Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে বাঙলাদেশের কৃষক – বদরুদ্দীন উমর

    October 29, 2025

    পূর্ব বাঙলার ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি ২ – বদরুদ্দীন উমর

    October 29, 2025

    বাঙলাদেশে কমিউনিস্ট আন্দোলনের সমস্যা – বদরুদ্দীন উমর

    October 29, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    ট্রেজার – ক্লাইভ কাসলার

    ক্লাইভ কাসলার এক পাতা গল্প596 Mins Read0
    ⤶ ⤷

    ৪৫. সংকট সম্পর্কে যাবতীয় তথ্য

    ৪৫.

    লেডি ফ্ল্যামবোরো সংকট সম্পর্কে যাবতীয় তথ্য পাহাড়ি ঢলের মতো টেলিটাইপ আর কম্পিউটরের মাধ্যমে এসে জমা হচ্ছে পেন্টাগনের মিলিটারি কমান্ড সেন্টার, স্টেট ডিপার্টমেন্টের অপারেশনস সেন্টার আর পুরনো এক্সিকিউটিভ অফিস বিল্ডিংয়ের ওপর গেমস রুমে। তিন জায়গাতেই প্রায় বিদ্যুৎগতিতে সাজানোর পর পর্যালোচনা করা হচ্ছে ডাটাগুলো। তারপর সংক্ষিপ্ত সারবস্তু, সুপারিশ সহ, হোয়াইট হাউসের বেসমেন্টে অর্থাৎ সিচ্যুয়েশন রুমে চূড়ান্ত বিশ্লেষণের জন্য পাঠানো হচ্ছে।

    সিচ্যুয়েশন রুমে ঢুকে লম্বা কনফারেন্স টেবিলের এক মাথায় বসলেন প্রেসিডেন্ট। স্ন্যাকস আর টার্টলনেক পরে আছেন ভদ্রলোক। পরিস্থিতি সম্পর্কে জানার পর উপদেষ্টাদের পরামর্শ চাইতে পারেন তিনি, যদিও কী করা হবে সে ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়ার একক ক্ষমতা ও অধিকার রয়েছে তার।

    মিসর থেকে পাওয়া ইন্টেলিজেন্স রিপোর্ট প্রায় সবগুলোই খারাপ। গোটা দেশ জুড়ে অরাজকতা শুরু হয়ে গেছে, প্রতি ঘন্টায় আরও অবনতি ঘটছে পরিস্থিতির। পুলিশ আর সামরিক বাহিনী ব্যারাক ছেড়ে বেরোয়নি, হরতালের ডাক দিয়েছে ইয়াজিদের অনুসারীরা। মন্দের ভালো এইটুকুই যে তারা এখনো সহিংস আন্দোলনে যায়নি।

    স্বরাষ্ট্রসচিব, ডগলাস ওটস-এর সামনে তার এইড একটা রিপোর্ট রাখল, সেটার ওপর চোখ বুলিয়ে বিড়বিড় করে তিনি বললেন, এইটুকুই বাকি ছিল।

    নিঃশব্দে তার দিকে তাকালেন প্রেসিডেন্ট।

    মৌলবাদী বিদ্রোহীরা খানিক আগে কায়রোর টিভি স্টেশন দখল করে নিয়েছে।

    স্ক্রিনে দেখা গেছে আখমত ইয়াজিদকে?

    একসার কম্পিউটর মনিটরের দিকে পেছন ফিরলেন সি.আই.এ. চিফ। না, এখনও সে মুখ দেখাচ্ছে না। শেষ ইন্টেলিজেন্স রিপোর্ট পেয়েছি, আলেকজান্দ্রিয়ার কাছে সে তার নিজের ভিলায় বসে আছে, অপেক্ষা করছে পরিস্থিতি সামলাতে না পেরে কখন পদত্যাগ করবে সরকার।

    তার বোধ হয় আর বেশি দেরিও নেই, একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন প্রেসিডেন্ট, তারপর জিজ্ঞেস করলেন, ইসরাইল কী করছে?

    পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ। আখমত ইয়াজিদকে এখনো বড় কোনো হুমকি বলে ভাবছে না তারা, স্বরাষ্ট্রসচিব বললেন।

    আখমত ক্যাম্প ডেভিড চুক্তি ছিঁড়ে ফেললে তখন টের পাবে। সি.আই.এ. চিফের দিকে কঠিন দৃষ্টিতে তাকালেন প্রেসিডেন্ট। তাকে আমরা বের করে আনতে পারি?

    পারি, স্নান গলায় বরলেন সিআইএ প্রধান।

    কীভাবে?

    আপনার প্রশাসনের ওপর সমস্ত দায়-দায়িত্ব চাপতে পারে, তাই পদ্ধতিটা আপনাকে আমি জানাতে চাই না মি. প্রেসিডেন্ট।

    সায় দিয়ে মাথা ঝাঁকালেন প্রেসিডেন্ট। তবে কাজটা করতে হলে সিআইএ কে আমার নির্দেশ পেতে হবে।

    আততায়ী পাঠানোর ঘোর বিরোধী আমি, সিআইএ চিফ বললেন।

    ডগলাস ওটস ঠিক বলছে, জুলিয়াস শিলার মন্তব্য করলেন। আপনার ভাবমূর্তি দারুণভাবে ক্ষুণ্ণ হবে আঁততায়ী পাঠালে।

    আর কংগ্রেসে যে কী হৈচৈ হবে, বলার নয়, ডেইল নিকোলাস যোগ করলেন। পত্রিকাঅলারা আপনার পিণ্ডি চটকাবে।

    কিছু সময় চিন্তা করে প্রেসিডেন্ট বললেন, ঠিক আছে, পরে ভাবা যাবে ওটা নিয়ে।

    প্রসঙ্গ বদল করলেন তিনি, মেক্সিকো থেকে কিছু জানা গেল?

    ওখানকার পরিস্থিতি অস্বাভাবিক শান্ত, সিআইএ প্রধান মারটিন ব্রোগান জবাব দিলেন। কোনো বিক্ষোভ মিছিল বা দাঙ্গা হয়নি। টপিটজিন তার ভাইয়ের মতোই অপেক্ষায় আছে।

    ঝট করে মুখ তুললেন প্রেসিডেন্ট, চেহারায় হতচকিত ভাব। আমি কি ঠিক শুনলাম? ভাই?

    চোখ ইশারায় ডেইল দিকে ইঙ্গিত করলেন মারটিন ব্রোগান। সন্দেহ হওয়ায় চমৎকার একটা পরীক্ষা চালিয়ে বাজিমাত করেছে ডেইল। আখমত ইয়াজিদ আর টপিটজিন পরস্পরের আপন ভাই, তারা কেউই জন্মসূত্রে মেক্সিকান বা মিসরীয় নয়।

    পারিবারিক সম্পর্ক নিঃসন্দেহে প্রমাণ করা গেছে? সবিস্ময়ে প্রশ্ন করলেন জুলিয়াস শিলার। কোনো সন্দেহ নেই?

    আমাদের অপারেটররা তাদের জেনেটিক কোড সংগ্রহ করে মিলিয়ে দেখেছে।

    এই প্রথম শুনলাম, প্রেসিডেন্টের বলার সুরে অসন্তোষ প্রকাশ পেল। আমাকে আরও আগে জানানো হয়নি কেন?

    চুড়ান্ত প্রমাণ সাজানোর কাজ চলছে, ল্যাংলি থেকে সরাসরি আপনার কাছে পাঠানো হবে। দুঃখিত, প্রেসিডেন্ট, নিশ্চিদ্র প্রমাণ ছাড়া আপনাকে জানাতে চায়নি আমরা।

    নিকোলাস এবারে জিজ্ঞেস করলেন, ওদের জেনেটিক কোড জোগাড় হলো কীভাবে?

    দু’জনেই আত্মপ্রচার পছন্দ করে, ব্যাখ্যা করলেন মারটিন ব্রোগান। আমাদের জালিয়তিবিষয়ক বিভাগ আখমত ইয়াজিদের কাছে পবিত্র কোরআনের একটা কপি পাঠায়, আর টপিটজিনের কাছে পাঠায় আযটেক পোশাক পরা তারই একটা ফটো, সেই সাথে দু’জনকে অনুরোধ করা হয়, তারা যেন সংক্ষিপ্ত প্রার্থনা লিখে ওগুলো ফেরত দেয়। ওগুলো পাঠানো হয় ওদের পরিচিত বিদেশি ভক্তদের নামে, যাদের হস্তাক্ষর আখমত ইয়াজিদ ও টপিটজিন চেনে। দু’জনেই ওরা টোপ গেলে। প্রার্থনা লিখে ডাকযোগে ফেরত পাঠায় ওগুলো। নির্দিষ্ট ঠিকানায় পৌঁছানোর আগে মাঝপথ থেকে ওগুলো আমরা সংগ্রহ করি।

    দীর্ঘ কাহিনী, স্রোতাদের মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখলেন সিআইএ প্রধান। ফেরত আসা পবিত্র কোরআন থেকে কয়েক জোড়া হাতের ছাপ পাওয়া যায়। বছর কয়েক আগে কায়রোয় একবার গ্রেফতার হয়েছিল আখমত ইয়াজিদ, মিসরীয় পুলিশ বিভাগের কাছ থেকে তার হাতের ছাপ আগেই জোগাড় করেছে সিআইএ সেটার সাথে মিলে গেল কোরআনে পাওয়া একটা ছাপ। ফিঙ্গারপ্রিন্ট অয়েল থেকে তার ডিএনএ টেস্ট করে ল্যাব কর্মীরা।

    টপিটজিনের আঙুলের ছাপ মেলানো অত সহজ হয়নি। মেক্সিকোয় কখনও গ্রেফতার হয়নি সে। তবে ফেরত আসা ফটোয় পাওয়া অনেকগুলো প্রিন্টের মধ্যে থেকে একটার সাথে মিলে যায় ইয়াজিদের কোড। এরপর ইন্টারপোল-এর প্যারিস, হেডকোয়ার্টারে বসে ইন্টারন্যাশনাল ক্রিমিনাল রেকর্ড ঘটিতে গিয়ে সিআইএ অপারেটররা চমকপ্রদ একটা তথ্য পেয়ে যায়। ভোজবাজির মতো বেরিয়ে আসে অবিশ্বাস্য একটা পারিবারিক কাহিনী।

    দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর এই পারিবারিক সংগঠন অপরাধ জগতে মাথাচাড়া দিতে শুরু করে। একশো মিলিয়ন ডলার পুঁজি নিয়ে চুটিয়ে অবৈধ ব্যবসা ফেঁদে বসে মা বাবা, তিন ভাই আর এক বোন। মা-বাবা নীতিনির্ধারণ করে, ভাই-বোনেরা অপারেশনের দায়িত্বে থাকে। চাচা-মামা, খালা-খালু, চাচাতো-খালাতো ভাইবোন, বরক্ত সূত্রে বা বিবাহ সূত্রে বা বিবাহ সূত্রে নিকটাত্মীয়রা অপরাধ সাম্রাজ্যের এক একজন মন্ত্রী। ঘনিষ্ঠ আত্মীয় ছাড়া সংগঠনে বাইরের কেউ না থাকায় আন্তর্জাতিক ইনভেন্টিগেটরদের পক্ষে তদন্ত চালানো অসম্ভব হয়ে ওঠে।

    ওদের নাম? নিচু গলায় জিজ্ঞেস করলেন প্রেসিডেন্ট।

    ক্যাপেসটার, বললেন মার্টিন ব্রোগান। মা জোসেফিন ক্যাপেসটার, বাবা রোলান্ড ক্যাপেসটার। বড় ছেলেও নাম রবার্ট ক্যাপেসটার, যাকে আমরা টপিটজিন বলে জানি। মেজো ছেলে পল।

    অর্থাৎ, আখমত ইয়াজিদ?

