Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    রবিনসন ক্রুসো – ড্যানিয়েল ডিফো

    August 19, 2025

    দ্য দা ভিঞ্চি কোড – ড্যান ব্রাউন

    August 19, 2025

    এঞ্জেলস এন্ড ডেমনস – ড্যান ব্রাউন

    August 19, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • 🔖
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    Subscribe
    সাইন ইন
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    তেইল্যা চোরা – ওবায়েদ হক

    ওবায়েদ হক এক পাতা গল্প132 Mins Read0

    তেইল্যা চোরা – ৭

    ৭

    খালি পেটে ঘুমানোর অভ্যাস আমেনার আছে, কিন্তু রোশনীর নেই। তার চোখ এখনো শুকায়নি, সুযোগ পেলেই এখনো চোখ ভেজায়। কনকনে ঠাণ্ডা বাতাস একটু পরপর যেন চাবুক মেরে যাচ্ছে। বাঁশের বেড়া সেই ঠাণ্ডা ভয়ানক বাতাস আটকাতে পারছে না। মজিদকে মাঝখানে রেখে আমেনা আর রোশনী দুই পাশে শুয়েছে। ছেঁড়া একটা কাঁথা শীত নিবারণ করতে পারছে না। আমেনাও এই শীতে ঘুমাতে পারছে না। মজিদের গা’টা একটা চটের বস্তা দিয়ে ঢেকে দিয়েছে। নাকেমুখে বাতাসের ঝাঁপটা লাগতে পারে, তাই নিজের আচঁল দিয়ে মজিদের মুখটা ঢেকে দিয়েছে সে। রোশনী নিঃশব্দে কান্নার চেষ্টা করছে কিন্তু মাঝেমধ্যে নাকের ফ্যাঁচ ফ্যাঁচ শব্দ হচ্ছে। আমেনা বিরক্ত হয়ে বলল, ‘এতো কান্দ কেন? কানলে কি জামাই ফিরা পাবা নাকি কপালে ভাত জুটবো?’

    রোশনী আঁচল দিয়ে ফ্যাত করে নাক মুছে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, ‘কী করুম কও, কানলে খাওয়া জুটতো না, না কানলেও তো জুটতো না। কাইন্দা মনডারে ভাইল দেই। বইন ঘরে বইয়া থাকতে আর মন চায় না। কাইল কাজী বাড়িত ধান বানতে গেলে আমারেও নিও।’

    ‘ধান ভানা শেষ।

    ‘কও কী? ধান না ভানলে চাইল বা কেমনে? আমরা খাইয়া না খাইয়া তো আছিই, পোলাডা খাইবো কী?’

    ‘জানি না গো বইন। হেলেঞ্চা টুকাইয়া আইনা হিজাইয়া দুইটা ভাত পোলাডারে খাওয়াইতাম, কিন্তুক কাম না থাকলে কী করুম? ভীক্কা করতে অইবো নাইলে গতর বেচতে হইবো। চোরের জোয়ান বউরে কেউ ভীক্কা দিব না, গতর দিলে ঠিকই নিবো। গঞ্জে নাকি বেশ্যাঘর আছে, হেদিকে যামুগা।

    রোশনী ভাবলো, তার ননদ বেশ্যা হবে? তার নিজের ভাগ্যও হয়তো তাই। শোকে কাঁদছিল এতক্ষণ, আশঙ্কায় সে কান্না থেমে গেল, বুকটা কেঁপে উঠলো, সে আর কোনো কথা বলল না।

    ভোর হয়েছে কেবল, সূর্য তখনো উঠেনি। উঠলেও কুয়াশা ঠেলে রোদ পৌঁছাতে পারেনি। মোরগের ডাকে আমেনার ঘুম ভাঙ্গলো, মোরগের নাম হুরমতি। হুরমতি শেষ রাতে উঠে পড়ে, আমেনার পিন্ডি চটকিয়ে দিন শুরু করে এখন। হুরমতির গলার সাথে আরেকটা শব্দ পাওয়া গেল, ঠক ঠক শব্দ, কাঠ কাটার শব্দ। আমেনা হুড়মুড়িয়ে উঠলো, কাঠ কাটে কে? বাহিরে এসে প্রবল ঠাণ্ডা হাওয়া একটা ধাক্কা দিলো যেন, ঠাণ্ডায় আমেনা হাত পা গুটিয়ে এতটুকুন হয়ে গেল। কুয়াশার ভেতর ঢুকে গেল সে, বাঁশঝাড়ের কাছ থেকে শব্দটা আসছে। কাছে গিয়ে দেখলো, একটা মেয়ে কোমরে শাড়ি পেঁচিয়ে, কুড়াল দিয়ে বাঁশ কাটছে। আমেনা কাছে গিয়ে সেই মেয়েকে চিনতে পারলো, রোশনী। আমেনা কাছে গিয়ে বলল, ‘কী করো ভাবী?’

    রোশনী বাঁশে কুড়াল দাগা থামিয়ে জোরে শ্বাস টেনে বলল, ‘গতর বেচতে হইব না, গতর খাইটা কাম করুম।’

    *

    মোহাম্মদপুর গ্রামের মানুষের প্রধান পেশা হচ্ছে ‘ছইয়াল’। খুব উচ্চবিত্ত ছাড়া টিনের ঘর দেখা যায় না, সবাই বাঁশ অথবা পাটকাঠি দিয়ে ঘর বাঁধত। বাঁশের বেড়াই বেশি চলে। মোহাম্মদপুরের শিশুরা কথা বলতে শেখার আগেই বাঁশের কাজ শিখে যায়। বাঁশ দিয়ে চাটাই বানায়, মাছ ধরার চাঁই বানায়, ঝুড়ি বা ডুলা বানায়, ওড়া বানায়। রোশনীও সেই বিদ্যা ভুলে যায়নি। আমেনা উচ্ছসিত হতে গিয়েও নিজেকে সামলে নিলো, কী যেন মনে পড়ে গেল। রোশনীর দিকে তাকিয়ে বলল, “ভাবী বাঁশ কাইটা ওড়া বানাইবা, কিন্তুক কিনব কেডা? বেচতে হইলে গঞ্জে লইয়া যাইতে হইবো।’

    ‘আমি লইয়া যামু গঞ্জে।’

    ‘মাইয়া হইয়া গঞ্জে যাইবা? মাইনষে নানান কতা কইবো।’

    ‘গতর বেচার লাইগা বেশ্যা হইয়া গঞ্জে যাওনের থেইকা ওড়া, ডুলা বেঁচতে গঞ্জে যাওন ভালা। কে কী কইবো পরে দেহন যাইবো। মাইনষের কতা দিয়া পেট ভরত না।’

    ‘তুমি একলা যাইবা?’

    ‘না আমার লগে একজন পুরুষ মানুষও যাইবো।’

    আমেনা ভ্রু কুঁচকে রোশনীর দিকে তাকায়, রোশনী হেসে উঠে গা দুলিয়ে। হাসি থামিয়ে বলে, ‘ডরাইও না গো ননদ, মজিদরে লইয়া যামু।’

    ভোরবেলা ঘন কুয়াশার মধ্যে থরথর করে কাঁপতে কাঁপতে মানুষজন ঘর থেকে বেরিয়ে গেছে। কেউ মাঠে, কেউ ঘাটে, কেউ আবার হাটে। উপরের দিকে তাকিয়ে তারা রোদের অপেক্ষা করে, তাদের চিট পরা ছেঁড়া ময়লা কাপড়ে শীত ঢোকার জন্য যথেষ্ট ফাঁকফোকর পেয়ে যায়। রোশনী তার আঁচলখানা বেশ ভালো করে গায়ে মুড়িয়ে নিয়েছে তার মাথায় ওড়ার বোঝা, তার উপর বাঁশের চাঁটাই আর কিছু ঝুড়ি। মজিদও তার সাথে তাল মিলিয়ে হাঁটার চেষ্টা করছে, তার গায়ে চটের বস্তাটি ভালো করে জড়িয়ে দিয়েছে আমেনা। মজিদের মন খুব ভালো, গঞ্জে যেতে পারলেই তার ভালো লাগে, অতি উৎসাহে হেঁটে সে মাঝেমধ্যে রোশনীকে পেছনে ফেলে দিচ্ছে। রোশনী এক হাতে মাথার ঝাকাটা ধরে অন্যহাতে মজিদের হাত ধরলো।

    বলরামপুর গ্রাম আর গঞ্জের মাঝখানে একটা ছোটো নদী আছে, নাম কালী নদী, তারা বলে কালী গাঙ। নদীর পানি চোখের মণির মতো কালো। অনেকে বলে এটা আসলে খাল ছিল, অনেক আগের এক জমিদার এই খাল কেটেছিল, মা কালী নাকি তাকে স্বপ্নে বলেছিল। সেই খালই নাকি এখন নদী হয়ে গেছে। কালী নদী নামের পেছনে ‘দেবী’ নাকি ‘কালো পানি’ কোনটার ভূমিকা আছে তা স্পষ্ট নয়। নদী থেকে ভোরবেলা গরম পানির মতো ধোঁয়া বের হচ্ছে। রোশনী কালী গাঙের পাড়ে থমকে দাঁড়িয়ে গেল। এখন কীভাবে নদী পার হবে? হঠাৎ নদীর পানির উপর ভেসে থাকা কুয়াশার কুণ্ডুলি থেকে একটা নৌকা বেরিয়ে এলো। নৌকার অপর প্রান্ত এখনো ধোঁয়াটে। মাথায় গামছা বাধা, বয়স ত্রিশের এক লোক হাঁক ছাড়লো, ‘উইঠ্যা পড়ো গো মনা, পার কইরা দেই।’

    মাঝিটি বোধহয় রোশনীকে দেখতে পায়নি, মজিদকে দেখেই এই সম্বোধন। রোশনীকে দেখেই একটু চমকে গেল, লজ্জাও পেলো। রোশনী আর মজিদ নৌকায় উঠে বসলো। মাঝি আড়চোখে তার যাত্রীদের কিংবা নারী যাত্রীকে দেখে নিলো। তার দীনতা মলিন শাড়িতেই প্রকাশ পায়, ঘোমটার ফাঁক দিয়ে এলোমেলো চুল বেরিয়ে পড়েছে, চুলে তেল চিরুনীর স্পর্শ পড়ে না অনেকদিন। তবুও এই শ্যামবর্ণ নারীটি যেন কালী গাঙের মতোই। শীত গ্রীষ্মেও কালী নদীর পানি শুকিয়ে যায় না, পানি কালো কিন্তু স্বচ্ছ। এই মেয়েটিও যেন তাই, স্বচ্ছ। রোশনী চোখ তুলতেই মাঝির সাথে চোখাচোখি হয়ে গেল। মাঝি আবার লজ্জা পেলো, বৈঠা চালিয়ে পরিবেশ স্বাভাবিক করার জন্যই বলল, ‘আপনারে আগে দেখি নাই কুনোদিন, কুটুম নাকি?’

    রোশনী মাথার ঘোমটাটা আরেকটু টেনে দিয়ে বলল, ‘কুটুমও কইতে পারেন, আমার ননদের লগে থাকতে আইছি, কয়দিনের লাইগা আইছি জানি না।’

    রোশনী মনে মনে নিজেকে অভশম্পাত দিলো, অপরিচিত জোয়ান মাঝিকে এতকিছু কেন বলতে গেল সে, কিন্তু মাঝির কথায় এবং চোখে এত সারল্য যে আপন ভেবে সব কথা বলে দিতে ইচ্ছা করে। মাঝিটি মজিদের দিকে ইশারা করে বলল, ‘আপনের ছাওয়াল?’

    রোশনী এবার গম্ভীরভাবে জবাব দিলো, ‘না।’

    ছোটো নদী পার হতে বেশি সময় লাগলো না। পাড়ে ধাক্কা খেয়ে নৌকা থেমে গেল। মাঝি বলল, ‘দশ পাই (পয়সা) কইরা একজন, দুইজনে বিশ পাই।’

    রোশনী চুপ করে বসে আছে, কিছুক্ষণ পরে বলল, ‘পইসা তো নাই মাঝি, গঞ্জে ওড়া ঝুড়ি বেঁচতে যাই, মাদাইন্যা বেলা আবার যামু তহন পইসা দিমুনে।’

    মাঝি চমকে উঠলো, পয়সার জন্য নয়, এই মেয়ে গঞ্জে যাচ্ছে সেটা ভেবেই মনটা আঁতকে উঠলো। তার গঞ্জে যাওয়ার প্রয়োজন কী? স্বামী নাই? ভাই নাই? গঞ্জে যে পুরুষ আর বেশ্যা ছাড়া কেউ যায় না।

    গঞ্জে ঢুকার রাস্তাটাতে অনেক মানুষজন আসা যাওয়া করছে। এখানে কিছু ভিখারিনী বসে আছে, লোক দেখলেই হাত পেতে চেঁচাচ্ছে, কোলের বাচ্চাকে চিমটি দিয়ে কাঁদাচ্ছে। দুই-একজন বিরক্তি ভরা মুখে পাঁচ পয়সা ছুড়ে দিচ্ছে। পাঁচ পয়সার বিনিময়ে কিছু পুণ্য আয় করে অনেকে তৃপ্ত হয়। রোশনীকে দেখে একজন এগিয়ে এলো, একটু আগেই করুণ মিনতি করছিল সে। যখন কথা বলল, তখন রোশনীর বিশ্বাস হচ্ছিলো না একটু আগে এই বৃদ্ধাই করুণ সুরে ভিক্ষা চাইছিল। বৃদ্ধা গলায় বেশ তেজ এনে বলল, ‘এইদিকে বসন যাইবো না, অন্যদিকে বসো গা। জোয়ান মাগী আইছে ভিক্ষা করতে, জ্বালায় বাচি না।’

    রোশনী একটু সময়ের জন্য হতভম্ভ হয়ে গেল সম্ভবত বৃদ্ধার সুর পরিবর্তনে। সে নম্রভাবে বলল, ‘ভিক্ষা করতে আইনাই গো কাকী। বেচতে আইছি।’

    বৃদ্ধা কোমর নাচিয়ে রোশনীর কথার সুর নকল করে বলে উঠলো, ‘বেচতে আইছি! জোয়ান মাগি আইছে গঞ্জে বাণিজ্য করতে। যাও গঞ্জের উত্তর দিকে যাও, হেদিকে ভালা বেচাকিনা হয়।’

    ‘উত্তরদিকে কী গো কাকী?’

    ‘বেশ্যাঘর।’

    রোশনী চোখ দুটি আগুনের মতো জ্বলে উঠলো। সে ক্রুদ্ধকণ্ঠে বলল, ‘বেশ্যাঘর তো ভালাই চিনো, জোয়ানকালে কী হেদিকেই আছিলা?’ বলেই হনহন করে হেটে গঞ্জে ঢুকলো। পাতলা কয়েকটা দোকানঘর আছে এদিকে, কিছু লোক দোকানগুলোতে সদাই করছে, নাপিত বসেছে একজন পিড়ি পেতে। শসা, লাউ, কুমড়া নিয়ে দশ বারো বছরের একটা ছেলে বসে আছে খদ্দরের আশায়, তার বিষণ্ন মুখ দেখে বুঝা যায় এখনো কিছু বিক্রি করতে পারেনি। গাছে পেরেক গেঁথে একজন লোক খালি গায়ে চিটমিঠাই বানাচ্ছে। রোশনীকে দেখে সবার কাজে যেন স্থবিরতা চলে এলো, এক মুহূর্ত সব চাঞ্চল্য বন্ধ হয়ে গেল। ঘুরে ঘুরে রোশনীকে দেখছে কিছু লোক, গঞ্জে যেন সব মেয়েকে এভাবেই খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে হয়, পাতলা ছেঁড়া শাড়ির ভেতরে চোখ গেঁথে রেখেছে তারা। রোশনী ঘোমটাটা আরো টেনে আঁচলটা দাঁতে চেপে রাখলো। ভেতরে মনে হয় মূল হাট বসে। সেখানে পুরুষ মানুষে গিজগিজ করছে। রোশনীর সাহস হলো না ভেতরে যাওয়ার। কোমর থেকে জিনিসপত্র নামিয়ে দশ বারো বছরের ছেলেটির পাশে গিয়ে রাখলো, সেখানেই খুলে বসলো তার ভ্রাম্যমান দোকান।

    ঘোমটার আড়ালে লোকের চক্ষু সে ঠিকই দেখলো, কিন্তু কারো চোখে চোখ রাখলো না। গাছের ফাঁক দিয়ে গলে পড়া এক টুকরো রোদে মজিদকে বসিয়ে দিলো, নিজে বসলো একটু তফাতে। সকালের আড়ং প্রায় শেষ, মানুষজন দলে দলে বাড়ি ফিরে যাচ্ছে। রোশনীকে বসে থাকতে দেখেই ফিসফাস শব্দে আলোচনা হচ্ছে। জায়গায় জায়গায় জটলা বেঁধে গেছে। একটা মেয়ে মানুষ গঞ্জে এসেছে, দোকান খুলে বসেছে, এমন ঘটনা আগে ঘটেনি। কেউ গিয়ে আগ বাড়িয়ে কিছু কিনছে না, কিছু জিজ্ঞাসাও করতে পারছে না। মজিদের গায়ে পড়া রোদটা ঢেকে গেল, মেঘের মতো একদল লোক জটলা বেঁধেছে তাদের সামনে। মুরুব্বী গোছের এক লোক মজিদকে বলল, ‘ঐ পোলা তর মারে ক, এই গঞ্জে কেউ জেনানাগো কাছ থেইক্যা কিছু কিনবো না। এইডা জেনানাগো জায়গা না, তাগো জায়গা ঘরে।

    মজিদকে কিছুই বলতে হলো না, রোশনী সবই শুনেছে। সে নড়লো না, ঠায় বসে রইলো মাথা নিচু করে। মুরুব্বী এবার আর মধ্যবর্তী মাধ্যম ব্যবহার না করে রোশনীকে সরাসরি বলল, ‘এদিকে বুইয়া থাইক্যা লাভ নাই, ঘরে যাও।’

    ঠিক তখনি ভিড়ের মধ্য থেকে একজন সুঠাম দেহের পুরুষ এগিয়ে এলো, এখানের আলোচনা, পরিস্থিতি তোয়াক্কা না করে, সে মজিদকে জিজ্ঞাসা করলো, ‘ঐ ছ্যাড়া ডুলাডার দাম কতো?’

    সবগুলো চোখ বিস্ময়ে লোকটার দিকে ঘুরে গেল, রোশনীও ঘোমটার ফাঁক দিয়ে এক দফা দেখে নিলো, লোকটার হাতে বৈঠা, সেই কালী গাঙের মাঝি। মজিদ ডুলার দাম জানে না, সে বলল, ‘একশ ট্যাকা।’

    দাম শুনে ভিড়ের মধ্যে একটা হাসির রোল ছড়িয়ে পড়ল। মুরুব্বীর চোখ কেমন সরু আর মুখ শক্ত হয়ে গেল, একটু আগের গম্ভীর, ক্রুদ্ধ মানুষগুলো এখন হাসছে। সে রুক্ষ গলায় বলল, ‘হাসো হাসো, শয়তানে আছর করছে তোমাগো।’

    তার কথাটা হাসির মধ্যে হারিয়ে গেল। মুরব্বীর চোখে আগুন ধরে গেল, হনহন করে চলে যাওয়ার সময় মাঝির দিকে তাকিয়ে বলল, ‘নসু তোর বেয়াদ্দপি দিন দিন বাড়তাছে, মনে রাখিছ।’

    নসু তার মুখে হাসি ধরে রেখেই বলল, ‘আইচ্ছা, সালিশ বসাইয়া খবর দিয়েন, আমি চইলা আসুম।’

    এতক্ষণ পর রোশনী মুখ খুলল, বলল, ‘ডুলার দাম চাইর আনা।’

    নসু মাঝি লুঙ্গির খুট থেকে চার আনা বের করে দিলো। রোশনী বলল, ‘লাগবো না, এমনেই আপনের করজদার।’

    নসু একটি ডুলা হাতে নিয়ে, মজিদের হাতে পয়সা গুঁজে দিয়ে কিছু না বলে হাতে বৈঠা ঘুরাতে ঘুরাতে চলে গেল। রোশনী তাকিয়ে থাকলো, চোখ ভিজে এলো তার।

    পড়ন্ত দুপুরে রোশনী আর মজিদ কালী নদীর ধারে পৌঁছালো। দু আনার বাতাসা মুড়ি কিনেছে রোশনী, তারই খানিকটা আঁচলে রেখে চাবাচ্ছিলো, মজিদও আঁচলে হাত দিয়ে মুড়ি কম বাতাসা বেশি খাচ্ছিল। নৌকায় খালি গায়ে নসু মাঝি বসে ছিল, এই সময় তার যাত্রীদের আকাল থাকে, তাই বাড়ি চলে যায়। আজ থেকে গেল, সম্ভবত রোশনী আর মজিদের অপেক্ষাতেই। কালী গাঙের মাঝি নসুর শরীরটাও কয়লা কালো, কিন্তু চোখদুটোতে মায়া ভরা। কয়লার মাঝে যেন জ্বলজ্বল করা দুটি হীরকখণ্ড। এই প্রথম মাঝির চোখে চোখ রেখে হীরকখণ্ড দুটো আবিষ্কার করলো রোশনী। লজ্জায় কিংবা কৃতজ্ঞতায় চোখ নামিয়ে নিলো। আঁচলটা মাথায় তুলে দিতে গিয়ে খেয়াল করলো, তা মুড়ি দখল করে নিয়েছে, লাজুক মুখে এলোচুলে দাঁড়িয়ে রইলো সে। নসু মাঝি কৌতুক ভরা কন্ঠে বলল, ‘ভালা বাণিজ্য হইছে, এইবার আর কুটুমরে বাকিতে পার করবো না।’

    নসুর কৌতুকে রোশনী যেন সহজ হয়ে গেল, এই খালি গায়ের কালো মাঝিটি যেন কত পরিচিত। সে বলল, ‘বাণিজ্য তো তোমার দয়ায় হইলো মাঝি, তোমার কাছে আমরা আজীবনের করজদার।’

    ‘তা কইলে হইবো না কুটুম, দেনা শোধ করতে হইবো।’

    ‘আইচ্ছা, তুমি কোনোদিন ডুলা বেইচো, আমি কিনমু।’

    হো হো করে হেসে উঠলো মাঝি, রোশনীও হাসলো, কতদিন পরে হাসলো সে হিসেব ভুলে গেছে সে। মজিদ কিছু না বুঝেই হাসছে। রোশনী ডিঙ্গিতে বসে নসুর দিকে তাকিয়ে বলল, ‘তোমার তো ক্ষতি কইরা দিলাম মাঝি, মুরুব্বী তো তোমার উপ্রে রাগ করছে।’

    ‘আরে ধুর, ঐসব নসু মাঝি পাত্তা দেয় না। কত বিচার বসাইছে, সালিশ ডাকছে, আমার কচুও হয় নাই। দরমাইন্নারাও এই নসুরে ডরায়।

    ‘ক্যান ডরায়? আমার তো তোমারে ডর লাগে না।’

    ‘আমি একলা মানুষ, আগে পিছে কেউ নাই। আমার লাইগা কান্দনের কেউ নাই, আমার ডরও নাই, যার ডর নাই তারে সবাই ডরায়।’ কিছুক্ষন থেমে বৈঠা চালিয়ে শান্ত পানিকে দ্বিখণ্ডিত করে জিজ্ঞাসা করলো, ‘তুমি কুটুম মানুষ, গঞ্জে ক্যান? তোমার সুয়ামী কই?’

    রোশনীর বুকে রক্ত ছলাত করে উঠলো, চোখ দিয়ে ছল ছল করে অশ্রু গড়িয়ে পড়ল। নসু অবাক হয়ে গেল, মজিদ বলে উঠলো, ‘আমার মামা মইরা গেছে।

    নসু মাঝি পরম মমতায় বিধবা কুটুমের কান্না দেখছিল, তার মনটা ছটফট করে উঠলো, কিন্তু সে স্থির হয়ে রইলো শান্ত কালী গাঙের মতো।

    উঠানে শুকনো পাতা গড়াগড়ি করছে, ঝাঁট দেয়নি আমেনা। আজ দুইদিন হলো চুলা ধরানোর প্রয়োজন হয়নি, তাই রসুই ঘরেও কাজ ছিল না তার। দাওয়ায় বসে সে মাঠের সরু পথটার দিকে তাকিয়ে আছে। মনে অনেক চিন্তা আসছে অধিকাংশই ভালো চিন্তা নয়। মজিদ ছাড়া তার আর কিছু নেই, তার স্বামী মজিদের গায়ে হাত দিয়ে কসম কেটে তবুও চুরি করেছে। সেই কসমের কু প্রভাবে মজিদের একটা ক্ষতি হতেই পারে। মাঠের মধ্যে দূরে দুটি বিন্দু দেখতে পেলো আমেনা, ক্ষুদ্ৰ বিন্দুটি চোখে পড়তেই বুক থেকে যেন কয়েক মন ভার নেমে গেল। মজিদ এখনো মুড়ি বাতাসা চাবাচ্ছে। রোশনীর হাতের পুটলীতে সের দুয়েক চাল নিয়ে এসেছে, মজিদ এক মুঠো মুড়ি আর কিছু বাতাসা তার মায়ের দিকে এগিয়ে দিলো, ‘মা তোর লাইগা আনছি।’

    আমেনা ছেলেকে বুকের মধ্যে পুরে নিলো। দৃশ্যটা পূর্ণ হতো যদি আমেনার চোখ বেয়ে জল নেমে আসতো কিন্তু সে সাধ্য তো তার নেই।

    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleনীল পাহাড় – ওবায়েদ হক
    Next Article রুবাইয়্যাৎ – ওমর খৈয়াম

    Related Articles

    ওবায়েদ হক

    নীল পাহাড় – ওবায়েদ হক

    July 17, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo
    Most Popular

    রবিনসন ক্রুসো – ড্যানিয়েল ডিফো

    August 19, 2025

    অনুরাধা

    January 4, 2025

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    রবিনসন ক্রুসো – ড্যানিয়েল ডিফো

    August 19, 2025

    অনুরাধা

    January 4, 2025

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025
    Our Picks

    রবিনসন ক্রুসো – ড্যানিয়েল ডিফো

    August 19, 2025

    দ্য দা ভিঞ্চি কোড – ড্যান ব্রাউন

    August 19, 2025

    এঞ্জেলস এন্ড ডেমনস – ড্যান ব্রাউন

    August 19, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    Sign In or Register

    Welcome Back!

    Login below or Register Now.

    Lost password?

    Register Now!

    Already registered? Login.

    A password will be e-mailed to you.