Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    রূপমঞ্জরী – ২য় খণ্ড – নারায়ণ সান্যাল

    September 3, 2025

    রূপমঞ্জরী – ৩য় খণ্ড – নারায়ণ সান্যাল

    September 3, 2025

    কাঁটায়-কাঁটায় ৫ – নারায়ণ সান্যাল

    September 3, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • 🔖
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    Subscribe
    সাইন ইন
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    দ্বিখণ্ডিত – তসলিমা নাসরিন

    তসলিমা নাসরিন এক পাতা গল্প779 Mins Read0

    ১৮. কবন্ধের যুগ

    ৬ই ডিসেম্বর দুপুরবেলা আমি ঢাকা মেডিকেলের অপারেশন থিয়েটারে রোগীদের অজ্ঞান করছি। কিন্তু মন উচাটন। সেই সকাল থেকেই ভাবছি কাউকে আমার কাজের দায়িত্ব দিয়ে হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে পড়ব, দুপুর পেরিয়ে গেছে তবু সুযোগ হচ্ছে না। খুব বেশিদিন হয়নি ঢাকা মেডিকেলে চাকরি করছি, এখনও কারও সঙ্গে তেমন ঘনিষ্ঠতা হয়নি। চাকরির প্রথম দিন থেকে কাঁটায় কাঁটায় হাসপাতালে আসা, মুখ বুজে অপারেশন থিয়েটারে ঢুকে যাওয়া, একটির পর একটি রোগীকে অজ্ঞান করা, অপারেশনের পর জ্ঞান ফেরানো —- বিরতিহীন চলছে। দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়, বিকেলগুলো খোঁড়াতে খোঁড়াতে গিয়ে সন্ধের গায়ে ঢলে পড়ে, অজ্ঞানের কাজ তখনও চলতেই থাকে। কাঁটায় কাঁটায় কাজ শুরু করলেও কাঁটায় কাঁটায় কাজ শেষ করা যায় না। শেষ কখন হবে তার ঠিক নেই। বাঁধা রোগী তো আছেই, অবাঁধা রোগীও উপচে পড়ে। ইমার্জেন্সির রোগী। এক্ষুনি এসেছে, এক্ষুনি অপারেশন না করলে বাঁচবে না জাতীয় রোগী। আটটা থেকে দুটো পর্যন্ত কাজ করে মুক্তি পাবো এমন অবস্থা নেই, বিকেলেও ডিউটি আছে, রাতেও আছে। দম ফেলার ফুরসত নেই। মিটফোর্ডে এত রোগীর অপারেশন হত না, মাঝে মাঝে একটু ফাঁক পাওয়া যেত। কিন্তু শহরের মধ্যিখানে ঢাকা মেডিকেল, এখানে ফাঁক বলে কোনও ব্যপার নেই। ঢাকা মেডিকেলে চাকরি করার সুযোগ খুব কম ডাক্তারের হয় বলে নিজের সৌভাগ্যকে আমি মোটেও ছোট করে দেখি না, দেখি না বলেই আমাকে সদা সতর্ক থাকতে হয়, ঘড়ির কাঁটা আটটার ঘরে পৌঁছোনোর আগে হাসপাতালে ঢোকা চাই, পাঁচটার ঘর পেরিয়ে যদি যায় তবু বেরোনো হয় না, সে না হয় না হোক। মানুষটি আমি চেনা বলে অন্য যে কোনও ডাক্তারের চেয়েও বেশি সতর্ক থাকতে হয় আমাকে, আমার ভক্ত সংখ্যার চেয়ে অভক্ত সংখ্যা নেহাত কম নয়। লেখালেখি করি বলে নিশ্চয়ই আমি ডাক্তারিতে ফাঁকি দিই এরকম একটি অলিখিত ধারণা এই হাসপাতালটিতেও যেন চালু না হয় সেটির চেষ্টা শুরু থেকে করে আসছি। ফাঁকি যে আমি দিই না, তা প্রমাণ করতে অন্য ডাক্তারদের চেয়ে দ্বিগুণ কেন ত্রিগুণ কাজ করতে হয় আমাকে। অন্য ডাক্তাররা ঘড়ির কাঁটাকে না মেনে চললেও কথা হয় না, আমার বেলায় আমি বেশ জানি যে কথা হবে। অভিজ্ঞতাগুলো মিটফোর্ড হাসপাতাল থেকে অর্জন করেছি। অভিজ্ঞতার সদ্ব্যবহার করছি বলে এত সজাগ আমি, কিন্তু আজ আমাকে নিয়ম না ভাঙলেই নয়। আজ মন উচাটন। কিন্তু কার কাছে অনুমতি চাইব মুক্তি পেতে! কার কাছে প্রস্তাবটি পাড়ব! ডাক্তারদের কঠিন কঠিন মুখগুলোয় বড় নরম চোখে তাকিয়েও কোনও মুখের কাঠিন্য দূর করতে পারি না। ঘড়ি দেখছি, কিন্তু ঘড়ি দেখেই বা কী লাভ, এক রোগী টেবিল থেকে নামে তো আরেক রোগী ওঠে। অ্যানেসথেসিওলজিতে ডিপ্লোমা পাওয়া ঘন কালো মোচ আর মাথায় দলা পাকিয়ে থাকা কালো কোঁকড়া চুলের ডাক্তারটির সঙ্গে দুতিনদিন কথা হওয়ার পর মুখটি যদিও তাঁর কঠিনের কঠিন, মনটিকে খুব কঠিন বলে মনে হয়নি। মনে হয়নি বলেই তাঁকে বলি খুলে আমার আজ যে না গেলেই নয়, ফাঁকি আমার না দিলেই নয়, নিয়ম আমার না ভাঙলেই নয়। বলি যে আমার বোন হাসপাতালে, বাচ্চা হচ্ছে। বোনের বাচ্চা হচ্ছে তাতে কি! বাচ্চা সুরুৎ করে পেটে ঢোকে, ফুরুৎ করে বেরোয়। এ কারণে যেতে হয় নাকি! জানি এ কোনও যুক্তি নয় অপারেশন থিয়েটার ত্যাগ করার। তাই উচাটন মন যা নয় তাই বলে, বাড়িয়ে বলে। কণ্ঠ কাঁপে বাড়াতে গিয়ে। কোথায় তোমার বোন জিজ্ঞেস করেন তিনি। ময়মনসিংহে বললে যদি তিনি বলেন যে না অত দূর যেতে হবে না, বলি পিজিতে। ঢোক গিলে কণ্ঠের কাঁপন বন্ধ করে বলি, ‘যাবো, গিয়ে দেখেই ফিরে আসবো। এক ঘন্টাও লাগবে না।’

    ডাক্তার রশীদ চুপ করে আছেন দেখে আবার বলি, এবারও বাড়িয়ে, ‘সিজারিয়ান হচ্ছে, কিন্তু বোনের নাকি অবস্থা তেমন ভাল নয়।’ কণ্ঠ এবারও কাঁপে।

    চোখে কাতর অনুরোধ আমার ভাগের দায়িত্বটি তিনি যদি কিছুক্ষণের জন্য পালন করে আমাকে কৃতার্থ করেন। ডাক্তার রশীদ একবার না বলে দিলেই আমি জানি, কোনওউপায় থাকবে না আমার যাওয়ার। কালো মোচের তল থেকে বেরোলো একটি শান্তির বাণী, ‘ঠিক আছে যাও।’ বাক্যটি উচ্চারিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমি দৌড়। দৌড়ে রাস্তায় নেমে হাতের কাছে যে রিক্সাই পেয়েছি নিয়ে সোজা শান্তিবাগ। শান্তিবাগে শান্তি নেই, কারণ কায়সার নেই। কায়সারকে বলে রেখেছিলাম সে যেন আমার বাড়িতে সকালেই চলে আসে। বেচারা এসে ঘুরে গেছে। বেচারা না হয় ঘুরে গেছে, আমি বেচারা এখন যাই কি করে ময়মনসিংহে! কায়সারের অপেক্ষা করে বসে থাকলে চলবে না, আমাকে বেরোতে হবে। বাসে বা ট্রেনে যে করেই হোক যেতে হবে। সিঁড়ি দিয়ে নামছি, এমন সময় দেখি কায়সার ওপরে উঠছে। কায়সারের বাহু ধরে লাফিয়ে নিচে নামি। সোজা গাড়ি। সোজা ময়মনসিংহ। সোজা হাসপাতাল। সোজা প্রসুতি বিভাগ। ইয়াসমিন নেই। কোথায়? পোস্টঅপারেটিভ রুমে। ঠাণ্ডা হয়ে যায় শরীর। ভেবেছিলাম লেবার রুমে বাচ্চা হবে, আমি থাকব পাশে। ভেবেছিলাম ইয়াসমিনের গায়ে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে মনে সাহস দেব। যদি কারও হাত ধরে রাখতে চায় শক্ত করে, আমার হাতদুটো দেব। কিন্তু সে সুযোগ আমার হল না। বাচ্চা হয়ে গেছে আমি এসে পৌছোনোর এক ঘণ্টা আগেই। সিজারিয়ান হয়েছে। অবস্থা আসলেই ভাল নয়। খুব চেষ্টা হয়েছিল নরমাল ডেলিভারির, সম্ভব হয়নি, ফরসেপের চেষ্টা হয়েছে কিন্তু বাচ্চার অবস্থা ভেতরে আশঙ্কাজনক অবস্থায় পৌঁছোতে থাকলে অপারেশনের জন্য নিয়ে যাওয়া হয়। সিজারিয়ানেও অনেক সময় নিয়েছে। বাচ্চার ওজন পনেরো পাউণ্ড। বাচ্চাকে ইনকিউবেটরে রাখা হয়েছে। ইয়াসমিনের জ্ঞান এখনও ফেরেনি। এক হাতে রক্ত চলছে, আরেক হাতে স্যালাইন। পোস্ট অপারেটিভ রুমের পাশে বিষণ্ন দাঁড়িয়ে থাকা মিলনের কাছে শুনি সব। ভেতরে গিয়ে জ্ঞান না ফেরা ইয়াসমিনকে দেখি। কিরকম থমথমে চারদিক। কি লাভ হল দৌড়ে এসে, যদি কিছুতেই আমি থাকতে পারলাম না। এরকম আসার কি দরকার ছিল! আমি তো দূরের কোনও মানুষ নই! কথা দিয়েছিলাম আমি থাকবো শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত। ইয়াসমিন খুব চেয়েছিল আমি যেন পাশে থাকি। থাকা হল না। মেডিকেলের এমন বিদঘুটে কড়াকড়ি না থাকলে একদিনের ছুটি নেওয়ার সাহস করতে পারতাম। নিজের ওপর রাগ হয়, কেন ছুটি নিইনি একদিনের জন্য! রাগ হয় ডাক্তার রশীদের কাছে এত কৌশল করে, যা আমি পারতপক্ষে বলি না, মিথ্যে, বলার কী দরকার ছিল! না কোনও দরকার ছিল না। দরকার ছিল আমার এখানে থাকা। হয়নি। সামান্য একটি চেনা মানুষের মত ইয়াসমিনের বাচ্চা হয়ে যাওয়ার পর দেখতে এসেছি। বোনের মত আসিনি। বোন না ছাই!

    হাসপাতাল থেকেই ফিরে যাই ঢাকায়। রাতের ঢাকাকে কেমন যেন গুমোট লাগে। লোকজন জটলা পাকিয়ে আছে কোথাও কোথাও। মগবাজারের কাছে একটি জঙ্গী মিছিল দেখি। কেন মিছিল কিসের মিছিল কিছু বুঝতে পারি না। ট্রাফিক পুলিশ গাড়ি থামিয়ে অন্য রাস্তা ধরতে বলে। বড় রাস্তাগুলোয় গাড়ি চলতে দিচ্ছে না। গাড়ি থেকে গলা বাড়িয়ে ট্রাফিকের লোককে জিজ্ঞেস করি, ‘কি হয়েছে কি? মিছিল কেন?’ কোনও উত্তর জোটে না প্রশ্নের। কায়সারকে জিজ্ঞেস করি, ‘তোর কি মনে হয়, কি হয়েছে শহরে?’ কায়সার কিছুই অনুমান করতে পারে না। আমার পক্ষেও অনুমান করা সম্ভব নয়। দ্বিতীয় মিছিলটি দেখে আমি বুঝতে পারি কি হয়েছে। গগন ফাটানো চিৎকার থেকে দুটো শব্দ আমি কায়ক্লেশে উদ্ধার করি, ‘বাবরি মসজিদঞ্চ। বাবরি মসজিদ নিয়ে আবারও কি হল, নব্বই সালে যেভাবে বাবরি মসজিদ ভেঙেছে খবর রটিয়ে হামলা করা হয়েছিল হিন্দুদের ওপর, এবারও কি তেমন হচ্ছে নাকি!

    আমাকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে চলে যায় কায়সার। আমি টেলিভিশন খুলে বসি। সিএনএন খুলতেই দেখি ভয়ংকর দৃশ্য। বাবরি মসজিদের ওপর ঝাাঁপিয়ে পড়ছে গেরুয়াপোশাক পরা হিন্দু মৌলবাদীরা। খবরে বলছে, বাবরি মসজিদ নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। বুকের দেয়াল কেউ যেন হাতুড়ি দিয়ে ভেঙে দিল, আর স্রোতের মত দরজা জানালা সজোরে খুলে বেরিয়ে এল হৃদপিণ্ডের সব রক্ত। কী হবে এখন? কি হবে এখন তা অনুমান করার সাধ্য আমার নেই। এই হল আমার ছয়ই ডিসেম্বরের রোজনামচা।

    তারপর সাতই ডিসেম্বর। সাতের পর আসবে আটই ডিসেম্বর। তারপর নয়। দশ। কেমন সেই দিনগুলি! দিনগুলি কেমন তা ভাল গল্পকার হলে নিখূঁত বর্ণনা করতে পারতাম। কিন্তু আমি ভাল গল্পকার নই। আমি কেবল ভেতরে অনুভব করি, বোঝাতে পারি না। সাতই ডিসেম্বর তারিখে সকালে সংবাদপত্রগুলোর প্রথম পাতা জুড়ে বড় একটিই খবর, বাবরি মসজিদ ধ্বংস, বিধ্বস্ত। নব্বইএর অক্টোবরে বাবরি মসজিদ ধ্বংস হয়নি, তখনই ইনকিলাবের একটি ভুল খবরের কারণে দেখেছি পুরোনো ঢাকায় কি করে হিন্দুদের মন্দিরগুলো ভেঙে চুরমার করা হয়েছে, হিন্দুদের বাড়িগুলো, দোকানগুলো লুঠ করে পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। সেদিনও আমি ময়মনসিংহ থেকে রাতে ফিরেছিলাম ঢাকায়। আরমানিটোলায় থাকি তখন, সারারাত বারান্দায় দাঁড়িয়ে ভাঙনের শব্দ শুনেছি। চিৎকার আর কান্নার শব্দ সারা রাত। বাড়িঘরে মন্দিরে দোকানপাটে লাগানো আগুন লক লক করে বাড়তে বাড়তে আকাশে উঠল, দেখেছি। দেখেছি আর বেদনায় হতাশায় ক্রোধে ক্ষোভে একা একাই ফেটে পড়েছি। আমার পক্ষে সম্ভব ছিল না কোথাও গিয়ে কিছু থামাই। থামাই কোনও মর্মঘাতি করুণ বিনাশ। পরদিন হাসপাতালে যাওয়ার পথে দেখেছি ভাঙা পোড়া দালানকোঠো। হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে শাঁখারি বাজার, সুত্রাপুর, নবাবপুর, নয়াবাজার, বাবু বাজার, ইসলামপুর, ঠাঁটারি বাজার, সদরঘাট ঘুরে ঘুরে অগুনতি পোড়া বাড়িঘর, দোকানপাট, মন্দির দেখতে দেখতে আমি হতবুদ্ধি বসেছিলাম। পুড়ে যাওয়া ঢাকেশ্বরী মন্দিরটি থেকে চোখ ফিরিয়ে নিতে হয়েছে। আমি কোনও নাম দিতে পারি নি ওই বর্বরতার। মানুষ কি করে পারে জন্ম থেকে দেখা প্রতিবেশির ঘরে আগুন দিতে! কী করে পারে এমন ধ্বংসের খেলা খেলতে! কী করে পারে পাশের দোকানটি লুঠ করে, যে দোকানের আয়ে সংসার চালাতো দোকানের লোকটি, ভেঙে দিতে, পুড়িয়ে দিতে! নৃশংসতার একটা সীমা আছে, সীমা কেন ছাড়িয়ে যাচ্ছে এ দেশের মানুষ! কি ঢুকেছে মানুষের মগজে! এ দেশের হিন্দুরা বাবরি মসজিদ কোথায়, মসজিদটি কেমন দেখতে তাও তো জানে না, কী করে ভাঙবে তারা সেই মসজিদ! যদি না ই ভাঙে, তবে কেন মসজিদ ভাঙার দোষ পরে তাদের ওপর! পোড়া ভিটের ওপর মাথায় হাত দিয়ে বসে থাকা উন্মুল উদ্বাস্তু মানুষের কান্না কেবল দেখেছিই, কিছুই করতে পারিনি। কি করে সাহায্য করব আমি দুর্গতদের! আমার সে সাধ্য ছিল না। গোপনে কেবল চোখের জল ফেলেছি।

    মিথ্যে খবরেই যদি ওরকম কাণ্ড ঘটতে পারে, তবে আজ সত্যি সত্যিই যখন হিন্দু মৌলবাদীরা ভেঙে গুঁিড়য়ে দিয়েছে বাবরি মসজিদ, কি হবে আজ! আশঙ্কা আমাকে জ্বালিয়ে মারে। সকালে হাসপাতালে যাওয়ার পথে দেখি মালিবাগের জলখাবার পুড়ছে, রাস্তায় ছড়িয়ে আছে দোকানের চেয়ার টেবিল, ভাঙা। জলখাবারে আমি অনেকদিন খেয়েছি। বাড়িতে নাস্তার আয়োজন যেদিন না হত, অথবা মন খুব খুশি খুশি, ভাল কিছু খেতে ইচ্ছে হত, জলখাবারে চলে যেতাম খেতে, নয়ত ঠোঙায় করে বাড়ি নিয়ে আসতাম লুচি, নিরামিশ, হালুয়া। পথে আরও দোকান দেখি পুড়ে ছাই হয়ে আছে। লুঠ হওয়া, ভাঙা পোড়া দোকানগুলো দেখে বুঝি যে ওগুলো হিন্দুর দোকান ছিল। কোন দোকানটি হিন্দুর, কোনটি মুসলমানের তার খবর আমি বা আমার মত অনেকে না রাখলেও কেউ কেউ রাখত। হাসপাতালে পৌঁছে অপারেশন থিয়েটারে নিঃশব্দে গিয়ে নিঃশব্দে অজ্ঞান করতে থাকি রোগীদের। আশঙ্কা আমাকে ছেড়ে এক পা কোথাও যাচ্ছে না। কি হয় কি হয় কি জানি কি হয় আশঙ্কা। এখনও কি সরকার কোনও নিরাপত্তার ব্যবস্থা করছে না হিন্দুদের! যদি না করে থাকে! শীততাপ নিয়ন্ত্রিত ঘরের মধ্যে দাঁড়িয়ে আমি ঘেমে উঠি।

    দুপুরের দিকে ডক্টরস ক্যান্টিনে চা খেতে গিয়ে শুনি বলাবলি হচ্ছে, ইমারজেন্সিতে ক্যাসুয়ালটির রোগীর ভিড় হচ্ছে খুব, সামাল দেওয়া যাচ্ছে না। আচমকা একটি আশঙ্কা ঝড়ের ঝাপটা দিয়ে আমার হাত কাঁপিয়ে কাপ নাড়িয়ে জিভ পুড়িয়ে দেয় গরম চায়ে। চা পান শেষ হয় না। ছুটি ইমারজেন্সিতে। মাথা ফাটা, পা কাটা, পিঠ ভাঙা রোগীর ভিড়। স্ট্রেচারে করে রোগী ঢোকানো হচ্ছে রুমে। রুমে জায়গা হচ্ছে না, বারান্দায় রাখতে হচ্ছে রোগীদের। বারান্দার কয়েকজন রোগীর নাম জেনে নিই, বিশ্বনাথ, সুধীর, গোপাল, করুণা, পার্বতী। ইমারজেন্সি রুমে ঢুকে তিনজন ডাক্তারদের একজনকে বলি, ‘এখানে তো আরও ডাক্তার লাগবে, এত পেশেন্ট কি করে ম্যানেজ করবেন!’ ডাক্তার বললেন, ‘কি আর করা যাবে! এক্সট্রা ডাক্তার তো আর পাওয়া যাবে না এখানে। সবারই তো ডিউটি আছে।’

    ‘ওটিতে আমার দুটো পেশেন্ট বাকি আছে, সেরে আমি চলে আসছি এখানে।’ আমি দ্রুত চলে যাই দোতলায়। বাকি দুটো রোগীকে অজ্ঞান করি, জ্ঞান ফেরাই। ততক্ষণে ইমারজেন্সি থেকে সার্জারি ওয়ার্ডে হয়ে নতুন রোগী আসতে শুরু করেছে অপারেশন থিয়েটারে। অ্যানেসথেসিয়া দিতে বিকেলের ডিউটির ডাক্তার এসে গেছেন অপারেশন থিয়েটারে। আমার বিদায় নেবার পালা। বলি একা সামাল দিতে না পারলে, আমি ইমারজেন্সিতে আছি, আমাকে যেন তিনি ডেকে পাঠান। ইমারজেন্সিতে আগের চেয়ে রোগীর ভিড় এখন আরও বেশি। বাড়তি ডাক্তার হয়ে রোগীর চিকিৎসা করতে থাকি। হাতে হাতে স্যালাইন দিতে থাকি, রক্ত লাগবে, দৌড়ে যাচ্ছি রক্ত আনতে। কারও গায়ে কুড়ুলের কোপ, কারও মাথা ফেটে রক্ত ঝরছে, কেউ মাথায় লাঠি বা কিছুর আঘাতে অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে, কেউ গুলিবিদ্ধ, কারও মেরুদণ্ড ভেঙে গেছে মারের চোটে। সন্ধে হতে থাকে, রোগীর ভিড় আরও বেশি বাড়ে। ডাক্তারদের দম ফেলার সময় নেই। ঘড়ির দিকে তাকাবো, সে সময়ও নেই আমার। সারাদিন না খাওয়া, ক্যান্টিনে গিয়ে যে চা সিঙ্গারা খেয়ে আসবো, সে সময়ও পাওয়া হয় না। অপারেশন থিয়েটারেও রোগী নিয়ে যেতে হয়, ওখানে অ্যানেসথেসিয়া দিতে বাড়তি ডাক্তার হিসেবে কাজে লেগে যাই। অপারেশন করতে করতে সার্জন বলছেন, আজ সারারাতই রায়টের রোগী আসবে।

    ‘রায়টের? রায়ট কোথায় বাঁধলো?’ আমি প্রশ্ন করি।

    ‘দেখছেন না! সব তো রায়টের রোগি আসছে ইমারজেন্সিতে।’

    ‘কিন্তু সব তো হিন্দু! রায়ট হলে তো কিছু মুসলমানও পাওয়া যেত। হিন্দুতে হিন্দুতে তো কোনও মারামারি বাঁধেনি। মুসলমানরা হিন্দুদের মারছে।’

    সার্জন কোনও কথা বলেন না।

    যখন হাসপাতাল থেকে বেরোই, রাত দশটা বাজে। বাড়ি পৌঁছে ক্লান্ত আমি আজকের কাগজের শিরোনামগুলোয় চোখ বুলোই শুধু। উগ্র হিন্দু মৌলবাদীদের হাতে বাবরি মসজিদ ক্ষতিগ্রস্ত। উত্তর প্রদেশ সরকার ও রাজ্যসভা বাতিল। ভারতে প্রতিবাদের ঝড়। সমগ্র ভারতে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার। মসজিদ প্রাঙ্গণে অতিরিক্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা। পশ্চিমবঙ্গে বামফ্রণ্টের ২৪ ঘণ্টা বনধ। বাবরি মসজিদ ঘটনায় বাংলাদেশের উদ্বেগ প্রকাশ। প্রধানমন্ত্রীর উদ্বেগ। হাসিনার নিন্দা ও প্রতিবাদ। পাঁচ দলের নিন্দা ও প্রতিবাদ। সিপিবির নিন্দা। হিন্দু সাধুদের মন্দির নির্মাণের প্রচেষ্টাঃ নয়া রাজনৈতিক সংকটে রাও সরকার।

    পরদিন আটই ডিসেম্বর, ভোরবেলা উঠে উঠে চা খেতে খেতে পত্রিকার খবরগুলো দেখি, বাবরিমসজিদ ভেঙে ফেলার পর অশান্ত ভারতে রক্তক্ষয়ী দাঙ্গা। হত দুশতাধিক, আহত কয়েক হাজার। আরএসএস শিবসেনাসহ মৌলবাদী সংগঠনগুলো নিষিদ্ধ। লোকসভার বিরোধী নেতার পদ থেকে আদভানীর পদত্যাগ। বর্তমান স্থানেই মসজিদটি আবার গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত। বাবরি মসজিদ হামলার প্রতিবাদে ও ৪ দফা দাবিতে সমন্বয় কমিটির আহবানে আজ সারাদেশে সকাল সন্ধ্যা হরতাল। শান্তি ভাঙার চেষ্টার পরিণাম শুভ হবে না। বাবরি মসজিদ বিধ্বস্ত হওয়ার ঘটনায় রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশে বিক্ষোভ ও ভাঙচুর সংঘর্ষ। আহত তিন শতাধিক। ২৫ জন বুলেট বিদ্ধ। যে কোনও মুল্যে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও শান্তি বজায় রাখুন–শেখ হাসিনা। মন্ত্রি পরিষদের বিশেষ বৈঠক—দেশবাসীকে শান্ত থাকার আহবান। বাববি মসজিদ ভাঙার প্রতিবাদে চট্টগ্রামে জামাত শিবির বিভিন্ন মন্দির ভাঙচুর লুটপাট অগ্নিসংযোগ করেছেঃ পরিস্থিতি উত্তেজনাকর। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষার আহবান জানাচ্ছে বামদলগুলো। পুরো খবর পড়ার সময় নেই, হাসপাতালে দৌড়োতে হয়। আজ সারা দেশে হরতাল হচ্ছে বাবরি মসজিদে হামলার প্রতিবাদে। হরতাল, কিন্তু কিছু রিক্সা চলছে, শান্তিবাগ থেকে হেঁটে মালিবাগে এসে একটি রিক্সা নিই, এত সকালে পিকেটাররা রাস্তায় নামেনি বলে চলে যেতে পারি অনায়াসে। হাসপাতালের ইমারজেন্সিতে গতকালের চেয়ে আজকে বেশি ভিড় মার খাওয়া গুলি খাওয়া কোপ খাওয়া ছুরি খাওয়া পুড়ে যাওয়া মানুষের। হরতালের মধ্যেও ভিড়ের কোনও কমতি নেই। মানুষ আসছে পায়ে হেঁটে, রোগী কাঁধে নিয়ে। আজও অপারেশন থিয়েটারের কাজ শেষ করে ইমারজেন্সিতে ঢুকে যাই। এক একজন মানুষ, এক একটি গল্প। এক একটি জীবন। যাদের কথা বলার মত অবস্থা আছে, জিজ্ঞেস করে জেনে নিই কিকরে আক্রমণ হয়েছে তাদের ওপর। কি করে নিরীহ মানুষগুলোর ওপর সন্ত্রাসীরা ঝাঁপিয়ে পড়েছে আচমকা লাঠি হাতে, কুড়ুল হাতে, ছুরি হাতে। সুবোধ মণ্ডলের হুঁশ ছিল না কথা বলার। কাতরাচ্ছিল লোকটি। ফিনকি দিয়ে রক্ত বেরোচ্ছে মাথা থেকে, কুড়ুলের কোপে মাথার খুলি কেটে ঢুকে গেছে ভেতরে।

    ‘কারা এই অবস্থা করেছে, কারা?’ সুবোধ মণ্ডলের মাথার ক্ষত এন্টিসেপটিক দিয়ে মুছে ব্যাণ্ডেজ লাগিয়ে দ্রুত একটি এন্টিটিটেনাস ইনজেকশান দিয়ে দুই হাতে স্যালাইন আর রক্ত চালিয়ে নাকে অক্সিজেন দিয়ে স্ট্রেচারে তুলতে তুলতে জিজ্ঞেস করি। পাশে দাঁড়িয়ে আছে সুবোধের স্ত্রী গায়ত্রী।

    ‘কারা ওরা? চেনেন?’ বিন্দু বিন্দু ঘাম আমার কপালে।

    গায়ত্রী বলল, ‘চিনুম না কেন, ওরা তো আমাগো পাড়ার লোকই, আবুল, রফিক, হালিম, শহিদুল।’

    ‘কেন মারলো আপনাদের? কি অভিযোগ করল?’

    গায়ত্রী গলা চেপে ‘কইল আমরা নাকি মসজিদ ভাঙছি।’ বলেই ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে আমার হাতদুটো চেপে ধরে বলতে থাকে ‘দিদিগো, আমরা কোনও মসজিদ ভাঙ্গি নাই। বিশ্বাস করেন দিদি, মা কালির দিব্যি দিয়া কইতাছি আমরা ভাঙ্গি নাই।’

    ‘কোন মসজিদ ভাঙার কথা কইছে, জানেন?’

    ‘কী জানি কোন মসজিদ! জানি না। রিক্সা কইরা যখন আইতাছি সীতার বাপরে লইয়া, তখন ত অনেকগুলা মসজিদ দেখলাম, কোনওটাই তো ভাঙ্গা দেখলাম না।’

    ‘বাবরি মসজিদের নাম শুনেন নাই?’

    গায়ত্রী মাথা নাড়ে। নাম শোনেনি।

    বাবরি মসজিদ কোথায় তা জানে কি না জিজ্ঞেস করি, গায়ত্রী জানে না। গায়ত্রীর একটিই জোড় হাত প্রার্থণা, তার স্বামীকে যেন বাঁচিয়ে তুলি। স্বামী তার বাবুবাজারে আলু তরকারি বিক্রি করে। স্বামী না বেঁচে উঠলে দুটো ছেলে মেয়ে নিয়ে গায়ত্রীর উপোস করে মরতে হবে। ডাক্তাররা চেষ্টা করেও পারেননি গায়ত্রীর স্বামীকে বাঁচাতে। আমার চোখের সামনে গায়ত্রী তার স্বামীর দেহটি নিয়ে বারান্দায় নিথর বসে রইল। বেশিক্ষণ বসে থাকতে পারেনি। আরও রোগী আসছে, বারান্দা খালি করে দিতে হয়েছে গায়ত্রীকে।

    রোগীদের কাউকে কাউকে প্রাথমিক চিকিৎসার পর ছেড়ে দিচ্ছি, কাউকে মেডিসিন ওয়ার্ডে পাঠিয়ে দিচ্ছি, কাউকে সার্জারি ওয়ার্ডে। ব্লাড ব্যাংক থেকে এনে রক্ত চালু করে দিচ্ছি। সব ওষুধ হাসপাতালে নেই, গরিব রোগীদের আত্মীয় স্বজনের কাছে টাকা পয়সাও নেই। অ্যাপ্রোনের পকেটে যে কটা টাকা ছিল, ঝেড়ে দিয়ে দিই দুতিনজন গরিবকে ওষুধ কিনে আনতে। সন্ধানীতে গিয়ে বিনে পয়সার ওষুধ মুঠো ভরে ভরে নিয়ে এসে যাদের ওষুধ কেনার পয়সা নেই, দিই। রোগীদের কাছে কি করে কি হল তার বর্ণনা শোনার সময় নেই আমার। আমার জানা হয়ে গেছে কি করে হয়েছে এইসব কাণ্ড। আমার আর জানার দরকার নেই মন্ত্রিসভার বৈঠকে কোন কোন মন্ত্রী কি কি সব চমৎকার চমৎকার কথা বলছেন। জানার দরকার নেই খালেদা কি বলছেন, হাসিনা কি বলছেন, বা তাঁদের দলই বা কি করছে। রাজনীতির মুখে মনে হয় মানুষের গা থেকে ঝরতে থাকা রক্ত লেপে দিই। আজ আমার ডিউটি রাতে, রাতের ডিউটি শুরু হয় আটটা থেকে। ডিউটি থাকলে সাধারণত দুপুরে বাড়ি গিয়ে বিশ্রাম নিয়ে রাত আটটায় চলে আসি হাসপাতালে। আজ আমার আর বাড়ি যাওয়া হয়নি। সেই সকাল আটটা থেকে কাজ শুরু করেছি, বিকেল শেষ হয়েছে, রাত নেমে এসেছে, সারারাত কখন কেটে গেছে টের পাইনি। সারা রাতই বানের জলের মত রোগী এসেছে, সারা রাতই ইমারজেন্সির ডাক্তারদের হিমশিম খেতে হয়েছে। ভোরবেলায় ইমারজেন্সির এক অচেনা ডাক্তার আমাকে প্রশ্ন করে, ‘আপনি কি হিন্দু?’ ইমারজেন্সিতে আমার ডিউটি নেই, কিন্তু তারপরও এখানে বাড়তি কাজ করছি, রোগীদের বাঁচাবার চেষ্টা করছি, আমি নিশ্চয়ই হিন্দু, তাই আমার এত আবেগ, ডাক্তারের ধারণা।

    ডাক্তারটির প্রশ্নের আমি প্রথম আমি কোনও জবাব দিইনি। পরে আবার যখন জিজ্ঞেস করল, তখন দাঁতে দাঁত চেপে বলি, আমি মানুষ।

    রাতে ডিউটি থাকলে পরদিন ছুটি থাকে। ক্লান্ত শরীর আর বিধ্বস্ত মন নিয়ে সকালে ফিরে আসি বাড়িতে। বাবরি মসজিদে হামলার নিন্দা আর প্রতিবাদ চলছে সারা দেশে। সেই সঙ্গে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির আহবান জানানো হচ্ছে। সম্প্রীতি রক্ষার জন্য ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহবান জানিয়েছে বাম দলগুলো। আওয়ামি লীগ থেকেও বলা হচ্ছে, বাংলাদেশে উগ্র সাম্প্রদায়িক রাজনীতির স্থান নেই, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় দেশ পরিচালিত হতে হবে। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের দলগুলোকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার জন্য বলা হচ্ছে। ছাত্র সংগঠনগুলো আজ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষার জন্য শান্তি মিছিল করবে শহরে। হচ্ছে অনেক কিছুই, তারপরও হিন্দুর ওপর নির্যাতন চলছেই সারা দেশে। ক্ষিধেয় পেট জ্বলছে আমার, খেয়ে একটু ঘুমোবো আশা করেছিলাম। খাওয়া হয়, ঘুম হয় না। বেরিয়ে পড়ি রিক্সা নিয়ে। রিক্সা শান্তিনগর পার হয়ে পল্টনের দিকে যায়, পল্টন থেকে মতিঝিলের দিকে যেতে যেতে দেখি কমিউনিস্ট পার্টির অফিস পুড়ে ছাই হয়ে আছে, আরেকটু এগোলে শাপলা চত্ত্বরের কাছে ইণ্ডিয়ান এয়ারলাইন্সের অফিসটিও পোড়া। রাস্তায় ইট পাটকেল, পোড়া কাঠ পড়ে আছে। আরও দোকানপাট ভাঙা, পোড়া। পুরোনো ঢাকার দিকে গেলে ওখানে আরও দেখতে পাবো বাড়িঘর জ্বলছে পুড়ছে। যাবো! দেখবো! কিন্তু দেখে কী লাভ! জানিই তো কি হচ্ছে দেশে! কি দরকার আর আহত নিহত মানুষ আর ভাঙা পোড়া বাড়ি আর মন্দির দেখে! বড় একটি মিছিল চলে গেল টুপিওয়ালাদের, ‘বাবরি মসজিদ ধ্বংস কেন, ভারত সরকার জবাব দাওঞ্চ বলে চিৎকার করতে করতে। এরাই নিশ্চয়ই বাড়িঘরে মন্দিরে দোকানপাটে আগুন ধরাচ্ছে, এরাই নিশ্চয়ই যেখানে যে হিন্দু পাচ্ছে আক্রমণ করছে। এই লোকগুলোকে আমার মানুষ বলে মনে হয় না। মানুষের রূপ ধরে যেন এক একটি মানুষখেকো জন্তু। রিক্সাকে পলাশির দিকে যেতে বলি। পলাশির বস্তিতে নেমে রিক্সা ছেড়ে দিয়ে বস্তির যে ঘরটিতে নির্মলেন্দু গুণ থাকেন, সেটির দরজায় টোকা দিই। ঘরের দরজাটি নড়বড়ে। কেউ একটি লাথি দিলেই ভেঙে পড়ে যাবে দরজা। রাস্তার ওপরেই দাঁড়িয়ে আছে মলিন ঘরটি। আমার ভয় হয়, এই ঘরটিও সম্ভবত পুড়িয়ে দেবে। দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় কবি নির্মলেন্দু গুণকে যে কোনও মুহূর্তে হয়ত পুড়ে ছাই হয়ে যেতে হবে। গুণ ঘরে ছিলেন, বিছানার ওপর পা তুলে বসে আছেন। আমি বিছানায় বসে গুণের দিকে চেয়ে অনেকক্ষণ কোনও কথা বলতে পারিনি। কেন এসেছি আমি! সান্ত্বনা দিতে! কি বলে সান্ত্বনা দেব গুণকে! রাস্তায় চিৎকার করছে একপাল ছেলে, ‘একটা দুইটা হিন্দু ধর, সকাল বিকাল নাস্তা কর।’ চিৎকারের শব্দ কমে এলে গুণ বললেন, ‘পা নামাই না বিছানা থেকে, মনে হয় পা নামাইলেই বুঝি ওরা ধইরা ফেলবে।’ রসবোধ গুণের খুব বেশি। এই ভয়ংকর দুর্যোগের সময়েও তিনি লোক হাসাতে চান। আসলে কি হাসাতে চান নাকি এটি গুণের মনের কথা! মাটিতে পা রাখতে আসলেই তাঁর ভয় হয়! আমার বিশ্বাস, হয়। নির্মলেন্দু গুণের মত কিছুকে পরোয়া না করা শক্ত সমর্থ সাহসী মানুষটির চোখে আমি থোকা থোকা অনিশ্চয়তা আর আতঙ্ক দেখতে পাই, যতই তিনি তা লুকোনোর চেষ্টা করুন না কেন। এই সমাজে মেয়েদের কোনও নিরাপত্তা নেই, তারপরও আজ আমি নিরাপদ বোধ করছি, যেহেতু আমার নামটি মুসলমান নাম। আর দেশের বড় কবি হয়েও, পুরুষ হয়েও, সাহসী হয়েও, রাজনীতিবিদ হয়েও নির্মলেন্দু গুণ নিরাপদ বোধ করছেন না। আমার চেয়েও এখন অনেক অসহায় তিনি।

    ‘গুণদা, আমার বাসায় চলেন।’ দীর্ঘশ্বাসের সঙ্গে বাক্যটি বেরিয়ে আসে।

    না তিনি যাবেন না। বাড়িভর্তি গুণের পোষ্য, গীতাসহ গীতার কয়েকটি বোন। তিনি সবাইকে ছেড়ে একা নিজের জন্য নিরাপত্তা নেবেন না।

    অসীম সাহা কেমন আছেন, মহাদেব সাহা কেমন আছেন, জিজ্ঞেস করি। গুণ জানেন না কে কেমন আছেন। তিনি কেবল জানেন যে তিনি বেঁচে আছেন, এই বেঁচে থাকার কারণটি সম্ভবত, তাঁর ধারণা, দেখতে তাঁকে মুসলমান মৌলবির মত লাগে। লম্বা দাড়িঅলা, পাজামা পাঞ্জাবি পরা মানুষটি মৌলবী না হয়ে যান না, বস্তির লোকদের এমনই ধারণা। কিন্তু এভাবে কিছু লোকের চোখ হয়ত ফাঁকি দেওয়া যায়, সব লোকের চোখ নয়। ঘরের মেঝেয় বসে আছে চারবছর বয়সী একটি বাচ্চা ছেলে, ছেলেটি গীতার বোন কল্যাণীর পুত্রধন। কল্যাণীর বিয়ে হয়েছিল এক মুসলমান লোকের সঙ্গে, তখন সুমন জন্মায়। সুমনকে দেখিয়ে গুণ বলেন, ‘ও তো হাফ মুসলমান। ও আছে বলেই আমরা সবাই ভরসা পাই। সুমনরে বলছি এই ঘরে বইসা থাকতে। কেউ যদি আত্রমণ করতে আসে, সোজা বলে দেব যে এই বাড়িতে একজন মুসলমান আছে, সুতরাং সাবধান, কোনও রকম আক্রমণ যেন না হয়।’

    আমি হেসে উঠি। নির্মলেন্দু গুণ হাসেন না। মনে হয় তিনি সত্যিই মনে করছেন, চার বছরের মুসলমান বাচ্চাটির কারণে তিনি বাঁচবেন, গীতা আর গীতার আত্মীয়রা বাঁচবে। গুণ বললেন, ‘সুমনকে তো এখন ভাল খাওয়ানো দাওয়ানো হচ্ছে। বেশ আদর যত্ন করা হচ্ছে। ও হইল আমাদের সবার রক্ষাকর্তা। সুমনও বুইঝা গেছে সেইটা। আমারেও মাঝে মাঝে ধমক দিয়া কথা বলে।’

    আমি জোরে হেসে উঠি। গুণ গম্ভীর হয়ে বলেন, ‘ভাবছি অসীম কেমন আছে তা দেখতে ওর বাসায় যাবো একবার। সুমনকে নেবো। সুমনে আগে আগে হাঁটবে, আমি সুমনের পেছন পেছন। সঙ্গে একজন মুসলমান থাকলে ভয় ডর কম থাকবে।’

    এবার আমার আর হাসি পায় না। মাথায় একটি চিনচিনে যন্ত্রণা টের পাই। একটি বিচ্ছিরি রকম অসহায়বোধ আমাকে ছাড়পোকার মত কামড়াতে থাকে। নিজেকে সান্ত্বনা দিতে চেষ্টা করি, সেই সঙ্গে গুণকেও। বলতে থাকি, কাল সাম্প্রদায়িক শক্তির বিরুদ্ধে মানববন্ধন হচ্ছে। বাহাদুর শাহ পার্ক থেকে সংসদ ভবন পর্যন্ত লম্বা। আওয়ামি লীগ শান্তিমিছিল বের করবে। বিএনপিও করবে। আজও তো ছাত্রঐক্যের শান্তিমিছিল হচ্ছে। জামাত শিবিরকে যে কোনও ভাবে ঠেকানোর চেষ্টা চলছে। গুণ শোনেন। কোনও প্রতিক্রিয়া নেই তাঁর। সাধারণত রাজনীতির প্রসঙ্গে গুণ মুখর হয়ে ওঠেন। আজ সব মুখরতা আকাশের ওপারে চলে গেছে। জিজ্ঞেস করি কোনও পত্রিকা তিনি পড়ছেন কি না। না, কোনও পত্রিকাই তিনি পড়ছেন না, টেলিভিশনও দেখছেন না। তিনি কিছুই করছেন না। শুধু বসে থাকছেন বিছানার ওপর। খাবার খাচ্ছেন বিছানায় বসে, পেচ্ছ!ব পায়খানায় যেতে হলে দৌড়ে যাচ্ছেন, সেরে দৌড়ে এসে আবার বিছানার ওপর উঠে গুটিসুটি বসে থাকছেন। রাতে ঘুমোন না, বসে থাকেন। শুতে ভয় করে, শুলে যদি ঘুম এসে যায়, আর ঘুমোলে যদি ঘুমের মধ্যে কেউ মেরে রেখে যায়! ঘুমোন না, কারণ ঘুমিয়ে থাকলে চার বছরের মুসলমান বাচ্চাটির দায় দায়িত্ব যে তিনি নিয়েছেন, তা ব্যাখ্যা করে বেঁচে থাকার যদি একটি সুযোগ পাওয়া যায়, সেই সুযোগটি কেন হারাবেন! একটি ন্যাংটো বাচ্চা, নাক দিয়ে সর্দি ঝরছে, গা ধুলোয় মাখা, অথচ এই বাচ্চাটিকেই এ বাড়ির সবার চেয়ে শক্তিমান মনে করছেন নির্মলেন্দু গুণ। আমারও হঠাৎ মনে হয়, সুমনই এ বাড়ির গায়ে গতরে শক্তিধর, মেধায় বুদ্ধিতে শক্তিধর যে কোনও প্রাপ্ত বয়স্কদের চেয়েও বেশি শক্তি ধারণ করছে। সুমনই এ বাড়িতে সবচেয়ে মূল্যবান একটি প্রাণী।

    বিষাদ আমাকে আচ্ছত করে রাখে যখন বেরোই গুণের বাড়ি থেকে। বেরিয়ে অসীম সাহার বাড়িতে যাই, মহাদেব সাহার বাড়িতেও। গুণের মত ভাঙা ঘরে তাঁরা থাকেন না।কিন্তু ভয় একই রকম সবার। নিস্তেজ পড়ে আছেন, সর্বাঙ্গে আতঙ্ক। দরজায় শক্ত করে খিল এঁটে বড় বড় ছেলে মেয়ে নিয়ে বসে আছেন ঘরে। কবে বাইরে বেরোবেন, আদৌ বেরোতে পারবেন কি না কিছুই জানেন না। অসীম সাহার ইত্যাদি প্রেসটি বন্ধ। মহাদেব সাহা ইত্তেফাকে চাকরি করেন, এখন আর চাকরি করতে যাচ্ছেন না। আমি কাউকে কোনও সান্ত্বনার বাণী শোনাতে পারি না। আগামীকাল মানববন্ধন হচ্ছে সাম্প্রদায়িক শক্তির বিরুদ্ধে, এই সংবাদ কারও আতঙ্ক দূর করে না। বাড়ি ফিরে আসার পথে আমি ভাবি, দেশের বড় বড় কবিদেরই যদি আজ এমন করে ঘরের কোণে লুকিয়ে থাকতে হয়, তবে সাধারণ হিন্দুরা কি অবস্থায় দিন কাটাচ্ছে এ দেশে! নির্মলেন্দু গুণ, মহাদেব সাহা, অসীম সাহা সকলেই আপাদমস্তক নাস্তিক। আজ তাঁদেরকেও ভয়ে গুটিয়ে থাকতে হচ্ছে, যেহেতু তাঁরা হিন্দু নাম ধারণ করে আছেন। আমার নামটিও হিন্দু নাম হতে পারত, আমার জন্মও হতে পারতো কোনও হিন্দুর ঘরে। কি হত আমার তবে আজ! আমি কি পারতাম রাস্তায় বেরোতে! হয়ত ধর্ষিতা হতে হত। হয়ত পুড়িয়ে ফেলা হত আমাকে, আমার বাড়িঘর ভেঙে ফেলা হত, আমাকে সর্বস্বান্ত করা হত!

    দশ তারিখে সকাল সকাল হাসপাতাল পৌঁছোই। তখন রোগী আনা হয়নি অপারেশন থিয়েটারে। ক্যান্টিনে চা সিঙ্গারা খেতে খেতে দেখি টেবিলের ওপর পড়ে আছে দুদিন আগের ইনকিলাব পত্রিকাটি। ব্যানার হেডলাইন, বাবরি মসজিদের স্থানে হিন্দু মন্দির নির্মাণ, উগ্র হিন্দুদের উল্লাস, আহত ১০০০ নিহত দুই শতাধিক। পত্রিকাটি আলগোছে উল্টো রেখে দিই। এই পত্রিকাটি হিন্দুর ওপর হামলা করার জন্য এ দেশে মহান ভুমিকা রাখছে, এ বিষয়ে আমার সন্দেহ নেই। পাশের টেবিলে কজন ডাক্তারের আলোচনা কানে আসে,ভারতে বিজেপির সভাপতি যোশি আর আদভানীসহ মোট আটজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। উত্তর প্রদেশের মূল্যমন্ত্রী কল্যাণ সিংএর বিচারের দাবি উঠেছে। উগ্রবাদী সাতশ হিন্দুকে গ্রেফতার করা হয়েছে। লোকসভা বিধানসভা স্থগিত। বিশ্ব হিন্দু পরিষদ, আর এসএস, বজরং দল, জামাতে ইসলামি দলগুলোকে ভারতে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এ দেশে কি হচ্ছে? হিন্দুর বাড়িঘরে মন্দিরে দোকানপাটে লুটতরাজ চলছে, আগুন লাগানো চলছে। হিন্দুর জমি জমা কেড়ে নেওয়া হচ্ছে। পুলিশ গ্রেফতার করেছে বেশ কিছুজনকে। কোথাও কোথাও ১৪৪ ধারা জারি করা হয়েছে। বাম দল, আওয়ামি লীগ, সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্য ঘোষণা দিচ্ছে, বিবৃতি দিচ্ছে, বৈঠক করছে, মিছিল করছে সাম্প্রদায়িক শক্তিকে প্রতিহত করার জন্য। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির জন্য মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তিগুলোকে এক হতে বলা হচ্ছে। জামাত শিবিরকে মূলত দোষী করা হচ্ছে সাম্প্রদায়িকতা ছড়ানোর জন্য। বাংলাদেশ টেলিভিশনে বাবরি মসজিদ ভাঙার দৃশ্য দেখানো বন্ধ করা হয়েছে। রাস্তায় বিরোধী দল আর সরকারি দলের লোকেরা ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা পরিদর্শন করতে গিয়েছেন। অনেক কিছুই হচ্ছে কিন্তু তারপরও নিরাপত্তা নেই হিন্দুদের, তারপরও কোনও সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাস বন্ধ হচ্ছে না।

    মানববন্ধনে যোগ দেওয়ার সময় আমার নেই। আমার দিন কেটে যায় রোগীর চিকিৎসায়। ইমারজেন্সিতে ক্যাসুয়ালটির সংখ্যা কমছে না। খবর আসে পুরোনো ঢাকার মিটফোর্ড হাসপাতালে অতিরিক্ত ভিড় রোগীর, অনেককে পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে ঢাকা মেডিকেলে।

    সে রাতে আমি অবকাশে ফোন করে জিজ্ঞেস করি প্রতিবেশিদের ওপর কোনও আক্রমণ হচ্ছে কি না। আমলাপাড়া এলাকাটি হিন্দু অধ্যুষিত এলাকা। আমাদের বাড়িটিই ছিল প্রথম একটি মুসলমানের বাড়ি, এরপর ধীরে ধীরে আরও কিছু মুসলমান এসে বসত শুরু করেছে, একাত্তর সালের আগে আরও হিন্দুর বাস ছিল, অনেকে ভারতে আশ্রয় নিতে গিয়ে আর ফিরে আসেনি, সে সব বাড়িতে মুসলমান উঠেছে এখন। কিন্তু এখনও সংখ্যায় হিন্দুরাই বেশি এলাকাটিতে। মা আমাকে বলেন যে হিন্দুদের অনেকে বাড়ি ছেড়ে চলে গেছে অন্য কোথাও, অনেকে আছে, তবে তিনি কোনও আক্রমণের কথা শোনেননি। পাড়া থমথম করছে। কেউ বেরোচ্ছে না বাইরে তেমন। আমি মাকে বলি পাড়ার কেউ যদি আশ্রয় চায় অবকাশে, মা যেন কাউকে ফিরিয়ে না দেন। মা আরেকটি খবর আমাকে জানালেন যেটি আমাকে কষ্ট দেয় আবার স্বস্তিও দেয়, ছটকুর এক বন্ধু আছে ভুলন নামে, ছেলেটি ভয়াবহ ধরণের ছেলে, যে কাউকে খুন করতে দ্বিধা করে না রকমের ছেলে, ছেলেটি পৌরসভা থেকে কমিশনার পদে নির্বাচনে দাঁড়াচ্ছে, তাই ভোটের আশায় সে হিন্দুদের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করেছে, হিন্দুরা কথা দিয়েছে ভুলনকে ভোট দেবে, ভুলনের মত সন্ত্রাসীর ওপর আজ আমলাপাড়ার অসহায় লোকেরা নির্ভর করছে।

    হঠাৎ নিজেকে আমার ডলি পালের মত, গায়ত্রী মন্ডলের মত, গৌতম বিশ্বাসের মত মনে হয়। নিজেকে আমার হিন্দু বলে মনে হতে থাকে। একটি ভয় শিরদাঁড়া বেড়ে ছড়িয়ে পড়ে সমস্ত শরীরে। একটি ক্রোধ উঠে আসে আমার হাতের মুঠিদুটোয়, উত্তপ্ত নিঃশ্বাস আমার। এক ঘর থেকে আরেক ঘরে অস্থির হাঁটি। শেষে নির্মলেন্দু গুণের মত পা গুটিয়ে বসে থাকি বিছানায়। আমার মনে হতে থাকে আমি হিন্দু বলে আমাকে মেরে ফেলা হবে। পরদিন হাসপাতালে বসেই খবর পাই চট্টগ্রামে সাতশ বাড়ি ভস্মীভুত। খবর পাই ভোলার অবস্থার। ভোলার হিন্দু এলাকাগুলো এখন ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। হাজার হাজার বাড়িঘর পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। দশ হাজার পরিবার গৃহহারা হয়ে খোলা আকাশের নিচে বসে আছে। ভোলার এমপি আওয়ামি লীগের তোফায়েল আহমেদ বসে আছেন ঢাকায়! কেন! তাঁর কি দায়িত্ব ছিল না তাঁর এলাকায় থাকা, আগে থেকেই মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক শক্তিকে প্রতিরোধ করা! আমার মনে হতে থাকে বিএনপি সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করার সুবিধের জন্য আওয়ামি লীগও চাইছে হিন্দুর ওপর নির্যাতন হোক। এই ইস্যু নিয়ে সরকার বিরোধী আন্দোলন করতে চমৎকার মাঠে নামা যাবে। আমার রাগ হয় রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর। আমার ঘৃণা হয় নেতাদের কীর্তিকলাপে। ইচ্ছে করলেই ঠেকানো যেতে পারত এই সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাস। ভারত সরকার দ্রুত পদক্ষেপ নিয়ে দাঙ্গা দমন করেছে অনেক। ভারতে দাঙ্গা হয়, ওখানে মুসলমানও হিন্দুর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ার ক্ষমতা রাখে। কিন্তু বাংলাদেশে দাঙ্গা হয় না, হয় সন্ত্রাস। মুসলমানরা হিন্দুর ওপর নির্যাতন করে। হাসপাতালের ডিউটি সেরে বেরিয়ে পড়ি পুরোনো ঢাকার দিকে। জামাতে ইসলামির মিছিল ভারতীয় দূতাবাসের দিকে যাচ্ছে স্মারকলিপি দিতে। সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী ছাত্ররা মিছিলে স্লোগান দিচ্ছে ‘গোলাম আযম আদভানী ভাই ভাই, এক দড়িতে ফাঁসি চাই।’ মৌলবাদীদের চরিত্র প্রতিটি দেশেই এক। এখন মৌলবাদী দুই নেতাকে ফাঁসি দিলেই সমস্যার সমাধান হবে কি! মন বলে, হবে না। হবে না কারণ নতুন নেতা গজাবে। ধর্মীয় শিক্ষা ব্যবস্থা, পচা পুরোনো সমাজ ব্যবস্থা মৌলবাদ গজাতে চিরকালই সাহায্য করবে। মৌলবাদীরা যখন মাথা ফুঁড়ে বেরোয়, তখন কেবল দুএকটি শান্তিমিছিল আর সম্প্রীতি ভ্রাতৃত্বের কথা চিৎকার করে বললে কাজ হয় না। তাই একদিকে মানববন্ধন হচ্ছে, অন্যদিকে মানবনির্যাতন চলছে। পুরোনো ঢাকার প্রতিটি অঞ্চল ঘুরে ঘুরে দেখি। ঢাকেশ্বরী মন্দিরে নিয়ে এসেছিলাম তারাপদ রায় আর তাঁর স্ত্রীকে, যখন কলকাতা থেকে ঢাকায় বেড়াতে এসে একদিন মন্দিরটি দেখতে চেয়েছিলেন — আজ সেই মন্দির ভাঙা, পোড়া, ধ্বংসস্তূপের পাশে কয়েকটি পুলিশ বসে আছে। পুলিশ যদি বসানোই হল, পুলিশ কেন ছয় তারিখ রাতেই বসানো হয়নি! আমার প্রশ্নের উত্তর কে দেবে! যতগুলো মন্দির আছে এলাকায় সব মন্দিরেই হামলা চলেছে, হিন্দুদের দোকান পাট একটিও অক্ষত নেই। বাড়িঘর ধ্বংস। তাঁতিবাজারে নেমে আমি হাঁটতে থাকি। হাঁটতে হাঁটতে একটি সরু গলিতে ঢুকে দেখি একটি পোড়া বাড়ির স্তূপের ওপর বসে আছে এক লোক। উঠোন জুড়ে ছড়িয়ে আছে পোড়া কাঠ, পোড়া বই, পোড়া কাপড়চোপড়। কাছে গিয়ে লোকটির নাম জিজ্ঞেস করলে লোকটি কোনও উত্তর দিল না। আমি কে, আমি কেন, ইত্যাদি কোনও কিছুতে তার কোনও আকর্ষণ নেই। পোড়া কাঠের মত বসে পোড়া ভিটের দিকে চেয়ে আছে লোকটি। সব হারাবার পর যে শূন্যতা থাকে, সে শূন্যতাও আর তার চোখে আর নেই। অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকি ধ্বংসস্তূপের কাছে। গলি ছেড়ে এসে একটি লোক আমার দিকে উৎসুক তাকায়। তাকেই জিজ্ঞেস করি, ‘ওই যে লোকটি বসে আছে, ওর নাম কি জানেন?’

    ‘ও তো সতীপদ। সতীপদ দাস।’

    আলো নিভে আসছে বিকেলের। হাঁটতে হাঁটতে গলি পেরিয়ে বড় রাস্তায় উঠি। ইচ্ছে হয়েছিল সতীপদর কাঁধে একটি হাত রেখে তাকে সান্ত্বনা দিই, বলি যে ‘মানববন্ধন হচ্ছে, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির মিছিল হচ্ছে, মহল্লায় মহল্লায় শান্তি ব্রিগেড গড়ে তোলার কথা হচ্ছে। পত্রিকায় বুদ্ধিজীবীরা সাম্প্রদায়িক শক্তির বিরুদ্ধে কড়া কড়া কলাম লিখছেন, বাংলাদেশ রুখে দাঁড়াবে ধর্মীয় সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে, আপনি মোটেও দুশ্চিন্তা করবেন না, আর কেউ আপনার কোনও অনিষ্ট করবে না কোনওদিন,’ কিন্তু পারিনি বলতে। আমি অনুভব করি, একটি লজ্জা আমাকে গ্রাস করছে। আমার মুসলমান নামটি নিয়ে আমি লজ্জায় মাথা নুয়ে আছি। মানুষের ওপর মানুষের এই হিংস্রতা আমাকে লজ্জা দিচ্ছে। বিংশ শতাব্দির শেষ প্রান্তে এসে, যখন সভ্যতা জ্ঞান বিজ্ঞান প্রযুক্তি আর একই সঙ্গে মানবতার অকল্পনীয় বিকাশে ব্যস্ত, তখন এক মানুষ ঝাঁপিয়ে পড়ছে প্রচণ্ড নিষ্ঠুর বিবেকহীন জল্লাদের মত আরেক মানুষেরই ওপর, কারণ সেই মানুষ ভিন্ন ধর্মে বিশ্বাসী। সে রাতে আমি এক ফোঁটা ঘুমোতে পারিনি। সারারাত জেগে থাকি আমি আর আমার দীর্ঘশ্বাস। ভোরের দিকে শুয়ে শুয়ে লিখি আমার লজ্জার কথা। সতীপদকে স্পর্শ করতে না পারার লজ্জা।

    আমার লজ্জা যায় না। লজ্জা নিয়েই আমি আরও দুদিন নির্মলেন্দু গুণের বাড়িতে যাই, কেমন আছেন তিনি দেখতে যাই। দেখি ছেঁড়া কাঁথায় মুখ মাথা ঢেকে তিনি শুয়ে আছেন। মুখ ঢেকেছেন কেন জিজ্ঞেস করলে বললেন, ‘কিছু যেন দেখতে না হয়।’ নির্মলেন্দু গুণকে এ অবস্থায় দেখতে আমার ভাল লাগে না। তিনি সেই আগের মত শহরে ঘুরে বেড়াবেন। আজিমপুরে নিজের একটি ছাপাখানা না হলেও কম্পোজখানা দিয়েছেন, সেখানে বসে লিখবেন নিজের লেখা, অবসরে দাবা খেলবেন, বিকেলে ইত্যাদিতে বসে আড্ডা দেবেন, অনুষ্ঠানে কবিতাপাঠের আমন্ত্রণ পেলে কবিতা পড়ে আসবেন ঋজু দাঁড়িয়ে। যে কথা কখনও ভাবিনি নির্মলেন্দু গুণ উচ্চারণ করবেন, সে কথা শুনি তাঁর কণ্ঠে, মৃত্তিকাকে তিনি কলকাতায় পাঠিয়ে দেবেন। গুণকে বলি, ‘এসব কি ভাবছেন, মৃত্তিকা চলে গেলে আপনি এখানে একা থাকবেন কি করে?’

    গুণের সঙ্গে নীরা লাহিড়ির বিচ্ছেদ হয়ে যাওয়ার পর তাঁদের একটি মাত্র সন্তান মৃত্তিকা, যদিও সে তার দিদিমার বাড়িতে থাকে, গুণই দেখাশোনা করেন তার। তাঁর জীবন বলতে এই মৃত্তিকা—প্রচণ্ড ভালবাসেন মেয়েকে। মেয়েটিকে একদিন না দেখলে তিনি অস্থির হয়ে পড়েন। প্রতিদিন মেয়েকে ইশকুলে দিয়ে আসা, ইশকুল থেকে নিয়ে আসার কাজ তিনিই করেন। নীরা লাহিড়ি কুমিল্লায় চাকরি করেন, কালেভদ্রে মেয়েকে দেখতে আসেন। গুণ মেয়ের কাছাকাছি আছেন, আছেন মেয়ের প্রতিদিনকার প্রতিটি আবদার মেটাতে। এক বাড়িতে না থাকলেও পিতা কন্যার সম্পর্ক অত্যন্ত গভীর। গুণ যে টাকা রোজগার করেন, তার সিংহভাগ খরচ করেন মৃত্তিকার জন্য, বাকিটা দিয়ে নিজেকে এবং গীতার পরিবারকে কায়ক্লেশে চালান। মৃত্তিকাকে স্নেহে আদরে শিক্ষায় সংস্কৃতিতে বড় করে তোলাই তাঁর জীবনের লক্ষ্য। আর এখন তিনি ভাবছেন কলকাতা পাঠিয়ে দেবেন! আমি চমকে উঠি। বিস্ময় আমাকে অনেকক্ষণ নির্জীব করে রাখে।

    ‘না গুণ দা, মুত্তিকাকে কোথাও পাঠাবেন না। কেন পাঠাবেন? এটা আপনার দেশ, এই দেশ মৃত্তিকার। দেশ ছেড়ে ও যাবে কেন!’ শব্দগুলো একটি শোকার্ত হাওয়ায় ধাককা লেগে ক্ষীণ হয়ে আসে।

    আমার লজ্জা যায় না। খবর পাই সিলেটে চৈতন্যদেবের বাড়ি পুড়িয়ে দিয়েছে মৌলবাদীরা। চারশ বছরের পুরোনো লাইব্রেরীটিও রোষ থেকে রক্ষা পায়নি। ইচ্ছে হয় চিৎকার করে কাঁদি। মানুষের মনুষ্যহীনতার জন্য নিজের মানুষ পরিচয়টিই আমাকে ব্যঙ্গ করতে থাকে। আমার চেনা জানা অনেকে ভোলায় দুর্গতদের অবস্থা দেখে ফিরে বর্ণনা করেছে বীভৎস বর্বরতার কাহিনী, সহস্র নির্যাতিতের হাহাকার, ক্রন্দন। আমি ছটফট করি। যেন আমি নিজেই ভোলার খোলা মাঠে বসে থাকা একজন উদ্বাস্তু, জীবনের যা কিছু সহায় সম্পদ ছিল সব লুট হয়ে যাওয়া, পুড়ে যাওয়া, সর্বস্বান্ত একজন কেউ। এই অনুভবটি আমার থেকে যায় সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাস কমে আসার পরও। হিন্দুদের দেশ ত্যাগ করার খবর শুনছি। কেউ কেউ বলে, ‘ওদের এটা উচিত হচ্ছে না, দেশে থেকে লড়াই করা উচিত ছিল।’ আমি নিজেকে একজন হিন্দুর জায়গায় বসিয়ে বুঝতে চেষ্টা করি নিরাপত্তাহীনতার বোধ কতটা তীব্র হলে মানুষ দেশ ত্যাগের মত একটি ভয়ংকর সিদ্ধান্ত নেয় বা নিতে পারে। নিজেকে আমার মনে হতে থাকে আমি তাঁতিবাজারে বাস করা এক হিন্দু নামের যুবক, সুরঞ্জন দত্ত, আমি ধর্ম মানি না, আমি প্রগতিশীল আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত, আমার বন্ধুরা বেশির ভাগই ধর্মহীন, আমার দেশটিকে আমি ভীষণ ভালবাসি, দেশের মঙ্গলের জন্য দিন রাত ভাবি আমি, কিন্তু এই সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাস আমাকে চূর্ণ করে দিচ্ছে, আমার আদর্শ ধ্বসে পড়ছে, দেশের জন্য আমার ভালবাসা আমার আবেগ সব নিবে যাচ্ছে, সকলের দিকে আমি সন্দেহের চোখে তাকাচ্ছি, আমার ভয় হচ্ছে মুসলমানরা বুঝি এই আমাকে মারতে এল, সন্তা্রাস থেমে যায় কিন্তু আমার নিরাপত্তাহীনতা যায় না কোথাও, আমার ভয় হতে থাকে যে কোনও একদিন যে কোনও অজুহাতে আমার ওপর আক্রমণ হবে, শেষ পর্যন্ত, যদিও আমি চাই না, নিজের সঙ্গে যুদ্ধ করি, কিন্তু হেরে যাই, নিরাপত্তহীনতা আমাকে দেশ ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য করে। আমি চোখ বুজে ভাবছি দৃশ্য, তাঁতিবাজারের একটি দু ঘরের ছোট বাড়ি, বাবা মা বোন নিয়ে সংসার.. ভাবছি.. ভাবনা শেষ হয় না আমি কাগজ কলম নিয়ে বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে লিখি, ‘সুরঞ্জন শুয়ে আছে। মায়া বারবার তাড়া দিচেছ, দাদা ওঠ, কিছু একটা ব্যবস্থা কর।’ সাত তারিখ থেকে তেরো তারিখ পর্যন্ত সুরঞ্জনের দিনগুলো আমার ভাবনার ঢেউএ উথালপাথাল করে। ঘরে বসে লেখার সময় আমার নেই। দৌড়োতে হয় হাসপাতালে। অপারেশন থিয়েটারে রোগীর শিরায় থাইয়োপেন্টাল সোডিয়াম আর সাকসামেথোনিয়াম ঢুকিয়ে, নাকে নাইট্রাস অক্সাইড আর অক্সিজেনের ঘ্রাণ দিয়ে রোগীকে ঘুম পাড়িয়ে রোগীর নাড়ি আর রক্তচাপ দেখে নিয়ে সার্জনকে ইঙ্গিত দিই অপারেশন শুরু করার। কৃত্রিম শ্বাস প্রশ্বাসের জন্য মিটফোর্ড হাসপাতালের অপারেশন থিয়েটারে আধুনিক যন্ত্রপাতি ছিল না। ওখানে রোগীর মাথার কাছে বসে রোগীর ফুসফুসে অক্সিজেন পাঠাতে হত যন্ত্রের বেলুন চেপে চেপে। এখানে হাতে কিছু চাপার দরকার হয় না, যন্ত্রই চেপে দেয়। আমার তাই জ্ঞানহীন রোগীর পাশে তেমন কিছু করার থাকে না, মাঝে মাঝে নাড়ি আর রক্তচাপ আর শ্বাসপ্রশ্বাসের ঘনত্ব দেখা ছাড়া আর দীর্ঘ অপারেশনের সময় উঠে উঠে শরীর অবশ করার ইনজেকশন দেওয়া ছাড়া। রোগীর কাছাকাছি বসে লিখে যেতে থাকি সুরঞ্জনের গল্প। সার্জন যখন বলেন অপারেশন শেষ, তখন উঠতে হয়, ইনজেকশন দিয়ে রোগীকে জাগাতে হয়। চোখ খোলা রোগীকে নামিয়ে নতুন রোগী টেবিলে তোলা হবে। কাগজ কলম আমার পকেটেই থাকে। অপারেশন চলাকালীন জ্ঞান হারানো আর জ্ঞান ফিরে পাওয়ার মাঝখানের সময়টুকু সুরঞ্জনের জন্য ব্যয় করতে থাকি।

    পূরবী বসু আমাকে একদিন ফোনে বললেন, ‘সকলে কলাম লিখছে, তুমি এই সাম্প্রদায়িকতা নিয়ে কিছু লিখছ না যে!’ বড় বিব্রত বোধ করি আমি। কোনও কলাম লেখা হয়নি আমার। বিপর্যস্ত মন নিয়ে কি লিখব কিছুই পারিনি ঠিক করতে, যে কথাই লিখতে চেয়েছি দেখেছি অন্যরা লিখে ফেলেছেন।

    ‘পূরবী দি, আমি কলাম লিখিনি, তবে বড় একটা কিছু লেখার চেষ্টা করছি। তথ্যভিত্তিক লেখা।’

    তথ্য ভিত্তিক, কিন্তু তথ্য পাই কোথায়! পুরোনো ঢাকার অলিগলি ঘুরে একতা পত্রিকার আপিসে গিয়ে কোথায় কোন জায়গায় হিন্দুদের ওপর অত্যাচার হয়েছে, তার সরেজমিনে তদন্তের তথ্যগুলো নিয়ে আসি। একতা কমিউনিস্ট পার্টির কাগজ, এতে বিস্তারিত খবর ছাপা হয়েছে দেশের কোথায় কি ঘটেছে। সংবাদ, আজকের কাগজ, ভোরের কাগজও যথেষ্ট খবর ছেপেছে। এই হল আমার তথ্য সামগ্রী আর আছে নিজের চোখে দেখা ঢাকা এবং ঢাকার আশে পাশের এলাকায় ঘটা তাণ্ডব।

    খুব অল্প কথায়, অল্প বর্ণনায় মূলত তথ্য দিয়ে হিন্দুদের অবস্থার বর্ণনা করে লেখা এটিকে না বলা যায় গল্প, না বলা যায় উপন্যাস। বইটির নাম দিই লজ্জা। ফেব্রুয়ারি মাস চলে আসছে, বই ছাপাতে ব্যস্ত বাংলাবাজারের সব প্রকাশক। পার্ল পাবলিকেশন্সের মালিক আলতাফ হোসেন মিনু অগ্রিম টাকা দিয়ে গেছেন। তিনি একটি বই পাবেনই ফেব্রুয়ারিতে নিশ্চিত। ভাল একটি রমারমা উপন্যাস পাওয়ার উত্তেজনায় লাফানো মিনুকে বড় দ্বিধায় বড় সংকোচে বড় লজ্জায় দিই লজ্জার পাণ্ডুলিপি। পাণ্ডুলিপি হাতে পেয়ে মিনুর মুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। জিজ্ঞেস করলেন, ‘এইটা কী দিলেন? উপন্যাস তো?’

    ‘না, ঠিক উপন্যাস না।’

    ‘তাইলে কি? গল্প সংকলন?’

    ‘না। তাও না।’

    ‘তাইলে কী এইটা?’

    ‘সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে লেখা একটা বই।’

    ‘প্রবন্ধের বই?’

    ‘না, ঠিক প্রবন্ধও না।’

    ‘তাইলে কী এইটা।’

    ‘এইটা এমন কিছু না। খুব তাড়াতাড়ি কইরা একটা লেখা লিইখা ফেলছি। হিন্দুদের উপর যে অত্যাচার হইল ডিসেম্বরে, সেই সম্পর্কে।’

    মিনুর উজ্জ্বল মুখটি মুহূর্তে কালো হয়ে যায়। তিনি মন খারাপ করে বললেন, ‘এই বই তো চলবে না।’

    বড় সংকোচে বলি, ‘জানি বইটা চলবে না। কিন্তু এটা ছাপেন আপাতত, যেহেতু অন্য কোনও লেখা হাতে নাই। আমি কথা দিচ্ছি, আপনাকে আমি একটা উপন্যাস লিখে দেব।’

    মিনু খুশি হয়ে ওঠেন উপন্যাসের কথায় এবং কথা দেওয়ায়।

    লাল ঝরা জিভখানি নড়ে ওঠে, ‘কবে দিবেন?’

    ‘যত তাড়াতাড়ি পারি।’

    ‘বইমেলায় ধরতে পারবো?’

    ‘চেষ্টা করব।’

    ‘সত্যি কইতাছেন?’

    ‘সত্যি।’

    লজ্জার পাণ্ডুলিপি হাতে নিয়ে মিনু যখন যাচ্ছেন, তাঁর ব্যবসায় ক্ষতির কথা ভেবে আমার মায়া হয় খুব। বড় বিমর্ষ বিষণ্ন কণ্ঠ আমার, ‘এই বইটার ওপর আশা করবেন না। এই বই চলার মত না। বেশি ছাপানোর দরকার নাই। অল্প করে ছাপেন। আপনার যেন কোনও লস না হয়।’

    মিনু আমাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলেন, ‘লস হইলে হোক, আপনে যহন লেইখ্যাই ফেলছেন, আমি ছাপবো। পরে আপনের একটা উপন্যাস ছাইপা এইটার লস পুষাইয়া নিব।’

    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleকিছুক্ষণ থাকো – তসলিমা নাসরিন
    Next Article উতল হাওয়া – তসলিমা নাসরিন

    Related Articles

    তসলিমা নাসরিন

    লজ্জা – তসলিমা নাসরিন

    August 21, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    আমার মেয়েবেলা – তসলিমা নাসরিন

    August 21, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    উতল হাওয়া – তসলিমা নাসরিন

    August 21, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    কিছুক্ষণ থাকো – তসলিমা নাসরিন

    August 21, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    ভালোবাসো? ছাই বাসো! – তসলিমা নাসরিন

    August 21, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    ভ্রমর কইও গিয়া – তসলিমা নাসরিন

    August 21, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo
    Most Popular

    রূপমঞ্জরী – ২য় খণ্ড – নারায়ণ সান্যাল

    September 3, 2025

    অনুরাধা

    January 4, 2025

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    রূপমঞ্জরী – ২য় খণ্ড – নারায়ণ সান্যাল

    September 3, 2025

    অনুরাধা

    January 4, 2025

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025
    Our Picks

    রূপমঞ্জরী – ২য় খণ্ড – নারায়ণ সান্যাল

    September 3, 2025

    রূপমঞ্জরী – ৩য় খণ্ড – নারায়ণ সান্যাল

    September 3, 2025

    কাঁটায়-কাঁটায় ৫ – নারায়ণ সান্যাল

    September 3, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    Sign In or Register

    Welcome Back!

    Login below or Register Now.

    Lost password?

    Register Now!

    Already registered? Login.

    A password will be e-mailed to you.