Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    রবিনসন ক্রুসো – ড্যানিয়েল ডিফো

    August 19, 2025

    দ্য দা ভিঞ্চি কোড – ড্যান ব্রাউন

    August 19, 2025

    এঞ্জেলস এন্ড ডেমনস – ড্যান ব্রাউন

    August 19, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • 🔖
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    Subscribe
    সাইন ইন
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    দ্য দা ভিঞ্চি কোড – ড্যান ব্রাউন

    ড্যান ব্রাউন এক পাতা গল্প600 Mins Read0

    ০৪. সিস্টার সানডন

    ৩১.

    তাঁরা মরে গেছে।

    সিস্টার সানডন সেন্ট সালপিচ-এর নিজের ঘরে বসে ফোনটা হাতে নিয়ে ভয়ে কাঠ হয়ে আছেন। তিনি এনসারিং মেশিনে একটা মেসেজ রেখে দিয়েছেন। দয়া করে ফোনটা তুলুন! তাঁরা সবাই মরে গেছে।

    প্রথম তিনটি টেলিফোন নাম্বারে ফোন করে ভয়াবহ ফল পাওয়া গেলো—একজন হিস্টিরিয়াগ্রস্ত বিধবা, এক গোয়েন্দা হত্যা হবার পর ঘটনাস্থলে এসে পৌঁছেছেন আর একজন বিষণ্ণ পাদ্রী শোক-সন্তপ্ত পরিবারকে সান্ত্বনা দিচ্ছেন। তিনটা নাম্বারের সবগুলোই অকেজো। আর এখন, তিনি শেষ, অর্থাৎ চতুর্থ নাম্বারটা ফোন করতেই বাকি তিনটা নাম্বার ফোন করে না পেলেই কেবল এই নাম্বারটা তিনি করতে পারবেন—একটা এনসারিং মেশিনের কণ্ঠ শুনতে পেলেন। রেকর্ড করা কণ্ঠটা নিজের কোন নাম বা পরিচয় না দিয়ে সোজা বলে দিলো মেসেজটা ছেড়ে যেতে।

    ফ্লোরের প্যানেলটা ভেঙে ফেলা হয়েছে! মেসেজটাতে বললেন। বাকি তিনজন মারা গেছেন!

    সিস্টার সানডুন যে চারজনকে রক্ষা করছেন তাদের পরিচয় তিনি জানতেন না। কিন্তু তার বিছানার নিচে সযত্নে রাখা চারটা ব্যক্তিগত ফোন নাম্বার কেবল একটা ক্ষেত্রেই ব্যবহার করার কথা।

    যদি কখনও ফ্লোর প্যানেলটা ভাঙা হয়, অদেখা মেসেন্জার তাকে বলেছিলেন, তার মানে, আমাদের মধ্যে কেউ, জীবননাশের হুমকির মুখে একটা মিথ্যা বলতে বাধ্য হয়েছেন। নাম্বারগুলোতে ফোন করুন। বাকিদের সর্তক করে দিন। এ ক্ষেত্রে ব্যর্থ হবেন না।

    সেটা ছিলো একটা নিঃশব্দ এলার্ম। এটার সহজ সরলতা বোকাও বুঝতে পারবে। এই পরিকল্পনাটার কথা যখন তিনি প্রথম শুনেছিলেন, অবাকই হয়েছিলেন। যদি একজন ভাইয়ের পরিচয় উন্মোচিত হয়ে যায়, তবে একটা মিথ্যা বলবেন তিনি, যা ঘুরেফিরে বাকিদের কাছে পৌঁছে যাবে সতর্ক হবার জন্য। আজ রাতে, মনে হচ্ছে, কমপক্ষে একজন তো ধরা পড়ে গেছেই।

    দয়া করে উত্তর দিন, তিনি ভয়ে ফিসফিস করে বললেন। কোথায় আপনি?

    ফোনটা রাখুন, দরজা থেকে একটা গম্ভীর কণ্ঠ বললো। ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে সিস্টার তাকিয়ে দেখতে পেলেন বিশাল সন্ন্যাসীটাকে। তার হাতে ভারি মোমবাতি স্ট্যান্ডটা ধরা।

    কাঁপতে কাঁপতে তিনি ফোনটা নামিয়ে রাখলেন।

    তারা সবাই মারা গেছে, সন্ন্যাসীটা বললো। চার জনের সবাই। আর তারা আমার সাথে চালাকি করেছে। এবার আপনি বলুন, কি-স্টোনটা কোথায় আছে।

    আমি জানি না! সিস্টার সানভৃন সত্যি করেই বললেন। এই গুপ্ত ব্যাপারটা অন্যেরা জানে। অন্যরা, যারা মারা গেছেন।

    লোকটা সামনের দিকে এগিয়ে আসলো, তার সাদা হাতে লোহার স্ট্যান্ডটা শক্ত করে ধরা। আপনি এই চার্চের একজন সিস্টার। তারপরও আপনি তাদের হয়ে কাজ করেন?

    যিত্র একটা সত্য-বাণী আছে, সিস্টার সানড়ন দৃঢ়ভাবে বললেন। আমি ওপাস দাইর মধ্যে সেটা দেখতে পাইনি।

    লোকটার চোখে আচমকা একটা ক্রোধের ছায়া দেখা গেলো। সে শক্ত হাতে স্ট্যান্ডটা তুলে ধরলো। সিস্টার সানড়ন পড়ে যাবার সময় শেষ যে জিনিসটা তাঁর মনে হচ্ছিলো, সেটা হলো এক ধরনের স্বতস্ফুর্ত পূর্বাভাস।

    চার জনের সবাই মারা গেছেন।

    দূর্লভ সত্যটা চিরতরের জন্যই হারিয়ে গেলো।

     

    ৩২.

    ল্যাংডন আর সোফি প্যারিসের গভীর রাতে প্রবেশ করতেই ডেনন উইং-এর পশ্চিম প্রান্তের সিকিউরিটি এলার্মটা সশব্দে বেজে ওঠে আশপাশের তুইলেরি গার্ডেনের কবুতরগুলোকে এদিক ওদিক ছড়িয়ে দিলো। প্লাজায় রাখা সোফির গাড়ির কাছে যেতেই ল্যাংডন দূর থেকে পুলিশের গাড়ির সাইরেন শুনতে পেলো।

    ।এইতো, এটা এখানে, সোফি বললো, প্রাজায় রাখা নাক বোচা দুই সিটের লাল গাড়িটার দিকে ইঙ্গিত করলো সে।

    সে ঠাট্টা করছে, তাই না? গাড়িটা ল্যাংডনের দেখা সবচাইতে ছোটখাটো একটা গাড়ি।

    স্মার্ট গাড়ি, সোফি বললো, লিটারে একশো মাইল চলে।

    সোফি গাড়িটার ইজিন চালু করতেই ল্যাংডন কোনমতে ওটার ভেতরে গিয়ে বসে পড়লো। গাড়িটা ঝাকি খেয়ে ফুটপাতের ওপরে উঠে যেতেই ল্যাংডন দুহাতে গাড়ির ড্যাশ বোর্ডটা ধরে রাখলো। লাফাতে লাফাতে সেটা কারুজেল দু লুভরের ছোট্ট একটা গলি দিয়ে ছুটতে লাগলো।

    সঙ্গে সঙ্গেই, সোফির মনে পড়ে গেলো শর্টকাট পথটার কথা। গলিটা দিয়ে সোজা চলে গেলেই হবে। মেরিডিয়ান চতুরটার ভেতর দিয়ে তারা গোল ঘাসের চত্বরটা সোজা মাড়িয়ে গেলো।

    না! ল্যাংডন চিৎকার করে বললো, সে জানতো কারুজেল দু লুভর-এর একেবারে মাঝখানে একটা গহ্বর আছেলা পিরামিদ ইনভার্সি উল্টো পিরামিড স্কাই-লাইটটা সে জাদুঘরের ভেতরে আগেই দেখেছিলো। ওটা তাদের ছোট্ট স্মার্ট গাড়িটাকে খুব সহজেই গিলে ফেলতে পারার মতোই বিশাল। সৌভাগ্যক্রমে, সোফি সচরাচর রাস্তাটি ব্যবহার করারই সিদ্ধান্ত নিলো। ডান দিকে এক ঝট্কায় বাঁক নিয়ে একটা গোল চক্কর দিয়ে, বাম দিকে মোড় নিয়ে, উত্তর দিকের রুই দ্য রিভোলির পথে এগোলো।

    দুই টোনের পুলিশের সাইরেনটা তাদের পেছনে চিৎকার করতে করতে তাড়া করে আসছে। ল্যাংডন দরজার পাশের আয়না দিয়ে গাড়ির লাইটটা দেখতে পারলো। সোফি লুভর থেকে বের হয়ে যাবার জন্য গাড়ির গতি বাড়িয়ে দিলে স্মার্ট গাড়িটার ইনজিন একটা আর্তচিৎকার দিয়ে উঠলো। পঞ্চাশ গজ সামনে, রিভোলির ট্রাফিক লাইটটার লালবাতি জ্বলে উঠলো। সোফি দম নিয়ে গাড়ির গতি বাড়িয়েই যাচ্ছে। ল্যাংডন অনুভব করলো তার পেশীগুলো আড়ষ্ট হয়ে গেছে।

    সোফি?

    চৌরাস্তার মোড়ের কাছে এসে একটু ধীর গতি করলো সোফি। গাড়ির হেডলাইটটা জ্বালিয়ে, চোরা চোখে দুপাশটা দেখে নিয়ে, গাড়িটা আবার দ্রুত গতিতে বাম দিকে মোড় নিয়ে সোজা চলে গেলো রিভোলির ফাঁকা রাস্তায়। এরপর তারা শাম্প এলিসির প্রশস্ত এভিনুতে চলে এলো।

    গাড়িটা সোজা চলতেই ল্যাংডন নিজের আসন থেকে ঘুরে, ঘাড় বেঁকিয়ে রিয়ার উইন্ডো দিয়ে লুভরের দিকে তাকালো। সে দেখতে পেলো পুলিশ আর তাদেরকে তাড়া করছে না। নীল আলোর সমুদ্রে জাদুঘরটা আলোকিত হয়ে আছে।

    তার হৃদস্পন্দন অবশেষে ধীর-স্থির হলো। ল্যাংডন সোফির দিকে তাকিয়ে বললো, খুব মজার ব্যাপার ছিলো এটা।

    মনে হলো না কথাটা সোফি শুনতে পেয়েছে। তার চোখ সামনের সুদীর্ঘ শাম্প এলিসির দিকে স্থির হয়ে আছে। দুই মাইল দীর্ঘ অভিজাত প্রান্তরটাকে প্রায়শই প্যারিসের পঞ্চম এভিনু হিসেবে ডাকা হয়। এ্যামবাসিটা এখান থেকে মাত্র এক মাইল দূরে অবস্থিত। ল্যাংডন তার সিটে ঠিক করে বসে পড়লো।

    So dark the con of man.

    সোফির চটজলদি চিন্তাটা ছিলো খুব ইমপ্রেসিভ।

    Modonna of the Rocks.

    সোফি বলেছে, তার দাদু ছবিটার পেছনে তার জন্যে কিছু একটা রেখে গেছেন। একটা চুড়ান্ত মেসেজ? সনিয়ের অসাধারণ লুকানোর জায়গাটার কথা না ভেবে ল্যাংডন পারলো না; Madonna of the Rocks আজ রাতে ব্যবহৃত প্রতীকগুলোর সাথে একেবারেই সংগতিপূর্ণ আর সামঞ্জস্যপূর্ণ। মনে হচ্ছে, সনিয়ে প্রতিটি ক্ষেত্রেই লিওনার্দো দা ভিঞ্চির অজানা কালো-অধ্যায় সম্পর্কে বেশ ভক্তির স্বাক্ষর রেখে গেছেন। দা ভিঞ্চির ম্যাডোনা অব দি রকস্ ছবিটা আসলে ইমাকুলেট কনসেপশন নামে পরিচিত একটা ধর্মীয় দলের কাছ থেকে ফরমায়েশ পেয়ে আঁকা হয়েছিলো, যাদের দরকার ছিলো মিলানে অবস্থিত সেন্ট ফ্রান্সেকোর চার্চের বেদীর ঠিক মাঝ বরাবর জায়গায় একটা চিত্রকর্মের। নান লিওনার্দোকে নির্দিষ্ট করে বলে দিয়েছিলেন কোন থিমের ওপর ছবিটা হবে কুমারি মেরি, শিশু জন দ্য ব্যাপটিস্ট, ইউরিয়েল এবং শিশু যিশুখৃস্ট একটা গুহায় আশ্রয় নিয়েছেন। যদিও দা ভিঞ্চি অনুরোধক্রমেই ছবিটা এঁকেছিলেন, তারপরও ছবিটা সমাপ্ত করে তাদের কাছে হস্তান্তর করার সময় ঐ দলটি ভয়ে আঁতকে উঠেছিলো কেনো ছবিটাতে তিনি বিস্ফোরণােন্মুখ আর বিব্রতকর জিনিসে ভরে রেখেছিলেন।

    ছবিটাতে দেখানো হয়েছে, কুমারি মেরি নীল রঙের একটা গাউন পরে কোলে একটা শিশু নিয়ে বসে আছেন, শিশুটা হলো নবজাতক যিশু। মেরির বিপরীতে ইউরিয়েল, সেও আরেকটা নবজাতক নিয়ে বসে আছে, সেই শিশুটা হলো জন দ্য ব্যাপটিস্ট। বিষদৃশ্য ব্যাপারটা হলো, যিশু আর্শীবাদ করছেন জনকে, প্রচলিত এই দৃশ্যটা না রেখে বরং শিশু জনই যিশুকে আর্শীবাদ করছে এমন দৃশ্য দেখানো হয়েছে …আর যিশু সেই ব্যাপারটা অনুমোদন করছেন! আরো সমস্যা আছে, মেরির এক হাত শিশু জনের মাথার ওপর, আর সেটা খুবই ভয় দেখানো ইঙ্গিত করছে তার আঙ্গুলগুলো অনেকটা ঈগল পাখির বাঁকা নখের মতো, একটা অদৃশ্য মাথা ধরে আছে যেনো। চূড়ান্ত যে ভীতিকর জিনিস ছবিটাতে রয়েছে : মেরির কোঁকড়ানো আঙ্গুলগুলোর নিচে ইউরিয়েল হাত দিয়ে একটা আঘাত করার ভঙ্গী করছে—যেনো মেরির থাবা সদৃশ্য হাতে ধরা অদৃশ্য ঘাড়টাকে কেঁটে ফেলবে।

    ল্যাংডনের ছাত্ররা সব সময়ই এটা জানতে পেরে বিস্মিত হয় যে, দা ভিঞ্চি ধর্মীয় দলটাকে দ্বিতীয় আরেকটা ছবি একে দিয়ে তাদের ক্ষোভ প্রশমিত করেছিলেন। ওয়াটার ডাউন সংস্করণে মাড়োনা অব দি রকস-এ সবাইকে অনেক বেশি প্রচলিত ভঙ্গীতে দেখানো হয়েছিলো। দ্বিতীয় সংস্করণটা এখন লন্ডনের ন্যাশনাল গ্যালারিতে ভার্জিন অব দি রক নামে টাঙানো রয়েছে। অবশ্য ল্যাংডন এখনও লুভরে রাখা প্রথম ছবিটাই পছন্দ করে থাকে।

    শাম্প এলিসির দিকে যেতেই, সোফি গাড়িটার গতি আরো বাড়িয়ে দিলে ল্যাংডন বললো, চিত্রকর্মটার পেছনে, কি ছিলো?

    সোফির চোখ ছিলো রাস্তার দিকে। জিনিসটা আমি আপনাকে এ্যামবাসির ভেতরে, নিরাপদে পৌঁছাবার পরেই দেখাবো।

    তুমি ওটা আমাকে দেখাবে? ল্যাংডন খুব অবাক হয়ে বললো, তিনি তোমার কাছে একটা জিনিস রেখে গেছেন?

    সোফি হ্যাঁ-সূচক ইঙ্গিত করলো। ফ্লার-দ্য-লিস খোঁদাই করা, সেই সাথে পি,এস অক্ষর সংবলিত।

    ল্যাংডন নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছিলো না।

     

    আমরা প্রায় এসে গেছি, স্মার্ট গাড়িটা ডান দিকে মোড় ঘোরাতেই সোফি ভাবলো। বিলাসবহুল হোটেল দ্য সলোয় অতিক্রম করে সারি সারি বৃক্ষের কূটনৈতিক এলাকাটাতে প্রবেশ করলো। এ্যামবাসিটার দূরত্ব এখান থেকে একমাইলেরও কম। সোফির শেষ পর্যন্ত মনে হলো, সে এখন স্বাভাবিক নিঃশ্বাস নিতে পারছে আবার।

    গাড়ি চালানোর সময়ও সোফির চিন্তা-ভাবনা আঁটকে ছিলো পকেটে রাখা চাবিটার মধ্যে। অনেক দিন আগের দেখা সেই সোনার চাবিটা, পিএস অক্ষর দুটো আর ফ্লার-দ্য-লিস, সবগুলোই তার মনে পড়ে গেলো।

    যদিও এতোগুলো বছর ধরে চাবিটা সম্পর্কে সোফি খুব কমই ভেবেছে, তারপরও বুদ্ধিবৃত্তিক সম্প্রদায়ের সঙ্গে কাজ কর্ম করতে করতে সোফি নিরাপত্তাসম্পর্কিত অনেক কিছুই শিখেছিলো। তাই এই অদ্ভুত চাবিটা তার কাছে আর কোন রহস্যময় জিনিস বলে মনে হলো না। একটা লেজার মেট্রিক্স যন্ত্রপাতির মতো। এটা নকল করা অসম্ভব। অন্য চাবির মতো এর কোন দাত নেই, আর প্রচলিত চাবির মধ্যেও এটা কাজ করে না। একটা ইলেকট্রক চক্ষু দ্বারা এটা পরীক্ষিত হলেই কেবল চাবিটা কাজ করবে, অত্যাধুনিক কোন তালা খুলতে। একেবারেই সূক্ষ্ম একটা পদ্ধতি, একটু এদিক ওদিক হলেই কাজ করবে না। তাই এটা নকল করা একেবারেই অসম্ভব।

    সোফি ভাবতেই পারলো না, এরকম একটা চাবি দিয়ে কোন্ ধরনের জিনিস খোলা যায়। তবে তার মনে হলো রবার্ট এ ব্যাপারে সাহায্য তাকে করতে পারবে। হাজার হোক, জিনিসটা না দেখেই সে এটার খোঁদাই করা প্রতীকটার কথা বলতে পেরেছে। চাবিটার মাথায় আঁকা ক্রশের চিত্রটা কোন বৃস্টিয় সংগঠনের বলে মনে হলেও, সোফি জানতো, কোন চার্চই লেজার চাবি ব্যবহার করে না।

    তাছাড়া, আমার দাদু খৃস্টান ছিলেন না…

    এর প্রমাণটা সোফি দশ বছর আগেই প্রত্যক্ষ করেছে। পরিহাসের ব্যাপার হলো, সেটা ছিলো আরেকটা চাবি–অনেক বেশি স্বাভাবিক চাবি যা সোফির কাছে তার সত্যিকারের স্বভাবটা উন্মোচিত করেছিলো।

    সেই বিকেলটা ছিলো খুবই গরম যখন সোফি শার্ল দ্য গল বিমান বন্দরে নেমেই একটা ট্যাক্সি ধরেছিলো বাড়ি যাওয়ার জন্য। গ্র্যঁ পেয়া আমাকে দেখে খুবই অবাক হবেন। সে ভেবেছিলো। বৃটেনের গ্রাজুয়েট স্কুল থেকে বসন্তের ছুটি কাটাতে একটু আগেই দেশে ফিরেছিলো সে। এনক্রিপশন পদ্ধতি সম্পর্কিত শিক্ষাটা গ্রহণ করে সোফি তার দাদুকে সে সম্পর্কে বলার জন্য আর অপেক্ষা করতে চাইছিলো না।

    যখন প্যারিসের নিজ বাড়িতে এসে পৌঁছালো, দেখলো তার দাদু বাসায় নেই। হতাশ হলেও সে বুঝতে পারলো, তিনি তো আর জানতেন না সোফি আসবে। অবশ্যই তিনি ভরেই কাজ করছেন। কিন্তু আজতো শনিবার, সে বুঝতে পারলো। তিনি সপ্তাহান্তে কাজ কর্ম থেকে বিরত থাকেন। সপ্তাহান্তে, তিনি সাধারণত হেসে, সোফি গ্যারাজের দিকে ছুটলো। নিশ্চিত ছিলো দাদুর গাড়িটা থাকবে না। সপ্তাহান্তে জ্যাক সনিয়ে একটা গাড়ি নিয়ে একটি জায়গাতেই চলে যান নরম্যান্ডিতে তার অবকাশ যাপনের জন্য তৈরি করা শ্যাতুতে। সেটা প্যারিসের উত্তরে অবস্থিত। লন্ডনে কয়েক মাস কাটিয়ে, প্রকৃতির সান্নিধ্যে ছুটি কাটাবার জন্য উদগ্রীব ছিলো সোফি। সময়টা তখন ছিলো মাত্র সন্ধ্যা, তাই সে ঠিক করলো, সেখানে গিয়ে দাদুকে চম্‌কে দিবে। এক বন্ধুর কাছ থেকে একটা গাড়ি ধার করে নিয়ে সোফি রওনা দিলো। ঠিক দশটায় পৌঁছালো সেখানে। তাঁর দাদুর শ্যাতুর এলাকায় প্রবেশের পথটা একমাইলেরও বেশি, আর অর্ধেক রাস্তায় আসতেই সে গাছ-পালার ফাঁক দিয়ে বাড়িটা দেখতে পেলো—একটা বিশালাকৃতির পাথরের তৈরি শ্যাতু, পাহাড়ের পাশেই।

    সোফি আশা করেছিলো এসময়টাতে তার দাদু ঘুমিয়ে থাকবে, কিন্তু বাড়িটাতে বাতি জ্বলতে দেখে সে একটু উত্তেজিত বোধ করলো। তার আনন্দ বিস্ময়ে রূপান্তরিত হলো, যখন সে দেখতে পেলো বাড়ির প্রাঙ্গণটাতে অনেকগুলো গাড়ি পার্ক করা মার্সিডিজ, বিএমডব্লিউ, অদি আর রোলস-রয়েস। সোফি কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে থেকে হাসিতে ফেঁটে পড়লো। আমার দাদু, প্রখ্যাত সন্নাসী, জ্যাক সনিয়ে, দেখে মনে হচ্ছে, তিনি নিজেকে যতোটা সন্নাসী হিসেবে দাবি করেন, আসলে তিনি ততোটা নন। সোফির অনুপস্থিতিতে তিনি একটা পার্টির আয়োজন করেছেন বলেই মনে হচ্ছে। আর পার্ক করা গাড়িগুলো দেখে বোঝাই যাচ্ছে প্যারিসের প্রভাবশালী লোকেরা এখানে উপস্থিত আছেন।

    তাঁকে চমকে দেবার আশায়, সোফি সামনের দরজার দিকে দ্রুত ছুটে গেলো। কিন্তু দেখতে পেলো দরজাটা বন্ধ। কড়া নেড়ে কোন সাড়া-শব্দ পেলো না। হতভম্ব হয়ে সে পেছনের দরজা দিয়ে ঢোকার চেষ্টা করলো। সেটাও বন্ধ। কোন সাড়া-শব্দ নেই। হতাশ হয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে সে কিছু একটা শুনতে পেলো। নরম্যান্ডির উপকূল থেকে ভেসে আসা ঠাণ্ডা বাতাসের ঝিঝির শব্দই কেবল শুনতে পেলো।

    না কোন সংগীত।

    না কোন কণ্ঠ।

    কিছুই না।

    বনের নির্জনতায়, সোফি দ্রুত বাড়িটার পাশে স্তুপ করা কাঠের উপর উঠে বসার ঘরের জানালা দিয়ে ভেতরে তাকালো। সে যা দেখতে পেলো, তাতে আরো বেশি হতভম্ব হয়ে গেলো।

    এখানেও কেউ নেই!

    পুরো ঘরটাতে কেউ নেই, একেবারে ফাঁকা।

    লোকজন সব কোথায় গেলো?

    তার হৃদস্পন্দন বেড়ে গেলো, ছুটে গেলো একটা বক্সের কাছে, যেখানে তার দাদু বাড়তি একটা চাবি লুকিয়ে রাখতেন। সে দৌড়ে সামনের দরজা দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করলো। অভ্যর্থনা কক্ষে ঢোকামাত্রই সিকিউরিটি সিস্টেমটার লাল বাতি জ্বলতে শুরু করলো—একটা সতর্কতা, প্রবেশকারী দশ সেকেন্ডের মধ্যে সঠিক কোডটা টাইপ না করতে পারলে নিরাপত্তা এলার্মটা বাজতে শুরু করবে।

    পার্টির সময়টাতে তিনি এলার্ম দিয়ে রাখেন?

    সোফি দ্রুত কোডটা টাইপ করে এলার্মটা থামালো।

    ভেতরে ঢুকে সোফি পুরো ঘরটাকে জন-মানবশূন্য দেখতে পেলো। উপরের তলায়ও এরকমই। সে আবারো ফাঁকা অভ্যর্থনা কক্ষে এসে ভাবতে লাগলো, সম্ভাব্য কী ঘটতে পারে।

    এরপরই সোফি সেটা শুনতে পেয়েছিলো।

    চাপা একটা কণ্ঠস্বর। আর সেগুলো মনে হচ্ছে নিচ থেকে ভেসে আসছে। সোফি কল্পনাও করতে পারলো না। হামাগুড়ি দিয়ে সে মাটিতে কান পাতলো। হ্যাঁ, শব্দটা নিশ্চিত নিচ থেকেই আসছে। কণ্ঠগুলো মনে হচ্ছে গান করছে, অথবা…ফিসফাস্ করছে? সোফি ভয় পেয়ে গেলো। এই বাড়িতে যে একটা বেসমেন্ট রয়েছে সেটা সোফি জানতো না।

    এবার অভ্যর্থনা কক্ষের চারপাশটা ভালো করে তাকিয়ে দেখলো সোফি। পুরো ঘরটাতে সে শুধু একটা জিনিসই খুঁজে পেলো, যা একটু সরে ছিলো তার দাদুর প্রিয় এন্টিক। একটা চওড়া টেপেস্ট, যেটা পূর্ব দিকের দেয়ালে, ফায়ার প্লেসের পাশে সাধারণত টাঙানো থাকে। কিন্তু সেদিন সেটা একটু দূরে সরে ছিলো। যেনো জিনিসটা কেউ ইচ্ছে করেই সরিয়ে রেখেছে। এতে করে ওটার পেছনের দেয়ালটা দেখা যাচ্ছে।

    কাঠের দেয়ালটার কাছে যেতেই, সোফি শুনতে পেলো আওয়াজটা বেড়ে যাচ্ছে। দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে সে কাঠের উপর কান চেপে শুনতে চাইলো। আওয়াজটা এবার খুব পরিষ্কার শোনা যাচ্ছে। লোকগুলো নিশ্চিত সুর করে গাইছে…গানের কথাগুলো সোফি ধরতে পারলো না।

    এই দেয়ালটার পেছনে ফাঁকা জায়গা আছে!

    প্যানেলের কোনায়, সোফি টের পেলো একটা ছিদ্র আছে।একটা স্লাইডিং দরজা। তার হৃদস্পন্দন আবারো বেড়ে গেলো। ছিদ্রটার মধ্যে আঙ্গুল ঢুকিয়ে টান দিলো সে। কোন রকম শব্দ ছাড়াই ভারি দরজাটা সরতে লাগলো। ভেতরের অন্ধকার থেকে কণ্ঠস্বরের প্রতিধ্বনি শোনা যাচ্ছে।

    দরজাটা দিয়ে সোফি ভেতরে ঢুকেই দেখতে পেলো খড়খড়ে পাথরের তৈরি একটা সিঁড়ি নিচের দিকে নেমে গেছে। সে ছোট বেলা থেকেই এবাড়িতে নিয়মিত আসততা, তারপরও এ ধরনের সিঁড়ির অস্তিত্ব সম্পর্কে তার কোন ধারণাই ছিলো না।

    ভেতরে ঢুকতেই বাতাসটা ঠাণ্ডা অনুভূত হলো। কণ্ঠস্বরগুলো আরো পরিষ্কার শোনা যাচ্ছে। এখন সে নারী-পুরুষের কণ্ঠ শুনতে পেলো। সিঁড়ির একেবারে নিচের ধাপে নেমে সে দেখতে পেলো, একটা ছোট বেসমেন্ট ফ্লোর-পাথরের, ফায়ার লাইটের কমলা রঙের আলোতে জায়গাটা আলোকিত হয়ে আছে।

    দম নিয়ে, সোফি ভালো করে তাকিয়ে দেখলো। কী হচ্ছে, সেটা দেখতে কয়েক সেকেন্ড লাগলো তার। ঘরটা একটা গুহা—পাহাড়ের গ্রানাইটে তৈরি গহ্বরটা। দেয়ালের একটা মশালই ঘরটার একমাত্র বাতি। বাতির আলোতে, ত্রিশ জন বা সেই সংখ্যক লোক ঘরটাতে গোল হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

    আমি স্বপ্ন দেখছি, সোফি নিজেকে বলেছিলো। একটা স্বপ্ন ছাড়া আর কী?

    ঘরের সবাই মুখোশ পরে আছে। মহিলারা পরেছে সাদা গাউন আর সোনালি জুতা। তাদের মুখোশগুলো সাদা, হাতে সোনালি রঙের গোলক ধরা। পুরুষেরা কালো আলখেল্লা পরা, তাদের মুখোশও কালো। তাদেরকে দেখে বিশাল দাবার কোর্ট বলে মনে হচ্ছে। বৃত্তের সবাই সামনে এবং পেছনে দুলছে আর সুর করে গাইছে। তাদের সামনে কোন কিছু রাখা আছে, সেটাকে তারা এভাবে শ্রদ্ধা জানাচ্ছে…কিছু একটা যা সোফি দেখতে পাচ্ছিলো না।

    সুরধ্বনিটা আরো স্পষ্ট শোনা যেতে লাগলো। সেটা ক্রমশ বেড়ে বজ্রপাতের মতো প্রবল হলো এবার। অংশগ্রহণকারীরা এক কদম এগিয়ে গিয়ে হাটু গেঁড়ে বসে পড়লো। ঠিক সেই মুহূর্তেই, সোফি মাঝখানে কী হচ্ছে সেটা দেখতে পেলো। দৃশ্যটা দেখে ভয়ে পিছু হটে গেলেও, এই দৃশ্যটাই তার মনে চিরকালের জন্য গেঁথে গিয়েছিলো। তার বমি বমি ভাব হলে সে মাথা ঘুরে পড়ে যেতে লাগলো। পাথরের দেয়ালটা কোনভাবে হাতরাতে হাতরাতে সে সিঁড়ি দিয়ে উঠতে চেষ্টা করলো। দরজাটা টেনে বন্ধ করে ঐ বাড়িটা ছেড়ে চলে গেলো সে। কাঁদতে কাঁদতে গাড়ি চালিয়ে সেই রাতে প্যারিসে ফিরে এসেছিলো সোফি।

    ঐ রাতে সোফি ভগ্নহৃদয় নিয়ে সবকিছু গোছগাছ করে বাড়ি ছেড়ে চলে গিয়েছিলো। ডাইনিং রুমের টেবিলের ওপর একটা চিরকুট রেখে গিয়েছিলো সে।

    আমি সব দেখে ফেলেছি। আমাকে খোঁজার চেষ্টা করবে না।

    চিরকুটটার পাশেই শ্যাতুর বাড়িটার পুরনো একটা চাবি রেখে দিয়েছিলো।

    সোফি! ল্যাংডন তাড়া দিয়ে বললো, থামাও! থামাও।

    স্মৃতি থেকে ফিরে এসে সোফি জোরে ব্রেক কষলো। কি? কি হয়েছে?

    ল্যাংডন সামনের রাস্তার দিকে ইঙ্গিত করলো।

    দৃশ্যটা দেখে সোফির রক্ত ঠাণ্ডা হয়ে গেলো। একশো গজ সামনে, রাস্তার মোড়টায় ডিসিপিজের কয়েকটা গাড়ি পথ আঁটকে দাঁড়িয়ে আছে। তাদের উদ্দেশ্য খুবই পরিষ্কার। তারা গ্যারিয়েল এভিটা সিল করে দিয়েছে!

    ল্যাংডন একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। এ্যামবাসিতে যাওয়াটা আজ রাতে কঠিন হয়ে যাচ্ছে।

    রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা ডিসিপিজের দুজন অফিসার তাদের দিকে তাকালো।

    ঠিক আছে, সোফি, খুব ধীরে ধীরে ঘুরিয়ে ফেলে।

    সোফি স্মার্ট গাড়িটা একটু পেছনে নিয়ে বিপরীত দিকে ঘুরিয়ে ফেললো। গাড়িটা ছুটতেই সে শুনতে পেলো কতগুলো চাকার খ্যা খ্যাচ্‌ শব্দ আর সাইরেনের আওয়াজ। সোফি সঙ্গে সঙ্গে এক্সেলেটরে চাপ দিলো

     

    ৩৩.

    সোফির স্মার্ট গাড়িটা কূটনৈতিক এলাকা ছেড়ে এগিয়ে গেলো। অ্যামবাসি আর কনসুলেটগুলো অতিক্রম করে অবশেষে একটা রাস্তায় এসে পড়লো তারা, সেখান থেকে ডান দিকে মোড় নিয়ে আবার শাম্প-এলিসির বিশাল চত্বরটাতে ফিরে গলো।

    ল্যাংডন সিটে বসে পেছনের দিকে তাকিয়ে দেখলো কোন পুলিশের গাড়ি দেখা যায় কি না। হঠাৎ করে তার মনে হলো সে আর পালাবে না। তুমি এরকম কোরো না, নিজেকে স্মরণ করিয়ে দিলো। বাথরুমের জানালা দিয়ে জিপিএস ডটটা যখন সোফি ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিলো তখন তার হয়ে সোফিই সিদ্ধান্তটা নিয়েছিলো। এখন অ্যামবাসি থেকে চলে যাবার সময়, শাম্প-এলিসির পথ দিয়ে ছুটতে ছুটতে ল্যাংডনের মনে হলো তার সুযোগগুলো কমতে শুরু করেছে। যদিও মনে হচ্ছে সোফি পুলিশকে ক্ষণিকের জন্য ফাঁকি দিতে পেরেছে কিন্তু ল্যাংডনের সন্দেহ খুব বেশিক্ষণ তারা এভাবে নিজেদের সৌভাগ্য ধরে রাখতে পারবে না।

    এক হাতে স্টিয়ারিং ধরে থাকা অবস্থায় অন্য হাত দিয়ে সোফি তার সোয়েটারের পকেট থেকে ধাতব একটা বস্তু বের করে আনলো। জিনিসটা ল্যাংডনের দিকে এগিয়ে ধরলো সে। রবার্ট, জিনিসটা একটু দেখো। এটাই আমার দাদু ম্যাডোনা অব দি রকস্-এর পেছনে রেখে গিয়েছেন।

    ভেতরে ভেতরে প্রবল উত্তেজনা বোধ করে ল্যাংডন জিনিসটা হাতে নিয়ে পরীক্ষা করে দেখলো। খুব ভারি আর ক্রুশ আকৃতির একটা জিনিস। তার প্রথমে মনে হলো, সে ধরে রেখেছে একটা শেষকৃত্যের পাইকবরের পাশে, মাটিতে পোতা ফলকের ছোটখাটো একটা সংস্করণ। কিন্তু ভালোভাবে লক্ষ্য করে দেখলো জিনিসটা আসলে এক ধরনের উন্নত মানের সূক্ষ্ম-যন্ত্রবিশেষ।

    এটা একটা লেজার-কাট চাবি, সোফি তাকে বললো। শুধুমাত্র ইলেক্ট্রক-আই দিয়েই এটা রিড করা যায়।

    একটা চাবি? ল্যাংডন কখনও এরকম কিছু দেখেনি।

    অন্য দিকটা দেখো, সোফি বললো। রাস্তা বদলে একটা মোড়ের কাছে এসে পড়লো তারা।

    ল্যাংডন যখন চাবিটা ঘুরিয়ে দেখলো তার মুখ হা হয়ে গেলো। কুশটার মাঝখানে খোঁদাই করা ফ্লার-দ্য-লিস এবং পিএস অক্ষর দুটো রয়েছে! সোফি, সে বললো, এই সিলটার কথাই তোমাকে আমি বলেছিলাম। প্রায়োরি অব সাইনর অফিশিয়াল প্রতীক।

    সে মাথা নেড়ে সায় দিলো। তোমাকে যেমনটা বলেছিলাম, আমি চাবিটা অনেক আগে একবার দেখেছিলাম। তিনি আমাকে এ ব্যাপারে কখনও কোন কিছু বলতে বারণ করে দিয়েছিলেন।

    ল্যাংডনের চোখ তখনও চাবিটার দিকেই নিবদ্ধ। এর অতি উন্নত প্রাযুক্তিক কৌশল আর বহু প্রাচীন প্রতীকের সহাবস্থান আধুনিকতা আর প্রাচীনের সংমিশ্রন বলে মনে হলো তার কাছে।

    তিনি আমাকে বলেছিলেন চাবিটা দিয়ে একটা বাক্স খোলা যায়, যেখানে তিনি অনেক গোপনীয় কিছু রাখেন।

    ল্যাংডন এটা ভেবে খুব শীতল অনুভব করলো যে, জ্যাক সনিয়ের মতো একজন মানুষ কী ধরনের সিক্রেট রাখতে পারেন। একজন প্রাচীন ভ্রাতৃসংঘের মানুষ এরকম একটা চাবি দিয়ে কী করতেন। ল্যাংডনের সে সম্পর্কে কোন ধারণাই নেই। প্রায়োরিরা একটা সিক্রেটকেই রক্ষা করার উদ্দেশ্যে সংগঠনটির পত্তন করেছিলেন। অবিশ্বাস্য ক্ষমতার একটা সিক্রেট। এই চাবিটা কি সে সবের সাথে সংশ্লিষ্ট? ভাবনাটা তাকে রোমাঞ্চিত করলো।

    তুমি কি জাননা এটা দিয়ে কী খোলা যায়?

    সোফিকে দেখে খুব হতাশ মনে হলো। আমি আশা করেছিলাম তুমিই সেটা জানো।

    ল্যাংডন নিরবে চাবিটার ক্রশ পরীক্ষা করতে লাগলো। এটা দেখতে খৃস্টিয় বলে মনে হচ্ছে, সোফি জানালো।

    ল্যাংডন অবশ্য এ ব্যাপারে অতোটা নিশ্চিত ছিলো না। চাবির মাথায় যে কুশটা আঁকা আছে সেটা প্রচলিত খৃস্টিয় ক্রশের মতো একটা বাহু লম্বা নয়, বরং এটার চারটা বাহুই সমান-চারটা বাহু দৈর্যে একেবারে একই রকম-যা খৃস্টাব্দের পনেরোশ বছর আগেকার সময়কেই নির্দেশ করছে। এই ধরনের ক্রশ কোন খৃস্টিয় ধর্ম সম্পর্কিত নয়, যা ক্রুশবিদ্ধের সাথে সংশ্লিষ্ট। রোমানরা যেটা শাস্তি দেয়ার যন্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতো। ল্যাংডন সব সময়ই অবাক হয়ে ভেবেছে, কতজন খৃস্টান এটার দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারে, তাদের প্রতীকের রক্তাক্ত ইতিহাসটা এর নামকে সঠিকভাবেই প্রতিধ্বনিত করছে : ক্রশ এবং ক্রুশিফিক্স বা ক্রুশবিদ্ধ শব্দটা এসেছে লাতিন ক্রিয়াপদ Cruiare থেকে-মানে, নির্যাতন করা।

    সোফি, সে বললো, আমি যেটা তোমাকে বলতে পারি সেটা হলো, এরকম সমান বাহুর ক্রশকে শান্তিপূর্ণ ক্রশ হিসেবেই বিবেচনা করা হয়। তাদের চারকোনা আকৃতিটা ক্রুশবিদ্ধ করার জন্য অনুপোযোগী হয়ে যায়, তাদের উলম্ব আর আনুভূমিক ভারসাম্য নারী-পুরুষের স্বাভাবিক সম্মিলনকে ইঙ্গিত করে। এটা প্রায়োরিদের দর্শনের একটি প্রতীকি উপস্থাপন।

    সোফি একটা হতাশাপূর্ণ ভঙ্গী করলো। তোমার কোন ধারণা নেই, তাই না?

    ল্যাংডন ভুরু তুলে বললো, একটা ক্লুও পাচ্ছি না।

    ঠিক আছে, আমাদেরকে রাস্তাটা ছাড়তে হবে। সোফি তার বিয়ার-ভিউটা দেখে নিলো। আমাদেরকে নিরাপদ একটা জায়গায় গিয়ে খুঁজে বের করতে হবে চাবিটা দিয়ে কী খোলা যায়।

    ল্যাংডন তার হোটেল রিজ-এর আরামদায়ক ঘরটির কথাই প্রথমে ভাবলো। নিশ্চিতভাবেই এটা কোন জায়গা হতে পারে না। প্যারিসে আমার আমেরিকান ইউনিভার্সিটির নিমন্ত্রণকতার জায়গাটা কেমন হয়?

    এটা একদম নিশ্চিত, ফশে তাদের ওখানে সবার আগে খোঁজ নেবে।

    তুমি এখানে থাকো, অনেককেই নিশ্চয় চেননা।

    ফশে আমার ফোন, ই-মেইল রেকর্ড ঘেঁটে দেখবে, আমার সহকর্মীদের সাথে কথা বলবে। আমার পরিচিতজনদের কোন জায়গা নিরাপদ হবে না, আর কোন হোটেলে যাওয়াটাও ঠিক হবে না, সব জায়গায়ই আইডি কার্ড চাইবে।

    ল্যাংডন আবার ভাবতে লাগলো, যদি সে লুভরেই ফশের হাতে গ্রেফতার হোতো তবেই বেশি ভালো হতো। আসো, অ্যামবাসিতে ফোন করি। আমি তাদের সমস্ত পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করতে পারবো আর অ্যামবাসির কাউকে আমাদের সাথে অন্য কোথাও দেখা করার জন্য লোক পাঠাতে বলবো।

    আমাদের সাথে দেখা করা? সোফি তার দিকে ঘুরে এমনভাবে তাকালো যেনো ল্যাংডন একজন পাগল। রবার্ট, তুমি স্বপ্ন দেখছো। তোমার অ্যামবাসি নিজের কম্পাউন্ডের বাইরে এরকম কোন আইনগত ক্ষমতা রাখে না। আমাদেরকে নেয়ার জন্য লোক পাঠানোর অর্থ হলো ফরাসি সরকারের একজন ফেরারী আসামীকে সাহায্য করা। এটা হবে না। তুমি যদি তোমার অ্যামবাসিতে গিয়ে সাময়িক আশ্রয় চাওয়ার অনুরোধ করো সেটা একটা কথা, কিন্তু তাদের কাছে ফরাসি আইন প্রয়োগকারী সংস্থার বিরুদ্ধে যায় এমন কিছু চাওয়াটা? সোফি মাথা ঝাঁকালো। তোমার অ্যামবাসিকে এক্ষুণি ফোন করে, তারা তোমাকে বলবে আর বেশি ক্ষতি না করে ফশের কাছে ধরা দিতে। তারপর তারা প্রতীজ্ঞা করবে কূটনৈতিকভাবে ব্যাপারটা মীমাংসা করার, যাতে তুমি ন্যায় বিচার পাও। সোফি শাম্প-এলিসির অভিজাত এলাকার দিকে তাকালো। তোমার কাছে কি পরিমাণ টাকা আছে?

    ল্যাংডন মানি ব্যাগটা দেখে নিলো। একশো ডলার, আর কিছু ইউরো। কেন?

    ক্রেডিট কার্ড?

    অবশ্যই।

    সোফি গাড়িটার গতি বাড়াতেই ল্যাংডন অনুমান করতে পারলো সে একটা পরিকল্পনা আঁটছে। একেবারে সামনে শাম্প-এলিসির শেষ মাথায় আর্ক দ্য ট্রায়াঙ্গ অবস্থিত-নেপোলিয়নের ১৬৪ ফুট উচ্চতার স্মৃতিস্তম্ভ যা তার সেনাবাহিনীর শক্তিকে প্রকাশ করছে-সেটার চারপাশ ঘিরে রয়েছে ফ্রান্সের সবচাইতে বড় একটা চত্বর।

    সেখানে পৌঁছাতেই সোফি আবারো বিয়ার-ভিউ আয়না দিয়ে তাকালো। কিছুক্ষণের জন্য হলেও তাদেরকে আমরা ফাঁকি দিতে পেরেছি, সোফি বললো, কিন্তু এই গাড়িতে যদি আমরা থাকি তবে পাঁচ মিনিটও আর টিকতে পারবো না।

    তো, অন্য আরেকটা গাড়ি চুরি করতে হবে, ল্যাংডন মনে মনে বললো, আমরা এখন সত্যিকারের অপরাধী। তুমি কি করতে চাও?

    সোফি গাড়িটা দ্রুত গতিতে চত্বরটার সামনে নিয়ে গেলো। আমার উপর আস্থা রাখো।

    ল্যাংডন কোন প্রতিক্রিয়া দেখালো না। আজ রাতে আস্থা তাকে খুব বেশি দূর অবধি নিয়ে যেতে পারেনি। শার্টের হাতা গুটিয়ে হাত ঘড়িটা দেখলো-একটা পুরনো, সংগ্রহশালার সংস্করণের মিকি মাউস হাত-ঘড়ি, যা তার বাবা-মা তার দশম জন্মদিনে উপহার দিয়েছিলো। যদিও এটা দেখতে অল্পবয়সীদের মতো লাগে তবুও ল্যাংডন কখনও এটা বাদে অন্য কোন ঘড়ি পরেনি; আকার এবং রঙের জাদুর সাথে তার প্রথম পরিচয় ডিজনির কার্টুনের মধ্য দিয়ে। আর মিকি, ল্যাংডনকে প্রতিদিনের সময়ের কথা স্মরণ করার মধ্যে দিয়ে তাকে মনের দিক থেকে তরুণ করে রেখেছে। এখন মিকির হাত দুটো অত ভীতে আছে, ইঙ্গিত করছে সেরকমই অত সময়টাকে।

    ২টা ৫১ মিনিট।

    মজার ঘড়িতো, গাড়িটা একটানে ঘোরাতে ঘোরাতে তার হাত ঘড়ির দিকে তাকিয়ে সোফি বললো।

    এটার লম্বা একটা গল্প আছে, হাতটা নামিয়ে সে বললো।

    আমারও সে রকমই ধারণা। তার দিকে তাকিয়ে ছোট্ট একটা হাসি দিলো সে। গাড়িটা ঘুরিয়ে উত্তর দিকে গেলো। রাস্তাটা শহরের কেন্দ্রস্থল থেকে চলে গেছে। মোড়টা ছাড়িয়ে যেতেই তারা গাড়ির গতি বাড়িয়ে বুলেভার্ড মলেশাব-এর দিকে ছুটলো। সারি সারি গাছপালা সমৃদ্ধ কূটনৈতিক এলাকা ছেড়ে ঘন আঁধারে ঢাকা শিল্পাঞ্চলের ভেতরে ঢুকে পড়লো তারা। সোফি বাম দিকে মোড় নিতেই ল্যাংডন বুঝতে পারলো তারা এখন কোথায় আছে।

    গার সেন্ট-লাজারে।

    তাদের সামনে কাঁচের ছাদের ট্রেন টার্মিনালটা দেখতে অনেকটা এয়ারপ্লেন হ্যাঙ্গার অথবা গৃন-হাউজের মতোই লাগছে। ইউরোপের ট্রেন স্টেশনগুলো কখনও ঘুমায় না। এমন কি এই সময়ে প্রবেশ দ্বারের সামনে আধ ডজন ট্যাক্সি অলসভাবে দাড়িয়ে আছে। গাড়িতে করে স্যান্ডউইচ আর মিনারেল ওয়াটার বিক্রি করছে ফেরীওয়ালারা, মুটে-মজুররা মাল-পত্র ওঠানো নামানোর জন্য অপেক্ষা করছে। রাস্তার ওপরে দাঁড়ানো কয়েকজন পুলিশ পর্যটকদেরকে রাস্তা-ঘাট চেনার কাজে সহায়তা দিচ্ছে।

    যদিও পার্কিং এলাকাতে পর্যাপ্ত জায়গা রয়েছে তারপরও সোফি তার গাড়িটা ট্যাক্সি পার্ক করা জায়গার ঠিক পেছনে রেঙ-জোন এলাকায় থামালো। ল্যাংডন তাকে কী হচ্ছে বা কী করবে জিজ্ঞেস করার আগেই সোফি গাড়ি থেকে নেমে সামনের ট্যাক্সিটার জানালা দিয়ে ড্রাইভারের সাথে কথা বলতে শুরু করে দিলো।

    ল্যাংডন গাড়ি থেকে নামতেই দেখতে পেলো সোফি ড্রাইভারকে এক বান্ডিল টাকা দিচ্ছে। ট্যাক্সি ড্রাইভার মাথা নেড়ে ল্যাংডনকে বিস্মিত করে তাদের ছেড়ে চলে গেলো।

    কি হয়েছে? ট্যাক্সিটা চলে যেতে দেখে ল্যাংডন জানতে চাইলো।

    সোফি ইতিমধ্যেই ট্রেন স্টেশনের প্রবেশদ্বারের দিকে এগিয়ে গেছে। আসো। আমরা পরের ট্রেনেই প্যারিস ছেড়ে যাবার জন্য দুটো টিকেট কিনবো।

    ল্যাংডন তার পিছু পিছু দ্রুত ছুটতে লাগলো। ইউএস অ্যামবাসি থেকে এক মাইল দূরে এসে এখন যা শুরু হয়েছে তাতে মনে হচ্ছে একেবারে প্যারিসই ছাড়তে হবে। ল্যাংডন এই আইডিয়াটাকে একদমই পছন্দ করতে পারছিলো না।

     

    ৩৪.

    লিওনার্দো দা ভিঞ্চি বিমান বন্দর থেকে যে ড্রাইভার বিশপ আরিঙ্গারোসাকে তুলে নিলো সে একটা ছোট্ট সাদা-মাটা কালো ফিয়াট সিডান গাড়ি নিয়ে এসেছে। আরিজারোসার মনে পড়ে গেলো সেইসব দিনগুলোর কথা যখন ভ্যাটিকানের পরিবহন শাখায় ছিলো ব্যয়বহুল আর অভিজাত সব গাড়ি, যাতে মেডেল আর হলি সির সিলযুক্ত পতাকা উড়তো। সেইসব দিন আর নেই। ভ্যাটিকানের গাড়িগুলো জৌলুস হারিয়েছে, এখন আর সেগুলোর সবগুলোতে কোন কিছু দিয়ে চিহ্নিত করা থাকে না। ভ্যাটিকানের দাবি, এতে করে খরচ কমিয়ে বিশপদের এলাকায় আরো বেশি সেবামূলক কাজ করা যাবে। তবে আরিঙ্গারোসার সন্দেহ এটা আসলে নিরাপত্তার জন্যই করা হয়েছে। পৃথিবীটা উন্মাদ হয়ে গেছে, আর ইউরোপের অনেক অংশেই তোমার যিশুর জন্য ভালবাসার বিজ্ঞাপনটা করা হয়ে থাকে অনেকটা তোমার গাড়ির ছাদে ষাড়ের চোখ আঁকার মতো করে।

    কালো আলখেল্লাটা বেঁধে নিয়ে আরিজারোসা গাড়ির পেছনের সিটে গিয়ে বসলেন কাস্তেল গাডোলফোর উদ্দেশ্যে লম্বা একটা ভ্রমণের জন্য। এটা হবে ঠিক পাঁচ মাস আগের ভ্রমণের মতোই।

    গত বছরের রোমের ভ্রমণ, তিনি একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেললেন। আমার জীবনের দীর্ঘতম একটি রাত।

    পাঁচ মাস আগে ভ্যাটিকান তাকে ফোন করে বলেছিলো সঙ্গে সঙ্গে যেনো রোমে উপস্থিত হয়। তারা কোন ব্যাখ্যা দেয়নি। আপনার টিকিট এয়ারপোর্টেই আছে। হলি সি একটা ঢেকে থাকা রহস্য পুণরুদ্ধারের জন্য প্রবলভাবে কাজ করে যাচ্ছিলেন, এমনকি এর উচ্চতম যাজকও। এই রহস্যময় ডেকে আনাটা, আরিঙ্গাবোসা ভেবেছিলেন, সম্ভবত ওপাস দাইর সাম্প্রতিক সফলতার জন্য পোপ এবং ভ্যাটিকানের অন্যান্য কর্মকর্তাদের সাথে ছবি তোলার একটা সুযোগ-নিউইয়র্কে তাদের বিশ্ব-সদর দফতরের কাজ সমাপ্ত হয়েছিলো। আর্কিটেকচারাল ডাইজেস্ট ওপাস দাইর ভবনটাকে আধুনিক স্থাপত্যের মধ্য দিয়ে ক্যাথলিকদের জৌলুসের উজ্জ্বল আলো, হিসেবে বর্ণনা করেছিলো। শেষ পর্যন্ত মনে হলো ভ্যাটিকান আধুনিক শব্দটার সাথে কোন না কোনভাবে জড়িয়ে গেছে।

    দাওয়াতটা কবুল করা ছাড়া আরিজারোসার কোন উপায় ছিলো না। তারপরও তিনি অনিশ্চয়তা নিয়েই সেটা মেনে নিয়েছিলেন। সাম্প্রতিক সময়ের পাপাল প্রশাসনের কোন ভক্ত হিসেবে নয়, আরিজারোসা অন্যসব রক্ষণশীল যাজকদের মতোই, নতুন পোপের প্রথম বছরটা প্রচণ্ড উদ্বিগ্নতার সাথে লক্ষ্য করে যাচ্ছিলেন, কীভাবে তিনি তার অফিস চালান সেটা দেখতে। একটা নজিরবিহীন উদারতায় হিজ হলিনেস ভ্যাটিকানের ইতিহাসের সবচাইতে বির্তকিত কনক্লেইভ-এর মধ্য দিয়ে পাপাসিটাকে সুরক্ষিত করেছিলেন। পোপ এখন ঘোষণা দিয়েছেন, তার পাপাল মিশনটা হবে ভ্যাটিকানের মতবাদকে নতুন করে প্রতিষ্ঠিত করা এবং ক্যাথলিকবাদকে তৃতীয় সহস্রাব্দের উপযোগী করে গড়ে তোলা। এই কাজটাকে অন্যেরা ভুলভাবে ব্যাখ্যা করতে পারে বলে আরিজারোসার আশংকা হয়েছিল। যারা মনে করে আধুনিককালে ক্যাথলিকবাদ অকেজো, তাদের মন জয় করার জন্য লোকটা কি ঈশ্বরের আইনকে নতুন করে লেখার মতো দুঃসাহস দেখাবে?

    আরিঙ্গাবোসা ওপাস দাই আর তাদের ব্যাংকের মাধ্যমে সমস্ত রাজনৈতিক শক্তি ব্যবহার করে পোপ এবং তার উপদেষ্টাদেরকে চাপ দিলেন। বোঝালেন, চার্চের নিয়ম কানুন শিথিল করার মাধ্যমে শুধুমাত্র বিশ্বাসহীনতাই তৈরি হবে না বরং রাজনৈতিকভাবেও আত্মহত্যা করা হবে।

    তিনি অতীতে চার্চের নিয়ম-কানুন পরিবর্তন করার ভ্যাটিকানের দ্বিতীয় ফিয়াকোটার কথা স্মরণ করিয়ে দিলেন, যে ঘটনাটি মারাত্মক ক্ষতির কারণ হয়েছিলো : চার্চের বর্তমান সময়ে উপস্থিতির হার যে কোন সময়ের তুলনায় কম, আর্থিক সাহায্যও কমে আসছে, এমনকি ক্যাথলিক চার্চে সভাপতিত্ব করার মতো পর্যাপ্ত সংখ্যক পাদ্রীরও সংকট চলছে এখন।

    চার্চ থেকে লোকজন গঠনমূলক এবং কিছু দিকনির্দেশনাও প্রত্যাশা করে, আরিঙ্গাবোসা চাপাচাপি করেছিলেন, আসকারা দেয়া কিংবা প্রশ্রয় দেয়াটা তারা আশা করে না।

    কয়েক মাস আগের সেই রাতে, ফিয়াটটা এয়ারপোর্ট থেকে ভ্যাটিকানের দিকে না গিয়ে পূর্বদিকের একটা আঁকাবাঁকা পাহাড়ি পথ দিয়ে চলে গিয়েছিলো। আরিঙ্গাবোসা খুবই অবাক হয়েছিলেন। আমরা কোথায় যাচ্ছি? ড্রাইভারের কাছে তিনি জানতে চেয়েছিলেন।

    আলবান হিল-এ, লোকটা জবাব দিয়েছিলো। আপনার সাক্ষাক্টা হবে কাস্তেল গাভোলফোতে।

    পোপের গ্রীষ্মকালীন আবাস? আরিঙ্গাবোসা কখনও সেখানে যায়নি, যাওয়ার ইচ্ছেও হয়নি কখনও। পোপের এই বাড়তি আবাসটা, ষষ্ঠ শতাব্দীর স্পেকুলা ভ্যাটিকানা, সিটাডেল হাউজ ছিলো-ভ্যাটিকানের অবজারভেটরি-ইউরোপের সবচাইতে অগ্রসর অবজারভেটরির মধ্যে এটা অন্যতম। আরিঙ্গাবোসা ভ্যাটিকানের বিজ্ঞান নিয়ে ছেলেমানুষী করার ইতিহাসটায় খুবই ব্ৰিত বোধ করেন। বিজ্ঞান এবং বিশ্বাসের সংমিশ্রনের যৌক্তিকতা কি? যে ব্যক্তি ঈশ্বরে বিশ্বাস ধারণ করে তার দ্বারা নিরপেক্ষ বিজ্ঞান ভাবনা সম্ভব নয়। যেমনটা সম্ভব নয় বিশ্বাসী কারোর পক্ষে তার বিশ্বাসের স্বপক্ষে বস্তুগত কোন প্রমাণের।

    যাহোক, এইতো এটা, কাস্তেল গান্ডোলফোটা দৃষ্টিগোচর হলে তিনি মনে মনে বলেছিলেন। নভেম্বরের তারা ভরা আকাশে বুক উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সেটা। দূর থেকে প্রাসাদটাকে দেখা যায় ইতালিয় সভ্যতার পাদপীঠে-যে উপত্যকায় কুরিয়াজি এবং ওরাজি ক্লান লড়াই করেছিলো রোম পত্তন হবার অনেক আগে।

    প্রাসাদটার ছায়া দেখেও মনে হবে একটা আত্মরক্ষামূলক স্থাপত্যের চমৎকার অবয়ব। দুঃখজনক হলো, আরিঙ্গাবোসা দেখতে পান ভ্যাটিকান প্রাসাদটাকে এর ছাদের উপর বিশাল বড় দুটো অ্যালুমুনিয়ামের টেলিস্কোপ বসানোর মধ্য দিয়ে নষ্ট করে ফেলেছে। যেনো এককালের গর্বিত কোন যোদ্ধার মাথায় পার্টি টুপি পরিয়ে দেয়া হয়েছে।

    আরিঙ্গাবোসা গাড়ি থেকে নামতেই একজন তরুণ যাজক খুব দ্রুত ছুটে এসে তাঁকে অভিবাদন জানিয়েছিলো। বিশপ, আপনাকে স্বাগতম। আমি ফাদার মাঙ্গাননা। এখানকার একজন জ্যোর্তিবিদ।

    আপনার জন্য উপযুক্ত জায়গা। আরিঙ্গাবোসা শুভেচ্ছা বিনিময় করে ফাদারের পিছু পিছু প্রাসাদের ভেতরে প্রবেশ করেন। অভ্যর্থনা কক্ষটি বেশ খোলামেলা জায়গা, সেখানকার সাজসজ্জা বেঁনেসা চিত্রকলা এবং জ্যোর্তিবিদ্যার চিত্র দিয়ে সাজানো হয়েছে। এতে করে জৌলুসহীন হয়ে পড়েছে ভেতরের পরিবেশ। বিশাল এবং প্রশস্ত মার্বেলের সিঁড়ি দিয়ে উপরে ওঠার সময় আরিঙ্গাবোসা লক্ষ্য করেন কনফারেন্স রুম, সায়েন্স লেকচার হল আর পর্যটন তথ্য সার্ভিস ইত্যাদি সাইনগুলো। এটা তাকে বিস্মিত করলো। তিনি ভাবেন, ভ্যাটিকান প্রতিটি ক্ষেত্রেই আধ্যাত্মিকতার সমৃদ্ধি না ঘটিয়ে বরং পর্যটকদের কাছে ভৌত জ্যোর্তিবিদ্যার বক্তৃতা দিয়ে থাকে।

    আমাকে বলুন, আরিজারো তরুণ যাজককে বলেন, কখন থেকে লেজে কুকুর নাড়াতে শুরু করেছে?

    তরুণ যাজক তার দিকে অদ্ভুতভাবে তাকায়। স্যার?

    আরিঙ্গাবোসা ইশারা করে ব্যাপারটা ক্ষান্ত দেন। তিনি ঠিক করেন আজকের সন্ধ্যায় আর এইসব ব্যাপার নিয়ে আক্রমণাত্মক কোন কিছু বলবেন না। ভ্যাটিকান উন্মাদ হয়ে গেছে।

    ওপরের তলার করিডোরটা খুবই প্রশস্ত, একদিকেই চলে গেছে সেটা-একটা বিশাল ও কাঠের দরজার দিকে, যেটাতে পিতলের একটা সাইন লাগানো :

    BIBLIOTECA ASTRONOMICA

    আরিঙ্গাবোসা এই জায়গাটা সম্পর্কে শুনেছিলেন-ভ্যাটিকানের জ্যোর্তিবিদ্যার লাইব্রেরি-গুজব আছে, এখানে পঁচিশ হাজার ভলিউম সংরক্ষণ করা আছে, যার মধ্যে কোপার্নিকাসের বিরল কাজগুলোও রয়েছে। সেই সঙ্গে রয়েছে গ্যালিলিও, কেপলার, নিউটন আর সেচ্চির। আরো অভিযোগ আছে, এখানেই পোপের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা গোপন মিটিং করে থাকে…এসব মিটিং তারা ভ্যাটিকানের চার দেয়ালের মধ্যে করাটা পছন্দ করেন না।

    দরজার দিকে এগোতে থাকা বিশপ আরিঙ্গাবোসা কখনও কল্পনাও করতে পারেননি ভেতরে ঢুকে তিনি কী রকম দুঃখজনক একটি সংবাদ শুনবেন। এই ঘটনাই তাকে একটা মিশনে নামতে প্রবৃত্ত করেছিলো। এখন থেকে ছয় মাস পরে। মনে মনে ভাবলেন তিনি। ঈশ্বর আমাদের সাহায্য করুন।

     

    এখন ফিয়াটে বসে বিশপ আরিঙ্গাবোসা বুঝতে পারলেন, প্রথম মিটিংটার কথা ভেবে তার হাত দুটো মুষ্টিবদ্ধ হয়ে গেছে। তিনি তার মুঠোটা খুলে ধীরে ধীরে নিঃশ্বাস নিয়ে তার পেশীগুলো নিস্তেজ করলেন।

    সবকিছু ঠিকঠাক মতো হবে, ফিয়াটটা পাহাড়ী পথে উঠতেই তিনি নিজেকে বললেন। তিনি এখনও আশা করছেন তাঁর সেলফোনটা বাজুক। টিচার কেন ফোন করছে না আমাকে? সাইলাস হয়তো এরইমধ্যে কি-স্টোনটা পেয়ে থাকবে।

    নিজের নাভটা স্থিত করার জন্য বিশপ তার হাতের আঙটির বর্ণালি এমেথিস্টটার দিকে তাকিয়ে ধ্যান করার চেষ্টা করলেন। তার এও মনে হলো, হাতের পাথরটার যে ক্ষমতা আছে তার চেয়েও অনেক বেশি ক্ষমতা তিনি খুব শীঘ্রই অর্জন করতে যাচ্ছেন।

     

    ৩৫.

    গার সেন্ট লাজারের ভেতরটা দেখতে ইউরোপের অন্যান্য ট্রেন স্টেশনের মতোই, ছোট-ঘোট গমন-নির্গমনের দরজা, অনেকটা গুহার মতো-গৃহহীন লোকেরা হাতে সাইনবোর্ড ধরে আছে, কতোগুলো স্কুল কলেজের ছাত্র পিঠে ঝোলা নিয়ে এদিক ওদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে ঘুমাচ্ছে, কেউবা এমপি খৃ কানে লাগিয়ে গান শুনছে, নীল রঙের ব্যাগেজ নিয়ে সিগারেট ফুকছে একদল মুটে।

    সোফি উপরে ঝোলানো বিশাল ডিপার্চার বোর্ডটার দিকে তাকালো। কালো আর সাদা ট্যাবগুলো বদলে যাচ্ছে, ভেসে উঠছে নতুন তথ্য। আপডেটগুলো শেষ হলে ল্যাংডন সেটা দেখলো। তালিকার সবার উপরের লেখাটা পড়লো সে :

    লিলে-রেপাইড-৩:০৬

    মনে হচ্ছে এটা খুব শীঘ্রই ছাড়বে, সোফি বললো।

    শীঘই। ল্যাংডন তার ঘড়ির দিকে তাকালো : ২:৫৯। ট্রেনটা সাত মিনিটের মধ্যেই ছেড়ে যাবে আর এখন পর্যন্ত তারা টিকেট হাতে পায়নি।

    সোফি ল্যাংডনকে কাউন্টারের দিকে নিয়ে গিয়ে বললো, তোমার ক্রেডিট কার্ডটা দিয়ে দুটো টিকেট কেনো।

    আমার মনে হয় ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করলে ওরা ট্রে করে ফেলবে–

    একেবারেই ঠিক।

    ল্যাংডন এগিয়ে গিয়ে ভিসাকার্ডটা দিয়ে লিলের দুটো টিকেট কিনে সোফির হাতে তুলে দিলো।

    তাকে নিয়ে অন্য জায়গায় চলে গেলো সোফি। একটা পরিচিত কণ্ঠ মাথার উপর বেজে চলছে। পিএ ঘোষক লিলের বোর্ডিংয়ের জন্য চুড়ান্ত আহ্বান জানাচ্ছে। তাদের সামনে যোলোটা রেললাইন চলে গেছে। দূরের ডান দিকে, তিন নম্বর লাইনটাতে লিলের ট্রেনটা ছাড়ার জন্য অপেক্ষা করছে কিন্তু সোফি ল্যাংডনের কোমর এক হাতে জড়িয়ে ধরে তাকে ঠিক বিপরীত দিকে টেনে নিয়ে যেতে লাগলো। তারা লবিটা এবং সারারাত খোলা থাকে এমন একটা কফিশপ পেরিয়ে অবশেষে স্টেশনের পশ্চিম দিকের দরজা দিয়ে বের হয়ে বাইরে ফাঁকা রাস্তায় এসে পড়লো।

    দরজাটার সামনেই খালি একটা ট্যাক্সি দাঁড়িয়ে আছে। সোফিকে দেখেই হেডলাইট জ্বালালো ড্রাইভার।

    সোফি গাড়িটার পেছনের সিটে গিয়ে বসে পড়লে ল্যাংডনও তাকে অনুসরণ করে পেছনে গিয়ে বসলো।

    ট্যাক্সিটা স্টেশন থেকে ছেড়ে যেতেই সোফি এইমাত্র কেনা টিকেট দুটো বের করে ছিঁড়ে ফেললো।

    ল্যাংডন একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। সতেরো ডলার কতো ভালোভাবেই না খরচ করা হলো।

    তাদের ট্যাক্সিটা উত্তর দিকের রুই দ্য ক্লিচিতে না আসা পর্যন্ত ল্যাংডনের মনে হলো না তারা পালাতে পেরেছে। ডান দিকের জানালা দিয়ে সে দেখতে পেলো চমৎকার সুন্দর মস্তমাত্রে আর মনোরম স্যাকর-কোয়ে। বিপরীত দিক থেকে পুলিশের গাড়ির হেডলাইটের আলোতে দৃশ্যগুলো দেখতে বাঁধা পেলো।

    সাইরেনের আওয়াজটা পেতেই ল্যাংডন আর সোফি নিচু হয়ে শুয়ে পড়লো।

    সোফি ড্রাইভারকে আগেই বলে দিয়েছিলো সোজা শহরের বাইরে বেড়িয়ে যেতে, আর ল্যাংডন সোফির শক্ত চোয়ালটা দেখে অনুমান করতে পারলো পরবর্তী পরিকল্পনাটাও মনে মনে এঁটে নিচ্ছে মেয়েটা।

    ল্যাংডন ক্রুশাকৃতির চাবিটা আবার পরীক্ষা করতে লাগলো। জানালার সামনে তুলে ধরলো সেটা, খুব কাছে নিয়ে দেখতে চেষ্টা করলো ওটাতে কোন মার্ক দেয়া আছে কি না, যাতে বোঝা যায় চাবিটা কোথায় বানানো হয়েছে। কিন্তু এই স্বল্প আলোতে সে কেবল প্রায়োরি সিলটা ছাড়া আর কিছুই দেখতে পেলো না।

    কিছুই বোঝা যাচ্ছে না, বললো সে।

    কোনটা?

    তোমার দাদু এতো কষ্ট করে তোমার কাছে এমন একটা চাবি দিয়ে গেলেন যা দিয়ে কী করতে হবে সেটা তুমি জানো না।

    ঠিক বলেছো।

    তুমি কি নিশ্চিত তিনি ছবিটার পেছনে অন্য কিছু লেখেননি?

    আমি পুরো জায়গাটা খুঁজেছি। এটাই শুধু ছিলো। এই চাবিটা ছবিটার পেছনে ছিলো। আমি প্রায়োরি সিলটা দেখেই চাবিটা পকেটে ভরে চলে এসেছি।

    ল্যাংডন কপাল কুচকে চাবির ত্রিভূজাকৃতির দণ্ডটার দিকে তাকালো। কিছুই নেই। এবার চাবিটার মাথা ভালো করে দেখলো। সেখানেও কিছু নেই। আমার মনে হচ্ছে চাবিটা সম্প্রতি পরিষ্কার করা হয়েছে।

    কেন?

    এটা থেকে এলকোহলের গন্ধ পাচ্ছি।

    সোফি ঘুরে তাকালো। বুঝলাম না?

    এটা থেকে গন্ধ পাচ্ছি, তাতে মনে হচ্ছে কেউ এটা ক্লিনার দিয়ে পরিষ্কার করেছে। ল্যাংডন চাবিটা নাকের কাছে ধরে গন্ধ শুকলো। এদিকটাতে আরো বেশি গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। সে জিনিসটা উল্টে দেখলো। হ্যাঁ, এলকোহলই। মনে হচ্ছে। ক্লিনার হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। অথবা– ল্যাংডন থামলো।

    কি?

    সে চাবিটা আলোর কাছে কোনাকুনি করে ধরে এটার মসৃন পৃষ্ঠটার দিকে তাকালো। ভেজা-ভেজা মনে হচ্ছে, তাই চকচক করছে। চাবিটা পকেটে ঢোকানোর আগে তুমি এটার পেছনে কি ভালো করে দেখেছো?

    কি? না, ভালো করে দেখিনি। আমার খুব তাড়া ছিলো।

    ল্যাংডন সোফির দিকে ঘুরলো। তোমার কাছে কি ব্ল্যাক লাইটটা আছে?

    সোফি তার পকেট থেকে ইউভি পেনটা বের করে দিলে ল্যাংডন সেটা হাতে নিয়ে জ্বালিয়ে চাবিটার পেছন দিকে আলোর লম্মি ফেললো।

    পেছনটা সাথে সাথে জ্বলজ্বল করে উঠলো। কিছু একটা লেখা আছে।

    তো, ল্যাংডন হেসে বললো। আমার মনে হয় এলকোহলের গন্ধের কারণ কি সেটা আমি জানি।

    সোফি বিস্ময়ে চাবিটার পেছনে বর্ণালি লেখাটার দিকে তাকিয়ে আছে।

    ২৪ রুই হ্যাক্সে

    একটা ঠিকানা। আমার দাদু একটা ঠিকানা লিখে গেছেন।

    সেটা কোথায়? ল্যাংডন জিজ্ঞেস করলো।

    এ ব্যাপারে সোফির কোন ধারণাই ছিলো না। সামনের দিকে ঝুঁকে গাড়ির ড্রাইভারকে জিজ্ঞেস করলো সে, কনোসেজ-তু লা রুই হস্লো?

    ড্রাইভার একটু ভেবে মাথা নেড়ে সায় দিলো। সে জানালো জায়গাটা প্যারিসের বাইরে, পশ্চিম দিকে অবস্থিত টেনিসকোটের কাছেই। সোফি তাকে তক্ষুণিই সেই জায়গায় যেতে বললো।

    দ্রুত যাওয়ার রাস্তাটা হলো বোয়ে দ্য বুলোয়াঁ দিয়ে, ড্রাইভার ফরাসিতে সোফিকে জানালো। ওদিক দিয়ে যাবো?

    সোফি একটু চিন্তা করলো। সে চাইছে যতো কম সমস্যা হয় তেমন একটা পথ ধরে যেতে কিন্তু আজ রাতে হয়তো সেটা সম্ভব হচ্ছে না। উই। আমরা এই বেড়াতে আসা আমেরিকানটাকে একটু ঘাবড়ে দিতে পারবো।

    সে চাবিটার দিকে তাকিয়ে ভাবতে লাগলো, এটা দিয়ে ২৪ রুই দ্য হ্যাক্সোতে গিয়ে কী খুঁজে পাবে। একটা চার্চ? প্রায়োরিদের হেড কোয়ার্টার জাতীয় কিছু?

    তার আবারো মনে পড়ে গেলো, দশ বছর আগে বেসমেন্টে দেখা সেই গোপন ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানটার কথা, একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো সে। রবার্ট, তোমাকে আমার অনেক কথা বলার আছে। সোফি একটু থেমে তার দিকে তাকিয়ে রইলো। ট্যাক্সিটা পশ্চিম দিকে ছুটছে এখন। কিন্তু প্রথমে আমি চাই তুমি আমাকে প্রায়োরি অব সাইওন সম্পর্কে সব কিছু খুলে বলো।

     

    ৩৬.

    সল দে এতাত-এর বাইরে, বেজু ফশে লুভরের ওয়ার্ডেনের কাছে সোফি আর ল্যাংডন কিভাবে তাকে নিরস্ত্র করে পালিয়ে গেছে সেটা শুনে ফুসতে লাগলো। আপনি কেন ছবিটাতে গুলি করলেন না।

    ক্যাপ্টেন? লেফটেনান্ট কোলেত কমান্ড-পোস্ট থেকে এসে বললো। ক্যাপ্টেন, এইমাত্র আমি শুনলাম, তারা এজেন্ট সোফির গাড়িটার অবস্থান জানতে পেরেছে।

    সে কি অ্যামবাসির দিকে যাচ্ছে?

    না। ট্রেন স্টেশনে। দুটো টিকেট কিনেছে। ট্রেনটা এইমাত্র ছেড়েছে।

    ফশে ওয়ার্ডেন গ্রুয়ার্দকে হাত নেড়ে চলে যেতে বলেই কোলেতকে নিয়ে একটু আড়ালে গেলো। নিচু স্বরে বললো, গন্তব্যটা কোথায়?

    লিলে।

    সম্ভবত একটা ফাদ। ফশে খুব আগ্রহ নিয়ে একটা পরিকল্পনা আঁটলো। ঠিক আছে, পরের স্টেশনকে সতর্ক করে দাও। দরকার হলে ট্রেনটা থামিয়ে তল্লাশী করতে বলো। সোফির গাড়িটা বাদ দিয়ে, ওখানে সাদা পোশাকের কিছু লোককে নজরদারিতে রাখো, যদি তারা ফিরে আসে সেক্ষেত্রে তাদেরকে পাকড়াও করা যাবে। স্টেশন এলাকার আশেপাশে কিছু লোক পাঠিয়ে দিও, তারা যদি পায়ে হেঁটে পালাতে চায় তো ধরা যাবে। স্টেশন থেকে কি বাস ছাড়ে?

    এই সময়টাতে, স্যার। শুধু ট্যাক্সি ছাড়ে। ভালো।

    ড্রাইভারদেরকে জিজ্ঞাসাবাদ কোরো। দেখো, তারা তাদের দেখেছে কী। তারপর ট্যাক্সি কোম্পানির সাথে যোগাযোগ করবে। আমি ইন্টারপোলে ফোন করছি।

    কোলেতকে খুব অবাক হতে দেখা গেলো। আপনি এই ব্যাপারটা ওখানে জানাবেন?

    ফশে সম্ভাব্য ব্ৰিত হওয়ায় অনুশোচিত হলো কিন্তু এছাড়া তার কিছু করারও নেই।

    জালটা খুব দ্রুত গুটিয়ে ফেলল, খুব শক্ত করে করো।

    প্রথম ঘন্টাটি হলো খুব জটিল। পালানোর পর ফেরারীরা প্রথম ঘণ্টায় খুব বেশি অনুমেয় থাকে। তাদের সবসময়ই দরকার হয় একই জিনিস। ভ্রমণ। আশ্রয়। টাকা। পবিত্র-জয়ী। ইন্টারপোল এই তিনটি উধাও হওয়া জিনিস চোখের পলকে খুঁজে বের করতে পারে। ল্যাংডন আর সোফির ছবি প্যারিসের ট্রালে অধিকর্তা, হোটেল আর ব্যাংকে প্রচার করার মধ্য দিয়ে ইন্টারপোল কোন অপশনই বাদ রাখবে না-শহর ছেড়ে যাবার কোন পথই আর থাকবে না। কোথাও পালানো যাবে না, আর কোথাও থেকে নিজের পরিচয় লুকিয়ে টাকাও তোলা যাবে না। সাধারণত ফেরারীরা রাস্তাঘাটে ভয়ে থাকে, বোকার মতো কাজ করে বসে। হয়তো একটা গাড়ি চুরি করে। কোন দোকানে ডাকাতি করে। মরিয়া হয়ে ব্যাংক কার্ড ব্যবহার করে। যে ভুলই তারা করুক না কেন, স্থানীয় কর্তৃপক্ষের কাছে তাদের অবস্থান খুব দ্রুতই জানাজানি হয়ে যায়।

    শুধু ল্যাংডন, ঠিক আছে? কোলেত জানতে চাইলো। আপনি সোফি নেভুকে নিয়ে ব্যস্ত হবেন না। সে তো আমাদেরই এজেন্ট।

    অবশ্যই। আমি তাকে নিয়ে ব্যস্ত হবো ফশে জোর দিয়ে বললো। সে যদি ল্যাংডনের সব নোংরা কাজগুলো করে ফেলে তো ল্যাংডনকে নিয়ে টানাটানি করাতে আর লাভ কী? আমি নেভু ফাইলটা দেখার কথা ভাবছিবন্ধু-বান্ধব, পরিবার-পরিজন, ব্যক্তিগত যোগাযোগ-এমন কেউ, যার কাছে সোফি সাহায্যের জন্য যেতে পারে। আমি জানি না সে কী করছে কিন্তু এটা শুধু তার চাকরিই খাবে না তারচেয়েও বেশি কিছু হবে!

    আপনি কি আমাকে ফোনে রাখতে চান, না ফিল্ডে?

    ফিল্ডে। ট্রেন স্টেশনে গিয়ে পুরো দলটার সমন্বয় করো। তুমিই সবকিছু করবে, তবে আমার সাথে কথা না বলে কোন পদক্ষেপ নেবে না।

    জি, স্যার। কোলেত দ্রুত চলে গেলো।

    ফশের মেজাজ খারাপ হয়ে গেছে। বাইরের জানালা দিয়ে তাকিয়ে সে কাঁচের পিরামিডটা দেখতে পেলো। জ্বলজ্বল করছে সেটা। জানালায়ও সেই আলোর ছটা এসে পড়েছে। তারা আমার হাত ফসকে বেড়িয়ে গেছে, মনে মনে বললো সে।

    এমনকি একজন প্রশিক্ষিত এজেন্টও ইন্টারপোলের চাপ সহ্য করতে পারবে না, সেটা পারলে সেই এজেন্টটার জন্য সৌভাগ্যের ব্যাপারই হবে।

    একজন মহিলা ক্রিপ্টোলজিস্ট আর একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক।

    ভোর পর্যন্তও তারা টিকতে পারবে না।

     

    ৩৭.

    গভীর বনে আচ্ছাদিত উদ্যান যা বোয়ে দ্য বুলোয়াঁ হিসেবে পরিচিত। একে অনেক নামে ডাকা হলেও প্যারিসবাসি এটাকে জানে জাগতিক আনন্দের উদ্যান হিসেবেই। প্রশংসাসূচক কথাটা খুব বেশি বাড়াবাড়ি মনে হলেও সেটা একেবারেই স্ববিরোধী। একই নামে লুরিড ব-এর চিত্রকর্মটা কেউ দেখলেই বুঝতে পারবে। ছবিটা বনের মতোই খুব কালো আর দোমড়ানো-মোচরানো, বিপথগামী আর জড়বস্তুর পূজা করে যারা তাদের জন্য প্রায়শ্চিত্তমূলক। রাতের বেলায় বনের মধ্যে রাস্তাগুলোতে শতশত চক্চকে শরীর দাঁড়িয়ে থাকে ভাড়া খাটার জন্য, জাগতিক ফুর্তিকে সন্তুষ্ট করার জন্য, কারোর গহীনের অকথিত কামনা নিবৃত্তির জন্য-নারী, পুরুষ, আর এদের মাঝামাঝি যারা আছে, সবাই।

    ল্যাংডন সোফিকে প্রায়োরি অব সাইওন সম্পর্কে বলার জন্য মনস্থির করতেই পার্কের কাঠের তৈরি প্রবেশদ্বারটা পেরিয়ে পশ্চিম দিকের নুড়ি পাথরের ক্রশফেয়ারের দিকে এগিয়ে গেলো তাদের গাড়িটা। পার্কের নিশাচর অধিবাসীরা গাড়ির হেডলাইটের আলোতে আরো বেশি করে ল্যাংডনের চোখের সামনে উদ্ভাসিত হতে লাগলো, এতে তার মনোেযোগর বিঘ্ন ঘটলো। সামনে দুজন নগ্নবক্ষের অল্পবয়স্কা মেয়ে ট্যাক্সিটার দিকে তাকিয়ে আছে। তাদের পাশেই এক কৃষ্ণাঙ্গ শরীরে তেল মেখে নিজের পশ্চাদদেশ প্রদর্শন করছে। তার সাথে এক অসাধারণ সোনালি চুলের মেয়ে নিজের মিনিস্কাটটা তুলে ধরে বোঝাতে চাইছে, আসলে সে মেয়ে নয়।

    ঈশ্বর আমাকে সাহায্য করো! ল্যাংডন তার চোখটা সরিয়ে নিয়ে গাড়ির ভেতরে তাকিয়ে একটা গভীর নিঃশ্বাস নিলো।

    আমাকে প্রায়োরি অব সাইওন সম্পর্কে বলো, সোফি বললো।

    ল্যাংডন মাথা নাড়লো, কোথেকে শুরু করবে ভেবে পেলো না। ভ্রাতৃসংঘের ইতিহাসটা হাজার বছরের…একটা বিস্ময়কর সিক্রেট, ব্ল্যাকমেইল, বিশ্বাসঘাতকতা, এমনকি একজন রাগী পোপের হাতে বর্বর নির্যাতনের ইতিহাস এটি।

    প্রায়োরি অব সাইওন? সে বলতে শুরু করলো, ফরাসি সম্রাট গড়ফই দ্য বুইলো ১০৯৯ সালে জেরুজালেম দখল করে নেবার পর পরই জেরুজালেমে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।

    সোফি মাথা নাড়লো, তার চোখ ল্যাংডনের দিকে স্থির হয়ে আছে।

    সম্রাট গড়ফই একটা শক্তিশালী সিক্রেটের অধিকারী ছিলেন বলে গুজব ছিলো খৃস্টের সময় থেকেই সিক্রেটটা তার পরিবারের কাছে ছিলো। তিনি মারা গেলে সিক্রেটটা চিরতরে হারিয়ে যাবে বলে তার আশংকা ছিলো, তাই তিনি একটা ভ্রাতৃসংঘ প্রতিষ্ঠা করেন-প্রায়োরি অব সাইন-তিনি তাদেরকে সিক্রেটটা রক্ষা করার জন্যে বংশ পরম্পরায় এটা ধারণ করতে প্ররোচিত করেছিলেন। জেরুজালেমে সেই সময়ে প্রায়োরি অব সাইন জানতে পারলো, একগাদা দলিল-দস্তাবেজ ভগ্ন প্রায় হেরোডর মন্দিরের নিচে লুকিয়ে রাখা আছে। এই মন্দিরটা সলোমনের মন্দিরের ভগ্নাবশেষের ওপরেই নির্মাণ করা হয়েছিলো। তারা বিশ্বাস করতো এইসব দলিল গড়ইর শক্তিশালী সিক্রেটটার সাথে সংশ্লিষ্ট এবং সেগুলো এতোটাই উত্তেজনা সৃষ্টিকারী যে, চার্চ যেভাবেই হোক তাদেরকে নিবৃত্ত করে ওগুলো আয়ত্তে নিতে চাইবে।

    সোফিকে দেখে মনে হলো সে বুঝতে পারছে না।

    প্রায়োরিরা প্রতীজ্ঞা করলো, যতো সময়ই লাগুক না কেন এইসব দলিল মন্দিরের নিচ থেকে উদ্ধার করে চিরতরের জন্য সংরক্ষণ করা হবে, যাতে সত্যটা কখনই হারিয়ে না যায়। দলিলগুলো ধ্বংসাবশেষ থেকে উদ্ধার করার জন্যে প্রায়োরিরা একটি সামরিক বাহিনী সৃষ্টি করলো-নয়জন নাইটের একটি দল, যাদেরকে ডাকা হতো অর্ডার অব দি পুওর নাইটস্ অব ক্রাইস্ট অ্যান্ড দ্য টেম্পল অব সলোমন নামে। ল্যাংডন একটু থামলো। সাধারণভাবে যারা পরিচিত ছিলো নাইট টেম্পলার হিসেবেই।

    সোফি বিস্ময়ে তার দিকে তাকালো, তার চাহনিতে আছে স্বীকৃতি।

    ল্যাংডন নাইট টেম্পলারদের সম্পর্কে প্রায়ই বক্তৃতা দিয়ে থাকে। সে এও জানে, পৃথিবীর প্রায় সবাই এদের সম্পর্কে জানে। নিদেনপক্ষে, অর্থহীনভাবে হলেও। একাডেমিকদের জন্য টেম্পলারের ইতিহাস একটা আজব জগৎ, যেখানে সত্য-মিথ্যা, নানান মতবাদ, ভুল তথ্য, এমনভাবে একটার সাথে আরেকটা মিলে আছে যে, তা থেকে খাটি সত্যটা বের করে আনা প্রায় অসম্ভব। আজকাল ল্যাংডন নাইট টেম্পলারদের ব্যাপারে বক্তৃতা দিতেও বেশ দ্বিধাগ্রস্ত থাকে, কারণ সেটা নিশ্চিতভাবেই কতিপয় ষড়যন্ত্রমূলক তত্ত্বের বাধার সম্মুখীন হয়।

    সোফিকে খুব হতভম্ব দেখালো। তুমি বলছো নাইট টেম্পলাররা প্রায়োরি অব সাইন কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো একটা গোপন দলিল-দস্তাবেজ সংগ্রহের উদ্দেশ্যে? আমি জানি টেম্পলারদের জন্ম হয়েছিলো পবিত্রভূমি সুরক্ষার জন্য।

    একটা সার্বজনীন ভুল ধারণা। তীর্থযাত্রী দলের সুরক্ষার ধারণাটি আসলে একটা ভান, যার আড়ালে টেম্পলাররা তাদের মিশন পরিচালনা করতো। পবিত্র ভূমির জন্য তাদের সত্যিকারের লক্ষ্যটা হলো, ভগ্নপ্রায় মন্দিরের নিচ থেকে দলিল-দস্তাবেজগুলো দখলে নেওয়া।

    তাঁরা কি সেটা খুঁজে পেয়েছিলো?

    ল্যাংডন ভুরু তুললো। কেউই নিশ্চিত করে বলতে পারে না কিন্তু একটা ব্যাপারে সব একাডেমিকরাই একমত, তা হলো : নাইটরা ভগ্নস্তুপের নিচ থেকে কিছু একটা খুঁজে পেয়েছিলো…যাতে তারা ধারণাতীতভাবেই সম্পদশালী এবং ক্ষমতাবান হয়ে ওঠে।

    ল্যাংডন খুব দ্রুত সোফিকে নাইট টেম্পলারদের সম্পর্কে স্ট্যান্ডার্ড একাডেমিক রূপরেখাটি ব্যাখ্যা করলো। পবিত্র ভূমির নাইটরা দ্বিতীয় ক্রুসেডের সময় কীভাবে ছিলো। তারা সম্রাট দ্বিতীয় বন্ডউইনকে বলেছিলো, খৃস্টান তীর্থযাত্রী দলগুলোকে যাত্রা পথে রক্ষা করবে তারা। যদিও বেতনহীন আর আর্থিকভাবে দরিদ্র ছিলো তারপরও নাইটরা ম্রাটকে বলেছিলো, তাদের একটা আশ্রয়ের দরকার, অনুরোধ করেছিলো ভগ্নপ্রায় মন্দিরের মধ্যেই যেনো তাদের আবাসন দেয়া হয়। স্রাট বন্ডউইন তাদের অনুরোধ রক্ষা করেছিলেন, আর তখনই নাইটরা সেই জরাজীর্ণ মন্দিরে নিজেদের আস্তানা গেঁড়ে বসেছিলো।

    আস্তানা গাঁড়ার এমন পছন্দের ব্যাপারটা ল্যাংডন ব্যাখ্যা করলো, আর যাই হোক কাকতালীয় ব্যাপার ছিলো না। নাইটরা বিশ্বাস করতে প্রায়োরিরা যেসব দলিল খুঁজছে সেগুলো ধ্বংসাবশেষের নিচে রয়েছে-হলি অব হলিস্-এর নিচে একটা পবিত্র কক্ষ, যেখানে স্বয়ং ঈশ্বর থাকেন বলে তারা বিশ্বাস করতো। আক্ষরিক অর্থে ইহুদীদের বিশ্বাসের মূলের মতোই। প্রায় একদশক ধরে নয়জন নাইট সেই ধ্বংসাবশেষের মধ্যে বাস করেছিলো আর শক্ত পাথর খুঁড়ে বের করে এনেছিলো সিক্রেটটা।

    সোফি সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকালো। তুমি বলছে তারা কিছু একটা উদঘাটন করেছিলো?

    অবশ্যই তারা পেয়েছিলো, ল্যাংডন বললো, ব্যাখ্যা করলো কীভাবে এই কাজটা করতে নয় বছর লেগেছিলো। অবশেষে নাইটরা যা খুঁজছিলো সেটা পেয়ে যায়। মন্দির থেকে সম্পদটা নিয়ে ইউরোপ ভ্রমণে বের হয়েছিলো তাঁরা। সেখানে তাঁদের প্রভাব রাতারাতি সুদৃঢ় হয়েছিলো।

    নিশ্চিত করে কেউ জানে না, নাইটরা কি ভ্যাটিকানকে রাকমেইল করেছিলো নাকি চার্চ তাঁদের নিরবতা কিনে নিয়েছিলো। কিন্তু পোপ দ্বিতীয় ইনোসেন্ট খুব দ্রুতই একটা নজিরবিহীন পাপাল বুল ইসু জারি করেছিলেন, যাতে নাইট টেম্পলারদেকে সীমাহীন ক্ষমতা দিয়ে তাদেরকে তারা নিজেরাই স্বয়ং আইন-একটা স্বায়ত্তশাসিত সেনাবাহিনীর মর্যাদা দিয়েছিলেন। তারা সম্রাট এবং রাজ্যের কোনো কর্তৃপক্ষেরই অধীনে নয়, সবকিছু থেকেই তারা স্বাধীন, রাজনৈতিক এবং ধর্মীয় দুই কর্তৃপক্ষের কাছ থেকেও।

    ভ্যাটিকানের কাছ থেকে নতুন এই ক্ষমতার স্বীকৃতি পাবার পর নাইট টেম্পলাররা দ্রুত রাজনৈতিক শক্তি এবং সংখ্যায় বাড়তে লাগলো। এক ডজনেরও বেশি দেশে বিশাল রাজ্য জমিয়ে ফেললো তারা। দেউলিয়া লোকদেরকে ঋণ দিয়ে বিনিময়ে সুদ চালু করলো। এভাবেই আধুনিক ব্যাংকের পত্তন করে এবং নিজেদের সম্পদ ক্রমাগতভাবে বাড়াতে থাকে তাঁরা।

    ১৩০০ সালের মধ্যে, ভ্যাটিকানের প্রদত্ত ক্ষমতার বলে, নাইটদের ক্ষমতা এতো বেড়ে গেলো যে, পোপ পঞ্চম ক্লেমেন্ত ঠিক করলেন, কিছু একটা করতেই হবে। ফ্রান্সের রাজা চতুর্থ ফিলিপের সাথে যৌথভাবে মিলে পোপ একটা সুদূরপ্রসারি পরিকল্পনা আঁটলেন। টেম্পলারদের সম্পদটা জব্দ করে ভ্যাটিকান যাতে সিক্রেটটার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিতে পারে। একটা সামরিক কৌশলের মাধ্যমে, অনেকটা সিআইএর সঙ্গেই সেটা তুলনীয়, পোপ ক্লেমেন্ত একটা সিলংকিত গোপন নির্দেশ পাঠালেন, যা সমগ্র ইউরোপের সৈনিকরা একই সাথে খুলেছিলো, শুক্রবার, অক্টোবর ১৩, ১৩০৭ সালে।

    তেরো তারিখের ভোর বেলায়, সিলংকিত নির্দেশটা ভোলা হলে বিষয় বস্তুগুলো প্রকাশিত হলো। ক্লেমেন্তের চিঠিতে দাবি করা হলো যে, ঈশ্বর তাঁকে দেখা দিয়ে বলেছেন, নাইট টেম্পলাররা জঘন্য রকমের শয়তানের পূজা অর্চনা করছে, সমকামীতা আর কুশকে অপব্যাখ্যা সহ অন্যান্য ঈশ্বর নিন্দার কাজ করছে। পোপ ক্লেমেন্তকে ঈশ্বর নির্দেশ দিয়েছেন, সব নাইটদের ধরে এনে নির্যাতন করে তাদেরকে ঈশ্বরের বিরুদ্ধে অপরাধের স্বীকারোক্তি আদায় করে সব কিছু শুদ্ধ করতে হবে। ক্লেমেন্তের ম্যাকিয়াভেলীয় অপারেশনটা ঠিক ঘড়ির কাটা ধরে করা হয়েছিলো। সেদিনটাতে, অগুণতি নাইটকে ধরা হয়েছিলো। প্রচণ্ড নির্যাতনের পর ধর্মবিরোধীতা করার দণ্ডে দণ্ডিত করে আগুনে পুড়িয়ে মারা হয়েছিলো। ট্র্যাজেডিটার প্রতিধ্বনি এখনও আধুনিক সংস্কৃতিতে প্রতিফলিত হয়ে আসছে; আজকের দিনের তেরো তারিখের শুক্রবারকে দূর্গ হিসেবেই বিবেচনা করা হয়ে থাকে।

    সোফিকে খুব হতবিহবল দেখালো। নাইট টেম্পলারদেরকে নিশ্চিহ্ন করে ফেলা হয়েছে? আমি ভাবতাম টেম্পলারদের ভ্রাতৃসংঘের অস্তিত্ব আজও টিকে আছে।

    তা আছে, বিভিন্ন নামে। ক্লেমেন্তের মিথ্যা অভিযোগ এবং তাদেরকে নিশ্চিহ্ন করার সর্বাত্মক চেষ্টার পরও, নাইটদের ছিলো শক্তিশালী মিত্র। তাদের অনেকেই ভ্যাটিকানের রোষাণল থেকে পালিয়ে যেতে পেরেছিলো। টেম্পলারদের মূল্যবান সম্পদটা, যা তাদের ক্ষমতার উৎসও বটে, সেটাই ছিলো ক্লেমেন্তের আসল লক্ষ্য, কিন্তু সেটা তার হাত ফসূকে বের হয়ে গিয়েছিলো। দলিল-দস্তাবেজগুলো দীর্ঘদিন ধরে টেম্পলারদের কাছে নিরাপদে ছিলো, পরে তাদেরই ছায়া দল, প্রায়োরি অব সাইন, সিক্রেটটা ভ্যাটিকানের রুদ্ররোষ থেকে বাঁচিয়ে অন্যত্র সরিয়ে নিয়ে গিয়েছিলো। প্রায়োরিরা তাদের দলিলটা প্যারিস থেকে রাতের অন্ধকারে লা রশেলের টেম্পলারদের জাহাজে করে পাচার করেছিলো।

    দলিল-দস্তাবেজগুলো গেলো কোথায়?

    ল্যাংডন কাঁধ ঝাঁকালো। এই রহস্যময় উত্তরটা কেবলমাত্র জানে প্রায়োরি অব সাইওন। কারণ দলিলগুলো এখনও, এমনকি আজকের দিনেও, বিরামহীন তদন্ত আর তল্লাশীর শিকার।

    বার কয়েকই এগুলো ধরা পড়ে যাচ্ছিলো প্রায়। সাম্প্রতিককালে, অনুমান করা হয়, দলিলগুলো যুক্তরাজ্যের কোথাও লুকিয়ে রাখা হয়েছে।

    সোফি একটু অস্বস্তি বোধ করলো।

    হাজার বছর ধরে, ল্যাংডন বলে চললো, সিক্রেটটার কিংবদন্তী হস্তান্তর হয়ে আসছে। পুরো দলিলটা, এটার ক্ষমতা এবং সিক্রেটটা একটি নামেই পরিচিত স্যাংগৃল। এর ওপরে শত শত বই লেখা হয়েছে। স্যাংগৃলের মতো আর কোন রহস্যই ইতিহাসবিদদের এতো বেশি কৌতূহলী করেনি।

    স্যাংগৃল? শব্দটা কি ফরাসি শব্দ স্যাং অথবা স্পেনিশ স্যাংগার-এর সাথে সম্পর্কিত–যার অর্থ রক্ত?

    ল্যাংডন মাথা নেড়ে সায় দিলো। রক্ত হলো স্যাংগুলের মেরুদণ্ড, তারপরও সেটা সোফি যেমনটি কল্পনা করছে সেরকম কিছু নয়। কিংবদন্তীটা খুব জটিল, কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ যে ব্যাপারটা স্মরণে রাখা দরকার, তা হলো, সত্যটা প্রকাশ করার জন্য প্রায়োরিরা ইতিহাসের সঠিক সময়টার জন্য অপেক্ষা করছে।

    সত্যটা কি? কী এমন সিক্রেট, যা খুবই শক্তিশালী হতে পারে?

    ল্যাংডন খুব বড় করে একটা নিঃশ্বাস নিয়ে বাইরের দিকে তাকালো। সোফি, sangreal একটা প্রাচীন শব্দ। এটা সময়ে আরেকটা শব্দে রূপান্তরিত হয়ে গেছে… একটা আধুনিক নামে। সে একটু থামলো। যখন আমি তোমাকে এর আধুনিক নামটা বলবো, তখন তুমি বুঝতে পারবে, এ সম্পর্কে তুমি অনেক কিছুই জানো। সত্যি বলতে কী, পৃথিবীর প্রায় সবাই sangreal এর গল্পটা শুনেছে।

    সোফি সন্দেহপূর্ণ দৃষ্টিতে তাকালো। আমি এ সম্পর্কে কখনও কিছু শুনিনি।

    অবশ্যই শুনেছো। ল্যাংডন হাসলো। তুমি এটা হলি গ্রেইল নামে চেনো।

     

    ৩৮.

    সোফি গভীর সতর্কতার সাথে ট্যাক্সির পেছনে বসা ল্যাংডনের দিকে তাকালো। সে ঠাট্টা করছে। হলি গ্রেইল?

    ল্যাংডন মাথা নেড়ে সায় দিলো, তার ভাবভঙ্গী খুবই গুরুগম্ভীর। স্যাংগৃলের আক্ষরিক অর্থ হলো হলি গ্রেইল। শব্দটা এসেছে ফরাসি Sangraal থেকে, যা Sangreal-এ রূপান্তরিত হয়েছে, আর সেটাই প্রকারন্তরে দুটি শব্দ San Greal-এ বিভক্ত হয়ে গেছে।

    হলি গ্রেইল। সোফি ভাষাগত সংযোগটা তৎক্ষণাৎ ধরতে না পারাতে অবাক হলো। তারপরও, ল্যাংডনের দাবি টা তার কাছে বোধগম্য বলে মনে হচ্ছে না। আমি জানতাম হলি গ্রেইল হলো একটা পেয়ালা।…আর তুমি বলছো স্যাংগৃল হলো কতোগুলো দলিল-দস্তাবেজ, যা খুব গভীর কোন সিক্রেটকে উন্মাচিত করে।

    হ্যাঁ, স্যাংগৃল দলিল-দস্তাবেজগুলো হলি গ্রেইলের অর্ধেক গুপ্তধন। সেগুলো গ্রেইলের সাথেই সমাধিস্থ হয়ে আছে…আর এর সত্যিকারের অর্থটা প্রকাশ করে। দলিল-দস্তাবেজগুলো নাইট টেম্পলারদেরকে খুবই শক্তিশালী করে তুলেছিলো, কারণ এসব পৃষ্ঠায় গ্রেইলের সত্যিকারের ধারণাটা উন্মোচিত হয়েছে।

    গ্রেইলের সত্যিকারের ধারণা? সোফির এখন নিজেকে আরো বেশি হতবিহ্বল মনে হলো। সোফি জানতো হলি গ্রেইল হলো একটা পেয়ালা, যা যি লাস্ট সাপারে পান করেছিলেন। যাতে পরবর্তীতে, আরিমাথিয়ার জোসেফ ক্রুশবিদ্ধের রক্ত পেয়েছিলেন। হলি গ্রেইল হলো যিশুর পেয়ালা, সে বললো, এর চেয়ে সহজ আর কী হতে পারে?

    সোফি, ল্যাংডন নিচুস্বরে বললো, এখন তার দিকে ঝুঁকে আছে সে। প্রায়োরি অব সাইন-এর মতে, হলি গ্রেইল মোটেও কোন পেয়ালা নয়। তারা দাবি করে গ্রেইলের পেয়ালার কিংবদন্তীট আসলে একটা রূপক ধারণ করে আছে। খুব দক্ষতার সাথেই সেটা করা হয়েছে। তার মানে, গ্রেইলের কাহিনীটাতে পেয়ালার ব্যবহারটা একটা রূপক, যার অর্থ এমন, যা খুবই শক্তিশালী কিছুর চেয়েও বেশি। সে একটু থামলো। এমন কিছু, যার সাথে তোমার দাদু আজ যা বলতে চেষ্টা করেছেন, তার সবকিছুর সাথেই একেবারেই খাপ খেয়ে যায়। তাঁর সব প্রতীকধর্মী উল্লেখই পবিত্র নারীকে নির্দেশ করে।

    তবুও অনিশ্চিত, সোফি আঁচ করতে পারলো, ল্যাংডনের ধৈর্যের হাসিটাতে তার দ্বিধাটা ধরা পড়েছে। তারপরও তার চোখে আন্তরিকতা। কিন্তু, হলি গ্রেইল যদি একটা পেয়ালা না হয়ে থাকে, সোফি জিজ্ঞেস করলো, তাহলে সেটা কি?

    ল্যাংডন জানতো এই প্রশ্নটা করা হবে, তারপরও কীভাবে তাকে কথাটা বলবে বুঝতে পারছিলো না। সে যদি উত্তরটা এর ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট সহকারে না উপস্থাপন করে, তবে সোফির আবারো বিস্ময় হওয়া ছাড়া আর কিছুই হবে না ঠিক এরকম অবাক হবার ভঙ্গী ল্যাংডন কয়েক মাস আগে তার লেখা নতুন পাণ্ডুলিপিটা হস্ত ত্তির করার সময় তার সম্পাদকের চেহারায় দেখতে পেয়েছিলো।

    এই লেখাটায় কি দাবি করা হয়েছে? তার সম্পাদক মদের গ্লাসটা হাতে নিয়ে বিস্ময়ে বলেছিলেন। তাঁর সামনে পড়ে ছিলো আধা খাওয়া লাঞ্চ। তুমি সত্যি বলছো নাকি।

    একদম সত্যি, একবছর ধরে গবেষণা করার মতোই সিরিয়াস।

    নিউইয়র্কের বিখ্যাত সম্পাদক জোনাস ফকম্যান তার থুতনীর দাঁড়িটা চুলকাতে চুলকাতে বলেছিলেন। ফম্যানের কোন সন্দেহই ছিলো না যে, তার বর্নাঢ্য পেশাগত জীবনে এমন অদ্ভুত বইয়ের কথা কখনই শশানেনি। কিন্তু, এই বইটার কথা শুনে লোকটা হতভম্ব হয়ে গেলো।

    রবার্ট, ফকম্যান অবশেষে বলেছিলেন, আমাকে উল্টাপাল্টা কিছু বোলো না। আমি তোমার কাজ পছন্দ করি, আর আমরা দুজন একসঙ্গে খুব অসাধারণ কাজ করেছি। কিন্তু আমি যদি এই ধরনের বই প্রকাশ করার সিদ্ধান্ত নিই, তবে লোকজন আমাকে আমার অফিসের সামনেই একমাস ধরে পেটাতে থাকবে। তাছাড়া, এতে তোমার সুনামকেও একেবারে শেষ করে দেবে। তুমি হারভার্ডের একজন ইতিহাসবিদ। ঈশ্বরের দোহাই, তুমি কোন পপকমিস্টার নও যে, দ্রুত টাকা কামানোর ধান্দা করছে। এই রকম একটা তত্ত্বকে প্রমাণ করার জন্য তুমি পর্যাপ্ত এবং বিশ্বাসযোগ্য আলামত কোথেকে পাবে?

    নিরব হাসি দিয়ে ল্যাংডন তার পকেট থেকে একটা কাগজ বের করে ফকম্যানকে দিয়েছিলো। কাগজটাতে পঞ্চাশেরও বেশি শিরোনামের তালিকা ছিলো খুবই সুপরিচিত ইতিহাসবিদদের বইয়ের তালিকা। কিছু সাম্প্রতিক কালের, কিছু শত বছরেরও পুরনো অনেকগুলোই একাডেমিক বেস্টসেলার। সবগুলো বইয়েরই শিরোনাম, ল্যাংডন এইমাত্র যা বলেছে, সেই বিষয়টারই ইঙ্গিত করছে। ফকম্যান তালিকাটা পড়ার পর তাকে দেখে মনে হলো, এইমাত্র তিনি আবিষ্কার করেছেন যে, পৃথিবীটা আসলে সমতল। আমি এখানে কিছু কিছু লেখকদের চিনি। তারা… সত্যিকারের ইতিহাসবিদ!

    ল্যাংডন হাসলো। আপনি দেখতেই পাচ্ছেন, জোনাস, এটা শুধু আমার নিজের মতবাদ নয়। অনেকদিন আগে থেকেই এটা হয়ে আসছে। আমি কেবলমাত্র এটার ওপর কিছু একটা নির্মাণ করতে চাচ্ছি। এখন পর্যন্ত কোন বই-ই হলি গ্রেইলের ঐতিহাসিক কিংবদন্তীটাকে সিমোলজিমের দৃষ্টিকোণ থেকে তুলে ধরেনি। তত্ত্বটার পক্ষে, প্রমাণের জন্য আমি যেসব আইকনোগ্রাফিক প্রমাণ-পত্র খুঁজে বের করেছি, সেগুলো খুবই গ্রহণযোগ্য।

    ফকম্যান তালিকাটার দিকেই তাকিয়ে রইলো। হায় ঈশ্বর, এইসব বইয়ের একটা লেখক তো দেখি স্যার লেই টিবিং—একজন বৃটিশ রয়্যাল ইতিহাসবিদ।

    টিবিং তাঁর জীবনের বেশির ভাগ সময়ই ব্যয় করেছেন হলি গ্রেইল নিয়ে পড়াশোনা করে। তিনি আসলে, আমার অনুপ্রেরণার একটা বিশাল অংশ। তালিকার অন্য সবার মতোই, তিনি একজন বিশ্বাসী, জোনাস।

    তুমি আমাকে বলছো, এইসব ইতিহাসবিদরা আসলে বিশ্বাস করেন… ফকম্যান একটা ঢোক গিললেন, প্রকারন্তরে তিনি শব্দটা বলতেই পারলেন না।

    ল্যাংডন আবারো দাঁত বের করে হাসলো। হলি গ্রেইলটা তর্কাতীতভাবেই মানবেতিহাসের সবচাইতে বেশি গুপ্তধন সন্ধানের প্রচেষ্টা। গ্রেইলটা কিংবদন্তী ছড়িয়েছে, যুদ্ধ বাঁধিয়েছে, আর আজীবন এটা অন্বেষণ করা হয়েছে। এতে করে কী মনে হয়, এটা একটা নিছকই পেয়ালা? যদি তাই হয়, তাহলে নিশ্চিতভাবেই অন্য পুরানিদর্শনগুলো একই রকম কিংবা আরো বেশি কৌতূহলের জন্ম দিতে রাজ মুকুট, সত্যিকারের ক্রুশবিদ্ধের কুশটা, টিটালাসটা—তারপরও সেগুলো নয়। ইতিহাস জুড়েই হলি গ্রেইল বিশেষ কিছু একটা হিসেবে ছিলো। ল্যাংডন হাসলো। এখন আপনি বুঝতে পারছেন কেন।

    ফকম্যান বার বার মাথা ঝাঁকাতে লাগলেন। কিন্তু এই ব্যাপারটা নিয়ে এইসব বই লেখা হলেও, কেন এই মতবাদটা এতো বেশি সুপরিচিত নয়?

    এইসব বই শত শত বছরের প্রতিষ্ঠিত ইতিহাসের সাথে টক্কর দিতে পারেনি। বিশেষ করে এমন ইতিহাসের সাথে, যা সর্বকালের সেরা বিক্রি হওয়া বইতে রয়েছে।

    ফকম্যানের চোখ দুটো বড় হয়ে গেলো। আমাকে বোলো না যে, হ্যারি পটার আসলে হলি গ্রেইল সম্পর্কিত।

    আমি বাইবেলের কথা বলছিলাম।

    ফকম্যান জিভ কাঁটলো। আমি জানতাম সেটা।

     

    লেইসেজ-লো! সোফির চিৎকারটা ট্যাক্সির ভেতরের বাতাস কাঁপিয়ে দিলো। নামিয়ে রাখো!।

    সোফি ঝুঁকে ড্রাইভারের আসনের দিকে এসে চিৎকার দিতেই ল্যাংডন চম্‌কে গেলো। সে দেখতে পারছিলো ড্রাইভার হাতে রেডিও মাউথপিসটা ধরে কথা বলছে।

    সোফি এবার ঘুরে ল্যাংডনের পকেটে হাত ঢুকিয়ে দিলো। কি হচ্ছে সেটা বোঝার আগেই সে পিস্তলটা বের করে আনলো। সেটা পেছন থেকে ড্রাইভারের মাথা বরাবর তা করলো। সাথে সাথেই ড্রাইভার হাত থেকে রেডিওটা ফেলে দিয়ে অন্য হাতটা মাথার ওপর তুলে ধরলো।

    সোফি! ল্যাংডন আর্তস্বরে বললো। কি হচ্ছে এসব–

    আরেতেজ! সোফি ড্রাইভারকে আদেশ করলো। কাঁপতে কাঁপতে ড্রাইভার তার কথা মেনে গাড়িটা একটা জায়গায় নিয়ে থামালো।

    তখনই ল্যাংডন রেডিও থেকে একটা কণ্ঠ শুনতে পেলো। ট্যাক্সি কোম্পানি থেকে ঘোষণা দিচ্ছে, …কুইসাপেলে এজেন্ট সোফি নেভু… রেডিওটা খট খট করে উঠলো। এত্ উঁ আমেরিকেই, রবার্ট ল্যাংডন…

    ল্যাংডনের পেশীগুলো শক্ত হয়ে গেলো। তারা এরই মধ্যে আমাদেরকে খুঁজে বের করে ফেলেছে?

    দিসেনদেজ, সোফি আদেশ করলো।

    কাঁপতে থাকা ড্রাইভার দুহাত মাথার ওপর তুলে গাড়ি থেকে বের হয়ে একটু দূরে গিয়ে দাঁড়ালো।

    সোফি জানালার কাঁচটা নামিয়ে অস্ত্রধরা হাতটা বের করে ভ্যাবাচ্যাকা খাওয়া ড্রাইভারের দিকে তাক করলো। রবার্ট, সে খুব শান্তভাবে বললো, স্টিয়ারিংয়ে গিয়ে বসো। তুমি গাড়ি চালাবে।

    অস্ত্রহাতে ধরা কোন মেয়ের সাথে ল্যাংডন তর্ক করার সাহস করলো না। সে গাড়ি থেকে নেমে সামনে গিয়ে বসলো। ড্রাইভার লোকটা আকুতি মিনতি করতে লাগলো, তার হাত দুটো মাথার ওপরেই তোলা।

    রবার্ট, পেছনের সিট থেকে সোফি বললো, আমার বিশ্বাস তুমি আমাদের জাদুর বনটা যথেষ্ট দেখেছো?

    সে মাথা নেড়ে সায় দিলো। যথেষ্টই।

    ভালো। এখান থেকে বের হও আগে।

    ল্যাংডন গাড়িটার সামনের দিকে তাকিয়ে একটু ইতস্তত করলো। ধ্যাৎ। সে স্টিয়ারিংটা ধরলো। সোফি? যদি তুমি–

    চালাও! সোফি চিৎকার করে বললো।

    বাইরে, কিছু সংখ্যক পতিতা কী হচ্ছে সেটা দেখার জন্য উঁকি মারলো। একটা মেয়ে তার সেলফোনে ফোন করতে লাগলো। ল্যাংডন গিয়ারের স্টিকটা ধরেই প্রথমে তার যা মনে হলো, সেটা হলো ফার্স্ট গিয়ার।

    ল্যাংডন ক্লাচটা চেপে ধরলো। ট্যাক্সিটা সামনে এগোতেই চাকার খ্যাচ্‌ খ্যাচ্‌ শব্দ শোনা গেলো। সামনে জড়ো হওয়া মানুষজন আত্মরক্ষার্থে এদিক-ওদিক ছুটতে লাগলে ফোন হাতে ধরা মেয়েটা লাফিয়ে বনের ভেতরে চলে গেলো, অল্পের জন্য সে গাড়ি চাপার হাত থেকে বেঁচে গেছে।

    দুসমেঁ! গাড়িটা রাস্তায় আসতেই সোফি বললো, তুমি করছোটা কি?

    আমি তোমাকে সতর্ক করার চেষ্টা করছি, গিয়ারের শব্দকে ছাপিয়ে সে চিৎকার করে বললো। আমি স্বয়ংক্রিয়ভাবে চালাচ্ছি।

     

    ৩৯.

    যদিও রুই লা ব্রুয়েরের, ধূসর পাথরের অনাড়ম্বরপূর্ণ ঘরটা অনেক যন্ত্রণার সাক্ষী, কিন্তু সাইলাসের সন্দেহ, এখন তার শরীরে যে শারীরিক যন্ত্রণাটা আঁকড়ে ধরেছে সেটার সাথে আর কোন কিছুরই তুলনা হয় না। আমি প্রতারিত হয়েছি। সবকিছু শেষ হয়ে গেছে।

    সাইলাসের সাথে চালাকি করা হয়েছে। ভায়েরা তাকে মিথ্যে বলেছে। তাঁরা সত্যিকারের সিক্রেটটা প্রকাশ করার বদলে মৃত্যুকেই বেছে নিয়েছে। টিচারকে ফোন করার মতো শক্তি সাইলাসের ছিলো না। সে শুধুমাত্র চারজন লোককেই খুন করেনি, যারা জানতো কি-স্টোনটা কোথায় লুকিয়ে রাখা আছে, উপরন্তু, সেন্ট-সালপিচের অভ্যন্তরে একজন নানাকেও খুন করেছে। নানটা ঈশ্বরের বিরুদ্ধে কাজ করতো! সে ওপাস দাইর কাজ-কর্মগুলোও নিন্দা করতে!

    হঠাৎ করেই একটা অপরাধবোধ, মহিলার মৃত্যু ব্যাপারটাকে খুব বেশি জটিল করে ফেলেছে। বিশপ আরিঙ্গারোসার ফোন কলটার জন্যই সাইলাস সেন্ট-সালপিচের ভেতরে ঢুকতে পেরেছিলো; তিনি যখন আবিস্কার করবেন, নান মারা গেছে, তখন কি ভাববেন? যদিও সাইলাস মৃতদেহটা তার বিছানায় রেখে এসেছে, কিন্তু নানের আঘাতটা সহজেই চোখে পড়ে যাবে। সাইলাস জমিনের ভাঙা টাইল্সগুলো ঠিক করে রেখে দেবার চেষ্টা করেছিলো, কিন্তু ওগুলো এতো বেশি ভেঙে গিয়েছে যে, সবাই জেনে যাবে, এখানে কেউ এসেছিলো।

    সাইলাস পরিকল্পনা করেছিলো এখানকার কাজটা শেষ করে ওপাস দাইর ভেতরে লুকিয়ে পড়বে। বিশপ আরিঙ্গাবোসা আমাকে রক্ষা করবেন। সাইলাস কল্পনা করলো, ওপাস দাইর হেড কোয়াটারের অভ্যন্তরে প্রার্থনা করা আর ধ্যান করার চেয়ে বড় কোন আশীবাদের অস্তিত্ব এ জীবনে নেই। সে আর কখনই বাইরে পা রাখবে না। তার সব প্রয়োজনই ঐ উপাসনালয়ের ভেতরেই মেটাবে। কেউ আমার অভাবও অনুভব করবে না। দূভার্গ্যজনকভাবে, সাইলাস জানতো, বিশপ আরিঙ্গারোসার মতো খ্যাতিমান ব্যক্তি খুব সহজে উধাও হতে পারবে না।

    আমি বিশপকে বিপদে ফেলে দিয়েছি। সাইলাস জমিনের দিকে শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে নিজের কথা ভাবলো। হাজারহোক, আরিঙ্গারোসাই তাকে নতুন জীবন দান করেছিলেন…স্পেনের সেই ছোট্ট মঠে, তাকে শিক্ষাদীক্ষা দিয়েছেন, তার জীবনের উদ্দেশ্য ঠিক করে দিয়েছেন।

    আমার বন্ধু, আরিঙ্গাবোসা তাকে বলেছিলেন, তুমি ধবল হয়ে জন্মেছে। এজন্যে অন্যের কাছে তুমি লজ্জিত হয়ো না। তুমি কি বুঝতে পারছে না, এজন্যে তুমি কতোটা আলাদা হয়ে উঠেছো? তুমি কি জানো না, নুহ নিজেও একজন ধ্বল ছিলেন?

    নৌকার নূহ? সাইলাস একথাটা কখনও শোনেনি।

    আরিঙ্গারোসা হেসেছিলেন। অবশ্যই, নৌকার নৃহ। তিনি একজন ধবল ছিলেন। তোমারই মতো। তার ছিলো ফেরেস্তাদের মতো সাদা চামড়া। এটা মনে রেখো। নূহু এই পৃথিবীর সমস্ত প্রাণীকূলকে রক্ষা করেছিলেন। তোমারও জন্ম হয়েছে মহৎ কিছু করার জন্য, সাইলাস। ঈশ্বর তোমাকে একটা কারণেই মুক্ত করেছেন। তোমার ডাক তুমি পেয়েছে। ঈশ্বর তোমার সাহায্য চাইছে তার কাজের জন্য।

    সময়ে, সাইলাস নিজেকে নতুন আলোয় চিনতে শিখলো। আমি বিশুদ্ধ। সাদা। সুন্দর। ফেরেস্তাদের মতোন।

    ঠিক এই সময়েই, যদিও সে তার নিজের ঘরে, তার বাবার হতাশ কণ্ঠস্বরটা শুনতে পেলো। অতীত থেকে তার কাছে ফিসফিস করে বলছে।

    তু ইস্ উঁ দেসাস্ত্রে। উঁ স্পেকত্রে।

    কাঠের ফ্লোরে হাটু গেঁড়ে বসে সাইলাস ক্ষমা প্রার্থনা করলো। তারপর, দড়িটা খুলে ফেলে আবার তার প্রায়শ্চিত্তে ফিরে গেলো।

     

    ৪০.

    গিয়ারের শিফটটা নিয়ে বেসামাল ল্যাংডন খুব কষ্টে হাইজ্যাক করা গাড়িটা কোনমতে বোয়ে দ্য বুলোঁয়া থেকে দূরে নিয়ে যেতে পারলো। দূর্ভাগ্যজনকভাবে, এই ঘটনার কৌতুককর দিকটা, রেডিওতে ট্যাক্সি কোম্পানির বার বার ঘোষণার মধ্যে হারিয়ে গেলো।

    ভয়তুর সিঙ্গ-সিক্স-ত্রয়। ওউ ইতে-ভু? রিপোনদেজ!

    ল্যাংডন যখন পার্ক থেকে বের হবার পথটার কাছে এসে পৌঁছালো, তখন সে সজোড়ে ব্রেক কষলো। তুমিই চালাও।

    সোফি স্টিয়ারিংয়ে গিয়ে বসতেই ল্যাংডন হাপ ছেড়ে বাঁচলো বলে মনে হলো। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই, সোফি গাড়িটাকে খুব সুন্দর করে চালিয়ে নিয়ে জাগতিক আনন্দের উদ্যানটা পেছনে ফেলে, পশ্চিম দিকের আলি দ্য লং শাম্প-এর দিকে নিয়ে গেলো।

    রুই হাক্সোটা কোন্ দিকে? ল্যাংডন জিজ্ঞেস করলো। স্পিড মিটারের দিকে তাকিয়ে দেখতে পেলো ঘন্টায় একশো কিলোমিটারের বেশি গতিতে গাড়িটা চলছে।

    সোফির চোখ রাস্তার দিকেই নিবিষ্ট। ড্রাইভার বলেছিলো জায়গাটা রোল্যা গারো টেনিস স্টেডিয়ামের কাছেই। আমি সেই জায়গাটা চিনি।

    ল্যাংডন আবারো তার পকেট থেকে ভারি চাবিটা বের করে হাতের তালুতে রেখে সেটার ওজন অনুভব করলো। তার মনে হলো, এটা একটা বিশাল পরিণতির জিনিস। তার নিজের স্বাধীনতার চাবির মতোই অনেকটা।

    একটু আগে, যখন সোফিকে নাইট টেম্পলারদের ব্যাপারে বলছিলো, তখন ল্যাংডন বুঝতে পারছিলো যে, এই চাবিটা, প্রায়োরিদের সিলংকিত। প্রায়োরি অব সাইওনের সাথে খুব সূক্ষ্ম একটা সংযোগ ধারণ করে আছে। সমবাহুর ক্রুশ ভারসাম্য আর সম্প্রীতির প্রতীক, কিন্তু সেটা নাইট টেম্পলারদেকেও বোঝায়। সবাই নাইট টেম্পলারদের চিত্রকর্মগুলো দেখেছে, সাদা পোশাক পরা আর তার মাঝে লাল রঙের সমবাহুর ক্রুশ আঁকা। তবে এটা ঠিক, টেম্পলারদের ক্রশের বাহুর শেষ মাথাগুলো কিছুটা চওড়া, কিন্তু সেগুলোও সমান দৈর্ঘের।

    একটা সুষম বাহুর ক্রশ। ঠিক এই চাবিটাতে যেমন আছে।

    এটা দিয়ে তারা কী খুঁজে পাবে ভাবতেই, ল্যাংডনের কল্পনা পাগলাঘোড়ার মতো ছুটতে লাগলো। হলি গ্রেইল। কথাটার অর্থহীনতা ভেবে সে প্রায় জোরে হেসে উঠতে যাচ্ছিলো। বিশ্বাস করা হয়, গ্রেইলটা ইংল্যান্ডের কোথাও আছে, কোন এক টেম্পলার চার্চের ভূগর্ভস্থ গোপন কক্ষে সেটা লুকিয়ে রাখা হয়েছে, কমপক্ষে ১৫০০ সাল থেকে।

    গ্র্যান্ডমাস্টার দা ভিঞ্চির সময়কাল থেকে।

    প্রায়োরিরা, তাদের শক্তিশালী দলিল-দস্তাবেজগুলো নিরাপদে রাখার জন্যে শত শত বছর ধরে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় সরাতে বাধ্য হয়েছিলো। ঐতিহাসিকরা এখন আশংকা করছে, গ্রেইলটা জেরুজালেম থেকে ইউরোপে নিয়ে আসার পর থেকে কম করে হলেও, ছয় জায়গায় স্থানান্তরিত করা হয়েছে। গ্রেইলটা শেষবার দেখা গিয়েছিলো ১৪৪৭ সালে, যখন অসংখ্য চাক্ষুষ স্বাক্ষীদাতা বর্ণনা করেছে, দলিল দস্তাবেজগুলো আগুনে প্রায় পুড়ে যাবার আগেই, সেগুলো নিরাপদে চারটা সিন্দুকে করে সরিয়ে নেবার জন্য ছয় জন লোক লেগেছিলো। এরপর থেকে, কেউই আর গ্রেইলটা কখনও দেখেনি। যা কিছু শোনা গেছে, তাহলো, মাঝে মাধ্যে একটা ফিস্ ফাস্। গ্রেইলটা নাকি লুকিয়ে রাখা আছে গ্রেট বৃটেনে, নাইট আর্থার আর রাউন্ড টেবিলের নাইটদের দেশে।

    যেখানেই থাকুক না, দুটো গুরুত্বপূর্ণ সত্য রয়ে গেছে :

    লিওনার্দো তাঁর জীবনকালে জানতেন গ্রেইলটা কোথায় রাখা আছে।

    লুকিয়ে রাখার জায়গাটা বোধহয় আজকের দিন পর্যন্ত পরিবর্তিত হয়নি।

    এই কারণেই, গ্রেইল নিয়ে উৎসাহটা এখনও দা ভিঞ্চির ছবিতে আর ডায়রিতে গ্রেইলের বর্তমান অবস্থানটার সম্পর্কে কোন কু লুকিয়ে আছে বলে আশা করা হয়। কেউ কেউ দাবি করে থাকে, ম্যাড়োনা অব দি রকস-এর পেছনের পর্বতের দৃশ্যটা স্কটল্যান্ডের সারি সারি গুহা-পর্বতের সাথে একেবারে মিলে যায়। অন্যেরা দাবি করে, দ্য লাস্ট সাপার-এর শিষ্যদের সন্দেহজনক অবস্থানটা আসলে এক ধরনের কোড। এখনও অনেকে দাবি করে যে, মোনালিসার এক্সরেতে এটা উন্মোচিত হয়েছে যে, তাকে আসলে আইসিস এর ল্যাপিস লাজুইলি পরা অবস্থায় আঁকা হয়েছিলোদা ভিঞ্চি পরবর্তীতে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন এটার ওপরে আরো নিখুঁতভাবে কিছু আঁকার। ল্যাংডন কখনও এমন কোন প্রমাণ দেখেনি, বা কল্পনা করতে পারেনি, হলি গ্রেইলকে উন্মোচিত করে। তারপরও গ্রেইল সম্পর্কিত খবরাখবর ইন্টারনেটের বুলেটিন আর চ্যাট রুমে আলোচিত হয়। সবাই চক্রান্ত–ষড়যন্ত্র পছন্দ করে।

    আর চক্রান্তগুলো এখনও হচ্ছে। খুবই সাম্প্রতিককালে, পৃথিবী কাঁপানো একটা আবিস্কার হয়েছে যে, দা ভিঞ্চির বিখ্যাত এডোরেশন অব দি মাজাইর পরতে পরতে একটা সিক্রেট লুকিয়ে রাখা আছে। ইতালিয় চিত্রকলা ডায়াগনোস্টিশিয়ান মরিজিও সেরাসিনি সত্যটা উন্মোচন করেছেন, যা নিউইয়র্ক টাইম ম্যাগাজিন খুবই গুরুত্বের সাথে লিওনার্দোর ছদ্মবেশ শিরোনামে ছেপেছে।

    সেরাসিনি কোন সন্দেহের উদ্রেক না করেই উদঘাটন করেছেন যে, এডোরেশন এর ধূসর সবুজ স্কেচটার নিচের ড্রইংটা নিশ্চিতভাবেই দা ভিঞ্চির কাজ, কিন্তু উপরের মূল ছবিটা নয়। সত্য হলো, কোন অজানা শিল্পী দা ভিঞ্চির মৃত্যুর অনেক বছর পর, কয়েকবারই এর ওপর পেইন্ট করেছে। আরো বেশি ভয়ংকর ব্যাপার হলো, উপরে আঁকা ছবিটার নিচে যা আছে, সেটা ইনফারেন্স রিফ্লেক্টোগ্রাফি ছবি আর এক্স-রে বলছে, দৃবৃত্ত শিল্পী দা ভিঞ্চির স্কেচটার বিকৃত সাধন করেছে…যাতে দা ভিঞ্চির আসল উদ্দেশ্যটা উল্টিয়ে দেয়া হয়েছে। নিচের ড্রইংটার সত্যিকারের স্বরূপটা এখন পর্যন্ত জনসাধারনের কাছে প্রকাশ করা হয়নি। এমনকি ফ্লোরেন্সের উফিজি গ্যালারির বিব্রত কর্মকর্তারা সঙ্গে সঙ্গে ছবিটা রাস্তার অপরপাশে একটা ওয়্যারহাউসে স্থানান্তর করে ফেলে। গ্যালারির যে জায়গাটাতে এক সময় এডোরেশন-টা ঝোলানো ছিলো, সেখানে দর্শনার্থীরা গিয়ে একটা বিভ্রান্তিকর এবং ক্ষমাপ্রার্থনাসূচক কার্ড দেখতে পাবে এখন।

    এই শিল্পকর্মটি মেরামতের জন্য
    ডায়াগনোস্টিক টেস্ট-এর কাজ চলছে।

    আধুনিক গ্রেইল অম্বেষণকারীদের উদ্ভট আন্ডারওয়ার্ল্ডে লিওনার্দো দা ভিঞ্চি বিশাল একটি উন্মাদনা হিসেবে পরিগণিত হয়ে আসছেন। তাঁর শিল্পকর্ম একটা সিক্রেট-এর কথা বলছে যেনো, তার পরও, সেটা একেবারে লুকায়িত আছে। সম্ভবত ছবিটার নিচের পরতে, হয়তোবা সাদামাটা দর্শনের মধ্যে কোন গুপ্তলিখনের ভেতরে, অথবা একেবারেই কোথাও না। হতে পারে দা ভিঞ্চির হতবুদ্ধিকর কু-গুলো কিছুই না, কেবলই অসাড় প্রতীজ্ঞা, যার পেছনে রয়েছে অতি আগ্রহীদেরকে বিভ্রান্ত করা, তাঁর মোনালিসার বোকার মতো ভান করা হাসির মতোই।

    এটা কি সম্ভব, পেছনে বসে থাকা ল্যাংডনের দিকে ফিরে সোফি জিজ্ঞেস করলো, তুমি যে চাবিটা ধরে রেখেছে, সেটা দিয়ে হলি গ্রেইলের লুকিয়ে রাখা জায়গাটা খোলা যাবে?

    ল্যাংডনের হাসি পেলো। আমি আসলেই ভাবতে পারছি না। তাছাড়া, গ্রেইলটা যুক্তরাজ্যের কোথাও লুকিয়ে রাখা হয়েছে বলে বিশ্বাস করা হয়, ফ্রান্সে নয়। সে তাকে ইতিহাসটা দ্রুত বলে দিলো।

    কিন্তু, গ্রেইলটা-ই মনে হচ্ছে, একমাত্র যৌক্তিক উপসংহার, সে জোর দিয়ে বললো। আমাদের কাছে একটা অসম্ভব নিরাপদ চাবি আছে, প্রায়োরি অব সাইন এর সিলংকিত, আর সেটা দিয়েছেন প্রায়োরিদেরই একজন সদস্য—একটা ভ্রাতৃসংঘ, যা একটু আগে তুমি আমাকে বলেছো, হলি গ্রেইলের অভিভাবক।

    ল্যাংডন জানতো, সোফির কথায় যুক্তি আছে, তারপরও সেটাকে মনে প্রাণে সে মেনে নিতে পারছে না। গুজব আছে যে, প্রায়োরিরা প্রতীজ্ঞা করেছিলো, একদিন গ্রেইলটাকে ফ্রান্সে ফিরিয়ে আনবে এবং অন্তিম শয়নে রাখবে, কিন্তু নিশ্চিতভাবেই কোন ঐতিহাসিক প্রমাণাদি নেই, যাতে মনে হতে পারে এটা বাস্তবিকই ঘটেছে। তারপরও, যদি প্রায়োরিরা গ্রেইলটা ফ্রান্সে নিয়ে আসতে সক্ষম হয়ে থাকে, ২৪, রুই হাক্সো, টেনিস স্টেডিয়ামের নিকটের জায়গাটা কোনমতেই চুড়ান্ত অন্তিম শয়ানের স্থান বলে মনে হয় না। সোফি, আমি এই চাবিটার সাথে গ্রেইলের কোন সম্পর্কই দেখতে পাচ্ছি না।

    কারণ গ্রেইলটা ইংল্যান্ডে থাকার কথা?

    শুধু তাই নয়। হলি গ্রেইলের অবস্থানটা ইতিহাসের সব চাইতে সিক্রেট একটি ব্যাপার। প্রায়োরির সদস্যরা কয়েক দশক অপেক্ষা করে নিজেদেরকে বিশ্বাসযোগ্য হিসেবে প্রতিপন্ন করে থাকে। তারপর, তারা জানতে পারে গ্রেইলটা কোথায় আছে। সিক্রেটটা খুবই জটিল একটি জ্ঞান। আর যদিও প্রায়োরিদের ভাইয়েরা সংখ্যায় অনেক বেশি, তারপরও, একই সময়ে, কেবলমাত্র চার জন সদস্য জানে গ্রেইলটা কোথায় লুকিয়ে রাখা আছে—এ্যান্ড মাস্টার আর তাঁর তিন জন সেনেক্য। তোমার দাদুর বেলায় এরকম চারজনের একজন হওয়াটা, সম্ভবত খুবই ক্ষীণ।

    আমার দাদু তাদেরই একজন, সোফি ভাবলো। এক্সলেটরটা চাপ দিলো। তার স্মৃতিতে একটা ছবি আছে যা খুব নিশ্চিত করেই বলে দেয়, তার দাদুর অবস্থান ছিলো নিঃসন্দেহে ভ্রাতৃসংঘের ভেতরেই।

    আর তোমার দাদু যদি সে রকম কিছু হয়েও থাকেন, তবে কখনও ভ্রাতৃসংঘের বাইরের কারো কাছে সেটা প্রকাশ করার কথা নয়। তিনি তোমাকে তাদের একেবারে ভেতরের সার্কেলে নিয়ে আসবেন, সেটা বিশ্বাসযোগ্যও নয়।

    আমি ইতিমধ্যেই সেখানে ঢুকে গিয়েছিলাম, সোফি ভাবলো। বেসমেন্টের আচার অনুষ্ঠানটার ছবি ভেসে উঠলো তার মনের পর্দায়। সে ভাবলো, এই মুহূর্তে ল্যাংডনের কাছে নরম্যান্ডির শ্যাতুতে দেখা সেই রাতের ঘটনাটার কথা বলবে কি না। এখন থেকে দশ বছর আগে, কাউকে কথাটা বলতে তার ভীষণ লজ্জা করতো। কথাটা মনে করলেই সে দারুণভাবে লজ্জিত আর ব্রিত হতো। দূরে কোথাও সাইরেন বাজছে, তার মনে হলো, তার ভেতরে হালকা একটা অবসাদ এসে ভর করেছে।

    এইতো! ল্যাংডন বললো, সামনের বিশাল বোলা গারো টেনিস স্টেডিয়ামটা দেখে সে দারুণ উত্তেজনা অনুভব করলো।

    সোফি স্টেডিয়ামটার দিকে এগোলো। একটু যেতেই তারা রুই হাক্সোর মোড়টা খুঁজে পেলো। জায়গাটা খুব বেশি শিল্পাঞ্চলের মতো মনে হলো। সারি সারি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান।

    আমাদের দরকার চব্বিশ নাম্বার, ল্যাংডন আপন মনে বললো, বুঝতে পারলো, সে গোপন একটা চার্চের চূড়া দেখার আশা করছে। হাস্যকর হয়ো না। এই রকম জায়গায় একটা বিস্মৃত টেম্পলার চার্চ?

    এইতো সেটা, সোফি বিস্ময়ে চিক্কার করে উঠলো। আঙুল দিয়ে দেখালো জায়গাটা।

    ল্যাংডনের চোখ সামনের স্থাপত্যটার দিকে গেলো। এটা আবার কি?

    ভবনটা খুব আধুনিক। চারকোনা একটা ভবন, তাতে একটা বিশাল সমানবাহুর ক্রশ উপরের দিকে অংকিত। ক্ৰশটার নিচে লেখা :

    জুরিখের ডিপোজিটরি ব্যাংক

    ল্যাংডন ভাবলো তার টেম্পলার চার্চের প্রত্যাশার কথাটা সোফিকে বলবে না। ল্যাংডন প্রায় ভুলেই গেলো যে, এই শান্তিপূর্ণ, সমবাহুর ক্রশটা নিরপেক্ষ দেশ সুইজারল্যান্ড তাদের ফ্ল্যাগে স্থান করে নিয়েছে। নিদেনপক্ষে, রহস্যটার একটা সমাধান তো হলো।

    সোফি আর ল্যাংডন সুইস ব্যাংকের একটা ডিপপাজিট বক্সের চাবি হাতে ধরে রেখেছে।

    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleএঞ্জেলস এন্ড ডেমনস – ড্যান ব্রাউন
    Next Article রবিনসন ক্রুসো – ড্যানিয়েল ডিফো

    Related Articles

    ড্যান ব্রাউন

    এঞ্জেলস এন্ড ডেমনস – ড্যান ব্রাউন

    August 19, 2025
    ড্যান ব্রাউন

    দ্যা লস্ট সিম্বল – ড্যান ব্রাউন

    August 19, 2025
    ড্যান ব্রাউন

    অরিজিন – ড্যান ব্রাউন

    August 19, 2025
    ড্যান ব্রাউন

    ইনফার্নো – ড্যান ব্রাউন

    August 19, 2025
    ড্যান ব্রাউন

    ডিসেপশন পয়েন্ট – ড্যান ব্রাউন

    August 19, 2025
    ড্যান ব্রাউন

    ডিজিটাল ফরট্রেস – ড্যান ব্রাউন

    August 19, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo
    Most Popular

    রবিনসন ক্রুসো – ড্যানিয়েল ডিফো

    August 19, 2025

    অনুরাধা

    January 4, 2025

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    রবিনসন ক্রুসো – ড্যানিয়েল ডিফো

    August 19, 2025

    অনুরাধা

    January 4, 2025

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025
    Our Picks

    রবিনসন ক্রুসো – ড্যানিয়েল ডিফো

    August 19, 2025

    দ্য দা ভিঞ্চি কোড – ড্যান ব্রাউন

    August 19, 2025

    এঞ্জেলস এন্ড ডেমনস – ড্যান ব্রাউন

    August 19, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    Sign In or Register

    Welcome Back!

    Login below or Register Now.

    Lost password?

    Register Now!

    Already registered? Login.

    A password will be e-mailed to you.