Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    দারোগার দপ্তর ৩ – প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়

    September 22, 2025

    আরব জাতির ইতিহাস – ফিলিপ কে. হিট্টি (অনুবাদ : প্রিন্সিপাল ইবরাহীম খাঁ)

    September 22, 2025

    নিউ মুন – স্টেফিন মেয়ার

    September 22, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • 🔖
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    Subscribe
    সাইন ইন
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    দারোগার দপ্তর ৩ – প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়

    প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায় এক পাতা গল্প1897 Mins Read0

    প্রেমের খেলা বা খুনে প্রেমিক

    প্রেমের খেলা বা খুনে প্রেমিক 

    প্রথম পরিচ্ছেদ

    বেলা নয়টার পর সাহেবের পত্র পাইলাম। পাঠ করিয়া দেখিলাম, ঠঠনের কোন মুচির বাড়ীতে খুন হইয়াছে—আমাকে তাহারই অনুসন্ধান করিতে হইবে। পত্রপাঠ গাত্রোত্থান করিলাম এবং পদব্রজেই গন্তব্য স্থানের অভিমুখে গমন করিতে লাগিলাম।

    যখন আমি পথের বাহির হইলাম, তখন বেলা প্রায় দশটা। পথের উভয় ফুটপাথ দিয়া কেরাণী ও পুস্তক হস্তে বালকের দল হাসিতে হাসিতে কতই গল্পগুজব করিতে করিতে চলিয়াছে। পথের মধ্য দিয়া শকটশ্রেণী বড় বড় কেরাণী ও উকীলবাবুদিগকে লইয়া ক্ৰমাগত উর্দ্ধশ্বাসে ছুটিয়াছে। পথপার্শ্বস্থ পুস্তক ও ষ্টেসনারির দোকানগুলি বালকবৃন্দে পূৰ্ণ হইয়াছে। আমি অতি কষ্টে সেই জনতা ভেদ করিয়া রামামুচীর বাড়ী অন্বেষণ করিতে করিতে অগ্রসর হইতে লাগিলাম।

    রামার বাড়ী খুঁজিয়া লইতে আমাকে অধিক কষ্ট পাইতে হইল না। রামা একজন প্রসিদ্ধ দোকানদার, প্রায় দশ বৎসর সে ঠঠনের ভিতর একখানি চটীজুতার দোকান করিয়া বেশ সুখ্যাতির সহিত কার্য করিতেছিল। পাড়া-প্রতিবেশিগণের মধ্যে সকলেই রামাকে চেনে।

    রামার বাড়ীখানি খোলার। জমীদারের নিকট হইতে জমী খাজনা লইয়া রামা নিজব্যয়ে সেই খোলার ঘরখানি প্রস্তুত করিয়া সুখে-স্বচ্ছন্দে বাস করিতেছিল। সহসা তাহার বাড়ীতে এই নূতন বিপদ উপস্থিত

    বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিয়া দেখিলাম, তিনখানি ঘর। তাহারই একখানি ঘরে একজন কনেষ্টবল আমায় লইয়া গেল। ঘরখানির অবস্থা অতি শোচনীয়। ভিতরে কোন আসবাব নাই বলিলেও অত্যুক্তি হয় না। একখানি ভাঙ্গা তক্তাপোষের উপর কতকগুলি ছিন্ন কাঁথা ও একখানি মাদুর। ঘরের একপার্শ্বে একটা কাষ্ঠের পিলসুজের উপর একটা মাটীর প্রদীপ, একটা ভাঙ্গা ঘটী ও একখানা ছোট থাল ও একটা বাঁশের আল্লা ভিন্ন সে ঘরে আর কিছুই ছিল না। ঘরের আড়কাঠ হইতে একগাছি মোটা রজ্জু ঝুলিতেছিল এবং তাহারই একপ্রান্ত রামার বড় স্ত্রীর গলদেশে সংলগ্ন ছিল। বাহ্যিক দেখিলেই বোধ হয়, সে উদ্বন্ধনে প্রাণত্যাগ করিয়াছে।

    স্থানীয় থানা হইতে একজন জমাদার ও কয়েকজন কনেষ্টবল তথায় গমন করিয়াছিল বটে, কিন্তু তাহারা সাহস করিয়া সেই লাস স্পর্শ করিতে পারে নাই। আমি অগ্রে গলরজ্জু কাটিয়া ফেলিলাম, পরে সেই মৃতদেহ পরীক্ষা করিতে লাগিলাম। একজন কনেষ্টবলকে তখনই একজন ডাক্তারের নিকট সেই সংবাদ দিতে পাঠাইয়া দিলাম। বলিয়া দিলাম, তাঁহাকে যেন সঙ্গে করিয়া আনা হয়।

    লাসটি পরীক্ষা করিয়া দেখিলাম, প্রায় দশ ঘণ্টা পূর্ব্বে তাহার মৃত্যু হইয়াছে। কিন্তু বাহ্যিক অবস্থা দেখিয়া বোধ হইল না যে, সে উদ্বন্ধনে প্রাণত্যাগ করিয়াছে। তখন কাহাকেও কোন কথা না বলিয়া ঘরের চারিদিক একবার ভাল করিয়া অনুসন্ধান করিলাম। পরে রামকে ডাকিয়া জিজ্ঞাসা করিলাম, “কখন তুমি এ ব্যাপার জানিতে পারিয়াছ?”

    রামের বয়স প্রায় চল্লিশ বৎসর। তাহাকে দেখিতে ঘোর কৃষ্ণবর্ণ, শীর্ণ ও খর্ব্বাকৃতি। তাহার মুখশ্রী নিতান্ত মন্দ নয়, কিন্তু তাহার সম্মুখের দুইটি দত্ত প্রায়ই বাহির হইয়া থাকে বলিয়া তাহাকে সচরাচর অতি কদাকার দেখায়। রামচন্দ্র আমার সম্মুখে দাঁড়াইয়া হাতযোড় করিল। পরে অতি বিনীত ভাবে বলিল “হুজুর! আজ সকালে বাড়ীতে আসিয়াই এই কাণ্ড দেখিয়াছি। কাল বাড়ীতে ছিলাম না—অতি প্রত্যূষেই আমার ছোট স্ত্রীকে লইয়া বেলঘরে পঞ্চাননতলায় ‘গিয়াছিলাম। সমস্ত দিন সেখানে থাকিয়া ভোর রাত্রে সেখান হইতে রওনা হই এবং বেলা প্রায় আটটার সময় বাড়ীতে উপস্থিত হই।”

    আমি জিজ্ঞাসা করিলাম “তোমার কি দুই বিবাহ?”

    রা। আজ্ঞে হ্যাঁ; যে গলায় দড়ী দিয়াছে, সেই আমার বড় স্ত্রী—নাম কালী।

    আ। গলায় দড়ী দিবার কারণ কিছু জান?

    রা। আজ্ঞে না হুজুর। আমি তাহার কিছুই জানি না।

    আ। ইহার পূর্ব্বে কোনদিন কি তোমাদের মধ্যে বিবাদ হইয়াছিল?

    রা। আজ্ঞে না।

    আ। তোমার দুই স্ত্রীতে সদ্ভাব কেমন?

    রা। সদ্ভাব ত বেশ!

    আ। কখনও কলহ হইয়াছিল?

    রা। হাঁ, প্রায় মাসখানেক পূৰ্ব্বে।

    আ। তার পর?

    রা। তাহার পর আবার মিল হইয়াছিল।

    আ। কাল ভোরে কোথায় গিয়াছিলে?

    রা। আজ্ঞে বেলঘরে।

    আ। কেন?

    রা। বেলঘরের পঞ্চানন নামে এক ঠাকুর আছেন। বন্ধ্যা স্ত্রীলোকেরা সেখানে গিয়া ওই দেবতার নিকট পুত্র কামনা করিয়া থাকে। আমার ছোট স্ত্রীর পুত্র হইবার বয়স হইলেও এখনও কোন সন্তানের মুখ দেখে নাই। এই জন্য তাহারই অনুরোধে আমি কাল কেবল তাহাকে লইয়াই সেখানে গিয়াছিলাম।

    আ। তোমার বড় স্ত্রী তোমাদের সঙ্গে যাইতে ইচ্ছা করে নাই?

    রা। তাহার একটি পুত্র আছে। সে প্রথমে আমাদিগের সহিত যাইতে চাহে নাই, কিন্তু পরে যাইবার জন্য বড় ব্যস্ত হইয়াছিল। আমি অনেক বুঝাইয়াছিলাম, কিন্তু কিছুতেই তাহাকে নিবৃত্ত করিতে পারি নাই।

    আ। তবে তোমার পুত্রটি কোথায় ছিল?

    রা। সে আমাদের সঙ্গেই গিয়াছিল।

    আ। তোমার বড় স্ত্রী বিশ্বাস করিয়া তাহাকে যে ছাড়িয়া দিয়াছিল?

    রা। আজ্ঞে হাঁ—তাহার সে বিশ্বাস যথেষ্ট ছিল। পুত্রটি তাহার গর্ভধারিণীর অপেক্ষা আমার ছোট স্ত্রীকেই অধিক ভালবাসে এবং প্রায়ই তাহার নিকট থাকে।

    আ। আজ বাড়ী ফিরিয়াই কি এ কাণ্ড দেখিতে পাইয়াছিলে?

    রা। আজ্ঞে হাঁ—আটটার সময় বাড়ীর দরজায় আসিয়া দেখি, তখনও দরজা বন্ধ। কালী প্রায়ই রাত্রিশেষে শয্যা ত্যাগ করিয়া থাকে। আজ তাহার অন্যথা দেখিয়া

    বাধা দিয়া আমি জিজ্ঞাসিলাম “তুমি কেমন করিয়া জানিলে যে সে শয্যা ত্যাগ করে নাই? তুমি ত পথে দাঁড়াইয়াছিলে?”

    রাম তখনই উত্তর করিল “রৌদ্র উঠিবার আগেই সে রোজ সদর দরজা খুলিত। আজ তাহা হয় নাই দেখিয়া সন্দেহ হইল। আমি চীৎকার করিয়া কালীকে ডাকিতে লাগিলাম। পুত্রটিও মা, মা, বলিয়া চীৎকার করিয়া ডাকিতে লাগিল। কিন্তু কিছুতেই কালীর সাড়া পাইলাম না। ক্রমে বেলা হইতে লাগিল দেখিয়া আমি পার্শ্বের ডাক্তারখানা হইতে কম্পাউণ্ডার বাবুকে ডাকিয়া আনিলাম। তিনিও সন্দেহ করিলেন এবং আমাকে দরজা ভাঙ্গিয়া ভিতরে প্রবেশ করিতে পরামর্শ দিলেন। আমি তাহাই করিলাম। ভিতরে প্রবেশ করিয়া তাড়াতাড়ি যেমন এই ঘরের ভিতর যাইতে উদ্যত হইব, অমনি কালীকে গলায় দড়ী দিয়া এই আড়কাটায় ঝুলিতে দেখিলাম। আমি হতবুদ্ধি হইয়া গেলাম। পরে পাঁচজনের সহিত পরামর্শ করিয়া পুলিসে সংবাদ দিলাম!

    রামের কথা শুনিয়া আমি জিজ্ঞাসা করিলাম “কম্পাউণ্ডার বাবু কোথায়? একবার তাঁহাকে এখানে ডাকিয়া আন দেখি।”

    দ্বিরুক্তি না করিয়া রাম তখনই সেখান হইতে চলিয়া গেল এবং কিছুক্ষণ পরেই একজন হৃষ্টপুষ্ট বলিষ্ঠ লোককে লইয়া পুনরায় আমার নিকট আসিল। আমি নবাগত ব্যক্তিকে জিজাসা করিলাম “আপনিই কি এই পার্শ্বের ডিপেন্সারিতে কম্পাউণ্ডারের কার্য্য করিয়া থাকেন?”

    আমার কথায় লোকটি যেন কেমন হইয়া গেলেন; সহসা আমার প্রশ্নের উত্তর করিতে পারিলেন না। তাঁহার আকৃতি দেখিয়াই আমার কেমন সন্দেহ হইল। তাঁহাকে দেখিতে দিব্য গৌরকান্তি, স্থূলকায় ও অত্যন্ত বলিষ্ঠ। তাঁহার বয়স প্রায় ত্রিশ বৎসর। তাঁহাকে দেখিয়া নব্য যুবক বলিয়াই বোধ হইল। তাঁহার পরিধানে একখানা বিলাতী পালা কালাপেড়ে ধুতি, গায়ে একটা লংক্লথের কামিজ, মাথায় জসান সিতি, পায়ে একজোড়া ঠঠনের চটীজুতা।

    কিছুক্ষণ পরে তিনি বলিলেন “আজ্ঞে হাঁ—আমিই এই ডিসপেন্সারিতে কম্পাউণ্ডারের কর্ম্ম করিয়া থাকি।”

    আ। আপনার নাম?

    ক। মনমোহন দাস।

    আ। নিবাস?

    ক। এই ডিস্পেন্সারিতেই আজ-কাল বাস করিতেছি।

    আ। কতদিন এখানে কার্য্য করিতেছেন?

    ক। আজ্ঞে তিন বৎসর।

    আ। তাঁহার পূর্ব্বে কোথায় বাস করিতেন?

    ক। সিলায় বাসায় আমার মাসীর বাড়ীতে।

    আ। আপনি এই ব্যাপারে কিছু জানেন?

    মনমোহন স্তম্ভিত হইলেন। সহসা তাঁহার মুখ দিয়া বাক্য নিঃসরণ হইল না। কিন্তু পরক্ষণেই আত্মসংবরণ করিয়া বলিলেন “আজ বেলা আটটার সময় রামচন্দ্র বাড়ীতে ফিরিয়া যখন ভয়ানক চীৎকার করিতেছিল, তখন আমি জানিতে পারিলাম যে, রামের বাড়ীর দরজা খোলা হয় নাই। এ বাড়ীর সদর দরজা অতি ভোরেই খোলা হয়। কিন্তু আজ তাহা হয় নাই দেখিয়া আমার সন্দেহ হইল। আমি রামকে দরজা ভাঙ্গিয়া ভিতরে প্রবেশ করিতে পরামর্শ দিলাম। রাম আমার কথামত কার্য্য করিল এবং ভিতরে গিয়া এই ব্যাপার অবলোকন করিল। আমরা তখনই উহাকে পুলিসে সংবাদ দিতে পাঠাইয়া দিলাম। সঙ্গে সঙ্গে এই জমাদার ও এই সকল কনেষ্টবল এখানে আসিয়া উপস্থিত হইল।”

    দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ

    কম্পাউণ্ডার বাবুর কথা শেষ হইতে না হইতে ডাক্তারবাবু তথায় উপস্থিত হইলেন। তিনি প্রথমেই লাস পরীক্ষা করিয়া বলিলেন “শ্বাসরোধ হইয়া ইহার মৃত্যু হইয়াছে। ইহার চক্ষু ও মুখের অবস্থা দেখিলে স্পষ্টই জানিতে পারা যায় যে, যদিও শ্বাসরুদ্ধ হওয়ায় ইহার মৃত্যু হইয়াছে, তথাপি ইহা আত্মহত্যা নহে। যদি গলায় দড়ী দিয়াই এই স্ত্রীলোক মারা পড়িত, তাহা হইলে ইহার গলদেশের দড়ীর গাঁইট যেস্থানে আছে ওই স্থানে থাকিত না, জিহ্বা বাহির হইয়া পড়িত, হস্তদ্বয়ের বৃদ্ধ অঙ্গুলি ঈষৎ বক্রতা ধারণ করিত, যখন তাহা হয় নাই, তখন ইহা কখনও আত্মহত্যা হইতে পারে না। ইহার ভিতর নিশ্চয়ই কোন গূঢ় রহস্য আছে সন্দেহ নাই।”

    ডাক্তারবাবুর কথা শুনিয়া আমি আন্তরিক সন্তুষ্ট হইলাম। কেন না, আমিও ইতিপূর্ব্বে ওইরূপই স্থির করিয়াছিলাম; কিন্তু কোন উত্তর করিলাম না। আমার ঠিক পার্শ্বে মনমোহন বাবু দাঁড়াইয়াছিলেন। ডাক্তারবাবুর কথায় তিনি হাসিয়া বলিলেন “তবে কাল রাত্রে রামের ঘরে ভূত ঢুকিয়াছিল। সেই-ই রামের বড় স্ত্রীকে হত্যা করিয়া এরূপে ঝুলাইয়া রাখিয়া গিয়াছে।”

    কথাটা যেভাবে তিনি বলিলেন, তাহাতে আমার ভয়ানক রাগ হইল। ডাক্তারবাবু রাগে থরথর করিয়া কাঁপিতে লাগিলেন। কিছুক্ষণ পরে কিছু শান্ত হইয়া বলিলেন “আমি আপনাকে কোন কথা বলি নাই এবং আপনার নিকট উত্তর পাইবারও আশা করি নাই। এখানে থানার ইন্সপেক্টর বাবু স্বয়ং উপস্থিত আছেন। আমার কথার তিনি উত্তর দিতে পারিতেন।”

    এই বলিয়া তিনি মনমোহনের দিকে চাহিলেন। পরে জিজ্ঞাসা করিলেন “আপনার নাম কি? নিবাসই বা কোথায়? “ মনমোহন আন্তরিক ভীত হইলেন কিন্তু মৌখিক সাহস দেখাইয়া বলিলেন “আমার নাম মনমোহন, এই পার্শ্বের ডিপেন্সারিতে কম্পাউণ্ডারের কার্য্য করিয়া থাকি।”

    ডা। এই স্ত্রীলোকের সহিত আপনার কোন সম্বন্ধ আছে?

    ম। আজ্ঞে না—আমি কায়স্থ, রামচন্দ্র মুচী।

    ডা। তবে আপনি উপযাচক হইয়া কথা কহিলেন কেন?

    মনমোহন ছাড়িবার পাত্র নহেন। তিনি গম্ভীর ভাবে উত্তর করিলেন ‘আপনাদের কথা অতি আশ্চৰ্য্য বলিয়া বোধ হইল, সেই জন্যই হঠাৎ মুখ দিয়া ওই কথা বাহির হইয়া গিয়াছে। যদি কোন অপরাধ হইয়া থাকে, ক্ষমা করিবেন।”

    ডাক্তারবাবু আর কোন কথা কহিলেন না দেখিয়া আমিও চুপ করিয়া রহিলাম।

    আর কিছুক্ষণ পরে ডাক্তারবাবু প্রস্থান করিলেন। আমি তখন সেই গৃহ হইতে অপর লোকদিগকে বাহির করিয়া দিয়া তন্ন তন্ন করিয়া পরীক্ষা করিলাম। চারিদিক দেখিবার পর একখানি রুমাল আমার দৃষ্টি গোচর হইল। রুমালখানি দেখিয়াই কেমন সন্দেহ হইল। আমি তুলিয়া লইলাম। হস্তে উত্তোলন করিবা মাত্র একটা আরকের গন্ধ পাইলাম। আঘ্রাণ করিয়া দেখিলাম, উহা হইতে ক্লোরফরমের গন্ধ বাহির হইতেছে। আমি আশ্চর্যান্বিত হইলাম। রুমালখানি দেখিয়া মূল্যবান বলিয়া বোধ হইল। যাহার ঘরে সামান্য একখানি বড় থালা নাই, দিনান্তে যাহার পূর্ণমাত্রায় আহার জোটে না, সে সেই দামী রুমাল কোথায় পাইল? সে যাহা হউক, রুমালখানি পকেটে রাখিয়া আমি সেই ঘরের মেঝেটি ভাল করিয়া পরীক্ষা করিলাম; মেঝের সমস্ত চিহ্নগুলি পরিদর্শন করিলাম। পরে ঘরের বাহিরে আসিয়া রামচন্দ্রকে এক নিভৃতস্থানে লইয়া গেলাম এবং জিজ্ঞাসা করিলাম “তোমার বড় স্ত্রীর চরিত্র কেমন?”

    রামচন্দ্র আমার কথায় যেন আশ্চৰ্য্যান্বিত হইল। সে কিছুক্ষণ কোন উত্তর না করিয়া আমার মুখের দিকে চাহিয়া রহিল। পরে অতি ধীরে ধীরে বলিল, “আজ্ঞে আমি যতদূর জানি, তাহাতে তাহার চরিত্র খুব ভাল বলিয়াই বোধ হয়।”

    “তবে তুমি আবার বিবাহ করিলে কেন?”

    রা। কালী বড় মুখরা। সে সদাই আমার সহিত কলহ করিত। এক একদিন এমন কথা বলিত যে, আমি বাড়ীতে আহার করিতাম না। অবশেষে একদিন রাগ করিয়া বাড়ী হইতে চলিয়া যাই এবং একমাস পরে বিবাহ করিয়া বাড়ীতে প্রত্যাগমন করি।

    আ। তাহার পূর্ব্বেই তোমার পুত্র হইয়াছিল?

    রা। আজ্ঞে হাঁ—আমি যখন দ্বিতীয়বার বিবাহ করি, তখন আমার পুত্রের বয়স একবৎসর মাত্র।

    আ। এ বাড়ীতে কি অপর কোন পুরুষ-মানুষ আসিয়া থাকে?

    রা। আজ্ঞে না।

    আমি আর কোন কথা জিজ্ঞাসা করিলাম না। একজন কনেষ্টবলকে একখানি গাড়ি ভাড়া করিয়া আনিতে বলিলাম। গাড়ি আনীত হইলে সেই মৃতদেহ হাসপাতালে পাঠাইয়া দিলাম, আমিও থানায় ফিরিলাম।

    তৃতীয় পরিচ্ছেদ

    থানায় ফিরিয়া আসিয়া কিছুক্ষণ নিৰ্জ্জনে বসিয়া চিন্তা করিলাম। কে এই কাণ্ড করিল? কালী যদি সত্য সত্যই আত্মহত্যা করিত, তবে তাহার ঘরের দরজা নিশ্চয়ই ভিতর হইতে আবদ্ধ থাকিত, তাহার আকৃতিরও যথেষ্ট পরিবর্তন হইত! যে রুমালখানি সেই ঘর হইতে পাইয়াছিলাম, তাহাতে ক্লোরফরমের গন্ধ পাইয়া আমি স্পষ্টই বুঝিতে পারিতেছি যে, কোন লোক সেই রুমালের সাহায্যে কালীকে হতচেতন করিয়াছিল। পরে তাহার গলা টিপিয়াই হউক কিম্বা গলায় ফাঁস দিয়াই হউক হত্যা করিয়াছে। অজ্ঞান অবস্থায় ছিল বলিয়া সে ছট্‌ফট্ করে নাই, তাহার চোখ মুখও সেরূপ বিকৃত হয় নাই।

    এই প্রকার চিন্তা করিয়া স্থির করিলাম, কালী আত্মহত্যা করে নাই,—তাহাকে কোন লোক হত্যা করিয়াছে। কে এমন কাজ করিল? কালীর স্বামীর মুখে শুনিয়াছি, তাহার চরিত্রদোষ ছিল না, না থাকিবারই কথা। যাহাদের চরিত্রে কোন দোষ থাকে, যে রমণী কুলটা, সে স্বামীর সহিত বিবাদ করে না, স্বামীকে সে কখনও রাগায় না। যতক্ষণ স্বামীর কাছে থাকে, সে ততক্ষণই তাহার তোষামোদ করে। পাছে বিবাদ হয়, পাছে তাহার স্বামীর মনে কোনপ্রকার সন্দেহ হয়, সেই ভয়ে সে সদাই সশঙ্কিত থাকে, কখনও স্বামীর সম্মুখে অবাধ্যতাচরণ করে না, কিন্তু কালী যখন তাহার স্বামীর সহিত প্রায়ই কলহ করিত, তখন সে কখনও কুলটা নহে। যদি তাহাই হয়, তবে সে ঘরে রুমাল আসিল কোথা হইতে? রুমালখানি যদি সাধারণ হইত, তাহা হইলেও কোন কথা ছিল না। কিন্তু এখানির দাম ন্যূনকল্পে চারি আনার কম নহে। যাহারা উদরান্নের সংস্থান করিতে পারে না, যাহারা সকল দিন উদরপূর্ণ করিয়া আহার করিতে পায় না, তাহারা এমন রুমাল পাইল কোথা হইতে? নিশ্চয়ই গত রাত্রে কোন লোক ফেলিয়া গিয়াছে। আর সেই লোকই যে হত্যাকারী, সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নাই। কিন্তু কেমন করিয়া তাহাকে গ্রেপ্তার করিব, কেমন করিয়া তাহার সন্ধান পাইব, কোন্ সূত্র ধরিয়া কার্য্যারম্ভ করিব, তাহার কিছু স্থির করিতে পারিলাম না।

    আরও কিছুক্ষণ এইরূপ চিন্তা করিলাম। পরে মনে হইল, রুমালখানিতে যদি রজকের কোন চিহ্ন থাকে, তাহা হইলে সহজেই হত্যকারীর সন্ধান পাওয়া যাইতে পারে। এইরূপ উপায়ে অনেকবার সফল হইয়াছি ভাবিয়া আমি সত্বর পকেট হইতে রুমালখানি বাহির করিয়া খুলিয়া ফেলিলাম। পরে ভাল করিয়া চারিদিক পরীক্ষা করিলাম, কিন্তু কোন দাগ দেখিতে পাইলাম না। রুমালখানি যে একবারও রজকগৃহে প্রেরিত হয় নাই, তাহা বুঝিতে পারিলাম। সুতরাং উহাদ্বারা কোন উপকার হইল না।

    রামচন্দ্রের সেই ঘরের মেঝে দেখিয়া বোধ হইল, গতরাত্রে তিন জন লোক ওই ঘরের ভিতর ছিল। আমি বিশেষ লক্ষ্য করিয়া তিনজনের পায়ের দাগ দেখিয়াছিলাম। রামচন্দ্রের মুখে শুনিলাম, সে বাড়ীতে ছিল না; তাহার পুত্র ও ছোট স্ত্রী তাহার সঙ্গে গিয়াছিল। কালী একাই বাড়ীতে ছিল। নিশ্চয়ই সে তাহার অবকাশ সময় ঘরের ভিতরে ছিল।

    ঘরের মেঝেয় কেবল তাহার পায়ের দাগ থাকাই উচিত। আর দুইজনের পদচিহ্ন কেমন করিয়া আসিল? যে সকল লোক সেদিন ঘরের ভিতর গিয়াছিল, তাহারা দ্বারের নিকটেই ছিল, অধিক দূরে যায় নাই। যে যে স্থানে অপর দাগগুলি দেখা গিয়াছিল, তাহারা কেহই ততদূর যায় নাই। সে দাগগুলি যে, তাহাদের পায়ের নয়, তাহা নিশ্চয়। তবে দাগগুলি সেদিনের না হইয়া অপর কোন দিনের হইতে পারে। হয়ত তাহার পর হইতে ঘরের সেস্থানে আর কেহ যায় নাই। সেই জন্য দাগগুলি এখনও রহিয়াছে।

    এই স্থির করিয়া আমি তখনই রামকে ডাকিয়া আনিবার জন্য কনেষ্টবল পাঠাইয়া দিলাম। কনেষ্টবল প্রস্থান করিলে পর, সহসা সেই কম্পাউণ্ডারের কথা আমার মনে পড়িল! তাঁহার বেশ ভূষা ও কথাবার্তায় ভদ্র বলিয়া বোধ হইল বটে কিন্তু আকৃতি যেন ডাকাতের মত। তাঁহাকে সহসা দেখিলেই ভয় হইয়া থাকে। নামটি মন্দ নয়,— মনমোহন রামের সহিত তাঁহার বেশ সদ্ভাব দেখিলাম, রামের অন্দরমহল পর্যন্ত তাঁহার যাতায়াত আছে; বোধ হয়, মেয়েদের সহিত আলাপও আছে।

    এইরূপ চিন্তা করিয়া একবার তাঁহার সহিত সাক্ষাৎ করিতে মনস্থ করিলাম। কিন্তু ওই বেশে গমন করিলে কোন ফল হইবে না, কাজেই ছদ্মবেশে যাইতে হইবে। কিন্তু কি প্রকার বেশে যাইলে তাঁহার সহিত ভাল রকম কথাবার্তার সুবিধা হওয়া সম্ভব? কেমন করিয়াই বা তাহার নিকট হইতে প্রকৃত কথা বাহির করিব, তাহা সহজে স্থির করিতে পারিলাম না।

    চতুর্থ পরিচ্ছেদ

    একঘণ্টার মধ্যেই কনেষ্টবল রামকে লইয়া আসিল। কিছুক্ষণ বিশ্রাম করিলে পর আমি রামকে বলিলাম “দেখ রাম! তোমার স্ত্রী আত্মহত্যা করে নাই। নিশ্চয়ই কোন লোক খুন করিয়া তাহার দেহকে ওইরূপে ঝুলাইয়া রাখিয়া পলায়ন করিয়াছে।

    রামচন্দ্র আমার কথা শুনিয়া শিহরিয়া উঠিল। সহসা তাহার মুখ দিয়া কোন কথা বাহির হইল না। সে আমার মুখের দিকে হাঁ করিয়া চাহিয়া রহিল; বোধ হয় আমার কথা বিশ্বাস করিল না। আমি তখন পুনরায় বলিলাম “কি বাপু, আমার কথা বুঝিতে পারিতেছ না? কোন লোক তোঁমার স্ত্রীকে অজ্ঞান করিয়া তাহার গলা টিপিয়া হত্যা করতঃ শেষে তাহার গলে রজ্জু বাঁধিয়া ওইরূপে ঝুলাইয়া রাখিয়া গিয়াছে।”

    রামচন্দ্র এবার বুঝিতে পারিল। সে জিজ্ঞাসা করিল “কে এমন কাজ করিল হুজুর? আমি ত কাহারও কোন অপরাধ করি নাই।”

    এই বলিতে বলিতে তাহার চক্ষুদ্বয় অশ্রুপূর্ণ হইয়া আসিল, আবেগে কণ্ঠ রোধ হইল, সে নীরবে কাঁদিতে লাগিল দেখিয়া আমি বলিলাম “কেন বাপু কাঁদিয়া সময় নষ্ট কর। যে জন্য তোমায় ডাকিয়াছি শোন। যে ঘরে লাস পাওয়া গিয়াছে, সে ঘরটি কে ব্যবহার করিত?”

    রামচন্দ্র যোড়হস্তে উত্তর করিল আজ্ঞে সেটি কালীর ঘর; কালী আর আমি ছাড়া প্রায়ই সে ঘরে আর কেহ যাইত না।”

    আ। সম্প্রতি কোন লোক কি সে ঘরে গিয়াছিল?

    রা। হয় ত আমার ছোট স্ত্রী দুঃখী কিম্বা আমার পুত্র পঞ্চানন গিয়া থাকিবে। এই দুইজন ভিন্ন আর কোন লোক প্রায় মাসাবধি আমার বাড়ীতে নাই। প্রায় দেড়মাস হইল, আমার ভগ্নী শ্বশুরবাড়ী গিয়াছে।

    আ। তোমার ভগ্নিপতি কি এখানে আসিয়াছিল?

    রা। অনেক দিন পূর্ব্বে তিনি মারা গিয়াছেন।

    আ। তবে তোমার বড় স্ত্রীর ঘরে অপর দুইজনের পদচিহ্ন দেখিলাম কেন, দুইজন অপর লোক নিশ্চয়ই তাহার ঘরে গিয়াছিল। পায়ের দাগগুলি দেখিয়া একজন পুরুষ ও একজন রমণী বলিয়াই বোধ হইল। যদি তোমার ভগ্নীর পদচিহ্নের সহিত সেই স্ত্রীলোকের পদচিহ্নের মিল হয়, তাহা হইলেও সেই পুরুষের পদচিহ্ন কোথা হইতে আসিল? কালীর ঘরে অপর পুরুষ নিশ্চয় প্রবেশ করিয়াছিল। তাহার উপর তুমি যখন বলিতেছ যে, তোমার বড় স্ত্রীর চরিত্রদোষ ছিল না, তখন কেমন করিয়া সে ঘরে অপর পুরুষের পদচিহ্ন আসিল বলিতে পারি না। তোমার প্রতিবেশী কোন পুরুষের সহিত কালীর আলাপ ছিল কি?

    রামচন্দ্র কিছুক্ষণ কি চিন্তা করিয়া, পরে বলিল “আজ্ঞে না। বরং আমার ছোট স্ত্রীকে কোন লোকের সহিত কথা কহিতে দেখিলে সে তাহাকে যথেষ্ট তিরস্কার করিত।”

    আ। তোমার ছোট স্ত্রীর সহিত কাহারও সদ্ভাব আছে না কি?

    রা। সদ্ভাব আছে কি না বলিতে পারি না। তবে দুই একজনের সহিত আলাপ আছে।

    আ। তাহাদিগকে আমায় দেখাইয়া দিতে পার?

    রা। কেন পারিব না? সম্ভবতঃ আপনি দুজনকে দেখিয়াছেন।

    আমি সাগ্রহে জিজ্ঞাসা করিলাম “কে বল দেখি?”

    রা। আপনি যে কম্পাউণ্ডার বাবুকে দেখিয়াছিলেন, তাঁহার সহিত দুঃখীর বেশ আলাপ আছে। তিনি দুঃখীকে দিদি বলিয়া থাকেন।

    আ। দুঃখী কে? তোমার ছোট স্ত্রী?

    রা। আজ্ঞে হ্যাঁ।

    আ। তিনি দিদি বলেন কেন? তোমাদেরই স্বজাত না কি? দুঃখীর সহিত সত্য সত্যই কি কোন সম্বন্ধ আছে? রামচন্দ্র ঈষৎ হাসিল। পরে বলিল “আজ্ঞে না, মনমোহন বাবু যে কায়স্থ। দুঃখীই প্রথমে দাদা বলিয়া ডাকিত। এখন দেখিতেছি, তিনিও দিদি বলিয়া ডাকেন।”

    আ। তোমার স্ত্রীও দাদা বলে?

    রামচন্দ্র হাসিয়া বলিল “আজ্ঞে হাঁ।”

    আমি তখন জিজ্ঞাসা করিলাম, “আর একজন কে?”

    রামচন্দ্র বলিল “আমাদেরই দোকানের পার্শ্বে সে থাকে। আজ তখন সেও আপনার সম্মুখেই দাঁড়াইয়াছিল। তাহার নাম ঈশান।”

    আ। বয়স কত?

    রা। আজ্ঞে আমাদেরই মত। বেশীর ভাগ তাঁহার চুলগুলি পাকিয়া গিয়াছে, অর্দ্ধেকগুলি দাঁত পড়িয়া গিয়াছে। আমি বলিলাম “ সে বোধ হয় তোমাদের স্বজাতি? কেমন?”

    রা। আজ্ঞে হ্যাঁ-কালীর দূর-সম্পর্কের মামা।

    আ। তোমার ছোট স্ত্রীর স্বভাব-চরিত্র কেমন?

    রা। যতদূর জানি, আর যেমন দেখিতে পাই, তাহাতে ভাল বলিয়াই বোধ হয়।

    আ। কম্পাউণ্ডারের বয়স কাঁচা, তোমার ছোট স্ত্রীও পূর্ণ যুবতী। এ অবস্থায় উভয়ের মধ্যে আলাপ পরিচয় থাকা আদৌ সঙ্গত বলিয়া বোধ হয় না। তুমি তোমার স্ত্রীকে নিষেধ কর না কেন?

    রামচন্দ্র ঈষৎ হাসিল। পরে বলিল, “আজ্ঞে আপনার কথা সত্য কিন্তু জিজ্ঞাসা করি, স্ত্রীলোকের চরিত্র আমার মত লোকের বুঝিবার সাধ্য আছে কি?”

    কথাটা বড়ই সত্য। রামের কথায় আন্তরিক লজ্জিত হইলাম। বলিলাম “দেবতারাও বুঝিতে পারেন না, আমি সে কথা জিজ্ঞাসা করি নাই। যদি কখনও তোমার ছোট স্ত্রীর অসদাচরণ দেখিয়া থাক বল। তাহাতে তোমার উপকার ভিন্ন অপকার হইবে না। তোমার বড় স্ত্রী আত্মহত্যা করে নাই, তাহাকে কেহ খুন করিয়া গিয়াছে। কোন কথা না লুকাইয়া সমস্ত সত্য প্রকাশ করিলে হত্যাকারীকে শীঘ্রই গ্রেপ্তার করিতে পারিব।”

    আমার কথা শুনিয়া রামচন্দ্র কিছুক্ষণ কোন কথা কহিল না। পরে অতি বিনীত ভাবে উত্তর করিল যতদূর আমার জানা আছে “দুঃখীর কোনরূপ চরিত্রদোষ নাই। যদি তাহা হইত, তাহা হইলে সে আমায় এত তোষামোদ করিত না।”

    আমি জিজ্ঞাসা করিলাম “তোমার কিম্বা কালীর কি কোন শত্রু আছে জান?”

    রামচন্দ্র বিনীত ভাবে উত্তর করিল “আজ্ঞে না, – পাড়ার সকলেই আমাকে বেশ যত্ন করে। আমার সহিত কাহারও কখনও মনান্তর হয় নাই, কখনও কলহ হয় নাই, এমন কি, কখনও সামান্য কথান্তর বা বচসা পর্যন্ত হয় নাই। আমার সহিত পাড়ার সকলেরই বিশেষ সদ্ভাব আছে। এ পর্যন্ত কেহই আমার সহিত শত্রুতাচরণ করে নাই।”

    পঞ্চম পরিচ্ছেদ

    পরদিন অতি প্রত্যূষে গাত্রোত্থান করিলাম। আমি যখন প্রাতঃকৃত্য সমাধা করিয়া বিচক্ষণ বহুদর্শী ডাক্তারের ছদ্মবেশ ধারণ করিলাম, তখন উষার আলোকে চারিদিক উদ্ভাসিত হইয়াছিল। কাক কোকিলাদি বিহঙ্গমকুল স্ব স্ব নীড় ত্যাগ করিয়া আহারান্বেষণে ব্যাপৃত হইয়াছিল, গৃহস্থগণ স্ব স্ব শয্যা ত্যাগ করিয়া গৃহকর্ম্মে নিযুক্ত হইতেছিল।

    অনেক ভাবিয়া চিন্তিয়া অবশেষে ডাক্তারের বেশেই কম্পাউণ্ডার বাবুর সহিত সাক্ষাৎ করিতে মনস্থ করিলাম। কিন্তু লোকাচার আকার-প্রকার ও ভাবভঙ্গি দেখিয়া সশস্ত্র হইয়া যাইতে বাধ্য হইলাম। একটা দোনলা পিস্তল ও একখানা ছোরা সঙ্গে লইলাম, কিন্তু এমনভাবে রাখিলাম, যাহাতে কম্পাডণ্ডার বাবু কোনরূপ সন্দেহ করিতে না পারেন।

    আমার এক বন্ধু বড় ডাক্তার। তাঁহার নিকট হইতে গোটাকতক ডাক্তারি যন্ত্র আনাইয়া সঙ্গে রাখিয়াছিলাম। কোচম্যানকে রীতিমত শিক্ষা দিয়া আমি গাড়িতে উঠিলাম। সে শকট চালনা করিল।

    গাড়িখানি যেমন সেই ডিসপেন্সারির সম্মুখে গিয়া পঁহুছিল, অমনি উহার একটি ঘোড়া টলিয়া পড়িল। সঙ্গে সঙ্গে গাড়িখানিও হেলিয়া পড়িল। আমি ও কোচম্যান লম্ফ দিয়া নিম্নে অবতরণ করিয়া গাড়িখানি ধরিয়া ফেলিলাম। উহা আর পড়িয়া গেল না বটে কিন্তু সম্মুখের একখানি চাকার চতুঃপার্শ্বস্থ লৌহনিৰ্ম্মিত বেড়খানি খুলিয়া গেল। অশ্বরজ্জু গাড়ির একস্থানে বন্ধন করিয়া কোচম্যান একজন মিস্ত্রী ডাকিয়া আনিতে ছুটিল। আমি সেইখানে দাঁড়াইয়া রহিলাম। গাড়িখানির ওইরূপ অবস্থা হওয়ায় সেই স্থানে অনেক লোকের জনতা হইয়াছিল। বলা বাহুল্য যে, কম্পাউণ্ডারও আমার গাড়িখানি পড়িতে পড়িতে রক্ষা পাইল দেখিবার জন্য ডিস্পেন্সারি হইতে বাহির হইয়াছিলেন।

    কোচম্যান মিস্ত্রী আনিতে চলিয়া গেল, অপরাপর লোকেরাও স্ব স্ব কার্য্যে গমন করিল। কম্পাউণ্ডার বাবু আমাকে দণ্ডায়মান দেখিয়া দয়া করিয়া ভিতরে ডাকিলেন। আমিও সহিসের হস্তে গাড়ির ভার দিয়া তাঁহার ডিপেন্সারিতে প্রবেশ করিলাম।

    দেখিতে যাহাই হউক, কম্পাউণ্ডারের আচরণ সেদিন অতি সুন্দর। ভিতরে যাইবামাত্র তিনি শশব্যস্তে একখানি চেয়ার আনিয়া আমাকে বসিতে দিলেন। আমি উপবেশন করিলে পর তিনি একখানি ছোট ডিসে করিয়া আমার নিকট দুটো চুরুট ও দিয়াশলাই আনিয়া অতি বিনীতভাবে বলিলেন “চুরুট ইচ্ছা করুন। মহাশয়কেও ডাক্তার বলিয়া বোধ হইতেছে।”

    যদিও আমি চুরুট ভক্ত নহি, তত্রাচ কম্পাউণ্ডার বাবুর মান রক্ষার জন্য সেই ডিস হইতে একটি লইয়া মুখে দিলাম এবং দিয়াশলাইয়ের সাহায্যে ধরাইয়া টানিতে লাগিলাম। তিনিও একটি লইয়া ধরাইলেন এবং আমার সম্মুখে একখানি চেয়ার আনাইয়া তাহাতে উপবেশন করিলেন।

    কিছুক্ষণ কোন কথা হইল না। পরে আমি প্রশ্ন করিলাম “আপনি জানেন, নিকটে কোথাও মিস্ত্রী পাওয়া যাইতে পারে?”

    কম্পাউণ্ডার বাবু বাহ্যিক বেশ সরল। “তিনি হাসিয়া বলিলেন “আমরা সামান্যলোক, গাড়ি ঘোড়ার কথায় নাই। কোথায় ঘড়া গাড়ু মেরামত হয়, জিজ্ঞাসা করিলে বলিতে পারি। আপনার প্রশ্নের উত্তর করিতে পারিলাম না।”

    আমিও হাসিলাম। হাসিতে হাসিতে বলিলাম “এখানে কোথাও বড় আস্তাবল নাই?”

    কম্পাউণ্ডার কিছুক্ষণ ভাবিয়া উত্তর করিলেন “আপনি যথার্থ অনুমান করিয়াছেন। আপনার কোচম্যান ওই কথাই বলিয়া গেল। জমিরদ্দি সর্দ্দারের আস্তাবল। সেখানে গাড়ি মেরামত হয় টে। আমার মনে ছিল না।”

    আমি বলিলাম “সে আস্তাবল এখান হইতে কত দূর? একঘণ্টার মধ্যে গাড়িখানি মেরামত হইবার সম্ভাবনা আছে কি? যদি তাহা না হয়, তাহা হইলে আমাকে একখানা ভাড়াটীয়া গাড়ি করিয়াই যাইতে হইবে।”

    কম্পাউণ্ডার জিজ্ঞাসিলেন “কোথাও ডাক আছে না কি?”

    আ। আজ্ঞে হাঁ-একটা ফোড়া অস্ত্র করিতে হইবে।

    ক। কোথায় হইয়াছে?

    আ। বড় খারাপ স্থানেই ফোড়া হইয়াছে। হিপ জয়েন্টের উপর, ব্যাপার গুরুতর।

    ক। আজ্ঞে হাঁ-ফোড়ার মুখ হইয়াছে?

    আ। কই না-ও রকম জায়গায় ফোড়া হইলে প্রায়ই মুখ হয় না। ওই সকল ফোড়া অস্ত্র করা নিতান্ত সহজ নহে। বাধা দিয়া কম্পাউণ্ডার বাবু বলিয়া উঠিলেন “সহজ, ও কথা মুখেও আনিবেন না। অপরে বলে বলুক, যাহারা জানে না, তাহারা বলিতে পারে, কিন্তু আপনি বা আমি ওরূপ কথা মুখে আনিতে পারি না। আমাদের বাবু একবার একটা ফোড়া অস্ত্র করিতে গিয়া একটা শিরা কাটিয়া ফেলিয়াছিলেন; শেষে হারিস সাহেব আসিয়া তবে রোগীকে বাঁচান।”

    আমি মনে মনে হাসিলাম। ভাবিলাম, ঔষধ ধরিয়াছে, এই বার কাজের কথা বলিতে আরম্ভ করা যাউক। এই চিন্তা করিয়া জিজ্ঞাসা করিলাম “আপনার নাম কি? আপনার সহিত আলাপ করিয়া বড় সন্তুষ্ট হইলাম। আজ-কাল বাহ্যিক অনেক ভদ্রলোক দেখিতে পাওয়া যায় কিন্তু প্রকৃত ভদ্রলোকের সংখ্যা নিতান্ত অল্প।”

    কম্পাউণ্ডার বাবু ত মানুষ! তোষামোদ করিলে দেবতারাও বশীভূত হন। আমার মুখে প্রশংসা শুনিয়া তিনি পরম আপ্যায়িত হইলেন। পরে হাসিতে হাসিতে উত্তর করিলেন “আজ্ঞে আমার নাম মনমোহন।”

    আ। আপনার বাবুর নাম কি?

    ক। তারিণীপ্রসাদ বোস এম, বি।

    আমি আশ্চৰ্য্যান্বিত হইয়া জিজ্ঞাসা করিলাম “সত্য না কি? এইটিই কি তারিণী বাবুর ডিস্পেন্সারি? তাঁহার বাড়ীতেই ত ডিপেন্সারি আছে?”

    ক। আজ্ঞে হাঁ, এটি তিনি নূতন খুলিয়াছেন। এখানে তিনি প্রায়ই থাকেন না। বিশেষ প্রয়োজন হইলে আমি তাঁহার বাড়ীতে সংবাদ পাঠাইয়া থাকি।

    আ। আপনি কতদিন কম্পাউণ্ডারি পাশ করিয়াছেন?

    ক। প্রায় পাঁচ বৎসর হইল।

    আ। এখানে কতদিন কর্ম্ম করিতেছেন?

    ক। প্রায় তিন বৎসর।

    আ। পূর্ব্বে আর কোথাও কার্য্য করিয়াছেন?

    ক। আজ্ঞে হাঁ-একটা প্যাটেন্ট ঔষধের দোকানে।

    আ। এখানে কি আপনাকে সমস্ত দিনই থাকিতে হয়?

    ক। আজ্ঞে হাঁ—আমার বাসাও এই।

    আমি এতক্ষণ এই সুযোগই অন্বেষণ করিতেছিলাম। তখনই কম্পাউণ্ডার বাবুকে জিজ্ঞাসা করিলাম “আপনি তবে এইখানেই থাকেন?”

    ক। আজ্ঞে হাঁ।

    আ। আপনার বাড়ীর পার্শ্বে অত পাহারাওয়ালা কেন বলিতে পারেন?

    ক। মুচির বাড়ীতে একটা খুন হইয়াছে।

    আমি চমকিত হইয়া জিজ্ঞাসা করিলাম “খুন! কে করিল, কখন হইল?”

    ক।নিশ্চয়ই কাল রাত্রে এ কাণ্ড হইয়াছে। আমি ভাবিয়াছিলাম, মাগী আত্মহত্যা করিয়াছে। কিন্তু পুলিসের লোক অন্য কথা বলে। তাহারা বলিতেছে; কোন লোক উহাকে খুন করিয়া ওইরূপ ঝুলাইয়া রাখিয়া গিয়াছে।

    আ। হত্যাকারী ধরা পড়িয়াছে?

    ক। আজ্ঞে না—এখনও ধরা পড়ে নাই।

    আ। বাড়ীতে কি আর কোন লোক ছিল না?

    ক। আজ্ঞে না। রামামুচি ছোট বউকে লইয়া কোথায় গিয়াছিল। কাল প্রাতে বাড়ী ফিরিয়া এই ব্যাপার দেখিতে পায়।

    আ। রামা কে?

    ক। জুতাওয়ালা মুচি। তাহার দুই বিবাহ। বড় স্ত্রীই খুন হইয়াছে।

    আ। দুটি স্ত্রীই তবে বর্তমান ছিল?

    ক। আজ্ঞে হাঁ।

    আ। কৰ্ত্তা বোধ হয় ছোটটিকেই বেশী ভালবাসিত। তাহার উপর যখন তাহাকেই লইয়াই বেড়াইতে গিয়াছিল, তখন বড় স্ত্রী যে অভিমান করিয়া গলায় দড়ী দিবে তাহাতে আর আশ্চর্য্য কি?

    বাধা দিয়া কম্পাউণ্ডার বাবু বলিলেন “আজ্ঞে বিচক্ষণ ও বহুদর্শী লোক মাত্রেই ওই কথা বলিতেছেন। কিন্তু পুলিসের তাহাতে বিশ্বাস হইতেছে না। তাহারা কেবল দোষীর অন্বেষণে নিযুক্ত আছে। জানি না, কতদূর কৃতকার্য্য হইবে। তাহাদের কার্য্য তাহারাই ভাল বোঝে।”

    আমি কিছুক্ষণ আর ওই বিষয়ে কোন কথা জিজ্ঞাসা করিলাম না। সামান্য দুই চারিটা প্রশ্ন করিয়া আমি গাত্রোত্থান করিলাম। এমন ভাব দেখাইলাম, যেন বিলম্ব হওয়ায় আমি বড়ই ব্যস্ত হইয়া পড়িয়াছি।

    আমাকে উঠিতে দেখিয়া কম্পাউণ্ডার বাবু আমার হাত ধরিয়া পুনরায় সেই চেয়ারে বসাইয়া দিলেন। পরে বলিলেন “আর একটু অপেক্ষা করুন, আপনার কোচম্যান এখনই ফিরিয়া আসিবে। আপনার মত লোকের সহিত সাক্ষাৎ সকল দিন ঘটে না। যখন দয়া করিয়া পদধূলি দিয়াছেন, তখন আর কিছুক্ষণ অপেক্ষা করুন।”

    আমি তাঁহার অনুরোধ এড়াইতে পারিলাম না। পুনরায় সেই চেয়ারে বসিয়া পড়িলাম। কম্পাউণ্ডার বাবু একজন বেহারাকে তামাক দিতে বলিলেন।

    ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ

    বেহারা তামাক দিয়া গেল। আমি উহা সেবন করিতে করিতে জিজ্ঞাসা করিলাম “আপনি তবে প্রত্যহই দুই সতীনের কোলাহল শুনিতে পাইতেন?”

    কম্পাউণ্ডার হাসিয়া উঠিলেন। হাসিতে হাসিতে বলিলেন, সে কথা মিথ্যা নহে। এমন দিন ছিল না, যেদিন রামার বাড়ীতে কলহ নাই। বেচারা ঝগড়ার জ্বালায় বিবাগী হইয়া যাইতে চাহিয়াছিল। কেবল আমরা পাঁচজনে নিষেধ করায় সংসারে থাকিয়া গেল।

    আমি কৌতূহলাক্রান্ত হইয়া জিজ্ঞাসা করিলাম, “এত কি কলহ হইত? এত ঝগড়ার কারণ কি?”

    ক। অতি তুচ্ছ কারণে ঝগড়া বাধিত।

    আ। আপনার কিছু মনে আছে? কি কারণে শেষ বিষাদ হইয়াছিল স্মরণ আছে?

    কম্পাউণ্ডার বাবু কিছুক্ষণ কি চিন্তা করিলেন। পরে হাসিতে হাসিতে বলিলেন “আজ্ঞে হাঁ, মনে আছে।”

    আ। কি বলুন দেখি?

    ক। প্রায় আট দিন হইল একদিন সকালে দুঃখী কালীকে বলিতেছিল যে, সে আর একসঙ্গে থাকিবে না, স্বতন্ত্র রসুই করিয়া খাইবে। কালী অনেক বুঝাইল কিন্তু দুঃখী কিছুতেই তাহার কথা শুনিল না। সে কালীর নিকট হইতে চাউল চাহিল। অগত্যা কালী তাহাকে অর্দ্ধসের চাউল মাপিয়া দিল। কিন্তু তাহা দুঃখীর মনোমত হইল না। সে অনেক কথা শুনাইয়া দিল। কালীও ছাড়িবার পাত্র নহে। শেষে উভয়ের মধ্যে ঘোরতর বিবাদ হইল। এইরূপেই কলহ হইত।

    আমি হাসিয়া উঠিলাম। পরে জিজ্ঞাসা করিলাম “দোষ কাহার? বেশী দোষী কে?”

    ক। কালী।

    আ। কেন?

    ক। কালী দুঃখীকে খাইতে দিত না।

    আ। কেমন করিয়া জানিলেন?

    ক। দুঃখীর মুখে শুনিয়াছি। দুঃখী আমাকে দাদা বলিয়া ডাকে। আমিও তাহাকে দিদি সম্বোধন করিয়া থাকি। আমি হাসিয়া বলিলাম “এ বড় মন্দ নয়। এ সুবাদ কেন? দুঃখীর সহিত আপনার আলাপ আছে না কি? “ আমার কথায় কম্পাউণ্ডার বাবু স্তম্ভিত হইলেন। তাঁহার মুখ সহসা মলিন হইয়া গেল, ললাটে বিন্দু বিন্দু ঘৰ্ম্ম দেখা দিল, ঘন ঘন দীর্ঘনিশ্বাস পড়িতে লাগিল। তিনি সহসা কোন কথা কহিতে পারিলেন না।

    কিছুক্ষণ পরে কম্পাউণ্ডার বাবু আমার মুখের দিকে চাহিয়া ঈষৎ হাসিয়া বলিলেন, “আলাপ ছিল না—এখানে আসিয়া অবধি হইয়াছে।”

    আমিও হাসিতে হাসিতে জিজ্ঞাসা করিলাম “দুঃখীর বয়স কত? নিশ্চয়ই বেশী নয়, তাহা না হইলে আর আপনার সহিত আলাপ?”

    কম্পাউণ্ডার আমার উপহাস বুঝিতে পারিলেন, তিনি হাসিয়া বলিলেন “বয়স উপযুক্ত বটে। একবার দেখাইতে পারিলে বুঝিতাম। অন্যদিন হইলে এইখান হইতেই দেখিতে পাইতেন। আজ তাহাদের বাড়ীতে বিপদ, সেই জন্যই পারিলাম না।”

    কম্পাউণ্ডার বাবুর প্রাণ খুলিয়া গিয়াছে। আমাকে তিনি বন্ধুর মত দেখিয়াছেন। আর রক্ষা আছে কি? প্রাণের কথা বাহির হইয়া পড়িল। আমারও কার্য্য সিদ্ধ হইল। কিন্তু আমি সাহস করিয়া তখন একেবারে সকল কথা জিজ্ঞাসা করিতে পারিলাম না। হাসিয়া বলিলাম “দেখিলেই বা কি করিতাম বলুন? পরের দ্রব্যে লোভ করিও না, বাল্যকালে এই উপদেশ বিদ্যাসাগর মহাশয়ের দ্বিতীয়ভাগে পাঠ করিয়াছিলাম, সে কথা কি সহজে ভুলিতে পারি?”

    আমার কথায় কম্পাউণ্ডার বাবু হাসিয়া উঠিলেন। বলিলেন “আপনি বেশ রসিক পুরুষ বটে। কিন্তু জিজ্ঞাসা করি, সে দ্রব্যটি কি আমার মনে করিয়াছেন?”

    আমি হাসিয়া বলিলাম “নিশ্চয়ই– তাহা না হইলে আপনি দুঃখীর এত গুণগান করিতেন না। এ বুদ্ধি আমার যথেষ্ট আছে।”

    কম্পাউণ্ডার ঈষৎ হাসিলেন। পরে বলিলেন, “দুঃখীর দুঃখের কথা শুনিলে পাষাণও বিদীর্ণ হয়। যদি আপনি তাহার মুখের কথা শুনিতেন, তাহা হইলে আপনিও নিশ্চিন্ত থাকিতে পারিতেন না।”

    আমি কম্পাউণ্ডারের মনোভাব বুঝিতে পারিলাম। কিন্তু তত্রাপি যেন আশ্চৰ্য্যান্বিত হইয়া জিজ্ঞাসা করিলাম “দুঃখীর আবার এত দুঃখ কিসের?”

    কম্পাউণ্ডারও আশ্চর্যান্বিত হইলেন। তিনি বলিলেন “দুঃখ কিসের? সে কি কথা! দুঃখীকে না দেখাইলে আপনাকে বুঝাইতে পারিব না।”

    আমি হাসিয়া বলিলাম “সে আমার অদৃষ্টে নাই। দুঃখীকে দেখা সামান্য সৌভাগ্যের কথা নহে। কিন্তু তাহার দুঃখ কিসের তাহা বলিলে কি আর বুঝিতে পারিব না?”

    ক। দুঃখীর বয়স সতের বৎসরের অধিক বলিয়া বোধ হয় না। রামচন্দ্র বোধ হয় ষাইট বৎসর উত্তীর্ণ হইয়াছে। এ অবস্থায় কেমন করিয়া উভয়ের মিল হইতে পারে?

    আ। তাহাতেই বা ক্ষতি বৃদ্ধি কি?

    ক। আপনার মত বিচক্ষণ ব্যক্তিকে কি আর সকল কথা প্রকাশ করিয়া বলিতে হয়? যখন স্বামী স্ত্রীর বয়সের এত প্রভেদ, তখন উভয়ের মধ্যে মিল হওয়া সম্পূর্ণ অসম্ভব।

    আ। সেই জন্যই বুঝি আপনি তাহার সেই অভাব পূরণ করিয়াছেন?

    এই বলিয়া হাসিয়া উঠিলাম। ইত্যবসরে দুঃখী বাড়ীর বাহির হইল এবং আমি যেখানে বসিয়াছিলাম, সেই দিকে ঘন ঘন দৃষ্টিপাত করিতে লাগিল। আমাকে সম্পূর্ণ অপরিচিত জানিয়াও দুঃখী লজ্জিতা হইল না কিম্বা সেখান হইতে পলায়ন করিল না; বরং ধীরে ধীরে ডিসপেন্সারির জানালার নিকট আসিয়া দাঁড়াইল।

    কম্পাউণ্ডার বাবু সহসা সেইদিকে দৃষ্টিপাত করিলেন এবং দুঃখীকে দেখিতে পাইয়া সাগ্রহে বলিয়া উঠিলেন “এই দেখুন ডাক্তারবাবু! মেঘ চাহিতেই জল আসিয়াছে। এখন আমার কথা বিশ্বাস হয় কি?”

    আমি হাসিতে হাসিতে বলিলাম “আপনার কথায় আমার অবিশ্বাস নাই। তবে কি জানেন, লোকে নিজের সামর্থ্য না জানিয়া এক স্ত্রী থাকিতে আবার কেন বিবাহ করিবে?”

    ক। রামের দ্বিতীয়বার বিবাহ করিবার যথেষ্ট কারণ ছিল।

    আ। কি?

    ক। কালীর সঙ্গে রামের প্রায়ই কলহ হইত। এক একদিন এমন হইত, যে উভয়েরই আহার হইত না। এইরূপে কিছুকাল অতীত হইলে একদিন রামচন্দ্র রাগের মাথায় কালীকে উত্তম মধ্যম প্রহার করিয়া বাড়ী হইতে দূর করিয়া দেয়। মনের দুঃখে কালী একাই আপন পুত্রকে কোলে লইয়া পিত্রালয়ে গমন করে। রামচন্দ্র সেই সুযোগে দুঃখীকে বিবাহ করে।

    আ। এক স্ত্রী বর্তমান থাকিতে রামকে আবার কে কন্যা সমর্পণ করিল?

    ক। যাহাদের বড় দরকার। দুঃখীর বাপ নাই, মা আছে। সেও তখন দুঃখীর বিবাহের জন্য ব্যতিব্যস্ত হইয়া পড়িয়াছিল। কাজেই রামচন্দ্র যখন তাহাকে বিবাহ করিবার প্রস্তাব করিল, তখন তাহার মাতা সম্মত হইল এবং দুই একদিনের মধ্যেই বিবাহকাৰ্য্য সমাধা হইয়া গেল।

    আ। বড় স্ত্রী সে সময় কোথায় ছিল?

    ক। আজ্ঞে-পিত্রালয়েই ছিল।

    আ। সে কি তখন রামের দ্বিতীয়বার বিবাহের সংবাদ পায় নাই?

    ক। আজ্ঞে বিবাহের দিন জানিতে পারে নাই বটে, কিন্তু পরদিন সকলেই সমস্ত কথা জানিতে পারিল।

    আ। কালী কি করিল?

    ক। কাহাকেও কোন কথা না বলিয়া সহসা আবার স্বামীগৃহে উপস্থিত হইল।

    আ। রামচন্দ্র নিশ্চয়ই তাড়াইয়া দিয়াছিল?

    ক। আজ্ঞে না- সেইদিনই উভয়ের মধ্যে আবার মনোমিলন হইল।

    আমি না হাসিয়া থাকিতে পারিলাম না। হাসিতে হাসিতে বলিলাম “যদি তাহাই করিবার ইচ্ছা ছিল, যদি কালীকে পুনরায় গৃহে আনিয়া সংসার করিবার কামনা ছিল, তবে দুঃখীকে বিবাহ করিবার কোন প্রয়োজন ছিল না।”

    কম্পাউণ্ডার হাসিয়া বলিলেন “রাম জানিত যে, দুঃখী তাহাকে কোনরূপ উৎপীড়ন করিবে না, মোটা ভাত, মোটা কাপড়ে সন্তুষ্ট থাকিবে। কিন্তু পনর দিন মাত্র তাহার সহিত ঘর-কন্না করিবার পর রাম নিজের ভুল বুঝিতে পারিল। সে দেখিল, সকল স্ত্রীলোকই সমান। কালীর সহিত যেমন প্রায়ই কলহ হইত, দুঃখীর সহিতও সেই প্রকার বিবাদ চলিতে লাগিল। রামচন্দ্র আবার উৎপীড়িত হইল। এই সময়ে কালী এ বাড়ীতে আসিল। কাজেই রাম দুই স্ত্রীকে প্রতিপালন করিতে বাধ্য হইল।”

    কম্পাউণ্ডার বাবুর কথায় স্পষ্টই বুঝিতে পারিলাম, তাঁহার সহিত দুঃখীর অবৈধ প্রণয় আছে। কিন্তু সে কথা প্রকাশ করিলাম না। ইত্যবসরে দুঃখীও কম্পাউণ্ডারকে দেখিতে পাইল। সে ধীরে ধীরে ডিপেন্সারির মধ্যে প্রবেশ করিয়া কতকগুলি পান কম্পাউণ্ডারের নিকট দিয়া হাসিতে হাসিতে পলায়ন করিল।

    কম্পাউণ্ডার বাবু সযত্নে পানগুলি কুড়াইয়া লইয়া, আমাকে দেখাইলেন এবং তাহা হইতে একটি পান লইয়া আমাকে দিতে আসিলেন। আমি সে পান গ্রহণ করিলাম না। হাসিতে হাসিতে বলিলাম “ও সকল পান আপনার জন্যই সাজা হইয়াছে। আমি উহার একটি খাইলে দুঃখীর মনঃপূত হইবে না। বিশেষতঃ আমি অধিক পান খাই না। আহারের পর একটি করিয়া খাইয়া থাকি।”

    সপ্তম পরিচ্ছেদ

    কম্পাউণ্ডার বাবু আর কোন কথা কহিলেন না দেখিয়া আমিও আর দুঃখীর কথা তুলিলাম না। কিছুক্ষণ অন্যান্য কথাবার্তার পর জিজ্ঞাসা করিলাম “দুঃখীর অবস্থা ত বুঝিলাম, এখন কালীর কিরূপ বলুন দেখি? তাহার চরিত্র কেমন?”

    ক। ততোধিক।

    আ। দুঃখীর চেয়েও জঘন্য?

    ক। দুঃখীর ত একজন—যে একজনেই সন্তুষ্ট আছে। কিন্তু কালীর তাহা নয়—কালীর তিন চারিজন আলাপী লোক আছে।

    আমি হাসিয়া উঠিলাম। বলিলাম “না না, আপনি উপহাস করিতেছেন। একে কালীর বয়স অধিক, যৌবনের দুৰ্দ্দমনীয় আকাঙ্ক্ষা অনেক নিবৃত্তি হইয়াছে, তাহার উপর তাহার গর্ভে এক সন্তান জন্মিয়াছে; সন্তানের লালন পালন করিবে, না নিজের সুখের চেষ্টায় ফিরিবে?”

    কম্পাউণ্ডার বলিলেন “আপনি দুশ্চরিত্রা রমণীর আচরণ দেখেন নাই, বোধ হয় সেই জন্যই ওই কথা বলিতেছেন। পুত্রকে ঘুম পাড়াইয়া হউক, কিম্বা তাহাকে আর কোন উপায়ে শান্ত করিয়া হউক, কালী দিনের মধ্যে দুই তিনবার বাড়ী হইতে বাহির হইত এবং একাই পাশাপাশি বাড়ীতে প্রবেশ করিত।”

    আ। তবে কালীরও এ পাড়ায় বেশ সুনাম আছে?

    ক। আজ্ঞে না—এইটিই আশ্চর্য্য! আমি যতদূর জানি, তাহাতে দুঃখী অপেক্ষা কালীকেই অধিক মন্দ মনে করি। কিন্তু পাড়ার লোকে দুঃখীর নিন্দা করে এবং কালীর যথেষ্ট সুখ্যাতি করে।

    আ। উহার কারণ কিছু বুঝিতে পারিয়াছেন?

    ক। কতকটা। পাড়ার অনেকেরই দুঃখীর উপর লোভ পড়িয়াছে। দুঃখী কিন্তু তাহাদের দিকে দৃপাতও করে না। বোধ হয় সেই জন্যই তাহারা রাগ করিয়া দুঃখীর নিন্দা করে।

    আ। এত সুখ থাকিতে কালী আত্মহত্যা করে কেন?

    কম্পাউণ্ডার আবার যেন শিহরিয়া উঠিলেন। কিন্তু তখনই আত্মসংবরণ করিয়া বলিলেন “যখন পুলিসের বড় বড় কর্ম্মচারী উহাকে আত্মহত্যা বলিতেছেন না, তখন আমরাই বা বলি কেন? কালী আত্মহত্যা করে নাই—কোন লোক তাহাকে হত্যা করিয়াছে।”

    আ। কি আশ্চর্য্য! কে এমন কাজ করিল, কালীর কে শত্রু ছিল জানেন?

    ক। আজ্ঞে না—কাহারও সহিত তাহার কথান্তর হইতে শুনি নাই।

    আ। তবে কে তাহাকে খুন করিতে আসিল, কোন্ কোন্ লোকের সঙ্গে কালীর সদ্ভাব ছিল বলিতে পারেন? “বেশ পারি” এই বলিয়া কম্পাউণ্ডার বাবু একখানি কাগজে কি লিখিলেন। পরে সেই কাগজখানি আমার হস্তে দিলেন। আমি পাঠ করিয়া দেখিলাম, তিনি তাহাতে চারিজন লোকের নাম ও তাহাদের বাড়ীর ঠিকানা লিখিয়া দিয়াছেন। কাগজখানি পকেটে রাখিয়া বলিলাম “আপনি যে চারিজনের নাম দিয়াছেন, তাহাদের মধ্যে কোন লোক হয় ত এই হত্যাকাণ্ডের সংবাদ দিতে পারে।”

    কম্পাউণ্ডার বাবু আমার কথায় সায় দিলেন না। তিনি গম্ভীর ভাব ধারণ করিলেন। আমি বুঝিতে পারিলাম, সেই নাম লেখা কাগজখানি পকেটে রাখিয়াছি বলিয়া হয় ত তিনি আমার উপর সন্দেহ করিয়াছেন।

    এই মনে করিয়া আমি তখনই কাগজখানি বাহির করিলাম এবং নামগুলি বারকতক মনে মনে পাঠ করিয়া কণ্ঠস্থ করিয়া রাখিলাম; পরে হাসিতে হাসিতে কাগজখানি কম্পাউণ্ডার বাবুর সম্মুখে ধরিয়া জিজ্ঞাসা করিলাম “এই চারিজনের মধ্যে কাহার সহিত কালীর অধিক সদ্ভাব ছিল?”

    কম্পাউণ্ডার বলিলেন “যাহার নাম সকলের উপরি লেখা আছে সেই সকলের প্রিয়।”

    আমি হাসিয়া উঠিলাম এবং অগ্রাহ্য ভাবে সেই কাগজখানি কম্পাউণ্ডার বাবুকে ফেরৎ দিলাম, তিনিও আশ্বস্ত হইলেন এবং তখনই গ্রহণ করিয়া ছিঁড়িয়া ফেলিলেন। আমি যে পূৰ্ব্বেই উক্ত কাগজে লিখিত সকলের নাম ও ধাম কণ্ঠস্থ করিয়া রাখিয়াছিলাম, তাহা তিনি বুঝিতে পারিলেন না।

    কিছুক্ষণ পরে আমি হাসিতে হাসিতে জিজ্ঞাসা করিলাম ‘রামের দুই স্ত্রীর মধ্যে আপনি কাহাকে সুন্দরী বলেন?” ক। আমার মতে বড়ই সুন্দরী, তবে তাঁহার বয়স কিছু বেশী।

    আমি শশব্যস্তে সে কথায় সায় দিলাম। বলিলাম “আপনি ঠিক কথাই বলিয়াছেন। উভয়ের মধ্যে আমিও কালীকেই সুন্দরী বলিয়া জানি। নিজে দেখি নাই বটে কিন্তু পাড়ার লোকেরা কালীর বিষয়ে যাহা বলিতেছিল তাহাই শুনিয়াছি।” বাধা দিয়া কম্পাউণ্ডার বাবু বলিয়া উঠিলেন “কি করিব বলুন, সে জন্য আর এখন আপশোষ করি কেন? চেষ্টা করিয়াছিলাম, কৃতকাৰ্য্য হই নাই। এখন যাহাকে পাইয়াছি, তাহাকে লইয়াই সন্তুষ্ট থাকি।”

    এই বলিয়া তিনি হাসিতে লাগিলেন। সেই সময় আমার কোচম্যান ফিরিয়া আসিল। মেরামতের কথা জিজ্ঞাসা করিলে সে বলিল, কার্য্য সিদ্ধ হইয়াছে এবং আমাকে তখনই গাত্রোত্থান করিতে অনুরোধ করিল।

    আমি গাত্রোত্থান করিলাম দেখিয়া কম্পাউণ্ডার বাবু বাহ্যিক দুঃখিত হইলেন। তিনি আমাকে আরও কিছুক্ষণ সেখানে বসিয়া গল্প করিবার জন্য অনুরোধ করিলেন কিন্তু আমি তাহাতে সম্মত না হইয়া বলিলাম “আপনার সহিত আলাপ করিয়া বড় সন্তুষ্ট হইলাম। শীঘ্রই আবার আমাদের দেখা হইবে।”

    অষ্টম পরিচ্ছেদ

    ডিপেন্সারি হইতে বাহির হইয়া আমি পুনরায় শকটে আরোহণ করিলাম এবং কিছুদূর গমন করিয়া পুনরায় গাড়ি হইতে অবতরণ করিলাম। পরে ধীরে ধীরে সেই কাগজে লিখিত প্রথম ব্যক্তির বাড়ীতে গিয়া উপস্থিত হইলাম। লোকটির নাম হরিদাস। জাতিতে কায়স্থ। কোন সরকারী অপিসে কর্ম্ম করেন। বলা বাহুল্য, আমি সেই ছদ্মবেশেই তাঁহার সহিত সাক্ষাৎ করিয়াছিলাম। সুতরাং তিনিও আমায় পুলিসের লোক বলিয়া চিনিতে পারিলেন না।

    কিছুক্ষণ দুই একটা বাজে কথা কহিয়া আমি জিজ্ঞাসা করিলাম “আপনাদের পাড়ায় আজ কিসের গোল?” হরিদাসবাবু উত্তর করিলেন “মুচিদের বড় বৌকে কে না কি খুন করিয়া গিয়াছে। পুলিস তাহার অন্বেষণ করিতেছে বটে কিন্তু এখনও আসামীকে গ্রেপ্তার করিতে পারে নাই।”

    আমি যেন ভয়ানক কৌতূহলাক্রান্ত হইলাম এবং জিজ্ঞাসা করিলাম “স্ত্রীলোক খুন হইয়াছে? তাহার চরিত্র কেমন ছিল?”

    হ। যতদূর জানি তাহাতে কালীকে সচ্চরিত্রা বলিয়াই মনে করি। দুঃখীর চরিত্রদোষ আছে বটে কিন্তু কালীর নাই। আ। কালী কে?

    হ। কালীই মুচিদের বড় বৌ, সেই খুন হইয়াছে। দুঃখী ছোট সে জীবিত আছে।

    আ। দুঃখীর চরিত্র ভাল নয় কেমন করিয়া জানিলেন?

    হ। সকলেই জানে, তাহার সহিত মনমোহনবাবুর গুপ্ত প্রণয় আছে।

    আ। মনমোহন কে?

    হ। নিকটবর্ত্তী এক ডিস্পেন্সারির কম্পাউণ্ডার। লোকটা দুঃখীর সর্ব্বনাশ করিতে নিশ্চিন্ত ছিল না। ইদানীং তিনি কালীরও পাছু পাছু ঘুরিতেন। কালী অনেকবার সে কথা আমাদের নিকট বলিয়াছিল, কিন্তু আমরা পর মানুষ, কেন বৃথা পরের কথায় থাকিব।

    হরিদাসবাবুকে অতি ভদ্রলোক বলিয়া বোধ হইল। তাঁহার কথা আমি অবিশ্বাস করিতে পারিলাম না। এমন কি, তাঁহার নামে যে কলঙ্কের কথা শুনিয়াছিলাম, তাহাও তাঁহার নিকট প্রকাশ করিতে সাহস করিলাম না।

    কিছুক্ষণ চিন্তা করিয়া আমি ব্যাপার বুঝিতে পারিলাম এবং তখনই থানায় ফিরিয়া গিয়া ছদ্মবেশ ত্যাগ করিলাম। পরে পুলিসের বেশ পরিধান করতঃ কয়েকজন কনেষ্টবল লইয়া একবারে সেই ডিসপেন্সারিতে উপস্থিত হইলাম। দেখিলাম, কম্পাউণ্ডার বাবু দুঃখীকে ঘরের ভিতর আনিয়া কত কি গল্প করিতেছেন।

    আমি দক্ষিণ হস্তে ক্ষুদ্র পিস্তলটি লইয়া কম্পাউণ্ডারের দিকে লক্ষ্য করিলাম এবং তদ্দণ্ডেই তাঁহাকে গ্রেপ্তার করিবার জন্য সমভিব্যাহারী কনেষ্টবলগণকে আদেশ করিলাম।

    পূৰ্ব্বেই বলিয়াছি, মনমোহনবাবুর শরীরে অসুরের বল ছিল। চারি পাঁচজন কনেষ্টবল অতি কষ্টে তাঁহাকে গ্রেপ্তার করিল। পরে জিজ্ঞাসা করিলাম “আমাকে চিনিতে পারিয়াছেন কি মনমোহনবাবু? আমি সেই ডাক্তার।”

    আমার কথার পর কম্পাউণ্ডার বাবু যে ভাবে আমার দিকে দৃষ্টিপাত করিলেন, তাহাতে বোধ হইল যে, তাঁহার হস্তদ্বয় আবদ্ধ না হইলে তিনি আমাকে খুন করিতেন।

    কম্পাউণ্ডারবাবু কোন কথা কহিলেন না। তিনি কেবল আমার মুখের দিকে হাঁ করিয়া চাহিয়া রহিলেন দেখিয়া, আমি আবার বলিলাম “যখন আমি রামের বাড়ীতে তদারক করিতে আসিয়াছিলাম, তখন আপনাকে দুঃখীর সহিত যে ভাবে কথা কহিতে শুনিয়াছিলাম, তাহাতে আমার স্পষ্টই বিশ্বাস হইয়াছিল যে, আপনাদের মধ্যে অবৈধ প্রণয় আছে। কালীর সহিত দুঃখীর প্রায়ই বিবাদ হইত। সুতরাং দুঃখীর আন্তরিক ইচ্ছা, কালী সেখান হইতে দূর হয়, আপনি দুঃখীর দুঃখে দুঃখিত হইয়া কালীকে খুন করিয়াছেন। কালীর ঘরে যে পদচিহ্ন দেখিয়াছি, তাহার সহিত আপনার পদচিহ্নের কোন প্রভেদ নাই। আপনার পদচিহ্ন ভাল করিয়া দেখিবার জন্যই আমি এখানে আসিয়াছিলাম, –– আমার গাড়িখানি ইচ্ছা করিয়াই ভাঙ্গা হইয়াছিল। কালী দুঃখীর চেয়েও সুন্দরী। আপনি দুঃখীকে পাইয়াও কালীর চেষ্টায় ফিরিতেন। কিন্তু কালী তেমন ছিল না। সে সতী লক্ষ্মী, স্বর্গে গিয়াছে। সে আপনার কথায় রাজী হয় নাই। সেই জন্য তাহার উপর আপনার ভয়ানক আক্রোশ ছিল। এই সকল কারণে আপনি সে রাত্রে সুবিধা পাইয়া কালীর ঘরে প্রবেশ করেন এবং সম্ভবতঃ অন্যায় প্রস্তাব করেন। কালী সম্মতা হয় নাই। তখন আপনি এই রুমালখানি তাহার মুখে চাপা দেন। রুমালখানিতে ক্লোরফরম মাখান ছিল। কাজেই কালী অজ্ঞান হইয়া পড়ে, তখন আপনি স্বহস্তে তাহাকে হত্যা করেন এবং সেই দড়ীতে ঝুলাইয়া রাখেন।” এই বলিয়া রুমালখানি বাহির করিলাম। কম্পাউণ্ডার বাবু তখনও কোন কথা কহিলেন না দেখিয়া আমি তাঁহাকে লইয়া থানায় ফিরিয়া আসিলাম।

    উপসংহার

    থানায় আসিয়া মনমোহন সম্পূর্ণ বশীভূত হইলেন। ভাবিয়াছিলাম, তিনি কোন কথাই স্বীকার করিবেন না। হয় ত সকল কথা প্রমাণ করিবার জন্য আবার আমায় বিলক্ষণ কষ্ট পাইতে হইবে। কিন্তু সেরূপ কিছুই করিতে হইল না। তিনি সকল কথাই স্বীকার করিলেন।

    তিনি বলিলেন “কালীর উপর আমার বহুদিন হইতেই আক্রোশ ছিল। সে আমার কথায় রাজী হইত না। এমন কি, মধ্যে মধ্যে আমাকে নানাপ্রকার ভয় দেখাইত। তাহার উপর রাগ হইবার আরও একটা কারণ ছিল। সে দুঃখীকে বড় কষ্ট দিত। দুঃখী আমার বড় বাধ্য, আমি তাহাকে যেরূপ বলিতাম, সেও তাহাই করিত। আমাদের ভিতর গুপ্ত প্রণয় ছিল। আমি দুঃখীকে আন্তরিক ভালবাসিতাম এবং কালী যাহাতে তাহাকে উৎপীড়ন করিতে না পারে, তজ্জন্য বিশেষ চেষ্টা করিতাম। কিন্তু যতদিন রাম নিকটে ছিল, ততদিন আমি কিছুই করিতে পারিতাম না। আমিই দুঃখীর সহিত পরামর্শ করিয়া রামকে বেলঘরে পাঠাইয়াছিলাম। দুঃখীর ছেলে হইল না বলিয়া সে মধ্যে মধ্যে বড় দুঃখ করিত। আমি শুনিয়াছিলাম, বেলঘরের পঞ্চানন নামে এক দেবতা আছেন; তাঁহার নিকট অনেক রমণী পুত্র কামনা করিয়া গিয়া থাকে। আমিও দুঃখীকে সেই কথা বলিলাম। সে রাম ও কালীর পুত্রকে লইয়া একদিন প্রত্যুষে চলিয়া গেল। সেই রাত্রে বাড়ীতে কেহ না থাকায়, আমার বেশ সুবিধা হইল। আমি একখানি রুমালে ক্লোরফরম মাখাইয়া কালীর ঘরে প্রবেশ করিলাম। কালী গালাগালি দিতে লাগিল। আমি অনেক মিষ্টকথা বলিলাম, অনেক লোভ দেখাইলাম, শেষে অনেক ভয় দেখাইলাম, কিন্তু কিছুতেই সে সম্মতা হইল না। অগত্যা আমি সেই রুমালের সাহায্যে তাহাকে অজ্ঞান করিয়া গলা টিপিয়া হত্যা করিলাম। শেষে ওই মৃতদেহের গলায় ফাঁস দিয়া সেই ঘরের আড়কাঠে ঝুলাইয়া বাড়ী ফিরিয়া আসিলাম। মনে করিয়াছিলাম, কেহ আমার উপর সন্দেহ করিবে না। কিন্তু এখন দেখিতেছি, সেটা ভুল -পুলিসের অসাধ্য কাৰ্য্য নাই।

    যথাসময় বিচার হইয়া গেল। বিচারে মনমোহনের ফাঁসী সাব্যস্ত হইল।

    সম্পূর্ণ

    [ ভাদ্র, ১৩১৬ ]

    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26 27 28 29 30 31 32 33 34 35 36 37 38 39 40 41 42 43 44 45 46 47 48 49 50
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleআরব জাতির ইতিহাস – ফিলিপ কে. হিট্টি (অনুবাদ : প্রিন্সিপাল ইবরাহীম খাঁ)
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    দারোগার দপ্তর ৩ – প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়

    September 22, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    দারোগার দপ্তর ৩ – প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়

    September 22, 2025
    Our Picks

    দারোগার দপ্তর ৩ – প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়

    September 22, 2025

    আরব জাতির ইতিহাস – ফিলিপ কে. হিট্টি (অনুবাদ : প্রিন্সিপাল ইবরাহীম খাঁ)

    September 22, 2025

    নিউ মুন – স্টেফিন মেয়ার

    September 22, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    • Sign Up
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }

    Sign In or Register

    Welcome Back!

    Login below or Register Now.

    Lost password?

    Register Now!

    Already registered? Login.

    A password will be e-mailed to you.