Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    রবিনসন ক্রুসো – ড্যানিয়েল ডিফো

    August 19, 2025

    দ্য দা ভিঞ্চি কোড – ড্যান ব্রাউন

    August 19, 2025

    এঞ্জেলস এন্ড ডেমনস – ড্যান ব্রাউন

    August 19, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • 🔖
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    Subscribe
    সাইন ইন
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    দ্য দা ভিঞ্চি কোড – ড্যান ব্রাউন

    ড্যান ব্রাউন এক পাতা গল্প600 Mins Read0

    ০২. উঁয়ে প্লাঁসোইতোরি নিউমেরিক

    উঁয়ে প্লাঁসোইতোরি নিউমেরিক? বিবর্ণ মুখে ফশে অবিশ্বাসে সোফির দিকে চেয়ে আছে। একটা ঠাট্টা? সনিয়ের কোডের ব্যাপারে আপনার পেশাগত মূল্যায়ন হলো, এটা একধরনের গাণিতিক ঠাট্টা?

    ফশে এই মেয়েটার ধৃষ্টতায় বিস্মিত। তার অনুমতি ছাড়া সে এইমাত্র এখানে এসে যা করছে শুধু সেটাই নয়, বরং মেয়েটা এখন তাকে এই বলে বিশ্বাস করতে বলছে যে, সনিয়ে তার অন্তিম মুহূর্তে একটা গাণিতিক প্রহেলিকা রেখে গেছেন?

    এই কোডটা, সোফি ফরাসিতে দ্রুত বলে গেলো, একেবারেই অর্থহীন একটা জিনিস। জ্যাক সনিয়ে অবশ্যই জেনে থাকবেন যে, আমরা খুব দ্রুতই এখানে এসে এটা এভাবেই দেখবো। সে সোয়েটারের পকেট থেকে একটা দোমড়ানো কাগজ বের করে ফশের হাতে তুলে দিলো। এখানেই এটার পাঠোদ্ধারের বিষয়টা আছে।

    ফশে লেখাটার দিকে তাকালো।

    ১-১-২-৩-৫-৮-১৩-২১

    এই? সে ফুঁসে উঠলো। আপনি কেবল সংখ্যাগুলো ছোট থেকে বড়তে সাজিয়েছেন।

    সোফির নার্ভ খুব শক্ত, সে একটা সম্ভষ্ট হবার হাসি দিলো। একদম ঠিক। ফশে বিড়বিড় করে আপন মনে বকতে শুরু করলো।

    এজেন্ট নেভু, আপনি এসব নিয়ে কতদূর যাবেন, সে ব্যাপারে আমার কোন ধারণাই নেই, তবে আপনাকে উপদেশ দিচ্ছি, ওখানে খুব দ্রুত যান। সে ল্যাংডনের দিকে উদ্বিগ্ন দৃষ্টিতে তাকালো। সে কানে ফোনটা চেপে অদূরেই দাঁড়িয়ে আছে। ল্যাংডনের ফ্যাঁকাশে মুখের দিকে তাকিয়ে, ফশে আঁচ করতে পারলো খবরটা খারাপই হবে।

    ক্যাপ্টেইন, সোফি বললো, তার কণ্ঠ বিপজ্জনকভাবেই উদ্ধত। আপনার হাতে যে সংখ্যাগুলো আছে সেটা খুবই বিখ্যাত আর ঐতিহাসিক একটা সখ্যক্রম।

    ফশে এ ব্যাপারে সচেতন ছিলো না যে, পৃথিবীতে কোন সংখ্যাক্রম বিখ্যাত হয়ে থাকতে পারে। সে সোফির কথাটা পাত্তাই দিলো না।

    এটা ফিবোনাচ্চি সংখ্যাক্রম, সোফি জানালো, ফশের হাতে ধরে থাকা কাগজটার দিকে মাথা নেড়ে ইঙ্গিত করলো সে। এটা এমন একটি সংখ্যাক্রম, যার পূর্বের দুটি সংখ্যার যোগ ফল হলো তৃতীয় সংখ্যাটির সমান।

    ফশে সংখ্যাগুলো ভালো করে দেখে নিলো। কথাটা সত্যি। তারপরেও সে বুঝতে পারলো না, এর সাথে সনিয়ের মৃত্যুর সম্পর্ক কী।

    ত্রয়োদশ শতাব্দীতে গণিতশাস্ত্রবিদ লিওনার্দো ফিবোনাচ্চি এই সংখ্যাক্রম তৈরি করেছিলেন। নিশ্চিতভাবে সনিয়ের লেখা সংখ্যাগুলোর সবটাই ফিবোনাচ্চি সংখ্যা হওয়টা কোন কাকতালীয় ব্যাপার নয়।

    ফশে তরুণীর দিকে কয়েক মুহূর্ত চেয়ে রইলো। চমক্কার, যদি এটা কাকতালীয় ব্যাপার না-ই হয়ে থাকে, তাহলে আপনি কি আমায় বলবেন, কেন জ্যাক সনিয়ে এটা বেছে নিলেন। তিনি কি বলতে চাচ্ছেন? এটার মানেই বা কি?

    মেয়েটা কাঁধ ঝাঁকালো। একেবারে কিছুই না। এটাই হলো আসল কথা। এটা খুব সরল একটা ক্রিপটোগ্রাফিক জোক। অনেকটা বিখ্যাত কোন কবিতার কিছু শব্দ নিয়ে, সেগুলো এলোমেলো করে মিশিয়ে, কাউকে খুঁজে বের করতে বলা।

    ফশে খুবই আক্রমনাত্মকভাবে কয়েক পা সামনে এগিয়ে গেলো। সোফির চেহারা থেকে তার মুখটা মাত্র কয়েক ইঞ্চি দূরে। আমি নিশ্চিত করেই আশা করি যে, এসবের চেয়ে আরো ভালো ব্যাখ্যা আপনি আমাকে দেবেন।

    ক্যাপ্টেনের এভাবে সামনে ঝুকে আসাতে সোফির নরম চেহারাটা বিস্ময়ে হতবাক হলো। ক্যাপটেন, আজরাতের এখানকার যে বিপদ সেটা বিবেচনা করুন, আমার মনে হচ্ছে, আপনি এটা জেনে বিশ্বাস করবেন যে, জ্যাক সনিয়ে আপনার সাথে হয়তো খেলা খেলছেন। আসলে তা নয়। আমি ক্রিপটোগ্রাফির পরিচালককে জানিয়ে দেবো, আপনার আর আমাদেরকে প্রয়োজন নেই।

    এটা বলেই সে যে পথ দিয়ে এসেছিলো সেদিকে ঘুরে চলে গেলো।

    হতবাক হয়ে ফুশে চেয়ে চেয়ে দেখে মেয়েটা অন্ধকারে অদৃশ্য হয়ে গেলো। মেয়েটার কি মাথা খারাপ হয়ে গেলো? সোফি নেভু এইমাত্র যা করলো তা আর কিছু না, স্রেফ লো সুইসাইড প্রফেশনাল।

    ফশে ল্যাংডনের দিকে ঘুরে দেখলো সে এখনও ফোনে কথা শুনেই যাচ্ছে, আগের চেয়েও বেশি মনোযোগী আর চিন্তিত মনে হলো তাকে। খুব মনোযোগ দিয়েই সে ফোনের মেসেজটা শুনে যাচ্ছে। ইউ এস এ্যামবাসি। বেজু ফশে অনেক কিছুই ঘৃণা করে…কিন্তু ইউএস এ্যামবাসির ওপর তার যতোটা রাগ ততোটা খুব কম জিনিসের ওপরই।

    ফশে এবং এ্যামবাসেডর নিয়মিতই একে অপরকে মোকাবেলা করে থাকে পররাষ্ট্রবিষয়ক কিছু বিষয় নিয়ে তাদের সবচাইতে সাধারণ যুদ্ধটা বাঁধে ফ্রান্সে আগত আমেরিকানদের সাথে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার আচরণ নিয়ে। প্রায় প্রতিদিনই, ডিসিপিজে আমেরিকান ছাত্রদেরকে মাদকসহ গ্রেফতার করে থাকে। আমেরিকান ব্যবসায়ীরা অল্পবয়স্কা পতিতাসহ এবং আমেরিকান পর্যটকরা দোকান থেকে চুরির দায়ে অথবা ভাঙচুরের জন্য গ্রেফতার হয়ে থাকে। বৈধভাবেই ইউএস এ্যামবাসি অভিযুক্ত নাগরিকদেরকে নিজের দেশে বিচারের জন্য পাঠিয়ে দেয়, যেখানে তাদেরকে একটা থাপ্পর মারা ছাড়া আর কিছুই করা হয় না।

    আর এই কাজটা এ্যামবাসি বিরামহীনভাবেই করে থাকে।

    লো মাসকুলেশন দ্য লা পুলিশ জুডিশিয়ার, ফশে একে এভাবেই অভিহিত করে থাকে। প্যারিস ম্যাচ সম্প্রতি একটা কার্টুন ছেপেছে, যাতে ফশেকে পুলিশের কুত্তা হিসেবে দেখানো হয়েছে, কুত্তাটা এক আমেরিকানকে কামড়াতে চেষ্টা করছে, কিন্তু তার শেকল ইউএস এ্যামবাসিতে বাধা, তাই সে কামড়াতে পারছে না।

    আজ রাতে আর সেটা হচ্ছে না, ফশে মনে মনে বললো। অনেক বড় বিপদে পড়েছে আজকে।

    রবার্ট ল্যাংডন ফোনটা রেখে দিলো। তাকে খুব অসুস্থ দেখাচ্ছে।

    সবকিছু কি ঠিক আছে? ফলে জিজ্ঞেস করলো।

    ক্লান্ত ভঙ্গীতে ল্যাংডন মাথা নাড়লো।

    দেশ থেকে খারাপ খবর এসেছে, ফশে অনুমান করলো, খেয়াল করে দেখলো ল্যাংডন ঘামছে।

    একটা দুর্ঘটনা, ল্যাংডন ফশের দিকে অদ্ভুত ভঙ্গীতে তাকিয়ে তোতলাতে তোতলাতে বললো, এক বন্ধু… সে একটু ইতস্তত করলো। সকালের প্রথমই দিকেই আমাকে দেশের ফ্লাইটটা ধরতে হবে।

    ল্যাংডনের চেহারায় যে অভিব্যক্তি দেখা যাচ্ছে সেটা যে সত্যি, সে ব্যাপারে ফশের কোন সন্দেহ ছিলো না। তার পরও, তার কাছে মনে হলো ল্যাংডনের মনে অন্য কিছুও আছে, যেনো একটা দূরবর্তী ভয় আমেরিকানটার চোখে মুখে জেঁকে বসেছে। খবরটা শুনে আমি দুঃখিত, ল্যাংডনকে খুব ভালো করে দেখে কশে বললো। আপনি কি একটু বসবেন? সে গ্যালারির একটা ভিউয়িং বেঞ্চের দিকে ইঙ্গিত করে বললো।

    ল্যাংডন উদাসভাবে মাথা নেড়ে কয়েক ফিট দূরের একটা বেঞ্চের কাছে গিয়ে একটু থামলো। প্রতিটি মুহূর্তে তাকে আরো বেশি দ্বিধাগ্রস্ত বলে মনে হচ্ছে। আসলে, আমার মনে হচ্ছে বিশ্রামঘরটা একটু ব্যবহার করি।

    ফশে ভুরু তুললো একটু। বিশ্রাম ঘর। অবশ্যই। ঠিক আছে, কয়েক মিনিটের বিরতি নেয়া যাক তবে। সে বিশ্রাম ঘরটার দিকে আঙ্গুল তুলে দেখিয়ে দিলো। বিশ্রাম ঘটা কিউরেটরের অফিসের ঠিক পেছন দিকেই।

    ল্যাংডন একটু ইতস্তত করলো। অন্যদিকে ইঙ্গিত করে দেখালো, গ্যালারির করি ডোরের দিকে। আমার মনে হয় আরো কাছ একটা বিশ্রামঘর আছে, ওখানে।

    ফশে বুঝতে পারলো ল্যাংডন ঠিকই বলছে। গ্র্যান্ড গ্যালারির শেষ মাথায় দুটো বিশ্রামঘর আছে। আমি কি আপনার সাথে আসবো?

    ল্যাংডন মাথা নেড়ে সায় দিয়ে রওনা দিতে উদ্যত হলো। না, তার আর দরকার নেই। আমার মনে হয়, আমার কয়েক মিনিট একা থাকা দরকার।

    ল্যাংডনের একা চলে যাওয়াতে ফশে তেমন চিন্তিত হলো না। কারণ, সে জানে ল্যাংডন এখান থেকে কোনভাবেই বের হতে পারবে না সবগুলো ফটকেই পাহাড়া বসানো আছে। এমনকি ফায়ার-স্কেপ সিঁড়িগুলোও নজরে রাখা আছে। ডিসিপিজের এজেন্টরা ভেতরে, বাইরে, চারদিকেই আছে। ল্যাংডন ফশেকে ফাঁকি দিয়ে কোথাও যেতে পারবে না। এটা একেবারেই অসম্ভব।

    আমাকে মি. সনিয়ের অফিসে ফিরে যেতে হচ্ছে কিছুক্ষণের জন্য। ফশে বললো। দয়া করে সেখানেই সোজা চলে আসুন, মি. ল্যাংডন। আমাদের আরো অনেক ব্যাপারে কথা বলার দরকার রয়েছে।

    ল্যাংডন নিরবে চলে গেলো অন্ধকারের মধ্যেই।

    ল্যাংডন চলে যেতেই ফশে রেগে ফেটে পড়লো। গ্র্যান্ড গ্যালারির সনিয়ের অফিসটা এখন কমান্ডসেন্টার, সেখানে ধুম করে ঢুকে পড়লো সে।

    সোফি নেভুকে এই বিল্ডিংয়ে ঢোকার অনুমতি কে দিয়েছে! ফশে দাঁতে দাঁত চেপে বললো।

    কোলেই প্রথমে জবাব দিলো, সে বাইরের গার্ডদের বলেছিলো যে, সে কোডটার অর্থ বের করে ফেলেছে।

    ফশে চারপাশটা এক ঝলক তাকিয়ে দেখলো। সে কি চলে গেছে?

    সে আপনার সাথে নেই?

    না, সে চলে গেছে। ফশে অন্ধকার হলওয়ের দিকে তাকালো। সোফির এমন কোন স্বভাব নেই যে, যাবার পথে অন্য অফিসারদের সাথে গল্পগুজব কবে, কথা বলবে। তার ইচ্ছে হচ্ছিলো নিচের গর্দভদের ওয়্যারলেস করে বলবে সোফিকে আটকাতে। কিন্তু এই চিন্তাটা বাদ দিলো ফশে। আজরাতে ইতিমধ্যেই সে অনেক উল্টাপাল্টা করে ফেলেছে।

    এজেন্ট নেভুর সাথে পরে খেলা যাবে, মনে মনে বললো সে। মেয়েটাকে গুলি করতে ইচ্ছে হচ্ছিলো তার।

    সোফিকে মন থেকে ঝেড়ে ফেলে, ফশে কয়েক মুহূর্ত সনিয়ের ডেস্কে রাখা নাইট মূর্তিটার দিকে তাকালো, তারপর কোলেতের দিকে ফিরলো। তাকে পেয়েছো?

    কোলেত একটা ইতিবাচক ভঙ্গী করে ল্যাপটপ কম্পিউটারটা তার দিকে ঘুরিয়ে দিলো। লাল বিন্দুটা এই ভবনের মানচিত্রের একটা জায়গায় পরিষ্কার বিপ করছে। যে ঘরটাতে সেটা জ্বলছে সেটাতে পাবলিক টয়লেট লেখা।

    বেশ, একটা সিগারেট ধরিয়ে ফশে বললো, আমাকে একটা ফোন করতে হবে। আর ল্যাংডন যেনো শুধুমাত্র বিশ্রাম ঘরেই যেতে পারে সেটা একদম নিশ্চিত করে রেখো। অন্য কোথাও যেনো সে না যেতে পারে।

     

    ১২.

    গ্র্যান্ড গ্যালারির শেষ মাথায় পৌঁছে রবার্ট ল্যাংডনের মনে হলো তার মাথাটা, একেবারে হালকা হয়ে গেছে। সোফির ফোন মেসেজটা তার মাথায় বার বার বাজতে লাগলো। করিডোরের শেষ মাথায়, জ্বলজ্বলে একটা সাইনে বিশ্রামঘরের আন্তর্জাতিক একটা প্রতীক আঁকা আছে, সে একটা ঘোরের মধ্য দিয়ে এগিয়ে গেলো সেটার দিকে। বিশ্রামঘরটা ইতালিয়ান চিত্রের সারি সারি ক্যানভাসের এক ফাঁকে যেনো লুকিয়ে আছে।

    পুরুষের চিহ্ন দেয়া দরজাটা খুঁজে ল্যাংডন ভেতরে প্রবেশ করেই বাতি জ্বালালো।

    ঘরটা খালি।

    সিঙ্কের কাছে গিয়ে ঠাণ্ডা পানি দিয়ে সে মুখে ঝাঁপটা দিলো। ঘোরটা কাটাতে চেষ্টা করলো। কড়া ফুরোসেন্টের আলো চচ্চকে টাইলসে জ্বলজ্বল করছে। ঘরটাতে এমোনিয়ার গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। তোয়ালে দিয়ে মুখটা মুছতেই ঘরের দরজাটা খট করে খুলে গেলে খুব চমকে গেলো সে।

    সোফি নেভু ঢুকলো। তার সবুজ চোখে ভয়ের আভা। ধন্যবাদ ঈশ্বরকে, আপনি এসেছেন। আমাদের হাতে বেশি সময় নেই।

    ল্যাংডন সিঙ্কের পাশে দাঁড়িয়ে ডিসিপিজের ক্রিপ্টোগ্রাফার সোফি নেভুর দিকে বিস্ময়ে চেয়ে আছে।

    মাত্র মিনিটখানেক আগে ল্যাংডন ফোনে তার মেসেজাটা শুনেছে। ভাবছিলো এই ক্রিপ্টোগ্রাফার ভদ্রমহিলা নির্ঘাত পাগল। তারপর যতোই সোফি নেভুর কথা সে শুনছে, ততোই তার মনে হচ্ছে মেয়েটা সততার সাথেই কথা বলছে। এই মেসেজটা শুনে প্রতিক্রিয়া দেখাবেন না। ঠাণ্ডা মাথায় গুধ গুনে যান। আপনি এখন বিপদে আছেন। আমার কথা মনোেযোগ দিয়ে শুনুন।

    অনিশ্চয়তা বোধ করলেও, ল্যাংডন সিদ্ধান্ত নিলো সোফি যা বলবে ঠিক তা-ই করবে। সে ফশেকে বলেছে যে, ফোনের মেসেজটা তার নিজের দেশের একজন আহত বন্ধুর পাঠানো। তাকে দেশে ফিরে যেতে বলা হয়েছে। তারপর সে বিশ্রামঘর ব্যবহার করার কথা বলেছে, যেটা গ্যালারির শেষ প্রান্তে অবস্থিত।

    সোফি এখন তার সামনে দাড়িয়ে আছে, তার শ্বাস প্রশ্বাস এখনও দ্রুত চলছে। অনেকটা পথ ঘুরে এখানে আসতে হয়েছে তাকে। ফুরোসেন্ট লাইটে ল্যাংডন দেখলো সোফির মুখটা বেশ নরম। সে অবাকই হলো বলা যায়। শুধুমাত্র তার চোখটা তীক্ষ্ণ্ম। আর সেটা যেনো রেনোয়র একাধিক লেয়ারে আঁকা ঐন্দ্রজালিক একটা মুখচ্ছবি… আড়াল করা কিন্তু স্বতন্ত্র এক ধরনের ঢেকে থাকা রহস্য আর সাহসিকতাপূর্ণ।

    আমি আপনাকে সাবধান করে দিতে চাই, মি. ল্যাংডন… সোফি বলতে শুরু করলো, এখনও তার নিঃশ্বাস দ্রুত পড়ছে, আপনি এখন সু সারভিলেন্স ক্যাচির অধীনে আছেন। কথাগুলো যখন বলছিলো তখন তার উচ্চারিত শব্দগুলো প্রতিধ্বনি হলো।

    কিন্তু…কেন? ল্যাংডন জানতে চাইলো। সোফি ইতিমধ্যেই তাকে ফোনে একটা ব্যাখ্যা দিয়েছে। কিন্তু কথাটা সে সোফির মুখ থেকেই শুনতে চায়।

    কারণ, কয়েক পা সামনে এগিয়ে এসে সে বললো। এই হত্যাকাণ্ডে ফশের প্রাথমিক সন্দেহভাঁজন হলেন আপনি।

    ল্যাংডন কথাটা শুনে অবিশ্বাসে তাকালো, তারপরও কথাটা তার কাছে খুব হাস্যকর শোনালো। সোফির মতে, ল্যাংডনকে আজ রাতে লুভরে ডেকে আনা হয়েছে একজন সিম্বোলজিস্ট হিসেবে নয়, বরং একজন সন্দেহভাঁজন হিসেবে। তাকে বর্তমানে ডিসিপিজের কাছে জনপ্রিয় পদ্ধতি সারভিলেন্স ক্যাচির আওতায় রাখা হয়েছে এক ধরনের ধোকাবাজি, পুলিশ এই পদ্ধতিটা ব্যবহার করে সন্দেহভাঁজনকে অপরাধ সংঘটিত স্থানে নিয়ে এসে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে, যাতে সন্দেহভাঁজন ব্যক্তি নার্ভাস হয়ে ভুলবশত কিছু করে ফেলে, আর জালে আঁটকা পড়ে যায়।

    আপনার জ্যাকেটের বাম দিকের পকেটে দেখুন, সোফি বললো। আপনি প্রমাণ পাবেন, তারা আপনাকে নজরে রেখেছে।

    ল্যাংডন বুঝতে পারলো তার উদ্বিগ্নতা বাড়ছে। আমার পকেটে দেখবো? শুনে মনে হচ্ছে এক ধরনের সত্তা যাদুর কৌশল।

    একটু দেখুন।

    অনিচ্ছা সত্ত্বেও, ল্যাংডন তার জ্যাকেটের পকেটে হাত দিলো—এই পকেটটা সে কখনই ব্যবহার করে না। ভেতরে কিছুই খুঁজে পেলো না। কি আর আশা করতে পারো তুমি? সে একটু ভাবলো, হয়তো সোফি পাগলই হয়ে গেছে। কিন্তু পরক্ষণেই হাতে একটা কিছুর নাগাল পেলো, একেবারেই অপ্রত্যাশিত। জিনিসটা ছোট্ট আর শক্ত। তার আঙ্গুলে ওটার স্পর্শ লাগলো। ল্যাংডন সেটা বের করে এনে দেখলো, দারুণ বিস্মিত হলো সে। একটা ধাতব জিনিস। বোতামের মতো কিছু, অনেকটা হাতঘড়ির ব্যাটারির মতো দেখতে। আগে কখনও দেখেনি সে। এটা কি….?

    জিপিএস ট্র্যাকিং ডট, সোফি বললো, বিরামহীনভাবেই এটা নিজের অবস্থান সম্পর্কে গ্লোবাল পজিশনিং সিস্টেম স্যাটেলাইটের মাধ্যমে তথ্য দিয়ে থাকে, আর ডিসিপিজে সেটা মনিটরিংও করতে পারে। আমরা এটা লোকজনের অবস্থান জানার কাজে ব্যবহার করে থাকি। এই পৃথিবীর যে কোন জায়গা, এমনকি দুই ফিটের মতো জায়গাও এটা চিহ্নিত করতে পারে। এ দিয়ে তারা আপনাকে নজরদাড়ি করছে। যে এজেন্ট লোকটা আপনাকে হোটেল থেকে তুলে এনেছে, সে-ই এই জিনিসটা আপনার পকেটে ঢুকিয়ে দিয়েছে।

    ল্যাংডন হোটেল ঘরের কথাটা স্মরণ করলো…তার দ্রুত গোসল করা, পোশাক পরা, ডিসিপিজের এজেন্ট ঘর থেকে বের হবার সময় তার টুইড জ্যাকেটটা হাতে নিয়ে ছিলো। বাইরে খুব ঠাণ্ডা, মি. ল্যাংডন, এজেন্ট লোকটা তাকে বলেছিলো। প্যারিসের বসন্ত শুধু গানেরই হয় না। ল্যাংডন তাকে ধন্যবাদ জানিয়ে জ্যাকেটটা পরে নিয়েছিলো।

    সোফির অলিভ রঙের চোখের চাহনীটা খুবই প্রখর। আমি আপনাকে এই জিনিসটার ব্যাপারে আগে সতর্ক করিনি, কারণ আমি চাইনি আপনি ফশের সামনেই আপনার পকেট হাতড়ে বেড়ান। আপনি যে এটা খুঁজে পেয়েছেন সেটা যেনো সে না জানে।

    ল্যাংডন কী প্রতিক্রিয়া দেখাবে সে সম্পর্কে কোন ধারণাই তার ছিলো না।

    তারা আপনার সাথে জিপিএস লাগিয়ে দিয়েছে, কারণ তারা ভেবেছে, আপনি পালাতে পারেন। সোফি একটু থামলো। সত্যি বলতে কী, তারা আশা করছে আপনি পালাবেন ; এতে তাদের কেটা খুব শক্ত হবে।

    আমি পালাবো কেন! ল্যাংডন জানতে চাইলো। আমি নির্দোষ!

    ফশে কিন্তু অন্য কিছু মনে করছে।

    রেগে মেগে ল্যাংডন ময়লা ফেলার ঝুড়িতে ডটটা ফেলতে উদ্যত হলো।

    না! সোফি তার হাতটা টেনে ধরে তাকে থামালো।

    পকেটেই রাখুন। এটা ফেলে দিলে সিগনালটা থেমে যাবে, তখন তারা বুঝতে পারবে আপনি জিনিসটা খুঁজে পেয়েছেন। ফশে আপনাকে একা ছেড়েছে, তার কাণ সে আপনার অবস্থানটা মনিটরিং করতে পারছে। যদি সে জেনে যায় যে, আপনি এটা ধরে ফেলেছেন, তবে যা করবে… সোফি কথাটা শেষ করলো না। জিনিসটা তার পকেটেই আবার ঢুকিয়ে দিলো। এটা আপনার সাথেই থাকুক। অন্তত পক্ষে কিছুক্ষণের জন্য।

    ল্যাংডন আশাহত হলো। ফশে কী করে বিশ্বাস করতে পারলো যে, আমি জ্যাক সনিয়েকে খুন করেছি!

    আপনাকে সন্দেহ করার কিছু সঙ্গত কারণও রয়েছে, কিছু জোড়ালো প্রমাণ আছে তার কাছে। সোফির মুখে একটা চিন্তার ছাপ দেখা গেলো। এখানে একটা ছোটখাটো প্রমাণ রয়েছে যা আপনি দেখেননি। ফশে সেটা খুব যত্ন সহকারে আপনার কাছ থেকে লুকিয়ে রেখেছে।

    ল্যাংডন শুধু চেয়ে রইলো।

    আপনি কি সনিয়ের লেখা তিনটি লাইন মনে করতে পারবেন, ফ্লোরের লেখাটা?

    ল্যাংডন মাথা নাড়লো। সংখ্যা আর লেখাটা তার মনে ছাপা হয়ে গেছে।

    সোফির কণ্ঠটা নিচুতে নেমে ফিসফিসানিতে পরিণত হলো। দূভাগ্যজনক কথা হলো, আপনি মেসেজটার পুরোটা দেখেননি। সেখানে চতুর্থ একটা লাইন ছিলো যা আপনি আসার আগেই ফশে ছবি তুলে রেখে মুছে ফেলেছে।

    যদিও ল্যাংডন জানতো যে ওয়াটার-মার্কের কালি খুব সহজেই মুছে ফেলা যায় তবুও সে কল্পনাও করতে পারলো না, ফশে কেন সেটা করতে যাবে।

    মেসেজটার শেষ লাইন, সোফি বললো, এমন কিছু ছিলো যা সে চায়নি আপনি দেখে ফেলেন। সে একটু থামলো। অন্তত পক্ষে, আপনার সাথে একটা মীমাংসা করার আগে তো নয়ই।

    সোফি তার পকেট থেকে একটা কম্পিউটার প্রিন্টের ছবি বের করে সেটার ভাঁজ খুললো। ফশে এটা ক্রিপ্টোলজি ডিপার্টমেন্টে পাঠিয়েছিলো যাতে সনিয়ের মেসেজটার মর্মোদ্ধার করা যায়। এটা হলো মেসেজটার পূর্ণাঙ্গ ছবি। সে ছবিটা ল্যাংডনকে দিলো।

    অবাক চোখে, ল্যাংডন ছবিটার দিকে তাকিয়ে রইলো। ফ্লোরের মেসেজটার একটা ক্লোজ-আপ ছবি। শেষ লাইনটা ল্যাংডনকে এমনভাবে আঘাত করলো যেনো তার মাথায় কেউ প্রচণ্ড জোরে লাথি মেরেছে।

    ১৩-৩-২-২১-১-১-৮-৫

    ওহ্, ড্রাকোনীয় শয়তান!

    ও, ল্যাংড়া সেন্ট!
    পি,এস, রবার্ট ল্যাংডনকে খুঁজে বের করো।

     

    ১৩.

    কয়েক সেকেন্ড ধরে ল্যাংডন অবাক দৃষ্টিতে সনিয়ের লেখার ছবিটার দিকে তাকিয়ে রইলো। পি এস, রবার্ট ল্যাংডনকে খুঁজে বের করো। তার মনে হলো তার পায়ের নিচের মাটি কেঁপে উঠছে। সনিয়ে আমার নাম উল্লেখ করে একটা মেসেজ রেখে গেছেন? সে দুঃস্বপ্নেও এটা ভাবে নাই, এরকমটি কেন হলো সেটা বুঝে উঠতেও পারছে না।

    এখন আপনি বুঝতে পারছেন, সোফি বললো, তার চোখে তাড়া, কেন ফলে আপনাকে এখানে এনেছে, আর কেনইবা আপনি তার প্রাথমিক সন্দেহে আছেন?

    ল্যাংডন এবার বুঝতে পারলো, যখন সে বলেছিলো সনিয়ে তাঁর খুনির নাম রেখে যেতে পারেন তখন কেন ফশে ওরকম আচরণ করেছিলো তার সাথে।

    রবার্ট ল্যাংডনকে খুঁজে বের করো।

    সনিয়ে কেন এটা লিখবেন? ল্যাংডন জানতে চাইলো, তার হতাশা এখন রাগে পরিণত হলো। আমি কেন সনিয়েকে খুন করতে যাবো?

    ফশে এখনও মোটিভটা ধরতে পারেনি, কিন্তু সে আজরাতে আপনার সাথে তার সমস্ত কথাবার্তা রেকর্ড করে ফেলেছে এই আশায়, যাতে আপনি কিছু উন্মোচিত করে ফেলেন।

    ল্যাংডনের মুখ হা হয়ে গেলো, কোন কথা বললো না।

    সে ছোট্ট একটা মাইক্রোফোন ফিট করেছে, সোফি ব্যাখ্যা করলো, তার পকেটে থাকা একটা ট্রান্সমিটারের সাথে সেটা সংযুক্ত, সেখান থেকে সমস্ত কথাবার্তা কমান্ড পোস্টে ট্রান্সমিট হয়েছে।

    এটা অসম্ভব, ল্যাংডন চিৎকার করে উঠলো। আমার একজন এলিবাই আছে। আমি বক্তৃতা শেষ করে সরাসরি আমার হোটেলে ফিরে এসেছিলাম। আপনি হোটেলের ডেস্কে জিজ্ঞেস করে দেখতে পারেন।

    ফশে ইতিমধ্যেই সেটা করেছে। তার রিপোর্টে দেখানো হয়েছে, আপনি হোটেলের চাবি নিয়েছেন দশটা ত্রিশে, দূর্ভাগ্যজনকভাবে হত্যাকাণ্ডটি সংঘটিত হয় এগারোটার দিকে। আপনি খুব সহজেই, কাউকে না জানিয়ে, সবার নজর এড়িয়ে, সেখান থেকে বের হয়ে আসতে পারতেন।

    এটা পাগালামী! ফশের কাছে কোন প্রমাণ নেই!

    সোফির চোখ দুটো বড়বড় হয়ে গেলো যেননা সে বলতে চাচ্ছে : কোনো প্রমাণ নেই? মি. ল্যাংডন, আপনার নাম ফ্লোরে লেখা ছিলো, মৃতদেহের পাশেই। আর সনিয়ের ডেটবুকে লেখা ছিলো আপনি তার সাথে দেখা করবেন, ঠিক যে সময়টাতে তিনি খুন হয়েছেন সে সময়। সে একটু থামলো। আপনাকে গ্রেফতার করে জিজ্ঞাসাবাদ করার জন্য ফশের কাছে খুব বেশিই প্রমাণ আছে।

    ল্যাংডনের হঠাৎ করেই মনে হলো যে, তার একজন আইজীবির দরকার। আমি একাজ করিনি।

    সোফি একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেললো। এটা আমেরিকান টেলিভিশন নয়, মি. ল্যাংডন। ফ্রান্সের আইন পুলিশকে রক্ষা করে, অপরাধীকে নয়। দূভাগ্যজনক হলেও এটা সত্যি যে, এই কেসের ব্যাপারে মিডিয়াও বেশ আগ্রহী থাকবে। জ্যাক সনিয়ে প্যারিসে খুবই সম্মানিত এবং শ্রদ্ধেয় একজন ব্যক্তি। তার হত্যার খবরটি প্রতিটি মিডিয়ায় সকালেই চাউড় হয়ে যাবে। ফশের ওপর খুব জলদিই একটা বিবৃতি দেবার জন্য চাপ থাকবে। আর সেক্ষেত্রে, তিনি তো একজন সন্দেহভাঁজনকে গ্রেফতার করতেই বেশি পছন্দ করবেন। সেটাইতো তার জন্য সবচাইতে ভালো হবে। আপনি অপরাধী হন বা না হন, ডিসিপিজে আপনাকে তাদের হেফাজতে রাখতে চাইবে ততোক্ষণ পর্যন্ত, যতক্ষণ না তারা জানতে পারবে সত্যি কী ঘটেছিলো।

    ল্যাংডনের মনে হলো সে খাঁচায় বন্দী একটা পশু। আপনি আমায় কেন এসব বলছেন?

    কারণ, মি. ল্যাংডন, আমি বিশ্বাস করি আপনি নির্দোষ। সোফি তার চোখটা একটু নামিয়ে আবারো তার দিকে তাকালো। আর, আরেকটি কারণ হলো, আপনার এই বিপদের জন্য অংশত আমিও দায়ি।

    কি বললেন? আপনি দায়ী?

    সনিয়ে আপনাকে জড়াতে চাননি, ফাঁসাতেও চাননি। এটা একটা ভুল হয়ে গেছে। ফ্লোরের মেসেজটা আসলে আমার উদ্দেশ্যে লেখা হয়েছে!

    ল্যাংডন কথাটা বুঝতে বেশ কিছুক্ষণ সময় নিলো, আমায় মাফ করবেন, কি বললেন?

    মেসেজটা পুলিশের জন্য ছিলো না। তিনি ওটা আমার জন্য লিখেছেন। আমার মনে হয় কোন এক কারণে তিনি পুরো কাজটা খুব দ্রুত করেছেন, আর সেজন্যেই পুলিশের কাছে ব্যাপারটা কেমন দাঁড়াবে সেটা হয়তো তিনি খেয়াল করেননি। সে একটু থামলো। সংখ্যার কোডটা একেবারেই অর্থহীন। সনিয়ে এটা নিশ্চিত করতে চেয়েছেন যে, এই কেসটায় যেনো একজন ক্রিপ্টোগ্রাফারকে জড়ানো হয়, আর সেই সূত্রে যাতে আমি জানতে পারি তাঁর কী হয়েছিলো।

    ল্যাংডনের মাথায় কিছুই ঢুকলো না। তবে এটা সে বুঝতে পারলো যে, সোফি কেন তাকে বাঁচাতে চেষ্টা করছে। পি এস, রবার্ট ল্যাংডনকে খুঁজে বের করো। সোফি বুঝতে পারছে, কিউরেটর যে লেখাটা রেখে গেছেন সেটা বুঝতে হলে ল্যাংডনের সাহায্য নিতে হবে। কিন্তু আপনি এটা কেন ভাবলেন যে, মেসেজটা আপনার জন্যই লেখা হয়েছে?

    ভিটরুভিয়ান ম্যান, সোফি নিরুত্তাপ কণ্ঠে বললো। লিওনার্দোর এই স্কেচটা সবসময়ই আমার খুব প্রিয়। তিনি এটা করেছেন আমার মনোযোগ আকর্ষণ করার জন্য।

    রাখেন, রাখেন। আপনি বলছেন কিউরেটর সাহেব জানতেন আপনার প্রিয় ছবি কী?

    সোফি মাথা নেড়ে সায় দিলো। আমি দুঃখিত। জ্যাক সনিয়ে এবং আমি …।

    সোফির কণ্ঠ রুদ্ধ হয়ে গেলো। ল্যাংডন আঁচ করতে পারলো, সোফি এবং সনিয়ে একটা বিশেষ সম্পর্কে জড়িত। তার সামনে দাঁড়ানো যুবতীটাকে সে ভালো করে দেখলো। খুবই সুন্দরী, আর সে এ ব্যাপারে বেশ জ্ঞাত ছিলো যে, ফ্রান্সে বয়স্ক লোকেরা প্রায়শই অল্পবয়স্কা তরুণী রক্ষিতা হিসেবে রেখে থাকে। তারপরও, সোফি নেভুকে এজন রক্ষিতা হিসেবে একদমই মনে হচ্ছে না।

    দশ বছর ধরে আমাদের মধ্যে কোন যোগাযোগ নেই, সোফি বললো। তার কণ্ঠ এখন বেশ নিচু হয়ে গেছে। তারপর থেকে আমাদের মধ্যে খুব কমই কথা হয়েছে। আজরাতে ক্রিপ্টোগ্রাফি ডিপার্টমেন্ট থেকে আমি তাঁর ছবিটা দেখে বুঝতে পেরেছি, আমার সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা তিনি করেছিলেন। আমার কাছে একটা মেসেজ পাঠানোর চেষ্টাও করেছেন তিনি।

    ভিটাভিয়ান ম্যানের কারণেই?

    হ্যাঁ। আর পি, এস অক্ষর দুটো।

    পোস্ট স্ক্রিপ্ট?

    সে মাথা ঝাঁকালো। পিএস আমার নামের আদ্যাক্ষর।

    কিন্তু আপনার নাম তো সোফি নেভু।

    তিনি আমাকে ডাকতেন প্রিন্সেস সোফি বলে। তার চেহারাটায় লাল একটা আভা দেখা গেলো। পি এস মানে প্রিন্সেস সোফি।

    ল্যাংডন কোন প্রতিক্রিয়া দেখালো না।

    খুব ছেলেমানুষী শোনাচ্ছে, আমি জানি, সে বললো, কিন্তু অনেক বছর আগের কথা সেটা। তখন আমি খুব ছোট ছিলাম।

    আপনি তাকে চিনতেন যখন আপনি খুব ছোট ছিলেন?

    একদম তাই সোফি বললো, তার চোখ ছল-ছল করে উঠলো আবেগে। জ্যাক সনিয়ে আমার দাদু হোন।

     

    ১৪.

    ল্যাংডন কোথায়? কমান্ড-পোস্টের দিকে এগিয়ে যেতে যেতে সিগারেটে শেষ টানটা দিয়ে ফশে জিজ্ঞেস করলো।

    এখনও পুরুষ টয়লেটে আছে, স্যার। লেফটেনান্ট কোলেত প্রশ্নের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলো।

    ফশে বেশ বিরক্ত হলো, সময় নিচ্ছে সে, বুঝেছি।

    কোলেতের ঘাড়ের উপর দিয়ে ফশে ল্যাপটপের পর্দায় ডটটার ছবি দেখলো। সে ল্যাংডনের ব্যাপারে খোঁজ নিতে ওখানে যাবার জন্য চাপাচাপি করতে চাইলো। এরকম কাজে কাউকে বুঝতে দেয়া চলে না যে, তাকে চোখে চোখে রাখা হচ্ছে। ল্যাংডন নিজের ইচেয়ই ফিরে আসবে। ইতিমধ্যে দশমিনিট পার হয়ে গেছে।

    খুব বেশি সময় নিচ্ছে।

    ল্যাংডনের কি আমাদের চালাকিটা ধরে ফেলার কোন সম্ভাবনা আছে? ফশে জিজ্ঞেস করলো।

    কোলে মাথা ঝাঁকালো। এখনও পুরুষ টয়লেটের ভেতরে নড়াচড়া করার দৃশ্য দেখা যাচ্ছে। তার মানে জিপিএস ডটটা নিশ্চিতভাবেই তার সাথে আছে। হয়তো সে খুব অসুস্থবোধ করছে। যদি ডটটা সে খুঁজে পেতো, তবে সেটা ফেলে দিয়ে পালাতে চেষ্টা করতো।

    ফশে তার হাতঘড়িটা দেখে নিলো। চমৎকার। এখনও তাকে দেখে অস্থির মনে হচ্ছে। সারাটা সন্ধ্যা, কোলেত আঁচ করতে পেরেছে, তার ক্যাপ্টেনের মধ্যে এক ধরনের অদ্ভুত দুঃশ্চিন্তা। সচরাচর নির্লিপ্ত আর দারুণ চাপের মধ্যেও ঠাণ্ডা মাথার ফশেকে আজ রাতে দেখে মনে হচ্ছে আবেগ তাড়িত, যেনো এই ব্যাপারটা যে কোনভাবেই হোক, তার ব্যক্তিগত একটি ব্যাপার। অবাক করার কিছু নেই, কোলেত ভাবলো। ফশের এই গ্রেফতারটি খুবই দরকার, দারুণভাবেই দরকার। সামপ্রতিক সময়ে বোর্ড অব মিনিস্টার এবং মিডিয়া ফশের আগ্রাসী কৌশলের জন্য সমালোচনায় মুখর হয়ে উঠেছে। তার সাথে বেশ কিছু শক্তিশালী এ্যামবাসির দ্বন্দ্ব আর নিজের ডিপার্টমেন্টে অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করতে গিয়ে বাজেটও খুব বাড়িয়ে ফেলেছে। আজ রাতে, একটি অতি উচ্চ প্রযুক্তি ব্যবহার করে, স্বনামধন্য একজন আমেরিকানকে গ্রেফতার করার মধ্য দিয়ে ফশে তার সমালোচকদেরকে কিছু দিনের জন্য মুখ বন্ধ করে রাখতে পারবে, যা তার চাকরিটাকে বাঁচিয়ে দেবে। আর মাত্র কয়েক বছর পরই সে অবসরে চলে যাবে, সেই সাথে পাবে অবসরের আকর্ষণীয় ভাতা। সবটাই সে এই কাজের মধ্য দিয়ে সুরক্ষা করতে পারবে। ঈশ্বর জানেন, তার পেনশনটার খুবই দরকার, কোলেত ভাবলো। প্রযুক্তির ব্যাপারে ফশের অতি আগ্রহ পেশাগত এবং ব্যক্তিগতভাবে তার মর্মপীড়ার কারণ হয়েছে। আজরাতে, এখনও বেশ সময় হাতে রয়েছে। সোফি নেভুর অদ্ভুতভাবে বিঘ্ন সৃষ্টি করাটা যদিও দুঃখজনক, তবে সেটা খুব সামান্য ব্যাপারই। সে এখন চলে গেছে। আর ফশের কাছে খেলার জন্য এখনও কার্ড রয়েছে। সে এখনও ল্যাংডনকে জানায়নি যে, ফ্লোরের লেখার মধ্যে ল্যাংডনের নামও ছিলো। ভিকটিম নিজে সেটা লিখে গেছেন। পি, এস, রবার্ট ল্যাংডনকে খুঁজে বের করো।

    ক্যাপ্টেন? ডিসিপিজের এক এজেন্ট অফিস থেকে কল করলো। আমার মনে হয়, এই ফোনটা আপনার নেয়া দরকার। সে একটা ফোন হাতে ধরে রেখেছে। তাকে খুব চিন্তিত দেখাচ্ছে।

    কে করেছে? ফশে জিজ্ঞেস করলো।

    এজেন্ট চোখ কপালে তুলে বললো, ক্রিপ্টোলজি ডিপার্টমেন্টের ডিরেক্টর।

    কি?

    সোফির ব্যাপারে, স্যার। মনে হচ্ছে একটা কিছু হয়েছে।

     

    ১৫.

    সময় হয়ে গেছে।

    কালো অদি গাড়িটা থেকে নামতেই নিজেকে সাইলাসের খুব শক্তিশালী মনে হলো। রাতের বাতাসে তার কোমরে আলগা করে বাঁধা দড়িটা নড়ছে। পরিবর্তনের বাতাস বইছে। সে জানে, তার সামনে যে কাজটি আছে তার জন্যে শক্তির চেয়ে বেশি চাতুর্যের প্রয়োজন। তাই তার পিস্তলটা গাড়িতেই রেখে এসেছে। থার্টিন রাউন্ড হেলার এবং কচ ইউএসপি ৪০ পিস্তলটা টিচার তাকে দিয়েছে।

    ঈশ্বরের ঘরে কোন মারণাস্ত্রের স্থান নেই। বিশাল গীর্জাটার সামনের পাজাটা এই সময়ে একেবারেই ফাঁকা, সেন্ট সালপিচের দূরে, দৃশ্যত যে প্রাণীর চিহ্ন দেখা যাচ্ছে, তা হলো একজোড়া অল্প বয়স্কা পতিতা। পথঘাটের পর্যটকদেরকে নিজেদের সম্পদ দেখাচ্ছে। তাদের প্রাপ্তবয়স্ক শরীরটা সাইলাসের কাছে অতি চেনা মনে হলো। তার নিজের পাছার কথা মনে পড়ে গেলো। তার ঊরুতে বাধা কাটা তারের সিলিস বেল্টটা মাংস কেটে ভেতরে ঢুকে যাচ্ছে, আর তীব্র যন্ত্রণা হচ্ছে।

    আচমকা তার শারীরিক কামনা উথিত হলো। দশ বছর ধরে সাইলাস সব ধরনের যৌনকর্ম থেকে নিজেকে বিশ্বস্ততার সাথেই বিরত রেখেছে। এমনকি স্বমেহনও করেনি। দ্য ওয়ের জন্য। সে জানতো ওপাস দাইকে অনুসরণ করতে হলে তাকে আরো বড় আত্মত্যাগ করতে হবে। বিনিময়ে সে পাবে তার চেয়েও অনেক বেশি কিছু। ব্যক্তিগত সমস্ত সম্পদ আর ভোগকে বাদ দেয়ার একটা প্রতীজ্ঞা করেছে সে, এটাই তো আত্মত্যাগ। যে দারিদ্র থেকে সে উঠে এসেছে, আর যে যৌনতার শিকার সে জেলখানার ভেতরে হয়েছে, সেটা থেকে মুক্তি পেয়েছে সে।

    এবার, গ্রেফতার হয়ে ফ্রান্সের এনডোরায় বন্দী হবার পর, এই প্রথম সে ফ্রান্সে আসলো। সাইলাসের মনে হলো, তার স্বদেশ তাকে পরীক্ষা করছে। তার আত্মা অতীত হিংস্রতার স্মৃতিতে আচ্ছন্ন হলো। তুমি নতুন জন্ম লাভ করেছে, সে নিজেকে আবারো সুধালো। ঈশ্বরের জন্য আজকে তার যে কাজ, তার জন্য একটি হত্যার প্রয়োজন রয়েছে। এটাও আত্মত্যাগ, সাইলাস জানতো সেটা।

    যন্ত্রণা সহ্য করার পরিমাণই হলো তোমার বিশ্বাসের গভীরতা, টিচার তাকে এই কথাটা বলেছিলেন। যন্ত্রণার ব্যাপারে সাইলাস কোন আনাড়ি লোক না, আর সে এটা টিচারের কাছে প্রমাণ করবার জন্য মুখিয়ে ছিলো।

    হাগো লা ওরা দি দিয়োস, চার্চের মূল প্রবেশদ্বারের দিকে এগিয়ে যেতে যেতে সাইলাস ফিসফিস করে বললো।

    বিশাল দরজাটার সামনে এসে সাইলাস খুব গভীর একটা নিঃশ্বাস নিলো।

    কি-স্টোনটা। আমাদের চূড়ান্ত লক্ষ্যের দিকে নিয়ে যাবে। সে তার ভূতুরে সাদা হাতটা দিয়ে দরজায় তিনটা আঘাত করলো।

    কিছুক্ষণ পর, বিশাল দরজাটার বোল্ট খুলতে শুরু করলো।

     

    ১৬.

    সোফি ভাবতে লাগলো, সে যে এখান থেকে চলে যায়নি, সেটা বুঝতে ফশের কতোক্ষণ লাগতে পারে। ল্যাংডনকে খুব বেশি মাত্রায় ঘাবড়ে যেতে দেখে সোফি নিজেকে প্রশ্ন করলো, সে ল্যাংডনকে এই পুরুষ টয়লেটে নিয়ে এসে ভুল করেছে কিনা।

    এছাড়া আমি আর কী-বা করতে পারতাম।

    সোফি তার দাদুর মৃতদেহটার দৃশ্য কল্পনা করলো, নগ্ন এবং ঈগল পাখির মতো হাত-পা ছড়ানো। একটা সময় ছিলো, যখন তার দাদাই তার কাছে এই দুনিয়া ছিলো। তারপরও, সোফি খুব অবাক হলো যে, এই লোকটার জন্য তার কোন দুঃখবোধ হচ্ছে। না। জ্যাক সনিয়ে এখন তার কাছে একজন আগন্তুক। তাদের সম্পর্কটা মার্চের একরাতে, একটি মাত্র ঘটনায় আচমকাই উবে গিয়েছিলো। তখন সোফির বয়স ছিলো মাত্র বাইশ। দশ বছর আগের কথা। ইংল্যান্ডের গ্র্যাজুয়েট ইউনির্ভাসিটি থেকে কয়েক দিন আগেই বাড়ি ফিরে সোফি তার দাদুকে এমন কিছুতে জড়িত অবস্থায় দেখতে পায় যা তার কখনও দেখার কথা ছিলো না।

    হায়, আমি যদি নিজ চোখে সেটা না দেখতাম…

    লজ্জায় ঘৃণায় বিস্মিত হয়ে সোফি তার দাদুকে ছেড়ে অন্যত্র চলে গিয়েছিলো। নিজের জমাকৃত টাকা পয়সা নিয়ে ছোট্ট একটা ফ্ল্যাট ঠিক করে একজন বান্ধবীর সাথে বসবাস করতে শুরু করে দিলো। সোফি প্রতীজ্ঞা করেছিলো, যে দৃশ্য সে দেখেছে, সে সম্পর্কে কাউকে কোনদিন কিছুই বলবে না। তার দাদু তার সাথে যোগাযোগ করার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছিলেন। চিঠিপত্র আর কার্ড পাঠিয়ে বার বার অনুরোধ করে বলেছিলেন, সোফি যেনো একবার দেখা করে, যাতে তার কাছে ব্যাপারটা খুলে বলা যায়। কীভাবে ব্যাখ্যা করবেন? একবারই কেবল সোফি জবাব দিয়েছিলো তার সাথে কখনও কোন জায়গাতে যেননা তিনি দেখা না করেন, ফোন না করেন। সোফি বেশ ভীত ছিলো যে, ঘটনাটার ব্যাখ্যা ঘটনাটার চেয়েও বেশি ভয়ংকর হবে।

    অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি, সনিয়ে কখনও সোফির ব্যাপারে হাল ছেড়ে দেননি। সোফি একটা বন্ধ করা ড্রয়ার নিয়ে দশ বছর কাটিয়ে দিয়েছে। তার দাদু তার অনুরোধ ঠিকই রক্ষা করেছিলেন, তাকে কখনও ফোন করেননি কিংবা চিঠিও লেখেননি।

    কেবল আজকের সন্ধ্যার আগ পর্যন্ত।

    সোফি? সোফির এনসারিং মেশিনে তাঁর কণ্ঠস্বরটি অনেক বেশি বয়স্ক বলে মনে হয়েছিলো। আমি তোমার কথামতো দীর্ঘদিন যোগাযোগ করিনি, মেনে চলেছি তোমার নিষেধ, কিন্তু আজ তোমার সাথে আমার কথা বলতেই হবে। একটা ভয়ংকর কিছু ঘটে গেছে।

    তার প্যারিসের ফ্ল্যাটের রান্নাঘরে দাঁড়িয়ে সোফি এতোগুলো বছর পর তার কণ্ঠটা শুনে খুব শীতল অনুভব করলো। তার নম্র কণ্ঠস্বরটা শুনে সোফির ছেলেবেলাকার ভক্তির স্মৃতিটা ফিরে এলো।

    সোফি, দয়া করে আমার কথা শোনো। তিনি সোফির সাথে ইংরেজিতে কথা বলছিলেন। সে যখন ছোট ছিলো তখন ঠিক এভাবেই তিনি কথা বলতেন। স্কুলে ফরাসি চর্চা করবে। বাড়িতে ইংরেজি। তুমি চিরতরের জন্য পাগল হতে পারো না। তুমি কি সেইসব চিঠিগুলো পড়ে দ্যাখোনি, যা আমি বিগত বছরগুলো ধরে লিখেছি? তুমি কি এখনও বুঝতে পারোনি? তিনি একটু থামলেন। এক্ষুনি আমাদেরকে কথা বলতে হবে। দয়া করে এবারের মতো তোমার দাদুর কথাটি রাখো। এক্ষুণি লুভরে ফোন করো আমায়। এক্ষুণি। আমার মনে হচ্ছে, তুমি আর আমি ভীষণ বিপদে পড়ে গেছি।

    সোফি এনসারিং মেশিনের দিকে তাকিয়ে ছিলো। বিপদ? তিনি এসব কি বলছেন?

    প্রিন্সেস… তার দাদুর কণ্ঠটা আবেগমথিত ছিলো, সোফি আর অটল থাকতে পারেনি। আমি জানি, আমি তোমার কাছ থেকে কিছু লুকিয়ে রেখেছি আর সেজন্যে আমি তোমার ভালবাসা হারিয়েছি। কিন্তু সেটা তোমার নিরাপত্তার জন্যই। এখন তুমি অবশ্যই সত্যটা জানতে পারবে। আমি তোমার পরিবার সম্পর্কে সত্য কথাটা বলবো।

    সোফি হঠাৎ করেই তার নিজের মনের কথাটা শুনতে পেলো। আমার পরিবার? সোফির যখন চার বছর বয়স তখন তার বাবা-মা মারা গিয়েছিলো। তাদের গাড়িটা একটা সেতুর রেলিং ভেঙে খরস্রোতা নদীতে পড়ে গিয়েছিলো। তার দাদী এবং ছোট, ভাইটিও গাড়িতে ছিলো, হঠাৎ করেই সোফির পুরো পরিবারটা বিলীন হয়ে গেলো। সংবাদ পত্রের কিছু ক্লিপিংস সে রেখে দিয়েছে নিশ্চিত হবার জন্য।

    তাঁর কথাগুলো সোফির হাড়ে অপ্রত্যাশিতভাবে কাঁপুনি লাগিয়ে দিয়েছিলো। আমার পরিবার! সোফির মনে পড়ে গেলো, ছোটবেলায় সে স্বপ্নে অসংখ্যবার একটা জিনিস দেখে ঘুম থেকে জেগে উঠতো : আমার পরিবার জীবিত আছে। তারা বাড়িতে ফিরে আসছে। কিন্তু মুহূর্তেই এই ভাবনাটা উবে যেতো।

    তোমার পরিবার মারা গেছে সোফি। তারা আর ফিরে আসবে না।

    সোফি… এন্সারিং মেশিনে তার দাদুর কণ্ঠটা বলছিলো। অনেক বছর ধরে আমি এই কথাটা তোমাকে বলার জন্য অপেক্ষা করে আছি। ঠিক মুহূর্তটার জন্য অপেক্ষা করছিলাম। কিন্তু এখন সময় ফুরিয়ে যাচ্ছে। আমাকে লুভরে ফোন করো। যত দ্রুত সম্ভব। আমি এখানে সারা রাত অপেক্ষা করবো। আমার আশংকা, আমরা দুজনেই চরম বিপদে রয়েছি। তোমার অনেক কিছুই জানার দরকার।

    মেসেজটা এইখানেই শেষ হয়ে গিয়েছিলো।

    নিরবে, সোফি নিশ্চল কিছুক্ষণ দাঁড়িয়েছিলো। তার দাদুর মেসেজটার মর্মার্থ সে অনুমান করার চেষ্টা করলো। একটাই সম্ভাবনা আছে, তার মনে হচ্ছিলো, এটা একটা, টোপ।

    অবশ্যই, তার দাদু তাকে দেখার জন্য ব্যকুল হয়ে আছেন। আর সেজন্য তিনি সবকিছুই করতে পারেন। লোকটার ব্যাপারে তার ঘৃণা খুবই গভীর। সোফি ভাবলো, হয়তো তিনি মারাত্মক কোন অসুখে পড়েছেন, একেবারেই অন্তিম অবস্থা, আর ঠিক করেছেন যেভাবেই হোক একটা বুদ্ধি খাটিয়ে তিনি সোফিকে তার কাছে নিয়ে আসবেন, এক নজর দেখার জন্যে। যদি তাই হয়ে থাকে, তবে তিনি বুদ্ধিমানের মতোই কাজ করেছেন।

    আমার পরিবার।

    এখন, লুভরের পুরুষ টয়লেটের আঘো অন্ধকারে দাঁড়িয়ে সোফি সন্ধ্যাবেলার মেসেজটার প্রতিধ্বনি যেনো শুনতে পেলো। সোফি, আমরা হয়তো দুজনেই খুব বিপদে আছি। আমাকে ফোন করো।

    সোফি ফোন করেনি। এমনকি সেটা করার কোন পরিকল্পনাও করেনি। এখন, তার সন্দেহটা খুব বড়সড় একটা চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন। তার দাদু নিজের জাদুঘরে পড়ে আছেন। ফ্লোরে তিনি একটা কোডও লিখে গেছেন।

    তার জন্য একটা কোড। এ ব্যাপারে, সে একদমই নিশ্চিত। যদিও মেসেজটার অর্থ সে বুঝতে পারছে না, তবুও সে নিশ্চিত, কথাগুলো তার জন্যই। সোফির ক্রিপ্টোগ্রাফি সম্পর্কে ছোটবেলা থেকে যে আগ্রহ ধীরে ধীরে তৈরি হয়েছিলো সেটা কার্যত জ্যাক সনিয়ের জন্য—কোডের ব্যাপারে তাঁর নিজে মারাত্মক রকমের আসক্তি ছিলো। বিশেষ করে ওয়ার্ডস গেমস এবং পাজল। কত রোববার আমরা সংবাদ পত্রের ক্রিপ্টোগ্রামস্ আর ক্রসওয়ার্ডস নিয়ে পার করে দিয়েছি?

    বারো বছর বয়সে সোফি লা মদে পত্রিকার ক্রসওয়ার্ডস কারো সাহায্য ছাড়াই মেলাতে পারতো। তবে দাদু তাকে ইংরেজিতে ক্রসওয়ার্ডস, গাণিতিক পাজল আর সাবস্টিটিউশন সিফারে দক্ষ করে তুলেছিলেন। সোফি সবগুলোই ভালো পারতো। প্রকারান্তরে সোফি তার নেশাটাকে পেশায় রূপান্তর করে নিলো পুলিশ জুডিশিয়ারে একজন কোডব্রেকার হিসেবে কর্মজীবন শুরু করার মধ্য দিয়ে।

    আজরাতে, সোফির ক্রিপ্টোগ্রাফার সত্ত্বা তাকে বাধ্য করছে তার দাদুর সহজ সরল কোডটা দুজন আগন্তুককে এক সঙ্গে জুড়ে দেবার জন্য সোফি নেভু এবং রবার্ট ল্যাংডন।

    কিন্তু প্রশ্ন হলো, কেন?

    দুঃখের কথা হলো, ল্যাংডনের হতবাক দৃষ্টির দিকে তাকিয়ে সোফির মনে হলো এই আমেরিকানটাও তার চেয়ে বেশি কিছু জানে না, কেন তার দাদু তাদের দুজনকে একসঙ্গে, এরকম একটি ঘটনায় নিক্ষেপ করেছেন।

    সে আবার বলতে শুরু করলো। আপনার সাথে আমার দাদুর আজ রাতে দেখা করার কথা ছিলো। কিসের জন্য?

    ল্যাংডনকে সত্যি খুব কিংকর্তব্যবিমূঢ় মনে হলো। তার ব্যক্তিগত সচিব সাক্ষাতের ব্যবস্থাটা করেছিলো, আর এ ব্যাপারে সে কোন কারণও বলেনি। আমিও জিজ্ঞেস করিনি। আমার ধারণা, তিনি হয়তো শুনেছেন যে, আমি ফরাসি ক্যাথেড্রালের প্যাগান আইকনোগ্রাফি নিয়ে বক্তৃতা দেবো, সে ব্যাপারে হয়তো উনার আগ্রহ রয়েছে। আমি মনে করলাম, বক্তৃতার পর তার সাথে গল্পগুজব আর একটু পানাহার করাটা খুবই আনন্দদায়ক হবে।

    সোফি এ কথাটা একদমই মানতে পারলো না। সংযোগটা একেবারেই যুক্তিহীন বলে মনে হচ্ছে। তার দাদু প্যাগান আইকননাগ্রাফি সম্পর্কে এ পৃথিবীর যে কোন লোকের চেয়ে বেশিই জানতেন। তার চেয়েও বড় কথা, তিনি একজন অসম্ভব রকমের অন্তর্মুখী ব্যক্তি ছিলেন, কোন গুরুত্বপূর্ণ কারণ না থাকলে, একজন আমেরিকানকে ডেকে এনে আড্ডা জুড়ে দেবেন, সেটা একেবারেই অসম্ভব।

    সোফি একটা গভীর নিঃশ্বাস নিয়ে আবারো জানতে চাইলো। আমার দাদু আজ বিকেলে ফোন করে আমাকে বলেছিলেন যে, আমরা দুজনেই খুব বড় রকমের একটা বিপদে আছি। এটা কি আপনার কাছে কোন অর্থ বহন করে?

    ল্যাংডনের নীল চোখ দুটো চিন্তার মেঘে ঢেকে গেলো। না, কিন্তু যা ঘটেছে সেটা বিবেচনা করলে…

    সোফি মাথা নেড়ে সায় দিলো। আজরাতে যা ঘটেছে সেটা বিবেচনায় না নিলে সে খুব বোকা হিসেবেই প্রতীয়মান হবে। অন্যমনস্কভাবে হেটে বাথরুমের ছোট্ট একটা কাঁচের জানালার কাছে গেলো। সেখান থেকে বাইরে তাকালো, দেখলো জানালার কাঁচে এলার্ম টেপ লাগানো আছে। তারা অনেক উপরে আছেচল্লিশ ফুট উপরে।

    দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে সে প্যারিসের চমৎকার নৈসর্গিক দৃশ্যের দিকে তাকালো। বাম দিকে, সাইন নদীর ওপারে, জ্বলজ্বল করছে আইফেল টাওয়ার। আর ঠিক সোজাসুজি তাকালে, আর্ক দ্য ট্রায়াম্ফ। ডান দিকে ঢালু আর সুউচ্চ মতোয়ামাত্রে, গর্বিত সা কোয়েরের এরাবেস্কডাম-এর পালিশ করা সাদা পাথর দ্যুতি ছড়াচ্ছে পবিত্র আলোর মতো। এখানে ডেনন উইং-এর পশ্চিম মাথাটার কাছে প্লেস দু কারুজেল। লুভরের বাইরের দেয়ালটা শুধুমাত্র সরু একটা ফুটপাত দিয়ে সেই জায়গা থেকে পৃথক করা হয়েছে। নিচে, যথারীতি রাত্রিকালীন ট্রাকের সারি অলসভাবে দাঁড়িয়ে আছে। সিগনালের অপেক্ষায় আছে তারা। তাদের বাতিগুলো মনে হচ্ছে টিপটিপ করে সোফির দিকে ঠাট্টাচ্ছলে তাকাচ্ছে।

    আমি জানি না কী বলবো, ল্যাংডন বললো। সোফির পাশে এসে দাঁড়ালো সে। আপনার দাদু নিশ্চিতভাবেই আমাদেরকে কিছু বলতে চেষ্টা করেছেন। আমি দুঃখিত, আমি খুব কম সাহায্যেই আসতে পারছি।

    সোফি জানালা থেকে ঘুরে দাঁড়ালো। বুঝতে পারলো ল্যাংডনের কণ্ঠে গভীর অনুশোচনাটা একেবারেই নিখাদ। তাকে নিয়ে এতো সমস্যা হবার পরও সে নিশ্চিতভাবেই চায় তাকে সাহায্য করতে। ডিসিপিজের সন্দেহের তালিকায় নিজের নামটি দেখেও এই শিক্ষাবিদ ব্যাপারটা পরিষ্কার বুঝতে পারছে না।

    আমাদের দুজনের অবস্থাই একরকম, সে ভাবলো।

    একজন কোডব্রেকার হিসেবে সোফি তার জীবিকা অর্জন করে আপাত অর্থহীন তথ্যের অর্থ বের করে। আজরাতে রবার্ট ল্যাংডনকে নিয়ে তার সবচাইতে ভালো অনুমান হলো, লোকটা জানুক আর না-ই জানুক, সে এমন কিছু জানে, যা সোফির খুবই জানা দরকার। প্রিন্সেস সোফিয়া, রবার্ট ল্যাংডনকে খুঁজে বের করো।

    তার দাদুর মেসেজটা এর চেয়ে আর কতোটা পরিষ্কার হতে পারতো? ল্যাংডনের সাথে সোফির আরো বেশি সময় দরকার ভাবার জন্য। এক সাথে এই রহস্যের ভেদ করতে সময় লাগবে। কিন্তু দুঃখজনক, সময় দ্রুত ফুরিয়ে যাচ্ছে।

    ল্যাংডনের দিকে তাকিয়ে সোফি একটা জিনিসের কথাই শুধু ভাবতে পারলো। বেজু ফশে আপনাকে যেকোন সময়ে তার কাস্টডিতে নিয়ে নেবে। আমি আপনাকে এই জাদুঘর থেকে বের করতে পারি। কিন্তু আমাদের এখন একটু অভিনয় করতে হবে।

    ল্যাংডনের চোখ দুটো বড় হয়ে গেলো। আপনি চাচ্ছেন আমি পালাই?

    এটাই হবে আপনার জন্য সবচাইতে স্মার্ট কাজ। আপনি যদি ফশের কাছে ধরা দেন, তবে সে এক্ষুণি আপনাকে তার কাস্টডিতে নিয়ে নেবে। আপনাকে তখন কয়েক সপ্তাহ ফ্রান্সের জেলে কাটাতে হবে আর সেই সময়টাতে ডিসিপিজে এবং ইউএস এ্যামবাসি আপনার মামলাটা কোন্ কোর্টে হবে, সেটা নিয়ে লড়াই শুরু করে দেবে। কিন্তু, আপনি যদি এখান থেকে পালিয়ে গিয়ে আপনার এ্যামবাসিতে চলে যেতে পারেন, তবে আপনার সরকার আপনার অধিকার রক্ষা করতে পারবে। তখন আপনি আর আমি প্রমাণ করতে পারবো যে, এই হত্যাকাণ্ডের সাথে আপনার কোন সম্পর্ক নেই।

    ল্যাংডনকে দেখে মনে হলো না, সে পুরোপুরি একমত হতে পেরেছে। ভুলে যান এটা! সবগুলো বের হবার দরজায় ফুশে সশস্ত্র পাহাড়া বসিয়েছে। তারপরও যদি আমরা কোন গুলি না খেয়ে পালিয়ে যেতে পারি, তবে আমরা অপরাধী হিসেবেই প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাবো। আপনি ফশেকে বলুন যে, ফ্লোরের লেখা মেসেজটা আপনার জন্যই লেখা হয়েছে। আমার নামটা অভিযুক্তকারীর নাম হিসেবে লেখা হয়নি।

    আমি সেটা করবো, সোফি বললো, খুব দ্রুত কথা বলছে সে, তবে সেটা তখনই, যখন আপনি ইউএস এ্যামবাসির ভেতরে নিরাপদে থাকবেন। সেটা এখান থেকে মাত্র এক মাইল দূরে। জাদুঘরের বাইরে আমার গাড়িটা পার্ক করা আছে। এখানে ফশের সাথে দেনদরবার করাটা খুব বেশি জুয়া খেলা হয়ে যাবে। আপনি কি সেটা বুঝতে পারছেন না? ফশে আজরাতে তার মিশন ঠিক করে ফেলেছে, আপনাকে অপরাধী প্রমাণ করবেই সে। আপনি যদি কিছু করে বসেন তবে তার কেসটা আরো শক্তিশালী হবে, এই আশাই সে করছে।

    একদম ঠিক। যেমন পালিয়ে যাওয়া!

    সোফির সোয়েটারের পকেটে থাকা সেলফোনটা হঠাৎ করে বেজে উঠলো। সম্ভবত ফশে। সে পকেটে হাত দিয়ে ফোনটা বন্ধ করে দিলো।

    মি. ল্যাংডন, সে খুব হরবর করে বললো, আপনাকে আমি একটা শেষ প্রশ্ন করতে চাই। আর আপনার পুরো ভবিষ্যতটাই তার উপর নির্ভর করছে। ফ্লোরের লেখাটা একদম নিশ্চিত করে আপনার অপরাধের প্রমাণ নয়, তারপরও ফলে আমাদের পুরো টিমকে বলেছে যে, সে নিশ্চিত, আপনিই হলেন আসামী। আপনি কি এ ছাড়া অন্য কিছু ভাবতে পারেন, যা আপনাকে তার কাছে অপরাধী করতে পারে?

    ল্যাংডন কয়েক সেকেন্ড নিরব রইলো।তেমন কিছুই তো মনে হচ্ছে না।

    সোফি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। এর অর্থ, ফশে মিথ্যে বলছে। কেন, সোফি সেটা ভাবতে পারলো না। সত্য হলো এই, বেজু ফশে আজ রাতে রবার্ট ল্যাংডনকে চৌদ্দ শিকে ভরবেই, যে করেই হোক। সোফির নিজের জন্যেও ল্যাংডনকে প্রয়োজন। আর এ জন্যেই তার কাছে একমাত্র যে যৌক্তিক ব্যাপারটা মনে আসছে, সেটা আরো বেশি প্রহেলিকাময়। ল্যাংডনকে ইউএস এ্যামবাসিতে পৌঁছে দেয়ার দরকার।

    জানালার দিকে ঘুরে, সোফি কাঁচে লাগানো এলার্ম টেপটার দিকে তাকালো। সেখান থেকে নিচে তাকালো, চল্লিশ ফুট উচ্চতা হবে। এখান থেকে লাফ দেয়ার অর্থ ল্যাংডনের পা কয়েকটা জায়গায় ভেঙে যাওয়া। যাইহোক, সোফি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললো। রবার্ট ল্যাংডন লুভর থেকে পালাবেই, সে চাক আর না চাক।

     

    ১৭.

    কোন জবাব দিচ্ছে না মানে? ফশেকে খুব সন্দেহপ্রবণ দেখাচ্ছে। তুমি তার সেল ফোনে ফোন করেছে, ঠিক? আমি জানি ওটা তার সাথেই আছে।

    কোলে কয়েক মিনিট ধরেই সোফির সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করে যাচ্ছে। হয়তো তার ব্যাটারির চার্জ ফুরিয়ে গেছে। অথবা রিংটোন বন্ধ করে রেখেছে।

    ক্রিপ্টোলজির পরিচালকের সাথে ফোনে কথা বলার পর থেকেই ফলশকে খুব অস্থির দেখাচ্ছে। ফোনটা রেখেই সে কোলেতের কাছে এসে এজেন্ট নেভুকে ফোন করে তাকে দিতে বললো কিন্তু কোলেত লাইন দিতে ব্যর্থ হচ্ছে। ফশেকে দেখে মনে হলো খাঁচায় বন্দী একটা সিংহ পায়চারী করছে।

    ক্রিপ্টো থেকে কেন ফোন করা হয়েছিলো? কোলেত এবার জানতে চাইলো।

    ফশে তার দিকে তাকালো। এটা বলতে যে, ড্রাকোনীয় শয়তান আর ল্যাংড়া সেন্ট-এর ব্যাপারে তারা কিছু খুঁজে পায়নি।

    এই?

    না, তারা আরো বলেছে, এইমাত্র সংখ্যাগুলোকে তারা ফিবোনাচ্চি সংখ্যা হিসেবে চিহ্নিত করতে পেরেছে। কিন্তু তাদের সন্দেহ এটা একেবারেই অর্থহীন একটা জিনিস।

    কোলেতকে দ্বিধাগ্রস্ত দেখালো। কিন্তু তারা তো ইতিমধ্যে এজেন্ট নেভুকে আমাদের কাছে পাঠিয়েছে।

    ফশে মাথা নাড়লো। তারা নেভুকে পাঠায়নি। কি?

    ডিরেক্টরের মতে, আমার নির্দেশে তিনি তার পুরো দলটিকে আমার পাঠানো ছবিগুলো বিশ্লেষণে লাগিয়ে দেন। এজেন্ট নেভু ওখানে আসার পর সনিয়ের একটা ছবি আর কোডটা নিয়ে কোন কথা না বলেই অফিস থেকে বেড়িয়ে যায়। ডিরেক্টর বলেছেন, তিনি সোফিকে তার আচরণের ব্যাপারে কোন প্রশ্ন করেননি, কারণ ছবিগুলো দেখে সোফি সঙ্গত কারণেই ভেঙে পড়েছিলো।

    ভেঙে পড়েছিলো? সে কি কখনও মৃতদেহের ছবি দেখেনি?

    ফশে কিছুক্ষণ নিরব রইলো, এ ব্যাপারটা কেউই জানতো না, যতক্ষণ না সহকর্মীদের একজন ডিরেক্টরকে জানিয়েছিলো যে, আসলে জ্যাক সনিয়ে সোফি নেভুর দাদা হোন।

    কোলেত বাকরুদ্ধ হয়ে গেলো।

    ডিরেক্টর বলেছেন, সোফি একবারও বলেনি যে জ্যাক সনিয়ে তার দাদা হোন, আর তাঁর মতে এটা এজন্যে যে, সোফি তার বিখ্যাত দাদার কথা বলে কোন ধরনের বাড়তি সুবিধা পেতে চায়নি।

    ছবি দেখে ভেঙে পড়েছিলো তাতে অবাক হবার কিছু নেই। কোলেত কখনও কল্পনাও করতে পারেনি যে, কাউকে একদিন একটা কোডের মর্মোদ্ধার করতে বলা হবে তারই নিকট আত্মীয়ের হত্যাকাণ্ডের পর, ভিকটিমের নিজের লেখা সেই কোড। তারপরও সোফির আচরণ বেখাপ্পা মনে হচ্ছে। কিন্তু সে তো নিশ্চিতভাবেই সংখ্যাগুলো ফিবোনাচ্চি সংখ্যা হিসেবে চিহ্নিত করে আমাদের কাছে এসে বলে গেছে। আমি বুঝতে পারছি না, কেন সে অফিসের কাউকে সেই কথাটা না বলে অফিস থেকে বের হয়ে গেলো।

    কোলেত এই রকম ঘটনার একটা ব্যাখ্যার কথাই ভাবতে পারছে আর তা হলো, সনিয়ে এই আশায় ফ্লোরে একটা সংখ্যাগত কোড লিখেছেন যাতে ফশে একজন ক্রিপ্টোগ্রাফারকে এই ঘটনায় যুক্ত করে, আর এভাবেই তার নিজের নাতনী জড়িত হয়ে যাবে। আর বাকী লেখাগুলো তার নাতনীর কাছে দেয়া এক ধরনের মেসেজ ছাড়া আর কী? কিন্তু এতে ল্যাংডনকে কিভাবে মেলানো যায়?

    কোলেত এর চেয়ে বেশি ভাবোর আগেই, ফাঁকা জাদুঘরটা এলামের আওয়াজে কেঁপে উঠলো। মনে হলো এলার্মটা গ্র্যান্ড গ্যালারির ভেতর থেকে আসছে।

    এলার্মে! একজন এজেন্ট চিৎকার করে বললো। তার চোখ ভরের সিকিউরিটি সেন্টারের দিকে। গ্যালারি তয়লেত, মেঁসিয়ে!

    ফশে কোলেতের দিকে দ্রুত ঘুরে দাঁড়ালো। ল্যাংডন কোথায়?

    এখনও পুরুষ টয়লেটেই আছে! কোলেত ল্যাপটপের পর্দায় লাল বিন্দুটার অবস্থানে দিকে ইঙ্গিত করে বললো, সে জানালার কাঁচ ভেঙেছে, নিশ্চিত! কোলেত জানতো ল্যাংডন বেশি দূরে যেতে পারবে না। যদিও প্যারিসের ফায়ার কোড অনুযায়ী পনেরো মিটার উঁচুতে অবস্থিত জানালার কাঁচ আগুন লাগলে ভাঙা যেতে পারে, তবে লুভরের দোতলা থেকে মই অথবা হুক ছাড়া নামার অর্থ হলো নির্ঘাত আত্মহত্যা করা। আরেকটি ব্যাপার, ডেনন উইংয়ের পশ্চিম দিকে কোন গাছ-পালা নেই এমনকি মাটিতে কোন ঘাসও নেই যে, পড়ে গেলে কিছুটা রক্ষা পাওয়া যাবে। বিশ্রাম ঘরের জানালার নিচে দুই লেইন বিশিষ্ট প্লেস দু কারুজেল অবস্থিত।

    হায় ঈশ্বর, পর্দার দিকে তাকিয়ে কোলেত চিৎকার করে বললো। ল্যাংডন জানালা দিয়ে লাফ দিয়েছে!

    কিন্তু ফশে ইতিমধ্যেই তার কাজ শুরু করে দিয়েছে। তার ম্যানুরিন এম আর-৯৩ রিভলবারটা হাতে নিয়ে অফিস থেকে বেড়িয়ে গেছে।

    কোলেত পর্দার দিকে ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে চেয়ে আছে, তার চোখে বিস্ময়। লাল বিন্দুটা এই ভবনের বাইরে চলে গেছে। হচ্ছেটা কি? সে অবাক হলো। ল্যাংডন কি জানালা দিয়ে, নাকি–

    হায় যিশু। লাল বিন্দটা লাফিয়ে লাফিয়ে দেয়াল অতিক্রম করে ফেললে কোলেত উত্তেজনায় দাঁড়িয়ে গেলো। সিগনালটা একটু থামলো, তারপর বিন্দুটা ভবনের বাইরে, প্রায় দশ গজ দূরে চলে গেলো।

    তড়িঘড়ি করে কোলেত প্যারিসের রাস্তা-ঘাটের মানচিত্রটার জন্য কম্পিউটারে সার্চ করে জিপিএস সিস্টেমটা ঠিক করে নিলো। দৃশ্যটা একটু বড় করে সে বিন্দুটার একেবারে নিখুঁত অবস্থান দেখতে পেলো।

    এটা আর নড়ছে না।

    এটা এখন প্লেস দু কারুজেল-এর মাঝখানে থেমে আছে। ল্যাংডন ঝাঁপ দিয়ে…

     

    ১৮.

    ফশে ঊর্ধ্বশ্বাসে গ্র্যান্ড গ্যালারির দিকে ছুটে চললো, কোলেতের রেডিওটা ঘরঘর করছে, কিন্তু এলার্মের শব্দে সেটা শোনা যাচ্ছে না।

    সে ঝাঁপ দিয়েছে! কোলেত চিৎকার করে বলছে। আমি সিগনালটাকে প্লেস দু কারুজেলে দেখতে পাচ্ছি। বাথরুমের জানালার বাইরে! এটা একদমই নড়ছে না! হায় যিশু, আমার মনে হচ্ছে ল্যাংডন আত্মহত্যা করেছে, আর কিছু না।

    ফশে কথাটা শুনতে পেলো, কিন্তু তার কাছে এগুলো কোন অর্থই বহন করছে না। সে দৌড়াতেই লাগলো। হলওয়েটা মনে হচ্ছে কখনও শেষ হবে না। সনিয়ের মৃতদেহটা দৌড়ে অতিক্রম করার সময় সে ডেনন উইংয়ের পার্টিশনের দিকে তাকালো। এলার্মটা আরো জোরে শোনা যাচ্ছে।

    দাঁড়ান! রেডিওতে কোলেতের কণ্ঠটা চিৎকার করে বললো, সে নড়ছে! হায় ঈশ্বর, সে বেঁচে আছে। ল্যাংডন পালাচ্ছে!

    ফশে দৌড়াতেই লাগলো, প্রতিটি পদক্ষেপে হলওয়ের দৈর্ঘ্যটা কমিয়ে আনছে সে।

    ল্যাংডন খুব দ্রুত দৌড়াচ্ছে। কোলেত রেডিওতে চিৎকার করেই যাচ্ছে। সে কারুজেল দিয়ে দৌড়াচ্ছে। দাঁড়ান… সে খুব জোরে দৌড় শুরু করেছে। সে তো দেখি প্রচণ্ড দ্রুত দৌড়াচ্ছে।

    পার্টিশনের দিকে আসতেই ফশে দেখতে পেলো বিশ্রাম ঘরের দরজাটা, সে ওদিকেই দৌড়ে গেলো।

    এলার্মের শব্দে ওয়াকি-টকির কথা আর শোনা গেলো না। সে কোনও গাড়িতে চড়ে থাকবে! আমার মনে হয় সে গাড়িতেই আছে! আমি বলতে পারছি না–

    ফশে প্রবল বেগে পুরুষ টয়লেটের ভেতরে অস্ত্র হাতে ঢুকতেই কোলেতের কথাগুলো এলামের আওয়াজ গিলে ফেললো। পুরো ঘরটা ভালো করে দেখে নিলো সে। ঘরটা একেবারেই ফাঁকা। বাথরুমও খালি। ফশের চোখ ঘরের ভাঙাচোরা জানালাটার দিকে গেলো। সে দৌড়ে জানালার কাছে গিয়ে নিচের দিকে তাকালো। ল্যাংডনকে কোথাও দেখা গেলো না। ফলে কোনভাবেই ভাবতে পারলো না, এ রকম ঝুঁকি কেউ নিয়ে থাকবে। নিশ্চিতভাবেই, কেউ যদি এখান থেকে লাফ দেয়, তবে মারাত্মকভাবে আহত হবে।

    এলার্মটা বন্ধ করে দেয়া হলে ওয়াকিটকিতে কোলেতের কণ্ঠটা আবারো শোনা গেলো।

    …দক্ষিণ দিকে যাচ্ছে … খুব দ্রুত … পন দু কারুজেল দিয়ে সিন নদীটা পার হচ্ছে!

    ফশে তার বাম দিকে ঘুরলো। পন দু কারুজেলের রাস্তায় একমাত্র যে যানবাহনটা আছে, সেটা হলো বিশাল বড় একটা টুইনবেড ডেলিভারি ট্রাক, লুভর থেকে দক্ষিণ দিকে চলে যাচ্ছে সেটা। ট্রাকের পেছনের খোলা ডালাটা ত্রিপল দিয়ে ঢাকা, একটা বিশাল হ্যামোক আছে সেখানে। ফশে খুব দ্রুতই বুঝতে পারলো ব্যাপারটা। এই ট্রাকটা কিছুক্ষণ আগে বিশ্রামঘরের নিচে ট্রাফিক সিগনালের জন্য থেমে ছিলো।

    একটা উন্মাদগ্রস্ত ঝুঁকি, ফশে আপন মনে বললো। ল্যাংডনের কোনভাবেই জানতে পারা কথা নয়, ত্রিপলের নিচে কী আছে। ট্রাকটা যদি স্টিল বহন করে থাকে তবে কি হবে? অথবা সিমেন্ট? কিংবা ময়লা আবর্জনা? চল্লিশ ফুট উঁচু থেকে ঝাঁপ দেয়া? একেবারেই পাগলামী।

    ডটটা ঘুরে যাচ্ছে! কোলেত জানালো, পন দে সেন-পেরেজর দিকে যাচ্ছে!

    ঠিক তা-ই, ট্রাকটা বৃজ অতিক্রম করে ধীরে ধীরে পন দে সেন-পেরেজর দিকে যাচ্ছে। তাই হোক, ফশে ভাবলো। কোলেত ইতিমধ্যেই ওয়্যারলেসের মাধ্যমে কয়েকজন এজেন্টকে লুভর থেকে বাইরে পাঠিয়ে দিয়েছে। তাদেরকে প্যাট্রল গাড়িতে করে রাস্তায় টহল দিতে বলে দিয়েছে সে। এরই মধ্যে ট্রাকটার অবস্থান পরিবর্তিত হলো, যেনো ব্যাপারটা অদ্ভুত একটি চোর-পুলিশ খেলা।

    খেলা শেষ হয়ে গেছে, ফশে জানতো। তার লোকজন মিনিট খানেকের মধ্যেই ট্রাকটা আঁটকে ফেলতে পারবে। ল্যাংডন কোথাও যেতে পারবে না।

    অস্ত্রটা জায়গামতো রেখে ফশে বিশ্রামঘর থেকে বের হয়ে কোলেতকে ওয়্যারলেস করলো। আমার গাড়িটা নিয়ে আসতে বলো। গ্রেফতারের সময়টাতে আমি ওখানে থাকতে চাই।

    ফশে গ্র্যান্ড গ্যালারি থেকে বের হতে হতে ভাবছিলো, ল্যাংডন যদি এখান থেকে লাফ দেয়ার পরও বেঁচে থাকে, তবে সেটা অবাক হবার মতোই ব্যাপার হবে।

    এটা অবশ্য কোন ব্যাপার না।

    ল্যাংডন পালিয়েছে, অভিযুক্ত হয়ে।

    ***

    বিশ্রাম-ঘর থেকে মাত্র পনেরো গজ দূরেই ল্যাংডন আর সোফি গ্র্যান্ড গ্যালারির ছায়া ঢাকা জায়গাটাতে দাঁড়িয়েছিলো। ফশে বাথরুম থেকে বের হবার সময় তারা নিজেদেরকে খুব কষ্ট করে দৃষ্টির আড়ালে রাখতে পেরেছিলো। তার হাতে অস্ত্র ছিলো। হুরমুর করে বাথরুমে ঢুকেছিলো সে। শেষ ষাট সেকেন্ড সময়টা ছিলো ঘোরের মতো।

    ল্যাংডন পুরুষ টয়লেটের ভেতরে দাঁড়িয়ে বার বার পালাতে অস্বীকৃতি জানাচ্ছিলো। যে অপরাধ সে করেনি, সেই অপরাধ থেকে কেন সে পালাবে। যখন সোফি জানালার এলার্মটা পরীক্ষা করে নিচের দিকে তাকালো, তার ভাবসাব দেখে মনে হলো উপর থেকে লাফ দেবার হিসাব কষছে সে।

    ছোট্ট একটা নিশানার সাহায্যে এখান থেকে আপনি বের হয়ে যেতে পারেন, সে বলেছিলো।

    নিশানা? অস্বস্তি নিয়ে বিশ্রাম ঘরের জানালার দিকে তাকিয়েছিলো সে।

    রাস্তায়, একটা বিশাল আকারের আঠারো চাকার ট্রাক দাঁড়িয়ে আছে।

    ট্রাকটার ডালায় বিশাল একটা ত্রিপল দিয়ে মালপত্রগুলো ঢেকে রাখা হয়েছে। ল্যাংডন আশা করলো সোফিকে দেখে যা মনে হচ্ছে সে যেনো তা না ভাবে। সোফি, আমি কোনভাবেই লাফ দিচ্ছি না–

    ট্র্যাকিং ডটটা বের করুন।

    হতবুদ্ধিকর ল্যাংডন তার পকেট হাতরাতে লাগলো। হাতরাতে হাতরাতে পেয়ে গেলো ছোট্ট ধাতব জিনিসটা। সোফি সেটা হাতে নিয়ে সিংকে রেখে দিলো। একটা টয়লেট সাবান নিয়ে সেটার মধ্যে ধাতব বস্তুটি চেপে ধরে রাখলো যতোক্ষণ না সেটা দেবে গিয়ে আঁটকে না গেলো।

    সাবানটা ল্যাংডনের কাছে ফিরিয়ে দিয়ে সোফি একটা ময়লা ফেলার ভারি ড্রাম টেনে এনে জানালার কাছে নিয়ে এলো। ল্যাংডন কোন কিছু বলার আগেই সেই ড্রামটা দিয়ে জানালায় আঘাত করে জানালার কাঁচ ভেঙে ফেললো।

    এলার্মটা মাথার উপর প্রচণ্ড শব্দে বাজতে শুরু করলো।

    সাবানটা আমার হাতে দিন। সোফি চিৎকার করে বললো, এলার্মের আওয়াজে কিছু শোনা যাচ্ছিলো না।

    ল্যাংডন সাবানটা তার হাতে তুলে দিলো।

    সাবানটা হাতে নিয়ে, সোফি ভাঙা জানালা দিয়ে নিচে দাড়িয়ে থাকা আঠারো চাকার গাড়িটার দিকে তাকালো। টার্গেটটা খুব বেশি বড় আকাড়ের আর সেটা বিল্ডিংটা থেকে দশ ফুটেরও কম দূরত্বে দাঁড়িয়ে আছে। ট্রাফিক বাতিটা পরিবর্তন হবার আগেই, সোফি গভীর একটা নিঃশ্বাস নিয়ে সাবানটা ছুঁড়ে মারলো।

    সাবানটা ট্রাকের উপর গিয়ে পড়ে সেটা ত্রিপলের মধ্যে আঁটকে রইলো। আর ট্রাফিক সিগনালের বাতিটা সবুজ রঙে আসতেই ট্রাকটা সাঁই করে চলে গেলো।

    কগ্রাচুলেশনস্, দরজার দিকে তাকে টেনে নিয়ে যেতে যেতে সোফি বললো। আপনি লুভর থেকে পালিয়ে গেলেন আর কী।

    পুরুষ টয়লেট থেকে বের হয়েই তারা অন্ধকারে সরে পড়লো। ফশে খুব দ্রুতই এসে পড়েছিলো। এবার ফায়ার এলার্মটা বন্ধ হতেই ল্যাংডন শুনতে পেলো ডিসিপিজের সাইরেন লুভর থেকে বের হয়ে যাচ্ছে। পুলিশের হিজরত হচ্ছে। ফশেও খুব দ্রুতই গ্র্যান্ড গ্যালারি থেকে বের হয়ে গেলে জায়গাটা ফাঁকা হয়ে গেলো।

    গ্র্যান্ড গ্যালারির পেছনে, আনুমানিক পঞ্চাশ মিটার দূরে, একটা জরুরি সিঁড়ি আছে, সোফি বললো।

    এখন প্রহরীরা এই এলাকা ছেড়ে চলে গেলেই আমরা এখান থেকে বের হয়ে যেতে পারবো।

    ল্যাংডন ঠিক করলো আজ রাতে আর কিছু বলবে না। সোফি নেভুকে এখন তার চেয়েও অনেক বেশি বুদ্ধিমান বলেই মনে হচ্ছে।

     

    ১৯.

    সেন্ট-সালপিচ গীর্জা, বলা হয়ে থাকে প্যারিসের অন্য যেকোন দালানের চেয়ে এর ইতিহাস একটু ভিন্ন ধরনের। মিশরীয় দেবী আইসিসের একটা ভগ্নপ্রায় মন্দিরের উপর এটি নির্মাণ করা হয়েছিলো। গীর্জাটাতে একটা স্থাপত্যিক পদচিহ্ন আছে যেটা নটরডেমের পদচিহ্নের সাথে একেবারে মিলে যায়। এই গীর্জাটাতেই মারকুইস দ্য সাদ এবং বোদলেয়ারের ব্যাপটিজম অনুষ্ঠিত হয়েছিলো, সেই সাথে ভিক্টর হুগোর বিয়েটাও। গীর্জা সংলগ্ন সেমিনার কক্ষটি অপ্রচলিত ইতিহাসের জ্বলন্ত সাক্ষী, এক সময় গুপ্ত সভা কক্ষটি অসংখ্য গুপ্ত সংঘের আখড়া ছিলো।

    আজরাতে সেন্ট-সালপিচ গীর্জাটা কবরের মতোই নিরব-নিথর। সাইলাস আঁচ করতে পারলো সিস্টার সানড়ন তাকে ভেতরে নিয়ে যাবার সময় একটু অস্বস্তিতে ভুগছিলেন। এতে অবশ্য সে খুব একটা অবাক হয়নি। তার উপস্থিতিতে লোকজন যে অস্বস্তিবোধ করে থাকে, সাইলাস তাতে অভ্যস্ত ছিলো।

    আপনি একজন আমেরিকান, সিস্টার বললেন।

    জন্মসূত্রে ফরাসি, সাইলাস জবাব দিলো। স্পেনেও আমি ছিলাম, আর এখন যুক্তরাষ্ট্রে লেখাপড়া করছি।

    সিস্টার সানন মাথা নেড়ে সায় দিলেন। তিনি ছোটোখাটো একজন মহিলা, শান্ত শিষ্ট চোখের অধিকারিনী। আপনি কখনও সেন্ট-সালপিচ দেখেননি?

    আমি বুঝতে পারছি, এটা না দেখাটা এক ধরনের পাপই।

    দিনের বেলায় এটা আরো বেশি সুন্দর দেখায়।

    এ ব্যাপারে আমিও নিশ্চিত। তাসত্ত্বেও, আজরাতে আমাকে এখানে আসার সুযোগ করে দেয়ার জন্য আপনার কাছে খুবই কৃতজ্ঞ।

    আব্বে এজন্য আমাকে অনুরোধ করেছিলেন। আপনার তো দেখছি অনেক ক্ষমতাবান বন্ধ রয়েছে।

    আপনার কোন ধারণাই নেই, সাইলাস ভাবলো।

    সিস্টার সানভৃনের পেছনে পেছনে ভেতরে যাওয়ার সময় সাইলাস গীর্জার ভেতরটা দেখে অবাক হলো। রঙ-বেরঙের ফ্রেসকো, ছাদের নক্সা এবং উষ্ণ কাঠের জন্য সেন্ট-সালপিচ গীর্জাটাকে নটরডেমের মতো মনে হয় না। নিরব-নিথর আর ভেতরের পরিবেশ শীতল, অনেকটা স্পেনের ক্যাথেড্রালের মতো। সাজসজ্জার কমতির কারণে ভেতরটা আরো বেশি অভিজাত বলে মনে হয়। ছাদের দিকে তাকাতেই তার মনে হলো, সে কোন উল্টো করে রাখা বিশাল জাহাজের নিচে দাঁড়িয়ে আছে।

    খাপ খেয়ে যাওয়া দৃশ্য, সে ভাবলো। ভ্রাতৃসংঘের জাহাজটা চিরতরের জন্যই উল্টে যাবে। কাজে নেমে যাবার জন্য উদগ্রীব সাইলাস সিস্টার সানভৃনকে অনুরোধ করলো যাতে তাকে একটু একা থাকতে দেয়া হয়। তিনি খুবই ছোটোখাটো আকৃতির একজন মহিলা, যাকে সাইলাস খুব সহজেই কাবু করতে পারবে, কিন্তু সে প্রতীজ্ঞা করেছে, একেবারে প্রয়োজন না হলে শক্তি প্রয়োগ করবে না। তিনি একজন নারী, আর ভ্রাতৃসংঘের লোকেরা তাঁর চার্চকে নিজেদের কি-স্টোনটা লুকানোর কাজে ব্যবহার করার জন্য তো তাকে দায়ী করা যায় না। অন্যের পাপের জন্য তাকে শাস্তি দেয়াটা ঠিক হবে না।

    আমি খুবই বিব্রতবোধ করছি, সিস্টার। আমার জন্য আপনাকে ঘুম থেকে উঠতে হয়েছে।

    না, তা নয়। আপনি প্যারিসে খুব অল্প সময়ের জন্য আছেন। সেন্ট-সালপিচ না দেখাটা ঠিক হবে না। আপনি কি চার্চের স্থাপত্য দিক নাকি ঐতিহাসিক দিকের প্রতি বেশি আগ্রহী?

    আসলে, সিস্টার, আমার আগ্রহটা আধ্যাত্মিক ব্যাপারেই।

    সিস্টার একটা প্রশান্তির হাসি হাসলেন। তাহলে তো কোন কথাই নেই। আমি ভাবছিলাম, আপনি কোথা থেকে আপনার পরিদর্শনটা শুরু করবেন।

    সাইলাস বুঝতে পারলো তার চোখ বেদীর দিকে। পরিদর্শনের কোন প্রয়োজন নেই। আপনার দয়া সিস্টার। আমি নিজেই ঘুরে ঘুরে দেখতে পারবো।

    আমার কোন সমস্যা হবে না। তিনি বললেন। হাজার হোক আমিতো জেগেই গেছি।

    সাইলাস হাটা থামিয়ে দিলো। তারা বেদী থেকে মাত্র পনেরো গজ দূরে এসে পড়েছে। সে তার বিশাল দেহটা ছোটোখাটো মহিলার দিকে ঘুরালো। মহিলার চোখের দিকে তাকিয়ে তার পিছু হটার কারণটা বুঝতে পারলো। তার লাল চোখের দিকে সিস্টার তাকিয়ে ছিলো। যদি আপনার কাছে এটা খুব বেশি অভদ্র মনে না হয় সিস্টার, আমি ঈশ্বরের ঘরে শুধুমাত্র এমনিতে ঘোরাঘুরি করার ব্যাপারে অভ্যস্ত নই। প্রার্থনা করার আগে আমি একা একা জায়গাটা ঘুরে দেখলে আপনি কি কিছু মনে করবেন?

    সিস্টার সানড়ন একটু দ্বিধাগ্রস্ত হলেন। ওহ্, অবশ্যই। আমি চার্চের বেলকনিতে আপনার জন্য অপেক্ষা করবো।

    সাইলাস আলতো করে তার ভারি হাতটা সিস্টারের কাঁধে রেখে তার দিকে তাকালো। সিস্টার, আপনাকে ঘুম থেকে উঠিয়ে আমি বেশ অপরাধ বোধ করছি।

    আর আপনাকে জেগে থাকতে বলাটা খুব বেশি হয়ে যাবে। দয়া করে আপনি আপনার বিছানায় ফিরে যান। আমি আপনার চার্চে একা একা ভালোই থাকবো, তারপর একাই চলে যেতে পারবো।

    সিস্টার খুব অস্বস্তি বোধ করলেন। আপনি কি নিশ্চিত, এখানে আপনার একা একা খারাপ লাগবে না?

    মোটেই না। একা একা প্রার্থনা করাই সবচেয়ে বেশি আনন্দের।

    আপনার যেমন ইচ্ছে।

    সাইলাস তার হাতটা সিস্টারের কাঁধ থেকে সরিয়ে নিলো। ভালো ঘুম হোক, সিস্টার। ঈশ্বরের শান্তি আপনার সাথেই থাকুক।

    আপনার সাথেও। সিস্টার সানড়ন সিঁড়ির দিকে এগিয়ে গেলেন। বেড়িয়ে যাবার সময় দয়া করে দরজাটা ভালো করে লাগিয়ে যাবেন।

    ঠিক আছে। সাইলাস দেখলো তিনি চলে যাচ্ছেন। পুরোপুরি অপসৃত হবার পর সে ঘুরে হাটু গেঁড়ে বসে পড়লো, সিলিস বেল্টটার চাপ অনুভব করলো।

    হে ঈশ্বর, আজ যে কাজটি আমি করবো, সেটা তোমাকে নিবেদন করছি।

    কয়্যার বেলকনির ছায়া ঢাকা অংশ থেকে সিস্টার বেদীর সামনে হাটু গেঁড়ে বসা যাজকের দিকে আড়াল থেকে তাকালেন। তার মনে আচমকা একটা ভয় চেপে বসাতে ভাবতে শুরু করলেন, এই রহস্যময় অতিথি হতে পারে শত্রুপক্ষের কেউ, তারা তাকে আগেই এ ব্যাপারে সর্তক করে দিয়েছিলো। আজ রাতে হয়তো সে রকমই কিছু হবে, আর এজন্য সে অনেক বছর ধরে আদেশ বহন করে চলছে। সিস্টার ঠিক করলেন, তিনি অন্ধকারে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখবেন লোকটার প্রতিটি চলাফেরা।

     

    ২০.

    ছায়া ঢাকা জায়গা থেকে বের হয়ে ল্যাংডন আর সোফি চুপিসারে ফাঁকা গ্র্যান্ড গ্যালারির করিডোরে এসে উপস্থিত হলো। তারা জরুরি বহিগমনের সিঁড়িটার দিকে এগিয়ে গেলো।

    চলতে চলতে ল্যাংডনের মনে হলো সে অন্ধকারের মধ্যে জিগশ পাজল মেলাবার চেষ্টা করছে। এই রহস্যের নতুন মাত্রাটা হলো খুবই সমস্যা সংকুল আর কঠিন একটি অবস্থা।

    জুডিশিয়াল পুলিশের ক্যাপ্টেন আমাকে এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় ফাঁসানোর চেষ্টা করছে।

    আপনি কি মনে করেন, সে ফিসফিস করে বললো, ফশে নিজেই মেসেজটা ফ্লোরে লিখেছে?

    সোফি এমন কি তার দিকে ঘুরেও তাকালো না। অসম্ভব।

    ল্যাংডন অবশ্য খুব নিশ্চিত ছিলো না। সে আমাকে অপরাধী বানাতে সচেষ্ট বলে আমার মনে হচ্ছে। হয়তো সে ভেবেছে, ফ্লোরে আমার নাম লিখে দিলে তার মামলায় সাহায্য হবে?

    ফিবোনাচ্চি সংখ্যক্রমটা? পি,এস? দা ভিঞ্চি আর দেবীদের সবগুলো প্রতীকের ব্যাপারটা? এটা আমার দাদুই করেছেন।

    ল্যাংডন জানে সোফি ঠিকই বলছে। প্রতীকগুলোর সবই নিখুঁতভাবে জালের বুননের মতো—পেনটাকল, ভিটরুবিয়ান ম্যান, দা ভিঞ্চি, দেবী, এমন কি ফিবোনাচ্চি সংখ্যাক্রমটা। এক সেট সঙ্গতিপূর্ণ প্রতীকসমূহ, আইকনোগ্রাফাররা এটাকে এ নামেই ডাকবে। সবগুলোই একটার সাথে আরেকটা সংযুক্ত।

    আজ বিকেলে তিনি আমাকে ফোন করেছিলেন, সোফি যোগ করলো। তিনি আমাকে বলেছিলেন যে, আমাকে তার কিছু বলার আছে। আমি নিশ্চিত ভরে রেখে যাওয়া মেসেজটার মধ্য দিয়ে তিনি আমাকে কিছু বলতে চেয়েছেন, কোন গুরুত্বপূর্ণ কথা, এমন কিছু যা তিনি ভেবেছেন যে, আপনি সেটা আমাকে বুঝতে সাহায্য করতে পারবেন।

    ল্যাংডনের চোখ ছানাবড়া হলো। Oh, Draconian devil! ০, laine saint! ও, ড্রাকোনীয় শয়তান! ওহ, ল্যাংড়া সেন্ট! তার ইচ্ছে করলো মেসেজটা আবার উচ্চারণ করবে, সোফি এবং তার নিজের জন্য। ব্যাপারটা সেই প্রথম থেকে, যখন ল্যাংডন ক্রিপটিক শব্দগুলো দেখেছিলো, শুধুই খারাপের দিকেই যাচ্ছে। বাথরুমের জানালা দিয়ে ভূয়া লাফ দেয়াতে ল্যাংডনের জনপ্রিয়তায় কোন সাহায্যে আসবে না। সে সন্দেহ করলো, ফরাসি পুলিশের ক্যাপ্টেন পিছু নিয়ে সাবানের বারটা খুঁজে পেয়ে একটা কৌতুককর দৃশ্যই দেখবে।

    দরজাটা খুব বেশি দূরে নয়, সোফি বললো।

    আপনি কি মনে করেন, আপনার দাদুর মেসেজটাতে যে সংখ্যাগুলো আছে সেগুলো দিয়ে বাকি লাইনগুলো বোেঝার কোন সম্ভাবনা আছে? ল্যাংডন একবার বাকোনিয়ান ম্যানুস্ক্রিপ্টের ওপর কাজ করেছিলো, যেখানে শিলালিপিতে সাংকেতিক লিপি দেয়া ছিলো, যাতে করে নির্দিষ্ট একটা কোডের মাধ্যমে সংকেত উদ্ধার করা যায়।

    সারা রাত ধরে আমি সংখ্যাগুলো নিয়ে ভেবেছি। কিছুই পাইনি। গাণিতিক দিক থেকে এগুলো খুব এলোমেলোভাবে বিস্তৃত হয়ে আছে। একটা ক্রিপ্টোগ্রাফীয় প্রহেলিকা।

    তারপরও সেগুলোর সবটাই ফিবোনাচ্চি সংখ্যাক্রম। এটাতো কাকতালীয় হতে পারে না।

    তা না। ফিবোনাচ্চি সংখ্যাক্রম ব্যবহার করার মধ্য দিয়ে আমার দাদু আমার দৃষ্টি আকর্ষণই করতে চেয়েছেন যেমন, মেসেজটা তিনি ইংরেজিতে লিখেছেন, অথবা আমার প্রিয় চিত্রকর্মের অনুকরণে নিজেকে মেলে ধরেছেন। কিংবা নিজের শরীরে পেনটাকল আঁকা। সবটাই, আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য।

    পেনটাকল কি আপনার কাছে কোন অর্থবহন করে?

    হ্যাঁ। আমি সেটা আপনাকে বলার সুযোগ পাইনি, আমার দাদু এবং আমার মধ্যে পেনটাকল একটা বিশেষ প্রতীক ছিলো সেই ছোট বেলা থেকেই। আমরা আনন্দ পাওয়ার জন্য টারোট কার্ড খেলতাম। আর আমার ইন্ডিকেটর কার্ডটা সবসময়ই হতো পেনটাকল।

    ল্যাংডন শীতল অনুভব করলো। তারা টারোট খেলতো? মধ্যযুগের ইতালিয় কার্ড খেলাটাতে ঐতিহ্যবাহী প্রতীকের এতো বেশি প্রাচুর্য ছিলো যে, ল্যাংডন তার নতুন লেখাটার একটা পুরো অধ্যায়ই টারোট-এর নামে উৎসর্গ করেছে। বাইশ কার্ডের এই খেলাটায় মহিলা পোপ, তারকা ইত্যাদি নামও রয়েছে। উৎসের দিক থেকে, টারোট এমন একটি আদর্শিক অর্থ বহন করে যা চার্চ কর্তৃক নিষিদ্ধ। বর্তমানে, টারোটর রহস্যময় গুণাবলীর জন্য এই বিদ্যাটা আধুনিক জ্যোতিষীদের কাছে চলে গেছে।

    টারোটর ইঙ্গিতপূর্ণ পবিত্র নারীর পোশাকটা হলো পেনটাকল, ল্যাংডন ভাবলো। বুঝতে পারলো, সনিয়ে যদি তার নাতনীর সাথে আনন্দঘন সময় কাটানোর জন্য। খেলাটা খেলে থাকে, তবে পেনটাকল জোক হিসেবে যথার্থই ছিলো।

    তারা জরুরি সিঁড়ির কাছে এসে পড়লে সোফি খুব সাবধানে দরজাটা খুললো। কোন এলার্ম বাজলো না। শুধুমাত্র বাইরের দরজার সাথে একটা তার সংযুক্ত আছে। সোফি ল্যাংডনকে সরু সিঁড়িটা দিয়ে নিচে নামার জন্য পথ দেখিয়ে আগে আগে নামতে শুরু করলো। কিছু দূর নামার পর গতি একটু বাড়িয়ে দিলো।

    আপনার দাদু, দ্রুত তার পেছনে নামতে নামতে ল্যাংডন বললো, কখন আপনাকে পেনটাকলের ব্যাপারে বলেছিলেন, তিনি কি কোন দেবীপূজা অথবা ক্যাথলিক চার্চের সাথে সংশ্লিষ্ট কোন কিছুর উল্লেখ করেছিলেন?

    সোফি মাথা ঝাঁকালো। আমি আসলে এটার গাণিতিক ব্যাপারটার ব্যাপারেই বেশি আগ্রহী ছিলাম—স্বর্গীয় অনুপাতের ব্যাপার অর্থাৎ PHI, ফিবোনাচ্চি সংখ্যক্রম, এরকম কিছু জিনিস।

    ল্যাংডন খুব অবাক হলো। আপনার দাদু আপনাকে PHI সংখ্যা সম্পর্কে শিক্ষা দিয়েছেন?

    অবশ্যই। স্বর্গীয় অনুপাত। তার চেহারায় লাজুক একটা ভাব দেখা গেলো। সত্যি বলতে কী, তিনি ঠাট্টা করে বলতেন আমি হলাম অর্ধেক স্বর্গীয়…বুঝতেই পারছেন, আমার নামের অক্ষরগুলোর কারণে।

    ল্যাংডন কথাটা একটু সময় নিয়ে ভেবে আপন মনে বলে উঠলো। S – O – PHI -e

    অন্যমনস্কভাবে ল্যাংডন PHI নিয়ে ভাবতে লাগলো। সে বুঝতে পারলো সনিয়ের কু-গুলো প্রথম দিকে সে যতোটা আন্দাজ করতে পেরেছিলো তার চেয়েও বেশি সুসংহত।

    দা ভিঞ্চি… ফিবোনাচ্চি সংখ্যাক্রম … পেনটাকল।

    অবিশ্বাস্যভাবে এইসবগুলো জিনিস একটা ধারণার সাথেই সংযুক্ত, সেটা হলো চিত্র কলার ইতিহাস, যা ল্যাংডন প্রায়শই তার শ্রেণী কক্ষে টপিক হিসেবে বলে থাকে।

    PHI

    ল্যাংডন আচমকাই অনুভব করলো সে হারভার্ডে ফিরে গেছে, দাঁড়িয়ে আছে তার চিত্রকলায় সিম্বোলিজম ক্লাসের সামনে। তার প্রিয় সংখ্যাটা ব্ল্যাকবোর্ডে লিখছে।

    ১.৬১৮

    ল্যাংডন তার উদগ্রীব হয়ে চেয়ে থাকা ছাত্র-ছাত্রিদের সমুদ্রের দিকে ফিরলো। কে আমায় বলতে পারবে এই সংখ্যাগুলো কি?

    পেছনে বসা এক লম্বা পায়ের গণিতের মেজর, হাত তুললো। এটা PHI-র সংখ্যা। সে এটা উচ্চার করলো ফি বলে।

    চমৎকার বলেছেন, স্টেটনার, ল্যাংডন বললো। সবাই পরিচিত হোন PHI-র সাথে।

    PI-এর সাথে গুলিয়ে ফেলবেন না, স্টেট্রার আরো বললো, দাঁত বের করে হাসতে লাগলো সে। আমরা গণিতবিদরা যেরকমটি বলতে পছন্দ করি : PHIর একটা H আসলে PI-এর চেয়ে অনেক বেশি ঠাণ্ডা!

    ল্যাংডন উচ্চস্বরে হাসলো, কিন্তু অন্য কেউ এই ঠাট্টাটা বুঝতে পারলো বলে মনে হলো না।

    এই PHI সংখ্যাটা, ল্যাংডন বলতে শুরু করলো, এক দশমিক ছয়-এক-আট, শিল্পকলায় এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কে আমাকে বলতে পারে, কেন?

    স্টেটনার নিজেকে আবারো প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করলো। কারণ, এটা খুবই সুন্দর?

    সবাই হেসে উঠলো।

    আসলে, ল্যাংডন বললো, স্টেট্রার আবারো ঠিক বলেছে। PHI-কে সাধারণত এই মহাবিশ্বের সবচাইতে সুন্দর সংখ্যা হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

    হাসিটা থেমে গেলে স্টেটনারের মুখে তৃপ্তির একটা হাসি দেখা গেলো।

    ল্যাংডন তার স্লাইড প্রজেক্টরটাতে ফিল্ম ভরতে ভরতে ব্যাখ্যা করলো যে, PHI সংখ্যাটি ফিবোনাচ্চি সংখ্যক্রম থেকেই উদ্ভূত হয়েছে—সংখ্যাক্রমটি শুধুমাত্র এজন্যে বিখ্যাত নয় যে, প্রথম দুটি সংখ্যার যোগফল পরবর্তী সংখ্যার সমান, বরং সন্নিহিত সংখ্যার ভাগফলে বিস্ময়কর সংখ্যা ১.৬১৮ রয়েছে–অর্থাৎ PHI.

    PHI-এর রহস্যময় গাণিতিক উৎপত্তিটা ছাড়াও, ল্যাংডন ব্যাখ্যা করলো যে, PHI এর সত্যিকারের হতবুদ্ধিকর জিনিসটা হলো প্রকৃতির গঠনের ক্ষেত্রে তার মৌলিকতু। গাছপালা, জীবজম্বু এবং এমনকি মানুষের ক্ষেত্রেও, সবকিছুতেই মাত্রাগত দিক থেকে একেবারে ঠিক ঠিকই PHI-এর সাথে ১-এর সমানুপাতে আছে।

    PHI প্রকৃতির সর্বত্রই রয়েছে, ল্যাংডন বললো, বাতিটা নিভিয়ে দিলো সে, যা : পরিষ্কারভাবেই কাকতালীয় ব্যাপারটাকে অতিক্রম করে, আর তাই প্রাচীন কালের মানুষেরা PHI সংখ্যাটিকে মনে করতো বিশ্বজগতের সৃষ্টিকর্তা এটা আগে থেকেই ঠিক করে দিয়েছেন। প্রাচীন কালের বিজ্ঞানীরা এক দশমিক-ছয়-এক-আটকে স্বর্গীয় অনুপাত হিসেবে আখ্যায়িত করেছিলো।

    দাঁড়ান, সামনের সারিতে বসা এক তরুণী বললো, আমি বায়োলজির ছাত্রী, আমিতো কখনও প্রকৃতিতে এই স্বর্গীয় অনুপাতটা দেখিনি।

    দেখেননি? ল্যাংডন দাঁত বের করে হাসলো। কখনও কি মৌচাকের পুরুষ এবং স্ত্রী মৌমাছির সম্পর্কটা খতিয়ে দেখেছেন?

    অবশ্যই। স্ত্রী মৌমাছি সবসময়ই পুরুষ মৌমাছির তুলানায় সংখ্যায় বেশি থাকে।

    একদম ঠিক। আর আপনি কি এটা জানেন, যদি পুরুষ মৌমাছির সংখ্যা দিয়ে স্ত্রী মৌমাছির সংখ্যাকে ভাগ করা হয় তবে সবসময়ই একই সংখ্যা পাওয়া যাবে?,

    আপনি জানেন?

    আজ্ঞে। PHI।

    মেয়েটা খেদোক্তি করলো। একদমই না!

    একদমই! ল্যাংডন পাল্টা বললো, হাসতে হাসতে প্রজেক্টরে একটা ছবি প্রক্ষেপন করলো। চিনতে পেরেছেন এটা?

    এটা একটা সামুদ্রিক শামুক, এক বায়ো মেজর বললো। একটা শামুকের মাথার ভেতরের অংশ যা গ্যাস পাম্প করে ভেতরে নিয়ে যায় ভেসে থাকার জন্য।

    ঠিক বলেছেন। আপনি কি আন্দাজ করতে পারেন প্রতিটা স্পাইরালের ডায়ামিটার পরেরটার সাথে কি সুনপাতে রয়েছে?

    মেয়েটা অনিশ্চিত ভঙ্গীতে শামুকের স্পাইরালের দিকে তাকালো।

    ল্যাংডন মাথা নাড়লো। PHI। স্বর্গীয় অনুপাত। এক দশমিক ছয়-আট-এক। মেয়েটাকে বিস্মিত হতে দেখা গেলো।

    ল্যাংডন পরবর্তী স্নাইডটাতে গেলোসূর্যমুখী ফুলের বীজের মাথার একটা বিশাল ছবি। সূর্যমুখী ফুলের বীজ বিপরীত চক্রাকারে বেড়ে ওঠে। আপনারা কি অনুমান করতে পারেন, প্রতিটি ক্রোকারের ব্যস পরেরটার সাথে কত অনুপাতে আছে?

    PHI? সবাই বললো।

    বিঙ্গো। ল্যাংডন স্লাইডগুলো নিয়ে আবার ব্যস্ত হয়ে গেলো—পদ্ম ফুল, গাছপালার পাতার বিন্যাস, পোকা-মাকড়ের বিভাঁজন সবগুলো বিস্ময়করভাবেই স্বর্গীয় অনুপাত মেনে চলেছে।

    দারুণ! কেউ একজন চিৎকার করে বললো।

    হ্যাঁ, আরেকজন বললো, কিন্তু এর সাথে চিত্রকলার সম্পর্ক কি?

    আ-হা! ল্যাংডন বললো। আপনি জিজ্ঞেস করাতে খুশি হয়েছি। সে আরেকটা স্লাইড চড়ালো–বিবর্ণ হলুদ রঙের পার্চমেন্ট কাগজে লিওনার্দো দা ভিঞ্চির ভিরুভিয়ান ম্যান–প্রতিভাবান রোমান স্থপতি মার্কাস ভিরুভিয়ানের নামানুসারে করা হয়েছিলো, যিনি স্বর্গীয় অনুপাতকে তাঁর লেখায় প্রশংসা করে বলেছিলেন দ্য আর্কিটেকচুরা।

    মানুষের শরীরের স্বর্গীয় গঠনের ব্যাপারটা দা ভিঞ্চির চেয়ে বেশি কেউ বুঝতে। আসলে দা ভিঞ্চি শবদেহ ব্যবচ্ছেদ করে মানুষের শরীরে হাড়ের গঠনের যথার্থ অনুপাতটি মেপে ছিলেন। তিনিই প্রথম ব্যক্তি, যিনি দেখিয়েছিলেন যে, মানুষের শরীর গঠনে সবময়ই PHI-র হিসাবে থাকে।

    শ্রেণীকক্ষের সবাই সন্দেহজনক দৃষ্টিতে তাকালো।

    আমাকে বিশ্বাস করছেন না? ল্যাংডন চ্যালেঞ্জ করলো। এরপর গোসল করার সময় একটা মাপজোখ করার ফিতা নিয়ে যাবেন।

    কথাটা শুনে কয়েকজন ফুটবল খেলোয়াড় নাক সিঁটকালো।

    ল্যাংডন বললো, আপনাদের সবাই। ছেলে এবং মেয়ে। চেষ্টা করে দেখবেন এটা। আপনাদের মাথা থেকে পা পর্যন্ত মেপে দেখবেন। তারপর মাটি থেকে আপনাদের নাভি পর্যন্ত যে মাপ হয় তা দিয়ে সেটাকে ভাগ করে দেখবেন। কোন্ সংখ্যাটা আপনারা পাবেন, জানেন?

    PHI নয়! একজন সৈনিক অবিশ্বাসে কথাটা বললো।

    হ্যাঁ, PHI, ল্যাংডন জবাব দিলো, এক-দশমিক-ছয়-এক-আট। আরেকটা উদাহরণ চান? আপনাদের কাঁধ থেকে হাতের আঙুল পর্যন্ত মাপ নিন, আর সেটাকে আপনাদের বাহু থেকে আঙুল পর্যন্ত যে মাপ হয়, সেটা দিয়ে ভাগ করুন। আবারো PHI। আরেকটা চান? পা থেকে হিপর মাপকে পা থেকে হাটু দিয়ে ভাগ করুন। আবারো PHI। আঙুলের গিট, পায়ের পাতা। মেরুদণ্ডের বিভাঁজন। PHI, PHI, PHI। বন্ধুরা, আপনারা প্রত্যেকেই স্বর্গীয় অনুপাতের কল্যাণে হাটছেন।

    এমনকি অন্ধকারেও ল্যাংডন দেখতে পারলো তারা সবাই বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে আছে। সে ভেতরে ভেতরে অতিপরিচিত একটা আবেগ অনুভব করলো। এজন্যেই সে শিক্ষাদান করে থাকে। বন্ধুরা, আপনারা দেখতে পাচ্ছেন, এই পৃথিবীর বিশৃঙ্খল সবকিছুই আসলে সুপ্ত একটা শৃঙ্খলায় চলছে। যখন প্রাচীনকালের মানুষেরা প্রথম PHI আবিষ্কার করলো, তখন তারা নিশ্চিত হয়েছিলো যে, তারা ঈশ্বরের বিশ্ব নির্মানের একটা হিসাবের সন্ধান পেয়েছে। আর এজন্যেই তারা প্রকৃতি পূজা করে থাকে। যে কেউই ব্যাপারটা বুঝতে পারবে, কেন। প্রকৃতিতে ঈশ্বরের হাতের প্রমাণ রয়েছে, এমনকি আজকের দিনেও প্যাগানদের অস্তিত্ব রয়েছে। আমাদের অনেকেই, আজও প্যাগানদের মতো প্রকৃতি উৎসব করে থাকি। আর তারা এটা জানেও না। মে-ডে হলো এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ, বসন্ত উৎসব উদযাপন…পৃথিবী তার উর্বরা শক্তি ফিরে পায়। স্বর্গীয় অনুপাতের মধ্যে যে রহস্যময় জাদুশক্তি আছে, সেটা মানব সভ্যতার শুরুর দিকেই লিখিত হয়েছিলো। মানুষ প্রকৃতির নিয়মের দ্বারা শাসিত, আর যেহেতু শিল্পকলা হলো ঈশ্বরের হাতকে অনুকরণ করার একটা প্রচেষ্টা, সেজন্যে আপনারা এই সেমিস্টারে শিল্পকলায় স্বর্গীয় অনুপাতের ছড়াছড়ি দেখতে পাবেন।

    পরবর্তী আধঘণ্টা ধরে ল্যাংডন স্লাইডশোর মাধ্যমে একের পর এক মাইকেল এঞ্জেলো, আলব্রেখট দ্রার, দা ভিঞ্চি এবং অন্য অনেকের চিত্রকর্ম দেখালেন। প্রতিটাতেই শিল্পী ইচ্ছাকৃতভাবে নিজের কম্পােজিশনে স্বর্গীয় অনুপাত ব্যবহার করেছেন। ল্যাংডন গৃক পার্থিনোন, মিশরের পিরামিড, এমনকি যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থিত জাতিসংঘের ভবনের স্থাপত্যে PHI-এর বিষয়টি উন্মোচিত করলো। PHI মোজার্টের সোনাটার গঠনেও আছে, বিঠোফেনের পঞ্চম সিম্ফোনি এবং বার্তোক, ডেবুসি আর শুবার্টের কর্মেও সেটা বিদ্যমান। ল্যাংডন তাদেরকে বললো, PHI সংখ্যাটি, এমনকি স্ট্রাডিভ্যারিয়াসও ব্যবহার করেছেন তার বেহালার হোল-এর সঠিক অবস্থানের জন্য।

    অবশেষে, ব্ল্যাকবোর্ডের দিকে এগিয়ে গিয়ে ল্যাংডন বললো, আমরা আবার প্রতীকেই ফিরে আসবো। সে পাঁচটি বিন্দুর সাহায্যে একটা তারা আঁকলো। এই প্রতীকটা সবচাইতে শক্তিশালী একটা ইমেজ যা আপনারা এই টার্মে দেখতে পারবেন। সাধারণত এটাকে বলা হয় পেনটাগ্রাম অথবা পেনটাকল, যেমনটি প্রাচীন কালের মানুষেরা বলতো—এই প্রতীকটা বিভিন্ন সংস্কৃতিতে স্বর্গীয় আর জাদুকরী হিসেবে বিবেচনা করা হয়। কেউ কি বলতে পারবে, কেন?

    স্টেটনার, গণিতের মেজ, আবারো হাত তুললো। কারণ, আপনি যদি পেনটাগ্রাম আঁকেন তবে আপনা আপনিই সেটা স্বর্গীয় অনুপাতে বিভাজিত হয়ে যাবে।

    ল্যাংডন ছেলেটাকে মাথা নেড়ে সাধুবাদ জানালো। চমৎকার। হ্যাঁ, পেনটাকলর রেখার বিভিন্ন অংশের সবগুলোর অনুপাতই PHIর সমান। এজন্যেই, এই প্রতীকটা স্বর্গীয় অনুপাতের একটি অনিবার্য প্রকাশ হিসেবে পরিগণিত হয়ে থাকে। এই কারণেই পাঁচ বিন্দুর এই তারকাটা সবসময়ই দেবী এবং পবিত্র নারীর সাথে সংশ্লিষ্ট সৌন্দর্য আর নিখুতের প্রতীক হিসেবে বিবেচিত হয়।

    শ্রেনী কক্ষের মেয়েরা ভুরু কুঁচকালো।

    একটা কথা। আজকে আমরা শুধু দা ভিঞ্চিকে স্পর্শ করেছি। কিন্তু আমরা এই সেমিস্টারে তার আরো অনেক কিছুই দেখতে পাবো। লিওনার্দো প্রাচীন দেবীদের প্রতি খুবই নিবেদিতপ্রাণ ছিলেন, এর যথেষ্ট প্রমাণও আছে। আগামীকাল, আমি আপনাদেরকে তার দ্য লাস্ট সাপার ফ্রেসকোটি দেখাবো, এতে পবিত্র নারীর একটি বিস্ময়কর প্রমাণ রয়েছে, যা আপনারা কখনও দেখেননি।

    আপনি ঠাট্টা করছেন, তাই না? কেউ একজন বললো।

    আমরা তো জানতাম দ্য লাস্ট সাপার যিশু খৃস্টের উপর!

    ল্যাংডন মুচুকি হাসলো। আপনারা কল্পনাও করতে পারবেন না, প্রতীকগুলো কীভাবে বিভিন্ন জায়গায় লুকিয়ে আছে।

     

    আসুন, নিচু স্বরে সোফি বললো। কি হয়েছে আপনার? আমরা প্রায় পৌঁছে গেছি। জলদি করুন!

    ল্যাংডন চোখ তুলে তাকালো, দূরের চিন্তাভাবনা থেকে ফিরে আসলো। বুঝতে পারলে তারা সিঁড়ির শেষ মাথায় এসে পড়েছে। একটা ঘোরের মধ্যে চলে গিয়েছিলো সে।

    O, Draconian devil! Oh, lame saint!

    সোফি তার পেছনে থাকা ল্যাংডনের দিকে ঘুরে তাকালো।

    এটা এতোটা সহজ-সরল হতে পারে না, ল্যাংডন ভাবলো।

    কিন্তু সে জানে, অবশ্যই এটা।

    লুভরের এই গহ্বরের ভেতরে … PHI এবং দা ভিঞ্চি তার মনে ঘুরপাক খেতে লাগলো। রবার্ট ল্যাংডন আচমকা, অপ্রত্যাশিতভাবে সনিয়ের কোডটার মর্মোদ্ধার করে ফেললো।

    O, Draconian devil! সে বললো, Oh, lame saint! এটাতো খুব সহজ সরল ধরনের একটা কোড!

    সোফি থেমে তার দিকে দ্বিধাগ্রস্তভাবে তাকালো। এটা একটা কোড? সে সারারাত ধরে শব্দগুলো নিয়ে ভেবেছে কিন্তু কিছুই খুঁজে পায়নি, বিশেষ করে সহজ সরল ধরনের কোড।

    আপনি নিজেই এটা বলেছিলেন। ল্যাংডনের কণ্ঠে আবার উত্তেজনা ফিরে এলো। ফিবোনাচ্চি সংখ্যাগুলো শুধুমাত্র যথার্থ নিয়মে থাকলেই কোন অর্থ বহন করে। তা না হলে ওগুলো গাণিতিক প্রহেলিকা ছাড়া আর কিছুই না।

    সে কী বলছে সে সম্পর্কে সোফির কোন ধারণাই ছিলো না। ফিবোনাচ্চি সংখ্যা? সে এ ব্যাপারে খুব নিশ্চিত যে, এটা শুধুমাত্র ক্রিপ্টোগ্রাফি ডিপার্টমেন্টকে জড়িত করার উদ্দেশ্যেই করা হয়েছে। ওগুলোর আরেকটা উদ্দেশ্যও আছে? সে তার হাতটা পকেটে ঢুকিয়ে প্রিন্ট-আউটটা বের করলো, তার দাদুর মেসেজটা আবার খুটিয়ে খুটিয়ে দেখলো।

    13-3-2-21-1-1-8-5

    O, Draconian devil!
    Oh, lame saint!

    সংখ্যাগুলোর ব্যাপারটা কি?

    এলোমেলোভাবে ফিবোনাচ্চি সংখ্যাক্রমটা আসলে একটা ক্লু, প্রিন্ট-আউটটা হাতে নিয়ে ল্যাংডন বললো। সংখ্যাগুলো আসলে বাকি মেসেজগুলোর মর্মোদ্ধার করার একটা ইঙ্গিত। তিনি সংখ্যামটা এলোমেলোভাবে লিখেছেন আমাদেরকে এটা বলার জন্য যে, একই কাণ্ড করা হয়েছে লিখিত মেসেজেটাতেও। O, Draconian devil? oh, lame saint? এই লাইনগুলোর কোন অর্থ নেই। এগুলো এলোমেলোভাবে লেখা অক্ষর ছাড়া আর কিছুই না।

    আপনার মতে এই মেসেজটা…উনে এনাগ্রাম?  সে তার দিকে চেয়ে রইলো। অনেকটা সংবাদপত্র থেকে শব্দের দঙ্গল বানানো?

    ল্যাংডন সোফির চেহারায় সন্দেহ দেখতে পেলো, সঙ্গত কারণেই বুঝতে পারলো সেটা। খুব কম লোকই এনাগ্রাম জিনিসটা বুঝতে পারে। কোন শব্দ বা বাক্যাংশের বর্ণগুলো দিয়ে স্থান পরিবর্তনের সাহায্যে ভিন্ন-ভিন্ন শব্দ বা বাক্য তৈরি করাকে এনাগ্রাম বলে।

    কাবালার রহস্যময় শিক্ষা খুব বেশি রকমেরই এনাগ্রাম ভিত্তিক—এতে হিব্রু অক্ষরগুলো নতুন ভাবে সাজিয়ে নতুন অর্থ বের করে আনা হয়। রেনেসাঁর সময়কার ফরাসি রাজারা এনাগ্রামের ব্যাপারে এতোটাই মুগ্ধ ছিলো যে, তারা বিশ্বাস করতো এতে জাদুকরী শক্তি আছে। তারা রাজকীয় এনাগ্রাম বিশারদ পর্যন্ত নিয়োগ দিয়েছিলো যাতে করে গুরুত্বপূর্ণ দলিল-দস্তাবেজ বিশ্লেষণে সাহায্য করা যায়। রোমানরা সত্যিকার অর্থে এনাগ্রাম বিদ্যাকে আক্বস ম্যাগনা অর্থাৎ মহান চিত্র বলে অভিহিত করেছিলো।

    ল্যাংডন সোফির দিকে তাকালো, তার চোখে চোখ স্থির করলো। আপনার দাদুর অর্থটা আমাদের সামনেই রয়েছে, আর তিনি আমাদের কাছে এটা দেখানোর জন্য যথেষ্ট কু-ই রেখে গেছেন।

    আর কোন কথা না বলেই ল্যাংডন তার জ্যাকেটের পকেট থেকে একটা কলম বের করে প্রতিটা লাইনের অক্ষরগুলো নতুন করে সাজালো।

    0, Draconian devil!
    Oh, lame saint!

    এর একটি নিখুঁত এনাগ্রাম হলো …

    Leonardo Da vinci!
    The Mona Lisa!

    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleএঞ্জেলস এন্ড ডেমনস – ড্যান ব্রাউন
    Next Article রবিনসন ক্রুসো – ড্যানিয়েল ডিফো

    Related Articles

    ড্যান ব্রাউন

    এঞ্জেলস এন্ড ডেমনস – ড্যান ব্রাউন

    August 19, 2025
    ড্যান ব্রাউন

    দ্যা লস্ট সিম্বল – ড্যান ব্রাউন

    August 19, 2025
    ড্যান ব্রাউন

    অরিজিন – ড্যান ব্রাউন

    August 19, 2025
    ড্যান ব্রাউন

    ইনফার্নো – ড্যান ব্রাউন

    August 19, 2025
    ড্যান ব্রাউন

    ডিসেপশন পয়েন্ট – ড্যান ব্রাউন

    August 19, 2025
    ড্যান ব্রাউন

    ডিজিটাল ফরট্রেস – ড্যান ব্রাউন

    August 19, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo
    Most Popular

    রবিনসন ক্রুসো – ড্যানিয়েল ডিফো

    August 19, 2025

    অনুরাধা

    January 4, 2025

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    রবিনসন ক্রুসো – ড্যানিয়েল ডিফো

    August 19, 2025

    অনুরাধা

    January 4, 2025

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025
    Our Picks

    রবিনসন ক্রুসো – ড্যানিয়েল ডিফো

    August 19, 2025

    দ্য দা ভিঞ্চি কোড – ড্যান ব্রাউন

    August 19, 2025

    এঞ্জেলস এন্ড ডেমনস – ড্যান ব্রাউন

    August 19, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    Sign In or Register

    Welcome Back!

    Login below or Register Now.

    Lost password?

    Register Now!

    Already registered? Login.

    A password will be e-mailed to you.