Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    সমগ্র কিশোর সাহিত্য – নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়

    September 2, 2025

    ছোটগল্প – নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়

    September 2, 2025

    টেনিদা সমগ্র – নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়

    September 2, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • 🔖
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    Subscribe
    সাইন ইন
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    টেনিদা সমগ্র – নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়

    নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় এক পাতা গল্প790 Mins Read0

    দি গ্রেট ছাঁটাই

    দি গ্রেট ছাঁটাই

    –ডিলা-গ্র্যাণ্ডি মেফিস্টোফিলিস—

    এই পর্যন্ত যেই বলেছি, অমনি খ্যাঁক-খ্যাঁক করে তেড়ে এসেছে টেনিদা।

    –টেক কেয়ার প্যালা, সাবধান করে দিচ্ছি। মেফিস্টোফিলিস পর্যন্ত সহ্য করেছি, কিন্তু ‘ইয়াক ইয়াক’ বলবি তো এক চাঁটিতে তোর কান দুটোকে কোন্নগরে পাঠিয়ে দেব।

    সেই ঢাউস ঘুড়িতে ওড়বার পর থেকেই বিচ্ছিরি রকমের চটে রয়েছে টেনিদা। ইয়াক শব্দ শুনলেই ওর মনে হয়, এক্ষুনি বুঝি ঝপাং করে গঙ্গার জলে গিয়ে পড়বে। সেদিন গণেশমামা কায়দা করে ইংরেজীতে বলছিল :ইয়া-ইয়া। শুনে টেনিদা তাকে মারে আর কি।

    শেষে হাবুল সেন গিয়ে ঠাণ্ডা করে : আহা, খামকা চেইত্যা যাওয়া ক্যান? পেন্টুলুন পইর্যা ইংরাজী কইত্যাছে।

    টেনিদা দাঁত খিঁচিয়ে বলেছি, কেন, স্বাধীন ভারতে ইংরেজী ফলাবার দরকারটা কী? এই জন্যেই জাতির আজ বড় দুর্দিন!..শেষ কথাটা টেনিদা আমাদের পাড়ার শ্রদ্ধানন্দ পার্ক থেকে মেরে দিয়েছে। ওখানে অনেক মিটিং হয়, আর সবাই বলে, জাতির আজ বড় দুর্দিন। কাউকে বলতে শুনিনি, জাতির আজ ভারি সুদিন। অথচ যাওয়ার সময় দেখি, দিব্যি পান চিবুতে চিবুতে মোটরে গিয়ে উঠল। মরুক গে, জাতির দিন যেমনই হোক আমার আজকের দিনটা দারুণ রকমের ভালো। মানে, আজ সন্ধেয় আমাদের বল্টুদার পিসতুতো ভাই হুলোদর বউভাত। বল্টুদা আমাকে খেতে বলেছে। আমি বললুম, বা-রে মন খুশি হলে একটুখানি ফুর্তিও করতে পারব না?

    –ফুর্তি? বলি হঠাৎ এত ফুর্তিটা কিসের? আমি সকাল থেকে একটুখানি আলুকাবলি খেতে পাইনি–চার পয়সার ডালমুটও না। মনের দুঃখে মরমে মরে আছি, আর তুই কুচো চিংড়ির মতো লাফাচ্ছিস?

    বললুম, লাফাব না তো কী? আজ হুলোদার বউভাত।

    –হুঁলোদার বউভাত?–টেনিদা খাঁড়ার মতো নাকটার ভেতর থেকে ফুড়ত করে একটা আওয়াজ বের করে বললে, তাতে তোর কী?

    –দারুণ খ্যটি হবে সন্ধেবেলায়।

    –হুলোদার বউভাতে খ্যাঁটি?

    টেনিদার নাক থেকে আবার ফুড়ত করে আওয়াজ বেরুল : মানে নেংটি ইঁদুরের কালিয়া, টিকটিকির ডালনা, আরশোলার চাটনি–

    –কক্ষনো না। –আমি ভীষণভাবে আপত্তি করে বললুম, লুচি-পোলাও-মাংস চপ-ফ্রাই-দই-ক্ষীর-দরবেশ–

    টেনিদা প্রায় হাহাকার করে উঠল : আর বলিসনি, আমি এক্ষুনি হার্টফেল করব। সকাল থেকে একটুখানি আলুকাবলি অবধি খাইনি, আর তুই আমাকে এমন করে দাগা দিচ্ছিস? গো-হত্যের পাপে পড়ে যাবি প্যালা, এই বলে দিচ্ছি তোকে।

    শুনে আমার দুঃখু হল। আমি চুপ করে রইলুম।

    –হ্যাঁ রে, আমাকে তো বলেনি।

    আমি বললুম, না বলেনি।

    –আমি যদি তোর সঙ্গে যাই? মানে, তোর তো পেট-টেট ভালো নয়–বেশি খেয়ে-টেয়ে একটা কেলেঙ্কারি যাতে না করিস, সেইজন্যে যদি তোকে পাহারা দিতে।

    আমি বললুম, চালাকি চলবে না। হুলোদার বাবা ভীষণ রাগী লোক। কান পর্যন্ত গোঁফ। দু’বেলা দুটো একমনী মুগুর ভাঁজেন। বিনা নেমন্তন্নে খেতে গেলে তোমাকে ছাদ থেকে ফুটপাথে ফেলে দেবেন।

    টেনিদা ভারি ব্যাজার হয়ে গেল। বললে, আমি দেখছি, যেসব বাবার বড় বড় গোঁফ থাকে তারাই এমনি যাচ্ছেতাই হয়। বোধ হয় নিজেদের বাঘ-সিঙ্গী বলে ভাবে। আর যেসব বাবা গোঁফ কামায় মেজাজ খুব মোলায়েম। দেখ লই মনে হয় এক্ষুনি মিহি গলায় বলবে, খোকা, দুটো রসগোল্লা খাবে? আর গোঁফওয়ালা বাবাদের ছেলেরা দুবেলা গাট্টা খায়।

    এই সকালবেলায় গোঁফ নিয়ে বকবকানি আমার ভালো লাগল না। চলে যাওয়ার জন্যে পা বাড়িয়েছি, অমনি টেনিদা বললে, খ্যাঁট তো সন্ধেবেলায়–এখুনি গিয়ে কলাপাতা কাটবি নাকি? ·

    কলাপাতা কাটব কেন? আমি কি ওদের চাকর রামধনিয়া? আমি যাচ্ছি চুল কাটতে। বলে ডাঁটের মাথায় চলে যাচ্ছি, টেনিদা আবার পিছু ডাকল–কোথায় চুল কাটবি? সেলুনে?–চল, আমি তোর সঙ্গে যাই।

    আমার মনে নিদারুণ একটা সন্দেহ হল।

    –আবার তুমি কেন? আমি চুল ছাঁটতে যাচ্ছি–তোমার যাবার কী দরকার?

    টেনিদা বললে, দরকার আছে বই কি! বউভাতের নেমন্তন্ন খাবি যা-তা করে চুল হেঁটে গেলে মান থাকবে নাকি? এমন একখানা মোম ছাঁট লাগাবি যে, লোকে দেখলেই হ করে থাকবে। চল, আমি তোর চুল কাটার তদারক করব।

    কথাটা আমার মনে লাগল। সত্যিই তো টেনিদা একটা চৌকস লোকদশরকম বোঝে। আর, চুপি-চুপি বলতে দোষ নেই, একা সেলুনে ঢুকতে আমারও কেমন গা ছমছম করে। যেরকম কচাকচ কাঁচি-কাচি চালায় মনে হয় কখন কচাং করে একটা কানই বা কেটে নেবে।

    বললুম, চলো তা হলে।

    প্রথমেই চোখে পড়ল, ওঁ তারকব্রহ্ম সেলুন।

    যেই ঢুকতে যাচ্ছি, অমনি হাঁ-হাঁ করে বাধা দিল টেনিদা–খবর্দার প্যালা, খবর্দার। ওখানে ঢুকেছিস কি মরেছিস!

