Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    আসমানীরা তিন বোন – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025

    ইস্টিশন – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025

    উড়ালপঙ্খী – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • English Books
      • Jules Verne
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    দেয়াল – হুমায়ূন আহমেদ

    হুমায়ূন আহমেদ এক পাতা গল্প214 Mins Read0
    ⤶ ⤷

    ০৪. মার্চ মাস

    মার্চ মাস।

    সে বছর মার্চ মাসে অস্বাভাবিক গরম পড়েছিল। আকাশ থেকে রোদের বদলে আগুন ঝরছে। গাছের কোনো পাতাই নড়ছে না। আসন্ন দুর্যোগে ঝিঁঝিঁপোকা দিনেরবেলা ডাকে। এখন তা-ই ডাকছে।

    প্রচণ্ড গরমে কালো পোশাক পরা আর্টিলারির প্রধান মেজর ফারুক খুব ঘামছেন। গায়ের কালো শার্ট ভিজে উঠেছে। তিনি আকাশের দিকে তাকালেন। আকাশ মেঘে ঢাকা। গত কয়েকদিন ধরেই আকাশ মেঘাচ্ছন্ন, কিন্তু বৃষ্টি হচ্ছে না। মেঘের কারণেই গরম বাড়ছে। গ্রীন হাউস ইফেক্ট! একসময় নাকি পৃথিবীর গরম বাড়তে বাড়তে এমন হবে যে, মানুষ ও পশুপাখির বাসের অযোগ্য হবে। ফারুকের মনে হচ্ছে সেই দিন বেশিদূর না।

    মেজর ফারুক দলবল নিয়ে চট্টগ্রামের হাটহাজারীর জঙ্গলে। তাঁর শীতকালীন রেঞ্জ ফায়ারিংয়ের শিডিউল। মার্চ মাসে শীত নেই। চামড়া পোড়ানো গরম পড়েছে। সকালবেলা মাঝারি পাল্লার কামানে কয়েক দফা গুলি চালানো হয়েছে। জোয়ানরা তার মতোই ক্লান্ত। তিনি সুবেদার মেজর ইশতিয়াককে ডেকে বললেন, আজকের মতো ফায়ারিং বন্ধ।

    ইশতিয়াক বলল, স্যারের কি শরীর খারাপ করেছে?

    ফারুক বললেন, আই অ্যাম ফাইন। গেট মি এ গ্লাস অব ওয়াটার।

    তার জন্যে তৎক্ষণাৎ পানি আনা হলো। পানির গ্লাসে বরফের কুঁচি ভাসছে। ফারুক গ্লাস হাতে নিয়েও ফেরত পাঠালেন।

    ইশতিয়াক বলল, স্যার, পানি খাবেন না?

    ফারুক বললেন, না। একজন সৈনিক সর্ব অবস্থার জন্যে তৈরি থাকবে। সামান্য গরমে কাতর হয়ে বরফ দেওয়া পানি খাবে না।

    বরফ ছাড়া পানি দেই?

    না। মুক্তিযুদ্ধের সময় একনাগাড়ে দুদিন পানি না-খেয়ে ছিলাম।

    ইশতিয়াক বলল, পানি ছাড়া কেন ছিলেন স্যার? বাংলাদেশে তো পানির অভাব নেই।

    যেখানে ছিলাম সেখানে সুপেয় পানির অভাব ছিল। সবই পাট পচা নোংরা পানি। ভাগ্যিস পানি খাই নি। যারা খেয়েছিল তারা সবাই অসুস্থ হয়ে পড়েছিল। সেবার আমাদের হাতে অল্পবয়সী একজন পাকিস্তানি ক্যাপ্টেন ধরা পড়েছিল। তার সঙ্গে ছিল বোতলভর্তি পানি। দাঁড়াও, তার নামটা মনে করি। এস দিয়ে নাম। ইদানীং কেন যেন পুরনো দিনের কারোর নামই মনে পড়ে না। যাক, মনে পড়েছে। সামস। রাজপুত্রের মতো চেহারা। মাইকেল এঞ্জেলোর ডেভিডে খুঁত থাকলেও তার কোনো খুঁত ছিল না। খাড়া নাক, পাতলা ঠোঁট, মাথার চুল কোঁকড়ানো, আবু লাহাবের মতো গায়ের রঙ।

    স্যার, আবু লাহাব কে?

    আমাদের প্রফেটের চাচা। ওই সূরা নিশ্চয়ই পড়েছ—আবু লাহাবের দুই হস্ত ধ্বংস হোক এবং সে নিজেও ধ্বংস হোক।

    পড়েছি স্যার। সূরা লাহাব।

    লাহাব শব্দের অর্থ আগুন। ‘আবু লাহাব’-এর অর্থ আগুনের পিতা। লাহাবের গাত্রবর্ণ ছিল আগুনের মতো। ক্যাপ্টেন সামসের গায়ের বর্ণও তা-ই। সঙ্গে ক্যামেরা থাকলে তার একটা ছবি তুলে রাখতাম। মুক্তিযুদ্ধের সময় সবচেয়ে যে জিনিসটার অভাব অনুভব করেছি তা হলো একটা ভালো ক্যামেরা। ছবি তোলার মতো অপূর্ব সব সাবজেক্ট পেয়েছি। সমস্যা হচ্ছে, সৈনিকের হাতে রাইফেল মানায়। ক্যামেরা মানায় না। এখন অবশ্যি আমার সঙ্গে ক্যামেরা আছে। লাইকা নাম। জার্মানির ক্যামেরা। কিন্তু ছবি তোলার সাবজেক্ট পাচ্ছি না।

    সুবেদার মেজর ইশতিয়াক বিনীত গলায় বলল, স্যার, এক গ্লাস পানি খান। বরফ ছাড়া এক গ্লাস পানি দিতে বলি?

    না। ক্যাপ্টেন সামসের গল্পটা শোনো। আমি তার পানির বোতলের সবটা পানি ঢকঢক করে খেয়ে ফেললাম। তাকে বললাম, থ্যাংক যু। ইউ সেভড মাই লাইফ। পানির বদলে তুমি কিছু চাও?

    সে বলল, Yes! I also want to save my life.

    আমি বললাম, এটা সম্ভব না। কিছুক্ষণের মধ্যেই তোমাকে হত্যা করা হবে।

    সে কিছুক্ষণ শিশুর দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে থাকল। শিশুর দৃষ্টির অর্থ হচ্ছে, তুমি কী বলছ আমি বুঝতে পারছি না। আমাকে বুঝিয়ে বলল।

    সে বলল, আমার হাতে কতক্ষণ সময় আছে?

    আমি বললাম, আধ ঘণ্টা ম্যাক্সিমাম।

    সে বলল, এক কাপ কফির সঙ্গে একটা সিগারেট খেতে চাই।

    চা-কফি নেই। তোমাকে সিগারেট দিতে পারব।

    আমি কে-টু সিগারেটের প্যাকেট তার দিকে বাড়িয়ে দিলাম। তাকে বললাম, মৃত্যুর জন্যে তৈরি হওয়ামাত্র আমাকে বলবে।

    সামস বলল, একজন সৈনিক সবসময় মৃত্যুর জন্যে তৈরি।

    পাকিস্তানি ওই ক্যাপ্টেনের কথা আমার মনে ধরেছিল। এখনো সুযোগ পেলেই আমি বলি, একজন খাঁটি সৈনিক সবসময় মৃত্যুর জন্যে তৈরি। একজন আঁটি সৈনিক যুদ্ধ ছাড়াও সারা জীবন রণক্ষেত্রে কাটায়।

    পাকিস্তানি ওই ক্যাপ্টেনের মৃত্যুর জন্যে কি আপনার কোনো অনুশোচনা আছে?

