Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    আসমানীরা তিন বোন – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025

    ইস্টিশন – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025

    উড়ালপঙ্খী – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • English Books
      • Jules Verne
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    তিথির নীল তোয়ালে – হুমায়ূন আহমেদ

    হুমায়ূন আহমেদ এক পাতা গল্প133 Mins Read0
    ⤶ ⤷

    ০২. জাফর সাহেবের ঘরে এয়ারকুলার

    জাফর সাহেবের ঘরে এয়ারকুলার সারাবার মিস্ত্রী এসেছে। গোটা ভাদ্রমাস এয়ারকুলার বন্ধ ছিল। দেন-দরবার করেও মিস্ত্রী পাওয়া যায় নি। এখন শীত পড়ে গেছে। বিকেলে অফিস থেকে বাড়ি ফেরার পথে রীতিমত ঠাণ্ডা লাগে, আর এখন কি না এসেছে এয়ারকুলার ঠিক করতে। তাঁর ইচ্ছা করছে মিস্ত্রী দুজনকেই ঘাড় ধরে বাথরুমে ঢুকিয়ে দিয়ে বাইরে থেকে তালাবন্ধ করে রাখতে। বাথরুমের শাওয়ারটা খুলে দিতে পারলে ভাল হত। সারাক্ষণ শাওয়ারের পানিতে ভিজুক। সব ইচ্ছা পূর্ণ হবার নয়। অপরিচিত কারোর সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করা তাঁর ধাতে নেই। খারাপ ব্যবহার শুধু মাত্র প্রিয় এবং পরিচিতজনদের সঙ্গেই করা যায়। তিনি মিস্ত্রী দুজনের দিকে তাকিয়ে বিরক্ত গলায় বললেন, চা খাবেন?

    দুজন একসঙ্গে বলল, খামু স্যার।

    এদের আসার পর থেকেই জাফর সাহেব দেখছেন, এদের মতের মিল হচ্ছে না। একজন এক রকম করতে বলছে তো অন্যজন আরেক রকম বলছে। চা খাবার প্রশ্নে দুজনকেই তাৎক্ষণিকভাবে একমত হতে দেখা গেল। জাফর সাহেব চায়ের কথা বললেন। তিনি কাজে মন বসাতে পারছেন না। প্রায় দুশ পৃষ্ঠার এক গাবদা, ফাইল তার সামনে পড়ে আছে। আজ দিনের মধ্যে ফাইল পড়ে নোট দিতে হবে। পড়ায় মন বসছে না। মিস্ত্রী দুজন বিরক্ত করছে। অন্য কোথাও বসে যে কাজ করবেন সেই উপায় নেই। তিনি নিজের ঘর ছাড়া বসতে পারেন না। দম আটকে মাসে।

    জাফর সাহেব ভুরু কুঁচকে বললেন, আপনাদের কাজ শেষ করতে কতক্ষণ লাগাবে।

    ধরেন খুব বেশি হইলে আধা ঘণ্টা।

    জাফর সাহেব স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন, আধঘণ্টা অপেক্ষা করা যেতে পারে। এই ফাঁকে শায়লার সঙ্গে কি কথা বলে নেবেন? বিনীত ভঙ্গিতে বলবেন, সব অপরাধ আমার। বাসায় ফিরে আস। দুটি মাত্র বাক, বলা কঠিন হবার কথা না। সব অপরাধ আমার–এই বাক্যটা বলাটাই সমস্যা। তিনি জানেন, সব অপরাধ তাঁর না। এটা বলা মানে মিথ্যা কথা বলা।

    মিথ্যা বলা মানে আত্মার ক্ষয়। জন্মের সময় মানুষ বিশাল এক আত্ম নিয়ে পৃথিবীতে আসে। মিথ্যা বলতে যখন শুরু করে তখন আত্মা ক্ষয় হতে থাকে। বৃদ্ধ বয়সে দেখা যায়, আত্মার পুরোটাই ক্ষয় হয়ে গেছে। জাফর সাহেব সতেরো বছর বয়সের পর থেকে আত্মর ক্ষয়রোধ করার চেষ্টা চালাচ্ছেন। মানুষের সব চেষ্টা সফল হয় না। এটিও হচ্ছে না। পদে পদে বাধাগ্রস্ত হচ্ছেন। শায়লার সঙ্গে প্রায়ই মিথ্যা বলতে হচ্ছে। এই যে তিনি বলবেন, সব অপরাধ আমার এতে আত্মার অনেকটা ক্ষয় হবে।

    জাফর সাহেব টেলিফোনের ডায়াল ঘুরালেন। তার মেজো মেয়ে ইরা ধরল। হাসি-খুশি গলা। বাড়ি ছেড়ে এই যে এতদিন বাইরে আছে তার কোন রকম ছাপ মেয়ের গলায় নেই।

    হ্যালো বাবা, কেমন আছি?

    ভাল।

    তুমি কি অফিস থেকে টেলিফোন করছ?

    হুঁ।

    বাবা শোন, আমরা সিলেট বেড়াতে যাচ্ছি। ছোট মামার চা বাগানে।

    কবে যাবি?

    আজ রাতের ট্রেনে, সুরমা মেইল। মামা বলছিল গাড়িতে করে যেতে। বাই রোড। মা রাজি হল না।

    ও আচ্ছা।

    বাবা শোন, তুমি আমাদের সামনের মাসের হাত খরচের টাকাটা এডভান্স দিতে পারবে? একদম খালি হাতে সিলেট যাচ্ছি তো। ভাল লাগছে না।

    কদিন থাকবি?

    কদিন থাকব বলতে পারছি না। মা যতদিন থাকতে চায় ততদিন। বাবা, তুমি হাত-খরচের টাকা দেবে কি দেবে না তা তো বললে না?

    পাঠিয়ে দেব।

    থ্যাংকস।

    তোর মা কি আছে?

    আছে। কথা বলবে?

    হুঁ।

    ধর তুমি, ডেকে দিচ্ছি। তবে মা তোমার সঙ্গে কথা বলবে কি না তা তো জানি। মনে হয় বলবে না। যা রেগে আছে!

    তুই ডেকে দে।

    আচ্ছা।

    জাফর সাহেব টেলিফোন হাতে বসে আছেন। তিনি লক্ষ্য করলেন, মিস্ত্রী দুজন কাজ ফেলে হা করে তার দিকে তাকিয়ে আছে। টেলিফোনের কথা শুনছে। এই দুটার মাথা কামিয়ে দিলে কেমন হয়? শায়লার গম্ভীর গলা পাওয়া গেল —

    হ্যালো।

    জাফর সাহেব বললেন, কেমন আছ?

    আমি কেমন আছি সেটা দিয়ে তোমার দরকার নেই। কি বলতে চাচ্ছ বল।

    সিলেট না-কি যাচ্ছ?

    কেন–কোন অসুবিধা আছে? স্বামীর অনুমতি ছাড়া নড়তে পারব না।

    অনুমতির কথা তো আসছে না। যেতে চাচ্ছ যাবে।

    শায়লা গম্ভীর গলায় বললেন, রাখি?

    শোন শায়লা, হ্যালো–আমি অনেক ভেবে-টেবে দেখলাম, অপরাধটা আসলে আমার। অর্থাৎ আমি বলতে চাচ্ছি, সংসারে চলার পথে ….?

    খট করে শব্দ হল। শায়লা টেলিফোন নামিয়ে রাখলেন। জাফর সাহেবের দিকে মিস্ত্রী দুজন এখনো তাকিয়ে আছে। তিনি এমন ভাব করলেন যেন টেলিফোনে খুব আনন্দজনক সংবাদ পেয়েছেন। তিনি হাসিমুখে বললেন, আপনার কাজ কতদূর?

    কাজ বন্ধু স্যার।

    বন্ধ কেন?

    পার্টস নাই।

    পার্টস নাই, তাহলে শুধু শুধু বসে আছেন কেন?

    স্যার চলে যাব?

    অবশ্যই চলে যাবেন। এক থেকে পাঁচ গুনার আগেই যাবেন। ওয়ান টু থ্রি ফোর…

    মেশিনটা জায়গায় ফিট কইরা থুইয়া যাই?

    নো। এক্ষুণি বিদায় হতে হবে। রাইট নড়ি।

    জাফর সাহেব বুঝতে পারছেন তাঁর রাগ বিপদসীমা অতিক্রম করতে যাচ্ছে। এক্ষুণি ভয়াবহ কিছু হবে। এদের উপর রাগ করাটা অর্থহীন। স্ত্রীর উপর রাগ তিনি এদের উপর ঝাড়তে পারেন না…

    এমন এক বিপজ্জনক মুহূর্তে নুরুজ্জামান দরজা ঠেলে মাথা বের করে বলল, স্যার আসি?

    জাফর সাহেব থমথমে গলায় বললেন, কি ব্যাপার!

    কোন ব্যাপার না স্যার। আপনার অফিসের ঠিকানা ছিল। ভাবলাম দেখা করে যাই। মৌচাক মার্কেটে যাচ্ছিলাম।

    আমার সঙ্গে কি কোন দরকার আছে?

    জ্বি-না স্যার।

    তাহলে এলে কেন?

    নুরুজ্জামান ভয়ে ভয়ে বলল, মন্ত্রী সাহেবের পিএ-র সঙ্গে কথা হয়েছে। উনি আবার নেত্রকোনায় বিবাহ করেছেন।

    উনি নেত্রকোনা বিয়ে করেছেন তাতে কি হয়েছে?

    যোগাযোগের একটা সুবিধা হয়ে গেল।

    জাফর সাহেব হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইলেন। এতটা নির্বোধ কোন সুস্থ মানুষ হতে পারে তা তার ধারণায় নেই। চতুস্পদরা এরচে কিছু বেশি বুদ্ধি ধরে।

    নুরুজ্জামান বেশ স্বাভাবিক ভঙ্গিতে সামনের চেয়ারে বসেছে। জাফর সাহেব যে রেগে আগুন হয়ে আছেন তাও তার মাথায় ঢুকছে না। নুরুজ্জামান উৎসাহের সঙ্গে বলল, পি এ সাহেবের বাসায় একদিন চলে যাব। একটা ব্যবস্থা তখন হবেই।

    হুট করে একজন অপরিচিত মানুষের বাসায় উঠে যাবে?

    হুট করে যাব না। আগে টেলিফোন করব। টেলিফোন নাম্বার নিয়ে এসেছি।

    জাফর সাহেব লক্ষ্য করলেন নুরুজ্জামান টেলিফোন সেটটার দিকে তাকাচ্ছে। মনে হচ্ছে এখান থেকে টেলিফোন করবে এই মতলব করেই এসেছে। এই যদি মতলব হয় তাহলে তাকে খুব নির্বোধ বলা যাবে না। জাতে মাতাল হলেও তালে ঠিক W151

    স্যার একটা টেলিফোন করব?

    কাকে করবে পি এ সাহেবের স্ত্রীকে?

    জ্বী না। আমাদের দেশের একজন মানুষ আছে রামপুরায় বাসা। উনি আমাকে একটা সুযোগ করে দিবেন বলেছিলেন।

    কিসের সুযো?

    বাঁশি বাজাবার সুযোগ। টিভিতে বাঁশি বাজাব।

    তুমি বাঁশি বাজাতে জান?

    পাতার বাঁশি স্যার। দুটা পাতা ভাঁজ করে ঠোঁটের ভেতর দিয়ে …

    নুরুজ্জামান।

    জ্বী স্যার।

    আমি এখন অত্যন্ত জরুরি একটা কাজ করছি। আমার মন মেজাজও ভাল নেই–তুমি যাও।

    জ্বী আচ্ছা স্যার।

    জাফর সাহেব লক্ষ্য করলেন, নুরুজ্জামান তাঁর কথায় দুঃখিতও হল না। আপমানিত বোধ করল না। হাসি মুখে উঠে দাড়াল। সহজ গলায় বলল, স্যার বাসায় ফিরবেন কখন?

    কেন?

    বাসায় ফেরার সময়টা জানা থাকলে এখানে চলে আসতাম তারপর আপনার সাথে একসঙ্গে গাড়িতে চলে যেতাম। গাড়িতে চড়ার মজাই অন্যরকম।

    আমি পাঁচটার সময় বাসায় যাব।

    জ্বী আচ্ছা স্যার। আমি চলে আসব।

    জাফর সাহেবের মাথা দপদপ করছে। জ্বর এসে গেছে কিনা কে জানে। বমি বমি ভাব হচ্ছে। অতিরিক্ত মেজাজ খারাপ হলে তার এমন বমি বমি ভাব হয়।

    নুরুজ্জামান বলল, স্যার যাই। স্লামালিকুম।

    ওয়ালাইকুম সালাম।

    জাফর সাহেব ফাইল সামনে নিয়ে স্তব্ধ হয়ে বসে রইলেন। মেজাজ এতই খারাপ যে ফাইলের দিকেও তাকাতে পারছেন না। অথচ পুরো ফাইল আজ দিনের মধ্যেই দেখে দিতে হবে।

     

    ঝাঁ ঝাঁ রোদে নুরুজ্জামান হাঁটছে। এমন ভাবে হাঁটছে যেন এই শহরটা তার খুবই পরিচিত। তার প্রচণ্ড ক্ষিধে পেয়েছে। দুপুরে এখনো কিছু খাওয়া হয় নি। এক হোটেলে খেতে বসেছিল। দাম শুনে বুক ধড়ফড় শুরু হল। এক পিস মাছ কুড়ি টাকা। ভাত ফুল প্লেট পাঁচ টাকা পরের হাফ দু ঢাকা ডাল এক বাটি পঁাচ টাকা। একবেলা খেতেই বত্রিশ টাকা। অসম্ভব ব্যাপার। কাজেই এক কাপ চা খেয়ে সে। বের হয়ে এসেছে। চায়ের দামও নিল দু টাকা। টাকাটা একেবারে পানিতে পড়ে গেছে। এতটুক কাপে এক কাপ চা এর দাম দু টকি, পাগলের দেশ নাকি? টেলিফোন করতে গিয়েও পাঁচ টাকা নষ্ট হল। ফার্মেসী থেকে টেলিফোন করেছিল। এরা কল প্রতি তিনটাকা নেয়। পাঁচ টাকার একটা নোট দিল। তার নোটটা রেখে দিয়ে বলল, ভাংতি নাই। আরেক সময় এসে আরেকটা টেলিফোন করে যাবেন। এখন যান। বিরক্ত করবেন না।

    নুরুজ্জামান একবার ভাবল বলে, টাকাটা দিন আমি ভাংতি করে দেই। শেষ। পর্যন্ত বলল না। এই লোকের মুখ দেখে মনে হচ্ছে বললেও লাভ হবে না।

    নুরুজ্জামান এখন যাচ্ছে মৌচাকের দিকে।

     

    ভরদুপুরে কারোর বাসায় উপস্থিত হওয়া ঠিক না, কিন্তু খবর পাওয়া গেছে। কামরুদ্দিন সাহেব বাসায় খেতে যান। তাকে ধরার এইটাই উৎকৃষ্ট সময়।

    নুরুজ্জামান দুটা আনারস কিনল। এই সময় আনারস পাবার কথা না। ঢাকা শহরের ব্যাপারট্যাপার সবই অদ্ভুত। আনারস পাওয়া যাচ্ছে।

    বাচ্চাকাচ্চার বাসা, খালি হাতে যাওয়া ঠিক না।

    কামরুদ্দিন সাহেব বাসাতেই ছিলেন। দুপুরের খাওয়া শেষ করে পান মুখে দিয়েছেন। তার দুপুরে কিছুক্ষণ ঘুমানোর অভ্যাস–এই সময়ে দরজা খুলতে হল। নুরুজ্জামান হাসিমুখে বলল, স্যার চিনতে পারছেন? আমি নুরুজ্জামান।

    কামরুদ্দিন বললেন, কি ব্যাপার?

    বলেছিলেন ঢাকায় এলে যেন দেখা করি।

    এখন তো একটু ব্যস্ত আছি।

    তাহলে স্যার পরে আসি?

    আচ্ছা আসুন, পরে আসুন।

    আমাকে চিনতে পারছেন তো স্যার?–পাতার বাঁশি। বলেছিলেন একটা ব্যবস্থা করে দিবেন।

    হুঁ।

    বাচ্চা-কাচ্চার জন্যে দুটা আনারস এনেছিলাম।

    কামরুদ্দিন বিরক্তমুখে আনারস হাতে নিলেন। নুরুজ্জামান বলল, কবে আসব স্যার?

    আসুন, কাল আসুন। বাসায় না, অফিসে আসুন। বাসায় লোকজন আসা আমি পছন্দ করি না। দশটার দিকে অফিসে আসুন।

    টিভি ভবনে?

    হ্যাঁ। গেটে পাশ থাকবে। নাম যেন কি বললেন?

    নুরুজ্জামান। মুহম্মদ নুরুজ্জামান। পাতার বাঁশি কি সঙ্গে করে নিয়ে আসব স্যার?

    আনুন।

    তাহলে আজ স্যার যাই। কাল দেখা হবে। আমি ঠিক দশটার সময় চলে আসব স্যার।

    আচ্ছা।

    কামরুদ্দিন স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন। আগামী কাল তিনি টিভি ভবনে যাচ্ছেন না। অন্য কাজ আছে। এই লোক কিছুক্ষণ ঘোরাফেরা করে চলে যাবে। তার কপাল ভাল হলে আর আসবে না। কপাল মন্দ হলে আবারও আসবে। জীবন অস্থির করে দেবে। কামরুদ্দিন সাহেব দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে ভাবলেন, নির্বোধ লোকের সংখ্যা এত দ্রুত বাড়ছে–এর কারণ কি?

    নুরুজ্জামান আবার হাঁটতে শুরু করেছে। হাঁটতে তার ভাল লাগছে। ঢাকা শহরে হেঁটে বেড়ানোর আলাদা মজা। কত কিছু আছে দেখার। এত ব্যস্ত রাস্তায় এক গেঞ্জ গায়ে লোককে দেখা গেল ঘোড়ার পিঠে চড়ে চলে গেল। দুবলা-পাতলা ঘোড়া না, বেশ তরতাজা ঘোড়া। শহরের রাস্তায় ঘোড়াটাকে মানাচ্ছে না, আবার গেঞ্জী গায়ে লোকটাকেও ঘোড়ার পিঠে মানাচ্ছে না। তারপরেও পুরো ব্যাপারটা মানিয়ে গেছে। মনে হচ্ছে এই মুহূর্তে ঘোড়ার পিঠে এই মানুষটার দরকার ছিল।

    নুরুজ্জামান ঘড়ি দেখল। দুটা ত্রিশ। তার ঘড়ি পাঁচ মিনিট ফাস্ট আছে। আসল সময় দুটা পঁচিশ। পিএ সাহেবের বাসায় কি চলে যাবে? ঠিকানা আছে, যাওয়া যায়। দুপুর বেলা উপস্থিত হলে উনি কি রাগ করবেন? করতে পারেন। করাটাই স্বাভাবিক। তবু চেষ্টা করতে দোষ কি? উনার বাসা কলাবাগান। ঐদিকে বাস যায়। কিনা খোঁজ করতে হবে। হেঁটে রওনা দেয়াটা ঠিক হবে না। বাসের কোন খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। আজ নাকি বাস স্ট্রাইক। নুরুজ্জামান হাঁটা শুরু করল।

    কলিংবেল টিপতেই একজন মহিলা দরজা খুলে দিলেন, নুরুজ্জামান বলল, স্লীমালিকুম আপা।

    ওয়ালাইকুম সালাম। উনি তো বাসায় নেই।

    আপা, আমি আপনার কাছে এসেছি। আমার নাম নুরুজ্জামান। আমি অতিথপুর গার্লস স্কুলের হেডমাস্টার। আমি এক গ্লাস পানি খাব।

    আপনি তো ঘামে ভিজে জবজবা হয়ে গেছেন। আসুন, ফ্যানের নিচে আসুন।

    নুরুজ্জামান বসার ঘরে বসল। মহিলা তাকে পানি দিলেন না, এক গ্লাস সরবত এনে দিলেন। সরবতের উপর বরফের টুকরা ভাসছে। ভদ্রমহিলা বললেন, এক্ষুনি খাবেন না। একটু ঠাণ্ডা হয়ে নিন।

    আমার একটু শিক্ষামন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করা দরকার। কোন উপায় খুঁজে পাচ্ছি আপা।

    আচ্ছা, আমি বলে দেব। ও ব্যবস্থা করে দেবে।

    আপা, আপনার অনেক মেহেরবানী। এখন পানিটা খাই।

    খান। নুরুজ্জামান এক নিঃশ্বাসে সরবতের গ্লাস শেষ করে বরফের টুকরা চিবাতে লাগল। দাঁত দিয়ে বরফ ভাঙার কচকচ শব্দ হচ্ছে। ভদ্রমহিলা বললেন, আরেক গ্লাস এনে দেই?

    জ্বি আচ্ছা।

    আপনি একটা কাগজে আপনার নাম-ঠিকানা লিখে দিন। ও একটা পাশ দিয়ে রাখবে। আপনি সেক্রেটারীয়েটে ঢুকে ওর সঙ্গে দেখা করবেন। ও নিশ্চয়ই ব্যবস্থা করবে।

    কবে?

    আগামীকাল দশটায় আসুন।

    জ্বি না। আগামীকাল আসতে পারব না। আগামীকাল টিভিতে আমার একজনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করার কথা। উনার নাম কামরুদ্দিন। উনি আমাকে একটা অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করে দিবেন। পাতার বাঁশি। আমি পাতার বাঁশি বাজাই।

    ও আচ্ছা। তাহলে একটা কাগজে আপনার নাম-টাম লিখে দিন। কোন টেলিফোন নাম্বার কি আছে যাতে ও আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারে?

    জি আছে।

    টেলিফোন নাম্বার লিখে রেখে যান। ও আপনার সঙ্গে কথা বলে একটা এপয়েন্টমেন্ট করবে।

    আপা, তাহলে উঠি।

    আরেক গ্লাস পানি খাবার কথা না? বসুন, পানি নিয়ে আসি।

    তৃষ্ণা চলে গেছে আপা।

    নুরুজ্জামান হাসছে। ভদ্রমহিলাও হাসছেন। বিদায় নেবার সময় ভদ্রমহিলাকে পুরোপুরি হকচকিয়ে দিয়ে নুরুজ্জামান তাকে কদমবুসি করে ফেলল। নুরুজ্জামানের পকেষ্ট থেকে সানগ্লাস, চাবির রিং এবং ভাংতি পয়সা গড়িয়ে পড়ল।

     

    তিথি দুপুরে দুজনের জন্যে ভাত বেঁধেছিল। সে আর নুরুজ্জামান। জাফর সাহেব দুপুরে বাসায় খেতে আসেন না। কেনটিন থেকে একটা স্যাণ্ডউইচ আর কলা এনে খান।

    নুরুজ্জামান দুপুরে আসেনি। এক গাদা ভাত ফ্রীজে ঢুকিয়ে রাখতে হয়েছে। ফেলতে মায়া লাগছে বলেই ফ্রীজে ঢুকিয়ে রাখা। সে ভাল করেই জানে শেষ পর্যন্ত ফেলে দিতে হবে। ফ্রীজের ভাত গরম করলে কেমন শক্ত হয়ে যায়। চিবানো যায় না। নতলায় কোন ভিখিরী আসে না। কাজেই ভিখিরীকে ভাত দিয়ে দেয়ারও প্রশ্ন আসে না। ফ্রীজের ঠাণ্ডা ভাত গরম করারও হয়ত কোন কায়দা আছে। সে তা জানে না। মা নিশ্চয়ই জানেন। তিথি ঠিক করে রেখেছে মাকে টেলিফোনে ব্যাপারটা জিজ্ঞেস করবে। এটা আসলে তার একটা অজুহাত। মার সঙ্গে কথা বলার অজুহাত।

    টেলিফোন সেই যে কাল রাতে নষ্ট হয়েছে এখনো ঠিক হয়নি। পাশের ফ্ল্যাট থেকে মাকে টেলিফোন করতে হবে। নীলক্ষেত এক্সচেঞ্জেও জানাতে হবে। অফিসে যাবার সময় বাবাকে বলে দিলে তিনি একটা ব্যবস্থা করতেন। বাবাকে বলার কথা। তিথির মনে পড়েনি।

    একা একা ভাত খাওয়ার মত খারাপ ব্যাপার আর হয় না। একমাত্র পশুরাই খাবার একা খেতে পছন্দ করে। মানুষ পারে না।

    দুপুরে তিথি খানিকক্ষণ ঘুমুলো। ঘুমের মধ্যে স্বপ্ন দেখল, টেলিফোন ঠিক হয়ে গেছে। মারুফ কথা বলছে। মারুফ বলছে–শোন তিথি, পশুর সঙ্গে মানুষের সবচে বড় তফাৎ হল–মানুষ দলবল নিয়ে খেতে পছন্দ করে। পশু তার খাবার নিয়ে একা একা চলে যায়। এমনভাবে খায় যেন কেউ দেখতে না পারে।

    তিথি বলল, পাখিদের বেলায় কি হয়?

    পাখিদের জন্যেও একই ব্যাপার। শুধু খাচায় বন্দি পাখিদের একসঙ্গে খেতে হয় কারণ তাদের উপায় নেই। ক্রিং ক্রিং ক্রিং।

    তিথি বলল, ক্রিং ক্রিং শব্দ হচ্ছে কেন?

    মারুফ বলল, বুঝতে পারছি না। বোধহয় তোমাদের বাসায় কলিংবেল বাজছে।

    দরজা খুলে দেব?

    দরজা খোলার কোন দরকার নেই। তুমি ঘুমুতে থাক। যে এসেছে সে খানিকক্ষণ বেল বাজিয়ে চলে যাবে।

    ক্রিং ক্রিং ক্রিং।

    তিথির ঘুম ভাঙল। কলিং বেল না, টেলিফোন বাজছে। ঘুমের ঘোর তার এখনো কাটেনি। সে জড়ানো গলায় বলল, হ্যালো।

    ওপাশ থেকে শায়লা বললেন, তোদের টেলিফোন নষ্ট না কি? সকাল থেকে টেলিফোন করছি, লাইন পাচ্ছি না।

    টেলিফোন নষ্ট ছিল না। এখন ঠিক হয়েছে। তুমি কেমন আছ?

    ভাল। শোন, আমরা সিলেট যাচ্ছি।

    কবে?

    আজ রাতের ট্রেনে, সুরমা মেল। তোর ছোট মামার চা বাগান দেখে আসি। তুই যাবি?

    অবশ্যই যাব।

    তাহলে তোর কাপড়-চোপড় গুছিয়ে এখানে চলে আয়। আমি এক ঘণ্টা পরে গাড়ি পাঠিয়ে দেব। আমার ঘরে পরার কয়েকটা শাড়ি সঙ্গে নিয়ে আসবি–আর কাবার্ডের নিচে রাখা স্যাণ্ডেল জোড়া আনবি।

    ইটালীয়ান স্যাণ্ডেল?

    হ্যাঁ।

    ক দিন থাকবে?

    ঠিক নেই। চার-পাঁচ দিন থাকতে পারি।

    বাবাকে তাহলে এক সপ্তাহের ছুটি নিতে বলি?

    ওর ছুটি নেয়া-নেয়ির কি আছে?

    বাবা কি সঙ্গে যাচ্ছে না?

    না।

    সে-কি।

    তুই মনে হয় আকাশ থেকে পড়লি।

    বাবা একা একা থাকবে?

    হ্যাঁ থাকবে। সে কচি খোকা না। তাকে ফিডিং বোতল দিয়ে দুধ খাওয়াতে হয় না।

    বাবা একা থাকবে আর আমরা দল বেঁধে বেড়াতে যাব?

    হ্যাঁ।

    তাহলে মা তোমরা যাও, আমি যাব না।

    তুই যাবি না?

    না। এবং মা আমার মনে হয়–তুমি বাড়াবাড়ি করছ।

    আমি বাড়াবাড়ি করছি না। তুই বাড়াবাড়ি করছিস। আমি তোর বাবাকে একটা কঠিন শিক্ষা দিতে চাচ্ছি–তোর জন্যে পারছি না।

    কঠিণ শিক্ষা শুধু বাবার একার হবে কেন? তোমারও তো হওয়া উচিত।

    তুই কি বললি?

    রাগ করো না, মা।

    যার যা ইচ্ছা আমাকে বলে যাবে আর আমি রাগ করব না?

    মা শোন, চল আমরা সিলেট থেকে ঘুরে আসি। অনেক দিন ফ্ল্যাট বাড়িতে থেকে থেকে আমাদের মন-টন ছোট হয়ে গেছে। বাইরে ঘুরলে ভাল লাগবে। বাবাও আমাদের সঙ্গে যাক। তুমি তাঁর সঙ্গে কথা বলো না–তাহলেই হল। তুমি এমন ভাব করবে যেন বাবা একজন অপরিচিত মানুষ। আমার সঙ্গে চাল চালবি না তিথি।

    আমি কোন চাল চালছি না মা।

    আমি তোর বাবাকে এমন শিক্ষা দেব যে সে তার নিজের নাম পর্যন্ত ভুলে যাবে। তার এত বড় সাহস, সে আমার গায়ে হাত তুলে …।

    সে কি

    এখন দেখি একবারে আঁৎকে উঠলি। তোর বাবা এলে তাকে জিজ্ঞেস করিস, তারপর তুই তোর বাবার হয়ে ওকালতি করিস। তার আগে না।

    তিথি চুপ করে রইল, টেলিফোনের ওপাশ থেকে কান্নার শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। তির্থি কি করবে বুঝতে পারছে না। তিথি নরম করে ডাকল, মা।

    কি?

    ফ্রীজের ঠাণ্ডা ভাত কি করে গরম করতে হয়?

    জানি না। চুপ কর।

    শায়লা টেলিফোন নামিয়ে রাখলেন।

    পাঁচটা বেজে গেছে। জাফর সাহেবের আসার সময় হয়ে গেল। বিকেলে নাশতা দেয়ার মত কিছু নেই। ময়দা আছে, লুচি ভেজে দেয়া যায়। ঘরে ডিম আছে। ডিমের ওমলেট আর লুচি ভাজা।

    তিথি অনেক খুঁজেও লুচি বেলার বেলুন পেল না। একটা টিন ভর্তি চিড়া আছে। তার মুখ খুলে দেখা গেল কাল কাল পোকা পড়ে গেছে। তিথির অস্থির লাগছে। বাবা ক্ষুধার্ত হয়ে অফিস থেকে ফেরেন। হাত-মুখ ধুয়েই কিছু খাবার জন্যে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। তাঁকে দেয়ার মত কিছুই নেই।

    তিথি চায়ের পানি চড়াল।

    জাফর সাহেব এলেন সাড়ে পাঁচটার দিকে। নুরুজ্জামান তাঁর সঙ্গেই এসেছে। সে ঠিক পাঁচটায় অফিসে গিয়ে উপস্থিত। নুরুজ্জামান আরো দুটা আনারস কিনেছে। দোকানদার বলে দিয়েছে–মধুর মত মিষ্টি না হইলে আমার দুই গালে দুই চড় দিবেন।

    এদের কথা বিশ্বাস করা ঠিক না তবু সে দুটা কিনে ফেলেছে।

    তিথি বলল, আমি আনারস খাই না। বাবাও খান না। আপনি শুধু শুধু এনেছেন।

    নুরুজ্জামান বিব্রতমুখে বলল, আনারস একটা ভাল ফল।

    তিথি বলল, মোটেই ভাল ফল না। এর সারা গা ভর্তি চোখ। আনারসের দিকে তাকালে মনে হয় সেও হাজার হাজার চোখ মেলে আমাকে দেখছে। এই আনারস আপনাকেই খেতে হবে।

    জি আচ্ছা।

    আনারস কি করে কাটতে হয় তাও জানি না। আপনাকেই কাটতে হবে।

    একটা বটি দিন।

    রান্নাঘরে চলে যান। খুঁজে বের করুন। এই বাড়ির কোথায় কি আছে আমি জানি না।

    নুরুজ্জামান বটির খোজে রান্নাঘরে চলে গেল। তিথি চা নিয়ে গেল বাবার কাছে।

    অফিস থেকে ফিরে জাফর সাহেব সাধারণত হাত মুখ ধুয়ে বারান্দায় বসে থাকেন। মাগরেবের আজানের পর উঠেন। তার আগে না। সারাদিন এই এক ওয়াক্তের নামাজই তিনি পড়েন। আজ তিনি শোবার ঘরে হাত-পা এলিয়ে শুয়ে আছেন। তিথিকে দেখেই বললেন, চা খাব না রে মা।

    চা খাবে না কেন? শরীর খারাপ?

    জ্বর জ্বর লাগছে।

    ক্লান্ত হয়ে আছ এই জন্যে জ্বর জ্বর লাগছে। ডিমটা খাও। বেশি করে কঁচা মরিচ দিয়ে ওমলেট করে এনেছি। ওমলেট খেয়ে চা খাও, দেখবে ভাল লাগবে।

    জাফর সাহেব উঠে বসলেন। ডিম নিলেন না। চায়ের কাপটা নিলেন।

    তিথি!

    জি বাবা।

    তোর মা বোধহয় আজ রাতে সিলেট যাচ্ছে বেড়াতে। তুইও যা, ঘুরে আয়। আমার এখানে অসুবিধা হবে না। হোটেল থেকে খাবার আনিয়ে খেয়ে নেব।

    আমার এখানে জরুরী কাজ আছে। আমি যেতে পারব না। আমি যাই কি না যাই সেটা বড় কথা না। বড় কথা হল, তোমাদের ঝগড়াটা মিটমাট হওয়া দরকার।

    আমার অসহ্য লাগছে।

    জাফর সাহেব কিছু বললেন না, তিথি চেয়ার টেনে বাবার সামনে বসল। মনে হচ্ছে সে ঝগড়া করবে।

    বাবা!

    হুঁ।

    তুমি ভয়ংকর একটা অন্যায় করেছ। তুমি মার গায়ে হাত তুলেছ। আমি তো কল্পনাও করতে পারিনি যে, তুমি এমন একটা কাজ করতে পার। তুমি মাকে চড় দাও নি?

    হুঁ।

    কি করে এরকম একটা কাজ করলে?

    জাফর সাহেব বিড় বিড় করে বললেন, রেগে গিয়েছিলাম। রেগে গেলে মানুষের মাথার ঠিক থাকে না। মানুষ পশুর মত আচরণ করে।

    এত রেগেই-বা কেন গেলে?

    সে আমাকে গালাগালি করতে করতে তোর দাদাকে গালি দেয়া শুরু করল। বলল–তুমি যেমন গাধা, তোমার বাবাও গাধা। চট করে মাথায় রক্ত উঠে গেল।

    দাদাকে গাধা বলতেই তো আর উনি গাধা হয়ে যাননি।

    তা যায়নি। তবু বাবাকে গালাগালিটা সহ্য হল না। আমাকে যদি কেউ গাধা বলে–তোর কি ভাল লাগবে?

    না, ভাল লাগবে না। কিন্তু আমি তার জন্যে মারামারি শুরু করব না।

    একেক জন মানুষ একেক রকমের মা। কারো রাগ বেশি, কারোর কম।

    চা খাওয়া হয়েছে?

    হুঁ।

    এখন ডিমটা খাও।

    ডিম খাব না।

    খাও বলছি। আমি কষ্ট করে ভাজলাম আর তুমি খাবে না। এই দেখ, ডিম ভাজতে গিয়ে আমার হাত পুড়ে গেছে। গরম তেল ছিটকে এসে পড়ল।

    জাফর সাহেব ডিমের প্লেট হাতে নিলেন।

     

    নুরুজ্জামান তার ঘরে গামলা ভর্তি আনারস নিয়ে বসে আছে। দোকানদার মিথ্যা বলেনি। মধুর মতই মিষ্টি। দুপুরে খাওয়া না হওয়ায় তার খিদে লেগেছে প্রচও। সে দ্রুতগতিতে আনারস খেয়ে চলেছে। নুরুজ্জামানের মনে হল এমন মিষ্টি আনারস সে এই জীবনে খায়নি। মনে হয় বাকি জীবনেও খাবে না।

    দরজায় টোকা পড়ছে। নুরুজ্জামান বলল, কে?

    তিথি বলল, আমি। আসব?

    জ্বি আসুন।

    তিথি ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বলল, গামলা ভর্তি আনারস নিয়ে বসেছেন বলে মনে হচ্ছে।

    নুরুজ্জামান লজ্জিতমুখে বলল, আনারসটা খুব মিষ্টি।

    এক সঙ্গে এতটা খেতে পারবেন?

    পারব। দুপুরে খাইনি তো। খুব খিদে লেগেছে।

    দুপুরে খাননি কেন?

    ঘোরাঘুরি করতে করতে সময় পার হয়ে গেল।

    ভাত রান্না করা আছে। গরম করে দেব?

    জি না।

    আপনাকে একটা কাজ করে দিতে হবে।

    অবশ্যই দেব।

    একটা ঠিকানা দিয়ে দিচ্ছি। সেখানে আমার মা আছেন। মাকে কিছু জিনিস পৌঁছে দিতে হবে। পারবেন না?

    এক্ষুণি দিয়ে আসছি।

    এক্ষুণি দিতে হবে না। আপনি আপনার আনারস শেষ করুন।

    জি আচ্ছা।

    চা খাবেন? চা করে দেব?

    জি-না। ফল খাবার পর পানি জাতীয় কিছু খেতে নেই। খণার বচন আছে–

    ফল খেয়ে পানি খায়
    যম বলে আয় আয়।

    যম আয় আয় বললে পানি না খাওয়াই ভাল।

    তিথি ভাত বসিয়েছে। চেয়ার এনে বসে আছে চুলার পাশে। ভাত রান্নার জন্যে ঘরে একটা রাইস কুকার আছে। তিথি সেই কুকারের ব্যবহার জানে না। জানলে এত সমস্যা হত না। তার কাছে মনে হচ্ছে এই পৃথিবীতে সবচে জটিল কাজ হচ্ছে ভাত রান্না। ভাত কখন নরম হবে কখন শক্ত হবে কিছুই বলা যায় না। এবার মা এলে তার কাছ থেকে খুব ভাল করে কয়েকটা জিনিস শিখে নিতে হবে। ভাত রান্না এবং তরকারির রং সুন্দর করার কৌশল। তরকারি যা রান্না হচ্ছে খেতে খারাপ হচ্ছে না, কিন্তু দেখাচ্ছে কুৎসিত। মাটি-মাটি ধরনের হলুদ রঙ। টাইফয়েড রোগির পথ্য।

    জাফর সাহেব রান্নাঘরে উঁকি দিলেন। মেয়েকে রান্নাঘরের চেয়ারে চুপচাপ বসে থাকতে দেখে খুব অবাক হলেন। বিস্মিত হয়ে বললেন, হয়েছে কি তোর? এরকম চুপচাপ বসে আছিস কেন?

    ভাত রাঁধছি।

    ভাত রাধলে চুলার পাশে এরকম গালে হাত দিয়ে বসে থাকতে হয়?

    অন্যের হয় না, আমার হয়। ভাত রান্নার সময় যে কটা সূরা আমার জানা আছে সব কটা আমি পড়ে ফেলি।

    সূরা পড়ে ভাত রাঁধতে হবে না। চুলা বন্ধ কর।

    রাতে আমরা খাব না?

    চল যাই কোন একটা চাইনীজ হোটেল থেকে খেয়ে আসি।

    আর নুরুজ্জামান সাহেব? উনি?

    ওর জন্যে খাবার নিয়ে আসব।

    রোজ রোজ তো আর চাইনীজ খাওয়া যাবে না।

    একটা কিছু ব্যবস্থা হবেই। তুই উঠে আয়। কাপড় পর।

    তিথি উঠে এল। জাফর সাহেব বললেন, ভাল করে সাজগোজ করতো। তিথি বিস্মিত হয়ে বলল, কেন?

    এম্নি। সাজলে তোকে কেমন দেখায় দেখি। দোকান যদি খোলা থাকে তোকে সুন্দর দেখে একটা শাড়ি কিনে দেব।

    তিথি বলল, দরকার নেই। তুমি কিনে দেবে, মার রঙ পছন্দ হবে না। সে আবার দোকানে বদলাতে নিয়ে যাবে। এটা শুনে তুমি আবার রাগ করবে। আমার শাড়ি কেনার দরকার নেই। বাইরে খেতে যাচ্ছি, চল খেয়ে আসি।

    তিথি সাজগোজ করবে না বললেও ভালই সাজল। ঢাকা শহরে রাতে গয়না পরে বের হওয়া একেবারে নিষিদ্ধ। তবু সে গলায় একটা হার পরল। কপালে খুব যত্ন করে টিপ আঁকল। গত জন্মদিনে কেন নীল জামদানী শাড়িটা পড়ল। শাড়িটা তার পছন্দ না। এই প্রথম পরছে। বড় বড় শাদা ফুল। চোখে লাগে, কিন্তু পরবার পর সে নিজেই মুগ্ধ হয়ে আয়নায় নিজের দিকে তাকিয়ে রইল। এতো সুন্দর লাগছে তাকে। আশ্চর্য তো!

    জাফর সাহেব বললেন, তোর ফোন এসেছে। ফোনটা ধর। মাই গড! তুই সাজবিনা বলেও দেখি মারাত্মক সাজ দিয়েছিস।

    সুন্দর লাগছে বাবা?

    খুব সুন্দর লাগছে। ক্যামেরায় ফিল্ম আছে কি না দেখ তে। ফিল্ম থাকলে তোর একটা ছবি তুলে রাখব।

    ছবি তুলতে হবে না বাবা। তুমি জানালা বন্ধ কর। আমরা এখন বেরুব।

    তুই টেলিফোন ধরে আয়। মনে হচ্ছে মারুফ।

    তিথি টেলিফোন ধরতে গেল। বাবার সামনে ছুটে যেতে লজ্জা লাগছে। কিন্তু তার ইচ্ছা করছে ছুটে গিয়ে ধরতে।

    হ্যালো!

    তিথি শোন, বেশিক্ষণ কথা বলতে পারব না। খুব জরুরী খবর আছে। কাল অবশ্যই অবশ্যই অবশ্যই সকাল নটার মধ্যে পিজা কিং-এ থাকবে। কেমন? খোদা হাফেজ।

    মারুফ টেলিফোন নামিয়ে রেখেছে। তার পরেও তিথি অনেকক্ষণ রিসিভার কানে ধরে রাখল। শব্দহীন রিসিভার কানে ধরে রাখার মধ্যেও যে আনন্দ আছে তা সে আগে বুঝতে পারে নি।

    ⤶ ⤷
    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleদারুচিনি দ্বীপ – হুমায়ূন আহমেদ
    Next Article জীবনকৃষ্ণ মেমোরিয়াল হাইস্কুল – হুমায়ূন আহমেদ

    Related Articles

    হুমায়ূন আহমেদ

    আসমানীরা তিন বোন – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025
    হুমায়ূন আহমেদ

    ইস্টিশন – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025
    হুমায়ূন আহমেদ

    উড়ালপঙ্খী – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025
    হুমায়ূন আহমেদ

    এই বসন্তে – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025
    হুমায়ূন আহমেদ

    এই মেঘ, রৌদ্রছায়া – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025
    হুমায়ূন আহমেদ

    এইসব দিনরাত্রি – হুমায়ূন আহমেদ

    December 23, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Generic selectors
    Exact matches only
    Search in title
    Search in content
    Post Type Selectors
    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    আসমানীরা তিন বোন – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    আসমানীরা তিন বোন – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025
    Our Picks

    আসমানীরা তিন বোন – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025

    ইস্টিশন – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025

    উড়ালপঙ্খী – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }