Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    রূপমঞ্জরী – ২য় খণ্ড – নারায়ণ সান্যাল

    September 3, 2025

    রূপমঞ্জরী – ৩য় খণ্ড – নারায়ণ সান্যাল

    September 3, 2025

    কাঁটায়-কাঁটায় ৫ – নারায়ণ সান্যাল

    September 3, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • 🔖
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    Subscribe
    সাইন ইন
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    দ্বিখণ্ডিত – তসলিমা নাসরিন

    তসলিমা নাসরিন এক পাতা গল্প779 Mins Read0

    ০৪. তোমাকে পারিনি ছুঁতে, তোমার তোমাকে

    রুদ্রকে নিয়ে যে যৌথজীবনের চমৎকার স্বপ্ন দেখেছিলাম, সে স্বপ্ন-পোড়া-ছাই আমার সর্বাঙ্গে ত্বকের মত সেঁটে থাকে। জানি যে রুদ্রর সঙ্গে জীবন যাপন সম্ভব নয়। জানি যে যার যার জীবনের দিকে আমরা ঘুরে দাঁড়িয়েছি। জানি এখন সব ধুলোকালিছাই ধুয়ে মুছে পরিচ্ছত হওয়ার সময়। তবু সময় গড়াতে থাকে, দিন পুড়তে থাকে নির্জন রোদ্দুরে, রাতগুলো অন্ধকারে তক্ষকের মত ডাকতে থাকে আর উঠোনের উচ্ছিষ কাঠের মত বসে থাকি আমি নিজেকে নিয়ে। এই জীবনকে নিয়ে ঠিক কোনদিকে যাব, কোথায় গেলে নেই নেই করা হু হু হাওয়া আমার দিকে বদ্ধ উন্মাদের মত ছুটে আসবে না বুঝে পাই না। জীবনটিকে একবার পালক আরেক বার পাথর বলে বোধ হতে থাকে। এই যে জীবন, যে জীবনটি খুঁড়োতে খুঁড়োতে এসে শেষ অবদি বসেছে আমার গায়ে, কখনও মোটেও টের পাই না, আবার আমার ঘাড় পিঠ সব কুঁজো হয়ে যায় এই জীবনেরই ভারে। এই জীবনটিকে আমি ঠিক চিনি না, জীবনটি আমারই ছিল অথচ আমার ছিল না। দীর্ঘ দীর্ঘ বছর ধরে আমি এর যা কিছু পানীয় সব ঢেলে দিয়েছি একটি আঁজলায়, নিজের তৃষ্ণার কথা আমার একবারও মনে পড়েনি। পরে কাতর হয়ে হাত বাড়াতে গিয়ে দেখছি জলহীন শুষ্ক মরুর মত পড়ে আছে জীবন। আমারই ঘড়ায় আমার জন্য কিছু অবশিষ্ট নেই। প্রতিদিন সেই আগের মত আবার ঠিক আগের মতও নয়, ডাকপিয়নের শব্দে দৌড়ে যাই দরজায়। কারও কোনও চিঠির জন্য আমি অপেক্ষা করে নেই, জানি। কিন্তু চিঠির ভিড়ে চিঠি খুঁজি, একটি চেনা চিঠি খুঁজি, যে চিঠির শব্দ থেকে একরাশ স্বপ্ন উঠে ঘুঙুর পরে নাচে, যে চিঠির শব্দ থেকে রুপোলি জল গড়িয়ে নেমে আমাকে স্নান করায়। জানি যে আগের মত তার কোনও চিঠি আমি আর কোনওদিন পাবো না, তারপরও ভেতরে গুঁড়ি মেরে বসে থাকা ইচ্ছের! অবাধ্য বালিকার মত হুড়মুড় করে কী করে যেন বেরিয়ে আসে। আসলে এ আমি নই, আমার ভেতরের অন্য কেউ একটি চেনা হাতের লেখা খোঁজে চিঠির খামে। আমি নই, অন্য কেউ চেনা হাতের লেখার চিঠি না পেয়ে দীর্ঘ শ্বাস ফেলে। প্রতিদিন ডাকপিয়নের ফেলে যাওয়া চিঠি হাতে নিয়ে সেই দীর্ঘশ্বাসের শব্দ শুনি আমি। আমার নয়, অন্য কারও। কোথাও কোনও গোপন কুঠুরিতে লুকিয়ে থাকা সেই অন্য কাউকে ঠেলে সরাতে চাই দূরে, পারি না। রুদ্রর চিঠি আমি আর কখনও পাবো না জানি, তবু বার বার ভুলে যাই, প্রতিদিন ভুলে যাই যে পাবো না। ছাইএর ওপর উপুড় হয়ে অপ্রকৃতস্থের মত খুঁজতে থাকি তিল পরিমাণ স্বপ্ন কোথাও ভুল করে পড়ে আছে কি না।

    ফেব্রুয়ারিতে ঢাকার বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গনে বইমেলায় প্রতি বিকেলে হাঁটতে হাঁটতে চেনা কবি সাহিত্যিকের সঙ্গে দেখা হয়, কথা হয়, এমনকী কারও কারও সঙ্গে মেলার ভেতর চায়ের দোকানে বসা হয়, আড্ডা হয়, কিন্তু চোখ খুঁজে ফেরে একটি চেনা মুখ, একজোড়া চেনা চোখ। চোখের তৃষ্ণাটি নিয়ে প্রতিরাতে ঘরে ফিরি। তবে একদিন দেখা মেলে তার, আমার ভেতরের আমিটি আমাকে পা পা করে তার দিকে এগিয়ে নেয়। ইচ্ছে করে বলি, ‘তুমি কি ভাল আছো? যদি ভাল আছ, কি করে ভাল আছ? আমি তো ভাল থাকতে পারি না! এই যে আনন্দ করছ, কি করে করছ? আমি তো পারি না, দীর্ঘ দীর্ঘ দিন পারি না।’ কোনও কথা না বলে তাকে দেখি, বন্ধু বেষ্টিত রুদ্রকে অপলক চোখে দেখি। ইচ্ছে করে বেষ্টন ভেদ করে রুদ্রর সামনে গিয়ে দাঁড়াই, হাত ধরে তাকে নিয়ে আসি, সেই আগের মত দুজন পাশাপাশি হাঁটি মেলার মাঠে। ইচ্ছেগুলো নাড়ি চাড়ি, ইচ্ছেগুলোর সঙ্গে কানামাছি ভোঁ ভোঁ খেলি। ইচ্ছের চোখে কালো রুমাল বেঁধে দিয়ে দৌড়ে পালাই, জিতে গেছি ভেবে অট্টহাসি হাসি। আমার হাসিই, নিজের কানে শুনি কান্নার মত শোনাচ্ছে। রুদ্রর নতুন কবিতার বই বেরিয়েছে, তার আনন্দ আমি কেবল দূর থেকে অনুভব করি। দিয়েছিলে সকল আকাশ, তার নতুন বইটি কিনে যখন বাড়িয়ে দিয়েছি তার দিকে অটোগ্রাফ নিতে, রুদ্র কিছুক্ষণ ঠাণ্ডা চোখে আমাকে দেখে প্রথম পাতায় লেখে, যে কোনও কাউকে। হ্যাঁ, আমি এখন রুদ্রর কাছে যে কোনও কেউ। বইটি হাতে নিয়ে বিমূঢ় দাঁড়িয়ে থাকা আমার ওপর ইচ্ছেগুলো বাঁদরের মত লাফাতে থাকে। ছিঁড়তে থাকে আমাকে। রুদ্র কি জানে কী ভীষণ রকম আমি চাইছি যেন সে আমাকে একবার জিজ্ঞেস করে কেমন আছি আমি, কবে এসেছি ঢাকায়, কতদিন থাকব। চেনা মানুষগুলো সকলেই তো আমাকে জিজ্ঞেস করেছে। রুদ্র কি আমার কম চেনা ছিল! কি করে এমন নিস্পৃহ হতে পারে সে! কেউ কি এত শীঘ্র ভুলে যেতে পারে তার সবচেয়ে আপন মানুষটিকে। প্রশ্নগুলো আমার ইচ্ছেগুলোর কাঁধে সওয়ার হয়ে উৎসবমুখর মেলা ছেড়ে আমার সঙ্গে বাড়ি ফেরে।

