Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    রূপমঞ্জরী – ২য় খণ্ড – নারায়ণ সান্যাল

    September 3, 2025

    রূপমঞ্জরী – ৩য় খণ্ড – নারায়ণ সান্যাল

    September 3, 2025

    কাঁটায়-কাঁটায় ৫ – নারায়ণ সান্যাল

    September 3, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • 🔖
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    Subscribe
    সাইন ইন
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    দ্বিখণ্ডিত – তসলিমা নাসরিন

    তসলিমা নাসরিন এক পাতা গল্প779 Mins Read0

    ১১. দিবস রজনী আমি যেন কার আশায় আশায় থাকি

    দুপুরে অসীম সাহা হাসপাতালে ফোন করে খবর দেন রুদ্র অসুস্থ, হলি ফ্যামিলি হাসপাতালের দুশ একত্রিশ নম্বর কেবিনে ভর্তি। খবরটি শুনে আমি আর দেরি করিনি, একটি রিক্সা নিয়ে সোজা হলি ফ্যামিলি হাসপাতালের দিকে যাই। হাসপাতালের গেটের কাছে ফুলের দোকানে নেমে একগোছা রজনীগন্ধা কিনি। রুদ্রর খুব প্রিয় ফুল রজনীগন্ধা। হাসপাতালের নার্সের ঘরে গিয়ে একজন নার্সকে অনুরোধ করি দুশ একত্রিশ নম্বরে গিয়ে আমার নামটি রুদ্রকে বলতে, রুদ্র অনুমতি দিলে আমি ভেতরে ঢুকবো। ভেতরে রোগী দেখার অনুমতি হয়ত সবাই পায় না। আমি পাবো সে ব্যপারে আমি নিশ্চিত নই। রুদ্রর ঘরে রুদ্র ছাড়াও অন্য কেউ থাকতে পারে, আমার উপস্থিতি হয়ত পছন্দ করবে না। নার্স একবার বলেছিল, আপনি সোজা চলে যান রুমে। সোজা চলে যাওয়ার চেয়ে অনুমতি নিয়ে যাওয়া উচিত বলে আমি অপেক্ষা করি। অনুমতি মেলে। আমি জানি, অন্য কেউ না বললেও রুদ্র আমার নাম শুনলেই দেখা করতে বলবে। রুমে রুদ্রর তিনটে বোন ছিল, কারও সঙ্গে কোনও কথা হয়নি, কথা কেবল রুদ্রর সঙ্গেই হয়েছে। কাছে গিয়ে দাঁড়ালে বলেছে, ‘বসো’।

    রজনীগন্ধাগুলোর ঘ্রাণ নেবে কী! নাকে নল। ফুলগুলো টেবিলের ওপর রেখে দিই। শিয়রের কাছের চেয়ারটিতে বসে জিজ্ঞেস করি, ‘কী হয়েছে তোমার?’

    ‘ডাক্তার বলল পেটে নাকি আলসার।’ রুদ্র মাথা নাড়ায় না। কেবল চোখ নাড়িয়ে এপাশ ওপাশ তাকায়। মুখটি বড় মলিন।

    ‘পেটের আলসার এমন কোনও ব্যপার নয়। সেরে যাবে।’

    ‘সেরে যাবে?’

    ‘নিশ্চয়ই। এ রোগ শতকরা আশি জনের হয়। এ কোনও রোগ হল!’

    ‘নাকে নল নিয়ে তোমাকে লাগছে কেমন বলো তো!’ আমি মুচকি হাসি।

    আমার ডানহাতের আঙুলগুলো রুদ্রর চুলে বিলি কাটছে। বাম হাত তার বুকে।

    ‘কষ্ট হচ্ছে?’

    ‘কষ্ট তো হচ্ছেই।’

    ‘একটুও ভেবো না। তুমি খুব শিগরি ভাল হয়ে উঠবে।’

    ‘কী জানি! এ যাত্রাই শেষ যাত্রা কি না।’

    ‘বাজে কথা বলো না।’

    এরপর রুদ্র মৃদু স্বরে কে কে তাকে দেখতে এসেছিল, কোন কোন কবি লেখক, কি কি বলেছে তারা, কি কি করেছে, বলে। বলে শিমুলের কথাও।

    ‘আজই এসেছিল। চুপচাপ বসেছিল। মুখ ভার।’

    ‘কেন, ভার কেন?’

    ‘বোধহয় আমার এই অবস্থা দেখে মন খারাপ হয়ে গেছে। কোনও কথাই বলেনি।’

    ‘বিয়ে করছো কবে?’

    ‘যদি সুস্থ হই..’

    ‘সুস্থ তো নিশ্চয়ই হবে।’

    শিমুলের কথা যখন বলে রুদ্র তার মলিন মুখটি উজ্জ্বল দেখায়। বুঝি, শিমুলকে খুব ভালবাসে রুদ্র। অনেকক্ষণ শিমুলের কথাই বলে সে।

    ‘দূরে বসেছিল। কাছে এসে বসতে বলেছে, কাছে আসেনি।’

    ‘কেন আসেনি?’

    ‘রাগ করে আসেনি। অসুখ বাঁধিয়েছি বলে রাগ করেছে।’

    ‘ভাল, ওর হাতে পড়লে তোমার অনিয়ম করা চলবে না।’

    রুদ্রর উজ্জ্বল মুখে হাসি। আমিও হাসতে চেষ্টা করি। যেন রুদ্রকে অন্যের হাতে সঁপে দিতে আমার মোটেও কষ্ট হচ্ছে না।

    রুদ্রর সঙ্গে কখনও আমার ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে কোনও কথা হয়নি। সম্ভবত লোকের কাছে শোনে সে। আমি একা থাকি নাকি কারও সঙ্গে থাকি, ভাল আছি কী ভাল নেই — কিছু সে কোনওদিন জানতে চায়নি। নিজের কথা বলে সে। নিজের প্রেমের কথা। নিজের কবিতার কথা। অসুখের কথা। সুখের কথা।

    ‘শিমুলকে নিয়ে লিখলে কিছু,কোনও কবিতা?’

    ‘হ্যাঁ।’ রুদ্র ধীরে মাথা নাড়ে।

    ‘কাছে নেই?’

    ‘কাছে! হাসপাতালে!’ রুদ্র ম্লান হাসে।

    ‘নয় কেন! তোমার কবিতার খাতা তো সঙ্গে থাকেই তোমার! সে যেখানেই যাও।’

    ‘আর বোলো না। এই হাসপাতাল থেকে জলদি বেরোতে পারলে বাঁচি।’

    ‘অস্থির হয়ো না। আগে সুস্থ হও, তারপর বাড়িতে তো যাবেই। খাবারের আগে পরে খাওয়ার জন্য ডাক্তার কিছু ওষুধ লিখে দেবে। সেসব খেও নিয়মিত। পকেটে এন্টাসিড ট্যাবলেট রাখবে বাইরে গেলে। এসিডিটির ভাব দেখলে খেয়ে নেবে।’

    ‘ডাক্তার বলেছে ব্লাড প্রেশার বেশি।’

    ‘ব্লাড প্রেশার বেশি? বল কি! এই বয়সে ব্লাড প্রেশার বাড়বে কেন! ঠিক দেখেছে ডাক্তার?’

    ‘বলল তো!’

    ‘তাহলে তোমাকে খুব সাবধান থাকতে হবে। প্রেশার কমার ওষুধ দিচ্ছে তো!’

    ‘দিচ্ছে।’

    ‘কি বলল? সিগারেট মদ সব আগের মত চালিয়ে যেতে বলেছে?’

    ‘এবার বোধহয় সব ছাড়তেই হবে।’

    ‘ছেড়ে দাও। ছেড়ে দাও। নিয়মিত খাওয়া দাওয়া কোরো, দেখবে পেটের অসুখে আর ভুগতে হবে না।’

    সেদিন কথা দিয়েছিলাম আবার তাকে দেখতে যাবো। সেই দেখতে যাওয়া আর হয়নি। এরপর তো ইয়াসমিন এল শান্তিবাগের বাড়িতে, মিলন এল। মিলন ঢাকায় এসেছে চাকরি করতে। বাসাবোর এক গলিতে তার বোনের বাড়িতে ছিল, এখন এ বাড়িতে নিয়ে এসেছি। এতদিন বিয়ের কলংক নিয়ে মুখ লুকিয়েছিলাম। অবকাশে যাইনি। আত্মীয় স্বজন কারও সঙ্গেই দেখা করিনি। পূর্বাভাস পত্রিকায় আমার কলামের সমালোচনা করতে গিয়ে এক লোক লিখেছিল, যার এক কান কাটা সে কাটা কানটি আড়াল করতে রাস্তার এক কিনার দিয়ে হাঁটে, আর দুই কান কাটা যার, সে রাস্তার মধ্যিখান দিয়ে হাঁটে, কারণ তার আড়াল করার কিছুই নেই, আমি কাটা দুটো কান নিয়ে নির্লজ্জের মত রাস্তার মধ্যিখান দিয়ে হাঁটছি। আমি নির্লজ্জ বলে এমন আবোলতাবোল কথা লিখছি কলামে। আমাকে অপদস্থ করার জন্য লেখাটি। হেনস্থার যেহেতু শেষ নেই, রাস্তার মধ্যিখান দিয়েই হাঁটব পণ করেছি। একাধিক বিয়ের লজ্জা, দুর্নামের ভয় ইত্যাদি নিয়ে মুখ লুকিয়ে থাকলে আর কারও লাভ হয় হয়ত, আমার কিছু হয় না।

    ইয়াসমিনকে নিয়ে ছোটদার বাড়িতে গিয়েছি সুহৃদকে দেখতে, তখনই ও বাড়িতে আমার ফোন এল। ও বাড়িতে আমার ফোন, অবাক কাণ্ড বটে। হ্যাঁ ওটি আমারই ফোন। করেছে ক্যারোলিন রাইট। ক্যারোলিন রাইট আমেরিকার কবি, এখানে ফুলব্রাইট স্কলারশিপ নিয়ে বাঙালি মহিলা কবিদের কবিতা নিয়ে গবেষণা করতে এসেছে। আমার কবিতার ওপরও তাঁর গবেষণা চলছে, অনুবাদও কয়েকটি কবিতার করেছে। ক্যারোলিনের সঙ্গে দুদিন দেখা হয়েছে বাংলা একাডেমিতে যখন সে মুহম্মদ নুরুল হুদার সাহায্য নিয়ে আমার কবিতা অনুবাদ করছিল। ক্যারোলিনকে যে আমার খুব পছন্দ হয়েছে তা নয়। কিছুদিন এখানে থেকেই ভাব এমন যে এখানকার রাজনীতি, সমাজনীতি অর্থনীতি, সাহিত্য সংস্কৃতি সবই তার নখদর্পণে। এর মধ্যেই সৈয়দ মঞ্জুরুল ইসলামের প্রেমে পড়ে গেছে, মঞ্জুরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, ক্যারোলিনকে সাহায্য করছিলেন অনুবাদে। ক্যারোলিন যে কারও শোবারঘরে বড় নাক গলাতে চায়। আমি কটি বিয়ে করেছি, কাকে বিয়ে করেছি, ইত্যাদি জানার জন্য ক্যারোলিনের উৎসাহ টগবগ করে। বিদেশি মেয়ে, ধারণা ছিল কারও ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে মাথা ঘামায় না। দেখলাম, কবিতার চেয়ে কবি নিয়ে গবেষণা করার আগ্রহ তার বেশি। চরিত্র অবিকল গুঁজাবুড়ি কুটনিবুড়ির। পরে এই ক্যারোলিনকেই, যেহেতু সে সুন্দর বাংলা শিখেছে, একদিন টেলিভিশনের একটি অনুষ্ঠানে তার কবিতা পড়ার সুযোগ করে দিই। টেলিভিশন থেকে আমাকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল, আমি প্রযোজিকাকে বলে কয়ে ক্যারোলিনকে ঢুকিয়েছি অনুষ্ঠানে। ক্যারোলিন সে কী খুশি! চশমা পরলে তাকে নাকি কুৎসিত লাগে তাই চশমা খুলে ক্যামেরার সামনে এসেছিল। চশমা ছাড়া কাগজ দেখে নিজের লেখা পড়তেও তার অসুবিধে হচ্ছিল, তবু সে চশমাটা পরে নেয়নি, এমন। চশমা জিনিসটি আমার এত ভাল লাগে যে ছোটবেলায় চশমা পরার জন্য মধ্যাহ্নের সূর্যের দিকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা তাকিয়ে থাকতাম, চোখের ভেতর খোঁচাতাম যেন চোখ নষ্ট হয়, যেন বাবা আমাকে চোখের ডাক্তারের কাছে নিয়ে যান, যেন চোখের ডাক্তার আমার চোখ পরীক্ষা করে বলেন যে আমার চোখ নষ্ট, যেন একটি চশমা আমাকে দেন পরতে। ক্যারোলিন সেদিন ফোনের ওপাশ থেকে ভাঙা বাংলায় বলল, ‘রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ মারা গেছে, তুমি জানো?’

    ‘কি বললে?’

    ‘রুদ্র মারা গেছে।’

    ‘রুদ্র মারা যাবে কেন?’

    ‘আজ সকালে মারা গেছে।’

    ‘পাগলের মত কথা বলছো কেন! আমি তো সেদিন মাত্র রুদ্রকে দেখে এলাম হলি ফ্যামিলি হাসপাতালে। মরে যাওয়ার মত কোনও অসুখ ওর হয়নি।’

    ‘কিন্তু আমি শুনলাম মারা গেছে।’

    ‘তোমাকে কে বলেছে এসব কথা?’

    ‘বলেছে একজন। একজন কবি।’

    ‘নাম কি? যদি বলে থাকে মিথ্যে বলেছে ।’

    ‘কিন্তু সে কবিটি মিথ্যে বলবে না। তুমি খোঁজ নিয়ে দেখো।’

    ‘শোনো ক্যারোলিন,রুদ্র হাসপাতালে এই কথাটি হয়ত তোমাকে বলেছে, তুমি শুনতে ভুল করেছো।’

    ‘আমাকে ষ্পষ্ট বলল মারা গেছে।’

    ‘তাহলে যে বলেছে সে জানে না। কারও কাছে হয়ত শুনেছে যে রুদ্রর অসুখ। বানিয়ে বানিয়ে বলে দিল মারা গেছে। কানে কানে কত রকম খবর যে পৌঁছোয়।’

    ‘যাই হোক, তুমি খবর নিও।’

    ক্যারোলিনের খবরটিকে সত্য মনে করার কোনও কারণ আমি দেখিনি। তবু ইয়াসমিনকে নিয়ে হলি ফ্যামিলি হাসপাতালে যাই। হাসপাতালে রুদ্র যে কেবিনে ছিল সে কেবিনে খোঁজ নিয়ে দেখি রুদ্র নেই। নার্সকে জিজ্ঞেস করলে বলল, ‘রোগী গতকাল বাড়ি চলে গেছে।’

    ‘সুস্থ হয়েছিল?’

    ‘হ্যাঁ হয়েছিল।’

    ‘পুরোপুরি সুস্থ হয়েছিল, নাকি রোগী এখানে থাকতে চায়নি বলে নাকে নল টল নিয়ে বাড়ি চলে গেছে।’

    নার্স আমার দিকে বিরক্ত ভঙ্গিতে তাকিয়ে বলে, ‘সুস্থ না হলে কি ডাক্তার ডিসচার্জ দেয় নাকি?’

    নার্স রুদ্রর ফাইল বের করে আমাকে দেখিয়ে বলল, ‘রোগী ভাল হয়ে গেছে, ডাক্তার তাই বাড়ি চলে যেতে বলেছে।’

    হলি ফ্যামিলি থেকে রিক্সায় উঠে গজরাতে থাকি। ‘মানুষের মুখের কোনও লাগাম নাই। যা ইচ্ছ! তাই বইলা ফালায়। রুদ্র ভাল হইয়া দিব্যি হাসপাতাল থেইকা বাসায় গেছে । আর মানুষে কয় যে মারা গেছে।’ বলি কিন্তু রিক্সাঅলাকে বলি ইন্দিরা রোডের দিকে যেতে।

    ইয়াসমিন বলে, ‘ইন্দিরা রোডে যাইবা কেন?’

    ‘দেখি গিয়া। রুদ্র বাসায় ঠিক মত গেছে এইডা একটু কনফার্ম হইয়া আসি। অবস্থা খারাপ হইলে তো নার্সই কইত।’

    জানি খবরটি সত্য নয়, তবু সারা রাস্তা আমি অন্যমন বসে থাকি। ইয়াসমিন বলে, ‘কি চিন্তা কর? কিছু ত হয় নাই। এমনি একটা গুজব।’

    ‘গুজবই আসলে।’

    ‘কী অসুখ ছিল? হাসপাতালে ছিল কেন?’

    ‘বেশি কিছু না। পেটের আলসার ছিল। আমি দেইখা গেলাম সেইদিন। ভাল ট্রিটমেন্ট চলতাছিল। মারা যাবে কেন? মারা যাওয়ার তো কোনও কারণ থাকতে হবে। যে মানুষ হাসপাতাল থেইকা আলসারের ট্রিটমেন্ট পাওয়ার পর সুস্থ হইয়া বাসায় যায় গা, সেই মানুষ নাকি মারা গেছে। এর মত আজগুবি কথা আরও আছে? যদি কোনও কঠিন অসুখ হইত, বুঝতাম।’

    ইন্দিরা রোডে যাচ্ছি কিন্তু রুদ্রর বাড়ির ঠিকানা জানি না। ঝিনাইদহ থেকে যে রাতে এসেছিলাম, পথ আবছা যেটুকু মনে আছে, অনুমান করে এগোতে থাকি। হঠাৎ দেখি এক গলিতে চার পাঁচজন লোক দাঁড়িয়ে আছে। এরমধ্যে দুজনকে চিনি, একজন মইনুল আহসান সাবের। বুকের ভেতর হঠাৎ ভীষণ ঝড়ো হাওয়া এসে যা কিছু ছিল বুকে সব ছিনিয়ে নিয়ে যায়। মুহূর্তে রক্ত যেন ঠাণ্ডা হয়ে গেছে। শরীরে কাঁপুনি ওঠে। অন্ধকার লাগে সামনের সব কিছু। চোখ বন্ধ করে দাঁতে দাঁত চেপে নিজের এই কাঁপনকে রোধ করতে করতে বলি, ‘ইয়াসমিন রুদ্রর বন্ধুরা এইখানে কেন! কী হইছে?’

    ইয়ামমিন কোনও কথা বলে না।

    ‘তাইলে কি সত্যি খবরটা?’

    ইয়াসমিন কোনও কথা বলে না।

    রিক্সা এগোতে থাকে। আরও মানুষের জটলা, আরও চেনা মুখ।

    ‘না, খবরটা সত্যি হইতে পারে না। অসুখ বোধহয় বেশি।’

    আমি সান্ত্বনা খুঁজি। ইয়াসমিনের হাত চেপে ধরে রাখি।

    ‘ক কথা ক। ঠিক না!’

    ইয়াসমিন কোনও কথা বলে না।

    ‘এত মানুষ কেন! সবাই ইন্দিরা রোডে কেন! কোনও কবিতার অনুষ্ঠান আছে বোধহয় এই গলিতে! নাকি রুদ্রর কাছে আইছে তারা! কিন্তু এত মানুষ আইব কেন?’ চাপা আর্তনাদ আমার কণ্ঠে।

    ইয়াসমিন তার হাতটি আমাকে শক্ত করে চেপে রাখতে দেয়। কোনও কথা বলে না। যে বাড়িটির সামনে লোকের ভিড়, সেই বাড়ির কাছে রিক্সা থামিয়ে নেমে ভিড় সরিয়ে দৌড়ে দোতলায় উঠি আমি। ঘরের দরজা খোলা, কান্নার শব্দ ভেসে আসছে ভেতর ঘর থেকে। দরজার পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন অসীম সাহা।

    ‘অসীম দা, কী হয়েছে?’ বলার সঙ্গে সঙ্গেই তিনি হাউ মাউ করে কেঁদে উঠে বললেন, ‘নাসরিন, রুদ্র নেই।’

    ‘কি বলছেন এইসব!’

    শরীর থেকে শরীরের সব শক্তি কর্পুরের মত উবে যায়। শরীরটি দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না, পেছনের দেয়ালে ভর রেখেও শক্তিহীন শরীরটিকে আমি দাঁড় করাতে পারি না। পালকের মত এটি নিচে পড়তে থাকে। পুরো জগতটি লাটিমের মত ঘুরতে থাকে, শব্দহীন হয়ে যেতে থাকে সব। নিজের গলা ছেড়ে কাঁদার বা গোঙানোর বা কাতরানোর কোনও শব্দও আর শুনতে পাই না। অসীম সাহার কান্নার শব্দও আমার কানে আর পৌঁছে না। চারদিকের মানুষগুলোর মুখগুলোও আমার আর চেনা মনে হতে থাকে না। মানুষগুলো জলের ভেতরে নানারকম আকার নিয়ে ভাসতে থাকে। যেন মাছ সবাই। আমি একটি মৃত ডাল পড়ে আছি জলের তলে। মাছগুলো নিঃশব্দে সাঁতার কাটছে। ওভাবে কতক্ষণ পার হয় জানি না। চলতে চলতে হঠাৎ স্থির হয়ে আছে সময়। ঘড়ির কাঁটা হয়ত কোথাও টিক টিক করে চলছে, জগত হয়ত যেমন চলছিল, তেমন চলছে, আমার জগতে স্থির সময়ের মত সবকিছুই নির্বাক নিথর নিস্পন্দ হয়ে আছে। আমি আমাকে আর আমার ভেতর অনুভব করি না। আমি আর কিছুই অনুভব করি না। কেউ আমাকে স্পর্শ করলেও না। কেউ আমাকে ডাকলেও না।

    একটি মাছ এগিয়ে আসে মৃত ডালের দিকে। প্রজ্ঞা লাবণীর আকার ধরে মাছটি আমাকে স্পর্শ করে। স্পর্শটি আমাকে কোথাও কোনও মাছের বাজারের ভীষণ কোলাহলের মধ্যে টুপ করে ফেলে দেয়। আমি মাঝখানে দাঁড়িয়ে থাকি চারদিকের দরদামের চিৎকার, ঘামের গন্ধ আর এক ঘর নোংরার মধ্যে। আশ্চযর্, সব কিছুর মধ্যে, মেঝেয় শুয়ে কী নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছে রুদ্র। কোনও দুর্গন্ধ, কোনও কোলাহল তাকে জাগাচ্ছে না। রুদ্র, সেই রুদ্র, আমার ভালবাসার রুদ্র, দিবস রজনী আমি যার আশায় আশায় থাকি। ঘুমিয়ে আছে রুদ্র। একটি রেখা রেখা সাদা চাদরের ওপর শুয়ে ঘুমিয়ে আছে রুদ্র। এই চাদরটিতে দুজন শুয়েছি আমরা কত রাত। কত রাত আমাদের আনন্দ রসে ভিজেছে এই চাদর। কত রাত এই চাদরের যাদু আমাদের সাত আসমান ঘুরিয়ে এনেছে। কত রাত আমার সারা শরীরে চুমু খেতে খেতে আমাকে নিবিড় করে জড়িয়ে ধরে এই চাদরে ঘুমিয়েছে রুদ্র। এখন সে পুরো চাদর জুড়ে স্বার্থপরের মত একা শুয়ে আছে। আমাকে পাশে শুতে ডাকছে না। যেন রুদ্র শোনে, কেবল সে-ই শোনে শুধু, এমন নিভৃতে, প্রায় কানে কানে বলি ‘এই, এখন কি ঘুমোবার সময়! ওঠো। দেখ আমি এসেছি। চল কোথাও বেরিয়ে পড়ি। এখানে এত লোক! চল দুজন চুপ চুপ করে আলাদা হয়ে যাই। সেই আগের মত, ভিড় থেকে বেরিয়ে সেই যে চলে যেতাম কোথাও! হন্যে হয়ে নির্জনতা খুঁজতাম। ওঠো। না হয় না গেলে কোথাও, উঠে বসো তো বাবা, কবিতা শোনাও, নতুন কি লিখেছো, শোনাও। তোমার কোলে মাথা রেখে শুনব কবিতা। চমৎকার আবৃত্তি করে মুগ্ধ করে দাও সবাইকে।’

    রুদ্র ওঠে না। মিহি সুরে একটি কান্নার শব্দ শুনি, কান্নার কণ্ঠটি হঠাৎ কথা বলে ওঠে, ‘কী দেখতে এসেছো তুমি! কারে দেখতে এসেছো! দেখে যাও! দেখে যাও! প্রাণ ভরে দেখে যাও আমার ছেলেরে। কম কষ্ট তো দাওনি ওরে। দেখতে এসেছো এখন!’ পাথরের মত পার্থিব জগতটিতে দাঁড়িয়ে থাকি রুদ্রর পাশে। জগতের অশ্লীল শব্দগুলো আমাকে খোদাই করছে। শব্দ ভেসে আসছে লাশ ওঠাও, লাশ নামাও। রুদ্রকে রুদ্র না বলে ওরা লাশ বলে সম্বোধন করছে ! আহ রুদ্র, চোখ খোলো, দেখ, মোহন রায়হান তোমাকে লাশ বলে ডাকছে। মনে আছে, মেরে তোমার লাশ ফেলে দেবে বলেছিল যে ছেলেটি! দেখ, মুখে কেমন ফেনা তুলে ফেলছে তোমাকে লাশ ডাকতে ডাকতে। রাগ হচ্ছে না তোমার! আমি জানি না কখন পাথরটিকে কে সরিয়ে নিয়ে রিক্সায় তুলে দেয়। রিক্সা যাচ্ছে ট্রাকটির পেছন পেছনে, ট্রাকে রুদ্র। রুদ্র এখন টি এসসিতে যাবে। ওখান থেকে মিঠেখালি।

    ‘কি হইছে রুদ্রর?’ পাথর গলে যেতে থাকে।

    ‘সকালে ঘুম থেইকা উইঠা দাঁত মাজতে গেছিল। দাঁত মাজতে মাজতে হঠাৎ পইড়া গেছে। হার্ট এ্যাটাক।’

    ‘বাজে কথা কইস না। ইয়াসমিনকে ধমকে থামাই। ইয়াসমিন চুপ হয়ে যায়।

    অনেকক্ষণ পর ধীরে আমি, এই জগতে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করি, ‘ইয়াসমিন, রুদ্র কি সত্যিই মারা গেছে?’

    ইয়াসমিন কথা বলে না।

    ‘কথা ক। কথা ক ইয়াসমিন। সত্যি কইরা ক, ক যে মারা যায় নাই। ওর হার্ট এ্যাটাক হইব কেন? হার্টের তো কোনও প্রবলেম ছিল না ওর। ক যে মারা যায় নাই। ক যে ও ঘুমাইয়া রইছে।’

    ইয়াসমিন কথা বলে না।

    না, কোথাও কিμছু হয়নি। আমি আর ইয়াসমিন ঘুরে বেড়াচ্ছি ঢাকা শহরে। ইয়াসমিনের সঙ্গে আমার অনেকদিন পর দেখা। দুজন আমরা ময়মনসিংহের রাস্তায় যেমন ঘুরে বেড়াতাম, তেমন ঘুরে বেড়াচ্ছি। কোথাও যাইনি আমরা, কোনও ইন্দিরা রোডে যাইনি, কিছুই দেখিনি। রিক্সায় বসে ঘুমিয়ে পড়ার অভ্যেস আমার আছে, ঘুমিয়ে থাকার সময় কোনও দুঃস্বপ্ন দেখেছি হয়ত। কলকল করে উঠি সুখী স্রোতের মত, রিক্সার হুড ফেলে দিয়ে, ‘চল বেইলি রোডে যাই, শাড়ি কিনি গা।’

    ‘না।’

    ‘না কেন!’

    ‘বাসায় চল।’

    ‘কিসের বাসা! বাইরইছি ঘুরতে। চল ঘুইরা বেড়াই।’

    ‘না, বাসায় চল বুবু।’

    অনেকক্ষণ চুপ হয়ে বসে থেকে রিক্সাকে বলি টিএসসির দিকে যেতে। ইয়াসমিন বলে, ‘টিএসসিতে যাইও না।’

    ইয়াসমিনকে জোরে ধমক লাগাই চুপ থাকতে। ধমকে ইয়াসমিন চুপ হয় না। আমাকে জাপটে ধরে ভাঙা গলায় বলে, ‘বুবু, তুমি এমন কইর না।’

    ‘চল টিএসসিতে যাই। ওইখানে রুদ্র আছে।’

    ‘না।’

    ‘আমি রুদ্রর কাছে যাবো।’

    ‘বুবু, থামো এইবার। ওরা কেউ তোমারে পছন্দ করতাছে না। তুমি যাইও না টিএসসিতে।’

    আমি বিশ্বাস করতে চাই যে রুদ্র নেই। নিজেকে বার বার বলি রুদ্র নেই। রুদ্র আর নেই। রুদ্রর শরীর পড়ে আছে শুধু। সেই শরীরে হৃদপিণ্ডটি থেমে আছে, কোনও রক্ত সেখানে যাচ্ছে না, সেখান থেকে বেরোচ্ছে না, হৃদপিণ্ডের কোনও সংকোচন প্রসারণ হচ্ছেন!। রক্ত বইছে না শরীরে।ফুসফুস দুটো স্থির হয়ে আছে। রুদ্র শ্বাস নিচ্ছে না, ফেলছে না। রুদ্র আর জেগে উঠবে না। রুদ্র আর কবিতা লিখবে না। রুদ্র আর হাসবে না। রুদ্র আর কোনও মঞ্চে কবিতা পড়বে না। সবাই যার যার জীবন যাপন করবে, কেবল রুদ্র করবে না। বিশ্বাস করতে চাই, কিন্তু পারি না। আমার কিছুতে বিশ্বাস হয় না, রুদ্র সত্যি সত্যি নেই। রুদ্র নেই, এ কথা যখনই ভাবি, শকুন খেয়ে যাওয়া গরুর পাঁজর যেমন পড়ে থাকে বধ্যভূমিতে, আমার পাঁজরও অনুভব করি তেমন। খালি। ভেতরে কিছু নেই। হু হু করছে চারদিক, হু হু করছে বুকের ভেতর। শ্বাস নিতে চেষ্টা করি, কষ্ট হয়, যেন বাতাস ফুরিয়ে গেছে, পৃথিবীর সকল বাতাস। চারপাশের মানুষগুলো মানুষ নয়, সব শকুন। আমার চোখের কোটরে চোখ নেই। আমার খুলির ভেতর মস্তিস্ক নেই। সব খেয়ে গেছে কেউ। এই অনুভবটি আমার সমস্ত শরীরে সংক্রামক ব্যধির মত ছড়িয়ে যায়। রিক্সা কখন থেমেছে শান্তিবাগের বাড়িতে বুঝিনি, কখন উঠে এসেছি ঘরে, কখন দেয়ালে হেলান দিয়ে একা বসে আছি বুঝিনি। কতক্ষণ কত দীর্ঘক্ষণ বসে আছি কিছুই জানি না। হঠাৎ কাঁধে একটি হাত অনুভব করি কারওর, গভীর শূন্যতা থেকে চোখ উঠিয়ে দেখি নাইম। তখনই বাঁধ ভেঙে উতল সমুদ্রের জল নামে, ভাসিয়ে দেয় স্তব্ধ চরাচর।

    আমার পক্ষে ঢাকায় এক মুহূর্তের জন্য থাকা সম্ভব হয় না। ঢাকা যেন আচমকা আস্ত একটি শ্মশান হয়ে গেছে। শ্মশানে কোনও মানুষের চিহ্ন নেই। বাতাসে লাশের গন্ধ। ছোটদা খবর পেয়ে গাড়িতে মাল ওঠান। সপরিবার তিনি রওনা হন ময়মনসিংহে। আমি গাড়ির জানালায় মুখ রেখে দেখছিলাম গাছপালা ক্ষেত খামার। সবই তো যেমন ছিল, তেমনই আছে। কেবল রুদ্র নেই। রুদ্র আর হাঁটবে না কোনও পথে, আর ঘ্রাণ নেবে না কোনও ফুলের, আর নদীর রূপ দেখবে না, ভাটিয়ালি গান শুনবে না। আমার বিশ্বাস হয় না রুদ্র আর হাঁটবে না, ঘ্রাণ নেবে না, দেখবে না, শুনবে না। কেন যেন মনে হয় রুদ্র ফিরে আসবে। আবার হঠাৎ করে ফিরে আসবে একদিন। বলবে ‘মিঠেখালি গিয়েছিলাম, আজ ফিরেছি।’ যেমন ফিরে আসত বার বার। আমি কোনও অলৌকিকে বিশ্বাস করি না, কিন্তু আমার বিশ্বাস করতে ভাল লাগে যে রুদ্র ফিরে আসবে। আবার হাসবে, লিখবে,ভাববে, ভালবাসবে।

    ঢাকা শ্মশান শ্মশান লাগছিল বলে ময়মনসিংহে ফিরে দেখি এটিও শ্মশান। বিছানার তল থেকে আমার ট্রাংকটি টেনে এনে খুলি। রুদ্রর স্পর্শ পেতে খুলি। যে করেই হোক রুদ্রর স্পর্শ চাই আমি। তাকে আমি স্মৃতি হতে দিতে চাই না। রুদ্রর চিঠিগুলো পড়তে পড়তে পুরোনো দিনগুলো চোখের সামনে এসে দাঁড়ায়। দিনগুলো আমার এত কাছে যে আমি দিনগুলোকে স্পর্শ করি। দিনগুলোতে ভাসি, ডুবি, দিনগুলো নিয়ে খেলি, দিনগুলোকে চুলে বিনুনির মত বেঁধে রাখি। দিনগুলো হঠাৎ ঝাপসা হয়ে আসতে থাকে যখন কেউ আমাকে ডাকে। তাহলে সেই দিনগুলো নেই! সেই ভালবাসার দিনগুলো! সবই কেবল স্মৃতি! ভয়ংকর রকম নিঃসঙ্গ লাগে নিজেকে, ভয়ংকর রকম একা। নিজেকে সামনে নিয়ে বসে থাকি, এ জীবন নিয়ে কি করব আমি বুঝি না, মূল্যহীন মনে হতে থাকে জীবনটি। যে মানুষটি আমাকে ভালবাসত, সেই মানুষটি নেই! যে মানুষটির জন্য কতকাল আমি স্বপ্ন দেখেছি, নেই! যে মানুষটিকে ছেড়েছি, কিন্তু ছাড়িনি; যে মানুষটি থেকে দূরে সরেছি, কিন্তু দূরে সরিনি, সে নেই। এই নেই টি আমাকে বাড়ি কাঁপিয়ে কাঁদায়। পাড়া কাঁপিয়ে কাঁদায়। কালো ফটকের কাছে ভিড় করে কৌতুহলী চোখ। বাবা বাড়িতে। তিনি শুনেছেন একটি মুত্যুর খবর। তিনি আমার কান্নার দিকে কোনও ঢিল ছোঁড়েন না। আমাকে কাঁদতে দেন। বাড়ির সবাই আমাকে প্রাণভরে কাঁদতে দেয়।

    ঢাকায় ফিরে শ্মশান শ্মশান ঢাকাটি আমার আর সয় না। অসীম সাহার বাড়িতে যাই, অঞ্জনা সাহা, অসীম সাহার স্ত্রী, আমাকে আলিঙ্গন করেন শোকে। আমরা এক একটি কাঁধ খুঁজছিলাম মাথা রেখে কাঁদার। গভীর গোপন দুঃখগুলো প্রকাশের জন্য মানুষ খুঁজছিলাম আমরা। রুদ্রহীন এই নিস্তরঙ্গ নিঃসঙ্গ জগতের কথা বলতে থাকি আমরা। একসময় আমাদের শোক কোনও শব্দে প্রকাশ হয় না। আমাদের প্রতিবিন্দু অশ্রু রুদ্রর জন্য। আমাদের প্রতি কণা দীর্ঘশ্বাস রুদ্রর জন্য। কাছে পিঠে কোথাও যদি রুদ্র তুমি থাকো, দেখ, দেখ যে তোমার এই প্রস্থান আমরা কেউই গ্রহণ করতে পারি না। সম্ভব হয় না আমাদের কারওর পক্ষেই।

    যে মানুষটি ধর্মে বিশ্বাস করত না, তার জানাজা হবে, কুলখানি হবে। এগুলোকেও যদি অন্তত বন্ধ করা যেত! শক্তি নেই রুদ্রকে ফিরিয়ে আনার। শক্তি নেই ধর্মকে বিদেয় করার রুদ্রর আশপাশ থেকে। আমাদের অক্ষমতা, অপারগতা নিয়ে আমরা নির্বোধের মত বসে থাকি।

    শাহরিয়ার আজকের কাগজ পত্রিকার সাহিত্য পাতার সম্পাদক। আমাকে একদিন অনুরোধ করল রুদ্রকে নিয়ে কিছু লিখতে। লেখায় প্রকাশ হয় না রুদ্রর না থাকার কষ্ট। কেবল হৃদয় খুলে যদি দেখাতে পারিতাম। কাকে দেখাবো! কাউকে দেখাতে ইচ্ছে করে না। কষ্টগুলো আড়াল করে রাখি। সংগোপনে কেবল নিজের জন্য রাখি। রুদ্রই যদি নেই, দেখে আর কার কী লাভ!

    ইসহাক খান নামে রুদ্রর এক বন্ধু লিখছেন বলছেন খিস্তি ছুঁড়ছেন আমার বিরুদ্ধে, আমি নাকি রুদ্রর মৃত্যুর জন্য দায়ী। আমিই রুদ্রকে হত্যা করেছি। কী করে হত্যা করেছি, তা অবশ্য তিনি বলেননি। তাঁর লেখা পড়ে আমার খুব মন খারাপ হয়ে যায়। ইসহাককে আমি চিনি দীর্ঘদিন। রুদ্রর কাছে প্রায়ই আসতেন। সংসারে অভাব ছিল তাঁর, রুদ্রর উদার হস্ত, বন্ধুকে টাকা পয়সা দিয়ে সাহায্য করত। ইসহাকের সঙ্গে যতবারই দেখা হয়েছে আমার, অন্তর ঢেলে আপ্যায়ন করেছি। ইসহাক খান গল্প লেখেন, গল্পকার হিসেবে তেমন টাকা রোজগার করতে পারেননি, এখন কুৎসা রটিয়ে রোজগার করছেন। তসলিমা বিষয়ে যে কোনও লেখাই এখন পত্রিকাগুলো লুফে নেয়। কিছু ছাপাতে তাঁর এখন আর অসুবিধে হয় না। ইসহাকের লেখা পড়ে, আমি নিশ্চিত, পাঠকেরা চুক চুক করে দুঃখ করেছে রুদ্রর জন্য আর আমাকে ছিনাল পিশাচ খানকি বলে গাল দিয়েছে। রুদ্রর এক বন্ধু একদিন হেসে বলল, ‘রুদ্র না থাকায় মাগনা মদ খেতে পাচ্ছেন না বলে ইসহাকের মাথা খারাপ হয়ে গেছে!’ রুদ্রকে নিয়ে বাণিজ্য করার ধুম পড়েছে চারদিকে। একদিন সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলাল নামের এক কবি আসে, আমাকে লেখা রুদ্রর চিঠিগুলো যেন তাকে দিই, ছাপবে সে। আমি না বলে দিই। এই দুলালই রুদ্রর ট্রাক থেকে পেছনে রিক্সায় বসা আমার দিকে দলা দলা ঘৃণা ছুঁড়ে দিয়েছিল।

    যে কাজটি সবচেয়ে জরুরি সে কাজটি করি। রুদ্রর সমগ্রটি প্রকাশ করার উদ্যোগ নিই। রুদ্রর খুব ইচ্ছে ছিল তার সমগ্র প্রকাশ হোক। বেঁচে থাকলে কেউ প্রকাশ করেনি। রুদ্র কি তাই মরে গেল! মরে গিয়ে তার সমগ্র করার সুযোগ দিয়ে গেল! যা কিছু জীবনে সে লিখেছিল, সব নিয়ে সমগ্র। প্রকাশক বিদ্যাপ্রকাশ। খোকা এবার আর রুদ্রর সমগ্র বের করতে অনিচ্ছ! প্রকাশ করেননি। বইয়ের রয়্যালটি চলে যাবে রুদ্রর ভাই বোনদের কাছে। সম্পাদনার দায়িত্ব অসীম সাহার। আমার দায়িত্ব প্রুফ দেখা। ইত্যাদি প্রেসে ছাপা হতে থাকা রুদ্রর লেখাগুলোর প্রুফ যখন দেখি ঘরে বসে, যেন প্রুফ দেখি না, দেখি রুদ্রকে। যেন বসে আছে পাশে, শুনছে সে, আমি তার কবিতাগুলো পড়ছি, বার বার পড়ছি। প্রতিটি শব্দ পড়ছি, প্রতিটি অক্ষর। মেঝের ওপর একরাশ কাগজের মধ্যে সারা সারা রাত প্রুফ দেখতে দেখতে কোনও কোনও সময় ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছি ওই কাগজের ওপরই মাথা রেখে। স্বপ্নে রুদ্র আর আমি দুজন আমরা হাতে হাত রেখে হাঁটি আর কবিতার কথা বলি।

    রুদ্র কমিটি গঠন করে অসীম সাহা এবং আরও কয়েকজন রুদ্রর নামে মেলার আয়োজন করেন। মেলায় বই বিক্রি হয়, কুটির শিল্পের জিনিসপত্র বিক্রি হয়। এই মেলাই অকাল প্রয়াত এক প্রতিভাবান কবিকে প্রতিবছর স্মরণ করার দায়িত্ব নিয়েছে।

    রুদ্রকে নিয়ে অনুষ্ঠানে এখন অনেক বড় বড় লেখকরাই বড় বড় দীর্ঘশ্বাস ফেলে রুদ্রকে স্মরণ করেন, যাঁরা ইচ্ছে করলেই পারতেন রুদ্রকে ঢাকায় একটি চাকরি যোগাড় করে দিতে। রুদ্র তো দ্বারে দ্বারে কম ঘোরেনি। সেই গানটি, ভাল আছি, ভাল থেকো আকাশের ঠিকানায় চিঠি লিখো টেলিভিশনের একটি নাটকে ব্যবহার হওয়ার পর লোকের মুখে মুখে ফেরে। বেঁচে থাকলে কী বিষম আনন্দ পেত রুদ্র। বেঁচে থাকলে তার গান কি টেলিভিশনের কেউ ব্যবহার করতে চাইত! কে জানে! আকাশের ঠিকানায় আমি প্রতিদিন চিঠি লিখি রুদ্রকে। চিঠি সে পাক বা না পাক, লিখি।

    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleকিছুক্ষণ থাকো – তসলিমা নাসরিন
    Next Article উতল হাওয়া – তসলিমা নাসরিন

    Related Articles

    তসলিমা নাসরিন

    লজ্জা – তসলিমা নাসরিন

    August 21, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    আমার মেয়েবেলা – তসলিমা নাসরিন

    August 21, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    উতল হাওয়া – তসলিমা নাসরিন

    August 21, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    কিছুক্ষণ থাকো – তসলিমা নাসরিন

    August 21, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    ভালোবাসো? ছাই বাসো! – তসলিমা নাসরিন

    August 21, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    ভ্রমর কইও গিয়া – তসলিমা নাসরিন

    August 21, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo
    Most Popular

    রূপমঞ্জরী – ২য় খণ্ড – নারায়ণ সান্যাল

    September 3, 2025

    অনুরাধা

    January 4, 2025

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    রূপমঞ্জরী – ২য় খণ্ড – নারায়ণ সান্যাল

    September 3, 2025

    অনুরাধা

    January 4, 2025

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025
    Our Picks

    রূপমঞ্জরী – ২য় খণ্ড – নারায়ণ সান্যাল

    September 3, 2025

    রূপমঞ্জরী – ৩য় খণ্ড – নারায়ণ সান্যাল

    September 3, 2025

    কাঁটায়-কাঁটায় ৫ – নারায়ণ সান্যাল

    September 3, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    Sign In or Register

    Welcome Back!

    Login below or Register Now.

    Lost password?

    Register Now!

    Already registered? Login.

    A password will be e-mailed to you.