Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    সমগ্র কিশোর সাহিত্য – নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়

    September 2, 2025

    ছোটগল্প – নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়

    September 2, 2025

    টেনিদা সমগ্র – নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়

    September 2, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • 🔖
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    Subscribe
    সাইন ইন
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    টেনিদা সমগ্র – নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়

    নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় এক পাতা গল্প790 Mins Read0

    ৬. জয় মা নেংটীশ্বরীর জয়

    আমরা যেই বলেছি, জয় মা নেংটীশ্বরীর জয়, সঙ্গে সঙ্গেই যেন চিচিংচন্দ্র ফাঁক হয়ে গেলেন। মানে, তক্ষুনি সেই সরু গুফো তালঢ্যাঙা চেহারার রোগা লোকটা হুড়মুড় করে একটা নকশাকাটা কালো দরজা টেনে খুলে ফেললে। আর সেই দরজা দিয়ে তাকিয়েই আমরা চারজনে একেবারে থ।

    মা কালী, মা দুর্গা, রাধাকৃষ্ণ, লক্ষ্মী-সরস্বতী-বিশ্বকর্মা শীতলা-শিব, মায় ঘণ্টাকর্ণ ঠাকুর পর্যন্ত অনেক দেবতাই তো আমরা দেখেছি—মানে দেবতা আর কী করে দেখব, তাঁদের মূর্তিটুর্তি তো সব সময়েই দেখে থাকি। পাটনার সেই কংগ্রেস ময়দানে দেখেছি, বাঁশ, কাগজ আর সেই সঙ্গে আরও কী সব দিয়ে তৈরি রাবণ কুম্ভকর্ণ-ইন্দ্রজিতের আকাশ-ছোঁয়া মূর্তি-দশহরার দিন যাদের আগুনের তীর মেরে পুড়িয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু দরজা খুলতে আজ যা দেখতে পেলুম—এমন ঠাকুর এর আগে কোথাও কেউ দেখেছে বলে মনে হল না।

    টেনিদা বিড়বিড় করে বললে, ডি লা গ্র্যান্ডি!

    আমি বললুম, মেফিস্টোফিলিস!

    হাবুল সেন বললে, খাইছে!

    আর ক্যাবলা কিছুই বললে– না, হাঁ করে চেয়ে রইল, কেবল তার চশমাটা নাকের ওপর দিয়ে ঝুলে পড়ল নীচের দিকে।

    কী দেখলুম, সে আর কী বলব তোমাদের। ছোট্ট ঘরটা এই দিন-দুপুরেই অন্ধকার, তার ভেতরে মালার মতো করে লাল-নীল অনেকগুলো ইলেকট্রিকের বা ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছে। বাগুলো মিটমিটে হলেও কটা এক সঙ্গে জ্বলছে বলে একটা অদ্ভুত রঙিন আলো থমথম করছে ঘরময়। সেই আলোয় চিকচিক করছে মস্ত একটা সিংহাসন রুপো-টুপো তাতে লাগানো আছে বোধহয়। সিংহাসনের মাথায় একটা সাদা ছাতা, আর সেই ছাতার তলায় ভেলভেটের গদিতে বসে—

    স্বয়ং মা নেংটীশ্বরী। অথাৎ কিনা—ইয়া জাঁদরেল একটা নেংটি ইঁদুর।

    নেংটি ইংদুরটার মূর্তি একটা ধুমসো হুলো বেড়ালের চাইতেও তিনগুণ বড়। সামনের পা দুটো জড়ো করে, কান খাড়া করে, ল্যাজটাকে পিঠের ওপর দিয়ে বাঁকিয়ে এমন কায়দায় বসে আছে যে আচমকা দেখলে জ্যান্ত বলে মনে হয়। চোখ দুটো বোধ করি কালো কাচ কিংবা পুঁতি দিয়ে তৈরি লাল-নীল আলোতে সে দুটো যেন শয়তানিতে চিকচিক করছে। তার সামনে একটা মস্ত বারকোশে ছোলা কলাবাতাসা-চাল-ডাল এই সব সাজানো রয়েছে, দেবী নেংটীশ্বরীর ভোগ নিশ্চয়।

    তাকিয়ে তাকিয়ে প্রাণ চমকে উঠল। রাত-বিরেতে ওরকম একখানা পেল্লায় ইঁদুর যদি কারও ঘাড়ে লাফিয়ে পড়ে, তা হলে আর দেখতে হবে না। কামড়ে-ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে দেবে একেবারে।

    লোকটা ধমক দিয়ে বললে, কী হে–হাঁ করে সবাই দাঁড়িয়ে রয়েছ যে বড়? বোম্বাচাক লেগে গেল নাকি তোমাদের? মাকে পেন্নাম করলে না?

    বলার সঙ্গে সঙ্গেই আমরা চারজনে একেবারে সাষ্টাঙ্গে লুটিয়ে পড়লুম।

    লোকটা বলে চলল, হেঁ–হেঁ, ভারি দুর্লভ মূর্তি! দুনিয়ার কোথাও দেখতে পাবে না। এঁর প্রিতিষ্ঠে করেছেন কে জানো? বাবা বিটকেলানন্দ। তাঁর নাম শুনেছ তো?

    আমরা এ ওর মুখের দিকে চাইলুম। বিটকেলানন্দ! স্বামী ঘটুঘুটানন্দের সঙ্গে একবার রায়গড়ের জঙ্গলে আমাদের দারুণ রকমের একটা মোলাকাত হয়েছিল—তাকে মুলা কাত-ও বলা যায়, কারণ তিনি আমাদের চারজনকে প্রায় কাত করে ফেলেছিলেন। বিটকেলানন্দ তাঁরই মাসতুতো ভাই কি না, কে জানে!

    ক্যাবলা ঘাড়-টাড় চুলকে বললে, আজ্ঞে, তা—তা শুনেছি বইকি। বাবা বিটকেলানন্দের নাম কেই বা না জানে!

    লোকটা ফোঁস করে দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলল : সে কথা আর বোলো না। তোমরা বুদ্ধিমান বলে তাঁর খবর রাখো, তাই চাঁদনিতে গিয়ে খালের জলের কবিতা আউড়ে এখানে আসতে পেরেছ। কিন্তু অন্য কাউকে জিজ্ঞেস করে দ্যাখো, ঠোঁট উলটে অমনি বলে বসবে—অ্যাঁ, বিটকেলানন্দ? সে আবার কে!—লোকটার মুখ মনের দুঃখে যেন লম্বা হয়ে গেল : ছাঃ, এই জন্যই দেশটার কিছু হয় না।

    সঙ্গে সঙ্গে টেনিদাও কেমন বাজখাঁই গলায় বলে বসল, আজ্ঞে যা বলেছেন—এই জন্যেই দেশের কিছু হয় না। কী রকম বাঘাটে গলায় টেনিদা বলে ফেলল কথাটা, ঘর গম্ করে উঠল, লোকটাও যেন চমকে গেল। তারপর বললে, অথচ দ্যাখো বাবা বিটকেলানন্দ স্বপ্নাদেশ পেয়েছিলেন। চালাকি নয়?

    খাইছে!–হাবুল আর থাকতে পারল না। –খাইছে?—লোকটা আবার চমকে গেল : তার মানে? কী খেয়েছে? কোথায় খেয়েছে?কেনই বা খেল? ক্যালা বললে, যেতে দিন—যেতে দিন, ও মধ্যে মধ্যে ওই রকম বলে—কেউ কিছু খায়নি। এখন আপনি যা বলছিলেন বলুন।

    —আমি বলছিলুম, স্বপ্নাদেশ।—লোকটা একবার গলাখাঁকারি দিলে : বাবা বিটকেলানন্দ ছেলেবেলা থেকেই ভাবুক। ইস্কুলে মাস্টার পড়া জিজ্ঞেস করলে মৌনী হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতেন, পাষণ্ড মাস্টারগুলো ভাবত বাবার মাথায় কিছু নেই, তাই তাঁকে গোরুর মতো ঠ্যাঙাত। তারা তো জানত নাবাবা তখন ধ্যান করছেন। কিছু না বুঝেই মহাপাপী মাস্টারেরা পিটিয়ে তাঁর ধুন্ধুড়ি উড়িয়ে দিত ক্লাসে প্রোমোশন দিত না।

    আমি বললুম, আহা! ক্যাবলা বললে, আহা-হা! হাবুলও যেন কী একটা বলতে যাচ্ছিল, ঘাড়ে একটা থাবড়া বসিয়ে টেনিদা তাকে থামিয়ে দিলে। লোকটার গলার স্বর ভাবে কাঁদো-কাঁদো হয়ে উঠল, সে বললে, আহো-হো! যাক, তারপরে শোনো। ঠ্যাঙানি খেতে খেতে বাবা বিটকেলানন্দের মতো মহাপুরুষেরও ধৈর্যচ্যুতি হল। তিনি ভেবে দেখলেন, মাস্টারের গাঁট্টাতেই যদি তাঁকে মহাপ্রস্থানে যেতে হয়, তা হলে তিনি ধ্যান-জপ করবেন কী করে—আবার জীবেরই বা গতি হবে কী! তারপর একদিন তিনি বাড়ি ছেড়ে সটকালেন।

    ক্যাবলা বললে, বুদ্ধের গৃহগ আর কি।

    লোকটা মাথা নাড়ল : যা বলেছ, ব্যাপার প্রায় সেই রকম। কিন্তু জানো, বুদ্ধের কাল তো এটা না, মহাপুরুষকে এখন আর চেনে কে! তাই বাবা আর বোধিবৃক্ষের তলায় বসলেন না, তার বদলে গিয়ে চাকরি নিলেন বড়বাজারের পেটমোটা এক শেঠজীর গদিতে। সেখানে দেখলেন, অনেক শিখলেন, চালে কাঁকর মেশানো, আটায় ভুষি মেশানো, ওষুধে ভেজাল দেওয়া—সব জানলেন। জেনে-শুনে বাবার মগজ সাফ হয়ে গেল—তখন তিনি স্বপ্ন দেখলেন।

    -কী স্বপ্ন?—টেনিদা জিজ্ঞেস করলে।

    -দেখলেন, স্বর্গে পালে-পালে নেংটি ইঁদুর হানা দিয়েছে সেখানকার চাল-ডাল-মধু-সুজি-ফল-পাকড় সব খেয়ে ফেলেছে, দেবতাদের ঝাঁকে ঝাঁকে তাড়া করেছে, ইন্দ্র-চন্দ্র কার্তিক-টার্তিক সবাই বাপ রে মা-রে বলে ছুটে পালাচ্ছে। আর ইন্দ্রের ফাঁকা সিংহাসনে বসে গোঁফ ফুলিয়ে দেবী নেংটীশ্বরী বলছেন—দেখছিস কি এখন থেকে স্বর্গে-মতে-পাতালে আমারই রাজত্ব শুরু হল। আমার হুকুমমতোই সব চলবে। আজ থেকে তোদের কাজ হল নেংটি ইঁদুরের মতো চুরি করা—গর্ত কেটে, যেখানে যা পাওয়া যায়—সব লোপাট করা। বাঁচতে হলে এখন থেকে এই রাস্তাই তোদের ধরতে হবে। দেবী এই পর্যন্ত বলতে বলতেই দুটো বেড়ালের ঝগড়ার আওয়াজে বিটকেলানন্দের ঘুম ভেঙে গেল, হুলোর ভয়েই দেবী উধাও হলেন কি না কে জানে! আর বাবা বিছানা ছেড়ে লাফিয়ে উঠলেন, বললেন, পেয়েছি—পেয়েছি। তারপরেই দেবী নেংটীশ্বরীর এই মন্দিরপ্রতিষ্ঠা।

    ক্যাবলা বললে, উঃ, কী রোমাঞ্চকর।

    টেনিদা ঘাড় নেড়ে বললে, হুঁ, পয়লা নম্বরের মেফিস্টোফিলিস।

    –মেফিস্টোফিলিস? লোকটা চোখ পিটপিট করে বললে, তার মানে?

    আমি বললাম, তার মানে–ইয়াক ইয়াক!

    —ইয়াক ইয়াক? সে আবার কী?—লোকটা খাবি খেল : তোমরা কোন্ দেশের লোক হে? তোমাদের যে বোঝা যায় না।

    ক্যাবলা তাড়াতাড়ি বললে, ছেড়ে দিন ওদের ছেলেমানুষি ছেড়ে দিন। মানে, খুশি হলে ওরা অনেক সময় ও-সব বলে, ওগুলোর কোনওকালে নেই। এখন আপনি যা বলেছিলেন বলুন।

    লোকটা বিরক্ত হয়ে বললে, বলতেই তো চাচ্ছি, কিন্তু তোমরা কী সব বিচ্ছিরি ভাষা আউড়ে সব গোলমাল করে দিচ্ছ?

    আমি বললুম, বাবা বিটকেলানন্দ এখানে আছেন?

    লোকটা আরও ব্যাজার হল : থাকতেই তো চেয়েছিলেন। কিন্তু ম্যাও ম্যাও।

    –ম্যাও ম্যাও।

    —আবার কী?—ওরা কোমরে দড়ি বেঁধে নিয়ে গেল, বলে কিনা, বাবা চোর, বাবা কালোবাজারী! সইবে না সইবে না!ভীষণ চটে গিয়ে প্রায় চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বলতে লাগল : বাবা যোগবলে জেলের গরাদ ভেঙে বেরিয়ে আসবেন। আর যে হাকিম তাঁকে জেলে দিয়েছে–

    টেনিদা বললে, তাঁর কী হবে?

    -কী হবে?—দাঁত কিড়মিড় করে লোকটা বলতে লাগল : রাত্তিরে যখন সে ঘুমুবে, তখন মা নেংটীশ্বরী দল বেঁধে গিয়ে তার ভুঁড়ি ফুটো করে দেবে। নির্ঘাত দেখে নিয়ো।

    বলতে বলতেই–

    হঠাৎ কোত্থেকে বিকট গলায় বিশটা হুলো বিড়াল এক সঙ্গে ডেকে উঠল : ম্যাও—ম্যাও—ম্যাও–

    আর দারুণ চমকে উঠল লোকটা।

    -লুকোও—লুকোও–লুকোও। বাঁচতে চাও তো এখুনি লুকোও। না হলে—

    ঘরঘর শব্দে মা নেংটীশ্বরীর মন্দিরের দরজা বন্ধ হল, সেই তালঢ্যাঙা লোকটা জালে-পড়া গলদা চিংড়ির মতো ছটফটিয়ে উঠল, নেংটীশ্বরীর চোখ দুটো ঘরের সেই নানা রঙের আলোতে ঝকঝক করে জ্বলতে লাগল, কেমন যেন মনে হতে লাগল—মা আলোর দিকে কটমটিয়ে চেয়ে রয়েছেন, এখুনি ইকিখি বলে তেড়ে কামড়াতে আসবেন। তার উপরে আবার দরজাটা বন্ধ হয়ে যাওয়া বিচ্ছিরি গুমট গরমে আমরা সিদ্ধ হচ্ছিলুম-কেমন একটা বদখত গন্ধ আসছিল। একবার মনে হল ওটা নেংটি ইঁদুরের, তার পরেই মনে হল, না চামচিকের গন্ধ।

    একেবারে বেকুব বনে গিয়ে আমরা চার মূর্তি—আলু সেদ্ধর মতো চারটে মুখ করে—এ ওর দিকে চেয়ে রইলুম। আর টেনিদা খাঁড়ার মতো নাকটাকে একবার চুলকে নিয়ে বললে, হুঁ, পুঁদিচ্চেরি।

    লোকটা কী রকম চমকে গেল। বললে, পুঁদিচ্চেরি! সে আবার কী?

    হাবুল বললে, ওটা হৈল গিয়া ফরাসী ভাষা। তার মানে হৈল, ব্যাপার খুবই সাংঘাতিক হইয়া উঠছে।

    তালঢ্যাঙা লোকটা তাই শুনে এমন ব্যাজার হয়ে গেল যে মনে হল, এক্ষুনি কেউ তাকে জোর করে একমুঠো নিমপাতা খাইয়ে দিয়েছে। সে বললে, ব্যাপার খুবই সাংঘাতিক, তাতে কোনও সন্দেহ নেই। কিন্তু ফরাসী ভাষা বলো আর যাই বলো—ফিসফিসিয়ে বলবে। শুনলে না—ম্যাও ম্যাও এসেছে? যদিও এ-ঘরে ঢুকতে পারবে না—আর ঘরটা কী বলে এমন কায়দায় তৈরি যে বাইরে থেকে বোঝাই যায় না এখানে ঘর আছে, তবু সাবধানের বিনাশ নেই–বুঝতে পারছ না?

    আমি বললুম, আজ্ঞে সবই বুঝতে পারছি। কিন্তু ম্যাও ম্যাওটা—

    ক্যাবলা আমাকে একটা চিমটি কাটল, কিন্তু যখন বলেই ফেলেছি, তখন কথাটা আর সামলে নেওয়া যায় না। লোকটা আশ্চর্য হয়ে বললে, কেন, ম্যাও ম্যাও বুঝতে পারছ না। আচ্ছা নেংটি ইঁদুরের শত্রু কে?

    হাবুল বুদ্ধি করে বললে, মানুষ।

    —উঁহু হল না।—লোকটা হ-য-ব-র-ল-র কাক্কেশ্বর কুচকুচের মতো মাথা নেড়ে বললে, হয়নি, ফেল। তোমার মগজে দেখছি কিছু নেই।

    ক্যাবলা বললে, আজ্ঞে না, সেই জন্যেই তো ওর নাম হাবলা। নেংটি ইঁদুরের শত্রু হচ্ছে বেড়াল।

    —ইয়া, রাইট। তা হলে মা নেংটীশ্বরীর শত্রু কে হতে পারে?

    ক্যাবলা বললে, পুলিশ।

    -ঠিক, একদম করেকট। এইবার বুঝতে পারছ তো? আজ্ঞায় পুলিশ হানা দিয়েছে। ধরতে যদি পারে আমাদের সকলকে একেবারে সোজা শ্রীঘর।

    —শ্রীঘর?—টেনিদা খাবি খেয়ে বললে, মানে জেল?

    লোকটা ঠোঁটে আঙুল দিলে।

    —স্‌-স্‌-স্‌। তোমার তো দেখছি একেবারে হাঁড়িচাঁচার মতো গলা হে। একটু আস্তে কথা বলতে পারো না? তা ভেবেছ কী? পুলিশে একবার ধরতে পারলে তোমায় কি নেমন্তন্ন করে পোলাও-কালিয়া খাওয়াবে? একেবারে তিনটি বছর ঘানিগাছে ঘুরিয়ে দেবে—খেয়াল থাকে যেন।

    টেনিদা ধুপ করে সেই চামচিকের গন্ধভরা মেঝেটার উপরে বসে পড়ল, আমার পেটের ভেতরে পিলে-টিলেগুলো যেন কী রকম তালগোল পাকিয়ে যেতে লাগল, হাবুল মুখটাকে ফাঁক করে এমন ভাবে চেয়ে রইল যে, মনে হল, সে এখুনি হাঁউ-মাউ করে ড়ুকরে কেঁদে উঠবে। এ আবার কী ঝঞ্ঝাটে পড়া গেল রে বাপু। সেই উনপাঁজুরে বিশ্ববখাটে কম্বলকে খুঁজতে এসে শেষে জেল খাটতে হবে কে জানে কোন্ চুরি বাটপাড়ির দায়েই জেল খাটতে হবে! আগে একটুখানি বুঝতে পারলেও কে এমন ফ্যাচাঙের মধ্যে পা বাড়িয়ে দিত। কিংবা আমাদের গোড়াতেই বোঝা উচিত ছিল—টেনিদার নাক বরাবর পচা আমটা যখন শত্রুর অদৃশ্য আক্রমণ থেকে ছুটে এসেছিল—সেই তখন।

    আসলে, সব দোষ ক্যাবলার। ও-ই তো কী রকম বক্তৃতা দিয়ে আমাদের উত্তেজিত করে দিলে। মনে হল, নিরুদ্দেশ কম্বলকে খুঁজে বের করার মতন মহৎ কাজ দুনিয়ায় আর বুঝি দ্বিতীয়টি নেই। আমার একটা ভীষণ জিঘাংসা জাগল, ইচ্ছে করল, ক্যাবলার গায়ে কয়েকটা লাল পিঁপড়ে ছেড়ে দিই, কয়েকটা বিছুটির পাতা ঘষে দিই ওর পায়ে। কিন্তু এখানে লাল পিঁপড়েও নেই, বিছুটিও নেই। এখন কেবল পুলিশের হাতে পড়া, তারপর জেল খাটতে যাওয়া।

    জেল খাটতেও নয় রাজি আছি, কিন্তু জেল থেকে বেরুবার পর? বড়দা কি পিঠের একফালি চামড়া বাকি রাখবে? কিংবা জেলে যাওয়ার আগেই এসে এমন ধড়াধধম্ পিটুনি লাগিয়ে যাবে তাতেই ছমাস কাটাতে হবে হাসপাতালে।

    আমার চোখের সামনে সর্ষের ফুল-টুল কী সব দুলতে লাগল। যেন দেখতে পেলুম, মা নেংটীশ্বরী মুখটা একটুখানি ফাঁক করে আমার দিকে তাকিয়ে দাঁত খিচুচ্ছেন, তাঁর বাঁকা লেজটা যেন অল্প অল্প নড়ছে মনে হল, আমি যেন এখুনি অজ্ঞান হয়ে পড়ব, আমার দাঁত কপাটি লেগে যাচ্ছে।

    এরই মধ্যে শুনতে পেলুম, টেনিদা তোতলা হয়ে বলতে লাগল : পুল পুল পুলিশ—

    তাই শুনে লোকটা উচ্চিংড়ের মতো ভেংচি কেটে বললে, ডোন্ট বি ফুলিশ। বললুম, তো সাড়া কিছু করো না—তা হলেই আর টের পাবে না। আজই তো আর প্রথম নয়, এর আগে আরও তিন-চারবার তো ম্যাও ম্যাও এসে গেছে, কিন্তু ধরতে পেরেছে কাউকে? নেংটি ইঁদুর একবার গর্তে ঢুকলে বেড়াল কিছু করতে পারে তার? এটা হল মা নেংটীশ্বরীর গর্ত, যতক্ষণ এখানে আছ—ততক্ষণ ওই যে ইংরেজিতে কী বলে—একেবারে সাউন্ড অ্যান্ড ফিউরি।

    এর ভেতরে ক্যাবলা পণ্ডিতি করবার লোভ সামলাতে পারল না। টিকটিক করে বলতে লাগল : আজ্ঞে ভুল করছেন। ওটা সাউন্ড এন্ড ফিউরি নয়—সেফ অ্যান্ড সাউন্ড।

    তাই শুনে লোকটার মুখ ঠিক একটা ছারপোকার মতো হিংস্র হয়ে গেল। বললে, তুমি থামো হে ছোকরা, বেশি পণ্ডিতি করো না। চল্লিশ বছর এই সাউন্ড অ্যান্ড ফিউরি দিয়ে চালিয়ে দিলুম, তুমি এসেছ ওস্তাদি করতে। বেশি বকিয়ো না এখন, বাইরে শত্রু ঝাঁ করে হয়তোবা কান ধরেই পেঁচিয়ে দেব তোমার।

    ক্যাবলা রেগে ঠিক একটা টোমাটোর মতো রাঙা হয়ে গেল, তারপর কী একটা গোঁ-গোঁ। করে উঠেই চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। ক্যাবলার পণ্ডিতি আমরা অবশ্য কেউই পছন্দ করি না, কিন্তু তাই বলে বাইরের একটা উটকো লোক এসে তার কান ধরতে চাইবে—সে স্কলারশিপ-পাওয়া কলেজের ছাত্র, এ-ও তো আমাদের পটলডাঙার একটা জ্বালাময়ী অপমান।

    যা ভেবেছি তাই আমাদের লিডার টেনিদা সঙ্গে সঙ্গে গাঁ গাঁ করে উঠল।

    -কী বলছেন মশাই, কান ধরে পেঁচিয়ে দেবেন। আমরা পটলডাঙার ছেলে-খেয়াল রাখবেন সেটা। হয় আপনার কথা উইথড্র করুন, নইলে এগিয়ে আসুন—হয়ে যাক এক হাত।

    লোকটা বোধহয় এতটা আশা করেনি, কীরকম ভেবড়ে গেল কথাটা শুনে। একটু আগেই আমি অজ্ঞান হব হব ভাবছিলুম, এখন মনে হল মারামারিটা না দেখে অজ্ঞান হবার কোনও মানেই হয় না। চোখকান খুলে খুব খুশি হয়ে দেখতে পেলুম, টেনিদা আস্তিন গোটাচ্ছে।

    –শিগগির উইথড্র করুন বলছি, নইলে–

    লোকটা তালগাছের মত ঢ্যাঙা হলে কী হয়, বেজায় কাপুরুষ। আড়চোখে টেনিদার চওড়া চিতনো বুকের দিকে তাকিয়ে দেখল একবার। তারপর বললে, আহা—যেতে দাও, মানে বাইরে পুলিশ, এখন আত্মকলহ করে দরকার নেই। গোলমাল শুনলেই টের পেয়ে যাবে। তার চেয়ে এসোসরি বলে ফেলা যাক। ওই যে ইংরেজীতে কী বলে–ফরফিট অ্যান্ড ফরগেট–

    ক্যাবলা বললে, উঁহু, আবার ভুল। ফরগিভ অ্যান্ড ফরগেট।

    লোকটার মুখ আবার একটা ছারপোকার মুখের মতো হিংস্র হতে যাচ্ছিল, কিন্তু টেনিদার আস্তিনের দিকে তাকিয়ে কী রকম বিবর্ণ হয়ে গেল, তার মুখটাকে ফড়িংয়ের মুখের মতো মনে হল এখন। সে কেমন যেন পিঁপড়ে-পিঁপড়ে গলায় চু চু করে বললে, আচ্ছা-আচ্ছা, তাই হল, ফরগিভ অ্যান্ড ফরফিট।

    -আবার ভুল করলেন। ফরফিট, নয় ফরগেট।

    -তাই হবে, ফরগেট। আমি উইথড্র করলুম। ওহে ছোকরা, তুমি আর আস্তিনফাস্তিন গুটিয়ো না। ওদিকে বাইরে পুলিশ, এদিকে আবার হার্ট খারাপ, এর মধ্যে তুমি আবার যদি দুড়দুম করে আমাকে ঘুষি লাগিয়ে দাও—তা হলে আর আমি বাঁচব না।

    টেনিদা খুশি হয়ে বললে, বেশ আসুন, হ্যান্ডশেক করি। ভাব হয়ে যাক।

    -হ্যান্ডশেক? লোকটা সন্দেহে মিটমিটে চোখে চেয়ে রইল : শেষকালে পাঞ্জা ধরে আঙুল-টাঙুল ভেঙে দেবে না তো? আমার শরীর ভালো নয়, সে আগেই বলে রাখছি।

    টেনিদা বললে, নানা, কোনও ভয় নেই আপনার। মা কালী, মা নেংটীশ্বরীর দিব্যি, আপনার আঙুলে চাপ দেব না নিন—আসুন হা ড়ু ড়ু—

    লোকটা বললে, হা-ড়ু ড়ু? আমি তো কপাটি খেলিনি। আমি—

    কিন্তু কথাটা শেষ হওয়ার আগেই বাইরে থেকে পরপর কয়েকটা জোরাল চিচির আওয়াজ উঠল। লোকটা সঙ্গে সঙ্গে লাফিয়ে উঠে বলল, জয়গুরু লাইন ক্লিয়ার। ম্যাও ম্যাও চলে গেছে!

    ঘড়ঘড়িয়ে দরজাটা খুলে গেল। যেন নিঃশ্বাস ফেলে বাঁচলুম আমরা। সব ভুলে-টুলে গিয়ে টেনিদা গলা খুলে চেঁচিয়ে উঠল : ডি লা গ্র্যান্ডি মেফিস্টোফিলিস—

    সঙ্গে সঙ্গে আমরা বললাম, ইয়াক-ইয়াক।

    লোকটা খানিকক্ষণ হাঁ করে চেয়ে রইল—এবার ঠিক আরশোলার মতো হয়ে গেল ওর মুখটা।কী বলে তোমরা চেঁচালে?

    —ডি লা গ্র্যান্ডি মেফিস্টোফিলিস—ইয়াক-ইয়াক আমি জবাব দিলুম।

    —মানে কী ওর?

    হাবুল সেন বললে, এটা হৈল ফরাসী ভাষা। মানেটা হৈল গিয়া বড়ই কঠিন।

    লোকটা পিপির করে বললে, তাই দেখছি। কিন্তু যাই বলো বাপু তোমাদের হালচাল আমি বুঝতে পারছি না। তোমরা কোন্ ব্রাঞ্চ থেকে আসছ? চট না চিটেগুড়? সঞ্চি না ধুচনি?

    আমরা আর কেউ কিছু বলববার আগেই ফস করে ক্যাবলা বললে, কম্বল।

    -কম্বল? লোকটা ভুরু কোষ্ঠকাল : বুঝেছি, কোনও নতুন ব্রাঞ্চ হবে। কিন্তু এখনও ওসম্বন্ধে আমরা কোনও খবর পাইনি। যাই হোক, ছড়া যখন জানো আর চাঁদনি পর্যন্তও গেছ তখন চন্দ্রকান্ত নাকেশ্বরের কাছেই এবার চলল। তার পারমিট পেলে তখনই ছল ছল খালের জল পেরুতে পারবে। আর ঘর থেকে বেরুবার আগে আরও একবার মা নেংটীশ্বরীকে প্রণাম করো, তিনি সব সিদ্ধি দেবেন।

    আমরা আবার সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করে বললুম, জয় মা নেংটীশ্বরীর জয়।

    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26 27 28 29 30 31 32 33 34 35 36 37 38 39 40 41 42 43 44 45 46 47 48 49 50 51 52 53 54 55 56 57 58 59 60 61 62 63 64 65 66 67 68 69 70 71 72 73 74 75 76 77 78 79 80 81 82 83 84 85 86 87 88 89 90 91 92 93 94 95 96 97 98 99 100 101 102 103
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleফাউণ্ডেশন অ্যাণ্ড এম্পায়ার – আইজাক আসিমভ
    Next Article ছোটগল্প – নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়

    Related Articles

    নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়

    সমগ্র কিশোর সাহিত্য – নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়

    September 2, 2025
    নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়

    ছোটগল্প – নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়

    September 2, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo
    Most Popular

    সমগ্র কিশোর সাহিত্য – নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়

    September 2, 2025

    অনুরাধা

    January 4, 2025

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    সমগ্র কিশোর সাহিত্য – নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়

    September 2, 2025

    অনুরাধা

    January 4, 2025

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025
    Our Picks

    সমগ্র কিশোর সাহিত্য – নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়

    September 2, 2025

    ছোটগল্প – নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়

    September 2, 2025

    টেনিদা সমগ্র – নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়

    September 2, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    Sign In or Register

    Welcome Back!

    Login below or Register Now.

    Lost password?

    Register Now!

    Already registered? Login.

    A password will be e-mailed to you.