    মেলার শেষদিকে রুদ্রর সঙ্গে কথা হয়, চা খাওয়া হয় মুখোমুখি বসে। জিজ্ঞেস করি পায়ের কথা। বলে আগের চেয়ে কম দূরত্ব সে ডিঙোতে পারছে এখন। সিগারেট ছেড়েছো? হেসে বলে, ও ছাড়া যাবে না। আর কিছু ছেড়েছে কি না জিজ্ঞেস করি না। আমার শুনতে ভয় হয় যে বাকি নেশাগুলোও তার পক্ষে ত্যাগ করা সম্ভব নয়। রুদ্র অনেকক্ষণ আমার চোখের দিকে গভীর করে তাকিয়ে থেকে ভারী কণ্ঠে বলে, চল ঝিনেদা চল, কাল ভোরবেলা। আমি যাব কী না, যেতে চাই কী না, কোনও জানতে চাওয়া নয়। তার যেন দাবি আছে আমার ওপর, সেরকম দাবিতেই বলে। যেন রুদ্র জানেই যে আমি যাব। একবার স্পর্শ করলে কেঁদে উঠব অবুঝ বালিকা। কাল ময়মনসিংহে ফেরার কথা আমার, আর হঠাৎ কিনা ঝিনাইদহ যাওয়ার প্রস্তাব। ঝিনাইদহে কবিতার অনুষ্ঠান হচ্ছে, ওখানে আরও কিছু কবি যাচ্ছেন। গতবার, রুদ্রর সঙ্গে আমার যখন বিচ্ছেদ হচ্ছে হচ্ছে, আমরা দুজনই কক্সবাজারে গিয়েছিলাম, সমুদ্রের জলে সিনান করে, তীরের বালুর ওপর সূর্যাস্তের আলোর নিচে বসে কবিতা পড়েছিলাম। কবি মহাদেব সাহা আর নাসির আহমেদ ছিলেন সঙ্গে। লুঙ্গি পাঞ্জাবি পরা মহাদেব সাহা গামছা কাঁধে নিয়ে, লম্বা পান্তলুন পরে রুদ্র আর নাসির আহমেদ আর হলুদ ক্যাঙ্গারু গেঞ্জি আর জিনস পরে আমি জলে নেমেছিলাম, কাপড়ে জল ঢুকে আমাদের শরীর ভারী করে তুলছিল আর ক্ষণে ক্ষণে আমাদের তার নাড়ির দিকে টেনে নিচ্ছিল ভাটির জল। কী চমৎকার সময় কেটেছিল আমাদের! আমি যাব ঝিনাইদহ, এ যাওয়া কোনও উৎসবের আনন্দে শরিক হওয়ার জন্য নয়। এ কেবলই রুদ্রর পাশে থাকার জন্য। তার সঙ্গে বিবাহবিচ্ছেদ ঘটেছে আমার, আমরা আর স্বামী স্ত্রী নই, কিন্তু এই পৃথিবীতে সবচেয়ে কাছের মানুষ কে আছে আমার রুদ্র ছাড়া! বন্ধু কে আর আছে! দীর্ঘ বছর ধরে এক রুদ্রকেই আমি আপন করে তুলেছি, তাকেই আমি আমার জগত করে তুলেছি। রুদ্র আমাকে দুঃখ দিয়েছে জানি, কিন্তু আমি তো এ কথা অস্বীকার করতে পারি না তাকে যে ভাল বাসি। ঝিনাইদহ যাওয়ার বাস ছাড়ে বাংলা একাডেমি থেকে। পথে আমাদের আলাদা জীবনে যা ঘটছে ছোটখাটো ঘটনা দুর্ঘটনা সব বলি পরস্পরকে। একটি কথাই আমি কেবল লুকিয়ে রাখি, আমার কষ্টের কথা। বলি না রোদহীন শীতার্ত সকালগুলো আমাকে কেমন জমিয়ে বরফ করে রাখে। রুদ্র হঠাৎ বলে, কবিতা শুনবে! প্রিয় কবির কবিতা শুনব না, এ কেমন কথা। রুদ্র, বাসে বসে পাশে বসে, পড়ে, দূরে আছো দূরে।

    তোমাকে পারিনি ছুঁতে, তোমার তোমাকে —
    উষ্ণ দেহ ছেনে ছেনে কুড়িয়েছি সুখ,
    পরস্পর খুঁড়ে খুঁড়ে নিভৃতি খুঁজেছি।
    তোমার তোমাকে আমি ছুঁতে পারি নাই।

    যেভাবে ঝিনুক খুলে মুক্তো খোঁজে লোকে
    আমাকে খুলেই তুমি পেয়েছো অসুখ,
    পেয়েছো কিনারাহীন আগুনের নদী।

    শরীরের তীব্রতম গভীর উল্লাসে
    তোমার চোখের ভাষা বিস্ময়ে পড়েছি —
    তোমার তোমাকে আমি ছুঁতে পারি নাই।

    জীবনের পরে রাখা বিশ্বাসের হাত
    কখন শিথিল হয়ে ঝরে গেছে লতা।
    কখন হৃদয় ফেলে হৃদপিণ্ড ছুঁয়ে
    বসে আছি উদাসীন আনন্দমেলায়—

    তোমাকে পারিনি ছুঁতে — আমার তোমাকে,
    ক্ষ্যাপাটে গ্রীবাজ যেন, নীল পটভূমি
    তছনছ করে গেছি শান্ত আকাশের।
    অঝোর বৃষ্টিতে আমি ভিজিয়েছি হিয়া —

    তোমার তোমাকে আজো ছুঁতে পারি নাই।

    বাইরের কৃষ্ণচূড়া গাছের লালের দিকে তাকিয়ে থাকি অনেকক্ষণ, উদাসীন আমাকে ছুঁয়ে ছুঁয়ে যায় লু হাওয়া। রুদ্র তার কবিতার কথা শোনাতে থাকে, ইদানীং সে দুহাতে লিখছে, প্রচুর রাজনৈতিক কবিতা, পাশাপাশি একটি কাব্য নাটকও। রুদ্র তার কবিতার খাতা বের করে নতুন লেখা কবিতাগুলো আমাকে পড়তে দেয়, আমার অনুরোধেই দেয়। লক্ষ্য করি, নিপাত যাক ধ্বংস হোক জাতীয় কবিতা ছাড়া ব্যক্তিগত অনুভবের কবিতাগুলো অন্যরকম, নতুন ধরনের। নতুন ধরনটি ধারণ করতে সময় নেয়, কিন্তু সে যে পুরোনো খাঁচা ভেঙে বেরিয়ে এসেছে, তা অনুভব করে প্রশান্তি আসে। নতুন ধরনটি ধীরে ধীরে একটি স্নিগ্ধ মনোরম জগতে নিয়ে দাঁড় করায়, যে জগতে ব্যক্তি রুদ্র অনেক বেশি আন্তরিক,অনেক বেশি গভীর।

    ঝিনাইদহে আমরা যে যার কবিতা পড়ি মঞ্চে, অসত্যের বিরুদ্ধে, অসাম্যের বিরুদ্ধে, স্বৈরাচার অনাচার অত্যাচারের বিরুদ্ধে সংগ্রামী কবিতা। যার কণ্ঠ যত চিৎকার ওঠে, সে তত বাহবা পায়। যে যত নিকুচি করে সরকারের, সে তত নাম কুড়োয়। এখন এমন হয়েছে যে ব্যক্তিগত সুখদুঃখের কবিতা যারা লেখে, সচেতন মানুষ হিসেবে তাদের গণ্য করা হয় না। রুদ্রকেও দেখেছি সে তার রাজনৈতিক কবিতা নিয়ে যত গর্ববোধ করে, অন্য কবিতা নিয়ে তত নয়। এমন দৈশিক সামাজিক দুঃসময়ে ব্যক্তিক ক্ষুদ্রতা থেকে বেরিয়ে বিশাল আকাশের নিচে মানব বন্ধন রচনা করতে হয়, সম্মিলিত স্বপ্নের গান গাইতে হয়। কবিরা সমাজের বাইরে কোনও আলাদা জীব নয়, অসুস্থ সমাজকে সুস্থ করার দায়িত্ব কবিদেরও। কবিরা এ দেশে খুব জনপ্রিয়, শত শত লোকের ভিড় হয় কবিতার অনুষ্ঠানে, মানুষকে সংগ্রামে উদ্বুদ্ধ করার দায়িত্ব কবিরা নিয়েছেন। রুদ্রও নিয়েছে, স্বৈরাচারি শাসকের বিরুদ্ধে কয়েকটি আগুন আগুন কবিতা পড়ে আসর মাত করে। এমন দৃপ্ত যার কণ্ঠস্বর, এমন যার ক্ষমতা কেবল শব্দগুচ্ছ দিয়ে এক একটি জ্বলন্ত আগ্নেয়গিরি বানিয়ে ফেলার, শীতলতা তাকে কী ভীষণ আবৃত করে রাখে। মঞ্চ থেকে নেমে ধীরে হেঁটে, থেমে থেমে হেঁটে রুদ্র পিছিয়ে পড়ে যখন সবাই মিলে আমরা যাচ্ছি কোথাও! অল্প দূর হেঁটেই পায়ের যন্ত্রণা তাকে বারবারই দাঁড় করিয়ে দিলে কাঁধখানা বাড়িয়ে দিই যেন ভর দিয়ে দাঁড়ায়। বড় অসহায় দেখতে লাগে রুদ্রকে। ইচ্ছে করে তার অসুখগুলো এক ফুঁয়ে ভাল করে দিই, ইচ্ছে করে হাত ধরে দৌড়ে যাই দুটো উদ্দাম, উচ্ছঅল, উষ্ণ হৃদয়, সবার আগে, সামনে। ইচ্ছেগুলো দলিত হতে থাকে অগ্রগামীদের জুতোর তলে। ঝিনাইদহের সাংস্কৃতিক সংগঠনের কর্তার বাড়িতে তখন কবি আসাদ চৌধুরী অসংখ্য গুণগ্রাহী নিয়ে বসে গেছেন আলোচনায়। আলোচনা আজকাল একটিই, এরশাদ। এরশাদের পতন কী করে ঘটানো যায়। রাজনৈতিক দলগুলোর এরশাদ বিরোধী আন্দোলন সঠিক হচ্ছে কী না, হাসিনা খালেদা কারও কোথাও কোনও ভুল হচ্ছে কী হচ্ছে না এসব নিয়ে সূক্ষ্ম বিশ্লেষণ। আলোচনায় অংশ নিতে রুদ্রর আগ্রহ উপচে পড়ে, আমার আগ্রহ হলেও অংশগ্রহণ সম্ভব নয় জানি। আমার মুখে কঠিন কঠিন রাজনীতির শব্দ খুব কম আসে। বিশ্লেষণেও আমি খুব কাঁচা। আর্থ সামাজিক শব্দটির মানে বুঝতেই আমার অনেকদিন লেগেছে। আমি খুব সহজ করে যে জিনিসটি বুঝি তা হল, একটি সুস্থ এবং সুন্দর পরিবেশ তৈরি করতে হলে সবার জন্য অন্ন বস্ত্র বাসস্থান, সবার জন্য শিক্ষা স্বাস্থ্যর ব্যবস্থা করা উচিত। নারী পুরুষের সমান অধিকার, সম্পদের সুষম বণ্টন নিশ্চিত করা উচিত। অন্ধত্ব, গোঁড়ামি, হিংস্রতা, নৃশংসতা থেকে সমাজকে মুক্ত করা উচিত। এই উচিত কাজগুলোর জন্য দক্ষ এবং সৎ নেতৃত্ব প্রয়োজন। কিন্তু কার পক্ষে সম্ভব নেতৃত্ব দেওয়া! কেউ বলছে হাসিনা, কেউ খালেদা। যে যার বিশ্বাসের পক্ষে নানারকম যুক্তি দাঁড় করছে। তবে একটি আশার কথা এই, হাসিনা খালিদা দুজন হাতে হাত রেখে শুরু করেছেন এরশাদ বিরোধী আন্দোলন। দুজনের মুখ দেখাদেখি নেই, একে অপরকে গাল দিচ্ছেন এরকমই দেখে অভ্যস্ত আমরা। কিন্তু গালগাল ভুলে তাঁরা এখন দেশের স্বার্থে জোট বেঁধেছেন। অবশ্য এই জোট বাঁধার পেছনে তাঁদের নিজেদের যত কৃতিত্ব তার চেয়ে বেশি কৃতিত্ব বুদ্ধিজীবিদের। গণতন্ত্রের পক্ষের বুদ্ধিজীবিরা দুই নেষনীকে জোট বাঁধার জন্য প্রেরণা পরামর্শ যা কিছু দরকার দিয়েছেন। কেউ ভুগছে, কেউ ভোগ করছে, কারও কিছু নেই, কারও অঢেল এসব দেখতে দেখতে যদিও গা সওয়া হয়ে গেছে, তবু একটি স্বপ্ন এসে ভর করে আমার চোখে, অন্যায় আর বৈষম্যহীন একটি সমাজের স্বপ্ন। আয়ুঅব্দি জীবনের নিশ্চয়তা। কেবল কিছু মানুষের জন্য নয়, সবার জন্য। ঝিনাইদহে রাত গভীরে হতে থাকে আশায় হতাশায়, স্বপ্নে দুঃস্বপ্নে।

    রাতে অতিথিদের ঘুমোবার আয়োজন হচ্ছে যখন, আমার আর রুদ্রর জন্য আলাদা দুটি ঘরের ব্যবস্থা করা হল, কারণ অতিথিদের একজন বাড়ির কর্তার কানে কানে আমাদের বিয়ে-বিচ্ছেদের খবরটি পৌঁছে দিয়েছেন। রুদ্র আর আমি দুজনই আলাদা ঘরের প্রস্তাব সবিনয়ে প্রত্যাখ্যান করে এক বিছানায় ঘুমোই। অনেক অনেকদিন পর রুদ্র আমাকে স্পর্শ করে গভীর করে। অনেক অনেক দিন পর রুদ্র আমাকে চুমু খায়। অনেক অনেক দিন পর দুজনের শরীর একটি বিন্দুতে এসে মেশে। একবারও আমার মনে হয় না রুদ্র কোনও পরপুরুষ। মনে হয় না যে আমরা এখন পরষ্পরের অনাত্মীয় কেউ, অবন্ধু কোনও। পরদিন ঝিনাইদহে সকাল হয়, লোকে অদ্ভুত চোখে তাকিয়ে থাকে আমার দিকে। কী করে পরপুরুষের সঙ্গে এক ঘরে ঘুমোতে রুদ্রর না হোক, আমার দ্বিধা হল না! আমার হয়নি। যে পাপবোধের কথা অন্যরা ভাবে, সেই পাপবোধের লেশমাত্র আমার মধ্যে নেই। কারও ভ্রুকুঞ্চণ আমাকে স্পর্শ করে না। আমি রুদ্রকে কাগজে পত্রে ত্যাগ করেছি তা ঠিক, তবে কোনও পুরুষকে যদি আমার সবচেয়ে কাছের বলে মনে হয়, সবচেয়ে আপন বলে মনে হয়, সে রুদ্র। এর মধ্যে এক বিন্দু কৃত্রিমতা নেই, এক ফোঁটা মিথ্যে নেই। ভালবাসি এক রুদ্রকেই, যতই তার বিরুদ্ধে আমার অভিযোগ থাকুক না কেন। এই ভালবাসার বোধটি আমি খুব গোপনে গোপনে লালন করি। এই বোধটি আমার একটি হাত নিয়ে রাখে রুদ্রর উষ্ণ কৃষ্ণ হাতে। এই বোধটি একা নিভৃতে বসে থাকে, সংসার যাপনের পরিকল্পনা করে না, ভবিষ্যতের কথা সামান্যও ভাবে না, বোধটি বোধহীন বটে। ঢাকার পথে দুজন যখন কবিতার গল্পে ডুবে যাই, কবিতার দুটি একটি বাক্য পরস্পরকে শোনাচ্ছি, রুদ্র অনেকদিন আগের লেখা একটি কবিতা মুখস্ত বলতে থাকে। তার মনে হয় তার সময়গুলো আসলেই পচে গলে যাচ্ছে।

    ‘খুলে নাও এইসব পোশাক আমার কৃত্রিমতা
    মাংসের ওপরে এই ত্বক, এই সৌন্দর্য মোড়ক
    খুলে নাও দিনের শরীর থেকে রোদের ভূমিকা।
    গলা পিচের মতোন গলে যাচ্ছে মুহূর্ত, সময়,
    গলে যাচ্ছে নারী আর শিশুদের অনাবিল বোধ,
    মানুষের মৌলিক বিশ্বাস, গলে যাচ্ছে ভালবাসা
    আমি ফেরাতে পারি না সভ্যতার অবিরল ক্ষতি,
    আত্মরমনের ক্লেদ, জলে ভাসা পুস্পের সংসার,
    শিশুর মড়ক, আমি ফেরাতে পারি না মহামারি,
    ভ্রুণ হত্যা, অন্ধকারে জ্বলজ্বলে হননের হাত..
    ক্ষমাহীন অক্ষমতা জমে জমে পাহাড় হয়েছে,
    পাহাড়ের পাদদেশে সোনারঙ আলস্যের ধান,
    আর কিছু দলছুট পরাজিত বিবর্ণ মারিচ।
    টুকরো টুকরো করে ছিঁড়ে ফেলো আমার চেতন,
    বিশ্বাসের স্থবির শরীর চাবুকে রক্তাক্ত কর,
    ক্ষুধার্ত সিংহের মুখে ছুঁড়ে দাও আমার আত্মাকে।
    মানুষের মৌলিক মুখোশ আমি খুলতে পারি না,
    শুধু পুড়ে যেতে পারি, পুড়ে যাই, পোড়াই সৌরভ,
    রাতের আগুন এনে নিবেদিত সকাল পোড়াই।’

    পা পা করে একটি কষ্ট উঠে আসছে আমাদের দিকে, স্পষ্ট দেখি। ঝাঁক বেঁধে বিষণ্নতাও আসে। কষ্টকে দূর ছাই হাতে সরিয়ে রুদ্র শিমুল নামের একটি মেয়ের কথা বলে, মেয়েটিকে সে গত বছরই প্রথম দেখে মেলায়, মেয়েটিকে নিয়ে অনেকগুলো কবিতা লিখেছে।

    ‘কি রকম কবিতা?’

    ‘আমারও ইচ্ছে করে বৈশাখের ঝড়ের সন্ধ্যায়
    অন্য কোনো তরুণীর হাত ধরে সুদূরে হারাই,
    বৃষ্টি ও বাতাসে মেলি যুগল ডানার স্বপ্ন।
    আমারও ইচ্ছে করে ফুটে থাকি অসংখ্য শিমুল।’

    ‘তারপর?’

    ‘দুপুরের রোদে পোড়া চিবুকের উদাসীন তিল
    ছুঁয়ে দিতে ইচ্ছে করে ভালবাসা, নীল চোখ, চাঁদের শরীর
    আমারও ইচ্ছে করে আঙুলে জড়াই মিহি স্মৃতি,
    স্বপ্নের কপাল থেকে ঝরে পড়া চুলগুলো আলতো সরাই।’

    ‘আর কী কী ইচ্ছে করে?’

    ‘ইচ্ছে করে নগরের নিয়ন্ত্রিত পথে
    সমস্ত নিষেধ মানা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে
    সড়কের মাঝখান বেয়ে হেঁটে যাই
    আমারও ইচ্ছে হয় কাঁদি।’

    ‘এ তো সুখের কথা। এতে কাঁদার কি হল? কাঁদবে কেন?’

    রুদ্র হেসে বলে, ‘আরে শোনোই না।’

    আমিও হাসি বলতে বলতে, ‘আরে বলই না।’

    ‘আমারও ইচ্ছে করে খুলে দিই হাতকড়া বাঁধা হাত,
    চক্রান্তের খল বুকে কামড় বসাই।
    আমারও ইচ্ছে করে
    টুকরো টুকরো করে কেটে ফেলি তোমার শরীর।’

    ‘ছি ছি, এমন কসাইএর মত কথা বলছো কেন? কার শরীর টুকরো টুকরো করতে ইচ্ছে হয় তোমার?’ আমার বঙ্কিম চাহনী বঙ্কিম ওষ্ঠে এসে সরস হতে না হতেই রুদ্র বলে,

    ‘দৃশ্যকাব্যগুলো পড়েছো? শিমুলকে নিয়ে লেখা।
    আমি তোমার নাম জানি না,
    দেখলে চিনি।
    এখন আমি কোথায় গিয়ে খুঁজবো তোমায়?
    খুঁজতে খুঁজতে কোথায় যাবো?

    সিরামিকের গাছগাছালি,
    ইটের ঝাউ বনের ভেতর
    কোথায় আমি খুঁজবো তোমায়?

    কোথায় তোমার সৌম সকাল, শান্ত দুপুর?
    কোথায় তোমার মুখর বিকেল, একাকি রাত?
    খুঁজবো কোথায়–ঝরা পাতায় সাজানো ঘাস
    সন্ধ্যাবেলায়? কোথায় খুঁজবো?’

    আমি বলি, ‘অনেক খুঁজেছো, দৃশ্যকাব্য দুইএ তোমার ঘুমও যে মেয়েটিকে খুঁজতে গেছে, সকালে টের পেয়েছো। দৃশ্যকাব্য তিনেও তাকে খুঁজে বেড়াচ্ছে!। নদী পেরোচ্ছে!, সাগর পেরোচ্ছে!, বিস্তৃত মাঠ পেরোচ্ছে!, পাহাড় পর্বত বন বাদাড় সব খুঁজছো, এমনকি আকাশেও খুঁজছো, এত খুঁজে খুঁজে শেষ পর্যন্ত পেয়েছো তাকে?’

    রুদ্রর মুখে অমলিন হাসি। বলে সে পেয়েছে তাকে খুঁজে। শিমুলকে। শিমুল নাকি একটুখানি চেয়েছিল প্রথম প্রথম। অত বেশি নিজেকে খুলতে চায় নি। শিমুলের দুপুরগুলো রুদ্র তখন উড়িয়ে দিতে বলছে।

    ‘মেলার মধ্যে একটুখানি খোলামেলা
    একটুখানি কেন?
    খোলামেলা একটুখানি কেন?
    খুলতে পারো হৃদয় তোমার সমস্তটুক,
    দেবদারু চুল খুলতে পারো
    ভুরুর পাশে কাটা দাগের সবুজ স্মৃতি
    স্বপ্ন এবং আগামীকাল এবং তোমার
    সবচে গোপন লজ্জাটিও খুলতে পারো।
    উড়িয়ে দিতে পারো তোমার স্মৃতির ফসিল—
    উড়িয়ে দাও দুপুর তোমার শিমুল তুলো,
    মেঘের খোঁপায় মুখর বিকেল উড়িয়ে দাও,
    উড়িয়ে দাও ব্রীজের নিচের য়চ্ছ জলে
    স্বপ্নলেখা সবুজ কাগজ।
    এ বৈশাখে হাত মেলে চাও ঝড়ের ঝাপটা,
    ভেজা মাটির গন্ধে ফেলে পায়ের আঙুল
    এ বৈশাখে হাত মেলে চাও জীবন বদল।’

    হঠাৎ কী হয় জানি না, চোখ ভিজে ওঠে কী! জানালায় তাকিয়ে আড়াল করি ভেজা চোখ। খোলা জানালা গলে হাওয়ার সঙ্গে ধুলো আসছে উড়ে, যেন সেই ধুলো চোখে পড়েছে বলে দ্রুত মুছে নিচ্ছি, এমন করে মুছি জল। রুদ্রকে বুঝতে দিই না আমার কোনও কষ্ট হচ্ছে। আমার তো কোনও কষ্ট হওয়ার কথা নয়। কেন হবে! রুদ্রর আর আমার জীবন এখন আলাদা। এখন সে কারও প্রেমে পড়তেই পারে, কাউকে সে বিয়ে করতেই পারে।

    হেসে, যেন রুদ্রর এই প্রেম আমাকে বেশ আনন্দ দিচ্ছে, সুখে আমি ফেটে পড়ছি, এমন স্বরে এবং ভঙ্গিতে বলি, জীবন বদল করতে রাজি মেয়েটি?

    রুদ্র বলে যে হ্যাঁ শিমুল বিয়েতে রাজি, তবে কিছুদিন অপেক্ষা করতে বলছে।

    দুজন খুব ঘুরে বেড়াচ্ছো?

    তা বেড়াচ্ছি।

    শিমুল কেমন দেখতে?

    অল্প বয়স। সুন্দরী।

    বাহ।

    বাহ কি?

    বেশ ভালো।

    রুদ্রর চোখে অপরূপ দীপ্তি। তির তির করে স্বপ্ন কাঁপছে দুটি চোখে।

    চুমু খেয়েছো?

    খেয়েছি।

    শুয়েছো?

    চেয়েছিল। আমিই না বলেছি।

    তুমি না বলেছো! বল কি? কারণ কি?

    বলেছি, বিয়ের আগে শোবো না!

    মেয়েটি সত্যি সত্যি শুতে চেয়েছে?

    হ্যাঁ, সত্যি।

    অবাক হই শুনে। বাঙালি মেয়ে বিয়ের আগে আগ বাড়িয়ে যৌন সম্পর্ক করতে চায় প্রেমিকের সঙ্গে, এমন শুনিনি।

    তারপর?

    তারপর কি?

    শিমুলকে সত্যিই ভালবাসো?

    রুদ্র তাকায় আমার চোখে। চোখে ফুটে আছে অসংখ্য শিমুল। চোখ সরিয়ে নিয়ে জানালায়, বাইরের ফুটে থাকা কৃষ্ণচূড়া দেখতে দেখতে, কী জানি কোথাও সে শিমুল খুঁজছে কি না, সুখ-সুখ গলায় বলে, বাসি।

    ঠিক?

    ঠিক।

    কেন জিজ্ঞেস করলে? রুদ্র জিজ্ঞেস করে।

    আমি জানালার ওপারে ফসল উঠে যাওয়া নিঃস্ব ক্ষেতের দিকে তাকিয়ে বলি, না এমনি। রুদ্রকে হঠাৎ করে খুব দূরের মানুষ বলে মনে হয়। বন্ধু সে আমার, কিন্তু যেন কাছের কোনও বন্ধু নয়। আপন সে আমার, কিন্ত তত যেন আপন নয়।

    গভীর রাতে ঢাকা পৌঁছোলে রুদ্র তার বাড়িতে নিয়ে যায় বাকি রাতটুকু কাটাতে। ইন্দিরা রোডেই রুদ্র একটি নতুন বাড়ি ভাড়া নিয়েছে। দোতলায় রুদ্রর পেছন পেছন উঠে সোজা তার ঘরে ঢুকি। অচেনা ঘর, অচেনা ঘরটি অচেনারকম করে সাজানো। তবে আমাদের সেই আগের বিছানাটিই আছে, বিছানায় আগের চাদর, আগের নীল মশারি। সব চেনা। কিন্তু কোথায় যেন খুব অচেনা কিছু। বাকি রাতটুকু ঘুমন্ত রুদ্রর পাশে নির্ঘুম কাটাই। রুদ্রর সঙ্গে শরীরের সম্পর্ক অনেকের ছিল, ওদের সঙ্গে মনের সম্পর্ক কখনও হয়নি, সবসময় সে বলেছে ওদের কাউকে সে ভালবাসে না। এখন কী নিদ্বির্ধায় রুদ্র বলে, কাউকে সে ভালবাসে, কী অবলীলায় তার ভালবাসার গল্প আমাকে শোনায় সে! আলোঅন্ধকারে ঢেকে থাকা ঘরটিকে আবার দেখি, এ ঘরে নিশ্চয়ই শিমুল এসে বসে, শিমুলের চোখের দিকে রুদ্র তার ভালবাসায় কাঁপা চোখদুটো রাখে।

    সকাল হলে শুয়ে থাকা রুদ্রর পাশে বসে কপালে দুটো চুমু খেয়ে, ঘন চুলগুলোয় আঙুলের আদর বুলিয়ে বলি, ভাল থেকো। রুদ্র মাথা নাড়ে, সে ভাল থাকবে। বলে, তুমিও ভাল থেকো। রুদ্রকে বিছানায় রেখেই আমি যাই বলে বেরিয়ে যাই। আমার তো যাওয়ারই কথা ছিল।

    রাস্তায় বেরিয়ে একটি রিক্সার জন্য হাঁটতে থাকি। ভোরের স্নিগ্ধ হাওয়া আমাকে স্পর্শ করছে, অথচ মনে হচ্ছে বৈশাখি কালো ঝড় আমার ভেতরের সবকিছু ওলোট পালোট করে দিচ্ছে, সব বুঝি ভেঙে দিচ্ছে আমার যা ছিল, নিঃস্ব করে দিচ্ছে আমাকে। বড় একা লাগে, কী জানি কেন, বড় একা লাগে। মনে হয় রাস্তায় একটি প্রাণী নেই, আমি একা হেঁটে যাচ্ছি কোথাও, কোথায় যাচ্ছি তা জানি না, কেবল হাঁটছি, পেছনে দৌড়োচ্ছে স্মুতি, ঝাঁক ঝাঁক স্মৃতি। ময়মনসিংহের সেই দিনগুলো দৌড়োচ্ছে, কলেজ ক্যাম্পাস, ক্যান্টিন, প্রেস ক্লাব, বোটানিক্যাল গার্ডেনের সেইসব দিন, সেই তীব্র তুমুল ভালবাসার দিনগুলো। ভালবাসার সুতোয় গাঁথা সেই স্বপ্নগুলো। স্মৃতিরা আমাকে এমন করে পেছন থেকে জাপটে ধরে, নিজেকে ছাড়াতে এত চেষ্টা করি, পারি না। অক্টোপাসের মত স্মৃতির হাতগুলো আমার কণ্ঠ চেপে ধরে, নিঃশ্বাস নিতে আমার কষ্ট হতে থাকে।

    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleকিছুক্ষণ থাকো – তসলিমা নাসরিন
    Next Article উতল হাওয়া – তসলিমা নাসরিন

    Related Articles

    তসলিমা নাসরিন

    লজ্জা – তসলিমা নাসরিন

    August 21, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    আমার মেয়েবেলা – তসলিমা নাসরিন

    August 21, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    উতল হাওয়া – তসলিমা নাসরিন

    August 21, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    কিছুক্ষণ থাকো – তসলিমা নাসরিন

    August 21, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    ভালোবাসো? ছাই বাসো! – তসলিমা নাসরিন

    August 21, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    ভ্রমর কইও গিয়া – তসলিমা নাসরিন

    August 21, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo
    Most Popular

    রূপমঞ্জরী – ২য় খণ্ড – নারায়ণ সান্যাল

    September 3, 2025

    অনুরাধা

    January 4, 2025

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    রূপমঞ্জরী – ২য় খণ্ড – নারায়ণ সান্যাল

    September 3, 2025

    অনুরাধা

    January 4, 2025

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025
    Our Picks

    রূপমঞ্জরী – ২য় খণ্ড – নারায়ণ সান্যাল

    September 3, 2025

    রূপমঞ্জরী – ৩য় খণ্ড – নারায়ণ সান্যাল

    September 3, 2025

    কাঁটায়-কাঁটায় ৫ – নারায়ণ সান্যাল

    September 3, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    Sign In or Register

    Welcome Back!

    Login below or Register Now.

    Lost password?

    Register Now!

    Already registered? Login.

    A password will be e-mailed to you.