Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    রবিনসন ক্রুসো – ড্যানিয়েল ডিফো

    August 19, 2025

    দ্য দা ভিঞ্চি কোড – ড্যান ব্রাউন

    August 19, 2025

    এঞ্জেলস এন্ড ডেমনস – ড্যান ব্রাউন

    August 19, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • 🔖
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    Subscribe
    সাইন ইন
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    দ্য মেটামরফসিস – ফ্রানজ কাফকা

    কবীর চৌধুরী এক পাতা গল্প100 Mins Read0

    ৩. গ্রেগর বেশ কঠিন আঘাত পেয়েছিল

    গ্রেগর বেশ কঠিন আঘাত পেয়েছিল; একমাসের বেশি সময় তাকে অক্ষম হয়ে পড়ে থাকতে হয়। একটা চাক্ষুষ স্মারকের মতো আপেলটা তখন তার পিঠে বিধে রয়েছে, কেউ সেটা সরাতে সাহস করল না, আর এই অবস্থা তার বাবাকে পর্যন্ত স্মরণ করিয়ে দিল যে গ্রেগর, তার দুর্ভাগ্যজনক ও বিতৃষ্ণা জাগানো আকৃতি সত্ত্বেও, এই পরিবারের একজন সদস্য, তার সঙ্গে শত্রুর মতো আচরণ করা উচিত নয়, বরং পারিবারিক কর্তব্য বোধ দাবি করে যে সর্বপ্রকার বিতৃষ্ণা দমন করে তার সঙ্গে ধৈর্যের সাথে আচরণ করতে হবে; ধৈর্য, আর কিছু নয়।

    যদিও তার আঘাত হয়তো চিরদিনের জন্য তার চলাফেরার ক্ষমতাকে সীমাবদ্ধ করে দিয়েছিল, আপাতত তার ঘরের একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্তে যেতে অনেক অনেকক্ষণ সময় লাগছে, একজন অথর্ব বৃদ্ধের মতো, দেয়াল বেয়ে ওঠানামার কোনো প্রশ্নই এখন ওঠে না, তবু তার নিজের কাছে মনে হল যে তার অবস্থা আগের চাইতে খারাপ হলেও এর বদলে সে যা পেয়েছে তা যথেষ্ট মূল্যবান। এখন সন্ধ্যার দিকে বসবার ঘরের দরজা খোলা থাকে; আগে তাকে দু-এক ঘণ্টা ধরে সেদিকে হাপিত্যেস করে তাকিয়ে থাকতে হত; এখন দরজাটা খোলা থাকার ফলে নিজের ঘরের অন্ধকারে শুয়ে শুয়ে, পরিবারের আর সবার চোখের আড়ালে থেকে, সে ওদের সবাইকে আলোকোজ্জ্বল টেবিলের চারপাশে উপবিষ্ট দেখতে পাচ্ছে, ওদের কথাবার্তা শুনছে, সবার একটা সাধারণ সম্মতি নিয়েই যেন শুনছে, আগের মতো আড়ি পেতে চুপি চুপি শোনার চাইতে যা একেবারে ভিন্ন।

    সত্য বটে, ওদের কথাবার্তার মধ্যে আগের দিনের সেই প্রাণবন্ত উচ্ছলতা ছিল। তার ভ্রাম্যমাণ জীবনে হোটেলের ছোট্ট ঘরে ঠাণ্ডা বিছানায় ক্লান্ত হয়ে গা এলিয়ে দিয়ে সে সতৃষ্ণভাবে ওদের যে উচ্ছল আলাপচারিতার কথা মনে মনে ভাবত সে রকম সে আর এখন শুনছে না। বেশিরভাগ সময় এখন ওরা চুপ করে থাকে। রাত্তিরে খাবার অল্প পরেই বাবা তার আরামকেদারায় ঘুমিয়ে পড়তেন; মা আর বোন পরস্পরকে নীরব থাকতে উপদেশ দিত; মা, বাতির খুব কাছে ঝুঁকে পড়ে, একা, অন্তর্বাস-নির্মাতা সংস্থার জন্য খুব সূক্ষ্ম সেলাইর কাজ করতেন; আর তার বোন, যে বিক্রেতা-মেয়ের কাজ নিয়েছিল, এখন রাতের বেলায় শর্টহ্যান্ড আর ফ্রেঞ্চ শিখতে শুরু করেছে, এইভাবেই সে নিজের অবস্থার উন্নতি করবে। মাঝে মাঝে তার বাবা ঘুম থেকে হঠাৎ জেগে উঠতেন, তিনি যে ঘুমিয়ে পড়েছিলেন সে সম্পর্কে একেবারে অচেতন থেকে মাকে উদ্দেশ করে বলতেন, আজ যে অনেকক্ষণ ধরে সেলাই করছো! এবং বলেই তক্ষুনি আবার ঘুমিয়ে পড়তেন, আর মহিলা দুজন তখন পরস্পরের দিকে তাকিয়ে ক্লান্ত হাসি বিনিময় করতেন।

    একটা অর্থহীন একগুঁয়েমি নিয়ে বাবা বাড়িতেও সারাক্ষণ তার ইউনিফর্ম পরে থাকতে শুরু করলেন; তার ড্রেসিংগাউন এখন অকেজো হয়ে দেয়ালে আটকানো একটা পেরেকে ঝুলছে; তিনি পুরো ধরা-চূড়া পরা অবস্থায় যেখানে বসে থাকতেন সেখানেই ঘুমাতেন, যেন ডাক আসামাত্র কাজে বেরিয়ে পড়ার জন্য প্রস্তুত, যেন। এখানেও তিনি তাঁর ঊর্ধ্বতন কর্তার দাস। এর ফলে তার ইউনিফর্মটা, যা গোড়াতেই সম্পূর্ণ নতুন ছিল না, নোংরা দেখাতে আরম্ভ করল, তার মা ও বোন সযত্নে সেটা পরিষ্কার রাখার চেষ্টা করা সত্ত্বেও তা মলিন ও অপরিচ্ছন্ন হয়ে উঠল। গ্রেগর প্রায়ই তার পোশাকের গায়ে তেল চিটচিটে দাগগুলোর দিকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকত, দেখত তার চকচকে পলিশ করা সোনালি বোতামগুলো, লক্ষ করত ওই রকম অস্বাচ্ছন্দ্যের মধ্যেও কি গভীর প্রশান্তির সঙ্গে তিনি ঘুমাচ্ছেন।

    দশটার ঘণ্টা বাজার সঙ্গে সঙ্গে মা কোমল কণ্ঠে বাবাকে জাগিয়ে বিছানায় নিয়ে যাবার জন্য চেষ্টা করতেন, কারণ বসে বসে এই অবস্থায় যথার্থভাবে ঘুমানো মোটেই সম্ভব ছিল না, অথচ এখন তার পক্ষে ঘুমই ছিল সবচাইতে প্রয়োজনীয়, কারণ ঠিক সকাল ৬টায় তাকে কাজে যেতে হবে। কিন্তু ব্যাংকের বার্তাবহ হবার পর থেকে একগুঁয়েমি তাঁকে এমনই অধিকার করে বসেছে যে নিয়মিতভাবে টেবিলের পাশে ঘুমিয়ে পড়লেও তিনি ক্রমেই দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর সময় সেখানেই বসে থাকার জন্য জেদ করতেন। শেষে প্রচুর কষ্ট করে তাঁকে তাঁর আরাম কেদারা থেকে তুলে নিয়ে তার বিছানায় শুইয়ে দিতে হত। গ্রেগরের মা আর বোন যতই সস্নেহে তাঁকে ঘুমুতে যাবার কথা মনে করিয়ে দিত, তিনি ততই, প্রায় পৌনে এক ঘণ্টা ধরে, চোখ বন্ধ রেখে ধীরে ধীরে তার মাথা নাড়তেন, কিছুতেই উঠে দাঁড়াতেন না। মা তার জামার হাত ধরে টানতেন, কানে কানে ফিসফিস করে মধুর সম্ভাষণ করতেন, বোন নিজের পড়া ছেড়ে উঠে এসে মাকে সাহায্য করত, কিন্তু গ্রেগরের বাবা টলবার নয়। তিনি তার চেয়ারের মধ্যে আরো বেশি তলিয়ে যেতেন। অবশেষে মহিলা দুজন যখন বগলের নিচে হাত দিয়ে তাঁকে টেনে দাঁড় করিয়ে দিত শুধু তখনই তিনি চোখ খুলে, একজনের পর একজন করে তাদের দুজনের দিকে তাকিয়ে, সচরাচর এই ছোট্ট মন্তব্যটি করতেন, এই হচ্ছে জীবন। আমার বৃদ্ধ বয়সে এই হচ্ছে সুখ আর শান্তি। তারপর ওদের দুজনের উপর ভর দিয়ে, অনেক কষ্টে, যেন তিনি একটা দুর্বহ বোঝা, ওদের দুজনকে তিনি দরজা পর্যন্ত তাঁকে নিয়ে আসতে দিতেন, আর তারপরই হাত নেড়ে ওদের ফেরত পাঠিয়ে দিয়ে একা একা এগিয়ে যেতেন, আর তার মা নিজের সেলাই আর তার বোন নিজের কলম ফেলে দিয়ে আবার তাঁকে আরেকটু সাহায্য করবার জন্য তার দিকে ছুটে যেত।

