Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    দারোগার দপ্তর ৩ – প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়

    September 22, 2025

    আরব জাতির ইতিহাস – ফিলিপ কে. হিট্টি (অনুবাদ : প্রিন্সিপাল ইবরাহীম খাঁ)

    September 22, 2025

    নিউ মুন – স্টেফিন মেয়ার

    September 22, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • 🔖
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    Subscribe
    সাইন ইন
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    দারোগার দপ্তর ৩ – প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়

    প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায় এক পাতা গল্প1897 Mins Read0

    বেওয়ারিশ লাস

    বেওয়ারিশ লাস (দারোগার দপ্তর ৭৩ম সংখ্যা)
    (অর্থাৎ পথ-পার্শ্বস্থ পুলিন্দার ভিতরে প্রাপ্ত লাসের অদ্ভুত রহস্য!)
    প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায় প্রণীত।
    সিফদারবাগান বান্ধর পুস্তকালয় ও সাধারণ পাঠাগার হইতে শ্রী বাণীনাথ নন্দী কর্তৃক প্রকাশিত।All Rights Reserved.
    সপ্তম বর্ষ। সন ১৩০৫ সাল। বৈশাখ।
    Prvited By Shashi Bhusan Chandra, at the GREAT TOWN PRESS, 68, Nimtola Street, Calcutta.

    প্রকাশকের মন্তব্য।

    আজ দারোগার দপ্তর সপ্তম বৎসরে পদার্পণ করিল। এদেশে সাময়িক পত্র নিয়মিতরূপে এত অধিক দিন একাদি ক্রমে প্রচলিত থাকা বড় অনেকের ঘটেনা; সুতরাং ইহা গৌরবের কথা, তাহার আর সন্দেহ নাই। গ্রাহকগণের উপরেই সাময়িক পত্রের জীবন ও উন্নতি নির্ভর করে। আমাদের সেইরূপ অনুগ্রাহক গ্রাহক, যথেষ্ট আছেন বলিয়া, আজ আমরা গৌরবান্বিত হইতেছি। আজ তাই এই আনন্দের দিনে নুতন বর্ষারম্ভে সেই সকল গ্রাহকের নিকট আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানাইতে আসিয়াছি। তাহাদের এইরূপ অনুগ্রহ ও সাহায্য পাইলে অন্ততঃ আমাদের জীবনকাল পর্যন্ত এই দারোগার দপ্তরের অস্তিত্ব থাকিবে।

    কেহ কেহ এইরূপ বলিয়া থাকেন যে, এই দারোগার দপ্তরের দ্বারা জুয়াচোর, বদমায়েদিগের নূতন জুয়াচুরি বুদ্ধির পথ প্রদর্শন করা হয়। কিন্তু জানি না, ইহা দ্বারা জুয়াচোর গণ সাহায্য প্রাপ্ত হয়, কিম্বা সাধারণ লোকে সেই জুয়াচোর গণ-কৃত কাৰ্য্যের বিপক্ষে বাধা দিবার জন্য উপায় শিক্ষা প্রাপ্ত হয়। কারণ, আমরা কল্পনার অতিরঞ্জিত কোন চিত্র এই পুস্তকে দিই না; যাহা বাস্তবিক ঘটনা, এ দেশীয় জুয়াচুরি বুদ্ধির আয়ত্বাধীন, তাহাই ইহাতে লেখা হইয়া থাকে। তাহার পর সামান্য জুয়াচোর, বয়েস লোক পুস্তক পাঠ করে না; শিক্ষিত জুয়াচোরগণ পুস্তক পাঠ করে বটে, কিন্তু এরূপ পুস্তক দ্বারা তাহাদের বুদ্ধিবৃত্তির বিশেষ সাহায্য হইয়া থাকে, তাহা যদি মানিয়া লওয়া হয়, তবে আমাদের দারোগার দপ্তর অপেক্ষা ভয়ানক ঘটনা-পূর্ণ বিলাতী ডিটেকটিভ গল্প পুস্তকহইতে তাঁহারা অনেক অধিক সাহায্য পাইতে পারে। ইহা ত গেল, প্রতিদিন-ঘটিত এ দেশীয় ঘটনার কথা। কিন্তু যখন কল্পনার অতিরঞ্জিত ঘটনা-পূর্ণ নভেলাদি পড়িয়া এ দেশীয় স্ত্রী-বালকগণ বিকৃত-বুদ্ধি ও বিজাতীয় প্রকৃতি প্রাপ্ত হয়, তখন ত কেহ কোন কথা কহেন না, সেরূপ নভেলাদি সম্বন্ধে এইরূপ মন্তব্য প্রকাশ করেন না! ইহার কারণ কি, কেহ কি বলিতে পারেন?

    দারোগার দপ্তর একবারে সম্পূর্ণরূপ নূতন ধরণের পুস্তক। এরূপ পুস্তক ইতিপূর্বে বাঙ্গালা ভাষায় প্রচারিত হয় নাই। সুতরাং ইহা কোন্ শ্রেণীর পুস্তক, ইহা কাব্য বা উপন্যাস তাহা অনেকে ঠিক করিতে পারেন না। তবে ইহা গল্প ধরণে লেখা হইলেও, ইহাকে কাল্পনিক ঘটনা-পূর্ণ উপন্যাস বলা যাইতে পারে না। এরূপ স্থলে ইহার লেখক উপন্যাসিক পদবাচ্য কিরূপে হইবেন, বলিতে পারি না। আর বোধ হয়, এ পর্যন্ত সে কথা কেহ বলেন নাই। তবে কোন লেখক দারোগার দপ্তরের গল্প-লেখককে কবি-উপন্যাসিক বলিয়া, বিদ্রূপ-বাণ বর্ষণ করিলেন কেন বুঝিতে পারিলাম না। অবশ্য ইহা স্বীকার্য যে, কোন কোন সমালোচক দারোগার দপ্তরের ঘটনা-সমাবেশের বৈচিত্র্য ও পুস্তক-গত ভাষা সম্বন্ধে প্রশংসা করিয়াছেন।

    আর একটা গুরুতর কথা এখানে না বলিয়া থাকিতে পারিলাম না। গত বৎসর বৈশাখ মাসে দারোগার দপ্তরে মাংস ভোজন নামে য়ে পুস্তকখানি বাহির হইয়াছিল, সেই সম্বন্ধে পূর্ণিমা পত্রিকায় শ্রদ্ধাস্পদ বাবু অক্ষয়চন্দ্র সরকার মহাশয় আমাকে সমাজ-দ্রোহী বলিয়া প্রচার করিতে প্রস্তুত হইয়াছেন। তবে যদি মাংস ভোজন পুস্তকের ঘটনার যথার্থ নামধামাদি এবং কাৰ্য-কলাপ যথার্থ বলিয়া অক্ষয় বাবুর নিকট প্রমাণ করিয়া দিতে পারি, তবে আমার উক্ত কলঙ্কের ক্ষালন হইবে। কিন্তু বিজ্ঞ, ভূতপূর্ব সাধারণী পরে উপযুক্ত সম্পাদক মহাশয়কে জিজ্ঞাসা করি যে, আমরা যে সকল সমাজ-কালিমার প্রচার করি, সেই কালিমার প্রকৃত নিয়োক্তার নাম ধাম প্রভৃতি প্রকাশ করা কি আমাদের কর্তব্য? বিশেষতঃ উক্ত ঘটনার নায়ক, একজন সম্রান্ত উচ্চপদস্থ ব্যক্তি (বোধ হয় (!) মুন্সেফ)। আর অক্ষয় বাবু যে সময় সংবাদ পত্র পরিচালন করিতেন, বোধ হয়, উক্ত ঘটনা সেই সময়ে বাঙ্গালা দেশের মধ্যেই ঘটিয়াছিল। (অবশ্য কলিকাতার লোকে সে স্থানকে বাঙ্গাল দেশ বলিয়া থাকেন)। অতএব অক্ষয় বাবুর পক্ষে উক্ত ঘটনাকে কাল্পনিক বলিয়া ধারণা করা কি বিজ্ঞতার কাৰ্য্য হইয়াছে? অপর লোক হইলে আমরা এ বিষয়ে কিছুমাত্র উল্লেখই করিতাম না।

    যাহা হউক, পরিশেষে পরম কারুণিক ভগবানের নিকট প্রার্থনা করি, যেন তাহার অনুকম্পায় পূৰ্ব্ব পূৰ্ব্ব বৎসরের ন্যায় এ বৎসরেও গ্রাহক সংখ্যা বৃদ্ধি হইয়া, দারোগার দপ্তর আরও উন্নতি পথে অগ্রসর হয়, এবং ইহার জীবনের প্রতি দৃঢ় বিশ্বাস স্থাপিত হয়। ইতি—

    শ্ৰীবাণীনাথ নন্দী,
    প্রকাশক।
    সিকদারবাগান-বান্ধব-পুস্তকালয় ও সাধারণ-পাঠাগার।

    বেওয়ারিশ লাস

    প্রথম পরিচ্ছেদ।

    একদিবস প্রাতঃকালে থানার সম্মুখে বেড়াইতেছি, এরূপ সময়ে একটা লোকের মুখে শুনিতে পাইলাম যে, রাস্তার ধারে পুলিন্দার ভিতর একটা মৃতদেহ পাওয়া গিয়াছে। যাহার, নিকট হইতে আমি উহা শুনিতে পাইলাম, তাহাকে ডাকিয়া দুই একটা কথা জিজ্ঞাসাও করিলাম; কিন্তু তাহার নিকট হইতে কোনরূপ সন্তোষজনক উত্তর প্রাপ্ত হইলাম না। আমি তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলাম, আপনি মৃতদেহ কি নিজ চক্ষে দেখিয়া আসিয়াছেন?

    পথিক। না।

    আমি। তবে আপনি কিরূপে জানিতে পারিলেন যে, রাস্তার ধারে পুলিন্দার ভিতর একটী লাস পাওয়া গিয়াছে?

    পথিক। আমি শুনিয়াছি।

    আমি। কাহার নিকট হইতে আপনি শুনিয়াছেন?

    পথিক। তাহার নাম ধাম জানি না। রাস্তা দিয়া একটা লোক অপর আর একজনকে বলিতে বলিতে যাইতেছিল, তাই আমি শুনিয়াছি।

    আমি। কোন্ স্থানে এবং কোন্ রাস্তায় লাস পাওয়া। গিয়াছে, তাহার কিছু শুনিয়াছেন?

    পথিক। না, তাহা শুনি নাই।

    আমি। কবে পাওয়া গিয়াছে, তাহা কিছু শুনিয়াছেন?

    পথিক। আজ পাওয়া গিয়াছে।

    পথিকের এই কথা শুনিয়া একবার মনে হইল, হয় ত প্রকৃতই কোন স্থানে রাস্তার কিনারায় পুলিন্দার ভিতর একটা লাস পাওয়া গিয়া থাকিবে। ইহা যদি প্রকৃত হয়, তাহা হইলে ইহার সত্যাসত্য জানিতে অধিক বিলম্ব হইবে না, কোন না কোনরূপে এখনই তাহার সংবাদ আসিয়া উপস্থিত হইবে। আবার মনে হইল, কলিকাতা সহরে মধ্যে মধ্যে যেমন এক একটা মিথ্যা সংবাদ প্রচারিত হইয়া পড়ে, ইহাও হয় ত সেই প্রকারের কথা।

    মনে মনে এইরূপ ভাবিয়া সেই পথিককে কহিলাম, যান মহাশয়। আপনি এখন প্রস্থান করুন; কিন্তু সবিশেষ রূপ না জানিয়া এরূপ কোন কথা জনসাধারণের মধ্যে কখন প্রকাশ করিবেন না। কারণ, আপনি সবিশেষরূপে নিশ্চয়ই অবগত আছেন যে, কলিকাতা সহরের মধ্যে মত প্রকার গুজব উঠে, তাহার এক তৃতীয়াংশও সত্য হয় না।

    আমার কথা শুনিয়া পথিক সেই স্থান হইতে প্রস্থান করিলেন, আমিও সেই স্থানে বেড়াইতে লাগিলাম।

    ইহার দশ মিনিট পরেই সংবাদ আসিল, চটমোড়া একটা লাস একটা বাক্সের ভিতর বেওয়ারিশ অবস্থায় যোড়াবাগান থানায় পাওয়া গিয়াছে। এই সংবাদ পাইয়া, পূর্বের সংবাদকে আর মিথ্যা গুজব বলিতে পারিলাম না। আমাদিগের যেরূপ নিয়ম আছে, সেইরূপ ভাবে যোড়াবাগানের থানায় গিয়া উপস্থিত হইলাম। তথায় বুঝিলাম যে, যে সংবাদ প্রাপ্ত হইয়া ছিলাম, তাহার একবর্ণও মিথ্যা নহে।

    আমি থানায় গিয়া দেখিলাম, সেই লাসের পুলিন্দা সম্পূর্ণ রূপে খোলা হয় নাই। আমি সেই স্থানে গমন করিবামাত্রই যে খোলা হইল, তাহাও নহে। আমি সেই স্থানে উপস্থিত হইলে পর, ক্ৰমে ঊর্ধ্বতন কৰ্ম্মচারীগণ আসিয়া সেই স্থানে একত্র হইলেন। তাঁহারা আসিলেও বাক্সের ভিতর হইতে সেই লাস বাহির করা হইল না। ডাক্তার সাহেবকে সংবাদ প্রেরণ করা হইল, এবং করোনার সাহেবের নিকট একখানি পত্র সহ একজন কর্মচারী প্রেরিত হইল। ক্রমে ডাক্তার সাহেব আসিয়া উপস্থিত হইলেন, ও কয়েকজন জুরি সমভি ব্যাহারে করোনার সাহেবও আগমন করিলেন।

    এইরূপে সকলে সেই স্থানে সমবেত হইলে, যে বাক্সের ভিতর সেই মৃতদেহ রক্ষিত হইয়াছিল, তাহা সকলের সম্মুখে আনীত হইল। উহ ডবল টিনের একটা বেশ মজবুত বাক্স; কিন্তু নুতন নহে, পুরাতন। দেখিলে বোধ হয়, বহুদিবস হইতে সেই বাক্সটী অব্যবহাৰ্য্যরূপে কোন স্থানে রক্ষিত ছিল।

    শুনিলাম, যে সময় বাক্সটী থানায় আনিয়া জমা দেওয়া হয়, সেই সময় উহাতে চাবি বন্ধ ছিল, এবং খুব মজবুত। দড়িতে উহা বাঁধা ছিল। আমরা সেই স্থানে উপস্থিত হইবার পূৰ্বেই, যে দড়ি দিয়া বাক্সটা বাঁধা ছিল, তাহা সম্পূর্ণরূপে খুলিয়া, বাক্সটীর চাবি ভাঙ্গিয়া ফেলা হইয়াছিল।

    কিরূপে বাক্সটী থানায় আসিয়া উপস্থিত হইল, কিরূপ সন্দেহের উপর নির্ভর করিয়া উহার দড়ি খুলিয়া ফেলা হইল, ও বাক্সের চাবি ভাঙ্গিয়া ফেলা হইল, প্রথমে তাহাই জানিবার প্রয়োজন বিবেচনা করিয়া একজন ঊর্ধ্বতন কর্মচারী জিজ্ঞাসা করিলেন, কোন কর্মচারীর সম্মুখে এই বাক্সটী প্রথম থানার ভিতর আনীত হয়?

    থানার দারোগা নিতান্ত ভীত অন্তঃকরণে উত্তর প্রদান করিলেন, আমারই সম্মুখে প্রথমে এই বাক্স থানার ভিতর আনয়ন করে।

    ঊর্ধ্বতন কর্মচারী। কে এই বাক্স থানায় আনিয়া জমা দেয়?

    দারোগা। পোর্ট কমিশনরের একজন চাপরাশি দুইজন কুলির সাহায্যে এই বাক্সটী থানার ভিতর আনয়ন করে।

    ঊর্ধ্বতন কর্মচারী। পোর্টকমিশনরের সেই চাপরাশিকে তুমি চিন?

    দারোগা। তাহাকে চিনি বৈ কি।

    ঊর্ধ্বতন কর্মচারী। সে এখন কোথায়?

    দারোগা। তাহাকে আমি থানাতেই রাখিয়াছি, এই সে উপস্থিত আছে।

    ঊর্ধ্বতন কর্মচারী। উহার সঙ্গে যে দুইজন কুলি ছিল?

    দারোগা। তাঁহারাও এখানে উপস্থিত আছে। উঃ কঃ। (চাপরাশির প্রতি) এ বাক্স তুমি কোথায় পাইলে?

    চাপরাশি। রাত্রি দুইটার পর আমি পাহারা দিবার নিমিত্ত গঙ্গার ধারে গমন করি। সেই স্থানে এই বাক্সটা মামি দেখিতে পাই।

    ঊর্ধ্বতন কর্মচারী। গঙ্গার ধারে কোন্ স্থানে এই বাক্সটা ছিল?

    চাপরাশি। গঙ্গার ধারে যে সকল খোলা মালগুদাম আছে, তাহারই একটী গুদামের ভিতর এই বাক্সটী রক্ষিত ছিল।

    ঊর্ধ্বতন কর্মচারী। যে স্থানে বাক্সটা ছিল, সেই স্থানে আর কোন্ কোন্ ব্যক্তি ছিল?

    চাপরাশি। আর কেহই ছিল না, বেওয়ারিশ অবস্থায় কেবল বাক্সটীই ছিল মাত্র।

    ঊর্ধ্বতন কর্মচারী। উহা যে বেওয়ারিশ, তাহা তুমি কিরূপে বুঝিতে পারিলে?

    চাপরাশি। আমি প্রথমতঃ ভাবিয়াছিলাম যে, যাহার বাক্স, সে সেই স্থানে রাখিয়া অপর কোন কাৰ্য্য উপলক্ষে স্থানান্তরে গমন করিয়াছে, কাৰ্য শেষ হইলে যখন আসিবে, সেই সময় তাহার বাক্স লইয়া যাইবে। কিন্তু অনেকক্ষণ পর্যন্ত অপেক্ষা। করিয়া যখন দেখিলাম, সেই বাক্স লইবার নিমিত্ত কেহই আসিল না, তখন সহজেই আমি উহাকে বেওয়ারিশ মনে করিয়া আমার প্রধান কর্মচারীর নিকট সংবাদ প্রেরণ করিলাম। তিনি সমস্ত ব্যাপার শুনিয়া ওই বাক্স বেওয়ারিশ বলিয়া থানায় জমা দিবার নিমিত্ত আমাকে অনুমতি প্রদান করিলেন। তাই আমি এই বাক্স আনিয়া থানায় জমা দিয়াছি।

    ঊর্ধ্বতন কর্মচারী। তোমার সঙ্গে যে দুইজন কুলি আসি আছে, উহারা কাহারা?

    চাপরাশি। উহারা মুটিয়ার কাৰ্য্য করে, এবং নিকটবর্তী এক স্থানে থাকে। যখন আমি দেখিলাম যে, এই বাক্সী

    অতিশয় ভারি, দুইজন লোক ব্যতীত কোনরূপেই উহা থানায় আনা যাইতে পারে না, তখন এই দুইজন কুলিকে আমি ইহাদিগের গৃহ হইতে ডাকাইয়া আনি, ও ইহাদিগের সাহায্যে এই বাক্সটা আমি থানায় আনিয়া উপস্থিত করি।

    ঊর্ধ্বতন কর্মচারী। এই বাক্সটী থানায় জমা দিবার সময় উহার ভিতর কি আছে, তাহা তোমরা দেখিয়াছিলে কি?

    চাপরাশি। না মহাশয়! তাহা আমরা দেখি নাই। উহার ভিতর কি আছে, তাহা খুলিয়া দেখিবার নিয়ম আমা দিগের নাই। যেরূপ অবস্থায় যে কোন বেওয়ারিশ দ্রব্য পাওয়া যায়, সেইরূপ অবস্থায় তাহা আনিয়া আমরা থানায় জমা দিয়া থাকি।

    ঊর্ধ্বতন কৰ্ম্মচারী। তোমরা যদি এই বাক্স না খুলিয়া থাক, তাহা হইলে ইহা খুলিল কে?

    চাপরাশি। থানায় আনিবার পর দারোগা মহাশয় উহা খুলিয়াছেন। দোহাই ধর্মাবতার। আমরা উহা খুলি নাই।

    ঊর্ধ্বতন কর্মচারী। যে সময় দারোগা মহাশয় এই বাক্স থােলেন, সেই সময় তুমি সেই স্থানে উপস্থিত ছিলে?

    চাপরাশি। আজ্ঞা হাঁ, আমি সেই সময় সেই স্থানে উপস্থিত ছিলাম। আমার সম্মুখেই এই বাক্স খোলা হয়।

    ঊর্ধ্বতন কর্মচারী। (দারোগার প্রতি) কেমন, তুমিই এই বাক্স প্রথমে খুলিয়াছিলে?

    দারোগা। আজ্ঞা হাঁ, আমি উহা খুলিয়াছিলাম।

    ঊর্ধ্বতন কর্মচারী। এই বাক্স খুলিবার তোমার কি প্রয়োজন হইয়াছিল?

    .

    দারোগা। এই বাক্স যখন জমা করিয়া দিবার নিমিত্ত থানায় আনা হয়, তখন উহার ভিতর কি দ্রব্য আছে, তাহা না জানিয়া উহা কিরূপে জমা করিয়া লইতে পারি? মনে মনে এইরূপ ভাবিয়া যে দড়ি দিয়া এই বাক্স জড়াইয়া বাঁধা ছিল, তাহা প্রথমে খুলিয়া ফেলি। তাহার পর দেখিতে পাই, বাক্সের চাবি বন্ধ আছে। সুতরাং এই চাবিও আমাকে ভাঙ্গিয়া ফেলিতে হয়। চাবি ভাঙ্গিয়া বাক্সের ডালা উঠাইয়া দেখিতে পাই যে, উহার ভিতর যে দ্রব্য আছে, তাহা আবার চটে মোড়া। তখন সেই চটের এক পার্শ্বে অতি অল্পমাত্র ফাঁক করিয়া দেখি, উহার ভিতর মৃতদেহ রহিয়াছে। এই ব্যাপার দেখিয়া আমি তৎক্ষণাৎ আমার ঊর্ধ্বতন কর্মচারীকে সংবাদ প্রদান করি। তিনি উপর হইতে তৎক্ষণাৎ নীচে আগমন করেন, এবং স্বচক্ষে এই ব্যাপার দর্শন করিয়া পরিশেষে আপনাদিগের নিকট সংবাদ প্রদান করেন।

    ঊর্ধ্বতন কর্মচারী। থানার কেতাবে ভুমি এই বাক্স জমা করিয়া লইয়াছ?

    দারোগা। না।

    ঊর্ধ্বতন কর্মচারী। কেন?

    দারোগা। বাক্সের ভিতর যখন কোন দ্রব্য পাইলাম না, অথচ লাস বাহির হইয়া পড়িল, তখন আর কি জমা করিয়া লইব?

    দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ।

    থানার দারোগা ও চাপরাশির নিকট এই সকল কথা অবগত হইয়া ঊর্ধ্বতন কর্মচারী সেই বাক্স সৰ্ব্ব সমক্ষে সেই স্থানে খুলিতে কহিলেন। আদেশ প্রদান করিবামাত্র তাহার সেই আদেশ প্রতিপালিত হইল।

    বাক্সের ডালা খুলিবামাত্র আমরা সকলেই দেখিতে পাই লাম যে, সেই বাক্সের ভিতর চটে মোড়া ও উপরে দড়ি দিয়া উত্তমরূপে জড়াইয়া সেই মৃতদেহটী বাধা আছে। সেইরূপ অবস্থায় সেই চট-জড়ান মৃতদেহ সেই বাক্সের ভিতর হইতে বাহির করা হইল, এবং যে দড়ি দিয়া উহা জড়াইয়া বাঁধা ছিল, সেই দড়ি ও চট খুলিয়া দিলে, দেখিতে পাওয়া গেল, উহার ভিতর যে মৃতদেহ ছিল, তাহা একটা পুরুষের দেহ। উহার হাত পা দোমড়াইয়া যাহাতে অল্প স্থানের ভিতর স্থান হইতে পারে, সেইরূপ ভাবে বাঁধা হইয়াছিল।

    সেই মৃতদেহ দেখিয়া অনুমান হইল, যে ব্যক্তি মরিয়া গিয়াছে, তাহার বয়ঃক্রম ত্রিশ বৎসরের কম হইবে না। জাতিতে মুসলমান। মৃতদেহ উত্তমরূপে পরীক্ষা করা হইল; কিন্তু উহার কোন স্থানে কোনরূপ জখম বা অপর কোনরূপ আঘাতের চিহু দেখিতে পাওয়া গেল না। কেবল অনুমান হইল যে, উহার বাম গণ্ডে যেন একটু সামান্য কাল দাগ পড়িয়াছে।

    ডাক্তার সাহেব সেই স্থানেই উপস্থিত ছিলেন। তিনিও সেই মৃতদেহ উত্তমরূপে দেখিয়া কহিলেন, যদি ইহাকে কোন স্থানে আঘাত করা হইয়া থাকে, তাহা হইলে বাম গণ্ডে ব্যতীত যে অপর কোন স্থানে আঘাত করা হইয়াছে, তাহা অনুমান করা যায় না।

    তিনি আরও কহিলেন যে, তাঁহার বিবেচনায় সেই ব্যক্তির মৃত্যু চব্বিশ ঘণ্টার ভিতর হইয়াছে বলিয়া অনুমান হয় না। তিনি তখন এই সকল বিষয় সম্বন্ধে তাঁহার ঠিক মত প্রকাশ করিতে পারিলেন না, ও কহিলেন যে, এখন তিনি যাহা, বলিতেছেন, তাহা কেবল অনুমানের উপর নির্ভর করিয়া বলিতেছেন মাত্র। যে পর্যন্ত সেই শব ছেদন করিয়া তিনি উত্তমরূপে পরীক্ষা করিয়া না দেখিতে পারিবেন, সেই পৰ্যন্ত তিনি তাঁহার ঠিক মত প্রকাশ করিতে সমর্থ হইবেন না।

    ডাক্তার সাহেবের এই কথা শুনিয়া, সেই মৃতদেহ যে স্থানে ছেদন করিলে, পরীক্ষা হইতে পারে, সেই স্থানে উহা তৎক্ষণাৎ পাঠাইয়া দিবার নিমিত্ত ঊর্ধ্বতন কর্মচারী সাহেব আদেশ প্রদান করিলেন।

    এই আদেশ সম্বন্ধে তাহার মতের সহিত আমাদিগের কাহারও মতের ঐক্য হইল না। তখন আমরা সকলে মিলিয়া তাঁহাকে কহিলাম, এই মৃতদেহ এখনই পাঠাইয়া দিবার সম্বন্ধে আপনি যে আদেশ প্রদান করিতেছেন, তাহা এখনই প্রতিপালন করা আমাদিগের কর্তব্য কৰ্ম্ম; কিন্তু এই মৃত দেহ যে কাহার, এ পর্যন্ত তাহার কিছুই, নির্ণয় হয় নাই। অতএব যে পর্যন্ত উহা স্থিরীকৃত না হইবে, সেই পর্যন্ত এই

    হত্যার কোনরূপ উদ্ধার হইবে না, বা প্রকৃত অপরাধীও ধৃত হইবে না। এরূপ অবস্থায় আমাদিগের নিতান্ত ইচ্ছা যে, এই মৃতদেহ পরীক্ষার নিমিত্ত উহাকে কোন প্রকাশ্য স্থানে অনাবৃত ভাবে রাখিয়া দেওয়া কর্তব্য। কারণ, তাহা হইলে এই মৃতদেহ দেখিবার নিমিত্ত সেই স্থানে বিলক্ষণ জনতা হইবে, ও অনেক লোকে এই মৃতদেহ দেখিতে পাইবে। এইরূপ অবস্থায় যদি কেহ এই মৃতদেহ চিনিতে পারে, তাহা হইলে আমাদিগের অভিলাষ অনেকটা পূর্ণ হই বার সম্ভাবনা।

    ঊর্ধ্বতন কর্মচারী সাহেব আমাদিগের মনের ভাব বুঝিতে পারিলেন, এবং ডাক্তার সাহেবের সহিত পরামর্শ করিয়া কহিলেন, আচ্ছা তাহাই ঠিক; কিন্তু দিবা বারটার পর এই মৃতদেহ যেন আর রাখা না হয়। কারণ, তাহা হইলে উহা একবারে পচিয়া যাইবে। মৃতদেহ পচিয়া গেলে ডাক্তার সাহেব তাহা উত্তমরূপে পরীক্ষা করিতে সমর্থ হইবেন না।

    তিনি আরও কহিলেন, আমি এখনই প্রত্যেক থানায় সংবাদ প্রদান করিতেছি। সেই সকল থানার এলাকায় প্রত্যেক পল্লীতে যে সকল লোক বাস করে, তাহাদিগের মধ্যে কোন না কোন লোককে আনিয়া যেন এই মৃতদেহ দেখান হয়। তাহা হইলে সেই সকল লোকের মধ্য হইতে কোন না কোন লোক এই মৃতদেহ চিনিলেও চিনিতে পারিবে।

    এই বলিয়া ঊর্ধ্বতন কর্মচারী সাহেব, ডাক্তার সাহেব এবং করোণার সাহেবের সহিত সেই স্থান হইতে প্রস্থান করিলেন।

    তাঁহারা চলিয়া যাইবার পর আমরা সেই মৃতদেহটা চটের ভিতর হইতে বাহির করিয়া একটী প্রকাশ্য স্থানে অনাবৃত অবস্থায় রাখিয়া দিলাম। সেই মৃতদেহ দেখিবার নিমিত্ত সেই স্থান লোকে লোকারণ্য হইয়া পড়িল। কয়েকজন উচ্চ ও নিম্নপদস্থ বুদ্ধিমান্ কর্মচারীকে পুলিশের পোক না পরাইয়া সেই ভিড়ের মধ্যে রাখিয়া দেওয়া হইল। সেই মৃতদেহ দেখিয়া কোন্ ব্যক্তি কি বলে, কেহ উহাকে চিনিতে পারিলে আপনাদিগের মধ্যে কি কথা বলাবলি করে, তাহা জানিয়া লইবার ভার তাহাদিগের উপরই অর্পিত হইল।

    এদিকে উর্ধতন কর্মচারী মহাশয়ের আদেশ প্রচারিত হইবামাত্র প্রত্যেক থানার এলাকা হইতে রাশি রাশি লোক আসিয়া সেই স্থানে সমবেত হইয়া সেই মৃতদেহ দেখিতে লাগিল। কিন্তু তাহা যে কাহার দেহ, তাহা কেহ চিনিতে পারিল না, বা চিনিয়াও কেহ বলিল না। এইরূপে প্রায় দিবা এগারটা বাজিয়া গেল।

    ঊর্ধ্বতন কর্মচারী সাহেব সেই স্থান হইতে প্রস্থান করি বার পর, যে চটে সেই মৃতদেহ মোড়া ছিল, সেই চটটা আমরা উত্তমরূপে দেখিলাম। দেখিলাম, তাহাতে এরূপ কোন কথা লেখা নাই, বা এরূপ কোন চিহু নাই যে, যাহার দ্বারা, সেই চট যে কোথা হইতে আনীত হইয়াছে, বা তাহা কাহার, তাহার কিছুমাত্র সন্ধান পাওয়া যাইতে পারে।

    যে টিনের বাক্সের ভিতর সেই মৃতদেহ পাওয়া গিয়াছিল, সেই টিনের বাক্সটীর মধ্যে উত্তমরূপে দেখাতে, দেখিতে পাইলাম, তাহার ভিতর একটা পুরাতন ও নিতান্ত ক্ষুদ্র শিশি রহিয়াছে। সেই শিশিটা নিজের হাতে করিয়া উত্তমরূপে পরীক্ষা করিয়া দেখিলাম। দেখিলাম, প্রায় পাঁচ ছয় বৎসর পূৰ্বে সেই শিশিতে করিয়া ব্যাথগেট কোম্পানির ঔষধালয় হইতে একজন সাহেবের নিমিত্ত ঔষধ আসিয়াছিল। এরূপ শিশি প্রায় সকল গৃহেই পাওয়া যায়। বিশেষতঃ সাহেব দিগের গৃহের শিশি, বোতল প্রভৃতি তাহাদিগের খানসামা। বাবুর্চিরা প্রায়ই বিক্ৰীওয়ালাদিগের হস্তে বিক্রয় করিয়া ফেলে। বিক্ৰীওয়ালারা সেই সকল শিশি-বোতল আনিয়া শিশি-বোতল-ব্যবসায়ী দোকানদারের হস্তে বিক্রয় করে।, তাহাদিগের দোকান হইতে যাহাদিগের প্রয়োজন হয়, তাঁহারা ক্রয় করিয়া লইয়া যায়। এরূপ অবস্থায় সেই ঔষধের শিশি উপলক্ষ করিয়া অনুসন্ধান করিলে যে কোন রূপ সবিশেষ ফল লাভের সম্ভাবনা, তাহা বিবেচনা করি লাম না। যে স্থানের শিশি সেই স্থানে রাখিয়া দিয়া, অন্য কোন উপায় চিন্তা করিতে লাগিলাম। কিন্তু ভাবিয়া চিন্তিয়া কোন উপায়ই স্থির করিয়া উঠিতে পারিলাম না।

    এদিকে নানা স্থান হইতে নানা লোক আসিয়া সেই মৃতদেহ দর্শন করিতে লাগিল। কেহ বা তাহার অবস্থা দেখিয়া দুঃখ প্রকাশ, কেহ বা হত্যাকারীর উদ্দেশে গালি প্রদান, প্রভৃতি যাহার মনে যাহা আসিতে লাগিল, সে তাহাই বলিতে বলিতে সেই স্থান হইতে প্রস্থান করিতে লাগিল। তাহাদিগের কথার ভাবে স্পষ্টই অনুমান হইতে লাগিল যে, সেই মৃতদেহ তাহাদিগের মধ্যে কেহই চিনিয়া উঠিতে পারে নাই।

    যে স্থানে সেই মৃতদেহ রক্ষিত হইয়াছিল, আমি সেই স্থানে গমন করিয়া অনেকক্ষণ পর্যন্ত দণ্ডায়মান রহিলাম, এবং যে সকল ব্যক্তি সেই মৃতদেহ দর্শন করিতে লাগিল, তাহাদিগের মধ্যে কোন্ ব্যক্তি যে কি বলে, তাহার দিকে সবিশেষরূপ লক্ষ্য রাখিলাম।

    সেই সময় হঠাৎ একটী লোকের উপর আমার নয়ন আকৃষ্ট হইল। সেই ব্যক্তি আর একজন লোকের নিকট কি কথা বলিতেছিল। তখন উহার ভাবগতি দেখিয়া আমার বেশ অনুমান হইল যে, সেই মৃতদেহ সম্বন্ধেই সে কোন কথা বলিতেছে। আমার আরও অনুমান হইল যে, সেই-  মৃতব্যক্তি যেন তাহার পরিচিত।

    এই ব্যাপার দেখিয়া আমি আর কালবিলম্ব না করিয়া ধীরে ধীরে তাহার পশ্চাৎ ভাগে গিয়া দণ্ডায়মান হইলাম, ইচ্ছা যদি তাহার মুখের কোন কথা শুনিতে পাই।

    সেই সময় অপর ব্যক্তি কহিল, কেমন, তুমি বেশ চিনিতে পারিতেছ?

    উত্তরে সেই ব্যক্তি কহিল, আমার বেশ বোধ হইতেছে, এ সে-ই ব্যক্তি।

    এই সময় আমি আর চুপ করিয়া থাকিতে পারিলাম না, তাহাকে তৎক্ষণাৎ জিজ্ঞাসা করিলাম, এ কোন্ ব্যক্তির মৃতদেহ?

    দর্শক। আমার বোধ হইতেছে, ইহা হকদারের মৃতদেহ।

    আমি। হুকদার কে?

    দর্শক। সে ব্রাউন কোম্পানির একজন কোচমান।

    আমি। তাহার আর কে আছে, বলিতে পার?

    দর্শক। তাহার ভাই আছে।

    আমি। তাহার ভাইয়ের নাম কি?

    দর্শক। নাম আমি জানি না।

    আমি। কোথা থাকে বলিতে পার?

    দর্শক। সেও ব্রাউন কোম্পানির আফিসে কোচমানের কাৰ্য্য করে, এবং সেই স্থানেই থাকে।

    আমি। তুমি একবার আমার সঙ্গে গিয়া তাহার ভাইকে দেখাইয়া দিতে পার?

    দর্শক। আমি যাইতে পারিতাম, কিন্তু এখন আমি আমার মনিবের কাৰ্যে গমন করিতেছি। এরূপ অবস্থায় আমি কিরূপে আপনার সঙ্গে গমন করিব? আমার মনিব জানিতে পারিলে, তিনি আমাকে চাকরি হইতে জবাব দিবেন।

    আমি। তুমি আমাদিগের সহিত গমন করিয়া যদি এই কাৰ্যে আমাদিগের সাহায্য কর, তাহা হইলে তোমার মনিব তোমার উপর কোনরূপেই অসন্তুষ্ট হইবেন না, প্রত্যুত সবিশেষ সন্তুষ্টই হইবেন। তদ্ব্যতীত তোমার বাক্যানুসারে যদি আমা দিগের কাৰ্য উদ্ধার হয়, তাহা হইলে যাহাতে তুমি গবর্ণমেন্ট হইতে কিছু পারিতোষিক পাও, তাহার বন্দোবস্ত করিয়া দিব।

    আমার কথায় সেই ব্যক্তি পরিশেষে সম্মত হইল, এবং আমাদিগকে সঙ্গে করিয়া সেই আড়গড়ায় গিয়া উপস্থিত হইল।

    তৃতীয় পরিচ্ছেদ।

    সেই ব্যক্তিকে সঙ্গে করিয়া আমরা যখন আড়গড়ার ভিতর প্রবেশ করিলাম, সেই সময় দেখিতে পাইলাম যে, আড়গড়া হইতে একটা লোক বাহির হইয়া আসিতেছে। তাহাকে দেখিয়াই সেই ব্যক্তি কহিল, মহাশয়! আপনি যাহার অনুসন্ধান করিতেছেন, সে ওই বাহির হইয়া আমা দের দিকে আসিতেছে, দেখুন।

    এই কথা শুনিয়া আমি তাহাকে ডাকিলামসে নিকটে আসিলে তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলাম, তোমর নাম কি? উত্তরে সে কহিল, আমার নাম সুবেদার

    আমি। হকদার তোমার কে হয়?

    সুবেদার। সে আমার ভাই।

    আমি। সে এখন কোথায়?

    সুবেদার। দেশে যাইব বলিয়া আজ দুই দিবস হইল, সে এই স্থান হইতে চলিয়া গিয়াছে।

    আমি। দেশে যাইবার সময় সে মূল্যবান্ দ্রব্যাদি কিছু লইয়া গিয়াছে কি?

    সুবেদার। সবিশেষ মুল্যবান দ্রব্য কিছুই লইয়া যায় নাই; কিন্তু এত দিবস পর্যন্ত এই স্থানে চাকরি করিয়া যাহা কিছু নগদ অর্থ সংগ্রহ করিতে পারিয়াছিল, কেবল তাহাই লইয়া গিয়াছে।

    আমি। কত টাকা লইয়া গিয়াছে, বলিতে পার?

    সুবেদার। সে যে কত টাকা লইয়া গিয়াছে, তাহা ঠিক আমি বলিতে পারি না; কিন্তু আমার বোধ হয়, এক শত টাকার কম হইবে না।

    আমি। তোমার ভাই দেশে চলিয়া গিয়াছে, ইহা তুমি ঠিক বলিতে পার কি?

    সুবেদার। না, আমি তাহা ঠিক বলিতে পারি না। তবে এইমাত্র বলিতে পারি যে, দেশে যাইব বলিয়া টাকা কড়ি, পরিধেয় বস্ত্রাদি লইয়া যখন এই স্থান হইতে চলিয়া গিয়াছে, তখন তাহার দেশে যাওয়াই সম্পূর্ণরূপে সম্ভব।

    আমি।আমার বোধ হইতেছে, তোমার ভাই দেশে যায় নাই। এই কলিকাতার ভিতর কোন একটা মোক ব্দমায় জড়ীভূত হইয়া পড়িয়াছে। আমি যাহার কথা বলিতেছি, সে যে তোমার ভাই, এ কথা আমি নিশ্চয়ই বলিতে পারি না। কিন্তু আমার যতদুর বিশ্বাস, তাহাতে সেই ব্যক্তি তোমার ভাই হওয়াই সম্পূর্ণ সম্ভব।

    সুবেদার। কি মোকদ্দমায় আমার ভাই জড়ীভূত হইয়াছে, এবং কোথায় ও কিরূপ মোকদ্দমায় পড়িয়াছে, অনুগ্রহ করিয়া তাহা যদি আমাকে বলিয়া দেন, তাহা হইলে আমি বড়ই উপকৃত হইব।

    আমি। আমার বলিয়া দিবার কিছুমাত্র প্রয়োজন দেখি না। তুমি আমার সহিত আইস, যে স্থানে তোমার ভাই আছে, আমি এখনই সেই স্থানে লইয়া গিয়া তোমার ভাইয়ের সহিত সাক্ষাৎ করাইয়া দিব।

    আমার প্রস্তাবে সুবেদার সম্মত হইল, কিন্তু কহিল, আপনি একটু অপেক্ষা করুন। এই স্থানে আমার একজন আত্মীয় আছেন, তাহাকে ডাকিয়া আনিয়া আমরা উভয়ে এখনই আপনার সহিত গমন করিতেছি।

    এই বলিয়া সুবেদার সেই স্থান হইতে প্রস্থান করিল। আমরা সেই স্থানে তাহার প্রতীক্ষায় অপেক্ষা করিতে লাগি লাম। অতি অল্প সময় মধ্যেই অপর আর ব্যক্তিকে সঙ্গে করিয়া সুবেদার আমাদিগের নিকটে আসিয়া কহিল, চলুন মহাশয়! কোথায় যাইতে হইবে?

    সুবেদার ও তাহার আত্মীয়কে সঙ্গে লইয়া যে স্থানে সেই মৃতদেহ ছিল, সেই স্থানে আসিয়া উপস্থিত হইলাম, এবং সেই মৃতদেহী সুবেদারকে দেখাইয়া দিয়া কহিলাম, দেখ দেখি, এই মৃতদেহ কাহার, তাহা তুমি চিনিতে পার কি?

    সুবেদার অনেকক্ষণ পর্যন্ত সেই মৃতদেহটী স্থির নেত্রে দর্শন করিয়া কহিল, ইহা আমার ভ্রাতা হকদারের মৃতদেহ বলিয়া বোধ হইতেছে। ইহাকে এইরূপে কে হত্যা করিল মহাশয়?

    আমি। যে ব্যক্তি যেরূপে ইহাকে হত্যা করিয়াছে, ও যেরূপ অবস্থায় এই মৃতদেহ পাওয়া গিয়াছে, তাহা তুমি এখনই জানিতে পারিবে; কিন্তু তুমি অগ্রে উত্তমরূপে দেখ, ইহা তোমার ভ্রাতার মৃতদেহ কি না?

    সুবেদার। আমি বেশ করিয়া দেখিয়াছি, ইহা যে আমার ভাই হকদারের মৃতদেহ, তাহাতে আর কোন সন্দেহ নাই।

    আমি। মনুষ্য মরিয়া যাওয়ার পর, তাহার আকৃতি প্রায় বিকৃত হইয়া পড়ে। সুতরাং মৃতদেহ দেখিয়া উহা যে কাহার মৃতদেহ তাহা ঠিক নির্ণয় করা সময় সমন সবিশেষ কঠিন হইয়া উঠে। আর ইহাও প্রায় দেখিতে পাওয়া যায় যে, কোন কোন মৃতদেহ যাহার বলিয়া প্রথমে নির্ধারিত হয়, পরিশেষে তাহাকে জীবিতাবস্থাতেও পাওয়া গিয়া থাকে। এই নিমিত্ত আমি তোমাকে বলিতেছি, এই মৃতদেহ সম্বন্ধে যদি তোমার মনে কোনরূপ সন্দেহ থাকে, তাহা হইলে এই সময় আমাকে পরিষ্কার করিয়া বল। ইহা প্রকৃতই যদি তোমার ভ্রাতার মৃতদেহ হয়, তাহা হইলে বাঁহার দ্বারা এই ঘটনা ঘটিয়াছে, অনুসন্ধান করিয়া আমরা তাহা বাহির করিতে সবিশেষরূপে চেষ্টা করিব। আর এই মৃতদেহ তোমার ভ্রাতার কি না, এ সম্বন্ধে যদি কোনরূপ সন্দেহ হয়, তাহাও এখনই আমাকে বলতে পার, তাহা হইলে আমরা তাহার অপর উপায় দেখি।

    সুবেদার। আমি বেশ করিয়া দেখিয়াছি, এবং আমার বেশ প্ৰতীতি হইতেছে, ইহা আমার ভ্রাত হকদারের দেহই হইবে। ইহার নিকট টাকাকড়ি কিছু পাওয়া গিয়াছে মহাশয়?

    আমি। না, ইহার নিকট একটী পয়সাও পাওয়া যায় নাই।

    সুবেদার। তাহা হইলে টাকার লোভেই কেহ ইহাকে মারিয়া ফেলিয়াছে।

    আমি। যদি এই মৃতদেহ তোমার ভ্রাতার হয়, তাহা হইলে অর্থই যে এই ঘটনার মূল, তদ্বিষম্বে আমার কিছু মাত্র সন্দেহ নাই।

    সুবেদার। ইহা নিশ্চয়ই আমার ভ্রাতার মৃতদেহ।

    সুবেদারের কথায় অবিশ্বাস করিবার কোন কারণ নাই। কারণ, সে যদি তাহার ভ্রাতার মৃতদেহ চিনিতে না পারিবে, তাহা হইলে আর কে চিনিতে পারিবে? যাহা হউক, সুবেদারের কথা যদি প্রকৃত হয়, সেই মৃতদেহ যদি তাহার ভ্রাতা হকদারের হয়, তাহা হইলে কাহার দ্বারা এই হত্যাকাণ্ড সম্পন্ন হইয়াছে, তাহা স্থির করা নিতান্ত সহজ হইবে না। কারণ, অনুমান হইতেছে যে, অর্থের নিমিত্ত এই ঘটনা ঘটিয়া থাকিবে; এরূপ হইলে, এইরূপ কার্যে পরিপক্ক কোন লোকের দ্বারা নিশ্চয়ই এই কাৰ্য্য হইয়াছে। সেইরূপ লোকের দ্বারা এই কাৰ্য্য হইলে দেখা যায় যে, সে তোক প্রায়ই সহজে ধৃত হয় না। তথাপি এ বিষয়ে আমাদিগকে বিশেষরূপ চেষ্টা করিয়া দেখিতে হইবে।

    সেই সময় আমার মনে হইল, সুবেদারের সমভিব্যাহারে, তাহার আত্মীয় যে ব্যক্তি আগমন করিয়াছে, সেই ব্যক্তিও যে হকদারকে উত্তমরূপে চিনিতে পারিবে, তাহার আর কিছুমাত্র সন্দেহ নাই। তাহাকেও সেই মৃতদেহ দেখান সর্বতোভাবে কর্তব্য।, মনে মনে এইরূপ ভাবিয়া সুবেদারের আত্মীয়কেও সেই মৃতদেহ দেখাইলাম, সে কিন্তু অনেকক্ষণ পর্যন্ত নিরীক্ষণ করিয়া কহিল, না মহাশয়! ইহা কাহার মৃতদেহ, তাহা আমি চিনিয়া উঠিতে পারিতেছি না।

    আমি। তুমি সুবেদারের ভাই হকদারকে চেন?

    আত্মীয়। খুব চিনি।

    আমি। এই যে মৃতদেহ দেখিতেছ, তাহা হকদারের মৃতদেহ কি না?

    আত্মীয়। ইহা দেখিতে অনেকটা হকদারের দেহের মত বটে; কিন্তু আমার বোধ হয় এই মৃতদেহ হকদারের মৃতদেহ নহে।

    আমি। সুবেদার বলিতেছে, ইহা তাহার ভাই হকদারের মৃতদেহ।

    আত্মীয়। আমার বোধ হয়, সুবেদার ঠিক চিনিতে পারিতেছে না। ইহার আকৃতির সহিত হকদারের আকৃতির অনেকটা সৌসাদৃশ্য থাকিলেও, ইহার অপেক্ষা হকদার একটু মোটা ও একটু লম্বা।

    আমি। হকদার এখন কোথায়?

    আত্মীয়। সে দেশে গিয়াছে।

    আমি। দেশে যাইতে তাহাকে কে দেখিয়াছে?

    আত্মীয়। কেহ দেখিয়াছে কি না, জানি না; কিন্তু খাইবার সময় আমি দেখি নাই।

    আমি। রেলে উঠাইয়া দিবার নিমিত্ত কেহ তাহার সঙ্গে গমন করে নাই?

    আত্মীয়। কেহ গমন করিয়াছিল কি না, জানি না; কিন্তু তাহার সঙ্গে আমানতের গমন করিবার কথা ছিল।

    আমি। আমানত কে?

    আত্মীয়। যে গ্রামে হকদারের বাড়ী, আমানতের বাড়ী ও সেই গ্রামে।

    আমি। এখানে আমানত কোথায় থাকিত? আত্মীয়। কলিগঞ্জে।

    আমি। বালিগঞ্জের কোথায়?

    আত্মীয়। বালিগঞ্জে একটী আড়গড়া আছে; সে সেই স্থানেই থাকিত।

    আমি। সে কাহার আড়গড়া?

    আত্মীয়। সাহেবের আড়গড়া। সাহেবের নাম জানি না।

    আমি। সেই স্থানে সে কি কাৰ্য্য করিত?

    আত্মীয়। সহিসের কাৰ্য্য করিত।

    আমি। তুমি সেই আড়গড়া আমাকে দেখাইয়া দিতে পারিবে কি?

    আত্মীয়। কেন পারিব না? আমার সহিত আসুন, আমি তাহাকে এখনই দেখাইয়া দিব।

    সুবেদার কর্তৃক মৃতদেহ সেনাক্ত হইয়াছে, অর্থের লোভে তাহার ভাই হকদারকে মারিয়া ফেলিয়া বাক্সের ভিতর পূরিয়া ফেলিয়া দিয়াছে, এই কথা বিদ্যুৎবেগে সহরের সর্ব স্থানে প্রচারিত হইয়া পড়িল। যে সকল কর্মচারী, কাহার মৃতদেহ, এই সংবাদ পাইবার প্রত্যাশায় স্থানে স্থানে গমন করিয়াছিলেন, এবং যে সকল কর্মচারী অপর কার্যে নানাস্থানে চলিয়া গিয়াছিলেন, এই সংবাদ প্রাপ্ত হইয়া তাহার সকলে আসিয়া সেই স্থানে উপস্থিত হইতে লাগিলেন।

    যাহা হউক, অনন্তর একখানি দ্রুতগামী গাড়ি লইয়া আমি, সুবেদার ও তাহার আত্মীয়কে সমভিব্যাহারে লইয়া বালিগঞ্জে গমন করিলাম।

    কথিত আড়গড়ার সম্মুখে উপস্থিত হইলে, আমাদিগকে সেই স্থানে রাখিয়া সেই আত্মীয় আমানতের সংবাদ আনিবার নিমিত্ত আড়গড়ার ভিতর গমন করিল, এবং কিয়ৎক্ষণ পরে প্রত্যাবর্তন করিয়া কহিল, আমানত ও হকদার কেহই এ পর্যন্ত দেশে যায় নাই, আজ সন্ধ্যার সময় যাইবে।

    আমি। হকদার দেশে যায় নাই; কিন্তু সে এখন কোথায়, তাহ আমানত কিছু বলিতে পারিল?

    আত্মীয়। আমানত আর আমাকে কি বলিবে?. হকদার যে স্থানে আছে, তাহা আমি স্বচক্ষে দেখিয়া আসিয়াছি।

    আমি। সে এখন কোথায়?

    আত্মীয়। সে এখন আমানতের বাসায় বসিয়া রহিয়াছে।

    আমি। তুমি নিজ চক্ষে দেখিয়া আলিয়াছ?

    আত্মীয়। হ মহাশয়! আমি স্বচক্ষে দেখিয়া আসিতেছি। বিশ্বাস না করেন, বলুন, আমি তাহাকে ডাকিয়া আপনার সম্মুখে আনিয়া উপস্থিত করিতেছি।

    আমি। সে-ই ভাল, তাহাকে একবার ডাকিয়া আমার সম্মুখে আনয়ন কর।

    আমার কথা শুনিয়া সেই আত্মীয় পুনরায় সেই আড়গড়ার ভিতর প্রবেশ করিল, এবং অতি অল্প সময়ের মধ্যেই হকদারকে আনিয়া আমার সম্মুখে উপস্থিত করিল। তাহাকে দেখিয়া সুবেদার কহিল, হা মহাশয়! এ-ই আমার ভাই। এখন দেখিতেছি, সেই মৃতদেহ দেখিয়া আমি ঠিক চিনিতে পারি নাই।

    হকদারকে সঙ্গে লইয়া আমি প্রত্যাবর্তন করিলাম। হক দাকে জীবিত দেখিয়া সকলেই বিস্মিত হইলেন।

    চতুর্থ পরিচ্ছেদ।

    অনুসন্ধানের এক অধ্যায় শেষ হইল। আমি বালিগঞ্জ হইতে প্রত্যাবর্তন করিয়া সেই মৃতদেহ আর থানায় দেখিতে পাইলাম না। যে স্থানে শব পরীক্ষা হয়, সেই স্থানে সেই শব তখন প্রেরিত হইয়াছিল।

    সেই স্থানে গমন করিয়া দেখিলাম, সেই স্থানেও সেই মৃতদেহ দেখিবার নিমিত্ত অনেক লোকের সমাগম হইয়াছে।

    যে বাক্সের ভিতর মৃতদেহ পাওয়া যায়, সেই বাকের ভিতর ঔষধের একটা ছোট শিশি পাওয়া গিয়াছিল, তাহা পাঠকগণ পূর্ব হইতে অবগত আছেন। সেই শিশির উপরকার লেভেলে ব্যাথগেট কোম্পানির নাম লেখা ছিল। একজন কৰ্মচারী সেই শিশিটা লইয়া ব্যাথগেট কোম্পানির বাড়ীতে গমন করিয়াছিলেন।

    লাস পরীক্ষার স্থানে আমরা গিয়া উপস্থিত হইবার পর, সেই কর্মচারী ব্যাথগেট কোম্পানির ঔষধালয় হইতে প্রত্যা বৰ্তন করিলেন ও কহিলেন, এই শিশিতে যাহা লেখা আছে, ব্যাথগেট কোম্পানি তাহাদিগের খাতা-পত্ৰ দেখিয়া, তাহা অপেক্ষা আর অধিক কোন সংবাদ প্রদান করিতে পারি লেন না।

    অনেকে মনে করিয়াছিলেন, সেই ঔষধের শিশি হইতে এই অনুসন্ধানের কোন না কোন সুত্র বাহির হইয়া পড়িবে; কিন্তু সেই কর্মচারীর কথা শুনিয়া সকলেই একবারে নীরব হইয়া পড়িলেন। পুনরায় কোন্ উপায় অবলম্বন করিয়া, সকলে এই মোকদ্দমার অনুসন্ধানে নিযুক্ত হইবেন, তাহাই ভাবিতে লাগিলেন।

    যে একটী সূত্র পাইয়া আমি এই মোকদ্দমার উদ্ধার করিতে পারিব বলিয়া আশা করিয়াছিলাম, এখন আমার সে আশাও দূর হইয়াছে। পুনরায় আবার কোন্ উপায় অবলম্বন করিব, মনে মনে এইরূপ ভাবিতে ভাবিতে যে স্থানে সেই মৃতদেহ রক্ষিত ছিল, সেই স্থান হইতে বহির্গত হইয়া সদর রাস্তার উপর আসিয়া দাড়াইলাম। আমার সম্মুখ দিয়া কত লোক যে সেই মৃতদেহ দেখিবার নিমিত্ত সেই স্থানে প্রবেশ করিতে লাগিল, এবং কত লোক মৃতদেহ দেখিয়া সেই স্থান হইতে বহির্গত হইয়া যে চলিয়া যাইতে লাগিল, তাহার সংখ্যা করা নিতান্ত সহজ নহে।

    আমি সেই রাস্তার উপর দাঁড়াইয়া দাঁড়াইয়া ক্রমে ক্লান্ত হইয়া পড়িলাম। সেই রাস্তার ধারে একটা চাউলের দোকান ছিল, ক্ৰমে গিয়া আমি সেই স্থানে উপবেশন করিলাম। আমার সম্মুখ দিয়া তখন পর্যন্ত অনেক লোক সেই স্থানে গমন ও তথা হইতে প্রস্থান করিতে লাগিল। আমি বসিয়া বসিয়া কেবল তাহাদিগকে দেখিতে লাগিলাম, এবং তাহাদের মধ্যে কোন্ ব্যক্তি কি বলে, তাহা সবিশেষ মনোযোগের সহিত শ্রবণ করিতে লাগিলাম।

    এইরূপে কিয়ৎক্ষণ বসিয়া থাকিবার পর, একটা কথা হঠাৎ আমার কর্ণে প্রবেশ করিল। একজন মুসলমান অপর একজন মুসলমানকে বলিতেছে, এই মৃতদেহ কাহার, তাহা চিনিতে পারিলে কি?

    উত্তরে অপর ব্যক্তি কহিল, না, আমি কিছুই স্থির করিয়া উঠিতে পারিতেছি না; কিন্তু এই ব্যক্তি যে আমার পরিচিত, বা ইহাকে যেন কোথায় দেখিয়াছি, ইহা আমার বেশ মনে হইতেছে।

    প্রথম ব্যক্তি। এই ব্যক্তি মেহের আলির জামাই নয় কি?

    দ্বিতীয় ব্যক্তি। ঠিক কথা বলিয়াছ। এখন আমার বেশ মনে হইতেছে, এ মেহের আলির জামাই বটে।

    এই কথা শুনিয়া আমি উভয়কেই ডাকিলাম। তাঁহারা আমার নিকটে আসিলে, আমি তাহাদিগকে লক্ষ্য করিয়া কহিলাম, ওই মৃতদেহ দেখিয়া তোমরা কিছু চিনিতে পারিলে কি, যে ওই মৃতদেহ কাহার?

    ১ম ব্যক্তি। না মহাশয়! আমরা কিছুই স্থির করিয়া উঠিতে পারিলাম না।

    অমি। মেহের আলিকে তুমি চেন নাকি?

    ১ম ব্যক্তি। কোন্ মেহের আলি?

    আমি। কোন মেহের আলি।

    ১ম ব্যক্তি। না মহাশয়! আমি কোন মেহের আলিকে চিনি না।

    আমি। (দ্বিতীয় ব্যক্তির প্রতি লক্ষ্য করিয়া) কেমন, তুমিও বোধ হয়, মেহের আলিকে চিন না?

    ২য় ব্যক্তি। আমি এক মেহের আলিকে চিনি।

    আমি। সে মেহের আলি কে? .

    ২য় ব্যক্তি। সে থাকে তালতলায়। সে কোন সাহেব বাড়ীতে খানসামার কাৰ্য্য করে।

    আমি। তাহার জামাইকে তুমি চিন কি?

    ২য় ব্যক্তি। তাহার একটী জামাই ছিল জানি।

    আমি। সে জামাই এখন কোথায়?

    ২য় ব্যক্তি। তাহা আমি বলিতে পারি না।

    আমি। তাহার নাম কি?

    ২য় ব্যক্তি। তাহার নামটা যে কি, তাহা আমার স্মরণ নাই।

    আমি। তুমি যে মৃতদেহ দেখিয়া আসিলে, উহা মেহের আলির জামাতার মৃতদেহ বলিয়া বোধ হয় না কি?

    ২য় ব্যক্তি। সেইরূপই বোধ হয়; কিন্তু আমি ঠিক চিনিয়া উঠিতে পারিতেছি না।

    আমি। (প্রথম ব্যক্তির প্রতি) কেমন, তোমার কি বোধ হয়? যে মৃতদেহ দেখিয়া আসিলে, তাহা মেহের আলির জামাতার মৃতদেহ বলিয়া বোধ হয় কি?

    ১ম ব্যক্তি। আমি মেহের আলিকেই চিনি না, তাহার জামাতাকে চিনিব কি প্রকারে?

    আমি। তোমার মত মিথ্যাবাদী মুসলমান জাতির ভিতর আর আছে কি না, জানি না। এখনই তুমি তোমার এই সঙ্গীকে বলিতেছিলে যে, ওই মৃতদেহ মেহের আলির জামাতার। আর আমি তোমাকে যেমন জিজ্ঞাসা করিলাম, অমনি সকল কথা অস্বীকার করিলে! তোমার মত নির্বোধ লোক আমি আর দেখি নাই। এই মৃতদেহ যে কাহার, এই সংবাদ যে বলিয়া দিতে পারিবে, সে পঞ্চাশ টাকা পারিতোষিক পাইবে, এই কথা তুমি শুন নাই কি?

    ১ম ব্যক্তি। শুনিয়াছি; কিন্তু আমি যখন চিনিতে পারি নাই, তখন কাহার নাম করিব?

    আমি। তোমার মিথ্যা কথা আর আমি শুনিতে চাহি না। তুমি যেরূপ প্রকৃতির লোক, তোমার সহিত সেইরূপ ভাবে ব্যবহার না করিলে, তোমার নিকট হইতে কোন কথা পাইবার প্রত্যাশা নাই। যাহাতে তুমি প্রকৃত কথা সহজে বলিতে সক্ষম হও, আমি এখনই তাহার উপায় করিতেছি। তুমি একটু অপেক্ষা কর, তোমার সমভিব্যাহারী ব্যক্তিকে আর দুই চারিটী কথা আমি অগ্রে জিজ্ঞাসা করিয়া লই; তাহার পর আমার বিবেচনা মত ব্যবহার আমি তোমার প্রতি করিতেছি।

    এই বলিয়া আমি সেই দ্বিতীয় ব্যক্তিকে পুনরায় জিজ্ঞাসা করিলাম, মেহের আলির জামাতা কোথায় থাকে, তাহা তুমি বলিতে পার কি?

    ২য় ব্যক্তি। না মহাশয়! আমি তাহার বাড়ী জানি না।

    আমি। মেহের আলির বাড়ী জান?

    ২য় ব্যক্তি। তাহা জানি।

    আমি। তুমি আমাকে সেই বাড়ী দেখাইয়া দিতে পার?

    ২য়। সবিশেষ আবশ্যক হয়, ত কাজেই দেখাইয়া দিতে হইবে; কিন্তু এখন একটু প্রয়োজন বশতঃ আমাকে স্থানান্তরে গমন করিতে হইতেছে। পরে যখন বলিবেন, সেই সময় আমি আসিয়া আপনাকে সঙ্গে করিয়া লইয়া গিয়া মেহের আলির বাড়ী দেখাইয়া দিব।

    আমি। তুমি এখন অপর কার্যে গমন করিতেছ, কিন্তু ইহাও সবিশেষ কাৰ্য্য। কারণ, তোমার সংবাদ যদি ঠিক হয়, অর্থাৎ এই মৃতদেহ যদি মেহের আলির জামাতার হয়, তাহা হইলে সরকার হইতে তুমি একবারে পঞ্চাশ টাকা পাইবে, তদ্ব্যতীত সরকারী কাৰ্য্যে আমাদিগের সাহায্য করাও হইবে। তুমি এখনই আমার সঙ্গে আইস, এবং মেহের আলির ঘর আমাকে দেখাইয়া দেও। তাহা হইলে সেই স্থান হইতে আমি অনায়াসেই সন্ধান লইতে পারি যে, তাহার জামাতা কোথায় থাকে।

    আমার কথায় দুই একবার আপত্তি উত্থাপন করিয়া, পরি শেষে সেই ব্যক্তি আমার প্রস্তাবে সম্মত হইল। আমি তাহাকে সঙ্গে লইয়া তৎক্ষণাৎ সেই স্থান হইতে প্রস্থান করিলাম। অপর ব্যক্তি জনৈক প্রহরীর সহিত সেই স্থানে বসিয়া রহিল।

    সেই ব্যক্তি আমাকে সঙ্গে করিয়া তালতলায় মেহের আলির বাড়ীতে লইয়া গেল। অনুসন্ধানে জানিতে পারিলাম, মেহের আলি বাড়ীতে নাই। অতি প্রত্যুষে সে আপন কাৰ্য্যে গমন করিয়াছে। মেহের আলির একমাত্র কন্যা, সে সেই সময় মেহের আলির বাড়ীতেই ছিল।

    আমরা মেহের আলির বাড়ীর সম্মুখে গমন করিলেই, পাড়ার অনেক লোক আসিয়া সেই স্থানে ভিড় করিয়া ফেলিল। উহাদিগের একজনকে মেহের আলির আত্মীয় বলিয়া অনুমান হইল। তাহাকে মেহের আলির জামাতার নাম জিজ্ঞাসা করায়, সে নিজে তাহা বলিতে পারিল না; কন্তু মেহের আলির বাড়ীর ভিতর গমন করিয়া তাহার নাম জানিয়া আসিয়া আমাকে কহিল, মেহের আলির জামাতার নাম রব্বানি।

    যে বাড়ীতে মেহের আলি বাস করে, তাহা মেহের আলির নিজের বাড়ী। উহা একখানি সামান্য খোলার ঘর। রাস্তার উপর সদর দরজা, উহা খোলা রহিয়াছে; কিন্তু সেই দরজার উপর একখানি চটের পরদা ঝুলিতেছে। সেই পরদাটী নিতান্ত পুরাতন, এবং স্থানে স্থানে ছিড়িয়া গিয়াছে।

    যে ব্যক্তি বাড়ীর ভিতর গমন করিয়া মেহের আলির জামাতার নাম জানিয়া আসিল, সে ভিতর হইতে আমাদিগের নিকট আসিবার পরেই কয়েকটী স্ত্রীলোক সেই পরদার পার্শ্বে আসিয়া দাঁড়াইল। আমাদিগের প্রেরিত ব্যক্তি রানির নাম আমাকে বলিবার পরই পরদার অন্তরাল হইতে একটা স্ত্রীলোক কহিল, কেন গা কি হইয়াছে?

    আমি। রব্বানি কোথায়, তাহাই জানিবার নিমিত্ত এখানে আসিয়াছি।

    পরদার অন্তরালবর্তী স্ত্রীলোক। কেন মহাশয়! কেন তাহার অনুসন্ধান করিতেছেন? অন্য তিন দিবস হইতে তিনি যে কোথায় গিয়াছেন, তাহার কিছুই আমরা স্থির করিয়া উঠিতে পারিতেছি না।

    আমি। একটা মৃতদেহ পাওয়া গিয়াছে, কেহ কেহ বলিতেছে, উহা মেহের আলির জামাতার দেহ। তাই আমরা জানিতে আসিয়াছি যে, তাহার জামাতা এখন কোথায়।

    আমার এই কথা শুনিৰামাত্র সেই পরদার অন্তরালবর্তী স্ত্রীলোকদিগের মধ্য হইতে একটী স্ত্রীলোক হঠাৎ পরদ। ঠেলিয়া বহির্গত হইয়া পড়িল, এবং সেই রাস্তার উপর আমাদিগের সম্মুখে উপস্থিত হইয়া কহিল, আমি বুঝিতে পারিতেছি, আমারই সর্বনাশ হইয়াছে! চলুন, মহাশয়? আমাকে সঙ্গে করিয়া লইয়া চলুন, আমি এখনই গিয়া সেই মতদেহ দেখিয়া আসি।

    আমি নিজে যে প্রস্তাব করিব মনে করিয়াছিলাম, সেই স্ত্রীলোকটী আপনা হইতেই সেই প্রস্তাব করিল। সুতরাং বিনা-বাক্যব্যয়ে আমি তাহাতে সম্মত হইলাম, এবং আমার সমভিব্যাহারে যে গাড়ি ছিল, সেই গাড়িতে উঠিতে কহি লাম। রোদন করিতে করিতে সেই স্ত্রীলোকটী তিন চারিটী ছোট ছোট বালক-বালিকার সহিত সেই গাড়িতে গিয়া উপবেশন করিল। আমি তাহাদিগকে সঙ্গে লইয়া সেই মৃতদেহ যে স্থানে রক্ষিত ছিল, সেই স্থান অভিমুখে প্রস্থান করিলাম। গাড়িতে আমি তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলাম, তুমি কি মেহের আলির কন্যা?

    স্ত্রীলোক। হাঁ মহাশয়!

    আমি। তোমরা কয় সহোদরা?

    স্ত্রীলোক। আমি ভিন্ন আমার পিতার পুত্র কন্যা আর কেহই নাই।

    আমি। রব্বানি কি তোমার স্বামী?

    স্ত্রীলোক। হাঁ।

    আমি। রানি কি তোমার পিতার বাড়ীতেই থাকে?

    স্ত্রীলোক। না।

    আমি। সে কোথায় থাকে?

    স্ত্রীলোক। যে স্থানে পিতার বাড়ী, তাহার সম্নিকটে অপরের বাড়ীতে আমরা বাসা করিয়া থাকি।

    আমি। এ পুত্র কন্যা কয়েকটা কাহার?

    স্ত্রীলোক। এ কটী সকলই আমার।

    আমি। তোমাদের থাকিবার স্থান আছে শুনিতেছি, তবে তুমি তোমার পিতার বাড়ীতে রহিয়াছ কেন?

    স্ত্রীলোক। আমি আমার পিতার বাড়ীতে থাকি না, কেবল আমার স্বামীর অনুসন্ধান করিবার নিমিত্তই পিতার বাড়ীতে আসিয়াছিলাম।

    আমি। তোমার স্বামীর অনুসন্ধান করিতেছ কেন?

    স্ত্রীলোক। তিনি বাড়ী ছাড়া হইয়া কখনও কোন স্থানে থাকেন না; কিন্তু দুই রাত্রি বাড়ীতে না আসায়, আমি কিছুই বুঝিতে পারিতেছি না যে, তিনি কোথায় গেলেন। তাহার যদি কোনরূপে সন্ধান হয়, তাই জানিবার নিমিত্ত পিতার নিকট আগমন করিয়াছিলাম।

    আমি। তিনি কবে বাড়ী হইতে বাহির হইয়া গিয়াছেন?

    স্ত্রীলোক। পরশ্ব সন্ধ্যার কিছু পূর্বে তিনি বাড়ী হইতে বহির্গত হইয়া গিয়াছেন।

    আমি। কি জন্য, ও কোথায় যাইতেছেন, তাহার কিছু বলিয়া গিয়াছিলেন কি?

    স্ত্রীলোক। হাঁ, একরূপ বলিয়াছিলেন। আমাদিগের অবস্থা ভাল নহে; সামান্য যাহা তিনি উপার্জন করেন, তাহার দ্বারা কায়ক্লেশে কোনরূপে এই কয়েকটা বালক-বালিকাকে লইয়া জীবন ধারণ করিয়া থাকি। গত পরশ্ব তারিখে কোন স্থানে কাৰ্য হয় নাই। সুতরাং সে দিবস কিছু উপার্জনও হয় নাই। গৃহে অতি সামান্যই চাউল ছিল, তাহাই বন্ধন করিয়া বালক-বালিকা কয়টাকে দিয়া, অবশিষ্ট যাহা ছিল, তাহাই আমরা উভয়ে আহার করিলাম। বলা বাহুল্য, তাহাতে আমাদিগের অর্ধাশনও হইল না। পরে রাত্রিকালের নিমিত্ত গৃহে আর কিছুই ছিল না। পূর্বে কয়েক বৎসর তিনি কায করিয়াছিলেন, তাহার জন্য কয়েক স্থানে তাহার কিছু পাওনা ছিল, যদি তাহার মধ্যে কাহারও নিকট হইতে কিছু আদায় করিয়া আনিতে পারেন, তাহা হইলে রাত্রির একরূপ সংস্থান হয়, এই আশায় তিনি বাড়ী হইতে বহির্গত হইয়া যান।

    আমি। তিনি কি কাৰ্য্য করিতেন?

    স্ত্রীলোক। ঘরামীর কাৰ্য্য করিয়া থাকেন। উহার উপর নির্ভর করিয়া আমরা এতগুলি প্রাণী জীবন ধারণ করিয়া থাকি।

    আমি। কাহার নিকট তাহার পয়সা পাওনা আছে, ও কাহার নিকটেই বা পয়সার নিমিত্ত গমন করিবে, তাহার কিছু বলিয়াছিল কি?

    স্ত্রীলোক। এমন কিছু বলেন নাই, কেবলমাত্র এই বলিয়াছিলেন যে, তিনি প্রথমে আমার পিতার নিকট গমন করিবেন, সেই স্থান হইতে যদি কিছু পান, তাহা লইয়া অপর স্থানে গমন করিবেন, এবং সন্ধ্যার পরই বাড়ীতে প্রত্যাবর্তন করিবেন।

    আমি। তোমার পিতার নিকট গমন করিবে কেন?

    স্ত্রীলোক। তাহার নিকট কিছু পাওনা আছে, তাহারই নিমিত্ত।

    আমি। তোমার পিতার নিকট কিসের পাওনা?

    স্ত্রীলোক। আমার পিতা যে স্থানে চাকরী করেন, সেই সাহেবের বাড়ীতে একখানি ছোেট চালাঘর বাঁধা হয়। পিতা সেই সাহেবের খানসামা; তিনি সাহেবের নিকট হইতে সেই ঘর বাঁধিবার কন্ট্রাক্ট গ্রহণ করেন, এবং পরিশেষে নিজে কিছু লাভ রাখিয়া পুনরায় আমার স্বামীকে উহার কন্ট্রাক্ট দেন। আমার স্বামী দিনরাত্রি পরিশ্রম করিয়া কয়েক দিবসের মধ্যে সেই ঘর প্রস্তুত করিয়া দেন। আমার স্বামীকে যে টাকা দিবার কথা ছিল, তাহার সকল টাকা আমার পিতা এখনও তাহাকে প্রদান করেন নাই, কয়েকটা টাকা বাকী আছে। কিন্তু পিতা সমস্ত টাকা সাহেবের নিকট হইতে শোধ করিয়া লইয়াছেন।

    আমি। তোমার পিতার নিকট তোমার স্বামীর কত টাকা বাকী আছে?

    স্ত্রীলোক। ঠিক জানি না; শুনিয়াছি, অতি সামান্য। বোধ হয়, দুই তিন টাকার অধিক নহে। পাঁচ সাত টাকা বাকী ছিল; দুই আনা, চারি আনা করিয়া প্রায়ই দিয়াছেন, এখন দুই তিন টাকা বাকী আছে মাত্র।

    আমি। তোমার পিতার নিকট তিনি প্রথমে গমন করিবে, বলিয়া গিয়াছিল; কিন্তু কোন্ স্থানে গিয়া তোমার পিতার সহিত সাক্ষাৎ করিবে, তাহার কিছু বলিয়া গিয়াছিলেন কি? তোমার পিতার বাড়ীতে যাইবে, কি যে স্থানে তিনি চাকরী করে, সেই স্থানে যাইবে?

    স্ত্রীলোক। দিবাভাগে পিতাকে প্রায়ই বাড়ীতে দেখিতে পাওয়া যায় না। পিতা যে সাহেব বাড়ীতে চাকরী করেন, সেই স্থানে গিয়া তাহার সহিত সাক্ষাৎ করিবেন, এই কথা বলিয়া তিনি বাড়ী হইতে গমন করিয়াছিলেন।

    আমি। তোমার পিতা কোন্ সাহেব বাড়ীতে কর্ম করে, তাহা তুমি অবগত আছ কি?

    স্ত্রীলোক। না, তাহা আমি জানি না।

    আমি। ইহার পর তোমার পিতার সহিত তোমার সাক্ষাৎ হইয়াছিল কি?

    স্ত্রীলোক। হইয়াছিল।

    আমি। তাহাকে তুমি জিজ্ঞাষ করিয়াছিলে যে, তোমার স্বামী তাহার নিকট গমন করিয়াছিল কি না?

    স্ত্রীলোক। জিজ্ঞাসা করিয়াছিলাম।

    আমি। তাহাতে সে কি বলিয়াছিল?

    স্ত্রীলোক। জিজ্ঞাসা করায়, পিতা যেন আমার উপর বিরক্ত হন, এবং কহেন যে, তিনি তাহার নিকট গমন করেন নাই।

    আমি। তোমার পিতার বিরক্ত হইবার কারণ?

    স্ত্রীলোক। কারণ যে কি, তাহার কিছুই বুঝিতে পারি নাই।

    আমি। তোমার পিতার সহিত কখন তোমার সাক্ষাৎ হইয়াছিল?

    স্ত্রীলোক। শেষ রাত্রিতে।

    আমি। শেষ রাত্রিতে তোমার পিতার সহিত কোথায় তোমার সাক্ষাৎ হয়?

    স্ত্রীলোক। তাঁহারই বাড়ীতে।

    আমি। শেষ রাত্রিতে তাহার বাড়ীতে তুমি কি করিতে গিয়াছিলে?, স্ত্রীলোক। শেষ রাত্রিতে আমি তাঁহার বাড়ীতে যাই নাই।

    আমি। তবে কখন গিয়াছিলে?

    স্ত্রীলোক। পরশ্ব রাত্রিতে যখন দেখিলাম, আমার স্বামী বাড়ীতে প্রত্যাবর্তন করিলেন না, তখন কি করিতে হইবে, তাহার কিছুই স্থির করিতে না পারিয়া, পরদিবস প্রাতঃকালে আমি আমার পিতার বাড়ীতে গমন করিলাম। কিন্তু সে সময়ে পিতার সহিত আমার সাক্ষাৎ হয় না। মাতার নিকট জানিতে পারিলাম যে, রাত্রিতে পিতাও বাড়ীতে আসেন নাই। মাতার নিকট এই ব্যাপার জানিতে পারিয়া মনে করিলাম, তিনি পিতার নিকট গমন করিয়াছিলেন, কোন কার্যের নিমিত্ত পিতা তাঁহাকে তাহার নিকট রাখিয়াছেন, সে জন্য তিনিও বাড়ীতে আসেন নাই, পিতাও বাড়ীতে আসেন নাই। মাতা আর আমাকে সে দিবস আসিতে দিলেন না, আমি সেই স্থানেই থাকিলাম; কিন্তু সমস্ত দিবসের মধ্যে পিতা বাড়ীতে আসিলেন না। ক্রমে রাত্রিও অতিবাহিত হইয়া যাইবার যোগাড় হয়, তথাপি তিনি আগমন করিলেন না। ক্রমে রাত্রি প্রভাত হইবার অতি অল্পমাত্র বাকী আছে, এরূপ সময় পিতা একাকী আসিয়া বাড়ীতে উপস্থিত হন, এবং অতি অল্পক্ষণ মাত্র বাড়ীতে থাকিয়াই তিনি আপন কাৰ্য্যে গমন করেন। সেই সময় পিতাকে আমার স্বামীর কথা জিজ্ঞাসা করিলাম। তিনি আমার কথায় একটু বিরক্তিভাব প্রকাশ করিয়া কহিলেন, না, তোমার স্বামী আমার নিকট গমন করে নাই, বা আজ কয়েক দিবস আমি তাহাকে দেখিও নাই। এই বলিয়া তিনি বাড়ী হইতে বহির্গত। হইয়া যান। যাইবার সময় আমি তাহাকে পুনরায় কহিলাম, তিনি কোথায় গেলেন, কিরূপে আমি তাহার অনুসন্ধান করিব? ইহার উত্তরে পিতা কহেন, সে বালক নহে, তাহার নিমিত্ত আবার কি অনুসন্ধান করিতে হইবে? কোন স্থানে গমন করিয়া থাকিবে; কাৰ্য শেষ হইয়া গেলে, পুনরায় সে আপনা হইতেই আগমন করিবে। তোমার সহিত ঝগড়া করিয়া সে বাড়ী হইতে বাহির হইয়া যায় নাই ত? এই বলিতে বলিতে পিতা বাড়ী হইতে বহির্গত হইয়া গেলেন, আমার আর কোন কথা শুনিলেন না।

    সেই স্ত্রীলোকটীর সহিত এই সকল কথাবার্তা হইতে হইতে, যে স্থানে সেই মৃতদেহ ছিল, তাহার সন্নিকটে আমা দিগের পাড়ি আসিয়া উপস্থিত হইল।

    পঞ্চম পরিচ্ছেদ।

    আমি গাড়ি হইতে অবতরণ করিলে সঙ্গে সঙ্গে বালক বালিকা কয়েকটীর সঙ্গে স্ত্রীলোকটীও গাড়ি হইতে নামিল, এবং আমার পশ্চাৎ পশ্চাৎ সেই ভিড়ের ভিতর প্রবেশ করিল। _ যে স্থানে মৃতদেহটী রক্ষিত ছিল, সেই স্থানে গমন করিয়া সেই মৃতদেহটা আমি তাহাকে দেখাইয়া দিলাম ও কহিলাম, দেখ দেখি, তুমি উহাকে চিনিতে পার কি না?

    স্ত্রীলোকটা মৃতদেহের নিকট গমন করিয়া একটু স্থির হইয়া দাঁড়াইল, এবং অনিমিষ-লোচনে অতি অল্পক্ষণ মাত্র নিরীক্ষণ করিয়া বিনা-বাক্যব্যয়ে সেই স্থানে বসিয়া পড়িল।

    সেই সময় সেই স্ত্রীলোকটীর অবস্থা দেখিয়া বোধ হইল, আমার সহিত যে স্ত্রীলোকটী আসিয়াছে, এ সে স্ত্রীলোক নহে; এ যেন অপর আর কোন স্ত্রীলোক। এত অল্প সময়ের মধ্যে মনুষ্যের বর্ণ, মুখশ্রী প্রভৃতির যে এত পরিশ বৰ্ত্তন হইতে পারে, ইহা আমি এই প্রথম দেখিলাম; ইহার পূর্বে এরূপ দৃশ্য আমি আর কখনও দেখি নাই। এই ব্যাপার দেখিয়া সেই স্থানে যে কোন ব্যক্তি উপস্থিত ছিল, সকলেই বুঝিতে পারিল যে, ইহার অন্তরে বিষম আঘাত লাগিয়াছে।

    সেই সময় আমি তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলাম, এই মৃত দেহ কাহার, তাহা কি তুমি চিনিতে পারিয়াছ?

    আমার কথায় স্ত্রীলোকটী কোনরূপ উত্তর প্রদান করিল না।

    আমি পুনরায় তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলাম, ইহা কি তোমার স্বামীর মৃতদেহ?

    এ কথারও কোন উত্তর পাইলাম না।

    সেই স্ত্রীলোকটীর সহিত যে কয়েকটা বালক-বালিকা। আসিয়াছিল, তাহাদিগের মাতার এই অবস্থা দেখিয়া, তাঁহারাও যেন হতবুদ্ধি হইয়া সেই স্থানে দাঁড়াইয়া রহিল। কেবল একটী নিতান্ত ছোট বালিকা তাহার মাতার মুখ ধরিয়া কহিল, মা,বাবা?

    বালিকার এই কথা সকলেরই হৃদয়ে শেলসম প্রবেশ করিল। তখন সকলেই বুঝিতে পারিলেন, সেই মৃতদেহ তাহার পিতার।

    সেই বালক-বালিকাগণের মধ্যে য়েটী সকলের বড়, তাহাকে আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, এই কি তোমার পিতা?

    উত্তরে সে কহিল, ইনিই আমার পিতা।

    আমি। ইহারই নাম কি রব্বানি?

    বালক। হাঁ।

    আমি। মেহের আলি তোমার কে হয়?

    বালক। নানা।

    আমি। তুমি জান, তিনি কোথায় কার্য করেন?

    বালক। জানি।

    আমি। সে সাহেবের নাম কি?

    বালক। তাহা জানি না।

    আমি। কোন্ স্থানে, কোন্ রাস্তায়?

    বালক। তাহাও জানি না। সেটা একটা স্কুল।।

    আমি। যেখানে তোমার নানা কায করেন, সেটা স্কুল?

    বালক। হুঁ।

    আমি। সে স্কুল তুমি চিন? বা

    লক। চিনি।

    আমি। কিরূপে চিনিলে?

    বালক। আমি অনেকবার নানার সঙ্গে ও বাবার সঙ্গে সেই স্থানে গিয়াছি।

    আমি। তুমি আমাকে সেই স্থানে লইয়া যাইতে পারিবে?

    বালক। পারিব, কিন্তু এখান হইতে আমি চিনিতে পারিব না।

    আমি। কোথা হইতে চিনিতে পারিবে?

    বালক। আমি আমাদিগের বাড়ী হইতে চিনিয়া সেই স্থানে গমন করিতে পারি।

    আমি। আমি যদি তোমাকে সঙ্গে লইয়া তোমার নানার বাড়ীতে লইয়া যাই, তাহা হইলে তুমি সেই স্থান হইতে তোমার নানা যে স্কুলে কায করে, সেই স্কুলে লইয়া যাইতে পারিবে?

    বালক। পারিব।

    আমি। তবে আমার সঙ্গে আইস।

    বালক। আমার মা?

    আমি। তিনি এখন এখানে থাকুন, আমরা এখনই ফিরিয়া আসি।।

    এই বলিয়া আমি বালকটীকে সঙ্গে লইয়া গাড়িতে গিয়া উঠিলাম। রব্বানির স্ত্রী একরূপ অন্ধ-অচেতন অবস্থায় সেই স্থানে বসিয়া রহিল। সেই স্থানে আরও অনেক কর্মচারী উপস্থিত ছিলেন, তাহাদিগের মধ্যে কেহব সেই স্ত্রীলোকটীর নিকটেই রহিলেন, কেহবা বালক-বালিকাগণের সহিত কথা কহিতে লাগিলেন, আর কেহবা আমার সহিতই গমন করিলেন।

    গাড়িতে উঠিয়া গাড়িবানকে দ্রুতগতি চালাইতে কহিলাম। ক্রমে গাড়ি আসিয়া মেহের আলির বাড়ীর সম্মুখে উপস্থিত হইল।

    মেহের আলির বাড়ীর সম্মুখে গিয়া গাড়ি উপস্থিত হইলে,। সেই বালকটী কহিল, আমি গাড়ির ভিতর বসিয়া রাস্তা ঠিক পাইব না, গাড়ির উপর গিয়া বসিলে যে রাস্তা দিয়া আমি সর্বদা গমন করিয়া থাকি, সেই রাস্তা দিয়া অনায়াসেই এই গাড়ি সেই স্কুলে লইয়া যাইতে পারিব।।

    বালকের কথায় আমি সম্মত হইলাম। বালক গাড়ি হইতে বহির্গত হইয়া কোচবাক্সের উপর গিয়া উপবেশন করিল।

    বালকের নির্দেশ মত গাড়ি চলিতে লাগিল। ক্রমে দেখিলাম, গাড়ি গিয়া পার্ক স্ট্রীটের একটা প্রকাণ্ড বাড়ীর সম্মুখে গিয়া উপস্থিত হইল। সেই প্রকাণ্ড বাড়ী আমরা চিনিতাম। উহা প্রকৃতই একটী প্রকাণ্ড স্কুল। ইহাতে ইংরাজ বালকের সংখ্যাই অধিক, এবং তাহাদিগের মধ্যে অনেকেই সেই স্কুলের ভিতর রাত্রিদিন বাস করিয়া থাকেন।

    সেই স্থানে বালকটী গাড়ি হইতে অবতরণ কারয়া আমাকে কহিল, আমার সঙ্গে আসুন, এই স্কুলে আমার নানা কর্ম করিয়া থাকেন।

    বালকের কথা শুনিয়া আমরা সেই গাড়ি হইতে অবতরণ করিলাম, এবং বালকের পশ্চাৎ পশ্চাৎ সেই প্রকাণ্ড বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিলাম।

    সেই স্কুলে যে সকল চাকর কৰ্ম্ম করিত, উহার এক পার্শ্বে তাহাদিগের থাকিবার উপযোগী কয়েকটা ঘর আছে। মেহের আলির থাকিবার নিমিত্ত উহার মধ্যে একটা ঘর নির্দিষ্ট ছিল।

    বালক আমাদিগকে সঙ্গে লইয়া একবারে সেই ঘরের ভিতর গিয়া উপস্থিত হইল। দেখিলাম, ঘরের সম্মুখে

    একটী লোক বসিয়া রহিয়াছে, তাহাকে দেখিয়াই বালবটী কহিল, নানা! ইহারা তোমাকে খুঁজিতেছেন। বাবা মরিয়া গিয়াছেন।

    বালকের কথা শুনিয়া মেহের আলি আমাদিগকে লক্ষ্য করিয়া কহিল, আপনারা কাহার অনুসন্ধান করিতেছেন?

    আমি। মেহের আলির। তোমারই নাম কি মেহের আলি?

    মেহের আলি। হাঁ, আমার নামই মেহের আলি। আপ নার যে একবারে এখানে আসিয়া উপস্থিত হইয়াছেন, এ কথা আমাদিগের বড় সাহেব জানেন কি?

    আমি। না, তোমাদের বড় সাহেব কে?

    মেহের আলি। তিনি এই কুঠীতেই থাকেন, তাঁহার অনুমতি ব্যতীত বাহিরের কোন লোকের এই কুঠীর ভিতর প্রবেশ করিবার অধিকার নাই। তিনি না দেখিতে দেখিতে, আপনারা এখনই বাহিরে গমন করুন।

    আমি। আচ্ছা, তাহাই হইবে, আমরা এখনই বাহিরে গমন করিব; কিন্তু তোমাকে দুই চারিটী কথা জিজ্ঞাসা না করিয়া যাইতে পারি না। তোমাকে যাহা যাহা আমরা জিজ্ঞাসা করিতেছি, তুমি তাহার উত্তর প্রদান কর, আমরা এখনই তোমার সাহেবের কুঠী হইতে বাহির হইয়া যাইতেছি।

    মেহের আলি সাহেবের অনুমতি না লইলে আমি আপনাদিগের কোন কথার উত্তর দিতে পারিব না।

    আমি। ইচ্ছা হয় ত তোমার সাহেবকে সংবাদ প্রদান কর, বা তাহাকে জিজ্ঞাসা করিয়া পাঠাও যে, পুলিশের কয়েকজন লোক এখানে আসিয়াছে, তাঁহারা আমাকে কোন কোন কথা জিজ্ঞাসা করিতে চাহেন, আমি তঁহাদিগের কথার উত্তর প্রদান করিব কি না?

    মেহের আলি। লাহেবকে জিজ্ঞাসা করিবার আমায় কোন প্রয়োজন নাই। ইচ্ছা হয়, আপনারা গিয়া জিজ্ঞাসা করিয়া আসিতে পারেন।

    মেহের আলির কথা শুনিয়া আমার অতিশয় ক্রোধের উদ্রেক হইল, এবং সর্বশরীর যেন কাঁপিতে লাগিল। এক বার মনে করিলাম যে, ও যেরূপ ভাবে আমাদিগের সহিত কথা কহিতেছে, তাহাতে উহার সহিত আমাদিগের সেইরূপ ব্যবহার করাই কর্তব্য। কিন্তু পরক্ষণেই মনে হইল, সাহেব দিগের কুঠীর ভিতর কোনরূল্প গোযোগ করিলে আমার কার্যের সুবিধা হইবার সম্ভাবনা নাই। কারণ, তিনি ক্রোধান্বিত হইলে তাহার চাকদিগের নিকট হইতে আমা দিগের অধিক কোন কথা পাইবার সম্ভাবনা থাকিবে না কিন্তু যদি তিনি ইচ্ছা করিয়া আমাদিগের সহায়তা করেন, তাহা হইলে তাহার ভৃত্যগণ তাঁহার নিকট কোন কথা গোপন করিতে পারিবে না, বা যদি কেহ গোপন করে, তাহা হইলে অপরের নিকট হইতেও তাহা প্রকাশ হইয়া পড়িবে। এরূপ অবস্থায় মেহের আলির উপর ক্রোধান্বিত হইয়া, তাহার মনিবের সহিতই আমার প্রথম দেখা করা কৰ্ত্তব্য। বিশেষতঃ, আমি বিলক্ষণরূপে অবগত আছি যে, ভাল ভাল ইংরাজগণের নিকট সরকারী কাৰ্য্য উপলক্ষে যদি কোনরূপ সাহায্য প্রার্থনা করা যায়, তাহা হইলে তৎক্ষণাৎ তাঁহারা তাহাদের সাধ্যমত সাহায্য প্রদান করিয়া থাকেন।

    মনে মনে এইরূপ ভাবিয়া একজন কর্মচারীকে সেই স্থানে রাখিয়া আমি সেই স্কুলের সর্ব প্রধান সাহেবের উদ্দেশে গমন করিলাম। যে গৃহে সাহেব থাকেন, সেই গৃহের সম্মুখে তাহার চাপরাশি বসিয়াছিল। একখানি কার্ডে আমার নাম, আমি কে, এবং কি নিমিত্ত আমি তাহার সহিত সাক্ষাৎ করিতে চাহি, তাহা সেই কার্ডে লিখিয়া চাপরাশির হাতে প্রদান করিলাম, ও আমি যে কে, তাহা চাপরাশিকেও বলিয়া দিলাম। চাপরাশি কার্ড লইয়া ভিতরে প্রবেশ করি বার অতি অল্পক্ষণ পরেই, সেই কার্ড হন্তে সাহেব বাহিরে আসিয়া উপস্থিত হইলেন ও কহিলেন, আমি আপনাকে কিরূপ, সাহায্য করিতে পারি?

    আমি। আপাততঃ অপর সাহায্যের কিছু প্রয়োজন নাই, কেবলমাত্র আপনার খানসামাকে আমি একবার চাহি। এক ঘণ্টার নিমিত্ত আমি তাহাকে লইয়া যাইব মাত্র।

    সাহেব। তাহাকে প্রয়োজন?

    আমি। আমরা একটা ভয়ানক হত্যার অনুসন্ধান করি তেছি। যে ব্যক্তি হত হইয়াছে, এখন বোধ হইতেছে যে, সে আপনার খানসামার জামাতা। এই নিমিত্ত তাহাকে লইয়া গিয়া একবার সেই মৃতদেহ দেখাইব। তাহা হইলে সেই ব্যক্তি তাহার জামাতা কি না, তাহা অনায়াসেই সে চিনিতে পারিবে। তখন কাহার দ্বারা এই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়াছে, তাহার অনুসন্ধানে প্রবৃত্ত হইব, এবং আপনার সাহায্যের আবশ্যক হইলে, পুনরায় আপনার নিকট আগমন করিব।

    সাহেব। কিরূপে খানসামার জামাতা হত হইয়াছে?

    আমি। কিরূপে হত হইয়াছে, বা কে হত্যা করিয়াছে, তাহা এখনও স্থির হয় নাই। সেই মৃতদেহ যে কাহার, এখন তাহারই অনুসন্ধান চলিতেছে।

    সাহেব। সেই মৃতদেহ কোথায় পাওয়া গেল?

    আমি। বড় একটা টীনের বাক্সের মধ্যে একখানি চটের দ্বারা আবৃত সেই মৃতদেহ রাস্তার ধারে পাওয়া গিয়াছে।।

    সাহেব। আচ্ছা বাবু! আপনি আমার খানসামাকে লইয়া যান। আপনার কাৰ্য শেষ হইয়া গেলে, অমনি তাহাকে ছাড়িয়া দিবেন। ও আমাকে এই বলিয়া সাহেব তাহার চাপরাশিকে কহি লেন, আমার খানসামাকে আমার নিকট ডাকিয়া আন।

    সাহেবের আদেশ পাইবামাত্র, চাপরাশি দ্রুতগতি গমন করিয়া মেহের আলিকে তাঁহার সম্মুখে ডাকিয়া আনিল। তাহাকে দেখিধামাত্রই সাহেব কহিলেন, তুমি এই বাবুর সহিত গমন কর, এবং ইহারা তোমার নিকট হইতে যেরূপ সাহায্য প্রার্থনা করেন, সেইরূপ সাহায্য প্রদান কর।

    সাহেবের কথা শুনিয়া মেহের আলি আর কোন কথা কহিল না; স্থিরভাবে অথচ নিতান্ত ক্ষুন্ন মনে আমার পশ্চাৎ পশ্চাৎ আগমন করিতে লাগিল।

    আমি মেহের আলিকে সেই স্থানে আর কোন কথা জিজ্ঞাসা না করিয়া সেই বাড়ী হইতে তাহাকে বাহিরে আনিলাম। কিন্তু তাহাকে আমার গাড়িতে তুলিবার পূর্বে তাহাকে দুই একটা কথা জিজ্ঞাসা করা কর্তব্য মনে করিলাম।

    আমি। রব্বানি তোমার জামাতা?

    মেহের আলি। হাঁ মহাশয়! রব্বানি আমার জামাতা হয়।

    আমি। রব্বানি এখন কোথায়? মেহের আলি। তাহা আমি জানি না।

    আমি। তোমার সহিত তাহার কয়দিবস সাক্ষাৎ হয় নাই?

    মেহের আলি। এক সপ্তাহের মধ্যে তাহার সহিত আমার সাক্ষাৎ হয় নাই।

    আমি। তোমার বেশ মনে আছে যে, এক সপ্তাহকাল তোমার সহিত তাহার সাক্ষাৎ হয় নাই?

    মেহের আলি। আমার বেশ মনে আছে।

    আমি। তোমার মনিবের কুঠীতে সে কতদিবস আইসে নাই?

    মেহের আলি। প্রায় পূনর দিবস হইল, সে এখানে আইসে নাই।

    আমি। অদ্য তিন দিবস হইল, সে এখানে আসিয়াছিল যে?

    মেহের আলি। মিথ্যা কথা, এ কথা আপনাকে কে বলিল?

    আমি। যেই আমাকে বলুক না কেন, তোমাকে আমি যে কথা জিজ্ঞাসা করিতেছি, তুমি তাহারই উত্তর প্রদান কর?

    মেহের আলি। আমি ত তাহা বলিয়াছি যে, সে এখানে পনর দিবসের মধ্যে আইসে নাই।

    মেহের আলির কথা শুনিয়া আমার মনে কেমন একটু সন্দেহ হইল। অপর একজন কর্মচারীর নিকট তাহাকে রাখিয়া আমি পুনরায় সেই বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিলাম। বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিতেই সম্মুখে বড় সাহেবের সেই চাপরাশিকে দেখিতে পাইলাম। আমাকে পুনরায় বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিতে দেখিয়া, চাপরাশি আমার নিকট আগমন করিল ও কহিল, কি মহাশয়! পুনরায় ফিরিয়া আসিলেন যে?

    আমি। তোমাকে একটা কথা জিজ্ঞাসা করিব বলিয়া, ফিরিয়া আসিয়াছি।

    চাপরাশি। আমাকে?

    আমি। হাঁ। চাপরাশি। আমাকে যাহা জিজ্ঞাসা করিতে চাহেন, তাহা অনায়াসেই জিজ্ঞাসা করিতে পারেন।

    আমি। মেহের আলি তোমার নিকট কত দিবস হইতে পরিচিত?

    চাপরাশি। প্রায় দুই বৎসর হইল, আমি আমার সাহেবের নিকট কৰ্ম্ম করিতে প্রবৃত্ত হইয়াছি, সেই সময় হইতেই আমি মেহের আলিকে চিনি।

    আমি। তাহার একটা জামাতা আছে, তাহা তুমি জান?

    চাপরাশি। জানি, তাহার নাম রব্বানি। সম্প্রতি খোলার ওই ছোট ঘরখানি সে বাঁধিয়াছিল।

    আমি। তুমি তাহাকে কয়দিবস হইতে দেখ নাই?

    চাপরাশি। তিন চারি দিবস হইল, আমি তাহাকে দেখিয়াছি। কি পাওনা টাকার নিমিত্ত সে তাহার শ্বশুরের সহিত বকাবকি করিতেছিল।

    আমি। কোথায়?

    চাপরাশি। এই কুঠীর ভিতর তাহার শ্বশুর যে ঘরে থাকে, সেই ঘরের সম্মুখে।

    আমি। সে যে তিন চারি দিবসের ঘটনা, তাই তোমার বেশ মনে আছে কি?

    চাপরাশি। আমার বেশ মনে হইতেছে যে, উহা চারি দিবসের অধিক কোনরূপেই হইবে না।

    আমি। পাওনা টাকার নিমিত্ত উহারা কতক্ষণ পর্যন্ত বকাবকি করিয়াছিল?

    চাপরাশি। তাহা আমি জানি না। কোন কাৰ্য বশতঃ আমি সেই স্থানে গিয়াছিলাম, তাহাতেই জানি। আমি তখনই সেই স্থান হইতে চলিয়া আসিয়াছিলাম।

    আমি। তখন বেলা কত?

    চাপরাশি। বৈকালে; কিন্তু বেলা তখন অতি অল্পই ছিল।

    আমি। তাহার পর, রব্বানি কখন চলিয়া গিয়াছে, তাহা বলিতে পার?

    চাপরাশি। আমি তাহাকে চলিয়া যাইতে দেখি নাই।

    আমি। তুমি আমার সহিত একবার গমন করিতে পার কি? কারণ, যে লাসটী পাওয়া গিয়াছে, তাহাকে দেখিলে, তুমি বেশ চিনিতে পারিবে, সেই লাসটা রব্বানির কি না?

    চাপরাশি। আপনি এই স্থানে একটু অপেক্ষা করুন, আমি সাহেবকে জিজ্ঞাসা করিয়া আসিতেছি। তাঁহার আদেশ পাইলে, আমি এখনই আপনার সহিত গমন করিতেছি।

    এই বলিয়া চাপরাশি আমাকে সেই স্থানে রাখিয়া সে তাহার সাহেবের নিকট গমন করিল, এবং অতি অল্প সময়ের মধ্যেই প্রত্যাবর্তন করিয়া কহিল, চলুন, সাহেব অনুমতি দিয়াছেন।

    চাপরাশিকে আর কোন কথা না বলিয়া, তাহার সহিত আমি বাহিরে আসিলাম, ও মেহের আলির সহিত আপন গাড়িতে উঠি লাম। সেই বালকটীও গাড়ির উপর উঠিয়া বসিল।

    চাপরাশি আমাকে যে সকল কথা বলিয়াছিল, তাহা আমি মেহের আলিকে কহিলাম। আমার কথা শুনিয়া মেহের আলি কিয়ৎক্ষণ চুপ করিয়া রহিল, এবং পরিশেষে কহিল, চাপরাশি কখনই এ কথা বলে নাই। আর যদি বলিয়াই থাকে, তাহা হইলে সে মিথ্যা কথা বলিয়াছে। পনর দিবসের মধ্যে রব্বানি এ কুঠীতে আইসে নাই।

    মেহের আলির কথা শুনিয়া চাপরাশি কহিল, আমি মিথ্যা বলিতেছি, না তুই মিথ্যা বলিতেছিস্? তিন চারিদিবস হইল, সন্ধ্যার পূর্বে যে সে আসিয়া টাকার জন্য, তোর সহিত বকাবকি করিয়াছিল, সে কথা তোর মনে নাই কি?

    ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ।

    চাপরাশি ও মেহের আলির সহিত এইরূপ কথা হইতে হইতে আমাদিগের গাড়ি আসিয়া যে স্থানে মৃতদেহ রক্ষিত ছিল, সেই স্থানে উপস্থিত হইল।

    আমরা গাড়ি হইতে অবতরণ করিয়া, মেহের আলি এবং চাপরাশিকে সঙ্গে লইয়া সেই মৃতদেহের সন্নিকটে গমন করিলাম। সেই মৃতদেহ দেখিবার নিমিত্ত তাহাদিগকে কহিলাম। মেহের আলি সেই মৃতদেহের দিকে দৃষ্টিপাত না করিয়াই কহিল, না মহাশয়! এ কাহার দেহ, তাহা আমি চিনিতে পারিতেছি না।

    চাপরাশি। তাহা আর চিমিতে পারিবে কেন? তোমার জামাতাকে যে কখনও দেখিয়াছে, সে-ই এই মৃতদেহ চিনিতে পারিবে। কিন্তু তুমি চিনিতে পারিতেছ না, ইহা অপেক্ষা আশ্চর্যের বিষয় আর কি হইতে পারে?

    যে স্থানে মৃতদেহটা ছিল, তাহার সন্নিকটেই সেই টিনের বাক্সটী রক্ষিত ছিল। সেই বাক্সটী দেখিয়া চাপরাশি কহিল,

    ওই বাক্সটী কিসের মহাশয়?

    আমি। এই বাক্সের ভিতর পূরিয়া এই মৃতদেহটী কোন ব্যক্তি গঙ্গার ধারে রাখিয়া দিয়াছিল।

    চাপরাশি। তবে এই বাক্সের ভিতর ওই লাস পাওয়া যায়?

    আমি। হাঁ।

    চাপরাশি। মেহের আলি যে ঘরে থাকে, সেই ঘরে ঠিক এইরূপ একটা বাক্স ছিল। তাই এখন সেই স্থানে আছে কি না, তাহা মেহের আলিকে জিজ্ঞাসা করুন দেখি।

    আমি। কি হে মেহের আলি! তুমি যে ঘরে থাক, সেই ঘরে এইরূপ একটা টিনের বাক্স ছিল, তাহা এখন কোথায়? উহা এখন সেই স্থানে আছে কি?

    মেহের আলি। চাপরাশি কেবল মিথ্যা কথা কহিতেছে। যে ঘর আমার দ্বারা অধিকৃত, তাহার ভিতর এরূপ টিনের বাক্স কখনও ছিল না, এখনও নাই।।

    চাপরাশি। আমি মিথ্যা কথা কহিতেছি? তোমার ঘরে যে টিনের বাক্স ছিল, তাহা কে না জানে? কুঠীর সমস্ত চাকরই তাহা দেখিয়াছে। তাহাদিগের মধ্যে যাহাকে জিজ্ঞাসা করিবেন, সে-ই এ কথা বলিবে। চাকর-বাকরের কথাই বা জিজ্ঞাসা করিতেছি কেন? মনিব-সাহেব স্বয়ং ইহা বলিতে পারিবেন। একদিবস তিনি নিজে ওই বাক্স দেখিয়া, মেহের আলিকে জিজ্ঞাসা করিয়াছিলেন, এ বাক্স কাহার?

    আমি। হাতে মেহের আলি কি উত্তর করিয়াছিল?

    চাপরাশি। তাহাতে মেহের আলি এই কথা কহে যে, অনেক দিবস হইতে এই বাক্স এই স্থানে পড়িয়া রহিয়াছে।

    আমি। কেমন মেহের আলি! এই কথা কি প্রকৃত?

    মেহের আলি। না মহাশয়। ইহার সমস্তই মিথ্যা কথা।

    আমি। চাপরাশির সমস্ত কথা যদি মিথ্যা হয়, তাহা হইলে তোমার মঙ্গল। আর যদি প্রকৃত হয়, তাহা হইলে জানিও, এই হত্যা তোমা-ব্যতীত আর কাহারও দ্বারা হয় নাই।

    মেহের। সেকি মহাশয়! তাহা হইলে আমি আমার জামাতাকে কি হত্যা করিয়াছি। আপনারা এইরূপ বিশ্বাস করেন?

    আমি। কাজেই বিশ্বাস করিতে হইতেছে। তোমার নিজের কথার ভাবেই বেশ অনুমান হইতেছে, এই হত্যাকাণ্ডে তুমি সম্পূর্ণরূপে অপরাধী। তুমি এখন প্রকৃত কথা কি, তাহা বল দেখি। তাহা হইলে তুমি কতদুর অপরাধে অপরাধী, তাহা আমরা অনায়াসেই বুঝিতে পারিব, ও জানিতে পারিব, এই কাৰ্য্য তুমি ইচ্ছা করিয়া করিয়াছ, কি ক্রোধের বশবর্তী হওয়ায়, এই কাৰ্য্য হঠাৎ তোমার দ্বারা হইয়া গিয়াছে।

    মেহের আলি আমার কথায় আর কোনরূপ উত্তর প্রদান না করিয়া সেই স্থানে বসিয়া পড়িল।

    মেহের আলির কন্যা তখন সেই স্থানে উপস্থিত ছিল, আমা দিগের এই সকল কথা শুনিয়া সে কহিল, বাবা! এ কাৰ্য্য তুমিই করিয়াছ? তা বেশ করিয়াছ, নিজের কন্যাকে বিধবা করিয়া পিতার উপযুক্ত কাৰ্য্যই করিয়াছি! এই বলিয়া সে সেই স্থান হইতে একটু দূরে গিয়া ক্ৰমন করিতে লাগিল।

    মেহের আলির কথা শুনিয়া ও তাহার অবস্থা দেখিয়া, আমা দিগের মনে স্পষ্টই প্রতীতি জন্মিল যে, মেহের আলি ব্যতীত এই কাৰ্য্য আর কাহারও দ্বারা হয় নাই। তবে লাস স্থানান্তরিত করিবার সময় অপর কোন ব্যক্তি সাহায্য করিলেও করিতে পারে।

    মনে মনে এইরূপ ভাবিয়া সেই বাক্স ও উহার ভিতর যে ঔষধের শিশি পাওয়া গিয়াছিল, তাহা লইয়া মেহের আলি এবং চাপরাশির সহিত পুনরায় সেই স্কুলে গিয় উপস্থিত হইলাম।

    সেই স্থানে গিয়া সেই সর্বপ্রধান সাহেবের সহিত প্রথমে সাক্ষাৎ করিলাম এবং যতদূর অবগত হইতে পারিয়াছিলাম, তাহার সমস্ত ব্যাপার তাহার নিকট খুলিয়া বলিলাম। সমস্ত ব্যাপার শুনিয়া তিনি আমাদিগের সহিত মেহের আলির থাকি বার স্থানে গমন করিলেন ও কহিলেন, এইরূপ একটী বাক্স আমি এই স্থানে পূর্বে দেখিয়াছিলাম। কিন্তু এখন উহা দেখিতে পাইতেছি না।

    যে স্থানে সেই বাক্সটী পূৰ্ব্ব হইতে রক্ষিত ছিল বলিয়া জানা গেল, সেই স্থানটী আমরা উত্তমরূপে দেখিলাম। দেখিয়া স্পষ্টই বোধ হইল, সেই স্থানে অতবড় একটা বাক্স রক্ষিত ছিল, তাহার চিন্তু এখন পর্যন্তও বৰ্তমান রহিয়াছে।

    ঔষধের শিশি দেখিয়া সাহেব কহিলেন, উহাতে যে নাম লেখা আছে, সেই নামের একটী বালক এই স্কুলে পূৰ্ব্বে পাঠ করিত; কিন্তু এখন স্থানান্তরে গমন করিয়াছে। আবশ্যক হইলে তাহার অনুসন্ধান পাওয়া যাইতে পারিবে।

    অতঃপর সেই স্থানে অপর চাকরগণের বাসস্থান অনুসন্ধান করিলাম। সাহেব সেই অনুসন্ধানে নিজে আমাদিগকে সাহাব) করিতে লাগিলেন। এইরূপে কিছুক্ষণ অনুসন্ধান করিতে করিতেই অল্পে অল্পে আসল কথা বাহির হইয়া পড়িল।

    মেহের আলি যখন দেখিল যে, সকল কথা প্রকাশ হইয়া গেল, তখন সেও সমস্ত কথা স্বীকার করিল। সে যাহা কহিল, তাহার সার মৰ্ম্ম এইরূপ :

    রব্বানি আমার জামাতা। এই স্কুলের ভিতর একখানি ক্ষুদ্র খোলার ঘন সে বাঁধিয়া দেয়, তাহাতে আমার নিকট তাহার কিছু পাওনা থাকে। সেই পাওনা টাকার নিমিত্ত সে আমাকে সৰ্ব্বদা বিরক্ত করিত, সময় অসময় কিছুই না মানিয়া সৰ্ব্বদা সে আমার নিকট সেই টাকার তাগাদা করিত, এবং সময় সময় আমাকে কটুবাক্যও কহিত।

    গত পরশ্ব তারিখের সন্ধ্যার পূর্বে সে এই স্থানে আসিয়া আমার নিকট পুনরায় সেই টাকার তাগাদা করে। আমার নিকট সেই সময় টাকা না থাকায়, আমি উহা তাহাকে দিতে পারি নাই। সুতরাং সে আমার উপর অতিশয় অসন্তুষ্ট হইল, এবং আমাকে গালি প্রদান করিল। আমারও অত্যন্ত ক্রোধের উদ্রেক হওয়াতে আমি তাহাকে কহিলাম, তুমি আমার ঘরের ভিতর আইস, আমি হিসাব করিয়া তোমার সমস্ত টাকা পরিশোধ করিয়া দিতেছি। আমার কথায় বিশ্বাস করিয়া সে যেমন ঘরের ভিতর প্রবেশ করিল, অমনি আমি তাহার,কর্ণমুলে সজোরে এক চপেটা ঘাত করিলাম। চড় মারিবামাত্র সে সেই স্থানে পড়িয়া গেল। তাহার উপর আমি তাহাকে দুই চারিটী পদাঘাতও করিয়াছিলাম। পরে দেখিলাম, সে মরিয়া গিয়াছে। তখন আর কোন উপায় না দেখিয়া একখানি চটে উহাকে উত্তমরূপে জড়াইয়া বাঁধিলাম, এবং পরিশেষে এই বাক্সের ভিতর পূরিয়া আমার এই ঘরের ভিতরেই রাখিয়া দিলাম। কিন্তু কোন উপায়ে সেই বাক্স আমি ঘর হইতে বাহির করিয়া লইবার অবকাশ পাইলাম না। ক্রমে রাত্রি প্রভাত হইয়া গেল। সমস্ত দিবস সেই বাক্স আমার ঘরের ভিতরেই ছিল। পরদিবস রাত্রি হইলে একটা কুলীর সাহায্যে আমি সেই বাক্সল স্কুল হইতে বাহির করিয়া একখানি ভাড়াটিয়া গাড়ি আনিয়া তাহার উপর রাখিয়া দিলাম, এবং সেই গাড়িতে করিয়া উহা আমি গঙ্গার ধারে লইয়া গেলাম। সেই স্থানে খোেলা জেটির ভিতর সেই বাক্সটা রাখিয়া দিয়া, আমি সেই গাড়ি বিদায় করিয়া দিলাম। আমার ইচ্ছা ছিল যে, কোন গতিতে সেই বাটী গঙ্গাগর্ভে নিক্ষেপ করিব; কিন্তু তাহার সুযোগ করিয়া উঠিবার পূর্বেই একজন চাপরাশি সেই বাক্সটা দেখিতে পাইয়া তাহার নিকট গমন করিল। আমিও ভীত হইয়া সেই স্থান হইতে প্রস্থান করিলাম।

    মেহের আলি এইরূপে যাহা আমাদিগের নিকট কহিল, সে আর সে কথার পরিবর্তন করিল না। অনুসন্ধানে যে সকল প্রমাণের সংগ্রহ হইল, তাহাদিগের সাক্ষ্যে এবং মেহের আলির স্বীকারেই দায়রার বিচারে তাহার ফাঁসি হইয়া গেল।

    সম্পূর্ণ।

    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26 27 28 29 30 31 32 33 34 35 36 37 38 39 40 41 42 43 44 45 46 47 48 49 50
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleআরব জাতির ইতিহাস – ফিলিপ কে. হিট্টি (অনুবাদ : প্রিন্সিপাল ইবরাহীম খাঁ)
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    দারোগার দপ্তর ৩ – প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়

    September 22, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    দারোগার দপ্তর ৩ – প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়

    September 22, 2025
    Our Picks

    দারোগার দপ্তর ৩ – প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়

    September 22, 2025

    আরব জাতির ইতিহাস – ফিলিপ কে. হিট্টি (অনুবাদ : প্রিন্সিপাল ইবরাহীম খাঁ)

    September 22, 2025

    নিউ মুন – স্টেফিন মেয়ার

    September 22, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    • Sign Up
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }

    Sign In or Register

    Welcome Back!

    Login below or Register Now.

    Lost password?

    Register Now!

    Already registered? Login.

    A password will be e-mailed to you.