Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    রূপমঞ্জরী – ২য় খণ্ড – নারায়ণ সান্যাল

    September 3, 2025

    রূপমঞ্জরী – ৩য় খণ্ড – নারায়ণ সান্যাল

    September 3, 2025

    কাঁটায়-কাঁটায় ৫ – নারায়ণ সান্যাল

    September 3, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • 🔖
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    Subscribe
    সাইন ইন
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    দ্বিখণ্ডিত – তসলিমা নাসরিন

    তসলিমা নাসরিন এক পাতা গল্প779 Mins Read0

    ১৩. ঘটনার ঘনঘটা

    এর মধ্যে অনেক কিছু ঘটে গেছে। বিশেষ করে দেশের রাজনীতিতে। দেশজড়ে বিশাল স্বতস্ফূর্ত স্বৈরাচারবিরোধী গণআন্দোলন রাষ্ট্রপ্রধান এরশাদকে বাধ্য করেছে গদি থেকে নেমে যেতে। এরশাদের ধারণা ছিল না এই আন্দোলন এমন প্রবল হয়ে তাঁকে গদিচ্যূত করতে এভাবে ধাবিত হবে। তিনি বেশ ছিলেন। ভেবেছিলেন যে কোনও আন্দোলন তিনি অস্ত্র আর ধর্মের আঘাতে চূর্ণ করে দেবেন। জনগণ কি চায় না চায় তার তোয়াককা না করে তিনি যা চান তাই তিনি নিজেকে দিয়ে যাচ্ছিলেন। আটরশির পীরের কাছ থেকে দেশ কি করে চালাতে হবে কদিন পর পরই তার উপদেশ নিয়ে আসতেন। রাজনীতিবিদদের এরকম একএকজন পীর থাকে। দেশের রাজা মন্ত্রীদের দয়া দাক্ষিণ্যে পীরদের অবস্থা পোয়াবারো। পীরের কাছে তদবির করে চাকরি পাওয়া যায়, মন্ত্রীত্ব মেলে। হাফেজ্জী হুজুর নামের এক পীর সবাইকে চমকে দিয়ে পীরালি ব্যবসা বাদ দিয়ে রাজনীতি ব্যবসায় ঢুকেছিল। বুক ফুলিয়ে ছিয়াশি সালে নির্বাচনে দাঁড়িয়েছিল। পীরদের রাজনীতির শখ প্রচণ্ড। আটরশির পীর, শর্ষিনার পীর এরকম হরেক রকম পীর রাজনীতির হরেক রকম ব্যবসা নিয়ে জমকালো জীবন যাপন করছেন। ঢাকায় এখন সাইদাবাদি পীরের রমরমা ব্যবসা। এই লোকটি গুলিস্তানের মোড়ে দাঁড়িয়ে একসময় পুরোনো কাপড় বিক্রি করত, আর এখন ঢাকায় বিশাল এক প্রাসাদের মত বাড়িতে বসে পীর ব্যবসা করছে। এই পীর, লোকে বলে কাঁচা ডিম হাতে নিয়েই পাকা করে ফেলে। বাচ্চা দরকার, চাকরি দরকার, কাউকে সর্বস্বান্ত করা দরকার সব দরকারের জন্য পীরের কাছে ডিম নিয়ে হাজির হচ্ছে হাজার হাজার লোক। পীরের যাদু যখন বড় এক আলোচনার বিষয়, তখন স্বয়ং এরশাদও এক যাদু দেখালেন। এরশাদের বাচ্চা কাচ্চা নেই বলে কুসংস্কারাচ্ছত মানুষ তাঁকে আঁটকূড়ে বলে ডাকা শুরু করেছে, যে পুরুষ বাচ্চা হওয়াতে পারে না সে আবার কেমন পুরুষ, এমন পুরুষ দেশ চালালে দেশের ফলন যাবে কমে ইত্যাদি কথা বাতাসে ভাসে, বাতাসকে বাগে আনতে তিনি একটি আধখেঁচড়া নাটক করলেন। অনেকটা কাঁচা ডিম পাকা করে ফেলার মত। হঠাৎ একদিন স্ত্রী রওশনকে জনসমক্ষে এনে কোলে একটি বাচ্চা বসিয়ে বলে দিলেন, এই তো তিনি বাপ হয়েছেন। এতে অবশ্য এরশাদ বিরোধী আন্দোলন মোটেও থেমে যায়নি। আন্দোলন যখন তুঙ্গে, এরশাদ পুলিশকে আদেশ করেছেন মিছিলে মিটিংএ গুলি চালাতে। অজস্র গুলি চলেছে। অগুনতি মানুষের মৃত্যু হয়েছে। সব মৃত্যুই শোকের, সব মৃত্যুই মানুষের ভেতর ক্রোধ সৃষ্টি করেছে। যদিও অনেক মৃত্যুতে কোনও সাড়া পড়ে না, নূর হোসেনের মৃত্যু আন্দোলনকে অনেক ধাপ এগিয়ে নিয়েছে। আশ্চর্য এক সাহসী যুবক নূর হোসেন। নূর হোসেন মিছিলে সবার সামনে ছিল। সাধারণ মানুষ। বেবি ট্যাক্সি চালাত। কোনও রাজনীতি করেনি কোনওদিন, লেখাপড়া শেখেনি খুব, বুকে লিখেছে গণতন্ত্র মুক্তি পাক, পিঠে লিখেছে স্বৈরাচার নিপাত যাক। পুলিশের গুলি গণতন্ত্র মুক্তি পাক ভেদ করে চলে গেছে। নূর হোসেন মারা গেল মিছিলে। শেষ পর্যন্ত গণতন্ত্র মুক্তি পেয়েছে, কিন্তু নূর হোসেনের দেখা হয়নি সে মুক্তি। গণতন্ত্রকে মুক্তি পেতে কিছুতেই দিতে চাইছিলেন না এরশাদ। শেষ পর্যন্ত দীর্ঘ তিনটি বছর জোট বেঁধে আন্দোলনের পর, নব্বইএর তুমুল জোয়ারে ভেসে গেল এরশাদের গদি।

    এরশাদের পতনের পর তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন করে নির্বাচন হল। নির্বাচনে দুটো বড় দলের প্রতিদ্বন্দ্বিতা হল। আওয়ামী লীগ আর বিএনপি। শেখ মুজিবের কন্যা শেখ হাসিনা একদিকে, আরেকদিকে প্রয়াত প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের অষ্টম শ্রেণী পাশ সুন্দরী পুতুল ওরফে বেগম খালেদা। হাসিনা আর খালেদা যদিও এরশাদকে গদিচ্যূত করার সময় হাতে হাত রেখেছিলেন কিন্তু এরশাদ যেই না সরে গেল, যেই না নির্বাচনী প্রচারে নেমে গেলেন দুজন, কাদা ছোঁড়াছুঁড়ি শুরু হয়ে গেলে দুই দলে। হাসিনা কেঁদে কেটে বুক ভাসান তাঁর পরিবারের সকল সদস্যদের কি করে পঁচাত্তরের পনেরোই আগস্টে খুন করা হয়েছিল সেসব কথা বলে বলে। আওয়ামী শাসনামলের ভয়াবহ দুঃশাসনের কথা বর্ণনা করেন খালেদা। রাষ্ট্রধর্ম ইসলামের দেশে ধর্মও হয়ে উঠল অস্ত্র। খালেদা জিয়া যদি দুকথা ধর্মের বলেন, হাসিনা চারকথা বলেন। আওয়ামি লীগ ধর্মের পরোয়া করে না, এরকম একটি দুর্নাম ছিল আগে, যেহেতু ধর্মনিরপেক্ষতা ছিল আওয়ামী লীগ সরকারের রাষ্ট্রগঠনের চার নীতির এক নীতি। এই দুর্নাম থেকে যতই হাসিনা মুক্তি পেতে চান, খালেদা ততই কায়দা করে এটিকে ব্যবহার করেন। আশা ছিল শেখ হাসিনার দল সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাবে। কিন্তু ঘটনা তা ঘটে না। অনেক মানুষই বাংলাদেশ স্বাধীনতার পর আওয়ামি লীগ সরকারের অরাজকতার কথা স্মরণ করে ভোট আর যাকে দিক আওয়ামি লীগের কাউকে দেয় না। ভারতের সঙ্গে সুসম্পর্ক ছিল একদা আওয়ামি লীগের, এটি খালেদার আরেকটি অস্ত্র। নির্বাচনে দুটি জিনিসই কাজ করেছে, এক, আওয়ামি লীগ জিতে গেলে দেশে ধর্ম বলতে কিছু থাকবে না, দুই হাসিনা ভারতের কাছে বিক্রি করে দেবে এই দেশ। দুটো টোপই পাবলিক গিলেছে। অথবা দুটো দুর্নামেরই সঠিক ব্যবহার হয়েছে। আওয়ামি লীগ ভোট পায়, কিন্তু অধিকাংশের নয়। জনগণকে আওয়ামি আতংকে ভুগিয়ে খালেদা জিয়া ভোটে জিতে পেয়ারের কিছু রাজাকারদের মন্ত্রী বানিয়ে প্রধান মন্ত্রী হন। আবদুর রহমান বিশ্বাস নামের এক রাজাকারকে প্রেসিডেন্ট পদে বহাল করেন। মহা সমারোহে জামাতে ইসলামি আঠারোটি আসন নিয়ে সংসদে ঢুকেছে। ভারতের কাছে দেশ বিক্রির দুর্নাম ঘোচাতে শেখ হাসিনা মুখে ভারতবিরোধী কথা বলা শুরু করলেন। ধর্ম যাবে, এই দুর্নাম ঘোচাতেও ধার্মিক হয়ে গেলেন রাতারাতি। বিশাল করে ইফতার পার্টির আয়োজন করেন, টঙ্গীর বিশ্ব ইজতেমায় গিয়ে দু হাত তুলে আল্লাহর কাছে মোনাজাত করেন। মককা গিয়ে হজ্ব করে এলেন।। এই প্রথম দেশের প্রধান মন্ত্রী একজন মহিলা, প্রতিপক্ষ দলের পুরোধাও একজন মহিলা এ কারণে একটি আনন্দ ছিল আমার, সেই আনন্দটির শরীরে উঠে আসতে থাকে একটি অজগর, গা শিউরে ওঠা আতঙ্ক।

    খালেদা জিয়া ক্ষমতায় বসার পর এরশাদকে অস্ত্র মামলায় ফাঁসিয়ে জেলে ঢুকিয়ে দিল। কিন্তু একই স্বৈরাচারি আচরণ খালেদার সরকারও দেখাতে শুরু করেছে। প্রচার মাধ্যমকে নিরপেক্ষ রাখার কথা ছিল, কথা আরও কত কিছু ছিল, কোনও কথাই ক্ষমতা পেয়ে গেলে আর কারও রাখতে ইচ্ছে করে না। সংবিধানের রাষ্ট্রধর্মটিকে সরিয়ে ধর্মনিরপেক্ষতা বহাল করার কথাও উচ্চারণ করে না কেউ। দেশের মানুষের ভালর জন্য এ দেশের রাজনীতি নয়, রাজনীতি ক্ষমতার রাজনীতি। ছলে বলে কৌশলে ক্ষমতা পাওয়ার উদ্দেশ্যই সব রাজনৈতিক দলের। ক্ষমতার আনন্দ ভোগ করার উদ্দেশ্যই রাজনীতিকদের মূল উদ্দেশ্য। দেশের এহেন রাজনীতি আমাকে দুশ্চিন্তার পাঁকে ডুবিয়ে রাখে।

    গাইনি বিভাগে গাধার মত পরিশ্রম করে লেখালেখির জন্য কোনও সময় পাওয়া যায় না, সে কারণে গাইনি থেকে অ্যানেসথিসিয়া বিভাগে চলে গিয়েছি। গাইনির পরিবেশও আগের মত নেই আর। নতুন ইন্টার্নি এসে গেছে, পুরোনোরা বিদেয় নিয়েছে। অধ্যাপক বায়েস ভুঁইয়াও বদলি হয়ে অন্য হাসপাতালে চলে গেছেন। আমার ইউনিটে নতুন সি এ এসেছে। তার ওপর রাত দিন ডিউটি, লেখার জন্য তেমন সময় পাওয়া যায় না। আগের চেয়ে লেখার চাপ অনেক বেড়েছে। কিন্তু লিখতে হলে তো সময় চাই। সময় কোথায়! অ্যানেসথেসিয়া বিভাগেও যে একেবারে কাজের অভাব নেই, তা নয়, রাতে যে ডিউটি নেই, তা নয়। সবই আছে। কিন্তু এখানে দু হাত হলেই চলে, দশ হাতের দুর্গা দেবী না হলেও কাজ হয়। গাইনিতে দশ হাতে কাজ না করলে কাজকে কাজ বলে গণ্য করা হয় না। আমার বাড়তি আটটি হাত নেই, যার থাকে থাকুক। আর যেহেতু পোস্ট গ্রাজুয়েশনের পথ শেষ পর্যন্ত মাড়াচ্ছি না, কী দরকার অত ডুবে থেকে! তা ছাড়া যা শেখার ছিল, শেখা হয়ে গেছে। এ বিদ্যে নিয়ে দিব্যি বাকি জীবন গাইনির ডাক্তার হিসেবে কাজ করা যাবে। অ্যানেসথেসিয়া বিভাগে গাইনি বিভাগের মত চব্বিশ ঘন্টা খাটাখাটনি নেই। ছিমছাম, পরিচ্ছত, কাজের ফাঁকে চা সিঙ্গারা, ডাক্তারি আড্ডা। বিভাগের অধ্যাপক মজিবর রহমান এবং মানস পাল দুজনই চমৎকার মানুষ। বন্ধুর মত। বাকি দুজন ডাক্তার শামিমা বেগম আর দেবব্রত বণিকের সঙ্গে আমার সম্পর্ক প্রথম দিন থেকেই মধুর হয়ে ওঠে। বিশেষ করে শামিমার সঙ্গে। প্রথম দিনই দুএকবার দেখে শিখে গেলাম কী করে অ্যানেসিথিসিয়া দিতে হয়। দ্বিতীয় দিন থেকে নিজেই দিতে শুরু করি। মাঝে মাঝে এখানেও ব্যস্ততার শেষ নেই বিশেষ করে গাইনির অপারেশন থিয়েটারে যখন দৌড়োতে হয়। এমনও হয়, সারা রাতে দুমিনিটের জন্য অবসর জোটে না, সারারাতই একটির পর একটির অপারেশন হচ্ছে। আমি এবার আর ছুরি কাঁচি হাতে নিয়ে দাঁড়াই না, আমার হাতে অজ্ঞান করার ওষুধ, অক্সিজেন, কৃত্রিম উপায়ে শ্বাস নেওয়ার যন্ত্রপাতি। রোগীকে ঘুম পাড়ানো, অপারেশন শেষ হয়ে গেলে রোগীর ঘুম ভাঙানো খুব সহজ মনে হলেও সহজ নয়। ঘুমের ওষুধ আর মাংসপেশি অবশ হওয়ার ওষুধ দেওয়ার পর যদি কৃত্রিম শ্বাস চালু না করা হয়, তবে শ্বাসই নেবে না রোগী। ফুসফুস থেমে থাকার একটি নির্দিষ্ট সময় আছে, সময় পার হয়ে গেলে রোগীর পক্ষে শ্বাস নেওয়া আর সম্ভব নয়। ঘুম পাড়াচ্ছি, অপারেশন শেষ হবে, রোগীকে টেবিলেই ওষুধ দিয়ে জাগিয়ে পোস্ট অপারেটিভ রুমে পাঠাতে হবে, সেখানেও খবর নিতে হবে রোগীর শ্বাস প্রশ্বাস, রক্তচাপ ইত্যাদি সব ঠিক আছে কি না। কখনও আমার হাতে কোনও রোগীর কোনও অসুবিধে হয়নি। আমার সব রোগীই সুন্দর ঘুমিয়ে যায়, সুন্দর জেগে ওঠে। একবারই হয় অসুবিধে। সেটি অবশ্য আমার কারণে নয়। সেটি উঁচু নাক মালিহার কারণে। তিনি রোগীর সিজারিয়ান অপারেশন করার জন্য তৈরি। রোগীকে অজ্ঞান করার ইনজেকশান দিয়ে রোগীর শ্বাসনালী খুঁজছি নল ঢোকাতে, দুবার চেষ্টা করে পাইনি, তৃতীয়বার চেষ্টা করতে যাবো, তখন মালিহা তার হাতের ছুরি কাঁচি ফেলে গ্লবস খুলে আমার হাত থেকে নল কেড়ে নিয়ে আমাকে কনুইয়ের গুঁতোয় সরিয়ে দিয়ে নিজে দাঁড়িয়ে গেলেন আমার জায়গায়। এফসিপিএস ফার্স্ট পার্ট পাশ করার দেমাগে তিনি নল ঢোকাবেন, যেন আমার হাত থেকে এ কাজে তাঁর হাত বেশি পাকা। খুঁজে তো তিনি পেলেনই না শ্বাসনালীর মুখ, মাঝখান থেকে রোগীর সর্বনাশ করলেন। ডাক্তার দেবব্রত বণিককে ডেকে আনতে লোক পাঠালেন তিনি। বণিক এফ সিপিএস পুরোটা না করলেও অর্ধেক করেছে, ডাকা হলে সে দৌড়ে এসে সমস্যার সমাধান করে, তার পক্ষেও সহজ ছিল না শ্বাসনালী পাওয়া, আট নবার চেষ্টা করার পর অবশেষে ঢোকে নল। বণিকেরও ঘাম বেরিয়ে গেছে ঢোকাতে। অপারেশন হল। বণিকের হাতে রোগী। সুতরাং অপারেশন থিয়েটারে উঁচু নাকটির সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে আমার ইচ্ছে করে না। আমি বেরিয়ে যাই। পরদিন বণিক আমাকে জানাল যে রাগীকে সে জাগাতে পারেনি। অল্প বয়সের মেয়েটি প্রথম সন্তানের জন্ম দিয়ে আর জাগেনি। আমার খুব কষ্ট হয় শুনে। বণিক রোগীকে পাঠিয়ে দিয়েছিল পিজিতে। সেখানেও চেষ্টা করে রোগীকে বাঁচানো সম্ভব হয়নি। সবকিছুর দোষ আমার ঘাড়ে পড়ে। মালিহাই দোষটি দেন। নিজের মাতব্বরির গল্পটি তিনি কায়দা করে লুকিয়ে ফেলেন। আমি যখন কারণ দেখাই মালিহার মাতব্বরির, দেবব্রত উল্টো আমাকে দায়ী করে বলে, ‘আপনি কেন আপনার রোগী ওকে ধরতে দিয়েছিলেন?’

    ‘আমাকে তো ধাককা দিয়ে সরিয়ে দিল!’

    ‘সরিয়ে দিলে আপনি সরবেন কেন! আপনার দায়িত্ব রোগীকে অ্যানেসথেসিয়া দেওয়া। মালিহার দায়িত্ব অপারেশন করা।’

    ‘সে তো ট্রাকিয়া খুঁজতে চাইল, আমার হাত থেকে টিউব নিয়ে গেল। সে বলল ইনটিউবেশন সে করবে।’

    ‘আপনি দেবেন কেন? সে কী জানে এনডোট্রাকিয়াল ইনটিউবেশনের? তার কোনও অভিজ্ঞতা আছে? ওই রোগির ট্রাকিয়া পাওয়া খুব কঠিন ছিল। যখন আপনি ট্রাকিয়া পেলেন না, সঙ্গে সঙ্গে অক্সিজেন চালিয়ে দিয়ে আমাকে খবর পাঠাতেন!’

    ‘অক্সিজেন দেব কী করে, আমাকে তো কাছেই যেতে দেয়নি।’

    ‘আপনি ওকে ধাককা দিয়ে সরিয়ে দিলেন না কেন!’

    তা ঠিক, আমি কেন মালিহাকে ধাককা না দিলেও ধমকে সরিয়ে দিই নি! কয়েক রাত আমি ঘুমোতে পারিনি। মেয়েটির পান পাতার মত মুখটি, সুন্দর কাজলকালো চোখদুটো সারাক্ষণই মনে পড়েছে। আসলে আমি ধাককা দিতে পারি না। উচিত কথা বলতে, উচিত কাজ করতে আমার কেন এতে দ্বিধা থাকে, কেন এত লজ্জা আমার, কেন আমি মুখ বুজে থাকি মানুষ যখন চোখের সামনে অন্যায় করে! নিজের ওপর রাগ হয় আমার। নিজের এই মাথা নুয়ে লজ্জাবতী লতার মত পড়ে থাকার দিকে আমার রাগ হয় বড়। অনেক কিছুই আমার দ্বারা হয়ে ওঠে না, আমি লক্ষ করেছি। বাড়িতে কিছু অনাকাঙ্খিত অতিথি এসে এমন দীর্ঘ দীর্ঘ ক্ষণ বসে থাকে যে আমি এখন ব্যস্ত, এখন তোমাকে বা আপনাকে সময় দিতে পারব না বলা হয় না। ভেতরে ভেতরে গুমড়ে মরতে থাকি, কেবল না কথাটিই বেরোতে চায় না মুখ থেকে। ছোটবেলা থেকেই দেখেছি, আমার এই না বলতে পারার অক্ষমতা। কেউ আমার বুকের দিকে হাত বাড়াচ্ছে যেন দেখিনি সে যে চাইছে, আসলে কিন্তু দেখেছি, সেই বাড়ানো হাতে দ্রুত একটি কলম বা খাতা গুঁজে দিয়ে সরল হেসে বলি, ও এটি চাইছিলে বুঝি! সেই বাড়ানো হাতে কলম বা খাতাটি নিয়ে থতমত ভাবটি যেন সে আড়াল করতে যেন বাধ্য হয়, আড়াল করতে চেয়ে যেন বলতে বাধ্য হয় যে হ্যাঁ এটিই চেয়েছিলাম। দ্রুত কিছু একটা কাজের কথা বলে হাতের নাগাল থেকে দূরে সরে যাই। অথবা সম্পূর্ণ একটি অন্য প্রসঙ্গ টানি, যে প্রসঙ্গে তার মন উদাস হয়, যেমন তোমার বা আপনার বোনের যে বিয়ে হয়েছে, স্বামীর সঙ্গে নাকি বনছে না! গালে চড়, জুতো মারা এসব তো অনেক সাহসের ব্যপার, সামান্য যে মুখের কথা, ছি ছি তোমার মনে এই ছিল! অথবা সরে যা এখান থেকে হারামজাদা, কী অসভ্যরে কী অসভ্যতাও কখনও হাজার চেয়েও বলতে পারি না। বলি না, কারণ বলতে পারি না। তাকে বুঝতে দিই না যে তার অপকর্মের ইচ্ছেটি আমি বুঝেছি, আমি বুঝেছি জেনে যদি সে লজ্জা পায় অথবা আশকারা পায়। তাকে আমি লজ্জা বা আশকারা পেতে দিই না। তার অসুস্থতাকে আমাকে না বোঝা শিশুসুলভ সারল্য দিয়ে সুস্থ করে তুলতে চাই। সব লজ্জা একা ধারণ করি। পুরুষের জগতে এভাবেই আমাকে গা বাঁচিয়ে চলতে হয়, বুঝতে না দিয়ে তাদের চোখ টেপা, তাদের গা ঘেসা, তাদের হাত ছোঁয়া, রসের আলাপের ফাঁক ফোঁকর খোঁজা। যেন কিছুই ঘটেনি, যেন আমি তাকে যেরকম ভাল মানুষ ভাবি, সেরকম ভাল মানুষই সে, কখনও সে কোনও অশোভন ইঙ্গিত করে না, কখনও সে সুযোগ নিতে চায় না।

    এফসিপিএস না করলে সম্ভবত এই হয়, দূর দূর করে তাড়ায় নাক উঁচু ডাক্তারগুলো। আমার হাত ভাল, অপারেশন ভাল করছি, বা অ্যানেসথেসিয়া ভাল দিচ্ছি এগুলো কেউ গণনায় নেবে না। আমি ভুল করলে লোকে বলবে ওর লেখাপড়া বেশি নেই বলে ভুল করেছে, জানে না বলে ভুল করেছে। আর এফসিপিএস ডাক্তার যদি ভূল করে তবে দোষ দেওয়া হয় অন্য কিছুকে। লিভার কাটতে গিয়ে কিডনি কেটে ফেললে দোষ হয় ছুরির, ডাক্তারের নয়। ছুরিটি নিশ্চয়ই বাঁকা ছিল। হাসপাতালে সবসময়ই এফসিপিএসগুলোর সামনে মাথা নুয়ে থাকতে হয়, তারা হাঁটলে রাস্তা ছেড়ে দিতে হয়। তারা যখন ডাক্তারি বিষয়ে কোনও বিদ্যা ঝাড়ে, নিশ্চুপ শুনতে হয়, তারা যখন পাগালামো করে, তখন পাগলামোকে জিনিয়াসরা ওরকম একটু আধটু করেই বলেই ভাবতে হয়। বাবাকেও আমি দেখেছি, বাড়িতে অত্যাচারি রাজার ভূমিকায়, আর মেডিকেল কলেজে একেবারে নিরীহ প্রজা। কাঁচুমাচু হয়ে হাত কচলে কচলে এফসিপিএস বা এফআরসিএস পাশ করা অধ্যাপকদের সঙ্গে কথা বলতেন। ওঁদের দেখলেই একটি সশ্রদ্ধ হাসি ফুটতো বাবার মুখে। বাবার লজ্জা ছিল, যত না গরিব কৃষকের পুত্র হওয়ার লজ্জা, তার চেয়ে বেশি এফসিপিএস না করার লজ্জা। এটি না করলেও জুরিস প্রুডেন্সের বাড়তি কিছু পড়াশোনা করে একটি ডিপ্লোমা নিয়েছেন। মাঝে মাঝে দুঃখ করে বলেন সংসার সামলানোর কারণেই তাঁর এফসিপিএস করা হয়নি। তা ঠিক, বাবা চাইলে এই ডিগ্রিটি নিতে পারতেন। আমি না হয় যেমন তেমন ছাত্রী ছিলাম, বাবা ছিলেন মেডিকেল ইশকুলের ভাল ছাত্রদের মধ্যে এক নম্বর। বাবার চেয়ে খারাপ ছাত্ররা বড় বড় ডিগ্রি নিয়ে বাবার সামনে বুক ফুলিয়ে হাঁটেন। বাবার নিজের অনেক ছাত্রই বাবার চেয়ে অনেক বড় হয়ে বসে আছে। আমিও কি বাবার মত হচ্ছি! আমিও তো বাবার মত নিজের অস্তিত্ব নিয়ে মাঝে মাঝে বড় অস্বস্তিতে ভুগি। বড় ডাক্তারদের সামনে বাবাকে কাঁচুমাচু হতে দেখলে আমার কখনই ভাল লাগত না। একবার বাবাকে অহংকারে মাটিতে পা পড়ে না এমন এক ডাক্তারের সামনে মাথা উঁচু করিয়েছি। প্রেসিডেন্ট কবি এরশাদ এশীয় কবিতা উৎসবের আয়োজন করছেন, তিনি আমাকে খুঁজছেন আমন্ত্রণ জানাতে, এরশাদের খোঁজার কারণে স্বাস্থ্য সচিব, তিনিও কবি, আমার খোঁজ করতে লাগলেন। আমি ময়মনসিংহ মেডিকেলের ছাত্রী ছিলাম এটুকুই বোধহয় তাঁর জানার দৌড়, তিনি ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজেন অধ্যক্ষ মোফাখখারুল ইসলামের কাছে ফোন করে তাঁকে দায়িত্ব দিলেন আমাকে খুব জরুরি ভিত্তিতে প্রেসিডেণ্টের আমন্ত্রণ পৌঁছে দিতে। স্বাস্থ্য মন্ত্রী আর স্বাস্থ্য সচিবের সরাসরি আদেশ বা অনুরোধ পাওয়া কোনও এক মেডিকেল কলেজের কোনও এক অধ্যক্ষ মোফাখখারুল ইসলামের জন্য অকল্পনীয় ব্যপার। আমার খোঁজ পাওয়ার জন্য মোফাখখারুল ইসলাম বড় বিগলিত হাসি নিয়ে একাধিকবার বাবার দ্বারস্থ হলেন। বাবা নিশ্চয়ই তখন কাঁচুমাচু মোফাখখারুলের সামনে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছিলেন। আমি দৃশ্যটি কল্পনা করে স্বস্তি পাই। বাবা আমাকে ঢাকায় ফোন করে বড় সুখী সুখী কণ্ঠে আমাকে খবরটি জানিয়েছিলেন। যদিও এরশাদের আমন্ত্রণে এশীয় কবিতা উৎসবে আমি অংশ নেব না, এশীয় কবিতা উৎসবের প্রতিবাদে গণতন্ত্রে বিশ্বাসী কবিদের নিয়ে যে জাতীয় কবিতা উৎসব হয়, আমি শুরু থেকেই সেখানে, তারপরও আমার অন্যরকম আনন্দ দেয় এরশাদের এই আমন্ত্রণটি। আনন্দ দেয় এই জন্য যে এই আমন্ত্রণের কারণে স্বাস্থ্য সচিব ফোন করেছেন মোফাখখারুল ইসলামকে, যে মোফাখখারুল ইসলাম তাঁর অধ্যক্ষ-কক্ষে ডেকে নিয়ে একটি উড়ো চিঠির ওপর ভিত্তি করে আমাকে কী জঘন্য অপমানটাই না করেছিলেন। আমার মত নিরীহ মানুষ কোনওদিন শোধ নিতে পারেনি সেই অপমানের। তবে আমার জন্য স্বাস্থ্য মন্ত্রী বা স্বাস্থ্য সচিবের উতলা হওয়াটিই তাঁকে অন্তত এইটুকু বুঝিয়েছে যে আমি নিতান্তই একটি তুচ্ছ জীব নই, যে রকম জীব ভেবে তিনি ঘৃণায় আমাকে মাটির সঙ্গে থেতলে ফেলতে চাচ্ছিলেন। এইটিই আমার শোধ। এর চেয়ে ভাল শোধ আর কী হতে পারে! চড়ের বদলে চড় দেওয়া আমি পছন্দ করি না, শারীরিক পীড়নের চেয়ে মানসিক পীড়ন ঢের বেশি যন্ত্রণা দেয়। স্বাস্থ্য সচিব ইমরান নূর মোফাখখারুল ইসলামের কাছ থেকে আমার ফোন নম্বর নিয়ে আমাকে ফোন করেছিলেন, অনুরোধ করেছেন আমি যেন প্রেসিডেণ্টের সাদর আমন্ত্রণটি রক্ষা করি। আমি রক্ষা করিনি।

    শান্তিবাগের বাড়িটি সাজিয়ে নিয়েছি খুব সুন্দর করে। আরমানিটোলার বাড়িটির সঙ্গে শান্তিবাগের বাড়ির তুলনা হয় না। ও বাড়িটি ছিল বস্তির বাড়ি, এ বাড়ি আধুনিক, ঝকঝকে। ড্রইং কাম ডাইনিং। দুটো বাথরুম। দুটো বেডরুম। বারান্দা। আধুনিক কিচেন। বাড়িটি যেমন সুন্দর, পরিবেশও চমৎকার। আরমানিটোলার তুলনায় শান্তিবাগের সংসার অনেক য়চ্ছল। অবশ্য এই য়চ্ছলত!টুকু দিতে পরিশ্রমও করতে হয়। মাইনেতে বাড়িভাড়া কুলোয় না, সুতরাং কলাম লিখে টাকা রোজগার করতে হয়। যদিও লেখা থেকে ডাক্তারি চাকরির চেয়ে বেশি আয় হয়, তবু লেখার চেয়ে ডাক্তারি চাকরিতে সময় যায় কয়েকশ গুণ বেশি। লেখা আজ লোকে চাইছে, কাল হয়ত চাইবে না। চাকরিটিই তখন ভরসা। ভরসার জায়গাটি হেলাফেলায় নষ্ট করি না মোটেও। একটি কলামে কখনও তিনশ টাকা, কখনও পাঁচশ টাকা আসে, মাসে দশটি কলাম লিখলে বাড়িভাড়া, বিদ্যুৎ খরচ হয়ে যায়। মাইনের টাকায় বাজার খরচা আর রিক্সাভাড়া চলে। দশটির বেশি কলাম লিখলে নাটক থিয়েটার দেখে বই পত্র কিনে বেশ চলে যায়। তবে সবসময় যে এই নিয়মে সবকিছু চলে তা নয়, কখনও কোনও পত্রিকা বন্ধ হয়ে যায়, কোনও পত্রিকার মালিক বদলে যায়, নতুন মালিক আমার লেখা আর ছাপতে চায় না অথবা পত্রিকার টাকা ফুরিয়ে যায়, অথবা টাকা দেবে কথা দিয়েও কেউ হয়ত দেয় না। তারপরও আমি পিছু হটি না। আমি হার মানি না। অন্য কারও হাতে নিজেকে সমর্পণ করি না। মিলন মাঝে মাঝে সেও এটা সেটা বাজার করে। আর মা রান্নাঘর সামলালে তো খরচ বড় রকম বাঁচিয়ে চলেন। নিজে তলে তলে কৃচ্ছউস!ধন করে এই কাজটি করেন। শান্তিবাগের সব ভাল, তবে মিটফোর্ড হাসপাতালটি দূরে পড়ে যায়, এই যা সমস্যা। আরমানিটোলা থেকে হেঁটেই হাসপাতালে যাওয়া যেত। এখান থেকে রিক্সা নিতে হয়। রিক্সা গুলিস্তানের ট্রাফিক জ্যামে পড়ে আধঘণ্টা একঘণ্টা বসে থাকে।

    শান্তিবাগের বাড়িতে অতিথির আগমন অনেক বেশি। কবি বন্ধু, ডাক্তার বন্ধু, ভক্তকূল, আত্মীয়কূলের কেউ না কেউ আসছেই। শান্তিবাগের বাড়িটি সত্যিকার যাকে বলে হোম, সুইট হোম। যে অবকাশের টান কোনও দিনই অবকাশ ছেড়ে যেখানেই থেকেছি, কমেনি, এই শান্তিবাগের শান্তি আমার অবকাশের মোহ অনেক কমিয়ে দেয়। তাছাড়া একটি তো চ্যালেঞ্জ আছেই, আমি স্বনির্ভর হব এবং একা থাকব, কোনও স্বামী নামক প্রভু পুরুষ আমার আশেপাশে থাকবে না, আমি হব আমার নিয়ন্ত্রক, যেভাবে আমি জীবন যাপন করতে পছন্দ করি, সেভাবে করব, কেউ আমাকে বলবে না এটা কর, ওটা কর। কারও কাছে আমার জবাবদিহি করতে হবে না কিছুর জন্য। ঠিক এরকম জীবনই আমি তো চেয়েছিলাম। সম্পূর্ণ একটি স্বাধীন জীবন। বাবার অধীন থেকে, স্বামীর অধীন থেকে মুক্ত একটি জীবন। এই জীবনটি অর্জন করতে আমাকে কম পথ পেরোতে হয়নি। স্বামী সন্তান নিয়ে সংসার করার স্বপ্ন সাধকে আমি খুব অনায়াসে এখন ছুঁড়ে ফেলতে পারছি। তুলোর মত উড়ে যাও স্বপ্ন। এই স্বপ্ন আমার জন্য নয়। এই স্বপ্ন লালন করে নিজেকে কম অপদস্থ করিনি। স্বপ্ন তুমি ভেসে যাও বুড়িগঙ্গার জলে, তোমাকে আমার আর প্রয়োজন নেই। স্বপ্ন তোমাকে মাটির তলায় পুঁতে দিচ্ছি, তুমি মরে যাও। স্বপ্ন তুমি আমার আঙিনামুক্ত হও, আমার হৃদয়মুক্ত হও। আমাকে আর নাশ করতে এসো না কখনও। এক স্বপ্ন চলে গেলে অন্য স্বপ্ন আসে। স্বপ্ন তো কত রকম হতে পারে। আমার এখন অন্য রকম স্বপ্ন। এই স্বনির্ভরতাটুকু, নিজের এই স্বাধীনতাটুকু নিয়ে বাকি জীবন বেঁচে থাকবার স্বপ্ন। এখন বড় নির্ভার লাগে, বড় দুঃস্বপ্নমুক্ত লাগে। যেন দীর্ঘ একটি দুঃস্বপ্নের রাত পার হয়ে এখন দেখছি চারদিকে আলোয় ঝলমল সকাল। যেন ঘুমিয়ে ছিলাম, ঘুমের মধ্যে অনেক দুর্ঘটনা ঘটে গেছে। জেগে উঠেছি। দীর্ঘ দীর্ঘ কাল একটি অন্ধকার গুহার ভেতরে আটকা পড়ে ছিলাম, অন্ধকারই আমার জীবন আর জীবনের স্বপ্নগুলো নিয়ন্ত্রণ করত। আলোর কোনও ঠিকানা আমার জানা ছিল না। নিজে আলো খুঁজে খুঁজে বের করেছি, আলো আমি ছড়িয়ে দিই চাই আর যারা অন্ধকারে আছে, তাদের দিকে। অন্ধকারে পড়ে থেকে স্যাঁতসেঁতে জীবন কাটাচ্ছে যারা, তাদের দিকে একটি হাত বাড়াতে চাই, যে হাতটি ধরে তারা উঠে আসতে পারবে আলোর মিছিলে। আমার হাত কি তেমন কোনও শক্ত হাত! শক্ত নয় জানি, তবু তো একটি হাত! এই একটি হাতই বা কে বাড়ায়!

    আমার জীবনে অভাবিত কিছু ঘটনা ঘটতে থাকে। বাংলাবাজারের প্রকাশকরা ভিড় করেন আমার বাড়িতে। সকলের প্রশ্ন আমি কি পণ করেছি বিদ্যাপ্রকাশকে ছাড়া আর কোনও প্রকাশককে বই দেব না! এরকম পণ আমি নিশ্চিতই করিনি। খোকা আমার বই ছাপেন কিন্তু আমাদের মধ্যে এরকম কোনও চুক্তি হয়নি যে অন্য প্রকাশকেকে বই দেওয়া যাবে না। তাহলে বই দিন। আজই দিন। আশ্চর্য বই কোত্থেকে দেব! যা লিখেছি কবিতা। বিদ্যাপ্রকাশ থেকে সবই ছাপা হয়ে গেছে। যা কলাম ছাপা হয়েছে পত্রিকায়, সব বই হয়ে বেরিয়ে গেছে। তা হলে লিখুন। একটি উপন্যাস লিখুন। উপন্যাস! পাগল হয়েছেন! উপন্যাস আমি লিখতে জানি না। জীবনে কখনও লিখিনি। জীবনে কখনও না লিখলেও এখন লিখুন। খোকার কাছেও তাঁর প্রকাশক বন্ধুরা অনুরোধ নিয়ে যাচ্ছেন। খোকাও একদিন আমাকে বললেন তাঁর বন্ধু অনন্যা প্রকাশকের মুনিরকে যেন একটি বই দিই, শিখা প্রকাশনীর লোককে নিয়ে এলেন, তাকেও বই দিতে হবে। আবার একদিন আফসার ব্রাদার্সএর প্রকাশককে নিয়ে এলেন, একেও কিছু না কিছু দিতে হবে। উপন্যাস না দিলেও যেন গল্পের বই দিই, তা না হলে যেন কবিতা, বেশি যদি না দিতে পারি, অন্তত দশটি কবিতা, দশটি না হলেও পাঁচটি, শিল্পীকে দিয়ে ছবি আঁকিয়ে কবিতা কার্ডের প্যাকেট করবেন। যে ব্যপারটি ঘটে, তা হল অগ্রিম টাকা দিয়ে যান প্রকাশকগণ। রয়্যালটির টাকা পেতে কখনও অভ্যস্ত নই আমি। খোকা আমার ভাই বন্ধু শুভাকাঙ্খী, বাড়িতে এলে খালি হাতে আসেন না, নানা রকম ফল মিষ্টি বিস্কুট চানাচুর ইত্যাদি নিয়ে আসেন, কখনও কখনও হঠাৎ কোথাও বেশি খরচ করে একেবারে কপর্দকহীন হয়ে গেলে খোকা কিছু টাকা রেখে যান। সে তো প্রয়োজনে, শখের ব্যপারটিও দেখেন তিনি, লেখার টেবিলের জন্য সুন্দর একটি চেয়ার পছন্দ করেছিলাম, কিন্তু টাকা ছিল না বলে কিনতে পারিনি, খোকা সেটি কিনে একদিন বাড়িতে পাঠিয়ে দিলেন। কিন্তু রয়্যালটির হিসেব কখনও আমাকে দেননি। হিসেব আমি চাইও নি। চাইনি লজ্জায়। তাছাড়া খোকার সঙ্গে আমার সম্পর্ক হিসেবের সম্পর্ক নয়। যে কোনও প্রয়োজনে কোনও রকম দ্বিধা ছাড়াই আমি খোকাকে ডাকতে পারি, খোকা সব ফেলে ছুটে আসেন। কোনও টাকা দিয়ে এই সহানুভূতি কেনা যায় না। রয়্যালটির টাকা ব্যপারটি আসলেই বড় লজ্জার, যখন অনন্যা বা শিখা প্রকাশনীর লোক টাকা বাড়াল, আমার কান নাক সব লাল হয়ে গেল মুহূর্তে। টাকা হাতে নিতেও এমন লজ্জা হচ্ছিল যে হাত পেছনে গুটিয়ে রেখেছিলাম। প্রকাশকরা টাকা টেবিলে রেখেছেন নয়ত খোকার হাতে দিয়েছেন আমাকে দেওয়ার জন্য। অগ্রিম রয়্যালটির টাকা। অবশ্য টাকা দেওয়ার আগে আমি অনেক বলেছি, টাকা দেবেন না, বই তো লিখি নি। বই লিখিনি তাতে কারওর আপত্তি নেই। টাকা থাকুক, যখন লেখা শেষ হবে, এসে নিয়ে যাবেন। লিখতে যদি এক বছর লাগে? তা লাগুক। যদি পাঁচ বছর লাগে? তাতেও নাকি ক্ষতি নেই। টাকার দরকার নেই আমার। দরকার না থাকলেও যেন আমি রেখে দিই। বই লিখে নিই, ছাপা হোক, বিক্রি হয় কি না দেখুন, তারপর তো রয়্যালটি। প্রকাশকরা আমার কথা মানেন না, বলেন বই প্রকাশের পর তো রয়্যালটি পাবোই, তার আগেও টাকাটা থাকুক। টাকা থাকে। এত টাকা এক সঙ্গে কখনও দেখিনি আগে। শুনেছি এক হুমায়ুন আহমেদকেই রয়্যালটির টাকা বই লেখার আগেই দেওয়া হয়। এখন আমাকেও! মনে পড়ে সেই সব দিনের কথা। শিকড়ে বিপুল ক্ষুধা বইটির পরিবেশনার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল নসাস প্রকাশনীকে। নসাস প্রকাশনী বইটি বিলি করার কোনও রকম আগ্রহ প্রকাশ করেনি। দুবছর পর নসাসের গোডাউনে পড়ে থাকা পোকায় খাওয়া বই নিয়ে এসেছিলাম বাড়িতে। দ্বিতীয় বইটি প্রকাশের জন্য যে অনিন্দ্য প্রকাশনের নাজমুল হকের দ্বিধা ছিল, নিশ্চয়ই সেই নাজমুল হক আমার বই ছাপার জন্য আগ্রহ প্রকাশ করছেন এখন। আমি খুব ভাল করেই জানি আজ যে প্রকাশকরা করজোড়ে বই এর জন্য অনুরোধ করছেন, একসময় তাঁরাই হয়ত নাক সিটকোতেন নাম শুনলে। আমাকে লিখতে হয় প্রকাশকদের চাপে। হাসপাতালের অপারেশন থিয়েটারে বসে রোগী দেখার ফাঁকে ফাঁকে লিখি। বাড়িতে অতিথি এলে সময় দিতে হয়। সংসারে এটা নেই তো ওটা নেই, সেগুলোও দেখতে হয়, একশ একটা কাজের ফাঁকে ফাঁকে লিখি। লেখা আদৌ কিছু হয়েছে কি না তা ভাবার আগেই প্রকাশক এসে ছোঁ মেরে নিয়ে যান। প্রায় প্রতিদিন তাগাদা দেন, কতদূর হয়েছে লেখা, দেখি! হচ্ছে হচ্ছে হবে হবে করে করে সময় পার করি। সময় প্রকাশনের ফরিদ আমার বাড়ি এসে দিনের পর দিন অনুরোধ করে গেছেন, তাঁকে দিই অপরপক্ষ নামের একটি উপন্যাস। অনন্যাকে শোধ নামে একটি উপন্যাস দিই, উপন্যাস না বলে উপন্যাসিকা বলা উচিত অথবা বড় গল্প। গাইনিতে কাজ করে হাত দক্ষ হয়েছে হয়ত, এতদিনে অ্যানেসথেসিয়া দিতে দিতেও হাত পেকেছে, উপন্যাস লেখার জন্য মোটেও কিন্তু হয়নি। সভয়ে সলাজে লিখে শেষ করি। মনে খুঁতখুঁতি থেকেই যায়। লেখাগুলোয় একটি বক্তব্য অন্তত দাঁড় করাতে পেরেছি, নারীর শরীর এবং হৃদয় সবই যে তার নিজের, এসব অন্য কারও সম্পত্তি নয়, এক একটি নারীর জীবন বর্ণনা করে তা বলেছি। খোকার জন্য নতুন কলামের বই নষ্ট মেয়ের নষ্ট গদ্য আর বালিকার গোল্লাছুট নামে একটি কবিতার বই। কবিতাতেও দেখেছি আমি, কেবলই নারীর কথা। নারীর সুখের কথা, কষ্টের কথা, নারীর পায়ের নিচের মাটির কথা, শেকল ছেঁড়ার কথা, সমাজের রাষ্ট্রের পরিবারের নিয়মগুলো ভেঙে বেরিয়ে আসার কথা। মানুষের অধিকার নিয়ে বাঁচার কথা। জীবনে হোঁচট খেতে খেতে জীবনের যে মর্মান্তিক রূপ দেখেছি, জীবনে স্বপ্ন দেখতে দেখতে স্বপ্নের যে ভাঙন দেখেছি, তারপরও যে আবারও স্বপ্ন রচনা করেছি, আবারও যে উঠে দাঁড়িয়েছি এবং ক্লান্ত রক্তাক্ত জীবনের যে অভিজ্ঞতাই জীবনের রাজপথে, পথে, অলিতে, গলিতে সঞ্চয় করেছি তার সবই কবিতা, কলাম, উপন্যাস যা কিছুই লিখি না কেন, আমার অজান্তেই রক্ত ঝরার মত করে ঝরে কলমের নিব থেকে।

    আমার দিনগুলো অদ্ভুত রকম পাল্টো যাচ্ছে। মাঝে মাঝে সংশয় জাগে এ সত্যিই আমি তো! ব্রহ্মপুত্রের পাড়ের লজ্জাবতী ভীতু কিশোরীটি তো! মাঝে মাঝে আমার বিশ্বাস হয় না অনেক কিছুই। বিশ্বাস হয় না যে টেলিভিশনের প্রযোজিকা আমার বাড়ি এসে গান লিখিয়ে নিয়ে যান, আর সেই শৃঙ্খল ভাঙার গান দেশের জনপ্রিয় গায়িকা সামিনা নবী গান টেলিভিশনের অনুষ্ঠানে। এ অবশ্য প্রথম নয়, আগেও আমার কবিতাকে গান করা হয়েছে। সুর দিয়েছে ইয়াসমিন। সঙ্গী সাথী নিয়ে ইয়াসমিন সেসব গান গেয়েছে মঞ্চে। কিন্তু সে তো ময়মনসিংহে। ঢাকা শহরে, তার ওপর ঢাকার টেলিভিশনে যেখানে সাধারণের প্রবেশ নিষেধ সেখানে আমার মত সাধারণের কবিতা বা গান টেলিভিশনের পর্দায় দেখানো হবে তা কি আমি কখনও ভেবেছিলাম! বিখ্যাত গায়ক ফকির আলমগীর আমাকে গান লেখার জন্য তাগাদা দেন। তাঁর জন্যও গান লিখতে হয় আমাকে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপিকা আসেন আমার কাছে, আমার কবিতা ইংরেজিতে অনুবাদ করে বড় একটি এনথলজি বের করছেন, ওতে দেবেন। ব্রিটিশ কাউন্সিলে ডাকেন আমাকে কবিতা পড়ার জন্য। নারী সংস্থার নেষনীরা আসেন তাঁদের অনুষ্ঠানে আমাকে আমন্ত্রণ জানাতে। অনন্যা পত্রিকা থেকে বছরের সেরা দশ নারী নির্বাচন করা হয়েছে, এবং তাদের সম্মানিত করা হয়েছে চমৎকার অনুষ্ঠান করে, সেরা দশ নারীর মধ্যে একজন আমি। ঢাকায় তো আছেই, ঢাকার বাইরে থেকেও লোক আসে আমাকে আমন্ত্রণ জানাতে বিভিন্ন সাহিত্য অনুষ্ঠানে, বইমেলায়। টেকনাফ থেকে ডাক্তার মোহিত কামাল ঢাকায় আসে আমার সঙ্গে দেখা করতে। মোহিতের ইচ্ছে টেকনাফে তার প্রিয় দুই লেখক ইমদাদুল হক মিলন এবং তসলিমা নাসরিনকে সে সম্বর্ধনা দেবে। টেকনাফের কচি কাঁচার মেলার সে সভাপতি, মেলা থেকেই সম্বর্ধনা দেওয়ার ব্যবস্থা হবে। মোহিত সাহিত্য অনুরাগী, আমারই সমবয়সী, খোকার সঙ্গে পরিচয় হয় তার, কি করে কি করে খোকার সঙ্গে তার বন্ধুত্ব হয়ে যায়। টেকনাফে ফিরে গিয়ে খোকার সঙ্গে চিঠিতে যোগাযোগ করে এই ব্যবস্থাটি মোহিত পাকা করে। খোকা আমাকে আর মিলনকে নিয়ে টেকনাফে রওনা হন। দেশের আনাচ কানাচে কত কিছু দেখার আছে, আমার দেখা হয়নি দেশের বেশির ভাগ অঞ্চলই। দূরে কোথাও যাওয়ার জন্য আমি এক পায়ে খাড়া। টেকনাফে, দেশের দক্ষিণের শেষ বিন্দুটিতে পৌঁছে খুব আনন্দ হয় আমার। মোহিতের বাড়িতে অতিথি হই আমরা সবাই। অনুষ্ঠানে সম্বর্ধনা দেওয়া হয় দুই লেখককে। সম্বর্ধনা পেয়ে আমি অভ্যস্ত নই, শরমে মুখ তুলতেই পারিনি। দুই লেখককে দিয়ে কচি কাঁচাদের বাৎসরিক পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে পুরস্কারও দেওয়ানো হয়। অনুষ্ঠানের পর মোহিত আমাদের সেন্ট মার্টিন দ্বীপ আর মহেশখালি দ্বীপে বেড়াতে নিয়ে যাবার আয়োজন করল। ভযাবহ যাত্রা। মাছ ধরার ট্রলারে বসে আছি, উত্তাল সমুদ্রের এক স্রোত ট্রলার ডুবিয়ে নেয়, আরেক স্রোত ভাসায়, ডুবতে ডুবতে ভাসতে ভাসতে প্রবাল- দ্বীপ সেন্ট মার্টিনে পৌঁছি। আশ্চর্য সুন্দর একটি দ্বীপ। উঁচু উঁচু বাঁশের ঘরে কিছু মানুষ বাস করে। চারদিকে অচেনা সব গাছগাছালি। সমুদ্রের য়চ্ছ সবুজ জল ছুঁয়ে ছুঁয়ে হাঁটি। সেন্ট মার্টিন থেকে মহেশখালি দ্বীপেও গিয়ে জেলেদের জীবন দেখি, জলই এই জেলেদের বাঁচাচ্ছে, জলই এই জেলেদের মারছে। জলকে ভালবাসে, আবার জলের সঙ্গেই যুদ্ধ করে বেঁচে থাকে এরা। সমুদ্রের তীরে চমৎকার সময় কাটিয়ে ফিরে আসি ঢাকায়। টেকনাফে মিলন ছিল, সাধারণ এক লেখক-বন্ধুর মতই সে ছিল। মিলনের জন্য অন্যরকম কোনও আবেগ আমি অনুভব করিনি। কাশ্মীরের কিছু স্মৃতি আছে সুখের, তা থাক। স্মৃতি স্মৃতির জন্যই। এর পরের আমন্ত্রণ সিলেটে। সিলেটের বইমেলায়। এবারও খোকা ব্যবস্থা করেন সিলেট যাত্রা। আমি, খোকা, অসীম সাহা যাত্রা করি। সময় প্রকাশনের ফরিদ তাঁর বউসহ আমাদের সঙ্গী হন। সিলেটেও খুব ভাল সময় কাটে। বইমেলায় অটোগ্রাাফ শিকারির ভিড়ে চিড়েচ্যাপ্টা হয়ে যাই। এই সুদূর সিলেটেও লোকে আমার লেখা পড়ে! দেখে আমি অভিভুত। সিলেটের চা বাগানে ঘুরে, তামাবিলে শিলং পাহাড়ের গা বেয়ে নেমে আসা ঝর্নার স্রোত এসে নদীতে পড়েছে, সেই নদীর য়চ্ছ সুন্দর জলের পাথরকুচির ওপর খালি পায়ে হেঁটে হেঁটে আমি অপূর্ব রূপ দেখি প্রকৃতির। ওপারেই ভারত, হাত বাড়ালে ছোঁয়া যায় এমন দূরে। অথচ একটি কাঁটাতার বসানো মাঝখানে। এই বাধাটি দেখে বেদনায় নুয়ে থাকি। এখানের গাছ থেকে ফুল পাতা ঝরে পড়ছে ওখানের মাঠে। ওখানের পাখি উড়ে এসে বসছে এখানের গাছে, কেবল মানুষের অধিকার নেই দুকদম সামনে হাঁটার। আমরা এই পৃথিবীর সন্তান, আমরা কেন যতদূর ইচ্ছে করে হাঁটতে পারবো না এই পৃথিবীর মাটিতে, কেন সাঁতার কাটতে পারবো না যে কোনও নদী বা সমুদ্রে? মানুষই মানুষের জন্য রচনা করেছে অসভ্য শৃঙ্খল। সীমান্তের কণ্টক থেকে একটি কণ্টক এসে হৃদয়ে বেঁধে।

    আমন্ত্রণ আসতে থাকে আরও বড় শহর থেকে, আরও বড় বড় সাহিত্য অনুষ্ঠানে। আমাকে সম্বর্ধনা দেওয়া হয়। প্রধান অতিথির সম্মান দেওয়া হয়। মঞ্চের পেছনের বড় পর্দায় বড় বড় করে লেখা থাকে আমার নাম। ঢাকায় নাট্যসভা থেকে সাহিত্য পুরষ্কারও দেওয়া হল, শামসুর রাহমান আর আমি পাই পুরস্কার। শহিদুল হক খান পুরষ্কার বিতরণ অনুষ্ঠানটি করলেন জাতীয় যাদুঘরের মিলনায়তনে। শহিদুল হক নাটক লেখেন, নাটক পরিচালনা করেন আবার নাট্যসভা নামে একটি সংগঠনও করেন। প্রতিভা আছে লোকটির। লোকে বলে বড় শঠ লোক, আমি অবশ্য তার শঠতা দেখিনি নিজ চোখে। আমার সঙ্গে অসম্ভব আন্তরিক তিনি।

    কবি সাহিত্যিকরা ঘন ঘন আসেন আমার বাড়িতে, পুরো বিকেল জুড়ে আদা-চা খেতে খেতে আড্ডা জমে। শামসুর রাহমানের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়ে আমার। দীর্ঘ দীর্ঘক্ষণ আড্ডা হয় সাহিত্য নিয়ে রাজনীতি নিয়ে। লেখক রশীদ করিম শামসুর রাহমানের বিশেষ বন্ধু। তাঁর বাড়িতে আমাকে আর শামসুর রাহমানকে প্রায়ই তিনি ডাকেন সাহিত্যের আলোচনা করতে। সাহিত্য নিয়ে হয়, ধর্ম নিয়েও আমাদের কথা হয়, আমি আর শামসুর রাহমান ধর্মহীনতার পক্ষে, রশীদ করীম ধর্মের পক্ষে। পক্ষে হলেও তিনি একজন সুসভ্য সুশিক্ষিত সুসাহিত্যিক। এই যে আমাকে দেশের বড় বড় সাহিত্যিকরা স্নেহ করেন সে আমি অল্প বয়সী (তাঁদের বয়সের তুলনায়), সুন্দরী (!) মেয়ে বলে নয়, আমার লেখার কারণে করেন। আমার কবিতায় গদ্যে আমার বক্তব্যে তাঁরা নতুন প্রজন্মের নতুন দিনের একটি সম্ভাবনা দেখছেন বলে করেন। আমার লেখা তাঁরা পড়েন, আলোচনা করেন এবং বিশ্বাস করেন যে আমি খুব প্রয়োজনীয় কথা লিখছি। আমার সমবয়সী সাহিত্যিকদের চেয়ে আমার দ্বিগুণ ত্রিগুণ বয়সী সাহিত্যিকদের সঙ্গে আমার চলাফেরা বেশি হতে থাকে। শিল্প সাহিত্য সমাজ সংস্কৃতি এসব তো আছেই, মানবিক দিকটিও অপ্রধান নয়। যেদিন আমাকে শামসুর রাহমান খবর দিলেন যে রশীদ করিম হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েছেন, আমি হাসপাতাল থেকে ছুটে গিয়ে রশীদ করিমকে বাড়ি থেকে দ্রুত তুলে নিয়ে সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের ভর্তি করিয়ে দিই। রশীদ করিম বেঁচে যান কিন্তু মস্তিস্কে রক্তক্ষরণ হওয়ায় শরীরের অর্ধেকটা অচেতন হয়ে পড়ে থাকে। হাসপাতাল থেকে তিনি বাড়ি ফিরে যাওয়ার পর তাঁকে দেখতে, সঙ্গ দিতে, তাঁর মন ভাল করে তুলতে আমি আর শামসুর রাহমান দুজনই তাঁর বাড়িতে যাই। শামসুর রাহমানের সঙ্গে পান্না কায়সারের ভাল বন্ধুত্ব। ইস্কাটনে পান্না কায়সারের বাড়িতেও আমরা যাই পানাহার আর আড্ডার নেমন্তন্নে। পান্না কায়সার আর আমি যশোরের সাহিত্য সভায় গিয়েছিলাম। লেখক শহীদুল্লাহ কায়সারের স্ত্রী পান্না কায়সার নিজেও উপন্যাস লিখছেন, রাজনীতির মঞ্চে তিনি কথা বলে অভ্যস্ত, চমৎকার বক্তৃতা করলেন যশোরে। নতুন শহর দেখে, নতুন নতুন মানুষের সঙ্গে পরিচিত হয়ে ভাল লাগে আমার কিন্তু মঞ্চে যখন আমাকে ঠেলে দেওয়া হয় বক্তৃতা করতে, আমি দর্শক শ্রোতা কাউকে মুগ্ধ করতে পারি না, বক্তৃতা করতে হলে কিছু শক্ত শক্ত শব্দ ব্যবহার করতে হয়, সেই শব্দগুলো আমি কখনও আয়ত্ত্ব করতে পারি না।

    বেইলি রোডে চরমপত্রের নরম লোক এম আর আখতার মুকুলের বইয়ের দোকান সাগর পাবলিশার্সে বই কিনতে গেলে প্রায়ই দেখি শওকত ওসমান বসে আছেন ওখানে। আমাকে দেখেই খলবল করে রাজ্যির কথা বলেন। দেশের কত বড় একজন সাহিত্যিক। একদিন আমার নামের অর্থ করে দিলেন। তার পর দেখি তিনি ফটোকপি করে বিলোচ্ছেন আমাকে নিয়ে লেখা তাঁর একটি কবিতা। নাসরিন নামের অর্থ বন্য গোলাপ, কমতি হয় না তাই সুগন্ধের তাপ।পাওয়ার একটি সীমা আছে। আমার পাওয়া সীমা ছাড়িয়ে যায়।

    দেশের জনপ্রিয় কবি নির্মলেন্দু গুণের সঙ্গে আমার খুব চমৎকার বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। ধীরে ধীরে তিনি বাড়ির লোকের মত আপন হয়ে ওঠেন। গুণের চরিত্রের একটি সাংঘাতিক দিক আছে, তিনি কোনও অপ্রিয় সত্য কথা বলতে কোনও দ্বিধা করেন না, লোকে কি বলবে তা নিয়ে ভাবেন না। শুধু বলে তিনি ক্ষান্ত নন, জীবনে তিনি তা করেও দেখান। গুণের হুলিয়া কবিতাটি পড়ে যে কোনও পাঠকের মত আমিও ভেবেছিলাম, গুণের বিরুদ্ধে বুঝি কোনও রাজনৈতিক মামলার হুলিয়া জারি হয়েছিল। একদিন জানতে চেয়েছিলাম হুলিয়া জারি হওয়ার পর তিনি কি করে গা ঢাকা দিয়েছিলেন, শেষ পর্যন্ত ধরা পড়েছিলেন কি না এসব নিয়ে, তখনকার নিষিদ্ধ বাম রাজনীতির রোমহর্ষক কাহিনী বা পাকিস্তানী সরকারের বিরুদ্ধে কোনও গোপন আন্দোলনের কথা শুনব বলে কান মন সব সজাগ রেখে বসেছি, গুণ তখন অত্যন্ত শান্ত কণ্ঠে বললেন যে তিনি ডাকাতির মামলার আসামী ছিলেন। সত্যি সত্যিই ডাকাতির মামলা। কোনওরকম সংকোচ না করে বলে দিলেন ঘটনা, নেত্রকোনার এক গ্রামে এক রাতে তিনি সত্যিকার ডাকাত দলের সঙ্গে ভিড়ে ডাকাতি করতে গিয়েছিলেন। কেন ডাকাতি? খুব সরল জবাব, টাকার দরকার ছিল। টাকার দরকার জীবনে প্রচুর এসেছে গুণের। আনন্দমোহন কলেজের হোস্টেলে থাকাকালীন হোস্টেলের ক্যাপ্টেন হয়ে তিনি বাজার করার টাকা থেকে চুরি করতেন টাকা। নতুন শার্ট কিনেছিলেন সে টাকায়। হোস্টেলের ঘরে রাতে রাতে জুয়ো খেলতেন। ধরা পড়ে যাওয়ার পর তাঁকে কলেজ থেকে বের করে দেওয়া হয়েছিল। ঢাকায় যখন বাস করতে শুরু করলেন, কবিতা লিখে টাকা যা রোজগার করেন, তাতে জীবন চলে না। ক্ষিধে পেটে হাঁটেন, পকেটে পয়সা নেই। এরকম অনেক হয়েছে যে হাতে কোনও টাকা পয়সা ছাড়াই রেস্তোরাঁয় ঢুকে ভাত খেয়েছেন। এরপর মার খাবার ভয়ে পালানোর মতলব করেছেন। পানি নিয়ে বারান্দায় হাত ধুতে যাবার ভান করে পানির গেলাস ফেলে উর্ধ্বশ্বাসে দৌড়। রেস্তোরাঁর লোক পেছনে দৌড়েও রবীন্দ্রনাথের মত দেখতে লম্বু গুণের টিকি দাড়ি কিছুই ছুঁতে পারেনি। খেয়ে পয়সা না দিয়ে ঝড় বৃষ্টি কিছু মানেননি, দৌড়ে পালিয়েছেন। এসব বলতে গুণের আসলেই কোনও সংকোচ হয় না। তাঁর এই সংকোচহীনতা আমাকে মুগ্ধ করে। নিজেকে নিয়ে কোনও রকমের অহংকার না করে বরং প্রাণখুলে এমন রসিকতা করতে আমি আর কাউকে দেখিনি আগে। আমার যখন দশ বছর বয়স, ইশকুলের নতুন ক্লাসে উঠেছি, বাবা আমাকে নতুন ক্লাসের সব বই কিনে দেননি তখনও। ক্লাস শুরু হয়ে গেছে ওদিকে। ক্লাসে মেয়েরা নতুন নতুন বই নিয়ে আসছে। আমার চেয়ে বেশি বই তাদের। তখন ছুটির পর দেখি আভা রুদ্র নামে ক্লাসের একটি মেয়ে ভুলে তার বাংলা দ্রুতপঠনের গল্পের বইটি ফেলে চলে গেছে। আমিই সবচেয়ে শেষে বেরিয়েছিলাম ক্লাস থেকে। আভা রুদ্রর বেঞ্চে পড়ে থাকা বইটি হাতে নিয়ে এদিক ওদিক তাকিয়ে বইটির লোভ সামলাতে না পেরে আমি পাজামার মধ্যে বইটি গুঁজে নিয়েছিলাম। ক্লাসঘর থেকে বেরিয়ে হাঁটছি আর বুক কাঁপছে। পেটে বই। আমার কেবলই মনে হচ্ছিল জামার তলের বইটি বুঝি যে-ই আমার দিকে তাকাচ্ছে দেখে ফেলছে। গেটের কাছে মেয়েরা দাঁড়িয়ে আছে। আভা রুদ্রও দাঁড়িয়ে আছে। ওর বইটি আমার পেটে, আমার ইচ্ছে করছিল বইটি পেট থেকে বের করে তাকে দিয়ে দিই। কিন্তু পেট থেকে বইটি তখন ভরা মাঠে আমি বের করি কি করে! পেটে বই নিয়েই হেঁটে বাড়ি ফিরেছি। বুক ধড়ফড় তখনও থামেনি। তোশকের তলে লুকিয়ে রেখেছিলাম বইটি, কেউ যেন টের না পায় বইটি আমি চুরি করে এনেছি। বইটি পেটে করে গোসলখানায় নিয়ে, ছাদে নিয়ে পুরোটাই পড়ে ফেলি পরদিনই। দুদিন পর বাবা আমাকে বাকি পাঠ্য বইগুলো কিনে দিলেন, দ্রুতপঠন বইটি অবশ্যই ছিল। ইশকুলে গিয়ে আভা রুদ্রকে দেখে আমার বুক ভেঙে যায়। হারিয়ে যাওয়া বইটির জন্য সে কান্নাকাটি করছে, ক্লাসের সবাইকে জিজ্ঞেস করছে তার বইটি কেউ দেখেছে কিনা। তাকে আমি বইটি ফিরিয়ে দিতে পারছি না, ফেরত দিলে সে আমাকেই গাল দেবে চুরি করেছিলাম বলে। এদিকে মন খুব খারাপ আমার, নিজেকে চোর বলে মনে হচ্ছে প্রতিটি মুহূর্তে। রাতে ঘুম আসে না, এপাশ ওপাশ করি। কাউকেই নিজের এই চুরির কথাটি বলতে পারি না। ওই চিকন বইটি আমার কাঁধে গারো পাহাড়ের মত এমন ভারী হয়ে বসেছিল যে একদিন পেটে করে বইটি নিয়ে সকাল সকাল ইশকুলে গিয়ে ক্লাসঘরে কেউ না ঢোকার আগেই ঢুকে আভার ডেস্কের ওপর রেখে দিয়ে ভারমুক্ত হই। পরে আভার সঙ্গে আমার ভাল বন্ধুত্ব হয়েছিল। কোনওদিন তাকে বলিনি বই চুরির কথা। বড় হবার পরও কোনও দিন কাউকে বলিনি। বইটি গোপনে ফেরত দিয়েও চুরি করার অপরাধবোধ থেকে মুক্তি আমি পাইনি। নির্মলেন্দু গুণ, আমি জানি, এরকম অপরাধের কথা অনায়াসে বলে ফেলতে পারেন। নির্মলেন্দু গুণের চুরি ডাকাতি জুয়োখেলা এসব আমি পছন্দ না করলেও তাঁর স্বীকারোক্তি আমি পছন্দ করি। নিজের অংসযম নিয়েও তিনি কবিতা লিখেছেন অনেক, তাঁর বেশ্যাগমন নিয়ে তিনি কোনও রাখঢাক করেননি। মেডিকেলের ছাত্রী নীরা লাহিড়ির সঙ্গে গুণের বিয়ে হয়েছিল। কবি আর হবু ডাক্তারের সুন্দর সংসার, কন্যা মৃত্তিকা জন্মেছে। কবি ব্যস্ত অর্থ উপার্জনে, হবু ডাক্তার ব্যস্ত ডাক্তারি বিদ্যা অর্জনে। মৃত্তিকাকে দেখাশোনা করার জন্য নেত্রকোনা থেকে গীতাকে আনা হয়েছে। গীতার নিজের কোনও বাচ্চা কাচ্চা নেই, মৃত্তিকাকে সে পরম আদরে লালন করছে। এর মধ্যেই হঠাৎ একদিন গুণের সঙ্গে সম্পর্ক চুকিয়ে ফেললেন নীরা। বিয়ে ভেঙে নীরা তাঁর কন্যা নিয়ে চলে গেলেন। নির্মলেন্দু গুণ গীতাকে নিয়ে একা পড়ে রইলেন। ময়মনসিংহ থেকে ঢাকায় এসে বস্তিতে বাস করছেন কেবল গীতাকে নিয়ে নয়, গীতার জ্ঞাতিগুষ্ঠি নিয়ে, সবারই দায়িত্ব তিনি নিয়েছেন। নীরা দেখেশুনে একটি ডাক্তার ছেলেকে বিয়ে করে নিয়েছেন। মৃত্তিকা থাকে তাঁর দিদিমার বাড়িতে। গুণ থাকেন মৃত্তিকার ধারে কাছেই বস্তিতে। বস্তিতে থাকা নিয়ে বা গীতার গুষ্ঠি পালন করা নিয়ে গুণকে কোনও দুঃখ প্রকাশ করতে দেখিনি। তিনি সুখী। অভাব আছে কিন্তু অভাবের বোধ নেই। জীবনের প্রতি বিন্দু তিনি উপভোগ করেন। প্রাণ খুলে হাসেন, বুক খুলে ভালবাসেন, হাত খুলে লেখেন। ধন দৌলতের কোনও মোহ নেই। বিলাস ব্যসনের কোনও সাধ নেই। বিলাস বহুল বাড়ির বিলাস বহুল খাবার-টেবিলে সুস্বাদু সব উপাদেয় খাবার খেতে পারেন আবার বস্তির মাটির উঠোনে বসে মাছি তাড়াতে তাড়াতে নেড়ি কুত্তা খেদাতে খেদাতে বাসি ডাল ভাতও খেতে পারেন। দুটোতেই তাঁর সমান তৃপ্তি। লাস ভেগাসের ক্যাসিনোয় বসেও কয়েক হাজার ডলারের জুয়ো খেলে যে সুখ পান, ঢাকার কোনও ঘিঞ্জি গলিতে বসে দু পাঁচ টাকা নিয়ে জুয়ো খেলেও তাঁর একই সুখ। নির্মলেন্দু গুণ যে চোখে জীবন দেখেন, সে চোখটি বড় নির্মোহ কিন্তু বড় অভিজ্ঞ চোখ। বিশাল বিশ্ব ব্রম্মাণ্ডে জীবন হল সরু সুতোর মত, যে সুতোটি টান টান হয়ে আছে যে কোনও মুহূর্তে ছিঁড়ে যাবে বলে, সেই সুতোর ওপর নির্ভয়ে দাঁড়িয়ে জীবনের রস সন্ধানে এবং পানে তিনি কোনও কার্পণ্য করেন। আড্ডা দিতে দিতে একদিন অনেক রাত হয়ে যাওয়ায়, সেদিন মিলন, মা কেউ ছিল না বাড়িতে, বাড়তি ঘর আছে, বিছানা আছে, গুণকে বলেছি রাতে থেকে যেতে। তিনি থেকে গেলেন। ভোরবেলায় দেখি গীতা এসে হাজির। দাদা রাতে বাড়ি ফেরেননি, পাতি পাতি করে শহর খুঁজে শেষে আমার ঠিকানা যোগাড় করে এখানে দেখতে এসেছে গুণ আছেন কি না।

    গীতা গুণকে দেখেই বলল, ‘দাদা, আপনে কেমন মানুষ গো! আমরা চিন্তায় মইরা যাইতাছি। একটা খবর দিবেন না যে ফিরবেন না?’

    গুণ হাসতে হাসতে বললেন, ‘তুই জানলি কেমনে আমি যে নাসরিনের বাসায়?’

    গীতার উৎকণ্ঠিত মুখে প্রশান্তি এখন, ‘অসীমদা কইল যে দিদির বাসায় থাকতে পারেন।’

    ‘রিক্সা দিয়া আইছস না হাইট্যা?’ গুন জিজ্ঞেস করেন।

    ‘হাইট্যা কি এতদূর আইতে পারাম। রিক্সা লইছি।’

    ‘ভাড়া দিছস?’

    ‘না, রিক্সারে গেটের সামনে খাড়া কইরা থইয়া আইছি।’

    ‘তুই যে আইলি, তুই ইস্কুলে যাইতি না?’

    ‘হ যাইয়াম। চলেন বাড়িত চলেন। আমার ইস্কুলের দেরি অইয়া যাইব।’

    নির্মলেন্দু গুণ চা নাস্তা খেয়ে গীতাকে নিয়ে চলে যান। গুণ তাঁর কাব্য সমগ্রের প্রথম পর্ব উৎসর্গ করেছেন কবি শামসুর রাহমানকে, দ্বিতীয় পর্ব উৎসর্গ করেছেন এই গীতাকে, গীতা গাণ্ডীবা দাসীকে। গীতা আজিমপুরের একটি ইশকুলে ঘণ্টা বাজাবার কাজ করে। এখন সে কারও বাড়ির কাজের মহিলা নয়। শরীরটি শক্ত সমর্থ, টান টান। মাথাটি উঁচু। গীতার ছোট বোনগুলোকে গীতা নিজের কাছে নিয়ে এসেছে, তাদেরও কোথাও কাজে নামিয়ে দেওয়ার ইচ্ছে তার। গুণ আমাকে বলেছেন আমার বাড়িতে কোনও একটিকে তিনি পাঠাবেন কাজ করতে। কুলসুম বাড়ি থেকে পালিয়ে গেলে গীতার ছোট বোন বেবিকে নিয়ে এসেছিলাম বাড়ির কাজ করার জন্য। বেবি বেশিদিন থাকেনি। পরে একসময় গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিতে কাজ করতে শুরু করে। সুইয়ে সুতো ভরার কাজ। মাসে তিনশ টাকা মাইনে।

    নির্মলেন্দু গুণের পরিবারের ঘনিষ্ঠ লোক এরাই। গুণের মুখে এদের গল্প অনেক শুনি। একবার গুণকে বলেছিলাম, তিনি কেন বস্তি ছেড়ে উঠে আসছেন না, কেন তিনি একটি ভাল জায়গায় বাড়ি ভাড়া করে থাকছেন না। গুণ আমাকে বুঝিয়ে বলেন, ভাল জায়গা ওদের জন্য বস্তিই। ওখানেই ওরা আনন্দে থাকে। চেঁচিয়ে গালি গালাজ করে ইচ্ছে মত থাকা যায়। মধ্যবিত্ত ভাল এলাকায় এরকম বস্তিপনা প্রতিবেশিদের সহ্য হবে না। গীতা আর গীতার বোনদের সঙ্গে সম্পর্ক নিয়ে বাড়িভাড়া নিতে গেলে প্রশ্নও উঠবে। বস্তিতে এসব প্রশ্ন কখনও ওঠে না। এ কথা ঠিকই, সমাজের কঠোর কঠোর নিয়মগুলো মধ্যবিত্ত শিক্ষিতরাই পালন করে, উচ্চবিত্ত আর নিম্নবিত্তই কোনও রীতি নীতির ধার ধারে না। এটা করলে ইজ্জত যাবে, ওটা করলে মান যাবে এসব মধ্যবিত্তের ব্যপার। নির্মলেন্দু গুণের অবাধ যাতায়াত সব শ্রেণীর মানুষের মধ্যে। নিজে তিনি শ্রেণীহীন মানুষ। অনেকটা রাজহাঁসের মত, আজিমপুর বস্তির আবর্জনা তাঁর গায়ে লাগছে না, গুলশানের অট্টালিকার চাকচিক্য তাঁকে স্পর্শ করছে না।

    নির্মলেন্দু গুণ কোনওদিন জুয়ো খেলায় জেতেননি। খেলায় বসা মানে, খেলায় হারা। তারপরও তিনি খেলতে যান জুয়ো। বলেছিলাম, ‘ধুর, বাদ দেন তো। কেন খেলেন এই সব? সময় নষ্ট। পয়সা নষ্ট।’

    গুণ মলিন মুখে বলেন, ‘কি করব বল। না খেইলা তো উপায় নাই।’

    ‘উপায় নাই কেন?’

    গুণ খেলার সঙ্গীদের দোষ দিয়ে বললেন, ‘আমি না খেললে আমারে ওরা হারামজাদা বইলা গাল দেয়।’

    হারামজাদা গাল খেতে তিনি পছন্দ করেন না বলে জুয়ো খেলতে যান।

    জীবন নিয়ে তিনি যত মজাই করুন না কেন, রাজনীতির ব্যপারে তিনি খুবই সিরিয়াস। তবে একানব্বই এর নির্বাচনে তিনি এ নিয়ে একটু মজা করেছিলেন। তাঁর খুব নির্বাচনে দাঁড়াবার শখ হল। তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস ছিল যেহেতু তিনি আওয়ামি লীগের ঘোর সমর্থক, আওয়ামি লীগ থেকে তিনি প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন পাবেন। কিন্তু মনোনয়ন তাঁকে দেওয়া হল না। না দিলে কি হবে, নির্বাচন তিনি করতে চেয়েছেন, করবেন যে করেই হোক। কুমীর মার্কায় দাঁড়িয়ে গেলেন সতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে। নৌকো নেই ভাগ্যে, কিন্তু কুমীর তো আছে। নেত্রকোনা ছেয়ে ফেললেন পোস্টারে, পুরোদমে নির্বাচনী প্রচারে ব্যস্ত হয়ে গেলেন। কবিতা পড়ার কণ্ঠ স্লোগান দিতে দিতে বক্তৃতা করতে করতে ঘরে ঘরে গিয়ে ভোট চাইতে চাইতে ভেঙে টুকরো হয়ে গেল। গলায় কাগজের মালা পরে রিক্সায় দাঁড়িয়ে হাত দোলাতে দোলাতে পেছনে কুমীর মার্কার সমর্থক নিয়ে স্বতন্ত্র নেতা নির্মলেন্দু গুণ ঘুরে বেড়ালেন পুরো নেত্রকোণা। এতে অবশ্য তাঁর নির্বাচনের অভিজ্ঞতা হল অনেক, তবে ভোটে জেতা হয়নি। সাকুল্যে পাঁচটি ভোট পেয়েছিলেন।

    শেখ মুজিবকে নিয়ে একমাত্র নির্মলেন্দু গুণই সবচেয়ে বেশি এবং সবচেয়ে হৃদয়স্পর্শী কবিতা লিখেছেন। যে আওয়ামি লীগ নির্মলেন্দু গুণের কবিতা ব্যবহার করে যে কোনও উৎসবে অনুষ্ঠানে, সেই আওয়ামি লীগ অনেক অগাবগাগাগরুছাগলকে প্রার্থী করেছে, নির্মলেন্দু গুণকে করেনি। শেখ মুজিবকে নিয়ে যখন কেউ কোনও কথা বলতে সাহস পায়নি, লেখালেখি তো দূরের কথা, সেই সময় গুণই কাউকে পরোয়া না করে কবিতা লিখে গেছেন এবং প্রকাশ্য সভায় প্রথম তিনিই নির্ভয়ে সেসব কবিতা পড়েছেন। ‘মুজিব মানে আর কিছু না, মুজিব মানে মুক্তি, পিতার সাথে সন্তানের না লেখা প্রেম চুক্তি। মুজিব মানে আর কিছু না, মুজিব মানে শক্তি, উন্নত শির বীর বাঙালির চিরকালের ভক্তি।’ গুণের কবিতা আওয়ামি লীগের খুব বড় সম্পদ। রেসকোর্সের ময়দানে একাত্তর সালের সাতই মার্চের ভাষণকে তিনি কবিতা আর মুজিবকে কবি বলে উল্লেখ করে লিখেছেন স্বাধীনতা শব্দটি কিভাবে আমাদের হল কবিতাটি। বিএনপি যখন দাবি করছে জিয়াউর রহমান ছিলেন স্বাধীনতার ঘোষক, তখন একাত্তরে মুজিবের মহান ভূমিকাকে বার বার স্মরণ করিয়ে দিতে চাইছে আওয়ামি লীগ, আপাদমস্তক মুজিবভক্ত কবি নির্মলেন্দু গুণকে নিজেদের সভা সমাবেশে ডেকে মুজিবকে নিয়ে লেখা কবিতাগুলো পড়িয়ে বেশ গর্বিত মুজিব কন্যা হাসিনা। গুণ তাঁর ভরাট কণ্ঠে পিন পতন নিস্তব্ধতার মধ্যে পড়েন, সমবেত সকলের মত আমিও গোলাপফুল খুব ভালবাসি/রেসকোর্স পার হয়ে যেতে সেইসব গোলাপের একটি গোলাপ /গতকাল কানে কানে আমাকে বলেছে/ আমি যেন কবিতায় শেখ মুজিবের কথা বলি/আমি তার কথা বলতে এসেছি। /সমকাল পার হয়ে যেতে সদ্যফোঁটা একটি পলাশ/ গতকাল কানে কানে আমাকে বলেছে /আমি যেন কবিতায় শেখ মুজিবের কথা বলি/ আমি তার কথা বলতে এসেছি।/ শাহবাগ এভিন্যূর ঘুর্ণায়িত জলের ঝর্ণাটি গতকাল/ আর্তস্বরে আমাকে বলেছে /আমি যেন কবিতায় মুজিবের কথা বলি/আমি তার কথা বলতে এসেছি।/ শহীদ মিনার থেকে খসে পড়া একটি রক্তাক্ত ইট/ গতকাল কানে কানে আমাকে বলেছে/ আমি যেন কবিতায় শেখ মুজিবের কথা বলি/ আমি তার কথা বলতে এসেছি।/ সমবেত সকলের মত আমারও স্বপ্নের প্রতি পক্ষপাত আছে /ভালবাসা আছে –গতকাল রাতে দেখা একটি সাহসী স্বপ্ন/ গতকাল কানে কানে আমাকে বলেছে আমি যেন/ কবিতায় শেখ মুজিবের কথা বলি/ আমি তার কথা বলতে এসেছি।/এই বটমূলে সমবেত মানুষগুলো সাক্ষী থাকুক/ না ফোটা কৃষ্ণচূড়ার অপ্রস্তুত প্রাণের এই গোপন মঞ্জুরিগুলি কান পেতে শুনুক/ বিষণ্ন বসন্তের এই কালো কোকিলটি জেনে যাক/ আমার পায়ের তলার পূন্য মাটি ছুঁয়ে/ আমি আজ সেই গোলাপের কথা রাখলাম/ সেই পলাশের কথা রাখলাম/ আমি আজ কারো রক্ত চাইতে আসিনি,/আমি আমার ভালবাসার কথা বলতে এসেছিলাম।

    আওয়ামি লীগের সঙ্গে তার পরও নির্মলেন্দু গুণ সম্পর্ক নষ্ট করেননি। হাসিনার সঙ্গে তাঁর আগের মতই ভাল সম্পর্ক। হাসিনা বিরোধী দলের নেষনী হিসেবে মিন্টোরোডের সরকারি বাসভবনে ওঠার পর যেহেতু সরকারি দল থেকে বিশাল করে ইফতার পার্টির আয়োজন করেছে, তিনিও করেছেন আয়োজন। হাসিনার ইফতার পার্টিতে যাবার আমন্ত্রণ জোটে আমার। আমি আর গুণ ভরা পেটে হাসিনার দাওয়াত খেতে যাই। গুণের পকেটে একটি ডোভ ক্রিমের কৌটো, আমেরিকা থেকে আনা হাসিনার জন্য একটি উপহার। আমার খালি হাত, খালি পকেট, ভরা শুধু চোখ দুটো, রাজনৈতিক ইফতার দেখার কৌতূহলে। মিন্টো রোডের বাড়ির মাঠে বিশাল ত্রিপলের তলে চেয়ার টেবিল বসানো। মাইকে কোরান তেলোয়াত হচ্ছে। রোজদার আওয়ামী নেতারা সাইরেন পড়ার সঙ্গে সঙ্গে বিসমিল্লাহ বলে পানি মুখে দিয়ে রোজা ভাঙছেন। হাসিনা ঘোমটা মাথায় টেবিলে টেবিলে গিয়ে অতিথিদের সম্ভাষণ জানাচ্ছেন। আজ তিনি খবর করে দিচ্ছেন যে আওয়ামী লীগও বিএনপি বা জামাতে ইসলামীর মত ধর্মভীরু দল। ধর্মের সঙ্গে রাজনীতির এই মিশ্রণ আমি দেখতে থাকি বড় বেদনার্ত বড় ভীত চোখে।

    ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ ছিল এ দেশে, এখন সিদ্ধ। যে জামাতে ইসলামির খুনীরা দেশ স্বাধীন হওয়ার পর গর্তে লুকিয়েছিল, তারাই এখন এ দেশের সংসদের মহামান্য সদস্য। কি ভীষণ পাল্টো গেছে দিন! জামাতে ইসলামি আজ এই জায়গায় এসে পৌঁছোতে পারত না, যদি না তারা বিএনপি আর আওয়ামী লীগের আশকারা পেত। একাত্তরের গণহত্যাকারী গোলাম আযম বাংলাদেশে ফিরে জামাতে ইসলামির আমীর হয়ে বসেছেন। ঘাতক দালালরা এখন মাথা উঁচু করে এ দেশে চলাফেরা করে। একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি নামে একটি সংগঠন গড়ে তুলেছে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের কিছু মানুষ, জাহানারা ইমাম এই কমিটিতে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। একাত্তরের দিনগুলি নামে তিনি একটি স্মৃতিকথা লিখেছেন, ভয়াবহ সেই দিনগুলির বর্ণনা আছে বইয়ে। যুদ্ধে কী করে তিনি তাঁর স্বামী আর পুত্রকে হারিয়েছেন লিখেছেন। জাহানারা ইমামের বাড়িতে একদিন খোকা আমাকে নিয়ে গিয়েছিলেন। জাহানারা ইমাম তখন গোলাম আযমের শাস্তি হওয়ার পক্ষে জনগণের সই যোগাড় করছিলেন। আমাকেও দিয়েছিলেন সই যোগাড়ের দায়িত্ব। নির্মূল কমিটির উদ্যোগে সোহরোওয়ার্দী উদ্যানে যেদিন গণআদালত ডেকে গোলাম আযমের বিচার করা হয়, সেদিন হাজার হাজার দর্শকের মিছিলে আমিও ছিলাম। গণআদালতে গোলাম আযমের ফাঁসির রায় হল। কিন্তু ফাঁসি কে দেবে তাঁকে! সরকার পুলিশ লেলিয়ে দিয়েছে গণআদালত পণ্ড করতে। পুলিশ এসে স্বতস্ফূর্ত আন্দোলনের জনতাকে ছত্রভঙ্গ করে দিয়েছে, মাইক খুলে নিয়েছে, মঞ্চ ভেঙে ফেলেছে। গোলাম আযমকেও জেলে ভরা হয়েছে, নেহাতই লোক দেখানো জেল। পাকিস্তানি পাসপোর্টে এ দেশে ঢুকে ভিসার মেয়াদ ফুরিয়ে যাওয়ার পরও কেন থাকছেন— এই তুচ্ছ অপরাধের জন্য তাঁকে জেলে নেওয়া হয়েছে, কিন্তু একাত্তরের যুদ্ধের সময় যে তিনি পাকিস্তানি সামরিক জান্তার পক্ষ হয়ে হাজার হাজার বাঙালিকে খুন করেছেন তাঁর সেই অপরাধ নিয়ে সরকারের মুখ থেকে কোনও শব্দ বেরোচ্ছে না। আমার আশঙ্কা হয় পরিস্থিতি শান্ত হলে গোলাম আযমকে জেল থেকে আবার না মুক্তি দেওয়া হয়, গোলাম আযম এ দেশের নাগরিকত্বের জন্য যে আবেদন করেছেন, সেই নাগরিকত্ব না আবার তাঁকে দিয়ে দেওয়া হয়। এই দেশটি দেখতে তখন কেমন হবে! আদৌ কি বাসযোগ্য হবে! ধর্ম যেরকম প্রধান অঙ্গ হয়ে উঠছে রাজনীতির, আমার আশঙ্কা হয় ধীরে ধীরে জামাতে ইসলামির হাতেই না চলে যায় রাষ্ট্রক্ষমতা একদিন!

    শান্তিবাগে কুলসুম ফিরে এসেছে। পালিয়ে সে বেশিদূর যেতে পারেনি। যদিও তার ইচ্ছে ছিল ময়মনসিংহে তাদের গ্রামের বাড়িতে চলে যাওয়ার, ওখানে তার মাকে আর বোনকে নিয়ে জীবন যাপন করার, সেই স্বপ্নটি সফল হয়নি কুলসুমের। শান্তিবাগেই এক বাড়িতে সে কিছুদিন কাজ করেছে, ওখানে অশান্তি এমন বেশি যে ও বাড়ি থেকে পালিয়ে আবার আমার বাড়িতেই এসে থেমেছে। কুলসুম তেরো চৌদ্দ বছরের কিশোরী। এ বয়সেই পাঁচবেলা নামাজ পড়ে, সবগুলো রোজা রাখে, মাথা থেকে ওড়না সরতে দেয় না। পীর বাড়িতে অনেকদিন কাজ করেছে, ওখান থেকেই মাথায় আবর্জনা ভরে এনেছে সে। একদিন কুলসুমকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘এই যে নামাজ রোজা করস, কী লাভ!’

    কুলসুম ঘর মুছছিল, বালতির পানিতে নোংরা ত্যানা ধুয়ে চিপে আবার মেঝেয় ফেলে মুছতে মুছতে বলে, ‘বেহেস্তে যাইতে পারব।’

    ‘বেহেস্তে কী আছে?’ আমি জিজ্ঞেস করি।

    কুলসুম ঘর মোছা থামিয়ে মিষ্টি করে হাসে। চোখের তারাদুটো ঝিলমিল করছে ওর। বলল, ‘বেহেস্তে মাছের কলিজা খাইতে দিব আল্লাহ।’

    আমি বলি, ‘মাছের কলিজা? তর মাছের কলিজা খাইতে ইচ্ছ! করতাছে? যা, তরে মাছের কলিজা খাওয়াবো। শান্তিনগর বাজার থেইকা কালকেই আমি মাছের কলিজা কিন্যা আনব।’ কুলসুমের নাক কুঁচকে ওঠে, ঠোঁট বেঁকে থাকে, কপালে ভুরুতে ভাঁজ পড়ে বাজারের মাছের কলিজার কথা শুনে।

    ‘মাছের কলিজা তো তর খাইলেই হইল। এহন নামাজ রোজা বাদ দিয়া দে। মাথার কাপড় ফালা। এই গরমের মধ্যে মাথায় যে কাপড় দিয়া রাখস, আরও তো গরম লাগে। মাছের কলিজা..’

    কুলসুম ওড়নাটিকে টেনে মাথার ওপর আরও বেশি করে এনে বলে, ‘দুনিয়ার মাছের কলিজা তিতা, বেহেস্তের মাছের কলিজা মিষ্টি।’

    আমি হো হো করে হেসে উঠি। আমার হাসির দিকে কুলসুম বিরক্ত দৃষ্টি ছুঁড়ে বেরিয়ে যায়। আমাকে পাগল ভাবে নয়ত বোকার হদ্দ ভাবে।

    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleকিছুক্ষণ থাকো – তসলিমা নাসরিন
    Next Article উতল হাওয়া – তসলিমা নাসরিন

    Related Articles

    তসলিমা নাসরিন

    লজ্জা – তসলিমা নাসরিন

    August 21, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    আমার মেয়েবেলা – তসলিমা নাসরিন

    August 21, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    উতল হাওয়া – তসলিমা নাসরিন

    August 21, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    কিছুক্ষণ থাকো – তসলিমা নাসরিন

    August 21, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    ভালোবাসো? ছাই বাসো! – তসলিমা নাসরিন

    August 21, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    ভ্রমর কইও গিয়া – তসলিমা নাসরিন

    August 21, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo
    Most Popular

    রূপমঞ্জরী – ২য় খণ্ড – নারায়ণ সান্যাল

    September 3, 2025

    অনুরাধা

    January 4, 2025

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    রূপমঞ্জরী – ২য় খণ্ড – নারায়ণ সান্যাল

    September 3, 2025

    অনুরাধা

    January 4, 2025

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025
    Our Picks

    রূপমঞ্জরী – ২য় খণ্ড – নারায়ণ সান্যাল

    September 3, 2025

    রূপমঞ্জরী – ৩য় খণ্ড – নারায়ণ সান্যাল

    September 3, 2025

    কাঁটায়-কাঁটায় ৫ – নারায়ণ সান্যাল

    September 3, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    Sign In or Register

    Welcome Back!

    Login below or Register Now.

    Lost password?

    Register Now!

    Already registered? Login.

    A password will be e-mailed to you.