Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    আসমানীরা তিন বোন – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025

    ইস্টিশন – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025

    উড়ালপঙ্খী – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • English Books
      • Jules Verne
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    দেখা না-দেখা – হুমায়ূন আহমেদ

    হুমায়ূন আহমেদ এক পাতা গল্প102 Mins Read0
    ⤶ ⤷

    স্বর্গ, না অন্যকিছু?

    স্বর্গ, না অন্যকিছু?

    কোথায় যাচ্ছি?

    সুইজারল্যান্ড।

    কেন যাচ্ছ?

    খেলতে।

    কী খেলা?

    নাটক নাটক খেলা।

    পাঠকরা নিশ্চয়ই ধাঁধায় পড়ে গেছেন। ধাঁধা ভেঙে দিচ্ছি। আমি নাটকের এক দল নিয়ে যাচ্ছি সুইজারল্যান্ড। এই উর্বর বুদ্ধি আমার মাথা থেকে আসে নি। এতে বুদ্ধি আমার নেই।

    আমি (স্বল্পবুদ্ধির কারণেই হয়তো মনে করি না টিভি নাটক করার জন্যে দেশের বাইরে যেতে হবে। বাংলাদেশে সুন্দর জায়গার অভাব পড়েনি। পাহাড় আছে, সমুদ্র আছে, হাওর আছে, বন-জঙ্গল আছে, চা-বাগান আছে, রাবার বাগান আছে। মরুভূমি অবশ্যি নেই। ক্যামেরার সামান্য কারসাজিতে পদ্মার ধু-ধু বালির চরকে মরুভূমি দেখানো জটিল কিছু না, কয়েকটা উট ছেড়ে দিতে হবে। বাংলাদেশে এখন উটও পাওয়া যায়।

    তাছাড়া টিভি নাটকে প্রকৃতি দেখানোর তেমন সুযোগ কোথায়? টিভি নাটকে মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক দেখানো হয়। প্রকৃতি সেখানে গৌণ। টিভি পর্দায় Depth of field আসে না বলে প্রকৃতির অতি মনোরম দৃশ্যও মনে হয় two dimensional. সাদা কথায় ফ্ল্যাট।

    তাহলে আমি সুইজারল্যান্ড কেন যাচ্ছি? আমার এক প্রাক্তন ছাত্রের কথার জাদুতে বিভ্রান্ত হয়ে। ছাত্রের নাম হাসান। সে চ্যানেল আই-এর কর্তাব্যক্তিদের একজন। এইচআরভি নামক দামি এক জিপে করে গম্ভীর ভঙ্গিতে ঘুরে বেড়ায়।

    আমি যখন শহীদুল্লাহ হলের হাউস টিউটর সে ঐ হলের ছাত্র। হৃদয়ঘটিত কোনো এক সমস্যায় জর্জরিত। অর্থনৈতিকভাবেও পর্যদস্ত। এমন সময়ে সে আসে আমার সঙ্গে দেখা করতে। তার আবদার-এমন কিছু যেন বলি যাতে তার মন শান্ত হয়। আমি তাকে কী বলেছিলাম তা এখন আর তার মনে নেই। তবে হাসানের মন শান্ত হয়েছিল-এই খবর সে আমাকে দিয়েছে।

    সেই হাসান সুইজারল্যান্ডের কথা বলে আমাকে প্রায় কাবু করে ফেলল।

    স্যার, ভূস্বর্গ! আপনি ভূস্বর্গ দেখবেন না? রথ দেখবেন এবং কলা বেচবেন। নাটক ও হলো, ভূস্বর্গও দেখা হলো।

    বিদেশে নাটক করার নতুন হুজুগ ইদানীং শুরু হয়েছে। একজন নায়ক এবং একজন নায়িকা যান। তারা সুন্দর সুন্দর জায়গায় যান। প্রেম করেন। গান করেন। স্থানীয় কিছু ছেলেমেয়ে আনা হয়। তারা যেহেতু কখনো ক্যামেরার সামনে আসে নি তারা রোবটের মতো আসে। চোখ-কান বন্ধ করে দু’একটা সংলাপ কোনোমতে বলে।

    এ ধরনের নাটক করা তো আমার পক্ষে সম্ভব না। নায়ক-নায়িকা নির্ভর নাটক আমি লিখতেও পারি না। হাসানকে এই কথা বলতেই সে বলল, আপনার যে ক’জনকে নিতে হয় নেবেন। কোনো সমস্যা নেই। দশজন নিলে দশজন। পনেরোজন নিলে পনেরোজিন।

    আমি আশ্চর্যই হলাম। হাসান বলল, বিশাল দুটা বাড়ি আমি আপনাদের জন্যে এক মাসের জন্যে ভাড়া করেছি। বাড়িতে থাকবেন। নিজের মতো রান্না করে খাবেন। একজন বাবুর্চিকেও অ্যাপয়েন্টমেন্ট দেয়া হয়েছে।

    হাসানের কর্মকাণ্ডে আমি মুগ্ধ। তারপরেও মন টানছে না। কেন জানি বাইরে যেতে ইচ্ছে করে না। নিজের দেশের ঘরের এক কোণে সারাদিন বসে থাকতে ভালো লাগে। হাসানকে না করে দিলাম। ইতিমধ্যে সুইজারল্যান্ডে নাটক বানানোর প্রস্তাব প্রকাশ হয়ে গেছে। আমার সঙ্গে যারা কাজ করে তাদের খুব আগ্রহ যেন আমি রাজি হই।

    রাজি হলাম। হাসানের হাতে শিল্পীদের একটা তালিকা ধরিয়ে দিয়ে বললাম, এদের সবাইকে যদি নিয়ে যেতে পারি তাহলে OK.

    হাসান বলল, আরো আরো নিতে পারেন। আমি তো বলেছি কতজনকে নেবেন আপনার ব্যাপার।

    আমি আবারো চমৎকৃত হলাম। তালিকাটা যথেষ্টই বড়।

    রিয়াজ, শাওন, চ্যালেঞ্জার, স্বাধীন খসরু, ডাক্তার এজাজ, ফারুক আহমেদ, টুটুল, তানিয়া।

    আমাকে নিয়ে নয়জন। হাসান নিমিষের মধ্যে ভিসা করিয়ে ফেলল। যথাসময়ে বিমানে উঠলাম। ডাক্তার এজাজ এবং ফারুক আহমেদের এই প্রথম দেশের বাইরে যাত্রী। তাদের আনন্দ এবং উত্তেজনা দেখে ভালো লাগল। রিয়াজ অবশ্যি যেতে পারল না। শেষমুহর্তে তার জরুরি কাজ পড়ে গেল। ব্যস্ত নায়করা শেষমুহূর্তে জরুরি কাজ বের করে মূল পরিকল্পনা বানচাল করে ফেলেন। আমি এই ‘শেষমুহূর্ত’ নিয়ে প্রস্তুত ছিলাম বলে তেমন সমস্যা হলো না।

    আমি লক্ষ করেছি, ঢাকা শহরে খুব দামি গাড়ি চড়ে যারা ঘোরে তারা খোলামেলা কথা বলতে পারে না। দরজা-জানালা বন্ধ এসি গাড়িতে থাকার কারণেই মনে হয় এটা হয়।

    হাসানের কাছে শুনেছিলাম একটা বিশাল বাড়ি ভাড়া করা হয়েছে, বাস্তবে দেখা গেল শাহীন নামে সুইজারল্যান্ড প্রবাসী এক ছেলে তার ফ্ল্যাটের দু’টা কামরা ছেড়ে দিয়েছে। একজন বাবুর্চি অ্যাপয়েন্টমেন্ট দেয়া হয়েছিল বলে শুনেছিলাম, দেখা গেল বাবুর্চি আমাদের হাসান। সে উৎসাহের সঙ্গে জানালো যে, ডাল রান্নায় তার নৈপুণ্য অসাধারণ। তিনদিনের ভাল বেঁধে সে না–কি ডিপ ফ্রিজে রেখেও দিয়েছে।

    ব্যবস্থা দেখে আমার প্রায় স্ট্রোক হবার জোগাড় হলো। আমি খুবই গরিবের ছেলে। গরিবের ছেলের হাতে যদি দুটা পয়সা হয়, তখন তার মধ্যে নানা বিলাসিতা ঢুকে পড়ে। আমার মধ্যেও ঢুকেছে। শীতের দিনেও আমি এসি ছেড়ে ভাবল লেপ গায়ে দেই।

    সুইজারল্যান্ডে যথেষ্ট গরম। ঘরে এসি নেই। সিলিং পাখাও নেই। কয়েকটা ফ্লোর ফ্যান আছে, যার পাখা অতি দুর্বলভাবে ঘুরছে। আমার চিমশা মুখ দেখে হাসান আমাকে একটু দূরে নিয়ে গলা নামিয়ে বলল, আপনার এবং শাওন ভাবির জন্যে ভালো হোটেলের ব্যবস্থা আছে। অভিনেত্রী মৌসুমী এবং নায়ক মাহফুজ এই হোটেলেই ছিলেন। তারা হোটেল খুব পছন্দ করেছেন।

    আমি বললাম, হাসান, আমি এতগুলি মানুষ নিয়ে এসেছি। এরা সবাই আমার অতি আপন। এদেরকে ফেলে হোটেলে যাবার প্রশ্নই আসে না। যে ব্যবস্থা করা হয়েছে আমি তার মধ্যেই থাকব। কোনো সমস্যা নেই।

    হাসান বলল, আপনারা দুজন তাহলে শাহীনের শোবার ঘরে থাকুন। ঐ ঘরে এসি আছে।

    আমি বললাম, আমি আমার নিজের শোবার ঘরে কাউকে থাকতে দেই না। কাজেই অন্যের শোবার ঘরে আমাদের ঢোকার প্রশ্নই উঠে না। ঢালাও বিছানার ব্যবস্থা করো। সবাই একসঙ্গে থাকব। মজা হবে।

    আসন্ন মজার কথা ভেবে আমি উল্লসিত-এরকম ভঙ্গি করলেও মনে মনে চিন্তিত বোধ করলাম শাওনকে নিয়ে। ঘুমুবার জায়গা নিয়ে তার শুচিবায়ুর মতো আছে। সে আমার চেয়েও বিলাসী। তাকে দোষও দিতে পারছি না। সে অতি বড়লোকের মেয়ে।

    আল্লাহপাকের অসীম রহমত, সে সমস্যাটা বুঝল। এমন এক ভাব করল যেন সবাই মিলে মেঝেতে গড়াগড়ি করার সুযোগ পেয়ে তার জীবন ধন্য। অভিনয় খুব ভালো হলো না। সে হতাশী লুকাতে পারল না।

    রাতে ডিনার খেলাম হাসানের বিশেষ নৈপুণ্যে রাঁধা ডাল দিয়ে। ফার্মের মুরগি ছিল। ফার্মের মুরগি আমি খাই না। ঘন কৃষ্ণবর্ণের একটা বস্তুও ছিল। প্রশ্ন করে জানা গেল এটা সবজি। রান্নার গুণে কালো হয়ে গেছে।

    ডাক্তার এবং ফারুক সবজি খেয়ে বলল, অসাধারণ। সুইজারল্যান্ডে পৌঁছার পর থেকে তারা যা দেখছে বলছে অসাধারণ। খাবার টেবিলে কাঁচামরিচ দেখে বলল, অসাধারণ। সুইজারল্যান্ডেও কাঁচামরিচ আছে, আশ্চর্য! কাঁচামরিচে কামড় দিয়ে দেখে মিষ্টি। তখনো বলল, অসাধারণ। ঝাল নেই কাঁচামরিচ খেয়েছি। মিষ্টি কাঁচামরিচ এই প্রথম খাচ্ছি। মুহূর্তের মধ্যে এই দুজন টেবিলের সব কাঁচামরিচ শেষ করে ফেলল।

    রাতে আমার এবং শাওনের থাকার ব্যবস্থা হলো জেলখানার সেলের চেয়েও ছোট একটা ঘরে। বিছানায় দু’জনের শোবার প্রশ্ন উঠে না। আমি মেঝেতে চাদর পেতে ঘুমুতে গেলাম। ফ্যানের সমস্যা আছে। ফ্যানটা জীবন্ত প্রাণীর মতো আচরণ শুরু করল। ঘুরতে ঘুরতে সে থেমে যায়। কাশির মতো শব্দ করে। আবার ঘুরে আবার থামে। পুরোপুরি এক স্বাধীন সত্তা।

    টুটুল-তানিয়া দম্পত্তিকে একটা রুম দেয়া হয়েছে। সাইজে আমাদেরটার চেয়ে ছোট। তার উপর নেই ফ্যান।

    বাকি সবার গণবিছানা। সেই ঘরে ও ফ্যান নেই। সবাই গরমে অতিষ্ঠ। বাড়ির মালিক আমাদের জানালেন, সুইজারল্যান্ড অতি ঠাণ্ডার দেশ বলে ফ্যানের প্রচলন নেই। এসির তো প্রশ্নই উঠে না। সামারের এক দুই মাস গরম পড়ে। এই গরম সবাই Enjoy করে। গরমটাই তাদের কাছে মজা লাগে। আমাদের কারোই মজা লাগল না। শুধু ডাক্তার এজাজ এবং ফারুক বলল, অতি আরামদায়ক আবহাওয়া।

    ঘুমুতে যাবার আগে আগে আমি আমার দলের সবাইকে ডেকে একটা গোপন মিটিং করলাম। আমি বললাম, বুঝতে পারছি এখানে থাকা-খাওয়ার ব্যাপারটা কারো পছন্দ হচ্ছে না। আমাদের বাস্তবতা মানতে হবে। একটা টিভি চ্যানেল এতগুলো মানুষকে এত দূরের দেশে নিয়ে এসেছে। ইউরোপে হোটেল ভাড়া আকাশছোঁয়া। তাদের পক্ষে কোনো রকমেই সম্ভব না সবাইকে হোটেলে রাখা। তোমরা দয়া করে নায়ক-নায়িকাদের মতো নখরা করবে না। তোমরা চরিত্র অভিনেতা। চরিত্র অভিনেতারা অভিনয় করে, নখরা করে না।

    তারচেয়ে বড় কথা হাসান আমার ছাত্র তাকে আমি পছন্দ করি। সে যেন তোমাদের কোনো কথায় বা আচরণে কষ্ট না পায়। তার আগ্রহের কারণেই তোমরা ভূস্বর্গ হিসেবে পরিচিত একটা দেশ দেখবে। এর মূল্যও কম না। সারাদিন আমরা কাজ করব। রাতে ক্লান্ত হয়ে শুয়ে পড়ব। এক ঘুমে রাত কাবার। সামান্য কয়েক ঘণ্টার জন্যে কি ফাইভ স্টার হোটেল লাগবে?

    কথা দিয়ে মানুষকে ভোলানোর ক্ষমতা আমার আছে! (কথাশিল্পী না?) সবাই বুঝল। ফারুক অতি আগ্রহের সঙ্গে বলল, প্রয়োজনে মেঝেতে শুয়ে থাকব। আমি বললাম, মেঝেতেই তো শুয়ে আছ। সে চুপ করে গেল।

    ভোরবেলা দলবল নিয়ে শুটিং করতে বেরুবার সময় সবচে বড় দুঃসংবাদটা শুনলাম। আমাদের শুটিং করতে হবে চুরি করে। পুলিশ দেখতে পেলেই ধরে নিয়ে যাবে। কারণ শুটিং-এর অনুমতি নিতে বিপুল অংকের অর্থ লাগে। ইনস্যুরেন্স করতে হয়।

    হাসান সহজ ভঙ্গিতে বলল, পুলিশ আছে কি নেই এটা দেখে শুটিং করতে হবে। পুলিশ যদি ধরে ফেলে তাহলে বলতে হবে আমরা বেড়াতে এসেছি। হোম ভিডিও করছি। দেশে বন্ধুবান্ধবকে দেখাব।

    আমার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল। শুটিংটা হবে কীভাবে?

    হাসান বলল, নিশ্চিন্ত থাকেন। ফাঁক ফোকর দিয়ে বের করে নিয়ে আসব। শুধু শুটিং চলাকালীন সময় আপনি ধারে কাছেও থাকবেন না। এটা সাগর ভাইয়ের অর্ডার।

    আমি বিস্মিত হয়ে বললাম, আমি ধারে কাছে থাকব না কেন?

    হাসান বলল, পুলিশ যদি আপনাকে ধরে নিয়ে যায় তাহলে বিরাট কেলেঙ্কারি হবে। বাংলাদেশ এম্বেসি ধরে টান পড়বে।

    আমার কলিজা গেল শুকিয়ে।

    প্রথম দৃশ্য শুরু হলো। বাংলাদেশের এক ছেলে অন্ধ সেজে গিটার বাজিয়ে ভিক্ষা করে। তার স্ত্রী এসে (শাওন) তাকে এখান থেকে বকাঝকা করতে করতে নিয়ে যায়। অন্ধ ছেলের ভূমিকায় অভিনয় করছে টুটুল। তাকে ফোয়ারার পাশে দাঁড় করিয়ে দেয়া হলো। সামনে হাতে লেখা সাইনবোর্ড–Help a blind.

    টুটুলের গলা চমৎকার। গিটারের হাত চমৎকার। সে মুহূর্তের মধ্যেই জমিয়ে ফেলল। ক্যামেরা অনেক দূরে। কেউ বুঝতেই পারছে না ক্যামেরা চলছে। এক থুরথুরি বুড়ি চোখ বড় বড় করে কিছুক্ষণ গিটার শুনে দশ ইউরো একটা নোট টুটুলের হাতে গুঁজে দিল। টুটুল বিস্মিত।

    এখন শাওন যাবে, টুটুলকে বকাঝকা করতে করতে নিয়ে আসবে-ঠিক তখন স্বাধীন হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, হুমায়ূন ভাই, পুলিশ আসছে।

    আমি কাউকেই চিনি না এমন ভঙ্গিতে লম্বা লম্বা পা ফেলে হাঁটা দিলাম। শাওন বলল, তুমি আমাকে ফেলে চলে যাচ্ছ কেন?

    কিছুক্ষণের মধ্যেই চুরি করে নাটক বানানোর মজা পেয়ে গেলাম। নিষিদ্ধ কিছু করছি, এই আনন্দ প্রধান হয়ে গেল। ফ্রেম কী হচ্ছে জানি না। মনিটর নেই। অ্যাসিসটেন্ট ডিরেক্টর নেই। লেফট ইন রাইট আউট নামক জটিল বিষয় আমার মোটা মাথায় কখনো ঢোকে না। আমার সাহায্যে শাওন এগিয়ে এল। সে আবার আগমন নির্গমন এবং ‘লুক’ খুব ভালো বোঝে। ‘লুক’ বিষয়টা কী পাঠকদের বুঝিয়ে দেই। ‘লুক’ হলো পাত্রপাত্রী কোন দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে কথা বলছে। ভিডিওতে এই বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। লুক ঠিক না হলে দেখা যাবে নায়ক তার বান্ধবীর দিকে না তাকিয়ে সম্পূর্ণ উল্টো দিকে তাকিয়ে হাসি মুখে মাথা নাড়ছে এবং কথা বলছে।

    ভিডিওর কাজে আমাকে পুরোপুরি নির্ভর করতে হলো ক্যামেরাম্যান এবং শাওনের উপর।

    ক্যামেরাম্যানের নাম তুফান। ঝকঝকে চোখের লম্বা পোশাকে ফিটফাট যুবা পুরুষ। মাথাভর্তি টাক না থাকলে তাকে নায়কের চরিত্র দেয়া যেত। তুফান ভারী ক্যামেরা কাঁধে নিয়ে তুফানের মতোই ছোটাছুটি করে। ক্যামেরা কাঁধেই রাখতে হবে, ষ্ট্যান্ডে বসানোর উপায় নেই। পুলিশ চলে আসতে পারে। হোম ভিডিও যারা করে তারা ক্যামেরার জন্যে ষ্ট্যান্ড নিয়ে আসে না।

    আমি চিন্তিত, ক্যামেরায় কী ছবি আসছে কে জানে! আমাদের সঙ্গে না আছে লাইট, না আছে লাইট কাটার, না আছে শব্দ ধারণের ধুম। শব্দের সমস্যার সমাধান আছে, পরে ডাব করা যাবে। ছবি নষ্ট হলে কী করব! কাঁধের ক্যামেরা যদি কাঁপে ছবিও কাপবে। এত দূর দেশে এসে যদি এমন ছবি নিয়ে যাই যা দেশে মনে হবে পাত্র-পাত্রী সবাই ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত, সবার মধ্যেই কাঁপুনি, তাহলে হবে কী?

    তুফান আমাকে আশ্বস্ত করল। সে বলল, স্যার সব ঠিক আছে, আপনি মোটেও চিন্তা করবেন না। উপরে আল্লাহ আছেন।

    উপরে নিচে সবদিকেই আল্লাহ আছেন, তবে তিনি চুরি করে ভিডিও গ্রহণের ব্যাপারটার কি ভালোমতো নেবেন?

    এদিকে প্রথম দিনেই দু’টি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটল। স্বাধীন এক অতি রূপবতীর (হুমায়ূন আহমেদের নায়িকাদের চেয়েও রূপবতী) প্রেমে পড়ে গেল। মেয়ে সুইস, জার্মান ছাড়া অন্য ভাষা জানে না। স্বাধীন ও ইংরেজি এবং সিলেটি ভাষা ছাড়া কিছু জানে না। প্রেম একপক্ষীয় না, দুপক্ষীয় আমি কিছুতেই বুঝতে পারলাম না, ইশারার ইঙ্গিতে কী করে এত অল্প সময়ে এমন গভীর প্রেম হয়!

    সন্ধ্যাবেলায় দেখি স্বাধীন উসখুস করছে। জানা গেল মেয়ে তাকে ডিনারের নিমন্ত্রণ করেছে। রাতে যদি কাজ না করি তাহলে সে ডিনারে যাবে। আমি ডিনারে যাবার অনুমতি দিলাম।

    স্বাধীন আবেগমথিত গলায় বলল, আমাদের জন্যে একটু দোয়া করবেন হুমায়ূন ভাই।

    আমি বললাম, দোয়া লাগবে কেন?

    সে বলল, আমরা বিয়ের কথা চিন্তা করছি। সে শুধু একটা শর্ত দিয়েছে।

    কী শর্ত?

    পরে আপনাকে বলব।

    স্বাধীন ডেটিং-এ চলে গেল তার চেহারা চোখ-মুখ উদভ্রান্ত।

    দ্বিতীয় সমস্যা এজাজ এবং ফারুককে নিয়ে। তারা ডলার যা এনেছে প্রথম দিনেই সব শেষ। দু’জন এখন কপর্দকশূন্য। দুজনই মুখ শুকনা করে বসে আছে।

    আমি বললাম, কেনাকাটা কী করেছ যে প্রথম দিনেই সব শেষ?

    সাবান কিনেছি।

    সাবান কিনেছ মানে কী?

    দু’জনই স্যুটকেস বের করল। সুটকেস ভর্তি শুধু সাবান। নানান রঙের, নানান ঢং-এর।

    এত সাবান কেন কিনেছ?

    ফারুক বলল, দেখে এত সুন্দর লাগল। তাছাড়া দেশে এই জিনিস পাওয়া যায় না।

    হাসান দুজনকেই তিনশ’ ডলার করে দিল। এরা পরের দিন সেই ডলার দিয়েও সাবান কিনে ফেলল।

    ডাক্তার এজাজ সাবানের বস্তা নিয়ে দেশে ফিরতে পারে নি। এয়ার লাইন তার সাবানভর্তি দু’টা স্যুটকেসেই হারিয়ে ফেলে। ফারুক সাবান নিয়ে দেশে ফিরতে পেরেছে। শুনেছি এইসব সাবানের একটাও সে নিজে ব্যবহার করে নি, কাউকে ব্যবহার করতেও দেয়নি। সবই সাজিয়ে রাখা। তার জীবনের বর্তমান স্বপ্ন আবার বিদেশে গিয়ে সাবান কিনে নিয়ে আসা।

    শুটিং পুরোদমে চলছে। সুইজারল্যান্ডের সুন্দর সুন্দর জায়গা ব্যবহার করা হচ্ছে। রাইন নদী, রাইনস ফল, নেপোলিয়ানের বাড়ি-কিছুই বাদ যাচ্ছে না।

    খুব উৎসাহ নিয়ে রাইন নদী দেখে ধাক্কার মতো খেলাম। আমরা পদ্মা মেঘনার দেশের মানুষ, আমাদেরকে কি বড় সাইজের খাল দিয়ে ভুলানো যায়? তার সবই ঝকঝকে। মনে হয় পুরো সুইজারল্যান্ডকে ধুয়ে মুছে পরিষ্কার করে রাখা হয় শুধুমাত্র ছবি ভোলার জন্যে। গাছের প্রতিটি পাতা সবুজ। একটা শুকনা পাতা বা মরা ডাল নেই। গাছের নিচেও শুকনা পাতা পড়ে থাকা দরকার। সেইসব কোথায় গেল? পাতা কুড়ানির দল তো চোখে পড়ল না।

    নাটকে পিকনিকের একটি দৃশ্য আছে। বেশ বড় দৃশ্য। এই দৃশ্যে পুরো একটা গান আছে। নাটকীয় অনেক ব্যাপার-স্যাপার আছে। পিকনিকের দৃশ্য করার জন্যে রাইন নদীর পাশে ছোট্ট পার্কের মতো একটা জায়গী শাহীন এবং হাসান খুঁজে বের করল।

    ছবির দেশে সবকিছুই ছবির মতো। পার্কটাও সে-রকম। নাগরিক সুযোগ সুবিধা আছে অর্থাৎ বাথরুম আছে। বারবিকিউয়ের ব্যবস্থা আছে। একপাশেই আপেলের বাগান। গাছভর্তি আপেল। অন্যপাশে নাসপাতি বাগান। ফল ভারে প্রতিটি বৃক্ষ নত। আমরা মহানন্দে বারবিকিউয়ের ব্যবস্থায় লেগে গেলাম। মেয়েরা মনের আনন্দে ছুটাছুটি করতে লাগল। তাদের মুগ্ধ করল রাইন নদীতে সাতার কাটতে ব্যস্ত একদল রাজহাঁস। সাইজে দেশী রাজহাঁসের প্রায় দ্বিগুণ! গলা অনেক লম্বা। শুনেছি এরা প্রকৃতিতে ভয়ঙ্কর। মেজাজ খারাপ হলে এরা বিকট শব্দ করে ছুটে এসে কামড়ে দেয়।

    মেয়েরা রাজহাঁসের পোষ মানিয়ে ফেলল। তারা হাতে পাউরুটি ধরে এগিয়ে দিচ্ছে। রাজহাঁসের দল কাড়াকাড়ি করে খাচ্ছে। মেয়েদের জঙ্গি রাজহাঁসদের দলকে পোষ মানানোর ক্ষমতায় অবাক হলাম না। যারা পুরুষদের পোষ মানায়, তারা সবাইকে পোষ মানাতে সক্ষম।

    আমাদের আনন্দ-উল্লাসে হঠাৎ বাধা পড়ল। দুই সুইস জিপ গাড়িতে করে উপস্থিত। শাহীনের সঙ্গে তাদের নিম্নলিখিত কথাবার্তা হলো। আমরা তার এক বর্ণও বুঝলাম না। সব কথাই হলো জার্মান ভাষায়। এখানে বাঙ্গানুবাদটা দিচ্ছি।

    সুইস: তোমরা কী করছ জানতে পারি?

    শাহীন : পিকনিক করছি। ফ্যামিলি হলি ডে।

    সুইস : তোমরা কি জানো যে, এটা একটা পাবলিক প্রপার্টি? আপেল এবং নাসপাতি বাগান আমার।

    শাহীন; আমরা তো আপেল এবং নাসপাতি বাগানে যাচ্ছি না। আমরা নদীর ধারে পিকনিক করছি।

    সুইস : এই জায়গাও আমার। [কুৎসিত গালি। গালির অর্থ কী শাহীন বলল না। এতে মনে হচ্ছে ভয়ঙ্কর কিছু হবে।]

    শাহীন : [গালি, সে জার্মান গালির সঙ্গে বাঙলা গালি মিশিয়ে দিল। বাংলা ভাষায় সবচে’ ভদ্র গালিটা ছিল-খা–কির পুলা অফ যা।]

    সুইস : আমি তোমাদের পুলিশে ধরিয়ে দেব।

    শাহীন : যা তোর বাপদের খবর দিয়ে আয়।

    সুইস দু’জন হুস করে গাড়ি নিয়ে বের হয়ে গেল। আমি সব শুনে বললাম, অন্যের জায়গায় আমরা কেন পিকনিক করব? চল আরেকটা জায়গা খুঁজে বের করি।

    শাহীন বলল, স্যার সুইস সরকারের আইন বলে নদীর পাড় ঘেঁসে সমস্ত সুন্দর জায়গায় সবার অধিকার। এটা যদি ওর জায়গাও হয় তারপরেও আমাদের অধিকার আছে এখানে পিকনিক করার।

    আমি বললাম, ব্যাটা তো মনেহয় পুলিশে খবর দিতে গেল।

    শাহীন বলল, পুলিশে খবর দেবে না, কারণ আইন আমাদের পক্ষে। পুলিশে খবর দিলে নিজেই বিপদে পড়বে, তবে সে বন্দুক নিয়ে ফিরে আসতে পারে।

    বলো কী?

    বন্দুক দিয়ে গুলি করবে না-ফাঁকা আওয়াজ করে ভয় দেখাবে।

    আমরা তখন কী করব?

    ফাইট দিব। মেরে তক্তা বানিয়ে ফেলব। এখনো বাঙালি চেনে না।

    শাহীন আবারো খানকি বিষয়ক গালিতে ফিরে গেল।

    আমি স্তম্ভিত। এ কী বিপদে পড়লাম! আমি একা স্থান ত্যাগের পক্ষে, বাকি সবাই ‘বিনা যুদ্ধে নাহি দেব সুচাগ্র মেদেনী’ টাইপ মেয়েরা বিশেষ করেই রণরঙ্গিনী। বাঙালি রমণী কী বিষয় তারা তা সুইসদের শিখিয়ে দিতে আগ্রহী।

    চ্যালেঞ্জার লুঙ্গি পরে রাইন নদীর সুশীতল জলে সাঁতার কাটছিল। সে উঠে এসে লুঙ্গি বদলে প্যান্ট পরল। লুঙ্গি পরে মারামারি করা যায় না।

    আমার সিক্সথ সেন্স বলছিল ওরা ফিরে আসবে না ঝামেলা কে পছন্দ করে।

    আমার সিক্সথ সেন্স ভুল প্রমাণিত করে সেই দু’জন গাড়ি করে আবার উপস্থিত হলো। শাহীন বারবিকিউর চুলা থেকে জ্বলন্ত চ্যালাকাঠ তুলে হাতে নিল। স্বাধীনের দিকে তাকিয়ে দেখি তার হাতে সুইস নাইফ।

    দু’জন গাড়ি থেকে নেমে এগিয়ে এল। তাদের হাতে বন্দুক দেখা গেল না। তবে পিস্তল জাতীয় কিছু পকেটে থাকতে পারে।

    শাহীনের সঙ্গে তাদের নিম্নলিখিত কথাবার্তা হলো।

    সুইস : আমরা সরি বলার জন্যে এসেছি। তোমাকে যে সব গালাগালি করেছি তার জন্যে Sory, আমাদের এ উপলব্ধি গ্রহণ করলে খুশি হব।

    শাহীন : এ উপলব্ধি গ্রহণ করা হলো।

    সুইস : তোমরা কোন দেশ থেকে এসেছ?

    শাহীন : আমার বন্ধুরা বাংলাদেশ থেকে এসেছেন, আমি সুইস নাগরিক।

    সুইস : তোমাদের পিকনিক শুভ হোক।

    শাহীন: অল্পের জন্যে বাঁচলি, আইজ তরে জানে মাইরা ফেলতাম।

    সুইস : কী বললে বুঝতে পারলাম না।

    শাহীন : বাংলা ভাষায় বলেছি, তোমাদের ধন্যবাদ।

    মহান বাঙালির সম্মান বজায় রইল। শুটিংয়ের শেষে খাওয়া-দাওয়া হচ্ছে। আমি ঘোষণা দিলাম, আগামীকাল অফ ডে। আমরা কোনো শুটিং করব না।

    হাসানের মুখ শুকিয়ে গেল। শুটিং অফ মানে আরেকদিন বাড়তি থাকা। বাড়তি খরচ। বাড়তি টেনশন।

    আমি হাসনকে আশ্বস্ত করার জন্যে বললাম, তুমি টেনশন করো না। আমরা Extra কাজ করে আগামীকালের ক্ষতি পুষিয়ে দেব।

    আগামীকাল কাজ করবেন না কেন?

    আগামীকাল অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে বাংলাদেশের ক্রিকেট খেলা। আমি ক্রিকেট খেলা দেখব।

    শাহীন বলল, ক্রিকেট খেলা দেখা যাবে না।

    কেন দেখা যাবে না?

    শাহীন বলল, এখানকার কোনো বাঙালির বাড়িতে ডিশের লাইন নেই। খরচের ভয়ে তারা ডিশ লাইন নেয় না।

    আমি বললাম, রেস্টুরেন্টগুলোতে খেলা দেখার ব্যবস্থা নেই?

    সুইসরা ক্রিকেট ভক্ত না। তারা ফুটবল ছাড়া কোনো খেলা দেখে না।

    আমি হাসানের দিকে ফিরে বললাম, তোমার দায়িত্ব কাল আমাকে খেলা দেখানো।

    হাসান বলল, অবশ্যই।

    পাঠকরা ভুলেও ভাববেন না-আমি ক্রিকেটের পোকা, কে কখন কয়টা ছক্কা মেরেছে, কে কতবার শূন্যতে আউট হয়েছে, এসব আমার মুখস্থ। মোটেও না। আমি শুধু বাংলাদেশের খেলা থাকলেই দেখি। অন্য খেলা না।

    বাংলাদেশের কোনো খেলা আমি মিস করি না। ঐ দিন আমার সকল কর্মকাণ্ড বন্ধ। বাংলাদেশের কোনো খেলোয়াড় যখন চার মারে, আমার কাছে মনে হয় চারটা সে মারে নি। আমি নিজে মেরেছি। এবং আমাকে যথেষ্ট বেগ পেতে হয়েছে। বাংলাদেশের কোনো বোলার যখন কঠিন বল করে তখন আমার মনের ভাব হচ্ছে-’বলটা কেমন করলাম দেখলিরে ছাগলা? কলজে নড়ে গেছে কি-না বল। আসল বোলিং তো শুরুই করিনি। তোকে আজ পাতলা পায়খানা যদি না করাই আমার নাম হুমায়ূন আহমেদই না।

    আনন্দে চোখে পানি আসার মতো ঘটনা আমার জীবনে অনেকবার ঘটেছে। যে ক’বার বাংলাদেশ ক্রিকেট জিতেছে প্রতিবারই আমার চোখে পানি এসেছে। বাংলাদেশী ক্রিকেটের দুর্দান্ত সব খেলোয়াড়দের ধন্যবাদ। তারা চোখভর্তি পানি নিয়ে আসার মতো আনন্দ একজন লেখককে বারবার দিচ্ছেন। পরম করুণমায় এইসব সাহসী তরুণের জীবন মঙ্গলময় করুক, এই আমার শুভকামনা।

    আমরা যেখানে আমি (রুখতেনস্টাইন) সেখানে ক্রিকেট খেলা দেখার কোনো ব্যবস্থা হাসান করতে পারল না। তাকে পরাজিত ও বিধ্বস্ত মনে হচ্ছিল। সে বাসে করে আমাদের নিয়ে রওনা হলো সুইজারল্যান্ডের রাজধানী জুরিখে। জুরিখে অনেক বাঙালি, তাদের কারো বাসায় Star Sports কিংবা ESPN তো থাকবেই।

    কাউকে পাওয়া গেল না। আমরা পাবে পাবে ঘুরতে লাগলাম। সাধারণত পাবগুলোতে খেলা দেখানো হয়। কোথাও কোথাও গেল না। এই সময় খবর এল জুরিখের একপ্রান্তে অস্ট্রেলিয়ানদের একটা পাব আছে। অস্ট্রেলিয়া বাংলাদেশের খেলা সেই পাবে নিশ্চয়ই দেখানো হবে। গেলাম সেখানে, সেই পাবে রাগবি দেখাচ্ছে। আমরা ক্রিকেট দেখতে চাই চাই শুনে পাবের অস্ট্রেলিয়ান মালিক বিস্মিত হয়ে তাকাল।

    স্বাধীন বলল, আমরা তোমাদেরকে একবার হারিয়েছি। আজও হারাব। আমাদের এই আনন্দ পেতে দীও। প্লিজ।

    অস্ট্রেলিয়ান মালিক বলল, এসো। ব্যবস্থা করে দিচ্ছি।

    খেলা আগেই শুরু হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাট করছে। অবস্থা কেরোসিন। আমরা আয়োজন করে বসার দশ মিনিটের মধ্যে বাংলাদেশের চারজন খেলোয়াড় আউট।

    আমরা মাথা নিচু করে বসে রইলাম। আমি অস্ট্রেলিয়ার পাব মালিককে বললাম, আমরা ঠিক করেছি আজ কিক্রেট দেখব না। তুমি চ্যানেল বদলে দাও। সবাই রাগবি দেখতে চাচ্ছে। আমরা আসলে রাগবির ভক্ত।

    .

    ভ্রমণকাহিনী লেখার কিছু নিয়মকানুন আছে। যে-সব জায়গা দেখা হয় তার বর্ণনা দিতে হয় (ছবিসহ)। ছবিতে লেখক থাকেন। প্রতিটি ছবির সঙ্গে ক্যাপসন থাকে। নমুনা।

    রুখতেনষ্টাইনের রাজপ্রসাদের সামনে লেখক।
    লেখকের পাশে তার স্ত্রী শাওন।

    রুখতেনষ্টাইন রাজপ্রাসাদ সেখানে মুখ্য না। মুখ্য হলো লেখক এবং লেখক পত্নী হাসি হাসি মুখে দুজন দুজনের দিকে তাকিয়ে আছেন।

    ভ্রমণকাহিনীতে নিজ দেশের সঙ্গে একধরনের তুলনামূলক বিষয়ও থাকতে হবে। দেশে কিছুই নেই, বাইরে স্বর্গ-এই বিষয়টা আসতে হবে। যে-সব জায়গায় লেখক গেলেন, তার বর্ণনা এমনভাবে থাকতে হবে যেন পাঠক পড়তে গিয়ে টাসকি খেয়ে ভাবে-মানুষটা কত জ্ঞানী। নেপোলিয়ানের বাড়ি প্রসঙ্গে লিখতে হবে-কবে কখন নেপালিয়ান এসে রাইন নদী দেখে মুগ্ধ হয়ে এই প্রাসাদ করেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় নাৎসীরা এই বাড়ি নিয়ে কী করে ইত্যাদি। এক ফাঁকে নেপোলিয়ানের জীবনীও কিছুটা দিতে হবে। নয়তো পাঠকের জ্ঞান অসম্পূর্ণ থাকবে।

    আমার নানান সমস্যার একটি হচ্ছে, নিজের দেশ ছাড়া অন্য কোনো দেশই আমার ভালো লাগে না। পাঠকদের কেউ কেউ হয়তো চোখ কপালে তোলার মতো করে বলবেন–বাপরে, ব্যাটা দেশপ্রেম ফলাচ্ছে। আমি কিন্তু আমার কথা প্রমাণ করে দিতে পারি। আমেরিকায় পড়াশোনা শেষ করে সেই দেশেই বিরাট বেতনের চাকরি নিয়ে থেকে যাবার সুযোগ আমার ভালো মতোই ছিল। আমার প্রফেসর বারবারই বলেছেন-’তোমার পরিবারের সবার জন্যেই আমি সিটিজেনশিপের ব্যবস্থা করছি, তুমি থেকে যাও। দেশে ফিরে কী করবে? আমেরিকা ল্যান্ড অব অপরচুনিটি।’ আমি খাকি নি। দুশ’ ডলার সঞ্চয় নিয়ে দেশে ফিরে এসেছি।

    আমার ঘনিষ্ঠজনরা জানে, আমাদের দেশের বাইরে যাওয়ার ব্যাপারে রাজি করানো কতটা কষ্টের। কেন দেশের বাইরে যেতে চাই না? দেশের বাইরের কোনো কিছুই আমাকে স্পর্শ করে না। মনে লাগে না। বাইরে কম সময় কাটাই নি। আমেরিকায় এক নাগাড়ে ছয় বছর কাটালাম। কত বৈচিত্র্যের সুন্দর দেশ। কিন্তু আমার একদিনের জন্যেও মনে হয় নি-এই দেশ আমার হতদরিদ্র দেশের চেয়েও সুন্দর। পৃথিবীর কোন দেশে পাব আমি আমার দেশের উথালপাতাল জোছনা? কোথায় পাব আষাঢ়ের আকাশ ভাঙ্গা বৃষ্টি আমেরিকা থেকে একবার আমি মা’কে চিঠি লিখলাম-অনেকদিন বর্ষার ব্যাঙের ডাক শুনি না। আপনি কি ব্যাঙের ডাক রেকর্ড করে ক্যাসেট করে পাঠাতে পারবেন?

    চিঠি পৌঁছানোর পর আমার সর্বকনিষ্ঠ ভ্রাতা (আহসান হাবীব, সম্পাদক উন্মাদ) ক্যাসেট প্লেয়ার নিয়ে ডোবা ও খন্দে ঘুরে বেড়াতে লাগল। যথাসময়ে আমার কাছে ব্যাঙের ডাকের ক্যাসেট চলে এল। এক রাতে দেশের ছেলেমেয়েদের বাসায় দাওয়াত করেছি। সবাই খেতে বসেছে, আমি ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক হিসেবে ব্যাঙের ডাকের ক্যাসেট ছেড়ে দিলাম। ভেবেছিলাম সবাই হাসাহাসি করবে। অবাক হয়ে দেখি, বেশিরভাগ ছেলেমেয়ের চোখে অশ্রু চকচক করতে লাগল।

    থাক এই প্রসঙ্গ, ভূস্বর্গ সুইজারল্যান্ড সম্পর্কে বলি। এই দেশ ইউরোপের যে কোনো পাহাড়ি দেশের মতোই। আলাদা সৌন্দর্যের কিছু নেই। আমি আমার হাতের বলপয়েন্টের দোহাই দিয়ে বলছি-আমার দেশের রাঙামাটির সৌন্দর্য সুইজারল্যান্ডের সৌন্দর্যের চেয়ে কোনো অংশেই কম না। তফাত একটাই, আমরা গরিব ওরা ধনী। পরম করুণাময় ধনী-দরিদ্র বিবেচনা করে তাঁর প্রকৃতি সাজান না। তিনি সাজান নিজের ইচ্ছায়।

    সুইজারল্যান্ডের মানুষগুলি ভালো। বেশ ভালো। হাসিখুশি। বিদেশীদের দিকে অবহেলার চোখে তাকায় না। আগ্রহ নিয়ে তাকায়। আগ্রহ নিয়ে গল্প করতে আসে। শাওনকে বেশ কিছু বিদেশিনী জিজ্ঞেস করলেন-তুমি চামড়া ট্যান করার জন্যে যে লোশন ব্যবহার করো, তার নাম জানতে পারি?

    শাওন বলল, আমাদের চামড়া জন্ম থেকেই এরকম। কোনো লোশন দিয়ে ট্যান করানো হয় নি।

    তারা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেছে-তোমরা কত না ভাগ্যবতী!

    স্থানীয় অধিবাসীদের মানসিকতা কেমন-তার উদাহরণ হিসেবে একটা ছোট্ট গল্প বলছি। আমাদের নাটকে (রূপালী রাত্রি) আছে ডাক্তার এজাজ এবং ফারুক গ্রামের কামলাশ্রেণীর মানুষ। প্রথমবার সুইজারল্যান্ডের মতো একটা দেশে আসার সুযোগ হয়েছে। তারা স্যুট পরে মহানন্দে সুইজারল্যান্ডের পথে পথে ঘুরছে। যাকেই পাচ্ছে তাকেই বলছে, ‘হ্যালো’।

    নাটকের একটি দৃশ্য আছে, এরা দুইজন এক সুইস তরুণীকে বলবে, ‘হ্যালো’। তরুণী তাদের দিকে তাকাবে। জবাব না দিয়ে চলে যাবে। ডাক্তার এজাজ ফারুককে বলবে-এই মাইয়া ইংরেজি জানে না।

    সুইজারল্যান্ডের তরুণীর ভূমিকায় অভিনয় করার জন্যে এক পথচারী তরুণীকে প্রস্তাব করতেই সে রাজি হয়ে গেল। অভিনয় করল। অভিনয় শেষে সে ডাক্তার এজাজকে বলল, তুমি হ্যালো বলেছ, আমি জবাব না দিয়ে চলে গেছি। আমি কিন্তু এরকম মেয়ে না। আমাকে এরকম করতে বলা হয়েছে বলে আমি করেছি। তারপরেও আমি তোমার কাছে ক্ষমা চাচ্ছি।

    .

    আধুনিক পদার্থবিদ্যার ইতিহাসে সুইজারল্যান্ডের বার্ন শহরের বিরাট গুরুত্ব। বার্ন শহরের এক পেটেন্ট অফিসের তেইশ বছর বয়সী কেরানি Annals of Physics-এ তিন পাতার একটি প্রবন্ধ লিখে পদার্থবিদ্যার গতিপথই সম্পূর্ণ পাল্টে দিয়েছিলেন। পেটেন্ট অফিসের সেই কেরানি নাম আলবার্ট আইনস্টাইন। বার্ন শহরে তার একটি মিউজিয়াম আছে। আমার খুব ইচ্ছা হলো এই মিউজিয়ামটা দেখে যাই (মিউজিয়াম দেখার বিষয়ে আমার আগ্রহ নেই। আমি কোথাও বেড়াতে গেলে মিউজিয়াম দেখি না। সমুদ্র, জঙ্গল, পাহাড়, পর্বত দেখি)। শাহীনকে বলতেই সে বলল, কোনো ব্যাপারই না। নিয়ে যাব।

    একদিন শাওনকে নিয়ে তার সঙ্গে বের হলাম। সে আমাদের এক ক্যাসিনোতে ঢুকিয়ে দিয়ে বলল, হুমায়ুন ভাই, এই ক্যাসিনো ছোটখাট। এখানে জুয়া খেলে আপনার ভালো লাগবে।

    আমি বললাম, আইনস্টাইন সাহেবের খবর কী?

    উনার জায়গাটা এখনো বের করতে পারি নি।

    ফিজিক্স বাদ দিয়ে জুয়া?

    শাহীন খুবই উৎসাহের সঙ্গে বলল, ক্যাসিনোতে জুয়া খেলতে লাইসেন্স লাগে। মেম্বার হতে হয়। আপনাদের জন্যে বিশেষ ব্যবস্থা করেছি।

    ঈশ্বর এবং জুয়া নিয়ে আইনস্টাইনের একটি বিখ্যাত উক্তি আছে, যে উক্তি পরে ভুল প্রমাণিত হয়েছে।

    কোয়ান্টাম মেকানিক্সের শুরুতে আইনস্টাইন থমকে গেলেন। কোয়ান্টাম মেকানিক্স তিনি মনেপ্রাণে নিতে পারলেন না। তিনি বললেন, ঈশ্বর জুয়া খেলেন না (Good does not play dice), দেখা গেল আইনস্টাইনের বক্তব্য সঠিক না-ঈশ্বর জুয়া খেলেন।

    তিনিই যখন খেলতে পারেন–আমার খেলতে অসুবিধা কোথায়? আমি শাওনকে নিয়ে এক টেবিলে বসে অতি দ্রুত পাঁচশ’ ডলার হারলাম! শাহীন আনন্দিত গলায় বলল, মজা হচ্ছে না হুমায়ূন ভাই?

    আমি বললাম, হচ্ছে।

    সে গলা নামিয়ে বলল, আইনস্টাইন ফাইনস্টাইন বাদ দেন। বিদেশে এসেছেন, অঙ্ক করবেন না-কি?

    তা তো ঠিকই।

    পাঁচশ’ হেরেছেনে আরো হারেন-এই একটা জায়গাতেই হারলেও মজা।

    জুয়ায় জেতার আনন্দটা কী আমি জানি না। কখনো জিততে পারি নি। আমার জুয়ার ভাগ্য খারাপ। এই লাইনে অতি ভাগ্যবান একজনের নাম স্বাধীন খসরু। তিনি স্ক্রাচ কার্ড নামক একধরনের জুয়া আগ্রহের সঙ্গে খেলেন। এক ইউরো, দুই ইউরো দিয়ে স্কাচ কার্ড কিনেন। কার্ডের বিশেষ জায়গা ঘসা হয়। সেখানে যদি চারটা সাত উঠে আসে বা এই ধরনের কিছু হয় তাহলেই পুরস্কার।

    সুইজারল্যান্ডে স্বাধীন খসরু এই কাণ্ড ঘটালেন। কার্ড ঘসার পর যে বস্তু বের হলো তার অর্থ, তিনি বিশ হাজার ইউরো পুরস্কার পেয়েছেন। তাৎক্ষণিকভাবে ইউরো পাওয়া যাচ্ছে না। সেদিন এবং তার পরের দিন ব্যাংক বন্ধ। অফিস টফিসও বন্ধ। আমাদের উত্তেজনার সীমা নেই। লক্ষ করলাম, সফরসঙ্গীদের মধ্যে হিংসা কাজ করতে শুরু করেছে। অনেকেই মত প্রকাশ করছে, শেষ পর্যন্ত টাকা পাওয়া যাবে না। সামান্য কার্ড ঘসে কেউ এত টাকা পায়? কোনো একটা ঝামেলা অবশ্যই আছে।

    আমি জানি কোনো ঝামেলা নেই। নিউইয়র্কে দুজন বাঙালির সঙ্গে আমার দেখা হয়েছে–যারা পাঁচ ডলারে স্কাচ কার্ড ঘসে এক মিলিয়ন ডলার করে পুরস্কার পেয়েছেন।

    স্বাধীনের কার্ডের লেখা জার্মান ভাষায়। জার্মান ভাষা ভালো জানে এমন কয়েকজনকে দিয়ে কার্ড পড়ালাম। তারাও বললেন, ঘটনা সত্যি। এই কার্ড বিশ হাজার ইউরো জিতেছে।

    হঠাৎ লাখপতি হয়ে যাওয়ায় স্বাধীন দলছুট হয়ে পড়ল। কেউ তার সঙ্গে ভালোমতো কথা বলে না। সেও আলাদা থাকে। আমাদের সঙ্গে খাওয়া-দাওয়া করে না। নগদ ইউরো খরচ করে রেস্টুরেন্টে খেতে যায়। সঙ্গে থাকে নতুন পাওয়া বান্ধবী। এই বান্ধবী স্বাধীনকে বলেছে, সে যদি সুইজারল্যাণ্ডে থেকে যায় তাহলে স্বাধীনকে সে বিয়ে করতে রাজি আছে। সুইজারল্যান্ডে থেকে যাওয়া তার জন্য তেমন কোনো সমস্যা না। কারণ স্বাধীন ব্রিটিশ নাগরিক, তার পিছুটানও নেই। স্বাধীনকে মনে হলো নিমরাজি।

    আমি শঙ্কিত বোধ করলাম। স্বাধীন অতি আবেগপ্রবণ ছেলে। আবেগের বশে বিয়ে করতে বসতে পারে। সমস্যা একটাই, সে আবেগ ধরে রাখতে পারে না। স্বাধীনের সঙ্গে কথা বলা দরকার। লক্ষ করলাম, সে আমাকেও এড়িয়ে চলছে। নিজেই আগ বাড়িয়ে তার সঙ্গে কথা বলতে গেলাম। নিম্নলিখিত কথাবার্তা হলো।

    আমি : হ্যালো স্বাধীন!

    স্বাধীন : (চুপ)

    আমি : কনগ্রাচুলেশনস! বিশ হাজার ইউরো পেয়ে গেলে।

    স্বাধীন : থ্যাংকু য়্যু।

    আমি : তারপর কী ঠিক করলে, এই দেশেই সংসার পাতবে?

    স্বাধীন : আমার কাছে সব দেশই সমান। বাংলাদেশে জন্ম হলেও জীবন কেটেছে ইংল্যান্ডে।

    আমি: দু’দিনের পরিচয়ে একজনকে বিয়ে করে ফেললে পরে সমস্যা হবে তো?

    স্বাধীন: যখন এরেঞ্জ ম্যারেজ হয় তখন তো স্বামী-স্ত্রীর পূর্বপরিচয় ছাড়াই বিয়ে হয়। তারা সুখী হতে পারলে আমরা কেন হতে পারব না?

    আমি : (চুপ)

    স্বাধীন : হুমায়ূন ভাই, আমার অনুরোধ-এই বিষয়ে আমাকে আর কিছু বলবেন না।

    আমি : বিয়েটা হচ্ছে কবে?

    স্বাধীন : একটু দেরি হবে। লাইসেন্স করাতে হবে। আপনারা শুটিং শেষ করে দেশে চলে যান, আমি পরে আসব।

    আমি: আরো একটু চিন্তা ভাবনা করলে হতো না?

    স্বাধীন : চিন্তা ভাবনা তো করছি। সারারাতই চিন্তা করি। আগামীকাল সকালে আপনি আমাকে একটু সময় দেবেন? আপনাকে নিয়ে মেয়ের মায়ের বাসায় যাব। এখানে আপনি ছাড়া আমার মুরুব্বি কেউ নেই।

    আমি : ঠিক আছে যাব।

    মেয়ের মায়ের বাড়িতে যাবার আগে আমরা গেলাম স্কাচ কার্ড দেখিয়ে বিশ হাজার ইউরো তুলতে। সঙ্গে আছে শাহিন। সে জার্মান ভাষা জানে। আমরা জানি না।

    কোম্পানির তরুণী কার্ড উল্টেপাল্টে বলল, হ্যাঁ, তোমরা বিশ হাজার ইউরো পেয়েছ।

    আমরা তিনজন একসঙ্গে বললাম, থ্যাংক ইউ।

    তরুণী বলল, তোমরা টাকা পাবে না। কারণ তোমরা কার্ডটা অতিরিক্ত খোঁচাখুঁচি করে নষ্ট করে ফেলেছ। যেখানে স্কাচ করার কথা না সেখানেও করেছ।

    শাহীন বলল, তুমি তো খুবই অন্যায় কথা বলছ।

    তরুণী বলল, তুমি লইয়ারের কাছে যেতে পার।

    অবশ্যই লইয়ারের কাছে যাব।

    আমরা লইয়ারের কাছে গেলাম। তিনি বললেন, মামলা করলে অবশ্যই আমরা জিতব।

    আমি বললাম, মামলা আমরা অবশ্যই করব।

    লইয়ার বলল, আমি দশ হাজার ইউরো ফিস নেব। অর্ধেক এখন দিতে হবে।

    মুখ চাওয়া-চাওয়ি করা ছাড়া আমাদের কিছুই করার রইল না। কে দেবে উকিলকে এত টাকা? আর টাকা দিলেই শেষ পর্যন্ত যে আমরা মামলায় জিতব তার গ্যারান্টি কী?

    স্বাধীনের দিকে তাকিয়ে আমার খুবই মায়া লাগল। বেচারা এই টাকার আশায় নিজের যা ছিল সব শেষ করেছে। অন্যের কাছে ধারও করেছে।

    সব খারাপ জিনিসের একটা ভালো দিক থাকে। লটারির টাকা না পাওয়ার ভালো দিকটা হলো স্বাধীন ঘোষণা করল-এই পচা দেশে থাকার প্রশ্নই উঠে না। বিয়ে তো অনেক পরের ব্যাপার।

    সুইজারল্যান্ডে বাসের সময় শেষ হলো। কী দেখলাম?

    ক. ছবির মতো সুন্দর কিছু জায়গা। সবই সাজানো। জঙ্গলের গাছগুলিও হিসাব করে লাগানো। কোন গাছের পর কোন গাছ, কত দূরত্বে-সব মাপা।

    খ. অতি আধুনিক কেতায় সাজানো কিছু শপিংমল। পৃথিবীর হেন কোনো বস্তু নেই যা সেখানে নেই। দামেরও কোনো ঠিক-ঠিকানা নেই! দেশটা অতি ধনী। এদের ক্রয়ক্ষমতা অনেক অনেক বেশি। জিনিসের দাম তো হবেই। রুপার কৌটায় এক কৌটা টুথপিক বিক্রি হচ্ছে বাংলাদেশী টাকায় পঁচিশ হাজার টাকায়। যেখানে দেয়াশলাইয়ের কাঠি দিয়ে দাঁত খোঁচানোর কাজ সারা যায়, সেখানে কেন পঁচিশ হাজার টাকা খরচ করা হবে?

    গ. দেখলাম কিছু সুখী মানুষ। অর্থনীতির কঠিন চাপ থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত মানুষ। যাদের পেছনে আছে ক্ষমতাধর এক রাষ্ট্র। উদাহরণ দেই-এক সুইস নাগরিক অস্ট্রিয়ায় স্কি করতে গিয়ে আহত হয়েছে। খবর পাওয়া মাত্র সুইজারল্যান্ড থেকে হেলিকপ্টার গেল। তাকে হেলিকপ্টারে নিজ দেশে এনে চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হলো।

    এই দেশের সুখী মানুষদের সঙ্গে আমাদের কোনো যোগ নেই। তারা এক ভুবনের বাসিন্দা, আমরা অন্য ভুবনের। আমরাই শুধু বলতে পারি–

    অর্থ নয় কীর্তি নয় স্বচ্ছলতা নয়
    আরো এক বিপন্ন বিস্ময়
    আমাদের অন্তর্গত রক্তের ভেতরে খেলা করে
    আমাদের ক্লান্ত করে।

    ওরা এই কথা বলে না, কারণ অর্থশূন্য জীবন তাদের কল্পনাতে নেই। বিদায় সুইজারল্যান্ড। বিদায় ভূস্বর্গ।

    ⤶ ⤷
    1 2 3 4 5
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleঅনন্ত অম্বরে – হুমায়ূন আহমেদ
    Next Article হোটেল গ্রেভার ইন – হুমায়ূন আহমেদ

    Related Articles

    হুমায়ূন আহমেদ

    আসমানীরা তিন বোন – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025
    হুমায়ূন আহমেদ

    ইস্টিশন – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025
    হুমায়ূন আহমেদ

    উড়ালপঙ্খী – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025
    হুমায়ূন আহমেদ

    এই বসন্তে – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025
    হুমায়ূন আহমেদ

    এই মেঘ, রৌদ্রছায়া – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025
    হুমায়ূন আহমেদ

    এইসব দিনরাত্রি – হুমায়ূন আহমেদ

    December 23, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Generic selectors
    Exact matches only
    Search in title
    Search in content
    Post Type Selectors
    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    আসমানীরা তিন বোন – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    আসমানীরা তিন বোন – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025
    Our Picks

    আসমানীরা তিন বোন – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025

    ইস্টিশন – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025

    উড়ালপঙ্খী – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }