Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে বাঙলাদেশের কৃষক – বদরুদ্দীন উমর

    October 29, 2025

    পূর্ব বাঙলার ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি ২ – বদরুদ্দীন উমর

    October 29, 2025

    বাঙলাদেশে কমিউনিস্ট আন্দোলনের সমস্যা – বদরুদ্দীন উমর

    October 29, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    ট্রেজার – ক্লাইভ কাসলার

    ক্লাইভ কাসলার এক পাতা গল্প596 Mins Read0
    ⤶ ⤷

    ৩৫. সূর্য ওঠার খানিক পর

    ৩৫.

    সূর্য ওঠার খানিক পরই পৌঁছে গেল মিসরীয় ও মেক্সিকোন সিকিউরিটি এজেন্টরা। জাহাজে ওঠার সাথে সাথে কাজ শুরু করল তারা। প্রথমে বিস্ফোরকের খোঁজে তল্লাশি চালালো জাহাজের প্রতিটি কোণে, তারপর সম্ভাব্য আততায়ীকে খুঁজে বের করার জন্য ক্রুদের রেকর্ড চেক করল। পাকিস্তানি ও ভারতীয় ক্রু অল্প কয়েকজন, বেশির ভাগই ব্রিটিশ, তাদের কারও মিসর বা মেক্সিকো সরকারের শত্রুতা নেই।

    সুলেমান আজিজসহ আতঙ্কবাদী গ্রুপের সবাই অনর্গল স্প্যানিশ বলতে পারে, সিকিউরিটি এজেন্টদের প্রতি অত্যন্ত সহযোগিতার মনোভাব দেখল তারা। প্রত্যেকের কাছে ভুয়া ব্রিটিশ পাসপোর্ট আর ইনস্যুরেন্স-সিকিউরিটি ডকুমেন্ট রয়েছে, চাওয়ামাত্র দেখাতে ইতস্তত করল না।

    প্রেসিডেন্ট দো লরেঞ্জো জাহাজে পৌঁছুলেন আরও খানিক পর। ছোটখাটো মানুষটার বয়স হয়েছে, পাকা চুল কটাও ঝরো ঝরো, চোখ জোড়া বেদনাকাতর, বুদ্ধিজীবীসুলভ তীক্ষ্ণ চেহারা।

    প্রেসিডেন্ট লরেঞ্জোকে অভ্যর্থনা জানাল সুলেমান আজিজ, মাইকেল কলিঙ্গের ভূমিকায় তার অভিনয় চমৎকার উতরে গেল। জাহাজের অর্কেস্ট্রা মেক্সিকোর জাতীয় সঙ্গীত বাজাল, তারপর মেক্সিকোর নেতা আর তাঁর স্টাফকে পথ দেখিয়ে পৌঁছে দেয়া হলো লেডি ফ্ল্যামবোয়রার স্টারবোর্ড সাইডে, যার যার আলাদা স্যুইটে।

    দুপুরের খানিক পর জাহাজের গায়ে এসে ভিড়ল অদ্ভুত সুন্দর একটা ইয়ট। ইয়টের মালিক একজন মিসরীয় কোটিপতি, রফতানি তার প্রধান ব্যবসা। ইয়ট থেকে লেডি ফ্ল্যামবোরোয় পা রাখলেন প্রেসিডেন্ট নাদাভ হাসান। ভদ্রলোকের বয়স যাই হোক, চুলে পাক ধরলেও, চেহারা আর স্বাস্থ্য দেখে মনে হবে এখনও তিনি যৌবনকে ধরে রাখতে পেরেছেন। তাঁর হাড়গুলো চওড়া, চামড়ার নিচে অতিরিক্ত মেদ জমতে দেননি, দাঁড়াবার ভঙ্গিটা টান টান।

    মিসরের জাতীয় সঙ্গীত বাজানো হলো। তারপর অতিথিদের পৌঁছে দেয়া হলো পোর্ট সাইডের স্যুইটে।

    তৃতীয় বিশ্বের প্রায় পঞ্চাশজন সরকারপ্রধান পান্টা ডেল এসট শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দিতে এসেছেন। কেউ কেউ তাদের জাতীয় নাগরিকদের কেন প্রাসাদতুল্য অট্টালিকায় উঠেছেন, কেউ পাঁচতারা হোটেলে, আবার কেউ বা তীর থেকে দূরে নোঙর করা প্রমোদতরীতে।

    রাস্তা ও রেস্তোরাঁগুলো আগন্তুক কূটনীতিক আর সাংবাদিকে ভরে উঠল। হঠাৎ করে চলে আসা বিদেশি ব্যক্তিত্বের এই ভিড় সামলাতে পারবে কি না ভেবে উরুগুয়ে কর্তৃপক্ষ উদ্বিগ্ন। এমনিতেই এসময়টায় পান্টা ডেল এসটে-তে প্রচুর ট্যুরিস্ট আসে, এবারও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি। পরিস্থিতি সামাল দেয়ার জন্য জাতীয় সামরিক বাহিনী ও পুলিশ সাধ্যমতো সব কিছু করলেও, মানুষের বিরতিহীন মিছিলে তাদের উপস্থিতি নগণ্য হয়ে পড়ল। প্রধান সমস্যা হয়ে দাঁড়াল যানবাহন নিয়ন্ত্রণ। প্রায় প্রতিটি রাস্তায় যানজট, ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাগল ছাড়াতে। সব দায়িত্ব কাঁধ থেকে ঝেড়ে ফেলে অবশেষে তারা শুধু সরকারপ্রধানদের নিরাপত্তার দিকটা দেখবে বলে সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হলো।

    স্টারবোর্ড ব্রিজ উইংয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে সুলেমান আজিজ, চোখে বাইনোকুলার, তাকিয়ে আছে শহরের দিকে। চোখ থেকে সেটা একবার নামিয়ে হাতঘড়ি দেখল সে।

    পাশে দাঁড়িয়ে তার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে রয়েছে বিশ্বস্ত ভক্ত ও বন্ধু ইবনে। আপনি কি রাত নামার অপেক্ষায় আছেন?

    তেতাল্লিশ মিনিট পর সূর্য ডুববে, না তাকিয়েই বিড়বিড় করে বলল সুলেমান আজিজ।

    পানিতে বড় বেশি ব্যস্ততা, বলল ইবনে। বন্দরের চারদিকে ছোটোছুটি করছে ছোট ছোট অসংখ্য বোট, একটা হাত তুলে দেখল সে। প্রায় প্রতিটি বোটে সাংবাদিকরা রয়েছে, ডেকে দাঁড়িয়ে হৈচৈ করছে তারা-সরকারপ্রধানদের সাক্ষাৎকার গ্রহণ করতে

    মেক্সিকান বা মিসরীয় ডেলিগেট, যারা প্রেসিডেন্টদের স্টাফ, শুধু তাদেরকে জাহাজে উঠতে দেবে, ইবনেকে নির্দেশ দিল সুলেমান আজিজ। আর কেউ যেন উঠতে না পারে।

    আমরা বন্দর ত্যাগ করার আগে কেউ যদি তীরে যেতে চায়?

    অনুমতি দেবে, বলল সুলেমান আজিজ। জাহাজের রুটিন স্বাভাবিক থাকা চাই। শহরের বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি আমাদের উপকারে আসবে। ওরা যখন খেয়াল করবে আমরা নেই, ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে যাবে।

    বন্দর কর্তৃপক্ষকে বোকা মনে করা ঠিক নয়। সন্ধ্যার পর আমাদের আলো না জ্বললে খোঁজ নেবে ওরা।

    ওদের জানানো হবে আমাদের মেইন জেনারেটর মেরামত করা হচ্ছে। আরেকটা প্রমোদতরীর দিকে হাত তুলল সুলেমান আজিজ, তীর থেকে আরও খানিক দূরে লেডি মেরেয়েটা আর ধনুক আকৃতির পেনিনসুলার মাঝখানে নোঙর ফেলেছে সেটা। ওটার আলো তীর থেকে মনে হবে আমাদের আলো।

    যদি না কেউ কাছ থেকে দেখে।

    কাঁধ ঝাঁকাল সুলেমান আজিজ। খোলা সাগরে পৌঁছুতে মাত্র এক ঘণ্টা লাগবে আমাদের। দিনের আলো ফোঁটার আগে উরুগুয়ে সিকিউরিটি বন্দরের বাই সার্চ করবে না।

    মেক্সিকান আর মিসরীয় সিকিউরিটি এজেন্টদের যদি সরাতেই হয়, এক্ষুনি আমাদের কাজ শুরু করা দরকার, বলল ইবনে।

    তোমরা সবাই তোমাদের অস্ত্রে সাইলেন্সর লাগিয়েছো তো?

    বুঝতেই পারবে না যে গুলি হয়েছে, মনে হবে হাততালির শব্দ।

    কঠিন দৃষ্টিতে ইবনের দিকে তাকাল সুলেমান আজিজ। চুপিচুপি, নিঃশব্দে ইবনে। যেভাবেই হোক আলাদা করো ওদেরকে, প্রতি বার একজনকে শেষ করতে হবে। কোনো রকম চিৎকার বা ধস্তাধস্তি হওয়া চলবে না। জাহাজ থেকে পালিয়ে গিয়ে কেউ যদি তীরে উঠে পুলিশকে জানায়, আমরা মারা পড়ব। ব্যাপারটা তোমার লোকজন ভালোভাবে বুঝেছে কি না নিশ্চিত হও।

    সবাইকে সব বলা আছে, জনাব। আরেকবার সাবধান করে দেব আমি।

    আখমত ইয়াজিদের নুন খাচ্ছি আমরা, কথাটা যেন কেউ না ভোলে। তার ঋণ শোধ করার সময় হয়েছে। আমরা তাকে মিসরের শাসক হিসেবে দেখতে চাই।

    .

    প্রথমে মরতে হবে মিসরীয় সিকিউরিটি এজেন্টদের। সুলেমান আজিজের ভুয়া ইনস্যুরেন্স-সিকিউরিটি এজেন্টদের আতঙ্কবাদী হিসেবে সন্দেহ করার কোনো কারণ ঘটেনি, প্রতিপক্ষদের তারা সহজেই ভুলিয়া-ভালিয়ে খালি প্যাসেঞ্জার সুইটগুলোয় নিয়ে আসতে পারল। শুরু হলো নিমর্ম হত্যাযজ্ঞ।

    একজন সিকিউরিটি এজেন্টকে বলা হলো, তাদের একজন কর্মকর্তা ফুড পয়জনিংয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন, জাহাজের ক্যাপটেন ভাবছেন তার উপস্থিতি দরকার। খালি প্যাসেঞ্জার স্যুইটের দোরগোড়া পেরোনো মাত্র দরজা বন্ধ করে দেয়া হলো, এক হাত দূর থেকে গুলি করা হলো তা হৃৎপিণ্ডে। এভাবে কোনো না কোনো বিশ্বাস্য অজুহাত দেখিয়ে কেবিন থেকে এক এক করে বের করে আনা হলো তাদের। কাজ ভাগ করা আছে, সাথে সাথে মেঝে থেকে মুছে ফেলা হলো সমস্ত রক্ত, এক এক করে পাশের কামরায় জমা হতে লাগল লাশগুলো।

    এরপর মেক্সিকান সিকিউরিটি এজেন্টদের পালা। প্রেসিডেন্ট দো লরেঞ্জোর দু’জন গার্ডের মনে সন্দেহ দেখা দিল, প্যাসেঞ্জার স্যুইটে ঢুকতে অস্কীকৃতি জানাল তারা। এ ধরনের পরিস্থিতির জন্যও তৈরি হয়েছে সন্ত্রাসবাদীরা। তর্ক বিতর্কের মধ্যে না গিয়ে চারজন লোক ঘিরে ধরল দু’জনকে, ঘ্যাচ ঘ্যাচ করে ছোরা মারা হলো পেটে আর বুকে। খালি প্যাসেজওয়েতে লুটিয়ে পড়ল তারা, চিৎকার করার সুযোগ হলো না।

    একজন দু’জন করে সিকিউরিটি এজেন্টদের সংখ্যা কমতে লাগল। একসময় লাশের সংখ্যা দাঁড়াল বারোয়। বাকি থাকল দু’জন মিসরীয় আর তিনজন মেক্সিকান গার্ড, সবাই তারা যার যার নেতার স্যুইটের বাইরে পাহারা দিচ্ছে।

    চারদিক অন্ধকার হয়ে আসছে, ক্যাপটেনের সাদা ইউনিফর্ম খুলে ফেলে কালো উলের একটা জাম্পস্যুট পরল সুলেমান আজিজ। ক্যাপটেনের অবয়বও ত্যাগ করল সে, তার বদলে পরল ভাঁড়ের একটা মুখোশ। ভারী একটা বেল্ট জড়াল কোমরে, তাতে দুটো অটোমেটিক পিস্তল আর একটা পোর্টেবল রেডিও আটকানো রয়েছে। নক করে কেবিনে ঢুকল ইবনে।

    দারুণ, তোমার ওপর আমি খুশি, বলল সুলেমান আজিজ। ইবনের দিকে একদৃষ্টে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থাকল সে। এখন আর গোলযোগের ভয় করার দরকার নেই। চালাও হামলা, তবে তোমার লোকদের সতর্ক থাকতে বলো। আমি চাই প্রেসিডেন্ট হাসান বা প্রেসিডেন্ট লরেঞ্জোর দুর্ঘটনায় মারা পড়ন।

    মাথা ঝাঁকিয়ে দোরগোড়া পর্যন্ত হেঁটে গেল ইবনে, বাইরে দাঁড়ানো নিজের লোককে প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিল। তারপর আবার ফিরে এসে সুলেমান আজিজের সামনে দাঁড়াল সে। ধরে নিন, জাহাজ সম্পূর্ণ আমাদের নিয়ন্ত্রণে চলে এসেছে।

    ক্যাপটেন কলিসের ডেস্কের খানিকটা ওপরে একটা ক্রোনোমিটার রয়েছে, ইঙ্গিতে সেটা দেখল সুলেমান আজিজ। সাঁইত্রিশ মিনিটের মধ্যে রওনা হব আমরা। জাহাজের প্রকৌশলীদের বাদ দিয়ে সব কজন প্যাসেঞ্জার এক জায়গায় জড় করো! ইঞ্জিন-রুম ক্রুদের তৈরি থাকতে বলো, যাতে আমি নির্দেশ দিলেই জাহাজ রওনা হতে পারে। বাকি সবাইকে জড় করো মেইন ডাইনিং সেলুনে।

    কথা না বলে দাঁড়িয়ে থাকল ইবনে, নিঃশব্দ হাসিতে ফলের মতো ফেটে পড়ল তার চেহারা, বেরিয়ে বত্রিশটা দাঁত। তারপর সে বলল, আল্লাহ আমাদেরকে সাত রাজার ধন দিয়ে আশীর্বাদ করেছেন।

    সত্যি আশীর্বাদ করেছেন কি না আজ থেকে পাঁচ দিন পর জানা যাবে।

    আপনাকে আমি একশো ভাগ নিশ্চয়তা দিয়ে বলছি, জনাব-সত্যি তিনি আমাদের দিকে মুখ তুলে চেয়েছেন। মেয়েলোকটাকে আমরা হাতে পেয়েছি।

    মেয়েলোক? কার কথা বলছ তুমি?

    হে’লা কামিল।

    প্রথমে বুঝতে পারল না সুলেমান আজিজ। তারপর বিশ্বাস করতে পারল না। হে’লা কামিল? কী বলছ? সে এই জাহাজে?

    দশ মিনিটও হয়নি জাহাজে পা রেখেছে, জনাব, ঘোষণা করল একলা, হাসতে হাসতে তার ফর্সা চেহারা লালচে হয়ে উঠল। মহিলা ক্রুদের কোয়ার্টার রেখেছি তাকে, কড়া পাহারায়।

    আল্লাহ সত্যি পরম দয়ালু! কৃতজ্ঞতায় নুয়ে পড়ল সুলেমান আজিজের মাথা।

    তিনি মাকড়সার কাছে পতঙ্গ পাঠিয়েছেন, জনাব, চাপা স্বরে বলল ইবনে। আখমত ইয়াজিদের নামে তাকে খুন করার আবার একটা সুযোগ পেয়ে গেছেন আপনি।

    .

    সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে এই সময় এক পশলা ঝির ঝির বৃষ্টি ঝরিয়ে উত্তর দিকে সরে গেল এক টুকরো মেঘ। পান্টা ডেল এসটে শহর ও বন্দর নবরূপে সাজতে বসেছে, জ্বলে উঠেছে আলোগুলো। বন্দরের সবগুলো জাহাজ আলোকমালায় সাজানো। শুধু একটা বাদে।

    তবে মাত্র একজনই ব্যাপারটা লক্ষ করলেন।

    লেডি ফ্ল্যামবোহোর অস্পষ্ট কাঠামো ছাড়া আর কিছু দেখতে না পেয়ে বিস্মিত হলেন সিনেটর জর্জ পিট। লেডি ফ্ল্যামবোরোর পেছনে আরও একটা জাহাজ রয়েছে, উজ্জ্বল আলোয় উদ্ভাসিত সেটা, সেই আলোর আভায় কোনো রকমে লেডি ফ্ল্যামবোরোকে দেখতে পেলেন তিনি।

    একটা লঞ্চে রয়েছেন সিনেটর পিট। লেডি ফ্ল্যামবোরোকে শুধু অন্ধকার নয়, পরিত্যক্ত বলে মনে হলো তার। জাহাজটার বো-র সামনে দিয়ে এগোল লঞ্চ, বোর্ডিং স্টেয়ার-এর পাশে এসে থামল।

    হাতে শুধু একটা ব্রিফকেস, হালকা ছোট্ট লাফ দিয়ে প্ল্যাটফর্মে নামলেন তিনি। মাত্র দুটো ধাপ বেয়ে উঠেছেন, লঞ্চটা ঘুরে গিয়ে ডকের দিকে ফিরতি পথে রওনা হয়ে গেল। ডেকে পৌঁছে দেখলেন, তিনি একা। কোথাও মারাত্মক কিছু একটা ঘটেছে। প্রথমে তার ধারণা হলো, ভুল করে অন্য কোনো জাহাজে উঠে পড়েছেন।

    শব্দ আসছে শুধু সুপাস্ট্রাকচারের দিক থেকে, সম্ভবত একটা স্পিকার সিস্টেম অন করা হয়েছে। খোলের গভীর থেকে জেনারেটরের গুঞ্জন শোনা গেল। তাছাড়া আর কোনো শব্দ নেই। ঘুরলেন তিনি, গলা চড়িয়ে লঞ্চটাকে ডাকবেন, কিন্তু এরই মধ্যে বেশ অনেকটা দূরে চলে গেছে সেটা। এই সময় হঠাৎ করে কালো জাম্পস্যুট পরা একটা মূর্তি ঘনছায়া থেকে বেরিয়ে এল, হাতের অটোমেটিক রাইফেলটা সরাসরি সিনেটর পিটের তলপেট লক্ষ্য করে ধরা।

    এটা কি লেডি ফ্ল্যামবোরো নয়? জিজ্ঞেস করলেন সিনেটর পিট।

    কে আপনি? পাল্টা প্রশ্ন হলো কণ্ঠস্বর এত সতর্ক ও নিচু যে কোনো রকমে শুনতে পেলেন সিনেটর পিট। কী বললেন, সিনেটর পিট আপনি? আমেরিকান? কিন্তু আপনাকে আমরা আশা করছি না।

    প্রেসিডেন্ট নাদাভ হাসান জানেন আমি আসব, গম্ভীর সুরে বললেন সিনেটর পিট, রাইফেলটা যে তার দিকে তাক করা রয়েছে তা যেন তিনি দেখেও দেখছেন না। তবে এরই মধ্যে তিনি সতর্ক হয়ে গেছেন, রাইফেল ধরার ভঙ্গিটাই তাঁকে বলে দিয়েছে ওটার পেছনে দাঁড়ানো লোকটা প্রফেশনাল। আমাকে তার কাছে নিয়ে চলুন, বললেন তিনি, অনেকটা নির্দেশের সুরেই।

    তীর থেকে আসা আলোয় চকচক করে উঠল গার্ডের চোখ, সন্দেহের দোলায় দুলছে সে। আপনার সাথে আর কেউ এসেছে?

    না, আমি একা।

    আপনাকে তীরে ফিরে যেতে হবে।

    মাথা ঝাঁকিয়ে লঞ্চটাকে দেখিয়ে দিলেন সিনেটর পিট। আমার বাহন চলে গেছে।

    মনে হলো ব্যাপারটা নিয়ে চিন্তা করছে গার্ড। অবশেষে রাইফেলের ব্যারেল নিচু করল সে, কয়েক পা হেঁটে একটা দরজার সামনে থামল। খালি হাত লম্বা করে ব্রিফকেসটার দিকে ইঙ্গিত করল সে। এখানে, ফিসফিস করে বলল। হাতের কেসটা আমাকে দিন।

    এতে সরকারি ডকুমেন্ট আছে, শান্তভাবে বললেন সিনেটর পিট, সেটা আরও শক্ত করে ধরে গার্ডকে প্রায় ধাক্কা দিয়ে দরজার দিকে এগোলেন।

    ভারী, কালো পর্দাটা সরিয়ে ভেতরে ঢুকে সিনেটর পিট দেখলেন, বিশাল একটা ডাইনিং সেলুনে দাঁড়িয়ে রয়েছেন তিনি। কামরাটা চারকোনা, দুহাজার বর্গমিটারের কম হবে না। ভেতরে প্রচুর লোকজন, কেউ দাঁড়িয়ে, কেউ বসে কারও পরনে বিজনেস স্যুট, কেউ পরে আছে ক্রু ইউনিফর্ম; সবাই তারা মুখ ফিরিয়ে একযোগে তাঁর দিকে তাকাল, টেনিস ম্যাচে তিনি যেন একটা বল।

    চারদিকের দেয়াল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে রয়েছে নজন লোক, মারমুখো থমথমে চেহারা সবার, প্রত্যেকের পরনে কালো জাম্পস্যুট, পায়ে কালো জিগং শু, প্রত্যেকে তার হাতের অটোমেটিক রাইফেল বন্দিদের দিকে অনবরত ঘোরাচ্ছে।

    স্বাগতম, স্টেজের ওপর, মাইক্রোফোনের সামনে দাঁড়ানো লোকটা বলল, যান্ত্রিক কণ্ঠস্বর গমগম করে উঠল কামরার ভেতর। সশস্ত্র নজনের মতো একই কাপড় আর জুতো পরেছে সে, পার্থক্য শুধু আর কারও মুখে মুখোশ নেই। আপনার পরিচয় দিন প্লিজ।

    কী ঘটছে এখানে? কঠিন সুরে জিজ্ঞেস করলেন সিনেটর পিট।

    আপনি কি দয়া করে আমার প্রশ্নের উত্তর দেবেন? ঠাণ্ডা ভদ্রতার সাথে জিজ্ঞেস করল সুলেমান আজিজ।

    আমি সিনেটর জর্জ পিট, কংগ্রেস সদস্য। বললেন সিনেটর পিট, মিসরের প্রেসিডেন্ট নাদাভ হাসানের সাথে কথা বলার জন্য এসেছি। আমাকে বলা হয়েছে, তিনি এই জাহাজে আছেন।

    একটু কষ্ট করে তাকালে দেখতে পাবেন, সামনের সারিতেই বসে আছেন তিনি।

    স্টেজে দাঁড়ানো সুলেমান আজিজের দিক থেকে সিনেটর পিট চোখ সরালেন না। সবার দিকে এই লোকগুলো রাইফেল তাক করে আছে কেন?

    বুঝতে পারছেন না? বিস্ময় প্রকাশ করল সুলেমান আজিজ। লেডি ফ্ল্যামবোরোকে হাইজ্যাক করা হয়েছে।

    প্রচণ্ড রাগে এক সেকেন্ডের জন্য দিশেহারা বোধ করলেন সিনেটর পিট। নিজেকে সামলে নিয়ে সুলেমান আজিজের আপাদমস্তক খুঁটিয়ে দেখলেন। তারপর এমন দৃঢ়তার সাথে মুখ ফিরিয়ে নিলেন, তাতে শুধু তাচ্ছিল্য আর অবজ্ঞাই প্রকাশ পেল। সামনের সারিতে বসা লোকগুলোর দিকে তাকালেন তিনি। এগোলেন।

    ক্যাপটেন কলিন্স আর তার অফিসারদের পাশ কাটিয়ে এলেন সিনেটর পিট, তাদের পাশে বসে থাকতে দেখলেন প্রেসিডেন্ট নাদাভ হাসান ও প্রেসিডেন্ট দো। লরেঞ্জোকে। তারপর হে’লা কামিলকে দেখতে পেয়ে থমকে দাঁড়িয়ে পড়লেন।

    লোকজন মারা যাবে উপলব্ধি করে মনে মনে প্রমাদ গুনলেন তিনি।

    নিঃশব্দে একটা হাত বাড়িয়ে হে’লা কামিলের কাঁধে রাখলেন, চাপ দিলেন মৃদু, তারপর চরকির মতো আধপাক ঘুরে সুলেমান আজিজের দিকে ফিরলেন। খোদার নামে বলছি, কী করছো তুমি জানো?

    অবশ্যই জানি। খুব ভালো করে জানি। সিনেটরের মুখের ওপর হাসল সুলেমান আজিজ। আল্লাহর আমার সাথে প্রতিটি পদক্ষেপ হেঁটেছেন। উপরি পাওনা হিসেবে পেয়েছি জাতিসংঘ মহাসচিবকে। সঙ্গে মার্কিন সিনেটর।

    বিশাল কামরার ভেতর গমগম করে উঠল সিনেটরের ভারী গলা জীবনের সবচেয়ে বড় ভুলটা করে বসেছ, হে। নিজেদের ভালো চাইলে, এখনও সময় আছে, পালিয়ে যাও। তা না হলে পস্তানোরও সময় পাবে না।

    তাই না কি? কিন্তু আমি সফল হবই!

    অসম্ভব!

    ধৈর্য ধরুন, নিজের চোখেই দেখতে পাবেন সব।

    .

    ৩৬.

    বিকেল পাঁচটার খানিক পর অফিস থেকে বিদায় নেয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন ডেইল নিকোলাস, এই সময় সিআইএ হেডকোয়ার্টার থেকে তার সাথে দেখা করতে এল এক লোক। কিথ ফার্কার কে তিনি চেনেন, সিআইএ চিফের বিশেষ প্রতিনিধি। বলার অপেক্ষায় না থেকে একটা চেয়ারে বসল সে, হাতের ব্রিফকেসটা কোলের ওপর ফেলে প্রথমে তারা খুলল, তারপর একটা বোম টিপে ভেতরে লুকানো বিস্ফোরক আপাতত অকেজো করল। কেস থেকে মোটা একটা ফাইল বের করে ডেইল সামনে ডেস্কের ওপর রাখল সে।

    চিফ আপনাকে বলতে বলেছেন, আখমত ইয়াজিদ সম্পর্কে নিরেট তথ্য পাওয়া দুষ্কর জন্ম, পিতা-মাতা, পূর্ব-পুরুষ, লেখাপড়া, বিয়ে, বাচ্চাকাচ্চা, কিংবা আইনগত কোনো ব্যাপার, তা ক্রিমিনালই হোক বা সিভিল, বলতে গেলে এ-সবের প্রায় কোনো অস্তিত্বই নেই। মধ্যপ্রাচ্যে আমাদের সূত্র থেকে যেসব তথ্য পাওয়া গেছে তাও লোকজনকে, মানে তাকে যারা একসময় চিনত বলে দাবি করে তাদের জিজ্ঞেস করে। দুর্ভাগ্য যে তারা সবাই, কোনো না কোনো কারণে ইয়াজিদের শক্ত হয়ে ওঠে। কাজেই তাদের বক্তব্য নিরপেক্ষ মনে করা যায় না।

    আপনাদের সাইকোলজিকাল সেকশন কী বলছে? জিজ্ঞেস করলেন ডেইল নিকোলাস।

    তারা আবছা একটা প্রোফাইল তৈরি করেছে। তাকে ঘিরে আছে সিকিউরিটির দুর্ভেদ্য দেয়াল। আখমত ইয়াজিদ মানেই একটা রহস্য। তার আশপাশের লোকজনের সাথে সাংবাদিকরা কথা বলার চেষ্টা করেছে, কিন্তু প্রশ্নের উত্তর সবাই তারা শুধু কাঁধ ঝাঁকায়, মুখ খোলে না।

    রহস্য আরও বাড়ে।

    নিঃশব্দে হাসল কিথ ফার্কার। চিফ বলছেন, ছলনাময় মরীচিকা।

    ফাইলটা নিয়ে আসার জন্য ধন্যবাদ, বার্নস, ডেইল নিকোলাস বললেন। হ্যাভ আ নাইস ইভনিং।

    ইউ টু, বলে বিদায় নিল কিথ ফার্কার।

    ডেইলের সেক্রেটারি বাইরে থেকে বন্ধ করে দিল দরজা। বাক্স থেকে একটা চুরুট বেছে নিয়ে দাঁতের ফাঁকে খুঁজলেন ভদ্রলোক, কিন্তু ধরালেন না। ফাইলটা খুলে ধীরে ধীরে পড়তে শুরু করলেন।

    কিথ ফার্কার কিছু বাড়িয়ে বলেনি। ফাইলটা যথেষ্ট মোটা হলেও তাতে শুধু হতো ছয় বছরের তথ্যই বেশি, আখমত ইয়াজিদ দ্রুত জনপ্রিয় হয়ে ওঠার আগের দীর্ঘ সময় সম্পর্কে লেখা হয়েছে মাত্র ছোট্ট একটা প্যারাগ্রাফ। আখমত ইয়াজিদ প্রথম খবর হয়ে ওঠে ছোট্ট একটা ঘটনার মধ্যে দিয়ে। কায়রোর একটা পাঁচতারা হোটেলের সামনে ভুখানাঙ্গা কিছু লোক অবস্থান ধর্মঘট শুরু করে, সেখান থেকে তাকে গ্রেফতার করা হয়, কারণ লোকগুলোকে সেই নেতৃত্ব দিচ্ছিল। কাগজে লেখা হয়, সে নাকি বেশ কিছুদিন থেকে নোংরা বস্তি এলাকায় নিয়মিত বক্তৃতা দিয়ে আসছিল।

    আখমত ইয়াজিদের দাবি, কায়রো শহরের একপ্রান্তে, যেখানে দুনিয়ার আবর্জনা ফেলা হয়, তার পাশে ছোট্ট একটা মাটির ঘরে তার জন্ম। পরিবারের সদস্যরা কোনো দিন খেতে পেত, কোনো দিন পেত না। অপুষ্টিজনিত রোগে ভুগে তার দুই বোন আর বাবা মারা যায়। ছেলেবেলায় তার স্কুলে যাওয়া হয়নি, কৈশোরে মৌলভীদের কাছ থেকে ধর্মীয় শিক্ষা অর্জন করে সে, যদিও কেউ তারা তার ভরণ-পোষণের দায়িত্ব নিতে রাজি হয়নি। আখমত ইয়াজিদ আরও দাবি করে, দুনিয়ার শেষ পয়গম্বর হজরত মোহাম্মদ (স) তাকে দেখা দেন এবং তার সাথে কথা বলেন। তিনিই নাকি তাকে আদেশ দিয়ে বলেছেন, ঈমানদার লোকদের সাথে নিয়ে মিসরকে ইউরোপিয়ান ইসলামিক রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তোলা।

    অদ্ভুত সুন্দর ভাষণ দিতে পারে সে। শ্রোতারা তার কথার জাদুতে মুগ্ধ হয়ে যায়। শ্রোতাদের ধর্মীয় আবেগ উসকে দিতেও তার জুড়ি নেই। তার দাবি, পশ্চিমা দর্শন মিসরের সামাজিক/অর্থনৈতিক সমস্যার সমাধান করতে পারবে না।

    মুখে সন্ত্রাসবাদের নিন্দা করলেও, একাধিক ঘটনা থেকে আভাস পাওয়া যায় যে তার ধর্মীয় আন্দোলনের স্বার্থে সন্ত্রাসী তৎপরতার আশ্রয় প্রায়ই সে নিয়ে থাকে। একটা ঘটনায় এয়ারফোর্সে একজন জেনারেল খুন হন। আরেক ঘটনায় নিহত হন কায়রো ইউনিভার্সিটির চারজন অধ্যাপক, তারা ইসলামী অর্থনীতির বিরুদ্ধে ও সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির পক্ষে বক্তব্য রাখছিলেন। তৃতীয় ঘটনায় ভাগ্যক্রমে কেউ মারা যায়নি, সোভিয়েত দূতাবাসের সামনে বিস্ফোরিত হয় একটা ট্রাক। তদন্ত চালাতে গিয়ে দেখা গেছে প্রতিটি ঘটনার পেছনে গোপনে জড়িত ছিল আখমত ইয়াজিদ। নিশ্চিতভাবে কিছু প্রমাণ করা সম্ভব না হলেও, মুসলমান সূত্রের মাধ্যমে সিআইএ জানতে পেরেছে প্রেসিডেন্ট নাদাভ হাসানকে খুন করার জন্য একটা পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে আখমত ইয়াজিদ। তার প্রকৃত উদ্দেশ্য, জনতা তাকে চায়, এ কথা বলে সরকারকে উৎখাত করা।

    ফাইল বন্ধ করে অবশেষে চুরুটটা ধরালেন ডেইল নিকোলাস। কী যেন তার চোখে পরিষ্কারভাবে ধরা পড়েনি, সেজন্য অস্বস্তিবোধ করছেন। চিন্তা করতে গিয়ে নিজের ভুল বুঝতে পারলেন! না, ধরা পড়েনি নয়, কী যেন একটা পরিচিত বলে মনে হয়েছে তাঁর। ফাইলটা আবার খুলে ইয়াজিদের ফটোগ্রাফ দেখলে। ক্যামেরার দিকে কটমট করে তাকিয়ে আছে সে।

    হঠাৎ করে ব্যাপারটা উপলব্ধি করলেন তিনি। খুবই সহজ একটা ব্যাপার, কিন্তু মহা বিস্ময়কর! তাড়াতাড়ি হাত বাড়িয়ে ফোনের রিসিভার তুলে নিলেন ডেইল নিকোলাস। সরাসরি একটা লাইন পাবার জন্য কোড় করা নম্বরে চাপ দিলেন। ডেস্কের গায়ে আঙুল নাচাচ্ছেন, অপরপ্রান্ত থেকে সাড়া পাওয়া গেল।

    সিআইএ হেডকোয়ার্টার।

    সিআইএ প্রধান, মার্টিন ব্রোগান-এর গলা চিনতে পারলেন ডেইল নিকোলাস। ঈশ্বরকে ধন্যবাদ, তুমি এখনও অফিসে আছ।

    মার্টিন ব্রোগান-ও ডেইল গলা চিনতে পারলেন। কী ব্যাপার, ডেইল? তোমাকে উত্তেজিত মনে হচ্ছে? ইয়াজিদের ফাইলটা পেয়েছো?

    হ্যাঁ, ধন্যবাদ, বলল ডেইল নিকোলাস। ফাইলটা পড়তে গিয়েই তো একটা সন্দেহ ঢুকল মনে। তুমি আমাকে সাহায্য করতে পারবে?

    নিশ্চয়ই, কী ব্যাপার?

    দু সেট ব্লাড টাইপ আর ফিঙ্গারপ্রিন্ট দরকার আমার।

    ফিঙ্গারপ্রিন্ট?

    হ্যাঁ।

    আজকাল আমরা জেনেটিক কোড আর ডিএনএ ট্রেসিং ব্যবহার করি, মার্টিন ব্রোগান জানালেন। নির্দিষ্ট কোনো কারণ আছে, ডেইল?

    ভাবনাগুলো গুছিয়ে নেয়ার জন্য চুপ করে থাকলেন ডেইল নিকোলাস, তারপর বললেন, কারণটি যদি তোমাকে বলি, ঈশ্বরের দিব্যি, আমাকে তুমি বদ্ধ উন্মাদ ভাববে!

    ভুলে যেয়ো না, রাগের সুরে বলল হিরাম ইয়েজার, আমরা মোলোশো বছরের পুরনো একটা ট্রেইল খুঁজছি। কম্পিউটর তো আর অতীতে গিয়ে দেখে আসতে পারে না কেমন ছিল সেটা।

    শিল্পকর্মগুলো দেখলে ড. গ্রোনকুইস্ট হয়তো একটা ধারণা দিতে পারতেন, বলল লিলি।

    পিট বলল, খানিক আগে তাঁর সাথে আমার রেডিওতে কথা হয়েছে। নুমার অ্যামফিথিয়েটারে বসে রয়েছে ওরা, পিট বসেছে ওদের দুসারি চেয়ে সিটে, বা দিক ঘেঁষে। তার ধারণা, ভূমধ্যসাগরের বাইরে কোথাও আলেকজান্দ্রিয়া লাইব্রেরি থাকতে পারে না।

    একটা চিত্রে ফুটে রয়েছে আটলান্টিক মহাসাগর, তাতে তীরের উত্থান-পতন ও ভাজগুলো পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। স্টেজের ওপর একটা স্ক্রিন জুড়ে রয়েছে সাগরতলের বৈশিষ্ট্য। গভীর ধ্যানমগ্ন দৃষ্টিতে সেটার দিকে তাকিয়ে রয়েছে সবাই। সবাই, শুধু একজন বাদে।

    অ্যাডমিরাল স্যানডেকার যখন ছোট্ট অ্যামফিথিয়েটারে ঢোকেন, অ্যাল জিওর্দিনো তাড়াতাড়ি চুরুটটা লুকিয়ে ফেলে। সেই থেকে বারবার তার হাতের দিকে চোরা চোখে তাকাচ্ছেন তিনি। একসময় আর থাকতে পারলেন না, ফিরে জিজ্ঞেস করলেন, ওটা কী?

    আমাকে কিছু বলছেন, বস?

    তোমার হাতে ওটা কি?

    জ্বি? বিব্রত বোধ করল জিওদিনো। জ্বি, একটা চুরুট।

    এত লম্বা? অবাক হলেন অ্যাডমিরাল। বেশ দামি সিগার।

    জ্বি-না। নাম জানি না।

    কোত্থেকে পেলে? রীতিমতো জেরা শুরু করলেন স্যানডেকার।

    বাল্টিমোরের একটা দোকান থেকে কিনেছি।

    আর কোনো সন্দেহ থাকল না অ্যাডমিরালের, জিওর্দিনোই তার চুরুট চুরি করছে। চুরিটা অনেক দিন থেকেই হচ্ছে, কিন্তু কে করছে বা কীভাবে করছে ধরা যাচ্ছিল না। বক্স থেকে প্রতি সপ্তাহয় দুটো করে চুরুট খোয়া যায়। ঠিক আছে, মনে মনে ভাবলেন অ্যাডমিরাল, কে চুরি করছে তা যখন জানা গেছে, কীভাবে চুরি করছে তাও সময়মতো জানা যাবে।

    হ্যাঁ, কি যেন বলছলে তুমি? পিটকে জিজ্ঞেস করলেন তিনি।

    আমরা ভুল দৃষ্টিকোণ থেকে সমস্যাটা নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছি, বলল পিট।

    তুমি বলতে চাও, আরও একটা দৃষ্টিকোণ থাকতে পারে? প্রায় চ্যালেঞ্জের সুরে প্রশ্ন করল হিরাম ইয়েজার।

    দিকনির্দেশনা না থাকায় কাজটা অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে, বলল লিলি।

    দুঃখজনক হলো রাফিনাস তার দৈনন্দিন পজিশন বা কতটা পথ পাড়ি দিল সে সম্পর্কে কিছু লেখেনি, অ্যাডমিরাল হতাশা ব্যক্ত করলেন।

    তার ওপর কড়া নির্দেশ ছিল, কিছু রেকর্ড করা যাবে না।

    তবে কি তখনকার দিনে পজিশন জানা থাকলে নির্দিষ্ট একটা জায়গা খুঁজে বের করতে পারত তারা? জিওর্দিনো জিজ্ঞেস করল।

    মাথা ঝাঁকাল লিলি। গ্রিক হিপারচাস, খ্রিস্টের জন্মের একশো ত্রিশ বছর আগে, ল্যান্ডমার্ক-এর পজিশন নির্ধারণ করতেন ওগুলোর দৈর্ঘ্য, প্রস্থ আর পেছনে ফেলে আসা ল্যান্ডমার্কের দূরত্ব আন্দাজ করে।

    রিডিং গ্লাসটা নাকের ডগায় নেমে এসেছে, ফ্রেমের ওপর দিয়ে পিটের দিকে তাকালেন অ্যাডমিরাল। তোমার চোখের উদভ্রান্ত দৃষ্টি আমি চিনি। কী যেন বিরক্ত করছে তোমাকে।

    সীটের ওপর নড়েচড়ে বসল পিট। এত কিছু নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছি আমরা, কিন্তু আসল লোকটার কথা ভুলে বসে আছি। স্মাগলিংয়ের প্ল্যানটা ছিল তার।

    জুনিয়াস ভেনাটর?

    তাঁর সম্পর্কে বলা হয়েছে, একজন বেপরোয়া আবিষ্কারক ও গবেষক। অন্যান্য পণ্ডিতরা যেসব বিষয় নিয়ে কাজ করতে সাহস পেতেন না, তিনি বিশেষ করে সেসব বিষয়ে মাথা ঘামাতেন। সমস্যাটাকে এভাবে চিন্তা করতে হবে-আমরা যদি ভেনাটর হতাম, আমাদের সময়কার লাইব্রেরি সম্পদ কোথায় নিয়ে গিয়ে লুকাতাম আমরা?

    এখনও আমি বলব আফ্রিকায়, দৃঢ়তার সাথে জানাল ইয়েজার। পূর্বতীরের কোথাও।

    অথচ তোমার কম্পিউটর কোনো মিল দেখাতে পারছে না।

    সেটা কম্পিউটরের দোষ নয়, কারণ ষোলোশ বছরে জমিন সম্পূর্ণ বদলে গেছে।

    আচ্ছা, ভেনাটর উত্তর-পূর্ব দিকে অর্থাৎ কৃষ্ণসাগরের দিকে যেতে পারেন না? প্রশ্নটা লিলির।

    রাফিনাস স্পষ্ট করে জানিয়েছে, যেতে আটান্ন দিন লেগেছিল তাদের, বলল জিওর্দিনো।

    চুরুট ধরিয়ে অ্যাডমিরাল বললেন, হ্যাঁ, কিন্তু জাহাজ বহর যদি খারাপ আবহাওয়ায় পড়ে থাকে? ওই সময়ের মধ্যে হয়তো হাজার মাইলও পেরোতে পারেনি।

    তর্ক-বিতর্ক চলতেই থাকল, কোনো সমাধান আসছে না। এমন সময় পিট বলল, এমন কি হতে পারে না, ভেনাটর তার জাহাজবহর নিয়ে পশ্চিমে, এই আমেরিকায় এসেছিলেন?

    লিলি পিটের বিপক্ষে বলল, আমেরিকার সাথে কলম্বাসের আগে আর কেউ যোগাযোগ করেছিল, এমন আর্কিওলজিকাল রেকর্ড নেই, পিট।

    প্রথম কথা, সেরাপিসকে দেখে পরিষ্কার বোঝা যায়, দূরের পথ পাড়ি দেয়ার মতো করেই ওটাকে তৈরি করা হয়, বলল পিট। মায়ান আর্ট ও কালচারের কথাই ধরো, এশিয়া আর ইউরোপের আর্ট ও কালচারের সাথে এমন সব মিল আছে, এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। আমার শুধু একার নয়, অনেকেরই ধারণা, কলম্বাসের আগে আমেরিকায় আরও অনেকেই এসেছিল।

    আর্কিওলজিস্টরা তোমার কথায় কান দেবে না, পিট, বলল লিলি।

    অ্যাডমিরাল প্রস্তাব দিলেন, ঠিক আছে, ঠিক আছে-পিটের যুক্তিটাও পরীক্ষা করে দেখা যাক।

    ইয়েজার জানতে চাইল, কোথাকার তীর তুমি দেখতে চাও হে?

    গাল চুলকাল পিট। দুদিন দাড়ি কামানো হয়নি। গ্রিনল্যান্ড খড়ি থেকে শুরু করো, দক্ষিণ দিকে এগিয়ে পানামায় এসো। চার্ট প্রজেকশনের দিকে তাকিয়ে আছে ও। ওখানে কোথাও লাইব্রেরিটা থাকতেই হবে।

    .

    ৩৭.

    ব্রিজ ব্যারোমিটার আঙুলের একটা টোকা দিলেন ক্যাপটেন অলিভার কলিন্স। তীর। থেকে আসা অস্পষ্ট আলোয় কাঁটাটা কোনোমতে দেখা গেল। মনে মনে হতাশ হলেন তিনি। আবহাওয়া শান্ত থাকবে। যদি ঝড় উঠত, ভাবলেন তিনি, জাহাজ নিয়ে বন্দর ত্যাগ করা সম্ভব হতো না। ক্যাপটেন কলিন্স প্রথমশ্রেণীর নাবিক হলেও, মানুষের প্রকৃতি সম্পর্কে তার ভালো ধারণা নেই।

    নব্বই নট বেগে বাতাস বইলেও লেডি ফ্ল্যামবোরোকে নিয়ে খোলা সাগরে বেরোবে সুলেমান আজিজ। ব্রিজ উইন্ডোর পেছনে, ক্যাপটেনের সিটে বসে আছে সে, টান টান হয়ে আছে পেশিগুলো, জুলফি আর মাথার পেছনের চুল থেকে গড়িয়ে পড়া ঘামের ধারা মুছছে বার বার।

    স্যাঁতসেঁতে ব্রিজে হেলম-এর দায়িত্ব নিয়েছে আতঙ্কবাদীদের একজন, চোখে প্রত্যাশা নিয়ে তাকিয়ে আছে তার দিকে। দু’জন সশস্ত্র লোক ব্রিজের দরজা পাহারা দিচ্ছে, তাদের অস্ত্র ক্যাপটেন আর ফাস্ট অফিসার মাইকেল ফিনি-র দিকে তাক করা। দু’জনেই ওরা দাঁড়িয়ে আছে সুলেমান আজিজের হেলমসম্যানের পাশে।

    জোয়ার আসার পর নোঙরের মাথায় ঘুরে গেছে লেডি ফ্ল্যামবোরো, বন্দর এন্ট্রান্সের দিকে মুখ করে রয়েছে জাহাজ। চোখে বাইনোকুলার তুলে শেষ একবার বন্দরের চারদিকটা দেখে নিল সুলেমান আজিজ, তারপর একটা হাত তুলে সঙ্কেত দিল মাইকেল ফিনিকে, কথা বলল পোর্টেবল রেডিওতে। তৈরি হও, এক্ষুনি, নির্দেশ দিল সে।

    রাগে বিকৃত হয়ে আছে মাইকেল ফিনি-র চেহারা ঝট করে ক্যাপটেনের দিকে ফিরল সে। স্নান চেহারা নিয়ে ক্যাপটেনের শুধু মৃদু কাঁধ ঝাঁকালেন। অগত্যা বাধ্য হয়ে নোঙর তোলার নির্দেশ দিল ফার্স্ট অফিসার।

    দুমিনিট পর কালো পানি থেকে জাহাজে উঠে এল নোঙর। হুইলের পাশে দাঁড়িয়ে থাকলেও স্পোক ধরার কোনো চেষ্টা করল না হেলমসম্যান। আধুনিক জাহাজ সাধারণত শুধু খারাপ আবহাওয়ায় ম্যানুয়ালি চালানো হয়, কিংবা পাইলটের সাহায্যে কোনো বন্দর ত্যাগ করার সময় বা বন্দরে ঢোকার সময়। লেডি ফ্ল্যামবোরোয় রয়েছে অটোমেটিক কন্ট্রোল সিস্টেম, বোম টিপে সব কাজ সমাধা করা হয়। দায়িত্বে রয়েছে ফাস্ট অফিসার, রাডার স্ক্রিনের ওপরও তীক্ষ্ণ একটা চোখ রেখেছে সে।

    হাইজ্যাক করা জাহাজটাকে নিয়ে পালিয়ে যাচ্ছে সুলেমান আজিজ। সন্ধ্যার পর চারদিকে গাঢ় হয়ে নেমেছে অন্ধকার, প্রমোদতরীর কাঠামোটা অস্পষ্টভাবে দেখা যাচ্ছে শুধু অপর তীরের আলোর পথে বাধা হয়ে দাঁড়ালে। কী ঘটে যাচ্ছে কেউ লক্ষ করল না। ধীরগতিতে এগোল ফ্ল্যামবোরো, সাবধানে অন্যান্য নোঙর করা জাহাজগুলোকে পাশ কাটিয়ে এল। চ্যানেলে বেরিয়ে এসে ঘুরে গেল খোলা সাগরের দিকে।

    ব্রিজ ফোনের রিসিভার তুলে নিয়ে কমিউনিকেশন রুমের সাথে যোগাযোগ করল সুলেমান আজিজ। কিছু বলার আছে? তীক্ষ্ণ কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল সে।

    এখনও কিছু ঘটছে না, তার একজন অনুচর জবাব দিল, উরুগুয়ে নেভির পেট্রল বোটগুলোর রেডিও ফ্রিকোয়েন্সি মনিটর করছে সে।

    কোনো সঙ্কেত পেলেই ব্রিজ স্পিকারে রিলে করবে।

    জি, জনাব।

    ছোট একটা বোট আমাদের বো-র সামনে দিয়ে পার-হচ্ছে, জানাল মাইকেল ফিনি। আমাদের দিক বদলাতে হবে।

    অটোমেটিক পিস্তলের মাজলটা মাইকেল ফিনি-র খুলির গোড়ায় চেপে ধরল সুলেমান আজিজ। কোর্স আর স্পিড় যা আছে, তাই থাকবে।

    ধাক্কা লাগবে! প্রতিবাদ করল মাইকেল ফিনি। আমাদের আলো নেই, ওরা আমাদের দেখতে পাচ্ছে না!

    উত্তরে মাজলটা আরও জোরে চেপে ধরল সুলেমান আজিজ।

    ক্রমশ এগিয়ে আসছে বোটটা, লেডি ফ্ল্যামবোরো থেকে সবাই তারা পরিষ্কার দেখতে পেল ওটাকে। বেশ বড় একটা মোটর ইয়ট, লম্বায় চল্লিশ মিটারের কম হবে না, আন্দাজ করলেন ক্যাপটেন কলিন্স। চওড়া হবে আট মিটার। খুব সুন্দর দেখতে, উজ্জ্বল আলোয় ঝলমল করছে। ইয়টে সম্ভবত জমজমাট পার্টি চলছে, ডেকে প্রচুর লোকজন, বাজনার তালে তালে একদল নারী-পুরুষ নাচছে। রাডার অ্যান্টেনা ঘুরছে না দৈখে শিউরে উঠলেন কলিন্স।

    হর্ন বাজিয়ে সতর্ক করো ওদের, তাড়াতাড়ি অনুরোধ করলেন তিনি। সময় থাকতে ওদেরকে সরে যাবার একটা সুযোগ দাও।

    অবজ্ঞার সাথে চুপ করে থাকল সুলেমান আজিজ।

    দুঃসহ সেকেন্ডগুলো পেরিয়ে যেতে লাগল। একসময় সবাই উপলব্ধি করল, সংঘর্ষ অবধারিত। ইয়টের ডেকে যারা নাচানাচি করছে বা যে লোকটা হেলমের দায়িত্বে রয়েছে, কেউ তারা টের পায়নি অন্ধকারের ভেতর থেকে ইস্পাতের তৈরি প্রকাণ্ড একটা দানব তাদের ঘাড়ে লাফিয়ে পড়তে যাচ্ছে।

    অমানবিক! হাঁপিয়ে উঠলেন কলিন্স। এ স্রেফ অমানবিক!

    ইয়টের স্টারবোর্ড সাইডে সরাসরি বোর ধাক্কা মারল লেডি ফ্ল্যামবোরো। বড় কোনো ঝুঁকি লাগল না। লেডি ফ্ল্যামবোরোর চারতলা সমান উঁচু বোর নিচে চাপা পড়ে গেল ইয়ট। সামান্য একটু কাঁপুনি অনুভব করল ব্রিজে দাঁড়ানো লোকজন। বোর নিচে চাপা পড়ো ইয়ট পানির নিচে নেমে গেছে, মাঝখান থেকে দুটুকরো হয়ে গেছে আগেই।

    ফরওয়ার্ড ব্রিজে রেইলিং ধরে থরথর করে কাঁপছেন ক্যাপটেন কলিন্স, ইয়টের ভাঙাচোরা অংশ লেডি ফ্ল্যামবোরোর পাশ দিয়ে ভেসে যেতে দেখছেন তিনি, নারীকণ্ঠের করুণ আর্তনাদ পরিষ্কার শুনতে পাচ্ছেন। কোনো একটা অংশও পঞ্চাশ মিটার যেতে পারল না, তার আগেই ডুবে গেল। লেডি ফ্ল্যামবোরোর পেছনে আলোড়িত পানিতে লাশ ভাসতে দেখলেন তিনি।

    হতভাগা মাত্র কয়েকজন আরোহী ইয়ট থেকে ছিটকে পড়েছে দূরে, সাঁতার কেটে আরও দূরে সরে যাবার প্রাণপণ চেষ্টা করছে তারা। তাদের মধ্যে যারাহত, সাঁতার কাটতে পারবে না, কিছু একটা ধরার জন্য হাতড়াচ্ছে চারদিকে। হঠাৎ অন্ধকারে হারিয়ে গেল তারা।

    ইউ খুনি হারামজাদা! চিৎকার করে উঠল মাইকেল ফিনি, এক দলা থুথু ছুঁড়ে দিল সুলেমান আজিজের দিকে।

    ন্যায়-অন্যায় বিচার করার মালিক একা শুধু আল্লাহ, শান্তভাবে, নির্লিপ্ত সুরে বলল সুলেমান আজিজ। মাইকেল ফিনি-র খুলি থেকে অটোমেটিকটা সরিয়ে নিল সে। চ্যানেল থেকে বেরোবার পর হেডিং হবে ওয়ান-ফাইভ ডিগ্রি ম্যাগনেটিক। অটোমেটিক পাইলট এনগেজ করবে।

    রেলিং ছেড়ে সুলেমান আজিজের দিকে ফিরলেন ক্যাপটেন। ফর গডস সেক, সি রেসকিউ সার্ভিসকে রেডিও মেসেজ পাঠাও। কয়েকজনক এখনও বাঁচানো যাবে।

    না।

    রেসকিউ সার্ভিসকে নিজের পরিচয় না দিলেও পারো তুমি।

    মাথা নাড়ল সুলেমান আজিজ। আমার কি মাথা খারাপ হয়েছে? রেসকিউ সার্ভিস দুর্ঘটনার রিপোর্ট দেবে না সিকিউরিটি ফোর্সকে? আমাদের অনুপস্থিতি টের পেতে এক ঘণ্টাও লাগবে না তদন্ত টিমের। দুঃখিত, ক্যাপটেন, কোথাও কোনো খবর পাঠানো যাচ্ছে না। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব পান্টা ডেল এসটে থেকে দূরে সরে যেতে চাই আমি।

    কয়েক সেকেন্ড একদৃষ্টে সুলেমান আজিজের দিকে তাকিয়ে থাকলেন কলিন্স। তারপর তিনি জানতে চাইলেন, জাহাজ ফেরত পাবার আগে আর কী দেখতে হবে আমাদের?

    আপনারা যদি আমার কথা শোনেন, আপনাদের কারও কোনো ক্ষতি হবে না।

    আর প্যাসেঞ্জারদের? প্রেসিডেন্ট দো লরেঞ্জো আর প্রেসিডেন্ট নাদাভ হাসান? তাদের স্টাফ? ওদের জন্য কী ভেবেছ তুমি?

    শেষ পর্যন্ত ওরা মুক্তি পাবে, টাকার বিনিময়ে।

    কিন্তু আমার তা মনে হচ্ছে না, তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বললেন ক্যাপটেন। তুমি টাকা। পাবার আশায় ওদেরকে কিডন্যাপ করোনি।

    চোখে বিদ্রূপ নিয়ে হাসল সুলেমান আজিজ। জাহাজ চালাতে জানেন, আবার মানুষের মনও পড়তে পারেন?

    দেখেই চেনা যায়, বললেন ক্যাপটেন, তোমার লোকজন সবাই মধ্যপ্রাচ্যের। আমার ধারণা, আমার মিসরীয় অতিথিদের তুমি খুন করতে চাও।

    গলা ছেড়ে হেসে উঠল সুলেমান আজিজ। তারপর সে বলল, মানুষের ভাগ্য নির্ধারণ করেন একমাত্র আল্লাহ! আমি শুধু নির্দেশ পালন করি।

    তোমার নির্দেশের উৎস কী?

    সুলেমান আজিজ জবাব দেয়ার আগে ব্রিজ স্পিকার থেকে যান্ত্রিক একটা কণ্ঠস্বর ভেসে এল, জিরো টু-থারটি-তে হন্দেভো, কমান্ডার।

    পোর্টেবল ট্রান্সমিটারে মেসেজের প্রাপ্তির স্বীকার করল সুলেমান আজিজ। তারপর ক্যাপটেনের দিকে তাকাল। আলোচনা সময় নেই, ক্যাপটেন। সকালের মধ্যে অনেক কাজ সারতে হবে আমাদের।

    কিন্তু আমার জাহাজের কি হবে? জেদের সুরে প্রশ্ন করলেন ক্যাপটেন। আমার জাহাজ আর ক্রুদের সম্পর্কে অবশ্যই জানতে হবে আমাকে।

    হ্যাঁ, সে অধিকার আপনার আছে, আরেক দিকে ফিরে বিড়বিড় করল সুলেমান আজিজ, যেন অন্য কোনো বিষয় নিয়ে চিন্তা করছে সে। কাল সন্ধ্যায় এই সময়, আন্ত র্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলো রিপোর্ট করবে, লেডি ফ্ল্যামবোরোকে কোথাও খুঁজে পাওয়া যায়নি। সবাই ধরে নিতে বাধ্য হবে, সমস্ত প্যাসেঞ্জার আর ক্রু নিয়ে জাহাজটা দুশো ফ্যাদম পানির নিচে তলিয়ে গেছে।

    .

    ৩৮.

    কিছু শুনতে পেলে, কার্লোস? বুড়ো জেলে শক্ত হাতে ধরে আছে প্রাচীন ফিশিং বোটের মরচে ধরা হুইলটা, কোঁচকানো চেহারায় উদ্বেগ।

    কানের পাশে হাত রেখে বোর সামনে অন্ধকারের ভেতর তাকাল ছেলে। একটু পর হেসে উঠে বলল সে, তোমার কান আমার চেয়ে ভালো, পাপা। আমি শুধু আমাদের ইঞ্জিনের আওয়াজ পাচ্ছি।

    ভুল শুনলাম? বিড়বিড় করল বুড়ো। মনে হলো যেন একটা মেয়ের গলা। বাঁচাও! বাঁচাও!

    মেয়ের গলা? মুখের হাসি নিভে গেল ছেলের। আরেকবার সামনে তাকাল সে। তারপর কাঁধ ঝাঁকালো৷ কউ, আমি তো কিছুই শুনতে পাচ্ছি না।

    না, ভুল শুনিনে। বুড়ো লুই শাভেজ শার্টের আস্তিন দিয়ে দাঁড়ি মুছল, অলসভঙ্গিতে থ্রটল টেনে কমিয়ে আনল বোটের গতি। মন-মেজাজ আজ তার দারুণ ভালো। রোজ বেরোলেও, সব দিন মাছ পাওয়া যায় না। আজও অবশ্য হোল্ড মাত্র অর্ধেক ভরেছে, তবে জালে ধরা পড়েছে বিভিন্ন ধরনের সব দামি মাছ, হোটেল-রেস্তে ব্লার শেফ-রা যেকোনো দামে কিনতে রাজি হবে ওগুলো। আনন্দে এরই মধ্যে দু বোতল বিয়ার গিয়ে ফেলেছে বুড়ো।

    পাপা, পানিতে কি যেন দেখতে পাচ্ছি!

    কোথায়?

    হাত তুলল কার্লোস। পোর্ট বো ছাড়িয়ে। ভাঙা বোটের অংশ হতে পারে।

    রাতে আজকাল বুড়ো ভালো দেখতে পায় না। তারপর রানিং লাইটের ধরা পড়ল, ভাঙা টুকরোগুলো। তার মধ্যে অনেকগুলোই সাদা রং করা কাঠ। অভিজ্ঞতা থেকে আন্দাজ করল বুড়ো, ওগুলো শুধু একটা ভাঙা ইয়টের অংশ হতে পারে। বিস্ফোরণে বিধ্বস্ত হয়েছে? নাকি সংঘর্ষে? পোর্টের সবচেয়ে কাছের আলোটাও দুকিলোমিটার দূরে, বিস্ফোরণ ঘটলে তীর থেকে শুনতে পাবার কথা। অথচ চ্যানেলে কোনো রেসকিউ বোটের আলো দেখা যাচ্ছে না।

    ইয়টের ভাঙাচোরা টুকরোগুলো ভাসছে, সেগুলোর মাঝখানে ঢুকে পড়ছে ফিশিং বোট, এই সময় আবার সেই আওয়াজটা শুনতে পেল বুড়ো জেলে। প্রথমে যেটাকে চিৎকার বলে মনে হয়েছিল, এখন সেটাকে ফোঁপানোর শব্দ মনে হলো। এবার একেবারে কাছ থেকে ভেসে এল।

    গ্যালি থেকে রাউল, জাস্টিরো আর ম্যানুয়ালকে ডেকে আনো। জলদি, বাপ, জলদি! ওদের বলো, উদ্ধার করার জন্য পানিতে নামতে হবে।

    ছুটল কার্লোস। গিয়ার লিভার স্টপ-এ টেনে আনল বুড়ো লুই শাভেজ। হুইলহাউস থেকে বেরিয়ে এসে বোতাম টিপে স্পটলাইট জ্বালা সে, ধীরে ধীরে পানিতে ঘোরাল আলোটা।

    বিশ মিটার দূরেও নয়, চওড়া কেটা তক্তা দেখল লুই শাভেজ, সন্দেহ নেই কোনো ইয়টেরই ভাঙা ডেক। টুকরোটার ওপর জড়াজড়ির করে রয়েছে দুটো দেহ। একজন পুরুষ, তার বোধ হয় জ্ঞান নেই। দ্বিতীয়জন নারী, পুরুষটাকে এক হাতে বুকের সাথে জড়িয়ে ধরে রেখেছে, আলোর দিকে ফির অপর হাতটা ঘন ঘন নাড়ল সে, পা ছুড়ল পানিতে, উন্মাদিনীর মতো চিৎকার শুরু করল।

    শান্ত হও! অভয় দিল বুড়ো লুই শাভেজ। ভয় পেয়ো না! আমরা আসছি! ছুটন্ত পায়ের আওয়াজ পেয়ে পেছন ফিরল সে। ছুটে এসে দুপাশে ভিড় করল ত্রুরা।

    কিছু দেখতে পাচ্ছেন? জিজ্ঞেস করল লুইস।

    একটা তক্তার ওপর দু’জন বেঁচে আছে। ওদেরকে ভোলার জন্য প্রস্তুতি নাও।

    আজ কেউ আমরা পানিতে নামছি না। একজন মাল্লা বলল শান্ত স্বরে।

    তার বলার সুরে এমন একটা কিছু ছিল, ঝট করে তক্তাটার দিকে ফিরল লুই শাভেজ। লম্বা ফি দেখে ছ্যাঁৎ করে উঠল তার বুক। মেয়েটা বুকের সাথে আরও জোরে চেপে ধরেছে পুরুষটাকে, আতঙ্কে বিস্ফোরিত চোখ জোড়া রাক্ষুসে হাঙরের কুৎসিত মাথার ওপর স্থির।

    মস্ত চোয়ালটা খুলছে আর বন্ধ করছে হাঙর, তার কুতকুতে চোখ দুটো স্থির হয়ে আছে পানিতে নেমে আসা মেয়েটার পায়ের ওপর। বুড়ো লুই শাভেজ শিউরে উঠল, ইচ্ছে হলো মুখটা অন্য দিকে ফিরিয়ে নেয়, কিন্তু পারল না। আর্তনাদ করে উঠল মেয়েটা, চোয়ালের মাঝখানে তার পা আটকে নিয়ে নিচের দিকে টানছে হাঙর। এরপর যে দৃশ্যটা বুড়ো দেখল, জীবনে কখনও ভুলবে না। তক্তা থেকে অর্ধেক নেমে গেছে মেয়েটা, বুঝতে পারছে বাঁচার কোনো আশা নেই। বুক থেকে পুরুষটাকে ফেলে দিল সে, দুহাত দিয়ে ঠেলে তক্তার কিনারা থেকে সরিয়ে দিতে চেষ্টা করল অজ্ঞান দেহটাকে, হাঙর যাতে তার নাগাল না পায়। পরমুহূর্তে সরাৎ করে পানির নিচে তাকে টেনে নিল হাঙর। ভারসাম্যে ব্যাঘাত সৃষ্টি হওয়ায় তক্তাটা কাত হলো সামনের দিকে, গড়িয়ে পানিতে নেমে গেল অজ্ঞান দেহটাও। এক ঝাঁক হাঙর ঝাঁপিয়ে পড়ল দু’জনের ওপর।

    .

    এর প্রায় ঘণ্টাখানেক পর।

    ব্যাটল ড্র পরা একদল অফিসারের সামনে কর্নেল হোসে রোয়েস দাঁড়িয়ে আছে, ঠিক যেন খাড়া একটা লোহার রড। উরুগুয়ের সামরিক স্কুল থেকে গ্র্যাজুয়েট হবার পর ব্রিটেনে গিয়ে রণকৌশলের ওপর ট্রেনিং নিয়েছে সে, সেই থেকে হাতে একটা খাটো ছড়ি রাখা অভ্যাস পরিণত হয়েছে, এটা তার আত্মবিশ্বাস অনেক গুণ বাড়িয়ে দেয়।

    একটা টেবিলের পেছনে দাঁড়িয়ে আছে কর্নেল, টেবিলের ওপর পান্টা ডেল এসটে শহরের একটা মডেল, সাগর-সৈকতসহ। অফিসারদের উদ্দেশে কথা বলছে সে, ডক এলাকায় টহল দেব আমরা তিন দলে ভাগ হয়ে, প্রতি দলে চারজন করে লোক, প্রতি পালায় আট ঘণ্টা করে ডিউটি।

    কথা বলার সময় নাটকীয় ভঙ্গিতে হাতের তালুতে ছড়ির বাড়িয়ে মারছে। মনে রাখতে হবে, ব্যাকআপ ফোর্স হিসেবে কাজ করছি আমরা, সন্ত্রাসবাদীরা হামলা করেছে শুনলেই অকুস্থলে ছুটে যাবার জন্য প্রতি মুহূর্তে তৈরি থাকতে হবে। জানি, লোকের চোখে ধরা না পড়ে টহল দিয়ে বেড়ানো কঠিন, তবু চেষ্টা করে যাও। রাতের বেলা ছায়ার ভেতর থাকবে, দিনের বেলা ভিড়ের মধ্যে মিশে যাবে। ট্যুরিস্টদের আমরা ভয় পাওয়াতে চাই না, তারা যেন আবার ভেবে না বসে যে উরুগুয়ে একটা পুলিশি রাষ্ট্র। কোনো প্রশ্ন?

    লেফটেন্যান্ট এডুরাডো ভেজকুইজ হাত তুলল। কর্নেল?

    এডুরাড়ো?

    কাউকে দেখে যদি সন্দেহ হয়, কি করব আমরা?

    কিছুই করবে না, শুধু তার কথা রিপোর্ট করবে। হয়তো দেখা যাবে লোকটা ইন্টারন্যাশনাল সিকিউরিটি এজেন্টদের একজন।

    কিন্তু তাকে যদি আমরা সশস্ত্র অবস্থায় দেখি?

    সশব্দে নিঃশ্বাস ফেলল কর্নেল। তাহলে তো জানতেই পারলে লোকটা সিকিউরিটি এজেন্ট। আন্তর্জাতিক যেকোনো ব্যাপার কূটনৈতিকদের ওপর ছেড়ে দেয়াই ভালো। পরিষ্কার?

    আর কোনো হাত উঠল না।

    অফিসারদের বিদায় করে দিয়ে বন্দর মাস্টারের বিল্ডিংয়ে চলে এল কর্নেল হোসে রোয়েস, এখানেই অস্থায়ী অফিস দেয়া হয়েছে তাকে। মেশিন থেকে কাপে কফি ঢালছে, পাশে এসে দাঁড়াল তার এইড।

    ক্যাপটেন ফ্লোরেস, ন্যাভাল অ্যাফেয়ার্স, বলল সে। জানতে চাইছে আপনি তার সাথে দোতলায় দেখা করতে পারবেন কি না।

    কেন, বলেছে?

    বলল জরুরি।

    হাতে কফির কাপ, সিঁড়ি না ধরে এলিভেটরে চড়ে নিচে নামল কর্নেল রোয়েস। তার জন্য দোতলায় অপেক্ষা করছে ক্যাপটেন ফোরেস, পরনে নেভির ধবধবে সাদা ইউনিফর্ম। কোনো ব্যাখ্যা না দিয়ে কর্নেলকে পথ দেখিয়ে রাস্তায় বের করে আনল সে, রাস্তা পেরিয়ে ঢুকল বড়সড় একটা দোচালার ভেতর। পানি থেকে উদ্ধার করা বোট ইত্যাদি রাখা হয় এখানে। ভেতরে ঢুকে কর্নেল দেখল, কয়েকজন লোক তোবড়ানো, ভাঙা কিছু টুকরো পরীক্ষা করছে। টুকরোগুলো কোনো বোটের অংশ হতে পারে বলে মনে হলো তার।

    তার সাথে কার্লোস আর লুই শাভেজের পরিচয় করিয়ে দিল ক্যাপটেন ফোরেস। টুকরোগুলো একটা বিধ্বস্ত ইয়টের বলে সন্দেহ করছে ওরা। চ্যানেলে পেয়েছে। ওদের ধারণা, বড় কোনো জাহাজের সাথে ধাক্কা লেগে ডুবে গেছে ইয়টটা।

    ইয়ট অ্যাক্সিডেন্টের ঘটনা, বলল কর্নেল, স্পেশাল সিকিউরিটি কেন মাথা ঘামাতে যাবে?

    বন্দর মাস্টার ছোটখাটো মানুষটা, স্নান গলায় বলল, শীর্ষ সম্মেলন চলছে, দুর্ঘটনাটা শোকের ছায়া ফেলতে পারে। অকুস্থলে রেসকিউ বোট পাঠানো হয়েছে। এখনও জীবিত কাউকে উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি।

    ইয়টের পরিচয় জানতে পেরেছেন?

    উনি একটা টুকরো পেয়েছেন, বন্দর মাস্টার চোখ-ইশারায় লুই শাভেজকে দেখল। ইয়টের একটা নেমপ্লেট। তাতে লোলা লেখা রয়েছে।

    মাথা নাড়ল কর্নেল রোয়েস। আমি সৈনিক। প্রমোদতরীর সাথে পরিচয় নেই। নামটার কি বিশেষ কোনো তাৎপর্য আছে?

    লোলা হলো ভিক্টর রিভেরার স্ত্রীর নাম, ক্যাপটেন ফোরেস বিড়বিড় করে বলল। আপনি তাঁকে চেনেন, কর্নেল?

    আড়ষ্ট হয়ে গেল কর্নেল। আইনসভার স্পিকারকে চিনব না! ইয়টটা কি তার?

    তার নামে রেজিস্ট্রি করা, মাথা ঝাঁকিয়ে বলল ক্যাপটেন ফোরেস। ইতিমধ্যে আমরা তাঁর সেক্রেটারির সাথে বাড়িতে যোগাযোগ করেছি। কোনো তথ্য দিইনি। শুধু জানতে চেয়েছি মি. রিভেরার কোথায় আছেন বলতে পারবে কি না। মেয়েটা জানাল, সে শুধু জানে আর্জেন্টিনিয়ান, ও ব্রাজিলিয়ান ডিপ্লোম্যাটদের সম্মানে নিজের ইয়টে তিনি একটা পার্টি দিচ্ছেন।

    কতজন? জানতে চাইল কর্নেল রোয়েস, বুকের ভেতর মাথাচাড়া দিচ্ছে একটা আতঙ্ক।

    মি. রিভেরার আর তাঁর স্ত্রী, তেইশজন অতিথি, আট-দশজন সব মিলিয়ে ত্রিশ-বত্রিশজন।

    নাম?

    বাড়িতে সেক্রেটারি কোনো তালিকা রাখেনি। তাকে আমি স্পিকারের অফিসে খোঁজ করতে বলেছি।

    একটা দীর্ঘশ্বাস চেপে কর্নেল হোসে রোয়েস বলল, তদন্তের দায়িত্ব এখন থেকে আমি নিলে ভালো হয়।

    সাথে সাথে ক্যাপটেন ফোরেস প্রস্তাব দিল, নেভি যেকোনো সাহায্য করার জন্য প্রস্তুত।

    বন্দর মাস্টারের দিকে ফিরল কর্নেল। জাহাজটার নাম কী?

    সেটা একটা রহস্য। গত দশ ঘণ্টায় বন্দরে কোন জাহাজ আসা-যাওয়া করেনি।

    আপনাকে না জানিয়ে কোনো জাহাজের পক্ষে আসা সম্ভব?

    পাইলটকে না ডেকে সে চেষ্টা করা নেহাৎই বোকামি হবে ক্যাপটেনের।

    সম্ভব কি না? আবার জিজ্ঞেস করল কর্নেল।

    না, দৃঢ়কণ্ঠে জানাল বন্দর মাস্টার। আমি জানতে পারব না অথচ একটা জাহাজ নোঙর ফেলল, সম্ভব নয়।

    মেনে নিল কর্নেল। আর নোঙর তুলে বেরিয়ে যাওয়া?

    প্রশ্নটা নিয়ে কয়েক সেকেন্ড চিন্তা করল বন্দর মাস্টার। তারপর মাথা ঝাঁকাল সে। আমাকে না জানিয়ে ভক থেকে কেউ যেতে পারবে না। তবে জাহাজটা যদি তীর থেকে দূরে নোঙর ফেলে থাকে, যদি জাহাজটার ত্রুর আর ক্যাপটেনের কছে চ্যানেলটা পরিচিত হয়, আর তারা যদি কোনো আলো না জ্বালে-হা, কারও চোখে ধরা না পড়ে খোলা সাগরে বেরিয়ে যেতে পারে।

    নোঙর করা জাহাজের তালিকা, বলল কর্নেল, ক্যাপটেন ফোরেসের হাতে কতক্ষণের মধ্যে দিতে পারবেন?

    দশ মিনিটের ভেতর।

    ক্যাপটেন ফোরেস?

    কর্নেল।

    নিখোঁজ জাহাজ নেভির মাথাব্যথা, কাজেই আমার ধারণা, তদন্তের দায়িত্বটা আপনি নিলে ভালো হয়।

    ধন্যবাদ, কর্নেল। কাজ দেখাবার সুযোগ পেয়ে খুশি হলো ক্যাপটেন ফোরেস। এক্ষুনি শুরু করছি আমি।

    থমথমে চেহারা নিয়ে ঘুরে দাঁড়াল কর্নেল হোসে রোয়েস। জানে, আজ রাতে আকাশ ভেঙে পড়বে মাথায়

    মাঝরাতের খানিক আগে কর্নেলকে রিপোর্ট দিল ক্যাপটেন। ইতোমধ্যে বন্দর ও চ্যানেলের বাইরের জলসীমায় তন্নতন্ন করে তল্লাশি চালিয়েছে সে। রিপোর্টে বলা হলো, একটা মাত্র জাহাজকে পাওয়া যাচ্ছে না। সেটার নাম লেডি ফ্ল্যামবোরো।

    লেডি ফ্ল্যামবোরোর ভিআইপি প্যাসেঞ্জার লিস্ট দেখে স্তম্ভিত হয়ে গেল কর্নেল যোয়েস। সাথে সাথে একটা ফলোআপ ইনভেস্টিগেশনের নির্দেশ দিল সে, মনে ক্ষীণ ভঙ্গুর আশা যে মেক্সিকো ও মিসরের প্রেসিডেন্ট ও জাতিসংঘ মহাসচিব তীরে কোথাও রাত কাটানোর জন্য জাহাজ ত্যাগ করে থাকতে পারেন। গভীর রাতে নেতিবাচক রিপোর্ট পাওয়া গেল। জাহাজের সাথে তারাও নিখোঁজ হয়েছেন। সেই সাথে দিবালোকের মতো স্পষ্ট হয়ে উঠল, লেডি ফ্ল্যামবোরোকে হাইজ্যাক করে নিয়ে গেছে সন্ত্রাসবাদীরা।

    ভোর রাত থেকে বিপুল আয়োজনের সাথে তল্লাশির কাজ শুরু হলো। উরুগুয়ে, আর্জেন্টিনা ও ব্রাজিল বিমানবাহিনীর যতগুলো প্লেন হাতের কাছে পাওয়া গেল, সবগুলোকে তুলে দেয়া হলো আকাশে। দক্ষিণ আটলান্টিকের চার লক্ষ বর্গমাইল জুড়ে অনুসন্ধান চালাবার পরও লেডি ফ্ল্যামবোরোর কোনো সন্ধান পাওয়া গেল না।

    যেন সাগর গিলে খেয়ে ফেলেছে জাহাজটাকে।

    .

    ৩৯.

    শার্টের ভেতর, বুকে আর পিঠে, একজোড়া হাত নড়াচাড়া করছে। গভীর ঘুম থেকে ধীরে ধীরে সজাগ হলো পিট, স্বপ্ন দেখছে পানির তলা থেকে ওপরে ওঠার চেষ্টা করছে ও, কিন্তু পারছে না। চোখ রগড়াল, দেখল নুমার হেডকোয়ার্টারে ওর জন্য বরাদ্দ করা কামরাতেই একটা কাউচে শুয়ে রয়েছে ও। পুরোপুরি চিৎ হলো, দেখতে পেল সুগঠিত একজোড়া মেয়েলি পা।

    কাউচের ওপর উঠে বসল পিট, চোখ পিট পিট করে লিলি শার্পের দুষ্ট হাসিমাখা মুখের দিকে তাকাল। হাতঘড়ি দেখার জন্য কব্জিটা চোখের সামনে তুলল, তারপর মনে পড়ল হাতঘড়ি, মানিব্যাগ আর চাবি ডেস্কে রেখে চোখ বুজেছিল। কয়টা বাজে বলো তো?

    সাড়ে পাঁচটা, ফিক করে অকারণ হাসির সাথে বলল লিলি, পিটের কাঁধের ওপর ঝুঁকে ওর ঘাড় আর পিঠের পেশি ডলছে দুই হাতে।

    রাত নাকি দিন?

    শেষ বিকেল। মাত্র তিন ঘণ্টা ঘুমিয়েছ।

    তোমার কি ঘুম বলে কিছু নেই?

    প্রতি চব্বিশ ঘণ্টায় চার ঘণ্টা ঘুমালেই চলে আমার।

    মুখের সামনে হাত রেখে হাই তুলল পিট। তোমার ভবিষ্যৎ স্বামীর প্রতি আমার গভীরতম সহানুভূতি রইল।

    এখানে কফি দিলাম। পিটের নাগালের মধ্যে টেবিলের ওপর কাপে কফি ঢালল লিলি।

    পায়ে জুতো গলিয়ে শার্টের কিনারা ট্রাউজারের ভেতর ঔজল পিট। কম্পিউটর জাদুকর ইয়েজার পেল কিছু?

    বলছে তো।

    স্থির হয়ে গেল পিটের হাত। নদীটা?

    না, ঠিক তা নয়। ইয়েজার ভারি রহস্যময় আচরণ করছে, তবে বলছে তোমার কথাই নাকি ঠিক। কলম্বাস বা ভাইকিংদের আগে নাকি ভেনাটর আটলান্টিক পাড়ি দিয়েছিলেন।

    কফির কাপে চুমুক দিয়ে মুখ বাঁকাল পিট। একি! এ তো নিরেট চিনি!

    বিব্রত হলো লিলি। কিন্তু অ্যাল যে বলল, কফিতে তুমি চার চামচ চিনি নাও।

    মিথ্যে বলেছে। এক চামচই বেশি হয়ে যায় আমার!

    আমি দুঃখিত, মুচকি হেসে বলল লিলি। বোঝা যাচ্ছে, প্র্যাকটিকাল জোকারের পাল্লায় পড়েছিলাম।

    তুমিই প্রথম নও, বলে দরজার দিকে পা বাড়াল পিট।

    ইয়েজারের ডেস্কে পা তুলে দিয়ে চেয়ারে বসে দোল খাচ্ছে আল জিওর্দিনো। মুখভর্তি স্যান্ডইউ, একহাত দিয়ে নাকের কাছে ধরে আছে টোপোগ্রাফিক ম্যাপটা। ম্যাপে বিশদভাবে দেখানো হয়েছে একটা উপকূল রেখা।

    কুঁজো হয়ে বসে আছে হিরাম ইয়েজার, চোখ দুটো লাল, নাকটা কম্পিউটর মনিটরের দিকে তাক করা, একটা প্যাডে খস করে নোট নিচ্ছে। পায়ের আওয়াজ পেয়ে ঘাড় ফেরাতে হলো না তাকে স্ক্রিনেই দেখতে পেল কারা ঢুকল কামরায়। বাধাটা টপকানো গেছে, বলার সুরে খানিকটা সন্তুষ্টি প্রকাশ পেল।

    কী পেয়েছো? জিজ্ঞেস করল পিট।

    সেরাপিসকে গ্রিনল্যান্ডে যেখানে পাওয়া গেছে, সেখান থেকে এক ইঞ্চি এক ইঞ্চি করে না এগিয়ে, ব্যাঙের মতো আমি একটা লাফ দিই দক্ষিণ দিকে, একেবারে মেইন এ। তার রাফিনাসের বর্ণনার সাথে মিল খুঁজতে শুরু করি।

    অমনি কপাল খুলে গেল?

    সত্যি গেল। তোমার মনে আছে, রাফিনাস লিখেছে, ভেনাটরকে ফেলে চলে আসার পর একত্রিশ দিন ঝড়ের কবলে পড়েছিল তারা। তারপর একটা নিরাপদ বে খুঁজে পায়, মেরামতের কাজ সারে সেখানে। পরের ঝড়ে তাদের পাল ছিঁড়ে যায়, ভেঙে যায় দাঁড়। দিনের কোনো হিসাব দেয়া হয়নি, ভাসতে ভাসতে একদিন গ্রিনল্যান্ডের খাড়িতে পৌঁছায় জাহাজ। থামল ইয়েজার, একটা বোতামে চাপ দিল, মনিটরে ফুটে উঠল আমেরিকাসহ উত্তর আটলান্টিকের চার্ট। এরপর তার আঙুলগুলো কোড নাম্বারের একটা সিরিজে চাপ দিল। মনিটর স্ক্রিনে ঘোট একটা রেখা ফুটে উঠল, গ্রিনল্যান্ডের পূর্ব উপকূল থেকে ভাঙাচোরা, আঁকাবাঁকা পথ ধরে রওনা হলো সেটা দক্ষিণ দিকে, নিউ ফাউন্ডল্যান্ডকে ঘুরে, নোভা স্কটিয়া আর নিউ ইংল্যান্ডকে ছাড়িয়ে, থামল গিয়ে আটলান্টিক সিটির সামান্য ওপরে।

    নিউ জার্সি? বিড়বিড় করে উঠল পিট, চেহারায় হতচকিত ভাব।

    সঠিকভাবে বললে, বার্নেগ্যাট বে, জানাল জিওর্দিনো। টোপোগ্রাফিক ম্যাপটা নিয়ে এসেছে সে, একটা টেবিলে ফেলে রেড মার্কার দিয়ে উপকূলের একটা অংশকে বৃত্তের মধ্যে আটকাল।

    বার্নেগ্যাট বে, নিউ জার্সি? আবার প্রশ্ন করল পিট।

    তিনশো একানব্বইয়ে উপকূল রেখা অন্য রকম ছিল, বলল ইয়েজার।

    আরও এবড়োখেবড়ো ছিল তীরভূমি, বে ছিল আরও গভীর ও আড়াল পিট।

    বে-র বর্ণনা দিতে গিয়ে রাফিনাস খর্বকায় পাইন বনের কথা বলেছে, সেখানে লাঠি দিয়ে খোঁচা দিলেই মিষ্টি পানি বেরিয়ে আসে, মনে আছে? সে রকম বেঁটে পাইন গাছের একটা বন নিউ জার্সিতে রয়েছে। বনভূমির নাম, পাইন ব্যারেন্স, পূর্ব উপকূল থেকে রাজ্যের দক্ষিণ মধ্যভাগ পর্যন্ত বিস্তৃতি ওটার। মাটির ঠিক নিচেই পানি পাওয়া যায়। বর্ষা মৌসুমে লাঠি দিয়ে খোঁচা মারো, পানি পাবে।

    আশার কথা, সতর্ক মন্তব্য করল পিট। কিন্তু রাফিনাস তো স্টোন ব্যালাস্ট-এর কথাও বলেছিল।

    ব্যাপারটা আমাকে ভাবিয়ে তোলে। তাই আর্মি ইঞ্জিনিয়ারিং কোর-এর একজন আর্কিওলজিস্টকে ডাকি আমি। সে আমাকে পাথরের একটা খনি দেখিয়ে দেয়, ফলে ধরে নিতে পারি সেরাপিসের ক্রুরা ঠিক ওই জায়গাতেই নেমেছিল।

    চমৎকার, কৃতজ্ঞচিত্তে বলল পিট। ঠিক পথেই এগোচ্ছ তুমি।

    কিন্তু এখান থেকে কোথায়? জিজ্ঞেস করল লিলি।

    আমি দক্ষিণ দিকেই যেতে থাকি, বলল ইয়েজার। সেই সাথে আমার সহকারীরা কম্পিউটরের সাহায্যে স্পেন থেকে পশ্চিম দিকে ভেনাটরের আনুমানিক কোর্স নির্ধারণ করার চেষ্টা করুক। ভূমধ্যসাগর ত্যাগ করার পর, ধরে নেয়া চলে, জাহাজের বহরটা প্রথম নোঙর ফেলেছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজে। নিউ জার্সি থেকে সেরাপিসের পথ, আর স্পেন থেকে আমেরিকার দিকে ভেনাটরের পথ, দুটো কোথাও এক জায়গায় ক্রস করবে, তার পাঁচশো মাইলের মধ্যে রয়েছে আমাদের সাধনার নদীটি।

    সন্দেহ প্রকাশ করল লিলি, ভেনাটরের পথ আপনি কীভাবে খুঁজে পাবার আশা করেন তিনি তো দিক, স্রোত, বাতা ও দূরত্বের কোনো হিসাবই রাখতে দেননি।

    ওটা কোনো সমস্যাই নয়, হেসে উঠে বলল ইয়েজার। কলম্বাসের নিউ ওয়ার্ল্ড অভিযানের লগ ডাটা ব্যবহার করব আমি। তার জাহাজ আর হাজার বছরের পুরনো বাইজানটাইন জাহাজের খোল, রিগিং, সেইল আলাদা ছিল, সব মনে রেখে হিসাব করলেই বেরিয়ে আসবে…?

    শুনে মনে হচ্ছে পানির মতো সহজ একটা কাজ?

    বিশ্বাস করো, তা নয়। আমরা হয়তো লক্ষ্যের দিকে এগোচ্ছি, তবে সেখানে পৌঁছাতে নিরেট আরও চারটে দিন গাধার খাটনি খাটতে হবে।

    তাহলে শুরু করো, বলল পিট। খুঁজে বের করো লাইব্রেরিটা।

    .

    সাক্ষাৎ করার অনুরোধ পেয়ে পিট ভাবল, অ্যাডমিরাল স্যানডেকার বোধ হয় তল্লাশির খবর জানতে চান। কিন্তু চেম্বারে পর থমথমে চেহারা দেখে বুঝল, গুরুতর কিছু ঘটে গেছে। সবচেয়ে বেশি উদ্বিগ্ন করে তুলল ভদ্রলোকের ভোতা ও কোমল দৃষ্টি, তার চোখে সাধারণত কাঠিন্য মেশানো তীক্ষ্ণ দৃষ্টিই দেখা যায়।

    ডেস্কের পেছন থেকে ছেড়ে এগিয়ে এলেন স্যানডেকার, পিটের সামনে দাঁড়িয়ে ভারী হাত দুটো এর কাঁধে তুলে দিলেন। মুখ তুলে তাকাল পিট, অন্যদিকে ফিরলেন অ্যাডমিরাল, যেন মুখ লুকাতে চান, তারপর ওকে টেনে নিয়ে গিয়ে একটা কাউচে বসালেন, নিজেও বসলেন পাশেরটায়। সাহসে বুক বাঁধল পিট, জানে খারাপ কিছু শুনতে হবে।

    এইমাত্র হোয়াইট হাউস থেকে খবরটা পেলাম, অ্যাডমিরাল বলেলন। বুঝতেই পারছ, পিট, মাই বয়, তোমাকে আমি কোনো সুখবর দিতে যাচ্ছি না। প্রমোদতরী লেডি ফ্ল্যামবোরো হাইজ্যাক হয়েছে। প্রেসিডেন্ট নাদাভ হাসান ও প্রেসিডেন্ট দো লরেঞ্জো আছেন জাহাজে। ওরা উরুগুয়ের পাল্টা ডেল এসটে-তে ছিলেন, ওখানে অর্থনৈতিক শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হচ্ছে।

    এটা খবরের একটা অংশ মাত্র, উপলব্ধ করল পিট। শুনে দুঃখ পেলাম, বলল ও। তবে ব্যাপারটা নুমা-র কোনো মাথাব্যথা নয়, তাই না? আর আমি তো আলেকজান্দ্রিয়া লাইব্রেরি নিয়ে এতো ব্যস্ত যে নতুন কোনো অ্যাসাইনমেন্টের কথা ভাববারও সময় নেই।

    হে’লা কামিলও রয়েছেন জাহাজটায়।

    সর্বনাশ!

    এবং তোমার বাবা।

    বাবা? থ মেরে গেল পিট, অনুভব করল গায়ের রোম দাঁড়িয়ে যাচ্ছে। বিড়বিড় করে বলল, পরশু রাতে বাবার সাথে ফোনে কথা হয়েছে আমার, উরুগুয়েতে যাবার কথা কিছু বলেননি তো।

    প্রেসিডেন্ট হাসান দেখা করার অনুরোধ জানিয়েছিলেন। শোনা যাচ্ছে, মিসরীয় প্রেসিডেন্টের জন্য আমাদের প্রেসিডেন্টের একটা মেসেজও নাকি সাথে করে নিয়ে গেছেন জর্জ।

    কাউচ ছেড়ে পায়চারি শুরু করল পিট। খানিক পর আবার বসে পড়ল। পরিস্থিতিটা ব্যাখ্যা করবেন, প্লিজ?

    কাল রাতে লেডি ফ্ল্যামবোরো, ব্রিটিশ প্রমোদরী, পাল্টা ডেল এসটে বন্দর থেকে নিখোঁজ হয়েছে।

    নিখোঁজ হয়েছে?

    আমরা ধারণা করছি, হাইজ্যাক করার পর ডুবিয়ে দেয়া হয়েছে, পিটের চোখে চোখ রেখে মৃদুকণ্ঠে বললেন অ্যাডমিরাল। এয়ার সার্চ কোনো সন্ধান দিতে পারেনি। উদ্ধারকর্মীদের বিশ্বাস, পানির ওপরে ওটা নেই।

    নিশ্চিতভাবে প্রমাণ না হওয়া পর্যন্ত আমি তা মানব না।

    আমি তোমার দলে।

    আবহাওয়া?

    শান্ত-বাতাস, শান্ত সাগর।

    জাহাজ নিখোঁজ হয় ঝড়ে, বলল পিট। শান্ত সাগরে হয় না বললেই চলে।

    অসহায় ভঙ্গিতে হাত নাড়লেন অ্যাডমিরাল। আরও বিস্তারিত তথ্যের অপেক্ষায় থাকতে হবে।

    বাবা মারা গেছেন, ভাবতেই পারল না পিট। ঘটনার আবছা বর্ণনা থেকে কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছানো সম্ভব নয়। হোয়াইট হাউস এ ব্যাপারে কিছু করছে কি?

    ইচ্ছে থাকলেও করার কিছু নেই প্রেসিডেন্টের, গম্ভীর সুরে জানালেন অ্যাডিমরাল। বর্তমানে ওদিকে কোনো ট্রেনিং অনুষ্ঠিত হচ্ছে না, তাই দক্ষিণ আটলান্টিকে আমাদের একটাও ন্যাভাল ইউনিট নেই।

    আবার দাঁড়াল পিট, জানালা দিয়ে আলো ঝলমলে ওয়াশিংটনের দিকে তাকাল হঠাৎ দ্রুতবেগে আধপাক ঘুরল, অন্তর্ভেদী দৃষ্টি স্থির হলো অ্যাডমিরালের মুখের ওপর। আপনি আমাকে বলছেন, মার্কিন সরকার তল্লাশির সাথে জড়িত হচ্ছে না?

    সে রকমই দেখাচ্ছে ব্যাপারটা।

    কিন্তু নুমার তল্লাশি চালাতে বাধা কোথায়?

    আমাদের কোস্ট গার্ড বিমান কিংবা জাহাজ নেই।

    আমাদের সাউন্ডার রয়েছে, বলল পিট।

    কয়েক সেকেন্ড চিন্তা করলেন অ্যাডমিরাল। তারপর জানতে চাইলেন, আমাদের একটা রিসার্চ ভেসেলের কথা বলছ?

    দক্ষিণ ব্রাজিলের খানিক দূরে রয়েছে ওটা, বলল পিট। কন্টিনেন্টাল শেলফের সোনার ম্যাপিং প্রজেক্টে কাজ করছে।

    মনে পড়ল অ্যাডমিরালের। মাথা ঝাঁকালেন তিনি। ঠিক আছে। তবে, সাউন্ডার অত্যন্ত মন্থরগতি। কী কাজে লাগবে ওটা?

    লেডি ফ্ল্যামবোরোকে যদি পানির ওপর পাওয়া না যায়, পানির তলায় খুঁজব আমি।

    তোমাকে সম্ভবত এক হাজার বর্গমাইল চষে ফেলতে হবে। কিংবা তারো বেশি।

    সাউন্ডারের সোনার গিয়ার দুমাইলের বেশি নাগাল পায়, বলল পিট। সাথে একটা সাবমার্সিবলও থাকছে। আপনি আপত্তি না করলে আমি ওটার কমান্ড নিতে পারি।

    দুএকজনের সাহায্য লাগবে তোমার।

    জিওর্দিনো আর রুডি গান। আমাদের দলটা দারুণ।

    ডিপ-সি মাইনিং অপারেশনে ক্যানারি দ্বীপে রয়েছে রুডি।

    আঠারো ঘণ্টার মধ্যে উরুগুয়েতে পৌঁছানো তার জন্য কোনো সমস্যা হবে না।

    মাথার পেছনে দুহাত এক করে সিলিংয়ের দিকে তাকালেন অ্যাডমিরাল স্যানডেকার। অন্তরের গভীরে তিনি উপলব্ধি করলেন, মরীচিৎকার পেছনে ছুটতে চাইছে। পিট। একটা দীর্ঘশ্বাস চাপলেন তিনি, বললেন, সমস্ত ক্ষমতা দেয়া হলো তোমাকে। দেখো চেষ্টা করে।

    ধন্যবাদ, অ্যাডমিরাল, বলল পিট। আমি কৃতজ্ঞ।

    তার পরও প্রশ্ন থেকে যায়। আলেকজান্দ্রিয়া লাইব্রেরির কী হবে?

    ইয়েজার আর ডক্টর শার্প সমাধানের প্রায় কাছাকাছি পৌঁছে গেছে, আমরা থাকলে ওদের কাজে বরং বাধা সৃষ্টি করব।

    দাঁড়ালেন অ্যাডমিরাল, এগিয়ে এসে পিটের দুকাঁধে হাত রাখলেন আবার। উনি না-ও মারা যেতে পারে, বুঝতে পারছ তো?

    মারা না গেলেই ভালো করবে বাবা, গম্ভীর ক্ষীণ হাসির সাথে বলল পিট। এভাবে চলে গেলে তাকে আমি কোনো দিন ক্ষমা করতে পারব না।

    ⤶ ⤷
    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleদ্য মহাভারত কোয়েস্ট : দ্য আলেকজান্ডার সিক্রেট – ক্রিস্টোফার সি ডয়েল
    Next Article ড্রাগন – ক্লাইভ কাসলার

    Related Articles

    ক্লাইভ কাসলার

    দ্য ফারাও’স সিক্রেট – ক্লাইভ কাসলার ও গ্রাহাম ব্রাউন

    August 5, 2025
    ক্লাইভ কাসলার

    পাইরেট – ক্লাইভ কাসলার / রবিন বারসেল

    August 5, 2025
    ক্লাইভ কাসলার

    দ্য সলোমন কার্স – ক্লাইভ কাসলার ও রাসেল ব্লেক

    August 5, 2025
    ক্লাইভ কাসলার

    ড্রাগন – ক্লাইভ কাসলার

    August 5, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Generic selectors
    Exact matches only
    Search in title
    Search in content
    Post Type Selectors
    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে বাঙলাদেশের কৃষক – বদরুদ্দীন উমর

    October 29, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে বাঙলাদেশের কৃষক – বদরুদ্দীন উমর

    October 29, 2025
    Our Picks

    চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে বাঙলাদেশের কৃষক – বদরুদ্দীন উমর

    October 29, 2025

    পূর্ব বাঙলার ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি ২ – বদরুদ্দীন উমর

    October 29, 2025

    বাঙলাদেশে কমিউনিস্ট আন্দোলনের সমস্যা – বদরুদ্দীন উমর

    October 29, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    • Sign Up
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }