Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    আসমানীরা তিন বোন – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025

    ইস্টিশন – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025

    উড়ালপঙ্খী – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • English Books
      • Jules Verne
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    দিঘির জলে কার ছায়া গো – হুমায়ূন আহমেদ

    হুমায়ূন আহমেদ এক পাতা গল্প99 Mins Read0
    ⤶ ⤷

    ৩. রাতে বৃষ্টিতে ভিজে

    রাতে বৃষ্টিতে ভিজে লীলার ভালো ঝামেলা হয়েছে। শেষরাতে জ্বর এসেছে। শুরু হয়েছে ভাঙা ভাঙা স্বপ্ন। একটা শেষ হওয়া মাত্র আরেকটা। মাঝে মাঝে পানির পিপাসায় ঘুম ভাঙছে। খাটের পাশের সাইড টেবিলে পানির বোতল থাকে। বোতলে পানি নেই। ফ্রিজ থেকে পানির বোতল আনার প্রশ্নই আসে না। যতবার ঘুম ভেঙেছে ততবারই লীলা ক্লান্ত গলায় বলছে, কেউ কি আমাকে ঠান্ডা এক গ্লাস পানি খাওয়াবে? বলার জন্যে বলা। ঘরে সে এবং তার বাবা ছাড়া দ্বিতীয় প্রাণী নেই। শওকত সাহেবের ঘর সর্বক্ষিণে। তিনি দরজা-জানালা বন্ধ করে ঘুমান। চিল্কার করে ডাকলেও তার কানে যাবে না। কে তার জন্যে পানি নিয়ে আসবে? তবে জাগ্রত অবস্থায় পানি চাওয়ার একটা সুফল পাওয়া যাচ্ছে। স্বপ্নে তার জন্যে পানি আসছে। প্রতিবারই সাত-আট বছরের একটি বালক পানি নিয়ে আসছে। বিশাল সাইজের গ্লাসভর্তি পানি। সে পানি এনে বলছে, মা, পানি এনেছি। লীলা হাতে পানির গ্লাস নিচ্ছে, কিন্তু গ্লাসে মুখ দেবার আগেই ঘুম ভেঙে যাচ্ছে। স্বপ্নের বাচ্চাটা তাকে মা ডাকছে কেন কে জানে? তার অবচেতন মন কি চাইছে তার বিয়ে হোক? একটা বাচ্চা হোক। বাচ্চা তাকে মা ডাকুক?

    সকাল আটটা। লীলা চাদরের নিচে। সে বুঝতে পারছে না। তার কি ঘুম ভেঙেছে, না-কি স্বপ্ন দেখছে। ভ্যাকুয়াম ক্লিনারের শব্দ কানে আসছে। কে চালাবে ভ্যাকুয়াম ক্লিনার? কাজেই এটা স্বপ্ন। রান্নাঘর থেকে কল ছাড়ার শব্দ আসছে। কেউ থালাবাসন ধুচ্ছে। অবশ্যই স্বপ্ন। লীলা চেষ্টা করল জেগে ওঠার। আর তখন তার ঘরের দরজা কেউ একজন সামান্য ফাক করে বলল, আপা, গুড মর্নিং!

    বাইশ-তেইশ বছরের মেয়ে। সুশ্রী চেহারা। বড় বড় চোখ। মাথাভর্তি ঘন কালো চুল। অ্যাপ্রন পরে আছে। লীলা বলল, কে?

    ম্যাডাম, আমার নাম আসমা। আমি আপনাদের হাউসড়ে। আহসান স্যার আমাকে আর গনি মিয়াকে পাঠিয়েছে। আজ এই বাড়িতে উনার পার্টি আছে। আমরা গুছাচ্ছি। ম্যাডাম, চা-কফি কিছু খাবেন?

    ঠান্ডা এক গ্লাস পানি খাব।

    ম্যাডাম! আপনার কি শরীর খারাপ?

    মনে হয় জ্বর এসেছে।

    ম্যাডাম, আমি কি কপালে হাত দিয়ে জ্বর দেখব?

    দেখ।

    আসমা কপালে হাত দিয়ে বলল, অনেক জুর। ঘরে নিশ্চয় থার্মোমিটার আছে?

    বাবার কাছে আছে।

    ম্যাডাম, আমি পানি নিয়ে আসছি।

    লীলা শুয়ে পড়ল। তার চোখ বন্ধ। জানালা দিয়ে রোদ এসে বিছানায় পড়েছে, সেই রোদের দিকে তাকানো যাচ্ছে না। চোখ কট কট করছে। ভ্যাকুয়াম ক্লিনারের শব্দটা মাথায় লাগছে। আসমা পানি নিয়ে এসেছে। ট্রে-তে পানির গ্লাস, টিস্যুবক্স, এককাপ চা এবং একটা থার্মোমিটার। লীলা অবাক হয়ে দেখল, আসমা মেয়েটির কাজকর্ম অত্যন্ত গোছানো। সে লীলার হাতে পানির গ্লাস দিল। পানি খাওয়া শেষ হওয়ামাত্র তার হাতে দুটা টিস্যুপেপার দিল। কী জন্যে দিল লীলা বুঝতে পারল না। চায়ের কাপ এগিয়ে দিল। পিরিচে দুটা প্যারাসিটামল ট্যাবলেট।

    ম্যাডাম, প্যারাসিটামল খেয়ে চা খান। জ্বর সঙ্গে সঙ্গে কমবে। অনেকেই বলেন, খালি পেটে ওষুধ খাওয়া যায় না। কথাটা ঠিক না। অ্যাসপিরিন জাতীয় ট্যাবলেট খাওয়া যায় না। প্যারাসিটামল খাওয়া যায়। আগে থার্মোমিটারটা মুখে দিন, জ্বর দেখে দেই। টিপেপার দিয়ে থার্মোমিটারের মুখটা মুছে নিন।

    হাতে টিস্যুপেপার দেবার রহস্য এখন ভেদ হলো। লীলা মুখে থার্মোমিটার দিয়ে বসে আছে। ভ্যাকুয়াম ক্লিনারের শব্দ বন্ধ, এটা একটা স্বস্তির ব্যাপার। চেয়ার টানাটানির শব্দ হচ্ছে। এই শব্দ ভ্যাকুয়াম ক্লিনারের শব্দের মতো অসহনীয় না।

    ম্যাডাম! আপনার জ্বর একশ দুই পয়েন্ট পাঁচ। আপনি শুয়ে থাকুন।

    লীলা বাধ্য মেয়ের মতো শুয়ে পড়ল। আসমা বলল, আহসান স্যার আমাকে বলে দিয়েছেন আপনার ঘুম ভাঙামাত্রই যেন তার সঙ্গে আপনাকে টেলিফোনে যোগাযোগ করিয়ে দেই। ম্যাডাম দেব?

    না।

    ম্যাডাম, উনি বিশেষ করে বলে দিয়েছেন। এর মধ্যে দুবার টেলিফোন করেছেন। আপনার জ্বর স্যারকে আমি জানিয়েছি। সার খুবই চিন্তিত। স্যারকে ধরে দেই? শুধু হ্যালো বলুন। এতেই হবে।

    দাও।

    আসমা অ্যাপ্রনের পকেট থেকে মোবাইল টেলিফোন বের করল। নাম্বার টিপল এবং মোবাইল কানে দিয়ে বলল, স্যার, কথা বলুন। সে মোবাইল লীলার হাতে দিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে দরজা ভেজিয়ে দিল।

    লীলা! জ্বর না-কি বাঁধিয়েছ?

    হ্যাঁ।

    নিশ্চয়ই তোমার অভ্যাস মতো কাল রাতে বৃষ্টিতে ভিজেছ। ঠিক না?

    হ্যাঁ ঠিক।

    কতক্ষণ ভিজেছ?

    ঘড়ি দেখি নি, তবে অনেকক্ষণ ভিজেছি। বৃষ্টিতে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।

    আজকের পার্টি অফ করে দেই?

    দিন।

    আমি কিন্তু আসব। রোগী দেখে যাব।

    কখন আসবেন?

    রাত আটটায়। তবে আমার ধারণা, তার আগেই তোমার জ্বর সেরে আঁবে। আসমা মেয়েটি তোমাকে সুস্থ করে তুলবে। এই মেয়ে খুব expert.

    আসমা মেয়েটি সম্পর্কে বলুন। পার্টি গোছানোর জন্যে পাঠিয়েছেন?

    পার্টি গোছানোর জন্যে গনি মিয়াকে পাঠিয়েছি। আর আসমা হলো আমার দিক থেকে তোমাকে উপহার। সংসার ঘড়ির কাটার মতো সচল রাখতে ওর মতো

    একটি মেয়েই যথেষ্ট।

    তাকে পেয়েছেন কোথায়?

    সে দিনাজপুরের মেয়ে। ইন্টারমিডিয়েট পাশ। কুয়েতে এক আমীরের বাড়িতে হাউসমেড় ছিল। নানান ঝামেলায় পড়ে দেশে ফিরে আসে। তার অতীত ইতিহাসের তো তোমার দরকার নেই। না-কি আছে?

    দরকার নেই।

    তুমি রেস্ট নাও। জ্বর নিয়ে অতি প্রিয়জনদের সঙ্গেও কথা বলতে ভালো লাগে না। আর আমি অতি প্রিয়জনদের তালিকায় নেই।

    লীলা বলল, আমার অতি প্রিয়দের তালিকায় কে কে আছে বলে আপনার ধারণী?

    আহসান বলল, তোমার বাবা। মুহিব নামের যুবক, যে তোমাকে ডাস্টবিন থেকে উদ্ধার করেছে। তোমার ডাক্তার ছোটখালা সালেহা। ছাদে তোমার পোষা দুই ময়ূর এবং বাঁদরটা। বাঁদরটার নাম যেন কী? হড়হড়কু না?

    জি, হড়হড়কু।

    এই অদ্ভুত নামটা কেন দিয়েছ?

    লীলা বলল, আপনি আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে কয়েকবার হড়হড়কু বলুন, দেখবেন হড়হড়কু বলার সময় চেহারাটা বাঁদরের মতো হয়ে যায়। এইজন্যেই নাম রেখেছি হড়হড়কু।

    আহসান বলল, এক্ষুনি ব্যাপারটা টেস্ট করছি। লীলা, কথা শেষ করার আগে ছোট্ট আরেকটা কথা। ভিন্ন প্রসঙ্গ। বলি?

    বলুন।

    আমি বিদেশ থেকে যখন আসি, তুমি আমার সঙ্গে আপনি আপনি করে কথা বলো। একটা পর্যায়ে এসে তুমি বলতে শুরু কর, তখন বিদেশে যাবার সময় হয়। বিদেশ থেকে ফিরে আসি, আবার শুরু কর আপনি।

    লীলা বলল, এবার যখন তুমি বলা শুরু করব তখন বিদেশ যাবেন না। তাহলেই তো হয়।

    আহসান বললেন, এটা মন্দ বলে নি। লীলা রাখি। দেখা হবে সন্ধ্যায়। দ্রুত সেরে উঠ।

    চেষ্টা করছি।

    থ্যাংক য়্যু

    লীলা টেলিফোন রাখার পরপরই আসমা গামলাভর্তি পানি এবং তোয়ালে নিয়ে ঢুকেছে। লীলা বলল, কী?

    ম্যাডাম, আপনার গা স্পঞ্জ করে দেব।

    লাগবে না।

    আপনি চুপ করে শুয়ে থাকুন। আমি গা স্পঞ্জ করছি, দেখবেন কত ভালো লাগবে। ম্যাডাম, আমি আপনার সারা গা স্পঞ্জ করব। আপনি চোখ বন্ধ করে থাকুন। আমাকে লজ্জা করার কিছু নেই।

    আসমা গা স্পঞ্জ করছে। লীলা চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে। তার ভালো লাগছে। মনে হয় জ্বর কমতে শুরু করেছে।

    ম্যাডাম, ছাদে আপনার ময়র দুটা দেখে এসেছি। এদের স্বাস্থ্য বেশ ভালো। কিছুদিনের মধ্যেই পালকে রঙ ধরবে।

    তুমি জাননা কীভাবে?

    আমি কুয়েতে যে শেখের বাড়িতে কাজ করতাম, উনার দশটা ময়ূর ছিল। দুটা ইমু পাখি ছিল। ময়ুরকে খাওয়ানোর জন্যে উনি তার প্রাইভেট প্লেনে করে হংকং থেকে সাপ আনাতেন।

    শেখের নাম কী?

    অনেক লম্বা নাম— আল হাসান ইবনে মোহম্মদ ইবন জাফর ইবনিল হোসায়ান। সবাই ডাকত শেখ হাসান।

    তাঁর চিড়িয়াখানায় আর কী ছিল?

    নানান ধরনে পাখি ছিল। কোনো পশু ছিল না। তিনি পশু পছন্দ করতেন। অনেক জাতের ঈগল ছিল। একটা ঈগল ছিল তার পোষা। নাম সাব্বাই। তিনি ছাদে উঠে ঈগলটা ছেড়ে দিতেন। ঈগল সোজাসুজি আকাশে উঠে নিমিষের মধ্যে অদৃশ্য হয়ে যেত। আবার নেয়ে এসে তার হাতে বসত। ঈগলকে খাওয়ানোর জন্যে রোজ একটা করে দুম্বা জব হতো। উনার পাখি দেখাশোনার জন্যে চারজন লোক ছিল।

    তোমার দায়িত্ব কী ছিল?

    ম্যাডাম, আমি, ফিলিপিনের তিন মেয়ে, শ্রীলঙ্কার একটা মেয়ে আর ইন্ডিয়ার একটা মেয়ে, আমরা ছিলাম হাউসমভ।

    এতজন?

    শেখের বাড়িটা ছিল প্রকাণ্ড। শোবার ঘর ছিল একুশটা। ম্যাডাম, বাথরুমে যান, হাতমুখ ধোন। আমি নাশতা আনিচ্ছি। আপনার জ্বর নামছে, গা ঘামছে।

    কী নাশতা খাব?

    রুটি আর ভাজি। আমি একটা লিস্টি করে রেখেছি। লিস্টি মতো জিনিস আনিয়ে দিলে সকালের নাশতার সমস্যা হবে না।

    তোমার ঐ শেখ, উনি সকালে কী নাশতা খেতেন?

    প্যারিসের একটা রেস্টুরেন্টের সঙ্গে উনার কন্ট্রাক্ট ছিল। তারা নাশতার ব্যবস্থা করত। উনার এত টাকা যে খরচ করার পথ জানতেন না। ম্যাডাম, আপনার জ্বর এখন আরেকবার মাপব?

    দরকার নেই। আমি বুঝতে পারছি জ্বর কমেছে।

    আসমা থার্মোমিটার হাতে নিয়ে বলল, জ্বর কতটা কমেছে জানা দরকার ম্যাডাম।

    তুমি আমাকে এখন থেকে আপা ডাকবে। ম্যাডাম ডাকবে না। বারবার ম্যাডাম ডাকছু। মনে হচ্ছে আমি সিনেমার নায়িকা। এক্ষুনি ডিরেক্টর সাহেব আমাকে শট দেবার জন্যে ডাকবেন। আমাকে লীলা আপা ভাকবে। যতবার লীলা শব্দটা শুনি আমার ভালো লাগে।

    আসমা বলল, আমি আপা ডাকব। লীলা আপা ডাকব না। আপনার নাম ধরে ডাকবেন আপনার প্রিয়জনরা।

    লীলা বলল, থার্মোমিটার মুখে দিয়ে আমি এক মিনিট বসে থাকব, কথা বলতে পারব না। এই এক মিনিটে তুমি তোমার স্যার আহসান সাহেব সম্পর্কে যা জানো বলবে।

    আসমা বলল, পুরুষমানুষের মধ্যে মন্দভাব বেশি। মন্দ নাই এমন পুরুষ পাওয়া কঠিন। স্যারের মধ্যে মন্দ অংশ কম। আপা, আপনি এক সময় না এক সময় জানবেন এইজন্যে এখনই বলছি— কুয়েতের ঐ শেখ সৰু কয়জন মেয়েকে ব্যবহার করত। অনেক ঝামেলা করে আমি ফিরে আসি। আহসান স্যার ফিরে আসার ব্যাপারে আমাকে অনেক সাহায্য করেছেন। আমার মতো মেয়েদের পুরুষরা বেশ্যা বিবেচনা করে। তাদের সঙ্গে সেই আচরণ করে। অহসান স্যার কখনো এরকম করেন নি। তিনি সম্মানের সঙ্গেই আমার সঙ্গে কথা বলেন।

    আসমা থার্মোমিটার হাতে নিয়ে বলল, আপা, আপনার টেম্পারেচার এখন একশর সামান্য নিচে।

    লীলা বলল, শেখের নামটা আরেকবার বলো তো!

    আসমা বলল, আল হাসান ইবনে মোহম্মদ ইবন জাফর ইবনিল হোসায়ান।

     

    মুহিব নিলি ম্যাডামের বাড়ির গেটের সামনে দাঁড়িয়ে। দুজন দারোয়ান গেট পাহারা দিচ্ছে। আর একজন সম্ভবত কেয়ারটেকার জাতীয় কেউ। সে-ই মুহিবকে আটকেছে।

    আপনার নাম, কোথেকে এসেছেন সেই ঠিকানা এবং কেন এসেছেন সেটা লেখেন।

    মুহিব বলল, এত লেখাপড়া?

    জি এইটাই নিয়ম। নিলি ম্যাডাম এই নিয়ম করেছেন। তাকে অনেক উটকা লোক বিরক্ত করে তো এইজন্যে। আপনি করেন কী?

    আমি কিছু করি না। আমিও একজন উটকো লোক।

    তাহলে দেখা হবে না। লেখালেখি করে লাভ নাই। চলে যান।

    এসেছি যখন চেষ্টা করে দেখি।

    বসেন ঐ চেয়ারে। দশটা বাজুক। দশটার পর ভেতরে খবর দেব। দশটার আগে ম্যাডামের কাছে খবর পাঠানো নিষেধ।

    মুহিব বলল, তিনতলা বাড়ির পুরোটাতেই কি ম্যাডাম থাকেন?

    জি।

    মুহিব বলল, এমন কেউ কি আছে যাকে আপনারা গেটে আটকান না? সে সরাসরি চলে যেতে পারে। ফ্রি পাশ।

    এমন কেউ নাই। ম্যাডামের হাসবেন্ড যদি আসেন তাকেও খবর পাঠাতে হয়।

    ম্যাডাম বিবাহিত? জানতাম না তো।

    কেয়ারটেকার বলল, সম্পর্ক নাই। দুজন আলাদা থাকে। পুলা একটা আছে। স্যার তরে মাঝে মইদ্যে দেখতে আসে।

    মুহিব বলল, ছেলের নাম কী?

    পদ্ম।

    পদ্ম তো মেয়েদের নাম।

    কথা ঠিক বলেছেন, তয় বড়লোকদের কারবার। মেয়ের নাম দেয় ছেলেরে। ছেলের নাম দেয় মেয়েরে।

    মুহিব বলল, ভাই, সিগারেট খাওয়া যাবে? না রাস্তায় দাঁড়িয়ে খেয়ে আসতে হবে?

    খান সিগারেট।

    মুহিব একটা সিগারেট ধরালো। কেয়ারটেকারের দিকে প্যাকেট বাড়িয়ে দিয়ে বলল, আপনিও একটা খান। আসুন দুই ভাই মিলে ধোয়া ছাড়ি। আপনার নাম কী?

    মকবুল।

    মকবুল ভাই, সিগারেট ধরান।

    মকবুল সিগারেট নিল। গম্ভীর গলায় বলল, আমার সাথে খাতির কইরা লাভ নাই। ম্যাডাম পারমিশন না দিলে No see.

    মুহিব বলল, আশেপাশে চায়ের দোকান আছে? চা খেয়ে সময় কাটাই, দশটার পরে একবার এসে খোঁজ নিব পারমিট পাওয়া গেল কি-না।

    বড় রাস্তার উল্টাদিকে একটা চায়ের দোকান আছে। চা ভালো বানায়।

     

    পারমিশন পাওয়া গেছে। পারমিশন পাওয়ায় মকবুলকে অসন্তুষ্ট বলে মনে হচ্ছে। সে বিরক্ত মুখে বলল, চলে যান। ফিরত যাবার সময় যে টাইমে ফিব্রত যাচ্ছেন সেই টাইম লিখে যাবেন।

    কলিংবেলে হাত রাখার আগেই নিলি দরজা খুলল। কোনো একটা ম্যাগাজিনে (খুব সম্ভব তারকা সংবাদ) মুহিব পড়েছিল, মেকাপ ছাড়া নায়িকাদের চেহারা প্রায় পেতনির কাছাকাছি। নিলি মনে হয় তার মধ্যে পড়েন না। তাকে মেকাপ ছাড়া অনেক বেশি মিষ্টি লাগছে।

    নিলি বলল, মুহিব বসুন। আমার মন বলছিল আজকালের মধ্যে আপনি নাটকের বিষয়ে সুপারিশ করতে আসবেন। সুপারিশ করতে আসা দোষের কিছু না। জীবনের প্রথম নাটক প্রচারিত হোক সবাই চায়। আমি কিন্তু ঐ নাটকটা করব না।

    মুহিব বলল, ম্যাডাম, আমি সুপারিশ করতে আসি নাই। আমার কপালে আছে সবকিছুতে আমি ফাইনাল পর্যন্ত যাব, তারপর ভজঘট হয়ে যাবে।

    তাই না-কি?

    জি। টুথপেস্টের একটা অ্যাড করার সুযোগ পেয়েছিলাম। সব ফাইনাল। যেদিন শুটিং হবে সেদিন ডিরেক্টর বললেন আমাকে দিয়ে হবে না। আমার চোখে না-কি মায়া নাই।

    ডিরেক্টর সাহেবের নাম কী?

    নাম মনে নাই।

    চোখে মায়া নেই বলে বিজ্ঞাপন বাতিল?

    জি।

    নিলি বলল, চোখের মায়াটা আসলে কী?

    মুহিব বলল, জানি না।

    নিলি বলল, ভালো করে তাকিয়ে দেখুন তো। আমার চোখে কি মায়া আছে?

    মুহিব কী বলবে বুঝতে পারছে না। লীলার মতো সহজ সম্পর্ক থাকলে বলতো, ম্যাডাম আপনার চোখে তেমন মায়া দেখছি না। কাঠিন্য দেখছি। বিজ্ঞাপনের ছবিতে কাজ করতে গেলে ডিরেক্টর সাহেব আপনাকেও বাদ দিয়ে দিতেন।

    নিলি বলল, আমার চোখে মায়া নেই এই কথাটাই তো বলতে চাচ্ছেন। চক্ষুলজ্জায় বলতে পারছেন না। ঠিকই ধরেছেন। আমার দৃষ্টি কঠিন। যখন আমি আমার ছেলের দিকে তাকাই, তখন দৃষ্টি কোমল হয়। চোখে মায়া চলে আসে। চোখের মায়ার এই হচ্ছে রহস্য। চোখের মায়া গণবিষয় না। শুধুমাত্র প্রিয়জনদের জন্যে। আরো রহস্য আছে। জানতে চান? জানলে অভিনয়ে সুবিধা হবে।

    মুহিব বলল, বলুন।

    নিলি বলল, আপনি আপনার সামনের পেইন্টিংটার দিকে তাকান। কী দেখছেন?

    পাথরের ওপর পাখি বসে আছে।

    নিলি বলল, মানুষের চোখের দৃষ্টি হচ্ছে Convergent, দুই চোখের দৃষ্টি একবিন্দুতে মিলে। যদি ইচ্ছা করে মিলতে না দেয়া হয়, তাহলেই চোখে মায়া চলে আসে। আপনি এখন পেইন্টিং-এর দিকে তাকিয়ে থাকুন, তবে ছবি দেখবেন না। ডান চোখে দেখার চেষ্টা করেন পেইন্টিং-এর ডান ফ্রেম। বাঁ চোখে বা ফ্রেম। একটু চেষ্টা করলেই হয়ে যাবে। এই তো হয়েছে। এবং আপনার চোখে মায়া চলে এসেছে।

    মুহিব বলল, চোখে মায়া আনার ব্যাপারটা কি কেউ আপনাকে শিখিয়েছে?

    নিলি বলল, না। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে নিজেই বের করেছি। ভালো কথা, আপনার বাসায় কি বড় আয়না আছে? পুরো শরীর দেখা যায় এমন আয়না?

    না।

    বড় একটা আয়না কিনবেন। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের সঙ্গে কথা বলবেন।

    লাভ কী?

    অভিনয় ভালো হবে। এক্সপ্রেশন ভালো হবে। শব্দ করে হাসবেন। এতে মুখের চামড়ায় ফ্লেক্সিবিলিটি আসবে। আপনাকে অতি গুরুত্বপূর্ণ কিছু টিপস দিয়ে দিলাম। কারণ জানতে চান?

    চাই।

    আপনি খুব ভালো একটা দিনে এসেছেন। আজ আমার বাবুর জন্মদিন। দুবছর আগে এইদিনে সকাল দশটা চল্লিশ মিনিটে বাবু জন্মেছিল। ডাক্তার যখন আমার কোলে বাবুকে দিল আমি কাঁদতে কাঁদতে বললাম, ডাক্তার সাহেব, এই পদ্মফুল কি আমার? সেই থেকে ছেলের নাম পদ্ম!

    নিলির চোখে পানি এসে গেছে। সে কোনোরকম অস্বস্তি বোধ না করে শাড়ির আঁচলে চোখ মুছল। মুহিব বলল, আপনার পদ্মকে কি একটু দেখতে পারি?

    নিলি বলল, না। পদ্মার বাবা তাকে নিয়ে গেছেন। পদ্মার কাস্টডি নিয়ে মামলা চলছিল। মামলায় সে জিতেছে। সাত বছর বয়স পর্যন্ত সব মায়েরা বাচ্চাকে রাখার অধিকার পায়। আমি পাই নি। কারণ তার বাবা কোর্টে প্রমাণ করতে পেরেছেন। আমি চরিত্রহীনা নারী। আমার বাড়িতে রোজা রাতে দুষ্ট লোকের আড্ডা হয় মদ্যপান করা হয়। অভিনয়ের নাম করে আমি দিনের পর দিন বিভিন্ন শুটিংস্পটে রাত কাটাই। আমার ছেলে কাজের মেয়েদের কাছে একা একা থাকে। বাবুর যে মূল আয়া সজিরন কোর্টে তাই বলেছে। বাবুর বাবা সজিরনকে পঞ্চাশ হাজার টাকা দিয়েছেন। পঞ্চাশ হাজার টাকা ওদের কাছে অনেক বড় ব্যাপার।

    মুহিব বলল, সজিরন কি এখন বাড়িতে পল্লীর দেখাশোনা করে?

    ঠিকই ধরেছেন। আপনার বুদ্ধি ভালো। আপনি অভিনয় ভালো করবেন। বেকুবরা অভিনয় করতে পারে না। চা খাবেন?

    মুহিব বলল, না। আমি চা খেয়ে এসেছি। রাস্তার মোড়ে একটা চায়ের দোকান আছে, ভালো চা বানায়। সেখান থেকে পরপর তিনকপি চা খেয়েছি। চা এরকম যে এক কাপ খেলে আরেক কাপ খেতে ইচ্ছা হয়।

    নিলি বলল, আফিং টাফিং নিশ্চয় মেশায়া চা এমন কোনো নেশার জিনিস যে পরপর তিন কাপ খেতে ইচ্ছা করবে। একদিন খেয়ে দেখতে হবে।

    মুহিব বলল একটা ফ্লাস্ক দিন। ফ্লাস্কে করে নিয়ে আসি।

    নিলি বলল, চা আনতে হবে না। আচ্ছা শুনুন, সন্ধ্যাবেলা একটা কাজকরে দিতে পারবেন?

    মুহিব বলল, পারব।

    নিলি বলল, কী কাজ না জেনেই বললেন পারব?

    মুহিব বলল আমার ধারণী পদ্মার জন্মদিনের অনুষ্ঠানে তাকে আপনি উপহার। পাঠাবেন। সেই উপহার নিয়ে যেতে হবে আমাকে।

    নিলি বলল, ঠিক ধরেছেন। ফ্লাস্ক দিচ্ছি। চা নিয়ে আসুন।

    চুহিব বলল, গিফট কি কেনা হয়েছে?

    নিলি ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বলল, হ্যাঁ। বড় একটা গাড়ি কিনেছি। ব্যাটারি অপারেটেড প্যাডেলে চাপ দিলেই গাড়ি চলবে। পদ্মর বয়স দুবছর–প্যাডেলে চাপ দেয়ার বিষয়টা সে বুঝতে পারবে কিনা জানি না। আমার ধারণা বুঝবে। ওর অনেক বুদ্ধি। ওর বুদ্ধির একটা গল্প শুনবেন?

    গুনব।

    নিলি বলল, না থাক।

    নিলির চোখে পানি এসে গেছে। সে চোখ মুছছে। আশ্চর্যের ব্যাপার, মুহিবের চোখে পানি এসে গেছে। সে অন্যদিকে ঘুরে তাকিয়ে আছে। সে চাচ্ছে চোখের পানি যেন চোখেই শুকিয়ে যায়। সে চোখের পাতা ফেলছে না।

    মুহিব!

    জি ম্যাডাম। You are a good soul, আমি যে নাটকটা করব না বলেছিলাম সেটা করব। আপনার জীবনের প্রথম অভিনয় নষ্ট হতে দেব না।

    ম্যাডাম, অভিনয় নিয়ে আমার কোনো মাথাব্যথা নেই। হলে হবে। না হলে হবে না।

    নিলি হাসতে হাসতে বলল, আমি ভুলেই গিয়েছিলাম আপনি হিমু হবার চেষ্টা করছেন। আপনার কি রূপা বলে কেউ আছে?

    মুহিব বলল, আছে। তার নাম লীলা।

    বাহ কী সুন্দর নাম!

    লীলার একটা পোষা বদর আছে। বাঁদরটার নাম সুন্দর–হড়হড়কু।

    সুন্দর কোথায়? অদ্ভুত নাম। এই নাম কেন?

    লীলার ধারণা এই নাম উচ্চারণ করার সঙ্গে সঙ্গে মুখ খানিকটা বাঁদরের মতো হয়। ওর দুটা পোষা ময়ুর আছে। একটার নাম চিত্রা আরেকটার নাম মিত্রা।

    নিলা বলল, আপনার বান্ধবীকে দেখার ইচ্ছা করছে। আপনাদের প্রথম দেখা কীভাবে হয়?

    নর্দমাতে দেখা। লীলা এই নিয়ে চারলাইনের একটা ইংরেজি কবিতাও লিখেছে, শোনাব?

    অবশ্যই শোনাবেন।

    মুহিব বলল,

    We were in the drain
    I looked at him and saw his pain
    with weariness and fault
    I cave the dirty stain.

     

    লীলার জ্বর নেই তবে চেহারায় জুরের ছায়া পড়ে আছে। তাকে ক্লান্ত এবং বিষণ্ণ লাগছে। তার ইচ্ছা করছে বিছানায় চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকতে। লবণ-বাতির রহস্য আলো ছাড়া ঘরে আর কোনো আলো থাকবে না। লবণ-বাতি লীলার ছোট মামা স্পেন থেকে পাঠিয়েছেন। খনিজ লবণের একটা টুকরার ভেতর বাল্ব জ্বলে। বাল্বের আলো লবণের দেয়াল ভেদ করে আসার সময় অদ্ভুত লাল হয়ে যায়। লীলা এই লালের নাম দিয়েছে লবণ-লাল। এই লাল রঙ নিয়ে সে অনেকদিন থেকে একটা কবিতা লেখার চেষ্টা করছে। প্রথম লাইনটা মাথায় এসেছে— When the salt red glows in the dark radiating sorrow…। দ্বিতীয় লাইন আসছে না।

    লীলা বসার ঘরে সোফায় বসে আছে। তার সামনে আদার রস দেয়া এক কাপ গ্রিন টি। সে মাঝে মাঝে চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছে। তার সামনে আহসান বসে আছে। তার গায়ে হালকা মেরুন রঙের পাঞ্জাবি। পাঞ্জাবির রঙের সঙ্গে লবণ-আলোর মিল আছে। দ্রলোককে সুন্দর লাগছে। আহসান নিচু গলায় কথা বলে যাচ্ছে। লীলা আগ্রহ নিয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে। মনে হচ্ছে তার প্রতিটি কথা সে মন দিয়ে শুনছে। আসলে তা-না। লীলার মাথায় লবণ-আলো কবিতার দ্বিতীয় লাইন ঘুরছে। দুটা মাত্র শব্দ মাথায় এসেছে Radiating sorrow…। আর আসছে না।

    আহসান বলল, লীলা, তুমি কি ডেভিড ব্রেইনের নাম শুনেছ?

    লীলা বলল, না। উনি কি কবি?

    আহসান বলল, ম্যাজিকের কবি। street magician, অসাধারণ সব ম্যাজিক দেখান।

    তার কথী এল কেন?

    আমি নিউইয়র্কে তার একটা ম্যাজিক দেখেছি। Levitation Magic.

    লেভিটেশন ম্যাজিক মানে?

    লেভিটেশন মানে শূন্যে ভাসা। উনি নিউইয়র্কের ব্যস্ত রাস্তায় সবার সামনে শূন্যে ভেসেছেন। রাস্তা থেকে ছয় ইঞ্চি ওপরে উঠে দুই মিনিট ত্রিশ সেকেন্ড ছিলেন।

    লীলা বলল, দুই মিনিট শূন্যে ভেসে লাভ কী?

    মাধ্যাকর্ষণ শক্তিকে দুই মিনিটের জন্যে অগ্রাহ্য করে পৃথিবীর বিজ্ঞানীদের চমকে দিয়েছেন, এইটাই লাভ। লীলা, তুমি মনে হয় মন দিয়ে আমার কথা শুনছ

    । আবার জ্বর আসছে না-কি? দেখি হাতটা বাড়াও তো, জ্বর দেখি।

    লীলা হাত বাড়াল। আহসান লীলার হাত ধরল। লীলা মনে মনে গুনছে one thousand one, ore thousand two one thousand three…

    আহসান কতটা সময় হাত ধরে থাকে সেটা জানার জন্যেই one thousand one, two… বলা। একবার one thousand one বলতে এক সেকেন্ড লাগে।

    লীলার হিসেবে এগারো সেকেন্ড পর আহসান হাত ছেড়ে দিয়ে বলল, মনে হচ্ছে জ্বর আসছে।

    লীলা বলল, আসুক। ঝড় আসছে আসুক।

    ঝড় বলছ কেন?

    লীলা বলল, জ্বর হলো শরীরের ঝড়। এই কারণেই ঝড় বলছি। ম্যাজিক সম্বন্ধে কী বলছিলেন বলুন। ম্যাজিশিয়ান ভদ্রলোক দুই মিনিট ত্রিশ সেকেন্ড শূন্যে ঝুলে রইলেন।

    আহসান বলল, তুমি মনে হয় ridicule করছ। সবার সামনে কোনো যন্ত্রপাতির সাহায্য ছাড়া শূন্যে ভেসে থাকী কঠিন কাজ। যে দেখে তার মধ্যে এক ধরনের অলৌকিক অনুভূতি হয়। তুমি দেখবে?

    লীলা বলল, আমি কীভাবে দেখব? ব্লেইন সাহেবকে আমি কোথায় পাব?

    আহসান বলল, আমি দেখাব।

    লীলা বলল, আপনি দেখবেন মানে? আপনি ম্যাজিক জানেন না-কি?

    ম্যাজিক জানি না, তবে দেশের বাইরে যখন যাই দুই একটা ইজি আইটেম ম্যাজিক শপ থেকে কিনে নিয়ে আসি।

    শূন্যে ভাসা ইজি আইটেম?

    কৌশলটা খুবই সহজ। Optical illusion তৈরি করা। শূন্যে ভাসার ডেভিড ব্লেইনের এই ভার্সানটার কৌশল জানতে তিনশ ডুলার খরচ করতে হয়েছে। তোমাকে দেখাব?

    দেখান।

    আহসান উঠে দাঁড়াল। ঘরের শেষমাথায় চলে গেল। বড় করে নিঃশ্বাস ফেলে একটু নিচু হলো, তারপর লীলাকে অবাক করে দিয়ে সত্যি সত্যি শূন্যে ছয় ইঞ্চি ওপরে উঠে গেল। লীলা বলল, Oh God!

    আহসান শূন্য থেকে নামতে নামতে বলল, আনন্দ পেয়েছ?

    লীলা বলল, অবশ্যই আনন্দ পেয়েছি।

    কৌশলটা শিখিয়ে দেব?

    লীলা বলল, না। কৌশল কেন শেখাবেন? কৌশল শিখলে তো রহস্যই নষ্ট। তবে আপনি মুহিবকে দেখাতে পারেন। মাঝে মাঝে সে শূন্যে ভেসে আমাকে দেখাবে। আমি মজা পাব।

    আহসান ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, আচ্ছা তাকে শিখিয়ে দেব।

    লীলা বলল, এখন একটা কাজ করুন, আপনার শূন্যে ভাসার খেলা বাবাকে দেখিয়ে আসুন। বেচারা একা একা ঘরে বসে আছে।

    আহসান বললেন, তুমি চল। তিনজন মিলে গল্প করি।

    লীলা বলল, আমার জ্বর আসছে। জ্বর আসার সময় বাবার বক্তৃতী অসহ্য লাগে। আমি কিছুক্ষণ শুয়ে থাকব। ডিনারের সময় আমাকে ডেকে পাঠাবেন। আপনার সঙ্গে ডিনার করব।

    লীলা উঠে দাঁড়াল। তাকে দ্রুত বিছানায় শুয়ে পড়তে হবে। কবিতার দ্বিতীয় লাইনটা মনে হয় চলে এসেছে।

     

    আহসানকে পেয়ে শওকত সাহেব আনন্দিত।

    তিনি নতুন একটা বই পড়ছেন। বইয়ে বিবর্তনবাদের জনক Darwin সাহেবকে ধরাশায়ী করা হয়েছে। বিষয়টায় তিনি বিপুল আনন্দ পেয়েছেন। তার পূর্বপুরুষ বানর এটা তিনি নিতেই পারতেন না। এখন সমস্যার সমাধান হয়েছে। তিনি আহসানের দিকে ঝুঁকে এসে বললেন, তুমি ডারউইনবাদে বিশ্বাস কর?

    আহসান বলল, জি চাচা করি।

    তোমার বিশ্বাস তুমি এখন যে-কোনো একটা ভালো ডাস্টবিন দেখে ফেলে দিয়ে আসতে পার?

    আহসান বলল, জি আচ্ছা।

    পুরো বিষয়টা না শুনেই জি আচ্ছা বলবে না। আগে পুরো বিষয়টা শোন।

    আহসান হতাশভঙ্গিতে পুরো বিষয়টা শোনার জন্যে প্রস্তুত হলো। সহজে এই বিরক্তিকর মনুষটার কাছ থেকে ছাড়া পাওয়া যাবে বলে মনে হচ্ছে না।

    শওকত সাহেব বললেন, তোমাদের ডারউইনের থিওরি বলে পাখি এসেছে সরীসৃপ থেকে। তুমি এখন একটা সাপ এবং ময়ূর পাশাপাশি রাখ। চিন্তা কর যে ময়ুরের পূর্বপুরুষ সাপ। যে সাপ এখন ময়ূরের প্রিয় খাদ্য। বলো তোমার কিছু বলার আছে?

    এই মুহূর্তে কিছু বলার নেই চাচা।

    মনে মনে দশের ওপরে ৯৫০টা শূন্য বসাও। এই বিশাল প্রায় অসীম সংখ্যা দিয়ে এককে ভাগ কর। কী পাবে জানো? শূন্য। এটা হলো অ্যাটমে অ্যাটমে ধাক্কাধাক্কি করে DNA অনু তৈরির সম্ভাবনা। মিলার নামে কোনো সাইন্টিস্টের নাম

    শুনেছ? ছাগলটাইপ সাইনটিস্ট।

    চাচা, শুনি নি।

    ঐ ছাগলটা ১৯৫০ সনে একটা এক্সপেরিমেন্ট করে অন্য ছাগল সাইন্টিস্টদের মধ্যে হৈচৈ ফেলে দিয়েছিল। ছাগলটা করেছে কী, ল্যাবরেটরিতে আদি পৃথিবীর আবহাওয়া তৈরি করে ঘনঘন ইলেকট্রিক কারেন্ট পাস করেছে। কিছু প্রোটিন অনু তৈরি করে বলেছে— এইভাবেই পৃথিবীতে প্রাণের শুরু। প্রাণ সৃষ্টিতে সৃষ্টিকর্তার কোনো ভূমিকা নেই। এখন সেই ছাগল মিলারকে নিয়ে বৈজ্ঞানিক মহলে হাসাহাসি। Life ম্যাগাজিনে কী লেখা হয়েছিল পড়ে শোনাই।

    চাচা, আরেকদিন শুনি। জটিল কিছু শোনার জন্যে আমি এই মুহূর্তে মানসিকভাবে তৈরি না।

    শওকত সাহেব বললেন, জটিল কিছু বলছি না। জলবৎ তরলং। মন দিয়ে শোন। আল্ডারলাইন করে রেখেছি।

    শওকত সাহেব পড়তে শুরু করলেন। আহসান হতাশ চোখে জানালা দিয়ে তাকিয়ে রইল।

    Geologist now think that the premordial atmosphere consisted mainly of carbon dioxide and Nitrogen gases that are less reactive than those used in the 1953 Mitler experiment…

     

    পদ্মর জন্মদিন অনুষ্ঠানে মুহিব উপস্থিত হয়েছে। তার হাতে গিফট র্যাপ দিয়ে মোড়ানো বিশাল বাক্স দেখে দারোয়োন কিছু জিজ্ঞেস করল না। দারোয়ান বলল, ছাদে চলে যান। ছাদে প্যান্ডেল খাটিয়ে উৎসব।

    ছাদে উঠে মুহিব পুরোপুরি হকচকিয়ে গেল। বিশাল প্যান্ডেল। প্যান্ডেলের এক মাথায় স্টেজ করা হয়েছে। বিচিত্র পোশাক পরা একজন ডিসকো জকি ভয়ঙ্কর ধরনের বাজনা বাজাচ্ছেন। সেই বাজনার সঙ্গে ছেলেমেয়েরা যার যেমন ইচ্ছা নেচে যাচ্ছে। পাশেই বার তৈরি করা হয়েছে। নানান সাইজ এবং নানান ধরনের বোতল টেবিলে ঝলমল করছে। দুজন বারটেন্ডার ড্রিংক্স দিচ্ছে। বারের ওপর বড় বড় করে লেখা–

    Dont over do it. মুহিব উপহারের বাক্স নিয়ে কী করবে বুঝতে পারছে না। এখানে কারো হাতেই উপহারের কোনো প্যাকেট দেখা যাচ্ছে না। হলুদ ব্লেজার পরা অতি সুদর্শন এক ভদ্রলোক এসে মুহিবের সামনে দাঁড়ালেন। বিনয়ী গলায় বললেন, আপনার পরিচয় জানতে পারি?

    মুহিব বলল, আমি পদ্মর জন্যে একটা উপহার নিয়ে এসেছি। পদ্মর মা পাঠিয়েছেন।

    ভদ্রলোক ইশারা করে কাকে যেন ডাকলেন। তাকে বললেন, জলিল, উনার কাছ থেকে গিফট নিয়ে যাও।

    মুহিব বলল, নিলি ম্যাডাম বলে দিয়েছেন আমি যেন নিজের হাতে তাকে গিফটটা দেই।

    ভদ্রলোক বললেন, জলিল, উনাকে পদ্মর কাছে নিয়ে যাও। আর ভাই, আপনি গিফট দিয়ে ছাদে চলে আসবেন। পার্টি এনজয় করবেন। আপনার নাম?

    মুহিব।

    মুহিব সাহেব, পরে আপনার সঙ্গে দেখা হবে।

     

    ঘরভর্তি উপহারের মাঝখানে একটা দুবছরের বাচ্চা লাল শার্ট লাল প্যান্ট পরে ঘুরে বেড়াচ্ছে। কৌতূহলী হয়ে উপহার দেখছে। কোনো একটা বাক্সে হাত দেয়া মাত্র বৃদ্ধা এক মহিলা ধমক দিচ্ছে, হাত দিবা না কইলাম।

    মুহিবের মনে হলো এই মহিলাই সজিরন। পদ্মর আয়া।

    মুহিব বলল, পদ্ম! কাছে আস, তোমার মা তোমার জন্যে কী পাঠিয়েছেন দেখ।

    পদ্ম পরিষ্কার গলায় বলল, আমার মা পাঠিয়েছে?

    মুহিব বলল, হ্যাঁ।

    নিলি মা পাঠিয়েছে?

    হ্যাঁ।

    বলেছে—বাবুকে আদর?

    হ্যাঁ বলেছেন। এসো আমরা উপহার খুলি।

    পদ্ম ছুটে এল। বৃদ্ধা খ্যাখ্যান গলায় বলল, বাক্স এখন খোলা স্যারের নিষেধ আছে। পরে খোলা হবে। একপাশে থুইয়া দেন। সময় বুইঝা খোলা হইব।

    মুহিব বলল, তোমার নাম সজিরন না?

    জে।

    মুহিব বলল, বাঘের ওপরে আছে টাগ। তোমার স্যারের ওপরে আছে নিলি ম্যাডাম। তুমি মামলায় মিথ্যা সাক্ষ্য দিয়েছ, এই খবর আমরা জানি। হাইকোর্টে আপিল করা হয়েছে। যদি প্রমাণ হয় তুমি মিথ্যা সাক্ষ্য দিয়েছ, তোমার চার বছরের জেল হবে। জেলে যাবার জন্যে তৈরি হয়ে যাও। পান খাওয়ার অভ্যাস আছে দেখতে পাচ্ছি। অভ্যাস ছাড়ার চেষ্টা কর। জেলে পান পাবে না। সমস্যা হবে।

    মুহিব প্যাকেট খুলছে। পদ্ম ছোট ছোট হাতে তাকে সাহায্য করছে। এবং টুক টুক করে কথা বলছে।

    গোলাপ ফুল আমাকে গোঁতা দিয়েছে।

    মুহিব বলল, কাটা লেগেছে হাতে?

    হুঁ। এইখানে।

    পদ্ম হাত বাড়িয়ে বলল, উম্মা দাও।

    উম্মা ব্যাপারটা কী মুহিব বুঝতে পারছে না।

    সজিরন বলল, হাতে চুমা দিতে বলতাছে।

    মুহিব সজিরনের দিকে তাকিয়ে বলল, এই বেটি খবরদার, আমার সাথে কথা বলবি না। বদের হাডিড। ইয়া নফসি ইয়া নফসি করতে থাক। তোর কপালে দুঃখ আছে।

    সজিরন বলল, আমি স্যারের বগলে যাইতেছি। আপনি কী বলছেন সব বুলব।

    মুহিব বলল, যা তাড়াতাড়ি যা।

    সজিরন ঘর থেকে বের হওয়া মাত্র মুহিব পদ্মকে গাড়িতে বসিয়ে দ্রুত ঘর থেকে বের হয়ে গেল। এখানে বেশিক্ষণ থাকা বুদ্ধিমানের কাজ হবে না।

     

    মুহিব বাড়িতে ফিরল রাত নটায়। বাড়িতে ঢুকতে পারল না।

    বাড়ির সামনে ভিড়। লোকজন উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে। পুলিশের একটা জিপ গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। সেই গাড়ি ঘিরেও ভিড়। মুহিবের চোখের সামনে তার বাবা আলাউদ্দিনকে পুলিশের গাড়িতে তুলল। আলাউদ্দিনের হাতে হাতকড়া। কোমরে দড়ি। তিনি বিড়বিড় করে দোয়া ইউনুস পড়লেন। মুহিব পুলিশের গাড়ির কাছাকাছি যাওয়ার চেষ্টা করছে। ভিড় ঠেলে কাছে যাওয়া যাচ্ছে না। সে বাবা বলে চিৎকার দিতে যাচ্ছে, তার আগেই গাড়ি ছেড়ে দিল।

    ⤶ ⤷
    1 2 3 4 5 6 7 8
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleঅদ্ভুত সব গল্প – হুমায়ূন আহমেদ
    Next Article দারুচিনি দ্বীপ – হুমায়ূন আহমেদ

    Related Articles

    হুমায়ূন আহমেদ

    আসমানীরা তিন বোন – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025
    হুমায়ূন আহমেদ

    ইস্টিশন – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025
    হুমায়ূন আহমেদ

    উড়ালপঙ্খী – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025
    হুমায়ূন আহমেদ

    এই বসন্তে – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025
    হুমায়ূন আহমেদ

    এই মেঘ, রৌদ্রছায়া – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025
    হুমায়ূন আহমেদ

    এইসব দিনরাত্রি – হুমায়ূন আহমেদ

    December 23, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Generic selectors
    Exact matches only
    Search in title
    Search in content
    Post Type Selectors
    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    আসমানীরা তিন বোন – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    আসমানীরা তিন বোন – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025
    Our Picks

    আসমানীরা তিন বোন – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025

    ইস্টিশন – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025

    উড়ালপঙ্খী – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }