গৌরী
কে যেন জ্যোৎস্নার চাদর বিছিয়ে রেখেছিল ঘুমিয়ে থাকা গ্রামটির ওপর৷ একটু দূরে নগাধিরাজ হিমালয়ের সর্বোচ্চ শৃঙ্গ সাগরমাতা, তার পাশে লোৎসে৷ ওদিকে মাকালু৷ উদ্ধত গম্ভীর পাহাড়চূড়াদের গা বেয়ে নেমে আসছিল রুপোরঙা আলোর স্রোত৷ শরতের কালচে নীল আকাশের আঁচল জুড়ে ফুটে উঠেছে তারাদের সলমা জরি৷ বাতাসে হেমন্তের উদাসী শৈত্য৷
নেপালের এই দিকটা কাঠমান্ডু থেকে অনেক দূরে৷ আরও উত্তরে, হিমালয়ের কোল ঘেঁষে৷ শীতে সেখানে তাপমাত্রা শূন্যের নীচে নেমে যায়৷ চারিদিকে পাহাড় আর পাহাড়ের কোলে শুয়ে থাকা উপত্যকা জুড়ে পাইন, ফার, পপলার আর রডোডেনড্রনের বন৷ মাতাল হাওয়ার শিশুরা লুটোপুটি খায় তাদের শরীর জুড়ে৷
এসব অঞ্চলে রাত আটটা মানে মাঝরাত৷ লোকে অনেক ভোর থাকতে ওঠে, আর সন্ধে হওয়ার মুখে রাতের খাবার খেয়ে শুয়ে পড়ে৷ অবশ্য যদি খাবার জোটে, তবেই৷ পুরো গ্রামটার গায়েই দারিদ্রআর মালিন্যের ছাপ৷
গ্রামের একদম শেষে একটা একতলা বাড়ি৷ বাড়িটা কাঠের তৈরি৷ এদিককার সব বাড়িই তাই৷ গ্রামের বুক চিরে যে রাস্তাটা এভারেস্ট বেস ক্যাম্পের দিকে চলে গেছে, তার পাশেই এই ছোট্ট বাড়িটা৷ সামনে দাঁড়ালে চোখে পড়ে বাড়ির পেছনে পাহাড়ের খাদ, আর তার ওপারে সাগরমাতার সগর্ব, সুগম্ভীর উপস্থিতি৷
বাড়িটার আধখোলা জানলা থেকে অল্প আলো বেরিয়ে এসে কুয়াশায় মায়াবিভ্রম সৃষ্টি করেছে৷ বোঝা যাচ্ছে যে এদের রাতের খাওয়ার পালা এখনও শেষ হয়নি৷ খুব নীচু গলায় কথাবার্তা চলছে৷ কে যেন একবার খিলখিল করে হেসে উঠল৷ খুব মজার কথা হচ্ছে নিশ্চয়ই৷
একটুপর একটি বাচ্চা মেয়ে বেরিয়ে এলো৷ দেখে মনে হয় বয়েস সাত-আট বছরের বেশি নয়৷ মেয়েটির হাতের থালায় এঁটোকাঁটার স্তূপ৷ দরজার কাছে একটা কুকুর শুয়েছিল৷ বোধহয় এরই প্রতীক্ষায়৷ মেয়েটিকে দেখে উঠে দাঁড়াল কুকুরটা, একবার আড়মোড়া ভাঙল, তারপর লেজ নাড়তে নাড়তে এগিয়ে এল মেয়েটির দিকে৷
মেয়েটি থালাটা ওর মুখের সামনে ধরে দিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়াল৷ চারিদিকে সব শুনশান৷ একটা বাড়িতেও আলো জ্বলছে না, ওদের বাড়িটা ছাড়া৷ একটা বোবা নিস্তব্ধতা ঘিরে আছে গোটা গ্রাম৷ শুধু পাহাড়ি হিমেল হাওয়ার স্রোত পাক খেয়ে যাচ্ছে পাহাড়ের বুক জুড়ে৷
রাত হয়ে গেল, বাবা এখনও ফিরল না৷ অথচ এত দেরি তো করে না বাবা৷ এবার বাবার সঙ্গে যে লোকগুলো এসেছে ইন্ডিয়া থেকে, ওরাই যত নষ্টের গোড়া৷ লোকদুটো লিম্বুকাকার বাড়িতে উঠেছে৷ সারাদিন কী করে কে জানে৷ বাবা সন্ধে হলেই ওখানে চলে যায়, আর ফেরে মাঝরাত পেরিয়ে, টলতে টলতে৷ একদম ভালো লাগে না ওর, একদম না৷ বছরে এই এক-দুবারই তো আসে বাবা৷ সারাদিন থাকতে পারে না ওদের সঙ্গে?
একটু পরেই একটা ছোট ট্রাক চলে যায় কাঠমান্ডু থেকে পাহাড়ের দিকে৷ নিশ্চয়ই কোনও পর্বতারোহীদের নিয়ে বেসক্যাম্পে যাচ্ছে৷ এইসব ট্রাক হামেশাই যায় এই রাস্তা ধরে৷ গাড়িটার হেডলাইটের আলোয় চোখ ধাঁধিয়ে যায় মেয়েটির৷
ট্রাকটা চলে যাওয়ার পর মেয়েটি দেখল ওর ঠিক উল্টোদিকে রাস্তার ওপারে দুজন দাঁড়িয়ে৷ গায়ে লামাদের মতো পোশাক, কিন্তু নাক মুখ সব ঢাকা৷ শুধু চোখের জায়গাটা খোলা৷ আর মেয়েটির মনে হয় লোকদুটো যেন ওর দিকেই চেয়ে আছে৷
ভয় লাগে মেয়েটির৷ তাড়াতাড়ি দরজা বন্ধ করে সে৷ মা’কে কি বলবে এই কথাটা? না থাক৷ ওর একটা ভাই হতে চলেছে৷ মা’র এখন ভয় পাওয়া বারণ৷ বাঙালিদাদু বলে গেছেন৷
বাঙালিদাদু কবে আসবে আবার?
* * *
জঙ্গলের মধ্যে একটা কাঠের তৈরি এই দোতলা বাড়িটা কে কবে কেন বানিয়েছিল কেউ জানে না৷ তবে দেখলেই বোঝা যায় যে বাড়িটার বয়েস অনেক৷ অবস্থা সঙ্গিন, সর্বাঙ্গে মস আর শ্যাওলার প্রলেপ৷ চিমনির চুড়ো ভেঙে পড়েছে৷ থাম, দরজা, জানালা, সব কিছু বেয়ে গজিয়ে উঠেছে আগাছা আর ফার্নের ঝোপ৷
তবে খুব খুঁটিয়ে দেখলে বোঝা যায় সদ্য কিছু সারাই করা হয়েছে৷ যেমন নতুন দরজা, জানালায় নতুন কাচ৷ বারান্দায় ওঠবার সিঁড়িটাও নতুন৷ বাড়ির চৌহদ্দির চারিদিকের বেড়া ভেঙে পড়ে গেছিল৷ সেটাকেও সারাই করা হয়েছে৷
আজ প্রবল ঝড় উঠেছে৷ দার্জিলিংয়ের এই পাহাড়ি এলাকায় এমন সময়ে ঝড় ওঠা খুবই অস্বাভাবিক৷ সারা শহর তাই দরজা জানালা বন্ধ করে ঝড় থামার অপেক্ষায় আছে৷ পাগল হাওয়ায় ক্ষেপে উঠেছে এই জঙ্গলের আদিম মহাদ্রুমের দল৷
বাড়িটায় ঢুকেই একটা মস্তবড় হলঘর৷ এককালে নিশ্চয়ই সেখানে বলনাচের আসর বসত৷ কোনায় একটা অকেজো ভাঙা পিয়ানো তার সাক্ষ্য দিচ্ছে৷ মাথায় একটা ঝাড়বাতি ঝোলানোর আংটা৷ ঝাড়বাতি কে কবে খুলে নিয়ে গেছে কে জানে৷ ঘরের চারিদিকে প্রাচীন কিছু আসবাবপত্র৷ ঘুণ ধরে সবই জীর্ণ, ভগ্নপ্রায়, ঝুলের চাদরে ঢাকা৷ ঘরের কোনায় কোনায় কয়েকটা বাদুড় ঝুলে আছে৷ যেন প্রতীক্ষায় আছে এই উথালপাথাল প্রলয় শেষ হওয়ার৷ তার পরেই তারা ডানা মেলে উড়ে যাবে খাদ্যের সন্ধানে৷
হলঘরের মাঝখানটা সমস্ত আসবাবপত্র সরিয়ে ফাঁকা করা হয়েছে৷ মেঝের ওপর তেল আর সিঁদুর দিয়ে একটা বড় পঞ্চমুখী তারা আঁকা৷ তার মধ্যে দুটি চোখ৷ চোখ দুটির নীচে এবং তারার প্রতিটি শীর্ষবিন্দুতে একটি করে অক্ষর লেখা৷ আর প্রতিটি তারার মাথার দিকে একটি করে প্রদীপ৷ প্রদীপের তেলে একটি করে রক্তজবা৷
পঞ্চমুখী তারার মাথার দিকে একজন প্রৌঢ় পুরুষ বসে৷ বাকি চার তারার মাথায় দুইজন নারী এবং দুইজন পুরুষ বসে আছে৷ নারী দু’জনকে দেখে বোঝা যায় না তাদের বয়স কত৷ তাদের উচ্চতা অল্প, গায়ের রং গৌর, নাক চাপা, আর সরু চোখ দুটি অল্প বোজা৷ দু’জন পুরুষই অত্যন্ত বলশালী৷ তাদের চুল ছোট করে ছাঁটা৷ চোখগুলি অভিব্যক্তিহীন৷ এই চারজনের পরনে স্থানীয় পোশাক, প্রৌঢ় মানুষটির পরনে গেরুয়া৷ বোঝা যায় ইনিই এদের প্রধান৷
পাঁচজনেই বসে আছেন বজ্রাসনে৷ প্রত্যেকের কোলের কাছে মেঝেতে একটি করে করোটি রাখা, আর তার পাশে একটি হাড়ের টুকরো৷ প্রত্যেকের হাত একটি বিশেষ মুদ্রায় বদ্ধ৷
একটু পর প্রৌঢ় মানুষটি গম্ভীর গলায় বলে উঠলেন, ‘ওঁ হূং বজ্রচর্চিকায় স্বাহা৷’
বাকিরা প্রতিধ্বনি করলেন৷
এরপর প্রৌঢ় গম্ভীরস্বরে মন্ত্র আবৃত্তি করতে থাকলেন৷ তার ভাষাও অজানা, সুরও কেমন যেন ভয় ধরায় বুকের মধ্যে৷ বাকিরাও যোগ দিলেন৷ কারও সুরে বিন্দুমাত্র চ্যুতি হল না৷ সমান স্বরে, সমাল লয়ে, সমান তালে গাওয়া সেই সেই অজানা, অবশ করা সুর ভেসে বেড়াতে লাগলো ঘরটার মধ্যে৷
এদিকে ঝড়ের প্রকোপ আরও বেড়ে উঠেছে৷ বাতাসের ধাক্কায় কেঁপে কেঁপে উঠছে বাড়িটার বন্ধ শার্সিগুলো৷ মনে হচ্ছে হাওয়ায় যেন মাতন লেগেছে৷ ক্রুদ্ধ মহাসর্পের দল লন্ডভন্ড করে দিচ্ছে চারিদিক৷
খানিক পর সমবেত মন্ত্রোচ্চারণ শেষ হল৷ প্রৌঢ় লোকটি প্রসন্নস্বরে বললেন,
‘আজকের মহাসুখচক্র সুসম্পন্ন হয়েছে৷ মা বজ্রচর্চিকা আমাদের সহায়৷ সৃষ্টির যে অমৃতমূলাধার এতদিন মানবজাতির কাছ হতে লুকিয়ে রাখা হয়েছে তার উদ্ধার করব আমরা৷ আর একটি মাত্র সাধন বাকি৷ তাহলেই আমরা হব অজর, অমর, মহামৃত্যুঞ্জয়ী৷’
‘কী সেই সাধন গুরু বজ্রসত্ব?’ প্রশ্ন করে একজন৷
একটু সময় নেন গুরু বজ্রসত্ব৷ তারপর গম্ভীরস্বরে বললেন, ‘গৌরীদান৷’
* * *
অর্জুন ড্রাইভ করছিল মুম্বাই থেকে পুনে৷ সাড়ে তিনঘণ্টার রাস্তা৷ আর সে রাস্তা এমনই মসৃণ যে মনে হয় চলন্ত গাড়িতে বসে চেকে সই করা যাবে৷ তাছাড়া পশ্চিমঘাট পর্বতমালার বুক চিরে তৈরি হওয়া এই রাস্তার নৈসর্গিক সৌন্দর্যও তুলনাহীন৷ বিশেষ করে রাস্তাটা যখন লোনাভালা-খান্ডালা অঞ্চল পার করে, সেই দৃশ্যের তুলনা নেই৷ এই যেমন এখন৷ কয়েক দিন আগেই বর্ষা শেষ হয়েছে, শরৎ আসবে আসবে করছে৷ এই সময় পাহাড়ের গা বেয়ে নেমে আসে ছোট্ট ছোট্ট ঝরনার দল৷ যেন একদল চঞ্চল বালিকা নেমে আসছে নূপুর পায়ে৷ আর কালচে সবুজ পাহাড়ের বুক চিরে মাথা দোলা দেয় নাম না-জানা কত না রঙিন ফুলের দল৷ পিছনে উপত্যকার বুক জুড়ে ভেসে বেড়াচ্ছে কাশফুলের মতো সাদা মেঘের স্তূপ৷ সেই অপার্থিব সৌন্দর্য দেখলে মোহিত হয় না এমন মানুষ কমই আছে৷
দিনের বেলা এই রাস্তা দিয়ে এলে দেখা যায় পথের ধারে কত মানুষ দাঁড়িয়ে এই অমল সৌন্দর্যের স্বাদ নিচ্ছে৷ বেশিরভাগই ক্যামেরা নিয়ে আসে৷ প্রেমিক-প্রেমিকা আসে, আসেন প্রৌঢ় দম্পতি৷ শিশুদের সঙ্গে নিয়ে আসেন নবীন কপোত-কপোতীরা৷ রাশভারী কর্পোরেট কর্তা থেকে সফল ব্যবসায়ী, স্ট্রাগলিং অভিনেতা থেকে উঠতি রাজনীতিবিদ, এখানে দাঁড়িয়ে ছবি তোলেননি এমন মানুষ বিরল৷
এখন অবশ্য রাত৷ রাস্তা একেবারে ফাঁকা৷ এও ভারী আশ্চর্যের ব্যাপার৷ রাত হোক বা দিন, সচরাচর এই রাস্তায় গাড়ির ভীড় লেগেই থাকে৷ এই খাঁ খাঁ করা মুম্বাই-পুনে হাইওয়ে তাই অর্জুনের কাছে অস্বাভাবিক লাগার কথা ছিল৷ কিন্তু সেদিকে অর্জুনের মনই ছিল না৷ কারণ আজ, এই মুহূর্তে অর্জুন সেনগুপ্ত’র মনটা বিতৃষ্ণা, হতাশা আর বিরক্তিতে ভরে আছে একেবারে৷
অর্জুন একজন ডকুমেন্টারি ফিল্ম পরিচালক৷ ফিল্মি দুনিয়ায় যে কজন উঠতি প্রতিভাবান ডকুমেন্টারি ফিল্ম মেকারের নাম উচ্চারিত হয়, অর্জুনের নাম তার মধ্যে একদম প্রথম সারিতে৷
অর্জুনের বিশেষত্ব হচ্ছে সমাজের অসঙ্গতি এবং অন্ধকার দিক নিয়ে ডকুমেন্টারি বানানো৷ যেমন দিল্লির রাজনীতি আর অন্ধকার জগতের আঁতাত, মুম্বাইয়ের কামাথিপুরার অসহায়তা, বস্তারের আদিবাসীদের দুঃখ-দুর্দশা, এসব নিয়েই বিভিন্ন ডকু ফিল্ম বানায় সে৷ তার ডকু ফিল্ম দেশ-বিদেশে উচ্চপ্রশংসিত৷ বিভিন্ন বিদেশি কার্নিভালে ডাক পড়ে তার৷ কয়েকটি ছোটখাটো পুরস্কারও জুটেছে কপালে৷
কিন্তু আপাতত সেই জনপ্রিয়তায় কিছু ভাঁটার টান দেখা যাচ্ছে৷ কাল তার সদ্য রিলিজ হওয়া নতুন ডকুমেন্টারি ফিল্মের প্রিমিয়ার ছিল৷ সেখানে কয়েকজন প্রভাবশালী ফিল্ম জার্নালিস্ট কাম ক্রিটিক-এর সঙ্গে কিছু উত্তপ্ত বাক্যবিনিময় হয়েছে৷ তাঁরা অর্জুনের সাম্প্রতিক ডকুমেন্টারিগুলিকে একই বিষয়ের চর্বিতচর্বণ এবং সৃজনশীলতার নিরিখে নিম্নমানের বলে অভিযুক্ত করেছেন৷ অর্জুনও পালটা জবাব দিতে ছাড়েনি৷ দুপক্ষের উত্তপ্ত বাক্যবিনিময় শেষ পর্যন্ত তর্কাতর্কিতে গড়ায়৷ ব্যাপারটা আরও বিশ্রী দিকে মোড় নেওয়ার আগেই প্রযোজক সংস্থার পি আর ম্যানেজার রঘু বাধ্য হয় প্রিমিয়ারের ইতি টানতে৷
অর্জুন বুঝতে পারছিল কাজটা ঠিক হয়নি৷ এমনিতেই তার লাস্ট দুটো ফিল্ম মিশ্র প্রতিক্রিয়া পেয়েছে৷ কাল যা হল তাতে এই সমালোচকরা রিভিউতে তাকে তুলো ধুনে দেবে৷ তাতে তার কেরিয়ারের কী অবস্থা দাঁড়াবে সেটা চিন্তার বিষয়৷ রাধিকা তাকে পই পই করে বারণ করেছিল ঝামেলা ঝঞ্জাটে না জড়াতে৷ আর ঠিক সেটাই হল৷
রাধিকা হচ্ছে অর্জুনের স্ত্রী৷ তাদের দাম্পত্যের বয়েস প্রায় দশ৷ সুখের সংসার তাদের৷ দুটি সন্তান, নূপুর আর নিখিল৷ নূপুর বয়সে বড়, আট৷ নিখিলের বয়েস ছয়৷ অর্জুনের সঙ্গে রাধিকা চাওলা’র আলাপ গোয়াতে, শুটিং করতে গিয়ে৷ সেই আলাপ পড়ে গাঢ় হয়ে প্রণয়ের রূপ নেয়৷ মুম্বাই ইউনিভার্সিটির দর্শনের অধ্যাপিকা রাধিকা অর্জুনকে বিয়ে করতে দুবার ভাবেনি৷ চাকরিটা অবশ্য ছেড়ে দিয়েছে রাধিকা৷ এখন সে পুরোদস্তুর গৃহিণী৷ সময় সুযোগ পেলে সে গেস্ট লেকচারার হিসেবে মাঝে মধ্যে বিভিন্ন কলেজে পড়াতে যায়৷
অর্জুন ড্রাইভ করতে করতে ভাবছিল কী করবে সে৷ যে প্রোডাকশন হাউসের হয়ে সে ডকুমেন্টারি বানায়, তার মালিক সোফিয়া থাডানি৷ কালকের ঝামেলার খবরটা শুনে সোফিয়া তৎক্ষণাৎ তাকে ফোন করেছিল৷ এখনও অবধি সে অর্জুনের পক্ষেই আছে৷ কিন্তু এইভাবে চললে কতদিন থাকবে বলা মুশকিল৷ হাজার হোক, এটা সোফিয়ার ব্যবসা, চ্যারিটি নয়৷
এখন অর্জুন যাচ্ছে সোফিয়ার ফার্মহাউসে৷ ফার্মহাউসটা পুনের একটু বাইরের দিকে৷ প্রায় বাইশ একর জমির ওপর ছড়ানো বাগানবাড়ি৷ প্রতি ডকুমেন্টারি বা সিনেমা রিলিজ হওয়ার পর সোফিয়া এখানে ক্রু মেম্বারদের জন্য পার্টির আয়োজন করে৷ রাতভর হইচই আর হুল্লোড়ে সময়টা বেশ কাটে৷ তবে আজ অর্জুন সেই পার্টি কতটা এনজয় করতে পারবে সে নিয়ে সন্দেহ আছে৷
লোনাভালা পৌঁছনোর আগে অল্প ঝিরিঝিরি বৃষ্টি শুরু হল৷ এই জায়গাটা সমতলের থেকে বেশ উঁচুতে৷ মেঘেদের দল নেমে এসেছে রাস্তার ওপর৷ বৃষ্টির মধ্যেই অর্জুনের গাড়ি টানেলে ঢুকে গেল৷
টানেল পেরোবার একটু পর অর্জুন দেখল একজন মাঝবয়েসী লোক রাস্তার পাশে অসহায় ভাবে দাঁড়িয়ে লিফট চাইছে৷ রেইন কোট তো দূরে থাক, লোকটার সঙ্গে একটা ছাতা অবধি নেই৷ অর্জুন চট করে এইভাবে কাউকে লিফট দেয় না৷ দিনকাল ভালো না, চুরি-ডাকাতির সম্ভাবনা তো আছেই৷ কিন্তু আজ যেন কী মনে হল তার৷ লোকটার পাশে গিয়ে গাড়ি দাঁড় করাল৷ কাচ নামিয়ে জিজ্ঞাসা করল, ‘কেয়া হুয়া?’
লোকটা ভাঙাচোরা হিন্দিতে জানাল, বাসে করে লোনাভালা যাচ্ছিল৷ মাঝখানে ভুল করে নেমে পড়েছে৷ একটু সামনে পৌঁছে দিলে খুব উপকার হয়৷
অর্জুন ইঙ্গিতে লোকটাকে উঠে পড়তে বলল৷ হিন্দি শুনে বোঝা যাচ্ছে যে ভদ্রলোক বাঙালি৷ মধ্যবয়স্ক বাঙালি লোক লোনাভালার রাস্তায় হাত দেখিয়ে গাড়ি থামিয়ে ডাকাতি করবে, এমন সম্ভাবনা নেই বললেই চলে৷
ভদ্রলোক গাড়িতে উঠে একগাল হেসে বলল, ‘অনেক অনেক ধন্যবাদ স্যার৷ আপনি না এলে যে কী হত৷ এই অসময়ে ভিজলে শরীর খারাপ হওয়া আটকায় কে৷’
লোকটার হিন্দি উচ্চারণ শুনে আবার মজা পেল অর্জুন৷ হেসে জিজ্ঞেস করল, ‘বাঙালি বলে মনে হচ্ছে৷’
লোকটা খানিক অবাক হয়ে একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল, ‘আপনিও বাঙালি? যাক, বাঁচা গেল৷ হিন্দি বলে বলে গলা শুকিয়ে যাচ্ছিল মশাই৷ আপনার নাম জানতে পারি?’
‘অর্জুন সেনগুপ্ত৷ পেশায় ফিল্ম মেকার৷ আমি কিন্তু কলকাতার বাঙালি নই, মুম্বাইয়ের৷’
‘আহা, সে হোক৷ বাঙালি তো৷ আপনার জন্মকর্ম সব কি এখানেই?’
‘তা বলতে পারেন৷ বাবা আর্মিতে চাকরি করতেন৷ তাই সারা দেশ ঘুরতে হয়েছে৷ তবে বেশিটাই এই মহারাষ্ট্র সাইডে৷ আমার জন্ম এখানে, থাকিও এখানেই৷ তা আপনার হিন্দি শুনে তো মনে হচ্ছে খাঁটি কলকাতার লোক৷’
লোকটি স্মিত হাসেন, ‘ঠিকই ধরেছেন৷ তবে ঠিক কলকাতা না, আরও একটু পুবে, নদিয়া ডিস্ট্রিক্ট৷’
‘আচ্ছা৷ তা এখানে কি কাজকর্মের সূত্রে?’
‘একরকম তাইই বলতে পারেন৷ আমার পেশা হচ্ছে অধ্যাপনা৷ সেই সূত্রেই আসা৷’
‘আপনি প্রফেসর? ইন্টারেস্টিং৷ তা কোন সাবজেক্ট পড়ান আপনি?’
‘আমার সাবজেক্ট হচ্ছে ইন্ডোলজি৷ আরও বিশেষ করে বলতে গেলে বৌদ্ধধর্মের ইতিহাস ও দর্শন৷’
চমৎকৃত হল অর্জুন, ‘আরে বাহ৷ কোন ইউনিভার্সিটি?’
‘বহুদিন নেপাল রাজ কলেজে পড়িয়েছি৷ আপাতত শরীরে আর দিচ্ছে না বলে চাকরি ছেড়ে দেশে ফিরেছি৷ ভাবছি কয়েকদিন বিশ্রাম নিয়ে আবার কাজে জয়েন করব কোথাও৷’
বলতে বলতেই ভদ্রলোক বললেন, ‘আমি এখানেই নামব অর্জুনবাবু৷ অনেক অনেক ধন্যবাদ৷ ঈশ্বর আপনার মঙ্গল করুন৷’
ভদ্রলোক গাড়ি থেকে নামার আগে একটা অদ্ভুত কাজ করলেন৷ হ্যান্ডশেক করার পর কিছুক্ষণ অর্জুনের হাত ধরে রইলেন৷ তারপর একটা অদ্ভুত কথা বললেন, ‘যারা ঘুমিয়ে আছে তাদের জাগাবেন না সাহেব৷ আমাদের চেনা পৃথিবীর বাইরে অন্য একটা পৃথিবী আছে, সেই অচেনা পৃথিবী নিজের মধ্যে মগ্ন হয়ে আছে৷ তাকে বিরক্ত করবেন না৷’
অর্জুন অবাক হল৷ বলল, ‘হঠাৎ এই কথা?’
লোকটা খানিকক্ষণ অর্জুনের মুখের দিকে চেয়ে থেকে বলল, ‘আমি সর্বনাশের রং দেখতে পাই মিস্টার সেনগুপ্ত৷ আপনার মুখে তার ছায়া পড়ছে৷ আপনি সতর্ক থাকুন, সাবধান থাকুন৷ আর যদি তেমন কিছু হয়, আর মা মঙ্গলময়ী যদি চান তো আমি আপনার কাছে পৌঁছে যাব৷ ততদিন ভালো থাকুন, সাবধানে থাকুন’ বলে লোকটা দরজা বন্ধ করে অন্ধকার রাস্তার মোড়ে মিলিয়ে গেল৷
অর্জুন একটু ধন্দে পড়ে গেল৷ কী বলে গেল লোকটা? পাগল ছাগল তো মনে হয় না৷ কথাবার্তা দিব্যি শিক্ষিত লোকেদের মতো৷ তাহলে ওই শেষের কথাগুলোর মানে কী?
ধুত, মাথা থেকে চিন্তাটা ঝেড়ে ফেলল অর্জুন৷ যত্তসব উটকো আপদ৷ গেছে, বাঁচা গেছে৷
গাড়ি চালানো শুরু করার পর অর্জুন খেয়াল করল লোকটার নামই জানা হয়নি তার৷
* * *
পার্টিতে এসে লোকজনের সঙ্গে হাসি ঠাট্টা আড্ডার মধ্যে অর্জুনের মন খারাপটা একটু একটু করে কেটে যেতে লাগল৷ সোফিয়া তো ওকে ডেকে নিয়ে আলাদা করে বলেই দিল, ‘ওই মাথামোটা রিভিউয়ারগুলো কী বলল সে নিয়ে মাথা ঘামিও না সেনগুপ্তা৷ ওদের কিনতে আমার ট্যাঁকের থেকে অল্প কিছুই খসবে৷ তুমি বরং তোমার পরের প্রোজেক্ট নিয়ে কাজ শুরু করে দাও৷’
সোফিয়া থাডানি এক কথার মানুষ৷ তিন রাউন্ড ড্রিঙ্কসের পর সবাইকে আগের প্রোজেক্টের পারিশ্রমিকের চেক হ্যান্ডওভার করল৷ তারপর ফের অর্জুনকে আড়ালে টেনে নিয়ে গিয়ে বলল, ‘এবার নতুন কিছু করা যাক অর্জুন৷’
‘যেমন?’ ভদকার গ্লাসে সতর্ক চুমুক মারতে মারতে জিজ্ঞাসা করল অর্জুন৷
লং আইল্যান্ড টী’র গ্লাস হাতে অনেক্ষণ চুপ রইল সোফিয়া৷ ভুরু কুঁচকে কী যেন ভাবছে সে৷ তারপর বলল, ‘সাউথ ইস্ট এশিয়ায় যে পেগান বা প্রাকৃত ধর্ম সম্পর্কিত রিচুয়ালস আছে সেই নিয়ে একটা কাজ করো৷ আজকাল লোকজন অকাল্ট, তান্ত্রা, এসব উইয়্যার্ড, ক্রিপি, ঈরী বিষয় নিয়ে খুব ইন্টারেস্ট নিচ্ছে৷ আশা করি এই প্রোজেক্টটা লোকে খাবে৷’
অর্জুন কথাটা ভাবতে থাকে৷ আজকাল এইসব নিয়ে চর্চার একটা ঝোঁক বেড়েছে বটে৷ করলে মন্দ হয় না৷
‘কবে চাই কাজটা?’
‘আমি চাইছি ইমিডিয়েটলি শুরু করতে৷’
‘কিন্তু পরের সপ্তাহে আমাদের ছুটি কাটাতে গোয়া যাওয়ার প্ল্যান আছে সোফিয়া৷’
‘প্ল্যান চেঞ্জ করো অর্জুন৷ তুমিও জানো যে তোমার লাস্ট কয়েকটা ডকুমেন্টারি তেমন সাফল্য পায়নি৷ এ চান্সটা মিস করা তোমার উচিত হবে না৷’
অর্জুন বুঝতে পারে সোফিয়া তাকে একটা শেষ সুযোগ দিচ্ছে৷ হয়তোতার কেরিয়ারের শেষ সুযোগ৷ একজন ডুবন্ত উদ্বিগ্ন মানুষের আর কী লাগে?
‘আয় আয় ক্যাপ্টেন৷ ইওর উইশ ইজ মাই কমান্ড’ বলে ছদ্মবিনয়ের ভঙ্গিতে বাও করে সে৷ সোফিয়া হেসে গড়িয়ে পড়ল, ‘কত নাটকই যে জানো বস৷’
তারপর বলল, ‘আই নিউ ইট অর্জুন৷ তোমার সিনসিয়ারিটি নিয়ে আমার মনে কোনওদিনই কোনও সন্দেহ ছিল না৷ কাল থেকেই কাজ শুরু করে দাও৷’
বলতে বলতেই অর্জুনের হাতে অগ্রিম হিসেবে একটা চেক আর একটা ফাইল গুঁজে দেয় সোফিয়া, ‘এখানে তোমার প্রয়োজন হবে এমন সব ডেটা দেওয়া আছে৷ তুমি তো জানো আমার একটা রিসার্চ টিম আছে৷ আমি এই বিষয় নিয়ে অনেক দিন ধরেই খোঁজখবর করছি৷ এমনি এমনি এই প্রোজেক্টটা তোমার ঘাড়ে চাপাইনি অর্জুন৷ আই অ্যাম ড্যাম সিরিয়াস অ্যাবাউট ইট৷’
অর্জুন মাথা নীচু করে ফাইলগুলো ঘাঁটছিল৷ প্রতি পাতাতেই নোটস আর ডায়াগ্রাম৷ রিসার্চ যে বা যিনি করেছেন তাঁর পরিশ্রমের ছোঁয়া পাওয়া যায় প্রতি পাতায়৷
ফাইলটা বন্ধ করে অর্জুন, ‘এক্সেলেন্ট সোফিয়া৷ অর্ধেক কাজ তো এগিয়েই রেখেছ দেখছি৷ আমাদের পরের পদক্ষেপ কী?’
সোফিয়া তার আইফোনটা বার করে বলে, ‘একটা নাম্বার দিচ্ছি, সেভ করে রাখো৷ আসল কাজ দিন দুয়েক বাদ থেকেই শুরু হবে৷ যিনি এই রিসার্চটা করেছেন তিনি একজন অকাল্ট বিশেষজ্ঞ৷ আমার টিম খুঁজে বের করেছে এঁকে৷ এই বিষয়ে ভদ্রলোকের প্রভূত পড়াশোনা আছে৷ আমরা কথা বলে রেখেছি৷ তুমিও কথা বলে নিও৷ বেস্ট অফ লাক৷’
অর্জুন নাম্বারটা সেভ করে মোবাইলটা পকেটে রাখল৷ এখন বেশ ভারমুক্ত লাগে তার৷ এবার দেখিয়ে দেবে সে, অর্জুন সেনগুপ্ত কী জিনিস৷
* * *
হঠাৎ করেই শুরু হয়েছে প্রবল বৃষ্টি৷ মেঘে ঢেকে গেছে শরতের আকাশ৷ এই অন্ধকার স্যাঁতস্যাঁতে জঙ্গল দেখে মনে হয় যেন আদিম কোনও অরণ্য উঠে এসেছে দার্জিলিংয়ের বুকে৷ মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে বিষণ্ণ মহাদ্রুমদল৷ তাদের কালচে গুঁড়ি বেয়ে নেমে আসছে জলের ধারা মনে হচ্ছে যেন কোনও এক প্রাগৈতিহাসিক মহাসমুদ্র থেকে উঠে আসা অতিকায় মহাসর্পের গা বেয়ে নেমে আসছে প্রাচীন লবণাক্ত স্রোত৷
এই অন্ধকার অরণ্যে, প্রবল বর্ষায় ভিজতে থাকা বাড়িটাকে দেখে মনে হচ্ছিল যেন কোন এক বৃদ্ধা বসে আছে মহা সর্বনাশের অভিশাপ মাথায় নিয়ে৷ তার শার্সির মধ্যে থেকে ক্ষীণ একটা আলো কাঁপতে কাঁপতে এসে পড়ছিল প্রবল বারিধারায় ধুয়ে যাওয়া বারান্দায়৷
ঘরের ভেতর থমথম করছে ভয়৷ থেকে থেকে বিপুল বজ্রপাতের শব্দ আর আলোর ঝলকানি ছিটকে পড়ছে ঘরের মধ্যে৷ তারপরেই ঘরের কোণে গুটিশুটি মেরে বসে থাকা আলোয় মেশানো অন্ধকার আবার ঝাঁপিয়ে পড়ছে ঘরের মধ্যে৷
হলঘরের ঠিক মধ্যিখানে একটি সিংহাসনের মতো আসন৷ সেখানে বসে আছেন একজন মানুষ৷ তাঁর সারা শরীর, এমনকি মুখও ঢাকা৷ শুধু চোখটুকু খোলা৷ তীক্ষ্ণ, খর সেই চোখ দেখলে ভয় করে, এমনই তার তীব্রতা৷ আর সিংহাসন ঘিরে আরও পাঁচজন লোক৷
তার সামনে একজন মেঝেতে হাতজোড় করে বসে আছে৷ তার বসার ভঙ্গিতে বোঝা যাচ্ছে যে ভীত৷ মহাভয়ে ভীত, ত্রস্ত, আশঙ্কিত৷
একটু পরে সিংহাসনে বসে থাকা মানুষটি একটি পাথরের গ্লাস এগিয়ে দিল মেঝেতে বসে থাকা লোকটির দিকে৷ গম্ভীর স্বরে বলল, ‘খেয়ে নে বীরবাহাদুর৷ মনে জোর পাবি৷’
লোকটি কাঁপা কাঁপা হাতে গ্লাসটি নিয়ে বলল, ‘এতে কী আছে ঠাকুর?’
‘মায়ের চরণামৃত৷ এক চুমুকে শেষ কর বীরবাহাদুর৷ নইলে মা রুষ্ট হবেন৷ তুই তো জানিস মায়ের ক্রোধ বড় সাঙ্ঘাতিক৷ তার হাত থেকে কারও নিস্তার নেই৷’
বীরবাহাদুর এক চুমুকে গ্লাসটা শেষ করে৷ তারপর মুখ বিকৃত করে চাপা আর্তনাদ করে, ‘কী খাওয়ালে ঠাকুর৷ গলা-বুক জ্বলে যায় যে৷’
সিংহাসনে থাকা লোকটি কিছু বলে না৷ শুধু তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল বীরবাহাদুরের দিকে৷ এই আরক বড় শক্তিশালী, বহু প্রাচীন পদ্ধতিতে তৈরি৷ এর তেজ সহ্য করার মত মানুষ এক নিজেকে ছাড়া আর দ্বিতীয়টি দেখেননি তিনি৷
বীরবাহাদুর কিছুক্ষণ টলতে থাকে৷ তারপর স্থির হয়ে চোখ মেলে তাকায় সে৷
একটু পর সিংহাসনে বসে থাকা লোকটি গম্ভীরস্বরে বলে উঠল, ‘তাহলে কী ভাবলি বীরবাহাদুর?’
‘ও যে আমার একমাত্র মেয়ে ঠাকুর৷ ওকে কী করে….’
ভুরু কুঁচকে যায় ঠাকুরের৷ এখনও মনের জোর রয়ে গেছে লোকটার, সম্পূর্ণভাবে আরকের বশীভূত হয়নি৷
‘তুই বুঝছিস না কেন বীরবাহাদুর৷ তোর বউয়ের পেটে যে ছেলে আছে সে তোর নাম উজ্জ্বল করবে৷ তোর পরিবারকে একডাকে চিনবে লোকে৷’
‘সে চিনুক ঠাকুর৷ কিন্তু তার বদলে কী করে… ও যে আমার বড় আদরের মেয়ে৷’
‘মেয়েরা জন্ম কেন নেয় বীরবাহাদুর? পরের বাড়ি যাবে বলেই তো৷ মেয়ে কখনও নিজের হয় না বীরবাহাদুর, ও হচ্ছে পরের গচ্ছিত সম্পত্তি৷ সে যখন যাবেই তখন না হয় মা নিজেই নিলেন৷’
‘কিন্তু ঠাকুর, আমার ছেলে মেয়ে দুই-ই না হয় থাকুক৷ আমার অত খ্যাতি দরকার নেই৷’
‘তা হয় না রে বীরবাহাদুর,’ একটা ক্রুর হাসি খেলে যায় লোকটার মুখে, ‘মা স্বয়ং তোর মেয়েকে চেয়েছেন৷ আমার লোক গিয়ে দেখে এসেছে তাকে৷ তোর মেয়ে সর্বসুলক্ষণা, এই কাজের জন্য সম্পূর্ণভাবে উপযুক্ত৷ মায়ের চাওয়ার কি অন্যথা হতে পারে রে? তোর মেয়েকে আমাদের চাই বীরবাহাদুর৷ ওই দেখ মা কী বলছেন৷’
ঘরের একদিকের দেওয়ালে একটা পর্দা টাঙানো ছিল৷ সেটা একটানে সরিয়ে দিল কেউ৷ আর সেদিকে তাকিয়ে আঁতকে উঠল বীরবাহাদুর৷
পর্দার ওপারে এক ভয়ঙ্করদর্শন দেবীমূর্তি৷ মূর্তির সম্পূর্ণ দেহ অস্থিসার, কঙ্কাল৷ মুখটিও করোটির মতো৷ দেবীর পরনে বাঘছাল৷ তিনি ছয়টি হাত নিয়ে একটি শবদেহের ওপর নৃত্যরতা৷ ডানদিকের তিন হাতে বজ্র, খড়্গ আর চক্র৷ বামদিকের তিনটি হাতে নরকরোটি, রত্ন এবং পদ্ম৷ অন্ধকার চোখদুখানি যেমন ভীতিকর তেমনই ক্রুর৷
ভয়ের চেয়েও ভয়ঙ্কর এই মূর্তি দেখে ঠকঠক করে কাঁপতে থাকল বীরবাহাদুর৷ এতক্ষণে আরকের সম্পূর্ণ প্রভাব ছেয়ে ফেলেছে তার মস্তিষ্ক৷ মাথাটা শূন্য হয়ে যায়৷ অঙ্গপ্রত্যঙ্গ যেন অবশ হয়ে আসে তার৷
ঠাকুর সিংহাসন থেকে উঠে দাঁড়ালেন৷ তারপর ধীরেসুস্থে বীরবাহাদুরের সামনে মেঝেতে বসলেন৷ শীতল কণ্ঠে বলেন, ‘মা বজ্রচর্চিকা তোর মেয়েকে চেয়েছেন রে বীরবাহাদুর৷ ওর রক্তে তোর পরিবারের শুদ্ধি হবে, তোর অনাগত সন্তানের কল্যাণ হবে৷ মায়ের ইচ্ছায় বাধা দিস না বীরবাহাদুর৷ মা যে ওকে চাইছেন৷’
বীরবাহাদুর আছড়ে পড়ে যায় ঠাকুরের পায়ে৷ গোঙাতে থাকে, তারপর পা দুটো স্থির হয়ে যায়৷
বাকিরা এতক্ষণ স্থির হয়ে পুরো নাটকটা দেখছিল৷ এবার বীরবাহাদুরকে তুলে নিয়ে গেল তারা৷
* * *
কফিশপে দরজা খুলে লোকটাকে লোকেট করতে পারল অর্জুন৷ তারপর আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘আরে, আপনাকেই আমি পুনে যাওয়ার পথে লিফট দিয়েছিলাম না?’
লোকটা হেসে ফেলল, ‘ফোনে আপনার নাম আর গলার স্বর শুনেই আপনাকে চিনতে পেরেছিলাম৷ কিন্তু পরিচয় আর দিইনি৷ ভাবলাম একটু মজা হোক৷ দুনিয়াটা সত্যিই গোল মিস্টার সেনগুপ্ত৷ সত্যি কথা বলতে কি ওইদিন আমারও সোফিয়া ম্য্যাডামের পার্টিতে যাওয়ার কথা ছিল৷ কিন্তু খান্ডালায় একজনের বাড়িতে একটা পুরনো পুঁথির খোঁজ করতে গিয়ে আর যাওয়া হয়ে ওঠেনি৷ তবে আমি কিন্তু নিশ্চিত ছিলাম যে মা আমাদের আবার মিলিয়ে দেবেন৷’
আশ্চর্য হল অর্জুন, ‘মা?’
লোকটা প্রণাম করে, ‘জগজ্জননী মহামায়া৷ তিনি সব জানেন, সব শোনেন, সবার খবর রাখেন৷ আর যার যখন আমাকে দরকার হয়, তার সঙ্গে আমাকে ঠিক মিলিয়ে দেন৷’
লোকটাকে ভালো করে লক্ষ্য করল অর্জুন৷ পাগল বলে তো মনে হচ্ছে না৷ এমনিতে সাধারণ দেখতে৷ একটা হাওয়াই শার্ট, ট্রাউজার আর পায়ে চামড়ার পা-ঢাকা চপ্পল পরে আছে৷ হাইট মাঝারি, গায়ের রং চাপা, বাঙালিদের যেমন হয়৷ তবে লোকটার সব শক্তি যেন চোখদুটোতে৷ এমন শান্ত, গভীর অথচ উজ্জ্বল চোখ অর্জুন দ্বিতীয়টি দেখেনি জীবনে৷ আর সবসময় মনে হয় ভদ্রলোক যেন চোখের কোণ দিয়ে হাসছেন৷ বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকা যায় না সেই চোখের দিকে৷ শুধু মনে হয় এই বুঝি ধরা পড়ে গেলাম৷
অর্জুন বলে, ‘কাজের কথা, দরকারের কথা পরে হবে৷ আগে আপনার নামটা বলুন দেখি৷ সেদিন তো আপনি গাড়ি থেকে নেমে যাওয়ার পর খেয়াল হল আপনার নামটাই জানা হয়নি৷’
দুহাত জড়ো করে লোকটা, ‘আমার নাম কে এন মৈত্র৷ পুরো নাম কৃষ্ণানন্দ মৈত্র৷ বাড়ি তো আগেরদিনই বলেছি, নদিয়া৷ আরও ঠিক করে বলতে গেলে নবদ্বীপে৷ আর পেশা তো জানেনই, অধ্যাপনা৷’
‘ইন্ডোলজি, স্পেশালাইজেশন হচ্ছে বৌদ্ধধর্মের দর্শন ও ইতিহাস৷ তাই তো?’
‘ঠিকই বলেছেন৷ তবে শুধু বৌদ্ধধর্ম নয়৷ পৃথিবীর প্রায় প্রতিটি প্রকৃতিবাদী বা পেগান ধর্মের ইতিহাসই আমার অধ্যয়ন আর অধ্যাপনার বিষয়৷ তবে হ্যাঁ, বৌদ্ধধর্ম, বিশেষ করে বজ্রযানী বৌদ্ধধর্ম আর দর্শন আমার বিশেষ আগ্রহের বিষয়৷’
অর্জুন আর দেরি করল না৷ ‘সোফিয়ার সঙ্গে আপনার এক প্রস্থ আলোচনা হয়ে গেছে শুনেছি৷ এবার এটা নিয়ে কী ভাবে এগোনো যায় সে নিয়ে আপনার পরামর্শ চাই৷’
‘আপনি কীভাবে কাজ শুরু করতে চাইছেন বলুন৷’
পরের আধঘণ্টা ধরে অর্জুন বিশদে তার পরিকল্পনা খুলে বলল৷ মৈত্রমশাই সবটা মন দিয়ে শুনলেন৷ তারপর বললেন ‘ভারতের বিভিন্ন প্রান্তেই তন্ত্র বা অকাল্ট বিষয়ে এতসব আকর্ষণীয় বিষয় ছড়িয়ে আছে যে একটা ডকুমেন্টারিতে শেষ করতে পারবেন না৷’
‘যেমন?’
‘যেমন ধরুন শৈব আগম, শক্তিতন্ত্র উপাসকদের মধ্যেই প্রচুর ভাগ আছে৷ বামাচার আছে, বীরাচার আছে, যামল আছে, ডামর আছে…’
‘দেখুন লোকে তো অত ফিলোসোফি বুঝবে না৷ তারা তন্ত্র-মন্ত্র এসবের অলৌকিক দিকটা নিয়ে বেশি ইন্টারেস্টেড৷ আমি চাইছি সেই দিকটা নিয়ে কাজ করতে৷’
‘অর্থাৎ?’
‘মানে কিছু ডেঞ্জারাস, স্পাইন চিলিং তান্ত্রিক রিচুয়ালস ক্যামেরাতে ডকুমেন্ট করতে৷’
মাথা নাড়লেন ভদ্রলোক, ‘সেটা ঠিক হবে না সাহেব৷ তান্ত্রিক সাধনপদ্ধতি অতি গূঢ়, অতি গোপন৷ শাস্ত্রে বলে এই সাধনা মাতৃজারবৎ, মানে মায়ের উপপতির পরিচয়ের মতো গোপন রাখতে হয়৷ তাকে ক্যামেরাবন্দি করে সাধারণ্যে প্রকাশ করাটা অত্যন্ত অনুচিত কাজ হবে৷’
‘বুঝলাম না৷ এতে এত গোপনীয়তার কী আছে?’
‘তন্ত্র আর পাঁচটা সাধারণ পূজা উপাসনার মতো নয় সাহেব৷ এক আশ্চর্য গোপন শাস্ত্র৷ প্রকৃতি নিজের হাতে একে সৃষ্টি করেছেন৷ তাই এই শাস্ত্র আধিদৈবিক, আধিভৌতিক, পারমার্থিক এবং পারত্রিক৷ লৌকিক এবং অলৌকিক জগতের মধ্যে অতি সূক্ষ্ম পর্দা হল তন্ত্র৷ সেই পর্দা উঠিয়ে অন্য জগতে প্রবেশের ক্ষমতা খুব কম লোকেরই থাকে সাহেব৷ তার জন্য স্বয়ং মহামায়ার কৃপা লাগে৷ তিনি নিজে এই সংসারকে মায়ায় আচ্ছন্ন করে রেখেছেন৷ সেই মায়ার বাঁধন কাটিয়ে জ্ঞানচক্ষু উন্মুক্ত করতে হয়৷ সে বড় কম ক্ষমতা নয়৷ সেই পৃথিবী অনধিকারীদের জন্য নয়৷ যারা শুয়ে আছে তাদের শুয়ে থাকতে দিন সাহেব৷ সেই পৃথিবীকে বিরক্ত করবেন না৷’
অর্জুন মাথা নাড়ে, ‘আমি কুসংস্কারে বিশ্বাস করি না দাদা৷ সোফিয়া আমাকে যে কাজের দায়িত্ব দিয়েছে সেটা তো শেষ করতেই হবে৷ এখন বলুন আপনি আমাদের হেল্প করবেন কি না৷’
মৈত্রমশাই বললেন, ‘সোফিয়া ম্যাডাম আমাকে তথ্য সংক্রান্ত ব্যাপারে সাহায্য করতে বলেছেন৷ তার জন্য আগাম টাকাও দিয়েছেন৷ শাস্ত্রে বলে অন্নের ঋণ মস্তবড় ঋণ৷ তাই আমাকে সাহায্য করতেই হবে, তবে একটাই অনুরোধ, আমাকে না জানিয়ে উল্টোপাল্টা কিছু ডকুমেন্ট করতে যাবেন না প্লিজ৷’
‘হুম৷ তাহলে আমরা কোথা থেকে শুরু করব?’
মৈত্রমশাই চোখ বন্ধ করে কিছুক্ষণ ভাবলেন৷ তারপর বললেন, ‘বঙ্গদেশ, মানে অভিবক্ত বাংলা, কামরূপ, শ্রীহট্ট এসব হচ্ছে তন্ত্রের আদিভূমি৷ বিশেষ করে উত্তরবঙ্গ, কামরূপ, নেপাল, তিব্বত এসব অঞ্চল৷ শাস্ত্রে বলে ‘গৌড়ে প্রকাশিতা বিদ্যা, মৈথিলৈঃ প্রবলীকৃত৷ ক্বচিৎ কচিন্মহারাষ্ট্রে গুর্জরে প্রলয়ং গতা৷’ আপাতত বঙ্গভূমি দিয়েই শুরু করা যাক৷ আমি বেশ কিছু তন্ত্রসাধনার জায়গা, আখড়া এসব চিনি৷ বেশ কিছু প্রকৃত তান্ত্রিক সাধকদের সঙ্গেও আমার আলাপ পরিচয় আছে৷ কবে যাবেন বলুন৷’
অর্জুন বলল, ‘বাড়িতে একটু আলোচনা করেই আপনাকে জানাচ্ছি৷’
সেদিনকার মতো মিটিং শেষ হল৷
* * *
গৌরী তার মায়ের পেটের ওপর কান রেখে কী যেন শুনছিল৷ আট বছর বয়েস তার৷ পৃথিবীর সব কিছু নিয়েই তার বড় কৌতূহল৷ এই উপত্যকা, জঙ্গল, গ্রাম, গ্রামের পথ, বাজারের নরবু বুড়োর দোকান, দোকানের সামনে শুয়ে থাকা কুকুরটা, চা খেতে আসা ট্যুরিস্টদের পোশাক আশাক, গ্রামের একপ্রান্তে মচ্ছিন্দরনাথের মন্দির, মন্দিরের মস্ত তামার ঘণ্টাটা, সব কিছুই তার আগ্রহের বিষয়৷ এই নিয়ে সে ক্রমাগত তার মায়ের সঙ্গে বকবক করেই যায়৷ মা শেষমেশ বিরক্ত হয়ে বলে, ‘অত জানি না বাপু৷ তোর বাবা এলে জিজ্ঞেস করিস বরং৷’
গৌরীর বাবা এখানে থাকে না৷ এখান থেকে ইন্ডিয়া অনেক দূর৷ সেখানে একটা চা-বাগানে কাজ করে গৌরীর বাবা৷ বছরে দুবার বাড়ি আসে আর আসার সময় গৌরীর জন্য অনেক অনেক খেলনা আর জামাকাপড় নিয়ে আসে৷ তখন গৌরীর খুব আনন্দ হয়৷ রাতদিন বাবার কোলে বসে চোখ বড় বড় করে ইন্ডিয়ার গল্প শোনে৷ সেখানে নাকি এরকমই পাহাড়, জঙ্গল আর নদী আছে৷ আর আছে চা-বাগান৷ কোমরসমান উঁচু চা-গাছের সারি চলে গেছে মাইলের পর মাইল৷ সেখানে নাকি মাঝেমধ্যে চিতাবাঘ বেরোয়৷ আর সেখান থেকে একটু দূরে আরও মস্ত বড় জঙ্গল আছে৷ সেখানে হাতি, বুনো মোষ কত কী জানোয়ার থাকে৷ বাবা বলেছে আর একটু টাকা জমাতে পারলেই বাবা তাকে আর তার মা’কে ওখানে নিয়ে যাবে৷ চিতাবাঘ হাতি এসব শুনে কি গৌরীর ভয় করছে? দূর পাগল, বাবা আছে না৷ বাবা একবার খুকরি নিয়ে দাঁড়ালে কার সাধ্য গৌরীর ক্ষতি করে?
এখন গৌরীর মন আনন্দে ভরপুর, যাকে বলে ডবল মজা৷ একে তো গৌরীর একটা ভাই হবে৷ সেই নিয়ে গৌরীর উত্তেজনার শেষ নেই৷ সারাদিনে সে যখনই সময় পায়, এসে খানিকক্ষণ মায়ের পেটে কান ঠেকিয়ে কী যেন শোনে৷ তার ওপর বাবা এসেছে দিন দুয়েক আগে৷ বাবা অবশ্য মাসখানেক আগেই এসেছিল একবার, দুর্গাপুজোর আগে যেমন আসে তেমনই৷ তখন সঙ্গে আরও দুটো লোক ছিল৷ তারা অবশ্য ওদের বাড়ি ওঠেনি, নিজেদের থাকার ব্যবস্থা নিজেরাই করে নিয়েছিল৷ তবে একমাসের মধ্যে বাবার ফের আবার আসাটা গৌরীর কাছে বিশেষ আনন্দের বিষয় বই কি৷!
বাবা বাইরে গেছে একটু৷ কী যেন একটা কাজে৷ মা শুয়েছিল৷ গ্রামের দাই মা বলেছে আর বেশিদিন নেই৷ আর মাসদুয়েকের মধ্যেই গৌরীর কোলে একটা জলজ্যান্ত ভাই এসে যাবে৷ সেই শোনা ইস্তক মেয়েটার উত্তেজনা আর বাঁধ মানছে না৷ বন্ধুদের, বন্ধুর মায়েদের, গোটা গ্রাম, এমনকি বাজারে গিয়ে ইস্তক গৌরী সবাইকে বলে এসেছে, তার একটা ভাই হবে৷ পুতুল পুতুল দেখতে জ্যান্ত একটা ভাই৷ শুধু তার, একমাত্র তার জন্যই গোটা একটা ভাই৷ পাড়া-প্রতিবেশীরা সববাই এই পাগল মেয়ের ভাইয়াকে নিয়ে পাগলামি জানে৷ তাই তারা হাসে আর গৌরীর মাথায় কপালে দুটো করে চুমু খায়৷ আর বলে, ‘এই একটা চুমু তোর জন্য, আর অন্যটা তোর আনেওয়ালা ভাইয়ার জন্য৷’
মায়ের পেটে কান পেতে কী যেন শুনছিল গৌরী৷ মেয়ের মাথায় বিলি কেটে দিতে দিতে মা বলে, ‘কী শুনছিস গৌরী?’
‘ভাইয়ার ডাক৷’
‘তাই?’ হেসে ফেলে মা৷ ‘তা ভাইয়া কী বলছে?’
‘বলছে ওর খিদে পেয়েছে৷ আর খেয়েই আমার সঙ্গে খেলতে বেরোবে৷’
‘বটে? আর কী বলছে?’
‘বলছে, দিদি, তোমার সঙ্গে কবে দেখা হবে?’
‘হবে তো৷’ তৃপ্তমুখে বলে গৌরীর মা বলে, ‘এই তো আর মাস দুয়েক৷ তার পরেই ভাইয়ার সঙ্গে তোর দেখা হবে৷’
‘ভাইয়াকে কেমন দেখতে হবে মা?’ উৎসাহিত স্বরে প্রশ্ন করে গৌরী৷
‘সে তো হলে দেখতেই পাবি৷’ কৌতুক খেলে যায় মায়ের মুখে৷
গৌরীর কল্পনা আর বাঁধ মানে না৷ কেমন হবে তার ভাইয়া? ছোট্ট ছোট্ট হাত পা, খুদি খুদি চোখ, মাথায় অল্প চুল৷ হাত পা ছুঁড়বে আর ট্যাঁ ট্যাঁ করে কাঁদবে৷ আর গৌরী তাকে কোলে নিয়ে আদর করবে, ঘাঁটু ঘাঁটু আদর করবে৷
গৌরী এবার মুখ তুলে চায়, ‘ভাইয়াটা শুধু আমার, তাই না মা?’
মা কিছু বলার আগেই গৌরীর বাবা ঢুকল ঘরে৷ শঙ্কিত৷ ত্রস্ত৷ অস্থির৷ এবার আসার পর থেকেই গৌরী দেখছে তার বাবা কেমন যেন ছটফট করছে৷ কে যেন তাকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে সবসময়৷ আর কী যেন একটা ঘোরের মধ্যে রয়েছে৷ বিড়বিড় করে কী যে বলে বোঝাই যায় না৷
গৌরীর মা বলল, ‘কী হল? এত অস্থির দেখাচ্ছে কেন?’
বাবা বলল, ‘কিছু না৷ আমি একটু বেরোচ্ছি৷ গৌরীকেও সঙ্গে নিয়ে যাব৷’
‘এত রাতে? কোথায় যাবে? কেন?’
‘জঙ্গলে একটা জিনিস পড়ে আছে৷ তুলে আনতে হবে৷ গৌরী লণ্ঠন ধরবে৷’
* * *
রাধিকা রাগে ফেটে পড়ল, ‘মানে? তুমি এখন তোমার ডকুমেন্টারির কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়বে? আমি যে এত করে বললাম ঘুরতে যাব, ছেলেমেয়েরা অপেক্ষা করে আছে, তার কোনও দাম নেই?’
অর্জুন মাথা নীচু করে বসেছিল৷ সত্যিই তো, পরিবারকে সময় দেবে বলে রাধিকা ওর অমন কেরিয়ার ছেড়ে চলে এল৷ ছেলেমেয়ে মানুষ করতে, সংসার সামলাতে উদয়াস্ত খাটে৷ ওরও তো একটা শখ আহ্লাদ আছে৷
বছরের এই একটা সময় ওরা ঘুরতে যায়৷ দেশের মধ্যেই কোথাও৷ এক-দুবার মলদ্বীপ, মরিশাসও হয়েছে৷
এবারে প্ল্যান ছিল সিমলা কুলু মানালি যাওয়ার৷ রাধিকার আর দুই ছেলেমেয়েরই পাহাড় খুব প্রিয়৷ অর্জুন টাকা সরিয়েও রেখেছিল এই প্ল্যানের জন্য৷ মধ্যে এই আচমকা ব্যাঘাত৷
‘দেখ রাধিকা, যাওয়ার ইচ্ছে যে আমারও ছিল না তা তো নয়৷ কিন্তু বিশ্বাস করো, আমার কাছে আর কোনও অপশন নেই৷ পরপর দুটো প্রোজেক্ট মার খেয়ে গেল৷ দেখছ তো কী কম্পিটিশনের মার্কেট৷ টিঁকে থাকতে গেলে এই কষ্টটুকু করতেই হবে৷ নইলে বাজারে কি ডকুমেন্টারি ফিল্মমেকার কম আছে? সোফিয়ার অন্য কাউকে খুঁজে নিতে জাস্ট দুদিন লাগবে৷’
রাধিকা তাও গজগজ করতে থাকে, ‘বছরে তো এই একবারই বেরোতে বেড়াই৷ তাতেও অশান্তি৷’
অনেক তর্কবিতর্ক শেষে অবশেষে একটা সমাধান বেরোল৷
অর্জুনের বাবার নাম সুবিনয় সেনগুপ্ত৷ ভদ্রলোক কাজ করতেন আর্মিতে৷ শেষে মেজর জেনারেল অবধি হয়েছিলেন৷ জীবনের অনেকটা সময় পশ্চিম ভারতে কাটিয়েছেন৷ অর্জুনের জন্মও মুম্বাইতেই৷
সুবিনয়বাবু রিটায়ার করার পর দার্জিলিংয়ে একটা বাড়ি কিনে ওখানেই সেটল করে গেছেন৷ তিনি প্রকৃতিপ্রেমী মানুষ৷ শহরের ঝুটঝামেলা তাঁর পোষায় না৷ আর্মি জীবনে তাঁর এক শাগরেদ ছিল, হাবিলদার জংবাহাদুর থাপা৷ সেই-ই তার মেজর শা’ব কে বাংলোটা সস্তায় পাইয়ে দেয়৷ রিটায়ার করার পরও সে মেজর শা’ব-এর খিদমত খাটা ছাড়েনি৷ সে শুধু যে সেনগুপ্ত ভিলার কেয়ারটেকার তাই-ই নয়, সেনগুপ্ত পরিবারের সব কিছু তারই জিম্মায়৷ তাকে ছাড়া মেজর সেনগুপ্ত’র এক মুহূর্ত চলে না৷
অর্জুন ভাবল এক ঢিলে দুই পাখি মারা যাক৷ মৈত্রবাবুও ওদিকেই যেতে বলছেন পরের কাজের জন্য৷ তাহলে ওখানেই ভ্যাকেশনটা কাটানো যাক৷ পাহাড়ও হল, ছুটিও হল, কাজও এগিয়ে রইল খানিকটা৷
প্রস্তাব শুনে রাধিকা তো বটেই, নূপুর আর নিখিলও খুব খুশি৷ তারা দাদা-দাদিকে খুব ভালোবাসে৷ বহুদিন হল তারা দাদা-দাদির আদর খায়নি৷ পারলে তারা এখন থেকেই রেডি হয়ে থাকে আর কী!
সেদিন রাতে একটা অদ্ভুত স্বপ্ন দেখল অর্জুন৷ দেখল কে যেন ওকে একটা উঁচু পাহাড় থেকে ঠেলে ফেলে দিচ্ছে৷ আর সেই সঙ্গে চারিদিকে কারা যেন হাড়ের খটাখট শব্দে তালি দিয়ে নেচে চলেছে৷ পড়তে পড়তে যে ঠেলা দিল তার মুখটা দেখা চেষ্টা করল সে৷ এ কি! এ তো একটা বাচ্চা মেয়ে৷ মুখটা নূপুরের মতো না?
সারা রাত এপাশ-ওপাশ করে ভোরের দিকে অঘোরে ঘুমিয়ে পড়ল অর্জুন৷ আর সেই রাতে রাহু প্রবেশ করল অশ্লেষা নক্ষত্রে৷ মহানাক্ষত্রিক কালসর্প ধীরে ধীরে তুলে ধরল তার তুণ্ডখানি৷
* * *
অন্ধকার রাস্তা ধরে গাড়িটা যাচ্ছিল দূর থেকে আরও দূরে৷ পাহাড়ের পাকদণ্ডী ধরে দ্রুত নেমে আসছিল ইঞ্জিনের কর্কশ আর্তনাদ৷ মনে হচ্ছিল যেন কোনও প্রাগৈতিহাসিক সরীসৃপের পিঠ বেয়ে নেমে আসছে বিষাক্ত দাঁতালো কোনও পোকা৷ গাড়ির হেডলাইটের আলো গিলে খাচ্ছে উপত্যকার হাঁ করা অন্ধকার৷ দূরে দূরে মাঝে মাঝে পাহাড়ের বুকে থোকা থোকা আলো দেখা যায়, অন্ধকারে স্থির জোনাকির ঝাঁকের মতো৷ বোঝা যায় ওগুলো কোনও না কোনও পাহাড়ি জনপদ৷
নেপাল থেকে দার্জিলিং ঢোকার সবচেয়ে সহজ রাস্তা নকশালবাড়ি হয়ে৷ কিন্তু ঠাকুরের আদেশ, রক্সৌল হয়ে দ্বারভাঙার রাস্তা ধরে পূর্ণিয়ার পথে শিলিগুড়িতে পৌঁছতে হবে৷ সময় বেশি লাগে বটে, কিন্তু অনেক সেফ রাস্তা৷ রাতে থাকার জায়গাও ঠাকুর বলে দিয়েছেন৷ যেখানে কেউ প্রশ্ন করবে না তিনটে লোক একটা বাচ্চা মেয়েকে নিয়ে কোথায় যাচ্ছে৷ আর মেয়েটা সবসময় এমন ঘুম ঘুম চোখে ঝিমিয়ে থাকে কেন৷
গাড়ি একটু পরেই রক্সৌল ঢুকবে৷ যে লোকটা গাড়ি চালাচ্ছে তার পাথর কোঁদা শরীর আর ভাবলেশহীন চোখমুখ দেখলে প্রাণহীন রোবট মনে হয়৷ গাড়ির পেছনের সিটে বসে আছে বীরবাহাদুর৷ তার কোলে অচৈতন্য গৌরী৷ বীরবাহাদুরের চোখমুখ লাল৷ বোঝা যায় যে সে প্রকৃতিস্থ নেই৷ চুল উস্কোখুস্কো, চোখ দুটো ভীত পশুর মতো ঘুরছে এদিক ওদিক৷ মাঝে মাঝে মেয়ের বুকে হাত রেখে দেখছে সব ঠিক আছে কি না৷ ঠোঁটে সবসময়ই যেন কী বিড়বিড় করছে৷
বীরবাহাদুরের পাশে যে বসে আছে তার দৈত্যের মতো চেহারা৷ মাথাটা গাড়ির ছাদ ছুঁই ছুঁই প্রায়৷ হাত দুটো থামের মতো মোটা৷ লোকটা কথা বলে না বললেই চলে৷ সারাক্ষণ ধরে কী একটা চিবিয়ে চলেছে৷ আর গাড়ি থামলে বীরবাহাদুরের কাছ ঘেঁষে থাকে৷
বীরবাহাদুর একবার বাইরে দেখার চেষ্টা করল৷ বুঝতে পারল না কোথায় এসেছে তারা৷ স্খলিতস্বরে একবার জিজ্ঞাসা করল, ‘হামলোগ কাঁহা তক আয়ে হ্যাঁয়?’
পাশের লোকটা তার মোটা থাবাটা বীরবাহাদুরের ঘাড়ে রেখে ইশারায় চুপ করতে বলল৷ ড্রাইভার লোকটা রিয়ার ভিউ মিরর দিয়ে দৃশ্যটা দেখে ফের রাস্তায় মন দিল৷ আর মাত্র দুটো দিন৷ তারপরেই অমরত্ব তাদের হাতের মুঠোয়৷
বিড়বিড় করতে করতে বীরবাহাদুর ফের মেয়েকে আঁকড়ে ধরে ঘুমিয়ে পড়ে৷ তার মাথার মধ্যে কে যেন বলে চলেছে খুব ভুল করছে সে৷ ভয়ানক, মারাত্মক ভুল৷
* * *
পার্ক হোটেলের বিছানায় গা এলিয়ে দিয়ে রাধিকা বলল, ‘আঃ, কী আরাম৷ আমি বাপু এখান থেকে এখনই নড়ছি না৷ কয়েকদিন থাকব, নিখিল আর নূপুরকে কলকাতা দেখাব, নিউমার্কেট থেকে চুটিয়ে শপিং করব৷ তারপর দার্জিলিং যাব৷’
অর্জুন জামা ছাড়তে ছাড়তে বলে, ‘জো হুকুম মেমসাহেব৷ গোটা পার্ক স্ট্রিট আর এসপ্ল্যানেড আপনার জন্যে কাঁদছে৷ দয়া করে দেখবেন, ব্যাঙ্ক ব্যালান্স যেন একেবারে ধসে না যায়৷’
রাধিকা হেসে ফেলল৷ কথাটা অর্জুন একদমই বাড়িয়ে বলেনি৷ কিছু কিছু শহরের সঙ্গে মানুষের আত্মিক টান থাকে৷ বোধহয় পূর্বজন্মের প্রারব্ধের টান৷ কলকাতার সঙ্গে রাধিকার টানটা বোধহয় সেরকমই৷
অথচ অর্জুনের সঙ্গে বিয়ে হওয়ার আগে রাধিকা কলকাতা কেন, পূর্ব ভারতের কোনও শহরেই আসেনি৷ তার জন্ম, পড়াশোনা, বড় হয়ে ওঠা সবই দিল্লিতে৷ কাজের সূত্রে মুম্বাইয়ে এসে অর্জুনের সঙ্গে পরিচয়, প্রণয় ও পরিণয়৷ আর সেই সূত্রেই রাধিকার কলকাতায় আসা৷
কলকাতায় প্রথমবার এসে রাধিকা একটা ধাক্কা খেয়েছিল৷ মনে হয়েছিল এই শহর যেন কত চেনা তার৷ প্রথমবার ট্রামে চড়ে মনে হয়েছিল এর আগেও যেন সে চড়েছে এই অতিধীর জড়দগব বাহনে৷ পার্ক স্ট্রিটে পা রেখে তার মনে হয়েছিল কত যুগ পরে সে আবার পা রাখল এই আলোকোজ্জ্বল সরণিতে৷ এসপ্ল্যানেডের উচ্চকিত বিকেল, উত্তর কলকাতার অথর্ব গলিখুঁজি, দক্ষিণ কলকাতার ঝলমলে স্মার্টনেস সবই তার মনে হয় যেন কত জন্মের চেনা৷ যেন সে কত জন্ম এই কলকাতার পথে হেঁটেছে, ভালোবেসেছে, জন্মেছে, মরে গিয়েছে৷
তাই একবার কলকাতা এলে তিন-চারদিন না কাটিয়ে অন্য কোথাও যায় না রাধিকা৷ একটু একটু করে এই শহরটা তার আত্মার অংশ হয়ে উঠেছে৷
অর্জুনও তার স্ত্রী’র এই কলকাতা প্রেমের ব্যাপারটা বেশ উপভোগ করে৷ তার অবশ্য তেমন টান নেই কলকাতা নিয়ে, সে ঘোর মুম্বাইয়া পাবলিক৷ মজা করে বউকে বলে, ‘আগের জন্মে তুমি শিওর বাঙালি মেয়ে ছিলে৷ শিলে মশলা বেটে মাছের ঝোল আর সুক্তো রান্না করতে৷ আর খোঁপা বেঁধে গরদের শাড়ি পরে পুজোয় অঞ্জলি দিতে যেতে৷’ রাধিকা শুনে মিটিমিটি হাসে৷ মাছের ঝোল আর সুক্তো, দুটোই ভালো পারে সে, মুম্বাইয়ে তাদের এক বাঙালি প্রতিবেশীর কাছ থেকে শিখেছে৷ আর পুজোয় পাওয়াইয়ের বাঙালি অ্যাসোসিয়েশনের পুজোতে অষ্টমীর অঞ্জলি দিতে তার কখনও ভুল হয় না৷
অর্জুনের রাতের ট্রেন, কাঞ্চনকন্যা এক্সপ্রেস৷ সে বেরিয়ে গেল কিছু কেনাকাটা করতে৷ রাধিকা স্নান করতে ঢুকল৷ একবার কালীঘাটে ছেলেমেয়েকে নিয়ে গিয়ে পুজো দিয়ে আসতে হবে৷ পুজো দিতে হবে অর্জুনের নামেও৷ বড্ড চাপ যাচ্ছে লোকটার ওপর৷
* * *
অর্জুনের সঙ্গে মৈত্রমশাইয়ের দেখা হল শিয়ালদা স্টেশনের গেটে৷ ভদ্রলোকের পরনে সেই শার্ট ট্রাউজার্স আর পা ঢাকা চামড়ার চপ্পল৷ তফাতের মধ্যে এবারে গায়ে একটা শাল জড়ানো৷ অর্জুনকে দেখে হেসে বললেন, ‘গরম জামাকাপড় সঙ্গে নিয়েছেন তো অর্জুনবাবু? দার্জিলিংয়ে কিন্তু এখন মারাত্মক ঠান্ডা৷ মুম্বাইয়ের লোকেদের পক্ষে সে শীত সহ্য করা মুশকিল৷’
অর্জুন হেসে ফেলল৷ কৌতুকের সুরে বলল, ‘দাদা, আমাকে সে ডকুমেন্টারি ফিল্মের শুটিংয়ের জন্য সারা ভারত ঘুরতে হয়৷ গত বছর লেহ লাদাখ অবধি ঘুরে এসেছি৷ দার্জিলিংয়ের ঠান্ডা কি তার থেকেও ভয়ানক?’
মৈত্রমশাইয়ের চোখে কৌতুকের ঝিলিক খেলে গেল৷ তিনি বললেন, ‘বটে? দার্জিলিংয়ের ঠান্ডাকে চ্যালেঞ্জ? দেখা যাক, কে জেতে, লাদাখ না দার্জিলিং৷’
অর্জুন হা হা করে হেসে উঠল৷ তারপর বলল, ‘বাই দ্য ওয়ে, রাতের জন্য লুচি আর মাংস নিয়ে এসেছি৷ চলবে তো?’
‘চলবে মানে? দৌড়বে৷’
‘আপনি মাংস খান?’
‘কী বলছেন মশাই? আমি ঘোর শাক্ত, মায়ের পুজোয় মাছের অন্নভোগ দিই৷ আর আমিষ ছাড়া বাঙালি বাঁচে নাকি?’
কথা বলতে বলতে দুজনে নিজেদের বার্থ খুঁজে নিলেন৷ ঠিক সাড়ে ন’টায় কাঞ্চনকন্যা যাত্রা শুরু করল নিউ জলপাইগুড়ির উদ্দেশ্যে৷
* * *
কালীঘাট থেকে বেরিয়ে এদিক-ওদিক খানিক হেঁটে রাধিকা বুঝতে পারল রাস্তা ভুল করেছে সে৷ অথচ এমন হওয়ার তো কথা নয়! প্রতি বছরই একবার করে এখানে পুজো দিতে আসে সে৷ তারপর খানিক হেঁটে বেড়ায় এদিক-ওদিক৷ এদিকের প্রায় সব রাস্তাই চেনা তার৷ রাস্তাটা গুলিয়ে গেল কী করে?
তখন সন্ধে হয়ে এসেছে৷ কলকাতা শহর সন্ধেবেলাতেই জেগে ওঠে৷ রাধিকার কানে কল্লোলিনীর বিপুল কলতান ভেসে আসছে৷ মানে বড় রাস্তা এখান থেকে বেশি দূরে নয়৷ অথচ সে যেখানে দাঁড়িয়ে আছে সেই পাড়াটা কেমন যেন নিঝুমমতো৷ বাড়িঘর সবই আছে৷ গলির রাস্তার পাশে গাড়ি পার্ক করা আছে৷ বাড়িতে বাড়িতে আলো, সিলিং ফ্যান চলছে৷
শুধু কোথাও কোনও আওয়াজ নেই৷
একটু পর রাধিকার খুব অদ্ভুত লাগতে লাগল৷ জঙ্গল বা মরুভূমি নয়, মহানগরী কলকাতার বুকে একটি পাড়ার মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে সে৷ বাড়িতে আলো জ্বলছে৷ ল্যাম্পপোস্ট-এর আলো আছে৷ প্রাণের সব লক্ষণ আছে৷ কিন্তু সাড়া নেই৷ কোনও বাড়ি থেকে কোনও শব্দ ভেসে আসছে না৷ কোনও সাংসারিক কথাবার্তা, টিভির আর্তনাদ, উচ্চকিত তর্কাতর্কি, গাড়ির আওয়াজ, কিছুই নেই৷ কোথাও একটা লোক, কুকুর বা বিড়াল কিচ্ছু দেখা যাচ্ছে না৷
রাধিকা এদিক-ওদিক তাকাল৷ এ তো ভারী আশ্চর্যের ব্যাপার! সন্ধে ছ’টার সময় কলকাতা শহরের একটা পাড়া এমন নির্জন, নিঃস্তব্ধ হতে পারে এ ভাবাই যায় না৷ ব্যাপারটা নিখিল আর নূপুরও লক্ষ্য করেছে৷ তারা ইতিউতি চাইছে৷ নিখিল একবার মায়ের হাতটা জোরে আঁকড়ে ধরল৷ তার মানে ভয় পেয়েছে ও৷
আর একটু এগিয়ে বাঁদিকে ঘুরল রাধিকা৷ আর তখনই দেখতে পেল দোকানটাকে৷ এই রাস্তাটা একটু এগিয়ে দুদিকে ভাগ হয়ে গেছে৷ সেই মোড়ে খুব সম্ভবত একটা পার্ক৷ অন্ধকারটা যেন ঝুপসি হয়ে পাকিয়ে আছে সেখানে৷ আর পার্কের বন্ধ গেটের ঠিক পাশে একটা গুমটি৷ আলো জ্বলছে৷ একটা লোকের অবয়বও দেখা যাচ্ছে সেখানে৷
স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল রাধিকা৷ যাক লোক যখন পাওয়া গেছে, তখন এখান থেকে বেরোনোর রাস্তাও পাওয়া যাবে৷
গুমটির কাছে গিয়ে রাধিকা দেখল একটা ছোট চায়ের দোকান৷ কলকাতার ফুটপাথে এমন দোকান অহরহ দেখা যায়৷ চায়ের স্টোভ আর তার সঙ্গে, সিগারেট, বাপুজি কেক, কয়েকটা বিস্কুট, এই সব নিয়ে ক্ষুদ্র সম্ভার৷ একটা লোক স্যান্ডো গেঞ্জি আর হাফপ্যান্ট পরে বসেছিল৷
রাধিকা গিয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘এখান থেকে মেন রোডে যাওয়ার রাস্তা কোনটা দাদা?’
লোকটা রাধিকার দিকে তাকাল না৷ যেমন উদাসভাবে আকাশের দিকে তাকিয়েছিল, তেমনই তাকিয়ে রইল৷ তারপর নিস্পৃহসুরে বলল, ‘মানুষ যে পথে হেঁটে পথ হারায়, সে পথেই পথ খুঁজে পায়৷ যে রাস্তায় হেঁটে দিশা হারিয়েছেন, সেই রাস্তাই আপনাকে ঠিক দিশা দেখাবে৷’
রাধিকা ঘাবড়াল না৷ সে জানে বাঙালিদের মধ্যে এরকম একটা অদ্ভুত পাগলামি আছে৷ দিল্লি বা মুম্বাইয়ে চায়ের দোকানি ফিলোসোফির কথা আওড়ালে অস্বাভাবিক লাগতে পারে৷ কলকাতায় এসব বিচিত্র কিছু না৷
সে আবার জিজ্ঞেস করতে যাবে বড় রাস্তাটা কোনদিকে, এমন সময় শুনল গুমটির পাশ থেকে কে যেন ক্ষীণস্বরে বলল, ‘কিছু খেতে দেবে মা?’
রাধিকা দেখল শতছিন্ন কাপড় পরা এক বুড়ি গুমটির পাশে গুটিশুটি মেরে বসে আছে৷ জায়গাটা গুমটির ছায়ায় অন্ধকার বলে চোখে পড়েনি৷ রাধিকা সেদিকে তাকাতে বুড়ি স্তিমিত স্বরে আবার বলল, ‘দুটি খেতে দেবে মা? আজ সারাদিন পেটে কিছু জোটেনি গো৷’
রাধিকা চেয়ে দেখল তার সামনে যেন একটুকরো ক্ষুধার্ত ভারতবর্ষ বসে আছে৷ পরনে ছেঁড়া কাপড়, পা খালি, উস্কোখুস্কো সাদা চুল আর কঙ্কালসার শরীর৷ বিবর্ণ হতশ্রী দুই চোখে অন্ধ আকুল প্রত্যাশা, যদি একটুকরো খাওয়ার পাওয়া যায়৷
রাধিকা কিছু বলার আগে নূপুর হাত বাড়িয়ে দোকানের বয়াম থেকে বিস্কুট আর কেক তুলে নিল৷ তারপর বুড়ির হাতে দিয়ে বলল, ‘খাও ঠাম্মি৷’
বুড়ির গলা থেকে ক্ষীণ শব্দ বেরোল, ‘জল, একটু জল দেবে মা?’
নিখিলের হাতে একটা মিনারেল ওয়াটারের বোতল ছিল৷ সে বোতলের ঢাকনাটা খুলে বুড়ির দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, ‘এই নাও৷ জল৷’
বুড়ির দু’বার হাত ওঠাবার চেষ্টা করেও পারল৷ না খেয়ে খেয়ে এমনই দুর্বল হয়ে গেছে বুড়ি, যে হাত তুলে জলের বোতলটা অবধি নিতে পারছে না৷ সেই দেখে নূপুর হাত বাড়িয়ে নিখিলের হাত থেকে বোতলটা নিল৷ তারপর পরম মমতায় বুড়ির মুখে জল ঢেলে দিতে থাকল৷
দেখতে দেখতে রাধিকার বুকটা গর্বে ফুলে উঠছিল৷ যাক, ছেলেমেয়েকে অন্তত এইটুকু যে শেখাতে পেরেছে, সেটাই বা কম কী?
বুড়ির জল খাওয়া শেষ হলে নিখিল আর নূপুর আবার মায়ের কাছে ফিরে এল৷ রাধিকা দু’জনের মাথায় একটু হাত বুলিয়ে দিল, নিচু হয়ে একটু চুমুও খেল৷ তারপর সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে দেখল সেই গুমটিও নেই, বুড়িও নেই৷ আর গলি থেকে বাঁদিকে তাকালেই দেখা যাচ্ছে বড় রাস্তার জনস্রোত৷
* * *
নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশনে নেমে গাড়ি খুঁজে পেতে অসুবিধা হল না৷ মৈত্রমশাই বেশ চমকিত হলেন, ‘আপনাদের কম্পানির সিস্টেম তো বেশ আধুনিক মশাই৷ আগে থেকেই সব ঠিক করা থাকে৷’ অর্জুন হেসে বলল, ‘সোফিয়া থাডানির হাউস বেশ বড় হাউস দাদা৷ এমপ্লয়িদের ট্যুর অ্যান্ড ট্রাভেলস ম্যানেজ করার জন্য ওদের আলাদা ডিপার্টমেন্টই আছে৷ এমনকি আমাদের দার্জিলিংয়ে হোটেলও বুক করা আছে৷’
মৈত্রমশাই বললেন, ‘এখনই দার্জিলিংয়ের জন্য রওনা দেব নাকি?’
অর্জুন বলল, ‘সেরকমই তো কথা ছিল৷ আমি অবশ্য হোটেলে থাকব না৷ দার্জিলিংয়ে আমার বাবা-মা থাকেন, আমি ওখানেই উঠব৷ আপনার জন্য হোটেল ঠিক করা আছে৷’
মৈত্রমশাই মাথা নেড়ে বললেন, ‘না মিস্টার সেনগুপ্ত৷ আমাদের দিন দুয়েক এখানে থাকতে হবে৷ একে তো আমাকে কিছু কেনাকাটা করতে হবে৷ দ্বিতীয়ত, শুনেছি এখানে একজন মস্ত বড় তন্ত্রবিদ থাকেন৷ তাঁর সঙ্গে একবার দেখা করতে হবে৷ আপনিও ব্যবহারিক তন্ত্র কী এবং কেন এ নিয়ে একটা ভালো ধারণা পেয়ে যাবেন৷ আপনার কাজও অনেকটা এগিয়ে যাবে৷’
অর্জুন ভুরু কুঁচকে বলল, ‘সে না হয় বুঝলাম৷ কিন্তু এই তান্ত্রিক ভদ্রলোক থাকেন কোথায়?’
‘জায়গাটার নাম নাগরাকাটা৷ এখান থেকে কয়েক ঘণ্টার রাস্তা৷ বেলাবেলি বেরোলে সন্ধের মধ্যে ফিরে আসা যাবে৷ কাল আমার কিছু জিনিস জোগাড় করার আছে৷ আপনি চাইলে শিলিগুড়ি ঘুরে দেখতে পারেন৷ তারপর পরশু সকালে দার্জিলিংয়ের জন্য রওনা দিলেই হল৷’
অর্জুন ইতস্তত করল, ‘সেক্ষেত্রে তো আজকের জন্য একটা হোটেল বুকিং করতে হয় সেটা তো হেড অফিসে বলে রাখিনি৷’
মৈত্রমশাই হেসে বললেন, ‘আরে মশাই, আপনাদের হেড অফিসের সঙ্গে যোগাযোগ আছে এমন হোটেল ছাড়া কি আর শিলিগুড়িতে হোটেল নেই? ডলি ইন-এ থাকবেন চলুন৷ ভালো ব্রেকফাস্ট দেয়, আর রাতে দুর্দান্ত ভালো মাটন করে মশাই, খেলেই মন ভালো হয়ে যাবে৷’
* * *
দুজনে যখন নাগরাকাটার পথে, তখন দুপুর প্রায় মাথার ওপর৷ চমৎকার ঝকঝকে রাস্তার দুধারে জঙ্গল আর চা-বাগানের দিগন্ত-উন্মোচিত উদার বিস্তার৷ মাথার ওপর ঝকঝকে আকাশ৷ উত্তরবঙ্গের নির্মল বাতাস গাড়ির জানলা বেয়ে মুখে ঝাপটা মারতেই মন ভালো হয়ে গেল অর্জুনের৷ মুম্বাইয়ে মানুষ হলে কী হবে, কর্মসূত্রে দেশের অনেক জায়গাই ঘুরতে হয়েছে তাকে৷ তবুও এই সজল সপ্রাণ স্নিগ্ধ বঙ্গভূমি প্রথম আলাপেই তার মন কেড়ে নিয়েছে৷ মনে হয় মায়ের আঁচল বিছিয়ে কে যেন তাকে ডাকছে, আয় আয় আয়৷
নাগরাকাটা পৌঁছে তান্ত্রিক ভদ্রলোকের ঠিকানা খুঁজে পেতে একটু বেগ পেতে হল৷ লোকের কাছ থেকে জিজ্ঞাসা করে দুজনে যে জায়গাটায় পৌঁছলেন সেটা একটা গ্রাম, নাম চম্পাগুড়ি৷ কাছেই একটা চা-বাগান আছে, নাম কুর্তি টী গার্ডেন৷ এখানে অবশ্য চারিদিকেই চা-বাগান৷ নাগরাকাটা টী গার্ডেন তো আছেই৷ তাছাড়াও আছে নয়াসইলি, গাটিয়া, লুকসান, গ্রাসমোর, আরও কত কী৷
যেতে যেতে অর্জুন জিজ্ঞেস করল ‘যাঁর সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছি তাঁর নাম কী?’
‘ভদ্রলোকের নাম কালিকিঙ্কর ভট্টাচার্য৷ এককালে স্থানীয় স্কুলে শিক্ষকতা করতেন৷ এখন সেসব ছেড়ে হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা, স্কুলছুটদের স্কুলে ফিরিয়ে আনা, লাইব্রেরি স্থাপন, রক্তদান শিবির এসব করে বেড়ান৷ তবে প্রধান কাজ হচ্ছে তন্ত্রচর্চা৷ এই এলাকায় ঝাড়ফুঁক, তুকতাক, তাবিজ কবচ এসবের প্রচলন খুব৷ ভট্টাচার্যমশাই এ লাইনে একেবারে ধন্বন্তরি বললেই চলে৷ এলাকার কোনও শুভ কাজ তাঁকে ছাড়া হওয়ার জো নেই৷ পুংসবন থেকে শ্রাদ্ধশান্তি সবেতেই ভট্টাচার্যমশাই৷ এলাকার পঞ্চায়েত থেকে শুরু করে এমএলএ অবধি কালিকিঙ্কর ভট্টাচার্যর পারমিশন না নিয়ে ইলেকশন ক্যাম্পেইন শুরু করেন না৷ তবে আমি যা শুনেছি, ভদ্রলোকের তন্ত্র নিয়ে পড়াশোনা প্রচুর৷ আমাদের কাজে লাগবে সেইটে৷’
গ্রামের ঢোকার মুখে একটা বড় বটগাছ৷ তার নীচে বাঁধানো বেদিতে কয়েকজন লোক অলস ভাবে বসেছিল৷ মৈত্রমশাই লক্ষ্য করলেন যে বসার ভঙ্গি অলস হলেও চোখ সতর্ক৷ গাড়িটাকে দেখেই তাদের একজন চেঁচিয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘যাবেন কোথায়?’
মৈত্রমশাই চেঁচিয়ে বললেন, ‘কলকাতা থেকে আসছি৷ কালিকিঙ্কর ভট্টাচার্য’র বাড়ি কি এদিকেই?’
গাঁট্টাগোট্টা চেহারার একজন নেমে এল, ‘চলুন, পৌঁছে দিয়ে আসি৷’
ভট্টাচার্য মশাই দাওয়াতে বসে কোষ্ঠীবিচার করছিলেন৷ সামনে লম্বা লাইন৷ কেউ এসেছে হাত দেখাতে, কেউ হোমিওপ্যাথি ওষুধ নিতে, কেউ সরকারি দপ্তরে পাঠাবে বলে চিঠি লেখাতে৷ সঙ্গে আসা লোকটি চেঁচিয়ে বলল, ‘ঠাকুরমশাই, এঁরা কলকাতা থেকে এসেছেন, আপনার সঙ্গে আলাপ করবেন বলে৷’
কালিকিঙ্কর চোখ তুলে তাকালেন৷ ফর্সা ঋজু দেহ৷ মাথায় অল্প চুল, সবই সাদা৷ উন্নত কপাল, খাড়া নাক আর দুখানি অন্তর্ভেদী চোখ৷ পরনে গেরুয়া ধুতি আর চাদর, গলায় একগাছা রুদ্রাক্ষমালা৷ অর্জুনের মনে হল একবার যেন মেপে নিলেন দুজনকে৷ তারপর স্মিত হেসে বললেন, ‘আসুন, গরিবের ঘরে স্বাগত৷ কী সাহায্য করতে পারি বলুন৷’
বাকিরা ঠাকুরমশাইয়ের ইশারায় উঠে পড়ল৷ অর্জুন আর মৈত্রমশাইয়ের জন্য চেয়ার এল ভেতর থেকে৷ দুজনেই ভটচাজমশাইকে প্রণাম করে চেয়ারে বসলেন, নিজেদের পরিচয় দিলেন৷ মৈত্রমশাই বললেন, ‘বলুন, কী সেবা করতে পারি?’
মৈত্রমশাই বললেন, ‘আমরা দুজনে একটা বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে আপনার কাছে এসেছি৷ আমার এই সঙ্গীর নাম অর্জুন সেনগুপ্ত, থাকেন বম্বেতে৷ ইনি পেশায় ডকুমেন্টারি ছবি বানান৷ অর্জুনবাবু ঠিক করেছেন তন্ত্র নিয়ে একটা ডকুমেন্টারি বানাবেন৷ তাই আপনার কাছে আসা৷ প্রধান উদ্দেশ্য তন্ত্র কী সেই সম্পর্কে একটা প্রাথমিক ধারণা করা৷ দ্বিতীয় উদ্দেশ্য এই ছবির ব্যাপারে যদি কোনও তান্ত্রিক ক্রিয়াকলাপ করে দেখাতে পারেন তো সেটা ইনি নিজের ক্যামেরায় বন্দি করতে পারেন৷’
ভটচাজমশাই কিছুক্ষণ চুপ রইলেন৷ তারপর বললেন, ‘তন্ত্র হচ্ছে পৃথিবীর আদিতম ধর্ম৷ প্রকৃতি মা যে ধর্ম নিজে মানবসভ্যতাকে শিখিয়েছেন, তাকেই আমরা ইংরেজিতে পেগান ধর্ম বলি৷ আর ভারতবর্ষের আধ্যাত্মিক আত্মা সেই প্রাকৃতধর্মকে আরও পরিশোধিত করে, আরও উন্নত করে তার নাম দিয়েছে তন্ত্র৷
তন্ত্র শব্দের সাধারণ অর্থ জ্ঞানের বিস্তারসাধন করা, ‘তনোতি বিস্তারং করোতি’, অথবা তন্যতে বিস্তার্যতে জ্ঞানং অনেন ইতি তন্ত্রম৷ অথবা তনোতি বিপুলং অর্থং তন্ত্র-তত্ব-সমন্বিতম এনঞ্চ কুরুতে যস্মাৎ তন্ত্রং ইত্যভিধীয়তে৷’ তন্ত্র তাই কোনও ধর্ম নয়, তন্ত্র একটি আচরণবিধি৷ সংসার ধর্ম ত্যাগ করে তবে পরমার্থ পাওয়ার সাধনা তন্ত্র স্বীকার করে না৷ তন্ত্র বাস্তববাদী৷ বস্তুতন্ত্রকে স্বীকার করে তার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে তন্ত্রের সাধনবিধি তৈরি হয়েছে৷ তাই তন্ত্রের মধ্যে দার্শনিক মতবাদ থাকলেও তা বড় কথা নয়৷ এখানে মূলত মানবদেহকে যন্ত্রস্বরূপ করে কতগুলি গুহ্য সাধনপদ্ধতির সন্নিবেশ ঘটে থাকে, যে পদ্ধতি আদতে সাধনশাস্ত্র ও শক্তিসাধনায় সিদ্ধিলাভের পথে দিশারী৷’
অর্জুন প্রশ্ন করল, ‘এই তন্ত্রসাধনার ইতিহাস কত পুরনো?’
‘ওই যে বললাম, যবে থেকে মানবসভ্যতা শুরু হয়েছে, তবে থেকে তন্ত্রের উৎপত্তি৷ অথর্ববেদেই রহস্যমার্গ সাধনপদ্ধতির উল্লেখ আছে৷ আর তন্ত্রের প্রধান ধারাই তো মাতৃকাসাধনা৷ যে মাতৃকাসাধনার ধারা তুরস্ক, পারস্য, মেসোপটেমিয়া, এশিয়া মাইনর, সিরিয়া, ইজিপ্ট, চীন সর্বদেশেই ব্যাপৃত ছিল৷ তবে ভারতবর্ষে মাতৃকাউপাসনার যেমন প্রকাশ, তেমনটা আর কোথাও দেখা যায় না৷ এ আমাদের দেশের জলহাওয়ার গুণ বলতে পারেন৷’
অর্জুন একটু ইতস্তত করে বলল, ‘তন্ত্রে অনেক অদ্ভুত রিচুয়ালসের কথা শোনা যায়৷ যার অনেকগুলোই মানে ইয়ে., শুনলে ভালো লাগে এমন নয়৷ এ নিয়ে কিছু বলবেন?’
ভটচাজমশাই একটা রহস্যময় হাসি হাসলেন৷ ‘তন্ত্রের পথ সহজ পথ নয় সেনগুপ্ত সাহেব৷ কথায় বলে বাঘের পিঠে সওয়ার হয়ে কালকেউটের মাথা চেপে ধরার সাহস যদি থাকে, তবেই এই পথে অগ্রসর হওয়া উচিত৷ এই পথ রহস্যমার্গ৷ কুণ্ডলিনীতত্ত্ব, শরীরজ্ঞান, পঞ্চ ম’কার সাধনা, বীরসাধনা, চক্রানুষ্ঠান, মন্ত্রসিদ্ধি এসবের অধিকারী হওয়া মুখের কথা নয়৷ গুরুর আদেশ ছাড়া এ পথে অগ্রসর হওয়া কঠোরভাবে নিষিদ্ধ৷ তন্ত্রে বলে তনুকে যা ত্রাণ করে তাই তন্ত্র৷ আমরা বলি যা নেই এই দেহভাণ্ডে, তা নেই ব্রহ্মাণ্ডে৷ এই দেহসাধনার পথ ধরে নির্বাণে উত্তরণ, এই হচ্ছে তন্ত্রের মূলকথা৷ দুঃখের কথা হচ্ছে নিম্নশ্রেণীর সাধকেরা অনেক ঘৃণ্য পথ আশ্রয় করে লোকের ক্ষতি করার জন্য৷ তাতে তন্ত্রের নামের থেকে বদনাম হয় বেশি৷’
মৈত্রমশাই বললেন, ‘আপনি ষটকর্মের কথা বলছেন কি?’
‘সে তো বটেই৷ মারণ, উচাটন, বশীকরণ, স্তম্ভন, বিদ্বেষণ, ও স্বস্ত্যয়ন, এই হচ্ছে কৃষ্ণষটকর্ম৷ এতে লোকের ক্ষতি তো হয়ই৷ যারা এই ষটকর্ম করে তাদেরও খারাপ বই ভালো হয় না৷ আর এসব কুপ্রথাকেই লোকে তন্ত্র বলে মেনে নিয়েছে৷’
‘কিন্তু এই ষটকর্ম ছাড়া আরও তো অনেক ভয়ঙ্কর প্রথা আছে তন্ত্রে৷ যেমন ধরুন বলিদান প্রথা৷’
‘বলিদান প্রথা শুধু তন্ত্রে আছে বলছেন কেন? দেবতার উদ্দেশ্যে পশু বলি, এ তো যে কোনও ধর্মেই আছে৷ ধর্মের ইতিহাসে পশুবলির ধারা অতি প্রাচীন৷ এই প্রথা ইসলামে আছে, খ্রিস্টান ধর্মে আছে, ইহুদিদের মধ্যেও পশু উৎসর্গের প্রথা আছে৷ ভারতেও বৈদিক যাগযজ্ঞের অন্যতম অংশই ছিল পশুবলি৷
যে কোনও তান্ত্রিক সাধনায়, বা মাতৃপূজায় বলি আবশ্যক৷ বলির রক্তে দেবী প্রীত হন৷ শাস্ত্রে বলে ‘পশুঘাত পূর্বক রক্তশীর্ষয়োর্বলিত্বং৷ স্থানে নিয়োজয়েন্দ্রক্তং শিরশ্চ সপ্রদীপকম৷ এবং দত্বা বলিং পূর্ণং ফলং প্রাপ্নোতি সাধকঃ৷’ অর্থাৎ পশু হনন করে তার রক্ত ও মুণ্ড উপহার দিতে হয়৷ কারণ বিধি আছে, হত পশুর রুধির ও মুণ্ড প্রদীপের সঙ্গে যথাস্থানে স্থাপন করবে৷ সাধক এইভাবে বলি প্রদান করলে পূর্ণ ফল প্রাপ্ত হয়৷’
অর্জুন বলল, ‘আমরা অনেক সময় দেশের বিভিন্ন প্রান্তে নরবলিরও খবর পাই৷ শোনা যায় সেসব নাকি বিভিন্ন তান্ত্রিকদের উসকানিতেই হয়েছে৷ তন্ত্রে কি সত্যিই নরবলির বিধান আছে?’
উসকানি শব্দটা শুনে ভটচাজমশাই বোধহয় কিঞ্চিৎ অপ্রসন্ন হলেন৷ গম্ভীরস্বরে বললেন, ‘দেখুন, নরবলি দেশের আইনে নিষিদ্ধ, তাই তাতে প্রশ্রয় দেওয়া আইনের চোখে অপরাধ তো বটেই৷ তবে নরবলির ইতিহাস সুপ্রাচীন৷ এ নিয়ে লম্বা আলোচনা করতে পারি৷ তবে আপনাদের মনে হয় সে সময় নেই৷ বেদেও নরবলির ভূরি ভূরি উদাহরণ আছে৷ আর তন্ত্রের কথা যদি বলেন, তবে বলি, হ্যাঁ, তন্ত্রের নরবলির বিধান আছে৷ দেবীর সামনে কী কী বলি দেওয়া যায় কালিকাপুরাণে তার লম্বা তালিকা আছে৷ সবধরনের পাখি, কচ্ছপ, কুমির, শুয়োর, ছাগল, মোষ, গোসাপ থেকে শুরু করে মানুষ অবধি৷ শাস্ত্রে নরবলিকে বলে অতিবলি৷ ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণ বলছে দুর্গাদেবী মেষ বা কুষ্মাণ্ডে একবছর, ছাগল বা কৃষ্ণসার মৃগে দশ বছর, মহিষে শতবর্ষ এবং নরবলিতে সহস্র বছর প্রীত হয়ে থাকেন৷’
মৈত্রমশাই মৃদুস্বরে বললেন, ‘কিন্তু ভটচায্যিমশাই, বেদে কিন্তু নরবলি হত না৷ বৈদিকযুগে নরবলি ছিল প্রতীকী৷ বধ্য পুরুষকে যজ্ঞস্থলে এনে পর্যাগ্নিকরণ নামের একটা অনুষ্ঠান, যাতে বধ্যমানুষটির গলায় যজ্ঞাগ্নি ছুঁইয়ে দেওয়া হয়, করে তাকে ছেড়ে দেওয়া হত৷ আপনি তো তন্ত্রজ্ঞ, শাস্ত্রজ্ঞ মানুষ, সত্যি করে বলুন তো, মা কি কখনও তাঁর সন্তানের বলি চাইতে পারেন? আপনি ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণের কথা তুললেন৷ ওই পুরাণেই তো এই কথাও আছে, ‘বলিদানেন বিপ্রেন্দ্র দুর্গা প্রীতি ভবেন্নৃণাং৷ হিংসাজন্যঞ্চ পাপঞ্চ লভতে নাত্র সংশয়ঃ৷’ অর্থাৎ বলিদান দ্বারা দুর্গাদেবী প্রীত হন বটে, কিন্তু সেই কার্যে মনুষ্যগণ হিংসাজনিত পাপও অর্জন করে৷’
ভট্টাচার্যমশাই দৃশ্যতই অপ্রসন্ন হলেন, বললেন,‘তাহলে আপনার কী মত? তান্ত্রিক পূজায় বলিবিধির কী উদ্দেশ্য?’
মৈত্রমশাই বললেন, ‘আপনি কালিকাপুরাণের কথা তুললেন৷ কালিকাপুরাণেরই সদাচার অধ্যায়ে আছে, রাজা হোম দ্বারা দেবগণের, শ্রাদ্ধ ও দান দ্বারা পিতৃগণের এবং বলিদান দ্বারা ভূতগণের পূজা করবেন৷ দেবীপুরাণেও বলছে শিবা ও নাগগণের বলি পায়স, পিতৃ ও দেবগণের বলি তিলমিশ্রিত অন্ন, যক্ষগণের বলি ঘৃত ও মধু, দেবীগণের বলি মোদক এবং দৈত্যদের বলি মৎস্য ও মাংস৷ ওই একই পুরাণে আছে দেবদেবীদের পূজা ধূপদীপ ও হোম ইত্যাদির মাধ্যমে করবে, পিশাচ, দানব ও রাক্ষসদের পূজা মদ্যমাংস দ্বারা করবে৷ আরও শুনুন, দেবীপুরাণেই আছে, নবমীতে অজ মেষ মহিষাদি পশু বধ করে ভূত ও বেতালদের বলি উপহার দিতে হয়৷ যদি শাস্ত্রের কথাই তুললেন ভট্টাচার্যমশাই, তাহলে বলতে হয় বলিপ্রথা দেবীর ভূতানুচরদের তৃপ্ত করার জন্য৷ যিনি সর্বপ্রেমময়ী স্নেহময়ী জগন্মাতা, তাঁর বলির রক্তে বিন্দুমাত্র রুচি নেই৷’
ভট্টাচার্যমশাই বড় অর্থপূর্ণ হাসলেন৷ বললেন, ‘লোকে রক্তলোলজিহ্বা, অতিবিস্তারদশনা, মহাঘোরা, মহাভয়ঙ্করী মায়ের পূজা করে কেন মৈত্রমশাই? কামার্থে ক্রিয়তে ধর্ম৷ কোনও কিছু কাম্যবস্তুর জন্যই তো মায়ের আরাধনা করি আমরা৷ তাছাড়া শাস্ত্রেই যখন বলির বিধান আছে…’
মৈত্রমশাই বললেন, ‘কিন্তু ভটচাজমশাই, বৃহস্পতিঠাকুর স্বয়ং আজ্ঞা করেছেন, ‘কেবলং শাস্ত্রমাশ্রিত্য ন কর্তব্যো বিনির্ণয়ঃ৷ যুক্তিহীন বিচারে তু ধর্মহানি প্রজায়তে৷’ কেবল শাস্ত্রের কথায় কোনও সিদ্ধান্ত নেওয়া কর্তব্য নয়৷ বিচার যদি যুক্তিহীন হয়, তবে তাতে ধর্মহানি হয়ে থাকে৷’
ভট্টাচার্যমশাই কিছুক্ষণ মাথা নীচু করে বসে রইলেন৷ তারপর যখন তিনি মাথা তুললেন তখন তাঁর চোখ ঈষৎ ঘোলাটে হয়ে এসেছে৷ তিনি সামান্য শ্লেষ্মাজড়িতস্বরে বললেন, ‘শাস্ত্রের ব্যাখ্যা বিভিন্ন লোক বিভিন্নভাবে করে থাকে মৈত্রমশাই৷ সে তর্কে আমাদের কাজ নেই৷ কথায় বলে বিশ্বাসে মিলায় বস্তু, তর্কে বহুদূর৷ আপাতত আপনারা যে কাজে আমার কাছে এসেছেন তার কারণ বলুন৷’
অর্জুন বলল, ‘এই যে বিভিন্ন তান্ত্রিক রিচুয়ালসের আপনি নাম বললেন, তার কোনও একটা আমাদের সামনে পারফর্ম করতে পারবেন? আমাদের মানে ক্যামেরার সামনে৷ আমরা দেশের বিভিন্ন তান্ত্রিক ক্রিয়াকলাপের ওপর একটা ডকুমেন্টারি করছি৷ তাই জন্যই আপনার কাছে আসা৷ এর জন্য দরকার হলে উপযুক্ত সাম্মানিক দিতেও রাজি আছি৷’
মৈত্রমশাইয়ের মনে হল কালিকিঙ্কর ভট্টাচার্য’র চোখ দুটো একবার দপ করে জ্বলে উঠেই নিভে গেল৷ তিনি গম্ভীরমুখে বললেন, ‘আমরা নাচিয়ে বা গাইয়ে নই মিস্টার সেনগুপ্ত যে দুটো পয়সার বিনিময়ে আমাদের বিদ্যে নিয়ে ক্যামেরার সামনে পারফর্ম করব৷ তন্ত্র লোকসমক্ষে দেখাবার জিনিস নয়, নিভৃতে অনুশীলনের জিনিস৷ আমি দুঃখিত, আপনার অনুরোধ রাখতে পারলাম না৷ তবে তন্ত্র কী এবং কেন এই নিয়ে যদি আমার মন্তব্য ক্যামেরাবন্দী করতে চান তাহলে অবশ্যই পারেন৷ তার জন্য কোনও টাকা লাগবে না৷’
অর্জুন অপ্রস্তুত হল৷ বিব্রতস্বরে বলল, ‘কিছু মনে করবেন না প্লিজ৷ কথাটা আমার ওভাবে বলা উচিত হয়নি৷ আসলে আমি আমার ডকুমেন্টারির উদ্দেশ্য নিয়ে বলছিলাম৷ ঠিক আছে, আপনি যদি তন্ত্রের ব্যাপারে একটা প্রাথমিক আইডিয়া দেন তাতেও আমাদের অনেকটা উপকার হবে৷ কবে পারবেন জানাবেন কাইন্ডলি৷ আমরা কাল অবধি শিলিগুড়ির হোটেল ডলি ইন-এ আছি, পরশু দার্জিলিংয়ের জন্য বেরোব৷ যদি কালকের মধ্যে না হয়, আমরা দার্জিলিং থেকে ফেরার পথেও আপনার ইন্টারভিউটা নিতে পারি৷’
ভটচাজমশাই বললেন, ‘আচ্ছা, আমি জানিয়ে দেব, কেমন? এখন আমার স্নান খাওয়ার সময়, আমাকে এবার উঠতে হবে৷’
দুজনে উঠে আসার আগে মৈত্রমশাইয়ের দিকে ফিরলেন কালিকিঙ্কর, ‘আপনার সঙ্গে একদিন আলাদা করে আলাপ করার ইচ্ছে রইল৷ আপনার দেহলক্ষণ বলছে আপনি কোনও সাধারণ মানুষ নন৷ খুব সম্ভবত কর্কট রাশি, কুম্ভ লগ্ন৷ চতুর্থে বৃহস্পতি, বুধাদিত্য যোগ আছে৷ নবমে শনি৷ কি, ঠিক বলছি তো মৈত্রমশাই?’
মৈত্রমশাই কিছু বললেন না৷ অল্প হেসে নমস্কার করে বললেন, ‘দেখা হবে ভটচাজমশাই৷ আপাতত আসি৷’
* * *
অন্ধকার ঘরে অস্থির পায়ে পায়চারি করছিলেন কালিকিঙ্কর ঠাকুর৷ কোনায় একটা হ্যারিকেন জ্বলছে৷ নিভু নিভু হয়ে এসেছে তার আলো৷ ঘরের মধ্যে জমাট অন্ধকার ঘাপটি মেরে বসে আছে, সুযোগ পেলেই ঝাঁপিয়ে পড়বে বলে৷
দুজন বলশালী লোক দরজার দুদিকে নিশ্চল নিস্তব্ধ দাঁড়িয়েছিল৷ তাদের নির্বিকার মুখে কোনও ভাব খেলছিল না৷ কিন্তু শরীরের পেশির টানটান ভাব বুঝিয়ে দিচ্ছিল প্রভুর যে কোনও আদেশ পালন করতে তাদের শরীর আর মন উদগ্রীব হয়ে আছে৷
লোকটা খানিক পর পায়চারি থামিয়ে বলল, ‘বীরবাহাদুর আর ওর মেয়ে কোথায়?’
একজন উত্তর করল, ‘আমাদের কাছেই আছে ঠাকুর৷ আপনার ওষুধ খাইয়ে রেখেছি৷ দুজনেই ঘুমোচ্ছে৷’
লোকটা আবার পায়চারি করতে লাগল৷ তারপর অন্যমনস্ক স্বরে বলল, ‘ভালো না, লক্ষণ ভালো না৷’
‘কী ভালো না ঠাকুর?’
‘কাল অমাবস্যা৷ কালই বলিদানের প্রকৃষ্ট সময়৷ তিথি নক্ষত্র সব অনুকূল, এমন সুযোগ হয়তো হাজার বছরে একবার আসে৷ আর আজই ওকে এখানে আসতে হল?’
‘কার কথা বলছেন ঠাকুর?’
হ্যারিকেন-এর নিভু নিভু আলোয় কালিকিঙ্কর ভট্টাচার্য’র মুখটা নিষ্ঠুর আর ভয়ঙ্কর দেখাচ্ছিল৷ তিনি দাঁতে দাঁত চিপে বললেন, ‘ওই যে কলকাতা থেকে এসেছে, কী এক মৈত্র৷ ও যদি এখানে থাকে তাহলে আমাদের সমস্ত কাজ ভণ্ডুল করে দিতে পারে৷’
একজন ইতস্তত করে জিজ্ঞেস করল, ‘কিন্তু ও জানবেই বা কী করে আমরা কী করতে চলেছি? আর যদি জানেও বা, ভণ্ডুল করতে যাবেই বা কেন?’
‘পারে পারে, ও সব পারে৷ আমি দেহলক্ষণ চিনি৷ ও অতি উচ্চমার্গের সাধক, কোটিতে একজন এমন হয়৷ আজ আমরা যা করতে চলেছি তা এর আগে কেউ করেনি৷ জেনে রাখো, যে কোনও বড় মাপের চিন্তা বা উদ্যোগের একটা স্পন্দন হয়৷ মহাজাগতিক স্পন্দন৷ সবাই সেই স্পন্দন টের পায় না৷ যারা পায় তারা ঈশ্বরের বিশেষ আশীর্বাদ নিয়ে এসেছে৷ ও সেই মানুষ৷ ও চাইলে আমাদের সব উদ্যোগ পণ্ড করে দিতে পারে৷ ওকে আটকাতে হবে৷’
‘কিন্তু ঠাকুর, উনি যদি আমাদের কাজে কোনও বাধা না দেন, তাহলে তো আটকাবার প্রশ্ন ওঠে না৷’
‘না না না,’ অস্থির হয়ে ওঠেন কালিকিঙ্কর ঠাকুর, ‘কোনও ঝুঁকি নেওয়া যাবে না৷ আমরা আমাদের সাধনার শেষ চরণে এসে পৌঁছেছি৷ এ সুযোগ এ জীবনে আর আসবে না৷ এখন যদি বিন্দুমাত্র ব্যাঘাত ঘটে তাহলে আমাদের এতদিনের স্বপ্ন, সাধনা, চেষ্টা সব ব্যর্থ হয়ে যাবে৷’
‘তাহলে উপায়?’
অনেকক্ষণ চুপ থাকেন কালিকিঙ্কর ঠাকুর৷ তারপর ধীরস্বরে বলেন, ‘কাঁটা দিয়ে কাঁটা তুলতে হবে, বুঝলি৷ যে উদ্দেশ্যে ওরা আমার কাছে এসেছিল, সে উদ্দেশ্য আমি সফল করব৷ আর সেটাই হবে ওস্তাদের মার৷
তোরা এক কাজ কর৷ কাল সকালে তোরা যে হোটেলে ওরা উঠেছে ওখানে চলে যা৷ ওই যে সেনগুপ্ত নামের সিনেমা করিয়ে লোকটা ছিল, মৈত্র’র চোখের আড়ালে তার সঙ্গে দেখা কর৷ খেয়াল রাখবি, ও যেন সম্পূর্ণ একা থাকে তখন৷ সেনগুপ্ত’র সঙ্গে ফোনে আমার কথা বলা৷ বাকিটা আমি দেখছি৷ আর কাল রাতের ব্যবস্থা যেন নিখুঁত হয়৷ সেদিকে লক্ষ্য রাখিস৷ বিন্দুমাত্র ত্রুটি যেন না হয়৷’
দুজনে কোনও কথা বলল না৷ ঠাকুরকে প্রণাম করে বেরিয়ে গেল৷ কালিকিঙ্কর ঠাকুর ভ্রু কুঁচকে বসে রইলেন৷’
* * *
রিসেপশন থেকে ফোন পেয়ে অবাক হল অর্জুন৷ এখানে তাকে কেউ চেনে না৷ তার সঙ্গে দেখা করতে কারা এল? দেখা করাটা কি উচিত হবে?
কাল রাতে মৈত্রমশাই যে কাণ্ডটা করেছেন তাতে বেশ হকচকিয়ে গেছিল অর্জুন৷ নাগরাকাটা থেকে ফেরত আসার সময় অর্জুনের জন্মসময় আর জন্মস্থান জেনে নিয়েছিলেন মৈত্রমশাই৷ তারপর রাতের খাওয়াদাওয়া করে অর্জুন ঘুমোবার উদ্যোগ করছে, এমন সময় মৈত্রমশাই ইন্টারকমে অর্জুনকে ফোন করে বললেন, ‘একবার আমার ঘরে আসতে পারবেন?’
মৈত্রমশাইয়ের ঘরে গিয়ে আশ্চর্য হয়ে গেল অর্জুন৷ ঘরের মধ্যে অস্থিরভাবে পায়চারি করছেন৷ চুল উস্কোখুস্কো৷ অথচ সন্ধেবেলাতেই তো সব ঠিক ছিল৷ এই ক’ঘণ্টার মধ্যে কী হল ভদ্রলোকের?
অর্জুন ঘরে ঢোকামাত্র প্রায় দৌড়েই এলেন কে এন মৈত্র৷ অর্জুনের হাত ধরে উত্তেজিত স্বরে বললেন, ‘একটা কথা বলি সাহেব, কাল যাই হোক, কোনও পরিস্থিতিতেই ঘরের বাইরে বেরোবেন না৷ চন্দ্র সূর্য এদিক ওদিক হয়ে গেলেও না৷ আমার কথা যদি না শোনেন তাহলে মহা অনর্থ হয়ে যাবে৷’
অর্জুন হতভম্বের মতো চারিদিকে চেয়ে দেখল৷ সারা খাট জুড়ে খাতার পাতা ছড়িয়ে আছে৷ তাতে কোষ্ঠীছক আঁকা আর জ্যোতিষ গণনা করা৷
অর্জুন অবাক হয়ে বলল, ‘কীসের কী অনর্থের কথা বলছেন মিস্টার মৈত্র? ঘর থেকে বেরব নাই বা কেন? আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না৷’
মৈত্রমশাই ফিসফিস করে বললেন, ‘আপনার সঙ্গে দেখা হওয়ার পর থেকেই আমার একটা সন্দেহ হচ্ছিল মিস্টার সেনগুপ্ত৷ আমি সর্বনাশের গন্ধ পাই সাহেব, মৃত্যুর গন্ধ পাই৷ সেই আসন্ন মহাসর্বনাশ আপনার শিরে সর্পাঘাত করার জন্য উদ্যত হয়েছে৷ তাই আপনার জন্মসময় আর জন্মস্থান নিলাম৷ সারা রাত ধরে আপনার ছক দেখেছি সাহেব৷ আপনার জীবনে একটা ঝড় আসতে চলেছে, মস্ত বড় ঝড়, যা আপনার জীবন তছনছ করে দেবে৷ আর সেই ঝড় আসবে এক অতি ভয়ঙ্কর কালরাত্রির রূপ ধরে৷
আমার গণনা বলছে কালকের রাতই সেই কালরাত্রি৷ কাল দয়া করে আপনি এই হোটেলের বাইরে বেরোবেন না, আমার অনুরোধ৷ আমি যাচ্ছি একটা বিশেষ ব্যক্তিগত কাজে, আমাকে যেতেই হবে, উপায় নেই৷ পরশু সকালের আগে আমি ফিরব না৷ কিন্তু দোহাই আপনার, পৃথিবী এদিক থেকে ওদিক হয়ে যাক, আপনি কিন্তু হোটেলের রুমের বাইরে পা রাখবেন না৷’
অর্জুন বিস্মিত হয়ে গেল৷ অবাক স্বরে বলল, ‘কী বলছেন আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না৷ কাল রাতে আমার সর্বনাশ হবে? আপনি নিশ্চিত? আমার ভবিষ্যৎ এত স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছেন? কে আপনি? এত ক্ষমতা পেলেন কোথা থেকে?’
কথাটা শুনে ঘুরে দাঁড়ালেন মৈত্রমশাই, ‘শুনুন সেনগুপ্ত সাহেব, আমার নাম কৃষ্ণানন্দ মৈত্র৷ আমি আগমশাস্ত্রে কিছু অধিকার রাখি, তাই আমার একটা অন্য উপাধিও আছে, আগমবাগীশ৷ লোকে ডাকে কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ৷ মা চিদানন্দময়ী আনন্দস্বরূপিণীর দীন সন্তান আমি৷ কিন্তু জগন্মাতা মহামায়া আমাকে কিছু বিশেষ ক্ষমতা দিয়েছেন৷ তন্ত্রশাস্ত্র আমার অধিগত বিদ্যা সাহেব, চন্দ্র সূর্য এদিক-ওদিক হতে পারে, কিন্তু আমার গণনা আজ অবধি মিথ্যা হতে দেখিনি৷ আমার কথা শুনুন৷ এই এখন থেকে পরশু সকালে আমি ফিরে আসা না পর্যন্ত ঘরের বাইরে বেরোবেন না৷ এর যেন অন্যথা না হয়৷’
* * *
লোকদুটোর সঙ্গে কথা বলে অর্জুন দোলাচলে ভুগছিল, বেরোনো উচিত নাকি উচিত নয়? লোকদুটো তার ঘরেই বসে আছে৷ মনে হচ্ছে তাকে না নিয়ে বেরোবে না৷ অবশ্য তারা যে প্রস্তাবটা এনেছে তা অর্জুনকে ঘর থেকে বার করার জন্য যথেষ্ট৷ এর জন্যেই তো এতদূর এসেছে সে৷
লোকদুটো এসে বিনা বাক্যব্যয়ে নিজেদের মোবাইল থেকে কাকে একটা কল করে ফোনটা ধরিয়ে দিয়েছিল অর্জুনকে, বলেছিল ঠাকুরমশাই কথা বলতে চান৷
কালিকিঙ্কর ঠাকুর যে প্রস্তাব দিয়েছিলেন সেটা শুনে অর্জুনের নিজের কানকেই বিশ্বাস হচ্ছিল না৷ উনি বলছিলেন যে সারা রাত ভেবে উনি স্থির করেছেন তন্ত্রবিদ্যার আরও প্রসার এবং প্রচার আবশ্যক, যাতে লোকে আরও বেশি করে এর দিকে আকৃষ্ট হয়৷ আজ রাতের দিকে নাগরাকাটার শ্মশানে একটা গোপন তান্ত্রিক অনুষ্ঠান আছে৷ সেনগুপ্ত সাহেব চাইলে সেখানে আসতে পারে, সব কর্মকাণ্ড ক্যামেরায় রেকর্ডও করতে পারেন৷ শর্ত একটাই, ওই মৈত্রমশাইকে সঙ্গে আনা যাবে না, এমনকি এ ব্যপারে তাঁকে ঘুণাক্ষরেও কিছু জানানো যাবে না৷ সাহেব কি রাজি? তাহলে এই দুজন লোক তাঁকে সঙ্গে করে নিয়ে আসবে৷
দ্বিধার সুতোয় দুলছিল অর্জুন৷ মৈত্রমশাই কাল অত করে বলেছেন ঘরের বাইরে না যেতে৷ এদিকে এত বড় সুযোগ ফসকে যেতে দেওয়াটাও ঠিক নয়৷ কী করবে সে? এসব ক্ষেত্রে সে সচরাচর রাধিকার সঙ্গে কনসাল্ট করে নেয় একবার৷ কিন্তু সকাল থেকে কোনও কারণে রাধিকার সঙ্গে ফোনে কানেক্ট হচ্ছে না৷
দশটা নাগাদ সোফিয়ার ফোন এল৷ অর্জুন পুরো ব্যাপারটা খুলে বলতেই সোফিয়া প্রায় লাফিয়ে উঠল৷ ধমকের সুরে বলল, ‘এত বড় চান্স কেউ মিস করে? মিস্টার মৈত্রকে শুধু রিসার্চ করার জন্য রিটেন করেছি, অপারেশনসে মাথা গলাবার জন্য না৷ মনে রেখো অর্জুন, এই ডকুমেন্টারি ঠিকঠাক না দাঁড়ালে কিন্তু তোমার কেরিয়ার কোনদিকে মোড় নেবে বলতে পারব না৷’
অর্জুন সিদ্ধান্তটা নিয়েই ফেলল৷ চুলোয় যাক মৈত্রমশাইয়ের সতর্কবাণী৷ চাকরি বাঁচলে বাপের নাম৷ তার কেরিয়ার চৌপাট হয়ে গেলে কি ওই আগমবাগীশ এসে বাঁচাবে? শালা আগমবাগীশ না আগমগাম্বাট৷ ক্যামেরা আর রেকর্ডিং-এর জিনিসপত্র নিয়ে একাই বেরিয়ে পড়ল সে৷ লাঞ্চটা না হয় রাস্তাতেই করে নেবে সে৷
* * *
বীরবাহাদুর কিচ্ছু বুঝতে পারছিল না৷ জঙ্গলের বাইরে তাকে কোথায় ছেড়ে গেল ওরা? এটা কোন রাস্তা? একদিকে উঁচু উঁচু পাইনগাছের বন, অন্যদিকে গভীর খাদ৷ যেদিন তারা তাদের গ্রাম থেকে যাত্রা শুরু করেছিল সেদিন কী তিথি ছিল যেন? আজ আকাশ পুরো অন্ধকার৷ নষ্ট যাওয়া ফ্যাকাসে আকাশের গায়ে কতগুলো মৃত তারা ধুঁকতে ধুঁকতে জ্বলছে৷ চারিদিকে হাওয়ার দল তাকে ঘিরে পাক খাচ্ছে আর ফিসফিস করে তার কানে বলে যাচ্ছে, ‘ফেরবার পথ নেই, পথ নেই৷’
এই কদিন টানা ঘুমিয়েছে সে৷ খাবার কম খেয়েছে, মদ বেশি৷ সেই মদে কি কিছু মেশানো ছিল? কে জানে! কেমন যেন অন্যরকম, ঝাঁজালো স্বাদ ছিল মদটার৷ এ ক’দিন কোন রাস্তা ধরে তারা এসেছে, কোথায় রাত কাটিয়েছে, কিছুই মনে নেই তার৷ কেমন যেন একটা ঝিমধরা ঘোরের মধ্যে কেটেছে তার এই ক’টা দিন৷
আর গৌরী? গৌরীকে কোথায় নিয়ে গেল ওরা?
সেই ঝাঁজালো মদ আজও অনেকটা খেয়েছে বীরবাহাদুর৷ সঙ্গে বোধহয় আরও কিছু মেশানো ছিল৷ মাথাটা ঝিমঝিম করছে তার৷ গলাটা শুকিয়ে গেছে৷ আরও একটু মদ পেলে হত এখন৷ টাকা তো কম পায়নি সে৷
ওরা পৌঁছতেই ঘুমন্ত গৌরীকে ওরা নিয়ে গেল কোথায় যেন৷ তারপর ঠাকুর কী যেন বলল ওকে৷ মা ওকে অনেক আশীর্বাদ করবে, গৌরী এই জন্মেই মুক্ত হয়ে গেল, এইসব আগড়ম বাগড়ম৷ তারপর তাবিজের মতো কী যেন একটা হাতে ধরিয়ে দিল তার হাতে৷ বলেছে ছেলে জন্মালে তার গলায় পরিয়ে রাখতে, আর টাকাও দিয়েছে, অনেক টাকা৷ দেশে ফিরে এবার একটা খাবারের দোকান দেবে সে৷ বিদেশে বিভুঁইয়ে মেয়ে বউকে ছেড়ে থাকতে হবে না তাকে আর৷
মেয়ে? মেয়ে কোথায় গেল তার? গৌরীকে কেন যেন সঙ্গে করে এনেছিল বীরবাহাদুর? মনে পড়ছে না তার৷ যেমন মনে পড়ছে না এই অন্ধকারে তাকে কেন এখানে দাঁড় করিয়ে রেখে গেল ওরা৷
গৌরী কোথায়? গৌরীকে ছাড়া কী করে দেশে ফিরবে বীরবাহাদুর? কী বলবে গৌরীর মা’কে?
অনেকক্ষণ থেকে বীরবাহাদুরের বুকের মধ্যে একটা কষ্ট দলা পাকাচ্ছিল৷ এবার সেটা উদগত কান্নার মতো বেরিয়ে এল তার গলা থেকে৷ কোথায় গেল তার মেয়ে, তার সোনার পুতলি? দুটো পয়সার লোভে আর ভয়ে কী করে বসল সে৷ সে হাউ হাউ করে কাঁদতে থাকল মেয়ের নাম ধরে, গৌরী, গৌরী রে, কোথায় গেলি মা, কোথায় গেলি তুই?
বেশিক্ষণ অবশ্য কাঁদতে হল না বীরবাহাদুরকে৷ একটু পরেই তার পিছনে ছায়ার মতো কতগুলো লোক এসে দাঁড়াল৷ তারা দেখল অন্ধকার আকাশের সামনে, অগণন মৃত তারাদের দিকে তাকিয়ে একটা লোক অল্প অল্প টলছে আর কী যেন বলতে বলতে হাউ হাউ করে কাঁদছে৷ অবশ্য বেশিক্ষণ আর সেই কষ্ট করতে হল না তাকে৷ কয়েকটা তাগড়া লাঠি নেমে এল বীরবাহাদুরের মাথায়৷ কষ্ট আর মায়ার মধ্যে দ্বন্দ্ব মিটে গেল তার৷
* * *
কালিকিঙ্করের লোকজন দাঁড়িয়েছিল বাসস্ট্যান্ডে৷ সেখান থেকে ওরাই অর্জুনকে নিয়ে এসেছিল ঠাকুরমশাইয়ের বাড়িতে৷ দুপুরের খাওয়াদাওয়াও ঠাকুরমশাইয়ের বাড়িতেই করল অর্জুন৷ বহুদিন বাদে খাঁটি বাঙালি খাবার খেতে অর্জুনের খারাপ লাগছিল না৷
খাওয়ার পর ঠাকুরমশাই বসেছিলেন অর্জুনের সঙ্গে৷ বিস্তারিতভাবে বুঝিয়েছিলেন তন্ত্র কী, তার প্রকরণ এবং প্রয়োগ৷ তার সঙ্গেই তন্ত্রের ইতিহাস বিশদে জানিয়েছিলেন তিনি৷
তন্ত্রের খুঁটিনাটি নিয়ে ঠাকুরমশাইয়ের প্রভূত জ্ঞানের পরিচয় পেয়ে অভিভূত হয়ে গেছিল অর্জুন৷ পুরো সাক্ষাৎকারটাই রেকর্ড করেছে সে৷ এ জিনিস এডিট করার পর সাবটাইটেল-সহ যে কী দাঁড়াবে সে ভাবতেও রোমাঞ্চিত হচ্ছিল সে৷ নিজের ভাগ্যকে ধন্যবাদ দিচ্ছিল অর্জুন৷ ভাগ্যিস মৈত্রমশাইয়ের কথা শোনেনি সে৷ নইলে এই জিনিস পাক্কা মিস হয়ে যেত তার৷
বিকেলের দিকে একটু ঘুমিয়ে নিয়েছিল অর্জুন৷ আসল কাজ রাত আটটার পর৷ ততক্ষণ পর্যন্ত একটু বিশ্রাম নেওয়া জরুরি৷
অর্জুনের যখন ঘুম ভাঙল তখন বেশ রাত৷ রিস্টওয়াচে টাইম দেখল সে, রাত ন’টা বাজে৷ ধড়মড় করে উঠে বসল অর্জুন৷ ইশ, এতক্ষণ ঘুমিয়েছে সে?
বাইরে আসতেই একজন ঘটিতে জল নিয়ে এল, ‘মুখে চোখে একটু জল দিয়ে নিন বাবু৷ ঠাকুরমশাই আর বাকিরা সব জোগাড়যন্ত্র করতে গেছে৷ আপনি মুখ হাত ধুয়ে তৈরি হয়ে নিন, আমি আপনাকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যাব৷’
অর্জুন তাড়াতাড়ি মুখ হাত ধুয়ে এসে দেখল লোকটা একটা বাইক নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে৷ অর্জুন আর দ্বিরুক্তি না করে বাইকে চেপে বসল৷ সঙ্গে রইল তার রেকর্ডিং-এর এর জিনিসপত্র৷
বড় রাস্তা দিয়ে কিছুক্ষণ যাওয়ার পরেই বাইকটা বাঁদিক বেঁকে একটা জঙ্গলের রাস্তা ধরল৷ বোঝা যায় যে এই রাস্তায় লোক যাতায়াত করে, পথের রেখা স্পষ্ট৷ মোটরবাইকের আওয়াজ আর হেডলাইটের আলো জঙ্গলের শান্ত পরিবেশ খানখান করে দিচ্ছিল৷
দুধারের জঙ্গল ক্রমশ ঘন হয়ে আসতে লাগল৷ অর্জুন কখনও রাতের জঙ্গল দেখেনি৷ তার কেমন একটা অস্বস্তি হতে লাগলো৷ কেমন যেন একটা চোরা ভয়, একটা গা ছমছমে ভাব৷ মনে হচ্ছে সে যেন ক্রমেই একটা অন্ধকারের মধ্যে ঢুকে যাচ্ছে৷ আর সেই সর্বগ্রাসী অন্ধকার তাকে যেন গিলে খাওয়ার জন্য ডাকছে, আয় আয় আয়..
একটু পরেই বাইকটা এসে একটা জায়গায় থামল৷ অর্জুন নেমে দেখল একটা খোলামেলা জায়গায় এসে পৌঁছেছে তারা৷ সামনের বেশ খানিকটা ফাঁকা জায়গা৷ একটু দূরে একটা নদীর মরা খাত৷ তার পাশে কয়েকটা ভাঙা কুঁড়েঘরের অবশেষ৷ নদীখাতের ওপারে জঙ্গল৷ তবে এপারেও গাছপালা কম নয়৷ ওই ফাঁকা জায়গাটার মধ্যেই অনেকটা জায়গা পরিষ্কার করে রেখেছে ঠাকুরের লোকজন৷ একটু পরে কেউ একজন এসে দূরে দূরে কয়েকটা মশাল পুঁতে দিয়ে গেল৷ সেই আলোয় এবার চারিদিক সামান্য স্পষ্ট হল৷
অর্জুনের মনে হল এটা বোধহয় কোনও পরিত্যক্ত গ্রাম্য শ্মশান৷ চারিদিকে ইতিউতি উঁচু হয়ে আছে শব জ্বালানোর বেদি৷ কুঁড়েঘরগুলোতে বোধহয় শ্মশানযাত্রীরা এসে থাকত৷
এর একদম মাঝখানে একটি মাটির উঁচু বেদি মতো করা আছে৷ আপাতত সেইটেকে বোধহয় একটা একটা পুজোর আসন করা হয়েছে৷ কারণ তার সামনে বেশ কিছু পুজোর উপকরণ রাখা… কয়েকজন ছায়ার মানুষ যন্ত্রের মতো নিজেদের কাজ করে চলেছে৷ অর্জুন অনুমান করল ওরা ঠাকুরের লোক৷
একটু পর বেদির একপ্রান্তে একজন একটি দেবীমূর্তি এনে রাখল৷ অর্জুন নিজের কাজ শুরু করে দিয়েছিল৷ মূর্তিটাকে দেখে কীসের আকর্ষণে যেন হাতের কাজ থামিয়ে সেদিকে এগিয়ে গেল সে৷
মূর্তিটা ভারী অদ্ভুত৷ আর শুধু অদ্ভুত নয়, মূর্তিটাকে দেখে রীতিমতো অস্বস্তি হতে শুরু করল তার৷ এমন ভীতিপ্রদ ভয়ঙ্করদর্শন মূর্তি জীবনে দ্বিতীয়টি দেখেনি সে৷ সারা শরীর অস্থিসার কঙ্কালের মতো, মুখটা একটা করোটি বই আর কিছু নয়৷ মূর্তির ছ’টা হাত, তাতে কী সব যেন ধরা৷ আর সবচেয়ে ভয় লাগে মূর্তিটার চোখের দিকে তাকালে৷ মনে হয় এক আদিম অপার শূন্যতা যেন গিলে খাবে৷ আর সেই অতলগ্রাসী দৃষ্টি নিয়ে সেই মূর্তি যেন একাগ্রচিত্তে অর্জুনের দিকেই তাকিয়ে আছে৷
ঝট করে চোখ নামিয়ে নিল অর্জুন৷ ওদিকে আর তাকাল না সে৷ বাপ রে, এমন ভয়ঙ্করদর্শন দেবীমূর্তি জীবনে দ্বিতীয়টি দেখেনি সে৷ থাক, ওদিকে আর তাকাবে না সে৷ নিজের কাজেই মনোনিবেশ করা যাক না হয়৷
আধঘণ্টা পর অর্জুন যখন উঠে দাঁড়াল তখন সব কিছু সেট করে ফেলেছে সে৷ ক্যামেরাটা এমন জায়গায় রেখেছে যেখান থেকে সব কিছু স্পষ্ট দেখা যায়৷ মাইকটাও ঠিকঠাক জায়গায় প্লেস করা৷ আলোর অবশ্য কোনও ব্যবস্থা নেই, ঠাকুরের বারণ আছে৷ তবে অর্জুনের ক্যামেরায় নাইট ভিশনের ব্যবস্থা আছে, অসুবিধা হবে না৷
চারিদিকে তাকিয়ে একটু অবাক হল অর্জুন৷ ঠাকুরের লোকজন কেউ আর নেই চারিপাশে৷ শুধু আছে সে, আর আছে শবদাহবেদির ওপর ওই ভয়ঙ্করদর্শন মূর্তি৷ আর তার ঠিক অন্যদিকে একটা হাড়িকাঠ৷ এটা যে ঠাকুরের লোকেরা কখন পুঁতে দিয়ে গেছে সেটা খেয়াল করেনি সে৷
একটু পরে কালিকিঙ্কর ঠাকুর এলেন৷ পরনে লাল টকটকে ধুতি, ঊর্ধ্বাঙ্গ সম্পূর্ণ উন্মুক্ত৷ কাঁধে একটি ঝোলা, গলায় ঝুলছে রুদ্রাক্ষের মালা৷ এই শীতেও এ ছাড়া আর কিছু পরেননি তিনি৷ সঙ্গে একজন সেবক৷ সেও একই পোশাকে সজ্জিত৷
ঠাকুরের সঙ্গে আসা অনুচরটি দেখিয়ে দিল অর্জুন কোথায় বসে আছে৷ ঠাকুর দৃঢ় পদক্ষেপে এগিয়ে এলেন অর্জুনের দিকে৷ একটিও কথা বললেন না৷ সঙ্গে থাকা ঝোলা থেকে একটি নরকরোটি বার করলেন তিনি৷ তারপর তাতে একটি তরল ঢেলে অর্জুনের দিকে এগিয়ে দিয়ে সংক্ষিপ্ত আদেশ করলেন, ‘খাও৷’
অর্জুন খুব শক্ত মনের মানুষ৷ তাকে আদেশ দিয়ে কাজ করাতে পারে এমন লোক কমই আছে৷ কিন্তু এই অতিপ্রাকৃত পরিবেশে সেও কেমন যেন বিহ্বল হয়ে গেল৷ বিনা বাক্যব্যয়ে সেই নরকরোটিতে ঢেলে ঘনকৃষ্ণ ঝাঁজালো তরলটি গলাধঃকরণ করে নিল সে৷
তারপর ঠাকুরমশাই ফিরে গিয়ে পুজোয় বসলেন৷ বিভিন্ন মন্ত্রোচ্চারণের সঙ্গে পুজোপচার অর্পিত হতে থাকল সেই দেবীমূর্তির চরণে৷ অর্জুন পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে প্রতিটি ফ্রেম তুলে রাখতে লাগল তার ক্যামেরায়৷ নাইট ভিশন ক্যামেরায় বন্দি হতে লাগল একের পর এক দৃশ্য৷
আস্তে আস্তে অর্জুন বুঝতে পারছিল যে ক্রমশ সারা শরীরের ওপর থেকে তার নিয়ন্ত্রণ চলে যাচ্ছে৷ মনে হচ্ছে সে যেন যন্ত্রের মতো কাজ করছে৷ শরীর চলছে, কিন্তু সে শরীর পুরোপুরি তার ইচ্ছাধীন নয়৷ তার চৈতন্য, বুদ্ধি, উচিত অনুচিত বোধ সব যেন স্তিমিত হয়ে এসেছে৷
পূজাপাঠ শেষ হল৷ এবার সব চুপচাপ৷ মন্ত্রোচ্চারণ থেমে গেছে৷ গুগগুলের ক্ষীণ গন্ধ ভেসে বেড়াচ্ছে জঙ্গলের বাতাসে৷ ঠাকুর ধ্যানস্থ৷ চারিদিকে জঙ্গলের রাতচরা পাখিদের টীটীইই ডাক থেমে গেছে৷ বাতাস যেন বইতে বইতে হঠাৎ করেই অশক্ত বৃদ্ধের মতো নুইয়ে পড়েছে এই অঞ্চলে৷ বেদির ওপর ঠাকুর বজ্রাসনে বসে আছেন৷ নিভু নিভু মশালের আলো ছিটকে যাচ্ছে তাঁর ঘর্মাক্ত শরীর থেকে৷
অর্জুন অসাড় নিবিষ্ট মনে সব রেকর্ড করে যাচ্ছিল৷ একটু পর তার ক্যামেরার এক কোনায় কিছু চাঞ্চল্য দেখা গেল৷ অর্জুন মনিটরে দেখল ঠাকুরের এক শাগরেদ, একটি অচৈতন্য মেয়েকে টানতে টানতে নিয়ে এল৷ মেয়েটি শিশু, সাত-আটের বেশি বয়েস হবে না৷
ক্যামেরা চলছে৷ মনিটরে নাইট ভিশনে কিছু কালচে সবজেটে শরীর নাড়াচাড়া করছে৷ এবার আরও একজন এল স্ক্রিনে৷ দুজন এসে হাড়িকাঠে জুতে দিল মেয়েটাকে৷ তারপর তাদেরই একজন কালিকিঙ্কর ঠাকুরের হাতে একটা মস্ত খাঁড়া এনে দিল৷
অর্জুনের বোধ সব নিষ্ক্রিয় হয়ে গেছে৷ সে শুধু দেখে যাচ্ছে, কোনও ক্রিয়া বা প্রতিক্রিয়া দেওয়ার ক্ষমতাও যেন লুপ্ত হয়ে গেছে তার৷ শুধু মাথার মধ্যে যেন একটা বোবা আর্তনাদ ফেটে পড়ছে৷ কে যেন চিৎকার করে বলছে যা হচ্ছে ঠিক হচ্ছে না৷ অর্জুনের এক্ষুনি দৌড়ে যাওয়া উচিত মেয়েটার কাছে, সাহায্য করা উচিত৷ মেয়েটা সাঙ্ঘাতিক বিপদের মধ্যে আছে৷ কিছু করা উচিত তার এখনই৷
কিন্তু না, তার সমগ্র অস্তিত্ব যেন অসাড় হয়ে আছে৷ কোনও বোধ নেই, সাড় নেই, চৈতন্য নেই, স্পন্দন নেই৷ তার হাত পা কাঁপছে হিস্টিরিয়াগ্রস্ত রোগীর মতো৷ ঘামের স্রোত নেমেছে সারা শরীর জুড়ে৷ অথচ তার কিচ্ছু করার ক্ষমতা নেই৷ শুধু বিস্ফারিত চোখে সামনে যেটা ঘটছে সেটা দেখে যাওয়া ছাড়া৷
মন্ত্রোচ্চারণ করতে করতে কালিকিঙ্কর বিশালকায় খাঁড়াটি মাথার ওপর তুললেন৷ তারপর সেটি সবেগে নামিয়ে আনলেন মেয়েটির গলার ওপর৷
অর্জুন অজ্ঞান হয়ে গেল৷
* * *
ঘুম ভাঙতেই চোখটা কুঁচকে গেল অর্জুনের৷ জানালার পর্দাটা অনেকটা সরে গেছে৷ ভোরের রোদ্দুর বল্লমের মতো আছড়ে পড়ছে তার চোখেমুখে৷ তার সঙ্গে সেবক রোডের ব্যস্ত ট্রাফিকের কর্কশ শব্দ তো আছেই৷
উঠে বসে চাদরটা গা থেকে সরিয়ে মাটিতে পা দুটো পা রাখল অর্জুন৷ তারপরেই বুঝতে পারল সারা শরীর অজানা ব্যথায় টাটিয়ে আছে তার৷ এমন নয় যে ব্যথাটা শরীরের কোনও বিশেষ জায়গায় হচ্ছে৷ কোনও মাসল পুল, হ্যাঁচকা টান, জয়েন্ট পেইন, এমন কিছুই নেই৷ অথচ সারা শরীর জুড়ে যেন একটা বিষাক্ত ভোঁতা কষ্ট জেগে আছে৷
ধীরে ধীরে বাথরুমে গেল অর্জুন৷ ফ্রেশ হল৷ স্নান সারার পর আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখল৷ কই, সারা শরীরে তো কোনও দাগ বা কিছু নেই৷ তাহলে এই বিষব্যথা কেন?
দ্রুত চিন্তাটা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলল অর্জুন৷ এখন এই নিয়ে ভাবলে তার চলবে না৷ আজ তাদের দার্জিলিং যাওয়ার কথা৷ অভ্যস্ত হাতে জামাকাপড় পরল অর্জুন৷ তারপর ভাবল মৈত্রমশাইয়ের রুমে ইন্টারকম থেকে একটা ফোন করবে৷ মৈত্রমশাই ঘুম থেকে উঠেছেন?
মৈত্রমশাইয়ের নামটা মনে পড়তেই কে যেন একটা বিদ্যুতের চাবুক চালিয়ে দিল তার স্মৃতির মধ্যে৷ মৈত্রমশাইয়ের আজ সকালে ফেরার কথা না? তিনি কোথাও একটা গেছেন৷ আর তার আগে বলে গেছিলেন অর্জুন যেন হোটেলের বাইরে পা না রাখে৷
আস্তে আস্তে অর্জুনের স্মৃতির পটে একটা একটা করে ঘটনার দানা ফুটে উঠতে লাগল৷ মৈত্রমশাইয়ের বারণ সত্ত্বেও কাল দুটো লোকের সঙ্গে হোটেলের বাইরে গেছিল সে৷ কোথায় যেন গেছিল অর্জুন? কাল কী যেন হয়েছিল তার? কী যেন দেখে ফেলেছিল সে যেটা তার দেখার কথা না?
মুহূর্তের মধ্যে ফ্লাডগেট খোলা বন্যার জলের মতো একরাশ কুৎসিত ভয়ঙ্কর দৃশ্য আছড়ে পড়ল তার মাথার মধ্যে৷ হাত পা থরথর করে কাঁপতে লাগল অর্জুনের৷ বলির ওই ভয়ঙ্কর দৃশ্যটার কথা মনে পড়তেই সমস্ত গা গুলিয়ে বমি উঠে এল তার মুখে৷
বমি করে একটু সুস্থ হল অর্জুন৷ ঘরে এসে দেখল তার ক্যামেরা পরিপাটি করে সাজিয়ে রাখা আছে ঘরের কোণে৷ সেদিকে আতঙ্কিত চোখে তাকিয়ে রইল সে৷ যে ভয়ঙ্কর দৃশ্য ওই ক্যামেরায় বন্দি হয়েছে তা ভাবতেও আর একবার থরথর করে কেঁপে উঠল সে৷ না, সেই দৃশ্য আর দ্বিতীয়বার কিছুতেই দেখতে পারবে না সে৷
মৈত্রমশাই৷ একমাত্র মৈত্রমশাই-ই বাঁচাতে পারেন তাকে৷
ঘরের দরজা একটানে খুলে মৈত্রমশাইয়ের রুমের দিকে ছুটে গেল সে৷
কিন্তু মৈত্রমশাইয়ের ঘরের দরজা বন্ধ৷ ঘরে ফিরে এসে রিসেপশনে ফোন করল সে৷ ওরা বলল মিস্টার মৈত্র কাল রাতে ফেরেননি৷ ভদ্রলোক মোবাইল ব্যবহার করেন না৷ ফলে অন্যভাবেও যোগাযোগ করার উপায় নেই৷
অর্জুন ফোন রাখার আগে রিসেপশনিস্ট জিজ্ঞেস করল, ‘এখন কেমন আছেন মিস্টার সেনগুপ্ত? সুস্থ বোধ করছেন তো?’
অর্জুন সতর্ক এবং বিস্মিতস্বরে প্রশ্ন করল, ‘মানে?’
রিসেপশনিস্ট যা বলল তা এইরকম৷
কাল গভীর রাতে তিন চারজন লোক এসে অচৈতন্য অর্জুনকে তার জিনিসপত্র-সহ হোটেলের রিসেপশনে পৌঁছে দিয়ে যায়৷ বলে অর্জুন নাকি অত্যধিক পরিমাণে মদ্যপান করে অসুস্থ হয়ে পড়েছে৷ তার গা থেকেও মদের গন্ধ ছাড়ছিল৷ হোটেলের লোকজনই তাকে রুমে পৌঁছে দেয়৷ তাই রিসেপশনিস্ট তার স্বাস্থ্যের খোঁজখবর নিচ্ছে৷
অর্জুন কিছু না বলে ফোনটা ক্রেডলে নামিয়ে রাখল৷ এরপর কী করবে সে? আরও একবার কালিকিঙ্কর ঠাকুরের কাছে যাবে? ওরা যদি অস্বীকার করে? তাছাড়া অর্জুন একা, ঠাকুরের লোকবল কম নয়৷
তাহলে কি ও পুলিশে যাবে? কিন্তু পুলিশ তো প্রথমেই প্রমাণ দেখতে চাইবে৷
কাঁপা কাঁপা হাতে ক্যামেরাটা হাতে তুলে নিল অর্জুন৷ আবার কপালে বিড়বিড় করে ঘাম জমতে শুরু করেছে তার৷ বুকের ভেতর যেন হাতুড়ি পিটছে৷ হাতে সুইচ অন করল৷
প্রথমে অন্ধকার স্ক্রিন ভেসে এলো৷ তারপর শুরু হল একটা একটানা বিশ্রী ক্যারক্যার শব্দ৷ বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করল অর্জুন৷ তারপর আবিষ্কার করল যে কিচ্ছু নেই৷ কোনও ভিডিও নেই৷ সব রেকর্ডিং উধাও৷
ক্যামেরাটা বন্ধ করল অর্জুন৷ মাথার মধ্যে সব গন্ডগোল হয়ে যাচ্ছিল তার৷ কাল রাতে কারা তাকে হোটেলে পৌঁছে দিল? নিশ্চয়ই ঠাকুরের লোক৷ তারাই ওই নরবলির দৃশ্য তার ক্যামেরা থেকে মুছে দিয়েছে নির্ঘাত৷ কিন্তু কেন?
এর একটাই উত্তর, এই জঘন্য অপকর্মের কোনও সাক্ষী রাখতে চায় না তারা৷
অথচ তাই যদি হয়, তাহলে ওখানে অর্জুনকে ডেকে নিয়ে গিয়ে ওই ভয়ংকর দৃশ্যটা দেখাবার দরকারই বা কী ছিল?
ছটফট করছিল অর্জুন৷ মৈত্রমশাইয়ের আসার কোনও নামলক্ষণ নেই৷ কিন্তু অর্জুনের আর তর সইছে না৷ এই রহস্য তাকে ভেদ করতেই হবে৷
এদিকে আবার আজই রাধিকাদের ফ্লাইটে বাগডোগরা এসে পৌঁছবার কথা৷ তারপর তারা তিনজন চলে যাবে দার্জিলিং৷ তার আগে মৈত্রমশাইয়ের সঙ্গে তার দেখা করা জরুরি, অত্যন্ত জরুরি৷
অসহায়ভাবে ছটফট করতে করতে একবার ঘড়ি দেখল অর্জুন৷ হ্যাঁ, ফ্লাইট আধঘণ্টা আগেই ল্যান্ড করার কথা৷ কিন্তু রাধিকা ফোন করেনি কেন তাকে? এতক্ষণে তো ওদের চলে আসার কথা এখানে৷ ওরা এখনও এসে পৌঁছল না কেন?
রাধিকাকে ফোন করল অর্জুন৷
রাধিকা ফোন তুলেই হাউমাউ করে কেঁদে উঠল, ‘তুমি কোথায় আছ অর্জুন? এক্ষুনি এয়ারপোর্টে এসো৷ এদিকে সাঙ্ঘাতিক বিপদ হয়ে গেছে৷’
অর্জুন হতভম্ব হয়ে গেল৷ সে জিজ্ঞেস করল, ‘কী হয়েছে রাধিকা? এমন করছ কেন?’
রাধিকা ক্রমাগত ফোঁপাতে লাগল৷ তার জড়ানো গলার স্বর শুনে কিছু বোঝাই যায় না৷ ক্রমে ক্রমে তাকে শান্ত করে পুরো ঘটনাটা শুনল অর্জুন৷
ফ্লাইট যখন কলকাতা থেকে ওড়ে তখন সব কিছু ঠিকঠাক ছিল৷ স্মুথ টেক অফ৷ শান্ত আবহাওয়া৷ নির্বিঘ্ন উড়ে যাওয়া৷ সব একদম ছবির মতো সুন্দর৷ নূপুর বসেছিল উইন্ডো সিটে, নিখিল মিড, রাধিকা আইল সিটে৷
তখন ল্যান্ডিং হতে আর মিনিট পনেরো বাকি৷ আচমকাই প্লেনটা মিড এয়ারে সাঙ্ঘাতিক ভাবে নড়ে ওঠে৷ পাগলের মতো দুলতে থাকে ওপর-নীচে৷ ফ্লাইটের নিয়মিত যাত্রীরা এসবে অভ্যস্ত৷ তারা ভেবেছিল হয়তো এ কয়েক মিনিটের ব্যাপার, এক্ষুনি ঠিক হয়ে যাবে৷
তারপর হঠাৎ করেই শুরু হয় ফ্রি ফল৷ এবার যাত্রীদের মধ্যে আর্তচিৎকার শুরু হয়ে যায়৷ ককপিট থেকে ক্যাপ্টেনের উত্তেজিত সতর্কবার্তা ভেসে আসে৷ যাত্রীদের তো বটেই, এমনকি ফ্লাইট অ্যাটেনডেন্টদেরও সিটবেল্ট লাগিয়ে বসতে বলা হয়৷ ততক্ষণে যাত্রীদের খাবার প্লেট, জলের বোতল সব এদিক-ওদিক উড়তে শুরু করেছে৷ বাচ্চাদের আর্তচিৎকার, বয়স্কদের কান্না আর ঈশ্বরের নাম নেওয়া, সব মিলিয়ে নরক গুলজার অবস্থা৷
রাধিকাও ভয় পেয়েছিল বিলক্ষণ৷ এতদিন ধরে এত জায়গায় ফ্লাইটে করে যাতায়াত করেছে সে, ফ্লাইট টার্বুলেন্স কম দেখেনি৷ তবে আজকেরটা যেন সব কিছু ছাড়িয়ে৷ এমন উথালপাথাল করা সর্বনাশী টার্বুলেন্স রাধিকা কখনও দেখেনি তার জীবনে৷ তবে নিজের থেকেও তার চিন্তা ছিল নূপুর আর নিখিলকে নিয়ে৷ অতটুকু বাচ্চা, ওরা সামলাবে কী করে?
টার্বুলেন্স থামতে নেয় পাঁচমিনিট মতো৷ ততক্ষণে সব শান্ত হয়েছে৷ ফ্লাইটের চারিদিকে শুধু ঠাকুরের নাম আর ফোঁপানো কান্নার শব্দ৷ আর মিনিট দশেক পরেই ফ্লাইট বাগডোগরা ল্যান্ড করে৷
আর তার পর থেকেই শুরু হয়েছে নাটক৷ নূপুর এতটাই ভয় পেয়ে গেছে যে ফ্লাইট ল্যান্ড করার পরেও কিছুতেই প্লেন থেকে নামতে চায়নি৷ চেঁচামেচি করে, সবাইকে আঁচড়ে কামড়ে একাকার কাণ্ড করেছে৷ শেষে ফ্লাইট অ্যাটেনডেন্টদের সাহায্যে, লেডি পুলিশ ডেকে কোনওমতে তাকে নামানো হয়েছে৷ তারপরেও নূপুর অত্যন্ত অস্বাভাবিক আচরণ করছে৷ ওরা এখন এয়ারপোর্টের ট্রমা কেয়ার সেন্টারে আছে৷ অর্জুন যেন যত তাড়াতাড়ি সম্ভব হোটেল ছেড়ে বাগডোগরা এয়ারপোর্টে চলে আসে৷
অর্জুনের এবার অন্য টেনশন শুরু হয়৷ নূপুর এমনিতে খুব সাহসী মেয়ে, আর অনেকবার ফ্লাইটে চড়েছে৷ এয়ার টার্বুলেন্স নতুন কিছু নয় ওর কাছে৷ হঠাৎ করে এই পাগলামি শুরু হল কেন?
তড়িঘড়ি নিজের জিনিসপত্র গুছিয়ে নিল অর্জুন৷ আগে পরিবার, তারপর গতকালের রহস্য ভেদ করা যাবে না হয়৷ ছেলেমেয়েরা তার প্রাণ, তাদের কিছু হলে অর্জুনের মাথা খারাপ হয়ে যায়৷
অর্জুন যখন চেক আউট করে বেরোচ্ছে, ঠিক তখনই মৈত্রমশাই হোটেলে ঢুকছিলেন৷ সারা শরীরে ক্লান্তির ছাপ৷ মাথার চুল উস্কোখুস্কো৷ খুব অবিন্যস্ত এবং দুশ্চিন্তাগ্রস্ত দেখাচ্ছিল তাঁকে৷
অর্জুন তাঁকে কিছু বলার আগেই মৈত্রমশাই অর্জুনকে দেখে ঝাঁকুনি দিয়ে দাঁড়িয়ে গেলেন৷ তাঁর চোখেমুখে আতঙ্ক ফুটে উঠল৷ যেন হঠাৎ করেই ভয়াবহ কিছু একটা দেখে ফেলেছেন তিনি৷
তিনি বলতে গেলেন, ‘আপনি…আপনি কাল বেরিয়েছিলেন?’
কিন্তু তিনি কিছু বলার আগেই অর্জুন বলে উঠল, ‘এদিকে বিশাল কাণ্ড হয়ে গেছে মিস্টার মৈত্র৷ আমাকে এক্ষুনি এয়ারপোর্টে যেতে হচ্ছে একটা এমার্জেন্সিতে৷ আপনাকে অনেক কথা বলার আছে, কিন্তু এখন তার একদম সময় নেই৷ আমি আমার ফ্যামিলিকে পিক করে সোজা দার্জিলিং চলে যাচ্ছি৷ আপনার সঙ্গে আমি পরে যোগাযোগ করে নিচ্ছি৷’
অর্জুন দেখতে পেল না তার চলে যাওয়ার দিকে স্থির চোখে তাকিয়ে আছেন কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ৷ তাঁর চোখে একই সঙ্গে ফুটে উঠেছে ভয়, হতাশা আর আতঙ্ক৷
* * *
এই নূপুরকে অর্জুন চেনে না৷ তার বড় স্নেহের সন্তান, চোখের মণি, যেন এই দুদিনেই সম্পূর্ণ পালটে গেছে৷ সারা রাস্তা একটাও কথা বলেনি সে৷ বাড়িতে ঢুকেই একটা ঘরের মধ্যে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিয়েছিল৷ সেই থেকে সে ঘরের বাইরে একবারও বেরোয়নি নূপুর৷ রাধিকা, অর্জুন অনেক চেষ্টা করেছিল নূপুরকে বার করার৷ কোনও ফল হয়নি৷ শুধু ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্নার আওয়াজ শোনা গেছে৷ অর্জুন একবার জোর করে ঘরের দরজা ভাঙতে গেছিল৷ একটা অস্বাভাবিক জান্তব গলায় চেঁচিয়ে উঠেছিল নূপুর৷ সেই অস্বাভাবিক গর্জন শুনে থমকে গেছিল বাড়ির লোকজন৷
কাল দুপুর থেকে দাঁতে কুটোটি কাটেনি নূপুর, এমনকি জল অবধি খায়নি সে৷ অর্জুন আর রাধিকা ক্রমেই উদ্বিগ্ন হয়ে উঠছিল৷ এত অস্বাভাবিক আচরণ তো নূপুর করেনি কখনও৷
সন্ধেবেলায় ক্লান্ত বিধ্বস্ত রাধিকা আর অর্জুন বাগানে বসে আলোচনা করছিল৷ অর্জুনের বাবা হাই ব্লাড প্রেশারের পেশেন্ট৷ তাঁকে বাড়ির দোতলায় ঘুমের ওষুধ খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়েছে৷ প্রাণের চেয়েও প্রিয় নাতনির এই অবস্থা তিনি আর দেখতে পারছিলেন না৷ অর্জুনের মা তাঁর দেখভাল করছিলেন৷ নিখিল তার ঠাম্মি দাদুর কাছেই ছিল৷ দিদির এই অবস্থা দেখে সেও খুব ভীত হয়ে পড়েছে৷
অর্জুন বলছিল কোনও সাইকিয়াট্রিস্টকে ডেকে আনার কথা৷ রাধিকার মত হচ্ছে আজকের রাতটা দেখে নেওয়া৷
ঠিক এই সময়ে এই বাংলোর কেয়ারটেকার জংবাহাদুর দৌড়ে এসে বলল, ‘ছোটিমেম ঘর পে নেহি হ্যায় শা’ব৷ ঘর খালি হ্যায়৷ বাংলো মে কঁহি নেহি মিল রহি হ্যায়৷’
রাধিকা আর অর্জুন ছিলে ছেঁড়া ধনুকের মতো উঠে দাঁড়াল৷ অর্জুন বলল, ‘তুমি জানলে কী করে?’
জংবাহাদুর উদ্বিগ্নস্বরে বলল, ‘আমি ঘরের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলাম শা’ব৷ দেখি ছোটি মেমসাহেবের ঘর খোলা৷ গিয়ে আলো জ্বেলে দেখলাম ভিতরে কেউ নেই৷ তারপর অন্যান্য ঘর খুঁজে এলাম৷ তারপর পুরো বাংলো ওপর নীচে তন্ন তন্ন করে খুঁজে এলাম৷ কোত্থাও নেই৷’
দুজনে দ্রুত গিয়ে ঢুকল নূপুরের ঘরে৷ ঘর ফাঁকা৷ তারপর একের পর এক অন্যান্য ঘর খোঁজা শুরু হল৷ দরজার আড়াল, সিঁড়ির নীচে, বাথরুম, রান্নাঘর, স্টোররুম, পিছনের বাগান, সব তন্নতন্ন করে খোঁজা হল৷ কিন্তু নূপুর কোথাও নেই!
অর্জুন এবার ঘামতে শুরু করল৷ মাথা কাজ করছে না তার৷ বুকের ধক ধক শব্দটা ক্রমেই বেড়ে চলেছে৷ মেয়েটা কোথায় গেল? কোনও সর্বনাশ হয়ে গেল না তো?
একটু পর একটা বড় টর্চ আর জংবাহাদুরকে নিয়ে বেরিয়ে গেল অর্জুন৷ রাধিকাকে বলল, ‘এদিকে সব কিছু সামলে রাখো৷ আমি আশপাশটা একটু খুঁজে আসছি৷ দরকার হলে থানায় যেতে হবে৷’
* * *
নূপুরকে খুঁজে পাওয়া গেল একটা খাদের ধারে৷ তখন অন্ধকার ঘনিয়ে এসেছে৷ দূরে পাহাড়ের গায়ে গায়ে আলোর বিন্দু জ্বলে উঠেছে জোনাকির ঝাঁকের মতো৷ খাদের গা থেকে প্রেতযক্ষের মতো উঠে এসেছে দীর্ঘ ও প্রাচীন পাইন বৃক্ষের দল৷ আর খাদের নীচ থেকে দলা দলা প্রহেলিকার মতো কুয়াশার উঠে আসা দেখছিল নূপুর৷
অর্জুন টর্চটা বন্ধ করে দিল৷ নীলচে চাঁদের আলোয় ধীরে ধীরে গিয়ে দাঁড়াল নূপুরের পিছনে৷ তারপর খুব নরম করে ডাকল, ‘নূপুর, বেটা…’
নূপুর ধীরে ধীরে ঘুরে দাঁড়াল৷ অর্জুন দেখল নূপুরের চোখের মধ্যে কোনও ভাষা নেই৷ যেন একটা পুতুল তাকিয়ে আছে তার দিকে৷
অর্জুন আবার ডাকল, ‘নূপুর, ঘরে যাবি না মা?’
নূপুর একটা সম্পূর্ণ একটা অচেনা মেয়ের গলায় বলে উঠল, ‘তিমিলে মলাই মারেকো ছো৷ মা তিমিলাই ছোড়নে চৈন৷’
জংবাহাদুর অর্জুনের পিছনেই ছিল৷ তার মুখ থেকে একটা আতঙ্কের চাপা আর্তনাদ বেরিয়ে এল৷ অর্জুন বলল, ‘কী হয়েছে?’
জংবাহাদুর থরথর করে কাঁপতে কাঁপতে বিস্ফারিত চোখে বলল, ‘আপনার মেয়ে নেপালী কোথা থেকে শিখল শা’ব? আর এ কার গলা?’
অর্জুনের গলা শুকিয়ে গেছিল৷ সে কোনওমতে জিজ্ঞেস করল, ‘এ কী বলছে?’
‘বলছে, তোমরা আমাকে মেরেছ৷ তোমাদের আমি ছাড়ব না৷’
অর্জুন থমকে গেল৷ একটু এগিয়ে শক্ত হাতে নূপুরের হাতটা ধরল সে৷ শক্ত গলায় বলল, ‘কী পাগলের মতো বকছিস নূপুর৷.ঘরে চল৷ তোর মা তোর জন্য চিন্তায় আছে৷’
নূপুর একবার নিষ্প্রাণ চোখে তাকাল অর্জুনের দিকে৷ তার ঠোঁটের কোণে একটা দুর্বোধ্য হাসি ফুটে উঠল৷ তারপর সে যেটা করল, সেটা অবিশ্বাস্য৷ সে এক হ্যাঁচকা টানে অর্জুনকে নিয়ে এনে ফেলল খাদের ধারে, তারপর তাকে সর্বশক্তিতে ঠেলে দিতে চাইল পাহাড়ের গা বেয়ে!
অর্জুন নিয়মিত শরীরচর্চা করে৷ তবুও এই আকস্মিক আক্রমণে হতবাক হয়ে গেছিল সে৷ খাদের ধার বেয়ে পড়ে যেতে যেতেও সে একটা গাছের ডাল ধরে ঝুলতে লাগল৷
জংবাহাদুর একটা আর্তনাদ করে দৌড়ে এল অর্জুনের দিকে৷ প্রথমেই নূপুরকে এক ধাক্কায় মাটিতে ফেলে দিল সে৷ নূপুরের মাথাটা একটা পাথরে ঠুকে গেল৷ সেখানেই নিশ্চল হয়ে পড়ে রইল সে৷
জংবাহাদুর হাঁচোড়পাঁচোড় করে নেমে এল খানিকটা৷ তারপর অর্জুনকে এক হাতে জড়িয়ে ধরে বলল, ‘ধীরে ধীরে উঠিয়ে শা’ব, হড়বড়ি মত কিজিয়ে৷ নেহি তো প্যায়ের ফিসল জায়েগা৷’
অনেক কষ্টে একটু একটু করে অবশেষে ওপরে উঠে এল অর্জুন৷ তারপরেই দৌড়ে গেল মেয়ের কাছে৷
নূপুর ততক্ষণে উঠে বসেছে৷ সে একদৃষ্টে চেয়ে আছে জংবাহাদুরের দিকে৷ সে দৃষ্টিতে কতটা ঘৃণা, কতটা ক্রোধ আর কতটা বিতৃষ্ণা মিশে আছে সে একমাত্র ঈশ্বরই জানেন৷
অর্জুন কোনওমতে কাঁপা কাঁপা হাতে নূপুরের হাতটা ধরে বলল, ‘ঘরে চল বেটা৷ তোর মা খুব চিন্তা করছে৷’
নূপুর কিছু বলল না৷ উঠে দাঁড়াল৷ জংবাহাদুরের দিকে তাকিয়ে একটু হাসল৷ তারপর চুপচাপ অর্জুনের হাত ধরে হাঁটতে শুরু করল৷ অর্জুনের মনে হল সে যেন একটা মানুষ নয়, একটা নিষ্প্রাণ পুতুলকে হাঁটিয়ে নিয়ে চলেছে৷
* * *
ঘরে আসার পর নূপুর আর কোনও কিছু করেনি৷ চুপচাপ নিজের ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়েছে৷ দরজা বন্ধ করেনি৷ কাঁদেনি, ফোঁপায়নি৷ কারও সঙ্গে একটা কথাও বলেনি৷ যেন স্প্রিং দেওয়া পুতুলের মতো চলছে সে, কোনও ভাব, বিকার সাড়, কিছুই নেই৷
রাত্রিবেলা ঘুম ভেঙে গেল অর্জুনের৷ ও আর নিখিল এক ঘরে শুয়েছে৷ নূপুর আর রাধিকা অন্য একটা ঘরে৷ উঠে দেখল পাশে নিখিল নেই৷
ঘুম থেকে উঠে নিখিলকে পাশে না পেয়ে চিন্তিত হল অর্জুন৷ বাথরুমে গেল নাকি?
কই না তো৷ বাথরুমের দরজার নীচ থেকে কোনও আলোর রেখা এসে পড়ছে না৷ জলের শব্দও নেই৷ এত রাতে কোথায় গেল ছেলেটা?
বিছানা থেকে নেমে টর্চটা হাতে নিল অর্জুন৷ ধীরে ধীরে দরজা খুলে বাইরে এল৷ ক্ষীণ চাঁদের আলো বারান্দায় এসে পড়ছে৷ এদিক-ওদিকে টর্চ মেরে দেখল কেউ কোথাও নেই৷ তারপর একটু এগিয়ে সিঁড়ির কাছে আসতেই নিখিলকে দেখতে পেল সে৷
নিখিল সিঁড়ির একটা ধাপের ঠিক মাঝখানে বসেছিল৷ দৃষ্টি সিলিংয়ের দিকে৷ যেন খুব মন দিয়ে কিছু একটা দেখছে সে৷
অর্জুন জিজ্ঞেস করল, ‘নিখিল, কী করছ এখানে?’
মাথা না ঘুরিয়েই নিখিল জবাব দিল, ‘ওকে দেখছি৷’
চকিতে একবার সিলিংয়ের দিকে টর্চের আলো বুলিয়ে নিল অর্জুন৷ কিচ্ছু নেই সেখানে৷
‘কাকে দেখছ নিখিল?’
এবার মুখ ঘোরালো নিখিল, মুখে একটা অদ্ভুত হাসি৷ যেন খুব মজা পেয়েছে এমন ভঙ্গিতে বলল, ‘দিদি ওখান থেকে ঝুলছে৷ দেখতে পাচ্ছো না?’
অর্জুন কিছু বলার আগেই নুপূরের ঘর থেকে একটা আর্তচিৎকার ভেসে এলো৷ রাত্রির নিস্তব্ধতা খান খান হয়ে গেল সেই চিৎকারের শব্দে৷
* * *
কৃষ্ণানন্দ মৈত্র বাংলোর চৌহদ্দির মধ্যে ঢুকেই থমকে গেলেন৷ অর্জুন এগিয়ে আসছিল তাঁকে স্বাগত জানাতে৷ সেও থমকে গেল, জিজ্ঞেস করল, ‘কী হল মৈত্রমশাই?’
মৈত্রমশাই কিছু বললেন না৷ অর্জুনকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে বাংলোর বেড়া বরাবর প্রদক্ষিণ করতে শুরু করলেন৷ মাঝে মাঝে থামছেন, নীচু হয়ে মাটি তুলে এনে শুঁকছেন, আবার ফেলে দিচ্ছেন৷ আর বিড়বিড় করে ক্রমাগত কী যেন বলে চলেছেন৷
এই করতে করতে বাংলোর দক্ষিণ ও পশ্চিম কোণের ঠিক মাঝামাঝি এসে দাঁড়িয়ে গেলেন৷ অর্জুনের মনে হল একবার যেন শিউরে উঠলেন ভদ্রলোক৷ তারপর দ্রুত ঘুরে দাঁড়িয়ে তীব্রস্বরে বললেন, ‘আমি আপনাকে সেদিন অনেক করে বলেছিলাম না বেরোতে৷ তাও আপনি আমার কথা অগ্রাহ্য করে বেরিয়েছিলেন৷ কেন?’
অর্জুনের মাথা নীচু হয়ে এলো৷ এমনিতেই তার মাথা কাজ করছে না কালকের পর থেকে৷
কাল রাতে নিখিলের কথা শুনে স্তম্ভিত হয়ে গেছিল অর্জুন৷ এসব কী বলছে কী নিখিল? মাথা খারাপ হয়ে গেল নাকি ছেলেটার? কিন্তু কিছু বুঝে ওঠার আগেই চিৎকার ভেসে এসেছিল রাধিকার ঘর থেকে৷ অর্জুনের ঘোর কেটে গেছিল তখনই৷ সে দৌড়ে গিয়েছিল রাধিকার ঘরে৷
রাধিকা তখন প্রাণের ভয়ে সারা ঘরের মধ্যে দৌড়ে বেড়াচ্ছে৷ আর তার পিছনে রান্নাঘরের মাংসকাটার বড় ছুরিটা নিয়ে তাড়া করেছে নূপুর৷ ফ্যানের হাওয়ায় তার চুল উড়ছে সহস্র সাপিনীর মতো৷ ক্রমাগত থুতু ছিটিয়ে চলেছে সে৷ তার সঙ্গে সেই বিজাতীয় স্বরে নেপালী ভাষায় ক্রমাগত কী যেন বলে চলেছে৷
অর্জুন মুহূর্তের জন্য থমকে গেছিল এই দৃশ্য দেখে৷ তারপর চিৎকার করে উঠেছিল, ‘নূপুর!!!’
নূপুর ধীরে ধীরে ঘুরল তার দিকে৷ আর ভয়ে অর্জুনের প্রাণ উড়ে গেল মেয়েকে দেখে৷
কোন অলৌকিক মন্ত্রবলে নূপুরের গাল দুটো চুপসে একেবারে ভেতরে ঢুকে গেছে৷ হনু দুটো অস্বাভাবিক উঁচু৷ হাত-পায়ে মাংস নেই, যেন ক’খানা হাড়ের ওপর চামড়া জড়ানো আছে৷ কয়েকঘণ্টার মধ্যে মেয়েটা যেন কঙ্কালে পরিণত হয়েছে৷
আর চোখদুটো?
অর্জুন দেখল, নূপুরের চোখে শুধু অন্ধকার৷
নূপুর ছুরিটা হাতে নিয়ে এবার ধীরে ধীরে এগোতে লাগল অর্জুনের দিকে৷ দেখে মনে হচ্ছে যেন কোনও হিংস্র শ্বাপদ এগোচ্ছে তার শিকারের দিকে৷ অর্জুন দুবার নূপুরের নাম ধরে ডাকতে গেল৷ কিন্তু কোনও স্বর ফুটল না তার গলায়৷
নূপুর সেই বিজাতীয় স্বরে হিংস্রস্বরে ফের বলে উঠল, ‘তোরা মেরেছিস আমাকে৷ তোদের আমি ছাড়ব না৷’
এই বলে সে ঝাঁপিয়ে পড়ার আগেই দরজার কাছ থেকে নিখিলের আর্তস্বর ভেসে এলো, ‘দিদি, এ কী করছিস তুই?’
নূপুরের মাথাটা ধীরে ধীরে ঘুরল নিখিলের দিকে৷
নিখিল আঁতকে উঠল তার দিদিকে দেখে৷ আতঙ্কিত, ত্রস্তস্বরে বলল, ‘দিদি, ওই দিদি, তুই এমন কেন করছিস দিদি? আমার ভয় লাগছে তো৷’
নূপুরের হাত থেকে ছুরিটা পড়ে গেল৷ তারপর অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেল মেয়েটা৷
ফোনটা ভোর রাতের দিকে এসেছিল অর্জুনের মোবাইলে৷ তখনও ঘুমোয়নি অর্জুন আর রাধিকা৷ মেয়েকে কোলে চেপে ভোর হওয়ার প্রতীক্ষা করছিল৷ ফোনের ওপারে সেই চেনা গম্ভীরস্বর, ‘আমি দার্জিলিং পৌঁছেছি মিস্টার সেনগুপ্ত৷ আপনাদের বাড়িটা ঠিক কোথায় একটু বলবেন?’
অর্জুন ধীরে ধীরে মাথা তুলল৷ তার চোখে জল৷ সে বলল, ‘আজ অবধি জ্ঞানত কারও কোনও ক্ষতি করিনি মিস্টার মৈত্র৷ জানি না কার পাপে আজ আমার মেয়ের এই অবস্থা৷’
মৈত্রমশাই এসে অর্জুনের কাঁধে হাত রাখলেন, ‘আপনাকে বলেছিলাম না যে আমি সর্বনাশের গন্ধ পাই? যেদিন আমরা ফিরে এলাম ওই কালিকিঙ্কর ঠাকুরের ওখান থেকে, সেদিন থেকেই বুঝতে পেরেছিলাম যে আপনার ওপর একটা ঝড় আসতে চলেছে৷ কিন্তু ঝড়টা কোনদিক থেকে কীভাবে আপনার ওপর আছড়ে পড়বে সেটা বুঝতে পারিনি৷ কিন্তু সেদিন আমাকে বেরোতেই হত৷ আপনাকে তাই পইপই করে বলে গেছিলাম বাইরে বেরোবেন না৷
কিন্তু কপালে ভোগান্তি থাকলে আর কী হবে৷ আপনি সেই বেরোলেন৷ আর সেদিন থেকেই যাবতীয় বিপত্তির শুরু৷ এবার বলুন তো মিস্টার সেনগুপ্ত, সেদিন ঠিক কী কী হয়েছিল?’
পরের আধঘণ্টা শুধু বলে গেল অর্জুন৷ মৈত্রমশাই চুপ করে শুনে গেলেন, কিছু বললেন না৷ অর্জুনের কথা শেষ হওয়ার পর মুখ খুললেন তিনি, ‘সেদিন আপনাকে ছেড়ে কোথায় গেছিলাম জানেন?’
অর্জুন তাকিয়ে রইল মৈত্রমশাইয়ের দিকে৷
‘মায়ের আশীর্বাদে আমার কিছু ক্ষমতা আছে সাহেব৷ আমি চাইলে মানুষের ভেতরটা অবধি দেখতে পাই৷ সেদিন কালিকিঙ্কর ঠাকুরকে দেখে আমি স্তম্ভিত হয়ে গেছিলাম৷ কেন জানেন? ওই লোকটার ভেতরটা শুধু অন্ধকার, ঘন অন্ধকার৷ জীবনে অনেক মানুষ দেখেছি সাহেব৷ কেউ কখনও পুরো সাদা বা পুরো কালো হয় না৷ ভালো মন্দ, সাদা-কালো মিশিয়েই জীবন৷ কিন্তু কালিকিঙ্কর ঠাকুর আলাদা, সবার থেকে আলাদা৷ আত্মিক ক্ষমতায় মহাশক্তিধর তিনি৷ তন্ত্রচর্চায় তিনি মহাসিদ্ধ, মহাকৌল৷ চীনাচার তন্ত্রের সর্বোচ্চ বিন্দুতে আরোহণ করেছেন তিনি৷ আমার জীবনে এমন মহাপ্রতিভাধর তন্ত্রসিদ্ধ আমি দ্বিতীয়টি দেখিনি৷
কিন্তু মানুষ আসলে কী জানেন? মানুষ আসলে তার সমস্ত সিদ্ধান্তের সমষ্টি৷ আমরা প্রতি মুহূর্তে কোনও কোনও সিদ্ধান্ত নিই৷ এটা ঠিক, ওটা ভুল, ওটা করব, এটা করব না৷ এই ঠিক ভুলের ভুলভুলাইয়াতে নিজেকে এগিয়ে নিয়ে চলার নামই জীবন৷ আর আমরা এই ভুলভুলাইয়াতে যা যা সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকি, শেষ পর্যন্ত সেই সিদ্ধান্তগুলোই আমাদের আমরা যা, তাই করে তোলে৷
আর আশ্চর্যের কথা কী জানেন? এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার সঙ্গে মানুষের শিক্ষাগত যোগ্যতার, বা প্রতিভার সবসময় মিলমিশ থাকবে তার কোনও মানে নেই৷ আমি সমাজের একদম নীচের স্তরের মানুষও দেখেছি যাঁরা নৈতিক, আত্মিক চরিত্রের উন্নতায় সমুজ্জ্বল৷ আবার সমাজের উপর স্তরের মানুষের মধ্যেও কত যে নীচ, হীন মানসিকতা দেখেছি তা বলার নয়৷
কালিকিঙ্কর ঠাকুর তন্ত্রশাস্ত্রে মহাসিদ্ধি লাভ করেছেন বটে, কিন্তু অন্তরের লোভকে জয় করতে পারেননি৷ তন্ত্র মুক্তির কথা বলে, দেহ থেকে দেহাতীতে যাওয়ার কথা বলে, আত্মার বিশুদ্ধতার কথা বলে৷ এই জীবনচক্রের আবর্তন থেকে পুণ্য নির্বাণের দিকে যাওয়ার কথা বলে৷ কিন্তু কালিকিঙ্কর সেই মুক্তি চাননি৷ তিনি চেয়েছেন অন্যকিছু৷ আর সেই চাওয়াই তাঁর কাল হয়েছে৷ কোনও এক অতিলৌকিক, অতিদৈবিক ক্ষমতার লোভে নিজের আত্মাকে অন্ধকারের কাছে বলি দিয়েছেন তিনি৷ নিজেকে বিক্রি করেছেন, পাপের পথে হেঁটে নিজেই মূর্তিমান পাপ হয়ে উঠেছেন৷ আর সেই পাপকর্মের কিছুটা ফল ভোগ করছেন আপনি৷
শুনুন অর্জুনবাবু, অন্ধকার জগতের এক অত্যন্ত অশুভ আত্মা আপনাকে অধিগ্রহণ করেছে৷ সেদিন বলিদান নিয়ে কথা হচ্ছিল মনে আছে? মা কখনও সন্তানের বলি চান না৷ তিনি শুভঙ্করী, এই পৃথিবীর রক্ষাকর্ত্রী৷
বলি দেওয়া হয় দেবীর অনুচর ভূতপ্রেতপিশাচাদির উদ্দেশ্যে, কোনও বিশেষ কামনা নিয়ে৷ ঠাকুরের সেই অশুভ কামনার একটা ছোট্ট অংশ হয়ে পড়েছেন আপনি৷ সেদিন আপনি যখন বেরিয়ে যাচ্ছেন, আপনাকে দেখেই সেটা বুঝতে পেরেছিলাম৷ আজ এখানে পা দিয়ে সেই অশুভ প্রভাব সর্বাংশে অনুভব করতে পারছি৷’
শুনতে শুনতে অর্জুনের শীত করছিল৷ সে কাতরস্বরে প্রশ্ন করল, ‘কী করেছি আমি? আমার ছোট মেয়েটাই বা কী অপরাধ করেছে?’
‘কালিকিঙ্কর ঠাকুর দেবী বজ্রচর্চিকার সাধনায় সিদ্ধিলাভ করেছেন অর্জুনবাবু৷ ইনি একজন অতি প্রাচীন বৌদ্ধতন্ত্রের দেবী৷ মায়ের রূপ অত্যন্ত ভয়ঙ্কর, অস্থিসার, কঙ্কালসদৃশ৷ আমরা হিন্দুরা যাঁকে মা চামুণ্ডা বলে পূজা করি, তিনিই আদিকালে দেবী বজ্রচর্চিকা নামে প্রকট ছিলেন৷
আমি খোঁজ নিয়ে জেনেছি কালিকিঙ্কর ঠাকুরের একটি অনুগত অঘোরী তান্ত্রিকের গোপন দল আছে, তার নাম হচ্ছে অক্ষোভ্যসমাজ৷ এই অক্ষোভ্যসমাজ আজকের নয়, এটি একটি প্রায় সহস্রাব্দপ্রাচীন গুপ্ত তান্ত্রিক গোষ্ঠী৷ এদের সাধনার ধারা হচ্ছে কালচক্রযান৷
কালচক্রযান বৌদ্ধতন্ত্রের একটি সাধনপদ্ধতি৷ এর বিষয়ে বিস্তারিত বিবরণে যাব না, আমাদের তার দরকারও নেই৷ এই অক্ষোভ্যসমাজ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল কালচক্রযানের একটি মিথকে কেন্দ্র করে, তার নাম হচ্ছে অমৃতমূলাধার৷ এই অমৃতমূলাধার নাকি সৃষ্টির আদিতম বিন্দুগ্ধ তাকে আয়ত্ত করতে পারলে মানুষ অমর হয়, কারণ তখন সে তার নিজের জরাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে, কালকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে৷
কালিকিঙ্কর ঠাকুর সেই প্রাচীন অক্ষোভ্যসমাজকে আবার জাগিয়ে তুলেছেন৷ তিনি চর্চিকাসিদ্ধাই, দেবীর সাধনায় মহাবেত্তা৷ আপনি সেদিন যে মূর্তিটি দেখেছিলেন, ওটিই দেবী বজ্রচর্চিকার মূর্তি৷ আর দেবীর সামনে সাত বা আট বছরের বালিকার বলিকে ওরা বলে গৌরীদান৷ এর অর্থ হচ্ছে ঠাকুর সিদ্ধিলাভের পথে একদম শেষ পর্যায়ে উপনীত হয়েছেন৷ আর একটি মাত্র অন্তিমচক্র বাকি৷ তারপরেই ঠাকুর অমিত শক্তির অধিকারী হবেন৷ তিনি নরকের দ্বার উন্মুক্ত করতে সক্ষম হবেন, তুলে আনবেন সৃষ্টির আদিবিন্দু, অমৃতমূলাধার৷’
‘কিন্তু, কিন্তু…’ কথা খুঁজে পাচ্ছিল না অর্জুন, ‘এর সঙ্গে আমার, আমার মেয়ে, বা পরিবারের কী সম্পর্ক?’
‘সম্পর্ক আছে সাহেব,’ ধীরে ধীরে বললেন মৈত্রমশাই, ‘শাস্ত্রে বলে বলিপ্রাপ্ত প্রাণী তৎক্ষণাৎ জীবনচক্রের আবর্তন থেকে মুক্তিলাভ করে, নির্বাণপ্রাপ্তি ঘটে তার৷ কিন্তু এই অমৃতমূলাধারপ্রাপ্তির বলিদানে তা ঘটে না৷ এ উপাসনা নারকী উপাসনা, স্বয়ং যমারি এর হোতা, যমান্তক এর উদগাতা, দেব হেরুক এর অধ্বর্যু৷ তাই এই উপাসনার বলিপ্রাপ্ত জীবের কোনও মুক্তি নেই, তার একমাত্র গতি নরকের প্রেতলোক৷
যে মেয়েটিকে বলি দেওয়া হয়েছে, তার প্রেত তখন কোনও আধার খুঁজছিল৷ ওই কালিকিঙ্কর ঠাকুর বোধহয় অন্য কোনও হতভাগ্য আর তার পরিবারকে এর জন্য নির্বাচিত করে রেখেছিল৷ তারপর আপনাকে দেখে তার মাথায় এই অভিনব পরিকল্পনা আসে৷ আপনাকে আমার থেকে সুকৌশলে সরিয়ে নিয়ে যায় তার বলিদানের সময়৷ আর সেই হতভাগ্য মেয়েটির প্রেতাত্মাকে দেখিয়ে দেয় আপনার পরিবারকে৷
‘কিন্তু কেন? আমি আর আমার মেয়ে কী ক্ষতি করেছি ওদের?’
‘না, আপনি কোনও ক্ষতি করেননি ওর৷ আপনি ওর পরীক্ষার পাত্র বিশেষ৷ ওই যে বললাম, ও বোধহয় অন্য কাউকে নির্দিষ্ট করে রেখেছিল প্রেতের ভোগ হিসেবে৷ আপনার আগ্রহ দেখে ও আপনার ওপরেই পরীক্ষা করার সিদ্ধান্ত নেয়৷ তাই সেদিন আপনাকে যেতে বলেছিল, কিন্তু আমাকে না নিয়ে৷ ও জানত আমি থাকলে ওই নৃশংস পাপকাজ আমি কিছুতেই করতে দিতাম না৷ আমিও যেমন ওকে প্রথম দেখাতে চিনেছি, ও-ও আমাকে প্রথম দেখাতেই চিনতে পেরেছে৷ কালিকিঙ্কর কম বড় তান্ত্রিক নয় অর্জুনবাবু৷’
‘তাহলে উপায়?’
বিষণ্ণমুখে ধীরে ধীরে মাথা নাড়লেন মৈত্রমশাই ‘জানি না অর্জুনবাবু, সত্যি জানি না৷ তবে এটুকু জানি এই পাপ আপনার সংসার ছারখার করে দেবে৷ প্রথমে যাবে আপনার মেয়ে, তারপর ছেলে, তারপর আপনার স্ত্রী, আর তারপর অনেক কষ্ট দিয়ে তিলে আপনাকে শেষ করবে৷’
অর্জুন কিছুক্ষণ কোনও কথাই বলতে পারল না৷ তারপর স্খলিতস্বরে বলল, ‘তাহলে এখন উপায়?’
কৃষ্ণানন্দ গম্ভীরমুখে বললেন, ‘এই প্রেতকর্মের প্রতিষেধক আমার জানা নেই সাহেব৷ এই প্রেত অন্ধ, সে শুধু জানে ধ্বংস করতে আর তার আগে অসীম, অবর্ণনীয় কষ্ট দিতে৷ মা মহামায়াকে ডাকুন, এক তিনিই যদি কোনও রাস্তা দেখান৷’
অর্জুন কিছু বলে ওঠার আগেই দোতলার বারান্দা থেকে রাধিকার চিৎকার শোনা গেলো, ‘অর্জুন, শিগ্গিরি এদিকে এসো, সর্বনাশ হয়ে গেছে৷’
* * *
কালিকিঙ্কর ঠাকুরমশাইয়ের ভুরুদুখানা কুঁচকে ছিল৷ যা যা দরকার ছিল সবই তো করেছেন৷ সাধনার সব কটি ধাপ বিনাবাধায় সুসম্পন্ন করেছেন৷ গৌরীদান হয়েছে যথাযথ প্রক্রিয়াতে৷ প্রেতসন্নিবেশ করেছেন ওই মূর্খ সিনেমা করিয়ের পরিবারের ওপর৷ আর দুদিন পর অমাবস্যা৷ সেদিন রাহু প্রবেশ করবেন ভরণী নক্ষত্রে, শনি থাকবেন অশ্বিনীতে৷ শনি মূল ত্রিকোণে থেকে রাজযোগ তৈরি করবেন৷ ওই দিন তাঁর সিদ্ধিলাভের প্রকৃষ্ট দিন৷ তার আগে এই দুদিন তাঁর কিছু প্রাথমিক ক্রিয়া আছে৷ সেসবই অতি সাধারণ ক্রিয়া, তিনি ইচ্ছামাত্রে সেসব সুসম্পন্ন করতে পারেন৷ অথচ তিনি মনঃসন্নিবেশ করতে পারছেন না কেন? এই অতি সাধারণ ক্রিয়াতেও তাঁর সিদ্ধিলাভ হচ্ছে না কেন?
কালিকিঙ্কর ওরফে ঠাকুরমশাই মাথা আঁকড়ে বসে থাকেন৷ সব কিছু অতি সাবধানে, অতি সুচারুরূপে, অতি যত্ন সহকারে সুসম্পন্ন করা সত্ত্বেও তাঁর অভীষ্ট সিদ্ধ হচ্ছে না কেন? এত বাধা আসছে কোথায়?
প্রতিবার পঞ্চমুণ্ডির আসনে বসা সত্ত্বেও তাঁর কানে ওই বালিকার অন্তিম আর্তনাদ ভেসে আসে কেন? তাঁর সব সাধনা, সব সিদ্ধি, সব ইষ্ট নষ্ট হয়ে যায়৷ তাঁর মনের কোণে যেন কোন আশঙ্কার কালো মেঘ ঘনিয়ে ওঠে৷
আসনে স্থির হয়ে বসেন কালিকিঙ্কর ঠাকুর৷ গম্ভীরস্বরে মন্ত্রোচ্চারণ করতে শুরু করলেন, ‘ওঁ বজ্রচর্চিকায়ৈ স্বাহা, ওঁ মহাবিদ্যৈ স্বাহা, ওঁ তারে তুত্তারে তুরে স্বাহা৷ ওঁ আর্য্যপরাজিতায়ৈ স্বাহা৷ ওঁ সর্ববুদ্ধডাকিন্যৈ স্বাহা….
তাঁকে এই সাধনায় সিদ্ধিলাভ করতেই হবে৷ যে করেই হোক৷
* * *
নূপুরকে ডাক্তার দেখানো হয়েছে৷ কড়া সিডেটিভের প্রভাবে আচ্ছন্ন হয়ে আছে সে৷ একটা ঘরে থম মেরে বসে আছে রাধিকা৷ তার হাতে, পায়ে, পিঠে ড্রেসিং করা৷ রাধিকার কোলের কাছে গুটিসুটি হয়ে শুয়ে আছে নিখিল৷ অর্জুনের বাবাকে অন্য একটা ঘরে রাখা হয়েছে৷ অর্জুনের মা রয়েছেন স্বামীর কাছে৷ সারা বাড়িতে একটা থমথমে ভাব৷
অর্জুন ধরা গলায় কৃষ্ণানন্দকে জিজ্ঞাসা করল, ‘এসব কী হচ্ছে মিস্টার মৈত্র৷’
রাধিকার চিৎকার শুনে দৌড়ে গেছিল অর্জুন৷ চিৎকারটা আসছিল রান্নাঘর থেকে৷ অর্জুন গিয়ে দেখে নূপুর রাধিকাকে চেপে ধরেছে গ্যাসের স্টোভের ওপর৷ রাধিকা চাইছে তাকে ঠেলে ফেলে দিতে, কিন্তু পারছে না৷ কোথা থেকে যেন অমানুষিক শক্তি এসে ভর করেছে ওই একরত্তি মেয়েটার ওপর৷ এদিকে রাধিকার শাড়ির আঁচলে আগুন ধরে গেছে৷ তারস্বরে চিৎকার করছে সে৷ আর নূপুর সেই আর্তনাদ শুনে সম্পূর্ণ অচেনা গলায় খিলখিল করে হাসছে আর বলছে ‘তপাইকো সময় সকিয়ো বুড়ি৷’
কৃষ্ণানন্দের ওপরে উঠে আসতে একটু সময় লাগল৷ তিনি এসে দেখলেন অর্জুন একটা বেত দিয়ে নির্মমভাবে মারছে নূপুরকে৷ নূপুরকে দেখে মনে হচ্ছে সেই প্রহার যেন তার গায়েই লাগছে না৷ এক জায়গায় দাঁড়িয়ে উন্মাদের মতো হি হি করে হাসছে সে৷ আর সেই ভয়াবহ দৃশ্য দেখে রাধিকা নিখিলকে জড়িয়ে কাঁদছে৷
মৈত্রমশাই এসে বেতের লাঠিটা কেড়ে নিলেন৷ তারপর কড়া গলায় ধমকালেন অর্জুনকে, ‘কী করছেন কী৷ মেরে ফেলবেন নাকি মেয়েটাকে৷’
এতক্ষণের পরিশ্রমে নূপুর বোধহয় ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল৷ সে ধুপ করে পড়ে গেল মেঝের ওপর৷ মৈত্রমশাই পরম মমতায় তাকে তুলে বিড়বিড় করে কী একটা মন্ত্র বলতে বলতে তাকে তার ঘরে শুইয়ে দিয়ে এলেন৷
* * *
সেদিন রাতে হঠাৎ করেই ঘুম ভেঙে গেল জংবাহাদুরের৷ প্রথমে সে বুঝতে পারল না তার কারণটা কী৷ বুকের ওপর যেন একটা পাহাড় বসে আছে, নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে তার৷
ওঠার চেষ্টা করতেই জংবাহাদুর বুঝল যে সে একটুও নড়তে পারছে না৷ এমনকি ডানদিকে ঘুরে যে জলের বোতলটা নেবে, সেটাও পারছে না সে৷
বুকের ওপর চাপটা ক্রমশ বাড়ছে৷ কপালে ঘাম জমছে জংবাহাদুরের৷ নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে ক্রমশ৷ মনে হচ্ছে ফুসফুসটা যেন গলা দিয়ে বেরিয়ে আসবে এবার৷
হাঁসফাঁস করতে করতেই জংবাহাদুর বুঝল তার বুকের ওপর চেপে থাকা পাহাড়টা নড়ছে৷ তারপর সেটা অল্প ঝুঁকে এল জংবাহাদুরের ওপর৷ আর চেনা একটা গলায় ভেসে এল, ‘ধেরৈ দুখাই ছ?’
মিসিবাবা বসে আছে তার বুকের ওপর! তাকে জিজ্ঞেস করছে, খুব কষ্ট হচ্ছে!
আতঙ্কিত হওয়ারও সময় পেল না জংবাহাদুর৷ শুধু অল্প খোলা জানালা দিয়ে ঘরের ভিতর ঢুকে আসা চাঁদের আলোয় ঝলসে উঠল মাংস কাটা ছুরিটা৷
পরদিন সকাল থেকে জংবাহাদুরকে আর খুঁজে পাওয়া গেল না৷
* * *
সকালে রাধিকার ঘরে ঢুকে চমকে উঠল অর্জুন৷ রাধিকার মুখ দেখে মনে হচ্ছে যেন একরাতেই অনেক বয়েস বেড়ে গেছে তার৷ চুল উসকোখুসকো, চোখের নীচে কালি৷ এই মুহূর্তে সে বসে আছে নিখিলের মাথার কাছে৷ সারা রাত কেঁদেছে ছেলেটা, ঘুমিয়েছে ভোররাতের দিকে৷
এই মুহূর্তে রাধিকার মাথার ভেতর সব কিছু শূন্য হয়ে আছে৷
নিখিল ঘুমিয়ে যাওয়ার পর একবার নূপুরকে দেখতে এসেছিল রাধিকা৷ নূপুর তখন অঘোরে ঘুমিয়ে আছে৷ আর তার ডানহাতে আলগোছে ধরা আছে রান্নাঘরের মাংস কাটার ছুরিটা৷ আর তার গায়ে শুকিয়ে যাওয়া রক্ত!
মাথা ঘুরে গেছিল রাধিকার৷ কোনওমতে দরজা ধরে নিজেকে সামলেছিল সে৷ কী করেছে মেয়েটা? ছুরিতে রক্ত কেন?
একটু পরে নিজেকে সামলাল রাধিকা৷ আলগোছে ছুরিটা তুলে নিল নুপূরের হাত থেকে৷ তারপর দৌড়ে ফিরে গেল নিজের ঘরে, ওয়ার্ড্রোবের একদম ভেতরে জামাকাপড়ের মধ্যে লুকিয়ে রাখল ছুরিটা৷
কিছু তো একটা ঘটিয়েছে মেয়েটা৷ সাঙ্ঘাতিক একটা কিছু৷
ভাবতেই রাধিকা আবার অসুস্থ বোধ করতে লাগল৷ বাথরুমে গিয়ে ঘাড়ে মুখে চোখে জল দিয়ে এল কিছুটা৷ তারপর কী ভেবে আবার নূপুরের ঘরে গেল৷ মেয়েটা কোথায় কী করে এসেছে জানা দরকার৷ ছুরিতে যখন রক্ত লেগে আছে, নিশ্চয়ই রক্তের ফোঁটাও পড়ে থাকবে কোথাও না কোথাও৷
কিন্তু নূপুরের ঘরে ঢুকে আঁতিপাঁতি করে খুঁজেও কোনও রক্তের দাগ দেখতে পেল না রাধিকা৷ ভুরু কুঁচকে গেল তার৷ এমন তো হওয়ার কথা নয়৷
খুব খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে মেঝেটা পরীক্ষা করে দেখল রাধিকা৷ কই, না তো, কোথাও একবিন্দু রক্তের ছাপ নেই৷ মেঝে, চৌকাঠ, ব্যালকনি, সিঁড়ি, এক এক করে সব পরীক্ষা করল সে৷
নাহ, কোথাও কোনও রক্তের চিহ্নমাত্র নেই৷
আবার নূপুরের ঘরে ফিরে এল রাধিকা৷ এবার চাদরটা পরীক্ষা করল সে৷ আর তখনই একটা অদ্ভুত জিনিস নজরে পড়ল তার৷
চাদরের একপ্রান্তে একফোঁটা রক্তের দাগ লেগে আছে৷ কিন্তু প্রায় মিলিয়ে এসেছে সেটা৷ ওই জায়গাটা ভালো করে দেখল রাধিকা৷ বুঝতে পারল যে ওখানে অনেকটা জায়গা জুড়ে রক্ত লেগেছিল৷ কিন্তু কোন অলৌকিক উপায়ে সেই দাগ মুছে এসেছে প্রায়৷ শুধু একফোঁটা রক্ত লেগে আছে৷ আর তার স্তম্ভিত চোখের সামনে সেই দাগটাও ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেল৷ যেন ওখানে কিছুই ছিল না৷
অর্থাৎ যেখানে যেখানে রক্তের ফোঁটা পড়েছিল, সেই দাগও এভাবেই মিলিয়ে গেছে৷ তাই কোথাও কোনও চিহ্ন পায়নি রাধিকা৷
চুপচাপ উঠে পড়ল রাধিকা৷ নিজের ঘরে এসে ওয়ার্ড্রোব খুলল৷ বার করে আনল ছুরিটা৷
নিদাগ নিষ্কলঙ্ক ছুরি৷ কে বলবে একটু আগে এই ছুরিটার সারা গায়ে রক্ত লেগেছিল?
অর্জুনকে আঁকড়ে ধরে হাউ হাউ করে কেঁদে উঠল রাধিকা৷ ‘এসব কী হচ্ছে অর্জুন? কেন হচ্ছে আমাদের ছেলেমেয়েদের সঙ্গে? আমি কি এবার পাগল হয়ে যাব? আমাদের সঙ্গে কী হচ্ছে কি এসব?’
অর্জুন রাধিকার মাথাটা নিজের বুকে চেপে ধরল৷ তাকে এখন বিভ্রান্ত হলে চলবে না৷ মাথা ঠান্ডা রাখতে হবে৷
একটু পর রাধিকার কান্নার বেগ কমলে সে বলল, ‘রাতে কী হয়েছে জানো?’
অর্জুন বলল, ‘কী হয়েছে?’
ফোঁপাতে ফোঁপাতে সব কথা খুলে বলল রাধিকা৷ শুনতে শুনতে স্তম্ভিত হয়ে গেল অর্জুন৷
* * *
তাকদা থানার ইন্সপেক্টর অনিল গুরুং কাজের লোক৷ জংবাহাদুরের উধাও হওয়ার রহস্য সমাধানের ভার তাঁর ওপরেই পড়েছে৷ সকাল সকালই পুলিশ এনে একপ্রস্থ রুটিন এনকোয়্যারি শুরু করে গেছে৷ এবার গুরুং সাহেব নিজে এসেছেন সরেজমিনে তদন্ত করতে৷
নূপুরকে দেখবার জন্য ডাক্তারবাবু এসেছেন৷ তিনি নূপুরকে চেক করতে করতে মাথা নাড়লেন, ‘কাল যা বলেছি, আজও তাই বলছি মিস্টার সেনগুপ্ত৷ আমি কিন্তু অসুস্থতার কোনও লক্ষণ খুঁজে পাচ্ছি না৷ আমার মনে হয় কোনও মেন্টাল ট্রমা থেকে ও এরকম করছে৷ আমার সাজেশন হচ্ছে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব কলকাতা বা মুম্বাইতে নিয়ে গিয়ে কোনও ভালো সাইকিয়াট্রিস্ট দেখান৷’
ডাক্তারবাবু চলে গেলে রাধিকা এসে ঢুকল ঘরে৷ অর্জুন তাকে বলল, ‘এসো রাধিকা, পাশে বোসো৷ অনেক কথা বলার আছে মৈত্রমশাইকে৷’
মৈত্রমশাই রাধিকাকে দেখে অবাক হয়ে গেছিলেন৷ অমন ঝকঝকে সুন্দরী আধুনিকা মেয়েটিকে তিনি এমন বিধ্বস্ত, বিস্রস্ত অবস্থায় দেখবেন এ তাঁর দূরতম কল্পনাতেও ছিল না৷
রাধিকা ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল৷ বলল, ‘আজ অবধি সজ্ঞানে কারও ক্ষতি করিনি মৈত্রমশাই, কারও খারাপ চাইনি৷ আমার সন্তানদের সঙ্গেই এমন কেন হচ্ছে বলতে পারেন?’
মৈত্রমশাই ভারী নরম সুরে বললেন, ‘উতলা হবেন না মা৷ জানি আপনারা এক মহাবিপদের মধ্য দিয়ে যাচ্ছেন৷ মা যদি কৃপা করেন তাহলে এই মহাবিপদ থেকে উদ্ধারের পথ তিনিই বলে দেবেন৷’
একটু সামলে রাধিকা ভোররাতের পুরো ঘটনাটা বলল৷ শুনে খানিকক্ষণ ভুরু কুঁচকে বসে রইলেন মৈত্রমশাই৷ তারপর রাধিকাকে প্রশ্ন করলেন, ‘আচ্ছা মা, একটা কথা বলুন তো আমাকে৷ আজ ভোররাতের ঘটনাটা ছাড়াও গত কয়েকদিনের মধ্যে এমন কিছু আপনার সঙ্গে ঘটেছে আপনি যুক্তিতে যার ব্যাখ্যা খুঁজে পাননি?’
রাধিকা প্রথমে প্রশ্নটা বুঝতে পারল না৷ জিজ্ঞেস করল, ‘যুক্তিতে ব্যাখ্যা খুঁজে পাচ্ছি না বলতে?’
‘মানে এমন কিছু ঘটনা যা ঘটা আপাতদৃষ্টিতে অসম্ভব, অবিশ্বাস্য৷ অথচ তাই ঘটেছে আপনার সঙ্গে৷ এমন কিছু যার কোনও কার্যকারণ সম্পর্ক নেই, এমন কিছু৷’
রাধিকা একটু ভাবল৷ খানিক পর বলল, ‘হ্যাঁ, ঘটেছিল৷ যেদিন আপনারা ট্রেন ধরলেন, সেদিন আমি কালীঘাটে নূপুর আর নিখিলকে নিয়ে পুজো দিতে গেছিলাম৷ ফেরত আসার সময় একটা আশ্চর্য ঘটনা ঘটে৷’
সোজা হয়ে বসলেন মৈত্রমশাই, ‘কী ঘটনা?’
রাধিকা থেমে থেমে পুরো ঘটনাটা বলল৷ শুনতে শুনতে মৈত্রমশাইয়ের চোখমুখের ভাষা পালটে যাচ্ছিল৷ রাধিকার কথা শেষ হতে সাগ্রহে জিজ্ঞেস করলেন, ‘যে বৃদ্ধার কথা বললেন তাঁকে দেখতে কেমন?’
‘একদম শুকনো কঙ্কালসার চেহারা৷ গাল দুটো বসে গেছে, চোখ একেবারে কোটরে ঢুকে গেছে, হাত দেখলে মনে হয় যেন হাড়ের ওপর চামড়া জড়ানো৷ গায়ে একটা শতচ্ছিন্ন শাড়ি, আর খালি পা৷ এইটুকু মনে আছে৷’
কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ দুহাত জড়ো করে কপালে ঠেকালেন, বললেন, ‘জয় মা, জয় মা চামুণ্ডা৷ মা রাধিকা, জানি না আপনি কত পুণ্য সঞ্চয় করেছেন যে মা স্বয়ং আপনাকে দেখা দিয়েছেন, আপনার সন্তানের হাতে জল খেয়েছেন৷ মা গো, আর ভয় নেই৷ যে জলে আপনার মেয়ে জগন্মাতার তৃষ্ণা নিবারণ করেছে, মা নিজে এসে সেই জলেই রক্তের দাগ মুছে দিয়েছেন, যাতে নূপুরের কোনও বিপদ না হয়৷ জয় জগদিশ্বরী…জয় মহামায়া৷ ওই ছুরিটি আমাকে এনে দিন মা৷ ওতে স্বয়ং জগত্তারিণীর হাতের ছোঁয়া আছে৷ ওটি আমার লাগবে৷’
বলতে বলতেই ইন্সপেক্টর গুরুং ঘরে ঢুকে চেয়ারে বসলেন৷ বেজার মুখে বললেন, ‘কী ঝামেলার কেস বলুন তো৷ লোকটা কী করে উধাও হয়ে গেল কিছুই বুঝতে পারছি না৷
এমনিতে জংবাহাদুরকে আজ অবধি এই গ্রামের বাইরে কেউ যেতে দেখেনি৷ হঠাৎ করে কাউকে না বলে চলে যাবে সেটাও সম্ভব না৷ তাছাড়া কাপড়জামা জুতো টাকাপয়সা সবই রেখে গেছে৷ ঘরে ধস্তাধস্তির কোনও চিহ্ন নেই, রক্তপাতের চিহ্ন নেই৷ খুন বা অপহরণ বলেও মনে হচ্ছে না৷ কী হতে পারে সে তো মাথাতেই আসছে না৷’
রক্তপাতের কথা শুনে একবার ঢোঁক গিলল অর্জুন৷
গুরুং বললেন, ‘ডাক্তারবাবুকে দেখলাম বেরোতে৷ কী বললেন উনি? শুনেছি আপনার মেয়ে খুব অসুস্থ৷ সে ঠিক আছে এখন?’
অর্জুন বলল, ‘ওই সামান্য নার্ভাস ব্রেকডাউন মতো৷ ডাক্তারবাবু বলেছেন ওকে কোনও বড় স্পেশালিস্ট দেখাতে৷ খুব শিগ্গিরিই ওকে আমরা কলকাতা নিয়ে যাব৷’
ইন্সপেক্টর গুরুংকে দেখে মনে হল কথাটা শুনে যেন হাঁপ ছেড়ে বাঁচলেন৷ বললেন, ‘হ্যাঁ হ্যাঁ, নিয়ে যান৷ এমনিতেও কাল থেকে অন্য একটা ঝামেলায় বিচ্ছিরি ভাবে ফেঁসে আছি, তার ওপর এই৷ একের পর এক আমার ওপর দিয়ে যা যাচ্ছে না…’
মৈত্রমশাই ভদ্রতাবশত জিজ্ঞেস করল, ‘কী হয়েছে?’
‘আর বলবেন না৷ কাল থেকে এক মহিলাকে নিয়ে অত্যন্ত বিব্রত হয়ে আছি৷ বাড়ি নেপালের কোন না কোন গ্রামে৷ কাল থেকে এখানে এসে হাজির৷ তার একমাত্র মেয়ে, আর হাজব্যান্ড নাকি এদিকে এখানে কোথায় এসেছে, তারপর তাদের আর খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না৷ মেয়ের বয়েস আট, নাম গৌরী৷ মহিলা প্রেগনেন্ট, অ্যাডভান্স স্টেজ৷ এই অবস্থায় শিলিগুড়ি, কালিম্পং, কার্শিয়াং, দার্জিলিং এসব চষে বেড়াচ্ছেন মেয়ে আর স্বামীর খোঁজে৷ কাল থানায় এসে কী হুজ্জুতি, যে করে হোক আমরা যেন ওঁর মেয়ে আর স্বামীকে খুঁজে দিই৷’
মৈত্রমশাই প্রায় লাফিয়ে উঠলেন,‘এখুনি আমাকে ওই মহিলার সঙ্গে দেখা করান ইন্সপেক্টর সাহেব, এই মুহূর্তে৷’
অর্জুন আর ইন্সপেক্টর গুরুং দুজনেই অবাক হয়ে গেলেন৷ গুরুং বললেন, ‘এ কী মশাই, আপনি অমন ক্ষেপে গেলেন কেন?’
ছটফট করে উঠলেন কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ, ‘সব পরে বলব আপনাকে৷ আপাতত আমাকে ওই মহিলার কাছে নিয়ে চলুন সাহেব৷ মায়ের কৃপায় এবার একটা রাস্তা বোধহয় পাওয়া গেছে৷’
* * *
ডুয়ার্সের জঙ্গলের মধ্যে একটি পরিত্যক্ত মন্দির৷ সেখানে আজ আলো জ্বলেছে বহুদিন বাদে৷ লোক লাগিয়ে মন্দিরটি পরিষ্কার করা হয়েছে৷ মন্দিরের মধ্যে একদিকে দেবী চামুণ্ডার পূর্বাস্য মূর্তি৷ তাঁর সামনে হোম এবং অন্যান্য পুজোপকরণ৷ একটি যজ্ঞের বেদি প্রস্তুত করা হয়েছে৷ তাকে ঘিরে বসে আছেন চারজন৷ মৈত্রমশাই, অর্জুন, নিখিল আর নূপুর৷
নূপুরকে নিয়ে আসা সহজ হয়নি৷ তাকে কড়া ঘুমের ওষুধ দিয়ে গাড়িতে তোলা হয়েছে৷ সারাটা রাস্তা নূপুরের মাথা নিজের কোলে নিয়ে বসেছিলেন মৈত্রমশাই৷ ক্রমাগত মন্ত্রজপ করে গেছেন এখন, এই মন্দিরে বসেও সে ঘুমে ঢুলছে৷
অর্জুন চারিদিক দেখে প্রশ্ন করল, ‘এটা কীসের মন্দির মৈত্রমশাই?’
‘এই মন্দির চামুণ্ডা মন্দির অর্জুনবাবু৷ এ বহু প্রাচীন মাতৃমন্দির৷ কালাপাহাড়ের আক্রমণের সময় এই মন্দির পরিত্যক্ত হয়৷ কালের করালগ্রাসে এই মন্দিরকে লোকে ভুলে গেছে বটে, তবে এই চামুণ্ডামূর্তি ভারী জাগ্রত৷ আজ মায়ের আশীর্বাদ নিয়ে এক মায়ের চোখের জল মোছাব৷ আর আমার ছোট মায়ের হত্যার প্রতিশোধ নেব৷’
‘ছোট মায়ের হত্যার প্রতিশোধ?’ অর্জুনের গলায় বিস্ময়, ‘কার কথা বলছেন মৈত্রমশাই?’
স্তব্ধ হয়ে বসে থাকেন মহাতন্ত্রবেত্তা কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ৷ তাঁর চোখে জল৷ তিনি ধীরে ধীরে বলেন, ‘আপনি তো জানেন আমি বহুদিন নেপাল রাজ কলেজে অধ্যাপনা করেছি৷ তখন প্রায়ই পশুপতিনাথ মন্দিরে যেতাম পূজার্চনার জন্য৷ সেখানেই একটি ছয় বছরের মেয়ের সঙ্গে আমার একবার আলাপ হয়৷ ওর বাবা মা মন্দিরে এসেছিল পুজো দিতে৷ মেয়েটি ভারী মিষ্টি, অতি সুলক্ষণা৷ আমার সঙ্গে তার দিব্যি ভাব হয়ে গেছিল৷
যে কদিন তারা কাঠমান্ডুতে ছিল, পশুপতিনাথ মন্দির চত্বরে প্রায় রোজই দেখা হত৷ গত বছরেও আমি কাঠমান্ডু গেছিলাম শুধু মেয়েটির সঙ্গে দেখা করতে৷ মেয়েটি আমাকে বাঙালিদাদু বলে ডাকত৷
গত কয়েকদিন ধরেই মেয়েটিকে বারবার স্বপ্নে দেখছিলাম৷ মন বলছিল কিছু একটা অঘটন ঘটেছে৷ ওরা কাঠমান্ডুর বাইরে একটা গ্রামে থাকে৷ সেখানে টেলিফোন মোবাইল কিচ্ছু নেই৷ ফোনে যোগাযোগ করার উপায়ও নেই৷
যেদিন আপনাকে আমি হোটেলে একলা ছেড়ে আমি চলে যাই, তার আগেরদিন রাতে আমি আপনার সঙ্গে ওই মেয়েটিরও কোষ্ঠী গণনা করেছিলাম, আর বুঝতে পারি যে তার সমূহ বিপদ৷ সেদিন আমি গেছিলাম আমার এক প্রাক্তন সহকর্মীকে ফোন করতে, যার বাড়ি ওই মেয়েটির গ্রামের কাছাকাছি৷ তাকে অনুরোধ করেছিলাম সে যেন একবার ওদের বাড়ি গিয়ে দেখে আসে মেয়েটি কেমন আছে৷
সারাদিন, সারারাত আমি ফোনের কাছে ঠায় বসেছিলাম৷ অবশেষে মাঝরাতে আমার সেই সহকর্মী আমাকে জানায় তাদের বাড়ি ফাঁকা, কেউ নেই৷ সেই থেকে মেয়েটির জন্য ভারী উদ্বিগ্ন হয়েছিলাম৷
আজ বুঝলাম কেন আমার মন বারবার মেয়েটির অমঙ্গল আশঙ্কা করছিল৷ আপনার সামনে যে মেয়েটিকে বলি দেওয়া হয়েছিল, ওই-ই সেই মেয়ে, গৌরী, আমার অসমবয়সী বন্ধু৷’
অর্জুন শ্বাসরূদ্ধ করে এই কাহিনী শুনছিল৷ সে বলল, ‘সেই মেয়েটির আত্মাই কি…’
‘হ্যাঁ অর্জুনবাবু৷ গৌরীর প্রেতাত্মাই আজ আপনার মেয়ের শরীর অধিগ্রহণ করেছে৷ দেবী বজ্রচর্চিকার উদ্দেশ্যে নিবেদিত নরবলির কুৎসিত উপসর্গ আজ অভিশপ্ত পিশাচিনীর রূপ ধরে আপনার জীবন ছারখার করতে উদ্যত৷
দুদিন আগে অবধি সেই প্রেতাত্মার কবল থেকে আপনাদের উদ্ধার করার কোনও উপায়ই আমার জানা ছিল না৷ তবে মায়ের কৃপায় সেদিন একটি উপায় আমার করায়ত্ত হয়েছে৷
আজ অমাবস্যা৷ আমি জানি কালিকিঙ্কর এখনও চূড়ান্ত সাফল্য লাভ করেনি৷ আজ সে তার সর্বশক্তি দিয়ে শেষ চেষ্টা করবেই৷ নইলে তার সমস্ত সাধন, সমস্ত উদ্যোগ বিফলে যাবে৷ আর আজ আমি এই অতি প্রাচীন চামুণ্ডামন্দিরে বসে আমার সমস্ত পুণ্যফল সম্বল করে উপায়সাধনে প্রবৃত্ত হব, কালিকিঙ্করের সাধনা ব্যর্থ, হবে, হবে, হবেই৷
‘কিন্তু আপনি যে বললেন কালিকিঙ্কর ঠাকুর বজ্রচর্চিকার সাধনা করছেন৷ ইনি তো…’
‘বৌদ্ধ দেবী বজ্রচর্চিকা আর হিন্দু দেবী চামুণ্ডা এক এবং অভিন্ন সাহেব৷ আজ আমি মা চামুণ্ডার কাছে আহুতি দেব৷ গৌরীর আত্মাকে নূপুরের শরীর থেকে মুক্তি দেব আর তাতেই কালিকিঙ্করের সমস্ত উদ্যোগ ব্যর্থ হবে৷’
‘কিন্তু মৈত্রমশাই, কী করে জানলেন যে কালিকিঙ্কর ঠাকুর এখনও তার সাধনায় সফল হয়নি?’
প্রায় ঘুমন্ত নূপুরের দিকে ইঙ্গিত করলেন কৃষ্ণানন্দ, ‘কারণ গৌরীর আত্মা এখনও সম্পূর্ণ পিশাচে পরিণত হয়নি৷ সে সবার ক্ষতি করতে চেয়েছে, হয়তো একজনের প্রাণও নিয়েছে৷ একজন ছাড়া, নিখিল৷ সেই পিশাচিনী কিছুতেই নিজের ভাইয়ের ক্ষতি করতে পারেনি৷ আর আজকে নিখিলই হবে আমার সর্বোত্তম অস্ত্র৷’
‘কিন্তু কেন? নিখিলই কেন?’
‘এটা আমাকেও ভাবাচ্ছিল৷ গৌরীর আত্মা সবাইকে মারতে চাইছে, সবার ক্ষতি চাইছে, কিন্তু নিখিলের ওপর তার আক্রোশ নেই কেন?
সেদিন গৌরীর মায়ের সঙ্গে কথা বলেই সমস্ত ব্যাপারটা আমার কাছে পরিষ্কার হয়ে যায়৷
গৌরীর মা গর্ভবতী, আসন্নপ্রসবা৷ গৌরী জানত ওর একটা ভাই আসছে৷ সেই না দেখা, না পরিচিত হওয়া ভাইয়ের প্রতি এক আশ্চর্য মমতা, অদ্ভুত ভালোবাসা জন্মেছিল মেয়েটির৷ সেই ভালোবাসা কোনও কারণেই, কোনও তন্ত্রসাধনাতেই, কোনও অপশক্তিতেই নষ্ট হয়নি৷ তাই গৌরীর আত্মা সবার ক্ষতি চাইলেও নিখিলের কোনও ক্ষতি চাইতে পারেনি৷
আর আজ গৌরীর সেই নিজের অদেখা ভাইয়ের প্রতি ভালোবাসাই আপনাকে রক্ষা করবে সাহেব৷ জেনে রাখুন সাহেব তন্ত্র মন্ত্র অপশক্তি সব পারে, শুধু ভালোবাসাকে নষ্ট করতে পারে না, ভালোবাসাই হল সবচেয়ে বড় তন্ত্র, সবচেয়ে বড় জাদু৷’
* * *
কালিকিঙ্কর সাধনায় বসেছেন৷ সেই একই শ্মশানে৷ সেই একই বেদি৷ সামনে দেবী বজ্রচর্চিকার মূর্তি সেই একই মূর্তি৷ কিন্তু বারবার বাধা আসছে কেন৷ মন উৎকণ্ঠিত, বিক্ষিপ্ত হয়ে আছে কেন?
মনকে একাগ্রচিত্ত করে বজ্রাসনে বসে হুঙ্কার দিলেন মহাঘোরী তন্ত্রসিদ্ধ কালিকিঙ্কর শাস্ত্রী৷ আজ তাঁকে বিজয়ী হতেই হবে৷
* * *
পূজা যত এগোতে লাগল ততই চঞ্চল হয়ে উঠতে লাগল নূপুর৷ চুল খুলে গেছে তার৷ চোখে রক্তের আভা৷ ধীরে ধীরে অল্প অল্প দুলতে লাগল সে৷
অর্জুন লক্ষ্য করল ধীরে ধীরে তার মুখের, হাত পায়ের গড়ন বদলে যাচ্ছে৷ গাল দুটো চুপসে গেল, চোখ ঢুকে গেল অক্ষিকোটরের মধ্যে৷ হাত পায়ের মাংস শুকিয়ে গেল, মনে হচ্ছে শুধু কয়েকটা হাড়ের ওপর চামড়ার আস্তরণ জড়িয়ে আছে৷
অর্জুন ভয় পেয়ে নূপুরকে ধরতে গেল৷ নূপুর একঝটকায় সরিয়ে দিল বাবার হাত৷ তার চুলগুলো তখন উড়তে শুরু করেছে অশনিসঙ্কেতের মতো৷ একদৃষ্টে সে চেয়ে আছে কৃষ্ণানন্দের দিকে৷ রগের শিরা ফুলে উঠেছে তার৷ সেই অচেনা গলায় ঘরঘরে স্বরে নেপালী ভাষায় বলে উঠল সে, ‘বন্ধ কর শয়তান, বন্ধ কর এসব৷’
কৃষ্ণানন্দ সেসবে কান দিলেন না৷ তিনি তখন হোমের আগুন প্রজ্বলিত করেছেন৷ গম্ভীর গলায় মন্ত্রোচ্চারণ করে চলেছেন,
‘চামুণ্ডাট্টহাসাং বিকটিতদশানাং ভীমক্ত্ৰাং ত্রিনেত্রাং নীলাম্ভোজ-প্রভাভাং প্রমুদিতপুষং নারমুণ্ডালিমালাম৷ খাং শূলং কপালং নরশিখরখচিতং খেটকং ধারয়ন্তীং প্রেতারূঢ়াং প্রমত্তাং মধুমদমুদিতাং ভাবয়েচ্চগুরূপাম৷ ওঁ চামুণ্ডায়ৈ নমঃ…’
নূপুর হঠাৎই লাফিয়ে উঠল ছিলে ছেঁড়া ধনুকের মতো৷ তারপর দুহাত বাড়িয়ে ঝাঁপ দিল মৈত্রমশাইয়ের গলা লক্ষ্য করে৷ অর্জুন সতর্কই ছিল৷ নূপুরের হাত মৈত্রমশাইয়ের গলা অবধি পৌঁছবার আগেই সে ধরে ফেলল নূপুরকে৷ তার দুই বাহুর মধ্যে ছটফট করে উঠল একরত্তি মেয়েটা৷ তাকে ধরে রাখতে পারছে না অর্জুন৷ ওইটুকু মেয়ের শরীরে যেন অজুত হস্তীর বল৷ নূপুরের চোখ টকটকে লাল হয়ে উঠেছে৷ বেরিয়ে এসেছে শ্বদন্ত দুটি৷ আর সেই সঙ্গে তার মুখ থেকে অচেনা নেপালি স্বরে ছিটকে আসছে উচ্চকিত অভিশাপ আর দুর্বাক্যের স্রোত৷
কোনওমতে নূপুরকে আটকে রাখল অর্জুন৷ ততক্ষণে তাকে আঁচড়ে কামড়ে ক্ষতবিক্ষত করে দিয়েছে নূপুর৷ অর্জুনের হাত, গলা, গাল থেকে রক্ত ঝরছে অঝোরধারায়৷ নিখিল দিদির এই রূপ দেখে সিঁটিয়ে গেছে মন্দিরের এক কোণে৷ আর্তনাদ করে কাঁদছে সে৷
হোম সম্পন্ন করে নূপুরের দিকে চাইলেন কৃষ্ণানন্দ৷ যজ্ঞের ফোঁটা হাতে উঠে দাঁড়ালেন৷ তারপর নূপুরের কপালে সেই ফোঁটা পরিয়ে দিয়ে বললেন, ‘মা, তুমি সাক্ষাৎ জগদীশ্বরী, মহাগৌরী, ব্রহ্মচৈতন্যস্বরূপা৷ অপশক্তির সাধ্য কি তোমার শুদ্ধ আত্মাকে কলঙ্কিত করে? মুক্ত হও মা, শুদ্ধ হও৷ যে মহাগৌরী স্বয়ং ভগবতীর অংশ তার কি এই পিশাচযোনি সাজে?’
কপালে ফোঁটা পরাবার সঙ্গে সঙ্গে চিৎকার করে উঠল নূপুর৷ তারপর তার এক ধাক্কায় অর্জুন ছিটকে পড়ে গেল চামুণ্ডামূর্তির পায়ের কাছে৷ যজ্ঞবেদির কাছে পূজার উপকরণ হিসেবে সেই মাংস কাটার ছুরিটি রাখা ছিল৷ সেই তুলে নিয়ে নূপুর অস্বাভাবিক স্বরে চেঁচিয়ে উঠল, ‘আমাকে আমার শিকার খেতে দিবি না বুড়ো? মর, তুই মর৷’
অর্জুন অসহায় স্তম্ভিত চোখে দেখল উন্মাদিনী নূপুর মৈত্রমশাইয়ের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তে যাচ্ছে ছুরি হাতে৷ কৃষ্ণানন্দ কিন্তু অটল৷ তিনি চোখ বন্ধ করে কীসের যেন ধ্যান করছেন৷
ঠিক তখনই উঠে দাঁড়াল নিখিল৷ না, তার দিদিকে এই কাজ কিছুতেই করতে দেবে না সে৷ ‘দিদি’ বলে চিৎকার করে সে দৌড়ে গেল নূপুরের সামনে৷ আর সবেগে নেমে আসা ছুরিটা গেঁথে গেল নিখিলের বুকে৷
অর্জুন আর্তনাদ করে উঠল৷ কৃষ্ণানন্দ চোখ খুললেন না৷ তাঁর মন্ত্র আরও উচ্চকিত হয়ে উঠল৷ অর্জুন ধড়মড় করে উঠে দৌড়ে এল নিখিলের কাছে৷
রক্তের ছিটে এসে লেগেছে নূপুরের মুখে, গায়ে৷ খানিকক্ষণ স্থির দাঁড়িয়ে রইল সে৷ তার হাত থেকে খসে পড়ে গেল ছুরিটা৷ নূপুরকে দেখে মনে হল যেন এক সুদীর্ঘ নিদ্রার ঘোর কেটে জেগে উঠছে সে৷ একটু পর ক্লান্ত হয়ে মাটিতে শুয়ে পড়ে নূপুর৷ তারপর তার কণ্ঠ থেকে অচেনা মেয়ের গলায় আর্তনাদ ভেসে আসে, ‘তোর সঙ্গে এই জন্মে আর দেখা হল না রে ভাই৷ এই কষ্ট আমি ভুলব না৷ তোর সঙ্গে কোনও না কোনওদিন আবার দেখা হবে, অন্য কোনও জন্মে, অন্য কোনও সংসারে…’
* * *
হল না৷ আজও হল না৷ ব্যর্থ হলেন কালিকিঙ্কর৷ তিল তিল করে সারাজীবন ধরে গড়ে তোলা সাধনবিভূতি আজ সব নষ্ট হয়ে গেল৷ ইহজীবনে এই সাধন আর সম্ভব হবে না৷
চোখ বন্ধ করলেন কালিকিঙ্কর৷ কোথা থেকে একটা হাসির শব্দ ভেসে আসছে না? হ্যাঁ, ওই তো৷ ওই তো স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছেন তিনি৷ কে হাসে অমন করে?
চোখ খুললেন কালিকিঙ্কর৷ কোথাও কোনও আলো নেই৷ নীরব নিশ্ছিদ্র অন্ধকার জমাট বেঁধে আছে নিরেট পাথরের মতো৷ ক্রমেই যেন যেই পাথুরে অন্ধকারের বুক চিরে আবার ভেসে এল সেই তীক্ষ্ণ, ছুরির মতো ধারালো হাসি৷
এবার তার সঙ্গে মিশেছে আরও একটা শব্দ৷ খটখট, খটাখট৷ হাড়ের শব্দ৷
সামনের অন্ধকার একটু নড়ে উঠল নাকি?
চোখ বুজে ধ্যানস্থ হলেন কালিকিঙ্কর৷ দেবী বজ্রচর্চিকা জাগ্রত হয়েছেন৷ ব্যর্থ সাধকের জীবনপাশ ছিন্ন করতে এগিয়ে আসছেন তিনি৷ তবে তাই হোক৷ ওঁ বজ্রচর্চিকায় হ্রুং৷
* * *
নিখিল সেরে উঠেছে৷ ছুরির আঘাত তেমন গভীর ছিল না৷ নূপুর আবার আগের মতো হয়ে গেছে৷ অর্জুন সোফিয়াকে বলে দিয়েছে এই ডকুমেন্টারি সে করবে না৷ তার বদলে অন্য বিষয় বেছে নিয়েছে সে, ভারতের বিভিন্ন পরিত্যক্ত মন্দির ও তাদের ইতিহাস৷
কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশকে ছাড়ার ইচ্ছে ছিল না অর্জুনের৷ কিন্তু তাঁকে তো যেতেই হবে৷ আবার কোথায় কোন গৌরী তার বাঙালিদাদুর পথ চেয়ে বসে আছে কে জানে?