    হ্যাঁ।

    সিআইএ আর কি জানে, শুনতে বোধহয় ভালোই লাগবে আমাদের, বললেন প্রেসিডেন্ট।

    কাহিনীর দ্বিতীয় পর্যায়ের শুরুতেই মারটিন ব্রোগান স্বীকার করলেন, সব তথ্য এখনও তার জানা নেই। কার্ল আর ম্যারি, অর্থাৎ ছোট ভাই আর বোন কোথায় আছে বা অন্যান্য আত্মীয়স্বজনের নাম-ঠিকানা জানা সম্ভব হয়নি। হাতের কাছে ফাইল নেই, যতটুকু মনে করতে পারলেন, বলে গেলেন তিনি।

    ক্যাপেসটাররা অপরাপধপ্রবণ একটা পরিবার, তাদের এই ঐতিহ্য আশি বছরের পুরনো। ক্যাপেসটারে বাবা ফ্রান্স ত্যাগ করে ক্যারিবিয়ার অঞ্চলে চলে যায়, সেখানে চোরাচালান ব্যবসা শুরু করে সে-পণ্য সংকটের যুগে আমেরিকায় মদ সরবরাহ করত, চুরি করা জিনিস পাচার করত বিভিন্ন দেশে। প্রথমে সে পোর্ট অভ স্পেন থেকে ব্যবসা করত, পরে কাছাকাছি একটা দ্বীপ কিনে সেটাকে হেডকোয়ার্টার বানায়। বাবা মারা যাবার পর রোলান্ড ক্যাপেসটার, স্ত্রীকে নিয়ে বসবাস শুরু করে দ্বীপটায়। কারও কারও ধারণা, অপরাধ সাম্রাজ্যের ব্রেন হলো তার স্ত্রী, জোসেফিন ক্যাপেসটার। স্বামীর সাথে এসেই, শ্বশুর যা করেনি বা করতে পারেনি, তাই করল সে, ড্রাগ ব্যবসা ধরল। নিজেদের দ্বীপে প্রথম তারা কলার চাষ করল। ভালোই লাভ হতো তাতে। এরপর তারা দুটো করে ফসল তোলার ব্যবস্থা করল-একটা কলা, অপরটি মারিজুয়ানা। কলাগাছের তলায় মারিজুয়ানার চাষ হত, যাতে কেউ দেখতে না পায়। দ্বীপে তারা একটা বিশুব্ধকরণ ল্যাবরেটরিও বসায়।

    আমি কি পরিষ্কার একটা ছবি দিতে পারছি? জিজ্ঞেস করলেন মারটিন ব্রোগান।

    মাথা ঝাঁকালেন প্রেসিডেন্ট। বলে যাও, মার্টিন।

    নিজেদের জায়গায় মারিজুয়ানা চাষ করল, বিশুদ্ধ করল, তারপর পাচার করল, বললেন মার্টিন ব্রোগান। প্রতিটি কাজে অংশগ্রহণ করল ক্যাপেসটার পরিবারের লোকজন, বাইরের কাউকে ভাড়া করা হলো না। আশ্চয়ই বলতে হবে, ইউরোপ আর পূবের দেশগুলোতে মারিজুয়ানা বিক্রি করল তারা, আমেরিকায় নয়।

    ড্রাগস এখনও কি তাদের প্রধান ব্যবসা? ডেইল নিকোলাস জানতে চাইলেন।

    না। মাথা নাড়লেন মারটিন ব্রোগান। নিজেস্ব সূত্র থেকে এই পরিবার খবর পায়, ওয়েস্ট ইন্ডিজের কয়েকটা সিকিউরিটি ফোর্স একসাথে তাদের দ্বীপে হানা দেবে। তাড়াহুড়ো করে মারিজুয়ানার খেত পুড়িয়ে ফেলল তারা, রাখল শুধু কলা বাগানটা, তারপর অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে এমন সব করপোরেশন পাইকারি হারে কিনে ফেলল। ব্যবসা-বুদ্ধিতে কারও চেয়ে কম যায় না, প্রতিটি করপোরেশন সঙ্কট কাটিয়ে উঠল, ক্যাপেসটার পরিবারের সঞ্চয় দাঁড়াল বারোশো মিলিয়ন ডলার। বলাই বাহুল্য, ব্যবসা পরিচালনায় নিজেদের কৌশল খাটায় তারা।

    নিজেদের কৌশল, সেটা কী রকম? প্রশ্নটা ডেইলের।

    ব্ল্যাকমেইল, ঘুষ আর হত্যাকাণ্ড, জবাব দিলেন মারটিন ব্রোগান। প্রতিযোগী কোনো কোম্পানি ক্যাপেসটাররেদ স্বার্থের বিরুদ্ধে হুমকি হয়ে দেখা দিলে প্রথমে কোম্পানির বড় কোনো কর্মকর্তাকে মোটা টাকা ঘুষ দেয়ার চেষ্টা করা হয়। হয়তো দেখা গেল, নিজেদের বিরাট কোনো স্বার্থ জলাঞ্জলি দিয়ে কোম্পানিটি ক্যাপেসটারদের সাথে একা চুত্তিতে এসেছে। ক্যাপেসটার পরিবারের রয়েছে নামকরা সব উকিল, তাদের কাজই হলো প্রতিযোগী অন্যান্য কোম্পানির বিরুদ্ধে প্রতি মাসে একটা-দুটো করে মামলা ঠোকা। প্রতিপক্ষ কোম্পানির ডিজাইনার, পরিচালক, প্রোডাকশন ম্যানেজার বা এক্সিকিউটিভ নিজেদের দায়িত্ব ঠিকমতো পালন করে না, কারণ তারা ক্যাপেটারদের কাছ থেকে মাসোহারা পায়। কেউ যদি মাসোহারা নিতে অস্বীকার করে, বেড়াতে গিয়ে তার স্ত্রী বা ছেলে খুন হয়ে যায় সাগরসৈকতে, কিংবা সে নিজেই গাড়ির তলায় চাপা পড়ে। অনেকে স্রেফ গায়েব হয়ে যায়। অথবা কারও বাড়িতে আগুন লাগে।

    মাফিয়া পরিবারগুলোর মতো একটা সংগঠন, বুঝলাম, বললেন প্রেসিডেন্ট।

    সঠিক তুলনা, মার্টিন ব্রোগান সায় দেন, এভাবেই আন্তর্জাতিক ব্যবসা জগতে নিজেদের আসন পাকাঁপোক্ত করে নিয়েছে ক্যাপেসটার পরিবার। সরকারি হিসেবেই তাদের মূলধনের পরিমাণ এখন বারোশো মিলিয়ন ডলার।

    বিলিয়ন মানে বি দিয়ে যেটা বানান করতে হয়? স্বরাষ্ট্রসচিব হতভম্ব। গির্জার প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেললাম আমি!

    কাঁধ ঝাঁকালেন জুলিয়াস শিলার, কে বলে- অপরাধে অর্থ নেই?

    কিন্ত দুই ছেলেকে মেক্সিকো আর মিসরে কেন তারা পাঠাল? ছেলে দুটো স্থানীয় বলে পরিচিতিই বা পেল কীভাবে?

    দু’জনেরই গায়ের রং শ্যামলা, তার কারণ ওদের মায়ের পূর্বপুরুষরা কৃঞ্চকায় ক্রীতদাস ছিল। বিশদ ইতিহাস জানার সুযোগ নেই, তবে আন্দাজ করতে অসুবিধা হয় না যে রোলান্ড আর জোসেফিন ক্যাপেসটার অন্তত চল্লিশ বছর আগে সাম্রাজ্য স্থাপনের স্বপ্ন দেখে ও পরিকল্পনা তৈরি করে। ছেলেরা জন্ম নেয়ার আগেই বিদেশের মাটিতে কোথায়, কীভাবে তাদেরকে পাঠিয়ে মানুষ করা হবে, সব ঠিক করে ফেলা হয়। পল, ওরফে আখমত ইয়াজিদকে আরবি ভাষা শেখানো হয়, তখনও সে ভালো করে হাঁটতে শেখেনি, রবার্ট, ওরফে টপিটজিনকে শেখানো হয় প্রাচীন আযটেক ভাষা। বয়স বাড়ার পর ওদেরকে সম্ভবত মেক্সিকো আর মিসরের প্রাইভেট স্কুলে ভর্তি করা হয়, নাম পাল্টে।

    চমৎকার প্ল্যান, গম্ভীর সুরে বললেন প্রেসিডেন্ট। জন্মের পর পরই বাচ্চাদের ট্রেনিং দেয়া শুরু হলো, যাতে তারা দুটো রাষ্ট্রের ক্ষমতা দখল করতে পারে। বিপুল সম্পদ, অসীম ক্ষমতা, উদ্ভট উচ্চাকাঙ্ক্ষা পরিবারটিকে বেপরোয়া করে তোলে। আমি তাদের জেদ আর ধৈর্যের প্রশংসা করলে অন্যায় হবে কি।

    প্রশংসা না করে উপায় কী, স্বরাষ্ট্রসচিব ডগলাস ওটস বললেন। ওদের পরিকল্পনা যে সফল হতে চলেছে সে তো আমরা দেখতেই পাচ্ছি। তৃতীয় বিশ্বের নেতৃস্থানীয় দুটো দেশের শাসনভার চলে যাচ্ছে ক্যাপেসটার পরিবারের হাতে।

    সে রকম কিছু আমরা ঘটতে দিতে পারি না, দৃঢ়কণ্ঠে বললেন প্রেসিডেন্ট। রবার্ট ক্যাপেসটার সরকারপ্রধান হওয়ার পর যদি বিশ লাখ মেক্সিকানকে আমাদের সীমান্তের দিকে ঠেলে দেয়, সেনাবাহিনী না পাঠিয়ে আমাদের কোনো উপায় থাকবে না।

    আক্রমণাত্মক ব্যবস্থা গ্রহণের বিপক্ষে আমি, ভারী গলায় বললেন স্বরাষ্ট্রসচিব। বিশ্ববিবেক সব সময় আক্রমণকারীর নিন্দা করে এসেছে। আখমত ইয়াজিদ আর টপিটজিনকে খুন করলে বা মেক্সিকো আক্রমণ করলে সমস্যার দীর্ঘস্থায়ী কোনো সমাধান হবে না।

    তা হয়তো হবে না, প্রেসিডেন্ট বললেন, তবে তাকে আমরা পরিস্থিতি হালকা করার সময় পাব হাতে।

    আরেকটা সমাধান থাকতে পারে, ডেইল নিকোলাস বললেন। ক্যাপেসটার পরিবারের মধ্যে ভাঙন ধরানো যায় না? ওরা যদি নিজেদের মধ্যে ঝগড়া বাধায়?

    আমি ক্লান্ত, চেহারায় বিরক্তি নিয়ে বললেন প্রেসিডেন্ট। হেঁয়ালি বাদ দিতে পারো না?

    সমর্থনের আশায় মার্টিন ব্রোগানের দিকে তাকালেন ডেইল নিকোলাস। ওরা তো ড্রাগ ব্যবসায়ী, তাই না? নিশ্চয়ই ওরা ওয়ান্টেড ক্রিমিনাল, ঠিক?

    ড্রাগ ব্যবসায়ী, হ্যাঁ। ওয়ান্টেড ক্রিমিনাল, না। ওদেরকে সাধারণ অপরাধী ভাবলে ভুল হবে। গোটা পরিবারটার ওপর কয়েক যুগ ধরে তদন্ত চলছে। আজ পর্যন্ত একজনও গ্রেফতার হয়নি। কোনো অভিযোগই তোলা যায়নি। দুনিয়ার শ্রেষ্ঠ লইয়ারদের চাকরি দিয়ে রেখেছে ওরা। বন্ধুত্ব আর যোগাযোগ আছে বিশজন সরকারপ্রধানের সাথে। ওদের কাউকে গ্রেফতার করে হাজতে পাঠানোর কথা ভাবাই যায় না, তার চেয়ে কাটাচামচ দিয়ে পিরামিড ভাঙা অনেক সহজ।

    সেক্ষেত্রে প্রচারমাধ্যমের সাহায্যে ওদের আসল পরিচয় ফাঁস করা হোক, পরামর্শ দিলেন ডেইল নিকোলাস।

    কোনো লাভ নেই, প্রেসিডেন্ট বললেন। মিথ্যে প্রচারণা বলে ওরা বিবৃতি প্রচার করবে।

    ডেইলর পরামর্শটা ভেবে দেখা যেতে পারে, বললেন জুলিয়াস শিলার, তিনি বলার চেয়ে শোনেন বেশি। ওদের কুকীর্তি ফাঁস করলে কাজ হতে পারে।

    শিলারের দিকে তাকালেন প্রেসিডেন্ট। পরিষ্কার করে বলো।

    লেডি ফ্ল্যামবোরো , বললেন জুলিয়াস শিলার। জাহাজাটাকে হাইজ্যাক করার পেছনে আখমত ইয়াজিদ দায়ী, এটা যদি প্রমাণ করা যায়, ক্যাপেসটার পাঁচিলটাকে ভেঙে দেয়া কোনো সমস্যা নয়।

    সায় দিয়ে মাথা ঝাঁকালেন সিআইএ প্রধান। তা যদি প্রমাণ করা যায়, আখমত ইয়াজিদ আর ম্যানুয়ের টপিটজিনের ধর্মীয় মুখোশ খসে পড়বে। একটা কুকীর্তি ফাঁস করা গেলে, পরিবারের আরও হাজারটা অপরাধ বেরিয়ে আসবে।

    নিউজ মিডিয়া হয়ে উঠবে ক্ষুধার্ত হাঙর, মন্তব্য করলেন ডগলাস ওটস।

    কিন্তু একটা কথা সবাই ভুলে যাচ্ছি, বললেন ডেইল নিকোলাস। লেডি ফ্ল্যামবোরোর নিখোঁজ হওয়ার সাথে ক্যাপেসটার পরিবারের সম্পর্ক এখনও প্রমাণিত হয়নি।

    মার্টিন ব্রোগান জিজ্ঞেস করলেন, প্রেসিডেন্ট হাসান, প্রেসিডেন্ট লরেঞ্জো আর হেলাকে কিডন্যাপ করার মোটিভ আর কার থাকতে পারে?

    মোটিভ শুধু ক্যাপেসটার পরিবারের আছে, বললেন জুলিয়াস শিলার।

    এক মিনিট, বললেন প্রেসিডেন্ট। ডেইলের কথায় যুক্তি আছে। ক্রু রা কিন্তু টিপিকাল মিডল ইস্ট আতঙ্কবাদীদের মতো আচরণ করছে না। এখনও তারা কৃতিত্ব দাবি করেনি। স্বীকার করতে বাধ্য হচ্ছি, ওদের এই চুপ করে থাকাটা দুঃস্বপ্নের মতো লাগছে আমার কাছে।

    আমিও স্বীকার করছি, হাইজ্যাকাররা উদ্ভট আচরণ করছে, বললেন মার্টিন ব্রোগান। আমার ধারণা, ক্যাপেসটার পরিবার অপেক্ষার খেলা খেলছে, আশা করছে প্রেসিডেন্ট হাসান আর প্রেসিডেন্ট লরেঞ্জোর অনুপস্থিতিতে ওঁদের সরকারের পতন ঘটবে।

    সিনেটর পিটের ছেলে, ডার্ক, জাহাজ বদলের ব্যাপারটা বুঝে ফেলার পর থেকে কী ঘটছে? ওটস প্রশ্ন করলেন।

    শেষ খবর পেয়েছি, লেডি ফ্ল্যামবোরো টিয়েরা ডেল ফুগো-তে রয়েছে, জবাব দিলেন জুলিয়াস শিলার। তীরবেগে ছুটছে দক্ষিণ দিকে। স্যাটেলাইট থেকে চোখ রাখা হয়েছে ওটার ওপর, আশা করি এই সময় কাল সকালে কোণঠাসা করা যাবে।

    প্রেসিডেন্ট খুশি হতে পারলেন না। ততক্ষণে আরোহীদের সবাইকে ক্রু রা সম্ভবত খুন করে ফেলবে।

    এখনও যদি না করে থাকে, বললেন মার্টিন ব্রোগান।

    ওদিকে আমাদের ফোর্স বলতে কিছুই কি নেই?

    নেই বললেই চলে, মি. প্রেসিডেন্ট, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বললেন। থাকার মধ্যে আছে শুধু কয়েকটা এয়ারফোর্স ট্রান্সপোর্ট প্লেন, পোলার রিসার্চ স্টেশনে সাপ্লাই আনা-নেওয়া করে। লেডি ফ্ল্যামবোরার কাছাকাছি মার্কিন জাহাজ মাত্র একটাই আছে, সাউন্ডার। ওটা নুমার একটা ডিপওয়াটার সার্ভে শিপ।

    ডার্ক পিট যেটায় আছে?

    জি, স্যার।

    আমাদের স্পেশাল ফোর্স কী করছে?

    বিশ মিনিট আগে পেন্টাগনে ফোন করে জেনারেল কিথের সাথে কথা বলেছি, জবাব দিলেন জুলিয়াস শিলার। ঘণ্টাখানেক আগে কার্গো জেটে উঠে রওনা হয়ে গেছে একটা এলিট দল, ইকুইপমেন্টসহ। ওদের সাথে অ্যাসল্ট এয়ারক্যাফও আছে। চিলির পাল্টা অ্যারেনাস-এ ল্যান্ড করবে ওরা, প্ল্যান বদলের দরকার না হওয়া পর্যন্ত ওখানেই ঘাঁটি গাড়বে।

    দূরের পথ, শান্তভাবে বললেন প্রেসিডেন্ট। কখন পৌঁছুবে তারা?

    পনেরো ঘণ্টার মধ্যে। আগে পৌঁছালেও লাভ হতো না, কারণ লেডি ফ্ল্যামবোরোকে কোণঠাসা করার পর উদ্ধারকাজ শুরু করতে পারবে স্পেশাল ফোর্স।

    ওটসের উদ্দেশ্যে এবারে প্রেসিডেন্ট বললেন, চিলি এবং আর্জেন্টিনার সরকারের সাথে কথা বলো, ডগলাস।

    মার্টিন ব্রোগান বললেন। আমাদের সবচেয়ে কাছের ক্যারিয়ার শিপটাও রয়েছে পাঁচ হাজার মাইল দূরে। পুরোমাত্রার আকাশ এবং সমুদ্র সন্ধান এক কথায় অসম্ভব।

    কোনো পরিত্যক্ত খাড়িতে যদি লুকায়, লেডি ফ্ল্যামবোরোকে খুঁজে বের করতে কয়েক মাস লেগে যেতে পারে, আশঙ্কা প্রকাশ করলেন জুলিয়াস শিলার। অ্যান্টার্কটিক কোস্ট লাইনে অনেক গুহা আছে, সবগুলো পরীক্ষা করতে হলে এক বছর লেগে যাবে, তারপর আছে কুয়াশা, তুষারপাত আর নিচু মেঘ।

    কেউ আমাকে জানাবেন আপনারা, প্রেসিডেন্ট ব্যাখ্যা চেয়ে বসলেন, মার্কিন সরকার এরকম দিগম্বর অবস্থায় ধরা পড়ে কেন? ঈশ্বরের দিব্বি, সব কিছু আমরা শুধু লেজেগোবরে করে ছাড়ি। দুনিয়ার সেরা ডিটেকশন সিস্টেম আবিষ্কার করেছি আমরা, কিন্তু যখন ওগুলো দরকার, দেখা যাবে ভুল জায়গায় রাখা হয়েছে সব।

    কেউ কথা বললেন না, কেউ নড়লেন না। পরস্পরের দিকে কেউ তাকালেনও না।

    অবশেষে নিস্তব্ধতা ভাঙলেন ডেইল নিকোলাস, জাহাজটাকে আমরা ঠিকই ধরতে পারব, মি. প্রেসিডেন্ট। ওদেরকে জীবিত ফিরিয়ে তে পারলে একমাত্র স্পেশাল ফোর্সই পারবে।

    জানি, এ ধরনের মিশনের জন্য উঁচু দরের ট্রেনিং নেয়া আছে ওদের, ম্লান কণ্ঠে বললেন প্রেসিডেন্ট। কিন্তু আমি শুধু ভাবছি, ওরা পৌঁছে উদ্ধার করার মতো কাউকে পাবে কি না। এমন তো নয় যে, স্পেশাল ফোর্সকে আমরা লাশ উদ্ধার করতে পাঠাচ্ছি?

    .

    ৪৬.

    স্ত্রীর জন্মদিনের পার্টি থেকে হঠাৎ উঠে আসতে হওয়ায় কর্নেল মরটন হোলিসের মনটা বিশেষ বিক্ষিপ্ত।

    ভেনিজুয়েলার ওপর দিয়ে দক্ষিণ দিকে যাচ্ছে সি-১৪০ ট্রান্সপোর্ট প্লেনটী। বিশেষভাবে সাজানো অফিস কমপার্টমেন্টে একটা ডেস্কের সামনে বসে রয়েছে কর্নেল মরটন হোলিস, হাতে লম্বা হাভানা চুরুট। প্লেন আকাশে ওঠার পর থেকে সমস্যাগুলো নিয়ে দশবার চিন্তা করেছে সে, প্রতিবার অ্যান্টার্কটিক পেনিনসুলার ওয়েদার রিপোর্ট আর বরফ মোড়া উপকূল রেখার ফটোগ্রাফের ওপর চোখ বুলিয়েছে। স্পেশাল অপারেশনস ফোর্স সদ্য গঠিত হয়েছে, পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ কমান্ডো ইউনিটের তুলনায় কয়েক গুণ কঠিন ট্রেনিং পেলেও, তাদের অভিজ্ঞতার ঝুলি এখনও ভারী হয়ে ওঠেনি। লেডি ফ্ল্যামবোরো থেকে আরোহীদের উদ্ধার করার। দায়িত্ব যোগ্য টিমের হাতে পড়েছে, তবে এই মাপের অভিযানে এই প্রথম হাত দিচ্ছে তারা।

    নক করে ভেতরে ঢুকল সেকেন্ড-ইন-কমান্ড, মেজর জন ডিলিঞ্জার। প্ল্যান তৈরি করছেন কর্নেল?

    ছয়ছটা প্ল্যান রয়েছে মাথায়, একটা জাহাজে কীভাবে উঠতে হয় চুপিসারে, বলো তো এঁকেও দেখাতে পারি। হাসল কর্নেল মরটন হোলিস। লেডি ফ্ল্যামবোয়োর ডিজাইন আর ডেক লেআউট হাতের উল্টোপিঠের মতোই চিনে ফেলেছি। কিন্তু প্যারাসুট ব্যবহার করব নাকি স্কুবা, অথবা বালি বা শক্ত বরফের ওপর দিয়ে হেঁটে যেতে হবে কিনা, এসব জানা না থাকায় কোন প্ল্যানটা কাজে লাগবে বুঝতে পারছি না।

    মিসরের প্রেসিডেন্ট, জাতিসংঘ মহাসচিব, মেক্সিকোর প্রেসিডেন্ট- উনারা কেউ আমাদের গোলাগুলির মধ্যে না পড়ে, মন্তব্য করল মেজর।

    হেলিকপ্টার থেকে নামার প্রশ্ন ওঠে না, শব্দ শুনেই ঝাঁক ঝাঁক গুলি ছুড়বে ওরা। ভেতরে ঢুকতে হবে আমাদের ক্রু রা কিছু টের পাবার আগেই।

    যদি রাতের অন্ধকারে প্যারাস্যুট নিয়ে নামি?

    সম্ভব।

    একটা ক্যানভাস সিটে বসল জন ডিলিঞ্জার। নাইট ল্যান্ডিং এমনিতেই ডেঞ্জারাস, তার ওপর যদি অন্ধকার একটা জাহাজে অন্ধ সেজে নামতে হয়, ব্যাপারটা পাইকারী আত্মহত্যা হয়ে উঠতে পারে। চল্লিশজনের মধ্যে পনেরোজন টার্গেট মিস করে সরাসরি সাগরে পড়বে। বিশজন হাজাজের এটা-সেটার সাথে ধাক্কা খেয়ে আহত হবে। যুদ্ধ করার অবস্থায় পাঁচজনকে পেলেও ভাগ্যবান বলব নিজেকে।

    তবু হয়তো শেষ পর্যন্ত তাই করতে হবে আমাদের।

    আরও তথ্যের জন্য অপেক্ষা করা যাক, মৃদুকণ্ঠে বলল জন ডিলিঞ্জার। কোথায় জাহাজটাকে পাওয়া যাবে তার ওপর সব কিছু নির্ভর করছে। কোথাও থেকে আছে না সচল, দুটোর মধ্যে মেলা পার্থক্য। কিছু একটা জানা গেলেই আপনাকে আমি একটা শক্ত অ্যাসল্ট প্ল্যান দেবে অনুমোদনের জন্য।

    ভেরি গুড। লোকজনদের খবর কী?

    হোমওয়ার্ক করছে। পাল্টা অ্যারেনাসে পৌঁছাবার আগেই লেডি ফ্ল্যামবোরোর সব কিছু মুখস্ত করে ফেলবে ওরা।

    পেন্টাগন থেকে জানানো হয়েছে… হঠাৎ থেকে উতস্তত করল কর্নেল হোলিস, জেনারেল ব্রাভোর ক্রুরা ফ্ল্যামবোরোয় ঠাই পেয়েছে ধরে নিয়ে, সব মিলিয়ে সন্ত্রাসবাদীদের সংখ্যা আমাদের সমান হতে পারে।

    চল্লিশজন। প্রায় আঁতকে উঠল জন ডিলিঞ্জার।

    প্রচুর লোক হুমকির মুখে পড়বে এই খেলা শেষ হওয়ার আগে।

    .

    ওয়াশিংটন ডিসি। একটা পাহাড়ের নিচে কংক্রিট বাঙ্কারের ভেতর নিজের অফিস কামরায় পায়চারি করছেন মেজর জেনারেল ফ্রাঙ্ক ডজ। দরজায় নক করে ভেতরে ঢুকল একজন লেফটেন্যান্ট স্যামুয়েল টি. জোন্স। মেজর জেনারেল তার কয়েকজন স্টাফকে নিয়ে সর্বশেষ স্যাটেলাইট ইমেজ পাওয়ার অপেক্ষায় আছেন, টিয়েরা ডেল ফুগোর দক্ষিণ জলভাগ দেখতে পাওয়া যাবে ইমেজটায়। লেফটেন্যান্টকে দেখেই হুঙ্কার ছাড়লেন মেজর জেনারেল ডজ। আট মিনিট আগে পৌঁছানোর কথা তোমার।

    খালি হাত দিয়ে মাথা চুলকে লেফটেন্যান্ট বলল, দুঃখিত, স্যার।

    লেফটেন্যান্টের হাত থেকে ছোঁ দিয়ে স্যাটেলাইট ইমেজটা নিলেন মেজর জেনরেল, লম্বা ওয়ালবোর্ডের গায়ে আটকালেন পিন দিয়ে, বোর্ডের মাথায় এক সারে হুড পরানো অনেকগুলো স্পটলাইট রয়েছে। এর আগের একটা ইমেজও ঝুলছে কাছাকাছি, তাতে লেডি ফ্ল্যামবোরোর সর্বশেষ পজিশন দেখানো হয়েছে লাল বৃত্ত এঁকে, ফেলে আসা পথটা সরু রেখা দিয়ে বোঝানো হয়েছে আর কমলা রঙের বিন্দুগুলো সম্ভাব্য পরবর্তী কোর্স।

    জেনারেলের দুপাশে ভিড় জমাল স্টাফরা, খুদে বিন্দু অর্থাৎ লেডি ফ্ল্যামবোরোকে দেখতে পাবার জন্য সবাই ভারি ব্যাকুল।

    কেপ হর্ন-এর একশো কিলোমিটার দক্ষিণে শেষবার দেখা গিয়েছিল লেডি ফ্ল্যামবোরোকে, একজন মেজর বলল, আগের চার্ট থেকে কোর্সটা ট্রেস করল সে। ইতিমধ্যে ড্রেক প্যাসেজ ছাড়িয়ে যাওয়ার কথা ওটার, সম্ভবত অ্যান্টার্কটিক পেনিনসুলা পেরিয়ে দ্বীপপুঞ্জের কাছে পৌঁছে গেছে।

    ঝাড়া এক মিনিট ফিসফাস করল সবাই, তারপর ঝট করে লেফটেন্যান্টের দিকে ফিরলেন মেজর জেনারেল। ফটোটা তুমি দেখেছ, লেফটেন্যান্ট? বন্ধ অফিসরুমে গমগম করে উঠল তার গম্ভীর কণ্ঠস্বর।

    না, স্যার। অযথা সময় নষ্ট করিনি। হাতে পেয়েই ছুটে এসেছি।

    তুমি ঠিক জানো এটাই লেটেস্ট ট্রান্সমিশন?

    হতচকিত দেখার লেফটেন্যান্টকে। জ্বি, স্যার।

    কোনো ভুল নেই?

    ভুল হতে পারে না, স্যার। নুমার সিস্যাট স্যাটেলাইট এরিয়াটা রেকর্ড করেছে ডিজিটাল ইলেকট্রনিক ইমপালস-এর সাহায্যে, রেকর্ড করার সাথে সাথে পাঠিয়ে দিয়েছে গ্রাউন্ডে। আপনি যে ইমেজটা দেখছেন, খুব বেশি হলে ছয় মিনিট আগে পৌঁছেছে ওটা।

    পরবর্তী ফটো কখন আসবে?

    এলাকাটার ওপর দিয়ে ল্যান্ডস্যাট যাবে চল্লিশ মিনিট পর।

    আর ক্যাসপার?

    লেফটেন্যান্ট হাতঘড়ির দিকে তাকাল। যদি সময় মতো ফেরে, ফিল্মের ওপর চোখ বুলাব আমরা এখন থেকে চার ঘণ্টা পর।

    পৌঁছাবার সাথে সাথে নিয়ে আসবে আমার কাছে।

    ইয়েস, স্যার।

    স্টাফদের দিকে ফিরলেন মেজর জেনারেল ফ্রাঙ্ক ডজ। ওয়েল, জেন্টলমেন বুঝতেই পারছ, হোয়াইট হাউস ব্যাপারটা পছন্দ করবে না। এগিয়ে গিয়ে তিনি একটা ফোনের রিসিভার তুললেন।

    বিশ সেকেন্ডের মধ্যে জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টার কণ্ঠস্বর ভেসে এল, আশা করি ভালো কোনো খবর শোনাবে, ফ্রাঙ্ক।

    দুঃখিত, না, মেজর জেনারেল কোনো রকম ভণিতা করলেন না। দেখা যাচ্ছে প্রমোদতরী ….

    ডুবে গেছে? বাধা দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন উপদেষ্টা।

    নিশ্চিতভাবে কিছু বলতে পারছি না।

    তাহলে কী বলতে পারছ?

    বড় করে শ্বাস টানলেন মেজর জেনারেল। প্রেসিডেন্টকে জানান, প্লিজ, লেডি ফ্ল্যামবোরো আবার গায়েব হয়ে গেছে।

    .

    ৪৭.

    ছবি বা কোনো তথ্য বিশ্বের যেকোনো প্রান্তে পৌঁছানোর জন্য মাইক্রোওয়েভের মাধ্যমে উপগ্রহের ব্যবহার ১৯৯০ সাল থেকেই বিশ্বব্যাপী প্রচলিত। খুঁটিনাটিসহ মুহূর্তের মধ্যে রঙিন ছবি পাঠানো যায় যেকোনো স্থানে।

    দশ মিনিট পর, ওভাল অফিসে একটা ডেস্কের ওপর হুমড়ি খেয়ে সীস্যাট ইমেজটা দেখছেন প্রেসিডেন্ট ও ডেইল নিকোলাস।

    এবার হয়তো সত্যি জাহাজটা ডুবে গেছে, বললেন ডেইল নিকোলাস, ক্লান্ত ও উদভ্রান্ত দেখাল তাকে।

    আমি তা বিশ্বাস করতে রাজি নই, দৃঢ়কণ্ঠে বলেন প্রেসিডেন্ট, তার চেহারা রাগে লাল হয়ে আছে। পাল্টা ডেল এসটে পেরোবার পর জাহাজটাকে ধ্বংস করার সুযোগ পেয়েছিল কুরা, তা না করে জেনারেল ব্রাভোর পথ ধরে লেডি ফ্ল্যামবোরোকে নিয়ে পালিয়ে গেছে ওরা। এখন কেন ডোবাবে?

    সাবমেরিনে করে পালায়নি তো?

    সাউন্ডার থেকে কী বলা হয় শোনার জন্য অপেক্ষা করব আমি।

    কিছুই যেন শুনছেন না প্রেসিডেন্ট। এই কাণ্ডটার পেছনে আমাদের অযোগ্যতা কম দায়ী নয়।

    সত্যি, একেবারে অপ্রস্তুত অবস্থায় ধরা খেয়ে গেছি আমরা, নিকোলাস বললেন।

    জর্জ পিটের কাছে আমার অনেক দেনা, জানি না, কেমন করে নিজেকে ক্ষমা করব। দীর্ঘশ্বাস ফেললেন প্রেসিডেন্ট।

    .

    সি-১৪০ এই মুহূর্তে বলিভিয়ার ওপর দিয়ে উড়ছে। প্লেনের ভেতর সবাই খুব হতাশ। খানিক আগে লেয়ার রিসিভারের মাধ্যমে স্যাটেলাইট ইমেজ পৌঁছেছে, তাতে প্রমোদতরী লেডি ফ্ল্যামবোরোর চিহ্নমাত্র নেই।

    গেল কোথায়! একাধারে বিস্ময় ও উষ্ম প্রকাশ পেল কর্নেল হোলিসের চেহারায়।

    জন ডিলিঞ্জার শূন্য দৃষ্টিতে তাকাল। কোথাও নিশ্চয়ই আছে, একবারে নেই হয়ে যেতে পারে না।

    তাই তো হয়েছে। নিজের চোখেই তো দেখতে পাচ্ছ।

    টার্গেট যদি এভাবে লুকোচুরি খেলতে থাকে …, অসহায় ভঙ্গিতে কাঁধ ঝাঁকিয়ে বাক্যটা অসমাপ্ত রাখল জন ডিলিঞ্জার। আমার ধারণা, লেডি ফ্ল্যামবোয়রা ডুবে গেছে। ফটোয় ওটার না থাকার আর কোনো ব্যাখ্যা নেই।

    চল্লিশজন একসাথে আত্মহত্যা করতে রাজি হয়েছে, এ আমি বিশ্বাস করতে পারি না।

    এখন কী করা হবে?

    রেডিনেস কমান্ড থেকে নির্দেশ চাওয়া ছাড়া আর তো কিছু ভেবে পাচ্ছি না আমি।

    আমরা কি মিশন বাতিল করব? জিজ্ঞেস করল জন ডিলিঞ্জার।

    নির্দেশ না পেলে করব না।

    তার মানে যেমন যাচ্ছি যেতে থাকি।

    হতাশ ভঙ্গিতে মাথা ঝাঁকাল কর্নেল মরটন হোলিস।

    .

    সবার শেষে জানল পিট। মড়ার মতো ঘুমাচ্ছে ও, কেবিনে ঢুকে ওর ঘুম ভাঙালো রুডি।

    জ্যান্ত হও হে, ব্যস্ত সুরে বলল সে, জটিলতা দেখা দিয়েছে।

    ঘুমে ভারী হয়ে থাকা একটা চোখ মেলে হাতঘড়ি দেখল পিট। কী ব্যাপার, পান্টা অ্যারেনাসে এক্ষুনি পৌঁছে গেলাম?

    বন্দরে ঢুকতে আরও এক ঘণ্টা দেরি আছে….

    তাহলে আর বিরক্ত কোরো না না, আরেকটু ঘুমিয়ে নিতে দাও, বলে পাশ ফিরে শুলো পিট।

    গেট সিরিয়াস। গম্ভীর কন্ঠে বলল রুডি। জাহাজের রিসিভারে খানিক আগে লেটেস্ট স্যাটেলাইট ফটো এসেছে। আবার অদৃশ্য হয়েছে তোমার লেডি ফ্ল্যামবোরো।

    সত্যি।

    এটা কি ঠাট্টা করার বিষয়? এইমাত্র অ্যাডমিরালের সাথে কথা বলেছি আমি। হোয়াইট হাউস আর পেন্টাগনে মহা হৈচৈ বেধে গেছে। স্পেশাল ফোর্সের একটা দলকে পাঠানো হয়েছে, আশা- পরিষ্কার এরিয়াল ফটো পাওয়া যাবে।

    পিট চোখ খুলল না, রুডির দিকে ফিরলও না। অ্যাডমিরালকে জিজ্ঞেস করে দেখো, বিশেষ সেই দল ল্যান্ড করার সাথে সাথে নেতা আর আমার মধ্যে একটা মিটিং হতে পারে কি না।

    কী আশ্চর্য! অ্যাডমিরালের সাথে তুমি কেন কথা বলছ না?

    এইজন্য যে আমি এখন ঘুমাব, বলে বিশাল একটা হাই তুলল পিট।

    রুডি গান হতভম্ব। জাহাজটায় না তোমার বাবা আছেন? তোমার কিছু আসে যায় না?

    হ্যাঁ, চিৎ হলো পিট, সিলিংয়ের দিকে তাকাল, আসে যায়। কিন্তু এই মুহূর্তে আমার কিছু করার আছে বলে তো মনে হচ্ছে না।

    কাঁধ ঝাঁকিয়ে সিধে হলো রুডি, ভারী গলায় জিজ্ঞেস করল, অ্যাডমিরালকে আর কিছু বলতে হবে?

    চাদর দিয়ে মাথা ঢাকতে যাচ্ছিল পিট, চোখ খুলে রুডির দিকে তাকাল। হ্যাঁ, একটা কথা ইচ্ছে হলে বলতে পারো তাঁকে। বলতে পারো, আমি জানি কীভাবে লেডি ফ্ল্যামবোয়রা অদৃশ্য হয়েছে। কোথায় ওটা লুকিয়েছে, তা-ও বেশ আন্দাজ করতে পারি।

    কখাগুলো আর কেউ উচ্চারণ করলে রুডি তাকে চাপাবাজ ভাবত। পিটকে অবিশ্বাস করা তার পক্ষে সম্ভব নয়। দু একটা ব্লু চাইলে কিছু মনে করবে?

    চোখ বুজল পিট। তুমি তো এক ধরনের আর্ট কালেক্টর, তাই না, রুডি?

    আমার অ্যাবস্ট্রাক্ট সংগ্রহ নিউ ইয়র্ক মিউজিয়াম অভ মডার্ন আর্ট-এর সাথে তুলনা করা যাবে না, তবে বন্ধুমহলে ওটারও খ্যাতি আছে। কৌতূহলে পিটের দিকে আবার ঝুঁকে পড়ল রুডি। আর্টের সাথে কী সম্পর্ক?

    আমার যদি ভুল না হয়, খুব আয়োজন করে দাঁড় করানো একটা শিল্পকর্মের সাক্ষাৎ পাব আমরা অচিরেই।

    সে শিল্পকর্ম আমি বুঝব?

    ক্রিস্টো একজন বিখ্যাত শিল্পী তাই না? পাশ ফিরে শুলো পিট। তার দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে একটা ভাস্কর্য নির্মাণ করা হয়েছে।

    .

    ৪৮.

    দুনিয়ার সর্বদক্ষিণের সবচেয়ে বড় শহরের উপরে ঝরছে হালকা তুষার। পানামা খাল তৈরি হবার আগে বন্দর হিসেবে নাম ছিল পাল্টা অ্যারেনাসের, পরে গুরুত্ব হারিয়ে ফেলে। শহরের লোকজন এত দিন ভেড়া পেলে রুজি-রোজগার করেছে, ইদানীং কাছাকাছি তেলখনি আবিষ্কার হওয়ায় আবার জমে উঠছে শহর।

    জেটির ওপর দাঁড়িয়ে রয়েছে কর্নেল মরটন হোলিস আর জন ডিলিঞ্জার, সাউন্ডারে চড়ার জন্য অস্থির হয়ে আছে তারা। ফ্রিজিং পয়েন্টের কয়েক ডিগ্রি নিচে নেমে গেছে তাপমাত্রা, হালকা তুষারপাত শুরু হয়েছে, কর্কশ ঠাণ্ডা কামড় বসাচ্ছে নিরাবরণ মুখে, আর্কটিকে উটের মতো লাগছে নিজেদের। চিলি কর্তৃপক্ষের সহায়তায় নিজেদের পরিচয় গোপন করেছে তারা, ব্যাটল ড্রেসের বদলে পরেছে ইমিগ্রেশন অফিসারদের ইউনিফর্ম।

    সময়মতোই, তখনই অন্ধকার ছিল আকাশ, কাছাকাছি একটা সামরিক এয়ারপোর্টে ল্যান্ড করেছে ওদের প্লেন। তুষারপাত শুরু হওয়ায় ভালোই হয়েছে, প্লেন থেকে ওদেরকে কেউ নামতে দেখেনি। চিলির মিলিটারি কমান্ডের সৌজন্য সি-১৪০ ও অ্যাসল্ট এয়ারক্রাফট ঠাই পেয়েছে লোকচক্ষুর আড়ালে একটা হ্যাঁঙ্গারের ভেতর। এয়ারপোর্ট থেকে বেরিয়ে একটা অয়্যার হাউসে ঢোকে ওরা, দূর থেকে দেখতে পায় নোঙর ফেলছে রিসার্চ শিপ সাউন্ডার। সাউন্ডারের ব্রিজ উইং-এ বেরিয়ে এল এক যুবক, মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি, পরনে স্কি জ্যাকেট। মুখের সামনে চোঙ তৈরি করল হাত দিয়ে। জিজ্ঞেস করল, সিনর লোপেজ?।

    জি, মাথা ঝাঁকাল কর্নেল মরটন হোলিস।

    আপনার বন্ধুটি কে? স্প্যানিশ ভাষায় জিজ্ঞেস করল যুবক।

    একই ভাষায় উত্তর দিল কর্নেল, আমার বন্ধু সিনর জোন্স।

    বিড়বিড় করে জন ডিলিঞ্জার বলল, এমনকি চীনা রেস্তোরাঁয়ও এর চেয়ে ভালো স্প্যানিশ শুনেছি আমি।

    প্লিজ, উঠে আসুন জাহাজে, বলল যুবক। মেইন ডেকে ওঠার পর ডান দিকে একটা মই পাবেন, ওটা বেয়ে ব্রিজে চলে আসুন।

    ধন্যবাদ।

    মই বেয়ে ওঠার সময় কৌতূহলের মাত্রা বেড়ে গেল কর্নেলের। যুবকের কথা শুনে তাকে আমেরিকান বলে মনে হয়নি। পরিচয় আন্দাজ করতে গিয়ে ব্যর্থ হলো সে। আসলে এখনও অন্ধকারে রাখা হয়েছে তাকে। পাল্টা অ্যারেনাসে পৌঁছাবার এক ঘণ্টা আগে জেনারেল ডজের কাছ থেকে কোড় করা জরুরি একটা মেসেজ পেয়েছে সে, নুমার সার্ভে শিপ সাউন্ডার নোঙর ফেললে তাতে চড়তে হবে তাকে। ব্যস, এইটুকু। আর কোনো ব্যাখ্যা দেয়া হয়নি। পরবর্তী নির্দেশও পায়নি সে। ভার্জিনিয়া ব্রিফিং থেকে তার শুধু জানা আছে রিসার্চ শিপ আর তার ক্রুরা কীভাবে যেন একটা অসম্ভবকে সম্ভব করেছে-লেডি ফ্ল্যামবোরোকে জেনারেল ব্রাভো বলে চালাবার চেষ্টা করেছিল, সেটা তারা ধরে ফেলে। আর কিছু জানা নেই কর্নেলের। তাকে এখন জানতে হবে পান্টা অ্যারেনাসে এস.ও.এফ. দল যখন পৌঁছাল, একই সময়ে হঠাৎ করে সাউন্ডার-ও পৌঁছাল কেন? অন্ধকারে থাকতে পছন্দ করে না কর্নেল, কাজেই তার মেজাজও খুব একটা ভালো অবস্থায় নেই।

    যুবককে ব্রিজ উইংয়েই পাওয়া গেল। তার ঘন সবুজ, ওপাল পাথরের মতো চোখ দুটো খুঁটিয়ে দেখল কর্নেল মরটন হোলিস।

    তার কালো চুলে তুষারের সাদা কণা জমেছে। পাঁচ সেকেন্ড অফিসার দু’জনকে দেখল সে, তারপর কোট পকেট থেকে হাত বের করে বাড়িয়ে ধরল। কর্নেল মরটন হোলিস, মেজর ডিলিঞ্জার, আমি ডার্ক পিট।

    দেখা যাচ্ছে, আমরা আপনার সম্পর্কে কিছু জানি না, কিন্তু আপনি আমাদের সম্পর্কে অনেক কিছু জানেন, মি. পিট।

    বৈষম্যটা দূর করা হবে, কথা দেয়ার সুরে বলল পিট, মুখটা হাসি হাসি। আসুন, ক্যাপটেনের কেবিনে যাওয়া যাক।

    কৃতজ্ঞচিত্তে তুষার আর হিম ঠাণ্ডা পেছনে ফেলে পিটকে অনুসরণ করল অফিসাররা, এক ডেক নিচে নেমে স্কিপার ফ্রাঙ্ক স্টুয়ার্টের কেবিনে ঢুকল পিট। ভেতরে ঢুকে সবার সাথে হ্যান্ডশেক করল অফিসাররা, খুশিমনে ধূমায়িত কফির কাপে চুমুক দিল।

    বসুন আপনারা, ওদেরকে চেয়ার দেখাল স্কিপার।

    মেজর ডিলিঞ্জার বসল, তবে মাথা নাড়ল কর্নেল মরটন হোলিস।

    ধন্যবাদ, বলল সে। আমি বরং দাঁড়িয়ে থাকতেই পছন্দ করব। এক এক করে নুমার চারজন লোকের দিকে তাকাল সে। সরাসরি জিজ্ঞেস করলে যদি কিছু মনে না করেন, কী ঘটছে বলবেন আমাকে?

    বুঝতেই পারছেন, ব্যাপারটা লেডি ফ্ল্যামবোরোকে নিয়ে, জবাব দিল পিট।

    আলোচনার আছেটা কী? জানা কথা আতঙ্কবাদীটা ওটাকে ডুবিয়ে দিয়েছে।

    দৃঢ় আশ্বাস দিয়ে বলল পিট, এখনও ওটা পানির ওপর দিব্যি ভাসছে।

    আমাকে উল্টোটা জানানো হয়েছে, কঠিন সুরে বলল কর্নেল মরটন হোলিস। লেটেস্ট স্যাটেলাইট ফটোতে জাহাজটা নেই।

    আমার কথার ওপর ভরসা রাখুন।

    আপনি আমাকে প্রমাণ দেখান।

    আপনি এখানে হুকুম চালাবেন না। নাকি চালাবেন?

    দল নিয়ে এখানে আমি এসেছি মানুষের প্রাণ বাঁচানোর জন্য, কর্কশ সুরে বলল কর্নেল। কেউ, এমনকি আমার ঊর্ধ্বতন অফিসাররাও, আমাকে বলেননি যে লেডি ফ্ল্যামবোরোর আরোহীদের এখনও বাঁচানো যেতে পারে।

    আপনাকে বুঝতে হবে, কর্নেল, হঠাৎ চাবুকের মতো শব্দ করল পিটের কণ্ঠস্বর, প্রতিপক্ষরা সাধারণ গান-হ্যাপি আতঙ্কবাদী নয়। অত্যন্ত বুদ্ধিমান এক লোক ওদেরকে নেতৃত্ব দিচ্ছে। দুনিয়ার সেরা সিকিউরিটি মেধাগুলোকে বোকা বানিয়ে চলেছে সে।

    অথচ কেউ একজন তার সব চালাকি বুঝে ফেলতে পারছে, প্রশংসাই করল কিন্তু তীব্র ব্যঙ্গের সুরে।

    আমাদেরকে সহায়তা করেছে ভাগ্য। সাগরের ওই অংশে সার্ভে করছিল সাউন্ডার, তা না হলে জেনারেল ব্রাভোকে খুঁজে পেতে এক মাস লেগে যেত। সময়টা কমিয়ে এনেছি আমরা, তার পরও এক কি দেড় দিন এগিয়ে আছে লেডি ফ্ল্যামবোরো।

    নরম না হয়ে উপায় দেখল না কর্নেল। তার সামনে দাঁড়ানো লোকটা এক ইঞ্চি জায়গা ছাড়তেও রাজি নয়। জাহাজটা কোথায়? সরাসরি জানতে চাইল সে।

    আমরা জানি না, জবাব দিল রুডি।

    আনুমানিক পজিশনও জানা নেই?

    শুধু একটা যুক্তিসংগত ধারণা দিতে পারি, বলল জিওর্দিনো।

    কিসের ওর ভিত্তি করে?

    পিটের দিকে তাকাল জিওর্দিনো, মৃদু হেসে বলটা নিজের নিয়ন্ত্রণে নিল পিট। ইনটুইশন।

    কর্নেলের আশা পঁড়িয়ে যেতে শুরু করল। আপনারা কি জাদু দণ্ড ব্যবহার করছেন, নাকি ক্রিসটাল বল?

    সত্যি কথা বলতে কি, আমার পছন্দ চায়ের পাতা, উত্তর দিল পিট, মনে মনে বলল, টিট ফর ট্যাট।

    শীতল, দীর্ঘ নিস্তব্ধতা নেমে এল কেবিনের ভেতরে। কর্নেলের উপলব্ধিতে কোনো ভুল নেই, চোটপাট দেখিয়ে এখানে সুবিধা করা যাবে না। কফি শেষ করে খালি কাপটা বারবার হাত বদল করল সে। অবশেষে সে-ই নিস্তব্ধতা ভাঙল,

    ঠিক আছে। মানলাম, আমি একটু তাড়াহুড়ো করে ফেলেছি। আসলে সিভিলিয়ানদের সাথে মেলামেশা করে অভ্যস্ত নই।

    ব্যঙ্গ বা তাচ্ছিল্যের কোনো ভাব নয়, পিটের চেহারায় শুধু নির্মল কৌতুক। শুনে যদি স্বস্তি বোধ করেন, তাহলে বলি, এয়ারফোর্সের একজন মেজর আমি।

    ভ্রু কুঁচকে পিটের আপাদমস্তক নিরীক্ষণ করল কর্নেল। জানতে পারি, মুমার মতো একটা প্রতিষ্ঠানের জাহাজে কী করছেন আপনি?

    সে অনেক কথা, বলল পিট। সব শোনার ধৈর্য হবে না আপনার।

    মেজর ডিলিঞ্জার ধরতে পারল ওর পরিচয়। বিভিন্ন ব্যাপার নিয়ে মাথা জ্যাম না থাকলে কর্নেল হোলিসও আগেই বুঝতেন।

    আপনি কি সিনেটর পিটের কেউ হন?

    সিনেটর আমার বাবা।

    ধপ করে একটা চেয়ারে বসে পড়ল কর্নেল মরটন হোলিস।

    ঠিক আছে, মি. পিট। এবারে বলুন, কী খুঁজে পেয়েছেন আপনি?

    মেজর ডিলিঞ্জার সময় নষ্ট না করে প্রসঙ্গটা ফিরিয়ে আনল, শেষ রিপোর্টে দেখা গেছে, লেডি ফ্ল্যামবোরো অ্যান্টার্কটিকার দিকে যাচ্ছে। আপনি বলছেন, জাহাজটা এখনও পানির ওপর আছে। নতুন ফটোগুলোয় ভাসমান বরফের মধ্যে নিশ্চয়ই ওটাকে দেখা যাবে।

    ফটোগুলো যদি এসআর-নাইনটি ক্যাসপার থেকে তোলা হয়, দেখা যাবে না, বলল পিট।

    চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল কর্নেল মরটন হোলিস। কী বলছেন আপনি, মি. পিট। এক লাখ কিলোমিটার দূর থেকে এসআর নাইনটি ত্রিমাত্রিক ইমেজ এত পরিষ্কার ধরতে পরে যে একটা ফুটবলের সেলাই পর্যন্ত আলাদাভাবে চিনতে পারবেন আপনি।

    কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু যদি বলটাকে পাথরের মতো দেখানোর ব্যবস্থা করা হয়?

    কী বলছেন বুঝতে পারছি না।

    দেখালে বুঝবেন, বলল পিট। আমার সাথে ডেকে চলুন, সব আয়োজন করে রেখেছে ক্রুরা।

    .

    জাহাজের পেছন দিকে খোলা ডেক বড় ও স্বচ্ছ একটা সাদা প্লাস্টিক দিয়ে ঢেকে রাখা হয়েছে, প্রতিটি প্রান্ত শক্তভাবে আটকানো, ফলে জোরাল বাতাসেও সেটা ফুলে উঠছে না। একটা ফায়ার হোস হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে দু’জন ক্রু, তাদের পাশে রয়েছ স্কিপার ফ্রাঙ্ক স্টুয়ার্ট।

    জেনারেল ব্রাভোর চারদিকে তল্লাশি চালাতে গিয়ে প্লাস্টিকের টুকরোটা পাওয়া গেছে, ব্যাখ্যা করল পিট। দুটো জাহাজ মিলিত হবার সময় সম্ভবত দুর্ঘটনাবশত টুকরোটা পানিতে পড়ে যায়। ওটার আশপাশে অনেকগুলো খালি ব্যারেল ছিল, ব্যারেলগুলোয় ছিল রং, প্রমোদতরী লেডি ফ্ল্যামবোরোকে জেনারেল ব্রাভোর চেহারা দেয়ার জন্য ওই রং ব্যবহার করে ক্রুরা। প্রমাণটাকে ধ্রুব সত্য বলে মেনে নেয়া যায় না। পিটের ধারণার ওপর বিশ্বাস রাখতে হবে। তবে এসব থেকে বেরিয়ে আসে রূপ বদলের আকেটা সম্ভাবনা। সর্বশেষ স্যাটেলাইট ফটোতে কিছু দেখা যায়নি, কারণ সংশ্লিষ্ট সবগুলো চোখ একটা জাহাজকে খুঁজছিল। অথচ লেডি ফ্ল্যামবোরোকে এখন আর কোনো জাহাজের মতো দেখাচ্ছে না। সন্ত্রাসবাদীদের নেতা নির্ঘাত একজন শিল্পরসিক ও সমঝদার আদমি। ভাস্কর ক্রিস্টোন শিল্পকর্ম অবশ্যই তাকে অনুপ্রাণিত করেছে। ক্রিস্টো, প্লাস্টিক দিয়ে ভাস্কর্য তৈরিতে যিনি সিদ্ধহস্ত, ঈর্ষণীয় খ্যাতিও অর্জন করেছেন। আউটডোর স্কাল্পচার-এর তিনি একজন বিশেষজ্ঞ। হাইজ্যাকাররা তাঁর পদ্ধতি অনুকরণ করে গোটা জাহাজটাকে প্লাস্টিক দিয়ে মুড়ে ফেলেছে।

    প্রমোদতরী বিশাল কোনো জাহাজ নয়। ওটার খোলের কাঠামো খুঁটি ও মাচার সাহায্যে প্রয়োজন মতো বদলে নেয়া সম্ভব। ওটার খোলের কাঠামো খুঁটি, প্রতিটিতে নম্বর দিয়ে নিলে, গোটা জাহাজ মুড়ে ফেলা তেমন কঠিন কোনো কাজ নয়, খুব বেশি হলে ঘণ্টা দশেক লাগবে। কাজটা তারা করছিল ল্যান্ডস্যাট যখন মাথার ওপর দিয়ে যাচ্ছে। ক্রুদের ব্যস্ত তৎপরতার বিস্তারিত বিবরণ ফটোতে ধরা পড়েনি, পড়ার কথাও নয়। বারো ঘণ্টা পর সিস্যাটের তোলা ফটোতে জাহাজটা সম্পূর্ণ গায়েব হয়ে যায়, জাহাজের কোনো আকৃতিই ধরা পড়েনি। ব্যাখ্যা শেষে জিজ্ঞেস করল পিট, আমি খুব তাড়াতাড়ি বলছি?

    না- ধীরে ধীরে বলল কর্নের মরটন হোলিস। তবে কিছুই তেমন বোধগম্য হচ্ছে না।

    ওনাকে তাহলে দেখাই? পিটের অনুমতি প্রার্থনা করল জিওর্দিনো।

    স্কিপার ফ্রাঙ্ক স্টুয়ার্টের উদ্দেশে ছোট্ট করে মাথা ঝাঁকাল পিট।

    ঠিক আছে, বয়েজ, ক্রুদের বলল স্কিপার। প্রথমে হালকাভাবে।

    ক্রুদের একজন ভালভ ঘোরাল, অপরজন তাক করল হোস পাইপে মুখ। প্লাস্টিকের ওপর ছড়িয়ে পড়ল পানির অনেকগুলো সরু ধারা। প্রথমদিকে বাতাসের ধাক্কায় উড়ে গেল ধারাগুলো। ক্রুরা হোসের মুখ ঘোরাল, এরপর প্লাস্টিকের গায়ে পানির একটা স্তর তৈরি হলো।

    এক মিনিটও পেরুল না, প্রচণ্ড ঠাণ্ডায় শক্ত বরফ হয়ে গেল পানির পাতলা স্তরটা।

    ধৈর্য ধরে রূপান্তরটা লক্ষ করল মরটন হলিস। হঠাৎ এগিয়ে এল সে, খপ করে পিটের একটা হাত ধরে হ্যান্ডশেক করল! মুগ্ধ হলাম, মি. পিট। আপনি আমাকে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন।

    বিস্ময়ে হাঁ হয়ে তাকিয়ে থাকল জন ডিলিঞ্জার। একটা আইসবার্গ, প্রচণ্ড রাগের সাথে, যদিও নিচু গলায়, বিড়বিড় করল সে, বেজন্মা রা লেডি ফ্ল্যামবোরোকে আইসবার্গ বানিয়ে ফেলেছে।

    .

    ৪৯.

    ঠাণ্ডায় হি হি করতে করতে ঘুম ভাঙল হে’লা কামিলের। অনেকক্ষণ আগে সকাল হয়েছে, তবু চারদিকে রয়ে গেছে আবছা অন্ধকার। ফাইবার বোর্ড আর প্লাস্টিক শিটের গায়ে বরফ জমায় লেডি ফ্ল্যামবোরোর দিনের আলো তেমন প্রবেশ করতে পারছে না। ঘাড় ফিরিয়ে তাকালেন। ভিআইপি স্যুইটে রয়েছেন তিনি, পাশের বিছানায় প্রেসিডেন্ট নাদাভ হাসান ও প্রেসিডেন্ট দো লরেঞ্জোকে অস্পষ্টভাবে দেখতে পেলেন, একটা চাদরের তলায় জড়াজড়ি করে শুয়ে আছেন তাঁরা। তাঁদের নিঃশ্বাস বাষ্পের মতো উঠে আসছে মাথার ওপর, তারপর দেয়ালে জমাট বাঁধছে।

    শুধু ঠাণ্ডা তবু সহ্য করা যায়, কিন্তু অতিরিক্ত আর্দ্রতার সাথে হিমাঙ্কের নিচের তাপমাত্রা অসহনীয় হয়ে উঠেছে। বেঁচে থাকা আরও দুষ্কর হয়ে উঠেছে পাল্টা ডেল এসটে ছাড়ার পর থেকে পেটে কিছু না পড়ায়। প্যাসেঞ্জার বা ক্রুদের কিছুই খেতে দেয়নি হাইজ্যাকাররা। আর সুলেমান আজিজের নিষ্ঠুরতা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে সবাই। শরীর ও মন প্রতি মুহূর্তে দুর্বল হয়ে পড়ছে, সময় কাটছে দুঃস্বপ্নের ভেতর, অজানা ভয়ে সবাই কাহিল।

    প্রথম দিকে বাথরুমে পানি ছিল, তা-ই খেয়েছে সবাই। তারপর পাইপের ভেতর পানি বরফ হয়ে গেছে। খিদের সাথে অসহ্য হয়ে উঠেছে পিপাসা।

    ঘুম সবারই ভেঙেছে, তবে নড়াচড়া করার বা কথা বলার শক্তি নেই কারও। দেন-দরবার করে কোনো লাভ হয়নি, অতিরিক্ত চাদর দিতে রাজি হয়নি সুলেমান আজিজ। কেবিন আর স্যুইটগুলো গরম রাখার জন্য হিটিং সিস্টেম চালু করার অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করেছে সে। বাধা দিয়ে বা জোর খাঁটিয়ে কোনো লাভ নেই জেনে, ক্যাপটেন কলিন্স বিনা প্রতিবাদে পরিস্থিতি মেনে নেয়ার নির্দেশ দিয়েছেন ক্রুদের। তার সিদ্ধান্তই ঠিক, এখনকার একমাত্র কর্তব্য হলো কোনো রকমে প্রাণে বেঁচে থাকা।

    সিনেটর পিটকে রুমে ঢুকতে দেখে একটা ভ্র সামান্য উঁচু করলেন হে’লা কামিল।

    নীল ডোরাকাটা শার্টের ওপর অ্যাশ কালারের বিজনেস স্যুট পরেছেন তিনি। হে’লা কামিলকে অভয় দিয়ে হাসলেন বটে, তবে হাসিটা প্রায় সাথে সাথে ম্লান হয়ে গেল! পাঁচ দিনের ধকলে তার ছিমছাম, চোখা চেহারা বিধ্বস্ত হয়ে গেছে। কেমন বুঝছেন, মিস কামিল?

    এক কাপ গরম চা পেলে ডান হাতটা খোয়াতে রাজি আছি, ক্লান্তি ঝেড়ে ফেলে উৎসাহ দেখানোর চেষ্টা করলেন হে’লা কামিল।

    কমপিটিশন হলে আমি জিতব, হাতের সাথে আমি একটা পা হারাতেও রাজি, কৌতুক করলেন সিনেটর পিট।

    বিছানায় উঠে বসলেন দো লরেঞ্জো, পা দুটো ডেকে নামালেন। আমি কখনও ভাবিনি।

    আমিও না, বললেন হে’লা কামিল।

    পাশ ফিরে শুলেন নাদাভ হাসান, মৃদু গোঙালেন, তারপর বালিশ থেকে মাথা তুলে তাকালেন ওদের দিকে।

    পিঠটা বুঝি আবার ভোগাচ্ছে আপনাকে? জিজ্ঞেস করলেন দো লরেঞ্জো, চেহারায় উদ্বেগ ফুটে উঠল।

    দেশে কী ঘটছে ভাবতে গেলে শুধু মাথা ঘোরে, ব্যথা টের পাই না, জবাব দিলেন মিসরীয় প্রেসিডেন্ট। দো লরেঞ্জোর দিকে তাকালেন তিনি, মৃদু হাসলেন। আপনার সাথে অন্য কোনো পরিস্থিতিতে পরিচয় হলে ভালো হতো।

    শুনেছি আমেরিকানরা বলে, পলিটিক্স মেকস স্ট্রেঞ্জ বেড়ফেলোজ। আমরা যেন আক্ষরিক দৃষ্টান্ত।

    এই বিপদ থেকে উদ্ধার পেলে অবশ্যই আপনি আমার অতিথি হবেন মিসরে।

    মাথা ঝাঁকালেন দো লরেঞ্জো! আমন্ত্রণ আমার তরফ থেকেও রইল।

    দুর্লভ সম্মান হিসেবে নিলাম আমন্ত্রণটা।

    তারপর হঠাৎ করে হে’লা কামিল জানালেন, ইঞ্জিন বন্ধ হয়ে গেছে।

    মাথা ঝাঁকিয়ে তাকে সমর্থন করলেন সিনেটর পিট। এইমাত্র নোঙর ফেলা হয়েছে। আমরা দাঁড়িয়ে পড়েছি।

    তার মানে মাটির কাছাকাছি কোথাও রয়েছি আমরা।

    পোর্ট উইন্ডো খোলা না থাকায় কী করে বলি।

    ওরা আমাদেরকে অন্ধ করে রেখেছে, নাদাভ হাসান ক্ষোভ প্রকাশ করলেন।

    আপনাদের একজন যদি দরজা পাহারা দেন, দো লরেঞ্জোকে বললেন সিনেটর পিট, জানালা ভাঙার একটা চেষ্টা করতে পারি আমি। গার্ডদের না জানিয়ে যদি কাঁচ ভাঙতে পারি, ফাইবার বোর্ডে একটা গর্ত করা সম্ভব। ভাগ্য ভালো হলে দেখতে পাব কোথায় আমরা রয়েছি।

    ঠিক আছে, বললেন হে’লা কামিল, আমি দরজায় কান পাতব।

    কিন্তু মেক্সিকান প্রেসিডেন্ট উৎসাহ দেখালেন না। এমনিতেই জমে যাচ্ছি, ফাইবার বোর্ড ফুটো করলে ঠাণ্ডা আরও বাড়বে।

    মাথা নেড়ে দ্বিমত পোষণ করলেন সিনেটর পিট। ভেতরে-বাইরে টেমপারেচার একই।

    তর্কে সময় নষ্ট করতে চান না, সিটিংরুমের জানালার সামনে চলে এলেন তিনি। কাঁচের গায়ে টোকা দিলেন। ভোতা আওয়াজ শুনে বুঝলেন, যথেষ্ট পুরু। কারও আঙুলে হীরের আংটি আছে? জিজ্ঞেস করলেন তিনি।

    রেইনকোটের পকেট থেকে হাত দুটো বের করে চোখের সমনে আঙুলগুলো তুললেন হে’লা কামিল। দুটো আংটি পরে আছেন তিনি, রিংয়ের সাথে পাথরও আছে, তবে সেগুলো দুধসাদা ওপাল আর নীলকান্তমণি। মুসলমান পাণিপ্রার্থীরা মূল্যবান উপহার দিয়ে মেয়েদের লোভী করে তুলতে রাজি নয়।

    লালচে আঙুল থেকে নিজের আংটি খুলে নাদাভ হাসান বললেন, এটা তিন ক্যারেট, সিনেটর।

    ম্লান আলোয় পাথরটা পরীক্ষা করলেন সিনেটর পিট। এতেই হবে। ধন্যবাদ, নাদাভ।

    সাবধানে, যতটা সম্ভব দ্রুত কাজ করে গেলেন তিনি। নিঃশব্দে ছোট্ট একা গর্ত তৈরি করছেন কাঁচের গায়ে, যাতে আঙুল ঢুকতে পারে। হাতে ফুঁ দেয়ার জন্য খানিক পরপর থামতে হলো তাকে। আঙুলগুলো অসাড় হয়ে এলে বগলের নিচে ঢুকিয়ে গরম করে নিলেন।

    ধরা পড়লে রা কি করবে তাঁকে নিয়ে? চিন্তাটা মাথায় বারকয়েক এল, ঝেড়ে ফেলে দিলেন সিনেটর পিট। তবু, অসতর্ক মুহূর্তে, নিজের লাশটা তিনি ভাসতে দেখলেন বরফ-জলে।

    মাঝখানের ফুটোটার চারধারে একটা বৃত্তাকার রেখা তৈরি করলেন তিনি। রেখাটাকে ধীরে দীরে গভীর করছেন। বিপজ্জনক কাজটা হলো, কাঁচের ভাঙা কোন টুকরোকে নিচে পড়তে না দেয়া। ইস্পাতের খোলে লেগে শব্দ করবে ওটা।

    ফুটোয় একটা আঙুল ঢুকিয়ে সেটা বাঁকা করলেন তিনি, ধীরে ধীরে নিজের ওপর নামিয়ে রাখলেন সেটা। ফাঁকটা যথেষ্ট বড় হয়েছে, অনায়াসে এবার মাথাটা বাইরে বের করতে পারবেন।

    জানালা থেকে আধ হাত দূরে ফাইবার বোর্ডের আবরণ, জাহাজের মাঝখানে সুপারস্ট্রাকচার পুরোটা ঢেকে রেখেছে। সদ্য তৈরি ফাঁকটা দিয়ে সাবধানে মাথা গলিয়ে দিলেন সিনেটর পিট, একটু অসতর্ক হলেই ধারালো কাঁচের কিনারায় লেগে কান কাটা পড়বে। এদিক-ওদিক তাকিয়ে ফাইবার বোর্ড আর ইস্পাতের খাড়া দেয়াল ছাড়া কিছুই দেখতে পেলেন না। মুখ তুললেন ওপর দিকে। আলো দেকে বোঝা গেল ওখানে আকাশ আছে; কিন্তু এত স্নান, যেন কুয়াশা সব শুষে নিয়েছে। নিচে তাকিয়ে সচল পানি দেখতে পাবার কথা, কিন্তু পানির বদলে বিশাল একটা প্লাস্টিকের আবরণ দেখতে পেলেন। জিনিসটার দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে থাকলেন তিনি, ওখানে ওটা কী কাজে লাগছে বুঝতে পারলেন না।

    তবে নিজেকে নিরাপদ মনে হলো তাঁর। ডেকে যারা পাহারা দিচ্ছে তাদেরকে যদি তিনি দেখতে না পান, তারাও তাঁকে দেখতে পাচ্ছে না।

    সিটিংরুম থেকে বেডরুমে ফিরে গেলেন সিনেটর পিট, স্যুটকেস খুলে ব্যস্তভাবে হাতড়াতে শুরু করলেন।

    কাজে ফিরে যাবার আগে হাত দুটো গরম করে নিলেন। ছুরির লাল হাতলটা শক্ত করে ধরলেন, কাঁচের ফাঁক দিয়ে বের করে দিলেন হাতটা, ফাইবারবোর্ডের গায়ে ছোট ফলাটাকে ড্রিল হিসেবে ব্যবহার করলেন, বড় ফলাটা দিয়ে কাটলেন।

    ধৈর্য আর নৈপুণ্যের পরীক্ষা দিচ্ছেন সিনেটর পিট। খুব সাবধানে ছুরির ছোটো ফলাটা ঘোরাতে হচ্ছে, যাতে ফাইবারবোর্ডের ওদিকে ফলাটার ডগা বেরিয়ে না পড়ে। নিচের গার্ডরা ছুরির ডগা দেখে ফেলতে পারে। ফাইবারবোর্ডের একটা করে স্তর চেঁছে তুলতে হচ্ছে।

    আঙুলগুলো অসাড় হয়ে গেল, তবু ওগুলো গরম করলেন না। ছোট ছুরিটা তার হাতেরই একটা অংশ হয়ে উঠেছে যেন। অবশেষে খুদে একটা ফুটো তৈরি হলো। জানালার বাইরে মাথা বের করে দিয়ে ফাইবারবোর্ডের গায়ে মুখ ঠেকালেন তিনি, ফুটোয় চোখ রেখে ভালো করে দেখলেন বাইরেটা।

    দৃষ্টিপথে কী যেন একটা বাধা হয়ে রয়েছে। ফুটোয় একটা আঙুল ঢুকিয়ে ঘোরালেন, অনুভব করলেন জিনিসটা-স্বচ্ছ প্লাস্টিকের আবরণ। এতক্ষণে তিনি উপলব্ধি করলেন, আক্ষরিত অর্থেই গোটা জাহাজ প্লাস্টিক দিয়ে মুড়ে রাখা হয়েছে।

    দুঃখের মধ্যেও হাসি পেল তাঁর। ফাইবারবোর্ড কাটার সময় অতটা সতর্ক না হলেও চলত। প্লাস্টিকের পর্দা থাকায় নিচ থেকে ছুরির ফলা কেউ দেখতে পেত না। সুবিধাটা সাথে সাথে গ্রহণ করলেন তিনি, ফাইবারবোর্ডের গায়ে বড় একটা গর্ত বানালেন। কেটে ফেললেন খানিকটা প্লাস্টিক। তারপর তাকালেন। না সাগর, না তীরচিহ্ন, কিছুই তিনি দেখতে পেলেন না। দেখতে পেলেন বরফের পাঁচিল, এত উঁচু যে শেষ সীমা পর্যন্ত দৃষ্টি পৌঁছাল না। চকচকে পাঁচিলটা এত কাছে, যেন লম্বা করা একটা ছাতা দিয়ে নাগাল পাওয়া যাবে।

    তাকিয়ে আছেন, ড্রাম পেটানোর মতো গুরুগম্ভীর ভোঁতা আওয়াজ ঢুকল কানে। সাধারণত ভূমিকম্প হলে এ ধরনের আওয়াজ শোনা যায়।

    দ্রুত পিছিয়ে এলেন সিনেটর, চেহারায় হতচকিত ভাব।

    তাঁকে আড়ষ্ট হয়ে উঠতে দেখলেন হে’লা কামিল। কী? ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করলেন তিনি। কি দেখেছেন আপনি?

    হে’লা কামিলের দিকে ফিরলেন সিনেটর পিট, কিছু বলতে গিয়েও পারলেন না, গলা দিয়ে আওয়াজ বেরোল না। ছুটে এসে তার হাত আঁকড়ে ধরলেন হে’লা কামিল। নাদাভ হাসানও বিছানা থেকে নেমে এলেন। প্রেসিডেন্ট দো লরেঞ্জো দাঁড়িয়ে পড়েছেন ডেকে।

    প্রকাণ্ড একটা গ্লেসিয়ারের গায়ে নোঙর ফেলেছে ওরা, বিড়বিড় করে বললেন সিনেটর পিট। যেকোনো মুহূর্তে ভেঙে পড়তে পারে বরফের পাঁচিল। যদি পড়ে, চিড়ের মতো চ্যাপ্টা হয়ে যাবে জাহাজ।

    ⤶ ⤷
    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleদ্য মহাভারত কোয়েস্ট : দ্য আলেকজান্ডার সিক্রেট – ক্রিস্টোফার সি ডয়েল
    Next Article ড্রাগন – ক্লাইভ কাসলার

    Related Articles

    ক্লাইভ কাসলার

    দ্য ফারাও’স সিক্রেট – ক্লাইভ কাসলার ও গ্রাহাম ব্রাউন

    August 5, 2025
    ক্লাইভ কাসলার

    পাইরেট – ক্লাইভ কাসলার / রবিন বারসেল

    August 5, 2025
    ক্লাইভ কাসলার

    দ্য সলোমন কার্স – ক্লাইভ কাসলার ও রাসেল ব্লেক

    August 5, 2025
    ক্লাইভ কাসলার

    ড্রাগন – ক্লাইভ কাসলার

    August 5, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Generic selectors
    Exact matches only
    Search in title
    Search in content
    Post Type Selectors
    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে বাঙলাদেশের কৃষক – বদরুদ্দীন উমর

    October 29, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে বাঙলাদেশের কৃষক – বদরুদ্দীন উমর

    October 29, 2025
    Our Picks

    চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে বাঙলাদেশের কৃষক – বদরুদ্দীন উমর

    October 29, 2025

    পূর্ব বাঙলার ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি ২ – বদরুদ্দীন উমর

    October 29, 2025

    বাঙলাদেশে কমিউনিস্ট আন্দোলনের সমস্যা – বদরুদ্দীন উমর

    October 29, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    • Sign Up
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }