Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    রবিনসন ক্রুসো – ড্যানিয়েল ডিফো

    August 19, 2025

    দ্য দা ভিঞ্চি কোড – ড্যান ব্রাউন

    August 19, 2025

    এঞ্জেলস এন্ড ডেমনস – ড্যান ব্রাউন

    August 19, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • 🔖
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    Subscribe
    সাইন ইন
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    দ্য ফারাও’স সিক্রেট – ক্লাইভ কাসলার ও গ্রাহাম ব্রাউন

    ক্লাইভ কাসলার এক পাতা গল্প435 Mins Read0

    ২১. দক্ষিণ লিবিয়া

    ২১. দক্ষিণ লিবিয়া

    পুরনো DC-3 বিমানের ককপিটটা থরথর করে কাঁপছে। মরুভূমির প্রায় পাঁচশো ফুট ওপর দিয়ে দুশো নট গতিতে চলাটা ওর বুড়ো হাড়ে সহ্য হচ্ছে না। পল ট্রাউট অনুমান করল হয় প্রপেলারগুলোর মধ্যে সমন্বয় নেই নয়তো ওগুলো সামান্য ভারসাম্যহীন। এগুলোর একটা যদি হঠাৎ করে খুলে নিচের মরুভূমিতে পড়ে যায় বা বন বন করতে করতে এই কেবিনের ভেতর-ই ঢুকে পড়ে তাহলে তাহলে যে কি হবে সেই ভাবনাতেই আতঙ্কিত হয়ে কাঠ হয়ে বসে আছে ও।

    যথারীতি গামায় এসব কোনো ব্যাপারেই ভয় পাচ্ছে না। সে বসেছে পাইলটের পাশের কো-পাইলটের সিটে। বাইরের মনোরম দৃশ্য উপভোগের পাশাপাশি এত নিচু দিয়ে এত জোরে উড়ে যাওয়ার কারণে দারুণ উত্তেজনা অনুভব করছে।

    ওদের নিমন্ত্রণ দাতা রেজাও পাইলটের সিটের পেছনে পলের সাথে বসা।

    “মাটির এতো কাছ দিয়ে এতো জোরে যাওয়ার কোনো দরকার আছে?” পল জিজ্ঞেস করল।

    “এভাবেই নিরাপদ বেশি, না হলে বিদ্রোহীরা গুলি করে এটাকে নামিয়ে ফেলবে।” রেজা জবাব দিল।

    পল অবশ্য এরকম কোনো জবাব আশা করেনি, “বিদ্রোহী?”

    “আমাদের দেশে এখনও হালকা-পাতলা গৃহযুদ্ধ চলছে। এখানে বেশ কিছু ভাড়াটে সৈন্যবাহিনী আছে। এরা মাঝে মাঝে আমাদের হয়ে কাজ করে, আবার মাঝে মাঝে আমাদের বিপক্ষে কাজ করে; বিদেশি গুপ্তচর দিয়ে দেশটা ভরে গেছে। মিসর, মুসলিম ব্রাদারগুড এমনকি গাদ্দাফির দলের লোকেরাও ক্ষমতার জন্য এখনও লড়েই যাচ্ছে। ইদানীং লিবিয়ায় খুব বেশি গণ্ডগোল চলছে।” রেজা ব্যাখ্যা করল।

    হঠাৎ পলের মনে হলো আরো একদিন তিউনিসিয়া থেকে গিয়ে বাড়ি ফিরে গেলেই ভালো হতো। এতোক্ষণে বারান্দায় বসে পাইপ টানতে টানতে রেডিও শুনতে পারতো। এভাবে জান হাতের মুঠোয় নিয়ে চলতে হতো না। “চিন্তা করবেন না। এতো পুরনো একটা বিমানে মিসাইল মারার মতো বোকামি ওরা করবে না। ওরা সাধারণত জায়গায় বসে রাইফেল দিয়ে গুলি করে। আর এখন পর্যন্ত একটা গুলিও লাগাতে পারেনি। রেজা আশ্বস্ত করার চেষ্টা করল। তারপর ককপিটের পিছনের কাঠের দেয়ালে টোকা দিল। DC-3 র মতো এই জিনিসটাও অন্য আরেক যুগের জিনিস। প্রায় পঞ্চাশ বছর ধরে লোকজন ককপিটে ঢোকা আর বের হওয়ার সময় এটায় পাড়া দিয়ে আসছে।

    বিমানের কন্ট্রোলও আগের মতোই আছে। ক্ষয় হয়ে যাওয়া। বিশাল লম্বা লম্বা কয়েকটা দণ্ড ইতস্তত বেরিয়ে আছে। যুগের পর যুগ ধরে কত পাইলট-ই না এগুলো ব্যবহার করে আসছে।

    পাইলটের হাতের স্টিয়ারিং মাঝখানে বাঁকা। গামায় এর সামনে যেটা আছে সেটার চেহারা অবশ্য একটু ভালো।

    “আমাদের গাড়িতে করে আসাই ভালো ছিল।” পল বলল।

    “ট্রাকে করে গেলে আট ঘণ্টা লাগতো আর আকাশ পথে মাত্র দেড় ঘণ্টা। আর ওপরের দিকে গরমও কম।” রেজা বলল।

    পল ঘড়ি দেখতে দেখতে ভাবলো বাপরে বাপ দেড় ঘণ্টা।” তবে ঘড়ি দেখে কিছুটা স্বস্তি ফিরলো মনে। যাক প্রায় চলে এসেছে।

    বাইরে বালির ভেতর প্রায়ই বিশাল বিশাল পাথর বের হয়ে আছে। দেখে মনে হয় যেনো সমুদ্র থেকে বিশাল কোনো দানব লাফ দিচ্ছে। আরো কিছু দূর দক্ষিণে যাওয়ার পর একটা লবণ ঘেরের মতো জায়গায় কয়েকটা চক্কর দিয়ে তারপর নামতে শুরু করল। জায়গাটা দেখে পলের মনে হলো কোনো তেল ক্ষেত্র। বিশাল বিশাল টাওয়ার, চিমনি ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে আশে পাশে। কয়েকটা ভবনও দেখা গেল।

    নামতে অবশ্য কোনো সমস্যা হলো না। মাত্র একটা ঝাঁকুনি খেয়েই বিমানের গতি কমতে শুরু করল। আগেরকালের বেশিরভাগ বিমানের মতো DC-3’র লেজের দিকে ওজন বেশি। পাখা দুটোর নিচে বড় বড় দুটো চাকা আছে এটার আর একদম পিছনে ছোট্ট লেজের নিচেই ছোট্ট আর একটা চাকা।

    এজন্যেই নামার সময় মনে হলো যে মাটিতে বিমান সোজা হয়েই নেমেছে তারপর আস্তে আস্তে বিমানের নাক উঁচু হচ্ছে। অথচ ঘটনা ঘটছে উল্টোটা। তবে যা-ই হোক মাটিতে নামতে পেরেই পল খুশি। মাটিতে নেমেই ও গেল গামায়কে নামতে সাহায্য করতে। দরজা খুলতেই পল হাত বাড়িয়ে দিল। গামায় সেটা ধরে ছোট্ট একটা লাফ দিয়ে নেমে এলো। “দারুণ মজা লেগেছে। এবার দেশে ফিরেই বিমান চালানো শিখবো। জো-ই শিখাতে পারবে।”

    “খুবই ভালো।” পল বলল। খুব চেষ্টা করছে সমর্থকের ভঙ্গিটা ধরে রাখতে। “বের বের মরুদ্যানটা দেখেছিলে?” গামায় জিজ্ঞেস করল।

    “নাতো কখন দেখা গেল ওটা?” মনে করার চেষ্টা করতে করতে বলল পল।

    “চক্কর মারা শুরু করার ঠিক আগে।” রেজা বলল।

    “তার মানে ঐ শুকিয়ে যাওয়া এলাকাটা?”

    রেজা মাথা ঝাঁকালো।” এক সপ্তাহে। এক সপ্তাহে ওটা এটা স্বর্গোদ্যান থেকে লবণের ঘেরে পরিণত হয়েছে। গাফসাতে যেভাবে হয়েছে ঠিক একই ঘটনা সমগ্র সাহারা জুড়েই ঘটছে।

    “এটা কি করে সম্ভব?” পল বলল।

    রোদ থেকে বাঁচতে রেজা কপালের ওপর হাত দিয়ে রেখেছে। “চলেন আগে ভেতরে যাই।” বলল ও।

    ওরা মেইন বিল্ডিং-এর দিকে এগুলো। রাস্তার পাশেই সারি সারি পাম্প আর পাইপ, সেগুলো বিভিন্ন দূরত্বে ছড়িয়ে গিয়েছে। গন্তব্য বেনগাজী। মরুভূমির দাবদাহে ঝলসে আসার পর এসি রুমে ঢোকা মানে বেহেশতে প্রবেশ করা। ওদের সাথে একদল শ্রমিকের দেখা হয়ে গেল।

    “কোনো কিছু হলো?” রেজা জিজ্ঞেস করলেন।

    প্রধান প্রকৌশলী মাথা নাড়লেন, “পানি উত্তোলন আরো বিশ ভাগ কমে গিয়েছে। আরো তিনটা পাম্প বন্ধ করে দেয়া লেগেছে। বেশি গরম হয়ে গিয়েছিল আর এগুলো দিয়ে পানির বদলে খালি তৈলাক্ত কাদা বেরুচ্ছে।” শক্ত মুখে বলল সে।

    পল ওদের কথা শুনতে শুনতে চারদিকে তাকাল। রুম ভর্তি অনেক কম্পিউটার আর ডিসপ্লে স্ক্রিন। জানালা মাত্র কয়েকটা। সেগুলোও কালো রঙে ঢাকা। রুমটা দেখতে অনেকটা বিমান বন্দরের এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোল রুমের মতো।

    “পৃথিবীর বৃহত্তম মানব-নির্মিত নদীর সদর দপ্তরে স্বাগতম।” রেজা বলল ওকে। “পৃথিবীর সবচেয়ে বড় সেচ প্রকল্প এটাই। এটাসহ আরো কয়েকটা জায়গা থেকে আমরা পানি সংগ্রহ করি, তারপর প্রায় পাঁচশো মাইল মরুভূমি পাড়ি দিয়ে বেনগাজী, ত্রিপোলি আর তোবরুক শহরে পৌঁছে দেই। পানিটা আসে মূলত নুবিয়ান স্যান্ডস্টোন জলাধার থেকে।”

    রেজা একটা ডিসপ্লের স্ক্রীন স্পর্শ করতেই একের পর এক বিভিন্ন বিশাল বিশাল পাম্প, পানি ভরা কৃপ আর পাইপ ভরা পানির স্রোতের ছবি ভেসে আসতে লাগল।

    “আপনারা কতটুকু পানি উত্তোলন করেন?” গামায় জিজ্ঞেস করেলল।

    “এতোদিন তো করতাম দিনে সাতশো মিলিয়ন কিউবিক মিটার। আমেরিকান হিসেবে ধরেন প্রায় দুই বিলিয়ন গ্যালন।” রেজা জবাব দিল।

    পলের নজর বোর্ডের দিকে। সেখানে হলুদ, লাল আর কমলা নির্দেশক জ্বলছে। সবুজ নেই কোথাও।

    “খরায় আপনাদের ঠিক কতটা ক্ষতি হয়েছে?” পল জিজ্ঞেস করল।

    “আমাদের পরিমাণ ইতোমধ্যে সত্তর ভাগ কমে গিয়েছে। দিনে দিনে আরো কমছে।” রেজা বলল।

    “ইদানীং কী কোনো ভূমিকম্প হয়েছে? মাঝে মাঝে ভূমিকম্প হলে জলাধারের অবস্থান সরে যায়। ফলে তখন আর পানি উঠতে চায় না।”

    “না, ওরকম কিছু হয়নি। সামান্য কাঁপা কাপিও না। ভূতাত্ত্বিকভাবে এই এলাকাটা খুবই সুস্থির। যদিও রাজনৈতিকভাবে উল্টো।”

    পল পুরোপুরি হতবুদ্ধি হয়ে গিয়েছে। শেষমেশ একটা কথাই ওর কাছে যুক্তিসঙ্গত মনে হলো, “আমি জানি কেউই হয়তো বিশ্বাস করবেন না, কিন্তু জলাধারগুলো কী শুকিয়ে যেতে পারে না?”

    “চমৎকার প্রশ্ন।” রেজা জবাব দিল। এখানকার যে ভূনিম্নস্থ পানি সেটার অস্তিত্ব সেই বরফ যুগ থেকে বিদ্যমান। আমরা যে পানি তুলছি সেটুক আর ফেরত যাচ্ছে না। কিন্তু যেটুকু পানি আছে সেটুকুও আগামী পাঁচশো বছর নিশ্চিন্তে চলে যাওয়ার কথা। যদি খুব বেশি বেশি করেও ভোলা হয় তাতেও একশো বছরের আগে কিছু হওয়ার কথা না। আর আমরা পানি তুলছি মাত্র পঁচিশ বছর হয়েছে। তাই আসলে যে কী হচ্ছে সেটার উত্তর আপনার মতো আমারো জানা নেই। পানি কোথায় যাচ্ছে আল্লাহ মালুম।”

    “আপনারা জানেন কী তাহলে?” গামায় জিজ্ঞেস করল।

    রেজা একটা মানচিত্র টেনে আনলেন, “আমি শুধু জানি খরা দিন দিন বেড়েই চলেছে। আস্তে আস্তে অবস্থা আরো খারাপ হচ্ছে। খরার বিস্তার পশ্চিম দিকে বাড়ছে। প্রথম কূপ শুকায় এখানে। আর এটা হচ্ছে পূর্ব সীমানা।” রেজা মানচিত্রে টোবরুক এর দক্ষিণে লিবিয়া আর মিসরের সংযোগস্থলের একটা জায়গা দেখালো।” ঘটনাটা ঘটে নয় সপ্তাহ আগে। তার কয়েকদিন পরেই সারির, টাজেরবো এলাকার কূপগুলো শুকানো শুরু করে। আর তিরিশ দিন আগে আমাদের পশ্চিমাঞ্চলে, ত্রিপোলির দক্ষিণের কূপগুলোর পানির সংগ্রহ যে, কমে গিয়েছে তা আমরা টের পাই। কয়েকদিনেই পাম্প করা পানির পরিমাণ অর্ধেকে নেমে আসে। এজন্যেই আমি গাফসা-তে গিয়েছিলাম।

    “কারণ গাফসা হচ্ছে আরো পশ্চিমে।” পল বলল।

    রেজা মাথা ঝাঁকালো। “প্রভাবটা কী আরো বাড়ছে কি-না তা আমার দেখার দরকার ছিল। এবং দেখলাম বাড়ছে। আলজেরিয়াতেও একই সমস্যা দেখা দিয়েছে। কিন্তু এসব দেশের কোনোটাই ভূগর্ভস্থ পানির ওপর আমাদের মতো এতোটা নির্ভরশীল না। গত পঁচিশ বছরে লিবিয়ার জনসংখ্যা প্রায় দ্বিগুণ হয়ে গিয়েছে। সেচ-নির্ভর কৃষির সংখ্যা বেড়েছে প্রায় পাঁচ হাজার গুণ। শিল্পক্ষেত্রে পানির প্রয়োজন বেড়েছে পাঁচশো গুণ। সবাই এই পানির ওপর নির্ভরশীল।”

    পিটার মাথা ঝাঁকালো। “তার মানে সবাই ট্যাপ ছেড়ে যদি দেখে যে পানি পড়ছে না, তাহলে আপনারা খুব বিপদে পড়বেন।”

    “ইতোমধ্যে পড়ে গিয়েছি।” রেজা পলকে নিশ্চিত করল।

    “আপনারা বাদে আর কেউ এবিষয়ে খোঁজ-খবর করছে?” গামায় জিজ্ঞাসা করল।

    রেজা কাঁধ ঝাঁকালেন, “সেভাবে না। আসলে করার মতো যোগ্য লোকই নেই। আর বুঝতেই পারছেন যে দেশে এখনো গৃহযুদ্ধ চলছে। তাই সরকার এখন এর চেয়েও বড় বড় সমস্যায় হাবুডুবু খাচ্ছে। বা তাদের ধারণা সেরকম। ওরা শুধু জিজ্ঞেস করেছে যে এটা কী বিদ্রোহীদের কাজ কি-না? উচিত ছিল মিথ্যে করে হ্যাঁ বলা। তাহলে ওরা দেশের সমস্ত সম্পদ এদিকে দিতো সমস্যার সমাধানের জন্যে। কিন্তু আমি না বলে দিলাম। সাথে এও বললাম যে এরকম চিন্তা করাটা হাস্যকর।” ব্যাপারটা মনে পড়তেই রেজার চেহারা মলিন হয়ে গেল। একটা কথা মনে রাখবেন ভুলেও কখনো কোনো রাজনীতিকের প্রশ্নকে হাস্যকর বলবেন না। অন্তত আমার দেশের কোনো রাজনীতিককেও না।”

    “কেন?”

    “আমার কাছে সেটাই মনে হয়েছে।”

    “না, ওটা না, বিদ্রোহীদের দ্বারা এমন কাজ সম্ভব নয় কেন?” গামায় খুলে বলল।

    “বিদ্রোহীরা সবকিছু বোমা মেরে উড়িয়ে দেয় কিন্তু এই ব্যাপারটা সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক। সম্ভবত কোনো বড় প্রাকৃতিক দুর্যোগ আসছে। তার ওপর সবারই পানির দরকার হয়। যদি পানিই শেষ হয়ে যায় তাহলে যুদ্ধ করবে কিসের জন্যে?” রেজা ব্যাখ্যা করল।

    “দেশটা তাহলে টিকে আছে কীভাবে?” পল জিজ্ঞেস করল।

    “এখন পর্যন্ত বেনগাজী, সার্তে আর ত্রিপোলির বাইরের জলাধারগুলোই সবদিক সামাল দিচ্ছে। কিন্তু এর মধ্যেই ভাগ করে করে দেয়া শুরু হয়ে গিয়েছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে আশেপাশের সব পাম্প-ই কয়েকদিনের মধ্যে বন্ধ হয়ে যাবে। আর তা যদি হয় তাহলে আবার মানুষ বেপরোয়া হয়ে উঠবে। আবার এদেশটায় চরম অরাজকতা শুরু হবে।

    “আপনাদের সরকারকে এসব প্রমাণ দেখাচ্ছেন না কেন? এগুলো দেখলে তো আপনার কথা শোনার কথা।” গামায় বুদ্ধি দিল।

    “দেখিয়েছি। ওরা শুধু বলে আমাকেই সমস্যার সমাধান করতে। না হলে সব দায় আমার ঘাড়ে চাপিয়ে অব্যস্থাপনার অভিযোগে আমাকে বরখাস্ত করা হবে। আবার তাদের সাথে দেখা করার আগে আমাকে একটা সমাধান বের করতেই হবে। অন্তত কেন এরকম হচ্ছে সেটা অন্তত জানতে হবে।”

    “এই নুবিয়ান স্যান্ডস্টোন জলাধারটা কত বড়?” পল জিজ্ঞেস করল। রেজা খনন কাজের একটা প্রস্থচ্ছেদের ছবি আনালেন, “বেশির ভাগ কৃপই গভীরতায় পাঁচশো থেকে ছশো মিটার।”

    “আরো গভীরে খোঁড়া যায় না?”

    “সবার প্রথমেই এই বুদ্ধিটা এসেছিল। আমরা পরীক্ষামূলকভাবে এক হাজার মিটার পর্যন্ত খুড়ে দেখেছি। কাজ হয়নি। এরপর দুই হাজার মিটার খুড়েছি। তাও দেখি শুকনো।”

    পল নকশাটা খুঁটিয়ে পরীক্ষা করল। ছবি অনুযায়ী মাটির ওপরের ছোট ছোট খোপওয়ালা দালানটায় ওরা এখন অবস্থান করছে। এটার রঙ ধূসর। কূপগুলোর রঙ উজ্জ্বল সবুজ। ফলে সহজেই দেখা যাচ্ছে। কীভাবে কূপগুলো মাটি আর পাথরের বিভিন্ন স্তর পেরিয়ে লাল লাল বেলে পাথরের ভেতর আটকে পড়া সেই বরফ যুগের পানিকে উত্তোলন করে। বেলে পাথরের ঠিক নিচেই কালো একটা স্তর। এটা মাটির নিচে প্রায় আরো এক হাজার মিটার পর্যন্ত নেমে গিয়েছে। তার নিচের অংশটুকু ধূসর কিন্তু চিহ্নিত করা নেই।

    “বেলে পাথরের নিচে এগুলো কী পাথর?” পল জিজ্ঞেস করল।

    রেজা কাঁধ ঝাঁকালো, “আমরা আসলে নিশ্চিত না। দুই হাজার মিটারের নিচে কি আছে তা নিয়ে কোনো গবেষণা হয়নি। আমার মনে হয় পুরোটাই পাললিক শিলা।”

    “আমার মনে হয় একবার পরীক্ষা করে দেখা দরকার। হয়তোবা সমস্যা। আপনার এই বেলে পাথরে না। সমস্যা এটার নিচে।” পল বলল। “তাহলে অন্তত একটা ভূকম্পনজনিত নিরীক্ষা তো চালানোই যায়।” পল প্রস্তাব দিল। রেজা বুকে দু হাত ভাজ করে দাঁড়ালেন তারপর মাথা ঝাঁকিয়ে বললেন, কাজটা করতে পারলে আমিও খুশি হতাম। কিন্তু এতো নিচে আর এতো পাথর ভেদ করে কম্পন পাঠানোর জন্যে খুব শক্তিশালী একটা আঘাত লাগবে। দুঃখজনক হলেও সত্য আমাদের সমস্ত গোলাবারুদ বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে।

    “বুঝতে পারছি কেন। সরকার চায়না বিদ্রোহীদের হাতে বিস্ফোরক গুলি পড়ক।” গামায় বলল।

    “আরে সরকার না, বিদ্রোহীরাই ওগুলো নিয়ে গিয়েছে। তারপর সরকার আর ওগুলোর বদলে নতুন দেয়নি। মোদ্দাকথা হলো, আমার এখানে এমন কিছু নেই যা দিয়ে এতো শব্দ বানানো সম্ভব যে ভূমি থেকে দু’হাজার ফুট নেমে আবার ফিরে আসবে এবং স্পষ্টভাবে সেটাকে ধরা যাবে।”

    এক মুহূর্তের জন্যে পল দিশাহারা হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু হঠাৎই একটা বুদ্ধি এসেছে মাথায়। বুদ্ধিটা পুরোপুরি পাগলামি। কিন্তু যদি কাজ করে তাহলে এটাই কাজ করবে। ও গামায় এর দিকে তাকাল, “এখন আমি জানি নতুন কোনো বুদ্ধি বের করতে পারলে কার্টের কেমন লাগে। এটা হলো একই সাথে মেধা আর পাগলামির সমন্বয়।”

    গামায় চুকচুক করল, “তবে কার্টের ক্ষেত্রে এ দুটোর মধ্যে ভারসাম্য থাকে না।”

    আশা করি আমার বেলায় সেটা হবে না।” তারপর রেজার দিকে ফিরে বলল, “আপনার কী শব্দ তরঙ্গ রেকর্ড করার মতো যন্ত্রপাতি আছে?”

    “পৃথিবীর সেরা যন্ত্রপাতিগুলোই আছে।”

    “ওগুলো রেডি করুন। আর বলতে ইচ্ছে হচ্ছে না তাও বলছি, আপনার ও লক্কর-ঝক্কর বিমানটায় তেল ভরুন। ওটাকে নিয়ে একটু চক্কর মারতে যাবো।”

    .

    ২২.

    DC-3 আবারো ধুলো ভরা রানওয়ে ধরে ছুটছে। পাম্পিং স্টেশনগুলো পার হতেই নাক উঁচু করে উঠে গেল আকাশে। দুটো কার্টিস-রাইট সাইক্লোন ইঞ্জিন সর্বোচ্চ গতিবেগে গর্জন করে চলার পরও এই গরম বিকেলে ওটার দরকারি উচ্চতা অর্জন করতে ঘাম ছুটে গেল। এই ধরনের ইঞ্জিন এখন আর ব্যবহার হয় না। প্রতিটার কর্মক্ষমতা এক হাজার হর্স পাওয়ার। কিন্তু যতোই যত্ন নেয়া হোক না কেন সত্তর বছর পর ইঞ্জিন থেকে এতোটা শক্তি পাওয়ার আশা করাটা বোকামি। তারপরও কম করে হলেও বিমানটা ধীরে ধীরে ওপরে উঠতে লাগল, মুখ দক্ষিণে। দশ হাজার ফুট ওপরে উঠতেই বাতাস শুষ্ক আর ঠাণ্ডা হয়ে এলো। সেখানে কিছুক্ষণ স্থির থাকার পর সেটা আবার রানওয়ের দিকে ছুটলো।

    রেজার পাইলট বিমান সামলাতে ব্যস্ত। আর পল ও গামায় কেবিনের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে। একটা চাকাওয়ালা ঠেলাগাড়ির দু’প্রান্ত ধরে সামলানোর চেষ্টা করছে।

    ধাতব ঠেলাটার চাকা চারটা। তার ওপর একটা চারধার উঁচু সমতল ডেক। আর তার দুপাশে হাতল লাগানো। এর ওপর প্রায় চারশো পাউন্ড ওজনের কষ্ক্রিটের টুকরো ফিতা দিয়ে বেঁধে রাখা। পল আর গামায় প্রাণপণ চেষ্টা করছে যাতে কীট বা ঠেলা কোনোটাই যাতে ঘুরে না যায়।

    গামায় একটা ফিতা খুলতে খুলতে বলল, “সবার শেষে তো তুমিই ধরবে না?”

    পল হাঁটু মুড়ে বসে শক্ত করে ঠেলাটার পা ধরে রেখেছে যাতে ওটা বিমানের লেজের দিকে চলে যেতে না পারে।

    “আর দুই মিনিট আছে।” পাইলট চেঁচিয়ে জানান দিল।

    “দেখা যাক কাজ করে কি-না। আস্তে, এখন।” বলল পল।

    গামায় হাতলটা ধরলো আর পল ওর দিক থেকে টেনে ধরে ধরে ঠেলাটাকে বিমানের লেজের দিকে নিয়ে যেতে লাগল। ওখানকার সিট, দরজা সব খুলে ফেলা হয়েছে। বিশাল ফাঁকা জায়গাটা দিয়ে হু হু করে বাতাস ঢুকছে। পরিকল্পনা অনুযায়ী এই ফাঁকা জায়গা দিয়েই গামায় আর পল ঠেলাটাকে ঠেলে ফেলে দেবে। সাথে সাথে ওরাও না পড়ে গেলেই হয়।

    খোলা দরজার পাঁচ ফুট পর্যন্ত ওরা নিরাপদেই গেল, তারপরই বাঁধলো ঝামেলা। ওরা বিমানের পিছনে পৌঁছাতেই বিমানের নাক উঁচু হয়ে গেল। কীটের টুকরো আর ঠেলাগাড়িটা মিলিয়ে ওরা বিমানের সামনে থেকে প্রায় সাতশো পঞ্চাশ ফুট পিছনে ঠেলে নিয়ে এসেছে। ফলে বিমানের ভারসাম্য নষ্ট হয়ে গিয়েছে। লেজ হয়ে গেছে বেশি ভারি আর নাক উঠে গিয়েছে ওপরে।

    “সামনের দিকে নামান।” গামায় চিৎকার করে বলল।

    “আমার ধারণা উনি এটা জানেন।” বহু কষ্টে ঠেলাটা ওল্টে পরা থেকে আটকে রেখেছে ও।

    “তাহলে করছে না কেন?” গামায় জিজ্ঞেস করল।

    পাইলট আসলেই বিমান সামনের দিকে নামানোর চেষ্টা করছিল। কিন্তু সব কাজ করছে অত্যন্ত ধীর গতিতে। সে আরো জোরে লিভারটা চেপে ধরলো। ফলে এবার ফল হলো উল্টো। নাক নেমে এলো ঠিক কিন্তু নেমেও গেল খানিকটা বেশি। ফলে এবার ঠেলাগাড়িটা গামায়কে চাপা দিয়ে ককপিটের দিকে ছুটে আসার চেষ্টা করল।

    “পল।” চেঁচিয়ে ডাকলো গামায়।

    কিন্তু চেষ্টা করা ছাড়া পলের আর কিছুই করার ছিল না। বহু কষ্টে ও গামায় এর ওপর পড়ার হাত থেকে টুকরোটাকে আটকালো। কিন্তু ততক্ষণে গামায় বাকি সিটগুলোর গায়ে পিঠ ঠেকিয়ে দিয়েছে।

    এবার ওজন আবার সামনের দিকে ফিরে আসায় প্লেনের নাক আরো নিচে নেমে গেল আর ওটা প্রচণ্ড গতিতে নিচে নামতে লাগল। গামায় এর মনে হচ্ছে ও পুরো চ্যাপ্টা হয়ে যাবে। ও সমস্ত শক্তি দিয়ে ঠেলাগাড়িটা ঠেলে সামনে পাঠানোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে, “এটা হচ্ছে দুনিয়ার জঘন্যতম বুদ্ধি। কার্টের সব বাজে বুদ্ধিকেও হারিয়ে দিতে পারবে।” চিৎকার করে বলল গামায়।

    পলও ওর সর্বশক্তি দিয়ে ঠেলাগাড়িটা টানছে যাতে গামায় এর ওপর চাপটা কমে। সব দেখে শুনে ও-ও কথাটায় সায় দিল।

    “টেনে ওঠান, টেনে ওঠান। ও নিজেই এখন পাইলটকে নির্দেশ দিতে লাগল। রেজা আর ওর লোকজন মাটিতে সেন্সর পুঁতে বিমানটা ফেরার অপেক্ষা করছে। বিমানের শব্দ পেয়ে ওরা তাকিয়ে দেখে বিমানটা পিঠ বাঁকিয়ে সোজা নিচে নেমে আসছে। ইঞ্জিন প্রচণ্ড শব্দ করছে। নিচ থেকে মনে হয় যে একটা রোলার কোস্টার।

    “ওরা করছে টা কী?” একজন লোক রেজাকে জিজ্ঞেস করল।

    “আমেরিকানরা সবাই পাগল।” আরেকজন বলল।

    .

    বিমানে বসে পলও একই কথা ভাবছিল। বিমানের নাক আবারো সোজা হতেই ঠেলাটা আবার নাড়ানো গেল। আর ওরা আবার ওটা টেনে পিছনে নিয়ে গেল। এবার পাইলট আগে থেকেই রেডি ছিল। তাই খুব বেশি সমস্যা হয়নি।

    পল দাঁড়িয়ে আছে খোলা দরজার কাছে। ঠেলার এক প্রান্ত ধরে আছে, আর চিন্তা করছে যে কীভাবে নিজে না পড়ে শুধু কীটসুদ্ধ ঠেলাটাকে নিচে ফেলতে পারবে।

    জোরে ধাক্কা দেয়া যায়, কিন্তু তাহলে ওকে আটকাবে কে?

    “চলে এসেছি প্রায়।” পাইলট চেঁচিয়ে জানালো।

    পল গামায়ের দিকে তাকাল, “যখন ভেবেছিলাম তখন তো অনেক সহজ ই লেগেছিল কাজটা।”

    “আমার একটা বুদ্ধি এসেছে।” গামায় বলল। তারপর পাইলটের দিকে ফিরে বলল, “বামে মোড় নিন।”

    পাইলট ঘুরে তাকাল, “কী?”

    গামায় হাত দিয়ে ইশারা করে দেখিয়ে মুখেও বলল। কিন্তু পাইলট বুঝলো বলে মনে হলো না। তবে পল ঠিকই বুঝেছে, “দারুণ বুদ্ধি। তুমি ওনাকে দেখিয়ে দিয়ে আসো।”

    গামায় ট্রলিটা ছেড়ে দৌড়ে ককপিটে চলে গেল। সে কো-পাইলটের সিটে বসে পড়ল তারপর হুইল ধরে বলল, “এভাবে!” ও হুইলটা বামে ঠেলে দিল। পাইলটও ওর দেখা দেখি একই কাজ করল আর DC-3 একদিকে কাত হয়ে গেল।

    পিছনে পল এক হাত দিয়ে মাল বাঁধার একটা ফিতা টেনে ধরলো আর যতটা সম্ভব দরজা থেকে সরে গেল। বিমানটা বাঁকা হতেই ও ট্রলিটা ধাক্কা দিল আর ওটা খোলা দরজা পেরিয়ে কংক্রিটসহ নেমে গেল নিচের দিকে।

    তারপর বিমানটা আবার ভারসাম্যে ফিরতেই ও সতর্কতার সাথে দরজা দিয়ে উঁকি দিল। ট্রলি আর কীটের টুকরো দুটো আলাদা আলাদা বোমার মতো সোজা নিচে নেমে যাচ্ছে। ঘুরছে না বা গোত্তা খাচ্ছে না, নিশ্ৰুপে বাতাস কেটে সোজা পড়ছে নিচে।

    গামায়ও দ্রুত ফিরে এসে নিচে তাকাল, “এটাই তোমার এযাবত কালের শ্রেষ্ঠ বুদ্ধি।” পলের গালে একটা চুমু দিয়ে বলল গামায়। পলও মৃদু হেসে ওর বুদ্ধি কতটা কাজে দেয় তা দেখতে লাগল।

    রেজা আর বাকিরাও ওগুলো পড়তে দেখেছে।

    “ওগুলো পড়ছে। সবাই রেডি?” রেজা বলল।

    এখানে চারটা দল আছে। কয়েক একর জায়গা ছেড়ে ওদেরকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। সবাই মাটি খুঁড়ে সেখানে সেন্সর লাগিয়েছে। যদি সব কিছু ঠিক থাকে তাহলে কীটের টুকরোটা মাটিকে আঘাত করলে যে কম্পনের সৃষ্টি হবে তা নিচের পাথরে যে প্রতি ধ্বনির সৃষ্টি করবে এই সেন্সরগুলো সেগুলোকে সনাক্ত করবে। আর তার মাধ্যমে আশা করা যায় বের করা যাবে যে বেলে পাথরের নিচে কি আছে।

