Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    দারোগার দপ্তর ৩ – প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়

    September 22, 2025

    আরব জাতির ইতিহাস – ফিলিপ কে. হিট্টি (অনুবাদ : প্রিন্সিপাল ইবরাহীম খাঁ)

    September 22, 2025

    নিউ মুন – স্টেফিন মেয়ার

    September 22, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • 🔖
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    Subscribe
    সাইন ইন
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    দারোগার দপ্তর ৩ – প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়

    প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায় এক পাতা গল্প1897 Mins Read0

    গোঁসাই ঠাকুর

    গোঁসাই ঠাকুর 

    প্রথম পরিচ্ছেদ

    পৌষ মাস। বড়দিনের ছুটী হইয়া গিয়াছে। স্কুল, কলেজ, অফিস সমস্তই বড়দিন উপলক্ষে বন্ধ হইয়াছে। দীর্ঘ অবকাশ পাইয়া স্কুল ও কলেজের ছাত্রগণ দেশ-দেশান্তর হইতে কলিকাতায় তামাসা দেখিবার জন্য আগমন করিয়াছে।

    আমারও কাজকর্ম্ম কমিয়া গিয়াছে। তবে আমার অবকাশ অতি অল্প। দৈনিক কাৰ্য্যগুলি না করিলে আর আমার অব্যাহতি নাই।

    এই সময় একদিন প্রাতঃকালে আমি থানার অফিস-ঘরে বসিয়া আছি, এমন সময়ে টেলিফোনের ঘণ্টা টুং টুং করিয়া বাজিয়া উঠিল। নিকটে কেহ না থাকায় আমিই যন্ত্রের নিকট যাইলাম। শুনিলাম, বড় সাহেব বিশেষ কোন কার্য্যের জন্য আমায় তলব করিয়াছেন। আমিও যত শীঘ্র সম্ভব সাহেবের নিকট উপস্থিত হইলাম।

    সাহেব আমারই অপেক্ষা করিতেছিলেন। আমাকে দেখিবামাত্র সাগ্রহে বলিয়া উঠিলেন “হাড়কাটি গলিতে একটি খুন হইয়াছে। আপনাকে এখনই তাহার তদন্তে যাইতে হইবে।”

    সাহেবের কথা শুনিয়া আমি তাঁহার নিকট বিদায় লইলাম ও এক কোয়ার্টারের মধ্যেই ঘটনাস্থলে উপস্থিত হইলাম; এবং যে বাড়ীতে খুন হইয়াছে, সেই বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিলাম। বাড়ীখানি দ্বিতল কিন্তু ক্ষুদ্র। দেখিলাম, স্থানীয় পুলিসের দারোগাও সেই স্থানে উপস্থিত থাকিয়া অনুসন্ধান করিতেছেন। তিনি আমাকে উপরে লইয়া গেলেন। উপরে দুইটি ঘর। একটি ঘর বাহির হইতে আবদ্ধ ছিল, তিনি পকেট হইতে চাবি বাহির করিয়া সেই ঘরটি খুলিয়া দিলেন। আমি ভিতরে প্রবেশ করিলাম। দেখিলাম, ঘরের মেঝে রক্তের নদী প্রবাহিত হইতেছে, একজন বৃদ্ধ উপুড় হইয়া মেঝের উপর পড়িয়া রহিয়াছে। তাহার পৃষ্ঠে এক প্রকাণ্ড ছোরার আঘাত চিহ্ন; সেই ক্ষতমুখ হইতে তখনও অল্প অল্প রক্ত নিঃসৃত হইতেছিল।

    দেহের অবস্থা দেখিয়া আমি স্পষ্টই বুঝিতে পারিলাম যে, বৃদ্ধ অনেক পূর্ব্বেই প্রাণত্যাগ করিয়াছে; তথাপি কালবিলম্ব না করিয়া একজন ডাক্তারকে তথায় আনিতে আদেশ করিলাম। একজন কৰ্ম্মচারী চলিয়া গেল এবং অর্দ্ধ ঘণ্টার মধ্যেই একজন ডাক্তার সঙ্গে লইয়া আমার নিকট উপস্থিত হইল।

    ডাক্তারবাবু আমার পরিচিত। তিনি আসিবামাত্র আমি অতি সমাদরে তাঁহাকে সেই গৃহে লইয়া গেলাম। তিনি বৃদ্ধের দেহের নিকট গমন করিয়া বিশেষ যত্ন সহকারে পরীক্ষা করিলেন। পরে বলিলেন “প্রায় ছয় ঘণ্টা পূৰ্ব্বে এই ব্যক্তি প্রাণত্যাগ করিয়াছে। আঘাতের চিহ্ন দেখিয়া স্পষ্টই জানিতে পারা যায় যে, কোন শানিত ছোরা দ্বারাই ইনি আহত হইয়াছেন। পৃষ্ঠের যে অংশে আঘাত করা হইয়াছে, তাহাতে ইনি যে আত্মহত্যা করিয়াছেন, এরূপ বোধ হয় না। ইহার গলায় অঙ্গুলির দাগ দেখিয়া বোধ হইতেছে যে, কোন লোক ইহার গলা টিপিয়া ধরিয়াছিল। যেরূপ ভাবে দাগগুলি দেখা যাইতেছে, তাহাতে স্পষ্টই বোধ হয় যে, পাছে ইনি চীৎকার করিয়া সকলকে জাগ্রত করেন, এই ভয়েই ইহার গলা চাপিয়া ধরা হইয়াছিল। যে ছোরা দ্বারা আঘাত করা হইয়াছে, তাহার দুই দিকে ধার। আঘাতও এত জোরে করা হইয়াছিল যে, ছোরাখানি বৃদ্ধের হৃদয় ও ফুসফুস ভেদ করিয়াছে। সুতরাং ইহার মৃত্যুও যে ঠিক সেই সময়েই হইয়াছিল, তাহাতে কোন সন্দেহ নাই।

    লাস পরীক্ষা করিয়া ডাক্তারবাবু প্রস্থান করিলেন। আমি তখন বেহারাকে ডাকিয়া জিজ্ঞাসা করিলাম “এ লাস কার? ইনিই কি তোমার প্রভু?”

    বেহারা অতি বিনীত ভাবে উত্তর করিল “আজ্ঞে হাঁ, ইনিই আমার মনিব।”

    আ। এ বাড়ীতে আর কেহ থাকে?

    বে। ইহার এক কন্যা ছাড়া আর কেহ থাকে না।

    আ। কোথায় সে?

    বে। বলিতে পারি না।

    আ। তুমি কতদিন এখানে চাকরী করিতেছ?

    বে। প্রায় এক বৎসর।

    আ। তোমার প্রভু কি কাজ করিতেন জান?

    বে। থিয়েটারে কি কর্ম্ম করিতেন।

    আ। কন্যাটির বিবাহ হইয়াছে?

    বেহারা ঈষৎ হাসিল। বলিল, “বিবাহ? আজ্ঞে না।”

    বেহারার মুখের ভঙ্গি ও তাহার কথা শুনিয়া আমি স্পষ্টই বুঝিতে পারিলাম যে, বৃদ্ধের কন্যা বেশ্যাবৃত্তি করিয়া থাকে। যখন সে থিয়েটারে কার্য্য করে, তখন অনেক যুবকই এখানে আসিয়া থাকে, এই বিবেচনা করিয়া আমি পুনরায় জিজ্ঞাসা করিলাম “এখানে কোন বাবু আসিয়া থাকেন?”

    বেহারা কিছুক্ষণ কোন উত্তর করিল না। পরে বলিল “থিয়েটার রাত্রি ছাড়া প্রায় প্রতি রাত্রেই এক জমীদারবাবু এখানে আসিতেন। প্রায় এক সপ্তাহ হইল তিনি আর আসেন না।”

    আ। কেন?

    বে। সে কথা বলিতে পারি না।

    আ। উভয়ের মধ্যে কি বিবাদ হইয়াছে?

    বে। জানি না।

    আ। জমীদারবাবুর নাম কী? তাঁহার নিবাস কোথায়?

    বে। নাম মোহিতকুমার; বাড়ী হ্যারিসন রোডে।

    আ। কন্যাটির নাম কী?

    বে। মালতী।

    আ। মালতী কি বৃদ্ধের ঔরসজাত কন্যা?

    বে। শুনিয়াছি, ইনি না কি মালতীকে বাল্যকাল হইতে প্রতিপালন করিতেছেন। আপনার কন্যা হইলে ইনি কখনও তাঁহাকে থিয়েটারে কাজ করিতে অনুমতি দিতেন না।

    আ। মোহিতকুমার কতদিন এখানে যাতায়াত করিতেছেন?

    বে। প্রায় ছয় মাস হইবে। শুনিয়াছিলম, তিনি না কি মালতীকে বিবাহ করিতে ব্যগ্র হইয়াছিলেন। কিন্তু তাহার পর কি হইল বলিতে পারি না।

    আ। মোহিতকুমারের সহিত মালতীর কি তবে বিবাহ হইয়া গিয়াছে?

    বে। এখানে ত হয় নাই। যদি গোপনে আর কোথাও হইয়া থাকে, বলিতে পারি না।

    আ। মালতী বৃদ্ধের সহিত কি প্রকার ব্যবহার করে? উভয়ের মধ্যে সদ্ভাব কেমন?

    বে। সদ্ভাব বেশ ছিল। কিন্তু সম্প্রতি বোধ হয় উভয়ের মধ্যে কোনরূপ মনোমালিন্য ঘটিয়া থাকিবে। পূৰ্ব্বে মালতীকে কখনও অবাধ্য হইতে দেখি নাই, কিম্বা বৃদ্ধের সহিত তর্ক করিতেও শুনি নাই। কিন্তু ইদানিং মালতী প্রায়ই বৃদ্ধের কথার উপর কথা কহিতেন, উভয়ের মধ্যে প্রায়ই বচসা হইত।

    আ। গত রাত্রে আর কোন লোক এখানে আসিয়াছিল?

    বে। না।

    আ। কাল বুধবার গিয়াছে; থিয়েটার ছিল। কালও কি ইহারা থিয়েটিরে গিয়াছিলেন?

    বে। হাঁ। সন্ধ্যার কিছু পরেই বাবু আমাকে একখানি গাড়ি ভাড়া করিয়া আনিতে বলেন। গাড়ি আনিলে উভয়ে তাহাতে আরোহণ করেন এবং থিয়েটারে গমন করেন। বাড়ীতে আমি একাই ছিলাম। রাত্রি প্রায় দুইটার সময় আমি বাবুকে দরজা খুলিয়া দিয়াছিলাম। তিনি বাড়ীতে প্রবেশ করিলে আমি যখন দরজা বন্ধ করিতে যাই, তখন তিনি আমায় নিষেধ করেন। বলেন, মালতী এখনও আসে নাই, দরজা খোলাই থাকুক। এই বলিয়া বাবু উপরে গেলেন, আমিও দরজা বন্ধ করিয়া দিলাম কিন্তু অর্গল বদ্ধ করিলাম না। বলা বাহুল্য, আমি তখন নিদ্রায় বড়ই কাতর হইয়াছিলাম। সুতরাং বাড়ীর সদর দরজা ভেজাইয়া দিয়া খাটিয়ার উপর শুইয়া পড়িলাম এবং তখনই গভীর নিদ্রায় নিদ্রিত হইলাম।

    আ। মালতী কখন ফিরিয়া আসিয়াছিল?

    বে। তিনি ত আর ফিরিয়া আসেন নাই।

    আ। তুমি ত গভীর নিদ্রায় নিদ্রিত ছিলে। মালতী আসিয়াছিল কি না, কেমন করিয়া জানিতে পারিলে?

    বে। তিনি আসিলে আমি নিশ্চয়ই জানিতে পারিতাম।

    আ। তার পর।

    বে। তার পর, আজ প্রাতে শয্যা হইতে উঠিয়া বাবুর চা প্রস্তুত করিবার জন্য তাঁহার গৃহে গমন করি। সেখানে গিয়া যাহা দেখি, তাহাতে আমার অন্তরাত্মা উড়িয়া গিয়াছিল। গৃহের মধ্যে রক্তের নদী প্রবাহিত হইতেছিল, বুদ্ধ উপুড় হইয়া পড়িয়াছিল। আমি গৃহ মধ্যস্থ কোন দ্রব্যে হস্তক্ষেপ না করিয়া তখনই সেই স্থান হইতে বাহির হইয়া থানায় খবর দিই।

    দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ

    লাসটি পরীক্ষার নিমিত্ত যথাস্থানে প্রেরিত হইল। আমি বেহারাকে সঙ্গে লইয়া মোহিতকুমার ও মালতীর অনুসন্ধানে বহির্গত হইলাম।

    মোহিতকুমারের বাসা জানিতাম না বলিয়া পদব্রজেই গমন করা যুক্তিসঙ্গত মনে করিলাম। কর্ণওয়ালিস ষ্ট্রীট পার হইয়া একটি ভদ্রলোকের বাড়ীর সম্মুখে কতকগুলি ভদ্রলোক দেখিতে পাইলাম। মোহিতকুমারের কথা জিজ্ঞাসা করিলে তাঁহাদের মধ্যে একজন উত্তর করিলেন “নিকটবর্তী একখনি ত্রিতল বাটীতে তাঁহার বাসা।” সন্ধানে আরও জানিলাম, তিনি সত্য সত্যই পূর্ব্ববঙ্গের এক জমীদার-পুত্র। বাণিজ্য উপলক্ষে কলিকাতায় থাকেন। তাঁহার বাসাতেই কাপড়ের গুদাম। সেখানে তিনি ও তাঁহার কর্ম্মচারিগণ ভিন্ন আর কোন লোক থাকে না। আমি আরও অগ্রসর হইলাম। মোহিতকুমারকে কাপড়ের ব্যবসায়ী জানিয়া মনে মনে আনন্দিত হইলাম।

    প্রায় এক কোয়ার্টারের পর মোহিতকুমারের বাসা পাইলাম। দেখিলাম, বাড়ীখানি সত্যই ত্রিতল। বাটীর সদর দরজা পার হইয়া দক্ষিণ দিকের একটি প্রকোষ্ঠে কয়েকজন ভদ্রলোককে বসিয়া থাকিতে দেখিতে পাইলাম। আমাকে দেখিয়া তাঁহারা সাগ্রহে আমার অভ্যর্থনা করিলেন, পরে আমার অভিপ্রায় কি জিজ্ঞাসা করিলেন।

    আমি বলিলাম “মোাহিতকুমারের সহিত দেখা করিতে আসিয়াছি। যদি তিনি এখানে থাকেন, একবার অনুগ্রহ করিয়া ডাকিয়া দিন, আমার বিশেষ প্রয়োজন।”

    আমার কথা শুনিয়া একটি ভদ্রলোক আমাকে সঙ্গে লইয়া উপরে উঠিলেন। আমার ইঙ্গিতমত বেহারা দূরে বাহিরে রহিল। দেখিলাম, বাড়ীটি ত্রিতল হইলেও ক্ষুদ্র। বোধ হয়, এককাঠা ভূমির উপর সেই অট্টালিকা নিৰ্ম্মিত হইয়াছিল। বাড়ীতে স্ত্রীলোক না থাকায় আমিও নিঃসঙ্কোচে উপরে উঠিলাম; এবং সেই ভদ্রলোকের সহিত এক প্রকোষ্ঠে প্রবেশ করিলাম। দেখিলাম, একটি সম্ভ্রান্ত যুবক একা সেই গৃহে বসিয়া হিসাব নিকাশ করিতেছেন। আমাকে সেই গৃহ মধ্যে প্রবেশ করিতে দেখিয়া তিনি আমার সমভিব্যাহারী ভদ্রলোককে জিজ্ঞাসা করিলেন “ইনি কে হরিদাস?”

    ভদ্রলোকটির নাম হরিদাস। গলে যজ্ঞোপবীত থাকায় স্পষ্টই প্রতীয়মান হইল, তিনি জাতিতে ব্রাহ্মণ। পূর্ব্বোক্ত ব্যক্তির প্রশ্ন শুনিয়া হরিদাস উত্তর করিল “ইনি আপনার সহিত সাক্ষাৎ করিতে আসিয়াছেন।” পরে আমার দিকে চাহিয়া বলিলেন, ইহারই নাম মোহিতকুমার বাবু। আমরা সকলেই ইহাঁর কর্ম্মচারী।” এই বলিয়া হরিদাস প্রস্থান করিলেন।

    মোহিতকুমার আমাকে সাদরে অভ্যর্থনা করিয়া নিকটে বসিতে বলিলেন। আমি তাঁহার অনুরোধ রক্ষা করিলাম। দেখিলাম, ঘরটি দৈর্ঘ্যে প্রস্থে প্রায় দশ হাত; ঘরের ভিতর ছয়টি জানালা ও একটি দরজা। আবাবের মধ্যে একটি প্রকাণ্ড দেরাজ ও দুইটি আলমারি, একখানা বড় আয়না ও একটি ঘড়ী। চারিটি দেওয়ালে দশ বারখানি হিন্দু-দেবদেবীর প্রতিমূর্তি। দেরাজের উপর একটি সুন্দর আলোকাধার। ঘরের মেঝেয় ঢালা বিছানা। একটি তোষকের উপর একখানা সতরঞ্চ, তাহার উপর একখানি দুগ্ধফেননিভ চাদর পাতা ছিল। মোহিতকুমার সেই শয্যোপরি বসিয়া একখানি খাতা খুলিয়া কি হিসাব দেখিতেছিলেন। আমি তাঁহার অনুরোধে সেই শয্যার উপর বসিয়া পড়িলাম।

    কিছুক্ষণ পরে মোহিতকুমার জিজ্ঞাসা করিলেন “মহাশয়ের নাম কি? কি অভিপ্রায়েই বা এখানে আসা হইয়াছে?” আমি অতি বিনীত ভাবে উত্তর করিলাম “আমার নাম বিমলাচরণ। পশ্চিমবঙ্গে আমার বাড়ী। কাপড়ের ব্যবসায় উপলক্ষে আমি কলিকাতায় আসিয়াছি। মহাশয় অনেকদিন হইতে ওই কার্য্য করিতেছেন শুনিয়া, ওই বিষয়ে আপনার পরামর্শ গ্রহণ করিতে আসিয়াছি।”

    মোহিতকুমার অতি সজ্জন। আমাকে ব্যবসায়ী জানিয়া তিনি পরম আহ্লাদিত হইলেন। বলিলেন “কতদিন হইল আপনার এখানে আসা হইয়াছে?”

    আ। প্রায় মাস খানেক হইবে।

    মো। আপনার বাসা কোথায়?

    আ। বড় বাজারে ঢাকাই পটীতে।

    মো। আপনি কাপড়ের ব্যবসায় করিবেন? কিন্তু ওই ব্যবসায়ে আর তেমন লাভ নাই। আমরা পূর্ব্ব পূর্ব্ব বৎসরে যেমন লাভ করিয়াছিলাম, গত বৎসরে তাহার অর্দ্ধেকও লাভ হয় নাই। তা বলিয়া মনে করিবেন না যে, আমি আপনাকে নিরুৎসাহ করিতেছি। বাস্তবিক তাহা নহে। যখন আপনি আমার নিকট পরামর্শ লইতে আসিয়াছেন, তখন আমাকে সকল কথাই বলিতে হইবে।

    আ।নিশ্চয়ই। আমি আপনার মনোগত অভিপ্রায় বুঝিতে পারিয়াছি। বিশেষতঃ আপনার সুখ্যাতি শুনিয়াই আমি এখানে আসিয়াছি। আপনার মুখে প্রকৃত ব্যাপার জানিতে পারিব বলিয়াই আমার এখানে আগমন

    বেলা প্রায় দুইটাও বজিয়াছে। মোহিতকুমার যে কার্য্য করিতেছিলেন, তাহাও শেষ হইয়াছে। তিনি খাতা-পত্র বদ্ধ করিয়া আমাকে কাপড়ের ব্যবসায় সম্বন্ধে নানাপ্রকার পরামর্শ দিতেছিলেন। কোন্ কোন্ কোম্পানির নিকট হইতে কিরূপ ভাবে কাপড় পাওয়া যায়, তাহাদিগের টাকা দিবার নিয়মই বা কি, কোন্ দালালের সাহায্যে কোন্ কোম্পানির মাল পাওয়া যায়, এই সকল কথা তিনি আমাকে তন্ন তন্ন করিয়া বুঝাইয়া দিতেছিলেন।

    নানাপ্রকার পরামর্শ দিয়া তিন যেন ক্লান্ত হইয়া পড়িলেন এবং শয়ন করিবার জন্য যেন ব্যস্ত হইয়া পড়িলেন। আমি তাঁহার মনোভাব বুঝতে পারিয়া বলিলাম “আপনার কষ্ট হইতেছে, আজ আমি বিদায় হই, আর একদিন আসিয়া অপরাপর কথা জানিয়া লইব।”

    মোহিতকুমার ঈষৎ হাসিয়া উত্তর করিলেন “আপনি যথার্থ অনুমান করিয়াছেন। গত রাত্রে থিয়েটারে গিয়াছিলাম। সেখান হইতে ফিরিতে রাত্রি প্রায় চারিটি বাজিয়াছিল। সুতরাং গত রাত্রে আমার ভাল নিদ্রা হয় নাই।”

    থিয়েটারের নাম শুনিয়া আমি আন্তরিক আনন্দিত হইলাম। জিজ্ঞাসা করিলাম “কোন্ থিয়েটারে গিয়াছিলেন। কাল বুধবার গিয়াছে। বুধবারে ভাল বিষয় হয় না। তদ্ভিন্ন আজ-কাল থিয়েটারে একপ্রকার নূতন নিয়ম প্রচলিত হইয়াছে। সমস্ত রাত্রি নাচ গান না হইলে আজ-কাল দর্শকগণের মনের তৃপ্তি হয় না। আপনি কোন্ থিয়েটারে গিয়াছিলেন?”

    মো। ষ্টার থিয়েটারে।

    আ। ষ্টার থিয়েটার? আজ-কাল সেখানে ভাল অভিনেত্রী কে? আমি বহুদিন পূর্ব্বে একরাত্রি ষ্টারে গিয়াছিলাম সেদিন চৈতন্যলীলা অভিনয় হইয়াছিল। যাহা দেখিয়াছিলাম, তাহা এ জন্মে ভুলিতে পারিব না।

    মো। সে সকল পালা আর আজ কাল অভিনীত হয় না। এখন অন্যান্য পুস্তক অভিনীত হইয়া থাকে। আজ-কালকার বিখ্যাত অভিনেত্রীর নাম মালতী। তবে সে কোন নির্দিষ্ট থিয়েটারের বেতনভোগী নহে। যেদিন যেখানে সুবিধা হয়, সেদিন সেইখানেই অভিনয় করিয়া থাকে। মালতীর মত নর্তকী, গায়িকা ও অভিনেত্রী, আজ কাল কলিকাতার মধ্যে নাই বলিলেও অত্যুক্তি হয় না। মালতী যেদিন যেখানে থাকিবে, সেইদিন সেইখানেই অতিরিক্ত দর্শকবৃন্দের সমাগম হইবে।

    আ। তবে তাহাকে কেহ বেতন দিয়া রাখে না কেন? যদি এক মালতী থাকিলেই দর্শকবৃন্দের হুড়াহুড়ী হয়, তবে লোকে তাহাকে একচেটিয়া করিয়া লয় না কেন?

    মো। মালতী বেতনভোগী হইয়া থাকিতে ইচ্ছা করে না। অনেকে তাহাকে দুই শত টাকা বেতন দিয়াও রাখিতে চেষ্টা করিয়াছিল, কিন্তু মালতী তাহাতেও সন্তুষ্ট হয় নাই।

    আ। একরাত্রি অভিনয় করিতে সে কত টাকা লইয়া থাকে?

    মো। পঞ্চাশ টিকার কম নহে।

    আ। আর আমি যদি তাহার বাড়ী গিয়া নৃত্য-গীতাদি শুনিয়া আসি, তাহা হইলে আমাকে কত দিতে হইবে? মোহিতকুমার হাস্য করিলেন। জিজ্ঞাসা করিলেন “আপনারও ওই সকল স্থানে যাতায়াত আছে না কি?” আমিও হাসিতে হাসিতে উত্তর করিলাম “দেশ ছাড়িয়া, পরিবার ছাড়িয়া, যখন কলিকাতায় আসিয়াছি, তখন একটু-আধটু আমোদ না করিলে বাঁচিব কিরূপে? তবে অনর্থক অযথা ব্যয় করাও আমার অভিপ্রায় নহে।”

    মো। বেশ কথা, আপনি আজ সন্ধ্যার পর এখানে আসিবেন। আপনাকে মালতীর গান শুনাইয়া আনিব।

    আ। কিন্তু আমায় কত দিতে হইবে? সেখানে গিয়া যেন আমাকে অপ্রস্তুত হইতে না হয়।

    মে। সে চিন্তা আপনাকে করিতে হইবে না, আপনাকে একটি পয়সাও দিতে হইবে না।

    আ। তবে কি মালতীর সহিত আপনার আলাপ আছে? সেখানে যাতায়াত আছে?

    মো। আলাপ আছে বই কি! অতবড় একটি অভিনেত্রী, রূপে গুণে সমান, তাহার সহিত সদ্ভাব না থাকিবে, তবে আর কাহার সহিত আলাপ থাকিবে? আপনি আজ সন্ধ্যার পর আসিবেন। আমার সহিত সেখানে যাইলেই বুঝিতে পারিবেন, আমার সহিত তাহার কেমন সদ্ভাব।

    আর কোন কথা না বলিয়া আমি মোহিতকুমারের নিকট বিদায় লইয়া থানায় ফিরিয়া আসিলাম।

    তৃতীয় পরিচ্ছেদ

    সন্ধ্যার কিছু পূর্ব্বেই পুনরায় ছদ্মবেশ ধারণ করিলাম এবং সন্ধ্যার পরই মোহিতকুমারের বাসায় উপস্থিত হইলাম। তিনি আমায় বসিতে বলিলেন।

    আমি পূর্ব্বে যে ঘরে তাঁহার সহিত দেখা করিয়াছিলাম, সেই ঘরে গিয়া বসিয়া রহিলাম। কিছুক্ষণ পরে মোহিতকুমার আমার নিকট আগমন করিলেন। দেখিলাম, তিনি বিষণ্ণ। আমি স্মিতমুখে জিজ্ঞাসা করিলাম “আর দেরি কেন? শুভস্য শীঘ্রং।”

    মোহিতকুমার হাসিলেন বটে কিন্তু সে হাসি আমার বড় ভাল লাগিল না। তিনি বলিলেন “সৰ্ব্বনাশ হইয়াছে মহাশয়! মালতী কোথায় চলিয়া গিয়াছে।”

    সে কথা আমি পূৰ্ব্বেই জানিতাম। তথাপি যেন তাঁহার কথায় অত্যন্ত আশ্চর্যান্বিত হইয়া জিজ্ঞাসা করিলাম “সে কি মহাশয়! আপনার সঙ্গে তাহার এত আলাপ, এত সদ্ভাব, আর আপনাকে একটি কথাও না বলিয়া চলিয়া গেল? মালতীর বাড়ী কোথায়?”

    মো। হাড়কাটি গলিতে।

    আ। তাহার বাড়ীতে আর কে থাকে?

    মো। তাহার পিতা! জন্মদাতা পিতা নহে, পালক পিতা।

    আ। তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করিয়াছিলেন?

    মো। তিনি কি আর আছেন? গতরাত্রে তাঁহাকে কে খুন করিয়া দিয়াছে।

    আমি যেন আকাশ হইতে পড়িলাম। বলিলাম “সে কি! খুন! এই শহরের মধ্যে হাড়কাটি গলির মত জনাকীর্ণ স্থানে খুন! কে খুন করিল? যখন মালতী পলায়ন করিয়াছে, তখন লোকে তাহারই উপর সন্দেহ করিবে। থানায় সংবাদ দেওয়া হইয়াছে?”

    মো। সে কি আর এখনও বাকি আছে? বাড়ীতে একটি বেহারা ছিল, সেই থানায় সংবাদ দিয়াছিল। শুনিলাম, পুলিস না কি তাহাকে গ্রেপ্তার করিয়া লইয়া গিয়াছে।

    আ। আমার বোধ হয় মালতীই খুন করিয়া পলায়ন করিয়াছে। আপনি অবশ্য মালতীর চরিত্র অবগত আছেন। আমি নিশ্চয় করিয়া কোন কথা বলিতে পারি না। যদি মালতীর সহিত তাহার পালক পিতার বিবাদ হইয়া থাকে, তাহা হইলে মালতীই খুন করিয়াছে বলিয়া বোধ হয়।

    মো। আপনার অনুমান কতকটি সত্য হইলে হইতে পারে। মালতীর সহিত বৃদ্ধের বিবাদ চলিতেছিল বটে; কিন্তু স্ত্রীলোক হইয়া সে কেমন করিয়া একজন পুরুষকে হত্যা করিল বুঝিতে পারি না।

    আ। সে নিজে স্বহস্তে খুন না করিতে পারে, অন্য কোন লোকের দ্বারা মালতী এ কার্য্য করিতে পারে। মো। আর ও সকল কথায় প্রয়োজন নাই। বেহারা বেটা নাকি আমার নাম পর্য্যন্ত পুলিসের গোচর করিয়াছে। আমার সত্য সত্যই বড় ভয় হইয়াছে।

    আ। মালতীর সহিত কি আপনার কাল দেখা হইয়াছিল?

    মোহিতকুমার কোন কথা কহিলেন না দেখিয়া আমি তাঁহাকে পুনরায় ওই কথা জিজ্ঞাসা করিলাম। তিনি যেন বিরক্ত হইলেন। আমি তাঁহার মনোভাব বুঝিতে পারিয়া বলিলাম “মোহিতবাবু! আমাকে আপনার বন্ধু বলিয়া মনে করিবেন। যখন আমরা উভয়েই ব্রাহ্মণ, তখন আপনি আমার পর নহেন। নিশ্চয়ই কোন না কোন সম্পর্ক আছে।”

    মোহিতকুমার ক্ষণকাল কি চিন্তা করিলেন। পরে বলিলেন “আপনি সত্যই বলিয়াছেন। আপনাকে দেখিয়া অবধি আমারও কেমন বিশ্বাস হইয়াছে। যদি তাহা না হইবে, তাহা হইলে আপনাকে আজ মালতীর নিকট লইয়া যাইতে স্বীকৃত হইব কেন?”

    আমি দেখিলাম, ঔষধ ধরিয়াছে, সুতরাং কোন কথা কহিলাম না। মোহিতকুমার আবার বলিতে লাগিলেন “বিমলাচরণবাবু! মালতী সম্বন্ধে আমি যাহা জানি বলিতেছি শুনুন।

    “প্রায় সাত মাস হইল, একদিন ক্লাসিক রঙ্গমঞ্চে মালতীকে অভিনয় করতে দেখি। মালতীর রূপলাবণ্য, তাহার হাবভাব, তাহার অঙ্গসৌষ্ঠব দেখিয়া তাহার সহিত আমার আলাপ করিবার ইচ্ছা হয়। থিয়েটার শেষ হইলে, আমি মালতীর সন্ধান লই এবং একখানি গাড়ি ভাড়া করিয়া তাহার অনুসরণ করি। সেই দিন আমাদের প্রথম আলাপ হয়। মালতীর রূপ যেমন, তাহার গুণও সেইরূপ। তাহার সদ্ব্যবহারে আমি এত আনন্দিত হইয়াছিলাম যে, সেই দিন হইতে আমি প্রত্যহই সেখানে যাতায়াত করিতে লাগিলাম। ছয়মাস এইরূপে অতীত হইল।”

    আমি মোহিতকুমারকে বাধা দিয়া হাসিতে হাসিতে জিজ্ঞাসা কহিলাম “আপনি মালতীকে কত করিয়া দিতেন? সে যখন বেশ্যাবৃত্তি করিয়া জীবিকা উপার্জ্জন করিয়া থাকে, তখন যে টাকার তাহার প্রয়োজন ছিল সে তো বলাই বাহুল্য। এই শুনিয়া মোহিতলাল বলিল, আমি তাহাকে শুধু টাকা-পয়সা, বিষয়-সম্পত্তি নহে এমনকি বিবাহ করিতে প্রস্তাব দিয়াছিলাম। এও বলিয়াছিলাম যে আমাদের ধর্ম্মে এই বিবাহ প্রচলিত আছে। কিন্তু তবুও কিছুতেই সে সম্মত হয় নাই। সাত আট দিন হইল, মালতীর সহিত তাহার বিবাদ হইয়াছিল। মালতী প্রাণপণে চেষ্টা করিল কিন্তু তাহার বিবাহে বৃদ্ধের মত ছিল না। অবশেষে পিতা পুত্রীতে মৌখিক খুব ঝগড়া হইল। আমাকেও দুই একটি কথা বলিতে ও শুনিতে হইল। আপনাকে অপমানিত বোধ করিয়া আমি আর মালতীর বাড়ী যাই নাই।

    আ। মালতী আপনার নিকট কোন অপরাধে অপরাধী নহে, আপনি বৃদ্ধের উপর রাগ করিয়া তাহার সহিত আলাপ বন্ধ করিলেন কেন?

    মো। না, মালতীর সহিত আমার প্রত্যহই দেখা হইত। আমি প্রত্যহই থিয়েটারে যাইতাম। সকল থিয়েটারের লোকের নিকট আমি পরিচিত। যেদিন সে যেখানে থাকিত, আমিও সেইদিন সেখানে গিয়া দেখা করিয়া আসিতাম। আ। বুধ, শনি ও রবি, সপ্তাহে এই তিনদিন মাত্র থিয়েটির হয়। আপনি প্রত্যহই মালতীকে কেমন করিয়া দেখিতে পাইতেন?

    মোহিতকুমার হাস্য করিলেন। বলিলেন “আপনি সম্প্রতি কলিকাতায় আসিয়াছেন, এখনও আপনার কোন বিষয় জানা হয় নাই। সপ্তাহে একদিন, বোধ হয় সোমবার ভিন্ন প্রতিদিনই থিয়েটার খোলা থাকে। সকল অভিনেতা ও অভিনেত্রীকেই সেখানে যাইতে হয়। বুধ শনি ও রবিবারে সাধারণের সমক্ষে অভিনয় হয়। অপর দিন শিক্ষাকার্য সমাধা হয়।

    আমি ও সকল কথা বেশ জানিতাম, কিন্তু যে কার্য্য উদ্ধার করিতে আসিয়াছি, তাহার জন্য আমাকে সত্য সত্যই ‘নেকা’সাজিতে হইল। আমি বলিলাম “আপনি অনেকদিন এখানে আছেন, কাজেই এখানকার অনেক বিষয় আপনার জানা আছে। যদি প্রত্যহই আপনার সহিত মালতীর দেখা হইয়া থাকে, তাহা হইলে আপনি কালও রাত্রে মালতীকে দেখিতে পাইয়াছিলেন?”

    মো। হাঁ, কালও মালতীর সহিত দেখা হইয়াছিল।

    আ। কোথায়? কোন্ থিয়েটারে?

    মো।ষ্টারে। থিয়েটারের কার্য্য শেষ হইলে আমরা তিন জনে একসঙ্গেই এক গাড়িতে গৃহে ফিরিয়াছিলাম। দেখিলাম, উভয়ের মনোমালিন্য আরও বৃদ্ধি পাইয়াছে। মালতী আবার বৃদ্ধের সহিত বিবাদ করিয়াছিল। বৃদ্ধ তাহাকে কলিকাতা হইতে অন্যত্র লইয়া যাইতে মনস্থ করিয়াছে। মালতী আমাকে এই সকল কথা চুপিচুপি বলিতেছিল, বৃদ্ধ তাহা শুনিতে পাইয়াছিল। তাহাতে বৃদ্ধ মালতীকে যৎপরোনাস্তি তিরস্কার করিল। মালতী সহ্য করিল না। সেও বৃদ্ধকে যথেষ্ট গালাগালি দিয়া বলিল “যদি নিজের মঙ্গল চাও, কোন কথা কহিও না। নতুবা জানিও, আমি না পারি এমন কাজ নাই। এতদিন কুসংসর্গে বেড়াইয়াও যে অধঃপাতে যাই নাই, সে কেবল আমার মনের বলে।” যতক্ষণ আমি তাহাদের সহিত ছিলাম, ততক্ষণ পিতা পুত্রীর বিবাদ চলিতে লাগিল। আমি আমার বাসায় পঁহুছিলাম, তাহারা উভয়ে সেই স্থান হইতে পদব্রজে চলিয়া গেল। আমি গাড়ি লইয়া যাইতে কহিলাম, কিন্তু তাহারা তাহা লইল না; রাগভরে উভয়েই প্রস্থান করিল।

    আ। আপনি বাড়ী ফিরিলেন কখন?

    মো। তখন রাত্রি প্রায় তিনটা। কিন্তু বাড়ীতে প্রবেশ করিয়া আমার মনে কেমন সন্দেহ হইল। ভাবিলাম, মালতীর সহিত বৃদ্ধের যেরূপ বিবাদ হইতেছে, তাহা শীঘ্র মিটিবে না? হয় ত বাড়ী গিয়া উভয়েরই ক্রোধবৃদ্ধি হইবে এবং শেষে হয় ত একটি গুরুতর কাণ্ড হইবে। এই মনে করিয়া আমি তখনই আবার বাসা হইতে বাহির হইলাম এবং শীঘ্রই তাহাদের নিকট যাইলাম। দেখিলাম, বৃদ্ধ অগ্রে অগ্রে বকিতে বকিতে যাইতেছে, মালতী গম্ভীর ভাবে তাহার অনুসরণ করিতেছে। আমি আর তাহাদিগকে দেখা দিলাম না-কিছুদূর থাকিয়া পশ্চাৎ পশ্চাৎ যাইতে লাগিলাম। হাড়কাটি গলির মোড়ে আসিলে বৃদ্ধ গলির ভিতর প্রবেশ করিল। মালতী সেদিকে গেল না। সে পথের পশ্চিমদিকের ফুটপাতে আসিল এবং নিকটস্থ একটি গলির ভিতরে প্রবেশ করিয়া সটান পশ্চিমদিকে যাইতে লাগিল। বৃদ্ধ একবার ফিরিয়াও দেখিল না।

    আমি ব্যগ্র ভাবে জিজ্ঞাসা করিলাম “মালতী কোথায় গেল?”

    মো। সমস্তই বলিতেছি, শুনুন। মালতীকে পশ্চিমদিকে যাইতে দেখিয়া আমারও সন্দেহ হইল। আমি ভাবিলাম, হয় ত মালতীর কোন গুপ্তবন্ধু আছে, সে তাহারই নিকট যাইতেছে। আমার কৌতূহল জন্মিল। আমি তাহাকে দেখা দিলাম না; কিছুদূরে থাকিয়া তাহার অনুসরণ করিতে লাগিলাম। রাত্রি তিনটা বাজিল, পথে জনমনুষ্য নাই। মধ্যে মধ্যে দুই একটি কুকুর চীৎকার করিয়া প্রকৃতির নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করিতেছে। আর এক একজন কনেষ্টবল অর্দ্ধনিমীলিতচক্ষে কোন একটি গ্যাস পোষ্টে হেলান দিয়া দণ্ডায়মান রহিয়াছে। মালতী কোনদিকে দৃপাত না করিয়া ক্রমাগত যাইতে লাগিল। আমিও তাহার পাছু পাছু ছুটিতে লাগিলাম। প্রায় অর্দ্ধঘণ্টি এইরূপ গমন করিয়া মালতী গঙ্গাতীরে উপস্থিত হইল। এখনও আমি তাহার উদ্দেশ্য বুঝিতে পারিলাম না। তাহার পর মালতী গঙ্গাজল স্পর্শ করিয়া গঙ্গায় নামিতে লাগিল। আমার সন্দেহ বৃদ্ধি হইল, ভাবিলাম, মালতী আত্মহত্যার জন্য গঙ্গাতীরে আসিয়াছে। আমি আর থাকিতে পারিলাম না। তখনই মালতীর পশ্চাতে যাইয়া দৃঢ়মুষ্টিতে তাহার হস্তধারণ করিয়া উপরে তুলিলাম। মালতী আমায় দেখিয়া চমকিত হইল। বলিল “তুমি এখানে?”

    মোহিতকুমারকে বাধা দিয়া আমি জিজ্ঞাসা করিলাম “মালতী কি জলমগ্ন হইয়াছিল।”

    মো। না, জলমগ্ন হয় নাই বটে, কিন্তু তাহার সমস্ত কাপড় ভিজিয়া গিয়াছিল।

    আ। তার পর?

    মো। তারপর আমি মালতীকে সমস্ত কথা বলিয়া তাহার আত্মহত্যার কারণ জিজ্ঞাসা করিলাম। সে বলিল, বৃদ্ধ তাহাকে যেরূপ উৎপীড়ন করিতে আরম্ভ করিয়াছে, তাহাতে তাহার মরণই মঙ্গল। সে প্রায়ই ভয় দেখায় যে, তাহাকে কলিকাতা হইতে অন্যত্র লইয়া যাইবে, কলিকাতায় তাহার অনেক বন্ধু জুটিয়াছে। যেভাবে মালতী শেষ কথাগুলি বলিল, তাহাতে স্পষ্টই বুঝিতে পারিলাম যে, তাহার বড় দুঃখ হইয়াছে। আমি তাহাকে অনেক করিয়া বুঝাইলাম, ও অবশেষে তাহাকে লইয়া হাড়কাটি গলিতে আসিলাম।

    আ। আপনি মালতীর বাড়ী গিয়াছিলেন?

    মো। না, তাহাকে গলির মোড়ে ছাড়িয়া দিয়া একস্থানে গোপনে দাঁড়াইয়া রহিলাম। দেখিলাম, মালতী বাড়ীর দরজায় পঁহুছিল। তখন আমি বাসায় ফিরিয়া আসিলাম। কাপড় ছাড়িয়া শয্যায় শুইতেছি, চারিটা বাজিল।

    চতুর্থ পরিচ্ছেদ

    মোহিতকুমারের কথা শুনিয়া ভাবিলাম, মালতীই বৃদ্ধকে হত্যা করিয়াছে। সে আত্মহত্যা করিয়া বৃদ্ধের হস্ত হইতে মুক্তিলাভের ইচ্ছা করিয়াছিল, কিন্তু তাহাতে সফল না হইয়া বৃদ্ধকেই হত্যা করিয়াছে। কিন্তু পরক্ষণে মনে হইল, মালতী একা এই কাৰ্য করিতে পারিবে না, নিশ্চয়ই তাহার সঙ্গে আর কোন লোক ছিল। সরকারী ডাক্তারের রিপোর্টে . প্রকাশ যে, বৃদ্ধের গলায় যে দাগ রহিয়াছে, তাহা কোন লোকের অঙ্গুলির চিহ্ন, বৃদ্ধ পাছে চীৎকার করে, এই আশঙ্কায় তাহার গলা টিপিয়া ধরা হইয়াছিল। যে গলা ধরিয়াছিল, সে কিছু আঘাত করে নাই। এ কাজ একজনের দ্বারা হওয়া অসম্ভব। নিশ্চয়ই দুই বা ততোধিক লোকের দ্বারা হইয়াছে। মালতী গেল কোথায়? যে রমণী কলিকাতায় থিয়েটারে অভিনয় করে, সে না পারে এমন কি কাজ আছে? মালতী যখন একজন অভিনেত্রী, তখন সে যে খুন করিতে পারিবে না, একথা মনে লাগে না। কিন্তু মালতী একা খুন করিতে পারে নাই, তাহার সঙ্গে আর কোন লোক ছিল। কে সেই লোক? বোধ হয় মোহিতকুমার। মোহিত কুমারের আন্তরিক ইচ্ছা, সে মালতীকে বিবাহ করে। কেবল বৃদ্ধের জন্যই তাহাদের এতদিন বিবাহ হয় নাই। বৃদ্ধই সেই বিবাহের একমাত্র প্রতিবন্ধক ছিল। মোহিত যে সে প্রতিবন্ধক দূর করিতে চেষ্টা করিবে না, এ কথা কে বলিতে পারে? মোহিত কুমারই কাল রাত্রে মালতীর সহিত ছিল। উভয়ে একসঙ্গে গঙ্গাতীর হইতে ফিরিয়া আসিয়াছিল। সে যে হাড়কাটি গলির মোড়ে মালতীকে ছাড়িয়া দিয়াছে বলিল, তাহা মিথ্যা কথা উভয়েই মালতীর বাড়ী গিয়াছিল এবং বৃদ্ধকে নিদ্রিত দেখিয়া মোহিতকুমার তাহার গলা চাপিয়া ধরে এবং মালতী ছোরার আঘাত করে। মোহিতকুমার এ ব্যাপারে নিশ্চয়ই লিপ্ত আছে। কিন্তু কি করিয়া জানা যায়? অথচ সে আমাকে মালতীর বাড়ীতে লইয়া যাইতে চাহিয়াছিল, সে যদি উহাকে হত্যাই করিবে, বা হত্যার কথা অবগত থাকিবে, তাহা হইলে সন্ধ্যার পর আমাকে তাহার নিকট লইয়া যাইতে চাহিবে কেন?

    পরদিবস মোহিতকুমার থানায় আনীত হইলেন। পূর্ব্বে তিনি আমার ছদ্মবেশ দেখিয়াছিলেন, সুতরাং আমায় চিনিতে পারিলেন না। আমি মোহিতকুমারকে জিজ্ঞাসা করিলাম “আপনারই নাম মোহিতকুমার?”

    মো। আজ্ঞে হাঁ। কোন অপরাধে আমি বন্দী হইলাম।

    আ। সে কথা পরে জানিতে পারিবেন। এখন বিরক্ত করিবেন না। যাহা জিজ্ঞাসা করি, তাহার যথার্থ উত্তর দিন। হাড়কাটি গলিতে মালতী বলিয়া একজন অভিনেত্রী বাস করিত। সে একজন বৃদ্ধকে খুন করিয়া পলায়ন করিয়াছে। মালতীর বাড়ীর চাকর বলে যে, আপনার সহিত মালতীর বিশেষ আলাপ ছিল। আপনি তাহার অনেক সংবাদ রাখেন। সেই জন্যই আপনাকে এখানে আনা হইয়াছে।

    মো। মালতীর সহিত আমার আলাপ ছিল বটে কিন্তু সে যে কোথায় পলায়ন করিয়াছে, তাহা আমি জানি না।

    আ। আপনার সহিত তাহার কাল দেখা হইয়াছিল?

    মোহিতকুমার কিছুক্ষণ কি ভাবিল। পরে বলিল “হাঁ, হইয়াছিল।”

    আ। কখন?

    মো। রাত্রে।

    আ। কোথায়?

    মো। ষ্টার থিয়েটারে।

    আ। কত রাত্রে আপনি চলিয়া আইসেন?

    মো। রাত্রি প্রায় দুইটা।

    আ। মালতী কি আপনার সঙ্গে বাড়ী গিয়াছিল?

    মো। হাঁ।

    আ। শুনিয়াছি, বৃদ্ধও থিয়েটারে কর্ম্ম করিত। সেও কি আপনাদের সঙ্গে আসিয়াছিল?

    মো। সে আমাদের সঙ্গে আসিতেছিল, আমার বাড়ী হ্যারিসন রোডে। ষ্টার থিয়েটার হইতে আসিবার সময় আগে আমি বাড়ী গিয়াছিলাম।

    আ। মালতী কোথায় গেল?

    মো। সে বাড়ীর দিকে গিয়াছিল।

    আ। ঠিক বলিতেছেন?

    মো। হাঁ।

    আমি দেখিলাম, মোহিতকুমার অনেক কথা গোপন করিলেন। কিন্তু সে সকল আমি আর উত্থাপন করিলাম না। জিজ্ঞাসা করিলাম “শুনিয়াছি, আপনি না কি মালতীকে বিবাহ করিতে চাহিয়াছিলেন?”

    ঈষৎ হাসিয়া মোহিতকুমার উত্তর করিলেন “আপনার অনুমান মিথ্যা নয়, কিন্তু বৃদ্ধের তাহাতে মত ছিল না; তাই বিবাহ হয় নাই।”

    আ। মালতীর আর কোন বন্ধু আছে?

    মো। কই, আমার ত মনে হয় না।

    আ। মালতী কি বৃদ্ধের কন্যা?

    মো। আজ্ঞা হাঁতবে ঔরসজাত নহে। বৃদ্ধ পালক পিতা মাত্ৰ।

    আ। মালতীর পৈতৃক বাড়ী কোথায় জানেন?

    মোহিতকুমার কিছুক্ষণ চিন্তা করিলেন। পরে বলিলেন, “কথায় কথায় একদিন মালতী বলিয়াছিল, তাহার পৈতৃক বাটী গ্রামে। সে না কি সেখানকার কোন ভদ্রঘরের কন্যা।”

    আমি মোহিতকুমারের শেষ কথা শুনিয়া আনন্দিত হইলাম। ভাবিলাম, মালতী নিশ্চয়ই সেইখানে পলায়ন করিয়াছে।

    মোহিতকুমারকে ছাড়িতে পারিলাম না। তাঁহাকে বন্দী করিয়া থানায় রাখিলাম। কিন্তু যাহাতে তাহার কোনপ্রকার কষ্ট না হয় তাহার বন্দোবস্ত করিয়া দিলাম।

    পঞ্চম পরিচ্ছেদ

    আহারাদি করিয়া গঙ্গাতীরে আসিলাম। একখানি নৌকা ভাড়া করিয়া মালতীর গ্রামাভিমুখে যাত্রা করিলাম। শীতকাল, গঙ্গা স্থির, কোন প্রকার বিপদের আশঙ্কা নাই।

    যখন নৌকায় আরোহণ করিলাম, তখন বেলা এগারটা বাজিয়া গিয়াছে। যখন সেই গ্রামের ঘাটে উপস্থিত হইলাম, তখন বেলা দুইটা। কলিকাতা হইতে ওই গ্রাম প্রায় বার মাইল; তিন ঘণ্টায় আমরা বার মাইল পথ অতিক্রম করিলাম। বলা বাহুল্য, আমি ছদ্মবেশেই খড়দহে গিয়াছিলাম। সেই গ্রামের সেই ভদ্রলোকের বাড়ী আমার জানা ছিল। পূর্ব্বে সেখানে আমি দুই একবার গিয়াছিলাম। ঘাট হইতে সেই বাড়ী প্রায় পনর মিনিটের পথ।

    নৌকা হইতে নামিয়া দেখিলাম, ঘাটে তখনও দুই একজন স্ত্রীলোক স্নান করিতেছে। তাহাদের কথাবার্তা শুনিয়া আমার মনে কেমন সন্দেহ হইল। ভাবিলাম, তাহাদের মুখেই মালতীর সন্ধান পাইব। কিন্তু পাছে তাহাদিগকে কোন কথা জিজ্ঞাসা করিলে তাহাদিগের ভয় হয়, কিম্বা তাহারা সেই সকল কথা গোপন করে, এই আশঙ্কায় কোন কথা জিজ্ঞাসা না করিয়া ঘাটের নিকটস্থ একটি বট-বৃক্ষতলে দণ্ডায়মান হইলাম। এরূপভাবে সেখানে দাঁড়াইয়া রহিলাম যে, ঘাটের স্ত্রীলোকেরা আমাকে দেখিতে না পায়, অথচ আমি তাহাদিগের সকল কথাই শুনিতে পাই। কিছুক্ষণ সেই বৃক্ষতলে দাঁড়াইয়া শুনিলাম, একজন আর একজনকে জিজ্ঞাসা করিল “কি গো মাসি! আজ তোমাদের এত বেলায় স্নান হচ্চে যে?”

    অপরা রমণী উত্তর করিল “আর মা! মনিবের মন যোগাতে আর পারি না। কোথা হতে এক হতভাগী কাল আমাদের বাড়ীতে এসেছে; তারই জন্যে আজ আমার এত বেলা।”

    প্র। সে কে মাসি?

    উত্তর। কে জানি নে মা, শুছি ত সে আমাদের মনিবেরই আত্মীয়। মেয়েটি বড় সুন্দরী — ভদ্রঘরের মেয়ে বলেই বোধ হয়। কিন্তু মা, আমি ত এতদিন ও বাড়ীতে চাকরী কচ্চি, কই, আর কখনও ত তাকে দেখি নে।

    প্র। আমিও সে কথা শুনেছি। তোমার বাবুর দূরসম্পর্কের এক ভাইয়ের এক মেয়ে ছিল। মেয়েটিকে কে না কি চুরি ক’রে নে গেছিলো। তার বয়স কত মাসি?

    উ। বয়স ষোল সতের বৎসর হবে।

    প্র। নাম কি?

    উ। গিন্নী ত তাকে প্রভাবতী বলেই ডাকছেন।

    প্র। এতদিন তিনি ছিলেন কোথায়?

    উ। শুছি কলকেতায়।

    প্র। সধবা না বিধবা?

    উ। তা জানি নে মা।

    প্র। ও মা, সে কি! মাথায় সিঁদুর আছে?

    উ। কই না।

    প্র। তবে সে বিধবা। তা এতদিন সে কার কাছে ছিল?

    উ। তা কেমন ক’রে বলবো। সে কথা ত শুনি নে।

    আমি অতি মনোযোগের সহিত এই সকল কথাবার্তা শ্রবণ করিলাম। ভাবিলাম, প্রভাবতী কে? মালতীরই নাম কি প্রভাবতী? নিশ্চয়ই হয় ত এতদিন সে প্রকৃত নাম গোপন করিয়াছিল।

    এইরূপ চিন্তা করিয়া আমি আর সেখানে দাঁড়াইলাম না। তখনই সেই বাড়ীর দিকে যাত্রা করিলাম।

    বাড়ীখানি প্রকাণ্ড। পূর্ব্বে অনেক পরিবার ছিল, সম্প্রতি অনেকেই মারা পড়িয়াছেন। আমি বাড়ীতে উপস্থিত হইবামাত্র একজন ভৃত্য আসিয়া জিজ্ঞাসিল “মহাশয়, কাহাকে খুঁজিতেছেন?”

    আমি উত্তর করিলাম “তোমার বাবুকে, তিনি কোথায়?”

    ভৃ। বড়বাবুকে ডাকিতেছেন? তিনি এইমাত্র উঠিয়াছেন, এতক্ষণ ঘুমাইতেছিলেন।

    আমি বাবুর নাম জানিতাম না। কৌশলে জানিয়া লইবার জন্য হাসিতে হাসিতে ভৃত্যকে জিজ্ঞাসা করিলাম “শীতকালেও তোমার বাবু দিনের বেলায় নিদ্ৰা যান?”

    ভৃত্যও হাসিয়া উত্তর করিল “আজ্ঞে হাঁ, যতই গোলযোগ হউক না কেন, ললিতবাবুকে দিনের বেলায় একবার চক্ষু মুদিতে হইবেই হইবে।”

    আমার মনোভিলাষ পূর্ণ হইল। জিজ্ঞাসা করিলাম “কেন বল দেখি, তিনি কি অধিক রাত্রি পর্য্যন্ত জাগিয়া থাকেন?”

    ভৃ। আজ্ঞে হাঁ, তিনি রাত্রি দুই প্রহরের পূর্ব্বে কোন দিন নিদ্রা যান না।

    আ। কেন? এত রাত্রি পর্য্যন্ত কি কায করেন?

    ভৃ। কায? কায আবার কি? রাত্রি দুপুর পর্য্যন্ত তিনি তাস খেলিয়া থাকেন। পাড়ার অনেকেই এখানে আসিয়া থাকেন।

    আ। খেলা আরম্ভ হয় কখন?

    ভৃ। রাত্রি আটটির সময়।

    আ। প্রতি দিনই ওই সময়ে?

    ভৃ। প্রায় বটে, তবে যেদিন বাবুর কোন কায কৰ্ম্ম থাকে, সেইদিন হয় খেলা বন্ধ থাকে, না হয় কিছু অধিক রাত্রে খেলা বসিয়া থাকে।

    আ। আজও বসিবে?

    ভৃ। আজ আরও সকাল সকাল বসিবার কথা আছে।

    আ। কেন?

    ভৃ। কাল রাত্রে খেলা হয নাই।

    আ। কারণ কি?

    ভৃ। অনেক দিন পরে এ বাড়ীর একটি মেয়ে কাল এখানে আসিয়াছে। সেই জন্যই বোধ হয় কাল রাত্রে খেলা বসে নাই।

    ভৃত্যের কথা শুনিয়া তখন আমার আর ললিতবাবুর সহিত দেখা করিবার ইচ্ছা হইল না। ভাবিলাম, কাল যখন খেলা বসে নাই, তখন নিশ্চয়ই আজ সেই বিষয়ে কোনরূপ কথোপকথন হইবে। যদি সেই সকল কথাবার্তা গোপনে শুনিতে পাওয়া যায়, তাহা হইলে কতকটি কাৰ্য্য সিদ্ধ হইতে পারে।

    এই মনে করিয়া আমি ভৃত্যকে জিজ্ঞাসা করিলাম “তোমার বাবু কখন বাহিরে আসিবেন বলিতে পার?” ভূ। আজ্ঞে হাঁ, তাঁহার বাহিরে আসিতে এখনও ঘণ্টাখানেক বিলম্ব আছে।

    আ। কেন, এত দেরি কেন?

    ভৃ। হস্ত মুখাদি প্রক্ষালন ও কিঞ্চিৎ জলযোগ না করিয়া তিনি বাহিরে আসেন না।

    আ। তবে আমি এখন বিদায় হই। সন্ধ্যার পূর্ব্বেই ফিরিয়া আসিব।

    ভৃত্য সম্মত হইল। আমিও সেখান হইতে বিদায় লইয়া পুনরায় গঙ্গাতীরে উপস্থিত হইলাম এবং এক নির্জ্জন স্থানে বসিয়া কত কি ভাবিতে লাগিলাম।

    ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ

    সন্ধ্যার কিছু পূর্ব্বে আমি আবার সেই বাড়ীর নিকটে গেলাম। দূর হইতে দেখিলাম, চারি পাঁচজন লোক বাড়ীর দরজায় দাঁড়াইয়া গল্প-গুজব করিতেছে।

    বাড়ীখানি দ্বিতল বটে, কিন্তু সম্মুখে খানিকটা একতলা। মধ্যে প্রকাণ্ড এক উঠান, তাহার চারিদিকে চক-মিলান। সদর দরজার উভয় পার্শ্বে দুইখানি করিয়া বড় ঘর। এই দুই ঘর বৈঠকখানা। সদর দরজার ঠিক সম্মুখে পূজার দালান। দালানের দুইদিকে অনেকগুলি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র প্রকোষ্ঠ। পর্ব্বোপলক্ষে যখন বাড়ীতে অনেক লোকের সমাগম হয়, সেই সময় ওই সকল ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ঘরে অনেকেই শয়ন করিয়া থাকে।

    বৈঠকখানা দুইটির মধ্যে দক্ষিণদিকেরটির সমস্ত জানালা খোলা ছিল, বাহির হইতে সমস্তই দেখা যাইতেছিল। কিছুক্ষণ পরে বাহিরের লোকগুলি একে একে ভিতরে গেল। আমি বুঝিলাম, এইবার খেলা আরম্ভ হইবে। আমার অনুমান মিথ্যা হইল না। লোকগুলি ভিতরে যাইবামাত্র আমি তখনই সেই ঘরের একটি জানালার পার্শ্বে এমন ভাবে দাঁড়াইয়া রহিলাম যে, ভিতরের কোন লোক আমাকে দেখিতে পাইল না।

    তাসের শব্দে ও কথাবার্তায় বুঝিলাম, খেলা আরম্ভ হইয়াছে। কিছুক্ষণ বেশ উৎসাহের সহিত খেলা চলিল, তাহার পর ঘরের ভিতর হইতে কে বলিয়া উঠিল “শিরীষ বাবু, আজ যে বড় জোর খেলছো, ব্যাপার কি?”

    যাহাকে প্রশ্ন করা হইল, তিনি উত্তর করিলেন “খেলবো না কেন? কাল খেলা বন্ধ ছিল, কাজেই আজ জোর বাড়িয়াছে।”

    কথার ভাবে বুঝিলাম, তিনিই শিরীষবাবু। তিনি উত্তর দিয়া বাড়ীর কর্তাকে জিজ্ঞাসা করিলেন “ললিতবাবু! কাল মজলিস বসালে না কেন?”

    তিনি উত্তর করিলেন “কাল সেই গোলযোগে পড়িয়াছিলাম, তাই খেলা বন্ধ গিয়াছে। তা না হইলে এ বাড়ীর খেলা কি কখনও বন্ধ হয়?”

    শিরীষবাবু উত্তর করিলেন “মেয়েটির খুব সাহস বটে।”

    ললিতবাবু সে কথার কোন উত্তর দিলেন না। শিরীষবাবু আবার বলিলেন “এরই মধ্যে পাড়ায় মহা হুলস্থুল পড়িয়া গিয়াছে। অনেকে অনেক কথা কহিতেছে। যা’ বল ভাই, কলিকাতায় এ সব ব্যাপার নিয়ে এত গোলযোগ হয় না। যত উৎপাত এই পল্লীগ্রামে।”

    উত্তর হইল, “গোলমাল করিয়া আমার কে কি করিবে? বেশী উৎপীড়ন করে, মেয়েটিকে দূর করিয়া দিলেই চলিবে।”

    শিরীষবাবু উত্তর করিলেন “কেন ভাই, তোমার বড় ভাইয়ের মেয়ে বলিয়া কি তাহাকে বাড়ীতে স্থান দিবে না? সে কি! লোকনিন্দায় তোমার ক্ষতিবৃদ্ধি কি? হাজার হউক আপনার; সে যখন বলিতেছে যে, তোমার বাড়ীতে দাসীবৃত্তি করিয়া নিজের ভরণপোষণ করিবে, তখন তোমার আপত্তি কি?”

    ঠিক এই সময়ে আমিও বাড়ীর ভিতর গিয়া সেই বৈঠকখানায় প্রবেশ করতঃ জিজ্ঞাসা করিলাম “ললিতবাবু এখানে আছেন?”

    এক অতি সম্ভ্রান্ত যুবক, বয়স প্রায় ত্রিশ বৎসর, দেখিতে গৌরবর্ণ, দোহারা, মুখশ্রী অতি সুন্দর, বলিয়া উঠিলেন “আমারই নাম ললিত। আপনার কি প্রয়োজন বলুন?”

    আমি বলিলাম “আপনাকে একবার নিৰ্জ্জনে আসিতে হইবে। গোপনীয় কথা।”

    ললিতবাবু তখনই আমার সহিত সেই ঘর হইতে বাহিরে আসিলেন। আর একটি ছোট ঘরের দরজা খুলিয়া ভিতরে প্রবেশ করিলেন। ঘরখানি বেশ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। ঘরের ভিতরে তিন চারিটি বেতের মোড়া। আমি তাহারই একটায় বসিয়া পড়িলাম। ললিতবাবুও আমার সম্মুখে বসিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন “বলুন মহাশয়, কি কথা?”

    আমি গম্ভীর ভাবে উত্তর করিলাম “আপনারা এতক্ষণ যে মেয়েটির কথা কহিতেছিলেন, সে একজনকে খুন করিয়া পলাইয়া আসিয়াছে। আমার দৃঢ়বিশ্বাস, তাহাকে ধরিবার জন্য পুলিস নিশ্চয়ই আপনার বাড়ীতে আসিবে। তাই বলিতেছি, তাহাকে এখনই বাড়ী হইতে দূর করিয়া দিন। নতুবা আপনার পর্যন্ত বিপদ হইবে।”

    আমার কথা শুনিয়া ললিতবাবু স্তম্ভিত হইলেন। বলিলেন “বলেন কি মহাশয়! প্রভা খুন করিয়াছে? বাঙ্গালীর ঘরের মেয়ে, খুন করিল কেমন করিয়া? আপনার নাম কি?”

    আ। আমার নাম বিমলাচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়।

    ল। কোথা হইতে আসা হইয়াছে?

    আ। কলিকাতা হইতে।

    ল। প্রভাকে আপনি চিনিলেন কিরূপে?

    আ। সে আমাদেরই থিয়েটারে কর্ম্ম করিত, যেদিন সে অভিনয় করিত, সেইদিন আমাদের যথেষ্ট লাভ হইত। এই জন্যই তাহাকে বাঁচাইবার আমাদের এত ইচ্ছা।

    ললিতবাবু কিছুক্ষণ চিন্তা করিলেন। পরে বলিলেন, “প্রভা যে থিয়েটারে কর্ম্ম করিত, এ কথা এখানে রাষ্ট্র করিবেন না। তাহা হইলে এখানকার লোকে আমায় একঘরে করিবে। প্রভা আমাদের বাড়ীতে রহিয়াছে বলিয়া পাড়ায় মহা হুলস্থুল পড়িয়া গিয়াছে।”

    আমি ঈষৎ হাসিয়া বলিলাম “আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন, আমার কথা আর কেহ জানিতে পারিবে না। কিন্তু আমি যাহা বলিলাম, তাহার কি করিতেছেন?”

    ললিতবাবু আবার কি ভাবিলেন। বলিলেন “প্রভা সামান্য রমণী; সে যে কেন লোককে খুন করিবে, ইহা আমাদের মনে লাগিতেছে না। তবে সে হঠাৎ এখানে আসিল কেন, এ কথা জিজ্ঞাস্য বটে। আমি একবার প্রভাকে জিজ্ঞাসা করিয়া আসি। ভাল কথা, প্রভার সহিত যখন আপনার পরিচয় আছে, তখন তাহাকে আপনার নিকট ডাকিয়া আনিতেছি, আপনিই তাহাকে জিজ্ঞাসা করুন।”

    আ। আমি থিয়েটারের স্বত্বাধিকারী মাত্র। আমার সহিত কোন অভিনেতা বা অভিনেত্রীর আলাপ নাই। প্রভাকে আমি চিনি বটে, কিন্তু সে আমাকে দেখে নাই। তাহা হইলেও যদি আপনার আপত্তি না থাকে, তাহা হইলে একবার তাহাকে এই ঘরে ডাকিয়া আনুন।

    ল। যে রমণী কলিকাতায় থিয়েটার করিত, তাহার লজ্জাই বা কি আর ভয়ই বা কি? আমার কোন আপত্তি নাই। আমি এখনই তাহাকে ডাকিয়া আনিতেছি।

    আ। প্রভা আপনার কে?

    ল। জ্ঞাতি ভ্রাতুষ্কন্যা। প্রভার পিতার মৃত্যুর পর সে আমারই গলগ্রহ হয়। কিছুদিন পরে আমার একটি কন্যার সহিত তাহার বিবাদ হয়, সেই বিবাদের জন্য আমার স্ত্রী প্রভাকে বাড়ী হইতে দূর করিয়া দিতে ইচ্ছা করে। প্রভার বয়স যখন এক বৎসর, তখন তাহার মাতার মৃত্যু হয়। যখন তাহার পিতার মৃত্যু হয়, তখন তাহার বয়স সাত বৎসর। বালিকাকে এ বাড়ী হইতে দূর করিয়া দিব জানিতে পারিয়া, পাড়ার এক ভদ্রলোক দয়া করিয়া তাহার ভরণ-পোষণ-ভার গ্রহণ করে। সেই অবধি প্রভা তাহার সহিত নানাস্থানে ঘুরিয়া বেড়াইতেছিল। কবে সে কলিকাতায় যায়, কবেই বা সে নাচ গান শিক্ষা করে, তাহা আমি জানি না। ভাবিয়াছিলাম, এতদিনে সে মারা পড়িয়াছে। কিন্তু কাল হঠাৎ সে এখানে আসিয়াছে। জিজ্ঞাসা করিলে সে বলিল, বৃদ্ধ তাহার অভিভাবক মরিয়া গিয়াছে, অন্য আশ্রয় অভাবে তাহাকে আমার বাড়ীতে আসিতে হইয়াছে।

    আ। বৃদ্ধ মারা পড়ে নাই, বৃদ্ধকে প্রভাই খুন করিয়াছে। এখন আপনি একবার তাহাকে এখানে আসিতে বলুন। আপনার সাক্ষাতেই আমি তাহাকে সকল কথা জিজ্ঞাসা করিতেছি।

    ল। প্রভাই যে খুন করিয়াছে তাহার কিছু প্রমাণ আছে?

    আ। না থাকিলে এত কষ্ট করিয়া এখানে আসিব কেন?

    ললিতবাবু আর দ্বিরুক্তি না করিয়া সেখান হইতে চলিয়া গেলেন এবং কিছুক্ষণ পরেই এক সুন্দরী ষোড়শী যুবতীর সহিত পুনরায় আমার নিকট আগমন করিলেন। দেখিলাম, প্রভার দেহে একখানিও গহনা নাই। তাহার পরিধানে একখানা মোটা সাদা ধুতি দেখিয়াই তাহাকে বিধবা বলিয়া বোধ হইল।

    ঘরে প্রবেশ করিয়া প্রভা আমার দিকে দৃষ্টিপাত করিল, কিন্তু চিনিতে পারিল না। আমি তাহার মনোগত অভিপ্রায় বুঝিতে পারিয়া জিজ্ঞাসা করিলাম, “শুনিয়াছি, তোমার প্রকৃত নাম প্রভাবতী। তবে এতদিন মালতী বলিয়া থিয়েটারে পরিচয় দিতে কেন?”

    প্রভা ওরফে মালতী উত্তর করিল “সে কেবল আমার পিতার ইচ্ছায়? তিনি আমাকে যেরূপ শিখাইয়াছিলেন, আমি সেইরূপই করিয়াছি।”

    আ। কোন্ দোষে তোমার পিতাকে হত্যা করিলে?

    প্র। আমি? না মহাশয়, আপনি ভুল বুঝিয়াছেন। আমি পিতৃহত্যা করি নাই।

    আ। বৃদ্ধ তোমার পালক পিতা মাত্র।

    প্র। আমার যখন সাত বৎসর বয়স, তখন আমার পিতা মারা যান। তাহার পরই বৃদ্ধ আমাকে গ্রহণ করে। আমার জন্মদাতা পিতা অপেক্ষা পালক পিতাই আমার যাবতীয় সৌভাগ্যের মূল। সুতরাং তাহাকে হত্যা করিলে আমারই ক্ষতি। আমি নিজের ক্ষতি স্বীকার করিতে যাইব কেন?

    আমি মোহিতকুমারের মুখ হইতে যাহা যাহা শুনিয়াছিলাম, সমস্তই প্রকাশ করিলাম। প্রভাবতী সমস্তই স্বীকার করিল, কিন্তু সে যে পিতৃহত্যা করিয়াছে, এ কথা স্বীকার করিল না।

    যেভাবে প্রভাবতী অস্বীকার করিল, তাহাতে আমার স্পষ্টই বোধ হইল, সে নিদোষী। একবার মনে করিলাম, তাহাকে স্থানীয় পুলিসের তত্ত্বাবধানে রাখিয়া যাই, কিন্তু আমি একাকী বলিয়া সেই সময় সেই কার্য্য করিতে সাহসী হইলাম না।

    আমি ললিতকুমারকে জিজ্ঞাসা করিলাম “যে বৃদ্ধ প্রভার ভরণ-পোষণ, ভার গ্রহণ করিয়াছিল, তাহার বাড়ী কোথায় ছিল জানেন?”

    ল। এই পাড়াতেই তাঁহার বাড়ী ছিল। একটা গোলযোগে পড়িয়া তিনি কিছুদিন নিরুদ্দেশ হইয়াছিলেন। যখন প্রভার পিতার মৃত্যু হয়, সেই সময় তিনি পুনরায় ফিরিয়া আইসেন। প্রভার পিতা আমার জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা। তাঁহার সহিত আমার সদ্ভাব ছিল না। তাঁহার মৃত্যুর পর লোকে আমাকে প্রভার ভার লইতে অনুরোধ করেন, কিন্তু আমি তাহাতে সম্মত হই নাই। প্রভার পিতার যাহা কিছু ছিল, সমস্তই তিনি পূর্ব্বে বিক্রয় করিয়াছিলেন। তাঁহার মৃত্যুর পর এমন সঙ্গতি ছিল না যে, প্রভা শ্রাদ্ধাদি সম্পন্ন করে। প্রতিবেশীগণ চাঁদা তুলিয়া সে কায সমাধা করিয়াছিল। আমাকে প্রভার ভরণ-পোষণে অনিচ্ছুক দেখিয়া, তাহারাই ওই ব্যক্তির হস্তে তাহাকে সমর্পণ করে। তিনিও আহ্লাদের সহিত প্রভাকে গ্রহণ করেন এবং তাহাকে লইয়া এখান হইতে চলিয়া যান। সেই অবধি আর তাহার কোন সংবাদ পাই নাই। আজ আপনার মুখে শুনিতেছি, তাহাকে কে হত্যা করিয়াছে।

    ললিতবাবুর কথা শুনিয়া আমি জিজ্ঞাসা করিলাম “তাহার প্রকৃত নাম কি? কলিকাতায় তিনি মহাদেব শৰ্ম্মা বা মহাদেব ওস্তাজ বলিয়া পরিচিত।”

    ললিতবাবু উত্তর করিলেন “তাঁহার নাম আশুতোষ মুখোপাধ্যায়।”

    আ। আপনি যে গোলযোগের কথা বলিলেন, সেটি কি আপনার জানা আছে?

    ল। আজ্ঞে না, ঠিক জানি না।

    আ। যা জানেন, শুনিই না; তাহাতে আপনাদের কন্যারই মঙ্গল। যদি কোন উপায়ে প্রকৃত হত্যাকারী গ্রেপ্তার হয়, তাহা হইলে প্রভার কোনরূপ ক্ষতি হইবে না। নতুবা পুলিস উহাকে যৎপরোনাস্তি উৎপীড়ন করিবে।

    ল। যাহা শুনিয়াছি, তাহা মুখে বলিলেও পাপ হয়। শুনিয়াছি, তিনি না কি গুরুকন্যা হরণ করিয়াছিলেন। আ। সে কি! ছি ছি! সত্যই এ কথা শুনিলে পাপ হয়। ঘটনা কিরূপ হইয়াছিল শুনিয়াছেন?

    ল! আশুতোষবাবু কোন সময়ে গুরুগৃহে গমন করিয়াছিলেন। সেখানেই এই ঘটনা হইয়াছিল। কিছুদিন সেখানে বাস করিয়া গুরুকন্যাকে লইয়া সেখান হইতে পলায়ন করেন।

    আ। সে কথা পুলিসকে জানান হইয়াছিল?

    ল। বোধ হয় না; তাহা হইলে অনেকেই এ কথা জানিতে পারিত। এখন আমি ভিন্ন সে কথা আর কেহ জানে না!

    আ। তাঁহার সহিত কি আপনাদের কোন সম্পর্ক ছিল?

    ল। ছিল; তিনি আমার দূর-সম্পর্কীয় পিসতুতো ভাই ছিলেন। তাঁহার মাতা আমার দূর-সম্পর্কের পিসি-মা। আ। তাঁহার গুরুর বাড়ী কোথায় জানেন?

    ল। আমাদেরই এক জ্ঞাতি তাঁহার গুরু। তাঁহার নিবাস কলিকাতায়, বোধ হয় গোঁসাই গলিতে।

    আ। নাম কি?

    ল। হরমোহন গোস্বামী।

    আমি তখন প্রভাবতীর দিকে চাহিয়া জিজ্ঞাসা করিলাম “তুমি বলিতেছ, রাত্রি দুইটার পর একবার বাড়ী গিয়াছিলাম। সত্য করিয়া বল দেখি, তখন তোমার পালক পিতার অবস্থা কিরূপ?”

    প্রভাবতী কাঁদিয়া ফেলিল। কাঁদিতে কাঁদিতে অস্পষ্ট ভাবে বলিল “ সে কথা মনে হইলেও আমার কেমন আতঙ্ক হয়। তিনি উপুড় হইয়া পড়িয়া রহিয়াছন। তাঁহার পৃষ্ঠ দিয়া রক্তস্রোত নির্গত হইতেছে। বোধ হইল, তখনও তাহার জীবন আছে। আমি একবার ভিতরে গেলাম। দেখিলাম, আমার অনুমান মিথ্যা। তিনি পূর্ব্বেই ইহলীলা সংবরণ করিয়াছেন। আমার সেখানে থাকিতে ভয় হইল। ভাবিলাম, এখনই পুলিস আমাকে হত্যাকারী বলিয়া গ্রেপ্তার করিবে; আমি পলায়ন করিলাম। ধীরে ধীরে গঙ্গাতীরে আসিয়া একখানি নৌকা ভাড়া করিলাম। বলিলাম, হুগলী যাইব। যখন হুগলী ঘাটে পঁহুছিলাম, তখন বেলা একটা। সেখানে যাহার নিকট যাইব মনে করিয়াছিলাম, তিনি বাড়ীতে ছিলেন না। কাজেই এখানে আসিলাম।

    প্রভাবতীর সমস্ত কথা আমি সত্য বলিয়া বিশ্বাস করিলাম। ভাবিলাম, কলিকাতায় হরমোহন গোস্বামীর সন্ধান না পাইলে এ রহস্য ভেদ করা সহজ নহে।

    সপ্তম পরিচ্ছেদ

    যখন কলিকাতায় ফিরিয়া আসিলাম, তখন রাত্রি দশটা বাজিয়া গিয়াছে। আহারাদি শেষ করিয়া ভাবিলাম, বৃদ্ধকে কে খুন করিল? রহস্য ক্রমেই জটিল হইয়া উঠিতেছে। প্রথমে মনে করিয়াছিলাম, মোহিতকুমারই হত্যাকারী। কিন্তু তাঁহার কথাবার্তায় আমার সে সন্দেহ দূরীভূত হইল। মোহিতকে নিরপরাধী বলিয়াই বোধ হইল। তাহার পর ভাবিলাম, মালতী খুন করিয়াছে। কিন্তু সে যেভাবে সমস্ত কথা বলিল, তাহাতে তাহার উপর আর সন্দেহ হয় না। বিশেষতঃ মালতী একা কখনই হত্যা করিতে পারে না। নিশ্চয়ই তাহার কোন সহকারী ছিল। কিন্তু আজ তাহার কথা শুনিয়া আমার দৃঢ়বিশ্বাস হইয়াছে যে, সেও নিদোষী। তবে কে এ কাজ করিল? ললিতবাবুর মুখে যাহা শুনিলাম, তাহাতে হরমোহন গোস্বামী তাহার শত্রু ছিলেন। হয় তিনি নিজে, না হয় তাঁহার কোন লোক বৃদ্ধকে হত্যা করিয়াছে বলিয়া বোধ হয়। কিন্তু তাহাই বা কেমন করিয়া সম্ভব হইতে পারে? আশুতোষের বয়স পঞ্চাশ বৎসরের কম নহে। সে যখন গুরুকন্যা অপহরণ করিয়াছিল, তখন তাহার যৌবনাবস্থা। সে আজ দশ এগার বৎসর। যদি হরমোহন গোস্বামীর লোক বৃদ্ধকে খুন করিয়া থাকে, তাহা হইলে এতদিন ওই কাৰ্য্য হয় না কেন? বৃদ্ধ এতদিন নানাস্থানী হইয়া ঘুরিয়া বেড়াইতেছিল, একস্থানে এক বৎসরের অধিক বাস করে নাই। সুতরাং তাহার সন্ধান পাওয়াও কঠিন ব্যাপার।

    এইরূপ নানাপ্রকার চিন্তা করিয়া হরমোহন গোস্বামীকেই হত্যাকারী বলিয়া সাব্যস্ত করিলাম, এবং পরদিনই তাঁহাকে একেবারে গ্রেপ্তার করিতে মনস্থ করিলাম।

    পরদিন প্রাতঃকালে ছদ্মবেশ ধারণ করিয়া গোঁসাই গলির সন্ধান লইলাম। অগ্রে নিমু গোস্বামীর গলিতে গেলাম, কিন্তু সেখানে হরমোহন গোঁসাই-এর কোন সন্ধান পাইলাম না। অনেকক্ষণ ভাবিয়া চিন্তিয়া স্থির করিলাম, গোঁসাই পাড়া নামে আরও একটি পাড়া আছে। অগত্যা সেইদিকে গমন করিলাম।

    গোঁসাই পাড়ায় উপস্থিত হইয়া হরমোহন গোস্বামীর বাড়ীর সন্ধান পাইলাম এবং অবিলম্বে সেইখানে গমন করিলাম।

    যখন হরমোহন গোস্বামীর বাড়ীতে পঁহুছিলাম, তখন বেলা প্রায় নয়টা। গোস্বামীর বাড়ীখানি প্রকাণ্ড ও দ্বিতল। বাড়ীতে অনেকগুলি লোকজন। জিজ্ঞাসা করিয়া জানিলাম, হরমোহন সম্প্রতি মারা পড়িয়াছেন, তাঁহার জ্যেষ্ঠ পুত্র রামচন্দ্রই এখন বাড়ীর কর্তা। তাঁহারা তিন ভাই– রাম, লক্ষ্মণ ও ভরত।

    বাড়ীতে প্রবেশ করিয়া একজন ভৃত্যকে রামচন্দ্রকে ডাকিয়া দিতে বলিলাম। ভৃত্য আমার বেশ দেখিয়া আমাকে বড়লোক মনে করিল এবং আমায় বসিতে বলিয়া বাবুকে ডাকিতে গেল।

    কিছুক্ষণ পরে একজন প্রৌঢ় বয়স্ক ব্যক্তির সহিত ভৃত্য ফিরিয়া আসিল এবং আমাকে দেখাইয়া দিয়া বলিল “এই বাবু আপনাকে কি জন্য ডাকিতেছিলেন?”

    ভৃত্য প্রস্থান করিলে আমি জিজ্ঞাসা করিলাম “আপনারই নাম রামচন্দ্র বাবু?”

    তিনি সম্মতিসূচক উত্তর দিবার পর আমি আবার জিজ্ঞাসা করিলাম “আপনারই পিতার নাম হরমোহন গোস্বামী? “ রামবাবু ঘাড় নাড়িয়া উত্তর দিলেন। আমি আবার জিজ্ঞাসা করিলাম “আপনারা কয় ভাই? পিতা মাতা বর্তমান?” রা। পিতা সম্প্রতি স্বর্গারোহণ করিয়াছেন; মাতা বর্ত্তমান। আমরা তিন ভাই।

    আ। আর দুই ভাই কোথায়?

    রা। মধ্যম লক্ষ্মণ এখানে আছেন। তাঁহার শরীর অসুস্থ। কনিষ্ঠ শিষ্য-বাড়ী গিয়াছেন।

    আ। কতদিন হইল তিনি শিষ্য-বাড়ী গিয়াছেন?

    রা। আজ দুইদিন।

    আ। কোথায়? রা। হুগলীতে।

    আ। কবে আসিবেন?

    রা। ঠিক জানি না। সম্ভবত এখন আসিবে না।

    যেভাবে তিনি আমার শেষ কথার উত্তর দিলে, তাহাতে আমার সন্দেহ বৃদ্ধি হইল। আমি বিদায় লইব মনে করিতেছি, এমন সময় রামচন্দ্রবাবু রাগত ভাবে আমাকে জিজ্ঞাসা করিলেন “আপনি কে? কোথা হইতে কি অভিপ্রায়ে এখানে আসিয়াছেন?”

    আমি বিনীত ভাবে উত্তর করিলাম “উপযুক্ত গুরুর সন্ধানে এখানে আসিয়াছি। শুনিয়াছি, আপনার কনিষ্ঠের অনেকগুলি শিষ্য আছে। তাঁহার শাস্ত্রজ্ঞানও যথেষ্ট। তাঁহাকে গুরু করিবার অভিপ্রায়েই আমার এখানে আগমন। যখন তিনি এখানে নাই, তখন আর বৃথা সময় নষ্ট করি কেন। তিনি আসিলে বহুবাজার বিমলাচরণবাবুর বাড়ীতে পত্র লিখিলেই আমি পুনরায় এখানে আসিব।”

    আমার কথায় তাঁহার বিশ্বাস হইল। তিনি বলিলেন “ভরত শীঘ্র ফিরিবে; আপনি কাল এমন সময়ে আসিবেন, হয় ত দেখা হইতে পারে। আমি আজই তাহার নিকট লোক পাঠাইব।”

    আমার সন্দেহ আরও বৃদ্ধি হইল। ভাবিলাম, ভরত নিশ্চয়ই কোথাও লুকাইয়া আছে। আমি তখন আর কোন কথা কহিলাম না। পরদিন বেলা নয়টির সময় পুনরায় দেখা করিব বলিয়া তাঁহার নিকট বিদায় লইলাম। কিন্তু থানায় ফিরিয়া আসিলাম না। রামবাবুর বাড়ীর ঠিক সম্মুখে একটি ভাঙ্গা বাড়ী ছিল, আমি সেই বাড়ীতে আশ্রয় লইলাম।

    সে বাড়ীতে কোন লোকজন ছিল না। জনকয়েক রাজমিস্ত্রী কাজ করিতেছিল। আমায় ভদ্রলোক ও বড় লোক মনে করিয়া তাহারা আমায় অনেক কথা জিজ্ঞাসা করিল। কিন্তু আমি তাহাদিগকে সে সকল কথার প্রকৃত উত্তর দিতে পারিলাম না। কৌশলে কথায় কথায় জিজ্ঞাসা করিলাম, তাহারা ভরত গোস্বামীকে চেনে কি না?

    একজন মিস্ত্রী বলিয়া উঠিল “কে, ছোট গোঁসাই? এইমাত্র তিনি বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিলেন।”

    আ। আজ কখন তিনি বাটীর বাহির হইয়াছিলেন?

    রা। আমরা আসিয়া কার্য্য আরম্ভ করিতেছি, একজন ভয়ানক আকৃতি লোক আসিয়া তাঁহাকে ডাকিয়া লইয়া যায়।

    আমিও কিছু পূৰ্ব্বে একজনকে সেই বাড়ীতে প্রবেশ করিতে দেখিয়াছিলাম। রাজমিস্ত্রীরা নিশ্চয়ই তাঁহাকে ভরত গোঁসাই বলিয়া স্থির করিয়াছে। এই মনে করিয়া আমি এমন স্থানে দাঁড়াইয়া রহিলাম, যেখান হইতে গোস্বামী-বাড়ী বেশ দেখা যাইতেছিল। অথচ অপর লোক আমাকে দেখিতে পায় নাই।

    প্রায় একঘণ্টা পরে একজন গুণ্ডা সেই বাড়ীর সম্মুখে আসিয়া ‘ভরতবাবু’’ভরতবাবু’ বলিয়া চীৎকার করিতে লাগিল। রাজমিস্ত্রীরা আমাকে ডাকিয়া তাহাকে দেখাইয়া দিল। বলিল “এই লোকই প্রাতঃকালে ছোট গোঁসাইকে ডাকিয়া লইয়া গিয়াছিল।”

    গুণ্ডা আমার পরিচিত। সে না পারে এমন কার্য্য অতি বিরল। যখন ভরতের সহিত তাহার এত সদ্ভাব, তখন ভরত যে এই হত্যাব্যাপারে লিপ্ত আছে, সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নাই।

    কিছুক্ষণ পরে বাড়ীর ভিতর হইতে একজন বাহির হইল এবং সেই নবাগত গুণ্ডার সহিত কি কথা কহিয়া যেমন বাড়ীর ভিতর গমন করিতে উদ্যত হইবে, অমনই আমি এক লম্ফে সেই বাড়ী হইতে বহির্গত হইলাম এবং সেই বাবুর হস্তধারণ করিয়া বলিলাম “ভরতবাবু! একবার বাহিরে আসুন, আপনার সহিত আমার গোটা কতক কথা আছে।” আমার কথা শুনিয়া এবং আমাকে তাহার হাত ধরিতে দেখিয়া ভরতের মুখ শুকাইয়া গেল। সে দ্বিরুক্তি না করিয়া মন্ত্রমুগ্ধবৎ আমার পশ্চাৎ পশ্চাৎ বাহিরে আসিল।

    ইত্যবসরে ঘাটীর পাহারাওয়ালা সেইখানে উপস্থিত হইল। সে দূর হইতে আমায় দেখিতে পাইয়া নমস্কার করিল। আমি ইঙ্গিত করিয়া তাহাকে নিকটে ডাকিলাম এবং আমার সঙ্গী ভরত বাবুকে গ্রেপ্তার করিতে বলিলাম।

    ভরত উগ্রমূর্তি ধারণ করিল। সে উচ্চৈঃস্বরে ‘আমেদ’ ‘আমেদ’ বলিয়া চীৎকার করিতে লাগিল।

    যে বিকটাকার গুণ্ডা এতক্ষণ ভরতের সহিত কথা কহিতেছিল, সে ভরতের ডাক শুনিয়া তখনই ফিরিয়া আসিল এবং আমাকে দেখিবামাত্র এক সুদীর্ঘ সেলাম করিল।

    ইত্যবসরে ঘাটীর পাহারাওয়ালা ভরতবাবুকে গ্রেপ্তার করিল। সে আমেদকে নিকটবর্ত্তী দেখিয়া বলপ্রকাশ করিতে উদ্যত হইয়াছিল বটে, কিন্তু আমেদ বলিল “বাবু! যাঁহার হাতে পড়িয়াছেন, তিনি সামান্য লোক নহেন। অন্য কোন লোক হইলে এত ভয় করিতাম না, কিন্তু ইনি বড় সহজ পাত্র নন্। এখন আত্মসমর্পণ করা ভিন্ন আর উপায়ান্তর নাই।”

    আমি তখন আমেদকে সমস্ত কথা জিজ্ঞাসা করিলাম। সে বলিল “আপনার অনুমান সত্য। বৃদ্ধ আশুতোষকে ইনিই হত্যা করিয়াছেন।”

    আমি। আর তুমি?

    আমেদ। আমিও সাহায্য করিয়াছি। যখন আপনার হাতে এই খুনের সন্ধান ভার পড়িয়াছে, তখন আর আমাদের নিস্তার নাই।

    আমি তখন ভরতকে জিজ্ঞাসা করিলাম, “বৃদ্ধকে হত্যা করিবার কারণ কি?”

    ভ। আশুতোষ আমার ভগ্নীকে লইয়া পলায়ন করিয়াছিল। শুনিয়াছি, আমার ভগ্নীর অনিচ্ছাসত্ত্বেও সে তাহাকে বলপূর্ব্বক চুরি করিয়া লইয়া যায়। এ কথা আমরা পূর্ব্বে জানিতাম না। জানিলে বহু দিন পূর্ব্বেই তাহার সর্ব্বনাশ করিতাম। পিতার মৃত্যুকালে তিনি আমাদিগকে সমস্ত ব্যাপার বলেন, এবং যাহাতে সেই বৃদ্ধ যথোচিত শাস্তি পায়, তাহার জন্য আমাদিগকে শপথ করিতে অনুরোধ করেন। পিতার মৃত্যুশয্যায় তাঁহার পদস্পর্শ করিয়া আমি বৃদ্ধের প্রাণসংহার করিব বলিয়া শপথ করিয়াছিলাম। এতদিন বৃদ্ধের সন্ধান করিতে পারি নাই। চারিদিকে লোক পাঠাইলাম, কিন্তু সকলেই নিষ্ফল হইয়া ফিরিয়া আসিল। কেবল এই আমেদ তাহার প্রকৃত সন্ধান দিয়াছিল। বৃদ্ধের সন্ধান পাইয়া আমার প্রতিহিংসানল প্রজ্বলিত হইল। আমি আমেদের সহিত পরামর্শ করিলাম। সেও আমার মতে মত দিল। অবশেষে সেইদিন যখন সে থিয়েটার হইতে ফিরিয়া আসিতেছিল, তখন আমরা দুইজনে তাহার পাছু পাছু আসিতে লাগিলাম। দেখিলাম, তাহার কন্যার সহিত তাহার বিবাদ হইল। বৃদ্ধ একাই বাড়ীতে প্রবেশ করিল। তাহার কন্যা কোথায় চলিয়া গেল। আমরাও সুযোগ পাইলাম। কিছুক্ষণ পরে উভয়ে বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিলাম। দেখিলাম, বৃদ্ধ অপরদিকে মুখ করিয়া কি ভাবিতেছে। আমেদ এমন করিয়া তাহার গলা চাপিয়া ধরিল যে, সে আর কথা কহিতে পারিল না। ইত্যবসরে আমি তাহার পৃষ্ঠে এমন এক ছোরার আঘাত করিলাম যে, সে তখনই ছট্‌ফট্ করিয়া প্রাণত্যাগ করিল। আমরা কার্য্য সিদ্ধ করিয়া সেখান হইতে পলায়ন করিলাম। জানিতাম না, আপনি আমাদিগকে ধরিতে পারিবেন। কিন্তু আমার সে ধারণা ভুল হইল। আমি বন্দী হইলাম।

    আর কোন কথা জিজ্ঞাসা না করিয়া আমি একখানি গাড়ি ভাড়া করিলাম এবং ভরত, আমেদও সেই কনেষ্টবলকে সঙ্গে লইয়া প্রায় একটার সময় থানায় ফিরিয়া আসিলাম।

    ভরত ও আমেদ সমস্ত কথাই স্বীকার করিল। কিন্তু এই মোকদ্দমার অপর বিশেষ প্রমাণ না থাকায় আমেদকে মহারাণীর সাক্ষী করা হয়। প্রধান আদালতের বিচারে ভরতচন্দ্র দোষী সাব্যস্ত হন। কিন্তু জজ বাহাদুর চরম দণ্ডে দণ্ডিত না করিয়া তাহাকে চির নির্বাসিত করেন।

    সম্পূর্ণ

    [ ভাদ্র, ১৩১৫ ]

    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26 27 28 29 30 31 32 33 34 35 36 37 38 39 40 41 42 43 44 45 46 47 48 49 50
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleআরব জাতির ইতিহাস – ফিলিপ কে. হিট্টি (অনুবাদ : প্রিন্সিপাল ইবরাহীম খাঁ)
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    দারোগার দপ্তর ৩ – প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়

    September 22, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    দারোগার দপ্তর ৩ – প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়

    September 22, 2025
    Our Picks

    দারোগার দপ্তর ৩ – প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়

    September 22, 2025

    আরব জাতির ইতিহাস – ফিলিপ কে. হিট্টি (অনুবাদ : প্রিন্সিপাল ইবরাহীম খাঁ)

    September 22, 2025

    নিউ মুন – স্টেফিন মেয়ার

    September 22, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    • Sign Up
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }

    Sign In or Register

    Welcome Back!

    Login below or Register Now.

    Lost password?

    Register Now!

    Already registered? Login.

    A password will be e-mailed to you.