    অতিরিক্ত কর্মভার-পীড়িত ও ক্লান্তিতে জর্জরিত এই পরিবারে গ্রেগরকে নিয়ে, ন্যূনতম প্রয়োজনের বাইরে চিন্তা-ভাবনা করার সময় কার ছিল? ক্রমেই বাড়ির কাজের লোক কমতে লাগল; পরিচারিকা মেয়েটিকে ছাড়িয়ে দেয়া হল; একটি বিশালদেহী ঢ্যাঙা ঝি সকালে বিকালে এসে ভারী কাজগুলো করে দিয়ে যেত, তার সাদা চুল উড়তে থাকত মাথা ঘিরে; গাদা গাদা সেলাই করা ছাড়াও বাকি সব কাজ করতে হত গ্রেগরের মাকে। তার মা আর বোন নানা উৎসব অনুষ্ঠান ও পার্টিতে পারিবারিক যেসব অলঙ্কার সগর্বে পরতেন সেগুলো পর্যন্ত বিক্রি করতে হল। বিক্রি করে কত দাম পাওয়া গেছে একদিন সন্ধ্যায় তারা সে সম্পর্কে কথাবার্তা বলার সময় গ্রেগর ব্যাপারটা জানতে পারে। কিন্তু যার জন্য তারা সব চাইতে বেশি দুঃখ প্রকাশ করল তা এই যে, তাদের বর্তমান পরিস্থিতিতে এই বাড়িটা বড় বেশি বড়, অথচ গ্রেগরকে কীভাবে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় সরিয়ে নেয়া যাবে তা তারা কিছুতেই ভেবে উঠতে পারল না। তবু, তার প্রতি বিবেচনা বোধই যে ওদের বাড়ি বদলের পথে প্রধান বাধা নয় এটা গ্রেগর স্পষ্ট বুঝতে পারল; কারণ তাকে স্থানান্তরিত করার জন্য ওরা সহজেই বাতাসের জন্য কয়েকটা ছিদ্র রেখে একটা উপযুক্ত বাক্স বানিয়ে নিতে পারত; আসলে তারা নিজেরাই এমন পরিপূর্ণ হতাশায় ডুবে গিয়েছিল, এমন একটা বিশ্বাসে ভারাক্রান্ত হয়েছিল, যে তাদের মনে হল তারাই বুঝি এই ধরনের দুর্ভাগ্যের জন্য বিশেষভাবে নির্বাচিত হয়েছে, যেরকম দুর্ভাগ্যের শিকার তাদের কোনো আত্মীয় পরিজন অথবা চেনাজানা মানুষ কখনো হয়নি, আর এই জন্যই তাদের বর্তমান বাড়ি ছেড়ে তারা অন্যত্র উঠে যেতে পারছিল না। এই দুনিয়া গরিব মানুষদের কাছ থেকে যা দাবি করে এরা তার সবকিছু কড়ায়-গণ্ডায় মিটিয়ে দিচ্ছিল; বাবা ব্যাংকের নিম কেরানিদের জন্য সকালের নাস্তা বহন করে এনে দিতেন; মা অচেনা অজানা মানুষদের অন্তর্বাস তৈরির কাজে নিজের সমস্ত ক্ষমতা প্রয়োগ করছেন; বোন কাউন্টারের ওপাশে দাঁড়িয়ে ছুটে ছুটে খদ্দেরদের ফরমাস তামিল করত, কিন্তু এর চাইতে আর বেশি কিছু করার শক্তি তাদের ছিল না। আর যখন তার মা আর বোন, বাবাকে বিছানায় শুইয়ে আবার ফিরে আসত, নিজেদের কাজ ফেলে দিয়ে দুজন দুজনের গালে গাল ঠেকিয়ে কাছাকাছি বসত, গ্রেগরের পিঠের ক্ষতটা নতুন করে তাকে যন্ত্রণা দিতে শুরু করত। মা তখন তার দরজার দিকে অঙুলি নির্দেশ করে বলতেন, গ্রেটা, ওই দরজাটা এখন বন্ধ করে দাও, আর গ্রেগর তখন আবার একা অন্ধকারের মধ্যে পরিত্যক্ত হত, আর পাশের ঘরে ওরা দুজন তখন কান্নায় ভেঙে পড়ত কিংবা হয়তো শুকনো চোখে এক দৃষ্টিতে টেবিলের দিকে তাকিয়ে থাকত।

    রাতে কিংবা দিনে গ্রেগর প্রায় একটুও ঘুমাত না। একটা ধারণা তার মাথায় চেপে বসল; পরেরবার দরজাটা খুললেই আবার সে আগের মতো সংসারের যাবতীয় কাজকর্মের ভার নিজের মাথায় তুলে নেবে। দীর্ঘ বিরতির পর আবার তার চিন্তাভাবনার মধ্যে ফিরে এল বড়কর্তা আর মুখ্য কেরানি ভ্রাম্যমাণ বাণিজ্যিক কর্মচারীবৃন্দ, শিক্ষানবিস, আর সেই মোটামাথা দারোয়ানের ছবি; তার মনে পড়ল অন্য প্রতিষ্ঠানে কর্মরত দুতিনজন বন্ধুর কথা, গ্রামাঞ্চলের এক হোটেলের একটি পরিচারিকা তরুণীর কথা, দ্রুত মিলিয়ে যাওয়া একটি মধুর স্মৃতি, মহিলাদের টুপির দোকানে কাজ-করা একটি মেয়ের কথা, যাকে সে আন্তরিকভাবে প্রেম নিবেদন করেছিল কিন্তু বড় বেশি মন্থর গতিতে—তারা সব একসঙ্গে এসে উপস্থিত হল, এদের সঙ্গে সঙ্গে আরও এল অপরিচিত অথবা ভুলে যাওয়া কিছু মানুষ, কিন্তু তাকে বা তার পরিবারকে সাহায্য করার পরিবর্তে ওদের সবাইকে, ব্যতিক্রমহীনভাবে, দেখা গেল অনধিগম্য। ওদের কারো কাছে এগুনো যায় না, এবং ওরা যখন অদৃশ্য হয়ে গেল গ্রেগর তখন খুশিই হল। অন্য সময় হলে সে তার পরিবারের লোকজনকে নিয়ে এত মাথা ঘামাত না, ওরা যে তাকে এতটা অবহেলা করছে এজন্য তার চিত্ত ক্রোধে পূর্ণ হয়ে উঠেছিল। এবং কী খাবার তার পছন্দ সে সম্পর্কে তখন পর্যন্ত তার কোনো স্পষ্ট ধারণা না-গড়ে উঠলেও, ভাড়ার ঘরে গিয়ে, ক্ষুধার্ত না হলেও, যে খাবারের উপর তার ন্যায্য দাবি রয়েছে সে তা নিজেই সংগ্রহ করবার মতলব আঁটতে আরম্ভ করল। তার বোন আর আগের মতো, যে রকম খাবার তাকে বিশেষভাবে তৃপ্তি দিতে পারত সেরকম খাবার তার জন্য নিয়ে আসত না। ভোরবেলায় কিংবা দুপুরে, নিজের কাজে বেরিয়ে যাবার আগে, সে তাড়াহুড়া করে হাতের কাছে সহজে যা খাবার মিলত তাই পা দিয়ে তার ঘরের মধ্যে ঠেলে দিত, আর তারপর সন্ধ্যার সময় ঝাটার এক বাড়িতে সব পরিষ্কার করে নিয়ে যেত, গ্রেগর শুধু একটু চেখে দেখেছে নাকি কিছুই খায়নি—যা ক্রমেই বেশি বেশি করে ঘটতে লাগল—সে বিষয়ে তার বোন কোনো দৃষ্টিই আর। দিত না। এখন রাত্তিরে তার ঘরও সে পরিষ্কার করত কোনোরকমে, অত্যন্ত তাড়াহুড়া করে। দেয়ালের গায়ে ময়লার রেখা পড়ে থাকত, এখানে ওখানে পড়ে থাকত ধুলো আর নোংরা বস্তুর গোল্লা। প্রথমদিকে তার বোন ঘরে ঢুকতেই গ্রেগর বিশেষভাবে অপরিষ্কার কোনো একটা কোণায় গিয়ে নিজের অবস্থান নিত, যেন এর মাধ্যমে সে তার বোনকে তিরস্কার করছে। কিন্তু দেখা গেল, ওখানে এক সপ্তাহ বসে থাকলেও তার বোনকে দিয়ে অবস্থার উন্নতি-বিধানে সে কিছুই করাতে পারবে না। ময়লাগুলো ঠিক তার বোনের চোখে পড়ত, ওর নিজের মতই, কিন্তু সে মন স্থির করে ফেলেছিল যে ওগুলো সে সরাবে না। অথচ, অদ্ভুত এক স্পর্শকাতরতা নিয়ে, যার দ্বারা পরিবারের সকলেই আক্রান্ত মনে হল, সে গ্রেগরকে দেখাশোনার কাজে তার একক অধিকারকে অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে রক্ষা করে যেতে লাগল। তার মা একবার তার ঘরটা আগাগোড়া খুব ভালো করে পরিষ্কার করে দিয়েছিলেন, এজন্য বালতি বালতি জল ঢালতে হয়েছিল; ঘরটা সঁতসেঁতে হয়ে যাওয়ায় অবশ্য গ্রেগরের খুব অস্বস্তি বোধ হয়েছিল, সে মুখ গোমড়া করে নিশ্চল হয়ে হাত-পা ছড়িয়ে সোফার উপর শুয়েছিল, কিন্তু এজন্য তাকে কঠিন শাস্তি পেতে হয়। সেদিন সন্ধ্যায় তার ঘরের পরিবর্তিত রূপ দেখার সঙ্গে সঙ্গে তার বোন রাগে আগুন হয়ে বসবার ঘরে ছুটে যায়, আর তার মা ওপর দিকে দুহাত তুলে অনুনয় করা সত্ত্বেও সে কেঁদে ভাসিয়ে দেয়, আর তার বাবা-মা—অবশ্যই বাবা ইতোমধ্যে, চমকে, চেয়ার ছেড়ে লাফিয়ে উঠে। দাঁড়িয়েছিলেন প্রথমে অসহায় বিস্ময়ে তাকে লক্ষ করলেন, আর তারপরই ওরা সবাই প্রচণ্ড হৈ চৈ শুরু করে দিল। তার ডান দিকে দাঁড়ানো মাকে বাবা তিরস্কার করলেন, গ্রেগরের ঘর পরিষ্কার করার দায়িত্ব কেন তিনি গ্রেগরের বোনের উপর ছেড়ে দেননি, আর তার বাঁ দিকে দাঁড়ানো গ্রেগরের বোনের দিকে তাকিয়ে তিনি চিৎকার করে বললেন, সে যেন আর কক্ষনো গ্রেগরের ঘর পরিষ্কার করতে না যায়; ওদিকে তার মা, বাবাকে উত্তেজনায় প্রায় সম্বিতহারা হয়ে যেতে দেখে, হাত ধরে তাঁকে তাঁর নিজের ঘরে টেনে নিয়ে যেতে চেষ্টা করলেন; আর তার বোন ডুকরে কাঁদতে কাঁদতে তার ছোট মুষ্টিবদ্ধ দুহাত দিয়ে ক্রমাগত টেবিলে আঘাত করতে থাকল; আর গ্রেগর ভীষণ চটে গিয়ে সজোরে হিসহিস করে উঠল, কারণ তাকে এই দৃশ্য আর এত গোলমালের অত্যাচার থেকে রক্ষা করার জন্য ওদের কেউ দরজাটা বন্ধ করে দেবার কথা পর্যন্ত ভাবেনি।

    তবুও দৈনন্দিন কাজের চাপে অবসাদগ্রস্ত হয়ে তার বোন আগের মতো গ্রেগরকে দেখাশোনার ব্যাপারে শৈথিল্য প্রদর্শন করলেও এই কাজে মার নাক না গলালেও চলত, আর গ্রেগরকে অবহেলা করারও কোনো দরকার ছিল না। সেই ঠিকা-কাজের মহিলা তো ছিল। তার শক্তসমর্থ ঢ্যাঙা শরীরের ওপর দিয়ে এই দীর্ঘ জীবনে অনেক ঝড়ঝাঁপ্টা বয়ে গেছে, সব সে সহ্য করতে পেরেছে, গ্রেগরকে দেখে তার ভয় বা বিতৃষ্ণা হত না। একদিন সে হঠাৎ, কোনোরকম কৌতূহল ছাড়াই, তার ঘরের দরজা খুলে ফেলেছিল। গ্রেগর চমকে গিয়ে ঘরময় ছোটাছুটি করতে শুরু করে দিয়েছিল, যদিও কেউ তাকে তাড়া করেনি। ওই মহিলা তাকে দেখে দুহাত বুকের উপর জড়ো করে শুধু চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিল। তারপর থেকে রোজ সকাল-সন্ধ্যায় সে এক মুহূর্তের জন্য দরজাটা একটু ফাঁক। করে তাকে এক নজর দেখে নিতে কক্ষনো ভুল করত না। প্রথমদিকে সে, তার ধারণায় বন্ধুর মতো ভঙ্গিতে, তাকে নিজের কাছে আসার জন্য ডাকত, যেমন বলত, এই যে গুবরে পোকা মশাই, আসুন এদিকে। কিংবা দেখ, দেখ, বদমাশ গুবরে পোকাটাকে দেখ! গ্রেগর এইসব আহ্বানে কোনো সাড়া দিত না, নিজের জায়গায় নিশ্চল হয়ে দাঁড়িয়ে থাকত, এমন ভাব দেখাত যেন তার ঘরের দরজা খোলাই হয়নি। ওর খেয়াল খুশিমতো এরকম অর্থহীনভাবে তাকে বিরক্ত করার পরিবর্তে ওদের উচিত ছিল তাকে, ওই মহিলাকে, ওর ঘরটা রোজ পরিষ্কার করার নির্দেশ দেওয়া। একদিন, খুব ভোরে—জানালার শার্সির উপর তখন জোর বৃষ্টির ঝাঁপটা এসে পড়ছিল, বোধ হয় বসন্ত আগতপ্রায় তার সংকেত—ওই মহিলা। তাকে উদ্দেশ করে কথা বলতে শুরু করার সঙ্গে সঙ্গে গ্রেগর ভীষণ ক্ষেপে গিয়ে তার দিকে ছুটে গেল, যেন তাকে সে আক্রমণ করবে, অবশ্য সে অগ্রসর হল। অত্যন্ত ধীরে ধীরে, এবং খুব দুর্বলভাবে। তাকে দেখতে পেয়ে ঠিকা মেয়েলোকটি কিন্তু একটুও ভয় না পেয়ে, দরজার পাশেই রক্ষিত একটা চেয়ার উঁচু করে ধরে, নিজের মুখ ব্যাদান করে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকল, পরিষ্কার বোঝা গেল যে হাতের চেয়ারটা গ্রেগরের পিঠের উপর সজোরে নামিয়ে দেবার পরই সে তার মুখ বন্ধ করবে। গ্রেগর ঘুরে দাঁড়াতেই ও বলল, তাহলে আর তুমি কাছে এগুচ্ছ না?, বলেই সে আবার নীরবে চেয়ারটা যথাস্থানে এক কোণায় রেখে দিল।

    ইদানীং গ্রেগর প্রায় কিছুই খেত না। যে জায়গায় তার জন্য খাবার মেলে রাখা হত শুধু তার সামনে দিয়ে কখনো যেতে হলে সে খেলাচ্ছলে কিছু একটা মুখে তুলে, ঘণ্টাখানেক সেটা মুখের মধ্যে রেখে, সাধারণত আবার সেটা থু করে ফেলে দিত। প্রথমে সে ভেবেছিল যে তার ঘরের অবস্থা দেখে মন খারাপ হয়ে যাওয়ায় সে খেতে পারছে না, কিন্তু অল্পদিনের মধ্যেই সে ঘরের বহুল পরিবর্তিত অবস্থায় অভ্যস্ত হয়ে গেল। ইতোমধ্যে পরিবারের সবার একটা অভ্যাস হয়ে গিয়েছিল; যখনই কোনো জিনিসের অন্যত্র স্থান সংকুলান হত না তখনই তারা সেসব জিনিস গ্রেগরের ঘরে ঠেলে ঢুকিয়ে দিত, বিশেষ করে যখন একটা ঘর। তিন ভদ্রলোকের কাছে ভাড়া দেয়া হল তারপর থেকে। এই ভারিক্কি ভদ্রলোকদের, এদের তিনজনই ছিল ঘন শ্মশ্রুমণ্ডিত, গ্রেগর একদিন দরজার ফাঁক দিয়ে দেখেছে, এরা ছিল শৃঙ্খলার ব্যাপারে প্রচণ্ড উৎসাহী, শুধু তাদের নিজেদের ঘরের জিনিসপত্রের ক্ষেত্রে নয়, বরং, যেহেতু তারা এখন এই বাড়িরই সদস্য, সমস্ত জিনিসপত্রের ক্ষেত্রেই, বিশেষ করে রান্নাঘরের। নোংরা তো বটেই, কোনো রকম ফালতু জিনিসই তারা বরদাস্ত করতে পারত না। এই জন্য দেখা গেল যে অনেক কিছুই বাদ দেয়া যায়, অথচ সেসব বিক্রি করার চেষ্টা করেও কোনো লাভ নেই, আবার সেগুলো ফেলেও দেয়া যায় না। সেইসব জিনিস গ্রেগরের ঘরে ঠাই পেল। ছাই-র হাঁড়ি, রান্নাঘরের ময়লার ঝুড়িও। তাৎক্ষণিকভাবে কোনো জিনিসের প্রয়োজন না থাকলেই ওই কাজের মহিলা তা গ্রেগরের ঘরের মধ্যে ছুঁড়ে ফেলে দিত, আর সে তার সব কাজই করত তাড়াহুড়া করে। সৌভাগ্যবশত গ্রেগর শুধু বস্তুটা দেখত, সেটা যাই হোক না কেন, আর বস্তুটা ধরে থাকা হাতটি। হয়তো মহিলার ইচ্ছা ছিল সুযোগ-সুবিধা মতো সে জিনিসগুলো এখান থেকে আবার সরিয়ে নিয়ে যাবে, কিংবা সব জড়ো করে একসঙ্গে বাইরে ফেলে দেবে, কিন্তু বাস্তব ক্ষেত্রে সে জিনিসগুলো যেখানে ছুঁড়ে ফেলল সেখানেই পড়ে থাকল। মাঝে মাঝে শুধু একটা ব্যতিক্রম ঘটত, যখন গ্রেগর আবর্জনার স্তুপ ভেদ করে, ঠেলে, সামনে এগুতো তখন জিনিসগুলো কিছুটা নড়েচড়ে যেত; প্রথমে তাকে একাজটা করতে হয় প্রয়োজনের তাগিদে, কারণ নড়ে বেড়াবার মতো যথেষ্ট জায়গা তার ছিল না, কিন্তু পরে এর মধ্যে সে ক্রমবর্ধমান আনন্দ পেতে শুরু করল, কিন্তু এই জাতীয় প্রতিটি অভিযানের পর ক্লান্তি ও বিষণ্ণতায় মৃতপ্রায় হয়ে তাকে কয়েক ঘণ্টা নিশ্চল হয়ে শুয়ে থাকতে হত। ভাড়াটে ভদ্রলোকেরা প্রায়ই বাড়ির সবার ব্যবহৃত বসবার ঘরে রাত্রির খাবার খেতেন, তখন অনেক রাত্রিতেই বসবার ঘরের দরজাটা বন্ধ থাকত, গ্রেগর কিন্তু এই দরজা বন্ধ থাকার ব্যাপারটার সঙ্গে সহজেই নিজেকে মানিয়ে নিয়েছিল, কারণ মাঝে মাঝে কোনো রাত্তিরে দরজা খুলে দিলেও গ্রেগর তা সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে নিজের ঘরের সবচাইতে অন্ধকার কোণটিতে, পরিবারের সবার দৃষ্টির আড়ালে, চুপচাপ পড়ে থাকত। কিন্তু একদিন কাজের মহিলা দরজাটা একটু খোলা রেখে দিয়েছিল, এবং ভাড়াটেরা নৈশাহারের জন্য ঘরে ঢোকার পরও বাতি-জ্বালিয়ে দেবার পরও, দরজাটা খোলা পড়ে রইল। ওরা টেবিলের মাথার দিকে আসন নিল, যেখানে আগে গ্রেগর এবং তার মা-বাবা বসে আহার করতেন; এখন ওরা সেখানে বসে ন্যাপকিনের ভাঁজ খুলল, হাতে তুলে নিল ছুরি আর কাঁটা। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে অন্য দরজা দিয়ে, হাতে মাংসের পাত্র নিয়ে, তার মা ঘরে ঢুকলেন এবং তার প্রায় পেছনে পেছনে হাতে উঁচু-করে বোঝাই আলুর ডিশ নিয়ে ঢুকল তার বোন। ভাড়াটে তিনজন মুখে দেবার আগেই তাদের সামনে স্থাপিত খাবার মাথা নিচু করে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখল। বস্তুতপক্ষে মাঝে বসা লোকটি, যাকে এই বিষয়ে অন্য দুজন চূড়ান্ত কর্তাব্যক্তি রূপে বিবেচনা করে বলে মনে হল, তার প্লেটে রাখা এক টুকরা মাংস কেটে দেখল, স্পষ্টতই সেটা নরম, না শক্ত, নাকি আবার রান্নাঘরে ফেরত পাঠাতে হবে তা পরীক্ষা করে দেখল। সে সন্তোষ প্রকাশ করতেই, তার মা আর বোন, যারা এতক্ষণ চিন্তাকুল মুখে লোকটির দিকে তাকিয়েছিল, সহজভাবে নিঃশ্বাস ফেলে হাসতে শুরু করল।

    পরিবারের সদস্যরা এখন রান্নাঘরে আহার করে। তা হলেও, রান্নাঘরে যাবার আগে গ্রেগরের বাবা টুপি হাতে নিয়ে, মাথা নিচু করে দীর্ঘ অভিবাদন জানিয়ে, এই ঘরের টেবিলটা একবার প্রদক্ষিণ করতেন। ভাড়াটে তিনজন তখন উঠে দাঁড়িয়ে তাদের দাড়ি-গোঁফের আড়াল থেকে বিড়বিড় করে কিছু একটা বলত। তারপর আবার একা হলেই প্রায় সম্পূর্ণ নীরবতার মধ্যে তারা তাদের আহারপর্ব সমাধা করত। গ্রেগরের একটা ব্যাপার খুব আশ্চর্য মনে হল; টেবিলের ওখান থেকে নানা ধরনের যেসব শব্দ আসছিল তার মধ্যে সে সর্বদা ওদের দাঁত দিয়ে খাবার চিবানোর শব্দটা স্পষ্ট আলাদা করে বুঝতে পারত। এটা যেন গ্রেগরকে সংকেতে বলে দিচ্ছে যে খাবার জন্য একজনের দাঁত প্রয়োজন, এবং দন্তহীন মাড়ি নিয়ে, তা সেটা যত নিপুণই হোক-না-কেন, কেউ কিছু করতে পারে না। গ্রেগর বিমর্ষভাবে আপন মনে বলল, আমি বেশ ক্ষুধার্ত, কিন্তু ওই রকম খাবারের জন্য নয়। এহ্, ওই ভাড়াটেগুলো কী রকম গোগ্রাসে গিলছে, আর আমি এদিকে উপোস করে মরছি।

    সেদিন রাতেই—এতদিনের মধ্যে একবারও বেহালার শব্দ শুনেছে বলে গ্রেগরের মনে পড়ল না—রান্নাঘর থেকে বেহালা বাজাবার শব্দ ভেসে এল। ভাড়াটেদের খাওয়া ইতোমধ্যে শেষ হয়ে গিয়েছিল; মাঝের ভদ্রলোক একটা খবরের কাগজ বার করে, তার মধ্য থেকে একটি পাতা নিয়ে অপর দুজনের একজনকে, এবং আরেকটি পাতা নিয়ে অন্যজনকে দিল, আর তারপর তারা আরাম করে আসনে পিঠ হেলিয়ে কাগজ পড়তে এবং ধূমপান করতে লাগল। বেহালা বাজানো শুরু হতেই তারা কান খাড়া করে শুনল, চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল, তারপর পা টিপে টিপে হলঘরের দরজার সামনে গিয়ে জড়ো হল। ওদের নড়াচড়ার শব্দ নিশ্চয়ই রান্নাঘরের ভেতরে গিয়ে পৌঁছেছিল, কারণ গ্রেগরের বাবা ভিতর থেকে চেঁচিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, বেহালা বাজানোতে আপনাদের কি কোনো অসুবিধা হচ্ছে ভদ্রমহোদয়গণ? এক্ষুনি বন্ধ করে দেয়া যেতে পারে কিন্তু। মাঝের ভাড়াটিয়াটি বলল, ঠিক তার উল্টো। আচ্ছা, কুমারী সামসা কি এই ঘরে, আমাদের মাঝখানে এসে বাজাতে পারেন না? এখানটা তো অনেক বেশি আরামের, অনেক বেশি সুবিধাজনক। গ্রেগরের বাবা সঙ্গে সঙ্গে বললেন, যেন তিনিই বেহালা-বাদক, নিশ্চয়ই। ভাড়াটিয়ারা বসবার ঘরে এসে অপেক্ষা। করতে লাগল। দেখতে দেখতে গ্রেগরের বাবা মিউজিক স্ট্যান্ড হাতে নিয়ে উপস্থিত হলেন, মা এলেন স্বরলিপির খাতা হাতে নিয়ে, আর তার বোন বেহালা নিয়ে। তার বোন ধীরভাবে বাজাবার জন্য প্রস্তুত হল; ওর মা-বাবা কখনো এর আগে ঘর ভাড়া দেয়নি, তাই ভাড়াটিয়া সম্পর্কে তার মনে ছিল মাত্রাতিরিক্ত রকম সৌজন্যবোধ; সেই বোধের কারণে তাঁরা নিজেদের চেয়ারে আসন গ্রহণ করলেন না; বাবা, আনুষ্ঠানিকভাবে বোতাম-আঁটা তাঁর ইউনিফর্মের কোটের দুই বোতামের মধ্য দিয়ে ডান হাত ঢুকিয়ে দরজার গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়ালেন; ভাড়াটেদের একজন অবশ্য তার মাকে একটা চেয়ার এগিয়ে দিল, লোকটি চেয়ারটা যেখানে রাখল মা সেটাকে সেখান থেকে একটুও সরালেন না, ফলে তিনি আসন গ্রহণ করলেন এক পাশে, ঘরের এক কোণায়।

    গ্রেগরের বোন বাজাতে শুরু করল, তার বাবা-মা, দুজন দুদিক থেকে, গভীর মনোযোগের সঙ্গে তার হাতের গতিভঙ্গি লক্ষ করতে লাগলেন। বাজনার সুরে আকৃষ্ট হয়ে গ্রেগর সাহস করে একটু সামনে এগিয়ে গেল, প্রকৃতপক্ষে এখন তার মাথা বসবার ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়েছে। অন্যদের সম্পর্কে নিজের বিবেচনা বোধের অভাবে সে একটুও অবাক হল না, যদিও একসময় সে তার বিবেচনা বোধের জন্য রীতিমত গর্ব অনুভব করত। ঠিক এই মুহূর্তে তার আত্মগোপন করে থাকার বিশেষ কারণ ছিল, ওর ঘর ছিল ধুলোভর্তি, সামান্য একটু নড়াচড়া করলেই চারদিকে ভীষণভাবে ধুলো উড়ত, ওর নিজের সারা শরীর এখন ধুলোয় ভরা। তার শরীরে রোয়া, চুল আর খাবারের ধ্বংসাবশেষ লেগে রয়েছে, তার পিঠের উপর আর তার পার্শ্বদেশে সেগুলো আটকে রয়েছে। একসময় সে দিনে কয়েকবার উল্টেপাল্টে কার্পেটের উপর ঘষে ঘষে নিজের শরীরটাকে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করে নিত, কিন্তু এখন তার ঔদাসীন্য এমন একটা স্তরে পৌঁছেছিল যে সে এ-বিষয়ে বিন্দুমাত্র মনোযোগ দিল না। তার বর্তমান অবস্থা সত্ত্বেও বসবার ঘরের তকতকে ঝকঝকে মেঝের উপর দিয়ে আরেকটু এগিয়ে যেতে কোনোরকম লজ্জাবোধ তাকে কিছুমাত্র বাধা দিল না।

    অবশ্য, এ-কথা ঠিক, কেউ তার উপস্থিতি টের পায়নি। পরিবারের সবাই বাজনার ভেতর গভীরভাবে ডুবে গিয়েছিল। ভাড়াটেদের ক্ষেত্রে কিন্তু পরিস্থিতি ভিন্নতর দেখা গেল। প্রথমে তারা দুহাত পকেটে ঢুকিয়ে মিউজিক স্ট্যান্ডের পেছনে, খুব কাছে, অবস্থান নিল, যেন স্বরলিপি নিজেরা পড়তে পারে। এতে তার বোন নিশ্চয়ই বেশ অস্বস্তি বোধ করছিল; কিন্তু একটু পরেই ওরা জানালার কাছে। গিয়ে মাথা নিচু করে ফিসফিস করে কী সব বলাবলি করল। গ্রেগরের বাবা। চিন্তিতমুখে ওদের দিকে তাকালেন; ওরা কিছুক্ষণ সেখানে দাঁড়িয়ে থাকল। প্রকৃতপক্ষে, ভালো কিংবা উপভোগ্য বেহালাবাদন শুনবার তাদের প্রত্যাশা যে পূর্ণ হয়নি, এক্ষেত্রে যে তারা হতাশ হয়েছে, সেটা তারা বেশ স্পষ্ট করে বুঝিয়ে দিল। বস্তুতপক্ষে তাদের যেন যথেষ্ট বেহালা শোনা হয়ে গেছে, এখন শুধু সৌজন্যের খাতিরে ওরা তাদের শান্তির উপর এই অত্যাচার সহ্য করে যাচ্ছে। যেভাবে তারা সবাই মুখ উঁচু করে নাক-মুখ দিয়ে তাদের সিগারের ধোঁয়া ছাড়ছিল তাতে তাদের বিরক্তিটা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল। অথচ গ্রেগরের বোন ভারি সুন্দর বাজাচ্ছিল। তার বোনের মুখ একপাশে সামান্য হেলানো, তার বিষণ্ণ চোখ দুটি নিবিষ্ট স্বরলিপির পাতার উপর। গ্রেগর সুড়সুড় করে আরেকটু এগিয়ে গেল, তারপর তার মাথা মাটির কাছে নামিয়ে আনল, যেন বোনের চোখের উপর চোখ রাখা সম্ভব হয়। সংগীত তার উপর এমন প্রভাব বিস্তার করছে কেন? সে কি একটা পশু সেই জন্য? তার মনে হল যে অজ্ঞাত মানসিক পুষ্টির জন্য সে এত দিন হাপিত্যেস করে বসেছিল সেই পথ যেন এবার তার জন্য খুলে যাচ্ছে। সে স্থির করল তার বোনের আরও কাছে এগিয়ে যাবে, তার কাপড় ধরে টানবে, তাকে বেহালা নিয়ে ওর ঘরে আসতে বলবে, কারণ সে যেভাবে তার বাজনার মর্যাদা দেবে, সেটা উপভোগ করবে, এখানে কেউ তেমন করছে না। সে কক্ষনো তার বোনকে তার ঘর ছেড়ে বাইরে যেতে দেবে না, অন্তত যত দিন সে বাঁচবে। তার বীভৎস চেহারা, এই প্রথমবারের মতো, তার কাজে আসবে। সে তার ঘরের সবগুলো দরজার উপর সর্বদা সতর্ক দৃষ্টি রাখবে, জোর করে, কেউ ঢুকতে চেষ্টা করলেই তার গায়ে থুতু ছিটাবে; তবে তার বোনের উপর কোনো বাধ্যবাধকতা থাকবে না; সে স্বেচ্ছায় তার সঙ্গে থাকবে; সোফাতে তার পাশে বসে সে তার মুখের কাছে কান নামিয়ে আনবে, তার দৃঢ় সংকল্পের কথা শুনবে, সে যে ওকে। কনসার্ভেক্টোরিয়ামে পাঠাবে বলে ঠিক করে রেখেছিল সে কথা ওকে বলবে, গত বড়দিনের সময়ই—নিশ্চয়ই বড়দিন অনেক আগে পার হয়ে গেছে—সে এ-কথা সকলের সামনে ঘোষণা করত, কারো কোনো আপত্তিতে কান দিত না। তার বোন এ-কথা শুনে অভিভূত হয়ে নিশ্চয়ই কান্নায় ভেঙে পড়বে, আর তখন গ্রেগর। নিজেকে ওর কাঁধ অবধি উঁচু করে তুলে ওর ঘাড়ে চুমু খাবে; আর তার বোন এখন বাইরে কাজে যায় বলে সেখানে কোনো রিবন বা কলারের বালাইও নেই।

    মধ্যবর্তী ভাড়াটে, মি. সামসা! বলে চেঁচিয়ে গ্রেগরের বাবার দৃষ্টি আকর্ষণ করল, তারপর আর কোনো কথা না বলে ধীরে ধীরে অগ্রসরমাণ গ্রেগরের দিকে অঙুলি নির্দেশ করল। সঙ্গে সঙ্গে বেহালা বাজানো থেমে গেল, আর ওই ভদ্রলোক প্রথমে তার বন্ধুদের দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়ল, পরে আবার গ্রেগরের দিকে দৃষ্টি ফেরাল। ভাড়াটেদের মোটেই সন্ত্রস্ত দেখাল না, বরং মনে হল বেহালা শোনার চাইতে গ্রেগরকে দেখেই যেন তারা বেশি আমোদ পাচ্ছে; কিন্তু তবু গ্রেগরের বাবা তাকে ওর ঘরে তাড়িয়ে দেবার পরিবর্তে ভাড়াটেদের আশ্বস্ত করার জন্যই বেশি ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। তিনি দু-হাত প্রসারিত করে দ্রুত তাদের দিকে এগিয়ে গেলেন, তাদেরকে নিজেদের ঘরে চলে যেতে ইঙ্গিত করলেন, আর সেই সাথে সাথে গ্রেগরকে তাদের চোখের আড়ালে রাখতে চেষ্টা করলেন। কিন্তু এবার ওরা সত্যি সত্যি ক্রুদ্ধ হয়ে উঠতে আরম্ভ করল, বুড়ো বাবার আচরণে, নাকি পাশের ঘরে যে গ্রেগরের মতো একজন প্রতিবেশী আছে হঠাৎ সেটা আবিষ্কার করে ফেলার জন্য, সেটা স্পষ্ট বোঝা গেল না। ওরা বাবার কাছে সমস্ত ব্যাপারটার ব্যাখ্যা দাবি করল, তারই মতো হাত নাড়ল, নিজেদের দাড়ি ধরে টানল, এবং অবশেষে নিতান্ত অনিচ্ছার সঙ্গে তাদের ঘরের দিকে পা বাড়াল। ইতোমধ্যে গ্রেগরের বোন, হঠাৎ যার বাজানোতে বাধা পড়ার জন্য যে এতক্ষণ হতবুদ্ধি হয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়েছিল, তখনও যার অবশ হাতে বেহালা আর ছড়িটা ধরা, নিষ্পলক চোখে যে তাকিয়ে ছিল তার স্বরলিপির পাতার দিকে, এবার মায়ের কোলে বেহালাটা গুঁজে দিল। মা তখন নিজের চেয়ারে বসে তার হাঁপানির সঙ্গে যুদ্ধ করে নিঃশ্বাস নিতে চেষ্টা করছেন, আর বাবা ভাড়াটেদের, আগের চাইতেও দ্রুততার সঙ্গে, তাদের ঘরের দিকে ঠেলে নিয়ে যাচ্ছেন। তার বোন ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটে ভাড়াটেদের ঘরে গিয়ে ঢুকল। তখন দেখা গেল যে তার অভ্যস্ত হাতে সে ভাড়াটেদের ঘরে বালিশ আর কম্বল সুশৃঙ্খলভাবে বিছানায় সাজিয়ে দিচ্ছে। ভাড়াটেরা ঘরে ভালো করে ঢুকবার আগেই তার বোন বিছানা করার কাজ শেষ। করে নিঃশব্দে সেখান থেকে বেরিয়ে এল।

    বাবার নিজের ইচ্ছা অন্যের ওপর জোর করে চাপিয়ে দেবার একগুঁয়েমি মনোভাবটা আবার ভয়ানক প্রবল হয়ে উঠেছে বলে মনে হল। ভাড়াটেদের প্রতি যে কিছু শ্রদ্ধা-সৌজন্য দেখানো উচিত তা তিনি বেমালুম ভুলে গেলেন। তিনি তাদেরকে ক্রমাগত ওদের ঘরের দিকে তাড়িয়ে নিয়ে চললেন, শেষে প্রায় যখন ওদের শোবার ঘরের দোরগোড়ায় ঠেলে নিয়ে গিয়েছেন তখন মধ্যবর্তী ভাড়াটিয়াটি মেঝের উপর প্রচণ্ড জোরে পা ঠুকল। এবার বাবা থমকে দাঁড়ালেন। লোকটি একটা হাত উঁচু করে গ্রেগরের বাবা-মার দিকে তাকিয়ে বলল, এই বাড়িতে, এই পরিবারে, যে জঘন্য অবস্থা বিরাজ করছে, এখানে সে সজোরে মেঝেতে থুতু ফেলল, তার পরিপ্রেক্ষিতে আমি এই মুহূর্তে আপনাদের নোটিশ দিচ্ছি। স্বভাবতই যে সময়টা আমি এখানে বাস করেছি। তার জন্য আমি এক পয়সাও দেব না, উল্টো আপনাদের বিরুদ্ধে ক্ষতিপূরণের অভিযোগ আনার কথা আমি বিবেচনা করছি, এবং—বিশ্বাস করুন—সে দাবি সহজেই প্রমাণ করা যাবে। লোকটি কথা বলা থামিয়ে সোজা সামনের দিকে তাকাল, যেন কিছু-একটা প্রত্যাশা করছে। বস্তুতপক্ষে তার বন্ধু দুজন এই বিরতির সুযোগ নিয়ে তাড়াতাড়ি বলে উঠল, আমরাও এই মুহূর্তে নোটিশ দিচ্ছি। এই কথা বলেই মাঝের ভাড়াটিয়া দরজার হাতল টেনে সশব্দে তাদের ঘরের দরজা বন্ধ করে দিল।

    গ্রেগরের বাবা হাতড়ে হাতড়ে এগিয়ে গিয়ে ধপ করে নিজের চেয়ারে বসে পড়লেন : একবার মনে হল তিনি বোধ হয় তার স্বাভাবিক সান্ধ্যকালীন স্বল্পন্দ্রিার জন্য গা এলিয়ে দিচ্ছেন, কিন্তু তার মাথার সুস্পষ্ট নড়াচড়া, মনে হল এই নড়াচড়াটা এখন চলছে তার নিয়ন্ত্রণের বাইরে, বুঝিয়ে দিল যে তিনি মোটেই ঘুমাচ্ছেন না। গ্রেগর এতক্ষণ ভাড়াটিয়া তাকে যেখানে দেখেছিল ঠিক সেই এক জায়গায় চুপ করে অবস্থান করছিল। নিজের পরিকল্পনা বাস্তবায়িত না করতে পারার হতাশায় এবং ভীষণ ক্ষুধার কারণে দুর্বলতার জন্য, সে একটুও নড়তে পারল না। তার আশঙ্কা হল, এ বিষয়ে সে প্রায় সুনিশ্চিত হল যে, যে-কোনো মুহূর্তে পরিস্থিতির অস্থিরতা-উত্তেজনা এমন স্তরে পৌঁছে যাবে যে সবাই তখন সম্মিলিতভাবে তাকে। আক্রমণ করার জন্য তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়বে। সে চুপ করে তার জন্য অপেক্ষা করতে লাগল। এমনকি বেহালাটা যখন তার মায়ের কোল থেকে, তাঁর কাঁপা কাঁপা আঙুলের বাঁধন ছিন্ন করে, সশব্দে মাটিতে পড়ে গিয়ে একটা সুরেলা আওয়াজ তুলল তখনও তার ভাবভঙ্গিতে কোনো প্রতিক্রিয়া দেখা গেল না।

    তার বোন ভূমিকা স্বরূপ টেবিলে হাতের চাপড় মেরে বলল, বাবা-মা, এরকম ভাবে আর চলতে পারে না। আপনারা হয়তো এটা বুঝতে পারছেন না, কিন্তু আমি পারছি। এই প্রাণীটার সামনে আমি আমার ভাইয়ের নাম উচ্চারণ করব না : তাই আমি শুধু এটুকু বলছি যে এটাকে আমাদের তাড়িয়ে দেবার চেষ্টা করতে হবে। আমরা এর যত্ন নেবার চেষ্টা করেছি, মানুষের পক্ষে যতটা সম্ভব আমরা ততটা সহ্য করেছি, আমার মনে হয় না কেউ আমাদের দোষ দিতে পারবে।

    গ্রেগরের বাবা আপন মনে বললেন, ওর কথা একদম ঠিক। আর তার মা, এখনও ভালোভাবে নিঃশ্বাস নিতে গিয়ে তাঁর দম আটকে আসছে, মুখে হাত চাপা দিয়ে কেশে উঠলেন, তার চোখে ফুটে উঠল উদ্ৰান্ত দৃষ্টি।

    বোন ছুটে গিয়ে মায়ের কপালে হাত রাখল। গ্রেটার কথা শুনে বাবার ভাবনারাজি যেন অস্পষ্টতার কুয়াশা ছিঁড়ে বেরিয়ে এল; তিনি তাঁর চেয়ারে পিঠটান করে বসলেন, খাবার টেবিলে এখনো পড়ে থাকা তার টুপিটা আঙুল দিয়ে নাড়াচাড়া করলেন, আর মাঝে মাঝে গ্রেগরের নিশ্চল মূর্তির দিকে চোখ তুলে তাকালেন।

    মা তখনো এত কাশছিলেন যে গ্রেটার কোনো কথা তার কানে যাচ্ছিল না। তাই গ্রেটা এবার সরাসরি বাবাকে লক্ষ করে বলল, এটাকে তাড়িয়ে দিতে আমাদের চেষ্টা করতেই হবে, নইলে আপনারা দুজনেই মারা পড়বেন। আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি সেটা। আমাদের এখন কী ভীষণ পরিশ্রম করতে হচ্ছে, আমাদের সবাইকে, এর উপর বাড়িতে এই রকম নিরন্তর অত্যাচার আর সহ্য করা যায় না। অন্তত আমি আর সহ্য করতে পারছি না। বলতে বলতে সে উচ্ছ্বসিত কান্নায় ভেঙে পড়ল, টপ টপ করে তার চোখের জল পড়ল মায়ের মুখের উপর, আর যন্ত্রের মতো সে ওই অশ্রু মুছে ফেলতে লাগল।

    বৃদ্ধ বাবা স্পষ্টতই ব্যাপারটা বুঝতে পেরে সহানুভূতির সঙ্গে বললেন, কিন্তু, মা, আমরা কী করতে পারি?

    গ্রেগরের বোন অসহায়ভাবে শুধু কাঁধ কোঁচকাল। তার আগেকার আত্মবিশ্বাস ততক্ষণে কান্নার দমকে ধুয়েমুছে নিঃশেষ হয়ে গেছে।

    বাবা কতকটা প্রশ্ন তোলার ভঙ্গিতে বললেন, ও যদি আমাদের কথা বুঝতে পারত। গ্রেটা তখনো কাঁদছিল, সেই অবস্থাতেই সে সজোরে হাত তুলে সেটা যে অচিন্ত্যনীয় তা ইঙ্গিতে জানিয়ে দিল।

    গ্রেগরের পক্ষে বোঝা যে অসম্ভব, কন্যার এই প্রত্যয়কে খতিয়ে দেখার। উদ্দেশ্যে বাবা চোখ বন্ধ করে আবার বললেন, সে যদি আমাদের কথা বুঝতে পারত তাহলে আমরা হয়তো তার সঙ্গে কোনো একটা চুক্তিতে উপনীত হতে পারতাম, কিন্তু এই অবস্থায়—

    গ্রেগরের বোন চিৎকার করে বলল, ওকে যেতেই হবে, এইটেই একমাত্র সমাধান, বাবা। এই জিনিসটা যে গ্রেগর আপনাকে সে-ধারণা ত্যাগ করার চেষ্টা করতে হবে। আমরা যে এতকাল এটা বিশ্বাস করে এসেছি সেটাই আমাদের সকল দুঃখ-দুর্দশার মূলে। কিন্তু এটা কেমন করে গ্রেগর হতে পারে? এটা যদি গ্রেগর হত তাহলে সে বহু আগেই বুঝতে পারত যে এরকম একটি প্রাণীর সঙ্গে কোনো মানুষ বাস করতে পারে না, তখন নিজের ইচ্ছাতেই সে এখান থেকে চলে যেত। তাহলে আমাদেরও কোনো হাঙ্গামা পোহাতে হত না, আমরা তার স্মৃতিকে সসম্মানে লালন করে স্বাভাবিক জীবনযাত্রা চালিয়ে যেতে পারতাম। কিন্তু দেখা যাচ্ছে এই প্রাণীটা আমাদের ওপর নির্যাতন চালাচ্ছে, আমাদের ভাড়াটিয়াদের হাঁকিয়ে দিচ্ছে, গোটা বাড়িটা নিজের অধিকারে রাখতে চাইছে; পারলে সে যেন আমাদের সবাইকে ঘুমোবার জন্য নর্দমায় পাঠিয়ে দিত। দেখুন, বাবা, গ্রেটা হঠাৎ তীক্ষ্ণ্ণ চিৎকার করে উঠল, আবার শুরু করেছে ও! ভয়ে দিশাহারা হয়ে গেল সে; ব্যাপারটা গ্রেগরের কাছে মোটেই বোধগম্য হল না; তার বোন মাকে ত্যাগ করে, তার কাছ থেকে ঠেলে চেয়ারটা সরিয়ে দিয়ে, অন্যদিকে ছুটে সরে গেল, যেন গ্রেগরের অত কাছে থাকা তার পক্ষে অসম্ভব; সে গিয়ে বাবার পিছনে অবস্থান নিল, আর তার বাবাও ওর অস্থিরতায় বিমূঢ় হয়ে, ওকে যেন আশ্রয় দেবার জন্য, দু-হাত অর্ধপ্রসারিত করে নিজের চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন।

    অথচ কাউকে ভয় পাইয়ে দেবার বিন্দুমাত্র ইচ্ছা গ্রেগরের ছিল না, তার বোনকে তো নয়-ই। সে শুধু হামাগুড়ি দিয়ে নিজের ঘরে ফিরে যাবার জন্য ঘুরতে শুরু করেছিল, কিন্তু ব্যাপারটা ছিল সত্যিই দেখে চমকে যাবার মতো, কারণ তার বর্তমান অবস্থায় শরীর ঘোরাবার মতো কঠিন কাজ করার জন্য তাকে নিজের মাথাটা তুলে বারবার সেটা মেঝেতে ঠেকিয়ে শক্তি আর গতিবেগ সংগ্রহ করে নিতে হচ্ছিল। সে একটু থেমে চারদিকে তাকিয়ে দেখল। মনে হল তার সদিচ্ছা এখন সবাই উপলব্ধি করেছে, ওদের আতঙ্কটা ছিল তাৎক্ষণিক। এখন ওরা সবাই নীরবে বিষণ্ণভাবে তাকে লক্ষ করছে। মা তার চেয়ারে শুয়ে আছেন, পা দুটো জড়ো করে শক্তভাবে সামনে মেলে দিয়েছেন, ক্লান্তিতে তার দুচোখ প্রায় সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে এসেছে; বাবা আর বোন পাশাপাশি বসে আছে, তার বোনের বাহু বাবার গলা জড়িয়ে ধরে আছে।

    গ্রেগর ভাবল এবার বোধ হয় আমি আবার ঘুরে দাঁড়াবার প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে পারি। সে পুনরায় পরিশ্রম করতে শুরু করল। কিন্তু সশব্দে হাপাতে হাঁপাতে নিঃশ্বাস নেয়াটা সে বন্ধ করতে পারল না; মাঝে মাঝে তাকে তার সকল প্রয়াস থামিয়ে জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিতে হল। তবে কেউ তাকে কোনো কষ্ট দিল না, তাকে বিন্দুমাত্র ব্ৰিত করল না, তাকে নির্বিবাদে নিজের কাজ চালিয়ে যেতে দিল। সম্পূর্ণ ঘোরার কাজটা শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গে সুড়সুড় করে সোজা নিজের ঘরের দিকে এগিয়ে গেল। তার বর্তমান অবস্থান থেকে তার ঘরের দূরত্ব দেখে সে অবাক হয়ে গেল, নিজের দুর্বল অবস্থায়, অল্প একটু আগে, সে কীভাবে এই দূরত্বটুকু অতিক্রম করতে সক্ষম হয়েছিল তা সে বুঝতে পারল না। তখন যেন সে এটা লক্ষই করেনি। যত দ্রুত গতিতে সম্ভব সে গুটিগুটি পায়ে একাগ্রচিত্তে নিজের ঘরের দিকে এগিয়ে গেল, ওরা সবাই যে একটি শব্দও উচ্চারণ করল না, কোনোরকম বিস্ময়সূচক ধ্বনি পর্যন্ত করল না, এটা সে লক্ষও করল না। কেউ তার অগ্রগতিতে বাধা দিল না। একেবারে দোরগোড়ায় পৌঁছে সে তার মাথা ঘুরাল, পুরোপুরি নয়, কারণ তার ঘাড়ের মাংসপেশি শক্ত হয়ে উঠতে শুরু করেছিল, কিন্তু যতটুকু ঘোরাতে পারল তাতেই সে দেখল যে সবকিছু যেমন ছিল তেমনি আছে, শুধু তার বোন চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়েছে। তার শেষ দৃষ্টি গিয়ে পড়ল মায়ের ওপর, যিনি তখনো পুরোপুরি ঘুমিয়ে পড়েননি।

    সে ভালো করে ঘরে ঢুকতে না ঢুকতেই তার দরজাটা ঠেলে, বল্ট লাগিয়ে, তালা বন্ধ করে দেয়া হল। পিছনের দিকে হঠাৎ ওই রকম শব্দ শুনে সে এমন চমকে গেল যে তার ছোট ছোট পাগুলো অবশ হয়ে পড়ল। এই প্রচণ্ড তাড়াহুড়াটা করল তার বোন। সে এর জন্য দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিল, ঠিক সময়ে এক লাফে সে সামনে ছুটে আসে, গ্রেগর টেরও পায়নি সে কখন এসেছে। এবার দরজার তালায় চাবি লাগাতে লাগাতে তার বোন বাবা-মাকে উদ্দেশ্য করে চিৎকার করে বলল, এতক্ষণে!

    অন্ধকারে চারপাশে তাকাতে তাকাতে গ্রেগর নিজেকে প্রশ্ন করল, এখন কী হবে? অল্পক্ষণের মধ্যেই সে আবিষ্কার করল যে এখন সে আর তার একটি অঙ্গও নাড়াতে পারছে না। এতে সে অবাক হল না, বরং তার ওই দুর্বল ছোট ছোট পা নিয়ে সে যে সত্যি সত্যি নড়ে বেড়াতে পেরেছিল সেটাই তার কাছে অস্বাভাবিক মনে হল। এছাড়া তুলনামূলক তার ভালই লাগছিল। সত্য বটে, তার সারা শরীর ব্যথা করছিল, কিন্তু ব্যথাটা মনে হল ক্রমেই কমে আসছে, এবং অবশেষে হয়তো একদম বন্ধ হয়ে যাবে। পিঠের উপর আটকে-থাকা পচা আপেলটা ও তার পাশের লাল হয়ে-ওঠা অংশ ইতোমধ্যেই তাকে আর বিশেষ যন্ত্রণা দিচ্ছিল না। সে সমতার সঙ্গে, ভালোবাসার সঙ্গে, নিজের পরিবারের লোকজনদের কথা ভাবল। তাকে যে চলে যেতে হবে এই সিদ্ধান্ত সে দৃঢ়ভাবে গ্রহণ করল, সম্ভব হলে তার বোনের চাইতেও বেশি দৃঢ়তার সঙ্গে। এইভাবে নির্ভার ও প্রশান্ত ধ্যানে সে অনেকক্ষণ কাটিয়ে দিল। অবশেষে টাওয়ারের ঘড়িতে যখন সকাল তিনটা বাজবার ঘণ্টাধ্বনি হল তখন তার আত্মসমাহিত ভাবটা কাটল। তখন জানালার বাইরে এই ধরণীতে ক্রমসম্প্রসারমাণ আলোর প্রথম ছটা আরেকবার তার চেতনায় ধরা পড়ল। তার মাথা আপনা থেকে মেঝের উপর লুটিয়ে পড়ল আর তার নাক থেকে নির্গত হল তার শেষ নিঃশ্বাসের মৃদু মন্থর বায়ু।

    পরদিন খুব ভোরে যখন ঠিকা-কাজের মহিলাটি এল—তার গায়ের জোর আর অসহিষ্ণুতা এই দুই মিলে সে বাড়ির দরজাগুলো খুলত আর লাগাত ভীষণ শব্দ করে—তাকে হাজার বার এরকম করতে নিষেধ করেও কোনো লাভ হয়নি, ফলে সে বাড়িতে ঢুকবার পর পুরো এপার্টমেন্টে কারো পক্ষে আর শান্তিতে ঘুমোবার উপায় ছিল না-তখন গ্রেগরের ঘরে তার স্বাভাবিক উঁকি দিয়ে সে অস্বাভাবিক কিছুই লক্ষ করল না। সে ভাবল গ্রেগর ইচ্ছা করে নিশ্চল হয়ে পড়ে রয়েছে, ভান করছে যেন তার মন-মেজাজ খুব খারাপ। যেহেতু তখন তার হাতে ছিল লম্বা দণ্ডবিশিষ্ট আঁটাটা, তাই তার সাহায্যে সুড়সুড়ি দিয়ে সে ওকে দরজার সামনে থেকে সরিয়ে দিতে চেষ্টা করল। কিন্তু যখন তাতেও গ্রেগরের কোনো প্রতিক্রিয়া দেখা গেল না তখন মহিলা চটে উঠে ঝাঁটাটা দিয়ে তাকে আরেকটু জোরে ধাক্কা দিল, এবং যখন তাকে মেঝের উপর দিয়ে ঠেলে সরিয়ে নিয়ে যাবার সময়ও সে কোনো রকম প্রতিরোধের সম্মুখীন হল না শুধু তখনই তার কৌতূহল জাগ্রত হল। ব্যাপারটা যে সত্যি সত্যি কী সেটা প্রতিষ্ঠিত করতে অবশ্য তার খুব বেশিক্ষণ লাগল না, আর তখন তার চোখ দুটি বিস্ফারিত হল, সে শিস দিয়ে উঠল, কিন্তু এ নিয়ে বিশেষ সময় নষ্ট না করে সে সজোরে ধাক্কা দিয়ে সামসাদের শোবার ঘরের দরজা খুলে, অন্ধকারের মধ্যে, তার গলায় যতটা জোর আছে ততটা জোর। দিয়ে চিৎকার করে উঠল, এই যে, এসে দেখুন, মরে গেছে ওটা। ওইখানে মরে। পড়ে রয়েছে, অক্কা পেয়েছে একদম!

    মি. এবং মিসেস সামসা তাঁদের জোড়া খাটে চমকে উঠে বসলেন। ওই মহিলার আকস্মিক ঘোষণায় ওরা এমন চমকে গিয়েছিলেন যে তার প্রকৃত অর্থ উপলব্ধি করতে তাদের কিছুটা সময় নিল। কিন্তু তারপরই ওঁরা দ্রুত খাট ছেড়ে উঠে পড়লেন, দুজন দুদিক দিয়ে, মি. সামসা গায়ে একটা কম্বল জড়িয়ে নিলেন, মিসেস সামসার পরনে শুধু তাঁর রাত্রিবাস, ওই ভাবেই তারা গ্রেগরের ঘরে ঢুকলেন। ইতোমধ্যে বসবার ঘরের দরজাও খুলে গেল; ভাড়াটিয়ারা আসার পর থেকে গ্রেটা ওখানেই ঘুমাত; সে পুরো পোশাক পরে আছে, মনে হল সে শুতেই যায়নি, তার মুখের পাণ্ডুরতাও সে অনুমান সমর্থন করল। মিসেস সামসা ঠিকা ঝির দিকে সপ্রশ্ন দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বললেন, মরে গেছে?, যদিও তিনি নিজেই সেটা তদন্ত করে দেখতে পারতেন, অবশ্য কোনোরকম তদন্ত ছাড়াই বিষয়টা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল। ঝি জবাব দিল, আমার তো তাই মনে হয়, এবং ওর কথা যে সত্য তার প্রমাণ হিসেবে হাতের লম্বা ঝাঁটাটা দিয়ে গ্রেগরের মৃতদেহ একপাশে ঠেলে অনেক দূর পর্যন্ত সরিয়ে দিল। মিসেস সামসা যেন তাকে বাধা দেবার জন্য একটু নড়ে উঠলেন, কিন্তু তারপরই নিজেকে তিনি সামলে নিলেন। মি. সামসা বললেন, যাক্, ঈশ্বরকে অনেক ধন্যবাদ। তিনি ক্রুশের চিহ্ন স্পর্শ করলেন, মহিলা তিনজনও তার দৃষ্টান্ত অনুসরণ করল। গ্রেটার চোখ এক মুহূর্তের জন্যও গ্রেগরের মৃতদেহের উপর থেকে সরেনি। সে বলল, দেখুন, কি রকম শুকিয়ে গিয়েছিল ও। অনেক দিন ধরেই কিছুই খাচ্ছিল না। যেভাবে খাবার দেয়া হত সেভাবেই তা ফিরে আসত। সত্যিই গ্রেগরের শরীরটা এখন দেখাচ্ছিল সম্পূর্ণ সমতল এবং শুষ্ক, তার পায়ের উপর তার শরীর আর এখন দাঁড়িয়ে ছিল না, আর তাই তাকে খুঁটিয়ে ভালো করে দেখার পথে কোনো বাধা ছিল না।

    মিসেস সামসা ঈষৎ কাঁপা হাসি হেসে বললেন, গ্রেটা, তুমি একটু আমাদের সঙ্গে চল, আর গ্রেটাও, মুখ ফিরিয়ে মৃতদেহটার দিকে একবার তাকিয়ে, মা-বাবার পেছন পেছন নিজেদের শোবার ঘরে চলে গেল। কাজের মহিলা এবার দরজাটা বন্ধ করে, ঘরের জানালা হাট করে খুলে দিল। এখনও খুব ভোর, কিন্তু তবু বাতাসের মধ্যে পরিষ্কার একটা কোমলতার স্পর্শ পাওয়া গেল। হাজার হোক, মার্চ মাস তো প্রায় শেষ হয়ে এল।

    এই সময় ভাড়াটিয়া তিনজন তাদের ঘর থেকে বেরিয়ে এসে প্রাতরাশের কোনো আয়োজন না দেখে অবাক হল। তাদের কথা ওরা ভুলে গিয়েছিল। মাঝের ভাড়াটিয়া বিরক্ত মুখে ঝিকে জিজ্ঞাসা করল, আমাদের নাশতা কোথায়? কিন্তু সে তার ঠোঁটের উপর আঙুল-চাপা দিয়ে, কোনো কথা না বলে, ভাবভঙ্গি দ্বারা, ইঙ্গিতে তাদেরকে গ্রেগরের ঘরে যেতে বলল। তারা তাই করল; নিজেদের কিছুটা পুরনো ও অনুজ্জ্বল কোটের পকেটে হাত ঢুকিয়ে তারা গ্রেগরের ঘরে গিয়ে তার মৃতদেহের চারপাশ ঘিরে দাঁড়াল। ওই ঘর তখন আলোয় আলোময়।

    এই সময় সামসাদের শয়নকক্ষের দরজা খুলে গেল : মি. সামসা তাঁর ইউনিফর্ম গায়ে চড়িয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন, একদিকে তার স্ত্রী একটি বাহু ধরে আছেন, অন্যদিকে তাঁর কন্যা। দেখে মনে হল তারা সবাই একটু কেঁদেছেন : মাঝে মাঝে গ্রেটা তার বাবার বাহুর মধ্যে নিজের মুখ গুঁজে দিচ্ছিল।

    নিজেকে মহিলা দুজনের মাঝখান থেকে মুক্ত করে নিয়ে সোজা দরজার দিকে অঙুলি নির্দেশ করে, মি. সামসা বললেন, আপনারা এই মুহূর্তে আমার বাড়ি ছেড়ে চলে যান। খানিকটা অবাক হয়ে মুখে একটা দুর্বল হাসি ফুটিয়ে মাঝের ভাড়াটিয়া বলল, কী বলতে চাইছেন আপনি? অন্য দুজন পেছনে হাত নিয়ে হাতে হাত ঘষতে লাগল, যেন সানন্দে একটা প্রচণ্ড বিতণ্ডার জন্য অপেক্ষা করছে, যার মধ্য থেকে তারা নিঃসন্দেহে বিজয়ী হয়ে বেরিয়ে আসবে। মি, সামসা জবাব দিলেন, যা বলেছি ঠিক তাই বলতে চেয়েছি আমি বলেই তিনি কন্যা ও স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে লোকটির দিকে সোজা এগিয়ে গেলেন। ভদ্রলোক প্রথমটায় মেঝের দিকে তাকিয়ে স্থির হয়ে নিজের জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকল, যেন তার চিন্তাভাবনাকে নতুনভাবে গুছিয়ে নিতে চেষ্টা করছে। তারপর সে মি. সামসার দিকে চোখ তুলে বলে উঠল, ঠিক আছে, তাহলে আমরা চলেই যাব। মনে হল হঠাৎ বিনয়ের বন্যায় সিক্ত হয়ে সে নতুন কোনো ব্যবস্থা প্রত্যাশা করছে। কিন্তু মি. সামসা তার দিকে অর্থপূর্ণ দৃষ্টিপাত করে শুধু সংক্ষেপে দু-একবার নিজের মাথা নাড়লেন। এবার ভাড়াটিয়াটি সত্যিই লম্বা লম্বা পা ফেলে হলঘরের দিকে এগিয়ে গেল। তার দুই সঙ্গী এতক্ষণ কান খাড়া করে সব শুনছিল, কিছুক্ষণ ধরে তাদের হাত ঘষা সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে গিয়েছিল, এখন তারা সুটসুট করে তার পশ্চাদধাবন করল, যেন ভয় পেয়েছে, মি. সামসা হয়ত তাদের আগেই হলঘরে পৌঁছে গিয়ে ওদেরকে ওদের নেতার কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলবেন। হলঘরে গিয়ে ওদের তিনজনই র্যাক থেকে তাদের টুপি তুলে নিল, ছাতার স্ট্যান্ড থেকে তুলে নিল তাদের লাঠি, তারপর নিঃশব্দে মাথা নিচু করে অভিবাদন জানিয়ে অ্যাপার্টমেন্ট ত্যাগ করল। সন্দিগ্ধচিত্তে, যে সন্দেহ অবশ্য সম্পূর্ণ তিত্তিহীন প্রমাণিত হল, মি. সামসা ও রমণী দুজন তাদের অনুসরণ করে এগিয়ে গেলেন, সিঁড়ির থামের উপর দিয়ে ঝুঁকে পড়ে তারা দেখলেন যে লোক তিনটি ধীরে ধীরে কিন্তু নির্ভুলভাবে দীর্ঘ সোপান বেয়ে নিচে নেমে যাচ্ছে, ঘোরানো সিঁড়ির একটি বাঁকে প্রতিটি তলায় তারা দৃষ্টির আড়ালে চলে যাচ্ছে, দু-এক মুহূর্ত পরেই আবার তাদের দেখা যাচ্ছে, ক্রমেই তারা ক্ষীয়মাণ হতে থাকল, আর সেই সঙ্গে সঙ্গে তাদের সম্পর্কে সামসা পরিবারের উৎসাহও ক্ষীয়মাণ হতে থাকল। এবং শেষে যখন কসাইর ছেলেকে দেখা গেল, মাথায় মাংসের ট্রে নিয়ে তাদের পাশ কাটিয়ে সগর্বে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে আসছে, শুধু তখনই মি. সামসা ও রমণী দুজন নিজেদের অ্যাপার্টমেন্টে ফিরে গেলেন; মনে হল তাদের মাথা থেকে একটা বোঝা নেমে গেছে।

    ওঁরা স্থির করলেন, আজকের দিনটা তারা বিশ্রাম নেবেন, একটু হাঁটতে বেরুবেন। কাজ থেকে এই অবসরটুকু নেবার অধিকার যে তারা শুধু অর্জন করছিলেন তাই নয়, এটা তাদের দরকারও হয়ে পড়েছিল। অতএব তারা তিনজন টেবিলে বসে তিনটা ছুটির দরখাস্ত লিখে ফেললেন, মি. সামসা তাঁর ব্যবস্থাপনা পরিষদের কাছে, মিসেস সামসা তার নিয়োগকর্তার কাছে আর গ্রেটা তার ফার্মের প্রধানের কাছে। তারা যখন লিখছিলেন সেই সময় কাজের মহিলাটি এসে জানাল যে তার সকালের কাজ শেষ হয়েছে এবং এখন সে যাচ্ছে। প্রথমে চোখ না তুলে ওরা মাথা নাড়ল, কিন্তু মহিলাটি যখন বিদায় না নিয়ে ওখানেই ঘুরঘুর করতে থাকল তখন বিরক্তভাবে তার প্রতি দৃষ্টিপাত করে মি. সামসা জিজ্ঞাসা করলেন, কী? ও দরজার কাছে দাঁড়িয়ে দাঁত বার করে হাসল, যেন সবাইকে একটা সুখবর দেবার আছে, কিন্তু ভালোভাবে তাকে প্রশ্ন না করলে সে কিছুই ভাঙবে না। তার মাথায় খাড়া হয়ে চাপানো ছিল উট পাখির পালকের ছোট একটা টুপি, তাকে কাজে নিয়োগ করার প্রথম দিন থেকেই যেটা দেখে মি. সামসা বিরক্ত হয়ে উঠেছিলেন, সেই টুপির পালকগুলো এখন সোল্লাসে চতুর্দিকে দোল খাচ্ছিল। মিসেস সামসা, যাকে মেয়েলোকটি অন্যদের চাইতে খানিকটা বেশি সম্মান করত, জিজ্ঞাসা করলেন, তো, ব্যাপারটা কী? ওহ, সে এমন খিলখিল করে হেসে উঠল যে তক্ষনি কিছুই বলতে পারল না, তারপর জানাল, শুধু এই যে, পাশের ঘরের ওই জিনিসটাকে নিয়ে কী করবেন তা নিয়ে আপনাদের আর ভাবতে হবে না, যা করবার আমি করে ফেলেছি। মিসেস সামসা এবং গ্রেটা যেন খুব ব্যস্ত এমনিভাবে তাদের চিঠির উপর আরও ঝুঁকে পড়লেন; মি. সামসা যখন দেখলেন যে ঠিকা-ঝি ব্যাপারটা সবিস্তারে বর্ণনা করার জন্য বিশেষ উদগ্রীব তখন তিনি দৃঢ়ভাবে হাত তুলে তাকে থামিয়ে দিলেন। কিন্তু ঝিকে যখন তার গল্পটা বলতে দেয়াই হল না, যখন তার মনে পড়ল যে তার খুব তাড়া আছে, এবং স্পষ্টতই মনোক্ষুণ্ণ হয়ে সে বলল, ঠিক আছে, চলি, বলেই সে প্রায় হিংস্রভাবে ঘুরে দাঁড়িয়ে সাংঘাতিক জোরে দরজা বন্ধ করে প্রস্থান করল।

    মি. সামসা বললেন, ওকে আজ রাত্রেই নোটিশ দেব, কিন্তু তাঁর স্ত্রী বা কন্যা কেউ কিছু বলল না; মনে হল, যে-প্রশান্তিটুকু তারা সবেমাত্র অর্জন করেছিলেন তা ওই মেয়েলোকটি খান খান করে ভেঙে দিয়ে গেছে। ওঁরা উঠে জানালার কাছে গিয়ে দুজন দুজনকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে সেখানে দাঁড়িয়ে রইলেন। মি. সামসা নিজের চেয়ারে ঘুরে বসে কিছুক্ষণ চুপ করে ওদের দেখলেন, তারপর ওদেরকে ডাক দিলেন, এই, এদিকে এস। অতীতকে অতীতের মধ্যেই থাকতে দাও। তাছাড়া, আমার প্রতি তো কিছু বিবেচনাবোধ দেখাতে পার। ওরা দুজন সঙ্গে সঙ্গে তার কথা শুনল, তাড়াতাড়ি তার কাছে এসে সস্নেহে তার গায়ে হাত বুলিয়ে দিল, এবং তারপর তারা দ্রুত তাদের চিঠি শেষ করে ফেলল।

    এরপর তারা তিনজন একসঙ্গে অ্যাপার্টমেন্ট থেকে বেরোলেন, বিগত কয়েকমাসের মধ্যে যা তারা একবারও করতে পারেননি। তাঁরা ট্রামে চড়ে শহরের বাইরে গ্রামাঞ্চলের পথে যাত্রা করলেন। ট্রামটা, যার মধ্যে তারাই ছিলেন একমাত্র যাত্রী, উষ্ণ সূর্যালোকে ভরে গিয়েছে। নিজেদের আসনে আরাম করে হেলান দিয়ে বসে ওঁরা ওঁদের ভবিষ্যতের কথা আলোচনা করলেন। একটু খুঁটিয়ে দেখতেই দেখা গেল যে তাদের ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা মোটেই খারাপ নয়, কারণ যে চাকরি তারা পেয়েছেন, এ সম্পর্কে ইতিপূর্বে তাঁরা কেউ ভালোভাবে পরস্পরের সঙ্গে কোনোরকম আলাপ-আলোচনাই করেননি, সে চাকরি-তিনটিই বেশ ভালো, এবং পরে আরও ভালো হবার সম্ভাবনা রয়েছে। তবে তাৎক্ষণিকভাবে তাঁদের অবস্থার ক্ষেত্রে সবচাইতে বড় উন্নতি যেটা হবে সেটা হবে অন্য একটা বাসায়। উঠে যাবার জন্য। গ্রেগর যে বাসা পছন্দ করেছিল এটা হবে তার চাইতে ছোট ও সস্তা, তবে তার চাইতে ভালো জায়গায় অবস্থিত, এবং পরিচালনার দিক থেকে সহজতর। ওঁরা যখন এসব কথা বলছিলেন তখন হঠাৎ মি. আর মিসেস সামসা একটু যেন অবাক হয়েই লক্ষ করলেন, দুজনে প্রায় একইসঙ্গে, যে তাদের মেয়ের উৎসাহ-উদ্দীপনা বেশ বেড়েছে, সাম্প্রতিককালের দুঃখ-বেদনা সত্ত্বেও, যার জন্য তার গাল দুটি পাণ্ডুর হয়ে গিয়েছিল, সে এখন একটি সুন্দরী মেয়ে হয়ে ফুলের মতো ফুটে উঠেছে, তার দেহসৌষ্ঠবও হয়েছে চমৎকার। ওরা একটু চুপ করে পুরোপুরি ঐকমত্যের মধ্য দিয়ে, পরস্পরের সঙ্গে দৃষ্টি বিনিময় করল; তারা ঠিক করলেন যে কিছুদিনের মধ্যেই ওর জন্য একটি ভালো বর খোঁজার সময় হয়ে যাবে। এবং তাদের এই নতুন স্বপ্ন এবং চমৎকার উদ্দেশ্যের সমর্থনেই যেন। তাঁদের কন্যা, ওদের ভ্রমণ যাত্রার সমাপ্তিতে, সকলের আগে লাফ দিয়ে উঠে তার তরুণ শরীরটা টানটান করে দাঁড়াল।

    1 2 3
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleওয়েটিং ফর গডো – স্যামুয়েল বেকেট
    Next Article পিঞ্জরে বসিয়া শুক – কমলকুমার মজুমদার

    Related Articles

    কবীর চৌধুরী

    ওয়েটিং ফর গডো – স্যামুয়েল বেকেট

    July 17, 2025
    কবীর চৌধুরী

    আমার ছোটবেলা – কবীর চৌধুরী

    July 17, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo
    Most Popular

    রবিনসন ক্রুসো – ড্যানিয়েল ডিফো

    August 19, 2025

    অনুরাধা

    January 4, 2025

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    রবিনসন ক্রুসো – ড্যানিয়েল ডিফো

    August 19, 2025

    অনুরাধা

    January 4, 2025

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025
    Our Picks

    রবিনসন ক্রুসো – ড্যানিয়েল ডিফো

    August 19, 2025

    দ্য দা ভিঞ্চি কোড – ড্যান ব্রাউন

    August 19, 2025

    এঞ্জেলস এন্ড ডেমনস – ড্যান ব্রাউন

    August 19, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    Sign In or Register

    Welcome Back!

    Login below or Register Now.

    Lost password?

    Register Now!

    Already registered? Login.

    A password will be e-mailed to you.