    -কেন!

    –নাম দেখছিস না? ওঁ তারকব্রহ্ম। ওখানে ঢুকলে কী হবে জানিস? সব চুলগুলো কদমছাঁট করে দেবে আর চাঁদির ওপর টিকি বানিয়ে দেবে একখানা; হয়তো টিকির সঙ্গে ফ্রিতে একটা গাঁদা ফুলও বেঁধে দিতে পারে–কিচ্ছুই বলা যায় না।

    ঘাবড়ে গিয়ে বললুম, না, আমি টিকি চাই না, ফ্রি গাঁদা ফুলেও দরকার নেই।

    –তবে চটপট চলে আয় এখান থেকে। দেখছিস না একটা হোঁতকা লোক কেমন জুলজুল করে তাকাচ্ছে? আর দেরি করলে হয়তো হাত ধরে হিড়হিড় করে ভেতরে টেনে নিয়ে যাবে।

    তক্ষুনি পা চালিয়ে দিলুম। একটু এগোতেই বিউটি-ডি-সেলুনিকা।

    একে বিউটি, তায় আবার সেলুনিকা! দেখেই আমার কেমন ভাব এসে গেল। বলতে ইচ্ছে করল : সত্যিই সেলুকাস, কী বিচিত্র এই দেশ। তারপর কী যেন রাতে প্রচণ্ড সূর্য-টুর্য-ও-সব আর মনে পড়ল না।

    –টেনিদা এইখানেই ঢোকা যাক!

    শুনেই টেনিদা দাঁত খিঁচিয়ে উঠল, হ্যাঁ, এইখানেই ঢুকবি বই কি! পটোল দিয়ে শিঙিমাছের ঝোল খাস, তোর বুদ্ধি আর কত হবে!

    –কেন? নামটা তো–

    –হ্যাঁ, নামটাই তো! ঢুকেই দ্যাখ না একবার। ঠিক কবিদের মতো বাবরি বানিয়ে দেবে। পেছন থেকে দেখলে মনে হবে, মেমসায়েব হেঁটে যাচ্ছে। আর কেউ যদি তোকে ঠ্যাঙাতে চায়, তা হলে ওই বাবরি চেপে ধরে–

    শুনেই আমার বুক দমে গেল। এমনিতেই ছোটকাকা আমার কান পাকড়াবার জন্যে তকে তকে থাকে, বাবরি পেলে কি আর রক্ষে থাকবে! কান প্লাস বাবরি একেবারে দুদিক থেকে আক্রমণ!

    –না–না, তবে থাক।

    .

    আমি বাঁইবাঁই করে প্রায় সিকি-মাইল এগিয়ে গেলুম। আর টেনিদা লম্বা-লম্বা ঠ্যাঙে তিন লাফেই ধরে ফেলল আমাকে : বুঝলি প্যালা, সেলুন ভারি ডেঞ্জারাস জায়গা। বলতে গেলে সুন্দরবনের চাইতেও ভয়াবহ। বুঝেসুঝে ঢুকতে না পারলেই স্রেফ বেঘোরে মারা যাবি। সেইজন্যেই তো তোর সঙ্গে এলুম। আর দেখলি তো, না থাকলে এতক্ষণে হয়তো তোর ঘাড় ফাঁপানো বাবরি কিংবা দেড়-হাত টিকি বেরিয়ে যেত।

    –কিন্তু চুল তো ছাঁটতেই হবে টেনিদা।

    –আলবাত ছাঁটাতেই হবে। টেনিদার গলার আওয়াজ গম্ভীর হয়ে উঠল; চুল না ছাঁটলে কি চলে? ছাঁটবার জন্যেই তো চুলের জন্ম। যদি চুল ছাঁটবার ব্যবস্থা না থাকত, তা হলে কি আর চুল গজাত? দ্যাখ না ক্ষুর আছে বলেই মানুষের মুখে গোঁফ উঠেছে। তবু সংসারে এমন এক-একটা পাষণ্ড লোক আছে যারা গোঁফ কামায় না, আর ক্ষুরকে অপমান করে।

    নিশ্চয় হুলোদার বাবার কথা বলছে। আমার কিন্তু ওসব ভালো লাগছিল না। বলতে যাচ্ছি ‘গোঁফ-টোফ এখন থামাও না বাপু’–এমন সময় দেখি আর-একটা সেলুন। সুকেশ কর্তনালয়! আবার ইংরেজী করে লেখা : দি বেস্ট হেয়ার কাটিং।

    –টেনিদা, ওই তো সেলুন।

    –সেলুন?–টেনিদা ভুরু কোঁচকালে, তারপর নাক বাঁকিয়ে পড়তে লাগল : সুকেশ কর্তনালয়। কর্তনালয়! বাপস।

    –বাপস!–বাপস কেন?

    টেনিদা এবার বুক চিতিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়াল। কটমট করে কিছুক্ষণ তাকাল আমার দিকে। তারপর হঠাৎ আমার চাঁদির ওপর পটাং করে গোটা দুই টোকা মেরে বললে, গাঁট্টা খেতে পারবি?

    আমি বিষম চমকে উঠে বললুম, মিছিমিছি আমি গাঁট্টা খাব? আমার কী দরকার?

    –গুরুজনের মুখে-মুখে তক্কো করিস ক্যান র‍্যা? যা বলছি জবাব দে। খেতে পারবি গাঁট্টা? পাঁচ-দশ পনেরোটা?

    আমি তাড়াতাড়ি বললুম, একটাও না, একটা খেতেও রাজি নই।

    –সাতটা চাঁটি?

    বললুম, কী বিপদ! হচ্ছে সেলুনের কথা–চাঁটি আসে কোত্থেকে?

    –আসে, আসে। চাঁটাবার মওকা পেলেই আসে। নে– জবাব দে এখন। খাবি চাঁটি?

    –কক্ষনো না।

    –না?–টেনিদার গলা আরও গম্ভীর : ‘জাড্যাপহ’ শব্দের মানে জানিস?

    –না।

    –উড়ম্বর?

    –না, তাও জানি না। আমি বিব্রত হয়ে বললুম, যাচ্ছি চুল কাটতে– তুমি কেন যে এসব ফ্যাচাং

    কথাটা শেষ করার আগেই টেনিদা গর্জন করে উঠল : স্তব্ধ হও, রে-রে বাচাল।

    তারপর আবার গদ্য করে বললে, জানিস্ কুটমল মানে কী? বল দেখি, মকুণিকা অর্থ কী?

    আমি কাতর হয়ে বললুম, কী যে বলছ টেনিদা, কোনও মানে হয় না। তুমি কি পাগল, না পারশে মাছ যে খামকা এইসব বকবক করে–

    টেনিদা আবার আমার চাঁদিতে পটাং করে একটা টোকা মারল–ওরে গাধা! সেলুল্পে। নাম দেখেও বুঝতে পারিসনি? কর্তনালয়, তার ওপর আবার সুকেশ! ওরকম নাম কে দিতে পারে? কোনও হেড পণ্ডিত নিশ্চয় ইস্কুল থেকে পেনশন নিয়ে এখন সেলুন খুলেছে। যেই ঢুকবি অমনি হয়তো জিজ্ঞেস করবে, আপনার শিরোরুহ কি সমূলে উৎপাটিত হইবে? তুই বুঝতে পারবি না, হাঁ করে তাকিয়ে থাকবি। তখন রেগে তোকে চাঁটি-গাঁট্টা লাগিয়ে বলবে, ‘অরে-রে অনড়বান, সত্বর বিদ্যালয়ে গমনপূর্বক প্রথম ভাগ পাঠ কর’—না–না ‘পাঠ করহ’।

    শুনে, আমার পালাজ্বরের পিলে তড়াক করে লাফিয়ে উঠল। তবুও সাহসের ভান করে বললুম, যত সব বাজে কথা, গিয়েই দেখি না একবার।

    টেনিদা বললে, যা না, যেতেই তো বলছি তোকে। যা ঢুকে পড়, এক্ষুনি যা—

    এমনভাবে উৎসাহ দিলে আর যাওয়া যায় না, আমি তৎক্ষণাৎ এদিকের ফুটপাথে চলে এলুম।

    –কিন্তু সেলুনে কি ঢোকা যাবে না টেনিদা?

    টেনিদা চিন্তা করে করে অনেকক্ষণ ধরে আস্তে-আস্তে মাথা নাড়ল : আমার মনে হচ্ছে ঢোকা উচিত নয়। একটু ভালো বাংলা-টাংলা যদি জানতিস তা হলেও বা কথা ছিল।

    –তবে চুল কাটা হবে না?–আমার পালাজ্বরের পিলে হাহাকার করে উঠল : কিন্তু ভালো করে চুল ছাঁটতে না পারলে হুলোদার বউভাতে যাব কী করে?

    টেনিদা বললে, দাঁড়া ভেবে দেখি। তার আগে চারটে পয়সা দে।

    –আবার পয়সা কেন?

    –ডালমুট খাব, খেলে মগজ সাফ হবে, তখন বুদ্ধি বাতলে দেব।

    কী আর করি, দিতেই হল চার পয়সা।

    টেনিদা ওই চার পয়সার ডালমুখ কিনে বেশ নিশ্চিন্তে বুদ্ধি সাফ করতে লাগল, আমাকে একটুও দিলে না।

    –টেনিদা, একবার ছোটকাকার অফিসে গেলে কেমন হয়?

    টেনিদার ডালমুট চিবোনো বন্ধ হল : সে কী-রে। তোর ছোটকাকার সেলুন আছে নাকি?

    –না-না, সেলুন না। ছোটকাকা বলছিল ওদের অফিসে ছাঁটাই হচ্ছে। গেলে আমার চুলটাও নিশ্চয় ছাঁটাই করে দেবে।

    টেনিদা বিরক্ত হয়ে বললে, দুর বোকা–অফিসে কি চুল ছাঁটে? সে অন্য ছাঁটাই।

    –কী ছাঁটাই?

    –বোধ হয় জামাকাপড় ছাঁটাই। কান-টানও হতে পারে। কী জানি, ঠিক বলতে পারব। তবে চুল ছাঁটে না। তা হলে আমার কুট্টিমামার ধামার মতো চুলগুলো কবে হেঁটে দিত।

    তাই তো।–মনটা দমে গেল।

    –তবে কী করা যায়? টেনিদা ডালমুটের তলার নুনটা চাটতে-চাটতে বললে, ওই তো গাছটার তলায় ইট পেতে পরামানিক বসে আছে, চল ওর কাছে–

    –কিন্তু পরামানিক?–আমি গজগজ করে বললুম, ওরা ভালো চুল কাটে না।

    –তোকে বলেছে।–টেনিদা রেগে বললে, ওই বিড়ালই বনে গেলে বাঘ হয়–বুঝলি? এখন নিতান্ত ফুটপাথে বসে আছে, তাই ওর কদর নেই। একটা সেলন খুললেই ওর নাম হবে ‘দি গ্রেট কাটার’। চল চল আমার পিঠে একটা থাবড়া দিয়ে টেনিদা বললে, আমি আছি না সঙ্গে? এমন ডিরেকশন দিয়ে দেব লোকে বলবে, প্যালা ঠিক, সায়েব বাড়ি থেকে চুল ছেঁটে এসেছে। কোনও ভাবনা নেই–আয়–

    কী আর করি, পরামানিকের সামনে বসেছি ইট পেতে। টেনিদা থাবা গেড়ে দাঁড়িয়ে আছে সামনে। দেখছে মনের মতো ছাঁট হয় কি না।

    কুরকুর করে কাঁচি চলেছে, আমিও বসে আছি নিবিষ্টমনে। হঠাৎ টেনিদা হাঁ হাঁ করে উঠল : এ পরামানিক জী, ঠারো ঠারো।

    পরামানিক আশ্চর্য হয়ে বললে, ক্যা ভৈল বা?

    –ভৈল না। মানে, ঠিক হচ্ছে না। অ্যায়সা নেহি। ও-ভাবে ছাঁটলে চলবে না।

    পরামানিক বললে, তো কেইসা?

    আমি বিরক্ত হয়ে বললুম, কেন বাগড়া দিচ্ছ টেনিদা? বেশ তো কাটছে–কাটুক না।

    টেনিদা দাঁত বের করে বললে, কাটুক না। যা-তা করে কাটলেই হল? এ হল বউভাতের ছাঁট, এর কায়দাই আলাদা। যা খুশি কেটে দেবে, আর শেষে লোকে আমারই বদনাম করে বলবে, ছি–ছি–পটলডাঙার টেনিরাম কাছে থাকতেও প্যালা যাচ্ছেতাই চুল ছেঁটে এসেছে! রামোঃ!

    পরামানিক অধৈর্য হয়ে বললে, কেইসা ছাঁটাই?. বোলিয়ে না।

    –বোলতা তো হ্যাঁয়!–টেনিদা আমার মাথায় আঙুল দেখিয়ে বলে চলল : হিঁয়া দু ইঞ্চি ছাঁটকে দেও, হিয়া তিন ইঞ্চি–

    আমি কাতর হয়ে বললুম, আমার কায়দায় দরকার নেই টেনিদা–ও যেমন কাটছে কাটুক।

    –শট আপ! ছেলেমানুষ তুই–গুরুজনের মুখে-মুখে কথা বলিস কেন?–শুনো জী পরামানিক, হিয়া-সে চার ইঞ্চি কাট দেও– হিঁয়া ফের এক ইঞ্চি–হিঁয়া দু ইঞ্চি ঘাড় ছাঁচকে দেও–

    পরামানিক এবার রেগে গেল! ওইসা নেহি হোতা।

    টেনিদা বললে, জরুর হোতা। তুম কাটো।

    পরামানিক বললে, নেহি ওইসা কভি নেহি হোতা।

    আমি কাঁদো কাঁদো হয়ে বললুম, দোহাই টেনিদা, পায়ে পড়ছি তোমার, ওকে কাটতে দাও

    টেনিদা গর্জন করে বললে, চোপ রাও। তুম কাটো পরামানিক জী—

    পরামানিকের আত্মসম্মানে ঘা লেগেছে তখন। নিজের সংকল্পে সে অটল।

    –নেহি, হোতা নেহি।

    –আলবাত হোতা। কয়ঠো ছাঁট দেখা তুম? তুম ছাঁটের কেয়া জানতা? কাটো–

    –নেহি কাটেগা। বদনাম হো যায়েগা হামকো। ওইসব নেহি হোতা।

    –নেহি হোতা?–টেনিদা এবার চেঁচিয়ে উঠল : সব হোতা। আকাশে শুটনিক হোতা মাথামে টাক হোতা– মুরগি আজ ঠ্যাং নিয়ে চলে বেড়াতা, কাল সেই ঠ্যাং প্লেটমে কাটলেট হো-যাতা। সব হোতা, তুমি নেহি জানতা!

    –হাম নেহি জানতা?

    –নেহি জানতা।–টেনিদার গলার স্বর বজ্রকঠোর।

    –আপ জানতে হেঁ- পরামানিক এবার চ্যালেঞ্জ করে বসল।

    –জরুর জানতা হেঁ!–টেনিদা গরুণ উত্তেজিত।

    –তো কাটিয়ে।

    পরামানিকের বলবার অপেক্ষা মাত্র। পটাং করে টেনিদা তার কাঁচি হাত থেকে কেড়ে নিলে। আর আমি—’বাবা-রে-মা-রেপিসিমা-রে’–বলে চেঁচিয়ে লাফিয়ে ওঠবার আগেই আমার চুলে টেনিদার কাঁচি চলতে লাগল : এই দেখো চার ইঞ্চি–এই দেখো পাঁচ ইঞ্চি এই দেখো–ইয়ে তিন ইঞ্চি—দেখো–

    কিন্তু পরামানিক দেখবার আগেই আমি চোখে সর্ষে ফুল দেখছি তখন। উঠে প্রাণপণে ছুট মেরেছি আর তারস্বরে চেঁচাচ্ছি : মেরে ফেললে ডাকাত–খুন–

    আমার পেছনে রাস্তার লোক ছুটছে, কুকুর ছুটছে, পরামানিক ছুটছে, পুলিশ ছুটছে। আর সকলের আগে ছুটছে কাঁচি হাতে টেনিদা। বলছে, দাঁড়া প্যালা– দাঁড়া। একবার ওকে ভালো করে দেখিয়ে দিই, ছাঁট কাকে বলে–

    হুলোদার বউভাতে সবাই পোলাও-মাংস-ফ্রাই-সন্দেশ খাচ্ছে এতক্ষণে, আর আমি? একেবারে মোক্ষম ছাঁট দিয়ে বিছানায় চুপচাপ শুয়ে আছি। অর্থাৎ ন্যাড়া হওয়া ছাড়া উপায় ছিল না। এই ছাঁট নিয়ে কোনওমতেই বউভাতের নেমন্তন্ন খেতে যাওয়া চলে না। আর চাটুজ্যেদের রোয়াক থেকে কে যেন আমাকে শুনিয়ে-শুনিয়ে চিৎকার করে বললে, ডি-লা গ্রাণ্ডি মেফিস্টোফিলিস ইয়াক ইয়াক! মনে হল, টেনিদারই গলা।

    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26 27 28 29 30 31 32 33 34 35 36 37 38 39 40 41 42 43 44 45 46 47 48 49 50 51 52 53 54 55 56 57 58 59 60 61 62 63 64 65 66 67 68 69 70 71 72 73 74 75 76 77 78 79 80 81 82 83 84 85 86 87 88 89 90 91 92 93 94 95 96 97 98 99 100 101 102 103
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleফাউণ্ডেশন অ্যাণ্ড এম্পায়ার – আইজাক আসিমভ
    Next Article ছোটগল্প – নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়

    Related Articles

    নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়

    সমগ্র কিশোর সাহিত্য – নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়

    September 2, 2025
    নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়

    ছোটগল্প – নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়

    September 2, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo
    Most Popular

    সমগ্র কিশোর সাহিত্য – নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়

    September 2, 2025

    অনুরাধা

    January 4, 2025

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    সমগ্র কিশোর সাহিত্য – নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়

    September 2, 2025

    অনুরাধা

    January 4, 2025

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025
    Our Picks

    সমগ্র কিশোর সাহিত্য – নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়

    September 2, 2025

    ছোটগল্প – নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়

    September 2, 2025

    টেনিদা সমগ্র – নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়

    September 2, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    Sign In or Register

    Welcome Back!

    Login below or Register Now.

    Lost password?

    Register Now!

    Already registered? Login.

    A password will be e-mailed to you.