Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • English Books
      • Jules Verne
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    দশটি উপন্যাস – আশাপূর্ণা দেবী

    লেখক এক পাতা গল্প1079 Mins Read0
    ⤶ ⤷

    ১. অগ্নিবৃষ্টির পর

    সমস্ত দিন অগ্নিবৃষ্টির পর পড়ন্ত বিকেলে যখন দক্ষিণ সমুদ্র থেকে এক মুঠো বাতাসের উপঢৌকন আসবার প্রত্যাশায় অধীর অপেক্ষা চলছে, তখন হঠাৎ চলমান বাতাসটুকুও বন্ধ হয়ে গেল। যেন একটা গুমোটের সাঁড়াশি অসহিষ্ণু অপেক্ষার কণ্ঠরোধ করে ধরল।

    চিরন্তন ভেবেছিল, এইবার বাতাস উঠবে, তখন কোথাও একটু বসে পড়া যাবে। দক্ষিণের বাতাসের দাক্ষিণ্যে শরীর এবং মনের একটা ভারসাম্য রক্ষিত করে নিয়ে তবে বাড়ি ফিরবে। কিন্তু বাতাস উঠল না, এল গুমোট!

    চিরন্তন ভাবল, বেহালা চলে গেলে হয়। এক্ষুনি বাড়ি ফেরার কোনও মানে হয় না। ফিরলেই তো সংসারের যাবতীয় বিরক্তিকর সমস্যাগুলোর খবর কানে আসবে। চিরন্তনকে কেউ সে সব সমস্যার সমাধান করতে ডাকে না অবশ্য, কিন্তু কানে আসাও যে বিরক্তিকর।

    মানুষ যে কী করে আসন্ন সন্ধার কোমল মাধুর্যটুকু ছিন্নভিন্ন করতে পারে রেশনের চিনির পরিমাণ নিয়ে হাহাকার করে, এ চিরন্তন ভেবেই পায় না। অথচ প্রায়শই ওই হাহাকারটারই মুখোমুখি হতে হয় চিরন্তনকে। কারণ সেটাই হচ্ছে শাশ্বতীর চা তৈরির সময়। সে সময় দাদা ফেরে অফিস থেকে, বউদি এসে বসে রান্না সেরে, আর ধ্রুবময় নীচের তলা থেকে উঠে আসে।

    ধ্রুবময় অবশ্য অনেকক্ষণ আগেই তার স্কুলের মাস্টারি সেরে ফেরে, কিন্তু ধ্রুবময়ের জন্যে কেউ আগে আগে চা বানাবার কথা ভাবতেই পারে না।

    চিরন্তন মাঝে-মাঝে অফিস থেকে বেরিয়েই বাড়ি ফেরে, সে দিন ওই চা-পর্বের দর্শক অথবা বলা চলে অংশীদার হতে হয় ওকে। এবং প্রায় সবদিনই আধ চামচ চিনি, এক ফোঁটা সুইটেক্স, আর এক মুঠো হাহাকার মিশ্রিত চা গলা দিয়ে নামাতে হয় তাকে।

    চিনির বরাদ্দটা যে অনেকদিন থেকেই স্থিরীকৃত হয়ে আছে, এবং কোনও অলৌকিক মন্ত্রবলেই তার আশু পরিবর্তনের কোনও আশা নেই, এ সত্যটা যেন ওরা কিছুতেই মানতে রাজি নয়। চিরন্তনের এগুলো অসহ্য লাগে। চিরন্তন বিরক্তি বোধ করে। চিরন্তন সংকল্প করেদুর, কাল থেকে রাস্তায় ঘুরে দেরি করে ফিরব। ওই ভয়ানক দামি চায়ে আমার কাজ নেই।

    চিরন্তনের আরও একটা জিনিস বিরক্তিকর লাগে। চিরন্তন লক্ষ করে শাশ্বতী অন্য আর সকলের চা ঢাললেও, ধ্রুবময়ের পেয়ালার চা-টায় বউদি তাড়াতাড়ি এসে হাত লাগায়। বউদির সেই হাত লাগানোর কৌশলে সেই পেয়ালায় ওই আধ চামচ চিনিটুকুও শুন্যের অঙ্কে গিয়ে ঠেকে। ধ্রুবময়ের চায়ে শুধু এক ফোটা সুইটেক্স।

    তা ছাড়া ধ্রুবময়ের জলখাবারের প্লেটেও তারতম্যের ছাপ। ধ্রুবময়ের প্লেটে পুড়ে যাওয়া টোস্ট, ধ্রুবময়ের প্লেটে আধকাঁচা পাঁপর, ধ্রুবময়ের প্লেটে না-ফোলা লুচি।

    ইচ্ছে করেই যে ধ্রুবময় স্পেশাল বানানো হয় তা অবশ্য নয়, তবে তার ভাগ্যে জুটে যায় স্পেশাল। কারণ রান্নাবান্নার বিভাগটা বউদির হাতে, এবং বউদিকে আর যাই হোক পাকা রাঁধুনি আখ্যাটা কেউ দেবে না। তার হাতে কিছু পুড়বে, কিছু কাঁচা থাকবে, কিছু কুদর্শন হবে। হবেই। আর হবেই যখন, তখন সেগুলোর সদগতি হবে কার ওপর দিয়ে? ধ্রুবময় ছাড়া?

    চিরন্তনের এ সব বড় খারাপ লাগে। প্রথম প্রথম চিরন্তন এ বিষয়ে নজর দিতে চেষ্টা করেছে, কিন্তু তাতে হিতের অপেক্ষা অহিতই ঘটেছে। বউদি লাল মুখে নিজের প্লেটটা ধ্রুবময়ের দিকে সরিয়ে দিয়ে, তার অখাদ্যটা নিজের দিকে টেনে বলেছে, বুঝতে পারিনি! যা ছিল সব টেবিলে এনে বসেছি, বেছে বেছে খারাপটাই যে ধ্রুবর পাতে দিচ্ছি, এমন কথা স্বপ্নেও ভাবিনি।

    অতঃপর পরিস্থিতি যা হবার হয়েছে।

    ধ্রুব কাঠ হয়ে গিয়ে কিছুই খেতে পারেনি, চিরন্তনের দাদা নিত্যধন আধখাওয়া পাত ফেলে উঠে গেছে কালিবর্ণ মুখে, শাশ্বতী ভয় রাগ দুঃখ ঘৃণা সব কিছুর বাহক হয়ে বসে থেকেছে, আর বউদি সেই অখাদ্যের উপচারগুলি সোনা হেন মুখ করে বসে বসে খেয়ে দেখিয়ে দিয়েছে মোটেই সেগুলো অখাদ্য নয়।

    এ পরিস্থিতি সৃষ্টি করেও তো সুখ স্বস্তি নেই। তার চেয়ে অফিস থেকে বেরিয়ে কেটে পড়াই শ্রেয়।

    চিরন্তন তাই ভাবল, বাতাস যখন উঠল না, তখন বরং বেহালায় চলে গেলে হয়।

    কিন্তু বেহালায় কি দক্ষিণে বাতাসের চাষ হয়?

    বেহালার তেমন কোনও গুণ আছে কিনা চিরন্তনই জানে। তবে বেহালার বাস ধরবে বলেই ফুটপাথের ধারে দাঁড়াল চিরন্তন, আর দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে একটা সম্পূর্ণ অবান্তর কথা ভাবতে লাগল। অথচ এই ভাবনাটা অনেক অনেক আগে ভেবে উত্তর সংগ্রহ করে ফেলে নিশ্চিন্ত হওয়ার কথা।

    কিন্তু আজই হঠাৎ এই গুমোটের বিকেলে টালিগঞ্জের একটা রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে কথাটা মনে এল চিরন্তনের।

    আমাদের এমন বাহারি বাহারি নাম রাখল কে? দাদা নিত্যধন, আমি চিরন্তন, আমার বোন শাশ্বতী…তিনটে নামের মধ্যেই একটা অক্ষয় অব্যয় ভাবের ইশারা। অর্থাৎ নামগুলোর মধ্যে উচ্চ চিন্তার ছাপ আছে।

    কিন্তু এই উচ্চ চিন্তাটি করেছিল কে? বাবা? যিনি কলকাতা কর্পোরেশনে ছেষট্টি টাকা থেকে শেষত তিনশো টাকা মাইনের চাকরি করে সংসার চালিয়ে, তিনটে ছেলেমেয়েকে লেখাপড়ার খরচ জুগিয়ে, তিপ্পান্ন হাজার টাকার একখানা বাড়ি করে রেখে গেছেন?

    না কি নামের ক্রেডিট আমার মায়ের?

    চিরন্তনের জ্ঞানগোচরে যাঁর চিন্তার পরিধি তেল নুন লকড়ির মধ্যেই সীমাবদ্ধ, যাঁর কর্মের কারুকলা বড়ি, আচার, গুল, খুঁটে, আর চটের আসনের মধ্যেই আবর্তিত! চিরন্তনের জ্ঞানে কখনও মার হাতে একটা বই দেখেছে বলে মনে পড়ে না।

    এঁদের দ্বারা এই উচ্চ এবং সূক্ষ্ম চিন্তার কাজ সম্ভব, তা মনে হল না চিরন্তনের। তবে কি মামার বাড়ি থেকে নামকরণ হয়েছে ওদের? হায়, সেখানেই বা কে? চিরন্তনরা যখন একে একে পৃথিবীতে অবতীর্ণ হয়েছে, তখন তার মাতুলতুলে দিদিমা ব্যতীত আর তো কেউ বর্তমান ছিল না। সেই দিদিমা, যিনি বানান করে করে রামায়ণ-মহাভারত পড়তেন। অবশ্য অধ্যবসায় ছিল বুড়ির। কিন্তু?

    আবার পিতৃকুলেই ফিরে এল চিরন্তন, আর হঠাৎ বিদ্যুৎবিকাশের মতো একটা কথা তার মনে হল, আর মনে আসার সঙ্গে সঙ্গে হেসে উঠে প্রায় উচ্চারণ করে বলল, আরে, আমি কি বুন্ধু! এটা এতক্ষণ মনে আসেনি। এ নাম যে আমাদের বংশের ঐতিহ্যের ধারারক্ষক। ঠাকুরদার নাম ছিল অবিনাশ, জেঠামশাইয়ের নাম অক্ষয়, বাবা ছিলেন অনাদি, কাকা অনন্ত।…এরপর বাড়িতে যেই শিশুর আবির্ভাব ঘটেছে, নিশ্চয়ই অভিধান খুলে দেখা হয়েছে কোন শব্দটি চয়ন করে নিলে সেই ধারাটি রক্ষিত হবে।

    অতএব ওর মধ্যে থেকে উচ্চ চিন্তা না খুঁজলেও চলবে।

    চিরন্তন যেন স্বস্তি পেল।

    একটা দুর্বোধ্য অঙ্ক মিলে গেলে যে স্বস্তিটা পাওয়া যায় সেই ধরনের স্বস্তি। তার সঙ্গে কিঞ্চিৎ পরিমাণে কৃতজ্ঞতাবোধ। কাকা ঠাকুরদার বদলে তার নামটাই যে অবিনাশ অথবা অনন্ত হয়ে যায়নি, এই বাঁচোয়া। তার নামকরণকর্তাদের কাছে তো চিরন্তন আর অনন্ত অবিনাশে পার্থক্য কিছু ছিল না। নিত্যধন নামটিও ওই দাদাকেই মানায়। চিরন্তন নিজ নামে সন্তুষ্ট।

    কিন্তু হঠাৎ নাম নিয়েই বা চিন্তা এল কেন আমার? চিরন্তন আর একবার হেসে উঠে ভাবল, তিরিশটা বছর ধরে তো এই নামের অধিপতি হয়ে চরে বেড়াচ্ছি। তারপর ভাবল, আমার বাড়ি থেকে আমি যা যা পেয়েছি, তার হিসেব কষতে বসা থেকেই বোধ হয় এই চিন্তা।

    ঘ্যাঁচ করে কাছ ঘেঁষে একখানা গাড়ি থামল। নীল আর সাদার যুক্ত প্রচেষ্টায় গাড়িটি সুন্দর। চিরন্তনের পরিচিত গাড়ি।

    গাড়ি থেকে একটি পরিচিত গলাও গলা বাড়াল, এই চিরো, সঙের মতন রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছিস যে? উঠে আয়।

    চিরন্তন অবশ্য এককথায় উঠে এল না; বলল, না, আজ থাক, অন্য জায়গায় যাচ্ছি।

    সেটা অন্যদিন যাস। আজ আমি তোর জন্যেই পথে পথে গাড়ি নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছি। আয় বাবা, আর ভোগাসনে—

    অগত্যাই সেই নীলে সাদায় সুন্দর গাড়িটার ভিতরে উঠে এল চিরন্তন, যার গদিটা লালে কালোয় অভিনব। পছন্দ আছে গাড়ির মালিকের।

    উঠে বসে বলল চিরন্তন, আমার জন্যে পথে পথে ঘুরে বেড়াচ্ছিস মানে? গ্রেপ্তারি পরোয়ানা আছে নাকি?

    আছেই তো। না থাকলে এত ভুগে মরি? মিসেসের কড়া হুকুম, জীবন্ত অথবা মৃত তোমাকে আজ তার এজলাসে নিয়ে গিয়ে ফেলতেই হবে।

    ওরে বাস! কারণটা কী? কিছু খোয়া গিয়েছে নাকি?

    খুব সম্ভব। তলবের চেহারাটা প্রায় সেই রকমই। মূল্যবানই কিছু গেছে বোধ হয়, এবং সন্দেহ করা যাচ্ছে কাজটা তোমার

    তোদের সংসারে মূল্যবান জিনিসপত্র বুঝি খোলা জায়গায় পড়ে থাকে?

    জানি না ভাই। আদৌ জানি না জিনিসটা আসলে ছিল কিনা। আমি তো কোনওদিন দেখিনি।

    দেখবার চেষ্টা করেছিলে কোনওদিন?

    খেয়াল নেই করেছিলাম কি না। তবে আপাতত মনে হচ্ছে ছিল কোথাও কোনও আয়রণ চেস্টে তোলা। গড জানে। কিন্তু তুই হঠাৎ হাওয়া হয়েছিস কেন? দেখতে পাচ্ছি তোর অদর্শনে শ্রীমতী কদিন যেন সর্বহারার প্রতিমূর্তি হয়ে বেড়াচ্ছে। মেজাজ খাপা, খিদে কম, ঘুম নেই, শেষ পর্যন্ত চক্ষুলজ্জার মাথা খেয়ে বলল, লোকটা যে হঠাৎ বেপাত্তা হয়ে গেল, তা দেখবে তো, আছে না মরেছে! তখনই টের পেলাম আমার কপাল ভেঙেছে।

    চিরন্তন ভুরুটা একটু কোঁচকায়, মুখটা একটু বিকৃত করে, তারপর তেতো তেতো গলায় বলে, আর তুই সেই ভাঙা কপাল নিয়ে আমার জন্যে হৃদয়দ্বার খুলে ঘুরে বেড়াচ্ছিস?

    কী করব বল, জীবে দয়া বলেও তো একটা কথা আছে!

    চিরন্তন সামান্য গম্ভীর হয়।

    বলে, তোর বউ একটা পরপুরুষের জন্যে পাগল, আর তুই পেট্রল পুড়িয়ে বউয়ের সেই প্রেমাস্পদকে খুঁজে বেড়াচ্ছিস, এর থেকে হাস্যকর আর কী আছে আমি তো জানি না।

    তোর জানার বাইরেও অনেক কিছু আছে। আমিই কি জানতাম, যে-মেয়েমানুষ স্বক্ষেত্রে আইসক্রিম, সেই মেয়েমানুষই অন্য ক্ষেত্রে অগ্নিবৎ হতে পারে। বাস্তবিক ওর মধ্যে যে এত আবেগ আছে, এত অস্থিরতা আছে, তা কোনওদিন টেরই পাইনি। অবশ্য সে সব আমার জন্যে নয়। মৃদু হাসে রামানুজ।

    চিরন্তনের দীর্ঘকালের বন্ধু। প্রাক্ বিবাহযুগ তো বটেই, প্রাক্‌ কলেজযুগও।

    চিরন্তন এবার একটু খাড়া হয়ে বসে, কটু গলায় বলে, তা এ সব আমায় শোনাতে বসেছিস কেন? আমাকে কি সেই অগ্নিতে পুড়ে মরতে বলছিস?

    আমি অন্য আর কিছুই বলছি না–রামানুজ খাপছাড়া গলায় বলে, আমি শুধু আমায় বাঁচাতে বলছি।

    তোমায় বাঁচাতে? চিরন্তন বলে, তোমাকে বাঁচাবার আর স্কোপ কোথায়? তুমি অলরেডি মরেই আছে।

    মৃতদেহটারও তো একটা সৎকারের দরকার। রামানুজ প্রায় কাতরকণ্ঠে বলে, তোকে আর কিছু করতে হবে না ভাই, শুধু দৈনিক একবার করে দেখা দিবি?

    চমৎকার! চিরন্তন তীব্র গলায় বলে, আমার কাজকর্ম নেই? তুমি না হয় একটা গাড়োল নপুংসক, তাই তোমার স্ত্রীর মনোরঞ্জনাৰ্থে অপর একটা পুরুষকে আদর করে বাড়িতে নিয়ে যাচ্ছ। কিন্তু আমি? আমি যাব কী করতে? আমি তো তোর বউয়ের প্রেমে পড়িনি?

    রামানুজ আলগা আলগা উদাস গলায় বলে, পড়তেও তো পারিস। প্রেমে পড়ার পক্ষে খুব একটা অনুপযুক্তও নয় সে! সুন্দরী, সুশিক্ষিতা, বাকপটু, কর্মদক্ষ, সংগীতে পারদর্শিনী ।

    বলে যা, আরও বলে যা, থামলি কেন? বলতে বাধা কী? জগতে যত রকম গুণ থাকা সম্ভব তা তোর বউয়ের মধ্যে বিদ্যমান, কিন্তু আমাকে খুব বেশি বিগলিত করতে পারবি না বাবা! তোর বউকে আমি তোর বউ হিসেবেই দেখে আসছি, হঠাৎ তোর হুকুমে প্রেমিকা ভাবতে পারব না।

    চিরন্তনের কণ্ঠ রূঢ়।

    অথচ এতে রামানুজের তো অপমানিত হবার কথা, রামানুজের তো আহত হবার কথা, কিন্তু সে তা হয় না কেন? এ সব কি তবে তার ছল? সে কি এই ছলনার জাল পেতে তার বন্ধুকে পরীক্ষা করতে চায়?

    তাই সে চিরন্তনের রূঢ় প্রত্যাখ্যানের পরও মিনতির গলায় বলে, দোহাই তোর চিরো, তুই অন্তত অভিনয়ও কর। আগে তো কলেজ সোশ্যালে কত অভিনয় করেছিস, সেই বিদ্যেটাই একটু কাজে লাগা না? কবি মানুষ পারবি ঠিক। চিরন্তনকে সহপাঠীরা মাঝে-মাঝে কবি বলে, কারণ কবিতা লেখা তার আসে।

    এই কথার খেলার মধ্যেও গাড়িটা রামানুজ নির্ভুল চালাচ্ছিল। স্টিয়ারিং ধরা হাতটা তার দৃঢ় বলিষ্ঠ, আঙুলে দু দুটো আংটি, মাঝে-মাঝে কোনখান থেকে আলোর চিলতে এসে পড়ে ঝিকমিক করে উঠছে। রামানুজের পরনে দামি কাপড়ের প্যান্ট, শৌখিন কাপড়ের বুশ শার্ট, সুগৌর এবং সুপুষ্ট কব্জিতে যে ঘড়িটা বাঁধা সেটাও নিঃসন্দেহে দামি।

    রামানুজকে অতএব বলা যায় রূপবান, বিত্তবান, হৃদয়বান। হ্যাঁ, হৃদয়বানই বা নয় কেন? স্ত্রীর হৃদয়দৌর্বল্যের দাওয়াই জোগাড় করতে যে ব্যক্তি এহেন দৈন্য স্বীকার করতে পারে, অপরে আসক্ত স্ত্রীকে গুলি করে না মেরে, তার সেই প্রেমাস্পদকে নিয়ে এসে উপঢৌকন দিতে চাইতে পারে, তাকে তো দেবদুর্লভ হৃদয়ের অধিকারী বলাই উচিত।

    আচ্ছা লোকটা যদি এতই গুণসম্পন্ন, তবে তার স্ত্রী এমন বেয়াড়া হয় কেন?

    স্ত্রীজাতির প্রথম প্রার্থনা তো বিত্ত, সেটা রামানুজের আছেই দেখা যাচ্ছে তার দ্বিতীয় প্রার্থনা রূপ, সেটাও তো প্রত্যক্ষই; আর তার তৃতীয় প্রার্থনা সহানুভূতিসম্পন্ন হৃদয়; তা তাতেও রামানুজের পুরো নম্বর পাবার কথা। তবে?

    কোনও কোনও মেয়ে অবশ্য আরও একটা জিনিসের জন্যে সব কিছু তুচ্ছ করতে পারে, সেটা হচ্ছে প্রতিষ্ঠা। প্রতিষ্ঠা লাভই তাদের জীবনের চরম কাম্য।

    কিন্তু তা হলেও তো কোনও যুক্তিতে এসে পৌঁছনো যাচ্ছে না। রামানুজের স্ত্রী তার প্রতিষ্ঠাবান স্বামীকে ছেড়ে স্বামীর একটা হতভাগা শুধু কেরানি বন্ধুকেই বা তবে ভজতে যাবে কেন?

    শুধুই অহেতুক প্রেমের দায়ে?

    যার ফাঁদ পাতা আছে ভুবনে?

    তা সে প্রেম কি কেবল একতরফা হয়? এক হাতে কি করতাল বাজে?

    চিরনের রূঢ় ভাষণের পিঠে সেই কথাটাই বলতে পারত রামানুজ মুচকি হেসে, প্রেমিকা ভাবতে পারবে না এটাই বা বিশ্বাস করি কী করে? এক হাতে কি করতাল বাজে?

    কিন্তু সে কথা বলল না রামানুজ, রামানুজ মিনতি করে বলল, না হয় একটু অভিনয়ই কর বাবা!

    চিরন্তন একটা সিগারেট বার করে হাতে ঠুকতে ঠুকতে বলে, আচ্ছা বল দিকি এতে তোর লাভটা কী?

    আমার!

    রামানুজ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, আমার লাভ ওর মুখের হাসি। আমার লাভ ওর মুখের প্রকৃতিস্থতা। তোকে নিয়মিত দেখতে পেলেই ওর মাথা-মেজাজ ভাল থাকবে।

    এই ধারণাটির সৃষ্টি হল তোর কী করে, সেটা খুলে বল দিকি?

    এ সবের কি আর খুলে বলবার মতো স্পষ্ট কোনও উপাদান থাকে? তবে এটা নিশ্চিত এখন ওর মানসিক অবস্থা যে রকম, তাতে তোর দীর্ঘ অনুপস্থিতিতে পাগলফাগল হয়ে যাওয়া বিচিত্র নয়।

    আমার কি ইচ্ছে হচ্ছে জানিস? তোকে খুন করি।

    দোহাই বাবা ওইটি করিস না, জীবনে অনেক কিছু করবার আছে আমার। খুন হয়ে গেলে সেগুলো করে যেতে পারব না।

    রামানুজের বাড়ির কাছে এসে গিয়েছিল ওরা।

    চিরন্তন সহসা বলে ওঠে, রামানুজ, আমায় ছেড়ে দে।

    ছেড়ে দে!

    হ্যাঁ, নেমে যেতে দে। আমার ভাল লাগছে না।

    আমার উপকার করছিস ভেবে চল।

    দেখ আদৌ মন লাগছে না। খুব খারাপ লাগছে।

    রামানুজ এতক্ষণে গম্ভীর হয়। বলে, সত্যিই যদি তোর এত খারাপ লাগে, তা হলে অবশ্য বলব না আর। তবে এ যদি তুই না হয়ে অন্য কেউ হত, আমি তাকে পারিশ্রমিক কবলাতাম।

    কী কবলাতিস?

    চিরন্তন তীক্ষ্ণ হয়।

    কিন্তু রামানুজ অবিচলিত, পারিশ্রমিক, বা বলতে পারিস ঘুষ। কিংবা তাও না বলিস তো ডাক্তারের ফিজ। আমার স্ত্রীর একটি জটিল ব্যাধি জন্মেছে, সারাবার জন্যে আমি টাকা খরচ করব এটা কিছু আশ্চর্য কথা নয়।

    প্রকারান্তরে কী বলতে চাচ্ছিস তুই বল দিকি? চিরন্তন কড়া গলায় বলে, তোর স্ত্রীর মনোরঞ্জনার্থে যদি আমি বাঁদর নাচতে রাজি হই, তুই আমায় উপযুক্ত মজুরি দিতে প্রস্তুত আছিস?

    বাড়ির সামনে এসে পড়েছে ওরা। রামানুজ গাড়ি থামিয়েছে, তবু নামবার তাড়া না করে রামানুজ উদাস গলায় বলে, তোকে এত বড় কথা বলি এমন সাহস নেই ভাই, বলছিলাম, আর কেউ হলে বলতাম।

    তোমার স্ত্রীর জন্যে বাঁদর নাচাবার বাঁদর জোগাড় করে দেওয়ার বদলে, নিজে তাঁর জন্যে একটু সময় দাও না। তোমার সর্বদা কাজ, অতএব সে ভদ্রমহিলা নিঃসঙ্গ, কাজেই কিছু মানসিক জটিলতা আসাই স্বাভাবিক।

    এই তো বুদ্ধিমান যুবক, তুমি যে কথাটা এত সহজে বুঝলে, আমার সেটা বুঝতে পুরো পাঁচ বছর লাগল। মাঝখানে আবার ভিলাইতে বদলি হয়ে তিন বছর থেকে, ও যেন আরও কেমন–কিন্তু এখন আর আমার দ্বারা কিছু হবে না।

    তুমি একটি বুদ্ধু।

    একশোবার। কিন্তু একটা কথা বলে রাখি চিরো, আমি যে তোকে ওর এই মানসিক অবস্থার কথা বলেছি, তা যেন ফাঁস করিসনে, তা হলে আমায় আরও শত্রু ভাবতে শুরু করবে।

    তোকে কি শত্রুও ভাবে নাকি?

    না, মানে শত্রু ঠিক নয়, যত্নটত্ন সবই করে, তবে কেমন যেন প্রতিপক্ষ প্রতিপক্ষ ভাব।

    এই কথা! চিরন্তন হেসে ওঠে, সে চিরকালীন ঘটনা। স্ত্রী স্বামীকে প্রতিপক্ষ ভাবছে না, এমন নজিরই তো বিরল।

    রামানুজ বলে, আচ্ছা কেন বল দিকি? তুই সাইকলজির স্টুডেন্ট ছিলি, তুই-ই বলতে পারবি, এ রকমটা কেন হয়?

    কী মুশকিল, এটা তো অতি সহজ প্রশ্ন। এর উত্তরের জন্যে সাইকলজির ছাত্র না হলেও চলে। মহিলাদের চাহিদা অনন্ত, এটা তুই অবশ্যই মানিস? অন্তর বাহিরের সেই অনন্ত চাহিদা নিয়ে সে একটি ক্ষুদ্র প্রাণীর গলায় মালা দিয়ে বসে। মানে দিতে বাধ্য হয়। অতএব প্রতিপদে তার বাসনার সঙ্গে বাস্তবের বিরোধ, চাহিদার সঙ্গে প্রাপ্তির বিরোধ। তার মনের মধ্যে যে ষড়ৈশ্বর্যশালী পুরুষ কীর্তির কল্পনা, এই ক্ষুদ্র প্রাণীটা তো সে মূর্তির ধারে কাছেও পৌঁছয় না! কাজেই মহিলাটির সর্বদাই মনের মধ্যে বিক্ষোভ, এই হতভাগাটার হাতে পড়েই আমার সমস্ত সম্ভাবনা নষ্ট হয়ে গেল। তখন অহরহ ত্রুটি আবিষ্কার, অহরহ সমালোচনা, আর অহরহ বাদ-বিসংবাদ। অতএব প্রতিপক্ষে পরিণত!

    রামানুজ মৃদু হেসে বলে, বিয়ে না করেও দাম্পত্য জীবনের এই সব নিগূঢ় তত্ত্ব জানলি কী করে?

    বিয়ে না করেই তো জানা স্বাভাবিক! চিরন্তন হেসে ওঠে, শোভাযাত্রার যাত্রীরা কি তাদের যাত্রার শোভাটা দেখতে পায়? সমুদ্রে পড়ে হাবুডুবু খাওয়া ব্যক্তি কি টের পায় ঢেউয়ের সৌন্দর্য কী?

    তোর সঙ্গে কথায় কোনওদিনই পারিনি, রামানুজ বলে, হার মানছি। কিন্তু ভাই ওই যা বললাম, আমি তোকে এইসব বলেছি মোটেই বলবি না রীতাকে।

    চিরন্তন ওর ভয় দেখে হেসে ওঠে।

    বলে, আরে আমি তো ভাবছি গিয়েই আগে প্রশ্ন করব জীবিত অথবা মৃত আমির জন্যে কত টাকা পুরস্কার ঘোষণা করেছেন আপনি?

    ওই তো, ওই থেকেই আগুন জ্বলে উঠবে। ঠাট্টা-তামাশার ব্যাপারটা সে আবার তেমন বোঝে না কিনা।

    তুই এমন ভাব করছিস যেন তোর বউকে আমি ইতিপূর্বে দেখিনি।

    দেখেছিস। তবে এমন বিরহজর্জরিতরূপে তো দেখিসনি? আমাদের ভিলাই থেকে ফেরার পর তুই রোজ এসেছিস আমার এখানে। হঠাৎই যে কেন—

    গাড়ির দরজাটা খুলে নেমে, এদিকের দরজাটা খুলে ধরল রামানুজ। আর চিরন্তন নামতেই আবার গাড়িতে উঠে স্টার্ট দিয়ে ইশারায় বলল, যা তবে ভিতরে।

    যা তবে মানে? চিরন্তন অবাক হয়ে বলে, আর তুই?

    আমি? আসছি এক্ষুনি, একটু কাজ আছে।

    চিরন্তন বলল, এটা দারুণ অসভ্যতা হল তোর।

    কিন্তু সে কথা শুনতে পেল না রামানুজ।

    গর্জন তুলে বেরিয়ে গেছে ততক্ষণে।

    আমি ওর হাতের পুতুল না হতে পারি, চিরন্তন ভাবল দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে, আমি না ঢুকতে পারি, আমি চলে যেতে পারি। ও ওর পাগল বউয়ের পাল্লায় আমায় লেলিয়ে দিয়ে কেটে পড়ল, আমি অসহায়ের মতো ওর সেই উদ্দেশ্য সিদ্ধির উপকরণ হব?

    কিন্তু রামানুজ যেভাবে চিত্রিত করল রীতাকে, রীতা কি সত্যিই তাই? কবে এমন অ্যাবনর্মাল হয়ে উঠল রীতা? কই, চিরন্তন তো এর আগে লক্ষ করেনি? অবশ্য আসেনি অনেক দিন। হিসেব করল মনে মনে।

    অন্তত মাস ছয় সাত।

    এর মধ্যে একদিন রামানুজ চিরন্তনের বাড়িতেও এসেছিল খোঁজ নিতে। চিরন্তন ছিল না, এসে শুনল শাশ্বতীর কাছে।

    আশ্চর্য, তবুও যায়নি চিরন্তন রামানুজের বাড়ি। এমনকী কোনও মতে একটা যোগাযোগও করেনি। নিজের অফিস থেকে রামানুজের অফিসে ফোন করার অভ্যাসও তো ছিল আগে।

    বন্ধু অথবা বন্ধু-গৃহ সম্পর্কে এতটা ঔদাসীন্য হল কেন চিরন্তনের?

    নিতান্তই অকারণ?

    স্বভাবগত খামখেয়াল?

    না কি ছমাস পূর্বের সেই কারণটা? কিন্তু তাকে কি একটা কারণ বলে? উল্লেখ করলে কি কোনও একটা ঘটনা বলেই মনে হবে?

    বন্ধুর স্ত্রী একদিন একখানা বই নিয়ে শখের কাড়াকাড়ি করতে গিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরেছিল, এটা কি একটা ঘটনা?

    বইখানা কিছুই নয়, একটা বাজে ডিটেকটিভ গল্প, শাশ্বতীর অনুরোধে পড়ে অফিস ফেরার পথে লাইব্রেরি থেকে নিয়েছিল চিরন্তন। সঙ্গে ছিল। অদ্ভুত মেয়ে রীতা, স্বামীর বন্ধুর অফিস ব্যাগ হাঁটকাতে বসল। বলে কিনা, দেখি কারও প্রেমপত্র অথবা ফোটোগ্রাফ বয়ে বেড়াচ্ছেন কি না। কবি-টবিরা এমন সঙ্গে ছিল।

    অন্যদিন হলে চিরন্তন হেসে বসে থাকত বৃথা শ্রম করছেনবলে। কিন্তু সেদিন চিরন্তনের ওই বইটা নিয়ে হয়েছিল জ্বালা। অস্বীকার করে লাভ নেই, চিরন্তনের মনে হয়েছিল, রামানুজের বউ দেখে পাছে ভাবে চিরন্তন এইসব বাজে বই পড়ে। চিরন্তন কিছু আর কৈফিয়ত দিতে বসবে না যে, বইটা সে বোনের জন্যে নিয়ে যাচ্ছে। সেটা আরও লজ্জার।

    তাই চিরন্তন ফস করে বইটা তুলে নিয়েছিল।

    কী সরালেন?

    রীতার গলায় ঘনীভূত সন্দেহ।

    চিঠি নয়, ফোটো নয়, একখানা বই মাত্র।

    দেখি কী বই? কার উপহার দেওয়া?

    আরে রাম রাম, মলাট দেখছেন না? লাইব্রেরির বাঁধাই।

    বইটা কী?

    ও ছেলেমানুষদের দেখতে নেই।

    ইস ছেলেমানুষ! নিজে আনম্যারেড হয়ে এত পাকামি! নিশ্চয় কোনও ঘোরালো বই, দিন শিগগির–

    উঁহু

    ভাবছেন কেড়ে নিতে পারি না?

    কেড়ে? হু! একদা মুষ্টিযোদ্ধা ছিলাম!

    ভারী মুষ্টিযোদ্ধা রীতা প্রায় ঝাঁপিয়ে এসেছিল, আমার হাতের জোর দেখবেন? হি হি করে বেদম হেসেছিল রীতা।

    কথার পিঠে কথা, ঘটনার পিছে ঘটনা, চিরন্তন দাঁড়িয়ে উঠে হাতটা উঁচু করে বইটা আঙুলের আগায় ধরে হাসতে লাগল, নিন এবার? আমার হাঁটুর বয়সী, মাপে বুড়ো আংলা–!

    রীতা অবশ্য মাপে একটু ছোটখাটো, মাজাঘষা টাইট গড়নের অ-দীর্ঘাঙ্গী সুন্দরী। তা বলে বুড়ো আংলা? হাসতে হাসতে আর লাফালাফি করতে করতে রীতার মুখ লাল হয়ে উঠেছিল, খোঁপাটা পিঠে ভেঙে পড়েছিল, কাঁধের আঁচল হাতের উপরে এসে পড়েছিল, আর বুকটা ওঠাপড়া করছিল তার।

    সেই বিস্রস্তমূর্তিতে রীতা চিরন্তনকে জড়িয়ে ধরে ওর বাহুমূলটা আঁকড়ে টেনে নামাতে চেষ্টা করে, গাছের ডাল নুইয়ে ফুল পাড়ার ভঙ্গিতে।

    তখন রামানুজ বাড়ি ছিল না, রামানুজের চাকর রাঁধুনিরা নীচ তলায় কাজে ব্যস্ত, সারা দোতলাটায় শুধু নিঃসম্পর্কিত দুই যুবকযুবতী। অবস্থাটা সহসা চোখে পড়ল চিরন্তনের। অথচ এতক্ষণ পড়েনি চোখে। এতক্ষণ নিতান্তই ছেলেমানুষী খেলা খেলছিল।

    চিরন্তনের মনে হল, রীতার এই সমস্তই ছল। বইটা তার মূল উদ্দেশ্য নয়, কাড়াকাড়িটাই মূল উদ্দেশ্য। ওই রকম একটা কিছু করবে ভেবেই ব্যাগ হাঁটকাতে বসেছিল।

    চিরন্তনের খারাপ লাগল।

    কেউ কোনও মতলব নিয়ে কাজ করছে দেখলেই খারাপ লাগে চিরন্তনের। বরাবরই লাগে। তাই চিরন্তন বইটা হাত থেকে ফেলে দিয়ে সোফায় বসে পড়ে বলল, হার মানলাম।

    রীতা কিন্তু বইটা আর কুড়িয়ে দেখল না। রীতা আঁচল গুছিয়ে ভাঙা খোঁপা জুড়তে বসল।

    কই নিলেন না? বলল চিরন্তন

    । রীতা অবজ্ঞার গলায় বলল, ফেলে দেওয়া জিনিস আমি ছুঁই না। ছেলেবেলায় কখনও গাছের তলায় ঝরে পড়া ফুল নিইনি।

    চিরন্তনের মনে হচ্ছিল, ওই জড়িয়ে ধরাটা যেন তার গায়ে লেগে রয়েছে, চিরন্তনের কাছে সেই লেগে থাকাটা অস্বস্তির অনুভূতি বহন করছে। চিরন্তনের এখন মনে পড়ছে এই এতবড় দোতলাটায় তৃতীয় ব্যক্তি নেই। নীচের তলাটাতেও দুতিনটে ভৃত্য মাত্র।

    চিরন্তন বলল, রামানুজের ফিরতে দেরি হবে?

    জানি না।

    বলে না আপনাকে?

    কে শুনতে চায়?

    আমার বন্ধুর স্বার্থের দিক থেকে বলছি, এটা খুব খারাপ।

    সে তো বলবেনই রীতা আঁচলটা তুলে জোরে জোরে মুখের ঘাম মুছতে মুছতে বলে, স্বজাতিপ্রীতির আধিক্যে লোকের বিচারবিবেচনার চোখ অন্ধ হয়ে যায়।

    উপায় কী! যায় যখন, তখন ওটাই কমন? আচ্ছা উঠি।

    সে কী, উঠবেন কী? চা খাবেন না?

    না।

    কেন? রীতা তীব্র হয়।

    ভাল লাগছে না।

    ভাল লাগছে না? না ভয় লাগছে?

    ভয়? হঠাৎ ভয়ের কী হল?

    নিজেকে জিজ্ঞেস করুন।

    নিজের কথা আমার জিজ্ঞেস করে জানতে হয় না। ভয় বস্তুটা আমার ধারে কাছে আসতে পায় ন। যেটা লাগছে সেটা হচ্ছে খারাপ।

    খারাপ? খারাপ লাগছে আপনার?

    হ্যাঁ!

    স্পষ্ট পরিষ্কার উচ্চারণ চিরন্তনের।

    কেন, শুনতে পাই না?

    দেখুন, খারাপ লাগা, ভাল-লাগা–এগুলোর কোনও কারণ নেই। একদিন দেখেছিলাম আপনি একটা হালকা নীল শাড়ি পরে আর একগোছা হালকা গোলাপি সিজন ফ্লাওয়ার চুলে গুঁজে চুপ করে ওই বারান্দাটায় দাঁড়িয়ে ছিলেন, সেদিন খুব ভাল লেগেছিল, আজ খারাপ লাগছে। এর আর উপায় কী?

    সেই সেদিন বইটা কুড়িয়ে নিয়ে চলে এসেছিল চিরন্তন। মাস ছয়েকের মধ্যে আর যায়নি।

    কিন্তু কেন?

    চিরন্তন কি এত শুচিবাই?

    চিরন্তন কি একেবারে সনাতনী সংস্কারের পঙ্কে নিমজ্জিত।

    তা জানে না চিরন্তন। শুধু রামানুজের বাড়ির নামেই ওর একটা বিতৃষ্ণা জন্মে গিয়েছিল।

    কে জানে এরই নাম সংস্কার কি না। কিন্তু চিরন্তন তা মানতে রাজি নয়। চিরন্তন শুধু ভাললাগা আর ভালনা-লাগার মাপকাঠিতেই বিচার করে।

    ছ মাস পরে আজ রামানুজ বন্ধুকে প্রায় রাস্তা থেকে লুঠ করে নিয়ে এসেছে। আর এসে তাকে সম্পূর্ণ অসহায়ভাবে ছেড়ে দিয়ে সরে পড়েছে।

    চিরন্তন কি ঢুকবে?

    না কি চিরন্তন রামানুজের মতলবের শিকার হতে রাজি নয়?

    চিরন্তন চলে যাচ্ছিল।

    গেটটায় হাত লাগিয়েছিল, এই মহামুহূর্তে বোধ হয় দোতলার বারান্দা থেকে দেখতে পেয়ে রীতা নেমে এল।

    রীতাকে কিন্তু দেখে মনে হচ্ছে না উন্মাদিনী, রীতাকে বেশ ভালই দেখাচ্ছিল।

    রীতার কণ্ঠস্বরও সহজ।

    কী ব্যাপার বলুন তো? বহুকাল আর আসছেন-টাসছেন না

    চিরন্তনের মনে পড়ল রীতার সেই ঘোষণা। জীবিত অথবা মৃত চিরন্তনকে ধরে নিয়ে আসতে।

    চিরন্তনের ইচ্ছে হল সেই প্রশ্নটা করে, কিন্তু রামানুজের নিষেধটা বাধাস্বরূপ হল। তাই চিরন্তনকে ফিকে হাসি হেসে বলে উঠতে হয়, সময়টময় হচ্ছে না, এই আর কি!

    উঃ কী রাজকার্য! নীচে গাড়ির শব্দ শুনলাম যেন, সেই ছোটলোকটা আসেনি?

    লোকটা হঠাৎ ছোটলোকে পরিণত হল কেন?

    এ সব হঠাৎই হয়। তা চলুন।

    রীতা কাঁধের আঁচলটা একটু টানে।

    রীতার পিছু পিছু একটা অ্যালসেসিয়ান এসে দাঁড়ায়।

    চিরন্তন কুকুর সম্পর্কে খুব সাহসী নয়, তাই চিরন্তন ওর দিকে তাকিয়ে বিপন্ন গলায় বলে, ইনি আবার কবে থেকে এসেছেন? দেখিনি তো আগে।

    অনেক কিছুই হয়তো দেখেননি আপনি, যা দেখবেন। এ এসেছে পাঁচ মাস বারো দিন। ও বাবা, তারিখ পর্যন্ত মুখস্থ! তা এত বড় কুকুর পুষেছেন কেন? একটা ছোট বাচ্চা পুষতে পারেননি?

    রীতা খিলখিল করে হেসে ওঠে, বাচ্চাই তো পুষেছিলাম। এতটুকু বাচ্চা! বাচ্চাটা ধাড়ি হয়ে উঠল।

    ধ্যাৎ, এত তাড়াতাড়ি এত বড় হল?

    তা হয়। এরা তাড়াতাড়িই বাড়ে।

    পাড়ায় বুঝি চোরের উৎপাত বেড়েছে? সাবধানে পায়ে পায়ে এগোতে এগোতে বলে চিরন্তন, তাই কুকুর পুষেছেন?

    কুকুর কুকুর করবেন না চিরন্তনবাবু, এ আমার জুলজুল। …জুলজু জু উল! দুষ্টুমি করে না। উনি হচ্ছেন ফ্রেন্ড।

    সব বুঝল?

    ব্যঙ্গ করে বলে চিরন্তন।

    রীতা সগর্বে উত্তর দেয়, নিশ্চয়। মানুষের থেকে অনেক বেশি বোঝে এরা।

    রীতা বলেছিল আরও অনেক কিছু দেখবেন, যা আগে দেখেননি।

    সেটা দেখল চিরন্তন।

    রীতা আর রামানুজের ঘর আলাদা হয়ে গেছে।

    রীতা ইচ্ছে করে নিজের ঘর দেখায়, সুন্দর করে সাজানো বিছানার পাশে আলাদা একটা বড়সড় বেবি কট।

    চিরন্তন থতমত খেলে, চিরন্তন সন্দিগ্ধদৃষ্টিতে তাকাল রীতার দিকে। মাত্র ছটা মাস তো আসেনি সে, এর মাঝখানে এতবড় ঘটনাটা ঘটে গেছে? সেটা সম্ভব?

    রীতা ওর অনুক্ত প্রশ্ন টের পায়।

    রীতা হেসে ওঠে, ঘাবড়াবেন না, এই বেবি কট-এ আমার জুলজুল শোয়।

    আপনি কিন্তু আমার একটা প্রশ্নের উত্তর দেননি– চিরন্তন বলে, হঠাৎ জুলজুল পোর শখটা হল কেন? চোরের উপদ্রব?

    চোরের? তাও বলতে পারেন।

    রীতা একটু রহস্যব্যঞ্জক হাসি হাসে, তবে গয়না টাকা বাসন শাড়ি নয়, চুরির লক্ষ্য আমি। তাই নিজের ওপর পাহারা বসিয়েছি।

    চিরন্তনের মনে হল, এই সবই তবে মানসিক বিকৃতির লক্ষণ? এই অর্থহীন কথা, এই রহস্যময় হাসি?

    অথচ পরবর্তী সব কিছুই সুন্দর স্বাভাবিক।

    চা খাবার খাওয়াল রীতা যত্ন করে, বাড়ির কুশল সংবাদ চাইল, চিরন্তন আদৌ বিয়ে করবে কি না, এবং চিরন্তনের বোনের বিয়ের কী হল, সেটা জানতে চাইল। দেশের কথা, রাজনীতির কথা, সাহিত্যের কথা, অনেক প্রসঙ্গেই চরে বেড়াল। তারপর বিদায়বেলায় সহাস্যমুখে বলল, আবার আসবেন তো? না কি জুলজুলের ভয়ে পলাতক হবেন?

    তা বলে এত কাপুরুষ নই।

    কাপুরুষ নয়? রীতা লহরে লহরে হেসে ওঠে, তা ভাল। আত্মসান্ত্বনা ভাল। আমার আবার কাপুরুষ দেখে দেখে এমন বদ অভ্যাস হয়ে গেছে, পৃথিবীতে যে সত্যি পুরুষ আছে বিশ্বাসই হয় না।

    চিরন্তন সহসা দাঁড়িয়ে পড়ে। বলে, সেটা সত্যি দেখলে সহ্য করতে পারবেন না, ভয় পাবেন—

    তারপর রাস্তায় নেমে যায়।

    .

    অভিসারের উত্তেজনা নিয়ে শাশ্বতী নীচে নামছিল। যদিও চিরপরিচিত বাড়ি, আর চিরপরিচিত নায়ক, তবু উত্তেজনাটা কম নয়। সিঁড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আর একবার পিছন ফিরে তাকাল শাশ্বতী, তারপর পা টিপে টিপে নীচে নেমে এল।

    এখন মা তিনতলার ছাদে ভিজে গামছা মাথায় দিয়ে বসে তাঁর আমের আচার পাহারা দিচ্ছেন, এখন বউদি তার কোলের ছেলেটাকে ঘুম পাড়ানোর অজুহাতে দরজায় খিল দিয়ে ঘুমোচ্ছে, এখন দাদা আর ছোড়দা অফিসে, কাজেই এখনই হচ্ছে অভিসারের প্রশস্ত সময়।

    বৃন্দাবনে নাকি একদা এই অভিযানের জন্যে বর্ষার রাতটাকে প্রশস্ত বলে ধরত। কে জানে সেটা কেমন ধরনের বাস্তববুদ্ধির পরিচয়? বৃষ্টি যখন প্রবল বর্ষণে আকাশ পৃথিবী একাকার করছে, মেঘ গর্জন করছে, বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে, আর পায়ের নীচে কর্দমাক্ত পথ, ধারে কাছে গভীর বন, কেমন করে অভিসারযাত্রা সম্ভব? ভিজে নেয়ে? সিক্ত কেশে? নিউমোনিয়া হবার আশঙ্কাও কি ছিল না তখন? কিংবা না হয় আশঙ্কা ছিল না, প্রেমের কাছে সব তুচ্ছ হয়ে গিয়েছিল। অথচ আশ্চর্য, শাশুড়ি ননদের ভয়টা তুচ্ছ হয়নি, লোকনিন্দার ভয়ও নয়। এসব তুচ্ছ হলে তো অভিসারযাত্রার জন্যে অমন অদ্ভুত সময় নির্বাচন করতে হত না।

    শুধু বর্ষার রাতেই নির্ভয় নয় রাধা, আবার নীল বসনে অঙ্গ ঢাকেন, নীল কস্তুরী ললাটে লেলেন। অথচ মাথার উপর প্রবল বর্ষণ চলছে। খুব সম্ভব মজবুত ধরনের ওয়াটারপ্রুফ ব্যবহার করতেন রাধা, হাতে নিতেন জোরালো টর্চ! পায়েও কোনওনা-কোনও রবারের চটি।

    নচেৎ ওই দুর্যোগ মাথায় করে যাওয়া যায়?

    এমনিতেই তো কাজটাই দুর্যোগের মতো।

    এই যে শাশ্বতী রোদে খাঁ খাঁ গ্রীষ্মের দুপুরে শুধু উপরতলা থেকে নীচের তলায় নামছে, তাতেও তো শাশ্বতীর বুক কাঁপছে। তাতেও তো শাশ্বতীকে নামবার আগে কত আটঘাট বাঁধতে হচ্ছে। বউদি জেগে উঠেই না কোনও অসুবিধেয় পড়ে, মা হঠাৎ ছাত থেকে নেমে এসে কোন পরিস্থিতিতে পড়তে পারে, খাবার জলের কুঁজোয় জল আছে কিনা, তারে মেলে দেওয়া কাপড়গুলো ভোলা হয়েছে কিনা, এত সব দেখে তবে অভিসার।

    ধ্রুবময়ের গ্রীষ্মের ছুটি।

    ধ্রুবময় গলদঘর্ম হয়ে বসে খাতা দেখছিল

    ধ্রুবময়কে গলদঘর্ম হয়েই কাজকর্ম করতে হয়, কারণ ধ্রুবময়ের ঘরে পাখার কথা ওঠে না। আলো অবশ্য আছে একটা পঁচিশ পাওয়ারের, কিন্তু পাখা?

    গেরস্ত তো পাগল নয়।

    ধ্রুবময়ও পাগল নয় যে সে বায়না করবে।

    কিন্তু ধ্রুবময়ের জন্যে যে পাগল, সে তেমন অন্যায় বায়না করে থাকে। সে যখন তখন বলে, যা হোক কিছু রোজগারও তো করছ, ঘাড়-নড়বড়ে একটা টেবিল ফ্যান তো ভাড়াও নিতে পারো একটা সিজনের জন্যে!

    ধ্রুবময় হাসে।

    ধ্রুবময় বলে, বড়লোকি অভ্যাস করে কী হবে?

    ভবিষ্যতে বড়লোক হবে।

    দুঃখের বিষয় একালের পরিদের হাতে জাদুদণ্ড থাকে না যার অলৌকিক শক্তিবলে অসাধ্যসাধন ঘটে।

    গরিব থেকে বড়লোক হবার দৃষ্টান্ত জগতে অনেক আছে।

    গরিব থেকে গরিবই থেকে যাবার দৃষ্টান্তও কম নয়।

    তারা অক্ষম, তাদের মধ্যে কোনও উপাদান নেই।

    ধ্রুবময় সকৌতুকে বলে, তোমার কি ধারণা সে উপাদান আমার মধ্যে আছে?

    হয়তো ধ্রুবময়ের সেই প্রিয়ার মনেও সে বিষয়ে ঘোরতর সন্দেহ আছে, হয়তো সেও জানে, নেই। পরের বাড়ি পড়ে থাকা চিরকালের আশ্রিত এই ছেলেটার মধ্যে আছে শুধু নম্রতা, বাধ্যতা, সহিষ্ণুতা, সভ্যতা। আর কিছু না।

    তার মানে ওর মধ্যে জল আছে, আগুন নেই।

    তবু শাশ্বতী বাড়তি জোর দিয়ে বলে, আছে ধারণা। চেষ্টায় কী না হয়?

    কিন্তু ধ্রুবময়ের মধ্যে সে চেষ্টা নেই।

    ধ্রুবময় সামান্য একটা স্কুলমাস্টারি আর তার খাতা দেখার মধ্যেই যেন সব সার্থকতা খুঁজে পেয়েছে।

    দেখলে মাথা জ্বলে যায় শাশ্বতীর।

    আজও এত আয়োজন করে এসে সেই দৃশ্যই দেখতে পেল। খাতা দেখছে।

    ধ্রুবময় হেসে কলমটার মুখে ক্যাপ পরিয়ে সরিয়ে রেখে বলল, অতি মহৎ সংকল্প। তা দেশলাই সঙ্গে এনেছ তো? এ ঘরে তো খুঁজলে মিলবে না।

    তা জানি–শাশ্বতী তেমনি কড়া গলায় বলে, একটা সিগারেট খাবার দুঃসাহসও যে নেই ভাল ছেলের, তা জানি। তোমার এই ভালছেলেমি দেখলে কী ইচ্ছে হয় জানো?

    জানি।

    কী জানো?

    ধরে ফাঁসি দিতে।

    না। তাতেই রাগ মিটবে না। ইচ্ছে হয় ছুরি দিয়ে কেটে টুকরো টুকরো করতে।

    বাঃ কী উত্তম ইচ্ছে! শুনে বড় ভাল লাগল। তা ছুরি কি আছে? না সাপ্লাই করতে হবে?

    ধ্রুবময় যে এত কথা বলতে জানে, সে কথা শুধু শাশ্বতীই জানে। একই বাড়িতে একসঙ্গে মানুষ হয়েছে দুজনে, আজীবনের ভাব। কিন্তু সেই মানুষ হওয়ার মধ্যে এক স্ট্যান্ডার্ড ছিল না। চিরদিনই ধ্রুবময়কে বাড়ির লোক আর চাকরবাকরের মধ্যবর্তী একটা জায়গায় রাখা হয়েছে। খেতে হয়তো বসেছে একসঙ্গে, কিন্তু সেটা যেন তাকে নিতান্তই করুণা করে বসতে দেওয়া হয়েছে। করুণা আর অবজ্ঞা, বিরক্তি আর নিরুপায়তা, এর সংমিশ্রণে গঠিত একটি ভাব নিয়ে ব্যবহার করা হয়েছে তার সঙ্গে।

    তা ধ্রুবময় কোনওদিন এতটুকু অভিযোগ তোলেনি, এতটুকু দুঃখভাব দেখায়নি। রাগের কথা তো ওঠেই না।

    কিন্তু সেই ছোট্ট মেয়ে শাশ্বতীর চোখেও এটা অসহ্য ঠেকত। সে বলত, তুই রাগ করতে পারিস না? বলতে পারিস না সবাই লুচি খাচ্ছে, আমি রুটি খাব কেন? বলতে পারিস না আমার বালিশ ছেঁড়া কেন? আমার জামা-জুতো বিচ্ছিরি কেন? আমি ছোড়দার ইস্কুলে পড়ি না কেন?

    ধ্রুবময় হেসে ফেলত।

    বলত, তোর এক কুড়ি কেন আমার মুখস্থ থাকলে তো?

    তুই একটা ল্যাবাকান্ত বলেই এই দশা তোর।

    দূর, আমার তো মনেও হয় না আমি খারাপ আছি। কষ্টটা কী?

    চাকরের মতন থাকাটাই তো কষ্ট।

    ছিঃ ও কথা বলিস না। মামাবাবু আমায় খুব ভালবাসেন।

    ছাই বাসেন। তা হলে তোকে ছোড়দার ইস্কুলে দেয়নি কেন? বিচ্ছিরি ইস্কুলে দিয়েছে কেন?

    আমি তো ছোড়দার চেয়ে ছোট। পাড়ার ইস্কুলে থাকাই ভাল বলে।

    তোকে ওই বুঝিয়েছে। শাশ্বতী ঝংকার দিত, আসলে পাড়ার ইস্কুলে কম মাইনে বলে।

    এ কথায় ধ্রুবময় রাগ করত, বলত, এতটুকু মেয়ে তুই, এত পাকা কেন রে? এ রকম কথা বললে তোর সঙ্গে কথাই বলব না।

    তখন এরা তুই করে কথা বলত।

    তখন চিরন্তনের বাবা বেঁচে ছিলেন।

    কালক্রমে তুইটা তুমিতে পরিণত হয়েছে, তেমন সহজ মেলামেশার সুযোগও আর নেই। শাশ্বতীর উপর কড়া আইন জারি হয়েছে, এবং কেমন করে কে জানে, কোন কৌশলে কখন ধ্রুবময়কে দোতলা থেকে একতলায় গড়িয়ে দেওয়া হয়েছে!

    বোধ করি চিরন্তনের দাদার বিয়ের সূত্রে ঘরের প্রয়োজনের প্রশ্ন তুলে এ কাজ ঘটানো হয়েছে।

    কিন্তু একতলাতেই বা খানিকটা ভূমি দখল করে থাকবে কেন সে?

    কে সে এ-বাড়ির?

    ভগবান জানেন সত্যি কেউ কি না, তবে চিরন্তনের বাবা অনাদিকে সে মামা বলত। কোন এক দূরাতিদূর সম্পর্কের বোন নাকি মৃত্যুকালে অনাদির হাতে তার শিশুপুত্রের ভারটুকু তুলে দিয়ে সত্যবদ্ধ করিয়ে নিয়েছিল, অনাদি ওকে মানুষ করবেন, অনাদি ওকে ফেলবেন না। তা কর্পোরেশনের কেরানি অনাদি বোসের ধর্মজ্ঞান ছিল বলতে হবে। মানুষ করেছে, ফেলেনি, আবার মরবার আগে উইলে এক বিটকেল কাণ্ড করে গেছে।

    ধ্রুবময়কে কেউ এ বাড়ি থেকে তাড়াতে পারবে না। সে যদি স্বেচ্ছায় যেতে চায় তো আলাদা কথা, কিন্তু থাকবার অধিকার তার থাকবে।

    অনাদির স্ত্রী চিরন্তনের মা উইলের সংবাদ শুনে কাঠ কাঠ মুখে বলেছিলেন, ভাল!নাকে সর্দি, কানে ঘা, পেটে পিলে, মাথায় উকুন, অজ পাড়াগাঁ থেকে কুড়িয়ে নিয়ে রাজপুতুরের আদরে মানুষ করলেন, নীলমণি নাম বদলে বাড়ির ধাঁচে নাম রাখলেন, ইস্কুলে পড়ালেন, এততেও আশা মিটল না, উইল করে বাড়ির ভাগ দিয়ে গেলেন। মরে গেছেন, হাত ফসকে বেরিয়ে গেছেন, আর তো করবার কিছু নেই। থাকুন নীলমণি রাজ-আদরে!

    রাজ-আদরের নমুনাটা অবশ্য হাস্যকর, কিন্তু বলতে বাধা কী? তবে ওঁর কথা থেকে বোঝ গিয়েছিল ছেলেটার নামটা পর্যন্ত এ বাড়ির দান।

    অনাদি যখন ছিলেন, তখন এতটা তারতম্য করা হত কিনা কে জানে, এখন অন্তত তারতম্যটা দৃষ্টিকটু। হয়তো–ও স্বেচ্ছায় চলে যেতে চাইবে, এমন পরিস্থিতি সৃষ্টির জন্যেই

    কিন্তু এম.এ. পাশ করেছে, স্কুলে মাস্টারি করছে, তবু যেন ছেলেটা অবোধের রাজা! পরিস্থিতির কারুকার্য দেখতেই পায় না।

    ক্রমশ চিরন্তনও ওকে অবজ্ঞা করতে শুরু করেছে। কারণ চিরন্তন আগে ওর উপর আশা রাখত। ওর মার, দাদার এবং বউদির দৈনিক যে ব্যবহার দেখত ধ্রুবর উপর, তাতে আশা করত ধ্রুবময় একটা কিছু কাজ জোটাতে পারলেই চলে যাবে। উপায় হলে নিশ্চয়ই এত অপমান সহ্য করে পড়ে থাকবে না।

    কিন্তু চিরন্তনের দৃঢ় ধারণাকে ধূলিসাৎ করে উইলের সুযোগটি উসুল করতে রয়েই গেল আত্মসম্মানজ্ঞানহীন ছেলেটা। তা সুযোগ নেওয়াই। নচেৎ এত অপমানেও থাকবে কেন?

    চিরন্তন হতাশ হয়েছে, অবাক হয়েছে, বিরক্ত হয়েছে। শেষ পর্যন্ত মন থেকে মুছে ফেলেছে ওকে। বলেছে, রাবিশ।

    শুধু একসঙ্গে খেতে বসলে, তারতম্য দেখলে খুব খারাপ লাগে তার। আর নতুন করে ভাবে বেহায়া ছেলেটা তবু তো যায়ও না!

    চিরন্তন কথাটা ভাবে, আর শাশ্বতী সেটা মুখের উপর বলে।

    কটকট করে বলে, তবু তো বিদেয়ও হচ্ছ না এদের সংসার থেকে?

    আজও সেই কথাই বলতে এসেছে শাশ্বতী। তার অভিসারের শেষ পরিণাম শুধুই এই। কড়া করে কটকটিয়ে শুনিয়ে দেওয়া।

    ধ্রুবময় যখন বলল, ছুরি আছে, না সাপ্লাই করতে হবে?

    তখন শাশ্বতী স্বচ্ছন্দে বলল, সংগ্রহ করাই আছে।

    তারপর বলল, প্রহারেণর অপেক্ষাতেই আছো তা হলে?

    কেন, হঠাৎ আবার কী হল?

    আকাশ থেকে পড়ছ যে? সকালবেলা দাদা বউদির প্রেমালাপ শোনোনি বুঝি? কী বলছিল বউদি?

    ধ্রুবময় হেসে ফেলে বলে, ওঁদের প্রেমালাপে কান দেবার দরকার আছে বুঝতে পারিনি।

    তা পারবে কেন? বউদি বলছিল না, ঢের ঢের আশ্চয্য কাণ্ড দেখেছি, কিন্তু তোমাদের বাড়ির মতো এমনটি আর দেখিনি। আজকালকার দিনে একখানা ঘর ভাড়া দিলে অনায়াসে পঞ্চাশ-ষাটটা টাকা ঘরে তোলা যায়, সে জায়গায় একটা ঘর বিনি পয়সায় বিকোনো হচ্ছে! মাইনের টাকা এনে ধরে দেন! দেখে হাসি পায়, ওই টাকায় একটা মানুষের খাওয়া থাকা চলে যেন আজকালকার বাজারে!

    ওরে বাস! এই বিরাট ভাষণটি তুমি মুখস্থ করে ফেলেছ? ধন্য ধন্য!

    কথা উড়িও না

    শাশ্বতী ধ্রুবময়ের দুটো কাঁধ ধরে ঝাঁকুনি দিয়ে বলে, তুমি মানুষ, না মাটির পুতুল?

    আপাতত মাটির পুতুলের ভূমিকাতেই আছি

    কেন? কেন? বিদায় হয়ে যেতে পারো না এ বাড়ি ছেড়ে?

    ধ্রুবময় একটু হাসে।

    অদ্ভুত একটু হাসে।

    বলে, এ বাড়ি থেকে বিদেয় হব, এ বাড়ির খুব বড় একটা জিনিস হাতিয়ে নিয়ে। সেই সুযোগের সাধনা করছি।

    শাশ্বতী ওর সরু চৌকিটার উপর বসে পড়ে বলে, মিথ্যে কথা! সে সাহস থাকলে তো? হাতাবার ইচ্ছে থাকলে অনেকদিন আগেই হাতাতে পারতে। হাতের মধ্যেই রয়েছে যখন।

    হাতের মধ্যে থাকলেই কি হাতানো যায়? লগ্ন আসার অপেক্ষা করতে হয়।

    ওসব হচ্ছে ইস্কুলমাস্টারি ভীরুতা। হাতের মুঠোয় ভরে দেওয়া জিনিসও ভোগ করবার সাহস নেই তোমার। আমি যাই হাড়বেহায়া তাই আবার তোমার কাছে আসি। অন্য মেয়ে হলে আর তোমার মুখ দেখত না।

    শাশ্বতীর মুখ লাল হয়ে ওঠে।

    শাশ্বতী মুখ ফেরায়। বোঝা যায় চোখে জল।

    ধ্রুব সেই দিকে একটুক্ষণ তাকিয়ে থেকে আস্তে বলে, শাশ্বতী, আমরা একই বাড়িতে মানুষ হয়েছি, আমাদের পরস্পরের মধ্যে কোথাও নেই অজানার রহস্য। তোমার পিঠে একটা লাল জজুল আছে, এ আমার জানা, আমার বুকে একটা পোড়ার দাগ আছে, সেও তোমার মুখস্থ। বলতে গেলে আমরা দুজনেই দুজনের কাছে মুখস্থ হয়ে যাওয়া কবিতার মতো। তা হলে–থাকলই বা একেবারে গভীরে একটুখানি অজানা রহস্য! সেই রহস্যটুকুও খরচ করে ফেলব কেন?

    শাশ্বতী ঝাঁজালো গলায় বলে, ফেলোনা খরচ করে, রেখে দাও তুলে। তবে যখন এইবার সময় হয়েছে বলে তারিয়ে বসে উপভোগ করতে যাবে, তখন যদি দেখো রহস্য ঘুণ পোকায় খেয়ে ফেলেছে, আমায় দুষতে এসো না। ইচ্ছে আবেগ এসব প্রভিডেন্ট ফন্ডের টাকা নয় যে, জমিয়ে জমিয়ে বাড়িয়ে তুলব, ভবিষ্যতের সংস্থান থাকবে।

    ধ্রুব কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, হঠাৎ ভেজানো দরজাটা খুলে গেল, আর সে দরজায় দেখা গিল চিরন্তনকে।

    শাশ্বতীর গলা দিয়ে অস্ফুট একটা শব্দ বেরোলো, যে শব্দটা কথায় দাঁড় করালে এই হয়, এ কী ছোড়দা, তুমি এখন?

    সত্যি, চিরন্তনের এখন আসার কথা নয়। চিরন্তন সকালে যথারীতি অফিসে গিয়েছিল।

    শাশ্বতী ভাবল, আর কিছু নয়, ছোড়দা আমাদের হাতেনাতে ধরবে বলে অফিস পালিয়ে অসময়ে চলে এসেছে। এটা একটা পরিকল্পনার ব্যাপার। শুধু একার পরিকল্পনা নয়, নিশ্চয় গার্জেনদের পরামর্শেরও ব্যাপার।

    হুঁ, সবাই সমান।

    নইলে ছোড়দা কিনা মা, দাদা, বউদির ষড়যন্ত্রে অংশ গ্রহণ করে? ছোড়দা না ওদের সব কিছুই হাস্যকর বলে মনে করে?

    আচমকা এসে পড়ার উদ্দেশ্যই তো হচ্ছে অসতর্কে ধরা।

    ছোড়দা সেই ধরে ফেলার উদ্দেশ্যে অসময়ে বাড়ি ফিরেছে। আর সে উদ্দেশ্য ওর সিদ্ধও হয়েছে।

    এমনও হতে পারত, ছোড়দা এসে দেখত ধ্রুব একা বসে খাতা দেখছে, শাশ্বতী দোতলায় কোথায় না কোথায়। হয়তো দিবানিদ্রা দিচ্ছে, হয়তো বা সেলাই নিয়ে বসে আছে।

    তা হলে ছোড়দা ভাবত, ইস শুধু শুধু দুটো সরল ছেলে-মেয়েকে অন্যায় সন্দেহ করেছি আমি।…বাচ্চাবেলা থেকে একসঙ্গে বেড়েছে ওরা, ওদের মধ্যে একটা ফ্রি ভাব তো থাকবেই। মা দাদারা যদি দোষ ভাবতে বসেন, সেটাই দোষণীয়।

    মিনিট কয়েক আগে এলেই সেই দৃশ্য দেখতে পেত ছোড়দা। সেই ভাবনাটা ভাবত। সে জায়গায় কিনা দেখল আমি ধ্রুবর বিছানায় আড় হয়ে পড়ে আছি। কপাল বটে আমার একখানি!

    ধড়মড় করে উঠে চলে যাওয়াটা অপরাধীর মতো হয়, তাই কাঠ হয়ে বসেই থাকে শাশ্বতী। চোখে চোখে তাকাতে সাহস হয় না। অথচ এতক্ষণ ভীরুতার অপরাধে লাঞ্ছনা দিচ্ছিল ধ্রুবময়কে।

    অথচ ভীরু ধ্রুবময়ই বলে উঠল, ছোড়দা, এমন অসময়ে? শরীর খারাপ হয়েছে না কি?

    শুনে রাগে হাড় জ্বলে গেল শাশ্বতীর।

    একথা তোর বলতে যাওয়া কেন রে? এতে তো ছোড়দার বক্তব্যকে এগিয়েই দেওয়া হল। এক্ষুনি ছোড়দা বলে বসবে, এসে তোমাদের খুব অসুবিধে ঘটালাম বোধ হয়? তবে শোনো, সাহসের মাত্রাটা তোমাদের একটু বেশি বেড়ে গেছে বলেই আইনটা হাতে নেওয়া দরকার মনে করছি।

    কথাটা শোনার জন্যে প্রস্তুত হচ্ছিল শাশ্বতী।

    কিন্তু আশ্চর্য, চিরন্তন সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত একটা কথা বলল। চিরন্তন সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত একটা কাজ করল। চিরন্তন এগিয়ে এসে শাশ্বতীকে বলল, মাথাটা একটু টিপে দে দিকিনি। বলে ধ্রুবময়ের সেই সরু বিছানাটাতেই শুয়ে পড়ল।

    শাশ্বতী মাথাটা টিপে দে শুনেই ধড়মড়িয়ে উঠে দাঁড়িয়েছিল, এখন সভয়ে তাকাল। চিরন্তন বলল, হ্যাঁ, শরীরটা খারাপ হয়েছে মনে হচ্ছে। বোধ হয় জ্বর এসেছে।…যাক শোন, বসুশ্রীর দুটো টিকিট আছে, আমার পকেট থেকে বার করে নে, তোরা দেখে আয়। যাবার আগে কিন্তু আমার মুণ্ডুটা ভাল করে একটু ডলাইমলাই করে দিয়ে যেতে হবে।

    শাশ্বতী স্তম্ভিত হয়ে গিয়ে মাথা টিপে দেবার কথা ভুলে যাচ্ছিল, এখন ভয়ে ভয়ে ছোড়দার মাথার কাছে এগিয়ে এল।

    ব্যাপারটা কী!

    তা হলে ছোড়দা শত্রুপক্ষের চর নয়? সে তার নিজের উদার প্রকৃতিতেই স্থির আছে?

    কিন্তু এটা কী?

    এই সিনেমার টিকিট? তোরা দেখে আয় মানে? শুধু ধ্রুবময় আর শাশ্বতী একলা সিনেমা দেখতে যাবে? মা তা হলে আস্ত রাখবে? বউদি? দাদা? জ্বরের ঘোরে কি ভুল বকছে ছোড়দা? ওঁদের কী আদৌ চেনে না?

    তা ছাড়া দুটো টিকিটই বা কার জন্যে ছিল?

    শাশ্বতী যে ছোড়দাকে খুব একটা ভয় করে তা নয়, কিন্তু আজকের কথা স্বতন্ত্র, আজকের পরিস্থিতি খারাপ। তাই শাশ্বতী হৃদয় আলোড়িত করা এই সব প্রশ্নের একটাও উচ্চারণ না করে নীরবে মাথাটাই টিপতে থাকে।

    প্রশ্ন ওই ভীরু ছেলেটাই করে।

    টিকিট দুটো কার জন্যে কেনা হয়েছিল ছোড়দা?

    তুই একটা বুন্ধু! এই মগজ নিয়ে ছেলে পড়াস? কেন, এটা খেয়াল হল না, আমার এবং আমার জনৈকা বান্ধবীর?

    চিরন্তনের কথার ধরনই এই রকম, তবু ইদানীং আর যেন ধ্রুবময়ের সঙ্গে এমন সহজ প্রীতিতে কথা বলত না। যেন অগ্রাহ্যই করত।

    আজ ছোড়দার পূর্বভাব দেখে শাশ্বতী কৃতার্থ হল। এবং এতক্ষণে সাহস করে একটা কথা বলে ফেলল, বাঃ তা হলে?

    তা হলে আর কী। তুই আর তোর বন্ধুতে যাবি। টিকিটটা তত ফেলে দেওয়া যায় না!

    ধ্রুবময় শাশ্বতীর বন্ধু এটা নতুন কথা নয়। চিরদিনই ধ্রুবময়কে বন্ধু বলে পরিচয় দিয়েছে শাশ্বতী। তার জন্যে মার কাছে লাঞ্ছনা, দাদার কাছে ধিক্কারশাসন, অনেক কিছুই সইতে হয়েছে তাকে।

    তবু শাশ্বতী জোর গলায় বলত, কেন খেলব না ধ্রুবদার সঙ্গে? ধ্রুবদা তো আমার বন্ধু?

    মা বলত, আহা মরে যাই, মেয়ে আমার আর বন্ধু পেল না!

    ধ্রুব যে এ বাড়িতে আশ্রিত মাত্র, ধ্রুবর যে তিনকুলে এমন কেউ নেই যে ঘাড় থেকে নামানো যায় তাকে, এই তীব্র সত্যটুকু শাশ্বতীর মা কিছুতেই ভুলতে পারত না।

    আর আশ্চয্যি, অনাদি নামের সেই মানুষটা, একটা অনাথ অসহায় ছেলেকে আশ্রয় দিয়েও, তার পক্ষ হয়ে দাঁড়াতে পারত না কখনও। একশো অবিচার দেখলেও উদাসীন মূর্তিতে থাকত, মনে হত এ সব যেন তার চোখে পড়ছে না। চোখে পড়ছে না, অতএব ভাবছেও না, চাকর না থাকলেই বাড়ির সবচেয়ে ছোট ছেলেটা কেন চাকরের কর্মভার মাথায় তুলে নিতে বাধ্য হয়, চাকর খেটেখুটে ঘুমোচ্ছে বলে সেই ছোট ছেলেটাকে কেন বারবার পড়া ছেড়ে ফরমাশ খাটতে উঠতে হয়। আর কেনই বা সংসারে খাদ্যের অপ্রাচুর্য না থাকলেও ওই ছেলেটাকে তেমন প্রাণভরে দেওয়া হয় না।

    ভাবা বারণ, অতএব ভাবত না।

    কিন্তু অদ্ভুত একটা কাজ করত। লুকিয়ে ছেলেটাকে একান্তে ডেকে লজেন্স দিত, বিস্কিট দিত, পয়সা দিত, আর বলত, কাউকে দেখাসনি।বলত–তোকে তো মামি দেখতে পারে না, তাই তোকে ভাল করে দেয় না, নে এটা।

    তবু অনাদির আমলে চক্ষুলজ্জাটা একটু ছিল। এখন পর্দাটা উঠে গেছে।

    শুধু চিরন্তনই এদের সংসারের সঙ্গে বিচ্ছিন্ন। চিরন্তন শুধু ছেলেটাকে অগ্রাহ্য করে রাবিশ বলে, আর কিছু না।

    কিন্তু আজ চিরন্তন ধ্রুবময়কে স্বীকৃতি দিল। বোনকে বলল, তোর বন্ধু।

    বন্ধু!

    অথচ ওই শব্দটা শাশ্বতী আর এখন মুখে উচ্চারণ করতে সাহস পায় না। অনেকদিনই পায় না।

    বয়েস জিনিসটা বড় উলটোপালটা। অথবা যেন নদী। ও একদিকে ভাঙে, একদিকে গড়ে।

    ঠিক যখন ভিতরের সাহস প্রবল হয়ে ওঠে, তখনই বাইরের সাহস হরে যেতে শুরু হয়।

    ছেলেবেলায় মার বকুনির আমলে সোজা খাড়া দাঁড়িয়ে বলা যেত, কেন মিশব না ধ্রুবদার সঙ্গে? ধ্রুবদা আমার বন্ধু নয়? বলা যেত, ধ্রুবদাকে এইটুকুনই মাছ দাও কেন? ধ্রুবদাকে সব সময় কাজ করতে বল কেন? ধ্রুবদার বুঝি পড়া নেই? ধ্রুবদার বুঝি কষ্ট হয় না?

    কিন্তু এখন আর তেমন কথা বলবার সাহস নেই। এখন ন্যায়ের পক্ষ হবার উপায়ও নেই। এখন তাই শুধু আড়ালে চোখ রাঙানো যায়, খাও কেন অমন অছেদ্দার খাবার? ওই পোড়া পোড়া শুকনো টোস্ট দুটো বউদির মুখের উপর ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে উঠে আসতে পারলে না? তোমার টোস্টটায় মাখন লাগায় না বউদি, শুধু মাখন লাগানো লাগানো খেলা করে বুঝলে?

    আরও কী কী বলে।

    যা মুখে আসে তাই বলে শাশ্বতী ধ্রুবকে। কিন্তু ওই আড়ালে।

    কবে থেকে এই ভীরুতা প্রবেশ করেছে শাশ্বতীর মধ্যে, কবে থেকে সে বন্ধু বলা বন্ধ করেছে, নিজেরই তার মনে পড়ে না। তাই চিরন্তনের মুখের ওই বন্ধু শব্দটা যেন কানের ওপর ঝপাৎ করে এসে পড়ল। কান মাথা ঝাঁ ঝাঁ করে উঠল শাশ্বতীর।

    কিন্তু কথাটা বেরিয়ে উদারপ্রাণ ছোড়দার মুখ থেকে। অতএব বলে ওঠে, হ্যাঁ বন্ধু না হাতি! ওর বন্ধু ওই কাগজের তাড়াগুলো…তা ছাড়া শাশ্বতী একটা নিশ্বাস ফেলে, তা ছাড়া মা যেতে দিলে তো?

    মা?

    চিরন্তন শাশ্বতীর হাতটা কপাল থেকে সরিয়ে দিয়ে বলে, মা যেতে দিলে তবে যাবি? মার ভরসাতেই বসে আছিস তা হলে?

    শাশ্বতী ভিতরে ভিতরে কেঁপে ওঠে।

    ছোড়দা কীসের ইঙ্গিত করছে?

    শাশ্বতী চুপ করে থাকে।

    চিরন্তন আবার বলে, দেখ মার আজ্ঞামতো কাজ করবার বাসনাই যদি থাকে, তা হলে সোজা উপরে উঠে যা। খবরদার এ ঘরে এসে ঢুকবি না, এবং খবরদার ধ্রুবর সঙ্গে একটি কথা বলবি না। মা যখন সুপাত্র জুটিয়ে বিয়ে দেবে, লাল চেলি পরে সেই সুপাত্রর পিছু পিছু বিদেয় হবি।

    ছোড়দা, তোমার জ্বর হয়েছে, বেশি কথা বোলো না–ধ্রুব কাছে উঠে এসে বলে, একেই তো মাথা ধরেছে

    জ্বর হয়েছে বলে জ্বরের ঘোরে প্রলাপ বকছি না–চিরন্তন উঠে বসে বলে, সোজা কথার পষ্ট উত্তর দে, তোরা কী ঠিক করেছিস?

    শাশ্বতীর হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে যায়, শাশ্বতীর বুকটা ধড়ফড় করে ওঠে।

    কিন্তু ধ্রুবময় মুখ তুলে একটু হেসে বলে, তুমি নিশ্চয় না বললেও বুঝতে পারছ?

    কী করে বুঝব?–চিরন্তন তীব্র গলায় বলে, একদিন দুজনে একলা কোথাও বেড়াতে যাবারই যখন সাহস নেই, তখন কোন সাহস সংগ্রহ করে বিয়েটা ঘটাবে?

    ধ্রুব হেসে ফেলে বলে, তুমি তো আছ।

    শাশ্বতী অবাক হয়ে তাকায় ধ্রুবময়ের দিকে। কী আশ্চর্য খোলাখুলি এই সব কথা! তাও শাশ্বতীর সামনে! লজ্জায় মরে গেল না ধ্রুবময়! কার্যকালে যে ধ্রুবর মুখ দিয়ে কথা বেরোবে না, যা কিছু বেহায়াপনা শাশ্বতীকেই করতে হবে, সেই ধারণাই তো বদ্ধমূল ছিল শাশ্বতীর।

    খুব যেদিন অস্থিরতা আসে, যেদিন রাত্রির ঘুম হরণ করে নিয়ে যায় সেই অস্থিরতা, যেদিন সেই জ্বালাকরা বিনিদ্র চোখ নিয়ে বিছানায় ছটফট করে, সেদিন মনে মনে ধ্রুবকে সামনে দাঁড় করিয়ে তীব্র প্রখরতায় ক্ষতবিক্ষত করে বলে, তোমার আর কী? তুমি ঠিক আছে। ভাত বেড়ে খেতে না ডাকলে তুমি কখনও ডেকে বলো না খেতে দাও, তুমি কি আর একটি কড়ে আঙুলও নাড়বে আমার জন্যে? জীবন জিনিসটা তোমার কাছে কিছুই নয়, তার জন্যে তোমার কোনও চাহিদা নেই, তোমার কাছে ঢের বেশি মূল্যবান তোমার ওই নম্রতা, ভদ্রতা, লজ্জাশীলতা। দরকারের সময় তুমি থাকবে মুখে তালাচাবিটি লাগিয়ে সভ্যতার প্রতিমূর্তি হয়ে, আমাকেই অসভ্য হতে হবে, বাঁচাল হতে হবে, বেহায়া হতে হবে।…আবার কখনও কাঁদো কাঁদো হয়ে যেন ওর চুলের মুঠিটা ধরে নাড়া দিয়ে দিয়ে বলে, কী আছে তোমার ভিতরে? শুধু জল আর মাটি? রক্ত নেই? মাংস নেই? এই এক বাড়িতে থেকেও এতটুকু উচাটন নেই তোমার!..হয়তো বর্ষার রাতে, শীতের রাতে আরও ভয়ানক ভয়ানক কথা বলে, আর সেই বলার পরিশ্রমে শেষপর্যন্ত নিজেই ক্লান্ত হয়, অবসন্ন হয়। সকালে উঠে প্রতিজ্ঞা করে, আজই একটা হেস্তনেস্ত করে ছাড়ব।

    কিন্তু এখন, যখন চিরন্তন হঠাৎ অমন খোলাখুলি কথাটা বলে বসল, তখন শাশ্বতীরই তো মাথা ঝিমঝিম করে এল। শাশ্বতীর গলা শুকিয়ে এল, আর শাশ্বতী স্বর্গ মত খুঁজতে বসল, এ সন্দেহ মনে এল ছোড়দার কোন সূত্রে? তাদের সংকল্প তো তাদের দুজনার মধ্যেই নিবদ্ধ আছে। কোনওদিন তো শাশ্বতী এতটুকু অসতর্ক হয়নি। অন্যের সামনে তো শাশ্বতী ধ্রুবময় সম্পর্কে নির্বিকার উদাসীন। বাড়িতে যেমন মা আছে, বউদি আছে, অথবা যজ্ঞেশ্বর আছে, বিজুর মা আছে, তেমনি ধ্রুব আছে। যাকে নিয়ে শাশ্বতীর কোনও মাথাব্যথা নেই।

    বরং শাশ্বতীর আবাল্যের পরিচিত ওই মুখচোরা ছেলেটাকে যে এখন বড় হয়ে কীটস্য কীট মনে করে মাঝে মাঝে সেই ভাবটাই ঝলসে ওঠে ওর কথায়।

    ধ্রুববাবু ঘড়িতে দম দিয়েছেন? ওঃ তা হলে তো ঘড়ির চিরবারোটা বাজল।…বিস্কিট কিনে এনেছেন ধ্রুবময়? ওঃ তাই বল! আমি ভাবছি বিস্কিটে কেন বাসি রুটির আস্বাদ পাচ্ছি।..নয়তো বা চায়ের আসরে বসে বাতাসকে শুনিয়ে বলে, শুনেছি সাতবছর ইস্কুলমাস্টারি করলে কী যেন একটা হয়, কিন্তু সাতবছর না হতেই যেন বেশ প্রোগ্রেস দেখছি। ইস্কুলটা খুব প্রোগ্রেসিভ বলতে হবে।

    মা যদি কোনও সময় বলে, সাবান কিনতে তুই আবার বেরুবি কী করতে? ধ্রুব এনে দিক না…যদি বলে,সেলাইয়ের সুতো আবার কী একটা আশ্চয্যি জিনিস যে নিজে যেতে হবে? ধ্রুব তো বসে রয়েছে, যাক না।

    তখন শাশ্বতী হাতজোড় করে বলে, দোহাই মা, তোমার ধ্রুব তোমারই ভাল, আমার কাজ করায় কাজ নেই। ওর কাজ তোমারই পোয়।

    এই রকমই কথা বলে শাশ্বতী।

    এই ভাবেই বাঁধ দেয়।

    কিন্তু বোঝে না, বিরাট সমুদ্রে এই তুচ্ছ বালির বাঁধ কোনও কাজেই লাগে না।

    শাশ্বতী ধ্রুবকে যতই তুচ্ছি তাচ্ছিল্য করুক, শাশ্বতীর বউদি আড়ালে ঠোঁট ওলটায়, কত ঢং! লোকে যেন আর তোমাদের ভিতরের রহস্য বোঝে না!

    আর এখন শাশ্বতীর ছোড়দা, পুরুষ মানুষ, সর্বদা যে পায়ে চাকা বেঁধে রাস্তায় ঘুরে বেড়াচ্ছে, সেও কিনা বলে বসল, সোজা কথার সোজার জবাব দে, তোরা কী ঠিক করেছিস?

    আর এই ভয়ংকর মুহূর্তে ওই মুখচোরা ছেলেটা বলল, যা ঠিক করেছি তা তুমিই জানো।বলল, তুমি তো আছে।

    ছোড়দার মুখে এমন অভাবনীয় কথা শুনে চমকে গেল না।

    আর যখন ছোড়দা ধমকে উঠে বলল, না, আমি নেই। কেউ কোথাও নেই। মনে রেখো এই কথাটা পৃথিবীতে তোমার ভার বহন করবার জন্যে কেউ বসে নেই। নিজেদের জন্যে শুধু নিজেরা আছে–

    তখনও ঘাবড়ে গেল না, থতমত খেল না, শুধু মৃদু হেসে বলল, আচ্ছা, থাই ভাবব।

    হ্যাঁ, তাই ভাববে বলে আবার শুয়ে পড়ল চিরন্তন। শুয়ে পড়ে বলে উঠল, যা ভাগ, আর মাথা টিপতে হবে না, মাথাটা জখম হয়ে গেল! একগাদা চুড়িবালা না পরলে যে কী লোকসান হয়! যাও সময় আর বেশি নেই, ম্যাটিনি শোর টিকিট। দয়া করে পচিও না টিকিট দুটো। একজনের গাঁটের কড়ি দিয়ে কেনা মাল।

    শাশ্বতী ভয়ে ভয়ে বলল, তোমার যদি জ্বর বেশি হয় ছোড়দা?

    বেশি হবার হলে হবে। তুমি বসে থেকে আটকাতে পারবে?

    না মানে, তুমি এখানেই শুয়ে থাকবে?

    হ্যাঁ শোবো! তাতে তোমার কোনও আপত্তি আছে? যত সব! এক গ্লাস জল দে।…না কি ধ্রুবময় বাবুর ঘরে জলের কুঁজোর মতো বাহুল্য বিলাস নেই?

    ধ্রুবময় মৃদু হেসে দেয়ালের ধারে রাখা কুঁজো থেকে এক গ্লাস জল গড়িয়ে দিয়ে আস্তে বলে, কিন্তু ছোড়দা, তোমার না হয় জ্বর এসেছে, আর যাঁর যাবার কথা ছিল? তিনি খবর পেয়েছেন?

    খবর? তাঁকে আবার কে খবর দিতে গেছে?

    তা হলে? মানে–

    মানে কিছু নয়। অপেক্ষা করতে করতে তাঁরও রাগে জ্বর এসে যাবে। থাক, ও নিয়ে আর মাথা ঘামাতে হবে না। সময় আর নেই, ম্যাটিনি শো–

    চোখ বুজে পাশ ফেরে চিরন্তন।

    ধ্রুবময় শাশ্বতীর দিকে একটা কৌতুক দৃষ্টি হেনে যেন ওর বিব্রত বিপন্ন ভাবটুকু উপভোগ করে নিজের খাতাপত্র গোছাতে থাকে। সত্যি যাবে কি যাবে না, তাও বোঝা যায় না।

    শাশ্বতী মিনিটখানেক তার দিকে আক্রোশের দৃষ্টিতে তাকিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। আর তার পিছনে টুক করে একটি কথা শোনা যায়, কনে সাজতে লগ্ন পার হবে না তো?

    ওরা চলে গেল।

    অথচ ঘণ্টাখানেক আগেও কল্পনা করতে পারেনি ওরা, এই বাড়ি থেকে দুজনে সিনেমা দেখতে বেরিয়ে যেতে পারে। সাহসই দুঃসাহসের জন্মদাতা। চিরন্তন যেন ওদের নাড়া দিয়ে সচেতন করে দিল হঠাৎ।

    যাবার আগে শাশ্বতী আর একবার এ ঘরে ঢুকল, কুণ্ঠিত গলায় বলল, জ্বর কি বেশি আসছে। ছোড়দা?

    চিরন্তনের ঘুম ঘুম আসছিল, চোখ মেলে বলল, আরে না না, আদৌ হয়তো জ্বর আসছেই না। শুধু মাথাটা বড্ড ধরেছে বলে–যা পালা। ছবি দেখতে দেখতে যেন ছোড়দার জ্বরের চিন্তা করতে বসিস নে।

    আমার কিন্তু ভয় ভয় করছে ছোড়দা।

    ভয়কে জয় করতে শেখো। ভয়ে কাতর হলে কোনও উপায় নেই। মনে জেনো, তোমাদের ব্যবস্থা তোমাদের নিজেদেরই করতে হবে।

    ধ্রুব দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে জুতো পরছিল, শাশ্বতী ঝাপসা গলায় বলে, ছোড়দা, তুমি কী করে জানলে?

    চিরন্তন একবার ভুরুটা কোঁচকাল, বলল, কী জানলাম? তারপর আস্তে আস্তে ওর মুখটায় একটা আলগা আলো ছড়িয়ে পড়ল। বলল, তুই একটা পাগল। যা এখন কেটে পড়।

    জানো ছোড়দা, ধ্রুবদা জীবনে নাকি কুল্লে তিনটে সিনেমা দেখেছে। ছোটবেলায় সেই একবার বাবা আমাদের সব্বাইকে টারজানের ছবি দেখিয়েছিলেন, তোমার মনে আছে ছোড়দা? সেই দেখেছিল, আর দাদার বিয়ের পর একবার বাড়িসুদু দেখা হয়েছিল। সবাই একসঙ্গে সিনেমা দেখা, আর সবাইয়ের একসঙ্গে গ্রুপ ফোটো ভোলা, এই সব হয়েছিল না দাদার বিয়ের সময়? আর একবার মাত্র নাকি বন্ধুদের সঙ্গে

    ভাল। এটা তা হলে মনে থাকবে, ভিড়ে হারিয়ে যাবে না।

    না, ওদের কোনও ভাললাগা ভিড়ে হারিয়ে যাবে না। ওরা চলে যাবার পর কথাটা ভাবল চিরন্তন, ওরা গান্ধারীর মতো অধৈর্যের মুষল মেরে মেরে উজ্জ্বল সম্ভাবনার অজাত শিশুকে অকালে পৃথিবীর আলোয় টেনে এনে বিকৃত মূর্তিতে ছড়িয়ে ফেলেনি।

    তার কারণ ওরা ভীরু।

    ওদের ওই ভয়ই ওদের রক্ষা করেছে।

    অথচ এ যুগে এটা হাস্যকর।

    এদের দেখলে মনে হয়, ওরা এখনও রবীন্দ্র-শরৎচন্দ্রের যুগে রয়েছে। পৃথিবী যে উগ্র আলোয় প্রখর হয়ে উঠেছে, কুণ্ঠিত প্রেম যে অচল পয়সার মতো হয়ে গেছে, তা যেন জানেই না।

    ভাবছিল এদের মানুষ করা দরকার, কিন্তু ওদের ওই ভীরু পদপাতটাও যেন বেশ ভাল লাগছে।

    সংস্কার বড় ভয়ানক দৈত্য।

    সত্যি বলতে, চিরন্তন যখন এ ঘরে ভেজানো দরজাটা খুলেই দেখতে পেয়েছিল শাশ্বতী ধ্রুবর বিছানায় গা এলিয়ে শুয়ে আছে, হঠাৎ চড়াৎ করে রক্তের একটা শিহরন পা থেকে মাথায় উঠে গিয়েছিল। কিন্তু সেটা মুহূর্তের জন্যেই। তখুনি হাসি পেয়ে গিয়েছিল চিরন্তনের। ওর মনে পড়ে গিয়েছিল, নিত্যধন বোসের অনুজের ভূমিকায় তা হলে ভালই মানিয়ে যাব আমি।

    আমার বোনকে তার ভালবাসার পাত্রের কাছাকাছি দেখেই আমার অজ্ঞাতসারে আমার রক্ত বিদ্রোহী হয়ে উঠল। এরই নাম সংস্কার।

    বুদ্ধির মূল্যে আমরা ওর ক্রীতদাসত্ব থেকে মুক্তি পাবার চেষ্টা করছি, কিন্তু দাসত্বের সেই খতটা বেশি বড় শক্তিশালী।

    আমি সিনেমার ওই টিকিট দুটো ধ্রুবকেই দিতে এসেছিলাম, শাশ্বতীকে নিয়ে একসঙ্গে যাবার প্রস্তাবই করতে এসেছিলাম, তবু এ ঘরে শাশ্বতীকে দেখে, এক নিমেষের জন্যেও আমার ভিতরের সংস্কার চড়াৎ করে উঠে জানিয়ে দিল আমি আছি।

    হয়তো ওদের দুজনকে আর একটু ঘনিষ্ঠ অবস্থায় দেখলে মেজাজ ঠিক রাখতে পারতাম না। কিন্তু ঈশ্বর আমায় রক্ষা করেছেন।

    আমি জানি, ছেলেবেলা থেকেই ওরা দুজনে দুজনকে ভালবাসে, কিন্তু ধ্রুবর প্রতি আমার আস্থা আসে না। মনে হয় বড় বেশি নির্বীর্য ও। এ বাড়িতে তো কম অপমানের মধ্যে নেই ও, তবু কেন চলে যায় না? তবু কেন একবারও মাথা তুলে দাঁড়ায় না? দেখায় যেন সেই অবহেলা অবজ্ঞাটা বুঝতে পারছে না, কিন্তু পারে না এটা সম্ভব নয়। একটা রাস্তার কুকুরও অবজ্ঞা অবহেলা বোঝে।

    অথচ ওর কাছাকাছি এলে শ্রদ্ধা আসে, স্নেহ আসে।

    কিন্তু দুটোই যেন ঝাপসা ঝাপসা।

    হঠাৎ তাসের প্যাকেট থেকে একগোছা তাস ছড়িয়ে পড়ার মতো অনেকগুলো দৃশ্য ছড়িয়ে পড়ল যেন চিরন্তনের মনের মধ্যে। পুরনো দৃশ্য।

    দেখতে পেল একটা হাফপ্যান্ট আর হাতকাটা গেঞ্জি পরা বছর দশ এগারোর ছেলে এটা লম্বা ঝাড়ু নিয়ে নীচতলার বৈঠকখানা ঘরটা সাফ করছে।…আর নাকে ধুলো লাগার ভয়েই বোধ করি চিরন্তনের বাবা সেই অনাদি নামের ভদ্রলোক কোঁচার খুঁটটা তুলে নাকে চেপে ঘরের বাইরে দরজার কাছে দাঁড়িয়ে আছেন। খুব সম্ভব ঘরে ঢুকতে যাচ্ছিলেন। ওই ধুলোর উল্লাসে থমকে দাঁড়িয়ে পড়েছেন।

    ভদ্রলোক তো অনাদিনাথ, ছেলেটা?

    ছেলেটা আর কেউই নয়, ধ্রুবময়।

    চিরন্তনের মনে পড়ল, সেই দৃশ্যটা দেখে রাগে আপাদমস্তক জ্বলে গিয়েছিল চিরন্তনের। তখন চিরন্তন স্কুল ছেড়ে কলেজে ঢুকেছে, তাই নিজের প্রতি সমবোধ অতীব প্রখর, অতএব নিজের সমপর্যায়ের একজনকে এ অবস্থায় দেখে যেন অপমানের দাহটা নিজের মধ্যেই অনুভব করেছিল।

    আর সেই দাহটা ওই নিরুপায় দর্শকের মতো দাঁড়িয়ে থাকা বাবার গায়ে ছিটিয়ে পড়তে চেয়েছিল।

    তবে বাবাকে কিছু বলেনি চিরন্তন, শুধু তাঁর পাশ কাটিয়ে ঘরে ঢুকে সেই হাফগেঞ্জি আর হাফপ্যান্টের উদ্দেশে কড়া গলায় বলেছিল, তুই ঘর ঝাড়ু দিচ্ছিস যে?

    ধ্রুব অপরাধীর গলায় অস্ফুটে বলেছিল, রঘুর জ্বর হয়েছে–

    রঘুর জ্বর হয়েছে? ওঃ। তা তুই বুঝি রঘুর জায়গায় বহাল হয়েছিস? কত করে মাইনে পাবি ঠিক হয়েছে?

    বলাই বাহুল্য, এই প্রশ্নবাণের লক্ষ্যটা ধ্রুব নয়, অনাদি।

    তা বাণটা বোধহয় তাঁর কোনওখানে বিধেছিল। তিনি নাক থেকে কোঁচার খুঁট নামিয়ে আহত গলায় বলেছিলেন, এসব কী কুশিক্ষা চিরা? দরকার পড়লে বাড়ির ছেলেরা বাড়ির কাজ করে না?

    চিরন্তন বিদ্রুপের গলায় বলেছিল, ছেলেরা করলে কিছুই বলার ছিল না বাবা! তবে দেখি কিনা, দরকার পড়লেই ওই ছোট ছেলেটার কথাই মনে পড়ে সকলের। সেটাই অসহ্য। ধ্রুব, রাখ তুই ঝাড়ু, আমি আসছি।

    অনাদি কী উত্তর দিতেন কে জানে, সেই সময় ধ্রুবময় তার কাচের মতো স্বচ্ছ চোখ দুটো তুলে স্পষ্ট পরিষ্কার গলায় বলে উঠেছিল, শুধু শুধু রাগ করছ কেন ছোড়দা? বড়দের কতরকম কাজ, সে সব তো আর আমি করতে পারব না? মামিমা কত করছেন বলো তো?

    মামিমা! মামিমা বাড়ির গিন্নি, দরকার পড়লে সবই করতে বাধ্য। তার সঙ্গে তোকেও সেই পোস্ট দিতে হবে? আমি বলছি তুই করবি না। আমি সারা বাড়ি সাফ করছি এসে।

    চিরন্তনের হাতে তখন বইখাতা ছিল, সেইগুলো রেখে তবে আসবার কথাই বলেছিল।

    তখনও নিত্যধনের বিয়ে হয়নি, কাজেই চিরন্তনের মায়ের গৃহকর্মের কোনও সহকারী ছিল না।

    অনাদি বোধহয় জানতেন কলেজ থেকে ফিরেই চিরন্তন যদি এখন ওই কাজটি করতে বসে, চিরন্তনের মা ওই ছোট ছেলেটাকেই বাক্যশরে বিধে বিধে শরশয্যায় শুইয়ে ছাড়বেন। তাই তিনি বলেছিলেন, কেন অশান্তি বাড়াবি বাবা সংসারে? করছে করুক। ক্ষয়ে তো যাবে না। তুই তেতেপুড়ে এলি—

    চিরন্তনের মনে পড়ছে, সেদিন যেন চিরন্তন লড়াইয়ে নামতে চেয়েছিল। তাই বলেছিল, স্কুল কলেজে পড়ে এলে তাতে পোড়ে না মানুষ! অন্যায় দেখলেই সেটা হয় বাবা! আপনি কি দেখতে পান না ওই ধ্রুবটার প্রতি কী ব্যবহার হয়? একটা ভদ্রবাড়িতে এটা হবে কেন? একটু সভ্যভদ্র আচরণের আশা করব না কেন আমরা?

    মিথ্যে একটা ভুল ধারণা করে কষ্ট পাও কেন ছোড়দা ধ্রুব দৃঢ়স্বরে বলেছিল। যা পাই তার থেকে আরও ভাল ব্যবহারে আমার কোনও দরকার নেই। আমার এই যথেষ্ট। আর ধ্রুব, সেই বছর দশেকের ছেলেটা, একটুখানি হেসে বলেছিল, তোমার নিজেরও মামাকে এভাবে বলা মোটেই সভ্যতা হচ্ছে না। শুধু একজনের ইচ্ছেয় তো সংসার চলে না, আর চাকরের কাজ করলেই মানুষ চাকর হয়ে যায় না।

    ⤶ ⤷
    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26 27 28 29 30 31
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleপ্রথম প্রতিশ্রুতি – আশাপূর্ণা দেবী
    Next Article রাতের পাখি – আশাপূর্ণা দেবী

    Related Articles

    হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    ভয় সমগ্র – হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    December 9, 2025
    হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    কিশোর অ্যাডভেঞ্চার সমগ্র – হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    December 9, 2025
    সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    প্রকাশ্য দিবালোকে – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    November 18, 2025
    সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    তারপর কী হল – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    November 17, 2025
    মাইকেল মধুসূদন দত্ত

    শর্ম্মিষ্ঠা নাটক – মাইকেল মধুসূদন দত্ত

    November 11, 2025
    সত্যজিৎ রায়

    মানপত্র সত্যজিৎ রায় | Maanpotro Satyajit Ray

    October 12, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Generic selectors
    Exact matches only
    Search in title
    Search in content
    Post Type Selectors
    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Our Picks

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }