Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    কাঙাল মালসাট – নবারুণ ভট্টাচার্য

    September 1, 2025

    লুব্ধক – নবারুণ ভট্টাচার্য

    September 1, 2025

    হারবার্ট – নবারুণ ভট্টাচার্য

    September 1, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • 🔖
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    Subscribe
    সাইন ইন
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    ট্যাবু – তৌফির হাসান উর রাকিব

    তৌফির হাসান উর রাকিব এক পাতা গল্প226 Mins Read0

    প্রাগৈতিহাসিক

    ডক্টর ব্যারনের এই বাড়িটা অনেকটা দুর্গের মত। শহর থেকে দূরে টিলার ওপর অনেকখানি জায়গা জুড়ে বিশালকায় দালান, চারপাশে আকাশছোঁয়া সীমানা প্রাচীর দিয়ে ঘেরা। পুরো এলাকায় প্রাচীরটাকে সঙ্গ দিচ্ছে সুগভীর একটা পরিখা। শোনা যায়, এককালে এই পরিখায় জীবন্ত কুমিরের বসবাস ছিল; কোথাও- কোথাও ছিল প্রাণঘাতী চোরাকাদা।

    প্রধান ফটকটা ছাড়া বাড়িটা থেকে বেরনোর দ্বিতীয় কোন পথ নেই। ওখানটায় পরিখার ওপর লোহার একটা ঝুলসেতু আছে, প্রয়োজনমত ওঠানো-নামানো যায়।

    সম্ভবত কাৰ্কান দস্যুদের হাত থেকে রক্ষা পাবার জন্যই এহেন নিরাপত্তা বেষ্টনী তৈরি করার প্রয়োজন হয়েছিল।

    পৈত্রিক সূত্রে পাওয়া বাড়িটা তৈরি করেছিলেন ডক্টর ব্যারনের প্রপিতামহ। তাঁর আমলে প্রায়ই এদিকটায় কার্কানদের উৎপাতের কথা শোনা যেত। ওদের নৃশংসতার কাহিনিগুলো এতটাই নির্মম যে, আজও ওগুলো শুনলে যে কারও গায়ের লোম দাঁড়িয়ে যাবে।

    বাড়ির লনটা বিশাল। যত্ন নেয়ার জন্য বাঁধা মালি রয়েছে, তাই পুরো আঙিনার সবুজ ঘাসের গালিচা একই রকম পুরু।

    লনের শেষপ্রান্তে গায়ে গা ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে একসারি ইউক্যালিপটাস গাছ; আচমকা তাকালে গা ছম ছম করে ওঠে। মনে হয়, অশুভ একদল প্রেত এসে হাজির হয়েছে জায়গাটায়, যে কোন মুহূর্তে হামলে পড়বে সবার ওপর!

    সবচেয়ে অদ্ভুত বাড়িটার বেজমেন্ট। এতটা বিরাট সেলার সাধারণত দেখা যায় না। অনায়াসে ওটাকে একটা ইনডোর স্টেডিয়াম বলে চালিয়ে দেয়া যাবে। আলাদা কোন পার্টিশান নেই, পুরোটাই ফাঁকা। কেবল নিয়মিত বিরতিতে দাঁড়িয়ে থাকা প্রকাণ্ড থামগুলো ছাদটার ভার বহন করছে।

    ঠিক কী কারণে জায়গাটাকে এতটা বিশাল আকৃতি দেয়া হয়েছিল, আজ আর সেটা জানার উপায় নেই। তবে এতে যে ডক্টর ব্যারনের মস্ত উপকার হয়েছে, তাতে কোন সন্দেহ নেই!

    খাস কামরায় নিজের স্টাডি টেবিলে বসে আপনমনে কী যেন ভাবছেন ডক্টর। চেহারা থমথমে; হৃদয়ের বিষণ্ণতা বক্ষ পিঞ্জর ভেদ করে ছড়িয়ে পড়েছে গোটা অবয়বে।

    টেবিল ল্যাম্পটা ছাড়া আপাতত আর কোন বাতি জ্বলছে না ঘরে। আলোর রেখার বাইরের আবছা অন্ধকার, সেই সাথে বাড়ির মালিকের বিমর্ষতা, পুরো পরিবেশটাকে অনেকখানি ভারী করে তুলেছে। তবে সুখের বিষয়, সেটা দেখার জন্য এই মুহূর্তে দ্বিতীয় কোন ব্যক্তি উপস্থিত নেই ঘরটায়।

    একাকী জীবন যাপন করেন ডক্টর ব্যারন। বিয়ে করেননি, তাই ছেলেমেয়েও নেই। বলতে গেলে গোটা জীবনটাই বিজ্ঞান সাধনায় কাটিয়ে দিয়েছেন তিনি।

    ল্যাবোরেটরিতে কাটিয়েছেন দিনের পর দিন, অভিযানে গেছেন পৃথিবীর নানা প্রান্তে। দেখতে-দেখতে কীভাবে যে ছোট্ট জীবনটার সিংহভাগ কেটে গেল, সেটা তিনি টেরও পাননি। তবে তাঁর এ নিয়ে কোন আফসোস নেই। নিজের কাজে যতটুকু আনন্দ পেয়েছেন, জীবনের কাছে এর বেশি কিছু চাওয়ার ছিল না তাঁর।

    আত্মীয়দের কারও সাথেই তেমন একটা যোগাযোগ নেই। একজন ছন্নছাড়া অসামাজিক বিজ্ঞানীর সাথে কে-ই বা আর যেচে পড়ে দিনের পর দিন যোগাযোগ রাখবে? আজকাল তো প্রত্যেকেই নিজের জীবন নিয়ে ভীষণরকম ব্যস্ত।

    তাছাড়া ঘরোয়া আড্ডার সঙ্গী হিসেবে খুব একটা সুবিধার নন ডক্টর ব্যারন। প্রচলিত চটকদার বিষয়-আশয় সম্পর্কে কোনরকম ধারণা না থাকায়, প্রায় সারাক্ষণই মুখে কুলুপ এঁটে থাকেন। তখন পেটে বোমা মারলেও তাঁর মুখ দিয়ে কথা বের করা যায় না।

    এহেন মুখ ভার করে থাকা প্রায়-বোবা একজন অতিথিকে নিমন্ত্রণ করে নিজের সাধের পার্টির বারোটা বাজাতে কারই বা ইচ্ছে হবে?

    দৈহিক শক্তিতে ভাটা পড়ায় বৈজ্ঞানিক সম্মেলনগুলোও আজকাল এড়িয়ে চলেন ডক্টর। তাই বন্ধুদের সাথেও এখন আর খুব একটা দেখা হয় না তাঁর। নিঃসঙ্গ জীবনে, বলতে গেলে বই-ই এখন তাঁর সর্বক্ষণের সঙ্গী।

    সাতপাঁচ ভেবে নিয়ে চিঠি লেখার প্যাড আর নিজের প্রিয় কলমটা কাছে টেনে নিলেন ডক্টর ব্যারন। তারপর মাথা নিচু করে লিখতে শুরু করলেন…

    প্রিয় বন্ধু,

    জানি, আমার এ চিঠিখানা তোমাকে ভীষণ অবাক করবে। যে মানুষটা গত পাঁচ বছরে একটিবারের জন্যও তোমার খোঁজ নেয়নি, সে যদি অভিমান ভুলে আচমকা বিশাল একখানা চিঠি লিখে বসে, বিস্মিত হওয়াটা সেক্ষেত্রে দোষের কিছু নয়।

    নাহয় ঝগড়াটা সেদিন আমিই বাধিয়েছিলাম, হয়তো আমার রাগারাগিটাও মাত্রা ছাড়িয়ে গিয়েছিল; তাই বলে তোমারও কি রাগটা এতদিন পুষে না রাখলে চলছিল না, বাপু?

    আমাদের বয়স বেড়েছে ঠিকই, তবে ভিতরে-ভিতরে আমরা এখনও ছেলেমানুষই রয়ে গেছি। তাই না, প্রফেসর?

    এই মুহূর্তে তোমার সাহায্য আমার ভীষণ প্রয়োজন, বন্ধু। বলতে পারো, এ কারণেই তোমার প্রতি পুঞ্জীভূত অভিমানটুকু স্বার্থপরের মত জলাঞ্জলি দিতে হয়েছে আমাকে।

    ভেবে দেখলাম, চোখ বুজে বিশ্বাস করে সব কথা খুলে বলা যায়, তুমি ছাড়া এমন আর কেউ নেই আমার। অন্য যারা বিশ্বাসী আছে, অন্তত এ ব্যাপারটায় কিছুতেই ওদেরকে জড়ানো যাবে না।

    না বুঝে ঝামেলা বাধিয়ে বসতে পারে ওরা, ঝুঁকিটা নেয়ার কোন ইচ্ছে নেই আমার।

    বিষয়টা গোপন, অনেক বেশি স্পর্শকাতর। আশা করি, বিস্তারিত শোনার পর সবকিছু জলের মত পরিষ্কার হয়ে যাবে তোমার কাছে।

    ঠিক একারণেই তুমি মহাবিরক্ত হবে জানা সত্ত্বেও আমার সর্বশেষ অভিযানের আদ্যোপান্ত তুলে ধরতে চলেছি এ পত্রে। তেতো ওষুধ গেলার মত করেই নাহয় গিলে নাও চিঠিটা। পড়েছ মোগলের হাতে, খানা খেতে হবে সাথে; কী আর করা!

    আরকেইন ন্যাশনাল পার্কে তুমি কখনও যাওনি, জানা আছে আমার। বেশ কয়েকবারই আমার অভিযানের সঙ্গী হতে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলাম তোমাকে। কিন্তু প্রতিবারই আমাকে তুমি যারপরনাই নিরাশ করেছ।

    আচ্ছা, বিশ্ববিদ্যালয়ের একগাদা ইঁচড়ে পাকা ছেলেমেয়েকে তোতাপাখির মত লেকচার দিয়ে কী সুখ পাও তুমি, বলো তো? কেন অহেতুক জীবনটাকে এভাবে অপচয় করলে?

    অথচ কী দারুণ মেধাবীই না ছিলে তুমি! পৃথিবীকে কত কিছুই না দেয়ার ছিল তোমার! আর তুমি কিনা বেছে নিলে বাচ্চা পড়ানোর চাকরি!

    আচ্ছা, থাক, থাক, ঘাট হয়েছে আমার। রাগে ফুলকো লুচির মত আর ফুলতে হবে না তোমাকে; কাজের কথায় ফিরছি।

    নামে ন্যাশনাল পার্ক হলেও আরকেইন পুরোপুরি বুনো; নামের মতই রহস্যময়। ওখানে এমন অনেক জায়গা আছে, আজতক যেখানে সভ্য মানুষের পা পড়েনি।

    কিছু-কিছু অঞ্চলে এখনও বজায় আছে প্রাগৈতিহাসিক পরিবেশ, সময়ের কোন আঁচড় লাগেনি সেখানে।

    ওখানকার মাটি-উদ্ভিদ-পাথর সবকিছুই আলাদা, একেবারে অন্যরকম। তোমাকে কেউ যদি চোখ বেঁধে ওখানটায় নিয়ে যায়, নির্ঘাত দৃষ্টি ফিরে পাওয়া মাত্র হতবিহ্বল হয়ে পড়বে তুমি। মনে হবে, টাইম মেশিনে চড়ে বুঝি প্যালিওলিথিক যুগে পৌঁছে গেছ!

    ঠিক কী কারণে বিবর্তনের ধারাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে জায়গাটা হাজার বছর ধরে অবিকল একইরকম রয়ে গেছে, তা নিয়ে বিজ্ঞানীদের মধ্যে মতবিরোধ রয়েছে। ওসব অপ্রাসঙ্গিক সায়েন্টিফিক থিওরির কচকচানি তোমার অসহ্য লাগবে বলে সেদিকে আর গেলাম না এখন। তবে সাক্ষাতে তোমার সাথে এসব নিয়ে জম্পেশ আড্ডা দেয়ার খায়েশ আছে আমার। কিছু-কিছু ব্যাপারে তোমার মতামত জানতেও আগ্রহী আমি।

    যা হোক, আরকেইনে ডেথ লেক নামে প্রকাণ্ড একখানা প্রাকৃতিক লেক আছে। ওটা এতটাই বিশাল যে, অনায়াসে ছোটখাট একটা উপসাগর বলে চালিয়ে দেয়া যাবে।

    অসংখ্য ছোট-ছোট দ্বীপ আছে ওটায়, যার বেশিরভাগই এখনও অনাবিষ্কৃত রয়ে গেছে। কারণ ডেথ লেক ভীষণ ঝুঁকিপূর্ণ, নামকরণটা অকারণে করা হয়নি। ক্ষণে-ক্ষণেই ওটার পানিতে প্রচণ্ড ঘূর্ণি তৈরি হয়, অনেকটা নদীর জোয়ার-ভাটার মত। তবে তফাৎ শুধু এটুকুই যে, জোয়ার-ভাটার মত নির্দিষ্ট কোন নিয়ম মানে না ঘূর্ণিটা। কখন এবং কোথায় যে আচমকা উদয় হবে ওটা, আগে থেকে বলার কোন উপায় নেই।

    টানা তিরিশ দিন গবেষণা করেও নির্দিষ্ট কোন প্যাটার্ন খুঁজে পাওয়া যায়নি ওটার।

    বেশ কয়েকবার ওটার কবলে পড়ে প্রাণ হারিয়েছে অসংখ্য মানুষ। তাই আপাতত জলপথ এড়িয়ে চলছেন বিজ্ঞানীরা, আকাশপথে যেসব দ্বীপে যাওয়া সম্ভব কেবল সেগুলোতেই গবেষণা চালাচ্ছেন।

    তবে আমাকে তো তুমি চেনই, ঘাড়ের রগ কতখানি বাঁকা সেটাও জান। সেই একগুঁয়েপনা থেকেই কিনা কে জানে, আমি ঠিক করলাম নৌপথেই দ্বীপগুলো চষে বেড়াব; উড়ুক্কু যান ব্যবহার করব না।

    কোনরকম পিছুটান না থাকায় সিদ্ধান্তটা নেয়া আমার জন্য খুব একটা কঠিন ছিল না। তাছাড়া হাওয়াই যান ভীষণ ব্যয়বহুল, ল্যান্ডিং-এর সুবিধা না থাকলে সব জায়গায় যাওয়াও যাবে না ওগুলো দিয়ে। তাই অহেতুক ঝক্কি পোহানোর চেয়ে ঝুঁকি নেয়াটাই বরং সমীচীন মনে হলো আমার কাছে।

    আমাকে অবশ্য একাই যেতে হলো, সফরসঙ্গী হিসেবে পেলাম না কাউকে। অনিশ্চিত যাত্রায় জান খোয়ানোর ঝুঁকি নিতে নারাজ সবাই।

    প্রায় সবাই বিবাহিত, পরিবার-পরিজন রয়েছে, তাই আমিও কাউকে জোর করিনি। কী দরকার? একাকী মানুষ একসময় নিজের সঙ্গ উপভোগ করতে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে। একারণেই সঙ্গী-সাথীর অভাব কখনও কোন কাজে পিছপা করতে পারেনি আমাকে।

    কোনরকম বিপত্তি ছাড়াই কাঙ্ক্ষিত প্রথম দ্বীপটায় পৌছলাম। আকারে ছোট, প্রায় ন্যাড়া। পুরোটা রেকি করতে ঘণ্টা দুয়েকের বেশি সময় লাগল না। উৎসাহব্যঞ্জক কিছু খুঁজে না পেয়ে রওয়ানা হলাম পরবর্তী দ্বীপটার উদ্দেশে।

    পুরো এলাকাটার একটা ম্যাপ ছিল আমার কাছে, তবে ওটা ছিল আকাশ থেকে করা। পানির গভীরতা কিংবা ডুবো পাথরের কথা উল্লেখ ছিল না ওতে। তাই খুব সাবধানে দেখে-শুনে এগোতে হচ্ছিল আমাকে।

    দ্বিতীয় দ্বীপটাতে পৌঁছতে-পৌঁছতে প্রায় সন্ধ্যা ঘনিয়ে গেল। তক্ষুণি আর কাজে নামলাম না। বোটের কেবিনেই রাত কাটানোর প্রস্তুতি নিলাম।

    নিজের রাঁধা খাবার দিয়ে উদরপূর্তি করে শুয়ে পড়লাম। রান্নাটা আমি ভালই করি, কখনও সুযোগ পেলে চেখে দেখো।

    ক্লান্ত ছিলাম, তাই চোখের পাতা ভারী হতে সময় লাগল না। অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়লাম।

    ঠিক কতক্ষণ পর ঘুমটা ভেঙে গেল, নিশ্চিত করে বলতে পারব না; শোয়ার সময় ঘড়ি দেখিনি। তবে খুব বেশি সময় পেরোয়নি, ঘুমটা তখনও কাঁচা ছিল, এটুকু জোর গলায় বলতে পারি। কী কারণে ঘুমটা ভাঙল, ভাবছিলাম; ঠিক তখনই শুনতে পেলাম আওয়াজটা।

    অদ্ভুত একটা চিৎকার; হাতি আর সিংহের গর্জন একত্রে মেশালে যেমন শোনাবে, অনেকটা ওরকম। একঘেয়ে, বিষণ্ণ, টানা-টানা।

    অকারণেই ঘাড়ের কাছটা শির-শির করে উঠল।

    তড়াক করে বিছানা ছাড়লাম। কোত্থেকে ভেসে আসছে, কীসে করছে চিৎকারটা, জানতে হবে আমাকে।

    স্বীকার করতে দ্বিধা নেই, মনে-মনে বেশ ভয় পাচ্ছিলাম আমি। তবে বৈজ্ঞানিকের সহজাত কৌতূহলী মন ভয়টাকে জয় করতে পেরেছিল।

    সাথে শক্তিশালী টর্চ লাইট ছিল, বোটের ডেকে দাঁড়িয়ে আলো ফেললাম পাশের দ্বীপটার ওপর। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগলাম চেনা-অচেনা গাছ, পাথুরে টিলা, কাঁটাঝোপের দঙ্গল। সেই সাথে কান পেতে রইলাম চিৎকারটা আবার শুনতে পাবার আশায়।

    কিন্তু হতাশ হতে হলো আমাকে। অনেকক্ষণ সময় পেরিয়ে গেলেও আর শোনা গেল না ডাকটা। খোঁজাখুঁজিও সার হলো, কোন প্রাণীর দেখা পাওয়া গেল না।

    গোটা কয়েক ব্যাঙ অবশ্য টর্চের আলোয় বিরক্ত হয়ে স্বেচ্ছায় ঝাঁপ দিয়েছিল লেকের জলে। তাদের ঝাঁপাঝাঁপি থেমে যাওয়া মাত্রই নীরব হয়ে গেল গোটা চরাচর, কোথাও কোন শব্দ নেই। যেন চির নৈঃশব্দ্যের রাজত্ব ওখানে!

    ভেবে দেখলাম, চিৎকারটা দূরের কোন দ্বীপ থেকেও ভেসে আসতে পারে। একে নিশুতি রাত, জলের ওপর দিয়ে শব্দও অনেক দ্রুত ছোটে। তাই সম্ভাবনাটা উড়িয়ে দেয়ার কোন জো নেই। শুনে হয়তো অবাক হবে, বেশ খুশি মনেই সে রাতে দ্বিতীয়বারের মত বিছানায় গিয়েছিলাম আমি। নতুন কিছু খুঁজে পাবার আশাতেই আরকেইনে গিয়েছিলাম, অভিযানের শুরুতেই এতটা আগ্রহ জাগানিয়া কোন কিছুর সন্ধান পেয়ে যাব, কখনও কল্পনাও করিনি। উত্তেজনায় বলতে গেলে ঘুমই এল না আর, ছটফট করতে-করতেই কেটে গিয়েছিল বাকি রাতটা।

    ভোরে হালকা নাস্তা সেরেই কাজে নেমে পড়লাম। দ্বীপটার এক মাথা থেকে অন্য মাথা পর্যন্ত চষে বেড়ালাম পরম ধৈর্যের সাথে। জঙ্গল, ঝোপঝাড়, খানা- খন্দ, কিছুই বাদ দিলাম না। কিন্তু শিকে ছিঁড়ল না ভাগ্যে, পেলাম না কিছুই।

    দুপুরের পর সিদ্ধান্ত নিলাম পাশের দ্বীপটায় চলে যাব। দৃষ্টিসীমার মধ্যেই ওটা, মাঝখানের দূরত্বটা বেশ কম।

    গোছগাছ করে দ্রুত রওয়ানা হয়ে গেলাম, বিকেলটাও কাজে লাগাতে চাই।

    এতসব উত্তেজনায় প্রায় ভুলেই গিয়েছিলাম কোথায় আছি আমি আর কেনই বা জায়গাটাকে ডেথ লেক বলা হয়! যখন মনে পড়ল, সতর্ক হওয়ার কোন সুযোগই ছিল না আমার।

    আচমকাই দেখতে পেলাম জলের ঘূর্ণিটাকে, একেবারে বোটের নাকের ডগায়! হলফ করে বলতে পারি কয়েক মুহূর্ত আগেও ওটা ছিল না ওখানটায়, চোখের পলকে উদয় হয়েছে মূর্তিমান রাহুর মত!

    বোটটাকে সামলানোর প্রাণপণ চেষ্টা করলাম, কিন্তু কোন ফল হলো না! তীব্র স্রোতের টানে ধীরে-ধীরে ওটা এগিয়ে যাচ্ছিল যমদূতের আলিঙ্গনে আবদ্ধ হতে!

    ওটাকে আর সামলানো যাবে না বুঝতে পেরে নিজেকে বাঁচানোর একটা শেষ চেষ্টা করলাম আমি। একছুটে চলে গেলাম বোটের পিছন দিকটায়, দ্রুত পরে নিলাম লাইফ জ্যাকেট। পরক্ষণেই ইষ্টনাম জপে ঝাঁপ দিলাম হ্রদের জলে। বোটসুদ্ধ মরণঘূর্ণিতে তলিয়ে যাওয়ার কোন ইচ্ছাই ছিল না আমার।

    প্রাণপণে সাঁতরে সবেমাত্র কয়েক ফুট দূরে সরতে পেরেছি, ঠিক তখনই এক ঝটকায় পুরো বোটটা অদৃশ্য হয়ে গেল ঘূর্ণির ভিতরে। দমবন্ধ করে অপেক্ষায় রইলাম কয়েক মুহূর্ত, ওটাকে আবারও দেখতে পাবার আশায়। কিন্তু না, একটিবারের জন্যও আর ভেসে ওঠেনি ওটা!

    ঝাঁপ দিতে আর কয়েক সেকেণ্ড দেরি করলে কী যে হাল হত আমার, ভাবতে গিয়ে অথৈ জলে আকণ্ঠ নিমজ্জিত থেকেও অন্তরাত্মা শুকিয়ে গিয়েছিল আমার।

    ঘূর্ণিটা থেকে যতটা সম্ভব দূরত্ব বজায় রেখে ধীরে-ধীরে সাঁতরাতে শুরু করলাম দ্বীপটার উদ্দেশে। দুটো দ্বীপের মাঝখানের যে দূরত্বটা এর আগে যৎসামান্য মনে হয়েছিল, সেটাই তখন আমার কাছে তেপান্তরের মাঠের শামিল!

    এই বুড়ো শরীর নিয়ে অতখানি পথ সাঁতরাতে পারব কিনা, তা নিয়েই তখন সন্দিহান হয়ে পড়েছিলাম। তবে ঈশ্বর সহায় ছিলেন বলেই সেদিন প্রাণে বেঁচে গিয়েছিলাম আমি। সূর্য ডোবার ঠিক আগ মুহূর্তে গিয়ে পৌছলাম দ্বীপটায়।

    আগেরগুলোর তুলনায় আকারে অনেক বড় ছিল ওটা। বনজঙ্গল, পাহাড়, গুহা, কোনকিছুরই অভাব ছিল না।

    অন্ধকার নামার আগেই রাত কাটানোর জন্য একটা আশ্রয় খোঁজার প্রয়াস পেলাম। একেবারে খোলা আকাশের নীচে অরক্ষিত থাকাটা ঠিক হবে না।

    খুব একটা খুঁজতে হলো না, জুতসই একটা গুহা পেয়ে গেলাম। আকারে মাঝারী, খটখটে শুকনো।

    আশপাশ থেকে কিছু ঝরা পাতা খুঁজে এনে বিছানা পাতলাম। পরনের ভেজা কাপড়গুলো শুকানোর জন্য ছড়িয়ে দিয়ে পুরোপুরি দিগম্বর হয়ে নেতিয়ে পড়লাম। শরীরে তখন আর এক বিন্দু শক্তিও অবশিষ্ট ছিল না আমার।

    কিছু খাবারের সন্ধান করা, নিদেনপক্ষে আগুন জ্বালার চেষ্টা করা উচিত ছিল বটে, কিন্তু জোর পাচ্ছিলাম না। বুড়ো হাড় আর কতই বা ধকল সইবে, তুমিই বলো!

    শেষ কবে এতটা গভীর ঘুমে তলিয়ে গিয়েছিলাম, জানা নেই আমার। আবছাভাবে মনে পড়ে, মাঝরাতের দিকে ওই অদ্ভুত ডাকটা আবারও শুনতে পেয়েছিলাম আমি। অনেক বেশি স্পষ্ট, অনেক বেশি কাছে।

    মনে হলো, এই দ্বীপেই আছে প্রাণীটা। হয়তো খানিকটা খুঁজলেই পাওয়া যাবে ওটাকে। শতভাগ ইচ্ছে থাকলেও, তখন কাজটা করার কোন উপায় ছিল না আমার। একে শরীরের বেহাল দশা, তার উপর একটা টর্চ পর্যন্ত ছিল না সাথে। খুঁজব কী করে?

    তাই মটকা মেরে পড়ে রইলাম। সকাল হোক আগে, তারপর দেখা যাবে কী করা যায়।

    ভোরের আলো ফোটার অনেক পরে সেদিন ঘুম ভাঙল আমার। বেঁচে থাকার সহজাত প্রবৃত্তি জানান দিল, খাবার চাইছে শরীর, খিদেয় চোঁ-চোঁ করছে পেট।

    অনেক খোঁজাখুঁজির পর একটা রুটিফল গাছ পেয়ে গেলাম। কোন একসময় ঝড়ের কবলে পড়েছিল গাছটা, কাণ্ডটা বেঁকে গিয়ে প্রায় মাটির কাছাকাছি চলে এসেছে। তবে শিকড় উপড়ে যায়নি বলে বেঁচে আছে এখনও, ফলও ধরেছে।

    পেটের আগুন নেভামাত্রই ভাবতে বসলাম, কীভাবে এখান থেকে উদ্ধার পাওয়া যায়। বাইরে থেকে কোন সাহায্য আসবে না, জানা ছিল আমার। যা করার নিজেকেই করতে হবে।

    সারভাইভাল সম্পর্কিত বইগুলো চিরকাল আগ্রহ নিয়েই পড়তাম। কিন্তু কল্পনাও করিনি কখনও, আমাকেও একদিন এমন পরিস্থিতিতে ফেঁসে যেতে হবে!

    বাঁশ দিয়ে ভেলা বানানোর সিদ্ধান্ত নিলাম। এছাড়া আর কোন পথও নেই। দড়ি হিসেবে কাজ চালানোর মত শক্ত লতার অভাব ছিল না, আঠার জোগান দিল রুটিফল গাছের কাণ্ড।

    যন্ত্রপাতি ছাড়া কাজ করাটা যে কতটা ঝক্কির, হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছিলাম সেটা। কয়েক ঘণ্টার কাজ সারতে লেগে গেল কয়েক দিন!

    প্রায় প্রতি রাতেই ওই অদ্ভুত ডাকটা শুনতে পেয়েছিলাম। তবে ওটাকে আর খুঁজতে যাওয়ার সাহস ছিল না আমার। ওই কয়দিনে মানসিক শক্তির প্রায় পুরোটাই হারিয়ে ফেলেছিলাম বলা যায়।

    আগে তো নিজে বাঁচি, তারপরই না গবেষণা! একবার বেঁচে ফিরতে পারলে, প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিয়ে আবারও আসা যাবে, অসুবিধে নেই। তখন নাহয় খোঁজা যাবে ওটাকে। অবশেষে পাঁচদিনের মাথায় শেষ হলো ভেলা বানানোর কাজটা।

    ঈশ্বরকে স্মরণ করে বহু কায়দা-কানুন করার পর ওটাকে জলে নামাতে পারলাম। রওয়ানা হওয়ার ঠিক আগ মুহূর্তে দেখতে পেলাম ওটাকে!

    কিম্ভূতকিমাকার একটা প্রাণী, গাছের গুঁড়ির আড়াল থেকে উঁকি দিয়ে দেখছে আমাকে!

    আকারে খুবই ছোট ছিল ওটা; একটা কুকুর ছানার চেয়ে বড় হবে না কিছুতেই। তবে দেখতে অদ্ভুত ছিল, ভীষণ অদ্ভুত। না দেখলে বিশ্বাস করতে পারবে না তুমি।

    একটা গিরগিটির শরীরে যদি বাঘের মাথা বসিয়ে দেয়া হয়, সাথে জুড়ে দেয়া হয় হাতির কানের মত চ্যাপ্টা দুটো কান; দেখতে যেমন হবে, ওটা অনেকটা ওরকমই।

    এহেন নমুনা চোখের সামনে পেয়েও ভাল করে না দেখে ফিরে আসতে মন সায় দিল না। নেমে পড়লাম ভেলা থেকে, ধীর পায়ে এগিয়ে গেলাম প্রাণীটার দিকে। ভয় পাচ্ছিলাম, কখন না আবার ছুটে পালিয়ে যায়!

    কিন্তু আমাকে অবাক করে দিয়ে ওখানেই ঠায় দাঁড়িয়ে রইল জানোয়ারটা। চোখের তারায় ভয়ের বদলে ফুটে উঠেছে কৌতূহল!

    হাঁটু গেড়ে বসলাম ওটার কাছে, বিস্ফারিত নেত্রে তাকিয়ে রইলাম অদ্ভুত দেহটার দিকে।

    কী বুঝল ওটা কে জানে, কুঁই-কুঁই করতে-করতে এগিয়ে এসে আমার গায়ে মুখ ঘষতে শুরু করল! হাত বুলিয়ে খানিকটা আদর করতেই পুরোপুরি ন্যাওটা হয়ে গেল; যেন কতকাল ধরে চেনে আমাকে!

    কী ওটা? কোন্ যুগের প্রাণী? তৃণভোজী না মাংসাশী?

    অনেকগুলো প্রশ্ন ততক্ষণে কড়া নাড়তে শুরু করেছে মনের দরজায়, যার একটারও জবাব জানা নেই আমার।

    জানার একটাই উপায়, প্রাণীটাকে নিবিড় পর্যবেক্ষণে রাখা। হয় আমাকে ওটার সাথে ওখানেই থেকে যেতে হবে, নয়তো ওটাকে নিয়ে আসতে হবে সঙ্গে করে। এ দুটো ছাড়া ভিন্ন কোন পথ খোলা ছিল না আমার জন্য।

    ওই মুহূর্তে ওখানে থেকে যাওয়াটা আমার পক্ষে একেবারেই অসম্ভব ছিল, তাই দ্বিতীয় পথটা বেছে নিতে বাধ্য হলাম। ওটাকে নিয়েই রওয়ানা হলাম ফিরতি পথে।

    প্রথমটায় খানিকটা হকচকিয়ে গেলেও, কিছুক্ষণের মধ্যেই ভেলার দুলুনির সাথে মানিয়ে নিল ওটা।

    স্রষ্টার অপার রহমতে কোনরকম বিপত্তি ছাড়াই তীরে ফিরতে পারলাম। তবে প্রাণীটাকে লোকচক্ষুর আড়ালে রেখে বাড়ি পর্যন্ত আনতে বহু কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে আমাকে। সাক্ষাতেই ওসব নিয়ে বিস্তারিত আলাপ হবে। তবে এটুকু জানিয়ে রাখি, তোমার বন্ধুর উপস্থিত বুদ্ধির তারিফ না করে পারবে না তুমি।

    বাড়ি ফেরার পর প্রথম ক’দিন ভালই কাটল। একটা আদুরে বিড়ালছানার মতই সারাক্ষণ আমার সাথে সেঁটে রইল ওটা। ভীষণ লক্ষ্মী ছিল, কোনকিছু নষ্ট করত না।

    আমার কথা বুঝতে পারত, চুপ করে বসে থাকতে বললে এক জায়গাতেই বসে থাকত ঘণ্টার পর ঘণ্টা। শুধু সময়মত খাবার পেলেই হলো, আর কোন ঝামেলা করত না।

    ততদিনে বুঝে গিয়েছিলাম, মাংসাশী প্রাণী ওটা; মোষের মাংসের প্রতিই আগ্রহটা বেশি।

    তবে গোটা ব্যাপারটা ক্রমেই জটিল হয়ে উঠল। যখন থেকে ডাকাডাকি শুরু করল, ঝামেলার অন্ত রইল না আর। প্রতিবেশীরা নানারকম প্রশ্ন করতে লাগল। আমিও বাধ্য হলাম শহরের বাড়িটা ছেড়ে এই পারিবারিক বাড়িতে এসে বসবাস করতে।

    নিশ্চয়ই বুঝতে পারছ, দ্বীপে যে অদ্ভুত চিৎকারটা আমি শুনতে পেতাম, ওটা এই প্রজাতির প্রাণীরাই করত। ওই দ্বীপে যে এই প্রজাতির অন্তত একজোড়া পূর্ণবয়স্ক প্রাণী রয়েছে, এতে কোন সন্দেহ নেই আমার। হয়তো গোটা একটা পালই বসবাস করছে ওখানকার জঙ্গলে, কে জানে!

    এই বাড়ির জংলা পরিবেশে এসে অবিশ্বাস্য দ্রুততায় বড় হতে শুরু করল ওটা। মাত্র কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই বড়সড় একটা বলদের আকৃতি পেয়ে গেল ওটার দেহ!

    ভীষণ অবাধ্য হয়ে গেল। চাকরবাকর দূরে থাক, আমার কথাও আর শুনতে চাচ্ছিল না কিছুতেই! শেষে একরকম বাধ্য হয়েই ওটাকে নিয়ে সেলারে পুরলাম। ভাবলাম, জায়গাটা বিশাল, চরে বেড়াতে কোন অসুবিধে হবে না ওটার। পরিচারকদের উপর দায়িত্ব ছিল, সময়মত যেন ওটার খাবার পৌঁছে দেয়।

    তবে অচিরেই আরও ভয়ঙ্কর হয়ে উঠল পরিস্থিতি। ভীষণ হিংস্র হয়ে গেল জানোয়ারটা। খাবার দিতে গিয়ে মারাত্মক আহত হলো এক পরিচারক, কামড়ে তার সারা শরীর রক্তাক্ত করে ফেলেছিল ওটা!

    তারপর থেকে আর কখনও সেলারের দরজাটা খোলা হয় না। উপরের পকেট ডোর দিয়েই এখন খাবার দেয়া হয় ওটাকে।

    মাঝেমধ্যে নীচ থেকে ভেসে আসা ওটার হিংস্র গর্জন শুনতে পাই। শব্দটা স্নায়ুর ওপর চাপ তৈরি করে, অস্বস্তি লাগে। জানি, বেরিয়ে আসতে পারলে কী-কী করতে পারে ওটা। আকারে জলহস্তীকেও ছাড়িয়ে গেছে এখন ওটার দেহ। আরও বড় হবে ওটা। কতটা, কোনদিন কল্পনাও করতে পারবে না তুমি!

    খাল কেটে মানুষ আনে কুমির, আমি এনেছি প্রাগৈতিহাসিক যুগের একটা রাক্ষস! কীভাবে এতকাল পরেও এই প্রজাতি পৃথিবীর বুকে টিকে রইল, ব্যাপারটা সত্যিই বিস্ময়কর।

    ওরা ভয়ঙ্কর, ভীষণ ভয়ঙ্কর।

    শরীরে মাংস আছে, এমন সবকিছুই আছে ওদের খাদ্য তালিকায়; এমনকী মানুষও!

    এটাকে লোকালয়ে নিয়ে এসে মস্ত ভুল করেছি আমি, বন্ধু। কাজটা করা মোটেও উচিত হয়নি আমার। মায়া পড়ে গেছে ওটার ওপর, মারতেও মন সায় দিচ্ছে না এখন।

    তাই সিদ্ধান্ত নিয়েছি, ফিরিয়ে নিয়ে যাব ওটাকে আরকেইনে; পৌঁছে দেব ডেথ লেকের সেই দ্বীপটায়।

    এ ব্যাপারে তোমার সাহায্য আমার ভীষণ প্রয়োজন, বন্ধু। কীভাবে কী করব, কিছুই মাথায় আসছে না। বিষয়টা জানাজানি হয়ে গেলে, এতবছর ধরে বিজ্ঞানী হিসেবে আমার যা-যা অর্জন, এক নিমিষে সবকিছু ধুলোয় মিশে যাবে। এত বড় ঝুঁকি নেয়ার জন্য বিজ্ঞানী মহল থেকে শুরু করে সরকার, কেউই আমাকে ক্ষমা করবে না। সভ্য মানুষদের চোখে রীতিমত ভিলেনে পরিণত হব আমি।

    এসব ভাবতে গিয়ে প্রতি মুহূর্তে মাথা আরও এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে আমার। একারণেই তোমাকে ভীষণ দরকার, বন্ধু। তুমি পাশে থাকলে অনেকখানি ভরসা পাব আমি।

    দয়া করে চিঠিটা পাওয়া মাত্রই এখানে চলে এসো। পরবর্তী করণীয় দু’জনে মিলেই ঠিক করতে চাই।

    তোমার অপেক্ষায়…

    ডক্টর ব্যারন

    .

    মানুষের সব কাজ কি পরিকল্পনামাফিক হয় কখনও? চিরস্থায়ী কালিতে লেখা নিয়তি সামনে নিয়ে মুচকি হাসেন ঈশ্বর; ভাবেন, মানুষ যদি জানত কী লেখা রয়েছে তার ভাগ্যে!

    ডক্টর ব্যারনের চিঠিটা সময়মত পেলেন না প্রফেসর কারমেল। নিজের বাড়িতে ছিলেন না তিনি, একটা শিক্ষক সম্মেলনে যোগ দিতে ফ্রান্সে গিয়েছিলেন।

    সাহিত্যের অধ্যাপক হিসেবে প্রায় সারা বছরই এখানে-ওখানে লেকচার দিতে হয় তাঁকে। খুব কম সময়ই বাড়িতে থাকার সুযোগ পান।

    তবে বন্ধুর চিঠিটা হাতে পেয়ে একদমই সময় নষ্ট করেননি তিনি, পরদিনই রওয়ানা দিয়েছেন ডক্টর ব্যারনের সাথে দেখা করার উদ্দেশ্যে।

    তবে ততদিনে ঘটে গেছে মেলা ঘটনা, যার কিছুই জানা নেই তাঁর!

    এক বিকেলে হঠাৎ ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন ডক্টর ব্যারন। সাথে-সাথেই তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয় শহরের হাসপাতালে। তারপর থেকে মস্তিষ্কের রক্তক্ষরণের কারণে প্রায় অচেতন অবস্থায় ওখানেই পড়ে আছেন তিনি।

    পরিচারকদের সবাই তাঁর সেবা শুশ্রূষায় ব্যস্ত থাকায় কেবলমাত্র মালিই রয়ে গিয়েছিল পাহাড়ের ওপরের বনেদী বাড়িটায়। জানোয়ারটাকে খাবার দেয়া আর বাড়িটার দেখভালের দায়িত্ব ন্যস্ত ছিল তার ওপর।

    আগে কখনও ওটাকে খাবার দেয়নি মালি, তাই নিয়মটাও জানা ছিল না তার। দরজাটা খোলা যে উচিত হয়নি, এটা অনেক দেরিতে বুঝতে পেরেছিল বেচারা।

    মানুষের মাংসের স্বাদ কেমন হয়, মালিকে দিয়েই সেটা প্রথম বুঝতে পেরেছিল প্রাগৈতিহাসিক জানোয়ারটা। তাকে সাবাড় করতে বেশ খানিকটা সময় নিয়েছিল ওটা। তারপর বহুদিন বাদে সেলার ছেড়ে বেরিয়ে এসেছিল মুক্ত পরিবেশে, আকারে ততদিনে হাতিকেও ছাড়িয়ে গেছে ওটা! তবে আকাশছোঁয়া সীমানা প্রাচীর আর বন্ধ ফটকের কারণে বাড়িটা ছেড়ে পালাতে পারল না ওটা, ভিতরেই বন্দি থাকতে হলো। এ কয়দিনে ক্ষুধার তাড়নায় রীতিমত পাগল হওয়ার দশা হলো ওটার।

    তার রাগের খেসারত দিতে হয়েছে বহু যত্নে গড়া বাগানটাকে। লণ্ডভণ্ড হওয়া গাছগুলো দেখে আর বোঝার জো নেই, এককালে কত সুন্দর ছিল জায়গাটা।

    .

    বাড়ির গেটে বেশ কিছুক্ষণ ডাকাডাকি করেও ভিতর থেকে কারও সাড়া পেলেন না প্রফেসর কারমেল। হলোটা কী? ভর সন্ধ্যাতেই ঘুমিয়ে পড়েছে নাকি সবাই?

    এগিয়ে গিয়ে দেয়াল হাতড়ে একটা সুইচ টিপে দিলেন তিনি। আগেও বহুবার এখানে এসেছেন, ফটক খোলার সুইচটা কোথায় লুকানো থাকে, ভালই জানা আছে তাঁর।

    সুটকেস নিয়ে ভিতরে ঢুকেই চমকে উঠলেন প্রফেসর। বাড়িটা এত অন্ধকার কেন?

    কেউ নেই নাকি? কোথাও বেড়াতে গেছে?

    বাগানটার দিকে চোখ পড়তেই রীতিমত আঁতকে উঠলেন তিনি। একটা গাছও আর আস্ত নেই, যেন বড়সড় কোন ঝড় বয়ে গেছে জায়গাটার ওপর দিয়ে!

    মনটা কু ডাকছে তাঁর। কেন যেন মনে হচ্ছে, এখানে আসাটা মোটেও উচিত হয়নি। শহর থেকে রওয়ানা দেয়ার আগে অন্তত একটু খবরাখবর নেয়া উচিত ছিল।

    আচমকা জমাটবাঁধা নিস্তব্ধতা চিরে দিল. একটা তীক্ষ্ণ চিৎকার! নিমিষেই তীব্র আতঙ্কের একটা শিরশিরে অনুভূতি ছড়িয়ে পড়ল তাঁর গোটা দেহে। কেঁপে উঠলেন তিনি।

    চোখের কোণে নড়াচড়ার আভাস পেয়ে ফিরে তাকালেন প্রফেসর। পরক্ষণেই বিস্ময়ে নির্বাক হয়ে গেলেন।

    কিম্ভূতকিমাকার একটা পাহাড়প্রমাণ জানোয়ার এগিয়ে আসছে তাঁর দিকে। কোন সন্দেহ নেই, চিঠিতে এটার কথাই লিখেছিল তাঁর বন্ধু।

    কিন্তু এটা বাইরে বেরোল কী করে? এত প্রকাণ্ডই বা হলো কীভাবে?

    মারা যাওয়ার ঠিক আগ মুহূর্তে আরেকবার ওটার হুঙ্কার শুনতে পেলেন প্রফেসর কারমেল। নিজের জন্য নয়, গেটটা বন্ধ না করার জন্যই তখন আফসোস হচ্ছিল তাঁর। ওটা এখান থেকে বেরিয়ে গেলে কতজন মানুষ প্রাণ হারাবে, কে জানে!

    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleবিফোর দ্য কফি গেটস কোল্ড – তোশিকাযু কাওয়াগুচি
    Next Article অন্ধকারের গল্প – তৌফির হাসান উর রাকিব সম্পাদিত

    Related Articles

    তৌফির হাসান উর রাকিব

    হাতকাটা তান্ত্রিক – তৌফির হাসান উর রাকিব সম্পাদিত

    August 25, 2025
    তৌফির হাসান উর রাকিব

    অন্ধকারের গল্প – তৌফির হাসান উর রাকিব সম্পাদিত

    August 25, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo
    Most Popular

    কাঙাল মালসাট – নবারুণ ভট্টাচার্য

    September 1, 2025

    অনুরাধা

    January 4, 2025

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    কাঙাল মালসাট – নবারুণ ভট্টাচার্য

    September 1, 2025

    অনুরাধা

    January 4, 2025

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025
    Our Picks

    কাঙাল মালসাট – নবারুণ ভট্টাচার্য

    September 1, 2025

    লুব্ধক – নবারুণ ভট্টাচার্য

    September 1, 2025

    হারবার্ট – নবারুণ ভট্টাচার্য

    September 1, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    Sign In or Register

    Welcome Back!

    Login below or Register Now.

    Lost password?

    Register Now!

    Already registered? Login.

    A password will be e-mailed to you.