Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    ব্রাইডা – পাওলো কোয়েলহো

    September 22, 2025

    দ্য জাহির – পাওলো কোয়েলহো

    September 22, 2025

    ভুলবে সে গান যদি – প্রসেনজিৎ দাশগুপ্ত

    September 22, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • 🔖
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    Subscribe
    সাইন ইন
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    ডুগডুগির আসর – প্রশান্ত মৃধা

    প্রশান্ত মৃধা এক পাতা গল্প240 Mins Read0

    ০১. মোসলেম উদ্দিন পোশাকে সবচেয়ে ধোপদুরস্ত

    মোসলেম উদ্দিন পোশাকে সবচেয়ে ধোপদুরস্ত। তা তো তাকে হতেই হবে, কাপড় ধোয়ার পাউডার বিক্রেতা বলে কথা। লন্ড্রিতে থোয়া ইস্তিরি করা ক্রিজ তোলা সাদা জামা আর ঈষৎ পরিষ্কার নীলাভ লুঙ্গি না-পরে উপায় আছে, কেউ কিনবে তার পাউডার!

    এই যে সকাল দশটা নাগাদ মোসলেম উদ্দিন কোর্ট চত্বরে এল, যেন মঞ্চে এক প্রবীণ অভিনেতার প্রবেশ। সিনেমায় এমন হলে দর্শকরা ক্লাপ দেয়, নায়কের উদ্দেশে চোখা ডায়লগ ছাড়লে শিস দেয় কেউ, মঞ্চে থাকলে বড়ো চোখে ঘাড় উঁচু করে দেখে। কিন্তু মোসলেম উদ্দিনের উদ্দেশে এখন ঘটবে না। এক পায়ে কবে কোন আদ্যিকালের পলিও নিয়ে ল্যাংচে একখানা ছোট্ট লাঠিতে ভর দিয়ে হাঁটার শুরু। উকিল মোক্তার পেশকার নাজির এমনকি মুনসেফ ম্যাজিস্ট্রেট ডিসি এসপির সামনে ভিড়ের ভিতর দিয়ে যতই ধোপদুরস্ত হয়ে মোসলেম হেঁটে আসুক না কেন, চত্বরের মেহগনি আর মেঘনিশ গাছটার নীচে এসে আসর জমানোর আগে তার একটিও ক্লাপ পাওয়ার সম্ভাবনা নেই। কে দেবে এখন হাতে তালি। সবাই সামনের মজমায় বিভোর! যদিও সে জমায়েতের সবারই এখন হাত মুঠ-ছাড়া। মুঠ করা যাবে না, পকেটে হাত দেয়া বারণ, লুঙ্গির কোচড়েও না। ওই মজমাঅলার অনুরোধ, হাত দেয়া যাবে না হোলে আর গালে!

    ল্যাংচাতে ল্যাংচাতে মোসলেম উদ্দিন মেঘনিশ গাছটার নীচের দিকে যায়। সে এসেছে উত্তর দিকের রেজিস্ট্রি অফিসের ছোটো ঘরটার কাছে থেকে। তারপর মূল কোর্ট বিল্ডিঙে পিছনের বার কাউন্সিলের পাশের ছোটো মাঠে বসে একটা বিড়ি ধরিয়ে টানছিল। সঙ্গে পোটলা-পুটলিভরতি জিনিসপত্র আরও আগে মেঘনিশ গাছের নীচে রেখে গেছে। সেখানেই প্রতিদিন সকালে রাখে। সে একলা না, সাপ খেলার বাকসো, মহাশংকর তেল বিক্রেতার জিনিসপত্র, একশ এক পদের ধন্বন্তরি গাছ-গাছড়া, ওই পাশের নীচু বটতলার বই বিক্রেতাও এখানে রাখে তাদের জিনিস। শুধু বানর খেলা দেখানো আজগর কখনও বানর দুটোকে এখানে বাঁধে না। তা সে বাঁধে ওই ট্রেজারির কাঁটাতারের পাশের ছোটো কুল গাছের কাণ্ডে। ওখানেই ও দুটো ভালো থাকে। এখানে গাছের গুঁড়ি মোটা, আজগরের বানরের গলার চেইন অত বড়ো না, তাছাড়া গুছিয়ে রাখা এসব জিনিসপত্রের পাশে বানর দুটোকে রাখলে বাঁদরামির অন্ত থাকবে না। ইদানীং মর্দাটার পিঠের লোম কমতে শুরু করেছে, সেখানে বাঁদরামির জন্যে দু-ঘা দিতে আজগরের আজকাল কষ্ট হয়। শত হলেও অবলা প্রাণী, তার পেটের ভাত জোগায়।

    মোসলেম উদ্দিন বার কাউন্সিলের কোনায় নীচু চিলতে কোর্ট বিল্ডিঙের দিকে যাওয়া ছাউনি দেওয়া সরু পথ ধরে কিছুটা এগিয়ে চত্বরের সামনে খেয়াল করল। এখনও লোক সমাগম কম। আকাশ পরিষ্কার। যদিও একটু গুমোট ভাব আছে। দক্ষিণে নিম্নচাপ-টাপ হল না তো? তা হতে পারে। কাল সন্ধ্যা থেকেই বাতাস কেমন যেন একটু আটকানো আটকানো। কিন্তু সন্ধ্যার পর পরই আকাশে তারা উঠলে সে বুঝেছিল, দক্ষিণে নিশ্চয়ই কিছু ঘটেনি। যদিও তখন নারকেল গাছের পাতায় পাতায় বাতাস খেলে যাচ্ছিল, এমনভাবে যেন নারকেল গাছের পাতাগুলো পরস্পরের সঙ্গে গলা জড়াজড়ি করে শব্দ করছে। সে শব্দ শুনতে ভালো লাগে মোসলেমের। হাতে তখন তার ছোট্ট বাজারের থলি। সে নাগেরবাজার থেকে হেঁটে মুনিগঞ্জের দিকে রওনা দিয়েছে। আকাশে ঝুঁকে ঝকে তারা, অথচ গাছের পাতায় বাতাস। সেই বাতাস কোনওভাবেই নীচের মাটিতে আসছে না। রাহাতের মোড়ের পরে কোর্ট এলাকা তারপর পোস্টাপিস ও থানা ছাড়িয়ে মেইন রোড ধরে লাশকাটা ঘরের সামনে আসলে, তখন ডান দিকে নদীর কূল থেকে বাতাস তার গায়ে এসে লেগেছিল। এতটা পথ তাহলে বাতাস ছিল আকাশে। নাকি লাশকাটা ঘরের কাছেই বাতাস নীচু হয়ে এসেছে?

    তবে যাই ঘটুক, ওই বাতাস গায়ে লাগামাত্র মোসলেম উদ্দিন একবার পাশের বাড়িটার সীমানায় পাশাপাশি লাগোয়া দুটো নারকেল গাছের পাতায় তাকায়। সে গাছের পাতা স্থির! অথচ তার গায়ে বাতাস। লাঠিটা ধীরে ঠুকে ঠুকে হাঁটে সে।

    মুহূর্তে, অনেক দিন আগে একবার বাদোখালি গ্রামের ভিতর দিয়ে তার বড়ো বোনের শ্বশুরবাড়ি যাওয়ার কথা মনে পড়ে মোসলেম উদ্দিনের। অল্প বয়েস। দলবেঁধে যাচ্ছিল তারা। হঠাৎ এমন বাতাসে পাশের নাকি কোনও এক শ্মশান থেকে একখানা সাদা কাপড় উড়ে যেতে দেখেছে তাদের একজন। ভর সন্ধ্যায়, ওই সাদা কাপড় নাকি ভূতে উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে। বাকি সবাই দৌড়ে সামনের দিকে যায়। কিন্তু মোসলেমের হাতে ছোট্টো লাঠি, সে পা ল্যাংচে এগোয়। দেশ তখন কেবল ভাগ হয়েছে। এদিকের গ্রামগুলোয় একের পর এক হিন্দু বাড়ি। পাশেই শ্মশান। সেখান থেকে অমন এক খণ্ড কাপড় উড়তেই পারে। কিন্তু সেই কাপড় খণ্ডকে ভূতের কারবার ভেবে ভয়ে বাকি সবাই মোসলেমকে ফেলে ওভাবে এগিয়ে যাবে! গিয়েছিল। সে হাতের লাঠিসহ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সেই সাদা কাপড়খানার উড়ে যাওয়া দেখেছে। এমনকি তার মনে হয়েছিল, ওখানা শ্মশানে পড়ে থাকা কোনও বুড়ো মানুষের কাপড়, ওর সঙ্গে ভূতের কোনও সম্পর্ক নেই। আর এই যে তার জন্যে দাঁড়াল না কেউ, সবাই দৌড়ে গেল, সে বুঝল, এই শরীরে সারাটা জীবন মোসলেম একা। এমন তার আগেও মনে হয়েছে, ওই দিন আবার মনে হয়। তখন আশেপাশে নারকেল গাছগুলোর মাথায় ছিল অমন বাতাসের দোলা, কিন্তু ওই কাপড়খানা যখন উড়ে যাচ্ছিল তখন তার যে গায়ে বাতাস লেগেছিল, মোসলেমের মনে হয়েছে, বাতাস আসলেই নীচু হয়ে আসছে। কিন্তু যতই নীচু হয়ে আসুক, নারকেলের পাতার সেই জড়াজড়ি করা শব্দটা বহুদিন তার কান থেকে যায়নি।

    গতকাল আবার লাশকাটা ঘরের সামনে সেই বাতাস তার গায়ে লাগলে মোসলেমের বহুদিনের আগের কথা মনে পড়ে। সঙ্গে কেউ নেই। সে একা। হাতে সম্বল লাঠিখানা। এখনও তাই। একটি পা ল্যাংচে মোসলেম চলে, তার এই লুলা পা-খানাই তার সাথি। বুকে সাহস থাকতে হবে, সে জেনেছিল। ওই সাদা কাপড়খানা দেখে সে উলটে পড়লে তো আর তার বাঁচন ছিল না। ওই মুহূর্তে মোসলেমের মনে হয়েছে, এই শহর, শহরের কংক্রিটের রাস্তার পাশে ঘাসের ওপর দিয়ে ধীরে ধীরে হেঁটে চলেছে সে, এখন তার সেদিনের কথা মনে পড়ছে কেন? সেই সাদা কাপড়, শ্মশান, দল বেঁধে বড়ো বোনের বাড়ি যাওয়া, সেখান থেকে সন্ধ্যা উৎরে ফিরে আসা।

    পরদিন সকালে বোনটা মরেছিল। তার মানে ওই সাদা কাপড়খানা ছিল অমঙ্গলের। সঙ্গীরা কেউ যদিও সে-কথা বলেনি পরদিন। এখন মনেও নেই, কেন সে সেদিন বড়ো বোনের বাড়িতে গিয়েছিল? মা বলেছিল, পোয়াটেক মাইল দূরে ওই বাড়িতে গিয়ে বোনটারে দেখে আসতে। নাকি হা-ডু-ডু খেলা শেষ হলে, কোর্টের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা মোসলেম বারইখালি গ্রামের সবার সঙ্গে সেদিকে রওনা দিয়েছিল। বিকেলে মায়ের বলা কথাটা মনে পড়েছিল সেই সন্ধ্যায়। সে সব কোনওকিছু আজ আর মনে নেই। তবে গতকাল সন্ধ্যায় তার সেই স্মৃতি জড়াজড়ি করে হামলে পড়লে, নাগেরবাজার থেকে পৌনে এক মাইল পথ হেঁটে প্রায় পুরানো বাজারের কাছে আসতে আসতে তার সত্যি মন খারাপ হয়। লাশকাটা ঘর, বোনটার স্মৃতি, আরও কত কী! সামনে মুনিগঞ্জ পর্যন্ত আরও প্রায় আধা মাইল পথ। মোসলেমকে বাসায় পৌঁছতে হবে। মালোপাড়ার কোল ঘেঁষে বাসা। সেখানে পৌঁছে আজকের মতন জিরোবে। একটা দিন গেল। আলেকজান প্যাকেটগুলো ঠিক। মতো করেছে কি না? ছেলেগুলো একটাও আর কাছে থাকে না। একজন বাড়ির জায়গা বেচে গেল সৌদি, এখন খোঁজ নেই। আর-এট্টা যশোরে কোথায় যেন মেকানিকের কাজ করে, মোসলেম মানুষকে বলে, সে ছেলে ইঞ্জিনিয়ার। তার পরেরটা খুলনায় আজম খান কমার্স কলেজে পড়ে।

    এসব প্রায় সকলের জানা কথা। কোর্ট চত্বরে মোসলেম উদ্দিনের সঙ্গের বাকি ক্যানভাসাররা প্রায় সবাই তার সম্পর্কে জানে। কিন্তু কাল সন্ধ্যা থেকে তার কেন মনটা খারাপ, আজ কেন একবারও মেঘনিশ গাছ তলায় আসতে ইচ্ছে করছে না তার, তা তারা জানবে কোত্থেকে?

    মোসলেম বার কাউন্সিলের থেকে কোর্টের বিল্ডিংয়ে যাবার সরু পথ ধরে এগিয়ে, চত্বরের সামনের ফাঁকা জায়গাটা দেখে আবার ফিরে এসে এসব ভাবে। চারদিকে মানুষে ভরে গেছে। চত্বরেও মানুষ। যদিও আজ হাটবার নয়, তাও শহরে এত লোক, নিশ্চয় কোনও বিশেষ মামলা আজ কোর্টে উঠবে। তা যাই উঠুক সেসব কোনওকিছুই জানার প্রয়োজন নেই তার। এই চত্বরে কাপড় ধোয়া পাউডারের ক্যানভাস করতে করতে জীবনটা পার করে দিল সে, কিন্তু কোনও দিনও কোনও কারণে কোর্টের বারান্দায় উঠেছে? না, কোনওদিন সেখানে ওঠার কোনও প্রয়োজন তার পড়েনি। আর তার মতন মানুষ, কোর্টে কোন কেস উঠল আর উঠল না, কোথায় কী হল আর হল না, তা জানার কোনও দরকার আছে? আদার ব্যাপারির জাহাজের খবর দিয়ে দরকার কী? কিন্তু মোসলেম উদ্দিন যতই আদার ব্যাপারি হোক আর যাই হোক, তারও তো মন খারাপ হতে পারে? হয়তো হয়েছে আগেও। কাল সন্ধ্যা রাত্তির থেকে বড়ো বোনটার কথা মনে পড়েছে। তারপর নারকেল গাছের পাতার বাতাস, সেই সঙ্গে ওই বোনের কথা, এখন যদি একবার সে আবার গাছগুলোর আগায় তাকায়, তাতে অসুবিধা কী?

    কিন্তু এই চিলতে সরু পথটুকু দিয়ে আকাশের কোনও অংশই দেখা যায় না। গাছের পাতাও না। কোর্ট বিল্ডিংয়ের পিছনে এক সারিতে গোটা পাঁচেক নারকেল গাছ, মাঝারি আকারের গাছগুলোর কাণ্ড দেখা যাচ্ছে, কিন্তু পাতা দোল খাচ্ছে কি না তা দেখা যায় না।

    ওখান থেকে বামে এলে পিছনের চত্বর, বারে যাদের কাজ সেখানে তাদের আনাগোনা, ডানে নামলেই মেইন রোড। উলটো দিকে একটা স’-মিল। একটু এগোলে আর-একটা। পরেই নদী। স’-মি দুটোর মাঝখানে কয়েকটা ওষুধের দোকান। সামনে এগোলে বাঁয়ে ডাক বাংলো তারপর বাগেরহাট স্কুলের দিক থেকে আসা রাস্তা ফেলে পোস্টাপিস। আবার, পিছনে একটু গেলেই লঞ্চঘাট বায়ে, ডানে কোর্ট বিল্ডিংয়ের সামনের মাঠ আর উলটো দিকে ডিসি অফিস। মোসলেম উদ্দিন ওই চিলতে ছাউনি দেয়া পথের প্রায় শেষ মাথার পরে ডানে মেইন রোডে আসে। স’-মিল দুটো ছাড়িয়ে আলমের চায়ের দোকানের সামনে দাঁড়ায়। ভিতরে ভিড়, বাইরেও মানুষ মন্দ না। আইজকে সারা শহরের হলটা কী? শহরে আজ এত মানুষ কেন? এত মানুষ দেখলে এখন আর মোসলেম চোখের কোনা খুশিতে ঝিলিক মারে না। আগে মারত। ভাবত, এত মানুষ! আলেকজান মাত্তর কয় প্যাকেট গুড়া সাবান বানাইচে, তাতে কুলোবে নানে। সব তার ক্যানভাসের গুণে এক ধাক্কায় বিক্রি হয়ে যাবে। কিন্তু পরে বুঝেছে, খদ্দের-কাস্টমারও ওই আকাশের মতন, যত গর্জে কোনও কালেই তত বর্ষে না। চত্বরে মানুষ যতই থাক প্যাকেট তার ফুরবে না।

    তবে আকাশের দিকে তাকিয়ে ওসব কথা ভেবে এখন আর কোনও লাভ নেই। এখনও কেউ ক্যানভাস শুরুও করেনি, প্রায়ই দিন মোসলেম উদ্দিনই সাধারণত সবার আগে ক্যানভাস শুরু করে। তারপর অন্যরা। দুপুর গড়িয়ে যেতে যেতে মোসলেম কোনও কোনওদিন দ্বিতীয় বার। তার সঙ্গে তো কোনও টক্কর নেই কারও। যেমন, কোনও টক্কর নেই বইঅলা বারিক বুড়োর সঙ্গে কারও। সে ওই বট গাছটার নীচে নীলচে পলিথিনের ছাউনি আর মাটিতে একখানা বড়োসড়ো ছালার চট পেতে বসে থাকবে তো থাকবে।

    মোসলেম উদ্দিন যেদিন দ্বিতীয় বার ক্যানভাস শুরু করে, তখন হয়তো ট্রেজারির দিকে ফাঁকা জায়গায় তিন ফলকের খেলাসহ চলে ছোটোখাটো সার্কাসের আসর অথবা বানর খেলা। ঝিবুতপালা অর্থাৎ ছোটো ছেলেরাই সেখানে বেশি যায়। আবার উলটোও হয়, সে তখন ট্রেজারির দিকে কুলগাছের কাছে তার ক্যানভাস শুরু করেছে আর কোর্ট বিল্ডিংয়ের প্রায় সামনে তখন বড়োসড়ো মজমা মিলিয়েছে কেউ। ধ্বজভঙ্গের ওষুধ কিংবা মহাশংকর তেল কিংবা শক্তিবর্ধক গাছ-গাছরা মাথার খুলি এইসমস্তর গুণাগুণ বর্ণনা করছে ওপারের আকিল সিকদার।

    আলমকে এক কাপ চা দিতে বলে, লাঠিখানা চায়ের দোকানের বাইরের দেয়ালে রেখে, মোসলেম দেওয়াল ধরে দাঁড়ায়। এমনিতে দাঁড়াতে পারে সে, কিন্তু ডান হাঁটুতে ভর রেখে অনেকখানিক নীচু হয়ে যেতে হয়। এখন সেভাবে দাঁড়ানো যাবে না। মাজায় কি তার একেবারে বল নেই। একখানা পা লুলা কিন্তু এই কোমরের জোরে লাঠিতে ভর দিয়ে দিয়ে প্রায় খাড়া হয়ে হেঁটেই কাটিয়ে দিল সারাটা জীবন। কিন্তু এখন এত মানুষের ভিতরে দেয়াল ধরে এক পায়ে একটু খাড়া হয়ে না দাঁড়ালে চলে?

    চা খেতে খেতে মোসলেম চারদিকে তাকায়। এটা অবশ্য তার অনেকদিনের অভ্যেস। চা খাওয়ার সময়, যদি চায়ের দোকানের ভিতরে না-ঢোকে তাহলে চারধারে গিজগিজে মানুষের মুখ দেখতে তার ভালো লাগে। এখানে কাটিয়ে দিল এতটা কাল, স্বাধীনতারও আগে প্রায় বছর পনেরো আর এই দিকেও তো সতের বছর হয়ে গেল দেখতে দেখতে। দিন যে কীভাবে যায়। আজকাল সকালে নদীতে গোসল করে, ছোটো আয়নাখানার সামনে চুল আঁচড়াতে আঁচড়াতে মোসলেম দেখতে পায় সামনে ও মাঝখানে, দুই পাশে কত চুল যে পাতলা হয়ে গেছে। এখন সামনে চুল আছে তবে পাতলা, আঁচড়ালে প্রায় মাথার চাড়ার সঙ্গে শুয়ে থাকে। তা দেখতে দেখতে মোসলেমের মনে হয়, আর কত দিন তো কম হল না। এই গলার উপর দিয়ে পেটে ভাত। এই গলা চালায় জগৎ-সংসার। শরীরও কম ধকল সইল না। এখনও যে মাথায় চুল আছে এই বেশি।

    সেকথা মনে করে মোসলেম চায়ের ছোট্ট গ্লাস সামনের চা বানানোর টেবিলের উপর রেখে, আলত করে মাথার চুলে হাত ঘষে। পকেটের ছোটো ডায়েরির ভিতর থেকে টাকা বের করে। আবার সে টাকা ডায়েরির ভিতরেই রেখে দেয়। জামার পাশের পকেটে হাত দিয়ে পঞ্চাশ পয়সার একটা রেজগি বের করে চায়ের ছোট্টো গেলাসটার পাশে রাখে। তারপর আবার মাথায় হাত ডলে। এটাও মোসলেমের বহুদিনের অভ্যাস। এই আলত হাত ঘষার কায়দাটা অন্ধকারে দেখলেও, এটা যে মোসলেম তা যে চেনে সে সনাক্ত করতে পারবে। দেয়াল থেকে লাঠি নেওয়ার আগে বুক পকেট থেকে চিরুনি বের করে চুল আঁচড়ায়। তারপর রাস্তা পার হয়ে বার কাউন্সিলের সামনে আসে।

    এ সময়, এই সকাল সাড়ে দশটা নাগাদ মোসলেমের মনে হয়, এত রোদ অনেক দিনের ভিতরে সকালবেলা ওঠেনি। রোদ উঠুক। রোদ উঠলে দিন ভালো। সঙ্গে সঙ্গে এও ভাবে, যদি এইভাবে রোদ চেতে, তাহলে চত্বরে কোনও মানুষ থাকবে? যদিও মোসলেম সকালের খেপেই ক্যানভাস শুরু করবে মেহগনি গাছটার কাছে। গাছটা চত্বরের দক্ষিণ কোণে। মেইন রোড ঘেঁষে একটা বড়ো মেঘনিশ গাছ আছে, সে গাছের ছায়া প্রায় সারাটা চত্বর জুড়ে। কিন্তু এমন রোদ হলে দুপুরের পর পর আর দ্বিতীয়বার আর ক্যানভাস করা হবে না।

    বার কাউন্সিলের সরু পথের পর বিল্ডিঙের পিছনের চত্বর হয়ে সোজা রেজিস্ট্রি অফিসের কোনায় এসে মোসলেম একটা বিড়ি জ্বালায়। পাশের ট্রাফিক ব্যারাকের সামনে সার্জেন্ট মোটর সাইকেল স্টার্ট দিচ্ছে। মোসলেম বিড়িটা তালুতে গোঁজে। সার্জেন্ট ক্লাবের সামনে গতি কমিয়ে জেলখানার দিকে গেলে সে শোনে, দুই ট্রাফিক পুলিশ প্যান্টে জামা ইন করতে করতে সার্জেন্টকে নিয়ে বেশ রসালো কথা বলছে। তা ওই আলতাফ সার্জেন্টকে নিয়ে শহরে কিছু রসালো কথা প্রচলিত আছে বইকি! মোসলেম উদ্দিনের মতন প্রায় কোনও খোঁজ খবর না-রাখা মানুষের কানে যখন আসে, তখন সে সব কথা কিছুটা হলেও সত্যি। শহরের কোন বাড়িতে তার যাতায়াত। শহরের কে কে জাতীয় পার্টিতে যোগ দেয়ার পরে, নতুন করে তাদের সঙ্গে খায়খাতির শুরু করেছে এই সার্জেন্ট, সে সব সংবাদের কিছু কিছু তারও কানে আসে। কার মেয়ে কার সঙ্গে চলে গিয়েছিল, কাটাখালি না কোথা থেকে মোটর সাইকেলের পিছনে বসিয়ে এই সার্জেন্ট উদ্ধার করে এনেছে। তারপর থেকে সেই মেয়েকেই কখনও কখনও আলতাফের মোটর সাইকেলের পিছনে ঘুরতে দেখা গেছে, সে সব খবর যতই উড়ো হোক আর ঠিকই হোক মোসলেমের কানে আসে। এখন এই দুই ট্রাফিক আর নতুন কী বলছে। মোসলেম বরং বিড়বিড় করতে করতে কোর্ট বিল্ডিং আর ট্রেজারির মাঝখানের রাস্তা দিয়ে কোর্ট চত্বরের দিকে যায়, সুযোগ পালি তোমরাও কম পারো না!

    মোসলেম উদ্দিনের বিড়ি টানা শেষ। চা খাওয়ার পর পর একটা বিড়ি জ্বালানো ও আয়েস করে টানার এই অভ্যেস তার দীর্ঘদিনের। আজকাল বিড়ি টানা কমেছে, কিন্তু এখনও সকালে মজমা মিলানোর আগে এক কাপ চা খেয়ে তারপর একটা বিড়ি টেনে অতি ধীর পায়ে কোর্ট চত্বরের মেহগনি তলার দিকে তার আগমন যেন কোনও প্রবীণ অভিনেতার মঞ্চে সদর্প আবির্ভাব। জীবনে। যাত্রাপালা একেবারে কম দেখেনি সে। মুনিগঞ্জে নদীর ওপর চরগাঁয়ে যাত্রা আগে হত, এখনও হয়, তবে আগের চেয়ে অনেক কমে গেছে। কেউ জানতে চাইলে, মোসলেম এক নিশ্বাসে অনেকগুলো পালার নাম বলতেও পারবে। জীবনে ওই সাধ কোনওদিন পূরণ হবে না, হলও না, হওয়ার নয়। এমন লুলো মানুষকে স্টেজে উঠাবে কোন অধিকারী? তবু একবার লুলো এক ভিখারির ভূমিকায় সে গ্রামের অ্যামেচার যাত্রা পালায় অভিনয় করেছিল।

    প্রায় সেই ভঙ্গিতে, এখন আর লুলো ভিখিরি নয়, কিন্তু যেন মঞ্চে উঠছে এমন ভঙ্গিতে মোসলেম উদ্দিন কোর্ট চত্বরের দক্ষিণে, কোর্ট বিল্ডিং আর ডিসি অফিসের মাঝখান দিয়ে যাওয়া রাস্তায় পাশের মেহগনি গাছতলায় গিয়ে দাঁড়ায়। একটু হাঁফ ছাড়ে। চারদিকে দেখে। যা রোদ চেতেছে! যদিও চত্বরে পুবের বড় মেগনিশ গাছটার ছায়া। পাশের আকৃতিতে কিছুটা ছোটো মেগনিশ গাছের নীচে বই সাজিয়ে বসার প্রস্তুতি নিচ্ছে বারিক বুড়ো। বুড়ো কেন? মোসলেম সত্যি জানে না। বারিকের বয়েস তার চেয়ে কত আর বেশি হবে, কিন্তু ওই আজগর কি সুকুমার সবাই তাকে পিছনে বারিক বুড়ো বলেই ডাকে। সামনে বলে বারিকদা। এমনকি আজগরের সঙ্গে যে রঙ্গ করতে করতে লঞ্চঘাটের দিকে ভাতের হোটেলে যায়, কী যেন নাম, মোসলেম তার নাম হাতড়ায়। মনেও পড়ে, জরিনা। জরিনাও যখন বারিকের সামনে এসে বসে, ডাকে বইঅলা বারিকদাদা। কিন্তু পিছনে ঠিকই বারিক বুড়ো। তা বারিকের বড়োসড়ো পেটের সাইজ আর চুলের রঙ মিলিয়ে একটু বুড়োই লাগে। আর কী ভাব! চোখ দুটো প্রায় খোলেই না। কিন্তু দেখে নাকি সবই। একেবারে পেট ফুলিয়ে বসে থাকে, কোনওদিকে চাওয়া চাইয়ি নেই। সুকুমার বলে, ‘সাক্ষাৎ ভোলানাথ শিব ঠাকুর। জরিনা তাই শুনে একদিন বলেছিল, ‘একদিন সামনে ওয়ার দুম্নারে আইনে দিলি পারো! তহোন দেইহেনে নড়বেনে। বেটা মানুষ, মাইয়ে মানুষ পালি সব জায়গা নইড়ে ওঠে!’ অবশ্য মোসলেম তখন তার গাম্ভীর্যপূর্ণভাব ঠিকই রাখে, এসব মেয়েকে বেশি পাত্তা দিতে হয় না। সোজা বাংলায় বাজারি মাইয়ে। চান্স পালিই কোলে উঠে বসপে। পুরুষ মানুষ নিয়ে কোনও অস্বস্তি নেই, সে আল দুধ গজাতি গজাতি ভাইঙে গেছে। ফলে, মোসলেমকে বলতে হয়, ‘বাদ দে, বাড়িঘর নেই। কোথায় কোথায় থাহে। বিয়ে করল না কোনওদিন। ছওয়াল মাইয়ের প্রশ্ন নেই। এখন তারে তুই আবার বিয়ে দিতিচিস!’

    কথা এগোয়। জরিনা বলে, ‘ও কাকা, কইয়ে দেহেন, কলিই বিয়ে বসপে।‘

    ‘তুই কইচিস?’

    ‘চান্স পালি তো? তয় সুকুমারদা কইল—’

    ‘কী কয়?’

    ‘হাসে। তয়, আজগরদার সাতে খায়খাতির ভালো।‘

    ‘আজগরের সাতে তো তোরও খায়খাতির ভালো, তুই করিচিস আজগররে বিয়ে?’

    ‘হয়, খাইয়ে কাজ নেই। ওই চেটের বান্দরচোদা পদের সাতে বিয়েয় বসপানি! আপনি আর মানুষ পালেন না?’

    ‘কেন, তুই থাহিস না আজগরের সাতে?’

    ‘কইচে কেডা আপনারে? ওই সুকুমারদা?’

    সুকুমার এখানে আছে। তখন বিকেল। সবার জিরানোর সময়। কোর্ট চত্বরে একটু একটু করে স্থবিরতা আসছে। অথবা, একটি কর্মক্লান্ত দিন এই কিছুক্ষণের ভিতরে শেষ হবে। ঘেরা দেয়া ডিসি অফিসের পুবদিকে মেইন রোড লাগোয়া টাইপিস্টদের বড়ো একচালা ঘরের সামনে বসে এই আলাপ। কিছুক্ষণ পরই, সন্ধ্যা লাগতেই এ আসর ভাঙবে। সুকুমার তার বাক্স-পোটলা গুছিয়ে আশেপাশে গিয়েছিল, এখন আবার এল। তখন মোসলেম উদ্দিন বলছে, ‘সুকুমারের কতি হবে কী জন্যি, আমরা দেইহে কিছু বুঝি না? চোখ নেই আমাগে?’

    সুকুমার জানতে চায়, ‘কী হয়েছে?’

    মোসলেম উদ্দিন বলে, ‘হবে আর কী? এ সুকুমার, ক’দেহি, জরিনা থাহে না ওই আজগরের সাথে?’

    জরিনা সুকুমারের দিকে তাকায়, সুকুমার জরিনার দিকে। অবশ্য জরিনার চোখের তারায় কোনও বাড়তি কাপন দেখা গেল না। সুকুমার যা ইচ্ছে তাই বলুক। যদি মোসলেমের কথায় সায়ও দেয়, তাতে তার কিছুই আসে যায় না। কিন্তু জরিনার কেন যেন মনে হয়, সুকুমার হয়তো কোনও কারণে সেকথা বলবে না। কিন্তু জরিনার ঈষৎ সলজ্জ মুখের দিকে তাকিয়ে মোসলেম উদ্দিন যা বলেছিল যেন প্রায় তাই বলল সুকুমার, ‘ওই আর কি মোসলেমদা, বোঝেন তো সবই!’

    ‘তালি, এ ছেমড়ি, তুই যে কলি ওই আজগররে তুই বিয়ে করবি না!’

    ‘একসাতে থাহি তাতে হইচে কী সেই জন্যি বান্দর নাচানোরে বিয়ে করতি হবে?’

    ‘কী ফাও কথা কইস?’ মোসলেমের আপাত মার্জিত রুচিতে একটু খোঁচা লাগে। এসব মেয়ের সঙ্গে এই জন্যেই তার কথা বলতে ইচ্ছে করে না। কথা নেই বার্তা নেই, কথায় কথায় মুখ খারাপ! কোন সময় কী কয় তারও যেন কোনও ঠিক নেই। আজ আছে আজগরের সাথে, কাল যদি সুকুমারের সাথে দেখে রাত্তিরে, তাতেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। পরশু যদি সাপের খেলা আর গাছগাছড়া বেচা ইব্রাহিম শেখের সঙ্গে লঞ্চঘাটের কোনও হোটেলে ঘুমায় তাতেও-বা কী?

    জরিনার এ কথায় অন্য সময় হলে মোসলেম উদ্দিনের মেজাজ খিচে যেত। সুকুমার অথবা অন্য যে কেউ কাছে থাকলে বলত, ‘মার এই ছেমড়িরে কানপাটি জড়াইয়ে ঠাটাইয়ে একখান চড়।‘ এখন তা না বলার কারণ অবশ্য আজগর। আজগরের কাছে তার দরকার। আজগর বানর দুটো নিয়ে নদীর পাড়ে গেছে। সেখান থেকে ফিরলে মোসলেম তার প্রয়োজনীয় কাজ সেরে বাজারের দিকে যাবে। আলেকজান বলেছিল পাউডার বানানোর জিনিসপত্রে টান পড়েছে। সেগুলো কিনে কিছু কাঁচা বাজার-সদাইও করতে হবে। প্রতিদিন প্রায় এক কাজ। সেকথা ভাবতে মোসলেমের আর ভালো লাগে না। মনে হয়, এ জীবন এই রকম টানতে টানতে যেতে হবে। সুকুমারের মতন যদি গানের গলা থাকত, তাহলে গলা ছেড়ে দিয়ে গাইতে পারত, ‘এই জীবন তো একদিন চলতে চলতেই থেমে যাবে। কেউ তো জানে না, শেষ কোথায় হবে!’ সত্যি এই দুনিয়াদারির শেষই-বা কোথায়, রোজ কেয়ামতের দিনই-বা কেমন? তা যদি জানা যেত। কিন্তু সেকথা জেনে মোসলেমের লাভটা কী? সেদিন পর্যন্ত এই দুনিয়ায় আছে নাকি সে? আলেকজানকে সঙ্গে নিয়ে এই জীবনটাকে যদি কোনওমতো বাকি কয়টা কাটিয়ে যেতে পারে, তাতেই তার চলে।

    মেহগনি গাছের নীচে পেটলার পাশে বসে মোসলেম উদ্দিন আবার চারদিকে তাকাল। বারিকের বই লাছা শেষ। এবার বারিক চুপচাপ মেঘনিশ গাছটায় হেলান দিয়ে বসে থাকবে। মোসলেম একটু সামনে এগিয়ে বোচকটা রাখল। দিন কয়েক আগে একটা অল্প বয়েসি ছেলে এসেছিল। মাথাভরতি চুল। দাড়ি গোঁফ তেমন গজায়নি, গজাবে গজাবে। দারুণ সুন্দর গান গায়। লালন ফকিরের গান অথবা ভাওয়াইয়া কি ভাটিয়ালি। সুকুমারের সঙ্গে ট্রেনে চেপে এসেছে। সারা গায়ে মশার কামড়ের দাগ। কিন্তু সুকুমার তার খেলা দেখানোর আগে তাকে পাশের ওই বারিকের বইয়ের দোকানের সামনে মেঘনিশ গাছের তলায় গান গাইতে দাঁড় করিয়ে দিয়েছিল। আহা, কী গায় সে ছেলে! মোসলেম তখন বারিকের দোকানের পাশে দাঁড়ানো। মুখে মাথায় কড়া রোদ। তাতে কী? ‘খাঁচার ভিতর অচিন পাখি’ ধরতেই ভিড়। তারপর গাইল একখানা সিনেমার গান, ‘তুমি কি দেখেছো কভু, জীবনের পরাজয়’। একেবারে যেন আবদুল জব্বার। ছেলেটির নাম মনে করার চেষ্টা করে মোসলেম, কোনওভাবেই মনে পড়ে না। মাত্র তো ওই কয়দিনের দেখা, তাও হয়ে গেল বছর কয়েক, সেবার এরশাদ এসেছিল মহকুমা থেকে জেলা করতে। তখন এটা ছিল এসডিও অফিস। মোসলেম বছরের হিসেব মেলানোর চেষ্টা করে। সে হিসেব মেলেও, কিন্তু ছেলেটির নাম কোনওভাবেই তার মনে আসে না। তাহলে অমন গান গাওয়া, কয়েক দিনের জন্যে দেখা সেই ছেলেটির নাম সে নিজের অজান্তেই হারিয়ে বসে আছে। আজকাল এমন হয়, নিশ্চয়ই বয়স হচ্ছে।

    মোসলেম ভাবে, এখন রোদ চড়ার আগে সেই ছেলেটিকে যদি একটু সামনে এগিয়ে, গাছের এই ছায়া আর রোদ্দুর মেলানো চত্বরে একখানা গান গাইতে দাঁড় করিয়ে দেয়া যেত, তাহলে তাকে আর কষ্ট করে মজমা মেলাতে হত না। রোদ তাপ আলো ছায়া গাছের পাতায় রোদের ঝিলিক, সকল কিছুর ভিতরে মোসলেম এখন কল্পনায় সেই ছেলেটিকে চত্বরে গান গাইতে দেখে। অথবা, সেই কথা ভাবতে ভাবতে নিজের ক্যানভাসের প্রস্তুতি নেয়। যেন, ছেলেটি ওই সুর ধরছে, এই যে গাইছে : এ মালিকে জাহান, আমি বড়ো অসহায়, আজ দু-ফোঁটা পানি তরে বুক ফেটে যায়। কোন ছবির গান? মোসলেমের মনে নেই। ফকির মজনু শাহ? হতে পারে। তবে মনে আছে লাইট হল সিনেমায় সে আর আলেকজান ইভিনিং শোতে ছবিটা দেখেছিল। আজ আর সেকথা মনে করতে ইচ্ছে করছে না। ওই ছেলেটার মুখ মনে পড়ছে না। আজগর অথবা বারিক নিশ্চয়ই নামটা মনে করতে পারবে। কোনও কিছু স্মরণ না-এলে সে এই বয়সেও একবার একবার মাথা চুলকায়। তা করল, তারপর হাত বোলাল মুখের সঙ্গে মিশিয়ে ছাঁটা দাড়িতে।

    এরপর কয়েক কদম সামনে এগিয়ে মোসলেম পোটলাটা রাখল। মনে মনে বহুদিন আগে এখানে এক ক্যানভাসারের বলা সেই কথা কটা আওড়াল, কিন্তু শব্দ করে বলল না। সে আওড়া, আজ এই রৌদ্রোজ্জ্বল দিনে এইখানে এই প্রান্তরে শুভ্রতার খোঁজে আপনাদের আমি আহ্বান জানাচ্ছি। এটুকুই বলেই সেই লোক এরপর প্রায় বরিশালের উচ্চারণে কথা বলতে শুরু করত। দাঁতের মাজন বিক্রেতা ছিল লোকটা। মোসলেম আজও জানে না, কেন শুরুতে সে অমন করে কথা বলত। মোসলেম জানত, লোকটার বাড়ি মোড়েলগঞ্জ; ওখানকার লোকজন প্রায় বরিশালের ধরনে। কথা বলে। যাই বলুক, লোকটির শুরুতে বলা ওই বইয়ের ভাষায় কথাগুলো তার ভালো লেগেছিল। তাই আজও মনে আছে। নিজেও পরে এক-আধবার চেষ্টা করেছে ওভাবে শুরুতে বলতে, কিন্তু পারেনি। তাছাড়া পরে ভেবেছে, ওভাবে কথা বলে তার লাভ কী? কিন্তু লাভ হোক কি লোকসান, যাই ঘটুক, ওই কথাগুলো এখনও কখনও কখনও আসর শুরু করার আগে তার মনে পড়ে। এইমাত্র আর একবার মনে পড়ল। সেই লোকটার নামও সে ভুলে গেছে, নিশ্চয়ই বারিকের মনে আছে, ওর সঙ্গে বেশ খাতির ছিল। বারিকের কাছ থেকে বই নিত। পড়া হয়ে গেলে একদিন দুইদিন বাদে ফেরত দিয়ে দিত। বারিক বসেছে বই বেচার জন্যে, কিন্তু ওই লোকটিকে একখানা দুইখানা বই পড়তে দিতে বারিকের কখনও আপত্তি ছিল না।

    পোটলাটা রাখার সঙ্গে সঙ্গে কি মানুষ জমে? তখন কিছুক্ষণ বেশ ফাঁকা ফাঁকা লাগে। মনে হয় একলা কোন প্রান্তরে মানুষজনের অপেক্ষায় বসে আছে। অথচ দেখো চারধারে এত মানুষ। ওই যে বয়েসি উকিলরা যাচ্ছে। মোসলেম তাদের কারও কারও নামও জানে। এমনকি শহরে কার কোথায় বাড়িঘর তাও জানা আছে তার। তাদের পিছন পিছন মহুরিরা। ওইদিকে কোর্টের লোকজনও আছে। জজ সাহেবের জন্যে অপেক্ষা। আজ কোন কোন কেসের তারিখ সেই অনুযায়ী মানুষজন এসেছে। জজ সাহেব খাস কামরায় নাকি এজলাসে, তাও এখান থেকে বোঝা যায়। আর সে এই একটা পোটলা নিয়ে এখন প্রায় একাকী বসে আছে। বারিক একইভাবে চোখ বন্ধ করে বসে। বারিকের দোকানের সামনে কেউ নেই। অথচ চত্বরে কত মানুষ, একজন মানুষ কি বারিকের সামনে। থাকতে পারত না। মোসলেমের মনে হয়, একবার ডাকবে নাকি আজগরকে। বান্দর নাচানোর ডুগডুগিটা বাজিয়ে মুখে যে ‘আউ-আউ-আউ’ করে, তাতে নিশ্চয়ই বেশ বড়োসড়ো একটা জমায়েত হয়ে যেত। কিন্তু আজগরকে কোথায় পায়। ট্রেজারির কাঁটাতার ঘেরা দেয়া সীমানার বাইরে কুলগাছের ছায়ায় কিছুক্ষণ আগে বানর দুটো বেঁধে রেখে কোথায় সে যেন গেছে। যাবে আর কই? নিশ্চয়ই ওই দিকের টাইপিস্টের ঘরের পাশে খাড়া সবেদা গাছটার নীচে জরিনার সাথে বসে আছে। না না, তাও-বা কী করে হয়, এখন কোর্টের এই ভরার সময়, টাইপিস্টদের ঘরের দিকে লোকজন আসে যায়, এখন ওই গাছের নীচে জরিনার সঙ্গে রঙ্গ করার সুযোগ পাবে? মোসলেম সেদিকে দেখতে মাথা ঘোরায়। না, বারিক বইয়ের দোকানের উপরে ছাউনি দিয়েছে, ফলে ওই দিকে নজর এখান থেকে আটকে যাচ্ছে।

    মোসলেম আর দেরি করল না। জানে কিছুক্ষণের ভিতর ওই পাশে আসর বসাবে ইব্রাহিম শেখ। আর নয় সুকুমারও আসতে পারে। তার এই জায়গায় বানর নাচাতে আজগরেরও আসার সময় হয়ে গেল। ফলে, তাকে শুরু করতে হয়। মোসলেম উদ্দিন, ‘আসেন আসেন আসেন-’ বলে একটু গলা তুলে হাঁক দিল। ছোট্ট ডুগডুগিটা বাজাল। যদিও এমনিতে মোসলেম কখনওই এইভাবে গলা তোলে না। তার আসর আসলেই একটু নীচু গলায়। কিছুক্ষণ পরেই তাই হবে, মানুষ জমলে মোসলেমের গলাটা নীচু হয়ে আসবে। কিন্তু জমার আগে তো তাতে হাঁক দিতেই হবে। তাছাড়া সে জানে, সে কী বেচে। সে তো খেলা দেখায় না। গাছ-গাছড়ার গুণাগুণ বর্ণনা করে না। ধ্বজভঙ্গ একশিরা স্বপ্ন দোষের তাবিজ দেয় না। পির খানজাহানের দরগার মাদুলি বিক্রি করে না। দড়ি কি ছুরির খেলা দেখায় না। সাপে কাটলে কীভাবে মানুষকে বাঁচাতে হবে তাও শেখায় না। ফলে, এসে বসলেই তাকে ঘিরে মানুষ আসবে তাই-বা সে ভাবে কী করে। মোসলেমের কথার এমন কী গুণ যে নীচু স্বরে কথা আর টপাটপ তার সব পাউডারের প্যাকেট বিক্রি হয়ে যাবে?

    কিন্তু মোসলেম জানুক কি না জানুক, তার কথায় কিছু গুণ তো আছেই। আর পাঁচ কি দশ জন ক্যানভাসারের মতন সে নিশ্চয়ই না। মোসলেম হয়তো তা জানে না, কিন্তু অন্য মানুষ তো তাকেই দেখেই বোঝে, মোসলেমের সঙ্গে তাদের তফাক্টা কোথায়। আছে এই কোর্ট চত্বরে এইরকম সাদা ইস্তিরি করা কাপড় পরা আর কোনও মানুষ, যার গায়ে জামাটা দেখলেই মনে হবে যেন ভদ্দরলোক! কেউ যদি না বলে, তাহলে বোঝার কোনও উপায় আছে, এই লোকটি কোর্টের সামনের এক ক্যানভাসার।

    মোসলেম আবার ডাক দিল। না বলা ভালো, একটু গলা তুলে হাঁক দিল। আজ তার কী হয়েছে কে জানে। সেই নাম মনে না-থাকা লোকটির মতন গলায় বলল, ‘আসেন এই রৌদ্রোজ্জ্বল দিনে, কিছু শুভ্রতার খোঁজে এইখানে এই কোর্ট চত্বরে। আমার কাছে।’

    মোসলেমের সামনে, ডাইনে-বামে একজন দুইজন দাঁড়িয়ে গেল। মোসলেম জানে এই বৃত্ত কী করে বড়ো করতে হয়!

    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleউইংস অব ফায়ার – এ পি জে আবদুল কালাম
    Next Article রবিজীবনী (১ম খণ্ড) – প্রশান্তকুমার পাল
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo
    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    ব্রাইডা – পাওলো কোয়েলহো

    September 22, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    ব্রাইডা – পাওলো কোয়েলহো

    September 22, 2025
    Our Picks

    ব্রাইডা – পাওলো কোয়েলহো

    September 22, 2025

    দ্য জাহির – পাওলো কোয়েলহো

    September 22, 2025

    ভুলবে সে গান যদি – প্রসেনজিৎ দাশগুপ্ত

    September 22, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    Sign In or Register

    Welcome Back!

    Login below or Register Now.

    Lost password?

    Register Now!

    Already registered? Login.

    A password will be e-mailed to you.