Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    আরব জাতির ইতিহাস – ফিলিপ কে. হিট্টি (অনুবাদ : প্রিন্সিপাল ইবরাহীম খাঁ)

    September 22, 2025

    নিউ মুন – স্টেফিন মেয়ার

    September 22, 2025

    ব্রাইডা – পাওলো কোয়েলহো

    September 22, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • 🔖
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    Subscribe
    সাইন ইন
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    ডুগডুগির আসর – প্রশান্ত মৃধা

    প্রশান্ত মৃধা এক পাতা গল্প240 Mins Read0

    ০৮. আজগরের জন্যে সাগুদানা

    বাজার থেকে আজগরের জন্যে সাগুদানা এনে দেবার পরে সারাটা দুপুর সুকুমার ঘুমিয়ে কাটিয়ে দিল। ঝিলিক ভেবেছিল বুঝি রঙ্গ করে। এমন কথা সুকুমারের মুখেই মানায়। যে লোক, হঠাৎ যে কোনও জায়গায়, রেল স্টেশন কি পার্কের বেঞ্চিতে কোনও সময়ে ঘুমিয়ে পড়তে পারে, তার পক্ষে এমন রঙ্গ করা সত্যি সম্ভব। কিন্তু তাই বলে মোটামুটি আয়োজন করে ঘুম! সেই গেল আলতাফের হোটেলের দিকে তারপর আর দেখা নেই। ঝিলিক ভেবেছিল, একটু ঘুমাবে মানে হয় কোনও লঞ্চের ভিতরে কি পন্টুনের কোনও পাশের বেঞ্চিতে। আকাশে মেঘ আছে। বৃষ্টিও হয়েছে কয়েক পশলা। সকালের পরে আর দাবাড় চালায়নি। ফলে, ঢাকাই লঞ্চের ভিতরে কিংবা অন্য কোনও ছোটো লঞ্চের ভিতরে সুকুমার ঘুমিয়ে নিতে পারে। তাই বলে একেবারে আলতাফের হোটেলের দোতলায় গিয়ে এইরাম ঘুম!

    তা সত্যি। আলতাফের হোটেলে এই দুপুরের পর পর্যন্ত সুকুমার ঘুমিয়ে থাকতে পারে, তা ঝিলিক জনমেও ভাবেনি, জরিনারও মনে হয়নি সেকথা। ফলে ওদিকে কেউ আসেনি। আলতাফের হোটেলে সুকুমারকে কেউ খোঁজেনি। ঝিলিক লঞ্চের কাছে গিয়ে জিজ্ঞাসা করে এসেছে সেখানের দু-একজনকে। পন্টুনের চারপাশে দেখেছে। একবার কদম আলিকে জিজ্ঞাসা করেছে। কদম আলি বলেছে, সে গতকালের পর আর সুকুমারকে দেখেনি। যদিও ঝিলিককে বলা তার এই কথাটা মিথ্যা, কারণ কদম আলি সুকুমারকে চেনে না। জরিনাকে বলেছে ঠিক, যে পন্টুনে ওইরম চেহারার কেউকে সে দেখেনি, চেনেও না।

    তবে, সুকুমারকে পাওয়া না পাওয়ায় তারা দুজন উতলা হয়নি। সুকুমারকে তাদের প্রয়োজনও পড়েনি। ঝিলিক বসেছিল আজগরের ছাপড়ার সামনে, তখন জরিনা গিয়ে হাফেজের বউয়ের কাছে থেকে সাগু ফুটিয়ে নিয়ে এসেছে। তারপর দুজনে মিলে ধীরে ধীরে খাইয়েছে আজগরকে। তখন আজগর একটুক্ষণের জন্যে আধো জাগরণে। জরিনা বিড়বিড় করে বলছিল, মোসলেম ভাই কী ডাক্তার দেখাইয়ে নিয়ে আসল, আর ডাক্তার এমন এক ইনজেকশন দেল, লোকটা আর ঘুম দিয়ে ওঠে না।

    এই প্রায় বিড়বিড়ানি বলার জন্যে বলা হয়তো, জরিনা নিজেও জানে, এই যে মানুষটা ঘুমাল এই ঘুমেই তার কাহিল অবস্থা ছাড়বে। এ জন্যে কয়দিন যাবে না কর্মকার পট্টির পিছনে, সেখানে গিয়ে বোতলভরতি ওই ছাইপাশ গেলে। কোনওদিন ওখানে বসে না, পাইটের বোতল কোমরে গুঁজে নিয়ে আসে, তারপর পন্টুনে হেলান দিয়ে গলায় ঢালে। কোনও কোনওদিন ওইসমস্ত না খেলে তার ঘুম আসে না। সে রাতে ছটফট করে। কোনও রাতে খেয়ে কাঁদে। অস্ফুট সেই কান্নায় আজগর কত কতদিন আগে ফেলে আসা বাড়িঘরের কথা বলে। নাকি বলে বাপ ভাই বোনের কথা। জরিনা শোনার চেষ্টা করেছে, যদিও কোনওদিনও উদ্ধার করতে পারেনি কী বলে। কাকে বলে। কার জন্যে কাঁদে। নাকি একসময় খুলনায় কোর্টের সামনে খেলা দেখাত, সেখানে এই জরিনার মতো কারও সঙ্গে তার পরিচয় ছিল, তার জন্যে এখন নিশি রাইতে আজগরের প্রাণ কান্দে!

    জরিনা জানে না। কখনও জানার চেষ্টা করেনি। কোনও দিনও জানতে চায়নি, কেন বলা যাবে, তবে তাকে এই বিষয়ে আজগর কিছু বলেনি। জরিনা তো জানে, আজগর তারে মনে মনে হয়তো মানুষই মনে করে না। যদি মানুষ মনে করে, তাহলে ভাবে বাজারের মাইয়ে মানুষ। আবার এই বাজারের মাইয়ে মানুষটার সাথেই বছর কাটায়। তা কাটাও। কেউ এই নিয়ে কিছু বলতে আসছে না। আশেপাশের মানুষজন কেউই তো তাদের মানুষ বলেই গণ্য করে না, গণ্য করে না বলেই তাদের নিয়ে কোনও কথা নেই। কথা যা কয় ঘাটের কদম আলি। তবু জরিনার মনে হয়, তারা এই লঞ্চঘাটের কাছে আছে দুইজন আর পার্কে আছে বেঙ্গা-বেঙ্গি। এই চারজন মানুষরে নিয়ে বাকি মানুষের কোনও আপত্তি নেই। কোনও চাওয়া চাইয়ি নেই।

    সমাজের সে সব হিসেবের বাইরে, জরিনাও এই বানর-নাচানো আজগরকে নিয়ে সংসার গড়ে তুলতে ইচ্ছে হয়। কিন্তু আজগরকে বোঝায় কে। শুকনার সময়ে ইচ্ছে হয়, নদীর পাড়ে ওই পাশে একটু বেড়া দিয়ে চারটে ডাল ভাত ফুটানোর। কিন্তু একদিন দুইদিনও কি পেরেছে? চালের নীচে মাথা দেওয়ার স্বভাব নাই ওই আজগরের। মুনিগঞ্জে মেলা থেকে জরিনা কিনেছিল একটা মাটির হাঁড়ি আর একটা কড়াই আর তালগাছের ড্যাগায় বানানো চামচ। সে সব এখন কোথায়? নদীর পানিতে ভেসে ভেসে এতদিনে নিশ্চয়ই দক্ষিণ সমুদ্রে ভেসে গেছে। সেই সংসার পাতা হয়নি জরিনার। লালির কাছে সাগুদানা ফোঁটাতে গিয়ে তার মনে হয়েছে, এইটুকু ফোঁটানোর জন্যে এই নাগের বাজারে হাফেজের দোকান পর্যন্ত আসা লাগে, যদি থাকত তাদের দুটো হাঁড়ি কি একটা কড়াই আর আলগা চুলো তাহলে জরিনা নিজেই রান্না করে আজগরকে খাওয়াতে পারত। তারও তো ইচ্ছে করে। ভাত মাছ তরকারি না-হোক, এই এক বাটি সাগুদানা তো জ্বাল দিতে পারত!

    যা হয়নি, হয়নি। হবেও না কোনওদিন। জরিনা আর সে আশাও করে না। মানুষের চোখে রাস্তার মেয়ে মানুষ, তার এত খায়েস কেন সংসার করার। তা বলে মানুষের বাড়িঘর, ঘরদুয়ার সংসার দেখলে জরিনার গা জ্বলে না। বরং চায়, একটা মাথা গোঁজার ঠাঁই আর রান্নার হাঁড়িকুড়ি যেন জোটে এই জীবনে সব মেয়ের কপালে। এই ঝিলিক আর সুকুমারও যেন একদিন থিতু হয়। এইভাবে, ঘরের চালে মাথা না দিয়ে মানুষের জীবন চলে নাকি?

    একটু আগেই তো জ্বরের ঘোরে আজগরের মতন মানুষও সে কথা বলল। তখন আজগরের ঠোঁটের কাছে জরিনার ধরা বাটিটা ওই এক মুহূর্তে যেন প্রায় থমকে গিয়েছিল। আজগর বিড়বিড় করার ফাঁকে চোখ খুলে ঝিলিককে দেখে বলে, কী খবর বোইন। আমার এই দশায় তোমাগো যে কষ্ট হতিচে!

    ঝিলিক অস্ফুট বলে, হয়, কী যেন কততা করতিচি, কত যেন কষ্ট!

    আজগর সাগুর বাটিতে চুমুক দিতে দিতে বলে, ও জরি, ও কয় কী? তারপর ঝিলিককে, কেন আমি যেন বুঝি না?

    জরিনা বলে, কতা কইয়ে না, খাও।

    আজগর নীচু গলায় বলে, বুইনডারে কী কষ্ট দিতিচি। সেই সহলদে এই হানে—

    আজগরের মুখ মুছিয়ে দিয়ে জরিনা বলে, হয়। বইসেই আচে।

    আজগর অস্ফুট বলতে বলতে ঘাড় ঘোরায়। তার চোখ বুজে আসছে, সুকুমার কোতায়, তারে দেকলাম না। আইজে বৃষ্টি তো সব মাটি কইরে দেল!

    আজগর শুনছে কি শোনেনি, এর ভিতরে জরিনা বলে চলে, তোমার জন্যি এই সাগুদানা কিনে দিয়ে তারপর যে কোহানে গেল।

    আজগর ঘুমিয়ে পড়লে তাদের সুকুমারের কথা মনে হয়। তারপর আশেপাশে খোঁজে। কিন্তু একবারও তাদের মনে হয়নি, এমন অবেলায় আলতাফের হোটেলের দোতলায় উঠে লোকটা সটান ঘুমিয়ে থাকতে পারে। তারা বরং ভেবেছে কোর্ট চত্বরে আছে। ঝিলিককে বসিয়ে রেখে, জরিনা কোর্টের দিকে গেছে ডাকবাংলো ঘাট হয়ে। আলতাফের হোটেল তার পথে পড়েনি। কোর্ট চত্বরে গিয়ে জরিনা দেখে এসেছে ফাঁকা। বারিক বুড়ো নেই। বারিক বুড়ো নেই তো কোর্ট চত্বরে কোনও ক্যানভাসারই থাকার কথা নয়। ছিলও না কেউ। শুধু মহুরিদের ঘরের কাছে গলায় চামরার ব্যাগ ঝুলিয়ে দাঁড়িয়েছিল গোলাপ মিয়া। জরিনাকে দেখে হেসেছে। সে জানে আজগরের শরীরের কী অবস্থা। এই হাসিতে কোনও রঙ্গ ছিল না। জরিনা কাছে আসলে হয়তো জানতে চাইত আজগর কেমন আছে। আবার নাও জানতে চাইত পারত, ঘণ্টা দুয়েক আগে সুকুমারের কাছে শুনেছে। জরিনা বাঁ-দিকে একটু এগিয়ে টাইপিস্টদের চত্বরের দিকে যায়। ভিতরের সার সার বেঞ্চি কোনওটাতে সে বসে থাকতে পারে। লোকজন নেই প্রায়। অনেক টাইপিস্টের টাইপ রাইটার কভার দিয়ে ঢাকা দেওয়া। দুই একজন কাজ করছে। তাও নিশ্চয়ই খুব কষ্টে, ভিতরে আলো নেই। বাইরেও আলো কম। আকাশ মেঘে ঢাকা থাকলে এই টিন শেডের ভিতরে টাইপের মতন সূক্ষ্ম কাজ করতে টাইপিস্টদের কষ্ট হয়।

    এসব হয়তো জরিনা বোঝে না। কিন্তু আজকের বৃষ্টি বাদলে সবই যে খানিকটা এলোমেলো হয়ে গেছে তা বুঝতে পারছে। আর সুকুমারও যে এইখানে নেই, তাও তার দেখা হয়ে গেছে। এ সময়ে কোত্থেকে এসে হাজির দিলদার। শেডের বাইরে দিলদার এলে জরিনা দেখল তার বাত নিরাময় যন্ত্রটা এক কোনায় রাখা। এখন তা দিলদারের পায়ের কাছে। দিলদার হাসল। জরিনা অবশ্য এই হাসির উত্তর দিল না। তার দিলদারকে সব সময়ে একটু ফটকা মনে হয়। এখনই কোনও ফটকামি শুরু করবে। জরিনা যেন তার কোনও সুযোগ না দেয়ার জন্যে বলল, আইজকে এই বইষ্যাকাদার দিনেও ওই নাপিতের বাকসো লইয়ে আইচো।

    জরিনা এভাবে কথা বলে, তা জানা আছে দিলদারের। কিন্তু আজগর অসুস্থ, আর আবহাওয়ার এই দশা, তার ভিতরে হঠাৎ এভাবে তার প্রতি চড়াও হল কেন, দিলদার যেন ঠিক বুঝে উঠতে পারে না। একটুক্ষণ তাকিয়ে থাকে। তারপর আত্মরক্ষার ভিতর দিয়ে আক্রমণের জন্যে মিয়ানা গলায় বলে, তোমার এই একথা। এইডে দেকলিই নাপিতের বাকশো। কত মানষির কাজ হয়। বুড়ো তো হওনেই হলি বোঝদা, বাত কারে কয়।

    হয়। ওইয়ে দিয়ে বাত সারাতি যাবেনে মানুষ। মানষির আর খাইয়ে কাজ নেই।

    কেন, দেহো না, মানুষ আসে তো। ধরে আর আমি কত মানষির বাত ছাড়াইয়ে ভালো কইরে দেলাম।

    হইচে। জানি জানি। কার কার বালে আসে তোমার ধারে বাত ছাড়াতি, সেয়া আমার জানা আছে।

    ফাও কতা কইয়ে না। বাদুক বোঝবা!

    হয় হইছে।

    জরিনার ধান্দাটা কী? দিলদারের সঙ্গে এখন কথা জমিয়ে, তারপর তাকে নিয়ে কোনও চায়ের দোকানে যাবে? আজগর তাকে পেশানে পেশানে একবারে এক শেষ করে দিয়েছে। কিন্তু সে যে সুকুমারকে খুঁজতে এসেছে, সে কথা কি ভুলে গেছে। নাকি সুকুমারকে খুঁজতে আসার উছিলায় এমন একটা দিনে কোর্ট চত্বরটা কেমন তাই দেখে গেল। আবার এই মুহূর্তে দিলদারকে পেয়ে একটু যদিও রঙ্গ করে এক কাপ চা আর এক খিলি পান মুখে দেয়া যায়, তাই-বা মন্দ কী?

    হয় হইচে না। ঘুমোও তো ওই আজগরের সাতে, ঠিকমতো ডলা দেনা, ঠিকমতো ডলা দিতি পারলি তোমারে বাত বাদাইয়ে দিতি সময় লাগদ না!

    জরিনা ফিক করে হাসল। চাইল একবার দিলদারের চোখে। অন্য সময়েও দিলদার এমন সব কথা বলে। কিন্তু এখন দিলদারের কথায় জরিনার এই হাসিতে অনুমোদন ঠিক নয়, কিন্তু আবার একপ্রকার অনুমোদনও। আবার তাও হয়তো না, দিলদারের কথা বলার ভঙ্গিটা এই মুহূর্তে ভালো লেগেছে তার। কিন্তু মুখে তার কপট রাগত একটা ভঙ্গি এখন ঠিকই থাকে, হইচে। ঘুরোয় ঝাঁকাও ওই কাটাবাড়ার এক কল, সেইয়ের জোরে আমার বাত বাধাতি চাতিচো। তোমার ওই যন্তর দেখলিই বোঝা যায় তোমার মুরোদ কীরাম!”

    আমার মুরোদ আবার দেখলা কবে?

    দেখিনি, চেহারা দেকলিই বোঝা যায় কার কী মুরোদ।

    চেহারা দেকলি! আর ফাও কতা কইয়ে না। মুরোদ দেকতি চালি কইয়েনে, দেহাইয়ে দেবানে।

    জরিনা আবারও চাইল দিলদারের চোখে। সঙ্গে সঙ্গে সে চোখ থেকে চোখ সরিয়ে নিল। ওদিকে দিলদার তার কথা বলে চলছে, তারপর দেইয়েহানে আমার এই যন্তরের ধারে আইসে বাত কোমান লাগে নাকি?”

    জরিনা হাসে। সে বুঝেছে দিলদারের কথায় সে আটকে যাচ্ছে। এসব ক্যানভাসারের সঙ্গে কথায় পারা যায় না। এরা প্রত্যেকটাই কথায় এক একটা ঝুনো তাল। এমনভাবে পাকাবে যে সে কথা দিয়ে কোনও ভাবে বের হওয়া যাবে না। এই পর্যন্ত ভাবতেই জরিনার মনে হল, সুকুমারকে খুঁজতে এসে সে দিলদারের সঙ্গে এভাবে আলাপে জড়িয়ে পড়ছে? ওদিকে ঝিলিক বুঝি এখনও একা একা বসে আছে ঝুপড়ির সামনে। বেলা পশ্চিমে হেলে গেছে কখন। সূর্যের মুখ আজকে দেখা যাচ্ছে না বলে বোঝা যাচ্ছে না বেলা কত হয়েছে। খিদেও হয়তো এখনও সেভাবে লাগেনি, কিন্তু পেট সময়মতো যা জানান দেয়ার তা জানাবে।

    হইচে, তোমার আর কতা দিয়ে ভিজোনোর দরকার নেই। এই মেঘলা দিনে এমনিই ভিজে রইচি, মানষি বাচতিচে না নিজের জ্বালায়, এর মদ্যি উনি খালি কতা দিয়ে ভিজোইয়ে যাতিচে।

    তা চলো গলা ভিজোইয়ে দি। নদী ভরা পানি, সেইয়ে দিয়ে ভিজোবা না চা দিয়ে ভিজোবা?

    নদীর পানি দিয়ে ভিজোলি আর তোমার ধারে জিগোতি যাব নানে। যাইয়ে নদীতেই নাইমে যাবানে–

    তা চলো চা দিয়ে ভিজোইয়ে আনি।

    এবারও জরিনার আলতাফের দোকানের পথে নদীর পাড়ে আসা হল না। দিলদার টাইপিস্টদের শেডের একজনের জিম্মায় তার বাত নিবারণের যন্ত্রটা রেখে জরিনাকে নিয়ে চলল ডাকবাংলোর কাছে, বার কাউন্সিলের সামনে। সেখানে অবশ্য কিছুটা ভিড় আছে। উকিল মোক্তার মহুরিরা সেখানে থাকবে, তাই স্বাভাবিক। এত পথটুকু যেতে যেতে জরিনার মনে হল, অনেকক্ষণ হয়েছে। সুকুমারকে খুঁজতে এসেছে সে, চা খেয়েই তাকে চলে যেতে হবে।

    আলমের দোকানের সামনে রাস্তায় দাঁড়িয়ে দিলদার আর জরিনা চা খায়। এক ফাঁকে জরিনা দিলদারকে জিজ্ঞাসা করে, আইজ এমন দিন লোক নেই, জন নেই, আইজকে কেন আইছো?

    দিলদার জানায় এমনি। রোজই আসে। আইজকেও আসল। বিকেলে নদীর ওপর দিয়ে এক বেয়াই আসপে, তার সাথে এট্টা কাজ আছে। সন্ধ্যা বাদে বাড়ির দিক যাবে।

    জরিনার মনে হয়, মানুষ যে এই লোকরে গোয়েন্দা কয়, এ শালা আসলেই মনে হয় গোয়েন্দা। কাজ নেই কাম নেই তবু আসপে। মনে হয়, কোর্টের এলাকার সব খবরাখবর পুলিশরে দে। নিশ্চিত পুলিশের লোক। আবার ভাবে, হোক, তাদের কারও সাথে আইজ পর্যন্ত কোনও উলটো পালটা ব্যবহার করেনি। যা এট্ট রঙ্গ-রসিকতা করে। আর পকেটে পয়সা আছে।

    কী ভেবে জরিনা জানতে চায়, সন্ধ্যারও পর?

    হয়। এই জায়গায় থাকপো। সন্ধ্যার পর আসো না এদিক।

    যাব কোয়ানে, এই এলাকায়ই তো থাহি। আর যাব কোয়ানে? এরপরই সে বলে, পান। খাওয়াবা না?” তারপর দ্রুত রাস্তার উলটো পাশের পানের দোকান থেকে এক খিলি পান নিয়ে দিলদারকে বলে, দাম দিয়ে দিও, গেলাম। কাজ আছে।

    জরিনা দ্রুত হেঁটে ছাপড়ার সামনে এসে দেখে, ঝিলিক নেই। হয়তো এতক্ষণ ধরে জরিনার অপেক্ষায় বসে থেকে থেকে কোথাও চলে গেছে। সেই সকালের পর তার পেটে কিছু পড়েনি, সুকুমার এসে একবার খোঁজ নেয়নি, কতক্ষণ একজন জ্বরের মানুষের মাথার কাছে হাত পা-গুঁজে বসে থাকতে পারে। বৃষ্টির আর বাদলের জন্যে নদীতে জোয়ার ভাটা প্রায় নেই। নদীর বুকে অথই জল। অন্য দিন হলে একবার ভাটা হয়ে আবার জোয়ারে নদী ভরে যেত। জরিনা গেছিল তাওবা কম সময়। এতক্ষণ এখানে না-থাকলে ঝিলিককে সে দোষ দেয় কী করে?

    কিন্তু ঝিলিকও তো গিয়েছিল সুকুমারকে খুঁজতে। জরিনা এখান থেকে যাওয়ার পর যখন আর আসে না, তখন ঝিলিকের কেন যেন মনে হয়, কোথায় গেল লোকটা? একবার বলেছিল, যদি কোর্টের সামনের অবস্থা এমন হয়, তাহলে হয় রেল স্টেশনে যাওয়ার কথা ভাবতে পারে। তা যদি যায়, তাহলে তো তার মাল-সামান নেবে আলতাফের হোটেল থেকে। এইসব ভেবে ঝিলিক আলতাফের হোটেলেই যায়। আলতাফের আজ মন খারাপ। নদীতে লঞ্চ চলাচল কম। মোংলা পোর্টে নাকি সিগন্যাল দিয়েছে। তাই দক্ষিণ আর পুব থেকে শহরে লঞ্চ ভিড়েছে কম। কোর্টেও তো লোকজন তেমন নেই। লোক না থাকলে তার হোটেলে ভাত খেতে আসবে কে? শহরের মানুষ তো আলতাফের হোটেলে খেতে আসে না। ঝিলিক আলতাফের কাছে জানতে চেয়েছে, সুকুমারকে দেখেছে কি না? আলতাফ দেখেনি। আলতাফের অবশ্য এই কথা বলায় কোনও ভুল নেই। সুকুমার যখন এখন থেকে গিয়ে, পাশের কাঠের সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠেছিল, তখন আলতাফ দোকানের সামনে ছিল না। পিছনের রান্না ঘরের বাবুর্চিকে বলতে গিয়েছিল ভাত যেন কম চড়ায়। তরকারিও একটু কম কাটুক। মাছ-মাংস তো রান্না হলে জ্বাল দিয়ে রাখা যাবে। তারপর যা থাকবে তা মেশানো যাবে আগের দিনের ঝোলে। এ তো সব সময়ই করে। প্রতিদিনই রাতে কিছু তরকারি বাঁচে, তা আগের দিনেরটার সঙ্গে মিশায়। আর ভাজা মাছ হলে আবার ভেজে রাখে। তারপর নতুন আর পুরনো ভাজা মাছ এক করে। কয়জন খদ্দের তা বুঝতে পারে? খাওয়ানোর কত পদের কায়দা আছে। একবার ধরে বেঁধে আঁট করে বসাতে পারলে হল। তারপর এটা খান এই দাম। ঠিক আছে কম নেওয়া যাবে। ওটা খান, এই দাম, কম নেওয়া যাবে। একসঙ্গে দুইখানা খান, আরও কম। একটা বেলে আর একটা টেংরা খান। টেংরাটা ফ্রি। আসলে টেংরাটা দিন দুইয়েক আগের। কড়কড়ে ভাজা। বোঝার কোনও উপায় নেই, দুই দিনে কতবার এই টেংরা তেলের চুবনি খেয়েছে। আজকের বেলে মাছের সঙ্গে গছিয়ে দিতে পারলে হল। দেড় গুণ দাম তো পাওয়া গেল।

    সামনে একটু উঁচু টেবিল মতন জায়গায় সাজানো ভাজা মাছের সামনে দাঁড়িয়ে আলতাফ ঝিলিককে জানিয়েছে, সে সুকুমারকে দেখেনি। ওদিকে ভাজা মাছের ঘ্রাণ। সঙ্গে ঘন মশলা মাছ মিলে যে এক অদ্ভুদ বাহারি স্বাদ তৈরি হয়, ঝিলিক তা ভেবে নিতে পারল। কতদিন এই সব মাছ দিয়ে যেন ভরপেট ভাত খায় না। যদিও নাগের বাজারের মাঝি ঘাটায় মতির হোটেলে সে আর সুকুমার ছোটো গুলশা টেংরা দিয়ে ভাত খেয়েছে গত পরশু। কিন্তু এইরকম বড়ো বড়ো সাইজের বেলে মাছ। এগুলো বেলে না তুলার দান্ডি! আলতাফ কালকে বলছিল, চুডা বাইলা। ঝিলিক ভালো করে তাকায়, না এগুলো বেলে। তাদের দিকে এক সময় তুলার দান্ডি কেউ খেত না।

    ঝিলিক একটু সরে আসে। আলতাফ হয়তো বুঝে ফেলবে জরিনার পেটের ভিতরে এই মাছ মোচড় দিয়ে চলেছে। তখন আলতাফ কী ভেবে বলে, দেহো উপরে যাইয়ে, থাকতিও পারে। আমি মাঝে মদ্যি পিছনে যাই। এদিক ওদিক চা পান বিড়ি খাতি যাই, তহোন আইসে উপরে যাইয়ে ঘুমোইয়ে রইচে নিকি তোমার লোক, জানে কেডা?

    ঝিলিক চকিত চোখে আলতাফের দিকে তাকায়। কোনও বদ মতলবে এই দুপুরে তাকে উপরে যেতে বলল না তো? পুরুষ মানুষ বিশ্বাস করা যায় না। তাছাড়া, তাকে জরিনা এই লঞ্চঘাটের এক একজন সম্পর্কে যা বলার বলেছে। আলতাফের চোখ কেমন চলে, তা বলতে বলতে জরিনা ঝিলিকের গায়ে হেসে প্রায় গড়িয়ে পড়েছিল। সেই আলতাফ এখন সুকুমার উপরে আছে কি না তা না-জানার ভান করে, তা উপরে যেতে বলছে। যদিও কথাটা একেবারে নীচু গলায় আর সঙ্গে তার–জানাকে মিশিয়ে দিয়েই বলেছে, মনে হল ঝিলিকের। সে হোটেলের বড়ো দরজার কাছে এসে দাঁড়াল। এক থাক সিঁড়ি। তার নীচে জল জমেছে। ঝিলিকে পায়ের নীচে জল। রাবারের স্যান্ডেলটা ভিজে চুপচুপে। সামনে একখানা মোটা ছালার চট লেছে দেয়া। সেখানে উঠে দাঁড়িয়ে আবার জানতে চাইবে, না এখনই একটু এগিয়ে কাঠের সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে তাই ভাবল।

    না, থাকলি আপনি জানতেন! ঝিলিক তার সন্দেহ প্রকাশ করে।

    আলতাফ বিষয়টা বুঝতে পারল। কিন্তু আলতাফের হিসেব তো ভিন্ন, একটু ইয়ার্কি ফাজলামি যাই করুক, গ্রাহক খরিদ্দারের সঙ্গে কোনও প্রকার নগুছগু সে যেমন নিজে করে না, তার কোনও কর্মচারী কি আশেপাশের কোনও দোকানদার এই কাজ করুক তা সে চায় না। সে বলল, কেন, অসুবিধা কী? যাইয়ে দেইখে আসো। আমি জানি না, দেহিনি।

    তালি থাহে কী কইরে। এহোন তয় যাই, পরে নয় জরিনাদিরে নিয়ে আসপানে।

    কেন, রাইতে উপরে থাকতি পারো আর এহেন উপরে যাইয়ে দেইহে আসতি ভয়! পিছনে। শিউলির মা আছে। দরকার হলি তারে লইয়ে যাইয়ে দেইহে আসে।

    কেন যেন ঝিলিকের সন্দেহ কাটল একথায়। অথবা সে যেন না বুঝে সন্দেহ করেছে আলতাফকে। শুনেই ঝিলিক হাসল। অর্থ এই, না সে একাই যেতে পারব, অথবা, আসলে সে ভেবেছিল জরিনাকে নিয়ে আসাই তার জন্যে ভালো। ঝিলিক বলে, না, ভাবিলাম, সেই মানুষটা যদি ঘুমোইয়ে থাকে, তালি জরিনাদিরে নিয়েই আসা ভালো। না-পালি আপনার এই জায়গাদে দুইজনে চাইরডে ভালোমন্দো খাইয়ে খাতি পারতাম।

    তা লইয়ে আসো, খাইয়ে যাও। আইজে আমার এমনিতেই বাণিজ্য খারাপ। দেহো না, মানুষজন নেই। তবু তোমরা খাইয়ে গেলা। বেচলাম কয়ডা ভাত।

    হয়। এইয়ে আমরা খাতি পারি নিকি। এসব খাওয়ার যে দাম!

    আসো, কোমাইয়ে রাখপানে। আইজকে এহেবারে বিক্রি বাট্টা নেই।

    দেহি। তার আগে দেইহে আমি সেই মানুষটা আছে নিকি। বাপুরে বাপুরে, যদি ঘুমোইয়ে থাহে, তবু এইরাম ঘুমোতি পারে মানুষ?

    আইজে ঘুমোনোর দিন।

    হয়, যেন লাট সাহেব। ঘুমোইয়ে থাকলি পেটের ভাত জোটাবে কেডা?

    বলতে বলতে ঝিলিক ধীরে ধীরে সিঁড়ির দিকে এগোয়। আলতাফের চোখে চোখ রাখে। বুঝতে চায়, আলতাফ যে তাকে আর জরিনাকে খেতে বলল, আসলেই বলল তো। যদিও এখন তার সুকুমাররে পাওয়া দরকার। এখানে খাওয়ার ব্যাপারে জরিনা বা সুকুমারের সঙ্গে পরামর্শ না করে কিছুই করা যাবে না।

    দোতলায় উঠে দেখে, পুরোটাই ফাঁকা। সামনের ছোটো কাঠের বারান্দায় যাওয়ার দরজাটা দেওয়া। আর ওইপাশে যে খুপরি ঘরগুলো, প্রতিটারই দরজা খোলা। কোনার দিকেরটায়, প্যান্ট পরা অবস্থায় ঘুমিয়ে আছে সুকুমার। খাটের পাশে তার খেলা দেখানোর মালামাল রাখা। একটা বাক্সর মুখ ভোলা। বুকের ওপর এক পেটি তাস ছড়ানো। ঝিলিক এমন আধো অন্ধকারে ঘুমন্ত সুকুমারের মুখের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে কিছুক্ষণ। ঘুমন্ত সুকুমারের মুখোনা দেখতে বড়ো ভালো লাগছে। কী সরল মুখোনা মানুষটার। যেন এই জগতের কোনও কিছুর উপর তার কোনও রাগ নেই। বিরক্ত নেই। মুখোনায় আছে শুধু ক্লান্তি। একেবারে হাভাতে ঘরের ছেলে না, বাপ ভাইয়ের উপরে কোন রাগে পথে পথে এই জীবনটা কাটিয়ে দিল। তারপর, ঝিলিক নিজের কথাও ভাবে, সে এসে জুটেছে লোকটার জীবনে। তারপর, তারপর তারা জানে না, একদিন কোথায় ভেসে যাবে।

    ঝিলিকের কখনও কখনও মনে হয়, এখন, এই মুহূর্তে সুকুমারের মুখের দিকে তাকিয়ে তার আরও বেশি মনে হল, সুকুমারকে আবারও বলবে তারে বিয়ে করতে। আবার ভাবে, সে জানে না, আবার বিয়ে করা যায় কি না? যদিও একদিন এমন কথা সুকুমারের কাছে তুলতেই সে বলেছিল, শাখা খুলতি কইচে কেডা? ভক্তদা মরিচে নাকি? তাও তো সত্যি কথা, শাখা জোড়া না খুললেই হত। সুকুমার তাই বলেছিল, শাঁখা যদি নাই খোলতা তালি দরকার হলি মানুষজনরে কতি পারতাম আমার বউ। আর ওয়া হাতে থাকলি এমনিতে কেউ জিগোনিও আসত না।

    আহা, কী সোজা পরামর্শ! শাখা একজন মানুষ খোলে কেন? যা করিচে তোমার ভক্তদা, সেয়া কোনও মানুষ করে? একেবারে না-মানুষের জাত। ওই গুষ্টির রক্ত খারাপ! এরপর বিড়বিড় করে সুকুমারের মামাতো দাদা ভক্তর আর খানিক মুণ্ডুপাত করে। তবে, সে জন্যে ঝিলিকের কষ্ট না, কষ্ট তার ছেলে ভরতের জন্যে। এখন পথে ঘাটে যে কোনও জায়গায় ওই বয়সের কোনও ছেলে দেখলে ঝিলিক অপলক চোখে তাকিয়ে থাকে। তখন ঝিলিকের অজান্তে কখন যে চোখ ভিজে যায়। ঝিলিকের তখন একবারও ভক্তর কথা মনে পড়ে না। ছেলেটার মুখ চোখে ভাসে শুধু। সে তারপর সেই ভেজা চোখে অন্যত্র তাকায়। অন্যদিকে মনোযোগ দিয়ে নিজেকে স্মৃতি থেকে সরিয়ে নেয়।

    এখন ঘুমন্ত সুকুমারের দিকে এই আধো অন্ধকারে চেয়ে থাকতে থাকতে অজান্তে ঝিলিকের চোখ ভিজে গেল। কিন্তু এখন তার চোখে তেমন আলো নেই, অন্ধকারই, আলো যেন অস্কুট, ওপাশে একটি জানলা মতন থেকে সুকুমারের মুখে খানিকটা আলোর আভাস, সেই মুখোনার দিকে তাকিয়ে অজ্ঞাতে ঝিলিকের চোখ জ্বলে ভরে উঠছে। কিন্তু ঝিলিক জানে না, কেন এমন হচ্ছে। কেন হঠাৎ ভরেছে তার চোখ জলে। আজকের ভেজা আকাশের মতন তার চোখের দশা! ভেজা চোখের অস্তিত্ব বুঝতে একটুক্ষণ সময় লাগল তার। তারপর আঁচল টেনে চোখ মুছে এবারও অজ্ঞাতে সে ফিসফিসায়, এই যে, এই যে, সুকুমার বাবু, আমার সাধের দেওরা, ওঠেন।

    একথায় সুকুমারের কোনও প্রকার নড়চড় নেই। সে হয়তো শোনেনি, মুখোনা দেখে এমনিতে মনে হয়, গভীর ঘুমে অচেতন। আসলেই তাই। কিন্তু ঝিলিকের তো জানা আছে, সুকুমারের ঘুম কত পাতলা। এক ডাকেই সাড়া নেয়। পথেঘাটে থাকা মানুষ, ঘুম গাঢ় হবার জো আছে। কিন্তু এখন এভাবে ডাকার পরও উঠছে না কেন? নেশাটেশা করে ঘুমায়নি তো। কিন্তু ওসব অভ্যাস কখনও সুকুমারের দেখেনি। বিড়ি-সিগারেট খায়, তাও খুব পাতলা পাতলা। নাকি আজকের এই বৃষ্টি বাদলায় শরীর ছেড়ে দিয়ে ঘুমাচ্ছে লোকটা।

    ঝিলিক আবার ডাকে, ও সু, সুকুমার?

    সুকুমার চোখ খুলল না, কিন্তু আড়মোড়া ভাঙল। একটু নড়েচড়ে উলটো ফিরে শুল। বুকের ওপরে আলগোছে রাখা তাসগুলো গড়িয়ে পড়ল দুদিকে। কিছু নীচে, কিছু খাটের ওপর। আর বুকের ওপরে রাখা হাতখানা গড়িয়ে গেল। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে হাতখানা মুখের কাছে এনে সে মুখ ডলল। ঝিলিকের মনে হয়, এখনই জাগবে। সে সুকুমারের কাছে যায়। ঝুঁকে মুখের কাছে হাত নিয়ে সুকুমারের মুখে হাত বুঝিয়ে ডাকে, ওঠো আমার সাধের দেওরা–

    সুকুমার চোখ খোলে। সত্যি রাস্তাঘাটে ঘুমানো মানুষ, চোখ খোলামাত্রই যেন জাগরণে। আর, সেই জাগরণে ঝিলিককে কিছু বুঝতে না-দিরে সুকুমার তাকে টেনে বুকের সঙ্গে জাপটে ধরে। ঠোঁটে ঠোঁটে খুঁজতে চায়। কিন্তু ঝিলিক দাঁড়িয়ে থাকায়, তারপক্ষে ঘাড় তোলা যেন সহজ। সে বলে, এই দিনে দুপুরে! এই সময়! এই জায়গায়? তোমার আর আক্কেল হল না।

    কেন আগে যেন দিনে দুপুরে কোনও দিন কিছু করিনি। মনে আছে, আমারে রূপসার পড়ে দিনের বেলা ভজাইলে?

    কেডা ভজাইল তোমারে? আমি? আমার আর খাইয়ে কাজ নেই।

    তালি কি আমি ভজাইলাম?

    হইচে। এহোনও কতা কইয়ে না। ওঠো। খিদেয় জীবন যায়। কয়ডা সাগুদানা আইনে দিয়ে এইরাম কুম্ভকর্ণের মতো ঘুমোইয়ে রইছো?

    তা কী করব। কোর্টের সামনে গেইলাম, মানুষজন নেই, সুকুমার উঠতে উঠতে বলে, তালি ঘুমাইয়ে থাকপো না তো করব কী?

    সেই জন্যি এই বেলা পর্যন্ত!

    আজগর ভাইর কী অবস্থা?

    ঘুমোচ্ছে। আমরা দুইটে মানুষ কী খাইচি না খাইচি, কোথায় গেইচি না গেইচি, তোমারে জরিনাদিও খুঁজদি গেইচে। পারোও। মানুষের নাওয়া খাওয়া লাগে না!

    হইচে। উঠতিচি। তোমার গলা কোমল না মাইজে বউ।

    কথাটা খুবই কোমল গলায় বলল সুকুমার। ততক্ষণে উঠে দাঁড়িয়েছে। ওই কথা বলেই সে ঝিলিককে জড়িয়ে ধরে, গালে আলত চুমু দেয়। ঝিলিক তাতে অবাক হল না তেমন, এমন কাজ সুযোগ পেলে সুকুমার করে। কিন্তু এখন কেন? সে বলে, হইচে, চলো।

    তুমি যাও। আমি আসতিচি। সে পেচ্ছাপ করে আসবে সেই ইঙ্গিত করল।

    নীচে নেমে ঝিলিক হোটেলের দরজার দিকে যায়, সুকুমার পিছনে। আজগরের ঝুপড়ি পর্যন্ত যেতে হল না ঝিলিককে। তার আগেই নদীর কূলে জরিনার সঙ্গে দেখা। জরিনা ঝিলিককে দেখেই জানতে চায়, পাইচো তোমার নাগররে? আমি এই সারা বাড়ি খুঁইজে আসলাম, সে চান্দু কোনও জায়গায় নেই।

    পাইচি। ওই আলতাফ মিয়ার হোটেলের দোতলায় প্যান্ট পইরে সে ঘুমোইয়ে রইচে। এদিক তুমিও তো গেইচো কোম সমায় না, বাপুরে বাপুরে তোমরা সব পারোও এক-একজন। আমি এই জ্বরের মানুষটার মাথার ধারে বইসে রইচি তো রইচি। কেউ যদি আসে।

    জরিনার মনে হল, গেরস্ত ঘরের বউ ঝিলিক। তারমতো এমন এখানে ওখানে বেরিয়ে বেড়ানো পদের না। তাছাড়া, এখনও এই যেখানে রাত সেখানে কাত শিখতে পারেনি। থাকুক সুকুমারের সাথে কিছুদিন, সব এক সময় শিখে যাবে। তবু সে যেন ঝিলিককে বুঝ দিতে বলল, হয় এট্টু দেরি হইয়ে গেইচে আমার আসতি। কিছু মনে কইরে না। তা সে বাবু যে আসতিচে না?

    আসপেনে। এই আইসে গেল।

    সুকুমার এলে তারা কোথায় যাবে তাই নিয়ে আলোচনা করে। ঝিলিক জানায়, একটু আগে আলতাফ তাদের খাওয়ার প্রস্তাব দিয়েছে। একথা শুনে সুকুমার একটু বিস্ময়ে চোখ বড়ো করে ঝিলিকের দিকে তাকায়। ওদিকে জরিনা বলে, মাগনা খাওয়াবে? টাহা নেবে না? ঝিলিক এর উত্তরে বলে, দেবেহানে মাগনা।

    জরিনা বলে, ওই শগুন খাওয়াবেনে মাগনা?

    এসব কথায় কোনও সমাধান হয় না। যদি বৃষ্টি এখন নেই। চাইলে তারা হেঁটে নাগের বাজারে হাফেজের হোটেলে যেতে পারে। তবে, ঝিলিকের মনে হয়, এত খিদেয় এতটা পথ যাওয়া যাবে লাগবে না। তাছাড়া, আলতাফ তো বলেছে, দাম কম নেবে। সে কথা তাদের বলে সে। ঝিলিকের এ কথায় সুকুমার এট্টু অবাক হয়। কয়দিন আগেও যে ঝিলিক হিন্দু হোটেল ছাড়া খেতে চাইত না, সে এখন যাবে আলতাফের হোটেলে!

    তারা আলতাফের হোটেলে খেতে যায়। খেতে খেতে জরিনা বলে, সুকুমার ভাই, এইভাবে সারা দিন পেরায় ঘুমাইয়া কাটাইলা?

    এর উত্তরে অবশ্য সুকুমার বলেছে, এই বাদলায় কার কী করার আছে? এর ভিতরে সুকুমার জানতে চেয়েছে আজগর অবস্থা এখন কেমন। একটু আগে আজগরকে দেখে সুকুমারের মনে। হয়েছে, এই দুইদিনে লোকটা শুকিয়ে প্রায় অর্ধেক হয়ে গেছে। কয়দিনে সেরে উঠবে পারবে একমাত্র ভগবান জানে। এইভাবে হাফেজের আর আলতাফের হোটেলে বাকি খাওয়া!

    কিন্তু জরিনা কেন কথাটা বলেছে, তা সুকুমার কিছুটা হলেও বুঝতে পারলেও কারই-বা কী করার আছে। তবু এ ফাঁকে সুকুমার ভেবেছে, যদি আকাশ এমনই ধরা থাকে, তাহলে বল আর তাস নিয়ে চলে যাবে রেল স্টেশনে। ওখানে হয়তো খেলা দেখাতে পারবে। যদি পারে তাহলে, আলতাফের ধারের কিছুটা হলেও শোধ হবে। কিন্তু এই ভাবনার কিছুই সে ঝিলিককে বলল না, জরিনার কথারও কোনও উত্তর দিল না। বরং, ঝিলিকের কাছে জানতে চাইল, ঝিলিক আবার মোড়েলগঞ্জ যাবে কি না?

    এ সবই এখন, আজকের এই দিনে কিছুটা হলেও অপ্রয়োজনীয় কথা। কারণ, আবহাওয়ার ভাবগতিক ভালো না হলে কোনওতায় কিছু আসবে যাবে না। আবার, যদি আজগরের শরীর ভালো না-হয়, তাহলে জরিনাকেও তাদের টেনে যেতে হবে।

    খাওয়া প্রায় শেষ হতে সুকুমার জানতে চায়, আচ্ছা, বান্দর দুটোরে কিচু খাতি দেয়া হইছে?

    জরিনা জানাল, সে সেই কলা কিনে দেয়ার পরে একবার বিস্কুট খাইয়েছে। আর লালির কাছ থেকে এসেছিল দুইখানা বাসি রুটি। সেইসব খেয়ে ছাউনির তলে এখনও ঝিমাচ্ছে। ওই দুটোও অবাক আজ অনেকদিন বাদে তাদের কেন কোর্ট চত্বরে নেওয়া হল না, আর ওই ট্রেজারির পাশে কুল গাছটার নীচে কেন আজ তাদের বেঁধে রাখা হল না।

    এরপর বিকেলের অনেকখানিক কেটে গেলে, জরিনা আর ঝিলিক বসে থাকে আজগরের মাথার কাছে। এর আগে, আলতাফের হোটেল থেকে ফুটিয়ে আনা সাগুদানা আর ভাতের মাড় খাওয়ায় আজগরকে। আজগর আবার ঘুমিয়ে যায়। তারা দুজন নিজেদের সুখ-দুখের কথা কয়। তারপর কী মনে করে চলে যায় লঞ্চের ঘাটের পন্টুনে। কদম আলি নেই। কিন্তু একটু আগেই জরিনা তাকে দেখেছিল নদীর কূলে কিছু শ্যাওড়া গাছ আর কলা গাছের নীচে কেঁচো খুঁজতে। মানুষটা গেল কোথায়। এখন তার বড়শিতে মাছ ধরার সময়। জরিনা জানে, কদম আলির বড়শি কোথায় থাকে। বড়শি খুঁজতে গিয়ে তারপাশে একটা আঁচায় কেঁচেও পেল। তারপর জরিনা আর ঝিলিক পন্টুনে বসে মাছ ধরতে শুরু করে।

    এ সময়ে আলতাফের হোটেলের উপরে উঠে সুকুমার আর একটু গড়াগড়ি দেয়। পেটের ভাত একটু তলানিতে গেলেই সে চলে যাবে রেল স্টেশন। ফুটবলের খেলা যদি নাও দেখানো যায়, চাউনির নীচে তাসের খেলা দেখাতে পারবে। আর লেকের পাড়ের কংক্রিটের চত্বরে খেলা দেখানোর সুযোগ হলে, বলটা পায়ে নিয়ে কয়েকটা কায়দা দেখাবে! তার আগে দিয়াশলাইটা পকেট থেকে বের করে কাঠি জ্বালিয়ে জিহ্বায় লাগিয়ে বারবার জ্বালিয়ে দেখানো। হাতের তালুতে রাখা ওই দিয়াশলাই বাক্স মুহূর্তে নিয়ে যাবে হাতের উলটো পিঠে। এইসব করে যদি মানুষ জমে তাহলে ফুটবলের খেলা দেখাতে পারবে। তখন পাবলিক পকেটের পয়সা নিশ্চিত ছুড়বে। আর যদি বৃষ্টির জন্যে তা না-পারে, তাহলে ভাগ্য খারাপ।

    কদম আলিকে ডিসি অফিস থেকে ডেকে পাঠানো হয়েছে। তাই সে পন্টুনে নেই। লঞ্চের একজনের কাছে থেকে জরিনা এ সংবাদ জানতে পেরে অতি উৎসাহের সঙ্গে মাছ ধরে। জরিনার চেয়ে দ্রুত মাছ তুলতে পারে ঝিলিক। যদিও আজ নদীতে অথই পানি। এত ভরা থাকলে মাছরা সাধারণত কম ধরা পড়ে। এখন পানি কিছু নামছে, হয়তো আরও খানিকক্ষণ বাদে মাছ ধরা পড়তে পারে। তবে, এসবই তাদের শুধু সময় কাটানো। মাছ যাই পাক, সবই তো নেবে ওই কদম আলি।

    মেঘ থাকায় আজ বিকেল দ্রুত মরে আসে। জরিনা ওপারে চরগার দিকে তাকিয়ে দেখেছে। একটু আগেও যতটা আলো ছিল এখন তা নেই। অন্ধকার ঝুপ করেই নামবে। সে হঠাৎ ঝিলিককে বলে, তুই বাও বড়শি, আমি এট্টু বান্দর আলারে দেইহে আসি।

    ঝিলিক জানতে চায়, যার বড়শি, সে যদি কিছু কয়?”

    কবে কী? সে আইসে এইডে বাবে। জরিনা হাতের বড়শি গুটিয়ে রাখতে রাখতে বলে, মাছ কয়ডা ঠিকমতো পালি ওই কদম আলি কেউরে কিছু কয় না।

    তাড়াতাড়ি আইসো। আচ্ছা, এই বড়শি কার, ওই ঘাটে যে থাহে সেই?”

    হয়। সেই। মুহের এই জায়গায় কয়গাছ দাড়ি–সেই বেটা এই জায়গায় থাহে।

    আচ্ছা।

    জরিনা পন্টুন ছেড়ে যেতে যেতে বলে, আমি দেহি মোসলেম ভাইরে পাই নিকি। পালি কবানে এট্টু সাগুদানা আর মুড়ি কিনে দিয়ে যাতি–

    তালি তুমি আর তাড়াতাড়ি আইচো।

    আসপানে। অন্ধকার হলি তুমি নয়, বান্দরআলার ঘরের সামনে যাইয়ে বইসো।

    অন্ধকার হতি যেন বাকি আছে। লঞ্চের মদ্যি বাতি জ্বালাইয়ে দিচে।

    বাইরে এহোন আলো আচে।

    পন্টুন থেকে উঠে জরিনা নদীর কূলে আসে। সোজা রাস্তায় মুখ দিয়ে দাঁড়ায়। এখন নদীর কূল ধরে বাঁয়ে গেলে আজগরের ঝুপড়ি ডানে গেলে ডাক বাংলো ঘাট। এখন সে সামনে রাস্তা ধরে মেইন রোডে যাবে না। যাবে ডাক বাংলো ঘাটের দিকে। সেখান থেকে ডাক বাংলো ঘাট হয়ে আলমের চায়ের দোকান। সেখানে কিছুক্ষণ দাঁড়াবে। যদি মোসলেম উদ্দিনের সঙ্গে দেখা হয় তো ভালো। তাকে আজগরের কথা বলবে। তাদের হাতে টাকা পয়সা নেই, তা জানাবে। সুকুমার আলতাফের কাছ থেকে ধার করেছে। আলতাফের হোটেলে দুপুরের পরে তারা বাকিতে খেয়েছে। এইসব। এক কাপ চাও খাবে, যদি মোসলেম উদ্দিন খাওয়ায়।

    কিন্তু জরিনা আলমের চায়ের দোকানে মোসলেম উদ্দিনকে পায় না। পাওয়ার কথাও নয়। এসময় মোসলেম উদ্দিনের কোনওভাবেই এখানে থাকার কথা নয়। আজ কোর্ট বসেনি বলতে গেলে। যদি কোর্টের কাজ হয়েও থাকে, তখন মানুষ প্রায় ছিলই না। ফলে মোসলেম উদ্দিনের কোর্ট চত্বরে থাকার কোনও কারণ ছিল না। তারপর আর ওই মানুষ এখানে থাকে। আজগরকে হাসপাতাল থেকে এখানে পাঠিয়ে তারপর কিছুক্ষণ এখানে থেকে কখন চলে গেছে মুনিগঞ্জে।

    তবু আলমের দোকানে দাঁড়িয়ে জরিনা চা খায়। জরিনা জানে এখন পয়সা না-দিলে আলম কিছু বলবে না। লিখে রাখবে দোকানের দেয়ালের তক্তার এক কোনায়। অথবা, মনে রাখবে। পরে এলে দাম চাবে। আলম মানুষটা ভালো আছে। শুধু গলার স্বরে কোনও রস নেই।

    চা খাওয়ার সময় জরিনা ডানে বামে তাকায়। যদি পরিচিত কারও সঙ্গে দেখা হয়। কিন্তু এখন উকিল বারের সামনে তার পরিচিত কারও থাকার কথা নয়। তবু, কখনও তো ভাগ্যে মেলে। অথবা, দুপুরের পর দিলদার বলেছিল, এসময় থাকতে পারে। যদি দিলদার থাকত। জরিনা মনে মনে দিলদারকে খুঁজছিল। দুপুরের পর পর তার মনে হয়েছিল, দিলদারের সঙ্গে তার দেখা হবে।

    তবে, দিলদার এই এলাকায় থাকতে পারে, একথা বললেও এখন আলমের দোকানের সামনে এসে এভাবে উদয় হবে, একথা কিন্তু তার ভাবনার বাইরেই ছিল। জরিনা চায়ের গ্লাস নামিয়ে বলে, ও আল্লা, এ আমি কারে দেকতিচি। তুমি কোহানদে?

    কেন, সেই সময় কলাম না, এই জায়গায় থাকার কতা তো কইলাম, সন্ধ্যা পর্যন্ত আইজকে থাকপো। ওপারদে একজন আসপে, তার সাথে কাজ সাইরে তারপর যাব।

    আইচে তোমার সে ওপারের লোক?

    হয়। এই গেল।

    ও। চা খাইছো?

    খাইচি সেই লোকের সাতে দুইবার। এহোন আর খাব না।

    তালি রাস্তার ওপার চলো। পান খাওয়াও আমারে। আর এই চায়ের দামড়া দাও

    হয়। খাইয়ে কাজ নেই আমার। ওনার চায়ের দাও। ওপার যাইয়ে পান খাওয়াও। কত তা করো।

    দেও। দেহো না, এহোন তোমারে দেইহে চেইনি, কইনি তোমার ওই নাপিতের বাকসোডা কই?

    সেয়া কলি আরও দেতাম না।

    একথা বলার আগে দিলদার তো জরিনার চোখ দেখেছে। সেখানে বলার ধরনে ইয়ার্কি যেমন আছে, আছে একপ্রকার অনুমোদন, যেন এই মুহূর্তে এসব কথা বলার জন্যেই সে দিলদারকে খুঁজছিল, যেন দিলদার চাইলে তাকে আরও দুটো কথা শোনাতে পারে। রাস্তার ওপার পানের দোকানের সামনে যেতে যেতে সে, দিলদারের কথার উত্তর দিতে বাম হাতখানা দিয়ে দিলদারকে ছুঁতে চায়, হইছে, আমার পানের দাম না দিয়ে তুমি যাতা কোন দুয়ারে?

    দিলদার চকিতে তাকাল। হঠাৎ জরিনার গলায় এত রঙ্গ। সে বলে, সেই তো কতা, কোন দুয়োরে যাই, তুমি কি আমার যন্তর ধরা বাতের রুগি?

    এবার তাকায় জরিনা। হয়তো দিলদার কথায় এসেছে, সে বুঝতে পারল। উকিল বারের সামনে আর কোর্ট বিল্ডিংয়ের পিছনে ফাঁকা ছোটো এক চিলতে মাঠ হয়ে পথ চলে গেছে সোজা ক্লাব আর পার্কের দিকে, সেখানে ঢুকে পড়ে। জরিনা তখন পানটা মুখে দিয়েছে, হয় খাইয়ে কাজ নেই? ওই যন্তর ধরতি যাবানে?

    কেন, কইলে না, অন্য যন্তর ধইরে তুমি ভালো ঝাঁকাতি পারো?

    হুঁ। পারি তো।

    যদিও এখন পরস্পরের দিকে তাকালেও চোখ দেখা যাচ্ছে না। এ জায়গা আধো অন্ধকার। আজ অন্ধকার খুব মিশমিশে। মেঘলা দিন বলেই অন্ধকারটা গাঢ়ও। একটু পরে যখন পুরোপুরি রাত আসবে, তখন তা আরও গাঢ় হবে। পথে লোকজন সকাল থেকেই কম, এখন আরও কম, তাতে বরং রাত্রির গভীরতা এখনই পথে। মনে হচ্ছে রাত্রির এক প্রহর পার হয়ে গেছে।

    জরিনা পার্কের দিকে হাঁটে। সঙ্গে হাঁটে দিলদার। দিলদার কিছুটা হলেও বুঝতে পারছে, আবার বুঝতে পারছে না, জরিনা তাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে। তবু, সেদিকে যেতে যেতে জরিনা বলে, চলো পার্কের দিক। দেইহে আসি বেঙ্গা-বেঙ্গি কী করে?

    এহেন পার্কে?

    চলো বাতাস খাই। পুকুর পাড়ে যে বাতাস।

    আইজ যে বাতাস চালাল, তাও বাতাস খাইয়ে হই নেই?

    গেলি চলো–

    এই যেন দিলদার বুঝতে পারল, জরিনা তাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে। এখন এই সন্ধ্যার পর পর পার্কে কী? পার্কের সামনে এসে, দিলদার স্বাধীনতা উদ্যান সাইনবোর্ডখানা পড়ে। তারপর মাঝখানের গেট দিয়ে ঢোকে। জরিনা আগেই ঢুকেছে। বামে রেডক্রিসেন্ট বিল্ডিং ফেলে একটু সামনে, যুবকেন্দ্রের কোনায় বেঙ্গি তার আলগা চুলায় রান্না চড়ায় প্রতিদিন। এখনও আয়োজন শেষ করেনি। হয়তো বৃষ্টি আসতে পারে এই ভয়ে দেরি করছে। বৃষ্টি যদি আসেই, তাহলে কোনও উঁচু বেঞ্চির নীচে রান্না চড়াবে অথবা রেড ক্রিসেন্টের বারান্দার এই কোনায়। যুবকেন্দ্রে আলো নেই। তার মানে, এখনও ইলেকট্রিসিটি আসেনি। ভিতরে মোমের আলো।

    এই পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে জরিনা কিছুক্ষণ সময় লাগে। সে বুঝে গেছে, কারেন্ট নেই, তাই যুবকেন্দ্রে প্রায় কেউ নেই। পুকুরের ঘাটে বেজি আছে, বাতি ধরাবে একটা বেঞ্চির নীচে। জরিনা বেঙ্গি কী করছে দেখতে যায়। বেঙ্গি চোখ তুলে জরিনার অবয়ব দেখে। একটু পিছনে দিলদার। জরিনা ও দিলদারকে দেখে বেঙ্গি কাজে মন দেয়। যে জানে এখন তাকে কী করতে হবে। জরিনা দিলদারকে গায়ে টোকা দেয়। তারপর রেডক্রিসেন্ট বিল্ডিংয়ের দিকে হাঁটে। দিলদার হাঁটে জরিনার পিছনে। বেঙ্গি হাতের কাজ রেখে গেটের দিকে যায়।

    রেডক্রিসেন্ট বিল্ডিংয়ের পিছনের কোনায়, সিঁড়ির কাছে পৌঁছে জরিনা উলটো ফিরে দিলদারকে বলে, দেহি তোমার যন্তরটা কীরাম? আমার বাত নামে কি না?

    দিলদার যেন এজন্যে প্রস্তুত হয়েই ছিল।

    দেহো- বলে সে জরিনাকে কাছে টানে।

    জরিনা বলে, কত দেবা?

    কত দিতি হবে?

    কও কত দেবা?

    তুমি কও—

    কুড়ি টাহা। কত লোন দোকানে হোটেলে।

    না। দশ– ততক্ষণে দিলদার বসে পড়েছে রেডক্রিসেন্টের সিঁড়িতে। পাহারাদার বেঙ্গি গেট থেকে মাঠের মাঝখানে এসে, অন্ধকারে দুটো শরীর মিশে থাকা ছাড়া আর কিছুই বুঝতে পারছে না।

    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleউইংস অব ফায়ার – এ পি জে আবদুল কালাম
    Next Article রবিজীবনী (১ম খণ্ড) – প্রশান্তকুমার পাল
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo
    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    আরব জাতির ইতিহাস – ফিলিপ কে. হিট্টি (অনুবাদ : প্রিন্সিপাল ইবরাহীম খাঁ)

    September 22, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    আরব জাতির ইতিহাস – ফিলিপ কে. হিট্টি (অনুবাদ : প্রিন্সিপাল ইবরাহীম খাঁ)

    September 22, 2025
    Our Picks

    আরব জাতির ইতিহাস – ফিলিপ কে. হিট্টি (অনুবাদ : প্রিন্সিপাল ইবরাহীম খাঁ)

    September 22, 2025

    নিউ মুন – স্টেফিন মেয়ার

    September 22, 2025

    ব্রাইডা – পাওলো কোয়েলহো

    September 22, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    Sign In or Register

    Welcome Back!

    Login below or Register Now.

    Lost password?

    Register Now!

    Already registered? Login.

    A password will be e-mailed to you.