Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    সমগ্র কিশোর সাহিত্য – নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়

    September 2, 2025

    ছোটগল্প – নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়

    September 2, 2025

    টেনিদা সমগ্র – নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়

    September 2, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • 🔖
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    Subscribe
    সাইন ইন
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    টেনিদা সমগ্র – নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়

    নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় এক পাতা গল্প790 Mins Read0

    দশাননচরিত

    দশাননচরিত

    আমি খুব উত্তেজিত হয়ে টেনিদাকে বললুম, ‘হ্যারিসন রোডের লোকে একটা পকেটমারকে ধরেছে।’

    টেনিদা আমার দিকে কী রকম উদাসভাবে চেয়ে রইল খানিকক্ষণ।

    ‘তারপর?’

    ‘তারপর আর কী! থানায় নিয়ে গেল।‘

    ‘লোকে পিটতে চেষ্টা করেনি?’

    ‘করেনি আবার? ভাগ্যিস একজন পুলিশ এসে পড়েছিল। সে হাতজোড় করে বললে–দাদারা, মেরে আর কী করবেন? মার খেয়ে খেয়ে এদের তো গায়ের চামড়া গণ্ডারের মতো পুরু হয়ে গেছে। অনর্থক আপনাদের হাত ব্যথা হয়ে যাবে। তার চাইতে ছেড়ে দিন–এ মাসখানেক জেলখানায় কাটিয়ে আসুক, ততদিন আপনাদের পকেটগুলো নিরাপদে থাকবে।’

    ‘বেশ হয়েছে।’–বলে টেনিদা গম্ভীর হয়ে গেল। তারপর মস্ত একটা ঠোঙা থেকে একমনে কুড়কুড় করে ডালমুট খেতে লাগল।

    আমি ওর পাশে বসে পড়ে বললুম, ‘আমাকে ডালমুট দিলে না?’

    ‘তোকে?–টেনিদা উদাস হয়ে ডালমুট খেতে খেতে বললে, না–তোকে দেবার মতো মুড নেই এখন। আমি এখন ভীষণ ভাবুক-ভাবুক বোধ করছি।’

    ‘ভাবুক-ভাবুক!’–শুনে আমার খুব উৎসাহ হল : ‘তুমি কবিতা লিখবে বুঝি?’

    টেনিদা বিরক্ত হয়ে বলল, ‘দুত্তোর কবিতা! ওসবের মধ্যে আমি নেই। যারা কবিতা লেখে–তারা আবার মনিষ্যি থাকে নাকি? তারা রাস্তায় চলতে গেলেই গাড়ি চাপা পড়তে পড়তে বেঁচে যায়, নেমন্তন্নবাড়িতে তাদের জুতো চুরি হয়, বোশেখ মাসের গরমে যখন লোকের প্রাণ আইঢাই করে তখন তারা দোর বন্ধ করে পদ্য লেখে—”বাদলরাণীর নূপুর বাজে তাল-পিয়ালের বনে!” দুদ্দুর!’

    আমি আশ্চর্য হয়ে বললুম, ’বোশখ মাসের দুপুরে বাদলরাণীর কবিতা লেখে কেন?’

    টেনিদা মুখটাকে ডিমভাজার মতো করে বললে, ‘এটাও বুঝতে পারলি না? বোশেখ মাসে কবিতা লিখে না পাঠালে আষাঢ় মাসে ছাপা হবে কী করে? যা–যা, কবিতা লেখার কথা আমাকে আর তুই বলিসনি। যত্তো সব ইয়ে–!’

    আমি বললুম, ‘তবে তুমি ওরকম ভাবুক-ভাবুক হয়ে গেলে কেন!’

    ‘ওই পকেটমারের কথা শুনে।‘

    ‘পকেটমারের কথা শুনে কেউ ভাবুক হয় নাকি আবার?’ আমি বললুম, ‘সবাই তো তাকে রে-রে-রে করে ঠ্যাঙাবার জন্যে দৌড়ে যায়। আমারও যেতে ইচ্ছে করে। এই তো সেদিন হাওড়ার ট্রামে আমার বড় পিসেমশায়ের পকেট থেকে—’

    ‘ইউ শাট আপ প্যালা—’ টেনিদা চটে গেল : কুরুবকের মতো সব সময় বকবক করবি না–এই বলে দিচ্ছি তোকে। পঞ্চাননের ঠাকুর্দা দশাননের কথা যদি জানতিস, তা হলে বুঝতে পারতিস–এক-একটা পকেটমারও কী বলে গিয়ে–এই মহাপুরুষ হয়ে যায়।’

    ‘কে পঞ্চানন? কে-ই বা দশানন? আমি তো তাদের কাউকেই চিনি না।’

    ‘দুনিয়াসুদ্ধ সবাইকে তুই চিনিস নাকি? জাপানের বিখ্যাত গাইয়ে তাকানাচিকে চিনিস তুই?’

    আমি বললুম, ‘না।’

    ‘লন্ডনের মুরগির দোকানদার মিস্টার চিকেনসনের সঙ্গে তোর আলাপ আছে?’

    ‘উহুঁ।‘

    ‘ফ্রান্সের সানাইওলা মঁসিয়ো প্যাঁকে দেখেছিস কোনওদিন?’

    ‘না–দেখিনি। দেখতেও চাই না কখনও।‘

    ‘তা হলে?’–টেনিদা আলুকাবলির মতো গম্ভীর হয়ে গেল : ‘তা হলে পঞ্চাননের ঠাকুর্দা দশাননকেই বা তুই চিনবি কেন?’

    ‘ঢের হয়েছে, আর চিনতে চাই না। তুমি যা বলছিলে বলে যাও।’

    ‘বলতেই তো যাচ্ছিলুম–টেনিদা আবার কিছুক্ষণ কুড়মুড় করে ডালমুট চিবিয়ে ঠোঙাটা আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললে, ‘খা। আমি তোকে ব্যাপারটা বলি ততক্ষণে।‘

    আমি ঠোঙাটা হাতে নিয়ে দেখলুম খালি। ফেলে দিতে যাচ্ছি হঠাৎ দেখি একেবারে নীচের দিকে, টেনিদার চোখ এড়িয়ে কী করে একটা চীনেবাদামের দানা আটকে আছে। সেটা বের করেই আমি মুখে পুরে দিলুম। আড়চোখে দেখে টেনিদা বললে, ‘ইস, একটা বাদাম ছিল নাকি রে? একদম দেখতেই পাইনি। যাকগে, ওটা তোকে বকশিশ করে দিলুম।’

    আমি বললুম, ‘সবই পঞ্চাননের ঠাকুর্দা দশাননের দয়া।‘

    টেনিদা বললে, ‘যা বলেছিস। আচ্ছা, এবার দশাননের কথাই বলি।‘

    –বুঝলি, কখনও যদি তুই ঘুঁটেপাড়ায় যাস—’

    ‘আমি বললুম, খুঁটেপাড়া আবার কোথায়?’

    ‘সে গোবরডাঙা থেকে যেতে হয়-সাত ক্রোশ হেঁটে। মানে, যাওয়া খুব মুস্কিল। কিন্তু যদি কখনও যাস-দেখবি দশানন হালদারের নাম শুনলে লোকে এখনও মাটিতে মাথা নামিয়ে পেন্নাম করে। বলে, “এমন ধার্মিক, এমন দানবীর আর হয় না। ইস্কুল করেছেন, গরিব-দুঃখীকে দুবেলা খেতে দিয়েছেন, মন্দির গড়েছেন, পুকুর কেটেছেন।” কিন্তু আসলে এই দশানন কে ছিল, জানিস? এক নম্বরের পকেটমার।‘

    ‘পকেটমার?’

    ‘তবে আর বলছি কী? অমন ঘোড়ে পকেটমার আর দুজন জমেছে কিনা সন্দেহ। পাঠশালায় যেদিন প্রথম পড়তে গেল, সেদিনই পণ্ডিতমশাইয়ের ফতুয়ার পকেট থেকে তাঁর নস্যির ডিবে চুরি করে নিলে। পণ্ডিত তাকে কষে বেত-পেটা করে তাড়িয়ে দিলেন। বাপকাকা-দাদা–তার হাত থেকে কারও পকেটের রেহাই ছিল না। যত পিট্টি খেত, ততই তার রোখ চেপে যেত। শেষে যখন একদিন বাড়িতে গুরুদেব এসেছেন আর দশানন তার ট্যাক থেকে প্রণামীর বারো টাকা আনা পয়সা মেরে নিয়েছে–সেদিন দশাননের বাপ শতানন হালদারের আর সইল না। বাড়ির মোষবলির খাঁড়াটা উঁচিয়ে দশাননকে সে এমন তাড়া লাগাল যে দশানন এক দৌড়ে একেবারে কলকাতায় পৌঁছে তবে হাঁফ ছাড়ল।

    ‘আর জানিস তো, কলকাতা মানেই পকেটমারের স্বর্গ। অনেক গুণী তোক তো আগে থেকেই ছিল, কিন্তু বছরখানেকের ভেতর দশানন তাদের সম্রাট হয়ে উঠল। তার উৎপাতে লোকে পাগল হয়ে গেল। টালা থেকে টালিগঞ্জ আর শেয়ালদা থেকে শালকে পর্যন্ত, কারও পকেটের টাকাকড়ি কলম থেকে মায় সুপুরির কুচি কিংবা এলাচ-দানা পর্যন্ত বাদ যেত না।

    ‘ধরা যে পড়ত না, তা নয়। দুমাস ছ’মাস জেল খাটত, তারপর বেরিয়ে এসে আবার যে-কে সেই। পুলিশ সুষ্ঠু জেরবার হয়ে উঠল। তখন দেশে ইংরেজ রাজত্ব ছিল, জানিস তো? পুলিশ কমিশনার ছিল এক কড়া সাহেব–মিস্টার প্যান্থার না কী যেন নাম। লোকে তার কাছে গিয়ে ধরনা দিতে লাগল। প্যান্থার তাদের বললে, “পকেটমারকে ফাঁসি ডেওয়া যায় না–নটুবা আমি ডশাননকে টাই ডিম। এবার ঢারিতে পারিলে টাহাকে এমন শিক্ষা ডিব যে সে আর পকেট কাটিবে না।”

    ‘ধরা অবশ্য দশানন কদিন বাদেই পড়ল। পকেটমারের ব্যাপার তো জানিস, ওরা প্রায়ই জেলে গিয়ে মুখ বদলে আসে–ওদের ভালোই লাগে বোধ হয়। কিন্তু এবার দশানন ধরা পড়বামাত্র তাকে নিয়ে যাওয়া হল প্যান্থার সাহেবের কাছে। সাহেব বললে, “ওয়েল ডশানন, টুমি টো কলিকাটায় লোককে ঠাকিটে ডিবে না। টাই এবার টোমার একটা পাকা বাবসটো করিতেছি।”–এই বলে সে হুকুম দিলে, “ইহাকে লঞ্চে করিয়া লইয়া গিয়া সুরবনে (মানে সুন্দরবনে) ছাড়িয়া ডাও-সেখানে গিয়া এ কাহার পকেট মারে ডেখিব। ঝঘের তো আর পকেট নাই।”

    ‘দশানন বিস্তর কান্নাকাটি করল, “আর করব না স্যার-এ-যাত্ৰা ছেড়ে দিন স্যার” বলে অনেক হাতে পায়ে ধরল, কিন্তু চিড়ে ভিজল না। সাহেব ঠাট্টা করে বললে, “যাও–বাঘের পকেট মারিটে চেষ্টা করো। যডি পায়রা, টোমাকে রায় সাহেব উপাঢ়ি ডিব।”

    ‘তারপরে আর কী? পুলিশ লঞ্চে করে দশাননকে নিয়ে গেল সুন্দরবনে। সেখানে তাকে নামিয়েই তারা দে-চম্পট। তাদেরও তো বাঘের ভয় আছে।

    ‘এদিকে দশাননের তো আত্মারাম খাঁচাছাড়া। জলে গিজগিজ করছে কুমির–ঝোপে ঝোপে মানুষখেকো বাঘ–সুন্দরবন মানেই যমের আড়ত। এর চাইতে সাহেব যে তাকে ফাঁসিতে ঝোলালেও ভালো করত!

    ‘বেলা পড়ে আসছিল, একটু দূরেই কোথায় হালুম-হালুম ডাক শোনা গেল। দশানন একেবারে চোখ-কান বুজে ছুটল। সুঁদরী গাছের শেকড়ে হোঁচট খেয়ে, গোলপাতার ঝোপে আছাড় খেয়ে-দৌড়তে দৌড়তে দেখে সামনে এক মস্ত ভাঙা বাড়ি। আদ্যিকালের পুরনোইট-কাঠ খসে পড়ছে, তবু অনেকখানি এখনও দাঁড়িয়ে। মরিয়া হয়ে দশানন ঢুকে গেল তারই ভেতরে। হাজার হোক, বাড়ি তো বটে!

    ‘ভাঙা সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় উঠতেই দেখে সামনে একটা মস্ত ঘর। দরজায় তার মাকড়সার জাল, ভেতরে কত জন্মের ধুলো। তবু ঘরটা বেশ আস্ত আছে। একটু সাফসুফ করে নিলে শাওয়াও যাবে একপাশে। দেশলাই জ্বেলে, সাবধানে সব দেখে নিলে দশানন। না–সাপ-খোপ নেই। আর দোতলার ঘর-বাঘও চট করে এখানে উঠে আসবে না। শুধু দশানন ঘরে ঢুকতে ঝটপট করে কতগুলো চামচিকে বেরিয়ে এল–তা বেরোক, চামচিকেকে তার ভয় নেই।

    ‘ক্যানিং-এর বাজার থেকে পুলিশ তাকে এক চাঙারি খাবার দিয়েছিল, মনের দুঃখে তাই খানিকটা খেল দশানন। বাইরে তখন দারুণ অন্ধকার নেমেছে। ঝিঝি ডাকছে, পোকা ডাকছে–অনেক দূর থেকে বাঘের ডাকও আসছে। “জয় মা কালী” বলে কাপড় জড়িয়ে ঘরের এক কোনায় শুয়ে পড়ল দশানন। রাতটা তো কাটুককাল সকালে যা হয় দেখা যাবে।

    ‘বাঘের ডাক, ঝিঝির শব্দ, জঙ্গলের পাতায়-পাতায় হাওয়ায় আওয়াজ আর মশার কামড়ের ভেতরে ভয়-ভাবনায় কখন যে দশানন ঘুমিয়ে পড়েছে জানে না। কতক্ষণ ধরে ঘুমুচ্ছিল, তাও না। হঠাৎ একসময়ে সে চমকে জেগে উঠল। দেখল, ভাঙা জানলা দিয়ে ঘরের ভেতরে জ্যোৎস্না পড়েছে–আর সেই জ্যোৎস্নার মাঝখানে দাঁড়িয়ে এক বিরাট পুরুষ। তার পোশাক-আশাক থিয়েটারের মোগল সেনাপতির মতো। মুখে লম্বা দাড়ি, মাথায় পাগড়ি। আগুনের মতো তার চোখ দুটো দপদপ করে জ্বলছে।

    ‘দশাননের হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে গেল। বুঝতে বাকি রইল না–এটা ভূত। তাও যে-সে ভূত নয়–একেবারে মোগলাই ভূত।

    ‘ভূত বাজখাই গলায় বললে, “এই বেতমিজ, তুই কে রে? আমার প্রাসাদে ঢুকেছিস কেন?”

    ‘দশানন একটু সামলে নিলে। উঠে সামনে এসে একেবারে মাটিতে লুটিয়ে প্রণাম করলে ভূতকে। বললে, “হুজুর, আমায় মাপ করবেন। আমি কিছুই জানতুম না। সন্ধেবেলায় বাঘের ভয়ে ছুটতে ছুটতে এখানে এসে আশ্রয় নিয়েছি। দয়া করে রাতটার মতো আমায় থাকতে দিন। ভেরে উঠেই চলে যাব।”

    ‘ভূত খুশি হল। চাপদাড়ির ফাঁকে হেসে বললে, “ঠিক আছে, থেকে যা। তুই যখন আমার আশ্রয় নিয়েছিস, তখন তোকে কিছু বললে আমার গুণাহ (মানে পাপ) হবে। কিন্তু তোর বাড়ি কোথায়?”

    “আজ্ঞে বাংলাদেশে।”

    “বেশ–বেশ, উঠে দাঁড়া।”

    ‘দশানন উঠে ভূতের সামনে দাঁড়াল। ভূত খুব মন দিয়ে দেখতে লাগল তাকে। তারপর বললে, “তোর বেশ সাহস-টাহস আছে দেখছি। আমার একটা কাজ করতে পারবি?”

    “আজ্ঞে, হুকুম করলেই পারি।”–দশানন খুব বিনীত হয়ে হাত কচলাতে লাগল।

    “তুই একবার নবাব সিরাজদ্দৌলার কাছে যেতে পারিস?”

    “আজ্ঞে কার কাছে?”–দশানন ঘাবড়ে গেল।

    “কেন–বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার নবাব সিরাজদ্দৌলার নাম শুনিসনি?”–ভূত খুব আশ্চর্য হল : তুই কোথাকার গাধা রে!”

    “নাম জানি বই কি হুজুর, বিলক্ষণ জানি।”–দশানন মাথা চুলকে বললে, “কিন্তু তিনি তো অনেকদিন আগে মারা গেছেন–আমি কী করে তাঁর কাছে”।

    “মারা গেছেন? নবাব সিরাজদ্দৌলা! সে কি রে! পলাশীর যুদ্ধের পরে তিনি রাজমহলের দিকে রওনা হলেন, আমাকে বললেন—’মনসবদার জবরদস্ত খাঁ, তুমি আমার এইসব মণিমুক্তাগুলো নিয়ে কোথাও লুকিয়ে থাকো এখন। আমি এরপরে আবার ইংরেজের সঙ্গে যুদ্ধ করব, তখন তোমাকে দরকার হবে–তোমায় আমি ডেকে পাঠাব। ততক্ষণ তুমি সুন্দরবনের প্রাসাদে গিয়ে লুকিয়ে থাকো।” সেই থেকে আমি আছি এখানে। কবে আমার এন্তেকাল (মানে মৃত্যু হয়েছে, কিন্তু নবাবের ডাক শোনবার জন্যে আমি বসে আছি, আর আমার দুই জেবে (মানে পকেটে) লাখ লাখ টাকার হীরে-মোতি বয়ে বেড়াচ্ছি। দেখবি?”

    বলেই জবরদস্ত খাঁ তার জেবের পকেট থেকে দু-হাত ভর্তি করে মণিমুক্তো বের করল। চাঁদের আলোয় সেগুলো ঝলমল করতে লাগল, দেখে চোখ ঠিকরে বেরুল দশাননের। মাথা ঘুরে যায় আর কি।

    ‘জবরদস্ত খাঁ সেগুলো আবার পকেটে পুরে বললে—”আর তুই বলছিস নবাব বেঁচে নেই? না-হতেই পারে না। তা হলে নিজেকেই এবার আমায় খুঁজতে যেতে হচ্ছে।”

    ‘দশানন চুপ করে রইল।

    ‘জবরদস্ত খাঁ বললে, “প্রথমে যাই মুর্শিদাবাদে, তারপরে যাব রাজমহল, তারপর মুঙ্গের পর্যন্ত ঘুরে আসব। তুই আজ রাতে আমার প্রাসাদে থাকতে পারিস। কোনও ভয় নেই—মন্‌সবদার জবরদস্ত খাঁর মঞ্জিলে বাঘও ঢুকতে সাহস পাবে না। কিন্তু কাল সকালেই কেটে পড়বি। ফিরে এসে যদি দেখি তুই রয়েছিস, তা হলে তক্ষুনি কিন্তু তোর গান নিয়ে নেব।”

    ‘এই বলেই, জবরদস্ত খাঁ ধাঁ করে চাঁদের আলোর মধ্যে মিশে গেল।

    ‘আর দশানন? যা থাকে কপালে বলে, তক্ষুনি বেরিয়ে পড়ল ভূতের বাড়ি থেকে। অন্ধকারে খানিক হেঁটে একটা গাছে উঠে রাত কাটালে! সকালে নদীর ধারে গিয়ে দূরে একটা জেলেদের নৌকো চোখে পড়ল–বিস্তর ডাকাডাকি করে, তাদের নৌকোয় উঠে দেশে চলে এল।

    ‘আর তারপর?

    ‘তারপর দেশে ফিরে অতিথিশালা করল, পুকুর কাটাল, গরিবকে দান-ধ্যান করতে লাগল, মহাপুরুষ হয়ে গেল—’

    আমি বাধা দিয়ে বললুম, ‘বা-রে, টাকা পেল কোথায়?’

    ‘টাকার অভাব কী রে গর্দভ? জবরদস্ত খাঁর পকেট মেরে এক থাবা মণি-মুক্তো তুলে নিয়েছিল না?

    ‘অ্যাঁ!’–আমি খাবি খেলুম : ‘ভূতের পকেট কেটে?’

    ‘যে কাটতে পারে–ভূতের পকেটই বা সে রেয়াত করবে কেন?’–টেনিদা হাসল : ‘অমন এক্সপার্ট হাত। কিন্তু ওইতেই তো তার স্বভাব-চরিত্তির একেবারে বদলে গেল। স্বয়ং নবাব সিরাজদ্দৌলার মণি-মুক্তো–সেগুলো কি আর বাজে খরচ করা যায় রে? ওসব বেচে লাখ লাখ টাকা পেল দশানন; আর তাই দিয়ে পরের উপকার করতে লাগল–মহাপুরুষ বনে গেল একেবারে।’

    ‘আর প্যাস্থার সাহেব?’

    ‘বাঘের পকেট কাটলে রায়সাহেব উপাধি দেবে বলেছিল, ভূতের পকেট কেটেছে জানলে তো মহারাজা-টহারাজা করে দিত। কিন্তু জানিস তো–ইংরেজ নবাবের শত্রু। শুনলেই কেড়ে নিত ওগুলো। তাই বলছিলুম প্যালা, পকেটমারকেও তুচ্ছ করতে নেই, সেও যে কখন কী হয়ে যায়—’

    আমি বললুম, ‘বাজে কথা–সব বানানো।‘

    ‘বানানো?’ টেনিদা দাঁত খিঁচিয়ে বললে, ‘ইউ প্যালাইউ গেট আউট–।‘

    গেট-আউট আর কী করে হয়, রাস্তার ধারেই তো বসেছিলুম দু-জনে। আমি টেনিদার গাঁট্টা এড়াবার জন্যে ঝাঁ করে পটলডাঙা স্ট্রিটে লাফিয়ে পড়লুম।

    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26 27 28 29 30 31 32 33 34 35 36 37 38 39 40 41 42 43 44 45 46 47 48 49 50 51 52 53 54 55 56 57 58 59 60 61 62 63 64 65 66 67 68 69 70 71 72 73 74 75 76 77 78 79 80 81 82 83 84 85 86 87 88 89 90 91 92 93 94 95 96 97 98 99 100 101 102 103
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleফাউণ্ডেশন অ্যাণ্ড এম্পায়ার – আইজাক আসিমভ
    Next Article ছোটগল্প – নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়

    Related Articles

    নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়

    সমগ্র কিশোর সাহিত্য – নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়

    September 2, 2025
    নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়

    ছোটগল্প – নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়

    September 2, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo
    Most Popular

    সমগ্র কিশোর সাহিত্য – নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়

    September 2, 2025

    অনুরাধা

    January 4, 2025

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    সমগ্র কিশোর সাহিত্য – নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়

    September 2, 2025

    অনুরাধা

    January 4, 2025

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025
    Our Picks

    সমগ্র কিশোর সাহিত্য – নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়

    September 2, 2025

    ছোটগল্প – নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়

    September 2, 2025

    টেনিদা সমগ্র – নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়

    September 2, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    Sign In or Register

    Welcome Back!

    Login below or Register Now.

    Lost password?

    Register Now!

    Already registered? Login.

    A password will be e-mailed to you.