    ‘রেডি! একদল বলল।

    ‘রেডি! বাকি দলগুলোও জানান দিল।

    রেজার দলও রেডি। বোর্ডে সবুজ সংকেত দেখাচ্ছে। তার মানে ওর সেন্সরগুলো নিখুঁতভাবে কাজ করছে। উনি আবার শেষ বারের মতো ওপরে তাকালেন জিনিসগুলোর অবস্থান দেখার জন্যে। এবার তাকাতেই দেখে মনে হলো যে সোজা তার দিকেই আসছে জিনিসগুলো।

    “চোখের ভুল।” নিজেকে বোঝালেন রেজা।

    আরও এক সেকেন্ড অপেক্ষার পর তিনি ঝেড়ে দৌড় দিয়ে পাশের বালির ওপর গিয়ে পড়লেন।

    মাত্র পঞ্চাশ গজ দূরে কীটের টুকরোটা পড়লো। কিন্তু সাথে সাথেই সংঘর্ষের প্রচণ্ড শব্দ পুরো মরুভূমি জুড়ে অনুনাদিত হয়ে ছড়িয়ে পড়ল। মাটিতে পড়ে থাকায় রেজা শুধু তার কানেই শুনলেন না সেটা তার বুক, হাত-পা এসব দিয়েও পুরো অনুভব করতে পারলেন।

    ঠিক এই জিনিসটাই চাইছিলেন তারা। তিনি ঝটপট উঠে দাঁড়ালেন, তারপর ধুলোবালির মেঘ ভেদ করে নিজের কম্পিউটার চেক করলেন দ্রুত। তখনো সবুজ বাতি জ্বলছে। তবে স্ক্রিনের গ্রাফটা তখনো ফাঁকা।

    “কাম অন, কাম অন।” অনুনয় করতে লাগলেন রেজা। অবশেষে একগাদা আঁকাবাঁকা রেখা গ্রাফ জুড়ে ফুটে ওঠা শুরু হলো। প্রতি সেকেন্ডে বাড়ছেই। বিভিন্ন গভীরতা থেকে বিভিন্ন কম্পন ধরা পড়ছে।

    “আমরা পেয়ে গেছি।” চিৎকার করে উঠলেন। “আমরা পেয়ে গেছি।” উচ্ছ্বাস প্রকাশ করতে তিনি মাথার হ্যাট খুলে ওপর দিকে ছুঁড়ে দিলেন। DC-3 তখনো নামছে। ডাটা প্রয়োজন ছিল, সেটা তারা পেয়েছেন। এখন খুঁজে বের করতে হবে এগুলোর মানেটা কি।

    .

    ২৩.

    তারিক সাকির যে ঘরটায় দাঁড়িয়ে আছেন। সেটা এক সময় শুধু ফারাও আর তাদের পুরোহিতদের জন্যেই সংরক্ষিত ছিল। এটা একটা লুকানো মন্দির। লাশ চোরেরা এটার হদিস না পাওয়ায় এখনো এটা চোখ ধাঁধানো সব অলঙ্কার আর সহায় সম্পদে রা। এখানকার জিনিসপত্র তুতেন খামেনের সমাধিতে আবিত জিনিসপত্রের চেয়েও বেশি। প্রথম দিকের রাজাদের আমলের চিত্রকলা আর হায়রোগ্নিফে দেয়াল ভরা। একটা ছোট স্ফিংসমর্তি একপাশে, সোনার তৈরি পাতা আর নীল রঙের দামি পাথরে ঢাকা। রুমটার ঠিক মাঝখানে ডজন খানেক পাথরের কফিন। প্রতিটার ভেতর একজন করে ফারাওয়ের লাশ পাওয়া যাবে। এতোদিন সবার ধারণা ছিল এগুলো চুরি করে নষ্ট করে ফেলা হয়েছে আরো হাজার বছর আগেই। কফিনগুলোর চারপাশে নানান জীব জন্তুর মমি। মিসরীয়দের ধারণা ছিল পরকালেও এরা তাদের মনিবের কাজে লাগবে। ওগুলোর পাশেই একটা কাঠের নৌকার কঙ্কালটা পড়ে আছে।

    পৃথিবীর খুব বেশি মানুষ এই কক্ষটার কথা জানে না। কাউকেও জানানোরও ইচ্ছে সাকিরের নেই। তবে ও প্রায়ই বিশেষজ্ঞ এনে এনে এখানকার জিনিসপত্র পরীক্ষা করিয়েছেন। আর শুধু ও আর ওর লোকেরাই এই প্রাচীন গৌরবের সৌন্দর্য একা একা উপভোগ করার বিপক্ষে কোনো যুক্তি খুঁজে পাননি।

    তার ওপর উনি যদি সফল হন, তাহলে উত্তর আফ্রিকা জুড়ে তার নিজেরই সৃষ্ট নতুন এক সাম্রাজ্যের গোড়াপত্তন হবে।

    কিন্তু এই মুহূর্তে তিনি একটা ঝামেলায় পড়েছেন।

    সমাধি কক্ষটা ছেড়ে তিনি কন্ট্রোল রুমের দিকে এগুলেন। সেখানে তার বিশ্বস্ত সহচর হাসান হাঁটুমুড়ে বসে আছে। কপালে তাক করা পিস্তল। সাকির-ই এটা করার নির্দেশ দিয়েছেন।

    “তারিক এসব কেন করছেন? হয়েছেটা কি?” হাসান জিজ্ঞাসা করল।

    সাকির এক পা সামনে বেড়ে শাসানোর ভঙ্গিতে একটা আঙুল তুললেন। হাসান তা দেখে চুপ করে গেল, “এখনই দেখতে পাবে সেটা।” বললেন সাকির।

    একটা রিমোট টিপতেই দূরের দেয়ালে একটা স্ক্রিন ফুটে উঠল। ছবি আসতেই চার নাম্বারের ফোস্কা পড়া মুখটা ভেসে উঠল।

    “মাল্টা থেকে রিপোর্ট এসেছে। হ্যাগেন আর তোমার বেছে নেয়া দুজনকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল আমেরিকানগুলোকে সরিয়ে দেয়ার। একজন ওদের হাতেই মারা যায়, হ্যাগেন ধরা পড়ে আর একজন পালিয়ে যায়। আমাদের কোনো লোকই যাতে ধরা না পড়ে সেটা নিশ্চিত করা যে কতো জরুরি তা তুমি জানো।”

    “জানি। আর জানিই বলেই তো”

    “তুমি এমন একজনকে পাঠিয়েছ যে কি-না প্রথমবার ব্যর্থ হয়েছিল। এমন একজনকে পাঠিয়েছ যে কি-না তিনদিন আগে মরুভূমিতেই মরে পড়ে আছে বলে আমি জানতাম। প্রচণ্ড রেগে বললেন সাকির।

    “ও যে মারা গিয়েছে এ কথা আমি কখনোই বলিনি।”

    “বেচে যে আছে সেটাও জানাওনি। দুটোই একই কথা।” সাকির বললেন।

    “না। সে বেঁচে গিয়েছিল। আপনি খোঁজ পাননি। আপনিই নির্দেশ দিয়েছিলেন যে যদি কেউ চেক পয়েন্টে বেঁচে ফিরতে পারে তাহলে তাকে আরেকটা সুযোগ দেয়া হবে। আমি শুধু সেই আদেশ পালন করেছি মাত্র।”

    নিজের কথাই নিজের বিরুদ্ধে ব্যবহার হচ্ছে দেখে সাকিরের মুখ কালো হয়ে গেল, “হ্যাঁ, কিন্তু চেক পয়েন্ট পর্যন্ত হেঁটে গিয়ে কারো বেঁচে থাকা সম্ভব না। শুধু তিরিশ মাইল-ই না। ওপরে গনগনে সূর্য, নিচে তপ্ত বালু, পানি নেই, ছায়া নেই। তার ওপর কয়েক সপ্তাহ ধরেই চলা কঠিন প্রতিযোগিতা তো আছেই।”

    “আমিতো বললামই যে ও পেরেছে। আর কারো সাহায্য ছাড়াই। ওর মুখের দিকে দেখেছেন? হাতের দিকে দেখেন। মরে যাচ্ছে মনে করে ওকে বালিতে গর্ত করে পুঁতে দেয়া হয়। সেখানে ও সন্ধ্যা পর্যন্ত অপেক্ষা করে। তারপর সূর্য ডুবলে গর্ত ছেড়ে বেরিয়ে এসে শেষ পর্যন্ত পৌঁছে যায়। হাসান বলল।

    সাকিরও ক্ষতগুলো খেয়াল করেছে। মনে মনে ছেলেটার বুদ্ধির তারিফ না করে পারলো না। তো আমার লোকেরা খবর পাঠায়নি কেন?”

    “ও যখন পৌঁছায় তখন চেক পয়েন্টে কেউ ছিল না। আপনার মতোই সবাই ভেবেছিল যে কেউ বেঁচে ফিরতে পারবে না। চার নম্বর তালা ভেঙে ঢুকে আমার সাথে যোগাযোগ করে। ওর শক্তি আর দৃঢ় সংকল্প দেখে বুঝতে পারি যে আমাদের লোকের ওপর ওর নজরদারির জন্যে ওর চেয়ে ভালো আর কেউ হবে না। ওকে কেউ চেনে না। ওকে আদেশ দেই যে যদি কেউ ধরা পড়ে যা আমাদের খবর ফাঁস হওয়ার কোনো সম্ভাবনা দেখা দেয়া মাত্র তাকে সরিয়ে দিতে হবে।” প্রশ্নাতীতভাবে সাকিরই ওসাইরিস এর একচ্ছত্র অধিপতি। তবে নিজের ভুল স্বীকার করতে সে দ্বিধা করে না। যদি হাসান সত্যি কথাই বলে থাকে তাহলে চার নম্বরই একটা পদ পাওয়ার একমাত্র যোগ্য ব্যক্তি। তবে তার আগে ওকে একটা নাম দিতে হবে।

    হাসানকে চুপ থাকতে বলে সাকির স্যাটেলাইট চার নাম্বারের সাথে কথা বলল কিছুক্ষণ। কথাগুলো হাসানের সাথে হুবহু মিলে না গেলেও কাছাকাছিই ছিল। এ কারণেই সাকির বিশ্বাস করলেন যে দুজনে মিলে গল্পটা বানায়নি, সত্য কথাই বলছে ওরা।

    তারপর হাসানের পিছনে থাকা প্রহরীদের নির্দেশ দিলেন, “ওকে ছেড়ে দাও।” প্রহরীরা সরে যেতেই হাসান উঠে দাঁড়ালো। সাকির আবার চার নম্বরের দিকে মনোযোগ দিলেন।

    “তোমাকে একটা গল্প বলি শোনো। আমি যখন ছোট, তখন আমার পরিবার থাকতো কায়রোর শহরতলীতে। আমার বাবা ভাঙ্গারির লোহা সংগ্রহ করে বিক্রি করতেন। দুবেলা পেটভরে খাবার জুটতো না নিয়মিত। একদিন হঠাৎ বাসায় একটা বিছে ঢুকে পড়ে। আমাকে কামড়ও দেয়। আমি রেগে ওটাকে একটা ইট দিয়ে থেতলে দিতে যাই। কিন্তু বাবা আমার হাত ধরে ফেলেন। তিনি বলেন আমাকে একটা জিনিস শেখাতে চান। তাই আমরা বিছেটাকে একটা পাত্রে রেখে সেটাকে পানি দিয়ে ভরে দিলাম। প্রথমে গরম পানি, তারপর ঠাণ্ডা পানি। তারপর ওটাকে একটা কাঁচের পাত্রের মধ্যে রেখে রোদের মধ্যে ফেলে রাখলাম কয়েকদিন। তারপর ওটার ওপর স্পিরিট ঢেলে দিলাম। ওটা সাঁতার কাটার অনেক চেষ্টা করল কিন্তু না পেরে শেষ পর্যন্ত পাত্রের নিচেই পড়ে থাকল। পরের দিন আমরা বিছেটাকে বাড়ির পাশের ডাস্টবিনে ফেলে দিলাম। ওটা মরে তো নি উল্টো সাথে সাথে আমাদেরকে আক্রমণ করল। কিন্তু আমার কাছে পৌঁছার আগেই বাবা ওটাকে বাড়ি দিয়ে দূরে পাঠিয়ে দিলেন। তারপর বললেন, “এই বিছেরাই আমাদের ভাই। জেদি, বিষাক্ত আর সহজে মরেও না। বিছেরা উন্নত হৃদয়ের অধিকারী।”

    স্ক্রিনে দেখা গেল চার নম্বর হালকা মাথা ঝোকালো।

    “তুমি তোমার যোগ্যতা প্রমাণ করেছ। এখন থেকে তুমি আমাদের একজন। আমাদের ভাই। তোমার কোড নেম হবে স্করপিয়ন (বিছে)। কারণ তুমি জেদি। মারাও শক্ত সেই সাথে উন্নত হৃদয়ের অধিকারী। তুমি সেদিন নিজের প্রাণ ভিক্ষা চাও নি। একটা বার ভয়ও পাওনি। সেজন্য আমি খুবই খুশি হয়েছি।

    স্ক্রিনে দেখা গেল সদ্য নাম পাওয়া লোকটা মাথা ঝুঁকিয়ে অভিবাদন গ্রহণ করেছে।

    “মুখের ক্ষতগুলোকে গর্বের সাথে লালন করবে।” সাকির বললেন।

    “অবশ্যই।”

    “এখন কি করবো আমরা?” হাসান জিজ্ঞেস করল। কথাবার্তা বলে আবার স্বাভাবিক হতে চাইছে ও। তবে আপাতত বেঁচে থাকতে পেরেই খুশি।

    “যা বলেছিলাম সেটাই। লোকজনের সামনে আসার আগেই শিলালিপিগুলো চরি করবে আর যাদুঘর থেকে ওটার অস্তিত্বের সব প্রমাণও মুছে ফেলবে। আর এবার তুমি নিজে গিয়ে ব্যক্তিগতভাবে সব তত্ত্ববধান করবে।” সাকির বললেন।

    .

    ২৪.

    মাল্টা
    সন্ধ্যা ৭টা

    একটা ডেলিভারি ট্রাক বিশাল একটা গুদাম ঘরের মালপত্র ওঠানামার জায়গাটায় ঢুকতেই একটা কর্কশ শব্দ রাত্রির নিস্তব্দতা ভেঙে চারপাশে ছড়িয়ে পড়ল। গুদাম ঘরটার মালিক মালটা সমুদ্রতাত্ত্বিক যাদুঘর। এখানেই মূলত তাদের নতুন নতুন মালামাল এনে রাখা হয় বা পুরনো জিনিস এনে ঝড়াপোছা করা হয়। গুদাম ঘরের গেট থেকেই দুজন সিকিউরিটি গার্ড গাড়িটাকে আসতে দেখলো।

    “শালার আমরা দুজনই এখানে পচে মরছি আর ডেলিভারি নিচ্ছি। বাকিরা সবাই যাদুঘরের সব সুন্দর জিনিস দেখে ফেলছে।” একজন গার্ড বলল।

    রাস্তার ধারেই লিমুজিনসহ নানান দামি দামি গাড়ি কিছুক্ষণ পর পর এসে যাদুঘরের মেইন বিল্ডিং-এর সামনে দাঁড়াচ্ছে। এখানেই হবে আজকের অনুষ্ঠান। অতিথিদের কেউ কেউ নৌকাতে করেও আসছেন। দূরেই ভাসছে তাদের ইয়ট।

    গাড়ি থেকে নামছেন গণ্যমান্য সব ব্যক্তি, তাদের স্ত্রী বা বান্ধবী, তার সাথে ঝলমলে পোশাক পরা লাবণ্যময়ী যুবতীদের দল তো আছেই। এ কারণেই গুদাম ঘরের গার্ডটা এতো বিরক্ত।

    দ্বিতীয় গার্ডটা কাঁধ ঝাঁকালো, “চিন্তা করোনা। কিছুক্ষণ পরেই দেখবে কারো কানের দুল খুলে পড়ে গিয়েছে আর তুলকালাম কাণ্ড শুরু হয়েছে সেটা খুজতে, আর এদিকে আমরা আরাম করে এখানে বসে থাকবো।”

    “হুম! আচ্ছা চলো দেখি ট্রাকে কি এলো।” একটা ক্লিপবোর্ড হাতে নিয়ে বলল গার্ড।

    প্রথম জন মাল খালাসের জায়গায় এগুতেই পিছনের জন দরজা বন্ধ করে দিল। চারপাশের দেয়ালের মাথায় কাটা বসানো। হাত দিলে কেটে যায়। ওটাই প্রথম স্তরের নিরাপত্তা। এরপর দ্বিতীয় স্তর হলো দরজায় লাগানো সিকিউরিটি কীপ্যাড।

    সেখানে কার্ড ঢুকিয়ে ভেতরে ঢুকতে হয়। তবে তারপরেও চব্বিশ ঘণ্টা এখানে পাহারা থাকে। আর কেনসিংটন খুন হওয়ার পর এখন লোকসংখ্যা তিন গুণ বাড়ানো হয়েছে।

    ট্রাকটা হালকা ঝাঁকুনি খেয়ে প্লার্টফর্মে উঠে এলো। ড্রাইভার লাফ দিয়ে নেমে পিছনে এসে দরজা খুলে দিল।

    “কি নিয়ে এসেছেন আপনি?” গার্ড জিজ্ঞেস করল।

    “শেষ মুহূর্তের জিনিস পত্র।”

    গার্ড ট্রাকের ভেতর উঁকি দিল। একটা কাঠের বক্সমতো দেখা যাচ্ছে ভেতরে। আট ফুট মতো লম্বা, চার ফুট চওড়া আর উচ্চতা পাঁচ ফুট হবে হয়তো।

    “রিসিট নাম্বার?” গার্ড জিজ্ঞেস করল।

    “SN-5417” নিজের ক্লিপবোর্ডের দিকে তাকিয়ে জবাব দিল ড্রাইভার। কিন্তু গার্ড নিজের কাছের কাগজে এই নাম্বারের কোনো অর্ডার দেখতে পেল না। পরের পাতা উল্টে একদম শেষে পেল নাম্বারটা। যাক পেয়েছি। একেবারে শেষ মুহূর্তে যোগ করা হয়েছে দেখছি। কোথায় ছিলেন এতোক্ষণ? এটাতো আরো এক ঘণ্টা আগে পৌঁছে দেয়ার কথা।”

    ড্রাইভারকে কিছুটা হতাশ দেখালে, “আমাদের বের হতে একটু দেরি হয়ে গিয়েছিল, আর আপনাদের এই পার্টি পুরো শহরে জ্যাম বাড়িয়ে দিয়েছে। আসতে যে পেরেছি এই বেশি।”

    গার্ডও একমত হলো, “দেখি একবার জিনিসাটা?”

    বাক্সটার ঢাকনার নিচে একটা স্কু-ড্রাইভার ঢুকিয়ে খুলে ফেলল ওটা। ভেতরে খড়ের গাদার ভেতর শুয়ে আছে একটা মানুষ মারা কামানের নল। এগুলো দিয়ে ছররা গুলি বের হতো। ডেলিভারি শিট অনুযায়ী এটা আঠারো শতকের একটা ব্রিটিশ জাহাজ থেকে পাওয়া। তার পাশেই অনেক তরবারি দেখা গেল। সেগুলো অন্ন প্রতিরোধী কাগজ দিয়ে মোড়া।

    সন্তুষ্ট হয়ে ট্রলি হাতে এক কর্মচারীকে বলল, “এগুলো পিছনে নিয়ে গিয়ে একপাশে সরিয়ে রাখো। দেখো রাস্তার মাঝে ফেলে রেখো না। পার্টি শেষ হলে তারপর এগুলোর ব্যবস্থা করবো।”

    ট্রলিওয়ালা মাথা ঝাঁকালো। সে অবশ্য এখানে থাকতে পেরে খুবই খুশি। রাতের ডিউটি মানেই ওভার টাইম। আর যদি কাজ মাঝরাত পার হয়ে যায় তাহলেই দ্বিগুণ টাকা পাওয়া যায়। আজতো মাঝরাত পার হবেই। সে বাক্সটা ট্রলিতে তুলে নিয়ে গুদামের দিকে চলে গেল। রাস্তা আটকাবে না এমন একটা জায়গা খুঁজে বের করে তবেই থামল।

    বাক্সটা নামিয়ে রাখার সময় সামান্য ঝাঁকি লাগল। এক নজর দেখেই লোকটা বুঝলো যে সবার নিচের কাঠের তক্তাটা ফেটে গেছে নিশ্চিত। লোকটা কাঁধ ঝাঁকালো। প্রায়ই এরকম হয়।

    তারপর আবার সে সামনের দিকে ফিরে গেল। আপাতত আর কোনো কাজ নেই। কিছুক্ষণ তাই টিভি দেখার সিদ্ধান্ত নিলো সে।

    ট্রলিটা রেখে মাথার শক্ত ক্যাপটা খুলে দরজা খুলে ঢুকতেই চোখে পড়ল মেঝেতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে লাশ। এ মধ্যে মাত্র যে দুজন গার্ড ডেলিভারি নিয়েছে তাদের লাশও আছে।

    রুমের অপর পাশেই পিস্তল হাতে আরো কয়েক সিকিউরিটি গার্ডকে দেখা গেল। লোকটা ঘুরে পালাতে গেল, কিন্তু তার আগেই গুলি খেয়ে লুটিয়ে পড়ল মাটিতে।

    সাইলেন্সার লাগানো পিস্তলের মৃদু শব্দ কেউ টেরও পেল না। লোকটা তখনো মরেনি। আরেকটা গুলি হলো, লোকটা এবার কাত হয়ে উল্টে আরেকটা লাশের ওপর পড়ল।

    ট্রলিচালক লোকটা আরেকটু ভালো করে খেয়াল করলেই দেখতে পেতে যে এই গার্ডগুলো আসলে নতুন যাদেরকে ভাড়া করা হয়েছে তারা। আর তাদের পেছনেই দাঁড়িয়ে আছে ঝলসানো মুখের একজন মানুষ। কিন্তু এসব তথ্য তার মস্তিস্কে পৌঁছানোর আগেই লোকটা মারা গিয়েছে।

    .

    ২৫.

    আবদ্ধ একটা জায়গায় আটকে আছে কার্ট। দমবন্ধ লাগছে ওর। ডাইভিং মাস্কের ভেতর দিয়ে উঁকি দিয়ে দেখার চেষ্টা করল বাইরে। নিচ্ছিদ্র অন্ধকার বাদে কিছুই নেই। কয়েকবার ধীরে ধীরে শ্বাস নিলো ও তারপর কততক্ষণ পর হয়েছে অনুমান করার চেষ্টা করল। কিন্তু ঠাহর করতে পারলো না। এরকম একটা অন্ধকার আর নিশূপ জায়গায় শুয়ে থাকা আর সেনসরি ডিপ্রাইভেশন ট্যাঙ্কের ভেতর শুয়ে থাকা একই কথা।

    ও পা সোজা করার চেষ্টা করল কিন্তু পা নাড়াতে পারলো না। বহু কষ্টে পা-টা মোচড়া মুচড়ি করতে লাগল। যেন ছোট্ট কোনো প্রাণী মাটি খুঁড়ে বের হতে চাচ্ছে। তারপর পাপোষে পা মোছর মতো করে প্যাকিং-এর জিনিসপত্রের গায়ে পা ঘষতে লাগল।

    “আস্তে। আমার বুকে লাথি লাগছে।” একটা কণ্ঠ শোনা গেল। কার্ট নিশ্বাসের পাইপ থেকে মুখ সরিয়ে বলল, “স্যরি। তবে মোচড়া মুচড়িতে লাভ হয়েছে কিছুটা। তবে তখনও অস্বস্তি কাটেনি। পিঠে তীক্ষ্ণ একটার খোঁচা লাগছে। আর গায়ের ওপরের খড়ের কারণে চুলকাচ্ছে শরীর। শেষমেশ আর থাকতে পারলো না।

    হাতটা বাঁকিয়ে চুরিয়ে মুখের সামনে নিয়ে আসলো। ঘড়িতে জ্বলজ্বল করছে কাটা।

    “দশটা ত্রিশ। পার্টি এতোক্ষণে শুরু হয়ে গিয়েছে। কেঁচোর মতো গর্ত ছেড়ে বের হওয়ার সময় হয়ে গেছে।” কার্ট বলল।

    “কেঁচো আমার একদম পছন্দ না। তবে তোমার লাথির হাত থেকে বাঁচতে, এই মুহূর্তে কেঁচো হতেও আপত্তি নেই।”

    কার্ট খড় আর ফোমের জঙ্গল ভেদ করে মাথা উঁচু করল। বাইরে কোনো সাড়া-শব্দ আছে কি-না শোনার চেষ্টা করছে। কিছুই শুনতে না পেয়ে ওর মুখোশের একপাশের একটা সুইচ টিপে দিতেই মাথার ওপর একটা LED লাইট জ্বলে উঠল। তার আলোয় দেখা গেল জো-ও পাশেই মাথা তুলেছে।

    “এটা তোমার এযাবত কালের সবচেয়ে জঘন্য বুদ্ধি। পল আর গামায়কে যখন বলবো যে বুদ্ধিটা কাজ করেছে তখন ওরা বিশ্বাসই করবে না”, জো বলল।

    “এটাকে বলে, থিং কিং আউট অফ দ্য বক্স”, কার্ট দাবি করল।

    “মজা পেলুম!” জো বলল, যদিও কণ্ঠ শুনে মনে হচ্ছে না যে মজা পাচ্ছে।

    “কতক্ষণ ধরে এই ডায়লগ ঝাড়ার জন্যে আঁকুপাঁকু করছো?”

    “একঘণ্টার মতো। আরে শোনো এবার ভুলটা কোথায় হয়েছে ধরতে পেরেছি। পরের বার আরও বড় একটা বাক্সের ব্যবস্থা করবো।” কার্ট বলল।

    “পরেরবার আর বক্সে ঢুকতে হবে না। নিজেই একটা বক্স সেজে নিও।” জো জবাব দিল।

    অনেক চেষ্টার পরেও খড় আর কাঠের গুড়া-টুড়া ওদের সারা গায়ে ছড়িয়ে পড়েছে। এদিকে রাস্তায়ও জ্যাম। আর সবশেষ ডেলিভারির পর রাখার সময় ওদেরকে প্রায় তিনফুট ওপর থেকে আছাড় মেরে ফেলা হয়েছে।

    “ভাগ্য ভালো যে ব্যাটারা কামানটা ভালো মতো পরীক্ষা করে দেখেনি। একপাশে মেড ইন চায়না লেখা আছে।”

    “তোমার কি একটা সত্যিকার কামানের নিচে সেনোর শখ হয়েছে নাকি?”

    “বেশি আরাম তো লাগার কথা না।” জো বলল।

    কার্টও একমত হলো, “আমাদেরকে জায়গা মতো ডেলিভারি করলেই হয় এখন।” কার্ট ওর অন্য হাতটাও খড় থেকে ছাড়িয়ে ওর বাহুর সাথে বাঁধা একটা ভেলক্রো প্যাক খুললো। সেখান থেকে একটা সরু কালো তার বের করে প্যাঁচ খুললো। তার এক মাথা লাগানো নিজের চশমার সাথে অন্য মাথা লাগানো একটা খুবই ছোট্ট ক্যামেরার সাথে। চারপাশটা পরীক্ষা করে দেখবে একবার।

    “পেরিস্কোপ।” ফিসফিস করে বলল ও।

    ক্যামেরাটা চালু করে সেটাকে বাক্সের ওপরের একটা ছিদ্র দিয়ে ঢুকিয়ে দিল। লেন্স ফোকাস করতেই কার্টের মাস্কের ভেতর ছবিগুলো চলে যেতে লাগল। যদিও সব ঝাপসা কারণ, গুদামের এদিকটায় বেশি আলো নেই।

    “কোনো জাপানি যুদ্ধ জাহাজ দেখা যাচ্ছে?” জো জিজ্ঞেস করল।

    কার্ট ক্যামেরার মুখ ঘুরালো আরেক দিকে। “না মি. জাভালা। সাগর পুরো শান্ত। আপনি চাইলেই পানির ওপর উঠতে পারেন।”

    কার্ট ক্যামেরাটা আবার খুলে ওর প্যাকে রেখে দিল। আর জো ঢাকনা খোলার কাজে মনোযোগ দিল। কার্টও মাথার লাইট বন্ধ করে ওর পাশের অংশে ঠেলা শুরু করল। দুজনের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় শেষে খুলে গেল ঢাকনা।

    জো-ই প্রথম বের হলো বাক্স থেকে। কার্টও বের হলো এক সেকেন্ড পর। তারপরই দুজন বাক্সটার পিছনে লুকিয়ে পড়ল। আস্তে আস্তে পুরোপুরি হাত পা-এর অনুভূতি ফিরে আসার পর ওরা উঠে বসলো।

    “রাস্তা থেকে দেখে যতটা ভেবেছিলাম, এটা তো তারচেয়েও অনেক বড়।” জো বলল।

    কার্ট চারপাশে চোখ বুলালোর ঘরে প্রচুর জিনিস, তবে সবই যে নির্দিষ্টভাবে ভাগ করে রাখা তা বোঝা যায়। পিছন দিকে ওরা যেখানে আছে, সেখানকার সব জিনিসই মাটিতে রাখা। তবে অন্যান্য দিকে বেশ কিছু তাক আর শেল্ফ দেখা গেল।

    “এতো কম সময়ে এতকিছু চেক করা সম্ভব না।” জো বলল।

    “সব দেখতে হবে না। শুধু নিলামের জন্য যেগুলো আনা সেগুলো দেখতে হবে। তার মধ্যেও যেগুলো মিসরীয় সেগুলো। ওরা যেগুলো নিলামে তুলবে সেগুলো এই হয় মাটিতে নামিয়ে রেখেছে। না হয় একেবারে আলাদা করে কোথাও রেখেছে। তাই আপাতত শেল্ফগুলোর দেখার দরকার নেই। তুমি ডান দিকে দেখো, আমি বামে দেখছি। এদিক থেকে দেখে দেখে সামনে পর্যন্ত যাবো।”

    জো মাথা ঝাঁকিয়ে কানের ভেতর একটা ছোট মাইক্রোফোন খুঁজে দিল। কার্টও একই কাজ করল। এরপর দুজনের হাতেই দেখা গেল ইনফ্রারেড ক্যামেরা। অন্ধকারেও ছবি তুলতে পারে এগুলো। পরে ছবিগুলো কাজে লাগতে পারে।

    “চোখ খোলা রেখো। আগের দিনের ঘটনার পর সিকিউরিটি কিন্তু খুব কড়া হবে। আর আমি নিজেও গুলি খেতে চাই না, বা ওদের কাউকেও গুলি করতে চাই না। কিছু হলেই এখানে এসে লুকিয়ে থেকো। কার্ট সাবধান করল জো-কে।

    “বলতে হবে না সেটা। পিস্তল আর শর্টগানের বিপক্ষে টীজার আর পিপার স্প্রে যে কাজ করবে না তা আমি জানি।”

    যেহেতু ওরা জানে যে এখানকার সিকিউরিটিরা নিতান্তই নির্দোষ মানুষ, সেজন্য প্রাণঘাতী কোনো অস্ত্র আনেনি। খুব দরকার পড়লে যাতে কাজে লাগে তাই নিরীহ পদ্ধতিই ব্যবহার করবে।

    “সুতরাং পিস্তলধারী কারো হাতে ধরা পড়োনা যেন।” কার্ট বলল।

    “দারুণ উপদেশ।”

    কার্ট দাঁত বের করে হাসলো, তারপর তীরন্দাজদের মতো দু আঙুল দিয়ে স্যালুট করে সামনের আলো ছায়ায় ঘেরা অংশটার দিকে এগিয়ে গেল।

    .

    ২৬.

    হাসান মাল্টা পৌঁছালো পার্টি শুরু হওয়ার কিছুক্ষণ আগে। এখন থেকে ও-ই সব দেখবে। প্রথমত, ঐ শিলালিপিগুলো উদ্ধার করতে হবে, আর ওগুলোর অস্তিত্বের সব প্রমাণ গায়েব করতে হবে। ভাগ্য ভালো যে ওর লোকেরা এর মধ্যেই যাদুঘরের সিকিউরিটি সার্ভিসে ঢুকে পড়েছে। এতোক্ষণে গুদাম ঘরটার ভেতর শিলালিপিটা খোঁজাও শুরু করার কথা। এখন শুধু সিকিউরিটি সুপারভাইজারকে অন্য কাজে ব্যস্ত রাখতে পারলেই হবে। লোকটা এই মুহূর্তে বলরুমের দায়িত্বে থাকা সিকিউরিটিদের সাথে রেডিওতে কথা বলছে। আর হাসান তার পিছনেই উদ্যত পিস্তল হাতে দাঁড়িয়ে আছে। ভাগ্যটা একটু বেশিই ভালো বলা যায়। সিকিউরিটি গার্ডদের চারভাগের তিনভাগই এখন বলরুমের আশেপাশে দায়িত্ব পালন করছে। তার মানে গুদামে মাত্র আটজন লোক। এর মধ্যে দুজন আবার ওসাইরিসের হয়ে কাজ করে।

    হাসান জানে গুদামের পুরাকীর্তিগুলোর অনেক দাম। তবে ওর কাছে ওগুলো ইয়ট, বা ব্যক্তিগত বিমান চালানো এসব ধনকুবেরদের কাছে কিছুই না।

    রেডিওতে একটা কল আসলো, “চার পাশটা খুঁজে দেখা শেষ। চারপাশে হীরা জহরতে ভরা। তবে সবকিছু ঠিক আছে।”

    সুপার ভাইজার ইতস্তত করতে লাগল।

    “জবাব দিন।” পিস্তলটা আরো একটু ঠেলে আদেশ দিল হাসান।

    সুপারভাইজার নিজের মাইক্রোফোন তুললো, “খুব ভালো, তিরিশ মিনিট পর আবার খবর দিও।”

    “ঠিক আছে। কয়েকজনকে একটু বাইরে পাঠিয়ে দেবো নাকি? অনেকেই দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে বিরক্ত হচ্ছে। গুদামের ওদিক থেকে ওদের বদলে আসতে বললেই হয়।”

    হাসান মাথা নাড়লো। অদল-বদল করার মতো কেউই বেঁচে নেই।

    “এখনই না। ভালো মতো খেয়াল রেখো সব। সুপারভাইজার বলল।

    কিছুক্ষণের জন্যে আর ঝামেলা নেই। “এখন আমাকে একত্রিশ, চৌত্রিশ আর সাতচল্লিশ নম্বর মাল যেখানে আছে সেখানে নিয়ে যান।” হাসান বলল।

    সুপার ভাইজার এক সেকেন্ড ভাবলো যে কি করবে। হাসান ওর হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে সজোরে চড় কষালো তার মুখে। সুপারভাইজার চেয়ারসুদ্ধ উল্টে মাটিতে পড়ে গেল।

    “দেরি করা আমার একদম পছন্দ না।” হাসান জানালো।

    একান্ত আনুগত্যের মতো হাত নেড়ে সুপার ভাইজার বলল, “চলুন নিয়ে যাচ্ছি।”

    হাসান স্করপিয়নের দিকে ফিরলো, “বোমাগুলো গুদামে নিয়ে যাও। যদি উদ্ধার করা সম্ভব না হয়, তাহলে ওগুলো ধ্বংস করে দিতে হবে। তবে ওগুলো অক্ষত অবস্থায় মিসরে ফিরিয়ে নেয়াই আমি বেশি পছন্দ করবো।”

    তারপর দ্বিতীয় আরেকটা লোকের দিকে ফিরে বলল, “সব কম্পিউটারে Cyan-ভাইরাস ঢুকিয়ে দাও। ঐ শিলালিপিগুলো সম্পর্কে কোনো তথ্যই যেন ওতে না থাকে।”

    লোকটা মাথা ঝাঁকাতেই হাসান সন্তুষ্ট হয়ে ঘুরে দাঁড়ালো। সবকিছুই ঠিকঠাক মতো চলছে। কিন্তু কেউই টিভি স্ক্রিনের দিকে খেয়াল করল না। বিভিন্ন সিকিউরিটি ক্যামেরার দৃশ্য ওখানে দেখা যাচ্ছে। খেয়াল করলে ওরা দেখতে পেতো দুটো স্ক্রীনে দেখা যাচ্ছে দুটো কালো অবয়ব গুদাম ঘরে কিছু একটা খুঁজে বেড়াচ্ছে।

    স্বরপিয়ন একটা চারচাকার ট্রলি নিয়ে ফিরে এলো।

    “চমৎকার, একত্রিশ নাম্বার দিয়েই শুরু করা যাক।” হাসান বলল প্রশংসার সুরে।

    .

    জো একটা শক্ত প্লাস্টিকের কেস-এর সামনে দাঁড়িয়ে আছে। একপাশে একটা ছোট কাগজে লেখা XXXI।

    “একত্রিশ,” বিড়বিড় করে বলল ও।

    জো ওপরের ঢাকনাটা সরিয়ে একটা আগুনরোধী কাগজ তুলে আনলো। এটার ঠিক নিচেই একটা ভাঙ্গা শিলালিপি দেখা গেল। মিসরীয় চিত্র কর্ম তাতে।

    ছবিটায় একজন লম্বা সবুজ মানুষ একটা মন্দিরের ভেতর দাঁড়িয়ে নিজের হাত একদিকে বাড়িয়ে রেখেছে। হাতের নিচেই অনেক মানুষ মেঝের ওপর শুয়ে আছে। সবুজ লোকটার হাত থেকে ঘুমন্ত বা মৃত লোকগুলোর পর্যন্ত দাগ টানা। দেখে মনে হয় যেন লোকটা শোয়া মানুষগুলোকে শূন্যে ভাসানোর চেষ্টা করছে। ওপরের কোণার দিকে একটা গোলাকার পিণ্ড আঁকা তবে সেটা আবার কালো রঙ দিয়ে ঢাকা। সম্ভবত সূর্য বা চন্দ্রগ্রহণ বোঝানো হচ্ছে।

    জো মিসরে বেশ কিছুদিন ছিল। কিছু প্রত্নতাত্ত্বিক খোঁড়াখুড়িও করেছে। প্রাচীন মিসরীয় চিহ্ন-টিহ্নও কিছুটা চেনে।

    জো কানের ইয়ার পিসে লাগানো একটা তার ধরে মোচড় দিল। এখন ও কার্টের সাথে কথা বলতে পারবো। “মিসরীয় ছবি আঁকা একটা শিলালিপি পেয়েছি। সবুজ একটা মানুষ আঁকা। বিশাল সাইজ। একবার দেখে যাও।”

    “তুমি কী নিশ্চিত যে ওটা দ্য ইনক্রেডিবল হাল্ক-এর প্রথম দিককার কোনো ছবি না?” কার্ট বলল শান্ত স্বরে।

    “তাহলে তো ভালোই। সেই জিনিস আবিষ্কার করে ফেলেছি।” জো বলল ফিসফিস করে। তারপর ক্যামেরাটা নিয়ে একটা ছবি তুললো আর আবার যেমন ছিল তেমন রেখে দিল।

    অন্য পাশে কার্ট অবশ্য এখনও তেমন কিছু খুঁজে পায়নি। তবে সময়ও নষ্ট করেনি একটুও। বেশির ভাগ জাদুঘরের মতোই প্রদর্শন ক্ষমতার অতিরিক্ত পুরার্কীতি দিয়ে এটা ভরা। মাঝ মাঝে হয়তো অদল-বদল করে প্রদর্শন করা হয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বেশিরভাগই গুদামে পড়ে থেকে থেকে ধুলো সঞ্চয়

    আর যেহেতু এগুলো গুছিয়ে রাখার কোনো বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিও নেই, তাই ঠিকভাবে সেটা করাও সম্ভব হয় না। এখন পর্যন্ত কার্ট পেলোপনেশিয়ান বিদ্রোহ থেকে রোমান সাম্রাজ্য পর্যন্ত সব ধরনের পুরাকীর্তিই খুঁজে পেয়েছে। এর মধ্যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ের জিনিসপত্রও আছে। পাশেই আছে ফরাসি বিদ্রোহের সময়কার ধ্বংসাবশেষ। ওয়াটারলু যুদ্ধে বিট্রিশদের ব্যবহৃত অস্ত্র এমনকি অ্যাডমিরাল নেলসন ট্রাফালগারে আহত হওয়ার পর যে কাপড়টা দিয়ে বেঁধে রক্তপাত বন্ধ করছিলেন সেটাও আছে।

    কাপড়টা যদি আসল হয় তাহলে এটা রয়্যাল নেভীর কাছে একেবারে ধর্মীয় জিনিসের মতোই মর্যাদা পাবে। তবে মাল্টায় জিনিসটা বিক্রির জন্য ভোলা হচ্ছে দেখে জিনিসটার সম্পর্কে সন্দেহ যাচ্ছে না। তবে জঙ্গলের ভেতরেও গুপ্তধন পাওয়া যায়।

    এর পাশেই নেপোলিয়নের কিছু জিনিসপত্র দেখতে পেল ও। সবই নাম্বার বসানো। এর মধ্যে একটা XVI।

    প্রথম যে জিনিসটা সেটা হলো একতাড়া চিঠি। এর মধ্যে বিভিন্ন সময়ে পাঠানো আদেশ নামাও আছে। পরেরটা হলো আরো বেশি টাকা চেয়ে অনুরোধ পত্র। চিঠিটা প্যারিসে পাঠানো হয়েছিল তবে তার আগেই ব্রিটিশদের হাতে পড়ে এটা। সবশেষে একটা ছোট বই, ওপরে লেখা “নেপেলিয়নের ডায়রি।”

    সময় খুবই কম। কিন্তু তারপরও কার্ট একবার ভেতরে তাকানোর লোভ সামলাতে পারলো না। এর আগে কোনোদিন নেপোলিয়নের কোনো ডায়রির কথা শোনেননি। বাক্সটা খুলে আগুনরোধী খামের ভেতর থেকে ডায়রিটা বের করল। কিন্তু ভেতরে কোনো ডায়রি নেই। তার বদলে একটা বই। হোমারের “ওডিসি”। বইটা উল্টে-পাল্টে দেখে ফ্রেঞ্চ ভাষায় বইটার এখানে সেখানে লেখা। এগুলো কী নেপোলিয়নের লেখা নাকি? সম্ভবত সেরকমই কিছু হবে। কিন্তু এটাকে কী নেপোলিয়নের ডায়রি বলে চালানো যাবে কি-না তা নিয়ে বিতর্ক হতেই পারে।

    পাতাগুলো উল্টাতেই একটা অসংগতি চোখে পড়ল। কয়েকটা পাতা নেই। আর বেশ কিছু শব্দের চারপাশে গোল করে দাগ দেয়া। দেখেই বোয়া যায় যে, পাতাগুলো টেনে ছেঁড়া হয়েছে। ডায়রির সাথের বর্ণনা লেখা কাগজটা থেকে জানা যায় যে, বইটা ফ্রান্সের সম্রাটের সাথে সেন্ট হেলেনায় তার শেষ দিনগুলো পর্যন্ত ছিল।

    খুব আগ্রহ থাকার পরও কার্ট বইটা বন্ধ করে ঠিক আগের মতো করে মুড়ে রেখে দিল। জিনিসটা খুবই টানছে ওকে তবে ওকে এখন আগে মিসরীয় জিনিস খুঁজতে হবে। কারণ কেনসিংটনের খুনী সেটাই খুঁজছিল।

    এরপরে কার্ট বিশাল বড় দুটো কাঁচে ঘেরা ট্যাংক দেখতে পেল। প্রথম ট্যাংকটায় পোর্সেলিনের তাকে অসংখ্য দামি দামি জিনিস রাখা। জিনিসটা দেখতে বড় একটা ডিশওয়াশের মতো লাগছে। পরেরটায় বিশাল বড় দুটো কামানের নল। ট্যাঙ্কের পাশের কাগজ থেকে জানা যায় যে ট্যাঙ্ক দুটো পাতিত পানি দিয়ে ভরা। তার মানে জিনিসগুলো সদ্য সমুদ্রতল থেকে উদ্ধার করা হয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে সমুদ্রের পানিতে থেকে যে লবণ এগুলোর গায়ে জমা হয়েছে তাকে অপসারণের জন্য এই ব্যবস্থা।

    ও গ্লাসের ভেতর দিয়ে উঁকি দিল। মিসরীয় কিছু নেই ওর ভেতর। এতে পুরো বাজার করতে যাওয়ার মতো। সব সময়ই আমি উল্টো দিকে জিনিস খুঁজে হয়রান হই।” বিড়বিড় করল কার্ট।

    তারপর ওই সারি বাদ দিয়ে পাশের সারি দেখতে গেল। কিন্তু সাথে সাথেই হামাওঁড়ি দিয়ে কোণের ছায়ার দিকে ঢুকে গেল। সামনের আবছায়ার মধ্যে নাড়াচাড়া দেখা যাচ্ছে। একজন লোক আর একজন মহিলা। অবাক করা ব্যাপার হলো দুজনেরই পরনে পার্টিতে আসার পোশাক। আর দুজনেরই হাতে পিস্তল।

    .

    ২৭.

    কার্ট ইয়ারফোনের সুইচ টিপে জো কে বলল, “এদিকে দুজন লোক দেখা যাচ্ছে।”

    “এদিকে আমিও একা না।” জো জবাব দিল।

    “ঘরের মাঝের দিকে চলে এসো। আমাদেরকে লুকাতে হবে।” কার্ট বলল। কার্ট ঘুরে আবার সেই পাতিত পানির ট্যাঙ্কের কাছে চলে এলো। জোও সেখানেই এসে হাজির হলো।

    “অফিস থেকে একজন লোক এসেছে। সারা গায়ে ছোট বড় অস্ত্র ঝোলানো।” জো বলল। “গার্ডের ড্রেস পরা, কিন্তু অন্য আরেকটা লোকের পিঠে পিস্তল ঠেকিয়ে নিয়ে এসেছে। বিপজ্জনক লোক দেখলেই বোঝা যায়। ধরা খেলে জান নিয়ে ফিরতে হবে না। হয় লুকিয়ে থাকতে হবে না হয় ওদিক দিয়ে কেটে পড়াই উত্তম।” কার্ট যেদিক থেকে এসেছে সেদিকে দেখালো জো।

    “ওদিকে যাওয়া যাবে না, এক ব্যাটা আর বেটি পিস্তল হাতে ওদিক দিয়েই আসছে।”

    “গার্ড নাকি?”

    “গার্ডরা নিশ্চয়ই টাক্সিডো আর গাউন পরে না। এরা নিশ্চিত পার্টি থেকেই আসছে।”

    আর কিছু বলার আগেই কঙ্কিটের মেঝেতে চাকা গড়ানোর ঘড় ঘড় আওয়াজ শুনতে পেল ওরা। একজোড়া ফ্লাশ লাইটের আলোও দেখা গেল শেল্ফগুলোতে অলসভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছে। জো-র দেখা দলটা কাছাকাছি চলে এসেছে।

    “আবারও গিয়ে বক্সটার ভেতরে ঢুকবো নাকি?” জো জিজ্ঞেস করল। কার্ট চারদিকে তাকাল। দ্বিতীয় গ্রুপটাকে কোথাও দেখা যাচ্ছে না। আর এভাবে উল্টোপাল্টা কোনো দিকে গিয়ে কোনো বন্দুকধারীর সামনে পড়তে চায় না। আর একজন দুজন তো না। সব মিলিয়ে অনেকজন এখন।

    “না, লুকাতে হবে দ্রুত।” কার্ট বলল।

    “কিন্তু এখানে তো খুব বেশি আড়াল নেই।”

    জোর কথা ঠিক। শেগুলোতে অনেক জিনিস। ওগুলোর আড়ালে যাওয়ার উপায় নেই। উল্টো দিকে তাকিয়ে কামানের নল ভর্তি অ্যাকুরিয়ামের মতো দেখতে ট্যাঙ্কটা চোখে পড়ল। ওটাই ওদের একমাত্র ভরসা। “ভিজতে হবে চলো।”

    জো ঘুরে ট্যাঙ্কটা দেখে মাথা ঝাঁকালো। ট্যাঙ্কের পাশের ছোট্ট মইটা ধরে ওঠে যতটা সম্ভব আস্তে নেমে পড়ল নিচে। বুঁদ বুদ আর ঢেউগুলো মিলিয়ে যেতেই ওরা প্রথম কামানের নলটার পিছনে চলে গেল। তারপর ওটার ওপর দিয়ে এমনভাবে মাথা ভাসিয়ে রাখলো যেন শিকারের আশায় একটা কুমির কোনো গাছের গুঁড়ির পিছনে লুকিয়ে আছে।

    প্রথম গ্রুপটা ওদের পাশ দিয়ে চলে গেল। পাঁচজন লোক তিনজনের হাতে বন্দুক; একজন একটা ট্রলি ঠেলছে আর একজন সম্ভবত ওদের কয়েদী। পিঠের ওপর পিস্তল তাক করা। সবার পরনেই এখানকার সিকিউরিটিদের পোশাক। তবে ওরা একবারও ট্যাঙ্কটার দিকে তাকালও না। দ্রুত পরের সারির দিকে গিয়ে উধাও হয়ে গেল।

    “ওরা এখান থেকে কিছু একটা নিতে এসেছে।” কার্ট ফিসফিস করে বলল। তারপর আর কিছু বলার আগেই জোড়াটাকে দেখা গেল। তবে ওরা আগের দলটার সাথে যোগ দেয়ার বদলে খুব সাবধানে পা টিপে টিপে এই সারিটার দিকে এগুলো। তারপর শেফের জিনিসপত্র পরীক্ষা করতে লাগল।

    কার্ট ওদের ফিসফিসানি শুনতে পাচ্ছে। অ্যাকুরিয়ামের পিছনের দেয়ালটা সামনের চেয়ে উঁচু। ওটায় বাড়ি খেয়ে শব্দ ওর কানে আসছে।

    “মহিলাটা তো সেই!” জো ফিসফিস করে বলল।

    মহিলাটা লম্বা, একহারা। পরনে কালো গাউন। তার আবার একপাশ কাটা। তবে পায়ের হিলের বদলে ফ্লাট স্যান্ডেল। সে উবু হয়ে শেলফের জিনিস পরীক্ষা করছে।

    “এই তো আরেকটা তবে কি লেখা পড়তে পারছি না। অন্ধকার বেশি।” মহিলা বলল।

    টাক্সিডো পরা নোকটা চারপাশে তাকিয়ে বলল, “আপাতত কেউ নেই। ফোনের লাইট জ্বালিয়ে দেখো।”

    মহিলা হাত দিয়ে ঢেকে মোবাইলের আলোতে কাগজটা পড়তে লাগল, “এটা না” হতাশ সুরে বলল সে।

    লোকটা আবার আশেপাশে তাকিয়ে বলল, “তাড়াতাড়ি করো। আশেপাশে লোকজন অনেক বেশি। পরিস্থিতি বিচারে খুবই ভালো সিদ্ধান্ত।

    সাইলেন্সর লাগানো পিস্তলটা শক্ত করে চেপে ধরে ওরা প্রস্থান করল।

    “আমার মনে হয় এরা ওদের সাথে না।” কার্ট বলল।

    “হায় হায়, চোরের দল তাহলে কয়টা?” জো বলল।

    “অনেক। পশ্চিমা বিশ্বে এটাই সম্ভবত সবচেয়ে কম সুরক্ষিত গুদাম ঘর।” কার্ট বলল।

    “আমরাই একমাত্র বেকুব যারা অস্ত্র আনিনি। জেনে শুনে বিষ পান করা আর কি।” জো জবাব দিল।

    কার্টও একমত, তবে আরেকটা ব্যাপারে ওর মন খুঁত খুঁত করছে।

    “টাক্সিডো পরা লোকটার কণ্ঠ খেয়াল করেছ? আমার কাছে কেমন পরিচিত পরিচিত লাগল।

    “আমারো। তবে ধরতে পারছি না কার।” জো বলল।

    “আমিও না। অন্ধকারে চেহারাটাও ঠিকমতো দেখতে পারিনি। তবে আমি নিশ্চিত যে এই কণ্ঠ আগেও শুনেছি।”

    আপাতত আশেপাশে কেউ নেই। “দেব নাকি দৌড়?” জো জিজ্ঞেস করল।

    “দরজা পর্যন্তই যেতে পারবে না। আমাদেরকে আগে সবাইকে এখান থেকে ভাগাতে হবে, তারপর কর্তৃপক্ষকে খবর দিতে হয়। আর তা করার একমাত্র উপায় হলো ফায়ার এলার্ম চালু করা। আশেপাশে কোথাও দেখেছো?” কার্ট বলল।

    জো সিলিং এর দিকে আঙুল তুলে বলল, “এগুলো দিয়ে হবে না?”

    কার্ট ওপরে তাকাল। অনেক পাইপ দেখা গেল সেখানে। কারেন্টের গ্রিডের মতো এক জায়গায় এসে জড়ো হয়েছে। সেগুলোর জায়গায় জায়গায় নজেল দেখা যাচ্ছে। তার পাশেই মোচাকৃতির সেন্সর। সেগুলোতে সবুজ নির্দেশক জ্বলছে। ওগুলো নিশ্চয় তাপ বা আগুন সনাক্তকারী।

    “ওখানে উঠতে পারবে?” কার্ট জিজ্ঞেস করল।

    “তুমি কি জানো তুমি এই মুহূর্তে সেন্ট ইগনাশিও জ্যাঙ্গল জিম চ্যালেঞ্জের চ্যাম্পিয়নের সাথে কথা বলছো?” জো বলল।

    “জিনিসটা কি তা আমার কোনো ধারণাই নেই। তবে উত্তরটা হা ধরে নিচ্ছি।” কার্ট বলল।

    “আরে শেলফের তাকগুলোয় পাড়া দিলেই উঠে যাওয়া যাবে।”

    সামনের দিকে আরেকবার তাকিয়ে জো ট্যাঙ্ক থেকে বের হয়ে ওটার মইটা শেরে গায়ে ঠেকিয়ে ওঠতে লাগল। প্রথম তাকটায় উঠেই ও ওপরের তাকে হাত দিয়ে শরীরটাকে পরের তাকে টেনে তুললল। সিলিং-এর কাছে যেই পৌঁছেছে তখনই কোথাও কয়েকটা গুলির আওয়াজ পাওয়া গেল। পর মুহূর্তেই আশেপাশে নরক ভেঙে পড়ল।

    .

    ২৮.

    কার্ট সাবধানে আশেপাশে উঁকি দিল। গোডাউনের একদম ভেতর থেকে আসছে গুলির শব্দ।

    ‘ধেৎ!” বিড়বিড় করল কার্ট। তারপর ভালো করে দেখার জন্যে পানি থেকে উঠে এলো।

    জো আড়ালে লুকালো আর কার্ট পাশের সারির শেষ মাথার দুই দলের মারামারি দেখার চেষ্টা করল। ফিটফাট পোশাক পরা দুজন আর গার্ডের পোশাক পরা দলটার মধ্যে গুলি বিনিময় হচ্ছে।

    ফিটফাট দলটা দুদিক থেকেই গুলি খাচ্ছে। তবে তাতে তারা ঘাবড়ে গেছে বলে মনে হলো না। বরং দারুণভাবে সেগুলোর প্রত্যুত্তর দিয়ে দিয়ে পিছিয়ে আসছে।

    হঠাৎই একজন গার্ড উন্মত্ত হয়ে সাবমেশিন গান দিয়ে গুলি করা শুরু করল আর একটা মাটির ফুলদানি ভেঙে চুরমার হয়ে গেল। মাটি, ধুলো আর ফুলদানির ভাঙ্গা টুকরোয় গলিটা ভরে গেল। এর মধ্যেই এলোমেলো গুলি চলতেই থাকল। গ্লাসের ট্যাংকটাতেও লাগল কয়েকটা গোল গোল দাগ হয়ে গেল ওটার গায়ে, সাথে সূক্ষ্ম ফাটল ছড়িয়ে গেল দশদিকে।

    টাক্সিডো পরা লোকটা গুলি এড়াতে একদিকে লাফ দিল। তারপর সটান উঠে দাঁড়িয়ে মহিলাটাকে টান দিয়ে একপাশে সরিয়ে পিছু হটলো। তারপর গলিটার ধার ঘেষে দাঁড়িয়ে গুলি করতে লাগল। লোকটা ফোন কানে লাগিয়ে বলল, “ম্যাকড, চেয়ারম্যান বলছি। ঝামেলা হয়ে গিয়েছে এদিকে। গুলি খেয়ে মরার দশা। এখান থেকে বের হওয়া দরকার এখুনি।”

    চেয়ারম্যান…।

    মহিলা আরেকদিকে গুলি করে বললো, “হুয়ান, ওরা আমাদেরকে ঘিরে ফেলছে। এখুনি সরে যেতে হবে।”

    “হুয়ান? হুয়ান ক্যাব্রিলো?” কার্ট ভাবছে মনে মনে।

    হুয়ান ক্যাব্রিলো, কর্পোরেশনের চেয়ারম্যান। কয়েক বছর আগে NUMA’র • একটা অপারেশনে ডার্ক পিটকে সাহায্য করতে গিয়ে একটা পা হারিয়ে ছিল লোকটা। উনি ওরিগন নামের একটা জাহাজের ক্যাপ্টেন। জাহাজটা বাইরে থেকে দেখতে লক্কর ঝক্কর হলেও আসলে ভেতরে পৃথিবীর সবচেয়ে আধুনিক প্রযুক্তি আর অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে সজ্জিত।

    হুয়ান আর তার সঙ্গিনী এখানে কি করতে এসেছে এ সম্পর্কে কার্টের বিন্দুমাত্র ধারণা নেই। তবে দেখতেই পাচ্ছে বেচারারা মারাত্মক বিপদে পড়তে যাচ্ছে। একে তো এরা মাত্র দুজন, গুলিও ফুরিয়ে আসার কথা এতোক্ষণে। কিছুক্ষণের মধ্যেই এদেরকে ঘিরে ফেলবে গার্ডের দল।

    গোলাগুলির মাঝেই আরেকদল গার্ড ঢুকলো ওখানে। তারপর গলির মাঝখানে কার্টের ঠিক সামনে বসে ক্যাব্রিলোর দিকে মারার জন্যে একটা C-4 রেডি করতে লাগল।

    কার্ট আর বসে থাকতে পারলো না। কামানের নলটার গায়ে কাঁধ ঠেকিয়ে কাঁচের দিকে ধাক্কা দিতে লাগল। তারের ওপর ভর করে দুলতে দুলতে সেটা সোজা গিয়ে আঘাত করলো সামনের কাছে। কাঁচের গায়ের ফাটলগুলো আরো একটু লম্বা হলো তবে ভাঙলো না পুরোপুরি। কামানের নলটা পিছন দিকে সরে এসে আবার সামনে ধেয়ে গেল। কার্ট পিছন থেকে আরো জোরে ধাক্কা দিল। এবার ঠিকই পাঁচশো পাউন্ড ওজনের নলটা সোজা কাঁচের দেয়াল ভেদ করে বেরিয়ে গেল। দশ হাজার গ্যালন পানি ট্যাঙ্কটা থেকে বেরিয়ে মেঝেতে ছড়িয়ে পড়ল। সেই সাথে বিস্ফোরক হাতে দাঁড়ানো লোকগুলোকে নিয়ে পাশের শেলফে আছড়ে ফেলল। কার্টও পানিতে ভেসে বাইরে চলে এসেছে। সোজা গিয়ে পড়ল এক গার্ডের ওপরে। ও দ্রুত পিছিয়ে এসে লোকটার চোয়াল বরাবর বিরাশি সিক্কার এক ঘুসি বসিয়ে দিল।

    দ্বিতীয় আততায়ীও উঠে বসার চেষ্টা করতেই কিছু একটা এসে ওর মাথাটা থেতলে দিল। ওপরে কোথাও থেকে জালা ছুঁড়েছে জিনিসটা।

    কার্ট বিস্ফোরকের টুকরাটা হাতে নিয়ে কারেন্টের তার দুটো আলগা করে দিল তারপর ক্যাব্রিলোর দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে বলল, “হুয়ান এই দিকে আসুন।”

    ক্যাব্রিলো গলিটার দিকে চাইলো। ইতস্তত করছে। ধোকা কি-না নিশ্চিত না। “তাড়াতাড়ি, আপনাদেরকে ঘিরে ফেলল।” কার্ট আবারো চেঁচালো। ইতস্ত ত ভাব কেটে গেল। “দৌড় দাও।” সঙ্গিনীকে বলল হুয়ান। মহিলা নির্দ্বিধায় দৌড় দিল। ক্যাব্রিলোও আরো কয়েকটা গুলি করেই পিছু নিলো। তারপর কার্টের পাশে হামাগুড়ি দিয়ে বসে পড়ল।

    “কার্ট অস্টিন।” যেন বিশ্বাস হচ্ছে না এমনভাবে মাথা নাড়তে নাড়তে বলল হুয়ান।

    “এই চুলোয় মরতে এসেছেন কোন দুঃখে?”

    “দেখেতো মনে হচ্ছে আপনার প্রাণ রক্ষা করতেই এসেছি। আপনি?”

    লম্বা কাহিনী। মোনাকোর ব্যাপারটার সাথে সম্পর্ক আছে অবশ্য।”

    ব্যস্ততার মাঝেও কার্ট মোনাকো গ্রাণ্ড প্রিক্স-এর দুর্ঘটনাটার কথা শুনেছে। গত কয়েক দিন ধরে ল্যাম্পেডুসার ঘটনা আর এই ঘটনাটা চব্বিশ ঘণ্টা টিভির খবরের শিরোনাম হিসেবে প্রতিযোগিতা করছে। কার্ট ঘুসি মেরে অজ্ঞান করা লোকটার পিস্তল তুলে নিয়ে এবার নিজেও মারামারিতে অংশ নিলো।

    গার্ড-সাজা লোকগুলো আড়াল নিয়েছে। হঠাৎ দুজনের জায়গায় প্রতিপক্ষ তিনজনে পরিণত হওয়ায় আর পানির তোড়ে নিজেদের লোকজন ভেসে যেতে দেখায় ওরা আগের চেয়ে সতর্ক হয়ে গিয়েছে। ফলে গুলি বর্ষণ আপাতত বন্ধ।

    “হচ্ছেটা কী এখানে?” মহিলা মুখ খুললো এতোক্ষণে।

    “পুরনো দোস্ত।” ক্যাব্রিলো এক কথায় ব্যাখ্যা করল সব।

    কার্ট মহিলার দিকে ফিরে তাকাল। কে হতে পারে ভাবছে। “আপনার নাম কি সোফি?” প্রশ্ন করল কার্ট।

    মহিলাও বিরক্ত চোখে ওর দিকে তাকিয়ে বলল, “নাওমি।”

    কার্ট কাঁধ ঝাঁকালো। “কাছাকাছি হয়েছিল।”

    ক্যাব্রিলো দাঁত বের করে হাসলো তারপর বলল, “আসলে এখানে কী করতে এসেছেন বলুন তো?”।

    কার্ট ওদিকের লোকগুলোকে ইঙ্গিতে দেখিয়ে বলল, “ল্যাম্পেডুসার ঘটনার জন্যে ঐ লোকগুলো সম্ভবত দায়ী।”

    “NUMA কী ঘটনাটা তদন্ত করছে নাকি?”

    “অন্য আরেক সরকারের হয়ে।”

    ক্যাব্রিলো মাথা ঝাঁকালো। “তার মানে তো আমাদের কারো হাত-ই খালি নেই। কোনো সাহায্য-টাহায্য লাগবে নাকি?”

    আরেক দফা গুলি করা হলো ওদিক থেকে। তিনজনই পারলে মাটির সাথে মিশে যায়। ওই অবস্থা থেকেই পাল্টা গুলি করল ওরা। আততায়ীর দল পিছু হটলো আবার।

    “কি আর সাহায্য করবেন। আমি আসলে এখানে একটা মিসরীয় পুরাকীর্তি খুঁজছিলাম।”

    “তাহলেই হয়েছে। এখানে কোনো জিনিস খুঁজে পাওয়া সম্ভব না। আমরা বহুক্ষণ ধরে নেপোলিয়নের একটা বই খুঁজলাম। বইটা ওনার কাছে মরার আগ পর্যন্ত ছিল।”

    “হোমারের ওডিসি নাকি? ফাঁকা জায়গাগুলোতে হাতে কি সব লেখা?” কার্ট জানতে চাইলো।

    “হা, ওটাই। দেখেছেন নাকি আপনি?”

    এতক্ষণ ধরে গোলগুলির কোনো ধারাবাহিকতা নেই। হঠাৎ মাঝে মাঝে গুলি ছোঁড়া হচ্ছে। আর যেহেতু দুই দলই আড়ালে আছে তাই মাঝখানের খালি জায়গাটা সবচে মারাত্মক।

    “কিন্তু ঐ দিকে যাওয়াটা তো সম্ভব বলে মনে হচ্ছে না।” হুয়ান জানালো।

    “আমার মাথায় একটা বুদ্ধি এসেছে।” কার্ট বলল। তারপর ওপরে তাকিয়ে জোর-এর উদ্দেশ্যে শিস বাজালো।

    জো আবার স্মোক ডিটেক্টরের দিকে বেয়ে উঠতে লাগল। কিন্তু একদম সবার ওপরের তাকেও উঠে দেখা গেল সেন্সরের নাগাল পাচ্ছে না। সামনে থেকে একটা বক্স সরিয়ে শরীর টান টান করে দিল সামনে। কিন্তু এর ফলে ওকে ওপাশ থেকে দেখে ফেলল একজন। লোকটা গুলি করল ওর দিকে। সিলিংটা বুলেটে ঝাঁঝরা হয়ে গেল।

    কার্ট সেদিকে তাকিয়ে পিস্তল তাক করল। কিন্তু ক্যাব্রিলো ওর আগে গুলি করল। এক গুলিতেই লোকটা কুপোকাত।

    লোকটা পড়ে যেতেই আবার হাত বাড়িয়ে স্মোক ডিটেক্টরের পাশে ওর টীজারটা চেপে ধরলো। চারহাজার ভোল্টের বিদ্যুতের বিচ্ছুরণে যে স্ফুলিঙ্গ উৎপন্ন হলো, তাতেই সেন্সরের কাছে সেটা আগুন হিসেবে বিবেচিত হলো। সাথে সাথে কান ফাটানো শব্দে অ্যালার্ম বাজা শুরু হলো, আশেপাশের লাইটগুলো ঘনঘন জ্বলতে-নিভতে আরম্ভ করল আর গোডাউন জুড়ে কার্বন ডাই-অক্সাইড গ্যাস বের হওয়া শুরু হলো।

    এক সেকেন্ড পরই আততায়ীর দল উল্টো ঘুরে দৌড় দিল। জো সেন্সর থেকে টীজার সরাতেই কার্বন-ডাই-অক্সাইড সঞ্চালন বন্ধ হয়ে গেল। তবে আশেপাশে খবর হয়ে গিয়েছে। লোকজন আসবেই দেখতে।

    “এখান থেকে চল্লিশ ফুটের মতো দূরে। বামদিকের প্রথম শেলকেই পাবেন। আপনার জায়গায় আমি থাকলে যতো দ্রুত সম্ভব কাজটা সেরে পালাতাম।” কার্ট বলল।

    ক্যাব্রিলো হাত বাড়িয়ে বলল, “আবার দেখা হবে।”

    কার্ট হাতটায় ঝাঁকি দিয়ে বলল, “আশা করি তখন গুলির বদলে ভালো কিছু খাবো।”

    লোকটা আর মহিলাটা সামনের দিকে ছুটলো। জোও নেমে এসেছে শেলফ থেকে।

    “আমি যার কথা ভাবছি উনি কী সে-ই নাকি?” নামতেই বলল জো। কার্ট মাথা আঁকালো। “এতো ভালো দুজন মানুষের সাথে এই রকম মরার গোডাউনে দেখা হলো। যাই হোক, এখান থেকে ভাগা যাক চলো।”

    ওরা বেরিয়ে মাল খালাস করার জায়গাটায় পৌঁছেই দেখে কয়েকটা অগ্নি নির্বাপনকারী ট্রাক আর পুলিশের গাড়ি পিছন দিয়ে ঢুকছে। অনুষ্ঠানের আসল সিকিউরিটি দলকেও দেখা গেল এদিকেই আসছে।

    “পাশের দরজা।” জো বুদ্ধি দিল।

    ওরা আবার গোডাউনে ঢুকে পড়ল তারপর সেটা পার হয়ে শেষ মাথার আরেকটা দরজার দিকে দৌড়ে গেল। জো দরজাটা খুলে বাইরেটা দেখে বলল, “কেউ নেই।”

    ওরা দরজা গলে গলিটায় নেমে পাঁচ কদম না যেতেই ঠিক ওদের মাথার ওপর একটা স্পট লাইট জ্বলে উঠল। আর ছাদ থেকে লাল আর নীল রঙের আলো বের করা একটা গাড়ি ছুটে এলো ওদের দিকে। জায়গায় জমে গেল ওরা, হাত তুলে ফেলেছে আগেই।

    “কে জানে আগের দিন যারা আমাদের গ্রেফতার করেছিল সেই পুলিশগুলোই কি-না। শালারা ভালোই খাতির করেছিল আগের দিন।” জো বলল।

    “সেরকম হলে তো ভালোই হয়।” কার্ট জবাব দিল।

    ওদের সামনে এসে গাড়িটা থামতেই দুজন অফিসার নেমে এলো। হাতে উদ্যত পিস্তল। কার্ট আর জো কোনো বাধা দিল না। বিদ্যুৎ গতিতে ওদের হাতে হাতকড়া পরিয়ে গাড়িতে তুলে ওখান থেকে বের করে নিয়ে আসা হলো। কার্ট অবাক হয়ে খেয়াল করল ওদেরকে শহরের দিকে না নিয়ে শহর থেকে দূরে কোথাও নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। তারপর সেই আগের থানাতেই ফিরে এলো।

    “আমাদের একটা ফোন করতে হবে তাই না?” কার্ট বলল। একটা হাসিমুখ ওদের দিকে ফিরে বলল, “ইতোমধ্যেই আপনাদের পক্ষ থেকে একটা ফোন করা হয়েছে। লোকটার কথার টানে ভূমধ্যসাগরীয় টান নেই, বরং কেমন একটা লুইজিয়ানার মানুষের মতো টেনে টেনে কথা বলছে।” চেয়ারম্যান নিজেই করেছেন ফোনটা।”

    অফিসার এক গোছা চাবি ছুঁড়ে দিল কার্টের দিকে। “আমি ম্যাকড।” পরিচয় দিল লোকটা। “এ সকল পরিস্থিতিতে আমাকে বন্ধু ভাবতে পারেন।”

    কার্ট দাঁত বের করে হাসলো। তারপর নিজের হাতকড়া খুলে জো’র টাও খুলে দিল। গাড়ির লাইট আর সাইরেন ততোক্ষণে বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। কয়েক মিনিট পরেই ওদের হোটেল থেকে কয়েক ব্লক আগে ওদেরকে নামিয়ে দেয়া হলো।

    “উদ্ধার করে আনার জন্য ধন্যবাদ। হুয়ানকে বলবেন একটা খাওয়া পাওনা হয়েছে ওনার।”

    ম্যাকড হাসলো, “উনি কখনোই আপনাকে টাকা দিতে দেবেন না। তবে আপনি যে খাওয়াতে চেয়েছেন সেটা আমি জানাবো ওনাকে।”

    কার্ট দরজাটা লাগিয়ে দিতেই, ম্যাকড ড্রাইভারকে ইশারা করল আর গাড়িটা চলতে শুরু করল।

    “এই মিশনটা কোনোভাবে হুয়ান আর ওদের লোকদের ঘাড়ে চাপানো যায় না?” জো জিজ্ঞেস করল।

    “যেত, কিন্তু ওরা নিজেরাই বহুত ঝামেলায় আছে।” কার্ট জবাব দিল। তারপর হোটেলের দিকে হাঁটা শুরু করল। ওদের গা থেকে তখনো পানি ঝরছে। গুলির শব্দে লাগা কান তালা এখনো খোলেনি। তবে রাস্তায় কোনো লোক না থাকায় ওদেরকে কেউ খেয়াল করল না। কিন্তু এতো চেষ্টার পরও–এতো ঝুঁকি নেয়ার পরও যে তিমিরে ছিল সেই তিমিরেই পড়ে রইল ওরা।

    “সন্ধ্যাটা অদ্ভুতভাবে কাটলো।” কার্ট বলল।

    “এটা বছরের সবচেয়ে ভুয়া কথা।” জো জবাব দিল।

    হোটেলে ঢুকে ক্লান্ত দেহে পা টেনে টেনে নিজেদের রুমে ঢুকেই দেখে রেনাটা বসে আছে। চোখমুখ ঝলমল করছে খুশিতে।

    “আরে আপনাদের এই দশা কীভাবে হলো?”

    কার্ট তার জবাব না দিয়ে বলল, “আপনি তত ভালোই মজায় আছেন মনে হচ্ছে।” তারপর দরজা আটকে একটা চেয়ার টেনে বসে পড়ল।

    “শহরের পুলিশের গাড়ি দৌড়াতে দেখলাম। আপনাদের কাজ নিশ্চয়ই?”

    “শুধু আমাদের না, আজকের পার্টিটা কেউই ভুলতে পারবে না।”

    কার্ট আশা করল রেনাটার হাসির পিছনে ভালো কোনো কারণ আছে।

    “সোফি সিলিনকে খুঁজে পেয়েছেন?”

    “সত্যি কথা হচ্ছে, হ্যাঁ পেয়েছি। আর সে থাকেও খুবই কাছে।” জবাব দিল রেনাটা।

    .

    ২৯.

    খবরটা শুনেই কার্টের সব ক্লান্তি দূর হয়ে গেল। “দেখা করতে যাবো কখন?”

    “আশা করি খুব দ্রুত তার সাথে দেখা করার সৌভাগ্য হবে না। কারণ তিনি আর ইহজগতে নেই।” রেনাটা জবাব দিল।

    খারাপ খবর। কার্টের কাছে অন্তত সেটাই মনে হলো। “সেজন্যে তো আপনার মন খারাপ বলে মনে হচ্ছে না।”

    “অনেকদিন হয়ে গেল তো, শোক কাটিয়ে উঠেছি। ভদ্র মহিলা মারা গিয়েছেন ১৮২২ সালে।”

    কার্ট জো-এর দিকে তাকিয়ে বলল, “মাথামুণ্ডু কিছুই তো বুঝতে পারছি না।”

    জো মাথা নাড়লো, “অতিরিক্ত কার্বন-ডাই-অক্সাইড আমার ব্রেনের কার্যক্ষমতা কমিয়ে দিয়েছে নিশ্চয়ই, কারণ আমি উল্টাপাল্টা শুনছি।” জো বলল।

    “মজা করছো জানি। কিন্তু ভেবে দেখো ব্যাপারটা। সোফি সি, কে? আর ১৮২২ সালে মারা যাওয়া একজন মহিলার সাথে ড, কেনসিংটন আর ল্যাম্পেডুসার ঘটনার কী এমন সম্পর্ক থাকতে পারে?”

    “সোফি সি, মানে হলো সোফি সিলিন।”

    “কাছাকাছি হয়েছিল আমারটা।” জো বলল।

    কার্ট কিছু বলল না জবাবে। রেনাটাকে বলল, “কে এই মহিলা?”

    “সোফি সিলিন ছিল পিয়েরে আনডিন-এর দূর সম্পর্কের মামাতো বোন আর গোপন প্রেমিকা। পিয়েরে আনডিন ছিলেন ফরাসি বিপ্লবের পর গঠিত ফ্রেঞ্চ লেজিশ্লেটিভ এসেম্বলীর সম্মানিত সদস্য। নিজেরা অন্যদের সাথে বিবাহিত হওয়ায় তাদের পক্ষে হয়তো এক হওয়া সম্ভব হয়নি। কিন্তু ভালোবাসাও তাতে আটকে থাকেনি। আর তারই ফসল হিসেবে একটা সন্তানও জন্ম নেয়।”

    “এতো দেখি কেলেঙ্কারির ব্যাপার স্যাপার।” কার্ট বলল।

    “হ্যাঁ। কেলেঙ্কারি হোক আর যা-ই হোক সন্তানটার জন্ম ছিল আনডিন-এর জন্য বিশেষ কিছু। তাই ও খুশি হয়ে নিজের প্রভাব খাঁটিয়ে ফ্রেঞ্চ নৌ-বাহিনীর একটা জাহাজের নাম বাচ্চার মায়ের নামে রাখতে বাধ্য করে।

    “উপহার হিসেবে?” জো জিজ্ঞেস করল।

    “আমিতো জানতাম বেশিরভাগ মেয়েই গয়না পছন্দ করে।” জো বলল।

    “একমত,” জানালো রেনাটা।

    “তা সোফির কি হলো?” কার্ট আবার ফিরিয়ে আনলো মূল কথায়। রেনাটা পায়ের ওপর পা তুলে বলল, “মহিলা বৃদ্ধ বয়সে ঘুমের মধ্যে মারা যান। তারপর তাকে প্যারিসের বাইরের একটা ব্যক্তিগত কবরস্থানে সমাহিত করা হয়।”

    কার্ট আসল ব্যাপারটা বুঝলো এতোক্ষণে, “তার মানে কেসিংটন আসলে সোফি সি. দিয়ে ঐ জাহাজটাকে বোঝাতে চেয়েছেন।”

    রেনাটা মাথা ঝাঁকালো। তারপর জাহাজটার ইতিহাস লেখা একতাড়া কাগজ কার্টকে ধরিয়ে দিল। “সোফি সি, ছিলো নেপোলিয়নের ভূমধ্যসাগরীয় নৌ-বহরের অন্তর্গত একটি জাহাজ। ফরাসি শাসনামলে জাহাজটা মাল্টাতেও একবার এসেছিল। দুর্ভাগ্যক্রমে মাল্টা বন্দর ছাড়ার কিছুদিন পরই জাহাজটা ঝড়ের কবলে পড়ে ডুবে যায়। তখন ওতে ছিল মিসর থেকে উদ্ধার করা নানা পুরাকীর্তি আর গুপ্তধন। দ্য চ্যাম্পিয়ন কমিশন এর তত্ত্বাবধানে জাহাজটা খুঁজে বের করে উদ্ধার করা হয়। এই কমিশনটা মাল্টার এক ধনাঢ্য পরিবারের অনুদানে পরিচালিত হতো। বহু বছর উদ্ধারকৃত পুরাকীর্তিগুলো নিজেদের ব্যক্তিগত সংগ্রহে রাখার পর সম্প্রতি তারা এর মধ্যে কয়েকটা বিক্রি করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। বিক্রয়ের নির্দিষ্ট অর্থ জাদুঘরও পাবে।”

    “এই জিনিসগুলোই আমাদের মারমুখী বন্দুরা কোনো টাকা পয়সা না। দিয়েই নিয়ে চলে গিয়েছে। জো বলল।

    “কেনসিংটন বলেছিলেন দুই লাখ ইউরো দিলেও ওরা নাকি টেবিলে বসার। মোগ্য-ই হবে না। আর ওরা এখন পুরো টেবিলটাই নিয়ে গেল।”

    জো এবার আসল প্রশ্নটা করল, “কেনসিংটন যেখানে আমাদেরকে নিলামে কোন কোন জিনিস উঠবে সেটাই বলছিলেন না, তো কোন দুঃখে এই সোফি সিলিন এর কথা বলতে গেলেন?”

    “যে কারণে আমরা উদয় হয়ে ওনাকে প্রশ্ন করা শুরু করার আগ পর্যন্ত লোকগুলো ওনাকে মেরে ফেলেনি। সম্ভবত ঐ ধ্বংসাবশেষে আরও কিছু আছে যেটা ওরা চায়। সম্ভবত ওটার খবর এখনো ফাস হয়নি।”

    “আমি যে মিসরীয় শিলালিপিটা দেখেছিলাম ওটা ভাঙ্গা ছিল।” পুরোটা ছিল না। খণ্ড খণ্ড। ওরা সম্ভবত বাকিগুলো খুঁজছে।” জো বলল।

    কার্ট রেনাটার দিকে ফিরে বলল, “জাহাজটা ডুবেছিল কোথায়?”

    রেনাটা হাতের বাকি কাগজটা বাড়িয়ে দিয়ে বলল, “এই হলো জাহাজটার অবস্থান। ভ্যালেট্টা থেকে তিরিশ মাইল পূর্বে।”

    “আমি যদ্দুর জানি, ওটা ফ্রান্স যাওয়ার রাস্তা না।” কার্ট বলল।

    “ওটার ক্যাপ্টেন ব্রিটিশ জাহাজের সামনে না পড়ার জন্যে এমনটা করেছিলেন। তাই প্রথমে পূর্ব দিকে যাওয়ার পরিকল্পনা করেন। তারপর উত্তরে। হয়তো ইচ্ছা ছিল সিসিলির উপকূল ঘেষে যাবেন বা সরাসরি সিসিলি আর ইতালির মাঝখান দিয়ে চলে যাবেন। শেষমেশ কোনোটা করার আগেই জাহাজ ঝড়ের কবলে পড়ে। ধারণা করা হয় উনি বন্দরে ফিরে আসতে গিয়েছিলেন। কিন্তু তার আগেই জাহাজ ডুবে যায়।”

    ঘটনা শুরুর পর এই প্রথম কার্টের মনে হলো যে ওরা চালে এগিয়ে গিয়েছে।

    “তারমানে এরপর কি করতে হবে তা আমাদের জানা। আর ওরা কি করবে সেটাও এখন জানি। যখনই ওরা টের পাবে যে এসব শিলালিপি আর ছবি আসলে ভাঙ্গা টুকরো আর খণ্ড অংশ, সাথে সাথেই ওরা ধ্বংসস্তূপ থেকে বাকি টুকরোগুলো উদ্ধারের চেষ্টা করবে।”

    “আমি হলেও সেটাই করতাম। তবে আমি এখনো ভেবে পাচ্ছি না এটার সাথে ল্যাম্পেডুসার দুর্ঘটনার কী সম্পর্ক? আর ঐ লোকগুলোই বা কি চায়? তবে যদি ব্যাপারটা আসলেই এতো গুরুত্বপূর্ণ না হয় তাহলে ওরা এটার পিছনে লাগবে না। তারপরও আমার মনে হয়, ওদের আগেই আমাদের জাহাজের ধ্বংসাবশেষটার খোঁজ করা উচিত।”

    .

    ৩০.

    কার্ট, জো, ডা. আমব্রোসিনি আর প্রয়োজনীয় লোকবলসহ সী ড্রাগন ভ্যালেট্টা বন্দর ত্যাগ করল। সাবধানতাস্বরূপ কার্ট বাকি সবাইকে দেশে ফেরত পাঠিয়ে দিয়েছে।

    “সোজা এই বরাবর চালাও।” ক্যাপ্টেন রেনল্ডসকে বলল কার্ট।

    “আই। তবে উত্তর দিকে না ঘুরলে যে আমরা ধ্বংসাবশেষের দেখা পাবো না সে কথা নিশ্চয়ই বুঝতে পারছো?” রেনল্ডস বলল।

    “আর কারো মুখোমুখি যাতে না হতে হয় সেজন্যেই দূরে থাকতে চাইছি।” কার্ট মাথা ঝাঁকিয়ে নিজের মনিটরের দিকে তাকিলে বলল, “আপনিই

    রেনল্ডসকে সব বুঝিয়ে দিয়ে কার্ট জাহাজের পিছন দিকে চলে এলো। জো আর রেনাটা মিলে গ্লাইডার (ইঞ্জিন বিহীন বিমান) জোড়া লাগাচ্ছে।

    “ওড়ানো যাবে এখন?”

    “প্ৰায়।” রেনাটা বলল। তারপর গ্লাইডারের গিটুগুলো শক্ত হয়েছে কি-না পরীক্ষা করে ওটার নিচে বসানো ক্যামেরাটা অন করে দিল।

    “রেডি।”

    কার্ট জাহাজের কপিকলের হাতলের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। এটা সাধারণত ফ্যাদো মিটার ওঠা-নামা করার জন্য ব্যবহার করা হয়। তবে এখন ওটার স্টিলের তার সরিয়ে সেখানে সরু প্লাস্টিকের সুতা প্যাঁচানো হয়েছে। আর এক প্রান্ত জোড়া দেয়া হয়েছে গ্লাইডারটার সাথে। জো সেটা হাতে করে জাহাজের সামনের দিকে চলে গিয়েছে।

    “রেডি। রেনাটা বলল।

    জো গ্লাইডারটার নিচের আড়কাঠ ধরে ওটাকে মাথার ওপর তুলে ধরলো। তারপর একটু জোরে বাতাস আসতেই ওঠা ওর হাত থেকে লাফ দিয়ে আকাশে ভেসে গেল।

    গ্লাইডার আকাশে উড়তেই কার্ট হাতল ঘুরিয়ে সুতা ছাড়তে লাগল আর ওটা আরো ওপরে উঠতে লাগল। উড়তে উড়তে ওটা জাহাজের পিছনে চলে যেতেই রেনাটা হাতের রিমোটের সাহায্যে ওটা নাড়াতে লাগল।

    গ্লাইডারটা পাঁচশো ফুট ওঠার পরেই ও ওটার আর ওঠা বন্ধ করে দিল। “এখানেই আটকে দিন।” কার্টকে বলল ও।

    কার্ট হাতল ঘুরানো বন্ধ করে দিল আর গ্লাইডারটা উচ্চতা স্থির রেখে সী ড্রাগনের পিছনে পিছনে আসতে লাগল। ওপর থেকে কেমন লাগছে দেখতে?”

    রেনাটা সুইচ টিপে গ্লাইডারের ক্যামেরা চালু করল। ওর ডান দিকে থাকা একটা মনিটরে ভিডিও দেখা গেল। শুরুতে সবকিছু ঝির ঝির করতে লাগল। রেনাটা ফোকাস ঠিক করে দিতেই সী ড্রাগনকে পরিষ্কার দেখা গেল। নীল রঙা একটা মাঠ চষে এগিয়ে চলেছে।”

    “ভালোই দেখা যাচ্ছে। দেখি আমাদের বন্ধুদের দেখা যায় কি-না।” বলল রেনাটা।

    ও ক্যামেরাটা উত্তর দিকে ঘোরালো। একজোড়া নৌকা চোখে পড়ল। শুরুতে মনে হচ্ছিলো সমুদ্রের বুকে এক টুকরো খড়ের মতো। ঠিক যেন একটা নীল টেবিল ক্লথের ওপর দুটো ধান পাশাপাশি পড়ে আছে। তবে ও ক্যামেরার ফোকাস ঠিক করতেই নৌকা দুটো ভালো করে দেখা গেল।

    “একটা ডুবুরিদের নৌকা আর একটা বজরা নৌকা। রেনাটা বলল।

    “আরো জুম করা যাবে?” কার্ট জিজ্ঞেস করল।

    “যাবে।”

    “বজরাটা আগে জুম করেন, কার্ট বলল।

    রেনাটা লেন্সটা লম্বা করে ফোকাস করতেই বজরার বিস্তারিত দেখা গেল। লাল রঙের কাঠামোয় সাদা রঙে লেখা “দ্য শ্যাম্পেন কনসারভেন্সি” একদিকে একটা ছোট ক্রেন বসানো। তাতে একটা বড় Pvc পাইপ ঝোলানো। ওটার ভেতর দিয়ে পানি আর বালি, কাদা এসব বেরুচ্ছে। পাইপের পানি পাশেই একটা ধাতুর তৈরি জালের ওপড় পড়ছে। হাতের মুঠির চেয়ে বড় যে কোনো কিছুই ওটায় আটকা পড়বে। তবে এখনো কিছু আটকায়নি। শুধু নীল সাগরের বুকে দুধ সাদা ফেনা সৃষ্টি করে বেরিয়ে যাচ্ছে পিছনে।

    “দেখেতো মনে হচ্ছে ওরা সাগর পরিষ্কার করছে।” জো মন্তব্য করল।

    “হুম! পুরো সাগরের তলাটাই দেখি পানির ওপর উঠিয়ে ফেলছে।” কার্ট বলল।

    ক্যামেরা আরেকটু নড়তেই দেখা গেল দুজন লোক নানান উদ্ধার করা জিনিস পরীক্ষা করছে। এক নজর দেখেই ওরা ওগুলো আবার পানিতে ফেলে দিল।

    “পাথর আর ঝিনুকের খোল, কার্ট অনুমান করল।

    “ওরা নিশ্চয়ই আরো বড় কিছু খুঁজছে! জাদুঘরে যেমন দেখেছিলাম ওরকম শিলালিপি বোধ হয়। এসব ছোটখাট গুপ্তধনে ওদের কিছু হবে না।” জো বলল।

    “ওরা যদি সত্যি সত্যিই কনসারভেন্সির লোক হতো তাহলে এগুলোকেও ওরা দাম দিতো। তবে আমার ধারণা ওরা সেটা না।” কার্ট বলল।

    তারপর রেনাটার দিকে ফিরে বলল, “অন্য নৌকাটার দিকে জুম করুন তো।”

    রেনাটা ক্যামেরা ঘুরিয়ে ষাটফুটি ডুবুরি নৌকার দিকে তাক করল। ডুব দেয়ার জন্য প্রয়োজনীয় নানান জিনিসে ডেকটা ঠাসা। নৌকাটার সামনের দিকে বেশ কিছু লোককে দেখা গেল। পায়ের ওপর পা তুলে রোদের মধ্যে বসে আছে।

    “এরা হয় ইয়োগা করছে নয়তো…”

    লোকগুলোর ঠিক পেছনেই আরেকটা লোক দাঁড়ানো। তার হাতে একটা লম্বা নলের রাইফেল।

    রেনাটা আরো বেশি জুম করার চেষ্টা করল কিন্তু লোকটার চেহারা স্পষ্ট হলো না। “লোকটার চেহারা ভালো বোঝা যাচ্ছে না।” বললও।

    “দরকার নেই। ওরা কারা তা আমরা জানি।” কার্ট বলল রেনাটাকে।

    “মাল্টার কোস্ট গার্ডকে খবর দিলে কেমন হয়? ওরা তাহলে কি হয়েছে। দেখতে আসবে, পুরো গ্যাঙটাই ধরা পড়বে তখন।” রেনাটা প্রস্তাব দিল।

    “বুদ্ধিটা ভালই। তবে সেটা করতে গেলে ঐ নির্দোষ ডুবুরিগুলো মারা পড়বে। এ লোকগুলোর কোনো বিবেকবোধ নেই। এর মধ্যেই ওরা নিজেদের লোককেও মেরে ফেলতে দ্বিধা করেননি ভুলে গিয়েছেন? ওরা কেনসিংটন, হ্যাগেন আর জাদুঘরের অর্ধেক সিকিউরিটি গার্ডকেই খুন করেছে। এমনকি বোমা মেরে গোডাউনটাও উড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা করেছে। মাল্টার কোস্ট গার্ডকে খবর দেয়া মাত্র ওরা ডুবুরিগুলোকে খুন করে লেজ তুলে পালাবে। আর যদি ধরাও পড়ে বা ওদেরকে ঘিরেও ফেলা হয়। তাহলে হয় কোস্ট গার্ডকে মেরে পালাবে, না হয় নিজেরাই মরবে। তাও ধরা দেবে না। তাহলে সেক্ষেত্রে লাভের গুড় পিপড়াই খাবে। খালি লাশের সংখ্যা আরো কিছু বাড়বে।”

    রেনাটা বুঝলো ব্যাপারটা। মুখ কালো করে শব্দ করে একটা শ্বাস ফেলে বলল, “আমার কথাই ঠিক। কিন্তু আমরা একারা তো ওদের সাথে পারবো না।”

    “হ্যাঁ, তবে সারপ্রাইজ কিন্তু দিতে পারবো।”

    “হায় হায় আগে বলব না? আমি তো আমার অদৃশ্য হওয়ার জামাটা ওয়াশিংটন রেখে এসেছি।” জো বলল।

    “আমি সরাসরি পানির ওপরে ওদের মুখোমুখি হতে বলছি না।” কার্ট বলল।

    “তার মানে আমাদেরকে গভীরে যেতে হবে।” জো বলল।

    “সারপ্রাইজটা দেবো হচ্ছে আমরা। আর এক্ষেত্রে কয়েকজন সাহায্যকারীও পাওয়া যাবে।”

    “কোত্থেকে?”

    “যদি এদের নিজস্ব ডুবুরি থাকতো তাহলে নিশ্চয়ই বন্দুকের ভয় দেখানো লাগতো না। যদি যেসব ডুবুরি পানির নিচে কাজ করছে, তারা ঐ নৌকার বন্দীদের বন্ধু হয়, আর শুধু ওদেরকে বাঁচানোর জন্যেই কাজ করতে থাকে তাহলে আমার বিশ্বাস সুযোগ পেলেই ওরা ওদের বিরুদ্ধে কাজ করবে।”

    “তার মানে আমরা গিয়ে তাদের সাথে দোস্তি পাতাবো, তারপর বিদ্রোহ করা শুরু করবো।” জো বলল।

    “বিদ্রোহ সব সময় এভাবেই হয়।” কার্ট বলল।

    বিশ মিনিট পর কার্ট আর জোকে দেখা গেল ডাইভ স্যুট পরে সমুদ্রে নামার জন্যে প্রস্তুত। সাথে নিচ্ছে একটা Rov (Romotely operated underwater Vehicle) নাম টার্টল। ওরা এখন ধ্বংসাবশেষ থেকে তিন মাইল দূরে আছে। এতদূর থেকে ওদের সন্দেহ হওয়ার কথা না। তারপরও সতকর্তাস্বরূপ ক্যাপ্টেন রেনল্ডস সী ড্রাগনকে আরো পিছিয়ে নিয়ে আসলেন। লোকগুলো যদি বাইনোকুলার বা রাডার দিয়ে ওদের দিকে লক্ষ রাখে তাহলে দেখবে যে ওরা ধীরে সুস্থে দক্ষিণ দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।

    কার্ট আর জো একটা প্লটফর্মে কসা। সেটা আস্তে আস্তে নিচের দিকে নামছে। পানির ওপর পৌঁছতেই কার্ট, জোর আর টার্টল পানিতে নেমে গেল। ওরা একবার স্যুটের জিনিসপত্র ঠিক আছে কি-না নেড়েচেড়ে দেখে পানির নিচে অদৃশ্য হয়ে গেল। ধীরে ধীরে নিচে নামছে ওরা, Rov’র বিশাল নাকটার দুপাশে দুজন ধরে রেখেছে। পঞ্চাশ ফুটের মতো নামতেই ওরা Rov-টায় চড়ে বসলো। তারপর কার্ট থাম্বস আপ’ দেখাতেই জো ওটা চালু করে দিল।

    এমনিতে সাধারণত টার্টল পানির ওপরে জাহাজ থেকেই পরিচালনা করা হয়। তবে যেহেতু এটা পানির নিচে ডুবুরিদের কাজের উপযোগী করে বানানো হয়েছে, তাই এটা ডাইভ স্যুটের সাথে লাগানো একটা ডিভাইস দিয়েও করা যায়। জো এখন সে কাজটাই করছে।

    “আরো নিচে নামো। মাটির কাছে চলে যাও।” কার্ট বলল।

    “রজার দ্যাট। জো বলল।

    মাল্টার পূর্বে সমুদ্র বেশি গভীর না। জায়গাটাকে ডাকা হয় “মাল্টা মালভূমি” নামে। এখান থেকে শুরু করে দক্ষিণ সিসিলি পর্যন্ত বিস্তৃত। সোফি সেলিন প্রায় নব্বই ফুট নিচে ডুবে আছে। মোটামুটি ভালোই গভীর। তবে পেশাদার ডুবুরির জন্য কোনো সমস্যা হওয়ার কথা না। ঝামেলা হলো এতো নিচে সূর্যের আলো পৌঁছায় না।

    “তলায় পৌঁছে গিয়েছি।” জো বলল।

    জো ওর হেলমেটের ভেতরের ডিসপ্লেতে সমুদ্রের গভীরতা, কোনদিকে যাচ্ছে বা ওদের গতি সবই দেখতে পাচ্ছে।

    কিছুক্ষণ পরই সমুদ্র তল চোখে পড়ল। Rov’র সামনের লাইটে আলোকিত হয়ে আছে। জো মাটিতে নামিয়ে ওদের দিক ঠিক করল। তারপর আবার চালানো শুরু করল।

    “লাইট বন্ধ করে দিচ্ছি, যাতে কারো চোখে না পড়ে।” জো বলল।

    “হুম! তবে কোনো কিছুতে বেধে আবার উল্টে পোড়ো না।” সাবধান করল কার্ট। লাইট বন্ধ হতেই মনে হলো ওরা একটা অন্ধকার গুহার ভেতর দিয়ে চলছে। কিছুক্ষণ পর চোখে অন্ধকার সয়ে আসতে জো বলল, “ভালোই তো দেখতে পাচ্ছি।

    “সমুদ্র এখন শান্ত। তাই পানিতে বেশি কাদা বা বালি নেই।” কার্ট বলল।

    “খালি চোখে সম্ভবত পঞ্চাশ ফুটের মতো দেখা যাচ্ছে।”

    “তার মানে ধ্বংসাবশেষ থেকে কমপক্ষে একশো দশ ফুট আগেই থামবে।”

    Rov হিসাবে টার্টল অত্যন্ত দ্রুত গতির। আর স্রোতের অনুকূলে থাকায় গতি এখন প্রায় সাত নট। তারপরও ধ্বংসাবশেষটার কাছে পৌঁছতে বিশ মিনিট মতো লেগে লেগো। দরেই দেখা যাচ্ছে হালকা আলো জ্বলছে।

    “কমপক্ষে তিন বা চারটা লাইট ওখানে।” জো বলল।

    কার্টও দেখছে। একটু পরই দেখা গেল আরো দুটো লাইট। বালির একটা টিবির পেছন থেকে এগিয়ে আসছে।

    আলো লাইটগুলো থেকে বেরিয়ে এমনভাবে ওপরে যাচ্ছে যেন আশ পাশে প্রচুর ধুলো উড়ছে। কার্ট ইতোমধ্যে পানির নিচের ভ্যাকুয়াম ক্লীনারের অদ্ভুত ধপধপ আওয়াজটা টের পাচ্ছে।

    “আরেকটু কাছে গিয়ে আমাকে নামিয়ে দাও। সবচে কাছের ডুবুরিটার সাথেই আগে কথা বলি।” কার্ট বলল।

    কার্ট হাতে লাগানো একটা প্যানেল খুলতেই ওয়াটার প্রুপ স্ক্রীন দেখা গেল। এখানে ও যা-বলবে তার লিখিত রূপ দেখা যাবে। এটা দিয়ে কথা না বলে সহজেই ডুবুরিটার সাথে যোগাযোগ করা যাবে।

    “আর যদি ও শয়তানদের দলের হয়?” জো জিজ্ঞেস করল।

    “তার জন্যে এটা।” বলে কার্ট বক্স থেকে একটা পিকাসো টুইন-রেইল স্পিয়ার গান তুলে নিলো। পাশাপাশি দুটো বর্শা বসানো ওটায়। সামনা সামনি দুটো ট্রিগার। এই মুহূর্তে সেফটি অন করা।

    “তোমার জন্যেও একটা এনেছি।” কার্ট বলল, “তবে আপাতত দূর থেকেই খেয়াল রাখো। যদি ঝামেলায় পড়ি তাহলে তো জানো-ই যে কি করতে হবে।”

    ওরা এই মুহূর্তে ডুবুরিগুলো থেকে একশো ফুট দূরে। এতোদূর থেকে ওকে দেখতে পাওয়ার কথা না। ও তারপরও কোনো ঝুঁকি নিতে চাইলো না।

    “এখানেই নামবো আমি।” বলে কার্ট টার্টলের পাশের দরজা খুলে নেমে গেল। তারপর নিজের প্রপালশন ইউনিট চালু করে কোণাকুণি এগুতে লাগলো। শেষবারের মতো ফিরে তাকিয়ে দেখে নির্দেশ মতো জো ওখানেই বসে আছে।

    1 2 3 4 5 6 7
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleপাইরেট – ক্লাইভ কাসলার / রবিন বারসেল
    Next Article ভারতীয় মধ্যযুগে সাধনার ধারা – ক্ষিতিমোহন সেন

    Related Articles

    ক্লাইভ কাসলার

    পাইরেট – ক্লাইভ কাসলার / রবিন বারসেল

    August 5, 2025
    ক্লাইভ কাসলার

    দ্য সলোমন কার্স – ক্লাইভ কাসলার ও রাসেল ব্লেক

    August 5, 2025
    ক্লাইভ কাসলার

    ড্রাগন – ক্লাইভ কাসলার

    August 5, 2025
    ক্লাইভ কাসলার

    ট্রেজার – ক্লাইভ কাসলার

    August 5, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo
    Most Popular

    রবিনসন ক্রুসো – ড্যানিয়েল ডিফো

    August 19, 2025

    অনুরাধা

    January 4, 2025

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    রবিনসন ক্রুসো – ড্যানিয়েল ডিফো

    August 19, 2025

    অনুরাধা

    January 4, 2025

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025
    Our Picks

    রবিনসন ক্রুসো – ড্যানিয়েল ডিফো

    August 19, 2025

    দ্য দা ভিঞ্চি কোড – ড্যান ব্রাউন

    August 19, 2025

    এঞ্জেলস এন্ড ডেমনস – ড্যান ব্রাউন

    August 19, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    Sign In or Register

    Welcome Back!

    Login below or Register Now.

    Lost password?

    Register Now!

    Already registered? Login.

    A password will be e-mailed to you.