Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    রবিনসন ক্রুসো – ড্যানিয়েল ডিফো

    August 19, 2025

    দ্য দা ভিঞ্চি কোড – ড্যান ব্রাউন

    August 19, 2025

    এঞ্জেলস এন্ড ডেমনস – ড্যান ব্রাউন

    August 19, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • 🔖
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    Subscribe
    সাইন ইন
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    দ্য দা ভিঞ্চি কোড – ড্যান ব্রাউন

    ড্যান ব্রাউন এক পাতা গল্প600 Mins Read0

    ০৬. ঘণ্টায় ষাট কিলোমিটারের মধ্যম গতি

    ৫১.

    এমনকি ঘণ্টায় ষাট কিলোমিটারের মধ্যম গতিতে ছুটলেও গাড়ির সামনে ঝুলে থাকা বাম্পারটা রাস্তার সাথে ঘষা লেগে শব্দ করার সাথে সাথে স্ফুলিঙ্গ হতে লাগলো। আমাদেরকে রাস্তা থেকে নেমে যেতে হবে, ল্যাংডন ভাবলো।

    সে কোথায় যাচ্ছে বুঝতে পারছিলো না আর সামনের রাস্তাটাও দেখতে পাচ্ছিলো। ট্রাকের একমাত্র সচল হেডলাইটটা বাম্পারের আঘাতে বেঁকে যাওয়াতে সেটার আলো রাস্তায় না পড়ে পাশের ঝোপ-ঝাড়ে পড়ছে।

    সোফি বসেছিলো প্যাসেঞ্জার সিটে। কোলের উপর রাখা রোজউড বাক্সের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সে।

    তুমি কি ঠিক আছো? ল্যাংডন জিজ্ঞেস করলো।

    সোফি একটু চমকালো। তুমি কি তাঁর কথা বিশ্বাস করো?

    বাকি তিন জনের খুন হওয়ার কথাটা? অবশ্যই। এটা অনেকগুলো প্রশ্নেরই উত্তর দিয়ে দিচ্ছে তোমার দাদুর কি-স্টেনেটা হস্তান্তর করার জন্য মরিয়া হওয়াটা এবং ফশে আমাকে ধরার জন্য কেন এতো বেশি উদগ্রীব, সব কিছুরই উত্তর মিলে যাচ্ছে।

    না, আমি বলতে চাচ্ছি, ভার্নেট তার ব্যাংককে রক্ষা করার ব্যাপারটি।

    ল্যাংডন তার দিকে তাকালো। এটার বিরুদ্ধে আপত্তি?

    কি-স্টোনটা নিজের কাছে নিতে চাওয়াটা।

    ল্যাংডন কথাটা বিবেচনাও করলো না। সে কীভাবে জানবে, বাক্সটার ভেতরে কি রাখা আছে?

    তার ব্যাংক ওটা রেখেছিলো। তিনি আমার দাদুকেও চিনতেন। হয়তো তিনি কিছু জানেন। তিনি হয়তো ঠিক করেছিলেন যে, তিনি নিজেই গ্রেইলটা চান।

    ল্যাংডন মাথা ঝাঁকালো। ভার্নেটকে সে রকম মোটেই মনে হয়নি। আমার অভিজ্ঞতা বলে, দুধরনের লোক আছে, যারা গ্রেইলটার খোঁজ করে। হয় তারা ধরে নিয়েছে কিংবা বিশ্বাস করে যে, তারা খৃস্টের হারানো পেয়ালাটা খুঁজছে…

    অথবা?

    অথবা, তারা সত্যটা জানে, আর এটা তাদেরকে আতংকিত করে থাকে। ইতিহাস জুড়ে অনেক দলই গ্রেইলটা ধ্বংস করার জন্য হন্যে হয়ে খুঁজে বেড়িয়েছে।

    তাদের দুজনের মধ্যেকার নিরবতাটা বাম্পারের ঘর্ষণজনিত শব্দের জন্য ঢাকা পড়ে গেলো। তারা এখন কয়েক কিলোমিটার পর্যন্ত চলে এসেছে। গাড়ির সামনের চাকার দিক থেকে স্কুলিঙ্গটা দেখে ল্যাংডনের মনে হলো, সেটা আবার বিপজ্জনক কিছু নাতো। যদি তারা রাস্তার দুপাশ থেকে কোন গাড়িকে অতিক্রম করে, তবে নিশ্চিতভাবেই মনোযোগের কারণ হবে সেটা। ল্যাংডন সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললো।

    আমি দেখছি, যদি বাম্পারটা আগের জায়গায় লাগাতে পারি।

    সে গাড়িটাকে থামালো।

    অবশেষে নিরবতা নেমে এলো।

    ল্যাংডন ট্রাকের সামনে যেতেই, হঠাৎ করেই একটু সতর্কতা অনুভব করলো। এই মুহূর্তে আর গ্রেফতার হওয়ার ঝুঁকি নেয়া যাবে না। তার কাঁধে এখন মস্তবড় দায়িত্ব। সোফির হাতে যে জিনিসটা আছে, সেটা ইতিহাসের সবচাইতে বড় রহস্যের জট খুলতে। সাহায্য করবে।

    যদি দায়িত্বটা অতো গুরুতর না হোততা, তবে ল্যাংডন প্রায়োরিদের খুঁজে বের করে কি-স্টোনটা তাদের কাছেই ফিরিয়ে দিতো। বাকি তিন জনের মৃত্যুর খবরটা মারাত্মকভাবেই সবকিছু বদলে দিয়েছে। প্রায়োরিদের ভেতরে অনুপ্রবেশ ঘটেছে। তারা আপোষ করে ফেলেছে। ভ্রাতৃসংঘকে অবশ্যই কড়া নজরদারিতে রাখা হয়েছিলো। অথবা কোন স্তরে বিশ্বাসঘাতকতা হয়েছে কিংবা, তাদের মধ্যে গুপ্তচর রয়েছে। সনিয়ে কেন কি-স্টোনটা সোফি আর ল্যাংডনের কাছে হস্তান্তর করতে চেয়েছেন, সেটা এখন বোঝা যাচ্ছে-ভ্রাতৃসংঘের বাইরের লোকজন, যে লোককে, তিনি মনে করেছেন আপোষ করবে না। আমরা কি-স্টোনটা আর ভ্রাতৃসংঘের কাছে ফেরত দিতে পারবো না। এমন কি, ল্যাংডন যদি প্রায়োরি সদস্যদের কাউকে খুঁজে বেরও করে, তবে যে-ই কি-স্টোনটা নেবার জন্যে এগিয়ে আসবে সে-ই শক্র বনে যাবে। এই মুহূর্তে, অন্তত, এটা মনে হচ্ছে, কি-স্টোনটা সোফি আর ল্যাংডনের হাতেই থাকবে, সেটা তারা চাক বা না চাক।

    ট্রাকের সামনের অংশটা ল্যাংডনের ধারণার চেয়েও বেশি খারাপ হয়ে গেছে। বাম দিকের হেড লাইটটা নেই, ডান দিকেরটা দেখে মনে হচ্ছে, চোখের মনি বের হওয়া একটা নষ্ট চোখ। ল্যাংডন সেটা ঠিক করার জন্য সোজা করলো, কিন্তু আবারো ওটা ঝুলে পড়লো। ভাঙাচোড়া বাম্পারটার যে মাথা আঁটকে কোনরকম ঝুলে আছে, সেখানে ল্যাংডন সজোড়ে একটা লাথি মেরে সেটা পুরোপুরি ভেঙে ফেলতে চাইলো।

    দোমড়ানো মোচড়ানো বাম্পারটাতে লাথি মারতে মারতে ল্যাংডন কিছুক্ষণ আগে বলা সোফির কথাটা স্মরণ করলো। আমার দাদু আমার জন্যে একটা ফোন মেসেজ রেখে গেছেন, সোফি তাকে বলেছিলো। তিনি বলেছিলেন, আমার পরিবার সম্পর্কে একটা সত্য কথা বলার দরকার। সেই সময়ে কথাটার কোন অর্থ বহন করেনি, কিন্তু এখন, প্রায়োরি অব সাইন-এর জড়িত থাকার কথাটা জেনে, ল্যাংডনের মনে নতুন একটা সম্ভাবনা উঁকি মারতে শুরু করলো।

    বাম্পারটা আচকা ভেঙে পড়লো। নিদেনপক্ষে ট্রাকটা দেখে এখন আর মনে হচ্ছে না, সেটা একটা ফোর্থ অব জুলাইর স্ফুলিঙ্গ সৃষ্টিকারী কিছু। বাম্পারটা পাশের ঝোপের আড়ালে ফেলে দিলো সে। এবার ভাবতে লাগলো, এরপর তারা কোথায় যাবে। ক্রিপ্টেক্সটা কীভাবে খুলবে, সে সম্পর্কে তাদের কোন ধারণাই নেই। অথবা এই জিনিসটা সনিয়ে তাদেরকে কেন দিলো, তাও জানে না। দুঃখজনক হলেও সত্য,

    আজকের রাতে তাদের টিকে থাকতে হলে, এই প্রশ্নের উত্তর পেতেই হবে।

    আমাদের সাহায্যের দরকার, ল্যাংডন সিদ্ধান্ত নিলো। পেশাদারী সাহায্য।

    হলি গ্রেইল এবং প্রায়োরি অব সাইওনের জগতে একজন ব্যক্তিই আছে। কিন্তু চ্যালেঞ্জটা হলো, কীভাবে এই আইডিয়াটা সোফির কাছে তুলে ধরবে।

     

    গাড়ির ভেতরে, সোফি তার কোলে রোজউড বাক্সটা নিয়ে ল্যাংডনের জন্য অপেক্ষা করছে। আমার দাদু কেন এটা আমাকে দিলেন? এই জিনিসটা দিয়ে সে কী করবে, তার বিন্দুবিসর্গও সে জানে না।

    ভাবো, সোফি! তোমার মাথাটা খাটাও। দাদু তোমাকে কিছু বলতে চেষ্টা করছেন!

    বাক্সটা খুলে সে ক্রিপ্টেক্সের ডায়ালের দিকে তাকালো, মেধার উৎকর্ষতার চিহ্ন। সে তার দাদুর হাতের তৈরি কাজটা অনুভব করলো। কি-স্টোন হলো একটা মানচিত্র যা শুধুমাত্র সুযোগ্য লোকই অনুসরণ করতে পারে।

    বাক্সটা থেকে ক্রিপ্টেক্সটা বের করে, সোফি এর ডায়ালের উপর আঙ্গুল বোলালো। পাঁচ অক্ষরের। সে ডায়ালটা একের পর এক ঘোরাতে লাগলো। যন্ত্রটা খুব সুন্দর করে ঘুরলো। সে একটা শব্দ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে মেলালো। এবার পাঁচ অক্ষরে যে শব্দটা হলো, সোফি জানতো, সেটা একেবারে অর্থহীন কিছু।

    G-R-A-I-L.

    আস্তে করে সিল্ডিরের দুপাশ ধরে টান দিলো সে। ক্রিপ্টেক্সটা খুললো না। ভেতরের ভিনেগারের ঘরঘর শব্দ শুনতে পেলো। তারপর, আবারো চেষ্টা করলো।

    V-I-N-C-I

    আবারো, কোন সাড়া শব্দ নেই।

    V-0-U-T-E

    ক্রিপ্টেক্সটার কিছুই হেরফের হলো না।

    চিন্তিত হয়ে, সে রোজউড বাক্সটার ঢাকনাটা বন্ধ করে দিলো। বাইরে, ল্যাংডনের দিকে তাকিয়ে সে কৃতজ্ঞ বোধ করলো যে, আজ রাতে সে তার সাথে আছে। পি এস, রবার্ট ল্যাংডনকে খুঁজে বের করো। তাকে জড়িত করার দাদুর অভিপ্রায়টা এখন খুবই যুক্তিযুক্ত মনে হচ্ছে। সোফি তার দাদুর অভিপ্রায় সম্পর্কে কিছুই বুঝতে পারছে না। আর রবার্ট ল্যাংডন এক্ষেত্রে তাকে দিক নির্দেশনা দিতে পারে। একজন টিউটর, যে কিনা তার ছাত্রের লেখা-পড়ার তদারকি করছে। ল্যাংডনের জন্য দুঃখজনক যে, সে আজ রাতে টিউটরের চেয়েও বেশি কিছু হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। সে বেজু ফশের শিকারে পরিণত হয়েছে…আর কিছু অদৃশ্য শক্তি হলি গ্রেইলটা দখলে নেবার পায়তারা করছে।

    গ্রেইলটা যা-ই হোক না কেন।

    সোফি অবাক হয়ে ভাবলো, তার জীবনে কোন সত্য জানা যাবে কিনা।

    ট্রাকটা চলতে শুরু করলে ল্যাংডন খুশি হলো যে, সেটা খুব ভালো মতোই চলছে। ভার্সেইতে কীভাবে যাওয়া যাবে, তুমি কি জানো?

    সোফি তার দিকে তাকালো। বেড়াতে যাবে?

    না, আমার একটা পরিকল্পনা আছে। ওখানে একজন ধর্মীয় ইতিহাসবেত্তা রয়েছেন, আমার চেনা, তিনি ভার্সেইর কাছেই বাস করেন। আমি ঠিক বলতে পারছি

    না, কোথায়, কিন্তু আমরা পেঁজ করে দেখতে পারি। আমি তাঁর এস্টেটে বার কয়েক গিয়েছি। তার নাম লেই টিবিং। তিনি একজন সাবেক বৃটিশ রয়্যাল হিস্টোরিয়ান।

    তিনি প্যারিসে থাকেন?

    টিবিংয়ের আজীবনের আকাঙ্খ হলো, হলি গ্রেইল। যখ, পনেরো বছর আগে প্রায়োরিদের কি-স্টোনটার ব্যাপারে কথাবার্তা শোনা গিয়েছিলো, তখন তিনি ফ্রান্সে চলে আসেন, বিভিন্ন চার্চে সেটা খোঁজার আশায়। তিনি কি-স্টোন এবং হলি গ্রেইল এর ওপর অনেক বই লিখেছেন। তিনি হয়তো আমাদেরকে সেটা কীভাবে খুলতে হবে সে ব্যাপারে সাহায্য করতে পারবেন।

    সোফির চোখে উদ্বিগ্নতা। তুমি তাকে বিশ্বাস করো?

    কিসে বিশ্বাস করি? তথ্যটা চুরি করবে না?

    এবং আমাদেরকে বিপদে ফেলবে না।

    আমার কোন ইচ্ছে নেই, তাকে বলি যে, আমরা পুলিশের ফেরারি।

    রবার্ট, তোমার কি মনে হচ্ছে না, আমাদের দুজনের ছবি ইতিমধ্যে ফ্রান্সের সমস্ত টেলিভিশনে প্রচারিত হয়ে গেছে? বেজু ফশে সবসময়ই তার সুবিধার জন্য মিডিয়াকে ব্যবহার করে থাকে। আমরা যাতে পরিচয় লুকাতে না পারি, সে ব্যাপারে সে সবকিছুই করবে।

    খুব ভালো কথা, ল্যাংডন ভাবলো। ফরাসি টিভিতে আমার ডেবু হবে প্যারিসের মোস্ট ওয়ান্টেড হিসেবে। নিদেন পক্ষে, জোনাস ফকম্যান তাতে খুশিই হবে; যতোবারই ল্যাংডন খবরের শিরোনাম হয়েছে, তার বইয়ের কাটতি বেড়েছে লাফিয়ে লাফিয়ে।

    এই লোকটা কি তোমার ভালো বন্ধু? সোফি জিজ্ঞেস করলো।

    প্রশ্নটা বিবেচনার দাবি রাখে। ল্যাংডনের মন বলছে, টিবিং পুরোপুরি বিশ্বস্তই হবে। একটা উপযুক্ত নিরাপদ আশ্রয়। টিবিং শুধু ল্যাংডনকে সাহায্যই করবে না, সে নিজেও একজন গ্রেইল অম্বেষণকারী এবং গবেষক, আর সোফি দাবি করছে, তার দাদু প্রায়োরি অব সাইওনের একজন গ্র্যান্ড মাস্টার। টিবিং যদি এ কথা শোনে, তবে নির্ঘাত সাহায্যকরার জন্য উঠে পড়ে লেগে যাবে।

    টিবিং হতে পারে খুব শক্তিশালী একজন মিত্র, ল্যাংডন বললো। তবে সেটা নির্ভর করছে, তুমি তার কাছে কতটুকু বলবে।

    ফশে সম্ভবত বিরাট অংকের পুরস্কারের ঘোষণা দেবে।

    ল্যাংডন হেসে উঠলো। বিশ্বাস করো, এই লোকটার কাছে টাকা পয়সা হলো শেষ জিনিস, লেই টিবিং খুবই ধনী ব্যক্তি। বৃটেনের ল্যাংকাস্টারের প্রথম ডিউকের একজন বংশধর। টিবিং তার টাকা পয়সা সেই পুরনো রীতি অনুযায়ীই পেয়েছে–উত্তরাধীকারী সূত্রে। প্যারিসের বাইরে তাঁর এস্টেটটা সপ্তদশ শতাব্দীর একটা প্রাসাদ, সেটাতে দুটো হৃদও রয়েছে।

    ল্যাংডন টিবিংয়ের সাথে প্রথম পরিচিত হয়েছিলো কয়েক বছর আগে, বৃটিশ ব্রডকাস্টিং কর্পোরেশনের মাধ্যমে। টিবিং বিবিসিকে একটি ঐতিহাসিক প্রামাণ্য দলিল সহকারে হলি গ্রেইলের তুমুল উত্তেজনা সৃষ্টিকারী একটি প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণের প্রস্তাব দিয়েছিলেন, যা মূলধারার টেভিভিশনের দর্শকদের জন্য সম্প্রচার করা হবে। বিবিসি টিবিংয়ের বিশ্বাসযোগ্যতা, পাণ্ডিত্য আর গবেষণার উপর আস্থা রাখলেও, এরকম একটি বির্তকিত বিষয় নিয়ে প্রামান্যচিত্র নির্মাণের ঝুঁকি নিতে চায়নি, কারণ এতে করে তাদের মানসম্মত সাংবাদিকতার দীর্ঘ দিনের ঐতিহ্যটা নষ্ট হয়ে যেতে পারে। টিবিংয়ের সাজেশনেই, বিবিসি বিশ্বের তিন জন সম্মানিত ইতিহাসবিদ, যারা হলি গ্রেইল সম্পর্কে নিজেদের মতবাদের জন্য বিখ্যাত, তাদেরকে জড়ো করে সাক্ষাৎকার প্রচার করেছিলো।

    ল্যাংডন ছিলো তাদেরই একজন। বিবিসি সাক্ষাঙ্কারটি ধারণ করার জন্য ল্যাংডনকে টিবিংয়ের প্যারিসের এস্টেটে নিয়ে গিয়েছিলো। টিবিংয়ের চমৎকার ড্রইংরুমে ক্যামেরার সামনে বসেছিলো টিবিংয়ের গল্পটা শোনার জন্য। প্রথমদিকে, হলি গ্রেইলের বিকল্প উপাখ্যানটাতে তার সন্দেহ ছিলো এই কথাটা ল্যাংডন স্বীকার করে নিয়ে বলেছিলো যে, কয়েক বছর গবেষণা করার পর অবশেষে সে বুঝতে পেরেছে কাহিনীটা সত্য।

    শেষে, ল্যাংডন তার নিজের কিছু গবেষণার কথা বর্ণনা করেছিলো সিম্বোলজিক সংযোগের একটা সিরিজ, যা খুব ভালো করেই বির্তকের দাবি রাখে।

    যখন অনুষ্ঠানটি বৃটেনে সম্প্রচার করা হলো, তখন এটার সুনির্মাণ আর যথাযথ প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও, খৃস্টান সমাজের বিরাট একটা অংশ প্রতিবাদে ফেটে পড়েছিলো, তাদের প্রতি শত্রুভাবাপন্ন হয়ে উঠেছিলো। এটা আর যুক্তরাষ্ট্রে কখনও প্রচারিত হয়নি। কিন্তু বিক্ষোভটা ঠিকই আটলান্টিক পাড়ি দিয়েছিলো। এর কিছুদিন বাদেই, ল্যাংডন এক পুরনো বন্ধুর কাছ থেকে একটা পোস্টকার্ড পেয়েছিলো ফিলাডেলফিয়ার একজন ক্যাথলিক বিশপ। কার্ডটাতে শুধু লেখা ছিলো : এত, তু রবার্ট?

    রবার্ট, সোফি জিজ্ঞেস করলো, তুমি নিশ্চিত, এই লোকটাকে বিশ্বাস করা যায়?

    অবশ্যই। আমরা সহকর্মী। তার টাকার দরকার নেই। আর আমি এও জানি, ফরাসি কর্তৃপক্ষের ওপর সে দারুণ ক্ষেপে আছে। ফরাসি সরকার ঐতিহাসিক স্থাপত্য নিদর্শনটা কেনার জন্য তাঁর কাছ থেকে অসম্ভব রকমের কর আদায় করেছে। সে বেজু। ফশেকে সহযোগীতা করার জন্য উঠে পড়ে লাগবে না।

    সোফি অন্ধকার পথের দিকে তাকালো। আমরা যদি তার কাছে যাই, তুমি তাকে কতটুকু বলতে চাও?

    ল্যাংডনকে এটা নিয়ে চিন্তিত মনে হলো না। আমাকে বিশ্বাস করো, লেই টিবিং, প্রায়োরি অব সাইওন আর হলি গ্রেইল সম্পর্কে এই পৃথিবীতে সবচাইতে বেশি জানে।

    সোফি তার দিকে তাকালো। আমার দাদুর চেয়েও বেশি?

    আমি বলতে চাচ্ছি, ভ্রাতৃসংঘের বাইরে।

    তুমি কী করে জানলে টিবিং ভ্রাতৃসংঘের সদস্য নয়?

    টিবিং সারাজীবন ব্যয় করেছেন হলি গ্রেইল সম্পর্কে সত্য কথা প্রচার করার জন্য। প্রায়োরিদের শপথ হলো হলি গ্রেইলটা গোপন রাখা।

    কথাটা শুনে আমার কাছে মনে হচ্ছে, স্বার্থের দ্বন্দ্ব।

    ল্যাংডন তার আশংকাটা বুঝতে পারলো। সনিয়ে ক্রিপ্টেক্সটা সরাসরি সোফিকে দিয়েছেন, যদিও সে জানে না ওতে কী আছে, কিংবা এটা দিয়ে সে কী করবে। তাই সে এ ব্যাপারে একজন অপরিচিত লোককে জড়িত করতে দ্বিধান্বিত। টিবিংকে শুরুতেই কি-স্টোন সম্পর্কে কিছু বলার দরকার নেই। অথবা, একেবারেই বলার দরকার নেই। তার বাড়িটা আমাদেরকে লুকিয়ে থেকে সুস্থিরভাবে চিন্তা করার সুযোগ করে দেবে। আমরা তার সাথে গ্রেইল নিয়ে আলাপের সময় তুমি ঠিক সময় মতো

    জানাবে, কেন তোমার দাদু তোমাকে এটা দিয়েছেন।

    আমাদেরকে, সোফি স্মরণ করিয়ে দিলো।

    ল্যাংডন খুব গর্বিত বোধ করলো। আরেকবার, অবাক হয়ে ভাবলো, কেন সনিয়ে তাকে এ ঘটনায় যুক্ত করেছেন।

    তুমি কি অল্প-বিস্তর জানো, টিবিং কোথায় থাকেন? সোফি জিজ্ঞেস করলো।

    ভার এস্টেটটা শ্যাতু ভিলে নামে পরিচিত।

    সোফি অবিশ্বাস ভরা দৃষ্টিতে তাকালো। শ্যাতু ভিলে?

    সেটাই।

    চমৎকার বন্ধুই বটে।

    তুমি এস্টেটটা চেনো?

    আমরা সেটা অতিক্রম করে ফেলেছি। এটা কাস্তেল জেলায়। এখান থেকে বিশ মিনিটের পথ।

    ল্যাংডন চিন্তিত হলো। এতো দূর?

    হ্যাঁ, এই সময়ের মধ্যে তুমি আমাকে বলল, আসলে হলি গ্রেইলটা কি?

    ল্যাংডন একটু থামলো। আমি টিবিংয়ের ওখানেই সেটা বলবো। সে আর আমি এ ব্যাপারটার বিভিন্ন দিকের ওপর বিশেষজ্ঞ। তাঁর আর আমার কথাবার্তায় তুমি পূর্ণাঙ্গ চিত্রটা পাবে। ল্যাংডন হাসলো। তাছাড়া, গ্রেইল হলো টিবিংয়ের জীবন, টিবিংয়ের কাছ থেকে হলি গ্রেইলের গল্প শোনা আর আইনস্টানের কাছ থেকে আপেক্ষিকতাবাদের ব্যাখ্যা শোনা একই কথা।

    আশা করি, মাঝরাতে আগমনের জন্য টিবিং কিছু মনে করবেন না।

    মনে রেখো, উনি স্যার লেই। ল্যাংডন একবারই এই ভুলটি করেছিলো। টিবিং একজন মজার মানুষ। কয়েক বছর আগে, হাউজ অব ইয়র্ক-এর ওপরে জ্ঞানগর্ভ একটা লেখার পরপরই সে নাইট উপাধিতে ভূষিত হয়েছিলেন।

    সোফি মাথা ঝাঁকালো। তুমি ঠাট্টা করছে, তাই না? আমরা একজন নাইটের কাছে যাচ্ছি।

    ল্যাংডন একটা অদ্ভুত হাসি দিলো। আমরা এখন গ্রেইলের খোঁজে আছি, সোফি। আর, একজন নাইটের চেয়ে এ ব্যাপারে কে বেশি সাহায্য করতে পারে?

     

    ৫২.

    ১৮৫ একরের বিশাল শ্যাতু ভিলে প্যারিসের ভার্সেই নগরীর উত্তর-পশ্চিম দিকে অবস্থিত। প্যারিস থেকে মাত্র পঁচিশ মিনিটের পথ। কাউন্ট অব অউফলর জন্য ১৬৬৮ সালে ফ্রাসোয়া মাসাত এটির নক্সা করেছিলেন। এটা প্যারিসের অন্যতম ঐতিহাসিক একটি শ্যাতু। দুটো বড় আয়তক্ষেত্রাকারের হৃদ আর একটা বিশাল বাগান আছে। এখানে। লো নটর বাগানটার নক্সা করেছিলেন। শ্যাতু ভিলেকে একটা ম্যানসনের চেয়ে বরং প্রাসাদ বলেই বেশি মনে হয়। এস্টেটটাকে লা পেতিত ভার্সাই বলেই ডাকা হয়।

    ল্যাংডন ট্রাকটা শ্যাতুর প্রবেশ পথের গেটে কাছে থামালো, এখান থেকে শ্যাতুটা আরো এক মাইল দূরে। সিকিউরিটি গেট দিয়ে দূরের প্রান্তরের মাঝখানে টিবিংয়ের প্রাসাদটা মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকাটা দেখা যায়। গেটের ফলকটা ইংরেজিতে লেখা। ব্যক্তিগত সম্পত্তি। প্রবেশ নিষেধ। যেনো ঘোষণা দিচ্ছে, এটা বৃটেনের কোন অঞ্চল। টিবিং কেবল গেটের ফলকটিই ইংরেজিতে লেখেন নাই, বরং গেটের পাশে ইন্টারকমটাও ডান দিকে রেখেছেন ইউরোপে কেবল ইংল্যাচেই প্যাসেঞ্জাররা বাম দিকে বসে।

    সোফি ইন্টারকমের অদ্ভুত অবস্থান দেখে অবাক হলো। কেউ যদি প্যাসেঞ্জার ছাড়া এখানে এসে পৌঁছায়, তাহলে কি হবে?

    আমাকে জিজ্ঞেস করো না। ল্যাংডন এ ব্যাপারটা নিয়ে টিবিংয়ের সাথে একবার কথা বলেছিলো। সে যেখানে থাকে, সেই জায়গাটাকে নিজের দেশের মতো করে ভাবতেই বেশি পছন্দ করে।

    সোফি পাশের কাঁচটা নামিয়ে দিলো। রবার্ট, তুমিই কথা বলো।

    ল্যাংডন সোফির দিকে হেলে তার কোলের উপর দিয়ে, হাত বাড়িয়ে ইন্টারকমের বোতাম টিপলো। এ সময়ে মনোরম একটা সুগন্ধী তার নাকে এসে লাগলো, বুঝতে পারলো, সোফির খুব কাছাকাছি এসে পড়েছে। ঐরকম অদ্ভুত ভঙ্গীতেই অপেক্ষা। করলো। কিছুক্ষণ বাদে, ফোনটা বাজতে লাগলো।

    শেষে, ইন্টারকম থেকে একটা খসখসে কণ্ঠ ফরাসিতে বললো। শ্যাতু ভিলে। কে বলছেন?

    রবার্ট ল্যাংডন বলছি, সোফির কোল ঘেষে ফোনটার আরো কাছে এগিয়ে গেলো সে। আমি স্যার লেই টিবিংয়ের একজন বন্ধু। আমার তাঁর সাহায্যের দরকার।

    আমার মনিব ঘুমাচ্ছেন। আমিও তার সাথে আপনার কি দরকার?

    একটা ব্যক্তিগত ব্যাপার। তাঁর অন্যতম সেরা আগ্রহের বিষয় সেটা।

    তাহলে, আমি নিশ্চিত, তিনি আপনাদেরকে সকালেই আমন্ত্রণ জানাতে পারলে খুশি হবেন।

    ল্যাংডন একটু নড়ে চড়ে বসলো, এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

    স্যার লেই ঘুমাচ্ছেন, আর আপনি যদি তার বন্ধুই হোন, তো আপনার ভালো করেই জানা আছে, তার স্বাস্থ্য খুব একটা ভালো নেই।

    স্যার লেই টিবিং শৈশব থেকেই পোলিওতে ভুগছেন। এখন তিনি লেগব্রেস ব্যবহার করেন, সাথে ক্রাচও। কিন্তু তাঁর সাথে শেষ দেখার সময়, ল্যাংডন তার মধ্যে যথেষ্ট প্রাণ প্রাচুর্য দেখেছিলো। যদি পারেন, দয়া করে তাঁকে জানান, আমি গ্রেইল সম্পর্কে নতুন কিছু খুঁজে পেয়েছি। আমাদের পক্ষে সকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করা সম্ভব। নয়।

    একটা লম্বা বিরতি।

    ল্যাংডন আর সোফি অপেক্ষা করতে লাগলো।

    পুরো এক মিনিট পার হয়ে গেলো।

    অবশেষে, একজন কথা বললো। আমার ভালো মানুষ, আমি বলতে বাধ্য হচ্ছি আপনি এখনও হারভার্ডের স্টান্ডার্ড সময়েই আছেন। কণ্ঠটা খস্ খসে এবং মৃদু।

    ল্যাংডন হাসলো। চিনতে পারলো বৃটিশ বাচন-ভঙ্গীর কণ্ঠটা। লেই, এরকম অসময়ে আপনাকে ঘুম থেকে ওঠানোর জন্য ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি।

    আমার কাজের লোক বললো, আপনি কেবল প্যারিসেই আছেন তা নয়, বরং গ্রেইল সম্পর্কেও কিছু বলতে চান।

    আমি ভেবেছিলাম একথা শুনে আপনি বিছানা ছেড়ে উঠবেন।

    তাই হয়েছে।

    এই পুরনো বন্ধুর জন্যে দরজা খোলার কোন সম্ভাবনা আছে কি?

    যারা সত্যের অন্বেষণ করে, তারা বন্ধুর চেয়েও বেশি কিছু। তারা আমার ভাই।

    ল্যাংডন সোফির দিকে চোখ গোল করে তাকালো।

    অবশ্যই, আমি গেটটা খুলে দিচ্ছি। টিবিং বললেন, কিন্তু, প্রথমে আমাকে নিশ্চিত হতে হবে, আপনার স্মরণ শক্তি ঠিক আছে কিনা। একটা পরীক্ষা হয়ে যাক। আপনি তিনটা প্রশ্নের উত্তর দেবেন।

    ল্যাংডন ছোট্ট করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। সোফিকে ফিস্ ফিস্ করে বললো, তোমাকে আগেই বলেছি, সে খুবই মজার একজন মানুষ।

    আপনার প্রথম প্রশ্ন, টিবিং বললেন, তাঁর কণ্ঠে গাম্ভীর্য। আপনাকে আমি চা, না কফি খাওয়াবো?

    ল্যাংডন জানতো, আমেরিকানদের কফি প্রীতি সম্পর্কে তাঁর মনোভাবটা কী রকম। চা, সে জবাব দিলো। হালকা বাদামী।

    চমৎকার। আপনার দ্বিতীয় প্রশ্ন। দুধ, না চিনি?

    ল্যাংডন একটু ইতস্তত করলো।

    দুধ, সোফি তার কানে ফিসফিস্ করে বললো, আমার মনে হয় বৃটিশরা দুধই দেয়।

    দুধ, ল্যাংডন বললো।

    নিরবতা।

    চিনি?

    টিবিং কোন জবাবই দিলেন না।

    দাঁড়ান! ল্যাংডনের মনে পড়ে গেলো, শেষবার যখন দেখা হয়েছিলো, তখন তেতো একটা পানীয় পান করেছিলো। সে বুঝতে পারলো, প্রশ্নটাতে চালাকি আছে। লেবু! সে জানালো।

    হালকা বাদামী, সঙ্গে লেবু।

    অবশ্যই। টিবিংয়ের কণ্ঠটা এখন খুব আমুদে শোনালো। শেষ প্রশ্ন, কোন্ বছর হারভার্ডের একজন নৌকাবাইচওয়ালা হেনলিতে অক্সফোর্ডের একজন লোককে পেছনে ফেলে গিয়েছিলো?

    ল্যাংডন এ সম্পর্কে কিছুই জানে না, তবে সে এটা বুঝতে পারলো, উত্তর একটাই হবে, এ জন্যেই এটা জিজ্ঞেস করা হয়েছে। নিশ্চিত করেই বলা যায়, এরকম কোন হাস্যকর ঘটনা কখনও ঘটেইনি।

    গেটটা খট করে খুলে গেলো। আপনার স্মরণ শক্তি ঠিকই আছে, বন্ধু। আপনি পাশ করেছেন।

     

    ৫৩.

    মঁসিয়ে ভার্নেট। জুরিখের ডিপোজিট ব্যাংকের রাত্রিকালীন ম্যানেজার টেলিফোনে ব্যাংকের প্রেসিডেন্টের কণ্ঠটা শুনতে পেরে স্বস্তি অনুভব করলো। আপনি কোথায় গিয়েছিলেন, স্যার? এখানে পুলিশ এসেছে, সবাই আপনার জন্য অপেক্ষা করছে!

    আমার একটু অসুবিধা হয়েছে, ব্যাংক প্রেসিডেন্ট বললেন, তাকে খুব তিক্ত মনে হচ্ছে। আমার এখন তোমার সাহায্য দরকার।

    আপনার একটু না, বেশিই সমস্যা হয়েছে, ম্যানেজার ভাবলো। পুলিশ ব্যাংকটা চারিদিক থেকে ঘিরে রেখেছে, তারা হুমকি-ধামকি দিচ্ছে, ডিসিপিজের ক্যাপ্টেন নিজে এসেছেন। ব্যাংকের দাবি অনুযায়ী ওয়ারেন্টও নিয়ে আসা হয়েছে। আমি আপনাকে কীভাবে সাহায্য করতে পারি, স্যার?

    ট্রাক নাম্বার তিন, সেটা একটু খোঁজো।

    হতভম্ব হয়ে ম্যানেজার তার ডেলিভারির শিডিউলটা দেখলো। এটাতো এখানেই আছে। নিচের লজিং ডকে।

    আসলে, সত্যি বলতে কী, সেটা নেই। পুলিশ যে দুজনকে খুঁজছে, তারাই ট্রাকটা চুরি করে নিয়ে গেছে।

    কী? তারা কিভাবে ওটা নিয়ে বাইরে গেলো?

    আমি ফোনে সেটা ব্যাখ্যা করতে পারবো না, কিন্তু আমাদের এখানে এমন পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটেছে যা দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমাদের ব্যাংকের জন্য বিপর্যয়কর।

    আপনি আমার কাছ থেকে কি সাহায্য চান, স্যার?

    আমি চাই, তুমি এক্ষুণি ট্রাকের ইর্মাজেন্সি ট্রান্সপোন্ডারটা চালু করো।

    ম্যানেজারের চোখটা ঘরের অন্যপাশে রাখা লোজ্যাক কন্ট্রোল বক্সের দিকে গেলো। সব আরমোর ট্রাকের মতোই, ব্যাংকের প্রতিটা ট্রাকেই রেডিও-কন্ট্রোড যন্ত্র বসানো আছে, যা ব্যাংক থেকেই রিমোট কন্ট্রোলের সাহায্যে চালু করা যায়। ম্যানেজার তার জীবনে সেটা মাত্র একবারই চালু করেছিলেন, একটা হাইজ্যাক হবার পর, আর সেটা দারুণভাবেই কাজ করেছিলোস্ট্রাকটার অবস্থান চিহ্নিত করে, স্বয়ংক্রিয়ভাবেই কর্তৃপক্ষকে সেটা জানিয়ে দেয়া হয়েছিলো। আজ রাতে, ম্যানেজারের মনে হচ্ছে, প্রেসিডেন্ট তার কাছ থেকে আরো বেশি কিছু আশা করছেন। স্যার, আপনি ভালো করেই জানেন, আমি যদি সেটা চালু করি, সেটা একইসাথে কর্তৃপক্ষকেও জানিয়ে দেবে, তাতে আমাদের সমস্যা হবে।

    ভার্নেট কয়েক সেকেন্ড নিরব রইলেন। হ্যাঁ, আমি জানি, যাইহোক, ওটা করো। ট্রাক নাম্বার তিন। আমি ফোন ধরে রাখছি। ট্রাকটার একেবারে নিখুঁত অবস্থান জানার সঙ্গে সঙ্গেই, আমি চাই তুমি সেটা আমাকে জানিয়ে দেবে।

    ঠি আছে স্যার।

     

    ত্রিশ সেকেন্ড পর, চল্লিশ কিলোমিটার দূরে, ট্রাকের ভেতর লুকিয়ে রাখা ছোট্ট ট্রান্সপোন্ডারটার চালু হয়ে গেলো।

     

    ৫৪.

    ল্যাংডন আর সোফি ট্রাকটা নিয়ে ভেতরের পথ দিয়ে যেতেই, সোফি অনুভব করলো তার মাংসপেশীগুলো শিথিল হচ্ছে। রাস্তা থেকে ভেতরে আসতে পারাটা স্বস্তি দায়ক, আর সোফি এই রকম একজন বিদেশী দ্রলোকের ব্যক্তিগত মালিকানার এস্টেটের চেয়ে বেশি নিরাপদ জায়গার কথা ভাবতেও পারেনি।

    তারা একটা বৃত্তাকারের পথ দিয়ে যেতেই শ্যাতু তিলেটা দৃষ্টি সীমার ভেতরে চলে এলো। তিন-তলা উঁচু এবং কমপক্ষে ষাট মিটার দীর্ঘ, সামনের অংশটা ধূসর পাথরের তৈরি, আর সেটা বাইরের স্পটলাইটের কারণে জ্বলজ্বল করছে।

    ভেতরের বাতিগুলো সবে জ্বালানো হয়েছে। ল্যাংডন সোজা ট্রাকটা চালিয়ে সদর দরজার সামনে না গিয়ে, পাশের সবুজ-বীথির কাছে গিয়ে গাড়িটা থামালো, যাতে রাস্তা থেকে সেটা না দেখা যায়। রাস্তা থেকে দেখে ফেলার ঝুঁকি নেবার কোন কারণই নেই। সে বললো। অথবা, এরকম একটা ট্রাক নিয়ে কেন এসেছি, সেটা লেই টিবিংয়ের কাছে প্রশ্ন হয়েও দেখা দিতে পারে।

    সোফিও তার সাথে সায় দিলো। ক্রিপ্টেক্সটা নিয়ে আমরা কি করবো? এটা এখানে রাখাটা ঠিক হবে না। কিন্তু লেই যদি এটা দেখে ফেলেন, তবে নিশ্চিতভাবেই জানতে চাইবেন জিনিসটা কি।

    উদ্বিগ্ন হবার কিছু নেই, ল্যাংডন বললো। জ্যাকেটটা খুলে বাক্সটা মুড়িয়ে নিয়ে সেটা কোলে নিয়ে নিলো, যেনো কোনো বাচ্চা কোলে নিয়েছে।

    সোফি সন্দেহপূর্ণ দৃষ্টিতে তাকালো। চতুর।

    টিবিং কখনও নিজের ঘরের দরজা খোলে না; সে ভেতরেই দেখা করতে বেশি পছন্দ করে। ভেতরে ঢুকেই, আমি তার আসার আগে এটা কোথাও লুকিয়ে রাখবো। ল্যাংডন একটু থামলো। আসলে, তুমি তার সাথে দেখা করার আগে আমার উচিত তোমাকে একটু সতর্ক করে দেয়া। স্যার লেইর হাস্য-রসাত্মক ব্যাপারগুলো লোকজনের কাছে প্রায়শই একটু …অদ্ভুত বলে মনে হয়।

    সোফি সন্দেহ করলো, এ পর্যন্ত যা ঘটেছে তাতে মনে হয় না, তার চেয়েও বেশি অদ্ভুত কিছু আজ রাতে ঘটবে।

    প্রধান ফটকের দিকে চলে যাওয়া পথটা কেবল পাথরে তৈরি। সোফি দরজাটাতে ন করার আগেই সেটা ভেতর থেকে খুলে গেলো।

    একজন অভিজাত বাটলার তাদের সামনে এসে দাঁড়ালো। নিজের টাইটা ঠিক করে নিলো সে। আসলে, সবেমাত্র সে পোশাকটা পরেছে। দেখে মনে হচ্ছে তার বয়স পঞ্চাশ। তার ভাবসাব দেখে মনে হলো, তাদের এই সময়ে উপস্থিতিত হওয়াতে সে মোটেও অবাক হয়নি।

    স্যার লেই নিচে নেমে আসছেন, সে জানালো, তার বাচনভঙ্গী পুরোপুরি, ফরাসি। পোশাক পরছেন। তিনি নাইট ড্রেস পরে মেহমানদের অভ্যর্থনা জানাতে পছন্দ করেন না। আমি কি আপনার কোটটা নিতে পারি? সে ল্যাংডনের হাতে ধরা পেচানো টুইড জ্যাকেটটার দিকে ইঙ্গিত করলো।

    ধন্যবাদ, ঠিক আছে।

    অবশ্যই। এদিকে আসুন, প্লিজ।

    বাটলার তাদেরকে বিশাল একটা ড্রইং রুমে নিয়ে এলো, সেখানে ভিক্টোরিয়ান ল্যাম্পের নরম আলো জুলছিলো। ঘরের ভেতরে পাইপের তামাকের গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। ঘরের এক কোনায় ফায়ারপ্লেসে আগুন জ্বলছে। সেটা এতো বড় যে, এর ভেতরে আস্ত একটা বাড়কে রোস্ট করা যাবে। বাটলার সেই ফায়ার প্লেস আর মোমবাতিগুলোতে আগুন জ্বালিয়ে দিলে ঘরটা আলোকিত হয়ে উঠলো।

    লোকটা সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে নিজের জ্যাকেটটা ঠিকঠাক করলো। আমার মনিব অনুরোধ করেছেন, এখানে আপনারা নিজের বাড়ি মনে করে থাকবেন। এই বলে সে ল্যাংডন আর সোফিকে একা রেখে চলে গেলো।

    সোফি ভাবলো, সে কোন পাশটাতে বসবে—একপাশে আছে রেনো যুগের ভেলভেট ডিভান, একটা পুরনো দিনের রকিং চেয়ার, একজোড়া পাথরের আসন, দেখে মনে হচ্ছে, ওগুলো বাইজানটাইন মন্দির থেকে তুলে আনা হয়েছে।

    ল্যাংডন মোড়ানো কোটটা খুলে ক্রিপ্টেক্সটা বের করে ডিভানের নিচে ঠেলে দিলে জিনিসটা দৃষ্টি সীমার বাইরে চলে গেলো। তারপর, জ্যাকেটটা অবার পরে নিলো। সোফির দিকে চেয়ে মুচকি হেসে বসে পড়লো সে।

    সোফিও তার পাশে বসলো। ফায়ার প্লেসের আগুনের উত্তাপটা উপভোগ করে সোফির মনে হলো, এরকম একটা ঘর, তার দাদু অবশ্যই পছন্দ করতেন। গাঢ় কাঠের দেয়াল জুড়ে রয়েছে মহান শিল্পীদের সব ছবি, তাদের একটাকে সোফি চিনতে পারলো, সেটা পুশিনের, তার দাদুর দ্বিতীয় সেরা পছন্দের শিল্পী। ফায়ার প্লেসের ঠিক উপরে আইসিস দেবীর একটা আবক্ষ মূতি, তাদের দিকে চেয়ে আছে সেটা।

    মিশরীয় দেবীর নিচে, ফায়ার প্রেসের ভেতরে, দুটো গারগোয়েল, তাদের হা করা মুখটা দিয়ে জিভ বের হয়ে আছে। শৈশবে গারগোয়েল দেখে সোফি সবসময়ই ভয় পেতো; তবে একবার, তার দাদু তাকে নটরডেম ক্যাথেড্রালের গারগোয়েলগুলো দেখিয়ে বলেছিলেন, প্রিন্সেস, এইসব নিরীহ জিনিসগুলোকে দ্যাখো, তুমি কি এদের মুখ থেকে মজার শব্দ শুনতে পাচ্ছো?

    সোফি মাথা নেড়ে শব্দটা শুনে একটু হেসেছিলো। তারা গার্গল করছে। তার দাদ তাকে বলেছিলেন। গারগারিসার! সেজন্যেই তাদেরকে গারগোয়েল-এর মতো অদ্ভুত নামে ডাকা হয়।

    সোফি এরপর থেকে আর সেগুলোকে ভয় পায়নি কখনও।

    এই প্রিয় স্মৃতিটার কথা মনে করে সোফির ভেতরে প্রচণ্ড যন্ত্রণার সৃষ্টি হলো। দাদু চলে গেছে। সে ভাবলো ক্রিপ্টেক্সটা কীভাবে খোলা যায়, সেটা যদি লেই টিবিং জানতো। সোফির দাদুর অন্তিম মুহূর্তের কথায় ল্যাংডনের কাছে যাবার নির্দেশ ছিলো। তিনি অন্য কাউকে জড়িত করার কথা বলেননি। আমাদের লুকানোর জন্য একটা জায়গার দরকার। সোফি বললো, ঠিক করলো রবার্টের বিচার বুদ্ধির ওপরে আস্থা রাখবে।

    স্যার রবার্ট! তাদের পেছনে থেকে একটা কণ্ঠ বলে উঠলো। আপনি দেখি একজন কুমারীর সঙ্গে ভ্রমণ করছেন।

    ল্যাংডন উঠে দাঁড়ালে সোফিও উঠে দাঁড়ালো। ঘরের এক কোনায় পেঁচানো একটা সিঁড়ি দিয়ে টিবিং নেমে এলেন।

    গুড ইভিনিং, ল্যাংডন বললো। স্যার লেই, পরিচয় করিয়ে দিচ্ছি, সোফি নেভু।

    কী সৌভাগ্য আমার। টিবিং আলোর দিকে চলে এলেন।

    আপনাকে ধন্যবাদ, সোফি বললো, দেখতে পেলো পায়ে লোহার লেগব্রেস পরেছেন তিনি আর হাতে ক্রাচ। আমি বুঝতে পারছি একটু দেরি হয়ে গেছে।

    দেরি নয়, মাইডিয়ার, একটু জলদিই এসে গেছেন। তিনি হাসলেন। ভু নেত পাস আমিরিকেই?

    সোফি মাথা ঝাঁকালো। প্যারিসেঁ।

    আপনার ইংরেজি চমৎকার।

    ধন্যবাদ। আমি রয়্যাল হলোওয়েতে পড়েছি।

    তাইতো বলি। টিবিং একটু কাছে এগিয়ে এলেন। হয়তো রবার্ট আপনাকে বলেছে, আমি অক্সফোর্ডের কাছাকাছিই একটা স্কুলে পড়েছি। টিবিং ল্যাংডনের দিকে তাকালেন। অবশ্যই, আমি হারভার্ডেও পড়েছি, একটা নিরাপদ শিক্ষায়তন হিসেবে।

    সোফির কাছে তাদের নিমন্ত্রণকর্তাকে দেখতে ঠিক স্যার এলটন জনের মতো মনে হলো না। টিবিংয়ের চুল লাল আর কথা বলার সময় তার দুটো চোখ পিটপিট করে।

    টিবিং ল্যাংডনের কাছে এসে হাত মেলালেন। রবার্ট আপনি ওজন হারিয়েছেন। ল্যাংডন হাসলো। আর আপনি সেগুলোর কিছু পেয়ে গেছেন।

    টিবিং প্রাণখুলে হাসলেন। নিজের পেটে চাপড় মারলেন। এবার সোফির দিকে ঘুরে আলতো করে তার হাত দুটো ধরে সরাসরি তার দিকে তাকালেন, মালেডি।

    সোফি ল্যাংডনের দিকে তাকালো। সে একটু পিছিয়ে গিয়ে হাটু গেঁড়ে সম্মান জানাবে, নাকি হাতটা চুমু খাওয়ার জন্য এগিয়ে দেবে, বুঝতে পারছিলো না।

    চায়ের কেটলি নিয়ে বাটলার ঘরে ঢুকে ফায়ারপ্লেসের সামনে রাখা টেবিলে সেটা রেখে দিলো।

    এই হলো রেমি লেগালুদে, টিবিং বললেন। আমার গৃহভৃত্য।

    বাটলার একটা হাসি দিয়ে চলে গেলো।

    রেমি লিওঁর অধিবাসী, টিবিং নিচু স্বরে বললেন, যেনো কথাটা খুব আপত্তিকর। কিন্তু সে খুব ভালো সসেজ বানাতে পারে।

    ল্যাংডন অবাক হলো। আমি ভেবেছিলাম, আপনি হয়তো একজন ইংরেজকে এনেছেন।

    হায় ঈশ্বর, তা হবে কেন! আমি এটা আশা করতে পারি না, একজন বৃটিশ শেফকে ফ্রেঞ্চ ট্যাক্স কালেক্টররা মেনে নেবে। তিনি সোফির দিকে তাকালেন। পারাদোনেজ-মোয়ে? মাদামোয়াজেল নে। দয়া করে নিশ্চিত হবেন, আমার ফরাসি বিদ্বেষ কেবলমাত্র রাজনীতিবিদ আর ফুটবলমাঠের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। আপনার সরকার আমার টাকা চুরি করে। আর আপনাদের ফুটবল টিম, সাম্প্রতিককালে আমাদেরকে অপমানিত করেছে।

    সোফি একটা স্বস্তির হাসি দিলো।

    টিবিং তার দিকে চেয়ে ল্যাংডনের দিকে ফিরলো। কিছু একটা হয়েছে। আপনাদের দুজনকেই একটু অন্যরকম লাগছে।

    ল্যাংডন মাথা নেড়ে সায় দিলো। আমাদের একটা অদ্ভুত রাত কেটেছে, লেই।

    তাতে সন্দেহ নেই। আপনারা মাঝরাতে আমার এখানে এসে গ্রেইল সম্পর্কে বলছেন। বলুন আমাকে, এটা কি আসলেই গ্রেইল নিয়ে, নাকি আপনারা এটা বলছেন এজন্যে যে, এই একটি মাত্র ব্যাপারই আছে যা আমাকে মাঝরাতেও জাগাতে পারে?

    বলা চলে দুটোই। সোফি ভাবলো, সোফার নিচে ক্রিপ্টেক্সটার কথা মনে করলো সে।

    লেই, ল্যাংডন বললো, আমরা আসলে প্রায়োরি অব সাইওন সম্পর্কে আলোচনা করতে চাচ্ছি।

    টিবিংয়ের ভুরু দুটো কৌতূহলে কুচকে গেলো। রক্ষক। তো, এটা আসলে গ্রেইল সম্পর্কিতই বটে। আপনারা বলেছিলেন, আপনাদের কাছে একটা খবর আছে? নতুন কিছু, রবার্ট?

    সম্ভবত। তবে আমরা পুরোপুরি নিশ্চিত নই। আমাদের মনে হচ্ছে, আপনার কাছ থেকে এ সম্পর্কে আগে শুনতে পারলেই আমাদের জন্য ভালো হয়।

    টিবিং তার আঙ্গুলগুলো নাচাতে লাগলেন। চতুর আমেরিকান। আগে শুনতে চান। খুব ভালো। আমি আপনাদের সেবায় নিয়োজিত। বলুন, আমাকে কী বলতে হবে?

    ল্যাংডন দীর্ঘশ্বাস ফেললো। আমি আশা করছি, আপনি আগে মিস্ নেভূকে হলি গ্রেইলের সত্যিকারের চরিত্রটি সম্পর্কে ব্যাখ্যা করবেন।

    টিবিং দারুণ অবাক হলেন। উনি জানেন না? ল্যাং

    ডন মাথা ঝাঁকালো।

    টিবিংয়ের মুখে যে হাসিটা দেখা গেলো, সেটা প্রায় অশ্লীল। রবার্ট, আপনি আমার কাছে একজন কুমারী নিয়ে এসেছেন?

    ল্যাংডন কাচুমাচু হয়ে সোফির দিকে তাকালো। কুমারি বা ভার্জিন এমন একটা শব্দ, যা এমন একজনের বেলায় প্রয়োগ করা হয়, যে গ্রেইলের সত্যিকারের গল্পটা শোনেনি, এই প্রথম তাকে সেটা বলা হবে।

    টিবিং আগ্রহভরে সোফির দিকে তাকালেন। আপনি কতোটুকু চান, মাই ডিয়ার?

    সোফি সংক্ষেপে জানালো, ল্যাংডনের কাছ থেকে অল্প-বিস্তর যা শুনেছিলো, তার বর্ণনা দিলো।

    এই? টিবিং ল্যাংডনের দিকে কটমট করে তাকালেন। রবার্ট, আমি ভেবেছিলাম আপনি একজন দ্রলোক। ইতিমধ্যেই আপনি তার উত্তেজনা হরণ করেছেন?

    আমি ভেবেছিলাম, হয়তো আপনি আর আমি দুজনে মিলে… ল্যাংডন বুঝতে পারলো কথাবার্তাগুলো একটু বেশিই দ্ব্যর্থবোধক হয়ে যাচ্ছে, বাড়াবাড়িও হয়ে গেছে।

    টিবিং ইতিমধ্যেই সোফিকে নিজের দৃষ্টিতে আঁটকে রেখেছেন। আপনি একজন গ্রেইল ভার্জিন, মাই ডিয়ার। বিশ্বাস করুন, আপনি আপনার প্রথম অভিজ্ঞতার কথাটি কখনও ভুলবেন না।

     

    ৫৫.

    ল্যাংডনের পাশে সোফায় বসে সোফি চায়ে চুমুক দিয়ে একটা কেক তুলে নিলো। ক্যাফেইন আর কেকটার স্বাগতম জানানোর আবেশটা অনুভব করলো সে। স্যার লেই টিবিং চোখ কুচকে অদ্ভুতভঙ্গীতে ফায়ার প্লেসের সামনে হাটতে লাগলেন। তার পায়ের লেগব্রেসটা খটখট করে শব্দ করলো।

    হলি গ্রেইল, টিবিং বললেন, তার কণ্ঠে ধর্মীয় উপদেশের ভাবগাম্ভীর্যের ছোঁয়া। বেশিরভাগ লোক আমাকে জিজ্ঞেস করে থাকে, সেটা কোথায়। আমার মনে হয়, এটা এমন একটা প্রশ্ন, যার উত্তর আমি কখনই দেবো না। তিনি ঘুরে সোজা সোফির দিকে তাকালেন। যাহোক…তার চেয়ে অনেক বেশি প্রাসঙ্গিক প্রশ্ন হলো : গ্রেইলটা আসলে কি?

    সোফি আঁচ করতে পারলো, তার দুজন পুরুষ সঙ্গীর মধ্যে এক ধরনের একাডেমিক আবহের উদ্ভব ঘটেছে।

    গ্রেইলটাকে পুরোপুরি বুঝতে হলে, টিবিং বলতে শুরু করলেন, আমাদেরকে সবার আগে বাইবেল বুঝতে হবে। আপনি নিউ টেস্টামেন্ট সম্পর্কে কতোটুকু জানেন?

    সোফি কাঁধ ঝাঁকালো। একদমই না, আসলে, আমি এমন একজন লোকের কাছে বড় হয়েছি, যিনি লিওনার্দো দা ভিঞ্চিকে পূজা করতেন।

    টিবিংকে একই সাথে হতচকিত আর আনন্দিত মনে হলো। একটি আলোকিত আত্মা। চমৎকার! তাহলে আপনি জানেন যে, লিওনার্দো ছিলেন হলি গ্রেইলের সিক্রেট রক্ষাকারীদেরই একজন। আর তিনি তার শিল্পে সেটার কু লুকিয়ে রেখেছেন।

    রবার্ট আমাকে এ সম্পর্ক বলেছে।

    আর নিউটেস্টামেন্ট সম্পর্কে দা ভিঞ্চির দৃষ্টিভঙ্গী?

    কোন ধারণা নেই।

    টিবিং তাঁর ঘরের এককোণে রাখা বুক-সেলুফের দিকে তাকালেন। রবার্ট, আপনি যদি কিছু মনে না করেন, ঐ দিকের শেলফে রাখা লা স্টোরিয়া দি লিওনার্দো বইটা দেবেন কি?

    ল্যাংডন বিশাল আর্টের বইটা নিয়ে এসে তাদের সামনের টেবিলটার ওপর রাখলো। টিবিং বইটার মলাট খুলে প্রথম দিকের একটা পৃষ্ঠায় কতোগুলো উক্তির দিকে নির্দেশ করলেন। এগুলো দা ভিঞ্চির নোটবুক থেকে সংগৃহীত। টিবিং বললেন। আমার মনে হয়, এতে আপনি আমাদের আলোচনার সাথে সম্পর্কিত কিছু পাবেন।

    সোফি লেখাটা পড়লো।

    অনেকেই ইন্দ্রজালের ব্যবসা আর বানোয়াট অলৌকিকত্ব দেখিয়ে
    বোকা জনগণকে ধোকা দিয়েছে।
    —লিওনার্দো দা ভিঞ্চি

    এখানে আরেকটা আছে, টিবিং আরেকটা উক্তির দিকে নির্দেশ করে বললেন।

    অন্ধ অজ্ঞতা আমাদেরকে ভুল পথে চালিত করে।
    ও! জীবিত মানুষ, তোমার চোখ খোলো!
    –লিওনার্দো দা ভিঞ্চি

    সোফি খুবই উত্তেজনা অনুভব করলো। দা ভিঞ্চি বাইবেল সম্পর্কে বলেছেন?

    টিবিং সায় দিলেন। বাইবেল সম্পর্কে লিওনার্দোর অনুভূতি সরাসরি হলি গ্রেইলের সাথে সংশ্লিষ্ট। সত্যি বলতে কী, দা ভিঞ্চি হলি গ্রেইলের আসল ছবিটা একেঁছিলেন। একটু পরে আপনাকে আমি সেটা দেখাবো। তবে, প্রথমে আমরা বাইবেল নিয়েই কথা বলবো। টিবিং হাসলেন। আর বাইবেল সম্পর্কে আপনার যা জানার দরকার, তা কামান বিশেষজ্ঞ মার্টিন পারসি কর্তৃক হিসাব করা। টিবিং তাঁর গলাটা পরিষ্কার করে জানালেন, বাইবেল ফ্যাক্স হয়ে কিংবা স্বর্গ থেকে আসেনি।

    কী বললেন?

    বাইবেল মানুষেরই তৈরি, মাইডিয়ার। ঈশ্বরের নয়। বাইবেল জাদুর মতো আকাশ থেকে পড়েনি। মানুষই এটা তৈরি করেছে, ইতিহাসের এক সন্ধিক্ষণে। আর এটা অসংখ্যবার অনুবাদিত হয়েছে, সংযোজিত হয়েছে, সংস্কার করা হয়েছে। বইটির সুনিশ্চিত নির্মযোগ্য কোন সংস্করণ ইতিহাসে পাওয়া যায়নি।

    ঠিক আছে।

    যিশু খৃস্ট ইতিহাসের একটি প্রভাবশালী চরিত্র। সম্ভবত সবচাইতে ক্ষ্যাপাটে অনুপ্রেরণাদায়ক বিশ্ব নেতাও বটে। পৃথিবীতে এর আগে তার মতো কেউ আসেনি। এাণকর্তা হিসেবে বিবেচিত হলেও, তিনি রাজা বনে গিয়েছিলেন, লক্ষ লক্ষ মানুষকে অনুপ্রাণিত করেছিলেন আর নতুন দর্শনের প্রবক্তা হয়েছিলেন। রাজা সোলেমান আর রাজা ডেভিডের বংশধর হিসেবে যিশু খৃস্টের ইহুদিদের বৈধ রাজা হবার অধিকার ছিলো। বোধগম্য কারণেই, পৃথিবীব্যাপী তাঁর জীবন সংরক্ষিত হয়েছিলো লক্ষ-লক্ষ অনুসারীদের দ্বারা।

    টিবিং চা খাওয়ার জন্য একটু থামলেন। নিউ টেস্টামেন্টের জন্য আশিটি গসপেল নির্বাচিত করা হয়েছিলো, কিন্তু খুব অল্পসংখ্যকই অর্ন্তভূক্ত করা হয়েছিলো ম্যাথিও, মার্ক, লিউক, এবং জনই সেইসব অর্ন্তভূক্ত করেছিলেন।

    কোন্ গসপেলটা অন্তর্ভূক্ত হবে, সেটা কে বেছে নিয়েছিলো? সোফি জিজ্ঞেস করলো।

    আহা! টিবিং আতিশয্যে বললেন। খৃস্টবাদের মৌলিক দূর্ভাগ্য! বাইবেল, আজকে যেমনটি আমরা দেখি, প্যাগান রোমান সম্রাট কনস্টানটিন দ্য গ্রেট কর্তৃক বিন্যস্ত হয়েছিলো।

    আমি জানতাম কনস্টানটিন একজন খৃস্টান ছিলেন, সোফি বললো।

    খুব একটা নয়, টিবিং বললেন। তিনি ছিলেন আজীবন একজন প্যাগান, যাকে মৃত্যু শয্যায় ব্যাপটাইজ করা হয়েছিলো। আর তিনি এতোটাই দুর্বল ছিলেন যে, প্রতিবাদ করতে পারেননি। কনস্টানটিনের সময়ে, রোমের রাজকীয় ধর্ম ছিলো সূর্য পূজাসল ইনভিকটাস-এর ধর্ম, অথবা, অদৃশ্য সূর্যের ধর্ম আর কনস্টানটিন ছিলেন সেটার প্রধান পুরোহিত। তার জন্যে খুব দুর্ভাগ্য ছিলো যে, একটা ক্রমবর্ধমান ধর্ম রোমকে কুক্ষিগত করতে যাচ্ছিলো। যিশুর ক্রুশবিদ্ধ হবার তিন শত বছর পর, তার অনুসারীরা বহুগুণে বাড়তে শুরু করেছিলো। খৃস্টান আর প্যাগানরা যুদ্ধ করতে শুরু করলো। আর দ্বন্দ্বটা এতোটাই প্রকট হয়ে উঠেছিলো যে, সেটা রোমকে দুভাগে বিভক্ত করার একটা হুমকি হয়ে দেখা দিয়েছিলো। কনস্টানটিন সিদ্ধান্ত নিলেন, রোমকে একক একটি ধর্মে ঐক্যবদ্ধ করবেন। খৃস্টান ধর্মে।

    সোফি খুব অবাক হলো। একজন প্যাগান সম্রাট কেন খৃস্টান ধর্মকে রষ্ট্রীয় ধর্ম হিসেবে বেছে নিলেন?

    টিবিং মিটিমিটি হাসলেন। কনস্টানটিন একজন ভালো ব্যবসায়ী ছিলেন। তিনি দেখতে পাচ্ছিলেন খৃস্টান ধর্ম ক্রমশ বাড়ছে, তাই তিনি বিজয়ী ঘোড়ার ওপরই বাজি ধরেছিলেন বলা চলে। ঐতিহাসিকরা এখনও যারপরনাই বিস্মিত হোন, কীভাবে, কনস্টাটিন সূর্য-পূজারী প্যাগানদেরকে খৃস্ট ধর্মে দীক্ষিত করেছিলেন। প্যাগান প্রতীক, সন-তারিখ, এবং আচারগুলোকে তিনি খৃস্টীয় ঐতিহ্যের সাথে মিশিয়ে দিয়ে নতুন এবং শংকর একটি ধর্ম প্রবর্তন করেছিলেন, যা দুপক্ষের কাছেই গ্রহণযোগ্য হয়েছিলো।

    প্যাগান ধৰ্ম রূপান্তরিত হয়ে খৃস্টান ধর্মের প্রতীকে ঠাই করে নেয়ার সত্যটা অনস্বীকার্য। ল্যাংডন বললো। মিশরীয় সূর্য চাকতি হয়ে গেলো ক্যাথলিক সেন্টদের হালোস। আইসিস দেবীর অলৌকিকভাবে পাওয়া সন্তানের সেবা করার ছবিটা খুব দারুণভাবেই, আধুনিককালে আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠা কুমারী ম্যারি শিশু যিশুকে সেবা করার দৃশ্যের সাথে মিলে যায়। আর ক্যাথলিকদের আচারগুলোর প্রায় সবটাই মিতার, বেদী, ডক্সোলজি, আর কমিউনিয়ন-এর গড ইটিং-সরাসরি প্যাগানদের কাছ থেকে নেয়া।

    টিবিং আর্তনাদ করে উঠলেন। খৃস্টান ধর্মের কোনকিছুই আসল নয়। প্রাক খৃস্টীয় ঈশ্বর মিথারস যাকে ডাকা হোতো ঈশ্বরের পুত্র এবং জগতের আলো বলে তিনি জন্মেছিলেন ২৫ শে ডিসেম্বর, মারা গিয়েছিলেন একটা পাথরের ফলকের ওপর। তারপর, তিন দিন পরে তাঁর পুণরুত্থান হয়েছিলো। ভালো কথা, ২৫ শে ডিসেম্বর অসিরিস, এডোনিস আর ডায়োনিসাস-এরও জন্মদিন। খৃস্টানদের সাপ্তাহিক ছুটিটাও প্যাগানদের কাছ থেকে চুরি করা।

    আপনি কী বলতে চাচ্ছেন?

    প্রথমে, ল্যাংডন বললো, খৃস্টান ধর্ম ইহুদিদের শনিবারের সাবাঘকে সম্মান জানিয়ে ছিলো, কিন্তু কনস্টানটিন সেটা বদলে, প্যাগানদের শ্রদ্ধেয় রবিবার, অর্থাৎ সান ডে-কে ছুটি হিসেবে ঘোষণা দিয়েছিলেন। সে একটু থেমে দাঁত বের করে হাসলো।

    আজকের দিনে, বেশিরভাগ চার্চ গমনকারীই জানে না, তারা আসলে প্যাগানদের সূর্য দেবতাকেই প্রকারন্তরে সম্মান করতে যাচ্ছে রবিবার।

    সোফির মাথা ঘুরতে লাগলো। আর এসব কিছুই গ্রেইলের সাথে সংশ্লিষ্ট?

    অবশ্যই টিবিং বললেন। আমার সাথেই থাকুন। এই দুটো ধর্মের সংমিশ্রণের সময়ে, কনস্টানটিনের নতুন খৃস্টীয় ঐতিহ্যকে দৃঢ় করার প্রয়োজন হয়ে পড়লো, সেজন্যে, তিনি একটা বিখ্যাত ধর্মসভার ডাক দিলেন, যা নিয়ে নামে পরিচিত।

    সোফি কথাটা একবার শুনেছিলো, তবে সেটা নিসেন ক্রিডের জন্মস্থান হিসেবে।

    এই সম্মেলনেই, টিবিং বললেন, খৃস্টান ধর্মের অনেক কিছুই আলোচনা করে ভোট দিয়ে সব ঠিক করা হয়েছিলো ইস্টারের দিন, বিশপের ভূমিকা, পুরোহিতদের ক্ষমতা এবং অবশ্যই যিশুর দেবত্ব।

    আমি বুঝতে পারছি না। দেবত্ব?

    মাইডিয়ার, টিবিং ঘোষণা দিলেন, এই দিনের আগপর্যন্ত, যিশুকে তার অনুসারীরা একজন মরণশীল পয়গম্বর হিসেবেই দেখতো…একজন মহান এবং শক্তিশালী মানুষ হিসেবে। আর অবশ্যই, একজন মরণশীল মানুষ হিসেবে।

    ঈশ্বরের পুত্র নয়?

    ঠিক, টিবিং বললেন। যিশুকে ঈশ্বরের পুত্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার প্রস্তাব করা হয়েছিলো সেই কাউন্সিলে, আর সেটা ভোটের মাধ্যমে অনুমোদিতও হয়েছিলো, নিসায়েতে।

    দাঁড়ান। আপনি বলছেন যিশু দেবত্ব ভোটের ফল?

    অনেকটা সে রকমই, টিবিং যোগ করলেন।

    খৃস্টের দেবত্ব প্রতিষ্ঠা করার মধ্য দিয়ে রোমান সাম্রাজ্যের ঐক্য এবং নতুন শক্তি কেন্দ্র ভ্যাটিকানকে আরো বেশি দৃঢ়তা দিয়েছিলো। আনুষ্ঠানিকভাবে যিশুকে ঈশ্বরের পুত্র হিসেবে প্রমাণ করার মধ্য দিয়ে কনস্টানটিন যিশুকে দেবতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। মনুষ্য সমাজের বাইরের একজন, যার শক্তি সমস্ত সন্দেহের উর্ধ্বে। এর মধ্য দিয়ে কেবল প্যাগানদের উথানই ঠেকানো হয়নি, বরং তার অনুসারীরা একটি সংগঠনও তৈরি করে ফেললো-রোমান ক্যাথলিক চার্চ।

    সোফি ল্যাংডনের দিকে তাকালে সে সোফিকে কথাটার সত্যতা সম্পকে আশ্বস্ত করলো।

    সবটাই ছিলো ক্ষমতা সংক্রান্ত ব্যাপার, টিবিং আবারো বলতে শুরু করলেন। ত্রাণকর্তার ব্যাপারটা খৃস্টীয় চার্চ এবং রাষ্ট্রের কাছে খুবই স্পর্শকাতর ছিলো। অনেক পণ্ডিতের দাবি, শুরুর দিকে চার্চ যিশুকে তাঁর সত্যিকারের অনুসারীদের কাছ থেকে চুরি করেছিলো। তার মানবিক বার্তাগুলো হাইজ্যাক করা হয়েছিলো, তাঁকে অপ্রবেশ্য এক স্বর্গীয় মহিমায় প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছিলো, আর এসব কিছুই করা হয়েছিলো নিজেদের শক্তি বাড়াতে। এই বিষয়ে আমি কতগুলো বইও লিখেছি।

    আমি অনুমান করতে পারি, একনিষ্ঠ খৃস্টানরা আপনার কাছে প্রতিদিন ঘৃণার চিঠি পাঠিয়েছে?

    কেন তারা সেটা করবে? টিবিং পাল্টা প্রশ্ন করলো। শিক্ষিত খৃস্টানদের মধ্যে বিশাল সংখ্যকই তাদের বিশ্বাসের ইতিহাসটা জানে। যিশু অবশ্যই একজন মহান আর ক্ষমতাবান লোক ছিলেন। কনস্টানটিনের নিজস্ব স্বার্থে তাকে ব্যবহার করার জন্য তো আর যির মহিমান্বিত জীবনটা হেয় হয়ে যায় না। কেউ তো আর বলছে না, খৃস্ট একজন ভণ্ড ছিলেন। অথবা অস্বীকার করতে পারে না যে, তিনি এই পৃথিবীর লক্ষ-লক্ষ মানুষকে উন্নততর জীবনের জন্য অনুপ্রাণিত করেছেন। আমরা যা বলছি সেটা হলো, কনস্টানটিন যিশুর প্রভাব এবং গুরুত্বকে নিজের স্বার্থে ব্যবহার করেছেন। আর এটা করার মধ্য দিয়ে তিনি খৃস্টান ধর্মকে একটি আকার দিয়েছেন, যা আজ আপনারা দেখছেন।

    সোফি তার সামনে রাখা আট-বুকটার দিকে তাকালো। এটা ভেতরে দা ভিঞ্চির আঁকা হলি গ্রেইলটা দেখার জন্য উদগ্রীব সে।

    কিন্তু পরিহাসের বিষয় হলো, টিবিং বললেন, এবার তিনি খুব দ্রুত বলে যেতে লাগলেন। যেহেতু যিশুর মৃত্যুর চার শত বছর পর কনস্টানটিন তাকে মহিমান্বিত করেছিলেন, তাই তার জীবন যে মরণশীল একজন মানুষের জীবন, সে সম্পর্কে হাজার হাজার দলিল-দস্তাবেজের অস্তিত্ব রয়ে গিয়েছিলো। ইতিহাসের বই নতুন করে লেখার জন্য কনস্টানটিনের দরকার ছিলো রক্তাক্ত একটি অধ্যায়ের। এখানেই শুরু হয়েছিলো। বৃস্টিয় ইতিহাসের সবচাইতে বড় অধ্যায়ের। সোফির দিকে তাকিয়ে টিবিং বিরতি দিলেন। কনস্টানটিন একটা নতুন বাইবেলের জন্য অর্থ প্রদান করে একটি কমিটি গঠন করলেন। এতে করে বাইবেল থেকে ঐসব গসপেল বাদ দিয়ে দেয়া হলো যাতে যিশুকে মানুষ হিসেবে বিবৃত করা হয়েছিলো। তার বদলে এমন সব গসপেল অর্ন্তভূক্ত করা হলো, যাতে যিশুকে ঈশ্বরতুল্য বলে মনে হয়। অনেক আদি গসপেল সংগ্রহ করে পুড়িয়ে ফেলা হয়েছিলো।

    আরেকটা কথা, ল্যাংডন যোগ করলো। কেউ যদি কনস্টানটিনের সংস্করণটা বাদ দিয়ে আসল গসপেলটা বেছে নিতো, তবে তাকে হেরোটিক বা ধর্মবিরোধী আখ্যা দেয়া হোতো। Heretic শব্দটা তখন থেকেই পৃথিবীতে প্রচলিত হয়ে গেলো। লাতিন শব্দ Haereticus মানে পছন্দ। যারা খৃস্টের আসল ইতিহাসটা পছন্দ করতো, তারাই ছিলো পৃথিবীর প্রথম ধর্মবিরোধী বা heretic।

    ইতিহাসবেত্তাদের জন্য সৌভাগ্যের ব্যাপার হলো, টিবিং বললেন, কনস্টানটিন যেসব গসপেল নিশ্চিহ্ন করেছিলেন, সেগুলোর কিছু কিছু টিকে গিয়েছিলো। ডেড সি ফুল বা পুঁথি, ১৯৫০ এর দশকে আবিষ্কৃত হয়েছিলো যা জুদিয়ান মরুভূমির কাছে কামরানের একটি গুহায় লুকিয়ে রাখা ছিলো। আর অবশ্যই, ১৯৪৫ এ নাগ হাম্মাদিতে প্রাপ্ত কপটিক্ স্কুলটা তো আছেই। এইসব দলিলে খৃস্টকে একজন মানুষ হিসেবেই বিবৃত করা হয়েছে। অবশ্য, ভ্যাটিকান তাদের ঐতিহ্য অনুসারে চেষ্টা করেছে এই ফুলগুলো যাতে প্রকাশিত না হয়। আর কেনই বা তারা সেটা করবে না। দলিলগুলোতে যে তথ্য আছে, তাতে স্পষ্টতই বোঝা যায় যে, বাইবেল সম্পাদিত এবং সংস্করণকৃত করা হয়েছিলো মানুষ কর্তক, যার ছিলো একটি রাজনৈতিক এজেন্ডা-মানুষ যিশুকে দেবত্ব আরোপ করে, তার প্রভাবকে ব্যবহার করার মাধ্যমে নিজেদের ক্ষমতাকে সুদৃঢ় করা।

    তারপরও, ল্যাংডন পাল্টা বলতে লাগলো, এটা মনে রাখা গুরুত্বপূর্ণ যে, আধুনিক চার্চ এইসব দলিলগুলোকে বিশ্বাস না করে নিজেদের বিশ্বাসেই অটল রয়েছে। ভ্যাটিকান মনে করে, এসব দলিল বানোয়াট এবং মিথ্যা।

    টিবিং সোফির বিপরীতে একটা চেয়ারে বসেছিলেন, তিনি চুক চুক করে একটা শব্দ করলেন। আপনি দেখতেই পারছেন, আমাদের অধ্যাপক সাহেব রোমের ব্যাপারে আমার চেয়ে বেশিই নরম। তারপরও, তিনি ঠিক বলেছেন। আধুনিক চার্চ এসবকে বানোয়াট বলেই বিশ্বাস করে একটা বোধগম্য কারণেই। কনস্টানটিনের বাইবেলটা দীর্ঘদিন ধরে তাদের কাছে সত্য বলে পরিগণিত হয়ে আসছে। কেউই প্রবর্তকারীর চেয়ে কেউ বেশি প্রবর্তন করতে পারে না।

    এর মানে হলো, ল্যাংডন বললো, আমরা আমাদের বাবাদের ঈশ্বরের আরধনা করি।

    আমি যা বলতে চাই, টিবিং সাথে সাথে বললেন। আমাদের বাবারা আমাদেরকে খৃস্ট সম্পর্কে যা বলে গেছেন তার প্রায় সবটাই মিথ্যা। হলি গ্রেইলের গল্পটাও সেরকমই।

    সোফি দা ভিঞ্চির বইয়ের সেই উক্তিটার দিকে তাকালো।

    টিবিং বইটা খুলে ভেতরের পাতায় গেলেন। আর শেষে, আপনাকে দা ভিঞ্চির আঁকা হলি গ্রেইলের ছবিটা দেখাবার আগে, আমি চাই আপনি এটা একটু দেখুন। তিনি বইয়ের একটা রঙ্গীন ছবির দিকে নির্দেশ করলেন, যা সমস্ত পাতা জুড়ে রয়েছে। আমার ধারণা আপনি এই ফ্রেসকোটা চিনতে পেরেছেন?

    উনি ঠাট্টা করছেন, তাই না? সোফি সর্বকালের সবচাইতে বিখ্যাত ফ্রেসকোটার দিকে চেয়ে আছে–দ্য লাস্ট সাপার–মিলানের সান্তা মারিয়া দেল গ্রাজির দেয়ালে আঁকা দা ভিঞ্চির কিংবদন্তী চিত্রকর্মটা। ক্ষয়িষ্ণু ফ্রেসকোটাতে যিশু এবং তাঁর শিষ্যদের ছবি আছে, যখন যিশু ঘোষণা দিলেন যে, তাদের মধ্যেই একজন তার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করবে।

    আমি এই ফ্রেসকোটা চিনি।

    তাহলে, আপনি হয়তো আমাকে এই ছোট্ট খেলাটা খেলতে দেবেন? চোখ বন্ধ করুন।

    একটু ইতস্তত করে সোফি তার চোখ বন্ধ করলো।

    যিশু কোথায় বসে আছেন? টিবিং জিজ্ঞেস করলেন।

    মাঝখানে।

    ভালো। তিনি এবং তাঁর শিষ্যরা কি খাবার খাচ্ছেন?

    রুটি। অবশ্যই।

    চমৎকার। পানীয়?

    মদ। তারা মদ পান করেছিলো।

    খুব ভালো। শেষ প্রশ্ন। টেবিলে কয়টা মদের গ্লাস আছে?

    সোফি একটু থামলো, বুঝতে পারলো প্রশ্নটাতে চালাকি আছে। আর প্রাতরাশ সেরে যিশু তার মদে পেয়ালাটা তুলে নিয়ে শিষ্যদের সাথে ভাগাভাগি করলেন। একটা কাপ, সে বললো। চ্যালিস মানে পেয়ালা। খৃস্টের পেয়ালা। হলি গ্রেইল। যিশু একটা পেয়ালা দিয়েই মদ পরিবেশন করেছিলেন, একজন একজন করে, যেমনটি আধুনিক খৃস্টানরা কমিউনের সময় করে থাকে।

    টিবিং দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। চোখ খুলুন।

    সোফি চোখ খুললো। টিবিং দাঁত বের করে ইঙ্গিতপূর্ণ একটা হাসি হাসছেন। সোফি চোখ খুলেই ছবিটার দিকে তাকিয়ে দেখলো টেবিলে সবার জন্য একটা করে কাপ আছে, খৃস্টের জন্যও। তেরোটি কাপ। তারচেয়েও বড় কথা, কাপগুলো খুব ছোট। কাঁচের তৈরি। ছবিটাতে কোন পেয়ালা বা চ্যালিস নেই। কোন হলি গ্রেইল নেই।

    টিবিংয়ের চোখ পিট পিট করছে। একটু অদ্ভুত লাগছে, তাই না, বাইবেল এবং হলি গ্রেইলের কিংবদন্তীতে নিশ্চিতভাবেই হলি গ্রেইলের কথা বলা আছে। অদ্ভুত ব্যাপার হলো, দা ভিঞ্চি দৃশ্যত যিশুর কাপটা আঁকতে ভুলে গিয়েছিলেন।

    নিশ্চিতভাবেই, চিত্রকলার পণ্ডিতেরা এটা নোট করে নিতে পারেন।

    আপনি এটা জেনে আরো বেশি ঘাবড়ে যাবেন, যা বেশির ভাগ পণ্ডিতই, হয় ব্যাপারটা খেয়াল করেননি, অথবা এড়িয়ে গেছেন। এই ফ্রেসকোটা আসলে হলি গ্রেইলের রহস্যের মূলচাবিকাঠি। দা ভিঞ্চি সেটা দ্য লাস্ট সাপার-এ খোলাখুলিভাবেই দেখিয়েছেন।

    সোফি ছবিটার দিকে ভালো করে তাকিয়ে দেখলো। এই ফ্রেসকোটাতে কি বলা আছে, হলি গ্রেইল আসলে কি?

    কি না বলে বলুন, কে। হলি গ্রেইল কোন বস্তু নয়। এটা আসলে…একজন ব্যক্তি।

     

    ৫৬.

    সোফি টিবিংয়ের দিকে অনেকক্ষণ চেয়ে থেকে ল্যাংডনের দিকে তাকালো। হলি গ্রেইল একজন ব্যক্তি?

    ল্যাংডন সায় দিলো। আসলে, একজন নারী।

    সোফির ফ্যাঁকাশে চেহারাটা দেখে ল্যাংডন তার অবস্থাটা বুঝতে পারলো। সে যখন প্রথম এই তথ্যটা জানতে পেরেছিলো, তখন তারও এমন অবস্থা হয়েছিলো। সেই কথাটা তার মনে পড়ে গেলো।

    টিবিং এবার ল্যাংডনকে বললো, রবার্ট, হয়তো একজন সিম্বোলজিস্ট হিসেবে ব্যাপারটা আরো খোলাসা করে বলার সময় হয়েছে? তিনি টেবিলের কাছে গিয়ে একটা কাগজ তুলে নিয়ে সেটা ল্যাংডনের সামনের মেলে ধরলেন।

    ল্যাংডন তার পকেট থেকে একটা কলম বের করলো। সোফি, তুমি কি নারী পুরুষের আধুনিক আইকনের সাথে পরিচিত? সে অতিপরিচিত পুরুষ প্রতীকটা ♂ এবং নারী প্রতীকটা ♀ আঁকলো।

    অবশ্যই, সে বললো।

    এগুলো, সে খুব শান্ত কণ্ঠে বললো, নারী-পুরুষের আসল প্রতীক নয়। অনেকেই ভুল করে ধারণা করে যে, পুরুষ প্রতীকটা এসেছে বর্ম এবং বর্শা থেকে, যেখানে নারী প্রতীক প্রতিনিধিত্ব করে আয়নার প্রতিফলিত সৌন্দর্যকে। আসলে, প্রতীকগুলোর উৎস হলো প্রাচীন জ্যোর্তিবিদ্যার মঙ্গল গ্রহ আর ভেনাসের প্রতীকগুলো। আসল প্রতীকগুলো অনেক বেশি সরল ছিলো। ল্যাংডন কাগজের উপর আরেকটা আইকন আঁকলো।

    ^

    এই প্রতীকটা ছিলো পুরুষের, সোফিকে বললো। একটা আদিম পুরুষ লিঙ্গ।

    একদম যথার্থই বলা যায়, সোফি বললো।

    আসলটার মতোই, টিবিং বললেন।

    ল্যাংডন আবারো বলতে লাগলো। এই আইকনটা সাধারণভাবে রেড বা তলোয়ার নামে পরিচিত। আর এটা প্রতিনিধিত্ব করে আগ্রাসন এবং পুরুষত্ব। সত্যি বলতে কী, ঠিক এই পুরুষলিঙ্গের প্রতীকটা, আজকের দিনেও আধুনিক সেনাবাহিনীতে উচ্চতর র‍্যাংক নির্দেশ করতে ব্যবহার করা হয়ে থাকে।

    একদম ঠিক। টিবিং দাঁত বের করে হাসলেন। তোমার যতো বেশি লিঙ্গ থাকবে, ততো বেশি উচ্চ র‍্যাংক হবে।

    ল্যাংডন একটু বিব্রত হলো। নারী প্রতীকটার দিকে যাই, এটা একেবারে পুরুষেরটার বিপরীত। সে আরেকটা প্রতীক আঁকলো। এটাকে বলা হয় চ্যালিস বা পেয়ালা।

    V

    সোফি চোখ তুলে তাকালো, তাকে দেখে মনে হলো অবাক হয়েছে।

    ল্যাংডন বুঝতে পারলো, সোফি ব্যাপারটা ধরতে পেরেছে। চ্যালিস, সে বললো, একটা পেয়ালা বা আঁধারের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ। তারচেয়েও বড় কথা, এটার আকৃতি নারীর যোনীর মতো। এই প্রতীকটা নারীত্বের, মাতৃত্বের, আর উর্বরতার। ল্যাংডন এবার তার দিকে সরাসরি তাকালো। সোফি, কিংবদন্তী বলছে, হলি গ্রেইল হলো একটা চ্যালিস মানে, একটা পেয়ালা। পেয়ালা হিসেবে গ্রেইলের বর্ণনাটা আসলে হলি গ্রেইলের সত্যিকারের চরিত্রকে রক্ষা করার জন্যই। এজন্যেই বলা হয়, কিংবদন্তীতে চ্যালিসকে একটা রূপক হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে।

    একজন নারী, সোফি বললো।

    একদম ঠিক। ল্যাংডন হাসলো। বাস্তবিক, গ্রেইল হলো নারীত্বের প্রাচীন একটা প্রতীক। হলি গ্রেইল দিয়ে আসলে পবিত্ৰ-নারী এবং দেবীদের বোঝানো হয়েছে, যা বর্তমানে হারিয়ে গেছে। সত্যি বলতে কী, চার্চ সেটাকে নিশ্চিহ্ন করে ফেলেছে। নারীর শক্তি এবং নতুন জীবন উৎপাদন করার ক্ষমতাকে এক সময় খুব পবিত্র জ্ঞান করা হতো। কিন্তু, এটা পুরুষশাসিত চার্চ ব্যবস্থার জন্য হুমকি হয়ে দেখা দিয়েছিলো, আর সেজন্যেই পবিত্র নারীকে ডাইনী আখ্যা দিয়ে ভ্রষ্ট করা হয়েছিলো। ঈশ্বর নয়, বরং মানুষই, আদি পাপের স্রষ্টা, যেখানে বলা হয়েছে, হাওয়া আদমকে গন্ধম খাইয়ে স্বর্গচ্যুত করেছিলেন। নারী, এক সময়ের পবিত্র জন্মদাত্রী, শত্রু হয়ে গেলো।

    আমার আরো বলা দরকার, টিবিং দাবি করলো, নারীরা জীবন আনে এই ধারণাটি আসলে প্রাচীন ধর্মের ভিত্তি ছিলো। সন্তান জন্ম দেয়াটা রহস্যময় আর শক্তিশালী একটি ব্যাপার। দুঃখজনক যে, খৃস্টিয় দর্শন সিদ্ধান্ত নিয়েছিলো যে, নারীর সৃজন ক্ষমতাকে অবজ্ঞা করে, জীববিদ্যার সত্যকে অস্বীকার করে, পুরুষকে স্রষ্টা হিসেবে তুলে ধরা হবে। জেনিসিস বা সৃষ্টিতত্ত্ব আমাদেরকে বলছে, আদমের পাঁজর থেকে হাওয়া সৃষ্টি হয়েছে। নারী হয়ে গেলো পুরুষ থেকে উদ্ভূত একটি পাপী জীব। জেনিসিসের শুরুটা হলো দেবীদের সমাপ্তি।

    গ্রেইল হলো, ল্যাংডন বললো, বিস্মৃত দেবীর একটি প্রতীক। খৃস্টান ধর্মের আগমনে, প্রাচীন প্যাগান ধৰ্ম খুব সহজেই মৃত্যুবরণ করেনি! নাইটরা, যারা চ্যালিস অন্বেষণকারী হিসেবে বিবেচিত, তাঁরা চার্চের হাত থেকে নারীদেরকে বাঁচাতে অবতীর্ন হয়েছিলেন। চার্চ দেবীদের নিশ্চিহ্ন করা শুরু করেছিলো, অবিশ্বাসীদেরকে পুড়িয়ে মেরে, প্যাগানদের পবিত্র নারীকে নিষিদ্ধ করেছিলো তারা।

    সোফি মাথা ঝাঁকালো। আমি দুঃখিত, যখন তুমি বলছিলে, হলি গ্রেইল হলো একজন ব্যক্তি, আমি ভেবেছিলাম তুমি সত্যিকারের ব্যক্তিকেই বুঝিয়েছে।

    সত্যিকারেরই তো। ল্যাংডন বললো।

    যে কোন ব্যক্তি নয়, টিবিং উৎফুল্ল হয়ে বললেন, উত্তেজনায় দাঁড়িয়েই গেলেন। এমন একজন নারী, যিনি এমন শক্তিশালী একটা সিক্রেট ধারণ করছেন, যা প্রকাশ পেলে খৃস্টধর্মের মূল ভিত্তিটাই ধ্বংস হবার হুমকি রয়েছে!

    সোফিও দারুণ উত্তেজিত হয়ে উঠলো। এই নারী কি ইতিহাসে খুবই সুপরিচিত?

    অনেকটাই। টিবিং ক্রাচটা ধরে হলের দিকে এগোলেন। আমরা যদি পড়ার ঘরে যাই, তবে আমি আপনাকে দা ভিঞ্চির আঁকা তাঁর ছবিটা দেখাতে পারবো।

     

    দুই ঘর পরে, রান্না ঘরে, গৃহপরিচারক রেমি লেগালুদেচ টেলিভিশনের সামনে নিশ্চুপ দাড়িয়ে ছিলো। খবরে একজন নারী আর পুরুষের ছবি প্রচার করা হচ্ছিলো…ঠিক সেই দুজনের, একটু আগে রেমি যাদেরকে চা পরিবেশন করে এসেছে।

     

    ৫৭.

    জুরিখের ডিপোজিটরি ব্যাংকের বাইরে রোড-ব্লকের সামনে দাঁড়িয়ে, লেফটেনান্ট কোলেত ভাবতেই পারছে না তল্লাশীর ওয়ারেন্টটা নিয়ে আসতে ফশের এতো দেরি হচ্ছে কেন। ব্যাংকাররা নিশ্চিত কিছু একটা লুকাচ্ছে। তারা দাবি করছে, ল্যাংডন আর নেভু একটু আগে ব্যাংকে ঠিকই এসেছিলো, কিন্তু তাদের কাছে কোন একাউন্ট নাম্বার না থাকার দরুন তারা এখান থেকে ফিরে গেছে।

    তাহলে তাদেরকে ভেতরে একটু তল্লাশী করতে দিচ্ছে না কেন?

    অবশেষে, কোলেতের সেলুলার ফোনটা বেজে উঠলো। কলটা লুভরের কমান্ড পোস্ট থেকে এসেছে। সার্চওয়ারেন্ট কি পাওয়া গেছে? কোলেত জানতে চাইলো।

    ব্যাংকের কথা ভুলে যাও, লেফটেনান্ট, এজেন্ট তাকে বললো। আমরা একটা খোঁজ পেয়েছি। ল্যাংডন আর নেভু কোথায় লুকিয়ে আছে, ঠিক সেই অবস্থানটা খুঁজে পেয়েছি।

    কোলেত তার গাড়ির হুডের ওপর বসে পড়লো। তুমি ঠাট্টা করছো।

    মফশলের দিকে আমার কাছে একটা ঠিকানা আছে। ভার্সেইর কাছাকাছি সেটা।

    ক্যাপ্টেন ফশে কি সেটা জানে?

    এখন পর্যন্ত না। তিনি একটা গুরুত্বপূর্ণ কলে ব্যস্ত আছেন।

    আমি যাচ্ছি। তিনি ফু হতেই তাকে ফোন কোরো। কোলেত ঠিকানাটা দেখে লাফিয়ে উঠলো। ব্যাংক থেকে বের হতেই তার মনে হলো, কে ল্যাংডনদের অবস্থান খোঁজ করতে ডিসিপিজেকে বলেছিলো। এতে অবশ্য কিছু যায় আসে না।

    সে তার জীবনের সবচাইতে বড় এবং হাই প্রােফাইল গ্রেফতারটি করতে যাচ্ছে। কোলেত ওয়্যারলেসে পাঁচটা গাড়িকে তার সাথে আসতে বললো। কোন সাইরেন না, বুঝেছো। ল্যাংডন যেনো না জানে, আমরা আসছি।

     

    চল্লিশ কিলোমিটার দূরে, একটা কালো অদি গাড়ি, গ্রামীন পথ দিয়ে এসে একটা মাঠের ছায়ায় থামলো। সাইলাস গাড়ি থেকে বের হয়ে রট আয়রনের ফাঁক দিয়ে ভেতরের দিকে তাকালো। তার সামনে বিশাল একটা প্রাঙ্গণ। নিচের ঘরের বাতিগুলো সব জ্বলছে। এই সময়ে বাতি জ্বলা অদ্ভুতই বটে, সাইলাস ভাবলো, মুচকি হাসলো। টিচার তাকে যে তথ্য দিয়েছেন, সেটা একেবারে নিখুঁত। কি-স্টোনটা ছাড়া আমি এই বাড়ি থেকে সরছি না, সে প্রতীজ্ঞা করলো। আমি বিশপ এবং টিচারকে ব্যর্থ হতে দিতে পারি না।

    লোহা কাটার যন্ত্রটা পরীক্ষা করে দেখলো সে। বারগুলো কেটে, দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে পড়লো সে। তার ঊরুতে বাঁধা সিলিস বেল্টের যন্ত্রণা উপেক্ষা করেই কাজে নেমে গেলো। অস্ত্রটা হাতে নিয়ে সাইলাস সুবিশাল সবুজ চত্বরে পা ফেললো।

     

    ৫৮.

    টিবিংয়ের স্টাডিরুমের মতো কোন স্টাডিরুম সোফি, জীবনেও দেখেনি। একটা বিলাসবহুল অফিস কক্ষের চেয়েও সেটা ছয় কী সাতগুণ বড়। সায়েন্স ল্যাবরেটরি, আর্কাইভ-লাইব্রেরি এমনকি ইনডোর ফ্রি মার্কেটও এতো বড় নয়। তিনটা ঝাড় বাতি ঝোলানো আছে। ফ্লোরের টাইলস ঢাকা পড়ে গেছে ওয়ার্ক টেবিল, আর্ট-ওয়ার্ক, হস্ত শিল্প, আর অবিশ্বাস্যরকমের ব্যাপার হলো, বিপুল সংখ্যক ইলেক্ট্রনিক যন্ত্রপাতি–কম্পিউটার, প্রজেক্টোর, মাইক্রোস্কোপ, কপি-মেশিন এবং বিশাল একটা স্ক্যানার।

    আমি বল রুমটাকে বদলে নিয়েছি, টিবিং বললেন, তাঁকে দেখে মনে হলো মজা করছে। নাচার জন্য আমার হাতে খুব কম সময়ই থাকে।

    সোফির মনে হলো, রাতটা যেনো এক ধরনের গোধূলির মতো, যেখানে তার প্রত্যাশার কিছুই ঘটছে না। এ সবই আপনার কাজের জন্য?

    সত্য জানাটা আমার জীবনের প্রেম হয়ে গেছে, টিবিং বললেন। আর স্যাংগৃল হলো আমার প্রিয় রক্ষিতা।

    হলি গ্রেইল হলো একজন নারী, সোফি ভাবলো, তার মাথায় এসব কিছুই ঢুকছিলো না। আপনি বলছেন, আপনার কাছে এই নারীর ছবিটা আছে যাকে আপনি দাবি করছেন হলি গ্রেইল হিসেবে।

    হ্যাঁ, কিন্তু তিনি যে হলি গ্রেইল, সেটা আমার দাবি নয়। খৃস্ট নিজে সেটা দাবি করেছেন।

    কোন ছবিটা? সোফি জিজ্ঞেস করলো, দেয়ালগুলো ভালো করে দেখে নিলো।

    উম-ম-ম… টিবিংকে দেখে মনে হলো, তিনি সেটা ভুলে গিয়েছিলেন। হলি গ্রেইল। স্যাংগৃল। চ্যালিস। তিনি আচমকা ঘুরে দূরের একটা দেয়ালের দিকে ইঙ্গিত করলেন। সেখানে আট ফুট দীর্ঘ দ্য লাস্ট সাপার-এর একটা প্রিন্ট টাঙানো রয়েছে। ঠিক এই ছবিটাই, একটু আগে সোফি দেখেছে। এইতো সে!

    সোফি নিশ্চিত, সে কিছু একটা ধরতে পারছে না। এই ছবিটাই তো আপনি আমাকে একটু আগে দেখিয়েছেন।

    তিনি মুচকি হাসলেন। আমি জানি, কিন্তু বড়টা আরো বেশি মজার এবং কৌতূহলোদ্দীপক। আপনার কি মনে হয় না?

    সোফি সাহায্যের জন্য ল্যাংডনের দিকে ঘুরলো। আমি ধরতে পারছি না।

    ল্যাংডন হাসলো। হলি গ্রেইলটা দ্য লাস্ট সাপার-এর মধ্যেই আবির্ভূত হয়েছে। লিওনার্দো তাকে খুব ভালোভাবেই অন্তর্ভূক্ত করেছেন।

    দাঁড়াও, সোফি বললো। তুমি বলছো হলি গ্রেইল হলো একজন নারী। দ্য লাস্ট সাপার হলো তেরো জন পুরুষের একটা ছবি।

    তাই কি? টিবিং তার ভূরু কপালে তুললেন। একটু ভালো করে দেখুন তো।

    একটু ইতস্তত করে সোফি ছবিটার কাছে গেলো, তেরোটি অবয়ব ভালো করে দেখে নিলো যিশু খৃস্ট মাঝখানে, ছয় জন শিষ্য তাঁর বাম দিকে, আর বাকি ছয় জন ডান দিকে। তারা সবাই পুরুষ, সে নিশ্চিত হয়ে বললো।

    ওহ্? টিবিং বললেন। প্রভুর ডান দিকের সম্মানের জাগাটাতে, যিনি বসে আছেন, তার ব্যাপারে?

    সোফি যিশুর ডান দিকে বসা চরিত্রটা ভালে করে পরীক্ষা করে দেখলো। খুতিয়ে খুতিয়ে দেখতে লাগলো সে। চরিত্রটার মুখ আর শরীর ভালো করে দেখতেই বিস্ময় জেগে উঠলো তার মধ্যে। চরিত্রটার চুল লাল, খুবই সরু ভাঁজ করা দুটো হাত। আর বুকের কাছে স্তনের আভা। এটা, নিঃসন্দেহে…একজন নারী।

    এটাতো একজন নারী! সোফি বিস্ময়ে বলে উঠলো।

    টিবিং হাসতে লাগলেন, খুব অবাক হয়েছেন, তাই না। বিশ্বাস করুন, এটা ভুল করে হয়নি। লিওনার্দো নারী-পুরুষ আঁকার বেলায় খুবই দক্ষ ছিলেন, গুলিয়ে ফেলার প্রশ্নই আসে না।–

    সোফি যির পাশে বসা রমণীর দিক থেকে চোখ ফেরাতেই পারছিলো না। দ্য লাস্ট সাপার তো তেরো জন পুরুষের ছবি হবার কথা। এই মেয়েটা তবে কে? যদিও সোফি এই ক্লাসিক ছবিটা বহুবার দেখেছে, কিন্তু এই জিনিসটা একদমই খেয়াল করেনি।

    সবাই মিস্ করে, টিবিং বললেন। আমাদের পূর্বচিন্তা এই ছবিটার বেলায় এতো শক্তিশালী যে, ছবিটা দেখার সময় আমাদের চোখের উপর সেটা সেঁটে থাকে।

    এটা Scotona হিসেবে পরিচিত, ল্যাংডন পাশ থেকে বললো। খুব শক্তিশালী প্রতীকের বেলায় মস্তিষ্ক এরকমটি করে থাকে।

    এই মেয়েটাকে ধরতে না পারার আরেকটা কারণ আছে, টিবিং বললেন, সেটা হলো, মূল ছবিটা থেকে বেশির ভাগ ফটোগ্রাফই ১৯৫৪ সালের আগে তোলা। তখন পর্যন্ত ছবিটা অষ্টাদশ শতকের এক শিল্পীর তুলির আঁচরে, কতগুলো পরতে ঢাকা ছিলো। এখন, এই ফ্রেসকোটা পরিষ্কার করে দা ভিঞ্চির সত্যিকারের ছবিটা তুলে আনা হয়েছে। ছবিটার দিকে ঘুরলেন তিনি। এত ভইলা?

    সোফি ছবিটার আরো কাছে গেলো। যিশুর ডান দিকে বসা নারীটা অল্প-বয়স্কা এবং দেখতে ধার্মিক। নম্র মুখ আর সুন্দর লাল চুল, হাতগুলো সুন্দর করে ভাঁজ করে রাখা এটাই কি সেই নারী, যে একাই চার্চকে নাড়িয়ে দিতে পারে?

    কে সে? সোফি জিজ্ঞেস করলো।

    এটা হলো, মাইডিয়ার, টিবিং জবাব দিলেন, ম্যারি মাগদালিন।

    সোফি চমকে উঠলো। বারবণিতা?

    টিবিং ছোট্ট করে একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেললেন, যেনো কথাটাতে তিনি ব্যক্তিগতভাবে আহত বোধ করলেন। মাগদালিন সেরকম কিছু ছিলেন না। এই দুঃখজনক ভুল ধারণাটি শুরুর দিকে চার্চই ছড়িয়েছে। চার্চের দরকার ছিলো ম্যারি মাগদালিনকে ভ্রষ্টা হিসেবে হেয়প্রতিপন্ন করার, যাতে ঢাকা পড়ে যায় তার বিপজ্জনক সিক্রেটটা হলি গ্রেইল হিসেবে তার ভূমিকা।

    তাঁর ভূমিকা?

    যেমনটি আমি বলেছি, টিবিং পরিষ্কার করে বললেন, শুরুর দিকে চার্চের দরকার ছিলো বিশ্ববাসীকে এটা জানানো যে, পয়গম্বর যিশু আসলে স্বর্গীয় স্বত্তা। তাই, যেসব গসপেলে যিশুকে মর্ত্যের মানুষ হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছিলো, সেগুলো বাইবেল থেকে বাদ দিয়ে দেয়া হয়েছিলো। কিন্তু প্রথম দিককার পরিমার্জনাকারীদের জন্য যেটা দুর্ভাগ্য, তাহলো, একটা পার্থিব বিষয়ের গসপেল বাইবেলে রয়ে গিয়েছিলো। ম্যারি মাগদালিন। বিরতি দিলেন তিনি। আরো ভালো করে বলতে গেলে বলতে হয়, যিশুর সাথে তার বিয়ে।

    ক্ষমা করবেন, কী বললেন? সোফি ল্যাংডনের দিকে চেয়ে আবার টিবিংয়ের দিকে ফিরলো।

    এটা ঐতিহাসিক রের্কডের ব্যাপার, টিবিং বললেন, আর দা ভিঞ্চি এ ব্যাপারে পুরোপুরি জ্ঞাত ছিলেন। দ্য লাস্ট সাপার-এ, নির্দিষ্ট করে বলতে গেলে, চিৎকার করে জানান দিচ্ছে যে, যিশু আর মাগদালিন ছিলেন স্বামী-স্ত্রী।

    সোফি আবারো ফ্রেসকোটার দিকে তাকালো।

    খেয়াল করে দেখুন, যিশু যে পোশাকটা পড়েছেন, তার মিরর ইমেজের পোশাক পড়েছেন মাগদালিন। টিবিং ছবিটার মাঝখানে বসা দুজনের দিকে ইঙ্গিত করলেন।

    সোফি হতবিহ্বল হয়ে গেলো। এটা নিশ্চিত যে, তাদের দুজনের পোশাকের রঙই উল্টো করে সাজানো আছে। যিশু পড়ে আছেন লাল রঙের রোব এবং নীল রঙের ক্লোক, ম্যারি পড়েছেন নীল রঙের রোব, এবং লাল ক্লোক। ইন এবং ইয়াং।

    আরো অদ্ভুত কিছুতে প্রবেশ করা যাক, টিবিং বললেন, খেয়াল করুন, যিশু এবং তাঁর বধুকে দেখে মনে হচ্ছে যেনো ঊরুর দিক থেকে ঘেষে আছেন তাঁরা, আর একে অন্যের দিকে এমনভাবে হেলে আছেন, যেনো তাদের মধ্যেকার নেগেটিভ স্পেসটা একটা নক্সা তৈরী করে ফেলেছে।

    টিবিং সোফিকে সেটা দেখাবার আগেই, সোফি নিজেই ওটা দেখতে পেলো— তর্কাতীতভাবেই, ছবিটার মাঝখানে এই V আকৃতিটা আছে। ল্যাংডন একটু আগেই বলেছিলো, এটা হলো, নারীর যোনীর প্রতীক।

    অবশেষে  টিবিং বললেন, আপনি যদি যিশু আর মাগদালিনকে মানুষ হিসেবে দেখে, কম্পােজিশনাল এলিমেন্ট হিসেবে দেখেন, তাহলে দেখতে পাবেন আরেকটা আকৃতি। একটু থামলেন তিনি। ইংরেজি বর্ণমালার একটা অক্ষর।

    সোফি সঙ্গে সঙ্গেই সেটা দেখতে পেলো। অক্ষরটার পুরোটা হঠাৎ করেই সে দেখতে পেলো। ছবিটার মাঝখানে, প্রশ্নাতীতভাবেই একটা বড়সড় M অক্ষর দেখা যাচ্ছে।

    কাকতালীয় বললে খুব বেশিই বলা হবে, অক্ষরটা খুবই নিখুঁত, আপনি কি বলেন? টিবিং বললেন।

    সোফি খুবই রোমাঞ্চিত হলো। এটা এখানে কেন?

    টিবিং কাঁধ ঝাঁকালেন। ষড়যন্ত্র তাত্ত্বিকের দল বলবে, এটা দিয়ে বোঝানো হয়েছে Matrimonio বা বিবাহ, অথবা ম্যারি মাগদালিন। সত্যি বলতে কী, কেউই নিশ্চিত করে বলতে পারে না। নিশ্চিত করে যা বলা যায়, তাহলো, লুকানো M-টা ভুল করে দেয়া হয়নি। গ্রেইল সম্পর্কিত অসংখ্য কাজে লুক্কায়িত M রয়েছে হয় জলছাপে, ছবির নিচে, কিংবা কম্পােজিশনাল প্রহেলিকার মাধ্যমে। সবচাইতে আলোচিত M টা লন্ডনের Our Lady of Paris-এর বেদীতে চিত্রিত করা আছে, যা প্রায়োরিদের এক সাবেক গ্র্যান্ড মাস্টার জ কতো ডিজাইন করেছিলেন।

    সোফি তথ্যটা জানতো। আমি মানছি, লুক্কায়িত M হলো কৌতূহলদীপক, তারপরও বলা যায়, কেউ এমন দাবি করছে না যে, সেটা যিশু এবং মাগদালিনের বিয়ের প্রমাণ।

    না, না, টিবিং বললেন, পাশের একটা টেবিলে রাখা বইয়ের দিকে গেলেন। আমি আগেই বলেছি, যিশু এবং মাগদালিনের বিয়ের ব্যাপারটা ঐতিহাসিক রেকর্ডের অংশ। তিনি বইটা ওল্টাতে লাগলেন। তারচেয়েও বড় কথা, বাইবেলের বর্ণিত অবিবাহিত যিশুর চেয়ে, বিবাহিত যিশুই আমাদের কাছে বেশি মানানসই বলে মনে হয়।

    কারণ, যিশু একজন ইহুদি ছিলেন, টিবিং যখন বইয়ের পাতা ওল্টাচ্ছিলেন সেই ফাঁকে কথাটা ল্যাংডন বললো। সেই সময়কার সামাজিক প্রেক্ষাপটে, একজন ইহুদি পুরুষের পক্ষে অবিবাহিত থাকাটা প্রায় অসম্ভব ছিলো। ইহুদি রীতি মতে, কুমার থাকাটা নিন্দনীয়। একজন ইহুদি বাবার জন্য নিজের ছেলের উপযুক্ত একজন স্ত্রী খুঁজে দেয়াটা বাধ্যতামূলক ছিলো। যদি যিশু অবিবাহিত থাকতেন, তবে কমপক্ষে একটি গসপেলেও সেটার উল্লেখ থাকতো।

    টিবিং বড়সড় একটা বই খুঁজে পেয়ে সেটা তুলে আনলেন তাদের সামনের টেবিলে। চামড়ায় বাঁধানো বইটার মলাটে লেখা আছে : The Gnostic Gospels. টিবিং সেটা খুললেন। ল্যাংডন আর সোফি তাঁর পাশে এসে দাঁড়ালো। সোফি দেখে বুঝতে পারলো, পৃষ্ঠাগুলো কোন প্রাচীন পুঁখির বড় করে তোলা ছবিতে পূর্ণ লেখাগুলো হাতের লেখা। প্রাচীন ভাষাটা সে চিনতে পারলো না, কিন্তু পরের পৃষ্ঠায় সেগুলোর টাইপ করা অংশ ছাপা আছে। সেগুলো অনুবাদ করা।

    এগুলো নাগ হাম্মাদি এবং ডেড সি স্কুলের ফটোকপি, যা আমি আগেই উল্লেখ করেছিলাম। টিবিং বললেন। খৃস্টধর্মের প্রাথমিক সময়ের রেকর্ড। সমস্যার কথা হলো, এগুলো বাইবেলের গসপেলের সাথে মেলে না।

    টিবিং একটা প্যারার দিকে ইঙ্গিত করলেন। ফিলিপ-এর গসপেলটাই শুরুর জন্য সবসময় ভালো।

    সোফি সেটা পড়লো :

    আর ত্রাণকর্তার সঙ্গীনী হলেন ম্যারি মাগদালিন। খৃস্ট তাঁকে বাকি সব শিষ্যদের চেয়েও বেশি ভালোবাসেন এবং প্রায়ই তার ঠোঁটে চুমু খান। বাকি শিষ্যরা এতে ক্ষিপ্ত হয়ে নিজেদের আপত্তির কথা জানালো। তারা তাকে বললো, আপনি কেন তাকে আমাদের চেয়েও বেশি ভালোবাসেন?

    কথাগুলো সোফিকে দারুণ অবাক করলো। তারপরও, সেগুলো থেকে কোন উপসংহার টানা যায় না। এখানে বিয়ের কোন কথা বলা হয়নি।

    অউ কনত্রেয়ার। টিবিং হাসলেন। প্রথম লাইনটার দিকে ইঙ্গিত করলেন। যেকোন আরামাই পণ্ডিতই আপনাকে বলে দেবে যে, সেসব দিনে সঙ্গীনী শব্দটি আক্ষরিক অর্থে স্ত্রী হিসেবেই ব্যবহৃত হোত।

    সোফি আবারো প্রথম লাইনটা পড়লো। আর ত্রানকর্তার সঙ্গীনী হলো ম্যারি মাগদালিন।

    টিবিং আরো অনেক প্যারা সোফিকে দেখালেন, যাতে এই কথাটার সত্যতা পাওয়া যায়। এসব প্যারাগুলো পড়তে পড়তে সোফির মনে পড়ে গেলো সেই ক্ষেপে যাওয়া যাজকের ঘটনাটির কথা, যে তার দাদুর দরজায় জোরে জোরে আঘাত করেছিলো, সোফি তখন স্কুলে যায়।

    এটা কি জ্যাক সনিয়ের বাড়ি? ছোট্ট সোফি যখন দরজাটা খুলেছিলো, যাজক লোকটা তখন নিচু হয়ে তার দিকে তাকিয়ে জানতে চেয়েছিলো। আমি তার সাথে এই সম্পাদকীয়টা নিয়ে কথা বলতে চাই, এটা উনি লিখেছেন। যাজক লোকটার হাতে একটা সংবাদ পত্র ছিলো।

    সোফি তার দাদুকে ডেকে দিলে, দুজনে স্টাডিরুমে দরজা বন্ধ করে আলাপে ব্যস্ত হয়ে গিয়েছিলেন। আমার দাদ পত্রিকায় কিছু লিখেছে? সোফি সঙ্গে সঙ্গে রান্নাঘরে দৌড়ে গিয়ে, সকালের পত্রিকাটা হাতে তুলে নিয়ে দেখেছিলো। দ্বিতীয় পৃষ্ঠায় সে তার দাদুর নাম লেখা একটা প্রবন্ধ দেখতে পেলো। সে ওটা পড়লো। কিছুই বুঝতে পারলো না, কী লেখা আছে। কিন্তু এটুকু বুঝলো যে, ফরাসি সরকারকে পাদ্রীরা চাপ দিচ্ছে একটা আমেরিকান ছবি দ্য লাস্ট টেম্পটেশন অব ক্রাইস্ট-কে নিষিদ্ধ করার জন্য। যাতে দেখানো হয়েছে, যিশু ম্যারি মাগদালিন নামের এক রমনীর সাথে সঙ্গম করছেন। তার দাদুর প্রবন্ধে বলা আছে যে, চার্চ খুব বেশি উগ্র আচরণ করছে আর তারা নিষিদ্ধ করার ব্যাপারেও ভুল করছে।

    এতে কোন ভুল নেই যে, যাজক লোকটি ছিলো পাগল। সোফি ভেবেছিলো।

    এটা পর্নোগ্রাফি! জঘন্য! যাজক লোকটি চিৎকার করে বলেছিলো। স্টাডি রুম থেকে হনহন করে বের হয়ে দরজার দিকে যেতে যেতে বলেছিলো, আপনি এটা কীভাবে বললেন! এই মার্টিন স্করসিজ আমেরিকানটা একজন ব্লাসফেমার। চার্চ তাকে কখনও ফ্রান্সে ঢুকতে দেবে না। যাজক ধপাস করে দরজা খুলে বের হয়ে গিয়েছিলো।

    তার দাদু বাইরে এসে দেখে সোফির হাতে পত্রিকাটা ধরা। খুব জলদি করে ফেলেছে।

    সোফি জিজ্ঞেস করেছিলো, তুমি কি মনে করো, যিশুর বান্ধবী ছিলো?

    না, ডিয়ার, আমি বলেছি, আমরা কোন্ বিনোদনটা গ্রহণ করবো, আর কোটা করবো না, সেটা চার্চের ঠিক করে দেয়াটা উচিত হবে না।

    যিশুর কি বান্ধবী ছিলো?

    তার দাদু কয়েক মুহূর্ত নিরব ছিলেন। থাকলে কি তিনি খারাপ হয়ে যাবেন?

    সোফি একটু ভেবে, কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলেছিলো, আমি অবশ্য এতে কিছু মনে করবো না।

     

    স্যার লেই তখনও কথা বলে যাচ্ছিলেন। যিশু আর মাগদালিনের বিয়ে সংক্রান্ত অসংখ্য রেফারেন্স দেখিয়ে আমি আপনাকে বিরক্ত করতে চাই না। এগুলো আধুনিক ইতিহাসের অংশ। আমি বরং আরেকটা প্যারা আপনাকে দেখাতে পারি। অন্য আরেকটা প্যারার দিকে ইঙ্গিত করলেন তিনি। এটা ম্যারি মাগদালিনের গসপেল থেকে নেয়া।

    সোফি জানতো না, মাগদালিনের নামেও একটা গসপেল রয়েছে। সে গসপেলটা পড়লো :

    আর পিটার বললো, ত্রাণকর্তা কি আমাদের অগোচরে কোন রমনীর সাথে কথা বলেছেন? আমরা কি তার দিকে ঘুরবো, তার সব কথা শুনবো? তিনি কি সেটা পছন্দ করবেন?
    আর লেভি জবাব দিলো, পিটার, তুমি সব সময়ই রগচটা। এখন আমি দেখতে পাচ্ছি, তুমি একজন নারীর বিরুদ্ধে প্রচারণায় নেমেছে। যদি ত্রাণকর্তা তাকে গ্রাহ্য করে, তবে তুমি কে, তাকে প্রত্যাখান করছো? নিশ্চিতভাবেই ত্রাণকর্তা তাকে ভালো করেই চেনেন। এজন্যেই, তিনি তাকে আমাদের চেয়েও বেশি ভালোবাসেন।

    যে নারী সম্পর্কে তারা কথা বলছে, টিবিং বুঝিয়ে বললেন, তিনি হলেন ম্যারি মাগদালিন। পিটার তাকে ঈর্ষা করতো।

    কারণ, যিশু ম্যারিকে পছন্দ করতেন?

    শুধু তাই না। তারচেয়েও বেশি কিছু। গসপেলের এই জায়গাটাতে, যিশু আশংকা করেছিলেন, খুব শীঘ্রই তাকে ধরে ক্রুশবিদ্ধ করা হবে। তাই যিশু মাগদালিনকে তাঁর চলে যাবার পর, তাঁর চার্চ কীভাবে চলবে, সে ব্যাপারে কিছু নির্দেশনা দিয়ে গিয়েছিলেন। এর ফলে, পিটার নিজেকে দ্বিতীয় ব্যক্তি হিসেবে অবমূল্যায়িত হয়েছেন বলে মনে করেছিলেন, তাও আবার একজন নারীর কাছে। আমি বলতে বাধ্য হচ্ছি, পিটার কিছুটা নারীবিদ্বেষী ছিলেন।

    সোফি বললো, এটা হলো সেন্ট পিটার। যিশুর চাচ নির্মাণ করেছিলেন যিনি।

    সবই ঠিক আছে, কেবল একটা বাদে। এইসব দলিল মতে, যিশু পিটারকে নয় বরং ম্যারি মাগদালিনকেই প্রথম বৃস্টিয় চার্চ নির্মানের জন্য দিক নির্দেশনা দিয়ে গিয়েছিলেন।

    সোফি তার দিকে তাকালো। তুমি বলছো, খৃস্টিয় চার্চ একজন নারী কর্তৃক নির্মিত হয়েছে?

    এটাই ছিলো পরিকল্পনা। যিশু ছিলেন প্রথম নারীবাদী। তিনি চেয়েছিলেন তাঁর চার্চের ভবিষ্যৎ ম্যারি মাগদালিনের হাতে ন্যস্ত হোক।

    আর এতে পিটার অসন্তুষ্ট হয়েছিলেন, ল্যাংডন বললো, দ্য লাস্ট সাপারের দিকে ইঙ্গিত করলো সে। এইতো পিটার, এখানে। তুমি দেখতেই পাচ্ছো, দা ভিঞ্চি এ ব্যাপারে খুবই সচেতন ছিলেন যে, পিটার মাগদালিনের ব্যাপারে কী মনোভাব পোষণ করতেন।

    আবারো সোফি বাকরুদ্ধ হয়ে গেলো। ছবিতে, পিটার ম্যারি মাগদালিনের দিকে ঝুঁকে আছে, আর তাঁর ছুরির মতো ধারালো আঙ্গুল ম্যারির ঘাড়ের দিকে তেড়ে আছে। একই ভঙ্গী ছিলো ম্যাডোনা অব দি রসে-ও!

    আর এখানেও আছে, ল্যাংডন বললো, পিটারের কাছে, শিষ্যদের ভীড়ের দিকে ইঙ্গিত করলো সে। এই হাতটা কি একটা চাকু ধরে আছে না?

    হ্যাঁ। অচেনা কেউ, তুমি যদি হাতগুলো গুণে দেখো, তবে দেখতে পাবে সেটা …কারোরই না। এটা অদৃশ্য কারোর। ছদ্মবেশী একজনের।

    সোফিকে দেখে মনে হলো বেশ উত্তেজিত। আমি দুঃখিত, আমি এখনও বুঝতে পারছি না, এসব দিয়ে কীভাবে বোঝা যায় যে, মারি মাগদালিন হলেন হলি গ্রেইল।

    আহা! টিবিং আবারো আতিশয্যে বললেন। এখানেই তো মজাটা লুকিয়ে আছে! আরেকটা বিশাল তালিকা বের করলেন তিনি। সেটা টেবিলের উপর ছড়িয়ে দিলেন। একটা বিশাল বংশ তালিকা। খুব কম লোকই বুঝতে পারে যে, ম্যারি মাগদালিন সেই সময়ে খুবই শক্তিশালী ছিলেন।

    সোফি এখন পরিবারের তালিকাটা দেখতে পেলো।

    বেনজামিনের গোত্র

    ম্যারি মাগদালিন হলেন এখানে, টিবিং বললেন। বংশ তালিকার উপরের দিকে নির্দেশ করলেন তিনি।

    সোফি খুব বিস্মিত হলো। তিনি বেনজামিনের বংশের ছিলেন?

    অবশ্যই, টিবিং বললেন। ম্যারি মাগদালিন ছিলেন রাজ বংশোদ্ভুত।

    কিন্তু, আমি জানতাম, মাগদালিন ছিলেন খুবই গরীব।

    টিবিং মাথা ঝাঁকালেন। মাগদালিনকে বেশ্যা হিসেবে প্রচার করা হয়েছিলো, যাতে তার শক্তিশালী পরিবারের ব্যাপারটা মুছে ফেলা যায়।

    ল্যাংডনও কথাটার সাথে সায় দিলো।

    সে টিবিংয়ের দিকে ফিরে বললো, কিন্তু মাগদালিন যদি রাজ বংশেরই হয়ে থাকে, তবে চার্চ কেন তাকে এতো পরোয়া করলো?

    ব্রাইটনটা হাসলেন। মাইডিয়ার, চার্চ ম্যারি মাগদালিনের রাজকীয় বংশ নিয়ে মাথা ঘামায়নি, তারা মাথা ঘামিয়েছিলো যিশুর সাথে তার সম্পর্কটা নিয়ে, যিশুও রাজ বংশের ছিলেন। আপনি হয়তো জানেন, বুক অব ম্যাথিউ বলছে, যিশু ছিলেন ডেভিডের বংশধর। মানে ইহুদিদে রাজা সোলেমানের বংশোদ্ভুত। বেনজামিনের বংশের কাউকে বিয়ে করার মধ্য দিয়ে যিশু দুটো রাজ বংশের রক্তের অধিকারী হয়ে উঠেছিলেন। এতে করে সম্ভাব্য রাজনৈতিক ঐক্য সাধিত হবার সম্ভাবনা দেখা দেয় আর সোলেমানের সময়ের মতো, আবারো একই বংশের লোক হিসেবে সিংহাসনের বৈধ দাবি দার হয়ে ওঠেন তিনি।

    সোফি বুঝতে পারলো, অবশেষে তিনি আসল জায়গায় এসেছেন।

    টিবিংকে আরো বেশি উত্তেজিত দেখাচ্ছে। হলি গ্রেইলের কিংবদন্তীটা আসলে রাজ বংশের রক্তধারার কিংবদন্তী। যখন গ্রেইল কিংবদন্তী বলে যিশুর রক্তের পেয়ালা বা চ্যালিস…তার মানে, সেটা ম্যারি মাগদালিন—যে নারীর যোনী যিশুর বংশকে ধারণ করেছে।

    কথাটা সোফির কাছে প্রতিধ্বনিত হতে লাগলো। মারি মাগদালিন যিশুর বংশধারাকে বহন করেছেন? কিন্তু যিশু কীভাবে বংশধর রেখে যাবেন, যদি না…? সে একটু থেমে ল্যাংডনের দিকে তাকালো।

    ল্যাংডন আততা করে হাসলো। যদি না তাদের কোন বাচ্চা-কাচ্চা না থাকে।

    সোফি উত্তেজনায় দাঁড়িয়ে গেলো।

    টিবিং যেনো ঘোষণা দিলেন, মানবেতিহাসের সবচাইতে বড় সিক্রেট। যিশু কেবল বিয়ে থা-ই করেননি, বরং তিনি একজন বাবাও ছিলেন। মাইডিয়ার, ম্যারি মাগদালিন ছিলেন একজন পবিত্র আধার!

    সোফির মনে হলো, তার হাতের পশমগুলো খাড়া হয়ে গেছে। কিন্তু, এরকম একটা সিক্রেট কি করে এতোদিন পর্যন্ত চেপে থাকলো?

    হায় ঈশ্বর! টিবিং বললেন। এটা মোটেও চেপে রাখা ছিলো না! যিশুর বংশ তালিকাই হলো সর্বকালের সেরা কিংবদন্তীর উৎস হলি গ্রেইল। মাগদালিনের গল্পটা শত শত বছর ধরে উচ্চারিত হয়েছে, বিভিন্নভাবে, বিভিন্ন কৌশলে। আপনি চোখ খুললেই দেখতে পাবেন, তাঁর গল্পটা চারিদিকেই আছে।

    আর স্যাংগৃল দলিল-দস্তাবেজগুলো? সোফি বললো। তারাও কি এই প্রমাণ দিচ্ছে যে, যিশুর বংশধর আছে?

    তারাও বলছে।

    তো, হলি গ্রেইলের পুরো কিংবদন্তীটা আসলে রাজবংশ সংক্রান্ত?

    আক্ষরিক অর্থে তাই। টিবিং বললেন। Sangreal শব্দটা এসেছে San Greal থেকে অথবা হলি গ্রেইল থেকে, কিন্তু সুপ্রাচীনকালে Sangreal শব্দটা দুটো ভাগে বিভক্ত ছিলো। টিবিং একটা কাগজে লিখে সেটা সোফির কাছে দিলেন।

    সোফি লেখাটা পড়লো।

    Sang Real

    সঙ্গে সঙ্গে, সোফি এটার অর্থটা ধরতে পারলো। Sang Real-এর আক্ষরিক অর্থ হলো Royal Blood, মানে, রাজকীয় রক্ত।

     

    ৫৯.

    নিউইয়র্কের লেক্সিংটনে অবস্থিত ওপাস দাইর সদর দফতরের লবিতে বসে থাকা পুরুষ রিসেপশনিস্ট, ফোনে বিশপ অরিঙ্গারোসার কণ্ঠটা শুনে অবাকই হলো। শুভ সন্ধ্যা, স্যার।

    আমার জন্য কোন ম্যাসেজ আছে? বিশপ জানতে চাইলেন, তার কণ্ঠে উদ্বিগ্নতা, যা সচরাচর দেখা যায় না।

    হ্যাঁ, স্যার। আপনি ফোন করাতে আমি খুব খুশি হয়েছি। আমি আপনার এপার্টমেন্টে যেতে পারিনি। আধ-ঘণ্টা আগে আপনার জন্যে একটা জরুরি ফোন ম্যাসেজ এসেছে।

    হ্যাঁ? কথাটা শুনে খুব স্বস্তি পেলেন বলে মনে হলো। কলার কি তার নাম বলেছে?

    না, স্যার, শুধু একটা নাম্বার দিয়েছে। অপারেটর নাম্বারটা বলে দিলো।

    প্রিফিক্স তেত্রিশ? এটাতো ফ্রান্সের, ঠিক বলছি না?

    হ্যাঁ, স্যার। প্যারিসের। কলার বলেছে, আপনাকে খুব দ্রুত যোগাযোগ করতে।

    ধন্যবাদ। আমি এই কলটার জন্য অপেক্ষা করছিলাম। আরিঙ্গাবোসা চট করে ফোনটা রেখে দিলেন।

    রিসেপশনিস্ট ফোনটা নামিয়ে রাখতেই ভাবলো, আরিঙ্গারোসার ফোন থেকে ঘর ঘর শব্দ আসছিলো কেন। বিশপের ডেইলি শিডিউল বলছে, তিনি এই সপ্তাহান্তে নিউ ইয়র্কেই আছেন, তারপরও শব্দ শুনে মনে হচ্ছিলো, বহু দূরে কোথাও আছেন। গত কয়েক মাস ধরে বিশপ আরিজারোসা খুবই অদ্ভুত আচরণ করছেন।

     

    আমার সেলুলার ফোনটা হয়তো কোন কল রিসিভ করছিলো না, রোমের সিয়ামপিনো চার্টার বিমানবন্দর থেকে ফিয়াটটা নিয়ে বের হতেই তিনি ভাবলেন। টিচার হয়তো আমার সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করেছিলেন। প্রত্যাশিত ফোন কলটা মিস্ করা সত্ত্বেও, আরিঙ্গারোসা খুবই উষ্ণু বোধ করলেন এই ভেবে যে, টিচার ওপাস দাইর সদর দফতরে সরাসরি ফোন করার মতো আত্মবিশ্বাসী ছিলেন।

    প্যারিসে হয়তো আজ রাতের সবকিছু খুব ভালো মতোই এগোচ্ছে। আরিঙ্গারোসা ফোন নাম্বারটা ডায়াল করতে করতে খুবই উত্তেজিত বোধ করলেন, হয়তো তিনি খুব শীঘ্রই প্যারিসে যাবেন। ভোর হবার আগেই সেখানে পৌঁছে যাবো। আরিজারোসার জন্য একটা চার্টার প্লেন অপেক্ষা করছে, ফ্রান্সে যাবার জন্য।

    ফোনটার রিং হতে লাগলো।

    একটা নারী কণ্ঠ জবাব দিলো, ডিরেকশন সেন্ট্রাল পুলিশ জুডিশিয়ার।

    আরিঙ্গাবোসা ইতস্তত করলেন। এটা খুবই অপ্রত্যাশিত। আহ্, হ্যাঁ,..আমাকে এই নাম্বারে ফোন করতে বলা হয়েছে?

    কুই এতৃ-ভু? মেয়েটা বললো। আপনার নাম?

    আরিঙ্গারো নাম বলতে ইতস্তত করলেন। ফরাসি জুডিশিয়ার পুলিশ।

    আপনার নাম, সিয়ে? মেয়েটা আবারো বললো।

    বিশপ ম্যানুয়েল আরিঙ্গাবোসা।

    উঁ মোমেস্ত। লাইনে একটা ক্লিক করে আওয়াজ হলো। দীর্ঘবিরতির পরে, আরেকজন লোকের গলা শোনা গেলো। তার কণ্ঠে বিচলিতভাব। বিশপ, শেষ পর্যন্ত আপনাকে পেয়ে আমি খুব খুশি। আপনার সাথে আমার অনেক কথা বলার আছে।

     

    ৬০.

    স্যাংগৃল…স্যাংগ রিয়েল…স্যান গৃল…রাজ বংশের রক্ত…হলি গ্রেইল।

    সবগুলোই, একটার সাথে আরেকটা সম্পর্কিত।

    হলি গ্রেইল হলো ম্যারি মাগদালিন … যিশুখৃস্টের সন্তানের মা। ল্যাংডন আর টিবিং যতোই টুকরো টুকরো প্রমাণগুলো জোড়া লাগাচ্ছে, ততোই এই পাজলটা বড় বেশি অননুমেয় হয়ে উঠছে।

    দেখতেই পাচ্ছেন, মাই ডিয়ার, টিবিং বললেন। একটা বইয়ের শেলফের দিকে ছুটে গেলেন তিনি। হলি গ্রেইল সম্পর্কে সত্যি কথাটা কেবল লিওনার্দো একাই বলার চেষ্টা করেননি। ঐতিহাসিকদের অনেকেই যিশুর বংশধরদের কথা উল্লেখ করে গেছেন। তিনি কয়েক ডজন বইয়ের ওপর আঙ্গুল বুলালেন।

    সোফি তার মাথাটা একটু উঁচু করে নামগুলো দেখলো :

    দ্য টেম্পলার রিভিলেশন :
    খৃস্টের সত্যিকারের পরিচয়ের শুপ্ত অভিভাবকগণ

    দ্য উইমেন উইথ দ্য এলাবাস্টার জার :
    ম্যারি মাগদালিন এবং হলি গ্রেইল

    গসপেলের দেবীরা :
    পবিত্র নারীর পুণঃদাবি

    সম্ভবত এটা সবচাইতে বেশি পরিচিত বই, টিবিং বললেন। শেফ থেকে একটা মোটা বই বের করে সোফির হাতে দিলেন।

    মলাটে লেখা আছে :

    হলি রাড, হলি গ্রেইল :
    আন্তর্জাতিক বেস্টসেলার হিসেবে স্বীকৃত

    সোফি খুব অবাক হলো, একটা আন্তর্জাতিক বেস্টসেলার? আমি এটার সম্পর্কে কখনও কিছু শুনিনি তো।

    আপনি তখন খুব ছোট ছিলেন। এটা উনিশশ আশির দিকে। আমার মতে, লেখকদের কিছু সন্দেহজনক বিশ্লেষণ থাকা সত্ত্বেও, অবশেষে তারা যিশুর বংশধরদের ব্যাপারটাকে মূলধারায় নিয়ে আসতে পেরেছে, এটাই তাদের কৃতিত্ব।

    এই বইটা সম্পর্কে চার্চের প্রতিক্রিয়া কি ছিলো?

    বলাই বাহুল্য, প্রচণ্ড ক্ষোভের। সেটা অবশ্য, প্রত্যাশিতই ছিলো। হাজার হোক, এটা এমন একটা সিক্রেট যা চতুর্থ শতকেই ভ্যাটিকান মাটি চাপা দিয়েছিলো। সেটা ক্রুসেডেরও একটা কারণ ছিলো। জড়ো করে তথ্য প্রমাণ ধ্বংস করা। প্রথম দিককার চার্চের পুরুষদের জন্য ম্যারি মাগদালিন ছিলেন বিশাল একটা হুমকি। তিনি যে কেবল যিশু কর্তৃক চার্চ প্রতিষ্ঠা করার আদেশই পেয়েছিলেন তাই নয়,বরং যিশু খৃস্টকে চার্চ যে অপার্থিব বলে দাবি করেছিলো সেটার বিরুদ্ধেও তিনি ছিলেন মূর্তিমান এক প্রমাণ। চার্চ নিজেকে রক্ষার জন্য রটিয়ে দেয় যে, মাগদালিন ছিলেন একজন বেশ্যা, আর এতে করে যিশুর সাথে তার বিয়ের ব্যাপারটা চার্চ ধামাচাপা দিতে পেরেছিলো। এজন্যেই যিশুর বংশধর থাকার সত্যটাকে চার্চ বিরোধীতা করে আসছে।

    সোফি ল্যাংডনের দিকে তাকালে সেও কথাটার সাথে সায় দিলো। সোফি, ঐতিহাসিক প্রমাণাদি এটার সত্যতা সম্পর্কেই সাক্ষ্য দেয়।

    আমি মানছি, টিবিং বললেন, ব্যাপারটা খুবই কঠিন, কিন্তু আপনি বুঝতেই পারছেন, সত্যটা ধামাচাপা দেবার ব্যাপারে চার্চের প্রচারণা কতোটা শক্তিশালী ছিলো। জনগণ যদি বংশধরদের ব্যাপারটা জানে, তবে তারা কখনই টিকে থাকতে পারবে না। যিশুর একজন সন্তান, চার্চের যিশু সম্পর্কিত অপার্থিব মানব বা স্বর্গীয়-সত্ত্বার দাবিটাকে বাতিল করে দেবে।

    পাঁচ পাপড়ির গোলাপ, সোফি বললো। আচমকাই টিবিংয়ের একটা বইয়ের দিকে ইঙ্গিত করলো সে। ঠিক এই নক্সাটাই রোজউড বাক্সে আছে।

    টিবিং ল্যাংডনের দিকে তাকিয়ে দাঁত বের করে হাসলেন। তার চোখ খুব ভালো। সোফির দিকে ফিরলেন এবার, এটা প্রায়োরিদের হলি গ্রেইলের প্রতীক। ম্যারি মাগদালিন। যেহেতু, তার নামটা চার্চ কর্তৃক নিষিদ্ধ ছিলো, তাই ম্যারিকে গোপনে অনেক ছদ্ম নামে ডাকা হোতো চ্যালিস, হলি গ্রেইল, এবং রোজ বা গোলাপ। একটু থামলেন। গোলাপের সাথে ভেনাসের পাঁচ-ভূজের পেনটাকলের মিল রয়েছে। তাছাড়া রোজ শব্দটা ইংরেজি, জার্মান, ফরাসি এবং আরো অনেক ভাষাতেই সুপরিচিত।

    রোজ বা গোলাপ, ল্যাংডন বললো। এটা গৃকের যৌন দেবতা Eros-এর একটা এনাগ্রামও বটে।

    টিবিংয়ের কথাটা শুনে সোফি ল্যাংডনের দিকে অবাক হয়ে তাকালো।

    গোলাপ সবসময়ই নারী যৌনতার প্রধান প্রতীক হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। প্রাচীন দেবী পূজায়, পাঁচ পাপড়ির গোলাপ নারী-জীবনের পাঁচটি অধ্যায়কে প্রকাশ করতো–জন্ম, মৃত্যু, ঋতুস্রাব, মাতৃত্ব এবং মেনোপোজ। আর আধুনিক যুগে ফুটন্ত গোলাপ নারীত্বের অনেক বেশি দৃষ্টিগ্রাহ্য ব্যাপারটার সাথে সংশ্লিষ্ট। কথাটা বলেই রবার্টের দিকে তাকালেন। সম্ভবত, সিম্বোলজিস্ট সাহেব সেটা ব্যাখ্যা করতে পারবেন?

    রবার্ট ইতস্তত করলো। নিশ্ৰুপ রইলো।

    ওহ্, ঈশ্বর! টিবিং কপট নিরাশা প্রকাশ করলেন। আপনারা, আমেরিকানরা খুব বেশি ভদ্র। সোফির দিকে ফিরলেন আবার। রবার্ট যে ব্যাপারটা নিয়ে ইতস্তত করছে, সেটা হলো, ফুটন্ত গোলাপ নারীর যোনর সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ। সেটার মধ্য দিয়েই এই পৃথিবীতে সব মানুষের আবির্ভাব ঘটে। আর আপনি যদি জর্জিয়া ওকিফির কোন চিত্রকর্ম দেখে থাকেন, তবে বুঝতে পারবেন, আমি কী বলতে চাচ্ছি।

    ব্যাপারটা হলো, ল্যাংডন বইয়ের শেফের দিকে তাকিয়ে বললো, এই সব বই-পুস্তক একটা ঐতিহাসিক দাবি কেই তুলে ধরে।

    যিশু একজন বাবাও ছিলেন।

    সোফি এখনও দ্বিধাগ্রস্ত।

    হ্যাঁ, টিবিং বললেন। আর মাগদালিনই হলেন তার বংশধরদের ধারক। প্রায়োরি অব সাইন, আজকের দিনে, এখনও, ম্যারি মাগদালিনকেই দেবী হিসেবে পূজা করে থাকে।

    সোফির আবারো বেসমেন্টে দেখা সেই ঘটনাটার কথা মনে পড়ে গেলো।

    প্রায়োরিদের মতে, টিবিং বলে চললেন। যিশুর ক্রুশবিদ্ধ হবার সময় ম্যারি মাগদালিন অন্তঃস্বত্তা ছিলেন। যিশুর অনাগত সন্তানের নিরাপত্তার খাতিরে, পবিত্র ভূমি ছেড়ে যাওয়া ছাড়া তার আর কোন উপায় ছিলো না। যিশুর বিশ্বস্ত চাচা, জোসেফ আরিমাথিয়ার সাহায্যে ম্যারি ফ্রান্সে পালিয়ে আসেন। তখন এ দেশটির নাম ছিলো গল। এখানে এসে তিনি ইহুদি সমাজে নিরাপদ আশ্রয় পেয়েছিলেন। ফ্রান্সেই তিনি এক কন্যা সন্তানের জন্ম দেন। তার নাম ছিলো সারাহ্।

    সোফি বিস্ময়ে চেয়ে রইলো। তারা বাচ্চাটার নামও জানতো?

    তার চেয়েও বেশি। মাগদালিন এবং সারাহ ইহুদিদের কাছে সুরক্ষিত ছিলো। মনে রাখবেন, মাগদালিনের সন্তান ইহুদিদের রাজা ডেভিড আর সোলেমানেরই বংশধর। সারার অসংখ্য বংশধরের নামের তালিকাও রয়েছে।

    সোফি আবারো বিস্মিত হলো। যিশুর পরিবারের বংশতালিকার অস্তিত্বও রয়েছে?

    অবশ্যই, স্যাংগৃল দলিল-দস্তাবেজের একটাতে খৃস্টের বংশধরদের প্রথম দিককার একটি পূর্ণাঙ্গ তালিকার কথা রয়েছে।

    খৃস্টের বংশধরদের তালিকায় কীই-বা এসে যায়? সোফি জিজ্ঞেস করলো। এটাতো কোন প্রমাণ হতে পারে না। ঐতিহাসিকরা এর বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে নিশ্চিত হতে পারবেন না।

    টিবিং মুচকি হাসলেন। তাহলে, বাইবেলের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়েও নিশ্চিত হওয়া যায় না।

    মানে?

    মানে হলো, ইতিহাস সবসময়ই বিজয়ী কর্তৃক লিখিত হয়ে থাকে। যেমনটি নেপোলিওন বলেছিলেন, ইতিহাস বিজয় গাথা ছাড়া আর কিছুই না। তিনি হাসলেন। ইতিহাসের চরিত্রই এমন যে, সেটা এক পক্ষকেই হিসাবের মধ্যে রাখে।

    সোফি কখনও এভাবে ভেবে দেখেনি।

    স্যাংগৃল দলিল-দস্তাবেজগুলো খৃস্টের অন্যদিকের গল্পটাই বলে। আপনি কোন্ দিকটার গল্প বিশ্বাস কবেন, সেটা আপনার বিশ্বাস এবং ব্যক্তিগত অভিরুচির ব্যাপার। স্যাংগৃল দলিলগুলো দশ-হাজার পৃষ্ঠার তথ্য সংবলিত। চাক্ষুষ করেছে যারা, তারা বলেছে, চারটা বড় ট্রাংকে করে সেগুলো বহন করা হয়েছিলো। এইসব ট্রাংককে পিউরিষ্ট ডকুমেন্ট নামে ডাকা হয়। হাজার হাজার পৃষ্ঠার প্রাক কনস্টানটিন যুগের দলিল। যিশুর প্রথম দিককার অনুসারীদের লেখায়, তাকে একজন পরিপূর্ণ মানুষের শিক্ষক এবং পয়গম্বর হিসেবেই বর্ণনা করা হয়েছে। আরো গুজব রয়েছে, দলিলগুলোর কিছু অংশ হলো Q দলিল–ভ্যাটিকানও এটার অস্তিত মেনে নিয়েছে। দাবি করা হয়, এটা যিশুর রচিত বই। সম্ভবত, তার নিজের হাতের লেখা।

    যির নিজের হাতের লেখা?

    অবশ্যই, টিবিং বললেন। কেন, যিশু তাঁর নিজের সময়ের কথা লিখবেন না? সেই সময়কার দিনে বেশিরভাগ লোকই তা করতো। আরেকটি আলোড়ন সৃষ্টিকারী দলিল হলো, মাগদালিন ডায়রিজমরি মাগদালিনের ব্যক্তিগত বিষয়, যিশুর সাথে তাঁর সম্পর্কের কথা, যি ক্রুশবিদ্ধ হওয়া, আর ফ্রান্সে তাঁর সময়ের কথা বিবৃত হয়েছে।

    সোফি কিছুক্ষণ নিরব রইলো। এই চার সিন্ধুক দলিল নাইট টেম্পলাররা সোলমানের মন্দিরের নিচ থেকে পেয়েছিলো?

    একদম ঠিক। এই দলিলগুলোই তাদেরকে অসম্ভব শক্তিশালী আর ক্ষমতাবান করেছিলো।

    কিন্তু আপনি বলেছেন যে, হলি গ্রেইল হলো ম্যারি মাগদালিন। যদি সবাই দলিলগুলো খোঁজ করে থাকে, তবে আপনি কেন সেটাকে হলি গ্রেইলের অন্বেষণ বলেছেন?

    টিবিং তার চোখের দিকে তাকালেন, তার অভিব্যক্তি একটু নরম বলে মনে হলো। কারণ, হলি গেইলের লুকানো জায়গায় একটা সমাধি-ফলকও রয়েছে।

    বাইরে প্রচণ্ড বাতাসের শব্দ শোনা গেলো।

    টিবিংকে এখন আরো বেশি শান্ত মনে হচ্ছে। হলি গ্রেইলের অনুসন্ধান মানে, আক্ষরিক অর্থে, ম্যারি মাগদালিনের হাড়-গোড়ের সামনে হাটু গেঁড়ে বসে প্রার্থনা করার অনুসন্ধান। সমাজচ্যুত একজনের পদতলে বসে প্রার্থনার পরিভ্রমণ করা। হারানো, বিস্মৃত পবিত্র এক নারী।

    সোফির মধ্যে অপ্রত্যাশিত একটা বিস্ময়ের উদয় হলো। হলি গ্রেইলের লুকিয়ে রাখা জায়গাটা আসলে…একটা সমাধি?

    টিবিংয়ের চোখ দুটো ঘোলাটে দেখালো। তাই। ম্যারি মাগদালিন এবং দলিলগুলোর একটা কবর।

    প্রায়োরির সদস্যরা, অবশেষে সোফি বললো। এতোগুলো বছর ধরে স্যাংগৃল দলিল আর মাগদালিনের সমাধিটা রক্ষা করে যাচ্ছে?

    হ্যাঁ, কিন্তু ভ্রাতৃসংঘের আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বও রয়েছে-বংশটাকে রক্ষা করা। খৃস্টের বংশধরেরা ক্রমাগত বিপদের মধ্যেই আছে। প্রথম দিকে, চার্চ আশংকা করতো, যদি যিশুর বংশধরদের খবরটা জানাজানি হয়ে যায়, তবে ক্যাথলিক মতবাদের মূল ভিত্তিটাই চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়ে যাবে—সর্গীয় ত্রাণকর্তা ঈসা মসীহ নারী সংস্পর্শে এসেছিলেন, বা যৌনকর্ম করেছিলেন। তিনি একটু থামলেন। তাসত্ত্বেও, পঞ্চম শতাব্দীতে ফরাসি রাজবংশের সাথে বৈবাহিক বন্ধনে আবদ্ধ হবার আগ পর্যন্ত খৃস্টের বংশ, ফ্রান্সে সঙ্গোপনেই বেড়ে উঠছিলো। যারা পরিচিত ছিলো মেরোভিনজিয়ান বংশ হিসেবে।

    এই কথাটা সোফিকে খুবই অবাক করলো। মেরোভিনজিয়ান এমন একটা শব্দ, যা প্রতিটি ফরাসি ছাত্রছাত্রীই জানে। মেরোভিনজিয়ানরাই প্যারিসের গোড়াপত্তন করেছিলো।

    হ্যাঁ, এজন্যেই, গ্রেইল কিংবদন্তী ফ্রান্সে এতো সমৃদ্ধ। ভ্যাটিকানের অনেক গ্রেইল অনুসন্ধানকারীই ফ্রান্সে এসে রাজবংশকে নিশ্চিহ্ন করার চেষ্টা করেছিলো। আপনি রাজা ডাগোবার্টের নাম শুনেছেন?

    সোফির মনে পড়ে গেলো সেই একঘেয়েমী ইতিহাসের ক্লাসের কথা। ডাগোবার্ট একজন মেরোভিনজিয়ান রাজা ছিলেন। তাই না? ঘুমন্ত অবস্থায়, চোখে ছুরির আঘাতের জন্য মারা গিয়েছিলেন?

    একদম ঠিক। সপ্তম শতাব্দীর শেষ দিকে পেপিন দি হেরিসটাইলের সহযোগীতায় ভ্যাটিকান এই গুপ্তহত্যা করেছিলো। ডাগোবার্টের হত্যার মধ্য দিয়ে মেরোজিনজিয়ান বংশ প্রায় নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছিলো। সৌভাগ্যবশত, ডাগোবার্টের ছেলে, সিগিসবার্ট, গোপনে পালিয়ে গিয়ে বংশধারাকে অক্ষুন্ন রাখতে সক্ষম হয়েছিলো। পরবর্তীতে সেই বংশেই জন্মেছিলেন গদফ্রোই দ্য বুইলো—প্রায়োরি অব সাইন-এর প্রতিষ্ঠাতা।

    এই লোকই, ল্যাংডন বললো। নাইট টেম্পলারদেকে সোলেমানের মন্দিরের নিচ থেকে স্যাংগৃল দলিলগুলো উদ্ধারের আদেশ দিয়েছিলেন, যাতে এটা প্রমাণ করা যায় যে, মেরোনিজিয়ানরা যিশুরই বংশধর।

    টিবিং সায় দিলেন। আধুনিক প্রায়োরিরা স্যাংগৃল দলিলগুলোকে রক্ষা করে থাকে। তাদেরকে ম্যারি মাগদালিনের কবরটাও রক্ষা করতে হয়। আর অবশ্যই, তাদেরকে যিশুর বংশধরদেরকেও রক্ষা করতে হয়—মেরোভিনজিয়ান বংশের যে কয়জন এখনও বেঁচে আছে, তাদেরকে।

    যিশুর বংশধরেরা, এই আধুনিক কালেও বেঁচে আছে? তার দাদুর কণ্ঠটা আবারো তার কানে ফিস ফিস করে বলে উঠলো। প্রিন্সেস, তোমার পরিবার সম্পর্কে সত্য কথাটা আমাকে বলতেই হবে।

    তার গায়ের রোম খাড়া হয়ে গেলো।

    রাজ বংশ।

    সে ভাবতেই পারছে না।

    প্রিন্সেস সোফি।

    স্যার সেই? গৃহপরিচারকের কণ্ঠটা দেয়ালের ইন্টারকম থেকে শোনা গেলো। সোফি একটু চমকে গেলো।

    আমাকে একটু রান্নাঘর থেকে আসতে হবে। টিবিং ইন্টারকমের কাছে গিয়ে বোতাম টিপলেন। রেমি, তুমিতো জানোই, আমি আমার অতিথিদের সঙ্গে ব্যস্ত আছি। আমাদের যদি রান্নাঘরে কিছু প্রয়োজন পড়ে, আমরা নিজেরাই সেটা নিয়ে নিতে পারবো। ধন্যবাদ তোমাকে, গুডনাইট।

    আমি চলে যাবার আগে, আপনার সাথে একটা কথা বলে যেতে চাই, স্যার।

    টিবিং তার কথা মেনে নিয়ে বোতাম টিপলেন। জলদি করো, রেমি।

    এটা গৃস্থালির ব্যাপার, স্যার, অতিথিদের সামনে বলাটা ঠিক হবে না।

    টিবিং একটু রু কুচকালেন। সকালের জন্য কি একটু অপেক্ষা করা যায় না?

    না, স্যার। আমার কথাটা বলতে মিনিট খানেক সময়ও লাগবে না।

    টিবিং চোখ দুটো গোল গোল করে ল্যাংডন আর সোফির দিকে তাকালেন। কখনও কখনও, আমার মনে হয়, কে কার চাকর? তিনি আবারো বোতাম টিপলেন। আমি আসছি, রেমি। তোমার জন্য কি কিছু নিয়ে আসবো?

    শুধু নিষ্পেষণ থেকে মুক্তি, স্যার।

    রেমি, তুমি বুঝতে পারছো, তোমার স্টিক অউ পোইভর-ই হলো একমাত্র কারণ, যার জন্যে তুমি এখনও আমার জন্যে কাজ করতে পারছে।

    যেমনটি আপনি বলছেন, স্যার, যেমনটি আপনি বলছেন।

    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleএঞ্জেলস এন্ড ডেমনস – ড্যান ব্রাউন
    Next Article রবিনসন ক্রুসো – ড্যানিয়েল ডিফো

    Related Articles

    ড্যান ব্রাউন

    এঞ্জেলস এন্ড ডেমনস – ড্যান ব্রাউন

    August 19, 2025
    ড্যান ব্রাউন

    দ্যা লস্ট সিম্বল – ড্যান ব্রাউন

    August 19, 2025
    ড্যান ব্রাউন

    অরিজিন – ড্যান ব্রাউন

    August 19, 2025
    ড্যান ব্রাউন

    ইনফার্নো – ড্যান ব্রাউন

    August 19, 2025
    ড্যান ব্রাউন

    ডিসেপশন পয়েন্ট – ড্যান ব্রাউন

    August 19, 2025
    ড্যান ব্রাউন

    ডিজিটাল ফরট্রেস – ড্যান ব্রাউন

    August 19, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo
    Most Popular

    রবিনসন ক্রুসো – ড্যানিয়েল ডিফো

    August 19, 2025

    অনুরাধা

    January 4, 2025

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    রবিনসন ক্রুসো – ড্যানিয়েল ডিফো

    August 19, 2025

    অনুরাধা

    January 4, 2025

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025
    Our Picks

    রবিনসন ক্রুসো – ড্যানিয়েল ডিফো

    August 19, 2025

    দ্য দা ভিঞ্চি কোড – ড্যান ব্রাউন

    August 19, 2025

    এঞ্জেলস এন্ড ডেমনস – ড্যান ব্রাউন

    August 19, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    Sign In or Register

    Welcome Back!

    Login below or Register Now.

    Lost password?

    Register Now!

    Already registered? Login.

    A password will be e-mailed to you.