Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    দারোগার দপ্তর ৩ – প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়

    September 22, 2025

    আরব জাতির ইতিহাস – ফিলিপ কে. হিট্টি (অনুবাদ : প্রিন্সিপাল ইবরাহীম খাঁ)

    September 22, 2025

    নিউ মুন – স্টেফিন মেয়ার

    September 22, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • 🔖
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    Subscribe
    সাইন ইন
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    দারোগার দপ্তর ৩ – প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়

    প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায় এক পাতা গল্প1897 Mins Read0

    বিদায় ভোজ

    বিদায় ভোজ 

    প্রথম পরিচ্ছেদ

    দৈনিক কার্য্য শেষ করিয়া বারান্দার ছাদে পায়চারি করিতেছিলাম। শনিবার রাত্রি আটটা বাজিয়া গিয়াছে। সুনীল অম্বরে পূর্ণচন্দ্র। জোছনায় চারিদিক উদ্ভাসিত। মলয় পবন প্রবাসীর দীর্ঘশ্বাসের ন্যায় থাকিয়া থাকিয়া শন্ শন্ শব্দে প্রবাহিত। সঙ্গে সঙ্গে রাজপথের ধূলিকণাগুলি চারিদিকে বিক্ষিপ্ত হইয়া জনগণের মনে অশান্তি আনয়ন করিতেছিল।

    এ হেন সময়ে সহসা আমার একজন বন্ধু সুশীলের কণ্ঠস্বর কর্ণ গোচর হইল। প্রায় এক বৎসর হইল সুশীল পশ্চিমে গিয়াছিল। কতদিন তাহাকে দেখি নাই। তাহার কণ্ঠস্বর শুনিয়া আমার মন অত্যন্ত চঞ্চল হইল। আমি আর নিশ্চিন্তমনে পদচারণা করিতে পারিলাম না। তৎক্ষণাৎ নিম্নে অবতরণ করিলাম। দেখিলাম, সুশীল একজন পুরাতন কনেষ্টবলের সহিত কথা কহিতেছে। সাদর সম্ভাষণ করিয়া আমি তখনই তাহাকে উপরের বৈঠখানায় লইয়া আসিলাম।

    কিছুক্ষণ অন্যান্য কথাবর্তার পর আমি জিজ্ঞাসা করিলাম “এত শীঘ্র ফিরিয়া আসিলে?”

    সুশীল হাসিয়া উত্তর করিল “আমরা কি কোথাও গিয়া নিশ্চিন্ত থাকিতে পারি, আমাদের অদৃষ্ট তেমন নয়! একটা সামান্য কাজের জন্য মা আমাকে বারবার পত্র লিখিয়াছিলেন। কি করি, কতদিন আর তাঁহার কথা অবহেলা করিতে পারি। বৃহস্পতিবারে এখানে আসিয়া উপস্থিত হইয়াছি।”

    আমি ঈষৎ হাসিয়া জিজ্ঞাসা করিলাম “কি এমন কাজ যে, তুমি না থাকিলে হইত না?”

    সু। আমার দিদির শ্বশুর ও শাশুড়ী তীর্থযাত্রা করিয়াছেন। যাইবার পূর্ব্বে তাঁহারা আমার মাতাঠাকুরাণীর সহিত সাক্ষাৎ করিতে আসিয়াছিলেন। সেই উপলক্ষে আমাদের কয়েকজন আত্মীয়-স্বজনকেও নিমন্ত্রণ করা হইয়াছিল।

    আ। কেন? তাঁহারা কি আর ফিরিবেন না?

    সু। অভিপ্রায় ত এই—তবে ঠিক বলিতে পারি না। কিন্তু সে যাহা হউক, এখন আমাদের মহা বিপদ। তুমি ভিন্ন অপর কেহই আমাদিগকে সে বিপদ হইতে মুক্ত করিতে পারিবে না।

    এই বলিয়া সুশীল এক দীর্ঘনিশ্বাস ত্যাগ করিল এবং আমার মুখের দিকে চাহিয়া রহিল। আমি তাহার কথার তাৎপর্য বুঝিতে পারিলাম না। জিজ্ঞাসা করিলাম “কি এমন বিপদ?”

    সুশীল বলিল “বাড়ী হইতে একটা দামী আংটী চুরি গিয়াছে। এত চেষ্টা করিলাম কিন্তু আংটীটা পাওয়া গেল না। হয় ত আমাদিগকে উহার মূল্য দিতে হইবে।”

    আ। মূল্য কত?

    সু। শুনিলাম, পাঁচ হাজার টাকা। যদি বাস্তবিকই আংটীটি না পাওয়া যায়, তাহা হইলে কেমন করিয়া অত টাকা দিব?

    আ। কবে চুরি হইয়াছে?

    সু। গত রাত্রে।

    আ। কেমন করিয়া চুরি হইল?

    সু। আহারাদির পর যখন সকলে বসিয়া গল্প-গুজব করিতেছিলেন, সেই সময়ে আমার এক জ্ঞাতি ভাই-এর কন্যা তথায় উপস্থিত হয়। তাহার হাতেই সেই আংটীটি ছিল। আমার মাতাঠাকুরাণীই প্রথমে উহা দেখিতে পান এবং তাহার মূল্য জিজ্ঞাসা করেন। আমার ভ্রাতুষ্কন্যা মূল্য বলিলে পর উপস্থিত সকলেই আশ্চৰ্য্যান্বিত হয়। মা তখন আংটীটি দেখিতে চান। মার দেখা হইলে আর একজন রমণী তাহা গ্রহণ করেন এবং যথেষ্ট প্রশংসা করেন। আর একজন মহিলা তাঁহার নিকট হইতে গ্রহণ করেন। এইরূপে সমাগত প্রায় সকলেই এক একবার সেই আংটীটি লন এবং দেখিয়া পরবর্তী লোকের হস্তে প্রদান করেন। কিছুক্ষণ পরে আমার ভ্রাতুষ্কন্যা যখন তাহা ফিরিয়া চাহিল, তখন সকলেই বলিলেন, তাঁহাদের নিকট আংটীটি নাই। প্রত্যেকেই বলিলেন, আংটীটি দেখিয়া অপর ব্যক্তিকে প্রদান করিয়াছেন।

    আ। তোমার ভ্রাতুষ্কন্যা ত সেই স্থানেই ছিলেন?

    সু। না ভাই! সে মার হাতে আংটীটি প্রদান করিয়া অন্যত্র গিয়াছিল।

    আ। তোমার মাতাঠাকুরাণী কি বলেন?

    সু। বলিবেন আর কি, তিনি যাঁহার হস্তে আংটীটি দিয়াছিলেন, তাঁহার নিকট হইতে চাহিলেন। কিন্তু তিনিও অপর এক ব্যক্তিকে দেখাইয়া দিলেন।

    সুশীলের কথা শুনিয়া আমি স্তম্ভিত হইলাম। ভাবিলাম, যদি আংটীটা সত্য সত্যই চুরি গিয়া থাকে, তাহা হইলে তাহার আর পুনরুদ্ধারের উপায় নাই। কিন্তু সে কথা তখন সুশীলকে বলিলাম না। কিছুক্ষণ চিন্তার পর জিজ্ঞাসা করিলাম, “তখন সেখানে কোন অপর লোক ছিল?”

    কিছুক্ষণ কি ভাবিয়া সুশীল উত্তর করিল “না, যাঁহারা তখন সেখানে ছিলেন, তাঁহারা সকলেই আমাদের বিশেষ আত্মীয়।”

    আ। কাহারও উপর সন্দেহ হয়?

    সু। না—তবে কাহার মনে কি আছে কেমন করিয়া বলিব?

    আ। ভাল করিয়া অন্বেষণ করিয়াছিলে?

    সু। আমাদের যতদূর সাধ্য। তবে তোমাদের চক্ষুর সহিত আমাদের চক্ষুর তুলনা হয় না। আমরা প্রাণপণে অন্বেষণ করিয়া যাহা বাহির করিতে পারি নাই, তুমি অতি অল্পকালের মধ্যেই তাহা বাহির করিয়া দিয়াছিলে। সেইজন্যই মা আমায় তোমার নিকট পাঠাইয়া দিয়াছেন এবং তোমাকে আমাদের বাড়ীতে যাইবার জন্য বারম্বার অনুরোধ করিয়াছেন।

    দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ

    কথায় কথায় রাত্রি নয়টা বাজিয়া গেল। আর বিলম্ব না করিয়া আমি একজন কনেষ্টবলকে একখানি গাড়ি ভাড়া করিয়া আনিতে বলিলাম এবং শকট আনীত হইলে দুই বন্ধুতে মিলিয়া তাহাতে আরোহণ করিলাম।

    অর্দ্ধঘণ্টার মধ্যেই রামবাগানে আসিয়া উপস্থিত হইলাম। সুশীলের বাড়ীখানি দ্বিতল ও নিতান্ত ক্ষুদ্র নয়। বাড়ীর দরজায় গাড়িখানি স্থির হইলে আমরা উভয়েই অবতরণ করিলাম। পরে কোচমানকে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করিতে বলিয়া সুশীলের সহিত ভিতরে প্রবেশ করিলাম।

    ইতিপূর্ব্বে আমি অনেকবার সুশীলের বাড়ী গিয়াছিলাম। সুশীলের মাতাঠাকুরাণী আমাকে পুত্রবৎ স্নেহ করেন। সুতরাং অন্দরে প্রবেশ করিতে আমার কিছুমাত্র লজ্জাবোধ হইল না।

    সুশীল আমাকে লইয়া একেবারে তাহার মাতাঠাকুরাণীর গৃহে প্রবেশ করিল। সুশীলের মাতা তখন সেই ঘরেই ছিলেন, আমাকে দেখিবামাত্র এক দীর্ঘনিশ্বাস ত্যাগ করিয়া বলিলেন “আসিয়াছ বাবা! বড়ই বিপদে পড়িয়াছি—তুমি বিপদের কাণ্ডারী।”

    আমিও দুঃখিত ভাবে বলিলাম, “আজ্ঞে আমি সুশীলের মুখে সকল কথাই শুনিয়াছি। কিন্তু যখন সকলেই আপনাদের আত্মীয়, তখন আংটীটা বোধ হয় কোথায় পড়িয়া গিয়া থাকিবে।”

    সুশীলের মাতাঠাকুরাণী বলিলেন “আমরা সকলেই ত তন্ন তন্ন করিয়া খুঁজিয়াছি, কিন্তু কই, আংটী ত পাওয়া গেল না।”

    আ। কি রকম আংটী?

    সুশীল নিকটেই ছিল। সে বলিল, “দেখিতে তেমন দামী বলিয়া বোধ হয় না। তবে আংটার উপরে একটি ক্ষুদ্র ঘড়ী আছে। ঘড়ীটি এত ছোট যে, দেখিয়া সহজে সময় স্থির করা যায় না। দূরবীণ দিয়া না দেখিলে ঘড়ীর দাগগুলি জানিতে পারা যায় না। ঘড়ীর দুই পার্শ্বে দুইখানি বড় বড় হীরক আছে। হীরক দুইখানির দাম অনেক বলিয়া বোধ হইল।”

    আমি তখন সুশীলের মাতাঠাকুরাণীর দিকে চাহিয়া জিজ্ঞাসা করিলাম “কোন্ স্থানে বসিয়া আপনারা আংটাটি দেখিয়াছিলেন?”

    সু-মা। ভিতরের দালানে।

    আ। তখন সেখানে কতগুলি লোক ছিলেন?

    সু-মা। প্রায় কুড়িজন।

    আ। সকলেই কি স্ত্রীলোক?

    সু-মা। না-চারিজন মাত্র পুরুষ ছিলেন।

    আ। সকলেই কি গৃহে ফিরিয়া গিয়াছেন?

    সু-মা। যাহার আংটী সে গিয়াছে আর আমার বেয়ান ও বেহাই কাশী যাত্রা করিয়াছেন। আর সকলেই আছেন।

    আমি আশ্চৰ্য্যান্বিত হইলাম। ভাবিলাম, তাঁহারা নিমন্ত্রণ রক্ষা করিতে আসিয়াছিলেন, এখনও গৃহে প্রত্যাগমন করেন নাই কেন? কিন্তু মুখে কোন কথা বলিলাম না।

    আমাকে নীরব দেখিয়া সুশীলের মাতাঠাকুরাণী আমার মনোগত অভিপ্রায় বুঝিতে পারিলেন। তিনি বলিলেন “এই আংটীর গোলযোগ না মিটিলে তাঁহারা ত এ বাড়ী ছাড়িতে চান না। আমি অনেক অনুরোধ করিয়াছি কিন্তু কেহই আমার কথা গ্রাহ্য করিতেছেন না।”

    আ। আপনার বেয়ান কি আর বাড়ী ফিরিয়া যান নাই? আপনাদের বাড়ী হইতেই কি তীর্থ যাত্রা করিয়াছেন?

    সু-মা। এইরূপই কথা ছিল। তাঁহারা উভয়েই প্রস্তুত হইয়া এখানে আসিয়াছেন।

    আ। তাঁহারা কি আর ফিরিবেন না?

    সু-মা। সে কথা ঠিক জানি না বাবা! তাঁহাদের কথা তোমার অগোচর নাই। তাঁহারা আমার সহিত এতদিন যেমন ব্যবহার করিয়া আসিতেছিলেন, তাহাও তোমার অবিদিত নাই। সরলার মুখে শুনিলাম, তাঁহারা সকল তীর্থ ভ্রমণ করিবেন। কবে ফিরিবেন তাহার স্থিরতা নাই। সেই জন্যই নিমন্ত্রণ করিয়াছিলাম।

    আর কোন প্রশ্ন না করিয়া আমি সুশীলের সহিত ভিতরের দালানে গমন করিলাম এবং উভয়ে মিলিয়া দুই তিনজন ভৃত্যের সাহায্যে সমস্ত স্থান ভাল করিয়া অন্বেষণ করিলাম। কিন্তু আংটীটির কোন নিদর্শন পাওয়া গেল না।

    সে রাত্রে বৃথা পরিশ্রম করিতে ইচ্ছা হইল না। সুশীলকেও তাহা বলিলাম; এবং উভয়ে মিলিয়া পুনরায় তাঁহার মাতাঠাকুরাণীর গৃহে ফিরিয়া আসিলাম। আমাদিগকে দেখিয়াই তিনি সাগ্রহে জিজ্ঞাসা করিলেন “কি বাবা, আংটীটা পাও নাই?”

    আমি কিছু সলজ্জভাবে উত্তর করিলাম “আজ্ঞে না–কিন্তু রাত্রিকালে অন্বেষণের সুবিধা হয় না। বিশেষতঃ আজ অনেক রাত্রি হইয়াছে। কাল অতি প্রত্যূষে আমি পুনরায় এখানে আসিয়া ভাল করিয়া অনুসন্ধান করিব।”

    সুশীলের মাতা আন্তরিক সন্তুষ্ট হইলেন। তিনি বলিলেন “এখন তোমারই ভরসা বাবা! তুমি আর সুশীল এক আত্মা বলিলেও হয়। সুশীলের বিপদ আপদে তুমি না দেখিলে আর কে দেখিবে বাবা। কিন্তু আংটীটা কি আর ফিরিয়া পাইব?”

    আমি বলিলাম “ সে কথা এখন বলিতে পারিলাম না। তবে যাহাতে উহাকে বাহির করিতে পারি, সেজন্য প্রাণপণে চেষ্টা করিব।”

    এই বলিয়া তাঁহার নিকট বিদায় লইলাম এবং সুশীলের হাত ধরিয়া বাড়ীর সদর দরজায় আগমন করিলাম। পরে সেই শকটে আরোহণ করিয়া সুশীলকে চুপি চুপি বলিলাম, “যাহাতে আর কোন লোক এখান হইতে না যাইতে পারে, তাহার উপায় করিও। সকলের মনের কথা জানা যায় না। আমার দৃঢ়বিশ্বাস, আংটীটা কেথাও না কোথাও পড়িয়া আছে। কিন্তু যদি বাস্তবিক তাহা না হয়, তাহা হইলে একবার প্রত্যেককে জিজ্ঞাসা না করিয়া কোন কাৰ্য্যে হস্তক্ষেপ করা হইবে না।”

    আমার শেষ কথা শুনিয়া সুশীল জিজ্ঞাসা করিল “তবে কি তুমি এ সংবাদ তোমার ডায়েরিতে লিখিয়া রাখিবে?” আমি ঈষৎ হাসিয়া বলিলাম “আজ রাত্রে আর লিখিব না। কাল প্রাতে অন্বেষণ করিয়াও যদি উহা বাহির করিতে না পারি, তাহা হইলে বুঝিব যে, কোন লোক নিশ্চয়ই আংটীটি চুরি করিয়াছে? চোরকে কোনরূপে প্রশ্রয় দিতে নাই।” কিছুক্ষণ কি ভাবিয়া সুশীল বলিল “তুমি ঠিক বলিয়াছ। চোর যাহাতে শাস্তি পায় তাহার চেষ্টা করিতে হইবে। কিন্তু দেখিও, বিনাদোষে যেন কোন লোক উৎপীড়িত না হয়।”

    “সে বিষয়ে নিশ্চিত্ত থাক” এই বলিয়া আমি কোচমানকে শকট চালনা করিতে আদেশ করিলাম। সুশীল বিদায় লইয়া বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিল। কোচমানও শকট চালনা করিল।

    তৃতীয় পরিচ্ছেদ

    অধিক রাত্রি জাগরণ বশতঃই হউক বা রবিবার বলিয়াই হউক, সেদিন যখন শয্যাত্যাগ করিলাম, তখন ছয়টা বাজিয়া গিয়াছে। সত্বর প্রাতঃকৃত্য সমাপন করিয়া দুইজন বিশ্বাসী কনেষ্টবল লইয়া সুশীলের বাড়ীতে গমন করিলাম। বিলম্ব দেখিয়া সুশীলের মাতাঠাকুরাণী ব্যস্ত হইয়া পড়িয়াছিলেন। তিনি পুত্রকে বারম্বার আমার নিকটে যাইতে আদেশ করিতেছিলেন; কিন্তু সুশীল তাঁহাকে মিষ্টবাক্যে প্রবোধ দিতে চেষ্টা করিতেছিল, এমন সময়ে আমি তথায় গিয়া উপস্থিত হইলাম।

    আমাকে দেখিবামাত্র সুশীল দাঁড়াইয়া উঠিল এবং সাদর সম্ভাষণ করিয়া তাহার মাতাঠাকুরাণীর নিকট লইয়া গেল। আমাকে দেখিয়া তিনি দীর্ঘনিশ্বাস ত্যাগ করিলেন। পরে বলিলেন “আসিয়াছ বাবা! এতক্ষণ আমি কতই ভাবিতেছিলাম। একবার দেখ বাবা! আংটীটা যদি বাহির করিতে পার, তাহা হইলে যাবজ্জীবন তোমার কেনা হইয়া থাকিব।”

    আমি শশব্যস্তে বলিলাম, “অমন কথা বলিবেন না। আমি প্রাণপণে চেষ্টা করিব।”

    এই বলিয়া সুশীলের দিকে চাহিলাম। পরে বলিলাম “আমার সহিত দুইজন লোক আসিয়াছে। আমি তাহাদিগকে বাড়ীর দরজায় অপেক্ষা করিতে বলিয়া আসিয়াছি। তুমি তাহাদিগকে বাড়ীর ভিতরে ডাকিয়া আন। একবার সকলে মিলিয়া ভাল করিয়া অন্বেষণ করা যাউক।”

    সুশীল তখনই আমার আদেশ পালন করিল। কনেষ্টবল দুইজন আমার নিকট আসিলে আমি তাহাদিগকে লইয়া সুশীলের সহিত ভিতরের দালানে গমন করিলাম এবং পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে সকল স্থান অন্বেষণ করিলাম। কিন্তু দুর্ভাগ্য বশতঃ আংটাটার কোন নিদর্শন পাওয়া গেল না।

    প্রায় দুই ঘণ্টা কাল যৎপরোনাস্তি পরিশ্রমের পর আমরা পুনরায় বাহির-বাটীতে আগমন করিলাম। সুশীলের মাতাঠাকুরাণী তখনই আমাদের নিকট উপস্থিত হইয়া আংটীর কথা জিজ্ঞাসা করিলেন এবং আমার উত্তর শুনিয়া দীর্ঘনিশ্বাস ত্যাগ করতঃ বলিলেন “এখন উপায় কি বাবা! আংটীটা কি আর পাওয়া যাইবে না?”

    সুশীলের মাতার সেই বিমর্ষ মুখমণ্ডল দেখিয়া ও তাঁহাকে ঘন ঘন দীর্ঘনিশ্বাস ত্যাগ করিতে অবলোকন করিয়া আমি আন্তরিক দুঃখিত হইলাম। সহসা তাঁহার প্রশ্নের কি উত্তর দিব তাহা ভাবিয়া স্থির করিতে পারিলাম না। কিছুক্ষণ চিন্তার পর বলিলাম “বাস্তবিকই বড় আশ্চার্য্য কথা! যখন সেখানে সমস্ত আত্মীয় স্বজন উপস্থিত ছিলেন, তখন তাঁহাদের মধ্যে যে কেহ সেই আংটীটা চুরি করিবেন এমন ত বোধ হয় না। কিন্তু সকল স্থানই ত তন্ন তন্ন করিয়া অন্বেষণ করিলাম। এখন আমার বড় ভাল বোধ হইতেছে না। পূৰ্ব্বে ভাবিয়াছিলাম, আংটীটা কোথাও পড়িয়া আছে কিন্তু এখন আমার আর সে ধারণা নাই। নিশ্চয়ই কোন লোক উহার লোভ সংবরণ করিতে পারে নাই।”

    আমার কথায় বাধা দিয়া সুশীলের মাতা জিজ্ঞাসা করিলেন “তবে কি আর উহাকে ফিরিয়া পাইবার আশা নাই? “ কিছুক্ষণ ভাবিয়া আমি বলিলাম “আর একবার চেষ্টা না করিয়া আপনার কথার উত্তর দিতে পারিব না।” ঈষৎ হাসিয়া তিনি বলিলেন “সমস্ত স্থানই ত অনুসন্ধান করা হইয়াছে, আবার কোথায় খোঁজ করিবে বাবা?” আ। না–আমি খুঁজিবার কথা বলি নাই। এখন আমার দৃঢ়বিশ্বাস হইতেছে যে, আংটীটা কেহ চুরি করিয়াছে। কিন্তু কে যে চুরি করিয়াছে তাহা জানিতে হইবে। আমি আপনাকে গোটাকতক কথা জিজ্ঞাসা করিব। আপনি তাহার যথাযথ উত্তর দিন।

    সুশীলের মাতাঠাকুরাণী দীর্ঘনিশ্বাস ত্যাগ করিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন “কি বলিবে বল বাবা?”

    আ। আংটীটা প্রথমে কে দেখিতে চাহিয়াছিল?

    সু-মা। আমি-আমার দেখা হইলে পর আমার পার্শ্বস্থ প্রতিবেশীর এক কন্যার হাতে দিয়াছিলাম।

    আ। তিনি এখন এখানে উপস্থিত আছেন?

    সু-মা। হাঁ বাবা, আছে।

    আ। তাঁহার বয়স কত?

    সু-মা। প্রায় ত্রিশ বৎসর – বিধবা।

    আ। একবার তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করুন, তিনি কাহার হস্তে আংটীটি প্রদান করিয়াছিলেন।

    সুশীলের মাতাঠাকুরাণী তখনই গাত্রোত্থান করিলেন এবং সেখান হইতে প্রস্থান করিলেন। কিছুক্ষণ পরে পুনরায় প্রত্যাগমন করিয়া বলিলেন “সুরমা তাহার ভ্রাতৃবধূর হাতে দিয়াছিল। সে আবার আমার বেয়ানের হাতে দেয়।”

    আমি জিজ্ঞাসা করিলাম “আপনার বেয়ান কাহার হাতে দিয়াছিলেন?”

    সুশীলের মাতা কিছুক্ষণ কি ভাবিয়া বলিলেন, “আমি ত বাবা সেখানে উপস্থিত ছিলাম না। স্বচক্ষে কিছুই দেখি নাই। তবে বেয়ান ও বেহাই ছাড়া আর সকলেই এখানে উপস্থিত আছে। একবার তাহাদিগকে জিজ্ঞাসা করিয়া দেখি কি বলে।”

    এই বলিয়া সুশীলের মাতা পুনরায় সেই স্থান হইতে চলিয়া গেলেন এবং কিছুক্ষণ পরে ফিরিয়া আসিয়া বলিলেন “বেয়ান আংটীটা দেখিয়া বেহাই-এর হাতে দিয়াছিলেন। কিন্তু বেহাই উহা কাহাকেও দিয়াছিলেন কি না সেকথা কেহই বলিতে পারে না।”

    আমি জিজ্ঞাসা করিলাম “কোন লোক কি উহা লক্ষ্য করিয়াছিল? যাঁহার আংটী তিনি এ বিষয়ে কি বলেন? অত টাকার জিনিষটা অপরের হস্তে দিয়া তিনি কেমন করিয়া নিশ্চিন্ত রহিলেন?”

    সৌভাগ্য বশতঃ আংটীর অধিকারিণী নিকটেই ছিলেন। সুশীলের মাতা তাহার নিকট গিয়া ওই কথা জিজ্ঞাসা করিলেন। পরে তাহার উত্তর পাইয়া আমার দিকে চাহিয়া বলিলেন, “না বাবা! তাহা লক্ষ্য করে নাই। বিশেষতঃ তাহার মনে কোন প্রকার সন্দেহ ত হয় নাই। যদি হইত, তাহা হইলে অবশ্যই লক্ষ্য করিত।”

    আমি তখন জিজ্ঞাসা করিলাম “আপনার বেয়ান ও বেহাই ত এ দেশ ত্যাগ করিয়া দিয়াছেন। সুতরাং তাঁহাদের সহিত ত এখন আর সাক্ষাৎ হইবার কোন সম্ভাবনা নাই, তাঁহারা কি সত্য সত্যই কাশীধামে গমন করিয়াছেন?”

    ঈষৎ হাসিয়া সুশীলের মাতাঠাকুরাণী উত্তর করিলেন “তুমি ত সকলই জান বাবা! তাঁহাদের কথা তোমাকে আর নূতন করিয়া কি বলিব? তবে যখন সমস্ত উদ্যোগ করিয়া বাড়ী হইতে বাহির হইয়াছেন, তখন বোধ হয় এবার সত্য সত্যই কাশীধামে গমন করিবেন।”

    আ। আরও দুইবার ত তাঁহারা এইরূপ করিয়াছিলেন।

    সু-মা। হাঁ বাবা, তাঁহাদের মনের কথা বোঝা ভার।

    আ। তবে এবারও যদি সেই মত হয়?

    সু-মা। এবার শুনিলাম, তাঁহারা এখান হইতেই হাওড়া যাইবেন, আর বাড়ীতে যাইবেন না, এই রকম কথা ছিল। আ। এখানকার কোন লোক তাঁহাদের সঙ্গে গিয়াছিল?

    সু-মা। না বাবা! আমি সঙ্গে যাইতে বলিয়াছিলাম, কিন্তু বেহাই তাহাতে রাজী হইলেন না। আমার ইচ্ছা ছিল, বাড়ীর চাকর তাঁহাদিগকে গাড়িতে তুলিয়া দিয়া আসে। বেয়ান রাজী ছিলেন বটে কিন্তু কর্তা মত করিবেন না।

    আ। এখান হইতে কখন রওনা হইয়াছেন?

    সু-মা। আজ বেলা নয়টার সময়।

    আ। অবশ্য গাড়ি করিয়া ষ্টেসনে গিয়াছেন?

    সু-মা। হাঁ বাবা!

    আ। কে গাড়ি ডাকিয়া আনিয়াছিল?

    সু-মা। বাড়ীর চাকর।

    ঠিক সেই সময় সেই ভৃত্য তথায় উপস্থিত হইল। আমি তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলাম, “সদা! কোথা হইতে গাড়ি ভাড়া করিয়া আনিয়াছিল?”

    সদানন্দ উত্তর করিল “আজ্ঞে-আমাদের গলির মোড়ে তখন একখানি খালি গাড়ি ছিল। আমি সেই গাড়িই ভাড়া করিয়াছিলাম।

    আ। কেন? নিকটেই ত আস্তাবল ছিল?

    স। সেখানে তখন একখানিও গাড়ি ছিল না।

    আ। গাড়িখানার নম্বর জানিস?

    সদানন্দ ওরফে সদা ঈষৎ হাসিয়া বলিল, “আজ্ঞে –আমি ত ইংরাজী পড়িতে জানি না, তবে সেই কোচম্যানের সহিত আমার আলাপ আছে।”

    আমি ব্যগ্র ভাবে জিজ্ঞাসা করিলাম “তাহার আস্তাবল কোথায়?”

    সদানন্দ কিছুক্ষণ চিন্তা করিয়া বলিল “আজ্ঞে সে কথা ঠিক বলিতে পারিলাম না। তাহার নাম করিমবক্স এই পৰ্যন্ত জানি।”

    আ। তোর সহিত কেমন করিয়া আলাপ হইল?

    স। আজ্ঞে, এক দেশে বাড়ী।

    আ। তোদের বাড়ী কোথায়?

    স। মেদিনীপুরে।

    আ। গাড়িখানি কি তাহার নিজের?

    স। আজ্ঞে হাঁ।

    আর কোন প্রশ্ন জিজ্ঞাসা না করিয়া আমি গাত্রোত্থান করিলাম। আমাকে প্রত্যাগমনে উদ্যত দেখিয়া সুশীল অতি নম্রভাবে জিজ্ঞাসা করিল, “কি ভাই, আংটীটা পাইবার আর আশা আছে কি?”

    কি উত্তর দিব স্থির করিতে না পারিয়া, আমি কোন কথা বলিলাম না। সুশীল আর কোন প্রশ্ন করিতে সাহস করিল না। কিন্তু তাহার মাতাঠাকুরাণী অতি বিমর্ষভাবে জিজ্ঞাসা করিলেন “এখন কি করিবে বাবা! আংটীটা কি আর পাওয়া যাইবে না? যদি তাহাই হয় তাহা হইলেই সৰ্ব্বনাশ! শুনিয়াছি, তেমন আংটী শহরে নাই। আংটীটা না কি বিলাত হইতে আনান হইয়াছিল।”

    সুশীলের মাতার কথা শুনিয়া আমি আন্তরিক দুঃখিত হইলাম। কিছুক্ষণ ভাবিয়া বলিলাম “একেবারে হতাশ হইবেন না। যতক্ষণ শ্বাস, ততক্ষণ আশ, আমি আর একবার চেষ্টা করিয়া দেখি, তাঁহার পর আপনার কথার উত্তর দিব।”

    এই বলিয়া আমি সুশীলের নিকট বিদায় লইলাম, সুশীল আমার সঙ্গে সঙ্গে বাড়ীর সদর দরজা পৰ্য্যন্ত আসিল। পরে আমাদিগকে গাড়িতে আরোহণ করিতে দেখিয়া কোচম্যানকে শকট চালনা করিতে আদেশ করতঃ পুনরায় বাড়ীর ভিতরে গমন করিল।

    চতুর্থ পরিচ্ছেদ

    থানায় ফিরিয়া আসিয়া স্নানাহার সমাপন করিলাম। পরে অপর একটি কার্য্যের জন্য পুলিস আদালতে গমন করিলাম। তত্রত্য কার্য্য সমাপন করিতে বেলা দুইটা বাজিয়া গেল। যখন পুনরায় থানায় প্রত্যাগমন করিলাম, তখন বেলা প্রায় তিনটা।

    একে গ্রীষ্মকাল, তাহার উপর প্রচণ্ড রৌদ্র, কাহার সাধ্য ঘরের বাহির হয়। নিতান্ত প্রয়োজন না হইলে আর কেহ সেই রৌদ্রে যাতায়াত করে না। আদালত হইতে প্রত্যাগমন করিয়া আমি অত্যন্ত ক্লান্ত হইয়া পড়িলাম এবং একটি নিভৃত স্থানে গিয়া বিশ্রাম করিতে লাগিলাম।

    কিছুক্ষণ পরে ভাবিলাম, কেমন করিয়া সুশীলের উপকার করি। আংটীটা চুরি যাওয়ায় সুশীলের মাতার মন এত খারাপ হইয়া গিয়াছে যে, আংটী না পাইলে হয় ত তিনি উন্মাদ হইয়া পড়িবেন। তাঁহার অর্থের অভাব নাই, অর্থের জন্য তাঁহার বিশেষ কষ্ট হইবে না কিন্তু তাঁহার বাড়ীতে, তাঁহারই আত্মীয়ের দ্বারা আংটীটা চুরি হইয়াছে জানিয়া তিনি মর্মান্তিক দুঃখিত হইয়াছেন।

    এইরূপ চিন্তার পর আমি ভাবিলাম, করিমবক্সের সন্ধান জানিতে পারিলে সুশীলের মাতার বেয়ান ও বেহাইএর সংবাদ জানা যাইতে পারে। কিন্তু করিমবক্সের সন্ধান পাই কোথায়? কেমন করিয়া তাহাকে বাহির করি। ভাবিলাম, মিউনিসিপাল আপিসে গাড়ির নম্বর ও অধিকারীর নাম লেখা থাকে। হয়ত সেখানে যাইলে করিমবক্সের ঠিকানা পাওয়া যাইতে পারে। কিন্তু করিমবক্স সাধারণ নাম, হয় ত অনেক করিমবক্স ভাড়াটিয়া গাড়ির অধিকারী। আমি কোন করিমবক্সের নিকট যাইব?

    কিছুক্ষণ এই প্রকার চিন্তা করিয়া অগ্রে মিউনিসিপাল আপিসে যাওয়াই যুক্তিসিদ্ধ বিবেচনা করিলাম এবং তখনই একজন কনেষ্টবলকে একখানি গাড়ি আনিতে বলিলাম।

    যখন মিউনিসিপাল আপিসে উপস্থিত হইলাম, তখন বেলা চারিটা। যে সাহেব ভাড়াটীয়া গাড়ির হিসাব রাখিতেন, তাঁহার সহিত আমার আলাপ ছিল। আমাকে দেখিয়া তিনি সাদর সম্ভাষণ করিলেন এবং বেলা অবসানে সেখানে গমন করিবার কারণ জিজ্ঞাসা করিলেন।

    আমার কথা শুনিয়া তিনি তখনই একজন কেরাণীকে আবশ্যকীয় পুস্তকাদি আনয়ন করিতে আদেশ করিলেন; পুস্তক আনীত হইলে তিনি স্বয়ং অতি মনোযোগের সহিত পরিদর্শন করিতে আরম্ভ করিলেন।

    কিছুক্ষণ দেখিবার পর তিনি তিনজন করিমবক্সকে তৃতীয় শ্রেণীর গাড়ির, দুইজনকে দ্বিতীয় শ্রেণীর গাড়ির অধিকারী জানিতে পারিলেন। আমি তাহাদের গাড়ির নম্বর ও ঠিকানা জিজ্ঞাসা করিলে তিনি একখানি কাগজে ওই সকল বিষয় লিখিয়া আমার হস্তে প্রদান করিলেন। আমিও তাঁহাকে শত শত ধন্যবাদ দিয়া তাঁহার নিকট বিদায় লইলাম।

    গাড়িতে উঠিয়া কাগজখানি পাঠ করিলাম; দেখিলাম, পাঁচজন করিমবক্সের ভাড়াটীয়া গাড়ি আছে। সৌভাগ্যের বিষয় এই যে, তাহারা সকলেই কলিকাতায় বাস করে।

    থানায় উপস্থিত হইয়া আমি একজন কনেষ্টবলকে সুশীলের বাড়ীতে পাঠাইয়া দিলাম এবং সদানন্দকে সত্বর সঙ্গে করিয়া আনিতে আদেশ করিলাম। কারণ সে ভিন্ন সহজে আসল করিমবক্সের সন্ধান পাওয়া যাইবে না।

    সন্ধ্যার পূর্ব্বেই সদাকে লইয়া কনেষ্টবল ফিরিয়া আসিল। আমি সদাকে সঙ্গে করিয়া পুনরায় একখানি ভাড়াটীয়া গাড়ি করিয়া এক এক করিয়া করিমবক্সের আস্তাবলে যাইতে আরম্ভ করিলাম।

    প্রথম তিনটি করিমবক্স আমাদের করিমবক্স নহে। চতুর্থ করিমবক্সকে দেখিয়া সদা চিনিতে পারিল। সে তাহার সহিত আমাকে দেখিয়া অত্যন্ত ভীত হইল এবং একদৃষ্টে কাতর নয়নে আমার মুখের দিকে চাহিয়া রহিল।

    করিমের ভীতভাব ও বিষণ্ন বদন অবলোকচন করিয়া আমার কেমন দয়া হইল। আমি মিষ্টবচনে বলিলাম “আমি তোমার কোন অনিষ্ট করিবার জন্য এখানে আসি নাই, একটি বিশেষ কথা জানিবার জন্য তোমার নিকট উপস্থিত হইয়াছি।”

    পরে সদানন্দকে নিৰ্দ্দেশ করিয়া জিজ্ঞাসা করিলাম “তুমি এই লোকটিকে চেন?”

    করিম হাসিয়া বলিল, “আজ্ঞে বেশ চিনি, এক দেশের—এমন কি এক পাড়ার লোক।”

    আ। সদার মনিবের বাড়ী হইতে কাল সকালে যে সওয়ারি লইয়া গিয়াছিলে, তাহাদিগকে কোথায় রাখিয়া আসিয়াছ?”

    আমার কথা শুনিয়া করিম যেন আশ্চর্যান্বিত হইল। একবার আমার মুখের দিকে চাহিয়া বলিল, “আজ্ঞে হাওড়া ষ্টেসনে। সেখানে যাইবার জন্যই ত গাড়ি ভাড়া করা হইয়াছিল?

    আ। তুমি কত ভাড়া পাইয়াছিল?

    করিমের কৌতূহল আরও বৃদ্ধি হইল। সে জিজ্ঞাসা করিল “কেন মহাশয় এ কথা জিজ্ঞাসা করিতেছেন? তাঁহারা আট আনার ভাড়া করিয়াছিলেন, তাহাই দিয়াছেন।”

    আ। শুনিয়াছি, কৰ্ত্তাটি বড় কৃপণ। সেইজন্যই জিজ্ঞাসা করিতেছি। তুমি যে পুরা ভাড়া আদায় করিতে পারিয়াছ, তাহাই যথেষ্ট।

    আমার কথায় করিমের সাহস বৃদ্ধি হইল। সে হাসিয়া বলিল “হুজুর! আপনি যথার্থই বলিয়াছেন। আধুলীটা বাহির করিতে আধ ঘণ্টা লাগিয়াছিল, তাঁহারা যে বড় ভাল লোক নয় তাহা বেশ বুঝিতে পারিয়াছি।”

    আমি দেখিলাম, কোচম্যানের বেশ সাহস হইয়াছে। মিষ্টকথায় এখন তাহার মনের কথা বাহির করিয়া লইতে পারা যায়। এই ভাবিয়া অতি মৃদুস্বরে জিজ্ঞাসা করিলাম “তোমরা কখন ষ্টেসনে উপস্থিত হইয়াছিলে?”

    ক। আজ্ঞে তখন বেলা প্রায় সাড়ে আটটা।

    আ। তাঁহারা কোন ট্রেনে গিয়াছে জান?

    করিমবক্স ঈষৎ হাসিয়া বলিল “কোন ট্রেনেই নয় বলিয়া বোধ হয়।”

    আমি বিস্মিত হইয়া জিজ্ঞাসা করিলাম “সে কি?”

    ক। তাঁহাদের কথাবর্তা শুনিয়া ওইরূপই বোধ হইয়াছিল।

    আ। কি কথা? কখন শুনিলে?

    করিম ঈষৎ হাসিয়া বলিল “হাওড়া ষ্টেসনে যাইবার সময় হ্যারিসন রোডের মোড়ে আমার একটি ঘোড়ার জোত খুলিয়া যায়। আমি তখনই গাড়ি থামাইয়া অবতরণ করি এবং জোত বাঁধিয়া দিই। যখন গাড়ি হইতে নামিতেছিলাম, সেই সময় কর্তা বলিতেছিলেন, ষ্টেসন পৰ্য্যন্ত না যাইলে কোচম্যান সন্দেহ করিতে পারে।”

    কথাটা শুনিয়া আমার সন্দেহ হইল, ভাবিলাম, যাঁহারা তীর্থে যাইবার জন্য প্রস্তুত হইয়া গৃহ হইতে বহির্গত হইয়াছেন, তাঁহারা এমন কথা বলেন কেন? কিন্তু সে সকল কথার উল্লেখ না করিয়া আমি হাওড়া ষ্টেসনে উপস্থিত হইলাম। তখন গাড়ি ছাড়িতে অতি অল্প সময় ছিল। কর্তার কথায় আমার সন্দেহ হওয়ায় আমি তখন ষ্টেসন ত্যাগ করিলাম না। গোপনে দাঁড়াইয়া তাঁহাদের কার্য্য লক্ষ্য করিতে লাগিলাম। তাঁহারা টিকিট কিনিবার জন্য ব্যস্ত হইলেন না, বরং অন্য পথ দিয়া ষ্টেসন হইতে বাহির হইয়া গেলেন। আমিও মনে মনে হাসিয়া তথা হইতে প্রস্থান করিলাম।

    যেরূপ করিয়া কোচম্যান ওই সকল কথা বলিল, তাহাতে আমার কোনরূপ সন্দেহ হইল না। আমি তাহাকে পুনর্ব্বার জিজ্ঞাসা করিলাম “তাঁহারা এখন কোথায় আছেন বলিতে পার?”

    কোচম্যান ঘাড় নাড়িয়া বলিল “আজ্ঞে না হুজুর। পরের কাজে আমরা অত সময় নষ্ট করিতে পারি না। বিশেষতঃ, সেদিন আমার ভাড়া অতি অল্পই হইয়াছিল বলিয়া আমি গাড়ি লইয়া সত্বর ঠিকা গাড়ির আড্ডায় প্রস্থান করিয়াছিলাম। কোচম্যানের কথা শুনিয়া আমি সদাকে লইয়া পুনরায় থানায় প্রত্যাগমন করিলাম। পরে সদাকে বিদায় দিয়া সুশীলের ভগ্নীপতির বাড়ীতে উপস্থিত হইলাম। সুশীলের সহিত বিশেষ ঘনিষ্ঠতা থাকায় আমি পূর্ব্বে দুই একবার তাঁহাদের বাড়ীতে গিয়াছিলাম। সুতরাং সেখানে পঁহুছিতে বিশেষ কোন কষ্ট হইল না।

    সুশীলের ভগ্নিপতির নাম কেশবচন্দ্র। তিনিও আমার পরিচিত ছিলেন। আমাকে সহসা সেখানে উপস্থিত দেখিয়া তিনি স্তম্ভিত হইলেন এবং সাদর সম্ভাষণ করিয়া তাঁহার সাক্ষাৎ করিবার কারণ জিজ্ঞাসা করিলেন।

    আমি ভাবিলাম, একেবারে প্রকৃত কথা জ্ঞাপন করিলে হয় ত তিনি অত্যন্ত বিরক্ত হইবেন, হয় ত আমাকে অপমানিত করিয়া বাড়ী হইতে বহিষ্কৃত করিয়া দিবেন, এই ভয় করিয়া ঈষৎ হাসিয়া বলিলাম “এই পথ দিয়া থানায় ফিরিতেছিলাম, অনেক দিন আপনার সহিত দেখা সাক্ষাৎ হয় নাই বলিয়া একবার এখানে আসিয়াছি। কিন্তু আপনার পিতা কোথায়? তিনি ত প্রায়ই সদর-দরজায় বসিয়া ধূমপান করিতেন।”

    কেশবচন্দ্র হাসিয়া উত্তর করিলেন “আমার পিতা-মাতা উভয়েই তীর্থ দর্শনে গমন করিয়াছেন।”

    আমি যেন আশ্চৰ্য্যান্বিত হইয়া জিজ্ঞাসা করিলাম “কবে? এই যে সেদিন বৈকালে পথে তাঁহার সহিত দেখা হইয়াছিল।”

    কে। আজ্ঞে হাঁ– তিনি গত কল্য প্রাতে কলিকাতা হইতে রওনা হইয়াছেন।

    আ। কোথায় যাইবেন?

    কে। কাশী।

    আ। কতদিনে ফিরিবেন?

    কে। সে কথা ঠিক বলিতে পারি না। তাঁহাদের যেমন অভিরুচি তেমনই করিবেন। আমার কথা তাঁহারা গ্রাহ্য করেন না।

    আ। বলেন কি! আপনি উপযুক্ত পুত্র, আপনার কথামত কার্য্য না করিলে এ বয়সে তাঁহাদিগকে অনেক কষ্ট পাইতে হইবে।

    কেশবচন্দ্র হাসিয়া বলিলেন “তাঁহাদের মনের কথা তাঁহারাই বোঝেন। মধ্যে পড়িয়া আমি কেন মারা যাই।” কেশবচন্দ্রের কথা শুনিয়া আমি স্পষ্টই বুঝিতে পারিলাম যে, তাঁহার পিতামাতা সে বাড়ীতে ফিরিয়া আইসেন নাই। তাঁহারা যে কোথায় গিয়াছেন, সে কথা জিজ্ঞাসা করিতেও সাহস করিলাম না। অগত্যা দুই একটা অপর কথা কহিয়া আমি কেশবচন্দ্রের নিকট বিদায় গ্রহণ করিলাম।

    পঞ্চম পরিচ্ছেদ

    সে রাত্রে আর কোন কাজ না করিয়া আহারাদি সমাপন করতঃ বিশ্রাম করিতে লাগিলাম। পরদিন দৈনিক কাৰ্য্য শেষ করিতে অনেক সময় অতিবাহিত হইল। সেদিন একটা খুনি মোকদ্দমা ছিল। যখন আদালত হইতে ফিরিয়া আসিলাম, তখন বেলা চারিটা বাজিয়াছিল।

    থানায় আসিয়া আমি ছদ্মবেশ পরিধান করিলাম এবং প্রথমেই বড়বাজারের একখানি সামান্য পোদ্দারের দোকানের নিকট কোন নিভৃতস্থানে দাঁড়াইয়া রহিলম। কত শত লোক আপন আপন কাৰ্য্যে ব্যস্ত হইয়া সেই সঙ্কীর্ণ পথে যাতায়াত করিতেছিল। কেহ বা স্বর্ণ ক্রয় করিতেছ, কেহ বা কোন পুরাতন অলঙ্কার বিক্রয় করিবার জন্য এক দোকান হইতে অপর দোকানে গমনাগমন করিতেছে, কেহ বা আবার কোন গহনা বন্দক রাখিয়া টাকা কর্জ্জ করিতে আসিয়াছে। আমি অতি মনোযোগের সহিত ওই সকল ব্যাপার অবলোকন করিতেছিলাম।

    প্রায় একঘণ্টা কাল এইরূপ অতীত হইলে আমি যে দোকানের নিকট দাঁড়াইয়া ছিলাম, সেই দোকানের নিকট একজন লোক আসিয়া উপস্থিত হইল। যদিও গ্রীষ্মের প্রকোপে গাত্রে বস্ত্র রাখা কষ্টকর বোধ হইতেছিল, তত্রাপি তাহার সর্ব্বাঙ্গে একখানি গরম কাপড় আবৃত। তাহার পরিচ্ছদ দেখিয়া সহজেই বোধ হইল যে, তাহার পিতৃ বা মাতৃদায় উপস্থিত। তাহার পরিধানে একখানি নূতন সাদা ধুতি, গাত্রে একখানি ময়লা পুরাতন শাল, গলায় কাচা, পায়ে জুতা ছিল না। হাতে একখানা পশমী আসন। লোকটির বয়স প্রায় ত্রিশ বৎসর। তাহাকে দেখিতে হৃষ্টপুষ্ট ও বলিষ্ঠ। তাহার বর্ণ গৌর, মুখশ্রী নিতান্ত মন্দ নয়। লোকটি আমার সম্পূর্ণ অপরিচিত।

    দুই একবার সেই দোকানের সম্মুখে পায়চারি করিয়া লোকটি দোকানের ভিতরে প্রবেশ করিল। আমার কেমন কৌতূহল জন্মিল; আমি দূরে থাকিয়া তাহার কার্য্য পর্যবেক্ষণ করিতে লাগিলাম। কিন্তু কি দোকানদার, কি সেই লোকটি কেহই আমার উপর কোনপ্রকার সন্দেহ করিল না।

    আমি দূর হইতে দেখিলাম, আগন্তুক কোন দ্রব্য বিক্রয় করিতে তথায় উপস্থিত হইয়াছে। কিন্তু সেই জিনিষটি আমি দেখিতে পাইলাম না। কিছুক্ষণ পরে দোকানদার গাত্রোত্থান করিলেন এবং দোকান হইতে বাহির হইয়া পরবর্তী আর একখানি দোকানে প্রবেশ করিলেন। আমি যেখানে দাঁড়াইয়াছিলাম, সেখান হইতে অপর দোকানখানি ভালরূপ দেখা যায় না দেখিয়া, একটু সরিয়া দাঁড়াইলাম। দেখিলাম, পূর্ব্বোক্ত দোকানদার অপর দোকানদারকে কি দেখাইতেছেন। দ্বিতীয় দোকানের অধিকারীকে ব্যগ্রদৃষ্টিতে তাহা অবলোকন করিতে দেখিয়া এবং তাঁহাকে বিস্মিত দেখিয়া আমার অত্যন্ত সন্দেহ হইল। আমি তখনই একটা অছিলা করিয়া সেই দোকানে প্রবেশ করিলাম।

    যে দোকানে প্রবেশ করিলাম, তাহার অধিকারী তখনই আমায় সম্ভাষণ করিয়া তথায় যাইবার কারণ জিজ্ঞাসা করিলেন। আমি প্রস্তুত ছিলাম, তখনই পকেট হইতে ঘড়ী ও চেন বাহির করিয়া বলিলাম, “আপনারা এই দুইটি দ্রব্য ক্রয় করিবেন?”

    দোকানদার দুই একবার দেখিয়া বলিলেন “আমরা এরূপ ঘড়ী ক্রয় করি না। তবে চেন ছড়া বিক্রয় করেন ত লইতে পারি।”

    ঘড়ী বা চেন বিক্রয় করা আমার অভিপ্রেত ছিল না। যখন দেখিলাম, সেখান হইতে প্রস্থান করিবার বেশ সুবিধা হইয়াছে, তখন আমিও আর কালবিলম্ব করিলাম না। বলিলাম “না বাপু, কেবল চেন বিক্রয় করিবার জন্য আমি এখানে আসি নাই। যদি ঘড়ী ও চেন দুইটিই ক্রয় করেন তাহা হইলে আমি সম্মত আছি, নচেৎ চলিলাম।”

    এই বলিয়া উত্তয়ের অপেক্ষায় দাঁড়াইয়া রহিলাম। কিন্তু সেই সময়ের মধ্যে পূর্ব্বোক্ত দোকানদারের হস্তে যাহা ছিল, তাহাও দেখিয়া লইলাম। তাঁহার হাতে একটি আংটী ছিল।

    আংটা দেখিয়া আমার সন্দেহ বৃদ্ধি হইল। সেখান হইতে নড়িতে ইচ্ছা হইল না। দোকানদারও আমার কথায় উত্তর দিতে বিলম্ব করিতে লাগিল দেখিয়া আমি যেন বিরক্ত হইয়া জিজ্ঞাসা করিলাম, “কি বলেন, ঘড়ীটি কিনিবেন কি?”

    দোকানদার বলিলেন “ও সকল সামান্য জিনিষ আমরা কিনি না। ঘড়ীটা যদি দামী হইত, তাহা হইলেও কথা ছিল। অল্প দামের পুরাতন ঘড়ী কিনিলে প্রায়ই ঠকিতে হয়।”

    বাধা দিয়া আমি বলিলাম “না দেখিয়া ঘড়ীর নিন্দা করেন কেন? ঘড়ীটা রূপার বটে, কিন্তু কম দামের নহে। ইহা বিলাতী রদারহামের, ইহার দাম ষাইট্ টাকার কম নহে। যদি লওয়া হয় বলুন, নচেৎ অন্যত্র চেষ্টা দেখি।”

    দোকানদার হাসিয়া উত্তর করিলেন “রাগ করেন কেন মহাশয়। ষাট সত্তর টাকার ঘড়ী কি আর ঘড়ী, পাঁচশত টাকার ঘড়ী হয়, তাহা হইলে আমরা ক্রয় করিতে পারি। রদারহামই বলুন, আর যাহাই বলুন, দু-এক শত টাকার ঘড়ী আমরা কিনি না।”

    আমার কেমন বোধ হইল। আমি সহ্য করিতে পারিলাম না। কর্কশস্বরে বলিলাম “যাহারা একটা সামান্য আংটা ক্রয় করিবার জন্য সাত দোকান ঘুরিয়া বেড়ায়, তাহাদের মুখে অমন কথা শোভা পায় না।”

    দোকানদার আমার কথায় হাসিয়া উঠিলেন। হাসিতে হাসিতে বলিলেন “আপনি কি মনে করিয়াছেন, এই আংটীটা সামান্য! দেখুন দেখি, এমন আংটা আপনি জীবনে আর কখনও দেখিয়াছেন কি না?”

    এই বলিয়া তিনি আমার হাতে সেই আংটীটি প্রদান করিলেন। আমি দৃষ্টি গোচর করিয়া মাত্র চমকিত হইলাম। যাহা দেখিলাম, তাহাতে যুগপৎ আনন্দিত—বিস্মিত হইলাম! আংটীটার উপরে একটি অতি ক্ষুদ্র ঘড়ী! ঘড়ীর কাঁটাগুলি এত ক্ষুদ্র যে, চর্ম্মচক্ষের অগোচর বলিলেও অত্যুক্তি হয় না।

    আমি বলিলাম “না বাপু! এমন ঘড়ীবসান আংটী আমি ইতিপূর্ব্বে আর কখনও দৃষ্টিগোচর করি নাই। আংটীটার দাম কত?”

    দো। আমার বোধ হয় হাজার টাকা।

    আ। এ রকম জিনিষ বোধ আর কখনও আপনাদের হাতে আইসে নাই?

    দোকানদার হাসিয়া বলিলেন “কেন আসিবে না? আপনি দেখেন নাই বলিয়া যে আর কোন লোক দেখে নাই, এরূপ মনে করিবেন না। আরও পাঁচ-ছয়বার এইরূপ আংটী আমাদের হাতে আসিয়াছিল। সেগুলির দাম আরও বেশী, কেন না, সেই ঘড়ীগুলিতে অনেকগুলি করিয়া দামী প্রস্তর ছিল।”

    পোদ্দারের কথা শুনিয়া আমি আমার পরিচয় প্রদান করিলাম। কহিলাম “আপনি যাহার নিকট হইতে এই আংটা পাইয়াছেন সে ভিতরে, এখন চলুন, আমি তাহাকে গ্রেপ্তার করিব।”

    “এই আংটী দেখিয়া আমার বোধ হইতেছে, ইহা চোরাদ্রব্য, আমি ইহারই অনুসন্ধান করিয়া বেড়াইতেছি।” এই বলিয়া আমি সেই দোকানদারের সহিত তাহার দোকানের ভিতর গমন করিলাম এবং তখনই তাহাকে ধৃত করিয়া নিকটবর্ত্তী একজন প্রহরীকে ডাকাইয়া তাহার জিম্মা করিয়া দিলাম। অনন্তর সে কোথায় থাকে তাহা জানিবার নিমিত্ত তাহাকে লইয়া তাহার বাসা অভিমুখে গমন করিলাম। লোকটি ক্রমে জোড়াবাগানের একটি ক্ষুদ্র মাঠগুদামে প্রবেশ করিল।

    ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ

    রাত্রি প্রায় আটটা বাজিয়াছিল। আকাশ মেঘশূন্য, অসংখ্য তারকা সেই সুনীল অম্বরে থাকিয়া আপন আপন ক্ষীণ জ্যোতি বিকিরণ করিতেছিল। মলয়পবন রাজপথের ধূলিকণাগুলিকে চারিদিকে বিক্ষিপ্ত করিয়া জনগণের মনে অশান্তির উদ্রেক করিতেছিল।

    যে বাড়ীর ভিতর আমরা প্রবেশ করিলাম, তাহা ভদ্রলোকের আবাস বলিয়া বেধ হইল না। সেই মাঠ কোটার বারান্দায় তিন চারিজন যুবতী সাজ সজ্জা করিয়া এক একটি টুলের উপর উপবিষ্ট রহিয়াছে।

    আমি তাহার গৃহ মধ্যে প্রবেশ করিলাম। দেখিলাম, ঘরখানি অতি ক্ষুদ্র। ভিতরে বিশেষ কোন আসবাব নাই। একখানি ভাঙ্গা তক্তাপোষ, তাহার উপর একটা ছিন্ন মাদুর, তদুপরি একটা বালিস। তক্তাপোষের অপর পার্শ্বে একটা টিনের ট্রাঙ্ক। বাহ্যিক অবস্থা দেখিয়া বোধ হইল, লোকটি বিদেশী, দুই একদিনের জন্য তথায় আসিয়া বাস করিতেছে। গৃহমধ্যে প্রবেশ করিয়া আমি সেই তক্তাপোযের উপর উপবেশন করিলাম। পরে অতি নম্রভাবে জিজ্ঞাসা করিলাম “তুমি কতদিন এখানে আসিয়াছ?”

    লোকটি কিছুক্ষণ আমার মুখের দিকে চাহিয়া রহিল। পরে জিজ্ঞাসা করিল “আপনি কেমন করিয়া জানিতে পারিলেন যে আমি বিদেশী লোক?”

    আমি হাসিয়া বলিলাম, “ঘরের অবস্থা দেখিয়া আমি পূর্ব্বেই ওই প্রকার অনুমান করিয়াছি। তোমার আদি নিবাস কোথায়? আর নামই বা কি?”

    লোকটি বলিল “আমার নাম ব্রজেন্দ্রনাথ ঘোষাল, নিবাস বরিশাল জেলায়। সম্প্রতি বিশেষ কোন কার্য্যের জন্য কলিকাতায় আসিয়াছি।”

    আ। এই আংটী কাহার এবং তুমি উহা কোথায় পাইলে?

    ব্র। উহা আমারই কোন আত্মীয়ের। তিনি উহা বিক্রয় করিবার জন্য আমাকে দিয়াছিলেন।

    আ। তিনি থাকেন কোথায়?

    ব্র। নিকটেই—আহীরীটোলায়।

    আ। আংটীটা দামী, যাঁহারা ওরূপ আংটী ব্যবহার করেন, তাঁহারা নিশ্চয়ই ধনবান লোক। তাঁহাদের যে চাকর, সরকার ইত্যাদি লোক নাই, তাহা ত বিশ্বাস হয় না। সে সকল লোক সত্ত্বেও তোমাকে দিয়া উহা বিক্রয় করিবার আবশ্যকতা কি?

    ব্র। তাহা আমি বলিতে পারি না, আমার সহিত বিশেষ আলাপ পরিচয় আছে, সেই বিশ্বাসেই তিনি আমাকে বিক্রয় করিতে দিয়াছিলেন।

    আমি। ওই আংটীটা কাহার, জানিতে আমার বড় ইচ্ছা; তাই তোমার আত্মীয়ের নিবাস জিজ্ঞাসা করিয়াছিলাম। আমাকে সেখানে লইয়া চল।

    ব্রজেন্দ্র প্রথমে অনেক আপত্য করিল, কিন্তু আমি কিছুতেই ছাড়িলাম না। অবশেষে আমাকে লইয়া বাড়ীর বাহির হইল এবং নিকটস্থ একখানি দ্বিতল অট্টালিকাতে প্রবেশ করিল।

    বাড়ীতে প্রবেশ করিয়াই বুঝিলাম, সেখানি হোটেল, দশ পনরজন লোক তথায় বাস করিতেছে। ব্রজেন্দ্র আমাকে দ্বিতলে লইয়া গেল। পরে একটি গৃহের ভিতরে প্রবেশ করিল এবং একজনকে দেখাইয়া দিল।

    ব্রজেন্দ্র যাহাকে দেখাইয়া দিল, তাহাকে দেখিয়া আমি চমকিত হইলাম। লোকটা আমার পরিচিত—একজন দাগী চোর। সৌভাগ্যের বিষয় এই যে, আমি তখন ছদ্মবেশে ছিলাম বলিয়া সে আমাকে চিনিতে পারিল না। আমিও অন্য কোন কথা জিজ্ঞাসা না করিয়া একেবারে তাহাকে গ্রেপ্তার করিলাম। পরে জিজ্ঞাসা করিলাম, এই আংটী তুমি ব্রজেন্দ্রকে বিক্রয় করিতে দিয়াছিলে?

    লোকটার বয়স প্রায় ত্রিশ বৎসর, দেখিতে বেশ সুপুরুষ। বাহ্যিক অবয়ব দেখিলে সকলে তাহাকে ধনবান বলিয়া মনে করিয়া থাকে। আমার কথায় সে উত্তর দিবার পূর্ব্বেই ব্রজেন্দ্র উপযাচক হইয়া বলিল, ইহারই আংটী-উপযুক্ত মূল্য দিলেই আংটীটা কিনিতে পারিবেন।

    আমি। তোমার নাম কি?

    সে বলিল “আমার নাম বসন্তকুমার দত্ত।”

    আ। আংটীটা কোথায় পাইয়াছিলে?

    ব। বিবাহের যৌতুক স্বরূপ পাইয়াছিলাম।

    আমি তখন বসন্তের দিকে চাহিয়া জিজ্ঞাসা করিলাম “আংটীটা কোথায় পাইয়াছ যদি সত্য করিয়া বল, তাহা হইলে তোমায় এ যাত্রা মুক্তি দিতে পারি। আমি তোমায় পূর্ব্বেই চিনিতে পারিয়াছি. তোমার প্রকৃত নাম রজনীকান্ত। সেদিন একটা ঘড়ী চুরি করিয়া ছয় মাস জেল খাটিয়াছে। আবার এত শীঘ্রই যে নিজ ব্যবসা আরম্ভ করিবে, তাহা স্বপ্নেও জানিতাম না।”

    আমার কথা শুনিয়া রজনীকান্ত একটী দীর্ঘনিশ্বাস ত্যাগ করিয়া বলিল “আপনারা না পারেন এমন কাৰ্য্যই নাই। কিন্তু এ বিষয়ে আমার কোন অপরাধ নাই। আংটীটা যিনি বিক্রয় করিতে দিয়াছেন, তিনি আমার পরিচিত, আমি আপনাকে তাঁহার নিকটে লইয়া যাইতেছি।”

    আমি সাগ্রহে জিজ্ঞাসা করিলাম “তিনি কি এই বাসায় আছেন?”

    ব। আজ্ঞে না, তিনি এই পার্শ্বের বাড়ীতে আছেন। আমাকে ছাড়িয়া দিলে আমি এখনই তাঁহাকে এখানে হাজির করিতে পারি।

    আমি হাসিয়া উঠিলাম। বলিলাম “এখনও যদি আমার চক্ষে ধূলি দিবার ইচ্ছা থাকে, তাহা হইলে তাহা ত্যাগ কর। লোকটার নাম বলিয়া দাও, আমি তোমার নাম করিয়া তাঁহাকে ডাকাইতে পাঠাইতেছি।”

    রজনীকান্ত অগত্যা আমার প্রস্তাবে সম্মত হইল। সে সেই বাসার দাসীকে দিয়া লোকটিকে ডাকাইয়া পাঠাইল। কিছুক্ষণের পর দাসী একজন প্রৌঢ়কে লইয়া আমাদের নিকট উপস্থিত হইল। প্রৌঢ়কে দেখিবামাত্র আমি অত্যন্ত আনন্দিত হইলাম। পূর্ব্বে তাঁহাকে আরও দুই চারিবার দেখিয়াছিলাম সুতরাং আমার ভ্রম হইবার কোন কারণ ছিল না।

    প্রৌঢ়কে কোন প্রশ্ন না করিয়া তাঁহাকে গ্রেপ্তার করিবার জন্য সেই কনেষ্টবলকে আদেশ করিলাম, অবিলম্বে তাঁহার হস্তে বলয় ভূষিত হইল।

    সুশীলের ভগ্নীর শ্বশুরই যে ওই আংটী সরাইয়াছিলেন, তাহা আমার বেশ ধারণা হইয়াছিল। এখন আমার অনুমান সত্যে পরিণত হইল দেখিয়া আন্তরিক প্রীত হইলাম। পরে প্রৌঢ়ের দিকে চাহিয়া বলিলাম “এ বয়সেও আপনি লোভ সংবরণ করিতে পারেন নাই। আপনি যে উহা আপনার পুত্রের শ্বশুরালয় হইতে চুরি করিয়া আনিয়াছেন, তাহা আমি পূৰ্ব্বেই ভাবিয়াছিলাম। কেন এ কাজ করিলেন?”

    প্রৌঢ় কোন উত্তর করিলেন না, কিম্বা আমার কথার কোন প্রতিবাদ করিলেন না। তাঁহার দুই চক্ষু দিয়া অনর্গল বাষ্পবারি বিগলিত হইতে লাগিল। আমি তখন জিজ্ঞাসা করিলাম “আমাকে কি চিনিতে পারেন নাই?”

    প্রৌঢ় কাঁদিতে কাঁদিতে উত্তর করিলেন, “বেশ চিনিয়াছি। আপনি পুলিস কর্মচারী তাহা জানি, আর সুশীলবাবুর সহিত আপনার যে অত্যন্ত সদ্ভাব আছে,তাহাও জানি। কিন্তুকি করিব “স্ত্রীবুদ্ধি প্রলয়ঙ্করী,” এক স্ত্রীলোকের পরামর্শে আমি ইহ ও পরকাল নষ্ট করিয়াছি এবং শেষ বয়সে জেলে পচিতে যাইতেছি। আপনার যাহা ইচ্ছা করুন, আমায় আর কোন কথা জিজ্ঞাসা করিবেন না।”

    অগত্যা সেই প্রৌঢ়, ব্রজেন্দ্র ও বসন্ত এই তিনজনকে থানায় চালান দিলাম। সকলেই আপন আপন দোষ স্বীকার করিল, কেবল প্রৌঢ় তাঁহার স্ত্রীর নাম উল্লেখ করিলেন না। কাজেই তিনি বাঁচিয়া গেলেন। বিচারে প্রৌঢ়ের এক বৎসর সশ্রম কারাদণ্ড হইল। অপর দুইজন নিষ্কৃতি পাইল।

    যথাসময়ে আমি আংটীটা সুশীলের মাতাকে ফেরৎ দিলাম। তিনি আমায় যৎপরোনাস্তি আশীর্ব্বাদ করিতে লাগিলেন।

    সম্পূর্ণ

    [ ফাল্গুন, ১৩১৬ ]

    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26 27 28 29 30 31 32 33 34 35 36 37 38 39 40 41 42 43 44 45 46 47 48 49 50
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleআরব জাতির ইতিহাস – ফিলিপ কে. হিট্টি (অনুবাদ : প্রিন্সিপাল ইবরাহীম খাঁ)
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    দারোগার দপ্তর ৩ – প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়

    September 22, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    দারোগার দপ্তর ৩ – প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়

    September 22, 2025
    Our Picks

    দারোগার দপ্তর ৩ – প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়

    September 22, 2025

    আরব জাতির ইতিহাস – ফিলিপ কে. হিট্টি (অনুবাদ : প্রিন্সিপাল ইবরাহীম খাঁ)

    September 22, 2025

    নিউ মুন – স্টেফিন মেয়ার

    September 22, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    • Sign Up
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }

    Sign In or Register

    Welcome Back!

    Login below or Register Now.

    Lost password?

    Register Now!

    Already registered? Login.

    A password will be e-mailed to you.