Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • English Books
      • Jules Verne
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    দশটি উপন্যাস – আশাপূর্ণা দেবী

    লেখক এক পাতা গল্প1079 Mins Read0
    ⤶ ⤷

    ৩. ভাগ্য না মেনে উপায় কী

    কিন্তু ভাগ্য না মেনে উপায় কী?

    ভাগ্য ছাড়া পথ কোথায়?

    চিরন্তনের এই ভবানীপুরের বন্ধু চিত্তপ্রিয়র অবস্থা দেখলে সে কথা অস্বীকার করা যায় না।

    রমেশ মিত্র রোডের উপর এই যে বিরাট তিনতলা অট্টালিকাখানা তাদের আজও গর্বোদ্ধত ভঙ্গিতে রাস্তার উপর দাঁড়িয়ে আছে, সে অট্টালিকা এখন গতযৌবনা হলেও এবং একেবারে প্রসাধনহীনা হলেও দামটা তার বেশ কয়েক লাখের কম নয়। যদিও চিত্তপ্রিয়র ঠাকুরদা বিশ্বপ্রিয়কে এক লাখের অর্ধেকও খরচ করতে হয়নি। সে যাক–তখনকার লাখ আর এখনকার লাখে আকাশ-পাতাল তফাত। বিশ্বপ্রিয় দুবিঘে জমি কিনেছিলেন দুহাজার টাকায়। আর এই বিরাট বাড়িখানাকে বানিয়েছিলেন, কিন্তু সেই অবিশ্বাস্য অঙ্কটা শুনেই বা লাভ কী?

    এখন তো এ বাড়ির দাম বেশ কয়েক লাখ।

    কিন্তু সেই লাখের একও তো চিত্তপ্রিয়র ভোগে লাগছে না। চিত্তপ্রিয় তো এ বাড়ির একখানা ইটও বেচতে পারছে না।

    বাড়ি এখন কোর্ট অব ওয়ার্ডসের গাড্ডায় পড়ে আছে। কারণ বাড়িটা নিয়ে এখন ত্রিভুজের লড়াই চলছে। চিত্তপ্রিয়, তার দাদা সত্যপ্রিয়, আর মা হেমলতা দেবী, এই তিন জনে টানাটানি চালাচ্ছেন বাড়ির অংশের ভালমন্দ অংশ নিয়ে।

    রাস্তার ধারের দক্ষিণ দিকের অংশটিতে তিনজনেরই দাবি। তিনজনেরই অবশ্য দাবির স্বপক্ষে যুক্তি আছে, অতএব যার যত নগদ টাকা সব গেছে উকিলের পকেটে। ভাগ হয়নি বলে পাঁচিল তোলবার উপায় না থাকায় বাড়ির যেখানে সেখানে প্ল্যাস্টিকের পরদা।

    একতলা এবং তিনতলা অবশ্য ভাগে ভাগে পায়রার খোপ, কারণ চিত্তপ্রিয়র বাবা নিত্যপ্রিয়ই শেষ জীবনে ভাগে ভাগে বারো ঘর ভাড়াটে বসিয়ে গেছেন। ফ্ল্যাট সিস্টেমে তৈরি বাড়ি নয়, চকমিলাননা প্যাটার্ন, কাজে কাজেই তাকে করোগেট টিন দিয়ে ভাগ করায় নীচতলাটায় একটা নারকীয় অবস্থা। তিনতলায় টিন নয়, বাখারি ও দর্মা। তবে সেখানে উঠোন না থাকায় ঈষৎ কম নারকীয়।

    তবু চিরন্তন এ বাড়িতে আসে।

    কারণ চিত্তপ্রিয়র সঙ্গে তার ভাব আছে।

    চিরন্তনের চরিত্রে এই এক অদ্ভুত উলটোপালটা সমাবেশ। চিরন্তন নিজের মনের সমকক্ষ কাউকে খুঁজে পায় না, তবু চিরন্তনের অনেক বন্ধু।

    হয়তো এই অনেক বন্ধু থাকাটাও একটা বিলাস। নিজেকে বিকশিত করবার একটা ক্ষেত্র তো চাই, আড্ডা দেবার সূত্রে সেই বিকাশ। অতএব দমদম থেকে গড়িয়া আড্ডা দিয়ে বেড়ায় চিরন্তন। অথবা আর কোনও উদ্দেশ্য আছে তার।

    চিরন্তন যখন এসে ঢুকল, তখন পড়ন্ত বিকেল, রাস্তায়, পার্কে, দোকানপসারের গায়ে গায়ে কনে দেখা আলোর সমারোহ, কিন্তু চিত্তপ্রিয়দের বাড়ির মধ্যে নেমে এসেছে সন্ধ্যার জমাটি অন্ধকার।

    বাড়ি ঢুকতেই বিটকেল একটা শ্যাওলা-শ্যাওলা গন্ধ নাকে এল, কিন্তু সেই সৌরভসারের উৎসটা চোখে পড়ল না, কারণ সিঁড়ির মুখেই একবারে সিলিঙ পর্যন্ত করোগেট টিনের দেয়াল। একসময় তাতে চুনকাম করা হয়েছিল, ঢেউ খেলানোর ঢেউয়ের মাথা থেকে সে চুন ঝরে পড়ে পড়ে সাবেক চেহারা বেরিয়ে গেছে, খাঁজে খাঁজে চুনের জমাটি।..এই সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় উঠে গেল চিরন্তন।

    সিঁড়ি দিয়ে উঠেই বাঁদিকে, অর্থাৎ পশ্চিম ধারে চিত্তপ্রিয়র মহল, ডানদিকে তার দাদা সত্যপ্রিয়র। আর হল পার হয়ে সামনাসামনি অর্থাৎ রাস্তার ধার বা দক্ষিণের অংশটি ওদের মা হেমলতা দেবীর।

    বাড়ির ওই শ্রেষ্ঠ অংশটি ছিল কর্তা নিত্যপ্রিয়র দখলে, অতএব গৃহিণীরও। কিন্তু এই অবিবেচক মহিলাটি কর্তা চন্দ্রবিন্দু হয়ে যাবার পরও শ্রেষ্ঠ অংশটি পুত্রদের দিয়ে নিজে কোনও অধম অংশে সরে না এসে সগৌরবে সেই তাঁর পুরনো ঘরেই বিরাজ করছেন অনূঢ়া কন্যাটিকে সম্বল করে।

    কন্যাটির আর কনে হবার বয়েস আছে কিনা সন্দেহ, কিন্তু সেদিকে তাকাচ্ছে কে? দাদাদের তো সে এখন শত্রুস্থানীয়, কারণ মামলার এই তেরো বছর কালের মধ্যে নমিতা প্রায় একটি পুঁদে উকিল হয়ে উঠেছে। আইনের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম প্যাঁচ তার নখদর্পণে, ঘুঘু উকিলদেরও সে মাঝে মাঝে বুদ্ধির জোগান দিতে যায়।

    কাজে কাজেই হেমলতা দেবীও এহেন কন্যাকে হস্তান্তরিত করে অসহায় হতে রাজি নন। তিনি উচ্চকণ্ঠে ঘোষণা করেছেন, আগে মামলা শেষ হবে, তবে মেয়ের বিয়ের কথা, তাতে মেয়ে আমার চল্লিশ বছরের হয় তোক।

    কিন্তু একটা বিধবা স্ত্রীলোক শুধু তার ধিঙ্গি-অবতার একটা মেয়েকে নিয়ে বাড়ির শ্রেষ্ঠ অংশটা দখল করে বসে থাকবে, এর থেকে দৃষ্টিশূল অবস্থা আর কী আছে?

    এ বিষয়ে দুই শত্রুভাইও একমত।

    উত্তর দিকটা সিঁড়ি, গ্যারেজ, ইত্যাদির দিক।

    তাদের ইচ্ছে তারা দুজনে পুব বনাম দক্ষিণ নিয়ে লড়ালড়ি করুক, মা পশ্চিমে নির্বাসিত হোক। কিন্তু মামলা এখন হাইকোর্টে গিয়ে উঠেছে, সম্পত্তি রিসিভারের হেপাজতে। বাড়িভাড়ার আয় গিয়ে ওঠে কোর্টে এবং কোর্ট থেকেই ধার্য করে দেওয়া হয় কে কতটা হাতখরচা পাবে।

    অথচ–এই বাড়ি আর পিছনের পোড়ো জমিটা বেচলে বেওজর ছ সাত লাখ টাকা হাতে আসে– চিত্তপ্রিয় দুঃখের গলায় বলে, সেই টাকাটা তিন জনে ভাগ করে নিলে হেসেখেলে ইচ্ছে মতন ভাবে থেকে জীবন কেটে যেত। কিন্তু তা হবে না। শেষ পর্যন্ত উকিল ব্যারিস্টারের খরচা মেটাতে এই বাড়ি নিলেমে তুলতে হবে, তারপর রাস্তার ভিখিরি হয়ে রাস্তায় নামতে হবে।

    চিরন্তন আসে যায়, সবই জানে, তাই চিত্তপ্রিয়র স্ত্রী চিরন্তনের সামনে শুধু এক পেয়ালা চা ধরে দিতে দ্বিধা করে না। দিয়ে নিশ্বাস ফেলে বলে, বাবা বড় বাড়ি দেখে বিয়ে দিয়েছিলেন, বউভাতে নেমন্তন্ন খেতে যখন বাপের বাড়ির দিকের লোকেরা এসেছিল, সবাইয়ের নাকি বাড়ির মাপ দেখে চোখ ট্যারা হয়ে গিয়েছিল; ভিতরে ভিতরে যে বারো ঘর ভাড়াটে, আর এমন অন্তঃসারশূন্য অবস্থা, তা কে জেনেছে? ওই জমিটায় প্যান্ডেল খাঁটিয়ে আসর করা হয়েছিল, ডেকরেটারই নাকি তিন হাজার টাকা নিয়েছিল। সে টাকা শুধতে আর বিয়ের ঘটার খরচ মেটাতে ঝামাপুকুরের খোলার চালের বস্তিটা নাকি বেচতে হয়েছিল। জানি না বাবা এই সব চালের মানে কী? গেরস্ত ঘরের মেয়ে, আমরা জানি সুখের থেকে স্বস্তি ভাল, এরা দেখি স্বস্তিও চায় না, সুখও চায় না, চায় শুধু অহমিকা পরিতৃপ্তি।

    চিত্তপ্রিয় বিরক্ত গলায় বলে, তাই হয়। বনেদিয়ানার মর্ম তুমি বুঝবেনা।…তবে কি জানিস চিরন্তন, এই মায়ে ছেলেয় আর ভাইয়ে ভাইয়ে মামলায় মনগুলো দিন দিন কেমন নরক হয়ে যাচ্ছে। দূরে থেকে শত্রুতা করা, সে একরকম, কিন্তু এক ছাতের নীচেয় থেকে মুখ দেখাদেখি বন্ধ, শাপমন্যি, হিংসা-হিংসী, এতে ছেলেপুলেগুলো উচ্ছন্নে যাচ্ছে।

    তবু ভাল চিত্তপ্রিয়র বউ বলে, এটা তোমার চোখে পড়েছে। আমার তো এক এক সময় মনে হয় ছাত থেকে লাফ দিই।…ওই যে আমার ননদটি আছেন? ওটি যে কী সাংঘাতিক! জা-ভাশুরকে আমি ভাল বলছি না, তাঁরাও স্বার্থপরের রাজা, নীচ নোংরা অসভ্য, কিন্তু এই ননদটি—

    ননদটি যে কী তা ভাষায় ব্যক্ত করতে না পেরেই বোধকরি চিত্তর বউ দুহাত জোড় করে নমস্কার করে।

    চিরন্তন বলে, তা তোরা একবার আপসে মিটমাট করে বাড়িটা বেচার কথাই বা আলোচনা করিস না কেন? সত্যি, এত টাকার সম্পত্তি থাকতে তোদের এভাবে টানাটানি করে চলবে

    টানাটানি বললে কিছুই বলা হয় না ঠাকুরপোে, চিত্তর বউ ফোঁস করে ওঠে, হাড়ির হাল বলাই ঠিক। এই এতবড় বাড়ির মালিক, অথচ ছেলেদের পাতে দুবেলা একটুকরো মাছ জোটাতে পারি না, দুধের চেহারা তো ভুলেই গেছে–

    চিত্ত বোধহয় এ সত্যটা উদঘাটন করা পছন্দ করে না, তাই তাড়াতাড়ি বলে, অথচ আমাদের পরমারাধ্যা মাতৃদেবী? তিনি আর তাঁর কন্যা? তাঁদের নাকি রোজ ভাতের পাতে বড় বাটির চিনিপাতা দই, আর রাত্রে লুচির পাতে ঘন ক্ষীর না হলে রোচেই না। ভদ্রমহিলা ভয়েলের থান আর আদ্দির শেমিজ ছাড়া পরতে পারেন না, এখনও একটা খাস চাকরানি ওঁকে তেল মাখায়, চুল শুকিয়ে দেয়, পা টেপে। মেয়েরও তেমনই আরাম, বামুনের রান্না খাচ্ছেন, পায়ের ওপর পা দিয়ে বসে রাতদিন নভেল পড়ছেন, রেডিয়ো শুনছেন, আর উকিল এলেই তার গায়ে পড়ছেন। সাজেরই বা বাহার কত!

    চিত্তপ্রিয়র মুখ দেখে বিশ্বাস করা কঠিন, সে তার মা বোনের কথা বলছে।

    এটা আবার বোধ করি বউয়ের রুচিতে বাধে, সে বলে, তা মরুকগে সাজে সাজুকগে, কিন্তু ভাইপো ভাইঝিদের এত দূরছাই করে, এত ব্যঙ্গবিদ্রূপ করে যে, ইচ্ছে হয় বাড়ির ভাগের নিকুচি করে দিয়ে টিনের চালায় গিয়ে থাকিগে। আমার জীবনই যদি ধ্বংস হয়ে গেল, আমার ছেলেমেয়েরাই যদি কুটিল কুৎসিত হয়ে গেল, আমার সমস্ত বয়েসটাই যদি এই নীচতার মধ্যে কেটে গেল, তো সর্বস্ব হারিয়ে মরণকালে মামলায় জিতে আমার লাভ?…তা কে শুনছে আমার কথা! আমি কেরানির মেয়ে, আমি নাকি এসব বুঝি না।

    চিত্ত বিরক্ত গলায় বলে, তা সেটা বললে ভুল বলা হয় না।…দেখ ভাই চিরন্তন, ওর আবদেরে কথা! বলে, বাড়ির ভাগ ছেড়ে চলে চলো। পাগল ছাড়া আর কেউ বলবে এ কথা? সাত লাখ টাকার বাড়ি!

    চিত্তর বউ বলে ওঠে, আমার মতে পাগল এই তোমরাই। কথাতেই বলে আজ মরলে কাল দুদিন হবে। তবে যেটুকু জীবন, সেটুকু শান্তিতে কাটাই না কেন বাবা! তা নয়, জগতে যত ইতরতা আছে, সেইসবে শান দেওয়া হচ্ছে বসে বসে। বিশ্বাস করবেন একটা কথা? আমার এই ছোট ছেলেটার একটু ভূতের ভয় আছে। সিঁড়িতে যেতে আসতে ছেলেটা ভয় পায়। সিঁড়িও তো তেমনি, যত চওড়া, তত উঁচু, অথচ মাথার ছাতে চামচিকের বাস, দেয়ালে ইট বার করা! তা যেই বেচারি সন্ধেবেলা খেলা সেরে উপরে উঠবে, অমনি আমার বড় জা জেঠি হয়ে সিঁড়ির আলো নিভিয়ে দিয়ে খোনা খোনা গলায়, কেঁ রে তুইবলে আবোল-তাবোল সব কথা বলবেন। সঙ্গে ওঁর ছেলেমেয়ে দুটিও যোগ দেবে। অথচ তারা বড় হয়েছে, ক্লাস টেন-এ পড়ছে।…আমার ছেলেটা ভয়ে নীলমূর্তি হয়ে এসে আছড়ে পড়ে, অজ্ঞানের মতো হয়ে যায়, আর ওঁরা ঘরে হাসির ধূম চালান…বেচারি ওই ভয়ে প্রাণভরে খেলতেই পায় না। বিকেলবেলাই ফিরে আসে। ওরা বড় হয়ে ওদের প্রতি সদয় হবে কখনও?

    চিত্ত এবার ফোড়ন দেয়।

    বলে, দুদিক থেকে সাঁড়াশি আক্রমণ! ছাদটা তো এজমালি? অথচ আমার ঝি যদি আমাদের কাপড় শুকোতে দিয়ে আসে, আমার মাতা ভগ্নী সে কাপড় তুলে ছাতের শ্যাওলায় নিক্ষেপ করেন। বললে বলে কিনা, কোন ছোটলোকের মেয়ে চোখে দেখেছে আমরা করেছি?

    চিত্তপ্রিয়র বউ এবার বোধহয় লজ্জিত হয়, তাই তাচ্ছিল্যের গলায় বলে, থাক, ও সব ফিরিস্তি দিতে বসলে সারা দিনরাত কেন, মাস বছরেও ফুরোবে না, ও কথা ছেড়ে দাও বাবা, অন্য কথা বলো।

    চিত্তপ্রিয়র বউ অনায়াসে বলতে পারে দুবেলা মাছ জোটাতে পারি না, দুধের চেহারা ভুলে গেছি– কিন্তু এই ধরনের হাঁড়ির খবর বলতে বসা তার রুচিতে বাধে।

    অথচ চিত্তপ্রিয়র ঠিক উলটো। চিত্তপ্রিয় স্বচ্ছন্দে ওর মা বোন দাদা বউদির নীচতার, ক্ষুদ্রতার, নোংরামির কথা বন্ধুর কাছে ফলাও করে আলোচনা করতে পারে, কিন্তু ওই মাছ দুধের প্রসঙ্গে বউয়ের উপর ক্রুদ্ধ হয়।

    তার মানে দৈন্য সম্পর্কে ধারণা দুজনের দুরকম।

    ওদের রুচি বিপরীতধর্মী।

    চিরন্তনের চোখ এড়ায় না এটা, আর মনে মনে ভাবে সে, আপসে বাড়ি বিক্রি করে লাখ দুই করে হাতে নিয়ে নিজের মতো জীবন যাপন করতে যেতে পেলেই বা লাভ কী তোমাদের? সেই নিজেটা কে হবে? এখনও বনেদি বংশের গৌরবে গৌরবান্বিত চিত্তপ্রিয়বাবুর সঙ্গে তার মা বোনের বা দাদা বউদির দূরত্ব আর কতটুকু? যৎসামান্য। কিন্তু বউয়ের সঙ্গে দূরত্ব ওর আকাশ-পাতাল। সেই আকাশ পাতালের ব্যবধান নিয়ে কোন স্বর্গ রচনা করবে দুজনে?

    চিত্তপ্রিয় যদি তার নিজের মতো কোনও গলে পচে যাওয়া বনেদি বাড়ির মেয়ে ঘরে আনত, দুজনে এক স্বর্গে না হোক, একই নরকে সুখে বাস করতে পারত।

    চিত্তর মা বোন যেই চিত্তদের ছাদে মেলে দেওয়া কাপড় টেনে নামিয়ে শ্যাওলায় ফেলে দিত, চিত্তর সেই বউও তৎক্ষণাৎ ছাদে গিয়ে ওদের কাপড় রাস্তায় ফেলে দিয়ে আসত।

    চিত্তর বউদি যেই চিত্তর ছেলেকে ভূতের ভয় দেখাত, চিত্তর সেই বউ চিত্তর দাদার ছেলেকে শাঁকচুন্নি হয়ে খামচে দিত।

    চিত্তর দাদা যেই তার ছেলেদের শেখাত, ও ঘরে যেতে হবে না খবরদার! গেলে ঠ্যাং ভাঙব।

    চিত্তর সেই বউ ভাশুরকে শুনিয়ে শুনিয়ে নিজের ছেলেকে শিক্ষা দিত, ও ঘরে গিয়ে কিছু খেয়ে বোস না বাবা, কে জানে কখন পুতনা বুড়ি বিষের লাভু জুগিয়ে রাখে।

    বউয়ের সেই ক্যাপাসিটিতে পুলকিত হত চিত্ত, বউ এসে ঘরে বসে নিজে বাহাদুরির গল্প করতে বসত। তা বাহাদুরি বইকী!

    খুব শুনিয়ে দিয়ে এলাম!..আচ্ছা করে সমঝে দিয়ে এলাম!…বাছাকে একেবারে নাকের জলে চোখের জলে করে এলাম। এ সব তো বাহাদুরি করবারই কথা।

    চিরন্তন দেখেছে এ জিনিস।

    কিন্তু চিত্তর এই বউ চিত্তর গোষ্ঠীর লোক নয়। তাই সে বলে ওঠে, ও কথা ছাড়ো বাবা, অন্য কথা বলো।

    অথচ চিত্তর তখন ওইসব কথাই মাথার মধ্যে গুলোচ্ছে। চিত্ত সেগুলো কাউকে বলে ভারমুক্ত হতে চাইছে। চিত্তর পক্ষে তার এই বউ অসুবিধের বইকী, বউয়ের ভয়ে ছেলে দুটোকে ইচ্ছামতো তালিম দিতে পায় না সে, কাজে কাজেই তাদের ঠাকুমা, পিসি, জেঠি বা জেঠতুতো ভাই-বোনেরা ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ করলে, উচিতমতো জবাব দিয়ে উঠতে পারে না তারা। ভ্যাবলার মতো ঘরে পালিয়ে আসে।

    এটা কম দাহজনক?

    আবার নিজেও যখন ওদেরআক্কেলহীনতা, স্বার্থপরতা নিয়ে আলোচনা করতে চায়, সেই চাওয়ার বোঝা নিয়ে ছটফটিয়ে মরে, বউ শুনতে চায় না।

    বউ বিরক্ত হয়ে বলে, নরক দর্শনেই সহস্র পাপের বোঝা, আর নরক বর্ণনায় দরকার কী?…বলে, ছেলে দুটোর পরকাল ঝরঝরে করে লাভ আছে কিছু? এমনিতেই তো জ্ঞানবৃক্ষের ফল যথেষ্ট পরিমাণে খাচ্ছে।

    আজ বন্ধুকে পৃষ্ঠবল পেয়ে চিত্তপ্রিয় নিজের ইচ্ছাকে চরিতার্থ করতে বসেছে, তাই এখন চিত্তপ্রিয় বলে ওঠে, ও কথা ছাড়ব তো ধরব কোন কথাটা? জানিস চিবো, বললে বিশ্বাস করবি কিনা জানি না, বাড়িতে একটা ফেরিওলা এলে তাকে আগে ডেকে নিয়ে বেশি দাম দিয়েও জিনিস কিনে আমাদের কাছ থেকে ভাঙিয়ে নেয়।…বাসনমাজা ঝি তিন ঘরে তিনটে, তবু বেশি মাইনের লোভ দেখিয়ে ভাংচি দেয়। আর নিজেদের ঝিকে শিখিয়ে দেয় আমাদের ঘরের সামনে জঞ্জাল ফেলতে। ওই ঝিগুলোও হয়েছে তেমনি! ওরাও–

    চিরন্তন ক্লান্ত হচ্ছিল।

    কী তুচ্ছ কথা!

    কী নগ্ন দৈন্যের ছবি! মন কত দীন হয়ে গেলে একটা পুরুষ মানুষ এই ধরনের কথা মুখ দিয়ে বার করতে পারে!

    তাদের বাড়িতেও শাশুড়ি বউ মেয়ে ইত্যাদির কলহলীলা আছে, কিন্তু এ ধরনের কথা তারা ভাবতেই পারে না। ওদের বাড়িতে প্রধানত কে কাকে মানল না, কে কার কথা শুনল না, আর কে কাজে ফাঁকি দিল, এই নিয়েই আন্দোলন। কারণ ওরা মধ্যবিত্ত।

    কিন্তু এরা বনেদি ঘর, এদের সবকিছুই বনেদিয়ানা-মণ্ডিত। এরা নীচতার আরও গভীর গহ্বরের সন্ধান রাখে।

    চিত্তপ্রিয়র বউদি নাকি চিৎকার করে শাশুড়ির চরিত্রদোষ ঘোষণা করে, আর চিত্তপ্রিয়র মা ছেলের বউকে গালাগাল দেন, যে আমায় এতবড় কথা বলে, সে স্বামী পুতুরের মাথা খাক, ঝুলি নিয়ে ভিক্ষেয় বেরোক, দুচক্ষু অন্ধ হয়ে পথে পথে ঘুরে বেড়াক।

    বউদি সঙ্গে সঙ্গে শুধোয়, কেন, অন্ধ হব কেন? তোমার কীর্তিকলাপ দেখতে পেয়েছি বলে? তা তাই যদি হয় তো হোক, তবু আমি বড় গলায় বলব, যে মেয়েমানুষ বিধবা হয়েও ষাট বছর বয়েসে গায়ে চন্দনবাটা মাখে, মাথায় ফুলেল তেল মেখে গুছি দিয়ে খোঁপা বাঁধে, থানের সঙ্গে গোছাভর্তি সোনার হার পরে, আর লুকিয়ে মাছ খায়, তার স্বভাবচরিত্র কখনও ভাল হতে পারে না।

    মুখোমুখি কথা নেই, সবই দেয়ালকে শুনিয়ে। অর্থাৎ দাসী চাকরের সামনে।

    চিরন্তন শুনেছিল এসব, চিরন্তন ভেবেছিল, অথচ এরা অভিজাত ঘরের, এরা নিজেদের বনেদি বলে বড়াই করে, আর মধ্যবিত্তদের দিকে অবজ্ঞার দৃষ্টি হানে।

    চিত্তপ্রিয়র বউ বলে, বলুন না ঠাকুরপো আপনার বন্ধুকে, মামলা-টামলা ছেড়ে দিয়ে চলে যেতে এই পরিবেশ থেকে। এই আজীবনের রংচটা প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড খড়খড়িদার জানলা, এই মলিন রংঘষা মার্বেল মোড়া মেঝে, এই রেলিংনড়বড়ে বারান্দা, আর এই লম্বা লম্বা ফাট ধরা দেয়াল, যা নাকি একদা ডিসটেম্পার করা ছিল বলে আর কলি ফেরানোরও উপায় নেই, এইসব যেন আমার প্রাণকে টুটি টিপে মারে। বড় বাড়িতে বিয়ে হয়েছিল কিন্তু পশ্চিমের রোদ ছাড়া আর কখনও কিছু দেখলাম না।

    চিরন্তন এই পরিস্থিতিটাকে লঘু করবার জন্যে বলে, ভালই তো! পশ্চিম দিকটাই তো প্রগতির দিক।

    চিত্তর বউ হাসে অবশ্য, কিন্তু সে-হাসিতে প্রাণ নেই। আবার পূর্বকথার জের ধরে সে, মানছি একটা বাড়ির পুব পশ্চিম উত্তর দক্ষিণ থাকবে, কিন্তু মানুষ তো এ ঘরে ও ঘরে গিয়ে বসে? এদিকের মানুষ ওদিকের বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ায়? এ বাড়িতে এসে সেটা দেখলাম না। শ্বশুর যখন ছিলেন, হাঁড়ি এক ছিল বটে, কিন্তু তিনি যেন আমার শাশুড়ির দ্বারা মন্ত্রপূত ছিলেন। একদিন একটু স্নেহ মমতা পাইনি।

    চিত্তপ্রিয় অবলীলায় বলে, স্ত্রৈণ পুরুষদের যা দশা আর কি!

    চিরন্তন স্তব্ধ হয়ে তাকায়।…চিরন্তনের মুখে কথা জোগায় না।…কিন্তু চিরন্তন আজ এবাড়িতে এল কেন? আজ না ওর মাথার যন্ত্রণা হচ্ছিল?

    চিরন্তন কি তার উপন্যাসের মালমশলা সংগ্রহ করছে?

    ছেলেবেলা থেকেই মাঝে মাঝে কিছু লেখে চিরন্তন, কবিতা কি ছোটগল্প। কখনও রেখে দেয়, কখনও বা ছাপা হয়। কিন্তু সেটা নিতান্তই অনুল্লেখযোগ্য।

    শুধু কিছুদিন থেকে বড় কিছু লেখবার প্রেরণা জাগছে মনে। তাই এখান ওখান ঘুরে বেড়ায় সে চরিত্রর সন্ধানে।

    কিন্তু চিরন্তন বড় অভাগ্য।

    চিরন্তনের ভাগ্যে একটা মহৎ চরিত্রের দর্শন মেলে না, মেলে না কোনও বিরাট চরিত্রের। চিরন্তন শিক্ষক সমাজে উঁকি দিয়েছে, রাজনীতিকদের ছায়ায় ঘুরেছে, চিরন্তন অতি-আধুনিকদের ক্লাবেও ঘুরেছে, ব্রিজ খেলেছে, ড্রিঙ্ক করেছে, তাদের ওপর লক্ষ রেখেছে। সর্বত্রই অনেক বিচিত্র চরিত্র দেখেছে, কিন্তু উঁচু দিকে চোখ তুলে দেখবার মতো চরিত্র পাচ্ছে না।

    সে বস্তু কি আর পাওয়া যায়?

    যেমন পাওয়া যায় না খাঁটি দুধ, সত্যিকার ঘি, নিষ্ঠাবান ব্রাহ্মণ, সরল শিশু!

    না, এসব আর পাওয়া যায় না, এসব সেকেলে হয়ে গেছে।

    চিরন্তনকে তাই তার অজাত উপন্যাসের মালমশলা খুঁজতে অবিরতই ব্যর্থ হতে হয়।

    হয়তো চিরন্তনের এটাও মনকে চোখ ঠারা, হয়তো চিরন্তনের সেই উপন্যাস জীবনে লেখা হবে না, হয়তো চিরন্তন নিজের এই অর্থহীন আড্ডা দেওয়ার পিছনে একটা কাল্পনিক অর্থ জুড়তে নিজেকে ওই চরিত্র অনুসন্ধানটা বোঝায়, তবু লক্ষ্যটা তীক্ষ্ণ থাকে চিরন্তনের।

    চিত্তর বউ যখন কথা বলছিল, তখন কেবলই যে ব্লাউজের একটা ছেঁড়া অংশ ঢাকা দেবার চেষ্টা করছিল, সেটা চিরন্তনের চোখ এড়ায়নি, চিত্ত যখন তার মায়ের নামে নিন্দে করছিল, তখন যে চিত্তর বউয়ের মুখটায় অসন্তোষের ছাপ পড়ছিল, সেটা চিরন্তনের চোখ এড়ায়নি।

    চিরন্তন কি তবে একেই তার গল্পের নায়িকা করবে? মনীষাকে বাতিল করে দিয়ে?

    হ্যাঁ, মনীষাকেই মনে মনে ভাঁজছিল চিরন্তন।…রীতাকে নয়। এখন ভাবছে চিত্তর বউ কেন নয়? কিন্তু আজ পর্যন্ত চিত্তর বউয়ের নাম জানে না চিরন্তন।…

    তাই বন্ধুকে ওই বউ দিয়েই বলে।

    বলে, দেখ চিত্ত, তোর বউ যা বলে ঠিকই বলে। সমস্ত বয়েসকালটা যদি মামলার দুর্ভোগেই গেল, তো টাকা পেয়ে ভাগটা করবি কবে? তার চেয়ে তোর ওই দাদা আর মাকে বলে, নিখুঁত ভাগের থেকে কমসম করে কিছু টাকা নিয়ে এবাড়ি থেকে কেটে পড়! দুটো ছেলে আর তোরা দুজন, চার চারটে মানুষ কেন বাবা গুমখুন হবি পড়ে পড়ে!

    চমৎকার!

    চিত্ত হেসে উড়িয়ে দেয় কথাটা, বলে, তোকে আর আমার এই বউকে এক গারদে রাখা উচিত।

    বউ বলে, আমার মতে তোমাকে।

    চিরন্তন বলে, মামলা জেতার পর তোমার আর কিছু পদার্থ থাকবে?

    কিছু না! এখনই তো অপদার্থ হয়ে গেছি চিত্তপ্রিয় মাথার চুল মুঠোয় চেপে পায়চারি করতে করতে বলে, তা ছাড়া জেতবারও কোনও ভরসা নেই। অপর পক্ষদের অনেক বল-ভরসা। আমার ঘরে শুধু আমার এক বিরুদ্ধবাদী স্ত্রী!

    তোমার হিতৈষিণী।

    জানি বুঝি, কিন্তু সেই হিত কে চায়? এ পৃথিবীতে তাকিয়ে দেখ, হিতটা কে চাইছে? চায় শুধু জিত। সেটা অপ্রাপ্য জেনেও চায়। আমি সেই পৃথিবীর ইতিহাসে একটু ক্ষুদ্র সংযোজন মাত্র।

    বাংলায় তো তোমার বেশ ভাল দখল আছে হে! বাঃ!

    ঠাটা করবার কিছু নেই হে চিরন্তন, এই হচ্ছে পরম সত্য।

    কিন্তু আমি ধ্বংস হয়ে যাচ্ছি, আমার ছেলেরা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। বউ উত্তেজিত হয়।

    যাবে, সেটাই তোমাদের বিধিলিপি—

    কিন্তু শত্রুপক্ষ তো বাইরের কেউ নয়, তোমারই মা ভাই

    ওই পচা সেন্টিমেন্টাল কথাটা বারবার বোলো না। অসহ্য! মা ভাই! শুনলে মাথা জ্বলে যায়।

    তা তুই তো এক কাজ করলে পারিস বাবা, খোশ মেজাজে মামলা চালিয়ে যা, কিন্তু অন্যত্র থাক ততদিন

    আরে, এটা কি আমার বউ তোকে শিখিয়ে দিয়েছে নাকি?..হা হা করে হেসে ওঠে চিত্তপ্রিয়, একবার এ বাড়ির চৌকাঠ পার হয়ে বেরিয়ে গেলে আর ঢুকতে পাব ভেবেছিস?…নেভার! তখন আমার মা জননী ওই বড় পুতুরের সঙ্গে সন্ধি করে আমার অংশটি মিলে-মিশে ভাগ করে নিয়ে আমে দুধে মিশে যাবেন।

    কথার মাঝখানে হঠাৎ হল-এ একটা ছায়া পড়ল, সঙ্গে সঙ্গে একটা আবাল্যপরিচিত অথচ অভাবনীয় শব্দ কানে এল চিরন্তনের।…ঈষৎ অনুচ্চ, কিন্তু স্পষ্ট।

    কুলপি বরোফ।

    চিরন্তন চমকে বলে, উপরতলায় কুলপি বরোফ হাঁকল কে?

    কেন, কুলপি বরফওলা। চিত্ত বলে, রোজ আসে এ সময়, মান্থলি বন্দোবস্ত।

    তাই নাকি? তা দোতলায় ওঠে কেন?

    দোতলায় উঠবে না? আমার পরমারাধ্যা মাতৃদেবীর ব্যাপার যে! শুধু দোতলায়? একেবারে শয়নকক্ষের অলিন্দে। দুই মায়ে-ঝিয়ে দিনে চার-পাঁচ টাকার মালাই কুলপি খান। অবশ্য দাসীরাও প্রসাদ পায়।…কিন্তু বাচ্চা নাতি-নাতনি কেউ ধারে কাছে যাক দিকি? বলে উঠবেন, এই হ্যাংলাগুলো সামনে এসে দাঁড়িয়েছে তো! আজ আর বরফ হজম হবে না। নমি, একটুখানি খুঁটে মাটিতে ফেলে বাঁ পায়ে মাড়া।

    চিরন্তন হতভম্ব গলায় বলে, ব্যাপারটা কী হল?

    চিত্তর বউ বরকে বকে ওঠে, তুমিও আচ্ছা মানুষ! এইসব কথা ওঁর কাছে! তোমাদের বাড়ির এইসব উচ্চাঙ্গের ভাষা আর কারও বোঝবার ক্ষমতা নেই।…কিছু নয় ঠাকুরপো, ও একটা মেয়েলি তুক! মানে ওতে নাকি নজর লাগে না।…এদের এই বনেদি বাড়িতে এতসব ওই তুকতাক, নজর লাগা, মন্দ করা ইত্যাদি জটিল ব্যাপার আছে, শুনলে আপনার মাথা খারাপ হয়ে যাবে।…রোদের উলটোমুখো দাঁড়ালে মানুষের ছায়া পড়বে এটা তো স্বাভাবিক? কার না পড়ে? আর কে বা সেটা হিসেব করে দাঁড়াতে যায়? কিন্তু এদের বাড়িতে ওই ছায়াটা যদি অন্য কারও গায়ে এসে পড়ে, তা হলে কুরুক্ষেত্র কাণ্ড ঘটে যায়! ওতে নাকি আয়ুক্ষয় অনিবার্য!

    চিরন্তন উঠে দাঁড়ায়।

    চিরন্তন বলে, উঠছি মিসেস! বড় বেশি গুরুপাক হয়ে যাচ্ছে, এরপর আরও শুনতে হলে ফেন্ট হয়ে যাব। ওঃ! তবু তুই এই ভদ্রমহিলাকে রোজ ফুলচন্দন দিয়ে পুজো করিস না চিত্ত? আচ্ছা চলি।

    দুজনেই বলে, আবার এসো।

    দুজনের প্রকৃতি দুই, তবু দুজনেই চিরন্তনকে ভালবাসে। দুজনেই বলে, আবার এসো। কারণ ওদের ভিতরের এই অভিযোগের ঢেউ একটা তীর চায়, আছড়ে পড়বার জন্যে।

    কিন্তু এই চিত্তপ্রিয় চিরন্তনের বন্ধু হল কী করে? এত উলটোপালটা প্রকৃতি সত্ত্বেও? চিরন্তনরা তো ভবানীপুরের বাসিন্দা নয় যে, এক স্কুলে পড়ার অথবা এক মাঠে খেলার সূত্রে বাল্যকালেই বন্ধুত্বটা জন্মে গেছে; যখন প্রকৃতিটা গড়ে ওঠে না।

    না, ঠিক বাল্যবন্ধুত্ব নয়, তবে প্রায় কৈশোর কালের বটে। অথবা সদ্য তরুণ বয়সের। সূত্র একটা সৃষ্টি হয়েছিল।

    চিরন্তনের কলম চালাবার শখ নেহাত বালক বয়েস থেকেই, স্কুল ম্যাগাজিন থেকে যার শুরু। যখন ক্লাস নাইনে পড়ে, তখন লিখে ফেলেছিল এক নাটক। নাটকের পাত্র-পাত্রী অবশ্য ঐতিহাসিক। নায়ক মীরজুমলা।

    নাটকটি আর কিছু হোক না হোক, নাটকীয় হয়েছিল সন্দেহ নেই। ক্লাসের ছেলেদের মধ্যে ধন্য ধন্য পড়ে গেল, এবং একটি ছেলে বাড়িতে দেখাব বলে নিয়েই চলে গেল একদিন।

    কয়েকদিন পরে অভাবনীয় এক বার্তা শোনাল সে এসে। তার এক দূর সম্পর্কের মাসিরা খুব বড়লোক, বাড়িতে দুর্গোৎসব হয়, এবং সেই সূত্রে বাড়ির কমবয়েসী ছেলেরা নাটক অভিনয় করে। এবার তারা এই মীরজুমলা অভিনয় করবে।

    চিরন্তন বলল, য্যাঃ!

    ছেলেটা বলল, সত্যি বলছি। তোর লেখাটা আমি সবাইকে দেখিয়েছি তো? মা সে কথা গল্প করেছে বোনের কাছে, সেই থেকে ছড়িয়েছে। আমার বন্ধুর লেখা শুনে মেসোর খুব উৎসাহ। মানে আসল পাণ্ডা তো ওই মেসো। তা তোর কোনও অমত নেই তো?

    অমত? চিরন্তন বলেছিল, অমত কি বল? আমার বিশ্বাসই হচ্ছে না।

    বন্ধুর সেই মেসো-ই হচ্ছেন চিত্তপ্রিয়র বাবা নিত্যপ্রিয়।

    জগতে যত রকম ভাবে আমোদ আহরণ সম্ভব, ভদ্রলোক সাধ্যমতো তা করতেন, অনেক সময় সাধ্যের অতিরিক্তও।

    পুজো উপলক্ষে নাটক করাও সেই আমোদ আহরণের একটা।

    খুদে নাট্যকারের ওই নাটক কেমন করে যেন তাঁর মনে ধরে গিয়েছিল; বলেছিলেন, দে, এবার ওটাই লাগিয়ে দে।

    এবং সেই উপলক্ষে খুদে নাট্যকারকে নেমন্তন্নও করেছিলেন সমাদর করে।

    অচেনা বাড়িতে আসার কুণ্ঠা সত্ত্বেও নিজের নাটকের অভিনয়ের মতো অবিশ্বাস্য ঘটনাটা চোখে দেখার জন্যে এসেই গিয়েছিল চিরন্তন তার বন্ধুর এই দূর সম্পর্কের মাসির বাড়ি।

    চিত্তপ্রিয়র দাদা সেজেছিল নাটকের নায়ক মীরজুমলা, চিত্তপ্রিয় সেনাপতি।

    হ্যাঁ, দুই ভাইয়ে তখন একই মঞ্চে অবতীর্ণ হয়েছিল।

    হয়তো তখন একই মশারির মধ্যে শুত দুজনে, একই চিরুনিতে চুল আঁচড়াত।

    সে যাক–সেই সূত্রে চিত্তপ্রিয়র সঙ্গে বন্ধুত্ব। চিত্তপ্রিয় ওকে দেখেই একেবারে ওর হাত চেপে ধরে বলেছিল, তুই তো দেখছি আমার থেকেও ছোট, এমন লেখা কী করে লিখলি বল তো? বাবা বলছিল পরে এ ছেলে বড় নাট্যকার হবে।

    চিত্তপ্রিয়র বাবার সেই ভবিষ্যদ্বাণী অবশ্য ফলেনি, নাটক লেখা চিরন্তনের সেই মীরজুমলাতেই প্রথম ও শেষ। তবে এই প্রশংসাবাণীতে বিগলিত হয়ে চিরন্তন সেই মুহূর্তেই মনে মনে নতুন নাটকের ছক কেটে ফেলে বন্ধু বলে গ্রহণ করে নিয়েছিল চিত্তপ্রিয়কে।

    যদিও ওইটুকু ছেলের একগাল পান খাওয়া মুখ, চিকনের পাঞ্জাবি, জরিপাড় ধুতি, আর নাগরাজুতো পরা চেহারাটা খুব রুচিকর বলে মনে হয়নি চিরন্তনের, তবু প্রশংসার বাণী জিনিসটার বড় মাদকতা। তা ছাড়া চিত্তপ্রিয়র ফরসা গোলগাল চেহারাটায় ওটা যেন মানিয়েও গিয়েছিল কিছুটা।

    আরও একটা কথা–চিত্তপ্রিয়র ওই প্রথম সম্বোধনের সরলতাটুকু ভাল লেগেছিল চিরন্তনের।

    চিত্তপ্রিয়র বাবা যদি তালপুকুরের সব জল শুষে খেয়ে শুধু শূন্য ঘটিটা ফেলে রেখে অসময়ে চলে না যেত, যদি যেভাবে ঠাটবাট বজায় রেখে চালিয়ে যাচ্ছিল এখনও বেঁচে থেকে সেটা চালিয়ে চলত, অত সাত সকালে বিয়ে দিয়ে না বসত চিত্তপ্রিয়র, তা হলে হয়তো চিত্তপ্রিয় এখনও তেমনি এক মুখ পান খাওয়া গোলগাল ফরসা ফরসা মুখে হ্যাঁ হ্যাঁ করে হেসে আড্ডা দিয়ে বেড়াত, আর শখের থিয়েটারে কোমরে জরির বেল্ট এঁটে সেনাপতি সাজত।

    অথবা নতুন বিয়ের বউ নিয়ে রোমাঞ্চ করত।

    কিন্তু চিত্তপ্রিয়র ভাগ্যে এ সব হয়নি।

    তাই চিত্তপ্রিয় অবলীলায় ওর দাদার সর্বনাশ চিন্তা করছে, অনায়াসে বাবা সম্পর্কে স্ত্রৈণ শব্দটা ব্যবহার করছে, এবং সারাক্ষণ শুধু ছোট কথা নিয়ে কাটাচ্ছে।

    চিরন্তন ওর প্রতি বিতৃষ্ণ, তবু ওকে ঠিক বর্জন করতে পারে না। কোথায় যেন একটু মমতা থেকে গেছে ওর জন্যে।

    অথবা–আরও গভীর মমতা সঞ্চিত হয়েছে অন্য কারও জন্যে। মমতার সঙ্গে শ্রদ্ধা।

    .

    বসুশ্রী থেকে ফিরে বাড়ি ঢোকবার একটু আগে দুজনে ছাড়াছাড়ি হল। শাশ্বতীই বলল, দুজনে আর একসঙ্গে ঢুকে কাজ নেই বাবা, তুমি খানিক পরে এসো।

    ধ্রুব মৃদু হাসল।

    বলল, এই যে একটু আগে বলছিলে, আর ভয় করব না। কিছু বলতে এলে মুখের উপর শুনিয়ে দেব আমি আর নাবালিকা নই!

    শাশ্বতীর মুখটায় একটা বিষাদের ছায়া এসে পড়ে। শাশ্বতী ম্লান গলায় বলে, বলতে তো ইচ্ছে করে, কিন্তু সে জোর কি তুমি জোগাতে পারছ? ওঁরা যদি বেশি কিছু বলেন, তুমি কি বলতে পারবে, ঠিক আছে, চলো আমরা চলে যাই। সে ভরসা থাকলে সাহস হত। এ তো জানি, আবার এদের ভাতই খেতে হবে, এদের বাড়িতেই থাকতে হবে।

    বাড়িটা?

    ধ্রুব হঠাৎ একটুখানি ব্যঞ্জনাময় রহস্যের হাসি হেসে বলে, বাড়িটা ওঁদের না ভাবলেও পারো।

    শাশ্বতী চলে যাচ্ছিল, শাশ্বতীর চলার ভঙ্গিতে ক্ষিপ্রতা ছিল, শাশ্বতী থমকে গেল, বলল, কী বলছ?

    আরে বাবা কিচ্ছু বলিনি, যাও, গিয়ে চারটি বকুনি খাওগে।

    কিন্তু কী যেন একটা বললে?

    আচ্ছা পরে শুনো। আমি এখন যাচ্ছি না।

    তারপরেই থেমে যায় ধ্রুব।

    বলে, না, আমি এখনই যাচ্ছি। তোমাকে এভাবে আগুনের মুখে ঠেলে দিয়ে পিছিয়ে যাওয়া ঠিক নয়।

    ধ্রুব বলেছিল, আগুনের মুখে ঠেলে দিয়ে

    ধ্রুব ওটাকে পরিহাসের অত্যুক্তি ভেবেই বলেছিল, ভাবেনি সত্যিই জ্বলন্ত আগুনের মুখে পড়তে হবে।

    কী করে ভাববে?

    ইত্যবসরে যে-ঘটনাটি ঘটে গেছে, তার সংবাদ তো তারা রাখে না।

    শাশ্বতীর বউদির সেজ বোন নাকি আজ বসুশ্রীতে শাশ্বতী আর ধ্রুবকে দেখেছে। পাশাপাশি বসে আছে দামি সিটে। আর হাসাহাসি দেখে কে! আর খাওয়ার ঘটাই বা কী! এই আইসক্রিম, এই চকোলেট, এই পটেটো চি!

    বউদির সেজ বোনের অবস্থা ভাল, গাড়ি আছে, নিজে বাড়ি বয়ে খবরটা দিয়ে গেলেন তিনি গাড়ির পেট্রল পুড়িয়ে। বলে গেলেন, শুধু যদি দেখতাম সিনেমা দেখতে এসেছে, এক টাকা চল্লিশের সিটে বসেছে, কিছু মনে আসত না। ছোট থেকে ভাইবোনের মতন মানুষ হয়েছে শুনেছি। এলই বা! কিন্তু এ যে দেখলাম ধরন অন্য।

    অতএব অবিশ্বাসের কারণ নেই ধরন অন্য করেছে ওই লক্ষ্মীছাড়া মেয়েটা, ছেলেটা।

    সেজ বোন চলে গেল।

    এদের মেরে রেখে গেল।

    তারপর প্রতীক্ষার মূহুর্ত।

    ফিরে এলেই তাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্যে। কিন্তু পাপী ছেলেমেয়ে দুটোর দেখা নেই। একই ছবি সেজ বোন দেখে এসে এত কথা বলে চলে গেল, অথচ এদের দেখা নেই।

    ভগবান জানেন পালিয়ে গেল কিনা।

    সুপ্রভা দুর্গা নাম জপ করছেন।

    সুপ্রভা চুপিচুপি দুটো পাপীর ঘরই তল্লাশ করে দেখছেন জামাকাপড় নিয়ে গেছে কি না। যেমন দেখেন চাকর বেড়িয়ে ফিরতে দেরি করলে তার ঘরটা, সে তার কাপড় গামছা নিয়ে পালিয়েছে। কিনা।…কিন্তু কই, সবই তো রয়েছে।

    সুপ্রভা জানলা আর ঘর করছেন।

    আর শাশ্বতীর বউদি আজ শনিবারের সুযোগে বরকে হাতে পেয়ে হাসির ছুরিতে বিদ্ধ করছে। তা হলে তো দেখছি সত্যি ভাই বোনেও বিশ্বাস নেই। শুনি কিনা, এতটুকু বয়েস থেকে একেবারে ভাই বোনের মতো মানুষ!

    নিত্যধন মাথা হেঁট করে থাকে।

    এ ছুরিটা তার প্রাপ্য।

    নিত্যধনই একদা এই ধমকটুকু দিয়ে স্ত্রীকে ঠাণ্ডা করেছিল। নইলে তার স্ত্রী তো কবেই এ সন্দেহ করেছে।

    এখন আর কিছু বলার নেই নিত্যধনের।

    ওদের মনে যদি গরল না থাকবে তো, লুকিয়ে না বলে গেল কেন? বলে কয়ে সরলভাবে যেতে পারত!

    স্ত্রীর মুখে বরং মার সমালোচনা সহ্য হয়, সহ্য হয় না বোনের সমালোচনা। তাও আবার তার রীতিনীতি সম্পর্কে। নিত্যধন সেই বোনটার উপরই আগুন হতে থাকে।

    মুহূর্ত যাচ্ছে…ঘণ্টা মনে হচ্ছে।

    বারবার মুখে আসছে সুপ্রভার, বড় ছেলেকে ডেকে একবার বলেন, রাস্তায় বেরিয়ে একবার দেখবি?

    কিন্তু বলতে পারছেন না।

    মুখে বাধছে।

    ছেলে তো একা বসে নেই, সেখানে যে বউ বসে।

    সে তো এ প্রস্তাব শুনেই হেসে উঠে বলবে, রাস্তায় বেরিয়েই যদি খোঁজ পাওয়া যায়, তা হলে আর খুঁজতে যাবার দরকার কী মা? এ রাস্তায় যদি আসে, এ বাড়িতেও ঢুকবে।

    উঃ। মস্ত বড় আইবুড়ো মেয়ের মা হওয়ার কী জ্বালা!

    অথচ সুপ্রভা কবে থেকেই বড় ছেলেকে বোনের বিয়ে সম্পর্কে চিন্তা করতে বলেছেন। গা-ই করে না। বলে, সময় পাচ্ছি কোথা?

    সুপ্রভা কি মনে করিয়ে দেবেন, ছুটির দিন হলেই যদি তুমি শ্বশুরবাড়ি গিয়ে বসে থাকো–বোনের বিয়ের জন্যে সময় বার করবে কী করে?

    মনে করিয়ে দেবার উপায় নেই।

    এ যুগের সমাজ বোনের বিয়ে দেওয়াকে করণীয় কর্তব্য বলে না। অতএব মনে করিয়ে দিতে গেলে লজ্জিত করার বদলে লজ্জিত হতে হবে।

    সুপ্রভার এখন স্বামীর উপর রাগ আসছে। যেন লোকটা শুধু সুপ্রভাকে জব্দ করবার জন্যেই অসময়ে কেটে পড়েছে! কেন, এতদিন পর্যন্ত কি তিনি বেঁচে থাকতে পারতেন না? তা হলে তো সুপ্রভার মাথায় এত দায় চাপত না?

    এই ধাড়ি আইবুড়ো মেয়ে, সেই খামখেয়ালি আর সংসারে মমতা-শূন্য আইবুড়ো ছেলে, আর ওই এক অবান্তর জীব ধ্রুব! সবই তো সুপ্রভার দায়।

    বড় ছেলে বড় বউ তো যখন তখনই বলে, আমাদের আবার কী, একটা বাচ্চা নিয়ে সংসার, যেখানে থাকব স্বচ্ছন্দে থাকব।

    পিতৃ-পিতামহের ধারাকে বহন করে নিয়ে যাবার দায়িত্ব তো আর এ যুগে নেই, নেই শাশুড়ি দিদিশাশুড়ির সংসারটিকে নতুন ফুলে পাতায় সাজিয়ে এগিয়ে নিয়ে যাবার।

    এ যুগ স্বতন্ত্র! এ যুগ শৃঙ্খলমুক্ত!

    এ যুগ ভুইফোঁড়!

    এ যুগ অতএব নির্মম।

    সময় অগাধ নয়, তবু মনে হচ্ছিল সুপ্রভার, অনন্তকাল অপেক্ষা করছেন তিনি মেয়ের জন্যে। হঠাৎ বাবুয়ার চিৎকার শুনতে পেলেন, মা, ওই তো পিসি এসেছে! আর তুমি বলছিলে পিসি পালিয়ে গেছে! জানলা দিয়ে দেখলাম পিসি–

    সুপ্রভা দ্রুত সিঁড়ি দিয়ে নেমে গেলেন।

    সুপ্রভা মেয়ের উপর প্রায় শারীরিক ভাবেই ঝাঁপিয়ে পড়লেন।

    .

    মানুষ ইচ্ছে করে জটিলতার সৃষ্টি করে কী সুখ পায়? চিরন্তন ভাবতে ভাবতে চলেছিল, তাতে যন্ত্রণা, তাতে অশান্তি, তাতে অনিষ্ট, তবু সহজ হতে ইচ্ছে করে না মানুষের। অথচ সব কিছুই মানুষের নিজের হাতে। মৃত্যু ব্যাধি জরা, এ ছাড়া আর সবই তো তার নিজকৃত।

    এই, সেদিন তোর কী হল?

    পাশ থেকে ঘ্যাঁচ করে শব্দ করে গাড়িটা থেমে গেল, রামানুজ গাড়ির দরজা খুলে বলল, উঠে আয়।

    কাজ আছে, ব্যস্ত। বলল চিরন্তন।

    উঠে আয় বলছি, নচেৎ গাড়ি চাপা দেব।

    উঠে আসার পর বলল, এই, সেদিন তোর কী হল?

    জ্বর।

    জ্বর!

    হ্যাঁ। কেন, আমার মতো হতভাগ্যের কি একদিন একটু জ্বরও হতে পারে না?

    তবে যে–রামানুজ সন্দিগ্ধ গলায় বলে, দিলীপ বলছিল সেইদিনই নাকি তোকে রমেশ মিত্তির রোডের রাস্তায় দেখেছে।

    স্বপ্ন দেখেছে। বলে হাসল চিরন্তন।

    তা কই তখন তো বললি না জ্বর হয়েছে!

    তখন হয়নি, পরে হল।

    রামানুজ হতাশ গলায় বলে, কেন, ঘণ্টা আড়াই আমার বউয়ের পাশে বসতে হবে ভেবে?

    তা সেটাও অসম্ভব নয়।

    হু।

    রামানুজ গাড়ি চালাতে চালাতে কিছুক্ষণ পরে বসে, আচ্ছা স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে যদি একজনের কুকুরাতঙ্ক থাকে, আর অপরজন যদি একটা হিংস্র কুকুর পোষে, সেটা ডিভোর্স স্যুটের একটা কজ হয় না?

    চিরন্তন উত্তর দেয় না। অদ্ভুত দৃষ্টি মেলে ওর দিকে তাকিয়ে থাকে।

    রামানুজ ডান হাতটা স্টিয়ারিং-এ রেখে বাঁ হাতে পকেট থেকে সিগারেটকেস বার করে চিরন্তনের হাতে বাড়িয়ে ধরে।

    চিরন্তন একটা জ্বেলে রামানুজের মুখে ঠেকিয়ে দিয়ে আর একটা ধরিয়ে আস্তে টানতে থাকে।

    রামানুজ একটু অপেক্ষা করে সিগারেটধরা মুখেই বলে, কই বললি না?

    চিরন্তন শান্ত গলায় বলে, জানি না। আমি লইয়ার নই!

    আহা তুই তো সবরকম বইটই পড়িস।

    আইনের বই নয়।

    তা হলে উকিলের কাছেই যেতে হবে।

    গম্ভীরভাবে বলে রামানুজ।

    চিরন্তন বলে, কেন, তোর বউয়ের কুকুর তোকে কামড়েছে?

    প্রত্যক্ষে কামড়ায়নি, পরোক্ষে প্রতিনিয়ত কামড়াচ্ছে। রাত্রে আমায় ওর ঘরে ঢুকতে দেয় না। ওর খাটে শুয়ে থাকে।

    তা হলে প্রেমের প্রতিদ্বন্দ্বী বল? চিরন্তন হেসে ওঠে, তা কোর্টে গিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বীর নামটা বলতে পারবি তো?

    রামানুজের কপালের শিরাটা ফুলে ওঠে, রামানুজের চোয়ালটা শক্ত দেখায়। রামানুজ কর্কশ গলায় বলে, সেটা হলে তো আমার পক্ষে মস্ত একটা সুবিধে হত। শুধু ওই পয়েন্টটা নিয়েই কেস জিততে পারতাম। কিন্তু আসলে ভ্যাস্তা! প্রতিদ্বন্দ্বী নয়, প্রতিদ্বন্দ্বিনী! রীতা একটা মেয়ে কুকুর পুষেছে।

    চিরন্তন তার আবাল্যের মুখের দিকে তাকিয়ে দেখে। চিরন্তনের মনে হয় মুখটা তার একেবারে অপরিচিত। চিরন্তনের হঠাৎ মনে হয়, আবাল্য আমি ওর মুখোশটাই দেখে এসেছি, মুখ দেখিনি।

    চিরন্তন গাড়ির দরজায় হাত দেয়, রামানুজ, আমায় নামিয়ে দে—

    কেন, এখানে কী?

    কিছু নয়!

    তবে?

    নেমে যাবার জন্যেই নেমে যাব। বসে থাকতে খারাপ লাগছে।

    কেন? আমার পাশে বসতে ঘৃণা হচ্ছে?

    তুই তো সবই বুঝতে পারছিস দেখছি।

    হু।…কিন্তু চিরো, তুই ভেবে দেখ, তুই রীতাকে নিয়ে ঘর করছিস। এবং তার অথবা তোর জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত ঘর করতে হবে। কী মনে হচ্ছে?

    ওকে পাগল তুমিই করেছ।

    কে কাকে করেছে, অত চট করে রায় দেওয়া যায় না হে! তুই তো কবিতাটবিতা লিখতিস, বল বাইরে থেকে যা দেখা যায়, সেটাই কি সব সময় ঠিক?

    অবশ্যই নয়। যেমন তুমি। চিরন্তন ক্রুদ্ধ স্বরে বলে, বাইরে থেকে তো তোমায় একটি আদর্শচরিত্র পত্নীবৎসল স্বামী বলে মনে হয়।

    চেষ্টা করেছিলাম, হল না! রামানুজ চড়া গলায় বলে, ওকে বাগ মানানো আমার কর্ম নয়। অসহ্য!

    তবু তো শয়নকক্ষে ঢুকতে না পেরে মরিয়া হয়ে কোর্টে ছুটতে চাইছ।

    নাঃ তা ঠিক নয়। রামানুজের মুখে একটা ক্রুর হাসি ফুটে ওঠে।

    রামানুজ বলে, অনেকদিন ধরে কেস করবার একটা উপযুক্ত কারণ জোগাড় করতে চেষ্টা করছি, সুবিধে করতে পারছি না।

    চিরন্তনের মুখেও একটা কুটিল হাসি ফুটে ওঠে, সেইজন্যেই বুঝি তোমার বন্ধুদের ধরে ধরে বাড়িতে ডেকে নিয়ে যাও, তোমার বউ তার বিরহে উন্মাদিনী বলে?

    ঠিক তাই। কিন্তু কিছুতেই তেমন একটা সিচ্যুয়েশ্যান তৈরি করতে পারছি না। আমার চেষ্টা ধরে ফেলে ঘরে কুকুর রাখছে।

    কিন্তু রীতাকে তুমি ভালবেসে বিয়ে করেছিলে। বাড়ির অমতে, নেহাত বন্ধুদের সাহায্যে

    করেছিলাম তাই। কিন্তু পরে দেখলাম অযথা বড্ড বেশি দাম দেওয়া হয়ে গেছে। ষোলো আনা দিয়ে আমি পচা ডিম কিনেছি।

    চিরন্তন গাড়ির দরজার হ্যাঁন্ডেল ঘোরায়, রামানুজ একটু স্লো কর।

    কী হচ্ছে? রীতার সম্পর্কে মন্তব্যটা অসহ্য হচ্ছে? তার মানে তুই ওকে ভালবাসিস। তা হলে তুইই ওর ভার নে না।

    চিরন্তন গাড়ির দরজা খুলে নেমে পড়ে।

    দেখতে পায় না কী একরকম জ্বলন্ত দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে থাকে রামানুজ তার চলার দিকে।

    দেখতে পায় না, তবু চিরন্তনের এমনিই মনে হয়, ভক্তি, ভালবাসা, বন্ধুত্ব, প্রেম, এই সব শব্দগুলো কি সাময়িক অর্থবাহী?

    .

    আশ্চর্য, ঠিক সেই সময় মনীষাও ওই রকম চিন্তাতেই মগ্ন ছিল।

    স্নেহ, প্রেম, ভক্তি, ভালবাসা, এগুলো কি কেবলমাত্র এক একটা শব্দ?..না কি ওগুলো এক একটা সাময়িক ঘটনা মাত্র? নইলে টুবলু একবারও মনীষার কাছে এসে হাজির হয় না? যে টুবলু তখন একটা রাতও মাকে ছেড়ে থাকতে পারত না।

    টুবলু যদি তেমন করে আবদার করত, তেমন কান্নাকাটি করত, টুবলুর অভিভাবক কি তাকে আটকে রাখতে পারত?

    আর আমি!

    আমিই বা কী? আমিও তোকই তার জন্যে ব্যাকুল হয়ে সেখানে গিয়ে আছড়ে পড়তে পারি নে। আমি আপন হৃদয়ভার আর আপন জেদ নিয়ে বসে আছি।

    আগে অবশ্য ভেবেছিলাম আছড়ে পড়তে যাব কেন? আইনের সাহায্যে ছেলেকে কেড়ে নিয়ে আসব। মাত্র তিন বছর বয়েস টুবলুর, ওর উপরে দাবি তো মায়েরই। ভেবেছিলাম তাই।

    কিন্তু এখন আর সেকথা ভাবি না।

    এখন তো জেনে গেছি, আইন টুলুকে অবৈধ বলে ঘোষণা করবে। জেনে গেছি আমার বিয়েটাই অসিদ্ধ। তবে আর আইন-আদালত করতে যাব কোন মুখে? আমার ওই লজ্জার কাহিনীটা ঢাক পিটিয়ে সকলকে জানাবার জন্যে?

    তা ছাড়া কদিনই বা আমি টুবলুকে আঁচলতলায় রেখে মানুষ করতে পারব? বড় হলেই তো দেখা দেবে নতুন সমস্যা। অসিদ্ধ বিবাহজাত অবৈধ সন্তান সমাজের কোথায় ঠাঁই পাবে?

    বরং ওর বাপের কাছে থাকলে ওর জীবনের সেই ত্রুটিটা চাপা পড়ে যাবে, সমাজে চলে যাবে টুবলু। কিন্তু আমি যদি কেড়ে আনতে যাই, চাপা পড়বে না। টুবলু বড় হয়ে টের পাবে।

    তখন?

    তখন যদি টুলু বলে, আমাকে পৃথিবীতে আনবার কী অধিকার ছিল তোমার?…আমাকে পিতৃপরিচয় থেকে কেড়ে এনে শুধু মাতৃপরিচয় দিয়ে ছেড়ে দেবার কী অধিকার ছিল তোমার?..যদি বলে, আমাকে বাঁচিয়ে রাখবারই বা কী দরকার ছিল তোমার?

    তখন কী উত্তর দেব?

    এখন আমি একা চলে এসেছি, এখন আমার সেই বয়োজ্যষ্ঠ বিজ্ঞ স্বামী শুধু পত্রের ছত্রে ছত্রে মিনতি জানিয়ে আমাকে অনুরোধ করছেন, আমি যেন ফিরে যাই।

    আমি ফিরে না গেলে অবশ্যই ও চিঠি থেমে যাবে, ও মিনতি চুপ হয়ে যাবে।…কিন্তু আমি যদি তাঁর সঙ্গে আইনের লড়াইয়ে নামি, তিনি কি তার শোধ তুলবেন না? তিনি কি প্রতিহিংসা শব্দটার মানে খুঁজে বার করবেন না?

    অতএব চুপ করে আছি।

    ভাবছি টুবলু আইনত অবৈধ হলেও ধৰ্মত তো নয়, তবে থাক সে তার বাপের কাছে।

    ভেবেছি। স্থির হয়ে আছি।

    অস্থির হয়ে ছুটে দেখতে যাইনি।

    তবে মাতৃহৃদয় না কি, শব্দটার অর্থ কী?…আমার তো মনে হয় এ জগতে একমাত্র সত্য অহমিকা, একমাত্র সত্য জেদ।

    অথচ এই জেদ জিনিসটাকে বুদ্ধি দিয়ে বিচার করে পরিমাপ মতো প্রয়োগ করলে জগতের অনেক লাভ হত।

    বলেছিল সেদিন চিরন্তন।

    যেদিন চিরন্তনের কাছে মনীষা তার জীবনের কথা বলেছিল। বলেছিল—

    প্রফেসরের আগের বিয়ের স্ত্রী ছিল।…জলজ্যান্ত আস্ত সুস্থ স্ত্রী। প্রফেসর তাঁকে উপযুক্ত জীবনসঙ্গিনী বলে মনে না করায় গ্রামের বাড়িতে ফেলে রেখে দিয়েছেন। ভদ্রমহিলার দু দুটি মেয়ে আছে। বড়সড় মেয়ে।

    চিরন্তন মৃদু হেসেছিল, আমাদের দেশে এ ঘটনা নতুন নয়, তবে এখন তো আইন বদলেছে। ভদ্রলোক কোন সাহসে? মানে ওঁর সেই পূর্ববিবাহিতা স্ত্রী যদি নালিশ ঠোকেন, জেল পর্যন্ত তো হয়ে যেতে পারে।

    যদি–মনীষা হেসেছিল, উনি ভালই জানেন সেনালিশ ঠোকবার ক্ষমতা তাঁর নেই। নেহাতই দেশের সামান্য জমিজমা ভরসা করে মেয়ে দুটো নিয়ে হাড়ির হালে পড়ে আছেন মহিলা, সহায় নেই, সম্বল নেই, হিতৈষী নেই, কী সাধ্য স্বামীর নামে নালিশ ঠুকতে যাবেন? সে নালিশ ঠুকতে যায় কোন মেয়েরা? যাদের পৃষ্ঠবল আছে। এমন নজিরও তো আছে, বিশ্বস্তচিত্ত স্বামী ভাইদের ফাঁকি দিয়ে, সরকারের ট্যাক্স ফাঁকি দিয়ে যথাসর্বস্ব স্ত্রীর নামে করে দিয়ে বসে আছেন, মহীয়সী মহিলাটি তলে তলে সব করতলগত করে ঠেলে গিয়ে পিত্রালয়ে উঠে স্বামীর নামে নালিশ ঠুকলেন, ওই অত্যাচারী পাষণ্ড স্বামীর ঘর করা থেকে আমায় রেহাই দিন ধর্মাবতার। আর আমার ওই বড় কী বলব সতীন? তা সতীনই! তার মতো হাড়দুঃখী মেয়েরা, তাদের কেবল চোখের জলই সম্বল। এই হতভাগা দেশে এমন প্রতারিত মেয়ে কত হাজার হাজার আছে, তার হিসেব আছে? আইনটা যে কী তাই হয়তো তারা জানে না।…আসল কথা, আইন চিরদিনই সবলের সহায়, দুর্বলের সংহারক।

    চিরন্তনের সঙ্গে অনেক কথা মনীষার।

    চিরন্তন নিষ্ঠাবান শ্রোতা। চিরন্তন বুদ্ধিমান শ্রোতা।

    কিন্তু চিরন্তনের সঙ্গে মনীষার যোগাযোগ হল কেমন করে? সেই এক আশ্চর্য রহস্য।

    কবে যেন সেই এক প্রবলবর্ষণ সন্ধ্যায় চিরন্তন অনেক কষ্টে একখানা ট্যাক্সিকে হাত তুলে দাঁড় করিয়ে দরজা খুল ঢুকছে, হঠাৎ আপাদমস্তক ভেজা ওই মহিলা এসে চেপে ধরলেন দরজা, কোন দিকে যাবেন?

    চিরন্তন অস্বস্তি বোধ করেছিল।

    চিরন্তন শুধু বলেছিল, আপনার ট্যাক্সিটা দরকার?

    সেটা কি প্রশ্নসাপেক্ষ? বলে মনীষা উঠে পড়ে দরজাটা দমাস করে বন্ধ করে দিয়ে বলেছিল, এখন শোনা যাক দুজনের গন্তব্যস্থল একদিকে কিনা।

    চিরন্তনের টেরিলিন প্যান্ট শার্ট দিয়ে জল ঝরে ঝরে নীচে পড়ছিল, আর মনীষার ভেজা শাড়ি সপসপিয়ে সিটটা ভিজিয়ে একত্সা করছিল।

    চিরন্তন ভীরু নয়।

    তবু চিরন্তন এই প্রগৰ্ভতার সান্নিধ্যে রীতিমত প্রমাদ গনল।

    কে এ?

    সেই যে সব চিটিংবাজ মেয়ের গল্প শোনা যায়, তেমনি কেউ নাকি? হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠে বলবে, আমায় জোর করে ধরে নিয়ে যাচ্ছে!

    ট্যাক্সি ড্রাইভার কি আমার স্বপক্ষে সাক্ষ্য দেবে? ও নিশ্চয় ভাববে মহিলার পক্ষ নেওয়াই নিরাপদ, নচেৎ সেও জড়িয়ে পড়বে।

    তা ছাড়া ও হয়তো ভাল করে ব্যাপারটা অনুধাবনই করেনি। পর পর দুটো মানুষকে উঠতে দেখেছে মাত্র। তারা একই দলের কিনা জানবে কী করে? কাঁচ তুলে যাচ্ছে, অত কি টের পেয়েছে?

    উঃ কত ভাগ্যে এই দুর্যোগে ট্যাক্সিটা মিলল, আর কিনা এই ঝামেলা! একেই বলে বাড়া ভাতে ছাই!

    চিরন্তন কি হঠাৎ বলবে, এই যে আমি এইখানে নামব।

    কিন্তু ওকে বললে তো হবে না। ড্রাইভার?

    তাকে তো চিরন্তন বলেছে সার্কুলার রোডে যাব। সে কী বলবে?

    চিরন্তনের এই চিন্তার মধ্যে মনীষাই কথা কয়ে ওঠে, কী ভাবছেন? মেয়ে-পকেটমার? না কি মেয়ে জোচ্চোর? এখনি বলব, ঘড়ি আংটি পার্স যা কিছু আছে চটপট দিয়ে দিন। নচেৎ কে কোথায় আছো বাঁচাও বলে চেঁচিয়ে উঠব?

    বলা বাহুল্য, চিরন্তন এই প্রগলভ সাফাইতে অধিকতর উদ্বিগ্ন হয়। তবু মনে হচ্ছে কণ্ঠস্বরটা যেন মসৃণ ভদ্র, অন্তত কিছুটা কথা চালিয়ে চালিয়ে যদি ভয়টা পার করা যায়।

    তাই চিরন্তন হেসে উঠে বলে, আপনি কি থটরিডিং জানেন? ঠিক এই মুহূর্তে ওই কথাটাই ভাবছিলাম।

    ভাবাই স্বাভাবিক। কারণ একটা পারফেক্ট ভদ্রমহিলার মতো কাজ তো আমি করিনি।

    দুঃসাহসিকার কাজ করেছেন। আমি যে কেমন লোক তা তো জানেন না।

    অজানাতে ঝাঁপিয়ে পড়া ছাড়া উপায় থাকে না এমন অবস্থাও তো আসে মানুষের।

    আচ্ছা এখন তবে ধরে নেওয়া যাক, আমিও গুণ্ডা নই, এবং আপনিও পকেটমার নন। অতএব নিশ্চিন্তে বসা যায়।

    কিন্তু একেবারে যে পকেটমার নই, তা বলা যাবে না।মনীষা হেসে উঠে বলেছিল, দৈব দুর্বিপাকে আমার কাছে একটি পয়সাও নেই। ব্যাগ হারানোর গল্প বড্ড পুরনো, তবু মাঝে মাঝে পুরনো গল্পের কাহিনীও ঘটে। অতএব আমাকে আমার বাসায় পৌঁছে দেওয়া ছাড়া উপায় থাকছে না আপনার।

    কৃতার্থ হয়ে দেব। কিন্তু বাসার রাস্তাটা?

    বেহালা। রায়বাহাদুর রোড।

    বেহালা? তা হলে তো গাড়ি ঘোরাতে হয়। বলতে হয় এতক্ষণে?

    এতক্ষণ তো সন্দেহভঞ্জনেই গেল। আপনি কোথায় যেতেন?

    সার্কুলার রোড।

    যদি বলি বাসায় নেমে ট্যাক্সির ভাড়াটা দিয়ে দেব

    বললে আপনাকে এইখানে নামিয়ে দিয়ে চলে যাব।

    মনীষা হেসে উঠেছিল।

    তারপর বলেছিল, পরে বাড়িতে গিয়ে গিন্নির কাছে গল্প করবেন তো, আচ্ছা এক পাল্লায় পড়া গেছল, অর্থ নষ্ট, সময় নষ্ট।

    ঘরে গিন্নি থাকলে অবশ্যই তাই করতাম।

    সেই পরিচয়। দুর্যোগের সন্ধ্যায়।

    নেই? বাঁচলাম।

    বলে সত্যিই যেন স্বস্তির নিশ্বাস ফেলেছিল মনীষা।

    শুনে একটু চমৎকৃত হয়েছিল চিরন্তন।

    এ আবার কেমনধারা মেয়ে?

    ভদ্র বলে তো ভাবতে চেষ্টা করছি, কিন্তু সত্যি কি তাই? পকেটমারা যাওয়ার গল্প তো করা হয়েই গেছে ইতিমধ্যে। অথচ এই যে পাশে বসেছে, কই তেমন বিজাতীয় কোনও ভাব তো মনে আসছে না?

    কিন্তু পাশেই বা কেন?

    চিরন্তন তো নেমে সামনের সিটে চালকের পাশে গিয়ে বসতে পারত। হয়তো পারত। কিন্তু বৃষ্টি পড়ছে মুষলধারে। এখন ও ধরনের চেষ্টা করাটা প্রায় বদ্ধ পাগলের মতো হবে। তা ছাড়া ড্রাইভারের কথাটাও তো মনে রয়েছে। ভাববে কী?

    অথবা হয়তো বৃষ্টির অসুবিধে না থাকলেও পারত না। কোনও মহিলার পাশের আসনে স্থান পেয়ে হঠাৎ সরে গিয়ে অন্যত্র বসতে চাওয়াটাও হাস্যকর মানসিক ব্যাধিগ্রস্তের মতো লাগত।

    অতএব ওসব কিছুই করা গেল না। যেটা করা গেল, সেটা হচ্ছে কথার পিঠে কথা চালানো।

    তাই মনীষা যখন বলে উঠল, নেই? বাঁচলাম।

    তখন ভিতরে উদ্বেলিত অনেক কিছু সন্দেহ চাপা দিয়ে চিরন্তন বলল, হঠাৎ এতে আপনার বাঁচার প্রশ্নটা উঠল কী করে?

    মনীষা ছোট্ট একটু হেসে বলল, আপনি একটা প্রশ্নের ঝড়ের মুখে পড়বেন না ভেবে।

    চিরন্তনের মনে হল, অত্যন্ত সাধারণ কথা হলেও ভঙ্গির মধ্যে কোথায় যেন একটু সূক্ষ্ম ব্যঞ্জনা রয়েছে।

    কোনও মেয়ে-পকেটমার বা চিটিংবাজের মুখোমুখি হবার সৌভাগ্য আমার হয়নি–ভাবল চিরন্তন, তবু মনে হচ্ছে তারা যেন ঠিক এ রকম হয় না।

    চিরন্তনও তাই মৃদু হেসে বলল, ওই ঝড়টার ডিউটি বোধহয় কেবলমাত্র একতরফা?

    মনীষা এক মুহূর্ত চুপ করে থাকল। বোধ করি প্রশ্নটা বুঝে নিতে ওই সময়টুকু লাগল। তারপর বেশ খোলা গলায় হেসে উঠে বলল, অন্তত আমার ক্ষেত্রে তাই। বাড়ি গিয়ে তালা খুলে ঢুকতে হবে।

    আহাহা! চিরন্তন বলে উঠেছিল, কী মনোরম অবস্থা! শুনে লোভ হচ্ছে।

    মনীষা আর হাসল না। বলল, আচ্ছা কই জিজ্ঞেস করলেন না তো–সে কী, এমন অবস্থা কেন? একা মহিলা থাকেন মানে?

    জিজ্ঞেস করব? কেন জিজ্ঞেস করতে যাব, কেন?

    সকলেই তো করে।

    আমি তা হলে ঠিক আর সকলের মতো নই।

    বন্ধু হিসেবে এমন ব্যক্তি লোভনীয়।

    উভয়পক্ষেই হতে পারে সেটা।

    এমনি কথার পিঠে কথা।

    তারপর আরও কত কথা! অর্থহীন, অবান্তর।

    অবশেষে আর এক বিপদ।

    মনীষার বাসার কাছাকাছি গলিতে প্রবল জল, ট্যাক্সি-ড্রাইভার গাড়ি থামিয়ে তুমুল বচসা শুরু করে দেয়, আর গেলে তার গাড়ি জখম হয়ে যাবে।

    চিরন্তনেরও জবরদস্তি–যেতেই হবে।

    মনীষা বলে, ছেড়ে দিন, আমি এটুকু হেঁটেই পার হই, শাড়ি তো ভিজেইছে।

    কিন্তু চিরন্তন আপসে অরাজি।

    ও বলে, ঠিক আছে, না যাক, কে ওর গাড়ি ছাড়ে দেখি। আসুন বসে থাকি শেকড় গেড়ে।

    সে কী?

    তবে আবার কী! ওর গাড়ির নম্বর নিয়ে বসে থাকি চুপচাপ, দেখি কেমন দুদুটো মানুষকে ও জোর করে নামায়।

    মনীষা গলা নামিয়ে বলে, দেখুন, ওদের হাতে ছোরাটোরা থাকে—

    আমার হাতেই যে নেই, তাই বা ও জানবে কী করে? আজকাল তো স্কুলের ছেলের হাতেও গুপ্তি থাকে। আসলে অত ভয় করতে নেই। থাকুন না চুপ করে বসে। ও কত চেঁচায় দেখুন।

    শেষ পর্যন্ত কিন্তু চিরন্তনেরই জিত হয়েছিল।

    ড্রাইভারটা চেঁচামেচি থামিয়ে একসময় বলেছিল, বেশ, তবে বাবু আলাদা দুটো টাকা দিন, গাড়ি ড্যামেজের ক্ষতিপূরণ। এবং চিরন্তন যখন তাতেও বলেছিল, বেশ তো আমি তো তোমার গাড়িতেই ফিরছি–কোনও গ্যারেজে নিয়ে গিয়ে দেখাও। খারাপ হলে দেব টাকা।তখন অবশেষে বর্ষার দিনে চা খাওয়ানোর রফা।

    মনীষা নিজের এই পল্লীকুটিরের দরজায় দাঁড়িয়ে হতাশ গলায় বলেছিল, ড্রাইভারটা আপনাকে একা পেয়ে রাগ মেটাতে খুন করে পথের ধারে ফেলে দিয়ে চলে যাবে কিনা জানতেও পারব না।

    পর পর কদিন বাংলা কাগজের ঘটনা ও দুর্ঘটনার কলামটা পড়বেন। টের পেতে পারেন।

    তাতেই কি নিশ্চিন্ত হওয়া যাবে? সব দুর্ঘটনার খবরই কি ছাপা হয়?

    তা হয় না বটে চিরন্তন একটু হেসে বলেছিল, যেমন আমাদের আজকের এই পরিচয়টা?

    আপনার হিসেবে দুর্ঘটনা?

    কে বলতে পারে? চিরন্তন হেসে উঠে বলেছিল, কে বলতে পারে এই সূত্রেই আমার সর্বনাশ ঘটে যেতে পারে কি না।

    অদ্ভুত কথাবার্তা আপনার-মনীষা বলেছিল, কিন্তু যে দুর্ঘটনার খবর ছাপা হয়, তা থেকেও আমি আপনাকে শনাক্ত করতে পারব না। কারণ আপনার এই ভিজে কাক চেহারাটাই দেখছি–আসল চেহারা যে কী—

    তবু ভাল যে, ভিজে বেড়াল বলেননি। হেসে উঠেছিল চিরন্তন, ঠিক আছে। যদি নিহত না হই, তা হলে একদিন এসে আপনাকে আশ্বস্ত করে যাব।

    মনীষা নমস্কার করে বলেছিল, সেই দিনটা যত তাড়াতাড়ি হয় জানেন তো উদ্বেগের মুহূর্ত প্রহরের শামিল।

    গাড়িতে ফিরে যেতে যেতে কিন্তু পাঁইজির সঙ্গে রীতিমত দোস্তি হয়ে গেল চিরন্তনের। তাকে ভাল রেস্টুরেন্টে নামিয়ে চা খাওয়াল, বাড়ি ফিরে ভাল বকশিস দিল।

    মনীষার সঙ্গে পরিচয়ের ইতিহাস এই।

    চিরন্তন সেদিন ভেবেছিল, আমার কথাবার্তা তোমার অদ্ভুত লেগেছে, কিন্তু তোমার কথাবার্তার ধরনও কম অদ্ভুত নয়। সচরাচর যাদের দেখি আমি, তাদের কারও সঙ্গে মেলে না।

    কে জানে কোন পরিস্থিতিতে কে কেমন হয়ে ওঠে।

    .

    পরিস্থিতি!

    পরিস্থিতিই মানুষকে ভাঙে গড়ে।

    দীর্ঘস্থায়ী পরিস্থিতি। মুহূর্তের পরিস্থিতি। এক এক রকম কাজ দুজনের।

    যে মানুষ শান্ত বলে আখ্যাত, সে হঠাৎ রাগের মুহূর্তে বাড়ি থেকে চলে গিয়ে নিরুদ্দেশ হয়ে যেতে পারে, যে মেয়ে লক্ষ্মী বউ বলে বিখ্যাত, সে ক্ষণকালের উত্তেজনায় আত্মহত্যা করতে পারে।

    কে জানে-সেই একদিন যদি মনীষার বড় সতীন গ্রামের বাড়ি থেকে তার দু দুটো মেয়ে নিয়ে তার প্রফেসর স্বামীর বাড়িতে আছড়ে এসে না পড়ত, মনীষার জীবন কোন খাতে বইত।

    হয়তো মনীষা লোকমুখে শুনত তার মার্জিতরুচি সভ্য শিক্ষিত শহুরে স্বামীর বাল্যবিবাহের কুফল একটি অমার্জিত অশিক্ষিত গাঁইয়া বউ গ্রামে বসে আছে ধান চাল বাগান পুকুর নিয়ে, মনীষা তার স্বামীর প্রতিই সহানুভূতিশীল হত। হয়তো ভাবতবুদ্ধি বিবেচনা জন্মাবার আগেই ধরে বিয়ে দিয়ে দেওয়া, এর থেকে অসংস্কৃতি আর কী আছে? হয়তো ওর থেকে বিশ বছরের বড় লোকটাকে ভালও বাসতে পারত ক্রমশ।

    কিন্তু গ্রহনক্ষত্র প্রতিকূল ছিল।

    অধ্যাপকের অনুপস্থিতিতে মনীষার কাছে আছড়ে এসে পড়েছিল মনীষার বড় সতীন চোদ্দো ষোলো বছরের দুটো মেয়ে নিয়ে।

    ওদের দেখে চাষার ঘরের মতো লেগেছিল মনীষার, আর অভিযোগটা শুনে ভেবেছিল ভুল বাড়িতে এসে ঢুকেছে।…বলেছিল, আচ্ছা আপনি একটু বসে থাকুন, আমার স্বামী বাড়ি এলেই বুঝতে পারবেন আপনি ভুল করছেন।

    যদিও আপনি বলাটাই বাহুল্য মনে হয়েছিল তার।

    কিন্তু ইংরেজির অধ্যাপক অমরেশ ঘোষাল যখন এলেন?

    টলমলিয়ে উঠল পৃথিবী, দুলে উঠল আকাশ। মনীষার মনে হল পৃথিবীতে এর চাইতে ভয়ানক অনিয়ম বুঝি আর কখনও ঘটেনি।

    অথচ এমন ঘটনা আকছার ঘটে, ঘটছে, ঘটবে।

    যুগ-যুগান্ত পরেও হয়তো পরিত্যক্তা নারী ওই অমরেশ ঘোষালের স্ত্রীর মতোই কাঁদবে, গালি দেবে, অভিশাপ বর্ষণ করবে, আর চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বলবে, ধর্ম নেই তোমার? বিবেক নেই? আমাকে না দেখো, নিজের সন্তান দুটোর মুখ চাও।

    তারপর উদঘাটিত করবে কী দুর্দশায় দিন কাটছে তার। বলবে, আর তুমি? তুমি এখন নতুন করে একটা মেয়ের যুগ্যি ঘুড়ি বিয়ে করে সুখ করছ। এ ঘটনা চিরন্তন।

    তবু মনীষার মনে হয়েছিল এর বাড়া অনিয়ম আর হয় না।

    আর যখন অমরেশ ঘোষাল তাদের মুখের উপর এক গোছা নোট ছুঁড়ে দিয়ে দূর দূর করে তাড়িয়ে দিয়েছিল, এবং সেই অকালবৃদ্ধা অর্ধবয়েসী মহিলাটি কাঁদতে কাঁদতে সেই টাকা কুড়িয়ে নিয়ে বলেছিল, তোমার মতন চামারের টাকা কড়ে আঙুলেও ছোঁবার কথা নয়, তবু নিতে হচ্ছে আমায়। ভগবান এর বিচার করবে।

    তখনই মনীষা স্থির করে ফেলেছিল, আর এখানে নয়।

    মনীষার মনে হয়েছিল, ওদের ওই হতশ্রী মূর্তির জন্যে দায়ী ওরা নয়। মনে হয়েছিল এই সুন্দর সাজানো গোছানো বাড়িটার আসল অধিকারিণী ওরাই।

    ওরা ভিখিরির মতো দূরীভূত হয়ে যাবে, আর সেই অধিকারের আসনে মনীষা বসে রাজ্যপাট করবে?

    ছি ছি!

    মনীষা অমরেশ ঘোষালকে প্রশ্ন করেছিল, বিবাহিতা স্ত্রী জীবিত থাকতে, তার অজান্তে আবার বিয়ে করার আইন আছে কিনা?

    মনীষা প্রশ্ন করেছিল, কোন বিয়েটা অসিদ্ধ হয়? আগেরটা না পরেরটা?

    মনীষা প্রশ্ন করেছিল, অসিদ্ধ বিয়ের ফল যে শিশু তাকে কি বৈধ শিশু বলা চলে?

    মনীষা তার মহাপণ্ডিত স্বামীর কাছ থেকে তার প্রশ্নের সদুত্তর আদায় করতে পারেনি।

    মনীষা তারপর চলে এসেছিল।

    মনীষা টুবলুকে নিতে যাচ্ছিল, অমরেশ ঘোষাল কেড়ে রেখেছিলেন। বলেছিলেন, ওকে কোথায় নিয়ে যাবে শুনি?…ও এখানে থাকবে।

    হয়তো প্রফেসর ভেবেছিলেন, কান টানলেই মাথা আসার থিয়োরিটা এখানে কাজে লাগবে।

    এ রোষ রবে না চিরদিন!

    ছেলেকে আটকালে মনীষা না এসে যাবে কোথায়?

    আর ভেবেছিলেন—

    গ্রাম্য সেই স্ত্রীলোকটা, যে নাকি নিতান্তই অমরেশের মার সইয়ের মেয়ে এই দাবিতে নাবালক অমরেশের গলায় মালা দিয়ে তার জীবনটা ক্লেদাক্ত করে রেখেছে, তাকে কিছু টাকা খাইয়ে একটা লেখাপড়া করিয়ে নেবেন, যেন সে স্বেচ্ছায় অনুমতি দিয়েছে অমরেশকে দ্বিতীয়বার বিয়েতে।

    ওই কালো কুশ্রী মেয়ে দুটো অমরেশের?

    ছিঃ!

    ওই আধবুড়ো চাষানীর মতো মেয়েমানুষটা অমরেশের স্ত্রী?

    ছিঃ!

    কিন্তু তখন আর অমরেশের ওই আক্ষেপ কাজে লাগেনি। সহানুভূতির সৃষ্টি করতে পারেননি তিনি মনীষার।

    মনীষা বলেছিল, ওদের এই অবস্থার জন্যে তুমিই দায়ী। তুমি ওদের যথার্থ অবস্থায় রাখলে, যথার্থ মূর্তিতেই পেতে।

    মনীষা ছেলে নিয়ে লড়ালড়ি করেনি। মনীষা চলে এসেছিল।

    মনীষা অনেক জায়গা ঘুরে এইখানে এসে স্থিতি হয়েছিল।

    কিন্তু মনীষার ভবিষ্যৎ কী?

    শুধু এই নিতান্ত অকিঞ্চিৎকর প্রাথমিক স্কুলটাই মনীষার ভবিষ্যৎ?

    মনীষার জীবনে আর রং আসবে না? স্বাদ আসবে না? আলো আসবে না?

    মনীষা আস্তে আস্তে বুড়িয়ে যাবে, খিটখিটে হয়ে যাবে, আর বিনিদ্র রাত্রে শুয়ে শুয়ে অনুমান করবে টুবলু এতদিনে কত বড় হল!

    অনেকদিন পরে তাদের পুরনো ক্লাব কিশোর সংঘে এসে বসল চিরন্তন। যখন কিশোর বয়স ছিল, মহোৎসাহে সর্বজনীন বাণী অর্চনা করত চিরন্তন পাণ্ডা হয়ে। বড় হয়ে পর্যন্ত ওই পুজোর দিন কোনও এক সময় ঢু মেরে যায়, এই অবধি।

    ক্লাবটার নাম একই আছে, কিন্তু দৃশ্যের পরিবর্তন ঘটেছে, এসেছে নতুন মুখ, নতুন কৈশোর।

    কিন্তু অপরিবর্তিত আছেন একটি মানুষ। তিনি হচ্ছেন, কিশোর সংঘের সঙঘাধিপতি চিরকিশোর ননীদা।

    ননীদা ননীলাল কি ননীগোপাল, ননীমাধব বা ননীচোরা, এটা সঠিক জানা নেই কারও। ননীদার পদবিও সবাই ভুলে মেরে দিয়েছে। ননীদা শুধু আদি ও অকৃত্রিম ননীদা হয়ে বিরাজ করছেন।

    পাকা বেলের মতো মাথা, টাইট তরমুজের মতো ভুড়ি, আর গাওয়া ঘিয়ের মতো রং! ননীদার প্রকৃতির মতো আকৃতিরও বদল নেই।

    ননীদা চিরন্তনকে দেখে হইচই করে বলে উঠলেন, আরে আরে ডুমুরের ফুল যে! কী ব্যাপার! খবর কী?

    চিরন্তন চৌকির একপাশে বসে পড়ে বলে, আর খবর! আপনারা তো নেবেন না খবরটবর।

    আমরা নেব তোর খবর? কেন কিশোর সংঘ তোর নয়?

    আর কি কিশোর আছি ননীদা? বার্ধক্য এসে গেল।

    আমি কিশোর আছি, কেমন?

    আরে আপনি তো চিরকিশোর! নওল কিশোর!

    তা বেশ! তা হঠাৎ মনে পড়ল যে?

    এমনি।

    ভাল! ভালই হয়েছে। বসে যা, রিহার্সাল দেখে যা।

    রিহার্সাল! সেটা আবার এ সময়ে কীসের?

    এ হে হে!

    ননীদা হতাশায় ভেঙে পড়েন, তুই কিছুই জানিস না? আমাদের নবনাটিকা নাট্যসংঘ থেকে তো রেগুলার নাটক হচ্ছে। কতবার মুক্তাঙ্গনে হয়ে গেল। সেবার একাঙ্কিকা নাট্য প্রতিযোগিতায় আমাদের নাটক প্রাইজ পেল।

    তা আমি তো কিছুই জানি না।

    জানবে কোথা থেকে দাদু-ননীদা খোলা গলায় বলেন, তুই আর আসিস? ছেলেগুলো বলে, রাস্তায় দেখলে নাকি চিনতে পারিস না। ওরা বলে তোর ডটি হয়েছে।

    আপনিও তাই বলেন নাকি?

    পাগল! ননীদা ওর ঘাড়ে একটি বিপুল রদ্দা মেরে বলেন, আমি তো ওদের বোঝাই–ওসব তোদের ভুল ধারণা। মানুষ কত কারণে রাস্তায় চেনা লোক দেখেও চিনতে পারে না। হয়তো পারিবারিক কোনও ব্যাপারে অন্যমনস্ক আছে, হয়তো গভীর ভাবে কিছু ভাবতে ভাবতে চলেছে, হয়তো চোখে রোদ পড়েছে। হয়তো ব্যস্ত হয়ে কিছু কাজে যাচ্ছে। এইসব ভেবে মানুষকে বিচার করবি।…তা ভায়া কে শুনবে কথা? বলেনাঃ আমরা কার্ড দিতে যাব না।…এখনকার ছেলেপিলেকে তো জানিস? গুরুলঘু জ্ঞান নেই, যা প্রাণ চায় তাই! এমন সব নাটক নামাতে চাইবে তার ডায়ালগ শুনলে মাথা খারাপ হয়ে যাবে। বলে আর্ট। আমি তো বলি, তোদের মুণ্ডু! এইসব ডায়ালগ উচ্চারণ করবি কী করে?নাটক দেখতে তোদের বাড়ির লোকেরা আসবেনা? মা বাপ?…তা ওই সব বলে-টলে নিবৃত্ত করা আর কি! ছেলেপুলেগুলোর হয়েছে কী জানিস? সময়ে তোবে-থা হবার আশা নেই, তাই আর কি নাটক নভেলে যেটুকু জোটে

    হা হা করে হেসে ওঠেন ননীদা।

    নির্মল উদাত্ত হাসি।

    তা আপনার তো সারা জীবনেও বিয়ে জুটল না ননীদা!

    আহা সে তো তামাদি কথা! ননীদা বলেন, মহাত্মা গান্ধী বলল নন-কো-অপারেশন…প্রথমেই লেখাপড়ার সঙ্গে করে ফেললাম সেটা।…বলল, ব্রহ্মচর্য দরকার। ভেবে দেখলাম বে-থা করে তারপর ওই তোর গিয়ে ব্রহ্মচর্যর গাড্ডায় পড়তে গিয়ে শ্যামকুল দুই যায় কেন বাবা! তার চেয়ে মেয়েমানুষ জাতটার সঙ্গেই নন-কো-অপারেশন করে ফেলা যাক।…তাপর তো জানিস, আইন অমান্য করছি, জেলে যাচ্ছি, চট পরছি, আর ভাবছি, কী কাজই করছি! শেষে দেখি–দুর, সবই ফকিবাজি। তার চেয়ে এ আছি ভাল।..কিশোর ক্লাব আর আমাদের নবনাটিকা নাট্যসংঘ নিয়ে বেশ আছি।

    বেশ থাকতে জানলে বেশ থাকা আটকায় কে? কী বলেন ননীদা?

    ননীদা একগাল হেসে বলেন, তা যা বলেছিস। সবই মনের খেলা দাদা।

    এখনও সেই আপনার পিসিমা আর আপনি?

    ননীদা আবার হা হা করে হেসে ওঠেন, আরে ভুলে তো মেরে দিয়েছিলি আমাদের। অথচ পিসিকে মনে আছে?

    বাঃ মনে থাকবে না? আপনার বাড়িতে গিয়ে কত খেয়েছি আপনার পিসিমার হাতে। আছেন তো? না স্বর্গে গেছেন?

    ননীদা বলেন, কই আর যেতে পাচ্ছে বুড়ি। রাতদিন কেবল যাব যাব বায়না। আমি বলি, আরে বাবা, আর সাতটা বছর কষ্ট করে থেকে যাও, শতবার্ষিকীটা সেরে দিয়ে তোমায় চিতায় তুলে দিয়ে আসি, তা কে শোনে কার কথা? কেবল মরণ ডাকছে।

    তা রান্নাটান্না? চিরন্তনের ননীদার বাড়িটা মনে পড়ে, দ্বিতীয় ব্যক্তিহীন সেই বাড়ি! চিরন্তন বলে, উনি কি এখনও

    আরে দূর পাগল!ননীদা হেসে ওঠেন, সাত গেলেই একশো হবে বললাম না? রান্না এখন আমিই করি। বুড়ি কেঁদে মরে। তা আমি বলি, আমাকে তুমি ষাট বছর ধরে বেঁধে খাইয়েছ, তোমায় নয় দুচার বছর খাওয়ালামই!..ভীষণ অবুঝ হয়েছে। কেবল কান্না। তা যাক, রিহার্সাল দেখিস তো চল।

    হচ্ছে কোথায়?

    শ্যামলদের বাড়ি। ওদের তো দেদার ঘর পড়ে আছে।

    নাটকটা কী?

    ওই যে বললাম, আধুনিক নাটক। নচেৎ তো ছোঁড়াদের পছন্দ নয়। তা তোকে বলব কি সত্যি, ওদের নাটক দেখে দেখে আর এখন ওই নবরস ঢালা পঞ্চমাঙ্ক নাটক ভাল লাগে না। বোকা বোকা আর সেকেলে লাগে। সবই অভ্যেসের ব্যাপার! চোখের নামই মহাশয়, বুঝলি? তাতে যা সওয়াবে তাই সয়। এই দেখ না, প্রথম যখন আমাদের পুজোয় সেকেলে ঠাকুর ছেড়ে আর্টের ঠাকুর করল, কী অসহ্যই লাগল। মনে হল গেল ধর্ম, গেল শাস্ত্র, গেল দেবীমাহাত্ম্য! ছেলেরা কিন্তু দমল না, চালিয়েই যেতে লাগল, ব্যস সেটাই ভাল লাগছে। এখন বরং সেই চিরাচরিত মূর্তিটিই সেকেলে লাগে। চোখে সয় না। চল, কেবল তোকে বকাচ্ছি।…নাটকের নাম? নাম শুনলে তাজ্জব হবি–অসংখ্য বৃষ্টির ফোঁটা! শুনেছিস এমন অনাসৃষ্টি নাম? তা যাকগে–দেখবেও তো ওই অনাসৃষ্টিরা।

    ননীদা আবার হাসতে থাকেন।

    রিহার্সাল দেখা হয় না।

    তখনও নাট্যপরিচালক এসে পৌঁছননি।

    ছেলেরা আস্ফালন করে বেড়াচ্ছে, আর পয়সা খরচ করে নিয়ে আসা হাফ পেশাদার দুটো মেয়ে নিশ্চিন্ত মনে কোকা-কোলা খাচ্ছে।

    তাদের কী?

    তারা তো যাতায়াতের গাড়িভাড়া পেয়েই গেছে।

    উপরন্তু লাভ কোকা-কোলা।

    রিহার্সাল দেখা হয় না, গল্প হয়। শ্যামল বলে, আপনিও তো ননীদার মতো বিয়েটিয়ে করছেন না চিরন্তনদা! চলে আসুন না আমাদের নবনাটিকা সমিতিতে! আপনি লিখতে-টিখতে পারেন, নাটক লিখে দেবেন। এখানে বসে লিখবেন, কে কোন পার্টটা করবে সেই বুঝে ক্যারেক্টার বানাবেন, তা হলে আর গোলমাল বাধবে না।

    চিরন্তন হাসে মনে মনে।

    আবার ভাবে, এতে আর হাসছি কেন? এরা তো অর্বাচীন! বিজ্ঞ বিচক্ষণ শিক্ষিত লোকেও তো সত্যিকার লেখককে এমন কথা বলে থাকে। বলে, আমি বলে দিচ্ছি আপনি লিখুন। অভিনেতা বুঝে ক্যারেক্টার বানান।

    চাঁদাটাঁদা বুঝলেন সামান্যই। নেহাত খাতায় নামটা রাখবার জন্যে বুঝলেন চিরন্তনদা! খরচা সবই ননীদার। ননীদা বলে, আমার টাকা নিয়ে আমি আমার কোন স্বর্গে বাতি দেব রে? এই সংঘই আমার স্ত্রী পুত্র পরিবার। কিশোর সংঘের নিয়ম তো কুড়ি বছর পর্যন্ত? আর এই নবনাটকে হচ্ছে কুড়ি থেকে। ওখান থেকে এখানে। এর আর ওদিকে বয়েসের বিচার নেই। চলে আসুন চিরন্তনদা!

    চিরন্তন এদের সকলের উৎসাহদীপ্ত মুখের দিকে তাকায়। মনে হচ্ছে এর মধ্যেই এদের জীবনের সব সার্থকতা নিহিত।

    এরা তা হলে সুখী?

    অন্তত এদের নাটকটা উতরোলেই সুখী! কোনও নাটক না উতরোলে হয়তো সাময়িক হতাশা, আবার নব উৎসাহে নবনাটকের সন্ধান।

    চিরন্তন কেন এদের মতো হতে পারে না?

    চিরন্তন কেন কেবল দর্শকের ভূমিকায় থাকে? চিরন্তন কেন এই জীবননাট্যের কোনও ভূমিকার মধ্যে ঢুকে পড়তে পারে না?

    চিরন্তনের কেন সব কিছুই জোলো আর অর্থহীন মনে হয়?

    এই যে নাটকটা–অসংখ্য বৃষ্টির ফোঁটা, এটা হচ্ছে একটা নতুন আইডিয়ার নাটক–শ্যামল বলে, জেমস জয়েসের একটা গল্প থেকে ভাব নেওয়া, অবশ্য জাস্ট একটা আইডিয়া নেওয়া! একজন আধুনিক লেখক লিখেছেন। খুব উচ্চাঙ্গের চিন্তা বুঝলেন? দেখতে আসতে হবে।

    চিরন্তন এতদিন আসেনি, তবু শ্যামলের আগ্রহের অভাব নেই চিরন্তন সম্পর্কে। অথচ চিরন্তন জানে এদের সঙ্গে মিলতে আসা তার পক্ষে সম্ভব নয়। যতই এরা উচ্চাঙ্গের চিন্তায় বিভোর হোক, ওই বিভোর হবার ক্ষমতাটাই নেই চিরন্তনের।

    চিরন্তনকে বোধহয় চিরদিনই জীবননাট্যের দর্শকের ভূমিকাতেই কাটাতে হবে।

    তবু চিরন্তন এদের আগ্রহের ছবিটায় জল ঢেলে দিতে পারল না। বলল, আচ্ছা আচ্ছা, চেষ্টা করব।

    ননীদা বললেন, চেষ্টা নয় হে ভায়া, নিশ্চয়।…চিরন্তন আসামাত্রই ছেলেদের বিরূপতা অন্তর্হিত হয়েছে। তাই ছেলেরাও ততোধিক উৎসাহে বলল, হ্যাঁ, হ্যাঁ নিশ্চয়! এদের কণ্ঠে আন্তরিকতা, এদের কণ্ঠে অন্তরঙ্গতা।

    আচ্ছা, চিরন্তন কেন কিছুতেই এই অন্তরঙ্গতার সুরে সুর মেলাতে পারে না? অথচ চিরন্তন মানুষ ভালবাসে। নিঃসঙ্গ চিন্তায় ঘণ্টা কাটানোর কথা ভাবতে ভয় করে তার।

    বহু সঙ্গের মধ্যে যে নিঃসঙ্গতা, চিরন্তনের মনের খোরাক হয়তো সেইটাই।

    চিরন্তন তাই আবার গিয়ে সেই করোগেটের টিনে দম-আটকানো সিঁড়িটা ধরে ধরে ওঠে। চিরন্তন ভাবে, আজ আমি চিত্তর বউয়ের নাম জেনে নেব। ওদের বনেদি বাড়িতে বউকে নাম ধরে ডাকার রেওয়াজ নেই, তাই চিত্তর বউ এখনও চিরন্তনের কাছে অনামী।

    কিন্তু সেই ছেলেমেয়ে দুটোর কী হল?

    চিরন্তনের অবিমৃষ্যকারিতায় যারা আগুনের মুখে এসে পড়ল?

    তা তাদের কথা বলতে হলে তো সেদিনের সেখান থেকেই শুরু করতে হয়। যেখানে সুপ্রভা তাঁর মেয়ের উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন।

    সুপ্রভা তাঁর একুশ বছরের মেয়ের চুলের বেণী ধরে মাথাটা নাড়া দিতে দিতে বলেছিলেন, ভেবেছ। কী তুমি? ভেবেছ কী? সাহেব বাড়ি পেয়েছ? মেম হয়েছ? বলি ওর সঙ্গে তোর এত কী? আমাকে না বলে সিনেমা যাবে তুমি ওর সঙ্গে?

    শাশ্বতী নিজের স্বপক্ষে একটা কথা বলেনি। শুধু তার চোয়ালটা শক্ত হয়ে গিয়েছিল, তার গলার শিরটা ফুলে উঠেছিল। শুধু বলেছিল, ছেড়ে দাও।শাশ্বতী অপেক্ষা করছিল ধ্রুবর আসবার প্রতীক্ষায়। শাশ্বতী এখন বুঝতে পারছে দুজনে একসঙ্গে না ঢুকে ভুল করেছে সে।

    দুজন মানেই তো শক্তি।

    দুজন মানেই তো সাহস।

    সুপ্রভা শাসন করছেন, সুপ্রভার বড় ছেলে ঘরের মধ্যে পায়চারি করছে। হয়তো ভাবছে, আমিও কি গিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ব? না কি ভাবছে, এ যুগে কি একুশ বছরের মেয়ের উপর এ রকম শাসন চালানো যায়?

    এই নাটকের মাঝখানে ধ্রুব এসে দাঁড়াল।

    এক মুহূর্ত স্তব্ধ হয়ে রইল।

    এমন ভয়ানক দৃশ্যের আশা নিশ্চয়ই করেনি সে। মুহূর্ত পরে এগিয়ে এল সে, দৃঢ় স্বরে বলল, মামিমা, এটা কী হচ্ছে?

    সুপ্রভা মেয়েকে রেখে ঘুরে দাঁড়ান।

    তীব্র স্বরে বলেন, এই যে তুমি এসেছ! বলি তোমার এত সাহস কী করে হয় বাছা যে, আমাকে একবার জিজ্ঞেস মাত্র না করে আমার মেয়েকে নিয়ে বেরিয়ে যাও?

    ধ্রুব শাশ্বতীর দিকে তাকিয়ে আরও দৃঢ় গলায় বলে, শাশ্বতী, তুই ওপরে যা।

    শাশ্বতী! তুই!

    সুপ্রভা যেন হঠাৎ থতমত খান।

    সুপ্রভার যেন মনে পড়ে যায় ওই ছেলেটা এ বাড়িতে আগন্তুক নয়। সুপ্রভার হঠাৎ নিজেকে ভারী নীচ মনে হয়। সুপ্রভা চুপ করে যান।

    ধ্রুব এবার সুপ্রভাকেই বলে, আপনার মেয়েকে কি খুব বাচ্চা বলে মনে করেন মামিমা? নিজের ইচ্ছেয় একটু বেড়াতে যাবার বয়েস ওর হয়নি?

    সুপ্রভা থতমত গলাতেই বলেন, না বলে যাবে কেন?

    গেলই বা। আপনি ঘুমোচ্ছিলেন–

    শাশ্বতী চলে গিয়েছিল, কিন্তু দূরে যায়নি। অদূরে সিঁড়ির রেলিঙে পিঠ ঠেকিয়ে গুম হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। শাশ্বতী দেখতে পেল, যে ধ্রুব কোনওদিন মুখ তুলে কথা বলে না মার সঙ্গে, সে তাঁর চোখে চোখ রেখে স্পষ্ট গলায় কথা বলছে।

    পুরুষমানুষ কি তা হলে এই রকমই হয়?

    প্রয়োজনের ক্ষেত্রে সাহস খুঁজে পায়, দৃঢ়তা খুঁজে পায়?

    আশ্চর্য! মার মুখের উপর নিজেই তো শাশ্বতী এ কথা বলতে পারত। কিন্তু সে খালি হাঁপাল, আর ফুসল। অথচ ধ্রুব

    হ্যাঁ, ধ্রুব বলছে, এত ভাবনারই বা কী আছে? বুঝতেই তো পেরেছিলেন, আমার সঙ্গে গেছে।

    তা তোমার সঙ্গেই বা যাবে কেন? এবার সুপ্রভা আবার গলায় জোর পান, তুমি আছ আছ, ছেলেবেলায় খেলেছ বেশ করেছ, এখন ও বড় হয়েছে বিয়ের বয়েস হয়েছে উত্তেজিত সুপ্রভা কথাটা শেষ করতে পারেন না।

    ধ্রুবর কণ্ঠস্বর কিন্তু অনুত্তেজিত, যাক সেটা আপনার মনে পড়েছে তা হলে? মনেই যখন পড়েছে, বলে রাখি আপনাকে, আমিই ওকে বিয়ে করব।

    বিয়ে করবে? তুমি ওকে বিয়ে করবে?সুপ্রভা যেন ফেটে পড়েন, এই কথা মুখ দিয়ে বার করতে পারলি তুই? তোরা না এতটুকু বয়েস থেকে ভাইবোনের মতো মানুষ হয়েছিস!

    ধিক্কারে যেন নিজেই বিগলিত হন সুপ্রভা।

    ধ্রুব কিন্তু হেসে ওঠে। বলে, সেটাই বা মনে রাখলেন কই?

    তারপর বলে, তাতে কী? মানুষই হয়েছি, সত্যি ভাইবোন তো নয়। কত সমাজে সম্পর্কিত ভাইবোনের মধ্যেও বিয়ে হয়।

    ধ্রুব! ছি ছি! এই পাপ ভিতরে পুষে তুই আমার বাড়িতে বসে আছিস? বলি তোর সঙ্গে মেয়ের বিয়ে দিলে লোকে আমাকে বলবে কী?

    আপনি বিয়ে দেবেন কেন? আমরাই করব। আপনার সেই লোকদের তাই বলবেন। বলবেন, ওরা নিজেরা বিয়ে করেছে। এমন ঘটনা পৃথিবীতে ঘটে না তা নয়।

    ধ্রুব নিজের ঘরে ঢুকে যায়।

    আর শাশ্বতী ধ্রুবর ওই অনুত্তেজিত স্থির মুখের দিকে বিহ্বল দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে।

    .

    ⤶ ⤷
    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26 27 28 29 30 31
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleপ্রথম প্রতিশ্রুতি – আশাপূর্ণা দেবী
    Next Article রাতের পাখি – আশাপূর্ণা দেবী

    Related Articles

    হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    ভয় সমগ্র – হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    December 9, 2025
    হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    কিশোর অ্যাডভেঞ্চার সমগ্র – হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    December 9, 2025
    সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    প্রকাশ্য দিবালোকে – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    November 18, 2025
    সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    তারপর কী হল – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    November 17, 2025
    মাইকেল মধুসূদন দত্ত

    শর্ম্মিষ্ঠা নাটক – মাইকেল মধুসূদন দত্ত

    November 11, 2025
    সত্যজিৎ রায়

    মানপত্র সত্যজিৎ রায় | Maanpotro Satyajit Ray

    October 12, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Generic selectors
    Exact matches only
    Search in title
    Search in content
    Post Type Selectors
    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Our Picks

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }