Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    রূপমঞ্জরী – ২য় খণ্ড – নারায়ণ সান্যাল

    September 3, 2025

    রূপমঞ্জরী – ৩য় খণ্ড – নারায়ণ সান্যাল

    September 3, 2025

    কাঁটায়-কাঁটায় ৫ – নারায়ণ সান্যাল

    September 3, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • 🔖
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    Subscribe
    সাইন ইন
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    দ্বিখণ্ডিত – তসলিমা নাসরিন

    তসলিমা নাসরিন এক পাতা গল্প779 Mins Read0

    ২২. ইস্তফা

    সেই যে বিমানবন্দরে আমার পাসপোর্ট নিয়ে নিল পুলিশের লোকেরা আর আমাকে বলে দিল পরদিন যেন পাসপোর্ট ফেরত নিই মালিবাগের স্পেশাল ব্রাঞ্চের আপিস থেকে, পরদিন সেই আপিসে গিয়ে যখন আমার পাসপোর্ট চাইলাম, লোকেরা কিসের পাসপোর্ট কোন পাসপোর্ট, বলে দিল, কিছুই জানে না। পরদিন আবার গেলাম। তখনও পাসপোর্টের খবর নেই। পরদিন আবার।

    ‘আমার পাসপোর্ট নিয়ে যাবার কথা এখান থেকে। আমার পাসপোর্টটা দিন।’

    ‘পাসপোর্ট ওপরে আছে। ওখান থেকে পাঠালেই আপনি নিয়ে যেতে পারবেন।’

    ‘ওপরে মানে? কোন ওপরে?’ মাথার ওপরে কাঠের তাকে কয়েক টন কাগজের দিকে তাকাই।

    ‘আরে না, এই ওপরে না, এই ওপরে না।’

    ‘তাহলে কোন ওপরে?’

    লোকটি পাজামা পাঞ্জাবি পরা, এক গাল হেসে বললেন, ‘স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে।’

    ‘ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে বুঝি ওপর বলেন! তা ওপর থেকে কারা পাঠাবে পাসপোর্ট?’ ‘ওপরঅলারা।’

    কয়েকদিন জুতোর সুকতলি খর্চা করে আমাকে এই শুনতে হল। পাসপোর্ট ওপরে আছে। ওপর থেকে আমার পাসপোর্টটি নিচে পাঠানোর অনুরোধ করে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে সরাসরি একটি আবেদনপত্র পাঠিয়ে দিই। আমার আবেদনে কোনও সাড়া কেউ দেয় না। পাসপোর্ট হাতে পেলেই বা কি লাভ! বহির্বাংলাদেশে ছুটিও তো পেতে হবে! ছুটি চেয়ে আবেদন করার পর স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে প্রতিদিন যাচ্ছি। মহাপরিচালক হয় ব্যস্ত, নয় এখনও আপিসে আসেননি। এরপরও ঘন্টার পর ঘন্টা অপেক্ষা করে যেদিন তাঁর দেখা মিলল, মুখোমুখি হই।

    ‘কি ব্যপার, কি চাই?’ মহাপরিচালক চশমার ফাঁক দিয়ে আমাকে দেখেন।

    ‘সই চাই।’

    ‘কিসের সই?’

    ‘অনেকদিন হল আমি একটা দরখাস্ত দিয়ে রেখেছি এক্সবাংলাদেশ লীভের জন্য। সই করে দেন।’

    ‘সই করা যাবে না।’

    বুকে আমার একটি পাথর ছোঁড়ে কেউ। একটি যন্ত্রণা বুক বেয়ে কন্ঠদেশ বেয়ে চোখে উঠে আসে। তাহলে কলকাতার অনুষ্ঠানে যাওয়া আমার হচ্ছে না!

    ‘কেন যাবে না সই করা?’ প্রশ্নটি করি।

    ‘ওপর থেকে অনুমতি এলে সই করব।’

    ‘কোন ওপর থেকে?’

    ‘স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে।’

    ‘অন্য কোনও ডাক্তারের বেলায় কি সই দিতে ওপরের অনুমতি লাগে?’

    মহাপরিচালক তাঁর কালো চশমাটি খুলে ফেললেন। আমি খুব বেয়াদবের মত এই প্রশ্নটি করেছি বলে তাঁর ধারনা। কঠিন কণ্ঠে বললেন, ‘না কারও জন্য ওপরের অনুমতির দরকার হয় না। কিন্তু আপনার জন্য দরকার হয়।’

    কেন হয়? এই প্রশ্নও আমি করি।

    তিনি এবার তাঁর টেবিলের একটি কাগজের দিকে ঝুঁকে বললেন, ‘নিজেই আপনি জানেন।’

    ‘না, আমি তো জানি না। আমার জন্য আলাদা নিয়ম কেন, তা আমার জানার ইচ্ছে।’ মহাপরিচালকের মুখের দিকে আমি তাকিয়ে থাকি উত্তরের আশায়।

    তিনি তাঁর চিবুক উঁচু করে ধরেন।

    ‘তাহলে এক কাজ করেন। নিজেকে প্রশ্ন করতে থাকেন। উত্তর একসময় পাবেন।’

    ‘উত্তর আমাকে নিজে পেতে হবে কেন, যেহেতু এটা আপনাদের তৈরি করা নিয়ম, সেহেতু আপনাকেই জানাতে হবে উত্তর।’

    যেন তিনি আমার কথা শোনেননি, এমনভাবে, বসে থাকা অন্যান্যদের দিকে তাকিয়ে হঠাৎ কথা বলতে শুরু করলেন, ‘কি খবর আপনার! ওদিকে এখন কেমন অবস্থা? গরম পড়েছে আজকাল খুব। হে হে হে হে।’

    মহাপরিচালকের হেহেহে তখনও শেষ হয়নি, আমি প্রশ্ন করি, ‘হেলথ মিনিস্টি থেকে পারমিশান দেওয়া হচ্ছে না কেন? এর কারণ কি?’

    এবার মুখ ফেরান আমার দিকে, চোয়ালভাঙা মহাপরিচালকের চোয়াল শক্ত হয়ে ওঠে টেবিলের ওপর তাঁর হাতের তলে যে ফাইলটি, সেটি খুলে আমার দরখাস্তের একটি কপি তুলে নিয়ে বললেন, ‘সই করে মিনিস্ট্রিতে আপনার দরখাস্ত পাঠালেই কি না পাঠালেই কি! আপনার ছুটি শুধু হেলথ মিনিস্ট্রির ব্যপার না। মেইনলি এটা হোম মিনিস্ট্রির ব্যপার। হোম মিনিস্ট্রি থেকে পারমিশান না পেলে আপনার ছুটি হবে না।’ টেবিলে আর কোনও ফাইল নেই, কেবল আমার ফাইলই। আশ্চর্য, আমার এই ফাইল কেন এত জরুরি এই অধিদপ্তরে! আমি ঘরে ঢোকার পর এই ফাইলটি তিনি খুঁজে বের করে টেবিলে রাখেননি। এটি রাখাই ছিল টেবিলে। অধিদপ্তরে সব ডাক্তারের একটি করে ফাইল থাকে। ফাইল খুললেই ডাক্তারের চাকরি এবং বদলি সংক্রান্ত কাগজ বেরোয়। যখন হৃষ্টপুষ্ট ফাইলটি খুলে আমার দরখাস্তটি দেখালেন, ফাইলের ভেতর পত্রিকার অনেকগুলো কাগজ চোখে পড়ল। পত্রিকার কাগজ আমার ফাইলে কেন!

    এরপর আরও আরও দিন যেতে থাকি মহাখালির স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে। হাসপাতালের ডিউটি শেষ করে সোজা মহাখালি। প্রতিদিন বাড়ি ফিরি শেষ বিকেলে। মা আমার শুকনো মুখ দেখে জিজ্ঞেস করেন, ‘এত দেরি কইরা ফিরস কেন আজকাল। সেই যে সকালে দুইডা বিস্কুট খাইয়া গেছস। সারাদিন ত পেটে কিছু পড়ে নাই।’ মা রান্নাঘরে দৌড়ে যান, আমার জন্য ভাত তরকারি বেড়ে নিয়ে আসেন। ক্ষুধার্ত পেট কোনওরকম শান্ত করে লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ি বিছানায়। পরদিন গিয়ে আমাকে আবারও শুনতে হয় ওপরের অনুমতি জোটেনি। ওপরের অনুমতি জোটাতে হলে ওপরে যেতে হয়। ওপরে গিয়েও দেখি আমাকে অনুমতি দেওয়া হচ্ছে না ভেতরে ঢোকার। না স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে। না স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ে।

    এদিকে ইনকিলাবে আমার পাসপোর্টের ছবি ছেপে লিখেছে আমি ভুয়া পাসপোর্ট নিয়ে বিদেশ যেতে চেয়েছিলাম। সরকার যেন আমার জন্য একটি কড়া শাস্তির ব্যবস্থা করে। আমার পাসপোর্ট আমার নাগালে নেই, তা ইনকিলাবের নাগালে কি করে যায়! তাহলে কি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ের সঙ্গে ইনকিলাবের বেশ দহরম মহরম। স্বরাস্ত্রমন্ত্রী আবদুল মতিল চৌধুরী নিজে একজন রাজাকার ছিলেন একাত্তরে। পাকিস্তানি বাহিনীর হয়ে মুক্তিযুদ্ধের সময় কাঁচপুর সেতু পাহারা দিতেন তিনি। আজ তিনি মন্ত্রী হয়েছেন এ দেশের, যে দেশের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে তিনি একদা লড়েছিলেন। সেই যে জিয়াউর রহমান শুরু করেছিলেন রাজাকারদের ক্ষমতায় বসাতে, সেই থেকে চলছে রাজাকারের রাজত্ব। এখন মুক্তিযোদ্ধারা পড়ে থাকেন পঙ্গু হাসপাতালে, রাজাকাররা মন্ত্রণালয়ে। আশঙ্কারা পিলপিল করে আমার শরীর বেয়ে ওঠে, লোমকূপে বাসা বাঁধে। ইনকিলাবের লোকেরা ভাল জানে যে এটি কোনও ভুয়া পাসপোর্ট নয়। পেশা আমি ডাক্তারি না লিখে কেন সাংবাদিকতা লিখেছি, সেটি নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে। পাসপোর্টে আমার নাম, আমার বাবার নাম, আমার উচ্চত!, আমার ঠিকানা, বয়স, এমন কী আমার বাঁ চোখের ওপর আমার কালো তিলটির কথা লেখা। কিছুই অসত্য নয়। আমার পেশাতেও কিন্তু অসত্য কিছু নেই। সাংবাদিকতাও আমার পেশা। এটি আমার পছন্দের পেশা বলে পাসপোর্টে পেশার ঘরে ডাক্তারি না বসিয়ে সাংবাদিকতা বসিয়েছি। ইনকিলাবের লোকেরা, আমি যে শাস্তি পাওয়ার যোগ্য, তার কারণ হিসেবে কেবল আমার পাসপোর্টটি ভুয়া এই বলেই শেষ করেনি, আমার লেখার উদ্ধৃতিই দিয়েছে বেশি। ধর্ম নিয়ে, দুই বঙ্গ নিয়ে, সরকারের সাম্প্রদায়িকতা নিয়ে এ যাবৎ যা লিখেছি, সেসব থেকে উদ্ধৃতি। যেহেতু আমি এসব লিখি, তাই সরকার যেন অচিরে আমাকে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিয়ে দেশ ও জাতির সেবা করেন। দৃষ্টান্তমূলক শাস্তিটি কি হতে পারে, তাও ইনকিলাবের লোকেরা বলে দিয়েছেন, ফাঁসি। মাওলানা মান্নানের পত্রিকা ইনকিলাব, সেই মাওলানা মান্নান, একাত্তরে যিনি ছিলেন পাকিস্তানী বাহিনীর জানি দোস্ত। আজ তিনি প্রচার মাধ্যমের মোগল। আশঙ্কারা আমাকে টুকুস টুকুস করে কামড় দেয়। আশঙ্কারা আমার ত্বক কেটে ঢুকে পড়ে শরীরের ভেতর, আমার হৃদপিণ্ডে, ফুসফুসে, আমার রক্তে, আমার মস্তিস্কের কোষে কোষে।

    স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে তারপরও আমি যাই। না, ওপর থেকে আমার বহির্বাংলাদেশ ছুটি মঞ্জুর করার জন্য কোনও অনুমতি দেওয়া হয়নি। মহাপরিচালক সোজাসুজি বলে দিলেন, আপনার ছুটি মঞ্জুর হবে না। কেন হবে না? ইনকিলাবে লেখালেখি হচ্ছে, তাই হবে না। আশ্চর্য ইনকিলাব কি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের মা বাপ! আমার ব্যপারে সিদ্ধান্ত নেবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। ডাক্তার হিসেবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কোনও নিয়ম আমি মেনেছি কি মানিনি, যদি না মানি, তার শাস্তি কি হবে, তা দেখার দায়িত্ব স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের, ইনকিলাবের নয়। অবশ্য বহির্বাংলাদেশ ছুটির আর প্রয়োজন নেই ততদিনে। কলকাতার অনুষ্ঠান শেষ, দেশের কবিরা দেশে ফিরে এসেছেন।

    অগত্যা পাসপোর্টটি ফেরত পেতে, অর্থাৎ আমার নাগরিক অধিকারটি ফেরত পেতে মালিবাগের স্পেশাল ব্রাঞ্চের আপিসে আবারও যাই। গিয়ে দেখি আবদুস সাত্তার লোকটি, যে লোকটি ওপর থেকে আমার পাসপোর্ট আসার কথা আমাকে বলেছিলেন, বই পড়ছেন খুব মন দিয়ে। বইয়ের বাক্যে বাক্যে লাল কালির দাগ। হাতে তাঁর একটি লাল কলম। টেবিলের এক কোনায় যত বই আমি লিখেছি এ যাবৎ, সবগুলো বই। আমাকে দেখে লোকটি বই গুটিয়ে রাখার প্রয়োজন মনে করলেন না। আমি একটি চেয়ার টেনে সামনে বসে জানতে চাইলাম ‘পাসপোর্টের খবর কি, ওপর থেকে এসেছে?’

    তিনি ওপরের প্রসঙ্গে না গিয়ে বললেন, তদন্ত চলছে।

    ‘কিসের তদন্ত?’

    ‘আপনার বই পড়ার হুকুম এসেছে। কোথায় আপত্তিকর কি কি লিখেছেন, সেসব দেখতে হচ্ছে।’

    ‘পাসপোর্টের সঙ্গে আমার বইয়ের সম্পর্ক কি?’

    তদন্তকারী অফিসারের ঠোঁটের কিনারে একটি হাসি ঝিলিক দিয়ে মিলিয়ে গেল। তিনি এর কোনও উত্তর দিলেন না। খানিকপর বললেন, ‘ধর্ম নিয়ে আপনি খুব বাড়াবাড়ি করে ফেলেছেন!’

    ‘মানে?’

    ‘খুব বাজে কথা লিখেছেন। এইসব লেখেন কেন?’

    ‘আমি যা বিশ্বাস করি, তা লিখি। কিন্তু আমার লেখার সঙ্গে তো পাসপোর্ট না দেওয়ার সম্পর্ক থাকতে পারে না। পারে কি?’

    আবদুস সাত্তার আমার প্রশ্নের কোনও উত্তর দেবার প্রয়োজন মনে করেননি। কিন্তু স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে গিয়ে আমার প্রশ্নের উত্তর আমি পেয়েছি। মহাপরিচালক আমাকে দেখে মধুর হাসি উপহার দিয়ে বললেন, ‘এইতো বিখ্যাত লেখিকা এসে গেছে। বসেন বসেন।’

    আমি মহাপরিচালকের রসিকতার ঝাঁজ সামলে নিয়ে চেয়ারে বসি।

    ‘আপনার কলাম তো পড়ি পত্রিকায়।’ মহাপরিচালক হাসলেন বলতে বলতে।

    ও। ও শব্দটি উচ্চারণ করে আমি চুপ হয়ে থাকি।

    ‘আপনি যে পত্রিকায় লেখেন, কিভাবে লেখেন?’

    ‘কিভাবে লিখি মানে! আগে হাতে লিখতাম। এখন কমপিউটারে লিখি।’

    ‘বেশ ভাল কথা, এখন কমপিউটারে লেখেন। আপনি তো শুধু পত্রিকায় লেখেন না, বইও তো লেখেন।’

    ‘হ্যাঁ লিখি।’

    ‘সরকারের কাছ থেকে পারমিশান নিয়েছেন?’

    ‘তার মানে?’

    ‘এই যে লেখেন, পত্রিকায় কলাম লেখেন। সরকারের পারমিশান ছাড়া লেখেন?’

    আমার কপালে ভাঁজ পড়তে থাকে। এ সব কী শুনছি!

    ‘সরকারের পারমিশান লাগবে নাকি লিখতে হলে?’

    ‘নিশ্চয়ই। সরকারি চাকরি করেন, সরকারি পারমিশান ছাড়া কী করে লিখবেন! হ্যাঁ লিখতে পারেন, ঘরে বসে লিখতে পারেন। কিন্তু কোথাও ছাপার অক্ষরে বেরোনোর আগে সরকারের পারমিশান লাগবে।’

    ‘এরকম নিয়ম নাকি?’

    ‘হ্যাঁ এরকম নিয়ম।’

    ‘কিন্তু এত যে লেখক আছেন, পত্রিকায় লিখছেন, বই লিখছেন, তাঁরা তো অনুমতি নিচ্ছেন না সরকারের!’

    ‘আপনি জানেন কি করে যে নিচ্ছেন না!’

    ‘আমি জানি।’

    ‘নিচ্ছেন নিচ্ছেন।’

    একটি যন্ত্রণা আমার ঠোঁটে উঠে এলে বলি, ‘কি করে অনুমতি নিতে হয়, বলবেন!’

    ‘যা ছাপতে চান, আগে তা সরকারের কাছে জমা দেবেন, তারপর যখন সরকার বলবে যে হ্যাঁ এই লেখা ছাপার জন্য পারমিশান দেওয়া গেল, তখন ছাপতে দেবেন। ভেরি সিম্পল।’

    ‘এই নিয়মটা কি কেবল আমার জন্যই নাকি?’

    মহাপরিচালক অপ্রতিভ একটি হাসি ছুঁড়ে দিয়ে বললেন, ‘আপনার জন্য হবে কেন! এই নিয়ম সবার জন্য!’

    ‘যদি আমি পারমিশান না নিয়ে ছাপি লেখা, তাহলে কি হবে?’

    ‘তাহলে আপনি আইন অমান্য করলেন। আইন অমান্য করলে কি হয়, তা তো নিশ্চয়ই জানেন!’

    আমি স্পষ্ট বুঝি যে মহাপরিচালক এসব কথা আমাকে বলছেন ওপরের আদেশ পেয়ে। ওপরের সিদ্ধান্তই তিনি আমাকে জানাচ্ছেন। তাঁর সঙ্গে আর কোনও কথা বলতে আমার ইচ্ছে হয় না। মাথা বনবন করে ঘুরতে থাকে। আমি বেরিয়ে যাই। মহাখালির মোড় থেকে একটি রিক্সা নিয়ে সোজা বাড়িতে। বাড়িতে কারও সঙ্গে আমার কথা বলতে ইচ্ছে করে না। মা খাবার নিয়ে আসেন। খাবো না বলে দিয়ে শুয়ে থাকি। জানালার দিকে মুখ করে শুয়ে থাকি। জানালার ওপারে আকাশ, আকাশে মেঘ উড়ে যাচ্ছে। কোথায় যাচ্ছে কে জানে! কী চমৎকার ওরা উড়ে যায় ঠিকানাবিহীন। নাকি মনে মনে ওদেরও কোনও ঠিকানা থাকে। হঠাৎ আমি শোয়া থেকে উঠে পড়ি। বুকের ভেতরকার ধ্বক ধ্বক শব্দ আমি চাইলেও থামাতে পারছি না। অস্থির পায়ে এঘর ওঘর করতে থাকি। বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াই, এদিক ওদিক তাকাই, তাকাই কিন্তু কিছুই আমার চোখে পড়ে না। সব কিছুই শূন্য শূন্য লাগে, যেন এক আকাশ ছাড়া আর কিছু নেই কোথাও। বিশাল আকাশটির তলে আমি একলা পড়ে আছি। ইচ্ছে হচ্ছে চিৎকার করে কাঁদি, কিন্তু কাঁদতে পারছি না। এসব মার নজরে পড়ে, আর কারওর না পড়লেও।

    ‘নাসরিন, কি হইছে?’ মা জিজ্ঞেস করেন।

    ‘কিছু না।’

    ‘কিছু একটা নিশ্চয়ই হইছে। আমারে বল কি হইছে।’

    আমি জোরে ধমক দিই, ‘প্যাঁচাল পাড়বা না তো। কিছু হয় নাই।’

    মা চুপ হয়ে যান।

    এক গেলাস লেবুর শরবত বানিয়ে আমার হাতে দেন। শরবত ঢক ঢক করে খেয়ে আবার আমি বিছানায় কুকুর কুণ্ডুলি হই। মা পাশে বসে একটি হাত রাখেন আমার মাথায়। চুলে বিলি কেটে দিতে দিতে নরম গলায় বলেন, ‘এত অস্থির অস্থির করতাছ কেন? ঘুম ধরলে কিছুক্ষণ ঘুমাও।’

    দীর্ঘশ্বাস বেরোয় আমার কণ্ঠ থেকে। নিজের একটি ম্লান কণ্ঠস্বর নিজেই শুনি, ‘মা, আমার লেখালেখি ছাইড়া দিতে হইব।’

    ‘কেন ছাড়তে হইব?’

    ‘আমার ওপর আদেশ জারি হইছে। তারা আমার জন্য নিয়ম খুইঁজা বাইর করছে। আইন দেখায়। সরকারি চাকরি করলে লেখালেখি করা যাবে না।’

    ‘তরে কত কইছি ধর্ম নিয়া লেখিস না। নারী নির্যাতন নিয়া লেখতাছিলি, তা তো ভালই ছিল। কেন খালি খালি ধর্মের সমালোচনা করতে গেলি! কথা কইলে তো শুনস না। এখন কি করবি? তাদেরে জানাইয়া দে, ধর্ম নিয়া আর লিখবি না, সরকারের বিরুদ্ধে কিছু লিখবি না বইলা দে।’

    আমার ঘুম পায়। মার কথাগুলো ধীরে ধীরে খুব দূরের মনে হতে থাকে।

    আমার সামনে এখন দুটি পথ। এক হল লেখা, আরেক হল সরকারি চাকরি। যে কোনও একটি আমার বেছে নিতে হবে। আমি লেখাকে বেছে নিই। কাউকে কিছু না বলে, কারও সঙ্গে কিছু না বুঝে, দেশের দ্য বেস্ট মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চাকরি রত অবস্থায় আমি একটি কাণ্ড করি, একটি সাদা কাগজ নিয়ে তাতে লিখি, মাননীয় মহাপরিচালক, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, বাংলাদেশ জনাব, বিনীত নিবেদন এই যে আমি, তসলিমা নাসরিন, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের অ্যানেসথেসিয়া বিভাগে কর্মরত মেডিকেল অফিসার য়েচ্ছ!য় সজ্ঞানে সরকারি চাকরিতে ইস্তফা দিচ্ছি। আমার এই ইস্তফা পত্র গ্রহণ করে আমাকে বাধিত করবেন। আশা করি অতি সত্ত্বর আমার এই ইস্তফাপত্র গ্রহণ করে আমাকে সরকারি নাগপাশ চাকরি থেকে মুক্ত করা হবে।

    লিখে, সই করে, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে নিজে গিয়ে আমার ইস্তফাপত্র দিয়ে আসি। ইস্তফাপত্র কেবল দিলেই তো চলবে না, এটি গ্রহণ করা হল কি না, তারও খোঁজ নিতে হবে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে দিনের পর দিন গিয়েও ইস্তফা পত্রটি সরকারিভাবে গ্রহণের কোনও কাগজ আমার পাওয়া হয় না। কাগজটি পেলে আমি যে সরকারি চাকরিতে আর নেই, সে প্রমাণ দেখিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয় থেকে আমার পাসপোর্ট ফেরত চাওয়ার দাবি করতে পারব। আমার এই ইস্তফার খবর পেয়ে বাবার মাথায় হাত, এ কি কাণ্ড করেছে মেয়ে, এর মাথা টাথা খারাপ হয়ে গেছে নাকি! বাড়ির সকলের ধারণা আমার সত্যিই মাথার ঠিক নেই। যেই শোনে, থ মেরে যায়। বন্ধুরাও। অবিশ্বাস্য একটি কাণ্ড বটে। সরকারি চাকরি লোকে হাজার তপস্যা করেও পায় না, সরকারি চাকরি পাওয়া যেমন কঠিন এবং যাওয়াও তেমন কঠিন। লোকে কয়েক লক্ষ টাকা ঘুষ দিয়েও পাঁচশ টাকার সরকারি চাকরি যোগাড় করতে চায়। মাসের পর মাস, বছরের পর বছর অনুপস্থিত থাকলেও, কাজে অবহেলা করলেও আর যাই যাক, সরকারি চাকরি যায় না, সরকারি চাকরি একটি মানুষের জীবনে সবচেয়ে বড় নিরাপত্তা, আর আমি কি না জীবনের সবচেয়ে বড় নিরাপত্তা, তাও আবার ফার্স্ট ক্লাস গেজেটেড অফিসার পদের এত ভাল একটি চাকরিটি শখ করে ছেড়ে দিয়েছি! হ্যাঁ দিয়েছি ছেড়ে, দ্বিতীয়বার আমি ভেবে দেখি না।

    এর মধ্যেই হঠাৎ দেখি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আমার পদটিকে শূন্য পদ উল্লেখ করে সেই পদে অন্য এক ডাক্তারকে পোস্টিং দেওয়া হয়েছে। বেশ ভাল কথা, এর মানে আমার ইস্তফা পত্র তোমরা গ্রহণ করেছো। আমাকে সাদরে ইস্তফা দিয়েছো, তাই আমার পদটিকে শূন্য পদ বলছো, এর মানে আমি ওই পদটিতে নেই, আমি তবে কোথায়, আমাকে তো কোথাও বদলিও করোনি, কোনও ডাক্তার মরে গেলেই পদটি শূন্য হয়। আমি তোমাদের কাছে মৃত একজন মানুষ। ইস্তফা দিলে তো মৃতই হয়, কিন্তু আমাকে কেন বলছো না যে ‘তোমাকে ইস্তফা দেওয়া হইল, তুমি এখন আমাদের সকল বদমায়েশি, সকল ষড়যন্ত্র, নোংরামি, সকল কুটিলতা জটিলতা হইতে মুক্ত!’ না সেরকম কোনও চিঠি আমার কাছে আসে না। কয়েক মাসের বকেয়া মাইনেও আমাকে দেওয়া হয় না। সরকারি রেভিন্যূ আপিসে অনেকদিন ধর্না দিয়েও আমি আমার পাওনা টাকা আদায় করতে পারি না। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে দেওয়া আমার ইস্তফাপত্রের একটি অনুলিপি আর ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আমার জায়গায় অন্য ডাক্তারকে চাকরি দেওয়ার কাগজটি পাঠিয়ে দিই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে, সঙ্গে আমার পাসপোর্ট ফেরত চেয়ে আবেদন। আমি তো এখন সরকারি চাকরি করছি না, আমি সম্পূর্ণ বেসরকারি মানুষ। পাসপোর্টে আমার যে পেশাটি দেওয়া আছে, পুরোদস্তুর সে পেশায় আমি নিয়োজিত। সুতরাং অনুগ্রহপূর্বক আটককৃত ছাড়পত্রটি এই অধমকে ফিরত দিয়া বাধিত করিবেন। তারপরও কোনও সাড়াশব্দ নেই। আমার পাসপোর্টও ফেরত দেওয়া হয় না। পাসপোর্ট আমি ফেরত চাই, দেশের বাইরে কোথাও যাওয়ার জন্য নয়, এটি আমার নাগরিক অধিকার বলে চাই। অধিকার কেড়ে নিয়ে অন্যায়ভাবে আমার পাসপোর্ট আটক করা হয়েছে এবং ততোধিক অন্যায়ভাবে আমি সরকারি চাকরিতে ইস্তফা দেওয়ার পরও আমার পাসপোর্ট ফেরত দেওয়া হচ্ছে না, সে কারণেই চাই। কিন্তু আমার কথা কে শোনে! সাড়াশব্দ না পেয়ে পাসপোর্ট আপিসে গিয়ে নতুন একটি পাসপোর্টের জন্য আবেদন করি। নাহ, নতুন কোনও পাসপোর্টও আমাকে দেওয়া হয় না।

    একদিন, তখনও সরকার লজ্জা নিষিদ্ধ করেনি, নাহিদ, আইনের মেয়েটি, আমাকে বলল যে তার এক চেনা লোক আছে, লোকটি জামাতপন্থী, আবার সরকারের লোকদের সঙ্গেও বেশ ওঠাবসা আছে, লোকটি তাকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বাড়িতে রাত আটটার দিকে নিয়ে যেতে পারবে। নাহিদই চেনা লোকটিকে অনুরোধ করেছে এই ব্যবস্থাটি করার জন্য। সুতরাং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে আমার পাসপোর্ট নিয়ে নাহিদ একটি মোক্ষম সুযোগ পেয়েছে কথা বলার। ভাল কথা। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে পাঠানো আমার আবেদপত্রটির একটি অনুলিপি নাহিদ নিয়ে গেল তাঁর বাড়িতে। ঘন্টা দুই পর মেয়ে তার বিষণ্ন মুখটি নিয়ে ফেরত আসে।

    কি হল?

    ‘বস, আপনের আবেদনপত্র উনি ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছেন।’

    ‘তাই নাকি!’

    ‘হ্যাঁ, বললেন, এই মেয়ে ধর্মের বিরুদ্ধে লেখে। আমাদের রাসুলল্লার বিরুদ্ধে জঘন্য সব কথা লেখে। একে তো পাসপোর্ট দেবই না। এর লজ্জা ব্যান করব।’

    ‘এই কথা বললেন?’

    ‘হ্যাঁ এই কথা বলে খুব জোরে জোরে হাসলেন।’

    ‘তুমি কিছু বললে না?’

    ‘বললাম, লজ্জা ব্যান করবেন কেন? ওতে কি কোনও আপত্তিকর কথা আছে? বললেন, আছে আছে নিশ্চয়ই আছে। বললাম, কিছু তথ্য দেওয়া, তথ্য তো উনি বানিয়ে লেখেননি। বললেন, তা হয়ত বানাননি। কিন্তু এভাবে কোন হিন্দুকে চড় দেওয়া হল, কোথায় গাল দেওয়া হল, কার বাড়ির বেড়ায় আগুন লাগল, এসব সব জানানো উচিত? মালাউনের বাচ্চারা তো লাই পেয়ে মাথায় উঠবে।’

    নাহিদ একটি সিগারেট ধরায়। আরেকটি বাড়ায় আমার দিকে।

    ‘নাহ, সিগারেট খাবো না।’

    ‘আরে বস, খান খান। আপনি খুব টেনশানে আছেন। খেলে টেনশান কমবে।’

    আমার বাড়ির কেউই নাহিদকে পছন্দ করে না। কারণ নাহিদ সিগারেট খায়। সিগারেট জিনিসটি আমারও পছন্দ নয়। কিন্তু নাহিদ আমার ঘরে বসে সিগারেট ধরাবেই এবং আমাকে এক টান দু টান তিন টান দেওয়ার জন্য সাধাসাধি করবে। বস বলে ডাকা আমি পছন্দ না করলেও সে আমাকে বস বলে ডাকবে। নাহিদ খুব সাহসী মেয়ে। সাহসী মেয়েদের আমার খুব ভাল লাগে। রাত বিরেতে সে তার নারায়ণগঞ্জের বাড়িতে বাসে করে রওনা হয়। আমি জিজ্ঞেস করি, তুমি কি ভয় পাও না নাহিদ?

    ‘বস, আপনার মুখে ভয়ের কথা মানায় না। ভয় পাবো কেন? কেউ কিছু করলেঞ্চ, নাহিদ তার হাত মুষ্ঠিবদ্ধ করে, ‘ঘুসি দিয়ে ফেলে দেব না!’

    নাহিদের ডান হাতের ছ নম্বর আঙুলটি মুঠির বাইরে অসহায় পড়ে থাকে।

    নাহিদ কখনও শাড়ি পরে না। জামা পাজামা ওড়না। পায়ে সেণ্ডেল। এই হল তার চিরাচরিত পোশাক। মুখে কখনও কোনও রং মাখে না সে। ফাঁক পেলেই আমার বাড়িতে চলে আসবে, বলবে, ‘বস, কিছু কাজ আছে? থাকলে বলেন, করে দিই।’ কাজ থাকলে করবে, না থাকলে গলা ছেড়ে গান গাইবে।

    ঠিক ঠিকই লজ্জা নিষিদ্ধ হল। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী খ্যাক খ্যাক করে হেসে বললেন, ‘ওর বাকি বইও ব্যাণ্ড করব।’ দেশের স্বাধীনতার শত্রুটি আমাদের দণ্ডমুণ্ডের কর্তা। আজ তাঁর ভারি নিতম্বের তলে লেখকের লেখার স্বাধীনতা, তার মত প্রকাশের অধিকার থেতলে যাচ্ছে।

    ভেবেছিলাম সরকারি চাকরিতে ইস্তফা দিলেই সরকারের রোষ মুক্ত হয়ে স্বাধীন ভাবে লেখালেখি করতে পারব। কিন্তু এই স্বাধীনতা আমাকে দেওয়া হবে কেন! আমি আপাদমস্তক বেসরকারি হলেও আমার গতিবিধির ওপর সরকারের কড়া নজর। একদিন স্পেশাল ব্রাঞ্চের দুটো লোক আমার শান্তিনগরের বাড়িতে উপস্থিত। প্রথম দরজা খুলিনি। এরপর এমন জোরে ধাককা দিতে শুরু করল দরজা, চিৎকার করে বলতে লাগল, ‘পুলিশের লোক, দরজা খোলেন।’ ভয়ে ভয়ে দরজা খোলা হল। লোকদুটো সদর্পে ঘরে ঢুকলেন, যেন নিজেদের কোনও হরিহর আত্মার বাড়িতে ঢুকেছেন। দিব্যি হাঁটাহাঁটি করতে লাগলেন ঘর জুড়ে, বৈঠকঘরের পাখা চালিয়ে দিয়ে, জানালার পর্দা সরিয়ে দিয়ে সোফায় বসে গেলেন হাত পা ছড়িয়ে। একজনের মুখে মিটিমিটি হাসি, আরকজনের চোখের ভুরু যথাসম্ভব কোঁচকানো।

    ভুরু প্রথম মুখ খুললেন, ‘লজ্জা বইটা আছে আপনার কাছে?’

    বুকের মধ্যে একটি ঠাণ্ডা জলের গেলাস উপুড় হয়ে পড়ে। আমার কাছে লজ্জা বইটি আছে। কিন্তু এটির সংরক্ষণ যেহেতু নিষিদ্ধ, এটি আমার কাছে সংরক্ষিত দেখলে লোকদুটো আমাকে এই মুহূর্তে হাতকড়া পরিয়ে নিয়ে যেতে পারে। আমি হ্যাঁ বলব নাকি না বলব ঠিক বুঝে পাই না।

    ‘কেন? আপনার দরকার?’ উল্টো প্রশ্ন করি।

    ভুরু বলেন, ‘হ্যাঁ একটা বই আমার দরকার।’

    ‘বইটার তো সংরক্ষণ নিষিদ্ধ!’ আমি বলি। আমি ভুরুর মুখোমুখি। মিটিমিটি আমার ডান পাশে।

    ‘আছে বই?

    ‘না।

    ‘ঠিক তো!’

    ‘ঠিক।’

    নির্লিপ্ত স্বর। দুজনের দুজোড়া পায়ের দিকে চোখ আমার। এঁরা যদি এখন আমার লেখার ঘরটিতে যান, নিশ্চয়ই একটি লজ্জা কোথাও পাবেন। তখন কী হবে না ভেবেই আমি ঠিক শব্দটি বলেছি। কথোপকথন শুনে মা যদি কোথাও বইটি পেয়ে লুকিয়ে রাখেন তবেই বাঁচোয়া। হঠাৎ চেয়ার ছেড়ে উঠি, ভুরু আমাকে থামিয়ে বলেন, ‘কোথায় যাচ্ছেন, বসেন বসেন।’ উঠে দাঁড়িয়ে যাওয়া আমাকে বসতে হয়। এক গাদা অস্বস্তি আর অরুচি নিয়ে বসি। বুকের মধ্যে একটি ভয়ও কোত্থেকে যেন উড়ে এসে বসে।

    এবার মধ্যবয়স্ক মিটিমিটি বলেন, ‘আপনার লজ্জা কেন বাজারে বিক্রি হচ্ছে?

    ‘আমার প্রকাশক বিক্রি করছে না লজ্জা। তার কাছে নেইও তো লজ্জা। সব তো পুলিশ নিয়ে গেছে।’

    ‘কিন্তু বিক্রি তো হচ্ছে! কেন হচ্ছে?’

    ‘তা আমি জানি না কেন হচ্ছে, কী করে হচ্ছে।’ গম্ভীর গলায় বলি।

    ‘আপনার তো জানার কথা।’

    আমার চোয়াল শক্ত হয়ে ওঠে। বলি, ‘আমি বইটা লিখেছি। বইয়ের লেখক আমি। এই বই বিক্রি করার দায়িত্ব আমার না। যারা বিক্রি করছে তাদের গিয়ে জিজ্ঞেস করেন কেন তারা বিক্রি করছে।’

    যে চিকন একটি ভয় ছিল, সেটি উবে যায়। কেবল অস্বস্তি আর অরুচিগুলো পড়ে থাকে। ভুরু মুখ খোলেন, ‘ফেরা.. .

    শব্দটি খপ করে ধরে মিটিমিটি বলেন, ‘ফেরা বইটা কেন লিখেছেন?’

    ‘কেন লিখেছি মানে? ইচ্ছে হয়েছে লিখতে তাই লিখেছি।’

    ফেরা নামের একটি গল্প লিখেছি নতুন। পত্রিকা শারদীয়া সংখ্যার জন্য দুলেন্দ্র ভৌমিক একটি উপন্যাস চেয়েছিলেন। কিন্তু উপন্যাস লেখা সম্ভব হয়নি, লিখেছি বড় গল্প, যদিও পত্রিকায় উপন্যাস হিসেবেই ফেরা ছাপা হয়েছে। ফেরা বই হয়ে বেরিয়ে গেছে দেশে, তবে পশ্চিমবঙ্গে বই হয়নি এখনও। আমার লেখার সঙ্গে সঙ্গেই বই ছাপা হয়ে যেতে পারে, কারণ আমি কমপিউটারে যে বাংলা লিপিতে লিখি সেই একই লিপি ব্যবহার করেন বাংলাদেশের প্রকাশকরা। আমি লিখে ডিসকেটে কপি করে দিলেই তাঁরা সোজা ছাপতে চলে যেতে পারেন প্রেসে। কম্পোজ করা, প্রুফ দেখা এসব ঝামেলা থেকে মুক্ত। কিন্তু আনন্দ পাবলিশার্সএর সব কিছুই শুরু থেকে করতে হয়, যেহেতু ওখানে বাংলা আদর্শলিপি ব্যবহার হয় না। ফেরার গল্পটি খুব ছোট, পূর্ববঙ্গের এক কিশোরী মেয়ে যাকে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল পশ্চিমবঙ্গে তার নিরাপত্তার জন্য, একদিন সে ফিরে আসে নিজের দেশটি দেখতে, তিরিশ বছর পর। সেই দেখাটি কেমন, তারই বর্ণনা। এখন পুলিশের লোক জানতে চাইছেন আমি কেন লিখেছি ফেরা। আমার ইচ্ছে হয়েছে বলে লিখেছি এই উত্তরটি তাঁদের মনঃপূত হচ্ছে না, বুঝতে পারি।

    ‘ফেরা আপনাকে কে লিখতে বলেছে?’ ভুরু।

    ‘মানে?’

    ‘কেউ তো নিশ্চয়ই বলেছে যে ফেরা নামে এরকম একটা গল্প নিয়ে একটা উপন্যাস লেখেন। কে বলেছে?’

    ‘প্রকাশকরা তো সবসময়ই বলছেন লিখতে। কিন্তু কি নাম হবে উপন্যাসের, কী গল্প আমি লিখব, তা আমাকে কেউ বলে দেন না। সে আমি নিজেই লিখি।’

    ‘ফেরার গল্পটা তো আর আপনার মাথা থেকে আসেনি। নিশ্চয়ই কেউ আপনাকে বলে দিয়েছে।’

    ‘না। কেউ বলে নাই। আমি তো বললামই, কি গল্প আমি লিখব সেটা আমিই ঠিক করি।’

    ‘ফেরার কোনও ক্যারেকটার কি আপনার চেনা? মানে আপনি কি চেনেন কল্যাণী নামের কোনও মহিলাকে?’

    ‘না।’

    ‘তাহলে কেন লিখেছেন যে কল্যাণী নামের একজন হিন্দু মহিলা কলকাতা থেকে এখানে এসেছে বাড়িঘর দেখতে!’

    ‘আশ্চর্য, এটা তো গল্প!’

    ‘বানিয়ে লিখেছেন তাহলে! এরকম কোনও ঘটনা ঘটে নাই।’

    ‘গল্প তো লেখকরা তাদের কল্পনা দিয়েই লেখেন।’

    ‘কিন্তু বাস্তবের সাথে তো কিছু মিল থাকতে হয়। তাই না? নাকি উদ্ভট উদ্ভট কল্পনা লিখে দিলেই হয়ে যায়!’

    ‘কলকাতায় বইটা বের হয়েছে?’ মিটিমিটি।

    ‘বই হয়ে বেরোয় নি।’

    ‘কি হয়ে বেরিয়েছে?’

    ‘পত্রিকায় গল্পটা ছাপা হয়েছে।’

    ‘কোন পত্রিকা?’

    ‘আনন্দলোক।’

    ‘হুম।’

    ‘আছে আপনার কাছে পত্রিকাটা?’

    আমার গা জ্বলে। ইচ্ছে করে ঘাড় ধরে যদি লোকদুটোকে বের করে দিই। বাইরের লু হাওয়া এসে আমার জ্বলুনি আরও বাড়াচ্ছে।

    ‘পত্রিকাটা আছে?’ ভুরু।

    ‘না।’ একটু জোরেই এই না টা বলি।

    ‘আপনি মুসলমান হয়ে হিন্দুদের নিয়ে গল্প লেখেন কেন?’

    ‘আমি মুসলমান পরিবারে জন্ম নিয়েছি। কিন্তু আমি কোনও ধর্ম বিশ্বাস করি না।’ বলি, জোর দিয়ে। এটি বলে যে একগাদা অস্বস্তি আর অরুচি ছিল, সেটিও দেখি সরে যাচ্ছে আমার ভেতর থেকে। যেন অনেকক্ষণ সিন্দুকে বসে থাকার পর খোলা হাওয়ায় এসে বুক ভরে শ্বাস নিলাম।

    ‘ইসলাম ধর্মে বিশ্বাস নাই আপনার?’ ভুরু জিজ্ঞেস করেন।

    ‘না।’

    ‘অন্য কোনও ধর্মে আছে বিশ্বাস?’

    ‘না।’

    ‘হিন্দু ধর্মে আছে?’

    ‘না।’

    ‘তাহলে হিন্দুর পক্ষে এত কথা বলেন কেন?’ মিটিমিটির প্রশ্ন।

    ‘কথা বলি, কারণ ওরা মানুষ। আমি কোনও ধর্ম দেখি না। আমি দেখি মানুষ। কোনও মানুষের ওপর যদি অযথা অত্যাচার করা হয়, আমি সেই মানুষের পক্ষে দাঁড়াই। সোজা কথা। সাফ কথা।’

    লোকদুটো চলে যাবার পর সশব্দে দরজা লাগিয়ে আমি ঘুরে দাঁড়াতেই দেখি মা দেয়ালের ওপাশে দাঁড়িয়ে আছেন বিবর্ণ মুখে। বললেন, ‘কেন কইলি যে ধর্ম বিশ্বাস করি না! এখন তো ওরা আরও অসুবিধা করব।’

    ‘করুক।’ বলে আমি সরে আসি।

    বিছানার তিন তোশকের তল থেকে মা লজ্জা বইটি বের করে রান্নাঘরে নিয়ে কুটি কুটি করে ছিঁড়ে আবর্জনার ঝুড়িতে ফেলে দিতে দিতে বলতে লাগলেন, ‘কোনও দরকার নাই এই বই থাকার। কখন আবার এই বই আছে বইলা বাড়ির সবাইরে বাইন্ধা নিয়া যায়!’ আমার কমপিউটারে বইটি লেখা আছে। ছিঁড়ে ফেলা বইটির জন্য আমার মায়া হয় না। বরং একদিক দিয়ে ভাল। অযথা হয়রানি থেকে হয়ত বাঁচব।

    আপদ বিদেয় হয় ঠিক কিন্তু সম্পূর্ণ বিদেয় হয় না। মিটিমিটি প্রায়ই ফোন করেন। আমি কেমন আছি, কেমন চলছে জীবন ইত্যাদি জিজ্ঞেস করেন। তিনি যে আমার মঙ্গল চান, এ কথাটি একবার একফাঁকে বললেন। মঙ্গল যেদিন চেয়েছেন সেদিনই জিজ্ঞেস করলেন, ‘আপনি কি আজকাল পত্রিকায় দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন ধর্ম নির্মূল হোক, বিবাহ নির্মূল হোক?’

    ‘হ্যাঁ বলেছি। তাতে কি হয়েছে?’আমার কঠিন কণ্ঠ।

    ‘হোম মিনিস্ট্রি থেকে ব্যপারটি তদন্ত করতে বলেছে।’

    আমি দীর্ঘশ্বাস ফেলে ফোন রেখে দিই। আমি কোথায় কি বলেছি, তারও তদন্ত হয়! আমি কি বলব না বলব, কি লিখব না লিখব, সবকিছুর জন্য একটি সীমানা তৈরি করতে চাইছে তারা। সীমানার বাইরে বেরোলে তদন্ত হবে। মন্ত্রণালয়ে ফাইল খোলা হবে। ফাইলের পেট দিন দিন মোটা হতে থাকবে। পুলিশ আমাকে চোখে চোখে রাখে। সাদা পোশাকের পুলিশের লোক আর যে কোনও অপুলিশ আমার চোখে একই রকম দেখতে লাগে। কিন্তু আমি না বুঝলেও অন্যরা আমাকে বলে যে আমার বাড়ির আশেপাশে ঘুরঘুর করে টিকটিকিগুলো। কী চায় তারা, কী পায় তারা আমি জানি না।

    শান্তিবাগ থেকে শান্তিনগরে এসে আমার মনে হয়েছিল একটু বোধহয় শান্তি জুটবে এবার। কিন্তু পুলিশের লোকেরা আমি যেখানেই যাই, সেখানেই ছায়ার মত আমাকে অনুসরণ করে। পুলিশই যদি কেবল সমস্যা হত, তাহলেও কথা ছিল। এ বাড়িতে ঢোকার পর থেকে নতুন নতুন সব উপদ্রব শুরু হয়েছে। কদিন পর পরই দরজার কড়া নড়ে, সমিতির টাকা দিতে হবে। আমি কোনও সমিতি করব না, জানিয়ে দিই, সুতরাং চাঁদা টাদা দেবার প্রশ্ন ওঠে না। মালিক-সমিতির লোকেরা জানান, সমিতির চাঁদা দিতেই হবে। এ থেকে মুক্তি নেই। বিশাল বড় চারটে দালান এই কমপ্লেক্সে। এক একটি দালান দশ তলা করে। চল্লিশটি করে আ্যপার্টমেন্ট এক দালানেই। একশ ষাটটি পরিবার, যা তা কথা নয়। সমিতির প্রয়োজন আছে। চুরি ডাকাতি বন্ধ করা, চব্বিশ ঘন্টা নিরাপত্তা প্রহরীর ব্যবস্থা করা, প্রহরীদের বেতন দেওয়া, আজ যদি লিফট নষ্ট হয়ে যায়, সারাবে কে? বাগানের মালি দরকার, কে যোগাবে? গাড়ির ড্রাইভারদের নাম ঠিকানা নথিভুক্ত করা, তেড়িবেড়ি করলে তাড়িয়ে দেওয়া, বারান্দাগুলো পরিষ্কার করা, ময়লা ফেলা ইত্যাদির জন্য লোক লাগানো, মাসে মাসে তাদের বেতন দেওয়ার ব্যবস্থা করা, ডিশ আ্যণ্টেনা লাগানো, নষ্ট হলে সারানো, বাড়ির চামড়া খসে গেলে চামড়া বসানো, রং পুরোনো হলে নতুন রং করা, কাজের শেষ নেই। এসব তো আর ইস্টার্ন হাউজিং এসটেটের এর মালিক জহিরুল ইসলাম করবেন না, জহিরুল ইসলাম তো সব বাড়ি বিক্রিই করে দিয়েছেন। এসব ব্যবস্থাপনায় এখন তাদের থাকবে হবে, বাড়ি যারা কিনেছে। কিছু উৎসাহী মালিক মিলে এই সমিতি গঠন করেছেন। বছর গেলে নির্বাচন হবে সমিতির দাঁয়িত্ব কার কার কাঁধে পড়বে এ নিয়ে। সমিতির কাজ কেবল এসব সামলানো নয়। ভবিষ্যতেরও নকশা আছে। নিচে গ্যারেজের সামনে দোকান বসবে, লণ্ড্রি বসবে, বেকারি বসবে। মূলত, আমি বুঝি, পুরো এলাকাটির অর্থাৎ একশ ষাটটি আ্যপার্টমেণ্টের মানুষদের সুবিধের জন্য এই সমিতি। আমি মাসে মাসে বাঁধা বারোশ টাকার ব্যবস্থাটি মেনে নিই। একদিন সমিতির ঘরে ঢুঁ দিয়ে সেক্রেটারি শফিক আহমেদএর সঙ্গে পরিচিত হয়েও আসি। পরিচয় দেওয়ার আগেই তিনি বলে উঠলেন, চিনি আপনাকে। দেখেছেন কখনও আমাকে? জিজ্ঞেস করি। না, দেখিনি, তবে পত্রিকায় তো ছবি টবি সবসময়ই দেখি। সামনাসামনি এই প্রথম দেখলাম। একটি স্মিত হাসি ঝুলে থাকে মুখে, হাসির তলে এক টুকরো আশঙ্কা। আমাকে, আজকাল লক্ষ করছি, কোথাও নিজের পরিচয় দেওয়ার প্রয়োজন হয় না। এটি কি ভাল, নাকি মন্দ! নিজেকে জিজ্ঞেস করি। মনে মনে নিজেকে উত্তর দিই, মন্দ।

    এরপর সমিতি থেকে যে জিনিসটি করা হল, তা আমি সোজাসুজি বলে দিই, আমার দ্বারা হবে না। মসজিদের চাঁদা। মসজিদ বানানো হচ্ছে, এর জন্য আলাদা করে টাকা চাই। আমি বলি, আমার বাড়ি থেকে কেউ মসজিদে যাবে না, সুতরাং চাঁদা দেওয়ার প্রশ্ন ওঠে না। তারপরও চাঁদা দিতে হবে। শফিক আহমেদ নিজে আসেন। সাদা শার্ট, কালো প্যান্ট কালো জুতোর সাদাসিধে মাঝারি আকার ভদ্রলোক শফিক আহমেদ। একটি কলমের কোম্পানীর মালিক। কোম্পানির মালিক বলেই অঢেল সময় পান সমিতিতে ঢালার। মুক্তিযুদ্ধ করেছিলেন। আমার লেখাটেখা, বললেন, ভালই লিখি মাঝে মাঝে, বিশেষ করে দেশের স্বাধীনতা বিষয়ে যখন লিখি।

    ‘মসজিদের চাঁদা সবাই দিচ্ছে, আপনিও দিয়ে দেন। মসজিদ তৈরি হচ্ছে, এটা সম্পূর্ণ করতে টাকার দরকার।’

    ‘কমপ্লেক্সের ভেতরে মসজিদ করার দরকারটা কি? আশেপাশেই তো অনেক মসজিদ আছে। যারা নামাজ পরতে চায়, তারা ওইসব মসজিদে যেতে পারে।’

    ‘কিন্তু ভাই মসজিদ করার জন্য কমপ্লেক্সে আগে থেকেই প্ল্যান ছিল।’

    ‘অন্য যে কোনও কিছু তৈরি করতে টাকা লাগে নিয়ে যান। কিন্তু মসজিদ তৈরি করার জন্য আমি কোনও টাকা দেব না।

    ‘আপনার কী ক্ষতি, টাকা দিলে?’

    ‘লাভটা কি বলেন?’

    ‘লাভ না হোক। তবু তো সবার ব্যপার। আমাদের তো এখানে মিলেমিশেই থাকতে হবে। সবাই দিয়ে ফেলেছে টাকা,শুধু আপনারটাই বাকি আছে।’

    ‘আমার টাকার জন্য আপনাদের মসজিদ আটকে থাকবে না। আপনারা মসজিদ করতে চান করেন। আমি তো আপনাদের বাধা দিতে পারব না। কিন্তু মসজিদে আমি বিশ্বাস করি না, আমি কোনও টাকা মসজিদের জন্য দেবই না।’

    শফিক আহমেদ চা খেয়ে বিদায় নেন।

    এ করে যে শান্তি জুটবে তা নয়। সমিতি আয়োজন করছে মিলাদ মাহফিলের, চাঁদা দাও। দরজা থেকে বলে দিই, মিলাদে যাবো না, সুতরাং চাঁদা দেব না।

    এরপর আবার। রোজার সময় ইফতারির আয়োজন হবে, চাঁদা দাও। ইফতারি খেতে যাবো না। চাঁদা দেওয়ার প্রশ্ন ওঠে না।

    এরপর আরেকদিন। শবে বরাতের অনুষ্ঠান হবে। সেটির জন্য চাঁদা চাই। বড় একটি না বলে বিদায় দিই।

    একুশে ফেব্রুয়ারির অনুষ্ঠান হবে, বিজয় দিবসের অনুষ্ঠান হবে, চাঁদা দিয়ে দিই।

    মসজিদের ঘটনার দু সপ্তাহ পর শফিক আহমেদের ফোন পেলাম। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ‘আচ্ছ!, কায়সার কে?’

    ‘কায়সার? কেন? কায়সার আমার বন্ধু।’

    ‘আপনার বাড়িতে আসে নাকি প্রায়ই?’

    ‘হ্যাঁ আসে। কেন, কি হয়েছে?’

    ‘কথা হচ্ছে।’

    ‘কোথায় কথা হচ্ছে?’

    ‘সমিতিতে।’

    ‘কি কথা?’

    ‘বলছে আপনার সঙ্গে নাকি অবৈধ সম্পর্ক আছে কায়সারের।’

    আমি জোরে হেসে উঠি। ‘আমার সঙ্গে কার কী সম্পর্ক , সম্পর্ক বৈধ না অবৈধ তা দেখার কাজ সমিতির? সমিতিকে আমার শোবার ঘরে ঢোকার অনুমতি কে দিয়েছে?’

    শফিক আহমেদ বললেন, ‘এসব তো আর আমি করছি না ভাই। আমি শুভাকাঙ্খী হিসেবে আপনাকে জানাচ্ছি। এগুলো করছেন ইস্টানং হাউজিংএর চিফ ইঞ্জিনিয়ার জুবাইর হোসেন, দুই নম্বর বিল্ডিংএ তাঁর আ্যপার্টমেন্ট আছে। সমিতির সভাপতি তিনি।’

    ‘যা ইচ্ছে করুক। যা ইচ্ছে বলুক। আমি পরোয়া করি না।’

    ‘আপনাকে মনে হয় চিঠি দেবে।’

    ‘কিসের চিঠি?’

    ‘কোনও অবৈধ কাজ যেন আ্যাপার্টমেণ্টে না করেন এ ব্যপারে চিঠি।’

    ‘আমার বাড়িতে আমি কি করি না করি, সেটা আমার ব্যক্তিগত ব্যপার।’

    আমি ফোন রেখে দিই। এসব বিষয়ে কথা বলার প্রবৃত্তি হয় না আমার।

    এরপর আবারও এক রাতে ফোন। শফিক আহমেদ জানালেন সভাপতি উঠে পড়ে লেগেছেন আমার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে। তাঁর পক্ষে অনেকেই আছে। এও জানালেন, সমিতির অধিকার আছে কোথাও কোনও অবৈধ কাজ হচ্ছে কি হচ্ছে না তার খবর নেওয়া এবং উপযুক্ত ব্যবস্থা নেওয়া।

    ‘অবৈধ বলতে কি বোঝাচ্ছেন?’

    ‘ধরেন, কোনও বাড়ির মালিক যদি তার বাড়িটাকে প্রসটিটিউশনের কাজে ব্যবহার করে। এরকম তো হতে পারে। দেখা গেল বাড়িতে প্রসটিটিউট আর ক্লায়েন্ট এনে রীতিমত ব্যবসা করছে মালিক, তখন সমিতির দায়িত্ব সেই লোককে উচ্ছেদ করা।’

    ‘কি করে উচ্ছেদ করবেন বাড়ির মালিককে? বাড়ির মালিক তো তিনি।’

    ‘এরকম নিয়ম আছে। বাড়ি বিক্রি করে যেতে তিনি বাধ্য।’

    ‘আমি তো কোনও ব্যবসা করছি না আমার বাড়িতে। তবে আমার বিরুদ্ধে ব্যবস্থার কথা বলছেন কেন তিনি?’

    ‘অবৈধ কাজ করছেন বলে তারা ভাবছে। আমি আপনার শুভাকাঙ্খী। আমাকে ভুল বুঝবেন না। ‌আপনি কায়সারকে বলে দিন আপনার বাড়িতে না আসার জন্য।’

    আমি রুখে উঠি। ‘না, আমি তা বলব না। এখানে কায়সার কোনও ব্যপার না। আমার বাড়িতে কে আসবে না আসবে, কে থাকবে না থাকবে, কে ঢুকবে বাড়িতে, কে বাড়ি থেকে বেরোবে, সেটা সম্পূর্ণ আমার সিদ্ধান্তে হবে। সমিতির সিদ্ধান্তে না। এ আমার শেষ কথা। এটা হচ্ছে মানুষের একটা মিনিমাম ফ্রিডম। এই ফ্রিডম আমি বিসর্জন দেব না।’

    ‘তাহলে চিঠি পাঠাবে।’

    ‘পাঠাক।’

    ‘প্রথম ওয়ার্নিং। তারপর সেকেণ্ড ওয়ার্নিং। থার্ড। তারপর বোধহয় বাড়িছাড়ার আদেশ।’

    ‘যা ইচ্ছে করুক। আমার বাড়ি থেকে আমাকে উচ্ছেদ কী করে করে আমি দেখব।’

    খটাশ করে ফোন রেখে দিই। শ্বাস পড়ছে দ্রুত আমার। নিজের কেনা বাড়ি, এই বাড়ি থেকে আমাকে উচ্ছেদ করার ষড়যন্ত্র চলছে। কোনও ভাড়া বাড়িতে আমার স্থান হয় না, এখন যদি নিজের বাড়িতেও বাস করার অধিকার না থাকে আমার, তবে যাবো কোথায়! আমার তো পেছোতে পেছোতে পেছোবার আর কোনও পথ নেই। ঠেলতে ঠেলতে লাথি কষাতে কষাতে আর কোথায় আমাকে নিতে চায় মানুষ! আর কত সর্বনাশ ঘটাতে চায় আমার! অস্থির হাঁটাহাঁটি করি ঘরে বারান্দায়। বাড়িটি কেনার পর নিজে হাতে সাজিয়েছি। রান্নাঘরের দেয়ালগুলোয় নিজে পছন্দ করে টাইলস কিনে এনে লাগিয়েছি, পুরো আধুনিক কেবিনেটে সাজিয়ে দিয়েছি রান্নাঘরটি, বড় শ্বেত পাথর বসিয়েছি কাটা বাছা করার জায়গায়, ভারি পর্দা কিনে সবগুলো জানালায় টাঙিয়ে দিয়েছি, পর্দাগুলো দেয়ালের মাথা থেকে মেঝে পর্যন্ত, কাঠের সোফা কিনেছি বৈঠক ঘরের জন্য, শোবার ঘরে নতুন একটি খাট পেতেছি, নতুন একটি বড় সেগুন কাঠের আলমারি বসিয়েছি, লেখার ঘরটির চারদেয়াল জুড়ে রেখেছি বইয়ের আলমারি, আলমারি ভর্তি বই, টেবিলে কমপিউটার। নিজের বাড়ি, নিজের সাধ্য মত রুচি মত সাজিয়ে বন্ধু বান্ধব সবাইকে নিমন্ত্রণ করে গৃহপ্রবেশ অনুষ্ঠান করেছি। অস্থির জীবনটি শেষ পর্যন্ত একটি নিশ্চিন্তের জায়গায় এসে স্থির হয়েছে। স্বামী ছাড়া কোনও মেয়ের পক্ষে থাকা সম্ভব নয়, আমার পক্ষেও সম্ভব হবে না, একা কোনও মেয়ে পায়ের তলায় শক্ত মাটি পাওয়া অসম্ভব ইত্যাদি বাণীকে আমি মিথ্যে প্রমাণ করেছি। গুষ্ঠির মধ্যে কেউই যা করতে পারেনি, তা আমি করে দেখিয়েছি যে মেয়ে হয়ে আমি তা করতে পারি। প্রচণ্ড আত্মবিশ্বাস নিয়ে আমি যখন ঋজু হয়ে দাঁড়িয়েছি, তখন কি না আমাকে আমার বাড়ি থেকেই তাড়িয়ে দেবে! কোথায় কোন নর্দমায় আমাকে ফেলতে চাইছে মানুষ! আমার মরণ না দেখে কারও বুঝি স্বস্তি নেই! সমাজে বাঁচতে হলে সমস্ত স্বাধীনতার গলা টিপে ধরে বাঁচতে হবে! আমার নিজস্ব কোনও মূল্যবোধ নিয়ে আমার বেঁচে থাকার অধিকার নেই! ক্রোধ আমার সর্বাঙ্গে। হাত নিশপিশ করে, মুহূর্তের জন্য মনে হয় একটি যদি রিভলভার পেতাম কোথাও, নির্দ্বিধায় আমি খুন করতে পারতাম জুবায়ের নামের লোকটিকে।

    জুবায়ের হোসেন আমাকে নিঃশব্দে নিরীক্ষণ করেন। তাঁর বাড়ি এক নম্বর দালানে নয়, তারপরও এক নম্বরের লিফটে চড়তে গেলেই ধোপ দুরস্ত ধবল শার্দূলটির শ্যেনচক্ষুদুটি দেখি সামনে। একদিন কায়সার আর আমি সেই একই লিফটে, তিনিও। আমাদের দেখে রোষে তাঁর নাকের পাটা ফুলে ফুলে উঠছিল। সেদিনই কায়সার তার গাড়ি রেখেছে অতিথির গাড়ি পার্কিংএ। জুবায়ের হোসেন দাঁড়িয়েছিলেন, কায়সারকে বললেন গাড়ি সরিয়ে নিতে, কারণ ওটি নাকি ঠিক জায়গা নয় গাড়ি রাখার। কায়সার বলল, ‘কেন, এইখানে তো জায়গা খালি আছে, গাড়ি রাখলে অসুবিধা কী?’

    ‘অসুবিধা আছে।’ নিরাপত্তা প্রহরীরা জুবায়েরের ইঙ্গিতে কায়সারকে জানিয়ে দেয়।

    ‘কি অসুবিধা, বলেন।’

    জুবায়ের চেঁচিয়ে বললেন, ‘আপনার গাড়ি এইখানে পার্ক করা যাবে না।’

    ‘কেন যাবে না?’ কায়সারের স্বরও উঁচুতে ওঠে।

    ‘দেখে নেব, ঠিক আছে আমিও দেখে নেব’ ধরণের উত্তপ্ত বাক্য বিনিময় চলে দুজনের মধ্যে। কায়সারকে শেষ পর্যন্ত গাড়ি সরিয়ে রাস্তার কিনারে রেখে আসতে হয়।

    কায়সারের চেয়ে অনেক বেশি ক্ষমতা ধারণ করেন জুবায়ের হোসেন। কায়সারকে অপমান করার অর্থ আমার অতিথিকে অপমান করা, আমার অতিথিকে অপমান করার অর্থ আমাকে অপমান করা। জুবায়ের হোসেন আমাকে আমার বাড়ি থেকে উচ্ছেদ করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। না, তারপরও মসজিদের চাঁদা আমি দিই না, কায়সারকে আমার বাড়ি আসতে আমি বারণও করি না।

    মা আমাকে বলেন, ‘তুই যে এমন হুট কইরা চাকরি ছাইড়া দিলি, এখন কি হইব? টাকা পয়সা যা ছিল সব দিয়া ত বাড়ি গাড়ি কিনছস।’

    ‘বাড়ি গাড়ি কি সাধে কিনছি? উপায় ছিল না বইলাই ত কিনছি।’

    ‘এখন চাকরি না থাকলে চলবি কি কইরা?’

    ‘সেইডা তোমার চিন্তা করতে হবে না।’

    মার উদ্বিগ্ন মুখের সামনে থেকে সরে আসি বটে, এই দুশ্চিন্তা কিন্তু আমাকে শকুনের ডানার মত ঢেকে ফেলেছে। কোনও প্রকাশক এখন আমাকে কোনও টাকা পয়সা দেবেন না। কারও কাছে কোনও রয়্যালটির টাকা বাকি পড়ে নেই। বরং আমিই দায়বদ্ধ সবার কাছে। বই লিখে তাঁদের টাকা শোধ করতেই আমার কয়েক বছর লেগে যাবে। বই তো আমি দুদিনে বসে লিখে ফেলতে পারি না। তার ওপর জোর করে নিজেকে দিয়ে আমি লেখাতেও পারি না। যদি না ভেতরে তোলপাড় হয়ে কিছু বেরিয়ে আসে। বসন্তের কুঁড়ি যেমন আপনিতেই ফুল হয়ে ফোটে, তেমন করে ফুটতে হয় আমার শব্দকে। আমি জোর করে ধমক দিয়ে কান মলে বাক্য রচনা করতে পারি না। আসলে আমি তো লেখক নই। যা লিখেছি এতদিন, তা না লিখে আমি পারিনি বলেই লিখেছি। লিখতে গিয়ে আমি কাঁদি। কোনও নারীর দুঃখের কথা লিখছি, লিখতে লিখতে দুঃখিতাটির জন্য অঝোরে কাঁদছি আমি, আমি অনুভব করতে থাকি সেই দুঃখিতা নারীটি আমি নিজে। ফেরা লিখতে গিয়ে চোখ আমার ঝাপসা হয়ে উঠেছে বার বার, নিজেকে আমার মনে হয়েছে আমিই কল্যাণী। কখনও কখনও কষ্ট এমন প্রবল হয়ে ওঠে যে আমি লেখা ছেড়ে উঠে যাই, বিছানায় গিয়ে বালিশে মুখ গুঁজে কাঁদি। যখন নিমন্ত্রণ নামের উপন্যাসটি লিখেছি, আমি অনুভব করেছি আমি সেই বালিকা, প্রেমিক যাকে নিমন্ত্রণ করেছিল, যাকে প্রেমিকসহ সাতজন পুরুষ উপুর্যুপরি ধর্ষণ করেছে। আমি কঁকাতে কঁকাতে, ফুঁপিয়ে কেঁদে কেঁদে সেই ধর্ষণের বর্ণনা করেছি, যেন আমাকেই ধর্ষণ করা হচ্ছে, যেন আমারই যৌনাঙ্গ ছিঁড়ে রক্তের ফিনকি ছুটছে। আমি সত্যি সত্যিই যন্ত্রণা অনুভব করেছি আমারই যৌনাঙ্গে। লিখে শেষ করে, যখন বালিকাটি তার বাড়ির দিকে যাচ্ছে, যাচ্ছে আর ভাবছে, বাড়ি ফিরলে যখন তার বাবা জিজ্ঞেস করবেন, কোথায় গিয়েছিলি? সে তখন একটুও মিথ্যে বলবে না, বলবে আমার নিমন্ত্রণ ছিল। এটুকু লিখে আমি হু হু করে লেখাটির ওপর উপুড় হয়ে কেঁদেছি। অপরপক্ষে যখন যমুনার গল্প লিখছি, লিখতে লিখতে আমি নিজেই যমুনার অস্তিত্ব অনুভব করি আমার ভেতর। যমুনা যখন সন্তান ধারণ করছে এবং ঘোষণা করছে এ তার সন্তান, অন্য কারও নয়, কোনও পুরুষের নয়, তখন আমারই মনে হয় যেন আমিই অন্তসত্ত্বা, আমারই ভেতর বেড়ে উঠছে আমার সন্তান, বিবাহবহির্ভূত সন্তান, যে সন্তানটিকে ভালবেসে বেড়ে উঠতে দিচ্ছি। শোধ গল্পটি লেখার সময় আমি নিজে ঝুমুর হয়ে স্বামী আফজালের ওপর শোধ নিই, গল্পটি লিখে একটি তৃপ্তির হাসি আমার ঠোঁটের কোণে অনেকক্ষণ লেগে থাকে, যে তৃপ্তি ঝুমুর পেয়েছিল, সেই তৃপ্তি। ভ্রমর কইও গিয়া বইএর গল্পটিতে নরাধম নপুংসক স্বামীর সংসার থেকে চলে গিয়ে সকলের ভ্রূকূটি তুচ্ছ করে একা একটি মেয়ে বেঁচে থাকার সংগ্রাম করে, নিজেকে আমার মনে হয়েছে আমি সেই মেয়ে। আমি লেখক নই। ছটা বারোটার নিয়ম করে আমি লিখতে পারি না। আমাকে বসতে হবে লিখতে, এমন কোনও অনুরোধ বা আদেশ আমাকে লেখার জন্য বসাতে পারেনি। অবশ্য অনেক কলাম লিখেছি যেন তেন করে, কিছু ফরমায়েসি লেখা, কিছু লেখা অভাবে পড়ে, না লিখে উপায় ছিল না বলে লেখা। প্রাণ খুঁজে পাইনি ওসব লেখায়। যেহেতু লেখক নই, আমার বাক্যগঠন সঠিক হয় না, আমার বানান গুলো শুদ্ধ হয় না, যেহেতু লেখক নই, গুছিয়ে কোনও ঘটনার বর্ণনা করতে পারি না। আমি জানি আমার সীমিত জ্ঞানের খবর। গ্রামের কোনও কৃষককে ধরে এনে কোনও লোহালককরের কারখানায় কাজ করার জন্য ছেড়ে দিলে যেমন অবস্থা হবে, আমার অবস্থা অনেকটা সেরকম মনে হয় লেখার জগতে। লেখক হওয়ার যোগ্য আমি নই তারপরও লেখক হিসেবে আমার পরিচয়। এই পরিচয়টি ধীরে ধীরে গৌণ থেকে মুখ্য হয়ে উঠেছে। এখন আর অবসরে শখের লেখা লেখার লেখক নই আমি। বিশেষ করে যখন লেখার জন্য এত বছরের চাকরিতে ইস্তফা দিয়েছি। লেখক পরিচয়টিকে ঝেঁটিয়ে বিদেয় করব, এখন তার আর উপায়ও নেই।

    বাড়ি কিনেছি, বাড়িভাড়া দিতে হয় না, খরচ কমার কথা! কিন্তু হিসেব করে দেখি খরচ আরও বেড়েছে। বিদ্যুৎ বিল, টেলিফোন বিল, গ্যাসবিল, সমিতির বিল, ড্রাইভারের বেতন সব মিলিয়ে অনেক। দুশ্চিন্তার চাদরটি, আমি না চাইলেও আমাকে ঢেকে রাখে। মা সেই আগের মতই আমার খরচ বাঁচানোর চেষ্টা করে যাচ্ছেন। কী দরকার ওই সামান্য কিছু জিনিস ময়মনসিংহ থেকে এনে বাবার সাহায্য ছাড়া আমার গতি নেই ধরণের কোনও একটি মিথ্যেকে সুযোগ দেবার কখনও কারও মুখে উচ্চারিত হতে! মাকে বলেছি। বলেও মার এই স্বভাবটি দূর করতে পারিনি। সেদিনও দেখি ময়মনসিংহে গিয়ে বাবাকে অনুরোধ উপরোধ করে অনেকটা চেয়ে ভিক্ষে করে নিয়ে এসেছেন কিছু জিনিস। নান্দাইলের জমি থেকে যে চাল আসে অবকাশে, সেই কিছু চাল, এক বোতল সয়াবিন তেল, কিছু পেঁয়াজ, রসুন। গামছায় বেঁধে দু তিন সের মসুরির ডালও এসেছেন। দুটো লাউ, কিছু পটল, চারটে গাছের নারকেল। সেদ্ধ হওয়া গরমে বাসে করে যাওয়া আসা! ঘামে মার সারা শরীর আঠা আঠা হয়ে আছে। শাড়ি লেপটে আছে আঠার সঙ্গে। আমি দেখি, সেদিন আর বলি না, বলি না যে খামোকাই এনেছেন মা এগুলো। কোনও কোনও সময় সামান্য কিছুই খুব বড় কিছু বলে মনে হয়। কিন্তু কারও করুণায় আমার বাঁচবো কেন! অর্থনৈতিক মেরুদণ্ড ভাঙছে, টের পাচ্ছি। সরকারি চাকরিতে ইস্তফা দিলে তো আমার ডাক্তারি বিদ্যেটি সেই ইস্তফার সঙ্গে চলে যায়নি কোথাও। তাই প্রাইভেট ক্লিনিকগুলোয় ধর্না দিতে থাকি, কোনও ডাক্তার তাদের লাগবে কি না জিজ্ঞেস করি। ডাক্তার লাগবে। মাত্র পাশ করে বেরোচ্ছে এমন অদক্ষ ডাক্তারদেরও তারা নিচ্ছে। আমাকে লুফে নেওয়ার কথা। স্ত্রীরোগ ও প্রসূতিবিদ্যা বিভাগ এবং আ্যানেসথেসিয়া বিভাগে ঢাকা শহরের বড় দুই সরকারি হাসপাতাল মিটফোর্ড আর ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আমার দীর্ঘদিনের কাজের অভিজ্ঞতা শুনে প্রাইভেট ক্লিনিকের ব্যবস্থাপকদের চোখ সোনা পাওয়া খুশিতে নেচে ওঠে। এরপর যে কাজটি তাঁরা করেন, আমার নাম জিজ্ঞেস করেন। নাম শুনে সকলেই পাংশু মুখে বলেন, আপনার নাম ঠিকানা অভিজ্ঞতা ইত্যাদি কাগজে লিখে রেখে যান অথবা চাকরি চেয়ে লিখিত আবেদন করুন, কমিটির বাকি সদস্যের সঙ্গে কথা বলে আমরা আপনাকে খবর দেব। সে খবর পাওয়া আমার আর হয়ে ওঠে না। আমার নাম দেখেই বাতিল করা হয় আমাকে। ডাক্তারের প্রয়োজন হলেও আমাকে প্রয়োজন হয় না কারওর। আমি একটি বাতিল নাম। আমি একটি নিষিদ্ধ নাম।

    ইয়াসমিন অনেকদিন থেকে বলছে ওর জন্য যেন একটি চাকরি যোগাড় করে দিই। শুধু বলছেই না, কাঁদছে। কি করে চাকরির যোগাড় করি ওর জন্য! উদ্ভিদ বিজ্ঞানে ভাল নম্বর পেয়ে অনার্স সহ মাস্টার্স পাশ করা মেয়ের কোনও চাকরি নেই এ দেশে। ঢাকার ইশকুল কলেজগুলোয় উদ্ভিদবিদ্যার শিক্ষিকা হওয়ার আবেদন করেছে, কাজ হয়নি। ওসব জায়গায় ঢুকতে হলে ওপরঅলাদের কৃপা থাকতে হয়। আমাদের ওপরঅলা নেই, মামা চাচা থাকতে হয়, তাও নেই। ইয়াসমিন মন খারাপ করে বসে থাকে। আমার সঙ্গে অনেক লোকের আলাপ আছে ভেবে আমার ওপর নির্ভর করে থাকে ওরা, ইয়াসমিন, মিলন। মিলনও বলছে আদমজী জুট মিলের ওরকম মাছি মারা কেরানির চাকরি ওর ভাল লাগে না। আমি যদি ওর জন্যও ভাল একটি চাকরির ব্যবস্থা করি। কিন্তু আমার নিজের চাকরি খেয়েই নিজে বসে আছি, ওদের জন্য আর কতটা কি করতে পারব! নিজের যেহেতু ক্ষমতা নেই, কাছের দুএকজন মানুষকেই বলি যদি কারও পক্ষে সম্ভব হয় কিছু করা।

    দীর্ঘদিন বলার পর খিরাজখোর কায়সার শেষ পর্যন্ত ইয়াসমিনের জন্য একটি চাকরির খবর দেয়। কায়সার যে কখনও কোনও চাকরির খবর দিতে পারবে, তা আমার ধারণা ছিল না কারণ কথা সে যে কোনওকিছুতে দিয়ে দেয়, নিরানব্বইভাগ কথা সে রাখে না অথবা রাখতে পারে না। বলল কাল সকালে সে আসবেই আসবে, কাল সকাল গিয়ে পরশু সকাল পার হয়, তার দেখা নেই, সপ্তাহ পার হয়, নেই দেখা, দশদিন পর ভর সন্ধেয় হয়ত উদয় হয়। সুতরাং কায়সার কথা দিল যে সে চাকরির খোঁজ করবে, কিন্তু তার ওপর আমাদের কারওরই সত্যিকার ভরসা থাকে না। আর চাকরির খোঁজ দিলেও কেমন ধরণের চাকরি সেটি, তা মোতালেবের চাকরিটি দেখেই অনুমান করা গেছে। সেই যে রুটি বানানোর কারখানায় কাজ দিয়েছিল, মোতালেব সেখানে সাতদিনও টিকতে পারেনি। চোখের সামনে তাকে প্রতিরাতে দেখতে হত কারখানার মালিক মদ খেয়ে মাতাল হয়ে কোনও কারণ ছাড়াই শ্রমিকদের বেধড়ক পেটাচ্ছে। মোতালেব তল্পি তল্পা গুটিয়ে চাকরি ছেড়ে চলে এসেছে। কায়সারের ওপর ভরসা না করলেও সে ঠিক ঠিকই চাকরির খবরটি দেয়। অবশ্য খুব জোরে সোরে দেয় না, কারণ সে নিশ্চিত যে এই চাকরি কারওরই পছন্দ হবে না। বলার পরই নাকচ হয়ে যাবে। চাকরির বৃত্তান্ত শুনে আমি কায়সারকে বলে দিই, ‘অসম্ভব। এই চাকরি করা যাবে না। অন্য কোনও চাকরি পাওয়া যায় কি না দেখ, যেখানে ও তার বোটানির জ্ঞানটা কাজে লাগাতে পারে।’ চাকরিটি ইয়াসমিনেরও পছন্দ হওয়ার কথা নয়। একটি বস্ত্রকল ব্যবসায়ীর প্রাইভেট সেক্রেটারির চাকরি। কি কাজ ওখানে? ফোনে কথা বলবে, মালিক আপিসে আছে কি না নেই এই খবর দেবে লোককে, আর আপিসের কাগজপত্র গুছিয়ে রাখবে। এই করার জন্য এতগুলো বছর ও উদ্ভিদ বিজ্ঞান পড়েছে! কিন্তু আমাকে স্তম্ভিত করে দিয়ে ইয়াসমিন বলে, ‘যে রকমই হোক, আমি করব চাকরি।’ অসহায় তাকিয়ে থাকি বোনটির দিকে।

    মিলনও বলে, ‘ও করুক চাকরি বুবু। আজকাল কি আর যে বিষয়ে পড়ালেখা করে মানুষ, সেই বিষয়ে চাকরি পায়? কেমেস্ট্রিতে মাস্টার্স কইরা ব্যাংকের একাউনটেন্ট হইতাছে না? ফিজিক্সে পড়ছে আমার এক বন্ধু, কোথাও চাকরি নাই। শেষ পর্যন্ত মাদ্রাসার টিচার হইছে। বাংলা সাহিত্যে এম এ পাশ পইড়া কারখানার সুপারভাইজারের পদে কাম লয়। মানুষ করবে কি বুবু? চাকরি ত নাই। তাই যেইডাই পায়, সেইডাই করে। আপাতত করতে থাকুক, পরে ভাল চাকরি পাইলে এইটা ছাইড়া দিবে।’

    আমার চাকরি নেই। ইয়াসমিন তার স্বামী সন্তান নিয়ে আমার বাড়িতে থাকে। মিলন যে টাকা উপার্জন করে তার প্রায় সবটাই বাচ্চার খরচে চলে যায়। ওদের আর কোনও বাড়তি টাকা নেই যে সংসার খরচে সাহায্য করবে। এরকম জীবন ইয়াসমিনকে যন্ত্রণা দেয় তাই যেমনই চাকরিটি, এ সময় যে কোনও চাকরিই যেহেতু সোনার হরিণের মত, লুফে নেয়। চাকরিটি করতে ও সকালে বেরিয়ে যায়, বিকেলে ফেরে। দু হাজার টাকা মাসের শেষে। এ অনেক টাকা ওর কাছে। একদিন লক্ষ করি, ইয়াসমিন আপিসে যাওয়ার সময় খুব সাজে। কড়া কড়া রঙের শাড়ি পরে, চোখে খুব কালো করে কাজল পরে, ঠোঁটে কড়া লাল লিপস্টিক লাগায়। দেখে আমার ভাল লাগে না। বলি, ‘অত সাজস কেন?’

    ইয়াসমিন উত্তর দেয়, ‘কেন, সাজলে অসুবিধা কি?’

    ‘না সাজলে অসুবিধা আছে তর?’

    ‘সবাই সাজে, তাই আমিও সাজি।’

    ‘তুই তো আগে এইরম ভূতের মত সাজতি না। এহন কি হইছে তর?’

    ‘কিছু হয় নাই। আমার সাজা নিয়া তোমার ভাবতে অইব না।’

    ইয়াসমিন গটগট করে হেঁটে বেরিয়ে যায়। একটি দীর্ঘশ্বাসের সঙ্গে আমি দিশেহারার মত দাঁড়িয়ে থাকি। আমি বুঝি, ইয়াসমিন ওর চাকরিটি টিকিয়ে রাখতে চাইছে সেজে। প্রাইভেট সেক্রেটারির কাজে কোনও মেধার দরকার হয়না, যে মেধাটি ওর আছে। দরকার হয় রূপের। সেই রূপ যে ওর আছে অর্থাৎ প্রাইভেট সেক্রেটারি হওয়ার যোগ্যতা যে ওর আছে তা প্রকট করে ওর আপিসের লোকদের দেখাতে চাইছে। যেন আপিসের কেউ কুরূপা কুচ্ছিত বলে ওকে ছাটাই করার কথা ভাবতে না পারে।

    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleকিছুক্ষণ থাকো – তসলিমা নাসরিন
    Next Article উতল হাওয়া – তসলিমা নাসরিন

    Related Articles

    তসলিমা নাসরিন

    লজ্জা – তসলিমা নাসরিন

    August 21, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    আমার মেয়েবেলা – তসলিমা নাসরিন

    August 21, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    উতল হাওয়া – তসলিমা নাসরিন

    August 21, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    কিছুক্ষণ থাকো – তসলিমা নাসরিন

    August 21, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    ভালোবাসো? ছাই বাসো! – তসলিমা নাসরিন

    August 21, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    ভ্রমর কইও গিয়া – তসলিমা নাসরিন

    August 21, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo
    Most Popular

    রূপমঞ্জরী – ২য় খণ্ড – নারায়ণ সান্যাল

    September 3, 2025

    অনুরাধা

    January 4, 2025

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    রূপমঞ্জরী – ২য় খণ্ড – নারায়ণ সান্যাল

    September 3, 2025

    অনুরাধা

    January 4, 2025

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025
    Our Picks

    রূপমঞ্জরী – ২য় খণ্ড – নারায়ণ সান্যাল

    September 3, 2025

    রূপমঞ্জরী – ৩য় খণ্ড – নারায়ণ সান্যাল

    September 3, 2025

    কাঁটায়-কাঁটায় ৫ – নারায়ণ সান্যাল

    September 3, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    Sign In or Register

    Welcome Back!

    Login below or Register Now.

    Lost password?

    Register Now!

    Already registered? Login.

    A password will be e-mailed to you.