    ফারুক বললেন, অনুশোচনা নেই। তাকে আমি নিজের হাতে গুলি করি। ওই ক্যাপ্টেন আমাদের অনেক মেয়েকে রেপ করেছে। তার অভ্যাস ছিল রেপ করার পর পর সে কামড়ে মেয়েদের স্তনের বোটা ছিঁড়ে নিত। এটা ছিল তার ফান পার্ট।

    ইশতিয়াক বলল, কী বলেন স্যার!

    যুদ্ধ ভয়াবহ জিনিস ইশতিয়াক। যুদ্ধে ফান পার্ট লাগে। যাই হোক, এখন এক গ্লাস পানি খাব। বরফ দিয়েই খাব। একটা জিপ রেডি করতে বলল। আমি হালিশহর যাব। একজনের সঙ্গে দেখা করব। তবে রাতেই ফিরব।

    স্যার, আমি কি সঙ্গে যাব?

    যেতে পারো।

    হালিশহরে কার কাছে যাবেন?

    একজন পীর সাহেবের কাছে যাব। তিনি জন্মান্ধ। বিহারি। কোরানে হাফেজ বলে অনেকেই তাকে ‘আন্ধা হাফেজ’ও ডাকে। তুমি কি তার বিষয়ে কিছু জানো?

    জি-না স্যার।

    আমার জানামতে তিনি একমাত্র মানুষ যিনি ভবিষ্যৎ চোখের সামনে দেখেন। আল্লাহপাক অল্প কিছু মানুষকে অলৌকিক ক্ষমতা দিয়ে পাঠান। তিনি তাঁদের একজন।

    বলেন কী স্যার!

    আমি তোমাকে সত্যি কথা বলছি। ভালো কথা, আমিও যে পীরবংশের সন্তান তা কি জানো?

    জি-না স্যার।

    আমি পীরবংশের। বংশের ধারা অনুযায়ী আমি এখন গদিনশীন পীর। অথচ আমার কোনোই ক্ষমতা নেই। এটা একটা আফসোস। তবে আফসোস থাকা ভালো। মানুষ একমাত্র প্রাণী যে পুরোপুরি সফল জীবন পার করার পরেও আফসোস নিয়ে মৃত্যুবরণ করে।

    ইশতিয়াক বলল, স্যার, আপনি মাঝে মাঝে ফিলোসফারদের মতো কথা বলেন।

    মেজর ফারুক দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে বললেন, সরি ফর দ্যাট! একজন সৈনিক সবসময় সৈনিকের মতো কথা বলবে। ফিলোসফারদের মতো বা রাজনীতিবিদদের মতো কথা বলবে না।Thate both the classes.

    ইশতিয়াক বলল, স্যার, একটা কথা বলি?

    ফারুক বললেন, বলো।

    আপনি প্রায়ই মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে চমৎকার সব গল্প করেন, কিন্তু আপনি মুক্তিযুদ্ধে খুব অল্প সময় ছিলেন। আপনি যুদ্ধে গেলেন নভেম্বরের শেষ দিকে। দেশ স্বাধীন হলো ডিসেম্বরে।

    ফারুক বললেন, তুমি কি আমার গল্প অবিশ্বাস করছ?

    জি-না স্যার।

    একটি যুদ্ধে চব্বিশ ঘণ্টায় অনেক কিছু ঘটে যেতে পারে। পারে না?

    পারে স্যার।

    ক্যাপ্টেন শামস নিয়ে আমি প্রায়ই যে গল্পটি করি তা অনরেকর্ড আছে। জেনারেল ওসমানির যুদ্ধকালীন আর্কাইভ। Do you understand?

    Yes sir.

    অতিরিক্ত চালাক হয়ো না। সেনাবাহিনী অতিরিক্ত চালাকদের জন্যে নয়।

    স্যরি স্যার।

     

    টিনের বেড়া, টিনের চালা। ছোট্ট কামরা। দড়ির চারপাইয়ের এক কোনায় প্রচণ্ড গরমেও উলের চাদর গায়ে আন্ধা পীর বসে আছেন। চারপাইয়ের এক কোনায় বিশাল হারিকেন। হারিকেনের কাচ ঠিকমতো লাগানো হয় নি বলে বুনকা বুনকা ধোঁয়া বের হচ্ছে। বাতাসের কারণে ধোয়া যাচ্ছে আন্ধা পীরের নাকেমুখে। তাতে তাঁকে ব্ৰিত মনে হচ্ছে না। চাদরের বাইরে তার ডানহাত বের হয়ে আছে। হাতে মোটা দানার তসবি। দানাগুলির একেকটির রঙ একেক রকম।

    মেজর ফারুকের হঠাৎ মনে হলো, এ রকম একটি তসবি ফরিদা পেলে খুশি হতো। মালা বানিয়ে গলায় পরত। এ ধরনের চিন্তা মাথায় আসায় ফারুক খানিকটা লজ্জিত বোধ করলেন। ফারুক বললেন, পীর সাহেব। আসসালামু আলায়কুম।

    আন্ধা হাফেজ সালামের জবাবে মাথা নাড়লেন। মুখে সালামের উত্তর দিলেন।

    আন্ধা হাফেজ পরিষ্কার শুদ্ধ উর্দুতে বললেন (বিহারিরা শুদ্ধ উর্দু জানে না), আপনি সৈনিক মানুষ। আপনি কষ্ট করে আমার কাছে এসেছেন। আমি আপনার জন্যে কী করতে পারি বলুন।

    হুজুর! আমি সৈনিক মানুষ, তা কী করে টের পেলেন?

    আন্ধা হাফেজ হাসতে হাসতে বললেন, আমি কোনো আধ্যাত্মিক ক্ষমতায় এই সংবাদ পাই নি। আপনি বুট পায়ে দিয়ে এসেছেন, বুটের শব্দে টের পেয়েছি। বুট জোড়া খুলে আমার পাশে বসুন।

    ফারুক তা-ই করলেন। আন্ধা পীর বললেন, সৈনিকদের সম্পর্কে একটি রসিকতা শুনবেন?

    শুনব।

    বলা হয়ে থাকে, সৈনিকদের বুদ্ধি থাকে হাঁটুতে। এটা ঠিক না। তাদের বুদ্ধি থাকে বুটজুতায়। যখন তারা বুট পরে, তখন তারা বুদ্ধিশূন্য মানুষে পরিণত হয়। তখন তাদের বুদ্ধি চলে যায় বুটজুতায়। এই কারণে কোনো সৈনিক যখন আমার কাছে আসে, আমি তাকে বুট খুলে আমার কাছে বসতে বলি। এখন বলুন, আমার কাছে কেন এসেছেন?

    ফারুক বললেন, আমি একটা কাজ করার পরিকল্পনা করেছি। আপনার দোয়া নিতে এসেছি।

    আন্ধা পীর বললেন, আপনার ডানহাতটা আমার দিকে বাড়ান। আমি ধরে দেখি।

    ফারুক হাত বাড়ালেন। আন্ধা পীর দুই হাতে ফারুকের হাত ধরলেন।

    সাংবাদিক অ্যান্থনি ম্যাসকারেনহাসের কাছে দেওয়া বর্ণনায় মেজর ফারুক হাত ধরাধরির এই অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেছেন, হঠাৎ তার মনে হলো শরীর দিয়ে যেন হাইভোল্টেজের বিদ্যুৎ প্রবাহিত হলো। কিছুক্ষণের জন্যে মনে হলো তাঁর শরীর অবশ হয়ে গেছে।

    মেজর ফারুকের বর্ণনার সঙ্গে বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রধান ঔপন্যাসিক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় ও সাধক অনুকূল ঠাকুরের প্রথম সাক্ষাতের মিল আছে। শীর্ষেন্দু লিখেছেন, ঠাকুর আমার গায়ে হাত রাখামাত্র আমার শরীরের ভেতর দিয়ে হাইভোল্টেজের বিদ্যুৎ প্রবাহিত হলো। কিছুক্ষণের জন্যে মনে হলো আমার শরীর অবশ হয়ে গেল।

     

    আন্ধা হাফেজ ফারুকের হাত ছেড়ে দিয়ে বললেন, আপনার পরিকল্পনা অতি বিপজ্জনক এবং অতি ভয়ঙ্কর। কাজটি যদি আপনি নিজের কোনো স্বার্থসিদ্ধির জন্যে না করেন তাহলে সফলকাম হবেন এবং বিপদেও পড়বেন না। তবে সময় এখনো আসে নি। যে-কোনো কাজের জন্যে নির্ধারিত সময় আছে।

    ফারুক বললেন, নির্দিষ্ট সময় সম্পর্কে আপনি কি আমাকে জানাবেন?

    জানাব।

    ফারুক বললেন, যদি ইজাজত দেন তাহলে আমি উঠব।

    আন্ধা হাফেজ মাথা নাড়লেন এবং ফারুকের দিকে হাতের তসবি এগিয়ে দিলেন। ক্ষীণ গলায় বললেন, আমার সামান্য উপহার গ্রহণ করুন। এই উপহার আপনার কোনো কাজে আসবে না, তা জানি। তবে আপনার প্রিয় কাউকে উপহার দিতে পারেন। একই জিনিসের নানান ব্যবহার হয়ে থাকে। যে লাঠি দিয়ে অন্ধ মানুষ পথ চলে, সেই লাঠি দিয়ে মানুষও খুন করা যায়। হাতের তসবি গলার মালাও হতে পারে।

    আন্ধা হাফেজের কথার মাঝখানেই চারপাইয়ের নিচ থেকে দুটি বিড়াল লাফ দিয়ে হাফেজের দু’পাশে বসল। ফারুকের মনে হলো বিড়াল দুটিও অন্ধ।

     

    জিপ শহরের দিকে ছুটে চলেছে। ফারুক চোখ বন্ধ করে বসে আছেন। তাঁকে খুবই ক্লান্ত মনে হচ্ছে। আকাশে ঘনঘন বিজলি চমকাচ্ছে। ঠান্ডা বাতাসও ছেড়েছে, মনে হয় দূরে কোথাও বৃষ্টি হচ্ছে। বৃষ্টি কি দূরেই হতে থাকবে? নাকি এগিয়ে আসবে?

    বড় ধরনের ঝাঁকি খেয়ে জিপ থেমে গেল। ফারুক বললেন, সমস্যা কী?

    ড্রাইভার বলল, চাকা পাংচার হয়েছে স্যার। স্পেয়ার আছে। দশ মিনিট লাগবে।

    ফারুক সিগারেট ধরাতে ধরাতে বললেন, Take your time.

    ইশতিয়াক বলল, স্যার কি জিপ থেকে নামবেন?

    ফারুক জবাব দিলেন না। সিগারেটে টান দেওয়ামাত্র তাঁর মাথায় আবারও পুরোনো পরিকল্পনা চলে এসেছে। শেখ মুজিবকে হত্যা করে দেশে একনায়কতন্ত্রের অবসান ঘটানো।

    পরিকল্পনা এখন ঈগল পাখি। পাখির দুটি ডানার একটি ডানা হলো সামরিক। হত্যা কীভাবে করা হবে? কারা করবে? দ্বিতীয় ডানা হচ্ছে রাজনৈতিক। এত বড় ঘটনা রাজনৈতিকভাবে কীভাবে সামাল দেওয়া হবে? এই দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে তাঁর ভায়রা ভাই মেজর রশীদকে। সে ইতিমধ্যে কাজ শুরু করেছে। তার ওপর ভরসা করা যায়।

    কাগজে-কলমে করা নিখুঁত পরিকল্পনা বাস্তবে ভেস্তে যায়। তুচ্ছ কারণেই ঘটে। A kingdom is lost for a nail.

    পরিকল্পনা কী কী কারণে জলে ভেসে যেতে পারে ফারুক তা ভাবার চেষ্টা করছেন।

    ১. পরিকল্পনা বাস্তবায়নের আগেই প্রকাশ পেয়ে যাবে। পরিকল্পনাকারীরা ধরা খাবে। তাদের কোর্টমার্শাল হবে। পাকিস্তানি ক্যাপ্টেন সামস যেভাবে হতভম্ব চোখে পিস্তলের নলের দিকে তাকিয়ে ছিল, তাকেও সেইভাবেই কোনো এক পিস্তলের নলের দিকে তাকিয়ে থাকতে হবে।

    ২. মূল পরিকল্পনা অতি অল্পকিছু মানুষকে জানানো হবে, যাদের দিয়ে কার্যসমাধা করতে হবে। তারা বেঁকে বসতে পারে। তারা বলতে পারে, বঙ্গবন্ধুকে হত্যার প্রশ্নই ওঠে না।

    ৩. ফারুকের হাতে ট্যাঙ্কবহর আছে। মিসরের প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদাত ত্রিশটি টি-৫৪ ট্যাঙ্ক এবং চার শ’ রাউন্ড ট্যাঙ্কের গোলা বাংলাদেশকে উপহার হিসেবে দিয়েছেন। গোলা এখন গাজীপুর অর্ডিন্যান্স ফ্যাক্টরিতে তালাবন্ধ।
    ফারুক ট্যাঙ্কবাহিনীর প্রধান, কিন্তু তার ট্যাঙ্ক গোলাশূন্য। এমনকি মেশিনগানের গুলি পর্যন্ত নেই। এই ট্যাঙ্ক আর খেলনা ট্যাঙ্ক তো একই।

     

    জিপ চলতে শুরু করেছে। জিপের চাকা কখন বদল হয়েছে, কখন জিপ চলতে শুরু করেছে, ফারুক কিছুই জানেন না। তিনি এতক্ষণ ছিলেন ঘোরের মধ্যে। হঠাৎ ঘোর কেটেছে।

     

    ফারুক আনন্দে অভিভূত হলেন। কারণ, আকাশ ভেঙে বৃষ্টি নেমেছে। ঝুম বৃষ্টি। তার ইচ্ছা করছে জিপ থামিয়ে কিছুক্ষণ রাস্তায় নেমে বৃষ্টিতে ভিজেন। তিনি বৃষ্টিবিষয়ক একটি বিখ্যাত কবিতা মনে করার চেষ্টা করছেন। কিছুতেই মনে পড়ছে। শুধু একটা লাইন মনে আসছে-বৃষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর নদেয় এল বান।

     

    খন্দকার মোশতাকের আগামসি লেনের বাড়ির দোতলায় মেজর রশীদ বসে আছেন। তাঁর গায়ে সামরিক পোশাক না। তিনি আজ নকশিদার পাঞ্জাবি পরেছেন। মাথায় কিস্তি টুপি পরেছেন। তাঁকে দেখে মনে হবে কিছুক্ষণ আগে তিনি একবার নামাজ শেষ করে বন্ধুর বাড়িতে বেড়াতে এসেছেন।

    মেজর রশীদ বললেন, দেশের মহাবিপদ যদি কখনো হয় আমরা কি আপনাকে পাব?

    খন্দকার মোশতাক জবাব দিলেন না। ফরসি হুক্কা টানতে লাগলেন। অতিরিক্ত গরমের কারণে খন্দকার মোশতাকের গায়ে পাতলা স্যান্ডোগেঞ্জি। মাথায় নেহেরু টুপি। তাঁর আশা ছিল এই টুপি দেশে জনপ্রিয় হবে। তা হয় নি। মুজিবকোট জনপ্রিয় হয়েছে। কালো রঙের এই কোট পরলে নিজেকে পেঙ্গুইন পাখির মতো লাগে। তারপরেও কপালের ফেরে পরতে হয়।

    মেজর রশীদ বললেন, আমি আপনাকে একটি প্রশ্ন করেছিলাম, আপনি জবাব দেন নি। প্রশ্নের জবাব জানা বিশেষ প্রয়োজন। প্রশ্নটা আবার করছি। দেশের পরম সংকটে আমরা কি আপনাকে পাব?

    খন্দকার মোশতাক বললেন, আমরা মানে কারা?

    সেনাবাহিনী।

    খন্দকার মোশতাক মূল প্রশ্ন এড়িয়ে গিয়ে বললেন, গরম কী পড়েছে দেখেছেন? ফ্যানের বাতাসে লু হাওয়া।

    রশীদ বললেন, লু হাওয়া বইতে শুরু করেছে। এই অবস্থায় দেশপ্রেমিকদের কর্তব্য কী?

    খন্দকার মোশতাক বললেন, খানা খান। খানা দিতে বলি।

    খানা খাব না। আমি আপনার কাছে খানা খেতে আসি নি। গুরুত্বপূর্ণ আলোচনার জন্যে এসেছি।

    মোশতাক বললেন, বাড়িতে আজ মোরগপোলাও হয়েছে। খেয়ে দেখেন, মুখে অনেক দিন স্বাদ লেগে থাকবে। তা ছাড়া আপনি গুরুত্বপূর্ণ কথা বলতে এসেছেন। খেতে খেতে বলুন। আমি এখন হা-না কিছু বলব না। আমি শুধু শুনে যাব।

    মেজর রশীদ বললেন, আপনার সম্পর্কে একটি বিশেষ গল্প প্রচলিত। গল্পটির সত্য-মিথ্যা আপনার কাছ থেকে শুনতে চাই।

    খন্দকার মোশতাক শীতল গলায় বললেন, কী গল্প?

    একবার নাকি আপনি, পরিকল্পনা পরিষদ প্রধান ড. নুরুল ইসলাম এবং বঙ্গবন্ধু নাশতা খাচ্ছিলেন। হঠাৎ বঙ্গবন্ধু বললেন, গত রাতে আমি অদ্ভুত এক স্বপ্ন দেখেছি।

    আপনি জানতে চাইলেন, কী স্বপ্ন?

    বঙ্গবন্ধু বললেন, আমি স্বপ্নে দেখলাম, আল্লাহপাক আমাকে কোরবানির নির্দেশ দিলেন। তারপর ঘুম ভেঙে গেল। এখন আমি কোরবানি দিতে প্রস্তুত। কোরবানি দিতে হয় সবচেয়ে প্রিয়জনকে। এই মুহূর্তে আমার সবচেয়ে প্রিয়জন হলো খন্দকার মোশতাক। ভাবছি তাকেই কোরবানি দিব।

    মেজর রশীদ কথা শেষ করে তাকিয়ে রইলেন। খন্দকার মোশতাক বললেন, শেখ মুজিবের কোনো রসবোধ নেই। ভুল সময়ে ভুল রসিকতা করে তিনি আনন্দ পান। আর আমরা পেঙ্গুইনরা তাঁকে আনন্দ দেওয়ার জন্যে প্রস্তুত থাকি। এটা আমাদের নিয়তি।

    মেজর রশীদ বললেন, গল্পটায় কি সত্যতা আছে?

    না।(১)

     

    বঙ্গবন্ধুর ধানমন্ত্রি বত্রিশ নম্বর বাড়িতে এসেছেন RAW (ভারতের সিক্রেট সার্ভিস)-এর রিসার্চ ও অ্যানালাইসিস উইংয়ের পরিচালক কাও। তিনি এসেছেন পানবিক্রেতার ছদ্মবেশে।(২)

    শেখ মুজিবুর রহমান বিরক্ত গলায় বললেন, আমি আপনাকে চিনি। অনেকেই আপনাকে চেনে। আপনার ছদ্মবেশ ধরার প্রয়োজন পড়ল কেন?

    কাও বললেন, মাঝে মাঝে নিজেকে অন্যরকম ভাবতে ভালো লাগে বলেই ছদ্মবেশ। আপনাকে উৎখাতের ষড়যন্ত্র হচ্ছে। মেজর রশীদ, ফারুক, লে. কর্নেল ওসমানী এই নিয়ে আলোচনায় বসেন জেনারেল জিয়াউর রহমানের বাসায়। এই বিষয়ে আপনাকে তথ্য দিতে এসেছি।

    শেখ মুজিব বললেন, আপনারা অতিরিক্ত সন্দেহপ্রবণ। পানবিক্রেতার ছদ্মবেশে যে আমার কাছে তথ্য দিতে আসে তার কথায় আমার বিশ্বাস নেই।

    আপনার সামনে মহাবিপদ।

    মহাবিপদ আমি পার করেছি। পাকিস্তানের কারাগারে যখন ছিলাম তখন বিপদ আমার ঘাড়ে বসে ছিল। এখন বিপদ ঘাড় থেকে নেমেছে।

    ঘাড় থেকে নামে নি স্যার।

    শেখ মুজিব বললেন, যাদের কথা আপনি বলছেন তারা আমার সন্তানসম। আমি এই আলোচনা আর চালাব না। আমার শরীরটা ভালো না। যদি কিছু মনে না করেন তাহলে আমি ঘুমুতে যাব।

    স্যার, আপনি ভুল করছেন।

    ভুল আমি করছি না। আপনারা করছেন।

    আমার কথা আপনি আমলে নিচ্ছেন না—ভালো কথা। পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থার কথা কি আমলে নেবেন?

    শেখ মুজিব উঠে দাঁড়ালেন। পানবিক্রেতার সঙ্গে আলাপ চালিয়ে যাওয়া তার কাছে অর্থহীন মনে হলো।

    ——-

    সূত্র-১: গল্পটির সত্যতা আছে। বাংলা একাডেমী পত্রিকা উত্তরাধিকার, শ্রাবণ সংখ্যা, ১৪১৭ দ্রষ্টব্য।

    সূত্র-২: Inside RAW, the Story of India Secret Service. Asoka Raina. Vikas Publication, New Delhi, India.
    RAW agents received information of a meeting between Major Rashid, Major Farooq and Lt Col Usmani at Zia-ur-Rahman’s residence. The decision, among other things, had centred on the coup. During the three-hour meeting one of the participants had doodled on a scrap of paper, which had been carelessly thrown into the waste basket. The scrap had been collected from the rubbish pile by a clerk and passed on to the RAW operative. The information finally reached New Delhi.
    Kao, convinced that a coup was in the offing, flew into Dacca, under cover of a pan exporter. After his arrival at Dacca, he was driven to a rendezvous arranged beforehand. Mujib is reported to have found the exercise highly dramatic and just could not understand why kao could not have come to see him officially.
    The Kao-Mujib meeting lasted one hour. Kao was unable to convince Mujib that a coup was brewing and that his life was threatened, in spite of being given the names of those suspected to have been involved.

    ⤶ ⤷
    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleদি একসরসিস্ট – হুমায়ূন আহমেদ
    Next Article প্রেমের গল্প – হুমায়ূন আহমেদ

    Related Articles

    হুমায়ূন আহমেদ

    আসমানীরা তিন বোন – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025
    হুমায়ূন আহমেদ

    ইস্টিশন – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025
    হুমায়ূন আহমেদ

    উড়ালপঙ্খী – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025
    হুমায়ূন আহমেদ

    এই বসন্তে – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025
    হুমায়ূন আহমেদ

    এই মেঘ, রৌদ্রছায়া – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025
    হুমায়ূন আহমেদ

    এইসব দিনরাত্রি – হুমায়ূন আহমেদ

    December 23, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Generic selectors
    Exact matches only
    Search in title
    Search in content
    Post Type Selectors
    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    আসমানীরা তিন বোন – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    আসমানীরা তিন বোন – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025
    Our Picks

    আসমানীরা তিন বোন – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025

    ইস্টিশন – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025

    উড়ালপঙ্খী – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }