদ্ধ করে মারা হয়েছে প্রভুবক্ত মুভিরোর দৈত্যসদৃশ পুত্র ওয়াসিষুকে। এক বছরের বেশি কাল ধরে সে ছিল লেডী জেনের দেহরক্ষী।

    ঘরের আসবাবপত্র ইতস্তত ছড়ানো। মেঝেতে চাপ চাপ জমাট রক্ত। সব কিছুতেই এক ভয়ঙ্কর যুদ্ধের স্বাক্ষর।

    ঘরের দরজা বন্ধ। নতমুখে বিবর্ণ চোখে টারজান নীরবে দরজার দিকে এগিয়ে গেল। ঘরের এক পাশে ছোট কোচটায় মুখ থুবড়ে পড়ে আছে একটি নিষ্প্রাণ দেহ। দেহটা এমনভাবে পুড়ে গেছে যে টারজান তাকে চিনতে পারল না। মৃতদেহকে উল্টে ধরতেই মৃত্যুর সেই ভয়ঙ্কর রূপ দেখে শোকে, আতংকে ও ঘৃণায় সে আর্তনাদ করে উঠল।

    টারজনের বুকের মধ্যে বোবা জানোয়ারের অসহ্য যন্ত্রণা। তার মস্তিষ্ক জুড়ে শুধু একটিই অব্যক্ত বাণী ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হল : সে নেই! সে নেই! সে নেই!

    টারজান পথে নামল।

    দু’দিন পরে কিলিমাঞ্জারের দক্ষিণ সানুদেশ থেকে বহুদূর পূর্বে কামানের শব্দ শুনতে পেল। বুঝতে পারল, সেখানে জার্মানদের সঙ্গে ইংরেজদের যুদ্ধ বেঁধেছে। সারাদিন ভেসে এল গুলি-গোলার শব্দ। টারজান লক্ষ্য করল, গুলি-গোলা সবচাইতে বেশি চলে ভোরে আর সন্ধ্যার দিকে; রাতে প্রায় থাকেই না সে শব্দ।

    সন্ধ্যা নাগাদ সে পৌঁছে গেল পর্বতমালার সানুদেশে একটা বড় গুপ্ত ঘাঁটিতে। সন্ধ্যার অন্ধকারে লুকিয়ে একটা তাবুর কাছে পৌঁছতে টারজনের কানে এল একজন বলছে : ওয়াজিরিরা দানোবের মতই লড়াই করল; কিন্তু আমাদের বাঘা-বাঘা যোদ্ধারা তাদের একেবারে কচুকাটা করে ফেলল। শেষ পর্যন্ত ক্যাপ্টেন এসে মেয়েটাকে খতম করল।

    টারজান তখন শিকারী জানোয়ারের মত ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছে। হামাগুড়ি দিয়ে এগিয়ে গেল তাঁবুটার আরও কাছে। কথা শেষ করে সৈনিকটা উঠে দাঁড়িয়ে সকলকে কি যেন বলে শিবিরের পিছন দিকে এগিয়ে চলল। শিকারী চিতার মত টারজান নিঃশব্দে একটা ঝোপের ছায়ায় পৌঁছেই সে লাফিয়ে পড়ল। লোকটার ঘাড়ে।

    তারপর টানতে টানতে তাকে একটা ঝোপের মধ্যে নিয়ে গিয়ে টারজান ফিসফিসিয়ে বলল, যে অফিসার বাংলোতে মেয়েটিকে খুন করেছে তার নাম কি?

    লোকটি মুহূর্তমাত্ৰ ইতস্তত করে জবাব দিল, হাউটম্যান স্নাইডার।

    সে কোথায়?

    এখানেই আছে। হয়তো হেডকোয়ার্টারে গেছে।

    টারজান আদেশ করল, আমাকে সেখানে নিয়ে চল।

    ঝোপের আড়ালে বেশ কিছুটা এগিয়ে দূরে একটা দোতলা বাড়ি দেখিয়ে লোকটি বলল, ওটাই হেডকোয়ার্টার।

    টারজান বলল, ওয়াজিরি ওয়াসিমুকে ক্রুশাবদ্ধ করার কাজে কে হুকুম দিয়েছিল?

    আন্ডার লেফটেন্যান্ট ভন গস! সেও এখানে আছে।

    টারজান দৃঢ়কণ্ঠে বলল, তাকে আমি খুঁজে পাবই।

    আর একটি কথাও না বলে টারজান আবার তার গলা ধরে টেনে তুলল। দুই হাতে তাকে মাথার উপরে তুলে ধরে এক, দুই, তিন পাক ঘুরিয়ে সবেগে তাকে ছুঁড়ে দিল। তারপর এগিয়ে গেল জেনারেল ক্রাউটের হেডকোয়ার্টারের দিকে।

    জানালা দিয়ে টারজনের চোখে পড়ল, সামনে একটা বড় ঘর- সেখানে বেশ কয়েকজন অফিসারের জটলা; পিছনের ছোট ঘরটায় টেবিলের পিছনে বসে আছে একটা লাল-মুখো লোক। একজন এড়-ডি ঘরে ঢুকে স্যালুট করে জানাল, ফ্রলিন কিরচার এসে গেছে স্যার।

    ভিতরে আসতে বলল, জেনারেল হুকুম করল।

    ফ্রলিন ঘরে ঢুকল। মেয়েটি খুব সুন্দরী। উনিশের বেশি বয়স হবে না।

    জেনারেলের টেবিলের কাছে গিয়ে কোটের ভিতরের পকেট থেকে একটা ভাঁজ করা কাগজ বের করে তার হাতে দিল।

    জেনারেল বলল, বস ফ্রলিন। একজন অফিসার একটা চেয়ার এনে দিল। জেনারেল কাগজটা খুলে পড়তে লাগল।

    ঘরের সবগুলো লোকের উপর চোখ বুলিয়ে নিল টারজান। দুই ক্যাপ্টেনের একজন তো হাউটম্যান স্নাইডার হতে পারে। মেয়েটি নিশ্চয় গোয়েন্দা বিভাগের লোক-গুপ্তচর।

    জেনারেল মুখ তুলে মেয়েটির দিকে তাকিয়ে বলল, খুব ভাল। এ-ডিকে বলল, মেজর স্নাইডারকে ডেকে পাঠাও।

    এড-ডি ফিরে এল। সঙ্গে মাঝারি আকারের একজন অফিসার। জেনারেল ঘাড় কাত করে মেয়েটির দিকে তাকিয়ে বলল, ফ্রলিন কিরচার, ইনি মেজর স্নাইডার।

    বাকিটা শোনার ধৈর্য হল না। জানালার গোবরাটে একটা হাত রেখে এক লাফে টারজান ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়ল। কাইজারের অফিসাররা তো হতভম্ব। আর এক লাফে টেবিলের কাছে পৌঁছে এক ঘুষিতে টারজান টেবিল-ল্যাম্পটাকে ছিটকে ফেলে দিল জেনারেলের মোটা খুঁড়ির উপর। দুই এ-ডি ধেয়ে গেল টারজনের দিকে সেও পাল্টা একজনকে তুলে ধরে ছুঁড়ে দিল অপর এড়-ডির মুখের উপর। মেয়েটি চেয়ার থেকে লাফ দিয়ে দেয়ালের গায়ে সেঁটে দাঁড়িয়ে পড়ল। অন্য অফিসাররা সাহায্যের জন্য চেঁচামেচি শুরু করে দিল। মুহূর্তের মধ্যে মেজর স্নাইডারকে ধরে মাথার উপর তুলে এত দ্রুত জানালা দিয়ে বেরিয়ে গেল যে উপস্থিত কেউ ব্যাপারটা বুঝতেই পারল না।

    অসীম ধৈর্যের সঙ্গে টারজান জার্মানদের শেষ ঘাঁটিটা পার হয়ে গেল। বন্দীকে আগে আগে হাঁটতে বাধ্য করে সে তাকে ঠেলে নিয়ে চলল পশ্চিম দিকে।

    বর্শার খোঁচায় খোঁচায় স্নাইডারের দেহ রক্তাক্ত হল। দীর্ঘ রাত এইভাবে কেটে গেল।

    তৃতীয় দিন দুপুরে পাহাড় বেয়ে কিছুটা হেঁটে চূড়ায় উঠে একটা খাড়া খাদের সামনে দু’জন থামল। স্নাইডার নিচে তাকিয়ে দেখল, সংকীর্ণ খাদের অনেক নিচে নদীর তীরে দাঁড়িয়ে আছে একটি মাত্র গাছ।

    টারজান বলল, আমিই লর্ড গ্রেস্টোক। ওয়াজিরিদের দেশে আমার স্ত্রীকে তুমিই খুন করেছ। এবার বুঝতে পারছ কেন আমি তোমার খোঁজে এসেছি। নেমে যাও!

    জার্মানটি নতজানু হয়ে বলে উঠল, তোমার স্ত্রীকে আমি খুন করিনি, দয়া কর। এ ব্যাপারে আমি কিছুই জানি না।

    নেমে যাও! টারজান বর্শা উঁচিয়ে হুকুম করল। স্নাইডার একটু একটু করে নামতে লাগল। পিছনে টারজান। এক ঠেলায় স্নাইডারকে নিচে ফেলে দিয়ে বলল, এবার ছুট পালাও।

    ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে জার্মানটি গাছ লক্ষ্য করে ছুটল। প্রায় গাছটার কাছে পৌঁছে গেছে এমন সময় ভয়ঙ্কর গর্জন করে ক্ষুধার্ত সিংহটা খাদের মধ্যে লাফিয়ে লাগাও।

    চূড়ায় উঠে টারজান একবার নিচে তাকাল। জার্মানটি আপ্রাণ চেষ্টায় গাছের একটা ডালকে আঁকড়ে ধরে আছে। তার নিচে নুমা অপেক্ষমান।

    টারজান সূর্য কুড়ুর দিকে মুখ তুলল। তার প্রশস্ত বুকের ভিতর থেকে বেরিয়ে এল একটা বন্য গোরিলার বিজয় হুংকার।

    রাতের অন্ধকারে দুই বিবদমান পক্ষকেই পাশ কাটিয়ে টারজান হাজির হল অনেক দূরে ব্রিটিশ শিবিরে। কেউ তাকে দেখতে পেল না। তার উপস্থিতিটাও টের পেল না।

    শত্রুপক্ষের দৃষ্টির আড়ালে সুবিধাজনক দূরত্বে গড়ে উঠেছে দ্বিতীয় রোডেশীয় বাহিনীর হেডকোয়ার্টার। একটা ফিল্ড-টেবিলের সামনে বসে আছে কর্নেল ক্যাপেল। সঙ্গে কয়েকজন অফিসার। মাথার উপর একটা বড় গাছ। টেবিলের উপর একটা লণ্ঠন জ্বলছে।

    গাছের ডালে খসখস আওয়াজ হল। সঙ্গে সঙ্গে তাদের সামনে নেমে এল একটা কঠিন বাদামী দেহ। সকলেরই হাত পড়ল পিস্তলের উপর। তারা বিস্মিত। কে এই প্রায় নগ্নদেহ শ্বেতকায় মানুষটি!

    একজন অফিসার বলল, কে হে তুমি মহাশয়?

    অরণ্যরাজ টারজান, নবাগত জবাব দিল।

    ও হো, গ্রেস্টোক! বলে মেজর সাহেব হাতটা বাড়িয়ে দিল।

    টারজান হেসে কর্নেলের দিকে ফিরে বলল, তোমাদের আলোচনা কিছুটা শুনেছি। জার্মান শিবিরের পিছন থেকেই আমি আসছি। হয়তো তোমাদের কিছুটা সাহায্য করতে পারব।

    কর্নেল প্রশ্ন করল, তুমি তাহলে আমাদের সঙ্গে যোগ দিচ্ছ?

    টারজান জবাব দিল, নিয়মিতভাবে নয়। আমি লড়ব আমার নিজের মত করে। সংক্ষেপে নিজের সব কথাই সে খুলে বলল।

    একটু চুপ করে থেকে ক্যাপেল শুধাল, তুমি কার সঙ্গে এসেছ?

    খাড়া হয়ে দাঁড়িয়ে টারজান বলল, আমি একাই এসেছি। আচ্ছা, এখনকার মত চলি। দ্বিতীয় রাতে আবার দেখা হবে।

    টারজান মুচকি হেসে পা চালিয়ে দিল। কিছুদূর এগোতেই অফিসারের ভারী ওভারকোটে গা ঢেকে একটি ছোটখাট লোককে পাশ দিয়ে যেতে দেখল। কোটের কলার তোলা, আর সামরিক টুপিটা চোখ পর্যন্ত টেনে নামানো। কিন্তু টারজনের মনে হল, মুখটা তার চেনা। হয়তো লন্ডনের পরিচিত কোন অফিসার। টারজান এগিয়ে গেল।

    পূর্ব আফ্রিকার ছোট ব্রিটিশ বাহিনীটি প্রাথমিক বিপর্যয়ের পরে এখন ধীরে ধীরে পায়ের নিচে মাটি ফিরে পাচ্ছে। জার্মান আক্রমণে ভাটা পড়েছে; হুনরা ক্রমেই পিছু হটে যাচ্ছে রেলপথ বরাবর টাঙ্গার দিকে।

    প্রচণ্ড মার খাবার পরে জার্মানরা বাঁ দিককার ট্রেঞ্চগুলো ছেড়ে চলে গেছে, আর দ্বিতীয় রোডেশীয় রেজিমেন্ট সেগুলো দখল করে নিয়েছে।

    তারপর বেশ কয়েক সপ্তাহ কেটে গেছে। আন্ডার লেফটেন্যান্ট ভন গসের মৃত্যু হয়েছে টারজনের হাতে। তারপর থেকে টারজনের আর কোন হদিস নেই। অনেকেই মনে করে জার্মানদের হাতে তার মৃত্যু ঘটেছে।

    কিন্তু সেরকম কিছুই ঘটেনি। একটি বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে সে ঘুরে বেড়াচ্ছে। একটি জার্মান গুপ্তচরকে জীবিত অবস্থায় গ্রেপ্তার করে সে ব্রিটিশদের হাতে তুলে দিতে চায়। গুপ্তচর মেয়েটিকে সে প্রথম দেখেছে জার্মান জেনারেলের হেডেকোয়ার্টারে। তারপর দেখেছে ব্রিটিশ শিবিরে একজন ব্রিটিশ অফিসারের ছদ্মবেশে। তার সন্ধানই টারজান বার বার হানা দিয়েছে জার্মান হেডকোয়ার্টারে।

    একদিন রাতে দেখা গেল সে ছুটে চলেছে ছোট্ট শৈলশহর উইলহেলস্টলের দিকে-জার্মান পূর্ব আফ্রিকা সরকারের সেটাই গ্রীষ্মবাস।

    ফ্রলিন বার্থা কিরচার পথ হারিয়ে ফেলেছে। বিনা দানা-পানিতে তার ঘোড়াটা সারাদিন পথ চলেছে। রাত নেমে আসছে। কোন মতে কিছু শুকনো কাঠ-খড় যোগাড় করে একটা ধুনি জ্বালাল। পাশেই বড় বড় ঘাসে ঢাকা খানিকটা জমি দেখতে পেয়ে সেখানে ঘোড়াটাকে ঘাস খেতে দিল। আর নিজে একটা বিছানার মত তৈরি করে ধুনির পাশে শুয়ে পড়ল।

    সেই রাতেই অরণ্যরাজ টারজনের সঙ্গে তার দেখা হয়ে গেল। টারজানই তাকে রক্ষা করল সিংহ নুমার হাত থেকে।

    একটু সুস্থ বোধ করে সে বলল, মৃত্যুর একেবারে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আমি কেমন যেন বিহ্বল হয়ে পড়েছিলাম। এখন ভাল বোধ করছি। তোমাকে কি বলে যে ধন্যবাদ দেব।

    মেয়েটির একেবারে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে এতক্ষণে সে তাকে ভালভাবে দেখার সুযোগ পেল। মেয়েটি খুব সুন্দরী। কিন্তু তাতে টারজনের মন গলল না। সে যে একজন জার্মান-জার্মান গুপ্তচর।

    হঠাৎ টারজনের চোখ পড়ল মেয়েটির খোলা বুকের উপর। বিস্ময়ে ও ক্রোধে সে আঁতক উঠল। মেয়েটির সাদা বুকের উপর ঝুলছে একটা হীরক খচিত সোনার লকেট-যে লকেট তার প্রথম প্রণয় উপহার- যা তার সঙ্গিনীর বুক থেকে চুরি করেছিল হুন স্নাইডার। মেয়েটির হাত চেপে ধরে হারটা ছিনিয়ে নিয়ে ক্রুদ্ধ স্বরে বলল, এটা তুমি কোথায় পেয়েছ?

    তা দিয়ে তোমার কি দরকার?

    এটা আমার। বল কে তোমাকে এটা দিয়েছে, নইলে আবার তোমাকে নুমার মুখে ছুঁড়ে দেব। তুমি তো গুপ্তচর, আর গুপ্তচরের শাস্তি মৃত্যু।

    মেয়েটি জবাব দিল, আমাকে ওটা দিয়েছে হাউটম্যান ফ্রিজ স্নাইডার।

    টারজান গম্ভীর গলায় বলল, বুঝলাম। এবার হেডকোয়ার্টারে চল।

    ঝোপ-ঝাড়ের ভিতর দিয়ে পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে এক সময় কিরচার বলল, তুমি কি করে বুঝলে যে আমি গুপ্তচর?

    টারজান বলল, তোমাকে প্রথম দেখেছিলাম জার্মান হেডকোয়ার্টারে, তারপর ব্রিটিশ শিবিরে।

    বার্থা কিরচার পকেটের পিস্তলটা স্পর্শ করল। কোন মতেই সে ব্রিটিশ শিবিরে ফিরে যাবে না। তার জন্য দরকার হলে পিস্তলের আশ্রয়ই নেবে। পর মুহূর্তেই এক অন্ধ আবেগে পিস্তলটা বাগিয়ে ধরে তার কুঁদো দিয়ে সজোরে আঘাত হানল টারজনের মাথায়। টারজনের দেহটা ছিন্ন মুণ্ড ষাঁড়ের মত সেখানেই লুটিয়ে পড়ল।

    টারজান ধীরে ধীরে চোখ মেলল। জঙ্গলের মধ্যে একটা সরু পথের উপর সে পড়ে আছে। ক্রমে সব কথাই মনে পড়ল। সঙ্গে সঙ্গে প্রতিহিংসার আগুন জ্বলে উঠল তার চোখে। উইহেলস্টলে পৌঁছবার আগেই তাকে ধরতে হবে।

    টারজান উঠে দাঁড়াল। বার্থা কিচারের পায়ের ছাপ অনুসরণ করে হাঁটতে শুরু করল।

    টারজান যখন ছোট পার্বত্য শহর উইলহেলম্স্টলে পৌঁছল তখন রাত হয়েছে। সৈনিকরা চলাফেরা করছে। শহরটি সুরক্ষিত।

    অতর্কিতে একটি জার্মান অফিসারের ঘাড়ে লাফিয়ে পড়ে গলা টিপে তাকে মেরে ফেলল। তারপর তাড়াতাড়ি তার পোশাকটা পরে নিজের ভোল পাল্টে নিল। এবার হোটেলটা খুঁজে বের করতে হবে। তার অনুমান মেয়েটিকে সেখানেই পাওয়া যাবে। তার সঙ্গেই পাওয়া যাবে হাউটম্যান ফ্রিজ স্নাইডারকে। আর সেখানেই পাবে তার মূল্যবান লকেটটা।

    অনেক খুঁজে হোটেলটা পাওয়া গেল। একটা নিচু দোতলা বাড়ি। উপরে-নিচে আলো জ্বলছে। অনেক অফিসারের মেলা। লাফ দিয়ে সে উঠে গেল বারান্দার ছাদে। কোণের একটা ঘরের শার্সি নামানো। ভিতরে আলো জ্বলছে। কথাবার্তাও শোনা যাচ্ছে। টারজান দরজায় কান পাতল।

    প্রথমে শুনেত পেল একটি নারী কণ্ঠ : আমার অভিজ্ঞান হিসেবে লকেটটা আমি নিয়ে এসেছি। জেনারেল ক্রাউটের সঙ্গে তোমার তো সেই রকমই কথা হয়েছিল। এবার কাগজপত্রগুলো আমাকে দিয়ে দাও, আমি চলে যাচ্ছি।

    পুরুষটি নিচু গলায় কি বলল টারজান তা ধরতে পারল না। আবার নারীকণ্ঠ-তাতে ঘৃণা ও ভয়ের আভাষ।

    এত স্পর্ধা ভাল নয় হাউম্যান স্নাইডার। আমাকে স্পর্শ করো না। হাত সরিয়ে নাও।

    এবার অরণ্যরাজ টারজান দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকল। দরজা খোলা ও বন্ধ হবার শব্দ শুনে স্নাইডার ঘুরে দাঁড়াল।

    এভাবে এ ঘরে ঢোকার অর্থ কি লেফটেন্যান্ট? এখনই ঘর থেকে বেরিয়ে যাও।

    টারজান দৃঢ়কণ্ঠে শুধাল, তুমিই হাউম্যান স্নাইডার?

    তাতে তোমার কি? জেনারেল গর্জে উঠল।

    আমি অরণ্যরাজ টারজান। এবার বুঝতে পারছ কেন আমি এঘরে ঢুকেছি।

    কোটটাকে মেঝেতে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে টারজান ট্রাউজারটাও খুলে ফেলল। এখন তার পরিধানে একটিমাত্র কটি-বস্ত্র। এবার মেয়েটি তাকে চিনতে পারল।

    টারজান চীৎকার করে বলল, পিস্তলে হাত দিও না। মেয়েটির হাত সোজা নেমে গেল।

    এবার এদিকে এস।

    মেয়েটি এগিয়ে গেল। টারজান তার অস্ত্রটা তুলে নিয়ে জানালা দিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দিল।

    স্নাইডার ভয়ে-ভয়ে বলল, আমার কাছে কি চাও তুমি?

    টারজান বলল, ওয়াজিরিদের দেশে একটা ছোট বাংলোতে যে অপকর্ম তুমি করে এসেছ তারই দামটা মিটিয়ে দিতে চাই।

    এক লাফে এগিয়ে টারজান লোকটির গলা টিপে ধরে শিকারী-ছুরিটা টেনে বের করল। সেটাকে আমূল বসিয়ে দিল স্নাইডারের তলপেটে। ভয়ঙ্কর গলায় হিসহিসিয়ে বলল, এইভাবে তুমি হত্যা করেছিলে আমার সঙ্গিনীকে। এইভাবেই তুমিও মরবে।

    মেয়েটির দিকে মুখ ফিরিয়ে হাতটা বাড়িয়ে টারজান বলল, আমার লকেটটা দাও।

    মৃত অফিসারকে দেখিয়ে মেয়েটি বলল, ওর কাছে আছে। লকেটটা খুঁজে পেয়ে টারজান বলল, এবার কাগজপত্রগুলো দিয়ে দাও।

    বিনা বাক্যব্যয়ে মেয়েটি ভাঁজ করা দলিলগুলো টারজনের হাতে তুলে দিল।

    জানালার কাছে এগিয়ে গিয়ে শার্সিটা তুলে মুহূর্তের মধ্যে টারজান বাইরের অন্ধকারে মিলিয়ে গেল।

    ফ্রলিন বার্থা কিরচার অতি দ্রুত মেঝের উপর পড়ে থাকা মৃত দেহটার কাছে গিয়ে তার জামার ভিতরে হাত ঢুকিয়ে দিয়ে একটা কাগজের বান্ডিল বের করে নিজের কোমরের মধ্যে ঢুকিয়ে নিল। তারপর জানালার কাছে গিয়ে সাহায্যের জন্য চীৎকার করতে লাগল।

    রয়্যাল এয়ার সার্ভিসের লেফটেন্যান্ট হারল্ড পার্সি স্মিথ-ওল্ডইউক অনুসন্ধানে বেরিয়েছে। জার্মান পূর্ব আফ্রিকার ব্রিটিশ হেডকোয়ার্টারে একটা খবর এসেছে-বরং বলা যায় যে, একটা গুজব ছড়িয়েছে যে শত্রুপক্ষ সসৈন্যে এসে পশ্চিম উপকূলে নেমেছে এবং ঔপনিবেশিক বাহিনীকে জোরদার করতে অন্ধকার মহাদেশের ভিতরেও ঢুকে পড়েছে। এমনকি তারা দশ-বারো দিনের মত এগিয়েও গেছে।

    তাই লেফটেন্যান্ট হারল্ড পার্সি স্মিথ-ওল্ডউইক বিমানপথে পশ্চিম দিকেই চলেছে- কোন হুম বাহিনী সেদিকে এসেছে কি না সে দিকেই তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রেখেছে। নিচে দূর বিস্তর ঘন অরণ্য। পাহাড়, উপত্যকা, মরুভূমি- সব মিলিয়ে চমৎকার প্রাকৃতিক দৃশ্য। কিন্তু জনমানুষের চিহ্নমাত্র নেই।

    উড়ে চলতে চলতে বিকেল হয়ে এল। গাছপালার ভিতর দিয়ে একটা নদীর আঁকাবাঁকা গতিপথ চোখে পড়ায় সেখানেই রাতের মত তাঁবু খাটাবার সিদ্ধান্ত নিল। আর তখনই ইঞ্জিনটা থেমে গেল। কাজেই কাছের একটা খোলা মাঠের মধ্যে নেমে মোটরটা নিয়ে নাড়াচাড়া করতে করতে গুণ গুণ করে একটা গানের সুর ভাঁজতে লাগল। পাশের জঙ্গলেই যে কোন বিপদ ওঁৎ পেতে থাকতে পারে তা সে। ভাবতেও পারেনি। বিশ জোড়া বর্বর চোখের দৃষ্টি যে আড়ালে থেকে তার উপর নজর রেখেছে তা সে। বুঝবে কেমন করে। ঠিক সেই মুহূর্তে ওয়ামাবো-সর্দার নুমাবো সঙ্গীদের নিয়ে হঠাৎ লাফিয়ে পড়ে তার দিকে ধেয়ে এল।

    অসভ্য লোকগুলো চারিদিক থেকে তাকে ঘিরে বর্শাগুলোকে ঘুরিয়ে ধরে হাতল দিয়ে তাকে সমানে পেটাতে শুরু করল। আঘাতে-আঘাতে জর্জরিত হয়ে সে মাটিতে পড়ে গেল। সকলে তাকে ধরাধরি করে তুলে দুই হাতে পিছ-মোড়া করে বেঁধে ঠেলতে ঠেলতে জঙ্গলের দিকে নিয়ে চলল। অসহায় স্মিথ ওল্ডউইক বুঝতে পারল কোন অসভ্য রাজশক্তির খেয়ালখুশির উপরেই নির্ভর করছে তার জীবন-মরণ।

    জঙ্গল পার হয়ে একটা খোলা জায়গায় পৌঁছে সে দেখতে পেল, দূরে একটা কুটিরের ভিতর থেকে এগিয়ে আসছে একদল নিগ্রো। তাদের পরনে জোড়াতালি দেয়া জার্মান ইউনিফর্ম। তাদের মধ্যে একটা গাট্টাগোট্টা লোকের গায়ে ছিল সার্জেন্টের পোশাক। ব্রিটিশ অফিসারটির উপর চোখ পড়তেই সে সোল্লাসে চীৎকার করে উঠল। অন্য সকলের কণ্ঠে উঠল তার প্রতিধ্বনি।

    কালা সার্জেন্ট উসাঙ্গা সর্দার নুমাবোকে জিজ্ঞাসা করল, এই ইংরেজকে কোথায় পেলে? তার সঙ্গে কি আরও অনেকে আছে?

    সর্দার বলল, ও তো আকাশ থেকে নেমেছে এমন একটা আজব বস্তুতে চড়ে যা পাখির মত আকাশে ওড়ে। তা দেখে প্রথমে আমরা ঘাবড়েই গিয়েছিলাম। পরে যখন বুঝলাম ওটা কোন জীবিত প্রাণী নয়। তখন সাহস করে এগিয়ে গেলাম, আর এই লোকটাকে ধরে ফেললাম।

    উসাঙ্গা চোখ বড় বড় করে শুধাল, ও কি মেঘের ভিতর দিয়ে উড়ে এসেছিল?

    উমোবা বলল, হ্যাঁ বস্তুটা দেখতে পাখির মত। এখনও জঙ্গলের ওপারেই পড়ে আছে, অবশ্য যদি এর মধ্যে উড়ে গিয়ে না থাকে।

    উসাঙ্গা বলল, সে ভয় নেই; এই লোকটা না উঠলে সেটা উড়তে পারবে না। ওকে ধরে এনে খুব ভাল করেছ। এই ইংরেজগুলো খুব খারাপ সাদা আদমি।

    তখন উমাবো ইংরেজ অফিসারটিকে ঠেলতে ঠেলতে গ্রামের একটা কুটিরে ঢুকিয়ে দিয়ে দু’জন সাহসী যোদ্ধাকে পাহারায় রেখে দিল।

    জঙ্গলের ফাঁক-ফোকর সম্পর্কে অরণ্যরাজ টারজনের জ্ঞান প্রায় অলৌকিকতার পর্যায়ে পৌঁছে যায়। তবু তার সব বিচার-বিবেচনা নির্ভুল হতে পারে না। গাছের বেশ মোটা ডাল ধরে ঝুলতে ঝুলতেই সে চলছিল। এক সময়ে যে ডালটা ধরে সে ঝুল দিল সেটাও বেশ মজবুত ও তাজা। সে কেমন করে জানবে। যে বাকলের নিচে সে ডালটাকে পোকায় কেটে একেবারে ঝাঁঝরা করে রেখেছে।

    তার দেহের ভারে হঠাৎ ডালটা সশব্দে ভেঙ্গ পড়ল। নিচে কোন মোটা ডাল ছিল না যে জাপটে ধরবে। হেট-মুণ্ড উৰ্দ্ধ-পদ হয়ে সে সপাটে ছিটকে পড়ল গ্রামের পথটার একেবারে মাঝখানে। ডাল ভাঙ্গার মড়মড় শব্দে ও পড়ন্ত দেহের ছরছরাৎ আওয়াজে চমকে ওঠে গ্রামবাসীরা। এসে দেখল, একটি প্রায় নগ্নদেহ সাদা মানুষ গাছ থেকে যেখানে পড়েছিল সেখানেই চুপচাপ পড়ে আছে। সর্দার নুমাবো। বলল, ওকে বেঁধে ফেল। আজ রাতে ভোজটা জমবে ভাল।

    শক্ত করে টারজনের হাত-পা বেঁধে তাকে নিয়ে হাজির করল সেই কুটিরে যেখানে লেফটেন্যান্ট হারল্ড পার্সি স্মিথ-ওল্ডউইক আসন্ন মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করে আছে। তারও হাত-পা বাঁধা।

    ধীরে ধীরে টারজনের জ্ঞান ফিরে এল। চোখ মেলে তাকাল। অনেক কষ্টে পাশ ফিরে উঠে বসল। সামনেই ইংরেজ যুবকটিকে পিছমোড়া করে বাঁধা অবস্থায় দেখে ম্লান-হেসে বলল, দেখছি আজ রাতে ওরা পেট ভরে খাবে।

    যুবকটি বলল, তুমি কেমন করে ধরা পড়লে?

    টারজান আক্ষেপের সুরে বলল, নিজের দোষে। আরে ভাই, ডালটা যে পোকায় খাওয়া তা কেমন করে জানব।

    যুবক বলল, পালাবার কোন পথ কি নেই?

    টারজান হেসে বলল, মরতে তোমার এত ভয় কেন? একদিন তো মরতে হবেই। আজ রাতে হোক, কাল রাতে হোক, আর এক বছর পরে হোক- তাতে তফাৎটা কি হবে?

    যুবক বলল, এসব দার্শনিক কথাবার্তা শুনতেই ভাল গো দাদা, কিন্তু আমার ওতে সায় নেই। যতক্ষণ শ্বাস ততক্ষণ আশ। দেখাই যাক।

    অরণ্যরাজ টারজান ও লেফটেন্যান্ট হারল্ড পার্সি স্মিথ-ওল্ডইউককে শক্ত করে বাঁধা হয়েছে। পাশাপাশি দুটো দণ্ডের সঙ্গে। ইংরেজ যুবকটি মুখ ঘুরিয়ে সঙ্গীর দিকে তাকাল। টারজান সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মুখে ভয় বা ক্রোধের চিহ্নমাত্র নেই। পরিপূর্ণ উদাসীনতা।

    যুবক লেফটেন্যান্ট ফিসফিস্ করে বলল, বিদায় গো দাদা।

    টারজানও মুখ ফিরিয়ে হেসে বলল, বিদায়।

    চারদিক থেকে তাদের দু’জনকে ঘিরে যোদ্ধারা গোল হয়ে এগিয়ে আসতে লাগল। কাছে আরও কাছে।

    নুমাবোর হাতের বর্শা টারজনের বুক স্পর্শ করল। ফিনকি দিয়ে রক্তের ছোট ধারা গড়িয়ে পড়ল তার বাদামী বুক বেয়ে। সঙ্গে সঙ্গেই কৌতূহলী দর্শকদের পিছন দিকে ভেসে এল নারী-কণ্ঠের আর্ত চীৎকার আর বহুকণ্ঠের বীভৎস হুংকার ও গর্জন। গোলমালটা কিসের তা দু’জনের কেউই দেখতে পেল না। কিন্তু কিছু না দেখেই কেবল শব্দ শুনেই টারজান বুঝতে পারল ওটা কাদের গর্জন ও হুংকার।

    কিন্তু সে ভেবেই পেল না কেমন করে গোরিলারা এখানে এল, আর তাদের এই আক্রমণের উদ্দেশ্যই বা কি। ওরা যে তাকেই উদ্ধার করতে এসেছে তা সে ভাবতেই পারল না।

    যুবক গোরিলা জু-টাগ প্রচণ্ড দুই থাবার আছাড় মেরে, থাবড়ে কামড়ে, সমবেত জনতাকে ছিন্নভিন্ন করে এগিয়ে এল। পিছন পিছন ধেয়ে এল তার কদাকার দলবল। টারজান সবিস্ময়ে দেখল, তাদের চালিয়ে এনেছে বার্থা কিরচার।

    সে চীৎকার করে বলল, জু-টাগ, আগে সর্দারের দলের উপর ঝাঁপিয়ে পড়। কিরচারকে বলল, তুমি আমার বাঁধন খুলে দাও। তাড়াতাড়ি।

    বার্থা কিচারের চেষ্টায় নিজেকে মুক্ত করে টারজান বলল, এবার এই ইংরেজের বাঁধন খুলে দাও। সঙ্গে সঙ্গে সে ছুটে গেল জু-টাগের পাশে। নুমাবো ও তার দলের সঙ্গে তখন গোরিলা দলের তুমুল যুদ্ধ চলেছে। আর্তনাদ করতে করতে নিগ্রোরা পালিয়ে গিয়ে অন্ধকারে অদৃশ্য হয়ে গেল। নুমাবো অনেক চেষ্টা করেও তাদের ফেরাতে পারল না।

    ততক্ষণে মেয়েটি ইংরেজ বৈমানিককে মুক্ত করে দিয়েছে। নিগ্রোদের পরিত্যক্ত বর্শা হাতে নিয়ে এবার তিন ইওরোপীয় মানুষ ও অবশিষ্ট গোরিলারা গ্রামের ফটক পার হয়ে অন্ধকারে মিলিয়ে গেল।

    টারজান সম্পূর্ণ নির্বাক। তার পাশেই চলেছে গোরিলা জু-টাগ। পিছনে বাকি গোরিলারা। সকলের শেষে ফ্রলিন বার্থা কিরচার ও লেফটেন্যান্ট হারল্ড পার্সি স্মিথ-ওল্ডইউক।

    হরিণ শিকার করে কাঁধে ঝুলিয়ে গাছের ডালে ডালে ফিরছিল টারজান। হঠাৎ থেমে নিচের বেড়া ঘেরা কুটিরের দিকে এগিয়ে চলা দুটি মনুষ্যমূর্তির দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। তাদের একজন যুবক- পরনে ব্রিটিশ রাজকীয় বিমান বাহিনীর শতছিন্ন ইউনিফর্ম; অপরজন যুবতী-পরনে একদা পরিচ্ছন্ন অশ্বারোহণ-পোশাকের এক শোচনীয় সংস্করণ।

    ভাগ্যের খেয়ালে তিনটি ভিন্ন চরিত্রের মানুষ এক সঙ্গে বাঁধা পড়েছে। একজন প্রায় নগ্নদেহ বর্বর, একজন ইংরেজ অফিসার, অপর জন এক ঘৃণিত জার্মান গুপ্তচর। এই দুটি প্রাণীকে পূর্ব উপকূল পর্যন্ত পৌঁছে না দেয়া পর্যন্ত তাদের হাত থেকে টারজনের মুক্তি নেই। কিন্তু তা করতে হলে তাকে যে নিজের স্বপ্নের দেশ থেকে অনেক অনেক দূরে সরে যেতে হবে। অথচ না গিয়েও তো উপায় নেই। এই দুটি যুবক-যুবতী তার সাহায্য ছাড়া এত দূরের অজ্ঞাত পথ কিছুতেই পার হতে পারবে না।

    শিকার নিয়ে তিনজন কুটিরে ফিরে গেল। টারজান হরিণটাকে কেটে টুকরো টুকরো করে কিছুটা। নিজের জন্য রেখে বাকিটা দু’জনকে দিয়ে বলল, তোমরা তো আবার রান্না না করে খেতে পার না। টারজনের ওসব বালাই নেই।

    যুবকটি আগুন জ্বালিয়ে দিল। যুবতীটি মাংস রান্নার কাজে মন দিল।

    একটু দূরে বসে স্মিথ-ওল্ডইউক টারজানকে বলল, আশ্চর্য মেয়ে! কি বল?

    টারজান উত্তর দিল, ও জার্মান এবং গুপ্তচর।

    কি বলছ তুমি?

    ঠিকই বলছি। মেয়েটা জার্মান গুপ্তচর।

    আমি বিশ্বাস করি না?

    বিশ্বাস করো না? তোমার বিশ্বাসে আমার কি যায়-আসে। আমি ভাল করেই জানি সে জার্মান গুপ্তচর। তবু সে একটি নারী, তাই আমি তাকে শেষ করে দিতে পারিনি।

    তরুণ লেফটেন্যান্ট বলে উঠল, হা ঈশ্বর! আমি যে কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছি না। মেয়েটি এত মিষ্টি এত সাহসী, আর এত ভাল।

    টারজান দুই কাঁধে ঝাঁকুনি দিয়ে বলল, মেয়েটি সাহসী সে কথা ঠিক। কিন্তু আমি তাকে ঘৃণা করি। তোমারও উচিৎ তাকে ঘৃণা করা।

    লেটেন্যান্ট হারল্ড পার্সি স্মিথ-ওল্ডইউক দুই হাতে মুখ ঢাকল। পরে বলল, ঈশ্বর আমাকে ক্ষমা করুন! আমি ওকে ঘৃণা করতে পারব না।

    তীব্র ঘৃণার চোখে তার দিকে তাকিয়ে টারজান উঠে দাঁড়াল। বলল, টারজান আবার শিকারে যাচ্ছে। যে মাংস আছে তাতে তোমাদের দু’দিন চলে যাবে। ততক্ষণে সে ফিরে আসবে।

    দু’জন একদৃষ্টিতে তার পথের দিকে তাকিয়ে রইল। এক লাফে একটা গাছের ডাল ধরে সে ডালপালার আড়ালে অদৃশ্য হয়ে গেল।

    কুটিরে বসে দু’জন তাদের ভবিষ্যৎ কর্তব্য সম্পর্কে আলোচনা করতে লাগল।

    স্মিথ-ওল্ডইউক বলল, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব একটা সাদা মানুষদের বস্তির সন্ধানে আমাদের বেরিয়ে পড়া উচিৎ।

    বার্থা কিরচার বলল, কিন্তু সে ফিরে না আসা পর্যন্ত আমরা তো যেতে পারি না।

    কিন্তু চলে যেতেই হবে, যুবকটি জোর দিয়ে বলল, সে চায় না যে আমরা এখানে থাকি। বিশেষ করে তুমি।

    মেয়েটি বলল, আমাকে বল সে কি বলেছে। সব কথা জানবার অধিকার আমার আছে।

    মেয়েটির চোখে চোখ রেখে স্মিথ-ওল্ডউইক বলল, সে বলেছে তোমাকে ঘৃণা করে। তুমি একটি নারী বলেই কেবল কর্তব্যবোধে সে তোমাকে সাহায্য করছে।

    মেয়েটির মুখ ম্লান হয়ে গেল। পরক্ষণেই হয়ে উঠল রক্তিম। দৃঢ় গলায় বলল, এই মুহূর্তেই আমি যাবার জন্য প্রস্তুত। কিছুটা মাংস সঙ্গে নিতে হবে। আবার কতদিনে জুটবে কে জানে।

    নদীর ভাটির পথে তারা দক্ষিণ দিকে এগিয়ে চলল। যুবকটি হাতে নিল টারজনের ছোট বর্শাটা। মেয়েটির হাতে একটা লাঠি মাত্র। বার্থার কথামত যাবার আগে যুবকটি একটা চিরকুটে টারজানকে ধন্যবাদ ও বিদায়-সম্ভাষণ জানিয়ে সেটাকে কুটিরের দেয়ালে সেঁটে দিল।

    স্মিথ-ওল্ডইউক নুমাবোর গ্রামে নিয়ে যাবার পরেই উসাঙ্গা বেরিয়ে পড়েছিল তার বিমানটার খোঁজে। কিন্তু সেটাকে খুঁজে পাবার পরে তার মনোভাব পাল্টে গেল। সেটাকে কাজে লাগাবার ধান্দা ঢুকল তার মাথায়। বিমানটির এটা-ওটা নিয়ে নাড়াচাড়া করতে করতে একদিন তার মনে বাসনা জাগল-আহা, সে যদি যন্ত্রটাকে চালাতে পারত! গাছের মাথার অনেক উপর দিয়ে যদি পাখির মত উড়তে পারত!

    কিন্তু অনেক চেষ্টা করেও বিমানটাকে চালাতে পারল না। অবশ্য আশা ছাড়ল না। তখন ভাবল, সাদা চালকটি যখন নুমাবোর গ্রাম থেকে পালিয়েছে তখন একদিন না একদিন সে তার বিমানের খোঁজে আসবেই। তখন তার কাছ থেকেই সে বিমানে ওড়ার কৌশলটা জেনে নিতে পারবে। সেই আশায়ই সে যখন-তখন এসে বিমানটির চারদিকে ঘুরঘুর করে।

    অবশেষে তার প্রতীক্ষার অবসান হল। উত্তর দিক থেকে মানুষের স্বর ভেসে আসতেই উসাঙ্গা দলবল নিয়ে ঘন গাছপালার আড়ালে লুকিয়ে পড়ল। দেখা দিল বহু প্রত্যাশিত ব্রিটিশ অফিসারটি। সঙ্গে সেই সাদা মেয়েটি।

    দুই যুবক-যুবতী জঙ্গল পেরিয়ে একটা খোলা জায়গায় পড়তেই তাদের চোখের সামনে দেখা দিল বহু-বাঞ্ছিত যন্ত্রটি। গভীর স্বস্তি ও আনন্দের উচ্ছ্বাস বেরিয়ে এল তাদের মুখ থেকে। আর ঠিক সেই মুহূর্তেই উসাঙ্গা তার নিগ্রো যোদ্ধাদের নিয়ে ঝোপের আড়াল থেকে বেরিয়ে তাদের দুজনকে ঘিরে ফেলল।

    দিনের পর দিন যায়। উসাঙ্গা একটু একটু করে বিমান চালানোর বিদ্যা আয়ত্ত করে। ক্রমে তার ধারণা হল যে সে একাই বিমান চালাতে পারবে।

    সঙ্গে সঙ্গে আর একটা চিন্তা উসাঙ্গার মাথায় ঝিলিক দিয়ে উঠল। একবার যদি সে নিজে নিজে উড়তে পারে তাহলে আর তাকে পায় কে। সে সোজা উড়ে যাবে পাশের রাজ্যে। সেখানকার রাজা তাকে যন্ত্রটা থেকে নামতে দেখেই ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে তার কাছে আত্মসমর্পণ করবে। সেখানে সে রাজা হয়ে সিংহাসনে বসবে। পাশে থাকবে তার চব্বিশটি বৌ রাণীর সাজে সেজে। আর সকলের মধ্যমণি হয়ে পাটরাণী সেজে বসবে নবাগতা শ্বেতাঙ্গিনী।

    আহ্লাদে উসাঙ্গা একেবারে আত্মহারা। ফন্দি-ফিরিক তৈরি করতেও বিলম্ব হল না।

    সঙ্গে সঙ্গে বেশ কিছু কালা যোদ্ধা এসে স্মিথ-ওল্ডইউকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলে ধাক্কা দিয়ে মাটিতে ফেলে দিল। সেই অবস্থায় সে দেখতে পেল, কিছু দূরে বার্থা কিরচারও হাত-পা বাঁধা অবস্থায় উসাঙ্গার পাশে দাঁড়িয়ে প্রচণ্ডভাবে মাথা নেড়ে কি যেন বলছে।

    উসাঙ্গার হুকুমে কালা আদমিরা মেয়েটিকে বিমানে তুলে দিল। সেখানে তার হাতের বেড়ি খুলে দিয়ে আসনে বসিয়ে উসাঙ্গা তাকে পেটি দিয়ে ভাল করে বেঁধে দিল। তারপর নিজে বসল সামনের আসনে।

    মেয়েটি মুখ ফিরিয়ে তাকাল ইংরেজ যুবকটির দিকে। চেঁচিয়ে বলল, বিদায়!

    যুবকটি ভারী গলায় বলল, বিদায়! ঈশ্বর তোমার সহায় হোন!

    উসাঙ্গা বোধ হয় বিমান-চালানোটা ভালই শিখেছে। একটা ধাক্কা খেয়ে বিমানটা মাটি ছাড়ল। বেশ ভালভাবেই উঠে গেল।

    দু’দিন ধরে শিকার করে টারজান ফিরে এল।

    কুটির ও তার চারদিকের বেড়া যেমন ছিল তেমনই আছে। কিন্তু ভিতরে জনমানবের চিহ্নও নেই। ভাল করে চারদিকটা খুঁকেই সে বুঝতে পারল, দু’দিই আগেই তারা চলে গেছে। বেরিয়ে যাবার জন্য পা বাড়াতেই ঘরে দেওয়ালে আঁটা এক টুকরো কাগজের উপর তার চোখ পড়ল। তাতে লেখা?

    মিস্ কিরচার সম্পর্কে তুমি আমাকে যা বলেছ তারপরে এবং তুমি যে তাকে অপছন্দ কর সেটা বুঝতে পেরে আমার মনে হয়েছে যে আর বেশিদিন তোমার ঘাড়ে চেপে বসে থাকা তার বা তোমার কারও পক্ষেই উচিৎ হবে না। আমি জানি, আমাদের জন্যই তুমি তোমার লক্ষ্যস্থল পশ্চিম উপকূলের দিকে অগ্রসর হতে পারছ না। তাই একটা কোন সাদা মানুষদের বসতি খুঁজে বের করার চেষ্টায় আমরা দু’জনেই বেরিয়ে পড়লাম। যে স্নেহের আশ্রয় তুমি আমাদের দিয়েছিলে সে জন্য আমরা দুজনই তোমাকে ধন্যবাদ জানাই।

    চিরকুটের নিচে লেফটেন্যান্ট হারল্ড, পার্সি স্মিথ-ওল্ডইউকের স্বাক্ষর।

    টারজান কাঁধ ঝাঁকাল; চিরকুটটাকে দলা পাকিয়ে ছুঁড়ে দিল। একটা অজানা প্রেরণায় হঠাৎ ছুটতে শুরু করল। অনেক পথ পার হয়ে দক্ষিণ পথে কয়েক মাইল এগিয়ে হঠাৎ তার কানে একটা গুড়গুড় শব্দ এল। ভাল করে কান পেতে হঠাৎ সে বলে উঠল, একটা বিমানের শব্দ।

    দ্রুতগতিতে ছুটতে ছুটতে সেই মাঠের প্রান্তে গিয়ে সে হাজির হল যেখানে মাটিতে নেমেছিল স্মিথ ওল্ডইউকের বিমান। দ্রুত দৃষ্টি চালিয়ে চারদিকে যা দেখতে পেলে তাতেই পরিস্থিতিটা বুঝতে পারলেও নিজের চোখকেই যেন সে বিশ্বাস করতে পারছিল না। হাত-পা বাঁধা অসহায় অবস্থায় মাটিতে পড়ে আছে ইংরেজ অফিসারটি। তাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে জার্মান পক্ষত্যাগী একদল কালা আদমি। একটা বিমান। তার দিকেই এগিয়ে আসছে। বিমানের চালক কালা উসাঙ্গা, আর তার পিছনের আসনে সাদা মেয়ে বার্থা কিরচার। এই অশিক্ষিত বর্বর মানুষটা কেমন করে বিমান চালাবার কৌশল শিখল তা নিয়ে মাথা ঘামাবার সময় তখন নেই। শুধু এইটুকু সে বুঝতে পারল যে কালা সার্জেন্ট উসাঙ্গা সাদা মেয়েটিকে নিয়ে পালাবার চেষ্টা করছে।

    ততক্ষণে বিমানটা মাটি ছাড়বার উপক্রম করেছে। মুহূর্তের মধ্যেই ধরা-ছোঁয়ার বাইরে চলে যাবে। মেয়েটিকে উদ্ধার করার একটি মাত্র উপায় আছে। কিন্তু সে চেষ্টায় বিফল হলে তার নিজের মৃত্যু অনিবার্য। তবু সেই পথটাই টারজান অনুসরণ করল।

    অনভ্যস্ত বিমান-চালানোর কাজে ব্যস্ত থাকায় উসাঙ্গা টারজানকে দেখতে পায়নি; কিন্তু একদল কালা আদমির চোখের সামনে সে দ্রুতগতিতে ছুটে গেল বিমানটার দিকে। কাঁধ থেকে লম্বা ঘাসের দড়িটা তুলে নিয়ে তার ফাঁস-কল বসানো দিকটাকে সজোরে মাথার উপর ঘোরাতে লাগল।

    ছুটন্ত লোকটির মাথার বিশ ফুট উঁচু দিয়ে বিমান তখন উড়ে চলেছে। দড়ির ফাঁস-কলটা বিমানের কাছে যেতেই ব্যাপারটা বুঝে নিয়ে বার্থা কিরচার দুই হাতে সেটাকে লুফে নিল। সঙ্গে সঙ্গে টারজনের পা দুটো মাটি থেকে উপরে উঠে গেল, আর তার ভারে বিমানটা বাঁ দিকে কাত হয়ে পড়ল। উসাঙ্গা বেপরোয়াভাবে চাকাটাকে ঘুরিয়ে দিতেই বিমানটা খাড়া হয়ে উপরে উঠে গেল। দড়ির অপর প্রান্ত ধরে টারজান ঝুলতে লাগল ঘড়ির পেণ্ডুলামের মত।

    ইংরেজ যুবকটি চিৎ হয়ে পড়ে সব কিছুই দেখল। টারজনের দোদুল্যমান অবস্থা দেখে তার বুকের রক্ত হিম হয়ে গেল। লম্বা গাছগুলোতে ধাক্কা খেয়ে লোকটির শরীর যে ভেঙ্গে চুরমার হয়ে যাবে।

    কিন্তু সে রকম কিছু ঘটল না। বিমানটি গাছের মাথা ছাড়িয়ে আরও উপরে উঠে গেল। ফঁস কলটাকে দুই হাতে চেপে ধরে মেয়েটি প্রাণপণ শক্তিতে অপর প্রান্তের ভারী দেহটাকে টেনে রেখেছে। আর টারজানও দড়ি বেয়ে একটু একটু করে বিমানের দিকে উঠে যাচ্ছে।

    উসাঙ্গা কিন্তু এসব কিছুই জানতে পারেনি। সে বিমানটিকে উঁচুতে-আরও উঁচুতে চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।

    এমন সময় এক হাতে বিমানটির একপাশ আঁকড়ে ধরে টারজান ভিতরে উঠে এল। এক পলকে উসাঙ্গার দিকে তাকিয়ে মেয়েটির কানের কাছে মুখ নিয়ে বলল, কখনও বিমান চালিয়েছ কি? মেয়েটি সম্মতিসূচক মাথা নাড়ল।

    ঐ লোকটাকে জাপটে ধরে তুমি ওর পাশে উঠে যেতে পারবে কি?

    উসাঙ্গার দিকে তাকিয়ে কাঁপা গলায় মেয়েটি বলল, পারব, কিন্তু আমার পা দুটো যে বাঁধা।

    খাপ থেকে শিকারী-ছুরিটা টেনে বের করে টারজান মেয়েটির পায়ের বেড়ি কেটে দিল। পরমুহূর্তেই এক লাফে সে জায়গা করে নিল উসাঙ্গার পাশে। বেচারি কিছু বুঝবার আগেই ইস্পাত কঠিন আঙুল চেপে বসল তার গলায়। একটা বাদামী হাতে ঝলসে উঠল তীক্ষ্ণ ছুরি। কোমরের ফিতেটা দুই খণ্ড হয়ে গেল। পেশীবহুল দুটো হাতে তাকে তুলে ধরে নিচে ছুঁড়ে ফেলে দিল।

    নিচে ভূমি-শয্যায় শুয়ে লেফটেন্যান্ট স্মিথ-ওল্ডইউক যখন দেখল যে একটা মানুষের দেহ সবেগে নিচে নেমে আসছে তখন আতংকে সে শিউরে উঠল। শূন্যে পাক খেতে খেতে এসে দেহটা মাটিতে ছিটকে পড়ে একেবারে তালগোল পাকিয়ে গেল।

    বিমানটি স্বচ্ছন্দে নিচে নেমে এল। এক লাফে বিমান থেকে নেমে টারজান ছুটে গেল যুবক লেফটেন্যান্টটির কাছে। কালা যোদ্ধারা কেউ সেখানে নেই। অলৌকিক সব কাণ্ড-কারখানা দেখে সকলেই পালিয়েছে।

    টারজান যুবকটির বাঁধন খুলে দিল। ততক্ষণে মেয়েটিও নেমে এসেছে। মুখে ধন্যবাদের কথা উচ্চারণ করতেই টারজান ইঙ্গিতে তাকে থামিয়ে দিয়ে যুবকটির দিকে ঘুরে বলল, এখনই যাত্রা কর। তোমরা কেউই জঙ্গলের লোক নও। তার মুখে ঈষৎ হাসি ফুটল।

    স্মিথ-ওল্ডইউক বলল, আমাদের তো নয়ই, এই জঙ্গল কোন সাদা মানুষেরই বাসস্থান নয়। তুমিও কেন আমাদের সঙ্গে সভ্য জগতে ফিরে চল না।

    টারজান মাথা নাড়ল। আমি জঙ্গলই ভালবাসি।

    তাছাড়া তুমি যা বলতে চাইছ তা বুঝতে পেরেছি। কিন্তু তার দরকার হবে না। কি জান, জঙ্গলেই আমি জন্মেছি। সারাটা জীবন জঙ্গলেই কাটিয়েছি। জঙ্গলেই মরতে চাই। আর কোথাও বাঁচতে বা মরতে চাই না।

    দু’জনেই মাথা নাড়তে লাগল। এই মানুষটিকে তারা বুঝতে পারে না।

    টারজান বলল, চলে যাও। যত তাড়াতাড়ি যাবে, তত তাড়াতাড়ি নিরাপদ হবে।

    দু’জন একসঙ্গে বিমানের দিকে গেল। স্মিথ-ওল্ডইউক টারজনের হাতটা টেনে ধরে দ্রুত পায়ে বিমানে উঠে গেল। হাতটা বাড়িয়ে দিয়ে বার্থা কিরচার বলল, বিদায়।

    লেফটেন্যান্ট হারল্ড পার্সি স্মিথ-ওল্ডইউক চালিত ব্রিটিশ বিমানটা যখন বার্থা কিরচারকে সঙ্গে নিয়ে বহু বিপদসংকুল জঙ্গলের অনেক উপরে উঠে গেল তখন হঠাৎই মেয়েটির মন খারাপ হয়ে গেল। এমন একটা মানুষকে সে পিছনে ফেলে যাচ্ছে যার প্রতি তার মনের টানের বুঝি অন্ত নেই।

    লেফটেন্যান্ট স্মিথ-ওল্ডইউক কিন্তু সপ্তম স্বর্গে। সে ফিরে পেয়েছে প্রিয় বিমানটিকে, দ্রত উড়ে চলেছে সহকর্মীদের কাছে, সঙ্গে ভাল-লাগা মেয়েটিও রয়েছে।

    নিচে ঘন অরণ্য: সম্মুখে দূর-বিস্তার অনুর্বর মরুভূমি। একটা পাহাড়ের চূড়াকে পার হবার পরক্ষণেই তাদের পথ আটকে উড়ে এল শকুন স্কার। সবেগে এসে শকুনটা বিমানের উপর পড়তেই প্রপেলারের আঘাতে স্কার ছিন্নভিন্ন রক্তাক্ত নিষ্প্রাণ দেহটা পালকের মত ছিটকে পড়ল মাটিতে। একটা ভাঙ্গা টুকরো আঘাত করল চালকের কপালে। সে মূৰ্ছিত হয়ে পড়ে গেল। আর বিমানটা গোত্তা খেয়ে খাড়া ঝাঁপ দিল পৃথিবীর বুকে।

    পাইলট মুহূর্তের জন্য জ্ঞান হারিয়েছিল; কিন্তু ক্ষতি যা হবার তার মধ্যেই হয়ে গেছে। জ্ঞান ফিরে আসতেই পাইলট বুঝতে পারল মোটরটা থেমে গেছে। বিমান সঞ্চারিত হয়েছে তীব্র গতিতে পৃথিবীর বুকে।

    নিচে চোখে পড়ল একটা সংকীর্ণ গিরি-খাত। অনেকটা সমতল ও বালুকাময়। মুহূর্তের মধ্যে স্মিথ ওল্ডউইক মনস্থির করে ফেলল : ওই গিরি-খাতে অবতরণই অপেক্ষাকৃত নিরাপদ। তাই সে করল; অবশ্য তাতেও বিমানটির বেশ ক্ষতি হল, আর দু’জনে ঝাঁকি খেল প্রচণ্ড।

    সৌভাগ্যবশত দু’জনের কেউই সেরকম আঘাত পেল না, কিন্তু তাদের অবস্থা দাঁড়াল শোচনীয়।

    মেয়েটি শুধাল, তুমি কি যন্ত্রটা মেরামত করতে পারবে না?

    চেষ্টা করে দেখতে হবে। আশা করি গুরুতর ক্ষতি কিছু হয়নি। টাঙ্গা রেলপথ তো এখান থেকে অনেক-অনেক দূরে।

    দু’দিন ধরে স্মিথ-ওল্ডউইক বিমানটাকে মেরামতের অনেক চেষ্টা করল। কিন্তু তার সব চেষ্টাই বিফল হল।

    স্মিথ-ওল্ডইউক বিমানে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে। মেয়েটি তাকিয়েছিল নিচের গিরি-খাতের দিকে। হঠাৎ সে যুবকটির হাত চেপে ধরল। ফিসফিস্ করে বলল, ওই দেখ।

    তার দৃষ্টি অনুসরণ করে দূরে পাহাড়ের বাঁকের দিকে দৃষ্টি ফিরিয়ে যুবক দেখতে পেল একটা বড় সিংহের মাথা।

    সিংহ নুমা একটু একটু করে এগিয়ে আসেছ। বিমানের একেবারে কাছে এসে উপরের দিকে তাকিয়েই সে একটা লাফ দিল। পাইলটও পিস্তল থেকে গুলি ছুঁড়ল।

    আর ঠিক সেই ক্ষণে অরণ্যরাজ টারজনের প্রবেশ ঘটল সেই দৃশ্যে। তাকে দেখেই নুমা মুখ ফিরিয়ে তার দিকে এগিয়ে গেল।

    টারজান বর্শা হাতে তৈরি ছিল। কিন্তু সে চিনতে পারল, এটা তার পরিচিত নুমা।

    নুমাও তাকে চিনতে পেরেছে। গুটি-গুটি পায়ে এগিয়ে এসে সিংহটা টারজনের পাশে দাঁড়াল বিশ্বস্ত ভৃত্যের ভঙ্গীতে।

    মুহূর্তের মধ্যে অরণ্যরাজ টারজান রূপান্তরিত হল লর্ড গ্রেস্টোক জন ক্লেটন-এ। বিমানের দিকে তাকিয়ে হেসে বলল, তোমাদের খুঁজে পাবার আশা প্রায় ছেড়েই দিয়েছিলাম। বড় ঠিক সময়ে এসে পড়েছি। বিমানটা কি একেবারেই অকেজো হয়ে গেছে?

    হ্যাঁ, কোন আশা নেই, স্মিথ-ওল্ডইউক বলল।

    টারজান শুধাল, তাহলে এখন কি করবে কিছু ভেবেছ?

    মেয়েটি উত্তর দিল, আমরা উপকূলে পৌঁছতে চাই। কিন্তু এখন তো সেটা অসম্ভব বলে মনে হচ্ছে।

    টারজান বলল, কিছুক্ষণ আগে হলে আমিও তাই মনে করতাম। কিন্তু নুমাকে যখন এখানে পেয়েছি তখন জলভাগ নিশ্চয় খুব দূরে হবে না। তোমরা নেমে এস।

    যুবক-যুবতী দুটি ভয়ে ভয়ে বিমান থেকে নেমে এল। আগে আগে চলল নুমা। তার পিছনে-পিছনে বাকিরা। অন্ধকার নেমে আসার আগেই হঠাৎ টারজান দাঁড়িয়ে পড়ল। দুই সঙ্গী সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকাতে সে আঙুল বাড়িয়ে সামনের পথটা দেখাল। ভাল করে নজর করতেই মেয়েটি চেঁচিয়ে বলে উঠল, মানুষের পায়ের ছাপ।

    টারজান মাথা নাড়ল।

    মেয়েটি আঙুল বাড়িয়ে বলল, কিন্তু পায়ের আঙুলের কোন ছাপ নেই।

    পায়ে নরম স্যান্ডেল ছিল, টারজান বুঝিয়ে বলল।

    তাহলে তো নিশ্চয় কাছাকাছি কোন গ্রাম আছে। স্মিথ-ওল্ডইউক বলল।

    টারজান বলল, তা আছে; কিন্তু আফ্রিকার এই সব অঞ্চলে যে সব মানুষ বাস করে তারা তো পায়ে স্যান্ডেল পরে না।

    তার মানে তুমি মনে কর যে এগুলো কোন সাদা মানুষের পায়ের ছাপ?

    সেইরকমই তো মনে হচ্ছে, বলেই টারজান হঠাৎ মাটিতে হামাগুড়ি দিয়ে পথটা শুঁকতে শুরু করল।

    যৎসামান্য খাবারে নৈশভোজন শেষ করে টারজান মেয়েটিকে একটা গুহার ভিতরে ঢুকতে বলল।

    বলল, তুমি ভিতরে ঘুমাবে। লেফটেন্যান্ট ও আমি শোব বাইরে গুহার মুখে।

    সেই রাতেই একদল মানুষ এসে তাদের আক্রমণ করল। এতগুলো মানুষের বিরুদ্ধে একা কিছুই করতে পারবে না জেনেও টারজান রুখে দাঁড়াল। কিন্তু তার সব চেষ্টা ব্যর্থ হল। একটা প্রচণ্ড ধাক্কায় ছিটকে পড়ে মাথায় আঘাত পেয়ে সে জ্ঞান হারাল।

    যখন জ্ঞান ফিরল তখন ভোরের আলো ফুটেছে। টারজান করে ধীরে চোখ মেলল।

    গুহার ভিতরে তাকিয়ে দেখল, স্মিথ-ওল্ডইউক ও বার্থা কিরচার কেউই সেখানে নেই। তার সব চেষ্টাই ব্যর্থ হয়েছে দেখে টারজান তীব্র রোষে মাথাটা ঝাঁকি দিল। যেমন করেই হোক এবার খুঁজে বের করতে হবে বার্থা কিরচার ও স্মিথ-ওল্ডইউককে। পথে অনেক স্যান্ডেল-পরা পায়ের ছাপ এবং একদল বিচিত্র মানুষের গন্ধ পেল। চলতে চলতে তার নাকে এল মেয়েটির গন্ধ, একটু পরে স্মিথ-ওল্ডইউকের গন্ধ। পথ ক্রমেই সরু হয়ে এল। মেয়েটি ও ইংরেজটির পায়ের ছাপও স্পষ্টতর হয়ে উঠল।

    মাটিতে উপুড় হয়ে শুয়ে আর একবার ভাল করে শুঁকে টারজান মেয়েটি ও তার অপহরণকারীদের পথের সন্ধান পেয়ে সেই পথে চলতে শুরু করল। চলতে চলতে এক সময় হঠাৎ তার বিস্মিত দৃষ্টির সামনে দেখা দিল গম্বুজ ও মিনারে শোভিত একটি প্রাচীরঘেরা নগর। প্রাচীর ছাড়িয়ে আকাশে মাথা। তুলেছে কয়েকটি গম্বুজ ও অসংখ্য মিনার; কেন্দ্রস্থ গম্বুজটি সোনালী রং করা; বাকিগুলো লাল, নীল বা হলুদ।

    সূর্য অস্ত গেল। অন্ধকারে ঢেকে গেল প্রাচীরঘেরা নগর। জানালায় জানালায় আলো জ্বলে উঠল। টারজান আগেই ভেবে রেখেছিল, কিছুটা দূরে পূর্ব দিকের প্রাচীর যেখানে দ্রাক্ষালতায় ছেয়ে গেছে সেখান দিয়ে প্রাচীর টপকে নগরে ঢুকবে। জঙ্গল ও প্রাচীরের মাঝখানে প্রায় সিকি মাইলের ব্যবধান। নিচের খোলা জায়গাটা হিংস্র পশুর অবাধ চলাফেরা। তার ভিতর দিয়ে ছুটে গিয়ে দ্রাক্ষালতা বেয়ে প্রাচীরের উপর উঠতে হবে।

    লোকগুলো যখন তার সঙ্গী দু’জনের উপর দিয়ে ছুটে এল তখন বার্থা কিরচার কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গুহার এক কোণে কুঁকড়ে সরে গেল। গুহার অন্ধকারে সে কিছুই দেখতে পাচ্ছিল না। কয়েকটা হাত এসে তাকে চেপে ধরল। তাকে টানতে টানতে গুহার বাইরে টেনে আনা হল। খাদের বালুময় পথে পা দিয়েই সে দেখতে পেল, কয়েকজন মিলে একটা লোককে প্রায় টানতে টানতে নিয়ে চলেছে। বুঝল, এ লোক স্মিথ-ওল্ডইউক ছাড়া অন্য কেউ নয়।

    জঙ্গল পার হতেই সামনে চাষের ক্ষেত ও একটা প্রাচীরঘেরা নগর দেখতে পেয়ে তারা অবাক হয়ে গেল।

    স্মিথ-ওল্ডইউক বলে উঠল, আরে, এ যে রীতিমত ইঞ্জিনীয়ারের হাতের কাজ।

    মেয়েটি দূরে তাকিয়ে বলে উঠল, আর ঐ গম্বুজ ও মিনারগুলো দেখ। প্রাচীরের ওপাশে নিশ্চয় সভ্য মানুষরা বাস করে। হয়তো ভাগ্যক্রমেই আমরা তাদের হাতে পড়েছি।

    স্মিথ-ওল্ডইউক মাথা নেড়ে বলল, হয়তো তাই। তবু আমার কেমন যেন ভাল বোধ হচ্ছে না। নিশ্চয়ই কিছু একটা গোলমাল আছে।

    খিলান-দেয়া ফটক পার হয়ে তারা ভিতরে ঢুকল। সরু সরু পথ। দু’দিকে সারি সারি বাড়ি ঘর। অধিকাংশই দোতলা।

    একদল রক্ষী এসে বার্থা কিরচারকে ইশারায় তাদের অনুগমন করতে বলল। স্মিথ-ওল্ডইউককে সঙ্গে নিল না। কিছুক্ষণ পরে আর দু’জন রক্ষী এসে তাকে নিয়ে গেল।

    বার্থা কিরচারকে নিয়ে যাওয়া হলো নগরের সবচাইতে বড় ও বেশি জাঁকজমকপূর্ণ বাড়িটাতে।

    পর পর অনেকগুলো দরজা পার হয়ে তারা একটা হলে ঢুকল। মেঝেতে পায়চারি করছে লাল পোশাকে সজ্জিত একটি মানুষ। তার বুক ও পিঠের উপর প্রকাণ্ড দুটো কাকাতুয়ার মূর্তি, আর শিরস্ত্রাণের উপর বসানো একটা খড়ভর্তি কাকাতুয়া।

    ঘরের চার দেয়ালে শত শত, হাজার হাজার কাকাতুয়ার মূর্তি কাপড়ের উপর সেলাই করে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে।

    লোকটি ঘরময় হাঁটছে তো হাঁটছেই। একটি মেয়েকে সেখানে আনা হয়েছে সে খেয়ালই নেই। হঠাৎ পায়চারি থামিয়ে ঘুরে দাঁড়িয়ে সে ছুটে এল মেয়েটির দিকে। তাকে ছুটে আসতে দেখে মেয়েটি তাকে রুখবার ভঙ্গীতে হাত বাড়িয়ে দিয়ে সভয়ে পিছনে হটে গেল।

    লোকটি কিন্তু খুব কাছে এসেও তাকে স্পর্শ পর্যন্ত করল না। চোখ ঘুরিয়ে তাকে দেখতে লাগল, আর তার চুল, চামড়া, পোশাক, বিশেষ করে তার দাঁতগুলো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখল।

    তারপর আবার পায়চারি শুর করল। এইভাবে পনেরো মিনিট কাটাবার পরে রক্ষীদের কি যেন হুকুম করতেই তারা মেয়েটিকে নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।

    অনেকগুলো বারান্দা ও ঘর পার হয়ে তারা সিঁড়ি বেয়ে আরও একতলা উপরে উঠে গেল। সেখানে একটা ছোট ঘরে তাকে ঢুকিয়ে দিয়ে রক্ষীরা দরজায় তালা লাগিয়ে চলে গেল।

    এক কোণে একটা নিচু আসনে বসে আছে একটি নারী। তার উপর চোখ পড়তেই বার্থ কিরচার চমকে উঠল। এ যে তারই মত এক শ্বেতাঙ্গিনী। বৃদ্ধ বয়স, বিবর্ণ নীল চোখ, থোবড়ানো দন্তহীন মুখ বলীরেখায় আকীর্ণ।

    দুর্বল দেহে বৃদ্ধা দুই হাতে লাঠিতে ভর দিয়ে স্খলিত পায়ে মেয়েটির দিকে এগিয়ে গেল। তাকে আপাদ মস্তক নিরীক্ষণ করে কাঁপা-কাঁপা গলায় বলল, তুমি কি বাইরের জগৎ থেকে এসেছ? ঈশ্বর করুণ, তুমি যেন আমার এই ভাষা বুঝতে ও বলতে পার।

    বার্থা কিরচার সবিস্ময়ে প্রশ্ন করল, তুমি একজন ইংরেজ? কত বছর এখানে আছ?

    ষাট বছর আমি এই প্রাসাদের বাইরে যাইনি। হাড়-জিরজিরে হাতটা বাড়িয়ে বলল, এস। এই আসনে আমার পাশে বস।

    মেয়েটিকে নিয়ে আসনে বসে বৃদ্ধা বলল, এবার বল, তুমি কেমন করে এদের খপ্পরে পড়লে?

    মেয়েটি সংক্ষেপে সব কথাই বলল। সব শুনে বৃদ্ধা শুধাল, তাহলে তোমার সঙ্গে একটি ছেলেও আছে?

    হ্যাঁ, কিন্তু সে যে কোথায় আছে, তাকে নিয়ে এরা কি করেছে, কিছুই আমি জানি না।

    বৃদ্ধা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। একটু পরে মেয়েটি শুধাল, এরা কারা? এরা তো আমাদের মত নয়, আর তুমিই বা এখানে এলে কেমন করে?

    আসনে দুলতে দুলতে বৃদ্ধা বলতে শুরু করল ও সে অনেক দিন আগেকার কথা। আমার বয়স তখন মাত্র বিশ বছর। খুবই সুন্দরী ছিলাম। বাবা ছিল মধ্য আফ্রিকার একজন মিশনারী। একদিন সেখানে হানা দিল একদল আরব ক্রীতদাস-ব্যবসায়ী। ছোট গ্রামের অন্য নারী-পুরুষের সঙ্গে তারা আমাকেও নিয়ে গেল।

    তারপর নদী, নালা, প্রান্তর, পাহাড় পেরিয়ে সে এক দীর্ঘ যাত্রা। ক্রমে তাদের হাবভাবে ও কথা বার্তায় বুঝলাম, তারা পথ হারিয়েছে।

    ক্ষুধায় তৃষ্ণায় কাতর হয়ে বন্দী নিগ্রোরা একে একে পথের মাঝখানেই মরতে লাগল। ক্ষিধে মিটাতে লাগল ঘোড়ার মাংস কেটে খেয়ে। শেষ পর্যন্ত এই দেশে এসে পৌঁছলাম মাত্র দু’জন- আমি ও আরব সর্দার আর পৌঁছেই বন্দী হলাম এদের হাতে-ঠিক যেভাবে তুমি বন্দী হয়েছ।

    তোমার মতই আমাকেও তারা এই প্রাসাদে নিয়ে এল। তখন রাজা ছিল পঞ্চবিংশতি আগো। তারপর থেকে অনেক রাজা দেখলাম। কি জান, এরা সকলেই ভয়ঙ্কর।

    কিন্তু এদের হয়েছে কি? মেয়েটি শুধাল।

    বৃদ্ধা বলল, এরা এক পাগল জাত। তুমি কি তা বুঝতে পারনি?

    এরা সব পক্ষীকে ভক্তি করে, কিন্তু এদের প্রধান দেবতা কাকাতুয়া। এই প্রাসাদের একটা খুব সুন্দর ঘরে একটি কাকাতুয়া আছে। সেই এদের দেবাধিপতি।

    কিছুক্ষণ দু’জনই চুপ।

    প্রথম কথা বলল বার্থা কিরচার এখান থেকে পালাবার কি কোন পথ নেই?

    গরাদে-দেয়া জানালার দিকে আঙুল বাড়িয়ে রানী বলল, দেখতেই তো পাচ্ছ। দরজার বাইরে আছে সশস্ত্র খোঁজা। তাকে পার হয়ে রাস্তায় যাবে কেমন করে? একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, না, এখান থেকে পালাবার কোন উপায় নেই।

    ঠিক সেই সময় একটি পীতবসনধারী সৈনিক ঘরে ঢুকে বৃদ্ধাকে কি যেন বলল।

    বৃদ্ধা বার্থাকে বলল, রাজার হুকুম হয়েছে তোমাকে ভালভাবে সাজিয়ে তার কাছে পাঠাতে হবে।

    স্নান সেরে সাজ-পোশাক পরে রক্ষীদের সঙ্গে বার্থা কিরচার বলল রাজ দর্শনে।

    সকলে যখন পাশের ঘরে রাজার জন্য অপেক্ষা করছে তখন আর একটি ঘর থেকে ঢুকল একটি সুন্দর যুবক। পরিধানে রাজকীয় পোশাক। তাকে দেখেই সৈনিকরা উঠে দাঁড়াল।

    জনৈক সঙ্গী অস্ফুট স্বরে বলল, যুবরাজ মেটাক।

    দরবার কক্ষের দিকে দু’পা এগোতেই যুবরাজের চোখ পড়ল বার্থা কিচারের দিকে। হঠাৎ থেমে সে নির্বাক হয়ে তাকিয়ে রইল মেয়েটির দিকে। তার তীক্ষ্ণ দৃষ্টিকে এড়াবার জন্য বার্থা মুখটা ফিরিয়ে নিতেই হঠাৎ মেটাকের সমস্ত শরীর থর থর করে কাঁপতে লাগল। তীব্র স্বরে হুংকার দিয়ে এক লাফে এগিয়ে এসে মেয়েটিকে কাছে টেনে নিল।

    শুরু হয়ে গেল হট্টগোল। যে রক্ষীরা মেয়েটিকে রাজার কাছে নিয়ে যেতে এসেছিল তারা খোলা তলোয়ার উঁচিয়ে যুবরাজকে ঘিরে নৃত্য শুরু করে দিল। বাকি সব রক্ষীরাও পাগলা যুবরাজের প্রতি সহানুভূতি দেখাতে তলোয়ার ঘোরাতে ঘোরাতে ছুটে এল।

    পাগলের কবল থেকে নিজেকে ছাড়াবার জন্য বার্থা প্রাণপণে চেষ্টা করতে লাগল। কিন্তু যুবরাজের বাহুর দৃঢ় বন্ধনে সে তখন শিশুর মত অসহায়। অনায়াসে তাকে বয়ে নিয়ে মেটাক উল্টো দিকের দরজা। দিয়ে বেরিয়ে গেল।

    সেইদিনই সন্ধ্যার ঠিক আগে একজন ক্লান্ত বৈমানিক দ্বিতীয় রোডেশীয় বিমান বাহিনীর কর্নেল ক্যাপেলের হেডকোয়ার্টারে ঢুকে স্যালুট করে দাঁড়াল।

    কর্নেল জিজ্ঞাসা করল, আরে টম্পসন, কি খবর? অন্য সকলেই তো ফিরে এসেছে। ওল্ডউইক বা তার বিমানের কোন পাত্তাই করতে পারেনি। মনে হচ্ছে, তোমারও যদি সেই দশা হয়ে থাকে তাহলে এ প্রচেষ্টা ছেড়েই দিতে হবে।

    যুবক অফিসার বলল, তা করতে হবে না। আমি বিমানটির দেখা পেয়েছি।

    কর্নেল ক্যাপেল বলে উঠল, বল কি হে! কোথায়? ওল্ডউইকের কোন হসিদ পেয়েছ?

    সে অনেক ভিতরে একটা জঘন্য গিরি-খাতের মধ্যে। বিমানটা দেখতে পেয়েছি ঠিকই, কিন্তু সেখানে নামতে পারিনি। একটা সিংহ অনবরত সেটাকে চক্কর মারছে। ঘণ্টাখানেক অপেক্ষা করে শেষ পর্যন্ত চলে এসেছি।

    তোমার কি মনে হয় ওল্ডউইক সিংহের পেটে গেছে?

    লেফটেন্যান্ট টম্পসন বলল, না, সে রকম মনে হল না। বিমানের কাছাকাছি কোথাও সিংহটা শিকার ধরে খেয়েছে এমন কোন চিহ্ন দেখতে পাইনি। যখন দেখলাম কিছুতেই নিচে নামা অসম্ভব নয় তখন। গিরিখাতের এদিক থেকে ওদিকে বার কয়েক উড়ে ভাল করে দেখলাম। একটা আশ্চর্য জিনিস দেখে এলাম। কয়েক মাইল দক্ষিণে একটা ছোটখাটো উপত্যকা গাছপালায় ঢাকা, আর তারই ঠিক। মাঝখানে আমার মাথা খারাপ হয়েছে বলে মনে করবেন না। একটা সুন্দর শহর: রাস্তাঘাট, বড় বড়। বাড়ি, গম্বুজ, মিনার-সব কিছু।

    শহরে লোকজন ছিল? কর্নেলের প্রশ্ন।

    হ্যাঁ। রাস্তায় লোকজন দেখেছি।

    ঠিক সেই মুহূর্তে একটা বড় ভকসল গাড়ি হেডকোয়ার্টারের সামনে এসে থামল। আর এক মিনিট পরেই জেনারেল ম্যাটস্ গাড়ি থেকে নেমে ভিতরে ঢুকল।

    জেনারেল বলল, এই পথেই যাচ্ছিলাম। ভাবলাম নেমে একটু গল্প করে যাই। ভাল কথা, লেফটেন্যান্ট ওল্ডউইকের খোঁজ-খবর কতদূর এগোল? এই তো টম্পসন দাঁড়িয়ে আছে। সেও তো। অনুসন্ধানের কাজে গিয়েছিল বলে শুনেছি।

    ক্যাপেল বলল, ঠিকই শুনেছেন। সেই ফিরেছে সকলের শেষে। লেফটেন্যান্টের বিমানটাকে সে দেখেছে। তারপর টম্পসনের দেয়া বিবরণ সবই তাকে শোনানো হল। তখন দুই অফিসার ও বৈমানিক মিলে টম্পসন-বর্ণিত শহরটার অবস্থানের একটা নক্সা তৈরি করে ফেলল।

    স্মাটস বলল, এ দেশটা যেমন বিশাল তেমনি দুরধিগম্য। তবু একটা ছোট বাহিনীকে সেখানে পাঠাতে হবে। খাদ্য ও জলসহ বেশ কয়েকটা মোট লরিসহ একটা বা দুটো কোম্পানি পাঠাও। পশ্চিমে। যতদূর পর্যন্ত লরি চলে সেখানে একটা বেসক্যাম্প বসাও। গোটা দুই বিমানও পাঠাবে সেই সঙ্গে। তারাই বেস-ক্যাম্পের সঙ্গে যোগাযোগ রাখবে। তোমার বাহিনীকে কখন পাঠাতে পারবে?

    ক্যাপেল জবাব দিল, আজ রাতেই লরি বোঝাই করা হবে, আর কাল সকাল একটা নাগাদ যাত্রা শুরু হবে।

    এক লাফে দ্রাক্ষালতাটা ধরে ঝুলে পড়েই টারজান বুঝতে পারল যে একটা সিংহও কাছাকাছিই আছে, আর তার জীবন নির্ভর করছে লতাটার শক্তির উপরে।

    মাত্র কয়েক ফুট নিচেই বাড়ির ছাদটা দেখতে পেয়ে তার উপর লাফিয়ে পড়ামাত্রই একটি ভারী দেহ পিছন থেকে তার উপর লাফিয়ে পড়ে বাদামী দুই বাহু দিয়ে তার কোমরটা জড়িয়ে ধরল।

    অসুবিধাজনক অবস্থায় ধরা পড়ে প্রথমে টারজান খুবই অসহায় বোধ করল। কিন্তু বিপদে ভড়কে যাবার পাত্র সে নয়। হঠাৎ সে এমনভাবে একটা ঝটকা মারল যে পিছনের লোকটা পাল্টি খেয়ে সামনে ছিটকে পড়ল, আর সেই ফাঁকে টারজান নিজেকে মুক্ত করে তার বুকের উপর বসে বাঁ হাতে চেপে ধরল তার তরবারি শুদ্ধ কব্জিটা আর ডান হাতে চেপে ধরল তার কণ্ঠনালী। গোঁ গোঁ করতে করতে লোকটির জিভ বেরিয়ে এল, চোখের মণি ঠেলে উঠল। তার ভবলীলা সাঙ্গ হল।

    যুবক অফিসার ও মেয়েটিকে খুঁজতে হলে তাকে শহরের পথে পথে ঘুরতে হবে। কিন্তু এ রকম প্রায় নগ্নদেহে পথে নামলে সে তো অচিরেই ধরা পড়ে যাবে। কাজেই একটা ছদ্মবেশ দরকার। কয়েক মিনিটের মধ্যেই ধৃত রক্ষীর কাকাতুয়া মার্কা পোশাকটা গায়ে জড়িয়ে কোমরবন্ধটা কোমরে জড়িয়ে নিল। অবশ্য পোশাকের তলে ছুরিটাকে লুকিয়ে রাখল। এইভাবে বেশ ভাল রকম ছদ্মবেশে টারজান শহরের পথে নামল।

    রাতের অন্ধকারে এ-পথ সে-পথ ঘুরতে ঘুরতে এক সময় হঠাৎ তার চোখে পড়ল, রাস্তার পূর্ব দিকের বাড়ির ছাদ থেকে একটি মনুষ্য মূর্তি নিচে নামবার চেষ্টা করছে। তা দেখে টারজনের মনে কৌতূহল জাগল।

    স্মিথ-ওল্ডইউককে যে গুপ্ত ঘরে রেখে রক্ষীরা চলে গেল তার দেয়াল হাতড়াতে হাতড়াতে স্মিথ ওল্ডইউক একটা কাঠের দরজা পেয়ে গেল। খুব সাবধানে নিঃশব্দে দরজার খিল খুলতেই চোখে পড়ল, বাইরে শুধু চাপ চাপ অন্ধকার।

    অন্ধকারে একটা সরু বারান্দা ধরে এগিয়ে কয়েক গজ যেতেই সে ধাক্কা খেল মইয়ের মত একটা বস্তুতে। সামনের পথ দেয়ালে অবরুদ্ধ। অগত্যা সে মই বেয়ে উপরে উঠতে লাগল। মইয়ের দু’তিনটে ধাপ পার হতেই মাথায় একটা জোর ঠোক্কর খেয়ে একটা হাত মাথার উপর তুলতেই বুঝতে পারল, ছাদের একটা চাপ-দরজার সঙ্গে তার মাথা ঠুকে গেছে। অল্প চেষ্টাতেই দরজাটাকে ঠেলে একটু উঁচু করতেই তার ফাঁক দিয়ে চোখের সামনে ফুটে উঠল রাতের আফ্রিকার তারায় ভরা আকাশ।

    একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস বেরিয়ে এল তার বুকের ভিতর থেকে। ধীরে ধীরে পাল্লাটাকে একপাশে সরিয়ে দ্রুত চারদিকে তাকিয়ে বুঝল, ধারে-কাছে কেউ কোথাও নেই।

    প্রাচীর বেয়ে একটা খিলানের নিচে নেমে গেল। আর তখনই পিছনে সামান্য শব্দ শুনে ফিরে তাকাতেই দেখল, একটি সৈনিক তার একেবারে সম্মুখে দাঁড়িয়ে আছে।

    স্মিথ-ওল্ডইউকের প্রথম চিন্তাই হল, একটা গুলিতে সৈনিককে সাবার করে দিয়ে দুই পা যেদিকে যায় সেই দিকে ছুটে পালাবে, কারণ এর হাতে পড়া মানেই আবার বন্দী হওয়া। সেই কথা ভেবে পিস্তলের জন্য পাশ-পকেটে হাত ঢোকাতেই একটা কঠিন মুঠি তার কব্জিটাকে চেপে ধরল, আর একটি নিম্নকন্ঠ ইংরেজিতে বলে উঠল, লেফটেন্যান্ট, আমি অরণ্যরাজ টারজান।

    স্মিথ-ওল্ডইউক বলে উঠল, তুমি? তুমি? আমি তো ভেবেছিলাম তুমি মরে গৈছ!

    টারজান বলল, না, মরিনি। দেখছি তুমিও মরনি। কিন্তু মেয়েটির খবর কি?

    ইংরেজ যুবক উত্তর দিল, এখানে আসার পর থেকে আর তাকে দেখিনি। শহরে আনার পরেই আমাদের আলাদা করে দিয়েছে।

    টারজান বলল, তাকে তো খুঁজে বের করতেই হবে। হতে পারে সে একটি জার্মান গুপ্তচর, তবু সে নারী-শ্বেতাঙ্গিনী- তাকে আমরা এখানে ফেলে যেতে পারি না।

    শেষ পর্যন্ত ফেলে যেতেও হল না। টারজনের সঙ্গে সংঘর্ষে মেটাকের মৃত্যু হল। সেই সুযোগে তাদের সঙ্গে পরিচয় হল নিগ্রো ক্রীতদাস ওটোবুর সঙ্গে। তাকে ক্রীতদাসত্ব থেকে মুক্তি দেয়া হবে এই শর্তে টারজান তাকেও দলে টেনে নিল। তিনজনের মিলিত আক্রমণে মেটাক পরাভূত হল।

    এবার সুযোগ পেয়ে টারজান মেটাকের গলাটা চেপে ধরল। ধীরে ধীরে দৈত্যের মুঠি বসে গেল তার গলায়। তার চোখ দুটো ঠিকরে বেরিয়ে এল। টারজান তখন তার মৃতপ্রায় দেহটাকে দুই হাতে মাথার উপর তুলে সবেগে জানালা দিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দিল নিচের সিংহের আস্তানার মধ্যে।

    বিজয়গর্বে সঙ্গীদের দিকে ফিরে তাকিয়ে টারজান দেখল সকলে হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

    টারজান ওটোবুকে বলল, তুমি যদি ওয়ামাবো দেশে ফিরে যেতে চাও তাহলে নিরাপদ পথ দরে আমাদের শহরের বাইরে নিয়ে চল।

    নিগ্রো বলল, নিরাপদ পথ তো নেই। তবে সকলের গায়েই এ দেশী পোশাক আছে। তাই ফটক পর্যন্ত আমরা নির্বিঘ্নেই যেতে পারব। তবে বিপদ দেখা দেবে সেখানেই, কারণ রাতের বেলা কাউকে শহর ছেড়ে যেতে দেয়া হয় না।

    টারজান বলল, সে দেখা যাবে। এখন তো চল।

    দুটি পুরুষ, একটি নারী ও একটি কালা ক্রীতদাস এ শহরের পথে কোন অসাধারণ দৃশ্য নয়। তাছাড়া এই গভীর রাতে পথও জনবিরল।

    দুটো মোড় ঘুরতেই ফটকটা চোখে পড়ল। সেখানে অন্তত বিশজন সশস্ত্র সৈনিক তাদের বন্দী করতে প্রস্তুত হয়ে আছে।

    টারজান ইংরেজ যুবকের দিকে ফিরে বলল, তোমার সঙ্গে কত গুলি আছে?

    স্মিথ-ওল্ডইউক উত্তর দিল, পিস্তলে আছে সাতটা, আর পকেটে আছে আরও এক ডজন।

    টারজান বলল, ওটোবু, তুমি থাক এই মেয়ের পাশে। ওল্ডউইক, তুমি আর আমি এগিয়ে যাব।

    শুরু হল আক্রমণ। স্মিথ-ওল্ডইউকের পিস্তল গর্জে উঠল। অনেকেই থর থর করে কাঁপতে কাঁপতে ধরাশায়ী হল। সেই সুযোগে টারজান তার দলবল নিয়ে ফটক পার হয়ে অন্ধকারের ভিতর দিয়ে ছুটতে লাগল।

    একটা গিরি-খাতে ঢোকার পরে দিনের আলো ফুটল। টারজান ছাড়া বাকি সকলেই ক্লান্ত; তবু তারা বুঝতে পারছে খাতের খাড়া পাহাড়ি দিকটা বেয়ে উপরের মালভূমিতে না ওঠা পর্যন্ত যে ভাবে হোক তাদের এগিয়ে যেতেই হবে।

    ক্রমে দুপুর হ’ল। সারাটা পথ টারজান হয় কাঁধে করে নয়তো গলা জড়িয়ে ধরে স্মিথ-ওল্ডউইককে সঙ্গে নিয়ে চলেছে। কিন্তু এবার যে বার্থা কিচারের পাও টলতে শুরু করেছে।

    তার অবস্থা দেখেই দুপুরের পরে ইংরেজ যুবক হঠাৎ বালির উপর বসে পড়ে বলল, আমি আর হাঁটতে পারছি না। মিস কিরচারও ক্রমেই দুর্বল হয়ে পড়েছে। আমাকে ফেলেই তোমাদের এগোতে হবে।

    মেয়েটি বলল, না, তা হতে পারে না। এত বিপদ-আপদের মধ্যেও আমরা একসঙ্গে আছি, আর কপালে যাই থাকুক একসঙ্গে থাকব। টারজনের দিকে মুখ তুলে বলল, অবশ্য তুমি যদি আমাদের এখানে রেখে এগিয়ে যাও সেটা স্বতন্ত্র কথা।

    ঈষৎ হেসে টারজান বলল, তুমি এখনও মরনি; লেফটেন্যান্ট বা ওটোবু বা আমিও মরিনি। হয় মরব না হয় বাঁচব, তবুও যতদিন না মরি ততদিন বাঁচার চেষ্টাই করব। এতদিন যখন আসতে পেরেছি তখন এগিয়েই যাব। আপাতত এখানেই বিশ্রাম করা যাক, কারণ তোমরা একটু সুস্থ হলে আবার আমরা পথ চলব।

    কিন্তু এক্সুজার লোকরা? বার্থা প্রশ্ন করল, তারা কি আমাদের তাড়া করে এখানে আসতে পারে না?

    টারজান বলল, তা আসতে পারে। সে যখন আসে তখন দেখা যাবে।

    প্রায় ঘন্টাখানেক বিশ্রামের পরে টারজান হঠাৎ উঠে বসল। ইশারায় সকলকে চুপ করতে বলে কান পাতল।

    বার্থা বলল, কি হল?

    ওরা আসছে। এখনও অনেক দূরে আছে। কিন্তু তাদের স্যান্ডেল-পরা পায়ের শব্দ ও সিংহের চলার শব্দ আমার কানে আসছে।

    স্মিথ-ওল্ডউইক বলল, আমরা কি করব? আরও এগোব? মনে হচ্ছে এবার আমি কিছুক্ষণ হাঁটতে পারব।

    বার্থা বলল, আমিও পারব।

    টারজান বুঝল এরা কেউই সত্যি কথা বলছে না। এত তাড়াতাড়ি এত বেশি ক্লান্তি কাটতে পারে না।

    তবু বলল, ওটোবু, তুমি লেফটেন্যান্টকে ধর। আমি মিস কিরচারের ভার নিলাম।

    তার আপত্তি সত্ত্বেও টারজান মেয়েটিকে বগলদাবা করে হাঁটতে শুরু করল। পিছনে চলল ওটোবু ও ইংরেজ যুবক।

    সামনেই বালির পথ থেকে কয়েক ফুট উঁচুতে একটা পাথরের চাঙর ভেঙে পড়ে গুহার মত সৃষ্টি হয়েছে। তার ভিতর দিয়ে একটা সংকীর্ণ সুড়ঙ্গ চলে গেছে পিছনের পাহাড় পর্যন্ত। গুহাটার দু’দিক খোলা হলেও ওরা সকলে একসঙ্গে আক্রমণ করতে পারবে না।

    সকলে সেখানে উঠে দেখল গুহাটা দু’ফুট চওড়া আর দশ ফুট লম্বা। তাড়াতাড়ি সকলে সেখানে লুকিয়ে পড়ল।

    টারজান পিস্তলসহ স্মিথ-ওল্ডউইককে রাখল গুহার উত্তর মুখে। ওটোবুকে বলল বর্শা হাতে তার পাশে দাঁড়াতে। নিজের দক্ষিণ মুখের দায়িত্ব। দু’য়ের মাঝখানে মেয়েটিকে শুইয়ে দিয়ে বলল, ওরা বর্শা ছুঁড়লেও এখানে তুমি নিরাপদে থাকবে।

    মিনিটের পর মিনিট কাটতে লাগল। বার্থা কিচারের মনে হল, এ প্রতীক্ষা বুঝি অনন্তকালের।

    প্রথম আক্রমণে এক্সজার লোকরা সুবিধা করতে পারল না। স্মিথ-ওল্ডউইকের গুলির মুখে তারা পিছু হটল। কিন্তু একটু পরেই তারা আবার এল। এবার আধা ডজন মানুষ আর আধা ডজন সিংহ।

    মেয়েটি বলল, এই কি আমাদের শেষ?

    না, টারজান চীৎকার করে বলল, এখনও আমরা বেঁচে আছি!

    আক্রমণকারীরা এবার দু’দিক থেকে বর্শা ছুঁড়তে লাগল। মেয়েটিকে আড়াল করতে গিয়ে একটা বর্শা সজোরে এসে বিধল টারজনের কাঁধে। তার প্রচণ্ড ধাক্কায় সে সপাটে মাটিতে পড়ে গেল। স্মিথ ওল্ডউইক দু’বার গুলি ছুঁড়ল; কিন্তু একটা বর্শা এসে বিধল তার উরুতে। সে অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেল। হাতের পিস্তলটা খসে পড়ল। শত্রুর মোকাবিলা করতে রইল শুধু ওটোবু।

    টারজান ওঠার চেষ্টা করতেই একটি সৈনিক ঝাঁপিয়ে পড়ল তার বুকের উপর। তার হাতের খোলা তলোয়ার ঝিলিক দিয়ে উঠল। আর ঠিক সেই মুহূর্তে বার্তা কিরচার পিস্তলটা তুলে নিয়ে শয়তানটার বুক লক্ষ্য করে ঘোড়া টিপল।

    প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই আক্রমণকারী ও আক্রান্ত উভয় দলের কানেই ভেসে এল গুলির শব্দ-গিরিখাতের দিক থেকে। আকাশ থেকে বুঝি ভেসে এল দেবদূতের মধুর কণ্ঠস্বর- শ্বেতাঙ্গদের কানে বাজল একজন নন- কমিশন্ড ইংরেজ-অফিসারের হুকুমের চীৎকার।

    টারজান অতি কষ্টে উঠে দাঁড়াল। বর্শাটা তখনও তার কাঁধে বিঁধে রয়েছে। এক টানে সেটাকে খুলে ফেলে টারজান বাইরে এসে দাঁড়াল। পিছনে বার্থা কিরচার।

    গিরিখাতের ভিতরে যে খণ্ড-যুদ্ধ বেঁধেছিল তা শেষ হয়েছে। এক্সজার সৈনিকরা সবাই মারা পড়েছে। টারজান ও বার্থাকে ভাল করে দেখে নিয়ে একটি ব্রিটিশ টমি হাতের রাইফেলটা তাক করল টারজনের দিকে। চোখের পলকে বার্থা বুঝে নিল, টারজরেন গায়ের পীতবসনই এই বিভ্রান্তির কারণ। এক লাফে দু’জনের মাঝখানে পৌঁছে সে হাত তুলে চীৎকার করে বলল, গুলি করো না; আমরা দু’জনই বন্ধু।

    টমি তখন টারজানকে হুকুম করল, তাহলে হাত তুলে দাঁড়াও। হলুদ তমাধারীদের বিশ্বাস নেই।

    এই সময় টমি দলের অধিনায়ক ব্রিটিশ সার্জেন্টটি সেখানে হাজির হল। টারজান ও বার্থা ইংরেজিতে তাকে বুঝিয়ে বলল তাদের ছদ্মবেশের কারণ ও অন্য সব বিবরণ। সার্জেন্ট সহজেই তাদের কথা বিশ্বাস করল। স্মিথ-ওল্ডউইক ও টারজনের ক্ষতস্থান বেঁধে দেয়া হল। আধ ঘণ্টার মধ্যেই সকলে যাত্রা করল উদ্ধারকারী দলের শিবিরের দিকে।

    রাতে স্থির হল, পরদিন স্মিথ-ওল্ডউইক ও বার্থা কিরচারকে বিমানযোগে পাঠানো হবে উপকূলবর্তী ব্রিটিশ হেডকোয়ার্টারে। সেজন্য দুটো বিমানের ব্যবস্থাও করা হল। ব্রিটিশ ক্যাপ্টেন প্রস্তাব করল, ফিরতি-যাত্রায় তার বাহিনীর সঙ্গে স্থলপথেই যাবে টারজান ও ওটোবু। কিন্তু টারজান আপত্তি জানিয়ে বলল, তার ও ওটোবুর দেশ পশ্চিম দিকে; কাজেই তারা দুজন একসঙ্গে সেইদিকেই যাবে।

    বার্থা বলল, তাহলে তুমি আমাদের সঙ্গে যাচ্ছ না?

    না। আমার বাড়ি পশ্চিম উপকূলে। আমি সেখানেই যাব।

    মিনতি-ভরা চোখ তুলে মেয়েটি বলল, সেই ভয়ঙ্কর জঙ্গলেই ফিরে যাবে? আর কোনদিন তোমার দেখা পাব না?

    নীরবে তার দিকে তাকিয়ে থেকে টারজান বলল, কোন দিন না। আর একটি কথাও না বলে সেখান থেকে চলে গেল।

    সকালে কর্নেল ক্যাপেল বেস-ক্যাম্প থেকে বিমানযোগে এসে নামল। টারজান একটু দূরেই দাঁড়িয়েছিল। সে দেখল, হাসিমুখে দুই হাত বাড়িয়ে কর্নেল বার্থা কিচারের দিকে এগিয়ে গেল। টারজান তো অবাক। একটি জার্মান গুপ্তচরের সঙ্গে এত মাখামাখি কেন? দূর থেকে তাদের কথাবার্তা কানে না। এলেও বুঝতে পারল, দু’জনের মধ্যে গভীর বন্ধুত্ব।

    বার্থা কিরচার বিমানে ওঠার আগে টারজনের সঙ্গে তার আর দেখা হয়নি। স্মিথ-ওল্ডউইকের সঙ্গেও সেখানেই দেখা হল। যথারীতি বিদায় সম্ভাষণ জানিয়ে সে তাকে বার বার ধন্যবাদ দিল। ছোট হতে হতে। তাদের বিমান পূর্ব দিগন্তের পথে অদৃশ্য হয়ে গেল।

    মালপত্র কাঁধে ফেলে অস্ত্রশস্ত্র ঝুলিয়ে টমিরা যাত্রার জন্য প্রস্তুত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কর্নেল ক্যাপেলও স্থির করেছে তাদের সঙ্গেই যাবে। টারজনের দিকে মুখ ফিরিয়ে সে বলল, তুমিও আমাদের সঙ্গে গেলে খুব খুশি হতাম গ্রেস্টোক। আমার কথায় মন না গললেও হয়তো স্মিথ-ওল্ডউইক ও তরুণীটির। কথা তুমি রাখবে। তারা আমাকে বার বার তোমাকে সভ্যজগতে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে বলে গেছে।

    টারজান বলল, না, আমি আমার পথেই যাব। মিস্ কিরচার ও লেফটেন্যান্ট স্মিথ-ওল্ডউইক আমার প্রতি কৃতজ্ঞতাবশতই আমার ভালর জন্যে ওকথা বলেছে।

    মিস কিরচার? ক্যাপেলের বিস্মিত প্রশ্ন। পরক্ষণেই হেসে ওঠে সে বলল, তাহলে তুমি তাকে জার্মান গুপ্তচর বার্থা কিরচার বলেই জান?

    টারজান এক মুহূর্ত নীরবে তাকিয়ে রইল। তারপর বলল, হ্যাঁ, আমি জানি সে বার্থা কিরচার একজন জার্মান গুপ্তচর।

    বাস্- শুধু এইটুকুই জান? ক্যাপেলের প্রশ্ন।

    হা-এইটুকুই, টারজনের উত্তর।

    তিনি হচ্ছেন মাননীয়া প্যাট্রিসিয়া ক্যানবি; পূর্ব আফ্রিকা বাহিনীর সঙ্গে যুক্ত ব্রিটিশ গোয়েন্দা বিভাগের একজন মূল্যবান কর্মী। ওর বাবা ও আমি ভারতবর্ষে একসঙ্গে কাজ করেছি। জন্মের পর থেকেই ওকে। আমি চিনি। আরে! এই তো দেখ এক বান্ডিল কাগজপত্র যা সে জনৈক জার্মান অফিসারের কাছ থেকে হাতিয়ে নিয়েছিল আর অনেক বিপর্যয়ের মধ্যেও হাতছাড়া করেনি-এমনি অবিচল তার কর্তব্যবোধ। এগুলো ভাল করে দেখার মত সময় এখনও পাইনি, কিন্তু এর মধ্যে আছে একখানা সামরিক মানচিত্র, এক বান্ডিল প্রতিবেদন, আর কে এক হাউটম্যান ফ্রিজ স্নাইডারের দিনপঞ্জি।

    চাপা গলায় টারজান বলল, হাউটম্যান ফ্রিজ স্নাইডারের দিনপঞ্জি। একবার ওটা দেখতে পারি ক্যাপেল? সেই তো লেডি গ্রেস্টোককে খুন করেছে।

    ক্যাপেল বিনা বাক্য ব্যয়ে একটা ছোট বই টারজনের হাতে দিল। খুব দ্রুত পাতা উল্টে টারজান একটা বিশেষ তারিখ খুঁজতে লাগল- যে তারিখে ঘটেছিল একটি ভয়ঙ্কর ঘটনা। সেই তারিখটা পেয়েই পড়তে শুরু করে দিল। হঠাৎ অবিশ্বাসের একটা অস্ফুট শব্দ বেরিয়ে এল তার ঠোঁট থেকে। ক্যাপেল জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তার দিকে তাকাল।

    টারজান বলে উঠল, ঈশ্বর! এ কি সত্যি? শোন। ঠাসাঠাসি লেখা একটা পাতা থেকে সে পড়তে লাগলঃ

    ইংরেজ শুয়োরটার সঙ্গে একটু মস্করা করা গেল। বাড়ি ফিরে স্ত্রীর শোবার ঘরে তার অগ্নিদগ্ধ দেহটাই। সে দেখতে পাবে-কিন্তু তাকে সে স্ত্রী বলেই ভুল করবে। আসলে একটা নিগ্রো রমণীর মৃতদেহকে পুড়িয়ে। ভন গস তার আঙুলে পরিয়ে দিয়েছিল লেডি গ্রেস্টোকের আংটি-জার্মান হাই কমান্ডের কাছে মৃত অপেক্ষা জীবিত লেডি জি-র মূল্য অনেক বেশি।

    সে বেঁচে আছে? টারজান চীৎকার করে বলল।

    ক্যাপেল বলল, ঈশ্বরকে ধন্যবাদ। এখন তুমি কি করবে?

    অবশ্যই তোমার সঙ্গে ফিরে যাব। মিস্ ক্যাবির প্রতি কী অবিচারই না করেছি। কিন্তু আমি জানব কেমন করে? স্মিথ-ওল্ডউইক তাকে ভালবাসে। তাকেও তো আমি বলেছি যে সে একটি জার্মান গুপ্তচর। স্ত্রীর খোঁজে আমাকে তো ফিরে যেতেই হবে। মিস্ ক্যাবির প্রতি এই অবিচারের প্রতিকারও আমাকে করতেই হবে।

    ক্যাপেল বলল, ও নিয়ে মাথা ঘামিও না। মিস্ ক্যান্‌বি নিশ্চয়ই তার প্রেমিককে বোঝাতে পেরেছে যে সে শত্রুর গুপ্তচর নয়, কারণ আজ সকালে আকাশে উড়বার আগে স্মিথ-ওল্ডউইক আমাকে বলে গেছে, মেয়েটি তাকে বিয়ে করবে বলে কথা দিয়েছে।

    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleলাল মৃত্যুর মুখোশ – এডগার অ্যালান পো – (অনুবাদক : চিত্তরঞ্জন মাইতি)
    Next Article The Gringos – Edith Nesbit
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo
    Most Popular

    রবিনসন ক্রুসো – ড্যানিয়েল ডিফো

    August 19, 2025

    অনুরাধা

    January 4, 2025

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    রবিনসন ক্রুসো – ড্যানিয়েল ডিফো

    August 19, 2025

    অনুরাধা

    January 4, 2025

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025
    Our Picks

    রবিনসন ক্রুসো – ড্যানিয়েল ডিফো

    August 19, 2025

    দ্য দা ভিঞ্চি কোড – ড্যান ব্রাউন

    August 19, 2025

    এঞ্জেলস এন্ড ডেমনস – ড্যান ব্রাউন

    August 19, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    Sign In or Register

    Welcome Back!

    Login below or Register Now.

    Lost password?

    Register Now!

    Already registered? Login.

    A password will be e-mailed to you.