Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • English Books
      • Jules Verne
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    দশটি উপন্যাস – আশাপূর্ণা দেবী

    লেখক এক পাতা গল্প1079 Mins Read0
    ⤶ ⤷

    ২১-৩০. অদ্ভুত প্রস্তাবটা

    ২১.

    কিন্তু সে কি অতটা বদলে যেতে রাজি হচ্ছে? তাকে কি ওই অদ্ভুত প্রস্তাবটা দেওয়া হয়েছে? তোমার পরিচয় যখন মুছেই ফেলতে চাইছ, তখন আমার দেওয়াটা নাও।

    ও কি সম্মতি দিয়ে বলেছে, বেশ তো, এতে যদি আপনাদের কিছু সুবিধে হয় তো আমি জ্যোতির্ময়ী ঘোষই সাজব?

    না, খোলাখুলি এসব প্রসঙ্গ নিয়ে আলোচনা হচ্ছে না, তবু যেন নিঃশব্দে ঘোষিত হচ্ছে, মালবিকা মিত্র আর এই গ্রামোন্নয়ন কেন্দ্রের প্রধান শিক্ষিকা থাকবে না। নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে সে এই গ্রাম আর গ্রামোন্নয়ন থেকে।

    তবে আর ভক্তিভূষণের পরিবারের সঙ্গে মিশে যেতে আপত্তি কী? সেটাই তো আরও সুবিধে। বরং কৃতার্থ হয়েই যাওয়া উচিত।

    কে ওকে এত সহজে এখান থেকে নিয়ে যেত? কে ওকে এই নিতান্ত দুঃসময়ে দেখত? কে অকারণে এমন স্নেহ দিয়ে সেবা দিয়ে বাঁচিয়ে তুলত? মানুষের উপর বিশ্বাস হারিয়েছিল মালবিকা, এরা সে বিশ্বাস ফিরিয়ে এনেছে।

    .

    ২২.

    এ ঘরে লীলাবতীর শাশুড়ির আমলের একখানা বড় আয়না আছে। যদিও তার সর্বাঙ্গে বয়েসের রেখা, তবু সেই অসংখ্য গোল গোল কালো কালো দাগের ফাঁক থেকেও অবয়বের একটা আভাস পাওয়া যায়।

    সেই আভাসের সামনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মৃদু হাসল মালবিকা। আবার এই বেশভূষা নিয়ে ট্রেনে চড়তে হবে ভেবে বিচলিত হল।

    লীলাবতীর গায়ের মাপের শেমিজ, আর লীলাবতীর চওড়াপাড় শাড়ি।

    কৌতুকপ্রদ সন্দেহ নেই। কিন্তু নিজেকে অন্যের কৌতুকের খোরাক ভাবতে ভাল লাগে না।

    মালবিকা ভাবল, আচ্ছা, একটা সেট তো পরা ছিল আমার? সেটা কোথায় গেল? কাঁচা হয়েছে অবশ্যই। এত যখন হচ্ছে!

    এত হচ্ছে! আশ্চর্য, কত হচ্ছে! অথচ কিছুই না হতে পারত।

    বাইরে পায়ের শব্দ হল।

    মালবিকা তাড়াতাড়ি আরশির সামনে থেকে সরে এল। বসে পড়ল খাটের উপর। আর ওই তাড়াতাড়িটুকুর জন্যে হাঁপাতে লাগল। আরও শিথিল দেখাল।

    এ শব্দ তার চেনা হয়ে গেছে।

    এই শব্দটির জন্যেই যে সমস্ত চেতনা তৃষিত হয়ে থাকে।

    এই তৃষিত হয়ে থাকার জন্যে লজ্জাবোধ করে মালবিকা। ভাবে, এটা আমার অন্যায়, এ বাড়ির কর্তা-গিন্নি কত স্নেহ করছেন, আমার সুবিধে-অসুবিধে দেখতে তৎপর হচ্ছেন, অথচ আমি ওঁদের থেকে ওঁদের ছেলেকেই বেশি প্রাধান্য দিচ্ছি।

    অস্ফুট চেতনার মধ্যে ওর নিকট-সান্নিধ্য অনুভব করলেও স্পষ্ট জ্ঞান হবার পর থেকে তো দেখছে নিজেকে সরিয়ে নিচ্ছে ও, নির্লিপ্ত রাখছে, প্রত্যক্ষ কোনও স্নেহ-মমতার স্পর্শ দিচ্ছে না, তবু মনে হচ্ছে আশ্ৰয়টা বুঝি ওইখানেই।

    তাই তার জন্যেই সমস্ত প্রাণটা উন্মুখ হয়ে থাকে।

    কেন? তার এই সাতাশ বছরের কুমারী-জীবনে তরুণ পুরুষ কি দেখেনি মালবিকা?

    অতএব এই পাঁচদিনেই প্রেমে পড়ে গেল উপন্যাসের নায়িকার মতো?

    দূর, এটা হচ্ছে কৃতজ্ঞতা। কৃতজ্ঞতাকে অন্যভাবে দেখছে সে!

    স্বস্তি পেল। নিশ্চিন্ত হল। কৃতজ্ঞ মুখ করে বসে থাকল।

    পায়ের শব্দ বাইরে থেকে ঘরে এল। মৃণাল ঢুকল।

    মালবিকা দেখল, ওর মুখের রেখায় রেখায় বিষণ্ণতা, ওর চোখের নীচে ক্লান্তির ছাপ। অথচ ও কথা বলে উঠল যেন উৎসাহের গলায়, কী হল, আবার হাঁপাচ্ছেন কেন? বেশ তো চাঙ্গা হয়ে উঠেছিলেন।

    মালবিকা মৃদু হাসল। ভালই তো আছি।

    ওটা বললে খুব সত্যি কথা বলা হয় না। সত্যি করে তুলুন, সত্যি করে তুলুন।

    মালবিকা আরও কৃতজ্ঞ হল। আরশি দিয়ে যদি দেখতে পেত, মনে হত একটু বেশিই হয়েছে। বিহ্বল বিহ্বল দেখাচ্ছে প্রায়।

    বলল, পূর্বজন্ম নিয়ে ভাবিনি কখনও, এখন ভাবছি।

    এখন ভাবছেন?

    হ্যাঁ, ভাবছি নিশ্চয় পূর্বজন্মে আপনারা আমার কাছে খুব মোটা ঋণ করে শোধ দেননি।

    চমৎকার! আপনার কল্পনাশক্তি তো খুব প্রখর!

    বিছানায় শুয়ে শুয়ে প্রখরতায় শান দেবার সময় পাচ্ছি কিনা! সত্যি, মানুষ যে কত মহৎ হতে পারে, তা এখানে এভাবে না এলে জানতেও পারতাম না।

    ওটাও আপনার কবি কল্পনা। যে-কোনও মানুষ এটুকু করত।

    মালবিকা একটু অবিশ্বাসের হাসি হাসল।

    তারপর বলল, আপনাদের কাছে কদিন রয়েছি, কত স্নেহ-মমতা সেবা-যত্ন পাচ্ছি, অথচ কিছুই জানি না আপনাদের।

    আমরাও আপনার সম্পর্কে একেবারে অন্ধকারে।

    মালবিকা সহসা যেন একটু চমকে যায়, তারপর হতাশ গলায় বলে, আসলে যে সবটাই তাই। শুধু অন্ধকার।

    মৃণাল মনে মনে বলে, তার মানে তুমি আমারই সমগোত্র। অতএব সেই একাত্মতা অনুভব করে সে।

    মুখে বলে, মনে উৎসাহ আনুন, ওটাও একটা চিকিৎসা। জানবেন, আমাদের সম্বন্ধে আস্তে আস্তে সবই জানবেন।

    আপাত বাক্য নয়, মৃণাল ভাবছিল, একে সবই বলা যায়। এ তো একই দুঃখের মধ্যে উঠে এসেছে। এ ছি-ছি করবে না। এ অবাক হবে না।

    মালবিকা আস্তে বলে, শুধু তো আজকের দিনটা। কলকাতায় গেলে কে কোথায়

    কে কোথায়!

    কলকাতায় গেলে কে কোথায়? মৃণাল অবাক গলায় বলে, কলকাতায় গিয়ে আর চিনতে পারবেন না আমাদের?

    ইস, ওকথা কে বলছে?

    বাঃ, তাই তো বলছেন।

    মোটেই না। বলছি, কলকাতা পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে আপনাদের ছুটি। অবশ্য যা করলেন তার মূল্যনির্ণয় করি এমন ক্ষমতা নেই।

    বেশ তো, ওটা না হয় পরজন্মের জন্যে তুলে রাখুন। আপনি তো ওতে বিশ্বাসী। পারেন তো তখন সুদে-আসলে শোধ দিয়ে দেবেন।

    শুনে হেসে ওঠে মালবিকা।

    হেসে ওঠে মৃণালও।

    ওই হাসির সময় মৃণালের চোখের নীচের সেই গভীর কালিমা যেন হালকা দেখায়।

    .

     ২৩.

    এ বাড়িতে আবার যথানিয়মে উনুন জ্বালতে হচ্ছে লীলাবতীকে, আবার পড়তে হয়েছে সেই জ্যোতির হাতের সাজানো চায়ের সাজ।

    মানুষ অবস্থার দাস, প্রমাণিত হচ্ছে আর একবার।

    প্রমাণিত হচ্ছে মানুষের দেহযন্ত্রই তার সবচেয়ে বড় শত্রু।

    আবার সবচেয়ে বড় প্রভুও।

    স্বামীর সামনে খাবার থালাটা এগিয়ে সেই কথাই বলেন লীলাবতী। বলেন, ভাবিনি আবার সংসারে হাঁড়ি নাড়ব।

    উপায় কী! ভগবান যা ফেরে ফেললেন!

    গোপালের মার চোখ বাঁচিয়ে বাঁচিয়ে কীভাবে যে কাটল এই কদিন! রাতটা পোহালে বাঁচি। ঘরে ঢুকতে দিচ্ছি না, বলছি ঘুমুচ্ছে। বলছি, ঘর পরিষ্কার করে ফেলেছি, কিন্তু কাপড় কাঁচতে গিয়ে প্রশ্ন তুলছে।

    কেন? ভক্তিভূষণ অবাক হন। মানে?

    মানে বুঝছ না? বলছে, মা, কেবলি তোমার কাপড় কাঁচছি। বউদির কাপড়জামা কই?

    ভক্তিভূষণ মাথাটা নিচু করেন। লীলাবতী আঁচলে চোখটা মোছেন।

    বউদি শব্দটা উচ্চারণ করলেই বুকটা ফেটে যেতে চায়।

    তোমার কাপড়ই পরতে দিচ্ছ?

    তা ছাড়া? লীলাবতী এদিক-ওদিক তাকিয়ে বলেন, তার তো অগাধ শাড়ি-জামা, হয়তো চিরদিনের মতোই ফেলে চলে গেল। কিন্তু মৃণালের সামনে সে জিনিসে আমি হাত দিই কী করে?

    এই সময় হঠাৎ হাসির আওয়াজ এল। এঁরা দুজনে একসঙ্গে চমকে উঠলেন। দুজনে একসঙ্গে ওদিকে তাকিয়ে থাকলেন।

    তারপর নিশ্বাস ফেলে একে অপরকে বললেন, ওর মুখে আবার হাসি শুনতে পাব ভাবিনি।

    বললেন, হঠাৎ এই উটকো বিপদটা দিয়েই হয়তো ভগবান সামলাবার সময় দিলেন। ওর চিন্তা-ভাবনা নিয়ে কাটছে খানিকটা।

    কলকাতায় যাওয়াটা পিছিয়ে গেল, ভক্তিভূষণ বললেন, তবু একরকম সুরাহাই হল বলতে হবে।

    মেয়েটার মুখটা কী মিষ্টি দেখেছ? আর কী নম্র স্বভাব! জ্ঞান হয়েই আমাদের কষ্ট ভেবে মরমে মরে যাচ্ছে।

    সেটাই স্বাভাবিক অবশ্য।ভক্তিভূষণ বলেন, জানতে পারলে কিছু?

    কী করে জানব? তোমার ছেলের কড়া শাসন না? কিছু জিজ্ঞেস করা চলবে না। বউমার বাপের বাড়ি নিয়ে ওই রকম করত মনে নেই?

    লীলাবতী যে কেন খামোকা তার বউমার তুলনা দিলেন কে জানে!

    জ্যোতির মা বাপ নেই, জ্যোতির ভাই-ভাজ ডিব্রুগড়ে থাকে, অতএব বিয়ে হয়ে ইস্তক। তত্ত্ব-তালাশের কোনও প্রশ্ন ছিল না, জ্যোতির বাপের বাড়ি যাওয়ারও না। সে সম্পর্কে একটি প্রসঙ্গ তোলবার উপায় ছিল না। মৃণাল বিরক্ত হত। এখন মালবিকার সূত্রে সেই কথাটা মনে পড়ল লীলাবতীর।

    যে রকম দেখছি, মনে হয় না বিশেষ কোনও আত্মীয় আছে। থাকলে ব্যস্ত হত। বে-থাও হয়নি বোধহয়।

    জানি না বাপু! আজকালকার মেয়েদের তো দেখলে বোঝার জো নেই সধবা, না বিধবা, না কুমারী। বিয়ে-হওয়া মেয়েরা সাজের মতো করে সিঁদুর পরে। ইচ্ছে হল, পরল, ইচ্ছে হল না, পরল না। তবে সধবা নয় নিশ্চয়ই। হয় আইবুড়ো, নয় বিধবা।

    খাওয়া-দাওয়ার বিচার আছে নাকি?

    নাঃ। সেসব কিছু নেই। তাই কি থাকে গো আজকাল? শোনননি তোমার ভাগ্নীর কথা? বলে, খাওয়া-পরা ব্যাপারটা সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত আর অবশ্য-প্রয়োজনীয়, ওর গায়ে নিজের পরিচয়লিপি এঁটে রাখতে হবে? কেন, পুরুষরা তো আমি বিবাহিত, আমি বিপত্নীক, আমি কুমার, এইভাবে টিকিট এঁটে বেড়ায় না!

    যত সব ডেঁপোমি?

    কদিন পরে আজ প্রথম সহজভাবে কথা বলছেন এঁরা। বোঝা যাচ্ছে এঁদের মুখেও হাসি শোনা যেতে পারে। হয়তো এখনই। অসম্ভব নয় সেটা। এমনকী লীলাবতী এ কথাও বলছেন, ডাল দেব আর একটু?

    দিচ্ছিলেন, মৃণাল এসে দাঁড়াল। যেন কিছু বলতে এসেছে, ইতস্তত করছে।

    লীলাবতী বললেন, বলবি কিছু?

    মৃণাল আর একবার ইতস্তত করে বলে ফেলল, বলছিলাম, তোমার ওই শাড়ি-টাড়িগুলো তো অদ্ভুত!…ট্রেনে যেতে হবে…এ ঘরে তো অনেক শাড়ি-ব্লাউজ পড়ে রয়েছে।

    পড়ে রয়েছে। হয়তো চিরদিনই তাই থাকবে।

    সেই অপচয়টার দিকে চোখ পড়েছে লীলাবতীর গোছালো ছেলের।

    লীলাবতী বললেন, তার কাপড়।

    অনেক তো রয়েছে।

    .

    ২৪.

    লীলাবতী অতঃপর একখানা হালকা নীল রঙের শাড়ি আর গাঢ় নীল রঙের ব্লাউজ বার করে নিয়ে এলেন, নিয়ে এলেন সায়া।

    বললেন, ট্রেনে যাবে, এগুলো পোররা। ঠিক করা থাক, খুব ভোরের গাড়ি।

    মালবিকা অবাক হয়ে তাকাল। বলল, এ শাড়ি কার? আপনার মেয়ের?

    লীলাবতী কষ্টে বললেন, ধরো তাই।

    মালবিকা এই কষ্টটা দেখে থতমত খেল।

    ভাবল, বোধহয় খুব একটা দুঃখের জায়গায় ঘা দিয়েছে। মৃতা কন্যার স্মৃতির সম্বলগুলি তাকে ধরে দিচ্ছেন দেখে লজ্জায় মরে গেল। আস্তে নিজের সেই শাড়ি-জামার কথা তুলল। যেগুলো পরনে ছিল সেদিন।

    লীলাবতী জানালেন, সেই অকথ্য কাদামাখা জিনিসগুলো ধোপর বাড়ি ঘুরে না এলে ব্যবহার করা অসম্ভব। সেগুলো জড়ো করে ময়লা কাপড়ের সঙ্গে নিয়ে যাচ্ছেন কলকাতায়।

    মালবিকা আরও আস্তে বলে, তবে এই থাক না, যা পরে আছি। এগুলো রেখে দিন।

    লীলাবতী ওর গায়ে মাথায় হাত রাখলেন, বললেন, আমার এই বেঢপ গায়ের বেঢপ জামা, ও পরে রেলগাড়িতে চড়া যায়? রাখো এগুলো। তুমি যা ভাবছ, তা নয়। আমার মেয়ের নয়। মেয়ে হয়নি আমার, ওই একমাত্তর ছেলে। সেসব কথা পরে বলব।

    .

    ২৫.

    কাল ভোরে রওনা।

    আজ রাত্রে, যখন বাইরের কারও এসে পড়বার ভয় নেই, তখন একটু এ-ঘর ও-ঘর করে দেখতে পারা যায় বাড়িটা। ভাবল মালবিকা।

    কদিন রইল, শুধু একটা ঘরের মধ্যে প্রায় লুকিয়ে।

    হ্যাঁ, লুকিয়ে থাকার প্রয়োজন তো মালবিকাও অনুভব করেছে। কে বলতে পারে কার চোখে পড়ে যায়। গ্রামোন্নয়নের মালবিকা মিত্র এখানে কোন সূত্রে, এ প্রশ্ন মুখর হয়ে উঠবে না?

    নিরুত্তর প্রশ্নের মধ্যে ঝাপসা হতে হতে মিলিয়ে যেতে চায় মালবিকা। দাগি হয়ে ওখানে চরে বেড়াতে পারবে না।

    এদের এই মস্ত দোতলা বাড়িটা অনেক দেয়াল, অনেক ঘর, অনেক খিলেনে মোড়া বলে তবু নির্ভয়। কিন্তু ভাল করে দেখা হয়নি।

    আস্তে বেরিয়ে এল।

    ভক্তিভূষণের চোখে পড়ল।

    ব্যস্ত হয়ে বললেন, এ কী, এ কী, তুমি কেন মা আবার? জল খাবে?

    মালবিকা মৃদু হাসল।

    ভক্তিভূষণের মনে হল হাসিটা ঠিক বউমার মতো। নিশ্বাস ফেললেন।

    মালবিকা বলল, জল চাই না। ভাবছি, আপনাদের এই বাড়িটায় পাঁচ-ছদিন রইলাম শুধু শুয়ে। আজ একটু দেখি–

    ভক্তিভূষণ প্রীত গলায় বললেন, দেখো। পারবে তো?

    যতটা পারি।

    পড়ে-উড়ে যেও না। সাবধানে দেয়াল ধরে ধরে যাও। এত বড় বাড়ি, ঠাকুরদালান, বারবাড়ি, সব দেখতে গেলে তোমার পায়ে ব্যথা হয়ে যাবে।

    মালবিকা আর একবার হাসল।

    ভক্তিভূষণ আর একবার বিচলিত হলেন।

    .

    ২৬.

    অনেক ঘুরে শেষে এই ঘর। মৃণালের ঘর। অবচেতনের অন্তরালে এইটাই কি লক্ষ্য ছিল? এদিকে-ওদিকে হারিকেনের আলো, মৃণালের ঘরে জ্বলছে একটা হ্যাঁজাক। চোখটা ধাঁধিয়ে গেল প্রথমটায়।

    তারপর চোখকে সামলে নেবার পর আর একবার ধাঁধালো। অবাক হয়ে গেল। এ তো অবিবাহিতের একক ঘর নয়, এ ঘরের সর্বত্র যে যুগল জীবনের স্বাক্ষর।

    এর মানে কী? কোথায় আবার সেই একজন? ওই বড় কাঠের আলনাটায় যার রঙিন শাড়ি ঝুলছে, ওই জল-চৌকিটার উপর যার চুল বাঁধার আর প্রসাধনের শৌখিনতম আর আধুনিকতম সব সরঞ্জাম সাজানো!

    বিছানাটা ওলটানো রয়েছে তাই হয়তো ওর অন্তরালে অবস্থান করছে চুলের গন্ধ আর ফুলের গন্ধ জড়ানো উপাধান।…

    কী এই রহস্য? যতদূর শুনল, তাতে তো জেনেছে এঁরা দীর্ঘকাল পরে কয়েকদিনের জন্যে বেড়াতে এসেছেন, ছুটি ফুরিয়েছে–চলে যাচ্ছেন।

    তবে? ওঁর স্ত্রী কি হঠাৎ বাপের বাড়ি কি কোথাও চলে গেছে? কোনও দরকারে? কিন্তু তা হলে একবারের জন্যেও তার নাম উচ্চারিত হয় না কেন? ঝগড়া করে চলে গেছে?

    তা হলে–এমন ভাবে, এইমাত্র ঘর থেকে বেরিয়ে গেছে এমন ভাবে সাজানো রইল কেন?

    তবে কী–? তবে কী? হাতে-পায়ে একটা হিমশীতল অনুভূতি বয়ে গেল। দুর্বলতা অনুভব করল। বসে পড়ল। তাই কি ওঁর চোখের কোলে কালি, মুখের রেখায় বিষণ্ণতা?

    একটুক্ষণ বসে রইল, অনেকটা ভাবল, কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারল না, খুব সম্প্রতি একটা মৃত্যু ঘটে গেছে এ বাড়িতে। তা হলে কী! তা হলে কী! জানলার নীচে একখানা পত্রিকা পড়ে রয়েছে, হাতে তুলে নিল। দেখল, মাঝখানের খাঁজে একটা চুলের কাঁটা গোঁজা। লোহার কাঁটা।

    .

    পড়বেন বইটা?

    মালবিকা চমকে উঠল। ও কি অনেকক্ষণ এসেছে?

    দেখছে, মালবিকা বোকার মতো পত্রিকাটা হাতে করে দাঁড়িয়ে আছে।

    মৃণাল আবার বলল, পড়ুন না!

    বলল। অথচ নিজে ও হাত দেয়নি। কাল ভোরে চলে যেতে হবে, লীলাবতী বলেছেন, তোর জিনিসপত্রগুলো একটু গুছিয়ে নিতে হবে যে বাবা!

    মৃণাল বলেছে, নেব। নেবখন রাত্রে।

    আর ভেবেছে, কী হয় যেখানে যেমন আছে থাকলে! যদি চাবি দিয়ে রেখে যাওয়া যাও! কোনওদিন যদি এসে চাবি খোলা হয়, যদি জ্যোতি সঙ্গে এসে দাঁড়ায়, বিস্ময়ে পুলকে বিহ্বল হয়ে বলে উঠবে, কী আশ্চর্য! যেখানে যেমন রেখে গিয়েছিলাম, সব রয়েছে, অবিকল!

    থাকেনা? রাখলে থাকে না? মৃণালের ঠাকুরমার হাতের সাজানো ভাঁড়ারটা রয়েছে কী করে? শিশি বোতল কৌটো?

    লীলাবতী যে দেখিয়ে বেড়ালেন জ্যোতিকে, এই দেখো বউমা, তোমার দিদিশাশুড়ির হাতের চিহ্ন। এই যে কুলুঙ্গিতে আরশি সিঁদুর-কৌটো, এইটিতে শেষ দিন অবধি সিঁদুর পরে গেছেন।

    সে তো কতদিনের কথা।

    মৃণালের ঠাকুরদার নিত্য পাঠের চণ্ডীস্তোত্রটা রয়েছে তাকের উপর, ঠাকুরমার ব্রতকথা। তবে জ্যোতির হাতের এই পত্রিকাটাই বা থাকবে না কেন? জ্যোতি তখন আহ্লাদে কৌতূহলে বলে উঠবে, ওমা, এই যে সেই চিহ্নর কাঁটাটা! গল্পটা পড়তে পড়তে উঠে পড়েছিলাম। তারপর বলবে, তুমি কী গো! এইসব রেখে দিয়েছ তেমনি!

    এত ভেবেছে। অথচ মৃণাল এখন ভদ্রতাকে বড় করল।

    বলল, পড়বেন তো পড়ুন না!

    মালবিকা হাসল। আস্তে নামিয়ে রাখল। বলল, অন্ধ চোখে আর পড়ব কী!

    আই সি! মৃণাল বিচলিত গলায় বলে, আপনার যে চশমা খোয়া গেছে। তাই তো! ইস! কলকাতায় গিয়েই প্রথম কাজ হবেচশমার ব্যবস্থা।

    মালবিকা চোখ তুলে তাকাল। বলল, আমার চশমার দায়িত্বও আপনাদের?

    নিশ্চয়! নিজেই বলেছেন আপনি।

    কথাটা বলেই চমকে গেল মৃণাল। এই ঘরে, জ্যোতির স্মৃতিচিহ্নর সামনে এমন লঘু কৌতুকের গলায় কথা বলল সে? বলতে পারল?

    মৃণাল নিজেকে সামলে নিল। ভাবল তাতে কী! জ্যোতি তো মারা যায়নি, জ্যোতি শুধু হারিয়ে গেছে। তাকে আমি খুঁজে বার করব।

    এখন, জ্যোতি এইখানে নেই বলে মানুষের সঙ্গে ভদ্রতা করব না?

    কিন্তু মালবিকা বিপন্ন দৃষ্টিতে তাকায়। নিজেই বলেছি আমি?

    বলেননি? বাঃ! মনে করে দেখুন। বলেননি পূর্বজন্মে আপনার কাছ থেকে মোটা টাকা ধার নিয়ে শোধ দিইনি?

    মালবিকা হেসে উঠল না। শুধু হাসল।

    তাই পাশের ঘর থেকে শোনা গেল না। আর হয়তো তাই মৃণালও হেসে উঠল না, শুধু মুখটা হাসির মতো হালকা দেখাল।

    মালবিকা বলল, আপনার স্মৃতিশক্তি তো বেশ।

    আপনারও কম নয়। জন্ম-জন্মান্তর পর্যন্ত মুখস্থ।

    এবার হেসে না উঠে পারে না। দুজনেই।

    এ-ঘরে লীলাবতী সুটকেস গোছাতে গোছাতে ভক্তিভূষণের দিকে তাকান।

    বলেন, চিরকাল বলেই এসেছি, ভগবান যা করেন মঙ্গলের জন্যে, এখন সেটা অনুভব করছি।

    ভক্তিভূষণ মৃদু গলায় বলেন, কম বয়েসের মন স্রোতস্বিনী নদীর মতো!

    ভগবানের সব কাজই মঙ্গলের, এ মতবাদে তাঁর সমর্থন আছে কিনা বোঝা যায় না। তারপর বলেন, নিজেদের দায়িত্বে সঙ্গে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। এখনও জানা গেল না মেয়েটার হিস্ট্রি কী?

    লীলাবতী অসন্তুষ্ট গলায় বলেন, শুনলেই তো গোপালের মার মুখে।

    সেটা নিশ্চিত নয়। কী অবস্থায় ওভাবে

    লীলাবতী হাতের কাজ থামিয়ে স্থির হয়ে বসেন। উদাসী গলায় বলেন, সে বিচার আর আমরা করতে যাব কোন মুখে?

    .

    ২৭.

    কিন্তু ক্রমশ সবই জানা হয় বইকী! উভয়ে উভয়কে জানে।

    মালবিকা জানতে পারে সেই ভয়ংকর দিনে, যখন মালবিকা দিগবিদিক জ্ঞান হারিয়ে গ্রামের ও-প্রান্ত থেকে এ-প্রান্তে ছুটে আসছিল শিকারির হাত ফসকানো ভয়ার্ত পশুর মতো, ঠিক তখনই এদের বাড়ির প্রাণপাখিটি কবলিত হয়ে গেল শিকারির অব্যর্থ মুষ্টিতে।

    এরা চলে যাচ্ছিল, পরাজয়ের চাদরে মুখ ঢেকে, মালবিকা এসে ওদের আটকে ফেলেছে। তারপর ওরা ওদের ওই হাহাকার করা শূন্যতায় মালবিকাকে পেয়েই বর্তে গেছে।

    মালবিকা সেই শূন্যতার গহ্বরের সামনে একটা পরদা ঝুলিয়ে দিয়েছে যেন।

    মাঝে মাঝেই বাতাসে উড়ে যাচ্ছে বটে সেই পরদা, সেই শূন্যতা দাঁত খিঁচিয়ে গ্রাস করতে আসছে, তবু সেটা আবার স্থির হচ্ছে, আবার ঢাকা পড়ছে। মালবিকা জানতে পারে, জ্যোতি নামের সেই ভাগ্যের মার-খাওয়া মেয়েটারও তারই মতো না আছে মা, না আছে বাপ। যারা বিয়ে দিয়ে কাজ সেরেছে, সেই দাদা বউদি ওকে ভুলে থাকতে পেলেই সুখী।…অতএব জ্যোতি এই ছোট্ট সংসারটুকুর মধ্যেই আপন জ্যোতির্ময় পরিমণ্ডল রচনা করে নিয়ে আলোক বিকীর্ণ করছিল। এখন তলিয়ে গেছে অন্ধকারে।

    .

    এরা জানতে পারে মালবিকা নামের ওই মিষ্টি চেহারার তীক্ষ্ণবুদ্ধি মাতৃপিতৃহীন মেয়েটি একদা কাকা কাকির উপর অভিমান করে শ্রীহট্ট থেকে চলে এসেছিল কলকাতায়। বিনা সম্বলে। বয়েস ছিল মাত্র সতেরো।

    তারপর কেবলমাত্র নিজের চেষ্টায় কলকাতা শহরে থেকেছে, পড়েছে, বি.এ., বি.টি, পাশ করেছে এবং এখানে সেখানে অনেকখানে কপাল ঠুকতে ঠুকতে নিতান্তই কিছু না করি বেগার খাঁটি গোছ মনোভাব নিয়ে বিভক্ত দেশের সীমান্তরেখায় ওই কাজটায় লেগেছিল।

    বেশিদিন নয়, মাত্র মাস দেড়েক। ইত্যবসরে একমনে কর্মখালির বিজ্ঞাপনও দেখে যাচ্ছে এবং পত্রাঘাতও করে যাচ্ছে।

    আরও জানল এরা, সেই দুর্দিনে ও শুধু ঝোঁপঝাড়ের আড়াল দিয়ে ছুটে ছুটেই আত্মরক্ষা করতে পেরেছিল সেদিন। সেই ছোটায় তার কাপড় ছিঁড়েছিল, ঘড়ি পড়ে গিয়েছিল, চশমা খসেছিল, আর শেষ পর্যন্ত ওই বড় বাড়ির ভাঙা দেয়ালটার অন্তরালে আশ্রয় নিয়ে জ্ঞান হারিয়েছিল। পড়ে ছিল সেই অবস্থায় পুরো দুটো দিন।

    মালবিকার ঘটনাটা এদের কাছে নতুন মনে হল না, সবটাই প্রায় অনুমানে জানা হয়ে গিয়েছিল। তবে নিশ্চিত হল। কিন্তু কবে এসব জানাজানি হল?

    .

    এরা কি তবে কলকাতায় গেল না?

    এরা কি এইখানেই রয়ে গেল মালবিকা মিত্রকে জ্যোতির্ময়ী ঘোষ সাজিয়ে? ভাবল, কলকাতার সমাজ আরও পরিচিত, আর পরিচিত বলেই ভয়ংকর! তার থেকে এই বহু পুরনো বিরাট প্রাসাদটার ভারী ভারী দেয়ালের অন্তরালে মুখ ঢেকে

    দূর, তাই কি হয়?

    ভক্তিভূষণ কি ঘোড়ার গাড়িকে বলে রাখেননি?

    সে গাড়ি কি ঠিক সময় এসে ভোরের আলো ফোটবার আগেই স্টেশনে পৌঁছে দেয়নি ঘোষেদের বাড়ির চারটে মানুষকে? যার মধ্যে একজন সদ্য জ্বর থেকে ওঠা দুর্বল। বউমার জ্বর এই কথাই তো বলেছেন কদিন লীলাবতী। অকারণেই একে-ওকে ডেকে ডেকে বলেছেন।

    গ্রামে গাড়ির গাড়োয়ানরাও আত্মীয়তার সুরে কথা বলে

    তাই গাড়োয়ান বংশী বলেছিল, আর কটা দিন থেকে গেলে হত বাবু! বউমার যেক্ষেত্রে এত শরীর খারাপ

    ভক্তিভূষণ তাড়াতাড়ি বলে উঠেছিলেন, ছেলের ছুটি ফুরিয়ে গেল

    তারপর মুখ ফিরিয়ে লীলাবতীকে উদ্দেশ করে বলেছিলেন সুউচ্চ স্বরে, ভাল করে ঢেকে বসতে বলল, ভোরের ঠাণ্ডা

    বংশী ইতিপূর্বে কোনওদিন এঁদের দেখেনি, হয়তো দেখেনি সরকারি স্কুলের সদ্য-আসা দিদিমণিকে, তথাপি ভক্তিভূষণ সাবধান করছিলেন।

    সব হাহাকার চাপা পড়ে গিয়েছিল ভক্তিভূষণের ওই আত্মরক্ষার তাড়নায়।

    হয়তো বা সকলেরই তাই হচ্ছিল।

    মৃত্যুভয়ের পরেই তো লোভয়।

    মৃণালও আসবার সময় ওই সামলানোটার দিকে দৃষ্টি দিয়েছিল, তবে সেটার কতকটা ওই ছদ্মবেশিনীর দুর্বল অবস্থাটা স্মরণ করে।

    আপনি নিজেকে একটু ঢেকেঢুকে নিন, জোলো জোলো হাওয়া বইছে।

    তা নিজেকে ঢেকে নেবার গরজ কি ছদ্মবেশিনীর নিজেরই ছিল না? সেও তো আত্মগোপনের পথ ধরেই পালাতে চেয়েছিল। নইলে আবার তো তাকে ওই সরকারি শিক্ষণ-কেন্দ্রে গিয়ে জুড়তে হত? সরকারের বদান্যতায় ট্রেনিং নিয়ে পাশ করেছে যখন। ছমাসের চুক্তি, বন্ডে সই করে আসা।

    .

    কিন্তু স্টেশনে এসে মৃণাল হঠাৎ যেন দূর আকাশের তারা হয়ে গেল। মনে হল মৃণাল এদের দলের নয়।

    চারখানা টিকিট কেটে, তিনখানা বাপের হাতে দিয়ে বাকিটা নিজের পকেটে পুরে বলল, আমি পাশের কামরায় আছি।

    পাশের কামরায়!

    পাশের কামরায় কেন?

    লীলাবতী ভয় পেলেন।

    লীলাবতীর মনে হল মৃণালের বুঝি ভয়ংকর কোনও অভিসন্ধি আছে। হয়তো মা বাপকে কলকাতার গাড়িতে তুলিয়ে দেবার অপেক্ষায় ধৈর্য ধরে ছিল এ কয়দিন।

    পাশের গাড়িতে আছি বলে হারিয়ে যাবে।

    লীলাবতী ব্যাকুল গলায় বললেন, কেন? পাশের গাড়িতে কেন?

    আমার সেটাই সুবিধে, বলল মৃণাল নির্লিপ্ত গলায়।

    এখানেই বা তোর কী অসুবিধে?লীলাবতীর স্বর আরও ব্যাকুল।

    হঠাৎ ভক্তিভূষণ ধমক দিয়ে উঠলেন, বলে উঠলেন, আঃ! সব সময়ই বা তুমি ওকে অত জবরদস্তি করো কেন? ওর যেখানে সুবিধে বসুক না!

    মনে হল যেন মৃণালের এই পাশের কামরার সিদ্ধান্তে খুশিই হলেন তিনি।

    লীলাবতী সেটা টের পেলেন। তাই চুপ করে গেলেন। শুধু তাঁর প্রাণটা আকুলি-বিকুলি করতে লাগল পরের স্টেশন আসবার অপেক্ষায়।

    গাড়ি থামলে নেমে গিয়ে দেখবেন তিনি।

    আশ্চর্য, বাপের প্রাণে কি ভয় থাকে না?

    ভক্তিভূষণ কেন ভাবছেন না মৃণাল এই সুযোগে হারিয়ে যেতে পারে, তার সেই হারানো বউকে খুঁজতে?

    কিন্তু পরের স্টেশনে লীলাবতীকে নামতে হল না, মৃণাল নিজেই এসে জিজ্ঞেস করে গেল কোনও অসুবিধে হচ্ছে কিনা। দুটো স্টেশন পরে আবার।

    ভয় ভাঙল আস্তে আস্তে। ভোরের গাড়ি জনবিরল, লীলাবতী ভক্তিভূষণের কান বাঁচিয়ে মালবিকার কাছে প্রকাশ করতে বসলেন, কেন তাঁর ছেলেকে নিয়ে এত ভয়।

    প্রশ্নোত্তরের মধ্যে দিয়েও অতঃপর মালবিকার ইতিহাসটাও হল প্রকাশিত।

    .

    ২৮.

    ও কি সবটা সত্যি বলেছে? প্রশ্ন তুলেছিলেন ভক্তিভূষণ। কদিন যেন পরে।

    লীলাবতী বিরক্ত হয়েছিলেন। বলেছিলেন, মিথ্যে হলে এ ইতিহাস হত না। বাঘের কবল থেকে কে কবে ফিরে আসতে পারে? তা পারলে

    থেমে গিয়েছিলেন। চোখ মুছেছিলেন।

    চোখটা অসম্ভব পানসে হয়ে গেছে লীলাবতীর, আর মনটা অসম্ভব দুর্বল। সবসময় যেন অসহায়তা অনুভব করেন। জ্যোতি এ সংসারের সবখানি জুড়ে ছিল, জ্যোতি এ-সংসারকে তার ভালবাসার হাতে তুলে নিয়েছিল। লীলাবতী নিজের প্রতি আস্থা হারিয়ে বসেছিলেন ক্রমশ।

    তাই এখন এই শূন্য সংসারের চেহারা চিন্তা করে আঁকড়াতে চাইছেন মেয়েটাকে। ছাড়তে চাইছেন না কিছুতেই। নইলে কলকাতায় এসে স্টেশনে নেমেই তো বলেছিল ও, মা, এইবার আমায় বিদায় দিন।

    মা! মা ডাকতে শেখাল কে?

    লীলাবতী কিন্তু এ ডাক শুনে ধিক্কার দিয়েছিলেন ওকে। ধিক্কার দিয়েছিলেন, মা ডেকে বিদায় চাওয়ার জন্যে। প্রশ্ন তুলেছিলেন মালবিকার হৃদয় নামক বস্তুটা আছে কিনা, তাতে মায়া-দয়া বস্তুটা বর্তমান কিনা। তারপর বলেছিলেন, কিছুতেই এখন ছাড়বেন না তিনি। ভগবান তাঁকে বড় দুঃসময়ে মিলিয়ে দিয়েছেন। এই দুঃসময়ে তুমি আমায় ছেড়ে যাবে?

    চলুন, চলুন এখন। গলা নামিয়ে বলেছিল মৃণাল।

    অনুভব করতে পেরেছিল লীলাবতীর ভিতরের কথা। বুঝেছিল সর্বত্র জ্যোতির চিহ্ন ছড়ানো এই বন্ধ বাড়িটায় চাবি খুলে ঢুকতে ভয় পাচ্ছিলেন লীলাবতী। সাহস পাচ্ছিলেন না জ্যোতির হাতে নতুন করে আঁকা নিজের সংসারটায় ঘুরতে। টের তো পাচ্ছেন, স্বামীপুত্র তাঁর এই ভয়ে ভরসা দিতে আসবে না, এই নিঃসঙ্গতায় সঙ্গ দিতে পারবে না। এখানে তিনি অসহায় হয়ে পড়ে থাকবেন।

    বরং ওদেরই ভার নিতে হবে লীলাবতীকে।

    আর সে ভার বড় কম নয়। প্রিয়বিচ্ছেদকাতর শোকাহত হৃদয়ের তুল্য ভারী ভার আর কী আছে জগতে?

    মালবিকা লীলাবতীর সেই ভার কিছুটা হালকা করে দিতে পারবে। মালবিকা সে প্রতিশ্রুতি এনেছে। মালবিকা যেন সে স্বাক্ষর রাখছে।

    আর তাকে ছাড়েন লীলাবতী? বলবেন না জড়িয়ে ধরে, কেমন তুই চলে যাস দেখি? বলবেন না, আমার মেয়ে নেই, তুই আমার মেয়ে?

    .

    ২৯.

    এসব কলকাতায় আসার পর।

    যখন ট্রেনে জ্যোতির শাড়ি-জামা পরা মেয়েটাকে দেখছিল আর চমকাচ্ছিল মৃণাল, যখন দেখে অবাক হচ্ছিল, জ্যোতির গায়ের জামা একেবারে ফিট করেছে ওর গায়ে, আর যখন বারেবারে মনে হচ্ছিল জ্যোতির সঙ্গে কোথায় যেন মিল আছে এর, তখনও নয়।

    তখনও দূরত্ব রেখে তুমি করেই কথা বলছিলেন লীলাবতী। আর ভক্তিভূষণকে ফিসফিস করে বলছিলেন, আড়াটা ঠিক তার মতো।বলছিলেন, ঘুরছে ফিরছে, চমকে চমকে উঠছি আমি। অনেকটা আদল আছে তার সঙ্গে। বলছিলেন, আমি সাহস করে বলতে পারছিলাম না, মৃণাল বললে তাই। কীরকম মানিয়েছে দেখেছ? কে বলবে ওর নিজের জামা কাপড় নয়!

    কাপড় বস্তুটা যে নিতান্তই অকৃতজ্ঞ, ও যখন যার তখন তার, সে কথা ভাবেননি। অবাক হয়েছিলেন। চমকে চমকে উঠছিলেন, তবু চমকাতে ভাল লাগছিল যেন। যেন সহসা মনে করতে পারবেন, জ্যোতি আছে। লীলাবতীর ধারে কাছে তার আঁচলের আভাস।

    দূরত্ব গেল শেয়ালদা স্টেশনে নেমে।

    যখন মালবিকা বলল, এবার তবে আপনারা ছুটি দিন? এখানে কাছে একটা মেয়ে হোস্টেলে আমার এক সহপাঠিনী থাকে–

    তখন লীলাবতী বললেন, তার মানে আমার বাড়িতে আর জলগ্রহণ করবি না?

    হ্যাঁ, তখনই হাত-পা হিম করা ভয়টা চেপে ধরেছিল লীলাবতীকে। তাই বলেছিলেন। আমার মেয়ে নেই, তুই আমার মেয়ে। সেই তুই শুরু।

    আর মালবিকা ভেবেছিল, কত মহৎ ইনি!

    তবু কুণ্ঠিত হয়েছিল, তবু বলেছিল, ভুগলেন তো আমাকে নিয়ে অনেক

    তার মানে পর ভাবছিস?

    কিন্তু

    আর কিন্তু দেখাসনে বাছা, এখনও তোর হাতে-পায়ে বল হয়নি, এখনও মুখ পাঙাস, আর বলছিস কিনা হোস্টেলে থাকব। কেন, কেউ কোথাও তো নেই তোর যে রাগ করবে! আমাকে মা ডাকলি, থাক আমার কাছে। এখানেই একটা চাকরি বাকরি জুটিয়ে নিয়ে রয়ে যা। বিদেশ-বিভুঁয়ে যেতে হবে না।

    মালবিকা হেসে ফেলেছিল, তা হলে আপনার কাছে করিই চাকরি। আর চাকরি দিচ্ছে কে?

    ঠিক আছে। তাই কর। আমার মেয়ের পোস্টটা দখল করে থাক–এই চাকরি।

    লীলাবতী কি এত ভাবপ্রবণ ছিলেন আগে? এমন আতিশয্যপূর্ণ কথা বলেছেন কখনও?

    বোধহয় না। জ্যোতির দুর্ভাগ্য তাঁর প্রকৃতি বদলে দিয়েছে যেন।

    থাকুন, থেকে যান। মৃণাল গলা নামিয়ে বলে, চাকরিটা খারাপ নয়, ভবিষ্যৎ আছে।

    ভবিষ্যৎ?

    হু। মা হয়তো এবার তাঁর অরক্ষণীয়া মেয়ের বিয়ে দেবার জন্যে উঠেপড়ে লাগবেন।

    আপনি কি আমাকে ব্যঙ্গ করছেন? বলেছিল মালবিকা।

    মৃণাল আহত হয়েছিল, মাপ করবেন।

    মালবিকা চোখ তুলে তাকিয়েছিল, ও শব্দটা আমিই উচ্চারণ করছি।

    নিয়তির অমোঘ বিধানকে দেখা যাচ্ছিল না, তবু সে তার কাজ করে যাচ্ছিল। মালবিকা ভক্তিভূষণের পরিবারভুক্ত হয়ে তাঁদের ফ্ল্যাটে এসে উঠেছিল। তবু ভাবেনি, সত্যি থেকে যেতে হবে। মনে করেছিল আজকের দিনটা যাক, বুঝিয়ে-সুঝিয়ে কাল যাওয়া যাবে।

    কিন্তু গেল না। যেতে পারল না।

    মৃণাল বলল, চশমাটা না করে যাওয়া চলে না। আমার প্রতিজ্ঞা আছে আপনাকে চক্ষুদান করবার। সেটা পালন করতে দিন।

    এমনি কৌতুকের সুরেই বরাবর কথা বলতে অভ্যস্ত মৃণাল, মালবিকার জন্যে নতুন নয়।

    কিন্তু এখন তো সে অভ্যাসের বদল হওয়া উচিত ছিল। জ্যোতিকে হারিয়েও পুরনো সুরে কথা কইবে সে? এটা তো অনিয়ম, এটা তো লজ্জার।

    তা মাঝে মাঝে নিজেই চমকে যায় সে। লজ্জা পায়, তবু কেন কে জানে ঝলসে ওঠে পুরনো অভ্যাস!

    কথা ওঠে কৌতুকে ঝলসে। এইজন্যেই বুঝি প্রবাদের সৃষ্টি স্বভাব যায় না মলে–মৃত্যুই তো ঘটে গেছে মৃণালের! অথচ স্বভাবটা রয়েছে।

    যদিও আগের মতো সমস্ত মুখটায় আলো জ্বলে ওঠে না, যদিও আগের মতো চোখের তারা ঝকঝকে দেখায় না, তবু কথায় লাগছে পুরনো সুর।

    এখানে দেশের বাড়ির সেই বুকচাপা ভাবটা নেই, এখানে অনেক ঘর আর অনেক দালান বারান্দার খাঁজ-খোঁজের হাহাকার করা শূন্যতা নেই। এখানে শুধু চেনা লোকের ভয়।

    সে ভয়টা সর্বদার নয়।

    সে ভয়টা শুধু দরজার কড়া নেড়ে উঠলে।

    তা ছাড়া অন্য সময় বলে ফেলা যায়–আমার প্রতিজ্ঞা আছে আপনাকে চক্ষুদান করবার, সেটা পালন করতে দিন।

    এ প্রস্তাবকে প্রত্যাখ্যান করা সহজ নয়। চক্ষুর অভাবে প্রায় অর্ধমৃত অবস্থায় কাটাচ্ছে মালবিকা। এক লাইন পড়তে পারছে না। একটা সূক্ষ্ম কাজ করতে পারছে না। দেয়ালে টাঙানো ফটোগুলোয় ঝাপসা চোখের দৃষ্টি বুলিয়ে বুলিয়ে ব্যর্থ হচ্ছে।

    তা কৌতুক করে বলা কথার উত্তরটা নেহাত নীরস করে দেওয়া যায় না। তাই মালবিকাকেও বলতে হয়, কথা আছে জানেন তো, কাঙালকে শাকের খেত দেখাতে নেই? চক্ষু লাভের সঙ্গে সঙ্গে কিন্তু আরও একটা দানের জন্যে হাত পাতব।

    মৃণাল মৃদু হেসে বলে, কী সে বস্তুটি?

    মালবিকা মাথা নিচু করে বলে, বিদায় দান।

    মৃণাল সেই নিচু করা মুখটার দিকে তাকিয়ে দেখে আস্তে বলে, সেটা আমার ডিপার্টমেন্ট নয়।

    আপনার পক্ষ থেকে তো দেবার আছে।

    শুধু আমারটায় তো কাজ হবে না। শ্ৰীমতী লীলাবতী দেবীর টেবিল থেকে পাশ করে বার করে নিতে পারেন। তবে তো?

    ওটা কিন্তু এড়িয়ে যাওয়া হল। আমি ফাইলটা আপনার টেবিলে আগে এনেছি

    কিন্তু আমি কে? আমি তো শুধু কেরানি। আমার সাইন করবার রাইট-ই নেই।

    অনেক ক্ষেত্রে কেরানিরাই আসল!

    সেটা ঘুষের ক্ষেত্রে, বলে হেসে ওঠে মৃণাল।

    যাদের ঘুষ দেবার ক্ষমতা নেই, তাদের মিনতিই সম্বল।

    মৃণাল একটু চুপ করে থেকে বলে, সত্যিই কি আপনার এখানটায় একেবারে অতিষ্ঠ লাগছে?

    কৌতুকের সুর ঝরে গিয়ে ভিতরের গাম্ভীর্য দেখা দেয়।

    মালবিকাও অতএব গম্ভীর হয়, এ কথাটা যে আপনি একটা অর্থহীন কথা বললেন, তা আপনি আমার থেকেও বেশি জানেন।

    তা হলে অত অস্থিরতা কেন?

    কেন, সেটাই কি বোঝেন না?

    উঁহু।

    আপনি ভয়ানক কথা এড়ান।

    বাঃ, এতে এড়ানোর কী হল? আবার হালকা সুরে ফিরে আসে মৃণাল, আপনার মা নেই, মুফতে একটি মা পেয়েছেন। আর শ্রীমতী লীলাবতী দেবীর মেয়ে নেই, কুড়িয়ে বাড়িয়ে একটি মেয়ে পেয়ে গেছেন, এর মাঝখানে অস্থিরতার প্রশ্ন কোথায়?

    বুড়োধাড়ি একটা মেয়ে বেকার বসে বসে মার অন্ন ধ্বংসাব?

    ওঃ তাই? তাই এত অস্থিরতা? মৃণাল বলে ওঠে, বেকার যে চিরদিন থাকবেন তা তো নয়। যে কটা দিন আছেন–না হয় ধ্বংসালেনই ছটাকখানেক করে অন্ন। চালের মাপে শূন্যস্থান পূরণে লীলাবতী দেবীর হৃদয়ের শূন্যতাটা কিঞ্চিৎ

    হঠাৎ চুপ করে যায় মৃণাল।

    যেন মনে হয় অসতর্কে পাহাড়ি রাস্তায় হঠাৎ খাদের ধারে গিয়ে পড়েছিল, সামলে নিল নিজেকে।

    মালবিকাও ওই অসমাপ্ত কথাটার গভীর ব্যঞ্জনায় মূক হয়ে রইল কিছুক্ষণ, তারপর আস্তে বলল, বেশ, আমাকে একটা চাকরিই খুঁজে দিন।

    চাকরি খোঁজা এত সহজ বুঝি? মৃণাল হেসে উঠে বলে, ওই ভয়েই তো প্রাণ মান সব গেলেও চাকরিটি আঁকড়ে বসে থাকতে হয়। মনে হয়েছিল বুঝি জীবনে আর সেই গতানুগতিক ছকে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারব না। এই তো অফিসে জয়েন করলাম।

    ভিতরে ভিতরে দুপক্ষই দুপক্ষকে জেনেছে, তাই ইঙ্গিতেও কাজ চলে। আর তাই কথার মধ্যে মেঘ ও রৌদ্রের খেলা চলে। কখনও স্বভাবের রোদ্দুর ঝকঝকিয়ে ওঠে। কখনও হৃদয়ের অন্ধকার মেঘ হয়ে সে রোদ্দুরকে ঢেকে দেয়।

    মালবিকা মৃদু গলায় বলল, কাজ তো করতেই হবে। কাজ না হলে বাঁচবেন কী করে?

    সেটা দুটো অর্থেই। বিষণ্ণ হাসি হাসল মৃণাল, মানুষ এমন একটা জীব, তার সমস্ত অভাব সয়ে যায়, সয় না কেবল খাওয়ার অভাব। আর সমস্ত রকম অস্বাভাবিক অবস্থার মধ্যেও সেটার ব্যবস্থা করে ফেলে।

    মালবিকা মৃদু হেসে বলে, সেটা আমি হাড়ে হাড়ে জানি। বছর সতেরো বয়স, হাতে পয়সার বালাই নেই, চলে আসছি শ্রীহট্ট থেকে কলকাতায়, অথচ খাওয়াটা ঠিক জুটিয়ে নিলাম, বেঁচেও গেলাম। আবার এখনও দেখুন-হাতে নেই কানাকড়ি, অথচ দিব্যি খাচ্ছি-দাচ্ছি, সুখে স্বচ্ছন্দে লালিত হচ্ছি

    স্বচ্ছন্দে আর কই? মৃণাল হেসে ওঠে, অস্বচ্ছন্দের কাঁটা প্রাণে বিধিয়ে বসে আছেন, আর ভাবছেন এ কণ্টক উৎপাটিত করা যায়, এই তো!

    বাঃ তাই বলে—

    না, বাঃ তাই বলে কিছু নেই, আমরা তো বিনা দ্বিধায় আপনার স্নেহ-যত্ন সেবা গ্রহণ করছি! আমরা তো লজ্জিত হচ্ছি না, কুণ্ঠিত হচ্ছি না

    আহা, ভারী একেবারে সেবা-যত্ন–মালবিকা লালচে হয়ে ওঠে।

    মৃণাল সেই দিকে তাকিয়ে গভীর সুরে বলে, আমাদের কাছে যে সেটা কতখানি, তা আপনাকে বোঝাতে পারব না মিস মিত্র! আমার কতখানি বোঝা যে আপনি হালকা করে দিয়েছেন। বাবা মা, এঁদের নিয়ে আমি যে কী করতাম! কিন্তু যাককথায় কথায় আসল কথাটাই চাপা পড়েছে, কাল সকাল সাড়ে আটটার সময় তৈরি থাকবেন, আমি আপনাকে নিয়ে যাব।

    নিয়ে যাবেন? কোথায়?

    বাঃ, সব ভুলে মেরে দিলেন? চোখটা দেখাতে হবে না?

    দেখুন, সত্যি, অনর্থক এই খরচা, অথচ বেশিদিন করিনি চশমাটা, প্রেসক্রিপশনও ছিল–

    মৃণাল হঠাৎ প্রায় বকুনির ভঙ্গিতে বলে ওঠে, ছিল? আশ্চর্য রকমের বেহুশ মহিলা তো আপনি! সেটা ফেলে রেখে এলেন? যখন ছুটতে শুরু করেছিলেন, তখন সঙ্গে নেবেন তো?

    মালবিকা প্রথমটা হতচকিত হয়ে গিয়েছিল, তারপর হেসে ফেলল।

    সেই হাসির দিকে তাকিয়ে মৃণালের মনে হল, সব মেয়েরই কি একই ভঙ্গি?

    মৃণাল তারপর বলল, আমার একসময় খুব দুঃখ ছিল, বুঝলেন? ভাবতাম, আঃ, এত লোকের চোখ খারাপ হয়, আমার একটু হয় না?

    তারপর? যখন হল? খুব আহ্লাদ হল তো?

    তাই কি হয়? মৃণাল মৃদু হেসে বলে, অপ্রাপ্যের জন্যেই তো ছটফটানি মানুষের। পেয়ে গেলে আর কি? কিছুই না। মনেও থাকে না।

    মালবিকা অন্য কিছু ভেবে বলেনি, মালবিকা ওই চশমা প্রসঙ্গেই বলল, আবার মনে পড়ে হারালে। হাড়ে হাড়ে মনে পড়ে, তাই না?

    বলেই চুপ করে যায় মালবিকা।

    মালবিকার মনে হয়, প্রসঙ্গটা যারই হোক–অন্য খাতে বয়ে যাচ্ছে বুঝি!

    মৃণাল সেটা বুঝতে পারল।

    মৃণালের মনে হল, মালবিকা অপ্রতিভ হয়েছে। অতএব মৃণাল সেই অন্য খাতটার দিকে না দেখতে পাওয়ার ভান করল। মৃণাল মুখে হাসি এনে বলল, তা আর বলতে? বিশেষ করে ঘড়ি, পেন, পার্স, চশমা। না হারালে বোঝাই যায় না ছিল।

    মালবিকা একটু চপল হল।

    মালবিকা ওই দীর্ঘায়ত দেহটার দিকে তাকিয়ে একটু বুঝি চঞ্চল হল, হেসে বলল, আরও একটা জিনিস আছে, যেটা হারালে তবে টের পাওয়া যায় ছিল।

    মৃণাল ওর ঈষৎ চপল হাসির দিকে তাকিয়ে হেসে উঠল, থাক, সব জায়গায় সব জিনিসের নাম করতে নেই। অপদেবতায় পায়।

    অপদেবতা!

    হ্যাঁ। জানেন না? মৃণাল দিব্য গম্ভীর গলায় বলে, অপদেবতারা ঘুরে ঘুরে বেড়ায়, আর যে যখন যা কথা বলে, ফাঁক পেলেই তার মধ্যে ঢুকে পড়ে।

    আপনি এসব বিশ্বাস করেন? মালবিকা ভুরু কুঁচকে প্রশ্ন করে।

    মৃণাল বলে, করব না? বলেন কী? বরং দেবতা না মানব, তা বলে অপদেবতা? ওরে বাবা! না মানলে ঘাড় মটকে দেবে না?

    বলে হাসতে থাকে। এই স্বভাব মৃণালের।

    মৃণালের জীবনে অতবড় একটা পরিবর্তন এল, তবু স্বভাবটার তেমন পরিবর্তন হচ্ছে না। না কি আর এক পরিস্থিতি তাকে পরিবর্তিত হতে দিচ্ছে না?

    বলতে গেলে, কুটুম্বের মতো এই যে একটা মানুষ বাড়িতে রয়েছে, তার সঙ্গে কিছু ভদ্রতা, কিছু সৌজন্য, কিছুটা হাস্য-পরিহাস দরকার বইকী! তা না হলে কেমন দেখাবে?

    জোর করে রাখা হচ্ছে তাকে, অথচ অবহেলা দেখাবে? ছিঃ!

    অথচ লীলাবতীর স্বভাব কেমন বদলাচ্ছে। তিনি যেন বুঝেও অবুঝ হচ্ছেন। ধীর-স্থির ছিলেন, আবেগপ্রবণ হচ্ছেন, হিসেবি ছিলেন, বেহিসেবি হচ্ছেন। বেহিসেবি হচ্ছেন অর্থ–অনর্থে।

    লীলাবতীর ছেলেটা মনমরা হয়ে থাকে বলে, লীলাবতী ছুতোয়তায় তার সামনে এগিয়ে দেন তাঁর পাতানো মেয়েটিকে। লীলাবতীর সেই পাতানো মেয়েটা নিঃসম্বল হয়ে ছুটে পালিয়ে এসেছিল বলে, লীলাবতী যখন-তখন তার জন্যে কিনে আনেন প্রয়োজনীয় বস্তুর সম্ভার।

    আর সে প্রতিবাদ করলেই বলে ওঠেন, তার মানে তুই আমায় পর ভাবিস?

    সবটাই বেহিসেবি কাণ্ড!

    কিন্তু ভক্তিভূষণ? তিনি অবশ্যই আপন কেন্দ্রে স্থির।

    তিনি ওই পাতানো মেয়েটাকে ভালবাসলেও এটা ভালবাসেন না, কারণে অকারণে সে তাঁর বিরহতপ্ত ছেলেকে সান্নিধ্য দিতে যাক। তিনি ওই মেয়েটিকে পুরো অবিশ্বাস না করলেও ভাবেন, বিশ্বাস কী? হয়তো সব কথা সঠিক নয়, হয়তো কিছুটা বানানো। কে জানে কাকা কাকির উপর অভিমান করে চলে এসেছিল, না কি আর কিছু?

    সত্যিই কুমারী, না বালবিধবা, না আরও কিছু। এ কথাও ভাবেন মাঝে মাঝে, তবু আস্তে আস্তে তাকে ভালও বাসতে শুরু করেন অন্তরের সঙ্গে।

    মেয়েটির স্বভাবটি ন, হাসিটি মিষ্টি, বুদ্ধিটা মার্জিত। প্রশ্রয় দিলেও নেয় না, সুযোগ দিলেও সহজে সুযোগ গ্রহণ করে না। এটা কম গুণ নয়।

    জ্যোতির সঙ্গে স্বভাবের তফাত আছে। জ্যোতি ছিল প্রবলা, এ মৃদু।

    দুজনের অবস্থার তারতম্যটা মনে পড়ে না ভক্তিভূষণের। আর এ কথাও ভাবেন না, জ্যোতির সঙ্গেই বা তুলনা করতে যাচ্ছি কেন আমি?

    .

    ৩০.

    তা এ ভুল আরও দুজনও করে। প্রতি পদে জ্যোতির সঙ্গে মনে মনে তুলনা করে। কিন্তু ভাবে না, জ্যোতির সঙ্গেই বা ওর তুলনা করতে যাচ্ছি কেন?

    তুলনা করে, হয়তো লীলাবতীর ওই পাতানো মেয়েটার আড়া জ্যোতির মতো বলে। হয়তো ওর হাসিটা জ্যোতির মতো বলে। হয়তো জ্যোতির কাজগুলো ও করছে বলে, জ্যোতির জায়গাগুলোয় ঘুরেফিরে বেড়াচ্ছে বলে। আর হয়তো বা জ্যোতির সঙ্গে একবয়সী বলে।

    জ্যোতির কাজগুলো আস্তে আস্তে ওর হাতে চলে যাচ্ছে এ কথা সত্যি।

    জ্যোতি হইচই করে করত, মালবিকা নিঃশব্দে করে, তবু করে সব। কেমন করে যে বুঝে নিতে পেরেছে, কেমন করে যে হাতে তুলে নিয়েছে। এই মেয়ের সঙ্গে ভদ্রতা বজায় রাখবে না মৃণাল? বাইরের একজন ভদ্রমহিলা তাদের সংসারে কাজ করবেন, ও কুণ্ঠিত হবে না? আর সেই কুণ্ঠা ঢাকতে কথার মধ্যে কৌতুকরস এনে সহজ হবে না?

    আবার মালবিকার পক্ষেও রয়েছে কথা। এতটা যারা দিচ্ছে তাকে, তাদের কাছে কৃতজ্ঞ হবে না?

    আর কার কাছেই বা কৃতজ্ঞ হবে, মৃণাল ছাড়া? ভক্তিভূষণ দূরের মানুষ, লীলাবতী নিতান্ত কাছের মানুষ। কৃতজ্ঞতা প্রকাশের অসুবিধে।

    অতএব এদের দুজনের মধ্যেই ভদ্রতা আর কৃতজ্ঞতার পালা চলে।

    কিন্তু সত্যিই কি মালবিকা বরাবরের জন্যে রয়ে গেল এ বাড়িতে?

    তা, দেখা যাচ্ছে তো রয়েই গেল।

    আচ্ছা, কোন পরিচয়ে?

    পরিচয় নেই। ওই ভগবানের দানএই পরিচয়ে। লোকে ভাবে সভ্য পরিচারিকা। বউ গেছে, একটা মানুষ তো দরকার। তাই জোগাড় করেছে। কিন্তু জোগাড় করল কী করে? ওই ভগবান! সত্যমিথ্যায় জড়িত হয়ে একটা সংবাদ এদের আত্মীয়-বন্ধুর কাছে স্পষ্ট হয়ে গেছে কদিনের জন্যে দেশের বাড়িতে বেড়াতে গিয়ে এদের সেই বড় আদরের বউটিকে হারিয়ে এসেছে এরা। জেনেছে, তবে অস্পষ্ট। কী করে হারাল? বলছে না এরা।

    ঘুরিয়ে ফিরিয়ে যে যেভাবেই প্রশ্ন করুক, লীলাবতী বলেন, ভগবান কেড়ে নিয়েছেন!…অথচ অন্য সন্দেহ মনে আসবার নয়, দেখেছে তো সবাই জ্যোতিকে। স্বামীতে তদগত!

    তবে? কী হয়েছিল?

    জিজ্ঞেস কোরো না ভাই, সহ্য করতে পারি না। বলতে পারি না।

    পুকুরের দিকে গিয়েছিল বুঝি তবে? জিজ্ঞেস করে কর্তাকে।

    ভক্তিভূষণ কপালে হাত ঠেকান। অতএব পুকুরের দিকেই।

    .

    মৃণাল আবার কাজে যোগ দিল। সহকর্মীরা শুনল, ছুটির মধ্যে মৃণাল ঘোষের স্ত্রী মারা গেছেন। স্তব্ধ হয়ে গেল সবাই।

    এতবড় অভাবনীয় ঘটনাকে কেন্দ্র করে গল্প করতে আসতে সাহস পেল না কেউ। শান্ত বিষণ্ণ গম্ভীর মৃণাল যথারীতি আসা-যাওয়া করতে লাগল। ওরা বলল, কী ভয়ানক বদলে গেছেন! বাইরের লোক তাই বলল।

    যাওয়া-আসা করতে লাগল মালবিকাও। কাছেই একটা মেয়েদের স্কুলে কাজ করতে ধরেছে সে। স্থায়ী নয়, অস্থায়ী। তবু করছে।

    মৃণাল বলেছিল, কেন নিচ্ছেন ও কাজ? ভারী তো স্কুল, তাও আবার অস্থায়ী!

    মালবিকা মৃদু হেসেছিল, জীবনের কোনটাই বা স্থায়ী?

    মৃণাল মাথা নিচু করেছিল।

    ⤶ ⤷
    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26 27 28 29 30 31
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleপ্রথম প্রতিশ্রুতি – আশাপূর্ণা দেবী
    Next Article রাতের পাখি – আশাপূর্ণা দেবী

    Related Articles

    হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    ভয় সমগ্র – হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    December 9, 2025
    হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    কিশোর অ্যাডভেঞ্চার সমগ্র – হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    December 9, 2025
    সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    প্রকাশ্য দিবালোকে – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    November 18, 2025
    সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    তারপর কী হল – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    November 17, 2025
    মাইকেল মধুসূদন দত্ত

    শর্ম্মিষ্ঠা নাটক – মাইকেল মধুসূদন দত্ত

    November 11, 2025
    সত্যজিৎ রায়

    মানপত্র সত্যজিৎ রায় | Maanpotro Satyajit Ray

    October 12, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Generic selectors
    Exact matches only
    Search in title
    Search in content
    Post Type Selectors
    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Our Picks

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }