Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    আরব জাতির ইতিহাস – ফিলিপ কে. হিট্টি (অনুবাদ : প্রিন্সিপাল ইবরাহীম খাঁ)

    September 22, 2025

    নিউ মুন – স্টেফিন মেয়ার

    September 22, 2025

    ব্রাইডা – পাওলো কোয়েলহো

    September 22, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • 🔖
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    Subscribe
    সাইন ইন
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    ডুগডুগির আসর – প্রশান্ত মৃধা

    প্রশান্ত মৃধা এক পাতা গল্প240 Mins Read0

    ০৫. কোর্টের সামনের ক্যানভাসার

    এই কোর্টের সামনের ক্যানভাসারদের ভিতরে একটু উলটো ধাঁচের মানুষ ইব্রাহিম শেখ। জামা কাপড়ে আলাদা, আচরণেও। এমনকি চেহারা সুরতেও একটু ভিন্ন কিসিমের। যদিও মানুষটা বেচে ধ্বজভঙ্গের তেল আর মানুষ আটকে রাখার জন্যে শেখায় সাপে কাটলে সেই রোগীকে কীভাবে সুস্থ করতে হবে।

    ইব্রাহিম শেখের পরনে থাকে বেলবটম প্যান্ট, ফুলহাতার এক রঙা শার্ট, পায়ে কালো চকচকে অক্সফোর্ড জুতো। সেই শার্ট সাধারণত সাদা অথবা একটু নীলচে। এখন অবশ্য বেলবটম প্যান্টের যুগ বা হুজুগ দুটোই গেছে। রাজ্জাক পরে না, আলমগীর পরে না, সোহেল রানাও পরে না, জাফর ইকবালের তো পরার প্রশ্নই ওঠে না। ইব্রাহিম উচ্চতায় বেশ, প্রায় ছ-ফুটের কাছাকাছি, তাই তার পোশাকে অনুকরণ একটু নায়ক আলমগীরের দিকে। যদিও, এখন নয়া আর পুরোনো ভদ্দরলোকরা সবাই প্রেসিডেন্ট এরশাদের সাফারিতেই অনুসরণ করে। কিন্তু ইব্রাহিম তলে তলে এরশাদকে দেখতে পারে না। কেন পারে না, কেউ জানে না। তার সহযাত্রী ক্যানভাসারদের কারও এরশাদই হোক আর জিয়াই হোক কিছুই আসে যায় না। এ বিষয়ে তারা কিছু তেমন বোঝেও না। একমাত্র ব্যতিক্রম মোসলেম উদ্দিন। মোসলেম জিয়া-এরশাদের নামই শুনতে পারে না। তাদের এক জন প্রেসিডেন্ট ছিলেন অন্য জন প্রেসিডেন্ট আছেন, এসব কথা বললে সে বলে, শেখসাব বাইচে থাকলি এইসব চৌকিদার-দফাদার-লাঠিয়ালগো কোনও খোঁজ থাকত না। তার ডাকে মানুষ যুদ্ধে গেইচে। এই কথায় অবশ্য ইব্রাহিমই সমর্থন জানায়। যদিও ইব্রাহিম কি সুকুমার সবই তার হাঁটুর বয়েসি, শেখসাবের রাজনীতির কিছুই তাদের জানা নেই। জানার যদি কিছু জানে আজগর। আর বারিক, সারাটা জীবন সে ওই চোখ জোড়া অমন তন্দ্রায় তালিয়ে দিয়ে কাটিয়ে দিল। এর মাঝে বছর সতের আগে যে মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল, তার ওই তন্দ্রায় মনে হয়, তখন সারাটা সময় সে এই বটগাছের নীচে বসেই কাটিয়ে দিয়েছে।

    ইব্রাহিম অবশ্য এসব কথা একমাত্র মোসলেম ছাড়া কখনও কাউকে বলেনি। একটু নিজের মতো থাকা মানুষ। আয় রোজগার ভালো। সেটা যে ভালো তা তার পোশাক দেখলেই বোঝা যায়। কিন্তুইব্রাহিম শেখ মানুষটা একটু আলাদা বটে। সেটা আজগর জানে, জানে অন্যরাও।

    যদিও ইব্রাহিম মজমা মেলায় মঘা ওষুধের। কোর্ট চত্বরে কি এখানে আগত মানুষজন। যৌনশক্তিবর্ধক ওষুধকে মঘা ওষুধ বলে। এমনকি ইব্রাহিম যত ব্যক্তিত্বসম্পন্ন ভাব নিয়ে চলুক না কেন, একটু দূর থেকে হেঁটে যেতে লাগলে, তাকে কেউ কেউ হাত তুলে দেখায় : ওই যে মঘা যায়। ইব্রাহিম কখনও কখনও তা শোনে, মাথার বাবড়ি দুলিয়ে পারলে চকিতে সেদিকে তাকায়, বুঝলে পারলে যে বলছে তাকে দেখে, না চিনতে পারলে একটু মচকি হাসে। লম্বা একাহারা মানুষের ভিতরে হয়তো একটা বিনয়ী ভাব থাকে, ইব্রাহিমের ভিতরে সেটা আছে। কোনওপ্রকার অসন্তোষ নেই তার আচরণে, এমনকি নেই স্বভাবে কোনও খিটিমিটি ভাব। এমনিতে গলা উঁচু করে প্রায় কথাই বলে না, সাধারণ গলার স্বরও একটু চাপা, কিন্তু আসরে দাঁড়ালে কে বলবে এই ইব্রাহিমের গলায় এত জোর। কোত্থেকে সে গলা কাঁপিয়ে এইভাবে কথা বলতে পারছে। তার তেল দেওয়া বাবড়ি চুলের এই দোলানিতে চটক যে কোত্থেকে আসে!

    গতকাল, গত পরশু আর তারও আগের দিন, এই চত্বরে মজমা মিলেছে ঠিকই, কিন্তু তাতে কারওই লাভের লাভ তেমন হয়নি। অথচ লোক সমাগমে কোনও কমতি নেই। ট্রেন নিয়ে একটা ঝামেলা চলছে, তাতে গোটা শহর উত্তাল। সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাগেরহাট-রূপসা রেল লাইনের ট্রেন তুলে নেবে। এ নিয়ে সরকারের সঙ্গে দেন দরবার করবেটা কে? শহরের অনেকেই সরকারি দল করে। তারা তো এ নিয়ে কোনও কথা বলবে না। ওদিকে যারা এখনকার বিরোধী দল, তারাই শহরের রাজনীতিতে ভারি, কিন্তু ট্রেন নিয়ে আন্দোলনে তাদের অনেকের নামেই কেস হয়েছে। ওদিকে কলেজের ছেলেরা কোনওভাবেই এই ট্রেন তুলে নিতে দেবে না। ট্রেন উঠে গেলে তাদের পড়াশোনার ক্ষতি হবে। এই নিয়ে আন্দোলন। কোর্ট চত্বরে বারবার ছাত্ররা আসে মিছিল নিয়ে, ডিসির কাছে স্মারকলিপি দেয়। ফলে, চত্বরে লোক সমাগম হয়, কিন্তু ক্যানভাসারদের আসর কোনওভাবেই জমে না।

    জমবে কীভাবে? এই কোর্টের উকিলদের অনেকেই রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। বড়ো উকিলদের কেউই সরকারি দল করেন না। ট্রেন নিয়ে ছাত্রদের এই আন্দোলন খুবই যৌক্তিক। কলেজে একটা স্টেশন আছে, সেই সামন্তসেনা-বাহিরদিয়া-মূলঘর-ফকিরহাট থেকে ছাত্ররা যে পড়তে আসে তা তো এই ট্রেন লাইন ধরেই। মূলঘরের এদিকে পরে খানজাহানপুর-যাত্রাপুর-ষাটগম্বুজ এলাকার মানুষজন আর ছাত্রছাত্রী সবাই শহরে আসে এই রেললাইন ধরে। আর, ইব্রাহিম হোক আর আজগর হোক, হোক সুকুমার কি মোসলেম উদ্দিন, এমনকি দিলদার–কে আছে যে জীবনে একবার আধবার রেল স্টেশনে মজমা মিলায়নি। তাছাড়া রেলগাড়ি চলে সারাটা বছর, কোন দিন কামাই নেই, বিরতি নেই, কিন্তু কোর্টও তো বন্ধ থাকে। তখন তাদের একমাত্র সহায় রেল লাইন, রেল স্টেশন। ওই জায়গায় গিজগিজে মানুষ, এই আসে এই যায়, কারও তাড়া আছে কারও নেই। একটু খোলা জায়গা পেলে তখন হাউশ মিটিয়ে ক্যানভাস করা যায়।

    কিন্তু এর ভিতরে তো এই কথাও শোনা যায়, এই রেল লাইন তুলে দেয়ার পিছনে বাস মালিকদের একটা ভূমিকা আছে। তারা চায় না এই রূপসা-বাগেরহাট লাইনে আর ট্রেন চলুক। ট্রেনে বেশির ভাগ মানুষ মাগনা যায়। টিকিট কাটা লাগে না। ফলে বাসে কোনও মানুষ ওঠে না।

    বাসের রাস্তা আগে ট্রেন লাইনের প্রায় পাশ দিয়েই ছিল। এখন পিরোজপুর মোংলা রোডের সঙ্গে মিলিয়ে নতুন রাস্তা হয়েছে। এই রাস্তার নাম মানুষের মুখে, সিএন্ডবি রোড। সে-রাস্তা অনেক বড়ো। এদিকে দড়াটানা ঘাটে ফেরি, পার হয়ে পিরোজপুর যেতে হয়, ওদিকে রাস্তা মিলেছে মোংলা-খুলনা অথবা মোংলা রূপসা রোডের কাটা খালিতে। মোংলা-খুলনার রাস্তা আরও সুন্দর।

    এসব কথা যেমন শহরবাসীর জানা আছে, জানা আছে এই কোর্টের এলাকার মানুষজনদের। এও জানা আছে, এই ট্রেনের পিছনে সরকার আর ভর্তুকি দিতে পারছে না, তখন কলেজের ছাত্ররা এক-দুই দিন ট্রেনের টাকা তুলে দেখিয়েছে, সরকার চাইলে কত টাকা তুলতে পারে।

    কিন্তু তারপরও সবার মনে হচ্ছে, ট্রেনটা থাকবে না। এরশাদের এবার ট্রেনটা উঠিয়েই নিয়ে যাবে। এ প্রায় একশ বছরের এই রেলপথ তখন একলা একলা শুয়ে থাকবে। যতদূর চোখ যায়, শুধু তখন সমান্তরাল এক জোড়া রেল লাইন শুয়ে আছে। আর এ-ও শোনা যায়, একদিন এই কোর্ট চত্বরও এখানে থাকবে না। তাও চলে যাবে ওই সিএন্ডবি রাস্তার কাছে, চলে যাবে কোর্টের পাশের এই জেলখানাও। তখন এই কোর্ট চত্বর আর ওই জেলখানা তখন শুধুই দালান, এই এলাকা তখন সারাটা দিনমান খা খা করবে।

    এই খা খা করার কথাটা অবশ্য মোসলেম উদ্দিন বলে। সঙ্গে এও যোগ করে, সেদিন এমন দিন আসবে, কোর্টের সামনে এই ক্যানভাস শোনার লোকই থাকবে না। আর, ওই যে জায়গায় কোর্ট হবে সেখানে তো ধানক্ষেত, এত সুন্দর মানুষ চলাচল বাজার, লঞ্চঘাট, এইসমস্তর জায়গা সেখানে কী করে হবে।

    এসব বলতে বলতে মোসলেম উদ্দিন তার হালকা দাড়িঅলা মুখোনা বিষণ্ণ করে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। বলে, ভালোই হবে, ততদিন সে বাঁচবে না, বাঁচলেও ক্যানভাস করার বয়েস থাকবে না, তাই ওইসব কোনও কিছুই তাকে দেখতে হবে না।

    কিন্তু এ কথায় ইব্রাহিম হোক আর সুকুমার হোক তারা দমকে কেন? এখনও তাদের কাছে জীবিকা মানে কোর্টের সামনে এই ক্যানভাস। যদিও সুকুমার জানে, সে যে সব খেলা দেখাতে জানে, কোনও সার্কাসের দল তাকে ডাকলে চলে যাবে। যেতে সে চায়, কিন্তু সার্কাস চলে সেই শীতকালের দিকে। বাকি সময় হাতে কাজ না থাকলে সে খাবে কী? তারে সারা বছরের খোরাকি দিয়ে কোনো সার্কাস পার্টি রাখবে না। ফলে, এইরকম কোর্টের সামনে খেলা দেখিয়েই তাকে চলতে হবে। তবে, খুলনায় থাকতে সুকুমারের আয় রোজগার আরও ভালো ছিল, সঙ্গে একটা ছেলে ছিল, তাকে আঁকার ভিতরে ভরে খেলা দেখাতে পারত, এমনকি মজমা ভালো হলে কখনও কখনও দেখাত ছুরি মারার একটা খেলা। চত্বরে রক্ত, মানুষ বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকত। একটু পরে অক্ষত ছেলেটি বের হয়ে আসত ঝাঁকার নীচ থেকে। পয়সা ঢালত পাবলিক। এখন সুকুমারকে দেখাতে হয়, হাতের কারসাজি, সে একজনেরই খেলা; কখনও কখনও ভিড়ের থেকে সে কাউকে ডেকে নেয়।

    মোসলেম উদ্দিন ইব্রাহিম আর সুকুমারের সঙ্গে বসেছিল বারিকের বইয়ের দোকানের পাশে, বড়ো অশত্থ গাছটার নীচে। এখানে একপ্রকার আড্ডা জমেই। বারিকের বেচাকেনা কম, তার আশেপাশে প্রায় সবাই ক্যানভাসের পোটলা-পুটলি মালপত্তর রাখে। কেউ রাখে একটু তফাতে, এমন জায়গায় যেন তাও বারিকের চোখের আয়ত্তে। চোখের আয়ত্তে না-রাখলেও তো কোনও সমস্যা নেই, ওগুলো এমন না যে কেউ নিয়ে যাবে। নিলে যারা চেনা জানা, তাদের মতন এখানকারই মানুষ, তারাই নেবে। বাইরে লোক, যারা এই আসছে যাচ্ছে–এগুলোয় কোনও ভাবেই হাত দেবে না। তাদের প্রয়োজন যেমন নেই। তাছাড়া, একটু দূরত্ব থাকলেও এইসব ক্যানভাসারের প্রতি তাদের প্রত্যেকেরই একপ্রকার জড়তা আছে। কেউ কেউ কাছেপিঠের গ্রাম-গাঁ থেকে আসে। শোনে এই কোর্টের সামনে পকেটমার টাউট বাটপার বেশ্যার দালাল থেকে শুরু করে জমির দালালসহ উকিল মুহুরি কি জজর সঙ্গে যোগাযোগ করারও লোকজন থাকে। কেউ জানে, এইখানে আসলেই পকেট উজাড় হয়। কেউ জানে, এইখানে আসলে পকেট কাটাও যায়। মজমা-আসরে ক্যানভাসের সময় ক্যানভাসাররা তা বলেও। হঠাৎ হঠাৎ আসরে সবাইকে সাবধান করে দিতে তারা বলে, পকেট সাবধান। শুধু আজগর একটু কায়ন্দা করে বলে, পাকেট সাবধান। আজগর কেন পাকেট বলে, সেই জানে। যদিও মোসলেম আজগরের এই পার্কেট বলা নিয়ে সবাইকে জানায়, কোন এক উড়ে মালি নাকি আজগরকে বলেছিল, পাকেটে নেই টাকা কেমনে যাব ঢাকা। তারপর থেকে আজগর বলে, পাকেট! অথচ তারা জানে, তারা এটা বলে মানুষকে সাবধান করে দেয়ার জন্যে। ওদিকে, আসরে উপস্থিত গ্রাম-গার মানুষজন মনে করে, আসলে পকেটমারদের সঙ্গে এই ক্যানভাসারদের যোগাযোগ আছে, তাদের এই আসরে সবাই যখন মশগুল তখন তাদের পকেট থেকে পয়সা হাতায় পকেটমাররা। কিন্তু এতই যদি যোগাযোগ থাকবে, তাহলে মোসলেম এই কয়দিন আগে এক পকেটমারকে ধরে থানায় নিয়ে গেল কেন?

    বারিকের নীল পলিথিন লাছা বইয়ের দোকানের ছাউনিও নীল, সূর্যের আলোয় নীচে নীলচে ছায়া পড়েছে। মোসলেম বারিকের দোকানের পাশে বসে একটা বিড়ি ধরাতেই ইব্রাহিম বলল, বড়দা, আইজকে মানুষজন আছে, কিন্তু পাবলিক নেই।

    সুকুমার হাসল, আপনি কথা জানেন ভালোই, ইব্রাহিম ভাই!

    কথা বেচেই খাই। কিন্তু তোমার মতন কলেজে যাওয়ার সুযোগ হলি আর এট্টু কথা জানতাম–

    মোসলেম বারিকের কাছে কিছু-একটা জানতে চাইলে, সে সময় ইব্রাহিম ওই কথাটা বলে। এবার মোসলেম তার কাছে জানতে চায়, পাবলিক নেই, মানুষ আছে? তোমার কথা তো কিছু বুঝদি পারি না!

    কী যে কন, মানুষ মানে মানুষ, এই যে গিজগিজ করতিচে মানুষ কিন্তু আমাগো মজমা শোনার কোনও পাবলিক নেই।

    ও-ও, কথাটা যেন মোসলেমের জন্যে একটু দূরবর্তী। বুঝেছেও, কিন্তু একটু সরু চোখে সে ইব্রাহিমের দিকে তাকাল, আরে ট্রেন নিয়ে শহরে কত কিছু হইয়ে যাতিচে। ছাত্ররা কহোন মিছিল নিয়ে আসে। আমলিগ-বিএমপির কতজন নেতার নামে নাকি অ্যারেস্টের অর্ডার হবে। ছাত্রগো কারে কারে আটকাইচে–

    সে তো জানি।

    তালি? কোর্টে মানুষ আসে, কিন্তু এই সব মানুষের কেস নিয়ে ভিড়, তার মদ্যি আমাগো এইয়ে শুনতি আসতিচে কেডা। তিনদিন আগে তোমার ভাবিরে পাউডারের প্যাকেট বানানোর মাল মশলা কিনে দিচি। চলে কোনও মাল? নতুন মাল আনাই লাগে না।

    সুকুমার বারিককে বলে, ও বড়ো ভাই, নাকি কাকা, কী যে ডাকিলাম ঠিক নেই? তার এই ডাকে বারিক তার প্রায় সব সময় মুদে থাকা চোখটা একটু মেলে সুকুমারসহ সবাইকে দেখে। সুকুমার সেই সুযোগে বলে, আপনার এই বই মানষি কেনে?

    ইব্রাহিম বলে, কেন কেনবে না? কত মানষি কেনে। এই জায়গায় দাঁড়ালে দেখা যায়। তাছাড়া না কিনলি কাকা এইরাম বই সাজাইয়ে রাখে?

    সুকুমার একে একে বইগুলো দেখে। নাম পড়ে। একটার উপর একটা থাকে থাকে সাজানো বই। প্রায় সবগুলোই পাতলা পাতলা। এই ধরনের বই সে বাড়িতে দেখেছে। উপরে লেখকের ছবি। শরৎচন্দ্রের চন্দ্রনাথ, দেবদাস, দত্তা। তারপর ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়ের চিতা বহ্নিমান, শাপমোচন, আছে বিষাদ সিন্ধু। আর চাষাবাদ নিয়ে কিছু বই। এইসব বইয়ের পাশে ও নীচে আছে। একটু অন্য ধরনের বই, সুকুমার জানে। তবে, এরপাশে বশীকরণ বিদ্যা আর জাদু শিক্ষার বই দেখে সে হাসে।

    সুকুমার বলে, এই দেখি বশীকরণ করার বই। এই বই কিনলি আর মাইয়ে মানুষ পটাতি কোনও সমস্যা হবে না।

    সুকুমারের একথা শুনে ইব্রাহিম তার দিকে তাকায়। তারপর প্রায় সঙ্গে সঙ্গে চোখ ঘুরিয়ে দেয়। মোসলেম উদ্দিনের দিকে। যেন ইব্রাহিম চায়, সুকুমারের এই কথা শুনে মোসলেম কিছু বলুক। মোসলেম তাই বললও, ও বই তোমার দেকতি হবে না। ও বিদ্যা তুমি এমনিতেই খারাপ জানো না।

    কথাটা সুকুমার গায়ে মাখল না। মুহূর্তে ঝিলিককে মনে পড়ল তার। ঝিলিক কাল চলে গেছে মোড়েলগঞ্জ। বলে গেছে, দুই-তিন দিন বাদে আবার আসবে। দুই দিন তার সঙ্গে ছিল। তাই মোসলেম উদ্দিন এখন ওই কথা বলল। কিন্তু যদি জানত, ঝিলিক কেন এসেছিল, আবার কোথায় গেছে, আবার কেন আসবে, আর তার কী হয়? এটা সত্যি ঝিলিককে সুকুমারের সঙ্গে দেখা গেছে, কিন্তু সুকুমার কারও সঙ্গে তার পরিচয় করিয়ে দেয়নি। এখানে ওই পরিচয় টরিচয় করিয়ে দেওয়ার কোনও বালাই নেই, তবু একটা মেয়ে মানুষ তার সঙ্গে, কিছু একটা তো তার হয় নিশ্চয়ই। কিন্তু তাও না, সুকুমার কারও সঙ্গে ঝিলিকের কোনও যোগাযোগ যেন হতে দেয়নি। শুধু জরিনা আগেই চিনত ঝিলিককে, একদিন তার দেখা হয়েছিল, সে-ই ঝিলিককে দেখে কথা বলেছিল, তারা দুজন দীর্ঘক্ষণ বসেছিল নদীর কূলে। কাছেপিঠে তখন আজগর আর সুকুমারও ছিল, কিন্তু সেকথা এখন। এখানে জানানোর কী দরকার। যদি জরিনার কাছে থেকে তারা কিছু জানতে পারে তো জানবে। যদি আবার আসে তো দেখবে। সুকুমার এখন ওকথা মনে করতে চায় না। তবে, ঝিলিকের মুখোনা তার মনে পড়ল আবার। সে অবশ্য অনেক কারণে।

    ইব্রাহিম বলল, এই যে জাদু শিক্ষা, সুকুমার তোমার লাগবে? বারিক কাকার কাছে কী সমস্ত বই আছে দেখিচো!

    সুকুমার বলল, ওই বইয়ে কী আছে তাও আমার জানা আছে, কন আপনারা?

    মোসলেম আবার বলে, জানা তো আছেই। জানা না-থাকলি তুমি জাদু দেখাও কী কইরে!

    সুকুমার হা-হা শব্দে হাসে। হাসলে ছেলেটা বেশ দেখায়। বারিক তার তন্দ্রা ভেঙে সুকুমারের মুখোনা দেখল।

    ইব্রাহিম তার হাসির কারণ জানতে চাইল, কেন কী হইছে?

    এত লেখা, একখানা ছুরি দিয়ে জবা ফুল কাটার পরে, তারপর সেই ছুরি দিয়ে লেবু কাটলি লাল রং বের হয়!

    কেন খাটে না? বের হয় না?

    আরে অল্প এট্টু লাল হয় লেবুর রসে! ওই বই পইড়ে জাদু দেখলি আর মাইর মাটিতে পড়বে নানে।

    এসব বলতে বলতে তারা লক্ষ করে দোকানে তখন কোনও খদ্দের আছে কি না? খদ্দের থাকলে তারা অবশ্য এমন কথা বলত না। এখন এই তিন জন বাদে বারিকে দোকানের সামনে কেউ নেই। থাকতে পারত, সাধারণত কোনও মজমা না-থাকলে দুই চারজন বই হাতানো খদ্দের বারিকের দোকানে থাকে। তাদের কেউ কেউ কখনও কখনও দুই-একখানা বই কেনে। এমনকি একসঙ্গে চার পাঁচখানা বইও কেউ কেনে। তবে বারিকের সহযোগীরা যেমন জানে, বারিক তো তেমন জানেই, কেউ কেউ আছে বারিকের দোকানের আশেপাশ দিয়ে ঘুর ঘুর করে। সামনে বসে। বই হাতায়। শরৎচন্দ্রের দেবদাস হাতে নেয়, সঙ্গীকে বলে, এর কাহিনি। বুলবুলের দেবদাসে অভিনয় দেখেছে। পাশের জন হয়তো জানায়, সেও দেখেছে, তবে তার কোন আত্মীয় আছে ইন্ডিয়ায়, সেই আত্মীয় বলেছে, দেবদাস দিলীপকুমার আর সুচিত্রা সেন অভিনয় করেছে, সেটি হিন্দি। প্রথমজন তখন বলে, কখনও ইন্ডিয়ায় গেলে সে দেখবে। দ্বিতীয়জন জানায়, সে বহুত পুরোনো বই। এখানে বই অর্থাৎ ছায়াছবি। তাদের হাতে দেবদাস, সেটাও বই, আবার বুলবুল আহমেদ ও কবরী আর দিলীপকুমার ও সুচিত্রা কেন অভিনীত দেবদাস ছায়াছবিও বই। অন্যজন তখন ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়ের শাপমোচন বইখানার উপরের পাতলা কাগজের প্রচ্ছদে দুই রঙা সুচিত্র-উত্তমের ছবি দেখিয়ে বলে ওই যে সুচিত্রা সেন। কিনবি নাকি শাপমোচন? প্রথমজন ডাইনে-বামে মাথা নাড়ে। কিনবে না।

    এতেই অবশ্য বারিক বুঝে যায়, এই দুজন কী বই খুঁজছে। হয়তো তারা একখানা শাপমোচন কি এরপরে নৌকাডুবি বা অগ্নিবীণা উলটাতে উলটাতে এইসমস্ত বইয়ের তলা থেকে তার একখানা আবিষ্কার করে নেয়। সেখানে অবশ্য একসঙ্গে একখানা দুইখানাই থাকে। এমনকি প্রচ্ছদে তেমন রগরগে ছবিও থাকে না। প্রত্যেকটাই পিনমারা। চাইলে এই জায়গায় বসে পড়াও যায় না। যদি পিনমারা না-থাকত, তাহলে বারিক জানে এ জায়গাতেই চলত ওই বই পড়া। এক একজন পড়তে পড়তে প্রায় সাবাড় করে ফেলত। এখানে বসে পড়তে পড়তে উত্তেজিত হত। লুঙ্গির মাঝখানে উঁচু হয়ে যেত। ওই গ্রাহকের চোখ মুখ কিছুটা লালচে, মুখ থমথমে আর কিছুটা ভারি বারিকের এ সবই জানা আছে। তারপর পড়তে থাকা তাদের কারও কারও লুঙ্গি হয়তো কিছুটা ভিজেও যেত। কেউ বা উঠে আশেপাশে কোনও গলি খুঁজে নিত, যেখাতে দাঁড়িয়ে নিজের শরীরের এই উত্তেজনার ভার দমন করা যায়।

    সে সুযোগ রাখেনি বারিক। কেউই রাখে না। এখানে বারিক বয়স্ক, তাও কখনও কখনও এসব বইয়ের কিছুটা উলটে পালটে দেখেছে। তখন তারই ভিতরে ভিতরে কেমন করে, আর এসব নওজোয়ান ছেলেদের। তারা উপরের ছবি দেখতে দেখতে, কখনও কখনও পিনের পাশ যে প্রায় ছুটিয়ে ফেলে, তাও তার জানা আছে। তাই ওই বই কেউ হাতে নিলে বারিকের আধ বোঝা চোখখানা স্পষ্ট হয়। এমনকি স্কুলেপড়া ছেলেরা কখনও ওই বইয়ে হাত দিলে চোখটা আরও বড়ো করে খুলে সে ডানে-বামে মাথা নাড়ে।

    কিন্তু এতদিনের অভিজ্ঞতায় বারিক জানে, কারা এই বই কিনবে আর কারা শুধু ওই বই হাতাবে। সে দেখেই ভাবভঙ্গি বুঝতে পারে। ওই যে যেমন, যারা শাপমোচন হাতিয়েছে, কিন্তু কিনবে না। নাড়তে নাড়তে নিজেদের ভিতরে কথা বলার ভঙ্গিতে বারিক বুঝত পারে, এরা নেবে। সে প্রায় সঙ্গে সঙ্গে দাম বলল, দশ টাকা। দশ টাকা একটু বেশি যদিও। বারিক জানে, এই বইয়ের পাইকার তারে এগুলো আড়াই টাকা দরে দিয়ে গেছে। বইয়ের গায়ে দাম লেখা আছে, বারো টাকা মাত্র। কিন্তু বারিক পাঁচ টাকা কি ছয় টাকায় ছেড়ে দেবে। সে জানে এরা কিনবে। এখনই দরদাম করতে শুরু করবে। কী বলবে, আরও আছে? থাকলি দেখান। বারিক তখন একজনকে তার কাছে আসতে বলবে। তারপর উপরে রাতের রজনীগন্ধা, তারপর মায়ামৃগ তারপর হয়তো আনোয়ারার তলে এই রকম বইয়ের আরও দুটো কপি তাদের দিকে দেবে। এইটুকু সাবধানতা অবলম্বন করা প্রয়োজন। কোর্ট চত্বরে পুলিশ, পুলিশের সেপাই আর টিকটিকির অভাব নেই। কেউ কেউ বলে, ওই রহম পাগলও পুলিশের লোক। যদিও তা কোনওভাবে সত্যি নয়। রহম কোনও গোয়েন্দা হতে পারে না। তবে, রহম একদিন তাকে আর মোসলেমকে বলেছিল, তার সঙ্গে এইখানে বছর খানেকের জন্যে যে আর একজন পাগল এসে জুটেছিল, সে গোয়েন্দা। রহম দেখেছে, সেই লোক একা একা রাতের অন্ধকারে কোর্ট বিল্ডিংয়ের ওই টেমি বারে আলোয় কী সব লিখত। তারপর রাত থাকতেই ফেলে দিয়ে আসত পোস্টাফিসের লাল বাক্সে। রহমকে পুলিশরা কখনও কখনও ফাও কথা বলেছে, কিন্তু সেই লোককে কখনওই কিছু বলেনি। যদিও বারিক-মোসলেম মনে করে, এই সবই রহমের বানানো গল্প। সেই সময়ে রহমের মাথা একটু সুস্থ। এতদিনের পরে নিজের কল্পনার কিছু কিছু সবাইকে বলতে শুরু করেছে। সে মনে করেছে, সেই পাগল গোয়েন্দা, সরকারের লোক–এইসব বললে সবাই রহমকে কিছুটা হলেও পাত্তা দেবে।

    লুকিয়ে বই দেখানো, তারপর সেই বই পুরনো খবরের কাগজে মুড়িয়ে গ্রাহকের হাতে গছিয়ে দিয়ে বারিক আবার চোখ বোজে। মনে মনে ভাবে, এসব বইয়ের গ্রাহকই তার ব্যবসা বাঁচিয়ে রাখবে, পেটে ভাত দেবে। ওইসব নোভেল তো শহরের বইয়ের দোকানেও পাওয়া যায়। তাই, বেলা একটু গুটিয়ে আসলে, বারিকের আধবোজা চোখ জোড়া একটু যেন খোলে। সে জানে, এখন যারা আজকের মতো কোর্টের কাজ সারল, কিন্তু সব কাজ সারা হয় নি, কোনো হোটেলে থেকে যাবে, তাদের কেউ কেউ তার দোকানে আসবে। কোনও কোনও দিন বেশ কজন আসে। তখন দোকান প্রায় গোটানোর সময়। বারিক জানে, তারা কিনবে। সে দাম একটু কমিয়ে বলে। যদিও বারিক এরপর আরও কল্পনা করে, ভাবির সঙ্গে মধুর রাত পড়তে পড়তে সেই লোকটি নির্জন হোটেল রুমে কোন কল্পনায় তলিয়ে যাবে। সেখানে কী ঘটতে পারে, তাও যেন তার জানা আছে।

    কিন্তু এখন যখন সুকুমার ছোঁকরা তার সহজ জাদু শিক্ষার বইখানা নিয়ে ওই কথা বলল, তাতে হেসে প্রায় গড়িয়ে পড়ল মোসলেম আর ইব্রাহিম, সেই হাসি বারিককেও একটু ছুঁয়ে গেল। বারিক জানে কথাটা কিছু ভুল বলেনি সুকুমার। ও ছোঁকরা খেলাঅলা, জাদু কিছু জানে, এইসমস্ত বই কম বেশি হাতিয়ে দেখেছে।

    ওই হাসির দমকের ভিতরে ইব্রাহিম জানতে চায় এই বই কেনে কারা?

    বারিক নীচু গলায় মুখে হাসি ঝুলিয়ে রেখে বলে, ওগুলো বেশির ভাগ স্কুল কলেজের ছেলেপেলেরাই কেনে? আর কেনবে কারা?

    বড়ো মানুষরা কেউ কেনে না?

    কেনে, কেউ কেউ কিনে বাড়িঘরে যাইয়ে কোনও কোনও সময় মনে হয় বেয়াই-বেয়ানগো খেলা দেখায়!

    ও কা, সে খবর আপনি জানলেন কোয়ানদে? তারপর সুকুমারের উদ্দেশ্যে বলে, দেখিচো, কাকারে যেরাম ভাবিলাম সেরম না। রস আছে কতায়।

    মোসলেম উদ্দিন তার সমবয়েসি বারিকের উদ্দেশ্যে একটা হাঁকমতন দিল, এ বারিক, পোলাপান কী কতিচে? ওরা জানে তোমার রস? বলে, বারিকের দিকে তাকিয়ে হাসল। হাসলে মোসলেমকে সুন্দর দেখায়। দাঁতগুলো তার খুব সুন্দর। চকচকে। সাধারণ লোকটা হাসে না, কিন্তু এই যে হাসল, হেসে বারিককে আরও জিজ্ঞেস করল, ওরা জানে খেড় কারে কয়? মানুষের কথা দিয়ে কী কইরে হাসাতি হয়?

    সেয়া জানবে কোহানদে। কাইলকের ছলপল। খালি শিখিছে খেইল দেহাতি। আর এক একজন নিয়ে ঘুইরে বেড়াতি।

    হয়। একেবারে।

    তাদের কথায় ইব্রাহিম আর সুকুমার যেন একটু পাশে পড়ে গেল। যাক, এই দুজন মানুষের কথা শুনতে তাদের খারাপ লাগছে না। যদিও বারিকের জন্য সেকথা আর এগোয় না। বারিক মোসলেমকে বলে, আইজকে এই জায়গায় বইসে কাটাইয়ে দেবা? নাকি মজমাটা মিলোব?

    মিলোব তো বারিক। মজমা মিলোনোর জন্যিই তো আইচি। থলির ডুগডুগি না বাজালি পেটও চলে না, কানেও ভালো লাগে না, কিন্তু আইজকে মানুষজনের কায়দা দেখিচো? ওই ইব্রাহিমের কথাই ঠিক, মানুষ আছে, পাবলিক নেই।

    হয়। তয় তোমাগো চোখ আছে। বারিক বলে, দেইহে বুঝদি পারো, কী অবস্থা চলতিচে। আমি এই জায়গায় তালগাছের মতন বইসে থাইহে থাইহে অত বুঝদিও পারি না। কিন্তু আইজকে বুঝদিচি, মানুষের এদিকে কোনও খেয়াল নেই।

    কিন্তু কিছু করারও নেই। রেল উইঠে যাবে। ছাত্ররা আন্দোলন করতিচে। কয়জনের অ্যারেস্ট করিচে। আইজ মনে হয় জামিনের তারিখ পড়বে।

    শোনলাম হক আর মোজাম্মেল উকিল সাহেবগোও অ্যারেস্ট করতি পারে।

    আমিও শুনিচি।

    তা কী আইজ এই জায়গায় বইসে থাকপা তোমরা?”

    হয়, সেইয়ে থাহি।

    মোসলেম উদ্দিন পায়ের কাছে রাখা লাঠিটা হাতে নেয়। কিন্তু উঠে দাঁড়ায় না। ঘাড় ঘুরিয়ে ইব্রাহিম আর পিছনে সুকুমারের উদ্দেশে বলে, কী তোমরা যাবা এহোন, না আমি যাব?

    ইব্রাহিম বলে, বেলা বাইরে গেইচে! আজগর ভাই যাবে না? তারে তো দেকতিচি না।

    বারিক তাদের কথায় ঢোকে, হয়, আইজকে মাইনষে দেকপেনে বান্দর খেলা? খাইয়ে তো কোনও কাজ নেই।

    ভুল বলেনি বারিক। মোসলেম তাকে সমর্থন দিল, তুমি দেহি এইসবও বোঝে। ঠিকই কইচো। আজগর সেইয়ে বুঝদি পাইরে দিছে ডুব।

    না না, ডুব দিনি, ডুব দিনি শরীর খারাপ। আর নয় ওই জরিনার সাথে লঞ্চঘাটে বইসে রইচে। বারিক অনুমান জানায়।

    ইব্রাহিম বলে, তালি কী করবেন?

    এরপর সিদ্ধান্ত হল, আগে মোসলেম যাবে। তারপর ইব্রাহিম। সুকুমার খেলা দেখাবে না। তার মন ভালো নেই। সে আলতাফের হোটেলের দিকে যাবে। অথবা, একবার দেখে আসবে আজগরকে। আবার তার যেতেও ইচ্ছে করছে না। আজগরকে দেখতে গেলেই জরিনা জিগগেশ করবে, ঝিলিক কেন চলে গেল? কারণ বললে জানতে চাবে, সে কেন চলে যেতে দিল? কিন্তু ও বিষয়ে কথা বলতে সত্যি ভালো লাগে না সুকুমারের। সুকুমার সে-কথা ভেবে এখনই গেল না।

    এদিকে এইসমস্ত বলতে বলতে বেলা গড়িয়েছে। মোসলেম তার ঝোলাটা নিয়ে চত্বরের মাঝখানে গিয়ে বসল। তখন ইব্রাহিমের মনে হয়, আজও রোদ উঠেছে ভালোই। সকাল গড়িয়ে দুপুরের দিকে গেছে তাও অনেকক্ষণ, কিন্তু আজ মানুষের ঢলের কারণে বেলা যে এতটা হয়েছে তা বুঝতে পারেনি, নাকি তারা বসে আছে অশত্থ গাছটার নীচে। এই গাছের ছায়ায় রোদ বোঝা যায় না, তাপ বোঝা যায় না, সেই জন্যেই হয়তো সারাটা বেলা ওখানে বসে বসে বারিক ওভাবে ঝিমায়। এই গাছের তলে সত্যি চোখ জুড়িয়ে আসে। এমনভাবে জুড়িয়ে আসে যে উঠে আর কাজে যেতে মন চায় না। চত্বরে যে রোদ, বুঝবে মোসলেমকা! কিন্তু সে-কথা ভাবতে ভাবতে ইব্রাহিমের মনে হয়, একটু বাদেই তো তাকেও যেতে হবে ওখানে। তখন সূর্য থাকবে একেবারে চান্দির ওপর। তখন কি ইব্রাহিমের গলা দিয়ে স্বর বের হবে।

    মোসলেম উদ্দিন তার ঝোলা থেকে ডুগডুগি বের করে বাজাতে শুরু করে। গলা থেকে বের করে এক অদ্ভুত স্বর। তাতে তার কাছে কিছু মানুষ ঘিরে দাঁড়ায়। দেখে ইব্রাহিমের মনে হয়, ট্রেন নিয়ে যাই হোক, কোর্টে তা নিয়ে যতই উত্তেজনা থাক, কিছু মানুষ এই চত্বরে আসে ঘুরতে, তাদের কোনও কাজ নেই। তাদের কয়েকজন তো মোসলেম কাকার আসরে আসবে। কিন্তু সেটুকু ভেবেই তার মনে হয়, তারা আসলেই-বা কী? তারা কি আর ওই পাউডার কিনবে। যারা কেনার পাবলিক, তারা যদি না আসে। ইব্রাহিমও উঠে সুকুমারের পাশে দাঁড়ায়। তারপর গলা নামিয়ে, একটু যেন বিষণ্ণ সুকুমারের কাছে জানতে চাইল, ভাইতি যাবা নাকি এট্টু চা খাতি?

    সুকুমার হ্যাঁ বা না কিছুই বলল না, তবে ডানে-বামে মাথা ঝকাল। একটু অন্যমনস্ক ভঙ্গি। মাথা নাড়ানোটাও স্পষ্ট নয়। ইব্রাহিম বুঝল না। ইব্রাহিম যে বোঝেনি, সেটা বুঝেই সুকুমার বলল, যাওয়া যায়। কিন্তু আইজকে সব দোকানে যেরাম ভিড়!

    চলো, যাইয়ে দেখি। এই সোজা এট্টা দোকান আছে নদীর পাড়ে।

    এই সোজা দোকানটায় যেতে হবে লঞ্চঘাটের আগের গলি দিয়ে। মেইন রোডে সেখানে দুই পাশে বড়ো বড়ো ফার্মেসি। মাঝখানে গলিটা। গলি ধরে এগোলে মাথায় নদীর পাড়। তার আগে একটা ছোটো চায়ের দোকান আছে। পাশে একটা পানের দোকানও। ইব্রাহিম পান খায়, সুকুমার খায় না। ওই দোকানের পান ইব্রাহিমের পছন্দ। সুকুমার অবশ্য তা জানে না।

    রওনা দেবে ঠিক সেই সময়ে সুকুমার বলল, আপনি যান, আমার যাতি ইচ্ছে করতিছে না।

    ইব্রাহিম বিস্ময়ের সঙ্গে সুকুমারের মুখের দিকে তাকায়। এই মানুষটাকে বোঝাই যায় না। তবু সে বলল, চলো, চলো, তাড়াতাড়ি চইলে আসপো। এই দেহো না কী রোদ্দুর! এক গ্লাস পানি খাইয়ে, এক কাপ চা খাইয়ে, এট্টা পান মুখে না-দিয়ে আমি আইজ আসর জমাতি পারব না।

    সুকুমার আর কোনও কথা না-বলে ইব্রাহিমের সঙ্গে যায়। পাশ থেকে বারিক বলে, পান আমার জন্যি এটা আনিস। অবাক করা ঘটনা এই, একটু পরে, সুকুমার ইব্রাহিমের সঙ্গে ফিরেও আসে এই অশখতলায়। পানটা সেই-ই বারিককে দেয়। ততক্ষণে মোসলেমের আসর প্রায় শেষ। সে প্যাকেট দিচ্ছে সবার হাতে। এদের কেউ নেবে, কেউ নেবে না। যারা নেবে তাদের কাছ থেকে টাকা নিয়ে মোসলেম আসর গোটাবে। ইব্রাহিমের ঢুকতে হবে প্রায় সঙ্গে সঙ্গে। আজকের এই অল্প জমায়েত, মোসলেমেরটা ভাঙতে ভাঙতে যদি মানুষ চলে যায়। সে তার পোটলা পাশে রাখা বাক্সটা নিয়ে মোসলেমের জমায়েতের পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। আবার ফিরে আসে। গাছতলায় আর-একটা বাকসো দেখিয়ে সুকুমারকে বলে, এইডে থাকল, লাগবে নানে। লাগলি পরে নেবানে।

    মোসলেমের শেষ। সে চলে আসবে। লাঠিটায় ভর দিয়ে সে যতটা পারে ঘাড় উঁচু করে। তার একটু পিছনেই দাঁড়ানো ইব্রাহিম। ইব্রাহিম বুঝেছে মোসলেম তাকেই খুঁজছে। মোসলেম তাকে দেখে, তারপর অশত্থ গাছটার নীচে চলে আসে। ইব্রাহিম ডুগডুগি বাজাতে বাজাতে ঢুকে পড়ে।

    মোসলেম লাঠিতে ভর দিয়ে ল্যাংচাতে ল্যাংচাতে একটু মাথা নীচু করে আসে। ডানে বামে মাথা নাড়ায়। বোঝা গেল, জমেনি। সুকুমারকে দেখে অবাক, ছেলেটা এখানে দাঁড়িয়ে! জানতে চায়, তুমি যাওনি? সুকুমার উত্তর দেয়ার আগেই আরও বলে, অবস্থা ভালো না। ইব্রাহিমের কথাই ঠিক–আইজকে মানুষ আছে পাবলিক নেই।

    সুকুমার বলতে যাচ্ছিল কেন সে যায়নি। তার আগে অশত্থ গাছের পাশের রাস্তার এক দল ছেলের ভিতর থেকে একজন মোসলেমের উদ্দেশে একজন বলে, ও কা, একা নাকি?”

    মোসলেম ভ্যাবাচেকা খায়। তাকে এই কথা বলে কে খেপাচ্ছে। সে দেখতে পারেনি। কথাটা বলে ওই ভিড় থেকে তাকায়নি কেউ। এমন ভাব তাদের ভিতর থেকে কেউ কিছু বলেনি। মোসলেম তাকিয়ে থাকল। তারপর বিড়বিড় করল, জাউড়ো ছওয়াল পয়াল যতো!

    বারিকের কানা ঠিক খাড়া। সে বলে, উত্তর দিয়ে দেতা, না একা না, তোর মাও আছে সাথে।

    বলে, বারিক আর মোসলেম দুজনই হাসে। যদিও সে হাসিতে সুকুমার যোগ দিতে পারে না। সে বিষয়টা বোঝেইনি। শহুরে ছেলেদের কাণ্ড। কিন্তু ভিতরে নিশ্চয়ই কোনও একটা বিষয় আছে। সেই বিষয়টা সুকুমার বুঝল না। এমনকি তখনই, মোসলেম আবার জানতে চাইল, কী-ই গেলা না?

    সুকুমার বলল, না। দাঁড়ায়ে দাঁড়ায়ে এট্টু ইব্রাহিমের মজমা দেখি।

    এই জায়গায় দাঁড়াইয়ে? এ জায়গায় দাঁড়ায়ে কিছু শোনাও যাবে নানে, দেখাও যাবে নানে।

    কী যে রোদ্দুর!

    তালি এট্টু আগোয়ে দাঁড়াও। আর নয় আমার সাতে চা খাতি চলো।

    না, চা খাইচি এট্টু আগে। আমি আর ইব্রাহিম।

    আচ্ছা। তালি সামনে আগাইয়ে যাইয়ে দেহে। গাছের ছায়া তো ওই যে, পেরায় ইব্রাহিমের মজমা পর্যন্ত ছায়া চইলে গেইচে।

    মোসলেম চলে যায়। আজ আর সে হয়তো আসবে না। কেননা, যাইরে বারিকও বলল এই সঙ্গে। গরমে লোকটা ক্লান্ত হয়ে গেছে। বোচকা হাতে ল্যাংচে হাঁটতে তার বেশ কষ্ট হচ্ছে বোঝা যায়। সুকুমারের মনে হয়, মোসলেম কাকার সঙ্গে গেলে হত, রিকশায় ওঠার আগ পর্যন্ত টেনে দিতে পারত বোচকাটা। কিন্তু গেল না।

    এদিকে ইব্রাহিম ডুগডুগি বাজিয়ে কী সমস্ত বলেছে। মোসলেমের সঙ্গে কথা বলায়, আর গাছের প্রায় গোড়ায় থাকায় কিছু শুনতে পায়নি সুকুমার। কিন্তু একটু এগিয়ে এসে সব শুনতে পারছে। ইব্রাহিম বেশ ফাজিল আছে। একটা গান গাইল। সেই গানের সঙ্গে বেলবটম প্যান্টের কোমর দুলিয়ে বৃত্তের এমাথা ওমাথা নৃত্য করে দেখাল। এ ভুবনে যাকে আমি চেয়েছি, আঁখি বলে তার দেখা পেয়েছি এই পর্যন্ত গেয়ে এপাশ থেকে গেল ওপাশে। তারপর সে-পাশ থেকে, এবার সুকুমার আরও স্পষ্ট দেখতে পেল, কালো জুতো জোড়ায় মাটি ঠুকতে ঠুকতে, ও একই সঙ্গে কোমর দোলাতে দোলাতে গাইল বাকি অংশ, সে আমায় আজ কথা দিয়েছে, সে আমায় সে আমায় সে আমায়–

    দারুণ! সুকুমারের হাসি পায়। এখানে আসার পর থেকে সে একদিনও ইব্রাহিমের ক্যানভাস দেখেনি। সুযোগ হয়নি। শুনেছে যেমন কথা বলে, একই সঙ্গে ক্যানভাসও করে দারুণ। ইব্রাহিম শেখের আসর। সুকুমারের তো আর কথা দিয়ে মানুষ তেমন ভিড়াতে হয় না, সে দেখায় খেলা। কিন্তু ইব্রাহিমের কাজ কথা নিয়ে। শুনেছে কথায় চিড়ে ভেজে, ইব্রাহিমের কথায় তা ভিজতে বাধ্য।

    এরপর ইব্রাহিম বসে পড়ল। সুকুমার ইব্রাহিমকে দেখতে পায় না। আবার ইব্রাহিমের বসা জায়গার কাছে মানুষ একটু ফাঁকা হলে দেখতে পায়। সুকুমারের মনে হয়, কাছে গিয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু যে রোদ! তার ইচ্ছে করছে না। এই দোটানায় একটু বাদে সুকুমার ইব্রাহিম শেখের আসরের শ্রোতাদের একজন হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে। ইব্রাহিম দেখে তাকে। সুকুমার দাঁড়িয়েছে সূর্যের দিকে পিঠ দিয়ে। তাকে দেখে কথার ছরবার ভিতরে ইব্রাহিম একটু হাসল। তারপরই, আবার যেন আগের মানুষ।

    ডুগডুগি বাজাল। বলল, পকেট সাবধান। একথা শুনতে শুনতে নিজেকে নিয়ে ভাববেন। ভাববেন এই জীবনের কোনও দাম আপনার কাছে আছে কি না। এর ভিতরে পকেটটা রাখবেন সাবধানে। আমার কথা শোনতে শোনতে গাল এমন হা করে রাখলেন যেন, সেই গালে মাছি ঢুকে গলার ভিতরে গিয়ে পৌঁছলে আপনি টের পাবেন। সেই ফাঁকে পকেটমার আপনার পকেট থেকে নিয়ে যাবে টাকা। আপনি এক অর্থশূন্য মানুষ। বলেন আপনারা অর্থশূন্য মানুষের জীবনের কোনও দাম আছে?

    সমবেত জনতা ইব্রাহিমের মজমায় জুড়ে গেছে। তারা না বলল! সুকুমারের মনে হল, এদের মুখ দিয়ে মাছি ঢুকে গেলেও টের পাবে না। এমনকি কেউ কেউ ওই না এর সঙ্গে ইব্রাহিমের কথায় যে হেসেছিল, সেই হাসির মুখও আর যেন বন্ধ করল না!

    ইব্রাহিম আবার কথা ধরে। সেই অর্থশূন্যতা দিয়েই শুরু। এই জীবনে রাজাধিরাজ হোক, বাদশা-সম্রাট হোক, জজ ব্যারিস্টার উকিল মোক্তার পেশকার ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার সওদাগর মহাজন যেই হোন না কেন, যদি অর্থ না থাকে তাহলে সে পথের ভিখিরি। ওসব মানুষ তখন তার মতো এই ক্যানভাসও হতে পারবে না। আজ সে সব মানুষের সামনে এসেছে, এই তাদের সামনে এসেছে, এই জীবনে টাকা পয়সা সব হাতের ময়লা, জীবনটাকে যদি তার অর্থহীন করে না তুলতে চায়, তাহলে আসতে হবে এই এখানে, এই ইব্রাহিমের কাছে। সেটা কেন?

    ইব্রাহিম তাও জানায়। মানুষকে কথা দিয়ে মুগ্ধ করার অসাধারণ ক্ষমতা তার, সুকুমার শুনতে শুনতে বুঝতে পারে। ইব্রাহিম এখন জীবনকে কোন কাজে অর্থপূর্ণ করা যায়, সেই দিকে যাবে। কিন্তু সেদিকে গেল না। আবার হাসানোর জন্যে কথা সহসা অন্য দিকে নিল। তখন সুকুমার চারপাশে তাকাল। তার মানে এখন জমায়েত তেমন ভালো হয়নি। আসল কথায় যাওয়ার আগে তার আরও মানুষ দরকার।

    মানুষ আমরা, বাঁচার জন্যে খাই। খায় না এমন মানুষ আছে? রিগান খায়, রাজীব গান্ধি খায়, এরশাদ খায়, এই কোর্টের জজ সাহেব খায়, ডিসি সাহেব খায়, এসপি সাহেব খায়, এমপি মিনিস্টাররা খায়–আমি খাই আপনি খায়, মা-জননীরা খান! জন্মাইয়া খাই মায়ের দুধ। সবাই খাইয়া খাইয়া জীবনটা কাটায়। যে খায় না, সে বাঁচে না। সবাই জানেন। খাইলে পেটে খাবার জমে। খাবার হজম হয়। সেই খাবার আমাদের মল দরজা দিয়ে বের হয়ে যায়। আর যার ঠিকমতো বের হয় না, খারাপ খাবার খায় তার পেটে হয় গুড়ো কৃমি। ফিতা কৃমি। লতা কৃমি। গরুর পেটে হয় হাতখানেক বড়ো কৃমি। দেখেছেন, যদি না দেখেন তাহইলে পশু হাসপাতালে যাইয়া দেখপেন। দেখেন তো খালি গরুর ওই একটা জিনিস, ষাড়ের এত বড়ো এক জোড়া হোল! আর কী! ওই বড় বাড়া দেইখইে জীবন কাটাই আমরা।

    ইব্রাহিমের আসর জমে গেছে। চারদিকে নীরবতা। কোর্ট চত্বরে যত কোলাহলই থাক, এই হাত দশ-পনেরোর একটা গোল জায়গায় এখন সবার চোখ ইব্রাহিমের দিকে। সুকুমারেরও বিস্ময় বাড়ে।

    গরুর পেটে যেমন বড়ো কৃমি। আপনার পেটেও কৃমি। সেই কৃমি আপনাকে বসতে দেয় না, হাঁটতে দেয় না, শুইতে দেয় না, খাইতে দেয় না, নাইতে দেয় না। আর বলব? আরও বলার দরকার নেই। আর কী কী করতে দেয় না, আপনারা ভালো জানেন। এমন ভাবে আপনার পাছায় খোঁটায়, আপনি পাছায় খোঁচান আর ড্যান্স দেন। যেন আপনি মিঠুন চক্রবর্তী, আই অ্যাম এ ডিসকো ড্যান্সার, জিন্দেগি মেরা গানা। হাতে মাইক্রোফোন ধরার ভঙ্গি করে ইব্রাহিম মিঠুনের ভঙ্গিতে গানটা গেয়ে দেখাল। পুরো আসর জুড়ে হাসি। সুকুমার আরও বিস্মিত! আর, এবার যে আসল কথায় যাবে ইব্রাহিম, তা বোঝা গেল, বলল, ছোটো বাচ্চা ছেলে যারা আছে তারা চলে যাও। দুই একটিকে দাবড়ানি দিল। কারও কোমরের একটু উপরে যাদের মাথা দেখা যাচ্ছিল, তাদের চলে যেতে বলল। তারপর, যাদের গোঁফের রেখা এখনও ওঠেনি, উঠবে উঠবে তাদের কয়েকজনকে।

    এবার শুরু হল, ওই ডিসকো ড্যান্সারের জীবনেও নারী আছে। নারীর জীবনেও পুরুষ আছে। আপনি সম্রাট আকবর, আপনার নানা আলিবর্দি খান আর আপনি বড়োলাট কি জমিদার শিশির রায়চৌধুরী যাই হোন, আর হোন পথের ভিখিরি। যদি রাতের বেলা, আমার মা আপনার স্ত্রী–সেই মায়ের কাছে গিয়ে নিজেকে পুরুষ প্রমাণ করতে না-পারেন, তাহলে এই জীবনের কোনও দাম নেই। একেবারে পরাজিত মানুষ। আলেকজান্ডার মারা গেছিলেন মশার কামড়ে অথচ সারা দুনিয়ার অর্ধেক তার ততদিন জয় করা সারা। এই রকম এই জিনিস পুরুষ মানুষ আপনি আপনার সঙ্গে আছে। সেটা যদি আপনার ক্ষমতা থাকে তাহলে তরবারি, ক্ষমতা না-থাকলে কিছুই না, ফুস একেবারে বেলুন। কিছুদিন আগে পত্রিকায় খবর বের হয়েছে, জার্মানিতে এক মহিলা তার স্বামীর ওই জিনিস কেটে জানলা দিয়ে বাইরে ফেলে দিয়েছে। কোর্টে কেস গেলে সে বলেছে, ইওর অনার যে জিনিস কাজে লাগে না, এই যেমন আপনার হাতের ওই কলমটা কাজ না-করলে তো আপনি ফেলে দেবেন, তাই তার ওই জিনিস আমার কোনও কাজে লাগত না, তাই ফেলে দিয়েছি। আদালত সেই মহিলাকে বেকসুর খালাস দিয়েছে।

    সমবেত মানুষের চোখে এবার বিস্ময়। ইব্রাহিম তাদের এক ধন্দে ফেলে দিয়েছে। এখন ইব্রাহিম তাদের যা বলবে, তাই তারা বিশ্বাস করবে ও শুনবে। এতক্ষণে সে যা বলার বলে জায়গামতন চলে এসেছে, কিন্তু একটি কথাও ফাজলামি করে বলছে না। এসব যারা বিক্রি করে, তাদের বেশির ভাগই কথা বলে অনেটাই ফাজলামি করে। ইব্রাহিম শেখ আসলেই মানুষটা একটু আলাদা। সুকুমার এই রোদের ভিতরে ইব্রাহিমকে মুখের একপাশের ঘাম মুছতে দেখে। তারপর খুবই ঠান্ডা গলায় ইব্রাহিম আবার আসরে ফেরে।

    কেন হয় এই সব রোগ, আপনারা জানেন? মানুষ এসব রোগ নিয়ে জন্মায় না। বড়ো হওয়ার আগে এসব রোগ হওয়ার কোনও প্রশ্নই নেই। মানুষ বড়ো হয় আর অসৎ সঙ্গে কুসঙ্গে পড়ে বাধায় বিভিন্ন যৌন রোগ। কেউ কেউ আবার লজ্জা পায়। রোগ হলে ডাক্তার কবিরাজের কাছে যায় না। আরে ভাই, শরীর আপনার, রোগ আপনার হবেই আর তার সমাধানও আপনাকে করতে হবে। লজ্জা পেলে চলে না। সাধু সেজে কোনও লাভ নেই। বাউল হবেন সঙ্গে বাউলানি, ফকির হবেন। সঙ্গে ফকিরানি, বৈষ্ণব হবেন সঙ্গে বৈষ্ণবী। যাবেন কোথায়, শরীরকে তো লাগবেই।

    এই পর্যন্ত বলেই ইব্রাহিম একখানা বাউল গান গায় :

    কত লোক জঙ্গলেতে যায়
    স্বপ্নদোষ কি নেইকো তথায়?
    নিজের মনের বাঘ যারে খায়
    কে ঠেকায় তারে?

    একটু আগের ডিসকো ড্যান্সারের গায়কের গলায় এ গান, এই ভর দুপুরবেলা! বিস্ময়ে সুকুমারের যেমন শেষ নেই। শেষ নেই যেন শ্রোতাদেরও। অথচ লোকটা অনেকেই মঘা বলে ডাকে। সুকুমারও তাই ভাবত।

    কোথায় যাবেন, জঙ্গলে? সেখানেও আপনার সঙ্গে যাবে আপনার এই শরীর। ফলে, জঙ্গলে যাওয়ার দরকার নেই। যারা অতিরিক্ত হস্তমৈথুন, ঘন ঘন স্বপ্নদোষ, পতিতালয়ে গমন ও খারাপ মেয়েদের সঙ্গে অবৈধ মেলামেশার ফলে সিফিলিস, গনোরিয়া বাধিয়েছেন, বিয়ে করতে ভয় পাচ্ছেন, তারা আর ভয় পাবেন না। এমনকি যাদের ধ্বজভঙ্গ অর্থাৎ আগামোটা গোড়া চিকন, পুরুষাঙ্গ ছোট ও নিস্তেজ, স্ত্রী মিলনে অক্ষমতা, অল্পেই বীর্যপাত হয়, আমার মা আপনার স্ত্রীর কাছে যেতে ভয় পান, তাদের জন্যে এই ওষুধ। মাত্র এক বোতল খেয়ে দেখুন, এক বোতল। যদি কোনও কাজ না-হয় তাহলে এই কোর্ট চত্বরে আমি জুতোর মালা পরে ঘুরে বেড়াব।

    সুকুমার সরে যায়। ইব্রাহিম তার পাশের বাক্সটায় হাত দিয়েছে, তাই দেখে সুকুমারের মনে পড়ে, ইব্রাহিম বারিকের গাছতলায় আর-একটা বাক্স রেখে এসেছিল। সুকুমার সেখানে যায়। ইব্রাহিম এখন তার গুরুর নাম বলছে, এই ওষুধ কোথায় সপ্তাহের কোন কোন বারে বানানো হয় তা জানাচ্ছে।

    সুকুমার অশঙ্খতলায় গেলে বারিক বলে, কেমন শোনলা?

    জব্বর!

    ওইরাম, আমারে সেদিন এই জায়গায় দিলদার আসে সে কচ্ছিল, এই ছেমড়ার কোনও তুলনা হয় না।

    হয়।

    কিন্তু এর কিছুক্ষণের ভিতরে ইব্রাহিম চলে আসে। সুকুমার জানতে চায়, এত তাড়াতাড়ি!

    কই নেই, মানুষ আছে পাবলিক নেই।

    তাও তো মন্দ কলা না!

    কই আর কলাম। আগে এট্টু সাপে কাটলি কী করতি হয়, তাই দেহাতাম, যাতে গাছগাছড়ার গুণাগুণ মানুষ বুঝতি পারে। সে সব কিছুই তো দেহালাম না।

    তাও তুমি যা সুন্দর কও–ওই জঙ্গলে গাও গানডা!

    ওডা ফকিরি গান, একবার যশোর স্টেশনে শুনিলাম, কুষ্টিয়ার এক ফকির গাইল। এই জায়গায় লাগাইয়ে দেলাম।

    সেয়া তো দেখলাম—

    চলো, লঞ্চঘাটের দিক যাই।

    তুমি থাহো কোতায়?

    ওই দড়াটানা ঘাট–ওই জায়গায় এক ছাপড়ায়। আমার মালপত্তর তো ট্রেনে আসে। ওই দিক থাকলিই সুবিধা। তুমি?

    আপাতত লঞ্চঘাটে আলতাফের হোটেলে।

    সুকুমার ইব্রাহিমের সঙ্গে এগোয় অপার মুগ্ধতা নিয়ে। কোর্ট চত্বর ছাড়তে ছাড়তে সে ইব্রাহিমকে বলে, চলো এবার তোমারে আমি চা-পান খাওয়াব–

    ইব্রাহিমের আসরের পরে হঠাৎ ফাঁকা হয়ে যাওয়া কোর্ট চত্বর থেকে লঞ্চঘাটের দিকে তারা এগিয়ে গেল।

    বারিক ঘাড় ঘুরিয়ে তাই দেখে। তারপর আবার ঝিমায়।

    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleউইংস অব ফায়ার – এ পি জে আবদুল কালাম
    Next Article রবিজীবনী (১ম খণ্ড) – প্রশান্তকুমার পাল
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo
    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    আরব জাতির ইতিহাস – ফিলিপ কে. হিট্টি (অনুবাদ : প্রিন্সিপাল ইবরাহীম খাঁ)

    September 22, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    আরব জাতির ইতিহাস – ফিলিপ কে. হিট্টি (অনুবাদ : প্রিন্সিপাল ইবরাহীম খাঁ)

    September 22, 2025
    Our Picks

    আরব জাতির ইতিহাস – ফিলিপ কে. হিট্টি (অনুবাদ : প্রিন্সিপাল ইবরাহীম খাঁ)

    September 22, 2025

    নিউ মুন – স্টেফিন মেয়ার

    September 22, 2025

    ব্রাইডা – পাওলো কোয়েলহো

    September 22, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    Sign In or Register

    Welcome Back!

    Login below or Register Now.

    Lost password?

    Register Now!

    Already registered? Login.

    A password will be e-mailed to you.