Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে বাঙলাদেশের কৃষক – বদরুদ্দীন উমর

    October 29, 2025

    পূর্ব বাঙলার ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি ২ – বদরুদ্দীন উমর

    October 29, 2025

    বাঙলাদেশে কমিউনিস্ট আন্দোলনের সমস্যা – বদরুদ্দীন উমর

    October 29, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    ট্রেজার – ক্লাইভ কাসলার

    ক্লাইভ কাসলার এক পাতা গল্প596 Mins Read0
    ⤶ ⤷

    ২০. আর্কিওলজিস্টরা নির্দেশ আর পরামর্শ দিল

    ২০.

    আর্কিওলজিস্টরা নির্দেশ আর পরামর্শ দিল, আইসব্রেকার পোলার এক্সপ্লোরারের ক্রুরা অত্যন্ত সতর্কতার সাথে বরফ ভেঙে খাঁড়ির তলায় পড়ে থাকা প্রাচীন জাহাজ সেরাপিসের টপ ডেক পর্যন্ত পৌঁছল। ধীরে ধীরে বরফ-মুক্ত হলো স্টার্নপোস্ট থেকে বো পর্যন্ত সবটুকু।

    খাড়ির সবাই দেখার জন্য ভিড় করেছে এক জায়গায়, কৌতূহল আর বিস্ময়ে প্রত্যেকে সম্মোহিত। শুধু পিট আর লিলিকে কোথাও দেখা গেল না।

    মোম ট্যাবলেট পরীক্ষার জন্য পোলার এক্সপ্লোরার-এ রয়ে গেছে ওরা।

    প্রাচীন জাহাজটাকে সম্পূর্ণ বরফ-মুক্ত করার পর কার্গো হ্যাঁচ খুলে নিচে নামল অ্যাল জিওর্দিনো, মাইক গ্রাহাম আর জোসেফ হসকিন্স। বরফের আবরণসহ মূর্তিগুলো ওদের দিকে তাকিয়ে আছে, মনে হলো গায়ে হাত দিয়ে নাড়া দিয়ে এক্ষুনি সবাই জ্যান্ত হয়ে উঠবে। বো-র দিকে, এক কোণে, আরও দুটো মূর্তি রয়েছে, পিটের চোখে এড়িয়ে গেছে ওগুলো। দুটোর মধ্যে একটা কুকুর, অপরটি ছোট্ট এক মেয়ে।

    .

    পোলার এক্সপ্লোরার-এর ডেকে একটা নুমা হেলিকপ্টার নামল। সবুজ সোয়েটার পরা দীর্ঘদেহী এক লোক নেমে এলেন প্যাসেঞ্জার কেবিন থেকে। চারদিকে তাকিয়ে পিটের ওপর স্থির হলো ভদ্রলোকের দৃষ্টি, পিট হাত নাড়তে মৃদু হাসলেন তিনি। এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করল পিট, ড. রেডফান?

    আপনি ডার্ক পিট?

    মাথা ঝাঁকিয়ে পিট বলল, ব্যস্ততার মধ্যেও সময় সরে আসতে পেরেছেন, সেজন্য ধন্যবাদ, ড. রেডফার্ন।

    ঠাট্টা করছেন। আপনার আমন্ত্রণ পেয়ে ক্যাঙ্গারুর মতো লাফিয়ে উঠেছিলাম, তা জানেন? আপনি যা আবিষ্কার করেছেন, তার সাথে জড়াবার জন্য যেকোনো আর্কিওলজিস্ট তার একটা চোখ হারাতেও পিছপা হবে না। আমার তর সইছে না, কখন দেখাবেন?

    দশ মিনিটের মধ্যে অন্ধকার হয়ে যাবে। আপনি বরং কাল সকালে দেখতে চাইলে ভালো হয়। তার আগে ড. গ্রোনকুইস্ট ব্রিফ করবেন আপনাকে। মেইন ডেক থেকে যেগুলো উদ্ধার করা হয়েছে, সেসব আজই দেখানো যেতে পারে।

    ড. মেল রেডফার্ন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন মেরিন আর্কিওলজিস্ট, পিটের আমন্ত্রণ পেয়ে এথেন্স থেকে রিকিয়াভিক-এ চলে আসেন প্লেনে চড়ে, সেখান থেকে আল জিওর্দিনো তাকে হেলিকপ্টারে তুলে নেয়। হ্যাঁচ গলে পোলার এপ্লারারের পেটে নেমে এল ওরা। খোলের ভেতর কী কী পেয়েছেন, বলবেন, মি. পিট?

    ক্রুদের দেহ ছাড়া কার্গো হোল্ডে আর কিছু পাইনি।

    কিন্তু মেসেজে আপনি জানিয়েছেন, জাহাজটা প্রায় অক্ষত অবস্থায় পাওয়া গেছে।

    হ্যাঁ, তা সত্যি। কিছু কিছু মেরামতের কাজ শেষ করতে পারলে, বৈঠা ঠেলে ওটাকে নিউ ইয়র্ক বন্দরে নিয়ে যেতে পারবেন।

    ড. গ্রোনকুইস্ট কি ওটার সময়কাল নির্ধারণ করতে পেরেছেন?

    মুদ্রাগুলো তিনশো নব্বই খ্রিস্টাব্দের। এমনকি জাহাজটার নামও জানি আমরা। সেরাপিস, স্টার্নপোস্টে গ্রিক ভাষায় খোদাই করা আছে।

    সম্পূর্ণ সংরক্ষিত চতুর্থ শতাব্দীর বাইজেন্টাইন বাণিজ্য জাহাজ, বিড়বিড় করে বললেন ড. রেডফার্ন। যুগান্তকারী আবিষ্কার। হ্যাঁ, ছুঁয়ে দেখার জন্য হাত দুটো নিশপিশ করছে আমার।

    অফিসার্স ওয়ার্ডরুমে চলে এল ওরা। টেবিলে বসে মোম ট্যাবলেটে পাওয়া অক্ষরগুলো একটা কাগজে কপি করছে লিলি শার্প। ওদের পরিচয় করিয়ে দিল পিট। চেয়ার ছেড়ে দাঁড়াল লিলি, হাতটা বাড়িয়ে দিল ড. রেডফানের দিকে। বলল, আপনার সাথে পরিচিত হয়ে সম্মানিত বোধ করছি, ড. রেডফার্ন। আমি মাটিতে কাজ করলেও, পানির নিচে আপনার কৃতিত্ব সম্পর্কে সব খবরই আমার জানা আছে, আমি আসলে আপনার একজন ভক্ত।

    সম্মানটুকু আমার, বললেন ডক্টর।

    ডক্টর, কী খেতে ইচ্ছে করেন? পিট জানতে চায়।

    এক গ্যালন গরম চকোলেট আর পাঁচ কেজি স্যুপ হলেই চলবে।

    হেসে ফেলে স্টুয়ার্ডকে ডাকল লিলি।

    আমরা একটা ধাঁধায় পড়েছি, ড. রেডফার্নকে বলল পিট। আপনার ল্যাটিন কেমন?

    চালিয়ে নিই। কিন্তু আপনি বললেন, জাহাজটা গ্রিক।

    গ্রিকই, পিটের বদলে জবাব দিল লিলি। তবে ক্যাপটেন মোম ট্যাবলেটে তাঁর লগ লিখেছেন ল্যাটিনে। ছয়টা ট্যাবলেটে অক্ষর পেয়েছি। সাত নম্বরটায় একটা ম্যাপ। জাহাজের ভেতর প্রথমবার ঢুকে এগুলো উদ্ধার করেছে পিট। অক্ষরগুলো কাগজে টুকেছি আমি।

    একটা চেয়ারে বসে একটা মোম ট্যাবলেট তুলে নিলেন ড. রেডফার্ন। নেড়েচেড়ে দেখে রেখে দিলেন। তারপর চোখ বুলালেন লিলির লেখা কাগজটায়।

    গরম চকোলেট আর অ্যাপ দিয়ে গেল স্টুয়ার্ড। অনুবাদ করায় এতই ব্যস্ত হয়ে উঠলেন ড. রেডফার্ন, যে তার আর খিদে থাকল না। যন্ত্রচালিত রোবটের মতো কাপটা মুখে তুললেন, চোখ স্থির হয়ে আছে হাতে লেখা কাগজটার ওপর। দশ মিনিট পর নিঃশব্দে চেয়ার ছাড়লেন তিনি, পায়চারি শুরু করলেন, বিড়বিড় করে ল্যাটিন শব্দ আওড়াচ্ছেন, বিস্মৃত দর্শকদের উপস্থিতি সম্পর্কে কোনো ধারণাই যেন নেই।

    চুপচাপ বসে থাকল পিট আর লিলি। এক চুল নড়ল না কেউ, শুধু চোখ দুটো অনুসরণ করল ড. রেডফার্নকে। টেবিলে ফিরে এসে কাঁপা হাতে কাগজগুলো আবার পরীক্ষা করলেন ড. রেডফার্ন। প্রত্যাশায় আর উত্তেজনায় টান টান হয়ে উঠল পরিবেশ। আরও প্রায় পাঁচ মিনিট পর কাগজগুলো টেবিলে রেখে ধীরে ধীরে দেয়ালের দিকে তাকালেন ড. রেডফার্ন, তার চোখে আচ্ছন্ন দৃষ্টি।

    কী ব্যাপার, ড. রেডফার্নং জিজ্ঞেস করল পিট।

    কী? রুদ্ধশ্বাসে জিজ্ঞেস করল লিলি। কী পেয়েছেন আপনি?

    ড. রেডফার্নের গলা কোনো রকমে শুনতে পেল ওরা। মাথা নিচু করলেন তিনি, ফিসফিস করে বললেন, সম্ভব। হ্যাঁ, সম্ভব। আপনারা সম্ভবত দুনিয়ার শ্রেষ্ঠ সাহিত্য আর শিল্পকর্মের সংগ্রহ আবিষ্কার করেছেন।

    .

    ২১.

    আরেকটু খুলে বলবেন, প্লিজ? শুকনো গলায় তাগাদা দিল পিট।

    বারকয়েক ঘন ঘন নেড়ে মাথাটা পরিষ্কার করার চেষ্টা করলেন ড. রেডফার্ন। গল্পটা…গল্প না বলে রূপকথা বললেই যেন বেশি মানায়। গোটা ব্যাপারটা এমনই অবিশ্বাস্য আর অদ্ভুত অথচ বাস্তব সত্য যে আমার ঠিক হজম হচ্ছে না।

    লিলি জানতে চাইল, ট্যাবলেটগুলো কী বলছে, গ্রিক-রোমান একটা জাহাজ বাড়ির পানি ছেড়ে এত দূর কেন চলে এল?

    গ্রিক-রোমান নয়, বাইজেন্টাইন, রেডফার্ন সংশোধন করলেন। সেরাপিস যখন নোঙর তুলে রওনা হয়, তার আগেই সাম্রাজ্যের সিংহাসন কনস্ট্যানটাইন দ্য গ্রেটের দ্বারা রোম থেকে বসফরাসে স্থানান্তর করা হয়ে গেছে-বসফরাস, এক সময় যেখানে বাইজেন্টিয়াম শহর দাঁড়িয়ে ছিল।

    পরে যেটা কনস্টানটিনোপল হয়, বলল পিট।

    তারপর ইস্তাম্বুল, লিলির দিকে ফিরে বললেন ড. রেডফার্ন। সরাসরি উত্তর দিচ্ছি না বলে দুঃখিত। তবে হ্যাঁ, ট্যাবলেটগুলো বলছে বটে কেন ও কীভাবে জাহাজটা এদিকে আসে। পুরোটা কাহিনী ব্যাখ্যা করতে হলে আগে আমাদের মঞ্চটা সাজাতে হবে, সেই মঞ্চে যে নাটকটা আমরা দেখব তার সূচনাকাল খ্রিস্টপূর্ব তিনশো তেইশ সাল, যে বছর আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট ব্যাবিলনে মারা গেলেন। তার সাম্রাজ্য নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি করে নিলেন জেনারেলরা। তাদের একজন, টলেমি, সাম্রাজ্য থেকে। কেটে নিলেন মিসরকে হলেন রাজা। তিনি আলেকজান্ডারের লাশও দখল করতে সমর্থ হলেন, সোনা আর স্কটিক দিয়ে তৈরি কফিনে মুড়ে রাখলেন সেটা। পরে লাশটা তিনি একটা মন্দির তৈরি করে সমাধিস্থ করলেন, মন্দিরের চারদিকে গড়ে তুললেন আশ্চর্য সুন্দর একটা শহর, যে সৌন্দর্য এথেন্সকেও হার মানিয়ে দিল। টলেমি শহরটা নাম রাখলেন আলেকজান্দ্রিয়া।

    কিন্তু এসবের সাথে সেরাপিসের কী সম্পর্ক? অবাক হয়ে জানতে চাইল লিলি।

    প্লিজ, আমাকে শেষ করতে দিন, আবেদনের সুরে বললেন ড. রেডফার্ন। ছিটেফোঁটা সংগ্রহ থেকে বিশাল একটা মিউজিয়াম আর লাইব্রেরি গড়ে তুললেন টলেমি। সংগ্রহের সংখ্যা বাড়তে বাড়তে পাহাড়ের মতো উঁচু হয়ে উঠল। তার উত্তরসূরিরা, ক্লিওপেট্রাসহ বাকি সবাই, এই মিউজিয়াম আর লাইব্রেরিতে নিজেদের সংগ্রহ জমা করেছেন। মিউজিয়ামটা হয়ে উঠল সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ সংগ্রহশালা। শুধু শিল্পকর্ম নয়, তৎকালীন ও অতীত যুগের বিজ্ঞান, দর্শন, সাহিত্য, কারিগরি বিদ্যা ইত্যাদির সমস্ত নিদর্শন এই লাইব্রেরি ও মিউজিয়ামে ঠাই পেল। জ্ঞানের এই বিশাল ভাণ্ডার কিন্তু মাত্র তিনশো একানব্বই খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত টিকল।

    সে বছর, সম্রাট থিয়োডাসিয়াস ও আলেকজান্দ্রিয়ার গির্জাপতি থিয়োডোসিয়াস সিদ্ধান্ত নিলেন, সদ্য প্রবর্তিত খ্রিস্টান নীতি ও আদর্শের সাথে মেলে না এমন সমস্ত শিল্পকর্ম সাহিত্য পৌত্তলিকতা দোষে দুষ্ট বলে মনে করতে হবে এবং তা অবশ্যই ধ্বংস করে ফেলতে হবে। লাইব্রেরি ও মিউজিয়ামে ছিল পাথর ও ধাতব মূর্তি, মার্বেল ও ব্রোঞ্জের তৈরি শিল্পকর্ম, সোনা আর আইভরির তৈরি খেলনা, অবিশ্বাস্য নৈপুণ্যের সাথে তৈরি পেইন্টিং, ভেড়ার চামড়া বা প্যাপিরাস কাগজে লেখা অসংখ্য বই, বহু জ্ঞানী গুণীর সংরক্ষিত লাশ, এমনকি সম্রাট আলেকজান্ডারের লাশও ছিল-ঠিক হলো, সব ধ্বংস করে ফেলা হবে। হয় ভেঙেচুরে ধুলোর সাথে মিলিয়ে ফেলা হবে নয়তো পুড়িয়ে ছাই করা হবে।

    ঠিক কী ধরনের হবে সংখ্যায়?

    শুধু বই ছিল কয়েক লাখ।

    হতাশায় মাথা নাড়ল লিলি। কী ভয়ানক ক্ষতি!

    শুধু বাইবেল আর চার্চের যাবতীয় লেখা বাদ দিয়ে, বলে চললেন ড. রেডফার্ন, লাইব্রেরি আর মিউজিয়ামের বাকি সব সংগ্রহ পুড়িয়ে ফেলার নির্দেশ দেয়া হয়।

    কয়েকশো বছর ধরে সংগ্রহ করা অসংখ্য মূল্যবান মাস্টারপিস হারিয়ে গেল!

    হারিয়ে গেল, সায় দিলেন ড. রেডফার্ন। এতকাল পর্যন্ত ঐতিহাসিকরা সেই বিশ্বাসই পোষণ করে এসেছেন। কিন্তু এই মুহূর্তে যা পড়লাম তা যদি সত্যি হয়, সংগ্রহের সার অংশটুকু হারিয়ে যায়নি। সেসব কোথাও লুকানো আছে।

    লিলি হতভম্ব।

    আজও সেগুলোর অস্তিত্ব আছে? তার মানে কি পুড়িয়ে ফেলার আগে সেরাপিসে তুলে পাচার করা হয়েছিল?

    মোম ট্যাবলেটে সে-কথাই লেখা আছে।

    সন্দেহ প্রকাশ করল পিট, সেরাপিস ছোট্ট জাহাজ, সংগ্রহের কতটুকুই বা আনতে পারে। আপনি যে বিপুল সংখ্যার কথা বলছেন…।

    প্রাচীন জাহাজ সম্পর্কে আপনার দেখছি ভালোই ধারণা আছে, পিটের দিকে সমীহের দৃষ্টিতে তাকালেন ড. রেডফার্ন।

    আচ্ছা, তার আগে জানা যাক, গ্রিনল্যান্ডে কী করতে এল সেরাপিস।

    লিলির কপি করা একটা কাগজ তুলে নিলেন ড. রেডফার্ন। চতুর্থ শতাব্দীর ল্যাটিন, আক্ষরিক অনুবাদ করতে গেলে আপনাদের বিরক্তি বাড়ানো হবে, বড় বেশি আড়ষ্ট আর আনুষ্ঠানিক। সহজ ইংরেজিতে ভাষান্তর করার চেষ্টা করছি। প্রথম এন্ট্রি জুলিয়ান ক্যালেন্ডার অনুসারে তেসরা এপ্রিল, তিনশো একানব্বই খ্রিস্টাব্দ।

    আমি, কুকিয়াস রাফিনাস, সেরাপিসের ক্যাপটেন, গ্রিক জাহাজ ব্যবসায়ী নিসিয়াস এর কর্মচারী, আলেকজান্দ্রিয়ার জুলিয়াস ভেনাটরের কার্গো পরিবহনে সম্মত হয়েছি। আলোচ্য সমুদ্র অভিযানটি দীর্ঘ এবং বিপদসংকুল হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে এবং ভেনাটর আমাদের গন্তব্য সম্পর্কে মুখ খুলতে রাজি নয়। আমার মেয়ে, হাইপেশিয়া, এই অভিযানে আমার সঙ্গিনী হচ্ছে, তার মা দীর্ঘ বিচ্ছেদের কারণে অত্যন্ত, উদ্বেগের মধ্যে থাকবে। তবে ভেনাটর স্বাভাবিক ভাড়ার চেয়ে বিশ গুণ বেশি দিচ্ছে, ফলে নিসিয়াস লাভবান হবার সাথে সাথে আমি এবং আমার ক্রুরাও লাভবান হব।

    জাহাজে কার্গো তোলা হলো রাতের অন্ধকারে, লোকচক্ষুর অন্তরালে। কার্গো তোলার সময় ক্রুসহ আমাকে ডকে থাকার নির্দেশ দেয়া হলো। সেঞ্চুরিয়ান ডোমিটিয়াস সেভেরাসের অধীনে চারজন সৈনিককে জাহাজে পাঠানো হলো, তারাও আমাদের সাথে অভিযানে শামিল হলো।

    গোটা ব্যাপারটা আমার একদম পছন্দ হলো না, কিন্তু ভেনাটর ভাড়ার টাকা অগ্রিম দিয়ে ফেলায় চুক্তি বাতিল করা আমার দ্বারা সম্ভব হলো না।

    বুদ্ধিমান ও সৎ লোক, বলল পিট। কার্গোটা কী, বুঝতে পারেনি কেন?

    সে প্রসঙ্গে পরে লিখেছে সে। পরের কয়েক লাইন অভিযানের লগ। প্রথম বন্দরের থামার পর থেকে পড়ছি আমি।

    আমাদের ঈশ্বর সেরাপিসকে ধন্যবাদ। একটানা চৌদ্দ দিন নিরাপদে জাহাজ চালিয়ে কারথাগো নোভায় পৌঁছেছি আমরা, সেখানে আমরা পাঁচ দিন যাত্রাবিরতি করি এবং স্বাভাবিক সময় যে পরিমাণ সাপ্লাই তুলি তার চেয়ে পাঁচগুণ বেশি তুলেছি জাহাজে। এখানে আমরা ভেনাটরের আর সব জাহাজের সাথে যোগ দিই। সেগুলো বেশিরভাগ এক একটা দুশো টনি, কোনো কোনোটার বহন ক্ষমতা তিনশো টনের ওপর। ভেনাটরের ফ্ল্যাগশিপসহ সংখ্যায় আমরা ষোলোটা জাহাজ হলাম। ঝাঁকের মধ্যে আমাদের সেরাপিস সবচেয়ে ছোট।

    এক ঝাক জাহাজ! চেঁটিয়ে উঠল লিলি, চোখ দুটো জ্বলজ্বল করছে তার। তার মানে সংগ্রহগুলো সত্যিই রক্ষা পেয়েছে!

    সবটুকু না হলেও, সহাস্যে বললেন ড. রেডফার্ন, একেবারে কমও নয়। ধরুন, দুটো জাহাজে রসদ আর লোকজন ছিল। বাকি চৌদ্দটা জাহাজ মানে দুহাজার আটশো টন, লাইব্রেরির এক-তৃতীয়াংশ বই আর মিউজিয়ামের বেশ বড় একটা অংশে ঠাই হবার জন্য যথেষ্ট।

    গ্যালি কাউন্টার থেকে কফি নিয়ে এল পিট। লিলির সামনে একটা কাপ রেখে ডোনাট খেতে খেতে আনমনে শুনতে লাগল।

    কফির কাপে চুমুক দিয়ে ড. রেডফার্ন বললেন, লগের শেষ দিকে কার্গো সম্পর্কে বর্ণনা দিয়েছে রাফিনাস ছোটখাটো মেরামতের কথা লিখেছে, লিখেছে ডক এলাকার গুজব সম্পর্কে, কারথাগো নোভার বর্ণনা দিয়েছে, এখন যেটা স্পেনে, কার্টানো নামে পরিচিত। কিন্তু আশ্চর্য, বন্দর ত্যাগ করার তারিখ সম্পর্কে কিছু লেখেনি সে। আসলে সবার চোখ এড়িয়ে, গোপনে এসব লিখতে হয়েছে তাকে। কী লিখেছে পড়ছি।

    আজ আমরা মহাসাগরের দিকে জাহাজ ছাড়লাম। দ্রুতগতি জাহাজগুলো বাকিগুলোকে টেনে নিয়ে চলল। আর লিখতে পারছি না। সৈনিকরা আমার ওপর নজর রাখছে। ভেনাটরেরর কঠোর নির্দেশ, অভিযানের কোনো রেকর্ড রাখা যাবে না।

    নিশ্চয়ই আরও কিছু আছে, জেদের সুরে বলল লিলি। আমি জানি, এর পরও কপি করেছি আমি।

    লিখেছে, হ্যাঁ, তবে নয় মাস পর, আরেকটা কাগজ তুলে নিয়ে বললেন ড. রেডফার্ন।

    ভীতিকর অভিযান সম্পর্কে এখন আমি স্বাধীনভাবে, নির্ভয়ে লিখতে পারি। ভেনাটর আর তার ক্রীতদাস বাহিনী, সেভেরাস আর তার সৈনিকদল, সবগুলো জাহাজের সব কয়জন ক্রু, অসভ্যদের হাতে মারা পড়েছে, আগুন লাগিয়ে পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে জাহাজগুলো। সেরাপিস বিপদ এড়িয়ে পালিয়ে আসতে পেরেছে, কারণ ভেনাটর সম্পর্কে আমার সন্দেহ আমাকে সতর্ক থাকতে সাহায্য করেছিল।

    জাহাজগুলোর কার্গো কী জিনিস, কোথা থেকে আনা হয়, পাহাড়ের কোথায় লুকিয়ে রাখা হয়েছে, এখন আমি সব জানি। এ ধরনের গোপন ব্যাপার মরণশীল মানুষের কাছে গোপন রাখাই শ্রেয় বলে ভেবেছিল ভেনাটর। দেশে ফেরার পথে বিশ্বস্ত কয়েকজন সৈনিক ও একটা জাহাজের কয়েকজন কুকে বাদ দিয়ে ভেনাটর আর সেভেরাস বাকি সবাইকে খুন করবে বলে সন্দেহ করেছিলাম আমি।

    আমি আমার মেয়ের নিরাপত্তার কথা ভেবে চিন্তিত হয়ে উঠি। আমার ক্রুদের সশস্ত্র থাকার নির্দেশ দিই, বলি তারা যেন প্রতিটি মুহূর্তে জাহাজের কাছাকাছি থাকে, যাতে বেঈমানির আভাস পাওয়া মাত্র নোঙর তুলতে পারি। কিন্তু ভেনাটর বেঈমানি করার আগেই অসভ্যরা হামলা করে বসল, কচুকাটা করল ভেনাটরের ক্রীতদাস আর সেভেরাসের সৈনিকদের। আমাদের প্রহরীরাও মারা পড়ল যুদ্ধে, তবে বিপদ ঘটার আগেই দড়িদড়া ছিঁড়ে গভীর পানিতে সেরাপিসকে নিয়ে বেরিয়ে আসতে পারলাম আমরা। ছুটে এসে পানিতে লাফিয়ে পড়ে নিজেকে রক্ষা করার চেষ্টা করল ভেনাটর। উদ্ধার পাবার জন্য তার ব্যাকুলতা আমরা লক্ষ করলাম। কিন্তু আমার মেয়ে ও ক্রুদের প্রাণের ওপর ঝুঁকি নেয়া আমার পক্ষে সম্ভব ছিল না। জাহাজ ঘুরিয়ে তাকে উদ্ধার করার কোনো চেষ্টাই আমরা করলাম না। স্রোতের বিরুদ্ধে কাজটা করতে গেলে সবাইকে নিয়ে আত্মহত্যা করা হতো।

    এই পর্যায়ে এসে একটু বিরতি দিলেন ডক্টর রেডফার্ন। এখানে এসে রাফিনাস আচমকা পেছনের ঘটনা বর্ণনা শুরু করেছে, সেই কার্টাজেনা বন্দর থেকে।

    এর পেছন থেকে আমাদের গন্তব্য সেই অদ্ভুত জগতে পৌঁছতে আটান্ন দিন লাগল। পিঠে বাতাসের ধাক্কাসহ আবহাওয়া ছিল অনুকূল। আমাদের ভাগ্যকে এই সহায়তাদানের বিনিময়ে দেবতা সেরাপিস উৎসর্গ দাবি করলেন। অচেনা রোগে মারা গেল আমাদের দু’জন ক্রু।

    নির্ঘাত স্কার্ভি, বলল লিলি।

    স্পেনীয়দের দীর্ঘ যাত্রার আগে স্কার্ভির প্রাদুর্ভাব দেখা যায়নি। অন্য যেকোনো রোগ হওয়া বিচিত্র না, জানাল পিট।

    বাধা দেওয়ার জন্য দুঃখিত। প্লিজ, পড়ে যান, লিলি ক্ষমা প্রার্থনা করে।

    প্রথমে আমরা বড় একটা দ্বীপে পা ফেললাম, সেখানকার অসভ্যরা সেদিয়ানদের মতো দেখতে, তবে গায়ের রং আরও অনেক কালো। তারা আমাদের সাথে বন্ধুর মতো ব্যবহার করল, সাহায্য করল জাহাজ মেরামতের কাজে, রসদ সংগ্রহেও সহযোগিতা কর।

    আরও দ্বীপ দেখলাম আমরা। তবে ফ্ল্যাগশিপ থামল না। একমাত্র ভেনাটর জানে জাহাজগুলো কোথায় যাচ্ছে। অবশেষে আমরা নমানবশূন্য একটা সৈকত দেখতে পেলাম, জাহাজ নিয়ে পৌঁছলাম একটা নদীর চওড়া মুখে। আমাদের অনুকূলে বাতাস বইবে, এই অপেক্ষায় পাঁচ দিন পাঁচ রাত অপেক্ষা করলাম আমরা। তারপর পাল তুলে নদী বরাবর এগোলাম, মাঝেমধ্যে বৈঠা চালালাম, যতক্ষণ না পৌঁছলাম রোমের পাহাড়ে।

    রোমের পাহাড়! অন্যমনস্কভাবে বিড়বিড় করল লিলি। ধাঁধা মনে হচ্ছে।

    আসলে বোধ হয় রোমের পাহাড়ের সাথে তুলনা করেছে রাফিনাস, ধারণা করল পিট।

    কঠিন ধাঁধা, স্বীকার করলেন ড. রেডফার্ন।

    ওভারশিয়ার ল্যাটিনিয়াস মাসেরের অধীনস্থ ক্রীতদাসরা নদীর ওপর পাহাড়ে সুড়ঙ্গ তৈরি করল। আটমাস পর জাহাজগুলো থেকে লুকানোর জায়গায় বয়ে নিয়ে যাওয়া হলো কার্গো।

    লুকানোর জায়গার বর্ণনা দিয়েছে? জিজ্ঞেস করল পিট।

    একটা কপি তুলে নিয়ে মোম ট্যাবলেটের লেখার সাথে মেলালেন ড. রেডফার্ন। একজোড়া শব্দ অস্পষ্ট। আন্দাজ করে নিয়ে পড়তে হবে।

    এভাবে গোপন জিনিসের গোপনীয়তা ক্রীতদাসদের তৈরি করা সুড়ঙ্গের ভেতর সুরক্ষিত করা হলো। বেড়া থাকায় জায়গাটা দেখতে পাওয়া যায় না। কার্গোর প্রতিটি জিনিস পাহাড়ের ভেতর ঢোকানোর পর অসভ্য হামলাকারীরা ঝাঁপিয়ে পড়ল। সময়মতো সুড়ঙ্গমুখ বন্ধ করা সম্ভব হয়েছিল কি না আমি বলতে পারব না। সৈকত থেকে ঠেলে আমার জাহাজটাকে পানিতে নামানোর কাজে ব্যস্ত ছিলাম আমরা।

    দূরত্ব জানাতে ব্যর্থ হয়েছে রাফিনাস, বলল পিট। দিকনির্দেশও দেয়নি। কে জানে অসভ্যরা পাহাড় খুঁড়ে সংগ্রহগুলো নষ্ট করেছে কি না।

    এত হতাশ হয়ো না তো! ধমকের সুরে বলল লিলি। ভেনাটর নিশ্চয়ই সুড়ঙ্গমুখ বন্ধ করেছিলেন। এই বিপুল সংগ্রহ এমনভাবে হারিয়ে যেতে পারে না যেন সেগুলোর কোনো অস্তিত্বই ছিল না। অন্তত কিছু কিছু নিশ্চয়ই উদ্ধার করা যাবে।

    জায়গাটা কোথায়, নির্ভর করছে তার ওপর, বলল পিট। সেরাপিস টাইপের জাহাজ, আটান্ন দিনে চার হাজার নটিক্যাল মাইল পাড়ি দিতে পারে।

    যদি সোজা একটা রেখা ধরে এগোয়, বললেন ড. রেডফার্ন। কিন্তু রাফিনাস জানায়নি তারা তীর ঘেঁষে গিয়েছিল কি না। শুধু লিখেছে আটান্ন দিন পর প্রথ একটা দ্বীপে পা ফেলে। তবে আমার ধারণা, সম্ভাব্য একটা জায়গা হতে পারে পশ্চিম আফ্রিকার দক্ষিণ উপকূল। ফিফথ সেঞ্চুরি বি. সি-তে একদল ফিনিশিয়ান ক্রু ঘড়ির কাটা ঘোরার আদলে আফ্রিকাকে চক্কর দিয়ে এসেছিল। রাফিনাসের সময়ে এলাকাটার বেশির ভাগই চার্ট করা হয়ে গেছে। স্ট্রেইটস অভ জিব্রালটার পেরোবার পর ভেনাটর তার জাহাজগুলোকে দক্ষিণ দিকে নিয়ে যায়, এটাই যেন যুক্তিসংগত বলে মনে হয়।

    কিন্তু রাফিনাস দ্বীপের কথা বলছে, মনে করিয়ে দিল পিট।

    মদেইরা হতে পারে, হতে পারে ক্যানারি বা কেপ ভার্দ দ্বীপপুঞ্জ।

    চিড়ে ভিজছে না, হেসে উঠে বলল পিট। আফ্রিকার ডগা থেকে অর্ধেক দুনিয়া। ঘুরে সেরাপিস গ্রিনল্যান্ডে চলে এল, এর কী ব্যাখ্যা দেবে? তুমি আট হাজার মাইল দূরত্বে কথা বলছ।

    মি. পিট ঠিক বলছেন, নিজের ভুল ধরতে পারলেন ড. রেডফার্ন।

    তাহলে উত্তরের পথ ধরেছিল ওরা, বলল লিলি। দ্বীপগুলো হতে পারে শেটল্যান্ড বা ফারো। তাই যদি হয়, যে পাহাড়টার কথা বলা হয়েছে সেটা নরওয়ের উপকূলে বা আইসল্যান্ডে কোথাও থাকতে পারে।

    আমি তোমাকে চ্যালেঞ্জ করছি না, বলল পিট। এ থেকে হয়তো ওদের গ্রিনল্যান্ডে আটকা পড়ার একটা ব্যাখ্যা বেরিয়ে আসবে।

    এরপর কী বলছে রাফিনাস, অসভ্যদের হাত থেকে বাঁচার পর কী ঘটল? চকোলেটের কাপে চুমুক দিলেন ড. রেডফার্ন। পড়ি।

    .

    খোলা সাগরে পৌঁছলাম আমরা। জাহাজ চালানো কঠিন হয়ে উঠল। নক্ষত্রগুলোকে অচেনা অবস্থানে দেখতে পেলাম আমরা। সূর্যও তার প্রকৃতি বদলেছে। দক্ষিণ দিকে ধেয়ে এল ভীষণ ঝড়। দশ দিনের দিন একজন কু পানির তোড়ে ভেসে গেল। আগের মতোই উত্তর দিকে চলেছি আমরা। একত্রিশ দিন পর আমাদের দেবতা পথ দেখিয়ে নিরাপদ একটা বে-তে নিয়ে এল আমাদের। এখানে আমরা মেরামতের কাজ সারলাম। তীর থেকে যতটুকু যা রসদ পাওয়া যায় ভোলা হলো। জাহাজে আমরা কিছু পাথর তুললাম, অতিরিক্ত ব্যালাস্ট হিসেবে। সৈকত থেকে খানিকটা সামনে খর্বকায় পাইনগাছের বন দেখলাম। লাঠির সামান্য খোঁচা দিতেই বালি থেকে মিষ্টি পানি বেরোল।

    ছদিন নির্বিঘ্ন জাহাজ চালাবার পর আবার একটা ঝড় আঘাত হানল। আমাদের পাল ছিঁড়ে গেল। ভেঙে গেল মাস্তুল। ভেসে গেল দাঁড়। নির্দয় বাতাসের ধাক্কায় অনেকগুলো দিন অসহায়ের মতো ভেসে চললাম আমরা। দিনের হিসাব হারিয়ে ফেললাম। ঘুমানো অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রচণ্ড শীত অনুভব করছি, এমন আবহাওয়ার কথা কেউ আমরা কখনও শুনিনি। ডেকের ওপর বরফ জমে যাচ্ছে। জাহাজ স্থির রাখা অসম্ভব হয়ে উঠেছে। ঠাণ্ডায় কাতর ও ক্লান্ত ক্রুদের নির্দেশ দিলাম, পানি আর মদের জারগুলো জাহাজ থেকে ফেলে দাও।

    এই জারগুলোই তুমি পেয়েছে সমুদ্রের তলে, রেডফার্ন পিটের উদ্দেশ্যে বললেন। সেই দীর্ঘ বে-তে ঢোকার কিছু সময় পর সৈকতে জাহাজ ভেড়াতে সমর্থ হলাম আমরা, তারপর দুদিন দুরাত মড়ার মতো ঘুমালাম।

    দেবতা সেরাপিস নিষ্ঠুর হলেন। শীত এসে গেল, বরফে আটকা পড়ল জাহাজ! সাহসে বুক বেঁধে গ্রীষ্মের জন্য অপেক্ষা করা ছাড়া আমাদের আর কোনো উপায় থাকল না। বে-র ওপারে অসভ্যদের গ্রাম, তারা আমাদের সাথে বিনিময় বাণিজ্যে রাজি হলো। আমরা খাবার সংগ্রহ করলাম। তারা আমাদের স্বর্ণমুদ্রা তুচ্ছ গহনা হিসেবে ব্যবহার করল, ওগুলোর আসল মূল্য সম্পর্কে কোনো ধারণা নেই। তাদের কাছ থেকে শিখলাম দৈত্যাকার কটা মাছের তেল পুড়িয়ে কীভাবে গরম থাকতে হয়। আমাদের সবার পেট ভরা, আশা করি এই বিপদ কাটিয়ে উঠতে পারব।

    সময় পেলেই প্রতিদিন কিছু কিছু লিখছি। আজ আমি স্মরণ করব সেরাপিসের হোল্ড থেকে ভেনাটর কী ধরনের কার্গো তার ক্রীতদাসদের দিয়ে বের করেছিল। গ্যালি থেকে লুকিয়ে সব আমি দেখেছিলাম। জিনিসটা ছিল প্রকাণ্ড, সেটাকে বের করার সাথে সাথে সবাই হাঁটু গেড়ে সম্মান প্রদর্শন করে।

    কী বোঝাতে চেয়েছে রাফিনাস? প্রশ্ন করল লিলি।

    ধৈর্য ধরুন, বললেন ড. রেডফার্ন। শুনুন।

    তিনশো বিশটা তামার টিউব, জিওলজিকাল চার্ট লিখে চিহ্নিত করা। তেষট্টিটা পর্দা। সোনা আর কাঁচ দিয়ে তৈরি কফিনের সাথে ছিল ওগুলো। কফিনটা আলেকজান্ডারের। আমার হাঁটু কাঁপতে লাগল। আমি তার মুখ দেখতে পেলাম…

    খতম, আর কিছু লেখেনি রাফিনাস, বিষণ্ণ কণ্ঠে বললেন ড. রেডফার্ন। এমনকি বাক্যটিও শেষ করেনি সে। শেষ মোম ট্যাবলেটে একটা নকশার সাহায্যে দেখানো হয়েছে তীর আর সৈকতের সাধারণ আকৃতি আর নদীর গতিবিধি।

    আলেকজান্ডার দি গ্রেটের নিখোঁজ কফিন, ফিসফিস করে বলল লিলি। তাহলে কি আজও তিনি কোনো এক পাহাড়ের ভেতর সুড়ঙ্গে শুয়ে আছেন?

    আলেকজান্দ্রিয়া লাইব্রেরির মাঝখানে? প্রশ্নটা যোগ করলেন ড. রেডফার্ন। আশা করতে দোষ কী!

    পিটের প্রতিক্রিয়া অন্য রকম হলো। চেহারায় দৃঢ় আত্মবিশ্বাস নিয়ে বলল, আশা জিনিসটা শুধু দর্শকদের জন্য। আমরা ধারণা, চেষ্টা করলে ত্রিশ দিনের মধ্যে লাইব্রেরিটা খুঁজে বের করা সম্ভব,..না, বিশ দিনের মধ্যেই পারা যাবে।

    ড. রেডফার্ন আর লিলির চোখ বিস্ফারিত হয়ে উঠল। পিট যেন রাজনৈতিক নেতা, নির্বাচনে দাঁড়িয়ে দ্রব্যমূল্য কমাবার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে। ওরা কেউ তার কথা বিশ্বাসই করল না।

    পিট বলল, অমন হা করে তাকিয়ে থেকো না এটাকে একটা কাজ হিসেবে দেখলে অসম্ভবের কিছু নেই। দেখি তো নকশাটা।

    মোম ট্যাবলেট দেখে নকশাটা বড় করে এঁকেছে লিলি, তার আঁকাটাই পিটের হাতে ধরিয়ে দিলেন ড. রেডফার্ন। তেমন কিছু নেই ওতে, আঁকাবাঁকা কয়েকটা রেখা ছাড়া। এ থেকে কোনো সাহায্য পাওয়া যাবে বলে মনে করি না, বললেন তিনি।

    নকশাটা দেখে মুখ তুলল পিট। এই-ই যথেষ্ট, দৃঢ় বিশ্বাসের সাথে বলল ও। এটাই আমাদের সদর দরজা পর্যন্ত পৌঁছে দেবে।

    .

    ভোর চারটের সময় পিটের ঘুম ভাঙানো হলো।

    ঘুমজড়িত চোখে পিট বুঝল, কেউ একজন আলো জ্বেলেছে ওর কক্ষের।

    দুঃখিত, বাছা, তোমাকে এখনই ঘুম ভেঙে ছুটতে হচ্ছে।

    হাসলেন কমান্ডার নাইট।

    কেন?

    ওপর থেকে নির্দেশ এসেছে। এই মুহূর্তে ওয়াশিংটনের উদ্দেশ্যে উড়তে হবে তোমাকে।

    কেন?

    কেন বলেনি, ওরা হলো গে পেন্টাগন, সিআইএ- কারো কাছে জবাবদিহি করতে বাধ্য নয়।

    উঠে বসে, খাটের পাশে পা ঝুলিয়ে বসল পিট। আমি আরো ভাবলাম, এখানে থেকে একটু জাহাজ উত্তোলনের ব্যাপারটা দেখব।

    ভাগ্য খারাপ- তুমি, অ্যাল আর ডক্টর শার্পকে এখনই চলে যেতে হচ্ছে।

    লিলি? উঠে দাঁড়িয়ে আড়মোড়া ভাঙে পিট। সোভিয়েত সাবমেরিনের কারণে আমাকে আর অ্যালকে দরকার, বুঝলাম। কিন্তু লিলিকে দিয়ে ওদের কী দরকার?

    এই বিষয়ে আমিও তোমার মতো অজ্ঞ।

    যাওয়ার কী ব্যবস্থা?

    রেডফার্ন যেমন করে এলেন। হেলিকপ্টারে করে এস্কিমো গ্রাম, আবহাওয়া স্টেশন। নেভি বিমানে করে আইসল্যান্ড, এরপর এয়ারফোর্সের বি ৫২ বোমারু বিমানে করে ওয়াশিংটন।

    টুথ ব্রাশ দিয়ে মাথায় টোকা দিল পিট। একটা বুদ্ধি এসেছে। ওদের জানান, অর্ধেক পথ নুমার হেলিকপ্টার দিয়ে পাড়ি দিয়ে থিউল এয়ারফোর্স বেজে দেখা করব আমরা। সরকারি জেট বিমান ছাড়া ওখান থেকে আমি যাব না।

    লাভ নেই, পিট।

    হতাশার ভঙ্গি করে হাত উঁচায় পিট। কেন যেন আমার প্রতিভার উপযুক্ত মর্যাদা পেলাম না কখনো!

    .

    ২২.

    সারাটা পথ শুধু আলেকজান্দ্রিয়া লাইব্রেরির কথা ভেবেছে পিট। ভেবেছে সেরাপিসের বরফে পরিণত ক্রুদের কথা। স্কিপার রাফিনাস, তার মেয়ে হাইপেশিয়া। অন্ধকার হোন্ডের অন্ধকার কোণে হাইপাতিয়া আর তার সঙ্গী কুকুরটাকে দেখতে পায়নি পিট, তবে ভিডিও ক্যামেরায় ঠিকই ধরা পড়েছিল। লম্বা চুলো এক কুকুরকে জড়িয়ে ধরে দাঁড়িয়ে আছে ছোট্ট এক মেয়ে।

    হাইপেশিয়াকে হয়তো শেষ পর্যন্ত একটা মিউজিয়ামে ঠাই পেতে হবে, যুগ যুগ ধরে কৌতূহলী মানুষ দেখতে তাকে। তারপর পিট নকশাটার কথা ভেবেছে। মোমের গায়ে আঁকা, আবহাওয়ার কারণে সেটা বিকৃত অবস্থায় পেয়ে থাকতে পারে ওরা। ড. রেডফার্ন আর লিলির সন্দেহই হয়তো ঠিক, আলেকজান্দ্রিয়া লাইব্রেরির সন্ধান কোনো দিন না-ও পাওয়া যেতে পারে। কিন্তু মনের বল আগের মতোই অটুট আছে ওর। চেষ্টা করে দেখবে ও। খুঁজে বের করার চেষ্টা করবে দুনিয়ার সর্বশ্রেষ্ঠ জ্ঞানের ভাণ্ডার। রীতিমতো একটা চ্যালেঞ্জ অনুভব করছে পিট। প্রতিদ্বন্দ্বী সময় আর প্রকৃতি।

    এন্ড্রু এয়ারফোর্স বেসে নামল প্লেন। ওদের জন্য একটা গাড়ি নিয়ে অপেক্ষা করছে একজন ড্রাইভার।

    প্ল্যানটা কী হে? ড্রাইভারের উদ্দেশ্যে জানতে চাইল পিট।

    অ্যাডমিরাল স্যানডেকারের ক্লাবে তার সাথে ডিনার।

    অ্যাডমিরালটা আবার কে? লিলি জানতে চায়।

    নুমায় আমাদের বস, জিওর্দিনো বলল। নির্ঘাত সাবাশি দেওয়ার জন্য ডাকছেন। যা কাজ দেখালাম এবার!

    জর্জটাউনের একটা আবাসিক এলাকায় যখন ঢুকল গাড়ি, ততক্ষণে অন্ধকার ঘনিয়েছে। পাঁচ ব্লক পেরিয়ে লাল ইটের ভিক্টোরিয়ান ধাঁচের একটা বাড়ির খোয়া বিছানো উঠানে থামল ড্রাইভার।

    সিল্ক স্যুট পরিহিত একজন ছোট্ট মানুষ এগিয়ে এলেন ওদের দিকে। রাজকীয় হাবভাব চলাফেরায়, মাথাভর্তি গাঢ় লাল চুল।

    বাছারা, তোমাদের দেখে ভালো লাগছে, গর্জে উঠে ঘোষণা করলেন অ্যাডমিরাল জেমস স্যানডেকার।

    লিলির সাথে তার পরিচয় করিয়ে দিল পিট।

    বসো, সবাই বসো, লিলির সাথে করমর্দন শেষ করে বললেন অ্যাডমিরাল।

    আপনারা কথা বলুন, আমি একটু লেডিস রুম থেকে তাজা হয়ে আসি।

    ডান দিকে প্রথম দরজাটা, হাত ইশরায় দেখিয়ে দিলেন অ্যাডমিরাল।

    লিলি অদৃশ্য হবার সাথে সাথে পিট আর জিওর্দিনোকে নিয়ে ছোট্ট রুমটায় বসে, দরজা আটকে দিলেন।

    তোমরা রাশিয়ার সাবমেরিনটা আবিষ্কার করে দারুণ কাজ দেখিয়েছে, সাধুবাদ জানাই। নেভির সেক্রেটারির সঙ্গে দেখা করতে কিছুক্ষণের মধ্যে রওনা হব আমি। প্রেসিডেন্ট নিজে তোমাদের ধন্যবাদ জানাতে বলেছেন।

    রাশান সাবমেরিনের উদ্ধারকাজ শুরু করব কবে থেকে?

    আমাদের কর্তৃপক্ষ চাইছেন ওটা নিয়ে তাড়াহুড়ো না করতে, অ্যাডমিরাল জানালেন।

    কতদিন অপেক্ষা করতে চাইছেন তারা?

    হয়তো, এক বছর। ওটা নয়, তোমাদের দু’জনের জন্য ভালো একটা কাজ পেয়েছি আমি।

    সোভিয়েত নেভির মারণাস্ত্র থেকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ কি হতে পারে? চিন্তাপূর্ণ স্বরে বলল পিট।

    এই ধরো একটা স্কি হলিডে! আগামীকাল সকালে একটা বাণিজ্যিক ফ্লাইটে ডেনভার রওনা হচ্ছে তোমরা, ড. শার্প থাকবে সাথে।

    পিটের দিকে চাইল জিওর্দিনো, কাঁধ ঝাঁকিয়ে পিট জানতে চাইল, পুরস্কার না নির্বাসন?

    ধরে নাও, ওয়ার্কিং হলিডে। বাকি ব্যাপারস্যাপার সিনেটর পিট বুঝিয়ে বলবেন।

    বাবা?

    এই সন্ধ্যায় তোমাকে বাড়িতে আশা করছেন উনি। পকেট থেকে সোনার ঘড়ি বের করে সময় দেখলেন অ্যাডমিরাল। একজন ভদ্রমহিলাকে অপেক্ষায় রাখা ঠিক হচ্ছে না।

    দরজার উদ্দেশ্যে রওনা হলেন জেমস স্যানডেকার। কিন্তু ঠায় দাঁড়িয়ে আছে পিট আর অ্যাল।

    কথা পেটে রেখে লাভ হবে না, অ্যাডমিরাল। পুরোটা না শুনে এক পাও নড়ছি না আমি, ঘোষণার সুরে বলল পিট। অ্যাল জিওর্দিনো সায় দেয়।

    আসল কথা হলো, পিট, জেমস স্যানডেকার ভ্রু উঁচালেন। রাশিয়ান সাবমেরিন নয়, তোমার আগ্রহ আলেকজান্দ্রিয়া লাইব্রেরি নিয়ে। নয় কি?

    আপনার ধারণা নির্ভুল, পিট বলে। আমি চেয়েছিলাম সেরাপিসের লগ বইয়ে চোখ বোলাতে। এখন দেখছি, কেউ আমাকে হারিয়ে দিয়েছে।

    কমান্ডার নাইট। ড. রেডফার্নের অনুবাদ নেভি হেডকোয়ার্টারে পাঠিয়েছেন তিনি, সেখান থেকে জানানো হয়েছে ন্যাশনাল সিকিউরিটি এজেন্সিকে। তারপর প্রেসিডেন্টকে। জাদুর বাক্স খুঁজে বের করেছো তুমি। আলেকজান্দ্রিয়া লাইব্রেরির রাজনৈতিক ভুমিকা কম নয়। তোমার বাবা, সিনেটর পিট, সব ব্যাখ্যা করবেন।

    এখানে লিলি এল কোথা থেকে?

    তোমাদের ছদ্মবেশের একটা অনুষঙ্গ হিসেবে। কেজিবি সন্দেহ করছে, হয়তো সাবমেরিনটা পাওয়া গেছে। মার্টিন ব্রোগান চাইছে, তোমাদের সাথে একজন সত্যিকারের প্রত্নতত্ত্ববিদ রেখে পুরো ব্যাপারটাকে আরো গ্রহণযোগ্য করতে। এজন্যই ক্লাবে দেখা করলাম তোমার সাথে। তোমার বাবা, বাসায় বসে বলবেন। তোমাদের আচরণে কোনো অফিশিয়াল ব্যাপার যেন না থাকে।

    বাড়াবাড়ি মনে হচ্ছে।

    ব্যুরোক্রেসি বেশ রহস্যময় উপায়ে কাজ করে। চলো, টেবিলে যাই। ক্ষিধেয় পেট ডাকছে।

    ডিনার শেষে জেফারসন হোটেলে তুলে দিল ওরা লিলিকে। বিদায় দেয়ার মুহূর্তে আলিঙ্গন করল সে ওদের দু’জনকে, তারপর পোর্টারের পিছু পিছু হোটেলের লবি ধরে এগালো।

    লিলির হোটেল থেকে বেরিয়ে নুমা হেডকোয়ার্টারে চলে এল পিট। কম্পিউটার সেকশনটা টপ ফ্লোরে, উঠে এসে এক কামরা থেকে আরেক কামরায় ঘুর ঘুর করতে লাগল। প্রতিটি কামরায় ইলেকট্রনিক ইকুইপমেন্ট আর কম্পিউটর হার্ডওয়্যার গিজগিজ করছে। পরিচিত অনেকের সাথে দেখা হলো, অন্যমনস্কতার ভান করে সবাইকে এড়িয়ে গেল পিট। তারপর যাকে খুঁজছে পেয়ে গেল তাকে।

    কি হে, জাদুকর, দিনকাল কেমন কাটছে?

    একটা মিনি টেপ রেকর্ডার নাড়াচাড়া করছিল হিরাম ইয়েজার। ঝট করে মুখ তুলেই হাসল সে। আরে পিট যে! তারপর অবাক হলো সে। তুমি ওয়াশিংটনে! তা কীভাবে সম্ভব!

    ক্যালিফোর্নিয়ার সিলিকন ভ্যালি নামে এক কম্পিউটর কারখানা থেকে হিরাম ইয়েজারকে ভাগিয়ে এনেছেন স্যানডেকার। আজ নুমার যে ডাটা কমপ্লেক্স গড়ে উঠেছে তা ইয়েজারের একক অবদান বললে বাড়িয়ে বলা হবে না। দুনিয়ার সমুদ্র নিয়ে যত গবেষণা বা বই লেখা হয়েছে, সেগুলোর সমস্ত তথ্য রয়েছে ইয়েজারের কাছে। বোম টিপে যেকোনো তথ্য মুহূর্তেই সরবরাহ করতে পারে সে।

    ওটা নিয়ে কী করছো? জিজ্ঞেস করল পিট।

    আছাড় মেরে ভেঙে ফেলব কি না ভাবছি, রাগের সাথে বলল ইয়েজার, ঠকাস করে টেবিলে রেখে দিল রেকর্ডারটা। ইচ্ছে করলে রান্নাঘরের জিনিসপত্র দিয়ে ওরকম একটা তৈরি করতে পারি, কিন্তু মেরামত করতে পারছি না।

    গোটা কমপ্লেক্স ভোমার হাতে গড়া, আর বলছ কী যে সামান্য একটা টেপ রেকর্ডার মেরামত করতে পারো না?

    কাজটায় আমার মন নেই, স্নান গলায় বলল ইয়েজার। যদি কখনও উৎসাহ পাই, ওটাকে আমি বদলে একটা টকিং ল্যাম্প বানাব।

    উৎসাহ পাবে এমন একটা কাজ করতে চাও? প্রসঙ্গটা তুলল পিট।

    পিটের দিকে একদৃষ্টে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থাকল ইয়েজার। কী ধরনের কাজ?

    রিসার্চ।

    টেবিলের দেরাজ খুলে কাগজপত্র হাতড়াতে শুরু করল ইয়েজার। একটা কাগজ তুলে নিয়ে বিড়বিড় করে কী পড়ল বোঝা গেল না। সেরাপিস সম্পর্কে, তাই না? মুখ তুলে প্রশ্ন করল সে।

    তুমি জানো?

    দুনিয়ার সমস্ত পত্রপত্রিকা ওটা নিয়ে লেখালেখি করছে।

    আমার হাতে এটা ড. রেডফার্নের অনুবাদ।

    কী করাতে চাও আমাকে দিয়ে?

    চাই নকশাটা সাথে নিয়ে ওই কাগজটাই ভালো করে দেখো।

    অনুবাদ আর নকশার ফটো কপি পাশাপাশি রেখে ঝুঁকে পড়ল ইয়েজার। তুমি জিওগ্রাফিকাল লোকেশন খুঁজছে?

    যদি সন্ধান দিতে পারো।

    এতে খুব একটা কিছু নেই, বলল ইয়েজার। কী এটা?

    একটা সাগরের তীররেখা আর একটা নদী।

    কবে আঁকা হয়েছে?

    তিনশো একানব্বই খ্রিস্টাব্দে।

    আমাকে বরং আটলান্টিকের রাস্তাগুলোর নাম কী জিজ্ঞেস করতে পারতে।

    কেন, তোমার ইলেকট্রনিক খেলনাগুলো দিয়ে জাহাজটার কোর্স বের করাতে পারো না, ভেনাটরের ফ্লিট কার্টাজেনা ত্যাগ করার পর? কিংবা জাহাজটা গ্রিনল্যান্ডে যেখানে অচল হয়ে পড়ল, সেই জায়গা থেকে পেছন দিকের কোর্সটা বের করতে পারো না?

    তুমি বুঝতে পারছ, নদীটার অস্তিত্ব আজ আর না-ও থাকতে পারে?

    ভেবেছি।

    অ্যাডমিরালের অনুমতি লাগবে আমার।

    কাল সকালে পেয়ে যাবে।

    ঠিক আছে, চেষ্টা করে দেখতে পারি। সময়সীমা?

    সাফল্য না আসা পর্যন্ত চেষ্টা করে যাও, বলল পিট। ওয়াশিংটনের বাইরে যেতে হচ্ছে আমাকে, কাল বাদে পরশু খবর নেব কেমন এগোচ্ছে তোমার কাজ।

    একটা প্রশ্ন করব?

    হ্যাঁ, করো।

    ব্যাপারটা কী গুরুত্বপূর্ণ?

    সম্ভবত আমি আর তুমি যা ভাবছি, তার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।

    .

    ২৩.

    ম্যাসাচুসেটসট এভিনিউয়ে খাকি একটা সোয়েটার পরিহিত সিনেটর জর্জ পিট তার মেরিল্যান্ডের বাড়ির দরজা খুললেন। দামি বেশভূষার জন্য ইতোমধ্যে সিনেটে বেশ নাম কিনেছেন তিনি।

    ডার্ক! ছেলেকে উষ্ণ আলিঙ্গন করলেন সিনেটর। কত কম আজকাল দেখা হয় আমাদের, ভেবে দেখেছো!

    বাপের কাঁধে হাত জড়িয়ে রাখল পিট। বাপ-পেটা মিলে এবারে হেঁটে গেল বাড়ির ভেতরে। মেঝে থেকে সিলিং পর্যন্ত উঁচু হয়ে আছে সিনেটরের বইয়ের সংগ্রহ- ভারী ওক কাঠের শেলফে।

    ছেলেকে চেয়ার এগিয়ে দিয়ে ছোট্ট বারের দিকে হেঁটে গেলেন সিনেটর।

    বোম্বে জিন-মার্টিনি-তাই না?

    জিন খাবার জন্য আবহাওয়াটা একটু বেশি ঠাণ্ডা; তার চেয়ে বরঞ্চ একটা কড়া জ্যাক ডেনিয়েলস দাও।

    ঠিক আছে।

    মা-র কী খবর?

    ক্যালিফোর্নিয়ায় গেছে, তোমার নানির ফার্মে। ওজন কমানোর জন্য হাঁটাহাঁটি করবে নাকি। নিশ্চিত জানি, কাল যখন ফিরবে, দেখব, দুই পাউন্ড ওজন বেড়েছে উল্টো!

    মা কখনো হাল ছাড়ে না।

    ছেলেকে বুরবন ধরিয়ে দিয়ে নিজের গ্লাস উঁচু করে ধরেন সিনেটর পিট। কলোরাভোয় সফল একটা সফরের কামনায়।

    ভ্রু কুঁচকে গেল পিটের। আমাকে কি করতে পাঠানোর চমৎকার পরিকল্পনাটা মূলত কার?

    আমার।

    জ্যাক ডেনিয়েলস থেকে এক চুমুক দিয়ে কঠোর চোখে বাপের দিকে তাকায় পিট। আলেকজান্দ্রিয়া লাইব্রেরির আর্টিফ্যাক্ট নিয়ে তোমার এত মাথাব্যথা কেন?

    দারুণ মাথা ব্যাথা, যদি সত্যিই ওগুলোর অস্তিত্ব থাকে।

    নাগরিক হিসেবে বলছো, নাকি কূটনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে?

    একজন দেশপ্রেমিকের দৃষ্টিকোণ থেকে।

    ঠিক আছে, দীর্ঘশ্বাস ফেলে পিট বলে, বলো তো, ধ্রুপদী শিল্পকর্ম, সাহিত্য-কর্ম, আলেকজান্ডারের কফিন দিয়ে আমেরিকার কী লাভ?

    ওগুলোর কোনোটাতেই লাভ নেই, সিনেটর জর্জ পিট বললেন, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, পৃথিবীর বিভিন্ন এলাকার খনিজ সম্পদের মানচিত্র। ফারাওদের হারিয়ে যাওয়া সোনার খনি, পান্নার খনি, যেটা ক্লিওপেট্রার বলে দাবি করা হয়। গোপন রহস্যে ভরা উপকথার সেই পাট নগরী-রুপো, সুর্মা আর অদ্ভুত সবুজাভ সোনার জন্য বিখ্যাত-দুই তিন হাজার বছর আগে নগরীর অবস্থান জানা থাকলেও আজ মানুষ তার ঠিকানা হারিয়ে ফেলেছে। তারপর ধরো, অফি-র রাজ্যের কথা। শুধু গুজব নয়, রাজ্যের বিপুল সম্পদ আর মহামূল্যবান দুর্লভ পাথর রেকর্ড করা ঐতিহাসিক সত্য সেটারও অবস্থান নিয়ে নানাজনের নানা মত। কোথায় গেল রাজা সলোমনের খনিগুলো? ব্যাবিলনের নেবুচাঁদনেজার? সাবা-র রানী, শেবার ঐশ্বর্য আর রাজ্য আজ শুধু অতীত স্মৃতি। এককালে এসবের অস্তিত্ব ছিল, মধ্যপ্রাচ্যের মাটির নিচে আজও সেসব নিশ্চয়ই কোথাও না কোথাও লুকানো আছে।

    বুঝলাম, মানচিত্রে খনিজ সম্পদের উল্লেখ আছে। পুরনো দিনের খনি বা সম্পদ যাই পাওয়া যাক, তাতে আমাদের সরকারের কি লাভ?

