Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • English Books
      • Jules Verne
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    দোলনা – আশাপূর্ণা দেবী

    লেখক এক পাতা গল্প156 Mins Read0
    ⤶ ⤷

    ৩. উপযাচক হয়ে

    কান্তিকুমার অঞ্জনাকে দিয়ে বলে পাঠান। নিজে আর উপযাচক হয়ে মেয়ের কাছে এসে বক্তব্য নিবেদনের ইচ্ছে নেই। এ পর্যন্ত ওর বুদ্ধিহীনতার জন্যে বিরক্ত হলেও কিছুটা সহানুভূতি পোষণ করতেন। ও যে ওর হৃদয়-ধর্মের কাছে নিরুপায় হয়ে আছে, এটা তিনি অনুভব করতে পারছিলেন। কিন্তু ক্রমশই যেন একটা মৌন কাঠিন্য ঘিরে ধরছে তাঁকে।

    তাই নিজে আসেননি।

    অঞ্জনাকে দিয়ে বলে পাঠিয়েছেন।

    অঞ্জনা এসে দরজার কাছে দাঁড়ায়। কুণ্ঠিত মুখে বলে,দিদি, বাবা বললেন এগারোটার সময় তৈরি হয়ে থেকো, নিয়ে যাবেন।

    কোথায় নিয়ে যাবেন, কোথায় যেতে হবে, সে কথা কি ভুলে গেছে সুমনা? তাই চমকে ওঠে, অবাক হয়ে যায়।

    কোথায় নিয়ে যাবেন?

    কোথায়! অঞ্জুও অবাক হয়ে যায়! কেন, ইউনিভার্সিটিতে যাবার কথা ছিল না?

    ওঃ!

    সুমনা একটু চুপ করে থেকে বলে, বাবাকে বলে দে অঞ্জু, দিদির ভুল হয়েছিল। দিদি এম. এ.তে ভর্তি হবে না।

    ভর্তি হবে না?

    নাঃ। সম্ভব নয়।

    অঞ্জু একটা নিশ্বাস গোপন করে বলে,দিদি, মিথ্যে কেন এরকম করছ! বাড়ির মধ্যে তুমিই লেখাপড়ায় ভাল, তুমিই বাড়ির গৌরব, তুমি এরকম করলে বাবার কীরকম কষ্ট হয় বলো তো?

    আমার ভাগ্য!

    দিদি, আমি যদি ওকে রাখি?

    কাতর বচনে বলে অঞ্জনা। দিদি বলে ডেকে কথা কইতে আজকাল আর তেমন পায় না বলেই হয়তো আজ মনের কথা বলে ফেলে।

    হ্যাঁ, পায় না।

    ঠাকুমার নিভৃত নির্দেশ, সবাই মিলে আদিখ্যেতা করতে হবে না। সবাই নিয়ে নাচানাচি করলে আরও পেয়ে বসবে। যাবি না, ঠুবি না।…আর ঠুবিই বা কেন? ডাস্টবিনের নোংরা।

    কিন্তু সেই ঘৃণ্য বস্তুটার দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে আর পলক পড়ে না অঞ্জনার।

    চারখানা হাত পা ছুঁড়ে ঠুকে উছলে উছলে খেলা করছে। মুখে স্বর্গের দীপ্তি। শুধু শিশু নয়, সুন্দর শিশু, স্বাস্থ্যবান শিশু।

    তাই হঠাৎ দানপত্রে স্বাক্ষর করে বসতে চায় অঞ্জু, দিদি, আমি ওকে রাখব।

    দুঃখের মধ্যেও হেসে ফেলে সুমনা।

    বলে, তোর লেখাপড়া সাগরে ভাসিয়ে দিয়ে?

    আমার লেখাপড়া।

    অঞ্জনা অগ্রাহ্যভরে বলে, হলেই বা কী আর না হলেই বা কী! যা না ব্রেন! দুদুবার ক্লাসে ফেল। আমি পড়তে না পেলে পৃথিবীর কোনও লোকসান হবে না দিদি।

    দুর পাগল। যা, পাগলামি করিস না।

    দিদি, আমি বাবাকে ওকথা বলতে পারব না।

    বলতে পারবি না?

    না। আমার কষ্ট হয়।

    ঠিক আছে। আমিই বলে আসছি। আমি তো নিষ্ঠুরের রাজা। তুই একটু থাকবি তো এখানে?

    অঞ্জু একবার এদিক-ওদিক তাকিয়ে ঘাড় নাড়ে। থাকব। তুমি দেরি করবে না তো?

    না দেরি করব কেন? দেরি করবার কী আছে?

    দেরি করবে না।

    ছেলেটা হঠাৎ দুদিন থেকে উপুড় হতে শিখে খাট থেকে নামবার সাধনা করছে। একদণ্ড নড়বার জো নেই। অঞ্জুর কি সে সতর্কতা আছে?

    .

    কিন্তু দেরি করব না বলেও কোথায় হারিয়ে গেল সুমনা?

    অঞ্জুর কেয়ারে থাকতে থাকতে দুরন্ত খেলার ক্লান্তিতে ঘুমিয়েই পড়ল ছেলেটা। অঞ্জু বসে আছে।

    বসে আছে, তাকিয়ে আছে।

    সবাই চুপিচুপি বলাবলি করে, দিদির মতো মুখ! কই, অঞ্জু তো তা বুঝতে পারছে না। এতটুকু ছেলের আবার মুখ বোঝা যায়? তবে কেন বলে! দিদি মানুষ করছে বলে দিদির মতো মুখ হয়ে যাবে?

    কিশোরী মনের অস্ফুট আলো-আঁধারিতে কত কী ভাবে, কিছু বোঝে না, ভয় ভয় করে।

    তারপর ভাবে–দুর! যতসব বাজে কথা!

    কিন্তু দিদি এত দেরি করছে কেন?

    বাবা কি রাগ করছেন?

    দিদিকে কি বকছেন?

    দিদি কি বসে বসে কাঁদছে?

    কিন্তু বাবা কি কখনও এত বকতে পারেন, যাতে মানুষ কাঁদবে?

    তা অঞ্জনা তো আর হাত গুনতে জানে না যে, জানতে পারবে আসলে বাবার সঙ্গে দেখাই হয়নি সুমনার!

    অঞ্জুকে আদেশ দিয়ে কোথায় যেন বেরিয়ে গিয়েছিলেন কান্তিকুমার। সুমনা জানে না। সুমনা সোজা চলে গিয়েছিল বাবার অফিস ঘরে।

    সেখানে বাবার চেয়ারটা শূন্য।

    কিন্তু ওদিকে বইয়ের আলমারির কাছে ইজি-চেয়ারে বসে কে!

    ওখানে বসে কী করছে?

    ও কি এখানে আসে?

    যেমন ভাবে নিশ্চিন্ত আরামে আধশোয়া হয়ে বসে বইটা খুলে চোখের সামনে মেলে ধরেছে, তাতে মনে হচ্ছে না এটা দৈবাতের ঘটনা। দৈবাৎ একদিন একটা বই ভাল লেগে গেছে বলেই পড়ে শেষ করছে।

    না। মনে হচ্ছে নিত্য অভ্যাসের ব্যাপার।

    ও আবার ল বুক পড়ছে কেন!

    সুমনা কি চলে যাবে?

    চলে যাবে ভেবে ও হঠাৎ বলে উঠল, বাবা কই?

    বলে উঠল না, কে যেন বলিয়ে দিল।

    হাতের বইখানা মুড়ে অর্ধশায়িত মানুষটা সোজা হয়ে উঠে বসল।

    বলে উঠল,আরে এসো এসো শ্রীমতী ম্যাডোনা। কী খবর?

    বাবার শূন্য চেয়ারটায় বসে পড়ে সুমনা বলে, খবরটা তা হলে কানে উঠেছে?

    কানে উঠেছে মানে? কানের পোকা বেরিয়ে যেতে বসেছে।

    হাঁ! তা এতদিনের মধ্যে একদিন তোকই দেখা করতে এলে না?

    দেখা করতে! ও বাবা! সাহস কোথা? সিদ্ধার্থ একটা বদ্ধগভীর দৃষ্টি ফেলে বলে,আর কি তুমি সেই সুমনা আছ? এখন যে ম্যাডোনা হয়ে গেছ।

    ঠাট্টা করছ!

    ঠাট্টা! অন্তত আমার পক্ষে ব্যাপারটা ঠিক ঠাট্টা নয়। লোকমুখে শুনছি, নির্জন আত্মকারাবাস, অহোরাত্র তোয়ালে কাঁথা ফিডিংবটলের মধ্যে নিমজ্জিত

    এত শুনছ কোথা থেকে? নোক-মুখটা কোন লোকের?

    বাঃ, আজকাল আমার পিসি যে তোমার জেঠিমার গুরু-ভগ্নী হয়েছেন। জানো না?

    না। এমন গুরুতর সংবাদটা আমার কান এড়িয়ে গেছে। তা শুধু ওইটুকুই শুনেছ?

    হঠাৎ ঠোঁটের কোণটা বিদ্রুপে বেঁকে যায় সুমনার। চোখের তারাটা জ্বলে ওঠে, আর কিছু শোনোনি?

    আর কী?

    এই আমি কত বড় একটা গল্প বানানেওয়ালি, আমার মা-বাপ কী চতুর কৌশলী।

    সিদ্ধার্থ মৃদু হেসে বলে, হ্যাঁ, ওরকম একটা কথাও কানে এসেছিল বটে। বিশ্বাস করিনি।

    কেন? সুমনা আরও তীক্ষ্ণ হয়ে ওঠে, সবাই তো বিশ্বাস করছে। মনে হচ্ছে ক্রমশ আমিও বিশ্বাস করতে শুরু করব, তুমি করোনি কেন?

    কেন করিনি জানো? সিদ্ধার্থ তেমনি করে একবার সুমনার চোখের দিকে তাকিয়ে বলে, বিশ্বাস করতে অহমিকায় আঘাত লাগল। নিজের চেয়ে ভাগ্যবান আর কেউ আছে, এটা বড় মর্মবিদারী চিন্তা।

    সুমনা কেঁপে ওঠে।

    ওরা ভালবেসেছে, গল্প করেছে, হাসিগল্পে মশগুল হয়েছে, এবং অলিখিত চুক্তিপত্রে একরকম স্থির করে রেখেছে ওদের বিয়ে হবে। কিন্তু এমন খোলাখুলি এধরনের কথা কোনওদিন বলেনি সিদ্ধার্থ!

    সুমনা তাই কেঁপে ওঠে।

    কিন্তু কেঁপে উঠেও সামলে নেয় নিজেকে। বলে, শুধু ওই জন্যে? নইলে বিশ্বাস করতে বাধা ছিল?

    সুমনা, পাগলামি কোরো না।

    কিন্তু তুমি তো আসোওনি।

    তা সত্যি! কিন্তু বিশ্বাস করো আসবার জন্যে অসম্ভব একটা ব্যাকুলতাকে রোধ করতে করতে, এই ক দিনে রোগা হয়ে গেলাম। মন একবার বলে যাই, একবার বলে থাক। একবার বলে দেখা হলেই সব সোজা হয়ে যাবে। একবার বলে,সোজা হলে আপনিই দেখা হবে। প্রায় মিছরির শরবতের মতো অবস্থা ঘটেছিল মনটার। এ গ্লাস থেকে ও গ্লাস। ইচ্ছের গ্লাস আর বিবেচনার গ্লাস। অতঃপর বিবেচনাই জয়ী হল।

    বিবেচনা!

    হ্যাঁ, বিবেচনা করে দেখলাম, তোমার এই অস্বাভাবিক মানসিকতার মাঝখানে আমার আবির্ভাবটা হয়তো আরও অস্বস্তিকর হবে। অপ্রীতিকরও হতে পারে। শুধু তুমি যদি কখনও শূন্যতা বোধ করে নিজেই

    সুমনা নিজের মনকে তলিয়ে দেখে একবার। শূন্যতা বোধ কি হচ্ছিল? কই? কোনও বোধই বুঝি ছিল না সুমনার এতদিন। কিন্তু এখন! সিদ্ধার্থকে দেখে বুঝি বোধ ফিরছে। তাই প্রাণের মধ্যেটায় ভয়ানক একটা শূন্যতার হাহাকার অনুভব করে। ভুলে যায়, অঞ্জুকে বলে এসেছে এখনই আসছি। ভুলে যায়, কেন বাবার এই চেম্বারে এসেছিল সে।

    শুধু অবাক হয়ে ভাবে, এতগুলো দিন সুমনা সিদ্ধার্থের কথা প্রায় ভুলে বসেছিল।

    সিদ্ধার্থ মিনিটখানেক ওর মুখের দিকে তাকিয়ে বলে, বাস্তবকে স্বীকার করাটাই বুদ্ধিমানের কাজ সুমনা। পৃথিবী ভাবপ্রবণতার মূল্য দেয় না।

    আর পৃথিবীর কাছে যদি আমি মূল্যের জন্যে হাত না পাতি? যদি কেবলমাত্র আমার আমিটাকে নিয়ে পড়ে থাকতে চাই?

    তাও দিতে চায় না পৃথিবী। তোমার সেই তুমিটাকে নিভৃত কোণ থেকে টেনে এনে প্রশ্নে প্রশ্নে ক্ষত-বিক্ষত করতে চাইবে তুই কেন এমন উলটোপালটা রে? আমাদের হিসেবের সঙ্গে তোর হিসেবটা যে মিলছে না।

    মিলোতেই হবে হিসেব?

    পাগলা গারদে বা পর্বতগুহায় থাকতে না চাইলেই মিলোতে হবে। সেটাই নিয়ম।

    সুমনা আস্তে বলে, আমার বিপদে তোমার কষ্ট হচ্ছে না?

    হচ্ছে, খুব কষ্ট হচ্ছে, তবে তোমার জন্যে নয়, আমার জন্যে। কারণ বিপদটা তোমার চাইতে অনেক বেশি আমার।

    তোমার!

    তবে না তো কী। ভেবে রেখেছিলাম তোমার রেজাল্টটা বেরোলেই এতদিনের সুখস্বপ্নের কথাটা সম্বন্ধে আর্জি তুলব।

    যাক, তুলতে হল না। কম খাটুনি বাঁচিয়ে দিলাম তোমার?

    সুমনা!

    সহসা খুব কাছাকাছি সরে আসে সিদ্ধার্থ। বলে, এটা কথা বলার সময় নয়, জায়গাও নয়, কিন্তু উপযুক্ত স্থান কাল এবং পাত্র একত্রে পাওয়ার আশা এখন দুরাশা। তাই খুব তাড়াতাড়ি বলছি কী ছেলেমানুষী হচ্ছে? ওসব পাগলামি ছেড়ে দাও। আমাদের যে জীবনকে আমরা এতদিন ধরে স্বপ্নে গড়েছি, তাকে ধূলিসাৎ কোরো না।

    সুমনাকে ঈষৎ কঠিন দেখায়, আমাকে কী করতে বলো?

    আমি কিছুই করতে বলব না সুমনা। শুধু একটু ভাবতে বলব তোমায়। ভেবে দেখতে বলব, তুমি নিজেকে কোথায় তলিয়ে নিয়ে যাচ্ছ।

    সুমনা স্পষ্ট কঠিন মুখে বলে,আচ্ছা তোমার অনুবোধ পালন করবার চেষ্টা করব। ভেবে দেখব।

    সুমনা! কঠিন হোয়ো না। নির্বোধ হোয়ো না। একটা কানাকড়ির দামে জীবনটাকে বিকিয়ে দিও না।

    সুমনা সেই কঠিন মুখেই একটু হেসে বলে, কোনটার কী দাম, সে কি চট করে অত সহজে কষে ঠিক করা যায় সিদ্ধার্থ? সময় লাগে।

    ততদিনে যে সময় পার হয়ে যায় সুমনা। আমি বলছি, তুমি একটা তুচ্ছ সেন্টিমেন্টের বশে চলে নিজে কষ্ট পাচ্ছ, অন্য অনেককে কষ্ট দিচ্ছ। তোমার এই দুর্মতিতে তোমার বাবার কী অবস্থা হয়েছে দেখেছ?

    সেটা আমার ভাগ্য সিদ্ধার্থ। ওঁরাও খুব একটা বুদ্ধির পরিচয় দিচ্ছেন না। ওঁরাও সেই নিতান্ত তুচ্ছ ব্যাপারকে ফেনিয়ে বাড়িয়ে নিজেদের জীবনকেও জটিল করে তুলেছেন।

    তুচ্ছই বা ভাবছ কেন? কেউ যখন তা ভাবছে না?

    সেইটাই তো আমার কাছে এক অদ্ভুত রহস্য সিদ্ধার্থ। কেন তা ভাবছে না?

    তা হয় না! সংসারী লোকদের হিসেব আলাদা।

    থাক, তবে আর কী করা। কেমন ছিলে এতদিনে শুনি।

    খুব ভাল।

    শুনে খুশি হলাম।

    সুমনা!

    কী!

    বাজে কথা, বৃথা অভিমান, থাক ওসব। চলো একদিন আমাদের জায়গায়।

    জায়গায় জায়গা অবশ্য আর কিছুই নয়, ওদেরই পাড়ার লাইব্রেরি। সুভাষ পাঠাগার।

    সিদ্ধার্থ যার প্রতিষ্ঠাতাদের একজন।

    অলকও অবশ্য।

    আর সুমনা লাইফ-মেম্বার।

    ওইখানেই প্রায় রোজ একবার করে দেখা হয় ওদের।

    সুমনার চোখে ভেসে ওঠে পাঠাগারের সেই দোতলার ঘরের সামনের বারান্দাটি। যেখানে তারা শুধু দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা গল্প করে কাটিয়ে দেয়।

    মানে কাটিয়ে দিত।

    .

    সুমনাদের পরিবার রক্ষণশীল।

    মেয়েকে এম. এ., বি. এ. পড়তে দিলেও যথেচ্ছ গতিবিধির সুবিধে দিতে নারাজ তাঁরা। কলেজে যাচ্ছে যাক, তা বলে একা একা অর্থাৎ বাড়ির লোকেদের সঙ্গে ভিন্ন যেখানে সেখানে ঘুরে বেড়াবে, এত আহ্লাদ দেবার কিছু নেই। পড়তে দেওয়া হচ্ছে, এই ঢের।

    কান্তিকুমার অবশ্য ঠিক এ মতাবলম্বী নন, কিন্তু পরিবার সম্পর্কে নিতান্ত মমতাশীল তিনি। যে কাজে মায়ের অসন্তোষ, দাদা বউদির বিরক্তি, ছোটভাইয়ের বিরুদ্ধতা, তেমন কাজ তিনি জোর করে করতে কুণ্ঠিত হন। তাই সুমনা স্কুলের গণ্ডি পার হলে বলেছিলেন, বেশ তো পড়ুক না, প্রাইভেট পড়ুক। মার যখন অমত–

    সুজাতাই চারদিক থেকে বাঁধ দিয়ে দিয়ে ঠেকিয়েছে। কান্তিকুমারকে বুঝিয়েছে মার তো অন্য অমত কিছু নেই, শুধু বলছিলেন এবার বিয়ের চেষ্টা করতে। তা যতদিন না বিয়ের কিছু ঠিক হচ্ছে শুধু শুধু বসে থাকবে কেন? যেমন স্কুলে যাচ্ছিল তেমনি যাবে। বাড়ির গাড়িতে যাবে-আসবে–

    আর শাশুড়ি-জা এবং তাঁদের মারফত ভাশুর দেওরকে বুঝিয়েছে, মেয়েটার একান্ত ঝোঁক, আর তার বাপেরও বড্ড ইচ্ছে যে, পড়াটা চালিয়ে যায়। শুধু বলতে সাহস পাচ্ছে না

    শুধু বলতে সাহস পাচ্ছে না!

    কান্তিকুমারের মতন মানী মানুষটা সংসারের এই লোকগুলোর কাছে নিজের ইচ্ছেটা প্রকাশ করতে পারছে না! এটা বড় সন্তোষজন। এর জন্যে কিছুটা নরম হওয়া যায়।

    অতএব ব্যবস্থা হয়ে গেল একরকম করে।

    অবিশ্যি কলেজে পড়তে পড়তে নিয়মের কড়াকড়ি কিছুটা শিথিল হয়ে এসেছিল। প্রফেসরের বাড়ি, সহপাঠিনীর বাড়ি, কি বইয়ের দোকানে আর পাড়ার লাইব্রেরিতে একা যাবার ছাড়পত্র মিলত, কিন্তু পাড়ার ছেলের সঙ্গে অবাধ মেলামেশার সুযোগ পাওয়া কঠিন ছিল।

    তাই একত্রিত হবার জায়গা ছিল ওই লাইব্রেরিটাই। এক ভদ্রলোক তাঁর বিরাট বাড়ির একাংশে দোতলার দুখানি ঘর ও একটু বারান্দা উৎসর্গ করেছিলেন পাঠাগারকে। ঘরে সকলের পা পড়ত, পিছনের বারান্দাটা থাকত নিরালা।

    সুমনার জেঠি কণ্ঠে মধু ঢেলে বলতেন, সন্ধেভর কোথায় ছিলি সুমু? তোর ঠাকুমা কত ডাকাডাকি করছিলেন।

    সুমনা হেসে উঠে বলত,কেন, দিদার আবার এ দুর্মতি কেন? ভগবানকে না ডেকে আমায় ডাকাডাকি!

    জেঠি বলতেন, তুই নইলে এই কুচো কাঁচাগুলোর দস্যিবৃত্তি যে কেউ থামাতে পারে না বাছা। তাই ডাকাডাকি। তা ছিলি কোথায়?

    সুমনা পাশ কাটাত। বলত, কোথায় আর, লাইব্রেরিতে তো। মাকে বলে গেলাম যে।

    সুজাতা বলতো, বই কি ওখানে বসে বসে পড়িস, কেন, নিয়ে এসে পড়তে পারিস না?

    সুমনা মিছিমিছি একটা ঝংকার দিয়ে বলত, আর বোলো না। যা না সব ছিরি! খোলবার কথা বিকেল পাঁচটায়, বাবুরা খোলেন গিয়ে ছটা সাতটা যখন খুশি। কী করব, তোমাদের যে আবার কড়া কানুন, নইলে ওই অখাদ্য পাড়ার লাইব্রেরিতে যায় কে? কলকাতা শহরে কত লাইব্রেরি। তা–সে তো–

    সে তো যে কী, তা আর বলে শেষ করত না সুমনা, অন্য একটা কিছু নিয়ে ব্যস্ত হত।

    ছোটকাকার চোখ পড়লে বলে উঠতেন, লাইব্রেরিতে গিয়ে আড্ডা দিয়ে সময় নষ্ট না করে, সন্ধ্যাবেলাটা পড়াশুনো করলেই ভাল হয় না?

    সুমনা আদরে গলে গিয়ে বলত, পড়াই তো করি ছোটকাকা। বাড়িতে নন্দি-সৃজিদের জ্বালায় মনই বসেনা। এ তবু সন্ধ্যাবেলা নিয়ম করে ঘন্টাখানেক কি ঘন্টা দেড়েক

    ওঃ! তা পাঠ্যপুস্তক সঙ্গে করে নিয়ে যাওয়া হয় বুঝি?

    আহা পুস্তক আবার কী! এই নোটের খাতা-টাতা–

    আমাদের সুভাষ লাইব্রেরিতে আবার কাজের বই কিছু আছে নাকি? থাকবার মধ্যে তো দেখি চারটি বাজে নভেল আর

    কী যে বলো ছোটকাকা! সব তুমি দেখেছ বুঝি?

    এইভাবেই চালানো।

    তবু চালিয়ে চলেছিল।

    যে দিন দেরি হত, সিদ্ধার্থ বলত, মনে হচ্ছে লাঙ্গুলটি বড্ড বেশি স্ফীত হয়ে উঠছে দিনদিন।

    সুমনা বলত, হওয়াই স্বাভাবিক। যেখানে এত বেশি স্বাগত, সেখানে অহংকার না এসে পারে?

    ভাবছি এবার সন্ধ্যায় একটা টিউশনি ধরব।

    আঃ কবে এ সুমতি ঘটবে তোমার? হলে আমি হরির লুট দেব।

    হরির লুট দেবে?

    না তো কী? রোজ এই যন্ত্রণার দায় থেকে রেহাই পাব, হাড় জুড়োবে।

    সিদ্ধার্থ ভয়ংকরের ভূমিকা অভিনয় করে বলত, বটে নাকি? তা হলে তো নেওয়া হবে না।

    নেওয়া হবে না!

    উঁহু! শত্রুপক্ষকে কদাচ স্বস্তি দিতে নেই। শাস্ত্রে নিষেধ আছে।

    আমি তোমার শত্রুপক্ষ?

    আমি তো তাই মনে করি।

    আবার দৈবাৎ কোনওদিন সিদ্ধার্থই হয়ত আটকা পড়ে যেত অন্য কাজে, দেরি হয়ে যেত তার। সেদিন সুমনা ছটফট করত, যাই যাই করত, এসেছিলাম। চলে যাচ্ছি। বলে চিরকুট লিখত অথচ চলে যেত না। আর সিদ্ধার্থ এলে একেবারে তাকে দেখতে না পাওয়ার ভান করে বইয়ের মধ্যে নিমগ্ন হয়ে যেত।

    তারপর পুড়ত অনেক কাঠখড়।

    .

    আমাদের জায়গা শুনেই সেই দিনগুলো চোখের উপর ভেসে ওঠে।

    ব্যাকুল হয়ে ওঠে মন, তবু অভিমান বড় দুর্ভেদ্য বর্ম।

    তাই মুখে সে ব্যাকুলতা ফোটে না।

    মুখে যা ফোটে তা এই: আমার সময় নেই।

    জানি। কিন্তু তোমার সময় যে হরণ করে নিয়েছে, তাকে আমি অভিসম্পাত দিই এই কি তুমি চাও সুমনা?

    সুমনা আবার কেঁপে ওঠে। কিন্তু সে মুহূর্তের জন্যে। তারপর পাথুরে মুখে একটু আগুনের হাসি হেসে বলে, অভিসম্পাত এত বেশি পাচ্ছে সে যে, তোমার টুকুতে আর বিশেষ কিছু হবে না। বোঝার ওপর শাকের আঁটি।

    সুমনা! আমায় মাপ করো। আমি শুধু তোমায় রাগিয়ে দিতে চাইছিলাম, তাতিয়ে তুলতে চাইছিলাম। শোনো, তোমার পায়ে পড়ি, এসো আজ সন্ধ্যাবেলা।

    বলেছি তো আমার সময় হবে না। সিদ্ধার্থ, তুমি আমার কথা ভুলে যাও।

    চমৎকার! প্রায় একটি নাটকের নায়িকার উক্তি!

    ব্যঙ্গ করে তুমি আমায় টলাতে পারবে না।

    হাত জোড় করে?

    তার উত্তরে হাত জোড় করব।

    সুমনা, আমি বলছি তুমি সারাদিন ধরে ভাবো। আমি লাইব্রেরির বারান্দায় আছি। সমস্ত সন্ধ্যা।

    দরজার কাছে কান্তিকুমার এসে দাঁড়ান।

    বুঝি সুমনাকে সিদ্ধার্থের কাছে এসে কথা বলতে দেখে একটু প্রীত হন, প্রসন্ন হন। শান্ত গলায় বলেন, এই যে সুমি, তুই এখানেই রয়েছিস! অঞ্জু কি তোকে বলেছে, এগারোটার মধ্যেই বেরোব আমরা–

    সুমনা মাথা নিচু করে বলে, হ্যাঁ বাবা, বলেছে। আমিও তাই নিজেই বলতে এলাম, আমার একটু ভুলই বলা হয়েছিল। এম. এ.-তে ভর্তি হওয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়!

    .

    আশা ছিল না।

    তবু সমস্ত সন্ধ্যাটা লাইব্রেরির দোতলার সেই বারান্দাটায় দাঁড়িয়ে থাকে সিদ্ধার্থ।

    পাঠাগারের দরজা বন্ধ হয়ে যায়। চাকরটা সিঁড়ির দরজা বন্ধ করে সরে পড়ার তালে খানিকক্ষণ ঘুরঘুর করে কাছে এসে বলে,দাদাবাবু এখন থাকবেন নাকি?

    সিদ্ধার্থ সচকিত হয়ে হাত তুলে ঘড়িটার দিকে তাকায়। লজ্জিত হয়ে বলে, না, তুমি দরজা বন্ধ করো।

    আরও একটা জায়গায়ও তবে দরজা বন্ধ হয়ে গেছে। হয়তো চিরকালের মতো গেছে।

    অনুভব করতে পারছে সিদ্ধার্থ। কিন্তু বন্ধ হয়ে গেছে বলেই হতাশ নিশ্বাস ফেলে চলে আসবে? দেখবে না যে তালাটা কতখানি মজবুত? আদৌ মজবুতই কিনা?

    তালা যে লাগিয়েছে সে কি নিজেই জানে সে কথা?

    সকালে দেখা কান্তিকুমারের মুখটা মনে পড়ে সিদ্ধার্থর। মনে পড়ে বাবাকে সুমনা কী ভালবাসত!

    বাবা তো ভালবাসারই জিনিস, তবু সকলের ভাগ্যে কি জোটে অমন বন্ধুর মতো, গুরুর মতো, শ্রদ্ধা করবার মতো বাবা?

    সুমনা অনুভব করত তার ভাগ্যের সেই পরম দান।

    সুমনা সে কথা ভুলে গেল কী করে?

    হঠাৎ মনে হল সিদ্ধার্থের, আগেকার আমলে বোধ করি একেই বলত ভূতে পাওয়া। জঙ্গলের ভূত এসে ঘাড়ে চেপেছে শিশুর মূর্তি ধরে! সেই হতভাগা ছেলেটা না জানি কেমন। না জানি বা কাদের।

    .

    কান্তিকুমারদের বাড়ি থেকে মিনিট কয়েকের রাস্তায় সিদ্ধার্থদের বাড়ি। তিন ভাইয়ের মধ্যে সিদ্ধার্থই ছোট, তাই মা বাপের কাছে তার কিছুটা প্রশ্রয় আছে। আর একটু বিশেষ প্রশ্রয় আছে বড়বউদি রমলার কাছে। কলকাতার এই বাড়িতে অবশ্য তিনিই একমেবাদ্বিতীয়াং। কারণ মেজদা মেজোবউদি থাকে রাজধানীতে। আসেন কদাচ।

    সিদ্ধার্থ আর সুমনার হৃদয়ঘটিত ব্যাপারটির রমলাই পৃষ্ঠপোষিকা। রমলা দেওরকে আশ্বাস দিয়ে রেখেছে, নিশ্চিন্তে নির্ভয়ে প্রেমবৃক্ষে জলসিঞ্চন করে যাও, অতঃপর আমি আছি।

    সিদ্ধার্থ বলত, তুমি তো আছ তোমার শ্বশুরকুলের কর্ণধার হিসেবে। কিন্তু ও কুল যদি সহসা অকূলে ভাসায়?

    ইস, ভাসালেই হল অমনি। নিরুপায়া বালিকার অশ্রু বিসর্জনের দিন এখনও আছে যে! বলি মশাই, তোমার প্রেয়সীর প্রেম কি এমনি অমজবুত যে অভিভাবকের একটু চোখ রাঙানির ধাক্কা খেলেই ধসে পড়বে?

    বলা কি যায়? মেয়েদের ব্যাপার!

    হু, ইতিমধ্যেই মেয়েদের যে বেশ চিনে নিয়েছ দেখছি! সুমনার ভালবাসার প্রতি আস্থাটা তা হলে জোরালো নয়?

    আহা আমি আস্থা রাখলেও

    থামো থামো! আর ন্যাকামি করতে হবে না। পৃথিবী উলটে গেলেও সুমনা বদলাবে না।

    এত দুঃসাহসিক ভবিষ্যৎদ্বাণী?

    নিশ্চয়। মেয়েদের তোমরা ভাবো কী? সুমনাকে আমি স্কুলে-পড়া মেয়ে থেকে দেখছি না?

    তা সিদ্ধার্থই কি আর দেখছে না? না সিদ্ধার্থের আস্থা আর নিশ্চিন্ততায় কোনও ভেজাল আছে। ও শুধু বউদির সঙ্গে চালাকি করে। বলে, আমি এই একটা সস্তা মাল। আমি কি আর অ্যাডভোকেট কান্তিকুমারের ওই রূপে গুণে আলো করা মেয়ের উপযুক্ত? এ প্রস্তাব তুললে ভদ্রলোক আমায় কবিরাজি চিকিৎসার পরামর্শ দেবেন।

    ভারী সাধ্যি! তবে তুমি যদি ভয় পেয়ে সরে আসো আলাদা কথা।

    সিদ্ধার্থ হাসত।

    ওদের দুজনের বিয়েটাকে চন্দ্ৰসূর্যের নিয়মের মতো নিশ্চিত ভেবে নিশ্চিন্ত আছে সে।

    মাঝে মাঝে পিসির প্ররোচনায় মা একটু একটু টোকা দিয়ে দেখেছেন, বলেছেন, যতদূর দেখছি, তুই তো ওই কান্তি উকিলের মেয়ের পিত্যেশে হাঁ করে বসে আছিস। আর ও যদি ঝপ করে মেয়ের জন্যে মগডালের ফুল জোগাড় করে বসে?

    সিদ্ধার্থ মাকে রাগাবার জন্যে বলত, কী আর করা যাবে! ভাবব ওই আমার বিধিলিপি। সংসার করা আমার কপালে নেই।

    ঘেন্নার কথা বলিসনি সিধু। ওর বাপ ওর অন্য পাত্রে বিয়ে দেবে, আর তুই বৈরাগ্য নিবি?

    সিদ্ধার্থ আরও হাসত।

    বলত, তাতে যদি মান খাটোই হয়, না হয় দেখেশুনে অন্য একটা বিয়েই করে ফেলা যাবে। কিন্তু বাতাসের সঙ্গে লড়াই কেন? যদি নিয়ে দুশ্চিন্তা কেন?

    পিসি বলে উঠতেন, মাঝে মাঝে ওই সুমনার জেঠি যা লম্বা-চওড়া কথা কয়! বলে, ওদের ওই মেয়ে নাকি রাজপুত্তুরের যুগ্যি। আমাকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলে। শুনলে গা জ্বলে যায়।

    কী মুশকিল! গা জ্বলবার কী আছে? বরং তাতেই তো আরও মজা। যে মেয়ে রাজপুত্তুরের যুগ্যি, সে মেয়েকে তোমাদের এই হতভাগা ছেলেটা লুঠে আনবে, এতে গা জ্বলবার কথা তো ওদেরই।

    তুই যতই নিশ্চিন্দি থাক সিধু-মা বলেন, আমার মনে হয় শেষ পর্যন্ত ওরা তোকে আমল দেবে না।

    ওরা কে? সিদ্ধার্থ হেসে ওঠে, ওদের দেওয়া না দেওয়ার ওপর নির্ভর নাকি? তবে হ্যাঁ, স্বয়ং রাজকন্যাই যদি হঠাৎ

    পিসি বলে উঠতেন, এখন এতসব ভাল ভাল সম্বন্ধ আসছে। কানে নেওয়া হচ্ছে না, পরে দেখবি

    .

    আজও রাত্রে বাড়ি এলে খেতে বসিয়ে সেই কথাই পড়েন সিদ্ধার্থের মা আর পিসি।

    কান্তিবাবুর মেয়ের দিকে তাকিয়ে থেকে, আর কোনও দিকে তো চোখ দিতে দিলি না এ যাবৎ। এবার বিবেচনা কর। ও মেয়ে তো শুনছি কাঠ কবুল, নাকি জগৎ ছাড়বে তবু ওই কুড়োনো ছেলেটাকে ছাড়বে না। জানি না বাবা ভিতরের রহস্য কী! তা সে যাই হোক ওর ভরসায় থাকবার আর দরকার কী?

    সিদ্ধার্থ ভুরু কুঁচকে বলে, তা এখুনি তাড়াহুড়ো করে ভরসা ছাড়বারই বা দরকার কী?

    দরকার কী, দুচার কথার শেষে কিছুক্ষণ পরেই প্রকাশ হয়। পিসিমার এক ভাগ্নে এসে ধরে পড়েছে মেয়ের জন্যে। সুন্দর মেয়ে, বি. এ. পাস, গানবাজনায় পটু ইত্যাদি ইত্যাদি

    পিসিমা সতেজে বলেন, ও তোর সুমনার চেয়ে একশো গুণে ভাল।

    সিদ্ধার্থ হেসে ওঠে, একশো গুণ বহন করা বড় শক্ত পিসিমা। ওসব চেষ্টা করতে যেয়ো না।

    মা কুদ্ধকণ্ঠে বলেন, তুই কি এখনও ভাবছিস ওকে বিয়ে করবি?

    ভাবছি বইকী মা।

    ওই একটা ছেলেসন্ধু মেয়ে, রাগের সময় ভাষার শালীনতা হারান মা, ভগবান জানেন,কার ছেলে, কাদের ঘরের ছেলে।

    ওটা খুব একটা বাধা নয়।

    নয়?

    আমি তো মনে করি, না।

    তোর মাথার উপর বাপ, দাদা, তাদের কথা ভাবিস। উনি বলে দিয়েছেন, কান্তিবাবুর মেয়ের আশা তোমায় ত্যাগ করতে হবে।

    রাগ করে উঠে যান মা।

    সিদ্ধার্থের কাছে খুব একটা প্রতিবাদের ভাষা নেই। সে তো এই সমাজেই মানুষ। জানে তো সমাজ-মন।

    উঃ সেই ছেলেটাকে ছিনিকেই নেওয়া যায় না সুমনার কাছ থেকে!

    তা হলে হয়তো সুমনা সহজ হয়ে যায়।

    .

    মনের কথাটা বুঝি মুখে ধরা পড়ে।

    রমলা এসে বলে ওঠে, যা দেখছি সহজে হবে না।

    সিদ্ধার্থ চমকে উঠে বলে, কী সহজে হবে না?

    চমকাচ্ছ কেন ভাই? আমি বলছি, তোমার প্রেয়সীটি পরিস্থিতি যেমন ঘোরালো করে তুলেছে, তাতে এ পক্ষের মত পাওয়া সহজ হবে না।

    মত পাওয়ার আশা আর করছি না।

    সে বুঝতেই পারছি। কিন্তু ঠাকুরপো

    কী!

    ও শুনছি ওই ছেলেটাকে উপলক্ষ করে ভীষণ জেদ ফলাচ্ছে, মা বাপ ঠাকুমা জ্যাঠা কারও কথা শুনছে না। তাই ভাবছি অত জেদি মেয়েকে নিয়ে।

    আহা বউদি, সে তো পড়েই আছে কথা। জীবন মহানিশা। কিন্তু করা যাবে কী, ভাগ্য বলে কথা। এই যে তুমি–

    সিদ্ধার্থ মৃদু হেসে থামে।

    ওমা! আমি আবার কী?

    আহা, মানে তুমি কিছু আর আমার দাদাটিকে আদর্শ পুরুষ বলে মনে করো না! তবু তো দাদাকে বহন করতে হচ্ছে তোমায়।

    শোনো কথা। কীসে আর কীসে! আমার সঙ্গে তোমার তুলনা? বিয়ের পর ঘর করতে করতে দেখছি মানুষটার কতটুকু দোষ, কতখানি গুণ।

    উঁহু, ঠিক হল না। বরং বলতে পারো কতখানি দোষ, কতটুকু গুণ।

    রমলা হেসে ফেলে বলে, দাদা গুরুজন তা মনে রেখো!

    অলওয়েজ মনে রাখি। তবে ধরে নিতে হবে কথাটা হচ্ছে নৈর্ব্যক্তিক ভাবে। বিয়ের পর বলেই ভাগ্য বলে মেনে নিতে হবে, আর বিয়ের আগে হলেই ভাবতে হবে ভাগ্য হাতের মুঠোয়, তা হয় না। প্রেমে পড়াও একরকম নিরুপায়তা।

    নাঃ, তোমার ওপর আর আশা নেই। বৃথাই মা আর পিসিমা আমাকে উকিল খাড়া করেছেন।

    ওঃ! বটে, তাই নাকি। তাই ভাবছি তোমার কথার মধ্যে এমন বিজাতীয় বিজাতীয় গন্ধ কেন!

    না না ঠাকুরপো! আমার নিজেরও খুব খারাপ লাগছে। আচ্ছা আমি একবার ওর কাছে যাব?

    গিয়ে?

    গিয়ে বুঝিয়ে বলব।

    পাগল হয়েছ? আরও খেপে যাবে। তোমাকে আমার চর ভাববে।

    তা হলে তোমার সিদ্ধান্তটা কী? কী করবে?

    আপাতত ওর মনের গতি-প্রকৃতি লক্ষ করে যাওয়া ছাড়া আর কিছু করব না।

    এরপরে আর কনে জুটবে না।

    রমলা বকে ওঠে।

    তা আমার বাজারদর যে হঠাৎ এত পড়ে যাবে, তাই বা ধরে নিচ্ছ কেন? চুপচাপ থাকোই না বাবা একটু?

    হুঁ, এদিকে তোমার দাদা রোজ শাসাচ্ছেন, আমি যেন কান্তিবাবুর মেয়ের দিকে না ঢলি। যেন তোমাকে সদুপদেশ দিয়ে দিয়ে।

    সেরেছে। দাদা আবার এর মধ্যে কেন, আমার তো ধারণা, বিয়ে ব্যাপারটা সম্পূর্ণ মহিলা মহলের এলাকা।

    বাঃ, উনি হচ্ছেন বংশের মানী পুরুষ, বংশের মান মর্যাদা দেখবেন না? ওঁদের তো প্রায় ধারণা জন্মে গেছে

    হঠাৎ চুপ করে যায় রমলা।

    সিদ্ধার্থ বলে, কী ধারণা জন্মে গেছে?

    নাঃ সে তোমায় বলা যাবে না। যতসব বাজে বিচ্ছিরি কথা।

    সিদ্ধার্থ একটু হাসে। কথাটা বুঝতে দেরি হয় না। সকলের মনেই সন্দেহের প্যাঁচ।

    তা হলে সুমনার সেই তীব্র ব্যঙ্গটা মিথ্যা নয়।

    ও ঘর থেকে মা আর একবার এসে দাঁড়ালেন। গম্ভীর মুখ। বললেন, সিধু, উনি বলছেন তোমার পিসিমার সেই ভাগ্নের মেয়েটিকে আজই দেখতে যাবেন। আর পছন্দ হলে পাকা কথা দিয়ে আসবেন।

    সিদ্ধার্থ হেসে বলে, তা তোমাদের এইসব পাকা কথাটথার ব্যাপার এই কাঁচা ছেলেটাকে শোনাতে এলে যে?

    একটু শুনিয়ে রাখছি–

    না। কোনও দরকার নেই। তোমরা যখন সবই পাকা করে তুলবার সাহস রাখছ, তখন বাকি দায়িত্বটাও নিয়ো। আমায় কেন জড়াচ্ছ বাবা!

    তার মানে উনি কথা দিয়ে আসার পরও তুই ওঁর মুখ রাখবি না?

    রাখা সম্ভব নয়।

    আর আমি যদি তোকে হুকুম করি?

    বলে একটি গর্বিত সাফল্যের দৃষ্টিতে তাকালেন মা।

    হু বাবা! এইবার? কেমন প্যাঁচে ফেলেছি।

    কিন্তু ধূলিসাৎ হল গর্ব।

    সিদ্ধার্থ বলল, হুকুম তুমি করতে পারবেই না মা! হুকুম করবার আগে তো এ সাহস থাকা চাই যে, হুকুমটা রক্ষা হবেই।

    বুকের উপর একটা হাতুড়ির ঘা বসিয়ে চলে গেল ছেলে! চোখের জল গোপন করতেই বুঝি আড়ালে সরে গেলেন সিদ্ধার্থের মা অনুপমা। আর সেই আড়ালে বসে ভাবতে লাগলেন, কী করে এমন বদলে যায় ছেলেরা? একদা যে মা থাকে সবচেয়ে ভালবাসার, সব বড় আশ্রয়, সেই মা এত তুচ্ছ হয়ে যায়? স্নেহ ভালবাসা শ্রদ্ধা সন্ত্ৰম কর্তব্য অকর্তব্য, ভাল দেখানো মন্দ দেখানো–সমস্ত কিছু পরাস্ত হয় যৌবনের উদগ্র বাসনার কাছে?

    ভগবান, ছেলেরা কেন বড় হয়ে যায়। কেন যুবক হয়ে ওঠে? যদি তাই হয়, তবে এমন নিয়ম কেন নেই, ছেলেরা বড় হয়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে মায়ের প্রাণ থেকে ধুয়েমুছে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে তার জন্যে আকুলতা, তার প্রতি আশা। পশুপক্ষী কীট-পতঙ্গ জীবজগতের সকলের যা নিয়ম, সে নিয়ম কেন মানুষের মধ্যেও রইল না? ছেলেদের মধ্যে তো জীবজগতের রীতিনীতি। শুধু এই অবুঝ অজ্ঞান মা-গুলোর মধ্যেই

    এই তো বড় ছেলে অমিতাভ!

    বিয়ের আগে পর্যন্ত কী ন্যাওটাই ছিল মার। ছোট থেকে সবাই বলত মায়ের ছায়া।

    সিদ্ধার্থটাই বরং চিরকেলে ডাকাবুকো।

    কিন্তু সেই মা-ন্যাওটা বড় ছেলে কী বদলেই গেছে! মা বলে প্রাণীটার প্রতি সেই একান্ত নির্ভরতার ভাব তো চুলোয় গেছেই, উলটে উঠতে বসতে ছুতো খুঁজে বেড়ায় কী করে মার একটু দোষ আবিষ্কার করবে।

    কেন?

    সে এক রহস্য।

    আগে বুঝতে পারতেন না, অবিরত শুধু অবাক হতেন, আর কেন কেন করে অন্ধকারে মাথা খুঁড়তেন। ক্রমশ রহস্যভেদ হয়েছে। ভাবতে ভাবতে কারণটা আবিষ্কার করতে পেরেছেন।

    আর কিছু নয়। মায়ের ত্রুটি ধরা পড়লে বউয়ের ত্রুটির ওজনটা খানিকটা হালকা হয়ে যায়। বউয়ের যে প্রতি পদেই ত্রুটি, সেটা চোখ বুজে অস্বীকার করতে চাইলেও, মনের অগোচর তো চিন্তা নেই।

    বড় ছেলেকে তাই অনুপমা খরচের খাতায় লিখে রেখেছিলেন। সেজো মেজো বিদেশে। ডাকাবুকো ছেলে সিধুটাই ছিল ভরসা। মনে করতেন ও ওরকম করবে না। যেমন মানুষ প্রতিনিয়তই মৃত্যু দেখেও ধারণা করতে শেখে না, আমার প্রিয়জনেরও মৃত্যু হবে। যে কোনও মুহূর্তেই সে ঘটনা ঘটতে পারে।

    ওর গেছে, তা বলে কি আমার যাবে?

    একজন মন্দ হয়েছে, তা বলে কি আর একজনও মন্দ হবে?

    কিন্তু সিদ্ধার্থ বুকে হাতুড়ি মেরে সেই অবোধ ভুল ভেঙে দিয়ে গেল। অনুপমা অনুভব করলেন সিদ্ধার্থ আর তাঁর নেই।

    জয় হয়েছে যৌবনের।

    তৃষ্ণার জলের চাইতে নেশার মদের আকর্ষণ অনেক প্রবল, প্রমাণ হয়ে গেছে একথা। তবে আর কী করবার আছে?

    .

    বড় বউ রমলাকে কিন্তু অনুপমা যত স্বার্থপর আর মমতাহীন ভাবেন, সে তা নয়। অনুপমার মনের গতিবিধির খবর সে রাখে, চেষ্টা করে সেই ক্ষুব্ধ চিত্তে সান্ত্বনার প্রলেপ দিতে। কিন্তু চেষ্টাটা কার্যকরী হয় না। যেখানে ছেলে দূরে সরে যেতে চায়, সেখানে বউয়ের সাধ্য কি যোগাযোগের সেতু রচনা করে?

    তবু সে অমিতাভর কাছে গিয়ে অভিযোগ করে, বেশ তো নিশ্চিন্ত হয়ে বসে আছ, ওদিকে মা তো কান্নাকাটি করছেন।

    কেন? হঠাৎ কান্নাকাটির কী হল?

    আর কি? তোমার কনিষ্ঠ ভ্রাতার ব্যাপার। কান্তিবাবুর মেয়ে ব্যতীত তার জীবন অচল, ওদিকে মা–

    তা এসবের মধ্যে আমি কে? আমি তো আগেই রায় দিয়ে রেখেছি।

    শুধু রায় দিলেই হয় না। ভাইকে বোঝাতে পারো না? বলতে পারো না যাতে সংসারে অশান্তি

    .

    ওহে মহীয়সী মহিলা, হলে অবধান করুন। আমের মধ্যে যেমন আঁঠি, সংসারের মধ্যে তেমনি অশান্তি। মানে ওই অশান্তিটুকুকে অবলম্বন করেই সংসার নামক মাকাল ফলের গঠন। ওই অশান্তির আঁঠিটুকুকে আঁকড়ে ধরেই তার যা কিছু রং রস স্বাদ গন্ধ। অশান্তিকে বিতাড়ন করতে চাও তো আগে সংসারকে খণ্ড বিচ্ছিন্ন করো।

    হয়েছে। খুব ব্যাখ্যা হয়েছে। সত্যি কী মুশকিল কাণ্ড বলো! আগে ভাবতাম, কান্তিবাবুর অমন দামি মেয়ে, তাকে কি আর ঠাকুরপোর হাতে দেবে? নিশ্চয় আসমান থেকে বর আসবে তার। শুধু মেয়েটার মতিগতিটুকুই ভরসাস্থল ছিল। আর এখন এ পক্ষই রিজেক্ট করতে চাইছে

    ওই তো! ওই তো ভবের খেলা। এই তো দেখোনা, তোমার বাবা কত না সাধ্য-সাধনা করে আমা হেন জামাই জোগাড় করলেন। আর এখন? শ্বশুর ঠাকুরের সেই কন্যাকে সাধ্যসাধনা করতে করতেই আমার

    তাই তো! খুব বক্তৃতা হয়েছে। তোমার দ্বারা যে কিছু হবে না সে আমার জানাই ছিল। যাক আমিই দেখি–

    তুমি দেখতে গেলে ফল উলটো হওয়ার চান্সই শতকরা একশো দশ।

    তার মানে?

    মানে পরিষ্কার। যেখানে প্রেম, সেখানেই তোমার সহানুভূতি।

    তাই নাকি? আমাকে তো তা হলে চিনেই ফেলেছ দেখছি।

    না, একেবারে ফেলেছি তা বলতে পারি না, তবে কিছু কিঞ্চিৎ চেষ্টা করছি।

    বউ হেসে চলে যায়।

    .

    তা সিদ্ধার্থও কথায় তার দাদার চেয়ে বেশি বই কম নয়। বউদিকে সে কথার ঘায়েই উড়িয়ে দেয়। সেও বলে, বলল কী বউদি, সংসারে যাতে অশান্তি না আসে তার সাধনা করতে লেগেছ তুমি? তাজ্জব!

    কেন, আমি বুঝি তোমাদের সংসারে কেবল অশান্তিই সৃষ্টি করি?

    আহা-হা তা বলছি না। মানে, আমি বলতে চাইছি–মেয়েরা তো চিরদিনই একটু টক ঝাল নুন মশলার ভক্ত। আর তুমিও নিশ্চয় মেয়ে ছাড়া আর কিছু নও? অতএব নির্বিদ আলু-ভাতে অভিরুচি না হওয়াই স্বাভাবিক। কাজেই একটু আধটু অশান্তির চাষ

    দুটি ভাই সমান! খালি বাক্য। পষ্ট কথা বলি শোনোসুমনার বিরুদ্ধে তো সবাই লড়তে শুরু করেছে। আমারও যুক্তিটুক্তি তেমন আসছে না। তা ওকেই বিয়ে করবে এটাই একেবারে স্থির?

    সে যদি করে।

    সেই তো কথা। কিন্তু এ সন্দেহ নিয়ে–?

    তা যেখানেই আশা সেখানেই সন্দেহ।

    কিন্তু ওর সম্বন্ধে তো এ পক্ষে একেবারে

    তাতেই তো আরও মজা পাচ্ছি।

    মজা পাচ্ছ।

    হ্যাঁ। তাই! নিজেকে বেশ বীরপুরুষ বীরপুরুষ মনে হচ্ছে।

    ওকে না হলে তা হলে চলবেই না তোমার?

    আপাতত তো তাই মনে হচ্ছে।

    মা তো কান্না জুড়েছেন।

    কাঁদুনে বাচ্চারা যেমন কাঁদে, তেমনি সহজে ভোলে।

    অতঃপর হঠাৎ কেমন করে যেন আলোচনার নৌকো উলটো দিকে বয়, এবং বউদিই পরামর্শ দিয়ে বসেন–তার থেকে আলাদা হয়ে যাওয়াই হল ঠিক ব্যবস্থা। তাতে প্রথমটা সবাই একটু বিচলিত হলেও কালে ভবিষ্যতে সেটাই ভাল হবে। মনে কোরো না আমি একলা একেশ্বরী হয়ে থাকতে চাই বলেই এ কথা বলছি। আমি শুধু বলতে চাইছি বিয়ে করবার সময় যে শপথ মন্ত্র উচ্চারণ করা হয়, তাতে বারবার বলা হয়–তোমাকে সুখে রাখব, সম্মানে রাখব…ইত্যাদি!তা ভাই সে সব শপথ আর কজন রাখে বলো? রাখে না তার কারণ এই একান্নবর্তী পরিবার। এর জাঁতার চাপে ছোট বড় কারও জীবনের বিকাশ নেই। প্রত্যেকের পর্বতপ্রমাণ অসন্তোষ। বড়রা ভাবে ছোটরা অকৃতজ্ঞ, ছোটরা ভাবে বড়রা অবিচারক।

    ওরে বাবা, তুমি যে দেখছি অনেকদূর অবধি ভেবে ফেলেছ। যাক–তোমার অভিজ্ঞতা কাজে লাগাব।

    রমলা দুষ্টু হাসি হেসে বলে, কিন্তু ঠাকুরপো, তোমার পড়শিনী কি সত্যিই তোমায় ভালবাসে? না কি এতদিন শুধু তোমায় নিয়ে খেলিয়েছে?

    সিদ্ধার্থ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকায় রমলার দিকে।

    বলে, কী করে বুঝব বলো? দেবা ন জানন্তি বলে একটা কথা আছে। তবে তোমরা জানলেও জানতে পারো। স্বজাতির হৃদয়রহস্য ভেদ করা হয়তো সম্ভব হতেও পারে। খেলানো ব্যাপারটার রীতিপদ্ধতি তোমরাই—

    আহা-হা! আমাদের সঙ্গে তুলনা! আমরা আবার মানুষ নাকি? বাবা গোরুখখাঁজা করে একটি জামাই খুঁজে বার করে মেয়েকে তার গোয়ালে সমর্পণ করে দিয়ে গেছেন, সেই গোয়ালে পড়ে আছি আর সেই পরম গোরুর চরণে জীবন যৌবন উৎসর্গ করে ধন্য হচ্ছি। আমরা আবার খেলাবার রীতি পদ্ধতির খবর রাখতে যাব।

    ইস বেচারা! বাবার অবিমৃষ্যকারিতায় জীবনটাই বরবাদ।

    তা প্রায় তাই। তবে কি জানো ভাই,জীবনটাকে নিজের এক্তারে পেলেই যে কী হত সে কথা বলা শক্ত। হয়তো বাঁদরের হাতে খোন্তা হত। এই যে সুমনা, আসলে রহস্যটা যে কী বোঝাই তো শক্ত। আমি তো আগে কিছুতেই বিশ্বাস করিনি, কিন্তু পিসিমা-টিসিমা যা সব অকাট্য যুক্তি দিচ্ছেন

    সহসা গম্ভীর হয়ে যায় সিদ্ধার্থ।

    বলে,ছিঃ বউদি! তোমার কাছে অন্তত এ ধরনের কথা শুনব আশা করিনি।

    কী, জানি ভাই, এমন সব বলছেন এঁরা– বলে অপ্রতিভ হয়ে সরে যায় রমলা।

    সিদ্ধার্থও বেরিয়ে পড়ে।

    দুর ছাই!

    অকারণে জীবনটা কী এক অদ্ভুত জটিলতার জালেই জড়িয়ে গেল! এ জাল থেকে মুক্ত হবার যে কী উপায়!

    .

    এই যে শ্রীমান অচিনকুমার

    অলক লা ল লা লা লা করতে করতে সুমনার ঘরে ঢুকে বলে, আরে আরে এটা মাটিতে পড়ে কেন?

    কাছেই বসে আছে সুমনা।

    তাকিয়ে দেখে বলে, এত দুষ্টু হয়েছে যে এক মিনিট খাটে রাখতে পারা যাচ্ছে না। এই দেখো না কাল পড়ে কপাল ফুলিয়েছে।

    তা দোলায় তুলে রাখলেই তো হয়–

    ছেলেটাকে টপাস করে তুলে নিয়ে নাচাতে নাচাতে বলে অলক, দোলা থেকে ট্যাঁ ফোঁটি করতে পারে না।

    দোলা। দোলনা।

    কত সাধ সুমনার!

    কত স্বপ্ন!

    দোলনায় শুইয়ে দোলা দিয়ে দিয়ে ঘুম পাড়াবে তার অচিনকে, খোকনকে, মানিককে। কিন্তু সে সাধের কথা বলবে কাকে?

    কান্তিকুমার জামা তোয়ালে বিছানা অয়েলক্লথ ফুড় ফিডিংবটল এসব জুগিয়ে আসছেন, তা বলে দোলার কথা তাঁর মনে পড়বার কথা নয়।

    ফিকে একটু হাসে সুমনা। বলে দোলনা কই?

    দোলনা নেই! অলক এদিক ওদিক তাকিয়ে বলে, ইস! পুওর বেবি! ঠিক আছে, আমিই ওকে একটা দোলনা প্রেজেন্ট করব!

    থাক দাদা। আর গোলমাল বাড়াসনে। ভিখিরিদের ঘরের ছেলে ভিখিরির মতনই মানুষ হোক।

    ভিখিরির ঘরের? কে বলে?অলক সেই মোমের পুতুলটাকে যত লোফালুফি করে ততই খিলখিল হাসিতে ঘর ভরিয়ে তোলে সে। আরও ছুঁড়ে দিয়ে বলে অলক, এ বেটা নির্ঘাত কোনও রাজবাড়ির ছাঁ। দেখছিস না কী কার্তিকের মতন মুখ, কী সোনার মতন রং!

    ওর সত্যিকার মা জানবেও না ও বেঁচে আছে, বড় হচ্ছে। হয়তো চোখের সামনে দেখলেও চিনতে পারবে না। ভাবলে কী অবাক লাগে, না রে দাদা?

    তা লাগে। অলক ছেলেটাকে নামিয়ে দিয়ে বলে, ভাবলে কত কীই অবাক লাগে। এই যে তুই দুদিনের জন্যে বেড়াতে গিয়ে কার না কার একটা জিনিস কুড়িয়ে এনে তার জন্যে সবত্যাগ করছিস, এও একটা পরম আশ্চয্যি। সিদ্ধার্থ তো বলছে তুই পাগল হয়ে গেছিস। বলছে, যে মেয়েদের মধ্যে মাতৃত্বের অংশ বেশি, তাদের নাকি খুব ছেলেবেলায় বিয়ে-টিয়ে হয়ে বাচ্চাটাচ্ছা হয়ে গেলেই মঙ্গল। নইলে এই রকম সব ম্যানিয়া–

    থাম দাদা! সুমনা প্রায় ধমকে ওঠে, তোর সিদ্ধার্থ দেখছি অনেক কথা শিখেছে।

    কিন্তু তুইও তো যা তা করছিস মনা। এম. এ-তে ভর্তি হলি না, বাড়ির কারও সঙ্গে সম্পর্ক রাখিস না

    বাড়ির কেউও আমার সঙ্গে রাখে না।

    বেশ তাই সই! অলক বলে, কিন্তু সিদ্ধার্থ? সে বেচারার কী দোষ? কী যন্ত্রণা তার! এদিকে এই, ওদিকে বাড়িতে বিয়ের জন্যে উৎপাত করছে–

    বাঃ চমৎকার! সুখবর তো! তাড়াতাড়ি লাগিয়ে দে না। পাড়ার একটা ঘটার বিয়ের নেমন্তন্ন খাওয়া যাবে।

    নাঃ সত্যিই তুই ভারী নিষ্ঠুর হয়ে গেছিস মনা! আগে এমন ছিলি না। আচ্ছা, বিয়ে-টিয়ে হওয়া, মানে সত্যি মা-হওয়া মেয়েও তো কত দেখেছি তারা তো পড়ছে লিখছে খেলছে গান গাইছে, সবই করছে। তোর মতন তো এমন জড়ভরত হয়ে ঘরে বসে থাকছে না।

    থাকে না, তা জানি—

    সুমনার উত্তর দেওয়া হয় না।

    ছেলেটা হামা দেবার চেষ্টায় মুখ তুলতে গিয়ে থুবড়ে পড়ে গিয়ে ককিয়ে কেঁদে ওঠে। সরবে ছেলে ভোলাবার অভ্যাস সুমনার নেই, অনেক দুলিয়ে থাবড়ে চুপ করিয়ে বলে,দেখলি তো? কী অবস্থা! সবাইয়েরই অনেক আত্ম-পরিজন আছে, এ বেচারার আমি ছাড়া আর কে আছে বল?

    তা মেজোকাকা তো ঝি রাখতে চেয়েছিলেন, তুই নাকি রাজি হোসনি?

    আচ্ছা দাদা, ঝি কি যত্ন করতে পারে?

    কেন পারবে না? শুধু তোর মতন মোমের পুতুল মায়েদের কাছেই পারে না। সত্যি সিদ্ধার্থ বলছিল–

    ও বুঝি তোকে উকিল খাড়া করেছে রে দাদা?

    তীক্ষ্ণ প্রশ্ন করে ওঠে সুমনা।

    অলক বলে, আমি কারও উকিল-টুকিল নই। নিজেই জজ। আমার মনে হয় তোর খুব ভুল হচ্ছে। এই তো তোদের প্রফেসর আর. কে. সেনের সঙ্গে দেখা হল সকালে। তুই ভর্তি হোসনি শুনে হায় হায় করতে লাগলেন, কারণ জানতে চাইলেন। কী আর বলি বল? বললাম, শরীর খারাপ। শুনে অত্যন্ত দুঃখিত হলেন। কী হয়েছে, কোনও ডাক্তার দেখছে, পরীক্ষার আগে থেকেই তো ভুগছিল, এখনও সারছে না কেন, ডাক্তাররা কী বলছে, এই সব বহু প্রশ্ন।..কী করে যে পাশ কাটিয়ে উত্তর দিয়ে এসেছি! আরও বললেন, তাই রেজাল্ট বেরোবার পর দেখা করতে আসতে পারেনি। অথচ আমি ভাবছি। নিজেই একদিন আসতে পারেন বললেন।

    অলক খানিক পরে উঠে যায়।

    একমাত্র যে মানুষটা সুমনার কাছে বাইরের বাতাস একঝলক করে এনে ছড়িয়ে দিয়ে যায় মাঝে মাঝে।

    .

    ও চলে যায়। স্তব্ধ হয়ে বসে থাকে সুমনা। বসে বসে ভাবে।

    প্রফেসর আর. কে. সেন!

    দেবতার মতো যাঁকে ভক্তি করত সুমনা।

    করত!

    হ্যাঁ, করত ছাড়া আর কী!

    সুমনার জীবনে বর্তমান বলে আর কিছু নেই। সবই অতীত হয়ে গেছে। নইলে প্রফেসর সেনকে সে প্রণাম করতে যায়নি পাস করার পর। করবার কথাও মনে পড়েনি।

    সুমনা কি জানোয়ার হয়ে গেছে? তাই পৃথিবীতে মানুষ আছে–এ কথা ভুলে গিয়ে গুহাবাসীর জীবন যাপন করছে কেন?

    হঠাৎ এই প্রথম ছেলেটার ওপর ভয়ানক একটা আক্রোশ আসে সুমনার। মনে হয় শত্ৰু, শত্রু, পরম শত্রু ও সুমনার।

    অথচ এই শত্রুর শত্রুতার বিরুদ্ধে কিছু করবার নেই। নিরুপায় আত্মসমর্পণে আত্মহত্যার পথে এগিয়ে চলতে হচ্ছে।

    আত্মহত্যা বইকী!

    নইলে সিদ্ধার্থকে অকারণে অপমান করে বিদায় দিতে পারে!

    সিদ্ধার্থের প্রতীক্ষার প্রহর ব্যর্থ করে দিয়ে নিশ্চিন্ত হয়ে ঘরে বসে থাকতে পারে?

    অনেকক্ষণ ভাবে।

    অতঃপর ঠিক করে, এই একটা অনির্দিষ্ট অনিশ্চিতের মধ্যে নিজেকে ভাসিয়ে দেওয়া চলবে না। একটা কিছু করতে হবে।

    এই জানোয়ারের মতো গুহার জীবন আর নয়।

    .প্রফেসর তাঁর পাকা চুলের মধ্যে আঙুল চালাতে চালাতে মৃদুগম্ভীর স্বরে এলেন, স্ট্রেঞ্জ! তোমার দাদা তো এসব কিছুই বলল না আমায়।

    ওর লজ্জা করেছিল।

    মাথা নিচু করে বলে সুমনা।

    প্রফেসর বলেন, তুমি আমার কাছে তোমার অসুবিধের কথা বললে বলেই এ কথা বলছি, আমার মনে হয় প্রথমেই তোমার বাবার পরামর্শই নেওয়া উচিত ছিল তোমার। অথবা তাঁর পক্ষেই উচিত ছিল তোমার সেন্টিমেন্টের বশে না চলে, জোর করে ঠিক ব্যবস্থা করে ফেলা। পরিত্যক্ত শিশুদের জন্যে গভর্নমেন্ট থেকে ব্যবস্থা আছে বহু সমাজকল্যাণ প্রতিষ্ঠান আছে, অনাথ আশ্রম আছে, খোঁজখবর করে যে কোনও এক জায়গায় পাঠিয়ে দেওয়া উচিত ছিল। মায়া পড়ে গেছে সত্যি কথা। পড়াই স্বাভাবিক। মেয়ে-মনের কাছে একটি অসহায় শিশু! কিন্তু সুমনা, যে মায়া তোমার জীবনে অকল্যাণ ডেকে আনবে তাকে তো প্রশ্রয় দেওয়া ঠিক নয়। তোমার কেরিয়ার, তোমার পারিবারিক জীবন, তোমার বিবাহিত জীবনের ভবিষ্যৎ, সবকিছু ক্ষতিগ্রস্ত করে এভাবে জড়িয়ে পড়বে কেন তুমি, তা আমি কিছুতেই বুঝতে পারছি না। তুমি এমন একটা ব্রিলিয়ান্ট স্টুডেন্ট, এই অদ্ভুত কারণে তুমি পড়া ছেড়ে দিলে! এক্ষুনি একটা যা হোক চাকরি করতে চাইছ! এ কী! আমরা জানি তুমি পড়বে, পাশ করবে, রিসার্চ করবে, রীতিমত একটা কেরিয়ার গড়ে নেবে। তা নয়–নো নো, মাই গার্ল! তোমার মতো ইনটেলিজেন্ট মেয়ের পক্ষে এ একটা অদ্ভুত অবাস্তব কল্পনা যে, যে কাজটা একটা সাধারণ দাই বা ঝিকে দিয়ে হতে পারে, সেই কাজটার জন্যে তোমার অমূল্য সময়টা নষ্ট করবে তুমি।

    স্তব্ধ হয়ে বসে থাকে সুমনা।

    প্রফেসরের যুক্তির মধ্যে ও যেন নিজের কল্পনার অবাস্তবতাটা সুস্পষ্ট দেখতে পায়। কান্তিকুমার যখন বলেছেন, বুঝিয়েছেন, তখন সুমনা শুনেছে মনের মধ্যে একটা বিরুদ্ধ ভাব নিয়ে। সমস্ত যুক্তি

    প্রতিহত করবে এই সংকল্প নিয়ে পাথর মনে শুনেছে।

    কারণ, সুমনার ধারণায় কান্তিকুমারের সে কথা সম্পূর্ণ স্বার্থ থেকে উদ্ভূত কথা।

    স্বার্থের জন্যে মানবিকতাকে বিসর্জন দিচ্ছেন কান্তিকুমার। একটু অসুবিধের জন্যে কচি শিশুটাকে দূর ছাই করছেন সুজাতা।

    পরিবারের আরও সবাইয়ের সম্পর্কে ওই একই কথা। এমনকী সিদ্ধার্থকেও তাই ভেবেছে সুমনা।

    সবাই স্বার্থপর।

    আপন স্বার্থের হানি হবে বলে, একটা অসহায় শিশুর কথা ভাবে না। ওরা বিশ্রী, ওরা বাজে।

    কিন্তু প্রফেসর সেন!

    তাঁর সঙ্গে তো কোনও স্বার্থের সংঘর্ষ নেই।

    তিনি কেন?

    কানের মধ্যে বাজতে থাকে শেষ কথাগুলো। তোমার মতো ইনটেলিজেন্ট মেয়ের পক্ষে এ একটা অদ্ভুত অবাস্তব পরিকল্পনা যে

    সুমনা এক সময় ইনটেলিজেন্ট বলে গণ্য ছিল না? সবাই তাই বলত। কিছুদিন ধরে তার নির্বুদ্ধিতার সমালোচনা শুনতে শুনতে সে কথা ভুলেই গেছে সুমনা।

    কিন্তু প্রফেসর আরও কথা বলছেন। বলছেন, তোমাদের তো শুনেছি জয়েন্ট ফ্যামিলি, বাড়িতে আরও তো অনেকে আছেন, তোমার মা রয়েছেন, কেউ একটা বেবির ভার নিতে পারছেন না?

    কেউ নেবেন না।সুমনা ক্ষুব্ধকণ্ঠে বলে, রাস্তায় কুড়োনো

    ইট ইজ ট্রু! প্রফেসর গম্ভীর কণ্ঠে বলেন, খুবই স্বাভাবিক। গৃহস্থ ঘরের মেয়েরা এই ভাবেই চিন্তা করতে অভ্যস্ত। সবচেয়ে ভাল হচ্ছে কোনও মিশনে দিয়ে দেওয়া। তোমাকে এইসব বাজে কল্পনা ছাড়তে হবে সুমনা– দৃঢ়স্বরে বলেন প্রফেসর, তুমি কালই চলে এসো আমার কাছে। এখনও চান্স আছে। জানো না বোধহয় আমি সম্প্রতি ক্যালকাটা ইউনিভার্সিটিতে এসেছি। আমি তোমায় নিয়ে নিতে পারব। অপরের পরিত্যক্ত সমস্যাকে নিজের জীবনের সমস্যা করে তুলো না।

    আসবার প্রতিশ্রুতি দিয়ে চলে আসে সুমনা।

    আবার সমুদ্রের ডাক!

    আবার অসীমের হাতছানি!

    এর কাছে ভারী ক্ষুদ্র লাগে কেবলমাত্র হাসি-কান্নার লীলা দিয়ে গঠিত একটা অবোধ প্রাণীকে। ভেবে অবাক লাগে, নিজের সেই ঘরটির মধ্যে ওকে অত বিরাট মনে হয় কেন?

    ঘরটা ছোট্ট বলে?

    সত্যি কতটুকুই বা ঘর।

    ওটা সুমনার পড়ার ঘর বলেই গণ্য ছিল। বড় হয়ে ইস্তক রাত জেগে পড়ার জন্যে, অথবা নিজস্ব নির্জনতায় রাত জেগে ভাবার জন্যে এই ছোট্ট ঘরটির মধ্যেই নিজের খাট আনিয়ে নিয়েছিল সুমনা।

    খাটটা কোনওরকমে ধরে।

    চারদিক ঘিরেই তো সেলফ ভর্তি বই আর বই।

    বই! ওই নামে একটা জিনিস আছে বটে!

    কিন্তু সুমনা ভুলে গিয়েছিল।

    ছি ছি ছি!

    নিজের ওপর ঘৃণায় ধিক্কারে চোখে জল এল সুমনার। মনে হচ্ছে কে যেন ওর বোকামির সুযোগ পেয়ে ভারী ঠকিয়েছে। কী করে সে সারাটা দিন?

    সেই–প্রফেসরের ভাষায় বলতে বলে অপরের পরিত্যক্ত সমস্যাকে ছবার ফুড তৈরি করে খাওয়ায়, শিশুপালনের নিয়ম অনুসারে এক ঘণ্টা তেল মাখায়, তার পর চান করায়, পাউডার মাখায়, চুল আঁচড়ে দেয়, বিভোর হয়ে দেখে, নাচায় হাসায়, কান্না ভোলায়, ঘুম পাড়ায়।

    আর ও যখন ঘুমিয়ে থাকে? তখন ওর জামাপত্র কাঁচে, শুকোয়, পরিপাটি করে পাট করে রাখে, আর বাকি সময় সেলাই করে।

    কাঁথা জামা, জামায় ফুল লতা!

    নিজেকে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে যেন মুখোমুখি দেখতে থাকে সুমনা। আর ধিক্কার দিতে থাকে সেই দাঁড় করানো সুমনাকে।

    বাসে ওঠার মুখে চোখ পড়ল।

    দাঁড়িয়ে রয়েছে ও ফুটপাথে।

    কেমন যেন অন্যমনস্ক, অনুজ্জ্বল। সিদ্ধার্থকে এমন দেখেনি কোনওদিন। ব্যথায় উদ্বেল হয়ে উঠল বুক। মনে ভাবল, কতটুকুর জন্যে কতখানি হারাতে বসেছি আমি!

    দ্রুতপায়ে রাস্তা পার হয়ে ওদিকে গিয়ে পড়ল।

    কাছে গিয়ে টোকা মারল পিঠে।

    চমকে ফিরে তাকাল সিদ্ধার্থ। একটু বা অবাক, একটু বা ম্রিয়মাণ হয়ে ফিকে করে হেসে বলল, কী ব্যাপার? শ্রীমতী ম্যাডোনা গুহা ছেড়ে বাইরে?

    সুমনা উচ্ছ্বসিত হবে।

    সুমনা ওর অভিমান ভাঙাবে।

    তাই হেসে বলে ওঠে, হয়েছে! খুব ঠাট্টা শিখেছ। একই ঠাট্টা বারবার করে কারা জানো? বোকারা।

    বোকা সে কথা তো অস্বীকার করছি না।

    দেখো, তুমি যদি আমার সঙ্গে এ রকম অসহযোগিতা করো, আমি কোথায় যাই বলল তো?

    তোমার তো কোথাও যাবার দরকার নেই, তোমার তো গুহার আশ্রয় অটুটু।

    আবার! ভাল হবেনা বলছি৷ খালি খালি ওই সব বলে রাগিয়ে দাও কেন? সুমনা ছলছলে চোখের দৃষ্টিটি তুলে তুলে ধরে আরতির প্রদীপের মতো।

    রাগিয়ে দিই কেন? সিদ্ধার্থ বলে ভাবি, যদি তাতে বরফের গায়েও একটু অগ্নিকণা জ্বলে ওঠে।

    বাজে কথা ছাড়ো। শোনো, প্রফেসর আর. কের কাছে গিয়েছিলাম। উনি খুব বকলেন। বললেন, পড়া ছাড়া চলবে না। আরও বললেন, এখন ক্যালকাটা ইউনিভার্সিটিতে রয়েছেন। আমাকে নিয়ে নিতে পারবেন। অবিলম্বে যেতে বললেন। আর দেরি করলে হবে না।…ঝুলেই পড়ি কী বলে?

    সুমনা!

    কী?

    এই সব সাধু সংকল্প শুধু মিনিট কয়েকের মতো? না কি ভ্যালু কিছু আছে?

    সুমনা ছেলেমানুষের মতো আবদারের সুর ধরে।

    বাঃ না আহা! একবার ওরকম হয়েছে বলে–না, সত্যি এবার আর নড়চড় নেই। ওঁর বকুনিতে!

    প্রফেসর আর. কে ভাগ্যবান।

    বাঃ ওঁকে আমি কীরকম ভক্তি করি জানো?

    এতদিন জানতাম না। এইবার জানলাম। অবশ্য জানার স্থায়িত্ব কতক্ষণ তা জানি না।

    তুমি খালি খালি আমার ওপর এরকম অনাস্থা প্রকাশ করছ কেন বলো তো?

    আস্থা খুঁজে পাচ্ছি না বলে।

    শোনো, আর ওরকম হবে না। এখন তোমার ওপর আস্থা রাখতে পারি কিনা বলো?

    কী বাবদ?

    ধরো–ওর উপযুক্ত একটা জায়গা–মানে কষ্ট না হয় এ রকম জায়গা।না, গলাটা কাঁপতে দেবে  সুমনা, অবাস্তব বুদ্ধি আর অনিষ্টকারী মায়া নিয়ে নিজের কেরিয়ার নষ্ট করবে না। তাই কথা শেষ করে পরিষ্কার গলায়, তোমাকে জোগাড় করে দিতে হবে। আর যাতে মাঝে মাঝে দেখতেনা পাওয়া যায়–

    চট করে দানপত্রে সই করে বোসো না সুমনা! বাড়ি গিয়ে ভাবো গে।

    ভেবেছি। এখানেই ভেবে নিয়েছি। ভাবাটা আর বাড়ির জন্যে তুলে রাখব না। ওখানে মন দুর্বল হয়ে যায়।

    সিদ্ধার্থ এতক্ষণে উপহাসের স্বর ছেড়ে মমতার স্বর ধরে।

    বলে, কিন্তু তোমার গলা কাঁপছে।

    ওটা সাময়িক।

    সুমনা, যদি তুমি মন প্রস্তুত করতে পেরে থাকো, জায়গা খুঁজতে সময় লাগবে না। এতদিন ধরে ওই সন্ধানই করে বেড়াচ্ছি।

    কেন বলো তো? সুমনা বিস্মিত হয়। আমি তো তোমাকে বলিনি। বাবা কি

    না সুমনা! কান্তিকাকা আমায় কিছুই বলেননি। আমি এমনি, হঠাৎ একদিন কী খেয়াল হল, ক্ষুব্ধ হাসি হেসে বলে সিদ্ধার্থ, ভাবতে শুরু করলাম–যদি তুমি বিয়ে নামক ব্যাপারটাকে একেবারে অর্থহীন অবান্তর বলে উড়িয়ে না দাও, যদি ওকে কাছছাড়া করতে রাজি হও–আমি এ সমস্তই যদির ওপরে ভেবেছি সুমনা, রাগ কোরো না তুমি–হ্যাঁ, যদি রাজি হও, তা হলে তখন যেন আবার খুঁজে বেড়ানোর দুর্ভোগ না পোহাতে হয়। তাই

    সুমনা একটু চুপ করে থাকে।

    কী বলতে গিয়ে থামে।

    তারপর আস্তে আস্তে থেমে থেমে বলে, সে রকম ভালমতো কোথাও দেখেছ নাকি?

    তারা তো অনেক ভাল ভাল কথাই বলল।

    কী বললে তুমি?

    বললাম? যা সত্যি তাই বললাম। শুধু সময়টার একটু হেরফের করলাম আর কি। অতদিন আগে না বলে বললাম সম্প্রতি পাওয়া গেছে

    সুমনার গলার স্বর ক্ষীণ হয়ে আসে কেন? সেই ক্ষীণ গলা থেকে প্রশ্ন ওঠে, বিশ্বাস করল?

    এক কথায় করে না। অনেক বলতে হয়েছে। আরও অনেক প্রমাণের দরকার। কিন্তু ফুটপাথে দাঁড়িয়ে আর কতক্ষণ কথা হবে? চলোনা কোথাও গিয়ে বসা তোক একটু।

    কোথায়?

    ধরো কোয়ালিটিতে। যেটা কাছাকাছি হবে।

    কোয়ালিটিতে!

    সিদ্ধার্থ আর সুমনা। গিয়ে বসবে, আগে আগে লুকিয়ে এক-আধদিন যেখানে এসে বসত।

    এসব এখনও আছে পৃথিবীতে?

    সুমনা ভুলে যায় অজীন আর অঞ্জনাকে একটু দেখতে বলে চুপি চুপি এসেছে সে, ঘণ্টাখানেকের জন্যে।

    ভুলে যায় প্রফেসরের কাছে কেটে গেছে দেড় ঘণ্টার উপর। ভুলে যায় সিদ্ধার্থের সঙ্গে শুধু রাস্তায় দাঁড়িয়ে কেটে গেল আধ ঘণ্টাটাক, আর ভুলে যায় চা খেতে ঢুকলে আরও কতখানি সময় হারানো। সময় গড়িয়ে পড়ে যাবে বিকেলের গা থেকে।

    চা-টা উপলক্ষ।

    তবু সিদ্ধার্থ জোর করে খাওয়ায় কিছু। তারপর পরামর্শে আর আলোচনায় গম্ভীর হয়ে ওঠে।

    ও বাড়িতে আর ভাল লাগে না সুমনার।

    চিরকালের জায়গা যেন অপরিচয়ের বর্ম পরেছে।

    কে জানে শুধু সুমনারই এরকম অনুভূতি, না সব মেয়েরই হয়। বিয়ে না হওয়া বড় মেয়েদের!

    হয়! সবাই জানে সে কথা।

    সুমনা জানে না। সুমনা জানত না। বড় হয়ে যাওয়া মেয়েদের মতো ছিল না সুমনা।

    এখন সুমনা ভাবে, শুধু তারই মনে হচ্ছে বাড়িটা যেন পরের। বাধ্য হয়ে থাকতে হচ্ছে সুমনাকে। কী গ্লানি, কী যন্ত্রণা!

    কান্তিকুমার মুখের ওপর একটা স্নেহহীনতার আবরণ পরে ঘুরে বেড়ান, সুজাতা প্রতি পদে কপালে করাঘাত করে আর সুমনার বুদ্ধিকে ধিক্কার দেয়। বাড়ির লোকেদের চোখে ক্রমশই একটা অনমনীয় সংকল্পের দৃঢ়তা। ঘোটরা কাছে আসতে চায়, কিন্তু বোধ করি উপরওলাদের নিষেধে থতমত খায়।

    অসহ্য!

    বড় অসহ্য!

    যাকে নিয়ে এত গোলমাল, তাকে বিদায় করে দিলেই হয়তো আবার আস্তে আস্তে ওরা প্রসন্ন হবে।

    হয়তো বাবা বলবেন, সুমি, আজ তোর কটায় ক্লাস? গাড়িকে বলে রাখব।

    হয়তো মা বলবে, মনটা খারাপ লাগছে? চল একটু তোর মেজোমাসির বাড়ি বেড়িয়ে আসি।

    হয়তো ছোটকাকাও বলবেন, সুমিটার চেহারাটা বিশ্রী হয়ে গেছে, ওকে একটু দেখাশোনা কোরো বউদি।

    আর হয়তো ঠাকুমা বলবেন, মনা, আয়না কাছে। একটু বোস না। কদিন তোর মুখে একটু ঠাকুর দেবতার গান শুনিনি।

    হয়তো এ সমস্তই হবে।

    কিন্তু সুমনার আর ভাল লাগবে না। সুমনার চোখে ধরা পড়ে গেছে সবকিছুর ফাঁকি। জেনে ফেলা হয়ে গেছে কীসের কী মূল্য।

    তাই, আবার যদি সেই মূল্যহীনতার বোঝাকে পরম মূল্যবানের ভানে বয়ে মরতে হয়, তার চাইতে যন্ত্রণা আর নেই।

    টিকতে পারবে না।

    আর সেই ছোট্ট ঘরখানার বিরাট শূন্যতা!

    সেও কি অহরহ গ্রাস করতে আসবে না সুমনাকে?

    কিন্তু এ বাড়িতেও সুমনাকে নেবে না।

    সিদ্ধার্থর বাড়িতে। সুমনা বুঝতে শিখেছে।

    শুধু সুমনার বুঝতে শেখা নয়, নিজের মুখে বলতেও লজ্জা পায় না সিদ্ধার্থ। বলে, তোমার হিতৈষিণী জেঠিমা যা একখানি ছুরি বসিয়ে রেখেছেন, তাকে টেনে তুলতে গেলেই রক্তপাত! রোগীর মৃত্যু। অতএব

    অতএব কী করা, সেই আলোচনাতেই কেটে যায় ঘন্টার পর ঘণ্টা।

    বিকেল গিয়ে সন্ধ্যা নেমে আসে।

    স্থির হয়, বিয়েটার আর দেরি করা নয়।

    ওটা করে ফেলে ঘাঁটি শক্ত করে নিয়ে ছোট একটি ফ্ল্যাট নেবে সিদ্ধার্থ!

    কোথায় পাবে?

    তাও আছে তার সন্ধানে।

    এক বন্ধুর বাসার বড় ভাড়া বেশি। দুখানা ঘর বিলি করতে চায় সে। অবশ্য বাড়িওলার চোখে ধুলো দিয়ে।

    হোক! অত সততায় কাজ নেই। ইদানীং তো এই তালেই ঘুরছে সিদ্ধার্থ। সামনেই যে চার্টার্ড অ্যাকাউন্টেন্সি পরীক্ষা তার, তা খেয়ালও করছে না।

    বাসা নেবে।

    দুজনে পাতবে ছোট সংসার।

    না, কান্তিকুমারের কাছে হাত পাতবে না সিদ্ধার্থ। হাত পাততে গেলেই কথা উঠবে উভয় পক্ষের সম্মতির!

    সম্মতি!

    কোথায় সেই সাপের পা, ব্যাঙের হাঁচি, স্বাতীনক্ষত্রের জল?

    অসম্মতি তো অনিবার্য। তা ছাড়া–কী দরকার সেই বর বামুন নাপিত পুরুত, হইহই রইরই!

    সুমনার আর রুচি নেই তাতে।

    এ বাড়ির বড় মেয়ে হিসেবে তার বিয়েতে যে সমারোহ হবার কথা, তার একটা আভাসময় কল্পনা মনের মধ্যে ছিল সেই কোন ছেলেবেলা থেকে।

    ঠাকুমা কান্না ভোলাতে বসলেই বলতেন, সে যা লোক নেমন্তন্ন হবে! কলকাতার শহরে ধরবে না। গয়না যা হবে, এই বড় বড় দশ আলমারি। আলো যা জ্বলবে রাতকে মনে হবে দিন। আর বাজনা যা বাজবে–দেশসুদু লোকের কানে তালা ধরে যাবে

    সে বিয়ের সম্ভাবনা সুমনা নিজে নষ্ট করেছে।

    আর হয়তো তার প্রয়োজন ঘুচে গেছে। এ বাড়ির ঋণ আকণ্ঠ হয়ে উঠেছে সুমনার। আর বেশি না জমে।

    অতএব ওরা নিজেরা বিয়ে করবে।

    আর তার আগে একদিন সিদ্ধার্থের সঙ্গে গিয়ে জন্মপরিচয়হীন ছেলেটাকে জন্মপরিচয়হীনের গোত্রে মিলিয়ে দিয়ে আসবে।

    করবে মন কেমন হবে কষ্ট। কী আর করা যাবে।

    ভুলে যাবে লেখাপড়ার মধ্যে। সত্যি তো আর নিজের নাড়িছেঁড়া ধন নয়।

    .

    অনেকক্ষণ পরে হঠাৎ ব্যস্ত হয়ে উঠল দুজনেই।

    সুমনার মনে পড়ল দুটো ছেলেমানুষের কাছে রেখে এসেছে ছেলেটাকে। সিদ্ধার্থের মনে পড়ল, সে এক বন্ধুর উদ্দেশে পাইকপাড়ায় যাচ্ছিল।

    .

    চোরের মতো ভয়ে ভয়ে ঢুকল সুমনা।

    কান পেতে দেখল কোথাও কোনও কান্নার গলা আর্তনাদ করছে কিনা। গুমরে উঠছে কিনা।

    না। কোথাও কিছু না।

    বরং বড় বেশি যেন নিথর। বুকটা ছাঁৎ করে উঠল।

    কিছু বিপদ ঘটেনি তো?

    পড়ে যায়নি তো অজীনের হাত থেকে? দেরি হচ্ছে দেখে অঞ্জু দুধ খাওয়াতে গিয়ে টাকরায় সটকে দেয়নি তো?

    ওপরে গিয়ে কী দেখবে সুমনা? নিথর ঘুমন্ত একটা শক্ত হয়ে যাওয়া ফুলের দেহ?

    শিশু অন্তর্যামী।

    তাই কি মুক্তিপিপাসু সুমনার ষড়যন্ত্র ধরা পড়ে গেছে তার কাছে? আর ক্ষোভে ধিক্কারে নিজেই। মুক্তি দিয়ে গেছে সে সুমনাকে?

    অরুণা!

    নিজের গলা নিজের কাছে অপরিচিত ঠেকল। কদর্য ঠেকল।

    অরুণাও চমকে তাকাল।

    পড়ছিল নীচের দালানে বসে। অবশ্য গল্পের বই। নইলে অত নিবিষ্ট হবার কথা নয়।

    কী বলছ দিদি?

    কী বলছে।

    কী বলতে ডেকেছিল সুমনা?

    ও!

    বলল, বাড়িটা এত চুপ কেন?

    কী জানি। এমনি।

    কী জানি। এমনি!

    অরুণা কি বাড়ির সমস্ত খবর রাখে?

    কী জানি এমনি, মানে? বাড়ির সবাই বাড়িতেই আছে তো?

    আছে তো! শুধু জেঠিমা জেঠামশাই পাঠ-বাড়ি থেকে এখনও

    জানি। বলে সিঁড়ি দিয়ে উঠে যায় সুমনা।

    তাড়াতাড়ি ঘরের দিকে যায়।

    না দেখলে বিশ্বাস নেই।

    ঘরে ঢুকতেই থমকে দাঁড়াল।

    মার কাছে খোকা!

    কোলে নয়!

    কাছে নিয়ে আগলাচ্ছেন।

    সুমনা অস্ফুট মন্তব্য করে, কী হয়েছে?

    নাঃ হবে আর কী?

    সুজাতা মেয়ে ঘরে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে দাঁড়িয়ে উঠে গম্ভীর মুখে বলে, তুমি তো আজকাল নিত্যই বেরোচ্ছ, এটাকে অন্তত সারদার মার জিম্মাতেও রেখে যেতে পারো। আমাদের না বলে ছোটদের কাছে রেখে গেলে

    না, মরে যায়নি। ঘুমোচ্ছে।

    কিন্তু ঘুমন্ত দেখলেও যে এত মন-কেমন করে তা তো জানত না সুমনা। তবু ছুটে এল না। আস্তে কাছে এসে আস্তে বলল, প্রফেসর আর. কে. সেনের কাছে গিয়েছিলাম, দেরি হয়ে গেল।

    সুজাতা চলে যেতে যেতে বলে, প্রফেসর মাস্টার, এদের সঙ্গে এখনও সম্পর্ক আছে তোমার? আমরা তো জানি তোমার ইহকাল পরকাল সবই এখানে বন্ধক দেওয়া হয়ে গেছে!

    হ্যাঁ, গিয়েছিল। সহসা সুমনা রুক্ষকণ্ঠে বলে ওঠে, আর থাকবে না। যার জন্যে এত, তাকে এবার বিদেয় করে দিচ্ছি। বলেই

    ঘুমন্ত কচি মুখটার দিকে চোখ পড়তেই চোখ দিয়ে জল ঝরে পড়ে তার। সমস্ত রুক্ষতা গলে গলে পড়ে।

    .

    বাসা নিচ্ছিস? সেই আলাদা বাসায় থাকবি?

    সিদ্ধার্থের মা বিস্ময় বিরক্তিতে ফেটে পড়েন, বাড়ি ছেড়ে আলাদা থাকতে যাবি?

    এইরকমই তো ঠিক করছি।

    ঠিক করছিস! একেবারে ঠিক করছিস। হঠাৎ বাড়ির কী অপরাধ হল?

    বড্ড বেশি গোলমাল! পড়া হচ্ছে না।

    সিদ্ধার্থের মা সন্দিগ্ধ কণ্ঠে বলেন,দেখ, তুই আসিসনে আমার সঙ্গে চালাকি করতে। বাড়িতে গোলমাল বলে তুমি আলাদা বাসাভাড়া করছ! এতবার এত একজামিন দিলি, আর এটাই এত বড় হয়ে উঠল! আরও কী মতলব ফেঁদেছিস তাই বল।

    এতই যদি বুঝতে পারছ মা, বাকিটাও তা হলে অনুমান করে নাও।

    করতে আমার বাকি নেই সিদ্ধি!

    সহসা হেসে ওঠে সিদ্ধার্থ।

    বলে,মা, তুমি একটা জ্যোতিষালয় খুলে বোসো না কেন? দুদিনে পসার করে ফেলতে পারবে।

    সিধু, বাজে কথায় ভাঁওতা দিয়ে আসল কথা চেপে যাচ্ছিস। আমি বলছি, ঠাকুরঝির ভাগ্নের মেয়েকে বিয়ে করো আর না করো–ও মেয়েকে বিয়ে করা চলবে না। কিছুতেই না।

    কী যে বলো মা! অচল কীসে! ওরা আমরা এক জাত। ওর বাবা-মানে মর্যাদায়—

    জননী গম্ভীর কণ্ঠে বলেন,তোমার বাপেরও একটা বংশমর্যাদা বলে জিনিস আছে—

    সিদ্ধার্থ সহসা তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বলে ওঠে, আছে, অতি উত্তম। কিন্তু কান্তিবাবুর মেয়েকে বিয়ে করলে সে মর্যাদা রসাতলে যাবে কীসে?

    জননী কী বলতে যাচ্ছিলেন, অকুস্থলে পিসিমা এসে হাজির হলেন, এবং ঘৃণাবিজড়িত কণ্ঠে বলেন, ইতিহাস জানতে তো বাকি নেই, তবে আবার ন্যাকা সাজছিস কেন সিধু? কান্তিবাবুর ও মেয়ের কি আর এদিকে বিয়ে হবে? দূরে বিদেশে-টিদেশে যদি হয়।

    সিদ্ধার্থ এক পলক চুপ করে থেকে দৃঢ়স্বরে বলে, এই দেশেই হবে পিসিমা। তবে এ বাড়িতে জায়গা হবে না জানি, তাই নূতন বাসা নিয়েছি।

    আচ্ছা ভালই করেছ– সিদ্ধার্থের মা নীরস স্বরে বলেন, বাপভাইকে তুমিই নিজেই বোলো।

    আমি বলতে পারব না। কান্তিবাবু একটা মিথ্যে গল্প বানিয়ে ওই ধর্মের ধ্বজা মেয়েকে আর সোহাগের নাতিকে নিয়ে দিব্যি ঘর করছেন। নাতির জুতো আসছে, জামা আসছে, লজ্জার বালাই মাত্তর নেই। সেই মেয়েকে তুই বিয়ে করবি?

    না করে উপায় নেই বলেই করব।

    গম্ভীরভাবে বলে সিদ্ধার্থ। হয়তো কথাটা কিছু ভেবেই বলে না। হয়তো শুধু মাকে থামাবার জন্যে বলে। কিন্তু হঠাৎ পিসি ওই কয়েকাক্ষর সংবলিত বাক্যটুকুর গুঢ়ার্থ আবিষ্কার করে চেঁচিয়ে উঠে বলেন, কী বললি?

    কী বললাম

    ওই মেয়েকে বিয়ে না করে উপায় নেই তোর?

    সহসা সিদ্ধার্থের মনের মধ্যে একটা বিদ্যুৎ খেলে যায়। মুখে ফুটে ওঠে একটা সংকল্পের আভাস, তাই স্থির স্বরে বলে, হ্যাঁ তাই-ই।

    সিদ্ধার্থের মা কিছুক্ষণ পাথরের মতো অনড় হয়ে তাকিয়ে থেকে বলেন, তাই! তাই অত বুকের পাটা তার! ছি ছি ছি সিধে! তোরা আবার এম. এ., বি. এ. পাসের বড়াই করিস! তোরা আবার শিক্ষার অহংকার করিস। ঘি আর আগুনের হুঁশিয়ারি করতে গেলে বড্ড তোদের অপমান হয়, তাই যে হুঁশ করিয়ে দিতে আসে, তাকে ব্যঙ্গ করিস, বিদ্রূপ করিস, নিচুমন বলিস। ওই মেয়েটার সঙ্গে অত ঘোরাঘুরি দেখে তোর দাদা যেদিন আমাকে দিয়ে বারণ করিয়েছিল, সেদিন দাদাকে যে বড্ড অপদস্থ। করেছিলি? আজ একথা নিজের মুখে কবুল করতে লজ্জা করল না তোর?

    সিদ্ধার্থ দাঁতে ঠোঁট কামড়ে বলে, করল না তো দেখছি।

    হঠাৎ পিসি বলে ওঠেন,দেখ বউ, ঘরের ছেলে, তাই আমি সন্দেহ ব্যক্ত করিনি। তুমিই বা কী মনে করবে। কিন্তু লক্ষ্মীছাড়া ছেলে যখন নিজে মুখে কবুল করল, তখন বলি–এ সন্দেহ আমার গোড়াগুড়িই হয়েছিল!

    হয়েছিল নাকি! বাঃ। চমৎকার তো!

    বলে ব্যঙ্গের একটা তীক্ষ্ণ হুল ফুটিয়ে চলে যায় সিদ্ধার্থ।

    ঠিক, ঠিক বলেছে সুমনা।

    বিশ্বাস কথাটা একটা অভিধানের শোভা, অর্থহীন শব্দ। বিশ্বাস জিনিসটা একটা শেকড়হীন রঙিন ফুল। ওকে যদি কাঁচের বাটিতে ফটিক জলে ভিজিয়ে রেখে দাও, বাহারের আর শেষ নেই। কিন্তু একটি ফুল তুলতে যাও–ডালপালা সবসুদ্ধ উঠে আসবে।

    পিসিমার গোড়াগুড়িই সন্দেহ হয়েছিল! তা হলে মারই বা হতে বাধা কী। হয়তো বাবা দাদা সকলেরই হয়েছে।

    এদের কাছে কী মূল্য সিদ্ধার্থের সুনাম-দুর্নামের?

    দুটোই সমান।

    তবে একটার বিনিময়ে যদি সিদ্ধার্থ খানিকটা সংঘর্ষের হাত এড়াতে পারে, কেন তা করবে না?

    ⤶ ⤷
    1 2 3 4
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleনদী দিকহারা – আশাপূর্ণা দেবী
    Next Article জীবন-স্বাদ – আশাপূর্ণা দেবী

    Related Articles

    হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    ভয় সমগ্র – হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    December 9, 2025
    হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    কিশোর অ্যাডভেঞ্চার সমগ্র – হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    December 9, 2025
    সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    প্রকাশ্য দিবালোকে – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    November 18, 2025
    সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    তারপর কী হল – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    November 17, 2025
    মাইকেল মধুসূদন দত্ত

    শর্ম্মিষ্ঠা নাটক – মাইকেল মধুসূদন দত্ত

    November 11, 2025
    সত্যজিৎ রায়

    মানপত্র সত্যজিৎ রায় | Maanpotro Satyajit Ray

    October 12, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Generic selectors
    Exact matches only
    Search in title
    Search in content
    Post Type Selectors
    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Our Picks

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }