Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    সাহিত্যিকদের ছদ্মনাম

    October 28, 2025

    অ্যারিস্টটলের পলিটিক্স ও অন্যান্য প্রসঙ্গ – বার্ট্রান্ড রাসেল

    October 28, 2025

    আলস্যের জয়গান – বার্ট্রান্ড রাসেল

    October 28, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    দেবযান – বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়

    উপন্যাস বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় এক পাতা গল্প333 Mins Read0
    ⤶ ⤷

    ১৪. সেদিন পুষ্প বল্লে

    সেদিন পুষ্প বল্লে–যতীন-দা, মন খারাপ করে বসে আছ নাকি? চলো করুণাদেবীর কাছে যাবে।

    –আমি সেখানে যেতে পারবো না। অত উঁচুতে উঠলে আমার। চৈতন্য থাকে না জানো–সব সময় তাঁকে দেখতেও পাইনে। কি করবো বলো। তা ছাড়া, আমার অন্য অনেক রকম ভাবনা–

    –ভাবনা তো জানি। ও ভেবে কোনো লাভ আছে? যার যেমন। অদৃষ্টে আছে, তেমনি হবে। চেষ্টা তো করলে অনেক। ওর কৰ্ম্মফল। ওকে ওই পথে নিয়ে যাচ্ছে, তুমি আমি কি করবো বলো।

    আরও কয়েক মাস কেটে গিয়েছে। আশালতার মনের অবস্থা দিনকয়েকের জন্য একটু ভাল হয়েছিল বটে, কিন্তু স্থায়ী কোনো ফল তাতে হয়নি। নেত্য তাকে গ্রামের প্রান্তে আলাদা বাড়ী করেও দেয়নি। ভুলিয়ে তার কতকগুলো সোনার গহনা হাত করে সেই টাকায় ওকে কলকাতায় এনে রেখেচে। যতীন রোজ সেখানে যায় রাত্রে, একটা লম্বা ব্যারাকমত পুরনো বাড়ীর একটা ঘরের সংকীর্ণ রোয়াকে আশা বসে রাঁধে, এখানে সে পাশের ভাড়াটেদের সামনে সামাজিকতা বজায় রাখবার জন্যে বিধবার বেশ ঘুচিয়ে নেত্যর স্ত্রী সেজেচে, হাতে চুড়ি ।পরে, কপালে সিঁদুর দেয়। প্রথমে যেদিন নেত্যই তার কাছে এ প্রস্তাব করে যতীন সেখানে উপস্থিত ছিল।

    নেত্য বল্লে–রাস্তা থেকেই তোমাকে এটি করতে হবে আশা। যেখানে যাবে, সেখানে আশপাশের ঘরে অনেক ফ্যামিলি বাস করে। তাদের সামনে কি বলে দাঁড়াবে, কি পরিচয় দেবে? বাড়ীওয়ালাই বা জায়গা দেবে কেন?

    আশা বল্লে–সে আমি পারবো না। ব্রাহ্মণের ঘরের বিধবা হয়ে আবার পেড়ে কাপড় পরবো, সিঁদুর পরবো–এ হবে না আমায় দিয়ে নেত্য-দা–

    নেত্য শ্লেষের সুরে বল্লেনাও নাও আর ন্যাকামি করতে হবে না! ব্রাহ্মণের বিধবার তো সব রাখলে, এখন যার সঙ্গে বেরিয়ে এলে তার কথামত চলো।

    আশা বিস্ময়ের সুরে বল্লে–বেরিয়ে এলাম!

    –আহা-হা নেকু! বেরিয়ে আসার কি হাতীঘোড়া আছে না কি? আবার তুমি ঘরে ফিরে যাও তো মানিক। এতক্ষণ গাঁয়ে ঢিঢি পড়ে গিয়েচে দ্যাখো গে যাও

    –বা-রে, তুমি বল্লে আমাকে কলকাতায় আলাদা বাসা করে দেবে। আমি আমার গহনা বিক্রি করে চালাবো–তারপর মাকে সেখানে নিয়ে এসে রাখা হবে। বলো নি?

    -হ্যাঁ গো হ্যাঁ। এখনও তাই বলচি, বলচি নে? আমার হাত ধরে যে মাত্তর বাড়ীর বাইরে পা দিয়েচ, সেই মাত্তরেই তুমি বেরিয়ে এসেচ। ওকেই বলে বেরিয়ে আসা। এখন আর ফেরবার পথ নেই–যা বলি, সেই রকমই করো। তোমার ভালোর জন্যেই তো বলচি। দেখো কত সুবিধে হবে, কলকাতায় বড় বড় লোকের সঙ্গে আলাপ হবে। আখেরে ভালো হয় কিনা দেখে নিও।

    যতীন সেদিন ফিরে এসে পুষ্পকে সব বলেছিল। পুষ্প বলে– আশাদি বড় নির্বোধ, নেত্য লোকটা ওকে ভুলিয়ে এই কাণ্ডটা ঘটাচ্চে। কিন্তু কিছু করবার নেই।

    –কেন পুষ্প? এক অবলা মেয়েকে সর্বনাশের পথ থেকে বাঁচাতে পারো না তোমরা?

    -কই পারি। যে যার কৰ্ম্মফলের পথে চলে, কে কাকে সামলায়?

    এরপর প্রায় তিন মাস কেটেছে। আশা ও নেত্য বাসাবাড়ীতে বেশ পাকাঁপোক্ত হয়ে বসে স্বামী-স্ত্রীর মত সংসার করচে। নেত্য বাজার করে নিয়ে আসে, আশার সামনে বসে গল্প করে, দুবার সিনেমা দেখাতে নিয়ে গিয়েছে, একবার পাশের ঘরের ভাড়াটেদের সঙ্গে আশা কালীঘাটেও ঘুরে এসেচে।

    পুষ্প কত চেষ্টা করেচে যতীনকে ওখান থেকে আনবার। কিন্তু যতীন শোনে না, পুষ্পকে লুকিয়ে সে আজকাল প্রায়ই আশার বাসায় যায়। একদিন রাত্রে একটা স্বপ্নও দেখিয়েছিল, কিন্তু পুষ্পের সাহায্য না পাওয়ায় সে স্বপ্ন হয় বড় অপষ্ট, তাতে ঘুম ভেঙে উঠে আশা সারা সকালটা মন ভার করে থেকে নেত্যর কাছে বকুনি খায়।

    পুষ্প বল্লে–চলো আজ করুণাদেবীর কাছে গিয়ে বলি–

    –এইখানেই তাঁকে আনো। আমি কোথাও যাবো না।

    –পৃথিবীর মধ্যে ভূত হয়ে ঘুরে বেড়াবে এই রকম?

    –কি করি বলো। আমরা তো খুব উঁচুদরের মানুষ নই তোমাদের মত, এই আমাদের পরিণাম। কৰ্ম্মফল!

    যতীনের ঠেস দেওয়া কথায় পুষ্প মনে আঘাত পেলেও মুখে কিছু বল্লে না। সে বেশ বুঝেছে যতীনদাকে এ পথ থেকে নিবৃত্ত না করলে ওর উন্নতি হবে না। যতদিন আশা বাঁচবে, তার পেছনে অস্থানে কুস্থানে ও ঘুরে ঘুরে বেড়াবে–তাতে কোনো পক্ষেরই কোনো সুবিধে হবে না।

    ইতিমধ্যে একদিন একটা ব্যাপার ঘটে গেল আশাদের বাসায়। আশার গ্রামের শম্ভ চক্কত্তি বলে সেই ছেলেটি অনেক খোঁজাখুঁজির পরে আশার সন্ধান পেয়ে সেখানে এল। আশা তখন রান্না করচে। শম্বুকে ঢুকতে দেখে ওর মুখ শুকিয়ে গেল। শম্ভ এসে বল্লে–কি আশাদি, চিনতে পারো?

    আশা শুকনো মুখে ভয়ের সুরে বল্লে–এসো বোসো শম্ভুদা–কি করে চিনলে ঠিকানা?

    –নেত্য স্কাউলেটা কোথায়? আমি একবার তাকে দেখে নিতাম। তারপর, কি মনে করে এখানে এসে আছ?

    -কারু দোষ নেই শম্ভুদা, আমি নিজের ইচ্ছেতেই এসেচি।

    –গাঁয়ে কি রকম হৈ চৈ পড়ে গিয়েচে তুমি জানো না। কেন তুমি এরকম করে এলে? কতদূর খারাপ করেচ তা তুমি বুঝেচ?

    –গাঁয়ে থেকেই বা কি করতাম শম্ভুদা। এ বেশ আছি। আমাদের মত মানুষের আবার গা আর অগাঁ কি? কি ছিল জীবনে? মা মরলে কোথায় দাঁড়াতাম? এখানে খারাপ নেই কিছু। ফিরে যখন যেতে পারবো না, তখন সেকথা ভেবে আর কি হবে।

    -আমি তোকে বোনের মত ভালবাসি আশা, চল তোকে এখান। থেকে নিয়ে অন্য জায়গায় রেখে দেবো।

    আশা কি একটা জবাব দিতে যাচ্চে এমন সময়ে নেত্য এসে। হাজির। শম্ভকে ওখানে দেখে সে খুব চটে গেল মনে মনে, তখন কিছু বল্লে না, কিন্তু তারপর আশাকে যথেষ্ট তিরস্কার ও অপমান করলে। তার ধারণা আশাই শম্বুকে লুকিয়ে খবর দিয়ে এনেছিল।

    যতীন সব দেখলে দাঁড়িয়ে। আজকাল সে সন্দেহ করে এই নেত্যর জন্যেই আশা শ্বশুরবাড়ী যেতে চাইত না। পুষ্প সব জানে কিন্তু তাকে কখনো কিছু বলেনি। তবুও রাগ হয় না আশার ওপর–গভীর একটা। অনুকম্পা, সে দ্বিতীয় স্তরের প্রেত যদি হোত, তবে নেত্যকে একদিন এমন বিভীষিকা দেখাতো যে মরে কাঠ হয়ে যেতো নেত্য, কেমন। নেত্য সে দেখে নিত!

    করুণাদেবীর কাছে এইজন্যেই সে গেল পুষ্পকে নিয়ে। একটা ক্ষুদ্র দ্বীপের মত স্থান অসীম ব্যোমসমুদ্রে, চারিদিকে উপবন, কুসুমিত বনলতা, কিছুদূরে একটা ঝর্ণা পড়চে পাহাড়ের মাথা থেকে। বনানীর বন্য সৌন্দৰ্য্য ও উপবনের শোভা এক হয়ে মিলেচে। একটা প্রাচীন বৃক্ষতলে ঝরা পাতার রাশির ওপর দেবী এলিয়ে শুয়ে পড়েছেন। কেউ কোথাও নেই, শূন্য দ্বীপ, শূন্য ব্যোমতল। দেবীর অপরূপ রূপে সেই প্রাচীন বনস্থলী উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। যতীন ভাবলে, এই তো স্বর্গ। এত সৌন্দর্য দিয়ে গড়া যে ছবি তা স্বর্গ ছাড়া আর কিছু নয়। পৃথিবীতে এমন বনবনানীর সমাবেশ কই, যদি বা থাকে এমন রূপসী মেয়ে কই, তাও যদি থাকে, এত নির্জনতা কই–যদি বা থাকে, এ-তিনের অদ্ভুর সমাবেশ কোথায়? দেবীর মাথায় কি এই তৈরি হয়েছে? হয়তো তাই। এতটুকু একটা গ্রহ বা উপগ্রহ, শুধু বনবনানীতে ঘেরা, সেখানে আবার অন্য কেউ নেই উনি ছাড়া, আবার দিব্যি পাখীর ডাকও আছে। করুণাদেবীর মুখশ্রী কি সুন্দর! আর কি সহানুভূতি ও করুণায় ঈষৎ বিষাদমাখা! মাতৃমূৰ্ত্তির এমন অপূৰ্ব্ব মহিমময় জীবন্ত আলেখ্য তার সামনে থাকতেও যদি সে ঈশ্বরের দয়ায় কি দেবদেবীতে বিশ্বাস করে, তবে সে নিতান্ত নির্বোধ। শুধু পুষ্পের জন্যই সে এখানে আসতে পারচে বা দেবীকে দেখতে পাচ্চেনইলে ওঁর দর্শন পাওয়া তার পক্ষে কি সহজ হোত?

    যতীনের বক্তব্য পুষ্পই বল্লে। আশাবৌদি কলকাতার বাসাবাড়ীতে কাল রাত্রে মার পর্যন্ত খেয়েচে–সারারাত কেঁদেছে, যতীনের মনে। বড় কষ্ট। এই আকর্ষণ তাকে সর্বদা পৃথিবীতে টানচে, এখন কি করা যায়?

    করুণাদেবী সব শুনে বল্লেন–এতে কিছু করবার নেই। কন্যা যতদিন ঠেকে না শিখবে, তার জ্ঞান হবে না।

    যতীন ভাবলে–এ কি হোল! এত বড় দেবীর মুখে এ কি সাধারণ পৃথিবীর মানুষের মত কথাবার্তা! এ কথা তো পৃথিবীতে যে কোন। জমিদারগিন্নি কি দরোগ ইন্সপেক্টরের বৌ শুনেই বলতো।

    সে বল্লে–আপনি মন করলে কি ওকে দয়া করতে পারেন না?

    করুণাদেবী হেসে বল্লেন–আমি খেটেই মরি, ভেবেই মরি। দয়া কি করতে পারি সে ভাবে বাছা? এদের যেদিন ভালো হবে, সেদিন আমারও ছুটি। এ সব অতি নিম্নদরের আত্মা, কেউ ওদের ইচ্ছে করে কষ্ট দিচ্ছে না, নিজের কৰ্ম্মফলে কষ্ট পাচ্ছে। ভগবান প্রত্যেক লোককে বড় দেখতে চান, সৎ, সুন্দর, নিৰ্ম্মল দেখতে চান, উচ্চ প্রকৃতি জাগলো কিনা দেখতে চান–যেমন ধরো সেবা, স্বার্থত্যাগ, দয়া, ভক্তি, ভালবাসা। এ যাদের মধ্যে নেই বা জাগেনি, তাদের সেগুলো জাগিয়ে দেবার কৌশল তাঁর জানা আছে। কষ্ট দিয়ে, শোকের বোঝা রোগের বোঝা দিয়ে যে করেই হোক ও-লোকে কি এ- লোকে তার চোখ ফোঁটানোর চেষ্টা হয়ই, তাও যাদের না হয়, অন্য গ্রহে তাদের জন্মগ্রহণের ব্যবস্থা। করে দেওয়া হয়, যে গ্রহ পৃথিবীর চেয়েও ধীর গতিতে চলে। সেখানে লোকে আস্তে আস্তে অনেক সময় নিয়ে সব জিনিস শেখে। জড়বুদ্ধি জীবেরা তাড়াতাড়ি শিখতে পারে না–সেটা তাদের উপযুক্ত পাঠশালা। এ-লোকেও নরকের মত যন্ত্রণাদায়ক ব্যবস্থা আছে, অতি নিম্নস্তরের পাপী জীবেরা সেখানে ঠেকে শিখে মানুষ হচ্চে। এ একটা মস্ত বড় বিদ্যালয়। দেখতে চাও? একবার নিয়ে যাবো

    পুষ্প জিজ্ঞেস করলে–তাহলে আশা বৌদির কি হবে বলুন–

    –আমিও দেখি একটু ভেবে, দাঁড়াও।

    পরে তিনি চোখ বুজে খানিকক্ষণ কি ভাবলেন। চোখ চেয়ে ওদের দিকে চেয়ে বল্লেন–এখনও তিন জন্ম। ওর হৃদয়ে প্রেম নেই। সব স্বার্থ। যে কোনো লোককে ভালবাসলেও তো বুঝতাম। এখন যার সঙ্গে আছে, তাকেও তেমন ভালবাসে না। সাংসারিক স্বার্থ। বুড়ো মার সেবা না করে তাকে ছেড়ে এসেচে। যতীনের মনে ভালবাসা আছে, তাই সেখানে যায়। কিন্তু ওর স্ত্রীর কোনো উপকার আপাতত কিছু হবে না।

    যতীন বল্লেওর জন্যে মন বড় খারাপ, ওর কষ্ট দেখে

    -তুমি যাকে ভাবচো কষ্ট বা পাপ, ও তাকে ভাবচে সুখ, সাংসারিক সুবিধা। ও যেদিন পাপ ভেবে ত্যাগ করবে, সেদিনই না ওর উন্নতি। তোমার ভাবনায় কি হবে?

    –আমি কি ওর কোনো উপকার করতে পারিনে? আপনি যদি দয়া করে ওকে পাপী ভেবে ওকে সাহায্য করেন–

    –পাপ বলে যে না বুঝেছে, অনুতাপ যার না হয়েছে, পাপকেই যে আনন্দের পথ বলে ভাবছে, যার মনে ত্যাগ নেই, কর্তৃব্যবুদ্ধি নেই, কোনো উঁচু ভাব নেই–আনবার চেষ্টাও নেই–তাকে শুধু দয়া করলেই ভালো করা যাবে না। ওর ভার আছে যাঁদের হাতে তাঁরা

    অসীম জ্ঞানের প্রভাবে জানেন, এই সব নিম্নশ্রেণীর মনকে কি ভাবে সংশোধন করতে হয়। সেই পথ দিয়ে ওরা উঠবে। কোনো আত্মার প্রভাব ওর মনে রেখাপাত করবে না।

    পুষ্প বল্লে–যদি আমরা রোজ ওর মনে ভাল ভাব দেবার চেষ্টা করি?

    –ঊষর মরুভূমিতে বীজ বুনলে কি হয়? যে চায়, সে পায়। যে কেঁদে বলে, ভগবান আমায় ক্ষমা করো, আমায় পথ দেখিয়ে দাও, সে পাপপুণ্য বুঝেচে। তখন তাকে আমরা সাহায্য করতে ছুটে যাই। যে যা চায়, সে তা পায়। যে জ্ঞান চায় তাকে জ্ঞানের পথ দেওয়া হয়। যে ভগবানের প্রতি ভক্তি চায়, তাকে সাধুজনের সঙ্গে মিলিয়ে দেওয়া। হয়, মনে ভক্তির সঞ্চার করে দেওয়া হয়।

    –যে বলে আমি ভগবানকে দেখবো?

    –ভগবান তাঁকে দেখা দেন।

    যতীন বিস্ময়ের সুরে বল্লে–তিনি দেখা দেন?

    –অবিশ্বাস করবার কি আছে বলো। সে যে-ভাবে চায় সেই রূপ ধরে তাকে দেখা দেন। ভগবানের বিরাট রূপের ধারণা কে করতে পারে। ইষ্ট মূর্তিতে দেখতে চায়, যার যা ইষ্ট, যে রূপ যে ভালবাসে, তাকে তিনি সেইরূপেই দেখা দেন। তিনি করুণার সাগর, কত বড় করুণা তাঁর– তা তুমি জানো না, বুঝতেও পারবে না। ক্ষুদ্র বুদ্ধির গম্য হয়ে ক্ষুদ্র সম্বন্ধ পাতিয়ে মা, ভাই, বোন, সন্তান, বন্ধু সেজে দেখা দেন।

    –আমার প্রতি একটা আদেশ করুন দেবী, আপনার কাছে এসেচি অনেক আশা নিয়ে, শুধু হাতে ফিরে যাবো?

    –আমি যা করতে পারি, এখন তা করবো না। সময় বুঝলে পৃথিবীর যে কোনো ভ্রান্ত ছেলেমেয়ের সাহায্যে আমিই সকলের আগে। ছুটে যাবো, বাছা। আশালতার কথা আমার মনে রইল। কিন্তু এখনও অনেক বাকি, অনেক দেরি, যতদূর বুঝেচি। তুমি পৃথিবীতে বেশি যাতায়াত কোরো না। পৃথিবীতে গেলে এমন সব বাসনা কামনা। জাগবে যা তোমাকে কষ্ট দেবে শুধু-কারণ পৃথিবীর মানুষের মত দেহ না থাকলে সে সব বাসনা পরিতৃপ্ত হয় না। তখন হয়তো তোমার ইচ্ছে হবে আবার মানুষ হয়ে জন্ম নিই। প্রবল ইচ্ছাই তোমাকে আবার পুনর্জন্ম গ্রহণ করবে। অথচ এখন পুনর্জন্ম নিয়ে কি করবে? গত জন্মে যা করে এসেচ তাই আবার করবে। সেই একই খেলা আবার খেলবে। তাতে তোমার উন্নতি হবে না। অথচ যার জন্যে করতে যাচ্চ, তারও কিছু করতে পারবে না। কারণ ওসব ভালমন্দ করবার কর্তাও তুমি নও। যে যার পথে চলেচে, তোমার পথ তোমার, তার পথ তার। পৰ্ব্বতকে টলাতে পারবে না, বিশ্বজগতের নিয়ম বড় কড়া, এক চুল এদিক-ওদিক করবার শক্তি নেই কারো।

    –আপনারও না?

    করুণাদেবী হেসে বল্লেন–তুমি এখনও ছেলেমানুষ। আমি তো আমি, পৃথিবীর গ্রহদেব স্বয়ং পারেন না। তিনি তো সাধারণ শক্তিধর দেবতা, ভগবানের ঐশ্বর্য রয়েছে তাঁর মধ্যে। তবে আমরা যেখানে যাই, সময় হয়েচে বুঝে যাই। যেখানে সাহায্য করলে সত্যকার উপকার হবে আত্মার, এ আমি মনে মনে বুঝতে পারি। সে ক্ষমতা আছে আমাদের। সেখানেই যাই শুধু। ঐ যে বল্লাম, পাপ বুঝে যে। সে পথ থেকে ফিরতে চায়, ভগবানকে মনেপ্রাণে ডাকে, বলে, আমি ভুল বুঝেচি, আমায় ক্ষমা করো, দয়া করে পথ দেখিয়ে দাও–ভগবান। সেখানে আগে ছুটে যান–তাঁর কত বড় করুণা, কত প্রেম জীবের প্রতি–তা ক’জন মানুষে বোঝে? সবাই পৃথিবীতে টাকা নিয়ে যশ নিয়ে মান নিয়ে উন্মত্ত–

    যতীন ও পুষ্প তাঁকে প্রণাম করে চলে আসতে উদ্যত হোলে তিনি ওদের দিকে চেয়ে প্রসন্ন হেসে বালিকার মত ছেলেমানুষী সুরে বল্লেন–আমার এ জায়গাটা তোমাদের কেমন লাগে?

    দুজনেই বল্লে, ভারি চমৎকার স্থান, এমন তারা কখনো দেখেনি।

    দেবী বালিকার মত খুশি হোলেন ওদের কথা শুনে। বল্লেন–মাঝে মাঝে এখানটাতে বিশ্রাম করি। তোমরা মাঝে মাঝে এসো। একাই থাকি।

    যতীন বিনীত সুরে বল্লে–গ্রহদেব বৈশ্রবণকে দেখাবেন একবার?

    করুণাদেবী হেসে বল্লেন–তোমার দেখচি বড় বড় সাধ।

    যতীন মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিল, ফেরবার পথে সে পুষ্পকে বল্লে–এমন। হোলে দেবী! কি সরলতা। জায়গাটা সম্বন্ধে আমাদের সার্টিফিকেট পেয়ে খুশি হয়ে গেলেন!

    উচ্চ স্বর্গে আজ পুষ্পকে নিয়ে গেলেন প্রেমের দেবী। বহু বিচিত্র বর্ণের মেঘের মধ্যে দিয়ে সে অপূৰ্ব্ব যাত্রা। অনন্তের জ্যোতি-বাতায়ন খুলে গিয়েচে যেন, সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে সে আলো।

    দেবী বল্লেন–সারা পৃথিবীতে প্রেমের জন্য এত দুঃখও পাচ্চে মানুষে! ইচ্ছে হয় সব মিলিয়ে দিই।

    –দেন না কেন দেবি?

    –দেই তো। কাজই ওই। আমার যা ক্ষমতা তা করি। তবে আমাদের ক্ষমতারও সীমা আছে–দেখচো তো সুধার কিছুই করতে পারচিনি। সুধার মত লক্ষ লক্ষ নরনারী পৃথিবীতে–তবে আমরা আকুপাঁকু করি নে তোমাদের মত। সময় অনন্ত, সুযোগ অনন্ত–তোমরা ভাবো অমুক দিন মরে যাবো কবে আর কাজ করবো? আমরা জগৎটাকে দেখি অন্য চোখে

    পুষ্প হেসে বল্লে–মরেচি তো অনেকদিন, তবে আর কেন এ। অনুযোগ দেবি?

    প্রণয়দেবী হঠাৎ থমকে দাঁড়িয়ে বলেন–আহা! আজ একাদশী। সুধা শুয়ে আছে ঘরে দোর দিয়ে–দেখো এখানে এসে।

    একটা আলোকের পথ যেন তৈরী হয়ে গিয়েছে এই অসীম ব্যোমের বুক চিরে। পৃথিবীর একটা ক্ষুদ্র গ্রামের ক্ষুদ্র ভাঙা কোঠার ভাঙা ঘরকে তার নোনাধরা চুণ-বালি-খসা দেওয়ালের ব্যবধান ঘুচিয়ে যুক্ত করচে অনন্ত তারালোক-খচিত মহাকাশের সঙ্গে, দেবযানের পথে।

    পুষ্পের সারাদেহ আনন্দে ও সত্যের অনুভূতিতে শিউরে উঠলো– যেখানে প্রেম, যেখানে সত্য, যেখানে গভীর রসানুভূতি বা দুঃখবোধ, সেখানে স্বর্গের সঙ্গে মর্তের যোগ ক্ষণে ক্ষণে নিবিড় হয়ে ওঠে–ওথচ সে অদৃশ্য যোগের বার্তা পৃথিবীর মানুষে জানেও না, বিশ্বাসও করে না।

    কোকিল ডাকে বৈশাখের অপরাহ্নে, ছায়াভরা মাঠে, নদীতীরে। সে সুরের মধ্যে দিয়ে পৃথিবীর বনঝোঁপ যুক্ত হয় সুরলোকের আনন্দবীণার ঝঙ্কারের সঙ্গে। কে জানে সে কথা।

    –আর একটি দেখবে? এদিকে চেয়ে দেখ–

    পুষ্প কিন্তু সে দেশ চিনতে পারলে না। খুব ফর্সা মেয়েটি, বয়স নিতান্ত কম নয়–দেখেই বোধ হয় আধ্যাত্মিক উন্নত অবস্থার মেয়ে। একটা পুরোনো সোফায় বসে বসে কি পরিষ্কার করচে। জিনিসটা পুষ্প কখনো দেখেনি, বুঝতে পারলে না।

    দেবী বল্লেন–ওর স্বামী ছিল শিকারী, কার্পেথিয়ান পৰ্ব্বতে শিকার করতে গিয়ে বুনো শূওরের হাতে মারা পড়ে। সে আজ সতেরো আঠারো বছরের কথা-স্বামীর তামাক খাবার নলটা যত্ন করে রোজ পরিষ্কার করে, ফুল দিয়ে সাজায়। সুন্দরী ছিল, বিধবা বিবাহ করবার জন্যে কত লোক ঝুঁকেছিল–কারো দিকে ফিরেও চায়নি। দুঃখকষ্ট কত পেয়ে আসছে, খেতে পায় না–তবুও স্বামী ধ্যান, স্বামী জ্ঞান।

    পুষ্প কি ভেবে বল্লে–বিবাহিত স্বামী যদি না হয়, তবে কি আপনাদের দৃষ্টি সেদিকে পড়ে না?

    প্রণয়দেবী হেসে বল্লেন–পুষ্প!

    পুষ্প সলজ্জ ভাবে চোখ নিচু করলে।

    –আমাদের অবিশ্বাস করো না, ছিঃ–আমি তোমাকে কতদিন থেকে দেখছি জানো, যতদিন তুমি পৃথিবী থেকে প্রথম এখানে এলে। যতীনের সঙ্গে আমিই তোমাকে মিলিয়ে দিয়েচি–নইলে তুমি ওর দেখা পেতে না। প্রেমের আকর্ষণ না থাকলে পৃথিবী ছেড়ে এসে সকলের সঙ্গে দেখা নাও হতে পারে।

    –এমন হয়?

    –কেন হবে না? সেই তো বেশি হয়। একটি মেয়েকে জানি, সে পৃথিবী থেকে এসেচে আজ তিনশো বছর। তার স্বামী এসেছে তার। আসবার পঁচিশ বছর পরেই। কিন্তু তাদের সঙ্গে দেখা হয়নি আজও। এই তিনশো বছর। কারণ প্রেম নেই। প্রেম না থাকলে আমরা মিলিয়ে দিই না। তাতে পরস্পরের আত্মার ক্ষতি বই লাভ হবে না কিছু।

    পুষ্প বিস্মিত হয়ে বল্লে–উঃ! তিনশো বছর স্বামী-স্ত্রীর দেখা হয়নি?

    দেবী বল্লেন–মানে, আর হবেও না। তারা কেউ নয় পরস্পরের। এতে বিস্মিত হবার কিছুই নেই। সত্যিকার প্রেম দুটি আত্মাকে পরস্পর সংযুক্ত করে। যে-প্রেম যত কামনা-বাসনাশূন্য সে প্রেম তত উঁচু। এই ধরনের প্রেমের জন্যই আমাদের কত খাটুনি।

    পুষ্প ফিরে এসে দেখলে যতীন নেই, আবার পৃথিবীতে চলে গিয়েছে আশার কাছে।

    পুষ্পের মনে কেমন একটা ব্যথা জাগলো–এতো করেও যতীনদা আপনার হোল না! পরক্ষণেই সে নিজের দুর্বলতা ঝেড়ে ফেলে দিলে। পৃথিবীর সম্পর্কে আশা বৌদিদির অধিকার তার চেয়ে অনেক বড়, অনেক ন্যায্য! ওদের পাশে গিয়ে দাঁড়াতে হবে তাকে।

    যতীন কলকাতার সেই ছোট্ট বাসাবাড়ীতে আবার এসে দাঁড়িয়েছে। নেত্য বাসাতে উপস্থিত আছে বটে কিন্তু ঘুমুচ্চে। আশা বসে বসে পরদিন রান্নার জন্যে মোচা কুটচে। যতীনের মনে হোল এমনি একদিন সে কুড়লে বিনোদপুরের বাড়ীর রোয়াকে বসে আশাকে মোচা কুটতে দেখেছিল, যতীনের মা তখন বেঁচে, পাশেই তিনিও ছিলেন বসে সেদিন। যতীন কোথা থেকে এসে হঠাৎ এ দৃশ্য দেখে বড় আনন্দ পেয়েছিল। পল্লীসংসারের সেই শান্ত পরিচিত পরিবেশ! এখনও তাই, সেই ছবিটিই অবিকল, কিন্তু কি অবস্থায়! কোথায় মা, কোথায় কুড়লে বিনোদপুরের সেই যত্নে পাতানো সংসার–কোথায় সে।

    কোথায় যেন কি অবাস্তবতা লুকিয়ে ছিল আপাতপ্রতীয়মান বাস্তবতার পেছনে। আসল রূপটি চিনতে দেয়নি সংসারের। ছেলেবেলায় শোনা যাত্রার পালার সেই গান মনে পড়লো–

    কেবা কার পর, কে কার আপন,
    কালশয্যা ‘পরে মোহতা ঘোরে,
    দেখি পরস্পরে আসার আশার স্বপন।

    সব মিথ্যে। সেই সন্ন্যাসীর দেখানো নির্বিকল্প সমাধির অবস্থা মনে পড়লো। কেউ কারো নয়। সব স্বপ্ন, সব মায়া, সব অনিত্য।

    পুষ্প এসে পাশে দাঁড়াতেই যতীনের চমক ভাঙলো। এ তো এসেছে, একে কিন্তু মিথ্যা বলে মনে হয় না তো? ‘নৈহাটির ঘাটে, বসে পৈঠার পাটে’–সেই পুষ্প কি অখণ্ড সত্যরূপে বিরাজ করচে চিরদিন এই খণ্ডিতসত্য খণ্ডিতসত্তা জীবনের আপাতপ্রতীয়মান স্থায়িত্বের মধ্যে?

    আশা মোচা কুটে উঠে নেত্যকে ডাকতে লাগলো–ওগো, ওঠো ভাত বাড়ি?

    নেত্য জড়িতস্বরে কি বল্লে, তারপর চোখ মুছতে মুছতে উঠে বসলো বিছানায়। বল্লে–কি? বাবাঃ, এতক্ষণ বসে বসে মোচা কুটলে? রাত কত?

    -তা কি করে জানবো?

    –দেখে এসো চৌধুরী মশায়ের ঘরে।

    –হ্যাঁ, এখন বুড়ো খেটেখুটে এসে শুয়েচে, আমি গিয়ে ওঠাই–

    শম্ভ চক্কত্তি আজ এসেছিল?

    –আমি জানিনে অতশত খোঁজ। এখন উঠে দয়া করে খেয়ে আমার হাত অবসর করে দাও

    এ কথার উত্তরে নেত্য আবার সটান বিছানায় শুয়ে পড়ে একটা অশ্লীল কথা উচ্চারণ করে চোখ বুজলে।

    পুষ্প বল্লে–যতীন-দা, তুমি চলে এসো, এখানে থেকো না।

    –পুষ্প তুমি চলে যাও, আমি আর একটু থাকি।

    যতীনের মুখের ও চোখের ভাব যেন কেমন। ও মোহগ্রস্ত হয়ে উঠেচে পৃথিবীর স্কুল আবহাওয়ায়। এ সব জায়গায় বেশিক্ষণ থাকা ওর পক্ষে ভালো না। চুম্বকের মত আকর্ষণ করে পৃথিবীর যত বাসনা কামনা আত্মিক লোকের জীবকে। টেনে এনে বেঁধে রাখবার চেষ্টা করে–ওপরে উঠতে দেয় না। অবিশ্যি যে বাসনা কামনা বিসর্জন দিয়েছে, সে কামচর, স্বাধীন, মুক্ত। শত পৃথিবী তাকে বাঁধতে পারে না। কিন্তু যতীনের মত আত্মার পক্ষে এমন ঘন ঘন যাতায়াত বড় বিপজ্জনক।

    পুষ্প কিছু বলবার আগেই যতীন আবার বল্লে–আমার বড় ইচ্ছে, করুণাদেবীকে আর একবার আশার বিষয় বলি। তোমার কি মত?

    –যতীনদা,তাতে ফল হবে না। আশা বৌদির কৰ্ম্ম ওকে ঘুরিয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে। কেউ কিছু করতে পারবে না। নইলে চেষ্টা তুমি আমি কম করিনি। ওর মন ওকে টানচে নিচের দিকে–অধঃপতনের পথে। বাধা দেবার সাধ্য কার! এক যদি ভগবান সাহায্য করেন, কৃপা করেন–

    কথাটা যতীনের মনঃপুত হোল না। সে বল্লেভগবান সাহায্য করলে এই অবস্থায় এসে ও দাঁড়ায় আজ? তিনি চোখ বুজে আছেন।

    পুষ্প বল্লে–ভুলে যাচ্চ যতীন-দা, ভগবান তাকেই সাহায্য করেন, যে অকপটে সৎ হবার চেষ্টা করচে তাঁর কাছে সাহায্য প্রার্থনা করে। যেচে তিনি সাহায্য করতে গেলে তাতে কোনো ফল হবে না বলেই তাঁর কাছ থেকে সাহায্য আসে না।

    -কেন?

    –যে ভগবানকে চেনে না, তাঁকে স্বীকার করে না, তার হোল। আচ্ছাদিত চেতন। তার চেয়ে যে ভালো, তাকে বলে সঙ্কুচিত চেতন। এই দুই ধরনের লোককে ভগবকথা শোনালে উল্টো উৎপত্তি হয়। আশা বৌদির আচ্ছাদিত চেতন। আলো জ্বাললে কি হবে? ঢাকনির। মধ্যে আলো সেঁধোবে না। এদের ওপরে মুকুলিত চেতন, তাদের মনে। ভগবানের জ্ঞান জাগতে সুরু করেছে। তারও ওপরে বিকচিত চেতন, সবার ওপরে পূর্ণ বিকচিত চেতন–যেমন বড় বড় ভক্ত কি সাধকেরা। কত নিচে পড়ে আছে আশা বৌদি আর নেত্যর দল ভাবো!

    যতীন কৌতুকের সুরে বল্লেও বাবা, তোমার পেটে এত! নবদ্বীপের ভট্টাচায্যিদের মত শান্তর কথা সুরু করলে যে। তোমার কী চেতন। পুষ্প, বিকচিত না পূর্ণ বিকচিত? আর আমিও বোধ হয় আচ্ছাদিত। চেতন–না, কি বলো?

    পুষ্প খিল খিল্ করে হেসে বল্লে–আলবৎ। নইলে তুমি কি ভাবো তুমি খুব উন্নতি করেচো?

    –না, তাই জেনে নিচ্চি তোমার কাছে।

    –জেনে নিতে হবে কেন, নিজে বুঝতে পারছো না, না? কখনো ভগবানকে ডেকেচ? তাঁর দিকে মন দিয়েচ জীবনে? তাঁকে বোঝবার চেষ্টা তো দূরের কথা। আমার কথা বাদ দাও যতীনদা, আমি তুচ্ছাদপি তুচ্ছ, কিন্তু বড় বড় বিদ্বান, জ্ঞানী, গুণী লোকের মধ্যেও অনেকে মুকুলিত চেতনও নয়। পূর্ণবিকচিত তো ছেড়ে দাও, বিকচিত চেতনই বা ক’জন? পৃথিবীতে বা এই লোকে কোথাও জিনিসটা পথেঘাটে মেলে না। তবে নেই তা নয়, আছে।

    –একজন তেমন লোকের কাছে একদিন নিয়ে যাবে?

    –আমার কি সাধ্যি যতীনদা? তাঁদের দেখা পাওয়া কঠিন, ধরা দিতে চান না সহজে।

    আচ্ছা, একজন মানুষকে আমি জানি–যাবে সেখানে? চলো, একটুখানি, দেখিয়ে দিই, সেখানে গিয়ে দেখে চলে আসবে, কোনো কথাবার্তা বোলো না। আশা বৌদিকে ছেড়ে একটু চলো দিকি। পৃথিবীর এ সব আবহাওয়া তোমার পক্ষে যে কত খারাপ তা তুমি বুঝতে পারবে না।

    যতীন হেসে বল্লে–কেন, ম্যালেরিয়া ধরবে?

    –আত্মারও ম্যালেরিয়া আছে। দেহ থেকে মুক্ত হয়েচ বলে গুমর কোরো না। এমন ম্যালেরিয়া ধরে যাবে মনের আত্মার যে কেঁদে কূল পাবে না যতীনদা। তখন ডাক্তার দেখাতে হোলে এই ছাই ফেলতে ভাঙা-কুলো পুষ্প হতভাগীকেই দরকার হবে।

    পৃথিবী দেখতে দেখতে নীচে মিলিয়ে গিয়েচে ততক্ষণ। সাদা সাদা মেঘ, অনন্ত আকাশ। সূর্যের আলোর রং আরও সাদা। মানুষের। স্থূল চোখ হোলে ধাঁধিয়ে যেতো। যতীন ভাবলে, এই তো রাত দেখে এলাম কলকাতা সহরে, এখানে-চোখ-ধাঁধানো সূর্যের আলো! জগতে সব ভেলকিবাজি, অথচ পৃথিবীতে বসে কিছু বোঝবার জো নেই।

    ভুবর্লোকের বিশাল আলোর সরণী দিক থেকে দিগন্তরে বিসর্পিত তাদের সামনে! বহু লোক যাতায়াত করছে, কেউ ধূসর বর্ণের, কেউ লাল মেটে সিঁদুরের রং, ক্বচিৎ কেউ নীল রঙের। পুষ্পকে যতীন বল্লে–দ্যাখো বেশির ভাগ আত্মাই কিছু ছাই রঙের আর লাল রঙের। নীলবর্ণের আত্ম পথেঘাটে কত কম।

    পুষ্প হেসে বল্লে–তুমিও ওদের দলে। ভেবো না তুমি নীলবর্ণের দেহধারী আত্মা। অনেক উঁচু জীব তাঁরা। পথে-ঘাটে তাঁদের কি ভাবে দেখবে? ও যা দেখচো, ওরাও তেমন উঁচু স্তরের নয়। পঞ্চম স্বর্গের লোকের দেহ উজ্জ্বল নীল, দামী নীল রঙের হীরের মত। সে বড় একটা দেখতে পাবে না।

    –তারও ওপরে?

    –উজ্জ্বল সাদা। ষষ্ঠ সপ্তম স্বর্গের আত্মারা দেবদেবী, তাঁদের দিকে চাইলে চোখ ধাঁধিয়ে যায়।

    –তোমার মত?

    হঠাৎ যতীন লক্ষ্য করলে সে এমন এক স্থানে এসে পড়েছে যেখানকার বায়ুমণ্ডলে একটি অদ্ভুত নিস্তব্ধতা ও পবিত্র আত্মার চিরযৌবন নির্দেশ করচে যেন। কিসের সুগন্ধ সৰ্ব্বত্র সেই গন্ধে ভরা বনপথের আবছায়া অন্ধকারে শত শত চিরযৌবনা অভিসারিকা যেন চলেছে তাদের পরমপ্রিয়ের মিলন আকাঙ্ক্ষায়, কত যুগের কত রাজ্য-সাম্রাজ্যের অতীত কাহিনীর দুঃখবেদনা যেন এর পরিবেশকে কোমল করুণ করে রেখেচে মুখে ঠিক বোঝানো যায় না, কিন্তু যতীন যেন হঠাৎ বুঝলে মনে সে অনন্তকালের শাশ্বত অধিবাসী, চিরযৌবন, অমর আত্মা–অনাদ্যন্ত বিশ্বের লীলাসহচর, সে ছোট নয়, পাপী নয়, পরমুখাপেক্ষী নয়–ভগবানের চিহ্নিত শিশু, অন্য হতভাগ্য আত্মাকে টেনে তোলবার জন্যে তার জন্মমৃত্যুর আবর্ত-পথে সুখ দুঃখময় পরিভ্রমণ।

    অদূরে একটি সাদা পাথরের মন্দির, মন্দিরের চূড়োটা তার গম্বুজের তুলনায় একটু যেন বেশি লম্বা বলে মনে হোল যতীনের। কিন্তু আশ্চর্য রকমের দুগ্ধ-ধবল কী পাথরের তৈরী, না মার্বেল, না এলাবেস্টাস, যেন স্বয়ংপ্রভ পালিশ করা স্ফটিক প্রস্তরে ওর বিমান ও জঘা গাঁথা।

    পুষ্প বল্লে–খুব বড় একজন ভক্ত সাধকের আশ্রমে তোমায় এনেচি।

    মন্দিরের চারপাশে খুব বড় বাগান। প্রায় সবই ফুলের গাছ, কিন্তু অত সুন্দর ও সুগন্ধি ফুল এ পর্যন্ত যতীনের চোখে পড়ে নি। খুব বড় উদ্যানশিল্পীর রচনার পরিচয় সেখানকার প্রতিটি ফুলগাছের সারিতে, লতাবিতানের সমাবেশে। যতীন ভাবলে–এ স্তরেও বাগান থাকে? এসব করে কে? কে গাছ পোঁতে না জানি। পৃথিবীর মত কোদাল দিয়ে মাটি কোপাতে হয় নাকি?

    পুষ্প একটি নিভৃত লতাবিতানের সামনে গিয়ে দাঁড়াল যতীনকে সঙ্গে করে।

    ভেতর থেকে কে বল্লে–এসো মা, তোমার অপেক্ষা করচি

    পুষ্প ও যতীন দুজনে লতাকুঞ্জের মধ্যে ঢুকে দেখলে একজন জ্যোতির্ময়দেহ সুশ্রী বৃদ্ধ পাথরের বেদীতে বসে। দুজনে পাদস্পর্শ করে প্রণাম করলে।

    ভুর ভুর করচে চন্দন ও ফুলের সুবাস লতাবিতানে, অথচ শৌখীন বিলাসলালসার কথা মনে হয় না সে সুগন্ধে, মনে জাগে অতীতকালের ভক্তদের প্রেমোচ্ছল অনুভূতি, মনে জাগে ভগবানের নৈকট্য, শান্ত পবিত্রতার আনন্দময় মৰ্ম্মকেন্দ্র। দিগন্তে বিলীন প্রেমভক্তির মধুর বেণুরব কান পেতে শোনো এখানে বসে বসে, শুনে নবজন্ম লাভ করো।

    বৃদ্ধ বল্লেন–আগে গোপাল দর্শন করে এসো

    মন্দিরের কাছে গিয়ে ওরা দেখলে নীল রঙের পাথরের অতি সুশ্রী একটি গোপালমূৰ্ত্তি, যেন হাসচে–এত জীবন্ত। নানা রঙের ফুল দিয়ে বিগ্রহের পাদপীঠ সাজানো, গলায় বনফুলের মালা। পুষ্প করজোড়ে কতক্ষণ ভাবে তন্ময় হয়ে দাঁড়িয়ে রইল–যতীন ভক্ত-টক্ত নয়, সে একটু অধীর ভাবেই পুষ্পের ভাব ভাঙবার প্রতীক্ষা করতে লাগলো।

    যতীন অবশেষে পুষ্পকে বল্লে–ইনি কে?

    –ইনি কে আমি জানিনে। সেকালের একজন বড় বৈষ্ণব আচার্য্য পৃথিবীতে নাকি এখনও এর আবির্ভাবের তিরোভাবের উৎসব হয়। বহুদিন পৃথিবী ছেড়ে এসেচেন।

    বৈষ্ণব সাধু জিজ্ঞেস করলেন-বিগ্রহদর্শন করলে?

    যতীন বল্লে–দেখেচি, অতি চমৎকার। প্রভু, আপনি কতদিন পৃথিবী থেকে এসেছেন?

    –অনেককাল। এখানে ওসব হিসেব রাখবার মন হয় নি, কি হবেই বা পৃথিবীর হিসেব রেখে?

    যতীনের মনে অনেক সংশয় উঁকি মারছিল। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে সে বল্লে–প্রভু, এখানেও বিগ্রহ?

    –কেন বল তো? কি আপত্তি তোমার?

    –এ তো স্বর্গ। ভগবানের সাক্ষাৎ এখানে পাওয়া যাবে। কাঠ পাথরের মূর্তি পৃথিবীতে দরকার হতে পারে, এখানে কেন?

    বৈষ্ণব ভক্তটি হেসে বল্লেন–ভগবানের সাক্ষাৎ তুমি যেভাবে বলচো। ওভাবে পাওয়া যায় কিনা জানিনে। আমি পৃথিবীতে এই বিগ্রহের পূজারী ছিলাম, বড় ভালবাসি ওকে, ছেড়ে থাকতে পারিনে–তাই এখানে এসে এই মন্দির স্থাপন করে বিগ্রহ প্রতিষ্ঠা করেচি, ওঁরই সেবা-আরাধনায় দিন কাটে বড় আনন্দে। মন্দির আর বাগান সবই মানসী কল্পনায় সৃষ্টি করেছি, এ স্বর্গে তা করা যায় তা নিশ্চয়ই জানো।

    –আজ্ঞে হ্যাঁ, তা এর নিচের স্বর্গেও দেখেচি।

    -–আমার দেবতা শুধু পাথরের নয়, জীবন্তও বটে। কিন্তু তোমাকে তো দেখাতে পারবো না। আমার মা দেখতে পারেন। দেখেচেনও। একবার।

    পুষ্প আবদারের সুরে বল্লে–আপনি দয়া করলে ইনিও দেখতে পারেন, বাবা।

    সাধু হেসে বল্লেন–ইনি দেখতে পারেন না। ইনি ভাবেন, ভগবানকে নিয়ে আমি এভাবে পুতুলখেলা করচি। বালগোপাল বড় লাজুক, এর সামনে বার হবেন না। যে তাঁকে মন অর্পণ করে ভাল না বেসেছে, বিশ্বাস না করেচে–তিনি যেচে অপমান কুড়তে যাবেন সেখানে? ভগবান যখন ইষ্টদেবের বেশে লীলা করেন কৃষ্ণ সেজে, কালী সেজে তখন তিনি মানুষের বা দেবদেবীদের মনোভাব–যেমন রাগ, লজ্জা, মান অভিমান, এমন কি ভয় পৰ্য্যন্ত পান। এই তো লীলা–এরই নাম লীলা। বিরাট ঐশী শক্তি যা বিশ্বচরাচর নিয়ন্ত্রণ করছে, তাকে কে ভালবাসতে পারে আপনার ভেবে? শত শত নক্ষত্র, শত শত সুৰ্য্য যার ইঙ্গিতে লয় হয়, যে পলকে সৃষ্টি, পলকে স্থিতি, পলকে প্রলয় করতে পারে–তাকে কে ভক্তি করতে পারে, যদি তিনি

    মন্দির থেকে চঞ্চল, মধুর, সজীব কণ্ঠে কে বলে উঠলো–ওখানে বসে বক্ব না করে এখানে এসে আমায় একবার জল খাইয়ে যাও না বাপু? তেষ্টায় মলুম–

    সাধু চমকে উঠলেন, পুষ্প ও যতীন চমকে উঠলো।

    পুষ্প হেসে বল্লে–যান, যান, জল খাইয়ে আসুন–

    যতীন অবাক হয়ে বল্লে–কে ছেলেটি?

    সাধু যতীনের মুখের দিকে চেয়ে বল্লেন–বুঝতে পারলে না? ঐ তো বালগোপাল। তোমার খুব ভাগ্য তোমাকে গলার স্বর শুনিয়ে দিলেন। আমার পুষ্প মায়ের ভাগ্য। যাই আমি

    সাধুর মুখে স্নেহ-বাৎসল্যের রেখা ফুটে উঠলো, তৃষ্ণার্ত সন্তানকে পানীয় জল দেবার ব্যাকুলতা নিয়ে তিনি মন্দিরের দিকে অদৃশ্য হোলেন।

    যতীন ভাবলে, এও পুতুলখেলা, নয় আবার!

    পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নিলে। সাধু অন্তর্যামী, সবার মনের কথা বুঝতে পারেন, অন্তত তার তো মনের অন্ধিসন্ধি খুঁজে বার করেছেন। এখানে কিছু ভাবা হবে না।

    পুষ্প হঠাৎ বলে উঠলো–মনে পড়েচে, ইনি বৈষ্ণব আচাৰ্য্য রঘুনাথ দাস।

    বেলা পড়ে যেন অপরাহ্ন হয়ে এসেচে। অপূৰ্ব্ব পুষ্প-সুবাসে আশ্রম আমোদিত। বৈষ্ণব সাধু বল্লেন–বিকেল বড় ভাল লাগে, তাই সৃষ্টি করি। নইলে এখানে আর সকাল বিকেল কি? সূৰ্য নেই, চন্দ্র নেই, অন্ধকারও নেই। হ্যাঁ, কি সংশয় তোমার, যতীন? এখনও যায়নি, অন্ধকার বড় একগুয়ে। তাড়ানো যায় না।

    –প্রভু কি করি বলুন। আপনি বৈষ্ণব আচার্য্য, কতদিনের লোক আপনি!

    –মহাপ্রভুর সমসাময়িক। সপ্তগ্রামের নাম শুনেছিলে? সেই সপ্তগ্রামে বাড়ী ছিল আমার।

    -আপনি এখানে কেন? আর সব কোথায় আপনার দলের? সাড়ে তিনশো বছর ধরে এ পুতুলখেলা নিয়ে

    –তোমার মন এখনও কাঁচা। আমি তোমাকে তো বলেছি, মুক্তি চাইনি। সপ্তগ্রামে হরিদাস শিক্ষা দিয়েছিল ভক্ত চায় ভগবানের প্রতি ভক্তি, তাঁর প্রতি যেন মন থাকে। আমাদের তাতেই আনন্দ। তাঁর ভজন। আরাধনা নিয়েই আছি। খুব সুখে আছি। মহাপ্রভু ভগবানে মিলিয়ে গিয়েছেন, তিনি নারায়ণের অংশ, মাঝে মাঝে আমাদের আহ্বানে প্রকট হন, এই আশ্রমে আসেন। তাঁহার পৃথিবী থেকে এখানে আসার দিনে আশ্রমে উৎসব হয়, সে উপলক্ষে বড় বড় বৈষ্ণব আচার্য্য এমন কি জীবগোস্বামী মীরাবাঈ পৰ্য্যন্ত আসেন। ওঁরা আরও উচ্চ লোকে আছেন। অনেকে জীবকে শিক্ষা দিতে দু-একবার ইতিমধ্যে পৃথিবীতে নেমেছিলেনও।

    –আর একটা কথা আপনাকে

    বুঝেছি। তুমি যা জিজ্ঞেস্ করবে তার মুখে উত্তর চাও, না সে জগৎ দেখতে চাও? অর্থাৎ তুমি জানতে চাইচ, পৃথিবী ছাড়া অন্য জীবলোক আছে কি না–কেমন তো? বহু বহু আছে। বিশ্বের অধিদেবতার ভাণ্ডার অনন্ত। কোনো কোনো জগৎ পৃথিবী থেকেও তরুণ, সজীব। সেখানে সব মানুষ অত্যন্ত বেশি তাড়াতাড়ি কাজ শেষ করে, তাড়াতাড়ি কাজ শেষ করে মরে যায়। আবার বৃদ্ধ জরাগ্রস্ত জগৎ আছে–সেখানে। মানুষ পৃথিবীর চেয়ে অনেক দীর্ঘজীবী, ধীরেসুস্থে জীবনের কাজ করে। পৃথিবীর হিসেবে যার বয়স পঁচিশ বছর, সেও বালক। ষাট বছর যার বয়স, সে নব্যযুবক। যাদের উন্নতি হতে দেরি হবে জানা যাচ্চে পৃথিবীতে, এমন সব আত্মাকে পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ করতে দেওয়া হয় না, দিলে সে পূৰ্ব্ব জন্মের জীবদেরই পুনরাবৃত্তি করবে মাত্র। সুতরাং তাদের এই সব ধীর সানন্দ প্রৌঢ় পৃথিবীতে পাঠানো হয়। অনেকদিন সময় পায় বলে শেখবার ও শোধরাবার অবকাশ ও সুযোগ পায়। বিশ্বের দেবতার এমন আইন, সকলেই অনন্ত মঙ্গলের পথে যেতে হবে–যে সহজে না যাবে, তাকে দুঃখ দিয়ে পীড়ন করে চোখ ফোঁটাবেনই। সেসব পৃথিবীতেও জীবশিক্ষার জন্যে উচ্চস্তরের আত্মারা নেমে যান দেহ গ্রহণ করে। পৃথিবী থেকেও বেশি কষ্ট পেতে হয় তাঁদের সে সবখানে। কিন্তু ভগবানের কাজ যাঁরা করেন, তাঁরা জানেন, দুদিনের দেহ, দুদিনের কষ্ট, দুদিনের অপমান। শাশ্বত আত্মায় কোনো বিকার স্পর্শ করে না, তার জরা নেই, মৃত্যু নেই।

    যতীন মুগ্ধ হয়ে শুনছিল মহাপুরুষের কথা, এর মধ্যে অবিশ্বাস এনে লাভ নেই। আজ তার অত্যন্ত সুদিন, এমন একজন লোকের দর্শনলাভ করেছে সে।

    বৈষ্ণব সাধু আবৃত্তি করচেন–

    মূকং করোতি বাচালং পঙ্গুং লঘয়তে গিরিং
    যৎকৃপা তমহং বন্দে পরমানন্দমাধব!

    যতীনের দিকে চেয়ে বল্লেন–তোমাকে যা কিছু বলেছি, সব তাঁর কৃপা। শ্রীধর স্বামীর ঐ শ্লোক তো শুনলে? তিনিই, মূক যে, তাকে করেন বাচাল। গোপালের এমনি কৃপা, এমনি শক্তি। তাঁর বিশ্ব, তিনি যা কিছু করতে পারেন।

    যতীন বল্লে–এ ভাবে কত কাল থাকবেন আর?

    –অনন্ত কাল থাকতে পারি, যদি তাঁর ইচ্ছা হয়।

    হঠাৎ তিনি উৎকর্ণ হয়ে বল্লেন–বৃন্দাবনে গোবিন্দ বিগ্রহের আরতি হচ্চে, চলো দেখে আসি–

    পুষ্প খুশি হয়ে বল্লে–আমাদের নিয়ে যাবেন! আপনার বড় কৃপা–

    বৈষ্ণব সাধুর জ্যোতির্ময় ঈষৎ নীলাভ দেহ ব্যোমপথে ওদের আগে আগে উড়ে চলেচে, ওরা তাঁর পেছন পেছন চলেচে। নভোচারী দু-একটি আরও অন্য আত্মাকে ওরা পরে দেখতে পেলে। যতীন কখনো বৃন্দাবন দেখেনি, তাই বৈষ্ণব সাধু ওকে চার-পাঁচটি বড় বড় গাছের ক্ষুদ্র বাগান দেখিয়ে বল্লেন–ওই দেখ চীরঘাট, ওখানে মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্য স্নান করে উঠে গোপালের দেখা পেয়েছিলেন। বড় পুণ্যস্থান, প্রণাম করো।

    তার পরেই একটা বড় মন্দিরের গর্ভগৃহে সেকালের ঝুলোনো প্রদীপের আলোয় একটি সুন্দর বিগ্রহের সামনে ওরা গিয়ে দাঁড়ালে। অনেক লোক আরতি দর্শন করচে। একটি আশ্চর্য দৃশ্য যতীন এখানে প্রত্যক্ষ করে স্বর্গ-মর্তের অপূৰ্ব্ব সম্বন্ধ দেখে অবাক হয়ে গেল। দেহধারী দর্শকদের মধ্যে বহু অশরীরী দর্শক এসে দাঁড়িয়ে বিগ্রহের আরতিদর্শন করছেন, তাঁদের মধ্যে কয়েকটি আত্মার দিব্য জ্যোতির্ময় দেহ দেখে যতীন বুঝলে, ওঁরা উচ্চ শ্রেণীর ভক্ত সাধক।

    যতীনের সঙ্গী বৈষ্ণব সাধু একজনকে দেখিয়ে বল্লেন–কবি ক্ষেমদাস। উনি বৃন্দাবনের বড় ভক্ত, এর মন্দির, এর কুঞ্জবন ছেড়ে থাকতে পারেন না।

    যতীন বল্লে–একটা কথা শুনেছিলাম, আত্মিক লোক থেকে বার বার এলে নাকি আত্মার অনিষ্ট হয়?

    সাধু বল্লেন–এসো, কবিকে প্রশ্নটা করি।

    সাধু ও ক্ষেমদাস পরস্পরকে আলিঙ্গনে আবদ্ধ করলেন। সাধুর প্রশ্ন। শুনে কবি ক্ষেমদাস হেসে বল্লেন–শ্রীরূপগোস্বামীর উজ্জ্বল নীলমণিতে গোপীদের বিরহের দশদশার বর্ণনা আছে–চিন্তা, উদ্যোগ, প্রলাপ,

    এমন কি মৃত্যুদশা, উন্মাদ রোগ পর্যন্ত। আমার এমন এক সময় ছিল। বৃন্দাবনের যমুনাতট না দেখলে প্রায় তেমনি অবস্থা-প্রাপ্তি ঘটতো। বৃন্দাবনের মত স্থানে এলে অনিষ্ট হয় না, কৃষ্ণে আসক্তি তো আত্মার ইষ্টই করে, ঊর্ধ্বলোকে নিয়ে যায়।

    বৈষ্ণব সাধু বল্লেন–কৃষ্ণে আসক্তি কৃষ্ণপদে মতি এনে দেয়। হরিদাস স্বামী কি বলেছিলেন সপ্তগ্রামে মনে নেই?

    ক্ষেমদাস বল্লেন–শুনেচি বটে। তবে মনে রাখবেন, আমি কবি ছিলাম, ভক্ত ছিলাম না আপনাদের মত। আপনারা ছিলেন শ্রীচৈতন্যের পার্শ্বচর, আপনাদের মত ভাগ্য আমি করি নি। আমার কৃষ্ণ বিশ্বের বনে বাঁশি বাজিয়ে বেড়ান, বালকস্বভাব–উদাস; কেউ যদি ডাকে তার কাছে যান, না ডাকলে আপন মনেই একা একা থাকেন। অনাদিকাল থেকে এমনি। তাঁকে যদি ভালবেসে কেউ ডাকে, তবে তিনি সঙ্গী পেয়ে খুশি হন–তিনি করুণস্বভাব, ভালবাসার বশ।

    পুষ্প বল্লে–কেন একা থাকেন? রাধা কোথায়?

    –ও সব কল্পনা। এই সব ভক্তপ্রভুরা বানিয়েছেন। কে রাধা? যে নারী ভালবাসে তাঁকে, সে-ই রাধা। সে-ই তাঁর নিত্যলীলার সহচরী। মীরাবাঈ যেমন।

    –মীরাবাঈ আছেন?

    –আছেন। তাঁরা নিত্যলীলার সহচরী ভগবানের–যাবেন কোথায়? বহু পুণ্যে তাঁদের দর্শন মেলে। বহু ঊর্ধ্বলোকে ওঁদের অবস্থিতি। আবার বিশ্ব ব্যেপে ওঁদের অবস্থান, তাও বলতে পারো। পৃথিবীর ব্যক্তিত্ব তাঁর নষ্ট হয়ে গিয়েছে বহুঁকাল, ও তো স্থূল দেহ ধরে লীলা করবার জন্যে যাওয়া। ওটা কিছু নয়। পৃথিবীর সেই মীরাবাঈকে কোথাও পাবে না। আছেন খাঁটি তিনি–অর্থাৎ যে শুদ্ধ, বুদ্ধ, চৈতন্যস্বরূপ আত্মা মীরাবাঈ সেজে অবতীর্ণ হয়েছিলেন দুদিনের জন্যে, তিনি আছেন।

    যতীন বলে উঠলো–তাই আপনার মত একজন কবি বলেছেন–All the world’s a stage, and the men and women merely players–অর্থাৎ–

    ক্ষেমদাস মৃদু হেসে বল্লেন-বুঝেচি। গভীর সত্যবাণী। নানাদিক থেকে সত্য–নানাভাবে।

    যতীন একটু বিস্ময়ের সুরে বল্লে–আপনি কি ইংরিজি জানেন?

    –ভাষার সাহায্যে বুঝি নি, তোমার মনের চিন্তা থেকে ও উক্তির অর্থ বুঝেচি। ওঁর সঙ্গে আমার দেখাও হয়েছে। পঞ্চম স্তরে কবি সম্মেলন হয়, সেখানে পৃথিবীর সব দেশের বড় বড় কবি আসেন

    যতীন ব্যাকুল আগ্রহের সুরে বল্লে, আপনি কালিদাসকে দেখেচেন? ভবভূতি?

    –সে সৌভাগ্য আমার হয়েছে। পৃথিবীর সে কালিদাস নয়–যে নিত্য মুক্ত কবি-আত্মা কালিদাসরূপে অবতীর্ণ হয়েছিলেন, সেই আত্মার সঙ্গে আমার পরিচয়। একবার নয়, অনেকবার নানা দেশে নানা প্রাকৃত দেহ ধারণ করে তিনি অবতীর্ণ হয়েছিলেন। কিন্তু আসলে তিনি অপ্রাকৃত দেহধারী চিদানন্দময় আত্মা; আজ নাম কালিদাস, কাল নাম চণ্ডীদাস, পরে ক্ষেমদাস–তাতে কি?

    –কবি-সম্মেলন হয় কোন্ সময়?

    ক্ষেমদাস জিজ্ঞেস করলেন–তুমি বুঝি নতুন এসেচ পৃথিবী থেকে? তোমার কথাতে মনে হচ্চে। এখানে সময়ের কি মাপ? কালোহ্যয়ং নিরবধিঃ–অনন্তকাল বায়ুর মত শন শন বইচে। বিদগ্ধমাধবে। শ্রীরূপগোস্বামী বলেচেন তাই–অনৰ্পিতচরীং চিরাৎ–রূপগোস্বামীও কবি, তিনিও আসেন। আর তুমি জানো না, যাঁর সঙ্গে এসেচ এই আচার্য্য রঘুনাথ দাসও কবি? এঁর রচিত চৈতন্যস্তবকল্পবৃক্ষ কি পড়ে থাকবে? পড়ে বলে মনে হচ্চে না। শোনো তবে–

    কচিন্মিশ্রাবাসে ব্রজপতিসুতস্যোরবিরহাৎ
    শ্লথাৎ শ্ৰীসন্ধিত্বাদ্দধতি দৈর্ঘ্যং ভূজপদোঃ।

    কেমন ছন্দ? কেমন লাগচে ওঁর শ্লোক?

    যতীন বিষণ্ণমুখে বল্লে–আজ্ঞে বেশ!

    বৃন্দাবনের গোবিন্দ-মন্দিরের আরতি বহুক্ষণ থেমে গিয়েছে। পাশের রাজপথ দিয়ে দু একখানা গাড়ী যাতায়াত করচে, মন্দিরের বড় বড় দরজায় আলো জ্বলচে, কোথা থেকে উগ্র বকুল ফুলের গন্ধ ভেসে আসচে বাতাসে, মন্দিরের সামনে একটা হিন্দুস্থানী টাঙ্গাওয়ালা যাত্রীর সঙ্গে ভাড়া নিয়ে বকাবকি করচে। যতীন ভাবলে, স্বর্গ-মর্তের কি অদ্ভুত সম্বন্ধ! অথচ বেঁচে থাকতে পৃথিবীর লোকে কেউ এ রহস্য জানে না। মৃত্যুভয়ে ভীত হয়, এত বড় জীবনের খবর যদি কেউ রাখতো, প্রেম-ভক্তির এ সম্পর্ক যদি রাখতে জানতো ভগবানের সঙ্গে–তবে কি তুচ্ছ বিষয়-আশয়, টাকা-কড়ি, জমিদারী নিয়ে ব্যস্ত থাকে? এই মাত্র যে লোকটা সামনের রাস্তা দিয়ে মোটর চড়ে গেল। ও হয়তো একজন মাড়োয়ারী মহাজন, সারাজীবন ব্যাঙ্কে টাকা মজুত করে এসেচে–জীবনের অন্য কোনো অর্থ ওর জানা নেই, কেবল তেজীমন্দী, লাভলোকসান এই বুঝেচে। জয়পুর শহরে হয়তো ওর সাততলা অট্টালিকা। কিন্তু হয়তো ছেলে গুলো অবাধ্য বেশ্যাসক্ত, স্ত্রী কুচরিত্রা। মনে সুখ নেই–অথচ ওকি জানে, এই পাশেই মদনমোহনের মন্দিরে এই গভীর রাত্রে ভিন্ন ভিন্ন লোকের কবি সাধুরা আজ সমবেত হয়েচেন, সেখানে পুষ্পের মত নারীর স্নেহ, কত শতাব্দীর পার থেকে ভেসে আসা অমর মহাপুরুষদের বাণী, বকুলপুষ্পের সুবাস, ভগবানে অর্পিত মধুর প্রেমভক্তির পরিবেশ–এইখানেই স্বর্গ-মর্তের বিশাল ব্যবধান রচনা করেচে। হায় অন্ধ পৃথিবীর মানুষ।

    ⤶ ⤷
    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleইছামতী – বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
    Next Article অপরাজিত – বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়

    Related Articles

    ছোটগল্প বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়

    কাদা kada

    August 11, 2025
    উপন্যাস কল্লোল লাহিড়ী

    ইন্দুবালা ভাতের হোটেল – কল্লোল লাহিড়ী

    May 28, 2025
    উপন্যাস বুদ্ধদেব গুহ

    কোয়েলের কাছে – বুদ্ধদেব গুহ

    May 23, 2025
    উপন্যাস সত্যজিৎ রায়

    রবার্টসনের রুবি – সত্যজিৎ রায়

    April 3, 2025
    উপন্যাস সত্যজিৎ রায়

    বোম্বাইয়ের বোম্বেটে – সত্যজিৎ রায়

    April 3, 2025
    উপন্যাস সত্যজিৎ রায়

    রয়েল বেঙ্গল রহস্য – সত্যজিৎ রায়

    April 3, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Generic selectors
    Exact matches only
    Search in title
    Search in content
    Post Type Selectors
    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    সাহিত্যিকদের ছদ্মনাম

    October 28, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    সাহিত্যিকদের ছদ্মনাম

    October 28, 2025
    Our Picks

    সাহিত্যিকদের ছদ্মনাম

    October 28, 2025

    অ্যারিস্টটলের পলিটিক্স ও অন্যান্য প্রসঙ্গ – বার্ট্রান্ড রাসেল

    October 28, 2025

    আলস্যের জয়গান – বার্ট্রান্ড রাসেল

    October 28, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    • Sign Up
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }