Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    কাঙাল মালসাট – নবারুণ ভট্টাচার্য

    September 1, 2025

    লুব্ধক – নবারুণ ভট্টাচার্য

    September 1, 2025

    হারবার্ট – নবারুণ ভট্টাচার্য

    September 1, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • 🔖
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    Subscribe
    সাইন ইন
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    ট্যাবু – তৌফির হাসান উর রাকিব

    তৌফির হাসান উর রাকিব এক পাতা গল্প226 Mins Read0

    ক্ষুধানল

    যে বয়সে বাচ্চারা নিত্য-নতুন খেলনার সাথে পরিচিত হয়, মানুকে সে বয়সে প্রতি পদে-পদে মোলাকাত করতে হয়েছে ‘অভাব’ নামের বিচ্ছিরি একটা বিষয়ের সাথে। যখন থেকে বুঝতে শিখেছে, তখন থেকেই খেয়াল করেছে মানু, ত্রিভুবনে অভাবের চেয়ে বিশ্বস্ত সঙ্গী আর দ্বিতীয়টি নেই!

    কত বন্ধু-বান্ধব তাকে সামান্য ছুতোয় ছেড়ে চলে গেল, কতজন তাকে অস্পৃশ্য মনে করে দূরে-দূরে রইল, কিন্তু কোন অছিলায়ই এই অভাব তাকে এক মুহূর্তের জন্যও একলা করেনি; নিতান্ত আপনজনের মত পরম মমতায় জড়িয়ে রেখেছে প্রতিটা ক্ষণ। মানুর আসল নাম মাঈনুদ্দীন, মাঈনুদ্দীন আহমেদ। কিন্তু লোকের মুখে-মুখে কখন যে নামটা মাঈনুদ্দীন থেকে মানু হয়ে গেছে, সেটা সে নিজেও জানে না।

    ছোটলোকের ছেলেকে আসল নামে ডাকার জন্য কার এত ঠেকা পড়েছে? তার মা অবশ্য তাকে পুরো নামেই ডাকে, তবে তাতে কাজের কাজ কিছু হয়নি। লোকের কাছে মানু নামটাই প্রতিষ্ঠা পেয়েছে, মাঈনুদ্দীন নয়।

    তার বদ দাদীটা তো এমনকী মানুও ডাকে না তাকে; সে ডাকে-মাইন্যা! ‘কই গেলি, মাইন্যা? কনে গেলি রে, হারামির পুলা?’-বলে যখন চেঁচায় বুড়িটা, রাগে ব্রহ্মতালু জ্বলে যায় মানুর।

    এমন করে কেউ কারও একমাত্র নাতিকে ডাকে?

    মানু মাঝে-মাঝে ভাবে, হতচ্ছাড়া বুড়িটাকে মোড়ের আঁস্তাকুড়ে ফেলে দিয়ে এলে কেমন হয়? দু’দিন পর-পর ময়লা নিতে আসে সিটি কর্পোরেশনের নোংরা ট্রাকটা। অন্য আবর্জনার সাথে ওরা যদি বুড়িকেও নিয়ে যেত, বেশ হত কিন্তু। বাড়ির সবাই তাহলে শান্তিমতন বাকি জীবনটা কাটাতে পারত।

    শুধু মানু একা নয়, ঘরের সবাইকেই ত্যক্ত করে বুড়িটা; কাউকে রেহাই দেয় না। সর্ব সাকল্যে জনা পাঁচেক মানুষ নিয়ে মানুর সংসার। মানু আর তার ছোটবোন টুনি, বুড়ো দাদা-দাদী আর মা।

    বাবা নামের একজন মানুষও এককালে এই পরিবারের অংশ ছিল, সংসারে এখনকার মত অভাব ছিল না তখন; এসব কথা রূপকথা মনে হয় মানুর কাছে, বাস্তব নয়। তাকে অবশ্য এটা নিয়ে দোষারোপ করারও কোন উপায় নেই। শহরে কেরানীর কাজ করা তার বাবা মাসে কেবল একদিনই ছুটি পেত। ওই একদিনের স্মৃতি, ছোট একটা বাচ্চার মনে কতটুকুই বা আর দাগ কাটে?

    রোড অ্যাক্সিডেন্টে লোকটা যখন মারা গেল, মানুর বয়স মোটে দেড়; টুনি তখনও তার মায়ের পেটে।

    বাবার উপর প্রায়ই খুব অভিমান হয় মানুর। কেন লোকটা অকালে ওদেরকে ফেলে চলে গেল এভাবে? কেন তার জায়গাটা স্বেচ্ছায় দখল করে নিল ‘অভাব’? কেন প্রতিটা দিন এতটা কষ্টে কাটে তাদের?

    নিজের পছন্দসই সালন দিয়ে ভরপেট ভাত খেয়েছে, নিকট অতীতে এমন কোন স্মৃতি নেই মানুর। রোজই একবেলা করে অভুক্ত থাকতে হয় ওদের সবাইকে। বাকি দুই বেলা যেটুকু খাবার একজনের ভাগে জোটে, সেটাও এক রকম না জোটার মতই।

    অবশ্য পরের বাড়িতে ঝি-গিরি করে কতটুকুই বা আর রোজগার করতে পারে মা? পাঁচটা মুখে দিনের পর দিন অন্ন জোগানো কি সহজ কথা?

    মা’কে লোকে মন্দ বলে। অসতী-ছিনাল বলে গালি দেয়।

    শব্দগুলোর মানে বোঝে না মানু; তবে এটুকু ঠিকই বোঝে যে, ওই নিষ্ঠুর শব্দগুলো মায়ের অন্তরটাকে চিরে ফালা ফালা করে দেয়। না হলে কি আর রোজ রাতে লুকিয়ে-লুকিয়ে কাঁদত মা?

    যে মানুষটা দিন-রাত হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে চারটে অসহায় প্রাণীকে বাঁচিয়ে রেখেছে, কেমন করে খারাপ মানুষ হয় সে? বোঝে না মানু।

    মায়ের দুঃখে বুক ফেটে যায় তার। ইচ্ছে হয়…ইচ্ছে হয়, মরে যেতে। তাতে অন্তত একটা ক্ষুধার্ত মুখ তো কমবে, তাই না? মায়ের যন্ত্রণা কি কিছুটা হলেও লাঘব হবে না? সত্যি-সত্যিই বেশ কয়েকবার মরার চেষ্টা করেছে মানু। কতবার যে ওদের বাড়ির পাশের রেললাইনটায় গিয়ে আড়াআড়িভাবে শুয়ে থেকেছে ও, তার কোন ইয়ত্তা নেই। একটা ট্রেন তীব্র গতিতে এগিয়ে যাবে, সঙ্গে-সঙ্গে কাটা পড়বে মানুর শীর্ণ দেহটা। আর তাতেই এই পৃথিবীর তাবৎ দুঃখ-কষ্ট থেকে এক লহমায় মুক্তি মিলবে। ক্ষুধার যন্ত্রণা সহ্য করাটা যে কতটা কঠিন, সেটা কি আদতেই কেউ কখনও অনুধাবন করতে পারবে?

    কিন্তু শেষ পর্যন্ত আর লাইনের উপর শুয়ে থাকা হয় না মানুর। ট্রেনের হুইসেল শোনা মাত্রই বার-বার তড়িঘড়ি করে লাইন ছেড়ে পালিয়ে আসে সে।

    ভয় হয়; মরণের পর যদি আরও বেশি কষ্ট ভোগ করতে হয়, তখন?

    এখানে তো তাও মা আছে, টুনি আছে, দাদা আছে। ওপারে একা-একা কেমন করে দিন কাটাবে সে?

    দাদা মোতালেব মিয়া ভীষণ ভালবাসে ওদের দু’জনকে। সকাল-সকাল বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে যায় লোকটা। কোথায় যায়, কে জানে! হয়তো ভিক্ষেই করে সে। তবে চেনা ভিখারি বলে পয়সা-কড়ি খুব একটা মেলে না; দিতে চায় না লোকে।

    তারপরও দিন শেষে যে কয়টা টাকা পাওয়া যায়, তা দিয়েই সাধ্যমত সদাই- পাতি নিয়ে ফেরে সে। কখনও আধ সের চাল, কখনও চারটে মুলো, কখনওবা পাতলা পলিথিনে ভরে খানিকটা সয়াবিন তেল। খালি হাতে বাড়ি ফেরার কোন নজির নেই তার।

    মাঝে-মধ্যে মানু-টুনির জন্য দুটো সস্তা লালরঙা চকোলেট আনে বুড়ো। ওতেই ভীষণ খুশি হয় ওরা, হল্লা করে গোটা বাড়ি মাথায় তোলে।

    আর তাতেই মোতালেব মিয়ার উপহার আনার খবরটা ফাঁস হয়ে যায়; বুড়ি সাবেরা খাতুনের কাছেও আর সেটা গোপন থাকে না।

    স্বামীর এই ব্যাপারটা একদমই পছন্দ করে না সাবেরা খাতুন। দু’বেলা যাদের কপালে ভাত জোটে না, নুন আনতে যাদের পান্তা ফুরায়; তাদের আবার কীসের মণ্ডা-মিঠাইয়ের বায়না?

    শরীরের ডান পাশটা অবশ সাবেরার, বিছানা ছেড়ে উঠতে পারে না সে। তবে দেহে জোরের ঘাটতি থাকলেও গলার জোরটা এখনও বহাল তবিয়তেই আছে। ক্যানক্যানে গলায় চেঁচাতে শুরু করে সে, ‘আরে ও, বুইড়া হারামি, আবার বুঝি তুই লজেস আনসস্? লজেস…? কই রে, মিনসে, আমার বাতের দুইডা বড়ি তো কোনদিন তোর হাতে ওড়ে না! ডেলি-ডেলি লজেস ওডে ক্যামনে? কম দিসিরে তোরে আমি? কোনদিন কম পাইসস্ আমার কাছ থাইকা?’ কাশির দমকে খানিকটা হয়তো বিরতি নিতে বাধ্য হয় সে, তারপর আবার নতুন উদ্যমে শুরু করে।

    ‘বয়সকালে তো রক্ত চুইষ্যা খাইসস্ আমার। অহন এত বিতিষ্ণা ক্যান? হারামি কোনহানকার…মরস না ক্যান তুই? আজরাইল তোরে চউক্ষে দেহে না? নাকি আমার মরণ নিজের চউক্ষে না দেখলে কইলজা ঠাণ্ডা হইব না তোর? মনের খায়েশ কিতা, খুইল্লা কস্ না ক্যারে, হারামজাদা?’

    এরপরই উচ্চস্বরে বিলাপ শুরু করে সাবেরা খাতুন। তার বাবার বাড়ি থেকে এযাবৎকালে কী-কী এনেছে সে মোতালেবের সংসারে, পাড়া-প্রতিবেশী কারোরই আর জানার বাকি নেই সেটা। ইনিয়ে-বিনিয়ে সুরেলা কান্নায় বহুবার বলা কথাগুলোরই পুনরাবৃত্তি করে সাবেরা।

    চুপসানো মুখ নিয়ে ঘরের দাওয়ায় নিশ্চুপ বসে থাকে মোতালেব মিয়া, স্ত্রীর কথার কোন প্রতিবাদ করে না। কী লাভ?

    বিনাবাক্যব্যয়ে কথাগুলো হজম করে নেয়াই মঙ্গলজনক। কিছু বলতে গিয়ে অযথা নিজের চোদ্দ গোষ্ঠীকে গাল খাওয়ানোর কোন মানে হয় না। সাবেরার সঙ্গে বচসা করে জিততে পারে, এমন মানুষ ইহজগতে খুঁজে পাওয়া ভার।

    দাদীর গালাগাল তবু সহ্য হয়, কিন্তু দাদার গোমড়া মুখটা কিছুতেই সহ্য হয় না মানুর। কবে মরবে বুড়িটা? কবে?

    বাতের ব্যথায় ঠিকমত ঘুমুতে পারে না সাবেরা খাতুন, প্রায় সারাটা রাতই জেগে কাটাতে হয় তাকে। বিছানায় শুয়ে-শুয়ে ককায়, আর নিচুস্বরে একনাগাড়ে বিলাপ করে। কাকে যে গালাগাল দেয়, খোদা মালুম!

    কখনও-কখনও মাঝরাতে প্রকৃতির ডাকে ঘুম ভেঙে গেলে, সন্তর্পণে দাদীর ঘরের দরজায় গিয়ে দাঁড়ায় মানু। দেখতে চায়, অক্কা পেয়েছে কিনা বুড়িটা।

    কিন্তু কী করে যেন প্রতিবারই ব্যাপারটা টের পেয়ে যায় সাবেরা খাতুন। মানুকে দেখেই আঁতকে ওঠে সে।

    ‘কী রে, হারামজাদা? এত রাইতে এইহানে কী করস্? খিদা লাগসে? খাইবি আমারে? খাইবি..?

    ‘তোর মা যেমুন কচি পুলাগুলারে চিবাইয়া-চিবাইয়া খায়, তেমুন কইরা তুইও কি খাইবার চাস আমারে?

    ‘নে, খা; খা কইলাম, হারামজাদা। ডাইন পাওডা আগে খা। কাইন্যা আঙুলডা দিয়া শুরু কর। নাকি বুইড়া আঙুলডা আগে খাইবি?

    ‘আইচ্ছা থাউক, পাও বাদ দে। ডাইন হাতড়া খা। কুড়মুড় কইরা হাড্ডিগুলান চিবাইয়া-চিবাইয়া খা। মজা পাইবি।

    ‘নাকি অইন্য মজা চাস? অইন্য কিছু খাইবি? কত বড় হইসস্ রে তুই, খা…র পুলা?’

    কোন জবাব দেয় না মানু, এক অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে দাদীর দিকে। খোলা জানালা গলে অবাধে ঢুকে পড়া চাঁদের আলো হুমড়ি খেয়ে পড়ে বিছানার একপাশে। গাছের পাতার দীর্ঘ ছায়াগুলো তির-তির করে কাঁপে মৃদু বাতাসে। কাছে-ধারে কোথাও অবিকল মানুষের গলায় কেঁদে ওঠে একটা রোমশ হুলো বেড়াল। অকারণেই গায়ে কাঁটা দেয় মানুর। কলিমের মায়ের কাছে শোনা ভয়ঙ্কর সব ভূতের গল্পগুলো বার-বার উঁকি দেয় মনের কোণে। শাঁকচুন্নি, পেত্নী, স্কন্ধকাটা…আরও কত জানা-অজানা অশরীরীরা ছড়িয়ে আছে চারপাশে। যারা মড়া পছন্দ করে, আধমরা পছন্দ করে। ওদের কেউ যদি আসত একদিন, আর বজ্জাত দাদীটাকে মেরে রেখে যেত…

    মানুর চোখের দিকে তাকিয়ে সাবেরা খাতুনের বুকটা ধক্ করে ওঠে। কীসের যেন অশুভ একটা ছায়া ছেলেটার দু’চোখে; বড্ড ভয় করে। নিরুপায় হয়ে উচ্চস্বরে চেঁচাতে শুরু করে সাবেরা, ‘ও, বউ…কই গেলি? কই গেলিরে, হারামজাদী? তোর লোচ্চা পুলারে লইয়া যা এইহান থাইকা। শিগির লইয়া যা কইলাম। অক্ষণ লইয়া যা। হারামজাদা আমারে খাইয়া ফালাইব। হাছাই একদিন খাইয়া ফালাইব আমারে বেজন্মাডা। লইয়া যা হেতেরে। লইয়া যা…’

    চোখভরা কাঁচা ঘুম নিয়ে টলতে টলতে বিছানা ছেড়ে উঠে আসে মানুর মা। জোর করে মানুকে নিয়ে গিয়ে বিছানায় শুইয়ে দেয় আবার। কখনও-কখনও উপরি হিসেবে হালকা চড়-চাপড়ও জোটে মানুর কপালে। পিছন থেকে তীক্ষ্ণ বাণের মত ধেয়ে আসে সাবেরার চিৎকার, ‘অর চউখগুলার দিকে একবার চাইয়া দেখ, বউ। দুইন্যার খিদা হারামজাদার চউক্ষে। সবকিছু যেন গিল্যা খাইবার চায় হারামির পুলা।’

    ছেলের চোখের দিকে তাকানোর কোন প্রবৃত্তি হয় না মানুর মা’র। ঘুমে তার নিজের চোখই ভেঙে আসছে; রাত-বিরেতে এসব হাঙ্গামা সহ্য হয়?

    ‘যন্ত্রণা দিয়েন না তো, আম্মা। ঘুমান। সারা জীবন বহুত যন্ত্রণা দিসেন, এইবার একটু ক্ষান্ত দেন। নিজেও শান্তিতে থাকেন, আমাগোরেও একটু শান্তিতে থাকবার দেন।’

    সাবেরা খাতুন মোটেও চুপ থাকার বান্দা নয়। শান্ত হওয়ার বদলে উল্টো তেলে-বেগুনে জ্বলে ওঠে সে। ‘দেমাগ দেহাইস না, মাগী। দেমাগ দেহাইস না আমার লগে। যন্ত্রণা দেই আমি, না? যন্ত্রণা দেই তোগোরে? তোর গতর বেচা টেকার কপালে উশটা মারি আমি। কাইল থাইকা আর খামুই না তোর ভাত। গুষ্টি কিলাই তোর দেমাগের।’

    তার কথায় পাত্তা না দিয়ে একখানা তেল চিটচিটে বালিশে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়ে মানুর মা। তার ভালই জানা আছে, দুপুর গড়ানোর আগেই ভাতের’ জন্য চেঁচামেচি জুড়ে দেবে সাবেরা খাতুন।

    .

    শহরতলীর সবচেয়ে ঘিঞ্জি এলাকায় মানুদের বসবাস। গায়ে-গা ঠেকিয়ে সারিবদ্ধভাবে ঘরগুলো দাঁড়িয়ে আছে একের পর এক। সীমানা প্রাচীর কিংবা আঙিনার বালাই নেই, ঘর থেকে বেরিয়ে দুটো কদম এগুলেই সদর রাস্তা।

    একসারি কুঁড়েঘরের মধ্যেও দুটো ঘর বেশ আলাদা করেই চোখে পড়ে। দুঃখ-দারিদ্র্যের ছাপ বেশ প্রকট হয়ে ফুটে আছে ও দুটোর অবয়বে। বাইরের বেহাল দশা থেকেই ভিতরে বাসিন্দাদের শোচনীয় অর্থনৈতিক অবস্থাটা স্পষ্ট ঠাহর করা যায়। অবধারিতভাবে এ দুটো ঘরের একটা মানুদের; অন্যটায় বসবাস করে মানুর প্রাণের বন্ধু জাফরের পরিবার।

    জাফর, মানুর সমবয়সী; সব কাজের দোসর। দু’জনে সারাদিন একসঙ্গে ডাংগুলি কিংবা গোল্লাছুট খেলে; কখনওবা অদূরের শীর্ণ নোংরা খালটায় গিয়ে লাফ-ঝাঁপ দেয়। আর গুজুর-গুজুর গল্প করে; ভাতের গল্প, খেলনার গল্প।

    জাফরেরও বাবা নেই। তবে মরেনি লোকটা, পালিয়ে গেছে। শহরে গিয়ে আরেকটা বিয়ে করে আবার সংসার পেতেছে। উড়ো খবর পাওয়া যায়, নতুন সংসারে তার দুটো সন্তানও আছে।

    সেই যে এক আশ্বিন মাসে গায়েব হয়ে গেল, এরপর আর একটিবারের জন্যও ফিরে আসেনি লোকটা। জাফররা বেঁচে আছে কি মারা গেছে, কিছুতেই যেন কিছু যায়-আসে না তার!

    গার্মেন্টসে কাজ করে ছয় সদস্যের পরিবারের দেখভাল করে জাফরের মা। মানুর দাদা-দাদীর পরিবর্তে জাফরের আছে নানা-নানী। সম্পর্কটা আলাদা বটে, তবে চরিত্রগুলোর মধ্যে খুব একটা ফারাক চোখে পড়ে না।

    খিটখিটে মেজাজের ওই বুড়ো-বুড়িও রাত-দিন হাড় জ্বালিয়ে মারে জাফরকে। একে-অন্যকে সান্ত্বনা দেয় মানু-জাফর, দুঃখ ভাগাভাগি করে নেয়।

    দুটো আধপেটা গল্প ওদের অজান্তেই মিলেমিশে একাকার হয়ে ভরপেটা হয়ে যায়।

    .

    আপাতদৃষ্টিতে সাদামাঠা একটা সকাল, আচমকা ভীষণ তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে উঠল জাফরের জীবনে। দীর্ঘকাল ক্ষয়রোগে ভুগে সেই সকালে মারা গেল তার বুড়ো থুথুড়ে নানী। মহিলার মানসিক অত্যাচার থেকে মুক্তিটাই যথেষ্ট ছিল জাফরের জন্য; উপরন্তু এই উপলক্ষে অভাবনীয় একটা উপহার পেল সে খাবার!

    মরা বাড়িতে প্রথম চারদিন চুলা জ্বালানো নিষেধ, এমন একটা কুসংস্কার প্রচলিত আছে সমাজে। ওই দিনগুলোতে আশপাশের প্রতিবেশীরাই তিনবেলার খাবার পৌঁছে দেয় শোকসন্তপ্ত পরিবারটিতে।

    মৃত্যুর মত বিশাল একটা ব্যাপারকে সামনে রেখে ক্ষুৎপিপাসা নিবারণের তুচ্ছ আয়োজনে ব্যস্ত থাকাটা মানায় না মৃতের স্বজনদের; এহেন একটা ধারণা থেকেই হয়তো গড়ে উঠেছে এই সামাজিক প্রথাটা।

    সে যা-ই হোক, শোকের পরিবর্তে সুখের সাগরেই নিমজ্জিত হলো জাফরের পরিবারের সবক’টা মানুষ!

    নিত্য যাদের অভুক্ত থাকতে হয়, তাদের যদি ভাল-মন্দ পদ দিয়ে তিনবেলার আহার জোটে, ব্যাপারটা কি আদতেই ভীষণ আনন্দের নয়?

    তবে বাইরের মানুষজনের সামনে অবশ্য শোকের অভিনয়টাই অব্যাহত রাখল ওরা। কারণ অভিনয় করেই টিকে থাকতে হয় মানব-সমাজে। মানুষ সেটাই প্রকাশ করে, যা করা উচিত; সত্যিটা নয়।

    চাকচিক্যময় এই সমাজ ব্যবস্থার পুরোটাই আসলে মেকি; ফাঁপা।

    .

    জীবনে প্রথমবারের মত বন্ধুর সৌভাগ্যে ঈর্ষান্বিত হয়ে উঠল মানু। ওদের মধ্যকার বন্ধুত্বের অটুট বন্ধনেও বুঝি খানিকটা ফাটল ধরল। রোজ-রোজ জাফরের মুখে সুস্বাদু খাবারের গল্প কাঁহাতক আর সহ্য করা যায়?

    বাড়ির বাইরে যাওয়া একরকম বন্ধই করে দিল মানু। দিনরাত ঘরের দাওয়ায় গোমড়া মুখে বসে থাকে, আর এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে সাবেরা খাতুনের ঘরের দিকে। বুড়িটা এখনও মরে না কেন? বেঁচে থেকে কী লাভ হচ্ছে তার? কেন এখনও বুড়ো কচ্ছপের মত মাটি কামড়ে পড়ে আছে সে?

    মানুর প্রতি ভয়টা আগের চেয়েও বহুগুণে বেড়ে গেছে সাবেরা খাতুনের। মানুকে দেখলেই সারা শরীর কেঁপে ওঠে তার। আগের মত কারণে-অকারণে আর মানুকে গালমন্দ করে না সে। তবে আপনমনে কী যেন বিড় বিড় করে সারাক্ষণ।

    মানুর সাথে চোখাচোখি হলেই আঁতকে ওঠে, চটজলদি চোখ সরিয়ে নেয়। ছেলেটার চোখে রাজ্যের ক্ষুধা; তাকিয়ে থাকতে ভীষণ অস্বস্তি লাগে।

    আগে দিনের বেলায় অন্তত খানিকটা ঘুম হত তার, এখন আর সেটুকুও হয় না। সর্বক্ষণ অজানা একটা তীব্র আতঙ্ক গ্রাস করে রাখে তাকে।

    জাফরের নানীর মৃত্যুটা, তার শক্ত ভিতের অনেকখানি নাড়িয়ে দিয়েছে। প্রায়ই এখন অদ্ভুত একটা আওয়াজ শুনতে পায় সে। ওপারের ডাক; কেউ যেন তার নাম ধরে ফিসফিস করে ডেকে চলেছে অনবরত।

    ছাতের কড়িকাঠের দিকে তাকিয়ে-তাকিয়েই এখন রাত পার করে সে। মাঝে-মাঝে তারস্বরে স্বামীকে ডাকে, ‘ওই, মোতালেব হারামজাদা। কই গেলি তুই? জানালাডা বন্ধ কইরা দিয়া যা কইলাম। ডর করে। তাগদা আয়, ডর করে আমার।

    বারান্দায় কাঁথামুড়ি দিয়ে শুয়ে-থাকা মোতালেব মিয়া বিরক্ত মুখে এপাশ- ওপাশ করে। কিন্তু স্ত্রীর ডাকে সাড়া দেয় না।

    সেই যে বিয়ের দিন থেকে সিন্দাবাদের রাক্ষসটার মত কাঁধে চড়ে বসেছে হারামজাদী, আজ অবধি আর নামানো যায়নি। কোন্ কুক্ষণে যে বিয়েটায় মত দিয়েছিল, এ নিয়ে আজও আফসোস হয় তার। এই দজ্জাল মহিলাকে বিয়ে না করলে, জীবনটা হয়তো অন্যরকম হতে পারত…

    .

    শেষতক অবশ্য সাবেরা খাতুনের সমস্ত সতর্কতা বিফলে যায়, বাস্তবতার কাছে হার মেনে নিতে হয় তাকে।

    এক কাকডাকা ভোরে, মানুর মা’র বুকফাটা আর্তনাদে ভর করে খবর পৌঁছে যায় সবার কাছে, মারা গেছে সাবেরা খাতুন। কট্টর বুড়িটার চেঁচামেচি আর কখনও শোনা যাবে না এই মহল্লায়। দুপুর গড়ানোর আগেই শেষ হয়ে যায় দাফন-কাফনের সমস্ত ক্রিয়াকর্ম। যৎসামান্য যে কয়জন আত্মীয়-স্বজনের সমাগম হয়েছিল, বিকেল নাগাদ তারাও বিদায় নেয়। অনেক-অনেকদিন পর উপাদেয় তরিতরকারি দিয়ে সে রাতে ভাত জোটে মানুর কপালে।

    বড়-বড় লোকমায় ভাত গেলে মানু, যেন দেরি করলেই যে কোন সময় হাওয়ায় মিলিয়ে যাবে দুষ্প্রাপ্য খাবারগুলো! সস্নেহে টুনিকেও মুখে তুলে খাইয়ে দেয় সে।

    মনে-মনে বলে, এত সহজ ভাত জোগাড় করা? এত্ত সহজ!

    নিজেকে নিয়ে ভীষণ গর্ব হয় তার!

    দাদীকে খুন করতে খুব একটা বেগ পেতে হয়নি মানুকে! মুখে যতই চটাং- চটাং কথা বলুক না কেন, শরীরে একরত্তি শক্তিও ছিল না বুড়ির।

    মুখের উপর বালিশ চাপা দিয়ে মেরেছে তাকে মানু। খানিকক্ষণ শুধু বাম দিকের হাত-পা নেড়ে তড়পেছে বুড়ি, তারপরই খেল খতম।

    কেউ বুঝতেই পারেনি, কত সহজে ঘরের সবার জন্য অন্নের সংস্থান করেছে সে! কিন্তু দেখতে-দেখতেই কেটে যাবে সামনের চারটে দিন। তারপর তো আবারও সেই পুরনো ছকে ফিরে যেতে হবে। তাহলে?

    বার কয়েক আড়চোখে মোতালেব মিয়ার দিকে তাকায় মানু।

    মাঝে-মধ্যে একটা করে মিষ্টি চকোলেট, নাকি টানা চারদিন ভরপেট ভাত; সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না সে!

    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleবিফোর দ্য কফি গেটস কোল্ড – তোশিকাযু কাওয়াগুচি
    Next Article অন্ধকারের গল্প – তৌফির হাসান উর রাকিব সম্পাদিত

    Related Articles

    তৌফির হাসান উর রাকিব

    হাতকাটা তান্ত্রিক – তৌফির হাসান উর রাকিব সম্পাদিত

    August 25, 2025
    তৌফির হাসান উর রাকিব

    অন্ধকারের গল্প – তৌফির হাসান উর রাকিব সম্পাদিত

    August 25, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo
    Most Popular

    কাঙাল মালসাট – নবারুণ ভট্টাচার্য

    September 1, 2025

    অনুরাধা

    January 4, 2025

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    কাঙাল মালসাট – নবারুণ ভট্টাচার্য

    September 1, 2025

    অনুরাধা

    January 4, 2025

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025
    Our Picks

    কাঙাল মালসাট – নবারুণ ভট্টাচার্য

    September 1, 2025

    লুব্ধক – নবারুণ ভট্টাচার্য

    September 1, 2025

    হারবার্ট – নবারুণ ভট্টাচার্য

    September 1, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    Sign In or Register

    Welcome Back!

    Login below or Register Now.

    Lost password?

    Register Now!

    Already registered? Login.

    A password will be e-mailed to you.