    দরাদরি করার জন্য দরকার আছে, বলে চলেন সিনেটর। যদি ওগুলোর হদিশ আমাদের হাতে থাকে, তো যৌথ উদ্ধার অভিযানের ব্যাপারে আলাপ করা যাবে। বিভিন্ন জাতীয় নেতার সাথে আলাপচারিতার সুযোগ মিলবে।

    মাথা নেড়ে যেন ধ্যানে মগ্ন হয় পিট। কংগ্রেস বিভিন্ন দেশের সাথে সুসম্পর্কের জন্য এতকিছু করছে। আমি ঠিক হজম করতে পারছি না। নিশ্চই অন্য কোনো ব্যাপার আছে।

    ছেলের অন্তদৃষ্টিতে মনে মনে গর্ব বোধ করলেন সিনেটর। অবশ্যই অন্য ব্যাপার আছে। স্ট্রাটিগ্রাফিক ট্র্যাপ কথাটা শুনেছ কখনও? জানো বিষয়টা কী নিয়ে?

    আমারই তো জানা উচিত, মুচকি হাসে পিট। কয়েক বছর আগে কুইবেক প্রদেশে, ল্যাব্রাডোর সাগরের নিচে আমি খুঁজে পেয়েছিলাম ও রকম একটা।

    হ্যাঁ। সম্ভবত ডুডলবার্গ প্রজেক্টে।

    আবিষ্কারের অপেক্ষায় ভয়ানক দুর্গম তেল খনি, তাকে বলা হয় স্ট্র্যাটিগ্রাফিক ট্র্যাপ। সাধারণ সাইজমিক এক্সপ্লোরেশনের সাহায্যে ওগুলো খুঁজে পাওয়া সম্ভব নয়। অথচ কয়েক জায়গায় আবিষ্কার হওয়ার পর দেখা গেছে প্রতিটি খনিতে বিপুল পরিমাণ তেল রয়েছে।

    এখানেই বিটুমিনের কথা এসে যায়। হাইড্রোকার্বনের মতো টার বা অ্যাসফলট, পাঁচ হাজার বছর আগে মেসোপটেমিয়ায় ব্যবহার করা হতো-বাড়িঘরের ছাদে, রাস্তায়, এমনকি ক্ষতস্থানেও। আরও পরে, উত্তর আফ্রিকার উপকূলের কথা লিখে গেছে গ্রিকরা, গোটা উপকূলে তেলের স্রোত বইত। রোমানরা সিনাই-এ একটা জায়গার সন্ধান পায়, নাম ছিল পেট্রল মাউন্টেইন। বাইবেলে দেখোনি, ঈশ্বর জ্যাকবকে নির্দেশ দিয়ে বলছেন, চকমকি পাথরে মুখ দিয়ে তেল চোষো। বাইবেলেই বর্ণনা দেয়া আছে, সিদ্দিম উপত্যকায় আঠালো পদার্থ ভরা বহু গভীর গর্ত আছে, আমরা ধরে নিতে পারি ওগুলো আসলে টার খনি।

    এসব এলাকা ইতিমধ্যে খুঁজে পাওয়া সম্ভব হয়নি বা ড্রিল-ও করা হয়নি? পিটের প্রশ্ন।

    ড্রিল করা হয়েছে, তবে আজ পর্যন্ত তেমন কিছু পাওয়া যায়নি। জিওলজিস্টরা

    দাবি করছে, শুধু ইসরায়েলের মাটিতেই পাঁচশো মিলিয়ন ব্যারেল ক্রুড পেট্রোলিয়াম পাবার শতকরা নব্বই ভাগ সম্ভাবনা রয়েছে। দুঃখজনক যে পুরনো দিনের সাইটগুলো হারিয়ে গেছে, চাপ পড়ে গেছে কয়েকশো বছরের ভূমিকম্পে।

    তো, প্রধান উদ্দেশ্যে ইসরায়েলে তেলের বিশাল খনি আবিষ্কার?

    হ্যাঁ, তাই।

    চুপচাপ বসে রইল বাপ-বেটা। এক মিনিট কোনো কথা নেই। ইয়েজার তার কম্পিউটারের মাধ্যমে কোনো সূত্র খুঁজে না পেলে এগোনোর কোনো উপায় নেই, পিট ভাবল। শিল্পকর্ম আর সাহিত্য নয়, তেল আর সোনায় ওয়াশিংটনের কর্তাব্যক্তিদের উৎসাহ, এটা সে বিলক্ষণ বুঝেছে।

    বেজে উঠল টেলিফোন। উঠে গিয়ে ফোন ধরলেন সিনেটর। কিছুক্ষণ নীরবে শুনে ফিরে এলেন চেয়ারে।

    কলোরাডোতে হারানো লাইব্রেরি খুঁজে পাব বলে মনে করার কোনো কারণ নেই, শুষ্ণ গলায় মন্তব্য করে পিট।

    পেলেই বরঞ্চ আমরা সবাই অবাক হব, সিনেটর দমে যাবার পাত্র নন। একজন বিশেষজ্ঞের সাথে তোমার দেখা করার ব্যবস্থা করেছি। কলোরাডো ইউনিভার্সিটিতে ক্লাসিকাল হিস্ট্রি পড়ান ভদ্রলোক, আমার পরিচিত, বলতে গেলে সারাটা জীবন আলেকজান্দ্রিয়া লাইব্রেরি নিয়ে গবেষণা করছেন। লাইব্রেরিটা খুঁজে বের করার ব্যাপারে তিনি তোমাকে সাহায্য করতে পারবেন। ভদ্রলোকের নাম ডক্টর বেরট্রাম রোথবার্গ।

    আমার তার কাছে যেতে হবে কেন? বরঞ্চ তিনি ওয়াশিংটনে এলেই ল্যাঠা চুকে যায়। একগুয়ের মতো বলে পিট।

    অ্যাডমিরাল স্যানডেকারের সঙ্গে কথা হয়েছে তোমার?

    হ্যাঁ।

    নিশ্চই বুঝতে পারছো, তোমার আর অ্যালের এই মুহূর্তে সোভিয়েত সাবমেরিনের থেকে যতটা সম্ভব দূরে থাকতে হবে। এইমাত্র যে ফোনটা পেলাম, সেটা এফবিআই এর একজন এজেন্ট করেছিল, সে একজন কে.জি.বি.এজেন্টকে ফলো করছে। কে.জি.বি. এজেন্ট লোকটা তোমাকে ফলো করছিল।

    নিজের জনপ্রিয়তার কথা শুনে ভালোই লাগছে।

    সন্দেহজনক কোনো কাজ করবে না তুমি।

    মাথা ঝাঁকায় পিট। বেশ, বুঝলাম। কিন্তু যদি রাশিয়ানরা টের পায় আমাদের মিশনের কথা? আলেকজান্দ্রিয়া লাইব্রেরি খুঁজে পেলে ওরাও তো লাভবান হবে?

    হতে পারে। কিন্তু সম্ভাবনা খুবই কম। মোমের টেবলেটগুলো হেফাজতে রেখেছি আমরা।

    আরেকটা প্রশ্ন আছে আমার।

    বলো।

    আমার গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে, পিট বলে। সেক্ষেত্রে, ডক্টর রোথবার্গের কাছে যাওয়ার সময় যদি কেজিবি অনুসরণ করে আমাকে?

    আমরা তো তা-ই চাই।

    অর্থাৎ, আমার এই যাত্রা লোক-দেখানো?

    ঠিক তাই।

    কিন্তু কেন?

    তোমার এল-২৯ কর্ড গাড়িটার জন্য।

    আমার গাড়ি?

    ডেনভারে যে ক্লাসিক গাড়িটা রেখেছো তুমি। যে লোকটা তোমার গাড়িটা ভাড়ায় খাটাচ্ছিল, সে গতকাল ফোন করে জানিয়েছে, কাজ ফুরিয়েছে তার। গাড়ির অবস্থাও টিপটপ।

    আচ্ছা। সবার সামনে দিয়ে কলোরাডো ভ্রমণ করব আমি, নিজের অ্যান্টিক গাড়ি দিয়ে দৃষ্টি কাড়ব, স্কি করব বরফের ঢালে, আর পার্টি করব ডক্টর শার্পের সঙ্গে।

    ঠিক তাই, জোর দিয়ে বললেন সিনেটর। ব্রেকেনরিজ হোটেলে উঠবে তুমি। ডক্টর রোথবার্গের সাথে কেমন করে দেখা করবে, সেই সম্পর্কিত একটা বার্তা পাবে ওখানে।

    বুরবন শেষ করে হাতের গ্লাসটা ম্যান্টলের ওপর নামিয়ে রাখলো পিট। আমাদের পারিবারিক লজটা ব্যবহার করতে পারি?

    বরঞ্চ দূরে থাকো ওটা থেকে।

    আশ্চর্য, ওটা আমার নিজের বাড়ি!

    মোটেও আশ্চর্য নয়, সিনেটর বললেন। সদর দরজা খুলে ঢোকার সাথে সাথে গুলি করা হবে তোমাকে।

    .

    পঁয়তাল্লিশ মিনিট পর। নিজের অদ্ভুত বাসস্থান, একটা প্লেন হ্যাঁঙারে রয়েছে পিট। গায়ে রোব জড়িয়ে টিভি দেখছিল। এমন সময় ইন্টারকম বেজে উঠল। অ্যাল জিওর্দিনোর গলা শুনবে মনে করে, স্পিকার অন করল পিট।

    কে?

    গ্রিনল্যান্ড খাদ্য-পরিবহন, নারী কণ্ঠ উত্তর দেয়।

    হেসে, সুইচ টিপে সাইড ডোর খুলে বারান্দায় এসে দাঁড়ায় পিট।

    বড় একটা পিকনিক ঝুড়ি সঙ্গে নিয়ে হেঁটে আসছে লিলি। চারপাশের অ্যান্টিক গাড়িগুলো দেখে থমকে গেছে ও।

    অ্যাডমিরাল স্যানডেকার অবশ্য বলেছিল, জায়গাটা অদ্ভুত, এখন দেখছি তিনি কিছুই বলতে পারেননি।

    সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে এল পিট। পিকনিক ঝুড়িটা নিতে গিয়ে ফেলে দিয়েছিল প্রায়। বাপরে! এত ভারী! ভেতরে কী?

    ডিনার।

    লিলির দিকে তাকিয়ে মুগ্ধ হাসি হাসল পিট। প্রাণবন্ত মুখ, চোখ দুটো উজ্জ্বল। চুলগুলো সমান করে আঁচড়ানো, পিঠ খোলা কালো একটা পোশাক পরনে। গ্রিনল্যান্ডের সেই ভারী কোট না থাকায়, দারুণ ভরাট লাগছে বুক জোড়া। পাতলা কোমড়। লম্বা পায়ে মোহনীয় ভঙ্গিমা।

    লিভিং রুমে ঢুকে হাতের ঝুড়ি নামিয়ে রাখলো পিট। হাত ধরল লিলির। পরে খেলে হয় না? নরম স্বরে বলল ও।

    ধীরে, দৃষ্টি নিচে নামিয়ে আবার পিটের চোখে চোখ রাখে লিলি। খুব দুর্বল বোধ হতে লাগল তার, যেন পা দুটো ওজন বইতে পারছে না। কেঁপে উঠল।

    লজ্জা পাচ্ছে কেন? নিজের কাছেই অবাক লাগছে লিলির। এ সব কিছুই তো ওর পরিকল্পনা করা ওয়াইন, পোশাক, কালো লেস দেয়া ব্রা আর প্যান্টি। তবে?

    ধীরে, ওর পোশাকের ফিতে খুলে দেয় পিট। ঝলমলে কালো পোশাকটা লিলির গোড়ালির কাছে স্তূপ হয়ে পড়ে থাকে। ওর কোমর আর হাঁটুর নিচে হাত রেখে কোলে তুলে নেয় পিট।

    শোবার ঘরের দিকে যখন এগোচ্ছে পিট, ওর বুকে মুখ ডুবিয়ে লিলি বলল, নিজেকে আমার ঝকঝকে বেশ্যা মনে হচ্ছে!

    যত্ন করে ওকে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে তাকায় পিট। নিজের ভেতরে কামনার আগুন জ্বলছে।

    ভালোই হলো, রুদ্ধ স্বরে ও বলে, দেখি তো, ওদের মতো পারো কি না!

    .

    ২৪.

    নিজের ভিলার খাবার ঘরে প্রবেশ করল ইয়াজিদ।

    বন্ধুরা, আশা করি খানাটা উপভোগ করেছেন। তার ভারী কণ্ঠস্বর গমগম করে উঠল।

    মোহাম্মদ আল-হাকিম, প্রখ্যাত মৌলানা ও ইয়াজিদের ছায়া হিসেবে পরিচিত, চেয়ার ঠেলে উঠে দাঁড়াল। আপনার আতিথেয়তার কোনো তুলনা হয় না, জনাব ইয়াজিদ। তবে আমরা আপনার সম্মানজনক উপস্থিতি থেকে বঞ্চিত হয়েছি।

    পেট ভরা থাকলে আল্লাহ তার ইচ্ছা আমার কাছে প্রকাশ করেন না, ক্ষীণ হাসির সাথে বলল আখমত ইয়াজিদ। পালা করে টেবিল ঘিরে দাঁড়ানো পাঁচজন লোকের দিকে তাকাল সে। তার প্রতি শ্রদ্ধায় আর ভক্তিতে মাথা নত করে আছে সবাই।

    তাদের মধ্যে দু’জনের পোশাক একই রকম। কর্নেল নাগিব বশির, সামরিক বাহিনীতে ইয়াজিদের যারা সমর্থক সেই সব অফিসারদের নেতা সে, পরে আছে ভোলা আলখেল্লা, কাপড়ের বাড়তি অংশটুকু দুই কাঁধ থেকে উঠে এসে মুখ ঢেকে রেখেছে। কায়রো থেকে আসার সময় চেহারা গোপন করার দরকার ছিল। তার মাথার সাদা পাগড়িটাও সাহায্য করেছে এ কাজে। মোহাম্মদ আল-হাকিমের পরনেও আলখেল্লা, তার পাগড়িটা সোনালি।

    মুসা মোহইদিন পরেছে ট্রাউজার আর স্পোর্টস শার্ট। সে একজন সাংবাদিক ইয়াজিদের প্রধান প্রচারিবদ। খালেদ ফৌজি, জেহাদ আহ্বানকারী কমিটির সামরিক উপদেষ্টা, তার পরনে ব্যাটল ফেটিগ। একা শুধু সুলেমান আজিজের পরনে সাফারি সুট।

    আপনারা নিশ্চয়ই ভাবছেন, কেন আজ আমি হঠাৎ করে জরুরি মিটিং ডেকেছি, টেবিলের মাথায় চেয়ারটা খালি পড়ে ছিল, সেটায় বসল আখমত ইয়াজিদ, তার ইঙ্গিতে বাকি সবাইও আসন গ্রহণ করল। আপনারা তো জানেনই আল্লাহ আমাকে বিশেষ সুনজরে দেখেন। তিনি স্বয়ং আমাকে একটা প্ল্যান দিয়েছেন-একটি মাত্র আঘাতে আমরা অযোগ্য নাদাভ হাসান আর তার দুর্নীতিপরায়ণ মন্ত্রিসভার সদস্যদের উৎখাত করতে পারব। প্লিজ, কফি খেতে শুরু করুন আপনারা।

    কেউ কফির কাপে চুমুক দিল, কেউ দিতে যাচ্ছে, এই সময় চেয়ার ছেড়ে দাঁড়িয়ে পড়ল আখমত ইয়াজিদ। তার সম্মানে আবার সবাইকে দাঁড়াতে হলো। শান্ত পায়ে হেঁটে একটা দেয়ালের সামনে চলে এল সে। হাত বাড়িয়ে চাপ দিল বোতামে। বড় একটা রঙিন ম্যাপ সিলিং থেকে মেঝের দিকে নেমে এল। চিনতে পারল সুলেমান আজিজ, দক্ষিণ আমেরিকার মানচিত্র-উরুগুয়ের উপকূল শহর পান্টা ডেল এসটে-কে লাল বৃত্ত এঁকে দেখানো হয়েছে। ম্যাপের বাকি অর্ধেকের নিচে টেপ দিয়ে আটকানো একটা আধুনিক প্রমোদতরীর এনলার্জ করা ফটো।

    টেবিলে ফিরে এসে আখমত ইয়াজিদ বসল আবার, দেখাদেখি অন্যান্যরাও। প্রত্যশায় ও উত্তেজনায় মনে মনে সবাই অস্থির হলেও, কেউ নল না বা কথা বলল না। সবাই তাকিয়ে আছে ইয়াজিদের দিকে, আল্লাহর বিশেষ অনুগ্রহপ্রাপ্ত তাদের নেতা কী বলে শোনার আশায় উন্মুখ। ইয়াজিদের প্রতি তাদের শ্রদ্ধা আর ভক্তিতে কোনো খাদ নেই। শুধু সুলেমান আজিজ তার মনোভাব গোপন রাখল। তার বাস্তব বুদ্ধি এতই প্রখর যে পবিত্র আধ্যাত্মিক শক্তি, আল্লাহর বিশেষ রহমত ইত্যাদি সে একদমই বিশ্বাস করে না।

    আজ থেকে ছয় দিন পর আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে পান্টা ডেল এসটে শহরে, আবার গমগম করে উঠল ইয়াজিদের কণ্ঠস্বর। ঋণগ্রস্ত দেশগুলো একজোট হয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, মিসর বাদে, সব ধরনের বকেয়া ঋণ পরিশোধ করতে অস্বীকার করবে তারা। সেই সাথে একটা নিষেধাজ্ঞা জারি করে বহুজাতিক কোম্পানিগুলোকে দেশ থেকে লভ্যাংশ নিয়ে যেতে বাধা দেবে। ঘোষণা দুটো জারি হলে, যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের কয়েকশো ব্যাংক রাতারাতি লালবাতি জ্বালবে।

    পশ্চিমা ব্যাংকগুলোর প্রতিনিধি আর উন্নত রাষ্ট্রগুলোর অর্থনীতি বিশেষজ্ঞরা রাত দিন চব্বিশ ঘণ্টা বৈঠক করছে আসন্ন সর্বনাশ ঠেকানোর জন্য। তাদেরকে সাহায্য করছে পুঁজিবাদীদের পা-চাটা কয়েকটা কুকুর, তাদের মধ্যে আমাদের প্রেসিডেন্ট নাদাভ হাসান একজন। হাসান ঋণগ্রস্ত তৃতীয় বিশ্ব ও মুসলিম দেশগুলোকে বোঝাতে চেষ্টা করছে, আরে ভাই, পাওনা টাকা শোধ না দিলে আল্লাহ নারাজ হবেন-টাকা শোধ দাও, তারপর আবার চড়া সুদে ঋণ নাও। নাদাভ হাসান একজন অন্তর্ঘাতক, তার ষড়যন্ত্র আমরা সফল হতে দিতে পারি না। মিসর পুঁজিবাদী দুনিয়ার দালালি করবে, এ অসহ্য।

    আমি বলি কী, অত্যাচারীকে খুন করে ঝামেলা মিটিয়ে ফেলা হোক, আক্রোশে কেঁপে গেল খালেদ ফৌজির গলা। তার বয়স কম, কৌশল জ্ঞানের ভারি অভাব। নবিশ বিপ্লবীদের দ্বারা অসময়ে একটা অভ্যুত্থান ঘটাতে গিয়ে এরই মধ্যে সত্তরজনের প্রাণহানি ঘটিয়েছে সে। তার সদা চঞ্চল দৃষ্টি টেবিলের চারদিকে থেকে ঘুরে এল। হাসানের প্লেন উরুগুয়ের পথে আকাশে ওঠার সাথে সাথে একটা গ্রাউন্ড-টু-এয়ার মিসাইল ছুঁড়ে দিই, খেল খতম!

    তাতে শুধু প্রতিরক্ষামন্ত্রীকে ক্ষমতা দখলের সুযোগ করে দেয়া হবে, কারণ দায়িত্ব গ্রহণের জন্য যে প্রস্তুতি দরকার তা এখনও শেষ করিনি আমরা, বিরোধিতা করল মুসা মোহাইদিন। সে একজন জনপ্রিয় লেখকও বটে, বয়স পঞ্চান্ন, টেবিলে যারা উপস্থিত তাদের মধ্যে একমাত্র তাকেই শ্রদ্ধা করে সুলেমান আজিজ।

    কর্নেল নাগিব বশিরের দিকে তাকাল আখমত ইয়াজিদ। কথাটা কি ঠিক, নাগিব?

    মাথা ঝাঁকাল কর্নেল। মুসা ঠিক বলেছে। প্রতিরক্ষামন্ত্রী হামিদ, জনগণের ম্যান্ডেট গ্রহণের শর্ত দিয়ে আসলে আপনাকে দেরি করিয়ে দিচ্ছে। সে যে উচ্চাভিলাষী তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তার স্বপ্ন, সেনাবাহিনীর সমর্থন নিয়ে প্রেসিডেন্ট হওয়া।

    মুসা মোহাইদিন বলল, আমার কাছে তথ্যও আছে। আবু হামিদের ঘনিষ্ঠ একজন অফিসার গোপনে আমাদের আন্দোলনে শরিক হয়েছেন। তিনি আমাকে জানিয়েছেন, জনসাধারণের সমর্থন পাবার জন্য চমৎকার একটা বুদ্ধি বের করেছে আবু হামিদ। হে’লা কামিলের জনপ্রিয়তাকে কাজে লাগাবে সে।

    কীভাবে?

    হে’লা কামিলের পাণিপ্রার্থী হয়ে, তাকে বিয়ে করে!

    ঠোঁট টিপে হাসল আখমত ইয়াজিদ। প্রতিরক্ষামন্ত্রী বালির দুর্গ গড়তে চাইছে। বিয়ের আসরে হে’লা কামিলকে পাবে না সে।

    কথাটা কি নিশ্চয় করে বলা যায়? জিজ্ঞেস করল সুলেমান আজিজ।

    হ্যাঁ, যায়, আধবোজা চোখে, মৃদুকণ্ঠে বলল আখমত ইয়াজিদ, তার চেহারায় তৃপ্তির একটা ভাব ফুটে উঠল। আল্লাহ ইচ্ছে করেছেন, কাল সূর্য ওঠার আগেই হে’লা কামিলকে তিনি দুনিয়ার বুক থেকে তুলে নেবেন।

    হে শ্রদ্ধেয় নেতা, হে মহা বুজর্গ পীর, দয়া করে সব কথা আমাদেরকে খুলে বলুন! ব্যাকুল কণ্ঠে অনুরোধ জানাল ইয়াজিদের ছায়া অর্থাৎ মৌলানা আল-হাকিম।

    ধীরে ধীরে ব্যাখ্যা করল আখমত ইয়াজিদ। বিশ্বস্ত মেক্সিকো সূত্র থেকে জানতে পেরেছে সে, ট্যুরিস্টদের অপ্রত্যাশিত ভিড় হওয়ায় পাল্টা ডেল এসটে-তে অভিজাত কোনো হোটেল খালি নেই। জায়গার অভাবে শীর্ষ সম্মেলন আয়োজন করার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হতে রাজি নয় উরুগুয়ে সরকার, তাই বন্দরে নোঙর করা একটা জাহাজ ভাড়া করেছে তারা। ব্রিটিশ প্রমোদতরী লেডি ফ্ল্যামবরোয় অবস্থান করবে প্রেসিডেন্ট নাদাভ হাসান ও তার সহকারীরা। তার সাথে মেক্সিকোর প্রেসিডেন্ট দো লরেঞ্জো ও স্টাফরাও থাকবে জাহাজে। পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করার পর আখমত ইয়াজিদ চোখ বুজে ধ্যানমগ্ন হবার ভান করল, তারপর থেমে থেমে বলল, পরম করুণাময় আল্লাহ স্বয়ং আমার কাছে এসেছেন। তিনি এসে আমাকে আদেশ করেছেন, আমি যেন জাহাজটা কব্জা করি।

    সকল প্রশংসা আল্লাহর! হুঙ্কার ছাড়ল খালেদ ফৌজি।

    বাকি সবাই চেহারায় অবিশ্বাস নিয়ে পরস্পরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করল। তারপর তারা, সবাই প্রায় একযোগে, চোখে প্রত্যাশা নিয়ে ইয়াজিদের দিকে তাকাল, তবে কেউ কোনো প্রশ্ন উচ্চারণ করল না।

    তোমাদের হাবভাব দেখে বুঝতে পারছি, শিষ্য এবং বন্ধুরা, আমার দিব্যদৃষ্টি সম্পর্কে তোমাদের সন্দেহ আছে।

    সন্দেহ নেই বা কোনো কালে ছিল না, বলল মোহাম্মদ আল-হাকিম। কারণ আমরা জানি আপনি সদা সত্য কথা বলেন। তবে আমরা ভাবছি, আল্লাহর নির্দেশ আপনি বুঝতে ভুল করেননি তো?

    না, আদেশটা স্পষ্ট ছিল, শুনতে আমার ভুল হয়নি। প্রেসিডেন্ট হাসানসহ জাহাজটাকে অবশ্যই দখল করতে হবে।

    কী উদ্দেশ্য? প্রশ্ন করল মৌলানা আল-হাকিম।

    দৃশ্যপট থেকে হাসানকে সরিয়ে রাখার জন্য, যাতে সে কায়রোয় ফিরতে না পারে, আর সেই সুযোগে আল্লাহর প্রিয় ইসলামিক ফোর্স ক্ষমতা দখল করবে।

    কর্নেল নাগিব বশির বলল, কিন্তু নিশ্চিতভাবে আমি জানি যে নিজে ছাড়া আর কেউ ক্ষমতা দখল করার চেষ্টা করলে আবু হামিদ তার সেনাবাহিনী নিয়ে বাধা দেবে।

    মানুষের ঢল আর স্রোতকে ঠেকাবে কীভাবে আবু হামিদ? জিজ্ঞেস করল আখমত ইয়াজিদ্র। নাগরিক অসন্তোষ চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। ঋণ শোধ করতে হচ্ছে, এই অজুহাতে সব রকম সাবসিডি দেয়া বন্ধ করে দিয়েছে সরকার, ফলে সাধারণ মানুষ সুদখোর ঋণ-দাতাদের ওপর ভয়ানক খেপে আছে। ঋণদাতা সংস্থাগুলোর নিন্দা না করে নিজেদের গলায় ফাঁস পরেছে হাসান আর আবু হামিদ। সবাই জানে, মিসরকে এখন শুধু নির্ভেজাল ইসলামী আইন রক্ষা করতে পারে।

    লাফ দিয়ে চেয়ার ছাড়ল খালেদ ফৌজি মুঠো করা হাত তুলল মাথার ওপর, বজ্রকণ্ঠে বলল, আমাকে শুধু হুকুম করুন, হে ইসলামের খেদমতগার! আপনার এক কথায় বিশ লাখ মানুষকে আমি রাস্তায় মিছিল করাব। আপনি শুধু তাদেরকে নেতৃত্ব দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিন, হে আল্লাহর পেয়ারা দোস্ত!

    সারা মুখে পবিত্র হাসি নিয়ে চুপ করে থাকল আখমত ইয়াজিদ। ধর্মীয় ভাবাবেগে একটু একটু কাঁপছে সে। তারপর সে বলল, জনতা, নেতৃত্ব দেবে। আমি তো গরিবের বন্ধু। জনতা নেতৃত্ব দেবে, আমি তাদের অনুসরণ করব।

    আল্লাহ আমার গুনাহ মাফ করুন! প্রায় কেঁদে ফেলল মৌলানা আল-হাকিম। তাঁর নেক বান্দা জনাব আখমত ইয়াজিদকে আমি ভুল বুঝেছিলাম!

    তুমি মৌলানা একটা কাপুরুষ! খালেদ ফৌজি চেঁচিয়ে বলল।

    মোহাম্মদ আল-হাকিম তোমার চেয়ে জ্ঞানী, শান্তভাবে বলল খালেদ ফৌজি। তিনি জানেন, ঢিল একবার ছোঁড়া হয়ে গেলে আর কিছু করার থাকে না। আল্লাহর নির্দেশ যখন এসেছে, সেটা নিখুঁতভাবে পালন করতে হলে নানা দিক খতিয়ে চিন্তা করার দরকার আছে।

    কর্নেল নাগিব বশির কথা বলল, সন্ত্রাসবাদীদের মতো পাইকারি হত্যাকাণ্ড ঘটালে আমাদের আন্দোলনের জন্য তা মঙ্গল ডেকে আনবে না।

    কর্নেল, তুমি আল্লাহর নির্দেশ অমান্য করতে চাও? সরাসরি প্রশ্ন করল আখমত ইয়াজিদ, চেহারা দেখে মনে হলো ভারি বিস্মিত হয়েছে সে।

    সবাই একযোগে কথা বলতে শুরু করল, প্রত্যেকেই নিজের কথা ছাড়া আর কিছু শুনতে আগ্রহী নয়। একা শুধু সুলেমান আজিজ নির্লিপ্ত থাকল। সব কয়টা গাধা, ভাবল সে, সব কয়টা। মুখ ফিরিয়ে ম্যাপের গায়ে সাঁটা প্রমোদতরীর দিকে তাকাল সে। মাথার ভেতর কাজ চলছে।

    আমরা শুধু মিসরীয় নই, বলে চলেছে কর্নেল নাগিব বশির, সেই সাথে আমরা আরবও। আমরা যদি আমাদের অফিসারদের পাইকারিভাবে খুন করি, অন্যান্য আরব দেশগুলো আমাদের বিরুদ্ধে চলে যাবে। আল্লাহর নির্দেশ ইত্যাদি বলে তাদেরকে বোঝানো যাবে না, ব্যাপারটাকে তারা রাজনৈতিক সন্ত্রাস ও ষড়যন্ত্র হিসেবে দেখবে।

    মুসা মোহাইদিন ইঙ্গিত মৌলানা আল-হাকিমকে দেখল। মৌলানার কথায় যুক্তি আছে। বিদেশি একজন প্রেসিডেন্টের সামনে হাসানকে খুন করার চেয়ে তাকে বরং দেশের মাটিতে খুন করা হোক।

    খুনটা করতে গিয়ে যদি বিদেশি প্রেসিডেন্ট বা তার সহকারীরা মারা পড়ে, সারা দুনিয়ায় আমাদের বিরুদ্ধে কথা উঠবে, চিন্তিত সুরে বলল মৌলানা আল-হাকিম।

    খালেদ ফৌজি চিৎকার করে বলল, আপনারা সবাই আৰু হামিদের দালাল! আমি আবারও বলছি, জাহাজটা আক্রমণ করা হোক, দুনিয়া দেখুক আমরা কতটা শক্তি। রাখি। যদিও মারমুখো তরুণের কথায় কান দিল না কেউ।

    আপনি বুঝতে পারছেন না, জনাব ইয়াজিদ? আবেদনের সুরে বলল কর্নেল ইয়াদানী। পান্টা ডেল এসটে-র সিকিউরিটি পেনিট্রেট করা প্রায় অসম্ভব। চারদিকে গিজগিজ করবে উরুগুয়ের পেট্রল বোট। প্রত্যেকটি জাহাজে, যেগুলোয় নেতারা থাকবেন, সশস্ত্র গার্ড থাকবে। আপনি কি সুইসাইড স্কোয়াড পাঠাবার কথা ভাবছেন?

    আমি কি ভাবছি না সব যদি তোমাদেরকে জানাতে পারতাম! দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল আখমত ইয়াজিদ। আল্লাহর গোপন ইচ্ছে জানার এই হলো বিপদ, মন খুলে সব কথা বলা যায় না। শুধু এইটুকু তোমাদেরকে জানাই, একটা বিশেষ উৎস থেকে সাহায্যের প্রস্তাব দেয়া হয়েছে আমাকে। সুলেমান আজিজের দিকে ফিরল সে। তুমি, সুলেমান আজিজ, আন্ডারকাভার অপারেশন সম্পর্কে একজন এক্সপার্ট। কারও চোখে ধরা না পড়ে আমাদের সেরা যোদ্ধাদের একটা দলকে যদি লেডি ফ্ল্যামবোরোয় তুলে দেয়া সম্ভব হয়, তারা কি জাহাজটা দখল করতে পারবে, দখল করার পর নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারবে, যতক্ষণ না আমরা মিসরকে ইসলামিক রিপাবলিক বলে ঘোষণা করি?

    হ্যাঁ, জবাব দিল সুলেমান আজিজ, এখনও তাকিয়ে আছে ম্যাপে সাঁটা লেডি ফ্ল্যামবোয়রীর দিকে। তার গলা শান্ত, তবে বিশ্বাসে দৃঢ়। দরকার হবে দশজন অভিজ্ঞ যোদ্ধা আর পাঁচজন অভিজ্ঞ নাবিক। যদি বিস্ময়ের ধাক্কা দিতে পারা যায়, কোনো রক্তপাত ঘটবে না।

    আখমত ইয়াজিদের চোখ দুটো চকচক করে উঠল। জানতাম! জানতাম, তোমার ওপর ভরসা করা যায়।

    অসম্ভব! প্রতিবাদ জানাল কর্নেল নাগিব। সন্দেহ না জাগিয়ে উরুগুয়েতে এতগুলো লোককে তুমি পাচারই করতে পারবে না। আর যদি জাদু দেখিয়ে জাহাজটা তুমি দখল করতেও পারো, চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে পশ্চিমা দুনিয়ার অ্যাসল্ট দলগুলো খুঁজে বের করে ফেলবে ওটাকে। জিম্মিদের খুন করার হুমকি দিলেও তারা থামবে না।

    এস তাহলে বাজি হয়ে যাক, প্রস্তাব দিল সুলেমান আজিজ। আমি দুসপ্তাহর জন্য গায়ের করে দেব লেডি ফ্ল্যামবোরোকে।

    মাথা নাড়ল কর্নেল নাগিব। তুমি স্বপ্নের জগতে বাস করছে।

    কী করে সম্ভব, বলবে আমাদের? জিজ্ঞেস করল খালেদ ফৌজি। উরুগুয়ে সরকার যে কড়া সিকিউরিটির ব্যবস্থা করবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। প্রহরার দায়িত্ব নেবে উরুগুয়ে সেনাবাহিনীর কমান্ডো ইউনিট। তারা অভিজ্ঞ, তাই না? কীভাবে তুমি তাদের সাথে লড়ে জিততে চাও?

    কে বলল আমি লড়তে চাই, লড়ে জিততে চাই? মুচকি হেসে পাল্টা প্রশ্ন করল সুলেমান আজিজ।

    একি পাগলামি বলল আখমত, বিব্রত বোধ করছে।

    পাগলামি নয়, আশ্বস্ত করল সুলেমান আজিজ। কৌশল জানা থাকলে পানির মতো সহজ।

    কৌশল?

    অবশ্যই, আবার ঠোঁট টিপে হাসল সুলেমান আজিজ। বুঝতেই পারছেন, আমার প্ল্যান হলো-লেডি ফ্ল্যামবোরোকে, তার ক্রু ও প্যাসেঞ্জারসহ, গায়েব করে দেয়া।

    ⤶ ⤷
    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleদ্য মহাভারত কোয়েস্ট : দ্য আলেকজান্ডার সিক্রেট – ক্রিস্টোফার সি ডয়েল
    Next Article ড্রাগন – ক্লাইভ কাসলার

    Related Articles

    ক্লাইভ কাসলার

    দ্য ফারাও’স সিক্রেট – ক্লাইভ কাসলার ও গ্রাহাম ব্রাউন

    August 5, 2025
    ক্লাইভ কাসলার

    পাইরেট – ক্লাইভ কাসলার / রবিন বারসেল

    August 5, 2025
    ক্লাইভ কাসলার

    দ্য সলোমন কার্স – ক্লাইভ কাসলার ও রাসেল ব্লেক

    August 5, 2025
    ক্লাইভ কাসলার

    ড্রাগন – ক্লাইভ কাসলার

    August 5, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Generic selectors
    Exact matches only
    Search in title
    Search in content
    Post Type Selectors
    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে বাঙলাদেশের কৃষক – বদরুদ্দীন উমর

    October 29, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে বাঙলাদেশের কৃষক – বদরুদ্দীন উমর

    October 29, 2025
    Our Picks

    চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে বাঙলাদেশের কৃষক – বদরুদ্দীন উমর

    October 29, 2025

    পূর্ব বাঙলার ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি ২ – বদরুদ্দীন উমর

    October 29, 2025

    বাঙলাদেশে কমিউনিস্ট আন্দোলনের সমস্যা – বদরুদ্দীন উমর

    October 29, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    • Sign Up
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }