Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    ইলিয়াড – হোমার

    October 13, 2025

    ওডিসি – হোমার

    October 13, 2025

    প্রেমের প্রান্তে পরাশর – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    October 13, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    ঠাকুর-বাড়ির আঙিনায় – জসীম উদ্দীন

    জসীম উদ্দীন এক পাতা গল্প180 Mins Read0

    ০২. অবন ঠাকুরের দরবারে

    অবন ঠাকুরের দরবারে

    কলিকাতা গেলেই আমি কল্লোল-আফিসে গিয়া উঠিতাম। সেবার কলিকাতা গেলে কল্লোলের সম্পাদক দীনেশরঞ্জন দাশ আমাদের সকলকার দীনেশদা বলিলেন অবনীন্দ্রনাথ তোমার সঙ্গে আলাপ করতে চান। কাল তোমাকে তার কাছে নিয়ে যাব। কল্লোলে প্রকাশিত তোমার মুর্শিদা-গান প্রবন্ধটি পড়ে তিনি খুশি হয়েছেন।–

    পরদিন সকালে আমরা ঠাকুরবাড়ির উদ্দেশ্যে রওয়ানা হইলাম। ঠাকুরবাড়ির দরজায় আসিয়া দীনেশা কার্ডে নাম লিখিয়া দরওয়ানের হাতে উপরে পাঠাইয়া দিলেন। আমি উপরে ওঠার সিঁড়ির সামনে দাঁড়াইয়া নানা কথা ভাবিতে লাগিলাম। এই সেই অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বাড়ি—প্রবাসীতে যার ‘শেষ বোঝা’ চিত্র দেখিয়া ঘণ্টার পর ঘন্টা কাটাইয়া দিয়াছে। সীমাহীন মোহময় মরুপ্রান্তরে একটি উট বোঝার ভারে নুইয়া পড়িয়া আছে। সেই করুণ গোধুলির আসমানের রঙ আমার মনে কেমন যেন এক বিরহের উদাসীনতা আঁকিয়া দিত। রঙের আর রেখার জাদুকর সেই অবন ঠাকুরের সঙ্গে আজ আমার দেখা হইবে। উপরে ওঠার কাঠের সিঁড়ির দুই ধারে রেলিংয়ের উপর কেমন সুন্দর কারুকার্য। নানা রকমের ছবি। একপাশে একটি ঈগলপাখি। এরা যেন আমার সেই কল্পনাকে আরও বাড়াইয়া দিল।

    কিছুক্ষণ পরে চাকর আসিয়া আমাদিগকে সেই সিঁড়ি-পথ দিয়া উপরে লইয়া গেল। সিঁড়ি দিয়া উপরে উঠিয়া একখানা ঘর পার হইয়া দক্ষিণ ধারের বারান্দা। সেখানে তিনটি বৃদ্ধলোক ডান ধারের তিনটি জায়গায় আরামকেদারায় বসিয়া আছেন। কাহারও মুখে কোন কথা নাই। কোথাও টু-শব্দটি নাই। দুই জন ছবি আঁকিতেছেন, আর একজন বই পড়িতেছেন। প্রত্যেকের সামনে একটি করিয়া আলবোলা। খাম্বিরা তামাকের সুবাসে সমস্ত বারান্দা ভরপুর। ডানধরে উপবিষ্ট শেষ বৃদ্ধ লোকটির কাছে আমাকে লইয়া গিয়া দীনেশদা বলিলেন, “এই যে জসীম উদ্দীন। আপনি এর সঙ্গে আলাপ করতে চেয়েছিলেন।

    ছবি আঁকা রাখিয়া ভদ্রলোকটি বলিলেন এসো, এসো, সামনের মোড়টা টেনে নিয়ে বস।

    আমরা বসিলাম। দীনেশা আমার কানে কানে বলিলেন, ইনিই অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর; আর ওপাশে বসে ছবি আঁকছেন, উনি গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুর। যিনি বই পড়ছেন, উনি সমরেন্দ্রনাথ ঠাকুর। এরা তিনজনে সহোদর ভাই।

    হুঁকোর নল হইতে মুখ বাহির করিয়া অবন ঠাকুর বলিলেন, ‘তোমার সংগৃহীত গানগুলি পড়ে আমার খুব ভাল লেগেছে। আমার প্রবন্ধে এর একটা গান উদ্ধৃত করেছি, এই যে–

    এক কালা দতের কালি
    যাদ্যা কলম লিখি,
    আরো কাল চক্ষের মণি
    যাদ্যা দৈনা দেখি—

    এ গুলি ভাল, আরও সংগ্রহ কর। এক সময় আমি এর কতকগুলি সংগ্রহ করিয়েছিলাম।

    এই বলিয়া তিনি তার বইপত্র খুলিয়া একখানা নোট বই বাহির করিলেন। আমি দেখিয়া আশ্চর্য হইলাম, কত আগে অবনবাবু তার কোন ছাত্রের সাহায্যে যশোর ও নদীয়া জেলা হইতে অনেকগুলি মুর্শিদা-গান সংগ্রহ করাইয়াছেন।

    দীনেশদা অবনবাবুকে, বলিলেন, ‘জসীমের মুর্শিদা-গানের সংগ্রহ আমার কাগজে ছাপিয়েছি। অনেকে বলে, এগুলো ছাপিয়ে কি হবে?’

    অবনবাবু বলিলেন, ‘মশাই, ও সব লোকের কথা শুনবেন না। যত পারেন, এগুলো ছেপে যান। এর পরে এগুলো আর পাওয়া যাবেনা।’

    তারপর নানা রকমের গ্রাম-গানের বিষয়ে আলাপ হইল। কবিগান যাত্রাগান জারীগান কোথায় কি ভাবে গাওয়া হয়, কাহারা গায়, কোথায় কোন গাজীর গানের দল ভাল রূপকথা বলে, শিশুর আগ্রহ লইয়া তিনি আমাকে জিজ্ঞাসা করিতে লাগিলেন। উত্তর দিতে আমার এমনই ভাল লাগিল!

    কিশোর বয়স্ক একটি ছেলে আমার কাছে আসিয়া দাঁড়াইল। এক বৎসর আগে এর সঙ্গে আমার আলাপ হইয়াছিল। দীনেশা প্রেসিডেন্সী কলেজে রবীন্দ্রনাথের “মুক্তধারা” বইখানার অভিনয় পরিচালনা করিয়াছিলেন। সেই উপলক্ষে আমি প্রেসিডেন্সী কলেজে গিয়া অভিনয় দেখি। আমার পাশে একটি ছোট্ট থোকা আসিয়া বসিল। অপরের সঙ্গে আলাপ করিবার তাহার কী আগ্রহ। সে-ই আমার সঙ্গে প্রথম কথা বলিল। আমি কোথা হইতে আসিয়াছি, কি করি ইত্যাদি। হয়ত সেই আলাপে নিজের পরিচয়ও দিয়াছিল। তার কথা একদম ভুলিয়া গিয়াছিলাম। খোকা আসিয়া আমার সঙ্গে আলাপ করিয়া সেই পরিচয়ের সূত্রটি ধরাইয়া দিল। অবনবাবুর নিকট হইতে বিদায় লইয়া কল্লোল-অফিসে ফিরিয়া আসিলাম।

    অবনবাবুর বাড়িতে যে গল্পটি বলিব ঠিক করিয়াছিলাম, সারাদিন মনে মনে তাহা আওড়াইতে লাগিলাম। এই গল্প আমি কতবার কত জায়গায় বলিয়াছি। সুতরাং গল্পের কোন কোন জায়গা শুনিয়া ঠাকুরবাড়ির শ্রোতারা একেবারে মন্ত্রমুগ্ধ হইয়া যাইবেন, তাহা ভাবিয়া মনে মনে রোমাঞ্চিত হইতে লাগিলাম।

    বিকালবেলা দীনেশার জরুরী কাজ ছিল। আমাকে সঙ্গে লইয়া অবনবাবুর বাড়ি চলিলেন পবিত্বদা। সুপ্রসিদ্ধ সাহিত্যিক পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায় মহাশয়। অবনবাবুর বাড়ি আসিয়া দেখি—সে কী বিরাট কাণ্ড! রবীন্দ্রনাথের বিচিত্রা-ঘরের হলে গল্পের আসর বসান হইয়াছে। বাড়ির যত ছেলেমেয়ে, বৃদ্ধ-বৃদ্ধা, যুবক-যুবতী সকলে আসিয়া সমবেত হইয়াছে গল্প শুনিতে। অবনবাবুর দুই ভাই গগনেন্দ্রনাথ আর সমরেন্দ্রনাথ আগেই আসিয়া আসন গ্রহণ করিয়াছেন। আরও আসিয়াছেন রবীন্দ্রনাথের সকল সুরের কাণ্ডারী আর সকল গানের ভাণ্ডারী দিনেন্দ্রনাথ, রবীন্দ্রনাথের পুত্র রথীন্দ্রনাথ। গল্পের আসরের উপলক্ষ করিয়া হলটিকে একটু সাজান হইয়াছে। কথক ঠাকুরদের মত সুন্দর একটি আসনও রচিত হইয়াছে আমার জন্য।

    এসব দেখিয়া আমার চোখ ত চড়কগাছ! সুদূর গ্রামদেশের লোক আমি। জীবনে দুই-এক বারের বেশী কলিকাতা আসি নাই। শহরে হাঁটিতে চলিতে কথা কহিতে জড়ায় জড়াইয়া যাই। আজ এই আসরে আমি গল্প বলিব কেমন করিয়া? আমার বুকের ভিতরে ঢিপঢিপ করিতে লাগিল। আমার ভয়ের কথা পবিত্বদাকে বলিলাম। তিনি বলিলেন, “তুই কোন চিন্তা করিসনে। যা জানিস বলে যাবি। এঁরা খুব ভাল শ্রোতা।”

    পবিত্রদা সাহস দিলেন। কিন্তু আমার ভয় আরও বাড়িয়া গেল। সভা-স্থলে অবনবাবু আসিলেন। তিনি সহাস্যে বলিলেন, “দেখ, তোমার গল্প শোনার জন্য কত লোক এনে জড় করেছি। রবিকাকেও ধরে আনতে চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু তিনি একটি কাজে অন্যত্র চলে গেলেন। এরারে তবে তুমি আরম্ভ কর।”

    বলির পাঠার মত আমি সেই আসনে গিয়া বসিলাম। পবিত্রদা আমার পাশে। কিন্তু থাকিলে কি হইবে? সামনের দিকে চাহিয়া দেখি—রঙিন শাড়ীর ঝকমকি, সুগন্ধি গুড় আর সেন্টের গন্ধ। আমার বুকের দুরুদুরু আরও বাড়িয়া গেল।

    অবনবাবু তাড়া দিলেন, “এবার তবে আরম্ভ হোক রূপকথা।”

    আমার তখনও কলিকাতার বুলি অভ্যস্ত হয় নাই। কিছুটা কলিকাতার কথ্য ভাষায়, আর কিছুটা আমার ফরিদপুরের ভাষায় গল্প বলিতে আরম্ভ করিলাম।

    উত্তরে বন্দনা করলাম হিমালয় পর্বত,
    যাহার হাওয়ায় কাপে সকল গাছের পাত।
    পুবেতে বন্দনা করলাম পুবে ভানুশ্বর,
    একদিকে উদয় গো ভানু চৌদিকে পশর।
    পশ্চিমে বন্দনা করলাম মক্কা-মদিস্থান,
    উদ্দেশ্যে জানায় গো সালাম মমিন মুসলমান।
    দক্ষিণে বন্দনা করলাম ক্ষীরনদীর সাগর,
    যেখানে বাণিজ্য করে চান্দ সওদাগর।
    চার কোণা বন্দনা কইরা মধ্যে করলাম স্থিতি,
    এখানে গাব আমি ওতলা সুন্দরীর গীতি।

    গল্প বলিতে বলিতে গল্পের খেই হারাইয়া ফেলি। পরের কথা। আগে বলিয়া আবার সেই ছাড়িয়া-আসা কথার অবতারণা করি। দশ-পনের মিনিট পরে দিমুবাবু উঠিয়া গেলেন। সামনে শাড়ীর ঝকমকিতে দোলায়া কৌতুকমতীরা একে অপরের কানে কানে কথা বলিতে লাগিলেন। কেউ কেউ উঠিয়া গেলেন। সেই সঙ্গে সঙ্গে আমার ভিতরেও পরিবর্তন হইতে লাগিল। কোন রকমে ঘামে নাহিয়া বুকের সমস্ত টিপটিপানি উপেক্ষা করিয়া গল্প শেষ করিলাম।

    অবনবাবু বলিলেন, “বেশ হয়েছে।” কিন্তু কথাটা যে আমাকে শুধু সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য বলিলেন, তাহা আর বুঝিতে বাকী রহিল না।

    দেশে ফিরিয়া মোহনলালের কাছে পত্র লিখিলাম। আবার আমি তোমাদের বড়ি গিয়া গল্প বলিব। যতদিন খুব ভাল গল্প বলা না শিখিতে পারি, ততদিন কলিকাতা আসিব না।

    গ্রামে গ্রামে ঘুরিয়া যেখানে যে যত ভাল গল্প বলিতে পারে, তাহাদের গল্প বলার ভঙ্গি লক্ষ্য করিতে লাগিলাম। ফরিদপুর ঢাকা তাহাদের ময়মনসিংহ জেলার যেখানে যে ভাল গল্প বলিতে পারে খবর পাইলাম, সেখানেই গিয়া উপস্থিত হইতাম। তারপর সেইসব গল্প বলার ভঙ্গি অনুকরণ করিয়া ছোট ছোট ছেলেদের মধ্যে বসিয়া গল্প বলিবার অভ্যাস করিতে লাগিলাম। ছেলেদের খেলার মাঠের একধারে প্রায় প্রতি সন্ধ্যায় আমার গল্পের আসর বসিত। অধুনা কবিখ্যাত আবু নইম বজলুর রশীদ আমার গল্পের আসরের একজন অনুরক্ত শ্রোতা ছিল। এইভাবে গল্পের মহড়া চলিতে লাগিল। দিনের পর দিন মাসের পর মাস। গল্প শুনিবার জন্য তখন কত জায়গায়ই না গিয়াছি। সুদূর ময়মনসিংহে ধনা গায়েনের বাড়ি গেলাম। কালীগঞ্জের মোজাফর গায়েনের বাড়ি গেলাম। টাকা খরচ করিয়া একদিন কালীগঞ্জের বাজারে তার গাজীর গানের আসর আহ্বান করিলাম।

    মোজাফর গায়েনের গল্প বলার ভঙ্গিটি ছিল বড়ই চমৎকার। এক হাতে আশাসোটা আর একহাতে চামর লইয়া সে গল্পের গানের গোন গাইয়া দোহারদের ছাড়িয়া দিত। দোহারেরা সেই সুর লইয়া সমবেত কণ্ঠে সুরের-ধ্বনি বিস্তার করিত। তারপর ছড়ার মতো কাটাকাটা সুরে গল্পের কাহিনীগুলি বলিয়া যাইত। সুরে যে কথা বলিতে পারিত না, নানা অঙ্গভঙ্গী করিয়া চামর ঘুরাইয়া তাহা সে প্রকাশ করিত। দীনেশচন্দ্র সেন-সংকলিত ময়মনসিংহ-গীতিকায় সংগীত-রত সদলবলে মোজাফর গায়েনের একটি ফটো প্রকাশিত হইয়াছে। তাহা আমি কোন ব্যবসায়িক ফটোগ্রাফারকে দিয়া তোলাইয়া লইয়াছিল। এই ফটোতে তখনকার বয়সের আমারও একটি ছবি আছে।

     

    ০২.

    এই ভাবে সুদীর্ঘ এক বৎসর গল্প বলার সাধনা করিয়া আবার কলিকাতা অসিয়া প্রথমে মোহনলালের সঙ্গে দেখা করিলাম। তাহাকে সঙ্গে করিয়া কলিকাতার একটি ছোটদের স্কুলে গিয়া গল্প বলিলাম। গল্পের যে স্থানটি খুব করুণ রসের, দেখিলাম, সে স্থানটিতে ছোটদের চোখ হইতে টসটস করিয়া জল পড়িতেছে। গল্প বলা শেষ হইলে মোহনলাল বলিল ‘এবার তোমার গল্প বলা ঠিক হয়েছে। এবার দাদামশায়কে শুনাতে পার।’

    পরদিন অবনবাবুর দরবারে আসিয়া হাজির হইলাম।

    এবার গল্পের আসরে পূর্বের মত তিনি সবাইকে আহ্বান করিলেন না। শুধু অবনবাবু আর তার দুই ভাই-সমর আর গগন। আর তার ছোট ঘোট নাতি-নাতনীরা। এবার আর পূর্ববারের মত গল্প বলিতে বলিতে ঠেকিয়া গেলাম না। আগাগোড়া গল্পটি সুন্দর করিয়া বলিয়া গেলাম। গল্প শেষ করিয়া নিজেরই ভাল লাগিল। ভাবিলাম অবনবাবু এবার আমার গল্পের তারিফ করিবেন। কিন্তু খানিকক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়, আমার সেই কথিত গল্পটি তিনি একটু-আধটু ঘুরাইয়া ফিরাইয়া আমি যেখানে করুণরসের অবতারণা করিয়াছিলাম সেখানে হাস্যরস করিয়া এমন সুন্দর করিয়া গল্পটি বলিলেন যে তার কথিত গল্পটি একেবারে নূতন হইয়া গেল।

    ফেরার পথে মোহনলাল বলিল, “এবার তোমার গল্প বলা ভাল হয়েছে। সেইজন্যই দাদামশায় ওটাকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে তোমাকে শুনিয়ে দিলেন। ওটাই তোমার গল্প বলার পুরস্কার।”

    আমি কিছু নকসী কথা সংগ্রহ করিয়াছিলাম। একদিন অবনবাবু এই কথা শুনিয়া খুব উৎসাহিত হইয়া উঠিলেন। তাঁর ড্রয়ার হইতে তিনি এক তাড়া কাগজ বাহির করিলেন। তাহার মধ্যে নানান রঙের বহু কাঁথার নক্সা ঝলমল করিতেছে। কথা সেলাই করিতে এক এক রকম নক্সায় এক এক রকমের ফোড়নের প্রয়োজন হয়। বয়কা সেলাই, বাঁশপাতা সেলাই, তেরসী সেলাই প্রভৃতি যত রকমের কথা-সেলাই প্রচলন আছে, তাহার প্রত্যেকটি নক্সা সেই কাগজগুলিতে আঁকা। নানা কথা সংগ্রহ করিয়া এই নক্সাগুলি তৈরী করিতে অবনবাবুর বহুদিন একান্ত তপস্যা করিতে হইয়াছে। আমি ভাবিয়া বিস্মিত হইলাম, আমাদের কত আগে তিনি এইসব অপূর্ব পল্লীসম্পদের সন্ধান করিয়াছিলেন।

    নকসী কাঁথার প্রশংসা করিতে অবনবাবুর মুখ দিয়া যেন নকসী কথার ফুল ঝরিয়া পড়ে। রাণী ইসাবেলাকে কে যেন একখানা নকসী কাঁথা উপহার দিয়াছিলেন। মহাভারতে চামড়ার উপর নক্সা-করা এক রকমের কথার বর্ণনা আছে। সিলেট জেলার একটি বিধবা মেয়ে একখানি সুন্দর কথা তৈরী করিয়াছিলেন; তার জীবনের বালিকা বয়স হইতে আরম্ভ করিয়া বিবাহের উৎসব, শ্বশুরবাড়ি যাত্রা, নববধূর ঘরকন্না, প্রথম শিশুর জন্ম, স্বামীর মৃত্যু প্রভৃতি নানা ঘটনা তিনি এই কাঁথায় অঙ্কিত করিয়াছিলেন।

    দেশে ফিরিয়া সিলেট জেলার এই মহিলার কাহিনী বারবার আমার মনে উদয় হইত। আমার নকসী কাঁথার মাঠ’ পুস্তকে আমি যে কাঁথার উপর এতটা জোর দিয়াছি, তাহা বোধ হয় অবনীন্দ্রনাথের-ই প্রভাবে।

    আর একবার কলিকাতা আসিয়া ‘নকসী কাঁথার মাঠ’ পুস্তকের পাণ্ডুলিপি লইয়া অবনীন্দ্রনাথকে দেখাইলাম। ইতিপূর্বে দীনেশবাবু এই পাণ্ডুলিপির উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করিয়াছেন। অবনবাবু ছবি আঁকিতে আঁকিতে আমাকে আদেশ করিলেন, “পড়।”

    আমি খাতা খুলিয়া নকসী কাঁথার মাঠ’-এর প্রথম পৃষ্ঠা হইতে পড়িতে আরম্ভ করিলাম। খানিক পরে দেখি, ও-পাশে সমরেন্দ্রনাথ তাঁহার বই পড়া রাখিয়া আমার কাব্য শুনিতেছেন। গগনবাবুর তুলিও আস্তে আস্তে চলিতেছে। আমি পড়িয়া যাইতিছি, বইএর কোন জায়গায় আধুনিক ধরনের কোন প্রকাশভঙ্গিমা আসিয়া পড়িলে অবনবাবু তাহা পরিবর্তন করিবার উপদেশ দিতেছেন। মাঝে মাঝে আমার হাত হইতে খাতাখানা লইয়া তারই স্বভাবসুলভ গদ্যছন্দে সমস্ত পৃষ্ঠাটি পরিবর্তন করিয়া দিতেছেন। আমি বাড়িতে আসিয়া রাত্রি জাগিয়া সেই পৃষ্ঠাগুলি আবার নূতন করিয়া লিখিয়া লইয়াছি। কারণ অবনবাবুর সমস্ত নির্দেশ গ্রহণ করিলে তাহার ও আমার রচনায় মিলিয়া বইখানা একটি অদ্ভুত ধরনের হইত।

    সকালে আসিয়া আমি কবিতা শুনাইতে বসিতাম। বেলা একটা বাজিয়া যাইত, চাকর আসিয়া তাহাকে স্নানের জন্য লইয়া যাইত। আমিও বাসায় ফিরিতাম। এইভাবে চার-পাঁচ দিনে বই পড়া শেষ হইল। বলা বাহুল্য যে এতটুকু বই পড়িয়া শুনাইতে এত সময় লাগিবার কথা নয়। কিন্তু বইয়ের কোন কোন জায়গায় পরিবর্তনের নির্দেশ দিতে অবনবাবু অনেক সময় লইতেন।

    এই কয়দিন তিনি শুধু আমার বই পড়াই শোনেন নাই, তাঁর হাতের তুলিও সামনের কাগজের উপরে রঙের উপর রঙ মেলিয়া নানা ছবির ইন্দ্রধনু তৈরী করিয়াছে। দীনেশবাবু এই পুস্তকের পাণ্ডুলিপি পড়িয়া এত প্রশংসা করিলেন, অবনবাবুর কাছেও সেই ধরনের প্রশংসা আশা করিয়াছিলাম। কিন্তু অবনবাবু শুধু বলিলেন, “মন্দ হয় নাই। ছাপতে দাও।”

    গগনবাবু কোন কথা বলিলেন না। শুধু সমরবাবু এক দিন আমাকে ডাকিয়া বলিলেন, “তোমার কবিতাটি বড়ই ভাল লাগল। নজরুলের চাইতেও ভাল লাগল।”

    অবনবাবুর সংশোধন-করা নকসী কাঁথার মাঠের পাণ্ডুলিপি বন্ধুবর মোহনলালের নিকট আছে।

    ‘নকসী কাঁথার মাঠ’ ছবি সহ প্রকাশ করিবার বড়ই ইচ্ছা ছিল। শ্রদ্ধেয় সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় মহাশয়ের পরিচয়-লিপিতে বন্ধুবর রমেন্দ্র চক্রবর্তী এই পুস্তকের ছবিগুলি আঁকিয়া দিতে রাজী হইলেন। কিন্তু আমি লিখিয়াছি পূর্ববঙ্গের কথা। রমেন্দ্র কোন দিন পূর্ববঙ্গ দেখেন নাই। পূর্ববঙ্গের মাঠ আঁকিতে তিনি শান্তিনিকেতনের মাঠ আঁকেন। আমাদের এখানে মেয়েরা কলসী কাখে করিয়া জল আনিতে যায়, ও-দেশের মেয়েরা কলসী মাথায় করিয়া জল আনে। আমাদের দেশে কথা সামনে মেলন কবিয়া ধরিয়া তার উপরে বসিয়া মেয়ের কথা সেলাই করে। রমেন্দ্র ছবি আঁকিলেন, একটি মেয়ে কাঁথাটি কোলের উপর মেলিয়া সেলাই করিতেছে। ছবিগুলি দেখিয়া আমার বড়ই মন খারাপ হইল। তাছাড়া তখন পর্যন্ত আমার কোন লেখাকে ছবিতে প্রতিফলিত হইতে দেখি নাই। তখনকার কবি-মন কবিতায় যাহা লিখিয়াছে, মনে মনে ভাবিয়াছে তার চাইতেও অনেক কিছু। সেই অলিখিত কল্পনাকে রূপ দিবেন শিল্পী। কিন্তু এরূপ শিল্পী কোথায় পাওয়া যাইবে? এখন অভ্যাস হইয়া গিয়াছে। এখন কোন কবিতা কেহ চিত্রিত করিলে চিত্রকরকে অনেকখানি স্বাধীনতা দিয়া তবে তার বিচার করি।

    ছবিগুলি আনিয়া অবনবাবুকে দেখাইলাম। বলিলাম, আমার বইএর সঙ্গে ছবিগুলি মেলে না। তিনি কিছুক্ষণ ছবিগুলি দেখিয়া বলিলেন, “তোমার কবিতা অন্য ধরনের। আমি ছাড়া এর ছবি আর কেউ আঁকতে পারবে না।”

    আমি বোকা। তখন যদি বলিতাম, আপনি ছবি আঁকার ভার নেন, হয়ত তিনি রাজি হইয়া যাইতেন। কিন্তু আমি বলিলাম, “ছবিগুলি আমার পছন্দ হচ্ছে না। রমেন্দ্রবাবুকে এই কথা কী করে বলি?”

    অবনবাবু উত্তর করিলেন, “রমেনকে বল গিয়ে আমার নাম করে। বলো যে ছবিগুলি আমি পছন্দ করি নি।”

    বন্ধুবর ব্রতীন্দ্রনাথ ঠাকুর বইয়েব ছবিগুলি অকিয়া দিবেন, কথা দিয়াছিলেন। কয়েকটি ছবি তিনি আঁকিয়াও ছিলেন। কিন্তু বেশি দূর অগ্রসর হইলেন না।

    গগনবাবুকে একদিন এইকথা বলিলাম। তিনি কিছুক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া হাসিয়া বলিলেন, “আচ্ছা, তোমার বইয়ের ছবি আমি করে দেব।” কিন্তু ইহার কিছুদিন পরেই গগনবাবু রোগে আক্রান্ত হইলেন। এবং এই রোগেই তিনি চিরনিদ্রায় নিদ্রিত হইলেন। গগনবাবুর মত এমন সুন্দর প্রাণ গুণীলোক দেখি নাই। তাঁর মত গুণের আদর কেহ করে নাই। আমার ওস্তাদ দীনেশবাবুর মুখে শুনিয়াছি, গগনবাবু যদি কাউকে পছন্দ করিতেন, তাকে সর্বস্ব দান করিতে পারিলে খুশি হইতেন। দীনেশবাবুর ‘বঙ্গভাষা ও সাহিত্য পুস্তক পড়িয়া তিনি তার প্রতি আকৃষ্ট হন। সেই জন্য তিনি বিশ্বকোষ লেনে দীনেশবাবুকে একখানা বাড়ি তৈরি করিয়া দিয়াছিলেন। কলিকাতার বুকে কাউকে একখানা বাড়ি তৈরী করিয়া দেওয়া কতটা ব্যয়সাপেক্ষ তাহা সহজেই বোঝা যায়।

    কিছুতেই ছবি দিয়া ‘নকসী কাঁথার মাঠ’ প্রকাশ করা সম্ভব হইল না। অবনবাবু উপদেশ দিলেন, তোমার পুস্তকের প্রতিটি অধ্যায়ের পূর্বে কয়েক লাইন করিয়া গ্রাম্য কবিদের রচনা জুড়িয়া দাও। তাহারাই ছবির মত তোমার বইকে চিত্রিত করিবে। অবনীন্দ্রনাথের উপদেশ অনুসারেই নকসী কাঁথার মাঠ’ পুস্তকের প্রত্যেক অধ্যায়ের পূর্বে নানা গ্রাম হইতে আমার সংগৃহীত গ্রাম্য-গানগুলির অংশবিশেষ জুড়িয়া দিলাম। গানের পিছনে তার-যন্ত্রের ঐক্যতানের মত তাহারা আমার পুস্তকের প্রত্যেকটি অধ্যায়ে বর্ণিত ভাবধারাকে আরও জীবন্ত করিতে সাহায্য করিয়াছে। অবনবাবু ‘নকসী কাঁথার মাঠ’ পুস্তকের একটি সুন্দর ভূমিকা লিখিয়া দিয়া আমাকে গৌরবান্বিত করিয়াছিলেন। প্রচ্ছদপটের জন্য তিনি একটি ছবি আঁকিয়া দিয়াছিলেন। পানির উপরে একখানা মাঠ ভাসিতেছে। সেই ছবিতে খুব সূক্ষ্মতিসূক্ষ্ম তুলি ধরিয়া তিনি এমন ভাসা-ভাসা আবছায়া রঙের মাধুরী বিস্তার করিয়াছেন, আমার প্রকাশক হরিদাসবাবু বলিলেন, ব্লক করিলে এ ছবির কিছুই থাকিবে না। সুতরাং ছবিখানি ব্যবহার করা গেল না। অমূল্য সম্পদের মত আমি উহা সঙ্গে রক্ষা করিতেছি।

    ‘নকসী কাঁথার মাঠ’ ছাপা হইবার সময় মাঝে মাঝে অবনবাবু তাহার প্রুফ ও দেখিয়া দিয়াছিলেন। দীনেশবাবুও ইহার অনেক গুলি প্রুফ দেখিয়া দিয়াছিলেন। আজ এ কথা বলিতে লজ্জায় মরিয়া যাইতেছি। কত ক্ষুদ্র কাজের জন্য কষ্ট বড় দুটি মহৎ লোকের সময়ের অপব্যয় করাইয়াছি। আমি যখনই কলিকাতায় যাইতাম, প্রতিদিন সকালে গিয়া অবনবাবুর সামনে বসিয়া থাকিতাম। তিনি আরামকেদারায় বসিয়া ছবির উপরে রঙ লাগাইতে থাকিতেন। মাঝে মাঝে সেই ছবিকে পানির মধ্যে ডুবাইয়া ধুইয়া ফেলিতেন; আবার তাহা শুখাইয়া তাহার উপরে নিপুণ তুলিকায় রঙের উপরে রঙ লাগাইয়া যাইতেন। ও-পাশে গগনবাবুও তাহাই করিতেন। আমি বসিয়া বসিয়া এই দুই বয়স্ক শিশুর রঙের খেলা দেখিতাম। ছবি আঁকিতে আঁকিতে অবনবাবু আমাকে গ্রাম্য গান গাহিতে বলিতেন। আমি ধীরে ধীরে গান গাহিয়া যাইতাম। বাড়ির ছেলেমেয়েরা আড়াল হইতে আমার গান শুনিয়া মুচকি হাসি হাসিয়া চলিয়া যাইতেন। কিন্তু আমার বয়স্ক শ্রোতাদের কোন দিনই অবহেলা লক্ষ্য করি নাই। নতুন কোন গ্রাম্য কাহিনী সংগ্রহ করিলে তাহাও অবন বাবুকে শুনাইতে হইত। নতুন কোন লেখা লিখিয়া আনিলে তিনি ত শুনিতেনই। সেইসব লেখা শুনিয়া তাহার কোথায় কোথায় দোষত্রুটি হইয়াছে, তাহাও বলিয়া দিতেন। কোন লেখারই কখনও তারিফ করিতেন না। কোন লেখা খারাপ লাগিলে তিনি আমাকে বলিতেন। লেখার ভিতরে ইঙ্গিত থাকিবে বেশি; সব কথা খুলিয়া বলিবে; কলম টানিয়া লইবার সংযম শিক্ষা কর।

     

    ০৩.

    আমার সঙ্গে আলাপ করিয়া আমার লেখাগুলি শুনিয়া অবন বাবুর ছবি আঁকার কাজের ব্যাঘাত হইত না। বরঞ্চ আমার মত কেহ তার কাছে বসিয়া গল্প করিলে ছবি আঁকা আরও সুন্দর হইত। এইজন্য বাড়ির লোকে আমার ঘন ঘন তার কাছে যাওয়া-আসা খুব পছন্দ করিতেন।

    একদিন মোহনলালের বাবা মণিলাল গঙ্গোপাধ্যায় মহাশয় আমাকে বলিলেন, “অবনবাবু তোমার ‘নকসী কাঁথার মাঠ’এর কথা বললেন। তোমার বই তার ভাল লেগেছে। আমাকে আদেশ করলেন বইএর ছন্দের বিষয়ে তোমাকে নির্দেশ দিতে। তা ছন্দের রাজা অবনবাবুই যখন তোমার সমস্ত বই দেখে দিয়েছেন, আমার আর কি প্রয়োজন।” আমি বুঝিতে পারিয়া আনন্দিত হইলাম। আমার সামনে না করিলেও অগোচরে তিনি পুস্তকের প্রশংসা করিয়াছেন।

    বার বার অবনবার বাড়ি আসিয়া তাহার দৌহিত্র মোহনলালের সঙ্গে আমার বিশেষ বন্ধুত্ব গড়িয়া উঠে। ঠাকুর-পরিবারের মধ্যে এমন নিরহঙ্কার মিশুক লোক খুব কমই দেখিয়াছি। মোহনলালের বন্ধুগগাষ্ঠী এমনই বিচিত্র, এবং পরস্পরে এমন আকাশ-জমীন তফাৎ, তাহা ভাবিলে আশ্চর্য হইতে হয়।

    আমি যখন কলিকাতা হইতে দেশে ফিরিতাম তখন মোহনলালের সঙ্গে সুদীর্ঘ পত্রালাপের মাধ্যমেঠাকুরবাড়ির সঙ্গে পরিচিতির যোগসূত্র বজায় রাখিতাম। আমি লিখিতাম পল্লীবাংলার গ্রামদেশের অলিখিত রুপকাহিনী। বর্ষাকালে কোন ঘন বেতের ঝাড়ের আড়ালে ডাহুকের ডাক শুনিয়াছি, কোথায় কোন ভোবায় সোলপোনাগুলি জলের উপরে আলপনা আঁকিতে আঁকিতে চলিয়াছে, বসন্তের কোন মাসে কোন বনের মধ্যে নতুন গাছের পাতার ঝালর দুলিয়া উঠিয়াছে, তাহার উপরে আমগাছের শাখায় হলদে-পাখিটি ডাকিয়া ডাকিয়া হয়রান হইতেছে, এই সব কাহিনী। আর মোহনলাল লিখিত তার দাদামশায়ের নিত্যনৈমিত্তিক জীবনের বহু বিচিত্র ঘটনা; আমার মানসলোকের রবীন্দ্রনাথের রহস্যময় আনাগোনার কথা, কোন মাসে তিনি শান্তি নিকেতনের রূপকারদের সঙ্গে লইয়া আসিয়া কোন কথাকাহিনীর উপহার দিয়া গেলেন কলিকাতার বুকে—সেই সব ঘটনা। চিঠির ঘুড়িতে চড়িয়া তখন দেবলোকের ইন্দ্রজিতের মনের গগন-কোণে আসিয়া ভিড় জমাইত। চিঠিতে যে কথা সবটা স্পষ্ট হইয়া না উঠিত, কলিকাতা গিয়া বন্ধুর সঙ্গে একান্তে বসিয়া সেই সব কথা ইনাইয়াবিনাইয়া ওলট করিয়া পালট করিয়া নতুন ভাবে উপভোগ করিতাম।

    তারপর অবনঠাকুরের বারান্দায় দিনের পর দিন, সকাল হইতে দুপুর পর্যন্ত, একাগ্র বসিয়া থাকিতাম। দুই ভাই অবনবাবু আর গগনবাবু রঙের জাদুকর; কথার সরিৎসাগর। তুলির গায়ে রঙ মাখাইয়া কাগজের উপরে রঙ মাখামাখি খেলা—দেখিয়া দেখিয়া সাধ মেটে না। দূর-অতীতে মোগল-হেরেমের নির্জন মণিকোঠায় সুন্দরী নারীর অধরের কোণে যে ক্ষীণ হাসিটি ফুটিতে না ফুটিতে ওড়নার আড়ালে মিলাইয়া যায়—একজন তারই এতটুকু রেস রঙিন তুলির উপরে ধরিয়া বিশ্বের রূপপিয়াসীদের মনে অনন্তকালের সান্ত্বনা আঁকিয়া দিতেছেন, আরজন কথাসরিৎসাগরে সাঁতার কাটিয়া ইন্দ্রধনুর দেশ হইতে রূপকথার রূপ আনিয়া কাগজের উপরে সাজাইতেছেন। এ রূপ দেখিয়া মন তৃপ্তি মানে না। দিনেয় পর দিন, মাসের পর মাস, বছরের পর বছর, সকাল হইতে দুপুর, বিকাল হইতে সন্ধ্যা চলিয়াছে দুই জাদুকরের একান্ত সাধনা। এদের বন্ধু নাই, আত্মীয় নাই, স্বজন নাই, প্রতিবেশী নাই। নীড়হীন দুই চলমান বিহঙ্গ উড়িয়া চলিতে চলিতে পথে পথে ছবির রঙিন ফানুস ছড়াইয়া চলিয়াছেন। এরা চলিয়া যাইবেন আমাদের গ্রহপথ হইতে হয়ত আর কোন সুন্দরতর গ্রহপথে। যাওয়ার পথখানি ছবির রঙিন আখরের দান-পত্রে রাঙাইয়া চলিয়াছেন। দুইজনের মুখের দিকে একান্তে চাহিয়া থাকি। গগনবাবু কথা বলেন না মাঝে মাঝে মৃদু হাসেন। সে কী মধুর হাসি! অবনবাবু কাগজের উপর রঙ চড়ান, আর মধ্যে মধ্যে কথা বলেন। কথার সরিৎসাগরে অমৃতের লহরী খেলে।

    অবনবাবু মাঝে মাঝে জিজ্ঞাসা করেন, “কি হে, জসীমিঞা, কোন কথা যে বলছ না?”

    কথা আর কী বলিব। হৃদয় যেখানে শ্রদ্ধা হইয়া ওই দুই সাধকের চরণতলে লুটাইয়া পড়িতেছে, সেখানে সকল কথা নীরব। মনে মনে শুধু বলি অমনই একান্ত সাধনার শক্তি যেন আমার হয়। আমার যা বলার আছে, তা যেন একান্ত তপস্যায় অঙ্কুরিত হইয়া ওঠে।

     

    ০৪.

    অতি সঙ্কোচের সঙ্গে একদিন জিজ্ঞাসা করি, “দাদামশাই, (মোহনলালের সঙ্গে আমিও তাকে দাদামশাই বলিয়া ডাকিবার অধিকার পাইলাম) আপনি ওরিয়েন্টাল আর্ট-এর জন্মদাতা। আপনার মুখে একবার ভাল করে শুনি ওরিয়েন্টাল আর্ট কাকে বলে।”

    ছবিতে রং লাগাইতে লাগাইতে অবনবাবু বলেন, “আমি জানিনে বাপু, ওরিয়েন্টাল আর্ট কাকে বলে।”

    আমি বলি, “তবে যে ওরিয়েন্টাল আর্ট নিয়ে লোকের এত লেখালেখি। সবাই বলে, অপনি ওরিয়েন্টাল আর্ট-এর পথের দিশারী।”

    হাসিয়া অবনবাবু বলেন, “তাদের কাছে জিজ্ঞাসা করে, ওরিয়েন্টাল আর্ট কাকে বলে। আমি করেছি আমার আর্ট। আমি যা সুন্দর বলে জেনেছি, তা আমার মত করে এঁকেছি। কেউ যদি আমার মত করে আঁকতে চেষ্টা করে থাকে, তারা আমার অনুকরণ করেছে। তারা তাদের আর্ট করতে পারেনি।”

    নিজের ছবির বিষয়ে তার কি মত, জানিতে কৌতূহল হইল। জিজ্ঞাসা করিলাম, “আপনার ছবির পাত্র-পাত্রীদের আপনি সুন্দর করে আঁকেন না কেন? লোকে বলে আপনি ইচ্ছে করেই আপনার চরিত্রগুলোকে এবড়ো-খেবড়ো করে আঁকেন।”

    অবনবাবু বলেন, “আমি সুন্দর করেই আঁকি। আমার কাছে আমার সুন্দর। তোমাদের কাছে তোমাদের সুন্দর। আমি ইচ্ছে করে কোন ছবি অসুন্দর করে আঁকিনে।”

    আমি তবু বলি,“আপনার বনবানীর ছবিখানার কথাই ধরা যাক। অত বয়সের করে এঁকেছেন কেন? অল্প বয়সের করলে কি দোষ হত?”

    অবনবাবু হাসেন : “আমি ওই বয়সেই তাকে সুন্দর করে দেখেছি।”

    এখন নিজের ভুল বুঝিতে পারি। বন কত কালের পুরাতন; সেই বনের রানীও অমনি পুরাতন বয়সের হইবেন। তাছাড়া অবনবাবুর বয়সও সেই বনের মত প্রবীন।

    আর একদিন অবনবাবুকে জিজ্ঞাসা করিলাম, “দাদামশাই, কিছু লিখতে মন আসছে না। কি করি?”

    তিনি বলিলেন, “চুপ করে বসে থাক। পড়াশুনো কর।”

    আমি জিজ্ঞাসাকরি, “আচ্ছা দাদামশাই, মনের ভাবকে বাড়াবার জন্য আপনি কিছু করেন না?”

    দাদামশাই হাসেন : “আমার যা ভাব আছে, তারই জন্যে রাতে ঘুম হয়না। সারাদিন তাই ভাব কমানোর জন্য ছবি আঁকি। আর ভাব বাড়ালে ত মরে যাব।”

    অবন আর গগন দু-ভাই আঁকেন। ওপাশে সমর বসিয়া বসিয়া শুধু বই পড়েন। কত দেশী-বিদেশী গুণীব্যক্তিরা আসেন। অবনের কাছে আর গগনের কাছে তাদের ভিড়। সমরের দিকে তাঁরা ফিরিয়াও চাহেন না। সময় তাঁর বই-এর পাতার পর পাতা উল্টাইয়া চলেন। আরব্য রজনীর ইংরাজী অনুবাদ, কালীসিংহের মহাভারত, কুট হ্যামসুন, টলস্টয় ইত্যাদি কত দেশের কত মহামনীষীর লেখা। স্বপনপুরীর রাজপুত্র বই-এর পাতায় ময়ুরপঙ্খীতে চড়িয়া দেশ বিদেশে ঘুরিয়া বেড়াইতেছেন। মাঝে মাঝে বই হইতে মুখ তুলিয়া গগনের ছবি দেখেন—অবনের ছবি দেখেন। দুই ভাই-এর সৃষ্টির গৌরব যেন তাঁরই একার। এই রঙ-রেখার জাদুকরদের দ্বারপ্রান্তে তিনি যেন প্রহরীর মত বসিয়া আছেন। কতবার কত সময়ে আমি সেই বারান্দায় গিয়া ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটাইয়াছি। কোনদিন ভাই-এ ভাই এ কথা-বলাবলি করিতে শুনি নাই। ঝগড়া ত তাহারা জানিতেনই না; সাংসারিক কোন আলাপ, কি কোন অবসর বিনোদনের কথাবার্তা—কোন কিছুতেই এই তিন ভাইকে কোনদিন মশগুল দেখিতে পাই নাই। গগন খুশি আছেন, এপাশে অবন ছবি আঁকিতেছেন ওপাশে সমর বই পড়িতেছেন। অবন খুশি আছেন,- পাশে গগনের তুলিকাটা কাগজের উপর উড়িয়া চলিয়াছে তেপান্তরের রূপকথার দেশে। সমর ত দুই ভাই এর সৃষ্টি কার্যের গৌরবে ডগমগ। কথা যদি এদের কিছু থাকে, সে কথা হয় মনে মনে। পাশে ভাইরা বসিয়া আছেন, ইহাই ত পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম আনন্দ।

    এক একদিন সন্ধ্যাবেলায় অবন নামিয়া আসেন নিচের তলায় হলঘরে। সেখানে বাড়ির ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা তাদের নাতিপুতিরা অবনদাকে ঘিরিয়া ধরে, “গল্প বল।”

    অবনের গল্প বলার সে কী ধরন। অবন যেমন ছবি আঁকেন, রঙ দিয়া মনের কথাকে চক্ষুর গোচর করাইয়া দেন—তেমনি তার গল্পের কাহিনীকে হাত নাড়িয়া ইচ্ছামত চোখমুখ ঘুরাইয়া কোনখানে কথাকে অস্বাভাবিকভাবে টানিয়া কোন কথাকে দ্রুতলয়ে সারিয়া তার গল্পের বিষয়বস্তুকে চক্ষুগোচর করিয়া তুলিতে চেষ্টা করেন। মাঝে মাঝে ইকিড়ি-মিকিড়ি কথা ভরিয়া শব্দের অর্থের সাহায্যে নয়, ধ্বনির সাহায্যে গল্পের কথাকে রূপায়িত করেন।

    অবনের দুই অস্ত্র-রঙ আর কথা, আঁচড় আর আখর। তাঁকে ঘিরিয়া শিশুলের মৌমাছি সর্বদা গুনগুন করে।

    কোন কোন দিন তিনি ভূতের গল্প বলিয়া শিশুদের ভয় পাওয়াইয়া দেন। বলেন, ভূতের গল্প শুনিয়া ওদের হার্ট বলবান হইবে।

    সেদিন ছিল বর্ষা। অবন নিচে নামিয়া আসিলেন। বাড়ির সকলে তাকে ঘিরিয়া বসিল। ভাইপোরা নাতি-নাতনীরা সকলে। তিনি উদ্ভট ধাঁধা রচনা করিয়া সবাইকে তার মানে জিজ্ঞাসা করেন। নাতিনাতনীরা শুধু নয়, বয়স্ক ভাইপোরা পর্যন্ত সেই ধাঁধার উত্তর দিতে ঘামিয়ে অস্থির। কত রকমের ধাঁধা রচনা করেন! ধাঁধার কথাটি মুখে উচ্চারণ না করিয়া হাত নাড়িয়া চোখমুখ ঘুরাইয়া ধাঁধার ছবি তৈরী করেন, সঠিক উত্তর না পাইলে উত্তরটিকে আরও একটু ইঙ্গিতে বুঝাইয়া দেন। নাতিপুতিরা উত্তর দিলে খুশিতে উজ্জ্বল হইয়া ওঠেন।

    সেবার গ্রীষ্মের ছুটির পর দেশ হইতে ফিরিয়া মোহনলালের কাছে শুনিলাম, খেয়াল হইয়াছিল কয়টি মোরগ পুষিবেন। সকালবেলা ঘণ্টার পর ঘণ্টা নাতিপুতিদের লইয়া জল্পনাকল্পনা চলে, কি রকম মোরগ হইবে, কেমন তার গায়ের রঙ, কেমন তার চলনবলন। তারপর গাড়িতে করিয়া দুপুরের রোদে শেয়লদার হাট। এমনি তিন-চার হাট ঘুরিলেন। মনের মত মোরগ পাওয়া গেল না।

    আমার কাছে ছিল একখানা শহীদে-কারবালার পুঁথি। তাকে পড়িতে দিলাম। সে বই তিনি শুধু পড়িলেন না, যে জায়গা তার ভাল লাগিল দাগ দিয়া রাখিলেন। হাতের চিহ্ন-আঁকা সেই বই এখনো আমার কাছে আছে।

    তারপর খেয়াল চাপিল, আরও পুঁথি পড়িবেন। আমাকে বলিলেন, “ওহে জসীমিঞা, চল তোমাদের মুসলমানী পুঁথির দোকানে মেছুয়াবাজারে।”

    তাঁকে লইয়া গেলাম কোরবান আলী সাহেবের পুঁথির দোকানে। দোকানের সামনে অবনীন্দ্রনাথের গাড়ি। জোব্বাপাজামা পরা এ কোন শাহজাদা পুঁথির দোকানে আসিয়া বসিলেন। পুঁথিওয়ালার অবাক! এমন সুন্দর শাহজাদা কোন দিন তাদের পুঁথির দোকানে আসে নাই। এটা-ওটা পুঁথি লইয়া নাড়াচাড়া করেন। দোকানী আমার কানে কানে জিজ্ঞাসা করেন, “কে ছদ্মবেশী বাদশাজাদা?” আমি বলি, “বাদশাজাদা নন, ইনি রঙের রেখার আর কথার আতসবাজ, পাশ্চাত্ত্য ও দেশীয় চিত্রকলার শাহানশাহ অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর।”

    দোকানী ব্যস্ত হইয়া ওঠে মেছুয়াবাজারের মালাই-দেওয়া সিঙ্গল চা ও পান আনিয়া হাজির করে।

    দোকানীর কানে কানে বলি, “ওসব উনি খাবেন না। পেয়ালাগুলো দেখুন না কেমন ময়লা?

    দোকানীর আন্ত িতা দেখিয়া চায়ের পেয়ালায় মুখ দিয়া বলিলেন, “দেখ জসীমিঞা, কেমন সুন্দর চা।”

    দোকানী খুশি হইয়া যেখানে যত ভাল পুঁথি আছে, তার সামনে আনিয়া জড় করে। ছহি সোনাভান, জয়গুন বিবির কেচ্ছা, আলেফ লায়লা, গাজী কালু চম্পাবতী—আরও কত বই। শিশু যেমন মুড়ি কুড়াইয়া খুশি হইয়া বাড়িতে লইয়া আসে, তেমনি এক তাড়া বই কিনিয়া অবনীন্দ্রনাথ ঘরে ফিরিলেন। তারপর দিনের পর দিন চলিল পুঁথি পড়া। শুধু পড়া নয়—পুঁথির যেখানে নায়িকার বর্ণনা, গ্রামদেশের প্রকৃতির বর্ণনা, বিরহিনী নায়িকার বারোমাসের কাহিনী, অবনবাবু তার খাতার মধ্যে ঢুকিয়ে রাখেন। খাতার পর খাতা ভর্তি হইয়া যায়। সবগুলি পুধি শেষ হইলে আবার একদিন চলিলেন সেই মেছুয়াবাজারে। এমনি করিয়া বার বার গিয়া এ-দোকান ও-দোকান ঘুরিয়া শুধু পুঁথিই কিনিলেন না, পুঁথির দোকানদারদের সঙ্গে রীতিমত বন্ধুত্ব করিয়া আসিলেন।

     

    ০৫.

    রোজ সকাল হইতে দুপুর, আবার বিকাল হইতে সন্ধ্যা সামনে পুঁথি পড়া চলিয়াছে। খাতার পর খাতা ভর্তি হইয়া চলিয়াছে। কেহ দেখা করিতে আসিলে তাকে পুঁথি পড়িয়া শোনন—গাজীকালুর পুঁথিতে যেখানে বাঘের বর্ণনা, মামুদ হানিফের সঙ্গে সোনাভানের লড়াই-এর বর্ণনা, নানা গ্রামের নাম ও নায়ক-নায়িকার পোশাকের বর্ণনা। রঙ-গোলার কোটা শুষ্ক হইয়া পড়িয়া আছে। তুলিতে ধূলি জমিয়াছে। কোথায় রঙ, কোথায় কাগজ কোনদিকে খেয়াল নাই। এই রূপে তিন-চার মাস কাটিয়া গেল। আর বই পাওয়া যাইতেছে না। মজার গল্পে-ভরা যত পুখি, সব পড়া শেষ হইয়া গিয়াছে।

    এমন সময় রবীন্দ্রনাথ আসিলেন শান্তিনিকেতন হইতে। খুড়োভাইপোতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা মুসলমানী পুঁথি লইয়া আলাপ চলিল। রবীন্দ্রনাথ বলিলেন, পুঁথির একটি সংকলন বিশ্বভারতী হইতে ছাপাইবেন। পুঁথি-সংকলনের খাতা বিশ্বভারতীতে চলিয়া গেল। (সেগুলি হয়ত সেখানেই পড়িয়া আছে; আজও ছাপা হয় নাই।)

    অবনীন্দ্রনাথ আবার ছবি আঁকায় মন দিলেন। কোথায় রঙের কৌটা শুষ্ক হইয়া পড়িয়াছিল, তাহাতে পানি ঢালিলেন, ধূলিমাখা তুলিটি ঝাড়িয়া মুছিয়া লইলেন।

    একবার তাঁর খেয়াল চাপিল, মানুষের ছবি আঁকিবেন। বাড়ির সবাইকে ডাকিলেন সিটিং দিতে। অনেকের ছবি আঁকা হইয়া গেল। একদিন আমাকে বলিলেন, “এসো, তোমার একটি ছবি আঁকি।”

    আমি সঙ্কোচবোধ করিতেছি। পাশে ব্বতীন্দ্রনাথ ঠাকুর দাঁড়াইয়াছিলেন। তিনি সিটিং দিতে বসিয়া গেলেন। আজ মনে বড়ই অনুতাপ হইতেছে। সেদিন যদি সঙ্কোচ না করিতাম, তবে সেই অমর তুলিকার জাদুস্পর্শে নিজেকে কতকটা অমর করিয়া লইতে পারিতাম।

    মহাত্মা গান্ধী যেদিন ডাণ্ডী-যাত্বা করিলেন লবণ-আইন অমান্য করিতে, তিনি সেইদিন আরব্য রজনীর ছবিগুলি আঁকা আরম্ভ করিলেন। এক একখানা ছবি আঁকিতে বিশ-পঁচিশ দিন লাগে। আমি সামনে বসিয়া বসিয়া দেখি আর তার কাছে আমার পল্লীবাংলার গল্প বলি।

    কোথায় কোন গ্রামে এক বেদে সাপ ধরিতে যাইয়া সাপের ছোবলে মৃত প্রায় হইয়াছিল, তারপর বেদেনী আসিয়া কেমন করিয়া তাকে মন্ত্র পড়িয়া সারাইয়া দিয়াছিল; কোন গ্রামে ভীষণ মারামারি হইতেছিল, হঠাৎ আফাজদ্দি বয়াতি আসিয়া গান গাহিয়া সেই কলহপ্রবণ দুই দলকে মন্ত্র-যুগ্ধ করিয়া তুলিয়াছিল; কোন গ্রামে মেয়েরা পিঠার উপর নক্সা আঁকিতে আঁকিতে গান করে, কোথায় এক বৈষ্ণবী গান গাহিতে থাকে আর তার বৈষ্ণব কাঁদিয়া কাঁদিয়া তার পায়ের উপর আছড়াইয়া পড়ে; কোথায় কোন জঙ্গলে একটা বৃষকাষ্ঠ আছে, তার ছবিগুলি যেন জীবন্ত হইয়া কথা কহিতে চায়। আমি বলি এই সব কথা, আর তিনি ছবি আঁকিয়া চলেন।

    বুড়া হইয়া যাইতেছেন। মুখের চামড়া ঝুলিয়া পড়িতেছে। কিন্তু তিনি বলেন, “সমস্ত আরব্য রজনীর গল্প ছবিতে ছবিতে ভরে দেব।”

    আমি জিজ্ঞাসা করি, “দাদামশাই, এক একটা ছবি আঁকতে এতদিন সময় নিচ্ছেন, এতবড় বিরাট আরব্য রজনীর বই-এর ছবিগুলি কি আপনি শেষ করে যেতে পারবেন?

    দাদামশাই হাসিয়া উত্তর করেন, “আমি শিল্পীর কাছে শিল্প সীমাবদ্ধ, কিন্তু শিল্পীর জীবন—eternal অনন্ত। এর কোন শেষ নেই, কতদিন বেঁচে থাকব সে প্রশ্ন আমার নয়, আমায় কাজ করে যেতে হবে।”

    দিনের পর দিন ছবি আঁকা চলিল। তখন বাংলার রাজনৈতিক আকাশে অসহযোগের ডামাডোল চলিতেছে। মহাত্মা গান্ধী জেলে গেলেন। সমস্ত ভারত রাজনৈতিক চেতনায় উন্মাদ হইয়া উঠিল। খবরের কাগজে নিত্য নূতন উত্তেজনাপূর্ণ খবর বাহির হইতেছে। ইস্কুল-কলেজ ভাঙিতেছে, জেলে রাজবন্দীদের উপর অত্যাচার হইতেছে, কিন্তু শিল্পী একান্তে বসিয়া বসিয়া আরব্য রজনীর ছবি আঁকিতেছেন। কোনদিন খবরের কাগজের পাতা উল্টাইয়া দেখেন না। সকাল হইতে দুপুর, আবার বিকাল হইতে সন্ধ্যা-সমানে চলিয়াছে ছবি আঁকার সাধনা। সেই ছবিগুলিতে শিল্পীর বাড়িরই ছেলেমেয়েরা, তারাই যেন আরব্য রজনীর পোশাক পরিয়া নাটক করিতে নামিয়াছে। এমনি করিয়া প্রায় এক বৎসর কাটিয়া গেল। শান্তিনিকেতন হইতে রবীন্দ্রনাথ আসিলেন বসন্ত-উৎসবের নাচের দল লইয়া। অবনীন্দ্রনাথ চলিলেন এম্পায়ার থিয়েটার-হলে অভিনয় দেখিতে।

    পরদিন সকালে দেখি, তিনি চুপ করিয়া বসিয়া আছেন। আমাকে দেখিয়া বলিলেন, “ওহে জসীমিঞা, কাল শান্তিনিকেতনের বসন্ত-উৎসব দেখে এলাম। ওরা কী আবিরের গুড়ো ছড়িয়ে দিল। তাতে চোখ অন্ধ হয়ে গেছে। তোমাদের মোগলযুগের ছবি আর চোখে দেখতে পাচ্ছিনে।”

    সেইদিন হইতে তার আরব্য রজনীর ছবি আঁকা শেষ হইল। সেই অসমাপ্ত ছবিগুলি রবীন্দ্রসদনে রক্ষিত আছে।

    বি. এ. পাশ করিয়া এম. এ. পড়িতে আমি কলিকাতায় আসিলাম। তখন থাকিতাম মেছুয়াবাজার ওয়াই. এম. সি. এ. হোস্টেলে। কিন্তু আমার মন পড়িয়া থাকিত অবনঠাকুরের দরবারে। অবসর পাইলেই আমি অবনীন্দ্রনাথের সামনে গিয়া চুপ করিয়া বসিয়া থাকিতাম। তিনি ধীরে ধীরে ছবির উপরে তুলি চালাইয়া যাইতেন। একটি বাঁশের চোঙায় তার ছবি আঁকার সাজ-সরঞ্জাম রাখিতেন।

    তিনি ছবির উপরে খুব আবছা রঙ দেওয়া পছন্দ করিতেন। একখানা কাঠের তক্তার উপর কাগজ রাখিয়া তিনি ছবি আঁকিতেন। হাতের তুলিটি যেন ইচ্ছামত নরম হইত, ইচ্ছামত শক্ত হইত। এ-রঙে ও-রঙে তুলি ঘষিয়া তিনি মাঝে মাঝে সামান্য জল মিশাইয়া ছবির উপরে মৃদু প্রলেপ মাখাইয়া যাইতেন। প্রথমে কাগজের উপর তিনি শুধু রঙ পরাইয়া যাইতেন। সেই রঙের উপর ধীরে ধীরে ছবির মূর্তিগুলি ভাসিয়া উঠিত। আমার মনে হইত, কোন ইন্দ্রপুরীর জাদুকর নিজের ইচ্ছামত কাগজের উপর রঙের কয়েকটি রেখার বন্ধনে স্বর্গ-মর্ত্য-রসাতলের দেব-নর-যক্ষ-কিন্নরদের আনিয়া ইচ্ছামত অভিনয় করাইয়া যাইতেছেন। সেই অভিনয়ের আরম্ভ হইতে শেষ পর্যন্ত দেখিতে প্রতিদিন কে যেন আমাকে সেখানে টানিয়া লইয়া যাইত। মাঝে মাঝে তিনি তার অঙ্কিত ছবির কাগজখানি পানিতে ডুবাইয়া লইতেন। রঙ আরও ফ্যাকাশে হইয়া যাইত। কাগজ কিঞ্চিৎ শুকাইলে আবার তাহার উপরে তিনি নতুন করিয়া রঙ পরাইতেন। এ দৃশ্য দেখিতে আমার বড়ই ভাল লাগিত।

     

    ০৬.

    অবনীন্দ্রনাথের স্ত্রী ছিলেন সাদাসিধে রকমের ভালমানুষটি। গল্প করিতে খুব ভালবাসিতেন। মোহনলাল তাকে দাদু বলিয়া ডাকিত। সেই সঙ্গে আমিও তাকে দাদু বলিতাম। তিনি রেডিও শুনিতে খুব পছন্দ করিতেন। আমি মাঝে মাঝে রেডিও সম্পর্কে গল্প বলিয়া তাকে খুশি করিতাম। তাঁর ঘরে গিয়া রেডিও শুনিতে চাহিলে তিনি যেন হাতে-স্বর্গ পাইতেন। অতবড় বাড়িতে সবাই আর্ট-কালচার লইয়া বড় বড় চিন্তাধারা লইয়া মশগুল থাকিত। স্বামীর বিশ্বব্যাপী খ্যাতি কত বিরাট কত বিস্তৃত। তিনি সেখানে হয়ত হারাইয়া যাইতেন। তাই তাঁর ক্ষুদ্র রেডিও-যন্ত্রটি বাজাইয়া নিজের স্বল্পপরিসর একটি জগৎ তৈরী করিয়া লইতেন।

    সন্ধ্যা হইলে অবনীন্দ্রনাথ ঘরে আসিয়া বসিতেন। কখনও খবরের-কাগজ পড়িতেন না। তিনি বলিতেন, “খবর শুনতে হয়। পড়ার জন্য ত ভাল ভাল বই আছে।”

    তাঁর আদরের চাকর ক্ষিতীশ। সন্ধ্যার পরে তার পায়ে তৈল মালিশ করিত আর নানা রকম সত্য-মিথ্যা গল্প বলিয়া যাইত। কোন পাড়ায় একটা মাতাল ঢুকিয়া পড়িয়া কী সব কাণ্ড-বেকাণ্ড করিয়াছিল; কোথায় কংগ্রেসসেবকের উপর গোরা সৈন্যেরা গুলি চালাইয়াছিল, কী করিয়া একজন সাধু আসিয়া সেই বন্দুকের গুলি খাইয়া ফেলিয়াছিল; গান্ধী সৈন্যের কোন কোন দেশ জয় করিয়া কত দূরে আসিয়া পড়িয়াছে—এই সব আজগুবি কাহিনী। রূপকথার শিশু-শ্রোতার মত শিল্পী এই সব খবর শুনিতে শুনিতে ঘুমাইয়া পড়িতেন।

    কোন কোন দিন গৃহিণীর রেডিও-যন্ত্রটি কোন অনুষ্ঠানের চটকদার সুর লইয়া জোরে বাজিয়া উঠিয়া গল্প শোনার কাজে ব্যাঘাত ঘটাইলে অতি-মৃদুস্বরে তিনি বলিতেন, “বলি, তোমার যন্ত্রটি একটু থামাও না।” গৃহিণী লজ্জিত হইয়া রেডিওর শব্দ কমাইয়া দিতেন।

    শুনিয়াছি, রেডিও-যন্ত্রটি লইয়া মাঝে মাঝে গৃহিণীর সঙ্গে তার মত-বিরোধ হইত। স্বামী যে একটা মহান সৃষ্টিকার্যে নিমগ্ন, সেটা তিনি বুঝিতেন। নানা রকমের সেবা লইয়া পূজার হস্ত প্রসারিত করিয়া এই নরদেবতাকে তিনি তাঁর ক্ষুদ্বপরিসর মনের আকুতি দিয়া সর্বদা অর্চনা করিতে প্রস্তুত থাকিতেন।

    জমিদারীর আয় কমিয়া যাইতেছে। আদরের চাকর রাধু বিবাহ করিতে বাড়ি যাইবে। তাকে কিছু টাকা দেওয়ার প্রয়োজন। আগেকার দিনে এসব ব্যাপারে তিনি কতবার হাজার টাকার ছোড়া ফেলিয়া দিয়াছেন। এখন আর সে দিন নাই। তবু কিছু দিতে হইবে। কিন্তু হাতে উঠাইয়া কিছু দিতে গেলে বড় ছেলে হয়ত অসন্তুষ্ট হইবে। তিনি রাধুর একটা ছবি আঁকিলেন—সে যেন পুকুরের ধারে* ছিপ হাতে মাছ ধরিতেছে। একজিবিশনে ছবিখানি বহুমূল্যে বিক্রিত হইল। ছেলেদের ডাকিয়া তিনি বলিলেন, “দেখ, ছবিখানি আঁকতে আমার বিশেষ কিছু কষ্ট হয় নি। আমি ত অমনি বসে বসে ছবি আঁকি-ই। রাধু বেচারারই এ জন্যে পরিশ্রম হয়েছে বেশি। তাকে তিন দিন সমানে ছিপ-হাতে বসে থাকতে হয়েছে। সুতরাং ছবির দামটি তার প্রাপ্য।”

    ছেলেরা সবই বুঝিতে পারিয়া মৃদু হাসিয়া পিতার কথায় সায় দিলেন। রাধু নাচিতে নাচিতে টাকা লইয়া বিবাহ করিতে বাড়ি ছুটিল। এই গল্পটি আমি মোহনলালের নিকট শুনিয়াছি।।

    চাকরবাকরদের সঙ্গে কেহ রাগারাগি হাঁকাহাঁকি করিত না। এত বড় একান্নবর্তী পরিবার—সকলেই যেন সুরে-বাধ বাদ্যযন্ত্র। কোনদিন এই তার-যন্ত্রে বেসুরো রাগিণী বাজিতে শুনি নাই। এত লোক একত্ব থাকিয়া এই মহৎ সংযম কী করিয়া আয়ত্ত করিয়াছিলেন, ভাবিতে বিস্ময় লাগে। শুনিয়াছি, তিনি যদি কখনো কোন চাকরের উপর একটু গরম কথা বলিয়াছেন, তৎক্ষণাৎ নিজের শাস্তিস্বরূপ তাকে দশটাকা বখশিস করিতেন। কোন কোন দুষ্ট চাকর তাঁর এই দুর্বলতার সুযোগ গ্রহণ করিত। ইচ্ছা করিয়াই কাজে অবহেলা করিয়া তাকে রাগাইয়া এইভাবে বখশিস আদায় করিত। একদিন তিনি তাঁর নিজের অতীত-জীবনের একটি ঘটনা বলিলেন। সব কথা মনে নাই। ভাসা-ভাসা যাহা মনে আছে, তাহাই এখানে উল্লেখ করিব।

    একবার তিনি পুরী বেড়াইতে গেলেন। সেখানে একটি মুসলিমপরিবারের সঙ্গে তার আলাপ হইল। কোথাকার কোন বৃদ্ধ জমিদারের পরিবার। বুড়োর তিন পুত্রবধূ আর দুই মেয়ে। তারা কেউ অবনবাবুকে দেখিয়া ঘোমটা দিত না। তাঁকে নিমন্ত্রণ করিয়া নানা রকমের মুসলমানি খানা খাওয়াইত। তাদের সঙ্গে করিয়া তিনি সমুদ্রতীরে নানা স্থানে ঘুরিয়া বেড়াইতেন।

    একদিন সকালবেলা বাড়ির সবাইকে লইয়া তিনি গল্পগুজব করিতেছেন। এমন সময় কয়েকজন ভদ্রলোক আসিয়া তাঁর সঙ্গে পরিচিত হইলেন। অমুক স্থানের মহারাজা, অমুক সমিতির সভাপতি, অমুক কাগজের সম্পাদক ইত্যাদি কয়েকজন বিখ্যাত লোক তাকে ঘিরিয়া বসিলেন। পানির মাছ শুকনায় পড়িলে যেমন হয়, তার যেন সেই অবস্থা। তিনি জিজ্ঞাসা করিলেন, তা কি মনে করে আপনারা আমার কাছে এসেছেন?”

    আগন্তুকের মধ্যে একজন একটু কাশিয়া বলিলেন, “মুসলমানেরা আজকাল শতকরা পঞ্চাশটি চাকরির জন্যে আবদার ধরেছে। আমাদের হিন্দুসমাজের যুবকেরা বেকার হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে, আর তারা এতগুলো চাকরি নিয়ে নেবে—এই অন্যায়ের প্রতিবাদ হওয়া উচিত। আজকাল গভন মেন্টও ওদের কথায় কান দিচ্ছে। আমরা রাজনৈতিক নেতারা এ জন্য বহু প্রতিবাদ করেছি। যাঁরা রাজনীতি করেন না, অথচ দেশের প্রসিদ্ধ ব্যক্তি, তাদের দিয়ে একটা প্রতিবাদ করাতে চাই। প্রতিবাদ-পত্র লিখে এনেছি। এতে জগদীশচন্দ্র, পি. সি রায় প্রভৃতি বহু মনীষী সই প্রদান করেছেন।”

    অবনীন্দ্রনাথ শিশুর মত বিস্ময়ে বলিলেন, “তা আমাকে কি করতে হবে?”

    তাঁর সামনে কাগজ-খাতা মেলিয়া ধরিয়া ভদ্রলোক বলিলেন, “বিশেষ কিছু না। শুধুমাত্র এখানে একটি সই।”

    তিনি বলিলেন, “মুসলমানেরা যদি বেশি চাকরি পায়, তাতে আমার কি। আমার প্রজাদের মধ্যে প্রায় সবাই মুসলমান। তারা যদি দুটো বেশি চাকরি পায় তাতে আমি বাদ সাধতে যাব কেন?”

    ভদ্রলোক তখন মুসলমানদের বিরুদ্ধে কিছু বলিতে যাইতে ছিলেন। পাশে আমি বসিয়া আছি। ভদ্রলোকের সমালোচনা শুনিয়া মনে ব্যথা পাইব, সেইজন্য অবনবাবু তাকে থামাইয়া দিয়া বলিলেন, ‘এই যে, আমার জসিম মিঞা বসে আছে। ওর একটা চাকরির জন্যে আমি কত চেষ্টা করছি। ওর চাকরী হলে আমি কত খুশি হই।”

    ভদ্রলোকেরা নানা ভাবে তাকে বুঝাইতে চেষ্টা করিলেন, কিন্তু তিনি কিছুতেই সহি করিলেন না। তিনি বলিলেন, “মশায়, আমি রঙ আর তুলি নিয়ে সময় কাটাই, রাজনীতির কি বুঝি। রবিকাকার কাছে যান। তিনি ওসব ভাল বোঝেন।”

    অগত্যা ভদ্রলোকেরা চলিয়া গেলেন। তিনি আবার আমাদের সঙ্গে গল্পগুজব আরম্ভ করিলেন।

     

    আমি ফরিদপুর রাজেন্দ্র কলেজে পড়িতাম। সেই সময় দীদেশবাবু আমাকে পল্লীগান সংগ্রহ করার ভার দেন। কলেজের ছুটির সময় আমি নানা গ্রামে ঘুরিয়া পল্লী-সংগীত সংগ্রহ করিয়া তাঁকে পাঠাইতাম। বিশ্ববিদ্যালয় এজন্য আমাকে মাসিক সত্তর টাকা করিয়া দিতেন। বি. এ. পাশ করিয়া আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে এম. এ. পড়িতে কলিকাতা আসিলাম। দীনেশবাবু আমাকে বলিলেন, “এখন থেকে তুমি আর পল্লী-গান সংগ্রহ করে মাসে মাসে টাকা পাবে না এতদিন তুমি গ্রামে ছিলে, সেখানে পড়াশুনো করেছে, আর কি কি করছে কেউ জানত না। এখন তুমি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনো করবে। লোকে আমার নিন্দে করবে, আমি তোমাকে বসিয়ে বসিয়ে টাকা দিচ্ছি।”

    আমি বলিলাম, “আমি আগেও পড়াশুনো করেছি। ছুটির সময় শুধু গ্রাম-গান সংগ্রহ করতাম। আপনি আমার কাছে কাজ চান। আমি যদি আগের মত আপনাকে গ্রাম্য-গান সংগ্রহ করে এনে দিতে পারি, তবে আপনার অসুবিধা কিসের?”

    দীনেশবাবু বলিলেন, “তুমি জান না, বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার বহু শত্রু আছে। তারা যদি টের পায়, আমার জীবন অস্থির করে তুলবে।”

    বহু অনুনয়-বিনয় করিয়াও আমি দীনেশবাবুকে বুঝাইতে পারিলাম না। বস্তুত এই সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে দীনেশবাবুর পূর্ব সম্মান অক্ষুণ্ণ ছিল না। স্যার আশুতোষের মৃত্যু হইয়াছে। তাহার পুত্র শ্যামাপ্রসাদ তখনও বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রভাব বিস্তার করিয়া উঠিতে পারেন নাই।

    দীনেশবাবু বিশ্বকোষ লেনে থাকিতেন। দুপুরবেলা ঘোড়ার গাড়িতে চড়িয়া বেহালা যাইতেন তাঁর নূতন বাড়ি তৈরীর কাজ দেখাশুনা করিতে। আমি প্রতিদিন দীনেশবাবুর সঙ্গে বেহালা যাই। সারাদিন তার সঙ্গে কাটাই। আর খুজি, কোন মুহুর্তে তাকে ভালমত বলিয়া তার মতপরিবর্তন করাইতে পারিব। দুই-তিন দিন যায়। একদিন আমার কথাটি পাড়িলাম। দীনেশবাবু তার পূর্বমতে অটল। আমার পরিবর্তে গ্রাম-গান সংগ্রহ করিবার জন্য তিনি একজন লোককে স্থির করিয়া ফেলিয়াছেন।

    এ সব কথা আমি অবনীন্দ্রনাথকে কিছু বলি নাই। বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যাপারে তাঁর কি হাত আছে? একদিন তার সামনে বসিয়া আছি। তিনি আমার মুখের দিকে চাহিয়া বলিলেন, “ওহে জসীমিঞা, মুখখানা যে বড় বেজার দেখছি।”

    আমি তাঁকে সমস্ত খুলিয়া বসিলাম। তিনি বলিলেন, “এটা বড় আশ্চর্য! আগে যদি পড়াশুনো করেই তুমি গ্রাম-গান সংগ্রহ করতে পেরেছে, এখন পড়াশুনো করে তা পারবে না কেন? তুমি এক কাজ কর। আমার একখানা চিঠি নিয়ে ভাইস চ্যান্সেলার মিঃ আরকুহার্টের সঙ্গে দেখা কর।”

    আমি বলিলাম, “এতে দীনেশবাবু যরি অসন্তুষ্ট হন?”

    হাসিয়া বলিলেন, “তোমাকে যতদিন তিনি মাসে সত্তর টাকা করে দিয়েছেন, ততদিন তিনি রাগলে তোমার ক্ষতি হত। সেই টাকাই যখন শেষ হল, তখন রাগলে তোমার কি আসে যায়? তুমি আমার চিঠি নিয়ে আরকুহার্ট সাহেবের সঙ্গে দেখা কর।”

    পত্র লইয়া আমি ভাইস-চ্যান্সেলারের সঙ্গে দেখা করিলাম। তিনি আমার সব কথা খুব মনযোগের সঙ্গে শুনিয়া বলিলেন, “এখন আমি তোমাকে কোন কথা দিতে পারি না। তুমি আমার নিকট একখানা দরখাস্ত কর। সিনেটে এ বিষয়ে আলোচনা হবে। আমি তোমাকে সাহায্য করব।”

    আমি আসিয়া দীনেশবাবুকে সমস্ত বলিলাম। তিনি বলিলেন, “ভাইস-চ্যান্সেলর যখন তোমাকে সাহায্য করতে চেয়েছেন, তখন তুমি দরখাস্ত কর।” সেই দরখাস্তের মুসাবিদা দীনেশবাবুই লিখিয়া দিলেন। সেনেটে আমার বিষয়ে আলোচনা হইবার নির্দিষ্ট দিবসের পূর্বে আমার বন্ধু অধ্যাপক সুরেন্দ্রনাথ গোস্বামী আমাকে লইয়া সেনেটের প্রত্যেক মেম্বরের বাড়ি ঘুরাইয়া আনিলেন। অবনীন্দ্রনাথ নিজেও শ্যামাপ্রসাদবাবুকে ও স্যার, রাধাকৃষ্ণনকে ব্যক্তিগত পত্র লিখিয়া আমাকে সাহায্য করিতে অনুরোধ করিলেন। সেনেটের আলোচনার দিনে, শুনিয়াছি, সকলেই আমাকে সমর্থন করিয়াছিলেন। আমি পূর্বের মত অবসর সময়ে গ্রাম্য-গান সংগ্রহ করিয়া মাসে সত্তর টাকা করিয়া পাইতে লাগিলাম। অবনবাবু শুনিয়া কতই খুশি হইলেন। এই টাকা দিয়া আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের এম. এ. পড়ার খরচ চালাইলাম। অবনঠাকুর সাহায্য না করিলে ইহা হইত না।

    __________
    *জোড়াসাঁকোবাড়িতে পুকুর ছিল না। দাদামশায় প্রায় কখনই জীবন থেকে স্টাডি করেন নি। রাধুর ছবি মন থেকেই এঁকেছিলেন। কিন্তু তবু ছবির জন্যে যেন রাধুরই কষ্ট হয়েছে বেশি, এই কথা বলেছিলেন।
    মোহনলাল গাঙ্গুলি

     

    ০৭.

    কলিকাতায় আসিয়া এখন ঘন ঘন অবনীন্দ্রনাথের সঙ্গে আমার দেখা হইতে লাগিল। একদিন তাহাকে বলিলাম, “দাদা মশাই, শুনেছি আপনাদের বাড়িতে লাল, ইয়াকুৎ, জহরৎ বহু রকমের মণিমাণিক্য আছে। রূপকথায় এগুলোর নাম শুনেছি। কিন্তু চক্ষে দেখিনি।”

    তিনি একটু ভাবিয়া বলিলেন “তুমি দেখতে চাও?”

    আমি বলিলাম, “যদি দেখান, বড় খুশি হব।”

    তিনি বলিলেন, “পরশু সকালবেলা এসো। সকালের আলো না হলে মণিমাণিক্যগুলির রোশনাই খোলে না।”

    নির্দিষ্ট সময়ে আমি তার সামনে উপস্থিত হইলাম। তিনি হাসিয়া বলিলেন, “এসেছ? আমার সঙ্গে এসো।”

    তাঁর সঙ্গে চলিলাম। আমার মন রহস্যে ভরপুর। রূপকথার আলাদীনের মত আমি যেন অতীতের কোন রাজা-বাদশার অন্ধকার ধনাগারে প্রবেশ করিতেছি।

    ঘরের এক কোণে একটি প্রকাণ্ড বাক্স। আমাকে তাহার ডালাটি তুলিয়া ধরিতে বলিলেন। ডালা তুলিয়া ধরিতে সেই বাক্সের ভিতর হইতে তিন-চারটি বাক্স বাহির করিলেন। প্রত্যেকটি বাক্স ভর্তি মুড়ি-পাথর—নানা আকৃতির, নানা রঙের।

    তিনি হাসিতে হাসিতে বলিলেন, “দেখ, কত মণিমাণিক্য এখানে জড় হয়ে আছে।”

    বাক্স হইতে এক একটি পাথর দেখাইয়া তিনি বলিতে লাগিলেন, “এইটে লাল, এইটে ইয়াকু এইটে জহরৎ, আর দেখ এইটে হল নীলমণি। শ্রীকৃষ্ণের বুকে লটকান থাকত।”

    বিস্ময়ে আমি হতবাক। অনেকক্ষণ সেই মণিমাণিক্য দেখিয়া বলিলাম, “আচ্ছা দাদামশাই, এগুলো এখানে এমন অসাবধানে রেখেছেন, বাক্সটায় তালা-চাবি পর্যন্ত লাগাননি। চোরে যদি চুরি করে নিয়ে যায়?”

    নির্বিকার ভাবে তিনি বলিলেন, “চোর এগুলো মুড়ি-পাথর না মণিমাণিক্য তা জানার চোখ থাকা চাই। তাছাড়া সাবধানে কোন জিনিস রাখলেই চোরের উপদ্রব হয় বেশি। দেখ না, সকালবেলা ঘাসের শিশিরফেঁাটায় কত মণিমাণিক্য জড় হয়। কেউ চুরি করে না। যদি তালা-চাবি দিয়ে কেউ বাক্সে আটকে রাখত, তবে রাতারাতি চুরি হয়ে যেত।”

    আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, “আচ্ছা দাদামশাই, এই সব মণিমাণিক্য কত কালের?”

    তিনি বলিলেন “বহু বহু আগের। হাজার হাজার বছর আগে এরা তৈরি হয়েছিল সমুদ্রের তলে। ভাল কথা, ওহে জসীমিঞা, তুমি ত দেখে গেলে আমার ধনরত্ন। কাউকে যেন বলে দিও না।”

    আমি নীরবে সম্মতি জানাইলাম। শ্রদ্ধায় ভক্তিতে তাঁর সামনে লুটাইয়া পড়িতে ইচ্ছা হইল। তিনি আমাকে কতই না বিশ্বাস করিয়াছেন। এই গুপ্ত ধনরত্নের কথা হয়ত তার ছেলেমেয়েরাও জানে না। তাই কিনা তিনি আমাকে দেখাইলেন। আমি বলিলাম, “দাদা মশাই, অন্ধকারে এগুলো ভাল মত দেখতে পাচ্ছিন। একটু বারান্দায় নিয়ে দেখব?”

    হাসিয়া বলিলেন, “তা দেখ।”

    আমি মণিমাণিক্য-ভরা দুই-তিনটি বাক্স বারান্দায় আনিয়া দেখিয়া অবাক হইলাম। ও মা, এ যে সবই মুড়ি-পাথর। মোহনলাল সামনে দিয়া যাইতেছিল, তিনি ডাকিয়া বলিলেন, “জসীমিঞা বোজ আমাকে ধরে মণিমাণিক্য দেখবে। আজ তাকে এগুলো দেখিয়ে দিলাম।”

    মোহনলাল মৃদু হাসিয়া চলিয়া গেল। পরে মোহনলালের কাছে শুনিয়াছি, বহুদিন আগে তার স্পর্শমণি পাওয়ার শখ জাগিয়াছিল। সেই উপলক্ষে তিনি নানা দেশ হইতে বহু মুড়ি-পাথর কুড়াইয়া আনিয়া জড় করিয়াছিলেন। গত দুই দিনে তিনি আরও কিছু পাথর সংগ্রহ করিয়া তাহাদের সঙ্গে যোগ করিয়াছেন। আমার মত একটি সামান্য লোককে বিস্মিত করিবার জন্য এমন প্রচেষ্টা তাঁর কাব্যময় অন্তরের পরিচয় দেয়।

    একবার অবনীন্দ্রনাথের খেয়াল চাপিল, যাত্রাগান করিবেন। সত্য-ত্রেতা-দ্বাপরের নহুস-মান্ধাতা-বিশ্বকর্মা প্রভৃতি নানা চরিত্র অবলম্বন করিয়া তিনি এক অদ্ভুত যাত্রার পালা রচনা করিলেন। তারপর এ-বাড়ির ও-বাড়ির ছেলেদের লইয়া সেই যাত্রাগানের মহড়া চলিতে লাগিল। মহড়ার সময় তার কি: মাতামাতি। ওখানটার বক্তৃতা থিয়েটারের মত হল; ঠিক যাত্রার দলেন রাজার মত বলা হল না। চোরের কথাটা চোরের মতই বলতে হবে; ভদ্রলোকের মত নয় ইত্যাদি।

    রবীন্দ্রনাথ কলিকাতায় আসিলেন। তিনি খবর পাইয়া বলিলেন, “অবন, কেমন যাত্রা করেছ দেখব।”

    অবনীন্দ্রনাথের হলঘরে যাত্রার আয়োজন হইল। রবীন্দ্রনাথ আসিয়া আরামকেদারায় বসিলেন। এ-বাড়ির ও-বাড়ির আত্মীয়স্বজনেরা ও আসিলেন। এর আগেও একবার এই যাত্রার অভিনয় হইয়াছে। সেদিন দেখিয়াছি তার কী লাফালাফি! এখানে ওকে দাড় করাও, ওখান দিয়ে প্রবেশ কর, খাড়া হয়ে দাঁড়াও—এমনি হম্বিতম্বি। কিন্তু আজ তিনি রবীন্দ্রনাথের সামনে ভেজা-বেড়ালটির মত আসরের এককোণে ঢোলক লইয়া বসিয়া আছেন। মুখখানা একেবারে চুন। বহু হাসিতামাশার মধ্যে যাত্রার অভিনয় শেষ হইল। শ্রোতারা খুব উপভোগ করিল। রবীন্দ্রনাথ নীরবে উঠিয়া চলিয়া গেলেন। তিনি কোন কথা বলিলেন না।

    পরদিন সকালে রবীন্দ্রনাথকে গিয়া ধরা হইল, যাত্রাগান কেমন হইয়াছে। রবীন্দ্রনাথ হাসিয়া বলিলেন, “নাটক জমেছিল খুব। কিন্তু এলোমেলো সব ঘটনা; একে অপরের সঙ্গে বিচ্ছিন্ন; পরিণামে যে কী হল বুঝতে পারলাম না।”

    এই কথা অবনীন্দ্রনাথকে জানাইলে তিনি বলিলেন, “এটাই ত নাটকের বৈশিষ্ট্য। নাটক যখন জমেছে তখন কী যে হল, না-ই বা বুঝা গেল।”

    একদিন তিনি ছবি আঁকিতেছেন। আমি বলিলাম, একজন সমালোচক আপনার ছবির সমালোচনা করে লিখেছেন, He is an wonderful wanderer, আপনি যখন মোগল আর্ট করেন তখন একেবারে সেই যুগের শিল্পীদের মধ্যে লোপ পেয়ে যান। আবার যখন চীনা আর্টিস্টদের মত আঁকেন তখন আপনি চীনা বনে যান। এ কথাই উদ্ধৃত করে একজন বাঙালি সমালোচক বলেছেন, আপনার নিজস্ব কোন বাণী নেই।”

    তিনি হাসিয়া বলিলেন, “ওটাই আমার বাণী। যে এক জায়গায় বসে থাকে, সে ত মরে যায়। নানা পথে ঘুরে বেড়ানই আমার বৈশিষ্ট্য।”

    আর একদিন তিনি বলিতেছিলেন, “প্রত্যেক দেশরই এক এক ভাষা। সেই ভাষায় কেউ না লিখে যদি অন্য ভাষায় লেখে, তবে তার লেখা হবে কৃত্রিম। এটা যেমন সাহিত্যের ব্যাপারে সত্য তেমনি শিল্পের ব্যাপারে। আমরা আমাদের নিজস্ব আটের ভাষায় অঙ্কন করেছি ভাষার ধারা ধরেই আমাদের আর্ট করতে হবে। অপরের অনুসরণ করে আমরা বড় হতে পারব না।

    মাঝে মাঝে শান্তিনিকেতন হইতে নন্দলাল বসু আসিতেন তার সঙ্গে দেখা করতে। গুরুশিষ্যে আলাপ হইত। মুখের কথায় নয়। যেন অন্তরে অন্তরে—যেন হৃদয়ের সঙ্গে হৃদয়ের বিনিময় হইত। গুরুর সামনে একটি চেয়ার লইয়া নন্দলাল বসতেন। গুরু ছবি আঁকিয়া যাইতেন, মাঝে মাঝে দু-একটি কথা। ডাহুক-মাতা যেন গভীর রাত্রিতে তার বাচ্চাদের আদরের কথা শুনাইতেছে।

    অবনীন্দ্রনাথের মুখে কতবার নন্দলালের একটি কাহিনী শুনিয়াছি। একবার শিষের একখানা ছবি দেখিয়া তিনি বলিলেন, এর background-এর রঙটি এমন না করিয়া অমন করিবে। শিষ্য নীরবে গুরুর নিকট হইতে বিদায় লইয়া গেলেন। রাত্রে তার মনে হইল, তিনি ভুল করিয়াছেন। শিষ্য ছবির background-এ যে রঙ দিয়াছেন, তাহাই ভাল। সারারাত্রি তাঁর ঘুম হইল না। কী জানি যদি তার কথা মত নন্দলাল ছবির রঙ পাল্টাইয়া থাকেন। ভোর হইতে তিনি তিন-চার মাইল দূরে শিষ্যের মেসে গিয়া দরজার টোকা মারিতে লাগিলেন। নন্দলাল তাড়াতাড়ি উঠিয়া আসিলেন। গুরু জিজ্ঞাসা করিলেন,“তোমার সেই ছবিটার রঙ ত পালটাও নাই?”

    শিষ্য বলিলেন, “না, কাল সময় পাই নাই। এখন রঙটা পালটাব।”

    গুরু হাঁফ ছাড়িয়া বাঁচিলেন। “না না, ওটার রঙ পালটাতে হবে না। তুমি যা রঙ দিয়েছ, সেটাই ঠিক।” এই বলিয়া গুরু ঘরে ফিরিয়া আসিলেন।

    নন্দলাল গুরুর সঙ্গে দেখা করিতে আসিলে বাড়ির মেয়েদের তরফ হইতে ছোট ছেলেদের মারফতে নানা রকমের বায়না আসিত। কারো কানের দুলের ডিজাইন করিয়া দিতে হইবে, কারো হাতের চুড়ীর নকসা আঁকিয়া দিতে হইবে। অবসর-সময়ে নন্দলাল বসিয়া বসিয়া সেই ডিজাইনগুলি আঁকিতেন।

    একদিন অবনবাবু বলিতে লাগিলেন, কি ভাবে তার শ্রেষ্ঠ ছবি ‘শাহজাহানের মৃত্যু অঙ্কিত হয় :

    আমার মেয়ের মৃত্যু হয়েছে। শোকে তাপে আমি জর্জরিত। হাভেল সাহেব বললেন, করোনেশন উপলক্ষে দিল্লীতে একজিবিশন হচ্ছে। তুমি একটা কিছু পাঠাও। আমি কি করি মনও ভাল না। রঙ-তুলি নিয়ে আঁকতে আরম্ভ করলাম। আমার মেয়ের মৃত্যুজনিত সমস্ত শোক আমার তুলিতে রঙিন হয়ে উঠল। শাহজাহানের মৃত্যুর ছবি আঁকতে আরম্ভ করলাম। আঁকতে আঁকতে মনে হল, সম্রাটের চোখে মুখে তার পিছনের দেয়ালের গায়ে আমার সেই দুঃসহ শোক যেন আমি রঙিন তুলিতে করে ভরে দিচ্ছি। ছবির পিছনের মর্মরদেয়াল আমার কাছে জীবন্ত বলে মনে হল। যেন একটা আঘাত করলেই তাদের থেকে রক্ত বের হবে। দিল্লীতে সেই ছবি প্রথম পুরস্কার পেল। কিছুদিন পরে হাভেল সাহেব আমাকে বললেন, এই ছবিটার একটি নকল আমাকে দাও। আমি ছবিটা কপি করতে আরম্ভ করলাম। নন্দলাল আমার পেছনে বসা। ছবি আঁকতে আঁকতে আমার মনে হচ্ছে, ছবির পেছনে মর্মর-দেয়াল যেন যুগ-যুগান্তর ধরে আমার সামনে বিস্তৃত হয়ে আছে। ছবির যা-কিছু সব যেন আমার কাছে জীবন্ত। এই ভেবে আমার তুলি নিয়ে সেই পেছনের প্রসারিত দেয়ালের উপর তুলির টান দিতে যাচ্ছি, অমনি নন্দলাল আমার হাত টেনে ধরেছে : করেন কি, ছবিটা ত নষ্ট হয়ে যাবে! অমনি আমার জ্ঞান ফিরে এলো।

    একবার অবনীন্দ্রনাথ চলিলেন স্কটিশ চার্চ কলেজে বক্তৃতা দিতে। আমি আর মোহনলাল স্থির করিলাম, তার বক্তৃতা আমরা লিখিব। আমরা দুইজনে নোট লইয়া বক্তৃতাটি লিখিয়া তাকে দিলাম। তিনি তাহার বহু অংশ পরিবর্তন করিয়া আবার মোহনলালকে দিয়া নকল করাইলেন।

    এই প্রবন্ধটি উদয়ন পত্রিকায় ছাপা হইল। পত্রিকার সম্পাদক প্রবন্ধের সঙ্গে আমাদে’ নাম প্রকাশ করিলেন না। আমরা তাহাতেও খুশি ছিলাম কিন্তু তাকে ধরিলাম, এই লেখার থেকে যে টাকা আসিবে তা দিয়া আমরা সন্দেশ খাইব। প্রবন্ধের জন্য টাকা পাঠাইতে পত্র লেখাইলাম। সম্পাদক মাত্র পাঁচটি টাকা পাঠাইয়া দিলেন। মোহনলাল ক্ষোভের সঙ্গে বলিতে লাগিল, “আচ্ছা, দাদামশায়ের লেখা নিয়ে ওরা মাত্র পাঁচ টাকা পাঠাল? ওদের লজ্জা হল না?” তিনি কিন্তু নির্বিকার ভাবে পাঁচটি টাকাই গ্রহণ করিলেন। সন্দেশের কথা মনে করাইয়া আমরা আর তাকে লজ্জা দিলাম না।

    অবনঠাকুরের কথা ভালমত জানিতে হইলে তাঁর বাড়ির অন্যান্যদের কথাও জানিতে হয়। যে সুন্দর পরিবারের কথা আমি বলিতেছি, তাহা আজ ভাঙিয়া চৌচির হইয়াছে। ফিউডাল যুগেরও শেষ হইয়া আসিতেছে। সেই জন্যই এদের কথা লিখিয়া রাখিলে হয়ত কাহারো কোন কাজে আসিতে পারে—অন্তত, ইতিহাসসন্ধানীর কিছুটা খোরাক মিলিবে।

    এদের পরিবারে খুবই একটা সুন্দর শৃঙ্খলা দেখা যাইত। বহুভাবে এদের সঙ্গে মিশিবার সুযোগ হইয়াছে। কখনো এদের কাউকে আমি রাগারাগি করিতে দেখি নাই। ছোটর গুরুজনদের খুব সম্মান এবং ভক্তি করিত। গুরুজনেরা ছোটদের কিছু করিতে বলিলে তারা খুব মনোযোেগ সহকারে তাহা করিত। বাড়ির মেয়েরা থিয়েটার করিতেন, কেহ কেহ স্টেজে নাচিতেন, গান করিতেন; কিন্তু আত্মীয়-পরিজন ছাড়া বাইরের কারো সঙ্গে কথা বলিতেন না।

    বন্ধুবর অজিনেন্দ্রনাথ ঠাকুরের কয়টি কোঠাঘর ভাড়া লইয়া আমি একবার প্রায় এক বৎসর ঠাকুরবাড়িতে ছিলাম। সেই উপলক্ষে আমি তাদের পরিবারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে মিশিয়া যাইবার সুযোগ পাইয়াছিলাম। তখনো দেখিয়াছি, বাড়ির মেয়েরা বাইরের কারো সঙ্গে কথা বলিতেন না। কনকবাবুর মেয়েরা ইস্কুলে কলেজে পড়িতেন। তাঁহাদের ছোট ভাইদের মারফৎ কাউকে কাউকে দিয়া আমি মাঝে মাঝে কাজ করাইয়া লইয়াছি। জনান্তিকে অনুরোধ পাইয়া আমিও তাদের কাজ করিয়া দিয়াছি। আমি তাদের পরীক্ষার ফল জানিয়া দিতে টেবুলেটরদের বাসায় ঘোরাফেরা করিয়াছি। কিন্তু তাহারা কেহই আমার সঙ্গে কথা বলেন নাই। এর ব্যতিক্রম হইয়াছিল শুধু কয়েক জনের ক্ষেত্রে। তারা হইতেছেন অবনীন্দ্রনাথের গৃহিণী, এবং তাঁর পুত্রবধু অলকবাবুর স্ত্রীমোহনলালের মামীমা। ভাল কিছু খাবার তৈরি হইলে তারা আমাকে ডাকিয়া খাওয়াইতেন। ছোট ছোট ছেলে দুইটি—বিশেষ করিয়া ‘বাদশা’ আমার বড়ই প্রিয় ছিল। কনকবাবুর ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা আমার চারপাশে গুঞ্জরণ করিয়া বেড়াইত। তার ছোট মেয়েটির নাম মনে নাই। ভারি সুন্দর দেখিতে। আমি তাকে আদর করিতে কাছে ডাকিতাম। এতে বাড়ির আর আর ছোটরা তাকে ক্ষেপাইত, জসীমুদ্দীনবাবু তোর বর। সেই হইতে আমাকে দেখিলেই দৌড়াইয়া পালাইত। কনকবাবুর স্ত্রী আমার সঙ্গে কথা বলতেন না। আমি রাত্রে রুটি খাইতাম। একবার আমার জন্য তিনি এক বোতল আমের মোরববা পাঠাইয়া দিয়াছিলেন। নরেন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছোট মেয়ে দীপালিকে আমার বড়ই ভাল লাগত। সে তার মামাদের লইয়া খুব গল্প করিত। মোহনলাল তাকে ক্ষেপাইত, জসীমুদ্দীন তোমার মামা।” এতে সে খুব চটিয়া যাইত। কিন্তু আমার আশেপাশে ঘুরিয়া বেড়াইত। আমিও তাকে দেখিলেই জিজ্ঞাসা করিতাম, “দিদি কেমন আছে?” সে হাসি গোপন করিয়া কৃত্রিম রাগের সঙ্গে বলিত, “আমার মা আপনার দিদি হতে যাবে কেন?” দীপালিকে কোনদিন তার মার সঙ্গে দেখিলেই জিজ্ঞাসা করিতাম, “দিদি ভাল আছেন ত?” দীপালি মায়ের আঁচলে মুখ লুকাইয়া আমাকে কিল দেখাইত।

    মোহনলালও মাঝে মাঝে দীপালিকে ক্ষেপাইত, “আমি তোমার মোহন মামা, না দীপালি?” দীপালি রাগিয়া টং হইত। একবার দীপালির জন্মদিনে আ. আর মোহনলাল মিলিয়া দীপালিকে খুশি করিবার জন্য এক পরিকল্পনা করিলাম।

    আমরা নিউমার্কেট হইতে বড় এক বাক্স চকলেট কিনিয়া আনিলাম। একটি কবিতা আমি আগেই লিখিয়া রাখিলাম। তাহা সেই বাক্সের মধ্যে পুরিয়া প্রকাণ্ড আর একটি বাক্সে সেই চকলেটের বাক্সটি পুরিয়া এক বাচ্চা কুলির মাথায় উঠাইয়া দীপালির ঠিকানা লিখিয়া পাঠাইয়া দিলাম ঠাকুরবাড়িতে। কুলি আমাদের নির্দেশমত পার্শেলটি ঠাকুরবাড়ি দিয়া গেল। জন্মদিনে এতবড় একটি উপহার পাইয়া দীপালি খুশিও হইল, আবার শঙ্কিতও হইল। পার্শেলের গায়ে লেখা ছিল “মামাবাড়ির উপহার।” কিন্তু তার মামারা ত কোন জন্মদিনে তার নামে উপহার পাঠায় না। আর উপহার দিলে তারা নিজে আসিয়া দিয়া যাইত। এমন কুলির মাথায় করিয়া উপহার পাঠাইবার উদ্দেশ্য কি? দীপালি পার্শেল লইয়া অন্দরমহলে ঢুকিল। অন্দরমহল আমার পক্ষে রুদ্ধদ্বার। মোহনলাল কোন একটা কাজের ছুতা করিয়া দীপালির পাছে পাছে ছুটিল। পার্শেল দেখিতে বাড়ির সবাই একত্র হইলেন। কিন্তু কী জানি ভয়ে দীপালি আর পার্শেল খোলে না। যদি ইহার ভিতর হইতে অকিছু বাহির হয়। কিন্তু ভালও ত কিছু বাহির হইতে পারে। পার্শেল না খুলিয়াই বা উপায় কি? বাড়ির সব ছেলেমেয়েরা উৎসুক দৃষ্টি লইয়া চারিদিক ঘিরিয়া আছে।

    অনেক ভয়ে ভয়ে দীপালি বাক্স খুলিল। পরতে পরতে কাগজের আবরণী খুলিয়া চকলেটের বাক্স। তাহার ডালা খুলিতেই আমার কবিতার সঙ্গে অসংখ্য চকলেটের টুকরা বাহির হইয়া পড়িল। আমার কবিতায় দীপালির মামাবাড়ির সম্পর্কে অহেতুক শ্রদ্ধার জন্য কিঞ্চিৎ বক্রোক্তি ছিল। কিন্তু অসংখ্য চকলেটের গন্ধে এবং স্বাদে তাহা কেহই লক্ষ্য করিল না। দীপালির জন্মদিনের কবিতা আমার ‘হাসু’ নামক পুস্তকে ছাপা হইয়াছে।

    বাড়ির ছেলে বুড়ো যুবক সবাই খুব আমুদে প্রকৃতির ছিল। একটা কৌতুকের ব্যাপার পাইলে সকলে মিলিয়া তাহাতে যোগ দিত।

     

    অবনীন্দ্রনাথের বাড়ির পাশে অ্যাডভোকেট বিপুল সাহার বাড়ি। ইনি নলিনীরঞ্জন সরকারের প্রসিদ্ধ মামলায় পক্ষ গ্রহণ করিয়াছিলেন। বিপুল সাহার বাড়িতে সাধুসন্ন্যাসীর খুব আদর। একবার এক ভণ্ড সাধু আসিয়া তাদের পরিবারে প্রতারণা করিয়া বহু অর্থ আত্মসাৎ করিয়া লইয়া গিয়াছিল।

    তবু সাধুসন্ন্যাসীতে তাদের বিশ্বাস কমে নাই। বিপুল বাবুর ছোটভাই ঘেটুবাবু একদিন মোহনলালের সঙ্গে দেখা করিতে আসিয়াছে। মোহনলাল আমাকে দেখাইয়া বলিল, “ইনি জসীমুদ্দীন বাবু। ফরিদপুরের প্রসিদ্ধ কালীসাধক। মা কালীকে সশরীরে দেখিতে পান।” শুনিয়া ঘেটুবাবু- আমাকে সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করিল।

    আমি বললাম, “মোহনলাল মিছে কথা বলেছে।”

    মোহনলাল আমাকে চোখ ইসারা করিয়া বলিল, “কেন বিনয় করছ? ইচ্ছা করলেই তুমি মা-কালীকে দেখাতেও পার।”

    আমি তখন ইঙ্গিত বুঝিতে পারিয়া বলিলাম, “যাকে তাকে কি দেখানো যায়?”

    ঘেটুবাবু আমার পা-দুখানি ধরিয়া কাদ-কাঁদ ভাবে বলিল, “দাদা, আপনি সাক্ষাৎ ভগবান। দেখবেন একদিন মা কালীকে?”

    আমার মনে তখন দুষ্টবুদ্ধি আসিল। “মা-কালীকে আমি দেখাতে পারি সাতদিন পরে। এই সাতদিন তুমি রাগ করতে পারবে না, আর নিরামিষ খাবে।।”

    ঘেটু বলিল, “দাদা, আপনি যা বলবেন, আমি তাই করব। কিন্তু মা-কালী আমাকে দেখাতেই হবে।”

    তখন আমি তার ভক্তি আর ও জাগ্রত করিবার জন্য দুই-একটি গল্প ফঁদিলাম। কোথায় কোন্ শ্মশানঘাটে মড়ার উপর যোগাসন করিয়া বসিয়াছিলাম, কোন সাধকের মন্ত্রে সেই মড়াসুদ্ধ আমি আকাশে উড়িয়া চলিলাম, তারপর কৈলাসে বাবা শিবের সঙ্গে দেখা করিয়া কী করিয়া ফিরিয়া আসিলাম। আবার, কোথায় কার ছেলে মরিয়া গিয়াছিল, কোন সাধনায় আমি মা-কালীকে ডাকিয়া আনিয়া সেই মরা ছেলেকে বাঁচাইয়া দিলাম।

    ভক্ত আমার কথাগুলি শুধু শুনিলই না, সমস্ত ইন্দ্রিয় দিয়া যেন গিলিয়া ফেলিল। দেখিলাম, যাহারা বিশ্বাস করিতে চাহে তাহাদের ঠকাইতে বিশেষ কোন উপায় অবলম্বন করিবার প্রয়োজন হয় না। ফিরিবার সময় মোহনলালকে কানে কানে বলিয়া আসিলাম, “এই সাতদিন তোমরা সবাই মিলে ওকে রাগাতে চেষ্টা করবে। রাগ হওয়া সত্ত্বেও ও যখন রাগবে না, তখন দেখতে খুব মজা।”

    আমি মেছুয়াবাজার ওয়াই. এম. সি. এ. হোস্টেলে চলিয়া আসিলাম। ভাবিলাম, ব্যাপারটি এখানেই খতম হইল। কিন্তু মোহনলাল খতম করিবার লোক নয়। “তিন দিন পরে মোহনলাল আমাকে ফোন করিল, “তুমি যাবার পরে ঘেটু একেবারে কী রকম হয়ে গেছে। সব সময় তোমার নাম করে আর পাগলের মত ফেরে। তুমি তাকে শুধু মাছ-মাংস খেতে নিষেধ করেছ, খাওয়া-দাওয়াই সে একেবারে ছেড়ে দিয়েছে। আমার পড়ার ঘরে সে বসে আছে এখন। আমি তাকে ফোনে ডেকে দিই, তুমি তাকে কিছু সান্ত্বনা দাও।”

    ঘেটু আসিয়া ফোন ধরিল। আমি তাকে বললাম, “ধ্যান ভরে আমি জানতে পেরেছি, তুমি একেবারে খাওয়া-দাওয়া ছেড়ে দিয়েছ। কিন্তু শরীরকে কষ্ট দিলে মা কালী বেজার হবেন। তুমি ভালমত খাও।”

    ঘেটুর কণ্ঠস্বর গদগদ। সে বলিল “দাদা, আপনি দেবতা। আপনি সব জানতে পারেন। মা কালী কিন্তু আমাকে দেখাতেই হবে।”

    আমি বলিলাম, “আচ্ছা, দেখা যাবে।”

    পরের দিন মোহনলাল নিজে আমার হোস্টেলে আসিয়া উপস্থিত। “ব্যাপারটা এতদূর গড়িয়েছে যে কালী তোমাকে দেখাতেই হবে। ঘেটুর বাড়ির সবাই জেনে গেছে। আরও অনেকের কাছে বলেছি। সুতরাং যেমন করেই হোক কালী তুমি দেখাবেই।”

    আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, “কি করে দেখাব?”

    মোহনলাল বলিল, “আমি সব ঠিক করেছি। গবামামা। অর্থাৎ ব্বতীন্দ্রনাথ ঠাকুর ) সুজনকে কালী সাজিয়ে দেবে। অন্ধকারের মধ্যে সে এসে ঘেটুকে দেখা দেবে।”

    তখন দুই বন্ধুতে মিলিয়া নানারূপজল্পনা-কল্পনা করিতে লাগিলাম। মোহনলালের মামাত ভাইদের সাত-আটজনকে আমাদের দলে রাখিতে হইবে। তাহারা কে কেমন অভিনয় করিবে, তাহারও পরিকল্পনা তৈরী হইয়া গেল।

    নির্দিষ্ট দিনে আমি হগ-মার্কেট হইতে নানা রকমের ফল কিনিলাম। অসময়ের আম, লকেটফল—যা সচরাচর পাওয়া যায় না; কলা, কমলা আরও কত কি! এগুলি একটি থলিয়ায় পুরিয়া মোহনলালকে ফোন করিলাম। আমি বাড়ির পিছনের দরজা দিয়া এগুলি মোহনলালের কাছে পৌছাইয়া দিব। আমার মন্ত্র-পড়া শুনিয়া কালী যখন আসিয়া দেখা দিবেন, তখন আমাদের নির্দেশমত দর্শকদের মধ্যে যে যাহা খাইতে চাহিবে কালী তাহা দিয়া যাইবেন। তবেই ত হইবে সত্যকার কালী। টেলিফোনে মোহনলালের কাছে ওবাড়ির আরও নানা খবর জানিয়া লইলাম। ঘেটুর দাদা বিপুল সাহাও কালী দেখিতে আসিবেন। তাকে কালী দেখান ঠিক হইবে না। উকিল মানুষ, যদি ধরিয়া ফেলেন।

    ঘড়িতে পাঁচটা বাজিল। আমি খদ্দরের ময়লা পাঞ্জাবি পরিয়া খালি পায়ে ঠাকুরবাড়ির পথে রওয়ানা হইব, এমন সময় বন্ধুর মনোজ বসু আসিয়া উপস্থিত। তখন ও মনোজ বসুর তত নাম হয় নাই। মাত্র দুই-একটি কবিতা ও ছোটগল্প বাহির হইয়াছে। মাঝে মাঝে আমার সঙ্গে সাহিত্যিক সঙ্গ করিতে আসিত।

    সমস্ত শুনিয়া মনোজ বলিল, “আমি তোমার সঙ্গে যাব?”

    আমি বলিলাম, “তা কি করে হবে?”

    মনজ বলিল, “কেন? আমি তোমার শিষ্য হয়ে তল্পিবাহক হয়ে যাব।”

    আমি খুশি হইয়া বলিলাম, “বেশ, চল তবে।”

     

    ১০.

    খিড়কির দরজায় মোহনলাল দাঁড়াইয়াছিল। তাহাকে বুলিটি দিয়া ঢুলিতে ঢুলিতে আমি সদর-দরজা দিয়া ঠাকুরবাড়িতে প্রবেশ করিলাম। পূর্বনির্দেশমত মোহনলালের মামাতোভাইর। সারি দিয়া দাঁড়াইয়াছিল। পুষ্পচন্দন লইয়া ঘেটু তারই একপাশে। আমাকে রবীন্দ্রনাথের ‘চিত্রা হলঘরে একটা জলচৌকির উপর বসিতে দেওয়া হইল। মনোজ অতি ভক্তিভরে চাদর দিয়া বসিবার জায়গাটি মুছিয়া দিল। আমি বসিতেই মোহনলালের ভাইরা পূর্ব নির্দেশমত একে একে আসিয়া আমাকে প্রণাম করিল। একটি থালাভরা সন্দেশ আমার সামনে রাখিয়া ঘেটু আসিয়া আমাকে সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করিয়া কহিল, “দেবতা, আপনি গ্রহণ করুন।”

    আমি স্বর্গীয় হাসি হাসিয়া বলিলাম, “এসব কেন এনেছ? আমি ত মা কালীকে না দিয়ে কিছু গ্রহণ করিনে। মা-কালী আসবেন সন্ধ্যার পরে।” ঘেটুর মুখ শুকনা হইয়া গেল। জোড়হাতে বলিল, আপনি শুধু একটু স্পর্শ করে দেন। ভক্তের মনে কষ্ট দেবেন না।”

    অগত্যা আমি সেই সন্দেশ স্পশ করিয়া দিলাম। তারপর সমবেত ভক্তজনেরা তাহা কাড়াকাড়ি করিয়া ভাগ করিয়া খাইল। গম্ভীর হইয়া বসিয়া থাকিলেও মাঝে মাঝে হাসি চাপিয়া রাখিতে পারিতেছিলাম না। মনোজ তাহার ব্যাখ্যা করিল, “উনি দিব্য ধামে আছেন কিনা, তাই মাঝে মাঝে দেবতাদের নানা ঘটনা দেখিয়া হাসিয়া উঠেন।”

    এমন সময় ঘেটুর বড় ভাই বিপুল সাহা আসিয়া আমাকে প্রণাম করিলেন। আমি তাহাকে আশীর্বাদ করিয়া বলিলাম, “তোমার নাম বিপুল সাহা। একটা খুব বড় মামলার উকিল হয়েছ।”

    বিপুলবাবু জোড়হাতে বলিলেন, “গুরুদেব আপনি দয়া করে আমাকেও যদি কালী দেখান, যারপর নাই খুসি হব।”

    আমি বলিলাম, “কালী দেখতে হলে সাত দিন নিরামিষ খেতে হয়। তুমি তা করনি?”

    বিপুলবাবু উকিল মানুষ। জিজ্ঞাসা করিলেন, “এই যে সব ছেলের দল, ওরাও কি মাছ-মাংস খায়নি?”

    তাহারা একবাক্যে সাক্ষ্য দিল, গত সাতদিন তাহারা মাছ-মাংস স্পর্শ করে নাই।

    এমন সময় মনোজ গল্প ফাঁদিল” “গুরুদেব যাকে তাকে কালী দেখান না। ইন্দোরের মহারাজা সেবার গুরুদেবের পা ধরে কত কাঁদলেন, কিন্তু তিনি দেখতে পেলেন না। আজ ঘেটুবাবুর বড়ই পুণ্যফল যে, তিনি কালী দেখতে পাবেন। গুরুদেব, কাল ধ্যানে বসে বুদ্ধদেবের সঙ্গে আপনার কি আলাপ হয়েছিল—একবার বলুন না?”

    আমি লজ্জিত ভাবে বলিলাম, “ওসব কেন তুলছ? বুদ্ধদেব বড় কথা নয়। সেদিন চৌঠা আসমানের পরে যিশুখৃস্টের সঙ্গে দেখা। তিনি আমাকে বললেন, কালী-সাধনাটা আমাকে শিখিয়ে যাও।”

    এই বলিয়া আমি ধ্যানমগ্ন হইলাম। মনোজ চাদর দিয়া আমাকে বাতাস করিতে লাগিল।

    বিপুলবাবু মনঃক্ষুণ্ণ হইয়া চলিয়া গেলেন। মোহনলাল আসিয়া আমার কানে কানে বলিল, “সর্বনাশ, গবামামা বের হয়ে গেছে। কালী সাজানো হবে না। সুজনকে সাহেব সাজিয়ে আনতে পারি। ভাতে তাকে কেউ চিনতে পারবে না।”

    আমি বলিলাম, “বেশ তাই কর।”

    ধীরে ধীরে রাত্রির অন্ধকার ঘনাইয়া আসিল। আমি ঘেটুকে ডাকিয়া বলিলাম, “ঘেটু, তুমি মা-কালীকে কেন দেখতে চাও?”

    ঘেটু বলিল, “মা-কালীর কাছে আমি একটি চাকরির বর চাই। অনেক দিন আমি বেকার।”

    আমি খুব স্নেহের সঙ্গে বলিলাম, “চাকরি ত মা-কালীকে দিয়ে হবে না। আমি একজন সাহেব ভুত আনি। তার কাছে তুমি যা চাইবে তাই পাবে।”

    ঘেটু গদগদ ভাবে বলিল, “দাদা, আপনি যা ভাল বোঝেন, তাই করুন।”

    রবীন্দ্রনাথের অন্দরবাড়িতে যেখানে অভিনয় হয়, তার উত্তর দিকের ঘরে একটি বেদী আছে। সেখানে মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ সাধনা করিতেন। মোহনলালের ব্যবস্থা মত সেই বেদীর উপর আমার কালী-সাধনার আসন তৈরী হইল। দক্ষিণ দিকে সৌম্যেন ঠাকুরদের বারান্দায় এমনভাবে আলো জ্বালান হইল যেন এ পাশের অন্ধকার আরও গাঢ় দেখায়। চারিদিকে অন্ধকার। সেই বেদীর উপর আসিয়া আমি বসিলাম। ভক্তমণ্ডলী আমার দুইদিকে সামনে বসিল, ঘেটু আমার পাশে। সে কেবল বার বার আমার পায়ে লুটাইয়া পড়িতেছে আর গদগদ কণ্ঠে বলিতেছে, “দাদা, আপনি ভগবান।”

    বাড়ির মেয়েরা উপরতলার গাড়ি-বারান্দায় দাঁড়াইয়া এই দৃশ্য উপভোগ করিতেছেন।

    একবার আমি এক তান্ত্রিক সাধুর শিষ্য হইয়া শ্মশানে শ্মশানে ঘুরিয়াছিলাম। তাহা ছাড়া অনেক ভূতান্তরী মন্ত্র ও আমার জানা ছিল। কতক পূর্বস্মৃতি হইতে, কতক উপস্থিত তৈরি করিয়া আমি ডাক ছাড়িয়া মন্ত্র পড়িতে লাগিলাম। প্রথম শরীর-বন্ধন করিয়া সরিষা-চালান দিলাম। পূর্বে, পশ্চিমে, উত্তর-মেরুতে, দক্ষিণ মেরুতে যোলশ ডাক-ডাকিনীর সঙ্গে আমার সরিষা উধাও হইয়া ছুটিল–

    পিঙ্গলবরণী দেবী পিঙ্গল পিঙ্গল জটা
    অমাবস্যার রাতে যেন কালো মেঘের ঘটা
    সেইখানে যায়া সরষে ইতিউতি চায়,
    কাটা মুণ্ডু হতে দেবীর রক্ত ভেসে যায়।
    এইভাবে সরষে ঘুরিতে ঘুরিতে–
    তারও পূবেতে আছে একখানা শ্বেত দ্বীপ,
    নীল সমুদ্রের উপরে যেন সাদা টিপ।
    সেইখান থেকে আয় আয়, দেও-দানা আয়,
    নীলা আসমান তোর ভাইঙ্গা পড়ুক গায়।

    এই মন্ত্র পড়িতে পড়িতে খট করিয়া একটি শব্দ হইল। পুর্ব নির্দেশমত তিন চারজন ভক্ত অজ্ঞান হইয়া পড়িল। মোহনলাল হাত জোড় করিয়া বলিল, “হায়, হায়, গুরুদেব, এখন কি করি? এরা যে অজ্ঞান হয়ে পড়ল।

    আমি বলিলাম, “কোন চিন্তা করো না। যতক্ষণ আমি আছি, কোন ভয় নাই।”

    পা দিয়া এক এক জনকে ধাক্কা দিতেই তারা উঠিয়া দাঁড়াইল। ঘেটু তখন ভয়ে কাঁপিতেছে, আর বিড়বিড় করিতেছে। মোহনলাল তার পাশে বসিয়া আছে স্মেলিংসল্টের শিশি লইয়া। যদি অজ্ঞান হইয়া পড়ে, তখন উহা ব্যবহার করা যাইবে।

    আমি আরও জোরে জোরে মন্ত্র পড়িতে লাগিলাম।

    “আয় আয়—কালকেচণ্ডী আয়, শ্মশানকালী আয়—”

    অদূরে সামনে আসিয়া সাহেবভূত খাড়া হইল। উপস্থিত ভক্তমণ্ডলীর কাছে আমি বলিলাম, “যার যা খাবার ইচ্ছে, সাহেব ভূতের কাছে চেয়ে নাও।”

    একজন বলিল, “আমি আম খাব।” কেউ বলিল, “আমি বিস্কুট খাব।” বলিতে না বলিতে সাহেব তার ঝুলির ভিতর হইতে যে যাহা চায়, ছুঁড়িয়া ফেলিয়া দেয়। বিস্ময়ে ঘেটু কেবল কাঁপিতেছে। তাকে বলিলাম, “ঘেটু, তুমি কিছু চাও।”

    মোহনলাল তাহার কানে কানে বলিয়া দিল, “বল, আমি লকেটফল চাই।”

    ঘেটু তাহার নির্দেশমত বলিল “আমি লকেটফল চাই।”

    আমি, ভুতকে বলিলাম, “শিগগীর লকেটফল নিয়ে এসো।” ভুত ইসারা করিয়া ‘না, না’ বলে। আমি বলি, “তা হবে না। তুমি এখনই সেই শ্বেতদ্বীপে গিয়ে লকেটফল নিয়ে এসো। অনেক দূর–কষ্ট হবে, তাই বলছ? কিন্তু মা-কালীর মুণ্ড চিবিয়ে খাবে যদি আমার কথা না শোন। দোহাই তোর দেব-দেবতার, দোহাই তোর কার্তিকগণেশের। আমার কথা রাখ।”

    তখন ভূত অন্ধকারে মিশিয়া গিয়া খানিক বাদে একছড়া লকেটফল ছুঁড়িয়া ফেলিয়া দিল। ঘেটু তাহা পাইয়া আমার পায়ের উপর পড়িয়া কেবল বলিতে লাগিল, “দাদা আপনি মানুষ নন। সাক্ষাৎ ভগবান।”

    তখন আমি ভূতকে বলিলাম, “তুই আরও এগিয়ে আয়। ঘেটুকে আশীর্বাদ করে যা। ঘেটুর যেন চাকরি হয়।”

    ভূত আসিয়া ঘেটুর মাথায় হাত রাখিয়া আশীর্বাদ করিল। ঘেটু তবু সাহেববেশধারী সুজনকে চিনিতে পারিল না।

    তখন আমি ঘেটুকে কাছে ডাকিয়া বলিলাম, “ভাই ঘেটু, সবই অভিনয়। তোমাকে নিয়ে আজ আমরা কিছু মজা করলাম। তোমার বন্ধু সুজন সাহেব-ভূত সেজে তোমাকে আশীর্বাদ করে গেল। তুমি কিন্তু চিনতে পারনি।”

    কিন্তু ঘেটুর চেহারায় কোনও রূপান্তর হইল না। সে আমার কথা বিশ্বাস করিল না। পরদিন যখন সে সমস্ত ব্যাপার বুঝিতে পারিল, লোকের ঠাট্টার ভয়ে সাত-আটদিন ঘরে দরজা দিয়া রহিল। এখনো ঘেটুর সঙ্গে দেখা হইলে সেই পূর্ব রহস্যের হাসিতামাসার রঙটুকু আমরা উপভোগ করি।

    এই রহস্যনাট্যের অন্যান্য অংশে যাহারা অভিনয় করিয়াছিল, তাদের সঙ্গে দেখা হইলেও এই ঘটনাটির উল্লেখ করিয়া আমরা পরস্পর আনন্দ লাভ করি। দশে মিলিয়া ভগবানকে কেমন করিয়া ভূত বানান যায়, এই ঘটনাটি তার একটি উজ্জ্বল নিদর্শন।

     

    ১১.

    শুনিয়াছি, মোহনলালের পিতা খুব বন্ধুবৎসল ছিলেন। সেই গুণ অনেকখানি মোহনলালের মধ্যে বর্তাইয়াছে। তার মত বন্ধু খুব কমই মেলে। যে কোন ব্যাপারে অসুবিধায় পড়িলে মোহনলাল তাহার সুরাহা করিয়া দিবে। “মোহনলাল; আজ টাকা নাই, এখনই আমার একশ টাকার প্রয়োজন।” মোহনলাল হাস্যমুখে বলে, “কোন চিন্তা নেই। এখনই এনে দিচ্ছি।” “মোহনলাল, আমার রিসার্চ-স্কলারশিপের রিপোর্ট কালই দাখিল করতে হবে। এতগুলো পৃষ্ঠা কি করে নকল করব একদিনের মধ্যে?” মোহনলাল বলে, “কোন চিন্তা নাই। আমি নকল করিয়ে দিচ্ছি।” মোহনলাল আমার কাছ হইতে কাগজ লইয়া তার মামাতো ভাই-বোনদের মধ্যে বিলি করিয়া দিল। এক রাতের মধ্যে সমস্ত কাজ হইয়া গেল।

    “মোহনলাল, টাকা নেই, রবীন্দ্রনাথের থিয়েটার দেখব।” মোহনলাল পিছনের দরজা দিয়া আমাকে ভিতরে ঢুকাইয়া দিয়া আসিল।

    বই-এর পাণ্ডুলিপি তৈরী করা, প্রচ্ছদপটে ছবি আঁকান প্রভৃতি কত কাজই সে আমাকে হাসিমুখে করিয়া দিয়াছে! তার সঙ্গে মতের কোন অমিল হইত না কোনদিন। আমি যদি বলিতাম “হু” সে বলিত “হঁ।”। কোনখানে বেড়াইতে যাইতে, কাউকে অসময়ে গিয়া বিরক্ত করিতে—যখন যে-কোন অসম্ভব কাজে তাহাকে ডাকিয়াছি, সে বাতাসের আগে আসিয়া সাড়া দিয়াছে।

    একদিন জ্যোৎস্নারাত। আমরা দুইজনে বসিয়া গল্প করিতেছি। রাত প্রায় একটা। আমাদের খেয়াল হইল, চল, আব্বাসউদ্দীন সাহেবকে ঘুম হইতে জাগাইয়া দিয়া আসি। জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ি হইতে রিকসায় চাপিয়া চলিলাম পার্ক সার্কাস। বৌবাজার হইতে দুইজনে দুইগাছি ভাল বেলফুলের গোড়ের মালা কিনিয়া লইলাম।

    আব্বাসউদ্দীন থাকিত কড়েয়া রোডের এক মেসে। বড়ই ঘুমকাতুরে। ঘুম হইতে জাগাইতে সেত রাগিয়া অস্থির। আমরা অভিনয়ের ভঙ্গীতে বলিলাম, “হে গায়ক প্রবর, আজ আমরা দুই বন্ধুতে স্থির করিলাম, অখ্যাতবিখ্যাত আব্বাসউদ্দীন সাহেবকে রজনী যোগে গিয়া ফুলের মালা পরাইয়া আসিব। অতএব আপনি ক্রোধ সংবরণ করিয়া এই মাল্য গ্রহণ করুন।”

    দুই জনে তাহার গলায় দুইটি মালা পরাইয়া দিলাম। বন্ধুবর হাসিয়া গড়াইয়া পড়িল। তারপর বহু ক্ষণ গল্প গুজব করিয়া জোড়াসাঁকো ফিরিয়া আসিলাম। পথের দুই ধারে ফুটপাথের উপর সারি সারি গৃহহীন সর্বহারারা শুইয়া আছে। মাঝে মাঝে রিক্সা থামাইয়া বহুক্ষণ তাহাদের দেখিলাম। মোহনলাল দীর্ঘশ্বাস ছাড়িয়া বলিল, “এদের কবিতা কোন কবি লিখবে?”

    মোহনলালকে লইয়া আরও কত আমোদ করিয়াছি! কোন কোন দিন আমাদের নাচে ইত। নাচের উপযুক্ত গান তৈরী করিয়া তখন তাহাতে সুর সংযোগ করিয়া মোহনলালের ভাইদের শিখাইয়া দিতাম। কেহ একটা ঢোলক আনিয়া বাজাইতে বসিত। ঘণ্টার পর ঘণ্টা আমাদের নাচ চলিত। এই আসরে নরেন্দ্রনাথ, ব্বতীন্দ্রনাথও মাঝে মাঝে আসিয়া যোগ দিতেন।

    দোলের দিনে ওদের বাড়ি খুব আমোদ হইত। একবার দোলের সময় আমি ঠাকুরবাড়ির সবাইকে তামাসা করিয়া একটি কবিগান ব্লচনা করিয়া ছিলাম। বাড়ির ছেলেরা সেই কবিগানের ধুয়া ধরিয়াছিল। ব্বতীন্দ্রনাথ সম্বন্ধে লিখিয়াছিলাম–

    ব্বতীনবাবু সর্বসময়
    ব্যস্ত আছেন ভারি,
    সবই কিন্তু পরের তরে
    কোন কাজ নেই তারি

    কনকবাবু অধিক সময় জমিদারির কাজ দেখিতে মফস্বলে ঘোরেন, মাঝে মাঝে জোড়াসাঁকো আসিয়া উদয় হন; কে খুব খাইতে পছন্দ করে কে গান গাহিতে ঘাড় নাচ’য়; কে সারা দিন বসিয়া শুধু নভেল পড়ে—ইত্যাদির বর্ণনায় গানটি ভরা ছিল। আমরা নাচিয়া নাচিয়া সেই গান গাহিয়া খুব আনন্দ উপভোগ করিয়াছিলাম।

    নীচের তলার ঘরে মাঝে মাঝে বসিয়া আমরা যত সব আজগুবি গবেষণা করিতাম। এই কাজে ব্রতীন্দ্রনাথের বুদ্ধি ছিল খুব প্রখর। একদিন আমাদের আলোচনার বিষয়বস্তু হইল—রবীন্দ্রনাথ কবি নন, একেবারেই নকল—তাহাই প্রমাণ করা। এক একটি করিয়া, পয়েন্ট টোকা হইল–

    ১। রবীন্দ্রনাথ খুব ভাল খাইতে পছন্দ করেন। কোন কবিই বেশি খান না।

    ২। কবিদের দেখা যায়, সন্ধ্যা-সকাল আকাশের দিকে বিভোর ভাবে চাহিয়া থাকিতে। রবীন্দ্রনাথ শেষরাত্রে উঠিয় স্নান করিয়া অনেক গুলি সন্দেশ খাইয়া লিখিতে বসেন। সুতরাং তিনি যাহা লেখেন, তাহা সেই সন্দেশ খাওয়ারই প্রভাব। সত্য সত্য তাহার ভিতরে কোন কাব্য নাই।

    ৩। বহু বৈষ্ণব কবিতা তিনি নকল করিয়া মারিয়া দিয়াছেন। দৃষ্টান্ত স্বরূপ তার পশারিণী’ কবিতার উল্লেখ করা যাইতে পারে। তিনি মাঝে মাঝে কাসিয়া উঠেন। তাহাও নিতান্ত অকবি-জনোচিত।

    ৪। যেহেতু তিনি জমিদারি কার্যে অত্যন্ত সুদক্ষ, সুতরাং কবি হইতে পারেন না।

    ৫। তাহার কণ্ঠস্বর ক্রমেই কর্কশ হইয়া যাইতেছে। কেমন ভাবলেশহীন। ইহা সত্যকার কবির লক্ষণ নয়।

    এইভাবে যে যত পয়েন্ট বাহির করিতে পারি, তাহার তত জিত হইত। এই সব আলোচনার পরে রবীন্দ্রনাথের গান বিকৃত করিয়া গাওয়া হইত। এই কাজে আমি ছিলাম বোধহয় সব চেয়ে অগ্রণী। আমার না ছিল তাল-জ্ঞান, না ছিল সুর-জ্ঞান। রবীন্দ্রনাথের গানগুলিকে ভাটিয়ালি সুরে গাহিয়া সকলের হাস্যের উদ্রেক করিতাম। এই জন্য দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুর অতর্কিতে একদিন আমাদের সভায় ঢুকিয়া আমাকে তাড়া করিয়াছিলেন। তার সব চাইতে ক্রোধের কারণ, আমার বেতালা সুরে গান গাওয়া। অন্য কোন কারণে কেহ কোনদিন তাঁকে রাগিতে দেখেন নাই, কিন্তু তার সামনে বেতালা বেসুরো করিয়া কেহ গান গাহিলে তিনি সহ্য করিতে পারিতেন না। মাঝে মাঝে ইচ্ছা করিয়াই আমরা বেতালা সুরে গান গাহিয়া তাকে রাগাইয়া দিতাম। আমার রচিত গ্রাম-গান তিনি খুব ভালবাসিতেন। তিনি আমাকে কথা দিয়াছিলেন, “তোমার গ্রাম্য-গানগুলির স্বরলিপি করিয়া আমি একটি বই তৈরী করিয়া দিব।” কিন্তু অকালে তাঁহার মৃত্যু হওয়ায় ইহা ঘটিয়া উঠে নাই।

    একবার নিখিলবঙ্গ সঙ্গীত-সম্মেলন হয়। খুব সম্ভব ১৯৩০ সনে। দিনু দা সেই সম্মেলনে পল্লীসঙ্গীত বিভাগে আমাকে বিচারক নিযুক্ত করিয়াছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছুটির সময় এই সম্মেলন বসে। তখন আমি বাড়ি চলিয়া আসি। সেইজন্য উহাতে যোগদান করিতে পারি নাই। রবীন্দ্রনাথের মাঝে মাঝে শান্তিনিকেতনের ছাত্রছাত্রীর দল লইয়া কলিকাতায় অভিনয় করিতে আসিতেন। এই উপলক্ষে সাত-আট দিন ঠাকুরবাড়িতে অনন্সরত রিহার্সাল। বাহিরের কাহারো প্রবেশ করিবার উপায় ছিল না। দিনু-দাকে অনুরোধ করিতেই তিনি আমাকে রিহার্সাল শুনিবার অনুমতি দিলেন।

    দিনু-দার পরিচালনায় রবীন্দ্রনাথের গানের মহড়া যাঁহার না শুনিয়াছেন, তাহারা রবীন্দ্রনাথের সঙ্গীতের একটা খুব বড় জিনিস। উপভোগ করিতে পারেন নাই। রবীন্দ্রনাথের নতুন নতুন গান দিনু-দা শান্তিনিকেতনের ছেলেমেয়েদের শিখাইতেন। তাঁহার কণ্ঠ হইতে গানের পাখি বাহির হইয়া নানা কণ্ঠে সুরের ডানা মেলিয়া ঘুরিত। এ যেন পক্ষি-মাতা তার শাবকগুলিকে ওড়া শিখাইত। তাদের ভীরু অপটু সুরের সঙ্গে তাঁর সুদক্ষ সুর মিলিয়া রিহাসেলের আসরে যে অপূর্ব ভাব-রসের উদ্রেক হইত, তাহার তুলনা মেলে না। সেই ভাব-সমাবেশ প্রতিদিন গাঢ় হইতে গাঢ়তর হইত। এক একটি রিহাসেলে গান এমনই জমিত যে, স্টেজে প্রকৃত গানের আসরে তাহার শতাংশের এক অংশও জমিত না। প্রতিদিন আমি দিদার গানের রিহাসেলের সময় বসিয়া অপূর্ব সঙ্গীত-সুধা উপভোগ করিতাম।

     

    ১২.

    দিনুদা সকলের নিকট অবারিতদ্বার। কারও কোন উপকার করিতে পারিলে যেন কৃতার্থ হইয়া যাইতেন। শৈলেনবাবু নামে এক ভদ্রলোক ময়মনসিংহ হইতে কলিকাতা আসেন। পল্লী-সঙ্গীতে -তাহার খুব নৈপুণ্য ছিল। কিন্তু অর্থ ভাবে কলিকাতা আসিয়া তিনি বিশেষ কিছু করিয়া লইতে পারেন নাই। দিনুদা তাকে একটি হারমোনিয়াম উপহার দিয়াছিলেন। দিনুদার মৃত্যুর পর আমি একটি কবিতা লিখিয়া বিচিত্র কাগজে প্রকাশ করিয়াছিলাম।

    এ বাড়ির এতসব লোকের কথা এমন করিয়া ইনাইয়া-বিনাইয়া কেন বলিতেছি, পাঠক হয়ত জিজ্ঞাসা করিবেন। রবীন্দ্রনাথ অবনীন্দ্রনাথের কথা সকলেই জানিবেন, কিন্তু সেই মহাতরুদ্বয়ের ছায়াতলে তিম্ভে তিলে যারা নিজেদের দান করিয়া তরুর বুকে শত শাখাবাহুবিস্তারে সাহায্য করিয়াছিলেন, তাঁদের কথাও কিছুই লিখিত থাকা উচিত। সঙ্গীত-জগতে দিনুদা যদি অন্য পথ ধরিতেন, তবে হয়ত আরও বেশী সুনাম অর্জন করিয়া যাইতে পারিতেন। কিন্তু মহাকবি যশ-সমুদ্রের তরঙ্গে তিনি সব কিছু স্বকীয়তা বিসর্জন দিয়াছিলেন। রবীন্দ্রনাথ বড় হইয়াছিলেন, এ যেন দিদার নিজেরই সাফল্য। এ কথা শুধু দিদার বিষয়েই খাটে না। ঠাকুর-পরিবারের সমস্ত লোক এই প্রতিভাদ্বয়কে নানা রকম সুযোগ সুবিধা করিয়া দিতে যে-কোন সময় প্রস্তুত হইয়া থাকিতেন।

    অবনীন্দ্রনাথের নীচের তলায় এক ঘরে বসিয়া গবাদা (ব্বতীন্দ্রনাথ ঠাকুর) ছবি আঁকিতেন। পাশে তাঁর শিষ্য অম্বি, প্রশান্ত এরাও ছবি আঁকিতেন। ওঘরে অলক বাবু ছবি আঁকিতেন। সমস্ত বাড়িটা যেন ছবির রঙে ঝকমক করিত। গবাদ এখন ছবি আঁকেন না। সন্ধ্যাবেলা পশ্চিম আকাশের মেঘ কাটিয়া গেলে সবুজ ধানের ক্ষেতের উপর যে আবছা আলোর একটু মৃদুপেলব স্পর্শ দেখা যায়, তারই মোহময় রেশ তিনি ছবিতে ধরিয়া রাখিতে পারিতেন। আমার ধানক্ষেত পুস্তকের প্রচ্ছদপটের জন্য তিনি অমনি একখানা ছবি অকিয়া দিয়াছিলেন। কিন্তু ব্লক করিয়া ছবি ছাপাইয়া দেখা গেল, সেই আবছা আলোর মোহময় রেশটি ছবির ধানক্ষেতের উপর রক্ষিত হয় নাই। আমার মন খারাপ হইয়া গেল। গবাদাকে এ কথা বলিতে তিনি বলিলেন, “হ্যাঁ ছবিতে যা এঁকেছি হাফটোন ব্লকে তার অর্ধেকটা মাত্র ধরা দেবে। সবটা পাওয়া যাবে না। এ জন্য দুঃখ করো না।”

    সারাটি সকাল গবাদা ছবি আঁকিতেন। তারপর আর তাকে খুঁজিয়া পাওয়া যাইত না। ইউনিভারসিটি ইনস্টিটিউটে কোথায় একজিবিশন হইবে, কোন কলেজে ছেলেরা নাটক অভিনয় করিবে—সাজানোগোছানোর ভার গবাদার উপর। ভারবোঝ তাহাকে দিতে হইত না, তিনি নিজেই যাচিয়া ভার গ্রহণ করিতেন। কোন কোন অনুষ্ঠানে তিন-চার দিন অনাহারে অনিদ্রায় একাদিক্রমে কাজ করিতেন। অনুষ্ঠানের কার্যসূচিতে তার নাম পর্যন্ত ছাপা হইত না। এ সব তিনি খেয়ালও করিতেন না।

    বহুদিন বহু গ্রামে ঘুরিয়া আমি নানা রকমের পুতুল, নক্সীকাঁথা, গাজীর পট, পিঁড়ি-চিত্র আলপনা-চিত্র, ব্যাটন, সিকা, পুতুলনাচের পুতুল প্রভৃতি সংগ্রহ করিয়াছিলাম। বন্ধুরা পরামর্শ দিলেন এইগুলি দিয়া কলিকাতায় প্রদর্শনী খুলিতে। কিন্তু কে আমার প্রদর্শনী দেখিতে আসিবে? প্রদশনী খোলর আগে বড় বড় নামকরা দুএকটি মতামত সংগ্রহের প্রয়োজন। রবীন্দ্রনাথের ঘরের ছাতে গবদা এই সংগ্রহগুলি উত্তম করিয়া সাজাইয়া রবীন্দ্রনাথকে ডাকিয়া আনিলেন। অবনীন্দ্রনাথও আসিলেন। তখন আমার মনে কত আনন্দ! এতদিনের পরিশ্রম সার্থক বলিয়া মনে হইল। রবীন্দ্রনাথ আর অবনীন্দ্রনাথ আমার সংগ্রহগুলির এটা-ওটা নাড়িয়া চাড়িয়া দেখিতে লাগিলেন। অবনীন্দ্রনাথ ত পুতুল নাচের পুতুলগুলি দেখিয়া খুশিতে বিভোর।

    সমস্ত দেখিয়া রবীন্দ্রনাথ বলিলেন, “আমার ইচ্ছা করে, এমনি পল্লীশিল্পের রকমারি সংগ্রহ আমার শান্তিনিকেতন সংরক্ষিত করি।”

    দিনে দিনে আমার সংগ্রহগুলির বহর বাড়িতেছিল। এই সংগ্রহগুলি কোথায় রাখিব, সেই ছিল আমার মস্তবড় সমস্যা। কবিকে বলিলাম, “আপনি যখন পছন্দ করেছেন, এগুলি শান্তিনিকেতনে নেবার ব্যবস্থা করুন। এগুলি আপনাকে যে আমি দিতে পারলাম, এটাই আমার বড় গৌরবের কথা। আপনার ওখানে থাকলে দেশবিদেশের কলারসিকেরা নখে আনন্দ পাবেন। নতুন শিল্পীরা তাদের শিল্পকাজে প্রেরণা পাবে। এটাও কি কম কথা?”

    রবীন্দ্রনাথ বলিলেন, “আমি নন্দলালকে এগুলি নিয়ে যাবার কথা বলব।”

    নন্দলাল বাবু আমার সংগ্রহগুলি একবার আসিয়া দেখিলেন, কিন্তু লইয়া যাইবার আগ্রহ প্রকাশ করিলেন না। দুই-একদিন তাকে তাগিদ দিয়া আমিও নিরস্ত হইলাম। পল্লী-শিল্পের এই প্রদর্শনী দেখিয়া রবীন্দ্রনাথ যে বিবৃতি দিয়াছিলেন, তাহা তৎকালীন পত্রিকা গুলিতে ছাপা হইয়াছিল।

    পরে আমার এই শিল্পকলার নিদর্শনগুলি দিয়া কতিপয় বন্ধুর সাহায্যে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃতত্ত্ব বিভাগে আমরা একটি প্রদর্শনী খুলিয়াছিলাম। এই উপলক্ষে সেখানে আমাকে কয়েকটি বক্তৃতা দিতে হয়। এই শিল্পগুলির কোনটি কি ভাবে কাহারা তৈরী করে, কোথায় কি উপলক্ষে ব্যবহৃত হয়, এর সঙ্গে কি কি পল্লীগান ও ছড়া মিশিয়া রহিয়াছে, এই শিল্পগুলি আমাদের গ্রাম্যজীবনের আনন্দবর্ধনে ও শোকতাপ হরণে কতটা সাহায্য করে, রঙে ও রেখায় কোথায় এই শিল্প কোন রূপময় কাহিনীর ইঙ্গিত বহিয়া আনে, আমি আমার বক্তৃতায় এই সব কথা বলিয়াছিলাম।

    সভাপতির ভাষণে শ্রদ্ধেয় কালিদাস নাগ মহাশয় যাহা বলিলেন, তাহা আমার সমস্ত বলাকে ম্লান করিয়া দিল। কিন্তু বক্তৃতা শুনিয়া গর্বে আমার বুক সাত হাত ফুলিয়া গেল। সমস্ত পৃথিবীর শিল্পকলা তার নখদর্পণে। তিনি বলিলেন, “আজ ইউরোপের একদল শিল্পী তাঁদের যুগযুগান্তরের শিল্পকলার পথকে নিতান্ত বাজে আখ্যা দিয়ে লোকশিল্পের সুধা-আহরণে মশগুল হয়েছেন। সেই আলো-আঁধারী যুগের স্তম্ভের গায়ে পাথরের গায়ে যে সব ছবির ছাপ রয়েছে, তারই উপরে তারা নতুন শিল্পকলা গড়ার সাধনা করছেন।”

    সেই বক্তৃতার মধ্যে তিনি গর্গার জীবনের কাহিনী অবতারণা করিলেন। সারা জীবনের শিল্প-সাধনাকে পশ্চাতে ফেলিয়া তিনি টিহিটি দ্বীপে গিয়া সমুদ্রতীরে উলঙ্গ হইয়া সেই আদিম যুগের বাসিন্দাদের মত সূর্যোদয় দেখিয়া তাহাদের মত বিস্ময় অনুভব করিতে চেষ্টা করিতেন। এই কাহিনী তিনি এমন সুন্দর করিয়া বলিলেন, যাহার রেশ আজও ছবির মত আমার মনে আঁকিয়া আছে।

    আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধু বিনয় বন্দ্যোপাধ্যায়, বীরেন ঘোষ, বীরেন ভঞ্জ এবং আরও কয়েকজনের চেষ্টায় ইউনিভারসিটি ইনস্টিটিউটের হলে আমার সংগ্রহগুলির আর একটি প্রদর্শনী হয়। তারা সকলেই চাহিতেন, গ্রাম্য লোক-শিল্প এবং লোক-সংস্কৃতির প্রতি আমার যে অনুরাগ, তাহা আরও দশজনে অনুভব করেন; কোন অর্থবান লোক আসিয়া আমার এই প্রচেষ্টাকে সাফল্যমণ্ডিত করেন।

    আজ তারা কে কোথায়, জানি না। আমার সেই নিঃসহায় প্রথম জীবনে তারা যে ভাবে আমাকে উৎসাহিত করিতেন, তাহা ভাবিয়া আজিকার অসাম্যের দিনে আমার দুই নয়ন অশ্রুপ্লাবিত হয়। ‘

    গবাদী পূর্বের মতই আমায় এই প্রদর্শনীর দ্রব্যগুলিকে যথাস্থানে সাজাইবার ভার নেন। প্রতিদিন স্ত্রী-পুরুষ বহুলোক আসিয়া এই প্রদর্শনীতে ভীড় করিত।

    গ্রীষ্মের ছুটিতে একটি বড় বাক্সের মধ্যে এই শিল্পনিদর্শনগুলি সাজাইয়া বন্ধুবর অজিনেন্দ্রনাথ ঠাকুরের বাড়িতে রাখিয়া আমি দেশে যাই। ছুটির পরে আসিয়া দেখিলাম, ঠাকুরবাড়ির দারোয়ান আমার সংগ্রহগুলি বাক্স হইতে ফেলিয়া দিয়া সেখানে তাহার কাপড়চোপড় বোঝাই করিয়াছে। সংগ্রহগুলির কথা জিজ্ঞাসা করিলে বলিল, আবর্জনা মনে করিয়া সে ফেলিয়া দিয়াছে। একথা আমার কিছুতেই বিশ্বাস হইল না। আজও মন বলে, কোন বিশিষ্ট পল্লীশিল্প সংগ্রাহক কোন লালের সাহায্যে আমার সংগ্রহ গুলি কবল করিয়াছিলেন। তাঁর সংগৃহীত নিদর্শনগুলি তিনি বহুলোককে দেখাইয়াছিলেন, কিন্তু আমাকে দেখান নাই।

    আজও একান্ত মনে বুসিয়া থাকিলে আমার মানসনয়নে কে যেন সেই নক্সীকাঁথাগুলি মেলিয়া ধরে। তার উপরে পুতুলগুলি, গাজীর পট, মনসাপূজার সরা, বিবাহের পিড়ি চিত্র একের পর এক আসিয়া কেহ নাচিয়া কেহ গান করিয়া যার যার অভিনয় নিখুতভাবে সমাধা করিয়া যায়। এক এক সময় ভাবি, এই সব জিনিস ভালবাসিবার মন যদি বিধাতা দিলেন, এগুলি সংগ্রহ করিয়া ধরিয়া রাখিবার অর্থসঙ্গতি আমাকে দিলেন না কেন? ভাবিয়া কিছু সান্ত্বনা পাই, আমার বন্ধু দেবপ্রসাদ ঘোষ কলিকাতায় আশুতোষ মিউজিয়ামে, ও শিল্পী জয়নুল আবেদীন তাঁর আর্ট-ইস্কুলে পল্লী-শিল্পের নিদর্শনগুলি অতি যত্নের সঙ্গে সংগ্রহ করিয়া রাখিয়াছেন।

    পূর্বেই বলিয়াছি, ১৯৩২ সনে কিছুদিনের জন্য আমি বন্ধুর অজিনেন্দ্রনাথ ঠাকুরের নীচের তলায় কয়েকটি ঘর ভাড়া লইয়া ঠাকুর-বাড়িতে থাকিতাম। ও-পাশে দোতলায় থাকিতেন সৌম্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর। বহুকাল ইউরোপ ঘুরিয়া তিনি দেশে ফিরিয়াছেন—নানান দেশের নানান অভিজ্ঞতা লইয়া বহুজন-সমাগমপূর্ণ বাড়ির এই ভদ্রলোক যেন আর এক দেশের মানুষ। আর সব বাড়িতে আটের কথা, সাহিত্যের কথা, নাট্যকলার কথা। সৌম্যেন ঠাকুরের ঘরে কুলীমজুরের কথা, চাষীর কথা—লোকের অন্নবস্ত্রের কথা। এ বাড়িতে ও-বাড়িতে লোক আসিত মোটরে করিয়া। তাহাদের গায়ের সুগন্ধী প্রলেপের বাসে বাতাস সুরভিত হইত। সৌম্যেন ঠাকুরের ওখানে আসিত ছোঁড়া খদ্দর-পরা কোন প্রেসের পদচ্যুত কম্পােজিটর; নিকেলের আধরঙা চশমাজোড়া কোন রকমে কানের সঙ্গে আটকাইয়া আলিত গোবিন্দ-মিলের ফোরম্যান বুকপকেটে রাঙা রেশমী রুমালেব আর্ধেকটা ঝুলাইয়া চটিজুতা পায়ে আসিত চট্টগ্রামের জাহাজী রহিমুদ্দীন, ছেড়া পাঞ্জাবীর উপর ওভারকোট পরিয়া জর্দাকিমাম সহ পান চিবাইতে চিবাইতে আসিত মেছুয়াবাজারের বছিরদ্দি। এদের লইয়া সৌম্যেন সারাদিন কী সব গুজুর-গুজুর করিত। এ-বাড়ির ও-বাড়ির লোকেরা ঠাট্টা করিয়া বলাবলি করিত, “দেখ গিয়ে ওখানে নতুন কাল মার্কসের উদয় হয়েছে।”

    এই সামান্য লোকদের লইয়া সৌম্য মহাশক্তিমান বৃটিশসিংহের কি ক্ষতি করিত, জানি না। কিন্তু প্রতিমাসে দুইবার তিনবার তার বাড়ি খানাতল্লাসী হইত।

    এ-বাড়ির ও-বাড়ির লোকে ঠাট্টা করিয়া বলিত, ওসব সাজানো খানাতল্লাসী। খানাতল্লাসী করাইয়া সে পলিটিক্সে নাম করিতে চায়; খবরের কাগজে নাম উঠাইতে চায়। কিন্তু খবরের কাগজগুলি যাঁদের হাতে, সৌম্য তাদেরও গাল পাড়িত; তাদের বরখাস্ত কর্মচারীদের লইয়া ফুসুর-ফুসুর করিত। খবরের কাগজে তার নাম উঠিত না। এ-বাড়ির ও-বাড়ির লোকদের চলা-বলার ভঙ্গীর অনুকরণ করিয়া সৌম্য তাদের ঠাট্টা করিত, গাল দিত, আর ভবিষ্যৎবাণী করিত “এদের তাসের ঘর ভাঙল বলে। দেশের সঙ্গে এদের সম্পর্ক নেই। মানুষের অভাবের কথা এরা বোঝে না, বুঝতে চেষ্টাও করে না। মিথ্যার উপরে এদের বেশাতি; প্রজার রক্তের উপর এদের জমিদারী। এদের সব-কিছু একদিন ভেঙে পড়বে। দেখছ না, এরা সব কেমন অলসের দল! এদের নিত্যকার গল্প ওখানে গেলুম। অমুক এলেন, অমুক গেলেন, গল্পটা এমন জমল জান! ওদের বাড়ি সেদিন যা খেলুম—এমন ভাল হয়েছিল রান্নাটা! সেদিনকার অভিনয় বেশ ভাল জমেছিল।—এইসব হল এদের নিত্যকার আলোচনা। যাঁরা প্রতিভা, তারা দিনরাত খাটছেন, তপস্যা করেন। কিন্তু সেই প্রতিভাগুলির সঙ্গে পরগাছাগুলো কী মধুর আলস্যে দিন কাটাচ্ছে। কোন কাজ করে না; কোনকিছু জানতে চায় না। এদের পতন একদিন হবেই।” সন্ধ্যার সময় সৌম্যের গুণগ্রাহীর দল চলিয়া যাইত। তখন ছাদে বসিয়া তাহার কাছে শুনিতাম নানান দেশের গল্প; ইতিহাসের নানা রকমের কাহিনী। সৌম্য কিছুই মানে না। গান্ধী হইতে আরম্ভ করিয়া নাজিমুদ্দীন সাহেব পর্যন্ত সবাইকে গাল দেয়। হিন্দু দেবদেবী, আল্লা, ভগবান, ব্বহ্মসমাজের কাহাকেও সে বাদ দেয় না। নিজের আত্মীয়স্বজনের ত কথাই নাই। সৌম্য সবাইকে সমালোচনা করে। আমার পক্ষে তার সঙ্গে তাল রাখিয়া চলা বড়ই মুস্কিল। মাঝে মাঝে তুমুল তর্কের অগ্নিদহনের পাশ দিয়া স্নেহের প্রতিমূর্তি সৌম্যের মা আমাদের দিকে একটু চাহিয়া মৃদু হাসিয়া চলিয়া যাইতেন।

    সৌম্যের তর্কের আর এক মজা, সে আপোস করিতে জানে। তার মত হইতে সে এক ইঞ্চি ও এদিক-ওদিক হইতে চায় না। যখন তর্কে হারিয়া যাই, তাকে গাল দিই: “তুমি সেই চিরকালের ভুৎমার্গী বামুনপণ্ডিত। তোমার ছোঁয়াছুয়ির ছুৎমার্গ আজ রূপগ্রহণ করেছে তোমার উৎকট মতবাদে। তোমার সঙ্গে যার মতের মিল নেই, তাকে তুমি অস্পৃশ্য বলে মনে কর।” সৌম্যও আমাকে বলে, “কাঠমোল্লা তোমার মুখে দাড়ি নেই, কিন্তু তোমার দাড়ি ভর করেছে তোমার সেকেলে মতবাদে।”

    সৌম্যকে বলি, “তুমি ঈশ্বর মান না, কিন্তু আর্ট-সাহিত্য ত মান? আজ ঈশ্বরকে বাদ দিলে জগতের কত বড় ক্ষতি হবে জান? মধ্যযুগের খৃস্টান-গির্জাগুলিতে দেখে এসো, রঙের রেখার ইন্দ্রজালে অচির সৌন্দর্যকে চিরকালের করে রেখেছে। ভারতবর্ষের মন্দির আর মসজিদগুলিতে দেখ, যুগে যুগে কত রঙ-পিপাসুর দল তাদের কালের যা-কিছু সুন্দর, অমর অক্ষরে লিখে রেখে গেছে। এগুলি দেখে আজ আমরা কত সান্ত্বনা পাই।”

    সৌম্য আমার কথাগুলি বিকৃত ভঙ্গীতে উচ্চারণ করিয়া উত্তর দেয়, “আহা মরি মরি রে! কালীর মন্দিরে মানুষ বলি দেওয়া, দেবস্থানে দেবদাসী রাখা, গঙ্গাসাগরে সন্তান বিসর্জন দেওয়া, পুরুষের চিতার উপরে জোর করে স্ত্রীকে পুড়িয়ে মারা ধর্মের কী অপরূপ কীর্তি! পৃথিবীতে ধার্মিক লোকেরা যত নরহত্যা করেছে, কোন তৈমুরলং বা নাদির শাহ, তা করতে পারেনি।”

    সৌম্যের সঙ্গে তর্ক করিয়া পারি না। নানা যুগের ইতিহাস লইয়া সৌম্য নূতন নূতন ব্যাখ্যা করে। তার সঙ্গে সব সময় একমত হইতে পারি না। কিন্তু তার কথা শুনিতে ভাল লাগে।

    এ-বাড়িতে ও-বাড়িতে কৃচিৎ রাজনীতি লইয়া আলোচনা হয়। সবাই আলোচনা করেন সাহিত্য লইয়া, শিল্পকলা লইয়া। দেশের রাজনীতির ক্ষেত্রে হিন্দু-মুসলমানে বিরাট পার্থক্য থাকিলেও পরস্পর মিশিতে কোন অসুবিধা হয় না। সৌম্যের আলোচনা দেশের রাজনীতি লইয়া। হিন্দু-মুসলমান কোন রাজনৈতিক নেতা তার কঠোর সমালোচনা হইতে বাদ যান না। কংগ্রেসের নেতা, হিন্দুমহাসভার নে, সমাজতন্ত্রী নেতা—এদের সৌম্য এমনই কঠোরভাবে সমালোচনা করে যে কোন গোঁড়া মুসলমান রাজনৈতিকের সমালোচনাও তার ধারকাছ দিয়া যাইতে পারে না। মুসলিম নেতারা অনেক সময় হিন্দু নেতাদের গাল দেন কোন রকমের যুক্তি না দেখাইয়াই। হিন্দু নেতারাও মুসলিম নেতাদের সেই ভাবে গাল দেন। যুক্তির বহর কোন দলেই ততটা শক্ত হয় না, কিন্তু সৌম্য এদের দুই দলকেই গাল দেয় যুক্তির অবতারণা করিয়া। সেইজন্য সৌম্যের সমালোচনায় হল থাকিলেও তাহাতে বিষ মেশানো থাকিত না।

    দুই দলকে সমান ভাবে সে গাল পাড়িল। হিন্দু নেতাদের গাল দিতে সে যেসব যুক্তির অবতারণা করিত, তাহা শুনিয়া মাঝে মাঝে আনন্দ পাইতাম। কারণ, তাঁদের সকলকে আমি সমর্থন করিতাম না। আবার যেসব মুসলিম নেতাকে আমি সমর্থন করিতাম, তাদের বিরুদ্ধে সে কিছু বলিলে প্রাণপণে তার যুক্তির বিরুদ্ধে তর্ক করিতাম, হারিয়া গিয়া কিছুটা ব্যথা পাইতাম।

    সৌম্য বলিত, “আস্তে আস্তে দেশ থেকে ধর্মে ধর্মে ভেদ উঠে যাবে। ধর্মের ভেদ জিইয়ে রেখেই দেশের নেতারা সমাজতন্ত্রের প্লাবন দাঁড়াতে দিচ্ছে না। এই যে মানুষে প্রভেদ—একদল ফেলে ছড়িয়ে খাচ্ছে, আর একদল না খেয়ে মরছে—এই অসাম্য দেশ থেকে কখনো যাবে না যদি ধর্মের লড়াই এমনি ভাবে চলতে থাকে। দেখছ না—এই যে তোমাদের মুসলানদের শক্তির লড়াই, এ শক্তি কার অন্য? মুষ্টিমেয় কয়েকজন সুবিধাবাদীর জন্য। দেশের না-খাওয়া ভুখা জনগণের জন্য নয়। আর হিন্দুরা যে তোমাদের বাধা দেয়, তা-ও সেই বনিয়াদি কয়েক ঘর ধনীর স্বার্থ নষ্ট হবে বলে। কিন্তু দুঃখের বিষয়, মুসলিম দলের ভুখা জনগণ বুঝতে পারে না, হিন্দুদলের সর্বহারারাও তা বোকে না। দুই সমাজের ধনিক লোকেরা নিজ নিজ সমাজের শ্রমিক লোকদের একের বিরুদ্ধে অপরকে লেলিয়ে দেয়। কত জীবন নষ্ট হয়। বড়লোকেরা কিন্তু ঠিকই থাকে। সেই জন্যে আমরা চাই, দেশের জনগণ ধর্ম সমাজ সব-কিছু ভুলে রুটির লড়াইয়ে নেমে আসুক।”

    আমি বলি, “তোমার রুটির লড়াইয়ে আজ যারা তোমার সঙ্গে, ‘তাদের সংখ্যা হাতের আঙুলে গণা যায়। মনে কর, আমরা একদল মুসলিম তোমার সঙ্গে এসে যোগ দিলাম; ধর্মের কোন ধার ধারলাম না। কিন্তু হিন্দু-মুসলমান, দুই সমাজেই ত সাম্প্রদায়িক লোকেরা একে অপরের বাড়ি আগুন ধরাবে। যেহেতু আমরা কয়েকজন তোমার সঙ্গে রুটির লড়াই করছি, এ জন্যে কি হিন্দু সাম্প্রদায়িকবাদী আমাদের বাদ দেবে? আমাদের ঘর যখন পুড়বে, তখন আমাদের রক্ষা করবে কে? তোমার সমাজতন্ত্রবাদ যখন আসবে, মেনে নিলাম, সেদিন কোন সম্প্রদায়ের কাছ থেকেই কারো কোনো ভয় থাকবে না। কিন্তু যতদিন সমাজতন্ত্রবাদ না আসে, ততদিন আমাদের রক্ষা করবে কে?”

    সৌম্য বলে, “তবে কি তুমি দেশকে এই ভাবেই চলতে দিতে চাও? দুই দলের সুবিধাবাদী কয়েকজন সাম্প্রদায়িক আগুন জ্বালিয়ে রেখে সমস্ত দেশকে এইভাবেই শোষণ করে যাবে?

    তর্কের উপর তর্ক চলিতে থাকে। কোন কোন রাতে আকাশে শুকতারা আসিয়া উদয় হয়।

    সৌম্যের কাগজ গণবাণীতে আমি মহাত্মা গান্ধীকে সমালোচনা করিয়া বেনামীতে একটি কবিতা প্রকাশ করিয়াছিলাম। এতেই বোঝা যাইবে, সৌম্যের মতবাদ তখন কতটা প্রভাবিত করিয়াছিল। মোপল-বিদ্রোহের উপর সৌম্য একখানা বই লিখিয়াছিল, সেই বিদ্রোহ সম্পর্কে মতভেদ হইয়া আলী-ভ্রাতারা মহাত্মা গান্ধীর দল হইতে বাহির হইয়া যান। সৌম্য তার ছোট্ট বইখানায় যুক্তি এবং তথ্যসহ প্রমাণ করিয়াছিল, মোপলা-বিদ্রোহ বনিয়াদি ধনিকদের বিরুদ্ধে দেশের জনগণের স্বতস্ফুর্ত ফরিয়াদ।

    তৎকালীন কংগ্রেস-নেতা কিদোয়াই এবং আরও অনেকের মতামত উদ্ধৃত করিয়া সৌম্য দেখাইয়াছিল, মোপল-বিদ্রোহকে সাম্প্রদায়িক বলিয়া মহাত্মা গান্ধী ভুল করিয়াছিলেন। সব চাইতে আশ্চর্যের বিষয় যে, তখনকার দিনের সব চাইতে অধিক মুসলিম স্বার্থরক্ষাকারী স্যার নাজিমুদ্দীন সেই পুস্তকখানা গভর্নমেন্টের তরফ হইতে বাজেয়াপ্ত করিয়াছিলেন।

     

    ১৩.

    নানা রকম রাজনৈতিক সমস্যার মাঝে মাঝে সৌম্য সাহিত্য লইয়াও আলোচনা করিত। তাহার বিচিত্র ভ্রমণ-কাহিনীর কথা বলিত। একবার অসুস্থ অবস্থায় লেনিন একটি পাড়াগাঁয়ে গিয়া কিছুদিন বাস করিয়াছিলেন। তিনি ত কোন রকম ধর্মই মানিতেন না; বড়দিনের উৎসবের সময় পাড়ার ছেলেরা লেনিনকে আসিয়া ধরিল, আমরা এখানে ক্রিসমাস-ট্রি লাগাইয়া উৎসব করিব। লেনিন অতি আগ্রহের সঙ্গে সেই উৎসবে যোগ দিলেন। তিনি রাজনৈতিক কার্যে বহুলভাবে ব্যস্ত থাকিতেন; কিন্তু প্রত্যেক বড়দিনের ছুটিতে সেই গ্রামের শিশুবন্ধুদের জন্য তিনি ক্রিসমাস-উপহার পাঠাইতেন।

    এরূপ বহু রকমের গল্প সৌম্যের নিকট শুনিতাম। বার্লিন বিশ্ববিদ্যালয়ের বাঙলার অধ্যাপক ডাঃ ভাব্গনারের সঙ্গে সৌম্য আমায় পরিচয় করাইয়া দেয়। তিনি জার্মানীর এক মাসিকপত্রে আমার নক্সী-কাঁথার মাঠ পুস্তকের সমালোচনা করেন। সৌম্য সবাইকে গালাগাল দিত, সমালোচনা করিত, দেশের সাহিত্যিক ধর্মনেতা রাষ্ট্র নেতা কাহাকেও বাদ দিত না। কিন্তু এক জনের প্রতি তার মনের গভীর শ্রদ্ধা ছিল। তিনি হলেন বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ।

    রবীন্দ্রনাথের কবিতা, নাটক—এগুলির উপরে তার কথকতা শুনিতে প্রাণ জুড়াইয়া যাইত। রবীন্দ্রনাথেরও সৌম্যের প্রতি অপরিসীম শ্রদ্ধা এবং মমতা ছিল। সৌম্য সেবার ইউরোপে। আমি রবীন্দ্রনাথের সামনে বসিয়া আছি। হঠাৎ খবর আসিল, হিটলারকে হত্যা করিবার ষড়যন্ত্রে একজন বাঙালী যুবক ধরা পড়িয়াছে— সে সৌম্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর। রবীন্দ্রনাথ খবরটি শুনিয়া অনেকক্ষণ চুপ করিয়া রহিলেন। তারপর বলিলেন, সৌম্যের মধ্যে যে প্রদীপ্যমান বহ্নি দেখে এসেছি, তাতে সে যে এই ষড়মন্ত্রে লিপ্ত হবে সে বিষয়ে আশ্চর্য হবার কিছু নেই।” তিনি বহুক্ষণ সৌম্যের নানা গুণের প্রংশসা করিতে লাগিলেন।

    সৌম্য প্রায়ই অসুস্থ থাকিত। দুরারোগ্য তার যক্ষ্মারোগ তার দেহকে মাঝে মাঝে একেবারে নিস্তেজ করিয়া তুলিত, কিন্তু দেশের সর্বহারা জনগণের জন্য তার মনের দাবদাহন এতটুকুও ম্লান হইত না। তার মা-বোন-ভাই আত্মীয়স্বজন সকলেই বড় শঙ্কিত ছিলেন—কোন সময়ে সৌম্যকে পুলিশে ধরিয়া লইয়া গিয়া জেলে আটক করিয়া রাখে। জেলে গেলে এই অসুস্থ শরীর তার ভালমত যত্ন লইবার কেহ থাকিবে না, ভালমত চিকিৎসাও হইবে না।

    আগেই বলিয়াছি, অজিনেন্দ্রনাথ ঠাকুরের নিচের তলায় কয়টি ঘর ভাড়া লইয়া আমি এক সময়ে ঠাকুরবাড়িতে থাকিতাম। একদিন আমার ঘরে বসিয়া আছি, এমন সময় মোহনলাল আসিয়া আমাকে বলিল, অলক-মামার এক বন্ধু পুলিশের বড় অফিসার; অফিসার তাকে গোপনে বলিয়াছেন, জসীমউদ্দীন আমাদের মাইনে-করা লোক; সৌম্য ঠাকুরের বিষয়ে সবকিছু জানার জন্য আমরা তাকে নিয়োগ করেছি। এই খবর বাড়ির সবার মধ্যে একটা ত্রাসের সঞ্চার করেছে। সৌম্যের মা-বোন খুবই শঙ্কিত হয়ে পড়েছেন। অতএব তুমি এখানকার পাততাড়ি গুটাও।”

    শুনিয়া আমি যেন আকাশ হইতে পড়িয়া গেলাম। সৌম্যের মাবোন ছোট ভাগ্নেভাগ্নিরা আমাকে কতই স্নেহের চক্ষে দেখেন। এদের কাছে আমি কেমন করিয়া প্রমাণ করিব, আমি সি. আই. ডি. নই, পুলিশের কোন লোক নই। নিজেরই মনের জানার তাগিদে আমি সৌম্যের সঙ্গে মিতালী করিতে গিয়াছিলাম। এ বাড়ির সব কিছু আকাশ-বাতাস, মাটি-পাথর, সবাই যেন আমাকে আজ সন্দেহের চক্ষে দেখিতেছে। এ অপবাদ হইতে আমি নিজেকে কেমন করিয়া মুক্ত করিব?

    যবনিকার অন্তরালে মোহনলাল নিশ্চয়ই আমার হইয়া অনেক লড়াই করিয়াছে। সুতরাং তার সঙ্গে এ আলোচনা করা বৃথা। রান্নাঘরের হাঁড়িতে ভাতগুলি অর্ধসিদ্ধ হইয়া আসিয়াছিল; সেগুলি পাশের ড্রেনে ফেলিয়া দিলাম। একদল কাক আসিয়া একটা পথচারী কুকুরের সঙ্গে কামড়াকামড়ি লাগাইল। নিজের বই-পুস্তক বিছানা-বালিশ গুছাইতে গুছাইতে শরীর অবশ হইয়া আসিতে চায়। মোহনলাল বাড়ির খিড়কি-দরজায় একখানা রিক্সা ডাকিয়া আনিল। সে হয়ত বুঝিয়াছিল, আজ বাড়ির সদর-দরজা দিয়া চলিয়া যাওয়া আমার পক্ষে কতখানি অসহ্য হইবে।

    সমস্ত কিছু রিক্সার উপর উঠাইয়া দিয়া ক্ষণেকের জন্য সৌম্যের ঘরে বিদায় লইতে আসিলাম। সৌভাগ্যের কথা, সেখানে আর কেউ ছিল না। সৌম্য বলিল, “আমি সবই শুনেছি। পুলিশের লোকেরা অনেক সময় এই ভাবে মিথ্যে কথা রটিয়ে আমাদের মধ্যে বন্ধুবিচ্ছেদ করতে চায়। এটাও ওদের এক রকমের কৌশল। তবে বাড়ির লোকে এ বিষয়ে বড়ই উদ্বিগ্ন। তুমি আপাতত এখান হতে চলে যাও।”

    সৌম্যের আড্ডায় আমার যাওয়া বন্ধ হইল, কিন্তু অবনঠাকুরের দরজা আমার জন্য আগের মতই খোলা রহিল। কারণ সে বাড়িতে কোন রাজনীতি ছিল না।

     

    ইহার পরে আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক হইয়াঢাকা চলিয়া আসিলাম। ছুটির সময়ে কলিকাতা গিয়, অবনীন্দ্রনাথের সঙ্গে দেখা করিতাম। সেবার গিয়া দেখিলাম, তিনি একাকী বসিয়া আছেন।

    বহুদিন আগে তিনি রামায়ণের কাহিনীর উপর একখানা মাত্রাগানের বই লিখিয়াছিলেন। তাহারই পাণ্ডুলিপির উপর ঝুকিয়া পড়িয়া কি যেন হিজিবিজি লিখিতেছেন। আমাকে দেখিয়া বড়ই খুশী হইলেন। বলিলেন, “সামনের টুলটা টেনে নিয়ে বস।”

    টুলের উপর বসিয়। জিজ্ঞাসা করিলাম, “দাদামশাই, কেমন আছেন?”

    ম্লান হাসিয়া বলিলেন, “ভালই আছি। আগে ভাল ছিলাম না। আমার ছেলে মেম বিয়ে করে ফিরছে। কত আশা ছিল মনে! ওদের ছেলেমেয়ে হবে—আমার কাছে গল্প শুনবে, ছড়া শুনবে; আমার বৃদ্ধ বয়সের নির্জন দিনগুলোকে মুখর করে তুলবে। কিন্তু মেম সাহেবের ছেলেমেয়েরা ত আমাকে বুঝবে না। তাই মন বড় খারাপ ছিল। এখন ভেবে দেখলাম, আমি নিমিত্তমাত্র। আমার পেছনে একজন কর্তা আছেন। তার ইচ্ছেই পূর্ণ হবে।”

    ইহা বলিয়া একটা দীর্ঘনিশ্বাস লইলেন। এত দিন এভাবে তার সঙ্গে মিশিয়াছি। কোন দিনই তাকে আমার কাছে এমন ভাবে আত্মবিশ্লেষণ করিতে দেখি নাই। কথার মোেড় অন্যদিকে ফিরাইয়া জিজ্ঞাসা করিলাম, “দাদামশাই, এখন কি আঁকছেন?

    দাদামশাই বলিলেন, “বিশেষ কিছুই না। ছবি-আঁক। আসছে, কী করে সময় কাটাই? তোমরাও দূরে চলে গেছ। সেই পুরানো যাত্রাগানের পালাটি সামনে নিয়ে বসে আছি। এটা যে এমন কিছু হয়েছে, তা মনে করি না। কিন্তু সময় কাটাবার একটা অবলম্বন খুঁজে নিতে হয়।”

     

    এই বলিয়া তার যাত্রাগানের সংশোধনে মন দিলেন। সেই আগের লেখা পাণ্ডুলিপির পাতাগুলির ধারে ধারে ছোট ঘোট করিয়া অক্ষর বসাইয়া যাইতেছেন। এত ছোট অক্ষর যে পড়া যায় কি যায় না। পাতার দুই পাশে যেন কতকগুলি বর্ণমালার মৌচাক সাজাইয়া রাখিয়াছেন। সামনে বসিয়া ভাবিতে ভাবিতে আমার দুইটি নয়ন অশ্রুভারাক্রান্ত হইতে চাহিল।

    মহাভারতের রঙ-রেখার এই সার্থক উত্তরাধিকারীর শেষ জীবন কি নির্মম দুঃসহ একাকী হইয়া চলিয়াছে। রূপে, রঙে, রেখায় সারাজীবনের তপস্যা দিয়া যে মহামনীষী যুগযুগান্তরের ব্যথাতুরদের জন্য চিরকালের সান্ত্বনা রচনা করিয়াছেন, আজ জীবনের সায়াহ্নকালে তার জন্য কেহ এতটুকু সান্ত্বনা-বারি বহন করিয়া আনিছে না। আমাদের পৃথিবী এমনি অকৃতজ্ঞ।

    কিছুক্ষণ পরে তিনি তার খাতা হইতে মুখ তুলিয়া আমাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “শুনবে, কেমন হয়েছে আমার যাত্রা-গান?”

    আমি বলিলাম, “নিশ্চয়ই শুনব দাদামশাই।”

    খাতা খুলিয়া, যাত্রা-গানের অভিনেতাদের মত করিয়া পড়িয়া চলিলেন। মাঝে মাঝে জুড়ি ও কুশীলবগণের গান। তাহাও তিনি সুর করিয়া গাহিয়া শুনাইলেন। সারাটি বিকাল কাটিয়া গেল। সন্ধ্যার অন্ধকারে যখন আর অক্ষর চোখে পড়ে না, তখন যাত্রা-পাঠ বন্ধ হইল।

    তার নিকট বিদায় লইয়া বাসায় ফিরিলাম। তিনি একবারও আমাকে জিজ্ঞাসা করিলেন না, যাত্রা-গান আমার কেমন লাগিয়াছে। সত্য বলিতে কি—তিনি চাহিয়াছিলেন, আমারই মত একজন নীরব শ্রোতা। আমাকে শুনাইতে পারিয়াই তাঁর আনন। আমাকে শুনাইতে গিয়া তিনি যেন তাঁর অন্তরের অন্তঃস্থলের সৃষ্টির গোপন কোঠাটিকে বিস্তার করিয়া দেখিলেন। এমনি নীরব শ্রোতা সৃষ্টিকার্যে বই সহায়ক। আমার মতামতের জন্যে তার কি আসে যায়? বই সরাইয়া রাখিয়া ধীরে ধীরে তিনি অন্দরমহলের দিকে চলিলেন। তাঁর মুখে-চোখে যেন নূতন প্রশান্তি।

     

    ১৪.

    একদিন গিয়া দেখি, অবনীন্দ্রনাথ অনেকগুলি খবরের কাগজ লইয়া কাঁচি দিয়া অতি সাবধানে ছবিগুলি কাটিয়া লইতেছেন। কত রকমারি বিজ্ঞাপনের ছবি—সেগুলি কাটিয়া কাটিয়া যাত্রার পাণুলিপির এখানে ওখানে আঠা দিয়া আটকাইয়া লইতেছেন। যেন বয়স্ক-শিশুর ছেলেখেলা। ছবিগুলির কোনটার মাথা কাটিয়া অপরটার মাথা আনিয়া সেখানে জুড়িয়া দেওয়া হইয়াছে। ছবিগুলি তাতে এক অদ্ভুত রূপ পাইয়াছে। তিনি বলিলেন, “আমার যাত্রার বই ইলাসট্রেট করছি।”

    একবার খবরের কাগজের বিজ্ঞাপন পড়ায় তিনি মন দিলেন। কাগজে প্রতিদিন কত রোমাঞ্চকর ঘটনা প্রকাশিত হয়, দেশের রাজনৈতিক রঙ্গমঞ্চে কত উত্তেজনাপূর্ণ কাহিনী লিপিবদ্ধ হয়, তিনি সেদিকে ফিরিয়াও তাকান না। খবরের কাগজ হইতে তিনি খুঁজিয়া খুঁজিয়া বাহির করেন, বুড়া লুকাইয়া হিমানী মাখিতেছেন। আমার যতদূর মনে পড়ে, এই ছবিটি তিনি তাঁর রামায়ণ-খাতার এক জায়গায় আঠা দিয়া আটকাইয়া রাখিয়াছিলেন। অতি-আধুনিক কবিদের মধ্যে কেহ কেহ খবরের কাগজের এখান হইতে ওখান হইতে ইচ্ছামত কয়েকটি লাইন একত্র সমাবেশ করিয়া কোন নূতন রকমের ভাব প্রকাশ হয় কি না তার পরীক্ষা করেন। তেমনি তিনিও এই ভাবে খবরের কাগজের বিজ্ঞাপনের ছবিগুলি লইয়া কোন একটা বিশেষ সৃষ্টিকার্যে প্রবৃত্ত হইয়াছিলেন কি না বলিতে পারি না। তার যাত্রা-গানের খাতাখানা আবার দেখিতে পাইলে সে বিষয়ে বিশদ করিয়া বলিতে পারিতাম।

    একদিন গিয়া দেখি, রাশি রাশি খবরের কাগজ-আনন্দবাজার, যুগান্তর ইত্যাদি লইয়া তিনি মসগুল হইয়া পড়িতেছেন। আমাকে দেখিয়া সহাস্যে ডাকিয়া বলিলেন, “ওহে জসীমিঞা, দেখ, দেখ, কেমন সুন্দর বিজ্ঞাপন বাহির হইয়াছে : সুন্দরী কন্যা, গৌরবর্ণ, এম. এ. পড়ে। তার জন্য পাত্র চাই। আর একটা দেখ : মেয়ের বর্ণ উজ্জ্বলশ্যাম; পিতা ধনী ব্যক্তি; ভাল পাত্র পাইলে বিলাত যাওয়ার খরচ দেওয়া হইবে।-কেমন, বিয়ে করবে?”

    এমনি খবরের কাগজ লইয়া তিনি খেলা করিতেন। তাঁকে কোনদিনও গুরুগম্ভীর হইতে দেখি নাই। তিনি যে ছবি আঁকিতেন, তাতেও যেন খেলা করিতেন। কখনো কখনো নিজের বাগান হইতে একটুখানি মাটি আনিয়া কিংবা একটি গাছের পাতা আনিয়া ছবির এক জায়গায় ঘলিয়া দিতেন খুব অস্পষ্ট করিয়া, একেবারেই চোখে মালুম হয় না। এমনি করিয়া ছবির উপরে সারাটি সকাল ধরিয়া রঙ ঘসিয়া দুপুরবেলা তাহা পানির মধ্যে ডুবাইয়া লইতেন। সমস্ত – ফ্যাকাশে হইয়া যাইত। ছবিখানা শুকাইলে তাহার উপর আবার নতুন করিয়া রঙ পরাইতেন। অতি সূক্ষ্মভাবে ছবিতে রঙ লাগাইতে তার বড় আনন্দ। কাছের আকাশে দু-একটি রেখায় পাখি উড়াইয়া, আকাশটিকে দূরে সরাইয়া দিতেন। দূরের গ্রামখানায় দু-একটি গাছ আঁকিয়া তাকে নিকটের করিয়া লইতেন। রঙের যাদুকর রঙের আর রেখার কৌশলে যা-কিছু নিকটের ও দূরের সমস্ত চোখের চাউনির জগতে টানিয়া আনিতেন।

    ঠাকুরবাড়ির সুপরিসর বারান্দার উপর বসিয়া রঙ লইয়া এই বয়স্ক-শিশুরা অপরূপ খেলা খেলিতেন। যে বিরাট জমিদারীর আয় হইতে ঠাকুরবাড়ির এই মহীরূহ বর্ধিত হইয়াছিল, ধীরে ধীরে তাহার পত্বপুষ্প খসিয়া পড়িতেছিল। অপরিসীম দানে ও জমিদারীকার্য তদারকের অক্ষমতায় সেই মহাতরু মাটির যে গভীরতা হইতে রস সংগ্রহ করিত, তাহা ধীরে ধীরে শুখাইয়া আসিল। অবনীন্দ্রনাথ ও গগনেন্দ্রনাথের শৈশব-যৌবন বার্ধক্যের লীলা-নিকেতন ঠাকুরবাড়ি নিলামে বিক্রী হইয়া ধনী মাড়োয়ারীর হস্তগত হইল। যাহারা মানুষের জীবনে রূপ দিয়াছিলেন, কথাকাহিনীর সরিৎসাগর খনন করিয়া দেশের জনগণকে পুণ্যস্নান করাইয়াছিলেন, আজ কেহই আসিয়া তাহাদের পিছনে দাঁড়াইল না। কত দরিদ্র সাহিত্যিক, অখ্যাত শিল্পী, প্রত্যাখ্যাত গুণী ভঁহাদের দুয়ারে আসিয়া ধনধান্যে পরিপূর্ণ হইত। দিতে দিতে তারা সর্বস্ব দিয়া প্রায় পথের ভিখারী হইলেন। যাদের কীর্তিকাহিনী সাগর পার হইয়া রাষ্ট্রে রাষ্ট্রে দেশের নামে জয়ডঙ্কা বাজাইয়া আসিত, তাদেরই দানে দেশ আজ বড় হইয়া তাদের দিকে ফিরিয়া ও তাকাইল না। রাজপুত্রের পথের ভিখারী হইলেন। বিরাট ঠাকুর-পরিবার শতধা বিচ্ছিন্ন হইয়া কলিকাতার অজ্ঞাত অখ্যাত অলিতে গলিতে ছড়াইয়া পড়িল।

    বরানগরের এক বাগানবাড়িতে অবনীন্দ্রনাথ উঠিয়া আসিলেন। তার আগেই আমি কলিকাতা ছাড়িয়া ঢাকা চলিয়া আসিয়াছি।

     

    সেবার কলিকাতা গিয়া বরানগরের বাড়িতে তার সঙ্গে দেখা করিলাম। কোন নূতন লেখা পড়িয়া শুনাইলে তিনি খুশী হইতেন। সেইজন্য আমার ‘বেদের মেয়ে নাটকের পাণ্ডুলিপি সঙ্গে লইয়া গিয়াছিলাম। তিনি তখন দুরারোগ্য শ্বাসরোগে কষ্ট পাইতেছিলেন।

    বারান্দায় বসিয়াছিলেন। জোড়াসাঁকোর সেই দক্ষিণের বারান্দা আজ আর নাই। বলিলাম, “কথা বলতে আপনার কষ্ট হবে। আমার ‘বেদের মেয়ে নামক নাটকের পাণ্ডুলিপি এনেছি, যদি অনুমতি করেন, পড়ে শুনাই।”

    তিনি বিশেষ কোন উৎসুক্য দেখাইলেন না। সস্নেহে হাতখানি ধরিয়া বলিলেন, “বস।”

    সামনে গিয়া বসিলাম। দুই চোখ পানিতে ভরিয়া উঠিতে চাহিতেছিল। সেই রূপকথা বলার কহকুণ্ডপাখি বাহীন। ছবির পরে ছবি মনে ভাসিয়া উঠিতেছিল। সেই প্রথম পরিচয়ের দিন হইতে যতগুলি দিন এই মহান সৃষ্টিকারের সঙ্গে কাটাইয়াছি, কত হাসি, কত কাহিনী।—সব আজ চিরজনমের মত ফুরাইয়া যাইতেছে।

    তিনি বলিলেন, “রাতে ঘুমোতে পারিনে। বড় কষ্ট পাচ্ছি।”

    আমি বলিলাম, “শুনেছি, আমেরিকায় কি রকমের যন্ত্র আছে। গলায় লাগালে শ্বাসকষ্টের অনেক লাঘব হয়।”

    বলিলেন, “কে এনে দেবে সেই যন্ত্র?”

    ভাবিয়া দুঃখ হইল, দেশে বিদেশে তার এত গুণগ্রাহী, এত আত্মীয়স্বজন—তাকে রোগযন্ত্রণা হইতে মুক্তি দিতে কাহারো কী মনে আকাঙ্ক্ষা জাগে না? হয়ত তাদের বুদ্ধিবিবেচনা অনুসারে তারাও রোগযন্ত্রণা-লাঘবের জন্য অনেক কিছু করিয়াছেন। আমারই ভাবিবার ভুল। আমার ভুল যেন সত্য হয়।

    বলিলাম, “দাদামশায়, আপনাকে আমি যেমন দেখেছি, সমস্ত আমি বড় করে লিখব।”

    এত যে শরীর খারাপ, তখনও সেই চিরকালের রসিকতা করিয়া কথা বলার অভ্যাস তিনি ভোলেন নাই। একটু হাসিয়া বলিলেন, “তোমার যা খুশী লিখে দিও। লিখে দিও, অবনঠাকুরকে আমি ছবি আঁকা শিখিয়েছি। কাগজে বের করে দাও। আমি বলব, সব সত্যি।”

    এতগুলি কথা একসঙ্গে বলিয়া তিনি হাঁপাইতে লাগিলেন। দেখিলাম, নির্জন বরানগরে তিনি আরও একাকী। সঙ্গ দেবার কেহ নাই। মোহনলাল চলিয়া যায় অফিসে। ছেলে অলকবাবু ব্যবসায়ে কিছু উপার্জন করিতে এখানে-ওখানে ছুটিয়া বেড়ান। ছোট দুইটি নাতি-বাদশা বীরু, তারা থাকে শান্তিনিকেতনে। স্ত্রী বহুদিন গত হইয়াছেন। পুত্রবধূকে সাংসারিক নানা কাজে ব্যস্ত থাকিতে হয়। শ্বশুরকে দেখিবার শুনিবার কতটুকুই বা অবসর পান তিনি। নির্জন বরানগরের বাড়িতে একাকী শিল্পকার দারুণ ব্যাধির সঙ্গে যুদ্ধ করিতেন। ব্যাধির যন্ত্রণা হইতে তাকে কেহ মুক্ত করিতে পারিবে না—কিন্তু এই দুঃসময়ে কেহ যদি নিকটে থাকিয়ার যন্ত্রণায় সমব্যথী হইয়া কাছে কাছে থাকিত, তবে রোগযন্ত্রণা সহ্য করা তাঁর পক্ষে রাখার মত কতই সহজ হইত।

    দুই হাতে পায়ের ধূলি লইয়া সালাম করিয়া বিদায় লইলাম। আমার হাত দুইটি শিথিল হাতে টানিয়া লইয়া বলিলেন, “মনে রেখো। তোমাদের কালে আমরা থাকব না। অনেক কিছু মনে পাবে। সেই সঙ্গে আমাকেও মনে রেখো।”

    বলিলাম, “আমি একা কেন মনে রাখব দাদামশাই, আমার দেশের শত শত লোক আপনাকে মনে রাখবে।”

    তিনি আমার কথার কোন উত্তর দিলেন না। রোগ-যন্ত্রণায় হাঁপাইতে লাগাইলেন। নীরবে অনেকক্ষণ পঁড়াইয়া রহিলাম। বহুকষ্টে নিজের দুই চোখের অশ্রুধারাকে সংযত করিতেছিলাম। মনে মনে কেবলই প্রার্থনার ধ্বনি জাগিতেছিল—হে অস্তাচল-পথযাত্রীতোমাকে জানাই আমার শেষ সালাম। তোমার তুলির রেখায় ও রঙে নতুন করিয়া জীবন পাইয়াছিল মহাভারতের সেই বিস্মৃতপ্রায় মহামহিমা। ইলোরা-অজন্তার প্রস্তর-গাত্রে পুরীর মন্দির-চত্বরে কাহিনী যুগ-যুগান্তর ঘুমাইয়াছিল, তুমি তাহাকে নূতন করিয়া আবার তোমার দেশবাসীর উপভোগের সামগ্রী করিলে। যদি দেশে সত্যকার একজনও দেশপ্রেমিক জন্ম গ্রহণ করে, তোমার কাহিনী সে অমর অক্ষরে লিখিয়া রাখিবে। অমনি স্নেহ-মমতা আর রঙের রেখার মাধুরী বিস্তার করিয়া তুমি অপেক্ষা করিও সেই চির-অজানা তুহিন রহস্যময় দেশে। আমরাও একদিন গিয়া তোমার সঙ্গে মিলিত হইব।

    বহুক্ষণ নীরবে দাঁড়াইয়া থাকিয়া চলিয়া আসিলাম। আসিবার সময় ফিরিয়া ফিরিয়া সেই স্নেহময় মুর্তিখানি দেখিলাম। সেই দেখাই যে শেষ দেখা হইবে, তাহা সেদিন বুঝিতে পারি নাই। আজ তাঁহার কথা ভাবিতে কেবলই মনে হইতেছে, দূরে বহুদূরে কোন করুণ গোধূলি-আলোকের তলে এক পথশ্রান্ত উট পিঠের বোঝার ভারে শ্রান্ত হইয়া পড়িয়া আছে বালুকার উপরে। দূরের আকাশ কান্নায় করুণ হইয়া আছে ওপারের রঙিন ম্লান রশ্মির উপর। তাঁর নিজের হাতে আঁকা সেই ‘বোঝা’ ছবিটির মতন তিনিও বুঝি সেখানে লুটাইয়া পড়িয়াছেন।

     

    ১৫.

    আমি ঢাকা চলিয়া আসিলাম দেশ-বিভাগের পরে। অবনীন্দ্রনাথের জমিদারী সংক্রান্ত বহু কাজ আমাদের পূর্ব-পাকিস্তান সেক্রেটারিয়েট-ভবনের সঙ্গে জড়িত ছিল। অবনবাবু বড় ছেলে অলকবাবু আমাকে সেই বিষয়ে খবরাখবর লইতে প্রায়ই পত্র লিখিতেন। আমিও তাহার ত্বরিৎ জবাব দিতাম।

    একদিন সকালে বাড়ি হইতে বাহির হইয়া প্রায় তিনটার সময়ে ফিরিয়া আসিয়াছি। দেখি, গবদা আমার বৈঠকখানায় বসিয়া আছেন। আমার স্ত্রী পরিচয় পাইয়া আগেই তাহাকে কিছু নাস্তা পাঠাইয়া দিয়াছিলেন। শুনিলাম, গবাদা ঢাকা আসিয়াছেন রাত একটায়। সারারাত্রি স্টেশনে কাটাইয়া সকালে আমার খোঁজে বাহির হইয়াছেন। স্বাধীনতার পর ঢাকায় কত নতুন নতুন সোক আসিয়াছে। কে কাহার সন্ধান রাখে! প্রায় সারাদিন ঘুরিয়া তিনি আমার বাসার খোঁজ পাইয়াছেন। এত বেলা পর্যন্ত এক কাপ চা-ও অন্য কোথাও পান করেন নাই। শুনিয়া আমার দুইচোখে পানি বাহির হইবার উপক্রম হইল। সেই ব্বতীন্দ্রনাথ ঠাকুর—আহারবিহারে কত বিলাসের মধ্যে মানুষ! রাত্রি একটার সময় হইতে পরদিন বেলা তিনটা পর্যন্ত অভুক্ত অনিদ্রায় ঘুরিয়া আমার বাসা খুঁজিয়াছেন। ঢাকায় কত হোটেল, ভাল ভাল থাকিবার জায়গা। তাহা সত্ত্বেও কতখানি অসুবিধা থাকিলে ঠাকুর পরিবারের ছেলে ঘুরিয়া ঘুরিয়া আমার বাসার সন্ধান করেন। ভাবিয়া নিজের উপরে ধিক্কার আসিল। কেন এমন হইল! দেশে আজ এমন কেহ নাই যে এই পরিবারের বিরাট দানের এতটুকুও আজ পরিশোধ করিতে পারে।

    আমার স্ত্রীকে গিয়া বলিলাম, “দেখ, রাজপুত্র আজ আমাদের অতিথি। তোমার যতটুকু আদর-আপ্যায়নের ক্ষমতা আর রন্ধনবিদ্যা আছে, জাহির কর।”

    দুই বন্ধুতে মিলিয়া ঘণ্টার পর ঘণ্টা আলাপ,—আমাদের বিগত জীবনের নানা ঘটনার পুনরাবৃত্তি। স্নেহময় অবনঠাকুর আজ পরলোকগত। তাঁর জীবনের ঘটনাগুলিকে অতীতের গহন অন্ধকার হইতে টানিয়া আনিয়া দুই বন্ধু সামনে মেলিয়া ধরিলাম। বায়স্কোপের চিত্রগুলির মত তারা একে অপরের হাত ধরাধরি করিয়া উপস্থিত হয়। সকাল কাটে, সন্ধ্যা কাটে। রাতও বুঝি ভোর হইবার জন্য ঢুলুঢুলু আঁখি। কিন্তু আমাদের বিরাম নাই। দুপুরে রেভেনিউ-বিভাগের সম্পাদক ফজলুল করিম সাহেবের সঙ্গে গবাদার বিষয় সংক্রান্ত আলাপ হইল। তিনি অতিশয় অমায়িক ব্যক্তি। গবাদার যা-কিছু কাজ তিনি করিয়া দিতে অঙ্গীকার করিলেন।

    দুই-তিন দিন গবাদা আমাদের এখানে ছিলেন। যে মানুষটি সব সময় পরের কাজ করিয়া বেড়াইতেন, আজ তিনি নিজের জন্য কাজ খুঁজিয়া বেড়াইতেছেন। বোম্বেতে সিনেমা-লাইনে কিছুদিন কাজ করিয়াছিলেন। তারপর দেশে ফিরিয়া একেবারে বেকার। বন্ধুকে পরামর্শ দিই, “আপনি এখানে চলে আসুন। নতুন করে এখানে নাটক সৃষ্টি করি—আর্ট সৃষ্টি করি।”

    গবাদা রাজী হইয়া যান। তার পর চলে দুই জনে নানা পরিকল্পনা।

    জানি যে, রাত্রি ভোর হইলে এই পাখি তার ক্ষণিকের নীড় ছাড়িয়া সুদূর আকাশে পাড়ি দিবে। তবু যারা কল্পনাবিলাসী, তাদের রাত্রি কল্পনার পাখা বিস্তার করিয়াই ভোর হয়। কয়েকদিন থাকিয়া গবাদা চলিয়া গেলেন। তাঁকে গাড়ীতে উঠাইয়া দিয়া আমার-লেখা “যাদের দেখেছি” বইখানা পথে পড়িবার জন্য উপহার দিলাম। এই পুস্তকে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে আমার পরিচয়ের কাহিনী লেখা আছে। তাতে অবনঠাকুরের বাড়ির অনেকের কথা আছে।

    বঙ্গ-সংস্কৃতি সম্মেলনে নিমন্ত্রণ পাইয়া সেবার কলিকাত গেলাম। গিয়া উঠিলাম সুজনেন্দ্রনাথ ঠাকুরের বাড়িতে। সুজন সমরেন্দ্রনাথ ঠাকুরের নাতি। অবনঠাকুরের বাড়ি নিলামে বিক্রী হওয়ার পরে তাঁরা সৌম্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের বাড়ির নিচের তলায় দুইখানা ঘর লইয়া কোন রকমে বসবাস করিতেছেন। সেই অল্প-পরিসর জায়গায় তাঁদেরই স্থান-সঙ্কুলান হয় না। কিন্তু তবু কতই না আদর করিয়া তাঁহারা আমাকে গ্রহণ করিলেন।

    আজ ঠাকুরবাড়ির সেই ইন্দ্রপুরী শ্মশানে পরিণত হইয়াছে। সে লোক নাই; সে জাঁকজমক নাই। বাড়িখানি ভাঙিয়া চুরিয়া রবীন্দ্রভারতীর জন্য নতুন নক্সায় ইমারৎ তৈরী হইয়াছে। সেই গাড়ীবারান্দা, সেই হল-ঘরগুলি, সেই উপরে সিঁড়ি, সেই দক্ষিণদুয়ারী বারান্দা—যেখানে বসিয়া দাদামশাই ও তাঁর দাদা গগনেন্দ্রনাথ শিল্পসাধনা কবিতেন, নির্মম বর্তমান তার কোন চিহ্ন রাখে নাই। শুনিয়াছি শেক্সপীয়ারের অতি-পুরাতন বাড়িখানি যেমনটি ছিল, তেমনি করিয়া সংরক্ষিত হইয়াছে। আজ অবনীন্দ্রনাথ-গগনেন্দ্রনাথের বাড়িটি কি সেই ভাবে রক্ষিত করা যাইত না? দেশের জন্য বক্তৃতা করিয়া যাহারা গোলদীঘি-লালদীঘিতে আলোড়ন তুলিতেন, দেশের লোকের কৃতজ্ঞতা কি শুধু তাদেরই জন্য? মহাভারতের মর্মকথা শুনাইবার জন্য যাহাদিগকে অামরা শ্রেষ্ঠ আসন দিই, তারা কি কারো চাইতে কম ছিলেন?

    দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, বৎসরের পর বৎসর, যাঁরা সর্বভারতের ভূত, ভবিষ্যৎ বর্তমান ঢুড়িয়া দেশবাসীর জন্য গৌরবের ইন্দ্রসভা রচনা করিয়াছেন, যাদের তুলির স্পর্শে জনগণ মহান দেশকে অনুভব করিতে শিখিয়াছে, তাদের প্রতি কি কারো কৃতজ্ঞতা নাই।

    সুজন কিছুই উপার্জন করে না। সে বিনা বেতনে কোথায় কোথায় রবীন্দ্রসঙ্গীত শিখাইয়া সময় কাটায়। ছোট ভাই কোন অফিসে সামান্য কিছু উপার্জন করে, তাই দিয়া অতি কষ্টে তাদের দিন চলে। সমর ঠাকুরের আদরের পুত্রবধু সুজনের মা পরিবারের কত বিলাস-উপকরণের মধ্যে লালিত-পলিত। আজ পরনে তাঁর শতছিন্ন বস্ত্র। ঘরের আসবাবপত্রের দৈন্য যেন আমাকে শত বৃশ্চিকদহনে দগ্ধ করিতেছিল।

    উপরে থাকেন সৌম্যের মা। কত আদর করিয়া চা খাইতে ডাকিলেন। চা খাইতে খাইতে কথা বলি। নানা কথার অবতারণা করিতে অতীত আসিয়া পড়ে। অতীত কথা আসিতে শোকের কথা আসিয়া পড়ে। ঐ শোক-সন্তপ্ত পরিবারে নিজের অজ্ঞাতে তাদের সঞ্চিত দুঃখকে আরও বাড়াইয়া দিয়া আসি।

    নীচে সুজনের মা–উপরে সৌম্যের মা—এ-বাড়ির বধূ ও-বাড়ির বধুতে কথা কওয়া-কওয়ি হয়, একের কাহিনী অপরের কাছে বলিয়া জ্বালাইয়া রাখে সেই অতীত যুগের কথা সরিৎসাগরের কাহিনী।

    প্রদীপ নিবিয়া গিয়াছে, মহানাটকের চরিত্রগুলি আজ একে একে বিদায় লইতেছেন। এ কাহিনী আর দীর্ঘ করিব না। যে নিয়োগব্যথা আমার অন্তরের অন্তস্তলে মোহময় কান্নার বাঁশী বাজাইয়া সেই অতীত কাল হইতে ছবির পর ছবি আনিয়া আমার মানসপটে দাড় করায়, তাহা আমারই নিজস্ব হইয়া থাকুক। লোকালয়ে টানিয়া আনিয়া আর তাহা স্নান করিব না।

    1 2 3
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleবোবা কাহিনী – জসীম উদ্দীন
    Next Article হাসু – জসীম উদ্দীন

    Related Articles

    জসীম উদ্দীন

    এক পয়সার বাঁশী – জসীম উদ্দীন

    August 12, 2025
    জসীম উদ্দীন

    জলের লেখন – জসীম উদ্দীন

    August 12, 2025
    জসীম উদ্দীন

    ধান ক্ষেত – জসীম উদ্দীন

    August 12, 2025
    জসীম উদ্দীন

    নকশী কাঁথার মাঠ – জসীম উদ্দীন

    August 12, 2025
    জসীম উদ্দীন

    ভয়াবহ সেই দিনগুলিতে – জসীম উদ্দীন

    August 12, 2025
    জসীম উদ্দীন

    রঙিলা নায়ের মাঝি – জসীম উদ্দীন

    August 11, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    ইলিয়াড – হোমার

    October 13, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    ইলিয়াড – হোমার

    October 13, 2025
    Our Picks

    ইলিয়াড – হোমার

    October 13, 2025

    ওডিসি – হোমার

    October 13, 2025

    প্রেমের প্রান্তে পরাশর – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    October 13, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    • Sign Up
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }