Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    নৌকাডুবি

    October 26, 2025

    আরণ্যক – বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়

    October 25, 2025

    থ্রি মাস্কেটিয়ার্স – আলেকজান্ডার দ্যুমা

    October 21, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    থ্রি মাস্কেটিয়ার্স – আলেকজান্ডার দ্যুমা

    ফারুক হোসেন এক পাতা গল্প60 Mins Read0
    ⤶

    ২. অ্যাট্রাগঁন মাদাম বোনাসিক্সের অপহরণ

    অ্যাট্রাগঁন মাদাম বোনাসিক্সের অপহরণ এবং তাঁর মুক্তি পুনরায় কার্ডিনাল এর রক্ষী বাহিনীর দ্বারা আক্রান্ত আর তাদের হাত থেকে মাদাম বোনাসিক্সকে উদ্ধার করার কথা বলার পর জানাল রানীর সমূহ বিপদের কথা।

    সব কথা শোনার পর দ্য ট্রেভিলকে খুবই চিন্তিত মনে হলো। তিনি দ্য অ্যাট্রাগঁনকে ধন্যবাদ জানালেন তাকে এই খবর সময় মতো দেবার জন্য আর বললেন রাজা-রানীকে অন্তরের সাথে রক্ষা করার ব্রত যেন সে গ্রহণ করে।

    অ্যাট্রাগঁন তার নিজের বাড়িতে এসে তার ভৃত্য প্ল্যানচেট জানাল মঁসিয়ে অ্যাথোসকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে গেছে কার্ডিনাল-এর সৈন্যরা। মঁসিয়ে অ্যাথোসকে আপনি ডেকে পাঠিয়েছিলেন। আপনি চলে যাবার পরই তিনি আসেন আর তার কিছুক্ষণ পরই কার্ডিনাল-এর অনেক সৈন্য এসে ধরে নিয়ে যায় বিচারের জন্য।

    ‘কিন্তু আমি বুঝতে পারছি না অ্যাথোসকে তারা কেন গ্রেপ্তার করল? সে-তো এসবের বিন্দু বিসর্গ কিছুই জানে না!’ অ্যাট্রাগঁন মাঝ পথে থামিয়ে প্লানচেটকে প্রশ্নটা করল।

    প্ল্যানচেট বলল–‘হ্যাঁ মঁসিয়ে, আপনাকে ধরতে এসে তারা ভুল করে। মঁসিয়ে অ্যাথোসকে ধরে নিয়ে গেছে চিনতে না পেরে।’

    ‘তা তো বুঝলাম, কিন্তু অ্যাথোস তার নিজের পরিচয়টা দিলেই আর গ্রেপ্তার হতো না।’

    ‘মঁসিয়ে অ্যাথোস সেটা সম্ভবত জানত; তাই যাবার আগে আমায় চুপিসারে বলে যায়–‘বন্ধু অ্যাট্রাগঁনকে বলল সে তো এই চক্রান্তের বিষয়ে অনেকটা জানে আর আমি কিছুই জানি না। তিন দিন পর আমি আমার নিজের পরিচয় দিয়ে ছাড়া পেয়ে আসবো, আর এই তিন দিনে অ্যাট্রাগঁন যেন এই চক্রান্তটাকে ধ্বংস করার কাজে অনেকটা এগিয়ে যায়। এই তিনদিন ওকে কেউ ঘটাবে না।’

    ‘বাঃ চমৎকার, মহৎ হৃদয় তোমার অ্যাথোস’ অ্যাট্রাগঁনের মুখ গর্বে উজ্জ্বল হয়ে উঠল।

    মঁসিয়ে দ্য ট্রেভিলের নির্দেশ ছিল সমস্ত নতুন ঘটনাই যেন তাকে সাথে সাথে জানানো হয়। অ্যাথোসের গ্রেপ্তার খবরটা তাঁকে জানাতে মঁসিয়ে দ্য অ্যাট্রাগঁন দ্য ট্রেভিলের বাড়ির দিকে রওনা হলো। সেখানে সে খবর পেলো মঁসিয়ে দ্য ট্রেভিল রানীর প্রাসাদে লুভেতে তাঁর রক্ষী বাহিনী নিয়ে রওনা হয়েছেন। অ্যাট্রাগঁন বুঝতে পারল রানীকে সুরক্ষার জন্যই মঁসিয়ে দ্য ট্রেভিলে লুভেতে গিয়েছেন। অ্যাট্রাগঁন দ্রুত পায়ে সেই দিকে রওনা হলো।

    কিছুটা গিয়েই হঠাৎ চমকে গিয়ে অ্যাট্রাগঁন দেখল দু-জন ব্যক্তি খুব সন্দেহজনক ভঙ্গিতে লুভের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। ভালো করে লক্ষ্য করে বুঝতে পারল তাদের মধ্যে একজন পুরুষ আর অপরজন মহিলা। আর সেই মহিলা যে মাদাম বোনাসিক্ষ তাতে কোনো সন্দেহ থাকার কথা নয়। দ্য অ্যাট্রাগঁন এগিয়ে গেল এবং তাদের সামনে থমকে দাঁড়াল। এক পা পিছনে সরে গিয়ে আগন্তুক বিদেশী উচ্চারণে প্রশ্ন করল—‘আপনি কি চান মঁসিয়ে?’

    ‘আপনার সাথে আমার কোনো কথা আছে বলে আমার মনে হয় না। আমি এই মহিলার ব্যাপারেই উৎসাহী। বেশ ঝাঁঝালো ভাবেই কথাগুলো বলল অ্যাট্রাগঁন। সেই বিদেশী বলল,–‘তাই না-কি? আপনি কি এই মহিলাকে চেনেন?’

    ‘আমার তো মনে হয় আমি খুব ভালোভাবেই চিনি।’

    ঠিক আছে আপনি চিনুন কি না চিনুন তাতে আমার কিছু এসে যায় না। এই বলে সেই আগন্তুক বলল–‘মাদাম আসুন আমার হাত ধরুন আমরা আমাদের পথে এগিয়ে যাই।’

    হতবুদ্ধি হয়ে দ্য অ্যাট্রাগঁন তাদের পথ আগলে দাঁড়িয়ে থাকাতে দু-পা এগিয়ে তাহ দিয়ে অ্যাট্রাগঁনকে পথ থেকে সরাতেই অ্যাট্রাগঁন নিমেষে তরোয়াল খুলে দাঁড়াল। ঠিক একই সময় সেই আগন্তুকও তার নিজের তরোয়াল কোষমুক্ত করল।

    আর মাদাম বোনসিক্স তক্ষুনি তাদের দুজনের হাত ধরে থামাল।

    ফরাসি উচ্চারণে বিদেশী আর মাদাম বোনাসিক্সের মধ্যে কয়েকবার ‘মাইলর্ড’ সম্বোধনে কথা হলো অ্যাট্রাগঁন বুঝতে পারল বিদেশী একজন যোদ্ধার ছদ্মবেশে রয়েছেন। আড়ালে ইনি আসলে আমাদের রানীর প্রেমিক বাকিংহামের ডিউক।

    ‘আমায় ক্ষমা করবেন মহামান্য প্রভু, আমার বুঝতে ভুল হয়েছিল।’ অ্যাট্রাগঁন অভিবাদ জানিয়ে বলল–‘আমায় ক্ষমা করবেন মহামান্য ডিউক। আসলে আমি এই মহিলাকে চিনি। মাদামের সাথে একজন সাধারণ যোদ্ধার ছদ্মবেশে আপনাকে দেখে আমার রাগ হয়েছিল। এবার আদেশ করুন মহামান্য ডিউক আপনার জন্য আমার জীবন কীভাবে নিয়োজিত করতে পারি।’

    ‘তুমি একজন সাহসী যুবক। ঠিক আছে আমি তোমার সাহায্য নেবো কুড়ি দা দূর থেকে তুমি আমাদের অনুসরণ করবে। আর কেউ যদি আমাদের বাধা দিতে আসে তাকে তুমি হত্যা করতে কুণ্ঠিত হয়ো না।’ ডিউক বললেন।

    মাদাম বোনাসিক্স আর ডিউক এগিয়ে যাবার পর মঁসিয়ে দ্য অ্যাট্রাগঁন উন্মুক্ত তরোয়াল হাতে তাদের পিছন পিছন যেতে লাগল। আর প্রার্থনা করতে লাগল এমন কেউ কেউ এসে ডিউককে বাধা দিক যাতে সে তরোয়ালের এক কোপে তাকে শেষ করে ডিউককে দেখাতে পারে সে তার অনুগামী। কিন্তু দুর্ভাগ্য অ্যাট্রাগঁনের সে রকম কোনো ঘটনাই ঘটল না। ডিউক ও মাদাম বোনাসিক্স নিরাপদে রানীর প্রাসাদ লুভের-এর পেছনের দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকল।

    এদিকে মঁসিয়ে বোনাসিক্সকে বাস্তিল দুর্গে গ্রেপ্তার করে নিয়ে আসার পর কমিশনার তাকে প্রশ্ন করল তার নাম বয়স পেশা ও বাসস্থান কোথায়?

    অভিযুক্ত মঁসিয়ে বোনাসিক্স বললেন তার নাম জেকাস মেখাইল বোনাসিক্স একান্ন বছর বয়স, একজন অবসরপ্রাপ্ত ব্যবসায়ী আর তার বাড়ির ঠিকানা ১৪ নং রু, ডেস, কোসসাইউর।

    কমিশার তাঁকে প্রশ্ন করল সিয়ে–‘আপনার একজন স্ত্রী বর্তমান?’

    ‘হ্যাঁ মঁসিয়ে ঠিকই, আমার মাত্র একটিই স্ত্রী আছে।’

    ‘কিন্তু আপনি তাকে কি কাজে নিযুক্ত করেছেন? যার ফলে তার সাথে আপনার কয়েক দিন যোগাযোগ নেই।’

    ‘মঁসিয়ে কমিশনার আমার স্ত্রীকে অপহরণ করা হয়েছে।’

    ‘আপনি জানেন কি কে এই অপহরণ করা হয়েছে।’

    ‘হ্যাঁ মঁসিয়ে তাকে চিনি, লোকটির গায়ের রঙ কালো, সুগঠিত আর ব্যবহারে প্রভুজনোচিত আচরণ।’

    আপন মনে অস্পষ্ট স্বরে কমিশনার বললেন ‘এ যে দেখছি কার্ডিনাল-এর নিজস্ব ব্যাপার।’

    মঁসিয়ে দ্য বোনাসিক্সকে আবার বাস্তিল দুর্গে নিয়ে যাওয়া হলো। সেখানে কার্ডিনাল স্বয়ং উপস্থিত ছিলেন। কার্ডিনাল উপস্থিত সকলকে বিদায় দিয়ে প্রশ্ন করলেন–‘মঁসিয়ে আপনার বিরুদ্ধে রাজদ্রোহিতা অভিযোগ আছে কেন না আপনি আপনার স্ত্রীকে রানীর অবৈধ প্রেমিক বাকিংহামের ডিউক প্যারিসে নিয়ে রানীর সাথে দেখা করার কাজে নিযুক্ত করেছেন।’

    মঁসিয়ে দ্য বোনাসিক্স বাস্তিলের অল্প আলোর পরিসরে কার্ডিনালকে চিনতে না পেরে বললেন–

    ‘মঁসিয়ে কার্ডিনাল ডি রিচেলিউ মিথ্যে চিঠির আশ্রয় নিয়ে বাকিংহানের ডিউককে প্যারিসে নিয়ে এসেছেন এবং তাঁকে ও আমাদের প্রিয় রানীকে হত্যার ষড়যন্ত্র করছেন।’

    ‘আপনার স্ত্রী এই কথা আপনাকে বলেছে?’ চিৎকার করে বলল কার্ডিনাল।

    ‘হ্যাঁ মঁসিয়ে আমার স্ত্রী আমায় একথা বলেছিল।’

    একটা লোককে ডেকে কার্ডিনাল আদেশ করল ‘যাও রকফোর্টকে এখনি পাঠিয়ে দাও।’

    রকফোর্ট আসতেই মঁসিয়ে দ্য বোনাসিক্স চিৎকার করে বলে উঠল ‘এই সেই লোক, যে আমার স্ত্রীকে অপহরণ করেছিল।’ একটা ঘণ্টা বাজাতেই দু-জন রক্ষী এসে অভিবাদন করে দাঁড়াল কার্ডিনাল এর সামনে। কার্ডিনাল আদেশ দিলেন ‘একে আমার অনুমতি না পাওয়া পর্যন্ত দুর্গে বন্দি করে রাখো।’ কার্ডিনাল আর রকফোট একটা ছোট রাস্তা দিয়ে বাইরে বেড়িয়ে যেতেই দুর্গের দরজা বন্ধ হলো। এরই মধ্যে মঁসিয়ে বোনাসিক্স রকফোর্ট আর কার্ডিনাল-এর আলোচনা দরজায় কান পেতে শুনল।

    রকফোর্ট কার্ডিনালকে জানাল—

    ‘রানী আর ডিউকের সাক্ষাৎ হয়েছে।’

    ‘কোথায়?’

    ‘লুভেতে।’

    ‘কখন তাদের মধ্যে সাক্ষাৎ হলো?’

    ‘প্রায় রাত সাড়ে বারোটায় রানীর দাসীরা লুকিয়ে লুভের পেছনের দরজা দিয়ে ডিউককে নিয়ে যায়।’

    ‘তারপর?’

    ‘তারপর রানী তাঁর দাসীদের উদ্দেশ্যে বলে তোমরা দশ মিনিটের জন্য এখানে অপেক্ষা করো আর রানী ডিউককে নিয়ে প্রাসাদের ভেতর নিজের ঘরে নিয়ে যায়।’

    ‘তাঁর সাথে কোনো দাসীই ছিল না।’

    ক্রুব্ধ স্বরে কার্ডিনাল বলল–‘বল রকফোর্ড, ডোনা তোমায় আর কি বলেছে।’

    ‘মঁসিয়ে আমি যতটুকু জেনেছি তা আপনাকে সবই জানাচ্ছি।’

    ‘ডিউক ঘরের মধ্যে প্রবেশ করেই দেখলেন, রানীর সুন্দর মুখ ভয়ে ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। রানী ডিউককে দিয়ে প্রতিশ্রুতি আদায় করলেন যে ডিউক যেন শীঘ্রই রাজদূত হিসেবে সালে রক্ষীবাহিনী নিয়ে একবার ফ্রান্সে আসে, আহলে রানী বুঝতে পারবে যে ডিউক নিরাপদ।’

    এরপর ডিউক বললেন–‘খুব ভালো, জানো এ্যান আমি যখন প্যারিস পৌঁছলাম তখন বুঝলাম ষড়যন্ত্র করে তোমার নামে চিঠি দিয়ে আমায় এখানে এনেছে। আমি সেখান থেকেই ফিরে যেতে পারতাম, কিন্তু মনে হলো একবার তোমার সাথে দেখা করেই যাই। আর সময় নেই আমি চলে যাচ্ছি–আচ্ছা এ্যান তুমি কি আমায় এমন কিছু দিতে পারো না যেটা আমি পড়ে থাকব আর তোমার কথা স্মরণ করব! একটা চমৎকার আংটি কিংবা গলার চেন?’

    একটু থেকে রকফোর্ট বলল, ‘ডোনা এসটেকেনা আমাদেরই লোক,’ সে বলল। এরপর রানী সিন্দুক খুলে গোলাপ কাঠের একটা সুন্দর বাক্স বার করল আর তার থেকে উজ্জ্বল একটা নেকলেশ বার করল যাতে বারোটা হীরে বোতামের মতো বসানো ছিল। তাকে মনে রাখার জন্য ডিউককে সেটা দিল।

    খুব খুশির সাথে কার্ডিনাল বলল–‘রকফোর্ট হতাশ হবার কোনো কারণ নেই, সব কিছুই বিফল হয়ে যায়নি, ডিউক আমাদের ফাঁকি দিয়ে প্যারিসে রানীর সাথে গোপনে দেখা করে আবার ইংল্যান্ড ফিরে গিয়েছে। আমি ভেবে ছিলাম আমাদের সব মতলব-ই বিফলে গেল কিন্তু না রকফোর্ট আমাদের হাতে এখনও যথেষ্ট প্রমাণ আছে।’

    রকফোর্ট বলল,–‘মঁসিয়ে আমায় পরবর্তী নির্দেশ দিন।’

    ‘হ্যাঁ, তুমি ভিটারীকে পাঠিয়ে দাও।’

    সশস্ত্র ভিটারী অভিবাদন করে কার্ডিনাল-এর সামনে দাঁড়াল, অদ্ভুত এই ভিটারী লোকটি। মুখে কোনো কথা নেই যন্ত্রের মতো সে শুধু নির্দেশ মেনে চলতেই অভ্যস্ত।

    ‘শোনো ভিটারী এই চিঠি আর দু’শ স্বর্ণ মুদ্রা নিয়ে তুমি এখনই ইংল্যান্ড চলে যাও। সেখানে মেলাডীকে এই চিঠিটা দেবে। এই চিঠি খুবই গুরুত্বপূর্ণ অন্য কেউ যেন চিঠির কথা না জানতে পারে, একমাত্র মিলাডীর হাতেই এটা তুমি দেবে। আর যথাসম্ভব তাড়াতাড়ি তুমি রওনা হবে রাস্তায় কোথাও দাঁড়াবে না।’ ভিটারী কোনো কথা না বলে শুধু অভিবাদন জানিয়ে চলে গেল। চিঠিতে লেখা ছিল–

    ‘মিলাডী–

    প্রথম যে নাচের অনুষ্ঠানে বাকিংহামের ডিউক উপস্থিত থাকবে সেই অনুষ্ঠানে দেখবে ডিউক বারোটা হীরের বোম বসানো একটা হার গলায় পরবে তুমি যতখানি সম্ভব ডিউকের সামনে থাকতে আর সময় মতো সুযোগ বুঝে তার থেকে দুটো বোতাম খুলে নেবে আর ওই দুটো তোমার হেফাজতে আসার সাথে সাথেই আমায় জানাবে।’

    কার্ডিনাল রিচেলিউ রাজপ্রাসাদে গিয়ে এক গোপন কক্ষে রাজাকে জানাল–‘মহাশয়, আপনি হয়তো জানেন না বাকিংহামের ডিক গত পাঁচ দিন প্যারিস শহরে ছিল আর মাত্র আজ সকালেই লন্ডন ফিরে গিয়েছে।’

    ‘মঁসিয়ে দ্য বাকিংহাম প্যারিসে ছিল? প্যারিসে আসার তাঁর উদ্দেশ্য কি?’ রাজাকে উদ্বিগ্ন দেখালো।

    ‘এটা তো বোঝাই যাচ্ছে আপনার বিরুদ্ধে চক্রান্ত ছাড়া আর কি-ই বা উদ্দেশ্য থাকতে পারে!’

    ‘মঁসিয়ে কার্ডিনাল আপনি কি জানেন বাকিংহাম আমার স্ত্রী অ্যানের সাথেও দেখা করেছিল কি না?’

    ‘আপনাকে বলতে কুণ্ঠা হচ্ছে ডিউক আপনার স্ত্রীর সাথেও দেখা করেছিল এ-সব আমি গোপন সূত্রে জেনেছি।’

    ‘আমার স্ত্রী… আমার স্ত্রী অ্যান…’

    ‘মহামান্য রাজা আপনি উত্তেজিত হবেন না, আমি নিঃসন্দেহে আপনার স্ত্রী আপনাকে ভালোবাসেন।’

    ‘স্ত্রী লোকেরা দুর্বল মঁসিয়ে কার্ডিনাল’ রাজা বললেন, ‘আর যদি আমার স্ত্রী সত্যিই আমায় ভালোবেসে থাকে তাহলে আমার কাছ থেকে ভালোবাসাই পাবেন।’

    ‘মহামান্য আমার মনে হয় ডিউকের প্যারিসে আসা সম্পূর্ণই রাজনৈতিক কারণে,’ কার্ডিনাল রাজার যেন পরম হিতাকাক্ষী হয়ে বলল।

    ‘না মঁসিয়ে কার্ডিনাল ডিউকের প্যারিস শহরে আসার পেছনে আমার মনে হয় অন্য কোনো কারণ ছিল।’

    ‘মহামান্য রাজা হয়তো ঠিকই ভাবছেন, না বললে রাজদ্রোহিতা তাই অনিচ্ছাসত্ত্বেও বলছি, মাদাম ল্যানয় এর কাছ থেকে জেরা করে জানতে পেরেছি গত রাত্রে রানী অনেক রাত পর্যন্ত জেগে বসেছিলেন এবং আজ সকালে তিনি শুধু কেঁদেছেন আর সারাদিন প্রায় চিঠি লিখেই সময় কাটিয়েছেন।’

    চিৎকার করে রাজা বললেন–‘মঁসিয়ে কার্ডিনাল, আপনি ঠিক কথাই বলেছেন আর আমি এখনই ওই চিঠিগুলো হস্তগত করতে চাই।’

    দ্রুত পায়ে রাজা রানীর ঘরে এলেন। রানী অ্যানকে তার সখীদের মধ্যে একজন একটা বই পড়ে শোনাচ্ছিল, রাজাকে আসতে দেখে তারা দ্রুত পায়ে ঘর থেকে বেড়িয়ে গেল,–‘মাদাম অ্যান তোমার কাছে এখনি আমার একজন প্রতিনিধি (কার্ডিনাল) আসবে, সে তোমাকে আমার নির্দেশ অনুযায়ী কিছু জিজ্ঞাসা করবে। আমি আশা করব তার কোনো কাজেই তুমি বাধা দেবে না।’

    দুঃখে রানীর সুন্দর মুখখানা কালো হয়ে গেল, তিনি বললেন ‘মহামান্য রাজা–রাজপ্রতিনিধি আমায় এখন কি কথা বলবে যা আপনি আমায় নিজেই জিজ্ঞেস করতে পারছেন না?’

    কোনো উত্তর না দিয়ে রাজা ঘর থেকে বেড়িয়ে যাবার সাথে সাথেই রাজপ্রতিনিধি রানীর ঘরে ঢুকল–রানীকে অভিবাদন জানানোর পর রাজপ্রতিনিধিকে রানী জিজ্ঞেস করলেন ‘বলুন মঁসিয়ে আপনার কি প্রয়োজন?’

    ‘মহামান্য রানী, আমি একজন রাজকর্মচারী ছাড়া আর কিছুই নই। রাজ আদেশ পালন করাই আমার কর্তব্য আপনি নিশ্চয়ই এটা অস্বীকার করবেন না, মহামান্য রাজার নির্দেশ আছে আপনার ঘরে আপনার ব্যবহার্য যত কাগজ এবং আপনার লেখা চিঠি আমি তল্লাস করে দেখব, মহামান্য রানী আমার এই কাজের জন্য আমায় ক্ষমা করবেন।’

    রাজপ্রতিনিধি রানীর ঘরের সমস্ত ড্রয়ার পরীক্ষা করেও যখন কোনো চিঠিই পেল না তখন রানীকে বলল–‘মহামান্য রানী আপনি আজ যে চিঠিটা লিখেছেন এবং যেটা এখনও পাঠানো হয়নি আমি রাজার নির্দেশে সেই চিঠিটারই তল্লাশ করেছি কিন্তু আপনার সমস্ত ড্রয়ার পরীক্ষা করেও সেটা পাইনি। সেই চিঠিটা যদি আপনার কাছে বা অন্য কোথাও লুকানো থাকে তাহলে রাজার নির্দেশ অনুযায়ী সেটা আমার হাতে দিন। সেটা রাজার কাছে পৌঁছে দেয়াই আমার দায়িত্ব।’

    ক্রুব্ধ স্বরে রানী এ্যান বললেন–‘মঁসিয়ে রাজপ্রতিনিধি নিশ্চয়ই রানীকে স্পর্শ করার স্পর্ধা রাখেন না!’

    ‘সম্মানীয়া রানী, রাজার নির্দেশ আছে আজকের লেখা চিঠিটা আমায় তাঁর কাছে পৌঁছে দিতে হবে, সেই কাজ সমাধানের জন্য আমায় সব কিছুই করতে হতে পারে। আমি রাজভৃত্য ছাড়া আর কিছুই নই, রানী আমায় নিশ্চয়ই ক্ষমা করবেন।’

    চিৎকার করে কান্নাজড়িত কণ্ঠে রানী বললেন, ‘অনেক হয়েছে সিয়ে, অনেক হয়েছে, একজন সামান্য রাজকর্মচারীর কাছে আমায় এই অপমানের চেয়ে মৃত্যুও অনেক শ্ৰেয় ছিল!’ বিছানায় অর্ধশায়িত মুচ্ছিত প্রায় রানী এই বলে ‘ডান হাতে একটা চিঠি, যেটা আজ-ই আমি লিখেছি কিন্তু পাঠানো হয়নি, এই সেই চিঠি। যান এটা নিয়ে যান। আর আপনার বিরক্তিকর উপস্থিতি থেকে আমায় নিষ্কৃতি দিন।’

    রাজপ্রতিনিধি সম্মানসূচক অভ্যর্থনা জানিয়ে চলে গেল, রানী হতাশায়, ক্রোধে, অপমানে, কান্নায় ভেঙে পড়লেন।

    রাজপ্রতিনিধি চিঠিটা নিয়ে রাজা লুইয়ের হাতে দিল। রাজা লুই চিঠিটা খুলে পাঠ করলেন–চিঠির ঠিকানা ছিল স্পেনের রাজার উদ্দেশ্যে। স্পেনের রাজা রানী এ্যানের আপন দাদা। আর চিঠির বিষয় বস্তু ছিল খুবই সাধারণ, তার দাদাকে রানী চিঠিতে জানিয়েছিল যে ফ্রান্স কার্ডিনাল-এর শাসন থেকে মুক্ত। বাকিংহামের সাথে তাঁর প্রণয়ের কোনো কথাই চিঠিতে লেখা ছিল না।

    চিঠি পড়ে রাজা খুব আনন্দিত হলেন। খোঁজ নিয়ে জানলেন যে কার্ডিনাল এখনো লুভেতেই আছে। রাজা আদেশ দিলেন কার্ডিনাল যেন আমার গোপন ঘরে অপেক্ষা করে।

    গোপন ঘরে রাজা এসে চিঠির কথা কার্ডিনালকে জানিয়ে বললেন ‘মঁসিয়ে কার্ডিনাল আপনিই ঠিক বলেছেন। ডিউকের প্যারিসে আসা সম্পূর্ণই রাজনৈতিক, অন্য কিছু নয়। রানী এ্যানের প্রতি সন্দেহের কোনো কারণ নেই। তিনি আমায় যথেষ্ট ভালোবাসেন বরং আমার খারাপ লাগছে সন্দেহের বশবর্তী হয়ে তাঁকে আমি অপমানই করলাম।’ খুব দুঃখের সাথে শেষের কথাগুলো রাজা বললেন। কার্ডিনাল রাজা লুই ত্রয়োদশকে অভিবাদন জানাল।

    ঘড়িতে রাত এগারোটার ঘণ্টা ধ্বনিত হলো। রাজাকে অভিবাদন জানিয়ে কার্ডিনাল বিদায়ের জন্য উঠে দাঁড়াল আর বলল ‘মহামান্য রাজা আপনার বিশ্রামের জন্য আমায় বিদায় নেবার অনুমতি দিন, আর মহামান্য রাজা আজকের ঘটনায় আমাদের রানী নিশ্চয়ই খুব আঘাত পেয়েছেন, আপনি আমাদের প্রিয় রানীকে আপনার ভালোবাসা এবং সুন্তর ব্যবহার জানিয়ে তাকে এই দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা থেকে শান্তি দিন। এ-ছাড়া আমি আপনাকে রানীর আনন্দের জন্য পরামর্শ দিই শীঘ্রই একটা ভোজসভা ডাকুন আমাদের রানী ভোজসভা খুবই পছন্দ করেন।’

    পরদিন রাজার ব্যবহারে রানী খুবই আশ্চর্য হয়ে গেলেন, রানী আশা করেছিলেন যে ওই চিঠিটার জন্য রাজা নিশ্চয়ই তাকে তিরষ্কার করবেন, কিন্তু একি! তার পরিবর্তে রাজা রানীর সাথে এত সুন্দর আবেগপূর্ণ ব্যবহার করছেন কেন? রাজা যখন বুঝতে পারলেন রানী এ্যানের আর রাগ নেই সেসময় রানীকে আশ্চর্য করে দিয়ে বললেন যে, তিনি শীঘ্রই একটা ভোজসভার আয়োজন করছেন।

    এই ঘটনার আট দিন পর কার্ডিনাল রিচিলিউ লন্ডনের ছাপ মারা একটা চিঠি পেলেন, চিঠির বিষয়বস্তু ছিল–

    ‘আমি সেগুলো হস্তগত করেছি, কিন্তু টাকার অভাবে আমি লন্ডন থেকে ফিরতে পারছি না, আমায় পাঁচশ স্বর্ণ মুদ্রা দ্রুত পাঠান টাকা পাবার চার থেকে পাঁচ দিনের মধ্যেই প্যারিসে পৌঁছে আপনার হাতে সেগুলো পৌঁছে দেব।’

    কার্ডিনাল যে দিন এই চিঠিটা পেলেন রাজা সেদিন সৌজন্যবশত কার্ডিনালকে জিজ্ঞেস করলেন–‘মঁসিয়ে কার্ডিনাল ভোজসভার নির্দিষ্ট দিন ঠিক করেছেন কি?’

    রিচিলিউ মনে মনে বলতে লাগল—‘মিলেডি লিখেছে টাকা পাবার চার পাঁচ দিনের মধ্যেই প্যারিস পৌঁছবে, লন্ডনে টাকা পৌঁছতেও চার পাঁচ দিন সময় লাগবে। তার মানে হীরের বোতাম নিয়ে তার পৌঁছতে মোট দশ দিন সময় লাগছে। অর্থাৎ বারো দিন আগে রানীর দুর্বলতায় প্রতিকুল আবহাওয়া কি রকম হতে পারে তা বোঝা যাবে না। আহা রানী সকলের সামনে কী রকম হেনস্তা হবে। এবার আর আমি বিফল হচ্ছি না আমার প্রেম প্রত্যাখানের কী চরম পরিণতি।’

    রাজা আবার জিজ্ঞেস করলেন–‘মঁসিয়ে কার্ডিনাল আপনি কি দিন ঠিক করেছেন করে আর কোথায় ভোজসভার আয়োজন হবে?

    ‘হ্যাঁ মহাশয়-আজ ২০ সেপ্টেম্বর। আগামী ৩ অক্টোবর ভোজসভার দিন ঠিক করেছি। এই ভোজসভাতেই আপনি রানীকে আপনার হৃদয়ের গভীর ভালোবাসা জানাতে পারবেন। মহামান্য রাজা একটা কথা আপনাকে স্মরণ করিয়ে দিই, ভোজের দিন রানী যে হীরের বোতাম লাগানো নেকলেসটা পরেন রানীকে আপনি যেটা তাঁর জন্মদিনে উপহার দিয়েছিলেন, আহা রানীকে কী চমৎকারই না সেদিন লাগবে।’

    এরপর ভোজের নির্দিষ্ট দিনের কথা জানাতে রাজা লুই ত্রয়োদশ রানীর ঘরে গেলেন, এত দিন রানী শুধু দিন গুনছেন কবে সেই ভোজসভা আসবে, কেন না রানী এ্যান ভোজসভা খুবই পছন্দ করেন। রাজা লুই বললেন হোটেল ডি ভ্যালিতে ভোজসভার আয়োজন করা হয়েছে। মাদাম সেই দিন তুমি উৎসবকে সুন্দর করতে তোমার সবচেয়ে প্রিয় আর দামি পোশাকটা পরবে। আর মনে করে হীরের বোতামওলা নেকলেসটা পরবে যেটা আমি তোমায় তোমার জন্মদিনে দিয়েছিলাম।

    ‘হ্যাঁ আমি নিশ্চয়ই সেই রকমই সাজবো কিন্তু ভোজসভার দিনটা কবে ঠিক হয়েছে।’ রানী জানতে চাইলেন।

    ‘কার্ডিনাল রিচিলিউ ৩ অক্টোবর দিন ঠিক করেছে।’ রাজা বললেন। কার্ডিনাল-এর নাম শুনেই রানীর মুখ রক্ত শূন্য হয়ে, হাঁটু থেকে পা কাঁপতে লাগল ভয়ে উত্তেজনায়।

    চরম হতাশায় দুঃখে কম্পিত স্বরে রানী জানতে চাইলেন–‘আমি সেই হীরের নেকলেশটা পরি এটাও কি কার্ডিনাল-এর ইচ্ছে?’ রাজা লুই ত্রয়োদশ বিরক্ত হয়ে প্রশ্ন করলেন–‘যদি তাই হয় তাতে ক্ষতিটা কি হয়েছে?’

    রানী মাথা নেড়ে বললেন–‘না ক্ষতি কিছুই হয়নি।’

    ‘তাহলে আমি তোমায় যেমন ভাবে সেজে যেতে আদেশ করলাম তুমি। সে ভাবেই ভোজসভায় যাবে।’

    ‘হ্যাঁ, আপনার নির্দেশ আমি পালন করব।’ কম্পিত স্বরে রানী বললেন। এক সময় রাজা ঘর ছেড়ে চলে যেতে তিনি হতাশায়, ক্লান্তিতে, ভয়ে, উৎকণ্ঠায় কাঁপতে কাঁপতে একটা চেয়ারে বসে পরলেন। ‘হায় আমি শেষ হয়ে গেলাম, আমার আর বাঁচার কোনো রাস্তা রইল না।’ আপন মনে নিজেকে উদ্দেশ্য করে রানী বললেন।

    একটা মিষ্টি মধুর মমতায় পরিপূর্ণ স্বর রানীর কানে এলো। মহামান্য রানী আমি আপনাকে কোনো রকমভাবেই সাহায্য করতে পারি না?

    ‘কে-কে বলছে এই কথা? আমি তো-জানি ঘরে আমি একাই ছিলাম?’ রানী মুখ তুলে সামনের ছোট ঘরটার দিকে তাকালেন, কেন না ওই দিক থেকেই এসেছিল।

    ‘হ্যাঁ মহামান্য রানী আপনি ঘরে একাই ছিলেন কিন্তু আপনি জানতেন বোধহয় পাশের ছোট ঘরটায় আমি আপনার পোশাক গোছাচ্ছিলাম’ মাদাম বোনাসিক্স কথাগুলো বলতে বলতে রানীর সামনে এসে দাঁড়াল।

    ‘হায় বোনাসিক্স আমায় আর প্রতারণা কোরো না, আমি তোমাকে কি করে বিশ্বাস করব বলো?’ কাতর স্বরে পাণ্ডুর মুখে রানী বললেন।

    ‘ওঃ মাদাম! আপনি আমায় বিশ্বাস করুন প্রাণ থাকতে আমি আপনার অবিশ্বাসের কাজ করব না, আপনি আমায় বিশ্বাস করুন রানীমা’ কাঁদতে কাঁদতে মাদাম বোনাসিক্স রানীর পা দুটো জড়িয়ে ধরল। মাদাম বোনাসিক্সের আন্তরিকতায় এতই গভীর ছিল যে, রানী তাকে বিশ্বাস না করে পারলেন না।

    ‘রানীমা–আপনি আপনার সমস্ত দাসীর মধ্যে আমায়–শুধু মাত্র আমায় বিশ্বাস করতে পারেন,–ভগবানের দোহাই আপনার প্রতি আমার গভীর শ্রদ্ধা আর ভালোবাসা ছাড়া কোনো ছল নেই।’ মাদাম বোনাসিক্স বলে চলল–‘হ্যাঁ রানীমা, আপনার দাসীদের মধ্যেই বিশ্বাসঘাতক আছে, তা না হলে, সেই হীরের বোতামওলা নেকলেসটা যেটা আপনি বাকিংহামের ডিউককে দিয়েছিলেন ভালোবাসার চিহ্ন স্বরূপ-কি রানীমা দেননি? আমি জানি রানীমা আপনি দিয়েছেন। সেই কথা,–সেই গোপন সংবাদ কি করে কার্ডিনাল-এর কানে গেল? আর এ-সব কার্ডিনাল-এর ষড়যন্ত্র। রাজা লুই য়ের কাছে আপনাকে, সমস্ত প্রজার সামনে আপনাকে অশ্রদ্ধা করার এ গভীর ষড়যন্ত্র। ভীত হবেন না রানীমা, ভোজসভার আগেই হীরের নেকলেশটা আপনার কাছে পৌঁছে দিতে হবে।’

    ‘কিন্তু কীভাবে বোনাসিক্স?’ উত্তষ্ঠিত রানী জিজ্ঞেস করলেন।

    ‘একজনকে লন্ডনে পাঠাতে হবে। খুব তাড়াতাড়ি এখান থেকে একজন ডিউকের কাছে যাবে, বর্তমান পরিস্থিতির কথা জানিয়ে তার কাছ থেকে হারটা নিয়ে আসতে হবে।’ মাদাম বোনাসিক্স মতলব বাতলালেন।

    ডিউককে উদ্দেশ্য করে একটা চিঠি লিখলেন রানী এ্যান এবং রানীর ভাই স্পেনের রাজার দেয়া উপহারের একটা দামি আংটি মাদাম বোনাসিক্সকে দিয়ে সেটার বিনিময়ে অর্থের সংস্থান করে একজন বিশ্বাসী অনুচরকে লন্ডনে যাবার জন্য রানী অনুরোধ করলেন।

    চিঠি আর আংটি নিয়ে মাদাম বোনাসিক্স বাড়ি ফিরে এলেন। বাড়ি ফিরে মাদাম বোনাসিক্স দেখলেন তার স্বামী আট দিন পর বাড়ি ফিরে এসেছেন। দীর্ঘ বিবাহিত জীবনে তাদের মধ্যে এত দিনের বিচ্ছেদ এর আগে কোনো দিন হয়নি।

    আনন্দে উভয় উভয়কে আলিঙ্গন করল। মাদাম বোনাসিক্স বলল–‘আমাদের বোধহয় এবার কপাল ফিরবে, তোমায় একটা জরুরি কাজে লন্ডন যেতে হবে।’ স্বতস্ফুর্ত স্বরে মাদাম বলল। লন্ডন?’ মঁসিয়ে বোনাসিক্স বলল ‘লন্ডন আমার কোনো কাজই নেই, আর আমি তোমার ভালোর জন্যই বলছি, রানীর ভালোর জন্য কিছু করতে যেও না। কেন করবে? আমাদের রানী ফরাসি মহিলা নন তিনি একজন অষ্ট্রিয়ান!’

    ‘হায় মঁসিয়ে বোনাসিক্স তুমি অবিবেচকের মতো এ-সব কি বলছ?’

    ‘হ্যাঁ আমি ঠিকই বলছি, এটা একটা চক্রান্ত ছাড়া আর কিছুই নয়। মঁসিয়ে কার্ডিনাল পরিষ্কার ব্যাপারটা আমায় বুঝিয়ে দিয়েছেন।’

    কার্ডিনাল-এর সাথে তোমার পরিচয় হয়েছে? ‘হ্যাঁ, পরিচয় মানে বন্ধুত্ব, তিনি আমার বন্ধুত্ব চেয়েছেন। আমি তাঁর সেবক এবং বন্ধুও বটে। আমার আর এক বন্ধু কাউন্ট দ্য রকফোর্ট। ওই যে ব্যাগটা দেখছ ওর মধ্যে অনেক স্বর্ণ মুদ্রা আছে সব আমার।’

    ‘রকফোর্ট!’ মাদামের চোখ জ্বলতে লাগল–‘রকফোর্ট! তোমার স্ত্রীকে অপহরণ করেছিল তার কাছ থেকে তুমি টাকা নিয়েছ!’

    ‘আমার স্ত্রী অপহৃত হয়েছিল সম্পূর্ণ রাজনেতিক কারণ। দেশের স্বার্থে একজন রমনী যদি অপহৃত হয়ই সেটা কোনো দোষের নয়। একজন নারীর চেয়ে দেশ অনেক বড়, আর এই দেশকে রক্ষা করতে পারেন এক মাত্র আমার বন্ধু–কার্ডিনাল রিচিলিউ।’

    মঁসিয়ে দ্য বোনাসিক্স ভেবে দেখলেন কার্ডিনাল-এর কাছে আমার মহত্ব প্রকাশ করার এই একটা সুযোগ। বাকিংহামকে লেখা চিঠিটা মাদামের কাছে যে করেই হোক আমায় হস্তগত করতে হবে, কিন্তু আমি জানি আমার স্ত্রী আমায় আর বিশ্বাস করে না আমায় কোনো দলেন আশ্রয় নিতে হবে।

    ‘মাদাম তুমি যে এখনি এখানে আসবে তা আমার জানা ছিল না, এদিকে আমায় একজনের সাথে এখনি দেখা করতে হবে, তুমি একটু অপেক্ষা করো, আমি ঘণ্টা খানেকের মধ্যেই ফিরে আসছি। সম্ভবত আমাকেই চিঠিটা নিয়ে লন্ডন যেতে হবে কেন না কার্ডিনাল-এর বন্ধুত্বের চাইতে স্ত্রীর ভালোবাসা অনেক বেশি মূল্যবান।’

    মঁসিয়ে বোনাসিক্স সোজা চলে গেলেন কার্ডিনাল-এর প্রাসাদে কাউন্ট রকফোর্টকে এই গোপন চিঠির কথা জানাতে।

    মঁসিয়ে বোনাসিক্স চলে যাবার পর মাদাম মৃদু হাসলেন ‘হায়! আমার প্রিয় স্বামী, তোমায় আমি এতটুকু বিশ্বাস করি না, সেই মুহূর্তে কি করা উচিত মাদাম যখন ভাবছেন,-এমন সময় দ্যা অ্যাট্রাগঁন সেখানে উপস্থিত হলো।’

    হতবাক মাদাম বললেন—’হায় ঈশ্বর, তুমি দেখছি আমাদের সমস্ত কথাই শুনেছ!’

    ‘হ্যাঁ মাদাম-এই ঘরের ওপরেই আমার ঘর আর সেখান থেকে আপনাদের ঘরের যাবতীয় কথা আমার শুনতে অসুবিধে হয় না।’

    ‘বেশ ভালো কথা সব কথা, শুনে তুমি কি বুঝলে? এর এখন কি করাই বা উচিত?’

    ‘আমি এটাই বুঝতে পারছি রানীর এই মুহূর্তে একজন বিশ্বাসী লোক দরকার যে একটা গোপন চিঠি নিয়ে দ্রুত লন্ডন যেতে পারবে। মাদাম আমার মনে হয় আমার অনুমান ভ্রান্ত নয়’–বলল দ্য অ্যাট্রাগঁন।

    ‘ঠিকই বলেছ! কিন্তু কে সেই লোক যাকে আমি বিশ্বাস করে রানীর চিঠি দিতে পারি!’

    গর্বিত স্বরে মঁসিয়ে দ্য অ্যাট্রাগঁন বলল–‘মাদাম আমিই সেই লোক যে এখনি পত্রবাহক হয়ে লন্ডন যেতে প্রস্তুত।’

    ‘যতখানি বিশ্বাস আপনি নিজেকে করেন মাদাম।’

    ‘ঠিক আছে মঁসিয়ে–তবে একটা কথা মনে রেখো, আমার সাথে তুমি যদি বিশ্বাসঘাতকতা করো তাহলে আমি আত্মঘাতিনী হবো আর আমার মৃত্যুর জন্য একমাত্র তুমিই দায়ী থাকবে।’

    মাদাম বোনাসিক্স উত্তর দেবার ঠিক সেই মুহূর্তেই রাস্তায় কার কথা বলার আওয়াজ ভেসে এলো। মাদাম বোনাসিক্স বললেন ‘মঁসিয়ে আমি নিঃসন্দেহে আমার স্বামী আমার বিশ্বাসঘাতক স্বামী কার্ডিনাল-এর লোক নিয়ে চিঠিটা উদ্ধারের জন্য আসছে।’

    ‘মাদাম আপনি দয়া করে আমার ঘরে চলুন। আমি আপনাকে কথা দিচ্ছি সেখানে আপনার মর্যাদা নষ্ট হবে না। সময় নেই মাদাম আমায় অনুসরণ করুন।’

    মঁসিয়ে দ্য অ্যাট্রাগঁনের ঘরে মাদাম বোনাসিক্সও অ্যাট্রাগঁন ঢুকে পড়তেই মঁসিয়ে দ্য বোনাসিক্স কার্ডিনাল-এর লোক নিয়ে তাঁর ঘরে এলেন। মঁসিয়ে বোনাসিক্স বললেন তাঁর স্ত্রী সম্ভবত আগেই বিপদ আঁচ করে লুভেতে আশ্রয় নিয়েছে। আগন্তুক খুবই বিরক্ত হয়ে চিঠিটা বিভিন্ন জায়গায় তল্লাশ করার আগন্তুক আদেশ দিয়ে মঁসিয়ে বোনাসিক্সকে বলল যেন দ্রুত চিঠিটা উদ্ধার করে তাকে পৌঁছে দেয়া হয়, পৌঁছে দেবার সাথে সাথেই কার্ডিনালকে সে চিঠির পাঠিয়ে দেয়া হবে।

    অন্ধকারে চুপিসারে মঁসিয়ে দ্য অ্যাট্রাগঁন সেই রাত্রেই ক্যাপটেন মঁসিয়ে দ্য ট্রেভিলের সাথে গিয়ে দেখা করল। রানীর বিপদের কথা জানিয়ে বলল এখনি সেই চিঠি নিয়ে সে লন্ডন যেতে চায় আর তার জন্য পনেরো দিনের দরকার।

    মঁসিয়ে দ্য ট্রেভিল সব শুনে বললেন–‘সাহসী যুবক, তোমার কি মনে হয় তোমার এই লন্ডন যাত্রায় কোথা থেকে কি বাধা আসতে পারে?’

    ‘হ্যাঁ মঁসিয়ে আমার স্থির বিশ্বাস কার্ডিনাল-এর লোকেরা আমায় বাধা দেবে, কেন না তারা জানে কেউ একজন রানীর চিঠি নিয়ে লন্ডন রওনা হচ্ছে।’

    ‘ঠিক–আমারও মনে হয় কার্ডিনাল-এর চরেরা তোমাকে বাধা দেবে, সেক্ষেত্রে আমার মতে অ্যাথোস, প্যাথোস, এ্যারোমিস আর তুমি তোমরা চারজন যাও। তোমাদের যে কেউ যেন লন্ডনে বাকিংহামের কাছে ঠিক সময়ে ফৌছতে পারে। মনে রেখ, কোনো বাধা হলে তার মোকাবেলা করার জন্য মাত্র একজনই থাকবে। এভাবে শেষ জন যেন লন্ডন পৌঁছতে পারে। পথে অযথা সময় নষ্ট করবে না। আমি তোমাদের চারজনেরই ছুটি মঞ্জুর করলাম।’

    অ্যাম্বোস, প্যাথোস এবং এ্যারামিস তিনজনেই দ্য অ্যাট্রাগঁনের কাছ থেকে তাদের এই ছুটির কারণটা কি জানতে পেরে খুব উৎসাহী হয়ে উঠল।

    সেদিনই দু-টোয় চার বন্ধু প্যারিস ছেড়ে লন্ডনের দিকে রওনা হলো। রাস্তায় কোনো বিপদ ঘটল না। পরের দিন সকাল আটটা নাগাদ তারা চ্যানটিলি নামে এক শহরে পৌঁছে কিছু খেয়ে নেবার জন্য তারা চার বন্ধু একটা হোটেলে ঢুকলো। হোটেলের যে টেবিল ঘিরে চারবন্ধু খাচ্ছিল, ঠিক সেই টেবিলেই এক আগন্তুক এসে বসল। সুন্দর সকাল আর আবহাওয়া। নিয়ে কথা বলার পর আগন্তুক জানাল তার তাড়া আছে এবং মঁসিয়ে প্যাথোসকে বলল—

    ‘আসুন মঁসিয়ে আমার তাড়া আছে, আমাকে এখনি চলে যেতে হবে তার আগে আমার প্রভু মঁসিয়ে কার্ডিনাল-এর স্বাস্থ্য কামনা একপাত্র সুরা পান করি।’

    ‘আমি নিশ্চয়ই আপনার প্রভুর স্বাস্থ্য কামনা করে পান করব কিন্তু পরের পাত্র পান করার সময় আপনাকে আমার প্রভু মহামান্য রাজা লুই ত্রয়োদশ স্বাস্থ্য কামনা করে পান করতে হবে।’ শান্তভাবে বলল প্যাথোস। চিৎকার করে আগন্তুক বলল–‘না আমার অন্য কোনো প্রভু থাকতে পারে না। মহামান্য কার্ডিনাল ছাড়া।’ এবং আগন্তুক প্যাথোসের উদ্দেশ্যে তরোয়াল বার করল।

    ‘বন্ধু প্যাথোস–আশা করি তুমি একাই এই আগন্তুকের মোকাবিলা করতে পারবে। একে যথাসম্ভব তাড়াতাড়ি শিক্ষা দিয়ে আমাদের পথে তুমি ঘোড়া নিয়ে ছুটে এসো।’ এই বলে অ্যাম্বোস বন্ধুদের নিয়ে তাদের গন্তব্যের দিকে ঘোড়া ছুটিয়ে রওনা হলো।

    বেশ কিছুক্ষণ ঘোড়া ছুটিয়ে তিনজনে বিউভিস নামক একটা শহরের কাছে উপস্থিত হলো। দূর থেকে তারা দেখল তাদের যে পথ দিয়ে যেতে হবে সেই পথেই আট দশ জন শ্রমিক রাস্তা সারাচ্ছে। কাছে আসতেই তারা বুঝতে পারল লোকগুলো ছদ্মবেশি জার্ডিনাল-এর যোদ্ধা। কোদাল বেলচার বদলে তাদের হাতে এখন বন্দুক ঝোঁপঝাড়ের আড়ালে লুকিয়ে রেখেছিল সেই অস্ত্রগুলো। অ্যাট্রাগঁন বন্ধুদের হুশিয়ার করে বলল, এরা ছদ্মবেশী যোদ্ধা, মনে রেখো এখন আমাদের লড়াই করার সময় নয় এতে আমাদের আসল কাজের দেরি হয়ে যাবে, ঘোড়া ছোটাও, বন্দুকের গুলির সীমার বাইরে যাও।

    কিন্তু দুর্ভাগ্য এত করে বিপদ এড়ালেও একটা গুলি এসে এ্যারামিসের কাঁধে লাগল। প্রচুর রক্তপাত হতে লাগল এ্যারামিসের কাঁধ থেকে, অবসন্ন হয়ে এলো তার দেহ। ‘আর তো এগুনো যায় না বন্ধু, আমার জন্যে তোমাদের কেন দেরি হবে, তাড়াতাড়ি কোনো সরাইখানায় আমায় পৌঁছে দাও, সুস্থ হলে না হয় আমি তোমাদের সাথে যোগ দেবো।’ এ্যারামিসের স্বরে ক্লান্তি। সারা দেহ ভিজে গেছে ঘামে আর রক্তে।

    এ্যারোমিসকে একটা সরাইখানায় বিশ্রামের ব্যবস্থা করে দুই বন্ধু। অ্যাথোস আর অ্যাট্রাগঁন লন্ডন অভিমুখে চলল।

    মাঝরাতে অ্যাথোস এবং অ্যাট্রাগঁন এসে পৌঁছল এ্যামিয়েনস নামে এক জায়গায়। রাতটা সেখানে বিশ্রাম নিয়ে পরের দিন তারা লন্ডন অভিমুখে রওনা হবে। পরিশ্রান্ত দুই যোদ্ধার ঘুম আসতে দেরি হলো না, পরের দিন সকালে সরাইখানার মালিককে অ্যাথোস দু-টো স্বর্ণমুদ্রা দিল। এই যাত্রার জন্য তাদের যে অর্থের প্রয়োজন ছিল তার সবটাই যোগান দিয়েছিলেন মাদাম বোনাসিক্স। সে স্বর্ণমুদ্রা কিছুক্ষণ হাতে নাড়াচাড়া করার পর সরাইখানার মালিক স্বর্ণমুদ্রা দু-টো অ্যাথোসকে ফেরত দিয়ে বলল–‘মঁসিয়ে সকালবেলা মস্করা করা ঠিক উপযুক্ত সময় নয়; আপনার দেয়া দুটো মুদ্ৰাই নকল।’ বিরক্ত অ্যাথোস বলল,–‘তোমার সাথে ঠাট্টা করার সময় আমার নেই আমার সাথে কেউ বিরক্তিকর কথা বললে আমি তার কান দুটো কেটে নেয়াই পছন্দ করি।’ ক্রুব্ধ অ্যাথোস সরাইখানার মালিকের দিকে এগিয়ে গেল। সরাইখানার মালিক অ্যাথোসের সামনে মুদ্রাদুটো এগিয়ে দিয়ে বলল, ‘মঁসিয়ে উত্তেজিত না হয়ে আমার কথার সত্যতা যাচাই করুন।’

    ঠিক সেই সময় চারজন সশস্ত্র লোক দরজা ঠেলে অ্যাম্বোস আর অ্যাট্রাগঁনের দিকে এগিয়ে এলো।

    ‘অ্যাট্রাগঁন এক মুহূর্ত সময় নষ্ট করো না, ঘোড়ায় চড়ে তাড়াতাড়ি তোমার উদ্দেশ্যে সাবধানে এগিয়ে যাও। আমার মনে হয় এই চারটে শেয়ালকে ঠাণ্ডা করতে আমার বেশি সময় লাগবে না।’ তরোয়াল নিয়ে ঐ চারজনের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তে পড়তে অ্যাম্বোস বলল।

    মুহূর্ত মাত্র সময় নষ্ট না করে ঘোড়ায় গিয়ে বসল অ্যাট্রাগঁন। পেছনের পথকে ধুলো ডুবিয়ে তার ঘোড়া তাকে নিয়ে তীব্র বেগে চলে গেল। যখন শহরে পৌঁছতে আর শ-খানের পা বাকি অ্যাট্রাগঁনের ঘোড়া ক্লান্তিতে অবসন্ন। হয়ে রাস্তাতেই বসে পড়ল। ঘোড়া ফেলে রেখে অ্যাট্রাগঁন দৌড়ে ক্যালিস শহরে গিয়ে দেখল বন্দরে সরাসরি জাহাজ বাধা কিন্তু কোনো জাহাজ-ই ছাড়বে না। উপস্থিত কি করা উচিত ভাবতে ভাবতে জাহাজ ঘাটায় হাঁটতে লাগল অ্যাট্রাগঁন। হঠাৎ চোখে পড়ল বুট জুতোয় একরাশ ধুলো মাখা একজন ব্যস্ত ভদ্রলোক একটা জাহাজের ক্যাপটেনের সাথে কথা বলছে। জাহাজের ক্যাপটেন ভদ্রলোকটিকে বলল–‘আমার জাহাজ ইংল্যান্ড যাবার জন্য তৈরিই ছিল কিন্তু আজ সকালে কার্ডিনাল-এর কাছ থেকে নির্দেশ এসেছে তার অনুমতি ছাড়া কোনো জাহাজ ইংল্যান্ড যাবে না।’

    পকেট থেকে একটা কাগজ বার করে ভদ্রলোক বলল, ‘ক্যাপটেন এই চিঠিটা দেখুন, এটাতে কার্ডিনালের অনুমতি আছে।’

    ‘ধন্যবাদ, কিন্তু মহাশয় বন্দর কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে আপনাকে এটা পরীক্ষা করে আনতে হবে।’ জাহাজের ক্যাপটেন বললেন।

    ‘কিন্তু মহাশয় আমি বন্দর কর্তৃপক্ষের সাথে কোথায় দেখা পেতে পারি?’ ব্যস্ত লোকটা প্রশ্ন করল।

    ‘হ্যাঁ আপনি বন্দর কর্তৃপক্ষকে ওঁনার বাড়িতে পাবেন সামান্যই দূরে, ওই যে দুরে কালো পাথরের ছাদওলা বাড়ি দেখতে পাচ্ছেন, ওইটেই কর্তৃপক্ষের বাড়ি।’

    জাহাজের ক্যাপটেনকে ধন্যবাদ জানিয়ে ব্যস্ত ভদ্রলোক দ্রুত বন্দর কর্তৃপক্ষের বাড়ির দিকে রওনা হলো। এদিকে অন্য কোনো উপায় না দেখে। দ্য অ্যাট্রাগঁন চুপিসারে গাছের আড়াল দিয়ে সেই ভদ্রলোককে অনুসরণ করল। একটা নির্জন জায়গায় এসে গাছের আড়াল থেকে হঠাৎ বেড়িয়ে এসে লোকটির কাছ থেকে ইংল্যান্ড যাবার অনুমতি পত্রটা কেড়ে নিল অ্যাট্রাগঁন। এর জন্য অবশ্য তাকে তিনবার লোকটার গায়ে তরোয়ালের আঘাত দিতে হয়েছিল। তিনটে আঘাত তিনজনের নামে উৎসর্গ করেছিল সে। প্রথমটা অ্যাসোথের, দ্বিতীয়টা প্যাথোস আর তৃতীয়টা এ্যারামিসের নামে। বন্দর কর্তৃপক্ষকে নিজে একজন কার্ডিনাল-এর অনুচর বলে পরিচয়। দিয়ে প্রয়োজনীয় কাজ মিটিয়ে অ্যাট্রাগঁন অন্য পথ ধরে বন্দরে এসে পৌঁছাল। একটা জাহাজ ভাড়া করে বন্দর ত্যাগ করে ইংল্যান্ডের দিকে রওনা হলো। কিছুটা দূর যাবার পরই একটা কামানের গোলা পড়ার শব্দ হলো। শব্দটার অর্থ হলো সমস্ত ফেরি চলাচল বন্ধ করে দেয়া হলো, ক্লান্ত অ্যাট্রাগঁন ঈশ্বরকে ধন্যবাদ জানাল–‘আমিই বোধহয় শেষ যাত্রী। আর সামান্য দেরি হলেই আমার জাহাজও বন্দর ছাড়তে পারতো না।’ মনে মনে ঈশ্বরকে আর একবার ধন্যবাদ জানিয়ে ক্লান্ত অ্যাট্রাগঁন শুয়ে পড়ল–‘আপাতত আমি নিরাপদ। সামান্য ঘুমিয়ে নেয়া যাক, এরপর হয়তো ঘুমাবার সময়ই পাবো না।’

    সকাল দশটায় জাহাজ ইংল্যান্ড উপকূলে ডোভার বন্দরে নোঙর ফেলল আর এক আধঘণ্টা পরই অ্যাট্রাগঁন ইংল্যান্ডের মাটিতে পা রাখল। তারপর একটা ঘোড়ার গাড়ি ভাড়া করল মঁসিয়ে দ্য অ্যাট্রাগঁন ইংরেজি ভাষার একটা বর্ণও জানে না অ্যাট্রাগঁন। তবে বাকিংহামের ডিউকের নামের বানানটা অনেক কষ্টে রপ্ত করেছিল। একটা কাগজে বাকিংহামের নামটা লিখে রাস্তায় তার সামনে যারই দেখা হতে লাগল তাকেই সেই কাগজের লেখাটা দেখাতে লাগল, এভাবে অনেক মেহনত করে অ্যাট্রাগঁন ডিউকের প্রাসাদে এসে পৌঁছল। কিন্তু সেখানে এসে জানতে পারল ডিউক সেখানে নেই, তিনি উইন্ডসরে গিয়েছেন রাজার সাথে শিকার করতে। প্যাট্রিক নামে এক ভৃত্য দ্য অ্যাট্রাগঁনকে নিয়ে গেল উইন্ডসরে।

    সে বলল, ‘মহাশয় আপনি অপেক্ষা করুন আমি মহামান্য বাকিংহামের ডিউককে আপনার আগমন বার্তা জানাচ্ছি। কিন্তু তাঁর কাছে আপনার পরিচয়টা কি দেব যদি বলে দেন?’ প্যাট্রিক বলল।

    ‘তুমি গিয়ে বলবে প্যারিসে লুভেরের কাছে যে ব্যক্তির সাথে তাঁর ঝগড়া হয়েছিল, সেই এসেছে দেখা করতে।’

    প্যাট্রিকের কাছে খবরটা শুনেই বাকিংহাম বুঝতে পারলেন ফ্রান্সে নিশ্চয়ই কিছু দুর্ঘটনা ঘটেছে, মুহূর্ত বিলম্ব না করে তিনি দ্য অ্যাট্রাগঁন ডেকে পাঠালেন।

    ভালোবাসা, উদ্বেগ আর ভয়ে বাকিংহাম বললেন–‘আমি আশা করতে পারি রানীর কোনো অনিষ্ট হয়নি?’

    ‘না মহাশয় অনিষ্ট এখনো হয়নি তাঁর, তবে বোধহয় হতে চলেছে, আর আমার মনে হয় একমাত্র আপনিই তাঁকে এই বিপদ থেকে উদ্ধার করতে পারেন।’

    ‘আমি? তোমাদের রানীকে আমি বিপদ থেকে উদ্ধার করতে পারি? বলো বালো আমি তাকে কিভাবে সাহায্য করতে পারি? খুব সামান্য সুযোগও যদি পাই তাকে উদ্ধার করার, তাহলেও আমি নিজেকে ধন্য মনে করব।’

    ‘এই নিন মঁসিয়ে ডিউক, এই চিঠিটা রানী আপনাকে দিয়েছেন।’

    ‘রানী এ্যান আমাকে চিঠি দিয়েছে।’ রানীর কোনো অজানা বিপদের আশংকায় বিবর্ণ হয়ে উঠল বাকিংহামের মুখ, কম্পিত হাতে চিঠি খুলে পড়লেন।

    চিঠি পাঠ করার পর রানীর বিপদটা কোথায় বুঝতে পারলেন ডিউক চিৎকার করে তিনি ডাকলেন,–‘প্যাট্রিক! প্যাট্রিক! এখুনি রাজার কাছে যাও তাঁকে বলো বিশেষ জরুরি দরকারে আমাকে এখনি লন্ডন চলে যেতে হচ্ছে, আমার এই হঠাৎ চলে যাওয়ার জন্য তাঁকে বলো–আমি আন্তরিক দুঃখিত।’

    প্যাট্রিককে নির্দেশ দিয়ে ডিউক বাকিংহাম দ্য অ্যাট্রাগঁনকে নিয়ে দ্রুত লন্ডনের দিকে রওনা হলেন।

    ঘোড়া থেকে নেমে প্রায় ছুটতে ছুটতে ডিউক দ্য অ্যাট্রাগঁনকে নিয়ে তার শোবার ঘরে নিয়ে গেলেন। মন্ত্রমুগ্ধের মতো তিনি বসে পড়লেন একটা ছবির সামনে। তার বসার ভঙ্গিটা ছিল প্রার্থনা করার মতো, ছবিটা ঢাকা দেয়া ছিল পার্সিয়ান মখমলের ওড়না দিয়ে, তাতে সূক্ষ সোনার কাজ করা, ওড়না সরাতেই মোমের মিষ্টি আলোয় দ্য অ্যাট্রাগঁন ছবির দিকে তাকিয়ে চমকে উঠলেন–রানী এ্যানের একটা পূর্ণ প্রতিকৃতি। কি জীবন্ত ছবি–মনে হচ্ছে যেন এখনি ছবি থেকে বেরিয়ে এসে তাদের সামনে দাঁড়াবেন। ছবিটার তলাতেই ছিল সুন্দর কারুকাজ করা একটা কাঠের সিন্দুক বাকিংহাম সেই সিন্দুক খুলে তার মধ্য থেকে আর একটা ছোট্ট বাক্স বার। করলেন। বাক্স খুলতেই হীরের দ্যুতিতে চতুর্দিক ঝলমল করে উঠল। ‘এই নাও ঘঁসিয়ে দ্য অ্যাট্রাগঁন’ এই হীরের নেকলেস রানী আমায় দিয়েছিলেন, এখন আবার তাঁর এটা প্রয়োজন পড়েছে, তার সব ইচ্ছে পূর্ণ হবে। বাক্স থেকে হারটা বার করে দ্য অ্যাট্রাগঁনের হাতে দেবার মুহূর্তেই ডিউক চিৎকার করে বলে উঠলেন–‘সব শেষ হয়ে গেল,’ ডিউক কপাল চাপড়ে বললেন ‘সব শেষ রানীকে বিপদ থেকে বাঁচাতে পারলাম না বোধহয়।’ হতভম্ব দ্য অ্যাট্রাগঁন জিজ্ঞেস করল ‘কি হয়েছে মহামান্য ডিউক?’

    ‘দুটো হীরের বোতাম খোয়া গিয়েছে। বারোটা ছিল এখন দেখছি দশটা।’

    ‘মহামান্য ডিউক মনে হচ্ছে-ও দুটো চুরি হয়ে গিয়েছে।

    ‘হ্যাঁ চুরিই হয়েছে। বুঝতে পারছি শয়তান ক্লাসক্লিনাল-এর কাজ এটা, দেখছ না ধারালো কাঁচি দিয়ে দুটো বোতাম কেটে নেয়া হয়েছে?’ উত্তেজিত ডিউক বললেন।

    ‘মহামান্য ডিউকের যদি তাই সন্দেহ হয় তাহলে আমার মনে হয় চোরের কাছে হীরের বোতাম দু-টো এখনো রয়েছে।’

    ‘দাঁড়াও আমায় মনে করতে দাও’–ডিউক বললেন, আমি এই হীরের নেকলেশটা মাত্র একবারই পরেছিলাম, গত সপ্তাহে উইন্ডসরে। হ্যাঁ মনে পড়েছে, কাউনট্রেস মিলেডি ডি উইনটার উইন্ডসরে ওই বল নাচের আসরে অহেতুক আমার সাথে বন্ধুত্ব করেছিল অথচ আমি জানি মিলেডি আমার আদৌ পছন্দ করে না, তাঁর ঐ ব্যবহারে তখনই আমি খুব অবাক হয়ে গিয়েছিলাম, এখন বুঝতে পারছি এটা তারই কাজ, মিলেডি কার্ডিনাল এর চর।

    ‘প্যাট্রিক!… প্যাট্রিক!’ জোরে হাঁক দিলেন ডিউক। ‘এই যে প্যাট্রিক, এখুনি আমার জহুরীকে ডাকো’ ডিউক আদেশ দিলেন।

    ‘স্বর্ণকার আসতে ডিউক হীরের নেকলেশটা দেখিয়ে বললেন এই নেকলেশটা ভালো ভাবে দেখো। বারোটার জায়গায় দশটা, যে দুটো নেই সে দু-টো হীরের বোতাম তোমায় তৈরি করে দিতে হবে, মনে রাখতে হবে নতুন দুটো এমন হবে যাতে তুমিও না বুঝতে পারো কোনটা নতুন আর কোনটা পুরোনো। হ্যাঁ এবার বলো কবে দেবে আর এর জন্য আমায় কত মূল্য দিতে হবে?’

    জহুরী ভালো করে হীরেগুলো পরখ করে বলল,–‘মহামান্য ডিউক প্রতিটির জন্য পনেরোশ স্বর্ণমুদ্রা খরচ পরবে।’

    ‘আর কত দিন লাগবে জিনিসটা সম্পূর্ণ করতে!’ প্রশ্ন করলেন ডিউক।

    ‘সাত দিন সময় লাগবে মহামান্য ডিউক।’

    ‘আমি তোমায় প্রতিটির জন্য তিন হাজার স্বর্ণমুদ্রা দেবো কিন্তু নেকলেশটা তোমায় আগামী পরশু তৈরি করে দিতে হবে আর মনে রাখবে আমি নিখুঁত কাজ চাই।’

    এরপর বাকিংহাম তার সেক্রেটারীকে নির্দেশ দিলেন বন্দর কর্তৃপক্ষকে জানিয়ে দিতে যেন তাঁর অনুমতি ছাড়া কোনো জাহাজ ফ্রান্স অভিমুখে রওনা না হয়। তার ধারণা মিলেডি হীরে দুটো নিয়ে এখনো লন্ডনেই আছে। যেহেতু ডিউক ইংল্যান্ডের রাজার ঘনিষ্ট বন্ধু এবং মন্ত্রিসভায় তাঁর বিশেষ ক্ষমতা থাকায় বন্দর কর্তৃপক্ষ সেই নির্দেশ যথাযথ পালন করল।

    নির্দিষ্ট দিনে জহুরী হীরে বসানো নেকলেশটা সম্পূর্ণ করে বাকিংহামের কাছে নিয়ে এলো এবং বলল,–‘মহামান্য ডিউক এই বারোটা হীরের বোতামের মধ্যে আপনি আলাদা করুন কোন দুটো হীরে আমি নতুন বসিয়েছি?’

    হাতে নিয়ে অনেক নেড়েচেড়েও ডিউক বলতে পারলেন না নতুন দুটো কোনটা। খুশী হয়ে ডিউক জহুরীর প্রাপ্য মিটিয়ে দিলেন।

    দ্য অ্যাট্রাগঁন যখন বাকিংহামের কাছে এসেছিল সেই দিন থেকে আর মাত্র পাঁচ দিন বাকি ছিল বল নাচের অনুষ্ঠানের, তার থেকে দু-দিন অতিক্রান্ত, হাতে আর মাত্র তিন দিন সময়, সময় খুবই কম, নির্দিষ্ট সময়ের সামান্য দেরি হলেই রানীর চরম বিপদ আর ধূর্ত কার্ডিনাল রিচিলিউ-এর চক্রান্ত সার্থক হবে।

    ডিউক বাকিংহাম দ্রুত ডেকে পাঠালেন মঁসিয়ে দ্য দ্য অ্যাট্রাগঁনকে।

    ‘এই যে মঁসিয়ে দ্য অ্যাট্রাগঁন হীরের নেকলেশ, যেটা নিতে তুমি ফ্রান্স থেকে অনেক পরিশ্রম করে এসেছ। আর সচক্ষে দেখলেন হীরের হারটা ফেরত দিতে একটা মানুষের যা সাধ্য আমি তার সবটাই করেছি।’

    ‘মহামান্য ডিউক আমি যা নিজের চোখে দেখলাম রানীকে তার সবটাই জানাবো। কিন্তু আপনি আমায় হীরের হারটাই দিলেন, হীরের হার রাখার বাক্সটা দিলেন না।’ দ্য অ্যাট্রাগঁন বলল।

    ‘না দ্য অ্যাট্রাগঁন এটা আমি ফেরত দিচ্ছি না, আশা করি বাক্সটা নিয়ে কোনো গোলমাল হবে না। এ্যানকে বলো স্মৃতি হিসেবে আমি এটাই রেখে দিলাম।’

    ‘মহামান্য ডিউক আপনি যেমন বললেন, আমি আমাদের রানীকে তাই বলবো।’

    ‘এবার বলো দ্য অ্যাট্রাগঁন আমি তোমায় কত অর্থ দেবো? হারটা ফেরৎ পেতে আমার কাছে তোমাকেও অনেক হয়রান হতে হয়েছে’ ডিউক বললেন।

    দ্য অ্যাট্রাগঁন গর্বিত ভাবে বলল,–‘মহামান্য ডিউক আপনি জানেন আমি আমাদের রাজা আর রানীর একজন বিশ্বস্ত ভূত্য, তাদের জন্য আমি সকল সময় প্রাণ দিতে প্রস্তুত, অতএব আপনার কাছ থেকে অর্থ নেবার কোনো প্রশ্নই আসছে না।’

    ‘আমি জানি যুবক দ্য অ্যাট্রাগঁন তুমি একজন সৎ আর বিশ্বাসী রাজকর্মচারী। তোমার আচরণে আমি মুগ্ধ।’

    অভিবাদন জানিয়ে দ্য অ্যাট্রাগঁন যখন চলে যাবার জন্য পিছু ফিরছে এমন সময় ডিউক তাকে বললেন, ‘দ্য অ্যাট্রাগঁন তুমি চলে যাচ্ছ, যাও কিন্তু আমার প্রশ্ন, তুমি কীভাবে রওনা দেবে?

    ‘মহামান্য ডিউক আপনি ঠিকই বলেছেন, পথে দেরি করা যাবে না। আমি বিপদকে ভয় পাই না কিন্তু আমার সামান্য দেরি হলে আমাদের রানী ভীষণ বিপদে পড়বেন।

    ‘এখান থেকে তুমি বন্দরে যাও সেখান থেকে তোমায় ‘সান্ড’ বন্দরে নিয়ে যাবার জন্য লোক প্রস্তুত থাকবে। হ্যাঁ এই চিঠি জাহাজের ক্যাপটেনকে দেবে, ক্যাপটেন ‘সান্ড’ থেকে তোমায় নিয়ে যাবে আর একটা ছোট্ট বন্দরে। বন্দরটার নাম ‘সেন্ট ভাব্রি’। মনে রাখবে বন্দরটা জেলেদের জন্য।’

    ‘তারপর?’ মঁসিয়ে দ্য অ্যাট্রাগঁন জিজ্ঞেস করল।

    ‘হ্যাঁ!’ তারপর সেখানে পৌঁছে তুমি দেখতে পাবে একজন জেলের ছোট্ট একটা কুঁড়ে ঘর। তার কাছে পৌঁছে তুমি ফরাসি ভাষায় ‘এনাভেন্ট’ শব্দটা বলবে। শব্দটা মিত্রতা সূচক সাংকেতিক শব্দ। ওই শব্দটা বলার পর ছেলেটা তোমায় জিন লাগানো শক্তিশালী একটা ঘোড়া দেবে এবং তুমি কোন পথে দ্রুত প্যারিস পৌঁছাতে পারবে দেখিয়ে দেবে। আর হ্যাঁ, তুমি সকল সময়ই সতর্ক থাকবে, যাতে পথে তোমার কোন বিপদ না হয়। আমি যা যা বললাম তোমার নিশ্চয়ই মনে থাকবে?’

    অ্যাট্রাগঁন বলল–‘হ্যাঁ মঁসিয়ে আমার সব কিছুই মনে থাকবে।’

    দ্য অ্যাট্রাগঁন ডিউককে অভিবাদন জানিয়ে তাড়াতাড়ি প্যারিস পৌঁছার জন্য রওনা দিল। ‘সান্ড’ বন্দর থেকে দ্য অ্যাট্রাগঁন জেলেদের জন্য ছোট বন্দর সেন্ট ভ্যালেরিতে পৌঁছে সাঙ্কেতিক শব্দে এনাভেন্ট বলল ছোট্ট কুঁড়ে ঘরের ছেলেটাকে। এরপর ডিউক যেমনটি বলেছিলেন সেইমত জেলেটা দ্য অ্যাট্রাগঁনকে নিয়ে এলো একটা আস্তাবলে, একটি শক্তিশালী ঘোড়া রওনা দেবার জন্য প্রস্তুত হয়েই ছিল। জেলেটি জানতে চাইল তার আর কিছু দরকার আছে কিনা?

    ‘হ্যাঁ মঁসিয়ে প্যারিস যাবার সহজ পথটা আপনার কাছে আমি জানতে চাইছি!’ বলল অ্যাট্রাগঁন।

    ‘এখান থেকে সোজা পথে চলে যান বালাঞ্জি আর বালাঞ্জি থেকে নিউচ্যাটেল সেখানে আপনার জন্য আর একটা ঘোড়া তৈরি থাকবে। আপনি এই ক্লান্ত ঘোড়াটার পরিবর্তে তাজা ঘোড়াটায় চেপে রওনা দেবেন।’ জেলেটি মুখস্ত বলে গেল।

    মঁসিয়ে দ্য অ্যাট্রাগঁন হাওয়ার গতিতে ঘোড়া চালিয়ে বারো ঘণ্টায় ১৮০ মাইল পথ ঘোঢ়া ছুটিয়ে যখন সিয়ে দ্য ট্রেভলির দপ্তরে পৌঁছাল তখন সকাল ন-টা।

    মঁসিয়ে দ্য ট্রেভিল অ্যাট্রাগঁনকে অভিবাদন জানিয়ে বললেন-‘মঁসিয়ে দ্য অ্যাসার্টর্স এখন লুভেতে কর্মরত। তুমি তার কাজে যোগ দাও এখনই। মনে রাখবে সকলে যেন এইটাই বোঝে ছুটি কাটিয়ে তুমি কাজে যোগ দিয়েছ।’

    অভিবাদন জানিয়ে দ্য অ্যাট্রাগঁন কাজে যোগ দিতে চলে গেল, গত সাত দিন প্যারিস শহরে সকলের মুখেই বল নাচের অনুষ্ঠান সম্পর্কে আলোচনা হয়েছে। রাজা রানী সেখানে অংশগ্রহণ করবেন, সাত দিনেরও বেশি সময় ধরে হোটেল ডি ভ্যালি সজ্জিত হয়েছে ফুল আর শয়ে শয়ে মোমবাতি দিয়ে।

    বল নাচের নির্দিষ্ট সময়ের আগে রাজা এয়োদশ লুই–যখন পথ দিয়ে হেঁটে অনুচরবর্গ সহকারে হোটেলে প্রবেশ করলেন তখন রাজভক্ত প্রজারা করতালি দিয়ে রাজাকে অভিবাদন জানাল। প্রজারা লক্ষ্য করল রাজার মুখমণ্ডল খুবই বিষণ্ণ।

    হোটেলে নিজের ঘরে যাবার আগে রাজা জানতে চাইলেন কার্ডিনাল রিচেলিউ এসেছেন কিনা।

    রাজা লুই হোটেলে তার নির্দিষ্ট আরামবহুল ঘরে ঢোকার পরেই প্যারিসের দুঃখী বিষণ্ণা রানী এ্যান তার সখীদের নিয়ে হোটেলে এলেন। প্রজারা করতালি দিয়ে তাঁকেও অভিবাদন জানাল।

    রানীর প্রবেশের সাথে সাথেই হোটেলের একটা ছোট্ট গ্যালারির পর্দা সরে গেল, উজ্জ্বল পোশাকে সজ্জিত কার্ডিনাল রিচেলিউ ধূর্ত চোখে অনুসন্ধান করে ফিরল রানীর পোশাক পরিচ্ছদ। ধূর্ত চোখের সাথে পাল্লা দিয়ে তীক্ষ্ম জয়ের হাসি দেখা দিল কার্ডিনাল এর ঠোঁটের কোণে–রানীর গলায হীরের নেকলেস নেই।

    অভিজাত বংশীয় পুরুষ মহিলারা ও উচ্চ রাজকর্মচারীরা রানীকে অভিনন্দন জানাল। রানী অভিবাদন গ্রহণ করলেন।

    ঠিক সেই সময় রাজা লুই হোটেলের ঘর থেকে বল নাচের ঘরে এলেন। আর কার্ডিনালকে দেখা গেল রাজার সাথে নিচু স্বরে কথা বলতে।

    কার্ডিনাল এর কথা শোনার পর, রাজা লুই গম্ভীর হয়ে গেলেন দ্রুত পায়ে রানী এ্যানের দিকে এগিয়ে গিয়ে উচ্চস্বরে রানী এ্যানকে জিজ্ঞেস করলন–‘মাদাম তুমি হীরের নেকলেসটা গলায় পরনি কেন? যখন তুমি জানো নেকলেসটা তুমি পরলে আমি আনন্দ পাই?’

    রানী দেখলেন রাজার পেছনেই কার্ডিনাল, ধূর্ত শয়তানী হাসি তার সারা মুখমণ্ডলে ছড়িয়ে আছে।

    ‘মহামান্য স্বামী’ কম্পিত স্বরে রানী বললেন–‘আমি এই ভীড়ের মধ্যে আপনার দেয়া মূল্যবান হীরের নেকলেসটা পড়তে ভরসা পাইনি। যদি কোনো দুর্ঘটনা ঘটে।’

    ‘না রানী তুমি ভুল করছ, আমি তোমার উপহারটা দিয়েছি যাতে তুমি ওটা পরিধান করে নিজেকে আরও সুসজ্জিত করে তুলতে পারো। চুরির ভয়ে সিন্দুকে তুলে রাখার জন্য নয়। তোমার ধারণা ভুল মাদাম।’

    ‘মহামান্য স্বামী, আমি নেকলেসটা লুভেতেই রেখে এসেছি, আমি এখনি কাউকে দিয়ে আনিয়ে হারটা পরছি, মহামান্য স্বামী নিশ্চয়ই তাতে খুশি হবেন!’

    ‘হ্যাঁ আমি নিশ্চয়ই খুশি হবো, তাড়াতাড়ি করো, আর মাত্র আধঘণ্টা বাকি আছে নাচ শুরু হতে।’

    রানী তাঁর সখীদের নিয়ে হোটেলে তাঁর জন্য সংরক্ষিত ঘরে চলে গেলেন।

    রাজা লুই ফিরে এসে নিজের আসন গ্রহণ করলেন, কার্ডিনাল রিচেলিউ রাজার পাশে বসে ছোট্ট সুন্দর একটা বাক্স বার করে রাজার হাতে দিল। রাজা বাক্সটা খুলে দেখলেন তাতে দুটো হীরে।

    ‘এর মানে কি?’ আশ্চর্য হয়ে রাজা প্রশ্ন করলেন কার্ডিনালকে, ধূর্ত কার্ডিনাল বলল, ‘কিছুই না, তারপর আস্তে আস্তে বলল, ‘রানীর যখন হীরের নেকলেসটা পরে আসবেন, খুব সম্ভব তিনি হয়তো সেটা পরে আসতে পারবেন না, যদি আসেন মহামান্য রাজাকে অনুরোধ করছি হীরের নেকলেসে হীরের বোতাম আছে আপনি শুনে দেখবেন।’

    ‘আপনার কথা আমি কিছুই বুঝতে পারছি না’ রাজা বললেন, ‘মহামান্য রাজা’ কার্ডিনাল রিচেলিউ বলল–‘আমার ধারণা রানী যদি হীরের হারটা পরেই আসেন তাতে বারোটার পরিবর্তে দশটা হীরের বোতাম থাকবে, আর তখনই মহামান্য রাজা আপনি এই হীরে দুটো দেখিয়ে জানতে চাইবেন। রানীর হার থেকে চুরি যাওয়া হীরে দুটো এখানে কি করে এলো?’

    হতবাক রাজা কার্ডিনালকে কিছু প্রশ্ন করার সময় হলো না। রাজা শুনলেন বল নাচ ঘরের উপস্থিত সকলের মুখে প্রশংসা সূচক শব্দ। মহামান্য রাজা লুই ত্রয়োদশ যদি তাঁর রাজ্যের সর্বপ্রধান সম্মানীয় ব্যক্তি তবে নিঃসন্দেহে বলা যায় রানী অ্যান ফ্রান্সের সবচেয়ে সুন্দরী মহিলা। রাজা দেখলেন রানীর গলায় শোভিত হচ্ছে তাঁর উপহার দেয়া সেই হীরের নেকলেসটা। রাজার মনে হলো হীরের হারটা তাঁর স্ত্রী রানী অ্যানকে শোভিত করেনি, রানীর গলায় হীরেটাই যেন নিজেকে শোভিত করেছে।

    রাজার মুখ আনন্দে উদ্ভাসিত হয়ে উঠল আর ঠিক তখনই দেখা কার্ডিনাল-এর মুখে যন্ত্রণার, হতাশার চিহ্ন।

    ‘তোমাকে ধন্যবাদ রানী–তুমি আমার ইচ্ছা পূরণ করেছ কিন্তু আমার মনে হয় এই নেকলেসের দুটো বোতাম তুমি ফিরে পেতে চাইছ, আমি তোমার সেটা ফিরিয়ে দেব।’ রাজা লুই বললেন।

    ‘বাহু চমৎকার!’ রানীর সর্বশরীর থেকে আনন্দের অভিব্যক্তি ফুটে উঠল ‘আপনি আমায় আরো দুটো হীরের বোতাম উপহার দিচ্ছেন? তাহলে আমার এখন চোদ্দটা বোতাম হলো।’

    রাজা রানীর গলায় উজ্জ্বল হীরেগুলো গুণে দেখলেন, না! সেখানে বারোটাই হীরে আছে। রাজা কার্ডিনাল রিচেলিউকে কাছে ডাকলেন এবং কঠোর স্বরে বললেন,–‘মঁসিয়ে কার্ডিনাল আপনার এ ধরনের কথাবার্তার অর্থ কি?’

    কার্ডিনাল তাড়াতাড়ি চিন্তা করে বলল, আমাদের সম্মানীয়া রানীকে আমি এই দুটো হীরে, আমার তরফ থেকে ক্ষুদ্র উপহার হিসেবে দিতে চাই, আমার এত কিছু করার উদ্দেশ্য ছিল মহামান্য রানী যেন এই উপহারটা গ্রহণ করেন।

    স্মিত হাসলেন রানী অ্যান, সেই হাসিতে তিনি যেন বলতে চাইলেন হায়! কার্ডিনাল তোমার সমস্ত ষড়যন্ত্রই আমি ধরতে পেরে উদ্ধার পেয়েছি, রানী বললেন,–‘হ্যাঁ মহাশয়, আপনাকে ধন্যবাদ। আমার মনে হয় রাজার দেয়া বারোটা হীরের চাইতেও আপনার এই দুটো কিনতে অনেক বেশি অর্থব্যয় হয়েছে?’

    দ্য অ্যাট্রাগঁন রাজার পেছন থেকে দাঁড়িয়ে রানীর জয়ের আনন্দে উদ্ভাসিত মুখ লক্ষ্য করল। কার্ডিনাল আর রানী ছাড়া এইমাত্র সেই জানে এই বল নাচের আসরে কি ঘটনা ঘটে গেল। এরপর রানী দ্য অ্যাট্রাগঁনকে ডেকে পাঠালেন আর তাকে ধন্যবাদ দিয়ে একটা হীরের আংটি উপহার দিলেন। দ্য অ্যাট্রাগঁন হীরের আংটি পরে, আনন্দমুখর বল নাচের আসরে ফিরে এলো। দ্য অ্যাট্রাগঁনের আজ ভীষণ আনন্দের দিন, রাজার কাছে সে আজ সম্মানিত। মঁসিয়ে দ্য ট্রেভিল তার কাজ, সাহসিকতায়, বিশ্বস্ততায় মুগ্ধ, আর রানী অ্যানকে গভীর চক্রান্ত থেকে উদ্ধার করেছে। সবচেয়ে বড় প্রাপ্য সে পেয়েছে তিনজন সাহসী বন্ধুর বন্ধুত্ব, তারা অ্যাথোস, প্যাথোস আর অ্যারামিস। অ্যাট্রাগঁন ভাবতে লাগলে একদিন সে-ও তার তিন বন্ধুদের মতন প্রথম সারির যোদ্ধা হয়ে উঠবে।

    ⤶
    1 2
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleটুয়েনটি ইয়ার্স আফটার – আলেকজান্ডার দ্যুমা
    Next Article আরণ্যক – বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়

    Related Articles

    ফারুক হোসেন

    টুয়েনটি ইয়ার্স আফটার – আলেকজান্ডার দ্যুমা

    October 21, 2025
    ফারুক হোসেন

    দ্য কর্সিকান ব্রাদার্স – আলেকজান্ডার দ্যুমা

    October 21, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    নৌকাডুবি

    October 26, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    নৌকাডুবি

    October 26, 2025
    Our Picks

    নৌকাডুবি

    October 26, 2025

    আরণ্যক – বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়

    October 25, 2025

    থ্রি মাস্কেটিয়ার্স – আলেকজান্ডার দ্যুমা

    October 21, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    • Sign Up
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }