Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে বাঙলাদেশের কৃষক – বদরুদ্দীন উমর

    October 29, 2025

    পূর্ব বাঙলার ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি ২ – বদরুদ্দীন উমর

    October 29, 2025

    বাঙলাদেশে কমিউনিস্ট আন্দোলনের সমস্যা – বদরুদ্দীন উমর

    October 29, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    ট্রেজার – ক্লাইভ কাসলার

    ক্লাইভ কাসলার এক পাতা গল্প596 Mins Read0
    ⤶ ⤷

    ১০. হিমেল বাতাস

    ১০.

    হিমেল বাতাসের চেয়ে ঠাণ্ডা একটা শিরশিরে অনুভূতি হলো পিটের ঘাড়ের পেছনে। বাইরের আলো জানলো দিয়ে ভেতরে ঢুকেছে, দেয়ালগুলোয় কিম্ভুতকিমাকার ছায়া নড়াচড়া করছে। এক এক করে সিটগুলো দিকে তাকাল ও, যেন আশা করছে চোখচোখি হলে হঠাৎ কেউ হাত বাড়াবে বা কথা বলে উঠবে। কিন্তু না, পাতাল সমাধিতে রাখা মমির চুপচাপ বসে থাকল সবাই।

    আরোহীদের একজনের ওপর ঝুঁকে পড়ল পিট। তার লালচে সোনালি চুল মাথায় ঠিক মাঝখানে দুভাগ করা। আলোর কিনারায় একটা সিটে বসে আছে সে। তার চেহারায় ব্যথা, ভয় বা বিস্ময়ের কোনো চিহ্ন নেই। চোখ দুটো আধখোলা, যেন ধুমে ঢলে পড়ার আগের মুহূর্তে রয়েছে। ঠোঁট জোড়া স্বাভাবিকভাবে জোড়া লাগানো। চেয়াল সামান্য একটু ঝুলে পড়া।

    তার অসাড় একটা হাত ধরল পিট। পালস্ পেল না। হার্ট বন্ধ হয়ে গেছে। কিছু বুঝছ? জিজ্ঞেস করলেন ডাক্তার গেইল, পিটকে পাশ কাটিয়ে আরেক আরোহীকে পরীক্ষা করছের তিনি।

    মারা গেছেন ভদ্রলোক, জবাব দিল পিট।

    ইনিও।

    মৃত্যুর কারণ?

    এক্ষুনি বলতে পারছি না। আঘাতের কোনো চিহ্ন দেখছি না। মারা গেছে খুব বেশিক্ষণ হয়নি। প্রচণ্ড ব্যথা বা হাত-পা ছোঁড়ার কোনো লক্ষণ নেই। চামড়ার রং দেখে রক্তে কার্বন ডাই-অক্সাইড জমে মারা গেছেন বলেও তো মনে হচ্ছে না।

    সেটারই সম্ভাবনা বেশি, বলল পিট। অক্সিজেন মাস্কগুলো এখনও ওভারহেড প্যানেলে রয়েছে।

    একের পর এক আরোহীদের পরীক্ষা করে চলেছেন ডাক্তার গেইল। আরও ভালোভাবে পরীক্ষা করে বলতে পারব।

    দোরগোড়ার মাথায় একটা আলো জ্বালার ব্যবস্থা সেরে ফেলল লে, সিমোন। বাইরের দিকে ফিরিয়ে একটা হাত আঁকাল সে। প্লেনের ভেতরটা দিনের মতো আলোকিত হয়ে উঠল।

    কেবিনের চারদিকে তাকাল পিট। চোখে পড়ার মতো ক্ষতি শুধু সিলিংয়ের হয়েছে, কয়েক জায়গায় তুবড়ে গেছে সেটা। প্রতিটি সিট খাড়া অবস্থা রয়েছে, প্রত্যেক আরোহীর সিট বেল্ট বাঁধা। বরফজলে অর্ধেক ডুবে বসে ছিল, নড়াচড়া না করে হাইপোথারমিয়ায় মারা গেছে, এ অবিশ্বাস্য। এক স্বর্ণকেশী বৃদ্ধাকে তার খোলা হাতের তালুতে লাল একটা গোলাপ।

    বোঝাই যাচ্ছে প্লেন বরফ স্পর্শ করার আগেই মারা গেছে সবাই, বললেন ডাক্তার গেইল।

    সার সার সিটের ওপর আবার চোখ বুলালো পিট। কিন্তু কেন?

    বিষাক্ত গ্যাস মৃত্যুর কারণ হতে পারে।

    কোনো গন্ধ পাচ্ছেন?

    না।

    আমিও না।

    আর কী হতে পারে?

    খাদ্যে বিষ?

    ঝাড়া তিন সেকেন্ড পিটের দিকে তাকিয়ে থাকলেন ডাক্তার গেইল। নিঃশ্বাস ফেলছে এমন কাউকে দেখতে পেয়েছ তুমি? কোথায়?

    দরজা ভেঙে ভেতরে ঢোকার আগে, বলল পিট, জানালা দিয়ে এক ভদ্রমহিলা আমার দিকে তাকিয়েছিয়েন। কোনো সন্দেহ নেই তাকে আমি জীবিত দেখছি। কিন্তু এখন কেন যে দেখছি না…।

    ডাক্তার গেইল কিছু বলার আগে পানি ঠেলে এগিয়ে এল লে, সিমোন। ভয়ে আর বিস্ময়ে বিস্ফারিত হয়ে আছে তার চোখ। ওহ্ গড! সিটে বসা আরোহীদের দিকে পেছন ফেরার জন্য ঘন ঘন একদিক থেকে আরেক দিকে ঘুরে দাঁড়াল সে। মানুষ এভাবে মারা যায়! সত্যিই কি লাশ ওগুলো, নাকি মমি?

    লাশ, মৃদুকণ্ঠে বলল পিট। তবে একজন অন্তত বেঁচে আছে। হয় ককপিটে, নয়তো লুকিয়ে আছে পেছনের কোনো বাথরুমে।

    তাহলে আমার চিকিৎসা দরকার তার, ব্যস্ত হয়ে উঠলেন ডাক্তার গেইল।

    আপনি বরং এখানেই আরোহীদের পরীক্ষা করুন, প্রস্তাব দিল পিট। দেখুন সবাই মারা গেছে কিনা। সিমোন ককপিটে চলে যান, আমি বাথরুমগুলো দেখি।

    এত লাশ, বলল লে, সিমোন, কী করে সরানো হবে? কমান্ডার নাইটকে জানানো দরকার না?

    যেখানে আছে সেখানেই থাকুক, দৃঢ়কণ্ঠে, নির্দেশের সুরে বলল পিট।

    রেডিওর ধারেকাছে যাবেন না। ক্যাপটেনকে আমার নিজেরা গিয়ে রিপোর্ট করব। আপনার লোকজনদের সবাইকে বাইরে রাখুন, কেউ যেন প্লেনের ভেতর না ঢোকে। ভালো হয় দরজাটা সিল করে দিলে। আপনার মেডিকেল দল সম্পর্কেও একই কথা, ডাক্তার গেইল। জরুরি প্রয়োজন ছাড়া কেউ কিছু স্পর্শও করবে না।

    কিন্তু…., প্রতিবাদের সুরে শুরু করল লে. সিমোন।

    আমাদের বোধবুদ্ধির বাইরে একটা কিছু ঘটেছে এখানে, তাকে থামিয়ে দিয়ে বলল পিট, দুর্ঘটনার খবর এরই মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে। কয়েক ঘণ্টার মধ্যে এয়ার ক্র্যাশ ইনভেস্টিগেটর আর রিপোর্টাররা ভিড় জমাবে। উপযুক্ত কর্তৃপক্ষ যোগাযোগ না করা পর্যন্ত কেউ আমরা কারও কাছে মুখ খুলব না।

    আবার কিছু বলতে গেল লে, সিমোন, কিন্তু শেষ মুহূর্তে নিজেকে সামলে নিল সে। ঠিক আছে, মি. পিট।

    তাহলে চলুন দেখা যাক কেউ বেঁচে আছে কি না।

    বিশ সেকেন্ডের পথ বাথরুমগুলো, পানি ঠেলে পৌঁছতে দুমিনিট লাগল পিটের। এরই মধ্যে ওর পা অসাড় হয়ে গেছে। আধাঘণ্টার মধ্যে গরম করে না নিলে ওগুলো যে ফ্রস্টবাইটের শিকার হবে তা জানার জন্য ডাক্তার গেইলের উপদেশ দরকার নেই ওর।

    প্লেনের ধারণক্ষমতা পুরোপুরি ব্যবহার করা হলে আরও বহু লোক মারা যেত। অনেক সিট খালি থাকা সত্ত্বেও তিপ্পান্নটি লাশ গুনল পিট। পেছনের বাল্কহেড ঘেঁষে সিটে বসা একজন মহিলা ফ্লাইট অ্যাটেনড্যান্টকে পরীক্ষা করল ও। তার মাথা সামনের দিকে ঝুঁকে আছে, পানিতে ঝুলে পড়েছে সোনালি চুল। পালস নেই।

    একটা কম্পার্টমেন্টের ভেতর ঢুকল পিট, এটার ভেতরই বাথরুমগুলো। তিনটে দরজার মাথায় খালি চিহ্ন দেখে ভেতরে উঁকি দিল ও। কেউ নেই ভেতরে। চার নম্বরটা রয়েছে খালি নয় চিহ্ন, ভেতর থেকে বন্ধ। তার মানে ভেতরে কেউ আছে। সজোরে কয়েকবার নক করল ও, তারপর ডাকাল, আমার কথা শুনতে পাচ্ছেন? ইংরেজিতে করল প্রশ্নটা। ভাষা ঠিক আছে? আমরা আপনাদেরকে সাহায্য করার জন্য এসেছি। প্লিজ, দরজা খোলার চেষ্টা করুন।

    কবাটে কান ঠেকালো পিট। মনে হলো কেউ যেন ফুঁপিয়ে উঠল নিচু গলায়। তার পরই শোনা গেল ফিসফিসে আওয়াজ, যেন নিজেদের মধ্যে আলোচনা করছে দু’জন মানুষ।

    গলা চড়াল পিট, পিছিয়ে যান। দরজা ভাঙছি।

    ভেজা পা তুলে দরজার গায়ে লাথি মারল পিট। খুব জোরে নয়, শুধু হুড়কো বা ছিটকিনি ভাঙতে চায়। কবাট ভেঙে পড়লে ভেতরে যারা আছে তারা আহত হতে পার। দ্বিতীয় লাথিতে কাজ হলো।

    বাথরুমের পেছনের একটা কোণে, টয়লেট প্ল্যাটফর্মের ওপর, দু’জন ভদ্রমহিলা দাঁড়িয়ে। একজন থরথর করে কাঁপছে, পরনে ফ্লাইট অ্যাটেনড্যান্টের ইউনিফর্ম, দ্বিতীয় ভদ্রমহিলাকে আঁকড়ে ধরে আছে সে। এক ভেঙে গেছে ইউনিফর্ম পরিহিতার, বুঝল পিট।

    অপরজনের চেহারায় সন্দেহ আর কাঠিন্য ফুটে থাকতে দেখল পিট। চিনতে পারল ও, এঁকেই জানালায় দেখেছিল। তখন অবশ্য মাত্র একটা চোখ খোলা ছিল, এখন দুটোই খোলা। ঘৃণা আর সাহস নিয়ে পিটের দিকে তাকিয়ে আছেন তিনি। মুখের একপাশ শুকনো রক্তের চাদরে ঢাকা। তার গলার সুরে মারমুখো ভাব লক্ষ করে অবাক না হয়ে পারল না ও। কে আপনি? কী চান? বিশুদ্ধ ইংরেজি, উচ্চারণ ভঙ্গি খানিকটা আঞ্চলিক।

    আমার নাম ডার্ক পিট, বলল পিট, আমেরিকার জাহাজ পোলার এক্সপ্লোরার থেকে এসেছি। যা বললেন প্রমাণ করতে পারবেন?

    দুঃখিত, ড্রাইভিং লাইসেন্সটা ফেলে এসেছি বাড়িতে। দরজার গায়ে হেলান দিল পিট। প্লিজ, ভয় পাবেন না, সম্মানের সুরে নরম গলায় বলল আবার। আমরা সাহায্য করতে এসেছি করতে এসেছি, ক্ষতি করতে নয়।

    ভদ্রমহিলার কাঁধ থেকে মাথা তুলে হিস্টিরিয়াগ্রস্থের হাসি হাসল ফ্লাইট অ্যাটেনড্যান্ট, তার পরই আবার কী মনে করে ফুঁপিয়ে উঠল।

    ওরা সবাই মারা গেছে, খুন!

    হ্যাঁ, জানি, শান্ত সুরে বলল পিট, একটা হাত বাড়িয়ে দিল। ধরুন। আপনাদের চিকিৎসা দরকার। আমাদের সাথে ডাক্তার আছেন। এই ঠাণ্ডায় দাঁড়িয়ে থাকলে….

    বুঝব কীভাবে আপনি টেরোরিস্টদের একজন নন? আগের মতোই কঠিন সুরে জিজ্ঞাসা করলেন ভদ্রমহিলা।

    শব্দখেলায় বিরক্ত হয়ে পড়েছে পিট। সামনে এগিয়ে গিয়ে এক কাঁধে তুলে নিল ফ্লাইট অ্যাটেনপেন্টকে।

    পেশি ঢিল দিন, মনে করুন, আপনি নায়িকা আর আমি নায়ক- উদ্ধার পেতে যাচ্ছেন এ যাত্রা। পিট বলে।

    নিজেকে নায়িকা ভাবতে পারছি না, চেহারা-পোশাকের যা অবস্থা।

    আমার কাছে তো ভালোই লাগছে, সহাস্যে পিট বলে। চলুন না হয়, ডিনারে যাই একদিন?

    আমার স্বামী আসতে পারবে তো?

    যদি উনি বিল দেন, তবে।

    আমি হাঁটতে পারব বলে মনে হয় না, বলে পিটের ঘাড় জড়িয়ে ধরল মেয়েটা। হাসি গোপন করে তাকে দুহাতের ওপর তুলে নিল উদ্ধার কর্তা। ঘাড় ফিরিয়ে ভদ্রমহিলার দিকে তাকাল ও। দয়া করে ভুলেও পানিতে নামতে যাবেন না। এক্ষুনি আপনার জন্য ফিরে আসছি আমি।

    এই প্রথম হে’লা কামিল উপলব্ধি করলেন, তিনি নিরাপদ। ভয়ংকর সময়টাতে স্থির থাকলেও এখন, এই মুহূর্তে কান্না পেল তার।

    .

    রুবিন জানে, সে মারা যাচ্ছে। ঠাণ্ডা বা ব্যথা, কিছুই অনুভব করছে না। অচেনা কণ্ঠস্বর, আকস্মিক আলো, এসবের কোনো অর্থ খুঁজে পেল না সে। নিজেকে তার বিচ্ছিন্ন, বিচ্যুত বলে মনে হলো। অলস মস্তিষ্কে চিন্তাশক্তি লোপ পেতে যাচ্ছে। যা কিছু ঘটছে সব যেন অতীত থেকে উঠে আসা অস্পষ্ট স্মৃতি, কবে যেন ঘটেছিল।

    বিধ্বস্ত ককপিট হঠাৎ সাদা উজ্জ্বলতায় ভরে উঠল। কোনো কোনো মানুষ দাবি করে মৃত্যুর পর পৃথিবীতে আবার ফিরে এসেছে তারা, তাহলে সেও কি তাই আসছে? শরীরবিহীন একটা কণ্ঠস্বর কাছ থেকে কথা বলে উঠল, শক্ত হোন, সাহস করুন, সাহায্য এসে গেছে।

    চোখ মেলে অস্পষ্ট মূর্তিটাকে চেনার চেষ্টা করল।

    আপনি কি ঈশ্বর?

    মুহূর্তের জন্য ভাবলেশহীন হয়ে গেল লে, সিমোন্সের চেহারা। তারপর সকেতুকে হাসল সে। না। স্রেফ মরণশীল একজন মানুষ, ঘটনাচক্রে আপনাদের প্রতিবেশী।

    আমি মারা যাইনি?

    দুঃখিত, বয়স আন্দাজ করতে যদি ভুল না করে থাকি, আপনাকে আরও পঞ্চাশ বছর অপেক্ষা করতে হবে।

    আমি নড়তে পারছি না। পা দুটো যেন পেরেকের সাথে আটকে আছে। বোধ হয় ভেঙে গেছে…প্লিজ, বের করুন আমাকে।

    ধৈর্য ধরুন, আপনাকে উদ্ধার করতেই এসেছি আমি, চামড়ার দস্তানা পরা হাত দিয়ে ব্যস্ততার সাথে প্রায় এক ফুট তুষার আর বরফ সরিয়ে ফেলল লে, সিমোন, রুবিনেরর বুক আর পেট মুক্ত হলো, ছাড়া পেল হাত দুটো। এবার আপনি নাক চুলকাতে পারবেন। শাবল আর যন্ত্রপাতি নিয়ে এক্ষুনি ফিরব আমি।

    মেইন কেবিনে ফিরে এসে সিমোন দেখল, ফ্লাই অ্যাটেনড্যান্টকে বুকে নিয়ে ভেতরে ঢুকছে পিটও। গেইলের হাতে মেয়েটাকে তুলে দিল ও।

    ডাক্তার গেইল, বলল সিমোন। ককপিটে একজন বেঁচে আছে।

    এই এলাম বলে।

    পিটের দিকে তাকাল সিমোন, আপনার সাহায্য পেলে ভালো হয়…

    মাথা ঝাঁকাল পিট। দুমিনিট সময় দিন। বাথরুম থেকে আরো একজন কে নিয়ে আসে আগে।

    .

    হাঁটু ভাঁজ করে নিচু হলেন হে’লা কামিল, ঝুঁকে আয়নার দিকে তাকালেন। নিজের প্রতিবিম্ব দেখার জন্য আলোর আভা যথেষ্টই রয়েছে বাথরুমে। যে মুখটা তার দিকে পাল্টা দৃষ্টি ফেলল, হঠাৎ দেখে তিনি চিনতে পারলেন না শুকনো, নির্লিপ্ত চেহারা, চোখে কোনো ভাষা নেই। ভাগ্যহত রাস্তার মেয়েদের একজন বলে মনে হলো, পুরুষের হাতে বেদম মারধর খেয়ে ক্ষতবিক্ষত হয়ে আছে।

    র‍্যাক থেকে টেনে কয়েকটা পেপার টাওয়েল নামালেন তিনি, ঠাণ্ডা পানিতে ভিজিয়ে মুখ থেকে রক্ত আর লিপস্টিক মুছলেন। মাসকারা আর আইশ্যাডো ও চোখের চারপাশে লেপে মুছে একাকার হয়ে গেছে, তাও পরিষ্কার করলেন। চুল মোটামুটি ঠিকঠাকই আছে, শুধু আলগা প্রান্তগুলো হাত দিয়ে নির্দিষ্ট জায়গায় সরিয়ে দিলেন।

    আয়নায় চোখ রেখে ভাবলেন, এখনও বিধ্বস্ত দেখাচ্ছে চেহারা। পিটকে ফিরে আসতে দেখে জোর করে একটু হাসলেন তিনি, আশা করলেন নিজেকে অন্তত পরিবেশনযোগ্য করে তুলতে পেরেছেন।

    দীর্ঘ এক সেকেন্ড তার দিকে তাকিয়ে থাকল পিট, তারপর কৌতুক করার লোভ সামলাতে না পেরে সবিনয় কোমল সুরে জিজ্ঞেস করল, মাফ করবেন, গর্জিয়াস ইয়াং লেডি, এদিকে কোনো বুড়ি ডাইনিকে দেখেছেন নাকি?

    চোখে পানি বেরিয়ে এলেও হে’লা কামিল স্বতঃস্ফূর্তভাবে হাসলেন। আপনি চমৎকার মানুষ, মি. পিট। থ্যাঙ্ক ইউ।

    আই ট্রাই, গড নোজ, আই ট্রাই।

    কয়েকটা কম্বল এনেছে পিট, সেগুলো মহাসচিবের গায়ে জড়িয়ে দিল। তারপর একটা হাত রাখল তার হাঁটুর নিচে, আরেকটা তার কোমরের চারদিকে, অনায়াস ভঙ্গিতে তুলে নিল শরীরটা বাথরুম প্ল্যাটফর্ম থেকে। বাথরুম থেকে বেরিয়ে আইল ধরে এগোল ও, অত্যন্ত সতর্কতার সাথে।

    পিট একবার হোঁচট খেতেই হে’লা কামিল উদ্বেগের সাথে জানতে চাইলেন, আপনি ঠিক আছেন?

    শুধু জ্যাক ডেনিয়েলসের গরম হুইস্কি পেটে পড়লে সব ঠিক, সহাস্যে জানাল পিট।

    পুরো এক বাক্স উপহার দেব, প্রতিশ্রুতি দিলেন হে’লা কামিল।

    বাড়ি কোথায়?

    আপাতত নিউ ইয়র্কে।

    পরের বার আমি যখন নিউ ইয়র্কে যাব, আপনি আমার সাথে ডিনার খাবেন?

    দুর্লভ একটা সম্মান বলে মনে করব, মি. পিট।

    উল্টোটাও সত্যি, মিস কামিল।

    ভ্রু জোড়া একটু ওপরে তুললেন মহাসচিব। এই বিধ্বস্ত চেহারায় আপনি আমাকে চিনতে পেরেছেন?

    মানে, একটু যখন পরিবেশনের যোগ্য করেছেন চেহারাটা, তখন আর কি চিনতে পেরেছি।

    আপনাকে কষ্ট দেয়ার জন্য সত্যি আমি দুঃখিত। আপনার পা নিশ্চয়ই অবশ হয়ে গেছ?

    লোককে বলতে পারব ইউ,এন, সেক্রেটারি জেনারেলকে দুহাতে বয়ে এনেছি, তার তুলনায় কষ্টটুকু কিছুই নয়।

    অদ্ভুত, সত্যি অদ্ভুত, ভাবল পিট। আজ কার মুখ দেখে ঘুম ভেঙেছিল ওর? এমন সাফল্য রোজ জোটে না ভাগ্যে। একই দিনে তিন তিনটে সুন্দরী মেয়েকে ডিনার খাবার প্রস্তাব দেয়ার সুযোগ কয়জন পায়। কোনো সন্দেহ নেই, এটা একটা রেকর্ড। সভ্যতা থেকে দুহাজার মাইল দূরে, জনমানবহীন বরফের রাজ্যে, মাত্র ত্রিশ মিনিট সময়সীমার ভেতর এই সাফল্য-ভাবা যায় না। রাশিয়ান সাবমেরিন খুঁজে পাবার চেয়ে ঢের বড়ো সাফল্য এটা।

    পনেরো মিনিট পর। আর ফ্লাইট অ্যাটেনড্যান্টের সাথে হেলিকপ্টারে আরাম করে বসে আছেন হে’লা কামিল { ককপিটের সামনে দাঁড়িয়ে আল উদ্দেশে হাত নাড়ল পিট, অ্যাল জিওর্দিনো পাল্টা সঙ্কেত দিল। ঘুরতে শুরু করল রোটর, তারপর তুষারের ঝড় তুলে আকাশে উঠে পড়ল কপ্টার। একশো আশি ডিগ্রী বাক নিয়ে ছুটে চলল আইসব্রেকার পোশর এক্সপ্লোরার অভিমুখে। এতক্ষণে খোঁড়াতে খোঁড়াতে হিটিং ইউনিটের দিকে এগোল পিট।

    পানি ভরা বুট আর ভিজে ভারী ওঠা মোজা খুলে ফেলল ও, পা দুটো ঝুলিয়ে রাখল এগজস্টের ওপর। রক্ত চলাচল নতুন করে শুরু হতে ব্যথা অনুভব করল, সহ্য করল মুখ বুঝে। খেয়াল করল, পাশে এসে দাঁড়াল লে, সিমোন।

    বিধ্বস্ত প্লেনটাকে দেখছে সিমোন। জাতিসংঘের প্রতিনিধিদল? অস্ফুটস্বরে জিজ্ঞেস করল সে। আসলেও কি তাই?

    কয়েকজন ছিলেন সাধারণ পরিষদের সদস্য, বলল পিট। বাকি সবাই জাতিসংঘের বিভিন্ন এজেন্সির ডিরেক্টর বা এইড। হে’লা কামিল জানালেন, ফিল্ড সার্ভিস অর্গানাইজেশনের একটা টুর থেকে ফিরছিলেন ওঁরা।

    ওঁদের মেরে কার কী লাভ?

    মোজা জোড়া হিটার টিউবের ওপর শুকাতে দিল পিট। কী করে বলব?

    মধ্যপ্রাচ্যের সন্ত্রাসবাদীরা দায়ী? সিমোন নাছোড়বান্দা।

    তারা বিষ খাইয়ে মানুষ মারতে শুরু করেছে, এটা আমার কাছে নতুন খবর।

    আপনার পা কেমন?

    ঠিকই আছে। আপনার?

    নেভি ইস্যু ফাউল-ওয়েদার বুট জোড়াকে ধন্যবাদ। পা দুটো গরম টোস্টের মতো শুকনো। আমার ধারণা, আবার প্রসঙ্গে ফিরে এল সিমোন, জীবিত তিনজনের একজন দায়ী।

    মাথা নাড়ল পিট। সত্যি যদি প্রমাণ হয় যে বিষক্রিয়াতেই মারা গেছেন ওঁরা, তাহলে ধরে নিতে হবে প্লেনে তোলার আগে ফুড সার্ভিস কিচেন থেকে বিষ মেশানো হয়েছে খাবারে।

    কেন, চিফ স্টুয়ার্ড বা ফ্লাইট অ্যাটেনড্যান্ট গ্যালিতে বসে কাজটা করতে পারে না?

    কারও চোখে ধরা না পড়ে পঞ্চাশ-ষাটজন লোকের খাবারে বিষ মেশানো অত্যন্ত কঠিন।

    খাবার না হয়ে, ড্রিংকেও তো হতে পারে।

    আপনি দেখছি দারুণ গোঁয়ার-গবিন্দ মানুষ- তর্ক করেই যাচ্ছেন।

    মনে মনে ভারি খুশি হলো সিমোন, তার একটা ধারণা গ্রহণযোগ্য বলে বিবেচনা করা হয়েছে বলে। তাহলে বলুন তো দেখি, মি. পিট, তিনজনের মধ্যে কাকে আপনার সবচেয়ে বেশি সন্দেহ হয়?

    তিনজনের একজনকেও নয়।

    তার মানে কি আপনি বলতে চাইছেন জেনেশুনে বিষ খেয়ে আত্মহত্যা করেছে কালপ্রিট? তাজ্জব হয়ে জানতে চাইল সিমোন।

    না, আমি চার নম্বর লোকটার কথা বলছি, যে এখন বেঁচে আছে।

    চার নম্বর! হাঁ হয়ে গেল সিমোন। কিন্তু আমরা তো মাত্র তিনজনকে জীবিত উদ্ধার করেছি!

    প্লেন ক্র্যাশ করার পর। তার আগে চারজন ছিল ওরা।

    আপনি নিশ্চয়ই ছোট্ট মেক্সিকান লোকটার কথা বলছেন না, ককপিটের সিটে যাকে দেখলাম?

    হ্যাঁ, আমি তার কথাই বলছি।

    হতভম্ব হয়ে পিটের দিকে তাকিয়ে থাকল লে, সিমোন। এই উপসংহারে পৌঁছনোর পক্ষে অকাট্য কোনো যুক্তি দেখাতে পারবেন আপনি, মি, পিট?

    উঁচুদরের রহস্য কাহিনী পড়া নেই আপনার? মুচকি হাসল পিট। জানেন না, রহস্য বা হত্যাকাণ্ডের ঐতিহ্য হলো সবচেয়ে যাকে কম সন্দেহ করা যায়, সেই শেষ পর্যন্ত খুনি প্রমাণিত হয়?

    .

    ১১.

    এমন জঘন্য তাস কে বাটল?

    চেহারায় অসন্তোষ নিয়ে প্রশ্ন করলেন রাজনৈতিক সচিব জুলিয়াস শিলার। কার্ডের ওপর চোখ বুলাচ্ছেন তিনি, কার্ডের কিনারা দিয়ে চুরি করে তাকাচ্ছেন অন্যান্য খেলোয়াড় সঙ্গীদের দিকে, চোখে চিকচিক করছে কৌতুক।

    পোকার টেবিলে বসে পাঁচজন খেলছেন ওঁরা। কেউ ধূমপান করছেন না, তবে শিলারের হাতে একটা চুরুট রয়েছে, এখনও ধরাননি। ইয়টটা শিলারের, পঁয়ত্রিশ মিটার দীর্ঘ, নোঙর ফেলেছে পটোম্যাক নদীতে, সাউথ আইল্যান্ডের কাছাকাছি আলেকজান্দ্রিয়া, ভার্জিনিয়ার ঠিক উল্টোদিকে।

    অপর সঙ্গীদের মধ্যে একজন হলেন সোভিয়েত মিশন-এর ডেপুটি চিফ আলেক্সেই কোরোলেঙ্কো। দৈহিক গড়নের দিক থেকে লম্বায় একটু কম কিন্তু চওড়ায় বিশাল। ওয়াশিংটনের কূটনৈতিক সমাজে তার হাসিখুশি চেহারা অত্যন্ত পরিচিত। জুলিয়াস শিলার অসন্তোষ প্রকাশ করায় তিনিই প্রথম তাঁকে সমর্থন করলেন।

    আমাদের দেশে সাইবেরিয়া বলে চমৎকার একটা জায়গা আছে, খেলাটা যদি মস্কোয় হত তাহলে ডিলারকে সেখানে পাঠানোর ব্যাপারে তদ্বির করতাম আমি।

    জুলিয়াস শিলার ডিলারের দিকে তাকালেন।

    পরের বার, ডেইল, কার্ড ভালো করে ফেটে নিয়ো, বুঝলে হে! আলেক্সেই তোমাকে সাইবেরিয়ায় পাঠাতে চাইছে, আর জর্জ হয়তো চাইবে সামরিক আইনে তোমার বিচার করতে।

    কৃত্রিম গাম্ভীর্যের সাথে ঘেৎ ঘোৎ করে ডেইল নিকোলাস, মার্কিন প্রেসিডেন্টের বিশেষ অ্যাসিস্ট্যান্ট বললেন, এতই যদি খারাপ হয় কার্ড, রেখে দিলেই তো পারো!

    সিনেটের পররাষ্ট্র-সম্পর্ক বিষয়ক বিভাগের সভাপতি, সিনেটের জর্জ পিট উঠে দাঁড়িয়ে গায়ের জ্যাকেট খুলে ফেললে। চেয়ারের হাতলে ওটা বিছিয়ে রেখে ইউরি ভয়স্কির দিকে তাকালেন।

    বুঝলাম না, এরা কেন কমপ্লেইন করছে, তুমি আর আমি তো একদম জিতিনি।

    সোভিয়েত দূতাবাসের আমেরিকা বিষয়ক বিশেষ উপদেষ্টা মাথা ঝাঁকালেন, মনে হচ্ছে, পাঁচ বছর আগে শেষ একটা ভালো হাত পেয়েছিলাম।

    শিলারের ইয়টে সেই ১৯৮৬ সাল থেকে প্রতি বৃহস্পতিবার চলে এই পোকার খেলা। কালক্রমে শুধু তাস খেলা নয়, বন্ধুদের মিলনস্থলে পরিণত হয়েছে এই আসর। বিশ্বের বড় বড় শক্তিগুলোর প্রতিনিধিরা এক জায়গায় মিলিত হয় এখানে। কোনো অফিশিয়াল ব্যাপার নেই, প্রেসের ঝুট-ঝামেলা নেই- সবমিলিয়ে বিশ্বশান্তির জন্য এই অনাড়ম্বর বৈঠক গুরুত্বপূর্ণ বৈকি।

    পঞ্চাশ সেন্টে শুরু করছি আমি, বললেন জুলিয়াস শিলার।

    বাড়িয়ে এক ডলার করলাম ওটাকে, বললেন আলেক্সেই কোরোলেঙ্কো।

    বোবঝা এবার! রাশিয়ানদের বিশ্বাস করতে নেই! ব্যঙ্গের সুরে মন্তব্য করলেন ডেইল নিকোলাস।

    জুলিয়াস শিলার, আলেক্সেই কোরোলেঙ্কোর দিকে না তাকিয়েই তাকে একটা প্রশ্ন করলেন মিসরে প্রকাশ্যে বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়তে পারে কি পারে না, এর ওপর ভবিষ্যদ্বাণী করো তো, হে।

    প্রেসিভেট নাদাভ হাসানকে ত্রিশ দিনের বেশি সময় দেব না, এরই মধ্যে তাকে ক্ষমতাচ্যুত করবে আখমত ইয়াজিদ।

    তুমি প্রলম্বিত যুদ্ধ দেখতে পাচ্ছ না?

    না, বিশেষ করে সামরিক বাহিনী যদি সমর্থন করে আখমত ইয়াজিদকে।

    তুমি আছ, সিনেটর? জিজ্ঞেস করলেন ডেইল নিকোলাস।

    শেষ পর্যন্ত।

    ইউরি?

    পটে তিনটে চিপস ফেললেন ভয়স্কি, প্রতিটি পঞ্চাশ সেন্টের।

    মোবারক পদত্যাগ করার পর যেদিন থেকে হাসান ক্ষমতা পেয়েছেন, অল্প দিন। হলেও, ইতোমধ্যে স্থিতিশীলতার একটা পর্যায় পর্যন্ত তুলে আনতে পেরেছেন মিসরকে, বললেন জুলিয়াস শিলার। আমার ধারণা, তিনি টিকে যাবেন।

    তুমি তো ইরানের শাহ সম্পর্কেও এই কথাই বলেছিলে, হে। অভিযোগের সুরে বললেন কোরোলেঙ্কো।

    মানলাম, হারু পার্টির পক্ষে বাজি ধরেছিলাম, জুলিয়াস শিলার তাস ফেলে গম্ভীর সুরে বললেন, আমাকে দুটো তাস দাও।

    আলেক্সেই কোরোলেঙ্কো নিজের কার্ড তুলে নিয়ে বললেন, তোমাদের বিপুল সাহায্য তলাবিহীন ঝুড়িতে ফেলা হচ্ছে কি না, সেটাই হলো প্রশ্ন। মিসরীয় জনতা অভুক্ত থাকার পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। এমন উৎকট অভাবের কারণেই তো বস্তি আর গ্রামগুলোয় ধর্মীয় উন্মাদনা ছড়িয়ে পড়ছে আগুনের মতো। এটা-সেটা করে খোমনিকে যেভাবে বেশি বাড়াবাড়ি করতে দাওনি, যদি ভেবে থাকো আখমত ইয়াজিদকেও কেটেছেটে সাইজে রাখতে পারবে তাহলে হয়তো ভুল করবে তোমরা।

    আমার জানার কৌতূহল, মস্কোর ভূমিকা কী হবে? প্রশ্ন করলেন সিনেটর পিট।

    আমরা অপেক্ষা করব, শান্তভাবে বললেন আলেক্সেই কোরোলেঙ্কো। আগুন না নেভা পর্যন্ত অপেক্ষা করব আমরা।

    নিজের কার্ডের ওপর দ্রুত চোখ বুলিয়ে জুলিয়াস শিলার বললেন, যাই ঘটুক না কেন, কেউ লাভবান হবে না।

    কথাটা ঠিক, হারব আমরা সবাই। তোমরা হয়তো মৌলবাদীদের দৃষ্টিতে মহা শয়তান, কিন্তু কমিউনিস্ট হিসেবে আমাদেরকেও ভালোবাসা হয় না। তোমাকে বলার দরকার পড়ে না, সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হবে ইসরায়েলের। ইরানের কাছে ইরাকের পরাজয় এবং সাদ্দাম হোসেনকে মেরে ফেলার চেষ্টার পর, এখন ইরান আর সিরিয়ার পথ খোলা। ওরা মুসলিম বিশ্বকে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে লড়তে ইন্ধন জোগাবে। এবারে ইহুদিরা শেষ।

    সন্দেহপূর্ণ ভঙ্গিতে মাথা নাড়লেন সিনেটর। মধ্যপ্রাচ্যে সেরা যুদ্ধাস্ত্র রয়েছে ইসরায়েলের। ওরা জিতে যাবে।

    দুই মিলিয়ন আরব যখন একসাথে হামলা করবে, আর জিততে হবে না। ভয়স্কি সতর্ক করে দিয়ে বললেন। দক্ষিণে রওনা হবে আমাদের বাহিনী, আর ইয়াজিদের মিসরীয় বাহিনী উত্তর দিকে সিনাই পর্বতের দিকে আক্রমণ শানাবে। এবারে ইরানের সেনাবাহিনীর সাহায্যও পাবে তারা। যতই শক্তিশালী হোক, ইসরায়েল শেষ।

    দক্ষযজ্ঞ থেমে যেতে, গম্ভীর স্বরে বলল আলেক্সেই, মুসলিম বিশ্ব ইচ্ছে মতো ছড়ি ঘোরাবে আমাদের ওপর। তেলের দাম বাড়াতে থাকবে তারা।

    তোমার বেট, জুলিয়াস শিলারকে বললেন ডেইল নিকোলাস।

    দু’ডলার।

    চারে তুলে দিলাম, বললেন আলেক্সেই কোরোলেঙ্কো।

    ভয়স্কি হাতের কার্ড টেবিলে ফেলে দিলেন, আমি নেই।

    আমিও চার, বললেন সিনেটর।

    চারদিকে নাগিনেরা ফেলিতেছে নিঃশ্বাস, হাসলেন ডেইল নিকোলাস। আমি নেই।

    নিজেদের বোকা বানিয়ে লাভ নেই, সিনেটর বলে চলেন, কোনো সন্দেহ নেই, চাপে পড়লে নিউক্লিয়ার বোমা ব্যবহার করবে ইসরায়েলিরা।

    বড় একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন শিলার। ওটা নিয়ে ভাবতেও ভয় লাগে।

    নক হলো দরজায়, ভেতরে ঢুকল বোটের স্কিপার। মি. শিলার, আপনার একটা জরুরি ফোন।

    এক্সকিউজ মি, বলে চেয়ার ছাড়লেন জুলিয়াস শিলার। ইয়টে খেলতে বসে সবাই কয়েকটা শর্ত মেনে চলেন, তার মধ্যে একটা হলো, ভয়ানক জরুরি ফোন ছাড়া, সেটা উপস্থিত সবার জন্য জরুরি হতে বরে, কেউ টেবিল ছেড়ে উঠতে পারবেন না।

    তোমার বাজি, আলেক্সি, সিনেটর বললেন।

    আরও চার ডলার।

    আই কল।

    অসহায় ভঙ্গিতে কার্ড উল্টো করে টেবিলে মেলে দিলেন আলেক্সেই কোরোলেঙ্কো। শুধু একজোড়া চার রয়েছে তার।

    মুচকি হেসে একজোড়া ছয় দেখালেন সিনেটর।

    ওহ, গুড লর্ড! হায় হায় করে উঠলেন ডেইল নিকোলাস। একজোড়া কিং নিয়ে অফ গেছি আমি!

    তোমার লাঞ্চের টাকাগুলো গচ্চা খেল, আলেক্সি, সহাস্যে বললেন ভয়স্কি।

    তাহলে দু’জনই পরস্পরকে ব্লাফ দিয়েছি। এই মুহূর্তে একটা তাগাদা অনুভব করছি, কে.জি.বি. চিফকে সাবধান করে দেয়া দরকার সে যেন ভুলেও তোমার সাহায্য না চায়।

    সে সাবধান হবে না, ডেইল নিকোলাস হেসে উঠে বললেল। কারণ উল্টোটাই সত্যি বলে জানে সে।

    রুমে ফিরে এসে টেবিলে আবার বসলেন জুলিয়াস শিলার। যেতে হয়েছিল বলে দুঃখিত। কিন্তু ব্যাপার হলো, এইমাত্র আমাকে জানানো হয়েছে, জাতিসংঘের চার্টার করা একটা প্লেন গ্রিনল্যান্ডের উত্তর উপকূলে বিধ্বস্ত হয়েছে। লাশ উদ্ধার করা হয়েছে পঞ্চাশের ওপর। কেউ বেঁচে আছ কি না এখনও জানা যায়নি।

    কোনো সোভিয়েত প্রতিনিধি ছিল? প্রশ্ন করলেন ভয়স্কি।

    আরোহীদের তালিকা এখনও আসেনি।

    সন্ত্রাসবাদীদের বোমা নাকি?

    এক্ষুনি বলা সম্ভব নয়, তবে প্রাথমিক আভাস বলা হয়েছে ব্যাপারটা দুর্ঘটনা নয়।

    কোন ফ্লাইট?

    লন্ডন টু নিউ ইয়র্ক।

    উত্তর গ্রিনল্যান্ড? চিন্তিতভাবে পুনরাবৃত্তি করলেন ডেইল নিকোলাস। কোর্স ছেড়ে হাজার মাইল দূরে সরে গেল!

    হাইজ্যাকিঙের গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে, বললেন ভয়কি।

    উদ্ধারকারী দল, পৌঁছেছে, ব্যাখ্যা করলেন জুলিয়াস শিলার। ঘণ্টাখানেকের মধ্যে আরও খবর পাওয়া যাবে।

    থমথম করছে সিনেটরের চেহারা, এতক্ষণে চুরুটটা ধরালেন তিনি। আমার সন্দেহ হচ্ছে, ওই ফ্লাইটে হে’লা কামিল আছেন। সামনের সপ্তায় সাধারণ পরিষদের অধিবেশন, ইউরোপ থেকে হেডকোয়ার্টারে ফেরার কথা তার।

    জর্জ বোধ হয় ঠিকই সন্দেহ করছে, বললেন ভয়স্কি। আমাদেরও দু’জন প্রতিনিধি তাঁর পার্টির সাথে ভ্রমণ করছে।

    এ স্রেফ পাগলামি, বিষণ্ণ চেহারা নিয়ে মাথা নাড়লেন জুলিয়াস শিলার। অর্থহীন পাগলামি। প্লেনভর্তি জাতিসংঘ প্রতিনিধিকে মেরে কার কী লাভ?

    কেউই সাথে সাথে উত্তর দিল না। দীর্ঘ একটা নিস্তব্ধতা জমাট বাঁধতে শুরু করল। আলেক্সেই কোরোলেঙ্কো তাকিয়ে আছেন টেবিলের মাঝখানে। অনেকক্ষণ পর শান্ত সুরে তিনি শুধু উচ্চারণ করলেন, আখমত ইয়াজিদ।

    সিনেটর জর্জ পিট রুশ ডিপ্লোম্যাটের চোখে সরাসরি তাকালেন। তুমি জানতে।

    অনুমান।

    তোমার ধারণা আখমত ইয়াজিদ, হে’লা কামিলকে খুন করার নির্দেশ দিয়েছে?

    আমাদের ইন্টেলিজেন্স জানতে পারে, কায়রোর একটা মৌলবাদী উপদল হে’লা কামিলকে খুন করার প্ল্যান নিয়ে ভাবছে।

    অথচ চুপচাপ দাঁড়িয়ে মজা দেখেছ, লাভের মধ্যে পঞ্চাশজন নিরীহ মানুষ মারা গেল!

    হিসেবের গরমিল, স্বীকার করলেন আলেক্সেই কোরোলেঙ্কো। কখন বা কোথায় খুন করার চেষ্টা করা হবে তা আমরা জানতে পারিনি। ধরে নেয়া হয়েছিল, হে’লা কামিল শুধু যদি মিসরে ফেরেন তাহলে বিপদ হবে তার। না, ইয়াজিদের তরফ থেকে নয়, বিপদ হবে তার ফ্যানাটিক অনুসারীদের দ্বারা। সন্ত্রাসবাদী কোনো তৎপরতার সাথে কখনোই জড়ানো সম্ভব হয়নি আখমত ইয়াজিদকে। তার সম্পর্কে তোমাদের আর আমাদের রিপোর্টে কোনো পার্থক্য নেই। প্রতিভাবান এক ধর্মীয় নেতা, নিজেকে যে মুসলিম গান্ধী বলে মনে করে।

    এই হলো কে. জি. বি. আর সি.আই.এ-র দৌড়! ক্ষোভের সাথে বললেন ভয়স্কি।

    হ্যাঁ, যা ভাবা হয়েছিল, লোকটা তার চেয়ে অনেক বড় সাইকো কেস।

    জুলিয়াস শিলার সায় দিয়ে মাথা ঝাঁকালেন। দুঃখজনক ঘটনাটার জন্য দায়ী হতে হবে আখমত ইয়াজিদকেই। তার সমর্থন ছাড়া অনুসারীরা এত বড় একটা ক্রাইম করতে পারে না।

    তার মোটিভ আছে, বললেন নিকোলাস। হে’লা কামিল এমন একটা আকর্ষণ, তার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে থাকা মিসরীয়দের পক্ষে সম্ভব নয়। তিনি তাঁর একার যোগ্যতায় গোটা মিসরকে সারা দুনিয়ার চোখে দুর্লভ একটা সম্মানের আসনে বসিয়ে দিয়েছেন। শুধু জনসাধারণের মধ্যে নয়, সামরিক বাহিনীতেও তার জনপ্রিয়তা প্রেসিডেন্ট হাসানের জনপ্রিয়তাকে ছাড়িয়ে গেছে। স্বাভাবিক কারণেই আখমত ইয়াজিদ তাকে প্রতিদ্বন্দ্বী ভাবছে। হে’লা কামিল মারা যাবার পর কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই চরমপন্থী মোল্লারা ক্ষমতা দখলের চেষ্টা করবে।

    কিন্তু হাসানের পতন হবার পর? ঠোঁটে ধারালো হাসি নিয়ে জিজ্ঞেস করলেন আলেক্সেই কোরোলেঙ্কো। হোয়াইট হাউস তখন কী করবে?

    জুলিয়াস শিলার আর ডেইল নিকোলাস দৃষ্টি বিনিময় করলেন। কেন, রাশিয়ানরা যা করবে আমরাও তাই করব, বললেন জুলিয়াস শিলার। আগুন না নেভা পর্যন্ত অপেক্ষা।

    কিন্তু যদি চরমপন্থী মিসরীয় সরকার অন্যান্য আরব দেশগুলোকে সাথে নিয়ে ইসরায়েলের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে আলেক্সেই কোরোলেঙ্কোর গলা তীক্ষ্ণ হলো।

    অবশ্যই ইসরায়েলকে আমরা সাহায্য করব, অতীতে যেমন করেছি।

    তোমরা কি মার্কিন সৈন্য পাঠাবে?

    বোধ হয় না।

    আর চরমপন্থী নেতারা সেটা জানে, কাজেই তারা হাতে ক্ষমতা পেলে নির্ভয়ে ইসরায়েলের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বে।

    সৈন্য পাঠাব না তা ঠিক, গম্ভীর সুরে বললেন জুলিয়াস শিলার, কিন্তু এবার আমরা নিউক্লিয়ার উইপন ব্যবহার করতে ইসরায়েলকে বাধাও দেব না। খুব সম্ভব ওদেরকে আমরা কায়রো, দামেস্ক আর বৈরুত দখল করতে দেব।

    তুমি বলতে চাইছ, ইসরায়েলিরা পারমাণবিক বোমা ব্যবহার করতে চাইলে তোমাদের প্রেসিডেন্ট আপত্তি করবেন না?

    অনেকটা তাই, নির্লিপ্ত সুরে বললেন জুলিয়াস শিলার। ডেইল নিকোলাসের দিকে ফিরলেন তিনি। কার ডিল?

    বোধ হয় আমার, বললেন সিনেটর, ওদের আলাপ শুনলেও তার চেহারা সম্পূর্ণ ভাবলেশহীন।

    পঞ্চাশ সেন্ট।

    ধীর কণ্ঠে ভয়কি বললেন, আমার কাছে ব্যাপারটা উদ্বেগজনক বলে মনে হলো।

    মাঝেমধ্যে ভূমিকা বদলানোর দরকার পড়ে, নতুন কিছু একটা ঘটা উচিত, অজুহাত খাড়া করার সুরে বললেন ডেইল নিকোলাস। আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে দারুণ ফল পেয়েছি আমরা। আমাদের তেলের রিজার্ভ এখন আশি বিলিয়ান ব্যারেল। প্রতি ব্যারেল যেহেতু পঞ্চাশ ডলারে উঠে যাচ্ছে আমাদের তেল কোম্পানিগুলো এখন বিশাল জায়গাজুড়ে তেল খোঁজার খরচ জোগাতে পারবে। তাছাড়া, মেক্সিকো আর দক্ষিণ আমেরিকার রিজার্ভ থেকেও প্রচুর তেল পাব আমরা। মোদ্দা কথা হলো, তেলের জন্য মধ্যপ্রাচ্যের ওপর নির্ভর করার কোনো দরকার নেই আমাদের। সোভিয়েত রাশিয়া যদি উপহার চায়, গোটা আরব জাহানই নিয়ে যেতে পারে তারা।

    নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছেন না আলেক্সেই। আমেরিকার নীতি তার পিলে চমকে দিয়েছে।

    সিনেটর পিটের মনে যথেষ্ট সন্দেহ আছে, তেলে আমেরিকা স্বয়ংসম্পূর্ণতা পাবে কি না। মেক্সিকো কি আসলে আমেরিকার বন্ধু? সন্দেহ আছে।

    মিসরে রয়েছে ধর্মান্ধ নেতা আখমত ইয়াজিদ। কিন্তু মেক্সিকোতেও তো রয়েছে উগ্র মৌলবাদী নেতা, টপিটজিন। আজটেক সাম্রাজ্যের মতো মেক্সিকোয় জাতীয়তাবাদের পুনরুত্থান চায় সে। ইয়াজিদের মতোই তার দেশেও টপিটজিনের রয়েছে বিশাল সমর্থন। বর্তমান সরকারকে উৎখাত করা এখন সময়ের ব্যাপার।

    সমস্ত উন্মাদ, ধর্মান্ধ নেতাগুলো আচমকা কোত্থেকে উদয় হচ্ছে? এই শয়তানগুলোকে কে নাচাচ্ছে? হাতের কাঁপুনি বন্ধ করতে বেগ পেতে হলে সিনেটর জর্জ পিটকে।

    .

    ১২.

    গভীর রাতের ভৌতিক নিস্তব্ধতার ভেতর দাঁড়িয়ে আছে প্রকাণ্ড মূর্তিগুলো, চোখহীন কোটর মেলে তাকিয়ে আছে দুর্গম অনুর্বর পাহাড় আর প্রান্তরের দিকে, যেন অপেক্ষা করছে তাদের পাষাণ শরীর প্রাণ সঞ্চার করার জন্য অজানা কোনো অস্তিত্বের উপস্থিতি ঘটবে। নগ্ন, আড়ষ্ট মূর্তিগুলো, এক একটা দোতলা বাড়ির সমান উঁচু, গম্ভীর মুখের চেহারা উদ্ভাসিত হয়ে আছে গোল চাঁদের উজ্জ্বল আলোয়।

    এক হাজার বছর আগে মূর্তিগুলো একটা মন্দিরের ছাদের অবলম্বন হিসেবে ছিল। মন্দিরটা ছিল পাঁচ ধাপে ভাগ করা একটা পিরামিডের মাথায়। কোয়েটজালকোটল পিরামিড আজও টিকে আছে, তবে কালের আঁচড়ে ধূলিসাৎ হয়ে গেছে মন্দিরটা। জায়গাটা টুলার টলটেক শহরে। নিচু একটা পাহাড়শ্রেণীর পাশেই এই প্রাচীন ধ্বংসাবশেষ, হারিয়ে যাওয়া শখের দিনে এই শহরে বাস করত ষাট হাজার মানুষ।

    খুব কম টুরিস্টই আসে এদিকে, একবার এলে দ্বিতীয়বার কেউ আসতে চায় না জায়গাটার ভৌতিক পরিবেশ আর নির্জনতার জন্য। বিধ্বস্ত শহরের আনাচেকানাচে বেটপ ছায়াগুলো মনে সন্দেহের উদ্রেক করে, গোঙানির শব্দটা বাতাসের কি না ঠিক বোঝা যায় না। এসব কিছু অগ্রাহ্য করে নিঃসঙ্গ একজন মানুষ পিরামিডের খাড়া সিঁড়ি বেয়ে উঠে যাচ্ছে চূড়ায় বসানো মূর্তিগুলোর দিকে। ভদ্রলোকের পরনে থ্রিপিস স্যুট, হাতে একটা লেদার অ্যাটাচি কেস।

    পাঁচটা টেরেসের প্রতিটিতে থেমে জিরিয়ে নিলেন তিনি, পাথুরে দেয়ালের গায়ে খোদাই করা শিল্পকর্ম দেখলেন। বিশাল সরীসৃপের হাঁ করা মুখ থেকে উঁকি দিচ্ছে মানুষের মুখ, ঈগলের ঠোঁটে ক্ষতিবিক্ষত হচ্ছে মানুষের হৃৎপিণ্ড। আবার উঠতে শুরু করলেন ভদ্রলোক, পেরিয়ে এলেন মানুষের খুলি আর হাড় খোদাই করা একটা বেদি। এগুলো প্রাচীন প্রতীক চিহ্ন, ক্যারিবিয়ান জলদস্যুরা ব্যবহার করত।

    পিরামিডের মাথায় উঠে চারদিকে তাকালেন তিনি। ঘামছেন, হাঁপিয়ে গেছেন। না, নিঃসঙ্গ নন ভদ্রলোক। ছায়া থেকে বেরিয়ে এল দুটো মানুষ্য মূর্তি, সার্চ করল তাঁকে। তারপর তারা হাত ইশারায় অ্যাটাচি কেসটা দেখল। বিনীত ভঙ্গিতে সেটা খুললেন ভদ্রলোক। ভেতরের জিনিসপত্র এলোমেলো করল লোক দু’জন, কোনো অস্ত্র না পেয়ে নিঃশব্দে ঘুরে দাঁড়িয়ে মন্দির মঞ্চের কিনারা লক্ষ করে হাটা ধরল।

    পেশিতে ঢিল পড়ল গাই রিভাসের। অ্যাটাচি কেসের হাতলে লুকানো বোতামে চাপ দিলেন তিনি, ঢাকনির ভেতর আড়াল করা ছোট্ট টেপ রেকর্ডারটা চালু হলো।

    দীর্ঘ এক মিনিট পর মূর্তিগুলোর একটা ছায়া থেকে বেরিয়ে এল একজন লোক। মেঝে পর্যন্ত লম্বা সাদা কাপড়ের আলখেল্লা পরে আছে সে। লম্বা চুল ঘাড়ের কাছে বাধা। চোখ আর নাকের ওপর গোটা কপালজুড়ে বহুরঙা নকশা করা মখমলের গোল একটা চাকতি, চাকতির দুধার থেকে দুটো চওড়া ফিতে বেরিয়েছে, পেঁচিয়ে আছে কানের ওপর দিয়ে মাথার পেছনটাকে। মাথার সামনের অংশে রেশম আর পাখির পালক খাড়া করে বাঁধা। পা দুটো আলখেল্লার ভেতর, তবে চাঁদের আলোয় বাহুতে পরা বৃত্তাকার ব্যান্ড দুটো পরিষ্কার দেখা গেল, সোনার ওপর মণিমুক্তোখচিত।

    তেমন লম্বা নয় সে, মসৃণ গোল ধাচের মুখাবয়ব ইন্ডিয়ান পূর্বপুরুষের কথা মনে করিয়ে দেয়। কালো চোখ দিয়ে সামনে দাঁড়ানো ভদ্রলোককে খুঁটিয়ে পরীক্ষা করল সে। লোকটার বয়স ত্রিশের বেশি না। লোকটা বুকের ওপর হাত দুটো ভাঁজ করে বলল,

    আমি টপিটজিন।

    আমার নাম গাই রিভাস, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট তাঁর বিশেষ দূত হিসেবে পাঠিয়েছেন আমাকে। রিভাস আশা করেছিলেন আরও বয়স্ক হবে টপিটজিন।

    নিচু একটা পাঁচিলের দিকে তাকাল টপিটজিন। কথা বলার জন্য ওখানে আমরা বসতে পারি।

    মাথা ঝাঁকিয়ে এগিয়ে গেলেন রিভাস, পাঁচিলের মাথায় বসলেন। সাক্ষাৎদানের জন্য অদ্ভুত একটা জায়গা বেছে নিয়েছেন আপনি।

    হ্যাঁ, তার কারণও আছে টুলা আমার উদ্দেশ্য পূরণ করবে। কোনো কারণ নেই, হঠাৎ করে তার চেহারা আর গলার সুরে আক্রোশ ও ঘৃণা ফুটে উঠল। তোমার প্রেসিডেন্ট আমাদের সাথে প্রকাশ্যে আলোচনায় বসতে ভয় পায়। সে একটা কাপুরুষ, সে তার মেক্সিকো সিটির বন্ধুদের অসন্তুষ্ট করতে সাহস পায় না।

    টোপ এড়িয়ে যাবার অভিজ্ঞতা রয়েছে রিভাসের। তিনি নরম সুরে বললেন, আপনি আমাকে সাক্ষাৎদানের রাজি হওয়ায় প্রেসিডেন্ট বলেছেন আমি যেন তার কৃতজ্ঞতা আপনার কাছে পৌঁছে দিই।

    আমি আশা করেছিলাম আপনার চেয়ে আরও উঁচু পদের কেউ আসবে।

    আপনার শর্ত ছিল কথা বলবেন শুধু একজন লোকের সাথে। স্বভাবতই আমরা ধরে নিই, আপনি চান না আমাদের সাথে কোনো দোভাষী থাকুক। আর, আপনি যেহেতু স্প্যানিশ বা ইংরেজি বলতে রাজি নন, অগত্যা আমাকেই পাঠানো হলো। কর্মকর্তা পর্যায়ে আমিই একমাত্র অফিসার যে প্রাচীন আযটেক ভাষা নাহুয়াটল জানে।

    বলতে বেশ ভালোই পারেন।

    এসকামপো শহর থেকে আমেরিকায় চলে গিয়েছিলেন আমাদের পরিবার। খুব যখন ছোট আমি, তখন শিখেছি।

    এসকামপো আমি চিনি। ছোট্ট একটা গ্রাম, দপূর্ণ ওখানকার লোকেরা। কিন্তু আয়ু কম।

    আপনি দাবি করেন, মেক্সিকো থেকে দারিদ্য চিরতরে হটিয়ে দেবেন। আমাদের প্রেসিডেন্ট আপনার প্রোগ্রাম সম্পর্কে জানতে অত্যন্ত আগ্রহী।

    সে কি সেজন্যই আপনাকে পাঠিয়েছে?

    মাথা ঝাঁকালেন রিভাস। তিনি যোগাযোগের একটা মাধ্যম খুলতে চান?

    গম্ভীর একটুকরো হাসি ফুটে উঠল টপিটজিনের মুখে।

    অর্থনৈতিক অবস্থা যেহেতু ভেঙে পড়েছে, কাজেই তিনি জানেন আমার আন্দোলনের তোড়ে নির্বাচিত সরকার উৎখাত হয়ে যাবে। আমার ক্ষমতায় আসার উজ্জ্বল সম্ভাবনা রয়েছে, তাই আগেভাগে সুসম্পর্কে তৈরি করার চেষ্টা করা হচ্ছে। আবার ওদিকে সরকারের সাথেও হাত মেলানো হচ্ছে। মেক্সিকোয় আপনাদের স্বার্থ আছে, সেটা থেকে বঞ্চিত হতে চান না, এই তো?

    প্রেসিডেন্টের মনের কথা পড়া আমার সাধ্যের অতীত।

    সে খুব তাড়াতাড়িই জানতে পারবে যে মেক্সিকোর নির্যাতিত মানুষ শাসকশ্রেণী আর ধনীদের অনুগ্রহ নিয়ে বেঁচে থাকতে রাজি নয় আর। দুর্নীতি আর রাজিৈনতক ধোঁকাবাজি ধৈর্যের শেষ সীমায় এনে ফেলেছে তাদেরকে। বস্তি এলাকার মানুষের দুর্দশা চোখে দেখা যায় না। গ্রামে সাধারণ মানুষের কোনো কাজ নেই। কিন্তু না, আর তারা সহ্য করবে না। তাদের চুপচাপ বসে থাকার দিন শেষ হয়েছে।

    আপনি চান, আযটেক ধুলো থেকে আদর্শ একটা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সমস্যার সমাধান করবেন?

    আমি বলি, আপনাদের উচিত পূর্বপুরুষদের হাতে দেশ ফিরিয়ে দেয়া।

    পুরো আমেরিকায় আযটেকরা ছিল সবচেয়ে বড় কসাই। এ রকম বর্বর একটা সভ্যতার ওপর ভিত্তি করে আপনি আধুনিক দেশ প্রতিষ্ঠা করতে চাইছেন… থেমে পড়েন রিভাস। বেশ কষ্টকল্পনা নয় কি?

    টপিটজিনের গোলাকার মুখাবয়বে ছায়া ঘনায়। আপনার তো জানা আছে, শয়তান স্পেনীয়রা আযটেকদের উৎখাত করেছিল। ওরা আমাদের পূর্ব পুরুষদের জবাই করেছে।

    এ রকম স্পেনীয়রা ও মুরের কথা বলবে।

    আপনার প্রেসিডেন্ট কী চায় আমার কাছে?

    তিনি শুধু মেক্সিকোর শান্তি আর উন্নতি চান, জবাব দিলেন রিভাস। এবং একটা প্রতিশ্রুতি-আপনি কমিউনিজমের দিকে এগোবেন না।

    আমি মার্ক্সিস্ট নই। কমিউনিজমকে সে যতটুকু ঘৃণা করে, আমি তার চেয়ে কম করি না। আমার অনুসারীদের মধ্যে সশস্ত্র গেরিলা একজনও নেই।

    শুনে তিনি খুশি হবেন।

    আমাদের নতুন আযটেক জাতি গৌরব ও মহত্ত্ব অর্জন করবে কালো টাকার মালিক, দুর্নীতিপরায়ণ অফিসার, বর্তমান মন্ত্রিসভার সদস্য আর সামরিক বাহিনীর কর্মকর্তাদের বলি দেয়ার পর।

    রিভাসের মনে হলো তিনি শুনতে বা বুঝতে ভুল করেছেন। আপনি কি হাজার হাজার মানুষকে খুন করার কথা বলছেন?

    খুন? কর্কশ শব্দে হেসে উঠল টপিটজিন। আরে না, মি, গাই রিভাস, না! আমি আমাদের দেবতাদের উদ্দেশ্য বলি দেয়ার কথা বলছি। কোয়েকজালকোটল, হুইটজিলোপোকটলি, টেক্যাটলিপোকা-আপনি তো জানেনই, এ রকম আরও অনেক দেবতা আছে আমাদের। অনেক যুগ পেরিয়ে গেছে, দেবতাদের উদ্দেশ্যে বলি উৎসর্গ করা হয় না। আমার দ্বারা সেই শুভ কাজটা এবার সম্পন্ন হবে, কথা দিচ্ছি।

    না! এই একটা শব্দ ছড়া গাই রিভাস আর কিছু বলতে পারলেন না।

    আমাদের আটেক রাষ্ট্রের নাম হবে টেনোচটিকলান। আইনের অনুশাসন হবে। ধর্মভিত্তিক। নাহুয়াটল হবে রাষ্ট্রীয় ভাষা। কঠোর ব্যবস্থায় কমিয়ে আনা হবে জনসংখ্যা। বিদেশি পুঁজি বা শিল্প হবে রাষ্ট্রের সম্পত্তি। সীমান্তের ভেতর বাস করতে পারবে শুধু নেটিভরা। বাকি সবাইকে দেশ থেকে বহিষ্কার করা হবে।

    স্তম্ভিত বিস্ময়ের সাথে তাকিয়ে থাকলেন গাই রিভাস। তারা চেহারা ফ্যাকাসে হয়ে গেছে।

    বিরতি না নিয়ে বলেই চলেছে টপিটজিন, যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে কোনো পণ্য কেন হবে না। আপনাদের কাছে এক ফোঁটা তেলও আমরা বিক্রি করব না। বিশ্বব্যাংকে আমাদের সমুদয় দেনা পরিশোধযোগ্য নয় বলে ঘোষণা করা হবে। ক্যালিফোর্নিয়া, টেক্সাস, নিউ মেক্সিকো আর আরিজানায় আমাদের যেসব জায়গা আপনারা দখল করে রেখেছেন, সেগুলো ফেরত চাওয়া হবে। ফেরত পাবার স্বার্থে লক্ষ লক্ষ মানুষকে নিয়ে সীমান্ত পেরোবার জন্য লং মার্চ করব আমরা।

    যদি ঠাট্টা না হয়, বিভাস বললেন, তাহলে বলব নেহাতই পাগলামি। এ ধরনের উদ্ভট দাবির কথা শুনতে চাইবেন না আমাদের প্রেসিডেন্ট।

    ধীরে ধীরে পাঁচিল থেকে নেমে দাঁড়াল টপিটুজিন, নত হয়ে আছে অলকৃত মাথা, চোখ নিস্পলক, বেসুরো গলায় বিড়বিড় করে বলল, তাহলে তো তাকে একটা মেসেজ পাঠাতে হয়, যাতে বিশ্বাস করে?

    সে তার মাথার ওর তুলল হাত দুটো, গোটা বাহু গঢ়ি আকাশের দিকে খাড়া হলো। যেন সঙ্কেত পেয়ে পাথুরে মূর্তিগুলোর গভীর ছায়া থেকে বেরিয়ে এল চারজন মানুষ, মাথায় পট্টি ছাড়া গায়ে কোনো আবরণ নেই। চারদিক থেকে এগিয়ে এসে গাই রিভাসকে ঘিরে ফেলল, ভয় আর অবিশ্বাসে আড়ষ্ট ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে থাকলেন তিনি। চারজন মিলে ধরল তাকে, নিজেদের মধ্যে ধরাধরি করে নামিয়ে আনল পাথরে বেদিতে, যেখানে মানুষের খুলি আর হাড় খোদাই করা রয়েছে পাঁচিলের গায়ে। বেদির ওপর শোয়ানো হলো তাকে। হাত আর পা ধরে থাকল চারজন।

    কী ঘটতে যাচ্ছে উপলব্ধি করে আরও কয়েক সেকেন্ড বোবা হয়ে থাকলেন গাই রিভাস। তারপর বাঁচার আকুতিতে চিৎকার করে উঠলেন, ওহ্ গড়, নো! নো। নো নো!

    আতঙ্কিত আমেরিকানকে গ্রাহ্যই করল না টপিটজিন, বেদির একপ্রান্তে নীরবে দাঁড়িয়ে থাকল সে। খানিক পর একবার শুধু মাথা ঝাঁকাল।

    লোকগুলো রিভাসের কোট আর শার্ট খুলে নিল। বেরিয়ে পড়ল নগ্ন বুক।

    টপিটজিনের হাতে হঠাৎ করে উদয় হলো লম্বা একটা ছোর। মাথার ওপর উঁচু করে ধরল সেটা। চাঁদের আলোয় চকচক করে উঠল কালো ফলা। এগিয়ে এল সে।

    আর্তনাদ করে উঠলেন গাই রিভাস, সেটাই তার শেষ চিৎকার।

    পরমুহূর্তে ছোরার ফলাটা গেঁথে গেল বুকে।

    সার বেঁধে দাঁড়িয়ে থাকা উঁচু মূর্তিগুলো নির্লিপ্ত। হাজার বছর ধরে এ ধরনের অমানুষিক নিষ্ঠুরতা বহুবার দেখেছে তারা নির্লিপ্ত চোখে।

    তখনও লাফাচ্ছে গাই রিভাসের হৃৎপিণ্ড, বুকের ভেতর থেকে সেটাকে যখন বের করা হলো।

    .

    ১৩.

    চারপাশে লোকজন ও ব্যস্ততা থাকলেও হিম উত্তরের গভীর নিস্তব্ধতা পিটের গোটা অস্তিত্বে যেন চেপে বসেছে। আর্কটিকের ঠাণ্ডা ওকে বিবশ করে ফেলছে একদম। এত শান্ত সুনসান নীরবতা- সমস্ত আওয়াজ শুষে নিচ্ছে যেন। পিটের মনে হতে লাগল ও বুঝি কোনো রেফ্রিজারেটরের মধ্যে রয়েছে।

    অবশেষে দিনের আলো ফুটল, ধূসর রঙের অদ্ভুত কুয়াশা ভেদ করে এত স্নান যে সে আলোয় ছায়া পড়ে না। আরও একটু বেলা হতে কোমল কমলা-সাদা রং নিল আকাশ, হিম কুয়াশা পোড়াতে শুরু করেছে সূর্য। খাড়ির ওপারে দাঁড়িয়ে থাকা পাথুরে চূড়াগুলোকে তুষারের সাদা বোরখা ঢাকা নারীমূর্তি মনে হলো।

    অকুস্থলের চারদিকে এখন অন্য রকম চেহারা। প্রথমে পৌঁছেছে পাঁচটা এয়ারফোর্স হেলিকপ্টার, সাথে করে এনেছে আর্মি স্পেশাল সার্ভিস ফোর্স। লোকগুলো সশস্ত্র, থমথমে কঠিন চেহারা, গোটা এলাকা তারা নিশ্চিদ্রভাবে ঘিরে ফেলল। এক ঘন্টার পর পৌঁছুল ফেডারেল এভিয়েশন ইনভেস্টিগেটররা, বিধ্বস্ত প্লেনের বিচ্ছিন্ন অংশ কী কী সংগ্রহ করা হবে সব চিহ্নিত করে ফেলল তারা। তাদের পিছু পিছু এল প্যাথোলজিস্টদের একটা দল, লাশগুলো হেলিকপ্টারে তুলে নিয়ে চলে গেল এয়ারফোর্স বেস থিউল-এর মর্গে।

    নেভির পক্ষ থেকে রইলেন কমান্ডার বায়রন নাইট, পোলার এক্সপ্লোরার পৌঁছেছে অকুস্থলে। ওটার ভেঁপুর গুরুগম্ভীর আওয়াজে সচকিত হলো সবাই।

    সাইরেন বাজিয়ে ধীরে ধীরে খাড়ির মুখে ঢুকল পোলার এক্সপ্লোরার। গথিক দুর্গের মতো লাগল জাহাজটাকে। আইসপ্যাক ভেঙে অনায়াসে পথ করে নিল সেটা, অকুস্থল থেকে মাত্র পঞ্চাশ মিটার দূরে থামল। কমান্ডার বায়রন নাইট ইঞ্জিন বন্ধ করলেন, সিঁড়ি বেয়ে বরফের ওপর নেমে এলেন। নেমেই তিনি উপস্থিত উদ্ধারকর্মীদের প্রয়োজনে জাহাজের সুবিধাদি ব্যবহার করার অনুরোধ জানালেন। কৃতজ্ঞচিত্তে তার প্রস্তাব গ্রহণ করল সবাই। কাজে বিরতি দিয়ে ছুটল তারা জাহাজের দিকে।

    সিকিউরিটির অবস্থা দেখে পিট মুগ্ধ। কোনো খবর এখনো চাউড় হয়নি। কেবল কেনেডি।

    আন্তর্জাতিক এয়ারপোর্ট জানে জাতিসংঘের ফ্লাইট বিলম্ব করছে। অল্প কিছুক্ষণের মধ্যে অবশ্য সমস্ত খবর জানাজানি হয়ে যাবে।

    মনে হচ্ছে, চোখের মণি জমে যাবে হে, বিষণ্ণ চিত্তে জিওর্দিনো বলে। নুমার হেলিকপ্টারের পাইলটের সিটে বসে এক কাপ কফি খাওয়ার চেষ্টা করছে সে।

    তুমি তো সারা দিন-রাত ককপিটেই বসে আছো, পিট কটাক্ষ হানে।

    আরে, বাইরের অবস্থা দেখে এখানে বসেই আমরা ফ্রস্টবাইট হয়ে যাচ্ছে, জিওর্দিনো সিরিয়াস চোখে জানায়।

    বাইরে তাকিয়ে কমান্ডার বায়রন নাইটকে বরফের ওপর দিয়ে হেঁটে আসতে দেখল পিট। ঝুঁকে, দরজাটা খুলে মেলে ধরল সে। ঠাণ্ডায় আরো এক দপা গুঙিয়ে উঠল জিওর্দিনো।

    শুভেচ্ছা জানিয়ে পারকার পকেট থেকে একটা কনিয়াকের বোতল বের করলেন নাইট।

    চুরি করে এনেছি বোতলটা। ভাবলাম, তোমাদের প্রয়োজন হতে পারে।

    বোতলটা হাতে ধরিয়ে দিয়ে পিট বলল, আপনি এইমাত্র অ্যালকে স্বর্গে পাঠিয়ে দিলেন।

    বোতলটা নিয়ে ঠাণ্ডায় হি হি করতে করতে জিওর্দিনো বলল, তারচেয়ে আমি নরক পছন্দ করব। ছিপি খুলে কয়েক ঢোক ব্র্যান্ডি খেল সে। বোতলটা পিটকে ফিরিয়ে দিল।

    জাহাজে ওঁরা কেমন আছেন? জিজ্ঞেস করল পিট।

    মিস কামিল বিশ্রাম নিচ্ছেন। অবিশ্বাস্য ব্যাপার, আমাকে দুবার ডেকে তিনি দেখা করতে চেয়েছেন তোমাদের সাথে। নিউ ইয়র্কে ডিনার না কী যেন একটা ব্যাপারে।

    ডিনার? পিটের চেহারায় কৌতুক।

    মজার ব্যাপার, ফ্লাইট অ্যাটেনড্যান্টের হাঁটুর চামড়ায় ওষুধ লাগানোর পর সে নাকি বলেছে, তোমার সাথে তারও একটা ডিনার ডেট ঠিক হয়ে আছে।

    ধোয়া তুলসী পাতার চেহারা নিয়ে পিট বলল, আমার ধারণা, ওদের নিশ্চয়ই খুব খিদে পেয়েছে।

    পিটের হাত থেকে বোতলটা ছো দিয়ে কেড়ে নিল জিওর্দিনো, বলল, কেন যেন মনে হচ্ছে, এ গান আগেও আমি শুনেছি!

    আর চিফ স্টুয়ার্ড?

    তার অবস্থা বেশ খারাপই বলব, পিটের প্রশ্নের জবাব দিলেন নাইট। তবে ডাক্তার বলছেন, সেরে উঠবে। তার নাম রুবিন। ওষুধের প্রভাবে ঘুমিয়ে পড়ার সময় বিড়বিড় করে কি বলল, ভুল বকছে কিনা বুঝলাম না-ফাস্ট আর সেকেন্ড অফিসারকে খুন করেছে পাইলট, তারপর উড়ন্ত প্লেন থেকে অদৃশ্য হয়ে গেছে…

    বোধ হয় ভুল বকছে না, বলল পিট। পাইলটের লাশ এখনও পাইনি আমরা। নাইটের দিকে তাকাল ও রাশিয়ান সাবমেরিন নিয়ে কী করা হবে?

    আপাতত এটা নিয়ে আমরা কোনো খবর জানাচ্ছি না। ভাগ্যই বলতে হয়, এই প্লেন ক্রাশ আমাদের কাজের দিক থেকে সবার চোখ সরিয়ে দিয়েছে। তবে কতক্ষণ চাপা থাকবে সংবাদটা, তাই চিন্তার বিষয়।

    বেশি খুশি না হওয়াই ভালো, অ্যাল জিওর্দিনো বলে। রাশিয়ানরা এত গাধা নয়। কখন দেখবেন সব বুঝে গেছে, তারপর দুনিয়ার জাহাজ আর উদ্ধারকারী বার্জ নিয়ে চলে এসেছে অকুস্থলে। ওরা দারুণ চতুর। জাহাজের পেছনে বেঁধে সোজা রাশিয়ায় নিয়ে থামবে সাবমেরিনটা।

    যদি ধ্বংস করে দেয়? পিট জানতে চায়।

    সোভিয়েতদের ভালো উদ্ধারকারী টেকনোলজি নেই। ওরা বরঞ্চ এতেই খুশি, কেউ যেন ওদের সাবমেরিন পরীক্ষা করে দেখতে না পারে।

    কনিয়াকের বোতল পিটের হাতে ধরিয়ে দেয় জিওর্দিনো। এখানে বসে তর্ক না করে, চলো গিয়ে জাহাজের গরম হাওয়া খাই?

    হ্যাঁ, কমান্ডার নাইট সায় দিলেন। তোমরা যথেষ্ট করেছে এখানে।

    পারকা গায়ে দিয়ে নেয় পিট। আমার অবশ্য একটু স্কি করার শখ জেগেছে মনে।

    তার মানে এখন জাহাজে আসছে না?

    এই আর কী। ওই আর্কিওলজির দলটাকে একটু দেখে আসি।

    অযথা। ডাক্তার তার কয়েকজন সাঙ্গ-পাঙ্গ পাঠিয়েছে ওখানে। ওরা ভালোই আছে।

    তাহলে ওরা কী খুঁড়ে বের করল, তাই না হয় দেখি, পিট নাছোরবান্দা।

    হ্যাঁ, যাও, গ্রিক দেবী-টেবিও পেয়ে যেতে পারো।

    অসম্ভব কী! হাসল পিট।

    কিন্তু প্লেন আর আরোহীদের সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে কী বলবে ওদেরকে?

    আমরা এখানে একটা জিওলজিক্যাল সার্ভে প্রজেক্টে কাজ করছি, বলল পিট। আরোহীরা ফিউজিলাজে আটকা পড়ে, হাইপথারমিয়ায় মারা গেছে।

    আমার জন্য অপেক্ষা করার দরকার নেই, বলে রওনা হলো পিট।

    তাজ্জব ব্যাপার! অ্যান্টিকস সম্পর্কে ওর আগ্রহ দেখে আমি আশ্চর্য হয়ে যাচ্ছি। জানতাম না, এই বিষয়েও ওর আগ্রহ আছে। নাইট বললেন।

    আরে, ও-ই কি ছাই জানত নাকি! দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে অ্যাল।

    .

    বরফের মাঠ শক্ত আর সমতল, খাড়ির ওপর দিয়ে দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে পিট। উত্তর পশ্চিম দিকে কালো মেঘ, সেদিকে একটা চোখ রেখে এগোচ্ছে ও। রোদে ঝলমলে প্রকৃতি কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে চেহারা পাল্টে রুদ্রমূর্তি ধরতে পারে, শুরু হয়ে যেতে পারে ঝড়-ঝঞ্ঝার তাণ্ডব নৃত্য, জানা আছে ওর। অন্ধকার হয়ে এলে দিক চেনার কোনো উপায় থাকে না, সেটাই সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়। বরফের রাজ্যে পথ হারালে মৃত্যু অনিবার্য হয়ে দেখা দেবে।

    দক্ষিণ দিকে যাচ্ছে পিট। তীররেখা পেরিয়ে এল। ধোয়ার একটা ক্ষীণ রেখা পথ দেখাচ্ছে ওকে। সন্দেহ নেই, আর্কিওলজিস্টদের আশ্রয় থেকে উঠছে ধোঁয়াটা।

    আশ্রয় যখন আর মাত্র দশ মিনিটের পথ, এই সময় ঝড়ের কবলে পড়ল পিট। বিশ মিটার দূরে পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছিল, এখন পাঁচ মিটার দূরের বরফও পরিষ্কার নয়। জগিং করার ভঙ্গিতে ছুটল ও, ব্যাকুলতার সাথে আশা করছে সরল একটা রেখা ধরেই সামনে এগোচ্ছে সে। কোনোকোনি ছুটে এসে বাম কাঁধে আঘাত করছে তুষারকণা আর বাতাস, বাতাসের গায়ে সামান্য হেলান দিয়ে ছুটল ও।

    বাতাসের গতিবেগ বাড়ল। হেলান দিয়ে থাকা সত্ত্বেও ঠেলে ফেলে দিতে চাইছে। ওকে। সামনে এখন প্রায় কিছুই দেখতে পাচ্ছে না ও। মাথা নিচু করে পায়ের দিকে চোখ রেখেছে, প্রতিটি পদক্ষেপ গুনছে, হাত দুটো মাথার দুপাশে ভাঁজ করা। জানে, কিছু দেখতে না পেয়ে হাঁটা মানে বৃত্তাকারে ঘোরা। হয়তো আর্কিওলজিস্টদের আশ্রয়কে পাশ কাটিয়ে এগিয়ে যাবে, টেরও পাবে না। সবশেষে, ক্লান্ত শরীর নেতিয়ে পড়বে বরফের ওপর।

    বাতাস যতই তীব্রগতি আর ঠাণ্ডা হোক, ভারী কাপড়গুলো গরম রাখছে শরীরটাকে। হার্টবিটের শব্দ শুনে বুঝতে পারছে, এখনও সে মাত্রাতিরিক্ত ক্লান্ত হয়ে পড়েনি।

    আশ্রয়ের কাছাকাছি পৌঁছে গেছে মনে হতে দাঁড়িয়ে পড়ল পিট। এবার সাবধানে এগোল। ত্রিশ পা এগিয়ে থামল আবার। ডান দিকে ঘুরল, এগোল তিন মিটারের মতো। উল্টোদিক থেকে ধেয়ে আসা তুষার ঝড়ের ভেতর ফেলে আসা পায়ের চিহ্ন অস্পষ্টভাবে চিনতে পারল ও। ঘুরল, ফেলে আসা পথের সমান্তরাল রেখা ধরে এগোল এবার, এভাবে ত্রিশ মিটার পরপর দিক বদলে, একটা নকশা তৈরি করে গোটা এলাকা চষে ফেলার উদ্দেশ্য।

    পাঁচবারে পাঁচটা রেখা তৈরি করল ও। আশ্রয়ের কোনো সন্ধান পেল না। তৈরি করা রেখাগুলো ধরে ফিরে এল মাঝখানে, অর্থাৎ তিন নম্বর রেখায়। এবার আড়াআড়িভাবে হাঁটা ধরল ও। তিনটে নতুন রেখা তৈরি শেষ করতে যাচ্ছে, এই সময় তুষারপে হোঁচট খেয়ে পড়ে যাবার উপক্রম করল, হাতে ঠেকল একটা ধাতব দেয়াল।

    দেয়াল ধরে দুবার দুটো কোণ ঘুরল পিট, হাতে চলে এল একটা রশি, রশিটা পৌঁছে দিল একটা দরজায়। ঠেলা দিতেই খুলে গেল সেটা। উপলব্ধিটুকু উপভোগ করল ও, তার প্রাণ সংশয় দেখা দিয়েছিল, তবে নিজেকে উদ্ধার করতে সমর্থ হয়েছে। সে। ভেতরে ঢুকতে হতাশ বোধ করল পিট।

    এখানে কেউ বসবাস করে না। মেঝেতে স্তূপ হয়ে আছে পাথর আর মাটি, চারদিকে গর্ত। হিমাংকের খুব একটা ওপরে হবে না তাপমাত্রা। তবে ঝড়ের হাত থেকে বাঁচা গেছে, কৃতজ্ঞচিত্তে ভাবল ও।

    আলো আসছে শুধু একটা কোলম্যান লণ্ঠন থেকে। প্রথমে ভাবল, কাঠামোটার ভেতর কেউ নেই। তারপর গর্ত থেকে ধীরে ধীরে উঁচু হলো একজোড়া কাঁধ আর একটা মাথা। শরীরটা ঝুঁকে আছে, পিটের দিকে পেছন ফিরে, গর্তের ভেতর একদৃষ্টে তাকিয়ে কী যেন গভীর মনোযোগের সাথে পরীক্ষা করছে।

    ছায়া থেকে বেরিয়ে এসে গর্তের ভেতর উঁকি দিল পিট। তুমি কি তৈরি?

    চরকির মতো আধপাক ঘুরল লিলি, যতটা না চমকে উঠেছে তার চেয়ে বেশি। হতভম্ব। কিসের জন্য তৈরি?

    শহরে যাবার জন্য?

    এতক্ষণে সচেতন হলে লিলি। লণ্ঠনটা গর্ত থেকে তুলল সে, ধীরে ধীরে সিধে হলো। পিটের চোখে তাকিয়ে থাকল দুই সেকেন্ড। হিসহিস শব্দ করছে কোলম্যান। সময় পেয়ে তার গাঢ় লাল চুল দেখে মনে মনে প্রশংসা করল পিট। মি. ডার্ক পিট, সত্যি তো? দস্তানা খুলে ডান হাতটা বাড়িয়ে দিল লিলি।

    পিটও একটা হাতের দস্তানা খুলে, মৃদু চাপ দিয়ে করমর্দন করল। সুন্দরী মেয়েরা আমাকে শুধু ডার্ক বললে খুশি হই।

    অপ্রতিভ ছোট্ট খুকির মতো লাগল নিজেকে, মেকআপ করা হয়নি বলে আরও অস্বস্তিবোধ করল লিলি। তারপর লক্ষ করল, কাপড়ে আর হাতে মাটি লেগে রয়েছে। পরিস্থিতি রীতিমত সঙ্গীন হয়ে উঠল চেহারা লালচে হয়ে উঠছে বুঝতে পেরে।

    শার্প…লিলি, থেমে থেমে বলল সে। আমার সঙ্গীদের সাথে আলাপ করছিলাম, কাল রাতে যে সাহায্যে তোমার কাছ থেকে পেয়েছি, অন্তত মৌখিক একটা ধন্যবাদ। দিয়ে আসা উচিত। আমরা হয়তো যেতাম, নিজে চলে এসে ভালো করেছ। ডিনারের প্রস্তাবটা ঠাট্টা মনে করেছিলাম। সত্যি যে আসবে ভাবিনি।

    শুনতেই পাচ্ছ বাইরে কী ঘটছে, বলল পিট, একটা তুষার ঝড়ও আমাকে বাধা দিয়ে রাখতে পারেনি।

    তুমি নির্ঘাত একটা উম্মাদ।

    না, স্রেফ বোকা বলতে পারো এইজন্য যে ভেবেছিলাম আর্কটিক ঝড় আমার সাথে পাল্লা দিয়ে পারবে না।

    দু’জনেই হেসে উঠল একসাথে, সেই সাথে আড়ষ্ট ভাবটা দূর হয়ে গেল। গর্ত থেকে উঠতে গেল লিলি, তার একটা হাত ধরে সাহায্য করল পিট। ব্যথা পেয়ে উফ করে উঠল লিলি, সাথে সাথে তার হাত ছেড়ে দিল পিট। পা এখনও ব্যথা করছে, তাই না? হাঁটাচলা করা উচিত হচ্ছে না।

    একটু আড়ষ্ট হয়ে আছে, নীলচে হয়ে আছে কয়েক জায়গায়, তোমাকে দেখানো যাবে না। তবে মরব না এক্ষুনি।

    লিলির হাত থেকে লণ্ঠনটা নিয়ে কাঠামোর চারদিকে আলো ফেলে দেখল পিট। কী পেয়েছ এখানে?

    এস্কিমোদের একটা গ্রাম, এক থেকে পাঁচশো খ্রিস্টাব্দের মধ্যে এখানে তারা বাস করত।

    নামকরণ হয়েছে?

    সাইটের নাম রেখেছি গ্রোনকুইস্ট বে ভিলেজ। ড. হিরাম গ্রোনকুইস্ট, আমাদের দলনেতা। জায়গাটা তিনি পাঁচ বছর আগে আবিষ্কার করেন।

    তিনজনের মধ্যে একজন, কাল রাতে যাদের দেখলাম?

    প্রকাণ্ড মানুষটা, অজ্ঞান হয়ে পড়েছিলেন।

    কেমন আছেন তিনি?

    মাথায় বড় একটা কালচে দাগ থাকলেও কিরে-কসম খেয়ে বলছেন, কোনো ব্যথা নেই। ঘর থেকে বেরোবার সময় দেখে এসেছি, একটা হাঁস রোস্ট করতে বসেছেন।

    হাঁস? হেসে উঠল পিট। তার মানে তোমাদের সাপ্লাই সিস্টেম প্রথম শ্রেণীর।

    মিনার্ভা প্লেন, ভার্টিক্যাল লিফট। এক প্রাক্তন ছাত্র ইউনিভার্সিটিকে ধার হিসেবে দিয়েছে। থিউল থেকে দুসপ্তাহ পরপর আসে।

    এমন কিছু পেয়েছে, যা পাবার কথা নয়?

    ঝট করে মুখ তুলে পিটের দিকে তাকাল লিলি। কেন, এ প্রশ্ন কেন করলে?

    কৌতূহল।

    মাটি খুঁড়ে আমরা প্রি হিস্টোরিক এস্কিমোদের হাতে তৈরি কয়েকশো শিল্পকর্ম পেয়েছি। লিভিং কোয়ার্টারে আছে সব, ইচ্ছে করলে পরীক্ষা করতে পারো।

    হাঁসের রোস্ট খেতে খেতে?

    চমৎকার হয়। গ্রোনকুইস্ট দারুণ রাঁধেন।

    ভেবেছিলাম তোমাদের সবাইকে জাহাজের গ্যালিতে দাওয়াত দেব, কিন্তু হঠাৎ ঝড় শুরু হওয়ায় আমার প্ল্যান ভেস্তে গেছে।

    টেবিলে নতুন মুখ দেখতে পেলে আমরা সবাই ভারি খুশি হই।

    অস্বাভাবিক কিছু আবিষ্কার করেছ তোমরা তাই না? হঠাৎ করে জিজ্ঞেস করল পিট।

    সন্দেহে বিস্ফারিত হয়ে উঠল চোখজোড়া। কীভাবে বুঝলে? তীক্ষ্ণকণ্ঠে প্রশ্ন করল লিলি।

    গ্রিক নাকি রোমান?

    রোমান এমপায়ার, বাইজানটিয়াম।

    বাইজানটিয়াম কি? পিটের চঞ্চল দৃষ্টি লিলির মুখে কী যেন খুঁজল। কত পুরনো?

    একটা স্বর্ণমুদ্রা, চতুর্থ শতাব্দীর।

    পেশিতে ঢিল পড়ল পিটের। বড় করে শ্বাস টানল, ছাড়ল ধীরে ধীরে। লিলি ওর দিকে হতভম্ব দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে, চেহারায় অস্বস্তি।

    সে বেসুরো গলায় বলল, কিছু বলতে চাও?

    যদি বলি, ধীরে ধীরে শুরু করল পিট, সাগর আর খাড়ির মাঝখানের একটা পথে রোমান আমলের জাহাজ ছড়িয়ে আছে?

    জাহাজ! সবিস্ময়ে পুনরাবৃত্তি করল লিলি।

    আন্ডারওয়াটার ক্যামেরা দিয়ে ভিডিও টেপে জারগুলোর ফটো তুলে নিয়েছি আমরা।

    গড! ওহ্, ডিয়ার গড! তার মানে এসেছিল! ওরা এসেছিল! লিলি যেন নেশার ঘোরে আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছে। সত্যি ওরা আটলান্টিক পাড়ি দিয়েছিল। ভাইকিংদের আগে রোমানরা পা রেখেছিল গ্রিনল্যান্ডে!

    প্রমাণ দেখে তাই তো মনে হচ্ছে, আস্তে করে লিলির কোমর পেঁচিয়ে ধরে তাকে দরজার দিকে হাঁটিয়ে নিয়ে চলল পিট। ঝড়ের মধ্যে এখানে আমরাটকা পড়েছি, নাকি রশিটা তোমাদের লিভিং কোয়ার্টারের দিকে গেছে?

    মাথা ঝাঁকাল লিলি। গেছে। ঘাড় ফিরিয়ে মেঝের গর্তগুলো আরেকবার দেখল সে। পাইথেয়াস, গ্রিক নেভিগেটর, খ্রিস্টের জন্মের তিনশো পঞ্চাশ বছর আগে একটা মহতি অভিযান শেষ করেন। কিংবদন্তি আছে, তারা উত্তর দিকে জাহাজ চালিয়ে আটলান্টিকে এসেছিলেন, সবশেষে পৌচেছিলেন আইসল্যান্ডে। অথচ আশ্চর্য ব্যাপার, আরও সাতশো বছর পর এত উত্তর আর পশ্চিমে রোমানরা এসেছিল কি না সে সম্পর্কে কোনো রেকর্ড বা কিংবদন্তি নেই।

    পাইথথয়াস ভাগ্যবান, গল্পটা বলার জন্য তিনি দেশে ফিরতে পেরেছিলেন।

    তোমার ধারণা, রোমান যারা এখানে এসেছিল তারা ফেরার পথে জাহাজডুবিতে মারা যায়?

    না, আমার ধারণা, এখনও তারা এখানেই আছে। লিলির দিকে চোখ নামিয়ে আত্মবিশ্বাসের সাথে হাসল পিট। তুমি আর আমি, সুন্দরী, খুঁজে বের করব ওদেরকে।

    .

    দ্বিতীয় পর্ব – দ্য সেরাপিস

    ১৪ অক্টোবর ১৯৯১, ওয়াশিংটন, ডি.সি,

    ১৪.

    ঝিরঝির বৃষ্টির মধ্যে সতেরো পেনিসিলভানিয়া এভিনিউয়ে থামল ট্যাক্সিটা, পুরনো এক্সিকিউটিভ অফিস বিল্ডিংয়ের ঠিক সামনে। ডেলিভারিম্যান-এর ইউনিফর্ম পরা এক লোক পেছনের সিট থেকে নেমে ড্রাইভারকে অপেক্ষা করতে বলল। ট্যাক্সির ভেতর ঝুঁকে লাল সিল্কে মোড়া একটা প্যাকেট বের করল সে। ফুটপাত পেরিয়ে কয়েকটা ধাপ টপকাল, দোরগোড়া হয়ে ঢুকে পড়ল মেইলরুমের রিসেপশন অংশে।

    প্রেসিডেন্টের জন্য, ইংরেজিতে বললেও তার বাচনভঙ্গি স্প্যানিশ।

    পোস্টাল সার্ভিসের একজন সহকারী প্যাকেটের গায়ে সময় লিখে সই করল। মুখ তুলে হাসল সে। এখনও বৃষ্টি হচ্ছে?

    ঝিরঝিরে। বলেই চলে গেল ডেলিভারিম্যান।

    প্যাকেটটা নিয়ে ফ্লুরোস্কোপ-এর নিচে রাখল পোস্টাল সহকারী। পিছিয়ে এসে স্ক্রীনের দিকে তাকাল সে, প্যাকেটের ভেতর কী আছে দেখতে পাচ্ছে।

    একটা ব্রিফকেস। কিন্তু ছবিটা তাকে অবাক করে দিল। ব্রিফকেসের ভেতর কোনো কাগজ বা ফাইল নেই, নির্দিষ্ট কাঠামো বা কিনারাসহ কোনো শক্ত জিনিস নেই। বিস্ফোরক ধরনের কিছু হলে চেনা যেত, তাও নয়। ব্যাপারটা ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। ফোনের রিসিভার তুলে ডায়াল করল সে।

    দুমিনিটের মধ্যে কুকরের চেইন হাতে করে একজন সিকিউরিটি অফিসার হাজির হলো। কি, মাতাহারির কোনো খোরাক? সহাস্যে জানতে চাইল এজেন্ট।

    ইঙ্গিতে প্যাকেটটা দেখিয়ে দিল পোস্টাল সহকারী। স্কোপে জিনিসটা কেমন যেন দেখাচ্ছে।

    মাতাহারি ট্রেনিং পাওয়া জার্মান কুকুর। মোটাসোটা, ছোটখাট; খয়েরি চোখ দুটো। বিশাল। যেকোনো বিস্ফোরকের গন্ধ চিনতে পারে সে। লোক দু’জন তাকিয়ে থাকল, প্যাকেটটাকে ঘিরে চক্কর দিচ্ছে কুকুরটা। চেহারা বিকৃত করল, গলার ভেতর থেকে বেরিয়ে এল চাপা গর্জন।

    অবাক হলো এজেন্ট লোকটা। কী ব্যাপার, মাতাহারি তো কখনও এ রকম করে না!

    ওটার ভেতর অদ্ভুত কিছু আছে।

    কার নামে এসেছে?

    প্রেসিডেন্টের।

    এগিয়ে গিয়ে ফোনের রিসিভার তুলে নিল এজেন্ট।

    এখানে আমাদের জিম গেরহাটকে দরকার।

    হোয়াইট হাউসের ফিজিকাল সিকিউরিটির চার্জে রয়েছে স্পেশাল এজেন্ট জিম। গেরহার্ট। লাঞ্চ ফেলে ছুটে এল সে। দেখল প্যাকেটটাকে ঘিরে চক্কর দিচ্ছে কুকুরটা। কিন্তু আমি তো কোনো ওয়্যারিং বা ডিটোনেশন ডিভাইস দেখছি না।

    না, বোমা নয়, পোস্টাল সহকারী বলল।

    ঠিক আছে, এসো খোলা যাক।

    সিল্ক আবরণ সাবধানে ভোলা হলো। বেরিয়ে এল কালো চামড়ার একটা কেস। কেসের গায়ে কোনো চিহ্ন নেই, এমনকি মডেল নম্বর বা প্রস্তুতকারকের নাম পর্যন্ত নেই। কমবিনেশন লকের বদলে চাবি ঢোকানোর জন্য দুটো ফুটো রয়েছে। ফুটোর পাশে ইস্পাতের বোতামে চাপ দিতেই ক্লিক করে একজোড়া শব্দ হলো। সত্যি উন্মোচিত হবার মুহূর্ত উপস্থিত! সতর্ক হাসি ফুটল এজেন্টের মুখে। ঢাকনির দুই কোণে দুটো হাত রেখে ধীরে ধীরে ওপর দিকে তুলল সে। ঢাকনি ভোলা হয়েছে, ভেতরে কী রয়েছে সবাই ওরা দেখতে পেল।

    জেসাস!

    পোস্টাল সহকারী আঁতকে উঠে পেছন ফিরল। হোঁচট খেতে খেতে টয়লেটের দিকে ছুটল সে নাকে-মুখে হাত চাপা দিয়ে রেখেছে যাতে বমি না করে ফেলে।

    ওহ্, গড! রুদ্ধশ্বাসে বলল গেরহার্ট। সশব্দে ঢাকনিটা বন্ধ করে দিল সে। রক্তশূন্য চেহারা নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা এজেন্টের দিকে তাকাল।

    এক্ষুনি এটাকে জর্জ ওয়াশিংটন হাসপাতালে পাঠিয়ে দাও।

    আসল জিনিস, নাকি এর মধ্যে কোনো চাতুরি আছে? রুদ্ধশ্বাসে জিজ্ঞেস করল এজেন্ট।

    আসল জিনিস, গম্ভীর সুরে বলল গেরহার্ট।

    .

    হোয়াইট হাউসে তার নিজের অফিসে রয়েছেন ডেইল নিকোলাস, এবার নিয়ে তিনবার পড়া শেষ করলেন ফোল্ডারটা। এটা তাঁর কাছে পাঠিয়েছেন ল্যাটিন আমেরিকা বিষয়ে প্রেসিডেন্টের সিনিয়র ডিরেক্টরদের একজন, আরমান্দো লোপেজ।

    ডেইল নিকোলাস ইউনিভার্সিটিতে পড়াচ্ছিলেন, প্রেসিডেন্ট বারবার অনুরোধ করায় হোয়াইট হাউসে তার বিশেষ অ্যাসিস্ট্যান্ট হতে হয়েছে ভদ্রলোককে। অনিচ্ছার সাথে দায়িত্বটা গ্রহণ করলেও, কাজ শুরু করার পর তিনি আবিষ্কার করেছেন যে হোয়াইট হাউসের আমলাদের নাকে দড়ি দিয়ে ঘোরানোর দুর্লভ একটা প্রতিভা এত দিন সুপ্ত ছিল তার ভেতর।

    তাঁর কফি-ব্রাউন রঙের চুল মাথার ঠিক মাঝখানে দুভাগ করা। চশমার কাঁচ গোল আর ছোট, তারের ফ্রেম। হাতের কাজটি ছাড়া দ্বিতীয় কোনো বিষয়ে মাথা ঘামাতে অভ্যস্ত নন তিনি। ভদ্রলোক পাইপ টানেন, তবে বন্ধুবর শিলারের সাথে দেখা হলেই প্রতিজ্ঞা করেন, ধূমপান তারা দু’জন একসাথে ছেড়ে দেবেন। যদিও ছাড়ার কোনো চেষ্টা দু’জনের কারও মধ্যেই দেখা যায় না।

    ফোল্ডারে মেক্সিকান সংবাদপত্রের প্রচুর কাটিং রয়েছে। সেগুলোর ওপর আবার চোখ বুলাতে শুরু করলেন ডেইল নিকোলাস, পড়তে পড়তেই পাইপে আগুন ধরালেন। ফোল্ডারের বিষয় একটাই।

    টপিটজিন।

    মেক্সিকান সাংবাদিকরা তার সাক্ষাৎকার নিতে পারলেও আমেরিকান সাংবাদিক বা সরকারি প্রতিনিধির সাথে কথা বলতে রাজি হয়নি সে। দেহরক্ষীদের তৈরি পাঁচিল ভেদ করে কেউ তারা তার সামনে পৌঁছতে পারেনি।

    স্প্যানিশ ভাষাটা ভালোই জানা আছে ডেইলের, শান্তি মিশনের সঙ্গে দুই বছর পেরু ছিলেন তিনি। কাজেই লেখাগুলো পড়তে তার অসুবিধা হলো না। এবার পড়ার সময় একটা প্যাড় আর কলম টেনে নিলেন তিনি, নোট রাখবেন।

    ‘এক। টপিটজিনের দাবি, দরিদ্রস্য দরিদ্রদের মধ্যে থেকে উঠে এসেছে সে। মেক্সিকো সিটিতে যেখানে আবর্জনা ফেলা হয়, সেই আস্তাকুড়ের কিনারায় আস্তাকুঁড় দিয়ে তৈরি একটা ঝুপড়ির ভেতর জন্ম হয়েছে তার। জন্মতারিখ, মাস বা বছর, কিছুই মনে নেই। কীভাবে সে বেঁচে গেছে বলতে পারবে না, তবে একটু বড় হবার সাথে সাথে শিখেছে কীভাবে মাছি, আবর্জনা, নর্দমা, দুর্গন্ধ, শীত আর খিদে নিয়ে বেচেঁ থাকতে হয়।

    দুই। স্বীকার করে, কোনো দিন স্কুলে যায়নি। ছেলেবেলা আর টলটেক/ আযটেক ধর্মের স্বঘোষিত অবতার হওয়ার মাঝখানের সময়টা সম্পর্কে তার কোনো ইতিহাস জানা যায় না।

    তিন। তার মধ্যে দিয়ে দশম শতাব্দীর ধর্মীয় গুরু ও টলটেকদের শাসক টপিন্টজিন পুনরায় ধরাধামে ফিরে এসেছেন বলে দাবি করে সে। কিংবদন্তির দেবতা কয়েটজালকোটল আর টপিটজিনকে এক বলে ধারণা করা হয়।

    চার। প্রাচীন সংস্কৃতি আর ধর্মের সংমিশ্রণে রাজনৈতিক দর্শন প্রচার করে টপিটজিন, যার মূল কথা হলো কোনো দল নয়, মাত্র একজন ধর্মীয় গুরু বা অবতার রাজ্য শাসন করবে। টপিটজিনের উচ্চাশা, মেক্সিকান জনসাধারণের সর্বজন শ্রদ্ধেয় পিতা হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করবে সে। কীভাবে বিধ্বস্ত অর্থনীতিকে আবার চাঙ্গা করবে জিজ্ঞেস সে সম্পর্কে আলোচনা করতে রাজি নয়।

    পাঁচ। ভাষণে জাদু আছে। মানুষকে মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখে। দোভাষীর সাহায্য নিয়ে শুধু প্রাচীন আযটেক ভাষায় কথা বলে সে। মধ্য মেক্সিকোয় এই ভাষা এখনও অনেকে ব্যবহার করে।

    ছয়। বেশির ভাগ সমর্থক ফ্যানাটিক। বাঁধ ভাঙা স্রোতের মতো গোটা দেশ জুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে তার জনপ্রিয়তা। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের বিশ্বাস, জাতীয় নির্বাচনে টপিটজিন আর তার দল শতকরা ছয় ভাগ আসনে জয়লাভ করবে। অথচ নির্বাচনে অংশগ্রহণে রাজি নয় সে। তার বক্তব্য, তা যথার্থও বটে, যে নির্বাচনে হারলেও দুর্নীতিপরায়ণ সরকার ক্ষমতা ছাড়বে না। জনসাধারণকে সাথে নিয়ে সরকারকে উৎখাত করাই তার লক্ষ্য।’

    নিভে যাওয়া পাইপটা অ্যাশট্রেতে রেখে সিলিংয়ের দিকে তাকালেন ডেইল নিকোলাস। তারপর মন্তব্য লিখতে শুরু করলেন তিনি।

    ‘সারাংশ : টপিটজিন হয় অকাট মূর্খ নয়তো অসম্ভব প্রতিভাবান ব্যক্তি। নিজের সম্পর্কে যা বলে, যদি সে সত্যিই সেই রকম হয়, তবে টপিটজিন একজন গর্দভ। আর যদি তার সমস্ত কাজের পেছনে কোনো উদ্দেশ্যে থেকে থাকে এবং নিজস্ব কোনো উপায় তবে সে একজন অসামান্য প্রতিভাধর ব্যক্তি। সমস্যা! সমস্যা! সমস্যা!’

    লেখা শেষ হয়েছে, ঝন ঝন শব্দে বেজে উঠল টেলিফোন। রিসিভার তুললেন ডেইল নিকোলাস।

    এক নম্বরে প্রেসিডেন্ট, স্যার, সেক্রেটারি ঘোষণা করল।

    বোতাম চাপ দিলেন নিকোলাস। ইয়েস, মি. প্রেসিডেন্ট।

    গাই রিভাসের কোনো খবর পেলেন?

    না, কোনো খবর নেই।

    প্রেসিডেন্টের প্রান্তে কয়েক সেকেন্ডের বিরতি। তারপর শোনা গেল, আমার সাথে তার দেখা করার সময় দুঘণ্টা হলো পেরিয়ে গেছে। আমি উদ্বেগ বোধ করছি। তার যদি কোনো সমস্যা হয়ে থাকে, এতক্ষণে পাইলটের একটা খবর পাঠানোর কথা।

    তিনি হোয়াইট হাউসের কোনো জেট নিয়ে মেক্সিকো সিটিতে যাননি, ব্যাখ্যা করলেন ডেইল নিকোলাস। গোপনীয়তা রক্ষার জন্য কমার্শিয়াল এয়ারলাইনারে গেছেন, কোচ ক্লাসে, ট্যুরিস্ট হিসেবে।

    বুঝলাম, বললেন প্রেসিডেন্ট। প্রেসিডেন্ট দো লরেঞ্জো যদি জানতে পারেন ব্যক্তিগত একজন প্রতিনিধিকে তার বিরোধীপক্ষের সাথে আলোচনা করতে পাঠিয়েছি, ব্যাপারটাকে তিনি অপমান বলে মনে করবেন, ফলে আগামী সপ্তাহর আরিজানা কনফারেন্সটা ভুল হয়ে যেতে পারে।

    ইয়েস, মি. প্রেসিডেন্ট।

    ইউ, এন, চার্টার ক্র্যাশ সম্পর্কে ব্রিফ করা হয়েছে আপনাকে? হঠাৎ প্রসঙ্গ বদলালেন প্রেসিডেন্ট।

    না, স্যার, জবাব দিলেন ডেইল নিকোলাস। আমি যে একমাত্র তথ্যটি জানি, হে’লা কামিল বেঁচে গেছেন।

    তিনি আর ক্রুদের দু’জন সদস্য। বাকি সবাই বিষক্রিয়ার মারা গেছেন।

    বিষ? গলায় অবিশ্বাস।

    ইনভেস্টিগেটররা তাই বলছে। তাদের বিশ্বাস, সবাইকে বিষ খাওয়ানোর চেষ্টা করে প্যারাসুট নিয়ে আইসল্যান্ডে নেমে গেছে পাইলট!

    তাহলে নিশ্চয়ই লোকটা ভুয়া হবে।

    একটা লাশ না পাওয়া পর্যন্ত হা-না কিছুই বলা যাচ্ছে না।

    গড, ইউ এন, প্রতিনিধিদলকে মেরে কোনো আতঙ্কবাদী গ্রুপ কি অর্জন করবে?

    এখনও কেউ কৃতিত্ব দাবি করেনি। সি.আই.এ থেকে মারটিন ব্রোগান বলছেন, এটা যদি আতঙ্কবাদীদের কাজ হয়, তাহলে মনে করতে হবে তাদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য বদলেছে।

    হতে পারে হে’লা কামিলই টার্গেট ছিলেন। আখমত ইয়াজিদ বহুবার বলেছে, তাকে সে দেখে নেবে।

    সম্ভাবনাটা উড়িয়ে দেয়া যায় না।

    প্রেস কিছু জানতে পেরেছ?

    এক ঘণ্টার মধ্যে গোটা দুনিয়া জানবে। চেপে রাখার কোনো কারণ আমি দেখছি না।

    আপনি আমাকে বিশেষ কিছু করতে বলেন, মি. প্রেসিডেন্ট?

    শুধু এইটুকু জানতে পারলে ভালো হয়। ইউ.এন. ফ্লাইটে মেক্সিকোর এগারোজন নাগরিক ছিলেন-ডেলিগেট ও এজেন্সি প্রতিনিধি। আমার নামে শোকবাণী পাঠান, সাহায্যের প্রস্তাব দিন। ও, হ্যাঁ, ভালো কথা, স্টেট ডিপার্টমেন্টের জুলিয়াস শিলারকে সব জানাবেন।

    ঠিক আছে।

    আর, মি. গাই রিভাসের কাছ থেকে খবর পাওয়া মাত্র আমাকে জানাবেন।

    ঠিক আছে, মি, প্রেসিডেন্ট।

    রিসিভার রেখে দিয়ে ফোল্ডারটার দিকে আবার তাকালেন ডেইল নিকোলাস। ভাবলেন, ইউ. এন হত্যাকাণ্ডের সাথে টপিটজিন কোনোভাবে জড়িত নয় তো?

    আসলে ঠিক কী অর্জন করতে চাইছে টপিটজিন? আযটেক মেক্সিকো? অতীতের পুনরুত্থান? সেকেলে শাসনব্যবস্থা আধুনিক যুগে অচল, এটা বোঝার মতো জ্ঞান তার নেই তা বিশ্বাস করা যায় না। তাহলে?

    আসলে ডেইল নিকোলাস ডিটেকটিভ নন। তিনি বুঝতে পারছেন বটে অন্য একটা কিছু পরিচালিত করছে বা শক্তি জোগাচ্ছে টপিটজিনকে, কিন্তু সেটা কী হতে পারে কোনো ধারণা করতে পারছেন না। তিনি শুধু টপিটজিনকে একজন ভিলেন হিসেবে বিবেচনা করতে পারছেন।

    আর্য রক্তের শ্ৰেত্বের স্বপ্নে উঁদ ছিল হিটলার। আয়াতুল্লাহ খোমেনি চেয়েছিল মুসলিম জাতীয়তাবাদের প্রতিষ্ঠা। লেনিন চেয়েছিল কমিউনিজমের ক্রুসেড।

    টপিটজিন কী চায়?

    দরজায় নক করে ভেতরে ঢুকল তার সেক্রেটারি, ডেস্কের ওপর একটা ফাইল ফোল্ডার রাখল। সি. আই.এ. থেকে যে রিপোর্টাটা চেয়েছিলেন, স্যার। আর, তিন নম্বরে আপনার একটা কল অপেক্ষা করছে।

    কে?

    জিম গেরহার্ট নামে এক ভদ্রলোক, বলল মেয়েটা।

    হোয়াইট হাউস সিকিউরিটি। কি চায় বলেছে?

    জরুরি।

    ফোনের রিসিভার তুলে বোতামে চাপ দিলেন ডেইল নিকোলাস। হ্যাঁ!

    জিম গেরহা …

    জানি, বলুন।

    খুব ভালো হয় আপনি যদি জর্জ ওয়াশিংটন হাসপাতালের প্যাথোলজি ল্যাবে চলে আসেন, স্যার।

    ইউনিভার্সিটি হাসপাতালে? কেন?

    আমি বরং ফোনে আর কিছু বলব না, স্যার।

    আমি অত্যন্ত ব্যস্ত, মি. গেরহার্ট। আপনাকে আরও খোলসা করে বলতে হবে।

    ক্ষণিক নীরবতা। ব্যাপারটা আপনার ও মি. প্রেসিডেন্টের জন্য উদ্বেগের বিষয়, স্যার। শুধু এইটুকু বলতে পারি।

    কোন আভাস দিতে পারেন না?

    প্রশ্নটার জবাব না দিয়ে জিম গেরহার্ট বলল, আপনার অফিসের বাইরে আমার একজন লোক অপেক্ষা করছে, স্যার। সে আপনাকে ল্যাবে নিয়ে আসবে। ওয়েটিংরুমে দেখা হবে আমাদের।

    আমার কথা শুনুন, গেরহার্ট…। যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল, আর কিছু বলা হলো না।

    .

    ল্যাবের ওয়েটিংরুমেই পাওয়া গেল জিম গেরহার্টকে। এসেছেন, সেজন্য ধন্যবাদ, আনুষ্ঠানিক সুরে বলল সে, করমর্দনের কোনো আগ্রহ দেখল না।

    আমি এখানে কেন? সরাসরি জিজ্ঞেস করলেন ডেইল নিকোলাস।

    শনাক্ত করার জন্য, স্যার।

    হঠাৎ বুকটা ছ্যাৎ করে উঠল, ফিসফিস করে জানতে চাইলেন, কাকে?

    দেখে নিয়ে আপনিই বলুন, স্যার।

    লাশ দেখায় আমি অভ্যস্ত নই।

    ঠিক লাশ নয়, স্যার। তবে শক্ত হতে হবে আপনাকে।

    কাঁধ ঝাঁকালেন ডেইল নিকোলাস। ঠিক আছে, চলুন সেরে ফেলা যাক।

    করিডর পেরিয়ে একটা কামরায় ঢুকল ওরা। কামরার মাঝখানে একটাই স্টেনলেস স্টিলের টেবিল। সাদা, স্বচ্ছ প্লাস্টিক দিয়ে মোড়া রয়েছে লম্বা কী যেন। টেবিলের গা থেকে এক ইঞ্চির বেশি নয় জিনিসটার উচ্চতা। চেহারায় বিহ্বল ভাব নিয়ে গেরহার্টের দিকে তাকালেন নিকোলাস। কী শনাক্ত করতে হবে আমাকে?

    কথা না বলে প্রাস্টিক আবরণ সরিয়ে নিল গেরহার্ট। তার হাত থেকে মেঝেতে পড়ে গেল সেটা।

    টেবিলে পড়ে থাকা জিনিসটার দিকে তাকিয়ে থাকলেন নিকোলাস, চিনতে পারছেন না। প্রথম মনে হলো, কাগজ কেটে মানুষের আকৃতি তৈরি করা হয়েছে। তারপর প্রচণ্ড ঘুষির মতো ধাক্কার সাথে উপলব্ধি করলেন। দুপা পিছিয়ে দেয়ালে হেলান দিলেন তিনি, কোমর বাঁকা করে হাঁপাচ্ছেন। তাড়াতাড়ি কামরা থেকে বেরিয়ে গিয়ে একটু পরই ফিরে এল গেরহার্ট, হাতে ফোল্ডিং একটা চেয়ার ও তোয়ালে। প্রেসিডেন্টের বিশেষ অ্যাসিস্ট্যান্টকে চেয়ারটায় বসতে সাহায্য করল সে, হাতে ধরিয়ে দিল তোয়ালেটা।

    প্রায় দুমিনিট চেয়ারে বসে থাকলেন ডেইল নিকোলাস। মুখে তোয়ালে চেপে ধরে শুকনো বমি করলেন। খানিকটা শান্ত হয়ে মুখ তুললেন তিনি। গুড লর্ড! ওটা তাহলে…?

    চামড়া, বলল গেরহার্ট। গা থেকে ছাড়ানো মানুষের চামড়া।

    টেবিলের দিকে জোর করে আবার তাকালেন নিকোলাস। চুপসানো বেলুনের কথা মনে পড়ে গেল তাঁর। ছালটা কাটা হয়েছে মাথার পেছন থেকে গোড়ালি পর্যন্ত, শরীর থেকে চামড়া উঠে এসেছে ঠিক যেমন পশুদের আসে। লম্বা একটা চেরা দাগ রয়েছে বুকে, সেলাই দিয়ে বন্ধ করা হয়েছে সেটা। চোখ নেই, তবে সবটুকু চামড়া আছে, হাত আর পায়েরও।

    বলতে পারেন, স্যার, কে হতে পারে? শান্তভাবে জানতে চাইল গেরহাট।

    মুখ খুলতে গিয়েও খুললেন না ডেইল নিকোলাস। আবার অসুস্থ লাগল নিজেকে। শুধু চুলগুলো তার চেনা চেনা ঠেকছে। তবু তিনি জানেন? গাই রিভাস, ফিসফিস করে বললেন তিনি।

    কথা না বলে ডেইল নিকোলাসকে ধরে দাঁড় করাল গেরহার্ট, পাশের কামরায় নিয়ে এসে একটা সোফায় বসাল। এক মিনিট পর তার হাতে গরম কফির একটা কাপ ধরিয়ে দিল সে। খান, এক্ষুনি আসছি আমি।

    একটা অ্যাটাচি কেস নিয়ে ফিরে এল গেরহার্ট। নিচু টেবিলের ওপর রাখল সেটা। চামড়াটা এটার ভেতরে করে আনা হয়েছে। ভাঁজ করা ছিল। প্রথমে মনে করেছিলাম, কোনো সাইকোর কাজ হবে। কিন্তু সার্চ করতে গিয়ে মিনি একটা টেপ রেকর্ডার পেয়ে গেলাম।

    চালিয়েছেন?

    কিছুই বুঝিনি। দু’জনের কথা রেকর্ড করা হয়েছে, যেন সাংকেতিক ভাষায় কথা বলছে তারা।

    রিভাসের সাথে আমার সম্পর্ক আপনি আবিষ্কার করলেন কীভাবে?

    ছাড়ানো চামড়ার ভেতর ভদ্রলোকের আইডি কার্ড ছিল। তার অফিসে গিয়ে সেক্রেটারিকে জেরা করি। সেখান থেকে জানতে পারি, এয়ারপোর্টের উদ্দেশে রওনা হবার আগে প্রেসিডেন্ট ও আপনার সাথে দুঘণ্টা কথা বলেছেন তিনি। কোথায় গিয়েছিলেন, সেক্রেটারি বলতে পারেনি। ধরে নিলাম ক্লাসিফায়েড কোনো মিশনে গিয়েছিলেন। তারপর আপনার সাথে যোগাযোগ করি।

    টেপ করা কথা কিছুই তুমি বোঝোনি?

    একেবারে কিছু বুঝিনি তা নয়। চামড়া ছাড়ানোর সময় মি. রিভাস যে চিৎকার করেন তাও টেপে আছে।

    চোখ বুজলেন ডেইল নিকোলাস, মন থেকে ছবিটা মুছে ফেলার চেষ্টা করলেন।

    তাঁর পরিবারকে জানাতে হবে, বলল গেরহার্ট। স্ত্রী আছেন?

    চার-চারটে ছেলেমেয়ে নিয়ে একা হয়ে গেল বেচারি। নিঃশব্দে কেঁদে ফেললেন নিকোলাস।

    এই প্রথম গেরহার্টের পাথুরে চেহারা নরম হলো। আমি দুঃখিত, স্যার।

    তার কথা ডেইল নিকোলাস শুনতে পেলেন না। দুঃস্বপ্ন দেখার আতঙ্ক কাটিয়ে উঠেছেন তিনি। এখন আর তার বমি পাচ্ছে না। গাই রিভাস তার ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের একজন ছিলেন। তার এই পরিণতি তিনি মেনে নিতে পারছেন না। প্রচণ্ড রাগ হচ্ছে তাঁর। এত রাগ কখনও তার হয়নি। হঠাৎ করে ডেইল নিকোলাস উপলব্ধি করলেন, তিনি দুর্বল নন। হোয়াইট হাউসের মুষ্টিমেয় যে কজন লোক প্রচণ্ড ক্ষমতার অধিকারী, তিনি তাদেরই একজন। অনেক অবিশ্বাস্য ঘটনা তিনি ঘটাতে পারেন, অনেক স্বাভাবিক ঘটনা তিনি ঘটতে না দেয়ার ব্যবস্থা করতে পারেন। সিদ্ধান্ত নিলেন, এই নিমর্ম হত্যাকাণ্ডের প্রতিশোধ নেয়ার জন্য তার সবটুকু ক্ষমতা ব্যবহার করবেন। এমনকি দরকার হলে অন্যায়ভাবেও।

    টপিটজিনকে মরতে হবে।

    ⤶ ⤷
    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleদ্য মহাভারত কোয়েস্ট : দ্য আলেকজান্ডার সিক্রেট – ক্রিস্টোফার সি ডয়েল
    Next Article ড্রাগন – ক্লাইভ কাসলার

    Related Articles

    ক্লাইভ কাসলার

    দ্য ফারাও’স সিক্রেট – ক্লাইভ কাসলার ও গ্রাহাম ব্রাউন

    August 5, 2025
    ক্লাইভ কাসলার

    পাইরেট – ক্লাইভ কাসলার / রবিন বারসেল

    August 5, 2025
    ক্লাইভ কাসলার

    দ্য সলোমন কার্স – ক্লাইভ কাসলার ও রাসেল ব্লেক

    August 5, 2025
    ক্লাইভ কাসলার

    ড্রাগন – ক্লাইভ কাসলার

    August 5, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Generic selectors
    Exact matches only
    Search in title
    Search in content
    Post Type Selectors
    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে বাঙলাদেশের কৃষক – বদরুদ্দীন উমর

    October 29, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে বাঙলাদেশের কৃষক – বদরুদ্দীন উমর

    October 29, 2025
    Our Picks

    চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে বাঙলাদেশের কৃষক – বদরুদ্দীন উমর

    October 29, 2025

    পূর্ব বাঙলার ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি ২ – বদরুদ্দীন উমর

    October 29, 2025

    বাঙলাদেশে কমিউনিস্ট আন্দোলনের সমস্যা – বদরুদ্দীন উমর

    October 29, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    • Sign Up
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }