Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • English Books
      • Jules Verne
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    দুজনার ঘর – আশুতোষ মুখোপাধ্যায়

    লেখক এক পাতা গল্প178 Mins Read0
    ⤷

    তপ

    মহিলাকে প্রথম দিন দেখেই মনে হয়েছিল, গল্প আছে।

    কথাটা সুবল মিশ্রকে বলেছিলাম। সুবল মিশ্রর দেশ উড়িষ্যায়, বিদ্যালাভ পশ্চিম বাংলায় তথা কলকাতায়, কর্মস্থল এই সুদূর ব্রহ্মপুত্রের দেশে। আমার সঙ্গে আলাপ এবং হৃদ্যতা ছাত্রজীবন থেকে। একই হস্টেলে একই ঘরে থাকতুম। এখন সে পয়সাঅলা লোক, চা-চালানের কারবারী। বছরে বার পাঁচেক কলকাতায় আসে। তাই যোগাযোগ আছে। আগে সে নিজে থাকত উড়িষ্যায়, তার কর্মচারী থাকত আসামে। বছর তিনেক হল নানা কারণে সে নিজেই আসামে স্থায়ী প্রবাসী হয়েছে।

    সম্প্রতি আমি তার অতিথি।

    তার ডেরা থেকে দু মাইল দূরে মাতৃকুটারের মায়ের প্রসঙ্গে আমার ওই উক্তি যে তার কাছে এমন কৌতুকের ব্যাপার হবে জানতাম না। দুদিন বাদে আবার যখন তাকে সঙ্গে করে এলাম মহিলার কাছে, তখন সে একঘর লোকের সামনেই আমাকে নাজেহাল করল। বলল, মা ভালো ডাক্তার, শুনেছি বাতাস টেনে রোগের গন্ধ পায়, আমাদের সাহিত্যিকও তেমনি আপনাকে দেখেই গল্পের গন্ধ পেয়েছে। সেদিন আপনাকে দেখে গিয়ে বলছিল, গল্প আছে।

    ঘরে আমার অপরিচিত যে কজন ছিল সুবল মিশ্রর সঙ্গে গলা মিলিয়ে তার হেসে উঠল। ঘরে মা অর্থাৎ মহিলার কৃতী ছেলে আর ছেলের বউ ছিলেন। ছেলে আমাদেরই বয়সী। আগের দিনের আলাপে তাকে স্বল্পভাষী মনে হয়েছিল। সুবল মিশ্রর কাছে শুনেছি মহানন্দ ঘোষ অর্থাৎ ওই ছেলে কলকাতার নামকরা ব্যারিস্টারদের। একজন। স্ত্রী-পুত্র-কন্যা নিয়ে বছরে দুবার মায়ের কাছে আসেন–পূজোর ছুটিতে আর গরমের ছুটিতে। মায়ের ছেলে-অন্ত প্রাণ, কিন্তু এ-জায়গা ছেড়ে তিনি নড়তে চান না। তাই ছেলেকেই ছুটে আসতে হয়। সুবল মিশ্র শুনেছে. এখানে বছর পনের আগেও ছোট পড়ো বাড়ি ছিল একটা। জায়গাটা এখনই নির্জন, এর থেকে অনেক বেশি ফাঁকা ছিল তখন। দেখতে দেখতে ছেলের পসার হয়েছে, উপার্জনের টাকা দিয়ে প্রথমেই তিনি এই ছিমছাম বাংলা প্যাটার্নের মাতৃকুটার স্থাপন করেছেন। শোনা যায় সেই পড়ো বাড়িতে কন্যা এক বৃদ্ধ থাকতেন। সে প্রায় তিন যুগ আগের কথা।

    শুধু মাতৃকুটীর স্থাপন নয়, সুবল মিশ্রর মুখে শুনেছি মাতৃভক্ত এই ব্যারিস্টার ছেলে মায়ের নির্দেশে এখানকার গরিবদের হাসপাতালে কত টাকা দিয়েছেন আর ব্রহ্মপুত্রের বন্যায় গ্রাম থেকে মানুষ বাঁচানোর জন্য কত সময় কত টাকা ঢেলেছেন ঠিক নেই।

    শুনে ভালো লেগেছিল। তব প্রথম দিনের আলাপে ভদ্রলোকের বাকসংযম কিছুটা কৃত্রিম মনে হয়েছিল আমার। ওটুকু পয়সাঅলা নামকরা ব্যারিস্টারের মর্যাদার সঙ্গে যুক্ত ধরে নিয়েছিলাম। আর মনে হয়েছিল, চেহারাখানা ভদ্রলোকের এখনো বহুজনের মধ্যে চোখে পড়ার মতই নিখুঁত সুন্দর, সেই কারণেও হয়ত একটু সচেতন এবং মিতভাষী।

    হাটে হাঁড়ি ভাঙার মত করে সুবল মিশ্র মায়ের প্রসঙ্গে আমার মন্তব্য ফাঁস করার সঙ্গে সঙ্গে আজ এই নামী ব্যারিস্টার ভদ্রলোকের দৃষ্টিটা যেন আমার মুখের ওপর থমকাতে দেখলাম কয়েক মুহূর্ত। শুধু তাই নয়, তার স্ত্রীটির চোখেমুখেও নীরব চাপা বিস্ময় দেখা গেল। আর এই কারণেই আমার আবারও মনে হল, গল্প আছে।

    মা হাসছেন মিটি মিটি। ষাটের কাছাকাছি বয়েস এখন। বয়েসকালে বেশ সুশ্রী ছিলেন বোঝা যায়। হাসিটুকু আরো কমনীয়। তার ওপর বুদ্ধির ছাপ।

    ঘরে আর যারা ছিল তার বেশির ভাগই ওষুধপ্রার্থী। কেউ ওষুধ নেবে, কারো বা পুরনো ওষুধ ফুরিয়েছে, এখন কি করবে জিজ্ঞাসা। মা একে একে তাদের বিদায়। করলেন, কাউকে ওষুধ দিলেন, কাউকে বা বললেন, অনেক ওষুধ খেয়েছ আর কাজ নেই। সবল মিশ্র বলে, মা পাকা হোমিওপ্যাথি ডাক্তার। আগে যাদের পয়সা জুটত না তারাই শুধু চিকিৎসার জন্যে মায়ের কাছে এসে জুটত। অনেকের অনেক কঠিন। ব্যামোও মায়ের ওষুধে ভালো হয়েছে নাকি। ওষুধে ভালো হয়েছে কি মায়ের কোন রকম দৈবশক্তি আছে সেই বিশ্বাসে–বলা শক্ত। প্রচারের ভার তারাই নিয়েছে। অনেক দূর থেকেও হামেশাই রোগী আসে এখন। আর শুধু অভাবী লোকই আসে না, পয়সাঅলা লোকও অনেক আসে। এ-সব ব্যাপারে বিশ্বাস বস্তুটা রোগের মতই। সংক্রামক বলা যেতে পারে।

    মা ডাক্তার কেমন জানি না, কিন্তু রীতিমত শিক্ষিত যে তাতে সন্দেহ নেই। এই বসার ঘরেই একটা আলমারি হোমিওপ্যাথি সংক্রান্ত নানা রকম বিদেশী বইয়ে। ঠাসা। কোথাও কোনো নতুন বই আর ভালো বইয়ের সন্ধান পেলেই তিনি ছেলেকে লেখেন আর ছেলে দেশ থেকে হোক বা বিদেশ থেকে হোক সে-বই সংগ্রহ করে মাকে পাঠাবেন। সবসময় লিখতেও হয় না, ছেলে নিজে থেকেও কোনো নতুন বইয়ের সন্ধান পেলে মায়ের জন্য কিনে ফেলেন। সুবল মিশ্র ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে মাকে এ-সব বই পড়তে দেখেছে-পড়ে পড়ে দাগ দিতে দেখেছে।

    মহিলাকে প্রথম দিনই আমার ভালো লেগেছিল। সকলেরই লাগে শুনি। তার হাসিমাখা চোখ দুটিতে সকলের জন্যেই যেন স্নেহ সঞ্চিত। কথাবার্তা স্বচ্ছ, স্পষ্ট। বড়লোকের স্ত্রী ছিলেন নাকি, আর মস্ত বড়লোকের মা তো বটেই। তার। এ-রকম অনাড়ম্বর জীবনযাত্রা মানুষকে কাছে টানবে তা আর বিচিত্র কি! ছুটি। ফুরোলে ছেলে যখন সপরিবারে কলকাতা, ফেরেন তখনো তার মায়ের জন্য দুশ্চিন্তার কারণ নেই। তাঁর মা এই তিন চার মাইল জোড়া গোটা এলাকার অজস্র লোকের। মা। বাড়িতেও বারোমাস কটি দরিদ্র ছেলে থাকে। তাছাড়া কাজকর্ম করার লোকজন তো আছেই।

    মহিলা বিধবা। কোরা বা এমনি সাদা থান পরেন না কখনো। সর্বদাই তসরের বা মুগোর থান পরেন। এও সুবল মিশ্রর মুখে শোনা। কতজনে কত দামী তাঁতের থান এনে মাকে প্রণাম করে যায়। মা সে-সব গরিব দুঃখী বিধবাদের চুপিচুপি বিলিয়ে। দেন। এমনি থান পরতে দেখলেই নাকি তার ছেলের মুখ ভার হয়। অতএব ছেলের যেভাবে মাকে সাজিয়ে আনন্দ সেইভাবেই সাজেন তিনি।

    ছেলের এই পছন্দের সঙ্গে আমি নিজেও দ্বিমত হতে পারিনি। সত্যিই এই বেশে ভারি সুন্দর দেখায় তাঁকে। সামনে এলে প্রথমেই মনে হয় না তিনি বিধবা। শুচিস্নিগ্ধ এই বেশ দেখলে দৃষ্টি প্রসন্ন হয়।

    ওষুধপ্রার্থী আর উপদেশপ্রার্থীদের বিদায় দিয়ে তিনি আমার দিকে ফিরলেন। সকৌতুকে নিরীক্ষণ করলেন একটু। তারপর বললেন, হ্যাঁ, আছে তো গল্প, তুমি লিখবে?

    আমি অপ্রস্তুত। সুবল মিশ্রর পুলকিত বদন। নামী ব্যারিস্টার ছেলের মুখে বিড়ম্বনা গোপনের প্রয়াস। তার স্ত্রীর মুখে কৌতুকব্যঞ্জনা।

    মা আবার বললেন, সেদিন তুমি চলে যাবার পর বউমা বলছিল, লেখক হিসেবে তোমার নাকি খুব নাম-ডাক, তোমার অনেক গল্প-উপন্যাস ওর পড়া। এখন তো দেখছি ও ঠিকই প্রশংসা করছিল, দিব্বি চোখ আছে–গল্প যে আছে সেদিন একঘণ্টা এখানে বসেই তুমি বুঝলে কি করে?

    তামাসা করছেন কিনা বোঝা গেল না, কারণ সুবল মিশ্রর মুখে মহিলাটির হাসি কৌতুকের গল্পও শোনা আছে। বললাম, আর লজ্জা দেবেন না।

    তিনিও হেসে উঠলেন, লজ্জা কি, অনুভব করার মত চোখ আর মন আছে বলেই ধরে ফেলেছ–উল্টে বাহাদুরীর কথা তো! হাসিমুখে তিনি ছেলের বউয়ের দিকে তাকালেন একবার, তারপর আবার বললেন, ওই বউমাকে যদি ভালোমত ধরতে পারো, একটা গল্প পেয়েও যেতে পারো–তবে তোমাকে খুব সাবধানে লিখতে হবে, ও গল্প লিখতে না পারুক বাড়িয়ে বলতে ওস্তাদ।

    ছেলের বউয়ের নাম ঊর্মিলা। বছর সাঁইতিরিশ-আটতিরিশ হবে বয়েস। ইনিও মন্দ সুশ্রী নন, তবে তার রূপবান স্বামীটির তুলনায় কিছুই নয়। কিন্তু ভদ্রলোকের তুলনায় অনেক বেশি হাসিখুশী। এই গুণেরও একটা রূপ আছে। শাশুড়ীর কথায় লজ্জা পেলেন হয়ত, কিন্তু ঠিক দেখলাম কিনা জানি না, তার দিকে চেয়ে একটা চাপা উদ্দীপনার আভাসও চোখে পড়ল যেন।

    মায়ের হাসিমাখা দৃষ্টি এবারে ছেলের মুখখানা চড়াও করেছে।–ও কি! তোর মুখ অত গম্ভীর কেন? পাছে মায়ের ঠুনকো মর্যাদায় ঘা পড়ে সেই ভয়ে বুঝি?

    এবারে ছেলে অপ্রস্তুত। হেসেই জবাব দিলেন, তোমার মর্যাদায় ঘা দিতে হলে এঁকে কলম ছেড়ে অন্য কিছু ধরতে হবে।

    মা-টি ছদ্মগাম্ভীর্যে তক্ষুনি আমার দিকে ফিরলেন, থাক বাবা, তোমার লিখে কাজ নেই, কোর্টে কাড়ি কাড়ি মিথ্যের ব্যবসা করে তো ও আগে থাকতেই ওর বউকে চাটুর রাস্তায় চালাতে চাইছে, আর কানাকড়িও সত্যি পাবে না তুমি–এর পর বউমা বলে যদি কিছু, আমার কাছে যাচাই করে নিও।

    .

    ফেরবার পথে সুবল মিশ্র বলল, আমার কেমন মনে হচ্ছে, তুমি ঠিকই ধরেছ –মায়ের জীবনে কিছু একটা ব্যাপার আছে।

    -মনে হচ্ছে কেন?

    -মায়ের কথা শুনে আর ওই ছেলে আর ছেলের বউয়ের হাবভাব দেখে।

    একটু বাদে নিজে থেকেই জানালো, মাকে এখানে স্কুলে সক্কলে ভালবাসে, ভক্তি করে, আপদে-বিপদে ছুটে আসে তার কাছে। মায়ের সর্বদাই হাসিমুখ আর সর্বদাই কিছু না কিছু কাজে ব্যস্ত। বিশেষ করে ছেলে, ছেলের বউ, নাতি-নাতনী এলে তো কথাই নেই। যত হাসিখুশী তত ব্যস্ত।..কিন্তু একদিন মায়ের সে-এক অদ্ভূত মূর্তি দেখেছিল সুবল মিশ্র। কার মুখে শুনেছিল, মায়ের একটু জ্বর-ভাব হয়েছে। কিন্তু সমস্ত দিন দেখতে যাওয়ার ফুরসত মেলেনি। সময় হল রাত আটটার পরে। শীতকাল। তখন। ঘরের মধ্যেই হাড়ে-হাড়ে ঠোকাঠুকি, নেহাত দায়ে না ঠেকলে বাইরে কেউ বেরোয় না। কিন্তু সুবলের ভিতরটা কেমন খুঁতখুঁত করতে লাগল। তার পরদিনই বড় লেন-দেনের ব্যাপার আছে একটা। এর মধ্যে মায়ের শরীর খারাপ শুনেও যাওয়া হল না বলে খুঁতখুতুনি আরো বেড়েই গেল। শেষে আপাদমস্তক গরম পোশাকে নিজেকে মুড়ে, সাইকেল আর টর্চ নিয়ে বেরিয়েই পড়ল সে। মা যদি ঘুমিয়ে পড়ে থাকেন, খবরটা তো নিয়ে আসতে পারবে!

    কিন্তু গিয়ে দেখে, বাড়িতে যারা থাকে তারাই ঘুমুচ্ছে–বাইরের ঘরে কম্বল মুড়ি দিয়ে একজন চাকর বসে। চাকরটা জানালো, মা তখনো পুজোর ঘর থেকে বেরোননি।

    কি খেয়াল হল, পায়ে পায়ে সুবল ভিতরে ঢুকল। মায়ের বাড়িতে অন্দরমহল বলে কিছু নেই। ভিতরে আগেও দুই একবার এসেছে। পুজোর ঘরের দরজার এক পাট খোলা। গিয়ে যে দৃশ্য দেখল ভোলবার নয়। গোবিন্দজীর বিগ্রহের সামনে মা দুহাত জোড় করে দাঁড়িয়ে আছেন। চোখ বোজা। সেই হাড়কাঁপানো শীতে মায়ের গায়ে একটা গরম জামা বা চাদর পর্যন্ত নেই। তসরের থানের আঁচলটা শুধু গায়ে। জড়ানো। কিন্তু মা যেন পাথরের মূর্তি। একটু কাঁপছেন না, একটু নড়ছেন না–নিঃশ্বাস প্রশ্বাসও নিচ্ছেন কিনা খুব ভালো করে লক্ষ্য না করলে বোঝা যায় না। সেই পাথরের মূর্তির দুই গাল বেয়ে অজস্রধারে. ধারা নেমেছে।

    হতবুদ্ধির মত কতক্ষণ দাঁড়িয়েছিল সুবল মিশ্র খেয়াল ছিল না। কম করে আধঘণ্টা হবে। ঠায় দাঁড়িয়ে সেই এক দৃশ্য দেখেছে সে। মায়ের সমস্ত দেহে কোনো অনুভূতির লেশমাত্র নেই। কেবল ওই নীরব নিঃশব্দ কান্না ছাড়া। কেঁদে কেঁদে মা। বুঝি নিজেকে নিঃশেষে ক্ষয় না করা পর্যন্ত ওমনি চোখ বুজে হাত জোড় করে গোবিন্দজীর সামনে দাঁড়িয়েই থাকবেন।

    যেমন এসেছিল সুবল মিশ্র তেমনি নিঃশব্দেই ফিরে গেছে।

    .

    মাতৃকুটীতে আমার আনাগোনা নৈমিত্তিক হয়ে দাঁড়াল।

    মায়ের সঙ্গে কথা হয়। তিনি ব্যস্ত থাকলে ব্যারিস্টার মহানন্দ ঘোষের সঙ্গে গল্প করি। তার স্ত্রী ঊর্মিলার সঙ্গে কথাবার্তা গল্পগুজব আরো বেশি হয়। মা তাও এক এক সময় লক্ষ্য করেন আর মুখ টিপে হাসেন। কখনো বা জিজ্ঞাসা করেন, তোমার গল্প কতদূর এগোলো?

    গল্প এগোচ্ছে কিনা সেটা আমি জানি আর ঊর্মিলা জানেন। একজনের জানার আগ্রহের সঙ্গে আর একজনের জানানোর আগ্রহ মিলেছে। কিন্তু সোজাসুজি আমি তাকে কিছু জিজ্ঞাসা করি না, তিনিও সরাসরি কিছু বলেন না। এই জানা আর জানানোর মধ্যে কখনো স্পষ্ট কখনো অস্পষ্ট অথচ অনায়াসে একটা লুকোচুরি খেলা চলেছে। যেন। কথাপ্রসঙ্গে কথা ওঠে, যেটুকু বললে চলে, তিনি হয়ত তার থেকে একটু বেশি বলেন। আর যেটুকু শুনলে কৌতূহল মেটে, আমি তার থেকে একটু বেশি শুনতে চাই।

    মাকে নিয়ে সত্যিই কিছু লেখা হবে কিনা ঊর্মিলা নিঃসংশয় নন। কিন্তু আগ্রহ যে তাঁরই সব থেকে বেশি সেটা সহজেই বোঝা যায়। কথার মাঝে থমকে সাগ্রহে জিজ্ঞাসা করেন, সত্যিই আপনি লিখবেন নাকি কিছু?

    মৃদু হেসে ব্যারিস্টার সাহেব আমাকে সতর্ক করেছেন, লিখতে গিয়ে আপনি মশায় না ফ্যাসাদে পড়ে যান, মাকে যিনি চেনাচ্ছেন আপনাকে, তিনি নিজেই কিন্তু অন্ধ

    ঊর্মিলা হাসিমুখেই রাগ করেছেন, বেশ, তুমিই তাহলে ভদ্রলোককে সাহায্য করো না একটু, মা তো পারমিশন দিয়েইছেন!

    হাসির মধ্যে মহানন্দ ঘোষকে অন্যমনস্ক হতে দেখেছি। একটু চুপ করে থেকে বলেছেন, মানুষের ভিতরটা বড় বিচিত্র ব্যাপার, কখন কোন ছোঁয়া লেগে কি কাণ্ড যে ঘটে যায়!…আমার এই মাকে দেখা, আকাশ দেখার মতই সহজ, কিন্তু চেনা বড় কঠিন। কথা কটা বলেই আত্মস্থ হয়ে হেসেছেন আবার, বলেছেন, জোড়া অন্ধের। হাতে পড়ার থেকে এক অন্ধের হাতে পড়াই নিরাপদ আপনার পক্ষে।

    তবু কথাপ্রসঙ্গে হোক বা জ্ঞাতসারেই হোক, সাহায্য তিনিও করেছেন আমাকে। যেটুকু আমি পেয়েছি তাই দুর্লভ মনে হয়েছে।

    ছুটি ফুরোতে ব্যারিস্টার সাহেব সপরিবারে কলকাতা রওনা হয়ে গেলেন। আমার আরো আগেই ফেরার কথা ছিল। শিগগীরই ফিরব শুনে তাঁরাও সাগ্রহে আমাকে তাদের সঙ্গী হবার আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। কিন্তু আমার কবে যাবার সময় হবে যে শুধু আমিই জানতাম।

    তারা চলে যাবার ঠিক চার দিন বাদে সন্ধ্যার পর আমি মায়ের কাছে এলাম। একা। মা তখন পুজোর ঘরে যাবেন বলে পা বাড়িয়েছেন। আমাকে দেখে দাঁড়ালেন।–সুবল বলছিল, তুমি দুই-একদিনের মধ্যেই চলে যাচ্ছ?

    –হ্যাঁ, কাল যাব ভাবছি।

    মা সাদা মনে বললেন, তাহলে তো নন্দদের সঙ্গে গেলেই পারতে, এত পথ একা-একা যেতে কষ্ট হবে।

    -আপনার জন্যেই থেকে গেছি, আপনি বলেছিলেন লেখা যাচাই করিয়ে নিতে।

    মায়ের মুখে প্রথমে বিস্ময়, পরে কৌতুক-মাধুর্যের নীরব বিন্যাস দেখলাম আমি। তার চোখে হাসি, মুখে হাসির আভাস।

    -সত্যি লিখেছ নাকি?

    আমি মাথা নাড়লাম- সত্যি।

    –আচ্ছা, এসো।

    আমাকে সঙ্গে করে সোজা পুজোর ঘরেই ঢুকলেন তিনি। তার আসন পাতাই ছিল, অদূরে আর একখানা আসন পেতে দিলেন।–বসো, এখানে বসেই শুনি কি লিখেছ!

    আমি যা লিখেছি সেটা আর যাই হোক চমকপ্রদ গল্প কিছু নয়। হৃদয়ের চিত্র বলা যেতে পারে। তবে বিচিত্র বটে।

    আমি পড়ছি। বাহুল্যবর্জিত খুব সংক্ষেপে আঁকা চিত্র। অদূরের আসনে বসে মা নিষ্পলক আমার মুখের দিকে চেয়ে শুনছেন।

    .

    ঘটনার প্রথম পটভূমি এখানেই। এই মাতৃকুটীরের জায়গায় যে ভাঙা বাড়ি ছিল, সেখানে। বাড়িতে থাকতেন বৃদ্ধ দ্বিজেন গাঙ্গুলি আর তার মেয়ে মনোরমা। বয়েস হিসেব করলে দ্বিজেন গাঙ্গুলিকে প্রৌঢ় বলা যেত। অবশাঙ্গ রোগী তিনি, অকালে বার্ধক্য এসেছে।

    কলেজের খাতায় মনোরমার নাম ছিল। কিন্তু যেতে কমই পারতেন। প্রথম বাধা বাপের ব্যাধি, দ্বিতীয় বাধা মেয়ের রূপ, তৃতীয় বাধা তার মেজাজ। রূপের কারণে স্তাবকদের অত্যাচার আর মেজাজের কারণে প্রায়ই অপ্রীতিকর পরিস্থিতির উদ্ভব। অসচ্ছল ঘরের রূপের প্রতি মানুষের লোভ বেশি অশালীন হয়ে উঠতে চায়। আর সেই রূপের ওপর মেজাজের ছটা দেখলে তাদের আচরণ আরো বেশি জ্বর হয়। মনোরমা কলেজে যাওয়া ছেড়েই দিয়েছিলেন প্রায়।

    (এইটুকু পড়েই আমি মায়ের দিকে তাকিয়েছিলাম। তাঁর মুখ নির্লিপ্ত, ভাবলেশশূন্য।)।

    ওই ভাঙা বাড়িতে নতুন একজনের পদার্পণ ঘটল একদিন। কলকাতার প্রেমানন্দ ঘোষ। সবে ল ফাইন্যাল দিয়েছেন। অন্তরঙ্গ বন্ধু এবং সহপাঠী রণদা চ্যাটার্জীর সঙ্গে আসামে বেড়াতে এসেছেন। রণদা চ্যাটার্জীর বাবার তখন আসামে কর্মস্থল।

    বন্ধুকে সঙ্গে করে রণদা চ্যাটার্জী গাঙ্গুলি কাকাকে দেখতে এসেছেন। পাড়ার সম্পর্কে কাকা। কাকার অন্যান্য জ্ঞাতিবর্গরা এখনো তাদের পাশের বাড়িতে থাকেন। এক গাঙ্গুলি কাকাই শুধু সকলের সংস্রব ছেড়ে ওই বাড়িতে বাস করছেন ওই মেয়ের জন্মেব আগে থেকে। আত্মীয়-পরিজনের সঙ্গে তার পোষায়নি। কিন্তু বাড়ি ছাড়লেও রণদা চ্যাটার্জীর বাবার সঙ্গে প্রীতির সম্পর্ক ছিল। সেই সুবাদে হৃদতা এবং যাতায়াত।

    রণদা চ্যাটার্জী গাঙ্গুলি কাকাকে দেখলেন এবং তাঁর শয্যার পাশে বসে সুখদুঃখের কথা কইতে লাগলেন। প্রেমানন্দ ঘোষ বাড়ির আর একজনকে দেখলেন বার কয়েক, এবং দেখে সারাক্ষণ বোবা হয়ে বসে থাকলেন। সকলের অগোচরে দুচোখ তার এই ভাঙা বাড়ির আনাচে-কানাচে উঁকি-ঝুঁকি দিতে লাগল। যাঁকে এই ঘরের মধ্যে দুই একবার দেখেছেন তাকে আবার দেখার জন্য তার নির্বাক দৃষ্টি থেকে থেকে উসখুস করে উঠতে লাগল।

    দ্বিজেন গাঙ্গুলি প্রেমানন্দ ঘোষের নামধাম লেখাপড়া ইত্যাদির খোঁজখবর নিলেন। প্রেমানন্দকে লক্ষ্যও করলেন ভালো করে। লক্ষ্য অনেকেই করে থাকে, অমন সুন্দর চেহারা শতেকে চোখে পড়ে না। যেমন গায়ের রঙ, তেমনি উঁচু লম্বা, তেমনি স্বাস্থ্য। দেখে দুচোখ হঠাৎ চকচক করে উঠল দ্বিজেন গাঙ্গুলির। এরপর বার কয়েক মেয়েকে তিনি ঘরে ডাকলেন–চা-জলখাবার দেবার জন্য, পেয়ালা নিয়ে যাবার জন্য, মশলা দিয়ে যাবার জন্য।

    তারপর রণদার উদ্দেশে অনুযোগ করলেন, আমাকে একটি ভালো ছেলে দেবার জন্য কলকাতায় তোমাকে চিঠি পর্যন্ত লিখেছি, কিছুই তো করলে না, এদিকে আমার এই হাল, কবে আছি কবে নেই, আর সুযোগ পেয়ে বাজে লোকে হামলাও করে, দুর্ভাবনায় আমি ঘুমুতে পারি না জানো?

    বাড়ি থেকে বেরিয়েই রণদা চাটুজ্যে প্রেমানন্দর জেরায় পড়লেন।-মেয়ের জন্য ভদ্রলোক আসলে তোমাকেই চান বোধ হয়?

    -না।

    –কেন? তুমি দুর্লভ?

    –না, ওই মেয়ে আমার দুর্লভ। মেয়ে রাজী হলে সকলের অমতেই বিয়ে করতুম।

    –আশ্চর্য! মেয়ে রাজী নয়?

    -প্রস্তাব দিইনি কখনো, দিলেও রাজী হবে না। মেয়ের দোষের মধ্যে মেজাজ কড়া।

    –কেন রাজী হবে না কেন, তুমি যোগ্য নও?

    -একটু বেশি যোগ্য বলে। মনোরমা বামুনের মেয়ে নয়, কায়স্থ। তোমার পছন্দ হয়ে থাকে তো বলো, দ্বিজেন কাকা আকাশের চাঁদ হাতে পাবেন।

    প্রেমানন্দ ঘোষের হৃৎপিণ্ডটা হঠাৎ লাফিয়ে উঠেছিল বুঝি। স্তব্ধ বিস্ময়ে জিজ্ঞাসা করেছেন, মেয়েটি তাহলে তোমার দ্বিজেন কাকার মেয়ে নয় বলছ?

    -না। তবে মেয়ের থেকে ঢের বেশি।

    রণদা চ্যাটার্জী এরপর খোলাখুলিই বলেছেন সব। কারণ তিনি অনুমান করেছেন মনোরমার রূপ দেখে বন্ধুর মাথা ঘুরেছে, আবার বন্ধুর রূপ দেখে ওদেরও মাথা ঘোরা বিচিত্র নয়। নইলে গাঙ্গুলি কাকা অত আগ্রহ নিয়ে খোঁজখবর করছিলেন কেন?

    যা তিনি নিবেদন করলেন, তার ইতিবৃত্ত সংক্ষিপ্ত, কিন্তু জটিল একটু। বয়েস কালে দ্বিজেন গাঙ্গুলি ভয়ানক বেপরোয়া ছিলেন আর তার চরিত্রেরও দুর্নাম ছিল। মদ-গাঁজা খেতেন, গান-বাজনা করতেন। পৈতৃক জমিদারির আয় ছিল, তাতেই চলে যেত। আজকের এই ব্যাধিও সে-সময়ের অপচয়ের ফল বলেই অনেকে সন্দেহ করেন।

    এক বড়লোকের মেয়েকে মনে ধরেছিল তার। তাকে সত্যিই ভালোবাসতেন। মেয়েটি ঘৃণা করতেন তাকে, কিন্তু তার গান পছন্দ করতেন। সেই বাসনায় মোহগ্রস্ত। মেয়ের দাদার বন্ধু ছিলেন গাঙ্গুলি কাকা। তারা কায়স্থ। তবু সেই মেয়েকে বিয়ে করার জন্য ক্ষেপে উঠেছিলেন তিনি। ফলে মর্মান্তিক বিচ্ছেদ, গাঙ্গুলি কাকার বাড়িতেও এ নিয়ে গঞ্জনা-লাঞ্ছনা। সব বাধা উপেক্ষা করে ওই মেয়েকে নিয়ে পালানোর ষড়যন্ত্র সম্পূর্ণ করেছিলেন। কিন্তু মেয়েটি টের পাওয়ার ফলে ষড়যন্ত্র বানচাল। আর তা প্রকাশ হবার ফলে গাঙ্গুলি কাকার অদৃষ্টে দ্বিগুণ লাঞ্ছনা।

    মেয়েটির অন্যত্র বিয়ে হয়ে গেল। বড়লোকের বাড়িতেই বিয়ে হল। অনেক দূরে, আসামের বাইরে।

    আত্মীয়স্বজনদের ছেড়ে গাঙ্গুলি কাকা এই বাড়িতে এসে আস্তানা নিলেন। আর আত্মঘাতী আনন্দে, অপচয়ের পাঁকে ডুবতে লাগলেন।

    বছর দেড়েক বাদে সকালে ঘুম ভেঙে দেখেন, তার শয্যার একধারে দেড়মাসের একটা মেয়ে ঘুমুচ্ছে। রাতের নেশার ঘোর কাটেনি কিনা বুঝলেন না। চোখ কচলে আবার দেখলেন। সত্যিই মেয়ে একটা!

    রাতে ঘরের দরজার কপাট খোলা রেখেই শোন তিনি। কোন্ বাড়ির মেয়ে, কে কখন এসে রেখে গেল! মেয়ের হাতে বাঁধা একটা ভাজকরা কাগজ চোখে পড়ল। তাড়াতাড়ি সুতোটা ছিঁড়ে নিয়ে খুললেন সেটা। ছোট্ট চিরকুট!–দয়া করে রেখো ওকে। নিরুপায় হয়েই তোমার আশ্রয়ে রেখে গেলাম। কেউ জানবে না।–মণিমালা।

    সেই মেয়ের নাম মণিমালা।

    গাঙ্গুলি কাকা হতভম্ব। অনেক ভেবে একসময় মণিমালার বাপের বাড়ি গেলেন। জিজ্ঞাসাবাদ না করেও বুঝলেন, সেখানে কেউ তার খবর রাখে না। ভাবতে ভাবতে গাঙ্গুলি কাকা ফিরে এলেন।

    এর ঠিক তিন দিন বাদে কাগজে মণিমালার আত্মহত্যার খবর বেরুলো। তার নাকি মাথাখারাপ হয়েছিল। আত্মহত্যা করার আগে নিজের মেয়েকেও হত্যা করে। গেলেন লিখেছেন। কিন্তু সেই শিশুর দেহের কোনো সন্ধান মেলেনি।

    কেন এরকম একটা ব্যাপার ঘটল সেই রহস্য আজও অগোচর।

    ঘরে একটা শিশু পুষছেন, ছমাসের মধ্যেও গাঙ্গুলি কাকা সেটা বাইরে কাউকে জানতে দিলেন না। পরে সকলে জানল, গাঙ্গুলি কাকারই মেয়ে, কোথায় কি কাণ্ড করে বসেছিলেন, এ তারই ফল।

    সেই শিশুকন্যাই এই মনোরমা।

    গাঙ্গুলি কাকার বাড়িতে প্রেমানন্দ ঘোষের যাতায়াত বেড়েছে। পরে সেটা দুবেলায় দাঁড়িয়েছে। মনোরমাকে যত বেশি দেখেছেন তিনি তত বেশি নিজেকে হারিয়েছেন। হারাবার নেশাতেই আবার ছুটে এসেছেন। কিন্তু ভিতরে দুশ্চিন্তার অন্ত নেই তাঁর। রক্ষণশীল পরিবার তাদের, বাপ সাধারণ উকীল, চেহারার জোরে ছেলে দেখেশুনে শাঁসালো মুরুব্বি ধরবে–ঘরে অর্ধেক রাজত্ব আর রাজকন্যা আসবে–সেই আশায় আছেন। অতএব দুর্ভাবনার কারণ বইকি তার। কিন্তু দ্বিজেন গাঙ্গুলির বাড়ি এলে তার সব ভাবনা-চিন্তা নিঃশেষে তলিয়ে যায়। দুনিয়ার বিপ্ন ঠেলে সরিয়ে ওই মেয়েকে ঘরে নিয়ে তুলতে চান তিনি।

    ফেরার দিন দশেক আগে ঘোষণা করলেন, মনোরমাকে বিয়ে করবেন। শুধু তাই নয়, একেবারে বউ নিয়ে কলকাতায় ফিরবেন। এ প্রস্তাবে আপত্তি একমাত্র রণদা। চ্যাটার্জী তুলেছিলেন, সেটা ঠিক হবে না, আগে বাবা-মাকে জানানো দরকার।

    প্রেমানন্দ বলেছেন, তাহলে বিয়ে হবে না, তারা রাজী হবেন না।

    অন্য কেউ হলে আপত্তি করতেন, কিন্তু দ্বিজেন গাঙ্গুলি সেই চরিত্রের মানুষ যিনি অন্য কারো মতামত বা অনুমোদনের গুরুত্ব দেন না। তিনি শুধু জিজ্ঞাসা করেছেন, প্রেমানন্দ মেয়ের সম্পর্কে বিস্তারিত জানেন কিনা। আর বিয়ে করলে আর কিছু যে প্রাপ্তির আশা নেই তাও তিনি স্পষ্ট করেই বুঝিয়ে দিয়েছেন।

    উকীলের ছেলে প্রেমানন্দ টাকা চেনেন, টাকার প্রতি তার টানও আছে। কিন্তু তখন সমস্ত চিন্তা তার একটাই। বলেছেন, আর কিছু তিনি আশা করেন না।

    বিয়ে হয়ে গেল। এমন অনাড়ম্বর বিয়ে প্রেমানন্দ কল্পনাও করতে পারেন না। তবু তখনকার মত আত্মবিহ্বল তিনি।

    মনোরমাকে নিয়ে যেদিন কলকাতায় রওনা হবেন, তার আগের দিন রাত্রিতে দ্বিজেন গাঙ্গুলি মানুষটিকে সত্যিই চেনা গেল। মনোরমাকে তিনি আদেশ দিলেন–ভারী কাঠের সিন্দুকটা খুলতে আর তার ভিতরে একটা উবুড় করা বড় হাঁড়ির মধ্যে যে শাড়ি জড়ানো বড় পুটলিটা আছে, সেটা নিয়ে আসতে।

    নির্দেশ পালন করা হল। পুঁটলি খুলতেই চক্ষুস্থির প্রেমানন্দ ঘোষের। একরাশ পুরনো ধাঁচের সোনার গয়না।

    দ্বিজেন গাঙ্গুলি বললেন, বিশ বছর আগের পঁচিশ হাজার টাকার গয়না এখানে, এখন এর দাম কম করে পঁয়তিরিশ হাজার হবে–খুব সাবধানে নিয়ে যাও!

    প্রেমানন্দ হতভম্ব। সত্যি দেখছেন বা সত্যি শুনছেন কিনা সেই সংশয়। দ্বিজেন গাঙ্গুলি আবার বললেন, এসবই ওর, পাছে গয়নার লোভে কেউ ওকে বিয়ে করতে চায় সেজন্যে বলিনি। দেড়মাস বয়সে ওর মা শুধু ওকেই রেখে যায়নি ওর মাথার কাছে এই পুঁটলিটাও রেখে গেছল।

    .

    কলকাতা।

    প্রেমানন্দর বাবা মা বা আত্মীয় পরিজন কেউ এ বিয়ে ক্ষমার চোখে দেখেননি। বউ রূপ্রস্রী সেটা সকলেই দেখেছেন, এমন রূপ সচরাচর চোখে পড়ে না, কিন্তু এই রূপের পিছনে কাটার ছায়াও দেখেছেন সকলে। এমন রূপসী মেয়েকে এভাবে কে গছিয়ে দেয়? যে-লোক ছেলের বাপ-মায়ের অনুমতি না নিয়ে এ-ভাবে মেয়ে পার করল, সেই লোককে ভালো বলা যাবে কেমন করে? আর ভালো না হলে তারই আশ্রয়ে ছিল যখন–এই মেয়েই বা কেমন?

    প্রেমানন্দ নিজের বাড়িতে চোরের মত কাটালেন কিছুদিন। উত্তেজনা একটু থিতিয়ে আসতে সব খুলে বলে মা-কে বোঝাতে চেষ্টা করলেন তিনি। ফল তাতে আরো বিপরীত হল। মা-টা কেন আত্মহত্যা করল? মায়ের স্বভাব-চরিত্র কেমন ছিল? একজন পর-পুরুষের বাড়িতে মেয়ে ফেলে রেখে গেল কেন?

    যাক, বাড়ির কর্তা পঁয়তিরিশ হাজার টাকার গয়না পাওয়া গেছে শুনেই হয়ত শেষ পর্যন্ত ত্যজ্যপুত্র করলেন না ছেলেকে। মোট কথা, ওই গয়না ছাড়া আর কিছুই পছন্দ হল না প্রেমানন্দর বাবা-মায়ের।

    তবু মনোরমা যতদিন মুখ বুজে ছিলেন, একরকম কেটেছে। মুখ খুলতেই গণ্ডগোল শুরু হল। দুমাস না যেতেই বউয়ের এক-এক সময় উগ্র মূর্তি দেখে বাড়ির মানুষেরা তাজ্জব। অন্যায় কিছু কানে এলে মনোরমা ফুঁসে ওঠেন। আর কানে তো হরদমই আসছে। বউ সহ্য করে না বলে প্রেমানন্দও বিরক্ত। কখনো বা ক্রুদ্ধ। তারও ফল বিপরীত। কাপুরুষের মত স্বামী অত্যাচারের প্রশ্রয় দেয় বলে তার ওপরেও এক এক সময় ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন মনোরমা।

    বউয়ের সাহস আর স্পর্ধা দিনে দিনে অসহ্য হয়ে উঠতে লাগল শ্বশুর-শাশুড়ীর। উঠতে বসতে চলতে ফিরতে তারা সাহস দেখেন; স্পর্ধা দেখেন। কথার জবাবে কথা বললে রাগে সাদা হয়ে ওঠেন তারা। আর সবকিছুর অবধারিত গঞ্জনার ঝাঁপটা এসে পড়ে প্রেমানন্দর ওপর। বেচারা নতুন উকীল, পসারের চেষ্টায় মাথা ঘামাবেন কি, বাড়ির অশান্তিতে নাজেহাল। ফলে বউয়ের ওপরেই ক্রোধে আরক্ত হয়ে ওঠেন তিনি।

    এদিকে রণদা চ্যাটার্জী ঘন ঘন বাড়িতে আসেন আজকাল। তার সঙ্গে অমন দেমাকী আর অতি রাগী বউয়ের সম্প্রীতি একটুও সুনজরে দেখেন না শ্বশুর-শাশুড়ী। ওদিকে এই একমাত্র মানুষকে বেশ সমীহ করতে দেখে প্রেমানন্দর নিভৃতের চিন্তাও বিকৃত রাস্তায় চলতে শুরু করল। মনোরমা রাজী হলে জাত-বর্ণের রাধা বা বাপ মায়ের আপত্তি তুচ্ছ করেও বিয়ে করতে আপত্তি ছিল না রণদার, এ তো তার নিজেরই মুখেই শুনেছেন। সামনা-সামনি বন্ধুর সঙ্গে কোনো বিবাদের সূচনা হল না বটে, কিন্তু অশান্তির আগুন ধিকি ধিকি জ্বলতেই থাকল।

    শেষে তুচ্ছ কারণেই দপ করে জ্বলে উঠল একদিন।

    কোন এক নিকট আত্মীয়ের বাড়িতে পৈতের নেমন্তন্ন ছিল সকলের। প্রেমানন্দ সকালে উঠেই সেখানে চলে গেছেন। বউকে নিয়ে শ্বশুর-শাশুড়ীরও সকাল-সকালই যাওয়ার কথা। কিন্তু মনোরমা জানালেন, তাঁর শরীর ভালো না, তিনি যাবেন না।

    বউ সাত মাস অন্তঃসত্ত্বা, শরীর ভালো নাও থাকতে পারে, শ্বশুর-শাশুড়ী তার আপত্তিতে কান দিতে চাইলেন না। হুকুম করলেন, যেতে হবে। মনোরমা শাশুড়ীকে জানালেন তার যাওয়া সম্ভব হবে না।

    ছুটির দিন। এর একটু বাদে রণদা এলেন গল্প করতে। শ্বশুর-শাশুড়ী দেখলেন বউ তার সঙ্গে দিব্বি কথাবার্তা কইছে।

    নেমন্তন্ন বাড়িতে এসে ছেলেকে ডেকে তার বাবা নিজেদের অপমানের ফিরিস্তি দিলেন, আর রণদার সঙ্গে বসে বউ গপ্পসপ্প করছে জানিয়ে তাকে বললেন বউকে নিয়ে আসতে।

    মাথার মধ্যে অগ্নিকাণ্ড শুরু হল প্রেমানন্দর। ট্যাক্সি হাঁকিয়েই বাড়ি ফিরলেন তিনি। এসে অবশ্য দেখেন বউ একাই আছে। তবু যা মুখে আসে তাই বলে গালাগালি করলেন। রণদাকে আর বাড়িতে ঢুকতে দেওয়া হবে না, একথাও ঘোষণা করলেন। আর বিয়ের নমাসের মধ্যে জীবনটা যে তাঁর অশান্তিতে জ্বলেপুড়ে খাক হয়ে গেল সরোষে তাও বার বার বলতে বাকি রাখলেন না।

    মনোরমা জিজ্ঞাসা করলেন, অশান্তির শেষ হবে কেমন করে?

    ক্রুদ্ধ গর্জনে প্রেমানন্দ জবাব দিলেন, শ্মশানে নিয়ে গিয়ে তোমাকে চিতায় শুইয়ে দিতে পারলে? বুঝলে? সেই রাস্তা করে দিতে পারো?

    মনোরমার দুই চোখেও তেমনি জ্বলন্ত আক্রোশ আর বিদ্বেষ। জবাব দিলেন না।

    প্রেমানন্দ চিৎকার করে উঠলেন, তুমি এক্ষুনি আমার সঙ্গে যাবে কিনা আমি জানতে চাই!

    মনোরমা বললেন, না।

    প্রেমানন্দ চলে গেলেন, আর ফিরে এসে এর শেষ দেখবেন বলে গেলেন।

    কিন্তু সন্ধ্যায় ফিরে এসে বউকে আর বাড়িতে দেখলেন না কেউ। মনোরমা নেই, তার বড় ট্রাঙ্কটাও নেই।

    বাড়ির মানুষেরা স্তম্ভিত।

    দুমাস বাদে আসাম থেকে দ্বিজেন গাঙ্গুলির টেলিগ্রাম এলো, মনোরমা মারা গেছে।

    ব্যস। বিয়ের এগারো মাসের মধ্যে একটা অধ্যায় শেষ।

    প্রেমানন্দ জানেন না ছেলে হতে গিয়ে মারা গেল কি আর কোনো কারণে?  মনোরমার মা মণিমালা আত্মহত্যা করেছিলেন। মেয়েও তাই করল কিনা কে জানে?

    বউয়ের জন্য এ-বাড়িতে শোক করার কেউ নেই। সংবাদের একঘণ্টার মধ্যে প্রেমানন্দর বাবা ছেলেকে ডেকে জিজ্ঞাসা করেছেন, যাবার সময় বউমা সব কটি গয়না তো গুছিয়ে নিয়ে গেছলেন, সেগুলির কি হবে?

    এরপর রণদাকেও ডেকে গয়নার কথা বলেছেন তিনি। জিজ্ঞাসা করেছেন, যাতায়াতের খরচ দিলে আসামে গিয়ে রণদা সেগুলি নিয়ে আসতে পারেন কিনা।

    রণদা চ্যাটার্জী মাথা নেড়েছেন– পারেন না।

    অগত্যা দিন পনের বাদে তিনিই বউয়ের গয়না চেয়ে অদেখা দ্বিজেন গাঙ্গুলির নামে চিঠি দিয়েছেন একখানা।

    জবাব মেলেনি।

    প্রেমানন্দ ঘোষের ধাক্কা সামলাতে খুব বেশি সময় লাগেনি। গয়নার কথা শেষে তারও মনের তলায় উঁকিঝুঁকি দিয়েছে। মাস চারেক বাদে দ্বিজেন গাঙ্গুলির নামে শেষে তিনিও চিঠি দিয়েছেন একখানা। লিখেছেন, তার নির্দেশ পেলে বউয়ের গয়না আনতে লোক পাঠাবেন, না নিজেই যাবেন।

    নির্দেশ পাননি। জবাব আসেনি।

    .

    পরের যবনিকা উঠেছে পঁচিশ বছর বাদে। অ্যাডভোকেট প্রেমানন্দ ঘোষ বাড়ি করেছেন, গাড়ি করেছেন, বাইরে জায়গাজমি কিনেছেন, ব্যাঙ্কে প্রচুর টাকাও জমিয়েছেন। কিন্তু মনে শান্তি নেই।

    সুমিত্রাকে বিয়ে করেছিলেন বউয়ের মৃত্যুসংবাদ আসার ছমাসের মধ্যে। সে সময়ের নামকরা সিনিয়রের মেয়ে। তা সে-ভদ্রলোক যতই বড়লোক হোন, তার আটটি মেয়ে। সুমিত্রা মাঝের দিকের একজন। অতএব প্রেমানন্দর প্রতি চোখ পড়েছিল তার। সুমিত্রারও পড়েছিল। সেদিক থেকে প্রেমানন্দর চেহারা প্রধান সহায়। ছেলেটা কালে-দিনে ভালো করবে এটা সিনিয়র ভদ্রলোক বুঝেছিলেন এবং বাড়িতে বুঝিয়েছিলেন। অতএব ঝঞ্ঝাটশূন্য প্রথম স্ত্রী-বিয়োগের বাধাটা বড় হয়ে ওঠেনি।

    দ্বিতীয় শ্বশুরের অনুমানে ভুল হয়নি। দেখতে দেখতে পসার বেড়েছে প্রেমানন্দর। কিন্তু দ্বিতীয় স্ত্রী অর্থাৎ সুমিত্রার সঙ্গেও খুব মনের মিল হল না প্রেমানন্দর। বিয়ের দশ বছর বাদেও ঠাট্টার ছলে রণদা চ্যাটার্জীকে শুনিয়েই সুমিত্রা বলেছেন, আপনার বন্ধুর মনমেজাজ ভালো থাকবে কি করে, প্রথম বউ মরার ছমাসের মধ্যে আবার বিয়ে করলেও তার স্মৃতিতে যে এখনো বুক ভরে আছে!

    রণদা চাটুজ্জে টিপ্পনী কাটতেন, গয়নার স্মৃতিতে নয় তো?

    যত হাসিমুখেই বলুন, জ্বালা ছিলই সুমিত্রার। দুজনের মতের মিল কমই হত, খিটিমিটি লেগে থাকত। অশান্তি বাড়তে থাকল ছেলেরা বড় হয়ে উঠতে। তিন ছেলে। বড় ছেলের তেইশ বছর বয়স, মেজ ছেলের একুশ, ছোট ছেলের উনিশ। বাপের পয়সার দরুন হোক বা মায়ের প্রশ্রয়ের কারণে হোক–পড়াশুনা একজনেরও তেমন। হয়নি। তারা বড়লোকের ছেলে, বড়লোকের ছেলের মতই চাল-চলন। এই চাল-চলন দেখে অনেক রকম সন্দেহও প্রেমানন্দর মাথায় ঘোরে। সন্দেহ কেন, বড় দুই ছেলের সম্পর্কে তিনি সম্পূর্ণ হতাশ। ছোটটাও দাদাদের রাস্তায় চলা শুরু করেছে।

    সুমিত্রা ছেলেদের দোষত্রুটি ঢেকে রাখতেন, ভদ্রলোকের কাছ থেকে তাদের আগলে রাখতে চেষ্টা করতেন। এই কারণেই সুমিত্রার সঙ্গে এক-একদিন তুমুল বচসা হয়ে যেত তার।

    প্রেমানন্দর শরীর ভালো যাচ্ছিল না। হঠাৎ কোর্টেই স্ট্রোক হয়ে গেল একদিন। চিকিৎসার দাপটে সেরে উঠলেন এ-যাত্রা, কিন্তু এখনো শয্যাশায়ী। ডাক্তার সতর্ক করেছেন, দ্বিতীয়বার হলে ভয়ের কথা। কিন্তু বিপদের সম্ভাবনাই বেশি দেখছেন। প্রেমানন্দ ঘোষ। হার্ট দুর্বল, প্রেসার হঠাৎ ওঠে হঠাৎ নামে। ভিতরে ভিতরে বিদায়ের জন্যেই প্রস্তুত হচ্ছেন তিনি।

    এই প্রস্তুতির আভাস ছেলেরা পেয়েছে, সুমিত্রা পেয়েছেন। প্রেমানন্দ ঘোষের ধারণা ছেলেরা দিন গুনছে, বাপ চোখ বুজলে সব তাদের হাতে আসতে পারে। স্ত্রীর সামনেই রণদা চ্যাটার্জীকে সেদিন ডেকে বললেন, ছেলেদের ইচ্ছে কোথায় কি আছে না আছে তাদের বুঝিয়ে দিই, ওদের মায়েরও সে-রকমই ইচ্ছে কিনা জানি না কিন্তু ছেলেদের হাতে সব পড়লে ফল কি হবে ভগবান জানেন! তাই ভেবেছি একটা উইল করব, তুমি ব্যবস্থা করো–এঁর জন্যে অর্ধেক অন্তত আলাদা করে রাখব ঠিক করেছি।

    রণদা চাটুজ্জে স্পষ্টই সুমিত্রাকে সচকিত হতে দেখলেন।

    বন্ধুর কথার জবাব দিলেন না রণদা চ্যাটার্জী। গম্ভীর। অন্যমনস্ক। হঠাৎ জিজ্ঞাসা করলেন, আসাম থেকে কেউ দেখা করতে এসেছিল তোমার সঙ্গে?

    প্রেমানন্দ ঘোষ অবাক।-না তো, আসাম থেকে কে আসবে?

    –একটি ছেলে, এলে শুনো। তাড়া আছে, চলি।

    চলে গেলেন। শুধু প্রেমানন্দ নয়, সুমিত্রাও বিস্মিত।

    পরদিন। প্রেমানন্দ শুয়ে, তার সামনে বসে বেদানা ছাড়াচ্ছেন সুমিত্রা। বুড়ো চাকর এসে খবর দিল, সাহেবপানা একটি ছেলে কর্তাবাবুর সঙ্গে দেখা করতে চান, বললেন, আসাম থেকে আসছেন–অসুখের জন্যেই দেখা করা বিশেষ দরকার।

    প্রেমানন্দ ঘোষ ভেবে পাচ্ছেন না কে হতে পারে? অসুখের খবর রণদার কাছে জেনে থাকবে। বললেন, নিয়ে এসো

    সুমিত্রা চলে গেলেন না অথবা যেতে পারলেন না। তাছাড়া বাড়ির কর্তার ঘরে একলা থাকা নিষেধ, আর বাইরের কেউ এলে বেশি কথা বলাও নিষেধ। চাকরের কথায় মনে হয়েছে- অল্পবয়সীই কেউ হবে।

    যিনি এলেন তাকে দেখে ঘরের দুজনেই একটু বিশেষ দৃষ্টিতে লক্ষ্য করলেন। হাজারের মধ্যে এরকম, চেহারা বড় দেখা যায় না। আর সাহেবপানাই বটে। তাকে দেখামাত্র প্রেমানন্দ ঘোষ কেমন বিমূঢ় যেন।

    আগন্তুকের হাতে বড় চামড়ার ব্যাগ একটা। পরনে ট্রাউজার আর চকচকে হাফ শার্ট। তাতেই রূপ ঠিকরে পড়ছে। ব্যাগসুষ্ঠু হাত তুলে ঘরের দুজনের উদ্দেশেই নমস্কার জানালেন।

    প্রেমানন্দ ঘোষ ইঙ্গিতে সামনের খালি চেয়ারটা দেখালেন।

    চেয়ারে বসে হাতের মোটা ব্যাগের খুপরি থেকে ছোট্ট একটা মোড়ক বার করে আগন্তুক বললে, এতে একটা কবচ আছে, আপনার অসুখ জেনে আমার মা আপনাকে পরার জন্য বিশেষ করে অনুরোধ করেছেন।

    প্রেমানন্দ এবং সুমিত্রা দুজনেই হতভম্ব। ফ্যালফ্যাল করে খানিক চেয়ে থেকে প্রেমানন্দ জিজ্ঞাসা করলেন, আপনার…মানে তোমার মা আমার অসুখ জানলেন কি করে?

    –মাস দুই আগে রণদা কাকার সঙ্গে দেখা করতে এসে আমিই শুনে গিয়ে। বলেছিলাম। মায়ের বিশ্বাস, এটা পরলে আপনার উপকার হবে।

    -তা তোমার নাম কি বাবা?

    –আমার নাম মহানন্দ ঘোষ।

    কোন দুর্বোধ্য কারণে প্রেমানন্দ আর সুমিত্রা দুজনেই কি চমকে উঠলেন একটু?

    সুমিত্রা চেয়েই আছেন ছেলেটির দিকে। তার কাছে ছেলের বয়সীই, বছর পঁচিশ ছাব্বিশ হবে বয়েস।

    আত্মস্থ হয়ে প্রেমানন্দ জিজ্ঞাসা করলেন, রণদার সঙ্গে তোমাদের কতদিনের পরিচয়?

    আমি গেলবারেই প্রথম দেখলাম।..বিলেতে গিয়ে ব্যারিস্টারি পড়ার ব্যাপারে তার তদবির-তদারকে কোনরকম সুবিধে হয় কিনা, আলাপ করতে এসেছিলাম। আমার বাবার বিশেষ বন্ধু তিনি।

    –তোমার বাবার নাম কি?

    খুব ধীর স্পষ্ট জবাব এলো, আমার বাবার নাম প্রেমানন্দ ঘোষ।

    আকাশ থেকে বাজ পড়ল একটা? নাকি সুমিত্রা আর প্রেমানন্দ দুজনেই স্বপ্ন দেখছেন? নিঃশ্বাস বন্ধ হবার উপক্রম প্রেমানন্দর। এত উত্তেজনা ভাল নয়। কিন্তু দুজনের কারোই তা খেয়াল থাকল না, খেয়াল শুধু মহানন্দ করলেন। বললেন, আপনি উত্তেজিত হতে পারেন ভেবে মা আমাকে আসতে দেবেন কিনা ভাবছিলেন।

    প্রেমানন্দর গলা দিয়ে স্বর বেরোয় না প্রায়। বিমূঢ় মুখে বললেন, কিন্তু তিনি তো পঁচিশ বছর আগে মারা গেছেন!

    মারা যাননি। আপনি যা চেয়েছিলেন টেলিগ্রামে তাই শুধু জানিয়েছেন।

    স্তব্ধ মুহূর্ত অনেকগুলো। প্রেমানন্দ ঘোষের নিষ্ক্রিয় মস্তিষ্ক সক্রিয় হতে লাগল খুব আস্তে আস্তে। দু চোখের সমস্ত দৃষ্টি ঢেলে লক্ষ্য করছেন। …ভাওতা নয়, হতে পারে। চেহারাই বলছে, হতে পারে। মায়ের মুখের আদল কি নিজের মুখের, জানেন না–কিছু একটা বড় বেশি স্পষ্ট। কিন্তু পঁচিশ বছর বাদে আজ হঠাৎ এই কবচ পাঠানো কেন? অসুখ বলে?…নাকি রণদার কাছে সঙ্কটের সময় উপস্থিত শুনে ছেলের জন্য কোনো সংগতির ব্যবস্থা চায়? ছেলেকে বিলেত পাঠিয়ে ব্যারিস্টার করে আনার উদ্দেশ্যও হতে পারে। অনেককাল ধরে আইন আর কোর্ট করে মানবচরিত্রের দুর্বলতা কিছু বেশিই জেনেছেন তিনি।

    অপেক্ষা করছেন। চেয়ে আছেন।

    মহানন্দ ঘোষ বললেন, বেশি বিরক্ত করব না, আর একটু কাজ সেরেই আমি যাব

    বড় চামড়ার ব্যাগ খুলে মস্ত একটা প্যাকেট বার করে তার সামনে রাখলেন। –এতে আপনার সব গয়না আছে, মা স্কুলে মাস্টারি করে আমাকে মানুষ করেছেন, এর একটাও খরচ হয়নি। দিয়ে গেলাম—

    বুকের ঠিক মধ্যিখানে প্রচণ্ড একটা আঘাত এসে লাগল যেন। সুমিত্রা মূর্তির মত বসে। প্রেমানন্দ ঘোষ ঘামছেন। পরক্ষণে উঠে বসতে চেষ্টা করে আর্তনাদ করে উঠলেন তিনি।

    –এগুলো তোমার মা তোমাকে দিয়ে পাঠিয়ে দিয়েছেন?

    -হ্যাঁ, এগুলোর জন্যে আপনি চিঠি লিখেছিলেন। মা তখন রাগ করেই দেননি। বোধ হয়।

    -তা বলে আজ–আজ এই প্রতিশোধ নিল! প্রতিশোধ নেবার জন্য তোমাকে দিয়ে এগুলো পাঠাতে পারল!

    সুমিত্রা তাড়াতাড়ি ধরে শুইয়ে দিলেন তাকে। প্রেমানন্দ ঘোষ কাঁপছেন থরথর।

    একটু চুপ করে থেকে মহানন্দ বললেন, তিনি ঠিক পাঠাননি, তার ইচ্ছে বুঝে আমিই নিয়ে এসেছি। মায়ের কাছে এত গয়না দেখে আমি ভেবেছিলাম আমার জন্যেই রেখেছেন। বিলেত যাবার জন্য এগুলো চেয়েছিলাম। মা তখন বলেছেন ওগুলো। আপনার, আপনাকে ফেরৎ দেবেন বলে রেখেছেন। সব শোনার পরেও পাছে আবার আমার লোভ হয়, তাই এবারে আসার সময় নিয়ে এলাম।

    আর কিছু বলার বা শোনার জন্য অপেক্ষা না করে উঠে দাঁড়ালেন মহানন্দ ঘোষ।এরপর আপনার আরো ক্ষতি হতে পারে, আচ্ছা চলি—

    লম্বা লম্বা পা ফেলে ঘরের বাইরে চলে এলেন তিনি। কিন্তু বাইরে এসেও প্রেমানন্দর আর্তস্বর শুনলেন। স্ত্রীকে বলছেন! দেখলে ব? শুনলে সব? এসব গয়না এখন তুমি নাও, তুমি দেখো, ছেলেদের দেখাও–খুব খুশী হবে, আমার শুধু এই কবচ থাক–বুঝলে? বুঝলে?

    .

    এই পর্যন্তই চিত্র।

    আমি মায়ের দিকে তাকালাম। নিস্পন্দের মত বসে আছেন তিনি, কিন্তু পরক্ষণেই হতভম্ব আমি। হঠাৎ সরোষে মা বলে উঠলেন ওই সুমিত্রার ওপরে তুমি পক্ষপাতিত্ব করেছ–তার ভিতরে অনেক বিষ ছিল–স্বামীর স্ট্রোক হবার পরে ছেলেদের ওপর বিশ্বাস হারিয়ে সেও মনে মনে চাইছিল স্বামী উইল করে দিয়ে যাক–জানো?

    তীক্ষ্ণ শোনালো কণ্ঠস্বর। এমন মহীয়সী যিনি, এত তেজ আর এত ক্ষমা যাঁর মধ্যে, তাঁর এই রূঢ়তা আমি আশা করিনি। আঘাতই পেলাম যেন। বললাম, আপনি নিশ্চয়ই রণদাবাবুর মুখে শুনেছেন এ-কথা, কিন্তু পুরোপুরি সত্যি তো না-ও হতে পারে…।

    মা নীরব একটু। নিজেকে সংযত করলেন। শান্ত কমনীয় আবার। একটু থেমে নিয়ে বললেন, গল্প মোটামুটি ঠিকই হয়েছে। কেবল তোমার ভাবনায় সামান্য একটু ভুল থেকে গেছে।

    আমি জিজ্ঞাসু নেত্রে চেয়ে আছি।

    তেমনি সহজ সুরেই তিনি আবার বললেন, আমি মনোরমা নই। সে ভাগ্যবতী সিথির সিঁদুর নিয়েই চোখ বুজেছে। আমি সুমিত্রা।

    আমি নির্বাক বিমূঢ় নিস্পন্দ কাঠ।

    ⤷
    1 2 3 4 5 6 7 8 9
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleফেরারী অতীত – আশুতোষ মুখোপাধ্যায়
    Next Article ত্রিবর্ণা – আশুতোষ মুখোপাধ্যায়

    Related Articles

    হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    ভয় সমগ্র – হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    December 9, 2025
    হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    কিশোর অ্যাডভেঞ্চার সমগ্র – হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    December 9, 2025
    সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    প্রকাশ্য দিবালোকে – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    November 18, 2025
    সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    তারপর কী হল – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    November 17, 2025
    মাইকেল মধুসূদন দত্ত

    শর্ম্মিষ্ঠা নাটক – মাইকেল মধুসূদন দত্ত

    November 11, 2025
    সত্যজিৎ রায়

    মানপত্র সত্যজিৎ রায় | Maanpotro Satyajit Ray

    October 12, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Generic selectors
    Exact matches only
    Search in title
    Search in content
    Post Type Selectors
    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Our Picks

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }