সন্ধ্যার পর
ইন্দুমতী সাজগোজ করে স্বামীর ঘরে ঢুকে জিজ্ঞেস করল, “কী হচ্ছে?”
নরেন্দ্র একটি বাংলা মাসিক পত্র পড়ছিল। স্ত্রীর মুখের দিকে চেয়ে কিছুক্ষণ নিঠুর নীরবতা রাখল, তারপর পত্রিকাটি তার হাতে এগিয়ে দিল।
ইন্দু খোলা পাতায় চোখ বুলিয়ে ভ্রু কুঁচকে বিস্ময় প্রকাশ করল—”এ যে কবিতা! বেশ তো, বসে না থেকে বেগার খাটছি। এটা কোন কাগজ? ‘সরস্বতী’? ‘স্বপ্রকাশ’-এ ছাপালে না বুঝি?”
নরেন্দ্রর শান্ত চোখ দুটো ব্যথায় ম্লান হয়ে এল।
ইন্দু আবার প্রশ্ন করল, “‘স্বপ্রকাশ’-এ পাঠাওনি?”
“পাঠাইনি।”
“একবার পাঠিয়ে দেখলে না কেন? ‘স্বপ্রকাশ’-এর তো কাণ্ডজ্ঞান আছে! ওরা ‘সরস্বতী’ নয়। তাই আমি এত সহজে কোনো কাগজ পড়ি না।”
একটু হেসে ইন্দু আবার বলল, “আচ্ছা, নিজের লেখা নিজেই মন দিয়ে পড়ো। ভালো কথা—আজ শনিবার, আমি ও-বাড়ির ঠাকুরঝিকে নিয়ে বায়স্কোপ দেখতে যাচ্ছি। কমলা ঘুমিয়ে পড়েছে। কবিতার ফাঁকে মেয়েটার দিকেও একটু নজর রেখো। চললাম!”
নরেন্দ্র পত্রিকাটি বন্ধ করে টেবিলে রেখে শুধু বলল, “যাও।”
ইন্দু বেরিয়ে যাচ্ছিল, হঠাৎ নরেন্দ্রর গভীর দীর্ঘশ্বাস শুনে ফিরে দাঁড়িয়ে বলল, “আচ্ছা, আমি কিছু করতে গেলেই তুমি এভাবে দীর্ঘশ্বাস ফেল কেন? বলো তো! এতই যদি তোমার কষ্ট, মুখ ফুটে বলো না—আমি বাবাকে চিঠি লিখে কোনো ব্যবস্থা করি।”
নরেন্দ্র মুহূর্তের জন্য ইন্দুর দিকে তাকিয়ে রইল। মনে হলো, সে কিছু বলবে। কিন্তু কিছুই বলল না, নীরবে মাথা নত করল।
ইন্দুর সখী বিমলা, নরেন্দ্রর মামাতো বোন। ইন্দু গাড়ি থামিয়ে ভেতরে ঢুকে অবাক হয়ে বলল, “ও কী ঠাকুরঝি! কাপড় পরোনি যে! খবর পেলে না?”
বিমলা লজ্জায় হেসে বলল, “পেয়েছি বৈকি! কিন্তু একটু দেরি হবে। উনি এইমাত্র বেড়াতে বেরিয়েছেন—ফিরে না এলে তো যেতে পারব না।”
ইন্দু মনে মনে বিরক্ত হয়ে বলল, “প্রভুর হুকুম পাওনি বুঝি?”
বিমলার মুখ মিষ্টি হাসিতে ভরে গেল। সে যেন এই বিদ্রূপ উপভোগ করল। বলল, “না, দাসীর আবেদন এখনো পেশ করা হয়নি। তবে মঞ্জুর হবে না, এমন তো নয়!”
ইন্দু আরও রেগে গেল। “তবে আবেদন করোনি কেন? আমি তো বেলা থাকতেই খবর পাঠিয়েছিলাম!”
“তখন সাহস হয়নি বৌ। অফিস থেকে এসেই বললেন, মাথা ধরেছে। ভাবলাম, জলটল খেয়ে একটু ঘুরে আসুন—মনটা ফুরফুরে হোক, তখন বলব। এখনও তো সময় আছে, একটু বসো না ভাই!”
“কী জানি, কিসে তোমার হাসি পায় ঠাকুরঝি! আমি হলে লজ্জায় মরে যেতাম। আচ্ছা, ঝি বা বেহারাকে বলে যেতে পারো না?”
বিমলা ভয়ে বলল, “বাপ রে! তা হলে তো বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেবেন—এ জন্মে আর মুখ দেখাবেন না!”
ইন্দু রেগে অবাক হয়ে বলল, “তাড়িয়ে দেবেন? কোন আইনে? কোন অধিকারে?”
বিমলা সহজভাবে বলল, “বাধা কী বৌ! তিনি মালিক, আমি দাসী। তিনি তাড়ালে কে ঠেকাবে?”
“ঠেকাবে রাজা, ঠেকাবে আইন! সে যাক গে, কিন্তু নিজেকে দাসী বলতে লজ্জা করে না? স্বামী কি মোগল বাদশাহ? স্ত্রী কি তাঁর ক্রীতদাসী যে, নিজেকে এত হীন ভাবো?”
বিমলা হেসে বলল, “তোমার ঠাকুরঝি মুখ্যু মেয়েমানুষ, তাই নিজেকে দাসী বলে গর্ব বোধ করে। আচ্ছা, তুমি কি দাদার অনুমতি নিয়ে বেরিয়েছ?”
“অনুমতি? কেন? তিনি যখন যান, আমার অনুমতি নেন? আমি শুধু জানিয়ে এসেছি। তবে এ কথা মানি, আমার মতো স্বামী কম মেয়ের ভাগ্যে জোটে। তিনি কখনো বাধা দেন না। কিন্তু তিনি যদি অন্যরকম হতেন, তবু আমি নিজের সম্মান রাখতাম। আমি সহধর্মিণী, ক্রীতদাসী নই। আমার নারীদেহেও ভগবান বাস করেন—এ কথা আমি ভুলিনি, তাঁকেও ভুলতে দিইনি।”
বিমলা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, “আমি জানি না আত্মসম্মান আদায় করা কী, কিন্তু তাঁর পায়ে আত্মবিসর্জন দিতেই জানি। ওই যে উনি এলেন! একটু বসো, আমি হুকুম নিয়ে আসি।”
বায়স্কোপ থেকে ফেরার পথে ইন্দু হঠাৎ বলল, “ঠাকুরঝি, হুকুম না পেলে তুমি আসতে পারতে না।”
বিমলা বলল, “না।”
“তাই আমার মনে হয়, আমি যখন-তখন এসে তোমাকে নিয়ে যাই বলে তোমার স্বামী রাগ করেন।”
বিমলা বলল, “তা হলে আমি নিজেই যেতাম না বৌ! বরং আমার ভয় হয়, তুমি এভাবে এসো বলে দাদা আমার ওপর রাগ করেন।”
ইন্দু গর্ব করে বলল, “তোমার দাদার সে স্বভাব নয়। তিনি কখনো অধিকারের বাইরে যান না। আর আমার কাজে রাগ করবেন, এমন স্পর্ধা তাঁর স্বপ্নেও আসে না।”
বিমলা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, “বৌ, দাদা তোমাকে কি ভালোই না বাসেন! কিন্তু তুমি বোধ হয়…”
ইন্দু হেসে বলল, “তাঁর ভালোবাসা অস্বীকার করি না। কিন্তু আমার সম্বন্ধে তোমার সন্দেহ কীসে?”
“তা জানি না। কিন্তু মনে হয়…”
“জানি ঠাকুরঝি, তোমাদের মতো পায়ে লুটিয়ে পড়া ভালোবাসা আমার নেই বলে। ঈশ্বর করুন, আমার নারীমর্যাদাকে ডিঙিয়ে কখনো ভালোবাসা মাথা চাড়া দিয়ে না ওঠে। যে ভালোবাসা আমার স্বাধীনতাকে লঙ্ঘন করে, তাকে আমি ঘৃণা করি।”
বিমলা শিহরিয়ে উঠল।
ইন্দু বলল, “কথা কও না যে! কী ভাবছ?”
“কিছু না। শুধু প্রার্থনা করি, দাদা তোমাকে চিরদিন এমনিই ভালোবাসুন। কারণ, যতই বলো না কেন বৌ, মেয়েমানুষের কাছে স্বামীর ভালোবাসার চেয়ে বড় কিছু নেই।”
ইন্দু রেগে বলল, “ছি! চুপ করো!”
বিমলা চমকে চুপ করল। ইন্দু বলল, “আমাদের দেশের মেয়েরা কি মাটির পুতুল? প্রাণ নেই, আত্মা নেই? আচ্ছা, এত করেও তুমি কী পেয়েছ? আমার চেয়ে বেশি ভালোবাসা পেয়েছ? ভালোবাসা মাপার যন্ত্র নেই, নইলে দেখাতাম! নিজেকে তোমাদের মতো হীন করিনি বলে—কাঙালি করে ভালোবাসা চাইনি বলে। আমার দুঃখ হয়, তিনি এত শান্ত, এত নিরীহ। তিনি যদি একটু প্রতিবাদ করতেন, দেখিয়ে দিতাম—যাকে গ্রাহ্য করেন না, সেও মানুষ। সেও আত্মমর্যাদা হারিয়ে ভালোবাসা চায় না।”
বিমলা জোর করে হাসি চেপে বলল, “না।”
“না কেন? তোমার ঠোঁটে এখনো হাসি লেগে আছে!”
বিমলা হেসে বলল, “তোমার কথা শুনে। বৌ, অনেক পেয়েছ বলেই এত কথা বেরোচ্ছে।”
ইন্দু রেগে বলল, “না পেলে?”
“বেরোত না।”
“ভুল! নিছক ভুল! ঠাকুরঝি, সবাই তোমার মতো নয়—সবাই ভিক্ষা চায় না। আত্মসম্মান বোঝে, এমন নারীও আছে।”
বিমলার হাসি মিলিয়ে গেল। বলল, “তা জানি।”
“জানলে আর বলতে না। এখন থেকে জেনো—যে ভিক্ষা চায় না, নিজের জোরে আদায় করে, এমন মানুষও আছে।”
বিমলা ব্যথিত স্বরে বলল, “আচ্ছা। এই যে বাড়ি এসে পড়লাম। একবার নামবে না?”
“না, আমিও বাড়ি যাই। গাড়োয়ান, ঐ গলিতে…”
“দাদাকে আমার প্রণাম জানিও বৌ!”
“জানাব। গাড়োয়ান, চলো!”
ইন্দুমতী স্বামীর কাছে এসে দাঁড়াল, “সংসারের খরচের জন্য কিছু টাকা দিতে হবে।”
নরেন্দ্র অবাক হয়ে বলল, “এই দু’শ টাকা এত তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে গেল?”
“না শেষ হলে কি মিথ্যে বলছি? না, লুকিয়ে রেখে চাইছি?”
নরেন্দ্রর চোখে-মুখে ভয়ের ছায়া নেমে এল। কোথায় টাকা? কীভাবে যোগাড় করবে?
ইন্দু স্বামীর মুখের ভাব দেখে ভুল বুঝল। বলল, “বিশ্বাস না হয়, এখন থেকে একটা খাতা দাও, হিসেব লিখে রাখব। না হয়, টাকা-পয়সা তোমার হাতেই রাখো—তোমারও ভয় থাকবে না, আমারও সংশয়ের লজ্জা থেকে রেহাই মিলবে।”
নরেন্দ্র ধীরে ধীরে বলল, “অবিশ্বাস করছি না, কিন্তু—”
“কিন্তু কী? বিশ্বাসও করছ না—এই তো? আচ্ছা, যাচ্ছি, হিসেব লিখে আনি। উফ্—কি সুখের সংসারই গড়েছি!”
রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে ইন্দু বেরিয়ে গেল। কিন্তু হঠাৎ ফিরে এসে বলল, “কিন্তু কেন? হিসেব লিখবো কেন? আমি কি মিথ্যে বলি? আমার মামাতো বোনের বিয়েতে কাপড়-জামা কিনতে পঞ্চাশ টাকা গেছে। কমলার জামা দুটো বারো টাকা, বায়স্কোপে দশ-বারো টাকা। বাকি কত টাকা আছে, তা হিসেব করে দেখো! এতদিন সংসার চালাতে এত টাকা লাগছে, তাতে তোমার চোখ কপালে উঠছে কেন? আমার দাদার সংসারে মাসে সাত-আটশ টাকাতেও চলে না। সত্যি বলছি, এমন করলে আমি আর টিকতে পারব না। তার চেয়ে স্পষ্ট বলো—দাদা মেদিনীপুরে বদলি হয়েছেন, আমি মেয়েকে নিয়ে সেখানেই চলে যাই। আমিও শান্তি পাব, তুমিও বাঁচবে!”
নরেন্দ্র মাথা নিচু করে অনেকক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর মুখ তুলে বলল, “এখনই তো পারব না, ওবেলায় দেখি যদি কিছু যোগাড় করতে পারি।”
“তার মানে? যদি যোগাড় না করতে পারো, উপোস করতে হবে? শোনো, কালই আমি মেদিনীপুরে চলে যাচ্ছি। কিন্তু তুমি একটা কাজ করো—এই দালালির ব্যবসা ছেড়ে দাও। দাদাকে ধরো, একটা চাকরি যোগাড় করে নাও। ভবিষ্যতে অন্তত কিছু থাকবে। যা পারো না, তাতে হাত দিয়ে নিজেও নষ্ট হয়ো না, আমাকেও নষ্ট করো না।”
নরেন্দ্র কোনো জবাব দিল না। ইন্দু আরও কিছু বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু ঠিক তখনই বেহারা এসে জানাল, শম্ভুবাবু এসেছেন।
শম্ভুবাবুর আগমন
শম্ভুবাবু মহাজন। নরেন্দ্রর বাবা প্রচুর ঋণ করে গেছেন, আর এখন সেই টাকা আদায় করতে শম্ভুবাবু মাঝেমাঝেই আসেন। আজও এসেছেন। তিনি নরম স্বভাবের মানুষ, ধীরে ধীরে এমন কয়েকটি কথা বললেন, যার মানে হলো—”টাকা দিতেই হবে, নইলে…”
শম্ভুবাবু চলে গেলে ইন্দু ফিরে এসে জিজ্ঞেস করল, “ইনি কে?”
“শম্ভুবাবু।”
“তারপর?”
“কিছু টাকা চেয়েছিলেন।”
“টের পেয়েছি। কিন্তু ধার করেছিলে কেন?”
নরেন্দ্র জবাবটা ঘুরিয়ে দিল, “বাবা হঠাৎ মারা গেলেন, তাই—”
ইন্দু রুক্ষ স্বরে বলল, “তোমার বাবা কি সারা পৃথিবীর কাছে ধার করে গেছেন? এ শোধ করবে কে? তুমি? কীভাবে করবে শুনি?”
নরেন্দ্রর কোনো উত্তর আসছিল না। ইন্দু নিজেই বলে গেল, “তোমার বাবা না হয় হঠাৎ মারা গেছেন, কিন্তু তুমি তো হঠাৎ বিয়ে করনি! বাবাকে এসব কথা জানানো উচিত ছিল। আমাকেও গোপন করা উচিত হয়নি। লোকের মুখে শুনি তুমি খুব ধার্মিক, এগুলো কি তোমার ধর্মশাস্ত্রে লেখে না?”
নরেন্দ্রর মুখে কোনো প্রতিবাদ নেই। সে শুধু নতমুখে বসে আছে। ইন্দুর তীব্র কথাগুলো তার বুকে আঘাত করছে, কিন্তু প্রতিশোধ নেওয়ার মতো শক্তি তার নেই। শুধু সহ্য করা—এইটুকুই তার সাধ্য।
অবশেষে নরেন্দ্র মৃদু স্বরে বলল, “বাবার সম্বন্ধে তোমার এভাবে বলা উচিত নয়।”
“উচিত না? কিন্তু আমি তো তোমাকে উচিত-অনুচিত বোঝাতে বলিনি! কেন তুমি বাবাকে সব খুলে বলোনি?”
“আমি কিছু গোপন করিনি ইন্দু। তিনি বাবার বাল্যবন্ধু ছিলেন, সব জানতেন।”
“তাহলে বলো, সব জেনে-শুনেই বাবা আমাকে জলে ফেলে দিয়েছেন!”
নরেন্দ্র স্তম্ভিত হয়ে গেল। স্ত্রীর এই রাগ সত্যি, নাকি কলহের ছলনা—তা সে বুঝতে পারল না।
পেছনের কথা
একসময় উভয় পরিবার পাশাপাশি থাকতেন, তখনই বিবাহ ঠিক হয়েছিল। কিন্তু ইন্দুর বাবা হঠাৎ মত বদলালেন—মেয়েকে বেশি বয়স পর্যন্ত অবিবাহিত রেখে লেখাপড়া শেখাবেন বলে সিদ্ধান্ত নিলেন। ফলে বিয়েটা ভেঙে যায়। কয়েক বছর পর, ইন্দুর আঠারো বছর বয়সে আবার কথা উঠলে, ইন্দুর বাবা কলকাতায় ফিরে শুনলেন নরেন্দ্রর বাবা মারা গেছেন। তখন ইন্দুর বাবা-মা নরেন্দ্রর আর্থিক অবস্থা ভালো করে যাচাই করেছিলেন। তাঁদের ইচ্ছেও ছিল না এই বিয়েতে, কিন্তু বড় মেয়ের জেদের কাছে হার মানতে বাধ্য হয়েছিলেন।
এতকিছু ইন্দু কি সত্যিই ভুলে গেছে? নাকি নিজেকে ধোঁকা দিচ্ছে? নরেন্দ্র কিছুই বুঝতে পারল না। সে শুধু নীরবে মাথা হেঁট করে বসে রইল।
ইন্দু স্বামীর নতমুখের দিকে তাকিয়ে আর কোনো কথা না বলে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। আজ প্রথমবার নরেন্দ্রর মনে হলো, ইন্দু যেন ইচ্ছে করেই তার বুকের ওপর পা দিয়ে চলে গেল। সে একবার মাথা তুলে স্ত্রীর দিকে তাকাল, কিন্তু ইন্দু তখন আর সেখানে নেই।
গভীর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে নরেন্দ্র নিষ্প্রাণের মতো শুয়ে পড়ল। আজ প্রথম মনে হলো—সব মিথ্যা। এই সংসার, স্ত্রী-কন্যা, স্নেহ-প্রেম—সবই যেন মরুভূমির মরীচিকার মতো উবে গেল।
“কে রে, বিমল? আয় বোন, বস!” বলে নরেন্দ্র বিছানা থেকে উঠে বসল। তার ঠোঁটের কোণে ব্যথার যে ছাপ ফুটে উঠল, তা বিমলার চোখ এড়াল না।
“অনেকদিন দেখিনি দিদি, ভালো আছিস তো?”
বিমলার চোখ দুটি জলে ভরে এল। সে ধীরে ধীরে বিছানার পাশে এসে বলল, “কেন দাদা, তোমার অসুখের কথা আমাকে এতদিন জানালে না?”
“অসুখ তেমন কিছুই ছিল না বোন, শুধু বুকের ব্যথাটা একটু—”
বিমলা চোখের জল মুছে বলল, “একটু বৈকি! উঠে বসতে পারো না—ডাক্তার কী বলল?”
“ডাক্তার? ডাক্তার দরকার কী রে, এ তো এমনিই সেরে যাবে।”
“এ্যাঁ! ডাক্তার পর্যন্ত ডাকাও নি? ক’দিন হলো?”
নরেন্দ্র একটু হেসে বলল, “ক’দিন? সেদিন তো। সাত-আট দিন হবে বোধ হয়।”
“সাত দিন! তা হলে বৌদি সব দেখেই চলে গেছে!”
“না না, দেখে যায়নি বোধ হয়। অসুখটা সে বুঝতেই পারেনি। আমি তার যাওয়ার দিনও উঠে বাইরে বসে ছিলাম। না না, হাজার হোক, তোরা পারিস বোন?”
“বৌদি তাহলে রাগ করে গেছে, বলো?”
“না, রাগ নয়—দুঃখ-কষ্ট। অভাব-অনটন তো জানিস? ওদের এ সব সহ্য করার অভ্যাস নেই। শরীরটাও তার খারাপ হয়ে গেছে, নইলে অসুখ দেখলে কি তোরা রাগ করে থাকতে পারিস?”
বিমলা চোখের জল চেপে কঠিন স্বরে বলল, “পারি বৈকি দাদা, আমাদের অসাধ্য কিছু নেই। নইলে, তোমরা বিছানায় না শোওয়া পর্যন্ত আমাদের চোখেই পড়ো না! ভোলা, পাল্কি এলো রে?”
“আনতে পাঠিয়েছি মা।”
“এত তাড়াতাড়ি যাবি দিদি? এখনো তো সন্ধ্যা হয়নি, আর একটু বস না?”
“না দাদা, সন্ধ্যা হলে হিম লাগবে। ভোলা, পাল্কি ভিতরে আনিস।”
“ভিতরে কেন, বিমল?”
“ভেতরেই ভালো দাদা। এই ব্যথা নিয়ে বাইরে গিয়ে উঠতে কষ্ট হবে।”
“আমাকে নিয়ে যাবি? এ কী পাগলামি! এ তো আমার প্রায়ই হয়—আপনিই সেরে যায়।”
“তা যাক দাদা। কিন্তু ভাই ত আমার আর নেই, তোমাকে হারালে আর কাউকে পাব না। ওই যে পাল্কি—এই র্যাপারটা গায়ে জড়িয়ে নাও। ভোলা, আর একটু এগিয়ে আনতে বলো—না দাদা, এ সময় তোমাকে চোখে চোখে না রাখলে আমার এক মুহূর্তও শান্তি থাকবে না।”
“কিন্তু, নিয়ে যেতে চাইবি বুঝলে তোকে আমি খবরই দিতাম না।”
বিমলা তার দিকে তাকিয়ে বলল, “তোমাদের বোঝা তোমাদেরই থাক দাদা, আমাকে আর শুনিয়ো না। আচ্ছা, কী করে মুখে আনলে বলো তো? এই অবস্থায় তোমাকে একলা ফেলে যেতে পারি? সত্যি কথা বলো!”
নরেন্দ্র দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “তবে চলো যাই।”
“দাদা!”
“কী রে?”
“আজ রাতেই বৌদিকে একটা টেলিগ্রাম করে দিই, কাল সকালেই চলে আসুক।”
নরেন্দ্র তাড়াতাড়ি বলল, “না, না, দরকার নেই।”
“কেন নেই? মেদিনীপুর তো বেশি দূর নয়, একবার আসুক, আবার চলে যাবে।”
“না রে বিমল, না। সত্যিই তার শরীর ভালো নেই—দু’দিন জুড়ুক।”
একটু থেমে বলল, “বিমল, আমি তোর কাছ থেকে ভালো না হতে পারলে আর কাউকে দিয়ে পারব না। হ্যাঁ রে, গগনবাবু কি শুনেছেন?”
“তুমি তো! তিনি এখনো অফিস থেকে ফেরেননি।”
“তবে?”
“তবে আর কী? তোমার ভয় নেই দাদা, তাঁর বড় বড় দুটো চোখ আছে, আমরা গেলেই দেখতে পাবেন।”
নরেন্দ্র বিছানায় শুয়ে বলল, “বিমল, আমার যাওয়া তো সম্ভব নয়।”
বিমলা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, “কেন?”
“গগনবাবুর অনুমতি ছাড়া—”
“অমন করলে মাথা খুঁড়ে মরব দাদা! একটা বাড়ির মধ্যে ভিন্ন মত থাকে নাকি? আমাকে অপমান করছ?”
“অপমান করছি? ঠিক জানিস বিমল, ভিন্ন মত থাকে না?”
বিমলা প্রয়োজনীয় জিনিস গুছিয়ে নিচ্ছিল, লজ্জায় মাথা নেড়ে বলল, “না।”
“দাদা, আজ ব্যথাটা তেমন টের পাচ্ছ না, না?”
“একেবারেই না। এ আট দিন তোদের কী কষ্টই না দিলাম—এখন বিদায় কর দিদি।”
“করব কার কাছে? আচ্ছা দাদা, এই ষোল-সতের দিনের মধ্যে বৌদি একখানা চিঠিও দিল না?”
“না, দিয়েছে বৈকি! পৌঁছানোর খবর দিয়েছিলেন, কালও একখানা পেয়েছি—আমিই জবাব দিতে পারিনি ভাই।”
বিমলা মুখ ভার করে চুপ করে রইল। নরেন্দ্র লজ্জায় কুঁকড়ে বলতে লাগল, “সেখানে গিয়েও তার শরীর ভালো নেই—সর্দি-কাশি, পরশু একটু জ্বরও হয়েছিল, তবু তার ওপরেই চিঠি লিখছেন।”
“আজ তাই বুঝি সেখানে টাকা পাঠিয়ে দিলে?”
নরেন্দ্র আরও লজ্জিত হয়ে বলল, “তার হাতে কিছুই ছিল না—বাড়ির পাশেই একটা মেলা বসেছে, লিখেছেন, সেটা শেষ হলে ফিরতে পারবেন—তোমাকে বুঝি চিঠি লিখতে পারেননি?”
“পেরেছেন বৈকি! কাল আমিও একখানা চার পাতার চিঠি পেয়েছি—”
“পেয়েছিস? পাবি বৈকি—তার জবাবটা—”
“তোমার ভয় নেই দাদা—তোমার অসুখের কথা লিখব না। আমার নষ্ট করার মতো সময় নেই।” বলে বিমলা ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
সন্ধ্যার আলাপ
সন্ধ্যার সময় খোলা জানালা দিয়ে লাল আকাশের দিকে তাকিয়ে নরেন্দ্র নিথর হয়ে বসে ছিল। বিমলা ঘরে ঢুকে বলল, “চুপ করে কী ভাবছ দাদা?”
নরেন্দ্র মুখ ফিরিয়ে বলল, “কিছুই ভাবিনি বোন, মনে মনে তোকে আশীর্বাদ করছিলাম, যেন এমনি সুখেই তোর চিরদিন কাটে।”
বিমলা কাছে এসে তার পায়ের ধুলো মাথায় নিয়ে একটা চৌকিতে বসল।
“আচ্ছা, দুপুরবেলা অত রাগ করে চলে গেলি কেন বলো তো?”
“আমি অন্যায় সহ্য করতে পারি না। তুমি অত—”
“অত কী বলো? ইন্দুর দিক থেকে একবার ভাবো দেখো? আমি তো তাকে সুখে রাখতে পারিনি?”
“সুখে থাকার ক্ষমতা থাকা চাই দাদা! সে যা পেয়েছে, ক’জন পায়? কিন্তু সৌভাগ্যকে মাথায় তুলে নিতে হয়, নইলে—” কথাটা শেষ করার আগেই বিমলা লজ্জায় মাথা নিচু করল।
নরেন্দ্র নীরবে স্নিগ্ধ দৃষ্টিতে বোনটির দিকে তাকিয়ে কিছুক্ষণ পরে বলল, “বিমল, লজ্জা করিস না দিদি, সত্যি বলো তো, তুই কখনো ঝগড়া করিস না?”
“উনি বলেছেন বুঝি? তা তো বলবেনই।”
নরেন্দ্র হেসে বলল, “না, গগনবাবু কিছুই বলেননি—আমি তোকেই জিজ্ঞেস করছি।”
বিমলা লাল মুখ তুলে বলল, “তোমাদের সঙ্গে ঝগড়া করে কে পারবে বলো? শেষে হাতে-পায়ে পড়ে—ওখানে দাঁড়িয়ে কে?”
“আমি, আমি—গগনবাবু। থামলে কেন? বলে যাও। ঝগড়া করে কার হাতে-পায়ে কাকে পড়তে হয়—কথাটা শেষ করো।”
“যাও—যে সাধুপুরুষ লুকিয়ে শোনে, তার কথায় আমি জবাব দিই না।” বলে বিমলা কৃত্রিম রাগের আড়ালে হাসি চেপে দ্রুত বেরিয়ে গেল।
নরেন্দ্র দীর্ঘশ্বাস ফেলে মোটা তাকিয়ায় হেলান দিয়ে বসল। গগনবাবু বললেন, “এবেলায় কেমন আছো হে?”
“ভালো হয়ে গেছি। এবার বিদায় দাও ভাই।”
“বিদায় দাও? ব্যস্ত হয়ো না হে—দু’দিন থাকো। তোমার এই বোনটির আশ্রয়ে যে যত দিন বাস করতে পায়, তার তত বছর আয়ু বাড়ে, জানো?”
“জানিনে বটে, কিন্তু সম্পূর্ণ বিশ্বাস করি।”
গগনবাবু চোখ বড় করে বললেন, “বিশ্বাস করো কি হে, এ তো প্রমাণিত কথা। বাস্তবিক নরেনবাবু, এমন রত্নও সংসারে পাওয়া যায়! ভাগ্য! ভাগ্য! ভাগ্যং ফলতি—কী হে কথাটা? নইলে আমার মতো হতভাগ্য যে এ বস্তু পায়, এ তো স্বপ্নেরও অগোচর! বৌঠাকরুন—না হে না, থেকে যাও দু’দিন—এমন সংসার ছেড়ে স্বর্গে গিয়েও আরাম পাবে না, তা বলে দিচ্ছি ভাই।”
বিমলা অনেক দূরে যায়নি, ঠিক পর্দার আড়ালেই কান পেতে ছিল—চোখ মুছে উঁকি দিয়ে দেখল, অন্ধকারেও স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে, তার স্বামীর কথায় নরেনদাদার মুখখানা একবার জ্বলে উঠেই যেন ছাই হয়ে গেল।
পনেরো দিন পর, দুপুরের গাড়িতে ইন্দু মেয়েকে নিয়ে মেদিনীপুর থেকে ফিরে এল। স্ত্রী ও মেয়েকে সুস্থ দেখে নরেন্দ্রর শীর্ণ মুখ মুহূর্তে উজ্জ্বল হয়ে উঠল। সে তাড়াতাড়ি ঘুমন্ত মেয়েকে বুকে টেনে নিয়ে জিজ্ঞেস করল, “কেমন আছ ইন্দু?”
“ভালো আছি। কেন?”
“তোমার জ্বরের মতো হয়েছিল শুনে খুব ভেবেছিলাম। সেরে গেছে?”
“না হলে ডাক্তার ডাকবো না কি?”
নরেন্দ্রর হাসিমুখ ম্লান হয়ে গেল। বলল, “না, তাই জিজ্ঞেস করছি।”
“কী হবে জিজ্ঞেস করে? এদিকে পঞ্চাশ টাকা পাঠিয়ে চিঠির পর চিঠি যাচ্ছিল—’কেমন আছ? সাবধানে থেকো’। আমি কি ছোট্ট খোকা, না দাদা আমাকে টাকা দিতে পারতেন না? ও টাকা পাঠিয়ে সবাইকে আমার মাথা হেঁট করিয়ে দিলে কেন? সেদিন বাড়িতে হাসির রোল পড়ে গেল।”
নরেন্দ্রর মুখ আরও কালো হয়ে গেল। অস্পষ্ট স্বরে বলল, “যোগাড় করতে পারিনি।”
“না পাঠালে তাই লিখে দিলে না কেন? উফ্—আবার সেই ‘নেই নেই’, ‘দাও দাও’! বেশ ছিলাম এতদিন। সত্যি বলছি, বড়লোকের মেয়ের গরিবের ঘরে পড়ার চেয়ে বড় অভিশাপ আর নেই!” এই বলে ইন্দু স্বামীর হৃদয়ে বিষ ঢেলে দিয়ে চলে গেল।
এক মাস পর স্বামী-স্ত্রীর এই প্রথম দেখা।
ঘরে ফিরে
বাইরে এসে ইন্দু চারিদিক তাকিয়ে নিজের শোবার ঘরে ঢুকে অবাক হয়ে দেখল, বাড়ির বাকি অংশের মতো এটাও ঝকঝকে পরিষ্কার। সে জিজ্ঞেস করল, “এত ঝাড়া-মোছা হচ্ছে কেন?”
নতুন ঝি বলল, “আপনি আসবেন বলে।”
“আমি আসব বলে?”
“হ্যাঁ মা, বাবু তাই বলে দিয়েছিলেন। আপনি ময়লা কিছু দেখতে পারেন না—তাই তিন দিন ধরে…”
ইন্দুর ভেতরে গর্বের অনুভূতি হল। কিন্তু সহজভাবে বলল, “ময়লা আবার কে দেখতে পারে? তবু ভালো যে—”
“হ্যাঁ মা, লোক লাগিয়ে পুরো বাড়ি সাফ করা হয়েছে।”
“ঝি, রামটহলকে ডেকে দাও তো, বাজার থেকে কিছু ফল আনুক।”
“ফল তো সব আছে মা। বাবু আজ সকালে নিজে বাজারে গিয়ে কিনে এনেছেন।”
“ডাব আছে? আঙুর—”
“হ্যাঁ মা, এখনি নিয়ে আসছি।” ঝি চলে গেল। ইন্দুর মুখের বিরক্তি মিলিয়ে গেল। বরং কিছুক্ষণ আগে স্বামীর ম্লান মুখ মনে পড়ে তার বুকটা একটু খচখচ করতে লাগল।
স্বামীর ঘরে
দুই ঘণ্টা বিশ্রাম নিয়ে ইন্দু প্রসন্ন মুখে স্বামীর ঘরে ঢুকল। দেখল, নরেন্দ্র চশমা খুলে ঝুঁকে কি লিখছে। জিজ্ঞেস করল, “এত মন দিয়ে কি লিখছ? কবিতা?”
নরেন্দ্র মুখ তুলে বলল, “না।”
“তবে?”
“ও কিছু না।” বলে সে লেখাগুলো চাপা দিল।
ইন্দুর মুখ আবার কালো হয়ে গেল। বলল, “তা হলে ‘কিছু না’ নিয়ে এত ঝুঁকে না থেকে দুঃখ-কষ্ট দূর করার চেষ্টা করো। শুনলাম দাদার হাতে কয়েকটা চাকরি খালি আছে।” বলে স্বামীর মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। সে নিশ্চিত ছিল, চাকরির প্রস্তাবে স্বামী আঘাত পাবে। কিন্তু আজ অবাক হয়ে দেখল, তার মুখে কোনো ব্যথার ছাপ নেই।
নরেন্দ্র শান্তভাবে বলল, “চাকরি করার লোক সেখানে আছে।”
এই অপ্রত্যাশিত উত্তরে ইন্দু রেগে আগুন হয়ে গেল। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, “তা জানি। কিন্তু সেখানে আছে, এখানে নেই নাকি? আজকাল ভালো কথা বললে তোমার খারাপ লাগে দেখছি! ঘরের কোণে বসে কবিতা লিখতে লজ্জা করে না?” বলে রাগে মুখ লাল করে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
বিমলার সঙ্গে দেখা
“এই যে বৌ! কখন এলে?”
“পরশু দুপুরবেলা।”
“পরশু—দুপুরবেলা! তাই আজ সন্ধ্যায় দেখা দিতে এলেন? টানাটানি একটু কম করো ভাই!”
ইন্দু মাথা নেড়ে বলল, “চিঠি লিখে জবাব পর্যন্ত পাই না। আমি একা আর কত টানব ঠাকুরঝি?”
বিমলা আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞেস করল, “জবাব পাওনি?”
“সে না পাওয়াই ভালো। চার পাতার জবাব চার লাইন!”
বিমলা অপ্রস্তুত হয়ে বলল, “সেই সময় একটু ব্যস্ত ছিলাম ভাই। এদিকে দাদা সেরে উঠলেন, অন্যদিকে নতুন ভাড়াটে চলে যাচ্ছিল।”
ইন্দু কথাটা বুঝল না। হা করে তাকিয়ে রইল।
বিমলা বলতে লাগল, “সেই মঙ্গলবারটা আমার চিরকাল মনে থাকবে। সাত দিনের দিন দাদাকে নিয়ে এলাম, তার দু’দিন পর তার বুকের ব্যথা বেড়ে গেল—আর অম্বিকাবাবুর অসুখও তেমনি বাড়ল। তোমাকে বলব কি বৌ, সেঁক দিতে দিতে সবাইর হাতের চামড়া উঠে গেল—সারাদিন কারও খাওয়া-দাওয়াও হল না। অম্বিকাবাবুর স্ত্রী সতী-সাধ্বী মেয়ে, কি যত্নই করল! তার পুণ্যেই তিনি বেঁচে গেলেন।”
“অম্বিকাবাবু কে?”
“ঘাটালের কাছে কোথায় তার বাড়ি। চিকিৎসার জন্য এখানে এসে আমাদের পাশের বাড়ি ভাড়া নিয়েছেন। গরিব মানুষ, শুধু স্ত্রীটি—”
ইন্দু মাঝখানেই জিজ্ঞেস করল, “তোমাদের দাদার ব্যথা কি খুব বেড়েছিল?”
বিমলা মুখ ভার করে বলল, “সে রাতে আমার সত্যিই ভয় হয়েছিল। ঐ তাকের ওপর ওষুধের শিশিগুলো দেখো না—তিন ডাক্তার—আচ্ছা বৌ, দাদা কি তোমাকে এ সব চিঠিতে লেখেননি?”
ইন্দু অন্যমনস্কভাবে বলল, “না।”
“এখানে এসে শুনলে?”
“হ্যাঁ।”
বিমলা বলতে লাগল, “আমি ত প্রথম দিনই তোমাকে টেলিগ্রাম করতে চেয়েছিলাম, কিন্তু দাদা কিছুতেই দিলেন না।” হেসে বলল, “তুমি তাকে কি করেছো, তা তুমিই জানো বৌ। পাছে অসুস্থ শরীরে তুমি কষ্ট পাও, তাই খবর দিতে দিলেন না। যাক, ঈশ্বরের কৃপায় সব ভাল হয়ে গেছে।”
“না হলে কি হত ঠাকুরঝি? অসুখ সারে তো আমার দরকার হয়নি, না সারলেও হত না!” বলে ইন্দু উঠে গিয়ে ওষুধের শিশিগুলো নাড়াচাড়া করতে লাগল।
কিন্তু কি হল? হঠাৎ তার চোখে জল এসে গেল। সে কি এমন কেউ নয় যে, এত বড় ব্যাপার হল, তাকে জানানো হল না? সে নিজে অসুখের কথা লিখেছিল, তবু তাকে খবর দেওয়া হল না!
তিনি সুস্থ হয়ে কত চিঠি লিখেছেন, শুধু নিজের অসুখের কথা বলতে ভুলে গেছেন? আর এখানে এসেও তিন দিন হয়ে গেল, তবু মনে পড়ল না?
ইন্দুর রাগ বিমলা টের পেয়েছিল। ফিরে এসে বলল, “শিশি নাড়ালে কি হবে বৌ, ওরা তো মিথ্যে বলবে না। এসো, তোমার চা দেওয়া হয়েছে।”
“চলো,” বলে ইন্দু চোখের জল মুছে ফেলল।
বিদায়
চা খাওয়ার পর বিমলা বলল, “একটা মজার কথা শোনো বৌ। এক বাড়িতে দুই রোগী, কিন্তু দুজনের চিকিৎসা সম্পূর্ণ আলাদা। দাদা মরমর অবস্থায়ও তোমাকে খবর দিতে দিলেন না, পাছে তুমি কষ্ট পাও। আর অম্বিকাবাবু এক মুহূর্তও স্ত্রীকে দূরে যেতে দিলেন না! তার ভয়, সে চোখের সামনে থেকে গেলেই তার প্রাণ বেরিয়ে যাবে! এমনকি, সে ছাড়া কারও হাতে ওষুধ খেতেন না। আমাদের দাদাকে তোমরা হাসো, কিন্তু অম্বিকাবাবু তো সবাইকে ছাড়িয়ে গেছেন!”
ইন্দু ‘হুঁ’ বলে উঠে দাঁড়াল। বলল, “আর একদিন এসে তোমার সতী-সাধ্বী বৌটির সঙ্গে আলাপ করব। আজ গাড়ি এসেছে, চললাম।”
“কাল এসো। আলাপ করে সুখী হবে।”
“দেখা যাবে, যদি কিছু শিখতে পারি,” বলে ইন্দু মুখ ভার করে গাড়িতে উঠল। অম্বিকাবাবুর পাগলামি তার মনের মধ্যে স্বামীর গভীর মমতাকে ঢেকে দিয়ে তাকে লজ্জা দিতে দিতে চলল।
দু-দিন পরে কথায় কথায় ইন্দু খুব বিরক্ত হয়ে বলে উঠল, “যদি সত্যি কথা শুনে রাগ না করো, তাহলে বলি ঠাকুরঝি, বিয়ে করা তোমার দাদারও উচিত হয়নি, এই অম্বিকাবাবুরও হয়নি।”
বিমলা জিজ্ঞেস করল, “কেন?”
“কারণ, পোষানোর ক্ষমতা না থাকলে এটা বড় পাপ।”
উত্তর শুনে বিমলা মনে মনে আঘাত পেল। সে ইন্দুকে ভালোবাসত। কিছুক্ষণ পরে বলল, “অম্বিকাবাবুর ভুল হয়ে থাকতে পারে, কিন্তু তাই বলে তার বউ কি নিজের কর্তব্য করবে না? তাকে তো মরা পর্যন্ত স্বামীর সেবা করতে হবে?”
“কেন হবে! তারা ভুল করবে, যা করার অধিকার নেই তাই করবে—আর তার ফল ভোগ করব আমরা? তুমি ইংরেজি পড়োনি, আর সভ্য সমাজের খবর রাখো না; নইলে বোঝাতে পারতাম, কর্তব্য শুধু একদিকে থাকে না। হয় দুদিকে থাকবে, নয়তো থাকবে না। পুরুষরা এটা আমাদের বোঝতে দেয় না; তাই আমরা অম্বিকাবাবুর বউয়ের মতো মরণপণ করে সেবা করি।”
বিমলা একটু চুপ করে তাকিয়ে বলল, “না হলে করতাম না! বউ, সেবা করাটা কি স্ত্রীর এত বড় দুঃখের কাজ বলে মনে করো? অম্বিকাবাবুর বউয়ের বাইরের কষ্টটাই দেখতে পাও, তার ভেতরের আনন্দটা কি জানো?”
“আমি জানতেও চাই না।”
“স্বামীর ভালোবাসাটাও বোধহয় জানতে চাও না?”
“না ঠাকুরঝি, ওতে আর রুচি নেই। বরং ওটা কম করে নিজের কর্তব্য করলেই বাঁচি।”
বিমলা দাঁড়িয়ে ছিল, একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আস্তে আস্তে বসে পড়ে বলল, “এই কথাটা তুমি আগেও একবার বলেছিলে। কিন্তু তখনও বুঝিনি, এখনও বুঝলাম না। আমার দাদা তার কর্তব্য করে না! কী সে, তা তুমিই জানো। তুমি অনেক বই পড়েছ, অনেক দেশের খবর জানো—তোমার সঙ্গে তর্ক করা আমার সাজে না। কিন্তু আমার পাকা বিশ্বাস, স্বামী ন্যায়-অন্যায় যাই করুক, তার ভালোবাসা উপেক্ষা করার সাহস কোনো দেশের বউয়ের নেই। আমার তো মনে হয়, ওটা হারানোর চেয়ে মরা ভালো; তারপরেও বেঁচে থাকা শুধু ঝক্কি।”
“আমি তা মানি না।”
“মানো নিশ্চয়ই,” বলে বিমলা হেসে ফেলল। হঠাৎ তার মনে হলো, এসব তো মজা। সত্যি তো, মজা ছাড়া নারীর মুখে এটা আর কী হতে পারে! বলল, “তাও বলি বউ, আমার কাছে যা মুখে আসে বলছ, কিন্তু দাদার সামনে এসব নিয়ে বেশি চালাকি কোরো না। কারণ, পুরুষমানুষ যতই বুদ্ধিমান হোক, অনেক সময়—”
“কী—অনেক সময়?”
“মজা কি না, ধরতে পারে না।”
“সে তাদের ব্যাপার। আমি তা নিয়ে চিন্তা করি না।”
“কিন্তু আমি তো না ভেবে থাকতে পারি না বউ।”
ইন্দু জোর করে হেসে জিজ্ঞেস করল, “কেন বলো তো?”
বিমলা একটু ভেবে বলল, “রাগ কোরো না বউ; কিন্তু সেই অসুখের সময় আমার সত্যিই মনে হয়েছিল, দাদা যে তোমাকে পাওয়ার জন্য একসময় পাগল হয়ে উঠেছিল, সেই যে কী বলে—‘পায়ে কাঁটা ফুটলে বুক পেতে দেওয়া’—কিন্তু সে ভাব আর বোধহয় নেই।”
হঠাৎ ইন্দুর মুখটা যেন কালো হয়ে গেল। তারপর জোর করে একটা শুকনো হাসি টেনে এনে বলল, “তোমাকে হাজার ধন্যবাদ ঠাকুরঝি, তোমার দাদাকে বলো, আমি এতটুকু পরোয়া করি না। আর তুমিও ভালো করে বোঝো, আমার ভালো-মন্দ আমি নিজেই সামলাতে জানি। তা নিয়ে অন্যের মাথা গরম করাটাও দরকার মনে করি না।”
ফিরে এসে ইন্দু স্বামীর ঘরে ঢুকেই জিজ্ঞেস করল, “আমি মেদিনীপুরে গেলে তোমার অসুখ হয়েছিল?”
নরেন্দ্র খাতা থেকে মুখ তুলে আস্তে আস্তে বলল, “না, অসুখ নয়—সেই ব্যথাটা।”
“খরচ বাঁচাতে ঠাকুরঝির বাড়িতে গিয়ে পড়েছিলে?”
স্ত্রীর এই তীক্ষ্ণ কথায় নরেন্দ্র আবার খাতার ওপর ঝুঁকে পড়ল, কয়েক মুহূর্ত চুপ থেকে মৃদু গলায় বলল, “বিমল এসে নিয়ে গিয়েছিল।”
“কিন্তু আমি শুনলে বলতাম, অক্ষমদের জন্যই হাসপাতাল তৈরি হয়েছে। অন্যের ঘাড়ে না চড়ে সেখানে যাওয়াই তাদের উচিত।”
নরেন্দ্র আর মুখ তুলল না—একটা কথাও বলল না।
ইন্দু টান মেরে পর্দা সরিয়ে বেরিয়ে গেল। ধাক্কায় একটা ছোট টিপাই ফুলদানি-সহ উলটে পড়ল; সে ফিরেও তাকাল না।
পাঁচ মিনিট পরে, তেমনই জোরে পর্দা সরিয়ে ফিরে এসে বলল, “ঠাকুরঝি খবর দিতে চেয়েছিল, তুমি বারণ করেছিলে কেন? ভেবেছিলে বুঝি আমি এসে ওষুধের সঙ্গে বিষ মিশিয়ে দেব!”
নরেন্দ্র মুখ না তুলে বলল, “না, তা ভাবিনি। তোমার শরীর ভালো ছিল না—”
“ভালোই ছিল। যদিও খবর পেলেও আমি আসতাম না, সে নিশ্চিত। কিন্তু আমি সেখানে যে রোগে মরে যাচ্ছিলাম, সে কথা তোমাকে চিঠিতে লিখিনি। অকারণে কিছু মিথ্যে কথা বলে ঠাকুরঝিকে বারণ করার কারণ ছিল না।” বলে সে যেমন এসেছিল, তেমনই চলে গেল। নরেন্দ্রও তেমনই খাতার দিকে ঝুঁকে রইল, কিন্তু সমস্ত লেখা তার চোখের সামনে ঝাপসা হয়ে একাকার হয়ে গেল।
ইন্দু পর্দার আড়াল থেকে বেরিয়ে ডাক্তারকে বলল, “আপনিই গগনবাবুর বাড়িতে আমার স্বামীর চিকিৎসা করেছিলেন?”
বুড়ো ডাক্তার চোখ তুলে ইন্দুর উদ্বিগ্ন মুখের দিকে তাকিয়ে, মাথা নেড়ে সম্মতি জানাল।
ইন্দু বলল, “কিন্তু আমার মনে হয় না তিনি পুরোপুরি সেরে উঠেছেন। এই আপনার ফি-এর টাকা—আজ বিকেলে যদি দয়া করে বন্ধুর মতো এসে তাকে দেখে যান, খুব উপকার হবে।”
ডাক্তার একটু অবাক হল।
ইন্দু বুঝিয়ে বলল, “ওঁর স্বভাব, চিকিৎসা করতে চান না। ওষুধের প্রেসক্রিপশনটা আমার কাছে লুকিয়ে দেবেন। তাকে একটু বুঝিয়ে বলবেন।”
ডাক্তার রাজি হয়ে বিদায় নিল।
রামটহল এসে খবর দিল, “মাজী, বল্লভ সেকরা এসেছে।”
“এসেছে? এদিকে ডাকো।”
“ও বল্লভ, একটা কাজের জন্য তোমাকে ডেকেছিলাম, তুমি আমাদের বিশ্বাসী লোক—এই চুড়িগুলো বিক্রি করে দিতে হবে। বড় পুরানো ধরনের চুড়ি, আর পরা যায় না। এই দামে নতুন একজোড়া কিনব মনে করছি।”
“বেশ তো মা, বিক্রি করে দেব।”
“নিক্তি এনেছ? ওজন করে দেখো তো কত আছে? দামটা কিন্তু কালই দিতে হবে। আমার দেরি হলে চলবে না।”
“তাই দেব।”
বল্লভ চুড়ি হাতে নিয়ে বলল, “এ তো একেবারে নতুন জিনিস মা। বেচলে তো কিছু লোকসান হবে।”
“তা হোক বল্লভ। এই গড়নটা আমার পছন্দ নয়। আর এ ব্যাপারে বাবুকে কিছু বোলো না।”
বাবুদের লুকিয়ে গয়না বেচা-কেনার কথা বল্লভের অজানা ছিল না। সে একটু হেসে চুড়ি নিয়ে চলে গেল।
“ডাক্তারবাবু, পাঁচ-সাত শিশি ওষুধ খেলেন, কিন্তু বুকের ব্যথাটা তো গেল না।”
“গেল না? কই, তিনি তো কিছু বলেন না?”
“জানেন তো, ওটাই তাঁর স্বভাব। কিন্তু আমি নিশ্চিত জানি, একটু ব্যথা রয়েই গেছে—তা ছাড়া, শরীর তো সারছে না!”
ডাক্তার ভেবে বললেন, “দেখুন, আমারও সন্দেহ হয়, শুধু ওষুধে কিছু হবে না। একবার জায়গা বদলানো দরকার।”
“তাহলে তাঁকে বলছেন না কেন?”
“একদিন বলেছিলাম। কিন্তু তিনি তো এটা জরুরি মনে করেন না।”
ইন্দু রেগে গিয়ে বলে ফেলল, “তিনি মনে না করলেই হবে? আপনি ডাক্তার, আপনি যা বলবেন, তাই তো হওয়া উচিত।”
বুড়ো ডাক্তার একটু হাসলেন।
ইন্দু নিজের উত্তেজনায় লজ্জা পেয়ে বলল, “দেখুন, আমি খুব উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছি। আপনি ওঁকে ভালো করে ভয় দেখিয়ে দিন।”
ডাক্তার মাথা নেড়ে আস্তে বললেন, “এ ধরনের রোগে ভয় তো থাকেই।”
ইন্দুর মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেল। বলল, “সত্যি ভয় আছে?”
তার মুখের দিকে তাকিয়ে ডাক্তার হঠাৎ জবাব দিতে পারলেন না।
ইন্দুর চোখে জল এসে গেল। বলল, “আমি আপনার মেয়ের মতো, ডাক্তারবাবু, আমার কাছে লুকোবেন না। কী হয়েছে, খুলে বলুন।”
ঠিক কী হয়েছে, তা ডাক্তার নিজেও জানতেন না। তিনি নানাভাবে যা বললেন, তাতে ইন্দুর ভয় কমল না। সে ঘরে ফিরে এসে কাঁদতে লাগল।
বিকেলে নরেন্দ্র কলমটা রেখে খোলা জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে ছিল। ইন্দু ঘরে ঢুকে কাছেই একটা চৌকি টেনে বসল। নরেন্দ্র একবার মুখ ফিরিয়ে আবার সেই দিকেই তাকিয়ে রইল।
কিছুদিন ধরে ইন্দু টাকা চায়নি। আজ সে কেন এসে বসেছে, তা ভেবে নরেন্দ্রর বুকের ভেতরটা ধড়ফড় করতে লাগল।
ইন্দু টাকা চাইল না। বলল, “ডাক্তারবাবু বলছেন, ব্যথাটা যখন ওষুধে সারছে না, তখন জায়গা বদলানো দরকার। একবার বেড়াতে যাও না কেন?”
নরেন্দ্র সত্যিই চমকে উঠল। অনেকদিন ধরে লুকিয়ে থাকা একটা গভীর স্নেহ যেন তাকে ডাক দিল। ইন্দুর এই কণ্ঠস্বর সে তো ভুলেই গিয়েছিল। তাই মুখ ফিরিয়ে হতভম্বের মতো তাকিয়ে কিছুক্ষণ মনে মনে কী যেন খুঁজতে লাগল।
ইন্দু বলল, “কী বলো? তাহলে কালই গুছিয়ে বেরিয়ে পড়া যাক। বেশি দূরে যাওয়ার দরকার নেই—এই বদ্যিনাথের কাছেই। আমরা দুজন, কমলা আর ঝি—রামটহল পুরোনো বিশ্বাসী লোক, বাড়িতেই থাকুক। সেখানে একটা ছোট বাড়ি নিলেই হবে। তাহলে আজ থেকে গোছানো শুরু করুক না কেন?”
খরচের কথা শুনলেই নরেন্দ্র ভয় পেত। এই বড় ধরনের ইঙ্গিতে তার মেজাজ একেবারে খারাপ হয়ে গেল। জিজ্ঞেস করল, “এই ডাক্তারকে এখানে আসতে বললে কে?”
ইন্দু জবাব দেওয়ার আগেই সে আবার বলল, “বিমলাকে বলো, আমার পিছনে ডাক্তার লাগিয়ে বিরক্ত করার দরকার নেই। আমি ভালো আছি।”
বিমলা লুকিয়ে ডাক্তার পাঠাচ্ছে—সব বিমলার কাজ। ইন্দু মনে মনে আঘাত পেল। কিন্তু চেপে গিয়ে বলল, “কিন্তু তুমি তো সত্যিই ভালো নেই। ব্যথাটা তো সারেনি।”
“সেরেছে।”
“তাও শরীর সারেনি—স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি। একবার ঘুরে এলে, অন্তত খারাপ তো কিছু হবে না।”
নরেন্দ্র ভেতরে-বাইরে এমন জায়গায় পৌঁছে গিয়েছিল, যেখানে তার সহ্য করার ক্ষমতা শেষ হয়ে গিয়েছিল। তবু ধাক্কা সামলে বলল, “আমার ঘুরে বেড়ানোর সামর্থ্য নেই।”
ইন্দু জেদ করে বলল, “সেটা হবে না। প্রাণটা তো বাঁচাতে হবে।”
এই জেদটা ইন্দুর কাছে এত নতুন ছিল যে, নরেন্দ্র পুরো ভুল বুঝল। তার মনে হলো, এটা তাকে কষ্ট দেওয়ার নতুন একটা কৌশল। এতদিনের ধৈর্যের বাঁধন মুহূর্তে ছিঁড়ে গেল। চেঁচিয়ে উঠল, “কে বলল প্রাণ বাঁচাতে হবে? না, হবে না। তোমার পায়ে পড়ি ইন্দু, আমাকে ছাড়ো, আমি নিশ্বাস ফেলে বাঁচি।”
স্বামীর কাছে এমন কঠোর কথা শোনার কথা ইন্দু কল্পনাও করতে পারেনি। সে যেন জড়িয়ে গিয়ে হতভম্ব হয়ে গেল। কিন্তু নরেন্দ্র তা বুঝল না। বলতে লাগল, “তুমি ঠিক জানো, আমি কী সঙ্কটের মধ্যে দিন কাটাচ্ছি। সব জেনেশুনেও শুধু আমাকে কষ্ট দেওয়ার জন্যই সবসময় খোঁচাচ্ছ। কেন, আমি তোমার কী করেছি? তুমি কী চাও?”
ইন্দু ভয়ে ফ্যাকাশে হয়ে তাকিয়ে রইল। একটা কথাও তার মুখ দিয়ে বেরোল না।
চিৎকার আর উত্তেজনা নরেন্দ্রর জন্য যে কতটা অস্বাভাবিক, সেটা এবার সে নিজেই টের পেল। গলার স্বর নামিয়ে বলল, “ঠিক আছে, মানলাম জায়গা বদলানো দরকার। কিন্তু কী করে যাব? টাকা কোথায় পাব? সংসার-খরচ জোগাতেই তো আমার প্রাণ বেরিয়ে যাচ্ছে।”
ইন্দু কখনো ধৈর্য শেখেনি। মাথা নোয়াতে গেলে তার মাথা কাটা যেত। কিন্তু আজ সে ভয় পেয়েছিল। নরম গলায় বলল, “টাকা নেই ঠিকই, কিন্তু অনেক টাকার গয়না তো আমাদের আছে—”
“আছে, কিন্তু আমাদের নয়, তোমার আছে। তোমার বাবা তোমাকে দিয়েছেন। আমার তাতে এক ফোঁটা অধিকার নেই—এটা আমার চেয়ে তুমি অনেক বেশি জানো।”
“ঠিক আছে, তা না নাও—আমি নগদ টাকা দিচ্ছি।”
“কোথায় পেলে? সংসার-খরচ থেকে বাঁচিয়েছ?”
এটা ছিল চুড়ি বিক্রির টাকা। ইন্দু সহজে মিথ্যে বলতে পারত না। এতে তার খুব অপমানবোধ হতো। কিন্তু আজ সে মিথ্যে বলল। নরেন্দ্রর মুখের ভাব ভয়ঙ্কর কঠিন হয়ে গেল। আস্তে বলল, “তাহলে রাখো, গয়না গড়াও। আমার অনেক রক্ত-জল করে যা জমেছে, তা এভাবে নষ্ট হতে পারে না। ইন্দু, কখনো তোমাকে কঠোর কথা বলিনি, সবসময় শুনেই এসেছি। কিন্তু তুমি কি সেদিন দম্ভ করে বলোনি, কখনো মিথ্যে বলো না? ছিঃ—”
কমলা পর্দা সরিয়ে ডাকল, “মা, পিসিমা এসেছেন।”
“কী হচ্ছে গো বউ?” বলে বিমলা ভেতরে এসে দাঁড়াল। ইন্দু মেয়েকে টেনে এনে তার গলার হারটা দুহাতে জোরে ছিঁড়ে ফেলল। স্বামীর মুখের সামনে ছুঁড়ে দিয়ে বলল, “মিথ্যে বলতে আমি জানতাম না—তোমার কাছেই শিখেছি। তবু এখনো পেতলকে সোনা বলে চালাতে শিখিনি। যে স্ত্রীকে ঠকায়, নিজের মেয়েকে ঠকায়, তার আর কী বাকি থাকে! সে অন্যকে মিথ্যাবাদী বলে কী করে?”
নরেন্দ্র ছেঁড়া হারটা তুলে জিজ্ঞেস করল, “কী করে জানলে পেতল? যাচাই করেছ?”
“তোমার বোনকে যাচাই করে দেখতে বলো।” বলে সে চোখ রাঙিয়ে বিমলার দিকে তাকাল।
বিমলা দুপা পিছিয়ে গিয়ে বলল, “ও কাজ আমার নয় বউ। আমি এত ইতর নই যে, দাদার দেওয়া গয়না সেকরা ডেকে যাচাই করব।”
নরেন্দ্র বলল, “ইন্দু, তোমাকেও দু-একটা গয়না দিয়েছি। সেগুলো যাচাই করেছ?”
“করিনি, কিন্তু এবার করতে হবে।”
“করো, সেগুলো পেতল নয়।”
বোনের মুখের দিকে তাকিয়ে হারটা দেখিয়ে বলল, “এটা সোনা নয় বোন, পেতলই। যে দুঃখে বাবা হয়ে আমার একমাত্র মেয়ের জন্মদিনে তাকে ঠকিয়েছি, সেটা তুই বুঝবি। তবু, মেয়েকে ঠকাতে পেরেছি, কিন্তু নিজের স্ত্রীকে ঠকাতে সাহস করিনি।”
“কথা শোনো বউ, একবার পায়ে হাত দিয়ে তাঁর ক্ষমা চাও।”
“কেন, কী দুঃখে? আমার মাথা কাটলেও আমি তা পারব না ঠাকুরঝি।”
“কেন পারবে না? স্বামীর পায়ে হাত দিতে লজ্জা কী? ঠিক আছে, তোমার দোষ নেই ধরো, কিন্তু তাঁকে খুশি করাটা তো সবচেয়ে বড় কাজ।”
“না—আমার তা নয়। ভগবানের কাছে খাঁটি থাকাটাই আমার সবচেয়ে বড় কাজ। যতক্ষণ আমি কোনো অপরাধ করিনি, ততক্ষণ আর কিছুই ভয় করি না।”
বিমলা রেগে বলল, “বউ, এসব বড় বড় কথা আমরাও জানি, কিন্তু তখন কিছুই কাজে আসবে না, বলে দিচ্ছি। চোখ বুজে বিপদ এড়ানো যায় না। দাদা সত্যিই তোমার ওপর রেগে উঠছেন।”
ইন্দু উদাস গলায় বলল, “তাঁর ইচ্ছে।”
বিমলা মনে মনে খুব রেগে গিয়ে বলল, “সেই ইচ্ছের টের পাবে, যেদিন সর্বনাশ হবে। দাদা যেমন নিরীহ, তেমনি কঠিন। তাঁর এই দিকটা দেখেছ, ওই দিকটা দেখা এখনো বাকি—বলে দিচ্ছি।”
“আচ্ছা, দেখতে পেলে তোমাকে খবর দিয়ে আসব।”
বিমলা আর কিছু বলল না। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে, একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আস্তে বলল, “তা সত্যি। বিশ্বাসই হয় না, স্বামীর ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত হব। কিন্তু সে মানুষ যে দাদা নয়—অসুখের সময় তাঁকে ভালো করে চিনেছি। তাঁর মনের দরজা একবার বন্ধ হয়ে গেলে আর খোলা যাবে না।”
ইন্দুও একটু গম্ভীর হয়ে বলল, “খোলা না পাই, বাইরেই থাকব। খুলে দেওয়ার জন্য তাঁর পা ধরে সাধব না—তোমাকেও সুপারিশ করতে ডাকব না। ও কি রাগ করে চলে গেলে না কি?”
বিমলা উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “রাগ নয়—দুঃখ করে যাচ্ছি। বউ, নিজের বোনের চেয়েও তোমাকে বেশি ভালোবেসেছি বলেই প্রাণটা কেঁদে উঠছে। দাদা যে ওরকম করে বলতে পারেন, আমি চোখে না দেখলে বিশ্বাসই করতাম না!”
ইন্দু হঠাৎ একটD হেসে বলল, “এত বড় বড় কথা আর কখনো তাঁর মুখে শুনবে না।”
“বড় বড় কথা তুমিও তো কম বলোনি বউ। তবে তিনি যে আর কখনো এমন করবেন না, তা আমারও মনে হয়। এক কথা তিনি একশোবার বলার লোক নন।”
ইন্দু আবার হেসে বলল, “সেটাও ঠিক। তবে আরেকটা গুরুতর কারণ ঘটেছে, যার জন্য তিনি আর কোনোদিন স্বপ্নেও চোখ রাঙাতে সাহস করবেন না। আমার বাবার চিঠি পেয়েছি। তিনি আমার নামে দশ হাজার টাকা উইল করে দিয়েছেন। কী বলো ঠাকুরঝি, পায়ে ধরার আর দরকার আছে বলে মনে হয়?”
বিমলার মুখ যেন আরও অন্ধকার হয়ে গেল। বলল, “বউ, এর আগে কখনো তিনি তোমাকে চোখ রাঙাননি। তুমি যা করে তাঁকে ফেলে মেদিনীপুরে চলে গিয়েছিলে, সেটা আমি তো জানি। কিন্তু তবুও কোনোদিন তোমার একটুও নিন্দে করেননি। হাসিমুখে তোমার সমস্ত দোষ আমার কাছেও লুকিয়ে রেখেছিলেন—সেটা কি তোমার টাকার লোভে? বউ, শ্রদ্ধা ছাড়া ভালোবাসা থাকে না। যে জিনিস তুমি তাচ্ছিল্য করে হারাচ্ছ—সেটার মর্যাদা বুঝবে যেদিন সত্যিই হারাবে। কিন্তু একটা কথা মনে রেখো বউ, আমার দাদা এত নীচ নয়। আর না, সন্ধ্যা হয়ে গেছে—চললাম। কাল-পরশু সময় হলে আমাদের বাড়ি এসো।”
“আচ্ছা!” বলে ইন্দু পিছন পিছন সদর দরজা পর্যন্ত এল। তার মৃদু পায়ের শব্দ বিমলা শুনেও না শোনার ভান করল, সেটা ইন্দু বুঝল। গাড়িতে উঠে বসার সময় সবসময় এই দুই সখী পরস্পরকে নিমন্ত্রণ করে, হেসে দরজা বন্ধ করত। আজ বিমলা গাড়িতে ঢুকেই দরজা টেনে দিল।
ঘরে ফিরে এসে ইন্দু কমলাকে বুকের কাছে টেনে শুয়ে পড়ল।
বিমলা চলে গেল, কিন্তু তার তীব্র কথাগুলো রয়ে গেল। এই কথার উত্তাপ যে কত, সেটা এবার ইন্দু টের পেল। এই তাপে তার অহঙ্কারের উঁচু তুষারস্তূপ যত গলতে লাগল, ততই নতুন নতুন জিনিস তার চোখে পড়তে লাগল। এত কাদা, আবর্জনা, এত কঠিন পাথরের টুকরো যে এই ঘন জলের তলায় লুকিয়ে ছিল, তা সে স্বপ্নেও ভাবেনি!
হঠাৎ তার মনের ভেতর থেকে কে যেন জিজ্ঞেস করল, “এ কেমন হয় ইন্দু, যদি তিনি মনে মনে তোমাকে ত্যাগ করেন? তুমি কাছে গিয়ে বসলেও যদি তিনি ঘৃণায় সরে বসেন?”
তার সারা শরীর কাঁটা দিয়ে উঠল।
কমলা বলল, “কী মা?”
ইন্দু তাকে জোরে বুকে জড়িয়ে ধরে, তার মুখে চুমু খেয়ে বলল, “তোর পিসিমা এত ভয় দেখাতেও পারে!”
“কীসের ভয়, মা?”
ইন্দু আরেকটা চুমু খেয়ে বলল, “কিছু না মা, সব মিথ্যে—সব মিথ্যে। যা মা, দেখে আয় তোর বাবা কী করছেন।”
মেয়ে ছুটে চলে গেল। এই দুদিন স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে একটা কথাও হয়নি। কমলা ফিরে এসে বলল, “বাবা চুপ করে শুয়ে আছেন।”
“চুপ করে? আচ্ছা, তুই শুয়ে থাক মা, আমি দেখে আসি।” বলে ইন্দু নিজে চলে গেল। পর্দার ফাঁক দিয়ে দেখল, তাই তো। তিনি ওপরের দিকে তাকিয়ে সোফায় শুয়ে আছেন। পাঁচ-ছয় মিনিট দাঁড়িয়ে দেখে ইন্দু ফিরে এল। আজ ঘরে ঢুকতে সাহস হল না দেখে সে নিজেই খুব অবাক হয়ে গেল।
“কমলা!”
“কী মা?”
“তোর বাবার বোধহয় খুব মাথা ধরেছে। যা মা, গিয়ে একটু মাথায় হাত বুলিয়ে দে।”
মেয়েকে পাঠিয়ে ইন্দু নিজে আড়ালে দাঁড়িয়ে উৎকণ্ঠা নিয়ে দুজনের কথা শুনতে লাগল।
মেয়ে জিজ্ঞেস করল, “কেন এত মাথা ধরেছে বাবা?”
বাবা বললেন, “কই, ধরেনি তো মা!”
মেয়ে আবার জিজ্ঞেস করল, “মা বললেন তো খুব ধরেছে?”
বাবা কিছুক্ষণ চুপ করে মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন। একটু পরে বললেন, “তোমার মা জানে না।”
পর্দা ঠেলে ইন্দু স্বাভাবিকভাবে ঘরে ঢুকল। টেবিলের আলোটা কমিয়ে দিয়ে বলল, “এত রোগা শরীরে এত পরিশ্রম কি সহ্য হয়? যা মা কমলা, ওই ঘর থেকে ওডিকোলনের শিশিটা নিয়ে আয়—আর রামটহলকে বলে দে একটু বরফ কিনে আনতে।”
মেয়েকে তুলে দিয়ে শিয়রে গিয়ে বসল। চুলের মধ্যে হাত দিয়ে বলল, “যেন আগুন উঠছে।”
নরেন্দ্র চোখ বুজিয়ে রইল—কিছুই বলল না। ইন্দু চুপচাপ মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে একটু ঝুঁকে স্নেহের গলায় জিজ্ঞেস করল, “আজ বুকের ব্যথাটা কেমন আছে?”
“তেমনই।”
“তবে এই যে রাগ করে দুদিন ওষুধ খেলে না, বেড়ে গেলে কী হবে বলো তো?”
নরেন্দ্র চোখ খুলে ক্লান্ত গলায় বলল, “আমার শরীরটা ভালো নেই—একটু চুপ করে থাকতে চাই ইন্দু।”
এই কথার এই জবাব!
ইন্দু তড়িৎ গতিতে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “তাই থাকো। আমার ঘাট হয়েছে তোমার ঘরে ঢুকেছিলাম।”
দরজার কাছে এসে হঠাৎ থেমে বলল, “নিজের প্রাণটা নষ্ট করে আমাকে শাস্তি দিতে পারবে না। এই চিঠিটা পড়ে দেখো, বাবা আমাকে দশ হাজার টাকা উইল করে দিয়েছেন।” বলে বাঁ হাতের চিঠিটা সোফার দিকে ছুঁড়ে ফেলে বাইরে এসে দাঁড়াল। তারপর মুখে আঁচল গুঁজে কান্না চেপে নিজের ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে শুয়ে পড়ল।
কথা সহ্য করতে, হার মানতে সে শেখেনি—অনেক নারীই শেখে না—তাই আজ তার সমস্ত ভালো সংকল্প ব্যর্থ হয়ে গেল। সে কী করতে গিয়ে কী করে ফিরে এল।
চলিত ভাষায় রূপান্তর:
“ও কী ঠাকুরঝি, তোমরা কাঁদছিলে নাকি? চোখ দুটো তোমাদের যে জবাফুল হয়ে গেছে?”
অম্বিকাবাবুর বউ শুনছিলেন আর বিমলা উপুড় হয়ে বই পড়ছিল। ধড়মড় করে উঠে বসে চোখ মুছে হাসল, “উঃ! দুর্গামণির দুঃখে বুক ফেটে যায় বউ!”
ইনডু জিজ্ঞেস করল, “কে দুর্গামণি?”
“ন্যাকামি কোরো না বউ। জানো না কে দুর্গামণি? চারদিকে যে এত নামডাক হয়েছে, সেটা ঠিকই।”
ইন্দু আর কিছুই বুঝল না, শুধু বুঝল একটা বইয়ের কথা হচ্ছে। হাত বাড়িয়ে বলল, “দেখি বইটা।”
হাতে নিয়ে উপরেই দেখল লেখকের নাম—তার স্বামীর নাম লেখা। পাতা ওলটাতেই চোখে পড়ল বইটা বিমলাকে উৎসর্গ করা হয়েছে। ইন্দু বইটা আগাগোড়া নাড়াচাড়া করে রেখে দিল। লেখা হয়েছে, ছাপা হয়েছে, দেওয়া হয়েছে—অথচ সে এর কিছুই জানে না। তার মুখের চেহারা দেখে বিমলা আর একটা প্রশ্ন করতেও সাহস পেল না। তখন ইন্দু নিজেই বলল, “আমার নাটক-উপন্যাস পড়তে ইচ্ছেও হয় না। ভালো লাগে না। যাই হোক, ভালো হয়েছে শুনে খুশি হলাম।”
অম্বিকাবাবুর চাকর এসে তাঁর বউয়ের দিকে তাকিয়ে বলল, “বাবু জিজ্ঞেস করছেন, আজ তাঁর যে যাদুঘর দেখতে যাওয়ার কথা ছিল—যাবেন?”
এই বউটি সবার চেয়ে ছোট; সে লজ্জা পেয়ে মাথা নিচু করে মৃদু গলায় বলল, “না, তাঁর শরীর এখনো তেমন সারেনি—আজ যেতে হবে না।”
চাকর চলে গেল। ইন্দু হাঁ করে তাকিয়ে রইল। তার মনে হলো এমন আশ্চর্য কথা সে জীবনে শোনেনি।
ভোলা এসে বিমলাকে জিজ্ঞেস করল, “বাবু অফিস থেকে লোক পাঠিয়েছেন—একটা বড় আলমারি-দেরাজ নিলাম হচ্ছে! বড় ঘরের জন্য কিনবেন?”
বিমলা বলল, “না, কিনতে বারণ করে দে। একটা ছোট বুককেস হলেই ওই ঘরের জন্য হবে।”
ভোলা চলে গেল। ইন্দু মহা বিস্ময়ে অবাক হয়ে বসে রইল। এই স্বামীদের প্রশ্নগুলোতেও সে বেশি প্রভুত্ব দেখতে পেল না, আর এঁদের বউদের আদেশগুলোও তার কাছে ঠিক দাসীদের মতো শোনাল না। অথচ, তার নিজের মনের মধ্যে কেমন যেন একটা ব্যথা বাজতে লাগল। বারবার মনে হতে লাগল, কীভাবে যেন এঁদের কাছে সে একেবারে ছোট হয়ে গেছে।
যাওয়ার সময় বিমলা চুপিচুপি জিজ্ঞেস করল, “বউ, সত্যি তুমি দাদার এই বইয়ের কথা জানতে না?”
ইন্দু তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বলল, “না। আমার ও নিয়ে মাথাব্যথা নেই। সারাদিন বসে তো লিখছে—কে অত খোঁজ করে বলো? ভালো কথা ঠাকুরঝি, কাল বাপের বাড়ি যাচ্ছি।”
বিমলা উদ্বিগ্ন হয়ে বলল, “না বউ, যেও না।”
“কেন?”
“কেন, সেটা কি বোঝাতে হবে বউ? দাদা তোমাকে তাঁর দুঃখ-সুখের কোনো ভারই দেন না—তাও কি চোখে দেখতে পাও না? স্বামীর ভালোবাসা হারাচ্ছ—তাও কি টের পাও না?”
ইন্দু হঠাৎ রেগে বলল, “অনেকবার বলেছি তোমাকে, আমি চাই না—চাই না—চাই না। আমি দাদার ওখানে নিশ্চিন্তে থাকব; উনি যেন আর আমাকে আনতে না যান—যেন আমাকে জ্বালাতন না করেন।”
এবার বিমলাও রেগে উঠল। বলল, “এসব বড়াই পুরুষের কাছে করো বউ, আমি তো মেয়েমানুষ, আমার কাছে করো না। তোমার বাবারা বড়লোক, তোমার ব্যবস্থা তারা করে দিয়েছেন—এই তো তোমার অহঙ্কার? আচ্ছা, এখন যাচ্ছ যাও; কিন্তু একদিন হুঁশ হবে, যা হারালে তার তুলনায় গোটা পৃথিবীটাও ছোট। বউ, তুমি যা পেয়েছিলে, কম মেয়েমানুষই তা পায়—সেটা আমি জানি। কিন্তু যে অপচয় তুমি করলে, তাতে অক্ষয়ও শেষ হয়ে যায়। বোধহয় গেলও তাই।”
সেই বইখানা বিমলার হাতেই ছিল। তার দিকে চোখ পড়ায় ইন্দুর বুকের ভেতরটা আরেকবার হু হু করে উঠল। বলল, “অহঙ্কার করার থাকলেই লোকে করে। কিন্তু আমার সর্বনাশ হয় হবে, যায় যাবে, সেজন্য ঠাকুরঝি তুমি কেন মাথা গরম করছ, আর আমি কেন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এসব শুনছি? আমার থাকতে ইচ্ছে নেই—থাকব না। এতে যা হয় তা হবে—কারো পরামর্শ নিতেও চাই না, ঝগড়া করতেও চাই না।”
বিমলা চুপ করে রইল। তার ব্যথা তার মনই জানল, কিন্তু এই অপমানের পর সে আর তর্ক করল না।
ইন্দু এগোতে যাচ্ছিল, বিমলা বলল, “দাঁড়াও বউ, তুমি সম্পর্কে বড়, একটা প্রণাম করি।”
সেদিন সন্ধ্যা থেকেই আকাশ মেঘে ঢেকে গিয়ে ঝমঝম করে বৃষ্টি পড়তে লাগল। ইন্দু মেয়েকে নিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ল। আজ তার ছোট বোনের জামাই এসেছিলেন। পাশের ঘর থেকে তাঁকে খাওয়ানো-দাওয়ানো আর গল্প-গুজবের অস্ফুট শব্দ যত ভেসে আসছিল, ততই কীসের একটা অব্যক্ত লজ্জায় তার বুক ভরে উঠছিল।
তিন মাস হয়ে গেল, সে মেদিনীপুরে এসেছে। ছোট বোনও এসেছে। তার স্বামী এই দু’মাসে শান্তিপুর থেকে অন্তত পাঁচ-ছ’বার এসে গেছে, কিন্তু নরেন্দ্র একবারও আসেনি, একটা চিঠিও লিখে খোঁজ করেনি।
কিছুদিন ধরে এই ব্যাপারটা সবার নজরে পড়েছে, আর প্রায়ই আলোচনা হচ্ছে। ছোট বোনের জামাইয়ের ঘরে সবার সামনে যদি এই কথাটা উঠে পড়ে, এই ভয়েই ইন্দু অসময়ে পালিয়ে ঘরে ঢুকে পড়েছিল।
স্বামী আসে না। তার অবহেলায় বেদনা কত, সেটা ইন্দুর নিজের কথা—থাক। কিন্তু এতে যে এত ভয়ঙ্কর লজ্জা, এটা তো সে কোনোদিন কল্পনাও করেনি। ভ্রূণহত্যা, নরহত্যার মতো এ যে শুধু লুকিয়ে ঘুরতে হয়! মরে গেলেও যে কারো কাছে স্বীকার করা যায় না, স্বামী ভালোবাসে না!
এতদিন স্বামীর ঘরে, স্বামীর পাশে বসে তাকে টানাটানি করে নিজের সম্মান আর মর্যাদা বাড়িয়ে তুলতেই সে সবসময় ব্যস্ত ছিল। কিন্তু এখন পরের বাড়িতে, চোখের আড়ালে সবকিছু যে ভেঙে ধসে পড়ছে—কী করে সে তা খাড়া রাখবে?
আজ বোনের জামাই আসার পর থেকে যে-ই তার দিকে তাকিয়েছে, তার মনে হয়েছে, তাকে করুণা করছে। কমলাকে কেউ তার বাবার কথা জিজ্ঞেস করলে, ইন্দু মরমে মরে যায়; বাড়ি ফেরার প্রশ্ন করলে লজ্জায় মাটির সঙ্গে মিশে যেতে চায়।
অথচ, আসার আগে স্বামীকে সে অনেকগুলো মর্মান্তিক কথা বলে এসেছিল—পোষানোর ক্ষমতা থাকলে যেন তাকে নিয়ে আসে।
হঠাৎ ইন্দুর মোহের ঘোর কেটে গেল। “কমলা, কাঁদছিস কেন মা?”
কমলা কান্না-চাপা গলায় বলল, “বাবার জন্য মন কেমন করছে!”
ইন্দুর বুকের ওপর যেন হাতুড়ির ঘা পড়ল। সে মেয়েকে প্রাণপণে বুকে জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল।
বাইরের প্রবল বৃষ্টি তার লজ্জা রক্ষা করল—মেয়ে ছাড়া এই কান্না আর কেউ শুনতে পেল না।
তার মা কী শিখিয়ে দিয়েছিলেন কে জানে, পরদিন সকাল থেকেই কমলা বাবার কাছে যাওয়ার জন্য জেদ ধরে বসল। প্রথমে ইন্দু অনেক ধমক-গর্জন করল, শেষে দাদার কাছে এসে বলল, “কমলা কিছুতেই থামছে না—কলকাতায় যেতে চায়।”
দাদা বললেন, “থামানোর দরকার কী বোন, কাল সকালেই তাকে নিয়ে যা। নরেন কেমন আছে? সে আমাকে তো চিঠি লেখে না, তোকে লেখে?”
ইন্দু মাথা নিচু করে বলল, “হুঁ।”
“ভালো আছে?”
ইন্দু তেমনভাবেই জানাল, “আছেন।”
বিমলা অবাক হয়ে বলল, “কখন এলি বউ?”
“এই এলাম।”
ভৃত্য গাড়ি থেকে ইন্দুর তোরঙ্গ নামিয়ে আনল। বিমলা খুব বিরক্তি চেপে বলল, “বাড়ি যাসনি?”
“না। শুধু কমলাকে সামনে থেকে নামিয়ে দিয়ে এসেছি। শুধু তার জন্যই এসেছি—নইলে আসতাম না।”
বিমলা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “না এলেই ভালো করতিস বউ। ওখানে তোর আর গিয়েও কাজ নেই।”
ইন্দুর বুকের ভেতরটা ধড়াস করে উঠল। “কেন ঠাকুরঝি?”
বিমলা সহজ গম্ভীর গলায় বলল, “পরে শুনিস। কাপড় ছাড়, মুখ-হাত ধো—যা হওয়ার তা তো হয়েই গেছে—এখন আজ শুনলেও যা, দু’দিন পরে শুনলেও তাই।”
ইন্দু বসে পড়ল। তার মুখ নীল হয়ে গেল। বলল, “সেটা হবে না ঠাকুরঝি। না শুনে আমি এক ফোঁটা জলও মুখে দেব না। তাঁকে দেখে এসেছি, তিনি বেঁচে আছেন—তবু সেখানে আমার গিয়ে কাজ নেই কেন?”
বিমলা একটু থেমে, দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “সত্যিই ওই বাড়িতে তোর জায়গা নেই। এখন তোর পক্ষে এখানেও যা, বাপের বাড়িতেও তাই। ওই বাড়িতে তুই থাকতে পারবি না।”
ইন্দু কান্না চেপে বলে উঠল, “আমি আর সইতে পারছি না ঠাকুরঝি, কী হয়েছে খুলে বল। বিয়ে করেছেন?”
“বিশ্বাস হয়?”
“না। কিছুতেই না। আমার অপরাধ যত বড়ই হোক, তিনি অন্যায় কিছুতেই করতে পারেন না। তবু কেন আমার তাঁর পাশে জায়গা নেই, বলবি না?” বলতে বলতে তার দু’চোখ দিয়ে ঝরঝর করে জল পড়তে লাগল।
বিমলার চোখও ভিজে উঠল, কিন্তু অশ্রু ঝরল না। বলল, “বউ, আমি ভেবে পাচ্ছি না, কী করে তোকে বোঝাব, সেখানে আর তোর জায়গা নেই। শম্ভুবাবু দাদাকে জেলে দিয়েছিল।”
ইন্দুর সারা শরীর কাঁটা দিয়ে উঠল। “তারপর?”
বিমলা বলল, “আমরা তখন কাশীতে। শম্ভুবাবু টাকা জোগাড় করার জন্য দু’দিন সময় দেয়। কিন্তু চার হাজার টাকা জোগাড় হয়ে ওঠে না। ধরে নিয়ে যাওয়ার পর দাদা ভোলাকে আমার কাছে কাশীতে পাঠায়, কিন্তু আমরা তখন এলাহাবাদে চলে যাই। সে ফিরে আসে, আবার যায়; এইরকম করে দশ দিন দেরি হয়ে যায়। তারপর আমি এসে পড়ি। আমার কাছেও নগদ টাকা ছিল না, আমার গয়নাগুলো বাঁধা দিয়ে এগারো দিনের দিন দাদাকে বার করে নিয়ে আসি। তোরও তো চার-পাঁচ হাজার টাকার গয়না আছে বউ, মেদিনীপুরও তো দূর নয়। তোকে খবর দিতে পারলে, এসব কিছুই হতো না। দাদা বরং দশ দিন জেলে কাটালেন, কিন্তু তোর কাছে হাত পাতলেন না। আর তোর তাঁর কাছে গিয়ে কী হবে? অনেক সুখই তো তাঁকে তুই দিয়েছিস, এবার মুক্তি দে—তিনিও বাঁচুন, তুইও বাঁচ।”
ইন্দু এক মুহূর্ত মাথা নিচু করে বসে রইল। তারপর একে একে গায়ের সব গয়না খুলে ফেলে, বিমলার হাতে দিয়ে বলল, “এগুলো নিয়ে তোর নিজের জিনিস উদ্ধার করে আন ঠাকুরঝি—আমি তাঁর কাছেই চললাম। তুই বলছিস জায়গা হবে না—কিন্তু আমি বলছি, এইবারই আমার তাঁর পাশে আসল জায়গা হবে। যা এতদিন আমাকে আলাদা করে রেখেছিল, এখন তাই তোর কাছে ফেলে দিয়ে, আমি নিজের জায়গা নিতে চললাম। কাল একবার যাস ভাই—গিয়ে তোর দাদা আর বউকে দেখে আসিস—চললাম।” বলে ইন্দু গাড়ির জন্য অপেক্ষা না করেই বেরিয়ে গেল।
“ওরে ভোলা, ওর সঙ্গে যা,” বলে বিমলা চোখ মুছে পিছন পিছন দরজায় এসে দাঁড়াল।