Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    রবিনসন ক্রুসো – ড্যানিয়েল ডিফো

    August 19, 2025

    দ্য দা ভিঞ্চি কোড – ড্যান ব্রাউন

    August 19, 2025

    এঞ্জেলস এন্ড ডেমনস – ড্যান ব্রাউন

    August 19, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • 🔖
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    Subscribe
    সাইন ইন
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    তেইল্যা চোরা – ওবায়েদ হক

    ওবায়েদ হক এক পাতা গল্প132 Mins Read0

    তেইল্যা চোরা – ৬

    ৬

    জেলখানায় যারা বিড়ি সিগারেট খায় না তারা সাধারণত দুই ধরনের হয়, হয় ফেরেশতা নয়তো মৃত। ফজর আলী এই দুই ধরনের মধ্যে পড়ে না। তাই সে ভুস ভুস করে বিড়ি টানে, প্রথম প্রথম বিড়িতে টান দিলেই মাথা ঘুরাতো, কাশি আসতো প্রবল বেগে, এখন তেমন কিছুই হয় না। স্বাচ্ছন্দে ধোঁয়া ভেতরে যায় আর বের হয়। বিড়ির সাথে সাথে অন্তর পোড়ার ধোঁয়াও বের হয়। বিড়ির ধোঁয়া শেষ হয়ে যায় কিন্তু অন্তরের জ্বলুনি কমে না। তার সাজা হয়েছে তিনদিন হয়েছে, আরো কতদিন বাকি হিসেব করতে গেলে বুকে একটা ভারী কিছু অনুভব করে, চিৎকার করে কাঁদতে চায়। দম বন্ধ করে বসে থাকে, চোখ ফেটে অশ্রু নামে।

    ইউসুফ মুন্সি এসে পিঠে হাত বুলিয়ে দেয় ফজরের। বিড়ি সিগারেট খায় না আবার মৃতও না ফেরেশতাও না, তৃতীয় প্রজাতির লোকটি হচ্ছে ইউসুফ মুন্সি। মাথায় সব সময় টুপি থাকে তার, প্রতি দুই তিন কথা অন্তর অন্তর আল্লাহর নাম নেয় সে। মুখে কাঁচাপাকা দাড়ি। চেহারায় একটা কোমল আর পবিত্র ভাব আছে। এরকম লোকগুলো মসজিদের ইমাম হয়, তাদের দেখলেই মানুষ হাত তুলে সালাম দেয়। চোর- ডাকাত-খুনি-ধর্ষকে ভরা জেলখানায় ইউসুফ মুন্সি বড়ো বেমানান। ছয় বছর ধরে এই জেলখানায় পড়ে আছে সে, থাকতে হবে আরো চার বছর।

    ফজর আলী যখন প্রথম জেলে এসেছিল, তখন তার পরনে শুধু একটি লুঙ্গি ছিল, সেটাও জোয়ার্দারসাহেবের কামলা আর দারোগার কল্যানে স্থানে স্থানে ছিড়ে গিয়েছিল। নাদির গুন্ডার দেয়া এক প্যাকেট সিগারেট দিয়ে অনেক সুবিধাই আদায় করতে পারতো, কিন্তু অনভিজ্ঞতার কারণে শুধু একটি কম্বল জোগাড় করতে পেরেছিল সে। গোসল করার সময় চৌবাচ্চার চারপাশে হুড়মুড়ে ভিড় লেগে থাকতো, সাকুল্যে গোসল করার জন্য একজন দুই মগ করে পানি পেতো। ফজর আলী ভেজা লুঙ্গি নিয়ে রোদে দাঁড়িয়ে থাকতো, লুঙ্গি না শুকানো পর্যন্ত। জেলখানায় ভয় আছে হিংসা আছে লোভ আছে কিন্তু মায়া নেই। ইউসুফ মুন্সি ছিল ব্যতিক্রম। তার মায়া হলো ফজরের উপর। দুইজন গার্ড পুলিশকে বলে তার জন্য কাপড়চোপড়ের ব্যবস্থা করে দিলো পাশাপাশি গ্রামের শোনার পর ইউসুফের মায়াটা যেন আরো বেড়ে গেল ফজরের প্রতি। সেই থেকে ফজর ইউসুফ মুন্সির সাথেই আছে। ইউসুফ ফজরের পাশে বসে জিজ্ঞাসা করলো, ‘কী হইছে রে ফজর, কান্দস ক্যান?’

    ‘রাগে কান্দি হুজুর। আমি খারাপ মানুষ আমার সাজা হইছে, ঠিক আছে কিন্তু আমার বউ পোলা তো কিছু করে নাই। আমি এইখানে তিনবেলা খাওন পাই, তারা কী খায় কে জানে? কইলজাডা ফাইট্যা যায় হুজুর। পোলাডার মুখটা মনে অইলেই ইচ্ছা করে সব ভাইঙ্গা পলাইয়া যাই।’

    ‘রাগে মানুষের মাতা ঠিক থাহে না, ভালা মানুষ রাক্ষস হইয়া যায়। আমার রাগের লাইগাই আল্লায় আমারে এই জেলে ফালাইয়া রাখছে। হরমুজ বেপারীর পোলায় ভাং খাইয়া আমার বাড়িত আইসা মাতলামী করতো, আমি ঠেইল্যা ঠুইল্যা তারে বাড়িত পাঠাইতাম। একদিন দেহি তোর ভাবীরে জ্বালাইতাছে নেশা কইরা। মাথাত রক্ত উইঠ্যা গেল, রাগের মাথাত কী করছি মনে নাই। পোলাডা দুই দিন পরে মরলো। উকিল কইছে আমারে, মিছা কতা কইলে এই মামলা থিক্যা খালাশ পাওন কোনো বিষয়ই না, কিন্তুক আমি এতবড়ো মিছা কতা ক্যামনে কই? আল্লায় ঠিক করছিল আমার জেল হইবো, হইছে। তুইও আল্লার ইচ্ছা মাইন্যা ল। আল্লায় তোর বউ পোলারে দেখবো। রাগ কইরা নিজের কপাল ভাঙ্গিছ না।’

    ফজর আলীর বিশ্বাস ছিল, ইউসুফ মুন্সি কখনো মিথ্যা বলে না। আল্লাহর ভরসায় মনের দুঃখ তার একটু হলেও কমলো। সবার কাছে ইউসুফ মুন্সি জ্ঞানী, বুদ্ধিমান, বিশ্বাসী ছিল না। তাদের মধ্যে সুজন মাস্টার অন্যতম। সুজন মাস্টারের সাথে ফজর হাজতে এক রাত কাটিয়েছিল, বিড়ির গন্ধে বমি করে দেয়া সুজন মাস্টারের চেহারার সামনে এখন সব সময় ধুমায়িত কুণ্ডুলি উড়ে। সেই ধোঁয়া এবং ডান দিকের ফাঁটা কাচের চশমা দিয়ে তার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি চোখে পড়ে। তার সেই চাচা কিংবা প্রেমিকার বাবা তার নামে অপহরণের মামলা দিয়েছিল, মেয়েটি আদালতে এসে বলে গিয়েছিল, সুজন মাস্টার তাকে জোর করে ধরে নিয়ে গিয়েছিল। সেদিন খুব হেসেছিল সুজন। সেই ‘চাচা” তার কথা রেখেছিল, সুজনকে জেলের ভাত খাওয়াচ্ছেন, এবং বেশ লম্বা সময় ধরে খাওয়ানোর বন্দোবস্ত করেছেন।

    সুজন এতিম ছেলে, এর বাড়ি ওর বাড়ি থেকে মেট্রিক পাশ করেছিল। সারাজীবন মানুষের করুণা পেয়ে এসেছে। শেষ পর্যন্ত একটি মেয়ে তাকে করুণা করেনি, ভালোবেসেছিল। ভালোবাসা পেয়ে সে ভয় পেয়ে গিয়েছিল, সারাজীবন যা তার আরাধ্য ছিল তা হাত পেতে নিতে ভয় পাচ্ছিল, যদি হারিয়ে যায়। রাতের অন্ধকারে পালিয়ে যাচ্ছিল ভালোবাসার ভয়ে। মেয়েটিও চলল সাথে, সে বাধা দিলো, নীতিকথা শোনালো, ভয় দেখালো। মেয়ে কিছু বুঝলো কী না কে জানে শুধু বলল, তাকে না নিয়ে গেলে গলায় কলসি বেঁধে পুকুরে ডুব দেবে। সুজন মেয়ের প্রাণ বাঁচানোর জন্য নিজের মান বিসর্জন দিয়ে হাত ধরে চলল অজানার পথে। তাদের জন্য যা অজানা মেয়ের প্রভাবশালী বাবার জন্য তা মোটেও অজানা নয়। তিনি ঠিকই তাদের খুঁজে বের করলেন,

    মেয়েকে দিয়ে স্বাক্ষী দেয়ালেন, তারপর মেয়েকে বিয়ে দিয়ে পাঠালেন ভূঁইয়া বাড়ি আর সুজনকে পাঠালেন জেলে।

    সুজন সেই থেকে বিশ্বাস হারিয়েছে, কাউকেই বিশ্বাস করে না সে নিজেকে ছাড়া। ইউনুস মুন্সিকে সময় পেলে অপমান করতেও ছাড়ে না সে। বলে, ‘দাড়ি টুপির লেবাজ ধরলেই মানুষ ভালা হইয়া যায় না, যে খুন করছে সে খুনিই থাকে। মূর্খরা আপনার কথা কিছু না বুঝেই বিশ্বাস করে, আমি করি না।’

    ইউসুফ মুন্সি মুখে হাসি এনে বলে, ‘তোমার বয়সটাই এমন, এই বয়সে শয়তান মানুষরে রং দেখায়, ভুল বুঝায়। তোমরা ভুল কতা কও, তা তোমরা মানতে চাও না। তুমি কও শেখসাহেব ভালা মানুষ, দেশের মানুষের ভালা করবেন তিনি। আমি কই তিনি ভারতের দালাল, পাকিস্তানরে ভাঙার কুটচাইল খেলাইতেছেন। আমি রাজনীতি বুঝি না, কিন্তুক এইডা বুঝি যে ইসলাম ধ্বংস করার লাইগা ইয়াং ছাত্রগো লইয়া আইয়ুব সাবরে নামাইছেন শেখসাহেব।’

    সুজনের ভাঙা চশমার ফাঁক দিয়েও দেখা যায় তার চোখ জ্বলজ্বল করছে, গলায় ঝাঁঝ এনে বলল, ‘তো আইয়ুব সাব তো নামছে, ইসলামের কী হইছে? ইসলাম ধ্বংস হইছে? ইলেকশনে শেখসাহেব পাশ করলে পুবের মানুষ ভাত পাইবো, নাইলে আমরা ক্ষেতে খাটুম, তারা পেট ভরবো।

    ‘এইসব তোমার কতা না, শয়তানের কতা। পাকিস্তানরে কেউ ভাঙ্গতে পারব না, বাঙালি দিয়া হইব না, দেশ চালাইতে লাগবো পাঞ্জাবি রক্ত। তারা আলিফ, বা, তা, ছা দিয়া লেহাপড়া করে, তাগো মনে ইলম আছে। আমরা বাঙালিরা নাফরমান, আলিফ, বা না পইড়া পড়ি সরু, সরায়া। এর লাইগা আমরার দেশের পুলাপাইন দুই পাতা পইড়া শয়তানের পাল্লায় পড়ে।

    এক কোণে বসে থাকা বাচ্চু জোর গলায় বলে উঠে, ‘আলবত। আপ ঠিক বলতা হায় হুজুর।’

    বাচ্চু ভুল করে বাংলায় জন্ম নিয়েছে, অন্তত সে তাই বিশ্বাস করে। পাঞ্জাব সিন্ধু নিদেনপক্ষে বেলুচিস্তানে জন্ম হলেও তার আফসোস থাকতো না। করাচিতে এক পাঠানের ঘরে কাজ করতো বাচ্চু। ফুট ফরমায়েশ খাটতো, ভারী কাজ করে দিতো। মুগ্ধ চোখে সে দেখতো তাদের, কী গায়ের রং, কী পুরুষ্ট গোফ ছেলেদের, বুকের ছাতি কত চওড়া, লম্বায় যেন আকাশ ছোঁয়া। পুরুষদের রূপেই যে এত অবিভূত, নারীদের রূপ যেন তার কাছে স্বর্গীয়। একটা কালো পাঞ্জাবি মেয়ে দেখেনি সে, ধনু বেপারীর মেয়ে ফর্সা বলে কত দেমাগ ছিল তার অথচ এদের কাছে সে শ্যামলাই হবে। সে দুই মাস বাড়িতে টাকা না পাঠিয়ে পাঞ্জাবিদের মতো কাবলি বানালো। চালচলনে একটা খাঁটি পাকিস্তানি ভাব ধরার চেষ্টা করলো। কিন্তু তার চেহারাটা অতিরিক্ত বাঙালি। তবুও চেষ্টার কমতি ছিল না তার। মাটির রং ঘষে ঘষে কত ফ্যাকাসে হওয়ার চেষ্টা করলো, কিন্তু যেই বাচ্চু সেই বাচ্চুই রইলো। তার নামটাও বড়ো বাঙালি, সেজন্য নিজের বাবা মা কে কম অভিশাপ দেয়নি সে। চেহারায় না পেরে বোল চালে চেষ্টা করলো, উর্দুতে কথা বলতো সব সময়। কাবলি পরে হাঁটা চলায় বেশ অসুবিধা হতো তার, কিন্তু তবুও কাবলি ছাড়লো না, লুঙ্গি তার কাছে বাঙালি ছোটোলোকদের পোশাক। মাঝেমধ্যে রাস্তায় হোঁচট খেতো, শুধু মাত্র তখন বাংলায় মায়ের কথা মনে হতো, ‘ও মাগো।’ দোকান থেকে আসতে দেরি হলে, তার পাঠান কর্তা কারণ জিজ্ঞাসা করলে বলতো, ‘রাস্তা মে উষ্ঠা খায়া।’

    দোকানির সাথে তাল মিলিয়ে উর্দুতেই বাঙালিদের গালাগালি করতো, ‘বাঙালি ফকিন্নী কা জাত হ্যায়।’

    সে নিজেকে সেই পাঠান পরিবারের সদস্য ভাবতে লাগলো, ভাবনাটা একেবারে তার নিজস্ব। কর্তা হাসি দিলে সে ভাবতো, ‘ম্যায় নোকর নেহী, পাঠান হামার খালতো ভাই জেইসা হ্যায়।’ গৃহকর্ত্রীকে সুযোগ পেলেই ‘ভাবীজান’ বলতো। গৃহকর্তী হয়তো শুনেওনি, সে ভাবতো, ‘ম্যায় ভাবীজানের দেওর জেইসা হ্যায়।’ এরকম ভাবনা তার মনে দিনে দিনে বহুগুণে বৃদ্ধি পেলো। একদিন খুব ক্ষুধা পেলো, কিন্তু অন্দরমহল থেকে খাবার আসার কোনো নাম নেই, সে তখন এক কুলক্ষণে আবার ভাবলো, ‘ম্যায় ঘর কা আদমি, ভিত্রে গিয়া খানা চাই, ভাবীজান ভুল গ্যায়া মনে হয়।’

    ‘ঘর কা আদমি’ বাচ্চু ঘরে ঢুকে বৈঠকখানার ভেতরে উঁকিঝুকি দিতে লাগলো। তখনি পাঠান ঘরে ঢুকলো, চাকরের স্পর্ধা দেখে শরীরের রক্ত টগবগ করে ফুটে উঠলো শক্ত হাতে ঘাড়ে ধরে বাহিরে এনে ফেলল। পেশীবহুল হাতুড়ির মতো হাত দিয়ে মারতে মারতে বলল, ‘শালা বাঙালি চোর, চুরি করতা হ্যায়।’

    বাচ্চু প্রথমে বুঝানোর চেষ্টা করলো, ‘ভাইজান, ভাইজান আপ গলদ বুঝতাছেন। হাম চোর নেহি হুঁ।’ তারপর মারের চোটে অজ্ঞান হবার আগ পর্যন্ত চেঁচাতে লাগল, ‘ও মাগো, ও মাগো।’

    ‘ভাইজানের’ ঘরে চুরির অভিযোগে তার জেল হয়। পূর্ব বাংলার জেলে দিয়েছে বলে সে একটু নাখোশ। তবে ইউসুফ হুজুরকে তার ভালো লাগে। ইউসুফ হুজুর পাকিস্তানিদের পক্ষে কথা বলে। বাচ্চুর উর্দু বলার ভূত পাঠানের প্রহারেও তাকে ছেড়ে যায়নি। পাকিস্তানের গল্প তার কখনো শেষ হয় না। খেতে বসলে গোগ্রাসে কঙ্কর মিশ্রিত ভাত গিলতে গিলতে বলে, ‘ভাত হজম নেহি হোতা হ্যায় ম্যারা। ভাত থিক্যা রুটি আচ্ছা।’

    পাকিস্তানের খাবার কতো মজার, ফলের দাম কত সস্তা, রুটি খাওয়ার বিবিধ উপকারিতা বর্ণনা করতো সে। কিন্তু রুটি খেয়ে যে তার বাঙালি পেটে কোষ্ঠকাঠিন্য হয়েছিল তা কখনো বলে না। রাজনীতির কথা সে বিশেষ বোঝে না, কিন্তু পাকিস্তানিদের প্রশংসা করলেই, সে বলে উঠবে, ‘আলবৎ।’

    আজও তাই করলো। ফজর আলীও কিছু বোঝে না, তারা বলে আইয়ুব, সে মনে মনে ভাবে, মজিদ। তারা বলে শেখ মুজিব, সে মনে মনে ভাবে, আমেনার কথা। তার কপালে দুশ্চিন্তার দুটি স্থায়ী ভাঁজ পড়ে গিয়েছিল, তার বউ আর ছেলের জন্য।

    সন্ধ্যার ঘণ্টা পড়া মাত্রই তারা লাইন ধরে বসে যায়, তিনবার করে গোনা হয়। তারপর ছোট্ট একটা ঘরে ঢুকে যায় তারা। ফজর ভাবে সন্ধ্যা হলেই আমেনা কীভাবে ‘হুস হুস’ করে হাঁস-মুরগি খোয়ারে ঢুকাতো। মজিদ দুপুরের গোসলের সব কৃতিত্ব গাছে উঠে, মাটিতে গড়াগড়ি দিয়ে সন্ধ্যা নাগাদ বিসর্জন করে দিতো। আমেনা হাঁস-মুরগীর রাত্রী নিবাসের ব্যবস্থা করে, মজিদকে পুকুর পাড়ে নিয়ে গিয়ে আবার মানুষ করে নিয়ে আসতো। কুপিতে কেরোসিন ভরে, সলতেটা টান দিয়ে উপরে তুলে আগুন জ্বালাতো। ঘরময় আলো ছড়িয়ে পড়ত। সেই মায়াবী সন্ধ্যায় আমেনার কঠিন মুখেও কী অদ্ভুত কোমলতা ফুটে উঠতো। ফজর দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভাবতে থাকে। যতবার ভাবে নতুন কিছু

    স্মৃতি যোগ হয় সেই সন্ধ্যায়। আর সে ততই ব্যাকুল হতে থাকে।

    ডিসেম্বরের মাঝামাঝি সময়, দেশে প্রচণ্ড শীতের মধ্যে নির্বাচনের উত্তাপ যেন আশীর্বাদ হয়ে এসেছে। হতাশ দরিদ্র মানুষগুলোর অন্ধকার বুকে একটু আশার রেখা দেখা দিয়েছে, এবার কিছু একটা হবে। কারাগারেও কিছুটা উত্তাপ লেগেছে। প্রায়ই বাকবিতণ্ডা হচ্ছে, একপাশে শোর উঠে শেখসাহেব, আরেকপাশে কিছু ম্রিয়মান কন্ঠ গোলযোগ করে বলে, ভূট্টো সাব। ফজর আলী সেই, শোর কিংবা গোল কিছুতেই নেই।

    সকাল পাঁচটা বাজেই তালা খুলে দেয়া হয় সেলের। সবাই হুড়মুড় করে ছুটে বেরিয়ে যায়, গরমকালে চৌবাচ্চার দিকে ছুটে, সারারাত ভ্যাপসা গরমে সিদ্ধ হয়ে, সকালে একটু ঠাণ্ডা পানির স্পর্শ লাগাতে চায় সবাই। এখন শীতকাল চৌবাচ্চায় তেমন ভিড় নেই, তবুও সবাই আগের মতোই সেল থেকে বের হওয়ার জন্য ব্যাকুল থাকে। একবার গণনা করার পর সবাইকে প্রাকৃতিক কাজ করার সুযোগ দেয়া হয়। সারিবদ্ধ শৌচাগারের সামনে লাইন ধরে সবাই, দূর্গন্ধময় সেই শৌচাগারে ঢোকার জন্য আকুলি বিকুলি করে। আবার ঢুকলে বের হওয়ার জন্য উন্মুখ হয়ে থাকে। বাচ্চু মিয়া ঢুকেছে কিন্তু বের হওয়ার নাম নেই, পাকিস্তানি রুটির প্রভাব এখনো শেষ হয়নি তার। বাহির থেকে ততক্ষণে বাচ্চুর চৌদ্দ গুষ্ঠী উদ্ধার হচ্ছে, সবগুলো গালাগালি যদি সত্য হতো, দুনিয়াব্যাপী বাচ্চুর আত্মীয়স্বজন থাকতো। আত্মীয়ের পরিমাণ আর না বাড়িয়ে বাচ্চু বিরস মুখে বেরিয়ে এলো। সবাই যখন একজোট হয়ে রোদ পোহাচ্ছে, অথবা শৌচাগারের সামনে গালির অনুশীলন করছে, তখন একটি লোক একপাশে চাঁপা গাছটার নিচে বসে বিড় বিড় করে কী যেন বলছে, ফজরের ধারণা সুরা পড়ে হয়তো। তার চেহারায় একটা সম্ভ্রান্ত ভাব আছে, মাথার চুলগুলোতে পাঁক ধরেছে, একসময় ঘন কালো কোঁকড়া চুল ছিল বলা যায়, চামড়া তামাটে রঙের নয়, বাদামী, তবে একসময় বেশ ফর্সা ছিল। লম্বা শরীরটাতে বাল্যকালের অপুষ্টির চিহ্ন নেই, এখনো সুগঠিত বলা যায়। ফজর আলী ইউসুফ মুন্সিকে জিজ্ঞাসা করলো, ‘কে গো ভাই এই বালা মাইনষের পোলা?’

    ‘নাম তো জানি না রে, তয় সবাই কয় পাগলা পফেসর। বড়ো কোনো কলেজের মাস্টার আছিল। বাপের বহুত ট্যাকা পইসা আছিল। খুন কইরা জেলে আইছে।’

    ‘কারে খুন করছে?’

    ‘জানি না, কারো লগে কতা কয় না, একলা একলা থাহে। বইটই পড়ে। সুযোগ পাইলেই চাঁপা গাছটার নিচে বইয়া থাহে। কেন জানি সবাই ভয় পায়, তুই কাছে যাইস না।’

    ফজর আলী লোকটার দিকে তাকিয়ে থাকে, ‘পাগলা পফেসর’ এর চোখ দুটি যেন জ্বলে নিঃশেষ হয়ে যাওয়া দুটি নিরীহ কয়লা, একেবারে নির্বীর্ষ কিন্তু পেছনে রয়েছে অনেক জ্বালা।

    *

    সকালে নাস্তা হিসেবে সেই আখের গুড় আর শুকনো খড়খড়ে রুটি। চিবিয়ে চিবিয়ে মাড়ি ধরে যায়। তারপরও কেউ একটা কণা ফেলে দেয় না। দুপুর পর্যন্ত কাজ করতে হবে কচু ক্ষেতে। এই সময়টার অপেক্ষায় থাকে সবাই, আবার এই সময়টাকেও ভয়ও পায়। চার দেয়ালের বাহিরে আসা যায়, মুক্ত মানুষের চলাচল দেখা যায়। বাহিরের কারো সাথে কথা বলা নিষেধ, রাইফেল হাতে চারজন পুলিশ সবসময় পাহারায় থাকে। মুক্ত বাতাসে শ্বাস নেয়ার সৌভাগ্য হয়, কিন্তু কচু ক্ষেতের পঁচা কাদাতে পায়ের আঙুলের ফাঁকে ঘা হয়ে যায়। ঝুঁকে কাজ করতে করতে কোমরে খিল ধরে যায়, প্রচণ্ড রোদে পিঠ পুড়ে যায়, দরদর করে ঘাম নামে, গায়ের ডোরাকাটা পোশাকটি ভিজে চপচপ করে। দুপুর হতে না হতেই ক্ষুধায় পেট আর মাথার মধ্যে ভোঁ ভোঁ করে। ফজর আলী একজন ছোকরা পুলিশের দিকে তাকিয়ে কাকুতি করে, ‘ও বাইজান, কইলজা হুকায়া গেছে, একটু পানি খাইতে দেন।’

    ‘জি ছ্যার, আর কিছু লাগবো? কোরমা, পোলাও? তালপাতা দিয়া একটু বাতাস কইরা দেই?’

    ‘একটু পানি দেন, হাশরের ময়দানে আল্লায় আফনেরে পানি দিবো।’

    পুলিশটি তার রাইফেলের বাট দিয়ে ফজরের পিঠে জোরে আঘাত করে। তারপর খেঁকিয়ে বলে উঠে, “শালা চাকর পাইছস, তোগো সেবা করার লাইগা খারাইছি? কাম কর।’

    ফজর বাড়ি খেয়ে কাদা পানির মধ্যেই ছপ করে লুটিয়ে পড়ল, পিঠে তীক্ষ্ণ একটা যন্ত্রণা ছড়িয়ে পড়ছে। একবার মুখ তুলে চেয়ে দেখলো সব ঝাপসা হয়ে আসছে, অস্পষ্টভাবে রাস্তায় যেন মজিদকে দেখতে পেলো সে। দূরে কেউ যেন ডেকে উঠলো ‘বাজান’ বলে। কাদা মাখামাখি হয়ে যাওয়া ফজরকে ধরে একপাশে নিয়ে আসলো ইউসুফ মুন্সি। বেশি জোরে মেরে ফেলেছিল ছোকরা পুলিশটি। এখন বেচারার একটু খারাপই লাগছে, কিন্তু মুখে সে খারাপ লাগা বিন্দুমাত্র প্রকাশ না করে, পাশেরজনকে তাচ্ছিল্যভরে বলল, ‘দেহেন তো ভাই মরছে নাকি? পানি-টানি দেন তো।’

    কাজে ফাঁকি দেয়ার ছুতা পেয়ে সবাই ঘিরে ধরলো ফজরকে, বাচ্চু এগিয়ে এসে বলল, ‘লাগতা হ্যায় মর গ্যায়া।’

    দুই একজন এগিয়ে এলো, মরে গেলে বেশ ভালো হয়, একটা হট্টগোল হবে। একঘেঁয়ে জীবনে একটু ঝামেলা হলে সেটা উপভোগ্যই হবে, বিশেষ করে ঝামেলাটা যদি হয় পুলিশ পক্ষের। সুজন মাস্টার নাড়ি ধরে বলল, ‘নাড়ি তো টের পাই না। হায় হায় মরলো নাকি?’

    মৃত্যুপ্রত্যাশীদের মুখ উজ্জ্বল হয়, ইউসুফ মুন্সি ডান হাতের আঙুলের ডগায় পানি নিয়ে ফজরের মুখে ছিটাতে থাকে সাথে বিড় বিড় করে দোয়াও পড়ছিল। ছিটানো পানির কল্যাণে অথবা দোয়ার জোরে ফজর ধীরেধীরে চোখ মেলে। মৃত্যুপ্রত্যাশীরা হতাশ হয়, সবাই কাজে ফিরে যায়, কিন্তু ফজরকে আর কাজ করতে হয়নি। সে ক্ষেতের আইলে একটি বড়ো লেবু গাছের তলায় বসে ছিল। অজ্ঞান হওয়ার আগে সে মজিদকে দেখেছিল, ‘বাজান’ ডাক শুনেছিল। আরো একবার ছেলেকে দেখার জন্য, ছেলের ডাক শোনার জন্য, স্থিরদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সে।

    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleনীল পাহাড় – ওবায়েদ হক
    Next Article রুবাইয়্যাৎ – ওমর খৈয়াম

    Related Articles

    ওবায়েদ হক

    নীল পাহাড় – ওবায়েদ হক

    July 17, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo
    Most Popular

    রবিনসন ক্রুসো – ড্যানিয়েল ডিফো

    August 19, 2025

    অনুরাধা

    January 4, 2025

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    রবিনসন ক্রুসো – ড্যানিয়েল ডিফো

    August 19, 2025

    অনুরাধা

    January 4, 2025

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025
    Our Picks

    রবিনসন ক্রুসো – ড্যানিয়েল ডিফো

    August 19, 2025

    দ্য দা ভিঞ্চি কোড – ড্যান ব্রাউন

    August 19, 2025

    এঞ্জেলস এন্ড ডেমনস – ড্যান ব্রাউন

    August 19, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    Sign In or Register

    Welcome Back!

    Login below or Register Now.

    Lost password?

    Register Now!

    Already registered? Login.

    A password will be e-mailed to you.